Shri Shri Mayer Katha ~ 1st Part

শ্রীশ্রীমায়ের কথা (প্রথম ভাগ)

প্রথম ভাগ

Shri Shri Mayer Katha ~ 1st Part

=========

পরিচয় 

১৭৭৫ শকাব্দ, ১২৬০ সাল ৮ই পৌষ, বৃহস্পতিবার, কৃষ্ণাসপ্তমী তিথি, রাত্রি ২ দণ্ড ৯ পল, ইংরেজী ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর বাঁকুড়া জেলায় জয়রাম বাটী গ্রামে জননী সারদেশ্বরী জম্মগ্রহণ করেন। 


জয়রামবাটী গ্রামে শ্রীরামচন্দ্র মুখােপাধ্যায় অতি নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন, মা তাঁহারই তনয়ারূপে ধরণীকে কৃতার্থ করিতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন।

১২৬৬ সালে শ্রীশ্রীমার বয়স যখন মাত্র ছয় বৎসর তখন যুগাবতার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার শুভ পরিণয় হয়। ইহার প্রায় সাত বৎসর পরে তিনি শ্বশুরালয় কামারপুকুরে প্রথম আসেন।

এই যে বিবাহ, ইহা একটি আশ্চর্য পরিণয়। শােনা যায়, বিবাহের পূর্বেই রমণীগণের বন-ভোজনস্থলে ঠাকুর ও মা যখন নিজ নিজ জননীর সঙ্গে বন ভােজনে আসিয়াছিলেন তখন তাঁহাদের প্রথম সাক্ষাৎ হইয়াছিল। ইহার পর যখন ঠাকুরের নানাস্থানে বিবাহ সম্বন্ধ হইতেছিল তখন কন্যা যে নির্দিষ্ট হইয়াই আছেন এ কথা ঠাকুর স্পষ্টই জানাইয়াছিলেন এবং জয়রামবাটী গ্রামের সেই ছয় বৎসরের কুমারীটিই তাঁহার মনােনীতা ও নিরূপিতা বলিয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন। 

কিন্তু বিবাহের পর সেই মনোনীত পত্নীর জন্য তাঁহার বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় নাই। প্রায় সাত বৎসর পরে ১২৭৩ সালে মা কামারপুকুরে প্রথম আসেন। নিতান্ত অল্প বয়স বলিয়া এতদিন তাঁহাকে আনা হয় নাই। ইহার পাঁচ বৎসর পরে ১২৭৮ সালে ফাগুন মাসে মা দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আসেন। দক্ষিণেশ্বরে মা নহবতে থাকিতেন। অতি প্রত্যুষে কেহ উঠিবার পূর্বেই তাহার স্নান প্রভৃতি হইয়া যাইত। মন্দিরে কর্মচারী অনেক, অতিথি ও সাধুসন্ন্যাসীর সমাগমও যথেষ্ট, কিন্তু কেহই তাহার ছায়াটি পর্যন্ত দেখিতে পাইত না। ঠাকুর সর্বদাই ভাবে মগ্ন রহিতেন আর সেই ভাবাবেশেই তাঁহাকে যা কিছু সম্ভাষণ করিতেন তাহাতেই মায়ের আনন্দের সীমা থাকিত না। যতটুকু স্বামীর সেবাকার্যের ভার পাইতেন তাহাই তাহাকে পরিতৃপ্ত রাখিত এবং সেই তৃপ্তিইে তিনি পরমানন্দিতা রহিতেন। 

ইহার পর ১২৮০ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজার দিন রাত্রে ঠাকুর মাকে ষোড়শীপূজা করেন এবং তাঁহাদের অপূর্ব দাম্পত্য সম্বদ্ধে এইটিই সম্পূর্ণ পরিচয়।

আগেই বলিয়াছি, এই বিবাহ একটি আশ্চর্য পরিণয়। ভাবুকের মনে ইহাতেই হরগৌরীর দাম্পত্যমাধুর্যে-চিত্র জাগরিত হয়। সম্পূর্ণ কামগন্ধহীন একান্ত প্রীতিপূর্ণ এই যে দাম্পত্যপ্রেম, জগৎ-সংসারে ইহার অনুরূপ কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ ইহা এমন সহজ ও সরলভাবপূর্ণ যে বিন্দু মাত্রও অস্বাভাবিকতা তাহাতে নাই। একবার মা পদব্রজে দক্ষিণেশ্বরে আসিছেন, তখন পথ হারাইয়া পথে বিপন্ন হইয়া দস্যুর ন্যায় বলিষ্ঠ ও ভীষণ আকৃতির এক অপরিচিত ব্যক্তি ও তাহার স্ত্রীর দেখা পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে পিতৃ-সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “বাবা, আমি পথ হারিয়েছি। তোমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে থাকেন-সেইখানে আমি যাচ্ছি।” এই ‘তােমার জামাই কথাটিতে মায়ের সরল ও প্রীতপূর্ণ মনের ভাবটি কি সুন্দরভাবেই প্রকাশ পাইয়াছে! ঠাকুরের সেবার প্রত্যেক খুঁটিনাটি কাজে মায়ের কত আনন্দ? সব সময়ই নিতান্ত লজ্জাশীলা কুলবধুর ন্যায় অতি মৃদু; আচরণ - যেন হ্রীর শোভন গুন্ঠনে মা সর্বদাই গুন্ঠিতা, অথচ সঙ্কোচহীন সহজ ভাব। পথ ভুলিয়া জন শূন্য মাঠে বলিষ্ঠ ভীষণাকৃতি অপরিচিতের সঙ্গে সাক্ষাতে মা যে ভাবে অতি সহজে “বাবা, আমি পথ হারিয়েছি” এবং “তােমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে থাকেন” বলিয়া তাহাকে এক কথাতেই পরমাত্মীয় করিয়া লইয়াছিলেন--অতি সাহসিকা কোন বয়ােধিকাও তাহা পারেন কি-না সন্দেহ। অথচ মা নিতান্ত সরলা গ্রাম্য মেয়ে মাত্র। স্বামি-সন্দর্শনের আশায় অতিমাত্র আনন্দিত হইয়া পথ চলিতেছেন, তাঁহার অনভ্যস্ত পথক্লেশে তাঁহাকে ক্লিষ্টা করিতে পারিতেছে না, কোন আশঙ্কাই তাঁহার মনে উদ্বেগের ছায়াপাত করিতে পারিতেছে না, আবার সকলের উপরেই তাঁহার আত্মীয়ভাব এবং সে আত্মীয়তার প্রভাব অতিক্রম করিবার মতো শক্তি কাহারও আছে কি-না সন্দেহ। 

মা সরলা, মা গ্রাম্য কুমারী, লেখাপড়াও শিখেন নাই। কত সময়ে মা যেন জগৎসংসারে কিছুই বুঝেন না, তাঁহার সরলতায় এমনিই মনে হইতে পারে, কিন্তু সেই সরলতার ভিতর গভীর বুদ্ধিমত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে সন্নিবেশিত। পূজ্যপাদ স্বামী সারদানন্দ-প্রণীত ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ হইতে একটি স্থান মাত্র এখানে উদ্ধৃত করিলাম-“দক্ষিণেশ্বরে একদিন দিনের বেলায় আমাদের পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতা ঠাকুরানীকে পান সাজিতে ও তাঁহার বিছানাটা ঝাড়িয়া ঘরটা ঝাঁটপাট দিয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিতে বলিয়া ঠাকুর কালীঘরে শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে দর্শন করিতে যাইলেন। তিনি ক্ষিপ্রহস্তে ঐ সকল কাজ প্রায় শেষ করিয়াছেন, এমন সময় ঠাকুর মন্দির হইতে ফিরলেন—একেবারে যেন পুরােদস্তুর মাতাল। চক্ষু রক্ত বর্ণ, হেথায় পা ফেলিতে হােথায় পড়িতেছে, কথা এড়াইয়া অস্পষ্ট অব্যক্ত হইয়া গিয়াছে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঐ ভাবে টলিতে টলিতে একেবারে শ্রীশ্রীমার নিকট উপস্থিত হইলেন। শ্রীশ্রীমা তখন একমনে গৃহকার্য করিতেছেন, ঠাকুর যে তাঁহার নিকট ঐ ভাবে আসিয়াছেন তাহা জানিতেও পারেন নাই। এমন সময় ঠাকুর মাতালের মতাে তাঁহার অঙ্গ ঠেলিয়া তাঁহাকে সম্বােধন করিয়া বলিলেন, ‘ওগো, আমি কি মদ খেয়েছি ? তিনি পশ্চাৎ ফিরিয়া ঠাকুরকে ঐরূপ ভাবাবস্থ দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত! বলিলেন, না, না, মদ খাবে কেন ? ঠাকুর ‘তবে কেন টলছি ? তবে কেন কথা কইতে পাচ্ছি না? আমি মাতাল ?” শ্রীশ্রীমা - না, না, তুদি মদ খাবে কেন ? তুমি মা কালীর ভাবমৃত খেয়েছ। ঠাকুর “ঠিক বলেছ বলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।” 

অন্যত্র আবার, ঠাকুর যখন পানিহাটিতে যাইবেন, মাও সঙ্গে যাইতে চাহেন কি-না জিজ্ঞাসা করিলেন। মায়ের সঙ্গিনীরা যাইতে চাহিলেও মা যাইতে চাহিলেন না। ঠাকুর তাহাতে আনন্দিত হইয়া বলিলেন, “ও খুব বুদ্ধিমতী, যেতে চাইল না। গেলে পরে লোকে বােলতাে-হংস - হংসী একত্রে এসেছে।” মা কেন যে যাইতে চাহিলেন না সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলিয়াছেন, “উনি আমি যাইব কি-না জিজ্ঞাসা করিলেন কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে হবে’ এ কথা তাে বলিলেন না। ইহাতেই আমার মনে হল না যাওয়াই ভাল।” 

ঠাকুরের সহিত শ্রীশ্রীমার সরল ভাবের বিষয়ে অতিশয় সৌসাদৃশ্য দেখা যায়। ঠাকুর যেমন গলার ব্যথা কিসে সারে ইহাকে-তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, মাও সেইরুপ অসুখের সময় “কি অসুখ হ’ল বাপু, একি আর সারবে না মা! আমায় যে বিছানায় পেড়ে ফেললে। কি করি বল দেখি।” ইত্যাদি বলিতেছেন। আবার শশধর তর্কচূড়ামণি অসুস্থ স্থানে মানসিক শক্তিপ্রয়ােগ করিয়া অসুখ -সারাইবার কথা বলিতেই ঠাকুর যেমন “পন্ডিত হয়ে ওকি কথা বল গাে ! যে মন সচ্চিদানন্দকে দিয়েছি তা কি আবার ফিরিয়ে এনে হাড়-মাসের খাঁচায় দেওয়া  যায় ?” দৃঢ়ভাবে এই উত্তর দিয়াছেন, মাও তেমনি যদি কেহ অনুনয় করিয়া প্রার্থনা করিয়াছেন, “আপনি একবার বলুন অসুখ সেরে যাবে, তা হলে নিশ্চয় অসুখ সেরে যাবে।” তা হলে কি বলতে পারি ? মা, ঠাকুর যা করেন তা তাে হবে; আমি আর কি বলবাে?” ইহা ভিন্ন অন্য উত্তর পাওয়া যায় নাই। যদি কেহ জেদ করিয়া বলিয়াছে, “আপনি একবার মুখে বলন, তা হলে নিশ্চয় অসুখ সেরে যাবে, তাহা হইলেও “আমি কি তা বলতে পারি ? ঠাকুর যা করেন তাই হবে।”—তাঁহার এই একই উত্তর ছিল। 
তাঁহার ভালবাসা ক্ষণে ক্ষণে তাঁহাকে নব নব ভাবে বিভাবিত করিত। এক জনের একটিমাত্র সন্তান সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছে, তিনি মায়ের নিকট আসিয়া নিজের মনের তাপ জানাইতে গিয়া অশ্রুবর্ষণ করিতেছেন, শ্রীমারও চোখে জল, মা বলিতেছেন, “আহা! তাই তাে, একটি মাত্র সন্তান, প্রাণের ধন, এমন করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে মা কি করে প্রাণ ধরে বল দেখি?’ আবার অপর একদিন একজন যখন তাঁহার দুইটি সন্তানই সন্ন্যাসী হইবার জন্য ব্রহ্মচর্য লইয়াছে ইহা জননীর কাছে জানাইয়া বলিতেছেন, “মা, সন্তানের কল্যাণ হয় সেইটিই মায়ের কামনা। কি আছে সংসারে ? ছেলে যদি পরম কল্যাণের পথে যায়, তার চেয়ে আনন্দের বিষয় কি আছে ?” মা তখন সহর্ষে বলিতেছেন, “ঠিক বলেছ মা, পরম কল্যাণের পথে যদি ছেলে যায়, তার চেয়ে আনন্দ কি হতে পারে ?” এই যে বিভিন্ন স্থানে মায়ের বিভিন্ন ভাবের উক্তি উভয়ই তাঁহার আন্তরিক ; একটিতে তিনি সন্তানহারা মায়ের দুঃখের সম-অংশিনী, আবার অপরটিতে মা যে সন্তানের প্রকৃত কল্যাণের বিষয় বুঝিয়াছেন ইহা দেখিয়া পরমানন্দিত। 

জননীর অনেক কন্যাই মনে করেন-মা আমাকে অতিশয় ভালবাসেন, কখনও আমাকে ভুলেন না। অযােগ্যা এই দীনা লেখিকাও তাহাদের মধ্যে একজন। মা অতি নিকটেই থাকিতেন, দর্শনের জন্য ইচ্ছাও যে প্রবল হইত না এমন নহে। কিন্তু সঙ্কোচ সব সময়েই বাধা দিত। তথাপি যখনই যতদিন পরেই মায়ের দশন পাইয়াছি তখনই মনেপ্রাণে অনুভব করিয়াছি-মা আমাকে একবারও ভুলেন নাই। 

সেই অপারস্নেহময়ী জননী যেমন তাঁহার পিতৃহীনা দুঃখিনী স্নেহপাত্রী রাধু’র সকল অত্যাচার অম্নানমুখে সহ্য করিয়াছেন, সেইরূপ তাহার সকল সন্তানেরই অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করিয়াছেন। জয়রামবাটীতে ইদানীং ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়া তাহার শরীর অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল ; সে সময় হয়তাে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম করিতেছেন এমন সময় বহুদূর হইতে দর্শনপ্রার্থী পথশ্রান্ত ভক্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জননী তখনই তাহার পরিচর্যার প্রয়ােজনের জন্য বিশ্রাম ত্যাগ করিয়াছেন। তাহাদের শতজনের শত আবদার-কেহ বা মায়ের হাতের অন্ন গ্রহণ না করিয়া জলগ্ৰহণ করিবেন না এই সংকল্প করিয়াছেন মা তখনই রন্ধনশালায় প্রবেশ করিলেন; কেহ বা ধূলিপায়ে মায়ের চরণপূজা করিয়া পরে প্রসাদান্ন গ্রহণ করবেন বলিয়া আবদার ধরিয়াছেন, স্নেহময়ী সন্তানের সে আবদারও পূরণ করিতেছেন। শত অবুঝ সন্তানের মায়ের উপর শত দাবী। সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি করুণময়ী জননী সকল প্রকারেই স্নেহ-সুধায় তাহাকে শান্ত করিতেছেন-মায়ের এই ছবি প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, কিন্তু আবার অনুরূপ দঢ়তারও অভাব ছিল না। তাঁহার অসুস্থ অবস্থায় একদিন একজন গৈরিকবস্ত্রপরিহিতা মহিলা তাঁহার চরণদর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি মায়ের নিকট দীক্ষা লইবার জনা অতিশয় ব্যাকুল হইয়া আসিয়াছেন। মা তখন খাটের উপর শুইয়াছিলেন। তিনি যেমন পদধূলি লইবার জন্য অগ্রসর হইয়াছেন, অমনি মা যেন সন্ত্রস্তা হইয়া বলিলেন, “কর কি, কর কি, পায়ে হাত দিও না ; গৈরিকধারিণী সন্ন্যাসিনী তুমি, পায়ে হাত দিয়ে কেন আমাকে অপরাধী কর ?” মেয়েটি নিতান্ত দুঃখিত হইয়া উত্তর করিলেন, “অনেক আশা করে 
যে আপনার কাছে এসেছি, আপনি আমায় দীক্ষা দেবেন বলে !” 

মা বলিলেন, “ব্যস্ত হলে কি কিছু হয়, মা? সময় হলে নিজেই হবে। দীক্ষা কি তােমার হয় নি ? গেরুয়া কে দিয়েছেন। যার কাছে সাধন পেয়েছ, নিষ্ঠা করে তাঁকেই ধরে থাক, সময়ে হবে।”  মেয়েটি অবশেষে বলিলেন, “গেরুয়া কেহ দেন নাই, আমি নিজেই ধারণ করেছি। আর যে সাধন-প্রণালী পেয়েছি তাতে মনে শান্তি পাচ্ছি না।” 

মা তখন বলিলেন, “আজ আমি বড় অসুস্থ ; তােমার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলাম না বলে মনে দুঃখ করাে না। কিন্তু মা, এটি মনে রেখাে, গেরুয়া পরা খুব সহজ নয়। এই যে সব আশ্রমের ত্যাগী ছেলেরা ঠাকুরের জন্য সব ছেড়ে এসেছে, এরাই গেরুয়া পরার অধিকারী। গেরুয়া পরা কি যার-তার কাজ ?” এই সব বলিয়া মিষ্টি কথায় তাঁহাকে বিদায় দিলেন।

কিন্তু মা তাহাকে পায়ের ধুলা নিতে দিলেন না। 

মা অসুস্থ থাকিতেই তাঁহার জন্মতিথির দিন আসিল, সেদিন তাঁহার চরণ পুজা করিতে বহু ভক্তের সমাবেশ হইয়াছে। মা তখন খুব দুর্বল, বার বার জ্বর হইতেছিল। মা পালঙ্কে অবগুণ্ঠিতা হইয়া বসিয়া আছেন, শত শত ভক্ত চরণপূজা করিতে আসিতেছেন, মা সস্নেহে সকলের পূজা গ্রহণ করিতেছেন। করা সত্ত্বেও পূজায় বহু সময় লাগিল, কিন্তু মা সমভাবেই প্রসন্নময়ীরূপে সস্তান দের অর্চনা গ্রহণ করিতেছেন। এই দৃশ্যটি আজও মনে অঙ্কিত রহিয়াছে। 

শ্রীশ্রীমায় স্বরূপ ভাষার তুলি দিয়া আঁকিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমার নাই। আমি যখন মার দশন পাই নাই, আমার মেয়ে তখন নিবেদিতা স্কুলে পড়িত, তাহার কাছে প্রথম মায়ের প্রত্যক্ষ সংবাদ পাই। তার পূর্বে কেবল মনে কল্পনা লইয়াই তৃপ্ত থাকিতাম। আমার মেয়ে প্রথম আসিয়া আমাকে তাহার প্রত্যক্ষ সংবাদ জানাইল। সে বলিল, “মা, মাকে আমরা দর্শন করতে গিয়েছিলাম, তিনি যে কত সুন্দর, কত ভাল, তুমি দেখলে বুঝতে পারবে। আমার এত ভাল লেগেছে মা, সে আর কি বলবাে। কেবলি মনে হচ্ছিল, তুমি যদি একবারটি তাঁকে দেখতে।” তাহার এই কথা শুনিয়া খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া তাহার কাছে মায়ের মধুর প্রসঙ্গ জিজ্ঞাসা করিলাম। সেও আনন্দের সহিত বলল—কেমন তিনি খাইতে বসিয়া হাসিতে হাসিতে বালিকাদের সম্ভাষণ করিতেছিলেন, অল্পাহারের জন্য গােলাপ-মার কাছে তিরস্কৃতা হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া হাসিতেছিলেন, সকলকে তাঁহার প্রসাদ কত স্নেহের সঙ্গে হাতে হাতে ভাগ করিয়া দিতেছিলেন। সেই ছবিটি যেন তাহার বর্ণনায় মনের মধ্যে আঁকা হইয়া গেল। সেইদিন হইতে তাহার কাছে মায়ের কথা প্রত্যহ শুনিতে পাইতাম, আর মনে অভিমান প্রবল হইয়া উঠিত ; কেবল মনে হইত সবাইকে আপন করে নিয়ে আমায় কেন এতদূরে রেখেছেন ? অবশেষে একদিন বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল। মায়ের দর্শন পাইলাম। 

আজ তিনি দুর্লভ, তিনি ধ্যানগম্য। ১৩২৭ সালের ৪ঠা শ্রাবণ রাত্রি ১টা ৩০ মিনিটের সময় চিন্ময়ী জননী মৃন্ময় ঘট ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন, জড়দৃষ্টি  তাঁহার দর্শনের অধিকার হারাইয়াছে, কিন্তু জগৎ তাহার পাদস্পর্শে পবিত্র হইয়া কি সম্পত্তি লাভ করিয়াছে, তাহাই অনুভব করিবার আজ সময় আসিয়াছে। 

শ্ৰীমতী সরলাবালা দাসী

সারদামণি দেবী 

শাস্ত্রে গৃহস্থের প্রশংসা আছে, সন্ন্যাসীরও প্রশংসা আছে। শাস্ত্রে ইহাও লিখিত আছে এবং সহজ বুদ্ধিতেও ইহা বুঝা যায় যে, গার্হস্থ্য আশ্রম অন্য সব আশ্রমের মূল। কিন্তু গৃহস্থমাত্রেরই জীবন প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয় নহে, সন্ন্যাসী মাত্রেরও জীবন প্রশংসনীয় বা নিন্দার্হ নহে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভগবদ্দত্ত শক্তি, হৃদয়-মনের গতি প্রভৃতির দ্বারা স্থির হয় যে, ভগবান কিরূপ জীবন যাপন করিয়া কি কাজ করিবার নিমিত্ত কাহাকে সংসারে পাঠাইয়াছেন। যিনি যে আশ্রমে আছেন, তদুচিত জীবন যাপন করেন কি-না, তাহা বিবেচনা করিয়া তিনি আত্মপ্রসাদ বা আত্মগ্লানি অনুভব করিতে পারেন। যিনি যে আশ্রমের মানুষ, কেবল সেই আশ্রমের নামের ছাপটি দেখিয়া তাহার জীবনের উৎকর্ষ অপকর্ষ সার্থকতা-ব্যর্থতা নির্ধারিত হইতে পারে না। ব্যক্তি-নির্বিশেষে গৃহস্থাশ্রম অপেক্ষা সন্ন্যাসের বা সন্ন্যাসাশম অপেক্ষা গার্হস্থ্যের উৎকর্ষ বা অপকর্য বিবেচিত হইতে পারে না। 

সাধারণতঃ ইহাই দেখা যায় যে, যাঁহারা সন্ন্যাসী তাঁহার হয় কখনও বিবাহই করেন নাই, কিংবা বিবাহ করিয়া থাকিলে পত্নীর সহিত সমুদয় সম্বন্ধ বর্জন করিয়া এবং তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া গৃহত্যাগী হইয়াছেন। পরমহংস রামকৃষ্ণ সন্ন্যাসী ছিলেন, কিন্তু তিনি চব্বিশ বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন। বাল্যকালে যখন তাঁহার বিচার করিবার ক্ষমতা ছিল না, তখন কিংবা তাঁহার অনভিমতে কে তাঁহার বিবাহ দেন নাই। তাঁহার বিবাহ তাঁহার সম্মতিক্রমে হইয়াছিল-তাঁহার জীবন-চরিতে লিখিত আছে যে, তাঁহারই নির্দেশ-অনুসারে পাত্রী-নির্বাচন হইয়াছিল। কিন্তু তিনি একদিকে যেমন পত্নী লইয়া সাধারণ গৃহস্থের ন্যায় ঘর করেন নাই, তাঁহার সহিত কখন কোন দৈহিক সম্বন্ধ হয় নাই, অন্য দিকে আবার তাঁহাকে পরিত্যাগও করেন নাই। বরং তাঁহাকে নিকটে রাখিয়া স্নেহ উপদেশ ও নিজের দৃষ্টান্ত দ্বারা তাঁহাকে সহধর্মিণীর মতাে করিয়া গড়িয়া তুলিয়াছেন। ইহা তাঁহার জীবনের একটি বিশেষত্ব। 

কিন্তু বিশেষত্ব কেবল রামকৃষ্ণের নহে। তাঁহার পত্নী সারদামণি দেবীরও বিশেষত্ব আছে। সত্য বটে রামকৃষ্ণ সারদামণিকে শিক্ষাদি দ্বারা গডিয়া তুলিয়াছিলেন। কিন্তু যাহাকে শিক্ষা দেওয়া হয়, শিক্ষা গ্রহণ করিয়া তাহার দ্বারা উপকৃত ও উন্নত হইবার ক্ষমতা তাহার থাকা চাই। একই সুযোগ্য গুরুর ছাত্র তাে অনেক থাকে, কিন্তু সকলেই জ্ঞানী ও সৎ হয় না। সােনা হইতে যেমন অলঙ্কার হয়, মাটির তাল হইতে তেমন হয় না। 

এইজন্য সারদামণি দেবীর জীবন-কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাহার কোন জীবন চরিত নাই। পরমহংসদেবের জীবন-চরিতে প্রসঙ্গক্রমে সারদামণি দেবী সম্বন্ধে স্থানে স্থানে অল্প অল্প যাহা লিখিত আছে, তাহা দ্বারাই কৌতুহল-নিবৃত্তি করিতে হয়। সম্ভব হইলে রামকৃষ্ণ ও সারদামণির ভক্তদিগের মধ্যে কেহ এই মহীয়সী নারীর জীবন-চরিত ও উক্তি লিপিবদ্ধ করিবেন, এই অনুরােধ জানাইতেছি। হয়তাে একাধিক জীবন-চরিত লিখিত হইবে । তাহার মধ্যে একটি এমন হওয়া উচিত, যাহাতে সরল ও অবিমিশ্র ভাবে কেবল তাঁহার চরিত ও উক্তি থাকিবে, কোন প্রকার ব্যাখ্যা, টীকা-টিপ্পনী, ভাষ্য থাকিবে না। রামকৃষ্ণের এইরূপে একটি জীবন-চরিতের প্রয়ােজন। ইহা বলিবার উদ্দেশ্য এই যে, রামকৃষ্ণমণ্ডলীর বাহিরের লােকদিগের রামকৃষ্ণ ও সারদামণিকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ জ্ঞানবুদ্ধি অনুসারে বুঝিবার সুযোগ পাওয়া আবশ্যক। মণ্ডলীভূক্ত ভক্তদিগের জন্য অবশ্য অন্যবিধ জীবন-চরিত থাকিতে পারে। 

গৃহস্থাশ্রমে রামকৃষ্ণের নাম ছিল গদাধর। সাংসারিক বিষয়ে তাহার পূর্ণমাত্রায় উদাসীনতা ও নিরন্তর উদ্মনাভাব দূর করিবার জন্য তাঁহার “স্নেহময়ী মাতা ও অগ্রজ উপযুক্ত পাত্রী দেখিয়া তাঁহার বিবাহ দিবার পরামর্শ স্থির করেন।” 

“গদাধর জানিতে পারিলে পাছে ওজর আপত্তি করে, এজন্য মাতা ও পুত্রে পূর্বোক্ত পরামর্শ অন্তরালে হইয়াছিল। চতুর গদাধরের কিন্তু ঐ বিষয় জানিতে অধিক বিলম্ব হয় নাই। জানিতে পারিয়াও তিনি উহাতে কোন আপত্তি করেন নাই। বাটীতে কোন একটা অভিনব ব্যাপার উপস্থিত হইলে বালক-বালিকারা যেরুপ আনন্দ করিয়া থাকে, তদ্রুপ আচরণ করিয়াছিলেন।" 

চারিদিকের গ্রামসকলে লােক প্রেরিত হইল, কিন্তু মনােমত পাত্রীর সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন গদাধর বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামের শ্রীরামচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের কন্যার সন্ধান বলিয়া দেন। তাঁহার মাতা ও ভ্রাতা ঐস্থানে অনুসন্ধান করিতে লােক পাঠাইলেন, সন্ধান মিলিল। অল্পদিনেই সকল বিষয়ের কথাবার্তা স্থির হইয়া গেল। সন ১২৬৬ সালের বৈশাখের শেষভাগে শ্রীরামচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের পঞ্চমবর্ষীয়া একমাত্র কন্যার সহিত গদাধরের বিবাহ হইল। বিবাহে তিনশত টাকা পণ লাগিল। তখন গদাধরের বয়স তেইশ পূর্ণ হইয়া চব্বিশে চলিতেছে। 

গদাধরের মাতা চন্দ্রাদেবী “বৈবাহিকের মনস্তুষ্টি ও বাহিরের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য জমিদার বন্ধু লাহা বাবুদের বাটী হইতে যে গহনাগুলি চাহিয়া বধূকে বিবাহের দিনে সাজাইয়া আনিয়াছিলেন, কয়েকদিন পরে ঐগুলি ফিরাইয়া দিবার সময় যখন উপস্থিত হইল, তখন তিনি যে আবার নিজ সংসারের দারিদ্রচিন্তায় অভিভূত হইয়াছিলেন, ইহাও স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। নববধুকে তিনি বিবাহের দিন হইতে আপনার করিয়া লইয়াছিলেন। বালিকার অঙ্গ হইতে অলঙ্কারগুলি তিনি কোন প্রাণে খুলিয়া লইবেন, এই চিন্তায় বৃদ্ধার চক্ষু, এখন জলপূর্ণ হইয়াছিল। অন্তরের কথা তিনি কাহাকেও না বলিলেও গদাধরের উহা বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। তিনি মাতাকে শান্ত করিয়া নিদ্রিতা বধুর অঙ্গ হইতে গহনাগুলি এমন কৌশলে খুলিয়া লইয়াছিলেন যে, বালিকা উহার কিছুই জানিতে পারে নাই। বুদ্ধিমতী বালিকা কিন্তু নিদ্রা ভঙ্গ বলিয়াছিল, আমার গায়ে যে এইরুপ সব গহনা ছিল, তাহা কোথায় গেল ? চন্দ্রাদেবী সজলনয়নে তাহাকে ক্লোড়ে সান্ত্বনাপ্রদানের জন্য বলিয়াছিলেন, ‘মা! গদাধর তােমাকে ঐ সকলের অপেক্ষাও উত্তম অলঙ্কারসকল ইহার পর কত দিবে।" 

চন্দ্রাদেবী যে অর্থে এই কথাগুলি বলিয়াছিলেন, সে অর্থে না হইলেও অন্য অর্থে ভবিষ্যৎকালে কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইয়াছিল। 

