100+ Sri Ramakrishna quotes about Sansarashram In Bengali ~ শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সংসারাশ্রম বাণী

 ~ শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণী  ~

- সংসারাশ্রম -

100+ Sri Ramakrishna quotes about Sansarashram In Bengali ~ শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সংসারাশ্রম বাণী


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০১

ঈশ্বরের ইচ্ছায় এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির পর আদ্যাশক্তি জগতের ভিতরেই থাকেন। জগৎ প্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। বেদে আছে ঊর্ণনাভি’র কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা ভিতর থেকে জাল বার করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে। ঈশ্বর জগতের আধার আধেয় দুই-ই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০২

তিনি নানাভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী। মহাকালী, নিত্যকালীর কথা তন্ত্রে আছে। যখন সৃষ্টি হয় নাই—চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, পৃথিবী ছিল না; নিবিড় আঁধার; তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালী—মহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছিলেন। শ্যামাকালীর অনেকটা কোমল ভাব—বরাভয়দায়িনী। গৃহস্থবাড়িতে তারই পূজা হয়। যখন মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি হয় তখন রক্ষাকালী পূজা করতে হয়। শ্মশানকালীর সংহারমূর্তি—শব, শিবা, ডাকিনী, যােগিনী মধ্যে শ্মশানের উপর থাকেন। রুধিরধারা, গলায় মুণ্ডমালা, কটিতে নরহস্তের কোমরবন্ধ।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৩

যখন জগৎ নাশ হয়, মহাপ্রলয় হয়, তখন মা সৃষ্টির বীজসকল কুড়িয়ে রাখেন। গিন্নির কাছে যেমন একটা ন্যাতাক্যাতার হাঁড়ি থাকে, আর সেই হাঁড়িতে গিন্নি পাঁচ রকম জিনিস তুলে রাখে। ভিতরে সমুদ্রের ফেনা, নীলবড়ি, ছােট-ছােট পুঁটলি-বাঁধা শসাবিচি, কুমড়াবিচি, লাউবিচি—এইসব রাখে, দরকার হলে বার করে। মা-ব্রহ্মময়ী সৃষ্টিনাশের পর ঐরকম সব বীজ কুড়িয়ে রাখেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৪

এ-সংসার তার লীলা, খেলার মতাে। এই লীলায় সুখ-দুঃখ,পাপ-পুণ্য, জ্ঞান-অজ্ঞান, ভাল-মন্দ—সব আছে। দুঃখ-পাপ এসব গেম লীলা চলে না। তাঁর ইচ্ছা যে, তিনি এইসব নিয়ে খেলা করেন। চোর-চোর খেলায় বুড়িকে আগে থাকতে ছুঁলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না, সকলেই যদি ছুঁয়ে ফেলে, খেলা কেমন করে হয় ? সকলেই ছুঁয়ে ফেললে বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়। খেলা চললে বুড়ির আহ্বাদ।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৫

ঈশ্বরের সৃষ্টিতে নানারকম জীবজন্তু, গাছপালা আছে। জানােয়ারের মধ্যে ভাল আছে মন্দ আছে, বাঘের মতাে হিংস্ৰজন্তুও আছে। গাছের মধ্যে অমৃতের ন্যায় ফল হয়—এমন আছে; আবার বিষফলও আছে। সংসারী জীব আছে, আবার ভক্ত আছে। তার জগতে সকল রকম আছে। সাধুলােকও তিনি করেছেন, দুষ্টলােকও তিনি করেছেন, সদ্বুদ্ধি তিনিই দেন, অসদবুদ্ধি তিনিই দেন। দুষ্টলােকেরও দরকার আছে। একটি তালুকের প্রজারা বড়ই দুর্দান্ত ছিল। তখন গােলােক চৌধুরীকে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। তাঁর নামে প্রজারা কাঁপতে লাগল—এত কঠোর শাসন। সবই দরকার। সীতা বললেন, “রাম, অযােধ্যায় সব যদি অট্টালিকা হতাে তাে বেশ হতাে, অনেক বাড়ি দেখছি ভাঙা, পুরানাে।” রাম বললেন, “সীতা, সব বাড়ি সুন্দর থাকলে মিস্ত্রিরা কী করবে?” ঈশ্বর সব রকম করেছেন—ভাল গাছ, বিষ গাছ, আবার আগাছাও করেছেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৬

বন্ধন আর মুক্তি—দুয়ের কর্তাই তিনি। তার মায়াতে সংসারী জীব। কামিনীকাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তার দয়া হলেই মুক্ত। তিনি ‘ভববন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী। তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, যা, এখন সংসার করগে যা। মনের কী দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তার পাদপদ্মে মন হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৭

সংসার আর মুক্তি দুই-ই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তিনিই সংসারে অজ্ঞান করে রেখেছেন, আবার তিনিই ইচ্ছা করে যখন ডাকবেন তখন মুক্তি হবে। ছেলে খেলতে গেছে, খাবার সময় মা ডাকে। যখন তিনি মুক্তি দিবেন তখন তিনি সাধুসঙ্গ করিয়ে নেন। আবার তাকে পাবার জন্য ব্যাকুলতা করে দেন। কর্ম গেলে কেরানির যেমন ব্যাকুলতা হয়। সে যেমন রােজ আফিসে আফিসে ঘােরে, আর জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁগা, কোনাে কর্মখালি হয়েছে?” ব্যাকুলতা হলে ছটফট করে কীসে ঈশ্বরকে পাব। গোঁপে চাড়া, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেন, পান চিবুচ্ছেন, কোনাে ভাবনা নেই—এরূপ অবস্থা হলে ঈশ্বরলাভ হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৮

যখন শবসাধন করে, মাঝে মাঝে শবটা হাঁ করে ভয় দেখায়। তাই চাল, ছােলাভাজা রাখতে হয়। তার মুখে মাঝে মাঝে দিতে হয়। শবটা ঠান্ডা হলে, তবে নিশ্চিন্ত হয়ে জপ করতে পারবে। তাই পরিবারদের ঠান্ডা রাখতে হয়। তাদের খাওয়া-দাওয়ার জোগাড় করে দিতে হয়, তবে সাধন-ভজনের সুবিধা হয়। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ০৯

সংসারে নষ্ট-স্ত্রীর মতাে থাকবে। নষ্ট-স্ত্রী বাড়ির সব কাজ খুব মন দিয়ে করে, কিন্তু তার মন উপপতির উপর রাত-দিন পড়ে থাকে। সংসারের কাজ কর, কিন্তু মন সর্বদা ঈশ্বরের উপর রাখবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০
সংসারধর্ম; তাতে দোষ নাই। কিন্তু ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে, কামনাশূন্য হয়ে কাজকর্ম করবে। এই দেখ না, যদি কারু পিঠে একটা ফোঁড়া হয়—সে যেমন সকলের সঙ্গে কথাবার্তা কয়, হয়তাে কাজকর্মও করে, কিন্তু যেমন ফোঁড়ার দিকে তার মন পড়ে থাকে, সেই রকম।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১১

সব কাজ করবে, কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে। স্ত্রী, পুত্র, বাপ, মা সকলকে নিয়ে থাকবে ও সেবা করবে। যেন কত আপনার লােক। কিন্তু মনে জানবে যে, তারা তােমার কেউ নয়। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ কচ্ছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন পড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতাে মানুষ করে। বলে ‘আমার রাম’, ‘আমার হরি’—কিন্তু মনে বেশ জানে—এরা আমার কেউ নয়। যেমন জবাব দিলে ব্যস, আর কোনাে সম্পর্ক নাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১২

কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়, কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান?—আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে, কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে। ঈশ্বরে ভক্তিলাভ না করে যদি সংসার করতে যাও, তাহলে আরও জড়িয়ে পড়বে। বিপদ, শােক, তাপ এসবে অধৈর্য হয়ে যাবে। আর যত বিষয়-চিন্তা করবে, ততই আসক্তি
বাড়বে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৩

যে-সংসারী ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি রেখে সংসার করে—সে ধন্য, সে বীরপুরুষ। যেমনকারু মাথায় দু-মণ বোঝা আছে, আর বর যাচ্ছে; মাথায় বােঝা—তবুও সে বর দেখছে। খুব শক্তি না থাকলে হয় না। যেমন পাকাল মাছ পাকে থাকে, কিন্তু গায়ে একটুও পাক নাই। পানকৌড়ি জলে সর্বদা ডুব। মারে, কিন্তু পাখা একবার ঝাড়া দিলেই আর গায়ে জল থাকে না। তােমরা সংসার কর, অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে, পাকাল মাছের মতাে। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে—তবু গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৪

তেল হাতে মেখে তবে কাঠাল ভাঙতে হয়। তা না হলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৫

 সংসার যেন বিশালাক্ষীর দ, নৌকা দহে একবার পড়লে আর রক্ষানাই। সেঁকুল কাঁটার মতাে এক ছাড়ে তাে আর একটি জড়ায়। গােলকধান্দায় একবার ঢুকলে বেরুনাে মুশকিল। মানুষ যেন ঝলসাপােড়া হয়ে যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৬

জনকাদি সংসারেও কর্ম করেছিলেন। ঈশ্বরকে মাথায় রেখে কাজ করতেন। নর্তকী যেমন মাথায় বাস করে নাচে। আর পশ্চিমের মেয়েদের দেখ নাই? মাথায় জলের ঘড়া—হাসতে হাসতে, কথা কইতে কইতে যাচ্ছে। সংসার করবে, অথচ মাথায় কলসি ঠিক রাখবে, অর্থাৎ ঈশ্বরের দিকে মন। ঠিক রাখবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৭

ওদেশে ছুতােরদের মেয়েরা চিঁড়ে বেচে। তারা কতদিক সামলে কাজ করে, শােনাে। ঢেঁকির পাট পড়ছে, এক হাতে ধানগুলি ঠেলে দিচ্ছে আর একহাতে ছেলেকে কোলে করে মাই দিচ্ছে। আবার খদ্দের এসেছে; চেঁকি এদিকে পড়ছে, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথাও চলছে। খদ্দেরকে বলছে, তাহলে তুমি যে ক-পয়সা ধার আছে, সে ক-পয়সা দিয়ে যেও, আর জিনিস লয়ে যেও। দেখ—ছেলেকে মাই দেওয়া, ঢেঁকি পড়ছে—ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান তােলা, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে করছে। এরই নাম অভ্যাসযােগ। কিন্তু তার পনেরাে আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে, পাছে হাতে পড়ে যায়। আর এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া আর খদ্দেরের সঙ্গে কথা কওয়া। তেমনি যারা সংসারে আছে, তাদের পনেরাে আনা মন ভগবানে দেওয়া উচিত। না দিলে সর্বনাশ-কালের হাতে পড়তে হবে। আর এক আনায় অন্যান্য কর্ম কর। ঈশ্বরেতে মন রেখে তেমনি সংসারে নানা কাজ করতে পার, কিন্তু অভ্যাস চাই; আর হুঁশিয়ার হওয়া চাই—তবে দু-দিক রাখা যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৮

