স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগাে বক্তৃতামালা

স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগাে বক্তৃতামালা এবং পূর্বের ও পরের ঘটনাবলী 
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগাে বক্তৃতামালা এবং পূর্বের ও পরের ঘটনাবলী

===========
প্রাককথন
আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার শিকাগাে শহরে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বধর্মমহাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চলেছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ পর্যন্ত। এই ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের অংশগ্রহণ ও ভাষণ ভারতবর্ষ তথা বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতের নবজাগরণ এর দ্বারা স্বরান্বিত হয়েছে, এবং যাঁরা প্রকৃতই ধর্মপ্রাণ ও চিন্তাশীল, পৃথিবীর সর্বত্র তাদের ধর্ম-সম্বন্ধীয় দৃষ্টিভঙ্গি এই ঘটনার দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছে তা তাঁরা যে-ধর্মেরই মানুষ হােন না কেন। 
ধর্মমহাসভায় অন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা যেখানে নিজের নিজের ধর্ম সম্বন্ধেই বলেছিলেন, স্বামীজী সেখানে দেখালেন যে, সব ধর্মই সত্য; কারণ প্রতিটি ধর্মই মানুষকে একই ভগবানের কাছে নিয়ে যায়। ধর্মমহাসভার প্রথম বক্তৃতাটি তিনি শুরু করেছিলেন, ‘আমেরিকার বােন ও ভাইয়েরা’ (সিস্টারস্ অ্যান্ড ব্রাদারস্ অফ আমেরিকা') এই সম্বােধনের মাধ্যমে। তার এই হৃদয়স্পর্শী অন্তরঙ্গ সম্বোধন উপস্থিত কয়েক হাজার শ্রোতাকে আবেগে উদ্বেল করে দিয়েছিল। টানা দু-মিনিট তাঁরা করতালি দিয়েছিলেন। প্রথমদিনের এই ভাষণটি তিনি শেষ করেছিলেন এই কথাগুলি বলে : ‘আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, এই সম্মেলনের সম্মানে আজ সকালে যে ঘণ্টাধ্বনি হল, তা যেন সমস্ত ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লেখনীর সাহায্যে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার অত্যাচারের মৃত্যুঘণ্টা হয়; একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে যেসব মানুষ, তাদের পরস্পরের মধ্যের সমস্ত অসদ্ভাবের সমাপ্তি ঘােষণা করুক ঐ ঘণ্টাধ্বনি।' এরপরে ধর্মমহাসভায় তিনি আরও ভাষণ দিয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ১৯ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে দীর্ঘ লিখিত ভাষণ এবং ধর্মমহাসভার শেষ দিন ২৭ সেপ্টেম্বরে প্রদত্ত ভাষণ। তার প্রতিটি ভাষণেরই সারমর্ম ছিল : সমন্বয়, শান্তি, পরমতগ্রহীষ্ণুতা এবং বিশ্বজনীনতা। বস্তুত, এগুলি যেমন তার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী, তেমনি ভারতবর্ষের বাণী। সংবাদপত্রগুলি একযােগে তার সম্বন্ধে বলেছিল : তিনিই ধর্মমহাসভার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং তার বাণী আকাশের মতােই উদার। ১২৫ বছর পরে আজ তাঁর বাণী যেন আরও প্রাসঙ্গিক। 
স্বামীজীর এই ঐতিহাসিক শিকাগাে বক্তৃতামালার ১২৫তম বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্তা মমতা ব্যানার্জীর আগ্রহে ও নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করেছে, যেটি ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে নানা কর্মসূচী পালন করবে। তার মধ্যে একটি হল স্বামীজীর শিকাগাে বক্তৃতা বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় দুটি পুস্তিকা প্রকাশ। রাজ্য সরকার এই পুস্তিকা দুটি মুদ্রণ ও প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরােধে আমরা এই পুস্তিকা দুটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম এবং দায়িত্বটি পালন করতে পেরে আমরা খুশি। 
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ধন্যবাদ যে, স্বামীজীর সর্বধর্মগ্রহীষ্ণুতা, শান্তি ও সমন্বয়ের বাণী সকলের কাছে, বিশেষত ছাত্র-সমাজের কাছে, পৌঁছে দেবার জন্য তাঁরা এরকম সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। বিশেষ ধন্যবাদ স্কুল শিক্ষা দপ্তরকেও, কারণ রাজ্য সরকারের পক্ষে তারাই এই বইটির প্রকাশক। পুস্তিকার বিষয়বস্তু অধিকাংশই আমরা নিয়েছি অদ্বৈত আশ্রম, মায়াবতী এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতার দুটি প্রকাশনা থেকে। আমাদের এই দুটি শাখাকেন্দ্রের প্রতিও আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। 
৯ জুলাই ২০১৮ বেলুড় মঠ 
স্বামী সুবীরানন্দ
সাধারণ সম্পাদক রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন 

স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগাে বক্তৃতামালা 

পটভূমিকা 

ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকালে এর অসীম সহনশীলতার শক্তি আমাদের মুগ্ধ করে। বিভিন্ন জাতি এদেশে এসেছে তাদের বিভিন্ন জীবনধারা ও সংস্কৃতি নিয়ে। কিন্তু ভারতবর্ষ সবাইকে আপনার করে নিয়েছে। বিদেশীরাও কখন যেন নিজেদেরও অজ্ঞাতসারে এদেশকে তাদের আপনার দেশ বলে ভাবতে শুরু করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে, ভারতবর্ষের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে, ভারতবর্ষের মানুষের ভালবাসার গুণে। কারণ ভারতবর্ষের বাণী হল : ‘বসুধৈব কুটুম্বক’সমস্ত পৃথিবীই আমার আত্মীয়।
কিন্তু যত বিদেশী শক্তি ভারতবর্ষে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল ইংরেজশক্তি। কারণ, তারা আঘাত হেনেছিল ভারতবাসীর চিন্তার জগতে। শিক্ষিত জনসাধারণের মনে তারা এই ধারণা জন্মাতে  পেরেছিল যে, ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে ভাল কিছু নেই, সবই মন্দ। যদি জগতে আমাদের সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হয়, তবে আমাদের সব। কিছুই শিখতে হবে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে। 

শ্রীরামকৃষ্ণ 

এরকম এক পরিস্থিতিতে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব–১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে, কলকাতা থেকে আশি মাইল দূরে কামারপুকুরে। ডাকনাম গদাধর। গদাধরের মাতাপিতা দরিদ্র, কিন্তু চরিত্র ও সততার গুণে গ্রামের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। প্রখর মেধা গদাধরের কিন্তু প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা তাঁর। 
শৈশবে পিতৃবিয়ােগ হয় গদাধরের। উপার্জনের পথ খুঁজতে পিতৃপ্রতিম জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসেন কলকাতায়, সঙ্গে নিয়ে আসেন সবচেয়ে আদরের ছােটভাইকে। রানী রাসমণির কালীমন্দিরে পূজকের কাজ পান রামকুমার। এবং তাঁর দেহত্যাগের পর গদাধরই মা-কালীর পূজারী হন। 
এবার গদাধরের সাধক জীবন শুরু হয়। তীব্র তপস্যার পরে মা একদিন জ্যোতির্ময়ী রূপে দেখা দেন তাকে। কিন্তু মায়ের দেখা পেয়েই ক্ষান্ত হলেন না গদাধর। একে একে হিন্দুধর্মের সব মত, সব পথ, সব ভাবে সাধনা করলেন তিনি। তারপর ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মের সাধনাও করলেন। বিভিন্ন ধর্মমতে সাধনা করে তিনি উপলব্ধি করলেন যে : সমস্ত ধর্মমতই মানুষকে একই লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। যত মত তত পথ। 
শ্রীরামকৃষ্ণের কথা এরপর কলকাতার লােকদের মধ্যে প্রচারিত হতে থাকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর সম্বন্ধে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে একদল ইংরেজি শিক্ষিত উৎসাহী যুবক তার চারপাশে সমবেত হন। এঁদের মধ্যে কয়েকজনকে শ্রীরামকৃষ্ণ বেছে নিলেন তার চিহ্নিত পার্ষদ হিসেবে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে প্রতিভাদীপ্ত ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত , ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয়পাত্রও ছিলেন তিনি, কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর বাণীকে তাঁর অবর্তমানে জগতে ছড়িয়ে দেবে এই নরেন্দ্রনাথই। 

শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বের সূচনা : বরানগর মঠ 

১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তিনি দেহরক্ষা করেন। তার আগে এই রােগশয্যায় শায়িত থাকার সময়েই তিনি ভবিষ্যৎ শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সূচনা করে যান। ছােট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিধর সেই সঙ্ঘ। নরেন্দ্রনাথ দত্ত, রাখালচন্দ্র ঘােষ, তারকনাথ ঘােষাল, বাবুরাম ঘােষ প্রভৃতি কয়েকটি শুদ্ধ চরিত্র সর্বত্যাগী যুবক সেই সঙ্ঘের স্তম্ভ। আর নরেন্দ্রনাথকে নির্দিষ্ট করে যান সেই সঘের নেতারূপে। 
শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর বরানগরে একটি পােড়াে বাড়ী ভাড়া নেওয়া হয়। যুবকভক্তরা গৃহত্যাগ করে সেখানে থাকতে আরম্ভ করেন। এটিই হল প্রথম রামকৃষ্ণ মঠ। অচিরেই যুবকভক্তরা বিরজাহােম করে সন্ন্যাসগ্রহণ করলেন। তাঁদের প্রত্যেকের নতুন নাম হল। নরেন্দ্রনাথের নাম হল বিবিদিষানন্দ। তবে পরিব্রাজক জীবনে তিনি সচ্চিদানন্দ ও বিবেকানন্দ নামও ব্যবহার করেছেন। শেষােক্ত নামেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন। এখানে উল্লেখ্য : শ্রীরামকৃষ্ণের ষােলাে জন সন্ন্যাসী-শিষ্য ছিলেন। 

বরানগর মঠের জীবন 

দারিদ্র ও কৃচ্ছতা ছিল বরানগর মঠের নিত্যসঙ্গী। খাওয়া কোনদিন জুটত কোনদিন জুটত না। তবুও যুবকভক্তরা সারাদিন সাধন-ভজন ও সৎপ্রসঙ্গ করতেন। স্বামীজীকে দেখলে তখন মনে হত, তাঁর যেন অফুরন্ত কর্মশক্তি। ভােরবেলা গান গেয়ে সবাইকে তিনি ঘুম থেকে তুলতেন। তারপর . সকলে মিলে ধ্যানে বসতেন, সেই ধ্যান চলত দুপুরবেলা পর্যন্ত। ধ্যানের পর শুরু হত স্তব পাঠ, ভজন ও অন্যান্য সৎপ্রসঙ্গ। নানা প্রসঙ্গ আলােচনা হত। স্বামীজীই সেই আলােচনার মধ্যমণি। তার বৈশিষ্ট্য হল ; এক প্রসঙ্গ থেকে আর এক প্রসঙ্গে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে যেতেন। সমস্ত জ্ঞানবারিধি যেন তিনি মন্থন করে রেখেছেন। যেসব বিষয় পড়া হত তার মধ্যে ছিল ধর্ম, সঙ্গীত, দর্শন, ইতিহাস, জড়বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি। গীতা, উপনিষদ প্রভৃতি শাস্ত্র যেমন পড়া হত, তেমনি পড়া হত কান্ট, মিল, হেগেল, স্পেন্সার, নাস্তিক এবং জড়বাদীদের মত। 
কিন্তু শুধু নিজের মুক্তিই সন্ন্যাসীদের লক্ষ্য নয়। জগতের কল্যাণও সন্ন্যাসীদের কর্তব্য এবং এই কর্তব্য পালনের শিক্ষা শ্রীরামকৃষ্ণই দিয়ে গেছিলেন নরেন্দ্রনাথকে। তাই সাধনভজন বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজী ও তাঁর গুরুভাইরা যথাসাধ্য আর্ত ও পীড়িতদের সেবা করতেন। এমনকি এই সময় তারা কুষ্ঠরােগীর সেবা পর্যন্ত করেছেন। 