“এইখানেই কিন্তু ঐ বিষয়ের পরিসমাপ্তি হইল না। কন্যার খুল্লতাত তাহাকে ঐদিন দেখিতে আসিয়া ঐকথা জানিয়াছিলেন এবং অসন্তোষ প্রকাশপূর্বক ঐদিনেই তাহাকে পিত্রালয়ে লইয়া গিয়া ছিলেন। মাতার মনে ঐ ঘটনায় বিশেষ বেদনা উপস্থিত হইয়াছে দেখিয়া গদাধর তাঁহার ঐ দুঃখ দূর করিবার জন্য পরিহাসচ্ছলে বলিয়াছিলেন, উহারা এখন যাই বলুক করুক না, বিবাহ তাে আর ফিরিবে না।" 

ইহার পর সন ১২৬৭ সালের অগ্রহায়ণ মাসে সারদামণি সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করিলে কুলপ্রথা-অনুসারে স্বামীর সহিত পিত্রালয় হইতে দুই ক্রোশ দূরবর্তী কামারপুকুর গ্রামে স্বশুরালয়ে আসিয়াছিলেন। 

অতঃপর বহু বৎসর রামকৃষ্ণ কামারপুকুরে ছিলেন না। ১২৭৪ সালে তিনি, যে ভৈরবী ব্রাক্ষণী তাঁহার সাধনে সহায়তা করিয়াছিলেন তাঁহার এবং ভাগিনেয় হৃদয়ের সহিত কামারপুকুরে আবার আগমন করেন। 

বহুকাল পরে তাঁহাকে পাইয়া এই দরিদ্র সংসারে এখন আনন্দের হাট-বাজার বসিল এবং নববধুকে আনাইয়া সুখের মাত্রা পূর্ণ করিবার জন্য রমণীগণের নির্দেশে জয়রামবাটী গ্রামে লােক প্রেরিত হইল। বিবাহের পর সারদামণি একবার মাত্র স্বামীকে দেখিয়াছিলেন। তখন তিনি সাত বৎসরের বালিকা মাত্র। সুতরাং ঐ ঘটনা সম্বন্ধে তাঁহার কেবল এইটুকু মনে ছিল যে, ভাগিনেয় হৃদয়ের সহিত রামকৃষ্ণ জয়রামবাটী আসিলে কোন নিভৃত অংশে লুকাইয়াও তিনি রক্ষা পান নাই। হৃদয় তাঁহাকে খুজিয়া বাহির করিয়া কোথা হইতে অনেকগুলি পদ্মফুল আনিয়া বালিকা মাতুলানী লজ্জা ও ভয়ে সঙ্কুচিতা হইলেও তাঁহার পা পূজা করিয়াছিল। ইহার প্রায় ছয় বৎসর পরে তাঁহার তের বৎসর বয়সের সময় তাঁহাকে শ্বশুরবাড়ি কামারপুকুর লইয়া যাওয়া হয়। সেখানে তিনি একমাস ছিলেন, কিন্তু রামকৃষ্ণ তখন দক্ষিণেশ্বরে থাকায় তাঁহার সহিত দেখা হয় নাই। উহার ছয় মাস আন্দাজ পরে আবার শ্বশুরবাড়ি আসিয়া দেড় মাস ছিলেন। তখন স্বামীর সহিত দেখা হয় নাই। তাহার তিন-চার মাস পর যখন তিনি বাপের বাড়িতে ছিলেন তখন খবর আসিল রামকৃষ্ণ আসিয়াছেন, তাঁহাকে কামারপকুরে যাইতে হইবে। তখন তাঁহার বয়স তের বৎসর ছয়-সাত মাস। 

রামকৃষ্ণ এই সময়ে একটি সুমহৎ কর্তব্য সাধনে যত্নবান হইলেন। পত্নীর তাঁহার নিকট আসা-না-আসা সম্বন্ধে রামকৃষ্ণ উদাসীন থাকিলেও যখন সারদামণি তাঁহার সেবা করিতে কামারপুকুরে উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি তাঁহাকে শিক্ষা দীক্ষাদি দিয়া তাঁহার কল্যাণসাধনে তৎপর হইলেন। 

রামকৃষ্ণকে বিবাহিত জানিয়া “শ্রীমদাচার্য তােতাপুরী তাঁহাকে এক সময় বলিয়াছিলেন, ‘তাহাতে আসে যায় কি? স্ত্রী নিকটে থাকিলেও যাহার ত্যাগ, বৈরাগ্য, বিবেক, বিজ্ঞান সর্বতােভাবে অক্ষুন্ন থাকে সেই ব্যক্তিই ব্রহ্মে যথার্থ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ; স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কেই যিনি সমভাব আত্মা বলিয়া সর্বক্ষণ দৃষ্টি ও তদনুরুপ ব্যবহার করতে পারেন; তাঁহারই যথার্থ, ব্ৰহ্ম বিজ্ঞান লাভ হইয়াছে, স্ত্রী পুরুষে ভেদদৃষ্টিসম্পন্ন অপর সকলে সাধক হইলেও ব্রহ্ম বিজ্ঞান হইতে বহু দুরে রহিয়াছে।” 

তােতাপুরীর এই কথা রামকৃষ্ণের মনে উদিত হইয়া তাঁহাকে দীর্ঘকালব্যাপী সাধনলব্ধ নিজের বিজ্ঞানের পরীক্ষায় এবং নিজ পত্নীর কল্যাণসাধনে নিযুক্ত করিয়াছিল। কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইলে তিনি কোন কাজ উপেক্ষা করিতে বা আধসারা করিয়া ফেলিয়া রাখিতে পারিতেন না। এ বিষয়েও তাহাই হইল। 

“ঐহিক পারত্রিক সকল বিষয়ে সর্বতােভাবে তাঁহার মুখাপেক্ষী বালিকা-পত্নীকে শিক্ষা প্রদান করিতে অগ্রসর হইয়া তিনি ঐ বিষয় অর্ধনিম্পন্ন করিয়া ক্ষান্ত হন না। দেবতা, গুরু ও অতিথি প্রভৃতির সেবা ও গৃহকর্মে যাহাতে তিনি কুশলা হয়েন, টাকার সদব্যবহার করতে পারেন এবং সর্বোপরি ঈশ্বরে সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া দেশকালপাত্রভেদে সকলের সহিত ব্যবহার করিতে নিপুনা হইয়া উঠেন, তদ্বিষয়ে এখন হইতে তিনি বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন।” 

চৌদ্দ বৎসর বয়সের সময় যখন সারদামণি দেবীর স্বামীর নিকট হইতে শিক্ষা লাভ আরম্ভ হয়, তখন তিনি স্বভাবতই নিতান্ত বালিকা-ভাব-সম্পন্ন ছিলেন। 

কামারপুকুর অঞ্চলের বালিকাদিগের সহিত কলিকাতার বালিকাদিগের তুলনা করিবার অবসর যিনি লাভ করিয়াছেন, তিনি দেখিয়াছেন কলিকাতা অঞ্চলের বালিকাদিগের দেহের ও মনের পরিণতি অল্প বয়সেই উপস্থিত হয়, কিন্তু কামারপুকুর প্রভৃতি গ্রামসকলের বালিকাদিগের তাহা হয় না। পবিত্র নির্মল গ্রাম্য বায়ুসেবন এবং গ্রামমধ্যে যথাতথা স্বচ্ছন্দ বিহারপূর্বক স্বাভাবিকভাবে জীবন অতিবাহিত করিবার জন্যই বােধহয় ঐরুপ হইয়া থাকে।” 

পবিত্ৰা বালিকা রামকৃষ্ণের দিব্য সঙ্গ ও নিঃস্বার্থ আদরযত্ন-লাভে ঐ কালে অনির্বচনীয় আনন্দে উল্লসিত হইয়াছিলেন। পরমহংসদেবের স্ত্রীভক্তদিগের নিকট তিনি ঐ উল্লাসের কথা অনেক সময় এইরূপে প্রকাশ করিয়াছেনঃ

“হৃদয় মধ্যে আনন্দের পূর্ণ ঘট যেন স্থাপিত রহিয়াছে--ঐকাল হইতে সর্বদা এইরূপ অনুভব করিতাম। সেই ধীর স্থির দিব্য উল্লাসে অন্তর কতদূর কিরূপ পূর্ণ থাকিত তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে!” 

কয়েক মাস পরে রামকৃষ্ণ যখন কামারপুকুর হইতে কলিকাতায় ফিরিলেন, সারদামণি তখন অত্যন্ত আনন্দ-সম্পদের অধিকারিণী হইয়াছেন--এইরূপ অনুভব করিতে করিতে পিত্রালয়ে ফিরিয়া আসিলেন। 

“উহা তাহাকে চপলা না করিয়া শান্তস্বভাবা করিয়াছিল, প্রগলভা না করিয়া চিন্তাশীলা করিয়াছিল, স্বার্থদৃষ্টনিবন্ধা না করিয়া নিঃস্বার্থ প্রেমিকা করিয়াছিল এবং অন্তর হইতে সর্বপ্রকার অভাববােধ তিরােহিত করিয়া মানব সাধারণের দুঃখকষ্টের সহিত অনন্তসমবেদনাসম্পন্না করিয়া ক্রমে তাঁহাকে সাক্ষাৎ প্রতিমায় পরিণত করিয়াছিল। মানসিক উল্লাস প্রভাবে অশেষ শারীরকি কষ্টকে তাঁহাব এখন হইতে কষ্ট বলিয়া মনে হইত না এবং আত্মীয়বর্গের নিকট হইতে আদর-যত্নের প্রতিদান না পাইলে মনে দুঃখ উপস্থিত হইত না। ঐরূপে সকল বিষয়ে সামান্য সন্তুষ্ট থাকিয়া বালিকা আপনাতে আপনি ডুবিয়া তখন পিত্রালয়ে কাল কাটাইতে লাগিলেন।” 

কিন্তু শরীর ঐ স্থানে থাকিলেও তাঁহার মন স্বামীর পদানুসরণ করিয়া এখন হইতে দক্ষিণেশ্বরেই উপস্থিত ছিল। তাঁহাকে দেখিবার এবং তাঁহার নিকট উপস্থিত হইবার জন্য মধ্যে মধ্যে মনে প্রবল বাসনার উদয় হইলেও তিনি উহা যত্নে সংবরণপূর্বক ধৈর্যবিলম্বন করিতেন; ভাবিতে প্রথম দর্শনে যিনি তাঁহাকে কৃপা করিয়া এতদূর ভালবাসিয়াছেন, তিনি তাঁহাকে ভুলিবেন না—সময় হইলেই নিজের নিকট ডাকিয়া লইবেন। | 

“ঐরুপ দিনের পর দিন যাইতে লাগিল এবং হৃদয়ে বিশ্বাস রাখিয়া তিনি ঐ শুভদিনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। আশাপ্রতীক্ষার প্রবল প্রবাহ বালিকার মনে সমভাবেই বহিতে লাগিল। তাঁহার শরীর কিন্তু মনের ন্যায় সমভাবে থাকিল না, দিন দিন পরিবর্তিত হইয়া সন ১২৭৮ সালের পৌষে তাঁহাকে অষ্টাদশবর্ষীয়া যুবতীতে পরিণত করিল। দেবতুল্য স্বামীর প্রথম সন্দর্শন জনিত আনন্দ তাঁহাকে জীবনের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ হইতে উচ্চে উঠাইয়া রাখিলেও সংসারে নিরাবিল আনন্দের অবসর কোথায় ?-গ্রামের পুরুষেরা জল্পনা করিতে বসিয়া যখন তাঁহার স্বামীকে ‘উন্মত্ত' বলিয়া নির্দেশ করিত, ‘পরিধানের কাপড় পর্যন্ত ত্যাগ করিয়া হরি হরি করিয়া বেড়ায় ইত্যাদি নানা কথা বলিত, অথবা সমবয়স্কা রমণীগণ যখন তাঁহাকে পাগলের স্ত্রী বলিয়া করুণা বা উপেক্ষার পাত্রী বিবেচনা করিত, তখন মুখে কিছু না বললেও তাঁহার অন্তরে দারুণ ব্যথা উপস্থিত হইত ; উন্মনা হইয়া তিনি তখন চিন্তা করিতেন-তবে কি পূর্বে যেমন দেখিয়াছিলাম তিনি সেরুপ আর নাই ? লােকে যেমন বলিতেছে, তাঁহার কি ঐরূপ অবস্থান্তর হইযাছে? বিধাতার নিবন্ধে যদি ঐরুপই হইয়া থাকে তাহা হইলে আমার তাে এখানে থাকা কর্তব্য নহে, পার্শ্বে থাকিয়া তাহার সেবাতে নিযুক্ত থাকাই উচিত। অশেষ চিন্তার পর স্থির করিলেন, তিনি দক্ষিণেশ্বরে স্বয়ং গমনপূর্বক চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করিবেন-পরে যাহা কর্তব্য বিবেচিত হইবে তদ্রুপ অনুষ্ঠান করিবেন।” 

ফাগুনের দোল-পণিমায় শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথিতে সারদামণি দেবীর দুরসম্পকীয়া কয়েকজন আত্মীয় এই বৎসর গঙ্গাস্নান করিবার নিমিত্ত কলিকাতা আসা স্থির করেন। তিনিও তাঁহাদের সঙ্গে যাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। তাঁহারা তাঁহার পিতাকে তাঁহার মত জিজ্ঞাসা করায় তিনি কন্যার এখন কলকাতা যাইবার অভিলাষের কারণ বুঝিয়া তাঁহাকে স্বয়ং সঙ্গে লইয়া কলিকাতা যাইবার বন্দোবস্ত করিলেন। জয়রামবাটী হইতে কলিকাতা রেলে আসা যাইত না, সুতরাং পালকিতে কিংবা পদব্রজে আসা ভিন্ন উপায় ছিল না। ধনী লোকেরা ভিন্ন অন্য সকলকে হাঁটিয়াই আসিতে হইত। অতএব কন্যা ও সঙ্গিগণের সহিত শ্রীরামচন্দ্র মুখােপাধ্যায় হাঁটিয়াই কলিকাতা অভিমুখে রওনা হইলেন। 

“ধানক্ষেত্রের পর ধানক্ষেত্র এবং মধ্যে মধ্যে কমলপূর্ণ দীর্ঘিকানিচয় দেখিতে দেখিতে, অশ্বথ, বট প্রভৃতি বৃক্ষরাজির শীতল ছায়া অনুভব করিতে করিতে তাঁহারা সকলে প্রথম দুই দিন সানন্দে পথ চলিতে লাগিলেন। কিন্তু গন্তব্যস্থল পৌঁছানাে পর্যন্ত ঐ আনন্দ রহিল না। পথশ্রমে অনভ্যস্ত কন্যা পথিমধ্যে একস্থানে দারুণ জ্বরে আক্রান্ত হইয়া শ্রীরামচন্দ্রকে বিশেষ চিন্তান্বিত করিলেন। কন্যার ঐরুপ অবস্থায় অগ্রসর হওয়া অসম্ভব বুঝিয়া তিনি চটিতে আশ্রয় লইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন।” 

প্রাতঃকালে উঠিয়া শ্রীরামচন্দ্র দেখিলেন, কন্যার জ্বর ছাড়িয়া গিয়াছে। পথি মধ্যে নিরুপায় হইয়া বসিয়া থাকা অপেক্ষা তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াই শ্রেয় মনে করিলেন। কন্যারও তাহাতে মত হইল, কিছুদূর যাইতে না যাইতে একটি পালকিও পাওয়া গেল। সারদামণি দেবীর আবার জ্বর আসিল। কিন্তু আগেকার মত জোরে না আসায় তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িলেন না এবং ঐ বিষয় কাহাকেও কিছু বলিলেনও না। রাত্রি নয়টার সময় সকলে দক্ষিণেশ্বরে, পেীছিলেন। 

সারদামণিকে এইরপ পীড়িত অবস্থায় আসিতে দেখিয়া রামকৃষ্ণ সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। 

‘ঠাণ্ডা লাগিয়া জ্বর বাড়িবে বলিয়া নিজগৃহে ভিন্ন শয্যায় তাঁহার শয়নের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন এবং দুঃখ করিয়া বারংবার বলিতে লাগিলেন, 'তুমি এতদিনে আসিলে ? আর কি আমার সেজবাবু, (মথুরবাবু) আছে যে তােমার যত্ন হবে?' ঔষধপথ্যাদির বিশেষ বন্দোবস্তে তিন-চার, দিনেই শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী আনােগ্যলাভ করিলেন।” 

ঐ তিন-চার দিন রামকৃষ্ণ তাঁহাকে দিনরাত নিজগৃহে রাখিয়া ঔষধপথ্যাদি সকল বিষয়ের স্বয়ং তত্ত্বাবধান করিলেন, পরে নহবতঘরে নিজ জননীর নিকট তাঁহার থাকিবার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। সারদামণি এখন বুঝিলেন, রামকৃষ্ণ আগে যেমন ছিলেন, এখনও তেমনি আছেন, তাঁহার প্রতি তাঁহার স্নেহ ও করুণা পূর্ববৎ আছে। তিনি প্রাণের উল্লাসে পরমহংদেব ও তাঁহার জননীর সেবায় নিযুক্ত হইলেন এবং তাঁহার পিতা কন্যার আনন্দে আনন্দিত হইয়া কয়েকদিন পরে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। 

রামকৃষ্ণ পত্নীর প্রতি কর্তব্যপালনে মনােনিবেশ করিলেন। অবসর পাইলেই, তিনি সারদামণিকে মানবজীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্য সম্বন্ধে সর্বপ্রকার শিক্ষা প্রদান করিতে লাগিলেন। শুনা যায়, এই সময়েই তিনি পত্নীকে বলিয়াছিলেন, “চাঁদা মামা যেমন সকল শিশুর মামা, তেমনি ঈশ্বর সকলেরই আপনার, তাঁহাকে ডাকিবার সকলেরই অধিকার আছে ; যে ডাকিবে, তিনি তাহাকেই দর্শনদানে কৃতার্থ করিবেন; তুমি ডাক তাে তুমিও তাঁহার দেখা পাইবে।” কেবল উপদেশ দেওয়াতেই রামকৃষ্ণের শিক্ষাপ্রণালী পর্যবসিত হইত না। তিনি শিষ্যকে নিকটে রাখিয়া, ভালবাসায় সর্বতোভাবে আপনার করিয়া লইয়া তাহাকে প্রথমে উপদেশ দিতেন; পরে শিষ্য উহা কাজে কতদূর পালন করিতেছে, সর্বদা সে বিষয়ে তীক্ষ দৃষ্টি রাখিতেন এবং ভ্রমবশতঃ সে বিপরীত অনুষ্ঠান করিলে, তাহাকে,বুঝাইয়া সংশােধন করিয়া দিতেন। সারদামণির সম্বন্ধেও এই প্রণালী অবদলম্বন করিয়াছিলেন। সামান্য বিষয়েও রামকৃষ্ণের এরূপ নজর ছিল যে, তিনি পত্মীকে বলিয়াছিলেন, “গাড়িতে বা নৌকায় যাবার সময় আগে গিয়ে উঠবে আর নামবার সময় কোন জিনিস নিতে ভুল হয়েছে কি-না, দেখেশুনে সকলের শেষে নামবে।” 

কথিত আছে, সারদামণি একদিন এই সময় স্বামীর পদসম্বাহন করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আমাকে তােমার কি বলিয়া বােধ হয় ?” রামকৃষ্ণ উত্তর দিয়াছিলেন, “যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়াছেন ও সম্প্রতি নহবতে বাস করিতেছেন এবং তিনিই এখন আমার পদসেবা করিতেছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রুপ বলিয়া তােমাকে সত্য দেখিতে পাই।” রামকৃষ্ণ সকল নারীর মধ্যে--অতি হীনচরিত্রা রমণীর মধ্যেও বিশ্বের জননীকে দেখিতেন। 

"উপনিষৎকার ঋষি যাজ্ঞবল্কা-মৈত্রেয়ী-সংবাদে শিক্ষা দিতেছেন--পতির ভিতর আত্মস্বরুপ শ্রীভগবান রহিয়াছেন বলিয়া স্ত্রীর পতিকে প্রিয় বােধ হয় ; স্ত্রীর ভিতর তিনি থাকাতেই, পতিব মন স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়া থাকে।” 

- (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৫ম ব্রাহ্মণ ) 

এই সময় রামকৃষ্ণ ও সারদামণি এক শয্যায় রাত্রিযাপন করিতেন। দেহ বােধ-বিরহিত রামকৃষ্ণের প্রায় সমস্ত রাত্রি এইকালে সমাধিতে অতিবাহিত হইত। এই সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া রামকৃষ্ণ যাহা বলিতেন, তাহাতে বুঝা যায় যে সারদামণি দেবীও যদি সম্পূর্ণ কামনাশূন্যা না হইতেন, তাহা হইলে রামকৃষ্ণের “দেহবুদ্ধি আসিত কি-না, কে বলিতে পারে ?” পৃথিবীর নানা কার্যক্ষেত্রে অনেক প্রসিদ্ধ ললাকের পত্নীদিগের সম্বন্ধে কথিত আছে যে, তাঁহারা উহাদের সহায় হইয়া উহাদের জীবন-পথ সর্ববিধ সাংসারিক বাধাবিঘ্ন. হইতে মুক্ত না রাখিলে, উহারা এত মহৎ কাজ করিতে পারিতেন না। অনেক মহান লােকের পত্নী কেবল যে পতিকে সংসারের খুটিনাটি ও নানা ঝঞ্জাট হইতে নিষ্কৃতি দেন তা নয়, অবসাদ, নৈরাশ্য ও বলহীনতার সময় তাঁহার হৃদয়ে শক্তি ও উৎসাহের সঞ্চার করিয়া থাকেন। আমাদের সমসাময়িক ইতিহাসে রামকৃষ্ণের সুস্পষ্ট মূর্তির অন্তরালে সারদামণি দেবীর মূর্তি এখনও ছায়ার ন্যায় প্রতীত হইলেও তিনি সাত্তিক প্রকৃতির নারী না হইলে রামকৃষ্ণও রামকৃষ্ণ হইতে পারিতেন কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কারণ আছে। 

বৎসরাধিক কাল অতীত হইলেও যখন রামকৃষ্ণের মনে একক্ষণের জনাও দেহ বুদ্ধির উদয় হইল না এবং যখন তিনি সারদামণি দেবীকে কখন জগন্মাতার অংশভাবে এবং কখন সচ্চিদানন্দস্বরপ আত্মা বা ব্রহ্মভাবে দৃষ্টি করা ভিন্ন অপর কোন ভাবে দেখিতে ও ভাবিতে সমর্থ হইলেন না, তখন রামকৃষ্ণ আপনাকে পরীক্ষোত্তীর্ণ ভাবিয়া ষোড়শীপূজার আয়ােজন করিলেন এবং সারদামণিদেবীকে অভিষেকপূর্বক পূজা করিলেন। পূজাকালের শেষদিকে সারদামণি বাহ্যজ্ঞান রহিতা ও সমাধিস্থা হইয়াছিলেন বলিয়া লিখিত আছে। 

ইহার পরও তিনি অহঙ্কতা হন নাই, তাঁহার মাথা বিগড়াইয়া যায় নাই। 

যােড়শীপূজার পর তিনি প্রায় পাঁচ মাস দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন। তিনি ঐ সময়ে পূর্বের ন্যায় রন্ধনাদি দ্বারা রামকৃষ্ণ ও তাঁহার জননীর এবং অতিথি-অভ্যাগতের সেবা করিতেন এবং দিনের বেলা নহবত ঘরে থাকিয়া রাত্রে স্বামীর শয্যা পার্শ্বে থাকিতেন। সকল প্রকারের খাদ্য ও রন্ধন রামকৃষ্ণের সহ্য হইত না বলিয়া অনেক সময়েই তাঁহার জন্য আলাদা রান্না করিতে হইত। সেই সময় দিবারাত্র রামকৃষ্ণের “ভাব-সমাধির বিরাম ছিল না” এবং কখন কখন “মৃতের লক্ষণসকল তাঁহার দেহে প্রকাশিত হইত।” কখন রামকৃষ্ণের সমাধি হইবে, এই আশঙ্কায় সারদামণির রাত্রিকালে নিদ্রা হইত না। এই কারণে তাঁহার নিদ্রার ব্যাঘাত হইতেছে জানিয়া রামকৃষ্ণ নহবত-ঘরে নিজের মাতার নিকটে তাঁহার শয়নের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। এইরূপে এক বৎসর চারি মাস দক্ষিণেশ্বরে থাকিয়া সারদামণি দেবী সম্ভবতঃ ১২৮০ সালের কার্তিক মাসে কামারপুকুরে ফিরিয়া আসেন। 

তখনকার কথা স্মরণ করিয়া সারদামণি দেবী উত্তরকালে স্ত্রী-ভক্ত-দিগকে বলিতেনঃ

‘সে যে কি অপূর্ব দিব্যভাবে থাকতেন, তা বলে বােঝাবার নয়। কখন ভাবের ঘােরে কত কি কথা, কখন হাসি, কখন কান্না, কখন একেবারে সমাধিতে স্থির হয়ে যাওয়া--এই রকম, সমস্ত রাত। সে কি এক আবির্ভাব আবেশ, দেখে ভয়ে আমার সর্বশরীর কাঁপত, আর ভাবতুম, কখন রাতটা পােহাৰে। ভাৰ সমাধির কথা তখন তাে কিছু বুঝি না ; একদিন তাঁর আর সমাধি ভাঙ্গে না দেখে ভয়ে কেঁদে কেটে হৃদয়কে ডেকে পাঠালাম। সে এসে কানে নাম শুনাতে শুনাতে তবে কতক্ষণ পরে তাঁর চৈতন্য হয়। তার পর ঐরপে ভয়ে কষ্ট পাই দেখে তিনি নিজে শিখিয়ে দিলেন-'এই রকম ভাব দেখলে এই বীজ শুনাবে। তখন আর তত ভয় হােত না, ঐ সৰ শুনালেই তাঁর আবার হুঁশ হোত 

সারদামণি দেবী বলিতেন-- 

“এইরুপে প্রদীপে শলতেটি কি ভাবে রাখিতে হইবে, বাড়ির প্রত্যেকে কে কেমন লােক ও কাহার সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, অপরের বাড়ি যাইয়া কিরুপ ব্যবহার করিতে হইবে, প্রভৃতি সংসারের সকল কথা হইতে ভজন, কীর্তন, ধ্যান, সমাধি ও ব্রহ্মজ্ঞানের কথা পর্যন্ত সকল বিষয় ঠাকুর তাঁহাকে শিক্ষা দিয়াছেন।” 

কলিকাতা প্রভৃতি স্থান হইতে অনেক ভদ্রমহিলা দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের দর্শনে আসিয়া নহবতখানায় সমস্ত দিন থাকিতেন। রামকৃষ্ণ ও তাঁহার জননীর জন্য রন্ধন ব্যতীত ইহাদের জন্য রান্নাও সারদামণি করিতেন। কখন কখন বিধবাদেয় জন্য গােবর গঙ্গাজল দিয়া তিনবার উনুনে পাড়িয়া আবার রান্না চড়াইতে হইত। 

একবার পানিহাটির মহােৎসব দেখিতে যাইবার সময় রামকৃষ্ণ জনৈক স্ত্রী ভক্তের দ্বারা সারদামণি দেবীকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন, তিনি যাইবেন কি না -“তােমরা তো যাইতেছ, যদি ওর ইচ্ছা হয় তাে চলুক।” সারদামণি দেবী ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “অনেক লোক সঙ্গে যাইতেছে, সেখানেও অত্যন্ত ভিড় ভিড় হইবে, অত ভিড়ে নৌকা হইতে নামিয়া উৎসব দর্শন করা আমার পক্ষে দুস্কর হইবে, আমি যাইব না।” তাঁহার এই না যাওয়ার সঙ্কল্পের উল্লেখ করিয়া, পরে রামকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন, অত ভিড় - তাহার উপর ভাব-সমাধির জন্য আমাকে সকলে লক্ষ্য করিতেছিল ও (সারদামণি) সঙ্গে না যাইয়া ভালই করিয়াছে, ওকে সঙ্গে দেখিলে লােকে বলিত-হংস-হংসী এসেছে। ও খুব বুদ্ধিমতী।” তারপর পত্নীর বুদ্ধির ও নির্লোভিতার দৃষ্টান্তস্বরূপে তিনি বলেন - 

“মাড়ােয়ারী ভক্ত (লছমীনারায়ণ) যখন দশ হাজার টাকা দিতে চাহিল তখন আমার মাথায় যেন করাত বসাইয়া দিল ; মাকে বলিলাম, “মা, এতদিন পরে আবার প্রলােভন দেখাইতে আসিলি।” সেই সময় ওর মন বুঝিবার জন্য ডাকাইয়া বলিলাম-“ওগাে, এই টাকা দীতে চাহিতেছে, আমি লইতে পারিব না বলিয়া তােমার নামে দিতে চাহিতেছে, তুমি উহা লওনা কেন ? কি বল ?” শুনিয়াই ও বলিল, তা কেমন করিয়া হইবে? টাকা লওয়া হইবে না-আমি লইলে, ঐ টাকা তােমারই হইবে। কারণ আমি উহা রাখিলে, তােমার সেবা ও অন্যান্য আবশ্যকে উহা ব্যয় না করিয়া থাকিতে পারি না। সুতরাং ফলে উহা তােমারই গ্রহণ করা হইবে। তােমাকে লােকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে তোমার ত্যাগের জনা—-অতএব টাকা কিছুতেই লওয়া হইবে না। ওর ঐ কথা শুনিয়া আমি হাঁপ ফেলিয়া বাঁচি।” 

যাঁহাকে দরিদ্রতাবশতঃ বিপদসঙ্কুল দুই-তিন দিনের পথ পদব্রজে অতিক্রম করিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাইতে হইত, ইহা সেইরূপ অবস্থার নারীর নিঃষ্পৃহতার সুবিবেচনারও অন্যতম দৃষ্টান্ত। |

 “সারদামণি দেবী পানিহাটির মহােৎসব দেখিতে না যাওয়ার কারণ সম্বন্ধে বলিয়াছেন--প্রাতে উনি আমাকে যে ভাবে যাইতে বলিয়া পাঠাইলেন তাহাতেই বুঝিতে পারিলাম, উনি মন খুঁলিয়া অনুমতি দিতেছেন না। তাহা হইলে বলিতেন—হাঁ, যাবে বই কি। ঐরূপ না করিয়া উনি ঐ বিষয়ের মীমাংসার ভার যখন আমার উপর ফেলিয়া বলিলেন, “ও ইচ্ছা হয় তাে চলুক', তখন স্থির করিলাম, যাইবার সঙ্কল্প ত্যাগ করাই ভাল।” 

