60+ Srima Sarada Devi Advice in Bengali ~ শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশ

~ শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশ ~

60+ Srima Sarada Devi Quotes in Bengali ~ শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশ


শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০১

রামপুরহাটে দুই-এক বছর হলাে এসেছি। ধুবলহাটির রাজপরিবারের এক কন্যার সঙ্গে আমার (মুকুন্দ বিহারী সাহা) বিবাহের একটি প্রস্তাব আসে। মা (শ্ৰীমা) আমাকে বলেছিলেন, “বিয়ে করােনা”। এই প্রস্তাবটিকে আমি সরাসরি অগ্রাহ্য করতে পারতাম, কিন্তু তা না করে সােজা বাগবাজারে মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মা’কে সব কথা বললাম। মা বললেন, “কেন বাবা, তুমি তাে বেশ আছ। তােমাকে দিয়ে অনেক ছেলের কল্যাণ হচ্ছে, এরপরে আরও অনেকের হবে। অনেক বড় কাজ করবে তুমি।”
“কিন্তু মা, আমার যে মাঝে মাঝে সংসার করতে খুব ইচ্ছে করে।” মা বললেন, “তােমার তাে অনেক বড় সংসার হবে।” আমি বললাম, “কিন্তু মা, আমি কি এভাবে সারাজীবন থাকতে পারবাে? যদি কখনাে মনে দুর্বলতা আসে?” মা দৃঢ়ভাবে বললেন, “ওর জন্য তুমি ভেবাে না। কলিতে মনের পাপ পাপ নয়। যখনই দুর্বলতা আসবে ঠাকুরকে স্মরণ করবে, আমাকে ভাববে।”
(পদপ্রান্তে ১/৯১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০২

মায়ের কথা ছিল খুব মিষ্টি। সেই মধুমাখা কথা এখনাে কানে বাজে। মা একদিন আমাকে (শিবরানী সেন) বলেছিলেন, “মা, কখনাে চুপচাপ বসে থেকোনা কিছুনা কিছু কাজ করবে। একটা কিছু কাজ নিয়ে থাকতে হয়, নইলে অলস মনে নানা চিন্তা এসে ভিড় করবে।” 
(পদপ্রান্তে ১/৯৬)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৩

একজন বয়স্ক মহিলাকে মা একদিন বলেছিলেন, “যে রাস্তায় তুমি চলছ, যদি দেখ সে-রাস্তায় কেউ পড়ে গিয়েছে তাকে তুমি তুলে দেবে। পথে পড়ে-থাকা কাউকে দেখে কখনাে ফেলে যেতে নেই।” ... এই আদর্শ তাে মা তার নিজের জীবন দিয়েই দেখিয়ে গেলেন। পথে পড়ে-থাকা কত পাপী-তাপী, আর্ত নরনারীকে দু'হাতে পথ থেকে তুলে নিয়ে নিজের কোলে তিনি স্থান দিয়েছেন। ধন্য তারা—মায়ের সেই পথে-কুড়ানাে ছেলেমেয়ের দল।
(পদপ্রান্তে ১/৯৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৪

শ্ৰীশ্ৰীমা ছিলেন “রামকৃষ্ণগতপ্রাণা”। তাঁর প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি চিন্তায় ঠাকুর থাকতেন জড়িয়ে। মা আমার মা-দিদিমাকে বলতেন, “জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ঠাকুরকে স্মরণ রেখাে। তাহলে কোনও কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হবে না। জীবনে দুঃখ-কষ্ট কার বা নেই? ওসব তাে থাকবেই; তার নাম নিলে, তাকে আশ্রয় করলে তিনি শক্তি দেবেন। দুঃখ ও কষ্ট তখন আর তােমার ওপর ছাপ ফেলতে পারবে না।”
(মায়ের মাথায় ছিল একরাশ কালাে চুল, আর সে চুল কি সুন্দর। মা নিজে যেমন গভীর ঠিক যেন তেমনি গভীর ঘন মায়ের মাথার চুল।.. মায়ের পা-দুটি ছিল খুব সুন্দর। পায়ের তলায় পদ্মফুলের রক্তাভা। পায়ের গড়নও ছিল খুব সুন্দর। মুখের গড়ন ছিল ভারি মিষ্টি; চোখ, নাক ছিল অপূর্ব। করুণা আর মমতায় মাখা ছিল মায়ের মুখ, মায়ের চোখ দুটি।)
(পদপ্রান্তে ১/৯৮)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৫

শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে আসার কিছুদিন পর তাকে যখন আমি (চন্দ্রমােহন দত্ত) কিছুটা ধারণা করতে পেরেছি তখন একদিন তার কাছে গিয়ে করজোড়ে আবদার করি, “মা, আমি আপনার সেবা করতে চাই।” মা বললেন, “এখানে যে সব কাজ করছে সে সব তাে আমারই সেবা, চন্দু।” আমি বললাম, “না, মা, ও সব কাজ করে আমি আপনার সামান্য কোনও সেবাও করতে চাই।” মা শান্তভাবে বললেন, “না বাবা, তুমি উদ্বোধনের যে কাজ করছে সেই কাজই কর! ওটি যেমন আমার সেবা তেমনি ঠাকুরেরও সেবা। সরলাই তাে আমার সেবা করছে। তুমি বরং উদ্বোধনের কাজ করে যখন সময়-সুযােগ পাবে তখন শরতের সেবা করবে। যদি তুমি তার আন্তরিকভাবে সেবা কর এবং শরৎ যদি তােমার ওপরে সন্তুষ্ট থাকে তাহলে জেনাে, তােমার ব্রহ্মজ্ঞান হবেই হবে। যে কেউ শরৎকে ভালবেসে সেবা করবে, মুক্তি তার কেনা। শরৎ ঠাকুরের গণেশ, শরৎ আমার মাথার মণি। সারা দুনিয়ায় শরতের মতাে মহাপুরুষ খুব কম আছে জানবে।”
(পদপ্রান্তে ১/১৩৩) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৬

একদিন মায়ের বাড়িতে গিয়েছি, যে-শাড়ীটা পরে গিয়েছিলাম সেটি নতুনই ছিল। বাড়িতে পেরেক লেগে ছিড়ে গিয়েছিল। ছেড়া জায়গাটা রিপু করে নিয়েছিলাম। আমি (চপলা সুন্দরী দত্ত) খেয়াল করিনি, ঘােমটার জায়গাটায় রিপু পড়েছিল। মায়ের চোখে ঠিক পড়েছে। মা’কে প্রণাম করতে তিনি বললেন, “বৌমা, কাপড় কখনাে সেলাই করে পড়বে না, মনে রেখাে” সেই থেকে আমি আর কোনদিন সেলাই-করা কাপড় পরিনি। আরেকদিন মা আমাকে বলেছিলেন, “বৌমা, একটা কথা মনে রেখাে—জাতাশৌচ, মৃতাশৌচ এবং কালাশৌচে ঠাকুরের কোনও কাজ করবে না, ঠাকুর ঘরেও যাবে না।”
(পদপ্রান্তে ১/১৩৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৭

আমার (ইন্দুবালা ঘােষ) মা খুব ইলিশমাছ, পােনা মাছের স্বপ্ন দেখতেন। বাবা ঐ কথা শুনে শ্রীশ্রীমায়ের কাছে গিয়ে বললেন, “মা, আপনার বৌমা খুব মাছের স্বপ্ন দেখে।” শ্রীমা শুনে হেসে বললেন, “ঐ স্বপ্ন দেখা খুব ভাল, মাছের খােসার মত টাকা আসবে।”
(পদ প্রান্তে ১/১৪৬) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৮

মা কারও মধ্যে ত্যাগের ভাব দেখলে খুশী হতেন। যাদের মধ্যে ত্যাগের ভাব দেখতেন, তাদের উৎসাহ দিতেন। একবার মা বলেছিলেন, “সবাই বলে শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্ম-সমন্বয় প্রচার করতে এসেছিলেন। তিনি যে বিভিন্ন ধর্ম সাধন করেছিলেন, তা কিন্তু এই উদ্দেশ্যে নয়। তার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ধর্মে কিভাবে ঈশ্বরকে ডাকে তা জানা।” মা বলতেন, “শ্রীশ্রীঠাকুরের মতন ত্যাগের কথা এর আগে কেউ কখনাে শােনেও নি।”
(পদপ্রান্তে ১/১৬৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ০৯

একবার এক ভক্ত মা’কে জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, আমাদের দেশ কবে স্বাধীন হবে?” মা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, “বাবা, তােমরা কি তাদের (ব্রিটিশদের) দেশ থেকে তাড়াতে পারবে? তা পারবে না। যখন ওদের নিজেদের মধ্যে লড়াই লাগবে তখন তােমরা স্বাধীন হবে।” 
 (ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে, বহুদিন আগে তিনি যা বলেছিলেন তা-ই সত্য হয়েছে। আমরা অবশ্য বলতে পারি আমরা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছিলাম, তাই স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আসল কথা এই যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যদি না হতাে, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা পেতে আরও অনেক বছর লেগে যেত।) 
(পদপ্রান্তে ১/১৭১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১০

এক আত্মীয় যুবকের চরিত্রে দোষ হওয়ায় শ্রীঠাকুরের এক প্রাচীন গৃহীভক্ত শ্ৰীমার নিকট আবেদন করিয়া পাঠান, যাহাতে শ্রীমা তাহাকে নিজের নিকট আসিতে না দেন। যুবকটি শ্রীমার সন্তান। আবেদন শুনিয়া।
শ্রীমা উত্তর দেন, “আমার কাছে আসবেনা তাে কার কাছে যাবে? আমি খালি ভালরই মা-মন্দের নই?”
(পদপ্রান্তে ২/৩৯২) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১১