পরিব্রাজক জীবন : ভারত পরিক্রমা 

ভারতীয় সাধুদের চিরন্তন ধারাই হল : তাঁরা একজায়গায় বেশীদিন থাকেন না; তীর্থে তীর্থে পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ান সাধন ভজনের জন্য। স্বামী বিবেকানন্দও এর ব্যতিক্রম নন। কখনও একাকী, কখনও বা কয়েকজন গুরুভাই মিলে তিনিও পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন একাধিকবার। শেষবার পরিব্রাজক হয়ে বেরিয়েছিলেন ১৮৯০-এর জুলাই মাসে। তিন বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ১৮৯৩-এর ৩১ মে আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন। স্বামীজীর ভারত-পরিক্রমা বলতে আমরা সাধারণত এই তিন বছরের পরিব্রাজক জীবনকেই বুঝিয়ে থাকি। 
পরিব্রাজক জীবনে পরিচয় গােপন করার জন্য স্বামীজী নানা নাম ব্যবহার করতেন—স্বামী বিবিদিষানন্দ, স্বামী সচ্চিদানন্দ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। অনেকদিন লােকের ধারণা ছিল ‘বিবেকানন্দ’ নামটি খেতড়ির রাজা অজিত সিং দিয়েছেন। কিন্তু আবু পাহাড় থেকে ৩০ এপ্রিল ১৮৯১ তারিখে লেখা একটি চিঠিতেও স্বামীজী ‘বিবেকানন্দ’ নামটি ব্যবহার করেছেন, অথচ তখনও তার খেতড়ি রাজের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। 
আত্মগােপন করলেও প্রতিভা গােপন করা স্বামীজীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন শিকাগাে ধর্মমহাসভার প্রস্তুতি সংবাদ ভারতে আসতে শুরু করেছে। তাঁর ব্যক্তিত্বে ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁকে শিকাগাে যাবার কথা বলতে থাকেন। ১৮৯২-এর ডিসেম্বর মাসে স্বামীজী দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারীতে পৌঁছন। তারিখটি ছিল সম্ভবত: ২৪ ডিসেম্বর। সমুদ্রবক্ষে কিছু দূরে একটি শিলাখণ্ড। এপারে মা কন্যাকুমারীর মন্দির, আর ঐ শিলাখণ্ডে রয়েছে কন্যাকুমারী মায়ের পদচিহ্ন। লােকের সেরকমই বিশ্বাস। নৌকার ভাড়া এক পয়সা। কিন্তু সেটুকু পয়সাও স্বামীজীর ছিল না। তাই হাঙড়-সঙ্কুল সেই সমুদ্র সাঁতরেই তিনি হাজির হলেন সেই শিলাখণ্ডে। তিন-দিন, তিন রাত তিনি ভারতবর্ষের ধ্যানে মগ্ন রইলেন। ভারতের অতীত গৌরব, বর্তমানের দুর্দশা ও তার কারণ, এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতর রূপ ও সেখানে পৌঁছনাের পথ সব চলচ্চিত্রের মতাে তাঁর অন্তরে খেলে গেল। যেন বােধিলাভ করে জেগে উঠলেন বুদ্ধের মতাে। বর্তমানের ঘন অন্ধকার থেকে কিভাবে মুক্তিলাভ করবে ভারতভূমি, তারই উত্তর খুঁজে পেলেন তিনি। ভারতের প্রাণশক্তি রয়েছে ধর্মে। ভারতের অধঃপতন ধর্মের জন্য নয়, বরং ধর্মকে সমাজে যেভাবে কাজে লাগানাে উচিত ছিল, তা হয়নি বলেই ভারতের এই অধঃপতন। এই ধর্মকে ঠিক ঠিক জাগাতে হবে। এখন এমন ধর্ম চাই যার মূলমন্ত্র হবে মানবপ্রেম। এবং ভারত ও বিশ্বের প্রয়ােজনে তার ভবিষ্যৎ ভূমিকা কি হবে, তাও তিনি বুঝতে পারলেন। 
ভগিনী নিবেদিতা স্বামীজীর সম্বন্ধে বলেছেন, শাস্ত্র, গুরু এবং মাতৃভূমি— এই তিনটি মিলে বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে। শাস্ত্র পড়ে তিনি যে সনাতন আধ্যাত্মিক সত্যের কথা জেনেছিলেন, গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে তিনি বুঝলেন যে, সেগুলি শুধু অতীতে সত্য ছিল না—আজও সমান সত্য। এবার তাঁর দেখার প্রয়ােজন ছিল : কিভাবে তার মাতৃভূমি সেই সত্যকে যুগ যুগ ধরে লালন করে এসেছে। তাঁর ভারত পরিক্রমার মাধ্যমে এই প্রয়ােজন সাধিত হল। এবং যে বিবেকানন্দকে জগতের প্রয়ােজন ছিল সেই বিবেকানন্দ তখনই তৈরী হয়ে উঠলেন। 
কন্যাকুমারী থেকে স্বামীজী এবার যখন মাদ্রাজে এলেন, তিনি তখন প্রায় মনঃস্থির করে ফেলেছেন শিকাগাে যাবার জন্য। সেকথা জেনে মাদ্রাজের যুবকরা উৎসাহে কিছু টাকা সংগ্রহ করে ফেললেন। কিন্তু সন্ন্যাসী তিনি চিরকাল ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে এসেছেন। তখনও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশ পাননি। তাই সংগৃহীত টাকা তিনি গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বললেন। অবশেষে একদিন স্বপ্নে দেখলেন : শ্রীরামকৃষ্ণ সমুদ্র অতিক্রম করছেন, আর তাঁকে ইঙ্গিত করছেন অনুসরণ করতে। ঘুম ভেঙে গেল, স্বামীজীর কানে তখনও ভাসছে শ্রীরামকৃষ্ণের অশরীরী বাণী—যাও'। .
স্বামীজীর মনের সন্দেহ দূর হল। কিন্তু শ্রীমা সারদাদেবীর আশীর্বাদ প্রয়ােজন। তাঁকে চিঠি লিখলেন আশীর্বাদ চেয়ে। কিছুদিন পরে মা-এর আশীর্বাদ-সহ চিঠি এল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বামীজী বললেন : আঃ এতক্ষণে সব ঠিক হল। মায়েরও তাহলে ইচ্ছা যে আমি যাই।' 
স্বামীজীর কথা শুনে তাঁর বহু বন্ধু ও ভক্তরা পূর্ণ উদ্যমে তাঁর পাশ্চাত্যযাত্রার আয়ােজন করতে শুরু করলেন। মাদ্রাজের যুবক-ভক্তরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে করে চার হাজার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। তা দিয়ে তারা স্বামীজীর জন্য একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেট কেটে দিলেন। যেটুকু টাকা বেঁচেছিল স্বামীজীর সঙ্গে দিয়ে দিলেন। পরে খেতড়ির রাজা ঐ টিকেটটিকে প্রথম শ্রেণীর টিকেট-এ পরিবর্তিত করে দেন এবং স্বামীজী তাঁর গুরু বলে, স্বামীজীর জন্য একটি সিল্কের আলখাল্লা ও পাগড়ি তৈরী করিয়ে দেন। 
৩১শে মে ১৮৯৩ স্বামীজী ‘পেনিনসুলার’ জাহাজে করে বােম্বে থেকে আমেরিকা যাত্রা করলেন। এর কয়েকদিন মাত্র আগে স্বামীজী তার গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দকে (হরি মহারাজকে) কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন : ‘হরিভাই, এই ধর্মমহাসভা-টভা যা হচ্ছে, এসব এর (নিজের দিকে দেখিয়ে) জন্য। আমার মন তাই বলছে।” 

আমেরিকায় স্বামীজী 

শিকাগােয় 

প্রায় দু-মাস পরে, পথে একবার জাহাজ পাল্টে, ২৫ জুলাই ১৮৯৩ স্বামীজী ‘এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া’ জাহাজে কানাডার ভ্যাঙ্কুবর বন্দরে উপস্থিত হলেন। ভ্যাঙ্কুবর থেকে দু-বার ট্রেন পাল্টে শিকাগােয় এসে উপস্থিত হলেন ৩০ জুলাই, রবিবার, রাত এগারােটায়। 
অপরিচিত, বন্ধুহীন পরিবেশে নিশ্চয়ই তিনি অস্বস্তি বােধ করছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক যে ব্যাপারটি ঘটল তা হল এই : তিনি জানতে পারলেন, ধর্মমহাসভায় যােগ দিতে হলে পরিচয়পত্র দরকার, তার সঙ্গে কোন পরিচয় পত্র নেই। আর ধর্মমহাসভায় যােগ দেবার তারিখও পেরিয়ে গেছে। 
যে-আশা নিয়ে স্বামীজী আমেরিকা এসেছিলেন, শিকাগােয় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা এইভাবে চুরমার হয়ে গেল। এদিকে শিকাগােয় থাকার খরচ বড্ড বেশী। স্বামীজীর সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসার মুখে। কি করবেন তিনি? 
শুনলেন, বস্টন শহরে খাওয়া-থাকার খরচ অনেক কম। তাই প্রায় দু-সপ্তাহ। শিকাগােয় থেকে তিনি রওনা হলেন বস্টন অভিমুখে। 

বস্টনে 

ট্রেনে পরিচয় হল বস্টনের এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলার সঙ্গে, নাম ক্যাথেরিন স্যানবর্ন। স্বামীজীর সৌম্য প্রতিভাদীপ্ত চেহারা দেখে তিনি নিজেই এসে পরিচয় করলেন স্বামীজীর সঙ্গে। দু-একটি কথা বলেই তিনি মুগ্ধ হলেন এবং স্বামীজীকে আমন্ত্রণ জানালেন তার খামার বাড়িতে থাকবার জন্য। স্বামীজী তখনই প্রায় কপর্দক শূন্য। তিনি মহিলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। বস্টনের সেই খামার বাড়ি থেকে কিছুদিন পরে স্বামীজী তার এক শিষ্যকে চিঠিতে লিখেছেন : এখানে থাকায় আমার এই সুবিধা হয়েছে যে, প্রতিদিন এক পাউণ্ড করে যে খরচ হচ্ছিল তা বেঁচে যাচ্ছে, আর তার লাভ এই যে, তিনি তার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে ভারতের এক অদ্ভুত জীব দেখাচ্ছেন! 
ঐ চিঠিতে পরে যে কথাগুলি তিনি লিখেছেন তা থেকে বােঝা যায়, সর্বাবস্থায় তিনি কতটা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন : ‘যিনি মেরীর পুত্র, আমি এখানে তার সন্তানদের মধ্যে আছি। প্রভু যীশুই আমায় সাহায্য করবেন। ঐ চিঠিতেই সুস্পষ্ট যে, দেশবাসীর জন্য তার উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না : ভারতে আমাদের দরিদ্র নীচু জাতদের আমরা কি ভেবে থাকি? তাদের কোন সুযােগ নেই, নিস্তার নেই, কোন পথ নেই উপরে ওঠার। ... প্রতিদিন তারা আরও নীচুতে নেমে যাচ্ছে।' 
বস্টনে থাকাকালীন মিস ক্যাথেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজী সুপরিচিত হয়ে উঠলেন। মিস স্যানবর্নের সূত্রেই স্বামীজীর সঙ্গে পরিচয় হল হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের। এই সুপণ্ডিত অধ্যাপককে বলা হয়েছে বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী। কিন্তু স্বামীজীর প্রতিভা তাঁকেও মুগ্ধ করল। তিনি স্বামীজীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কেন আসন্ন ধর্মমহাসভায় যােগ দিচ্ছেন না। স্বামীজী যখন বললেন যে, পরিচয় পত্র নেই বলেই যােগ দিতে পারছেন না, তখন অধ্যাপক রাইট বললেন : ‘আপনার কাছে পরিচয়পত্র চাওয়ার অর্থ হল সূর্যকে প্রশ্ন করা তার কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা।' তারপর ধর্মমহাসভার এক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে অধ্যাপক রাইট লিখে দিলেন : ইনি এমন একজন ব্যক্তি যে, আমেরিকার সমস্ত অধ্যাপকের পাণ্ডিত্য এক করলেও এঁর পাণ্ডিত্যের সমান হবে না। এইভাবে অধ্যাপক রাইটের চেষ্টায় অসম্ভব সম্ভব হল—ধর্মমহাসভার রুদ্ধ দ্বার অপ্রত্যাশিতভাবেই স্বামীজীর কাছে খুলে গেল। 
তিন সপ্তাহ বস্টনে থেকে স্বামীজী আবার রওনা হলেন শিকাগাে। বস্টন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই তিন সপ্তাহে স্বামীজী বারােটা বক্তৃতা করেছিলেন। ঐ সূত্রে আমেরিকার জনসাধারণ সম্বন্ধেও তাঁর কিছুটা ধারণা হয়েছিল। এইভাবে দৈবনির্দেশেই যেন আসন্ন ধর্মমহাসভার জন্য স্বামীজীর কিছুটা পূর্বপ্রস্তুতি হয়ে গেল। 