সারদামণি দেবী বাঙালী হিন্দুকুলবধু, সুতরাং সাতিশয় লজ্জাশীলা ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের বাগানে নহবতখানায় তিনি দীর্ঘকাল স্বামীর ও অতিথি অভ্যাগতের সেবায় আত্মনিয়ােগ করিয়াছিলেন, কিন্তু তখন অল্পলােকেই তাহাকে দেখিতে পাইত। রাত্রি তিনটার পর কেহ উঠিবার বহু, পূর্বেই উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য স্নানাদি সমাপন করিয়া তিনি যে ঘরে ঢুকিতেন, সমস্ত দিবস আর বাহিরে আসিতেন না, কেহ উঠিবার বহু, পূর্বে নীরবে নিঃশব্দে আশ্চর্য ক্ষিপ্ৰকারিতার সহিত সকল কার্য সম্পন্ন করিয়া পুজা-জপ-ধ্যানে নিযুক্ত হইতেন। অন্ধকার রাত্রে নহবতখানার সম্মুখস্থ বকুলতলার ঘাটের সিঁড়ি বাহিয়া গঙ্গায় অবতরণ করিবার কালে তিনি এক দিবস এক প্রকাণ্ড কুম্ভীরের গাত্রে প্রায় পদার্পণ করিয়া ছিলেন। কুম্ভীর ডাঙ্গায় উঠিয়া সােপানের উপর শয়ন করিয়াছিল। তাঁহার সাড়া পাইয়া জলে লাফাইয়া পড়িল। তদবধি সঙ্গে আলাে না লইয়া তিনি কখন ঘাটে নামিতেন না। এইরূপ স্বভাব ও অভ্যাস সত্ত্বেও স্বামীর কঠিন কণ্ঠ রােগের চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুরে অবস্থানের সময় “এক মহল বাটীতে অপরিচিত পুরুষসকলের মধ্যে সকল প্রকার শারীরিক অসুবিধা সহ্য করিয়া তিনি যে ভাবে নিজ কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়।” ডাক্তারের উপদেশ মতাে সুপথ্য প্রস্তুত করিবার লােকাভাবে ঠাকুরের রােগবৃদ্ধির সম্ভাবনা হইয়াছে, শুনিবামাত্র সারদামণি দেবী আপনার থাকিবার সুবিধা অসুবিধার কথা কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া শ্যামপুকুরের বাটীতে আসিয়া ঐ ভার সানন্দে গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে থাকিয়া সব প্রধান সেবাকার্যের ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি তখনও রাত্রি তিনটার পবে শয্যাত্যাগ করিতেন, এবং রাত্রি এগারটার পর মাত্র দুইটা পর্যন্ত শয়ন করিয়া থাকিতেন। হিন্দকুল বধু, হইলেও তিনি প্রয়ােজন হইলে পূর্বসংস্কার ও অভ্যাসের বাধা অতিক্রম 
করিয়া প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সাহসের সহিত যথাযথ আচরণে কতদূর সমর্থা ছিলেন তাহার দৃষ্টান্ত-স্বরপে একটি ঘটনার বিবরণ দিতেছি। 

স্বল্পব্যয়সাধ্য যানের অভাব, অর্থাভাব প্রভৃতি নানা কারণে সেকালে সারদামণি দেবী অনেক সময় জয়রামবাটী ও কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে হাঁটিয়া আসিতেন। আসিতে হইলে পথিকগণকে চার-পাঁচ ক্লোশব্যাপী তেলােভােলো ও কৈকলার মাঠ উত্তীর্ণ হইতে হইত। ঐ বিস্তীর্ণ প্রান্তরদ্বয়ে তখন নরহত্যা ডাকাতদের ঘাঁটি ছিল। প্রান্তরের মধ্যভাগে এখনও এক ভীষণ কালীমূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। এই তেলোভেলোর ডাকাতে-কালীর পূজা করিয়া ডাকাতরা নরহত্যা ও দস্যুতায় প্রবৃত্ত হইত। এই কারণে লােকে দলবদ্ধ না হইয়া এই দুইটি প্রান্তর অতিক্রম করিতে সাহসী হইত না।

একবার রামকৃষ্ণের এক ভাইপাে ও ভাইঝি এবং অপর কয়েকটি স্ত্রীলােক ও পুরুষের সহিত সারদামণি দেবী পদব্রজে কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিতেছিলেন। আরামবাগে পেীঁছিয়া তেলাভেলাে ও কৈকলার প্রান্তর সন্ধ্যার পবে পার হইবার যথেষ্ট সময় আছে ভাবিয়া তাঁহার সঙ্গিগণ ঐ স্থানে অবস্থান ও রাত্রিযাপনে অনিচ্ছা প্রকাশ করিতে লাগিল। পথশ্রমে ক্লান্ত থাকিলেও সারদামণি দেবী আপত্তি না করিয়া তাঁহাদের সহিত অগ্রসর হইলেন। তাহারা বরাবর আগাইয়া গিয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া, তিনি নিকটে আসিলে আবার চলিতে লাগিলেন। শেষবার তাঁহারা বলিলেন, এইরূপে চলিলে এক প্রহর রাত্রির মধ্যেও প্রান্তর পার হইতে পারা যাইবে না এবং সকলকে ডাকাতের হাতে পড়িতে হইবে। এতগুলি লােকের অসুবিধা ও আশঙ্কার কারণ হইয়াছেন দেখিয়া তিনি তখন তাঁহাদিগকে তাঁহার নিমিত্ত পথিমধ্যে অপেক্ষা করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, “তোমরা একেবারে তারকেশ্বরের চটিতে পৌঁছে বিশ্রাম করগে, আমি যত শীঘ্র পারি তােমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি।” তাহাতে সঙ্গীরা বেলা বেশী নাই দেখিয়া জোরে হাঁটতে লাগিল ও শীঘ্র দৃষ্টির বহিভূত হইল। সারদামণি দেবীও ক্লান্তি সত্ত্বেও যথাসাধ্য দ্রুত চলিতে লাগিলেন, কিন্তু প্রান্তরমধ্যে পৌছিবার কিছু; পরেই সন্ধ্যা হইল। বিষম চিন্তিত হইয়া তিনি কি করিবেন ভাবিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন দীর্ঘাকার ঘােরতর কৃষ্ণবর্ণ এক পুরুষ লাঠি কাঁধে লইয়া তাঁহার দিকে আসিতেছে। তাহার পিছনেও তাহার সঙ্গীর মতাে কে যেন একজন আসিতেছে মনে হইল। পলায়ন বা চীৎকার বৃথা বুঝিয়া তিনি স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটা তাঁহার কাছে আসিয়া ককশস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে গা এসময়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছ ?” সারদামণি বলিলেন, “বাবা, আমার সঙ্গীরা আমাকে ফেলে গেছে, আমিও বােধ হয় পথ ভুলেছি ; তুমি আমাকে সঙ্গে করে যদি তাঁহাদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। তােমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণির কালীবাড়িতে থাকেন। আমি তাঁহার নিকট যাচ্ছি। তুমি যদি সেখান পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যাও তা হলে তিনি তােমার খুব আদরযত্ন করবেন।” এই কথাগুলি বলিতে না বলিতে পিছনের দ্বিতীয় লােকটিও তথায় আসিয়া পৌঁছিল এবং সারদামণি দেবী দেখিলেন সে লােকটি পুরুষটির পত্নী। তাহাকে দেখিয়া বিশেষ আশ্বস্ত হইয়া তিনি তাঁহায় হাত ধরিয়া তাহাকে বলিলেন, “মা, আমি তােমার মেয়ে সারদা, সঙ্গীরা ফেলে যাওয়ায় বিষম বিপদে পড়েছিলাম ; ভাগ্য বাবা ও তুমি এসে পড়লে, নইলে কি করতাম বলতে পারি নে।” 

সারদামণির এইরূপ নিঃসংঙ্কোচ সরল ব্যবহার, একান্ত বিশ্বাস ও মিষ্ট কথায় বাগদী পাইক ও তাহার স্ত্রীর প্রাণ একেবারে গলিয়া গেল। তাহারা সামাজিক আচার ও জাতির পার্থক্য ভুলিয়া সত্যসতাই তাঁহাকে আপনার কন্যার ন্যায় দেখিয়া তাঁহাকে খুব সান্তনা দিতে লাগিল এবং তিনি ক্লান্ত বলিয়া আর তাঁহাকে অগ্রসর হইতে না দিয়া নিকটস্থ গ্রামের এক দোকানে লইয়া গিয়া রাখিল। রমণী নিজ বস্ত্রাদি বিছাইয়া তাঁহার জন্য বিছানা করিয়া দিল এবং পুরুষটি দোকান হইতে মুড়ি-মুড়কি কিনিয়া তাহাকে খাইতে দিল। এইরূপে পিতামাতার ন্যায় আদর ও স্নেহে তাঁহাকে ঘুম পাড়াইয়া ও রক্ষা করিয়া তাহারা রাত কাটাইল এবং ভােরে উঠিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া তারকেশ্বরে পেীঁছিল। সেখানে এক দোকানে তাঁহাকে রাখিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। বাগদিনী তাহার স্বামীকে বলিল, “আমার মেয়ে কাল কিছুই খেতে পায় নি, বাবা তারকনাথের পূজা শীঘ্র সেরে বাজার হতে মাছ তরকারি নিয়ে এস ; আজ তাকে ভাল করে খাওয়াতে হবে।” 

বাগদী পুরুষটি ঐসব করিবার জন্য চলিয়া গেলে সারদামণি দেবীর সঙ্গী ও সঙ্গিনীগণ তাঁহাকে খুজিতে খুঁজিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং তিনি নিরাপদে পৌঁছিয়াছেন দেখিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন তিনি তাঁহার রাত্রে আশ্রয়দাতা বাগদী পিতামাতার সহিত তাঁহাদের পরিচয় করাইয়া দিয়া বলিলেন, “এরা এসে আমাকে রক্ষা না করলে কাল রাত্রে যে কি করতুম, বলতে পারি না।” 

তাহার পর সকলে আবার পথ চলা আরম্ভ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে সারদামণি দেবী ঐ পুরুষ ও রমণীকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাইয়া বিদায় প্রার্থনা করিলেন। তিনি বলিয়াছেন -

“এক রাত্রের মধ্যে আমরা পরস্পরকে এতদূর আপনার করিয়া লইয়াছিলাম যে, বিদায়গ্রহণকালে ব্যাকুল হইয়া অজস্র ক্রন্দন করিতে লাগিলাম। অবশেষে সুবিধামত দক্ষিণেশ্বরে আমাকে দেখতে আসিতে পুনঃ পুনঃ অনুরোধপুর্বক ঐকথা স্বীকার করাইয়া লইয়া অতিকষ্টে তাহাদিগকে ছাড়িয়া আসিলাম। আসিবার কালে তাহারা অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসিয়াছিল এবং রমণী পাশ্ববর্তী ক্ষেত্র হইতে কতকগুলি কড়াইশুটি তুলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আমার অঞ্চলে বাঁধিয়া কাতর কন্ঠে বলিয়াছিল, মা সারদা রাত্রে যখন মুড়ি খাবি তখন ঐগুলি দিয়ে খাস। পুবোক্ত অঙ্গীকার তাহারা রক্ষা করিয়াছিল। নানাবিধ দ্রব্য লইয়া আমাকে দেখিতে মধ্যে মধ্যে কয়েকবার দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। উনিও আমার নিকট হইতে সকল কথা শুনিয়া ঐ সময়ে তাহাদিগের সহিত জামাতার ন্যায় ব্যবহার ও আদর আপ্যায়নে তাহাদিগকে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন। এমন সরল ও সচ্চরিত্র হলেও আমার ডাকাত বাবা পূর্বে কখন কখন ডাকাইতি যে করিয়াছিল, একথা কিন্তু আমার মনে হয়।”

১২৯৩ সালের ৩১শে শ্রাবণ পরমহংসদেব দেহত্যাগ করেন। তখন সারদামণি দেবীর বয়স ৩৩ বৎসর। আমি শুনিয়াছিলাম, স্বামীর তিরােভাবে সারদামণি দেবী বিধবার বেশ ধারণ করেন নাই। ইহা সত্য কিনা জানিবার জন্য পরমহংসদেবের ও সারদামণি দেবীর একজন ভক্তকে চিঠি লিখিয়াছিলাম। তিনি উত্তর দিয়াছেন : 

“শ্রীশ্রীমৎ পরমহংসদেবের দেহরক্ষার সময় মা হাতের বালা খুলিতে গেলে শ্রীশ্রীপরমহংসদেবকে জীবিত অবস্থায় রােগহীন শরীরে যেমন দেখিয়াছিলেন, সেই মূর্তিতে আসিয়া মার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন---আমি কি মরিয়াছি যে তুমি এয়ােস্ত্রীর জিনিস হাত হইতে খুলিতেছ ? এই কথার পর মা আর কখন শুধু, হাতে থাকেন নাই--পরিধান লাল নরুন-পেড়ে কাপড় এবং হাতে বালা ছিল।” 

আত্মার অমরত্বে এইরুপ বিশ্বাস সকলের থাকিলে সংসারে অনেক দুঃখ পাপ তাপ দুর্গতি দূর হয়।

স্বামীর তিরােভাবে পর সারদামণি দেবী ৩৪ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন। তিনি ১৩২৭ সালের ৪ঠা শ্রাবণ ৬৭ বৎসর বয়সে পরলােকগমন করেন। তার পরবর্তী ভাদ্রমাসের উদ্বোধন’ পত্রে তাঁহার ব্রত, ত্যাগ, নিষ্ঠা, সংযম, সকলের প্রতি সমান ভালবাসা, সেবাপরায়ণতা, দিবারাত্র অক্লান্তভাবে কর্মনুষ্ঠান ও নিজ শরীরের সুখদুঃখের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা, তাঁহার সরলতা, নিরভিমানিতা, সহিষ্ণুতা, দয়া, ক্ষমা, সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থপরতা প্রভৃতি গুণ কীর্তিত হইয়াছিল। তাঁহার স্বামীর ও তাঁহার ভক্তেরা তাঁহাকে মাতৃসম্বোধন করিতেন এবং এখনও মা বলিয়াই তাঁহার উল্লেখ করেন। এই মাতৃসম্বোধন সার্থক হউক। 

[ সারদামণি দেবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত-রচনা আমার পক্ষে নানা কারণে সহজ হয় নাই। তাঁহাকে প্রণাম করিবার ও তাঁহার সহিত পরিচিত হইবার সৌভাগ্য আমার কখনও না হওয়ায় তাঁহার সম্বন্ধে আমার সাক্ষাৎ কোন জ্ঞান নাই। পুস্তক ও পত্রিকা হইতে আমাকে তাঁহার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করিতে হইয়াছে। কিন্তু তাহা হইতেও যথেষ্ট সাহায্য পাই নাই। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ আমার প্রধান অবলম্বন। ছােট অক্ষরে যাহা ছাপা হইয়াছে, তাহা ছাড়া অন্য অনেক স্থলেও ঐ পুস্তকের ভাষা পর্যন্ত গৃহীত হইয়াছে। উদ্বোধন’ হইতেও অল্প সাহায্য পাইয়াছি। ইহার দুটি প্রবন্ধে ভক্তি-উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁহার নানা গুণের বন্দনা আছে। যে-সকল কথায়, কাজে, ঘটনায়, আখ্যায়িকায় ঐ সকল গুণ প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহা কিছু কিছু লিখিত হইলে ভাল হয়। যাহাতে মানুষের অন্তরের পরিচয় পাওয়া যায় এমন কোনও কথা, কাজ, ঘটনা, আখ্যায়িকা তুচ্ছ নহে। কাহারও জীবন্ত ছবি মানুষের নিকট উপস্থিত করিতে হইলে এগুলি আবশ্যক। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ ব্যতীত সারদামণি দেবীর যে-সকল ফটোগ্রাফ হইতে ছবি প্রস্তুত করাইয়াছি, সেইগুলির এবং কয়েকটি সংবাদের জন্যও আমি ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথের নিকট ঋণী। তাঁহাকে তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

{ প্রবাসী, বৈশাখ, ১৩৩১) 

শ্রীরামানন্দ চট্টোপাধ্যায় 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রীমতী ৺সরযু বালা 

প্রথম দর্শন-১৩১৭ 
কলিকাতা পটলডাঙার বাসায় শুক্রবার সকালে শ্রীমান - ব’লে গেল, কাল শনিবার মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে যাব; আপনি তৈরী হয়ে থাকবেন।" কাল তবে মায়ের দর্শন পাব! সারা রাত আমার ঘুমই এল না। আজ ১৩১৭ সন, প্রায় চৌদ্দ-পনর বৎসর হয়ে গেল কলিকাতায় আছি, এত কাল পরে মায়ের দয়া হ’ল কি? এত দিনে কি সুযােগ মিলল? পরদিন বৈকালে গাড়ি করে সুমতিকে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় হতে নিয়ে শ্রীশ্রীমায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে চললুম। কি আকুল আগ্রহে গিয়েছিল, তা ব্যক্ত করার ভাষা জানি না। গিয়ে দেখি মা বাগবাজারে তাঁর বাড়িতে ঠাকুরঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এক পা চৌকাঠের উপর, অপর পা পাপােশখানির ওধারে ; মাথায় কাপড় নেই, বাঁ হাত খানি উচু করে দরজার উপর রেখেছেন, ডান হাতখানি নীচুতে, গায়েরও অধাংশে কাপড় নেই, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। গিয়ে প্রণাম করতেই পরিচয় নিলেন। সুমতি বললে, “আমার দিদি।” সে পূর্বে কয়দিন গিয়েছিল; তখন মা একবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, “এই দেখ মা, এদের নিয়ে কি বিপদে পড়েছি। ভাই-এর বউ, ভাইঝি, রাধু, সব জ্বরে পড়ে। কে দেখে, কে কাছে বসে, ঠিক নেই। বস, আমি কাপড় কেচে আসি।” আমরা বসলুম। কাপড় কেচে এসে দুই হাত ভরে জিলিপি-প্রসাদ এনে দিয়ে বললেন, “বৌমাকে (সুমতি) দাও, তুমিও নাও।” সুমতিকে শীঘ্র স্কুলে ফিরতে হবে, তাই সে দিন একটু পরেই প্রণাম করে বিদায় নিলাম। মা বললেন, “আবার এস।” এই পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা, আশা মিটল না! অতৃপ্ত প্রাণে বাসায় ফিরলাম। 
৩০শে মাঘ, ১৩১৭
শ্রীশ্রীমা সে দিন বলরামবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন। আমি তার বাগবাজারের বাড়িতে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতেই মা ফিরলেন। প্রণাম করে উঠতেই হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কার সঙ্গে এসেছ?” 

আমি বললুম, “আমার এক ভাগ্নের সঙ্গে।” 

মা , { আছ ? বৌমা ভাল আছে? এত দিন আস নি-ভাবছিলুম অসুখ করল না কি। 
বিস্মিত হয়ে ভাবলুম একদিন মাত্র পাঁচ মিনিটের দেখা, তাতে মা আমাদের কথা মনে করেছেন ! ভেবে আনন্দে চোখে জলও এল। 

মা -  (আমার পানে সস্নেহে চেয়ে) তুমি এসেছ, তাই ওখানে (বলরাম বাবুর বাড়িতে বসে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। 

আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলুম ! 

মায়ের একটি শিশু ভাইপাের (ক্ষুদের) জন্য সুমতি দুটি পশমের টুপি দিয়েছিল ; মাকে উহা দিতে এই সামান্য জিনিসের জন্য কতই খুশী হলেন। তক্তাপােশের উপর বসে বললেন, “ব’স এখানে, আমার কাছে।” পাশেই বসলুম, মা আদর করে বললেন, “তােমাকে যেন মা, আরও কত দেখেছি -- যেন কত দিনের জানাশােনা।” 

আমি বললুম, “কি জানি, মা, এক দিন তাে কেবল পাঁচ মিনিটের জন্য এসেছিলাম।” 

মা হাসতে লাগলেন ও আমাদের দুই বােনের অনুরাগ-ভক্তির অনেক প্রশংসা করলেন। আমরা কিন্তু ঐ সকল কথার কতদূর যােগ্য তা জানি না। ক্রমে ক্রমে অনেক শ্রী-ভক্ত আসতে লাগলেন। ভক্তি-বিগলিত চিত্তে সকলেই মায়ের হাসিমাখা স্নেহভরা মুখখানির পানে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন, ওরূপ দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি। মুগ্ধ হয়ে তাই দেখছি, এমন সময় বাসায় ফিরবার অগিদ এল-গাড়ি এসেছে। মা তখন উঠে প্রসাদ দিয়ে ‘খাও খাও’ করে একেবারে মুখের কাছে ধরলেন। অত লােকের মধ্যে একলা অমন করে খেতে আমার লজ্জা হচ্ছে দেখে বললেন, “লজ্জা কি ? নাও।” তখন হাত পেতে নিলুম। “তবে আসি, মা,” বলে প্রণাম করে বিদায় নেবার সময় বললেন, “এস মা, এস, আবার এস। একলা নেমে যেতে পারবে তাে ? আমি আসব ?” এই বলে সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। তখন আমি বললাম, “আমি যেতে পারব মা। আপনি আর আসবেন না।” মা তাই শুনে বললেন, “আচ্ছা, একদিন সকালে এস।” পরিপূর্ণ প্রাণে ফিরলুম। ভাবলুম—এ কি অদ্ভুত স্নেহ। 

বৈশাখ-সংক্রান্তি ১৩১৮ 

আজ গিয়ে প্রণাম করতেই মা বললেন, “এসেছ মা, আমি মনে করছি কি হল গাে, কেন আসে না। এতদিন আসনি কেন?”

আমি বললুম, “এখানে ছিলুম না, মা, বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম।” 

মা - বৌমা (সুমতি) আসে না কেন? পড়াশুনার চাপে ? 

আমি - না, ভগ্নীপতি এখানে ছিলেন না। 

মা - তা, ও তো ইস্কুলে যাচ্ছে । আচ্ছা, ওরা সংসার ধর্ম করে তো ? 

আমি বললুম, “কাকে বলে সংসার, কাকে বলে ধর্ম, তা কি জানি মা-~ আপনিই জানেন।” মা একটু হাসলেন। 

মা ‘কি গরম পড়েছে!’ বলে বাতাস খেতে পাখাখানা হাতে দিয়ে বললেন, “আহা, দুটো ভাত খেয়েই ছুটে আসছ—এখন আমার কাছে একটু শোও।” 

মাকে নীচে মাদুর পেতে দিয়েছে। তাঁর বিছানায় শুতে সঙ্কুচিত হচ্ছি দেখে বললেন, “তাতে কি মা, শােও, আমি বলছি শােও।” অগত্যা শুলুম। মার একটু তন্দ্রা আসছে দেখে চুপ করে আছি এমন সময় দুই-একটি স্ত্রী-ভক্ত এবং শেষে দু’জন সন্ন্যাসিনী এলেন। একজন প্রৌঢ়া, অপরটি যুবতী। মা চোখ বুজেই বলছেন, “কে গাে, গৌরদাসী এলে?” 

যুবতী বললেন, “আপনি কি করে জানলেন, মা?” 

মা বললেন, “টের পেয়েছি। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসলেন। 

যুবতী বললেন, “বেলুড় মঠে গিয়েছিলাম। প্রেমানন্দ স্বামীজী খুব খাইয়ে দিয়েছেন, তিনি থাকলে তাে না খেয়ে ফিরবার উপায় নেই।” যুবতী সিন্দুর পরেন নি দেখে মা তাঁকে একটু বকলেন। 

পরে শ্রীশ্রীমায়ের কাছে আমার পরিচয় নিয়ে গৌরীমা একদিন তাঁদের আশ্রমে আমাকে যেতে বলে বললেন, “সেখানে প্রায় ৫০l৬০ জন মেয়েকে শিক্ষা দেওয়া হয়। তুমি সেলাই জান?” আমি সামান্য কিছু জানি বলাতে তিনি তাঁর আশ্রমের মেয়েদের তাই শিখিয়ে আসতে বললেন। 

মায়ের আদেশ নিয়ে গৌরীমার আশ্রমে একদিন গেলুম। তিনি খুব স্নেহ যত্ন করলেন এবং প্রত্যহ দুই এক ঘণ্টা করে এসে মেয়েদের পড়িয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। আমি বললাম, এই সামান্য শিক্ষা নিয়ে শিক্ষয়িত্রী হওয়া যায় না। ক, খ পড়তে বলেন তাে পারি।” গৌরীমা কিন্তু একেবারে নাছোড়। অগত্যা স্বীকৃত হয়ে আসতে হল। 

একদিন স্কুলের ছুটি হলে গৌরীমার আশ্রম হতে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে গেলুম। গ্রীষ্মকাল। সেদিন একটু পরিশ্রান্তও হয়েছিলুম। দেখি, মা একঘর শী-ভক্তের মধ্যে বসে আছেন। আমি গিয়ে প্রণাম করতেই মূখপানে চেয়ে মশারির উপর হতে তাড়াতাড়ি পাখাখানি নিয়ে আমায় বাতাস করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন, “শীগগির গায়ের জামা খুলে ফেল, গায়ে হাওয়া লাগুক।” কি অপূর্ব স্নেহ-ভালবাসা ! অত লােকের মধ্যে এত আদর-যত্ন ! আমার ভারি লজ্জা করতে লাগল—সবাই চেয়ে দেখছিল ; মা নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছেন দেখে জামা খুলতেই হল। আমি যত বলি, “পাখা আমাকে দিন, আমি বাতাস খাচ্ছি,” ততই স্নেহভরে বলতে লাগলেন, “তা হােক, হােক; একটু ঠাণ্ডা হয়ে নাও!” তারপর প্রসাদ ও এক গ্লাস জল এনে খাইয়ে তবে শান্ত হলেন। স্কুলের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাই দু-একটি কথা কয়েই সেদিন ফিরতে হল। 
১৮ই শ্রাবণ, ১৩১৮ 

আজ সকালে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে দীক্ষা নেবার আকাঙক্ষায় গেলাম। কি কি দ্রব্যের দরকার হয়, তা গৌরীমার নিকট জেনে তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম। মায়ের বাড়ি গিয়ে দেখি -  মা তদগতচিত্তে ঠাকুরপুজা করছেন, আমরা যাবার একটু পরে চেয়ে ইঙ্গিতে বসতে বললেন। পূজাশেষ হ'লে গৌরীমা আমার দীক্ষার কথা বললেন। পূর্বে মার সঙ্গে একদিন আমারও ঐ বিষয়ে কথা হয়েছিল। মর্তমান কলা নিয়ে গেছি, মা দেখে বললেন, “এই যে মর্তমান কলা এনেছ। { একজন সাধুর নাম করে) সে কলা খেতে চেয়েছিল, বেশ করেছ।” পরে বললেন, “ঐ আসনখানা নিয়ে আমার বাঁ দিকে এসে বস।” 

আমি বললুম “গঙ্গাস্নান তাে করা হয় নি।” 

মা - তা হােক। কাপড়চোপড় তাে ছেড়ে এসেছ ?” 

কাছে বসলুম। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। মা তখন ঘর হতে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “স্বপ্নে কি পেয়েছ ব’ল।” 

আমি বললুম, “লিখে দেব, না মুখে বলব?” 

মা - মুখেই ব’ল। 

দীক্ষার শেষ সময় শ্রীশ্রীমা স্বপ্নে প্রাপ্ত মন্ত্রের অর্থ বলে দিলেন। বললেন, “আগে ঐটি জপ করবে।” পরে তিনি আর একটি বলে দিয়ে বললেন, “শেষে এইটি জপ ও ধ্যান করবে।” 

মন্ত্রটির অর্থ বলবার পূর্বে মাকে কয়েক মিনিটের জন্য ধ্যানস্থ হতে দেখে ছিলুম। মন্ত্র দেবার সময় আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল এবং কেন বলতে পারি না, কাঁদতে লাগলুম। মা কপালে বড় করে একটা রক্ত-চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিলেন। দক্ষিণা ও ঠাকুরের ভােগের জন্য কিছু টাকা দিলুম। শ্রীশ্রীমা পরে গােলাপ-মাকে ডেকে ভােগের টাকা তাঁর হাতে দিলেন। 

দীক্ষার সময় মাকে খুব গম্ভীর দেখলুম। পরে পূজার আসন হতে মা উঠে গেলেন। আমাকে বললেন, “তুমি খানিক ধ্যান, জপ ও প্রার্থনা কর।” আমি ঐরূপ করবার পরে উঠে মাকে প্রণাম করতেই মা আশীর্বাদ করলেন “ভক্তি লাভ হােক।” মনে মনে মাকে বললুম, “দেখাে মা, তােমার কথা মনে রেখো, ফাঁকি দিও না যেন।” 

শ্ৰীশ্ৰীমা এইবার গঙ্গাস্নানে যাবেন -গােলাপ-মা সঙ্গে। আমিও মায়ের কাপড়-গামছা নিয়ে সঙ্গে গেলুম। স্নানের জন্য মা গঙ্গায় নেমেছেন, এমন সময় অল্প অল্প বৃষ্টি আরম্ভ হল। স্নান করে উঠে ঘাটের পাণ্ডা-ব্রাহ্মণকে একটি কলা, একটি আম ও একটি পয়সা দিয়ে মা বললেন, ‘ফল আমি দিলুম বটে, কিন্তু দানের ফল তােমার।” হায়! পাণ্ডাঠাকুর, জান না কার হাতের দান আজ পেলে! আর কত বড় কথা শুনলে! কোটি কামনায় জড়িত মানুষ আমরা ঐ দেববাণীর মর্ম কি বুঝব ! 

