স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাঃ প্রথম খণ্ড
প্রকাশকের নিবেদন
আজ হইতে শত বৎসর পূর্বে ভগবানের আশীর্বাদে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম ও ধ্যানের একটি পরিপূর্ণ আদর্শরূপে স্বামী বিবেকানন্দ আবির্ভূত হইয়াছিলেন। জড়বিজ্ঞানের চমকপ্রদ সাফল্যে ধর্মের প্রভাব তখন কিছুটা স্তিমিত ; অশিক্ষা ও কুশিক্ষায়, পরাধীনতা ও দারিদ্র্যে ধর্মের প্রাণকেন্দ্র ভারতও যেন পথ হারাইয়া ফেলিয়াছে ; সেই যুগসন্ধিক্ষণে ভবিষ্যৎ মানবজাতির অভ্রান্ত পথনির্দেশকরূপে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব। তাঁর আগমনে শুধু যে তমসাচ্ছন্ন ভারত কর্মযােগে জাগিয়া উঠিয়াছে—তাহা নয়, রজোগুণে উন্মত্ত ইওরােপ-আমেরিকাও তাহার শিক্ষা-দীক্ষায় ধ্যানজ্ঞানের নূতন আলােকের সন্ধান পাইয়াছে, আধ্যাত্মিকতার একটি শাশ্বত রূপ দেখিয়া মানুষ আজ ধর্ম-বিষয়ে নিজের ভুল বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছে।
মাত্র উনচল্লিশ বৎসর কার স্বামীজী এই মর্ত্যলােকে অবস্থান করেন, প্রকাশ্যভাবে তাহার ব্যাপক ও গভীর কর্মজীবন মাত্র নয় বৎসর কাল। পরিব্রাজক জীবনের শেষে শ্রীগুরুর ইঙ্গিতে ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি চিকাগো ধর্মমহাসভায় যান। সেখানে অপূর্ব সাফল্যের পর, তিনি আমেরিকা ও ইওরােপে সার্বভৌম আধ্যাত্মিক বাণী প্রচার করেন। পাশ্চাত্যে বেদান্তপ্রচারের কার্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া ১৮৯৭ খৃঃ তিনি ভারতে ফিরিয়া আসেন ও স্বদেশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বজ্রনির্ঘোষে নবজাগরণের বাণী শুনাইতে থাকেন। অতঃপর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভিত্তি স্থাপন করিয়া ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে স্বামীজী পুনরায় পাশ্চাত্যে গমন করেন ও বিভিন্ন দেশে বিশেষতঃ আমেরিকায় নবযুগের উদার ভাব প্রচার করিতে থাকেন। '১৯০০ খৃষ্টাব্দের শেষ দিকে তিনি বেলুড় মঠে ফিরিয়া আসেন।
কঠোর পরিশ্রমে তখন তাহার শরীর ক্লান্ত, মনও নির্বাণমুখী ; তাই অতি শীঘ্র জগতের সর্ববিধ কল্যাণের জন্য ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়' শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের কাজ যােগ্য হস্তে সমৰ্পণ করিয়া ১৯০২ খৃঃ ৪ঠা জুলাই তিনি তাহার নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন।
এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সাহা করিয়া গিয়াছেন, বিস্ময়-বিমুগ্ধ জগৎ বহুদিন তাহার দিকে তাকাইয়া থাকিবে। বক্তৃতা এবং রচনার মাধ্যমে স্বামীজীর বাণী প্রচারের কাল মাত্র সাত বৎসর (১৮৯৩-১৯০০), অবশ্য পত্র-রচনার কাল ইহা অপেক্ষা কিছু বেশী (১৮৮৮-১৯০২)।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় স্বামীজীর বক্তৃতাবলীর অধিকাংশই আশানুরূপভাবে লিপিবদ্ধ হয় নাই। তথাপি তাহার যে-কয়টি ভাষণ ও বক্তৃতা আমরা পাইয়াছি, তাহা চিরদিনই মানব-সমাজের অমূল্য সম্পদ রূপে পরিগণিত হইবে। বিভিন্ন দেশের বহু ব্যক্তিকে লিখিত তাহার পত্রগুলি এবং তাহার কথােপকথনও বলিষ্ঠ চিন্তাধারার উৎস।