মাঝে মাঝে ভক্তরা মাকে বলতাে, “মা, আমাদের কিছুই হচ্ছেনা। ধ্যান-জপ করি, কিন্তু তাতেও কোনও আনন্দ পাই না।” মা বলতেন, “একথা অনেকেই এসে বলে আমাকে, কিন্তু তারা রােজ দশ-পনের হাজার জপ করুক দেখি, তখন কেমন আনন্দ না পায় দেখবাে।” মা আরও বলতেন, “মুনি ঋষিরা ঈশ্বরলাভের জন্যে কত জন্ম কাটিয়েছেন তপস্যা করে, আর তােমরা ঈশ্বরলাভ করতে চাও কিছু না করে, ফাঁকি দিয়ে। বিনা চেষ্টাতেই কি তা সম্ভব? যা চাও তা পেতে গেলে উঠে-পড়ে লাগতে হবে।সবাই আসে আর বলে কৃপা, কৃপা। কৃপা কি করবে? কৃপা গিয়ে ফিরে আসে। কৃপা যার কাছে এল, সে যদি প্রস্তুত না থাকে, তাহলে কৃপা এসেও ফিরে যাবে।" তবে মা সবাইকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, “এ যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ এসে ঈশ্বরলাভের পথ প্রশস্ত করে দিয়ে গেছেন, যে কেউ একটু উদ্যোগী হয়ে ঈশ্বর চিন্তা করবে, সে-ই তাকে পেয়ে যাবে।”
মায়ের শেষ উপদেশ ছিল, “কারও দোষ দেখাে না।” আর একটি কথা বলতেন, “যখন তােমরা কোনও সমস্যায় পড়বে, যখন কোনও মানসিক অশান্তি আসবে, তখন মনে রাখবে তােমাদের একজন মা আছেন।”
(পদপ্রান্তে ১/১৭২) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১২

ভক্তরা সবাই শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করতে আসতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মায়ের কাছে দীক্ষাও পেতেন। আমি (কুমুদ বন্ধু সেন) শুনলাম তিনি একদিন এক শিষ্যাকে বলছেন, “অনেক সময়ে লঘু, চঞ্চল মনের মানুষ দীক্ষার জন্য আসে। আমি তাদের চেহারা, ভাবভঙ্গি দেখেই পূর্বজীবন বুঝতে পারি। জিজ্ঞাসা করি, আগে তারা অন্য কারও কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছে কিনা। যখন বলে—হ্যাঁ, তখন তাদের বলি, কী আশ্চর্য, তুমি আবার দীক্ষার জন্য এসেছ! তােমার গুরু যে মন্ত্র দিয়েছেন তার উপর এতটুকু বিশ্বাস নেই? মন্ত্র ভগবানের পবিত্র নাম ছাড়া আর কি! তারপরেও তুমি দীক্ষার জন্য এলে কেন? তখন তারা ক্ষমা চায়, কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে মন্ত্রের জন্য অনুনয় করে। কারও কান্না আমি সহ্য করতে পারিনা। তখন ঠাকুরকে ডেকে বলি, এদের বিশ্বাসে জোর এনে দাও। তারপর ঠাকুরের নির্দেশে নতুন মন্ত্র দিই। এই অতিরিক্ত মন্ত্র দিই ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভক্তি-বিশ্বাস বাড়াবার শক্তি হিসাবে।” সে কথা শুনে শিষ্যা বললেন, “তােমার কৃপা এবং আশীর্বাদে তারা বেঁচে গেলেন।” মা তৎক্ষণাৎ বললেন, “না না, আমি কেউ নই। ঠাকুরই তাদের আশীর্বাদ করেন। আমি তার যন্ত্র মাত্র।” 
(পদপ্রান্তে ১/১৯২)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৩

একদিন মাকে বললাম, “ধ্যানের সময়ে ভালভাবে মনঃসংযোেগ করতে পারছিনা। আমার (কুমুদ বন্ধু সেন) মন বড়ই তরল, চঞ্চলা।” মা হেসে উত্তর দিলেন, “ওটা কিছু নয়। মনের ঐ স্বভাব, চোখ এবং কানের মতােই। নিয়মিত ধ্যান-জপ করে যাও। ভগবানের আকর্ষণ ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণ থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। নিয়মিত অভ্যাস করলে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব সময় ঠাকুরের কথা ভাববে, তিনি তােমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন। তােমার ত্রুটি সম্পর্কে একদম চিন্তা করবে না।" আমি বললাম, “মা, আশীর্বাদ করুন যাতে আমি নিয়মিত অভ্যাস করতে পারি।” মা মিষ্টি হেসে বললেন, “তােমার কথাবার্তা, কাজকর্ম ও অভ্যাস সম্পর্কে সৎ থাকবে। তাহলেই অনুভব করবে, কতখানি ধন্য তুমি। ঠাকুরের আশীর্বাদ সর্বক্ষণ জীবের উপর বর্ষিত হচ্ছে, তা চাওয়ার দরকার হয় না। ব্যাকুল হয়ে ধ্যান-জপ কর, তাঁর অসীম কৃপা বুঝতে পারবে। ভগবান চান ঐকান্তিকতা, সত্যবাদিতা, ভালবাসা। বাহ্যিক ভাববাচ্ছাস তাঁর কাছে পৌঁছায় না। নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে নামজপ করবে, মন্ত্রোচারণের সময়ে সর্বশক্তি দিয়ে মনকে একাগ্র করবে। যদি অন্য সমস্ত চিন্তা সরিয়ে দিয়ে হৃদয়ের গভীরতম আর্তির সঙ্গে তুমি প্রভুকে ডাকতে পার, তিনি সাড়া দেবেনই। করুণাময় তিনি। তােমার প্রার্থনা পূরণ করবেন।” 
(পদপ্রান্তে ১/১৯৫)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৪

একজন বাছাই করা দুটি সেরা আম নিয়ে এসেছেন। মা চাইছিলেন আমি (ভগিনী দেবমাতা) ঐ আম দুটি নিয়ে যাই। কিন্তু আমি রাজি হলাম না, কারণ জানতাম, সেগুলি শেষ মরশুমের আম, আর মা আম খুব ভালবাসেন। বললাল, “আম দুটি আপনি নিজে রাখলে আমার বেশী আনন্দ হবে।” মা চকিতে বললেন, “আমি রাখলে তােমার আনন্দ, আর তুমি নিলে আমার আনন্দ, কার আনন্দ বেশী হবে তুমি মনে কর?” আমার মুখে তখনই কথা জুগিয়ে গেল, “মা, আপনার আনন্দই বেশী হবে, কারণ আপনার অনেক বড় মন।” জবাব শুনে মা খুশি হলেন।
(পদপ্রান্তে ২/২৫৪) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৫

“প্রথমবার মায়ের (জগদ্ধাত্রী) পূজা হল। পরের দিন কালী (শ্রীমাযের মধ্যমভ্রাতা-কালীকুমার) জিজ্ঞাসা করলে, “দিদি, দইকর্মার (দধিকর্মের) উদ্যোগ করি?” আমার মনে পড়ল, সেদিন বিষ্যুদবার। আমি অনুমতি দিতে পারলুম না। আমি বললুম, “আজ যে বিষ্যুদবার।” সে বুঝে নিলে আর সেদিন মায়ের-পুজো করালে। পরের দিন আবার মাস পয়লা -সেদিনও বলতে পারলুমনি দুইকর্মা করতে—অগস্ত্য যাত্রা বলে। তার পরের দিন নিরঞ্জন হলাে। সেই থেকে মা এখানে তিনদিন পুজো নিয়ে আসছেন।”
(পদপ্রান্তে ২/৩০০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৬

ললিত (ললিতমােহন চট্টোপাধ্যায়) আর লেখক (আশুতােষ মিত্র) যখন খুড়ার শবদেহ উপর হইতে নামাইতেছিল, তখন গােলাপমাকে অভিযােগ করিতে শােনা গিয়াছিল, “মা, আশু (আশুতােষ মিত্র) শুদ্দুর হয়ে বামুনের মড়া ছুঁলে?” শ্রীমার উত্তরও কর্ণে আসিয়াছিল, “শুদ্দুর কে? —ছেলে। ভক্তের জাত আছে কি গােলাপ?” 
(পদপ্রান্তে ২/৩০৯) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৭

সেদিন পাঁচখানি চিঠি আসিয়াছে—তিনখানি পােষ্টকার্ড এবং দুখানি খাম। লেখক (আশুতােষ মিত্র) প্রথমে একখানি খাম খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করে। পত্রখানি জনাই হইতে শ্রীশ-র লেখা। তিনি লিখিয়াছেন— “মা, শ্রীচরণে শতকোটি প্রণামপূর্বক নিবেদন এই যে, দাস—” আর পড়া হইল না। ছয়পৃষ্ঠা চিঠি মনে মনে পড়িতে কিছুক্ষণ লাগে। ততক্ষণ শ্রীমা তাহার (লেখকের) দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন। তাঁহার দিকে দেখিবামাত্র বুক ধড়ফড় করিয়া উঠিল। ভাবিল, জিজ্ঞাসা করিলে কি উত্তর দিবে সে? উত্তর ঠিক করিতে না পারিয়া চিঠিখানি আলাদা করিয়া রাখিয়া অপর চিঠিগুলি পড়িয়া শুনাইল। শ্ৰীমা চুপ করিয়া সব শুনিলেন। শ্রীমাও কি কি উত্তর লিখিতে হইবে বলিয়া দিলেন। সব শেষ হইলে শ্রীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও খা পড়লেনা কেন?” আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল তাহার মাথায়। কি উত্তর দিবে, একে গুরু তায় মাতৃরূপা—আবার মাতৃরূপা বলে মাতৃরূপা—স্বয়ং মা। কখনাে যে মাকে অ-বলা তাহার কিছুই নাই। তথাপি এ চিঠি সে কেমন করিয়া পড়িবে? ইহা যে অতীত জীবনের এমন সব কুকার্য্যের বর্ণনায় ভরা যাহা মনুষ্যে কি করিয়া সম্ভবপর হয়, তাহা মনুষ্য মাত্রেরই অগােচর। সঙ্গে সঙ্গে কি অকুতােভয়তা, কি অকপটতা সহকারে নিজ পাপকীর্তি ব্যক্ত করা। ইহার যে প্রশংসা না করিয়াও থাকা যায় না।
যাহা হউক শুষ্ক ওষ্ঠ কম্পিত স্বরে (লেখক) উত্তর করিল, “কি করে পড়ব মা? পারছিনা যে।” শ্রীমা বলিলেন, “বুঝেছি, পড়তে হবেনা। তাকে এরকম চিঠি লিখতে বারণ করে দাও। আমার চিঠি ছেলেরা মেয়েরা পড়ে শােনায়। দেশে কেউ না থাকলে ভায়েরা পড়ে। আর লিখে দাও— আগে ছিলে রাহুখেগাে চাঁদ, এখন ঠাকুরের আশ্রয়ে এসে হয়েছ পূর্ণিমার ষোলকলায় পূর্ণ! —ভাবনা কিসের? ঠাকুরই সব ঠিক করে দেবেন।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৪১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৮

