স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
সপ্তম খণ্ড
পত্রাবলী (পত্র সংখ্যাঃ ২৮১-৩৬৪)
*******************
পত্র সংখ্যা (২৮১-২৯০)
পত্র সংখ্যা - ২৮১
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৫ অগষ্ট, ১৮৯৬
আজ সকালে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের একখানি পত্র এসেছে; তাতে খবর পেলাম যে, শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকার অগষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।তুমি কি তা পড়েছ? তিনি ঐ বিষয়ে আমার মত চেয়েছেন। এখনও তা দেখিনি বলে তাঁকে কিছু লিখতে পারছি না। তুমি যদি তা পেয়ে থাক তো দয়া করে আমায় পাঠিয়ে দিও। ‘ব্রহ্মবাদিনে’র কোন সংখ্যা এসে থাকলে তাও পাঠিও। ম্যাক্সমূলার আমাদের কার্যধারা জানতে চান, … এবং মাসিক পত্রিকা সম্বন্ধেও খবর চান। তিনি যথেষ্ট সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ লিখতে প্রস্তুত আছেন।
আমার মনে হয়, পত্রিকাদি সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে তোমার সরাসরি পত্রালাপ করাই উচিত। ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পড়ার পরে তাঁর পত্রের উত্তর দিতে যখন আমি তোমাকে তাঁর চিঠিখানি পাঠিয়ে দেব, তখন তুমি দেখতে পাবে যে, আমাদের প্রচেষ্টায় তিনি কত খুশী হয়েছেন এবং যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছেন।
পুনশ্চ—আশা করি, বড় পত্রিকাখানি সম্বন্ধে ভাল করে ভেবে দেখবে। আমেরিকায় কিছু টাকা তুলতে পারা যাবে এবং কাগজখানি নিজেদের হাতেই রাখা যাবে। তুমি ও ম্যাক্সমূলার কি প্রকার কার্যধারা ঠিক কর, তা জেনে আমি আমেরিকায় পত্র লিখব ভেবেছি।
যে গাছের ফল ও ছায়া আছে, তারই আশ্রয় নিতে হয়; ফল যদি নাই বা পাওয়া যায়, ছায়া থেকে তো কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না?১০০ সুতরাং শিক্ষণীয় এই যে, বড় বড় কাজ এভাবেই করা উচিত।
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮২
সুইজরলণ্ড
৬ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিন্’ কতটা আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে, তা তোমার পত্রে জানলাম। লণ্ডনে যখন ফিরে যাব, তখন তোমায় সাহায্য করতে চেষ্টা করব। তুমি সুর নামিও না যেন—কাগজখানি চালিয়ে যাও; অতি শীঘ্রই তোমায় এমন সাহায্য করতে পারব যে, বাজে শিক্ষকতার কাজ থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে। ভয় পেও না; বড় বড় সব কাজ হবে, বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ একটি রত্নবিশেষ, একে নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। অবশ্য এ-জাতীয় পত্রিকাকে সর্বদাই ব্যক্তিগত বদান্যতার দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আর আমরা তাই করব। আরও মাস-কয়েক আঁকড়ে পড়ে থাক।
ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরীতে’ বেরিয়েছে। সেটি পেলেই আমি তোমায় পাঠিয়ে দেব। তিনি আমাকে চমৎকার সব চিঠি লেখেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের একখানি বড় জীবনী লেখবার উপাদান চান।
কলিকাতায় লিখে দাও, যেন তারা যতটা সম্ভব উপাদান যোগাড় করে তাঁকে পাঠায়।
আমেরিকার কাগজে প্রেরিত সংবাদটি আমি আগেই পেয়েছি। ওটি ভারতবর্ষে প্রকাশ করবে না। সংবাদপত্রে এই সব হইচই ঢের হয়ে গেছে; আমার অন্ততঃ এ সবে বিরক্তি এসে গেছে। মূর্খেরা যাই বলুক না কেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাব। সত্যকে কেউ চেপে রাখতে পারবে না।
Organization is power and the secret of that is obedience দেখতেই পাচ্ছ, আমি এখন সুইজরলণ্ডে রয়েছি, আর ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। পড়া বা কোন লেখার কাজ আমি করতে পারছি না—করাও উচিত নয়। লণ্ডনে আমার এক মস্ত কাজ পড়ে আছে, আগামী মাস থেকে তা শুরু করতে হবে। আগামী শীতে আমি ভারতে ফিরব এবং সেখানকার কাজটাকে দাঁড় করাব।
সকলে আমার ভালবাসা জানবে। সাহসে বুক বেঁধে কাজ করে যাও, পিছু হটো না—‘না’ বলো না। কাজ কর—প্রভু পেছনে আছেন। মহাশক্তি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ভয় পেও না; টাকা ও আর সব শীঘ্রই আসবে।
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৩
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কয়েকদিন পূর্বে তোমায় একখানি পত্র লিখেছি। সম্প্রতি আমার পক্ষে তোমায় জানান সম্ভবপর হয়েছে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য আমি এইটুকু করতে পারবঃ তোমায় দু-এক বছরের জন্য মাসিক ১০০ টাকা হিসাবে অর্থাৎ বছরে ৬০ বা ৭০ পাউণ্ড হিসাবে, যাতে মাসে ১০০ পুরা হয়; এমন সাহায্য করতে পারব, তাতে তুমি নিজে স্বাধীন হয়ে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর কাজ করতে পারবে ও সেটিকে ভাল করে দাঁড় করাতে পারবে। মণি আয়ার এবং অন্য কয়েকটি বন্ধু কিছু টাকা তুলে পত্রিকার মুদ্রণ প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। গ্রাহকদের চাঁদা থেকে কত আয় হয়? তা খরচ করে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ করা চলে না কি? ‘ব্রহ্মবাদিনে’ যা কিছু বেরুবে, তার সবটাই যে সকলকে বুঝতে হবে, তার কোন মানে নাই; কিন্তু দেশপ্রেম-প্রণোদিত হয়ে ও পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য সকলের এ-পত্রিকার গ্রাহক হওয়া উচিত—অবশ্য আমি হিন্দুদের লক্ষ্য করেই এ কথা বলছি।
[তোমাদের] কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজনঃ
প্রথমতঃ হিসাবপত্র সম্বন্ধে বিশেষ সততা অবলম্বনীয়। এই কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কোন আভাস দিচ্ছি না যে, তোমাদের মধ্যে কারও পদস্খলন হবে, পরন্তু কাজকর্মে হিন্দুদের একটা অদ্ভুত অগোছালো ভাব আছে—হিসাবপত্র রাখার বিষয়ে তাদের তেমন সুশৃঙ্খলা বা আঁট নাই; হয়তো কোন বিশেষ ফণ্ডের টাকা নিজের কাজে লাগিয়ে ফেলে এবং ভাবে শীঘ্রই তা ফিরিয়ে দেব—ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ ‘ব্রহ্মবাদিন্’টিকে ভালভাবে পরিচালনা করার উপর তোমার মুক্তি নির্ভর করে, এই ভাব নিয়ে উদ্দেশ্য-সিদ্ধি বিষয়ে পূর্ণ নিষ্ঠা প্রয়োজন। এই পত্রিকাই তোমার ইষ্টদেবতাস্বরূপ হোক; তাহলেই দেখবে সাফল্য কেমন করে আসে। এর আগেই অভেদানন্দকে ভারতবর্ষ থেকে ডেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, পূর্বের ‘স্বামী’ (সন্ন্যাসী)-কে পাঠাবার সময় যেমন দেরী হয়েছিল, এবারে তেমন হবে না। এই চিঠি পেয়ে তুমি আমায় ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর সমস্ত আয়ব্যয়ের একটা পরিষ্কার হিসাব পাঠিও—যাতে আমি বুঝতে পারি, কি করা উচিত। মনে রেখো—অখণ্ড পবিত্রতা ও গুরুর প্রতি স্বার্থশূন্য একান্ত আজ্ঞাবহতাই সকল সিদ্ধির মূল।
দু-বৎসরের মধ্যে আমরা ‘ব্রহ্মবাদিন্’কে এরূপ দাঁড় করাব যে, পত্রিকার আয় থেকে শুধু যে খরচ চলে যাবে তা নয়, স্বতন্ত্র একটু আয়ও হবে। বিদেশে ধর্ম-পত্রিকার বেশী কাটতি হওয়া অসম্ভব; সুতরাং হিন্দুদের মধ্যে যদি এখনও কিছুমাত্র ধর্মজ্ঞান বা কৃতজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে, তবে এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা তাদেরই করতে হবে।
ভাল কথা, এনি বেসাণ্ট (Annie Besant) একদিন আমাকে তাঁদের সমিতিতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি এক সন্ধায় বক্তৃতা দিই—কর্ণেল অল্কট্ (Col. Olcott)-ও উপস্থিত ছিলেন। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিই আমার সহানুভূতি আছে, এটি দেখাবার জন্যই আমি এরূপ করেছিলাম; কিন্তু আমি কোন আজগুবিতে যোগ দেব না। আমাদের দেশের আহাম্মকদের বলো, আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমরাই জগতে শিক্ষক—বিদেশীরা নয়। ইহলোকের বিষয়ে অবশ্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের প্রবন্ধ পড়েছি। ছয় মাস আগে যখন তিনি ওটি লেখেন, তখন তাঁর কাছে প্রতাপ মজুমদারের ক্ষুদ্র পুস্তিকা ছাড়া লেখবার আর কোন উপাদান ছিল না; সুতরাং সে হিসাবে তাঁর প্রবন্ধটি ভালই হয়েছে, বলতে হবে। সম্প্রতি তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বড় বই লেখবার সঙ্কল্প প্রকাশ করে আমাকে একখানি সুন্দর সুদীর্ঘ পত্র লিখেছেন। আমি এর মধ্যেই তাঁকে অনেক উপাদান দিয়েছি; ভারত থেকে আরও উপাদান পাঠাতে হবে। কাজ করে যাও। লেগে থাক, সাহসী হও, ভরসা করে সব বিষয়ে লাগ। ব্রহ্মচর্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে; তোমার তো ছেলেপুলে যথেষ্ট হয়েছে—আর কেন? এই সংসারটা কেবল দুঃখময়। কি বল? আমার স্নেহাশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৪
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
আমি এখন বিশ্রাম ভোগ করছি। বিভিন্ন চিঠিতে কৃপানন্দের১০১ সম্বন্ধে অনেক কথা পড়েছি। আমি তার জন্য দুঃখিত। … তার ভাবে তাকে চলতে দাও; তার জন্য তোমাদের কারও উদ্বেগ অনাবশ্যক।
আমায় ব্যথা দেওয়ার কথা বলছ?—তা দেব বা দানবের সাধ্যাতীত। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাক। অটল ভালবাসা ও একান্ত নিঃস্বার্থ ভাবই সর্বত্র জয়লাভ করে। প্রত্যেক প্রতিকূল অবস্থায় বেদান্তীর উচিত নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করা, ‘আমি এরূপ দেখি কেন? আমি কেন ভালবাসা দিয়ে এর প্রতিকার করতে পারি না?’
স্বামী সারদানন্দ যে অভ্যর্থনা পেয়েছেন, এবং তিনি যে ভাল কাজ করেছেন, আমি তাতে খুশী হয়েছি। বড় কাজ করতে হলে দীর্ঘকাল ধরে লেগে পড়ে থাকতে হয়। জনকয়েক বিফল হলেও আমাদের চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। জগতের ধারাই এই যে, অনেকের পতন হবে, বহু বাধা আসবে, দুর্লঙ্ঘ্য বিপদ উপস্থিত হবে এবং আধ্যাত্মিকতার আগুনে ভস্মীভূত হবার সময়েও মানুষের ভিতরের স্বার্থপরতা ও অন্যান্য দানবীয় ভাব প্রাণপণে লড়াই করে। ‘ভাল’র দিকে যাবার পথটি সবচেয়ে দুর্গম ও বন্ধুর। এটাই আশ্চর্যের কথা যে, এত লোক সফল হয়; অনেকে যে পড়ে যায়, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। সহস্র পদস্খলনের ভেতর দিয়েই চরিত্র গড়ে তুলতে হবে।
এখন আমি অনেকটা চাঙ্গা হয়েছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠিক সামনেই বিরাট তুষার প্রবাহগুলি দেখি আর অনুভব করি, যেন হিমালয়ে আছি। এখন আমি সম্পূর্ণ শান্ত। আমার স্নায়ুগুলিতে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে এসেছে, এবং তুমি যে-জাতীয় বিরক্তিকর ব্যাপারের কথা লিখেছ, তা আমাকে একেবারেই স্পর্শ করে না। এই ছেলেখেলা আমাকে উদ্বিগ্ন করবে কি করে? সারা দুনিয়াটা একটা নিছক ছেলেখেলা—প্রচার, শিক্ষাদান, সবই। ‘যিনি দ্বেষও করেন না, আকাঙ্ক্ষাও করেন না, তাঁকেই সন্ন্যাসী বলে জেনো।’১০২ আর রোগ শোক ও মৃত্যুর চির লীলাভূমি এই সংসাররূপ পঙ্কিল ডোবাতে কি কাম্য বস্তু থাকতে পারে?—‘যিনি সকল বাসনা ত্যাগ করেছেন, তিনিই সুখী।’
সেই শান্তি, সেই অনন্ত অনাবিল শান্তির কিছু আভাস আমি এখন এই মনোরম স্থানে পাচ্ছি। ‘একবার যদি মানুষ জানে যে, আত্মাই আছেন—আর কিছু নেই, তাহলে কিসের কামনায় কার জন্য এই শরীরের দুঃখতাপে দগ্ধ হতে হবে?’১০৩
আমার মনে হয়, লোকে যাকে ‘কাজ’ বলে, তা দ্বারা যতটুকু অভিজ্ঞতা হবার তা আমার হয়ে গেছে। আমার কাজ শেষ হয়েছে, এখন আমি বেরিয়ে যাবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছি। ‘সহস্র সহস্র লোকের মধ্যে ক্বচিৎ কেউ সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে; যত্নপরায়ণ বহুর মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ আমাকে যথাযথভাবে জানে।’১০৪ কারণ ইন্দ্রিয়গুলি বলবান্, তারা সাধকের মনকে জোর করে নাবিয়ে দেয়।
‘মনোরম জগৎ’, ‘সুখের সংসার’, ‘সামাজিক উন্নতি’—এসব কথা ‘তপ্ত বরফ’, ‘অন্ধকার আলো’ প্রভৃতি কথার মতই। ভালই যদি হত, তবে এটা আর সংসারই হত না। অজ্ঞানবশতঃ জীব অসীমকে সসীম বিষয়ের মধ্যে, অখণ্ড চৈতন্যকে জড় অণুর মধ্যে প্রকাশ করবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু শেষে নিজের ভুল ধরতে পেরে পালাতে চায়। এই প্রত্যাবর্তন—এই হল ধর্মের আরম্ভ; আর এর সাধনা হচ্ছে অহং-এর নাশ অর্থাৎ প্রেম। স্ত্রী, পুত্র বা আর কারও জন্য ভালবাসা নয়, পরন্তু নিজের ক্ষুদ্র ‘অহং’কে ছাড়া অপর সকলের জন্য ভালবাসা। আমেরিকায় ‘মানবজাতির উন্নতি’ ইত্যাদি যে-সব বড় বড় বুলি অহরহ শুনতে পাবে, সে-সব বাজে কথা ভুলো না। এক দিকে অবনতি না হলে অন্যদিকে উন্নতি হতে পারে না। এক সমাজে এক রকমের ত্রুটি আছে, অন্য সমাজে অন্য রকমের। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ সম্বন্ধেও তাই বলা চলে। মধ্যযুগে ডাকাতের প্রাধান্য ছিল, এখন জোচ্চোরের দল বেশী। কোন যুগে দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে ধারণা কম থাকে, অন্য যুগে বেশ্যাবৃত্তির আধিক্য দেখা যায়। কোন সময় শারীরিক দুঃখের আধিক্য, আবার অন্য সময় মানসিক দুঃখ সহস্রগুণ। জ্ঞান সম্বন্ধেও তাই। আবিষ্কার ও নামকরণের পূর্বেও কি মাধ্যাকর্ষণ প্রকৃতিতে ছিল না? যদি ছিলই, তবে তার অস্তিত্ব জানাতে তফাতটা কি হল? আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের চেয়ে তোমরা কি বেশী সুখী?
একমাত্র মূল্যবান জ্ঞান হচ্ছেঃ এইটি জানা যে, সবই প্রতারণা—ভান মাত্র। কিন্তু কম লোকই কদাচিৎ তা জানতে পারে। ‘সেই একমাত্র আত্মাকেই জান, আর অন্য সব বাক্য ত্যাগ কর।’১০৫ জগতের দিকে দিকে ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত আমাদের এইটুকু শিক্ষা লাভ হয়। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, সমগ্র মানবজাতিকে এই বলে ডাকা—‘ওঠ’ জাগো, যে পর্যন্ত না লক্ষ্যস্থলে পৌঁছচ্ছ, ততক্ষণ থেমো না।’ ধর্ম মানে ত্যাগ—তা ছাড়া আর কিছু নয়।
জীবসমষ্টিকে নিয়েই ঈশ্বর; মানবদেহের প্রত্যেক কোষ (cell)-এর একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও দেহ যেমন একটি অখণ্ড বস্তু, ঈশ্বরও ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি। সমষ্টিই ঈশ্বর এবং ব্যষ্টি বা অংশই জীব বা আত্মা। ঈশ্বরের অস্তিত্ব জীবের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করছে, দেহ যেমন কোষের ওপর নির্ভর করে; বিপরীতও সত্য। জীব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরসাপেক্ষ; একজন যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ অন্যকেও থাকতে হবে। আবার, এই পৃথিবী ছাড়া সব উচ্চতর লোকেই যেহেতু মন্দ অপেক্ষা ভালর ভাগ অনেকগুণ বেশী, সমষ্টি পুরুষ বা ঈশ্বরকে সর্বগুণশালী সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ বলা চলে। ঈশ্বরের পূর্ণত্ব মানলেই এই সব গুণ স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়; সেজন্য আর বিচারের প্রয়োজন হয় না।
ব্রহ্ম এই উভয়ের অতীত, কিন্তু কোন অবস্থাবিশেষ নহেন। ব্রহ্মই একমাত্র অদ্বৈত বস্তু; বহুবস্তুসম্ভূত নন। এই সর্বব্যাপী তত্ত্বই দেহ-কোষ থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত সর্বত্র অনুস্যূত, এবং একে বাদ দিয়ে কেউ থাকতে পারে না। যা কিছু সত্য, তা এই ব্রহ্মতত্ত্ব ভিন্ন আর কিছু নয়। যখন ভাবি—‘আমি ব্রহ্ম’, তখন শুধু ‘আমিই’ থাকি। তুমি যখন এই চিন্তা কর, তখন তোমার পক্ষেও তাই; এইরূপ সর্বত্র। প্রত্যেকেই ঐ পূর্ণ তত্ত্ব।
দিন কয়েক আগে হঠাৎ কৃপানন্দকে চিঠি লেখবার একটা অদম্য ইচ্ছা হয়েছিল। হয়তো সে আনন্দ পাচ্ছিল না এবং আমাকে স্মরণ করছিল। সুতরাং আমি তাকে খুব স্নেহপূর্ণ একখানি চিঠি লিখেছিলাম। আজ আমেরিকার সংবাদ পেয়ে তার কারণ বুঝতে পারলাম। আমি তুষার প্রবাহের কাছ থেকে তোলা গোটাকয়েক ফুল তাকে পাঠিয়েছি। মিস ওয়াল্ডোকে বলবে, তাকে যেন যথেষ্ট স্নেহ জানিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন। প্রেম কখনও মরে না। সন্তানেরা যাই করুক বা যেমনই হোক না কেন, পিতৃস্নেহের মরণ নেই। সে আমার সন্তান—সে আজ দুঃখে পড়ায় আমার স্নেহ ও সাহায্যের উপর তার দাবী ঠিক তেমনি বা আরও বেশী। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৫
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Grand Hotel, Saas Fee
Valais, Switzerland ৮ অগষ্ট,১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
তোমার চিঠির সঙ্গে একটি চিঠির তাড়া এসেছে। এইসঙ্গে ম্যাক্সমূলারের লেখা চিঠিখানা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা তাঁর সহৃদয়তা ও সৌজন্য।
মিস মূলার খুব শীঘ্রই ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন। সেক্ষেত্রে পূর্ব-প্রতিশ্রুতিমত সেই ‘পিওরিটি কংগ্রেস’ (Purity Congress) উপলক্ষে বার্নে যেতে পারব না। যদি সেভিয়ার-রা আমাকে সঙ্গে নিতে রাজী হন, তবেই আমি কিয়েল (Kiel) যাব এবং যাবার আগে তোমাকে লিখব। সেভিয়ার-রা মহৎ এবং সহৃদয়, কিন্তু তাঁদের বদান্যতার অযথা সুযোগ নেবার কোন অধিকার আমার নেই। মিস মূলারের ওপরও সে-দাবী করতে পারি না, কারণ সেখানকার খরচের বহর ভয়াবহ। অতএব বার্ন কংগ্রেসের আশা ত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করলাম, কারণ সেটা শুরু হতে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি, তার এখনও অনেক দেরী।
তাই ভাবছি জার্মানীর দিকেই যাব, যাত্রা শেষ করব কিয়েল-এ, এবং সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব।
তাঁর নাম হচ্ছে বালগঙ্গাধর তিলক (মিঃ তিলক) এবং বইয়ের নাম ‘ওরায়ন’ (Orion)।
তোমাদের বিবেকানন্দ
পুনঃ—জেকবীর (Jacobi) লেখাও একখানা আছে—সম্ভবতঃ একই ধারায় ও একই সিদ্ধান্ত সহ অনূদিত।
পুনঃ—আশা করি থাকবার বাড়ী ও হলঘরটি সম্বন্ধে তুমি মিস মূলারের অভিমত জিজ্ঞেস করবে, তাঁর সঙ্গে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা না হলে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হবেন।
—বি
গত রাত্রে মিস মূলার অধ্যাপক ডয়সনকে তার করেছিলেন, আজ ৯ অগষ্ট সকালে উত্তর এসেছে—আমাকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে; ১০ সেপ্টেম্বর আমি কিয়েল-এ ডয়সনের বাড়ীতে উঠব। তাহলে তুমি আমার সঙ্গে কোথায় দেখা করবে? কিয়েল-এ? মিস মূলার সুইজরলণ্ড থেকে ইংলণ্ডে যাচ্ছেন। আমি সেভিয়ারদের সঙ্গে কিয়েল যাচ্ছি। আমি ১০ সেপ্টেম্বর সেখানে পৌঁছব।
পুনঃ—বক্তৃতার বিষয়ে এখনও কিছু স্থির করিনি। আমার পড়াশুনো করার সময় একেবারে নেই। সেলেম সোসাইটি (Salem Society) খুব সম্ভবতঃ একটি হিন্দু সম্প্রদায়—কোন খেয়ালী দল নয়।
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৬
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
১২ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রেমাস্পদেষু,
আজ আমেরিকা থেকে একখানা চিঠি পেলাম, তা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাদের আমি লিখেছি, আমার অভিপ্রায় এককেন্দ্রীকরণ—বর্তমান কার্যারম্ভে তো বটেই। আমি তাদের এ পরামর্শ দিয়েছি যে, অনেকগুলি কাগজ ছাপাবার বদলে তারা ‘ব্রহ্মবাদিনে’র সঙ্গে আমেরিকার লেখা কয়েক পাতা জুড়ে শুরু করুক এবং কিছু চাঁদা তুলে আমেরিকার খরচটা পুষিয়ে নিক। জানি না, তারা কি করবে।
আগামী সপ্তাহে আমরা এখান থেকে জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা হব। আমরা সীমান্ত পার হয়ে জার্মানীতে পা দিতে না দিতে মিস মূলার ইংলণ্ডে চলে যাবেন। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং আমি তোমাকে কিয়েল-এ আশা করব।
আমি এখন পর্যন্ত কিছু লিখিওনি, পড়িওনি। বস্তুতঃ আমি নিছক বিশ্রাম নিচ্ছি। ভাবনার কারণ নেই, তুমি শীঘ্রই প্রবন্ধটি প্রস্তুত পাবে। আমি মঠ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে জানলাম যে, অপর স্বামীটি১০৬ রওনা হবার জন্য তৈরী। আমি নিশ্চিত যে, তোমরা যে ধরনের লোক চাও, তিনি সেই ধরনের উপযুক্ত হবেন। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের সংস্কৃতে বিশেষ অধিকার আছে, তিনি তাদের অন্যতম … এবং শুনলাম তাঁর ইংরেজী বেশ দুরস্ত হয়েছে। আমেরিকা থেকে সারদানন্দ সম্বন্ধে অনেকগুলি খবরের কাগজের অংশ পেয়েছি—তা থেকে জানলাম যে, তিনি সেখানে খুব সাফল্য অর্জন করেছেন। মানুষের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ফুটিয়ে তোলার পক্ষে আমেরিকা একটি সুন্দর শিক্ষাকেন্দ্র। ওখানকার হাওয়া কি সহানুভূতিতে পূর্ণ! গুডউইন এবং সারদানন্দের কাছ থেকে আমি চিঠি পেয়েছি।
চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৭
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
আজ ভারত থেকে লেখা অভেদানন্দের একখানা চিঠি পেলাম, খুব সম্ভবতঃ তিনি ১১ অগষ্ট B. I. S. N-এর ‘S. S. Mombassa’তে রওনা হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি কোন জাহাজ পাননি, তা না হলে আরও আগে রওনা হতে পারতেন। খুব সম্ভব তিনি ‘মোম্বাসা’ জাহাজে স্থান পেয়ে যাবেন। ‘মোম্বাসা’ লণ্ডনে পৌঁছবে ১৫ সেপ্টেম্বর নাগাদ। তুমি জেনেছ যে, আমার ডয়সনের কাছে যাবার দিন—মিস মূলার পরিবর্তিত করে ১৯ সেপ্টেম্বর করেছেন। অভেদানন্দকে অভ্যর্থনা করার জন্য আমি লণ্ডনে থাকতে পারব না। তিনি কোন গরম পোষাক ছাড়াই আসছেন; মনে হচ্ছে সে সময়ে ইংলণ্ডে ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এবং তাঁর অন্ততঃ কয়েকটি অন্তর্বাস ও একটি ওভারকোট দরকার হবে। এ সব ব্যাপার আমার চেয়ে তুমি অনেক ভাল জান। সুতরাং দয়া করে এই ‘মোম্বাসা’র দিকে একটু নজর রেখো। আমি তার কাছ থেকে আর একটি চিঠি আশা করছি।
বস্তুতঃ আমি বিশ্রী-রকম সর্দিতে ভুগছি। আশা করি রাজার নিকট হতে মহিনের টাকা ইতোমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলে আমি তাকে যে টাকা দিয়েছিলাম ফেরত চাই না। তুমি তার সবটাই ওকে দিতে পার।
গুডউইন ও সারদানন্দের কাছ থেকে আমি কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। তারা ভাল আছে। মিসেস বুলের কাছ থেকেও একখানা চিঠি পেয়েছি; তিনি কেম্ব্রিজে যে সমিতিটি গঠন করেছেন, আমি ও তুমি ডাক মাধ্যমে তার সভ্য হইনি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমার বেশ মনে আছে যে, আমি তাঁকে লিখেছিলাম, তোমার ও আমার পক্ষে তার সভ্যপদ গ্রহণ করতে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়। আমি এখন পর্যন্ত একটি লাইনও লিখে উঠতে পারিনি। এমন কি পড়বার জন্যও একমুহূর্ত সময় পাইনি, পাহাড়ের উপত্যকায় চড়াই উতরাই করতে করতে সবটা সময় কাটছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আমাদের যাত্রা আরম্ভ হবে। মহিন ও ফক্সের সঙ্গে এর পর যখন দেখা হবে, দয়া করে তাদের আমার ভালবাসা জানিও।
আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।
তোমার চিরন্তন
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৮
লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার শেষ চিঠিখানি আজ পেয়েছি; ইতোমধ্যে আপনার প্রেরিত ৫ পাউণ্ডের রসিদ পেয়ে থাকবেন। আপনি সভ্য হওয়ার কথা, কি লিখেছেন, তা বুঝতে পারলাম না; তবে কোন সমিতির তালিকায় আমার নাম যুক্ত করা বিষয়ে আমার আপত্তি নাই। স্টার্ডির নিজের এ বিষয়ে কি মতামত, তা কিন্তু আমি জানি না। আমি এখন সুইজরলণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখান থেকে জার্মানীতে যাব, তারপর ইংলণ্ডে এবং পরের শীতে ভারতে যাব। সারদানন্দ ও গুডউইন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকার্য সুন্দররূপে করছে শুনে খুব খুশী হলাম। আমার নিজের কথা এই যে, আমি কোন কাজের প্রতিদানে ঐ ৫০০ পাউণ্ডের ওপর কোন দাবী রাখি না। আমার বোধ হয়, আমি যথেষ্ট খেটেছি। এখন আমি অবসর নেব। আমি ভারত থেকে আর একজন লোক চেয়ে পাঠিয়েছি; তিনি আগামী মাসে আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি, এখন অন্যে এটাকে চালাক। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কাজটা চালিয়ে দেবার জন্য কিছুদিন টাকাকড়ি ও বিষয়-সম্পত্তির সংস্পর্শে আমাকে আসতে হয়েছে। আমার স্থির বিশ্বাস যে, আমার যতটুকু করবার তো শেষ হয়েছে; এখন আমার আর বেদান্ত বা জগতের অন্য কোন দর্শন এমন কি ঐ কাজটার ওপরও কোন টান নেই। আমি চলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি—পৃথিবীর এই নরককুণ্ডে আর ফিরে আসছি না। এমন কি, এই কাজের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার দিকটার ওপরও আমার অরুচি হয়ে আসছে। মা শীঘ্রই আমাকে তার কাছে টেনে নিন! আর যেন কখনও ফিরে আসতে না হয়।
এই সব কাজ করা, উপকার ইত্যাদি শুধু চিত্তশুদ্ধির সাধনা মাত্র। তা আমার যথেষ্ট হয়ে গেছে। জগৎ চিরকাল অনন্তকাল ধরে জগৎই থাকবে। আমরা যে যেমন সে তেমন ভাবেই জগৎটা দেখি। কে কাজ করে, আর কার কাজ? জগৎ বলে কিছু নেই—এ সবই তো স্বয়ং ভগবান্। ভ্রমে আমরা একে জগৎ বলি। এখানে আমি নেই, তুমি নেই, আপনি নেই—আছেন শুধু তিনি, আছেন প্রভু—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’।
সুতরাং এখন থেকে টাকাকড়ি সম্বন্ধে আমি আর কিছুই জানি না। এ আপনাদের টাকা, আপনারা ইচ্ছামত খরচ করবেন।
শুভানুধ্যায়ী
সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ডাক্তার জেনসের কাজে আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে, আমি তাঁকে তা জানিয়েছি। গুডউইন ও সারদানন্দ যদি আমেরিকায় কাজের প্রসার করতে পারে তো ভগবৎকৃপায় তারা তাই করতে থাকুক। স্টার্ডি, আমার বা অন্য কারও কাছে তো আর তারা নিজেদের বাঁধা দেয়নি! গ্রীনএকারের প্রোগ্রামে একটা ভয়ানক ভুল হয়েছে—ওতে ছাপা হয়েছে, স্টার্ডি কৃপা করে অনুমতি দেওয়ায় সারদানন্দ সেখানে রয়েছে। স্টার্ডি বা অপর কেহ—একজন সন্ন্যাসীকে অনুমতি দেবার কে? স্টার্ডি এটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এবং এজন্য দুঃখও করেছে। … এতে স্টার্ডিকে অপমানিত করা হয়েছে; আর এটা যদি ভারতে পৌঁছাত, তবে আমার কাজের পক্ষে সাঙ্ঘাতিক হত। ভাগ্যক্রমে আমি বিজ্ঞাপনগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছি। … আমি জগতের কোন সন্ন্যাসী বা প্রভুর চালক নই। যে কাজটা তাঁদের ভাল লাগে, সেইটে তাঁরা করেন এবং আমি যদি তাঁদের সাহায্য করতে পারি—বস্, এইমাত্র তাঁদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ। আমি পারিবারিক বন্ধনরূপ লোহার শেকল ভেঙেছি—আর ধর্মসঙ্ঘের সোনার শেকল পরতে চাই না। আমি মুক্ত, সর্বদা মুক্ত থাকব। আমার ইচ্ছা সকলেই মুক্ত হয়ে যাক—বাতাসের মত মুক্ত। যদি নিউ ইয়র্ক, বোষ্টন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোন স্থান বেদান্তের আচার্য চায়, তবে তাদের উচিত এই আচার্যদের সাদরে গ্রহণ করা, তাঁদের বাসস্থান ও ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। আর আমার কথা—আমি তো অবসর গ্রহণ করছি বললেই চলে। জগৎ-রঙ্গমঞ্চে আমার যেটুকু অভিনয় করবার ছিল, তা আমি শেষ করেছি। ইতি
আপনাদের
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৮৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
Lake Lucerne, সুইজরলণ্ড
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
কল্যাণবরেষু,
অদ্য রামদয়ালবাবুর এক পত্র পাইলাম। তাহাতে তিনি লিখিতেছেন যে, দক্ষিণেশ্বরের মহোৎসবে অনেক বেশ্যা যাইয়া থাকে এবং সেজন্য অনেক ভদ্রলোকের তথায় যাইবার ইচ্ছা কম হইতেছে। পুনশ্চ—তাঁহার মতে পুরুষদিগের একদিন এবং মেয়েদের আর একদিন হওয়া উচিত। তদ্বিষয়ে আমার বিচার এইঃ
আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।
১। বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মহাতীর্থে যাইতে না পায় তো কোথায় যাইবে? পাপীদের জন্য প্রভুর বিশেষ প্রকাশ, পুণ্যবানের জন্য তত নহে।
২। মেয়েপুরুষ-ভেদাভেদ, জাতিভেদ, ধনভেদ, বিদ্যাভেদ ইত্যাদি নরক-দ্বাররূপ বহুভেদ সংসারের মধ্যেই থাকুক। পবিত্র তীর্থস্থলে ঐরূপ ভেদ যদি হয়, তাহা হইলে তীর্থ আর নরকে ভেদ কি?
৩। আমাদের মহা জগন্নাথপুরী—যথায় পাপী-অপাপী, সাধু-অসাধু, আবালবৃদ্ধবনিতা নরনারী সকলের অধিকার। বৎসরের মধ্যে একদিন অন্ততঃ সহস্র সহস্র নরনারী পাপবুদ্ধি ও ভেদবুদ্ধির হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া হরিনাম করে ও শোনে, ইহাই পরম মঙ্গল।
৪। যদি তীর্থস্থলেও লোকের পাপবৃত্তি একদিনের জন্য সঙ্কুচিত না হয়, তাহা তোমাদের দোষ, তাহাদের নহে। এমন মহা ধর্মস্রোত তোল যে, যে জীব তাহার নিকট আসবে, সে-ই ভেসে যাক।
৫। যাহারা ঠাকুরঘরে গিয়াও ঐ বেশ্যা, ঐ নীচ জাতি, ঐ গরীব, ঐ ছোটলোক ভাবে, তাহাদের (অর্থাৎ যাহাদের তোমরা ভদ্রলোক বল) সংখ্যা যতই কম হয়, ততই মঙ্গল। যাহারা ভক্তের জাতি বা যোনি বা ব্যবসায় দেখে, তাহারা আমাদের ঠাকুরকে কি বুঝিবে? প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি যে, শত শত বেশ্যা আসুক তার পায়ে মাথা নোয়াতে, বরং একজনও ভদ্রলোক না আসে নাই আসুক। বেশ্যা আসুক, মাতাল আসুক, চোর ডাকাত সকলে আসুক তাঁর অবারিত দ্বার। ‘It is easier for a camel to pass through the eye of a needle than for a rich man to enter the kingdom of God.’১০৭ এ সকল নিষ্ঠুর রাক্ষসীভাব মনেও স্থান দিবে না।
৬। তবে কতকটা সামাজিক সাবধানতা চাই—সেটা কি প্রকারে করিতে হইবে? জনকতক লোক (বৃদ্ধ হইলেই ভাল হয়) ছড়িদারের কার্য ঐ দিনের জন্য লইবেন। তাঁহারা মহোৎসবস্থলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবেন, কোন পুরুষ বা স্ত্রীকে কদাচার বা কুকথা ইত্যাদিতে নিযুক্ত দেখিলে তাহাদিগকে উদ্যান হইতে তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দিবেন। কিন্তু যতক্ষণ তাহারা ভালমানুষের মত ব্যবহার করে, ততক্ষণ তারা ভক্ত ও পূজ্য—মেয়েই হউক বা পুরুষই হউক, গৃহস্থ হউক বা অসতী হউক।
আমি এক্ষণে সুইজরলণ্ডে ভ্রমণ করিতেছি—শীঘ্র জার্মানীতে যাইব অধ্যাপক ডয়সনের সহিত দেখা করিতে। তথা হইতে ইংলণ্ডে প্রত্যাগমন ২৩।২৪ সেপ্টেম্বর নাগাত এবং আগামী শীতে দেশে প্রত্যাবর্তন।
আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯০
সুইজরলণ্ড
২৬ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
এইমাত্র আপনার চিঠি পেলাম। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আল্পস্ পর্বতে খুব চড়াই করছি আর তুষারপ্রবাহ পার হচ্ছি। এখন যাচ্ছি জার্মানীতে। অধ্যাপক ডয়সন কিয়েলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমায় নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব। সম্ভবতঃ এই শীতে ভারতে ফিরব।
মলাটের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমার আপত্তি এই যে, ওটি বড্ড রঙচঙে, চটকদার (tawdry); আর তাতে অনাবশ্যক এক গাদা মূর্তির সমাবেশ করা হয়েছে। নক্সা হওয়া চাই সাদাসিধে, ভাবদ্যোতক অথচ সংক্ষিপ্ত (condensed)।
আমি সানন্দে জানাচ্ছি যে, কাজ সুন্দর চলছে। … যা হোক, একটা পরামর্শ দিচ্ছি—ভারতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আমরা যত কাজ করি, তার সব একটা দোষে পণ্ড হয়ে যায়। আমরা এখনও কাজের ধারা ঠিক ঠিক শিখিনি। কাজকে ঠিক ঠিক কাজ বলেই ধরতে হবে—এর ভেতর বন্ধুত্বের অথবা চক্ষুলজ্জার স্থান নেই। যার ওপর ভার থাকবে, সে সব টাকাকড়ির অতি পরিষ্কার হিসেব রাখবে; এমন কি যদি কাউকে পরমুহূর্তে না খেয়ে মরতে হয়, তবুও ‘শাকের কড়ি মাছে’ দেবে না। একেই বলে বৈষয়িক সততা। তারপর চাই—অদম্য উৎসাহ। যখন যা কর, তখনকার মত তাই হবে ভগবৎ-সেবা। এই পত্রিকাটি১০৮ এখনকার মত আপনার আরাধ্য দেবতা হোক, তাহলেই সফল হবেন।
যখন এই পত্রিকাটি দাঁড় করিয়ে দিতে পারবেন, তখন তামিল, তেলুগু, কানাড়া প্রভৃতি দেশীয় ভাষায় ঠিক ঐ ভাবের কাগজ বের করুন। মান্দ্রাজীরা খুব সৎ, উৎসাহী ইত্যাদি; তবে আমার মনে হয়, শঙ্করের জন্মভূমি ত্যাগের ভাব হারিয়ে ফেলেছে। নানা বাধা বিপদের মাঝে আমার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, সংসার ত্যাগ করবে; তবেই তো ভিত্তি শক্ত হবে!