শিকাগােয় আবার 

৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় স্বামীজী আবার শিকাগােয় এসে পৌঁছলেন। পৌছে দেখলেন, ধর্মমহাসভার অফিসের ঠিকানা লেখা কাগজটা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। লােককে জিজ্ঞেস করে ঠিকানা জানতে পারলেন না। তখন ক্লান্ত, অবসন্ন অবস্থায় তিনি রাতের জন্য আশ্রয় নিলেন স্টেশনেরই এক মালগাড়ির ফাঁকা কামরায়। পরদিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙল তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। ভারতের মতাে এখানেও তিনি ভিক্ষা করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমেরিকার শহরে ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীকে কেউ ভিক্ষা দেয় না। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করে তিনি যখন সম্পূর্ণ অবসন্ন, তখন ঠিক করলেন : আর চেষ্টা করবেন না তিনি। ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে রাস্তার ধারে বসে পড়লেন তিনি। আর ঈশ্বরও যেন ঠিক এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিকের বাড়ির দরজা খুলে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন ‘রাজরানী’ সদৃশ এক মহিলা। স্বামীজীর কাছে এসে তিনি জানতে চাইলেন । তিনি ধর্মমহাসভার প্রতিনিধি কিনা। স্বামীজী যখন বললেন, তিনি তা-ই, সেই। মহিলা তাকে সসম্মানে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মহিলার সঙ্গে ধর্মমহাসভার কর্তৃপক্ষের পরিচয় ছিল। বিকেলে এই মহিলাই সঙ্গে করে স্বামীজীকে নিয়ে গেলেন ধর্মমহাসভার অফিসে। সেখানে রাইট সাহেবের দেওয়া পরিচয় পত্র দেখানাের সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রতিনিধি হিসাবে গৃহীত হলেন। ঐ মহিলার নাম মিসেস জর্জ ডবলিউ হেল। এই হেল পরিবারের সঙ্গে স্বামীজীর চিরকালের জন্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল । 

ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে 

শিকাগাের বিশ্বধর্মমহাসভা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্করের চারশাে বৎসর পূর্তি উপলক্ষে আমেরিকা এক বিরাট মেলার আয়ােজন করেছিল। ১,০৩৭ একর জমির উপর অনুষ্ঠিত এই প্ৰকাণ্ড মেলার নাম দেওয়া হয়েছিল কলম্বিয়ান এক্সপােজিসন। কিন্তু এই মেলায় সবচেয়ে গুরুত্ব ও আকর্ষণ ছিল ধর্মমহাসভার। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম জগতের প্রধান প্রধান ধর্মগুলি এক মঞ্চে মিলিত হবে তাদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করতে! তাই এই ধর্মমহাসভাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা তথা বিশ্বে। উদ্দীপনার শেষ ছিল না। 
ধর্মমহাসভার জন্য স্থান নির্বাচিত হয়েছিল শিকাগাের আর্ট ইনস্টিটিউটে। ধর্মমহাসভার অধিবেশনগুলির দুটি করে ভাগ ছিল মূল শাখা ও বিজ্ঞান শাখা। মূল শাখার অনুষ্ঠানগুলি হয়েছিল কলম্বাস হলে, যার আসন সংখ্যা চার হাজার। আর বিজ্ঞান শাখার অনুষ্ঠানগুলির জন্য নির্দিষ্ট ছিল ওয়াশিংটন হল। 
ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত দুটি : প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ধর্মের প্রতিনিধিদের একই সভায় একত্রিত করা এবং বিভিন্ন ধর্ম পরস্পরকে কিভাবে আলােকিত করেছে বা আলােকিত করতে পারে—আলােচনা করা। উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল সন্দেহ নেই। এবং এই ধরনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অন্য কোন মত যে থাকতে পারে তা অকল্পনীয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল কিছু গোঁড়া খ্রীষ্টান ধর্মমহাসভাকে সমালােচনা করতে শুরু করলেন। তাদের মতে, খ্রীষ্টধর্মই একমাত্র ধর্ম, ধর্মমহাসভা ডেকে অন্য ধর্মকে তার পাশে বসানাের অর্থ ‘যীশুখ্রীষ্টর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা'। 
কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমেরিকার শিক্ষিত জনসাধারণ ধর্মমহাসভার পরিকল্পনাকে সর্বতােভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং এর জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলেন। 