আমার কাছ থেকে কাপড়খানি নিয়ে, পরে ভিজে কাপড়খানি আমার হাতে দিয়ে মা বললেন, “চল।” গােলাপ-মা আগে, মা মাঝে, আমি পেছনে চললুম। ছােট একটি ঘটিতে গঙ্গাজল নিয়ে মা রাস্তার ধারে প্রতি বটবৃক্ষে জল দিয়ে প্রণাম করে যেতে লাগলেন। মা তখন রাজার ঘাটে স্নান করতেন। কারণ নূতন, ঘাট (দূর্গাচরণ মুখার্জীর ঘাট) তখনও হয়নি। গােলাপ-মা ছােট একটি ঘড়ায় গঙ্গাজল নিয়ে এসেছিলেন, বাড়িতে ফিরে উহা ঠাকুরঘরে রাখতে গেলেন। নীচের কলতলায় চৌবাচ্চার কাছে একটা ঘটিতে জল ছিল, মা তাই দিয়ে পা ধুয়ে আমায় বললেন, “কাদা লেগেছে, ধুয়ে এস।” আমি জল খুঁজছি দেখে বললেন, “ঐ ঘটির জলেই ধােও না।” 

আমি বললুম, “আপনি যে ও জল ছুঁয়েছেন। 

মা - আগে একটু মাথায় দিয়ে নাও, তা হলেই হবে। 

আমার কিন্তু মন সরল নয়, বললুম “তা কি হয় ? আমি আর একটা পাত্র এনে চৌবাচ্চা হতে জল নিয়ে পা ধুয়ে নিলুম। মা ততক্ষণ আমার জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর উপরে গিয়ে ঠাকুরের প্রসাদ দু’খানি শালপাতায় সাজিয়ে নিজে একখানি নিলেন এবং আমাকে একখানি দিয়ে কাছে বসে খেতে বললেন। আমি প্রসাদ পাবার পবে মায়ের চরণামৃত পাবার আকাঙ্ক্ষা জানাতে মা বললেন, “তবে জালা হতে একটু কলের জল নিয়ে এস” এবং আমি উহা আনলে পাত্রটি আমাকে হাতে করে ধরে রাখতে বলে নিজে বাম ও দক্ষিণ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ জলে দিয়ে কি বলতে লাগলেন—বুঝতে পারলুম না, শুধু; ঠোঁট নড়তে দেখলুম। শেষে বললেন, “নাও এখন।” আমি নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করে উহা পান করলাম। তারপর খেতে খেতে প্রত্যেক জিনিসটি নিজে এক একটু খেয়ে আমার পাতে দিতে লাগলেন।

ক্রমে অনেকগুলি স্ত্রী-ভক্তের আগমন হ’ল। কাউকেই চিনি না। শুনলুম —তাঁরা সকলেই এখানে প্রসাদ পাবেন। ঠাকুরের ভােগের পর আমরা সকলে প্রসাদ পেতে বসলুম। মাও তাঁর নিদিষ্ট আসনে এসে বসলেন। তিনবার অন্ন মুখে দিয়ে মা আমাকে ডাকলেন এবং আমার হাতে প্রসাদ দিলেন। প্রসাদ গ্রহণ করলুম। কি যে একটি সুগন্ধ পেলুম এখনও সে কথা ভাবলে অবাক হই। তারপর একে একে সকলের পাতেই মার প্রসাদ বিতরিত হল। গােলাপ মা সকলকে দিয়ে শেষে নিজে খেতে বসলেন। মা এইবার খুব হাসিখুশি গল্প সল্প করতে করতে খেতে লাগলেন। তাই দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাচলুম। দীক্ষার সময় হতে এতক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে যেন আর এক মা মনে হচ্ছিল। সে কি গম্ভীর, অন্তর্মুখী নিগ্রহানুগ্রহসমর্থী দেবীমূর্তি ! ভয়ে জড়সড় হয়েছিলুম। পরে কত লােককে দীক্ষা দিতে দেখেছি, দু-চার মিনিটেই হয়ে গেছে, কিন্তু সেরূপ গম্ভীর ভাব তাঁর আর কখন দেখিনি। কতজনকে হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে বা বসে দীক্ষা দিয়েছেন। তারা খুশি হয়ে তখনই তৃপ্ত হয়ে চলে গেছে। কৌতুহলাক্রান্ত হয়ে কাউকে বা জিজ্ঞাসাই করে ফেলেছি, “দীক্ষার সময় মায়ের কেমন রুপ দেখলেন ?” একটি বিধবা স্ত্রী-ভক্ত আমার ঐ প্রশ্নে বলেছিলেন, “এই এনিই।” আমি পূর্বে কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলুম-পরে মায়ের কথা শুনে এখানে দীক্ষা নিতে এসেছি। পূর্বে কুলগুরু, যেটি দিয়েছেন, মা আমাকে সেটি রােজ প্রথমে দশবার জপ করে নিতে বললেন-পরে নিজে যেটি দিয়েছেন সেটি দিয়ে ঠাকুরকে দেখিয়ে বললেন, “উনি গুরু; (অন্য এক মূর্তি দেখিয়ে) আর ইনি ইষ্ট’, আর এই বলে প্রার্থনা করতে বললেন যে ‘ঠাকুর, আমার পূর্বজন্মের, ইহজন্মের কুকর্মের ভার তুমি নাও’ ইত্যাদি। আমার কি হয়েছে বলুন তাে, যখনই জপ করতে বসি, আধ ঘণ্টার বেশী জপ করতে পারি নে, কে যেন ঠেলা দিয়ে তুলে দেয়। আপনাদের এমন হয় ? ভাবি মার কাছে কত কথা বলি—কিছুই বলতে পারি নে। আপনারা তো বেশ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মা কি আমাকে ফাঁকি দিলেন ?” আমি কিন্তু অত কথা জানতে চাইনি, স্ত্রীলােকটির প্রায় প্রৌঢ়াবস্থা-সরল ভাবেই নিজেই বলে যাচ্ছেন। আমি বললুম, “যা আপনার ইচ্ছা হবে মায়ের কাছে বলুন না, দু-চার দিন বলতে বলতে সহজ হয়ে আসবে। আমরাও প্রথম প্রথম অত কথা বলতে পারিনি। এখনও এক এক সময় এমন গম্ভীরভাব ধারণ করেন, কাছেই এগুনাে যায় না।” 

বেলা পড়ে আসতে সমাগত ভক্ত-মহিলাগণ শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে একে একে বিদায় নিতে লাগলেন, কেহ বা আরতি দেখে যাবেন বললেন। শ্রীশ্রীমা কাপড় কেচে এসে ঠাকুরের বৈকালী ভােগ দিয়ে প্রত্যেককে প্রসাদ দিলেন। 

ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। মা রাধু, মাকু প্রভৃতিকে ঠাকুরঘরে এসে জপ করতে বসতে বললেন। তারা আসতে বিলম্ব করায় মা অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, “সন্ধ্যার সময় এখন এসে সব জপ টপ করবে, না কোথায় কি করছে দেখ।” একটু পরে তারা এসে জপ করতে বসল। 

পূজনীয় গােলাপ-মা, যোগীন-মা প্রভৃতি এসে সন্ধ্যাকালে ভক্তিভরে শ্রীশ্রীমায়ের পদধুলি গ্রহণ করলেন, মা তাঁদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কারও বা চিবুক স্পর্শ করে চুমাে খেলেন, আবার হাতজোড় করে নমস্কারও করলেন। তারপর ঠাকুরপ্রণাম করে একখানি আসন পেতে জপে বসলেন। সন্ধ্যারতির উদ্যোগ হচ্ছে, শ্ৰীশ্ৰীমা কিছুক্ষণ পরে জপ শেষ করে উঠলেন। বাসা হতে একটি ছেলে নিতে এসেছে, মায়ের কাছে বিদায় নিতে গিয়ে বললুম, “মা, কই সেদিনকার সেই কাপড়খানি তাে পরলেন না?” 

মা বললেন, “তাই তাে মা, তখন মনে করে দিলে কই ?” প্রণাম করে বাসায় ফিরলাম। 

স্কুলের কাজের জন্য শীঘ্র আর মায়ের কাছে যেতে সময় পাইনি। অনেক দিন পরে আজ আবার মায়ের পদপ্রান্তে গিয়ে বসতেই মা কত আনন্দ করতে লাগলেন। ভূদেব মহাভারত পড়ছিল। ছেলেমানুষ, পড়তে দেরি হচ্ছিল, মাকে এখন শীঘ্র উঠতে হবে, কারণ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। সেজন্য তিনি ভুদেবকে বললেন, “একে দে, এ জলের মতাে পড়ে দেবে এখন, এ অধ্যায় শেষ না করে তাে উঠতে পারব না।" মায়ের আদেশে মহাভারত পড়তে বসলুম। এর পূর্বে আর কখনও মায়ের কাছে পড়িনি। কেমন লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। যা হােক, কোন প্রকারে অধ্যায় শেষ হ’ল। মহাভারতকে মা হাতজোড় করে প্রণাম করে উঠে পড়লেন এবং আমরা সকলে ঠাকুরঘরে আরতি দেখতে গেলুম। মা নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে জপে বসলেন। 

জপান্তে হরিবােল হরিবােল করে উঠে ঠাকুরপ্রণাম করে সকলকে প্রসাদ দিলেন। কথায় কথায় কর্মের কথা উঠল। মা বললেন, “সর্বদা কাজ করতে হয়। কাজে দেহ-মন ভাল থাকে। আমি যখন আগে জয়রামবাটী ছিলাম, দিনরাত কাজ করতুম। কোথাও কারাে বাড়ি যেতুম না। গেলেই লোকে বলত, ‘ও মা, শ্যামার মেয়ের ক্ষ্যাপা জামাই-এর সঙ্গে বে হয়েছে। ঐ কথা শুনতে হবে বলে কোনখানে যেতুম না। একবার সেখানে আমার কি অসুখই করেছিল -কিছুতেই সারে না। শেষে মা সিংহবাহিনীর দুয়ারে হত্যে দিয়ে তবে সারে। বড় জাগ্রত দেবতা, সেখানকার মাটি কৌটায় করে রেখেছি। নিজে খাই এবং রাধুকে রােজ সেই মাটি একটু করে খেতে দিই।”

মায়ের বাড়ির সামনের মাঠে নানা দেশের কতকগুলাে স্ত্রী-পুরুষ বাস করে। নানা প্রকার কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তার মধ্যে একজনের উপপত্নী ছিল, উভয়ে একতেই বাস করত। ঐ উপপত্নীর কঠিন পীড়া হয়েছিল। মা ঐকথার উল্লেখ করে বললেন, “কি সেবাটাই করেছে মা, এমন দেখিনি। একেই বলে সেবা, একেই বলে টান।” এই বলে ঐরূপে তার সেবার কতই সুখ্যাতি করতে লাগলেন। উপপত্নীর সেবা! আমরা উহা দেখলে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করতুম, সন্দেহ নাই। মন্দের মধ্য হতেও ভালটুকু যে নিতে হয়, তা কি আমরা জানি !

সামনের মাঠের ঘর হতে একটি দরিদ্রা হিন্দুস্থানী নারী তার রুগ্ন শিশুকে কোলে করে মায়ের আশীর্বাদ নিতে এসেছে। তার প্রতি মায়ের কি দয়া ! আশীর্বাদ করলেন, “ভাল হবে।” তারপর দুটো বেদানা ও কতকগুলো আঙুর ঠাকুরকে দেখিয়ে এনে তাকে দিতে বললেন। আমি মায়ের হাতে ঐগুলাে এনে দিলে মা সেই নিঃস্ব রমণীটিকে দিয়ে বললেন, “তােমার রোগা ছেলেকে খেতে দিও।” আহা! সে কতই খুশি হয়ে যে গেল! বারবার মাকে প্রণাম করতে লাগল।

১৩১৮-পটলডাঙার বাসা হতে বৈকালে গিয়েছি। মায়ের ঘরে গিয়ে বসতেই গােলাপ-মা এসে আমাকে বললেন, একটি সন্ন্যাসিনী গুরুর দেনাশোধ করতে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে কাশী হতে এসেছেন। তােমাকে কিছু দিতে হবে।” আমি সানন্দে স্বীকৃত হলুম। মা হেসে বললেন, “আমাকে ধরেছিল। আমি কি কারো কাছে টাকা চাইতে পারি মা? বললুম থাকো, হয়ে যাবে। গােলাপ-মা বললেন, “হাঁ, মা আমার শেষে হিল্লে { উপায়) করে দিয়েছেন।” মা আস্তে চুপি চুপি আমাকে বলছেন, “গােলাপ তিনখানা গিনি দিয়েছে।” 

খানিক পরে সেই সন্ন্যাসিনী এলেন। তিনি বলরামবাবুর বাড়ি গিয়ে ছিলেন। সেখানে ভক্তেরা তাঁকে যাঁর যা সাধ্য কিছু কিছু দিয়েছেন। শুনলুম, সন্ন্যাসিনী হবার পূর্বে তার বৃহৎ সংসার ও সাত ছেলে ছিল, তারাই এখন কৃতী হয়ে সকল বিষয়ের ভার নিতে তিনি সংসার ত্যাগ করে চলে এসেছেন। 

সন্ন্যাসিনী - গুরু নিন্দা করতে নেই, বলে। 

তারপর তিনি প্রণাম করে বলছেন, “বড় মােকদ্দমাপ্রিয় ছিলেন—এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। আর পারেন না। ওদিকে পাওনাদার ডিক্রী পেয়ে ধরতে চায়। কি করি, তাই তাঁর জন্যে ভিক্ষায় বেরিয়েছি।” 

এই কথা শুনে শ্রীশ্রীমা একটি শ্লোক বললেন, শ্লোকটি মনে পড়ছে না। তবে ভাবটি এই - উচিত কথা গুরুকেও বলা যায়, তাতে পাপ হয় না। 

মা আরও বললেন, “তবে গুরুভক্তি থাকা চাই। গুরু, যেমনই হােক, তাঁর প্রতি ভক্তিতেই মুক্তি। ঠাকুরের শিষ্য-ভক্তদের কি ভক্তি দেখ দেখি। এই গুরুভক্তির জন্যে ওরা গুরুবংশের সকলকে ভক্তি তাে করেই, গুরুর দেশের বিড়ালটাকে পর্যন্ত মান্য করে।” 

সন্ন্যাসিনী রাত তিনটা হতে বেলা আটটা পর্যন্ত জপধ্যান করেন। সেই জন্য একখানি ধােয়া কাপড় চাইলেন ; মা ভুদেবের একখানি কাপড় দিতে বললেন। সন্ন্যাসিনী আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি রাতে থাকবে? থাক তাে তােমায় কিছু শিক্ষা দিতে পারি।” মনে মনে ভাবলুম, আমাদের মার কাছে আবার আপনি কি শিখাবেন! কিন্তু প্রকাশ্যে বললুম, “না, আমার থাকা হবে না।” 

আমার গাড়ি এসেছে। সন্ধ্যারতি হ’তে শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে বিদায় নিলুম। 

২৮শে মাঘ, ১৩১৮ 
আজ মায়ের কাছে গিয়ে প্রণাম করে বসতেই মা আক্ষেপ করে বললেন, “আহা, গিরিশবাবু মারা গেছেন-আজ চারদিন, চতুর্থীর কাজ, আমায় নিতে এসেছিল। সে নেই আর কি সেখানে যেতে ইচ্ছা করে ? আহা, একটা ইন্দ্রপাত হয়ে গেল! কি ভক্তি-বিশ্বাসই ছিল। গিরিশ ঘােষের সে কথা শুনেছ ? ঠাকুরকে পুত্রভাবে চেয়েছিল। ঠাকুর তাতে বলেছিলেন, হাঁ, বয়ে গেছে আমার তাের ছেলে হয়ে জন্মাতে। তা কে জানে মা, ঠাকুরের শরীর যাবার কিছুকাল পরে গিরিশের এমন একটি ছেলে হ’ল, চার বছর হয়েও কারাে সঙ্গে কথা বলে নি। হাবভাবে সব জানাত। ওরা তাে তাকে ঠাকুরের মতাে সেবা করত। তার কাপড় জামা, খাবার জন্য রেকাব, বাটি, গেলাস, সমস্ত জিনিসপত্র নূতন করে দিলে—সে সব আর কাউকে ব্যবহার করতে দিত না। গিরিশ বলত, ঠাকুরই এসেছেন। তা ভক্তের আবদার, কে জানে, মা। একদিন আমাকে দেখবার জন্যে এমন অস্থির হ’ল যে, আমি উপরে যেখানে ছিলুম— সকলকে টেনে টেনে সেই দিকে উ-উ করে দেখিয়ে দিতে লাগল। প্রথমে কেউ বােঝেনি। শেষে বুঝতে পেরে আমার কাছে নিয়ে গেল, তখন ঐটুকু ছেলে, আমার পায়ের তলায় পড়ে প্রণাম করলে। তারপর নীচে নেমে গিরিশকে ধরে টানাটানি আমার কাছে নিয়ে আসবে বলে। সে তাে হাউহাউ করে কাঁদে আর বলে, ‘ওরে, আমি মাকে দেখতে যাব কি—আমি যে মহাপাপী।’ ছেলে কিন্তু কিছুতেই ছাড়ে না। তখন ছেলে কোলে করে কাঁপতে কাঁপতে, দু’চক্ষে জলধারা, এসে একেবারে আমার পায়ের তলায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে পড়ে বললে, “মা, এ হতেই তােমার শ্রীচরণ-দর্শন হ’ল আমার। ছেলেটি কিন্তু, মা, চার বছরেই মারা গেল। 

মা তখন বরানগর কুটীঘাটায় সৌরীন্দ্রমােহন ঠাকুরের ভাড়াটে বাড়িতে ছিলেন 

“এর আগে একদিন গিরিশ ও তার পরিবার তাদের বাড়ির ছাদে উঠেছিল। আমি তখন বলরামবাবুর বাড়িতে, বিকেল বেলা ছাদে গেছি। গিরিশের ছাদ হতে তাকালে যে দেখা যায়, সেটা আমি লক্ষ্য করিনি। পরে তার পরিবারের কাছে শুনলাম, সে গিরিশকে বলেছিল, 'ঐ দেখ, মা ওবাড়ির ছাদে বেড়াচ্ছেন। গিরিশ ঐ কথা শুনে অমনি তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলেছিল - না না, আমার পাপ-নেত্র, এমন ক'রে লুকিয়ে মাকে দেখব না। এই বলে নীচে নেমে গিছিল।” 

১লা আষাঢ়, ১৩১৯ 

বেলা প্রায় চারটা, শ্রীশ্রীমা অনেক স্বী-ভক্তসঙ্গে বসে আছেন। আমার পরিচিতার মধ্যে তাঁদের ভিতরে আছেন মাস্টার মহাশয়ের স্ত্রী, ডাক্তার দুর্গাপদ বাবুর স্ত্রী, গৌরীমা ও তাঁর পালিতা কন্যা যাঁকে আমি দুর্গাদিদি বলে ডাকি এবং বরেনবাবুর পিসী। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের চিনি না। মা হাসিমুখে সকলের সঙ্গে কথা কচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, “এই যে এস মা, ব’স।” আমি গৌরীমাকে দিয়ে নীচে অফিস ঘর হতে নিবেদিতা’ ও ‘ভারতে বিবেকানন্দ বই দুখানি আনলুম। আমার ইচ্ছা মা ‘নিবেদিতা বইখানির কিছু শুনেন। মাও বই দেখে বলছেন, “ওখানি কি বই গা?” আমি বললুম-“নিবেদিত’। মা বললেন, “পড় তাে মা, একটু শুনি। সেদিন আমাকেও একখানি ঐ বই দিয়ে গিয়েছে, এখনও শোনা হয়নি। যদিও অত লােকের মধ্যে পড়তে লজ্জা করতে লাগল, তথাপি নিবেদিতার সম্বন্ধে সরলাবালা কেমন সুন্দর লিখেছেন, তা মাকে শােনাবার আগ্রহে ও মায়ের আদেশে পড়তে আরম্ভ করলুম। শ্রীশ্রীমা ও সমবেতা স্ত্রী-ভক্তেরা সাগ্রহে শুনতে লাগলেন। নিবেদিতার ভক্তির কথা পড়তে সকলেরই চোখ অশ্রসিক্ত হয়ে উঠল। দেখলাম, মায়ের চোখ দিয়েও তা গড়িয়ে পড়ছে। ঐ প্রসঙ্গে বলতে লাগলেন, “আহা নিবেদিতার কি ভক্তিই ছিল। আমার জন্যে যে কি করবে ভেবে পেত না! রাত্রিতে যখন আমায় দেখতে আসত, আমার চোখে আলো লেগে কষ্ট হবে বলে একখানি কাগজ দিয়ে ঘরের আলােটি আড়াল করে দিত। প্রণাম করে নিজের রুমাল দিয়ে কত সন্তর্পণে আমার পায়ের ধূলাে নিত। দেখতুম, যেন পায়ে হাত দিয়েও সঙ্কুচিত হচ্ছে।” কথাগুলি বলেই মা নিবেদিতার কথা ভেবে স্থির হয়ে রইলেন। তখন উপস্থিত সকলেও নিবেদিতার কথা যা জানতেন বলতে লাগলেন। দুর্গাদিদি বললেন, ভারতের দুর্ভাগ্য যে তিনি এত অল্পদিনে চলে গেলেন।” অপর একজন বললেন, “তিনি যেন ভারতেরই ছিলেন। নিজেও তাই বলতেন। সরস্বতীপূজার দিন খালি পায়ে হােমের ফোঁটা কপালে দিয়ে বেড়াতেন।” পুস্তকপড়া শেষ হ’ল। শ্রীশ্রীমা তখনও মাঝে মাঝে নিবেদিতার জন্য আক্ষেপ করতে লাগলেন। শেষে বললেন, “যে হয় সুপ্রাণী, তার জন্য কাঁদে মহাপ্রাণী (অন্তরাত্মা) , জান মা?”

এইবার মা কাপড় কেচে এসে ঠাকুরের বৈকালী ভােগ দিতে বসলেন। ইতঃপূর্বে কোন সময়ে স্বহস্তে অনেকগুলি ফুলের মালা গেঁথে বৈকালে পরিয়ে দিবেন বলে ঠাকুরের সামনে রেখেছিলেন। ব্রহ্মচারী রাসবিহারী ঐগুলাের নিকটেই ভােগের জন্য রসগােল্লা এনে রেখে গেছেন। তার রস গড়িয়ে ফুলের মালাতে লেগে ডেয়ো পিঁপড়ে ধরেছে। মা হাসতে হাসতে বলছেন, “এইবার ঠাকুরকে পিঁপড়েয় কামড়াবে গাে! ও রাসবিহারী, এ কি করেছ?” এই বলে সযত্নে পিঁপড়ে ছাড়িয়ে ঠাকুরকে পরিয়ে দিলেন। মা ঐরূপে সকলের সামনে নিজের স্বামীকে মালা পরিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছেন দেখে রাধুর মা মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলেন। শ্রীশ্রীমা উপস্থিত সকলকে প্রসাদ দিতে গৌরীমাকে বললেন এবং সকলে প্রসাদ পেলেন। 

একজন স্ত্রী-ভক্ত বললেন, “আমার পাঁচটি মেয়ে, মা, বে’ দিতে পারিনি, বড়ই ভাবনায় আছি।” 

শ্ৰীশ্ৰীমা - “বে’ দিতে না পার, এত ভাবনা করে কি হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দাও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।” 

ঐ কথা শুনে আর একজন স্ত্রী-ভক্ত বললেন, “মায়ের উপর যদি তোমার ভক্তি-বিশ্বাস থাকে, তাহলে ঐ কর, ভাল হবে। মা যখন বলছেন তখন আর ভাবনা কি ?” বলা বাহুল্য মেয়ের মায়ের এ-সব কথা মনে ধরল না। 

অপর একজন বললেন, “এখন ছেলে পাওয়া কঠিন, ছেলে আবার বে’ করতেই চায় না।” 

শ্রীশ্রীমা - ছেলেদের এখন জ্ঞান হচ্ছে, সংসার যে অনিত্য তা তার বুঝতে পারছে। সংসারে যত লিপ্ত না হওয়া যায় ততই ভাল। 

একে একে অনেকেই শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন। সন্ধ্যা হয়েছে, পুজনীয়া যোগীন-মা এসে শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে ঠাকুরের সন্ধ্যারতি করতে বসলেন। মা রাস্তার ধারের বারান্ডায় বসে জপধ্যান করছিলেন। পরে তিনি উঠে আসতে অপর স্ত্রী-ভক্তেরা সকলে প্রণাম করে বিদায়গ্রহণ করলেন। 

সকলে চলে যেতে মাকে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “মা স্ত্রী-লােকদের অশুচি অবস্থায় ঠাকুরকে পূজো করা চলে কি?” 

শ্রীশ্রীমা বললেন, “হ্যাঁ মা, চলে - যদি ঠাকুরের উপর তেমন টান থাকে। এ কথা আমিও ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। ঠাকুর বলেছিলেন, “যদি পূজো না করার জন্যে তােমার মনে খুব কষ্ট হয় তাহলে করবে, তাতে দোষ নেই। নতুবা করো না। তা তুমি পূজো করাে, কিন্তু মনে কোন দ্বিধা এলে করাে না।” সকলকেই যে মা ঐরূপ করতে বলতেন, তা নয়। কারণ দিন কয়েক পরে ঠিক এই একই অবস্থার আর একটি স্ত্রী-ভক্তকে বলেছিলেন, এই অবস্থায় কি ঠাকুর-দেবতার কাজ করতে হয়? তা করাে না।” ঐরূপে মা লােকের মানসিক অবস্থা দেখে কাকে কখন কি বলতেন, তা অনেক সময় বুঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে। 

অনেক রাত হয়েছে। এখনও আমাকে নিতে আসেনি। গােলাপ-মা ডেকে জিজ্ঞাসা করাতে নীচে হ’তে কে বললেন, “আমরা বলে দিয়েছি-গৌরীমার সঙ্গে চলে গেছেন বােধ হয়।” শুনে আমি মাকে বলেছি, না আসে, আজ থাকাই যাবে।” 

মা বললেন, “সে তাে কোন ভাবনা নেই, কিন্তু আজ পয়লা - অগস্ত্যযাত্রা, আজ বাড়ি হতে যাত্রা করে এসে কোথাও থাকতে নেই।” 

মনে ভাবলুম - এমন স্থানে যদি অগস্ত্যযাত্রা হয়, সে তাে ভালই। 

রাত্রে ঠাকুরের ভােগের পর সকলে প্রসাদ পেতে বসলেন। মা আমাকে বৈকালে অনেক প্রসাদ দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি পুনরায় এখন প্রসাদ পেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় গােলাপ-মা বললেন, “কেন গাে, আমাদের বাড়ি এসে উপােস করে থাকবে কেন ?” 

মা বললেন, “না না, দুখানি খাবি বৈকি।” - বলে নিজে একখানি রেকাবিতে চারখানা লুচি, তরকারি, মিষ্টি প্রভৃতি এনে দিলেন। রাত তখন প্রায় এগারােটা; এই সময় শ্রীমান বিনােদ আমাকে নিতে এল, সে গৌরীমার আশ্রমে গিয়ে আমাকে না পেয়ে পুনরায় এসেছে। নীচে সাধু - বম্ভ্রচারিগণ অনেকেই শয়ন করেছেন। মাকে প্রণাম করে বিদায় নিতে বললেন, “থাকা হল না গাে, তা আর একদিন এসে থেকো।” 

আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে নেমে আসছি, শুনছি—পুজনীয় শরৎ মহারাজ বলছেন, “সাবধানে সিৎড়িতে নামিয়ে নিয়ো, বিনােদ, রাত হয়েছে।” তিনি নীচের বৈঠকখানা ঘরে শুয়েছেন। বাসায় ফিরতে রাত বারটা হয়েছিল। 

আর একদিন গিয়ে দেখে শ্রীশ্রীমা দ্বিপ্রহরের আহারান্তে বিশ্রাম করছেন। আদেশ মতাে তাঁর কাছে শুয়ে বাতাস করছি, এমন সময়ে তিনি সহসা আপন মনেই বলছেন, “তাই তো মা, তােমরা সব এসেছ, তিনি (ঠাকুর) এখন কোথায় ?” শুনে বললুম, “এ জন্মে তাে তাঁর দর্শন পেলুমইনা। কোন জন্মে পাব কি-না তা তিনিই জানেন। আপনার যে দর্শন পেয়ে গেছি—এই আমাদের পরম সৌভাগ্য।” শ্রীশ্রীমা বললেন, “তা বটে।” ভাবতে লাগলুম, কি ভাগ্য যে এ কথাটি স্বীকার করলেন। সব সময়ই তাে দেখি নিজের কথা চেপে যান।

মায়ের কাছে কত লােকের কত রকমের গােপনীয় কথা যে থাকতে পারে - হাবা আমি তা তখন বুঝতে পারতুম না। জানবই বা কেমন করে - মার কাছে তখন অল্পদিন মাত্র যাচ্ছি বই তাে নয়। সেজন্য মার বাড়িতে পৌঁছে তাঁকে দেখতে না পেলে আসবার অপেক্ষা না করে খুঁজে খুঁজে যেখানে তিনি আছেন সেইখানে গিয়ে দেখা করতুম। একদিন বিকালবেলা বেশ সুশ্রী দুটি বৌ মাকে তাঁর ঘরের উত্তরের বারান্ডায় নিয়ে গিয়ে গােপনে কি বলছেন। এমন সময় আমি মাকে দেখতে একেবারে সেইখানে গিয়ে হাজির। শুনতে পেলুম মা তাঁদের বলছেন, “ঠাকুরের কাছে মনের কথা জানিয়ে প্রার্থনা করবে। প্রাণের ব্যথা কেঁদে বলবে—দেখবে তিনি একেবারে কোলে বসিয়ে দেবেন।” বুঝতে বাকি রইল না, বৌ দু’টি মার কাছে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। আমাকে দেখে তাঁরা লজ্জিত হলেন, আমিও ততােধিক। আমার কিন্তু খুব শিক্ষা হয়ে গেল। মনে মনে স্থির করলাম, আর কখনও সাড়া না দিয়ে মাকে অমন করে দেখতে যাব না। কয়েক মাস পরে মার বাড়িতে বৌ দুটির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এবং বুঝেছিলাম তাঁরা উভয়েই সন্তানসম্ভবা হয়েছেন।  

গৌরীমা এসেছেন। তাঁকে একটু ঠাকুরের কথা বলতে অনুরােধ করায় তিনি বললেন, “আমি ঠাকুরের কাছে অনেক আগে গিয়েছিলাম। তারপরে আর সকলে আসতে লাগলেন। এই নরেন, কালী এদের ছোট দেখেছি। বেলা বেশী নেই দেখে আর অধিক কথা হল না। মাকে প্রণাম করে গৌরীমা বিদায় নিলেন।

আমাকে যেতে হবে। মাকে প্রণাম করে বিদায় চাইতে মা বারান্ডায় ডেকে এনে প্ৰসাদ দিলেন ; বলতে লাগলেন, “তবে এস মা। আমার সব ছেলেমেয়ে গুলাে আসে, আবার একে একে চলে যায়। একদিন সকাল সাতটায় এসাে। এখানে প্রসাদ পাবে। 
রথযাত্রা, ৩১শে আষাঢ় ১৩১৯ 

আজ প্রাতে সাতটায় গৌরীমার আশ্রমে গিয়েছিলুম, তিনি প্রসাদ পাবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল, ওখান হতে সকাল সকাল শ্রীশ্রীমায়ের নিকট যাব। কিন্তু সুযােগ হয়ে উঠল না। ঠাকুরের ভােগ ও ভক্তসেবা সাঙ্গ হতে প্রায় দুটো বেজে গেল। চারটার সময় গৌরীমাকে নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম, তখন মা বৈকালের ভােগ দিতে বসেছিলেন। ভােগ দিয়ে উঠলে প্রথমে গৌরীমা, পরে আমি মাকে প্রণাম করলাম। গৌরীমা তাঁকে একটু নিভৃতে নিয়ে গেলেন এবং কি কথাবার্তার পর আমাকে ডাকলেন। মার জন্য একখানি গরদ নিয়ে এসেছিলুম। উহা পদপ্রান্তে রেখে প্রণাম করে বললুম, “মা, এখানি পরবেন।” মা হেসে বললেন, “হাঁ, পরবাে বই কি।” গৌরীমা আমাকে স্নেহভরে প্রশংসা করতে লাগলেন। মাও তাতে একটু যােগ দিলেন। ঠাকুরঘরে মাষ্টারমশায়ের স্ত্রী ও কন্যা এবং অন্যান্য স্ত্রী-ভক্তও অনেকে আছেন। সকলকে চিনি না। মাস্টারমশায়ের মেয়ে ও স্ত্রীর সহিত কিছুক্ষণ আলাপ করার পর পুুরুষ-ভক্তেরা মাকে প্রণাম করতে আসছেন শুনে আমরা সকলে বারান্ডায় গেলাম। একটি ভক্ত কতকগুলাে প্রস্ফুটিত গোলাপ, জবা, এক ছড়া সুন্দর জুই ফুলের গােড়ে এবং ফল ও মিষ্টি এনেছিলেন। মায়ের পদপ্রান্তে ঐ সব রেখে চরণপূজা করতে লাগলেন। সে এক সুন্দর দৃশ্য ! মা সহাস্যমুখে স্থির হয়ে বসে - গলায় ভক্ত প্রদত্ত মালা, শ্রীচরণে জবা ও গােলাপ। পূজাশেষে ভক্তটি ফল মিষ্টি প্রত্যেক জিনিস হতে কিছু কিছু নিয়ে মাকে প্রসাদ করে দিতে প্রার্থনা করলেন। গৌরীমা তাই শুনে হাসতে হাসতে বললেন, “শক্ত ভক্তের পাল্লায় পড়েছ মা, এখন খাও।” মাও তাতে হাসতে হাসতে “অত না, অত না--অত খেতে পারব না” বলে একটু খেয়ে ভক্তের হাতে দিতে লাগলেন; ভক্তটি প্রত্যেক দ্রব্য মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দে উল্লসিত হয়ে প্রণাম করে বিদায় নিলেন। মা তখন নিজের গলার ফুলের মালাটি গৌরীমার গলায় পরিয়ে দিলেন। পদে নিবেদিত ফুলগলি ভক্তেরা নিয়ে গিয়েছিলেন। 

ভুদেব রথ তৈরী করেছে। ঠাকুর রথে উঠবেন, সেই আয়ােজন হচ্ছিল। গৌরীমার আশ্রমে বিশেষ কাজ ছিল, তাই তিনি তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি সিঁড়ি পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে গিয়ে পুনরায় মায়ের কাছে ফিরে গেলুম। 

কথায় কথায় গৌরীমার কথা উঠল। মা বললেন, “আশ্রমের মেয়েদের ও বড় সেবা করে - অসুখ-বিসুখ হলে নিজের হাতে তাদের গু-মুত পরিষ্কার করে। সংসারে ওর ও-সব তাে আর বড় একটা করা হয়নি, ঠাকুর যে সবই করিয়ে নেবেন - এই শেষ জন্ম কি-না!”