পিঁপড়ের মতাে সংসারে থাক, এই সংসারে নিত্য-অনিত্য মিশিয়ে রয়েছে। বালিতে-চিনিতে মিশানাে—পিঁপড়ে হয়ে চিনিটুকু নেবে। জলে-দুধে একসঙ্গে রয়েছে। চিদানন্দরস আর বিষয়রস। হংসের মতাে দুধটুকু নিয়ে জলটি ত্যাগ করবে। গােলমালে মাল আছে—গােল ছেড়ে মালটি নেবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১৯

বিবি কেমন একপায়ে ঘােড়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘােড়া বনবন করে দৌড়ুচ্ছে! কত কঠিন, অনেক দিন ধরে অভ্যাস করেছে, তবে তো হয়েছে। একটু অসাবধান হলেই হাত-পা ভেঙে যাবে, আবার মৃত্যুও হতে পারে। সংসার করা ওইরূপ কঠিন। অনেক সাধন-ভজন করলে ঈশ্বরের কৃপায় কেউ কেউ পেরেছে। অধিকাংশ লােক পারে না। সংসার করতে গিয়ে আরও বন্ধ হয়ে যায়, আরও ডুবে যায়, মৃত্যুযন্ত্রণা হয়। কেউ কেউ, যেমন জনকাদি অনেক তপস্যার বলে সংসার করেছিলেন। তাই সাধন, ভজন খুব দরকার, তা না হলে সংসারে ঠিক থাকা যায় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২০
শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২০


চৈতন্যলাভের পর সংসারে গিয়ে থাক। অনেক পরিশ্রম করে যদি কেউ সােনা পায়, সে মাটির ভিতর রাখতে পারে—বাক্সের ভিতরও রাখতে পারে, জলের ভিতরও রাখতে পারে—সােনার কিছু হয় না। কাঁচা মনকে সংসারে রাখতে গেলে মন মলিন হয়ে যায়। জ্ঞানলাভ করে তবে সংসারে থাকতে হয়। শুধু জলে দুধ রাখলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। মাখন তুলে জলের উপর রাখলে আর কোনাে গােল থাকে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২১

তাঁকে যদি লাভ করতে পার, সংসার অসার বলে বোধ হবে না। যে তাঁকে জেনেছে—সে দেখে যে, জীবজগৎ—সে তিনিই হয়েছেন। ছেলেদের খাওয়াবে, যেন গােপালকে খাওয়াচ্ছ। পিতামাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরী দেখবে ও সেবা করবে। তাঁকে জেনে সংসার করলে বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় ঐহিক সম্বন্ধ থাকে না। দু-জনেই ভক্ত, কেবল ঈশ্বরের কথা কয়, ঈশ্বরের প্রসঙ্গ লয়ে থাকে। ভক্তের সেবা করে। সর্বভূতে তিনি আছেন, তাঁর সেবা দু-জনে করে। এরূপ স্ত্রী-পুরুষ অতি বিরল। বিষয়ী লােকেরা তাদের চিনতে পারে না। তবে এরূপটি হতে গেলে দু-জনেই ভাল হওয়া চাই। দু-জনেই যদি সেই ঈশ্বরানন্দ পেয়ে থাকে, তাহলেই এটি সম্ভব হয়। ভগবানের বিশেষ কৃপা চই। না হলে সর্বদাই অমিল হয়। এক জনকে তফাতে যেতে হয়। যদি না মিল হয়, তাহলে বড় যন্ত্রণা। স্ত্রী হয়তাে রাতদিন বলে, “বাবা, কেন এখানে বিয়ে দিলে! না খেতে পেলুম, না বাছাদের খাওয়াতে পারলুম, না পরতে পেলুম, না বাছাদের পরাতে পেলুম, না একখানা গয়না! তুমি আমায় কী সুখে রেখেছ! চক্ষু বুজে ঈশ্বর ঈশ্বর করছেন! ওসব পাগলামি ছাড়!”

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২২

একটা সৎ-কামনা রাখতে হয়। ঐ চিন্তা করতে করতে দেহত্যাগ হবে বলে। সাধুরা চারধামের একধাম বাকি রাখে। অনেকে জগন্নাথক্ষেত্র বাকি রাখে। তাহলে জগন্নাথ’ চিন্তা করতে করতে শরীর যাবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৩

তাঁকে চিন্তা যত করবে, ততই সংসারের সামান্য ভােগের জিনিসে আসক্তি কমবে। তার পাদপদ্মে যত ভক্তি হবে, ততই বিষয়বাসনা কম পড়ে আসবে, ততই দেহের সুখের দিকে নজর কমবে; পরস্ত্রীকে মাতৃবৎ বােধ হবে, নিজের স্ত্রীকে ধর্মের সহায় বন্ধু বােধ হবে, পশুভাব চলে যাবে, দেবভাব আসবে, সংসারে একেবারে অনাসক্ত হয়ে যাবে। তখন সংসারে যদিও থাক, জীবন্মুক্ত হয়ে বেড়াবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৪

(মাস্টারমহাশয়ের বন্ধু হরিবাবুর প্রতি) কিছুই কর না? সেকী! তুমি যে ‘কুমড়াে-কাটা বট্ঠাকুর’ হলে। তুমি না সংসারী, না হরিভক্ত। এ ভাল নয়। এক-একজন বাড়িতে পুরুষ থাকে - মেয়েছেলেদের নিয়ে রাতদিন থাকে, আর বাহিরের ঘরে বসে ভুড়ুর ভুড়ুর করে তামাক খায়, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে। তবে বাড়ির ভিতরে কখনাে গিয়ে কুমড়াে কেটে দেয়। মেয়েদের কুমড়াে কাটতে নাই, তাই ছেলেদের দিয়ে তারা বলে পাঠায়, বট্‌ঠাকুরকে ডেকে আন। তিনি কুমড়ােটা দু-খানা করে দিবেন। তখন সে কুমড়ােটা দু-খানা করে দেয়, এই পর্যন্ত পুরুষের ব্যবহার। তাই নাম হয়েছে ‘কুমড়ােকাটা বট্‌ঠাকুর’। তুমি এ-ও কর—ও-ও কর। ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে সংসারের কাজ কর। আর যখন একলা থাকবে তখন পড়বে ভক্তিশাস্ত্র— শ্রীমদ্ভাগবত বা চৈতন্যচরিতামৃত—এই সমস্ত পড়বে। সংসারীর পক্ষে যােগবাশিষ্ঠ, বেদান্ত—ভাল নয়। বড় খারাপ। সংসারীরা সেব্য-সেবক ভাবে থাকবে। ‘হে ঈশ্বর, তুমি সেব্য—প্রভু, আমি সেবক—আমি তােমার দাস।’

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৫

যাদের সময় আছে, তারা ধ্যান-ভজন করবে। যারা একান্ত পারবে না, তারা দুবেলা খুব দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তাে অন্তর্যামী—বুঝছেন যে, এরা কী করে। অনেক কাজ করতে হয়। তােমাদের ডাকবার সময় নাই—তাকে আমমােক্তারি (বকলমা) দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে তাকে দর্শন না করলে, কিছুই হলাে না।

ক্লিক করুনঃ- 25 Swami Vivekananda Bani In Bengali

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৬

সংসার কর্মভূমি। এখানে কর্ম করতে আসা। যেমন, দেশে বাডি কলকাতায় গিয়ে কর্ম করে। কিছু কর্ম করা দরকার—সাধন। তাড়াতাড়ি কর্মগুলি শেষ করে নিতে হয়। স্যাকরারা সােনা গলাবার সময় হাপর, পাখা চোঙ দিয়ে হাওয়া করে, যাতে আগুনটা খুব হয়ে সােনাটা গলে। সােনা গলার পর তখন বলে, তামাক সাজ। এতক্ষণ কপাল দিয়ে ঘাম পড়ছিল। তারপর তামাক খাবে। খুব রােখ চাই। তবে সাধন হয়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ঈশ্বরেতে সর্বদা মন রাখবে। প্রথমে একটু খেটে নিতে হয়। তারপর পেনশন ভােগ করবে। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৭

আপনার সন্তান-সন্ততিতে যেমন আপনার জ্ঞান আছে, তাকে সেই রকম আপনার ভেবে ডাক কি? আপনার হতেও আপনার ভেবে ডাক, নিশ্চয় বলছি তিনি ভক্তবৎসল, দেখা না দিয়ে থাকতে পারবেন না। মানুষ তাকে ডাকবার আগে তিনি এগিয়ে আসেন। মানুষ যদি এক-পা ঈশ্বরের দিকে এগােয়, তিনি দশ-পা এগিয়ে আসেন। তার চেয়ে আপনার জন আর কেউ নাই। তাকে যদি আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা যায়, তবে তিনি একশাে বার শুনবেন। তিনি খুব কানখড়কে, সব শুনতে পান। যত ডেকেছ, সব শুনেছেন। একদিন-না-একদিন দেখা দেবেনই দেবেন। অন্তত মৃত্যুসময়েও দেখা দেবেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৮

ডুব দিতে হয়। শুধু উপাসনা, লেকচারে হয় না। তাকে প্রার্থনা করতে হয়, যাতে ভােগাসক্তি চলে গিয়ে তার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়। হাতির বাহিরের দাঁত আছে, আবার ভিতরের দাঁতও আছে। বাহিরের দাঁতে শােভা, কিন্তু ভিতরের দাঁতে খায়। তেমনি ভিতরে কামিনীকাঞ্চন ভােগ করলে ভক্তির হানি হয়। বাহিরে লেকচার ইত্যাদি দিলে কী হবে? শকুনি উপরে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। হাওয়াই হুস করে প্রথমে আকাশে উঠে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে যায়। ভােগাসক্তি ত্যাগ হলে শরীর যাবার সময় ঈশ্বরকেই মনে পড়বে। তা না হলে এই সংসারের জিনিসই সব মনে পড়বে—স্ত্রী, পুত্র, গৃহ, ধন, মানসম্ভ্রম ইত্যাদি। পাখি অভ্যাস করে রাধাকৃষ্ণ বােল বলে। কিন্তু বেড়ালে ধরলে ক্যাঁ ক্যাঁ করে। তাই সর্বদা অভ্যাস করা দরকার। তার নামগুণকীর্তন, তার ধ্যান চিন্তা আর প্রার্থনা—যেন ভােগাসক্তি যায় আর তােমার পাদপদ্মে মন হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ২৯

