[PDF] বিদ্রোহিণী নিবেদিতা – ডঃ দীপক চন্দ্র

~ বিদ্রোহিণী নিবেদিতা  ~

ডঃ দীপক চন্দ্র

[PDF] বিদ্রোহিণী নিবেদিতা – ডঃ দীপক চন্দ্র

দৃষ্টিকোণ


মার্গারেট এলিজাবেথ নােবলের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে চার খণ্ডে যে মহাকাব্যিক উপন্যাস রচনার প্রতিশ্রুতি ছিল তা যথাযথ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করলাম। বর্তমান খণ্ডটি এই পর্বের চতুর্থ খণ্ড। এই পর্বের সময়কাল ১৮৯৯-এর ২০ জুন থেকে ১৯০২ এর ২০ জুলাই পর্যন্ত। অর্থাৎ ইংলন্ডে পাড়ি দেওয়ার দিন থেকে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দিন পর্যন্ত মােট তিন বছরের ঘটনা এই পর্বে স্থান পেয়েছে। বলা বাহুল্য এটা নিবেদিতার কোনাে জীবনীগ্রন্থ নয়। বলা যেতে পারে নিবেদিতার জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে গড়ে তােলা একটি গল্পগ্রন্থ। প্রতিপাদ্য গল্পকে ফোটাতে হলে জীবনের যে যে ঘটনা দরকার কেবল তাকেই অনুসরণ করেছি। কারণ লেখক একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে নিবেদিতার জীবনের ছবি আঁকছেন। তার মনের ক্যানভাসে নিবেদিতার যে মূর্তিটি রয়েছে তাকে শিল্পিত করে তােলার জন্য কিছু বাছাই ঘটনা সন্নিবেশিত করেছেন। নইলে, তা একটি বিবৃতিসর্বস্ব জীবনীগ্রন্থ হত। উপন্যাস হত না। উপন্যাসের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে কল্পনার রঙ ধরাতে হয়েছে ইতিহাসের নিবেদিতার গায়ে। তাই এই গ্রন্থের রক্তমাংসের নিবেদিতা কতখানি ইতিহাসের নিবেদিতা আর কতখানি লেখকের তৈরি প্রতিমা তা নিয়ে"পাঠক-পাঠিকাদের মনে ধন্দ হতে পারে। কিন্তু লেখক সত্যের অপলাপ করেনি কোথাও।
নিবেদিতার জীবন কত বিচিত্র ঘটনায়, অনুভূতিতে, ব্যথা-আনন্দে, ব্যর্থতা-সার্থকতায়, জয়-পরাজয়ে পরিপূর্ণ। কত মানুষের মিছিল তার জীবনে। কত কর্মের আহ্বান, কত নতুন দায়িত্ব এবং অভিনব সংগ্রামে তা বর্ণময়। শত চেষ্টা করেও তার সবটা উপন্যাসের পরিধিতে ধরতে পারিনি। পাছে উপন্যাসে জীবনের রঙ ফিকে হয়ে যায়, তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে স্থবিরতা প্রাপ্ত হয় তাই সাবধানে অনেক প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছি। কারণ, তাতে উপন্যাস লক্ষ্যচ্যুত হত। এই ধরনের উপন্যাস রচনার পূর্বপরিকল্পিত যে ছকই থাকুক না কেন, লিখতে লিখতে সে ছক আর থাকে না। থাকবে কী করে, লেখার সময় কাহিনী নিজের পথে নিজের মত চলে। ঘটনা ও তথ্যের গ্রহণ বর্জন এবং বাছাই সেভাবেই হয়। নজরটা প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর স্থির থাকে। তাকে ঘিরে ওঠে কাহিনী। কাহিনীতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে চারপাশের মানুষ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা। আমার মূল বিষয় নিবেদিতা ও বিবেকানন্দের সুগভীর প্রেম।
প্রথম খণ্ড থেকে তাঁদের সুগভীর প্রেমের প্রসঙ্গটি উপন্যাসের আধারে চিত্রিত করেছি। ব্যক্তিপ্রেমের রূপান্তরের এক-একটি মােহনা এক এক পৰ্বরূপে কল্পিত হয়েছে। চারখণ্ডে নিবেদিতার মানসিক রূপান্তর ও উত্তরণের সেই দিগন্তকে উন্মােচন করল। ভালােবাসা হল মূল সুর। আগেও বলেছি, আবার বলছি স্বামীজি এবং নিবেদিতা উভয়ে উভয়কে গভীরভাবে ভালােবেসেছিল। বন্য নদী, পাহাড়, প্রস্তরকে যেমন আকাশ ভালােবাসে তাদের ভালােবাসা অনেকটা সেরকম। তবু দীর্ঘকালব্যাপী অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নিবেদিতা স্বামীজি প্রদর্শিত পথে আত্মােৎসর্গে সমর্থ হয়েছিল। এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কোথাও কিছু লেখা নেই। উপাদানের অভাব সর্বত্র এত বেশি যে সংযােগসূত্র গড়ে তোলা দূরূহ হয়ে পড়ে। তবু চিঠিপত্রের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যে সব অনুভূতি, ক্ষোভে, দুঃখে, অভিযােগে অথবা গভীর বিস্ময়ে আগে বা পরে ব্যক্তি হয়েছিল কাহিনী নির্মাণে, চরিত্রের অন্তৰ্জীবন উন্মােচনসূত্রে তাকে একটি সম্পূর্ণ মানুষ করে গড়ার চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য।