এইবার পাশের ঘরে ঠাকুর রথে উঠলেন। মা তক্তাপােশে বসে অনিমেষ নয়নে তাঁকে দেখতে দেখতে কত যে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন। পরে ভুদেব ও ভক্তেরা মিলে রথ ঠাকুরকে ধরে তুলে নীচে নিয়ে গেলেন এবং রাস্তায়, গঙ্গার ধারে রথ টেনে সন্ধ্যার পর আবার ঘরে আনলেন। এইবার স্ত্রী-ভক্তেরা উপরের ঘরের ভিতর রথ টানলেন। তারপর মা, রাধু, নলিনী দিদি ও আমি টানলুম। যে কেউ আসতে লাগল তাকেই মা আনন্দ করে রথের কথা বলতে লাগলেন। ভক্ত-মহিলারা প্রসাদ নিয়ে একে একে চলে গেলেন। পরে রাত্রির ভােগ-আরতি হতে মা নিজেই একখানি থালায় করে প্রসাদ এনে আমাকে দিলেন। 
সেদিন বাসায় ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে এগারটা হয়ে গিয়েছিল। 

যখন সামনের রাস্তায় রথ টানা হচ্ছিল, মা বলেছিলেন, “সকলে তো জগন্নাথ যেতে পারে না। যারা এখানে ( ঠাকুরকে রথে) দর্শন করলে, তাদেরও হবে।”

রাধাষ্টমী, ২রা আশ্বিন, ১৩১৯ 

গৌরীমার আশ্রমের স্কুলের কার্যে ব্যস্ত থাকায় মায়ের নিকট আর ইচ্ছানুসারে আজকাল যাওয়া হয়ে ওঠে না। রাধাষ্টমীর দিন অবসর পেয়ে গিয়ে দেখি, মা গঙ্গাস্নানে যাবেন বলে পাশের ঘরে তেল মাখছেন। লােকে বলে, তেল মাখলে প্রণাম করতে নেই এবং মানবদেহ ধারণ করলে জগজ্জননীও মানব-রীতির বশীভূত হয়ে চলেন, তাই প্রণাম করলুম না। আমাকে দেখেই মা বললেন, “এস মা, এস, সকালে এসেছ - বেশ করেছ। আজ রাধাষ্টমী দিনও ভাল, বস, আমি স্নান করে আসি।” আমি তাঁর সঙ্গে গঙ্গায় যাব বলায় মা বললেন, “তবে এস।” কিন্তু অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছিল বলে গােলাপ-মা আমাকে কিছুতেই যেতে দিলেন না। মাও তখন গােলাপ-মার মতে মত দিয়ে বললেন, “তবে থাক, মা, আমি এখনি আসছি।” কাজেই রইলুম। ঐরূপ প্রায়ই দেখতে পেতুম-সরলা বধূটির মতাে মা কারও কথার উপর জোর করে কিছু বলতেন না। যা হােক, রাস্তায় মা বেরুতেই জল ধরে গেল। মা তাই বাড়ি ফিরে এসেই আমাকে বললেন, “বেরুতেই জল ধরে গেল দেখে আমি ভাবলুম, আহা, তুমি আসতে চেয়েছিলে, এলে বেশ হত, গঙ্গাদর্শন করে যেতে।” সত্যি কথা বলতে কি, আমি গঙ্গাদর্শনের জন্য যত না হােক, মার সঙ্গে যাবার আকাক্ষাতেই যেতে চেয়ে ছিলুম। কারণ, সংসারে নানা বাধাবিঘ্নের জন্য মার কাছে তাে আসাই হয় না, সেজন্য ভাগ্যক্রমে যে দিন আসা ঘটে, সে দিন আর ইচ্ছা হয় না যে এক মুহূর্তও মাকে চোখের আড়াল করি। গােলাপ-মা মায়ের কথা শুনে বললেন, “নাই বা গেছে, তােমার পা ছুঁলেই সব হবে।” আমিও তাই বলতেই মা বললেন, “আহা সেকি কথা ! গঙ্গা।” ঐরূপে ব্যবহারে বা কথাবার্তায় মা কখন নিজের মহত্ত্বের কথা প্রকাশ করতেন না-অপর সকলের ন্যায় তিনিও একজন সামান্য মানুষ এইরুপই বলতেন এবং দেখাতেন। তবে এও দেখেছি, অন্য কেহ কাছে না থাকলে কখন কখন কার কারও প্রতি কৃপায় তাঁর অসীম মহিমান্বিত জগন্মাতার ভাব প্রকাশ পেত। ঘরে এসেই তক্তাপােশখানির উপর বসে আমাকে বললেন, “বেশ, গঙ্গাস্নান করেও এসেছি।” বুঝলুম যে তাঁর পাদপদ্ম পূজা করব মনে করে এসেছি তা টের পেয়েছেন। মনে মনে বললুম--নিত্যশুদ্ধা তুমি মা, তােমার আবার গঙ্গাস্নান ! তাড়াতাড়ি ফুল চন্দনাদি নিয়ে পদতলে বসতেই বললেন, “তুলসীপাতা থাকে যদি তাে পায়ে দিও না।” পূজাশেষ হলে প্রণাম করে উঠলুম। মা এইবার জল খেতে বসলেন। সেই অপূর্ব স্নেহে কাছে নিয়ে বসা এবং প্রত্যেক জিনিসটির অর্ধেক খেয়ে প্রসাদ দেওয়া। আমিও মহানন্দে প্রসাদ পেলুম। শালপাতাখানিতে করে প্রসাদ খাবার সময় সাধু নাগ মহাশয়ের কথা মনে হ’ল। শ্রীশ্রীমাকে বললুম, “মা, শালপাতায় প্রসাদ পেলেই নাগ মহাশয়ের কথা মনে পড়ে?” 

মা বললেন, “আহা, তার কি ভক্তিই ছিল। এই তাে দেখ শুকনাে কটকটে শালপাতা! একি কেউ খেতে পারে? ভক্তির আতিশয্যে প্রসাদ ঠেকেছে বলে পাতাখানা পর্যন্ত খেয়ে ফেললে! আহা, কি প্রেমচক্ষুই ছিল তার। রক্তাভ চোখ, সর্বদাই জল পড়ছে। কঠোর তপস্যায় শরীরখানি শীর্ণ। আহা, আমার কাছে যখন আসত ভাবের আবেগে সিঁড়ি দিয়ে আর উঠতে পারত না, এমনি ( নিজে দেখিয়ে) থরথর করে কাঁপত - এখানে পা দিতে ওখানে পড়ত। তেমন ভক্তি আর কারও দেখলুম না !” 

আমি বললুম, “বইএ পড়েছি, তিনি যখন ডাক্তারী ব্যবসায় ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ঠাকুরের ধ্যানে তন্ময় থাকতেন, তখন তাঁর পিতা একদিন বলেছিলেন, ‘এখন আর কি করবি, নেংটা হয়ে ফিরবি আর ব্যাঙ ধরে খাবি!’ উঠানে একটা মরা ব্যাঙ পড়ে আছে দেখে নাগ মহাশয় কাপড়খানি ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে সেই ব্যাঙটা ধরে খেয়ে পিতাকে বলেছিলেন, “আপনার দুই আদেশই পালন করলুম, আপনি আমার খাওয়া-পরার চিন্তা ছেড়ে ইষ্টনাম করুন'।” 

মা - আহা, কি গুরুভক্তি ! কি শুচি-অশুচিতে সমজ্ঞান! আমি আবার বললুম, “অর্ধোদয়-যােগের সময় কলকাতা ছেড়ে নাগ মহাশয় বাড়ি গিয়েছিলেন, তাতে তাঁর পিতা ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, “গঙ্গাস্নান না করে গঙ্গার দেশ থেকে বাড়ি এলি ? কিন্তু যােগের সময় সকলে দেখে, উঠান ভেদ করে জল উঠে সারা উঠান একেবারে ভেসে যাচ্ছে! আর নাগ মহাশয় - ‘এস মা গঙ্গে, এস মা গঙ্গে’ বলে অঞ্জলি পূর্ণ করে সেই জল মাথায় দিচ্ছেন। তাই দেখে পাড়ার সকলে সেই জলে স্নান করতে লাগল। 

মা - হাঁ, তার ভক্তির জোরে অমন সব অদ্ভুতও সম্ভবে। আমি একখানা কাপড় দিয়েছিলাম, তা মাথায় জড়িয়ে রাখত। তার স্ত্রীও খুব ভাল আর ভক্তিমতী। এই সেবার -  আমের সময় এখানে এসেছিল। এখনাে বেঁচে আছে। 

এই সময় অন্য কয়েকজন স্ত্রী-ভক্ত আসায় কথাটা চাপা পড়ে গেল। মা উঠে তাঁদের প্রণাম নিয়ে আমাকে পান সাজতে যেতে বললেন। খানিক পরে আমি দুটো পান এনে মাকে দিলাম। মা পান দুটি হাতে নিয়ে একটি খেয়ে একটি আমাকে খেতে দিলেন। আমি আবার বাকি পানগুলি সাজতে চলে এলুম। মাও অল্পক্ষণ পরে দুটি স্ত্রী-ভক্তের সহিত সেই ঘরে এসে বসলেন। স্ত্রী-ভক্ত দুটিও সাহায্য করায় খুব শীঘ্রই পানসাজা হয়ে গেল। মা ঠাকুরের পানগুলি আলাদা করে আগে তুলে নিলেন এবং ‘আমার মা লক্ষীরা কত শীগগির সেজে ফেললে’ বলে আনন্দপ্রকাশ করতে লাগলেন। 

এইবার মা তেতলায় গােলাপ-মার ঘরে গেলেন। খানিক পরে আমি সেখানে গিয়ে দেখি, মা ঐ ঘরের দরজার চৌকাঠে মাথা রেখে শুয়ে আছেন - কেমন করে ভিতরে যাই। আমাকে দেখে মা বলছেন, “এস, এস, তাতে দোষ নাই।” মার সর্বত্র এইরূপ ভাব, পরে মা মাথা তুললেন। আমি ঘরে গিয়ে কাছে বসে তাকে বাতাস করতে লাগলুম। মা শুয়ে শুয়ে গৌরীমার স্কুলের নানা কথা, আর গাড়িভাড়া এ-সব কথা পাড়লেন। আমি যথাযথ উত্তর দিতে লাগলুম। এই সময়ে সেই স্ত্রী-ভক্ত দুটি সেখানে এলেন। তাঁদের একজন মায়ের চুল শুকিয়ে দিতে দিতে দু-একটি পাকা চুল বেছে আঁচলে বেঁধে রাখতে লাগলেন। বললেন, কবচ করবেন। মা লজ্জিত হয়ে বললেন, “ও কেন, ও কেন ? কত নুড়ােনুড়াে কাঁচা চুল যে ফেলে দিচ্ছি!” মা এইবার উঠে ছাদে একটু রােদে গেলেন। আমরাও সঙ্গে গেলুম এবং একপাশে দাঁড়িয়ে গঙ্গাদর্শন করতে লাগলুম। এমন সময়ে ঘর হতে গােলাপ-মা বলে উঠলেন, “মা তো সকলকে নিয়ে ছাদে গেলেন, এখন কে খাবে, কে না খাবে, তা আমি কি করে জানি ?” ঐ কথা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে গিয়ে তাঁকে বললুম, “বিধবাটি কেবল খাবেন না।” রোদে অনেকগুলি কাপড় ছিল, মা আমাকে সেগুলি তুলে ঘরে রাখতে বললেন। আমি তুলছি এমন সময়ে মা নীচে ঠাকুরের ভােগ দিতে নামলেন। আমরাও সকলে নীচে ঠাকুরঘরে এলুম ; ভােগ দেওয়া হলে মা আমাকে মেয়েদের খাবার জায়গা করতে বললেন। পরে সকলে প্রসাদ পেতে বসলুম। মা দুই-এক গ্লাস খাবার পরে আমাদের সকলকে প্ৰসাদ দিলেন। ইহার কিছু পরে আরও দুইটি স্ত্রী ভক্ত এসেছিলেন। তন্মধ্যে একজন বৃদ্ধা সধবা ঠাকুরের সময়ের এবং অপরটি তাঁর পুত্রবধূ! বৃদ্ধাটি খেতে খেতে বললেন, “আহা, ঠাকুর আমাদের যে-সব কথা বলে গেছেন, তা কি আমরা পালতে পেরেছি, তা হলে এত ভােগ ভূগবে কে, মা? সংসার সংসার করেই মরছি - ওকাজ হ’ল না, সেকাজ হল না - এই কেবল করছি।” মা তার ঐ কথায় বললেন, “কাজ করা চাই বই কি, কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়, তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।” 

আহারান্তে মা এখন একটু বিশ্রাম করবেন - খাটের উপর শয়ন করলেন। সকলেই এখন তাঁর একটু সেবা করতে ব্যগ্র। মা কিন্তু সকলকেই বিশ্রাম করতে বললেন; খানিক পরে বাড়িতে কাজ আছে বলে অপর স্ত্রীলােকেরা সব চলে গেলেন। আমি এবং ঠাকুরের সময়কার একটি বিধবা স্ত্রীলােক রইলাম। আমি এখন মার সেবার ভার একাই পেলুম। বিধবাটি মায়ের কাছে বসে তাঁর সংসারের দুঃখের অনেক কথা বলতে লাগলেন, “মা, আপনার কাছে সকল অপরাধের ক্ষমা পাই, কিন্তু ওদের কাছে ক্ষমা নাই” ইত্যাদি। আমি কথাপ্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম, “আপনি ঠাকুরকে দেখেছেন ?” 

ও মা, দেখেছি বই কি! তিনি যে আমাদের বাড়িতে আসতেন। মা তখন বৌটির মতােন থাকতেন।”  

আমি বললুম, “ঠাকুরের দুটো কথা বলুন না - শুনি।” তিনি বললেন, ‘আমি না - মা, মাকে বলতে বল।” কিন্তু মা তখন একটু চোখ বুঁজে আছেন দেখে আমি ওকথা বলতে পারলুম না। খানিক পরে মা নিজেই বলছেন, “যে ব্যাকুল হয়ে ডাকবে সেই তাঁর দেখা পাবে। এই সে দিন* একটি ছেলে মারা গেল। আহা, সে কত ভাল ছিল! ঠাকুর তাদের বাড়ি যেতেন। একদিন পরের গচ্ছিত ২০০.০০ টাকা ট্রামে তার পকেট থেকে মারা যায়, বাড়ি এসে দেখে। ব্যাকুল হয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে কাঁদছে -“হায় ঠাকুর, কি করলে তার অবস্থাও তেমন ছিল না যে নিজে ঐ টাকা শােধ করবে। আহা, কাঁদতে কাঁদতে দেখে ঠাকুর তার সামনে এসে বলছেন, “কাঁদছিস কেন? ঐ গঙ্গার ধারে ইট চাপা আছে দ্যাখ।” সে তাড়াতাড়ি উঠে ইটখানা তুলে দেখে — সত্যই একতাড়া নােট! শরতের কাছে এসে সব বললে। শরৎ শুনে বললে, 'তােরা, তাে এখনাে দেখা পাস, আমরা কিন্তু আর পাই নে। ওরা পাবে কি? ওরা তাে দেখে শুনে এখন গ্যাঁট হয়ে বসেছে। যারা ঠাকুরকে দেখেনি, এখন তাদেরই ব্যাকুলতা বেশী। 

“ঠাকুর তখন দক্ষি্ণেশ্বরে, রাখাল টাখাল এরা সব তখন ছােট। একদিন রাখালের বড় খিদে পেয়েছে, ঠাকুরকে বললে। ঠাকুর ঐ কথা শুনে গঙ্গার ধারে গিয়ে ‘ও গৌরদাসী, আয় না, আমার রাখালের যে বড় খিদে পেয়েছে’, বলে চীৎকার করে ডাকতে লাগলেন। তখন দক্ষিণেশ্বরে খাবার পাওয়া যেত না। খানিক পরে গঙ্গায় একখানা নৌকা দেখা গেল। নৌকাখানা ঘাটে লাগতেই তার মধ্য হতে বলরামবাবু, গৌরদাসী প্রভৃতি নামলাে এক গামলা রসগােল্লা 

নিয়ে। ঠাকুর তাে আনন্দে রাখালকে ডাকতে লাগলেন, ‘ওরে, আয় না রে রসগােল্লা এসেছে, খাবি আয়। খিদে পেয়েছে বললি যে। রাখাল তখন রাগ করে বলতে লাগল, ‘আপনি অমন করে সকলের সামনে খিদে পেয়েছে বললেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘তাতে কিরে, খিদে পেয়েছে, খাবি তা বলতে দোষ কি?’ তাঁর 
ঐ রকমই স্বভাব ছিল কি-না।” 

এমন সময় ভুদেব স্কুল থেকে জ্বর নিয়ে এল। মা তার জন্য বিছানা করে দিতে বললেন। বিছানা করে দিলুম। মাকে আজ একবার বলরামবাবুর বাড়ি যেতে হবে, রামবাবুর মাকে দেখতে -- কারণ তিনি রক্তামাশয়ে খুব পীড়িতা। তাই তাড়াতাড়ি উঠে বৈকালের কাজকর্ম সেরে নিতে লাগলেন, বললেন, “একবার যেতেই হবে, মাকুর স্কুলের (নিবেদিতা স্কুলের) গাড়ি এলে দাঁড়াতে বােলাে।” ঠাকুরকে বৈকালী ভােগ দিয়ে উঠে আমাকে কিছু প্রসাদ নেব কি-না জিজ্ঞাসা করায় বললুম, “এখন থাক। মা বললেন, “তবে পরে খেয়াে। নলিনী খেতে দিস।” মাকুর গাড়ি আসতেই বললেন, আমি শীগগির ঘুরে আসছি, তুমি বসে থেকো, আমি না এলে যেও না।” মা ও গোলাপ - মা বলরামবাবুর বাড়ি গিয়ে ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এলেন। এদিকে খবর এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে লােক এসেছে। আমি কিন্তু মার ফিরবার অপেক্ষায় ছিলুম। মা এসেই বললেন, “এই যে আছ মা, আমি এই তােমার জন্যে তাড়াতাড়ি আসছি; জল খেয়েছ?” 

“না, মা।” 

“সে কি, নলিনী খেতে দিস নি ? ব'লে গেলুম।” 

নলিনী ( লজ্জিতভাবে ) - মনে ছিল না, এই দিচ্চি। 

মা - না থাক, এখন আর তােকে দিতে হবে না, আমিই দিচ্চি। ( আমার প্রতি) তুমি চেয়ে খাও নি কেন, মা? এ যে নিজের বাড়ি। 

আমি বললুম, “তেমন খিদে পেলে চেয়ে খেতুম বই কি, মা।” 

মা তাড়াতাড়ি নিজেই কিছু প্রসাদী মিষ্টি এনে দিলেন। আমি আনন্দের সহিত খেলুম। “পান দি” বলে সাজা পান আনতে গেলেন। নলিনী দিদি বললেন, “বােগনোতে আর পান সাজা নেই, দেবে কি?” কিন্তু পুনরায় খুঁজতে গিয়ে মা তাতেই দুটি সাজা পান পেয়ে আমার হাতে দিলেন। আমি প্রণাম করে বিদায় চাইতে “এস মা, আবার এস, দূর্গা, দূর্গা” বলে উঠে বললেন, 
“আমি সঙ্গে যাব কি? একলা নেমে যেতে পারবে? রাত হয়েছে।” 

আমি বললুম, “খুব পারব মা, আপনাকে আসতে হবে না।” মা তবু “দূর্গা, দূর্গা” বলতে বলতে সহাস্য মুখে সিঁড়ি পর্যন্ত এসে দাঁড়ালেন ; আমি বললুম, “আর দাঁড়াতে হবে না মা, আমি বেশ যেতে পারব।” 

আর একদিন - সে দিন অক্ষয় তৃতীয়া, পূর্বোক্ত সধবা বৃদ্ধাটি ও তাঁর বন্ধু, স্নান করে এসে পৈতে আর দু-একটি কি ফল মায়ের হাতে দিতে গেলে মা বললেন, ‘আমাকে কেন ? ভুদেবকে দাও।” তার খানিক পরে, কথায় কথায় আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, “আজকের দিনে আমি তােমাদের আশীর্বাদ করছি, তােমাদের মুক্তি লাভ হােক। জন্ম-মৃত্যু বড় যন্ত্রণা, তা যেন তােমাদের আর ভুগতে না হয়।” 

* ৩১শে ভাদ্র ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত তেজচন্দ্র মিত্র দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীমা তাহার কথাই বলিতেছেন 
শেষ সপ্তাহ, অশ্বিন, ১৩১৯ 

পূজার ছুটিতে একদিন সকালেই মার কাছে গেলুম। দেখলুম, মা খুব ব্যস্ত। আমাকে বসতে বলে রাঁচি হতে কে ভক্ত এসেছেন তাঁকে ডাকতে বললেন। ভক্তটি অনেক ফল, ফুল, কাপড় ও একছড়া কাপড়ের গােলাপের মালা - দেখতে ঠিক সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতে - নিয়ে উপরে এলেন। মালাটি মাকে গলায় পরতে অনুরােধ করায় মা উহা পরলেন। এমন সময়ে গােলাপ-মা এসে মালার লােহার তার মায়ের গলায় লাগবে বলে ভক্তটিকে বকলেন। ভক্তটিকে অপ্রতিভ হতে দেখে করুণাময়ী মা বললেন, “না না লাগছে না, কাপড়ের উপর পরেছি।” ভক্তটি প্রণাম করে নীচে গেলেন। 

পরে মা ও আমি জলখাবার (প্রসাদ) খেতে বসলুম। আমি কিছু ফল ও খাবার নিয়ে গিয়েছিলুম মাকে দেবার জন্য। উহা তাঁর কাছে আনতেই মা বললেন, “ঠাকুরকে নিবেদন করে নিয়ে এস।” নিয়ে আসতে তা থেকে একটি আঙ্গুর মুখে দিয়ে বললেন, “আহা, বেশ মিষ্টি তাে।” একখানি কাপড় কয়েকদিন পূর্বে দিয়েছিলাম। সেই কাপড়খানিই পরেছিলেন। আমাকে দেখিয়ে বলেন, “এই দেখ গাে, তােমার কাপড় পরে পরে কালাে করেছি।” অবাক হয়ে ভাবলুম - এই অযােগ্য সন্তানের ওপর তােমার এতই কৃপা ও স্নেহ। মা নিজের পাত হতে প্রসাদ তুলে তুলে আমাকে দিতে লাগলেন। আমি হাত পেতে নিচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ একবার তাঁর হাতে আমার হাত ঠেকে গেল। আমি বললুম, “মা হাত ধুয়ে ফেলুন। মা হাতে একটু জল দিয়ে বললেন, “এই হয়েছে। এই সময়ে নলিনী দিদি এসে বসলেন, ইতঃপূর্বে কি কারণে যেন তিনি রাগ করেছিলেন। মা তাঁকে তিরস্কার করে বললেন, “মেয়েমানুষের অত রাগ কি ভাল, সহ্য চাই। শৈশবে বাপ-মায়ের কোল, যৌবনে স্বামীর আশ্রয় ছাড়া মেয়েদের আর কেউ ‘আবরুতে’ পারে না। মেয়েলােক বড় খারাপ জাত, ফস করে একটা যদি কেউ বলেই ফেললে গাে! মানুষের তো কথা - বললেই হ’ল। তাই দুঃখকষ্ট সয়েও ( স্বামী বা বাপ-মায়ের কাছে ) থাকতে হয়।” 

একটু পরে রাধু, এসে হাঁটুর কাপড় তুলে বসেছে। আবার মা তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন, “ও কি গো, মেয়েলােকের হাঁটুর কাপড় উঠবে কেন?” এই বলে কি একটি শ্লোক বললেন। তার মানে, হাঁটুর কাপড় উঠলেই মেয়েলােক উলঙ্গের সামিল। 

চন্দ্রবাবুর ভগ্নি এসেছেন। কথায় কথায় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মার গোঁসাই (স্বামী) আছেন ? এ সব বুঝি ছেলে, মেয়ে, বউ ?” 

আমি - কেন, ঠাকুরের কথা শোনেন নি ? তাঁর শিক্ষাই ছিল কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ। 

তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমি মনে করেছি এরা সব ছেলে, বউ হবে।” 

দূর্গাপূজা আসছে। মা তাই জামাইদের* কাপড় ভাগ ভাগ করে রাখ ছিলেন এবং আমাকে পৃথক করে বেঁধে রাখতে বললেন। আর একখানি কাপড় আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এখানা কুচিয়ে রাখত মা, গণেন পূজোর সময় পরে মঠে যাবে।” 

মধ্যাহ্নের ভােগ ও প্রসাদ পাওয়া হয়ে গেল। আহারান্তে মা বিশ্রাম করছেন। আমি নিকটে বসে বাতাস করছিলুম। মা তাতে বললেন, “ঐখান হতে একটা বালিশ নিয়ে আমার এইখানে শোও, আর বাতাস লাগবে না।” মায়ের বালিশে কি করে শোব মনে করে রাধুর ঘর হতে একটা বালিশ নিয়ে আসতেই মা হেসে বললেন, “ওটা পাগলের (রাধুর মার) বালিশ গাে, তুমি এই বালিশটাই আন না, তাতে দোষ নেই।” রাধুকে ডেকে বললেন, “রাধুও আয়, তাের দিদির পাশে শাে।” 

মার সঙ্গে চন্দ্রবাবুর ভগ্নীর সম্বন্ধে কথা হতে লাগল। মা বললেন, 

‘তা তুমি বললেই পারতে - হাঁ, এই তাে তাঁর স্বামী ঘরে বসে আছেন, আর তােমরা সব ছেলেমেয়ে।” 

আমি - সে তাে জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে কত ছেলেমেয়ে আছে, মা। 

মা হাসতে লাগলেন। কথায় কথায় আবার বললেন, ‘কত লোকে কত ভাবে আসে, মা। কেউ হয়তাে একটা শশা এনে ঠাকুরকে দিয়ে কত কামনা করে বলে - “ঠাকুর তােমাকে এই দিলুম, তুমি এই করাে। এমনি কত এই কামনা।” 

মা একটু পাশ ফিরে শুলেন। আমারও একটু তন্দ্রার মত এসেছিল, জেগে দেখি মা পাখা নাড়ছেন। একটু পরেই মা উঠলেন। দেখলুম পাশের ঘরে কয়েকটি লােক বসে আছেন। তন্মধ্যে দুজন গৈরিকধারিণী। তাঁরা মাকে প্রণাম করলেন। ঐ সঙ্গে একটি ছােট ছেলেও এসেছিল, সে প্রণাম করতেই মা প্ৰতিনমস্কার করলেন। তাঁরা মিষ্টি এনেছিলেন, মা আমাকে তুলে রাখতে বললেন এবং হাতমুখ ধুতে গেলেন। পরিচয় জানলুম, তাঁরা কালীঘাটের শিবনারায়ণ পরমহংসের শিষ্যা, সম্প্রতি তাদের গুরুর ওখানে অহােরাত্রব্যাপী এক যজ্ঞ হচ্ছে — ইত্যাদি। একটু পরেই শ্রীশ্রীমা এসে বসলেন। গৈরিকধারীণীদের মধ্যে একজন মাকে বললেন, “আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।” 

মা - বল। 

গৈরিকধারিণী - মূর্তিপূজায় কিছু সত্য আছে কি-না? আমাদের গুরু, বলেন, মূর্তিপূজা কিছু নয়, সূর্যের ও অগ্নির উপাসনা কর।’

মা - তােমার গুরু, যখন বলেছেন, তখন ওকথা আমায় জিজ্ঞাসা না করাই ঠিক। গুরুবাক্যে বিশ্বাস রাখতে হয়। 

তিনি বললেন, তা হবে না, আপনার মত বলতেই হবে।” মা নিজ মত বলতে পুনরায় অসম্মতি প্রকাশ করলেন। কিন্তু গৈরিকধারিণী একেবারে নাছােড়বান্দা। তখন মা বললেন, “তিনি (তােমার গুরু) যদি সর্বজ্ঞ হতেন  - এই দেখ তােমার জিদের ফল, কথায় কথা বেরুল  তা হলে ঐ কথা বলতেন না। সেই আদিকাল হতে কত লােকে মূর্তি উপাসনা করে মুক্তি পেয়ে আসছে, সেটা কিই নয় ? আমাদের ঠাকুরের ওরূপ সঙ্কীর্ণ ভেদবুদ্ধি ছিল না। ব্রহ্ম সকল বস্তুতেই আছেন। তবে কি জান - সাধুপুরুষেরা সব আসেন মানুষকে পথ দেখাতে, এক এক জনে এক এক রকমের বােল বলেন। পথ অনেক সেজন্যই তাঁদের সকলের কথাই সত্য। যেমন একটা গাছে সাদা, কালাে, লাল নানা রকমের পাখী এসে বসে, হরেক রকমের বােল বলছে। শুনতে ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকলগুলিকে আমরা পাখীর বােল বলি—একটাই পাখীর বােল আর অন্যগুলাে পাখীর বােল নয় এরূপ বলি না।” 

তাঁরা কিছুক্ষণ তর্ক করে শেষে নিরস্ত হলেন। তারপর তাঁরা শ্রীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার বাড়ি কোথায়?” 