সব লােক বাবুর বাগান দেখে অবাক—কেমন গাছ, কেমন ফুল, কেমন ঝিল, কেমন বৈঠকখানা, কেমন তার ছবি—এইসব দেখেই অবাক। কিন্তু কই, বাগানের মালিক যে-বাবু তাকে খোঁজে ক-জন? বাবুকে খোঁজে দুই-এক জনা। ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে খুঁজলে তাকে দর্শন হয়, তার সঙ্গে আলাপ হয়, কথা হয়; যেমন, আমি তােমাদের সঙ্গে কথা কচ্চি। সত্য বলছি দর্শন হয়। একথা কারেই বা বলছি—কে বা বিশ্বাস করে! 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩০
শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩০

যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন—এইরূপ দেশ-কাল-পাত্র ভেদে বিবেচনা করে সংসারে সকল বিষয়ে না চলতে পারলে শান্তিলাভ কিংবা নিজ লক্ষ্যস্থলে পহুছিতে পারে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩১

বিষয়ী লােক মাগের ব্যামাে হলে, কি টাকা লােকসান হলে, কি ছেলের জন্য, কি কর্মের জন্য, একঘটি কাঁদে—সেরূপ ঈশ্বরের জন্য কই কাঁদে? এক ডাকে দেখা না পেলে ভাবতে নাই যে তিনি নাই। জীবের অহঙ্কার আছে বলে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না। মেঘ উঠলে আর সূর্য দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না বলে কি সূর্য নাই? সূর্য ঠিক আছে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩২

সংসারে থেকে সাধন করা বড় কঠিন। অনেক ব্যাঘাত। তা আর তােমাদের বলতে হবে না—রােগ-শােক, দারিদ্র, আবার স্ত্রীর সঙ্গে মিল নাই, ছেলে অবাধ্য মূখ গোঁয়ার। তবে উপায় আছে—মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁকে প্রার্থনা করতে হয়, তাঁকে লাভ করবার জন্য চেষ্টা করতে হয়। যখন অবসর পাবে, কোনাে নির্জন স্থানে গিয়ে এক দিন দু-দিন থাকবে—যেন কোনো সংসারের সঙ্গে সম্বন্ধ না থাকে, যেন কোনাে বিষয়ী লােকদের সঙ্গে সাংসারিক বিষয় লয়ে আলাপ না করতে হয়। হয় নির্জনে বাস, নয় সাধুসঙ্গ।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৩

সংসারে নির্লিপ্তভাবে থাকতে গেলে কিছু সাধন করা চাই। দিনকতক নির্জনে থাকা দরকার; তা এক বছর হােক, ছয় মাস হােক, তিন মাস হােক বা এক মাস হােক। সেই নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়, সর্বদা তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ভক্তির জন্য প্রার্থনা করতে হয়। আর মনে মনে বলতে হয়—‘আমার এ-সংসারে কেউ নাই, যাদের আপনার বলি, তারা দু-দিনের জন্য। ভগবান আমার একমাত্র আপনার লােক, তিনি আমার সর্বস্ব। হায়! কেমন করে তাঁকে পাব। ভক্তিলাভের পর সংসার করা যায়। যেমন হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আর আঠা লাগে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৪

নির্জন না হলে ভগবানচিন্তা হয় না। সােনা গলিয়ে গয়না গড়াব— তা যদি গলাবার সময় পাঁচ বার ডাকে, তাহলে সােনা গলানাে কেমন করে হয়? চাল কাঁড়ছ, একলা বসে কাঁড়তে হয়। এক-একবার চাল হাতে করে তুলে দেখতে হয়, কেমন সাফ হলো। কাঁড়তে কাঁড়তে যদি পাঁচ বার ডাকবে। ভাল কাঁড়া কেমন করে হয়?

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৫

সংসারের বাইরে একলা গিয়ে যদি ভগবানের জন্য তিন দিনও কাঁদা যায়, সেও ভাল। এমনকী, অবসর পেয়ে এক দিনও নির্জনে তাঁর চিন্তা করা যায়, সেও ভাল। একটু সাধন-ভজন করতে হয়। দুধে মাখন আছে শুধু। বললেই হয় না, দুধকে দই পেতে, মন্থন করে মাখন তুলতে হয়। তবে মাঝে মাঝে একট নির্জন চাই। দিনকতক নির্জনে থেকে ভক্তিলাভ করে, তারপর যেখানে থাক। জুতাে পায়ে দিয়ে কাঁটাবনেও অনায়াসে যাওয়া যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৬

নির্জনে না গেলে, শক্ত রােগ সারবে কেমন করে? রােগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে-ঘরে বিকারী রােগী, সেই ঘরেই আচার, তেঁতুল আর জলের জালা! তা রােগ সারবে কেমন করে? আচার, তেঁতুল-এই দেখ, বলতে বলতে আমার মুখে জল এসেছে। সম্মুখে থাকলে কী হয়, সকলেই তাে জান। মেয়েমানুষ পুরুষের পক্ষে ওই আচার, তেঁতুল। ভােগবাসনা জলের জালা; বিষয়-তৃষ্ণার শেষ নাই, আর এই বিষয় রােগীর ঘরে! এতে কি বিকাররােগ সারে? দিনকতক ঠাঁইনাড়া হয়ে থাকতে হয়—যেখানে আচার-তেঁতুল নাই, জলের জালা নাই। তারপর নীরােগ হয়ে আবার সেই ঘরে এলে আর ভয় নাই। তাঁকে লাভ করে সংসারে এসে থাকলে, আর কামিনীকাঞ্চনে কিছু করতে পারে না। তখন জনকের মতাে নির্লিপ্ত হতে পারবে। কিন্তু প্রথমাবস্থায় সাবধান হওয়া চাই। খুব নির্জনে থেকে সাধন করা চাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৭

অশ্বথ গাছ যখন চারা থাকে, তখন চারিদিকে বেড়া দেয়, পাছে ছাগল-গরুতে নষ্ট করে। কিন্তু, ওঁড়ি মােটা হলে আর বেড়ার দরকার থাকে হাতি বেঁধে দিলেও গাছের কিছু করতে পারে না। যদি নির্জনে সাধন করে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তিলাভ করে বল বাড়িয়ে, বাড়ি গিয়ে সংসার কর, তাহলে কামিনীকাঞ্চনে তােমার কিছু করতে পারবে না। নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। ঠেলাঠেলি নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৮

ওরে কালে হবে, কালে বুঝবি। বিচিটা পুঁতলেই কি অমনি ফল পাওয়া যায়? আগে অংকুর হবে, তারপর চারাগাছ হবে, তারপর সেই গাছ বড় হয়ে তাতে ফুল ধরবে, তারপর ফল—সেই রকম। তবে লেগে থাকতে হবে, ছাড়লে হবে না। তাঁর সেবা, বন্দনা ও অধীনতা কিনা দীন ভাব—এই নিয়ে বিশ্বাস করে পড়ে থাকতে থাকতে সব হবে, তাঁর দর্শন পাওয়া যাবেই যাবে। তা না করে ছেড়ে দিলে কিন্তু ঐ পর্যন্তই হলাে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৩৯

দেখ, যারা খানদানি চাষা, তারা বারাে বৎসর অনাবৃষ্টি হলেও চাষ দিতে ছাড়ে না। আর যারা ঠিক চাষা নয়, চাষের কাজে বড় লাভ শুনে কারবার করতে আসে, তারাই এক বৎসর বৃষ্টি না হলেই চাষ ছেড়ে দিয়ে পালায়। তেমনি যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও বিশ্বাসী, তারা সমস্ত জীবন তার দর্শন না পেলেও তার নাম গুণানুকীর্তন করতে ছাড়ে না। যেমন সাঁতার দিতে হলে আগে অনেক দিন ধরে জলে হাত-পা ছুঁড়তে হয়, একবারেই সাঁতার দেওয়া যায় না, সেইরূপ ব্রহ্মরূপ সমুদ্রে সাঁতার দিতে গেলে অনেক বার উঠতে পড়তে হয়, একবারে হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪০
শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪০
সংসারে থাক ঝড়ের এঁটো পাতা হয়ে। ঝড় এঁটো পাতাকে কখনাে ঘরের ভিতরে লয়ে যায়, কখনাে আঁস্তাকুড়ে। হাওয়া যেদিকে যায়, পাতাও সেই দিকে যায়। কখনাে ভাল জায়গায়, কখনাে মন্দ জায়গায়। তােমাকে এখন সংসারে ফেলেছেন, ভাল, এখন সেই স্থানেই থাক—আবার যখন সেখান থেকে তুলে ওর চেয়ে ভাল জায়গায় লয়ে ফেলবেন, তখন যা হয় হবে।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪১

কোনাে এক গ্রামে একটি তাঁতি থাকে। বড় ধার্মিক, সকলেই তাকে বিশ্বাস করে আর ভালবাসে। তাঁতি হাটে গিয়ে কাপড় বিক্রি করে। খরিদ্দার দাম জিজ্ঞাসা করলে বলে—রামের ইচ্ছা, সুতার দাম এক টাকা, মেহন্নতের দাম চারি আনা; রামের ইচ্ছা, মুনাফা দুই আনা। কাপড়ের দাম—রামের ইচ্ছা, এক টাকা ছয় আনা। লােকের এত বিশ্বাস যে, তৎক্ষণাৎ দাম ফেলে দিয়ে কাপড় নিত। লােকটি ভারী ভক্ত, রাত্রিতে খাওয়াদাওয়ার পরে অনেকক্ষণ চণ্ডীমণ্ডপে বসে ঈশ্বরচিন্তা করে, তার নামগুণকীর্তন করে। একদিন অনেক রাত হয়েছে, লােকটির ঘুম আসছে না, বসে আছে, একএকবার তামাক খাচ্ছে; এমন সময় সেই পথ দিয়ে একদল ডাকাত ডাকাতি করতে যাচ্ছে। তাদের মুটের অভাব হওয়াতে ওই তাঁতিকে এসে বললে,’আয় আমাদের সঙ্গে’—এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। তারপর একজন গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে ডাকাতি করলে। কতকগুলাে জিনিস তাঁতির মাথায় দিলে। এমনসময় পুলিশ এসে পড়ল। ডাকাতেরা পালাল, কেবল তাঁতিটি মাথায় মােটসমেত ধরা পড়ল। সে-রাত্রি তাকে হাজতে রাখা হলাে। পরদিন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে বিচার। গ্রামের লােক জানতে পেরে সব এসে উপস্থিত। তারা সকলে বললে, “হুজুর! এ-লােক কখনও ডাকাতি করতে পারে না।” সাহেব তখন তাঁতিকে জিজ্ঞাসা করলে, “কিগাে, তােমার কী হয়েছে বল।” তাঁতি বললে, “হুজুর! রামের ইচ্ছা, আমি রাত্রিতে ভাত খেলুম। তারপর রামের ইচ্ছা, আমি চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছি; রামের ইচ্ছা, অনেক রাত হলাে। আমি, রামের ইচ্ছা, তার চিন্তা করছিলাম আর তার নামগান করছিলাম। এমন সময়ে রামের ইচ্ছা, একদল ডাকাত সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। রামের ইচ্ছা, তারা আমায় ধরে টেনে লয়ে গেল। রামের ইচ্ছা, তারা এক গৃহস্থের বাড়ি ডাকাতি করলে। রামের ইচ্ছা, আমার মাথায় মােট দিলে। এমন সময়, রামের ইচ্ছা, পুলিশ এসে পড়ল। রামের ইচ্ছা, আমি ধরা পড়লুম। তখন রামের ইচ্ছা, পুলিশের লােকেরা হাজতে দিলে। আজ সকালে রামের ইচ্ছা, হুজুরের কাছে এনেছে।” অমন ধার্মিক লােক দেখে, সাহেব তাতিটিকে ছেড়ে দেবার হুকুম দিলেন। তাঁতি রাস্তায় বন্ধুদের বললে, “রামের ইচ্ছা, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সংসার করা, সন্ন্যাস করা, সবই রামের ইচ্ছা। তাই তার উপর সব ফেলে দিয়ে সংসারে কাজ কর। তা না হলে আর কীই বা করবে? একজন কেরানি জেলে গিছিল। জেলখাটা শেষ হলে সে জেল থেকে বেরিয়ে এল। এখন জেল থেকে এসে, সে কি কেবল ধেই ধেই করে নাচবে? না, কেরানিগিরিই করবে? সংসারী যদি জীবন্মুক্ত হয়, সে মনে করলে অনায়াসে সংসারে থাকতে পারে। যার জ্ঞানলাভ হয়েছে, তার এখানে-সেখানে নাই। তার সব সমান। যার সেখানে আছে, তার এখানেও আছে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪২