একদিন জ্বর আসিয়াছে আর তিনি মাথায় হাত বুলাইতেছেন। বেশ মনে আছে, জ্বরের দমকে দুইটি চরণ আঁকড়াইয়া ধরিয়াছি— “বলতে হবে, আপনি কে? আজ আর ছাড়ছিনা।” তৎক্ষণাৎই উত্তর পাই, “ও সবে তােমার কি? তােমার কাছে আমি মা!” —নিরস্ত হইয়া বর প্রার্থনা করিলাম (আশুতােষ মিত্র), “এই স্নেহ চিরকাল পাব তাে?" উত্তর হইল; “হ্যাঁ, এখানে জোয়ার ভাটা নাই।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৪৩) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ১৯

অল্পবয়স্কা জনৈকা বিধবা শ্ৰীমার নিকট নিত্য আসিতেন। সময়ে সময়ে দু-চার দিন থাকিয়াও যাইতেন। ইহার অবস্থানকালে শ্রীমাকে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত হইতে হইত। ইনি শ্রীমার সন্তান। শ্রীমা ইহাকে অনেক উপদেশ দিতেন। বলিতেন, “মা, আমার নাম ডােবাসনি। শিষ্যের পাপ গুরুতে লাগে। খুব সাবধানে থাকবি। পুরুষ মানুষ, সে যেই হােকনা কেন—কাউকে বিশ্বাস করবিনি। পুরুষের দিকে একেবারে চাইবিনি। নিজের ধ্যান-জপ নিয়েই দিন কাটিয়ে দিবি।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৯৩) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২০

“ঠাকুর বড় কি মা বড়” —এইভাবের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীমা "জনৈক সন্তানকে বলেন, “ছিঃ, অমন কথা বলতে হয়?” পরক্ষণে আবার জিজ্ঞাসা করেন, “তােমার কি মনে হয়?” সন্তান বলেন, “কালী মহাদেবের উপরে দাঁড়িয়ে।” মা মৃদু হাসিয়া বলেন, “তুমি ঐ নিয়েই থাক।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৯৮) 

 শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২১

দক্ষিণেশ্বরের স্বল্পায়তন নহবতখানায় আবদ্ধ থাকিয়া শ্ৰীমার একটি পায়ে বাতের সূত্রপাত হয়।.... এক সময় উহা অতিশয় বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং তাহার শরীরের বিশেষ কষ্ট দিতেছে দেখিয়া জনৈক সন্তান তাহাকে বলেন, “মা আপনি অনুমতি দিন, আপনার শরীরের ঐ রােগ আমি নিজের শরীরে টেনে লই।” ইহা বলিয়াই তিনি প্রক্রিয়া করিতে উদ্যত হন। শ্রীমা জানিতেন, সন্তানটি ঐ বিদ্যা নেপালী মাঈর নিকট লাভ করিয়াছেন এ উহা করিতেও পারেন। সেজন্য তাঁহাকে অবসর না দিয়াই অতিশয় বিচলিত হইয়া তাহার হাত দুইটি ধরিয়া বলেন, “না, না, বাবা, করােনা। তুমি জাননা-ওটা এ শরীরে (নিজ শরীর দেখাইয়া) যে কষ্ট দিচ্ছে তােমার শরীরে গেলে ঢেড় বেশী কষ্ট আমায় দেবে—গােদের ওপর বিষ ফোড়া হবে। আমি যে মা।” মহাশক্তির নিকট ক্ষুদ্রশক্তির পরাজয় হইল।
(পদ প্রান্তে ২/৩৯৮) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২২

হরির মা নামে পাড়ার এক প্রৌঢ়া বিধবা শ্রীমার নিকট প্রত্যহ আসিতেন। একদিন অপরাহ্নে তিনি নিজের সাংসারিক মনোমালিন্যের বিষয় শ্রীমাকে জ্ঞাপন করিয়া অন্যান্য কথার সঙ্গে বলেন, “কি করবাে মা? এ তাে ছাড়া যায় না। এই দেখুন না, আপনি কি রাধুকে ছাড়তে পারেন,না, ছেড়ে থাকতে পারেন?”
শ্রীমা এক অপূর্ব হাসি হাসিয়া উত্তর করেন, “আমার কথা ছেড়ে দাও হরির মা।” শ্রীমার ঐ হাসি এবং ঐ উক্তি আমাদের হৃদয়ে এক অভিনব রেখাপাত করায় ঐ বিষয়ে উল্লেখ করিলে মা বলিতে থাকেন, “ওরা কি বুঝবে? দেখনা—আমায় বলে, রাধির ওপর টান। যাদের ঘরে জন্ম নিয়েছি, তাদের দেখতে হয়। তাইতাে মা বল, বাপ বল, ভাই বল, ভাইপাে ভাইঝি বল, করতে হয়। ঋণ তাে কারুর রাখতে নেই। তা না হলে রাধিটাধি আমার কে? ঠাকুর যে তার মা’র সেবা কত করেছেন—রামলালকে কালীঘরে ঢুকিয়েছেন।” ঐ উক্তিতে নূতন আলােকসম্পাত হওয়ায় জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলাম, “তবে আপনার আপনার জন কে?” উত্তর পাইলাম, “কথামৃতে সাঙ্গপাঙ্গ’ পড়েছ তাে? ঠাকুরেরই বল, আর আমারই বল, ছেলেমেয়েরাই হচ্ছে আপনার জন।” জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাই কি মা?” বলিলেন, “কেন, বুঝতে পারছাে না? ওখানে {লেখকের (আশুতােষ মিত্র) অন্তর দেখাইয়া} কি?” বলিলাম, “আপনি।” বলিলেন, “এখানেও (নিজ অন্তর দেখাইয়া) তােমরা—এতে মায়া নেই, এ বড় টান। এটানে বার বার আসতে যেতে হয়। বুঝেছাে তাে? হ্যাঁ, মা।” ...“দেখতে পাবে—জগতে আর কেউ তােমার আপনার নয়, তখন ঠিক ঠিক বুঝবে, একি টান।”
(পদপ্রান্তে ২/৪০৬) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৩

একবার একটি রহস্যজনক ঘটনা ঘটে। শ্রীমার ফটো (১৫"x১২") সাহেব-বাটী হইতে তৈয়ার হইয়া আসিলে, কেমন হইয়াছে দেখিবার জন্য একখানি তাঁহাকে দিলে, তিনি দুইহাত বাড়াইয়া উহা লইয়া নিজ মস্তকে ঠেকাইয়া দেখিতে থাকেন। তাঁহাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া অতি কষ্টে হাস্য সংবরণ করি। পরে উহা প্রত্যর্পিত হইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করি, “ছবিখানি কার মা?” তিনি সরলা বালিকার ন্যায় উত্তর করেন, “কেন, আমার।” ঐ উত্তরে হাসিয়া ফেলি। মা জিজ্ঞাসা করেন, “হাসছ কেন?” উত্তরে বলি, “তবে আপনি মাথায় ঠেকালেন কেন?” তিনিও সেই হাস্যে যােগদান করিয়া অবশেষে বলেন, “এরও ভেতর তাে ঠাকুর আছেন।”
(পদপ্রান্তে ২/৪০৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৪

সময় সময় শ্রীমাকে ভক্তদের দাম্পত্য কলহেরও মীমাংসায় লিপ্ত হইতে হইত। একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয়েই শ্রীঠাকুরের অতি প্রাচীন ভক্ত মধ্যে পরিগণিত এবং তাহাদের কলহে শ্রীঠাকুরকে নাকি মীমাংসা করিয়া দিতে হইত। তাহার তিরােভাবের পর শ্রীমার উপর ঐ ভার আসিয়া পড়েছে। আমরা শ্রীমাকে ঐ কাৰ্য্য করিতে কয়েকবার দেখিলেও, এখানে মাত্র সর্বশেষ ঘটনাটি উল্লেখ করিতেছি। একদিন প্রাতঃকালে স্ত্রীভক্তটি শ্ৰীমার নিকট আসিয়া থাকিয়া যান। শ্রীমা আমাদিগকে বলিয়া রাখেন, পুরুষভক্তটি আসিলে তিনি যেন সংবাদ পান। অবশেষে একদিন পুরুষভক্তটি সন্ধ্যার পর আসিলে শ্ৰীমা (তাহাকে) উপরে ডাকিয়া পাঠান এবং আমাদের দ্বারা বলান, “এখনো কি বুড়াে বয়সে ও সব ভাল দেখায়? (জ্যেষ্ঠ পুত্র) তিনটে পাশ করেছে। আজ বাদে কাল বে হবে—বউ এসে ঐ সব দেখে তাে শিখবে। আমি বলে দিচ্ছি, আর যেন ওরকম না হয়। হবে না তাে?” তিনি স্বীকার করিলেন যে আর হইবে না। শ্রীমা পুনরায় বলিয়া দেন, “ও ঘরের লক্ষ্মী—ওকে কোনও রকম মনঃকষ্ট দিতে নেই। ওকি নিজের জন্য কিছু করে? তবে ওর হাতটা একটু দরাজ। তাতে হলাে কি? ভক্তের সংসার। ওকে ভাল করে যেন রাখা হয়।” সেইদিন উভয়ে চলিয়া যান। আর কখনাে তাহাদের কলহ আমরা দেখি নাই।
(পদপ্রান্তে ২/৪০৮) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৫

নিকুঞ্জদেবী (শ্রীম’র স্ত্রী) — মা, সংসারে কেবল যন্ত্রণা আর অশান্তি। তােমার কাছে এলেই তপ্তহৃদয়ে একমাত্র শান্তি আসে। আর তােমাকে মা বলে ডাকলে হৃদয় জুড়ায়।
শ্ৰীশ্ৰীমা  - বৌমা, তুমি ওঁকে (শ্রীরামকৃষ্ণকে) দেখেছ, তােমার আর ভাবনা কি? তােমাকে উনি খুব ভালবাসতেন। তিনি আমায় বলেছেন, “মাস্টারের স্ত্রী কি উদার, কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।” আর মা, তােমায় বলি শােন, এই সংসারে সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ আছেই, যার যখন সময়, ঠিক আসে, ভােগও করিয়ে নেয়। মনে জোর করতে হয়, আর ঈশ্বরে মন রাখতে হয়। কেবল এমন অশান্তি-অশান্তি বলতে নাই।
(পদপ্রান্তে ২/৪৩১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৬