শিকাগাে ধর্মমহাসভায় স্বামীজী 

উদ্বোধনী ভাষণ 

১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর সােমবার ধর্মমহাসভা শুরু হল। ঠিক দশটার সময় আর্ট ইনস্টিটিউটের কলম্বাস হল-এ সমবেত দশটি ধর্মের উদ্দেশে দশটি ঘণ্টাধ্বনি হল। এই দশটি ধর্ম হল : ইহুদী ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, তাও ধর্ম, কনফুসিয়াসের ধর্ম, শিন্টো ধর্ম, পারসিক ধর্ম, ক্যাথলিক ধর্ম এবং গ্রীক চার্চ ও প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। সেই বিরাট হল, 'তার অত জাঁকজমক আর সামনে উপস্থিত কয়েক হাজার শ্রোতা---এসব দেখে স্বামীজীর মতাে মানুষও প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। সকালের অধিবেশনে তিনি বক্তৃতা করলেন না। 
দ্বিতীয় অধিবেশনে চারজনের বক্তৃতার পর স্বামীজী বক্তৃতা দিয়ে উঠলেন। দেবী সরস্বতীকে মনে মনে প্রণাম করে তিনি এগিয়ে গেলেন। যেই তিনি সম্বোধন করলেন—‘সিস্টার্স অ্যাণ্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা’ –-আমেরিকাবাসী আমার বােন ও ভায়েরা, সঙ্গে সঙ্গে সেই কয়েক হাজার নরনারী হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। দু-মিনিট ধরে তাদের করতালি চলল। হাততালি থামলে না। সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দিলেন, যার মর্মার্থ শ্রীরামকৃষ্ণের সেই ‘যত মত তত পথ’ বাণী। কোন নির্দিষ্ট ধর্মের জয়গান করলেন না স্বামীজী। সব ধর্মই যে সমান সত্য, ভারতবর্ষের মানুষের এই সনাতন বিশ্বাসকেই তিনি সকলের সামনে তুলে ধরলেন। সেই ভাষণে তিনি বললেন : 
 ‘হে আমেরিকাবাসী বােন ও ভায়েরা, আপনারা আমাদেন যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তার উত্তরে কিছু বলতে উঠে আমার হৃদয় অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সন্ন্যাগ সঙ্ঘের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সব ধর্মের যিনি জননী স্বরূপ, তাঁর নামে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর পক্ষ থকে। 
 ‘এই সভামঞ্চের কয়েকজন বক্তা প্রাচ্যদেশের প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে বলেছেন যে, দূরদেশ-আগত এইসব ব্যক্তিও বিভিন্ন দেশে সহিষ্ণুতার ভাবপ্রচারের গৌরব দাবি করতে পারেন-- আমার ধন্যবাদ তাঁদের প্রতিও। আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গৌরব বােধ করি, যে-ধর্ম জগৎকে শিখিয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গ্রহীষ্ণুতার আদর্শ। আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্যই করি না, সব ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি ‘এক্সক্লুশন” শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি। আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব বোধ করি, যে জাতি পৃথিবীর সব ধর্মের ও সব জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থী মানুষকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে এসেছে। আমি আপনাদের এ-কথা বলতে গর্ব অনুভব করছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরদের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে বুকে করে রেখেছি; যে বছর রােমানদের অত্যাচারে তাদের পবিত্র মন্দির ধ্বংস হয়, সেই বছরেই তারা দক্ষিণ ভারতে এসে আমাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। জরথুষ্ট্রের অনুগামী মহান পারসীক জাতির অবশিষ্ট অংশকে যে ধর্মের মানুষেরা আশ্রয় দিয়েছিল এবং আজ পর্যন্ত যারা তাদের প্রতিপালন করে আসছে, আমি সেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি।' 
‘আমি আপনাদের কাছে একটি স্তোত্রের কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করব, যেটি আমি খুব ছােটবেলা থেকেই আবৃত্তি করে আসছি এবং কোটি কোটি নরনারী নিত্য যেটি পাঠ করেন : রুচীনাং বৈচিত্র্যাদজুকুটিলনানাপথজুষাং। নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামৰ্ণব ইব।।১—বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলেই যেমন এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে দেয়, তেমনি হে ভগবান, নিজের নিজের রুচির বৈচিত্রের জন্য সরল-জটিল নানা পথ ধরে যারা চলেছে, তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্যস্থল তুমিই।। 
বর্তমান মহাসম্মেলন, যা পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত অনুষ্ঠিত শ্রেষ্ঠ সম্মেলনগুলির অন্যতম, তা কিন্তু গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরই সত্যতা প্রতিপন্ন করছে, গীতার এই বাণীই ঘােষণা করছে: ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।'—যে যে-ভাব আশ্রয় করে আসুক না কেন আমি তাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করে থাকি। হে অর্জুন, মানুষ সর্বতােভাবে আমার অভিমুখেই চলে। 
‘সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি এবং তার ভয়াবহ ফলশ্রুতি ধর্মোন্মত্ততা বহুদিন ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে। জগৎকে তারা হিংসায় পরিপূর্ণ করেছে, মানুষের রক্তে পৃথিবীকে বারবার সিক্ত করেছে এবং জাতির পর জাতি এর ফলে হতাশায় নিমগ্ন হয়েছে। এই সমস্ত ভয়ঙ্কর পিশাচ যদি না থাকত, তাহলে মানবসমাজ এখনকার থেকে অনেক বেশি উন্নত হত। কিন্তু তাদের অন্তিমসময় উপস্থিত। এবং আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, এই সম্মেলনের সম্মানে আজ সকালে যে ঘণ্টাধ্বনি হল তা যেন সমস্ত ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লেখনীর সাহায্যে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার অত্যাচারের মৃত্যুঘণ্টা হয় ; একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে যেসব মানুষ, তাদের পরস্পরের মধ্যের সমস্ত অসদ্ভাবের সমাপ্তি ঘােষণা করুক ঐ ঘণ্টাধ্বনি। 
১ শিবমহিমঃ স্তোত্রম্ 
বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার হর্ষধ্বনি হল। ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষার কথা তাঁর মতাে এমন স্পষ্টভাবে আর কেউ প্রকাশ করতে পারেননি। তাই শিকাগাের প্রথম দিনের বক্তৃতাই স্বামীজীকে আমেরিকায় পরিচিত করে তুলল। রাস্তায় রাস্তায় শােভা পেতে লাগল তার তেজোদৃপ্ত ছবি। আমেরিকার পত্র-পত্রিকাগুলি তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। তিনি শুধু মঞ্চের একদিক থেকে অপরদিকে হেঁটে গেলেই হাততালি পেতেন। ধর্মমহাসভায় তাঁর বক্তৃতা থাকত সবার শেষে। ‘দি ডেইলি হেরাল্ড' পত্রিকা ব্যাখ্যা করে লিখেছেন : ‘এর উদ্দেশ্য ছিল, লােককে শেষপর্যন্ত ধরে রাখা। কোন গরম দিনে নীরস বক্তার সুদীর্ঘ বক্তৃতার ফলে যখন শত শত লোক সভাকক্ষ ত্যাগ করতে থাকত, তখন বিরাট শ্রোতৃমণ্ডলীকে ধরে রাখার জন্য শুধু এইটুকু ঘােষণা করলেই যথেষ্ট হত যে, শেষ প্রার্থনার আগে বিবেকানন্দ সংক্ষেপে কিছু বলবেন। অমনি তাঁর পনেরাে মিনিটের বক্তৃতা শােনার জন্য তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত।' (১১ এপ্রিল ১৮৯৪)। 
কিন্তু এত খ্যাতি, এত প্রশংসার মধ্যেও স্বামীজীর মনে অনুক্ষণ জেগে ছিল তাঁর দেশবাসীর দুঃখ দুর্দশার কথা। প্রথম দিনের বক্তৃতার পর যখন তিনি রাত্রে শুতে গেলেন, হঠাৎ তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠল দেশবাসীর জন্য। ভারতের দুঃখ দারিদ্রর কথা ভেবে কোমল শয্যা তাঁর গায়ে কাঁটার মতাে বিঁধতে লাগল। বিছানা ছেড়ে তিনি মাটিতে এসে শুলেন। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন : মা, আমার দেশ যেখানে অবর্ণনীয় দারিদ্রে ডুবে রয়েছে, সেখানে মানযশের আকাঙ্ক্ষা কে করে? গরীব ভারতবাসী আমরা কি দুর্দশায়ই না এসে পৌঁছেছি। আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ একমুঠো অন্নের অভাবে মারা যায় আর এদেশের লােকেরা ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। ভারতের জনসাধারণকে কে ওঠাবে? কে তাদের মুখে অন্ন দেবে? মা! দেখিয়ে দাও, আমি কি করে তাদের সেবা করতে পারি।' 
স্বামীজীর এই প্রথম দিনের বক্তৃতা শ্রোতাদের মনে কিরকম রেখাপাত করেছিল, তার একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী নিখিলানন্দ। তিনি যখন নিউইয়র্ক বেদান্ত সােসাইটিতে আছেন, তাঁর সঙ্গে এক ইহুদী বুদ্ধিজীবীর পরিচয় হয়। যুবক অবস্থাতে তিনি ধর্মমহাসভায় গেছিলেন এবং স্বামীজীর প্রথম দিনের বক্তৃতা শুনেছিলেন। সেই ভদ্রলােক নিখিলানন্দজীকে বলেছিলেন : বিবেকানন্দের বক্তৃতা শুনেই তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, তার ইহুদী ধর্ম সত্য। শুধু তাই নয়, তার এও মনে হয় যে, স্বামীজী শুধু তার ধর্মের পক্ষ থেকেই কথা বলছেন না, তিনি কথা বলছেন পৃথিবীর সব ধর্মের প্রতিভূ হয়ে। 
বাস্তবিক, ধর্মমহাসভার মর্মবাণী স্বামীজীর মধ্য দিয়েই ঠিক ঠিক প্রকাশিত হয়েছিল। 