বীরের মত কাজ করে চলুন; (মলাটের) নক্সা-টক্সার চিন্তা এখন থাক, ঘোড়া হলে লাগামের জন্য আটকাবে না। আমরণ কাজ করে যান—আমি আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছি আর আমার শরীর চলে গেলেও আমার শক্তি আপনাদের সঙ্গে কাজ করবে। জীবন তো আসে যায়—ধন, মান, ইন্দ্রিয়ভোগ সবই দুদিনের জন্য। ক্ষুদ্র সংসারী কীটের মত মরার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে সত্য প্রচার করে মরা ভাল—ঢের ভাল। চলুন—এগিয়ে চলুন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহণ করুন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
(পাশ্চাত্য শিষ্য স্বামী কৃপানন্দকে লিখিত)
সুইজরলণ্ড
অগস্ট, ১৮৯৬
পবিত্র হও ও সর্বোপরি অকপট হও; মুহুর্তের জন্যও ভগবানে বিশ্বাস হারিও না—তা হলেই আলাে দেখতে পাবে। যা কিছু সত্য, তাই চিরস্থায়ী ; কিন্তু যা সত্য নয়, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বর্তমান ক্ষিপ্ত অনুসন্ধিৎসার যুগে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেকটা সুবিধা পেয়েছি। অন্যে যাই ভাবুক আর করুক, তুমি কখনও তােমার পবিত্রতা, নীতি ও ভগবৎপ্রেমের উচ্চ আদর্শ খর্ব করাে না। সর্বোপরি সব রকম গুপ্ত সমিতির বিষয়ে সতর্ক থেকে। ভগবৎ-প্রেমিকের পক্ষে চালাকিতে ভীত হবার কিছুই নেই। স্বর্গে ও মর্ত্যে পবিত্রতাই সবচেয়ে মহৎ ও দিব্য শক্তি। ‘সত্যমেব জয়তে নামৃতম, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযান।'—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যা নয়; সত্যের মধ্য দিয়েই দেবযান মার্গ চলেছে। কে তােমার সহগামী হ’ল বা না হ’ল, তা নিয়ে মােটেই মাথা ঘামিও না; শুধু প্রভুর হাত ধরে থাকতে যেন কখন ভুল না হয় ; তা হলেই যথেষ্ট।
গতকাল আমি মন্টি রোজা’র তুষাপ্রবাহের ধারে গিয়েছিলাম এবং সেই চিরতুষারের প্রায় মাঝখানে জাত কয়েকটি শক্ত পাপড়িবিশিষ্ট ফুল তুলে এনেছিলাম। তারই একটি এই চিঠির মধ্যে তােমাকে পাঠাচ্ছি—আশা করি, জাগতিক জীবনের সর্বপ্রকার বাধা-বিপৰ্যয়রূপ হিমরাশি ও তুষারপাতের মধ্যে তুমিও ঐ রকম আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা লাভ করবে।
তােমার স্বপ্নটি খুবই সুন্দর। স্বপ্নে আমরা আমাদের মনের এমন একটা স্তরের পরিচয় পাই, যা জাগ্রত অবস্থায় কখন পাই না, এবং কল্পনা যতই অবাস্তব হােক না কেন, অজ্ঞাত আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ তার পশ্চাতেই অবস্থান করে। সাহস অবলম্বন কর। মানবজাতির কল্যাণের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব—বাকী সব প্রভুই জানেন।
অধীর হয়ো না, তাড়াহুড়া করাে না। ধীর, একনিষ্ঠ এবং নীরব কমই সফল হয়। প্রভু অতি মহান। বংস, আমরা সফল হবই—সফল হতেই হবে। তাঁর নাম ধন্য হােক।
এখানে কোন আশ্রম নেই। একটি থাকলে কী সুন্দরই না হত। আমি তাতে কতই না আনন্দিত হতাম এবং তাতে এদেশের কতই না কল্যাণ হত!
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯২
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Kiel
১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… অবশেষে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। … অধ্যাপকের সঙ্গে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে ও বেদান্ত আলোচনা করে কালকের দিনটা খুব চমৎকার কাটান গেছে।
আমার মতে তিনি যেন একজন ‘যুধ্যমান (warring) অদ্বৈতবাদী’। অপর কিছুর সঙ্গে তিনি আপস করতে নারাজ। ‘ঈশ্বর’ শব্দে তিনি আঁতকে উঠেন। ক্ষমতায় কুলালে তিনি এ- সব কিছুই রাখতেন না। তোমার মাসিক পত্রিকার পরিকল্পনায় তিনি খুব আনন্দিত এবং এ- সব বিষয়ে লণ্ডনে তোমার সঙ্গে আলোচলা করতে চান; শীঘ্রই তিনি সেখানে যাচ্ছেন।
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৩
[মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
সুইজরলণ্ড থেকে ফিরে এসে এইমাত্র তোমার অতি মনোজ্ঞ খবরটি পেলাম। ‘Old Maids Home’ (আইবুড়ীদের আশ্রম)-এ লভ্য আরাম সম্বন্ধে তুমি যে অবশেষে মত পরিবর্তন করেছ, তাতে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। তুমি এখন ঠিক পথ ধরেছ, শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের পক্ষে বিবাহই জীবনের সর্বোত্তম লক্ষ্য। আর যে মুহূর্তে এই চিরন্তন সত্যটি মানুষ শিখে নেবে এবং মেনে চলতে প্রস্তুত হবে যে, পরস্পরের দোষত্রুটি সহ্য করা অবশ্য কর্তব্য এবং জীবনে আপস করে চলাই রীতি, তখনই তারা সবচেয়ে সুখের জীবন যাপন করতে পারবে।
স্নেহের হ্যারিয়েট, তুমি ঠিক জেনো ‘সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন’—একটা স্ববিরোধী কথা; সুতরাং সংসারের কোন কিছু আমাদের উচ্চতম আদর্শের কাছাকাছি নয়—এটা দেখবার জন্য আমাদের সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে, এবং এটা জেনে সব জিনিষের যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করতে হবে।
বর্তমান অবস্থায় আমাদের একখানি পুস্তক থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করাই আমার পক্ষে সব চেয়ে ভাল বলে মনে হচ্ছেঃ
‘স্বামীকে ইহজীবনে সমস্ত কাম্যলাভে সহায়তা করে তুমি সর্বদা তাঁহার ঐকান্তিক প্রেমের অধিকারিণী হও; অতঃপর পৌত্র পৌত্রী প্রভৃতির মুখদর্শনের পরে যখন জীবন-নাট্য শেষ হয়ে আসবে, তখন যে সচ্চিদানন্দ-সাগরের জলস্পর্শে সর্বপ্রকার বিভেদ দূর হয়ে যায় এবং আমরা এক হয়ে যাই, সেই সচ্চিদানন্দ-লাভে যেন তোমরা পরস্পরের সহায় হও।’১০৯
আমি তোমাকে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয়, তোমার মধ্যে এমন প্রভূত ও সুসংযত শক্তি রয়েছে, যা ক্ষমা ও সহনশীলতায় পূর্ণ। সুতরাং আমি নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, তোমার দাম্পত্য-জীবন খুব সুখের হবে।
তোমাকে ও তোমার ভাবী বরকে আমার অনন্ত আশীর্বাদ। ভগবান্ যেন তাকে সর্বদা এ-কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তোমার মত পবিত্র, সুচরিত্রা, বুদ্ধিমতী, স্নেহময়ী ও সুন্দরী সহধর্মিণী লাভ করে সে কৃতার্থ হয়েছে।
আমি এত শীঘ্র আটলাণ্টিক পাড়ি দেবার ভরসা রাখি না, যদিও তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকতে আমার খুবই সাধ।
তুমি সারাজীবন উমার মত পবিত্র ও নিষ্কলুষ হও, আর তোমার স্বামীর জীবন যেন উমাগতপ্রাণ শিবের মতই হয়। ইতি
তোমার স্নেহের ভাই
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৪
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
Airlie Lodge
Wimbledon, England
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
স্নেহের ভগিনী,
সুইজরলণ্ডে দু-মাস পাহাড় চড়ে, পর্যটন করে ও হিমবাহ দেখে আজ লণ্ডনে এসে পৌঁছেছি। এতে আমার একটা উপকার হয়েছে—কয়েক পাউণ্ড অপ্রয়োজনীয় মেদ বাষ্পীয় অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। তথাপি তাতেও কোন নিরাপত্তা নেই, কারণ এ জন্মের স্থূল দেহটির খেয়াল হয়েছে মনকে অতিক্রম করে অনন্তে প্রসারিত হবে। এ ভাবে চলতে থাকলে আমাকে অচিরেই সমস্ত ব্যক্তিগত সত্তা হারাতে হবে—এই রক্তমাংসের দেহে থেকেও—অন্ততঃ বাইরের জগৎটার কাছে।
হ্যারিয়েটের চিঠিতে যে শুভ সংবাদটি এসেছে, তাতে যা আনন্দ হল—তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আজ তাকে চিঠি দিলাম। দুঃখ এই যে, তার বিবাহের সময় যেতে পারছি না, তবে সর্বাধিক শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ নিয়ে আমি ‘সূক্ষ্ম দেহে’ উপস্থিত থাকব। ভাল কথা, আমার আনন্দ পূর্ণাঙ্গ করার জন্য আমি তোমার এবং অপর ভগিনীদের নিকট হতেও অনুরূপ সংবাদ আশা করছি। এবার স্নেহের মেরী, আমি জীবনে যে এক মহৎ শিক্ষা লাভ করেছি, তার কথা তোমাকে বলব। সেটা হল এইঃ ‘তোমার আদর্শ যত উচ্চ হবে, তুমি তত দুঃখী’, কারণ ‘আদর্শ’ বলে বস্তুটিতে পৌঁছান এ সংসারে সম্ভব নয়—অথবা এ জীবনেও নয়। যে এ জগতে পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা করে, সে উন্মাদ বৈ নয়, কারণ তা হবার যো নেই।
সসীম জগতে তুমি কি করে অনন্তের সন্ধান পাবে? সুতরাং আমি তোমাকে বলছি— হ্যারিয়েট বেশ সুখের ও শান্তির জীবন লাভ করবে, কারণ কল্পনাবিলাস ও ভাবপ্রবণতার বশবর্তী হয়ে চলার মত বোকা সে মোটেই নয়। যেটুকু ভাবাবেগ থাকলে জীবন মধুর হয় এবং যেটুকু সাধারণ বুদ্ধি ও কোমলতা থাকলে জীবনের অবশ্যম্ভাবী কাঠিন্যগুলি নরম হয়ে যায়—সেটুকু তার আছে। হ্যারিয়েট ম্যাক্কিণ্ডলিরও ঐ গুণটি আরও বেশী পরিমাণেই আছে। একজন সেরা গৃহিণী হবার মত মেয়ে সে, শুধু এ জগৎটা আহাম্মকদের দ্বারা এতই পরিপূর্ণ যে, খুব কম লোক রক্তমাংসের দেহকে অতিক্রম করে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তোমার ও ইসাবেল-এর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমি তোমাকে সত্য কথাটি বলব এবং আমার ‘ভাষা সোজা—স্পষ্ট’।
মেরী, তুমি হলে একটি তেজী আরবী ঘোড়ার মত—মহীয়সী ও দীপ্তিময়ী। তোমাকে রাণী হিসেবে চমৎকার মানাবে—দেহে ও মেজাজে। তুমি একজন তেজস্বী, বীর, দুঃসাহসী, নির্ভীক স্বামীর পাশে উজ্জ্বল দীপ্তিতে শোভা পাবে; কিন্তু স্নেহের ভগিনী, গৃহিণী হিসেবে তুমি হবে একেবারেই নিকৃষ্ট। তুমি আমাদের দৈনন্দিন জগতের স্বচ্ছন্দচারী, সাংসারিক, পরিশ্রমী অথচ ঢিলেঢালা স্বামী বেচারাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। ভগিনী, মনে রেখো, যদিও এ-কথা সত্যি যে বাস্তব জীবন উপন্যাসের চেয়ে বেশী রোমাঞ্চকর, কিন্তু সে-রকম ঘটে ক্বচিৎ কখনও। তাই তোমার প্রতি আমার উপদেশ, যতদিন না তোমার আদর্শকে বাস্তব ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারছ, ততদিন তোমার বিয়ে করা ঠিক হবে না। যদি কর, তবে তা তোমাদের উভয়ের অশান্তি ডেকে আনবে। কয়েক মাসের মধ্যেই তুমি একজন সাধারণ ভালমানুষ মার্জিত রুচি যুবা পুরুষের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে, তখন তোমার কাছে জীবন নীরস বলে বোধ হবে। ভগিনী ইসাবেল-এর মেজাজটাও তোমারই মতন, শুধু কিণ্ডারগার্টেনটি তাকে বেশ কিছুটা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছে। সম্ভবতঃ সে ভাল গৃহিণীই হতে পারবে।
জগতে দু-রকমের লোক আছে। একরকম হল—বলিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার করে, বেশী কল্পনার ধার ধারে না, কিন্তু সৎ সহৃদয় মধুরস্বভাব ইত্যাদি। তাদেরই জন্য এই পৃথিবী; তারাই সুখী হতে জন্মেছে। আবার অন্য রকমের লোক আছে, যাদের স্নায়ুগুলি উত্তেজনাপ্রবণ, যারা ভয়ানক রকম কল্পনাপ্রিয়, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন এবং সর্বদা এই মুহূর্তে উঁচুতে উঠছে এবং পরের মুহূর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের বরাতে সুখ নেই। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা মাঝামাঝি একটা সুখের সুরে ভেসে যায়। শেষোক্তেরা আনন্দ ও বেদনার মধ্যে ছুটোছুটি করে। কিন্তু এরাই হল প্রতিভার উপাদান। ‘প্রতিভা এক রকমের পাগলামি’—আধুনিক এই মতবাদের মধ্যে অন্ততঃ কিছু সত্য নিহিত আছে।
এখন এই শ্রেণীর লোকেরা যদি বড় হতে চায়, তবে তাদের তা চরিতার্থ করবার জন্য লড়াই করতে হবে—লড়াই-এর জন্যেই, আর বাইরে বেরিয়ে এসে। তাদের কোন দায় থাকবে না—বিবাহ নয়, সন্তান নয়, সেই এক চিন্তা ছাড়া আর কোন অনাবশ্যক আসক্তি নয়; সেই আদর্শের জন্যই জীবনধারণ এবং সেই আদর্শের জন্যই মৃত্যুবরণ। আমি এই শ্রেণীর মানুষ। আমার একমাত্র ভাবাদর্শ হল ‘বেদান্ত’, এবং আমি ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত’। তুমি ও ইসাবেল এই ধাতুতে গড়া; কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যদিও কথাটা রূঢ়, তোমরা তোমাদের জীবনের বৃথাই অপচয় করছ। হয় একটা আদর্শকে ধর, বাইরে ঝাঁপিয়ে পড় এবং তার জন্য জীবন উৎসর্গ কর; কিম্বা অল্পে সন্তুষ্ট থাক ও বাস্তববাদী হও; আদর্শকে খাটো করে বিয়ে কর ও সুখের জীবন যাপন কর। হয় ‘ভোগ’ নয় ‘যোগ’—হয় এই জীবনটাকে উপভোগ কর, অথবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে যোগী হও; দুটি একসঙ্গে লাভ করার সাধ্য কারও নেই। এইবেলা না হলে কোনকালেই হবে না, ঝটপট একটাকে বেছে নাও। কথায় বলে, ‘যে খুব বাছবিচার করে, তার বরাতে কিছুই জোটে না’। তাই আন্তরিকভাবে, খাঁটিভাবে আমরণ সংকল্প নিয়ে ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হও’; দর্শন বা বিজ্ঞান, ধর্ম বা সাহিত্য—যে-কোন একটিকে অবলম্বন কর এবং অবশিষ্ট জীবনে সেইটিই তোমার উপাস্য দেবতা হোক। হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও। তোমার ও ইসাবেলের প্রতি আমার এতটুকু সহানুভূতি নেই; তোমরা না এটায়, না ওটায়। তোমরাও হ্যারিয়েটের মত ঠিক পথটি বেছে নিয়ে সুখী হও, কিম্বা মহীয়সী হও—এই আমি দেখতে চাই। পান ভোজন সজ্জা ও যত বাজে সামাজিক চালচলনের ছেলেমানুষীর জন্য একটা জীবন দেওয়া চলে না—বিশেষতঃ মেরী, তোমার। অদ্ভুত মস্তিষ্ক ও কর্মকুশলতাকে তুমি মরচে পড়তে দিয়ে নষ্ট করে ফেলছ, যার কোন অজুহাত নেই। বড় হবার উচ্চাশা তোমাকে রাখতে হবে। আমি জানি, আমার এই রূঢ় মন্তব্যগুলো তুমি ঠিকভাবে নেবে, কারণ তুমি জান, আমি তোমাদের যে ‘বোন’ বলে ডাকি—তার চেয়েও বেশীই আমি তোমাদের মনে করি। আমার অনেকদিন থেকেই এই কথাটি তোমাকে বলার ইচ্ছা ছিল, এবং অভিজ্ঞতা জমছে, তাই বলার আবেগে বলে ফেললাম। হ্যারিয়েটের আনন্দসংবাদ আমাকে এ-কথা বলতে প্ররোচিত করেছে। আমি শুনতে পেলে খুবই আনন্দিত হব যে, তুমিও বিয়ে করেছ এবং সংসারে যতটা সুখী হওয়া যায় ততটা সুখী হয়েছ, অথবা এ-কথা শুনতে চাই যে তুমি বড় বড় কাজ করছ।
জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের কাছে গিয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই এই শ্রেষ্ঠ জার্মান দার্শনিকের নাম শুনেছ। তিনি ও আমি একসঙ্গে ইংলণ্ড ভ্রমণ করেছি ও আজ উভয়ে এখানে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি—আমার ইংলণ্ড বাসের অবশিষ্ট দিনগুলি তাঁর কাছেই কাটাব। ডয়সন সংস্কৃত বলতে খুব ভালবাসেন এবং পাশ্চাত্য দেশে সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি সেটা অভ্যাস করতে চান বলে আমার সঙ্গে সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলেন না।
আমি এখানে বন্ধুদের মধ্যে এসে জুটেছি, কয়েক সপ্তাহ এখানে কাজ করব এবং তারপর শীতকালে ভারতবর্ষে ফিরে যাব।
সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৫
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
C/o Miss Muller
Airlie Lodge, Ridgeway
Gardens
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
ম্যাক্সমূলারের লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় যে প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলাম, তা তুমি পাওনি বলেই মনে হচ্ছে। তিনি ঐ প্রবন্ধে আমার নাম উল্লেখ না করায় তুমি দুঃখিত হয়ো না; কারণ আমার সঙ্গে পরিচয় হবার ছ-মাস আগে তিনি ঐ প্রবন্ধটি লিখেছেন। তা ছাড়া মূল বিষয়ে যদি তিনি ঠিক থাকেন, তবে কার নাম করলেন বা না করলেন, এ নিয়ে কে মাথা ঘামায়!
জার্মানীতে প্রফেসর ডয়সনের সঙ্গে আমার কিছুদিন খুব সুন্দর কেটেছে। তারপর দুজনে লণ্ডনে আসি। ইতোমধ্যেই আমাদের দুজনের মধ্যে খুব সৌহার্দ্য জন্মেছে। আমি শীঘ্রই তোমাকে তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠাচ্ছি। দয়া করে এইটুকু শুধু মনে রেখো—আমার প্রবন্ধের প্রারম্ভে পুরানো ঢঙের ‘প্রিয় মহাশয়’ যেন ছাপা না হয়। রাজযোগের বইখানি কি তোমার দেখা হয়েছে? আগামী বৎসরের জন্য তোমায় একটি নক্সা পাঠাব। রাশিয়ার জারের লেখা একটি ভ্রমণ-বিষয়ক পুস্তকের উপর ‘ডেলী নিউজে’ যে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল, তা তোমায় পাঠালাম। যে প্যারাগ্রাফে তিনি ভারতবর্ষকে ‘ধর্মভূমি ও জ্ঞানভূমি’ বলেছেন, সেটা তোমার কাগজে উদ্ধৃত করা উচিত; তারপর ওটি ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ পাঠিয়ে দিও।
জ্ঞানযোগের বক্তৃতাগুলি তুমি অনায়াসে ছাপতে পার, আর ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাও সহজ বক্তৃতাগুলি ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ ছাপতে পারেন। তবে ওগুলো খুব ভাল করে দেখে নিয়ে ছাপাবে। আমার বিশ্বাস, পরে আমি আরও বেশী লিখবার সময় পাব। উৎসাহ নিয়ে কাজে লেগে যাও। সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—যে অংশটা ছাপতে হবে, তা দাগ দিয়ে দিয়েছি—বাকীটা অবশ্য পত্রিকার পক্ষে উপযুক্ত নয়।
যথেষ্ট প্রবন্ধ দিয়ে কাগজখানিকে বড় করতে পারবে—এমন ভরসা যদি না থাকে, তবে এখনই ওটাকে মাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করা আমার ভাল মনে হচ্ছে না। এ পর্যন্ত তো পত্রিকার আকার ও প্রবন্ধগুলি আশানুরূপ নয়। এখনও অনেক বিশাল ক্ষেত্র পড়ে আছে, যেখানে আমরা প্রবেশও করিনি; যথা—তুলসীদাস, কবীর, নানক ও দক্ষিণ ভারতীয় সাধুদের জীবন ও বাণী। অসাবধানে ও যা তা ভাবে না লিখে সঠিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে এ-সব লেখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে এই পত্রিকার আদর্শ বেদান্ত-প্রচার তো হবেই, তা ছাড়া এটি ভারতীয় গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের মুখপত্র হবে—অবশ্য ঐ গবেষণাদি হবে ধর্ম সম্বন্ধে। তোমার উচিত কলিকাতা ও বোম্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সংস্পর্শে আসা ও তাঁদের কাছ থেকে সযত্নে রচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ করা। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লাগ। ইতি
বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৬
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েস্টমিনস্টার, লণ্ডন
১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি প্রায় তিন সপ্তাহ হল সুইজরলণ্ড থেকে ফিরেছি; কিন্তু তোমাকে এ পর্যন্ত বিস্তারিত পত্র লিখতে পারিনি। আমি গত mail (ডাকে)-এ কিয়েল-নিবাসী পল ডয়সন সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছি। স্টার্ডির কাগজ বের করবার মতলব এখনও কাজে পরিণত হয়নি। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, আমি সেণ্ট জর্জেস্ রোডের বাসা ছেড়ে এসেছি। আমাদের একটি বক্তৃতা দেবার হল হয়েছে। ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, C/o E. T. Sturdy—এই ঠিকানায় এক বৎসর পর্যন্ত পত্রাদি এলে আমার কাছে পৌঁছবে। গ্রেকোট গার্ডেনে যে ঘরগুলি আছে, তা আমার ও অপর স্বামীর (সন্ন্যাসীর) থাকবার উদ্দেশ্যে মাত্র তিন মাস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। লণ্ডনের কাজ দিন দিন বেড়ে চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই ক্লাসে বেশী করে লোক সমাগম হচ্ছে। শ্রোতৃ-সংখ্যা যে ঐ হারে ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর ইংরেজ জাতি বড়ই দৃঢ়প্রকৃতি ও নিষ্ঠাবান্। অবশ্য আমি চলে গেলে যতটা গাঁথনি হয়েছে, তার অধিকাংশই পড়ে যাবে। কিন্তু তারপর হয়তো কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে, হয়তো কোন দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এসে এই কার্যের ভার গ্রহণ করবে—প্রভুই জানেন, কিসে ভাল হবে।
আমেরিকায় বেদান্ত ও যোগ শিক্ষা দেবার জন্য বিশ জন প্রচারকের স্থান হতে পারে; কিন্তু কোথা থেকেই বা প্রচারক পাওয়া যাবে, আর তাদের আনবার জন্য টাকাই বা কোথায়? যদি কয়েকজন দৃঢ়চেতা খাঁটি লোক পাওয়া যায়, তবে দশ বৎসরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক জয় করে ফেলা যেতে পারে। কোথায় এরূপ লোক? আমরা সবাই যে আহম্মকের দল—স্বার্থপর, কাপুরুষ; মুখে স্বদেশপ্রেমের কতকগুলি বাজে বুলি আওরাই, আর ‘আমরা খুব ধার্মিক’ এই অভিমানে ফুলে আছি! মান্দ্রাজীরা অপেক্ষাকৃত চটপটে ও একনিষ্ঠ; কিন্তু হতভাগাগুলো সকলেই বিবাহিত! বিবাহ, বিবাহ, বিবাহ! পাষণ্ডেরা যেন ঐ একটি কর্মেন্দ্রিয় নিয়েই জন্মেছে! … এ আমি বড় শক্ত কথা বললাম; কিন্তু বৎস, আমি চাই এমন লোক—যাদের পেশীসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব—ক্ষাত্রবীর্য, ব্র্হ্মতেজ! আমাদের সুন্দর সুন্দর ছেলেগুলি—যাদের উপর সব আশা করা যায়, তাদের সব গুণ, সব শক্তি আছে—কেবল যদি এই রকম লাখ লাখ ছেলেকে বিবাহ নামে কথিত পশুত্বের যূপকাষ্ঠে হত্যা না করা হত! হে প্রভো, আমার কাতর ক্রন্দনে কর্ণপাত কর। মান্দ্রাজ তখনই জাগবে, যখন তার হৃদয়ের শোণিতস্বরূপ অন্ততঃ একশত শিক্ষিত যুবক সংসার থেকে একেবারে স্বতন্ত্র হয়ে কোমর বাঁধবে এবং দেশে সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হবে। ভারতের বাইরে এক ঘা দিতে পারলে সেই এক ঘা ভারতের ভিতরের লক্ষ আঘাতের তুল্য হয়। যা হোক, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয় তবেই হবে।
আমি তোমাদের যে টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলাম, মিস মূলার সেই টাকা দেবেন বলেছিলেন। আমি তাঁকে তোমার নূতন প্রস্তাবের বিষয় বলেছি, তিনি তা ভেবে দেখেছেন। ইতোমধ্যে আমার বিবেচনায় তাঁকে কিছু কাজ দেওয়া ভাল। তিনি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র এজেণ্ট হতে স্বীকৃত হয়েছেন। তুমি তাঁকে ঐ সম্বন্ধে লিখো যেন। তাঁর ঠিকানা—Airlie Lodge, Ridgeway Gardens, Wimbledon, England. গত কয়েক সপ্তাহ তাঁরই বাড়ীতে ছিলাম। কিন্তু আমি লণ্ডনে না থাকলে লণ্ডনের কাজ চলতে পারে না; সুতরাং বাসা বদলেছি। মিস মূলার এতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, আমিও দুঃখিত। কিন্তু কি করব! এঁর পুরা নাম—মিস হেনরিয়েটা মূলার। ম্যাক্সমূলার দিন দিন আরও বেশী করে বন্ধুভাবাপন্ন হচ্ছেন। শীঘ্রই আমাকে অক্সফোর্ডে দুটি বক্তৃতা দিতে হবে।
মহীশূরে তামিল লিপিতে সমগ্র ১০৮ উপনিষদ্-সমন্বিত একখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অধ্যাপক ডয়সনের পুস্তকাগারে সেটি দেখলাম। ও বইয়ের কি কোন দেবনাগরী সংস্করণ আছে? যদি থাকে তো আমায় একখানি পাঠাবে। যদি না থাকে তো তামিল সংস্করণটিই পাঠাবে এবং একখানা কাগজে তামিল অক্ষরগুলি (সংযুক্ত অক্ষরসহ) পাশে পাশে নাগরীতে লিখে পাঠাবে—যাতে আমি তামিল অক্ষর শিখে নিতে পারি।
সেদিন আমার সঙ্গে সত্যনাথন মহাশয়ের সাক্ষাৎ হল লণ্ডনে। তিনি আমাকে তাঁর বেদান্তের উপর একটি বক্তৃতা এবং তাঁর মৃতা সহধর্মিণীকৃত একখানি উপন্যাস উপহার দিলেন। তিনি বললেন, মান্দ্রাজের প্রধান এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পত্র ‘মান্দ্রাজ মেলে’ রাজযোগ-পুস্তকখানির একটি অনুকূল সমালোচনা বেরিয়েছে। আরও শুনলাম, আমেরিকার প্রধান শারীরতত্ত্ববিৎ উক্ত পুস্তকে প্রকাশিত আমার মত ও ধারণাসমূহ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছেন। এই সময়ে আবার ইংলণ্ডে কতকগুলি ব্যক্তি আমার মতগুলি নিয়ে উপহাস করেছেন। ভাল কথা! আমার আলোচনা অতি নির্ভীক, আর এগুলির বেশীরভাগই লোকের নিকট চিরকাল অর্থহীন থেকে যাবে। কিন্তু ওতে এমন সব বিষয়ের আভাস দেওয়া হয়েছে, শারীরতত্ত্ববিদ্রা আরও আগেই গ্রহণ করলে ভাল করতেন। যা হোক, যেটুকু ফল হয়েছে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার ভাব এই—লোকে আমার বিরুদ্ধে বলুক, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু কিছু বলুক।
অবশ্য ইংলণ্ডের সমালোচকগণ ভদ্র, আমেরিকার সমালোচকদের মত বাজে বকে না। তারপর ইংলণ্ডের যে-সব মিশনরী ওদেশে দেখতে পাও, তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই dissenters (প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরোধী)। … এখানকার ভদ্রলোকগণের মধ্যে যাঁরা ধার্মিক, তাঁরা সকলেই ‘চার্চ অব ইংলণ্ডে’র। ইংলণ্ডে ঐ বিরোধীদের অতি অল্পই প্রতিপত্তি, আর তাদের শিক্ষাও নেই। তুমি আমাকে মধ্যে মধ্যে যাদের বিষয়ে সাবধান করে দাও, তাদের কথা আমি এখানে শুনতেই পাই না। তারা এখানে অজ্ঞাত ও অপরিচিত এবং তারা এখানে বাজে বকতে সাহসও পায় না। আশা করি, রামকৃষ্ণ নাইডু এতদিনে মান্দ্রাজে পৌঁছেছেন এবং তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কুশল।
হে বীরহৃদয় বালকগণ, অধ্যবসায় কর। আমাদের কার্য সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। কখনও নিরাশ হয়ো না, কখনও বলো না, ‘আর না, যথেষ্ট হয়েছে।’ আমি একটু সময় পেলেই ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য কয়েকটি গল্প লিখব। অভেদানন্দ মারফৎ মাননীয় সুব্রহ্মণ্য আয়ার দয়া করে যে সমাচার পাঠিয়েছেন, সেজন্য তাঁকে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবে।
তোমার চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনঃ—পাশ্চাত্য দেশে যখনই কেউ আসে এবং বিভিন্ন জাতিদের দেখে, তখনই তার চোখ খুলে যায়। কেবল অনর্থক বকে নয়, পরন্তু ভারতে আমাদের কি আছে আর কি নেই, তা তাদের স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে—এভাবেই আমি দৃঢ়চেতা কর্মবীরদের যোগাড় করে থাকি। আমার ইচ্ছা হয়, অন্ততঃ দশ লক্ষ হিন্দু সমগ্র জগতে ভ্রমণ করুক। ইতি
বি
পুনঃ—তোমার ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য লোহার ব্লক সমেত নক্সা পাঠাব। ইতি
বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৭
C/o Miss Muller
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৭ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় জো,
আবার সেই লণ্ডনে! আর ক্লাসগুলিও যথারীতি শুরু হয়েছে। সংস্কারবশেই আমার মন চারিদিকে সেই চেনা মুখখানি খুঁজে ফিরছিল, যে মুখে কখনও নিরুৎসাহের রেখা পড়ত না, যা কখনও পরিবর্তিত হত না আর যা ছিল সর্বদা সহায়ক, আনন্দময় ও শক্তিপ্রদ। আজ কয়েক সহস্র মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও সেই মুখখানিই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল; অতীন্দ্রিয় রাজ্যে দূরত্ব আবার কি? যাক্, তুমি তো তোমার বিশ্রাম ও শান্তিপূর্ণ ঘরে ফিরে গেছ—আর আমার ভাগ্যে আছে নিত্যবর্ধমান কর্মের তাণ্ডব! তবু তোমার শুভেচ্ছা সর্বদাই আমার সঙ্গে ফিরছে—নয় কি?
কোন নির্জন পর্বতগুহায় গিয়ে চুপ করে থাকাই হচ্ছে আমার স্বাভাবিক প্রবণতা; কিন্তু পেছন থেকে নিয়তি আমাকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে, আর আমি এগিয়ে চলেছি! অদৃষ্টের গতি কে রোধ করবে?
যীশুখ্রীষ্ট তাঁর Sermon on the Mount (শৈলোপদেশ)-এ এরূপ কোন উক্তি কেন করেননি—‘যারা সদা আনন্দময় ও সদা আশাবাদী তারাই ধন্য, কারণ স্বর্গরাজ্যলাভ তো তাদের হয়েই আছে?’ আমার বিশ্বাস তিনি নিশ্চয়ই ঐরূপ বলেছিলেন, কিন্তু তা লিপিবদ্ধ হয়নি; তিনি বিশাল বিশ্বের অনন্ত দুঃখ অন্তরে বহন করে বলেছিলেন, সাধুর হৃদয় শিশুর মত। তাঁর সহস্র বাণীর মধ্যে হয়তো একটি বাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ মনে করে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে ফল বাদাম প্রভৃতিই আমার প্রধান আহার; এবং ওতেই যেন আমি ভাল আছি। যদি কখনও সেই ‘উঁচু দেশে’র পুরাতন চিকিৎসকটির সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তবে সেই রহস্যটি তাঁকে বলো। আমার চর্বি অনেকটা কমে গেছে; তবে যেদিন বক্তৃতা থাকে, সেদিন কিছু পেট ভরা খাবার খেতে হয়। হলিস্টার কেমন আছে? তার চেয়ে মধুর প্রকৃতির বালক আমি দেখিনি। তার সারাটি জীবন সর্বপ্রকার মঙ্গলে পূর্ণ হোক!
তোমার বন্ধু কোলা নাকি জরথুষ্ট্রীয় দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন? অদৃষ্ট নিশ্চয়ই তাঁর খুব অনুকূল নয়। তোমাদের মিস—এবং আমাদের—এর খবর কি? … আর আমাদের মিস (নাম ভুলে গেছি!) কেমন? শুনলাম, সম্প্রতি আধজাহাজ বোঝাই হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এবং অন্যান্য আরও কত কি সম্প্রদায়ের লোক আমেরিকায় উপস্থিত হয়েছে; আর একদল লোক গিয়ে ভারতবর্ষে জুটেছে, যারা মহাত্মা খুঁজে বেড়ায়, ধর্মপ্রচার করে ইত্যাদি। চমৎকার! ভারতবর্ষ ও আমেরিকা—এই দুটি দেশই যেন ধর্মবিষয়ক উৎসাহ-উদ্দীপনার লীলাভূমি বলে মনে হয়। কিন্তু জো, সাবধান, এই বিধর্মীদের পাপ অতি ভীষণ! আজ পথে মাদাম-এর সহিত সাক্ষাৎ হল। তিনি আর আজকাল আমার বক্তৃতায় আসেন না। সেটা তাঁর পক্ষে ভালই; অত্যধিক দার্শনিক চিন্তা ভাল নয়।
সেই মহিলাটির কথা কি তোমার মনে আছে—যিনি আমার প্রত্যেক বক্তৃতার শেষে এমন সময় এসে উপস্থিত হতেন, যখন কিছুই শুনতে পেতেন না, কিন্তু বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে আমাকে ধরে রাখতেন এবং বকাতেন যে, ক্ষুধার জ্বালায় আমার পাকস্থলীতে ওয়াটারলুর মহাসমর উপস্থিত হত? তিনি এসেছিলেন, অপর সকলেও আসছে এবং আরও আসবে। এ সবই আনন্দের বিষয়। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সকলেই এসেছিলেন এবং গলস্ওয়ার্দি পরিবারের বিবাহিতা কন্যাদেরও একজন এসেছিলেন। মিসেস গলস্ওয়ার্দি আজ আসতে পারেননি, কারণ যথেষ্ট আগে খবর পাননি। এখন আমরা একটি ‘হল’—বেশ বড় ‘হল’ পেয়েছি; তাতে দু-শ বা তার চেয়েও বেশী লোকের স্থান হতে পারে। একটা বড় কোণ আছে, সেখানে লাইব্রেরী বসান যাবে। সম্প্রতি আমাকে সাহায্য করবার জন্য ভারতবর্ষ থেকে আর একজন এসেছেন।
সুইজরলণ্ড এবং জার্মানী দুটি জায়গায়ই আমার খুব ভাল লেগেছিল। অধ্যাপক ডয়সন খুব সদয় ব্যবহার করেছিলেন। আমরা উভয়েই লণ্ডনে এসে খুব আনন্দ করেছি। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মোটের উপর ইংলণ্ডের কাজ বেশ পাকা হচ্ছে, এবং খ্যাতনামা পণ্ডিতগণের আনুকূল্য দেখে মনে হয় যে, আমাদের কাজ শ্রদ্ধাও অর্জন করেছে। সম্ভবতঃ এই শীতে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধু সহ আমি ভারতবর্ষে যাব। আমার নিজের সম্বন্ধে আজ এই পর্যন্ত।
সেই নৈষ্ঠিক পরিবারটির সংবাদ কি? সব বেশ চমৎকার ভাবেই চলছে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। এতদিনে ফক্সের সংবাদ তুমি পেয়ে থাকবে। যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে শুরু না করলে সে ম্যাবেলকে বিয়ে করতে পারে না, এ-কথা তাকে যাত্রার আগের দিনে বলে ফেলে আমি হয়তো তাকে খুব মন-মরা করে দিয়েছি। ম্যাবেল কি এখন তোমার ওখানে আছে? তাকে আমার স্নেহ জানিও; আমাকে তোমার বর্তমান ঠিকানাও দিও। মা কেমন আছেন? ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স বরাবরের মত ঠিক সেই খাঁটি অমূল্য সোনাটিই আছে নিশ্চয়! এলবার্টা বোধ হয় ঠিক তার নিয়মমত গান-বাজনা, ভাষাশিক্ষা, হাসিঠাট্টা নিয়ে আছে এবং খুব করে আগের মত আপেল খাচ্ছে?
রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে; সুতরাং জো, আজকের মত বিদায় (নিউ ইয়র্কেও কি আদবকায়দা ঠিক ঠিক পালন করা দরকার?)। প্রভু নিরন্তর তোমার কল্যাণ করুন। … আমার চিরস্নেহ ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—সেভিয়ার-দম্পতি তোমাকে তাঁদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তাঁদের ঘর (ফ্ল্যাট) থেকেই এই চিঠি লিখছি। ইতি
বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৮
[মিস ওয়াল্ডোকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় ওয়াল্ডো,
… সুইজরলণ্ডে আমি বেশ বিশ্রাম লাভ করেছি এবং অধ্যাপক পল ডয়সনের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছে। বাস্তবিক, অন্যান্য স্থানের চেয়ে ইওরোপে আমার কাজ বেশী সন্তোষজনক হচ্ছে এবং ভারতবর্ষে এর একটা খুব প্রতিধ্বনি উঠছে। লণ্ডনের ক্লাস আবার আরম্ভ হয়েছে—আজ তার প্রথম বক্তৃতা। এখন আমার নিজের একটা ‘হল’ হয়েছে—তাতে দুইশত বা ততোধিক লোক ধরে। … তুমি অবশ্য জান, ইংরেজরা একটা জিনিষ কেমন কামড়ে ধরে থাকতে পারে, এবং সকল জাতির মধ্যে তারা পরস্পরের প্রতি সবচেয়ে কম ঈর্ষাপরায়ণ—এই কারণেই তারা জগতের উপর প্রভুত্ব করেছে। দাসসুলভ খোশামুদির ভাব একদম না রেখে কিভাবে আজ্ঞানুবর্তী হওয়া যায়—অপরিসীম স্বাধীনতার সঙ্গে কেমন করে কঠোর নিয়ম মেনে চলা যায়—এ রহস্য তারা বুঝেছে।
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার এখন আমার বন্ধু। আমি লণ্ডনে ছাপমারা হয়ে গেছি। র—নামক যুবকটি সম্বন্ধে আমি খুব কমই জানি। সে বাঙালী এবং অল্পস্বল্প সংস্কৃত পড়াতে পারবে। তুমি আমার দৃঢ় ধারণা তো জান—কামকাঞ্চন যে জয় করতে পারেনি, তাকে আমি বিশ্বাসই করি না। তুমি তাকে তত্ত্বমূলক (theoretical) বিষয় শেখাতে দিয়ে দেখতে পার; কিন্তু সে যেন রাজযোগ শেখাতে না যায়—যারা রীতিমত শিক্ষা না করেছে, তাদের ওটা নিয়ে খেলা করা মহা বিপজ্জনক। সারদানন্দের সম্বন্ধে কোন ভয় নেই—বর্তমান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী তার উপর আশীর্বাণী বর্ষণ করেছেন। তুমি শিক্ষা দিতে আরম্ভ কর না কেন? … এই র—বালকটির চেয়ে তোমার হাজার গুণ বেশী দর্শনের জ্ঞান আছে। ক্লাসের নোটিস বার কর এবং নিয়মিতভাবে ধর্মবিষয়ক আলোচনা কর ও বক্তৃতা দিতে থাক। এক-শ হিন্দু, এমন কি, আমার একজন গুরুভাই আমেরিকায় খুব সাফল্য লাভ করেছে শুনলে যে আনন্দ হয়, তোমাদের মধ্যে একজন ওতে হাত দিয়েছ দেখলে আমি তার সহস্রগুণ আনন্দলাভ করব। ‘মানুষ দুনিয়া জয় করতে চায়; কিন্তু নিজ সন্তানদের কাছে পরাজয় ইচ্ছা করে।’ জ্বালাও, জ্বালাও—চারিদিকে জ্ঞানাগ্নি জ্বালাও।
আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ২৯৯
[মিসেস বুলকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয়—,
জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিয়েল-এ (Kiel) তাঁর অতিথি হয়েছিলাম। দু-জনে একসঙ্গে লণ্ডনে এসেছি এবং এখানেও কয়েকবার দেখাশুনা হয়েছে, খুব আনন্দলাভ করেছি। … ধর্ম ও সমাজ-সম্বন্ধীয় বিভিন্ন কাজের প্রতি যদিও আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে, তবু দেখতে পাচ্ছি যে, প্রত্যেকের কাজের বিশেষ বিশেষ বিভাগ থাকা খুব দরকার। আমাদের বিশেষ কাজ—বেদান্তপ্রচার। অন্যান্য কাজে সাহায্যও এই এক আদর্শের অনুকূল হওয়া চাই। আশা করি, আপনি এটা সারদানন্দের মনে বদ্ধমূল করে দেবেন।
আপনি অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন কি? … এখানে ইংলণ্ডে সবই যেন আমাদের অনুকূল হয়ে উঠেছে। কাজ যে শুধু জনপ্রিয় হচ্ছে তা নয়, পরন্তু তার সমাদরও বাড়ছে।
আপনাদের স্নেহাধীন
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০০
[‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার জন্য লিখিত]১১০
লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
চিকাগো মহামেলার অঙ্গস্বরূপ ধর্মমহাসভার স্বীয় বিরাট কল্পনা সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য মিঃ সি. বনি ডাঃ ব্যারোজকে সহকারী নিযুক্ত করায় দক্ষতম ব্যক্তির হস্তেই কার্যভার অর্পিত হয়েছিল; আর ডাঃ ব্যারোজের নেতৃত্বে ঐ মহাসভাগুলির অন্যতম ধর্মমহাসভা কিরূপ বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিল, তা আজ ইতিহাসের বিষয়।
ডাঃ ব্যারোজের অদ্ভুত সাহস, অক্লান্ত পরিশ্রম, অবিচল সহনশীলতা ও ঐকান্তিক ভদ্রতাই এই মহাসভাকে অপূর্ব সাফল্যে মণ্ডিত করেছিল।
বিস্ময়কর চিকাগো মহাসভাকে অবলম্বন করেই ভারত, ভারতবাসী ও ভারতীয় চিন্তা জগৎসমক্ষে আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বলভাবে প্রকটিত হয়েছে এবং আমাদের জাতীয় যা কিছু কল্যাণ হয়েছে, তার জন্য সেই সভার অন্যান্য সকলের তুলনায় ডাঃ ব্যারোজের কাছেই আমরা বেশী ঋণী।
তা ছাড়া, তিনি আমাদের কাছে ধর্মের পবিত্র নাম, মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্যের নাম নিয়ে আসছেন এবং আমার বিশ্বাস—ন্যাজারেথের মহাপুরুষের প্রচারিত ধর্মের সম্বন্ধে তাঁর ব্যাখ্যা অতিশয় উদার হবে এবং আমাদের মনকে উন্নত করবে। ঈশার শক্তির যে পরিচয় ইনি ভারতকে দিতে চান, তা পরমত-অসহিষ্ণু প্রভুভাবাপন্ন ও অপরের প্রতি ঘৃণাপূর্ণ মনোবৃত্তিপ্রসূত নয়। পরন্তু ভ্রাতৃরূপে—ভারতে উন্নতিকামী বিভিন্ন দলের সহকর্মী ভ্রাতৃবর্গের অন্যতমরূপে গণ্য হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কৃতজ্ঞতা ও আতিথেয়তাই ভারতীয় জীবনের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য; তাই আমার দেশবাসীর কাছে এই বিনীত অনুরোধ—পৃথিবীর অপর দিক্ থেকে আগত এই বিদেশী ভদ্রলোকের প্রতি তাঁরা এমন আচরণ করুন, যেন তিনি দেখতে পান যে, এই দুঃখ দারিদ্র্য ও অধঃপতনের ভেতরেও আমাদের হৃদয় সেই অতীতেরই ন্যায় বন্ধুত্বপূর্ণ আছে, যখন ভারত আর্যভূমি বলে পরিচিত ছিল এবং যখন তার ঐশ্বর্যের কথা জগতের সব জাতের মুখে মুখে ফিরত।
C/o E. T. Sturdy
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার ‘ভক্তিযোগ’ ও ‘সর্বজনীন ধর্ম’ পেয়েছি। আমেরিকায় ‘ভক্তিযোগে’র নিশ্চয়ই খুব কাটতি হবে। কিন্তু ইংলণ্ডে স্টার্ডির সংস্করণ আগেই বেরিয়ে যাওয়ায় তোমার বিক্রীর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে বলে ভয় হয়।
আমি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ সম্বন্ধে তোমায় পূর্বেই সবিশেষ লিখেছি। ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য একটি গল্প আরম্ভ করেছি; শেষ হলেই তোমায় পাঠিয়ে দেব।
কোন্ মাসে ভারতে পৌঁছব, তার এখনও ঠিক নেই। পরে এ সম্বন্ধে লিখব। গতকাল এক বন্ধুভাবাপন্ন সমিতির সভায় নূতন স্বামী১১১ তাঁর প্রথম বক্তৃতা দিলেন। বেশ হয়েছিল এবং আমার ভাল লেগেছিল। তাঁর ভেতর ভাল বক্তা হবার শক্তি রয়েছে—এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত।
‘ভক্তিযোগ’টা ‘সর্বজনীন ধর্ম’-এর মত তেমন সুন্দরভাবে ছাপান হয়নি। মলাটে বোর্ড দিলে বইখানি দেখতে বেশ মোটা হত; আর ক্রেতাদের খুশী করবার জন্য অক্ষরগুলি মোটা করা যেত।
ভাল কথা, আমার ‘কর্মোযোগ’খানি যে প্রকাশ করনি, এটা একটা লজ্জার কথা—অথচ আমার পরামর্শ না নিয়ে বইখানির এক অধ্যায় ছেপে নিয়ে আমায় বেকায়দায় ফেলেছ। আরও দেখ, ভারতে বেশী কাটতির জন্য বইগুলি সস্তা হওয়া দরকার। ইচ্ছা করলে তুমি ‘রাজযোগ’খানি ছাপতে পার, আমি ইচ্ছা করেই ওখানার কপিরাইট নিইনি। যখনই ইচ্ছা হবে, তখনই ওর একটা সস্তা সংস্করণ বের করতে পার কিন্তু আমরা হিন্দুরা এত ঢিমে-তেতালা যে, আমাদের কাজ শেষ হতে না হতেই সুযোগ চলে যায়, আর তাতে আমাদের লোকসানই হয়। ছাপার কাজ ইত্যাদিতে তোমাকে চটপটে হতে হবে। তোমার ‘ভক্তিযোগ’ বেরুল বছরখানেক কথা চালানর পরে। তুমি কি বলতে চাও যে, পাশ্চাত্যবাসীরা মহাপ্রলয় পর্যন্ত ওটার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে? এই গড়িমসির ফলে তোমার ঐ বই-এর কাটতি আমেরিকা ও ইংলণ্ডে তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছে। তাহলে তো তুমি ‘কর্মযোগ’ ছাপছ না দেখছি; অথচ তোমার ঘাড়ে কি ভূত চেপেছিল যে, তুমি একটা বক্তৃতা ছেপে বসে আছ? ঐ হরমোহন একটা মূর্খ; বই-ছাপান বিষয়ে সে তোমাদের— মান্দ্রাজীদের চেয়েও ঢিলে, আর তার ছাপা একেবারে বীভৎস। বইগুলো ঐভাবে প্রকাশ করার মানে কি? দুঃখের বিষয়, সে গরীব। আমার টাকা থাকলে তাকে দিতাম; কিন্তু ওভাবে ছাপান তো লোক ঠকান—এ রকম করা উচিত নয়।
খুব সম্ভব মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার আর মিস মূলার ও মিঃ গুডউইনকে সঙ্গে নিয়ে আমি ভারতে ফিরব। মিস মূলারকে তো তুমি জানই; সম্ভবতঃ ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার অন্ততঃ কিছুদিন আলমোড়ায় বাস করবার জন্য যাচ্ছেন; আর গুডউইন সন্ন্যাসী হবে। সে অবশ্য আমার সঙ্গেই ভ্রমণ করবে। আমাদের সব বই-এর জন্য আমরা তার কাছে ঋণী। আমার বক্তৃতাগুলি সে সাঙ্কেতিক প্রণালীতে লিখে রেখেছিল, তাই থেকে বই হয়েছে। কিছুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়াই মু্হূর্তের প্রেরণায় এ-সকল বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল। অপরেরা হোটেলে বাস করতে চলে যাবে; কিন্তু গুডউইন আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার কি মনে হয়, দেশের লোকেরা এ বিষয়ে বড় বেশী আপত্তি করবে? সে খাঁটি নিরামিষাশী।
তুমি ইচ্ছা করলে আমার ‘জ্ঞানযোগে’র বক্তৃতাগুলি ছাপাতে পার। তবে একটু ভাল করে দেখে দিও। ভাল করে দেখে ছাপান উচিত। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—এখানকার সকলে ভালবাসা জানাচ্ছে। ডাক্তার ব্যারোজ সম্বন্ধে ও তাঁকে কি ভাবে অভ্যর্থনা করা উচিত—এই বিষয়ে একটি ছোট লেখা আমি আজ ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ পাঠিয়েছি। তুমিও তাকে স্বাগত জানিয়ে ‘ব্রহ্মবাদিনে’ দু-চারটি মিষ্টি কথা লিখো। ইতি
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০২
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মেরী,
‘সোনা, রূপা—এ সব কিছু আমার নেই; তবে যা আমার আছে, তা মুক্তহস্তে তোমায় দিচ্ছি’—সেটি এই জ্ঞান যে, স্বর্ণের স্বর্ণত্ব, রৌপ্যের রৌপত্ব, পুরুষের পুরুষত্ব, নারীর নারীত্ব—এক কথায়, প্রত্যেক বস্তুর যথার্থ স্বরূপ—ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মকেই আমরা অনাদিকাল থেকে বহির্জগতে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছি; আর এই চেষ্টার ফলে আমাদের মন থেকে এই সকল অদ্ভুত সৃষ্টি বের হয়ে আসছে, যথা—পুরুষ, নারী, শিশু, দেহ, মন, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জগৎ, ভালবাসা, ঘৃণা, ধন, সম্পত্তি, আর ভূত, প্রেত, গন্ধর্ব, কিন্নর, দেবতা, ঈশ্বর ইত্যাদি।
আসল কথা—এই ব্রহ্ম আমাদের ভেতরেই রয়েছেন এবং আমরাই তিনি (সোঽহং), সেই শাশ্বত দ্রষ্টা, সেই যথার্থ ‘অহম্’, যিনি কখনই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন এবং যাঁকে অন্যান্য জিনিষের মত ইন্দ্রিয়গোচর করার চেষ্টা—সময় ও ধীশক্তির অপব্যবহার মাত্র।
যখন জীবাত্মা এ-কথা বুঝতে পারে, তখনই সে এই জগৎ-কল্পনা থেকে নিবৃত্ত হয়, এবং ক্রমশই বেশী করে নিজের অন্তরাত্মার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এরই নাম ক্রমবিকাশ—এতে যেমন শারীরবিবর্তন ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে, তেমনই অপরদিকে মন উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে উঠতে থাকে; মানুষই পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিকাশ। ‘মনুষ্য’ কথাটি সংস্কৃত ‘মন্’ ধাতু থেকে সিদ্ধ—সুতরাং ওর অর্থ মননশীল অর্থাৎ চিন্তাশীল প্রাণী—কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়গ্রহণশীল প্রাণী নয়। ধর্মতত্ত্বে এই ক্রমবিকাশকেই ‘ত্যাগ’ বলা হয়েছে। সমাজ-গঠন, বিবাহ প্রথার প্রবর্তন, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, সৎকার্য, সংযম এবং নীতি—এগুলি ত্যাগেরই বিভিন্ন রূপ। প্রত্যেক সমাজে জীবন বলতে বুঝায় ইচ্ছা তৃষ্ণা বা বাসনাসমূহের সংযম। জগতে যত সমাজ ও সামাজিক প্রথা দেখা যায়, সে-সব একটি ব্যাপারেরই বিভিন্ন ধারা এবং স্তরমাত্র; সেটি এই—ইচ্ছার বা কল্পিত ‘আমি’র বিসর্জন, এই যে নিজের ভিতর থেকে যেন বাইরে লাফিয়ে যাবার ভাব রয়েছে, জ্ঞাতা (Subject)-কে যে জ্ঞেয় (Object)-রূপে পরিণত করবার একটা চেষ্টা রয়েছে, সেটিরও বিসর্জন। প্রেম এই আত্মসমর্পণ বা ইচ্ছাশক্তি রোধের সর্বাপেক্ষা সহজ এবং অনায়াস-সাধ্য পথ; ঘৃণা তার বিপরীত।
জনসাধারণকে নানারূপ স্বর্গ, নরক ও আকাশের ঊর্ধ্বলোক-নিবাসী শাসনকর্তার গল্প বা কুসংস্কার দ্বারা ভুলিয়ে এই একমাত্র লক্ষ্য আত্মসমর্পণের পথে পরিচালিত করা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানীরা কুসংস্কারের বশবর্তী না হয়ে বাসনা-বর্জনের দ্বারা জ্ঞাতসারেই এই পন্থার অনুবর্তন করেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে বাস্তব (Objective) স্বর্গ বা ‘সুখের সহস্র বর্ষে’র (millennium) অস্তিত্ব কেবল কল্পনাতেই রয়েছে; কিন্তু অধ্যাত্ম-স্বর্গ আমাদের হৃদয়ে এখনই বিদ্যমান। কস্তুরীমৃগ (নাভিস্থ) কস্তুরীর গন্ধের কারণ অনুসন্ধানের জন্য অনেক বৃথা ছুটাছুটির পর অবশেষে আপন শরীরেই তার অস্তিত্ব জানতে পারবে।
বাস্তব জগৎ—সর্বদাই ভালমন্দের মিশ্রণরূপে বিদ্যমান থাকবে; আর মৃত্যুরূপ ছায়াও চিরদিন এই পার্থিব জীবনের অনুসরণ করবে; আর জীবন যতই দীর্ঘ হবে, এই ছায়াও ততই দীর্ঘ হবে। সূর্য যখন ঠিক আমাদের মাথার উপর থাকে, কেবল তখনই আমাদের ছায়া পড়ে না—তেমনি যখন ঈশ্বর এবং শুভ ও অন্যান্য সবকিছুই আমাতেই রয়েছে—এই বোধ হয়, তখন আর অমঙ্গল থাকে না। বাস্তবজগতে প্রত্যেক ঢিলটির সঙ্গে পাটকেলটি খেতে হয়—প্রত্যেক ভালটির সঙ্গে মন্দটিও ছায়ার মত আছে। প্রত্যেক উন্নতির সঙ্গে ঠিক সমপরিমাণ অবনতিও সংযুক্ত হয়ে রয়েছে। তার কারণ এই যে, ভাল-মন্দ পৃথক্ বস্তু নয়, আসলে এক; পরস্পরের মধ্যে প্রকারগত কোন প্রভেদ নেই, প্রভেদ কেবল পরিমাণগত।
আমাদের জীবন নির্ভর করে অপর উদ্ভিদ প্রাণী বা জীবাণুর মৃত্যুর উপর। আর একটি ভুল আমরা প্রতিনিয়তই করে থাকি—তা এই যে, ভাল জিনিষটাকে আমরা ক্রমবর্ধমান বলে মনে করি, কিন্তু মন্দ জিনিষটার পরিমাণ নির্দিষ্ট বলে ভাবি। তা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত করি যে, প্রত্যহ কিছু কিছু মন্দের ক্ষয় হয়ে এমন এক সময় আসবে, যখন কেবল ভালটিই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু এই অপসিদ্ধান্তটি একটি মিথ্যা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
জগতে যদি ভালটি বেড়েই চলেছে, তাহলে মন্দটিও বাড়ছে। আমার স্বজাতীয় জনসাধারণের বাসনার চেয়ে আমার নিজের বাসনা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের চেয়ে আমার আনন্দ অনেক বেশী—কিন্তু আমার দুঃখও লক্ষগুণ তীব্র হয়ে গেছে। যে শরীরের সাহায্যে তুমি ভালর সামান্যমাত্র সংস্পর্শ অনুভব করতে পারছ, তাই আবার তোমাকে মন্দের অতি সামান্য অংশটুকু অনুভব করাচ্ছে। একই স্নায়ুমণ্ডলী সুখদুঃখ দু-রকম অনুভূতিই বহন করে এবং একই মন উভয়কে অনুভব করে। জগতের উন্নতি বলতে যেমন বেশী সুখভোগ বুঝায়, তেমনি বেশী দুঃখভোগও বুঝায়। এই যে জীবন-মৃত্যু, ভাল-মন্দ, জ্ঞান-অজ্ঞানের সংমিশ্রণ, এই-ই মায়া বা প্রকৃতি। অনন্তকাল ধরে তুমি জগজ্জালের ভেতর সুখের অন্বেষণ করে বেড়াতে পার—তাতে সুখ পাবে অনেক, দুঃখও পাবে অনেক। শুধু ভালটি পাব, মন্দটি পাব না—এ আশা বালসুলভ মূঢ়তা মাত্র।
দুটি পথ খোলা রয়েছে। একটি—(জগতের উন্নতির) সমস্ত আশাভরসা ত্যাগ করে এ জগৎ যেমন চলছে সেভাবেই একে গ্রহণ করা, অর্থাৎ মধ্যে মধ্যে একটু আধটু সুখের আশায় জগতের সমস্ত দুঃখকষ্ট সহ্য করে যাওয়া; অপরটি—সুখকে দুঃখেরই অপর মূর্তি জ্ঞানে একেবারে তার অন্বেষণ পরিহার করে সত্যের অনুসন্ধান করা। যারা এভাবে সত্যের অনুসন্ধান করতে সাহসী, তারা সেই সত্যকে সদা বিদ্যমান এবং নিজের ভেতরেই অবস্থিত বলে দেখতে সমর্থ হয়। তখনই আমরা এও বুঝতে পারি যে, সেই একই সত্য কিভাবে আমাদের বিদ্যা ও অবিদ্যারূপ—এই দুই আপেক্ষিক জ্ঞানের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা এও বুঝি যে, সেই সত্য আনন্দস্বরূপ এবং তা ভালমন্দ দুইরূপে জগতে প্রকাশিত; আর তার সঙ্গে সেই যথার্থ সত্তাকেও জানি, যা জগতে জীবন ও মৃত্যু উভয়রূপেই আত্মপ্রকাশ করছে।
এইভাবে আমরা অনুভব করব যে, জগতের বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা একটি অদ্বিতীয় সৎ-চিৎ-আনন্দ সত্তার দুই বা বহু ভাগে বিভক্ত প্রতিচ্ছায়া মাত্র—সেটি আমার এবং অন্যান্য যাবতীয় পদার্থের যথার্থ স্বরূপ। কেবল তখনই মাত্র মন্দ না করেও ভাল করা সম্ভবপর; কারণ, এইরূপ আত্মা জানতে পেরেছেন, ভালমন্দ—কি উপাদানে গঠিত; সুতরাং ওটি তখন তার আয়ত্তাধীন। এই মুক্ত আত্মা তখন ভালমন্দ যা খুশী তাই বিকাশ করতে পারেন; তবে আমরা জানি যে ইনি তখন কেবল ভালই করেন। এর নাম ‘জীবন্মুক্তি’ অর্থাৎ শরীর রয়েছে, অথচ মুক্ত—এটিই বেদান্ত এবং অপর সমস্ত দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। ইতি
মানবসমাজ ক্রমান্বয়ে চারটি বর্ণ দ্বারা শাসিত হয়—পুরোহিত (ব্রাহ্মণ), সৈনিক (ক্ষত্রিয়), ব্যবসায়ী (বৈশ্য) এবং মজুর (শূদ্র)। প্রত্যেকটির শাসনকালে রাষ্ট্রে (State) দোষগুণ উভয়ই বর্তমান। পুরোহিত-শাসনে বংশজাত ভিত্তিতে ঘোর সংকীর্ণতা রাজত্ব করে—তাঁদের ও তাঁদের বংশধরগণের অধিকার রক্ষার জন্য চারিদিকে বেড়া দেওয়া থাকে—তাঁরা ছাড়া বিদ্যা শিখবার অধিকার কারও নেই, বিদ্যাদানেরও অধিকার কারও নাই। এ যুগের মাহাত্ম্য এই যে, এ সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়—কারণ বুদ্ধিবলে অপরকে শাসন করতে হয় বলে পুরোহিতগণ মনের উৎকর্ষ সাধন করে থাকেন।
ক্ষত্রিয়-শাসন বড়ই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারপূর্ণ, কিন্তু ক্ষত্রিয়রা এত অনুদার নন। এ যুগে শিল্পের ও সামাজিক কৃষ্টির (culture) চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে।
তারপর বৈশ্যশাসন-যুগ। এর ভেতরে শরীর-নিষ্পেষণ ও রক্ত-শোষণকারী ক্ষমতা, অথচ বাইরে প্রশান্ত ভাব—বড়ই ভয়াবহ! এ যুগের সুবিধা এই যে, বৈশ্যকুলের সর্বত্র গমনাগমনের ফলে পূর্বোক্ত দুই যুগের পুঞ্জীভূত ভাবরাশি চতুর্দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। ক্ষত্রিয়যুগ অপেক্ষা বৈশ্যযুগ আরও উদার, কিন্তু এই সময় সভ্যতার অবনতি আরম্ভ হয়।
সর্বশেষে শূদ্রশাসন-যুগের আবির্ভাব হবে—এ যুগের সুবিধা হবে এই যে, এ সময় শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিস্তার হবে, কিন্তু অসুবিধা এই যে, হয়তো সংস্কৃতির অবনতি ঘটবে। সাধারণ শিক্ষার পরিসর খুব বাড়বে বটে, কিন্তু সমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই কমে যাবে।
যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারা যায়, যাতে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ-শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ—এই সবগুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না, তাহলে তা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। কিন্তু এ কি সম্ভব?
প্রত্যুত প্রথম তিনটির পালা শেষ হয়েছে—এবার শেষটির সময়। শূদ্রযুগ আসবেই আসবে—এ কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। সোনা অথবা রুপো—কোন্টির ভিত্তিতে দেশের মূদ্রা প্রচলিত হলে কি কি অসুবিধা ঘটে, তা আমি বিশেষ জানি না—(আর বড় একটা কেউ জানেন বলে মনে হয় না)। কিন্তু এটুকু আমি বেশ বুঝতে পারি যে, সোনার ভিত্তিতে সকল মূল্য ধার্য করার ফলে গরীবরা আরও গরীব এবং ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ব্রায়ান যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা এই সোনার ক্রুশে বিদ্ধ হতে নারাজ। রূপার দরে সব দর ধার্য হলে গরীবরা এই অসমান জীবনসংগ্রামে অনেকটা সুবিধা পাবে। আমি যে একজন সমাজতন্ত্রী (socialist),১১২ তার কারণ এ নয় যে, আমি ঐ মত সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে মনে করি, কেবল ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’—এই হিসাবে।
অপর কয়টি প্রথাই জগতে চলেছে, পরিশেষে সেগুলির ত্রুটি ধরা পড়েছে। অন্ততঃ আর কিছুর জন্য না হলেও অভিনবত্বের দিক্ থেকে এটিরও একবার পরীক্ষা করা যাক। একই লোক চিরকাল সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে, তার চেয়ে সুখদুঃখটা যাতে পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে, সেইটাই ভাল। জগতের ভালমন্দের সমষ্টি চিরকালই সমান থাকবে, তবে নূতন নূতন প্রণালীতে এই জোয়ালটি (yoke) এক কাঁধ থেকে তুলে আর এক কাঁধে স্থাপিত হবে, এই পর্যন্ত।
এই দুঃখময় জগতে সব হতভাগ্যকেই এক-একদিন আরাম করে নিতে দাও—তবেই তারা কালে এই তথাকথিত সুখভোগটুকুর পর এই অসার জগৎ-প্রপঞ্চ, শাসনতন্ত্রাদি ও অন্যান্য বিরক্তিকর বিষয়সকল পরিহার করে ব্রহ্মস্বরূপে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের চিরবিশ্বস্ত ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৩
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
খুব সম্ভব আমি ১৬ ডিসেম্বর রওনা হব; দু-এক দিন দেরীও হতে পারে। এখান থেকে ইতালী যাব এবং সেখানে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল্সে জাহাজ ধরব। মিস মূলার, মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার এবং গুডউইন নামে একজন যুবক আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। সেভিয়ার দম্পতি আলমোড়াতে বসবাস করতে যাচ্ছেন, মিস মূলারও তাই। মিঃ সেভিয়ার ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে পাঁচ বৎসর অফিসার ছিলেন; সুতরাং তিনি ভারত সম্বন্ধে অনেকটা পরিচিত। মিস মূলার থিওসফিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং অক্ষয়কে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। গুডউইন একজন ইংরেজ যুবক; এরই সাঙ্কেতিক লেখা থেকে আমার পুস্তিকাগুলি বের করা সম্ভব হয়েছে।
কলম্বো থেকে আমি প্রথমে মান্দ্রাজে পৌঁছব। অন্য সকলে স্বতন্ত্রভাবে আলমোড়া চলে যাবেন। মান্দ্রাজ থেকে আমি সোজা কলিকাতা যাব। যাত্রারম্ভে আমি তোমাকে সঠিক সংবাদ দেব। ইতি
তোমাদের স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চঃ—‘রাজযোগে’র প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। ভারত ও আমেরিকাতেই সব চেয়ে বেশী কাটতি।
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৪
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
গ্রেকোট গার্ডেন্স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১৩ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় বুল,
… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৫
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২০ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমি ইংলণ্ড থেকে যাত্রা করছি। ইতালীতে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল্সে জার্মান লয়েড লাইনের ‘S. S. Prinz Regent Leopold’ নামক জাহাজ ধরব। আগামী ১৪ জানুআরী ষ্টীমার কলম্বো গিয়ে লাগবার কথা। সিংহলে অল্পস্বল্প দেখবার ইচ্ছা আছে, তারপর মান্দ্রাজ যাব।
আমার সঙ্গে যাচ্ছেন আমার ইংরেজ বন্ধু সেভিয়ার দম্পতি ও গুডউইন। মিঃ সেভিয়ার ও তাঁর সহধর্মিণী হিমালয়ে আলমোড়ার কাছে আশ্রয় স্থাপন করতে যাচ্ছেন। ঐ হবে আমার হিমালয়ের কেন্দ্র, আর পাশ্চাত্য শিষ্যেরা সেখানে এসে ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরূপে বাস করতে পারবে। গুডউইন একজন অবিবাহিত যুবক, সে আমার সঙ্গে থাকবে এবং ভ্রমণ করবে। সে ঠিক সন্ন্যাসীরই মত।
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবের সময় আমার কলিকাতায় থাকার ভারি ইচ্ছা। সুতরাং খবর নিয়ে উৎসবের তারিখটি জেনে রেখো, যাতে আমায় মান্দ্রাজে বলতে পার।কলিকাতা আর মান্দ্রাজে দুটি কেন্দ্র খুলব—এই হচ্ছে আমার বর্তমান পরিকল্পনা; সেখানে যুবক প্রচারক তৈরী করা হবে। কলিকাতায় কেন্দ্র খোলবার মত অর্থ আমার হাতে আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন সেখানেই কাজ করে গেছেন, সুতরাং কলিকাতার উপরেই আমাকে প্রথম নজর দিতে হবে। মান্দ্রাজে কেন্দ্র খোলবার মত টাকাপয়সা, আশা করি ভারতবর্ষ থেকেই উঠবে।
এই তিনটি কেন্দ্র নিয়েই এখন আমরা কাজ আরম্ভ করব; পরে বোম্বাই ও এলাহাবাদে যাব। প্রভুর ইচ্ছা হলে এ-সকল কেন্দ্র হতে আমরা যে শুধু ভারতকেই আক্রমণ করব তা নয়, আমরা পৃথিবীর সমস্ত দেশেই দলে দলে প্রচারক পাঠাব। প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাব। মনে রেখো, আমাদিগকে এক সময় একটিমাত্র কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। কিছুদিনের জন্য ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট আমার প্রধান ঠিকানা, কারণ ওখান থেকেই কাজ চালান হবে। স্টার্ডি প্রকাণ্ড এক বাক্স ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকা পেয়েছে। আমি আগে জানতাম না, সে এখন ঐ জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করছে।
এখন তো আমাদের ইংরেজী পত্রিকাখানি দাঁড়িয়ে গেছে; অতঃপর ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় কয়েকখানি আরম্ভ করতে পারি। উইম্বল্ডনের মিস নোব্ল্ একজন ভাল কর্মী। তিনিও মান্দ্রাজের দুইটি পত্রিকার জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে চেষ্টা করবেন। তিনি তোমায় পত্র লিখবেন। এই সব কাজ ধীরে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে গড়ে উঠবে। অল্পসংখ্যক অনুগামীরাই এই-জাতীয় কাগজের পৃষ্ঠপোষক হয়। এখন কথা এই—এরূপ আশা করা চলে না যে, তারা একসঙ্গে অত্যধিক কাজের ভার নেবে। ইংলণ্ডের কাজের জন্য তাদের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, বই কিনতে হবে, এখানকার পত্রিকার জন্য গ্রাহক যোগাড় করতে হবে এবং সর্বশেষে ভারতের পত্রিকার চাঁদা দিতে হবে! এতটা করা চলে না। এরূপ করলে তা ধর্মপ্রচার না হয়ে বরং ব্যবসার মতই দেখাবে। সুতরাং তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমার মনে হয়, এখানে জনকয়েক গ্রাহক পাওয়া যাবে। ভারতের লোকেরাই ভারতের কাগজগুলির পৃষ্ঠপোষক হবে। সব জাতির নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় কোন কাগজ প্রকাশ করতে হলে সব জাতিরই লেখক সংগ্রহ করতে হবে; আর তার মানে হচ্ছে—বছরে অন্ততঃ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। তা ছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে এখানকার লোকদের কাজ থাকা চাই; তা না হলে সব ভেঙেচুরে যাবে। অতএব এখানে একখানি পত্রিকা চাই; ক্রমে আমেরিকাতেও চাই।
এ-কথা ভুলে যেও না যে, সব দেশের লোকের প্রতিই আমার টান রয়েছে, শুধু ভারতের প্রতি নয়। আমার শরীর ভাল আছে, অভেদানন্দেরও তাই। তোমরা সকলে আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৬
[শ্রীযুক্ত লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় লালাজী,
৭ জানুআরী নাগাদ আমি মান্দ্রাজে পৌঁছব; কয়েক দিন সমতলে থেকে আমার আলমোড়া যাবার ইচ্ছা।
আমার সঙ্গে তিনজন ইংরেজ বন্ধু আছেন; তাঁদের মধ্যে দুজন—সেভিয়ার-দম্পতি—আলমোড়ায় বসবাস করবেন। আপনি হয়তো জানেন, তাঁরা আমার শিষ্য এবং আমার জন্য হিমালয়ে আশ্রম তৈরী করবেন। এই কারণেই একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করতে আপনাকে বলেছিলাম। একটি সমগ্র পাহাড় আমাদের নিজেদের জন্য চাই, যেখান থেকে হিমালয়ের তুষারশ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে আশ্রম প্রস্তুত করতে সময় লাগবে। ইতোমধ্যে অনুগ্রহপূর্বক আমার বন্ধুদের জন্য একটি বাড়ী ভাড়া করবেন। বাংলোটিতে তিনজনের স্থান-সঙ্কুলান হওয়া চাই। বড় বাড়ীর কোন প্রয়োজন নেই, আপাততঃ একটি ছোট বাড়ী হলেই চলবে। আমার বন্ধুগণ সেই বাড়ীতে থেকে আশ্রমের জন্য উপযুক্ত স্থান ও বাড়ীর অন্বেষণ করবেন।
এই চিঠির উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। কারণ উত্তর আমার হাতে আসার পূর্বেই আমি ভারতবর্ষের পথে যাত্রা করব। মান্দ্রাজে পৌঁছেই আপনাকে তার করে জানাব।
আপনারা সকলে আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৭
[মিস মেরী ও মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৭ ২৮ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনীগণ,
আমার মনে হয়, যে-কোন কারণেই হোক, তোমাদের চারজনকেই আমি সবচেয়ে বেশী ভালবাসি এবং আমি সগর্বে বিশ্বাস করি যে, তোমরা চারজনও আমাকে সেই রকম ভালবাস। এইজন্য ভারতবর্ষে যাবার আগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তোমাদের কয়েক ছত্র লিখছি। লণ্ডনের প্রচারকার্যে খুব সাফল্য হয়েছে। ইংরেজরা আমেরিকানদের মত অত বুদ্ধিমান নয়; কিন্তু একবার যদি কেউ তাদের হৃদয় অধিকার করতে পারে, তাহলে তারা চিরকালের জন্য তার গোলাম হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আমি তাদের হৃদয় অধিকার করেছি। আশ্চর্যের বিষয়, এই ছ-মাসের কাজেই জনসভায় বক্তৃতার কথা ছেড়ে দিলেও আমার ক্লাসে বরাবর ১২০ জন উপস্থিত হচ্ছে। ইংরেজ কাজের লোক, সুতরাং এখানকার প্রত্যেকেই কাজে কিছু করতে চায়। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইন কাজ করবার জন্য আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন এবং এই কাজে তাঁরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করবেন। এখানে আরও বহুলোক ঐরূপ করতে প্রস্তুত। সম্ভ্রান্ত বংশের স্ত্রীপুরুষদের মাথায় একবার একটা ভাব ঢুকিয়ে দিতে পারলে, সেটা কার্যে পরিণত করবার জন্য তাঁরা যথাসর্বস্ব ত্যাগ করতেও বদ্ধপরিকর। আনন্দের সংবাদ এই (আর এটা বড় কম কথা নয়) যে, ভারতের কাজ আরম্ভ করবার জন্য অর্থ-সাহায্য পাওয়া গেছে এবং পরে আরও পাওয়া যাবে। ইংরেজ জাতি সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল, তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমি বুঝতে পারছি, অন্য সব জাতের চেয়ে প্রভু তাদের কেন অধিক কৃপা করেছেন। তারা অটল, অকপটতা তাদের অস্থিমজ্জাগত, তাদের অন্তর গভীর অনুভূতিতে পূর্ণ—কেবল বাইরে একটা কঠোরতার আবরণ মাত্র রয়েছে। ঐটে ভেঙে দিতে পারলেই হল—বস্, তোমার মনের মানুষ খুঁজে পাবে।
সম্প্রতি আমি কলিকাতায় একটি ও হিমালয়ে আর একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছি। প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতার এলটি গোটা পাহাড়ের উপর এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে। ঐ পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে বেশ শীতল থাকবে, আর শীতকালে খুব ঠাণ্ডা হবে। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার ঐখানে থাকবেন এবং ঐটি ইওরোপীয় কর্মিগণের কেন্দ্র হবে। আমি তাদের জোর করে ভারতীয় জীবন-প্রণালী অনুসারে চালিয়ে এবং ভারতের উত্তপ্ত সমতলভূমিতে বাস করিয়ে মেরে ফেলতে চাই না। আমাদের কার্যপ্রণালী হচ্ছে এই যে, শত শত হিন্দু যুবক প্রত্যেক সভ্যদেশে গিয়ে [বেদান্ত] প্রচার করুক, আর সে-সব দেশ থেকে নরনারী পাঠাক ভারতবর্ষে কাজ করতে। এতে পরস্পরের মধ্যে বেশ একটা আদানপ্রদান হবে। কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠা করে আমি ‘জবের গ্রন্থে’ বর্ণিত ভদ্রলোকটির মত১১৩ উপরে নীচে চারিদিক ঘুরে বেড়াব।
ডাক ধরতে হবে, আজ এখানেই শেষ। সব দিকেই আমার কাজের সুবিধা হয়ে আসছে—এতে আমি খুশী এবং জানি তোমরাও আমার মত খুশী হবে। তোমরা অশেষ কল্যাণ ও সুখশান্তি লাভ কর। ইতি
তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুঃ—ধর্মপালের খবর কি? তিনি কি করছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমার ভালবাসা জানিও।
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৮
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় এলবার্টা,
‘জো জো’কে লেখা ম্যাবেল (Mabel)-এর একটি চিঠি একসঙ্গে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি এর মধ্যেকার সংবাদটি খুব উপভোগ করেছি এবং তুমিও নিশ্চয়ই করবে।
এখান থেকে ১৬ যাত্রা করে নেপল্স্-এ গিয়ে আমাকে ষ্টীমার ধরতে হবে। দিনকয়েক আমি ইতালীতে থাকব—চার পাঁচদিন রোমে। বিদায় নেবার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশী হব।
ইংলণ্ড থেকে ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা অবশ্য আমার সঙ্গে ইতালীতেও থাকবেন। গত গ্রীষ্মে তুমি তাঁদের দেখেছ। বছরখানেকের মধ্যে আমেরিকা, তারপর ইওরোপে ফিরে আসব, ইচ্ছা করি।
প্রীতি ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩০৯
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
দি গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় জো,
তোমার সহৃদয় আমন্ত্রণের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় জো জো কিন্তু বিধি বাম। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইনের সঙ্গে ১৬ তারিখ ভারতের দিকে যাত্রা করছি। সেভিয়ার-দম্পতি ও আমি নেপল্স্-এ জাহাজ ধরব। রোমে চারদিন সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে এলবার্টার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেব।
এই মুহূর্তে ব্যাপার খুব জমজমাটি; ৩৯, নং ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীটে বড় হলঘরটি লোকে পরিপূর্ণ এবং এখনও আরও লোক আসছে।
হ্যাঁ আমার সেই পুরাতন প্রিয় দেশটি এখন আমায় ডাকছে; যেতেই হবে আমাকে। সুতরাং এই এপ্রিলে রাশিয়ায় যাবার সকল পরিকল্পনা বিদায়। ভারতে কাজকর্ম কিছুটা গোছগাছ করে দিয়েই আমি চিরসুন্দর আমেরিকা ইংলণ্ড প্রভৃতি স্থানে আবার ফিরে আসছি।
ম্যাবেলের চিঠিখানা পাঠিয়েছ, তোমার সহৃদয়তা—বাস্তবিকই সুসংবাদ। বেচারী ফক্সের জন্য শুধু আমার একটু দুঃখ হয়। যা হোক ম্যাবেল যে তার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে—এটা ভালই হয়েছে।
নিউ ইয়র্কে কাজকর্ম কি রকম চলছে—কিছু লেখনি। আশা করি সেখানকার খবর সব ভালই। বেচারী কোলা! সে কি এখন কিছু রোজকারের ব্যবস্থা করতে পেরেছে?