একবার কামারপুকুরে জনৈকভক্ত শ্রীমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। সেখানে আমিও (লক্ষ্মীমণি দেবী) ছিলাম। তিনি (ভক্তটি) বিদায় নেবার সময় শ্রীমা তাকে বললেন, “আমায় ডাকিস।” পরে বললেন, “ঠাকুরকে ডাক, তাকে ডাকলেই সব হবে।” আমি — "না মা, একি কথা, এতাে তােমার বড় অন্যায়। ছেলেদের এমন করে ভােলালে তারা কি করবে?” শ্ৰীমাকই, আমি কি করলুম? আমি — তুমি এই মুহুর্তে বললে, আমায় ডাকিস; আবার বলছ, “ঠাকুর কে ডাক’। শ্রীমা- ঠাকুর কে ডাকলেই তাে সব হলাে। আমি — মা, এ রকমভাবে ভােলানাে তােমার অন্যায়। (ভক্তকে) দেখ, আমি আজ এই নতুন শুনলুম যে মা বলছেন — আমায় ডেকো। তুমি এ কথা যেন ভুলােনা। ঠাকুর আর কে? তুমি মাকেই ডেকো। তােমার বড় ভাগ্য যে, মা নিজে তােমায় একথা বললেন। তুমি মাকেই ডেকো। (শ্রীমাকে) কেমন মা হয়েছে এখন? মা মৌন থেকে সম্মতির লক্ষণ জানালেন।
(পদপ্রান্তে ৩/৪৮৮) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৭

মা’র একটি উপদেশ আমি(স্বামী বিশুদ্ধানন্দ) প্রত্যহ চিন্তা করি। লীলা সংবরণের চার-পাঁচদিন আগে তিনি অন্নপূর্ণার-মা নামে আসন্ন মাতৃবিয়ােগে শােকাকুলা একটি ভক্ত মেয়েকে বলেছিলেন, “যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার।”
(পদপ্রান্তে ৩/৪৯৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৮

একবার আমার কালীঘাটে গিয়ে মা-কালীকে দর্শন করার ইচ্ছা হয়েছিল। বাবুরাম মহারাজকে সেকথা বলতে বললেন, “উদ্বোধনে মায়ের সঙ্গে দেখা করে যা, তিনিই সাক্ষাৎ মা কালী। সেখান হয়ে তবে কালীঘাটে যাবি।” বাগবাজারে মায়ের বাড়ি গিয়ে মাকে প্রণাম করে বাবুরাম মহারাজের কথাটি মা’কে বললাম। শুনে মা অল্প একটু হাসলেন। মায়ের সেই হাসির মধ্যে আমি যে কী দেখলাম তা এখনাে চোখে ভাসে। সে যে কী দিব্য রূপ তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। তারপর মা বললেন, “বাবুরাম ঠিকই বলেছে বাবা।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫০৯) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ২৯

মঠে যােগ দেবার আগেই একদিন স্বপ্নে (স্বামী বাসুদেবানন্দ) দেখলাম—মঠে উৎসব হচ্ছে। একজন একটা সােনার পাতে, সিঁদুর মাখানাে লাল পতাকা হাতে করে এসে বললেন, “এই তাের ইষ্টমন্ত্র” দেখি একটা মন্ত্র সেই পতাকায় লেখা। দিন কয়েক তাই জপ করলাম কিন্তু প্রত্যয় হলাে না, ছেড়ে দিলাম। কিছুদিন বাদে মঠে এসে বাবুরাম মহারাজকে আমার (স্বামী বাসুদেবানন্দ) দীক্ষা নেবার কথা বললাম। তিনি কৃষ্ণলাল মহারাজের (স্বামী ধীরানন্দ) সঙ্গে আমাকে উদ্বোধনে শ্ৰীশ্ৰীমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দীক্ষাকালে মা’র বাঁপাশে বসলাম। তিনি ধ্যানস্থ হলেন। অতি গম্ভীর। পরে বললেন, “তােমার দীক্ষা তাে আগেই ঠাকুর দিয়েছেন।” আমি বললাম, “আমার স্বপ্নে ঠিক বিশ্বাস হয় না। আপনিই আবার আমাকে বলে দিন।” তিনি হেসে বললেন, “এই তােমার মন্ত্র, এবার জপ করাে।” বলে স্বপ্ন প্রাপ্ত পূর্বমন্ত্রই উচ্চারণ করলেন। আমি তার নির্দেশমত জপ করতে লাগলাম। জপের সময় আঙ্গুল ফাঁক হচ্ছে দেখে বললেন, “আঙ্গুল ফাঁক রাখতে নেই, জপ স্খলন হয়।” তারপর বললেন, “আমি বলাও যা, তিনি বলাও তাই।” একটু থেমে আবার বললেন, “গুরু ও ইষ্ট একই। ঐ তােমার ইষ্ট এবং উনিই আবার রামকৃষ্ণ।” আমি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললাম, “মা, আমার যেন ভক্তি হয়।” মা আমার ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে আঙ্গুল দিয়ে বললেন, “ঠাকুরের কৃপায় জ্ঞানচক্ষু ফুটবে, ঠাকুর তােমার এই তৃতীয় চক্ষু খুলে দেবেন, অজ্ঞান অন্ধকার দূর হবে, দেখবে কত কী অনুভূতি হবে! খুব ধৈর্য ধরে থেক।”
(পদ প্রান্তে ৩/৫২৮) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩০


জনৈক ভক্ত—'শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনেকে ভগবান বলেন।' আপনি কি? শ্রীশ্রীমা"তিনি যদি ভগবান হন, আমি তবে ভগবতী।"
(পদপ্রান্তে ৩/৬৩১) 


শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩১

১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে আত্মারামের কৌটায় কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রীপুজো হয়। এবার (১৯১৫) জয়রামবাটীতে জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম, “আত্মারামের কৌটায় এঁদের পুজো হয় ? ‘গুহ্যাতিগুহ্যগােপ্তী ত্বং গৃহানাস্মৎ কৃতং জপমা/সিদ্ধির্ভবতু মে দেবী তৎপ্রসাদাৎ মহেশ্বরি ॥' বলে ঐ কৌটাতেই জপ সমর্পণ করি, তাতে দোষ হয় না?” মা বললেন, “তা হবে কেন? তুমি কি বেদান্ত পড়? ঠাকুরই মহেশ্বর, ঠাকুরই মহেশ্বরী। শুদ্ধ সত্ত্ব যােগমায়া তার শরীর—তিনি সশক্তিক ব্রহ্ম। শিব ও শক্তি এক।" ঠাকুরের অসুখের সময় একদিন দেখলাম, মা-কালী ঘাড় বেঁকিয়ে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, মা, অমন, করে রয়েছ কেন? বললেন, “ওর ঐটের (গলায় ঘার) জন্য। আমারও গলায় বড় ব্যথা।"
(পদপ্রান্তে ৩/৫২৯) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩২

উদ্বোধনে পুজোর বেদিতে অনেক ঠাকুর-মাকুর রাধাকৃষ্ণ, মার গােপাল, জগদ্ধাত্রী-কবচ, যােগেন-মার দুটি গােপাল, বাণেশ্বর, দুটি গগাবর্ধন-শিলা ও ঠাকুরের পট, কপিল মহারাজের মা-কালী ইত্যাদি। কপিল মহারাজের অসুখ করায় (বৈশাখ-১৩২৫) মঠ থেকে আমাকে উদ্বোধনে পুজো করতে পাঠানাে হল, বলরাম-মন্দিরে বাবুরাম মহারাজের দেহরক্ষার (১৪ শ্রাবণ, ১৩২৫) কিছুদিন পূর্বে। বাড়ীতে থাকাকালীন বাণেশ্বর, শালগ্রাম, শিব গােপালকে যেভাবে পুজো করতাম, এখানেও সেইভাবেই করতাম। মা জয়রামবাটী থেকে এলে জিজ্ঞেস করলাম, “এ সব ঠাকুর দেবতা কিভাবে পূজা করবাে?” জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কিভাবে কর?” আমি পূর্বাশ্রমে আমার ঠাকুমার কাছে যে সব মন্ত্র শিখেছিলাম সেই গুলি বললাম। তিনি বললেন, “নিজ ইষ্টবীজে সব পুজো করবে। ইষ্টই তাে সব হয়ে রয়েছেন।' বলে ইষ্টবীজের সহিত এক-একটি দেবতার নাম ‘নমঃ' শব্দ যােগে বসিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলেন।" আবার বললেন, “কখনাে যদি অন্য দেবদেবীর পুজো করবার ইচ্ছা হয় তাে ঠাকুরের মূৰ্ত্তিতে করলেই চলবে। কারণ, ইষ্ট ও তিনি এক এবং তিনিই সর্বদেবদেবীস্বরূপ হয়ে আছেন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৩

 একদিন উদ্বোধনে চন্দন ঘষছি, মা উত্তরদিকের দরজার ধারে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে মুখ করে মালা জপ করতে বসেছেন। কেউ নেই দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়ে পড়ে কেন?” তিনি শুনেই মাল রেখে বললেন, “ওদিকে নজর দিও না, কার মনে দুর্বলতা না আসে এক ঠাকুর ছাড়া? আজ পর্যন্ত এমন কোনও মহাপুরুষ জন্মেছেন কি, যার মনে কখনাে কোনও দুর্বলতা ওঠে নি? যদি শুধরােবার চেষ্টা থাকে, যদি মানুষ বুঝতে পারে যে, আমার মনে দুর্বলতা উঠেছে—তাহলে ঐ জিনিষটাই একটা মস্ত শিক্ষা, মহামায়া খুশি হয়ে তখন তাকে পথ ছেড়ে দেন। মানুষ কিছুদিন ভাল থাকলেই মনে করে আমার সব হয়ে গেছে, আরও উঁচুতে ওঠবার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিবেকীর মনেও মাঝে মাঝে দুর্বলতা দিয়েই ঠাকুর স্মরণ করিয়ে দেন যে, এখনাে সাধনা শেষ হয়নি, ভূত-প্রেত সব ওত পেতে ' চারপাশে বসে আছে, সুবিধে পেলেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এতে হয়কি অহঙ্কার নষ্ট হয়। যতদিন বাঁচবে সাবধানে ঠাকুরের শরণাগত হয়ে থাকবে, অহঙ্কার হলেই ঐ সব হিজিবিজি মনে উপস্থিত হবে। শেষ পর্যন্ত শরণাগতির ভাব নিয়ে থাকতে হয়। ঠাকুর একবার নিজের শরীরে কামের বেগ ধারণ করে দেখালেন, জীবের অহঙ্কার করবার কিছুই নেই।” 
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩২) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৪