‘হিন্দুধর্ম’ ও অন্যান্য বক্তৃতা 

প্রথম দিনের বক্তৃতার পর থেকেই স্বামীজী হয়ে উঠেছিলেন ধর্মমহাসভার কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাই প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে বক্তৃতা করতে হত, ধর্মমহাসভার মূল বিভাগে কিংবা বিজ্ঞান বিভাগে। ধর্মমহাসভা চলেছিল ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর। এই কয়েকদিনে তাকে মােট বারােটি বক্তৃতা করতে হয়েছিল। স্বামীজীর রচনাবলীতে কেবল ছ’টি বক্তৃতা মুদ্রিত আছে। এছাড়া ধর্মমহাসভা হয়ে যাবার পর ডঃ ব্যারােজ তাঁর যে রিপাের্ট প্রকাশ করেছিলেন তাতে বিষয় ও তারিখ সহ আরও চারটি বক্তৃতার উল্লেখ আছে। তাঁর মধ্যে একটি বিষয় ছিল “জৈন বৌদ্ধধর্ম। অর্থাৎ স্বামীজী শুধু হিন্দুধর্মের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। 
১৫ সেপ্টেম্বর স্বামীজী ‘কূপমণ্ডুক’ বা কুয়াের ব্যাঙের গল্পটি বলে বুঝিয়ে দিলেন, কেন ধর্মে ধর্মে মতভেদ হয়। কুয়াের ব্যাঙ কুয়ােতেই চিরকাল রয়েছে, কুয়াের বাইরে কখনও যায়নি। তাই সাগর থেকে এক ব্যাঙ এসে যখন বলল, সাগর তার কুয়াের তুলনায় লক্ষগুণ বড়, তখন সে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। এই গল্পটি বলে স্বামীজী বললেন : আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের ছােট কুয়াের মধ্যে বসে ভাবছি সেটাই সম্পূর্ণ জগৎ। হে আমেরিকার অধিবাসীরা আপনারা যে আমাদের এই ছােট ছােট জগৎগুলির বেড়া ভাঙবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করছেন, তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।' 
১৯ সেপ্টেম্বর স্বামীজী হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে লিখিত বক্তৃতাটি পাঠ করলেন। এটিই ধর্মমহাসভায় তাঁর প্রধান বক্তৃতা, কারণ ধর্মমহাসভায় তাঁর নাম নথিভুক্ত হয়েছিল হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু তা হলেও, তাঁর হিন্দুধর্ম কোন সাম্প্রদায়িক ধর্ম ছিল না। হিন্দুধর্ম দিয়ে শুরু করেও তিনি শেষ করেছিলেন বিশ্বজনীন ধর্মে। নিবেদিতার কথায় বলতে গেলে, ‘ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চেতনাই বাত্ময় হয়ে উঠেছিল স্বামীজীর মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারতবাসীর বাণী, যা গড়ে উঠেছে তাদের সমগ্র অতীত জীবনের ভিত্তিতে, তা-ই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর মুখে।’ হিন্দুধর্মের কোন নির্দিষ্ট দেবদেবীর কথা তিনি বললেন না। সহজ সরল ভাষায়, শাস্ত্রীয় পরিভাষা যথাসম্ভব বর্জন করে তিনি আসলে বেদান্তের সার্বভৌম সত্যই ‘হিন্দুধর্ম’ প্রবন্ধটির মধ্যে প্রকাশ করলেন। এমনভাবে তা করলেন, যা সংস্কৃত-অজ্ঞ পাশ্চাত্যবাসীর পক্ষে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। পরিশেষে তিনি এক বিশ্বজনীন ধর্মের আদর্শ উপস্থাপন করে বললেন : 
যদি কখনও একটি বিশ্বজনীন ধর্মের উদ্ভব হয়, তবে তা কখনও কোন দেশে বা কালে সীমাবদ্ধ হবে না; যে অসীম ভগবানের বিষয় ঐ ধর্মে প্রচারিত হবে, ঐ ধর্মকে তারই মতাে অসীম হতে হবে ; সেই ধর্মের সূর্য কৃষ্ণভক্ত, খ্রীষ্টভক্ত, সাধু অসাধু সবার উপর সমানভাবে কিরণ দেবে ; 
...এরকম একটি ধর্ম উপস্থাপন কর, সমস্ত জাতিই তােমায় অনুসরণ করবে। অশােকের ধর্মসভা কেবল বৌদ্ধদের জন্য হয়েছিল। আকবরের সভা ছিল বৈঠকী আলােচনামাত্র, যদিও ঐ উদ্দেশ্যের অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মেই ভগবান আছেন—সমগ্র জগতে এ-কথা ঘােষণা করার দায়িত্ব আমেরিকার জন্যই সংরক্ষিত ছিল। 
তাঁর ‘হিন্দুধর্ম’ বক্তৃতার বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, তিনি দেখালেন, নিজের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকেও কিভাবে মানুষ অন্য ধর্মকে মর্যাদা দিতে পারে; একটি ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকেও মানুষ কিভাবে নিজেকে বিশ্বজনীন ধর্মের উন্মুক্ত আঙ্গিনায় প্রসারিত করে দিতে পারে।' 
২০ সেপ্টেম্বর স্বামীজী একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন : ভারতের সবচেয়ে বেশী অভাব ধর্মের নয়। ভারতে ধর্ম যথেষ্ট আছে, ভারতের সমস্যা হচ্ছে দারিদ্র : 
আমি আমার দরিদ্র দেশবাসীর জন্য তােমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। খ্রীষ্টান দেশে খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে অখ্রষ্টানদের জন্য সাহায্য পাওয়া যে কি কঠিন ব্যাপার, বেশ বুঝতে পেরেছি। 
শ্রোতারা বুঝলেন, বিবেকানন্দ শুধু বাগ্মীই নন, হৃদয়বান দেশপ্রেমিকও।তাঁর পঞ্চম বক্তৃতা ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর। তিনি বললেন : ‘বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মেরই পরিপূরক।’ বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিচ্ছেদই হল ভারতের অধঃপতনের কারণ। এবং ভারতবর্ষের জন্য প্রয়ােজন, বৌদ্ধধর্মের হৃদয়বত্তার সঙ্গে ব্রাম্ভণ্য ধর্ম বা বৈদান্তিক ধর্মের ধীশক্তির সম্মিলন।