মা - কামারপুকুর, হগলী জেলায়। 

“এখানকার ঠিকানা কি বলুন, আমরা মাঝে মাঝে আসব।” 

মা ঠিকানা লিখে দিতে বললেন। তাঁরা যে মিষ্টি এনেছিলেন ইতঃপূর্বেই শ্রীশ্রীমা তা হতে ছেলেটিকে দিতে বলেছিলেন এবং আমি তখনই দিয়েছিলুম। একটু পরে তাঁরা বিদায় নিলেন। তাঁরা গেলে শ্রীশ্রীমা বললেন, “মেয়েলােকের আবার তর্ক। জ্ঞানী পুরুষরাই তর্ক করে তাঁকে বড় পেলে। ব্রহ্ম কি তর্কের বস্তু?” একটু পরেই আমার গাড়ী এল। মা বললেন, “এই গাে পটলডাঙ্গার গাড়ী এসেছে বলছে, এখনি এল ?” ঐ কথা বলেই তিনি তাড়াতাড়ি ঠাকুরের বৈকালী ভােগ দিলেন এবং কিছু প্রসাদ, প্রসাদী জলের গ্লাসটি এবং দুটি পান নিয়ে বারান্ডায় আড়ালে গিয়ে ডাকলেন-“এস।” তাঁর স্নেহযত্নে আমার চোখে জল এল। ভাবতে লাগলুম - আবার কত দিনে মার সঙ্গে দেখা হবে। কারণ, পূজার পরেই মা কাশী যাবেন। মা সস্নেহে বললেন, “আবার আসবে।” এমন সময় বাহির হতে চন্দ্রবাবু এসে একটু বিরক্তির সহিত বললেন, “বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে, গাড়ােয়ান দিক করছে, আমি এই সকলকে বলে রাখলাম গাড়ি আসলে কেউ যেন তিলার্ধ দেরী না করেন।” শ্রীশ্রীমা তাই শুনে বললেন, “আহা, তার কি, এই তো যাচ্ছে -- এস মা।” আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাড়াতাড়ি প্রণাম করে নেমে গেলুম। প্রাণের আবেগে সেদিন বাড়িতে কারও সহিত ভাল করে কথা বলতে পারলুম না। সারারাতও ঐ ভাবে কেটে গেল। 

* মায় তিনটি ভ্রাতুষ্পুত্রী - তাদের স্বামীর জন্য। 


 ১৮ই মাঘ, ১৩১৯ 

৩রা মাঘ মা কাশী হ'তে ফিরেছেন। সকালবেলা গিয়ে দেখি, মা পূজা করছেন এবং পূজা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পূজা শেষ হলে উঠে বললেন, “এই যে, মা, এসেছ, আমি ভাবছি দেখা হ’ল না বুঝি, আবার শীগগির দেশে চলে যাব।” খাবার তৈরী করে নিয়ে গেয়েছি দেখে মা বললেন, “ঠাকুরের আজ মিষ্টি কম দেখে ভাবছিলুম। তা ঠাকুর তাঁর ভােগের জিনিস সব নিজেই যােগাড় করে নিলেন - তা আবার কেমন ঘরের তৈরী সব খাবার?” ঠাকুরকে ঐ সব নিবেদন করা হলে ভক্তদের জন্য এক একখানি শালপাতায় ভাগ ভাগ করে সাজিয়ে দিতে লাগলেন। ভুদেব বললে, “এত দেব কাকে?” 

মা হেসে বললেন, “দেখ ছেলের বুদ্ধি ! নীচে যেসব ভক্তরা আছে তাদের দিবি। দিয়ে আয়গে যা।” 

একটু পরে রাঁচী হতে একটি ভক্ত এসে মাকে প্রণাম করে ফুলের মালা দিলেন এবং বললেন, “সুরেন আপনাকে এই টাকাটি দিয়েছে।” এই বলে টাকাটি মার পদতলে রাখলেন। 

বেলা হয়েছে। রাধু সামনের মিশনারী স্কুলে যাবে বলে খেয়ে দেয়ে কাপড় পরে প্রস্তুত, এমন সময় গােলাপ-মা এসে মাকে বললেন, “বড় হয়েছে মেয়ে, এখন আবার স্কুলে যাওয়া কি ?” এই বলে রাধুকে যেতে নিষেধ করলেন। রাধু কাঁদতে লাগল। 

মা বললেন, “কি আর বড় হয়েছে, যাক না। লেখাপড়া, শিল্প এ সব শিখতে পারলে কত উপকার হবে। যে গ্রামে বিয়ে হয়েছে—এ সব জানলে নিজের এবং অন্যেরও কত উপকার করতে পারবে, কি বল মা?” পরে রাধু স্কুলে গেল। 

অন্নপূর্ণার মা একটি মেয়ে নিয়ে এসেছেন দীক্ষার জন্য। তিনি বললেন, “মা, ও আমাকে খেয়ে ফেললে তােমার কাছে দীক্ষা নেবার জন্যে। কি করি,-, নিয়ে এলুম।” 

মা - “আজ কি করে হবে? জল খেয়েছি। 

অন্নপূর্ণার মা - ও তাে খায় নি। তা মা, তােমার খাওয়ায় তো আর দোষ নেই। 

মা - একেবারে কি ঠিক হয়েই এসেছে ? 

অন্নপূর্ণার মা - হাঁ মা, একেবারে স্থির করেই এসেছে। মা সম্মত হলেন। দীক্ষার পরে শ্রীশ্রীমাকে মেয়েটির কথা বলতে লাগলেন - “ও কি মা, তেমন মেয়ে ! ঠাকুরের বই পড়ে চুল কেটে পুরুষ সেজে তপস্যা করতে তীর্থে বেরিয়ে গিয়েছিল - একেবারে বৈদ্যনাথে গিয়ে হাজির। সেখানে এক বনের মধ্যে বসেছিল। ওর মায়ের গুরু সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, ওকে দেখতে পেয়ে পরিচয় 
নিয়ে নিজের কাছে রেখে ওর বাপের কাছে সংবাদ পাঠাতে ওর বাপ গিয়ে নিয়ে  এল।”

মা চুপ করে কথাগুলি শুনে বললেন, “আহা, কি অনুরাগ!” আর সকলে বলতে লাগলেন, “ও মা, সে কি গাে ! আমন রূপের ডালি মেয়ে (মেয়েটি খুবই সুশ্রী) কেমন করে রাস্তায় বেরিয়েছিল, হােক গে বাপু ভক্তি অনুরাগ!” 

নলিনী -- বাপরে আমাদের দেশ হলে আর রক্ষে থাকত না। 

অবশ্য এই সব কথা মেয়েটির ও অন্নপূর্ণার মার অসাক্ষাতেই বলা হচ্ছিল। 

নলিনী ও আমার সঙ্গী একটি স্ত্রীলোক উভয়েই স্বামীর কাছে থাকেন না। কি কথার যেন তাঁদের কথা এল। মা বললেন, “ঠাকুর বলতেন, জরু গরু, ধান -  এ তিন রাখবে আপন বিদ্যমান,” আরও বললেন, “এসব চারাগাছের সময়ে বেড়া না দিলে ‘ছাগলে মুড়াবে মাথা’।” 

দুপুরে আহারান্তে সকলে পাশের ঘরে শয়ন করলেন । নূতন মেয়েটিকে মা, একটু শুতে বললেন। সে বললে, “না, মা, আমি দিনের বেলায় শুই না।” আমি তাকে বললুম, “মা বলছেন, কথা শুনতে হয়।” “তবে শুই” বলে সে একটু শুয়ে আবার তখনই উঠে বারান্ডায় গেল। মা বললেন মেয়েটি একটুই চঞ্চল, সেই জন্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল।” মা মেয়েটির ঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মেয়েটির স্বামী কি করে ? কেন মেয়েটিকে কাছে নিয়ে রাখে না ?” 

ঝি বললে, “তিনি অল্প মাইনে পান, আর ঘরে কেউ নেই, ওকে নিয়ে গিয়ে একলাও রাখতে পারেন না। তাই শনিবার শনিবার শ্বশুরবাড়ি আসেন।” 

ন্নপূর্ণার মা - ও স্বামীকে বলে, “তুমি আমার কিসের স্বামী, জগৎ-স্বামীই আমার স্বামী। 

মা কোন উত্তর দিলেন না। 

ঠাকুরঘরের উত্তরের বারান্ডায় মেয়েরা সব গল্প করছিলেন। 

বড় গােল হচ্ছিল। মা বললেন, “বলে এস তো, মা, আস্তে কথা বলতে এক্ষুণি শরতের ঘুম ভেঙে যাবে (তিনি নীচে বৈঠকখানা ঘরে শুয়েছিলেন)। ঘরটি এখন নির্জন দেখে মাকে সাধন-ভজন ও দর্শন সম্বন্ধে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করলুম। মা বললেন, “ঠাকুর ও আমাকে অভেদ-ভাবে দেখবে, আর যখন যে ভাবে দর্শন পাবে, সেই ভাবেই ধ্যান-স্তুতি করবে, ধ্যান হয়ে গেলেই পূজা শেষ হ’ল। এইখানেই (হৃদয়ে) আরম্ভ ও এইখানে (মস্তকে) শেষ করবে।” এই বলে দেখিয়ে দিলেন। 

 মা - মন্ত্র-তন্ত্র কিছু নয়, মা, ভক্তিই সব। ঠাকুরের মাঝেই গুরু, ইষ্ট, সব পাবে। উনিই সব। 

তারপর কথাপ্রসঙ্গে গৌরীমা ও দূর্গাদেবীর কথা উঠল। মা উভয়ের অনেক সুখ্যাতি করলেন। আর বললেন, “দেখ, মা, চড় খেয়ে রামনাম অনেকেই বলে, কিন্তু শৈশব হ'তে ফুলের মতাে মনটি যে ঠাকুরের পায়ে দিতে পারে, সে-ই ধন্য। মেয়েটি যেন অনাঘ্রাত ফুল। গৌরীদাসী মেয়েটিকে কেমন তৈরী করেছে। ভায়েরা বিয়ে দেবার বহু চেষ্টা করেছিল! গৌরীদাসী ওকে লুকিয়ে হেথা সেথা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। শেষে পুরী গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে মালা বদল করে সন্ন্যাসিনী করে দিলে। সতী লক্ষী মেয়ে, কেমন লেখাপড়াও শিখেছে। কি একটা সংস্কৃত পরীক্ষাও দেবে শুনছি।” গৌরীমার পূর্বজীবন সম্বন্ধেও অনেক কথা বললেন। তাতে জানলুম, তার জীবনের উপর দিয়ে কম দুঃখ-ঝঞ্জা বয়ে যায় নি। কাশীর কথা ওঠাতে বললেন, “কাশীতে বেশ ছিলুম গাে, আর আমি তাে সঙ্গে করে যদুবংশ সব নিয়ে গিয়েছিলুম, মা।” 

একটু পরে চার-পাঁচটি স্ত্রীলােক এলেন। তাঁরা ডাব ও কিছু অন্য ফল মায়ের চরণপ্রান্তে রাখলেন। একটি স্ত্রীলােক প্রণাম করবার জন্য নিকটে আসবার উপক্রম করলে মা বললেন, “ওখান হতেই কর।” তাঁরা প্রত্যেকেই মার সামনে দু-চারটি পয়সা রেখে প্রণাম করতে লাগলেন । মা পয়সা দিতে বারবার নিষেধ করলেন। তাঁর কিছু উপদেশ চাইতে মা একটু হেসে বললেন, “আমি আর কি উপদেশ দেব। ঠাকুরের কথা সব বইয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তাঁর একটা কথা ধারণা করে যদি চলতে পার, তাে সব হয়ে যাবে।” শ্ৰীশ্ৰীমা খুঁটিনাটি অনেক কথা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁরা বিদায় নিলে মা আমাকে বললেন, “উপদেশ নেয় তেমন আধার কই ? আধার চাই, মা, নইলে হয় না।” কথায় কথায় ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় প্রভৃতির কথা উঠল ; দু-একটি কথা হতেই অন্নপূর্ণার মা ঘরে ঢুকতে সেসব কথা চাপা পড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘মা, আমি স্বপ্ন দেখেছি, তুমি যেন আমাকে বলছ, আমার প্রসাদ খা, তবে তোর অসুখ সারবে।’ আমি বলছি ঠাকুর নিষেধ করেছেন, আমাকে কারও উচ্ছিষ্ট খেতে। তা মা, আমাকে এখন তােমার প্রসাদ একটু দাও।” মা সম্মত না হওয়ায় তিনি খুব জিদ করতে লাগলেন। 

মা বললেন, “ঠাকুর যা নিষেধ করেছেন, তাই করতে চাও ?” 

অন্নপূর্ণার মা উত্তর করলেন, “তাঁতে ও তােমাতে যতদিন তফাত বােধ ছিল ততদিন ওকথা ছিল, এখন দাও।” মা শেষে তাঁকে প্রসাদ দিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে তাঁরা বিদায় নিলেন। গৌরীমার ওখান হয়ে যেতে হবে বলে আমিও একটু পরে বিদায় নিলাম। 

৫ই কি ৬ই ফাল্গুন, ১৩১৯—শ্রীমান শােকহরণের সহিত পুনরায় গিয়েছি। সকালবেলায় পূজা হয়ে গেছে। দেখেই মা বললেন, “এসেছ, মা বেশ করেছ। জয়রামবাটী যাবার দিন বদলে গেছে, ১৩ই নয় ১১ই (ফাল্গুন)। কার সঙ্গে এলে?”

আমি — শােকহরণ নিয়ে এসেছে। অনেক দূরে আছি মা, আসবার সুবিধা হয় না। 

মা শ্ৰীমানের প্রশংসা করে বললেন, “আহা, লক্ষী ছেলে কত কষ্ট করে নিয়ে এসেছে ?” জিজ্ঞাসা করলেন, “জামাই (আমার স্বামী) কেমন আছেন?” 

আমি - বড় ভাল নেই, মা। 

কিছুক্ষণ পরে একখানি চিঠির জবাব লিখে দিতে বললেন। মা বলতে লাগলেন, আর আমি লিখে যেতে লাগলুম। 

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মা একটু বিশ্রাম করছিলেন, এমন সময় কয়েকজন স্ত্রীলােক দর্শন করতে এলেন। মা শুয়ে শুয়েই তাঁদের কুশল-প্রশ্ন করতে লাগলেন। তাঁরা একটি কথার পর বলতে আরম্ভ করলেন, “আমার একটি ভাল ছাগল আছে, দু’ সের দুধ দেয়। তিনটি পাখী আছে। এ সবই এখন অবলম্বন। আর বয়স তাে কম হয়ে গেল না, মা।” আমার তখন ঠাকুরের কথা মনে পড়ল—“বেড়াল পুষিয়ে মহামায়া সংসার করান।' শ্রীশ্রীমা “হাঁ হাঁ করে যেতে লাগলেন। 

আহা! মা, আমাদের জন্য তোমাকে কতই না সইতে হয়। এই বিশ্রামটুকুর সময়েও যত রাজ্যের বাজে কথা। বৈকাল বেলা একটু পড়ে আসতে আমরা বিদায় নিলুম। 
গত ১১ই ফাল্গুন মা পিত্রালয়ে গিয়েছিলেন। ১৩২০ সনের আশ্বিন মাসের পূজার পূর্বে কলকাতা ফিরেছেন। একদিন বৈকালে গিয়ে দেখি, একটি স্ত্রীলােক তাঁর পদতলে কাঁদছেন - দীক্ষার জন্য। শ্ৰীশ্ৰীমা চৌকীর উপর বসে আছেন। মা সম্পূর্ণ অসম্মত — বলছেন, “আমি তাে তােমাকে পূর্বেই বারণ করেছি; কেন এলে ? আমার শরীর ভাল নয়, এখন হবে না।” সে যতই বলছে, মা আরও বিরক্তি প্রকাশ করছেন, “তােমাদের আর কি ? তােমরা তাে মন্ত্রটি নিয়ে গেলে ; তারপর ?” মেয়েটি তবুও নাছোড়। উপস্থিত সকলেই বিরক্ত হয়ে উঠলেন। শেষে মা বললেন, “পরে এস।” তখন স্ত্রীলােকটি বললে, “তবে আপনার কোন ভক্ত ছেলেকে বলে দিন।” 

মা - তারা যদি না শুনে ? 

মেয়েটি—সে কি, আপনার কথা শুনবে না ?

মা—এ ক্ষেত্রে নাও শুনতে পারে। 

তারপর কিছুতেই না ছাড়তে মা বললেন, “আচ্ছা, খােকাকে* বলে দেবাে, সে দেবে।” তবুও মেয়েটি বলতে লাগলেন, আপনি দিলেই ভাল হয়, আপনি ইচ্ছা করলেই পারেন।” এই বলে দশ টাকার একখানি নোট বের করে বললেন, এই নিন টাকা, যা লাগে আনিয়ে নেবেন।” ঐরূপে টাকা দিবার প্রস্তাবে আমাদের লজ্জা করতে লাগল, রাগও হ’ল। মা এবার তাঁকে ধমকে বলেন, “কি, আমাকে টাকার লােভ দেখাচ্ছ না কি? আমি টাকায় ভুলি না, যাও, টাকা নিয়ে যাও।” এই বলে উঠে গেলেন। 

পরে স্ত্রীলােকটির অনেক অনুনয়-বিনয়ে ঠিক হ’ল মহাষ্টমীর দিন দীক্ষা হবে। মেয়েটি তাে বিদায় নিলেন। মা এইবার পাশের ঘরে এসে ব'সে আমাকে ডাকলেন, “এস, মা, এই ঘরে এস। এতক্ষণ তােমাকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে পারি নি। কেমন আছ ?” 

বেলা শেষ হয়ে এসেছে, পূজার সময় বলে অনেক স্ত্রীলােক কাপড়, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন। মা হাসিমুখে তাঁদের কথার উত্তর দিচ্ছেন। খুব গরম, আমি মাকে হাওয়া করতে লাগলুম। একটি মহিলা এসে সাগ্রহে আমার হাত থেকে পাখাখানা চেয়ে নিয়ে মাকে হাওয়া করতে লাগলেন। মায়ের একটু সামান্য সেবার কাজ করতে পেলেও সকলের কি আনন্দ! আহা, কি অপূর্ব 

স্নেহ-করুণাতেই শ্রীশ্রীমা আমাদিগকে চিরবদ্ধ করে গেছেন আর তাঁর অবস্থানে বাগবাজারের মাতৃমন্দির সংসার-তাপদগ্ধ মানুষের কি মধুর শান্তিনিলয়ই হয়েছিল, তা বলা বা বুঝান অসম্ভব। 

এইবার আমিও রওনা হব। মাকে প্রণাম করতে গিয়ে বললুম, “মা, শীঘ্রই একবার বাপের বাড়ি যেতে হবে।” মা সন্দেহে বললেন, “আবার শীগগির এস, মা - চিঠিপত্র দিও।” মার জন্য একখানি কাপড় নিয়ে গিয়েছিলাম, আসবার সময় বলছেন, “তােমার কাপড়খানি দেখিয়ে দিয়ে যাও, মা - পরবাে।”

প্রায় আড়াই মাস পরে আবার একদিন (১৪ই অগ্রহায়ণ) গিয়েছি। সিঁড়ি উঠতেই কল-ঘরে মার সঙ্গে দেখা হল। মা কাপড় কাচতে গিয়েছিলেন। আধভিজে কাপড়েই এসে জিজ্ঞেস করে গেলেন, “এতদিন দেরিতে কেন এলে?” কাপড় কেচে এসে তক্তপােশের উপর বসতে কুশলপ্রশ্নাদির পর কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলুম, “সেই যে স্ত্রীলােকটি মন্ত্র নিতে চেয়েছিলেন, তার কি হল, মা ?”

মা -- সে সেদিন নিতে পারলে না। বলেছিলুম আমার অসুখ সারুক, তার পর নেবে- তাই হ’ল। অসুখ হওয়ায় সেদিন সে আসতে পারে নি। তার অনেক পরে একদিন এসে নিয়ে গিয়েছে। 

আমি - তাই তো মা, আপনার মুখ দিয়ে যে কথা বেরিয়ে পড়ে তাই হয়। আমরা আপনার ইচ্ছা না মেনে নিজেরা কষ্ট পাই, আপনিও নিজের অসুস্থ শরীরে অনেক সময় দয়া করে দীক্ষা দিয়ে আমাদের ভােগ নিজ শরীরে নিয়ে আরও বেশী কষ্ট পান।

মা বললেন, “হাঁ, মা, ঠাকুর ঐ কথা বলতেন। নইলে এসব শরীরে কি রােগ হয় ? এর মধ্যে আবার কলেরার মতাে হয়েছিল।” 

আমার ভাতৃবধূ, সঙ্গে গিয়েছিল। মা তাকে দেখে বললেন, “বেশ শান্ত বৌটি। এক ব্যন্নন নুনে পােড়া হলে মুশকিল হােত।” অথাৎ আমার ভাতৃবধূ একটি মাত্র, সে ভাল না হলে তাকে নিয়ে সংসারে থাকা কষ্টকর হােত। 

* স্বামী সুবোধানন্দ-ডাকনাম ‘খোকা’ মহারাজ। 

মাঘ, ১৩২০ 

একদিন সকালে গিয়েছি; বাগান থেকে অনেকগুলি ফুল তুলে নিয়ে গিয়েছিলুম। মায়ের নিকট উহা দিতে মা মহা আনন্দিত হয়ে ঠাকুরকে সাজাতে লাগলেন। নীল রঙের এক রকমের ফুল ছিল। সেইগুলি হাতে করে বললেন, “আহা, দেখছ কি রং! দক্ষিণেশ্বরে ‘আশা' বলে একটি মেয়ে একদিন বাগানে কাল-কাল-পাতা একটি গাছ থেকে সুন্দর একটি লাল ফুল তুলে হাতে নিয়ে খালি বলতে লাগল, ‘এ্যা, এমন লাল ফুল, তার এমন কাল পাতা। ঠাকুর, তােমার একি সৃষ্টি! এই বলে, আর হাউ হাউ করে কাঁদে। ঠাকুর তাই দেখে তাকে বলছেন, তাের হ’ল কি গাে, এত কাঁদছিস কেন ? সে আর কিছু বলতে পারে না, খালি কাঁদে, তখন ঠাকুর তাকে অনেক কথা বলে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেন। আহা, এই ফুলগুলি কেমন নীল রং দেখ! ফুল না হলে কি ঠাকুরকে মানায়।” এই বলে মা অঞ্জলি অঞ্জলি ফুল নিয়ে ঠাকুরকে দিতে লাগলেন। প্রথমবার দেবার সময় কয়েকটি ফুল সহসা তাঁর নিজের পায়ে পড়ে গেল দেখে বললেন, “ওমা, আগেই আমার পায়ে পড়ে গেল।” আমি বললুম, “তা বেশ হয়েছে।” মনে ভাবলুম, তােমার কাছে ঠাকুর বড় হলেও আমাদের কাছে তােমরা দুই-ই এক।

একটি বিধবা মহিলা এসেছেন। মাকে তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করলুম। মা বললেন, ‘মাসখানেক হ’ল দীক্ষা নিয়েছে। পূর্বে অন্য গুরুর নিকট দীক্ষিত হয়েছিল। তা মা, মনের ভ্রান্তি, আবার এখানে নিলে। গুরু, সবই এক, একথা বুঝলে না।” 

পরে প্রসাদ পাবার পর বিশ্রাম করতে গিয়ে কামারপুকুরের কথা উঠল। মা বললেন, “ঠাকুর যখন পেটের অসুখ করে কামারপুকুরে গিয়েছিলেন, আমি তখন ছেলেমানুষ বউটি ছিলুম গাে। ঠাকুর একটু রাত থাকতেই উঠে আমাকে বলতেন, কাল এই এই সব রান্না করো গাে। আমরা তাই রান্না করতুম। একদিন পাঁচফোড়ন ছিল না, দিদি (লক্ষীর মা) বললে, তা অমনিই হােক, নেই তার কি হবে। ঠাকুর তাই শুনতে পেয়ে ডেকে বলছেন, “সে কি গাে পাঁচফোড়ন নেই, তা এক পয়সার আনিয়ে নাও না; যাতে যা লাগে তা বাদ দিলে হবে না। তােমাদের এই ফোড়নের গন্ধের ব্যান্নন খেতে দক্ষিণেশ্বরের মাছের মুড়াে পায়েসের বাটি ফেলে এলাম আর তাই তােমরা বাদ দিতে চাও?’ দিদি তখন লজ্জা পেয়ে আনতে দিলে। সেই বামুন ঠাকরুণও (যােগেশ্বরী) তখন ওখানে ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে মা বলতেন। আমিও তাঁকে শাশুড়ীর মতাে দেখতুম ও ভয় করতুম। তিনি বড় ঝাল খেতেন। নিজে রান্না করতেন—কালে পােড়া । আমাকে খেতে দিতেন, চোখ মুছতুম আর খেতুম। জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন হয়েছে। ভয়ে ভয়ে বললুম, 'বেশ হয়েছে। রামলালের মা বলত, ‘হ্যাঁ, যে ঝাল হয়েছে।’ আমি দেখতুম, তিনি তাতে অসন্তুষ্ট হতেন; বলতেন, “বৌমা তো বলেছে ভাল হয়েছে। তােমার বাপু; কিছুতে ভাল হয় না। তােমাকে আর ব্যান্নন দেব না'।” এই বলে মা খুব হাসতে লাগলেন।

আবার ফুলের কথা উঠলো। মা বললেন, “দক্ষিণেশ্বরে থাকতে একদিন আমি রঙ্গনফুল আর জুঁইফুল দিয়ে সাত লহর গড়ে মালা গেঁথেছি ! বিকেল বেলা গেঁথে পাথরের বাটিতে জল দিয়ে রাখতেই কুঁড়িগুলি সব ফুটে উঠল। মাকে পরাতে পাঠিয়ে দিলুম। গয়না খুলে মাকে ফুলের মালা পরানাে হয়েছে। এমন সময়ে ঠাকুর মাকে দেখাতে গিয়েছেন, দেখে একেবারে ভাবে বিভাের। বারবার বলতে লাগলেন, ‘আহা, কাল রঙে কি সুন্দরই মানিয়েছে।’ জিজ্ঞাসা করলেন, “কে এমন মালা গেঁথেছে ? আমি গেঁথে পাঠিয়েছি একজন বলাতে তিনি বললেন, “আহা, তাকে একবার ডেকে নিয়ে এস গাে, মালা পরে মায়ের কি রূপ খুলেছে একবার দেখে যাক। বৃন্দের ঝি গিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে এল। মন্দিরের কাছে আসতেই দেখি, বলরামবাবু, সুরেনবাবু - এরা সব মায়ের মন্দিরের দিকে আসছেন, আমি তখন কোথায় লুকুই। বৃন্দের আঁচলটি টেনে ঢাকা দিয়ে তার আড়ালে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলুম। ওমা, ঠাকুর তা জানতে পেরে বলছেন, ওগাে, ওদিক দিয়ে উঠো মা। সেদিন এক মেছোনী উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মরেছে। সামনের দিক দিয়ে এস না। তাঁর ঐ কথা শুনে বলরামবাবুরা সরে দাঁড়ালেন। গিয়ে দেখি-মায়ের সামনে ঠাকুর ভাবে প্রেমে গান ধরে দিয়েছেন।” কয়েকজন স্ত্রী ভক্ত আসাতে উপস্থিত প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। আমারও যাবার সময় হয়ে এল। মা বললেন, আমাকে একটি জিনিস দেবেন - কাপড় কেচে এসে। 

আবার মুক্তির কথা উঠল। মা বললেন, “ও কি জান মা, যেন ছেলের হাতের সন্দেশ ! কেউ কত সাধাসাধি করছে, ‘একটু দে না, একটু দে না,’ তা কিছুতেই দেবে না ; অথচ যাকে খুশি হল, টপ করে তাকে দিয়ে ফেললে। একজন সারা জীবন মাথা খুঁড়ে কিছু করতে পারলে না, আর একজন ঘরে বসে পেয়ে গেল। যেমনি কৃপা হ’ল, অমনি তাকে দিয়ে দিলে। কৃপা বড় কথা।” এই বলে কাপড় কাচতে গেলেন। বৈকালী ভােগের পর বেল পাতায় মুড়ে আমাকে যা দেবেন বলেছিলেন দিয়ে বললেন, “মাদুলি করে পরে। এটির কথা কাউকে বোলাে না। তা হলে সবাই আমাকে ছিঁড়ে খাবে।” শ্রীশ্রীমাকে বালিগঞ্জে শ্রীমানের বাসায় যাবার কথা বললুম ; মা বললেন - যাবেন। মা আমায় বললেন, “আমাকে একখানা শীতলপাটি দিও, মা, আমি শোব।” 

আমি - সে তাে আমার সৌভাগ্য, অবশ্য আনব।
এই বলে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। 

মা বললেন, “আবার এস।” 