উদ্বোধনে একদিন পুজোয় বসে বাণেশ্বর শিবকে স্নান করাবার সময় আমার হাত পিছলে পড়ে গিয়ে গড়গড় করে গড়িয়ে গেলেন। আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে এনে যথাস্থানে গৌরীপট্টে স্থাপন করলাম। পরদিন সকালে রামকৃষ্ণপুর থেকে নীরদ মহারাজের (স্বামী অম্বিকানন্দ) মা এসে বললেন, “বাবা, কাল তুমি মহাদেবকে স্নান করাবার সময় হাত থেকে ফেলে দিয়েছ?” আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, “মা, আপনি জানলেন কেমন করে?” তিনি বললেন, “কাল স্বপ্নে দেখি, একটি পাঁচ বছরের ধবধবে ছেলে, মাথায় ছােট ছােট জটা, ন্যাংটো, নাচতে নাচতে এসে বলছে, “আমায় ফেলে দিয়েছে।” মা সামনে পা ছড়িয়ে বসে - কার সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু সব শুনছেন। ভয়ে আমি তখন ‘গুরু কৃপাহি কেবল জপ করছি—বুকের ধুকধুকানি নিজেই শুনতে পাচ্ছি। মা নীরদ মহারাজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছােট ছেলেরা অমন কত পড়ে খেলতে গিয়ে।” তারপর হেসে বাণেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বাবা অষ্টমূর্তিতে জগৎ ছেয়ে রয়েছ, ও অতটুকু ছেলে তােমায় ধরে রাখবে কেমন করে?” আমি মনে মনে বুঝলাম, “শিবঃ রুষ্টে গুরু স্ত্রাতা গুরুঃ কষ্টে ন কশ্চন।” যােগেন মা বললেন, “এবার থেকে সাবধান হবে।” আমি তিনজনকেই নমস্কার করলাম। 
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩৩) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৫

উদ্বোধনে আমরা একবার নিচে খুব হট্টগােল করছি। তাতে গােলাপমা মা’কে বলছেন, “তােমার ছেলেদের ওপর কোনও শাসন নেই। পরমহংস মশাই ছেলেদের কেমন শাসনে রাখতেন। কারু একচুল এদিকওদিক হবার জো ছিল না।” মা বললেন, ‘কি জানি মা, আমি কারুর কিছু খারাপই দেখতে পাইনে, তা শাসন করব কি? আমি যে মা! আমি শাসন করব কি করে? আমি ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে নিই। এরা ঠাকুরের ছেলে, শাসন করবাে বললেই হলাে। তিনি কেমন সব ঠিক করে নেন। তাঁর আপনভােলা ভালবাসায় সব সােজা হয়ে যায়। আমাদের প্রেমের ঠাকুর, তাতে কোনও কঠোর, রূঢ় ভাব নেই। যখন লােকে বলে “আচ্ছা, এর ফল ভগবান দেবেন।” আমি কিন্তু তখন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি—“ঠাকুর, নির্বোধ সুবােধ সকলেরই মঙ্গল কর।” আমি ছেলেদের বলি —“কাউকেও হিংসা করাে না, ভগবানকেও বিচার করতে বলাে না। বরং যাতে অত্যাচারীর ভাল হয় তার সম্বন্ধে প্রার্থনা করাে। ভগবানের বিচার নিক্তি ধরা, একচুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। ...কিন্তু তাঁর দয়ারও আবার শেষ নেই।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩৪)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৬

একজন খুব ছটফটে। মা তাকে একটু স্থির হয়ে ধ্যানজপ করতে বলেন। সে বলে, “মা, মন বসে না তাে কি করবাে?” মা বললেন, “ধ্যান না হয় কঠিন, আমরা মেয়েমানুষ জপেতেই আমাদের সব হয়, নয় তােমরা তাই কর। একটু স্থির হয়ে বসে জপ করতে হয়। দশ-বিশ হাজার জপ রােজ করে দেখ কেমন মন আপনি নুইয়ে না আসে; যদি না আসে তখন বােলাে। সাধু-সন্ন্যাসী ছাড়া ধ্যান হওয়া বড় কঠিন। তবে পুরুষ মানুষ হলেই হয় না, মনে জোর চাই, বৈরাগ্য হওয়া চাই, নির্বাসনা এবং ভগবানে ভালবাসা না হলে ধ্যান হওয়া বড় কঠিন। চার রকম ধ্যানসিদ্ধ আছে। (১) যারা জন্ম থেকেই সুকৃতি নিয়ে এসেছে, (২) যারা গুরুর শিক্ষা স্বীকার করে নানান রকমে অভ্যাস করতে করতে ধ্যানসিদ্ধ হয়েছে, (৩) আবার ঠাকুর বলতেন- ‘কৃপাসিদ্ধ’। গুরুকৃপা করে তাদের মনকে সংসার থেকে তুলে ধরেছেন। তাদের মনটা জলের উপর পদ্মফুলের মতাে ভাসে। এরা কৃপাসিদ্ধ। আর (৪) ঠাকুর বলতেন— ‘হঠাৎ সিদ্ধ’। যেমন, লােকে যে কোনও কারণে হােক অপরের সম্পত্তি পেয়েছে। এদেরও পূর্বের তপস্যা আছে, কিন্তু কোনও মোহে পড়ে বহুদিন ধরে প্রারব্ধ ভােগ করছিল, যেই প্রারব্ধ কেটে গেল, আর যেন রাস্তায় যেতে যেতে বহুমূল্য মাণিক পড়ে পেল। “ঠাকুর তাে এবার দয়া করে লােকের মঙ্গলের জন্য কঠোর তপস্যা করে গেলেন। ছিল শুধু হাড় আর চামড়া, তার ওপর আবার লােকের পাপ নিয়ে রােগ ভােগ। তাঁতে ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস করলেই, তার নামজপ, তার লীলা ধ্যান করলেই কুণ্ডলিনী আনন্দে আপনি জেগে উঠবেন, এতটুকুও কঠোরতা করতে হবেনা। কলিকাল, এখন কি আর লোকে সত্য-ত্রেতার মত তপস্যা করতে পারে? এখন অন্নগত প্রাণ। ঠাকুরের নাম কর, দেখাে তিনি খাওয়া-পরার সব ব্যবস্থা করে দেবেন। ঠাকুরের নাম করলে এবার কেউ কখনাে অন্ন কষ্ট পাবে না। মােটা ভাত মােটা কাপড়ের ব্যবস্থা তিনি করে গেছেন। গুরু—ঈশ্বরের সাহায্য না পেলে কি কেউ আপনি বন্ধন খুলতে পারে? তাই ঠাকুর অতি কঠোর তপস্যা করে তার ফল যে সব ভক্তরা আসবে তাদের জন্য সঞ্চয় করে রেখে গেলেন। তিনি তাে কৃপা করে দরজায় দাঁড়িয়ে, এখন তুমি দরজা খুললেই হয়।” 
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩৫)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৭

একবার আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। মাকে বললাম, “এমনিই মন স্থির হয় না, তাতে আবার শরীরে অস্বস্তি থাকলে মনটা বসতেই চায় না।” মা বললেন, “দেখ, মনটাকে দুভাগ করতে হয়, একটা যেন বিবেকী, আর একটা যেন অবিবেকী—ছেলেমানুষের মতাে। বিবেকী মনটা বাপ-মার মতাে সর্বদা অবিবেকী মনটার পিছনে লেগে থাকবে। একটা কিছু আবোল তাবোল করলেই তাকে শাসন করবে, গালমন্দ করবে, দেখনি বাপ-মা যেমন দুষ্টু ছেলেটাকে বকে ঝকে। দেখবে, এইরকম কিছুদিন অভ্যাস করলেই মনটা শায়েস্তা হয়ে আসবে। কিন্তু অবিবেকী মনে যদি একটা বিষয়ে বহুদিনের অভ্যাসের ফলে দৃঢ় সংস্কার জন্মে যায়, তাহলে শত তিরস্কারেও সেটা যেতে চায়না। তখন ঐ দুর্বল মনের জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে, নইলে আর কোনও উপায় নেই। তিনি ঈশ্বর—সব করতে পারেন। ঠাকুরের ইচ্ছের কাছে দেখেছি মানুষের মনগুলাে যেন কাঁচা মাটির তালের মতাে হয়ে যেতাে; আর তিনি যাকে যেমন ইচ্ছে তাকে তেমনি করে গড়ে তুলতেন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৩৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৮

আমি (স্বামী বাসুদেবানন্দ) রাসবিহারী মহারাজের কাছে শুনেছি, তিনি একদিন (কাশীতে) মা’কে বলেছিলেন, “নির্বাণ চাই না মা, তাহলে তােমায় পাব ।” মা শুনে বললেন, “বােকা ছেলে! নির্বাণই যে তার স্বরূপ!”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৪০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৩৯

মায়ের শরীর রক্ষার অনেক পরের কথা। একবার মনটা বড় চঞ্চল। ধ্যান, জপ-টপ যেন সব যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে, করতে হয়, সময়মাফিক করে যাচ্ছি। ‘দেখি, মা যদি কিছু বলেন’, বলে ‘মায়ের কথা’ খুললাম। খুলতেই যেখানে চোখ পড়ল, দেখি লেখা— “রােজ কি কারুর ঈশ্বর দর্শন হয়?”
ঠাকুর বলতেন, “ছিপ ফেললে কোনদিন পেল, কোনদিন পেল না, তা বলে কি চেষ্টা ছাড়তে আছে? ... এত চঞ্চল হলে চলবে কেন। যা পেয়েছ এতেই লেগে থাকো। আর কেউ তােমার না থাক, আমি তাে তােমার মা আছি। ঠাকুরের কথা মনে নেই? —যারা তাঁর আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কাছে তিনি প্রকাশ হবেনই, অন্ততঃপক্ষে শেষের দিন তিনি নিজে এসে সকলকে নিয়ে যাবেন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৪০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪০
“পত্নীর সহিত কিরূপ ব্যবহার করব?” উমেশ বাবুর (উমেশচন্দ্র দত্ত) এই প্রশ্নের উত্তরে মা বলেছিলেন, “মনে করবে যে, জগদম্বাই তােমার সেবা করবার জন্যে তােমার পত্নীরূপে এসেছেন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৭৩৪)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪১