গুডউইনের আসাটা একটা সৌভাগ্য, কারণ তার ফলে এখানকার বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হয়ে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই খরচা পোষাবার মত যথেষ্ট গ্রাহক জুটে গিয়েছে।
আগামী সপ্তাহে তিনটি বক্তৃতা, বস্, তারপর এই মরসুমের মত আমার লণ্ডনের কাজ শেষ। অবশ্য এখানকার সকলেই ভাবছেন, এই সাফল্যের মুখে কাজটা ছেড়ে যাওয়া বোকামি, কিন্তু আমার প্রিয় প্রভু বলছেন, ‘প্রাচীন ভারতের অভিমুখে যাত্রা কর’। আমি তাঁর আদেশ পালন করব।
ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, মা, হলিস্টার এবং প্রত্যেককে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানাবে এবং তোমার জন্যও তাই।
চির আন্তরিকভাবে তোমার
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১০
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার অতি উদার দানের প্রতিশ্রুতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা নিষ্প্রয়োজন। কার্যারম্ভেই অনেক অর্থ হাতে নিয়ে আমি নিজেকে বিব্রত করতে চাই না; তবে কাজের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঐ অর্থকে খাটাতে পারলেই আমি সুখী হব। খুব সামান্যভাবে কাজ আরম্ভ করাই আমার ইচ্ছা। এখনও আমার কোন সঠিক পরিকল্পনা নেই। ভারতবর্ষে কার্যক্ষেত্রে পৌঁছে আমার পবিত্র দায়িত্বের স্বরূপ জানতে পারব। ভারত থেকে আমার পরিকল্পনা এবং উহা কার্যে পরিণত করার উপায় আপনাকে আরও বিশদভাবে জানাব।
আমি ১৬ তারিখে রওনা হব এবং ইতালীতে কয়েকদিন কাটিয়ে নেপল্সে জাহাজ ধরব।
অনুগ্রহ করে মিসেস—, সারদানন্দ এবং ওখানকার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আপনার সম্বন্ধে এইটুকু বলতে পারি যে, আপনাকে আমি সর্বদাই সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করে এসেছি এবং আজীবন তাই করব। আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছাদি জানবেন। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
[জনৈক আমেরিকান মহিলাকে লিখিত]
লণ্ডন
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মহাশয়া,
নীতির ব্যাপারেও ক্রমোন্নতির মাত্রা আছে, এই ভাবটি ধরতে পারলেই আর সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। একটু কম সংসারিত্ব, একটু কম প্রতিকার, একটু কম হিংসার মধ্য দিয়ে আমাদিগকে ক্রমে ক্রমে বৈরাগ্য, অপ্রতিকার, অহিংসা প্রভৃতি আদর্শে উপনীত হতে হবে। এই আদর্শকে সর্বদা চোখের সামনে রেখে তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যান। প্রতিকার ছাড়া, হিংসা ছাড়া, বাসনা ছাড়া কেউ সংসারে বাস করতে পারে না। জগৎ এখনও সে অবস্থায় আসেনি, যখন ঐ আদর্শকে সমাজে রূপায়িত করতে পারা যায়। অশুভের মধ্য দিয়ে জগতের অগ্রগতি তাকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে আদর্শের উপযুক্ত করে তুলছে।অধিকাংশ লোককেই এই মন্থর উন্নতির পথে অগ্রসর হতে হবে। বিশেষ শক্তিমান্ পুরুষদের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই আদর্শ লাভ করতে হলে এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সময়োপযোগী কর্তব্যসাধনই শ্রেষ্ঠ পন্থা এবং শুধু কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠিত হলে ওতে বন্ধন আসে না।
সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিত কলা এবং যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে ওটি সবচেয়ে বড় উপাসনা।
অজ্ঞান ও অশুভ নাশ করবার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শুধু লিখতে হবে যে, শুভ বুদ্ধি দ্বারাই অশুভের নাশ হয়।
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১২
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স,,
তাহলে গোপাল১১৪ মেয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছে! এটা হওয়া সঙ্গতই হয়েছে—স্থান-কাল-বিবেচনায়। তার জীবন সকল আশীর্বাদে বিধৃত হোক। সে গভীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনার ধন, আপনার ও আপনার গৃহিণীর জীবনের আশীর্বাদরূপে সে আপনাদের কাছে এসেছে—এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
‘প্রাচ্যদেশের জ্ঞানী পুরুষেরা পাশ্চাত্য শিশুর জন্য প্রীতি-উপহার নিয়ে আসছেন’—সেই প্রচলিত প্রথাটি পালন করবার জন্য যদি এখন আমি আমেরিকায় যেতে পারতাম! তবে আমার অন্তরাত্মা সকল প্রার্থনা ও আশীর্বাদ নিয়ে সেখানে বিরাজ করছে; দেহের চাইতে মনের শক্তি ঢের বেশী।
আমি এ-মাসের ১৬ তারিখে রওনা হব এবং নেপল্স্-এ গিয়ে জাহাজ ধরব। রোমে এলবার্টার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব। পবিত্র পরিবারটির জন্য সর্ববিধ ভালবাসা। ইতি
আপনাদের সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৩
হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় এলবার্টা,
আগামীকাল আমরা রোমে পৌঁছব। খুব সম্ভব আগামী পরশু আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব, কারণ রোমে যখন পৌঁছব, তখন রাত হয়ে যাবে। আমরা হোটেল কণ্টিনেণ্টাল-এ উঠছি।
সর্ববিধ ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা -৩১৪
হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় রাখাল,
এই পত্র দেখেই বুঝতে পারছ যে, আমি এখনও রাস্তায়। লণ্ডন ছাড়বার আগেই আমি তোমার পত্র ও পুস্তিকাখানি পেয়েছিলাম। মজুমদারের পাগলামির দিকে দৃক্পাত করো না। ঈর্ষাবশতঃ তাঁর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। তিনি যেরূপ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা শুনলে সভ্য দেশের লোকে তাঁকে বিদ্রূপ করবে। এরূপ অশিষ্ট ভাষা প্রয়োগ করে তিনি নিজের উদ্দেশ্য নিজেই বিফল করেছেন।
সে যাই হোক, আমরা কখনও আমাদের নাম করে হরমোহন বা অপর কাকেও ব্রাহ্মদের সঙ্গে লড়াই করতে দিতে পারি না। জনসাধারণ জানুক যে, কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বিবাদ নেই। যদি কেউ কলহ সৃষ্টি করে, তার জন্য সে নিজেই দায়ী। পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপরায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয়—এই তো আমরা বাঙালী জাতি! আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গেলে এগুলি ত্যাগ করতে হবে। তা ছাড়া হরমোহনকে আমার বই ছাপতে দিও না। সে যেভাবে ছাপে তাতে লোক ঠকান হয়।
কলিকাতায় কমলানেবু থাকলে আলাসিঙ্গার ঠিকানায় মান্দ্রাজে এক-শ পাঠিয়ে দিও, যাতে আমি মান্দ্রাজে পৌঁছে পেতে পারি।
মজুমদার নাকি লিখেছেন যে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীরামকৃষ্ণ-উপদেশ খাঁটি নয়, মিথ্যা। তা যদি হয় তো সুরেশ দত্ত ও রামবাবুকে ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ এর প্রতিবাদ করতে বলবে। ঐ উপদেশ কিভাবে সংগৃহীত হয়েছে, তা তো আমি জানি না; সেজন্য এ বিষয়ে কিছু বলতে পারি না। ইতি
তোমার প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুঃ— … বেকুবদের কথা মোটেই ভেবো না; কথায় বলে, ‘বুড়ো বেকুবের মত আর বেকুব নেই।’ ওরা একটু চেঁচাক না।
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৫
ড্যাম্পিয়ার, ‘প্রিন্স-রিজেণ্ট লিওপোল্ড’
৩ জানুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি লণ্ডন থেকে ঠিকানা বদল হয়ে রোমে আমার কাছে পৌঁছেছে। তোমার অশেষ সৌজন্য যে, অমন সুন্দর একখানি চিঠি লিখেছ, তার প্রতিটি ছত্র আমি উপভোগ করছি। ইওরোপে অর্কেষ্ট্রার ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। নেপল্স্ থেকে চারদিন ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রার পর পোর্ট সৈয়দের কাছে এসে পড়েছি। জাহাজ খুব দুলছে—অতএব এই অবস্থায় লেখা আমার এই হিজিবিজি তুমি ক্ষমা করো।
সুয়েজ থেকে এশিয়া। আবার এশিয়ায়! আমি কি এশিয়াবাসী, ইওরোপীয় না আমেরিকান? আমার মধ্যে ব্যক্তিত্বের একটা অদ্ভুত সংমিশ্রণ অনুভব করছি। ধর্মপালের গতিবিধি বা কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছু লেখনি। গান্ধীর চেয়ে তার সম্বন্ধেই আমার অনেক বেশী আগ্রহ।
কয়েকদিন পরেই কলম্বোতে নামছি, এবং সিংহলে কিছু একটা করব ভাবছি। এক সময় সিংহলে দু-কোটি অধিবাসী ছিল—তাদের বিরাট রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ প্রায় এক-শ বর্গমাইল জুড়ে পড়ে রয়েছে।
সিংহলীরা দ্রাবিড়জাতি নয়—খাঁটি আর্য। প্রায় ৮০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে বাঙলাদেশ থেকে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপিত হয় এবং সেই সময় থেকে তারা তাদের পরিষ্কার ইতিহাস রেখেছে। এখানেই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র, আর অনুরাধাপুর ছিল সেকালের লণ্ডন।
পাশ্চাত্যের সব কিছুর মধ্যে আমি রোমকেই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি, পম্পিয়াই দেখার পর তথাকথিত ‘আধুনিক সভ্যতা’র ওপর আমি একেবারে শ্রদ্ধা হারিয়েছি। বাষ্প আর বিদ্যুৎ বাদ দিলে ওদের আর সব কিছু ছিল—এবং আধুনিকদের চেয়ে ওদের চারুকলার ধারণা এবং রূপায়ণের শক্তিও অনন্তগুণে বেশী ছিল। মিস লককে বলো, আমি যে তাকে বলেছিলাম ‘মানবমূর্তির ভাস্কর্য গ্রীসে যতটা উন্নত হয়েছিল, ভারতে ততটা হয়নি’—এ মত আমার ভুল।
ফার্গুসন প্রভৃতির প্রামাণিক গ্রন্থে পড়েছি উড়িষ্যার অথবা জগন্নাথে—যেখানে আমার যাওয়া হয়নি, সে-সব জায়গায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যে-সব মানব-মূর্তি রয়েছে, সেগুলি সৌন্দর্যে এবং অবয়বসংস্থানের চাতুর্যে গ্রীসের যে-কোন শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয়। সেখানে মৃত্যুর একটি বিশাল মূর্তি আছে—প্রকাণ্ড একটি লোলচর্ম নারীকঙ্কাল—তার প্রতিটি অবয়বের নিখুঁত সংস্থান ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। গ্রন্থকার বলেছেন—অলিন্দে স্থিত একটি নারীমূর্তি ঠিক মেডিচির ভেনাসের মত! এমন আরও কত কি!
মনে রেখো মূর্তিবিদ্বেষী মুসলমানরা প্রায় সবই ধ্বংস করেছে, তবু যা আছে—তা সমগ্র ইওরোপীয় ধ্বংসস্তূপের চেয়ে বেশী! আট বছর ঘুরেছি, তবু শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের অনেকগুলিই দেখা হয়নি।
ভগিনী লককেও বলো—ভারতের অরণ্যে একটি বিধ্বস্ত মন্দির রয়েছে; ফার্গুসন মনে করেন, সেটি আর গ্রীসের পার্থিনন স্থাপত্যশিল্প, যে যার নিজ আদর্শের শিখরসীমা; একটি হল ভাবের, আর একটি হল ভাব ও খুঁটিনাটির। পরবর্তী মোগল সৌধাবলী প্রভৃতি ইন্দো-সারাসেন স্থাপত্যশিল্প প্রাচীনকালের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলির সামনে তুলনায় একদম দাঁড়াতে পারে না। … স্নেহ ভালবাসা জেনো। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ফ্লোরেন্সে হঠাৎ মাদার চার্চ ও ফাদার পোপের সঙ্গে দেখা। সে তো তুমি জেনেছ।
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৬
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
রামনাদ
শনিবার, ৩০ জানুআরী, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
চারিদিকের অবস্থা অতি আশ্চর্যরূপে আমার অনুকূল হয়ে আসছে। সিংহলে—কলম্বোয় আমি জাহাজ থেকে নেমেছি এবং এখন ভারতবর্ষের প্রায় শেষ দক্ষিণপ্রান্ত রামনাদে সেখানকার রাজার অতিথিরূপে রয়েছি। এই কলম্বো থেকে রামনাদ পর্যন্ত আমার পর্যটন যেন একটা বিরাট শোভাযাত্রা—হাজার হাজার লোকের ভিড়, আলোকসজ্জা, অভিনন্দন ইত্যাদি! ভারতভূমির যেখানে আমি প্রথম পদার্পণ করি, সেই স্থানে ৪০ ফুট উচ্চ একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী হচ্ছে। রামনাদের রাজা একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত খাঁটি সোনার তৈরী বৃহৎ পেটিকায় তাঁর অভিনন্দনপত্র আমাকে দিয়েছেন; তাতে আমাকে His Most Holiness (মহাপবিত্রস্বরূপ) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা আমার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে, যেন সমগ্র দেশটা আমাকে অভিনন্দন করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সুতরাং তুমি দেখতে পাচ্ছ, মেরী, আমি আমার সৌভাগ্যের উচ্চতম শিখরে উঠেছি। তবু আমার মন চিকাগোর সেই নিস্তব্ধ, প্রশান্ত দিনগুলির দিকেই ছুটছে—কি বিশ্রাম-শান্তি ও প্রেমপূর্ণ দিনগুলি! তাই এখনি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। আশা করি, তোমরা সকলে বেশ ভাল আছ ও আনন্দে আছ। ডক্টর ব্যারোজকে সাদর অভ্যর্থনা করবার জন্য আমি লণ্ডন থেকে আমার স্বদেশবাসীদের নিকট চিঠি লিখেছিলাম। তারা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা করেছিল। কিন্তু তিনি লোকের মনের উপর কোন রেখাপাত করতে পারেননি, তার জন্য আমি দোষী নই। কলিকাতার লোকের ভিতর নূতন কিছু ভাব ঢোকান বড় কঠিন। ডক্টর ব্যারোজ আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু ভাবছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি; এই তো সংসার! মা, বাবা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
মান্দ্রাজ
১২ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় রাখাল,
আগামী রবিবার ‘মোম্বাসা’ জাহাজে আমার রওনা হবার কথা। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় পুণার এবং আরও অনেক স্থানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ও গরমে আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।
থিওসফিষ্টরা ও অন্যান্য সকলে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল; সুতরাং আমাকেও দু-চারটি কথা—খোলাখুলিভাবে তাদের শোনাতে হয়েছিল। তুমি জান, তাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাকে আমেরিকায় বরাবর নির্যাতিত করেছে। এখানেও তারা তাই শুরু করতে চেয়েছিল। কাজেই আমার মত পরিষ্কার করে বলতে হয়েছিল। এতে আমার কলিকাতার বন্ধুদের কেউ যদি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তো ভগবান্ তাঁদের কৃপা করুন। তোমার ভয় পাবার কারণ নেই; আমি নিঃসঙ্গ নই—প্রভু সর্বদাই আমার সঙ্গে আছেন। অন্য কীই বা করতে পারতুম। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—উপযুক্ত আসবাব থাকলে বাড়ীখানি নিও।
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৮
আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
সারদানন্দ ভারতের দুর্ভিক্ষ-মোচনের জন্য ২০ পাউণ্ড পাঠিয়েছে। কিন্তু কথায় বলে, ‘আগে নিজের ঘর সামলাও’, সুতরাং প্রথমে সেই দুর্ভিক্ষ দূর করাই আমি শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলে মনে করলাম। অতএব ঐ অর্থ যথাযথ কাজেই লাগান হয়েছে।
লোকে যেমন বলে, ‘আমার মরবারও সময় নেই’, সমগ্র দেশময় শোভাযাত্রা, বাদ্যভাণ্ড ও সম্বর্ধনার রকমারী আয়োজনে আমি এখন মৃতপ্রায়। জন্মোৎসব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাহাড়ে পালিয়ে যাব। আমি ‘কেম্ব্রিজ সম্মেলন’ থেকে একটি এবং ‘ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশন’ থেকে আর একটি মানপত্র পেয়েছি। ‘নিউ ইয়র্ক বেদান্ত এসোসিয়েশনে’র যে মানপত্রের কথা ডাঃ জেন্স্ লিখেছেন, তা এখনও পৌঁছয়নি।
ডাঃ জেন্সের আর একখানি চিঠিও এসেছে, তাতে ভারতবর্ষে আপনাদের সম্মেলনের অনুরূপ কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ-সব বিষয়ে মনযোগ দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি ক্লান্ত—এতই ক্লান্ত যে, যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ-মাসও বাঁচব কিনা সন্দেহ!
বর্তমানে আমাকে দুটি কেন্দ্র খুলতে হবে—একটি কলিকাতায়, আর একটি মান্দ্রাজে। মান্দ্রাজীদের গাম্ভীর্য বেশী, আর তারা অনেক বেশী অকপট এবং আমার বিশ্বাস তারা মান্দ্রাজ থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। কলিকাতার লোক, বিশেষতঃ কলিকাতার অভিজাত সম্প্রদায় দেশপ্রেমের হুজুগের বেলায় উৎসাহী; কিন্তু তাদের সহানুভূতি কখনও বাস্তবে পরিণত হবে না। প্রত্যুত, এদেশে হিংসুক ও নির্দয় প্রকৃতির লোকের সংখ্যা বড় বেশী—তারা আমার সব কাজকে লণ্ডভণ্ড করে নষ্ট করতে কোন চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
তবে আপনি তো বেশ জানেন, বাধা যত বাড়ে, আমার ভেতরের দৈত্যটাও তত বেশী জেগে ওঠে। সন্ন্যাসীদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আমার মৃত্যু হলে আমার জীবনব্রত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
আমি ইংলণ্ড থেকে ৫০০ পাউণ্ড এবং মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে ৫০০ পাউণ্ড পূর্বেই পেয়েছি। ঐ সঙ্গে আপনার দেওয়া অর্থ যোগ করলে দুটো কেন্দ্রই আরম্ভ করতে পারব নিশ্চয়। সুতরাং যথাসম্ভব সত্বর আপনার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সবচেয়ে নিরাপদ উপায় মনে হচ্ছে—আমেরিকার কোন ব্যাঙ্কে আপনার ও আমার দুজনের নামে টাকাটা জমা দেওয়া, যাতে আমাদের যে-কেউ টাকাটা তুলতে পারে। যদি টাকা তোলবার আগেই আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনি ঐ টাকার সবটা তুলে আমার অভিপ্রায় অনুসারে খরচ করতে পারবেন। তাহলে আমার মৃত্যুর পর আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ আর ঐ টাকা নিয়ে গোলমাল করতে পারবে না। ইংলণ্ডের টাকাও ঐভাবে আমার ও মিঃ স্টার্ডির নামে ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে।
সারদানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আপনিও আমার অসীম প্রীতি ও চিরকৃতজ্ঞতা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩১৯
[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
দার্জিলিঙ
১৯ মার্চ, ১৮৯৭
শুভমস্তু। আশীর্বাদপ্রেমালিঙ্গনপূর্বকমিদং ভবতু তব প্রীতয়ে। পাঞ্চভৌতিকং মে পিঞ্জরমধুনা কিঞ্চিৎ সুস্থতরম্। অচলগুরোর্হিমানিমণ্ডিতশিখরাণি পুনরুজ্জীবয়ন্তি মৃতপ্রায়ানপি জনান্ ইতি মন্যে। শ্রমবাধাপি কথঞ্চিৎ দূরীভূতেত্যনুভবামি। যত্তে হৃদয়োদ্বেগকরং মুমুক্ষুত্বং লিপিভঙ্গ্যা ব্যঞ্জিতং, তন্ময়া অনুভূতং পূর্বম্। তদেব শাশ্বতে ব্রহ্মণি মনঃ সমাধাতুং প্রসরতি। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ জ্বলতু সা ভাবনা অধিকমধিকং যাবন্নাধিগতানামেকান্তক্ষয়ঃ কৃতাকৃতানাম্। তদনু সহসৈব ব্রহ্মপ্রকাশঃ সহ সমস্তবিষয়প্রধ্বংসৈঃ। আগামিনী সা জীবন্মুক্তিস্তব হিতায় তবানুরাগদার্ঢ্যেনৈবানুমেয়া। যাচে পুনস্তং লোকগুরুং মহাসমন্বয়াচার্য-শ্রী১০৮রামকৃষ্ণং আবির্ভবিতং তব হৃদয়োদ্দেশং যেন বৈ কৃতকৃতার্থস্ত্বম আবিষ্কৃতমহাশৌর্যঃ লোকান্ সমুদ্ধর্তুং মহামোহসাগরাৎ সম্যগ্ যতিষ্যসে। ভব চিরাধিষ্ঠিত ওজসি। বীরাণামেব করতলগত মুক্তির্ন কাপুরুষাণাম্। হে বীরাঃ, বদ্ধপরিকরাঃ ভবত; সম্মুখে শত্রবঃ মহামোহরূপাঃ। ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ ইতি নিশ্চিতেঽপি সমধিকতরং কুরুত যত্নম্। পশ্যত ইমান্ লোকান্ মোহগ্রাহগ্রস্তান্। শৃণুত অহো তেষাং হৃদয়ভেদকরং কারুণ্যপূর্ণং শোকনাদম্। অগ্রগাঃ ভবত, অগ্রগাঃ হে বীরাঃ, মোচয়িতুং পাশং বদ্ধানাং, শ্লথয়িতুং ক্লেশভারং দীনানাং, দ্যোতয়িতুং হৃদয়ান্ধকূপম্ অজ্ঞানাম্। অভীরভীরিতি ঘোষয়তি বেদান্তডিণ্ডিমঃ। ভূয়াৎ স ভেদায় হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বেষাং জগন্নিবাসিনামিতি—
তবৈকান্তশুভভাবুকঃ
বিবেকানন্দঃ
(বঙ্গানুবাদ)
শুভ হউক। আশীর্বাদ ও প্রেমালিঙ্গনপূর্ণ পত্রখানি তোমাকে সুখী করুক। অধুনা আমার পাঞ্চভৌতিক দেহপিঞ্জর পূর্বাপেক্ষা কিছু সুস্থ আছে। আমার মনে হয়, পর্বতরাজ হিমালয়ের হিমানীমণ্ডিত শিখরগুলি মৃতপ্রায় মানবদিগকেও সজীব করিয়া তোলে। পথশ্রমের কথঞ্চিৎ লাঘব হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। লিখনভঙ্গীতে তোমার হৃদয়োদ্বেগকর যে মুমুক্ষুত্ব প্রকটিত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বেই অনুভব করিয়াছি। সেই মুমুক্ষুত্বই ক্রমশঃ নিত্যস্বরূপ ব্রহ্মে মনের একাগ্রতা আনিয়া দেয়। মুক্তিলাভের আর অন্য পন্থা নাই। সেই ভাবনা তোমার উত্তরোত্তর বর্ধিত হউক, যতদিন না সমুদয় কৃতকর্ম সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তখন তোমার হৃদয়ে সহসা ব্রহ্মের প্রকাশ হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে সমুদয় বিষয়বাসনা নষ্ট হইয়া যাইবে। তোমার অনুরাগের দৃঢ়তা দ্বারা জানা যাইতেছে, পরমকল্যাণকর সেই জীবন্মুক্তি অবস্থা তুমি শীঘ্রই লাভ করিবে। এক্ষণে সেই লোকগুরু মহাসমন্বয়চার্য শ্রী১০৮রামকৃষ্ণদেবের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তিনি তোমার হৃদয়ে আবির্ভূত হন, যাহাতে তুমি কৃতকৃতার্থ ও মহাশৌর্যশালী হইয়া মহামোহসাগর হইতে লোকদিগেরও উদ্ধারের জন্য সম্যক্ যত্ন করিতে পার। চিরতেজস্বী হও। মুক্তি বীরদিগেরই করতলগত, কাপুরুষদিগের নহে। হে বীরগণ! বদ্ধপরিকর হও, মহামোহরূপ শত্রুগণ সম্মুখে। শ্রেয়োলাভে বহু বিঘ্ন ঘটে; ইহা নিশ্চিত হইলেও তাহা লাভ করিতে সমধিক যত্ন কর। দেখ, জীবগণ মোহরূপ কুম্ভীরের কবলে পড়িয়া কি কষ্ট পাইতেছে! আহা! তাহাদের হৃদয়বিদারক করুণ আর্তনাদ শ্রবণ কর। হে বীরগণ, বদ্ধদিগের পাশ মোচন করিতে, দরিদ্রের ক্লেশভার লঘু করিতে ও অজ্ঞজনগণের হৃদয়ান্ধকার দূর করিতে অগ্রসর হও—অগ্রসর হও। ঐ শুন, বেদান্তদুন্দুভি ঘোষণা করিতেছে—‘ভয় নাই, ভয় নাই।’ সেই দুন্দুভিধ্বনি নিখিল জগদ্বাসিগণের হৃদয়গ্রন্থি ভেদ করিতে সমর্থ হউক।
তোমাদের পরমশুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২০
C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২০ মার্চ (এপ্রিল?), ১৮৯৭
প্রিয় শশী,
তোমরা অবশ্যই এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছ। বিলিগিরি অবশ্যই অতি যত্ন করিতেছে এবং সদানন্দ তোমার সেবা করিতেছে। পূজা-অর্চা পূর্ণ সাত্ত্বিকভাবে মান্দ্রাজে করিতে হইবে। রজোগুণের লেশমাত্র যেন না থাকে। আলাসিঙ্গা বোধ হয় এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছে। কাহারও সহিত বাদ-বিবাদ করিবে না—সদা শান্তিভাব আশ্রয় করিবে। আপাততঃ বিলিগিরির বাটীতেই ঠাকুর স্থাপনা করিয়া পূজাদি হউক, তবে পূজার ঘটা একটু কমাইয়া সে সময়টা পাঠাদি ও লেকচার প্রভৃতি কিছু কিছু যেন হয়। কান ফুঁকতে যত পার, ততই মঙ্গল জানিবে। কাগজ দুটোর তত্ত্বাবধান করিবে ও যাহা পার সহায়তা করিবে। বিলিগিরির দুটি বিধবা কন্যা আছেন। তাঁদের শিক্ষা দিবে এবং তাঁদের দ্বারা ঐ প্রকার আরও বিধবারা যাহাতে স্বধর্মে থাকিয়া সংস্কৃত ও ইংরেজী শিক্ষা পায়, এ বিষয়ে যত্ন সবিশেষ করিবে। কিন্তু এ সব কার্য তফাৎ হইতে। যুবতীর সাক্ষাতে অতি সাবধান। একবার পড়িলে আর গতি নাই এবং ও অপরাধের ক্ষমা নাই।
গুপ্তকে কুকুরে কামড়াইয়াছে শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম; কিন্তু শুনিতেছি যে, ঐ কুকুর হন্যা নহে—তাহা হইলে ভয়ের কারণ নাই। যাহা হউক, গঙ্গাধরের প্রেরিত ঔষধ সেবন করান যেন হয়। প্রাতঃকালে পূজাদি অল্পে সারা করিয়া সপরিবার বিলিগিরিকে ডাকাইয়া কিঞ্চিৎ গীতাদি পাঠ করিবে। রাধাকৃষ্ণ-প্রেম শিক্ষার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। শুদ্ধ সীতারাম ও হরপার্বতীতে ভক্তি শিখাইবে। এ বিষয়ে কোন ভুল না হয়। যুবক-যুবতীদের [পক্ষে] রাধাকৃষ্ণলীলা একেবারেই বিষের ন্যায় জানিবে। বিশেষ বিলিগিরি প্রভৃতি রামানুজীরা রামোপাসক, তাঁদের শুদ্ধ ভাব যেন কদাচ বিনষ্ট না হয়।
বৈকালে ঐ প্রকার সাধারণ লোকের জন্য কিছু শিক্ষাদি দিবে। এই প্রকার ধীরে ‘পর্বতমপি লঙ্ঘয়েৎ’।
পরমশুদ্ধ ভাব যেন সর্বদা রক্ষিত হয়। ঘুণাক্ষরেও যেন বামাচার না আসে। বাকী প্রভু সকল বুদ্ধি দিবে ভয় নাই। বিলিগিরিকে আমার বিশেষ দণ্ডবৎ ও আলিঙ্গনাদি দিবে। ঐ প্রকার সকল ভক্তদের আমার প্রণামাদি দিও। আমার রোগ অনেকটা এক্ষণে শান্ত হইয়াছে—একেবারে সারিয়া গেলেও যাইতে পারে—প্রভুর ইচ্ছা। আমার ভালবাসা, নমস্কার, আশীর্বাদাদি জানিবে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাওকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন ও আশীর্বাদ দিবে ও তাঁহাকে যতদূর পার সহায়তা করিও। তামিল অর্থাৎ ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে যাহাতে সংস্কৃত বিদ্যার বিশেষ চর্চা হয়, তাহা করিবে। ইতি
—বি
[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে ১১৫ লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
রোজ ব্যাঙ্ক
বর্ধমান রাজবাটী, দার্জিলিঙ
৬ এপ্রিল, ১৮৯৭
মান্যবরাসু,
মহাশয়ার প্রেরিত ‘ভারতী’ পাইয়া বিশেষ অনুগৃহীত বোধ করিতেছি এবং যে উদ্দেশ্যে আমার ক্ষুদ্র জীবন ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা যে ভবদীয়ার ন্যায় মহানুভবাদের সাধুবাদ সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহাতে আপনাকে ধন্য মনে করিতেছি।
এ জীবনসংগ্রামে নবীন ভাবের সমুদ্গাতার সমর্থক অতি বিরল, উৎসাহয়িত্রীর কথা তো দূরে থাকুক; বিশেষতঃ আমাদের হতভাগ্য দেশে। এজন্য বঙ্গ-বিদুষী নারীর সাধুবাদ সমগ্র ভারতীয় পুরুষের উৎকণ্ঠ ধন্যবাদাপেক্ষাও অধিক শ্লাঘ্য।
প্রভু করুন, যেন আপনার মত অনেক রমণী এদেশে জন্মগ্রহণ করেন ও স্বদেশের উন্নতি-কল্পে জীবন উৎসর্গ করেন।
আপনার লিখিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় মৎসম্বন্ধী প্রবন্ধ বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ মন্তব্য আছে; তাহা এইঃ
পাশ্চাত্যদেশে ধর্মপ্রচার ভারতের মঙ্গলের জন্যই করা হইয়াছে এবং হইবে। পাশ্চাত্যরা সহায়তা না করিলে যে আমরা উঠিতে পারিব না, ইহা চির ধারণা। এদেশে এখনও গুণের আদর নাই, অর্থবল নাই, এবং সর্বাপেক্ষা শোচনীয় এই যে, কৃতকর্মতা (practicality) আদৌ নাই।
উদ্দেশ্য অনেক আছে, উপায় এদেশে নাই। আমাদের মস্তক আছে, হস্ত নাই। আমাদের বেদান্ত-মত আছে, কার্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা নাই। আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে, আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি। মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম ভারতেই প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু কার্যে আমরা অতি নির্দয়, অতি হৃদয়হীন, নিজের মাংসপিণ্ড-শরীর ছাড়া অন্য কিছুই ভাবিতে পারি না।
তথাপি উপস্থিত অবস্থার মধ্য দিয়াই কেবল কার্যে অগ্রসর হইতে পারা যায়, অন্য উপায় নাই। ভাল-মন্দ-বিচারের শক্তি সকলের আছে। কিন্তু তিনিই বীর, যিনি এই সমস্ত ভ্রম-প্রমাদ-ও দুঃখপূর্ণ সংসারের তরঙ্গে পশ্চাৎপদ না হইয়া একহস্তে অশ্রুবারি মোচন করেন ও অপর অকম্পিত হস্তে উদ্ধারের পথ প্রদর্শন করেন। একদিকে গতানুগতিক জড়পিণ্ডবৎ সমাজ, অন্যদিকে অস্থির ধৈর্যহীন অগ্নিবর্ষণকারী সংস্কার; কল্যাণের পথ এই দুইয়ের মধ্যবর্তী। জাপানে শুনিয়াছিলাম, সে দেশের বালিকাদিগের বিশ্বাস এই যে, যদি ক্রীড়াপুত্তলিকাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসা যায়, সে জীবিত হইবে। জাপানী বালিকা কখনও পুতুল ভাঙে না। হে মহাভাগে, আমারও বিশ্বাস যে, যদি কেউ এই হতশ্রী বিগতভাগ্য লুপ্তবুদ্ধি পরপদবিদলিত চিরবুভুক্ষিত কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তবে ভারত আবার জাগিবে। যবে শত শত মহাপ্রাণ নরনারী সকল বিলাসভোগসুখেচ্ছা বিসর্জন করিয়া কায়মনোবাক্যে দারিদ্র্য ও মূর্খতার ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশঃ উত্তরোত্তর নিমজ্জনকারী কোটি কোটি স্বদেশীয় নরনারীর কল্যাণ কামনা করিবে, তখন ভারত জাগিবে। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র জীবনেও ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে, সদুদ্দেশ্য অকপটতা ও অনন্ত প্রেম বিশ্ব বিজয় করিতে সক্ষম। উক্ত গুণশালী একজন কোটি কোটি কপট ও নিষ্ঠুরের দুর্বুদ্ধি নাশ করিতে সক্ষম।
আমার পুনর্বার পাশ্চাত্যদেশে গমন অনিশ্চিত; যদি যাই, তাহাও জানিবেন ভারতের জন্য। এদেশে লোকবল কোথায়, অর্থবল কোথায়? অনেক পাশ্চাত্য নরনারী ভারতের কল্যাণের জন্য ভারতীয় ভাবে ভারতীয় ধর্মের মধ্য দিয়া অতি নীচ চণ্ডালাদিরও সেবা করিতে প্রস্তুত আছেন। দেশে কয়জন? আর অর্থবল!! আমাকে অভ্যর্থনা করিবার ব্যয়নির্বাহের জন্য কলিকাতাবাসীরা টিকিট বিক্রী করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সঙ্কুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!! ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না, কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব, ইহারই পোষণ করিতেছি। ইতি
চিরকৃতজ্ঞ ও সদা প্রভুসন্নিধানে
ভবৎ-কল্যাণ-কামনাকারী
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২২
[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে লিখিত]
C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৭
মহাশয়াসু,
আপনার সহানুভূতির জন্য হৃদয়ের সহিত আপনাকে ধন্যবাদ দিতেছি, কিন্তু নানা কারণবশতঃ এ সম্বন্ধে আপাততঃ প্রকাশ্য আলোচনা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। তন্মধ্যে প্রধান কারণ এই যে, যে-টাকা আমার নিকট চাওয়া হয়, তাহা ইংলণ্ড হইতে আমার সমভিব্যাহারী ইংরেজ বন্ধুদিগের আহ্বানের নিমিত্তই অধিকাংশ খরচ হইয়াছিল। অতএব এ কথা প্রকাশ করিলে যে অপযশের ভয় আপনি করেন, তাহাই হইবে। দ্বিতীয়তঃ তাঁহারা—আমি উক্ত টাকা দিতে অপারগ হওয়ায়—আপনা-আপনির মধ্যে উহা সারিয়া লইয়াছেন, শুনিতেছি।
আপনি কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—তদ্বিষয়ে প্রথমে বক্তব্য এই যে, ‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ’ই হওয়া উচিত; তবে আমার অতি প্রিয়বন্ধু মিস মূলারের প্রমুখাৎ আপনার উদারবুদ্ধি, স্বদেশবাৎসল্য ও দৃঢ় অধ্যাবসায়ের অনেক কথা শুনিয়াছি এবং আপনার বিদুষীত্বের প্রমাণ প্রত্যক্ষ। অতএব আপনি যে আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টার কথা জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহা পরম সৌভাগ্য মনে করিয়া অত্র ক্ষুদ্র পত্রে যথাসম্ভব নিবেদন করিলাম। কিন্তু প্রথমতঃ আপনার বিচারের জন্য আমার অনুভবসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ভবৎসন্নিধানে উপস্থিত করিতেছিঃ আমরা চিরকাল পরাধীন, অর্থাৎ এ ভারতভূমে সাধারণ মানবের আত্মস্বত্ববুদ্ধি কখনও উদ্দীপিত হইতে দেওয়া হয় নাই। পাশ্চাত্যভূমি আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া দ্রুতপদে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হইতেছে। এ ভারতে কৌলীন্যপ্রথা হইতে ভোজ্যাভোজ্য পর্যন্ত সকল বিষয় রাজাই নির্ধারণ করিতেন। পাশ্চাত্যদেশে সমস্তই প্রজারা আপনারা করেন।
এক্ষণে রাজা সামাজিক কোন বিষয়ে হাত দেন না, অথচ ভারতীয় জনমানবের আত্মনির্ভরতা দূরে থাকুক, আত্মপ্রত্যয় পর্যন্ত এখনও অণুমাত্র হয় নাই। যে আত্মপ্রত্যয় বেদান্তের ভিত্তি, তাহা এখনও ব্যাবহারিক অবস্থায় কিছুমাত্রও পরিণত হয় নাই। এইজন্যই পাশ্চাত্য প্রণালী অর্থাৎ প্রথমতঃ উদ্দিষ্ট বিষয়ের আন্দোলন পরে সকলে মিলিয়া কর্তব্যসাধন, এ দেশে এখনও ফলদায়ক হয় না; এইজন্যই আমরা বিজাতীয় রাজার অধীনে এত অধিক স্থিতিশীল বলিয়া প্রতীত হই। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে সাধারণে আন্দোলনের দ্বারা কোন মহৎকার্য করার চেষ্টা বৃথা, ‘মাথা নেই তার মাথা ব্যথা’—সাধারণ কোথা? তাহার উপর আমরা এতই বীর্যহীন যে, কোন বিষয়ের আন্দোলন করিতে গেলে তাহাতেই আমাদের বল নিঃশেষিত হয়, কার্যের জন্য কিছুমাত্রও বাকী থাকে না; এইজন্যই বোধ হয় আমরা প্রায়ই বঙ্গভূমে ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’ সতত প্রত্যক্ষ করি। দ্বিতীয়তঃ যে প্রকার পূর্বেই লিখিয়াছি—ভারতবর্ষের ধনীদিগের নিকট কোন আশা করি না। যাহাদের উপর আশা, অর্থাৎ যুবক সম্প্রদায়—ধীর, স্থির অথচ নিঃশব্দে তাহাদিগের মধ্যে কার্য করাই ভাল। এক্ষণে কার্যঃ ‘আধুনিক সভ্যতা’ পাশ্চাত্যদেশের ও ‘প্রাচীন সভ্যতা’ ভারত, মিসর, রোমকাদি দেশের মধ্যে সেইদিন হইতেই প্রভেদ আরম্ভ হইল, যেদিন হইতে শিক্ষা, সভ্যতা প্রভৃতি উচ্চজাতি হইতে ক্রমশঃ নিম্নজাতিদিগের মধ্যে প্রসারিত হইতে লাগিল। প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধি যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। ভারতবর্ষের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি—রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া। আজ অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া সমাজসংস্কারের ধুম উঠিয়াছে। দশ বৎসর যাবৎ ভারতের নানা স্থল বিচরণ করিয়া দেখিলাম, সমাজসংস্কারসভায় দেশ পরিপূর্ণ। কিন্তু যাহাদের রুধিরশোষণের দ্বারা ‘ভদ্রলোক’ নামে প্রথিত ব্যক্তিরা ‘ভদ্রলোক’ হইয়াছেন এবং রহিতেছেন, তাহাদের জন্য একটি সভাও দেখিলাম না! মুসলমান কয়জন সিপাহী আনিয়াছিল? ইংরেজ কয়জন আছে? ছ-টাকার জন্য পিতা নিজের ভ্রাতার গলা কাটিতে পারে, এমন লক্ষ লক্ষ লোক ভারত ছাড়া কোথায় পাওয়া যায়? সাত-শ বৎসর মুসলমান রাজত্বে ছ-কোটি মুসলমান, এক-শ বৎসর ক্রিশ্চান রাজত্বে কুড়ি লক্ষ ক্রিশ্চান—কেন এমন হয়? Originality (মৌলিকতা) একেবারে দেশকে কেন ত্যাগ করিয়াছে? আমাদের দক্ষহস্ত শিল্পী কেন ইওরোপীয়দের সহিত সমকক্ষতা করিতে না পারিয়া দিন দিন উৎসন্ন যাইতেছে? কি বলেই বা জার্মান শ্রমজীবী ইংরেজ শ্রমজীবীর বহুশতাব্দীপ্রোথিত দৃঢ় আসন টলমলায়মান করিয়া তুলিয়াছে?