স্বামীজীর বাংলা পত্র ও প্রবন্ধ কিছু কিছু তাঁহার জীবৎকালেই তৎপ্রতিষ্ঠিত পাক্ষিক ‘উদ্বােধন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিদেশে প্রদত্ত তাঁহার ইংরেজী বক্তৃতাবলীর কিছু কিছু সেই দেশেই পুস্তকাকারে বাহির হয়। আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকাতেও স্বামীজীর কয়েকটি দার্শনিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
স্বামীজীর উৎসাহে মাদ্রাজ হইতে ‘ব্রহ্মবাদী’ ও পরে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা প্রকাশিত হইলে তাহাতেও তাহার পত্র, প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী বাহির হইতে থাকে। কিছুকাল পরে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ হিমালয়ে স্থানান্তরিত হয়, তখন উহাতে নিয়মিতভাবে ভাঁহার লেখা ও বক্তৃতাগুলি প্রকাশিত হইতে থাকে।
স্বামীজীরই নির্দেশে গুরুসেবার অঙ্গরূপে স্বামী শুদ্ধানন্দ স্বামীজীর ইংরেজী বক্তৃতা ও পত্রাবলীর বঙ্গানুবাদ করিতে আরম্ভ করেন। স্বামীজী কর্তৃক অনুমােদিত হইয়া এগুলি ধারাবাহিকভাবে ‘উদ্বোধনে' প্রকাশিত হয়। পরে স্বামীজীর গুরু ভ্রাতা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তদানীন্তন সম্পাদক স্বামী সারদানন্দজীর ব্যবস্থাপনায় উদ্বোধন-কার্যালয় হইতে সেগুলি বিভিন্ন পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইতে থাকে এবং এখনও হইতেছে।
স্বামীজীর জন্মের শত বর্ষ পরে তাঁহার ঐ-সকল বাণী, রচনা ও পত্রাদি এবং আজ পর্যন্ত আরও যে-সকল অপ্রকাশিত বক্তৃতা ও পত্রাদি পাওয়া গিয়াছে, সে গুলি সব একত্র করিয়া শতবর্ষ-স্মারক-গ্রন্থাবলীরূপে প্রকাশ করার কথা দুই-তিন বৎসর পূর্বে আমাদের অনেকের মনে উদিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান অধ্যক্ষ স্বামী মাধবানন্দজীর পরামর্শক্রমে এই বিষয়ে আলােচনার জন্য মঠের কয়েকজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী ও আমাদের সুহৃদ কয়েকজন অধ্যাপককে লইয়া একটি ছোটখাট সভার অধিবেশন হয়। এই আলােচনা-সভায় সর্বসম্মতভাবে। স্থির হয় যে, স্বামীজীর পত্রাবলী সময়ানুক্রমে সাজাইয়া এবং বক্তৃতা ও রচনা, কথোপকথন-যথাসম্ভব বিষয়ানুযায়ী সাজাইয়া ১০ খণ্ডে বিভক্ত করিয়া উদ্বোধন কার্যালয় হইতে জন্মশতবর্ষ-স্মারক গ্রন্থ-রূপে প্রকাশিত হইবে।
দশটি খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থাবলীরঃ-
১ম খণ্ড চিকাগো বক্তৃতা, কর্মযোগ ও রাজযোগ ;
২য় খণ্ড জ্ঞানযোগ ;
৩য় খণ্ড ধর্ম ও দর্শন ;
৪র্থ খণ্ড ভক্তিযোগ এবং ‘দেববাণী’;