বিদায় নেওয়ার সময় আমার (স্বামী আদিনাথানন্দ) সঙ্গী (স্বামী সাধনানন্দ) মা’কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। “মা, মন্ত্রটি কতবার জপ করবাে? হাজার, দশহাজার, নাকি তারও বেশী?" মা বলেছিলেন, “বাবা, তােমরা এখন ছাত্র।.... অনেক পড়াশুনাে করতে হবে। পরীক্ষা দিতে হবে। বেশী জপ করতে পারবেনা এখন। পরে সময় সুযােগ পেলে ধীরে ধীরে বাড়াবে। তবে ঠাকুর স্বয়ং আমায় বলেছেন, ‘রামকৃষ্ণ নাম দশবার জপলেই হবে। তা-ই যথেষ্ট।’ ঠাকুর জগতের আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধনের জন্য স্বয়ং কঠোর তপস্যা করে ভগবদ্ ভাব জাগিয়ে দিয়ে গেছেন। আন্তরিকতা, ব্যাকুলতা, অনুরাগ, প্রীতি নিয়ে সাধনভজন করলে এখন অল্পেতেই সুফল পাবে।” এই সামান্য বিধান শুনে আমরা পুলকিত হলাম। কলকাতায় যখন আমরা স্বামী সারদানন্দ মহারাজকে ঐ কথা বললাম, তিনি বললেন, “হ্যাঁ, মনকে স্থির করতে পারলে এবং মনকে বশে আনতে পারলে দশবার জপই যথেষ্ট।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৬০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪২

সেদিন বিকালে ‘মায়ের বাড়ী’ থেকে ফিরে আসার আগে আবার তাঁর দর্শন পেলাম। আমি (মােহিনী মােহন মুখােপাধ্যায়) জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, আপনি বলেছেন, মন্ত্রটি সকালে ও সন্ধ্যায় অন্ততঃ ১০৮ বার করে জপ করতে। এ ছাড়া অন্য সময়েও যতটা পারি করতে। আমি কি যে কোনও জায়গায় জপ করতে পারি ?” মা বললেন, “হ্যাঁ, বাবা, তােমার যেখানে খুশী করতে পার।” আমি আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “খাওয়ার সময় বা কোনও অপরিষ্কার স্থানেও কি জপ করতে পারি?” মা খুব জোর দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অপরিষ্কার স্থানেও করতে পার। ওসব নিয়ে তােমায় কিছু চিন্তা করতে হবে না বাবা।”
(পদপ্রান্তে ৩/৫৯০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৩

মা’কে প্রণাম করে আমি (সােরাব মােদী) কাতরভাবে দীক্ষা প্রার্থনা করি। তিনি করুণাপরবশ হয়ে আমাকে তখনই দীক্ষাদান করেন। যদিও তিনি আমার ভাষা বুঝতেন না এবং আমিও বাংলাভাষা জানতাম না তবু দেখলাম তার কথা বুঝতে আমার কোনও অসুবিধা হলাে না এবং তারও আমার কথা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। মা বাংলাতেই কথা বলছিলেন, আমি বলেছিলাম হিন্দীতে। তার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় আমি বলেছিলাম, “মাঈ জী, ম্যায় যা রহা হুঁ।” মা বাংলায় বললেন, “যাই’ বলতে নেই বাবা, বলাে ‘আসি’।” একজন সেবক আমাকে মায়ের কথাগুলি ইংরাজীতে অনুবাদ করে আমায় শােনালেন, “Mother says, don't say 'I am going', say 'I am coming'." আমি তো শুনে অবাক! আমি যাচ্ছি, আর মা বলছেন ‘আসছি’ বলতে? আমি তখন জানতাম না, বাংলাদেশে এভাবেই বিদায় নেবার সময় বলা হয়।.... এখন আমি বুঝতে পারছি—যা তখন আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল আমি তার কাছ থেকে চলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শেষপর্যন্ত যেতে আমি পারিনি। আমরা কেউই পারিনা। মায়ের কাছে আমাদের ফিরে আসতে হবেই। আমার জীবনের অন্তিম উপলব্ধি—আমি আমার মায়ের কাছে ফিরে আসছি—I am coming to my Mother!
(পদপ্রান্তে ৩/৫৯২) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৪

একজনের একটিমাত্র সন্তান সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছে, তিনি মায়ের নিকট আসিয়া নিজের মনের তাপ জানাইতে গিয়া অশ্রুবর্ষণ করিতেছেন, শ্রীশ্রীমারও চোখে জল। মা বলিতেছেন, “আহা! তাইতাে, একটি মাত্র সন্তান, প্রাণের ধন—এমন করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে মা কি করে প্রাণ ধরে বলাে দেখি?” আবার অপর একদিন একজন যখন তাহার দুইটি সন্তানই সন্ন্যাসী হইবার জন্য ব্রহ্মচর্য লইয়াছে ইহা জননীর কাছে জানাইয়া বলিতেছেন, “মা, সন্তানের কল্যাণ হয় সেইটি মায়ের কামনা। কী আছে সংসারে? ছেলে যদি পরম কল্যাণের পথে যায়, তার চেয়ে আনন্দের বিষয় কী আছে?” মা তখন সহর্ষে বলিতেছেন, “ঠিক বলেছ মা, পরম কল্যাণের পথে যদি ছেলে যায়, তার চেয়ে আর মা’র আনন্দ কী হতে পারে ?” এই যে বিভিন্নস্থানে মায়ের বিভিন্নভাবের উক্তি—উভয়ই তাঁহার আন্তরিক, একটিতে তিনি সন্তানহারা মায়ের দুঃখের সম-অংশিনী, আবার অপরটিতে মা যে সন্তানের প্রকৃত কল্যাণের বিষয় বুঝিয়াছেন, ইহা দেখিয়া পরমানন্দিত।
(পদপ্রান্তে ৩/৫৯৬) 

 শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৫

তাঁহার (শ্রীমার) অসুস্থ অবস্থায় একদিন একজন গৈরিকবস্ত্র পরিহিতা মহিলা তাঁহার চরণ দর্শন করিতে আসিয়াছেন। তিনি মায়ের নিকট দীক্ষা লইবার জন্য অতিশয় ব্যাকুল হইয়া আসিয়াছেন। মা তখন খাটের উপর শুইয়াছিলেন। তিনি যেমন পদধূলি লইবার জন্য অগ্রসর হইয়াছেন, অমনি মা যেন সন্ত্রস্তা হইয়া বলিলেন, ‘কর কি? কর কি, পায়ে হাত দিও না, গৈরিকধারিণী সন্ন্যাসিনী তুমি, পায়ে হাত দিয়ে কেন আমাকে অপরাধী কর?” মেয়েটি নিতান্ত দুঃখিত হইয়া উত্তর করিলেন, “অনেক আশা করে যে আপনার কাছে এসেছি, আপনি আমায় দীক্ষা দেবেন বলে।” 
মা বলিলেন, “ব্যস্ত হলে কি কিছু হয় মা? সময় হলে নিজেই হবে। দীক্ষা কি তােমার হয়নি? গেরুয়া কে দিয়েছেন? যাঁর কাছে সাধন পেয়েছ, নিষ্ঠা করে তাকেই ধরে থাক, সময়ে হবে।”
মেয়েটি অবশেষে বলিলেন, “গেরুয়া কেউ দেন নি, আমি নিজেই ধারণ করেছি। আর যে সাধন প্রণালী পেয়েছি তাতে মনে শান্তি পাচ্ছি না।”
মা তখন বলিলেন, “আজ আমি বড় অসুস্থ, তােমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলুম না বলে মনে দুঃখ করাে না। কিন্তু মা, এটি মনে রেখাে, গেরুয়া পরা খুব সহজ নয়। এই যে সব আশ্রমের ত্যাগী ছেলেরা ঠাকুরের জন্য সব ছেড়ে এসেছে, এরাই গেরুয়া পরার অধিকারী। গেরুয়া পরা কি যার তার কাজ?" এই সব বলিয়া মিষ্টি কথায় তাঁহাকে বিদায় দিলেন।
 কিন্তু মা তাঁহাকে পায়ের ধূলা লইতে দিলেন না।
(পদপ্রান্তে ৩/৫৯৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৬

অনেক শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত স্বামীজীকে লৌকিক দৃষ্টিতে দেখিতেন— কায়স্থ বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁহাদের কাহারও মনে উঠিত যে, কায়স্থের ছেলে শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমায়ের সহিত একই সঙ্গে পূজাপ্রাপ্তির যােগ্য পাত্র কি? পূর্ববঙ্গের একদল ভক্ত তাই তাহাদের আশ্রমের ঠাকুর ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমায়ের পটের সহিত স্বামীজীর পটকে স্থান দেন নাই। সেই খবর শ্রীশ্রীমায়ের কানে পৌছাইলে সেই ভক্তদের ব্রাহ্মণত্বের অভিমান চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিয়া দৃপ্তকণ্ঠে তিনি ঘােষণা করিয়াছিলেন— "যেখানে নরেনের পুজো হয় না, ঠাকুর সেখানে পুজো গ্রহণ করেন না।” .... পূর্ববঙ্গেরই আর একদল ভক্ত তাহাদের আশ্রমের ঠাকুর ঘরে একই সঙ্গে একই সারিতে শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর পট রাখিয়া পূজা করিতেন। একবার তাঁহারা বাগবাজারে ‘মায়ের বাড়ীতে’ মাতৃসন্দর্শনে আসিয়াছেন। তাহাদের কাহারও কাহারও মনে একটি খকটা ছিল যে, শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমায়ের সহিত পূজাকালে ঐভাবে শিষ্যের একই সারিতে অবস্থান কি ঠিক? উহা কি শ্রীশ্রীমায়ের অভিপ্রেত ? তাই তাঁহারা যাহা করিতেছেন তাহা খুব ভয়ে ভয়ে মাকে বলিলেন। দেখিলেন, মায়ের মুখখানি গম্ভীর হইয়া গেল। তাঁহারা উহাতে খুব ভীত হইলেন। তাহা হইলে ঐ ভাবে স্বামীজীর পূজা মায়ের অনুমােদিত নহে? হঠাৎ মা গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন, “ঠাকুর থাকলে কি তা করতে দিতেন?” ভক্তকয়টির পা কাঁপিতে শুরু করিল। মা বলিয়া চলিলেন, “ঠাকুর থাকলে কি নরেনকে পাশে বসাতেন? তিনি নরেনকে কোলে নিয়ে বসতেন। নরেন যে তাঁর মাথার মণি।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬০৯) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৭