জ্যৈষ্ঠ, ১ম সপ্তাহ - ১৩২১ 

আজ মা বালিগঞ্জের বাসায় আসবেন। পূর্বদিন হ’তে সব বন্দোবস্ত হচ্ছে। মার জন্য পৃথক, আসন, নূতন শ্বেতপাথরের বাসন ইত্যাদি কেনা হয়েছে। মা আসবেন। আনন্দে সারারাত ঘুমই হ’ল না। কথা ছিল, মা অপরাহ্নে আসবেন। পাছে কোন কারণে তাঁর অন্য মত হয়, সেজন্য প্রাতেই শ্রীমান শােকহরণ বাগবাজারে মার বাড়িতে গাড়ি নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আর আমরা সংসারের কাজ সব সকাল সকাল চুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। মায়ের আসন পেতে চারিদিকে ফুল সাজিয়ে রাখলুম, সমস্ত ঘরদোরে গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলাম, ফুলের মালা গেঁথে রাখলুম এবং বড় দুটি ফুলের তােড়া করে মায়ের আসনের দু'পাশে দিলুম। বেলা পড়তেই পথ চেয়ে আছি কখন মা আসবেন। এইবার এতক্ষণে সেই শুভ মুহূর্ত! গাড়ির শব্দ হতেই সকলে নীচে নেমে এলুম। গাড়ি থামতেই দেখলুম, মা হাসিমুখে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের পানে চেয়ে আছেন। গাড়ি হ'তে নামতেই সকলে তাঁর পদূধলি নেবার জনা ব্যস্ত হলুম।

মায়ের সঙ্গে গােলাপ-মা, ছোটদিদি, নলিনীদিদি, রাধু এবং চার-পাঁচজন সাধু-ব্রহ্মচারী এসেছেন। শ্রীশ্রীমাকে উপরে নিয়ে আসনে বসিয়ে প্রণাম করলুম। মা বললেন, “খেয়েছ তাে ? আমি কত তাড়াতাড়ি করেছি, কিন্তু কিছুতেই আর এর চেয়ে সকালে হয়ে উঠল না। এতক্ষণে তবে আসা হ’ল” এই বলে চিবুকে হাত দিয়ে চুমাে খেলেন। আমি আর বসতে পারলাম না, খাবারের আয়ােজন করতে ও নিমকি ভাজতে হবে। আর সব খাবার ইতঃপূর্বে ঠিক করা ছিল। 

উপরে গ্রামােফোনে গান হচ্ছে। কাজ করতে করতে একটু ফাঁক পেয়ে ছুটে গিয়ে  দেখি - মা কলের গান শুনে ভারী খুশী, আর “কী আশ্চর্য কল করেছে।” - বলে বালিকার মতাে আনন্দ করছেন। খুব গ্রীষ্ম - মা বারান্ডায় শীতল পাটিতে শুয়ে আছেন এবং তাঁর আশেপাশে সবাই বসে আছেন। একটি পাথরের বাটীতে বরফ-জল দেওয়া হয়েছে, মা মাঝে মাঝে খাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে মা বললেন, “ওগাে, একটু বরফ-জল খেয়ে যাও।” মায়ের প্রসাদী জলটুকু খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নীচে রান্নাঘরে আবার ছুটে এলুম। আজ এত তাড়াতাড়ি করেও যেন কাজ আর সেরে উঠতে পাচ্ছি নে। | সন্ধ্যার পরে পাশের ঘরে ভােগ সাজান হ’ল। মা এসে গােলাপ-মাকে ঠাকুরের ভােগ নিবেদন করে দিতে বলতে তিনি বললেন, “তুমিই দাও, তুমি উপস্থিত থাকতে আমি কেন ?” তখন শ্রীশ্রীমা নিজেই ভােগ নিবেদন করতে বসলেন এবং “আহা, কি সুন্দর সাজিয়েছে!” বলে তারিফ করতে লাগলেন। এইরুপ সবেতেই বালিকার মতাে আনন্দ প্রকাশ করে আমাদের অপরিসীম আনন্দ দিতে লাগলেন। ভােগ দেওয়া হলে মা ও অন্য সকলে প্রসাদ গ্রহণ করতে বসলেন। সকলের আগে মায়ের খাওয়া হয়ে গেল। বারান্ডায় একখানি বেতের ইজিচেয়ারে বসে আমায় ডেকে বলছেন, “ওগাে, আমায় পান দিয়ে যাও।” আমি তখনও গােলাপ-মায়ের পরিবেশন করছিলুম। তাড়াতাড়ি গিয়ে পান দিয়ে এলুম। মাকে পান চেয়ে খেতে হ’ল বলে একটু লজ্জিতা হলুম। সুমতিকে বললুম, “পান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস নি, দেখছিস আমি এদিকে রয়েছি ?” একটু পরে মা একবার কলতলায় গেলেন। আমি আলাে নিয়ে সঙ্গে গেলুম। বাগানের এই দিকটি বেশ নির্জন, পথে দু'পাশে ক্রোটন-গাছের সার। মা সস্নেহে বললেন, “আহা, একটুও বসতে পেলে না কাজের জন্যে। যেয়ো ওখানে, তােমার মাকে নিয়ে যেয়াে।” আমার মা বেড়াতে এসেছিলেন। ভাগ্য ক্রমে ঘরে বসেই শ্রীশ্রীমায়ের দর্শন পেয়ে গেলেন।

তারপর বিদায়ের ক্ষণ এল। মোটরগাড়িতে যেতে মায়ের মত নাই। কারণ একবার মাহেশের রথ দেখতে যেতে তাঁর মােটরের তলায় নাকি একটা কুকুর চাপা পড়ে, কিন্তু অত দূরে বাগবাজারে মােটরে না গেলে রাত হবে, কষ্টও হবে বলায় ভক্তদের মতেই শেষে বাজী হলেন। বারবার ঠাকুরকে প্রণাম করে প্রস্তুত হলেন এবং আমাদের আশীর্বাদ করে গাড়িতে উঠলেন।

 *************

একদিন রাত্রে গিয়েছি। মা শুয়ে আছেন। কালাে-বউ (মা ঐ নামেই তাঁকে ডাকতেন) কাছে বসে আছেন। মা উঠে বসলেন - প্রণাম করবো সেইজন্য। প্রণাম করতেই কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে আবার শয়ন করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে বললেন। পরে কথাপ্রসঙ্গে বলতে লাগলেন, “শােনাে, মা, বিধাতা যখন প্রথম মানুষ সৃষ্টি করলেন, তখন একপ্রকার সত্ত্বগুণী করেই করলেন। ফলে তারা জ্ঞান নিয়ে জন্মাল, সংসারটা যে অনিত্য তা বুঝতে আর তাদের দেরি হল না। সুতরাং তখনি তারা সব ভগবানের নাম নিয়ে তপস্যা করতে বেরিয়ে পড়ল এবং তার মুক্তিপদে লীন হয়ে গেল। বিধাতা দেখলেন, তবে তাে হল না। এদের দিয়ে তাে সংসারে লীলা-খেলা কিছু করা চলল না। তখন সত্বের সঙ্গে রজঃ তমঃ অধিক করে মিশিয়ে মানুষ সৃষ্টি করলেন। এবার লীলাখেলা চলল ভাল।" এই পর্যন্ত বলে সৃষ্টিপ্রকরণ সম্বন্ধে সুন্দর একটি ছড়া বললেন। তারপর বললেন, “তখন, মা, যাত্রা কথকতা এই সব ছিল। আমরা কত শুনেছি, এখন আর তেমনটি শােনা যায় না।” ইতিমধ্যে কালাে-বউ অন্য ঘরে উঠে গিয়ে নলিনীদিদি ও মাকুর কাছে কি একখানা বই চেঁচিয়ে পড়ছিল। মা তাই শুনে বললেন, “দেখছ মা, অত চেঁচিয়ে পড়ছে, নীচে সব কত লােক রয়েছে, তা হুঁশ নেই ? ” 

রাধারানীর মা এসে বললেন, “লক্ষ্মীমণিরা নবদ্বীপে যাবে, তা তুমি আমায় তাদের সঙ্গে যেতে দিলে না।” ঐ কথা বলেই তিনি অভিমান করে চলে গেলেন। মা বললেন, “ওকে যেতে দেব কি মা, সে (লক্ষ্মী) হ’ল ভক্ত, ভক্তদের সঙ্গে মিশে কত নাচবে গাইবে, হয়তাে জাতের বিচার না করে তাদের সঙ্গে খাবে* ও-তো সে সব ভাল বুঝবে না, দেশে এসে লক্ষ্মীর নিন্দে করবে। 

তুমি দেখেছ লক্ষ্মীকে?” 

আমি বললুম, “না, মা।” 

মা - দক্ষিণেশ্বরেই তাে আছে, দেখাে। দক্ষিণেশ্বরে গেছ তাে ? 

আমি - হ্যাঁ, মা, অনেক বার গেছি। তা তিনি যে সেখানে আছেন, তা জানতুম না। 

মা - দক্ষিণেশ্বরে আমি যে নবতে** থাকতুম, দেখেছ ? 

আমি - বাইরে থেকে দেখেছি। 

মা - ভিতরে গিয়ে দেখাে। ঐ ঘরটুকুর মধ্যেই সব সংসার ছিল - মায় ঠাকুরের জন্য হাঁড়িতে করে মাছ জিয়ান পর্যন্ত। প্রথমে যখন কলকাতায় আসি আগে জলের কল-টল তাে কিছু দেখি নি, একদিন কলঘরে*** গেছি - দেখি কল সোঁ সোঁ করে সাপের মতাে গর্জাচ্ছে। আমি তো মা, ভয়ে এক ছুটে মেয়েদের কাছে গিয়ে বলছি ‘ওগাে, কলের মধ্যে একটা সাপ এসেছে, দেখবে এস। সোঁ সোঁ করছে।’ তারা হেসে বললে, ওগাে, ও সাপ নয়, ভয় পেয়াে না। জল আস বার আগে অমনি শব্দ হয়। আমি তাে হেসে কুটিপাটি। 

এই বলেই মা খুব হাসতে লাগলেন। সে কি সরল মধুর হাসি। আমিও আর হাসি চেপে রাখতে পারলুম না, ভাবলুম—এমনি সরলই আমাদের মা বটেন। 

মা - বেলুড়ে ঠাকুরের উৎসব দেখেছ ? 

আমি - না, মা, কখনও বেলুড়ে যাই নি। শুনেছি, সেখানে মেয়েদের গিয়ে গােল করা সাধু-ভক্তরা পছন্দই করেন না। সেই ভয়ে আরাে যাই নি। 

মা -- যেয়াে না একবার, ঠাকুরের উৎসব দেখতে যেয়াে। 

আর একদিন শ্রীশ্রীমা রাস্তার ধারে বারান্ডায় এসে আমাকে আসনখানি পেতে হরিনামের ঝুলিটি এনে দিতে বললেন, তা এনে দিলে বসে জপ করতে লাগলেন। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এমন সময় সামনের মাঠে যেখানে কুলি-মজুর-গােছের কতকগুলি লােক স্ত্রী-পূত্র নিয়ে বসবাস করতাে, সেখানে একজন পুরুষ, সম্ভবতঃ তার স্ত্রীকে বেদম মার সুরু করে দিলে - কিল, চড়, পরে এমন এক লাথি মারলে যে, স্ত্রীলোকটির কোলে ছেলে ছিল, ছেলেসুদ্ধ গড়িয়ে এসে উঠানে পড়ে গেল। আহা, তার উপর এসে আবার কয়েক লাথি! মায়ের জপ করা বন্ধ হয়ে গেল। একি আর তিনি সহ্য করতে পারেন? অমন যে অপূর্ব লজ্জাশীলা, গলার স্বরটি পর্যন্ত কেহ কখনও নীচে থেকে শুনতে পেত না—একেবারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে উঠে তীব্র ভর্ৎসনার স্বরে বললেন, “বলি ও মিনসে, বউটাকে একে বারে মেরে ফেলবি নাকি, আঃ মলাে যা!” লোকটা একবার তাঁর দিকে তাকিয়েই অত যে ক্রোধদ্মত্ত হয়েছিল, যেন সাপের মাথায় ধুলােপড়া দেওয়ার মতাে অমনি মাথা নীচু করে বউটাকে তখনি ছেড়ে দিল। মায়ের সহানুভূতি পেয়ে বউটির তখন কি কান্না! শুনলুম, তার অপরাধ--সে সময়মত ভাত রান্না করে রাখে নি। খানিক পরে পুরুষটার রাগ পড়ল এবং অভিমান ও সাধাসাধির পালা শুরু হ’ল দেখে আমরাও ঘরে চলে এলুম।

কিছুক্ষণ পরে একজন ভিক্ষুকের স্বর রাস্তায় শােনা গেল--“রাধাগোবিন্দ, ও মা নন্দরানী, অন্ধজনে দয়া কর, মা” ইত্যাদি। মা শুনতে পেয়ে বললেন, “প্রায়ই রাতে এই রাস্তা দিয়ে ঐ ভিখারীটি যায়, ‘অন্ধজনে দয়া কর, মা’ আগে এই ওর বুলি ছিল। তা গোলাপ ওকে সেদিন বলেছিল ভাল - “ওরে, সঙ্গে সঙ্গে একবার রাধাকৃষ্ণের নামটিও কর। গৃহস্থেরও কানে যাক, তােরও নাম করা হােক। তা নয়, ‘অন্ধ অন্ধ করেই গেলি। সেই হ’তে ও এখানে এলেই এখন রাধাগােবিন্দ’ বলে দাঁড়ায়। গােলাপ ওকে একখানি কাপড় দিয়েছে, পয়সাও পায়।” 

একদিন সন্ধ্যাবেলা গেছি, শুনি মা বলছেন—“নূতন ভক্তদের ঠাকুরসেবা করতে দিতে হয়, কারণ তাঁদের নবানুরাগ, সেবা হয় ভাল। আর, ওরা সব সেবা করতে করতে এলিয়ে পড়েছে। সেবা কি করলেই হয়, মা ! সেবাপরাধ না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখা চাই। তবে কি জান, মানুষ অজ্ঞ জেনে তিনি ক্ষমা করেন।” জনৈকা সেবিকা কাছে ছিলেন, তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন কিনা বুঝতে পারলুম না - কেননা বললেন, “চন্দনে যেন খিচ না থাকে, ফুল-বিল্বপত্র যেন পােকা-কাটা না হয়। পূজো বা পূজোর কাজের সময় যেন নিজের কোন অঙ্গে, চুলে বা কাপড়ে হাত না লাগে। একান্ত যত্নের সঙ্গে ঐ সব করা চাই। আর ভােগরাগ সব ঠিক সময়ে দিতে হয়। 

রাত্রি প্রায় ৮টা। আজ গিয়ে দেখি, মা তখন ঠাকুরঘরের উত্তরে রাস্তার দিকের বারান্ডায় অন্ধকারে বসে জপ করছেন। পাশের ঘরে আমরা বসবার খানিক পরে মা উঠে এলেন এবং হাসিমুখে বললেন, “এসেছ মা, এস।”

আমি - হ্যাঁ মা, আজ আমরা দু’ বােনে এসেছি। আরতি কি হয়ে গেছে? 

মা - না এখনও হয় নি। তােমরা আরতি দেখ, আমি আসছি। 

আরতি আরম্ভ হ’ল। অনেকগুলি মহিলা ঠাকুরঘরে জপ করতে বসলেন। আরতি সাঙ্গ হলে আমরা প্রণাম করে মায়ের উদ্দেশে পাশের ঘরে গেলুম। ওখানে গেলে এক মুহূর্তও মাকে চোখছাড়া করতে ইচ্ছা হয় না। খানিক পরে মা কাছে এসে বসলেন। একটি বৃদ্ধা অপর একজনের কাছে ভক্তি রসাত্মক একটি গান শিখছিলেন। মা তাই শুনে বললেন, “হাঁ, ও যা শিখাবে—দু ছত্র বলে আবার দু' ছত্র বাদ দিয়ে বলবে! আহা, গান গাইতেন তিনি (ঠাকুর) যেন মধুভরা, গানের উপর যেন ভাসতেন! সে গানে কান ভরে আছে। এখন যে গান শুনি, সে শুনতে হয় তাই শুনি। আর নরেনের কি পঞ্চমেই সুর ছিল। আমেরিকা যাবার আগে আমাকে গান শুনিয়ে গেল ঘুসুড়ীর বাড়িতে। বলেছিল, মা, যদি মানুষ হয়ে ফিরতে পারি, তবেই আবার আসব, নতুবা এই-ই। আমি বললুম, “সে কি! তখন বললে, “না, না, আপনার আশীর্বাদে শীঘ্রই আসব।' আর গিরিশ বাবু এই সেদিনও গান শুনিয়ে গেলেন। সুন্দর গাইতেন।’

রাধু, এই সময় মাকে তার কাছে গিয়ে শুতে বলায় মা বললেন, “তুমি যাও না, শোওগে। আহা, ওরা কতদূর থেকে এসেছে, আমি এদের কাছে একটু বসি।” রাধু, তবু, ছাড়ে না দেখে আমি বললুম, “আচ্ছা, মা, চলুন ও ঘরেই ( ঠাকুরঘরে ) চলুন, শােবেন ।” মা বললেন, “তবে তােমরাও এস।” আমরাও গেলুম। মা শুয়ে শুয়ে কথা বলতে লাগলেন এবং আমি বাতাস করতে লাগলুম। খানিক পরে মা বললেন, “এখন বেশ ঠান্ডা হয়েছে, আর না। আমি তখন পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলুম। একজন বৃদ্ধা অপর একজনকে যােগশাস্ত্রের ষটচক্রভেদ ও বিভিন্ন পদ্মের বীজাদি সম্বন্ধে কিছু বলছিলেন। গােলাপ-মা বললেন, “ও সব বীজ-মন্ত্র অমন করে বলতে নেই।” তবু তিনি বলতে লাগলেন। মা ঐ সব কথা শুনতে শুনতে সহাস্যে আমাকে বললেন, “ঠাকুর নিজ হাতে আমাকে কুল-কুণ্ডলিনী, ষট়্চক্র একে দিয়েছিলেন।” 

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সেখানি কই, মা ?” 

মা — আহা মা, এত যে হবে তা কি তখন জানি ? সেখানি কোথায় যে হারিয়ে গেল, আর পেলুম না। 

রাত প্রায় এগারটা হয়েছিল। আমরা প্রণাম করে বিদায় নিতে মা আশীর্বাদ করে দুর্গা, দুর্গা” বলতে বলতে উঠে বসলেন। যাবার পূর্বে একান্তে আমাদের বললেন, “দেখ, মা, স্বামী-স্ত্রী একমত হলে তবে ধর্মলাভ হয়।” 

* শ্রীশ্রীঠাকুর বলতেন, ভক্তেরা এক আলাদা জাত, ভক্তের স্বভাব গাঁজাখােরের মতাে ইত্যাদি। 

**উত্তর দিকের নহবতের নীচের কুঠরিতে মা থাকতেন। 

*** কলিকাতা কাঁসারীপাড়ায় গিরিশ ভট্টাচার্যের বাড়ি শ্রীশ্রীমার সহােদয় প্রসন্ন মুখােপাধ্যায়ের বাসায় তখন মা উঠেছিলেন। 
কার্তিক, ১৩২১ 

আমাদের বালিগঞ্জের বাসায় ফুলের অভাব ছিল না। মা ফুল পেলে খুব খুশী হন বলে অনেক ফুল যােগাড় করে নিয়ে একদিন ভােরে মায়ের কাছে গেলুম। দেখি মা সবে পূজার আসনে বসেছেন। আমি ফুলগুলি সাজিয়ে দিতে ভারি খুশী হয়ে পূজোয় বসলেন। শিউলি ফুল দেখে বললেন, “এ ফুল এনে বেশ করেছ। কার্তিক মাসে শিউলি ফুল দিয়ে পূজো করতে হয়। এবার আজ পর্যন্ত এই ফুল ঠাকুরকে দেওয়া হয়নি।” 

আমি আজ মায়ের শ্রীচরণপূজার ফুল আলাদা করে রাখিনি। সেজন্য ভাবলুম, আজ আর বােধ হয় মাকে পূজা করা হবে না; কিন্তু ফলে দেখলুম আমার ঐরুপ ভাববার আগেই মা সকল কথা ভেবে রেখেছেন। কারণ, সমস্ত ফুলগলিতে চন্দন মাখিয়ে মন্ত্রদ্বারা পুস্পশুদ্ধি করে নিয়ে পূজা করতে বসবার সময় দেখলাম তিনি থালার পাশে কিছু ফুল আলাদা করে রেখে দিলেন। পরে পূজা শেষ হলে উঠে বললেন, “এস গো মা, ঐ থালায় তােমার জন্য ফুল রেখেছি, নিয়ে এস।” এই সময় একটি ভক্ত অনেকগুলি ফল নিয়ে মাকে দর্শন করতে উপস্থিত হলেন। ভক্তটিকে দেখে মা খুব আনন্দিত হলেন, কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে চিবুকে হাত দিয়ে চুমো খেলেন। কোন পুরুষ-ভক্তকে এইরূপে আদর করতে আমি এ পর্যন্ত মাকে দেখি নি। তারপর আমাকে বললেন, “মা, তােমার ঐ ফুল হতে চারটি ওকে দাও তাে।” আমি দিতে গেলে ভক্তটি অঞ্জলি পেতে ফুল নিলেন। দেখলুম ভক্তির প্রবাহে তখন তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। তিনি সানন্দে মায়ের পায়ে পুম্পাঞ্জলি দিলেন এবং প্রসাদ নিয়ে বাহিয়ে গেলেন। শুনলুম তিনি রাঁচি হ’তে এসেছেন। তক্তাপােশখানিতে বসে মা এইবার সস্নেহে আমাকে ডেকে বললেন, “এইবার এস গাে।” আমি শ্রীচরণে অঞ্জলি দিয়ে উঠতেই মা চুমাে খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। এইবার আমরা পান সাজতে গেলুম। পান সেজে এসে মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি - মা ছাদে চুল শুকাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, “এস, মাথার কাপড় ফেলে দাও, চুল শুকিয়ে নাও, অমন ক'রে ভিজে চুলে থেকো না, মাথায় জল বসে চোখ খারাপ হয়।” এর মধ্যে আর একটি স্ত্রী-ভক্তও তথায় উপস্থিত হলেন। ছাদে অনেক গুলি কাপড় শুকাচ্ছিল, মা আমাকে সেইগুলি তুলে কুঁচিয়ে রাখতে বললেন। আমি কাপড়গুলি তুলছি, এমন সময় গােলাপ-মা শ্রীশ্রীমাকে ডেকে নীচে নেমে আসতে বললেন; কারণ ঠাকুরকে ভােগ দিতে হবে। মা নীচে নেমে গেলেন। আমিও খানিক পরে ঠাকুরঘরে গিয়ে দেখি-মা সলজ্জা বধূটির মতাে ঠাকুরকে বলছেন, “এস, খেতে এস।” আবার গােপালবিগ্রহের কাছে বলছেন, “এস গােপাল, খেতে এস।” আমি তখন তার পিছনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টি পড়তেই হেসে বললেন, “সকলকে খেতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছি। এই কথা বলে মা ভােগের ঘরের দিকে চললেন। তাঁর তখনকার ভাব দেখে মনে হল যেন সব ঠাকুররা তাঁর পিছনে চলেছেন। দেখে খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

ভােগের ঘর (সর্বদক্ষিণের ঘর) হতে ফিরে এসে মা পাশের ঘরে সকলকে সঙ্গে নিয়ে প্রসাদ পেতে বসলেন। আহারান্তে পাশের ঘরে বিছানা করে দিলুম, মা শয়ন করলেন। কাছে বসতেই মা বললেন, “শােও, এই খেয়ে উঠেছ।” শুয়েছি, মায়ের একটু তন্দ্রার মতো এসেছে, এমন সময় বলরামবাবুর বাড়ির চাকর “ঠাকুর-মা, ঠাকুর-মা” করে ডেকে ঠাকুরঘরে কতকগুলি আতা রেখে গেল। একটি চুপড়ি তে আতা ছিল, লােকটি নীচে সাধুদের কাছে গিয়ে চুপড়িটি কি করবে জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা বললেন, “ও আর কি হবে রাস্তায় ফেলে দে।” সে ফেলে দিয়ে চলে যেতেই মা উঠলেন এবং ঠাকুরঘরের রাস্তার দিকের রাস্তায় গিয়ে আমাকে ডেকে বলছেন, “দেখেছ কেমন সুন্দর চুপড়িটি। ওরা তখন ফেলে দিতে বললে। ওদের কি ? সাধু, মানুষ ও সবে কি আর মায়া আছে ? আমাদের কিন্তু সামান্য জিনিসটিও অপচয় করা সয় না। এটি থাকলে তরকারির খােসাও রাখা চলত।” এই বলে চুপড়িটি আনিয়ে ধুইয়ে রেখে দিলেন। মার এই কথায় ও কাজে আমার বেশ একটু শিক্ষা হয়ে গেল। কিন্তু ‘স্বভাব যায় না মলেও’। 

কিছুক্ষণ পরে নীচে একজন ভিক্ষুক এসে ‘ভিক্ষে দাও’ বলে চীৎকার করছিল। সাধুরা বিরক্ত হয়ে তাকে তাড়া দিয়ে উঠেছেন “যাঃ, এখন দিক করিস নে।” মা তাই শুনতে পেয়ে বললেন, 'দেখেছ দিলে ভিখারীকে তাড়িয়ে। ঐ যে নিজেদের কাজ ছেড়ে একটু উঠে এসে ভিক্ষা দিতে হবে, এইটুকুও আর পারলে না, আলস্য হ’ল। ভিখারীকে একমুঠো ভিক্ষা দিতে পারলে না। যার যা প্রাপ্য, তা হ’তে তাকে বঞ্চিত করা কি উচিত? এই যে তরকারির খােসাটা, এও গরুর প্রাপ্য। ওটিও গরুর মুখের কাছে ধরতে হয়।” 

বেলা প্রায় শেষ হয়ে এল। আমার রওনা হবার সময় হয়ে এসেছে। শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে কিছু প্রসাদ নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলুম। 

আজ সন্ধ্যায় গেছি। কাছে হবে বলে এখন বাগবাজারের বাসায় আছি এবং রােজই প্রায় শেষ বেলায় মার কাছে যাই। নিরিবিলি দেখে আজ তাঁকে একটি স্বপ্নবৃত্তান্ত বললুম, “মা, একদিন স্বপ্নে দেখি আপনি তখন জয়রাম বাটীতে, আমি যেন সেখানে গিয়েছি। ঠাকুরকে সামনে দেখে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলুম, মা কোথায়? তিনি বললেন, ঐ গলি ধরে যাও, খড়ের ঘরে সামনের দাওয়ায় বসে আছে।” মা শয়ন করেছিলেন, উৎসাহে একেবারে উঠে ব'সে বললেন, “ঠিক, মা, ঠিকই তো দেখেছ।” 

আমি - সত্য না - কি, মা? আমার কিন্তু এতদিন ধারণা ছিল, আপনার পিত্রালয় ইটের কোঠাবাড়ি। তাই মাটির দাওয়া, খড়ের চালা দেখে ভাবলুম মনের ভ্রান্তি। 

‘ভগবানের জন্য তপস্যা করা প্রয়োজন' এই কথাপ্রসঙ্গে মা এখন বললেন, “আহা গােলাপ, যোগীন ওরা কত ধ্যান-জপ করেছে। যােগীন কতবার চাতুর্মাস্য করেছে - একবার শুধু কাঁচা দুধ ও ফল খেয়ে ছিল। এখনও কত জপ-ধ্যান করে ! গােলাপের মনে বিকার নেই, দিলে হয় তাে খানিকটা দোকানের রাঁধা আলুর দম খেয়ে!” 

আজ মায়ের বাড়িতে কালীকীর্তন হবে। মঠের সন্ন্যাসী মহারাজেরাই কীর্তন করবেন। রাত প্রায় সাড়ে আটটায় কীর্তন আরম্ভ হল। মেয়েরা গান শুনবার জন্য অনেকেই বারান্ডায় গেলেন। আমি মায়ের পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছিলুম। ওখান হতেও বেশ শুনা যাচ্ছিল। এই সব গান আরও কতবার শুনেছি, কিন্তু ভক্তদের মুখে গানের শক্তি যেন আলাদা—কতই ভাবপূর্ণ বোধ হ’ল ! চোখে জল আসতে লাগল। শ্রীশ্রীঠাকুর যে-সব গান করতেন, মাঝে মাঝে যখন সেই গান দু-একটি হচ্ছে, মা সােৎসাহে বলতে লাগলেন, “এই গাে, এইটি ঠাকুর গাইতেন।” তারপর যখন ‘মজলাে আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে’-এই গানটি আরম্ভ হল তখন মা আর শয়ন করে থাকতে পারলেন না-চোখে দু-এক ফোঁটা অশ্রু, উঠে বললেন, “চল মা, বারান্ডায় গিয়ে শুনি।” কীতন শেষ হলে মাকে প্রণাম করে বাসায় ফিরলুম।

২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৫ 

বৈশাখ মাসে শ্রীশ্রীমা জয়রামবাটী হ’তে এসেছেন। ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগে দেহ জীর্ণ শীর্ণ। একটু সুস্থ হলেই দেখা করা উচিত মনে করে এবং তাঁর অসুস্থ শরীর বলে এখনও কাউকে বড় একটা দর্শন করতে দেয়া হচ্ছে না শুনে এতদিন দেখতে যাইনি। পরে মেয়েদের আসতে বাধা নাই’ - আজ এই মর্মে চিঠি পেয়ে গিয়ে দেখি, মা পাশের ঘরটিতে শুয়ে আছেন। দেহ অত্যন্ত শীর্ণ। আমাকে দেখেই বললেন, “এস, মা, এতদিনে এলে গাে।” 

“হ্যাঁ, মা, কবেই তাে আসতুম, কিন্তু শুনেছিলুম, এখনও আপনার অসুখের জন্য আপনার ভক্ত-ছেলেরা সকলের অবাধ আসাটা পছন্দ করছেন না, তাই এত দিন আসি নি। আপনার জন্যে আমাদের প্রাণ ছটফট করে, আর আপনি বাপের বাড়ি গিয়ে এতদিন আমাদের বেশ ভুলে ছিলেন। তা আপনার তাে সর্বত্রই ছেলেমেয়ে রয়েছে, অভাব তাে নেই।”

মা হেসে বললেন, “না, মা, না তােমাদের কারও কথা আমি ভুলি নি, সকলের কথাই মনে করেছি।”

“আপনার অসুখ শুনে আমরা তাে ভয়েই মরি, না জানি কেমন আছেন।” 

“আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি, মা, দেখ না পায়ে হাতে কি ছালচামড়াটা উঠে যাচ্ছে।” 

পায়ে হাত দিয়ে দেখি সত্যিই ঐরূপ হয়েছে। 

একখানি কাপড় নিয়ে গিয়েছিলুম, দিতেই মা বলছেন, “বেশ কাপড়খানি এনেছ, মা, এবার কাপড় কমও আছে, পূজোর সময় তো এখানে ছিলুম না। বউ-মা সেদিন এসেছিল। তারা সব ভাল আছে ?” শ্রীমান শােহরণের কথা জিজ্ঞাসা করে বললেন, “তার এখন কি করে চলছে ? কাজকর্ম-চাকরি কিছুরই তাে এখন সুবিধা নেই। কি পােড়া যুদ্ধ লেগেছে ! কতদিনে যে থামবে, লােকে খেয়ে পরে বাঁচবে! তা এ যুদ্ধটা গােড়ায় লাগল কেন বলতাে, মা?” আমি কাগজপত্রে যা পড়েছিলুম কিছু কিছু বলতে লাগলুম।

অধিক কথা কইলে পাছে তাঁর অসুখ বাড়ে এই ভেবে আজ অল্পক্ষণ থেকে বিদায়গ্রহণ করলুম। 
 ৬ই শ্রাবণ, ১৩২৫ 

রাত সাড়ে সাতটা, মায়ের শ্রীচরণদর্শনে গিয়েছি, প্রণাম করতেই বললেন, এস, মা, বস। ভারি গরম, বসে একটু ঠাণ্ডা হও। তারা গিয়ে পৌঁছেছে --সুমতিরা ? 