কেবল শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা! ইওরোপের বহু নগর পর্যটন করিয়া তাহাদের দরিদ্রেরও সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও বিদ্যা দেখিয়া আমাদের গরীবদের কথা মনে পড়িয়া অশ্রুজল বিসর্জন করিতাম। কেন এ পার্থক্য হইল? শিক্ষা—জবাব পাইলাম। শিক্ষাবলে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়বলে অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠিতেছেন; আর আমাদের—ক্রমেই তিনি সঙ্কুচিত হচ্ছেন। নিউ ইয়র্কে দেখিতাম, Irish colonists (আইরিশ ঔপনিবেশিকগণ) আসিতেছে—ইংরেজ-পদ-নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্বস্ব, মহাদরিদ্র, মহামূর্খ—সম্বল একটি লাঠি ও তার অগ্রবিলম্বিত একটি ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলি। তার চলন সভয়, তার চাউনি সভয়। ছ-মাস পরে আর এক দৃশ্য—সে সোজা হয়ে চলছে, তার বেশভূষা বদলে গেছে; তার চাউনিতে, তার চলনে আর সে ‘ভয় ভয়’ ভাব নাই। কেন এমন হল? আমার বেদান্ত বলছেন যে, ঐ Irishma-কে তাহার স্বদেশে চারিদিকে ঘৃণার মধ্যে রাখা হয়েছিল—সমস্ত প্রকৃতি একবাক্যে বলছিল, ‘প্যাট(Pat),১১৬ তোর আর আশা নাই, তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম।’ আজন্ম শুনিতে শুনিতে প্যাট-এর তাই বিশ্বাস হল, নিজেকে প্যাট হিপনটাইজ (সম্মোহিত) করলে যে, সে অতি নীচ; তার ব্রহ্ম সঙ্কুচিত হয়ে গেল। আর আমেরিকায় নামিবামাত্র চারিদিক থেকে ধ্বনি উঠিল—‘প্যাট, তুইও মানুষ, আমরাও মানুষ, মানুষেই তো সব করেছে, তোর আমার মত মানুষ সব করতে পারে, বুকে সাহস বাঁধ!’ প্যাট ঘাড় তুললে, দেখলে ঠিক কথাই তো; ভিতরের ব্রহ্ম জেগে উঠলেন, স্বয়ং প্রকৃতি যেন বললেন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ ইত্যাদি।
ঐ প্রকার আমাদের বালকদের যে বিদ্যাশিক্ষা হচ্ছে, তাও একান্ত negative (নেতিভাবপূর্ণ)—স্কুল-বালক কিছুই শিখে না, কেবল সব ভেঙেচুরে যায়—ফল ‘শ্রদ্ধাহীনত্ব’। যে শ্রদ্ধা বেদবেদান্তের মূলমন্ত্র, যে শ্রদ্ধা নচিকেতাকে যমের মুখে যাইয়া প্রশ্ন করিতে সাহসী করিয়াছিল, যে শ্রদ্ধাবলে এই জগৎ চলিতেছে, সে ‘শ্রদ্ধা’র লোপ। ‘অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি’—গীতা। তাই আমরা বিনাশের এত নিকট। এক্ষণে উপায়—শিক্ষার প্রচার। প্রথম আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার মন্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্ধন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ—এ সকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপাস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।’ দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, অদ্বৈত, শৈবসিদ্ধান্ত, বৈষ্ণব, শাক্ত, এমন কি বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি যে-কোন সম্প্রদায় এ ভারতে উঠিয়াছে, সকলেই এইখানে একবাক্য যে, এই ‘জীবাত্মা’তেই অনন্ত শক্তি নিহিত আছে, পিপীলিকা হতে উচ্চতম সিদ্ধপুরুষ পর্যন্ত সকলের মধ্যে সেই ‘আত্মা’,—তফাৎ কেবল প্রকাশের তারতম্যে, ‘বরণভেদস্তু ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ’— (পাতঞ্জলযোগসূত্রম্)। অবকাশ ও উপযুক্ত দেশ কাল পেলেই সেই শক্তির বিকাশ হয়। কিন্তু বিকাশ হোক বা না হোক, সে শক্তি প্রত্যেক জীবে বর্তমান—আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত। এই শক্তির উদ্বোধন করতে হবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়, এই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হবে। কথা তো হল সোজা, কিন্তু কার্যে পরিণত হয় কি প্রকারে? এই আমাদের দেশে সহস্র সহস্র নিঃস্বার্থ, দয়াবান, ত্যাগী পুরুষ আছেন; ইঁহাদের মধ্যে অন্ততঃ (এক) অর্ধেক ভাগকে—যেমন তাঁহারা বিনা বেতনে পর্যটন করে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছেন—ঐ প্রকার বিদ্যাশিক্ষক করান যেতে পারে। তাহার জন্য চাই, প্রথমতঃ এক এক রাজধানীতে এক এক কেন্দ্র ও সেথা হইতে ধীরে ধীরে ভারতের সর্বস্থানে ব্যাপ্ত হওয়া। মান্দ্রাজ ও কলিকাতায় সম্প্রতি দুটি কেন্দ্র হইয়াছে; আরও শীঘ্র হইবার আশা আছে। তারপর দরিদ্রদের শিক্ষা অধিকাংশই শ্রুতির দ্বারা হওয়া চাই। স্কুল ইত্যাদির এখনও সময় আইসে নাই। ক্রমশঃ ঐ সকল প্রধান কেন্দ্রে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি শিখান যাবে এবং শিল্পাদিরও যাহাতে এদেশে উন্নতি হয়, তদুপায়ে কর্মশালা খোলা যাবে। ঐ কর্মশালার মালবিক্রয় যাহাতে ইওরোপে ও আমেরিকায় হয়, তজ্জন্য উক্ত দেশসমূহেও সভা স্থাপনা হইয়াছে ও হইবে। কেবল মুশকিল এক, যে প্রকার পুরুষদের জন্য হইবে, ঠিক ঐ ভাবেই স্ত্রীলোকদের জন্য চাই; কিন্তু এদেশে তাহা অতীব কঠিন, আপনি বিদিত আছেন। পুনশ্চ এই সমস্ত কার্যের জন্য যে অর্থ চাই, তাহাও ইংলণ্ড হইতে আসিবে। যে-সাপে কামড়ায়, সে নিজের বিষ উঠাইয়া লইবে, ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং তজ্জন্য আমাদের ধর্ম ইওরোপ ও আমেরিকায় প্রচার হওয়া চাই! আধুনিক বিজ্ঞান খ্রীষ্টাদি ধর্মের ভিত্তি একেবারে চূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাহার উপর বিলাস—ধর্মবৃত্তিই প্রায় নষ্ট করিয়া ফেলিল। ইওরোপ ও আমেরিকা আশাপূর্ণনেত্রে ভারতের দিকে তাকাইতেছে—এই সময় পরোপকারের, এই সময় শত্রুর দুর্গ অধিকার করিবার।
পাশ্চাত্যদেশে নারীর রাজ্য, নারীর বল, নারীর প্রভুত্ব। যদি আপনার ন্যায় তেজস্বিনী বিদুষী বেদান্তজ্ঞা কেউ এই সময়ে ইংলণ্ডে যান আমি নিশ্চিত বলিতেছি, এক এক বৎসরে অন্ততঃ দশ হাজার নরনারী ভারতের ধর্ম গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ হইবে। এক রমাবাঈ অস্মদ্দেশ হইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার ইংরেজী ভাষা বা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিল্পাদিবোধ অল্পই ছিল, তথাপি তিনি সকলকে স্তম্ভিত করিয়াছিলেন। যদি আপনার ন্যায় কেউ যান তো ইংলণ্ড তোলপাড় হইয়া যাইতে পারে, আমেরিকার কা কথা। দেশীয় নারী দেশীয় পরিচ্ছদে ভারতের ঋষিমুখাগত ধর্ম প্রচার করিলে আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, এক মহান্ তরঙ্গ উঠিবে, যাহা সমগ্র পাশ্চাত্যভূমি প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। এ মৈত্রেয়ী, খনা, লীলাবতী, সাবিত্রী ও উভয়-ভারতীর জন্মভূমিতে কি আর কোন নারীর এ সাহস হইবে না? প্রভু জানেন। ইংলণ্ড, ইংলণ্ড, ইংলণ্ড-—আমরা ধর্মবলে অধিকার করিব, জয় করিব—‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ এ দুর্দান্ত অসুরের হস্ত হইতে কি সভাসমিতি দ্বারা উদ্ধার হয়? অসুরকে দেবতা করিতে হইবে। আমি দীন ভিক্ষুক পরিব্রাজক কি করতে পারি? আমি একা, অসহায়! আপনাদের ধন-বল, বুদ্ধি-বল, বিদ্যা-বল—আপনারা এ সুযোগ ত্যাগ করিবেন কি? এই এখন মহামন্ত্র—ইংলণ্ড-বিজয়, ইওরোপ বিজয় আমেরিকা-বিজয়! তাহাতেই দেশের কল্যাণ। Expansion is the sign of life and we must spread the world over with our spiritual ideals.১১৭ হায় হায়! শরীর ক্ষুদ্র জিনিষ, তায় বাঙালীর শরীর; এই পরিশ্রমেই অতি কঠিন প্রাণহর ব্যাধি আক্রমণ করিল! কিন্তু আশা এই—‘উৎপৎস্যতেঽস্তি মম কোঽপি সমানধর্মা, কালো হ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী।’১১৮
নিরামিষ ভোজন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই—প্রথমতঃ আমার গুরু নিরামিষাশী ছিলেন; তবে দেবীর প্রসাদ মাংস কেহ দিলে অঙ্গুলি দ্বারা মস্তকে স্পর্শ করিতেন। জীবহত্যা পাপ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই; তবে যতদিন রাসায়নিক উন্নতির দ্বারা উদ্ভিজ্জাদি মনুষ্যশরীরের উপযোগী খাদ্য না হয়, ততদিন মাংসভোজন ভিন্ন উপায় নাই। যতদিন মনুষ্যকে আধুনিক অবস্থার মধ্যে থাকিয়া রজোগুণের কৃপা করিতে হইবে, ততদিন মাংসাদন বিনা উপায় নাই। মহারাজ অশোক তরবারির দ্বারা দশ-বিশ লক্ষ জানোয়ারের প্রাণ বাঁচাইলেন বটে, কিন্তু হাজার বৎসরের দাসত্ব কি তদপেক্ষা আরও ভয়ানক নহে? দু-দশটা ছাগলের প্রাণনাশ বা আমার [অর্থাৎ নিজের] স্ত্রী-কন্যার মর্যাদা রাখিতে অক্ষমতা ও আমার বালকবালিকার মুখের গ্রাস পরের হাত হইতে রক্ষা করিতে অক্ষমতা, এ কয়েকটির মধ্যে কোন্টি অধিকতর পাপ? যাঁহারা উচ্চশ্রেণীর, এবং শারীরিক পরিশ্রম করিয়া অন্ন সংগ্রহ করেন না, তাঁহারা বরং [মাংসাদি] না খান; যাহাদের দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া অন্নবস্ত্রের সংস্থান করিতে হইবে, বলপূর্বক তাহাদিগকে নিরামিষাশী করা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা-বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য কি করিতে পারে, জাপান তাহার নিদর্শন। সর্বশক্তিমতী বিশ্বেশ্বরী আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণা হউন। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৩
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
(দার্জিলিঙ)১১৯
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
কয়েকদিন পূর্বে তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়েছি। গতকাল হ্যারিয়েটের বিবাহের সংবাদ বহন করে চিঠি এসেছে। প্রভু নবদম্পতিকে সুখে রাখুন।
এখানে সমস্ত দেশবাসী আমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য যেন একপ্রাণ হয়ে সমবেত হয়েছিল। শত সহস্র লোক—যেখানে যাই সেখানেই উৎসাহসূচক আনন্দধ্বনি করছিল, রাজা-রাজড়ারা আমার গাড়ী টানছিলেন, বড় বড় শহরের সদর রাস্তার উপর তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং তাতে নানা রকম মঙ্গলবাক্য (motto) জ্বলজ্বল করছিল। সমস্ত ব্যাপারটিই শীঘ্র পুস্তকাকারে বেরুবে এবং তুমিও একখানা পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি ইতোপূর্বেই ইংলণ্ডে কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়েছি, আবার এখানে দাক্ষিণাত্যের ভীষণ গরমে অতিরিক্ত পরিশ্রম করায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। কাজেই আমাকে ভারতের অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করবার পরিকল্পনা ছেড়ে নিকটতম শৈলনিবাস দার্জিলিঙে চোঁচা দৌড় দিতে হল। সম্প্রতি আমি অনেকটা ভাল আছি এবং আবার মাসখানেক আলমোড়ায় থাকলেই সম্পূর্ণ সেরে যাব। ভাল কথা, সম্প্রতি আমার ইওরোপে যাবার একটা সুবিধা চলে গেল। রাজা অজিত সিং এবং আরও কয়েকজন রাজা আগামী শনিবার ইংলণ্ড যাত্রা করছেন। তাঁরা অবশ্য আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাক্তারেরা রাজী নন। তাঁরা চান না আমি এখন কোন শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রম করি, সুতরাং অত্যন্ত ক্ষুণ্ণহৃদয়ে আমাকে এই সুযোগ ছেড়ে দিতে হচ্ছে; তবে যত শীঘ্র পারি যাবার চেষ্টা করব।
আশা করি ডাঃ ব্যারোজ এতদিনে আমেরিকায় পৌঁছেছেন। আহা বেচারা! তিনি অত্যন্ত গোঁড়া মনোভাব নিয়ে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন, সুতরাং যা সাধারণতঃ হয়ে থাকে—কেউ তাঁর কথা শুনল না। অবশ্য লোকে তাঁকে খুব সাদর অভ্যর্থনা করেছিল; তাও আমি চিঠি লিখেছিলাম বলেই। কিন্তু আমি তো আর তাঁর ভিতরে বুদ্ধি ঢোকাতে পারি না! অধিকন্তু, তিনি যেন কি-এক অদ্ভুত ধরনের লোক! শুনলাম, আমি দেশে ফিরে আসলে সমগ্র জাতিটা আনন্দে যে মেতে উঠেছিল, তাতে তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন। যে করেই হোক, আরও বেশী মাথাওয়ালা একজনকে পাঠান উচিত ছিল, কারণ ডাঃ ব্যারোজ যা বলে গেছেন, তাতে হিন্দুরা বুঝেছে ধর্মমহাসভা ছিল একটা তামাশার ব্যাপারে (farce)। দার্শনিক বিষয়ে জগতের কোন জাতই হিন্দুদের পথপ্রদর্শক হতে পারবে না।
একটা বড় মজার কথা এই যে, খ্রীষ্টান দেশ থেকে যত লোক এদেশে এসেছে, তাদের সকলেরই সেই এক মান্ধাতার আমলে নির্বোধ যুক্তিঃ যেহেতু খ্রীষ্টানরা শক্তিশালী ও ধনবান্ এবং হিন্দুরা তা নয়, সেই হেতুই খ্রীষ্টধর্ম হিন্দুধর্মের চেয়ে ভাল। এরই উত্তরে হিন্দুরা ঠিক জবাব দেয় যে, সেইজন্যই তো হিন্দুধর্মই হচ্ছে ধর্ম, আর খ্রীষ্টানধর্ম ধর্মই নয়। কারণ, এই পশুভাবাপন্ন জগতে পাপেরই জয়জয়কার আর পুণ্যের সর্বদা নির্যাতন! এটা দেখা যাচ্ছে যে, পাশ্চাত্য জাতি জড়বিজ্ঞানের চর্চায় যতই উন্নত হোক না কেন, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তারা শিশুমাত্র। জড়বিজ্ঞান শুধু ঐহিক উন্নতি বিধান করতে পারে; কিন্তু অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান থেকে আসে অনন্ত জীবন। যদি অনন্ত জীবন নাও থাকে, তাহলেও আদর্শ হিসাবে আধ্যাত্মিক চিন্তাপ্রসূত আনন্দ অধিকতর তীব্র এবং এ-চিন্তা মানুষকে অধিকতর সুখী করে, আর জড়বাদপ্রসূত নির্বুদ্ধিতা থেকে আসে প্রতিযোগিতা, অযথা উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিণামে ব্যষ্টি ও সমষ্টির মৃত্যু।
এই দার্জিলিঙ অতি সুন্দর জায়গা। এখান থেকে মাঝে মাঝে যখন মেঘ সরে যায়, তখন ২৮‚১৪৬ ফুট উচ্চ মহিমামণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এবং নিকটের একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে মাঝে মাঝে ২৯‚০০২ ফুট উচ্চ গৌরীশঙ্করের চকিত দর্শন পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীরা—তিব্বতীরা, নেপালীরা এবং সর্বোপরি সুন্দরী লেপ্চা মেয়েরা—যেন ছবিটির মত।
তুমি চিকাগোর কল্স্টন টার্নবুল নামে কাউকে চেন কি? আমি ভারতবর্ষে পৌঁছবার পূর্বে কয়েক সপ্তাহ তিনি এখানে ছিলেন। তিনি দেখছি, আমাকে খুব পছন্দ করতেন, আর তার ফলে হিন্দুরা সকলেই তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করত! জো, মিসেস অ্যাডাম্স্, সিষ্টার জোসেফিন এবং আমাদের আর আর বন্ধুদের খবর কি? আমাদের প্রিয় মিল্রা (Mills) কোথায়? তারা ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ‘পিষে’ চলেছে১২০ বোধ হয়? আমি হ্যারিয়েটকে তার বিবাহে কয়েকটি প্রীতি-উপহার পাঠাব মনে করেছিলাম; কিন্তু তোমাদের যে ভীষণ জাহাজের মাশুল—তাই উপস্থিত পাঠান স্থগিত রাখতে হচ্ছে। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার শীঘ্রই ইওরোপে দেখা হবে। এই চিঠিতে যদি তোমারও বিবাহের কথাবার্তা চলছে লিখতে, তাহলে আমি অবশ্য আহ্লাদিত হতাম এবং আধ ডজন কাগজের একখানি চিঠি লিখে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতাম।
আমার চুল গোছা গোছা পাকতে আরম্ভ করেছে এবং আমার মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে—দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে—রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমন কি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!! আমি এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বাস করছি—তারা সকলেই নিকার-বোকার পরে, অবশ্য স্ত্রীলোকেরা নয়। আমিও নিকার-বোকার পরে আছি। তুমি যদি আমাকে পাহাড়ী হরিণের মত পাহাড় থেকে পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াতে দেখতে অথবা ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ে-রাস্তায় চড়াই উতরাই করতে দেখতে, তাহলে খুব আশ্চর্য হয়ে যেতে।
আমি এখানে বেশ ভাল আছি। কারণ সমতলভূমিতে বাস করা আমার পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে; সেখানে আমার রাস্তায় পা-টি বাড়াবার যো নেই—অমনি একদল লোক আমায় দেখবে বলে ভিড় করবে!! নামযশটা সব সময়েই বড় সুখের নয়। আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ করেছে—এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায় এবং লোককে আমেরিকান কুৎসা-রটনাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে! হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিষই না ঢেকে রাখতে পার! তোমারই জয়জয়কার।
ডাক যাবার সময় হয়ে এল, তাই শেষ করলাম। তোমার স্বপ্ন সুখকর হোক, তোমার স্বাস্থ্য সুন্দর হোক এবং তোমার অশেষ কল্যাণ হোক। বাবা, মা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৪
আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
ভগ্ন স্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য একমাস দার্জিলিঙে ছিলাম। আমি এখন বেশ ভাল হয়ে গেছি। ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিঙে একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলবাসে যাচ্ছি—স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য।
আমি আগেই আপনাকে লিখেছি যে, এখানকার অবস্থা বেশ আশাজনক বলে বোধ হচ্ছে না—যদিও সমস্ত জাতটা একযোগে আমাকে সম্মান করেছে এবং আমাকে নিয়ে প্রায় পাগল হয়ে যাবার মত হয়েছিল! কোন বিষয়ে কার্যকারিতার দিকটা ভারতবর্ষে আদৌ দেখতে পাবেন না। কলিকাতার কাছাকাছি জমির দাম আবার খুব বেড়ে গেছে। আমার বর্তমান অভিপ্রায় হচ্ছে তিনটি রাজধানীতে তিনটি কেন্দ্র স্থাপন করা। ঐগুলি আমার শিক্ষকদের শিক্ষণকেন্দ্রস্বরূপ হবে—সেখান থেকেই আমি ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে চাই।
আমি আরও বছর-কয়েক বাঁচি আর নাই বাঁচি, ভারতবর্ষ ইতোমধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে।
অধ্যাপক জেম্সের একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছিলাম; তাতে তিনি অবনত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আমার মন্তব্যগুলির উপর বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। আপনিও লিখেছেন যে, ধর্মপাল এতে খুব রেগে গেছেন। ধর্মপাল অতি সজ্জন এবং আমি তাঁকে ভালবাসি। কিন্তু ভারতীয় কোন ব্যাপারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ অন্যায় হবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যেটাকে নানাবিধ কুরুচিপূর্ণ আধুনিক হিন্দুধর্ম বলা হয়, তা হচ্ছে অচল অবস্থায় পতিত বৌদ্ধধর্ম মাত্র। এটা স্পষ্ট বুঝলে হিন্দুদের পক্ষে তা বিনা আপত্তিতে ত্যাগ করা সহজ হবে। বৌদ্ধধর্মের যেটি প্রাচীনভাব—যা শ্রীবুদ্ধ নিজে প্রচার করে গেছেন, তার প্রতি এবং শ্রীবুদ্ধের প্রতি আমার গভীরতম শ্রদ্ধা। আর আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আমরা হিন্দুরা তাঁকে অবতার বলে পূজা করি। সিংহলের বৌদ্ধধর্মও তত সুবিধার নয়। সিংহলে ভ্রমণকালে আমার ভ্রান্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। সিংহলে যদি প্রাণবন্ত কেউ থাকে তো এক হিন্দুরাই। বৌদ্ধরা অনেকটা পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে—এমন কি ধর্মপাল ও তাঁর পিতার ইওরোপীয় নাম ছিল, এখন তাঁরা সেটা বদলেছেন। আজকাল বৌদ্ধেরা ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ এই শ্রেষ্ঠ উপদেশের এইমাত্র খাতির করেন যে, যেখানে-সেখানে কষাইয়ের দোকান খোলেন! এমন কি পুরোহিতরা পর্যন্ত ঐ কার্যে উৎসাহ দেন। আমি এক সময়ে ভাবতাম, আদর্শ বৌদ্ধধর্ম বর্তমানকালেও অনেক উপকার করবে। কিন্তু আমি আমার ঐ মত একেবারে ত্যাগ করেছি এবং স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কি কারণে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে তোমার প্রথমেই স্মরণ রাখা উচিত যে, ভারতবর্ষে থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের সংখ্যা নামমাত্র—নেই বললেই হয়। তারা দুচারখানা কাগজ বের করে খুব একটা হুজুগ করে দুচারজন পাশ্চাত্য-দেশবাসীকে নিজেদের মত শোনাতে পারে; কিন্তু হিন্দুদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে, এমন দুজন বৌদ্ধ বা দশজন থিওসফিষ্ট আমি তো দেখি না।
আমি আমেরিকায় এক মানুষ ছিলাম, এখানে আর এক মানুষ হয়ে গেছি। এখানে সমস্ত (হিন্দু) জাতটা আমাকে যেন তাদের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি (authority) বলে মনে করছে; আর সেখানে ছিলাম অতিনিন্দিত প্রচারক মাত্র। এখানে রাজারা আমার গাড়ী টানে—আর সেখানে আমাকে একটা ভাল হোটেলে পর্যন্ত ঢুকতে দিত না। সেইজন্য এখানে যা কিছু বলব, তাতে সমস্ত জাতটার—আমার সমস্ত স্বদেশবাসীর—মঙ্গল হওয়া আবশ্যক, তা সেগুলো দুচারজনের যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন। কপটতাকে কখনই নয়, যা কিছু খাঁটি ও সৎ, সেগুলিকে গ্রহণ করতে হবে, সেগুলির প্রতি উদারভাব পোষণ করতে হবে। থিওসফিষ্টরা আমায় খাতির ও খোসামোদ করতে চেষ্টা করেছিল, কারণ এখন আমি ভারতের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছি। আর সেইজন্য আমার কাজের দ্বারা যাতে তাঁদের আজগুবিগুলো সমর্থিত না হয় এই উদ্দেশ্যে দু-চারটে কড়া স্পষ্ট কথা বলতে হয়েছিল, আর ঐ কাজ হয়ে গেছে। এতে আমি খুব খুশী। আমি যতদূর যা দেখেছি, তাতে ভারতে ইংলিশ চার্চের যে সব পাদ্রী আছে, তাঁদের উপর বরং আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের উপর আদৌ নেই। আমি আবার তোমাকে বলছি, ভারতবর্ষ ইতোপূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে, এবং বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মের জন্য এখানকার কাজ একটু সংগঠিত করে নিয়েছি। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৫
আলমবাজার মঠ (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
তোমার প্রীতি ও উৎসাহপূর্ণ পত্রখানি আমার হৃদয়ে কত যে বলসঞ্চার করেছে, তা তোমার কল্পনারও অতীত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন মন একেবারে নৈরাশ্যে ডুবে যায়—বিশেষতঃ কোন আদর্শকে রূপ দেবার জন্য জীবনব্যাপী উদ্যমের পর যখন সাফল্যের ক্ষীণ আলোকরশ্মি দৃষ্টিগোচর হয়, ঠিক সেই সময়ে যদি আসে এক প্রচণ্ড সর্বনাশা আঘাত। দৈহিক অসুস্থতা আমি গ্রাহ্য করি না; দুঃখ হয় এইজন্য যে, আমার আদর্শগুলি কার্যে পরিণত হবার কিছুমাত্র সুযোগ পেল না। আর তুমি তো জানই, অন্তরায় হচ্ছে অর্থাভাব।
হিন্দুরা শোভাযাত্রা এবং আরও কত কিছু করছে; কিন্তু তারা টাকা দিতে পারে না। দুনিয়াতে আর্থিক সাহায্য বলতে আমি পেয়েছি শুধু ইংলণ্ডে মিস — এবং মিঃ —র কাছে। … ওখানে থাকতে আমার ধারণা ছিল যে, এক হাজার পাউণ্ড পেলেই অন্ততঃ কলিকাতার প্রধান কেন্দ্রটি স্থাপন করা যাবে; আমি এই অনুমান করেছিলাম দশ বার বছর আগেকার কলিকাতার অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু ইতোমধ্যে জিনিষের দাম তিন চার গুণ বেড়ে গেছে।
যাই হোক, কাজ আরম্ভ করা গেছে। একটি পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ী ছ-সাত শিলিঙ ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে এবং তাতেই প্রায় ২৪ জন যুবক শিক্ষালাভ করছে। স্বাস্থ্যলাভের জন্য আমাকে এক মাস দার্জিলিঙে থাকতে হয়েছিল। তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি। আর তুমি বিশ্বাস করবে কি যে, কোন ঔষধ ব্যবহার না করেও শুধু ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই এরূপ ফল পেয়েছি!! আগামী কাল আবার আর একটি শৈলনিবাসে যাচ্ছি, কারণ নীচে এখন বেজায় গরম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের ‘সমিতি’ এখনও টিকে আছে। এখানকার কাজের বিবরণী তোমাকে মাসে অন্ততঃ একবার করে পাঠাব। শুনতে পেলাম লণ্ডনের কাজ মোটেই ভাল চলছে না। প্রধানতঃ এই কারণেই আমি এখন লণ্ডনে যেতে চাই না, যদিও জুবিলী১২১ উৎসব উপলক্ষে ইংলণ্ডযাত্রী আমাদের কয়েকজন রাজা আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন; ওখানে গেলেই বেদান্ত-বিষয়ে লোকের আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেজায় খাটতে হত, আর তার ফলে শারীরিক কষ্ট আরও বেশী হত।
যাই হোক অদূর ভবিষ্যতে আমি মাসখানেকের জন্য (ওদেশে) যাচ্ছি। শুধু যদি এখানকার কাজের গোড়াপত্তন দৃঢ় হয়ে যেত, তবে আমি কত আনন্দে ও স্বাধীনভাবেই না ঘুরে বেড়াতে পারতাম!
এ পর্যন্ত তো কেবল কাজের কথা হল। এখন তোমার নিজের কথা পাড়ছি। কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্, তোমার যে অনুরাগ ভক্তি বিশ্বাস ও গুণগ্রাহিতা আছে, তা যদি কেউ পায়, তবে সে জীবনে যত পরিশ্রমই করুক না কেন, ওতেই তার শতগুণ প্রতিদান হয়। তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল হোক। আমার মাতৃভাষায় বলতে গেলে, তোমার কাজে সারা জীবন দিতে পারি।
তোমার এবং ইংলণ্ডের অন্যান্য বন্ধুদের চিঠিপত্র আমার কাছে সর্বদাই খুব আনন্দায়ক ছিল এবং ভবিষ্যতেও তা ছাড়া অন্যরূপ হবে না। মিঃ ও মিসেস হ্যামণ্ড দুখানি অতি সুন্দর ও প্রীতিপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। অধিকন্তু মিঃ হ্যামণ্ড ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় একটি চমৎকার কবিতা পাঠিয়েছেন—যদিও আমি মোটেই এ প্রশস্তির যোগ্য নই। আবার তোমায় হিমালয় থেকে পত্র লিখব; উত্তপ্ত সমভূমির চেয়ে সেখানে তুষারশ্রেণীর সামনে চিন্তা আরও স্বচ্ছ হয়ে যাবে এবং স্নায়ুগুলি আরও শান্ত হবে। মিস মূলার ইতোমধ্যেই আলমোড়ায় পৌঁছেছেন। মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার সিমলা যাচ্ছেন। তাঁরা এতদিন দার্জিলিঙে ছিলেন। দেখ বন্ধু, এইভাবেই জাগতিক ব্যাপারের পরিবর্তন ঘটছে—একমাত্র প্রভুই নির্বিকার, তিনিই প্রেমস্বরূপ। তিনি তোমার হৃদয়সিংহাসনে চির-অধিষ্ঠিত হোন—ইহাই বিবেকানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৬
আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭
প্রিয় সুধীর,
তোমার চিঠি পেয়ে ভারি আনন্দ হল। একটা জিনিষ বোধ হয় তোমাকে বলতে ভুলে গেছি—আমায় যে-সব চিঠি লিখবে, তার নকল রেখো। তা ছাড়া অন্যেরা মঠে যে-সব দরকারী চিঠি লেখে বা মঠ থেকে বিভিন্ন লোকের কাছে যে-সব পত্রাদি যায়, তাও নকল করে রাখা উচিত।
সব জিনিষটা সুচারুভাবে চলছে, ওখানকার কাজে ক্রমে উন্নতি হচ্ছে এবং কলিকাতারও তাই—এই জেনে আমি বড়ই খুশী হয়েছি।
আমি এখন বেশ ভাল আছি; শুধু পথশ্রমটা আছে—তাও দিনকয়েকের মধ্যেই যাবে। সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে বিশেষ সমাচার অবগত হইলাম। সুধীরের এক পত্র পাইলাম এবং মাষ্টার মহাশয়েরও এক পত্র পাই। নিত্যানন্দের (যোগেন চাটুয্যের) দুই পত্র দুর্ভিক্ষ স্থল হইতে পাইয়াছি।
টাকাকড়ি এখনও যেন জলে ভাসছে … যোগাড় নিশ্চিত হবে। হল, বিল্ডিং, জমি ও ফণ্ড—সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই—এবং দু-তিন মাস এক্ষণে আমি তো আর গরম দেশে যাচ্ছি না। তারপর একবার tour (ভ্রমণ) করে টাকা যোগাড় করব নিশ্চিত। এ বিধায় যদি তুমি বোধ কর যে, ঐ আট কাঠা frontage (সামনে খোলা জমি) না হয় …, তাহলে … দালালের বায়না জলে ফেলার মত দিলে ক্ষতি নাই। এ-সব বিষয় নিজে বুদ্ধি করে করবে, আমি অধিক আর কি লিখব? তাড়াতাড়িতে ভুল হওয়ার বিশেষ সম্ভব। … মাষ্টার মহাশয়কে বলিবে, তিনি যে বিষয়ে বলিয়াছেন, তাহা আমার খুব অভিমত।
গঙ্গাধরকে লিখিবে যে, যদি ভিক্ষাই সেখানে (দুর্ভিক্ষ স্থলে) দুষ্প্রাপ্য হয় তো গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া খাইবে এবং সপ্তাহে সপ্তাহে এক একটা পত্র উপেনের কাগজে (‘বসুমতী’তে) প্রকাশ করিবে। তাহাতে অন্য লোকেও সহায়তা করিতে পারে।
শশীর এক পত্রে জানিতেছি, … সে নির্ভয়ানন্দকে চায়। যদি উত্তম বিবেচনা কর, নির্ভয়ানন্দকে মান্দ্রাজে পাঠাইয়া গুপ্তকে আনাইবে। মঠের Rules & Regulations-এর (নিয়মাবলীর) ইংরেজী অনুবাদ বা বাঙলা কপি শশীকে পাঠাইবে এবং সেখানে যেন ঐ প্রকার কার্য হয়, তাহা লিখিবে।
কলিকাতায় সভা বেশ চলিতেছে শুনিয়া সুখী হইলাম। এক দুইজন না আইসে কিছুই দরকার নাই (কিছু আসে যায় না)। ক্রমে সকলেই আসিবে। সকলের সঙ্গে সহৃদয়তা প্রভৃতি রাখিবে। মিষ্ট কথা অনেক দূর যায়, নূতন লোক যাহাতে আসে, তাহার চেষ্টা করাই বিশেষ প্রয়োজন। নূতন নূতন মেম্বর চাই।
যোগেন আছে ভাল। আমি—আলমোড়াও অত্যন্ত গরম হওয়ায় ২০ মাইল দূরে এক উত্তম বাগানে আছি; অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, কিন্তু গরম। গরম কলিকাতা হইতে বিশেষ প্রভেদ কি?
জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়। এখানে হাওয়া এত শুষ্ক যে, দিনরাত্র নাক জ্বালা করছে ও জিভ যেন কাঠের চোকলা। তোমরা আর criticise (সমালোচনা) করো না; নইলে এত দিনে আমি মজা করে ঠাণ্ডা দেশে গিয়ে পড়তুম। … তুমি ও-সব মুখ্যু-ফুখ্যুদের কথা কি শোন? যেমন তুমি আমাকে কলায়ের দাল খেতে দিতে না—starch (শ্বেতসার) বলে!! আবার কি খবর—না, ভাত আর রুটি ভেজে খেলে আর starch (শ্বেতসার) থাকে না!!! অদ্ভুত বিদ্যে বাবা!! আসল কথা আমার পুরানো ধাত আসছেন। … এইটি বেশ দেখতে পাচ্ছি। এ-দেশে এখন এ-দেশী রঙচঙ ব্যামো সব। সে-দেশে সে-দেশী রঙচঙ সব! রাত্রির খাওয়াটা মনে করছি খুব light (লঘু) করব; সকালে আর দুপুরবেলা খুব খাব, রাত্রে দুধ ফল ইত্যাদি। তাই তো ওৎ করে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!!