ভােরে গঙ্গাস্নান করিতে গিয়া দশাশ্বমেধ ঘাটের রাস্তা ভুল করিয়া প্রয়াগঘাটে উপস্থিত হইলাম। ... স্নানান্তে পথপার্শ্ব হইতে ফুল-বেলপাতা, কিছু ফল এবং ছানার মিষ্টি লইয়া লক্ষ্মীনিবাসের দিকে অগ্রসর হইলাম। .... লক্ষ্মী নিবাসের সদর দরজায় একজন অর্ধাবগুণ্ঠিতা স্ত্রীলােক গালে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। ভাবিলাম, তবে কি মা? ... মা’কে প্রণাম করিতে উদ্যত হইতেই আমাকে(লাবণ্যকুমার চক্রবর্তী) বলিলেন, “আর একটু অপেক্ষা কর বাবা।” আর কৃষ্ণলাল মহারাজকে বলিলেন, “এক ঘটি গঙ্গাজল নিয়ে এস।” কৃষ্ণলাল মহারাজ খুব তাড়াতাড়ি পূজার উপকরণ ঠাকুর ঘরে রাখিয়া এক ঘটি গঙ্গাজল নিয়া আসিতেই মা বলিলেন, “ছেলের হাত ধুয়ে দাও।” তাহা হইল। তখন প্রাণ ভরিয়া প্রণাম করিলাম। হৃদয় আনন্দে ভরপুর। কিন্তু মনের কোণে যেন একটু সংশয় কেন গঙ্গাজল? তবে কি অপবিত্র আমাকে মা পবিত্র করিয়া লইলেন? মনের কথা অন্তর্যামিনী মা জানিয়াছেন। মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “ঠাকুরের পূজার জিনিষ তুমি যে হাতে এনেছ—সে হাত আমার পায়ে তাে দেওয়া যায়না বাবা! তাই তােমার হাত ধােয়ানাে হলাে।”
 (পদপ্রান্তে ৩/৬১৫) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৮

শ্রীশ্রীমা - ঠাকুর বলতেন, “আমাকে (ঠাকুরকে) যারা ডাকবে তাদের জন্য আমাকে অন্তিমে দাঁড়াতে হবে।” এটি তার নিজের মুখের কথা।
জনৈক ভক্ত শ্রীশ্রীমায়ের কৃপালাভের পর একবার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “মা, যােগশাস্ত্রানুযায়ী আবাল্য আমার যােগাভ্যাস করার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। যােগাভ্যাস আরম্ভ করব কি?” 
শ্রীশ্রীমা একটু নীরব থাকিয়া হাসিয়া বলিলেন, “যা লাভ করবার জন্য সাধক যোগাভ্যাস করেন তা তাে তােমার হয়ে গেছে বাবা। আর তার প্রয়ােজন কি? তাতে ত্রুটি হলে ক্ষতিও ঘটে। তােমার প্রয়ােজন নেই।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৩০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৪৯

নিবেদিতা বিদ্যালয়ের বাের্ডিঙের ঠাকুর ঘরে শ্রীশ্রীমা আমাদের (দীক্ষাপ্রার্থীদের) একে একে নিয়ে প্রবেশ করলেন। সেখানে ঠাকুর ও নানা দেবদেবীর ছবি ছিল। মা আমার ইষ্টদেবীকে দেখিয়ে দিলেন, ঠাকুরকে দেখিয়ে বললেন, “উনিই সব” এবং সবীজ মহামন্ত্র দান করলেন। আর বললেন, “মা, অনিবেদিত বস্তু কখনাে খেওনা, এক খিলি পান খেতে হলেও নিবেদন করে খাবে, আর শ্রাদ্ধের অন্ন কখনাে খেওনা।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৩৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫০
আমরা (আশুতােষ মিত্র) অনেক সময় লক্ষ্য করিয়াছি, শ্রীমাকে ত্যাগী অপেক্ষা গৃহীসন্তানকে বেশী স্নেহ করিতে। এ প্রকার পক্ষপাতিত্বের কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর পাইয়াছি, “এরা (ত্যাগীরা) সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ধ্যান-জপ নিয়ে আছে—নিজের চেষ্টায়ই উঠবে, আর ওরা (গৃহীরা) কচি ছেলের মত আমার পানে চেয়ে পড়ে আছে—কাজেই আমায় দেখতে হয়।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৯৮) 


শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫১

শিরােমণিপুরের ... হামেদি-চাচা ও মফেতি-চাচা বলত, “মায়ের কী ভক্তি! আমাদের পাল-পরবে মা সিন্নি মানত করে, বাতাসা দেয়।” মফিতি চাচা মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “মা, মুসলমানদের পরবে আপনি সিন্নি বাতাসা পাঠান কেন ? আপনারা তাে হিন্দু!”
মা বলতেন, “বাবা, ঠাকুর কি আলাদা হয়? সবই এক। তােমরা তাে জান বাবা, তােমাদের ঠাকুর ইসলাম ধর্মও সাধনা করেছিলেন। সে সময় নামাজ পড়তেন মুসলমানের মতােই। সবই এক বাবা! নামেই শুধু ভিন্ন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৬১) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫২

আমার ওপরে রাধির অত্যাচার দেখে আমার মা অস্থির হয়ে যেত। গজর গজর করে বলত, “নিজের পেটের তাে একটা হলাে না, যত সব পরের ঝঞ্ঝাট নিয়ে কেমন করে যে তুই হাসি মুখে থাকিস বাপু তা বুঝিনে।” আমি আবার মাকে কতরকম বলে তবে শান্ত করতাম।” কথাগুলি বলে মা একটু চুপ করে থাকলেন। ঐ সময়ে একটি ভক্ত মেয়ে হাসতে হাসতে বলল, “আচ্ছা মা, আজ যদি দিদিমা থাকতেন তাহলে আরও কত অধৈর্য হতেন! আজ কত ছেলেমেয়ে মা মা বলে এসে আপনাকে এত বিরক্ত করছে। আমরাও তাে আপনার পেটে হইনি, তা বলে কি আমরা আপনার ছেলে মেয়ে নই?” এ কথা শুনেই মা উঠে বসলেন। তপ্তস্বরে বললেন, “কী বললে, আমার পেটে হওনি? তবে কার পেটে হয়েছ? আমার ছেলেমেয়ে নও? তবে কার ছেলেমেয়ে? আমি ছাড়া মা আর কেউ আছে নাকি? সব মেয়ের ভিতরেই আমি, সব মায়ের মধ্যেই আমি রয়েছি। যে যেখান থেকেই আসুক সব্বাই আমার ছেলেমেয়ে। এটা সত্যি সত্যি জানবে। 'মা' বলে ডেকে যারাই আমার কাছে আসে তারা সবাই আমার ছেলেমেয়ে ....।” 
(পদপ্রান্তে ৩/৬৮০) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৩

‘মা শিশুদের কথা বলছিলেন। তাদের সরলতার কথা, পবিত্র স্বভাবের কথা। এ প্রসঙ্গে আমি (সুহাসিনী দেবী) মাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম, সব শিশুর মনে কি জানার আগ্রহ থাকে? কোনও কোনও ছেলে মেয়েকে দেখি, কেমন যেন জবুথবু। কিভাবে তাদের মনে স্বাভাবিক কৌতূহল জাগানাে যায়? কিভাবে তারা স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতাে হবে?” মা হেসে বললেন, “সে কি গাে, তােমরা মা হয়েছ আর কিভাবে ছেলেমেয়েদের মনের খবর জানবে তা তােমাদের বলে দিতে হবে? শােন, ওদের সাথে খুব সহজ সরলভাবে মিশতে হয়। গল্প করতে হয়। ওদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করতে দিতে হয়। ওদের বেশি বকা-ঝকা করতে নেই, মারতে নেই। ওদের বেশি বকা-ঝকা করলে, মারধর করলে ওরা ভয়ে জবুথবু হয়ে যাবে, দূরে সরে যাবে। ওদের ভালবেসে বুঝিয়ে দিলে ওরা সহজে বুঝবে। ওদের প্রশ্নকে ধমক দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দিতে নেই। ধমক দিলে বা ভয় দেখালে ওরা কোনকিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় পাবে। ওদের মনের স্বাভাবিক বিকাশ বাধা পাবে।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৮৫) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৪

“.... ভগবানই তাে যীশুর রূপে এসে জগৎকে প্রেমের শিক্ষা দিলেন। তাইতাে দেখ না, ওদেশের মেয়ে নিবেদিতা এদেশে এসে আমাদের ঘরের মেয়েদের জন্য কত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করেও হাসিমুখে কাজ করেছে, কত কষ্ট করে এখানে থেকে তাদের লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করেছে। লােকের বাড়ী গেলে তারা অপমান করেছে, ঘরে ঢুকতে দেয়নি — যদিবা ঢুকেছে, চলে আসতে না আসতে অথবা চলে আসার পর গােবরজল, গঙ্গাজল ছিটিয়েছে। চোখে দেখেও কিছু মনে করেনি। হাসিমুখে বেরিয়ে এসেছে। তার তাে কোনও দরকার ছিল না বাপু নিজের জীবনকে তিল তিল করে ক্ষয় করে, এত অসম্মান, লাঞ্ছনা সহ্য করে এদেশের মেয়েদের জন্য কাজ করার। কিন্তু মেয়ের আমার এমন সুন্দর মন যে, যেহেতু নরেন চেয়েছে—তার গুরু চেয়েছে, গুরু বলেছে—তাই এদেশের মেয়েদের শিক্ষার ভার সে তার নিজের কাঁধে নিয়েছে। দুঃখ-কষ্ট, অপমান কোনও কিছুকেই গ্রাহ্য করেনি, অথচ যাদের জন্য সে নিজেকে তিল তিল করে ক্ষয় করেছে তারাই তাকে দূর-দূর করেছে। আমাদের দেশের মেয়েরা কি এই পরিস্থিতিতে গুরুর জন্য এতখানি ত্যাগ করতে পারত? বলত, ‘বয়ে গেছে আমাদের’! তাই তাে বলি, ঠাকুর যে কি ভাবে কখন কাকে দিয়ে কী করিয়ে নেন তা তিনি ছাড়া কেউ জানেনা, বােঝেনা।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৮৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৫