যেমন রােগ, তার তেমনি ঔষধ। গীতায় তিনি বলেছেন, “হে অর্জুন, তুমি আমার শরণ লও, তােমাকে সবরকম পাপ থেকে আমি মুক্ত করব।” তাঁর শরণাগত হও, তিনি সদ্বুদ্ধি দেবেন, তিনি সব ভার নেবেন। তখন সবরকম বিকার দূরে যাবে। এ-বুদ্ধি দিয়ে কি তাকে বুঝা যায় ? এক সের ঘটিতে কি চার সের দুধ ধরে ? আর তিনি না বুঝলে কি বুঝা যায় ? তাই বলছি—তার শরণাগত হও—তার যা ইচ্ছা তিনি করুন। তিনি ইচ্ছাময়। মানুষের কী শক্তি আছে? সংসারে রেখেছেন তা কী করবে? সমস্ত তাকে সমর্পণ কর—তাঁকে আত্মসমর্পণ কর। তাহলে আর কোনাে গােল থাকবে না। তখন দেখবে—তিনিই সব করছেন, সবই ‘রামের ইচ্ছা। 


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৩

কী করবে? তার পদে সব সমর্পণ কর, তাঁকে আমমােক্তারি দাও। তিনি যা ভাল হয় করুন। বড়লােকের উপর যদি ভার দেওয়া যায়, সে লােক কখনও মন্দ করবে না। সাধনার প্রয়ােজন বটে; কিন্তু দু-রকম সাধক আছে— একরকম সাধকের বানরের ছা-র স্বভাব, আর একরকম সাধকের বিড়ালের ছা-র স্বভাব। বানরের ছা নিজে জো-সাে করে মাকে আঁকড়িয়ে ধরে। সেইরূপ কোনাে কোনাে সাধক মনে করে—এত জপ করতে হবে, এত ধ্যান করতে হবে, এত তপস্যা করতে হবে, তবে ভগবানকে পাওয়া যাবে। এ-সাধক নিজে চেষ্টা করে ভগবানকে ধরতে যায়। বিড়ালের ছা কিন্তু নিজে মাকে ধরতে পারে না। সে পড়ে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে। মা যা করে। মা কখনাে বিছানার উপর, কখনাে ছাদের উপর কাঠের আড়ালে রেখে দিচ্ছে; মা তাকে মুখে করে এখানে-ওখানে লয়ে রাখে, সে নিজে মাকে ধরতে জানে না। সেইরূপ কোনাে কোনাে সাধক নিজে হিসাব করে কোনাে সাধন করতে পারে না—এত জপ করব, এত ধ্যান করব ইত্যাদি। সে কেবল ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাকে ডাকে। তিনি তার কান্না শুনে আর থাকতে পারেন না, এসে দেখা দেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৪

যে মা-র উপর একান্ত নির্ভর করেছে, মা তার পা বেতালে পড়তে দেন না। যে-ছেলে নিজে বাপের হাত ধরে মাঠের আলপথে চলছে, সে-ছেলে বরং অসাবধান হয়ে বাপের হাত ছেড়ে দিয়ে খানায় পড়তে পারে। কিন্তু বাপ যে-ছেলের হাত ধরে, সে কখনও খানায় পড়ে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৫

উপায় সাধুসঙ্গ আর প্রার্থনা। সাধুসঙ্গে ঈশ্বরে অনুরাগ হয়, তাঁর উপর ভালবাসা হয়। ব্যাকুলতা না এলে কিছুই হয় না। সাধুসঙ্গ করলে আর একটি উপকার হয়, সদসৎ বিচার। সৎ নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর, অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। অসৎ-পথে মন গেলেই বিচার করতে হয়। হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুড় বাড়ালে, সেই সময় মাহুত ডাঙশ মারে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৬

বৈদ্যের কাছে না গেলে রােগ ভাল হয় না। সাধুসঙ্গ এক দিন করলে হয় না, সর্বদাই দরকার; রােগ লেগেই আছে। আবার বৈদ্যের কাছে না থাকলে নাড়িজ্ঞান হয় না, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হয়—তবে কোনটি বায়ুর নাড়ি, কোনটি পিত্তের নাড়ি, কোনটি কফের নাড়ি বােঝা যায়। অমুক নম্বরের সুতা যে-সে কি চিনতে পারে? সুতাের ব্যবসা কর, যারা ব্যবসা করে তাদের দোকানে কিছুদিন থাক;কোনটা চল্লিশ নম্বরের, কোনটা বিশ নম্বরের সুতাে, ঝাঁ করে বলতে পারবে। ন্যাংটা বলত—“ঘটি রােজ মাজতে হয়, তা না হলে কলঙ্ক পড়বে।” ভক্তি কীরূপে হয়? প্রথমে সাধুসঙ্গ করতে হয়। সাধুসঙ্গ করলে ঈশ্বরীয় বিষয়ে শ্রদ্ধা হয়। শ্রদ্ধার পর নিষ্ঠা, ঈশ্বরকথা বই আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না—তাঁরই কাজ করতে ইচ্ছা করে। নিষ্ঠার পর ভক্তি। তারপর ভাব—মহাভাব, প্রেম—বস্তুলাভ। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৭

সংসারে হবে না কেন? তবে কী জান, মন নিজের কাছে নাই। নিজের কাছে মন থাকলে তবে তাে ভগবানকে দেবে। মন বন্ধক দিয়ে-কামিনীকাঞ্চনে বন্ধক! তাই সর্বদা সাধুসঙ্গ দরকার। মন নিজের কাছে এলে তবে সাধন-ভজন হবে। সর্বদা গুরুর সঙ্গ, গুরুর সেবা, সাধুসঙ্গ প্রয়ােজন। হয় নির্জনে রাতদিন তার চিন্তা, নয় সাধুসঙ্গ। মন একা থাকবে ক্রমে শুষ্ক হয়ে যায়। এক ভাঁড় জল যদি আলাদা রেখে দাও, ক্রমে শুকিয়ে যাবে। কিন্তু গঙ্গাজলের ভিতর যদি ঐ ভাঁড় ডুবিয়ে রাখ, তাহলে শুকোবে না! কামারশালার লােহা আগুনে বেশ লাল হয়ে গেল। আবার আলাদা করে রাখ—যেমন কালো লােহা, তেমনি কালাে। তাই লােহাকে মাঝে মাঝে হাপরে দিতে হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৮

যে কর্মই লােকে করুক না কেন, সংসারী ব্যক্তির মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ বড় দরকার। ঈশ্বরে ভক্তি থাকলে লােকে সাধুসঙ্গ আপনি খুঁজে লয়। আমি উপমা দিই—গাঁজাখাের গাঁজাখােরের সঙ্গে থাকে, অন্য লােক দেখলে মুখ নিচু করে চলে যায়, বা লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু আরেক জন গাঁজাখোর দেখলে মহা আনন্দ। হয়তাে কোলাকুলি করে। আবার শকুটি শকুনির কাছে থাকে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৪৯

কেউ কেউ সাধুসঙ্গ করে গাঁজা খাওয়ার জন্য। সাধুরা গাঁজা খায় নি, তাই তাদের কাছে এসে বসে গাঁজা সেজে দেয় আর প্রসাদ পায়। আমি একবার মিউজিয়ামে গিছলুম; তা দেখালে ইট পাথর হয়ে গেছে, জানােয়ার পাথর হয়ে গেছে। দেখলে, সঙ্গের গুণ কী! তেমনি সর্বদা সাধুসঙ্গ করলে তাই হয়ে যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫০
সংসারী লােকের সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার। সকলেরই দরকার। সন্ন্যাসীরও দরকার। তবে সংসারীদের বিশেষত, রােগ লেগেই আছে - কামিনীকাঞ্চনের মধ্যে সর্বদা থাকতে হয়। সাধু ঈশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। সৎসঙ্গ সর্বদাই দরকার। গঙ্গার যত কাছে যাবে ততই শীতল হাওয়া পাবে; অগ্নির যত কাছে যাবে ততই উত্তাপ পাবে। ঢিমে তেতালা হলে হবে। যাদের সংসারে ভােগের ইচ্ছা আছে, তারা বলে, “হবে, কখনাে-না কখনাে ঈশ্বরকে পাব।”