নিবেদিতা ও বিবেকানন্দই আমার প্রতিপাদ্য বিষয়। বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্বের আলাে পড়ে নিবেদিতা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দুই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঘটনার মধ্যে প্রধানত অবস্থান করেছি। এর বাইরে যেতে গেলে এত বেশি ঘটনা ও মানুষ এসে পড়ে যে তাতে উপন্যাসটি লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সঙ্গে নিবেদিতা সম্পর্ক সূত্র ছিন্ন করার পর আর এক পাও এগােয়নি। কারণ এরপর দেশব্যাপী স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল নিবেদিতা তাতে অবগাহন করেছিলেন। ঐ আবর্তের মধ্যে ইতিহাসই প্রধান হয়ে ওঠেছে। তার মধ্যে ব্যক্তি নিবেদিতাকে তেমন নিবিড় করে পাব না। স্বাধীনতার কর্মযজ্ঞে নিবেদিতা একজন দেশব্রতী সৈনিক। তার মধ্যে তখন শুধু দেশ ও দেশের মানুষ বেঁচে আছে। ইতিহাসের সেই গতিপথে নিবেদিতাকে অন্বেষণ করার দায় ঔপন্যাসিকের নয়, ঐতিহাসিকের।

গ্রন্থ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর একটা কথা বার বার স্মরণ করেছি। “ভারতবর্ষকে আমি ভালােবেসেছি বিবেকানন্দ পড়ে। আর বিবেকানন্দকে আমি চিনেছি নিবেদিতার লেখায়”। বিবেকানন্দের দেশপ্রেমের আগুনকে নিবেদিতা বহন করে নিয়ে গেছিলেন ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। আমি তার আঁচটুকু উপন্যাসের মধ্যে রেখেছি। তাতে ভারতবর্ষকে চেনানাের কাজটা এবং নিবেদিতার মাধ্যমে স্বামীজিকে চিনতে পারার কাজটা সহজেই সম্পন্ন হয়। সেই সঙ্গে স্বামীজির বাণী ও ভাব প্রচারের ব্যাপারে নিবেদিতা যে দুটি ভূমিকা পালন করেছেন তা একটি মহাদেবের অন্যটি ভগীরথের। স্বামীজির আদর্শ ও বাণীর প্রবল বেগকে তিনি মহাদেবের মত যেমন ধারণ করেছেন তেমনি তার দুর্মদ স্রোতধারাকে ভগীরথের মত বহন করে বেড়িয়েছেন গােটা ভারতভূমির কোটি কোটি সন্তানের পুনরুজ্জীবনের জন্য। নিবেদিতার সমগ্র চেতনায় ভারতবর্ষ ও বিবেকানন্দ যে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাকে ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য। এর পরে যে নিবেদিতাকে পাই তিনি বিপ্লবের ও বিদ্রোহের। 
। শিবম, সত্যম, সুন্দরম।
ডঃ দীপক চন্দ্র

Read PDF Online

Post a Comment

0 Comments