 শেষ অধিবেশনের ভাষণ

 ২৭ সেপ্টেম্বর, মহাসভার শেষ দিনে স্বামীজী আবার বাগ্মিতার শিখরে পৌঁছে গেলেন। বিদায় ভাষণে তিনি বললেন : 
‘আমি সেই মহানুভব ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা তাঁদের উদার হৃদয় ও সত্যানুরাগ দিয়ে প্রথমে এই স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং পরে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন। এই সভামঞ্চ থেকে যেসব উদার ভাব প্রবাহিত হয়েছে, সেগুলাের প্রতিও আমার ধন্যবাদ। আমি ধন্যবাদ জানাই এই শিক্ষিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে—যাঁরা সবসময় আমার প্রতি সদয় মনােভাব প্রকাশ করেছেন এবং বিভিন্ন ধর্মের বিরােধ কমাতে যে ভাবগুলি সহায়তা করে, তার প্রত্যেকটিকে সমর্থন করেছেন। এই ঐকতানের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু বেসুরাে সুর শােনা গেছে—ঐগুলির জন্য আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তাদের স্পষ্ট বৈপরীত্য সমন্বয়ের সাধারণ ঐকতানকে আরও মধুর করে তুলেছে।' 
‘ধর্মীয় ঐক্যের সাধারণ ভিত্তি সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। আমি এখনই এ-বিষয়ে আমার নিজের মত পেশ করছি না। কিন্তু যদি কেউ এখানে এই আশা পােষণ করেন যে, একটি ধর্মের অভ্যুদয় ও অপর ধর্মগুলির বিনাশের দ্বারা এই ঐক্য আসবে, তবে আমি তাকে বলব, ভাই, এ তােমার দুরাশা।’ আমি কি চাই, খ্রীষ্টান হিন্দু হয়ে যাক? ভগবান না করুন। আমি কি চাই হিন্দু বা বৌদ্ধরা খ্রীষ্টান হয়ে যাক? ভগবান তা না করুন।’ 
‘মাটিতে বীজ পোঁতা হল, মাটি, বাতাস আর জল তার চারিদিকে রয়েছে। বীজটি কি মাটি, বাতাস বা জল হয়ে যায়? না, চারাগাছ হয়; ঐ চারাগাছ বড় হয়; মাটি, জল, বাতাসকে আত্মস্থ করে সেগুলিকে বৃক্ষের উপাদানে পরিণত করে এবং ক্রমশ বৃক্ষ হয়েই বেড়ে ওঠে। 
‘ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা। খ্রীষ্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হতে হবে না; কিংবা হিন্দু বা বৌদ্ধকেও খ্রীষ্টান হতে হবে না; কিন্তু প্রত্যেকেই অন্য ধর্মের ভাবগুলিকে আত্মস্থ করবে এবং নিজের নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী অগ্রসর হবে।' 
‘যদি এই ধর্মমহাসভা জগতে কোন কিছু প্রমাণ করে থাকে, তা হল এই : সাধুতা, পবিত্রতা ও দয়াদাক্ষিণ্য জগতের কোন একটি বিশেষ ধর্মমণ্ডলীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয় এবং প্রত্যেক ধর্মপদ্ধতির মধ্যেই অতি উন্নত চরিত্রের নরনারী জন্মগ্রহণ করেছেন।' 
‘এইসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ সত্ত্বেও যদি কেউ এরকম স্বপ্ন দেখেন যে, অন্যান্য ধর্ম লােপ পাবে আর তাঁর ধর্মই শুধু টিকে থাকবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র, তাঁর জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। তাঁকে আমি স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছি, তাঁর মতাে মানুষের বিরােধিতা সত্ত্বেও শীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপরে লিখিত হবে : ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরােধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’ 
বিশ্বধর্মমহাসভার পরিসমাপ্তি হল। কিন্তু তাঁর সমন্বয় ও শান্তির বাণী প্রচার করতে, মানুষকে তার দৈবী-স্বরূপ সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে, আরও প্রায় তিন বছর বিবেকানন্দ ছিলেন পাশ্চাত্য জগতে। তবে আর তিনি সেই অপরিচিত সন্ন্যাসী রূপে লােকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পারেননি। সমগ্র পাশ্চাত্য জগতের দৃষ্টি তখন তার দিকে। যেখানে তিনি যেতেন, শত শত লােক তাকে অনুসরণ করত। মানুষ তাকে বর্ণনা করত বুদ্ধ কিংবা যীশুর মতাে একজন মহাপুরুষ রূপে। তার বক্তৃতা শুনে আমেরিকার লােক বলতে শুরু করল : ‘আমরা এর দেশে মিশনারী পাঠাই? তাঁদেরই উচিত আমাদের দেশে মিশনারী পাঠানাে। আমেরিকার পত্রিকাগুলােও বিবেকানন্দের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল। মহাসভার বিজ্ঞান-বিভাগের সভাপতি মারউইন-মেরী স্মেল লিখলেন : ... যাঁরা অত্যন্ত গোড়া খ্রীষ্টান, তাঁরাও তাঁর সম্বন্ধে বলতেন যে, “তিনি সত্যিই মানুষের মধ্যে রাজা'। 
কিন্তু তার বাগ্মিতার থেকেও তাঁর জীবন ও চরিত্র মানুষকে মুগ্ধ করত বেশী। তিনি তাঁর সমস্ত সাফল্যকে তাঁর প্রতি ঈশ্বরের অযাচিত করুণা বলে মনে করতেন। ধর্মমহাসভার পরে অধ্যাপক রাইটকে একটি চিঠিতে তিনি এই মনােভাব প্রকাশ করেছেন : '... সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের জয় হােক, যার দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের একজন মূখ সন্ন্যাসী আর এই পরাক্রান্ত দেশের বিদগ্ধ পণ্ডিতরা সমান রূপে প্রতিভাত হয়েছেন।' 

ভারতবর্ষে এবং বহির্বিশ্বে প্রতিক্রিয়া 

শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন : বিবেকানন্দের আমেরিকা-যাত্রা হল প্রথম সুস্পষ্ট প্রমাণ যে ভারত আবার জেগে উঠেছে—জেগে উঠছে শুধু নিজে বেঁচে থাকার জন্য নয়, জয় করবার জন্যও। এই জয় যুদ্ধ দিয়ে জয় নয়, ভারতের সুন্দর ভাবাদর্শ দিয়ে বিশ্বজয়। আমেরিকায় স্বামীজীর কীর্তি-কাহিনী যখন ভারতবর্ষে এসে পৌঁছতে থাকল, সমগ্র জাতি শিহরিত হল, জয়ােল্লাসে মেতে উঠল। তারা তাদের দূরতম কল্পনাতেও কখনাে ভাবতে পারেনি যে, একজন ভারতীয় পাশ্চাত্যবাসীদের কাছ থেকে এতটা সভ্রম ও শ্রদ্ধা পেতে পারে। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে যে আত্মমর্যাদাবােধ জেগে উঠল, 'জাতির জীবনে তার আশ্চর্য প্রভাব পড়ল।’ বস্তুত স্বামীজীর শিকাগাে যাত্রা ভারতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর থেকেই ঘটল জাতীয় জাগরণ এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা লাভ। গান্ধীজী, শ্রীঅরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র এবং জাতীয় নেতাদের আর ও অনেকে স্বামীজীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ভারতকে তারা চিনেছেন, ভারতের শক্তি ও দুর্বলতাকে বুঝেছেন স্বামীজীর চোখ দিয়ে। এবং যে-ভারতগঠনের জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন, তা অনেকাংশেই স্বামীজীর স্বপ্নের ভারত। একাধিক চিন্তাবিদ স্বামীজী সম্বন্ধে বলেছেন : তিনিই ভারতের জাতীয় জাগরণের পিতা। 
কিন্তু স্বামীজী শুধুই ভারতের নন, সারা পৃথিবীর তিনি আপনজন ও সম্পদ। সর্বধর্মই যে সত্য—নিজে বিভিন্ন ধর্মে সাধনা করে এই মহান সত্য প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। কিন্তু এই সত্যকে জগতের সামনে সর্বপ্রথম প্রচার করেছেন স্বামী বিবেকানন্দই, শিকাগাে ধর্মমহাসভাতে। তিনি একবার বলেছিলেন ‘পাশ্চাত্যের জন্য আমার একটা বাণী আছে, ঠিক যেমন প্রাচ্যের জন্য বুদ্ধের একটা বাণী ছিল। জগতের জন্য তার শ্রেষ্ঠ বাণী হল বেদান্ত। 
আজকাল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময় বা ‘ইন্টার রিলিজিয়াস ডায়ালগ'-কে মানুষের সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই আন্তধর্ম-আলােচনা শুরু হয়েছিল স্বামীজীর শিকাগাে বক্তৃতা থেকে যেদিন স্বামীজী সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মত্ততার মৃত্যুঘণ্টা ঘােষণা করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে ‘পার্লামেন্ট অফ ওয়ার্ল্ডস রিলিজিয়ন্স’ বলে একটি সংস্থা তৈরী হয়েছিল শিকাগাে ধর্মমহাসভার শতবর্ষ পালনের জন্য। ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে ঐ সংস্থা তিন থেকে ছ-বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন দেশে ধর্মমহাসভা পালন করে আসছে। এই সংস্থার ওয়েবসাইটে। (www.parliamentofreligions.org) পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে : আজ সারা বিশ্বে এটি স্বীকৃত যে, ১৮৯৩-র ধর্মমহাসভার মাধ্যমেই আন্তধর্ম-আলােচনার জন্ম হয়েছিল। আর ঐ ধর্মমহাসভা আর স্বামী বিবেকানন্দ আজ সমার্থক হয়ে গেছেন। তার প্রমাণ হল, ঐ ওয়েবসাইটে ১৮৯৩-র ধর্মমহাসভার প্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র স্বামীজীর কথাই উল্লেখ করা হয়েছে : “নানান ধর্মের আধ্যাত্মিক নেতারা সারা পৃথিবী থেকে এসে সেই ধর্মমহাসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। একটি আকর্ষণীয় হিন্দু সন্ন্যাসী ৫,০০০ শ্রোতাকে ‘আমেরিকার বােন ও ভায়েরা' বলে সম্বোধন করেছিলেন। তার ভাষণের মাধ্যমে আমেরিকার মানুষ হিন্দুধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।' 
১৯৯২ সালে স্বামীজীর শিকাগাে বক্তৃতার শতবর্ষ পূর্তির এক বছর আগে এলেনর স্টার্ক নামে একজন আমেরিকান মহিলা স্বামীজী সম্বন্ধে একটা বই লিখেছিলেন, নাম : ‘দ্য গিফট আন-ওপেন্ড : এ নিউ আমেরিকান রেভলিউশন।' লেখিকা স্বামীজী ও তার বাণীকে ‘উপহার’ বলে বর্ণনা করেছেন— ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকাকে দেওয়া উপহার। তিনি বলছেন : সেই উপহারের প্যাকেট আমেরিকা খুলে দেখেনি, স্বামীজীর ৰাণীকে তার জীবনে ব্যবহার করেনি। যদি তারা তা করত, একটা নতুন ধরনের বিপ্লব ঘটে যেত আমেরিকাবাসীদের জীবনে! ঐ বইতেই তিনি লিখেছেন : কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশের ভূখণ্ডটা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ আবিস্কার করেছিলেন আমেরিকার আত্মাকে।' 
দুঃখের বিষয় শিকাগো ধর্মমহাসভার একশাে পঁচিশ বছর পরেও আজ পৃথিবীতে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতিগত বিদ্ধেষ রয়েছে। জগতে তাই সাম্প্রদায়িক মতবিরোধ এখনও আছে। এবং স্বামীজীও তাঁর শান্তি এ সমন্বয়ের বাণী নিয়ে প্রতিদিনই সমান প্রাসঙ্গিক। 