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫১

সাধুসঙ্গ সর্বদাই দরকার। রােগ লেগেই আছে। সাধুরা যা বলেন, সেইরূপ করতে হয়। শুধু শুনলে কী হবে? ঔষধ খেতে হবে, আবার আহারের কটকেনা করতে হবে। পথ্যের দরকার। বৈদ্য তিন প্রকার - উত্তম বৈদ্য, মধ্যম বৈদ্য, অধম বৈদ্য। যে বৈদ্য এসে নাড়ি টিপে ‘ঔষধ খেও হে’ বলে চলে যায়, সে অধম বৈদ্য—রােগী খেলে কি না, এ-খবর সে লয় না। আর যে বৈদ্য রােগীকে ঔষধ খেতে অনেক করে বুঝায়, মিষ্ট কথাতে বলে, “ওহে ঔষধ না খেলে কেমন করে ভাল হবে? লক্ষ্মীটি খাও, আমি নিজে ঔষধ মেড়ে দিচ্ছি খাও”—সে মধ্যম বৈদ্য। আর যে বৈদ্য রােগী কোনােমতে খেলে না দেখে, বুকে হাঁটু দিয়ে জোর করে ঔষধ খাইয়ে দেয়, সে উত্তম বৈদ্য। উত্তম বৈদ্য বুকে হাঁটু দিলে কোনাে ভয় নাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫২

সাধুদের ছবি ঘরে রাখতে হয়, তাহলে সর্বদা ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়। শােলার আতা দেখলে যেমন সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়; যুবতী স্ত্রীলােক দেখলে লােকের যেমন ভােগের উদ্দীপন হয়। তাই তােমাদের বলি—সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার। সংসারের জ্বালা তাে দেখছ। ভােগ নিতে গেলেই জ্বালা। চিলের মুখে যতক্ষণ মাছ ছিল, ততক্ষণ ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে তাকে জ্বালাতন করেছিল। সাধুসঙ্গে শাস্তি হয়। জলে কুম্ভীর অনেকক্ষণ থাকে; এক-একবার জলে ভাসে, নিঃশ্বাস লবার জন্য। তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। দেখ, সাধু-সন্ন্যাসীর পট ঘরে রাখা ভাল। সকালবেলা উঠে অন্য মুখ না দেখে সাধু-সন্ন্যাসীর মুখ দেখে উঠা ভাল। যেরূপ সঙ্গের মধ্যে থাকবে, সেরূপ স্বভাব হয়ে যায়। তাই ছবিতেও দোষ। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৩

 বাঘ যেমন কপ কপ করে জানোয়ার খেয়ে ফেলে, তেমনি ‘অনুরাগ বাঘ’ কাম-ক্রোধ এইসব রিপুদের খেয়ে ফেলে। ঈশ্বরে এবার অনুরাগ হলে কাম-ক্রোধাদি থাকে না। গােপীদের এই অবস্থা হয়েছিল। কৃষ্ণে অনুরাগ। আবার আছে ‘অনুরাগ-অঞ্জন’। শ্রীমতী বলছেন, ‘সখি, চতুর্দিক কৃষ্ণময় দেখছি।” তারা বললে, ‘সখি, অনুরাগ-অঞ্জন চোখে দিয়েছ, তাই ঐরূপ দেখছ।” উপায় অনুরাগ অর্থাৎ তাঁকে ভালবাসা আর প্রার্থনা। অনুরাগ আগে, পরে প্রার্থনা।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৪

নামের খুব মাহাত্ম্য আছে বটে! তবে অনুরাগ না থাকলে কি হয়? ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হওয়া দরকার। শুধু নাম করে যাচ্ছি, কিন্তু কামিনীকাঞ্চনে মন রয়েছে, তাতে কি হয়? বিছে বা ডাকুর (মাকড়সা) কামড় অমনি মন্ত্রে সারে না—ঘুঁটের ভাবরা দিতে হয়। হাতিকে নাইয়ে দিলে কী হবে, আবার ধুলাে-কাদা মেখে যে-কে-সেই! তবে হাতিশালায় ঢােকাবার আগে যদি কেউ ধুলাে ঝেড়ে দেয় ও স্নান করিয়ে দেয়, তাহলে গা পরিষ্কার থাকে। নামেতে একবার শুদ্ধ হলাে, কিন্তু তারপরেই হয়তাে নানা পাপে লিপ্ত হয়। মনে বল নাই; প্রতিজ্ঞা করে না যে, আর পাপ করব না। গঙ্গাস্নানে পাপ সব যায়। গেলে কী হবে? লােকে বলে থাকে, পাপগুলো গাছের উপর থাকে। গঙ্গা নেয়ে যখন মানুষটা ফেরে, তখন ঐ পুরানাে পাপগুলাে গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ওর ঘাড়ের উপর পড়ে। স্নান করে দু-পা না আসতে আসতে আবার ঘাড়ে চড়েছে! তাই নাম কর, সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা কর, যাতে ঈশ্বরেতে অনুরাগ হয়, আর যেসব জিনিস দু-দিনের জন্য, যেমন—টাকা মান দেহের সুখ, তাদের উপর যাতে ভালবাসা কমে যায়, প্রার্থনা কর।  

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৫

তাঁর নাম-বীজের খুব শক্তি। অবিদ্যা নাশ করে। বীজ এত কোমল, অঙ্কুর এত কোমল, তবু শক্ত মাটি ভেদ করে। মাটি ফেটে যায়। সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার সময় তােমরা তাঁকে ডাকবে। অন্ধকারে ঈশ্বরকে মনে পড়ে, সব এই দেখা যাচ্ছিল—কে এমন করলে! মুসলমানেরা দেখ, সব কাজ ফেলে ঠিক সময়ে নামাজটি পড়ছে। সন্ধ্যা হলে সব কর্ম ছেড়ে হরি স্মরণ করবে। নামেতে রুচি ও বিশ্বাস করতে পারলে তার আর কোনােপ্রকার বিচার বা সাধন করতে হয় না। নামের প্রভাবে সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়, নামেতেই চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং নামেতেই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৬

বিষয়ীদের পূজা, জপ, তপ, যখনকার তখন। যারা ভগবান বই জানে না, তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁর নাম করে। কেউ মনে মনে সর্বদাই ‘রাম’, ‘ওঁ রাম’ জপ করে। জ্ঞানপথের লােকেরাও ‘সােহহম’ জপ করে। কারাে কারাে সর্বদাই জিহ্বা নড়ে, সর্বদাই স্মরণ-মনন থাকা উচিত।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৭

জপ থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। নির্জনে গােপনে তার নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শন। যেমন, জলের ভিতর ডুবানাে বাহাদুরি কাঠ আছে—তীরেতে শিকল দিয়ে বাঁধা; সেই শিকলের এক এক পাব ধরে ধরে গেলে, শেষে বাহাদুরি কাঠকে স্পর্শ করা যায়। ঠিক সেইরূপ জপ করতে করতে মগ্ন হয়ে গেলে ক্রমে ভগবানের সাক্ষাৎকার হয়। জপ করা কিনা নির্জনে নিঃশব্দে তাঁর নাম করা। একমনে নাম করতে করতে-জপ করতে করতে—তার রূপ-দর্শন হয়—তার সাক্ষাৎকার হয়। দর্শনের কথা কাউকেও বলতে নাই, তাহলে আর হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৮

নাম কী কম? তিনি আর তার নাম তফাত নয়। সত্যভামা যখন তুলাযন্ত্রে স্বর্ণ-মণি-মাণিক্য দিয়ে ঠাকুরকে ওজন কচ্ছিলেন, তখন হলাে না! যখন রুক্মিণী তুলসী আর কৃষ্ণনাম একদিকে লিখে দিলেন, তখন ঠিক ওজন হলাে!

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৫৯

 ‘ত্বন্নামে অরুচি’! বিকারে যদি অরুচি হলাে, তাহলে আর বাঁচবার পথ থাকে না। যদি একটু রুচি থাকে, তবে বাঁচবার খুব আশা। তাই নামে রুচি। ঈশ্বরের নাম করতে হয়; দুর্গানাম, কৃষ্ণনাম, শিবনাম, যে-নাম বলে ঈশ্বরকে ডাক না কেন, যদি নাম করতে করতে অনুরাগ দিন দিন বাড়ে, যদি আনন্দ হয়, তাহলে আর কোনাে ভয় নাই, বিকার কাটবেই কাটবে। তাঁর কৃপা হবেই হবে।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬০
তাঁর নাম করলে সব পাপ কেটে যায়! কাম, ক্রোধ, শরীরের সুখ-ইচ্ছা—এসব পালিয়ে যায়। ব্যাকুল হয়ে তাঁকে প্রার্থনা কর, যাতে তাঁর নামে রুচি হয়। তিনিই মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬১

নামে রুচি, জীবে দয়া, বৈষ্ণব-পূজন। যেই নাম সেই ঈশ্বর—নাম নামী অভেদ জেনে সর্বদা অনুরাগের সহিত নাম করবে।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬২

সংসারে থাকতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে—একটু-আধটু অশান্তি আছে। কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগেই। হাততালি দিয়ে সকালে বিকালে হরিনাম করবে—‘হরিবােল হরিবােল’ ‘হরিবােল’ বলে। তার নামগুণকীর্তন করলে দেহের সব পাপ পালিয়ে যায়। দেহবৃক্ষে পাপপাখি, তার নামকীর্তন যেন হাততালি দেওয়া। হাততালি দিলে যেমন বৃক্ষের উপরের পাখি পালায়, তেমনি সব পাপ তার নামগুণকীর্তনে চলে যায়। আবার দেখ, মেঠো পুকুরের জল সূর্যের তাপে আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। তেমনি তার নামগুণকীর্তনে পাপ-পুষ্করিণীর জল আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। রােজ অভ্যাস করতে হয়। সার্কাসে দেখে এলাম—ঘােড়া দৌড়ুচ্ছে, তার উপর বিবি একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত অভ্যাসে ঐটি হয়েছে। আর তাঁকে দেখবার জন্যে অন্তত একবার করে কাঁদ। কলিতে বলে, এক দিন এক রাত কাঁদলে ঈশ্বরদর্শন হয়। তাঁর নাম সর্বদাই করতে হয়। কলিতে নাম-মাহাত্ম্য। অন্নগত প্রাণ, তাই যােগ হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৩

চৈতন্যদেব বলেছিলেন, ঈশ্বরের নামের ভারী মাহাত্ম্য। শীঘ্র ফল না হতে পারে, কিন্তু কখনাে-না কখনাে এর ফল হবেই হবে। যেমন কেউ বাড়ির কার্নিশ এর উপর বীজ রেখে গিয়েছিল; অনেক দিন পরে বাড়ি ভূমিসাৎ হয়ে গেল, তখনও সেই বীজ মাটিতে পড়ে গাছ হলাে ও তার ফলও হলাে। যাদের ভােগ একটু বাকি আছে, তারা সংসারে থেকেই তাঁকে ডাকবে। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৪

আগে সাদাসিদে জ্বর হতাে, সামান্য পাঁচন ইত্যাদিতে সেরে যেত; এখন যেমন ম্যালেরিয়া জ্বর, তেমনি ডি. গুপ্ত ঔষধ। আগে লােকে যােগ-যাগ - তপস্যা করত; এখন কলির জীব অন্নগত প্রাণ, দুর্বল মন—এক হরিনামই একাগ্র হয়ে করলে সংসারের সব দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যায়। টাকার জন্য যেমন ঘাম বার কর , তেমনি হরিনাম করে নেচে-গেয়ে ঘাম বার করতে হয়। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৫

ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই—’কী! আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে? আমার আবার পাপ কী ? আমার আবার বন্ধন কী?’ কৃষ্ণকিশাের পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, সে বৃন্দাবনে গিয়েছিল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লােক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে “ওরে তুই আমায় একঘটি জল দিতে পারিস? তুই কী জাত?” সে বললে “ঠাকুরমশায়, আমি হীন জাত—মুচি।” কৃষ্ণকিশাের বললে, “তুই বল, শিব। নে, এখন জল তুলে দে।” ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়। কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এইসব কথা কেন? একবার বল যে, অন্যায় কর্ম যা করেছি আর করব না। আর তাঁর নামে বিশ্বাস কর। তাহলে আর তীর্থাদিরও প্রয়ােজন হবে না। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৬

 তীর্থ, গলায় মালা, আচার—এসব প্রথম প্রথম করতে হয়। বস্তলাভ হলে, ভগবান দর্শন হলে, বাইরের আড়ম্বর ক্রমে কমে যায়। তখন তাঁর নামটি নিয়ে থাকা আর স্মরণ-মনন। যােলাে টাকার পয়সা এক কাঁড়ি, কিন্তু যােলােটি টাকা যখন একত্রে করলে, তখন আর অত কাঁড়ি দেখায় না। তাদের বদলে যখন একটি মােহর করলে, তখন কত কম হয়ে গেল! আবার সেটি বদলে যদি একটু হীরা কর, তাহলে লােকে টেরই পাবে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৭

তাঁর নাম করলে, তাঁকে চিন্তা করলে, তাঁর শরণাগত হলে— পূর্বজন্মের অনেক কর্মপাশ কেটে যায়। খানিকটা কর্মভােগ হয়। একজন পূর্বজন্মের কর্মের দরুন সাত জন্ম কানা হতাে; কিন্তু সে গঙ্গাস্নান করলে। গঙ্গাস্নানে মুক্তি হয়। সে-ব্যক্তির চক্ষু যেমন কানা সেই রকমই রইল, কিন্তু আর যে ছয় জন্ম সেটা হলাে না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৮

জান্তে, অজান্তে বা ভ্রান্তে যেকোনাে ভাবেই হােক না কেন, তাঁর নাম করলেই ফল হবে। কেউ তেল মেখে নাইতে যায়, তারও যেমনি স্নান হয়, আর যদি কাউকে জলে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, তারও তেমনি স্নান হয়। আর কেউ ঘরে শুয়ে আছে, তার গায়ে জল ঢেলে দিলে তারও স্নানের কাজ হয়ে যায়। অমৃতকুণ্ডে যেকোনাে প্রকারে একবার পড়তে পারলেই অমর হওয়া যায়; কেউ যদি স্তবস্তুতি করে পড়ে, সেও অমর হয়, আর কাউকে যদি কোনােরকমে ঠেলে সেই অমৃতকুণ্ডে ফেলে দেওয়া যায়, সেও অমর হয়। তেমনি ভগবানের নাম জান্তে, অজান্তে বা ভ্রান্তে যে-প্রকারে হােক, নিলে তার ফল হবেই হবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৬৯

যদি না বলেই থাকে, হরিনামে দোষ কী? যেখানে হরিনাম, সেখানে না বললেও যাওয়া যায়। নিমন্ত্রণ দরকার নাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭০
ভগবানের শরণাগত হয়ে এখন লজ্জা, ভয় ওসব ত্যাগ কর। আমি হরিনামে যদি নাচি, লােকে আমায় কী বলবে—এসব ভাব ত্যাগ কর। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়।’ লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, অভিমান, গােপন ইচ্ছা—এসব পাশ। এসব গেলে জীবের মুক্তি হয়। পাশবদ্ধ জীব, পাশমুক্ত শিব। ভগবানে প্রেম—দুর্লভ জিনিস। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭১

কী জান, একটু কামনা থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। ধর্মের সূক্ষ্ম গতি। ছুঁচে সুতা পরাচ্ছ—কিন্তু সুতার ভিতর একটু আঁশ থাকলে ছুঁচের ভিতর প্রবেশ করে না। ত্রিশ বছর মালা জপে, তবু কেন কিছু হয় না? ডাকুর ঘা হলে ঘুঁটের ভাবরা দিতে হয়। না হলে শুধু ঔষধে আরাম হয় না। কামনা থাকতে যত সাধনা কর না কেন, সিদ্ধিলাভ হয় না। তবে একটি কথা আছে—ঈশ্বরের কৃপা হলে, ঈশ্বরের দয়া হলে একক্ষণে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। যেমন, হাজার বছরের অন্ধকার ঘর, হঠাৎ কেউ যদি প্রদীপ আনে, তাহলে একক্ষণে আলাে হয়ে যায়! গরিবের ছেলে বড় মানুষের চোখে পড়ে গেছে। তার মেয়ের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিলে। অমনি গাড়ি-ঘোড়া, দাস-দাসী, পােশাক, আসবাব, বাড়ি সব হয়ে গেল। ঈশ্বর বালকস্বভাব। যেমন, কোনাে ছেলে কোঁচড়ে রত্ন লয়ে বসে আছে। কত লােক রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। অনেকে তার কাছে রত্ন চাচ্ছে, কিন্তু সে কাপড়ে হাত চেপে মুখ ফিরিয়ে বলে, না আমি দেব না। আবার হয়তাে যে চায়নি, চলে যাচ্ছে, পেছনে পেছনে দৌড়ে গিয়ে সেধে তাকে দিয়ে ফেলে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭২

যখন দেখবে ঈশ্বরের নাম করতেই অশ্রু আর পুলক হয়, তখন জানবে, কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি চলে গেছে, ঈশ্বরলাভ হয়েছে। দেশলাই যদি শুকনাে হয়, একটা ঘষলেই দপ করে জ্বলে উঠে। আর যদি ভিজে হয়, পঞ্চাশটা ঘষলেও কিছু হয় না। কেবল কাঠিগুলাে ফেলা যায়। বিষয় রসে রােসে থাকলে, কামিনীকাঞ্চন-রসে মন ভিজে থাকলে, ঈশ্বরের উদ্দীপনা হয় না। হাজার চেষ্টা কর, কেবল পণ্ডশ্রম। বিষয়রস শুকুলে তৎক্ষণাৎ উদ্দীপন হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত-শত বার উপদেশ দিলেও কিছু হয় না। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৩

তােমাদের ধন-ঐশ্বর্য আছে অথচ ঈশ্বরকে ডাকছ —এ খুব ভাল। গীতায় আছে, যারা যােগভ্রষ্ট তারাই ভক্ত হয়ে ধনীর ঘরে জন্মায়। তারপর আবার ঈশ্বরের জন্য সাধন করে। পূর্বজন্মে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে হয়তাে হঠাৎ ভােগ করবার লালসা হয়েছে। এরূপ হলে যােগভ্রষ্ট হয়। আবার পরজন্মে ঐরূপ জন্ম হয়। কামনা থাকতে—ভােগ-লালসা থাকতে মুক্তি নাই। তাই খাওয়া-পরা, রমণ-ফমন সব করে নেবে। ভােগ-লালসা থাকা ভাল নয়। আমি তাই জন্য যা যা মনে উঠত অমনি করে নিতাম। বাগবাজারের রং-করা সন্দেশ খেতে ইচ্ছা হলাে। এরা আনিয়ে দিলে। খুব খেলাম—তারপর অসুখ। একটি ছেলের কোমরে সােনার গােট দেখে গােট পরতে সাধ হলাে। তা বেশিক্ষণ রাখবার জো নাই—গােট পরেই ভিতর দিয়ে শিরশির করে উপরে বায়ু উঠতে লাগল-সােনা গায়ে ঠেকেছে কিনা! একটু রেখেই খুলে ফেলতে হলাে। তা না হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। ধনেখালির খইচুর,খানাকুল-কৃষ্ণনগরের সরভাজা, তা-ও খেতে সাধ হয়েছিল। একবার মনে উঠল যে ভাল জরির সাজ পরব। আর রুপার গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সেজোবাবু নূতন সাজ, ওড়গুড়ি সব পাঠিয়ে দিলে। সাজ পরা হলাে। গুড়গুড়ি নানারকম করে টানতে লাগলুম। একবার এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে—উঁচু থেকে নিচু থেকে। তখন বললাম, মন এর নাম রুপার গুডণ্ডডিতে তামাক খাওয়া। এই বলে গুড়গুড়ি ত্যাগ হয়ে গেল। সাজগুলাে খ্যানিক পরে খুলে ফেললাম—পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম—আর তার উপর ‘থু থু’ করতে লাগলাম—বললাম, এর নাম সাজ। এই সাজে রজোগুণ হয়। পেঁয়াজ খেলুন আর বিচার করতে লাগলুম—মন, এর নাম পেঁয়াজ। তারপর মুখের ভিতর একবার এদিক-ওদিক, একবার সেদিক করে তারপর ফেলে দিলুম। সংসার ভােগের স্থান, এক-একটি জিনিস ভােগ করে অমনি ত্যাগ করতে হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৪

ঐশ্বর্য থাকলেই যে তাতে আসক্ত হতেই হবে, এমন কিছু নয়। শম্ভু মল্লিক বলত, “হৃদু, পোঁটলা বেঁধে বসে আছি!” আমি বলতাম, “কী অলক্ষণে কথা কও।” তখন শম্ভু বলে, “ না-বল, এসব ফেলে যেন তাঁর। কাছে যাই!”