তুমি ভয় খাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তো বাতি জ্বলল, এখনও সারা রাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার—আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা ওকেও দুরস্ত বনাচ্ছি—ভয় কি? … খুব চুটিয়ে বুক বেঁধে কাজ কর দিকি, একবার তোলপাড় করা যাক। কিমধিকমিতি।
মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে ও next meeting (আগামী সভা)-কে আমার greeting (সাদর সম্ভাষণ) দিও ও কহিও যে, যদিও আমি শরীরের সহিত উপস্থিত নহি, তথাপি আমার আত্মা সেথায়, যেথায় প্রভুর নামকীর্তন হয়। ‘যাবৎ তব কথা রাম সঞ্চরিষ্যতি মেদিনীম্’ ইত্যাদি (হনুমান)—হে রাম, যেথায় তোমার কথা হয়, সেথায় আমি হাজির। আত্মা সর্বব্যাপী কিনা! ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৮
আলমোড়া
২৯ মে, ১৮৯৭
প্রিয় শশী ডাক্তার,
তোমার পত্র এবং দু-বোতল ঔষধ যথাসময়ে পেয়েছি। কাল সন্ধ্যা হতে তোমার ঔষধ পরীক্ষা করে দেখছি। আশা করি, একটি ঔষধ অপেক্ষা দুটির মিশ্রণে বেশী ফল পাওয়া যাবে।
আমি সকাল-বিকালে ঘোড়ায় চড়ে যথেষ্ট ব্যায়াম করতে শুরু করেছি এবং তার ফলে সত্যই অনেকটা ভাল বোধ করছি। ব্যায়াম শুরু করে প্রথম সপ্তাহে শরীর এতই ভাল বোধ করিতেছিলাম যে, ছেলেবেলায় যখন কুস্তি করতাম, তারপর তেমনটি কখনও বোধ করিনি। আমার তখন সত্যই বোধ হত যে, শরীর থাকা একটা আনন্দের বিষয়। তখন শরীরের প্রতি ক্রিয়াতে আমি শক্তির পরিচয় পেতাম এবং প্রত্যেক পেশীর নড়াচড়াই আনন্দ দিত। সে উৎফুল্ল ভাব এখন অনেকটা কমে গেছে, তবু আমি নিজেকে বেশ শক্তিমান্ বোধ করি। শক্তি-পরীক্ষায় জি. জি. এবং নিরঞ্জন দুজনকেই আমি মুহূর্তে ভূমিসাৎ করতে পারতাম। দার্জিলিঙে আমার সবসময় মনে হত, আমি যেন কে আর একজন হয়ে গেছি। আর এখানে আমার মনে হয় যেন আমার কোন ব্যাধিই নেই। কেবল একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু-ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মান্দ্রাজ থেকে দার্জিলিঙ পর্যন্ত (দার্জিলিঙের প্রথম মাস পর্যন্ত) বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ-ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রির আহারের পর গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে। দিনের আহারের পর অবশ্য গরম বোধ করি না।
এখানে একটি ফলের বাগান থাকায় এখানে এসেই বরাবরের চেয়েও আমি বেশী ফল খেতে শুরু করেছি। কিন্তু এখানে এখন খোবানি ছাড়া অন্য কোন ফল পাওয়া যায় না। নৈনীতাল থেকে অন্যান্য ফল আনবার চেষ্টা করছি। এখানকার দিনগুলি যদিও তীব্র গরম, তবু তৃষ্ণা বোধ করি না। … মোটের উপর, এখানে আমার শক্তি স্ফূর্তি এবং স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য আবার ফিরে আসছে বলে অনুভব করছি। তবে খুব বেশী দুগ্ধপানের ফলে বোধ হয় অত্যন্ত চর্বি জমতে শুরু করেছে। যোগেন কি লিখছে, তা ভ্রূক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ! যোগেন বোধ হয় দু-চারদিনের মধ্যেই এখানে আসবে। আমি তার ভার নেব। ভাল কথা, আমি সহজেই ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ি—আলমোড়ায় এসে প্রথম সপ্তাহ যে অসুস্থ ছিলাম, তা হয় তো তরাই অঞ্চল দিয়ে আসার ফলেই হয়ে থাকবে! যা হোক, বর্তমানে আমি নিজেকে খুবই বলবান্ বোধ করছি। ডাক্তার, আমি যখন আজকাল তুষারবৃত পর্বতশৃঙ্গের সম্মুখে ধ্যানে বসে আবৃত্তি করি—‘ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ, প্রাপ্তস্য হি যোগাগ্নিময়ং শরীরম্।’১২২—সেই সময় যদি তুমি আমায় একবার দেখতে!
রামকৃষ্ণ মিশনের কলিকাতার সভাগুলি বেশ সাফল্য লাভ করছে জেনে খুব সুখী হয়েছি। এই মহৎ কার্যের সহায়ক যাঁরা, তাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ হোক। … অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি
প্রভুপদাশ্রিত তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩২৯
[শ্রীযুক্ত প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিত]
আলমোড়া
৩০ মে, ১৮৯৭
সুহৃদ্বরেষু,
শুনিতেছি, অপরিহার্য সাংসারিক দুঃখ আপনার উপর পড়িয়াছে। আপনি জ্ঞানবান্, দুঃখ কি করিতে পারে? তথাপি ব্যাবহারিকে বন্ধু-জন-কর্তব্যবোধে এ কথার উল্লেখ। অপিচ, ঐ সকল ক্ষণ অনেক সময় সমধিক অনুভব আনয়ন করে। কিয়ৎকালের জন্য যেন বাদল সরিয়া যায় ও সত্যসূর্যের প্রকাশ হয়। কাহারও বা অর্ধেক বন্ধন খুলিয়া যায়। সকল বন্ধন অপেক্ষা মানের বন্ধন বড় দৃঢ়—লোকের ভয় যমের ভয় অপেক্ষাও অধিক; তাও যেন একটু শ্লথ হইয়া পড়ে; মন যেন অন্ততঃ মুহূর্তের জন্য দেখিতে পায় যে, লোকের কথা—মতামত অপেক্ষা অন্তর্যামী প্রভুর কথা শুনাই ভাল। আবার মেঘ ঢাকে, এই তো মায়া! যদিও বহু দিবস যাবৎ মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পত্রাদি ব্যবহার হয় নাই, তথাপি অন্যের নিকট মহাশয়ের সকল সংবাদই প্রায় প্রাপ্ত হই। মধ্যে মহাশয় কৃপাপূর্বক এক গীতার অনুবাদ ইংলণ্ডে আমায় প্রেরণ করেন। তাহার মলাটে একছত্র ভবৎ-হস্তলিপি মাত্র ছিল। শুনিলাম, তাহার উত্তরপত্রে অতি অল্প কথা থাকায় মহাশয়ের মনে—আপনার প্রতি আমার অনুরাগের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইয়াছে।
উক্ত সন্দেহ অমূলক জানিবেন। অল্প কথা লিখিবার কারণ এই যে, চারি-পাঁচ বৎসরের মধ্যে ইংরেজী-গীতার মলাটে ঐ একছত্র মাত্র আপনার হস্তলিপি দেখিলাম। তাহাতে বোধ হইল যে, আপনার যখন অধিক লিখিবার অবকাশ নাই, তখন পড়িবার অবকাশ কি হইবে?
দ্বিতীয়ত শুনিলাম, গৌরচর্মবিশিষ্ট হিন্দুধর্ম-প্রচারকেরই আপনি বন্ধু, দেশী নচ্ছার কালা আদমী আপনার নিকট হেয়, সে ভয়ও ছিল। তৃতীয়তঃ আমি ম্লেচ্ছ শূদ্র ইত্যাদি, যা-তা খাই, যার-তার সঙ্গে খাই—প্রকাশ্যে সেখানে এবং এখানে। তা ছাড়া মতেরও বহু বিকৃতি উপস্থিত—এক নির্গুণ ব্রহ্ম বেশ বুঝিতে পারি, আর তারই ব্যক্তিবিশেষে বিশেষ প্রকাশ দেখিতে পাইতেছি—ঐ-সকল ব্যক্তিবিশেষের নাম ‘ঈশ্বর’ যদি হয় তো বেশ বুঝিতে পারি—তদ্ভিন্ন কাল্পনিক জগৎকর্তা ইত্যাদি হাস্যকর প্রবন্ধে বুদ্ধি যায় না।
ঐ প্রকার ‘ঈশ্বর’ জীবনে দেখিয়াছি এবং তাঁহারই আদেশে চলিতেছি। স্মৃতি-পুরাণাদি সামান্যবুদ্ধি মনুষ্যের রচনা—ভ্রম, প্রমাদ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তাহার যেটুকু উদার ও প্রীতিপূর্ণ, তাহাই গ্রাহ্য, অপরাংশ ত্যাজ্য। উপনিষদ্ ও গীতা যথার্থ শাস্ত্র—রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীরাদিই যথার্থ অবতার; কারণ ইঁহাদের হৃদয় আকাশের ন্যায় অনন্ত ছিল—সকলের উপর রামকৃষ্ণ; রামানুজ-শঙ্করাদি সঙ্কীর্ণ-হৃদয় পণ্ডিতজী মাত্র। সে প্রীতি নাই, পরের দুঃখে তাঁহাদের হৃদয় কাঁদে নাই—শুষ্ক পাণ্ডিত্যই—আর আপনি তাড়াতাড়ি মুক্ত হইব!! তা কি হয়, মহাশয়? কখনও হয়েছে, না হবে? ‘আমি’র লেশমাত্র থাকতে কি কিছু হবে?
অপর এক মহা বিপ্রতিপত্তি—আমার দিন দিন দৃঢ় ধারণা [হইতেছে] এই যে, জাতি-বুদ্ধিই মহাভেদকারী ও মায়ার মূল—জন্মগত বা গুণগত সর্বপ্রকার জাতিই বন্ধন। কোন কোন বন্ধু বলেন—তা মনে মনে থাক—বাহিরে, ব্যাবহারিকে, জাতি-আদি রাখিতে হইবে বৈকি। … মনে মনে অভেদবুদ্ধি (‘পেটে পেটে’ যার নাম বুঝি), আর বাহিরে পিশাচ-নৃত্য, অত্যাচার, উৎপীড়ন—গরীবের যম; আর চণ্ডালও যদি বড় মানুষ হয়, তিনি ধর্মের রক্ষক!!!
তাতে আমি পড়ে-শুনে দেখছি যে, ধর্মকর্ম শূদ্রের জন্য নহে; সে যদি খাওয়া-দাওয়া বিচার বা বিদেশগমনাদি বিচার করে তো তাতে কোন ফল নাই, বৃথা পরিশ্রম মাত্র। আমি শূদ্র ও ম্লেচ্ছ—আমার আর ও-সব হাঙ্গামে কাজ কি? আমার ম্লেচ্ছের অন্নে বা কি, আর হাড়ীর অন্নে বা কি? আর জাতি ইত্যাদি উন্মত্ততা—যাজকদের লিখিত গ্রন্থেই পাওয়া যায়, ঈশ্বর-প্রণীত গ্রন্থে নাই। যাজকদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাহারাই ভোগ করুন, ঈশ্বরের বাণী আমি অনুসরণ করি, তাহাতেই আমার কল্যাণ হইবে।
আর এক কথা বুঝেছি যে, পরোপকারই ধর্ম, বাকী যাগযজ্ঞ সব পাগলাম—নিজের মুক্তি-ইচ্ছাও অন্যায়। যে পরের জন্য সব দিয়েছে, সে-ই মুক্ত হয়, আর যারা ‘আমার মুক্তি, আমার মুক্তি’ করে দিনরাত মাথা ভাবায়, তাহারা ‘ইতো নষ্টস্ততো ভ্রষ্টঃ’ হয়ে বেড়ায়, তাহাও অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। এই পাঁচ রকম ভেবে মহাশয়কে পত্রাদি লিখিতে ভরসা হয় নাই।
এ সব সত্ত্বেও যদি আপনার প্রীতি আমার উপর থাকে, বড়ই আনন্দের বিষয় বোধ করিব। ইতি
দাস
বিবেকানন্দঃ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩০
আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭
প্রিয়—,
তুমি বেদ সম্বন্ধে যে আপত্তিগুলি প্রদর্শন করেছ, সেগুলি যথার্থ বলে স্বীকার করতে পারা যেত, যদি ‘বেদ’ শব্দে কেবল সংহিতা বোঝাত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সর্ববাদিসম্মত মতানুসারে সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্ এই তিনটির সমষ্টিই বেদ! এদের মধ্যে প্রথম দুটিকে কর্মকাণ্ড বলে এখন একরকম তুলে দেওয়া হয়েছে। কেবল উপনিষদকেই আমাদের সকল দার্শনিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতারা গ্রহণ করেছেন।
কেবল সংহিতা-অংশটিই বেদ, এ মত অতি আধুনিক এবং স্বর্গীয় স্বামী দয়ানন্দই এই মতের প্রথম প্রবর্তক! প্রাচীন হিন্দুসমাজের ভেতর এই মতের প্রভাব কিছুমাত্র বিস্তৃত হয়নি।
স্বামী দয়ানন্দের এই মত অবলম্বন করবার কারণ এই যে, তিনি, ভেবেছিলেন, সংহিতার নূতন ধরনের ব্যাখ্যা করে তিনি একটি পূর্বাপরসঙ্গত মতবাদের সৃষ্টি করবেন, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা-প্রণালীতে গোল সমভাবেই থেকে গেল; শুধু এইটুকু হল যে, তিনি সংহিতার ভেতর যে অসামঞ্জস্য নিবারণের চেষ্টা করলেন, সেই অসামঞ্জস্য—সেই গোলযোগ ‘ব্রাহ্মণে’র উপর গিয়ে পড়ল। আর তাঁর প্রক্ষিপ্তবাদ ও অন্যান্য ব্যাখ্যা-প্রণালী সত্ত্বেও এখনও এমন অনেক স্থল আছে, যার ভেতর গোল তখনও যেমন, এখনও তেমনি রয়েছে।
যদি সংহিতার উপর ভিত্তি করে পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ধর্মপ্রণালী গঠন করা সম্ভব হয়, তবে উপনিষদকে ভিত্তি করে যে আরও অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ ধর্ম স্থাপন করা যেতে পারে, এ-কথা সহস্রগুণে বেশী নিশ্চিত। অধিকন্তু এ পক্ষে সমগ্র জাতির পূর্বপ্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যেতে হয় না। এ পক্ষে প্রাচীন সকল আচার্যই তোমার পক্ষে থাকবেন, আর নূতন নূতন পথে অগ্রগতিরও যথেষ্ট অবকাশ থাকবে।
গীতা নিশ্চয়ই এতদিনে হিন্দুধর্মের বাইবেল-স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং উহা সম্পূর্ণরূপেই ঐ সম্মানের উপযুক্ত; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মূল চরিত্র বর্তমানে এতটা কুয়াশায় ঢেকে আছে যে, তা থেকে জীবনপ্রদ উদ্দীপনা লাভ করা বর্তমান কালে অসম্ভব। বিশেষতঃ বর্তমান যুগে নূতন নূতন চিন্তাপ্রণালী ও নূতন ভাবে জীবনযাত্রা-নির্বাহের প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। আশা করি, আমার এই ক্ষুদ্র পত্র তোমায় আমার প্রদর্শিত পথে চিন্তার সাহায্য করবে। আমার শুভার্শীবাদ জানবে। ইতি
তোমারই
বিবেকানন্দ
[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
অবগমং কুশলং তত্রাত্যানাং বার্তাঞ্চ সবিশেষাং মঠস্য তব পত্রিকায়াম্। মমাপি বিশেষোঽস্তি শরীরস্য; সবিশেষঃ জ্ঞাতব্যঃ ভিষক্প্রবরস্য শশিভূষণস্য সকাশাৎ। ব্রহ্মানন্দেন সংস্কৃতয়া এব রীত্যা চলত্বধুনা শিক্ষা; যদি পশ্চাৎ পরিবর্তনমর্হে তদপি কারয়েৎ। সর্বেষাং সম্মতিং গৃহীত্বা তু করণীয়মিতি ন বিস্মর্তব্যম্।
অহমধুনা আলমোড়ানগরস্য কিঞ্চিদুত্তরং কস্যচিদ্ বণিজ উপবনোপদেশে নিবসামি। সম্মুখে হিমশিখরাণি হিমালয়স্য প্রতিফলিতদিবাকরকরৈঃ পিণ্ডীকৃতরজতানীব ভান্তি প্রীণয়ন্তি চ। অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীরম্। যোগানন্দঃ খলু সমধিকমস্বস্থ ইতি শৃণোমি আমন্ত্রয়ামি তমাগন্তুমত্রৈব। বিভেত্যসৌ পুনঃ পার্বত্যাৎ জলাৎ বায়োশ্চ। ‘উষিত্বা কতিপয়ানি দিবসানি অত্রোপবনে যদি ন তাবদ্ বিশেষঃ ব্যাধেঃ গচ্ছ ত্বং কলিকাতায়াম্’ ইত্যহমদ্য তমলিখম্। যথাভিরুচি করিষ্যতি। অচ্যুতানন্দঃ প্রতিদিনং সায়াহ্ণে আলমোড়ানগর্যাং গীতাদিশাস্ত্রপাঠং জনানাহূয় করোতি। বহূনাং নগরবাসিনাং স্কন্ধাবারস্থানাং সৈন্যানাঞ্চ সমাগমোঽস্তি তত্র প্রত্যহম্। সর্বানসৌ প্রীণাতি চেতি শৃণোমি।
‘যাবানর্থঃ ইত্যাদি শ্লোকস্য যো বঙ্গার্থঃ ত্বয়া লিখিতঃ নাসৌ মন্মতে সমীচীনঃ। সতি জলে প্লাবিতে উদপানে নাস্তি অর্থঃ প্রয়োজনম্’ ইতি অস্যার্থঃ—বিষমোঽয়ম্ উপন্যাসঃ, কিং সংপ্লুতোদকে সতি জীবানাং তৃষ্ণা বিলুপ্তা ভবতি? যদ্যেবং ভবেৎ প্রাকৃতিকো নিয়মঃ জলপ্লাবিতায়াং ভূমৌ জলপানং নিরর্থকং—ক্বচিদপি বায়ুমার্গেণ অথবা অন্যেন কেনাপি গূঢ়েনোপায়েন জীবানাং তৃষ্ণানিবারণং স্যাৎ, তদাঽসৌ অপূর্বং অর্থঃ সার্থকঃ ভবিতুমর্হেৎ। নান্যথা। শাঙ্কর এবাবলম্বনীয়ঃ।
ইয়মপি [ব্যাখ্যা] ভবিতুমর্হতি—সর্বতঃ সংপ্লুতোদকায়ামপি ভূমৌ যাবানুদপানে অর্থঃ তৃষ্ণাতুরাণাম্ (অল্পজলমলং ভবেদিত্যর্থঃ) ‘আস্তাং তাবদ্ জলরাশিঃ, মম প্রয়োজনং স্বল্পেঽপি জলে সিধ্যতি’ এবং বিজানতঃ ব্রাহ্মণস্য সর্বেষু বেদেষু অর্থঃ প্রয়োজনম্। যথা সংপ্লুতোদকে পানমাত্রং প্রয়োজনম্ তথা সর্বেষু বেদেষু জ্ঞানমাত্রং প্রয়োজনম্।
ইয়মপি ব্যাখ্যা অধিকতরা সন্নিধিমাপন্না গ্রন্থকারাভিপ্রেতা চ। উপপ্লাবিতায়ামপি ভূমৌ পানায় উপাদেয়ং পানায় হিতং জলমেব অন্বিষ্যন্তি লোকাঃ নানাৎ। নানাবিধানি জলানি সন্তি ভিন্নগুণ-ধর্মাণি উপপ্লাবিতায়া অপি ভূমেস্তারতম্যাৎ। এবং বিজানন্ ব্রাহ্মণো্ঽপি বিবিধজ্ঞানোপপ্লাবিতে বেদাখ্যে শব্দসমুদ্রে সংসারতৃষ্ণানিবারণার্থং তদেব গৃহ্নীয়াৎ যদলং ভবতি নিঃশ্রেয়সায়। ব্রহ্মজ্ঞানং হি তৎ।
ইতি শং সাশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য
[বঙ্গানুবাদ]
কল্যাণবরেষু,
তোমার চিঠিতে মঠের সবিশেষ বার্তা ও তত্রত্য সকলের কুশল অবগত হলাম। আমারও শরীরের কিছু উন্নতি হয়েছে। ভিষক্প্রবর শশিভূষণের কাছে সবিশেষ জানবে। ব্রহ্মানন্দ এখন সংশোধিত প্রস্তাবমতই শিক্ষাকার্য চালিয়ে যাক, পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও যেন করে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, সকলের সম্মতি নিয়েই তা করতে হবে।
আমি বর্তমানে আলমোড়া থেকে কিঞ্চিৎ উত্তরে একজন ব্যবসায়ীর একটি বাগান- বাড়ীতে বাস করছি। আমার সম্মুখে তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়ের চূড়াগুলি প্রতিফলিত সূর্যালোকে রজতস্তূপের মত দেখাচ্ছে এবং আনন্দ প্রদান করছে। মুক্তবায়ু-সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু শুনতে পেলাম যে, যোগানন্দ খুব অসুস্থ। তাকে এখানে আসবার জন্য আমন্ত্রণ করছি। সে অবশ্য পাহাড়ে জলহাওয়ায় ভয় পায়। আজ তাকে লিখলাম, ‘এই বাগানে কিছুদিন থেকে দেখ—যদি অসুখের কোন উপশম বোধ না কর, তবে কলিকাতা ফিরে যেও।’—এখন সে যেমন ভাল মনে করে, তাই করবে। আলমোড়া শহরে অচ্যুতানন্দ প্রতি সন্ধ্যায় বহুলোক একত্র করে তাদের সম্মুখে গীতা এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে। শহরের অনেক অধিবাসী, এমন কি সৈন্যাবাস থেকে সৈন্যেরা পর্যন্ত প্রতিদিন আসে; আর শুনছি, তারা আলোচনা বিশেষ উপভোগ করে।
‘যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ স্বংপ্লুতোদকে’ (গীতা, ২।৪৬)—ইত্যাদি শ্লোকের তুমি যে বঙ্গার্থ লিখেছ, তা আমার মতে সমীচীন নয়। তুমি এই অর্থ দিয়েছ—‘যখন দেশ জলপ্লাবিত হয়, তখন পানের জন্য পুষ্করিণী প্রভৃতির প্রয়োজন নাই’—এটা অদ্ভুত কল্পনা। জলপ্লাবন হলে লোকের তৃষ্ণা বিলুপ্ত হয়ে যায় নাকি? প্রাকৃতিক নিয়ম যদি এরূপ হয় যে, কোন স্থান জলপ্লাবিত হবার পর জল পান নিরর্থক হয়ে যায়, আর বায়ু অথবা কোন অদৃশ্য উপায়ে স্বতই তৃষ্ণা দূরীভূত হয়ে যায়—তবেই ঐ অদ্ভুত ব্যাখ্যা সমীচীন হতে পারে, নতুবা নয়। শঙ্করের ব্যাখ্যাই অনুসরণীয়।
অথবা এ ভাবেও শ্লোকটির ব্যাখ্যা হতে পারেঃ সমস্ত দেশ বন্যাপ্লাবিত হলে তৃষ্ণাতুরের নিকট ক্ষুদ্র জলাশয়ের যতটুকু প্রয়োজন (অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ পানীয় জলই তৃষ্ণার্তের পক্ষে যথেষ্ট)—সে যেমন বলে, ‘বিরাট জলরাশি থাকুক বা না থাকুক, সামান্য একটু পানীয় জলই আমার পক্ষে যথেষ্ট’—জ্ঞানী ব্রাহ্মণের পক্ষে সমগ্র বেদগ্রন্থেও ততটুকুই প্রয়োজন। সর্বব্যাপী বন্যার প্রয়োজন যেমন তৃষ্ণানিবারণ মাত্র, তেমনি সমগ্র বেদের প্রয়োজন কেবল জ্ঞান।
এই ব্যাখ্যাটিও অধিকতর স্পষ্ট ও গ্রন্থকারের অভিপ্রায়ানুরূপ—সমস্ত স্থান জলপ্লাবিত হলে মানুষ কেবল পানের জন্য আহরণীয়, পানের যোগ্য জলেরই অনুসন্ধান করে, অন্য জলের নয়। (কারণ) জলপ্লাবন হলেও মৃত্তিকার তারতম্যানুসারে বিভিন্ন গুণের ও বিভিন্ন ধর্মের জল দেখতে পাওয়া যায়। কৌশলী ব্রাহ্মণও সেরূপ জ্ঞানের শতধারাপ্লাবিত ‘বেদ’ নামে খ্যাত বিরাট শব্দসমুদ্র হতে সেই অংশটুকু আহরণ করবেন, যাতে সংসারের দারুণ তৃষ্ণা দূর হয় এবং যা মুক্তি দান করবার শক্তি ধারণ করে। কেবল ব্রহ্মজ্ঞানই তা করতে সক্ষম। আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩২
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
আলমোড়া
২ জুন, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
আমার প্রতিশ্রুত খোশগল্পভরা বড় চিঠিখানি শুরু করছি—আকারে তা সত্যি বড় হয়ে উঠুক, এই সদিচ্ছা নিয়ে। তা যদি না হয়ে ওঠে, সে তোমার কর্মফল। তোমার স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খুব ভাল যাচ্ছে। আমার শরীর খুবই খারাপ; আজকাল কিছুটা উন্নতি বোধ করছি—আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠব।
লণ্ডনের কাজকর্ম কি রকম চলছে? আমার ভয় হচ্ছে, বুঝি বা সেটা একেবারে ভেঙেচুরে যায়। তুমি মাঝে মাঝে লণ্ডন যাও তো? স্টার্ডির একটি শিশুসন্তান হয়েছে, নয় কি?
ভারতে সমতলভূমিতে এখন দাবদাহ। তা সহ্য করতে না পেরে এখানে এই পাহাড়ে এসেছি—জায়গাটা সমতলের চেয়ে কিছু ঠাণ্ডা।
আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি—এর চারিদিকে বহু ক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য। পরশু রাত্রে একটি চিতাবাঘ এই বাগানে এসে পাল থেকে একটি ছাগল নিয়ে গেছে। চাকরদের প্রাণপণ চেঁচামেচি ও পাহারাদার তিব্বতী কুকুরগুলির ঘেউ ঘেউ শব্দ মিলে ভয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা হবার মত অবস্থা ঘটেছিল। আমি এখানে আসা অবধি রোজ রাত্রে এই কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। চিতাবাঘটি তাই সুযোগ বুঝে একটি বেশ ভাল আহার্য জুটিয়ে নিল, সম্ভবতঃ অনেক সপ্তাহ এ-রকম জোটেনি। এতে তার প্রভূত কল্যাণ হোক!
মিস মূলারকে তোমার মনে পড়ে কি? কয়েকদিন থাকবার জন্য তিনি এখানে এসেছেন, কিন্তু চিতাবাঘের বৃত্তান্তটি শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে যে, লণ্ডনে পাকা চামড়ার চাহিদা খুব বেশী, আর অন্য কিছুর চেয়ে এই চাহিদাই আমাদের চিতা ও বাঘগুলির মধ্যে ব্যাপক ধ্বংস নিয়ে এসেছে।
তোমাকে লিখতে লিখতে আমার সামনে সারি সারি দিগন্তবিস্তৃত বরফের চূড়াগুলির উপর অপরাহ্নের রক্তিমাভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সেগুলি এখান থেকে সোজাসুজি কুড়ি মাইল—আর আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথে চল্লিশ মাইল।
আশা করি কাউণ্টেস-এর কাগজে তোমার তর্জমাগুলি সমাদরে গৃহীত হয়েছে। এই জুবিলী-উৎসবের মরসুমে আমাদের দেশীয় কয়েকজন রাজার সঙ্গে আমার ইংলণ্ড যাবার খুব ইচ্ছা ছিল এবং সুযোগও ঘটেছিল, কিন্তু আমার চিকিৎসকেরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইওরোপ যাওয়া মানে কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি মেলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়া-কাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে। যা হোক, আমি এখন বহুপ্রত্যাশিত বিশ্রাম উপভোগ করছি, আশা করি—এতে আমার পক্ষে ভালই হবে।
তোমার কাজ কিরকম চলছে? আনন্দে না দুঃখে? তোমার কি ইচ্ছা হয় না বেশ কয়েক বছর কোন কাজকর্ম না করে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে? নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা—আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি। মিঃ গুডউইন আমার সঙ্গে আছেন। ভারতীয় পোষাকে তুমি যদি তাকে দেখতে! খুব শীঘ্রই মস্তক মুণ্ডন করিয়ে তাকে একটি পূর্ণ-বিকশিত সন্ন্যাসীতে পরিণত করতে যাচ্ছি।
তুমি এখনও কিছু কিছু যোগাভ্যাস করছ নাকি? তাতে কিছু উপকার পেয়েছ কি? খবর পেলাম—মিঃ মার্টিন মারা গিয়েছেন। মিসেস মার্টিন কেমন আছেন—তাঁকে মাঝে মাঝে দেখতে যাও তো?
মিস নোব্ল্কে তুমি চেন কি? তাঁকে তুমি কখনও দেখেছ? এখানেই আমার চিঠি শেষ করতে হচ্ছে, কারণ বিরাট এক ধূলির ঝড় আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, লেখা আর সম্ভব হচ্ছে না। এ-সবই তোমার কর্মফল, স্নেহের মেরী, কারণ আমার তো ইচ্ছা ছিল—তোমাকে কত না অদ্ভুত ঘটনা লিখব ও মজার গল্প বলব; এখন সেগুলি আমাকে ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতে হবে, আর তোমাকেও অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ইতি
সতত প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৩
আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্,
… আমি নিজে তো বেশ সন্তুষ্ট আছি। আমি আমার স্বদেশবাসীদের অনেককে জাগিয়েছি; আর আমি চেয়েছিলাম তাই। জগৎ আপন ধারায় চলুক এবং কর্মের গতি অপ্রতিরুদ্ধ হোক। এ জগতে আমার আর কোন বন্ধন নেই। সংসারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় হয়েছে, এর সবখানিই স্বার্থপ্রণোদিত—স্বার্থের জন্য জীবন, স্বার্থের জন্য প্রেম, স্বার্থের জন্য মান, সবই স্বার্থের জন্য। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করি এবং দেখতে পাই, আমি এমন কোন কাজ করিনি যা স্বার্থের জন্য—এমন কি আমার কোন অপকর্মও স্বার্থপ্রণোদিত নয়; সুতরাং আমি সন্তুষ্ট আছি। অবশ্য আমার এমন কিছু মনে হয় না যে, আমি কোন বিশেষ ভাল বা মহৎ কাজ করেছি; কিন্তু জগৎটা বড়ই তুচ্ছ, সংসার বড়ই জঘন্য এবং জীবনটা এতই হীন যে, এই ভেবে আমি অবাক হই, মনে মনে হাসি যে, যুক্তিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কেমন করে এই স্বার্থের—এই হীন ও জঘন্য পুরস্কারের পেছনে ছুটতে পারে।
এই হল খাঁটি কথা। আমরা একটা বেড়াজালে পড়ে গেছি এবং যত শীঘ্র কেউ বেরিয়ে যেতে পারে, ততই মঙ্গল। আমি সত্যের সাক্ষাৎ পেয়েছি; এখন দেহটা জোয়ার-ভাটায় ভেসে চলুক—কে মাথা ঘামায়?
আমি এখন যেখানে আছি, সেটি পাহাড়ের উপর এক সুন্দর বাগান। উত্তরে প্রায় সমস্ত দিক্চক্রবাল জুড়ে স্তরে স্তরে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গাবলী আর নিবিড় বনরাজি। এখানে তেমন শীত নেই, গরমও বেশী নয়। সকাল ও সন্ধ্যাগুলি বড়ই মনোরম। সারা গ্রীষ্মটা আমার এখানে থাকা উচিত; বর্ষা শুরু হলে সমতলে নেমে গিয়ে কাজ করবার ইচ্ছা।
লোকালয় থেকে দূরে—নিভৃতে নীরবে পুঁথিপত্র নিয়ে পড়ে থাকার সংস্কার নিয়েই আমি জন্মেছি, কিন্তু মায়ের ইচ্ছা অন্যরূপ; তবু সংস্কারের অনুবৃত্তি চলেছে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৪
[জনৈক আমেরিকান ভক্তকে লিখিত]
আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭
আমার জন্য তোমাদের এত চিন্তিত হবার কিছুই নেই। আমার দেহ নানাপ্রকার রোগে বার বার আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেই কাল্পনিক পক্ষীবিশেষের (Phoenix) মত আমি আবার বার বার আরোগ্য লাভও করছি। আমার শরীর দৃঢ়বদ্ধ বলে আমি যেমন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করতে পারি, তেমনি আবার অতিরিক্ত শক্তি আমার দেহে রোগ নিয়ে আসে। সব বিষয়েই আমি চরমপন্থী—এমন কি আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তাই; হয় আমি লৌহদৃঢ় বৃষের মত অদম্য বলশালী, নতুবা একেবারে ভগ্নদেহ … ।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই এই রোগের সৃষ্টি হয়েছিল—বিশ্রাম নেওয়ার ফলে সে রোগ প্রায় দূর হয়েছে। দার্জিলিঙে থাকতে আমি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছিলাম; কিন্তু এখন আলমোড়াতে এসে আর সব বিষয়ে সুস্থ বোধ করলেও অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছি, এবং তা সারাবার জন্য ‘Christian Science’ (নিজের বিশ্বাসবলে রোগ সারানর) মত অনুযায়ী বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিঙে শুধু মানসিক চিকিৎসা-সহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম। আর এখানে আমার নিত্যকর্ম হচ্ছে—যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করা, পাহাড় চড়াই করা, বহুদূর পর্যন্ত ঘোড়ায় দৌড়ান এবং তারপর আহার ও বিশ্রাম। এখন আমি আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছি এবং শক্তিও বেশ পাচ্ছি। এর পর যখন দেখা হবে, তখন দেখতে পাবে—আমার চেহারা কুস্তিগিরের মত।
তুমি কেমন আছ এবং কি করছ, মিসেস-এর সময় কেমন কাটছে জানিও। ব্যাঙ্কের জমা কিছু কিছু বাড়াচ্ছ তো? আমার জন্য হলেও তা তোমাকে করতে হবে। যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে—কেমন পারবে তো? ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৪ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
চারুর যে পত্র তুমি পাঠাইয়াছ, তাহার বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। মহারাণীকে যে Address (মানপত্র) দেওয়া হইবে, তাহাতে এই কথাগুলি থাকা উচিতঃ
১| অতিরঞ্জিত না হয় অর্থাৎ ‘তুমি ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ ইত্যাদি nonsense (বাজে কথা), যাহা আমাদের native (নেটিভ)-এর স্বভাব।
২| তাঁহার রাজত্বকালে সকল ধর্মের প্রতিপালন হওয়ার জন্য ভারতবর্ষে ও ইংলণ্ডে আমরা নির্ভয়ে আমাদের বেদান্ত মত প্রচার করিতে সক্ষম হইয়াছি।
৩| তাঁহার দরিদ্র ভারতবাসীর প্রতি দয়া, যথা—দুর্ভিক্ষে স্বয়ং দান দ্বারা ইংরেজদিগকে অপূর্ব দানে উৎসাহিত করা।
৪| তাঁহার দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা ও তাঁহার রাজ্যে উত্তরোত্তর প্রজাদের সুখসমৃদ্ধি প্রার্থনা।
শুদ্ধ ইংরেজীতে লিখিয়া আমায় আলমোড়ার ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি সই করিয়া সিমলায় পাঠাইব। কাহাকে পাঠাইতে হইবে সিমলায়—লিখিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—মঠ হইতে শুদ্ধানন্দ আমায় সাপ্তাহিক পত্র লিখে, তাহার একটা নকল যেন মঠে রাখে। ইতি
—বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৫ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার সবিশেষ সংবাদ পাইতেছি ও উত্তরোত্তর আনন্দিত হইতেছি। ঐরূপ কার্যের দ্বারাই জগৎ কিনিতে পারা যায়। মতমতান্তরে আসে যায় কি? সাবাস্—তুমি আমার লক্ষ লক্ষ আলিঙ্গন আশীর্বাদাদি জানিবে। কর্ম কর, কর্ম, হাম আওর কুছ্ নহি মাঙ্গতে হেঁ—কর্ম কর্ম কর্ম even unto death (মৃত্যু পর্যন্ত)। দুর্বলগুলোর কর্মবীর মহাবীর হতে হবে—টাকার জন্য ভয় নাই, টাকা উড়ে আসবে। টাকা, যাদের লইবে, তারা নিজের নামে দিক্, হানি কি? কার নাম—কিসের নাম? কে নাম চায়? দূর কর নামে। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতলেও যায়, অহোভাগ্য-মহোভাগ্যম্। … ভ্যালা মোর ভাইরে, অ্যায়সাই চলো। It is the heart, that conquers, not the brain (হৃদয়, শুধু হৃদয়ই জয়ী হয়ে থাকে—মস্তিষ্ক নয়)। পুঁথিপাতড়া বিদ্যেসিদ্যে, যোগ ধ্যান জ্ঞান—প্রেমের কাছে সব ধূলসমান—প্রেমেই অণিমাদি সিদ্ধি, প্রেমেই ভক্তি, প্রেমেই জ্ঞান, প্রেমেই মুক্তি। এই তো পুজো, নরনারী-শরীরধারী প্রভুর পুজো, আর যা কিছু ‘নেদং যদিদমুপাসতে’। এই তো আরম্ভ ঐরূপে আমরা ভারতবর্ষ—পৃথিবী ছেয়ে ফেলব না? তবে কি প্রভুর মাহাত্ম্য!
লোকে দেখুক, আমাদের প্রভুর পাদস্পর্শে লোকে দেবত্ব পায় কিনা! এরই নাম জীবন্মুক্তি, যখন সমস্ত ‘আমি’—স্বার্থ চলে গেছে।
ওয়া বাহাদুর, গুরুকী ফতে! ক্রমে বিস্তারের চেষ্টা কর। তুমি যদি পার তো কলিকাতায় এসে আরও কতকগুলো ছেলেপুলে নিয়ে একটা ফণ্ড তুলে তাদের দু-একজনকে নিয়ে কাজে লাগিয়ে এক জায়গায়—আবার এক জায়গায় যাও! ঐ রকমে বিস্তার কর আর তাদের তুমি inspect (তত্ত্বাবধান) করে বেড়াও—ক্রমে দেখবে যে, ঐ কার্যটা permanent (স্থায়ী) হবে—সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও বিদ্যাপ্রচার আপনা-আপনিই হবে। আমিই কলিকাতাতে বিশেষ লিখেছি। ঐ রকম কাজ করলেই আমি মাথায় করে নাচি—ওয়া বাহাদুর! ক্রমে দেখবে এক-একটা ডিষ্ট্রিক্ট (জেলা) এক-একটা centre (কেন্দ্র) হবে—permanent (স্থায়ী)। আমি শীঘ্রই plain-এ (সমতলে) নাবছি। বীর আমি, যুদ্ধক্ষেত্রে মরব, এখানে মেয়েমানুষের মত বসে থাকা কি আমার সাজে? ইতি
তোমাদের চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৭
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
… তোমাকে সরলভাবে জানাচ্ছি যে, তোমার প্রত্যেকটি কথা আমার কাছে মূল্যবান, তোমার প্রত্যেকখানি চিঠি আমাকে খুবই আনন্দ দেয়। যখনই ইচ্ছা ও সুযোগ হবে, তখনই তুমি নিঃসঙ্কোচে লিখো এবং জেনো যে, তোমার একটি কথাও আমি ভুল বুঝব না, একটি কথাও উপেক্ষা করব না। অনেক কাল কাজের কোন খবর পাইনি। তুমি আমায় কিছু জানাতে পার কি? ভারতে আমাকে নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, আমি এখানে কোন সাহায্যের আশা রাখি না। এরা এত দরিদ্র!