স্বামীজীর শিকাগাে বক্তৃতা : সংবাদপত্র ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মন্তব্য 

• নি:সন্দেহে তিনি ধর্মমহাসভার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তার ভাষণ শােনার পর আমরা্ অনুভব করছি, এই প্রাজ্ঞ দেশে ধর্মপ্রচারক পাঠানাে কতটা মুগ্ধতা। 
-দি নিউইয়ক হেরান্ড
• ধর্মমহাসভার বিজ্ঞান--শাখার সভাপতিরূপে, এবং বিজ্ঞান সংশিষ্ট সকল 
অনুষ্ঠানের সভাপতিরূপে, আমি আমার ব্যক্তিগত সাক্ষ্য এখানে উপস্থিত করছি। স্বামী বিবেকানন্দ কী শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে এখানে গৃহীত হয়েছেন, কী প্রভাব তিনি বিস্তার করেছেন, কী মঙ্গলকার্য তিনি সম্পাদন করছেন, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরূপে কথা বলার আমি অধিকারী। ... হিন্দুধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘নিজস্ব’ প্রতিনিধি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি নিঃসন্দেহে ধর্মমহাসভার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রায়ই বক্তৃতা করেছেন---ধর্মমহাসভা মঞ্চে এবং বিজ্ঞান শাখার অধিবেশন গুলিতে শেষোক্ত ক্ষেত্র গুলিতে (অর্থাত্ বিজ্ঞানশাখার অধিবেশন গুলিতে) সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি খ্রীষ্টান বা অখ্রীষ্টান যে-কোন প্রতিনিধির চেয়ে অধিকতর উদ্দীপনার সঙ্গে গৃহীত হয়েছেন। তিনি যেখানেই যেতেন লােকে দলবেঁধে তাঁকে অনুসরণ করত এবং তাঁর মুখোচ্চারিত প্রতিটি শব্দের জন্য হাঁ করে অপেক্ষা করত।
-মিস্টার মারউইন মেরী স্নেল
ধর্ম মহাসভার বিজ্ঞান শাখার সভাপতি
(ভারতীয় পত্রিকা হোপকে লেখা চিঠি। তারিখঃ ৩০ জানুয়ার‍্য,১৮৯৪)
• ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দের বক্তৃতা ছিল আকাশের মতাে উদার। প্রতিটি 
ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবগুলিকে তিনি তাঁর ভাষণের মধ্যে আলিঙ্গন করেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে উপস্থিত করেছেন বিশ্বজনীন ধর্মের পরম আদর্শ -
-দি বােস্টন ইভনিং ট্রান্সক্রিপ্ট, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ 
• আমি কোন দ্বিধা না রেখেই বলতে পারি, ধর্মমহাসভায় মহান ও উত্তম হিন্দুসন্ন্যাসী বিবেকানন্দ অপেক্ষা অন্য কেউই অধিক মনােযােগ আকর্ষণ করতে পারেননি। ... আমাদের উত্তম ভ্রাতা আমেরিকার জনসাধারণের বুদ্ধিমান ও আলােকপ্রাপ্ত অংশকে বােঝাতে সমর্থ হয়েছেন যে, ভারতবর্ষ মহান দর্শন ও ধর্মের উদয়ক্ষেত্র এবং পীঠস্থান। আমি আপনাদের এই কথা জানাতে পারি যে, স্বামী বিবেকানন্দ বক্তৃতা দেবেন একথা বিজ্ঞাপিত হওয়া মাত্র আসন সংগ্রহের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। স্বামী বিবেকানন্দের ছবি সমস্ত শিকাগাে শহরে টাঙিয়ে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল। ... যেখানেই তিনি যেতেন মানুষ তাকে ঘিরে ধরত এবং তার প্রতিটি কথা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে শুনত। 
—অনাগরিক ধর্মপাল 
(ইনি বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামীজীর সঙ্গে ধর্মমহাসভায় 
ভাষণ দিয়েছিলেন। ভারতে ফিরে ১৮৯৪-এ ১৪ মে তারিখে 
তিনি মিনার্ভা থিয়েটারে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, 
সেখানে এই কথাগুলি বলেছিলেন) 
• পাশ্চাত্যের কাছে আমাদের জাতির মর্যাদাকে উত্তোলন করতে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এতকাল একযােগে যা করেছেন, তাঁর চেয়ে ঢের বেশী 
করেছেন বিবেকানন্দ একাই। 
 —অমৃতবাজার পত্রিকা, কোলকাতা 
১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ 

ধর্ম-সমন্বয় সম্পর্কে স্বামীজীর কয়েকটি বাণী 

প্রকৃত ধার্মিক লােক সর্বত্রই উদার হয়ে থাকেন তার ভিতর যে প্রেম আছে, তাইতে তাঁকে বাধ্য হয়ে উদার হতে হয়! কেবল তাদের কাছে ধর্ম একটি ব্যবসামাত্র তারাই ধর্মের ভিতর সংসারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিবাদ ও স্বার্থপরতা এনে ব্যবসার খাতিরে ওরকম সংকীর্ণ ও অনিষ্টকারী হতে বাধ্য হয়। 
*******
আমি মুসলমানদের মসজিদে যাব, খ্রীষ্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সামনে নতজানু হব, বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করে আমি বুদ্ধের ও তাঁর ধর্মের শরণ নেব, আবার অরণ্যে প্রবেশ করে হিন্দুর পাশে বসে ধ্যানমগ্ন হব। ..শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যে-সব ধর্ম আসতে পারে, তাদের জন্যও আমার হৃদয় আমি উন্মুক্ত রাখব। 
*******
অতীতের সকল ধর্মাচার্যদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি বর্তমানের সমস্ত মহাপুরুষদের এবং আমার শ্রদ্ধা সেই সব মহান মানুষেরও প্রতি, যাঁরা ভবিষ্যতে আসছেন। 
*******
আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে-হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্ম—এই দুই মহান মতের সমন্বয়—বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামীয় দেহ—একমাত্র আশা। আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি—এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা দূর করে ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ নিয়ে মহামহিমায় অপরাজেয় শক্তিতে জেগে উঠছে। 
আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগাে, ১৮৯৩ সালে যেখানে মহাসভা হয়েছিল।
আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগাে, ১৮৯৩ সালে যেখানে মহাসভা হয়েছিল। 

==========

Post a Comment

0 Comments