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৫

সংসারে থাকতে গেলেই ওরকম হয়। কখনাে উঁচু, কখনাে নিচু। কখনাে বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনীকাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা, তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখনাে ঈশ্বরচিন্তা, হরিনাম করে; কখনাে বা কামিনীকাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে। যেমন সাধারণ মাছি—কখনাে সন্দেশে বসছে, কখনাে বা পচা ঘা বা বিষ্ঠাতেও বসে। বিষয়ী লােকের জ্ঞান কখনাে দেখা যায়। একবার দীপশিখার ন্যায়। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৬

 সংসারীদের ঈশ্বরানুরাগ ক্ষণিক। যেমন তপ্ত খােলায় জল পড়েছে। ছ্যাঁক করে উঠল—তারপরেই শুকিয়ে গেল। সংসারী লােকেদের ভােগের দিকে মন রয়েছে, তাই জন্য সে-অনুরাগ সে-ব্যাকুলতা হয় না। লােকে সাধন ভজন করে, কিন্তু মন কামিনীকাঞ্চনে, মন ভােগের দিকে—তাই সাধন-ভজন। ঠিক হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৭

বিযয়ীর ঈশ্বর কীরূপ জান? যেমন খুড়ি-জেঠির কোঁদল শুনে ছেলেরা খেলা করবার সময় পরস্পর বলে, “আমার ঈশ্বরের দিব্য।” আর যেমন কোনাে ফিটবাবু, পান চিবুতে চিবুতে stick হাতে করে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে একটি ফুল তুলে বন্ধুকে বলে—ঈশ্বর কী beautiful ফুল করেছেন।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৮

একজন লােক তার ক্ষেতে জল ছেঁচছে। সমস্ত জল ছেঁচে সন্ধ্যার সময় মনে করলে, একবার দেখি কতটা জমি ভিজল। এসে দেখে—একটা আলের মধ্যে একটা গর্ত দিয়ে সব জল বেরিয়ে গেছে, এক ছটাক জমিও ভেজেনি। বিষয়বুদ্ধি থাকলে সেই রকম তাঁর নাম দিনরাত করলেও কিছুই হয় না। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৭৯

 বিযয়ী লােকের রােখ নাই। হলাে হলো, না হলাে না হলো। জলের দরকার হয়েছে, কূপ খুঁড়ছে। খুঁড়তে খুঁড়তে যেমন পাথর বেরুল, অমনি সেখানটা ছেড়ে দিলে। আরেক জায়গায় খুঁড়তে বালি পেয়ে গেল; কেবল বালি বেরােয়! সেখানটাও ছেড়ে দিলে। যেখানটা খুঁড়তে আরম্ভ করেছে সেইখানেই খুঁড়বে, তবে তাে জল পাবে। জীব যেমন কর্ম করে তেমনি ফল পায়। বিযয়ী লােকের ঈশ্বরের নাম করা—অনুরাগ নাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮০
ভগবানের শরণাপন্ন কী সহজে হওয়া যায় গা? মহামায়ার এমনি কাণ্ড—হতে কি দেয়? যার তিন কুলে কেউ নাই, তাকে দিয়ে একটা বিড়াল পুষিয়ে সংসার করাবে!—সেও বিড়ালের মাছ দুধ ঘুরে ঘুরে জোগাড় করবে, আর বলবে, “মাছ দুধ না হলে বিড়ালটা খায় না, কী করি!”

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮১

 কেউ কেউ মনে করে এরা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করছে, পাগল! এরা বেহেড হয়েছে। আমরা কেমন স্যায়না, কেমন সুখভােগ করছি; টাকা, মান, ইন্দ্রিয়সুখ। কাকও মনে করে—আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের ও খেয়ে মরে। তেমনি এ-সংসারে যারা বেশি চালাকি করতে যায়, তারাই কেবল ঠকে থাকে। যে-চাতুরীতে ভগবানকে পাওয়া যায়, সেই চাতুরীই চাতুরী। ‘সা চাতুরী চাতুরী!’ কেউ কেউ মনে করে, বেশি ঈশ্বর ঈশ্বর করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। তা নয়। এ যে সুধার হ্রদ—অমৃতের সাগর। বেদে তাকে ‘অমৃত’ বলেছে, এতে ডুবে গেলে মরে না—অমর হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮২

যারা নিজে সতরঞ্চ খেলে, তারা চাল তত বুঝে না, কিন্তু যারা না খেলে, উপর চাল বলে দেয়, তাদের চাল ওদের চেয়ে অনেকটা ঠিক ঠিক হয়। সংসারী লােক মনে করে—আমরা বড় বুদ্ধিমান, কিন্তু তারা বিষয়াসক্ত। নিজে খেলছে। নিজের চাল ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু সংসারত্যাগী সাধুলােক বিষয়ে অনাসক্ত। তারা সংসারীদের চেয়ে বুদ্ধিমান। নিজে খেলে না, তাই উপর চাল ঠিক বলে দিতে পারে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৩

সবাই সংসার ত্যাগ করবে কেন? আর তাঁর কী ইচ্ছা যে, সকলেই শিয়াল-কুকুরের মতাে কামিনীকাঞ্চনে মুখ জুবড়ে থাকে? আর কী কিছু ইচ্ছা তাঁর নয়? কোনটা তাঁর ইচ্ছা, কোনটা অনিচ্ছা কি সব জেনেছ? তাঁর ইচ্ছা সংসার করা তুমি বলছ। যখন স্ত্রী-পুত্র মরে তখন ভগবানের ইচ্ছা দেখতে পাও না কেন? যখন খেতে পাও না—দারিদ্র—তখন ভগবানের ইচ্ছা দেখতে পাও না কেন? তাঁর কী ইচ্ছা, মায়াতে জানতে দেয় না। তাঁর মায়াতে অনিত্যকে নিত্য বােধ হয়, আবার নিত্যকে অনিত্য বােধ হয়। সংসার অনিত্য—এই আছে এই নাই, কিন্তু তাঁর মায়াতে বােধ হয়, এই ঠিক। তাঁর মায়াতেই ‘আমি কর্তা’ বােধ হয়। আর আমার এইসব স্ত্রী-পুত্র, ভাই-ভগিনী। বাপ-মা, বাড়ি-ঘর—এইসব আমার বােধ হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৪

পাড়াগাঁয়ে মাছ ধরবার জন্য বিলের ধারে ও মাঠে ঘুনি পাতে। ঘুনির ভিতর চিকচিক করে জল যায় দেখে, ছােট ছােট মাছগুলি আনন্দে তার ভিতর চলে যায়; যে-পথে ঢুকেছে, সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু জলের মিষ্ট শব্দ আর অন্য অন্য মাছের সঙ্গে ক্রীড়া, তাই ভুলে থাকে—বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে না। ছেলে-মেয়ের আধাে-আধাে কথাবার্তা যেন জলকল্লোলের মধুর শব্দ। মাছ অর্থাৎ জীব, পরিবারবর্গ। তবে দু-একটা দৌড়ে পালায়—তাদের বলে মুক্তজীব।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৫

ভােগ থাকলেই যােগ কমে যায়। ভােগ থাকলেই আবার জ্বালা। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে—অবধূত চিলকে চব্বিশ গুরুর মধ্যে একজন করেছিল। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধরতে গিয়েছিল, একটি চিল এসে একটা মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় হাজার কাক তাকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যেদিকে যায়, কাকগুলােও তাড়া করে সেই দিকে যেতে লাগল। শেষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলাে চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিন্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর গিয়ে বসল। বসে ভাবতে লাগল—ঐ মাছটা যত গােল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই, আমি নিশ্চিন্ত হলুম। মাছ অর্থাৎ ভােগের বস্তু। কাকগুলাে ভাবনাচিন্তা। যেখানে ভােগ সেখানেই ভাবনা-চিন্তা; ভােগ ত্যাগ হয়ে গেলেই শান্তি। আবার দেখ, অর্থই আবার অনর্থ হয়। তােমরা ভাই-ভাই বেশ আছ কিন্তু ভাইয়ে-ভাইয়ে হিস্যে নিয়ে গােল হয়। কুকুররা গা চাটাচাটি করচে পরস্পর বেশ ভাব। কিন্তু গৃহস্থ যদি ভাত-দুটি ফেলে দেয় তাহলে পরস্পর কামড়াকামড়ি করবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৬

 বস্ত্রহরণের মানে কী? অষ্টপাশ—গােপীদের সব পাশই গিয়েছিল, কেবল লজ্জা বাকি ছিল। তাই তিনি ও-পাশটাও ঘুচিয়ে দিলেন। ঈশ্বরলাভ হলে সব পাশ চলে যায়। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, কুল, শীল, শােক, জুগুপ্সা (নিন্দা)—এই অষ্টপাশ। গুরু না খুলে দিলে হয় না। আজ বাগবাজারের পুল হয়ে এলাম। কত বন্ধনই বেঁধেছে। একটা বন্ধন ছিঁড়লে পুলের কিছু হবে না, আরও অনেক শিকল দিয়ে বাঁধা আছে—তারা টেনে রাখবে। তেমনি সংসারীদের অনেক বন্ধন, ভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে সে-বন্ধন যাবার উপায় নাই।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৭

সংসারাসক্ত বদ্ধ জীব মৃত্যুকালে সংসারের কথাই বলে। বাহিরে মালা জপলে, গঙ্গাস্নান করলে, তীর্থে গেলে কী হবে? সংসার-আসক্তি ভিতরে থাকলে মৃত্যুকালে সেটি দেখা দেয়। কত আবােল-তাবােল বকে— হয়তাে বিকারের খেয়ালে ‘হলুদ, পাঁচফোড়ন, তেজপাতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। শুকপাখি সহজবেলা ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলে, বিল্লি ধরলে নিজের বুলি বেরােয়, ক্যাঁ ক্যাঁ করে। গীতায় আছে, মৃত্যুকালে যা মনে করবে, পরলােকে তা-ই হবে। ভরত রাজা ‘হরিণ’, ‘হরিণ’ করে দেহত্যাগ করেছিল, তাই হরিণজন্ম হলাে। ঈশ্বরচিন্তা করে দেহত্যাগ করলে ঈশ্বরলাভ হয়, আর এ-সংসারে আসতে হয় না। 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৮

ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয়। তাই নামকীর্তন অভ্যাস করতে হয়। যখন মৃত্যু আসবে তখন সেই সংসার-চিন্তাই আসবে। পরিবার, ছেলেমেয়ের চিন্তা—উইল করবার চিন্তা—এইসব আসবে; ভগবানের চিন্তা আসবে না। উপায়—তাঁর নামজপ, নামকীর্তন অভ্যাস করা। এই অভ্যাস যদি থাকে, মৃত্যুর সময় তারই নাম মুখে আসবে।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৮৯

ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, তাই এত কর্মভােগ। লােকে বলে যে, গঙ্গাস্নানের সময় তােমার পাপগুলাে তােমায় ছেড়ে গঙ্গার তীরের গাছের উপর বসে থাকে। যাই তুমি গঙ্গাস্নান করে তীরে উঠেছ, অমনি পাপগুলাে তােমার ঘাড়ে আবার চেপে বসে। দেহত্যাগের সময় যাতে ঈশ্বরচিন্তা হয়, তাই তার আগে থাকতে উপায় করতে হয়। উপায়—অভ্যাসযােগ। ঈশ্বরচিন্তা অভ্যাস করলে শেষের দিনেও তাঁকে মনে পড়বে। তাই জপ, ধ্যান পূজা—এসব রাতদিন অভ্যাস করতে হয়, তাহলে মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা আসে—অভ্যাসের গুণে। এরূপ মৃত্যু হলে ঈশ্বরের স্বরূপ পায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯০