৫ম খণ্ড ‘ভারতে বিবেকানন্দ’ এবং ভারত-প্রসঙ্গে বক্তৃতা ও রচনাবলী মুদ্রিত হয়েছে ;
৬ষ্ঠ খণ্ড স্বামীজীর মৌলিক বাংলা রচনা (গদ্য ও কবিতা) এবং পত্রাবলী ;
৭ম খণ্ড পত্রাবলী ও ইংরেজী। কবিতার অনুবাদ ;
৮ম খণ্ড পত্রাবলী এবং মহাপুরুষ-প্রসঙ্গ;
৯ম খন্ড ‘স্বামী-শিষ্য-সংবাদ’, স্বামীজীর সহিত বিভিন্ন ব্যক্তির কথোপকথন এবং
১০ম খণ্ড মেরী লুই বার্ক লিখিত গ্রন্থে (Swami Vivekananda : New Discoveries in America) প্রকাশিত স্বামীজীর বক্তৃতার বিবরণীর বঙ্গানুবাদ এবং বিবিধ বিষয়ের লেখা ও বক্তৃতা সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রতি খণ্ডে স্বামীজীর রচনাদির সহিত একটি তথ্যপঞ্জী ও নির্দেশিকা দেওয়া হইয়াছে।
পুরাতন অনুবাদ গুলিতে যথাসম্ভব স্বামী শুদ্ধানন্দজীর রীতিই অনুসরণ করা হইয়াছে। একান্ত প্রয়ােজনবােধে কিছু কিছু ভাষার সংস্কার করা হইয়াছে। বানানে বর্তমান রীতি অনুসৃত।
এই গ্রন্থমালার সম্পাদন-ভার সর্বসম্মতিক্রমে ‘উদ্বোধন’-পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক স্বামী নিরাময়ানন্দকে দেওয়া হয়। ইহাও স্থির হয় যে, স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ এবং অধ্যাপক প্রণবরঞ্জন ঘােষ ও অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু এ-বিষয়ে তাঁহাকে সাহায্য করিবেন। প্রকাশনের অন্যান্য কার্যর ভার উদ্বোধনের প্রকাশন বিভাগের পরিচালক স্বামী অতন্দ্রানন্দের উপর অর্পিত হয়। এই গ্রন্থ-সম্পাদনায় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যে সুপরিচিত স্বামী গম্ভীরানন্দের সাহায্য এবং পরামর্শও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এই গ্রন্থমালা-প্ৰকাশ-প্রসঙ্গে আমরা সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের নিকট আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। তাহাদের উৎসাহে ও প্রাথমিক অর্থানুকুল্যে এই প্রকাশন কার্য আমরা আরম্ভ করি।
শান্তিনিকেতনের স্বনামধন্য শিল্পী আচার্য নন্দলাল বসু মহাশয় এই গ্রন্থমালার প্রচ্ছদপট পরিকল্পনা ও অঙ্কন করিয়া দিয়া আমাদিগকে অশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন।
অনুবাদ প্রভৃতি কার্যে নানাভাবে সাহায্য করিয়াছেন ডক্টর রমা চৌধুরী ও শ্রীযুক্তা সান্ত্বনা দাশগুপ্তা, শ্রীজ্ঞানেন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রীবিশ্বরঞ্জন, ভাদুড়ী,শ্রীসুধীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শ্রীতামসরঞ্জন রায়, শ্রীবিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, শ্রীদেবব্রত রায়চৌধুরী, শ্রীরমণীকুমার দত্তগুপ্ত, স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ, স্বামী বীতশোকানন্দ, স্বামী হিরন্ময়ানন্দ, স্বামী অব্জজানন্দ, স্বামী অমলানন্দ, স্বামী আদীশ্বরানন্দ এবং প্ৰব্ৰাজিকা মুক্তিপ্রাণা প্রভৃতি অধ্যাপক, অধ্যাপিকা ও বুধমণ্ডলী। সেজন্য তাহাদের সকলের নিকট আমরা কৃতজ্ঞ।