একদিন একজন ভক্ত মহিলা মাকে বললেন, “মা আমরা তাে সারা দিনরাত সংসার নিয়ে, সংসারের সকলের ফরমাস আর চাহিদা মেটাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সারা দিনরাতে পাঁচটা মিনিটও ঠাকুরকে ডাকতে সময় পাইনা। আমাদের কী হবে মা? আমাদের ওপর কি তাঁর দয়া হবে না?" মা বললেন, “নিশ্চয় হবে মা, তিনি তাে অন্তর্যামী। সবার বুকের মাঝে তিনি সব সময় আছেন। তােমার ভিতরে আকুতি থাকলে তা তিনি বুঝবেনই বুঝবেন। তাছাড়া সংসারের কাজ কি তােমরা কর মা? তিনি করান! এ সংসার তাে তারই। তার ইচ্ছা ছাড়া কি কিছু হয় মা? তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়েনা। ‘কৃষ্ণ-ইচ্ছা বিনা কোনও কর্ম নাহি হয়।’ তােমার মধ্যে এই যে ব্যাকুলতাটা এসেছে, জানবে তার ইচ্ছাতেই এসেছে। যে তাকে ভালবাসে, তাকে তিনি রক্ষা করেন। তাকে ভালবাস আর নাই বাস, তিনি তােমাকে ভালবাসেন। সংসারে সাধু আছে আবার গৃহীও আছে। তবে গৃহীর জন্যই তিনি বেশী ভাবেন। সাধুতাে তাকে ডাকবেই, কিন্তু গৃহীর যে পিঠে বিশমন বোঝা, ঠাকুর বলতেন। তাই গৃহীর জন্যই তার চিন্তা বেশী। শুধু একটু স্মরণ-মনন করলেই হলাে। মনে-প্রাণে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাক। তার স্মরণ-মনন কর। দিনান্তে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে তার নাম কর। ঐ দু ফোঁটা চোখের জল ছাড়া তােমাদের কি-ই বা আছে বল? আর সবই তাে তার। ঐ দু ফোঁটা জল শুধু তােমার। ওটুকুই তাকে দিও। তােমাদের কাছে বাঁধা হয়ে থাকবেন তিনি। ভয় কি মা, ঠাকুর এসে এবার তােমাদের জন্য ভগবানকে পাওয়ার এই সহজ পথ বলে দিয়ে গিয়েছেন।”
(পদপ্রান্তে ৩/৬৮৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৬

ঠাকুরের পূজান্তে মা আমাদের তিনজনের (স্বামী গিরিজানন্দ, স্বামী বিশুদ্ধানন্দ এবং স্বামী শান্তানন্দ)  হাতে গৈরিক বহির্বাস ও কৌপিন দিলেন এবং ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করলেন, “ঠাকুর, এদের সন্ন্যাস রক্ষা করাে। পাহাড়ে-পর্বতে, বনে-জঙ্গলে যেখানে থাকুকনা কেন, এদের দুটি খেতে দিও” আমাদের বললেন, “শ্রাদ্ধাদি কর্মে তােমাদের আর কোনও অধিকার রইল না। এখন থেকে সকলের অন্ন খেতে পারবে। যদি কোনও বান্দীরও মেয়ে এসে ভিক্ষা দেয়, মা অন্নপূর্ণা দিচ্ছেন মনে করে খাবে।”
(পদপ্রান্তে ৩/৭১৭) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৭

সুরমা রায়কে মা বলেছিলেন, “ঠাকুরের পুজোয় দূর্বা দিয়াে। মাঝের শীষটা ফেলে দিয়ে তিনটি দল রাখবে। শিবপূজা ঐ রকম দূর্বা ছাড়া হয় না।"
 (পদপ্রান্তে ৩/৭৩৩) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৮

আমরা (স্বামী ঈশানানন্দ প্রভৃতি) প্রণাম করিয়া বসিলে শ্ৰীশ্ৰীমা কোন্ দিন কোন্ সময়ে কোয়ালপাড়ায় পৌঁছিবেন এবং কে কে সঙ্গে যাইবেন ইত্যাদি বলিয়া শেষে বলিলেন, “দেখ বাবা, তােমরা যখন ঠাকুরের জন্য ঘর ও আমাদের পথের বিশ্রামের স্থান একটু করেছ, তখন এবার যাবার সময় ওখানে ঠাকুরকে বসিয়ে দিয়ে যাবাে। সব আয়ােজন করে রেখাে। পূজা, অন্নভােগ, আরতি সব নিয়মিত করতে থাকবে। শুধু স্বদেশী করে কি হবে? আমাদের যা কিছু সবার মূল ঠাকুর, তিনিই আদর্শ। যা কিছু করােনা কেন, তাকে ধরে থাকলে, কোনও বেচাল হবে না।” 
(মাতৃসান্নিধ্যে ১৪)

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৫৯

কেদারবাবু বলিলেন, “মা, রামেশ্বর প্রভৃতি কেমন সব দেখেছিলেন - সব বলুন। আপনার কাছে ঐ সকল কিছুই শােনা হয় নাই।” শ্রীশ্রীমা বলিলেন, “বাবা, যেমনটি রেখে এসেছিলাম, ঠিক তেমনটিই আছেন।” পূজনীয়া গােলাপ-মা তখন ওদিকে বারাণ্ডায় যাইতেছিলেন, তিনি মায়ের কথা শুনিয়া বলিলেন, “কি বললে মা?” শ্রীশ্রীমা একটু চমকিত হইয়া বলিলেন, “কই, কি বলবাে! বলছি এই তােমাদের কাছে যেমন শুনেছিলুম, তেমনটি দেখে বড় আনন্দ হয়েছিল।” তখন গােলাপ-মা একটু হাসিয়া বলিলেন, “তা না, মা, আমি সব শুনেছি, এখন আর কথা ফেরালে কি হবে? কেমন গাে কেদার (স্বামী কেশবানন্দ)?” ... তারপর শ্রীশ্রীমা বলিলেন, “ .... আমি এসেছি শুনে রামনাদের রাজা তাঁর দেওয়ানকে হুকুম দিলেন, মন্দিরের রত্নাগার খুলে আমাকে দেখাতে; আর আমি যদি কোনও জিনিষ পছন্দ করি, তখনি যেন তা আমাকে উপহার দেওয়া হয়। আমি আর কি বলবাে? কিছু ঠিক করতে না পেরে বললাম—আমার আর কি প্রয়ােজন, বাবা? আমাদের যা কিছু দরকার, সব শশীই ব্যবস্থা করছে। আবার তারা ক্ষুন্ন হবেন ভেবে। বললাম–আচ্ছা, রাধুর যদি কিছু দরকার হয়, নেবে’খন। তারপর ঐ সব মণি-জহরতের ঘরে ঢুকে রাধুকে বললাম—দ্যাখ, তাের যদি কিছু দরকার হয়, নিতে পারিস। যখন হীরা-জহরতের জিনিষ সব দেখছি, তখন কেবলি আমার বুক দুড়দুড় করছে আর ঠাকুরের কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করছি - ঠাকুর, রাধুর যেন কোনও বাসনা না জাগে। তা রাধু বললে, “ও আবার কি লুবাে। ওসব আমার চাইনি। আমার লেখবার পেন্সিলটা হারিয়ে ফেলেছি, একটা পেন্সিল কিনে দাও। আমি একথা শুনে হাঁকছেড়ে বাঁচলুম।”
 (মাতৃসান্নিধ্যে ১৯) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৬০

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৬০


ঠাকুর বলিতেন, “বাংলায় অক্ষরগুলাে একটা, জোর দুটো করে আছে। কিন্তু শ’ তিনটে শ, ষ, স—এর মানে সহ্যকর, সহ্যকর, সহ্যকর।” শ্রীমাকে আমরা ঐ অর্থে ভিন্ন উপমা দিতে শুনিয়াছি। তিনি বলিতেন, “পৃথিবীর মত সহ্যগুণ থাকা চাই।” বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিতেন, “পৃথিবীর ওপর দিয়ে কত উৎপাত, কত উপদ্রব হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী কিন্তু সব একভাবে সহ্য করে যাচ্ছে। এইরকম সহ্যগুণ মানুষেরও হওয়া চাই।”
(পদপ্রান্তে ২/৩৯৫) 

শ্রীমা সারদা দেবীর উপদেশঃ- ৬১

কেদারবাবু আসিয়া মায়ের কাছে বসিয়া গল্প করিতে করিতে মাকে বলিলেন, “মা, আপনার সব ছেলেরাই বিদ্বান, আমরা এই কয়টি আপনার একেবারে মূখ সন্তান। শরৎ মহারাজ ঠাকুরের বই (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ) লিখে তার কথা ও ভাব প্রচার করছেন। অন্যান্য ছেলেরা সব বক্তৃতা দিচ্ছেন—কত কাজ হচ্ছে!” সব শুনিয়া মা বলিতেছেন, “সেকি গাে? ঠাকুর লেখাপড়া তেমন কিছু জানতেন না। ভগবানে মতি হওয়াই আসল। তােমার দ্বারা এদেশের অনেক কাজ হবে। এই সব ছেলেরা আমার কত কাজ করছে। ঠাকুর এবার এসেছেন ধনী-নির্ধন, পণ্ডিত-মুখ সকলকে উদ্ধার করতে। মলয়ের হাওয়া খুব বইছে। এবার বাঁশ ও ঘাস ছাড়া যার ভিতরে একটু সার আছে, সেই চন্দন হবে। যে একটু পাল তুলে দেবে, শরণাগত হবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে। তােমাদের ভাবনা কি? তােমরা আমার আপনার লােক! তবে কি জানাে বিদ্বান্ সাধু যেন হাতীর দাঁত সােনা দিয়ে বাঁধানাে।”
(মাতৃসান্নিধ্যে ২৪)

==================================================

Post a Comment

0 Comments