তবে আমি নিজেও যেভাবে শিক্ষালাভ করেছিলাম, ঠিক সেইভাবেই গাছের তলা আশ্রয় করে এবং কোনরকমে অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কাজের ধারাও অনেকটা বদলেছে। আমার কয়েকটি ছেলেকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অঞ্চলে পাঠিয়েছি। এতে যাদুমন্ত্রের মত কাজ হয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আর আমার চিরকালের ধারণাও ছিল তাই যে, হৃদয়—শুধু হৃদয়েরই ভেতর দিয়ে সকলের মর্মস্থল স্পর্শ করতে পারা যায়। সুতরাং বর্তমান পরিকল্পনা এই যে, বহু যুবককে গড়ে তুলতে হবে—(উচ্চশ্রেণীকে নিয়েই আরম্ভ করব, নিম্নশ্রেণীকে নিয়ে নয়; ওদের জন্য আমায় একটু অপেক্ষা করতে হবে)—এবং কোন একটি জেলায় তাদের জনকয়েককে পাঠিয়ে দিয়ে আমার প্রথম অভিযান শুরু করব। ধর্মরাজ্যের এই অগ্রগামী কর্মিগণ যখন পথ পরিষ্কার করে ফেলবে, তখন তত্ত্ব ও দর্শন বলার সময় আসবে।
জনকয়েক ছেলে ইতোমধ্যেই শিক্ষা পাচ্ছে; কিন্তু কাজের জন্য যে জীর্ণ আশ্রয়টি১২৩ আমরা পেয়েছিলাম, গত ভূমিকম্পে তা ভেঙে গেছে; তবে বাঁচোয়া একটু যে, এটা ভাড়া-বাড়ী ছিল। যাক, ভাববার কিছু নেই; বিপত্তি ও নিরাশ্রয়তার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের সম্বল শুধু মুণ্ডিত মস্তক, ছেঁড়া কাপড় ও অনিশ্চিত আহার। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবেও নিশ্চয়; কারণ আমরা মনে-প্রাণে এই কাজে লেগেছি।
এক হিসাবে এটা সত্য যে, এদেশের লোকের ত্যাগ করবার কিছু নেই বললেই চলে, তবু ত্যাগ আমাদের মজ্জাগত। যে-সব ছেলেরা শিক্ষা পাচ্ছে, তাদের একজন একটি জেলার ভারপ্রাপ্ত একজিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার (Executive Engineer) ছিল। ভারতে এটি একটি উচ্চ পদ। সে খড়কুটোর মত ঐ পদ ত্যাগ করেছে। … আমার অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার শরীর পূর্বাপেক্ষা ভাল আছে শুনিয়া সুখী হইলাম। যোগেন ভায়ার কথাবার্তা? তিনি সঠিকে কন না, এজন্য সে-সকল শুনে কোন চিন্তা করিও না। আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই, আর রাত্রে উঠিয়া প্রস্রাব বন্ধ। … কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হল বুঝতে পারলাম না—কাজেই বন্ধ। আম খুব খাওয়া যাচ্ছে। ঘোড়াচড়াটা বেজায় রপ্ত হচ্ছে—কুড়ি-ত্রিশ মাইল একনাগাড়ে দৌড়ে গিয়েও কিছুমাত্র বেদনা বা exhaustion (অবসাদ) হয় না। দুধ একদম বন্ধ করেছি—পেট মোটার ভয়ে। কাল আলমোড়ায় এসেছি। আর বাগানে যাব না। … বাড়ী ভাড়া-টাড়া যা করতে হয় করবে; এতে আর অত জিজ্ঞাস-পড়া কি করবে!
শুদ্ধানন্দ লিখছে—কি Ruddock’s Practice of Medicine পাঠ হচ্ছে। ও-সব কি nonsense (বাজে জিনিষ) ক্লাসে পড়ান? একসেট Physics (পদার্থবিদ্যা) আর Chemistry-র (রসায়নের) সাধারণ যন্ত্র ও একটা সাধারণ telescope (দূরবীক্ষণ) ও একটা microscope (অণুবীক্ষণ) ১৫০|২০০ টাকার মধ্যে সব হবে। শশীবাবু সপ্তাহে একদিন এসে Chemistry Practical (ফলিত রসায়ন)-এর উপর লেকচার দিতে পারেন ও হরিপ্রসন্ন Physics ইত্যাদির ওপর। আর বাঙলা ভাষায় যে-সকল উত্তম Scientific (বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয়) পুস্তক আছে, তা সব কিনবে ও পাঠ করাবে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৩৯
[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩ জুলাই, ১৮৯৭
যস্য বীর্যেণ কৃতিনো বয়ং চ ভুবনানি চ।
রামকৃষ্ণং সদা বন্দে শর্বং স্বতন্ত্রমীশ্বরম্||
‘প্রভবতি ভগবান্ বিধি’-রিত্যাগমিনঃ অপ্রয়োগনিপুণাঃ প্রয়োগনিপুণাশ্চ পৌরুষং বহুমন্যমানাঃ। তয়োঃ পৌরুষাপৌরুষেয়প্রতীকারবলয়োঃ বিবেকাগ্রহনিবন্ধনঃ কলহ ইতি মত্বা যতস্বায়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র আক্রমিতুম্ জ্ঞানগিরিগুরোর্গরিষ্ঠং শিখরম্।
যদুক্তং ‘তত্ত্বনিকষগ্রাবা বিপদিতি’ উচ্যেত তদপি শতশঃ; ‘তৎ ত্বমসি’ তত্ত্বাধিকারে। ইদমের তন্নিদানং বৈরাগ্যরুজঃ। ধন্যং কস্যাপি জীবনং তল্লক্ষণাক্রান্তস্য। অরোচিষ্ণু অপি নির্দিশামি পদং প্রাচীনং—‘কালঃ কশ্চিৎ প্রতীক্ষ্যতাম্’ ইতি। সমারূঢ়ক্ষেপণীক্ষেপণশ্রমঃ বিশ্রাম্যতাং তন্নির্ভরঃ। পূর্বাহিতো বেগঃ পারং নেষ্যতি নাবম্। তদেবোক্তং—‘তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।’ ‘ন ধনেন ন প্রজয়া ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ ইত্যত্র ত্যাগেন বৈরাগ্যমেব লক্ষ্যতে। তদ্বৈরাগ্যং বস্তুশূন্যং বস্তুভূতং বা। প্রথমং যদি, ন তত্র যতেত কোঽপি কীটভক্ষিতমস্তিষ্কে বিনা; যদ্যপরং তদেদম্ আপততি—ত্যাগঃ মনসঃ সঙ্কোচনম্ অন্যস্মাৎ বস্তুনঃ, পিণ্ডীকরণঞ্চ ঈশ্বরে বা আত্মনি। সর্বেশ্বরস্তু ব্যক্তিবিশেষো ভবিতুং নার্হতি, সমষ্টিরিত্যেব গ্রহণীয়ম্। আত্মেতি বৈরাগ্যবতো জীবাত্মা ইতি নাপদ্যতে, পরন্তু সর্বগঃ সর্বান্তর্যামী সর্বস্যাত্মরূপেণাবস্থিতঃ সর্বেশ্বর এব লক্ষ্যীকৃতঃ। স তু সমষ্টীরূপেণ সর্বেষাং প্রত্যক্ষঃ। এবং সতি জীবেশ্বরয়োঃ স্বরূপতঃ অভেদভাবাৎ তয়োঃ সেবাপ্রেমরূপকর্মণোরভেদঃ। অয়মেব বিশেষঃ—জীবে জীববুদ্ধ্যা যা সেবা সমর্পিতা সা দয়া, ন প্রেম; যদাত্মবুদ্ধ্যা জীবঃ সেব্যতে, তৎ প্রেম। আত্মনা হি প্রেমাস্পদত্বং শ্রুতিস্মৃতিপ্রত্যক্ষপ্রসিদ্ধত্বাৎ। তদ্ যুক্তমেব যদবাদীৎ ভগবান্ চৈতন্যঃ, ‘প্রেম ঈশ্বরে, দয়া জীবে’ ইতি। দ্বৈতবাদিত্বাৎ তত্রভগবতঃ সিদ্ধান্তো জীবেশ্বরয়োর্ভেদবিজ্ঞাপকঃ সমীচীনঃ। অস্মাকন্তু অদ্বৈতপরাণাং জীববুদ্ধির্বন্ধনায় ইতি। তদস্মাকং প্রেম এব শরণং, ন দয়া। জীবে প্রযুক্তঃ দয়াশব্দোঽপি সাহসিকজল্পিত ইতি মন্যামহে। বয়ং ন দয়ামহে, অপি তু সেবামহে; নানুকম্পানুভূতিরস্মাকং অপি তু প্রেমানুভবঃ স্বানুভবঃ সর্বস্মিন্।
সৈব সর্ববৈষম্যসাম্যকারী ভবব্যাধি-নীরুজকরী প্রপঞ্চাবশ্যম্ভাব্যত্রিতাপহরণকরী সর্ববস্তুস্বরূপপ্রকাশকরী মায়াধ্বান্তবিধ্বংসকরী আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তস্বাত্মরূপপ্রকটনকরী প্রেমানুভূতির্বৈরাগ্যরূপা ভবতু তে শর্মণে শর্মন্।
ইতানুদিবসং প্রার্থয়তি
ত্বয়ি ধৃতচিরপ্রেমবন্ধ বিবেকানন্দঃ
(বঙ্গানুবাদ)
ঔঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
যাঁহার শক্তিতে আমরা এবং সমুদয় জগৎ কৃতার্থ, সেই শিবস্বরূপ স্বাধীন ঈশ্বর শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি সদা বন্দনা করি।
হে আয়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র, যে-সকল শাস্ত্রকার উদ্যোগশীল নহেন, তাঁহারা বলেন ভগবদ্-বিধিই প্রবল, তিনি যাহা করেন তাহাই হয়; আর যাঁহারা উদ্যোগী ও কর্মকুশল, তাঁহারা পুরুষকারকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই যে কেহ পুরুষকারকে দুঃখ-প্রতীকারের উপায় মনে করিয়া সেই বলের উপর নির্ভর করেন, আবার কেহ কেহ বা দৈববলের উপর নির্ভর করেন, তাঁহাদের বিবাদ কেবল অজ্ঞানজনিত, ইহা জানিয়া তুমি জ্ঞানরূপ গিরিবরের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের জন্য যত্ন কর।
‘বিপদই তত্ত্বজ্ঞানের কষ্টিপাথর-স্বরূপ’—নীতিশাস্ত্রে এই যে বাক্য কথিত হইয়াছে, ‘তত্ত্বমসি’-জ্ঞান সম্বন্ধেও সে কথা শত শত বার বলা যাইতে পারে। ইহাই (অর্থাৎ বিপদে অবিচলিত ভাবই) বৈরাগ্যের লক্ষণ।
ধন্য তিনি, যাঁহার জীবনে ইহার লক্ষণসমূহ প্রকাশ পাইয়াছে। তোমার ভাল না লাগিলেও আমি সেই প্রাচীন উক্তি তোমায় বলিতেছি, ‘কিছু সময় অপেক্ষা কর।’ দাঁড় চালাইতে তোমার শ্রম হইয়াছে, এক্ষণে দাঁড়ের উপর নির্ভর করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর; পূর্বের বেগই নৌকাকে পারে লইয়া যাইবে। এইজন্যই বলা হইয়াছে, ‘যোগে সিদ্ধ হইলে কালে আত্মায় আপনা-আপনি সেই জ্ঞানের প্রকাশ হইয়া থাকে।’ আর এই যে কথিত হইয়াছে, ‘ধন বা সন্তান দ্বারা অমরত্ব লাভ হয় না, কিন্তু একমাত্র ত্যাগ দ্বারাই অমরত্ব লাভ হয়’, এখানে ‘ত্যাগ’ শব্দের দ্বারা বৈরাগ্যকে লক্ষ্য করা হইয়াছে। সেই বৈরাগ্য দুই প্রকার হইতে পারে—হয় বস্তুশূন্য বা অভাবাত্মক, নয় বস্তুভূত বা ভাবাত্মক। যদি বৈরাগ্য অভাবাত্মক হয়, তবে কীটভক্ষিতমস্তিষ্ক ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাহা লাভ করিতে যত্ন করিবে না। আর যদি বৈরাগ্য ভাবাত্মক হয়, তবে ত্যাগের অর্থ অন্যবস্তুসমূহ হইতে মনকে সরাইয়া আনিয়া ঈশ্বর বা আত্মায় সংলগ্ন করা। সর্বেশ্বর যিনি, তিনি ব্যক্তিবিশেষ হইতে পারেন না, তিনি সকলের সমষ্টিস্বরূপ। বৈরাগ্যবান ব্যক্তির নিকট আত্মা বলিতে জীবাত্মা বুঝায় না, কিন্তু সর্বব্যাপী সর্বান্তর্যামী—সকলের আত্মারূপে অবস্থিত সর্বেশ্বরই বুঝিতে হইবে। তিনি সমষ্টিরূপে সকলের প্রত্যক্ষ। অতএব যখন জীব ও ঈশ্বর স্বরূপতঃ অভিন্ন, তখন জীবের সেবা ও ঈশ্বর প্রেম দুই একই। বিশেষ এই, জীবকে জীববুদ্ধিতে যে সেবা করা হয়, তাহা দয়া, প্রেম নহে; আর আত্মবুদ্ধিতে যে জীবের সেবা করা হয় তাহা প্রেম। আত্মা যে সকলেরই প্রেমাস্পদ তাহা শ্রুতি, স্মৃতি, প্রত্যক্ষ—সর্বপ্রকার প্রমাণ দ্বারাই জানা যাইতেছে। এইজন্য ভগবান্ শ্রীচৈতন্য যে ঈশ্বরে প্রেম ও জীবে দয়া করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহা যুক্তিযুক্ত। দ্বৈতবাদী ছিলেন বলিয়া তাঁহার এই সিদ্ধান্ত—যাহা জীব ও ঈশ্বরের ভেদ সূচনা করে—তাহা সমীচীনই হইয়াছে। অদ্বৈতনিষ্ঠ আমাদের কিন্তু জীববুদ্ধি বন্ধনের কারণ। অতএব আমাদের অবলম্বন প্রেম, দয়া নহে। জীবে প্রযুক্ত ‘দয়া’ শব্দও আমাদের বোধ হয় জোর করিয়া বলা মাত্র। আমরা দয়া করি না, সেবা করি। কাহাকেও দয়া করিতেছি, এ অনুভব আমাদের নাই; তৎপরিবর্তে আমরা সকলের মধ্যে প্রেমানুভূতি ও আত্মানুভব করিয়া থাকি।
হে শর্মন্ (ব্রাহ্মণ), সেই বৈরাগ্যরূপ প্রেমানুভব, যাহাতে সমস্ত বৈষম্যের সমতা সাধন করে, যাহা দ্বারা ভবরোগ আরোগ্য হয়, যাহা দ্বারা—এই জগৎপ্রপঞ্চে (মানবজীবনে) অবশ্যম্ভাবী ত্রিতাপ নাশ হয়, যাহা দ্বারা সমুদয় বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ বুঝিতে পারা যায়, যাহা দ্বারা মায়ারূপ অন্ধকার একেবারে নাশ হইয়া যায়, যাহা দ্বারা আব্রহ্মস্তম্ব সমুদয় জগৎকেই আত্মস্বরূপ বলিয়া বোধ হয়, তাহাই তোমার কল্যাণের জন্য তোমার হৃদয়ে উদিত হউক। ইহাই তোমার প্রতি চিরপ্রেমে আবদ্ধ বিবেকানন্দ দিবারাত্র প্রার্থনা করিতেছে।
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪০
আলমোড়া
৪ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
আশ্চর্যের কথা, আজকাল ইংলণ্ড থেকে আমার উপর ভাল ও মন্দ দুই প্রকার প্রভাবেরই ক্রিয়া চলছে; প্রত্যুত তোমার চিঠিগুলি উৎসাহ ও আশার আলোকে পূর্ণ এবং আমার হৃদয়ে বল ও আশার সঞ্চার করে—আর আমার এখন এগুলি বড়ই প্রয়োজন। প্রভুই জানেন।
আমি যদিও এখনও হিমালয়ে আছি এবং আরও অন্ততঃ এক মাস থাকব, আমি আসার আগেই কলিকাতায় কাজ শুরু করে দিয়ে এসেছি এবং প্রতি সপ্তাহে কাজের বিবরণ পাচ্ছি।
এখন আমি দুর্ভিক্ষের কাজে ব্যস্ত আছি, এবং জনকয়েক যুবককে ভাবী কাজের জন্য গড়ে তোলা ছাড়া শিক্ষাকার্যে অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারিনি। অন্নসংস্থানের ব্যাপারেই আমার সমস্ত শক্তি ও সম্বল নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত অতি সামান্য ভাবেই কাজ করতে পেরেছি, তবু অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধের পরে এই আবার প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণসন্তানেরা অন্ত্যজ বিসূচিকা-রোগীর শয্যাপার্শ্বে সেবায় নিরত।
ভারতে বক্তৃতা ও অধ্যাপনায় বেশী কাজ হবে না। প্রয়োজন সক্রিয় ধর্মের। আর মুসলমানদের কথায় বলতে গেলে ‘খোদার মর্জি হলে’—আমি তাই দেখাতে বদ্ধপরিকর। … তোমাদের সমিতির কার্য-প্রণালীর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত; এবং ভবিষ্যতে তুমি যা-ই কর না কেন, তুমি ধরে নিতে পার, তাতে আমার সম্মতি থাকবে। তোমার ক্ষমতা ও সহানুভূতির উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এর মধ্যেই আমি তোমার কাছে প্রভূত ঋণে ঋণী, এবং প্রতিদিন আরও অশেষভাবে বাধিত করছ। এইটুকুই আমার সান্ত্বনা যে, এই সমস্তই পরের জন্য। নতুবা উইম্বল্ডনের বন্ধুরা আমার প্রতি যে অপূর্ব অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আমি মোটেই তার উপযুক্ত নই। তোমরা ইংরেজরা বড় ভাল, বড় স্থির, বড় খাঁটি—ভগবান্ তোমাদের সর্বদা আশীর্বাদ করুন। আমি দূর থেকে প্রতিদিন তোমার আরও বেশী গুণগ্রাহী হচ্ছি। দয়া করে—কে আমার চির স্নেহ জানাবে এবং সেখানকার সব বন্ধুদের জানাবে। আমার অসীম ভালবাসা জেনো। ইতি
তোমাদের চিরসত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
আলমোড়া
৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় ভগিনী,
তোমার পত্রখানি পড়ে ও ভিতরে একটি নৈরাশ্যব্যঞ্জক ভাব ফল্গুনদীর মত বইছে দেখে বড় দুঃখিত হলাম, আর তার কারণটা কি তাও আমি বুঝতে পারছি। তুমি যে আমাকে সাবধান করে দিয়েছ, তাঁর জন্য প্রথমেই তোমায় বিশেষ ধন্যবাদ; তোমার ওরূপ লেখার উদ্দেশ্য আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে ইংলণ্ডে যাবার বন্দোবস্ত করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তাররা অনুমতি দিলে না, কাজেই যাওয়া ঘটল না। হ্যারিয়েটের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে জানতে পারলে আমি খুব খুশী হব। তিনিও তোমাদের যার সঙ্গেই হোক না কেন, দেখা হলে খুব আনন্দিত হবেন।
আমি অনেকগুলি আমেরিকান কাগজের টুকরো অংশ (cuttings) পেয়েছি; তাতে দেখলাম মার্কিন মেয়েদের সম্বন্ধে আমার উক্তিসমূহের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে—তাতে আরও এক অদ্ভুত খবর পেলাম যে, আমাকে এখানে জাতিচ্যুত করা হয়েছে! আমার আবার জাত হারাবার ভয়—আমি যে সন্ন্যাসী!
জাত তো কোনরকম যায়ইনি, বরং সমুদ্রযাত্রার উপর সমাজের যে একটা বিরুদ্ধ ভাব ছিল, আমার পাশ্চাত্য দেশে যাওয়ার দরুন তা বহুল পরিমাণে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমাকে যদি জাতিচ্যুত করতে হয়, তাহলে ভারতের অর্ধেক রাজন্যবর্গ ও সমুদয় শিক্ষিত লোকের সঙ্গে আমাকে জাতিচ্যুত করতে হবে। তা তো হয়ইনি, বরং আমি সন্ন্যাস নেবার পূর্বে আমার যে জাতি ছিল, সেই জাতিভুক্ত এক প্রধান রাজা আমাকে সম্মানপ্রদর্শনের জন্য একটি সামাজিক ভোজের আয়োজন করেছিলেন; তাতে ঐ জাতির অধিকাংশ বড় বড় লোক যোগ দিয়েছিলেন। অন্য দিক্ থেকে ধরলে আমরা সন্ন্যাসীরা তো নারায়ণ—দেবতারা সামান্য নরলোকের সঙ্গে একত্র খেলে তাঁদের মর্যাদাহানি হয়। আর প্রিয় মেরী, শত শত রাজার বংশধরেরা এই পা ধুইয়ে মুছিয়ে দিয়েছে, পুজো করেছে—আর সমস্ত দেশের ভিতর যেরূপ আদর অভ্যর্থনা অভিনন্দনের ছড়াছড়ি হয়েছে, ভারতে আর এ রকমটি কারও হয়নি।
এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, রাস্তায় বেরুতে গেলেই এত লোকের ভিড় হত যে, শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশের দরকার হত—জাতিচ্যুত করাই বটে! অবশ্য আমার এরূপ অভ্যর্থনায় মিশনরী-ভায়াদের প্রভাব বেশ ক্ষয় করে দিয়েছে। আর তারা এখানে কে? কেউ না। তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই আমাদের খেয়াল নেই!
আমি এক বক্তৃতায় এই মিশনরী-ভায়াদের সম্বন্ধে—ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত ভদ্র মিশনরীগণকে বাদ দিয়ে—সাধারণ মিশনরীর দল কোন্ শ্রেণীর লোক থেকে সংগৃহীত, সে সম্বন্ধে কিছু বলেছিলাম। সেই সঙ্গে আমেরিকার চার্চের অতিরিক্ত গোঁড়া স্ত্রীলোকদের সম্বন্ধে এবং তাদের কুৎসা সৃষ্টি করবার শক্তি সম্বন্ধেও আমায় কিছু বলতে হয়েছিল। মিশনরী-ভায়ারা আমার আমেরিকার কাজটা নষ্ট করবার জন্য এইটিকেই সমগ্র মার্কিন নারীর উপর আক্রমণ বলে ঢাক পেটাচ্ছে—কারণ তারা বেশ জানে, শুধু তাদের (মিশনরীদের) বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা খুশীই হবে। প্রিয় মেরী, ধর যদি ইয়াঙ্কিদের বিরুদ্ধে আমি খুব ভয়ানক কথা বলেই থাকি—তারা আমাদের মা-বোনদের বিরুদ্ধে যে-সব কথা বলে, তাতে কি তার লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও প্রতিশোধ হয়? ভারতবাসী ‘হিদেন’দের (বিধর্মী) উপর খ্রীষ্টান ইয়াঙ্কি নরনারী যে ঘৃণা পোষণ করে, তা ধুয়ে ফেলতে বরুণ-দেবতার সব জলেও কুলোবে না। আমরা তাদের কি অনিষ্ট করেছি? অন্যে সমালোচনা করলে ইয়াঙ্কিরা ধৈর্যের সঙ্গে তা সহ্য করতে শিখুক, তারপর তারা অপরের সমালোচনা করুক। এটি একটি মনোবিজ্ঞানসম্মত সর্বজনবিদিত সত্য যে, যারা সর্বদা অপরকে গালিগালাজ করতে উদ্যত, তারা অপরের এতটুকু সমালোচনার ঘা সহ্য করতে পারে না। আর তারপর তাদের আমি কি ধার ধারি? তোমাদের পরিবার, মিসেস বুল, লেগেটরা এবং আর কয়েকজন সমুদয় ব্যক্তি ছাড়া আর কে আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছে? কে আমার ভাবগুলি কাজে পরিণত করবার সাহায্য করতে এসেছিল? আমায় কিন্তু ক্রমাগত খাটতে হয়েছে, যাতে মার্কিনরা অপেক্ষাকৃত উদার ও ধর্মপ্রাণ হয় তার জন্য আমেরিকায় আমার সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে এখন আমি মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত।
ইংলণ্ডে আমি কেবল ছ-মাস কাজ করেছি, একবার ছাড়া কখনও কোন নিন্দার রব ওঠেনি—সে নিন্দা-রটনাও একজন মার্কিন মহিলার কাজ, এই কথা জানতে পেরে আমার ইংরেজ বন্ধুরা বিশেষ আশ্বস্ত হলেন। আক্রমণ তো কোন রকম হয়ইনি বরং অনেকগুলি ভাল ভাল ইংলিশ চার্চের পাদ্রী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন—আর না চেয়েই আমি আমার কাজের জন্য যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি এবং নিশ্চয়ই আরও পাব। ওখানকার একটা সমিতি আমার কাজের প্রসার লক্ষ্য করে আসছে এবং সেজন্য সাহায্যের যোগাড় করছে। ওখানকার চারজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমার কাজে সাহায্যের জন্য সব রকম অসুবিধা সহ্য করেও আমার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে এসেছেন। আরও অনেকে আসবার জন্য প্রস্তুত ছিল; এর পর যখন যাব, আরও শত শত লোক প্রস্তুত হবে।
প্রিয় মেরী, আমার জন্য কিছু ভয় করো না। মার্কিনরা বড়—কেবল ইওরোপের হোটেলওয়ালা ও কোটিপতিদের চোখে এবং নিজেদের কাছে। পৃথিবীতে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে—ইয়াঙ্কিরা চটলেও আমার জায়গার অভাব হবে না। যাই হোক না কেন, আমি যতটুকু কাজ করেছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি কখনও কোন জিনিষ মতলব করে করিনি। আপনা-আপনি যেমন যেমন সুযোগ এসেছে, আমি তারই সহায়তা নিয়েছি। কেবল একটা ভাব আমার মাথার ভিতর ঘুরছিল—ভারতবাসী জনসাধারণের উন্নতির জন্য একটা যন্ত্র প্রস্তুত করে চালিয়ে দেওয়া। আমি সে বিষয়ে কতকটা কৃতকার্য হয়েছি। তোমার হৃদয় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠত, যদি তুমি দেখতে আমার ছেলেরা দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি ও দুঃখকষ্টের ভেতর কেমন কাজ করছে, কলেরা-আক্রান্ত ‘পারিয়া’র মাদুরের বিছানার পাশে বসে কেমন তাদের সেবাশুশ্রূষা করছে এবং অনশনক্লিষ্ট চণ্ডালের মুখে কেমন অন্ন তুলে দিচ্ছে—প্রভু আমাকে সাহায্য করছেন, তাদেরও সাহায্য পাঠাচ্ছেন। মানুষের কথা আমি কি গ্রাহ্য করি? সেই প্রেমাস্পদ প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন, যেমন আমেরিকায়, যেমন ইংলণ্ডে, যেমন ভারতের রাস্তায় যখন ঘুরে বেড়াতাম—কেউ আমায় চিনত না—তখন যেমন সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। লোকেরা কি বলে না বলে, তাতে আমার কি এসে যায়—ওরা তো ছেলেমানুষ! ওরা আর ওর চেয়ে বেশী বুঝবে কি করে? কি! আমি পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করেছি, সমুদয় পার্থিব বস্তু যে অসার, তা প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করেছি—আমি সামান্য বালকদের কথায় আমার নির্দিষ্ট পথ থেকে চ্যুত হব?—আমাকে দেখে কি তেমনি মনে হয়?
আমাকে আমার নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে হল—কারণ তোমাদের কাছে না বললে যেন আমার কর্তব্য শেষ হত না। আমি বুঝতে পারছি—আমার কাজ শেষ হয়েছে। জোর তিন-চার বছর জীবন অবশিষ্ট আছে। আমার নিজের মুক্তির ইচ্ছা সম্পূর্ণ চলে গেছে। আমি সাংসারিক সুখের প্রার্থনা কখনও করিনি। আমি দেখতে চাই যে, আমার যন্ত্রটা বেশ প্রবলভাবে চালু হয়ে গেছে; আর এটা যখন নিশ্চয় বুঝব যে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে অন্ততঃ ভারতে এমন একটা যন্ত্র চালিয়ে গেলাম, যাকে কোন শক্তি দাবাতে পারবে না, তখন ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে আমি ঘুমাব। আর নিখিল আত্মার সমষ্টিরূপে যে ভগবান্ বিদ্যমান—একমাত্র যে ভগবানে আমি বিশ্বাসী, সেই ভগবানের পূজার জন্য যেন আমি বার বার জন্মগ্রহণ করি এবং সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি; আর সর্বোপরি আমার উপাস্য পাপী-নারায়ণ, তাপী-নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্রনারায়ণ! এরাই বিশেষভাবে আমার আরাধ্য।
‘যিনি তোমার অন্তরে ও বাহিরে, যিনি সব হাত দিয়ে কাজ করেন ও সব পায়ে চলেন, তুমি যাঁর একাঙ্গ, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যিনি উচ্চ ও নীচ, সাধু ও পাপী, দেব ও কীট সর্বরূপী, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞেয় সত্য ও সর্বব্যাপীর উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যাতে পূর্বজন্ম নাই, পরজন্ম নাই, বিনাশ নাই, গমনাগমন নাই, যাতে অবস্থিত থেকে আমরা সর্বদা অখণ্ডত্ব লাভ করছি এবং ভবিষ্যতেও করব, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাঁকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পেছনে ছুটেছ! তাঁর—সেই প্রত্যক্ষ-দেবতারই—উপাসনা কর এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।’
আমার সময় অল্প। এখন আমার যা কিছু বলবার আছে, কিছু না চেপে বলে যেতে হবে; ওতে কারও হৃদয় আঘাত লাগবে বা কেউ বিরক্ত হবে—এ বিষয়ে লক্ষ্য করলে চলবে না। অতএব প্রিয় মেরী, আমার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন, কিছুতেই ভয় পেও না। কারণ যে শক্তি আমার পশ্চাতে থেকে কাজ করছে, তা বিবেকানন্দ নয়—তা স্বয়ং প্রভু; কিসে ভাল হয়, তিনিই বেশী বোঝেন। যদি আমায়—জগৎকে সন্তুষ্ট করতে হয়, তাহলে তাতে জগতের অনিষ্টই হবে। অধিকাংশ লোক যা বলে তা ভুল, কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, জগৎ শাসন করছে তারাই, অথচ জগতের অবস্থা অতি শোচনীয়। যে-কোন নূতন ভাব প্রচারিত হবে, তারই বিরুদ্ধে লোকে লাগবে; সভ্য যাঁরা, তাঁরা শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন না করে উপহাসের হাসি হাসবেন; আর যারা সভ্য নয়, তারা শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ চীৎকার করবে ও কুৎসিত নিন্দা রটাবে।
সংসারের এ-সব কীটদেরও একদিন খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে—জ্ঞানহীন বালকদেরও একদিন জ্ঞানালোক পেতে হবে। মার্কিনরা অভ্যুদয়ের নূতন সুরাপানে এখন মত্ত। অভ্যুদয়ের শত শত বন্যা আমাদের দেশের উপর এসেছে ও চলে গেছে। তাতে আমরা এমন শিক্ষা পেয়েছি, যা কোন বালকস্বভাব জাতি এখনও বুঝতে অসমর্থ। আমরা জেনেছিঃ এ সবই মিছে; এই বীভৎস জগৎটা মায়ামাত্র। ত্যাগ কর এবং সুখী হও। কামকাঞ্চন ত্যাগ কর। এ ছাড়া অন্য কোন বন্ধন নাই। বিবাহ, স্ত্রীপুরুষ সম্বন্ধ, টাকাকড়ি—এগুলি মূর্তিমান পিশাচস্বরূপ। পার্থিব ভালবাসা দেহ থেকেই প্রসূত—কামকাঞ্চন সম্বন্ধে সব ছেড়ে দাও—ঐগুলি যেমন চলে যাবে, অমনি দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে—তখন আত্মা তাঁর অনন্ত শক্তি ফিরে পাবেন।
আমার বড়ই ইচ্ছা ছিল হ্যারিয়েটের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ইংলণ্ডে যাই।—আমার আর একটি মাত্র ইচ্ছা আছে, মৃত্যুর আগে তোমাদের চার বোনের সঙ্গে একবার দেখা করা; আমার সে ইচ্ছা পূর্ণ হবেই হবে। ইতি
তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
আজ এখান হইতে সভার উদ্দেশ্যের যে proof (প্রুফ) পাঠাইয়াছিলে, তাহা সংশোধন করিয়া পাঠাইলাম। Rules and regulations (নিয়মাবলী)-টুকু—যেটুকু আমাদের meeting hall-এ (সভায়) মশায়রা পড়িয়াছিলেন—ভ্রমপূর্ণ। বিশেষ যত্নের সহিত সংশোধিত করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিবে, নইলে লোক হাসিবে।
বহরমপুরে যে প্রকার কার্য১২৪ হইতেছে, তাহা অতীব সুন্দর। ঐ সকল কার্যের দ্বারাই জয় হইবে—মতামত কি অন্তর স্পর্শ করে? কার্য কার্য—জীবন জীবন—মতে-ফতে এসে যায় কি? ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো—এ সব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সর্বজনীন মহাব্রত—আবালবৃদ্ধবনিতা, আচণ্ডাল, আপশু সকলেই এ ধর্ম বুঝিতে পারে। শুধু negative (নিষেধাত্মক) ধর্মে কি কাজ হয়? পাথরে ব্যভিচার করে না, গরুতে মিথ্যা কথা কয় না, বৃক্ষেরা চুরি ডাকাতি করে না, তাতে আসে যায় কি? তুমি চুরি কর না, মিথ্যা কথা কও না, ব্যভিচার কর না, চার ঘণ্টা ধ্যান কর, আট ঘণ্টা ঘণ্টা বাজাও—‘মধু, তা কার কি?’ ঐ যে কাজ, অতি অল্প হলেও ওতে বহরমপুর একেবারে কেনা হয়ে গেল—এখন যা বলবে, লোকে তাই শুনবে। এখন ‘রামকৃষ্ণ ভগবান্’ লোককে আর বোঝাতে হবে না। তা নইলে কি লেকচারের কর্ম—কথায় কি চিঁড়ে ভেজে? ঐ রকম যদি দশটা district (জেলায়) পারতে, তাহলে দশটাই কেনা হয়ে যেত। অতএব বুদ্ধিমান, এখন ঐ কর্মবিভাগটার উপরই খুব ঝোঁক, আর ঐটারই উপকারিতা বাড়াতে প্রাণপণে চেষ্টা কর। কতকগুলো ছেলেকে দ্বারে দ্বারে পাঠাও—আলখ জাগিয়ে টাকাপয়সা, ছেঁড়া কাপড়, চালডাল, যা পায় নিয়ে আসুক, তারপর সেগুলো ডিষ্ট্রীবিউট (বিতরণ) করবে। ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর লোকের বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।
কলিকাতায় মিটিং-এর খরচ-খরচা বাদে যা বাঁচে, ঐ famine-এতে (দুর্ভিক্ষে) পাঠাও বা কলিকাতার ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাদের সাহায্য কর—হল্-ফল্—ঘোড়ার ডিম থাক্, প্রভু যা করবার তা করবেন। আমার এখন শরীর বেশ সেরে গেছে।
মেটিরিয়াল (মালমসলা) যোগাড় করছ না কেন? আমি এসে নিজেই কাগজ start (আরম্ভ) করব। দয়া আর ভালবাসায় জগৎ কেনা যায়; লেকচার, বই, ফিলসফি—সব তার নীচে। শশীকে ঐ রকম একটা কর্মবিভাগ গরীবদের সাহায্যের জন্য করতে লিখবে। আর ঠাকুরপুজো-ফুজোতে যেন টাকাকড়ি বেশী ব্যয় না করে। … তুমি মঠের ঠাকুরপুজোর খরচ দু-এক টাকা মাসে করে ফেলবে। ঠাকুরের ছেলেপুলে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। … শুধু জল-তুলসীর পুজো করে ভোগের পয়সাটা দরিদ্রদের শরীরস্থিত জীবন্ত ঠাকুরকে ভোগ দিবে—তা হলে সব কল্যাণ হবে। যোগেনের শরীর এখানে খারাপ হয়েছিল, সে আজ যাত্রা করিল—কলিকাতায়। আমি কাল পুনশ্চ দেউলধার যাত্রা করিব। আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৩
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় জো জো,
তোমার চিঠিগুলি পড়ার ফুরসত আমার আছে, এটা যে তুমি আবিষ্কার করে ফেলেছ, তাতে আমি খুশী।
বক্তৃতা ও বাগ্মিতা করে করে হয়রান হয়ে পড়ায় আমি হিমালয়ে আশ্রয় নিয়েছি। ডাক্তাররা আমায় খেতড়ির রাজার সঙ্গে ইংলণ্ডে যেতে না দেওয়ার আমি বড়ই দুঃখিত; আর স্টার্ডি এতে ক্ষেপে গেছে।
সেভিয়ার-দম্পতি সিমলাতে আছেন, আর মিস মূলার এখানে আলমোড়ায়। প্লেগ কমেছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ এখনও চলছে, তার উপর এ যাবৎ বৃষ্টি না হওয়ায় এ দুর্ভিক্ষ আরও করালরূপ ধারণ করবে বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের কর্মীরা দুর্ভিক্ষগ্রস্ত বিভিন্ন জেলায় যে কাজে নেমেছে, এখান থেকে তার পরিচালনায় আমি খুবই ব্যস্ত।
যেমন করেই হোক তুমি এসে পড়; শুধু এইটুকু মনে রেখো—ইওরোপীয়দের ও হিন্দুদের (অর্থাৎ ইওরোপীয়েরা যাদের ‘নেটিভ’ বলেন তাদের) বসবাসের ব্যবস্থা যেন তেল-জলের মত; নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করা ইওরোপীয়দের পক্ষে সর্বনেশে ব্যাপার। (প্রাদেশিক) রাজধানীগুলোতে পর্যন্ত বলবার মত কোন হোটেল নেই। তোমাকে অনেক চাকর-বাকর সঙ্গে নিয়ে চলা-ফেরা করতে হবে (খরচ হোটেলের চেয়ে কম)। কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত লোকের ছবি তোমায় সয়ে যেতে হবে; আমাকেও তুমি ঐ রূপেই দেখতে পাবে। সর্বত্রই ময়লা ও নোংরা, আর সব ‘কালা আদমী’। কিন্তু তোমার সঙ্গে দার্শনিক আলোচনা করবার মত লোক ঢের পাবে। এখানে যদি ইংরেজদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা কর, তবে তুমি আরাম পাবে বেশী; কিন্তু হিন্দুদের ঠিক ঠিক পরিচয় পাবে না। হয়তো আমি তোমার সঙ্গে বসে খেতে পাব না; কিন্তু তোমায় কথা দিচ্ছি যে, আমি তোমার সঙ্গে বহু জায়গায় ভ্রমণ করব এবং তোমার ভ্রমণকে সুখময় করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এই সবই তোমার ভাগ্যে জুটবে—যদি কিছু ভাল জুটে যায় তো সে বাড়তির ভাগ। হয়তো মেরী হেল তোমার সঙ্গে এসে পড়তে পারে। অর্চার্ড লেক্, অর্চার্ড দ্বীপ, মিসিগান—এই ঠিকানায় মিস ক্যাম্পবেল নাম্নী একটি সম্ভ্রান্তবংশীয়া কুমারী বাস করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ ভক্ত, উপবাস ও প্রার্থনাদি অবলম্বন করে এই দ্বীপে নির্জনে বাস করেন, ভারতবর্ষ দর্শন করার জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি বড়ই গরীব। তুমি যদি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আস, তবে যেমন করেই হোক, আমি তাঁর খরচ দেব। মিসেস বুল যদি বুড়ো ল্যাণ্ডস্বার্গকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন, তবে সে বেঁচে যায়!