আরও অনেকে এই গ্রন্থমালা প্রকাশনে নানাভাবে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন, স্থানাভাবে সকলের নাম পৃথকভাবে উল্লেখ করা গেল না। তাহাদের শ্রম ও সাহায্য ব্যতীত এত অল্প সময়ে এই গ্রন্থাবলী প্রকাশ করা সম্ভব হইত না। গ্রন্থমালার তথ্যপঞ্জীর পৌরাণিক অংশ অধ্যাপক
শ্রীত্রিপুরারি চক্রবর্তী, ঐতিহাসিক অংশ অধ্যাপক শ্ৰশৈলেন্দ্রনাথ ধর, নৃতাত্ত্বিক অংশ অধ্যাপক শ্ৰীনির্মল কুমার বসু সংগ্রহ করিয়া দিয়া এই গ্রন্থমালার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করিয়াছেন। দার্শনিক অংশের তথ্যপঞ্জী ডক্টর সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখিয়া দিয়াছেন। তথ্যপঞ্জীর অন্যান্য অংশ এবং নূতন পত্রগুলির অনুবাদ হাওড়া রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের শ্রীমান্ সুশীলরঞ্জন দাশ গুপ্ত ও শ্রীনারায়ণচন্দ্র সাউ-এর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও যত্বে সংগৃহীত ও লিখিত হইয়াছে। অধ্যাপক শ্রীসুবােধচন্দ্র মুখােপাধ্যায় ও শ্রীমান শঙ্করনাথ চট্টোপাধ্যায় সমগ্র গ্রন্থাবলীর বিষয়-নির্দেশিকা ( Subject Index) প্রণয়ন করিয়াছেন। প্রতিখণ্ডের শেষে নির্দেশিকা রচনা করিয়াছেন শ্রীমান তারকনাথ দে ও সতীশচন্দ্র ঘােষ। হিসাব রক্ষার ব্যাপারে প্রথম হইতেই শ্রীননীগােপাল চক্রবর্তীর অক্লান্ত পরিশ্রম উল্লেখযােগ্য।
বাগবাজার নয়নকৃষ্ণ সাহা লেনের বিজয়লাল গাঙ্গুলী মহাশয় তাহার বাড়ির অনেকটা অংশ আমাদের এই প্রকাশন বিভাগের জন্য ছাড়িয়া না দিলে দীর্ঘদিন ধরিয়া গ্রন্থগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুষ্ঠু বিতরণ আমাদের পক্ষে সম্ভব হইত না।
ইহাদের সকলের উপর ভগবানের শুভাশীর্বাদ সর্বদা বর্ষিত হউক ; স্বামীজীর জীবনপ্রদ ভাবধারা সকলের হৃদয়ে প্রবাহিত হউক-বিবেকানন্দ শতবার্ষিকীর পুণ্য বৎসরে, এই গ্রন্থাবলী প্রকাশনের শুভক্ষণে ইহাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা।
পৌষ কৃষ্ণা সপ্তমী, ১৩৬৯
জানুয়ারি ১৯৬৩
প্রকাশক
স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দ
উদ্বোধন কার্যালয়
কলিকাতা-৩
বেলুড় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের
অধ্যক্ষ কর্তৃক
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
![[eBook] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাঃ প্রথম খণ্ড [eBook] স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাঃ প্রথম খণ্ড](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjrzggSZqGTLsiijuAcoim-ixw_Y-6dV925fL8eDevPGazhAyhyphenhyphenagZswCVaOl80xoigTAREiqg9dc9Jp3kWqYWJUvHvyeCihPTt97Tsob34SEFAAiFLi3kerBWm7XHEu8eE57a9cjtJOQSv/w640-h350-rw/1.jpg)

0 Comments