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯০
জীব ঈশ্বরচিন্তা করে, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, আবার ভুলে যায়, সংসারে আসক্ত হয়। যেমন এই হাতিকে স্নান করিয়ে দিলে, আবার ধুলো কাদা মাখে। মনমত্তকরী! তবে হাতিকে নাইয়েই যদি আস্তাবলে সাঁধ করিয়ে দিতে পার, আর ধুলাে কাদা মাখতে পারে না। যদি জীব মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা করে, তাহলে শুদ্ধমন হয়, সে-্মন কামিনীকাঞ্চনে আবার আসক্ত হবার অবসর পায় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯১

দেহত্যাগের আগে যদি কেউ ঈশ্বরের সাধন করে—আর সাধন করতে করতে, ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে যদি দেহত্যাগ হয়, তাকে আর পাপ কখন স্পর্শ করবে? তবে শরীর ধারণ করলেই বড় গােল। আবার শাপ হলে তাে সাত জন্ম আসতে হবে। বড় সাবধানে থাকতে হয়। বাসনা থাকলেই শরীরধারণ।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯২

 যতক্ষণ না ঈশ্বরলাভ হয়, ততক্ষণ পুনঃপুন সংসারে যাতায়াত করতে হবে। কৃমোরেরা হাঁড়ি-সরা রৌদ্রে শুকুতে দেয়; ছাগল-গরুতে মাড়িয়ে যদি ভেঙে দেয় তাহলে তৈরি লাল হাঁড়িগুলাে ফেলে দেয়। কাঁচাগুলো কিন্তু আবার নিয়ে কাদামাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে ও আবার চাকে দেয়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৩

আমি ছেলেদের এত ভালবাসি কেন জান? ছেলেবেলা তাদের মন ষােলাে আনা নিজের কাছে থাকে, ক্রমে ভাগ হয়ে পড়ে। যে - মন ভগবানকে দিতে হবে, সে-মনের বারাে আনা মেয়েমানুষে নিয়ে ফেলে। তারপর তার ছেলে হলে, প্রায় সব মনটাই খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভগবানকে আর কী দেবে? এই জন্য ছেলেবেলায় যারা ঈশ্বরলাভের চেষ্টা করে, তারা সহজে তাকে লাভ করতে পারবে। বুড়ােদের হওয়া বড় কঠিন। আবার কারু কারু স্ত্রীকে আগলাতে আগলাতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৪

ছেলেবেলা থেকে কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ, এটি খুব আশ্চর্য! খুব কম লােকের হয়! তা না হলে যেমন শিল-খেকো আম—ঠাকুরের সেবায় লাগে না—নিজে খেতে ভয় হয়। আগে অনেক পাপ করেছে, তারপর বুড়াে বয়সে হরিনাম করছে—এ মন্দের ভাল। অমুক মল্লিকের মা, খুব বড় মানুষের ঘরের মেয়ে। বেশ্যাদের কথায় জিজ্ঞাসা করলে, ওদের কি কোনােমতে উদ্ধার হবে না? নিজে আগে আগে অনেক রকম করেছে কিনা! তাই জিজ্ঞাসা করলে। আমি বললুম, “হ্যাঁ, হবে—যদি আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, আর বলে— আর করব না।” শুধু হরিনাম করলে কী হবে, আন্তরিক কাঁদতে হবে!

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৫

সংসার-আশ্রম ভােগের আশ্রম। আর কামিনীকাঞ্চন ভােগ কী আর করবে? সন্দেশ গলা থেকে নেমে গেলে টক কি মিষ্টি মনে থাকে না। তবে সকলে কেন ত্যাগ করবে? সময় না হলে কি ত্যাগ হয় ? ভোগান্ত হয়ে গেলে তবে ত্যাগের সময় হয়। জোর করে কী কেউ ত্যাগ করতে পারে ? একরকম বৈরাগ্য আছে, তাকে বলে মর্কট-বৈরাগ্য। হীনবুদ্ধি লােকের ঐ বৈরাগ্য হয়। রাঁড়িপুতি (বিধবার ছেলে), মা সুতা কেটে খায়— ছেলের একটু কাজ ছিল, সে কাজ গেছে—তখন বৈরাগ্য হলাে, গেরুয়া পরলে; কাশী চলে গেল। আবার কিছুদিন পরে পত্র লিখছে—আমার একটি কর্ম হইয়াছে, দশ টাকা মাহিনা! ওরই ভিতর সােনার আংটি তার জামা-জোড়া কেনবার চেষ্টা করছে। ভােগের ইচ্ছা যাবে কোথায় ?

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৬

সময় না হলে কিছু হয় না। যাকে যা দেবার তাঁর সব ঠিক করা আছে। সরার মাপে শাশুড়ি বউদের ভাত দিত। তাতে কিছু ভাত কম হতাে। একদিন সরাখানি ভেঙে যাওয়াতে তখন বউরা আহ্লাদ করছিল। তখন শাশুড়ি বললেন, ‘নাচ কোঁদ বউমা, আমার হাতের আটকেল (আন্দাজ) আছে।”

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৭

সময় না হলে কিছু হয় না। কারু কারু ভােগ, কর্ম অনেক বাকি থাকে। তাই জন্য দেরিতে হয়। ফোড়া কাঁচা অবস্থায় অস্ত্র করলে হিতে বিপরীত হয়। পেকে মুখ হলে তবে ডাক্তার অস্ত্র করে। একটি ছেলে শুতে যাবার সময় মাকে বলেছিল, ‘মা, আমার যখন হাগা পাবে আমাকে তুলিও।” মা বললেন, “বাবা, হাগাতেই তােমাকে তােলাবে, আমায় তুলতে হবে না।” 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৮

সময় না হলে কিছু হয় না। যখন রােগ ভাল হয়ে এল, তখন কবিরাজ বললে, এই পাতাটি মরিচ দিয়ে বেটে খেয়াে। তারপর রােগ ভাল হলাে। তা মরিচ দিয়ে ঔষধ খেয়ে ভাল হলাে, না আপনি হলাে, কে বলবে? লক্ষ্মণ লবকুশকে বললেন, “তােরা ছেলেমানুষ, তােরা রামচন্দ্রকে জানিস না। তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যা-পাষাণী মানবী হয়ে গেল।” লবকুশ বললে “ঠাকুর সব জানি, সব শুনেছি। পাষাণী যে মানব হলাে সে মুনিবাক্য ছিল, গৌতমমুনি বলেছিলেন যে, ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র ঐ আশ্রমের কাছ দিয়ে যাবেন তাঁর পাদস্পর্শে তুমি আবার মানবী হবে।” তা এখন রামের গুণে না মুনিবাক্যে, তা কে বলবে বল?

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ৯৯

শুনে রাখা ভাল, কিন্তু সময় না হলে হয় না। যখন খুব জ্বর, তখন কুইনাইন দিলে কী হবে? ফিভার-মিক্সচার দিয়ে বাহ্যে-টাহ্যে হয়ে একটু কম পড়লে তখন কুইনাইন দিতে হয়। আবার কারু কারু অমনি সেরে যায় কুইনাইন না দিলেও হয়। কেউ কেউ এখানে আসে দেখি, কোনাে ভক্তসঙ্গে নৌকা করে এসেছে। ঈশ্বরীয় কথা তাদের ভাল লাগে না। কেবল বন্ধুর গা টিপছে, “কখন যাবে, কখন যাবে?” যখন বন্ধু কোনােরকমে উঠল না, তখন বলে, “তবে ততক্ষণ আমি নৌকায় গিয়ে বসে থাকি। যাদের প্রথম মানুষ জন্ম, তাদের ভােগের দরকার। কতকগুলাে কাজ করা না থাকলে চৈতন্য হয় না।

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০০
শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০০
 ভােগ আর কর্ম শেষ না হলে ব্যাকুলতা আসে না। বৈদ্য বলে দিন কাটুক–তারপর সামান্য ঔষধে উপকার হবে। নারদ রামকে বললেন “রাম। তুমি অযােধ্যায় বসে রইলে, রাবণবধ কেমন করে হবে? তুমি যে সেই জন্য অবতীর্ণ হয়েছ!” রাম বললেন, “নারদ! সময় হউক, রাবণের কর্মক্ষয় হউক; তবে তার বধের উদ্যোগ হবে।” 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০১

সংসার কর্মক্ষেত্র, কর্ম করতে করতে তবে জ্ঞান হয়। গুরু বলেছেন, এইসব কর্ম কোরাে, আর এইসব কর্ম কোরাে না। আবার তিনি নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দেন। কর্ম করতে করতে মনের ময়লা কেটে যায়। ভাল ডাক্তারের হাতে পড়লে ঔষধ খেতে খেতে যেমন রােগ সেরে যায়। কেন তিনি সংসার থেকে ছাড়েন না? রােগ সারবে, তবে ছাড়বেন। কামিনীকাঞ্চন ভােগ করতে ইচ্ছা যখন চলে যাবে, তখন ছাড়বেন। হাসপাতালে নাম লেখালে পালিয়ে আসবার জো নাই। রােগের কসুর থাকলে ডাক্তারসাহেব ছাড়বে না।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০২

মনে করলেই ত্যাগ করা যায় না। প্রারব্ধ, সংস্কার—এসব আবার আছে। একজন রাজাকে একজন যােগী বললে, তুমি আমার কাছে বসে থেকে ভগবানের চিন্তা কর। রাজা বললে, সে বড় হবে না; আমি থাকতে পারি, কিন্তু আমার এখনাে ভােগ আছে। এ-বনে যদি থাকি, হয়তাে বনেতে একটা রাজ্য হয়ে যাবে! আমার এখনাে ভােগ আছে। নটবর পাঁজা যখন ছেলেমানুষ, এই বাগানে গরু চরাত। তার কিন্তু অনেক ভােগ ছিল। তাই এখন রেড়ির কল করে অনেক টাকা করেছে। আলমবাজারে রেড়ির কলের ব্যবসা খুব কেঁদেছে।


শ্রী রামকৃষ্ণদেবের  বাণীঃ সংসারাশ্রম- ১০৩

অনন্যচেতাঃ সততং যাে মাং স্মরতি নিত্যশঃ।
           তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যােগিনঃ ॥ (গীতা, ৮/১৪)

 -যদি কোনাে ব্যক্তি চিরদিন অবিচ্ছেদে খাইতে, শুইতে, উঠিতে, বসিতে সর্বদা আমাকেই স্মরণ করেন, অর্থাৎ সাধক যদি আমাকে না ছাড়িয়া জীবনের সকল কার্যেরই অনুষ্ঠান করেন, তাহা হইলে তিনি আমাকে অনায়াসে লাভ করিতে পারেন। ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য তাহার কঠোর তপােব্রত, প্রাণায়াম ও যােগাদির আর কিছুমাত্র আবশ্যক নাই।

==================================================

Post a Comment

0 Comments