খুব সম্ভব আমি তোমার সঙ্গে আমেরিকায় ফিরব। হলিস্টার ও শিশুটিকে আমার চুমো দিও। এলবার্টা, লেগেট-দম্পতি ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা জানিও। ফক্স কি করছে? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমার ভালবাসা জানিও। মিসেস বুল ও সারদানন্দকে ভালবাসা জানাচ্ছি। আমি আগেকার মতই সবল আছি; কিন্তু কেমন থাকব, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার উপর। আর দৌড়ঝাঁপ করা চলবে না।
এ বছর তিব্বতে যাবার খুবই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এরা যেতে দিল না; কারণ ঐ পথে চলা ভয়ানক শ্রমসাপেক্ষ। যা হোক আমি খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পাহাড়ী ঘোড়া ছুটিয়েই সন্তুষ্ট আছি। তোমার বাই-সাইকেলের চেয়ে এটা আরও বেশী উন্মাদনাপূর্ণ; অবশ্য উইম্বল্ডনে আমার সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল চড়াই ও মাইলের পর মাইল উতরাই—রাস্তাটা কয়েক ফুট মাত্র চওড়া, খাড়া পাহাড়ের গায়ে যেন ঝুলে আছে, আর বহু সহস্র ফুট নীচে খাদ!
সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
পুঃ—ভারতে আসার সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে—অক্টোবরের মধ্যে বা নভেম্বরের প্রথমে; ডিসেম্বর, জানুআরী ও ফেব্রুআরী তুমি সব দেখবে এবং ফেব্রুআরীর শেষাশেষি ফিরে যাবে। মার্চ থেকে গরম পড়তে শুরু হয়। দক্ষিণ ভারত সব সময়েই গরম।
মান্দ্রাজে শীঘ্রই একখানি পত্রিকা আরম্ভ করা হবে; গুডউইন তারই কাজে সেখানে গেছে।
বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৪
[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১১ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
তুমি সম্প্রতি মঠের যে কার্য-বিবরণ পাঠিয়েছ, তা পেয়ে ভারি খুশী হলাম। তোমার রিপোর্ট সম্বন্ধে আমার সমালোচনার বড় কিছু নেই—কেবল বলতে চাই, আর একটু পরিষ্কার করে লিখো।
যতদূর পর্যন্ত কাজ হয়েছে, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট; কিন্তু আরও এগিয়ে যেতে হবে। আগে আমি একবার লিখেছিলাম, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধীয় কতকগুলি যন্ত্র যোগাড় করলে ভাল হয় এবং ক্লাস খুলে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন, বিশেষতঃ শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে সাদাসিদে ও হাতেকলমে শিক্ষা দিলে ভাল হয়; কই, সে-সম্বন্ধে তো কোন উচ্চবাচ্য এ পর্যন্ত শুনিনি।
আর একটা কথা লিখেছিলাম—যে-সব বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বাঙলা ভাষায় অনুবাদ হয়ে গেছে, সেইগুলি কিনে ফেলা উচিত; তার সম্বন্ধেই বা কি হল?
এখন মনে হচ্ছে—মঠে একসঙ্গে অন্ততঃ তিন জন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক্ দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।
শিক্ষাবিভাগের উপযুক্ত পরিচালক পাওয়াই দেখছি কঠিন। ব্রহ্মানন্দ ও তুরীয়ানন্দ অনায়াসে অপর দুটি বিভাগের ভার নিতে পারেন। মঠ দর্শন করতে কেবল কলিকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাঁদের দ্বারা কিছু হবে না। আমরা চাই সাহসী যুবকের দল—যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দলকে দিয়ে কি হবে?
ব্রহ্মানন্দকে বলবে, তিনি যেন অভেদানন্দ ও সারদানন্দকে—মঠে তাদের সাপ্তাহিক কার্য-বিবরণী পাঠাতে লেখেন; যেন তা পাঠাতে ত্রুটি না হয়, আর যে বাঙলা কাগজটা বার করবার কথা হচ্ছে, তার জন্য প্রবন্ধ ও প্রয়োজনীয় উপাদান যেন তারা পাঠায়। গিরিশবাবু কি কাগজটার জন্য যোগাড়যন্ত্র করছেন? অদম্য ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে কাজ করে যাও ও প্রস্তুত থাক।
অখণ্ডানন্দ মহুলাতে অদ্ভুত কর্ম করছে বটে, কিন্তু কার্য-প্রণালী ভাল বলে বোধ হচ্ছে না। মনে হয়, তারা একটা ছোট গ্রামেই তাদের শক্তিক্ষয় করছে, তাও কেবল চাল-বিতরণের কার্যে। এই চাল দিয়ে সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে কোনরূপ প্রচারকার্যও হচ্ছে—কই, এরূপ তো শুনতে পাচ্ছি না। জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখান না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।
আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রধানতঃ শিক্ষাদান—চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষসাধনের জন্য শিক্ষা-বিস্তার। আমি সে-সম্বন্ধে তো কোন কথা শুনছি না—কেবল শুনছি, এতগুলি ভিক্ষুককে সাহায্য দেওয়া হয়েছে! ব্রহ্মানন্দকে বলো, বিভিন্ন জেলায় কেন্দ্র খুলতে, যাতে আমাদের সামান্য সম্বলে যতদূর সম্ভব অধিক জায়গায় কাজ করা যায়। আরও মনে হচ্ছে, এ পর্যন্ত ঐ কার্যে ফল কিছু হয়নি; কারণ তাঁরা এখনও পর্যন্ত স্থানীয় লোকদের মধ্যে তেমন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পারেননি, যাতে তারা দেশের লোকের শিক্ষার জন্য সভাসমিতি স্থাপন করতে পারে এবং ঐ শিক্ষার ফলে তারা আত্মনির্ভরশীল ও মিতব্যয়ী হতে পারে, বিবাহের দিকে অস্বাভাবিক ঝোঁক না থাকে, এবং এইভাবে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। দয়ায় লোকের হৃদয় খুলে যায়; কিন্তু সেই দ্বার দিয়ে তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ যাতে হয়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সবচেয়ে সহজ উপায় এইঃ একটা ছোট কুঁড়ে নিয়ে গুরু-মহারাজের মন্দির কর। গরীবরা সেখানে আসুক, তাদের সাহায্যও করা হোক, তারা সেখানে পূজা-অর্চাও করুক। প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে ‘কথা’ হোক। ঐ কথার সাহায্যেই তোমরা লোককে যা কিছু শেখাতে ইচ্ছা কর, শেখাতে পারবে। ক্রমে ক্রমে তাদের নিজেদেরই ঐ বিষয়ে একটা আস্থা ও আগ্রহ বাড়তে থাকবে—তখন তারা নিজেরাই সেই মন্দিরের ভার নেবে, আর হতে পারে, কয়েক বৎসরের ভেতর ঐ ছোট মন্দিরটিই একটি প্রকাণ্ড আশ্রমে পরিণত হবে। যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন-কার্যে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রথমে প্রত্যেক জেলার কেন্দ্রস্থলে একটা জায়গা নির্বাচন করুন—এইরূপ একটি কুঁড়ে নিয়ে সেখানে ঠাকুরঘর স্থাপন করুন—যেখান থেকে আমাদের অল্প-স্বল্প কাজ আরম্ভ হতে পারে।
মনের মত কাজ পেলে অতি মূর্খও করতে পারে। যে সকল কাজকেই মনের মত করে নিতে পারে, সে-ই বুদ্ধিমান। কোন কাজই ছোট নয়, এ সংসারে যাবতীয় বস্তু বটের বীজের মত, সর্ষপের মত ক্ষুদ্র দেখালেও অতি বৃহৎ কাজকেই মহৎ করে তোলে।১২৫
যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন করছেন, তাঁদের এটিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, জুয়াচোরেরা যেন গরীবের প্রাপ্য নিয়ে যেতে না পারে। ভারতবর্ষ এমন অলস জুয়াচোরে পূর্ণ এবং দেখে আশ্চর্য হবে, তারা কখনও না খেয়ে মরে না—কিছু না কিছু খেতে পায়ই। ব্রহ্মানন্দকে বলো, যাঁরা দুর্ভিক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের সকলকে এই কথা লিখতেঃ যাতে কোন ফল নেই, এমন কিছুর জন্য টাকা খরচ করতে তাঁদের কখনই দেওয়া হবে না—আমরা চাই, যতদূর সম্ভব অল্প খরচে যত বেশী সম্ভব স্থায়ী সৎকার্যের প্রতিষ্ঠা।
এখন তোমরা বুঝতে পারছ, তোমাদের নূতন নূতন মৌলিক চিন্তার চেষ্টা করতে হবে—তা না হলে আমি মরে গেলেই গোটা কাজটা চুরমার হয়ে যাবে। এই রকম করতে পারঃ তোমরা সকলে মিলে একটা সভায় এই বিষয় আলোচনা কর, আমাদের হাতে যে অল্পস্বল্প সম্বল আছে, তা থেকে কি করে সবচেয়ে ভাল স্থায়ী কাজ হতে পারে। কিছুদিন আগে থেকে সকলকে এই বিষয়ে খবর দেওয়া হোক, সকলেই নিজের মতামত—বক্তব্য বলুক, সেইগুলি নিয়ে বিচার হোক, বাদপ্রতিবাদ হোক, তারপর আমাকে তার একটা বিবরণ পাঠাও।
উপসংহারে বলি, তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি—আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যত বড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক। তোমাদের প্রত্যেককেই এক একটা ‘দানা’ হতেই হবে—আমি বলছি—অবশ্যই হতে হবে। আজ্ঞাবহতা, উদ্দেশ্যের উপর অনুরাগ ও সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকা—এই তিনটি যদি থাকে, কিছুতেই তোমাদের হটাতে পারবে না। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
দেউলধার, আলমোড়া
১৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রেমাস্পদেষু,
এখান হইতে আলমোড়ায় যাইয়া যোগেন-ভায়ার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ভায়া একটু আরাম বোধ করিয়াই দেশে যাত্রা করিলেন। সুভালা-ভ্যালি পৌঁছে সংবাদ দিবেন।… ডাণ্ডি আদি পাওয়া অসম্ভব বিধায় লাটুর যাওয়া হইল না। আমি ও অচ্যুত পুনরায় এ স্থানে আসিয়াছি। আমার শরীর এই ঘোড়ার পিঠে রৌদ্রে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ের দরুন একটু আজ খারাপ আছে। শশীবাবুর ঔষধ প্রায় দুই সপ্তাহ খাইলাম—বিশেষ কিছুই দেখি না।—লিভারের বেদনাটা গিয়াছে ও খুব কসরত করার দরুন হাত-পা বিশেষ muscular (পেশীবহুল) হইয়াছে, কিন্তু পেটটা বিষম ফুলিতেছেঃ উঠতে বসতে হাঁপ ধরে। বোধ হয় দুধ খাওয়াই তার কারণ। শশীকে জিজ্ঞাসা করিবে যে, দুগ্ধ ছাড়িয়া দেওয়া যায় কিনা। পূর্বে আমার দুইবার sun-stroke (সর্দি-গরমি) হয়। সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই-তিন দিন শরীর খারাপ যায়।
মঠের খবর শুনিয়া বিশেষ সুখী হইলাম ও দুর্ভিক্ষের কার্য উত্তমরূপে হইতেছে শুনিলাম। দুর্ভিক্ষের জন্য ‘ব্রহ্মবাদিন্’ আফিস হইতে টাকা আসিয়াছে কিনা লিখিবে এবং এখান হইতেও শীঘ্র টাকা যাইবে। দুর্ভিক্ষ আরও অনেক স্থানে তো আছে। একটি গ্রামে এতদিন থাকিবার আবশ্যক নাই। উহাদিগকে অন্যত্র যাইতে বলিবে এবং এক এক জনকে এক এক জায়গায় যাইতে লিখিবে। ঐ সকল কাজই আসল কাজ; ঐরূপ ক্ষেত্র কর্ষিত হইলে পর ধর্মের বীজ রোপণ করা যাইতে পারে। ঐ যে গোঁড়ারা আমাদের গালি করিতেছে, ঐ রকম (সেবা) কার্যই তাহার একমাত্র উত্তর—এইটি সদা মনে রাখিবে। শশী ও সারদা যে প্রকার বলিতেছে, সেই প্রকার ছাপাইতে আমার কোন আপত্তি নাই।
মঠের নাম কি হইবে এইটা স্থির তোমরাই কর। … টাকা সাত সপ্তাহের মধ্যেই পৌঁছিবে; জমির তো কোন খবর নাই। এ বিষয়ে কাশীপুরের কেষ্টগোপালের বাগানটা নিলে ভাল হয় না? পরে বড় কার্য ক্রমে হবে। যদি মত হয়, এ বিষয় কাহাকেও—মঠস্থ বা বাহিরের—না বলিয়া চুপি চুপি অনুসন্ধান করিও। দুই-কান হইলেই কাজ খারাপ হয়। যদি ১৫|১৬ হাজারের ভিতর হয় তো তৎক্ষণাৎ কিনিবে (যদি ভাল বোঝ)। যদি কিছু বেশী হয় তো বায়না করিয়া ঐ সাত সপ্তাহ অপেক্ষা করিও। আমার মতে আপাততঃ ওটা লওয়াই ভাল। বাকী ধীরে ধীরে হবে। ও বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association (স্মৃতি জড়িত)। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ। অতি গোপনে—‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ সাংস্কারাঃ প্রাক্তনা ইব’।১২৬
কাশীপুরের বাগানের অবশ্য জমির দাম বেড়ে গেছে; কিন্তু কড়ি তেমনি কমে গেছে। যা হয় একটা করো ও শীঘ্র করো। গয়ং গচ্ছ করতে করতে যত কাজ মাটি হয়। ওটাও তো নিতেই হবে, আজ না হয় কাল—আর যত বড়ই গঙ্গাতীরে মঠ হউক না। অন্য লোক দিয়ে কথা পাড়লে আরও ভাল হয়। আমাদের কেনা টের পেলে লম্বা দর হাঁকবে। চেপে কাজ করে চল। অভীঃ, ঠাকুর সহায়। ভয় কি? সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।
বিবেকানন্দ
(খামের উপরে লিখিত)
… কাশীপুরের বিশেষ চেষ্টা দেখ। … বেলুড়ের জমি ছেড়ে দাও।
হুজুরদের নামের জ্বালায় কি গরীবগুলো শুকিয়ে মরবে? সব নাম ‘মহাবোধি’ নেয় তো নিক। গরীবদের উপকার হোক। কাজ বেশ চলছে—উত্তম কথা। আরও লেগে যাও। আমি প্রবন্ধ পাঠাতে আরম্ভ করছি। Saccharine & lime (স্যাকারিন ও নেবু) এসেছে।
বি
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
আমার সংক্ষিপ্ত চিঠির জন্য কিছু মনে করো না। আমি এখন পাহাড় থেকে সমতলের দিকে চলেছি, কোন একটা জায়গা পৌঁছে তোমাকে বিস্তারিত চিঠি দেব।
ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও সরলতা থাকতে পারে—তোমার এ কথার যে কি অর্থ, তা তো আমি বুঝি না। আমার দিক্ থেকে আমি বলতে পারি যে, প্রাচ্য লৌকিকতার সামান্য যা এখনও আমার আছে, তার শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত মুছে ফেলে দিয়ে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে কথা বলার জন্য আমি প্রস্তুত। আহা, যদি একটি দিনের জন্যও স্বাধীনতার পূর্ণ আলোকে বাস করা যায়, এবং সরলতার মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করা যায়! তাই কি শ্রেষ্ঠ পবিত্রতা নয়?
এ সংসারে অন্যের ভয়ে আমরা কাজ করি, ভয়ে কথা বলি, ভয়ে, চিন্তা করি। হায়, শত্রুপরিবেষ্টিত জগতে আমাদের জন্ম! ‘শত্রুর গুপ্তচর বিশেষভাবে আমাকেই লক্ষ্য করে ফিরছে’—এমনি একটা ভীতির হাত থেকে কে নিষ্কৃতি পেয়েছে? আর যে জীবনে এগিয়ে যেতে চায়, তার ভাগ্যে আছে দুর্গতি! এ সংসার কখনও কি আপনার জনে পূর্ণ হবে? কে জানে? আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি।
কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দুর্ভিক্ষনিবারণই আমাদের কাছে প্রধান কর্তব্য। কয়েকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কাজ চলছে—দুর্ভিক্ষসেবা, প্রচার এবং সামান্য শিক্ষাদান। এখন পর্যন্ত অবশ্য খুব সামান্য ভাবেই চলছে, যে-সব ছেলেরা শিক্ষাধীন, তাদের সুবিধামত কাজে লাগান হচ্ছে।
বর্তমানে মান্দ্রাজ ও কলিকাতাই আমাদের কাজের জায়গা। গুডউইন মান্দ্রাজে কাজ করছে। কলম্বোতেও একজন গেছে। যদি ইতোমধ্যেই পাঠান না হয়ে থাকে, তবে আগামী সপ্তাহ থেকে তোমাকে সমস্ত কাজের একটি করে মাসিক বিবৃতি পাঠান হবে। আমি বর্তমানে কর্মকেন্দ্র থেকে দূরে আছি; তাই সবই একটু ঢিলে চলছে, তা দেখতেই পাচ্ছ। কিন্তু মোটের উপর কাজ সন্তোষজনক।
তুমি এখানে না এসে ইংলণ্ডে থেকেই আমাদের জন্য বেশী কাজ করতে পারবে। দরিদ্র ভারতবাসীর কল্যাণে তোমার বিপুল আত্মত্যাগের জন্য ভগবান্ তোমাকে আশীর্বাদ করুন!
আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানকার কাজ অনেকটা জেঁকে উঠবে, তোমার মত আমিও তা বিশ্বাস করি। তথাপি এখানকার কর্মচক্র খানিক ঘুরতে আরম্ভ না করলে এবং আমার অনুপস্থিতিতে কাজ চালাবার মত অনেকে আছে, এটি না জেনে আমার পক্ষে ভারতবর্ষ ত্যাগ করা ঠিক হবে না। মুসলমানরা যেমন বলে, ‘খোদার মর্জিতে’—তা কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মী খেতড়ির রাজা এখন ইংলণ্ডে আছেন। তিনি শীঘ্র ভারতে আসবেন, এবং তিনি অবশ্যই আমার বিশেষ সহায়ক হবেন।
আমার অনন্ত ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৭
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
২৪ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। Orphanage (অনাথাশ্রম) সম্বন্ধে তোমার যে অভিপ্রায় অতি উত্তম ও শ্রী-মহারাজ তাহা অচিরাৎ পূর্ণ করিবেন নিশ্চিত। একটা স্থায়ী centre (কেন্দ্র) যাহাতে হয়, তাহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে। … টাকার চিন্তা নাই—কল্য আমি আলমোড়া হইতে plain-এতে (সমতল প্রদেশে) নামিব, যেখানে হাঙ্গাম হইবে সেইখানে একটা চাঁদা করিব—famine-এর (দুর্ভিক্ষের) জন্য—ভয় নাই। যে প্রকার আমাদের কলিকাতার মঠ, ঐ নমুনায় প্রত্যেক জেলায় যখন এক-একটি মঠ হইবে, তখনই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হইবে। প্রচারের কার্যও যেন বন্ধ না হয় এবং প্রচারাপেক্ষাও বিদ্যাশিক্ষাই প্রধান কার্য; গ্রামের লোকদের lecture (বক্তৃতা) আদি দ্বারা ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদি শিক্ষা দিতে হইবে—বিশেষ ইতিহাস। ইংলণ্ডে আমাদের এই শিক্ষাকার্যের সহায়তার জন্য একটি সভা আছে; ঐ সভার কার্য অতি উত্তম চলিতেছে, সংবাদ পাইয়া থাকি। এই প্রকার চতুর্দিক হইতে ক্রমশঃ সহায় আসিবে। ভয় কি? যারা ভাবে যে, সহায়তা এলে তারপর কার্য করব, তাদের দ্বারা কোন কার্য হয় না। যারা ভাবে যে, কার্যক্ষেত্রে নামলেই সহায় আসবে, তারাই কার্য করে।
সব শক্তি তোমাতে আছে বিশ্বাস কর, প্রকাশ হতে বাকী থাকবে না। আমার প্রাণের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও ব্রহ্মচারীকে জানাইবে। তুমি মঠে খুব উৎসাহপূর্ণ চিঠি মধ্যে মধ্যে লিখিবে, যাহাতে সকলে উৎসাহিত হয়ে কার্য করে। ওয়া গুরুকী ফতে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৮
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
আলমোড়া
২৫ জুলাই, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
এবার আমার প্রতিশ্রুতি পালনের সময়, ইচ্ছা ও সুযোগ হয়েছে। তাই এ চিঠি লিখতে বসেছি। কিছুকাল আমার শরীরটা খুব দুর্বল ছিল, এবং নানা কারণে এই (জুবিলী) উৎসবের মরসুমে আমার ইংলণ্ড যাওয়া স্থগিত রাখতে হল।
আমার অকপট ও প্রেমাস্পদ বন্ধুদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পারলাম না বলে প্রথমটায় মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দেখলাম কর্মফল এড়াবার যো নেই, তাই আমার এই হিমালয়কে নিয়েই পরিতুষ্ট থাকতে হল। তবে এ বিনিময়ে মোটেই খুশী হতে পারিনি, কারণ মানুষের মুখচ্ছবিতে জীবন্ত আত্মার প্রতিফলনে যে সৌন্দর্য, জড় জগতের যাবতীয় সৌন্দর্যের চেয়ে তা অনেক বেশী আনন্দদায়ক।
আত্মাই কি জগতের আলোকস্বরূপ নয়?
নানা কারণে লণ্ডনের কাজ একটু ঢিমে-তেতালায় চলেছে; তার একটি মুখ্য কারণ হল—কাঞ্চন, বুঝলে? আমি সেখানে থাকলে টাকাকড়ি যে-কোন উপায়ে জুটে যায়, এবং কাজ এগিয়ে যায়। এখন কেউই কাঁধ পাতছে না। আমাকে আবার যেতেই হবে, এবং কাজটাকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করতে হবে।
আজকাল বেশ খানিকটা ব্যায়াম করছি ও ঘোড়ায় চড়ছি, কিন্তু চিকিৎসকের ব্যবস্থা মত আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সর-তোলা দুধ খেতে হয়েছিল আর তারই ফলে আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশী এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান কিন্তু এখনই এতটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
জেনে খুশী হলাম খাবার সময় তোমার বেশ ক্ষুধা হয়।
উইম্বল্ডনের মিস মার্গারেট নোব্ল্কে তুমি জান কি? সে আমার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। যদি পার তো তার সঙ্গে ডাকে যোগাযোগ করো, তা হলে সেখানে তুমি আমার কাজে অনেকটা সহায়তা করতে পারবে। তার ঠিকানা—Brantwood, Worple Road, Wimbledon.
তাহলে আমার ছোট বন্ধু মিস অর্চার্ড (Miss Orchard)-কে তুমি দেখেছ এবং তাকে তোমার বেশ ভালও লেগেছে—বেশ কথা। তার সম্বন্ধে আমার অনেক আশা। যখন আমি খুব বুড়ো হয়ে যাব, তখন তোমার বা মিস অর্চার্ডের মত আমার বিশেষ প্রিয় ছোট ছোট বন্ধুদের জয়বার্তা পৃথিবীর বুকে ঘোষিত হচ্ছে দেখে কতই না আনন্দের সঙ্গে জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম থেকে চিরদিনের মত অবসর গ্রহণ করব!
কথায় কথায় বলে রাখি, আমার চুল পাকতে শুরু করেছে—এত তাড়াতাড়ি যে বুড়ো হতে চলেছি, তাতে আনন্দই হচ্ছে। সোনালীর মধ্যে—অর্থাৎ কালোর মধ্যে—রূপালী কেশ অতি দ্রত এসে যাচ্ছে।
ধর্মপ্রচারকের অল্পবয়সী হওয়া ভাল নয়, তোমার তাই মনে হয় না কি? আমি কিন্তু তাই মনে করি, সারা জীবন ধরেই মনে করেছি। একজন বৃদ্ধের প্রতি মানুষ অনেক বেশী আস্থা এবং তাঁকে দেখে অনেক বেশী শ্রদ্ধা জাগে। তথাপি এ জগতে বুড়ো বদমাসগুলিই সবচেয়ে মারাত্মক, তাই নয় কি? এই দুনিয়ার বিচারের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে, এবং হায়, সত্য থেকে তা কতই না স্বতন্ত্র!
তাহলে তোমার ‘বিশ্বজনীন ধর্ম’ (প্রবন্ধ) রিভিউ দ্য দ্যো মোঁদে (Revue de deux Mondes) পত্রিকা নাকচ করে দিয়েছে। মুষড়ে পড়ো না, আবার অন্য কোন কাগজে চেষ্টা কর। আমি নিশ্চিত যে একবার গৃহীত হলে তুমি খুব দ্রুত প্রবেশাধিকার পাবে। আমি খুবই আনন্দিত যে, কাজটিকে তুমি খুব ভালবাস; কাজ তার নিজের পথ তৈরী করে নেবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। স্নেহের মেরী, আমাদের ভাবাদর্শের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং অদূর ভবিষ্যতেই তার সার্থক রূপায়ণ হবে।
মনে হয় এ চিঠিখানা পারি-তে গিয়ে তোমার সঙ্গে মিলিত হবে—তোমার সৌন্দর্যময় পারি—এবং আশা করি ফরাসী দেশের সাংবাদিকতা ও সেখানকার আসন্ন ‘বিশ্ব মেলা’ সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছু লিখবে।
বেদান্ত ও যোগের সাহায্যে তুমি উপকৃত হয়েছ, এ-কথা জেনে আমি খুবই খুশী। দুর্ভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে সার্কাস-দলের ক্লাউনের মত মনে হয়, সে কেবল অন্যকে হাসায়, কিন্তু তার নিজের দশা সকরুণ।
স্বভাবতই তোমার বেশ হাসিখুশী মেজাজ। তোমার মনে কোন কিছুরই যেন প্রভাব পড়ে না। তা ছাড়া তুমি খুবই পরিণামদর্শী, কারণ খুব সাবধানে তুমি ‘প্রেম’ বা প্রেমঘটিত যাবতীয় বাজে জিনিষ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছ। তাহলেই দেখতে পাচ্ছ, তুমি শুভকর্ম করেছ এবং তোমার জীবনব্যাপী কল্যাণের বীজ বপন করেছ। আমাদের জীবনের ত্রুটি হল এই যে, আমরা বর্তমানের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হই—ভবিষ্যতের দ্বারা নয়। যা এই মুহূর্তে আমাদের ক্ষণিক আনন্দ দেয়, তারই পিছনে আমরা ছুটি; ফলে দেখা যায়, বর্তমানের ক্ষণিক আনন্দের বিনিময়ে আমরা ভবিষ্যতের বিপুল দুঃখ সঞ্চার করে বসি।
যদি ভালবাসবার মত কেউ আমার না থাকত! যদি আমি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হতাম! আমার আপনার লোকেরাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশী দুঃখের কারণ হয়েছে—আমার ভ্রাতা, ভগ্নী, জননী ও অন্য সব আপন জন। আত্মীয়স্বজনরাই মানুষের উন্নতির পথে কঠিন বাধাস্বরূপ। আর এটা খুব আশ্চর্য নয় কি যে, মানুষ তৎসত্ত্বেও বিবাহ করবে ও নূতন মানুষের জন্ম দিতে থাকবে!!!
যে মানুষ একাকী, সে-ই সুখী। সকলের কল্যাণ কর, সকলকে তোমার ভাল লাগুক, কিন্তু কাউকে ভালবাসতে যেও না। এটা একটা বন্ধন, আর বন্ধন শুধুই দুঃখ ডেকে আনে। তোমার অন্তরে তুমি একাকী বাস কর—তাতে সুখী হবে। যার দেখাশুনো করবার কেউ নেই এবং কারও তত্ত্বাবধান নিয়ে যে মাথা ঘামায় না, সেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।
তোমার মনের গঠন দেখে আমার ঈর্ষা হয়—শান্ত, নম্র, হাসিখুশী অথচ গভীর ও বন্ধনহীন। তুমি মুক্ত হয়ে গেছ, মেরী, তুমি মুক্ত হয়ে আছ; তুমি তো জীবন্মুক্ত। আমার প্রকৃতিতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের গুণ বেশী, আর তোমার মধ্যে মেয়েদের চাইতে পুরুষের গুণ বেশী। আমি সব সময়ই অন্যের দুঃখ-বেদনা শুধু-শুধুই নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছি, অথচ কারও কোন কল্যাণ করতেও পারছি না—ঠিক যেমন মেয়েদের সন্তান না হলে একটি বেড়াল পুষে তার প্রতি সকল ভালবাসা ঢেলে দেয়।
তোমার কি মনে হয়, তার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা আছে? একদম না, এগুলি হল জড় স্নায়বিক বন্ধন—হ্যাঁ, ঠিক তাই। হায়, পঞ্চভূতে গড়া এই দেহের দাসত্ব ঘোচান—সে কি সহজ কথা!
তোমার বন্ধু মিসেস মার্টিন প্রতি মাসে অনুগ্রহ করে তাঁর পত্রিকাটি আমাকে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে, স্টার্ডির থার্মোমিটার এখন শূন্য ডিগ্রীর নীচে। এই গ্রীষ্মে আমার ইংলণ্ডে যাওয়া হল না বলে তিনি খুবই নিরাশ হয়ে পড়েছেন। আমার কি-ই বা করার ছিল?
আমরা এখানে দুটি মঠের পত্তন করেছি—একটি কলিকাতায়, অপরটি মান্দ্রাজে। কলিকাতার মঠটি (একটি জীর্ণ ভাড়াটে বাড়ী) সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভয়ানক আন্দোলিত হয়েছে।
আমরা বেশ কয়েকটি যুবককে পেয়েছি, তাদের এখন শিক্ষানবিশী চলছে। তা ছাড়া আমরা বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের জন্য সেবাকেন্দ্র খুলেছি, এবং কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে আমরা ঐরকম কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করব।
কয়েকদিন বাদেই আমি সমতলে যাচ্ছি এবং সেখান থেকে যাব—এই পর্বতের পশ্চিম খণ্ডে। সমভূমিতে যখন একটু ঠাণ্ডা পড়বে, তখন দেশময় একবার বক্তৃতা দিয়ে বেড়াব—দেখব কি পরিমাণ কাজ করা যায়।
এখন আর লিখবার সময় নেই, অনেক লোক অপেক্ষা করছে—তাই স্নেহের মেরী, তোমার জন্য সর্ববিধ আনন্দ ও সুখ কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। হাড়মাসের দেহ কখনও যেন তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে, সতত এই প্রার্থনা।
সর্বদা প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৪৯
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
২৮ জুলাই, ১৮৯৭
মা,
আপনার সুন্দর ও সহৃদয় লিপিখানির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার কতই না ইচ্ছা ছিল খেতড়ির রাজার সঙ্গে লণ্ডনে গিয়ে সেখানকার আমন্ত্রণ গ্রহণ করার। গত মরসুমে লণ্ডনে আমার অনেকগুলি ভোজের নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু কপালে তা নেই; আমার ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যই রাজার সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হল না।
এলবার্টা তাহলে আবার আমেরিকায় স্বগৃহে ফিরে এসেছে। রোমে আমার জন্য সে যা করেছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ। হলি (Hollister) কেমন আছে? তাদের উভয়কে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আমার সর্বকনিষ্ঠ নবজাত ভগিনীটিকে আমার হয়ে চুম্বন দেবেন।
ন-মাস হল আমি হিমালয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি। এবার আবার কাজের লাগাম ধরতে সমতলে ফিরে যাচ্ছি।
ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, জো জো ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা এবং আপনাকেও চিরন্তনভাবে।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৫০
আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
স্টার্ডির একখানি চিঠি কাল পেয়েছি। তাতে জানলাম যে, তুমি ভারতে আসতে এবং সব কিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। কাল তার উত্তর দিয়েছি। কিন্তু মিস মূলারের কাছ থেকে তোমার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম, তাতে এ পত্রখানিও আবশ্যক হয়ে পড়েছে; মনে হচ্ছে, সরাসরি তোমাকে লেখা ভাল।
তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষতঃ ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর—একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখনও মহীয়সী মহিলার জন্মদান করতে পারছে না, তাই অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা—সর্বোপরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন।
কিন্তু বিঘ্নও আছে বহু। এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কি ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পার না। এদেশে এলে তুমি নিজেকে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নর-নারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা; ভয়েই হোক বা ঘৃণাতেই হোক—তারা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের খুব ঘৃণা করে। পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গেরা তোমাকে খামখেয়ালী মনে করবে এবং তোমার প্রত্যেকটি গতিবিধি সন্দেহের চক্ষে দেখবে।
ভারতে তা ছাড়া, জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান। এদেশের প্রায় সব জায়গার শীতই তোমাদের গ্রীষ্মের মত; আর দক্ষিণাঞ্চলে তো সর্বদাই আগুনের হল্কা চলছে।
শহরের বাইরে কোথাও ইওরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই। এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি। সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমনি আমি কেউ নই; তবু আমার যেটুকু প্রভাব আছে, সেটুকু দিয়ে আমি অবশ্যই তোমায় সাহায্য করব।
কর্মে ঝাঁপ দেবার পূর্বে বিশেষভাবে চিন্তা করো এবং কাজের পরে যদি বিফল হও কিম্বা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক্ থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে—তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাক। ‘মরদ্কী বাত হাতীকা দাঁত’—একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা। আবার তোমাকে একটু সাবধান করা দরকার—তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মিস মূলার কিম্বা অন্য কারও পক্ষপুটে আশ্রয় নিলে চলবে না। তাঁর নিজের ভাবে মিস মূলার চমৎকার মহিলা; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। এই মনোভাব তাঁর অজ্ঞাতসারেই বারবার মাথা তুলছে এবং দিন কয়েকের মধ্যেই তুমি বুঝতে পারবে যে, তাঁর সঙ্গে বনিয়ে চলা অসম্ভব। তাঁর বর্তমান সঙ্কল্প এই যে, তিনি কলিকাতায় একটি বাড়ী ভাড়া নেবেন—তোমার ও নিজের জন্য, এবং ইওরোপ ও আমেরিকা থেকে যে-সব বন্ধুদের আসার সম্ভাবনা আছে তাঁদেরও জন্য। এটা অবশ্য তাঁর সহৃদয়তা ও অমায়িকতার পরিচায়ক; কিন্তু তাঁর মঠাধ্যক্ষাসুলভ সঙ্কল্পটি দুটি কারণে সফল হবে না—তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততা। কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভাল; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
মিসেস সেভিয়ার নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভাল, এত স্নেহময়ী তিনি! সেভিয়ার-দম্পতিই একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমন কি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি। কিন্তু তাঁদের এখনও কোন নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই। তুমি এলে তোমার সহকর্মীরূপে তাঁদের পেতে পার এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে। কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড ও বোষ্টনের মিসেস বুল এই শরৎকালেই ভারত-পরিভ্রমণে আসছেন। মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লণ্ডনেই দেখছ—সেই পারি-ফ্যাশনের পোষাক-পরিহিতা মহিলাটি! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ইওরোপের হয়ে এদেশে আসছেন; সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে।
মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি। কিন্তু চিঠিটি বড় শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লণ্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয়।
অনন্ত ভালবাসা জানবে। ইতি
সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শশী,
তোমার কাজকর্ম বেশ চলছে, খবর পাইলাম। তিনটি ভাষ্য বেশ করে পড়ে রাখবে, আর ইওরোপীয় দর্শনাদিও বেশ করে পড়বে, ইহাতে অন্যথা না হয়। পরকে মারতে গেলে ঢাল-তলওয়ার চাই, এ কথা যেন ভুল একদম না হয়। সুকুল এক্ষণে পৌঁছিয়াছে, তোমার সেবাদিও বেশ চলছে বোধ হয়। সদানন্দ যদি সেখানে থাকিতে না চায়, কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবে, এবং প্রতি সপ্তাহে একটা রিপোর্ট—আয়-ব্যয় প্রভৃতি সব সমেত মঠে পাঠাইতে ভুল যেন না হয়। আলাসিঙ্গার বোনাই এখানে বদ্রী শা-র নিকট হতে চারিশত টাকা ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে; পৌঁছিবামাত্র পাঠাইবার কথা, এখনও কেন পাঠাইল না। আলাসিঙ্গাকে জিজ্ঞাসিবে এবং সত্বর পাঠাইতে কহিবে; কারণ আমি পরশুদিন এখান হতে যাচ্ছি—মসূরী পাহাড় বা অন্য কোথাও যাই পরে ঠিক করব। কাল এখানে ইংরেজ-মহলে এক লেকচার হয়েছিল, তাতে বড়ই খুশী। কিন্তু তার আগের দিন হিন্দীতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী—হিন্দীতে যে oratory (বাগ্মিতা) করতে পারব তা তো আগে জানতাম না। মঠে ছেলেপুলে যোগাড় হচ্ছে কি? যদি হয় তো কলিকাতায় যেভাবে কার্য হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে করে যাও। নিজের বুদ্ধি এখন কিছুদিন বেশী খরচ করবে না, পাছে ফুরিয়ে যায়—কিছুদিন পরে করো।
তোমার শরীরের উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে—তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টা আরও খারাপ হয়ে যায়। বিদ্যের জোর না থাকলে কেউ ঘণ্টা-ফণ্টা মানবে না—এ-কথাটা নিশ্চিত, এবং এইটি মনে স্থির রেখে কার্য করবে।
আমার হৃদয়ের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও গুডউইন প্রভৃতিকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৩৫২
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩০ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার কথামত ডিষ্ট্রীক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট লেভিঞ্জ সাহেবকে এক পত্র লিখিলাম। অপিচ তুমি তাঁহার বিশেষ বিশেষ কার্যকলাপ বিবৃত করিয়া শশী-ডাক্তারকে দিয়া দেখাইয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ একটি লম্বাচওড়া পত্র লিখিবে ও তাহার এক কপি উক্ত মহোদয়কে পাঠাইবে। আমাদের মূর্খগুলো খালি দোষ অনুসন্ধান করে, গুণও কিঞ্চিৎ দেখুক।
আমি আগামী সোমবার এস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি।
Orphan (অনাথ বালক) যোগাড়ের কি করছ? মঠ হতে চারি-পাঁচজনকে না হয় ডাকিয়া লও, গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজিলে দুদিনেই মিলিবার সম্ভাবনা।
Permanent Centre (স্থায়ী কেন্দ্র) করিতে হইবে বৈকি। আর—দেবকৃপা না হলে এদেশে কি কাজ হয়? রাজনীতি ইত্যাদিতে কোন যোগ দিবে না অথবা সংস্রব রাখিবে না। অথচ তাদের সহিত কোন বিবাদাদিতেও কাজ নাই। একটা কার্যে তন্ মন ধন। এখানে একটি—সাহেবমহলে-ইংরেজী বক্তৃতা হইয়াছিল, ও একটি—দেশী লোকদিগকে হিন্দীতে। হিন্দীতে আমার এই প্রথম, কিন্তু সকলের তো খুব ভাল লাগল। সাহেবরা অবশ্যই যেমন আছে, নাল গড়িয়ে গেল, ‘কালো মানুষ!’ ‘তাই তো কি আশ্চর্য’ ইত্যাদি। আগামী শনিবার আর একটি বক্তৃতা ইংরেজীতে, দেশী লোকের জন্য। এখানে একটি বৃহৎ সভা স্থাপন করা গেল—ভবিষ্যত