“হ্যাঁ, মা, তারা গেলে পরেই আমি এসেছি।” 

মা — একখানা পাখা রাধুকে দিয়ে এস, আর এই মরিচাদি তেলটা নাও। পিঠ মালিশ করে দাও। দেখেছ মা, হাতে পেটে আর জায়গা নেই - আমবাতে ঘামাচিতে ভরে গেছে। 

আমি মালিশ করতে বসতেই আরতির ঘণ্টা বেজে উঠল। মা উঠে বসে করজোড়ে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন। অন্য সকলে আরতি দেখতে ঠাকুরঘরে চলে গেলেন। 

মা - দেখ, মা, সকলেই বলে ‘এ দুঃখ, ও দুঃখ - ভগবানকে এত ডাকলুম, তবু, দুঃখ গেল না। কিন্তু দুঃখই তাে ভগবানের দয়ার দান।

সেদিন আমার মনটা বড় দুঃখ-ভারাক্রান্ত ছিল, তাই কি মা টের পেয়ে ঐ কথাগুলি বললেন ? মা বলতে লাগলেন, “সংসারে দুঃখ কে না পেয়েছে বল ? বৃন্দে বলেছিল কৃষ্ণকে, ‘কে বলে তােমাকে দয়াময় ? রাম-অবতারে সীতাকে কাঁদিয়েছ, কৃষ্ণ-অবতারে রাধাকে কাঁদাচ্ছ। আর কংস-কারাগারে দুঃখ-কষ্টে দিনরাত কৃষ্ণ কৃষ্ণ করেছে তােমার পিতামাতা। তবে যে তােমাকে ডাকি তা এইজন্য যে তােমার নামে শমনভয় থাকে না।” 

শচীন ও দেবব্রত মহারাজের কথা উঠল। মা বললেন, “শচীন বড় ভাগ্যবান ছিল। দেবব্রত যে রাতে দেহ রাখলে সেই রাতে বৃষ্টি ঝড়, লােকজন এ মঠে তখন কেউ ছিল না। আর শচীন সকালে গেল - মঠ লােকে ভরপুর।” * দেবব্রত মহারাজের কথায় বললেন, “দেবব্রত যােগী পুরুষ ছিল।”

একটি স্ত্রীলােকের কথা উঠল। মা বললেন, “ওরূপে চেহারার লোকের ভক্তি বড় একটা হয় না—ঠাকুর বলতে শুনেছি।” 

আমি বললুম “হ্যাঁ, মা, আবার কান-তুলসে ভিতরবুঁদে ইত্যাদি আছে, ঠাকুরের বইয়ে পড়েছি।” 

মা - ওঃ সেই কথা বলছ? সে নারায়ণদের বাড়ি গিয়ে ওকথা হয়েছিল। একজন একটি স্ত্রীলােককে রেখেছিল। সে স্ত্রীলােকটি এসে ঠাকুরের নিকট আক্ষেপ করে বলেছিল, ওই তাে আমাকে নষ্ট করেছে। তারপর আমার যত গহনা, টাকা ছিল সে সব নিয়েছে।’ ঠাকুর তাে সকলের অন্তরের সব কথাই জানতে পারতেন, তবু, জিজ্ঞাসা করতেন। স্ত্রীলােকটির কথা শুনে বললেন, ‘তাই নাকি? মুখে কিন্তু, ও তো খুব ভক্তির কথা সব বলে। ঐ কথা বলে তিনি ঐ শ্লোকটি বললেন। যা হােক, মাগী তাে তাঁর কাছে পাপের কথা সব ব্যক্ত করে খালাস পেয়ে গেল। 

নলিনী - তা কি হয়, মা ? পাপের কথা একবার মুখে বললে, আর সব ধুয়ে গেল—তাই যায় কি ? 

মা - তা যাবে না ? তিনি যে মহাপুরুষ, তাঁর কাছে বললে যাবে না ? আর এক কথা শোন, পাপ-পূণ্যপ্রসঙ্গ যেখানে হয় সেখানে যত লােক থাকে, তাদের সকলকেই সেই ভালমন্দের একটু না একটু অংশী হতে হয়। 

নলিনী - তা কেন হবে? 

মা আমাদের বললেন, “শােন, মা, কেমন করে হয়। মনে কর, একজন তােমাদের কাছে তার পাপপূণ্যের কথা বলে গেল। মনে কখনও সেই লোকের কথা উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে তার ঐ ভালমন্দ কাজগুলিরও চিন্তা এসে পড়বে। এইরূপে সেই ভাল বা মন্দ দুই-ই তােমাদের মনের উপর একটু কাজ করে যাবে। কি বল, মা, তাই না ?” 

আবার লােকের দুঃখকষ্ট ও অশান্তির কথা ওঠায় মা বলতে লাগলেন, “দেখ, লােকে আমার কাছে আসে, বলে - জীবনে বড় অশান্তি, ইষ্টদর্শন পেলুম না। কিসে শান্তি হবে, মা! - কত কি বলে ! আমি তখন তাদের দিকে চাই, আর আমার দিকে চাই, ভাবি - এরা এমন সব কথা কেন বলে। আমার কি তাহলে সবই অলৌকিক! আমি অশান্তি বলে তাে কখনাে কিছু দেখলুম না। আর ইষ্টদর্শন, সে তাে হাতের মুঠোর ভিতর - একবার বসলেই দেখতে পাই।” 

মার ‘ডাকাত বাবা’র কথাটি বইয়ে পড়েছিলাম। তাঁর নিজমুখে হ'তে সেইটি শােনবার ইচ্ছা হওয়ায় মাকে এখন জিজ্ঞাসা করলুম, “মা, বইয়ে পড়েছি একবার আপনি দক্ষিণেশ্বরে আসছিলেন, লক্ষ্মীদিদি প্রভৃতি সঙ্গে ছিলেন। আপনি নাকি তাদের সমান দ্রুত চলতে না পেরে ও সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে তাদের এগিয়ে যেতে বলে নিজে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় আপনার সেই বাগদি মা - পের সঙ্গে দেখা হয়।” 

মা - আমি একেবারে একলা ছিলুম, তা ঠিক নয়। আমার সঙ্গে আরও দু'জন বৃদ্ধা-গােছের স্ত্রীলােক ছিলেন - আমরা তিনজনেই পিছিয়ে পড়েছিলুম। তারপর সেই রুপাের বালা পরা, ঝাঁকরা চুল, কালাে রং, লম্বা লাঠি হাতে পুরুষটিকে দেখে আমি বড্ড ভয় পেয়েছিলুম। তখন ওপথে ডাকাতি হােত। লােকটি, আমরা যে ভয় পেয়েছি, তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলে, কে গা, তােমরা কোথায় যাবে? আমি বললুম, ‘পুবে’। লােকটি বললে, সে এ পথ নয়, ঐ পথে যেতে হবে।’ আমি তবুও এগুই নে দেখে সে তখন বললে, ভয় নেই, আমার সঙ্গে মেয়েলােক আছে, সে পেছিয়ে পড়েছে। তখন ‘বাপ' ডেকে তার আশ্রয়ে যাই। তখন কি এমনি ছিলুম মা ? কত শক্তি ছিল, তিনদিনের পথ হেঁটে এসেছি, বৃন্দাবন-পরিক্রমা করেছি, কোন কষ্ট হয় নি। 

তারপর মা বললেন, “দক্ষিণেশ্বরে নবত দেখেছ? সেইখানে থাকতুম। প্রথম প্রথম ঘরে ঢুকতে মাথা ঠুকে ঠুকে যেত। একদিন কেটেই গেল। শেষে অভ্যাস হয়ে গিছল। দরজার সামনে গেলেই মাথা নুয়ে আসত। কলকাতা হতে সব মোটাসােটা মেয়েলােকেরা দেখতে যেত, আর দরজায় দুদিকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলত, ‘আহা, কি ঘরেই আমাদের সীতা লক্ষ্মী আছেন গাে - যেন বনবাস গাে! ( নলিনী ও মাকুকে লক্ষ্য করে ) - তােরা হলে কি একদিনও সেখানে থাকতে পারতিস?” 

তাঁরা বললেন, “না, পিসীমা, তােমার সবই আলাদা।” 

আমি বললুম, “গুরুদাস বর্মণের বইয়ে পড়েছি, শেষে না-কি আপনাকে একখানি আটচালা ঘর করে দিয়েছিল এবং ঠাকুর একদিন সেই ঘরে গিয়ে খুব বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ায়, নিজের ঘরে আসতে পারেন নি।” 

মা - কৈ, মা, কোথায় আটচালা ? অমনি চালাঘর। শরতের বইয়ে সব ঠিক ঠিক লিখেছে। মাস্টারের বইও বেশ—যেন ঠাকুরের কথাগুলি বসিয়ে দিয়েছে। কি মিষ্টি কথা! শুনেছি, ঐ রকম বই আরও চার-পাঁচ খন্ড হতে পারে এমন আছে। তা এখন বুড়াে হয়েছে, আর পারবে কি? বই বিক্রি করে অনেক টাকাও পেয়েছে শুনেছি সে টাকা সব জমা রেখেছে। আমাকে জয়রামবাটীতে বাড়িটাড়ি করতে প্রায় এক হাজার টাকা দিয়েছে (বাড়ির জন্য ৪০০, ও খরচের জন্য ৫৩০,) আর মাসে মাসে আমাকে দশ টাকা দেয়। এখানে থাকলে কখন কখনও বেশী - বিশ পঁচিশ টাকাও দেয়। আগে যখন স্কুলে চাকরি করত, তখন মাসে দুটাকা করে দিত। 

আমি - গিরিশবাবু, না - কি মঠে অনেক টাকা দিয়েছেন ? 

মা - সে আর কি দিয়েছে? বরাবর দিয়েছিল বটে সুরেশ মিত্তির। তবে হ্যাঁ, কতক কতক দিয়েছে বই কি। আর আমাকে দেড় বছর রেখেছিল বেলুড়ে নীলাম্বরের বাড়িতে। দু'হাজার, পাঁচ হাজার মঠে যে দিয়েছে তা নয়। দেবেই বা কোখেকে ? তেমন টাকাই বা কোথা ছিল? আগে তাে পাষণ্ড ছিল, অসৎসঙ্গে থিয়েটার করে বেড়াত। বড় বিশ্বাসী ছিল, তাই ঠাকুরের অত কৃপা পেয়েছিল। এবারে ঠাকুর ওর উদ্ধার করে গেলেন। এক এক অবতারে এক এক পাষণ্ড উদ্ধার করেছেন। যেমন গৌর-অবতারে জগাই-মাধাই—এই আর কি! ঠাকুর এক সময়ে এও বলেছিলেন, “গিরিশ শিবের অংশ। টাকাতে কি আছে, মা? ঠাকুর তো টাকা ছুঁতেই পারতেন না। হাত বেঁকে যেত। তিনি বলতেন, ‘জগৎটাই যে মিথ্যা। ওরে রামলাল, যদি জানতুম জগৎটা সত্যি তবে তােদের কামারপুকুরটাই সােনা দিয়ে মুড়ে দিয়ে যেতুম। জানি ও সব কিছু না - ভগবানই সত্যি ।’

মাকু আক্ষেপ করছে, কী - এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারলুম না। মা বললেন, “থির কিগাে ? যেখানে থাকবি সেইখানেই থির। স্বামীর কাছে গিয়ে থির হবি ভাবছিস, সে কি করে হবে? তার অল্প মাইনে, চলবে কি করে ? তুই তাে ( এখানে যেন ) বাপের বাড়িতেই রয়েছিস। বাপের বাড়ি লােকে থাকে না ? এই দ্যাখ না, এ রয়েছে নিজের সংসার ছেড়ে। তােরা এতটুকু ত্যাগ করতে পারিস নে ? দ্যাখ না একে, কি শান্ত মতি! আর আমি আছি বলে আছে, আর তােরা থাকতে পারিস নে ?” 

আমি - থাক, মা, ঠাকুরের কথা আর একটু বলুন। 

মা - বইয়ে যে লেখে, সব ঠিক হয় না। আমাকে যে ঠাকুর ষােড়শীপূজা করেছিলেন সে কথা রামের বইয়ে যা লিখেছে তা ঠিক হয় নি। 

ঘটনাটি বলে শেষে বললেন, “বাড়িতে তাে নয়ই—দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে যেখানে গােল বারান্ডার কাছে গঙ্গাজলের জালাটি রয়েছে ঐখানে। হৃদয় আয়ােজন করে দিয়েছিল।”

এই সময়ে যােগেন-মা এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মার সঙ্গে কি কথা বলতে যেতেই মা তাকে বললেন, “এদিকে এস-না, তােমাদের যে দেখতেই পাই নে।” যােগেন-মা হাসতে হাসতে মার কাছে এলেন। আসবার সময় আমার গায়ে তাঁর পা ঠেকে গেল। তিনি হাতজোড় করে প্রণাম করছেন দেখে আমি শশব্যস্তে উঠে প্রণাম করে বলছি, “একি যােগেন-মা, যে আপনার চরণধূলিরও যােগ্য নয় তার গায়ে পা ঠেকেছে বলে প্রণাম।” 

যােগেন-মা - সে কি, মা! ছােট সাপটাও সাপ, বড় সাপও সাপ, তােমরা সব ভক্ত যে। 

মায়ের পানে চেয়ে দেখি মুখে সেই করুণামাখা হাসি। রাত্রি অনেক হয়েছে দেখে কিছুক্ষণ পরে প্রণাম করে বিদায় নিলুম। 

* দেবব্রত মহারাজ যখন দেহত্যাগ করেন তখন শ্রীশ্রীমায়ের (দেশে) কোয়ালপাড়ায় খুব অসুখ। তজন্য পূজনীয় শরৎ মহারাজ প্রভৃতি সব তথায় গিয়েছিলেন। শচীন মহারাজ যখন
দেহ রাখেন তখন সকলেই এখানে, শ্রীশ্রীমাও ছিলেন।

 ১২ই শ্রাবণ, ১৩২৫ 

সন্ধ্যার পরে গিয়েছি। এখনও আরতি আরম্ভ হয় নি। মা রাস্তার ধারের বারাণ্ডায় একটি আসন পেতে বসে জপ করছেন। ভারি গরম, কাছে গিয়ে প্রণাম করে বসতেই মা বাতাস করবার জন্য পাখাখানি হাতে দিলেন। বাতাস করছি, এমন সময় একটি বর্ষীয়সী বিধবা এসে মাকে প্রণাম করতেই মা জিজ্ঞাসা করলেন, কার সঙ্গে এলে ?” 

“দারােয়ানের সঙ্গে এসেছি” বলে তিনি আমার কাছে পাখাখানি চাইলেন মাকে বাতাস করবেন। আমি তখনি দিলুম। 

মা বললেন, “থাক থাক ও-ই দিক।” 

তিনি বললেন, “কেন, মা, আমার হাত দিয়ে একটু হবে না? ওরা তাে দিচ্ছেই।” মা যেন একটু বিরক্ত হলেন। তিনি দু-এক মিনিট বার্তা বললেন, “তবে আসি, মা, মহারাজের কাছে একবার যেতে হবে।” মায়ের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করতেই মা মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আঃ, পায়ে কেন? একে তাে দেহ খারাপ - এই করে করে তাে এই সব (অসুখ) হল।” তিনি চলে যাবার পরে জল দিয়ে পা ধুয়ে ফেললেন। বিধবা স্ত্রীলােকটি গােলাপ মাকে একটু দেখে এসে (তাঁর খুব অসুখ) পুনরায় মায়ের কাছে বিদায় নিতে এলেন। মা বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এস গে।” এর পূর্বে মাকে কারো সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে আমি চক্ষে দেখি নি। 

পরে মা আমাকে বললেন, “আমার আসনখানা তুলে ঘরে নিয়ে যাও আর বিছানাটা নীচে পেতে দাও।” মা এসে শয়ন করলেন এবং হাঁটুতে ঘি মালিশ করে দিতে বললেন। কিছু পরে বললেন, “এখন পিঠে মরিচাদি তেল মালিশ করে দাও।” 

ললিতবাবুর কথা উঠল। আমি বললুম, “মা, তিনি তাে শুনেছি আপনার কৃপাতেই বেঁচে গেছেন।” 

মা — তার অনেক বাসনা ছিল। তার যা অবস্থা হয়েছিল, মা, বালতি বালতি জল বেরুত পেট থেকে। একেবারে শেষ অবস্থাতেই দাঁড়িয়েছিল? তখন বড় কাতর হয়ে বললে, মা, কামারপুকুরে, জয়রামবাটীতে মন্দির করব, হাসপাতাল দেবাে, আমার বড় আশা ছিল, কিছুই করতে দিলি নি! আহা ! ঠাকুর বাঁচিয়েছেন। ওখানে সব করবার ইচ্ছা ওর মতাে আর কোন ভক্তের নেই। বেঁচেছে, এখন কাজ করুক। আমাকে একটি পুকুর কিনে দিয়েছে। 

১৩ই শ্রাবণ, ১৩২৫

 আজ বৈকালে প্রেমানন্দ স্বামীজী দেহত্যাগ করলেন। রাত্রে মায়ের নিকট গেলুম। মা বললেন, “এসেছ, মা, বস! আজ বাবুরাম আমার চলে গেল। সকাল হতে চক্ষের জল পড়ছে।” এই বলে কাঁদতে লাগলেন। “বাবুরাম আমার প্রাণের জিনিস ছিল। মঠের শক্তি, ভক্তি, যুক্তি সব আমার বাবুরামরুপে গঙ্গাতীরে আলাে করে বেড়াত। বাবুরামের মা ছিল আঁটকুড়ে ঘরের মেয়ে, বাপের বিষয় পেয়েছিল। সে জন্য একটু অহঙ্কার ছিল। নিজেই বলত, ‘হাতে বাউটি, কোমরে সােনার চন্দ্রহার পরে মনে করতুম ধরা যেন সরা। চারিটি সন্তান রেখে সে গেছে। একটি কেবল তার পূর্বে মারা গিয়েছিল।” 

খানিক পরে দেখি, মাঝের ঘরের দক্ষিণের দেয়ালে ঠাকুরের যে বড় ছবি ছিল তার পায়ে মাথা রেখে করুণস্বরে বলছেন, “ঠাকুর, নিলে!” - সে কি মর্মভেদী স্বর ! আমাদেরও বড় কান্না পেতে লাগল। 

এদিকে গোলাপ মার খুব অসুখ - মরণাপন্ন রক্তআমাশয় চলেছে। 

১৪ই শ্রাবণ, ১৩২৫ 

রাত সাড়ে সাতটা। শ্রীশ্রীমা ঠাকুরঘরে বসে আছেন। গিয়ে প্রণাম করে উঠতেই বললেন, ‘বারাণ্ডায় আমার আসনখানি পেতে দাও তাে মা, আর তক্তাপোশের পাশে মেজেয় পাতা ঐ বিছানাটা গুটিয়ে রাখ, আরতির সময় ওরা ওখানে বসে ঋাঁজ বাজাবে।” বিলাস মহারাজ আরতির আয়ােজন করছিলেন। বারাণ্ডায় আসন পেতে দিতে, মা বললেন, “কমণ্ডলুতে গঙ্গাজল আছে, নিয়ে এস।” গঙ্গাজলে হাতমুখ ধুয়ে জপে বসলেন এবং পাখাখানি আমার হাতে দিয়ে বাতাস করতে বললেন। একটু পরেই আরতি আরম্ভ হ’ল। শ্রীশ্রীমা “গুরুদেব, গুরদেব” বলে জোড়হাতে প্রণাম করলেন এবং জপ শেষ করে আরতি দেখতে লাগলেন। আরতি হয়ে গেলে বিলাস মহারাজ শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করে উঠে বললেন, “মা, আজ ভারি গরম।” মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “একটু বাতাস করবে?” 

তিনি বললেন, “কে করবে, মা?”

“কেন, এই মা করবে, করতাে মা।” আমি তার দিকে দু-একবার বাতাস করতেই তিনি বললেন, “না, মা, উনি আপনাকে বাতাস করছেন আপনাকেই করুন।” এই বলে বাইরে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে মা প্রেমানন্দ স্বামীজীর কথা তুলে বললেন, “দেখ, মা, বাবুরামের দেহেতে আর কিছু ছিল না, কেবল কাঠামখানি ছিল।” এমন সময়ে চন্দ্রবাবু, উপরে এসে ঐ কথায় যােগ দিলেন এবং বাবুরাম মহারাজের দেহ সৎকারের জন্য কয়েকজন ভক্ত যে চন্দনকাঠ, ঘি, ধুপ, গুগগুল, ফুল ইত্যাদি চার-পাঁচ শ’ টাকার জিনিস দিয়েছেন তাই বলতে লাগলেন। মা বললেন, “আহা! ওরাই টাকা সার্থক করে নিলে। ঠাকুরের ভক্তের জন্য দেওয়া। ভগবান ওদের দিয়েছেন, আরও দেবেন।” চন্দ্রবাবু প্রণাম করে উঠে গেলেন। মা বলতে লাগলেন, “শােন মা, যত বড় মহাপুরুষই হােক, দেহধারণ করে এলে দেহের ভােগটি সবই নিতে হয়। তবে তফাৎ এই, সাধারণ লােক যায় কাঁদতে কাঁদতে, আর ওঁরা যান হেসে হেসে - মৃত্যুটা যেন খেলা। 

‘আহা! বাবুরাম আমার বালককালে এসেছে। ঠাকুর কত রঙ্গের কথা বলতেন, আর নরেন বাবুরাম এরা আমার হেসে কুটিপাটি হােত। একদিন কাশীপুরে আড়াই সের দুধসুদ্ধ একটা বাটি নিয়ে সিঁড়ি উঠতে গিয়ে আমি মাথা ঘুরে পড়ে পেলুম। দুধ তাে গেলই, আমার পায়ের গােড়ালির হাড় সরে গেল। নরেন, বাবুরাম এসে ধরলে। পরে পা খুব ফুলে উঠল। ঠাকুর তাই শুনে বাবুরামকে বলছেন, তাই তো, বাবুরাম, এখন কি হবে, খাওয়ার উপায় কি হবে? কে আমায় খাওয়াবে? তখন মণ্ড খেতেন। আমি মণ্ড তৈরি করে উপরের ঘরে গিয়ে তাকে খাইয়ে আসতুম। আমি তখন নথ পরম, তাই বাবুরামকে নাক দেখিয়ে হাতটি ঘুরিয়ে ঠারে ঠোরে বলছেন, ‘ও বাবুরাম, ঐ যে ওকে তুই ঝুড়ি করে মাথায় তুলে এখানে নিয়ে আসতে পারিস ?” ঠাকুরের কথা শুনে নরেন, বাবুরাম তাে হেসে খন। এমনি রঙ্গ তিনি এদের নিয়ে করতেন। তারপর তিন দিন পরে ফোলাটা একটু কমলে ওরা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যেত — আমি খাইয়ে আসতুম। ও-কয়দিন গােলাপ-মা মণ্ড তৈরি করে দিয়েছিল, নরেন খাইয়ে দিত। 

“বাবুরাম তার মাকে বলত, ‘তুমি আমাকে কি ভালবাস ! ঠাকুর আমাদের যেমন ভালবাসেন, তুমি তেমন ভালবাসতে জান না। সে বলতাে, আমি মা, আমি ভালবাসি না, বলিস কিরে ? এমনি তাঁর ভালবাসা ছিল। বাবুরাম চার বছরের সময়ই বলত, “আমি বে করব না - বে দিলে মরে যাব। ঠাকুর যখন বলেছিলেন, আমি পরে সুক্ষ্ম শরীরে লক্ষ মুখে খাব,’ বাবুরাম বলেছিল, ‘তােমার লক্ষ-টক্ষ আমি চাই নে, আমি চাই তুমি এই মুখটিতে খাবে, আর আমি এই মুখটিই দেখব।’

“অনেকগুলাে ছেলেপিলে হয় যার, ঠাকুর তাকে গ্রহণ করতেন না। একটা দেহ হতে পঁচিশটা ছেলে বেরুচ্ছে, ওরা কি মানুষ! সংযম নেই, কিছু নেই -  যেন পশু!” 

গােলাপ-মার অসুখ আজ একটু কম। কি ঔষধ দিয়ে জুস দেওয়া হয়েছে - সরলা এসে বললেন ; ডাক্তার বিপিন বাবু বলেছেন, “তিন মাস লাগবে সারতে।” 

মা বললেন, রক্তামাশয় কি সােজা ব্যারাম ! তা লাগবে বইকি। ঠাকুরের অমনি আমের ধাত ছিল। দক্ষিণেশ্বরে এই সময় ( বর্ষাকালে) প্রায় আমাশয় হােত। নবতের দিকে লম্বা বারাণ্ডার ধারে একটা কাঠের বাক্স ফুটো করে নীচে সরা পেতে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে শৌচে যেতেন। আমি সকালেরটা ফেলে আসতুম। বিকালেরটা ওরা ফেলতাে। সেই সময়ে একটি মেয়ে আসে, বললে কাশীতে থাকে। সে প্রদীপের শীষে আঙুল তাতিয়ে প্রত্যহ ঠিক একুশবার করে তাপ দিতে মলদ্বারের ফুলাে টনটনানি কমে গেল। আমি তখন ভাবতুম - একে আমাশয়, তাতে গরম সেক, বেড়েই বা যায়। কিন্তু বাড়ল না, সেরে গেল। 

সেই মেয়েটিই আমাকে সে বাড়ি থেকে নবতে নিয়ে এসেছিল; বলল, “মা, তাঁর এমন অসুখ, আর তুমি এখানে থাকবে ?’ আমি বললুম, “কি করবাে, ভাগ্নে বউটি একা থাকবে, ভাগ্নে (হৃদয়) সেখানে ঠাকুরের কাছে রয়েছে। মেয়েটি বললে, তা হােক, ওরা লােকটোক রেখে দেবে। এখন তোমার কি তাঁকে ছেড়ে দূরে থাকা চলে?' আমি তার কথা শুনে তাঁর সঙ্গে চলে এলুম। কয়েক দিন পরে তিনি একটু সারলে সে মেয়েটি চলে গেল। কোথায় গেল আর কোন খোঁজ পেলুম না। তারপর আর দেখা হয় নি। সে আমার বড় উপকার করেছে। কাশী গিয়েও তাঁর খোঁজ করেছিলুম, পাই নি। তাঁর (ঠাকুরের) প্রয়ােজনে সব কোথা হতে আসত, আবার কোথা চলে যেত। 

“আমিও এক বছর আমাশয়ে ভুগেছি, মা। সে কি শরীর হয়ে গেল। দেশে আমাদের কলুপুকুরের ধারে শৌচে যেতুম। বারবার যেতে কষ্ট হোত বলে সেখানটিতেই শুয়ে পড়ে থাকতুম। একদিন পুকুরজলে শরীর পানে চেয়ে দেখি শুধু হাড় সার হয়েছে, দেহেতে আর কিছু নেই। তখন ভাবলুম - আরে ছিঃ ! এই দেহ, তবে আর কেন ? এইখানেই দেহটি থাক, দেহ ছাড়ি। পরে নিবি ( মা কি নাম বললেন ঠিক মনে নেই) এসে বললে, ‘ওমা, তুমি এখানে পড়ে কেন? চল চল, ঘরে চল - বলে ঘরে নিয়ে এল। এখন আর পুকুরধারে সে সব জায়গা নেই। ভাগ করে সব ঘিরে - ঘুরে নিয়েছে।” 

রাত্রি সাড়ে দশটা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমি বিদায় নিলুম। 

১৫ই শ্রাবণ, ১৩২৫ 

আজ দর্শন করতে গিয়ে সুবিধা থাকায় মার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। সবই কিন্তু মঠের সন্ন্যাসী ছেলেদের কথা। প্রেমানন্দ স্বামীজীর দেহরক্ষায় বােধ হয় তাঁর মনে আজকাল ছেলেদের কথা সর্বক্ষণ উদিত হচ্ছিল, তাই তাঁদের কথা তুলে মা বললেন, “ঠাকুরকে ছেলেরা সব বীড়ে ( পরীক্ষা করে ) নিয়ে তবে ছেড়েছে। বরানগর মঠে যখন ওরা ছিল, তখন আহা! নিরঞ্জন-টন ওরা সব কতদিন আধপেটা খেয়ে ধ্যানজপ নিয়ে কাটিয়েছে। একদিন সকলে বলাবলি করলে, “আচ্ছা, আমরা যে ঠাকুরের নামে সব ছেড়ে ছুড়ে এলুম, দেখি তার নাম নিয়ে পড়ে থাকলে তিনি খেতে দেন কি-না। সুরেশবাব এলে কিছু বলা হবে না। ভিক্ষেটিক্ষেও কেউ করতে যাব না। এই বলে সব চাদর মুড়ি দিয়ে ধ্যান লাগিয়ে দিলে। সারাদিন গেল-রাতও অনেক হয়েছে, এমন সময় শোনে দরজায় কে ঘা মারছে। নরেন আগে উঠেছে, বলছে - “দেখ তাে দরজা খুলে কে? আগে দেখ তার হাতে কিছু আছে কি-না। আহা! খুলেই দেখে লালবাবুর মন্দির থেকে (গঙ্গার ধারের শ্রীশ্রীগােপালের বাড়ি) ভাল ভাল সব খাবার নিয়ে একজন লােক এসেছে। দেখে তাে সব মহা খুশীঠাকুরের দয়া টের পেল। তখনি উঠে ঠাকুরকে ভােগরাগ দিয়ে সেই রাতে সকলে প্রসাদ পেলে। এমনি আরও কদিন হয়েছে। সিঁথির বেণী পালের বাড়ি হতেও অমনি করে এক দিন লুচি এসেছিল। এখন ছেলেরা তাে মহাসুখে আছে। আহা! নরেন, বাবুরাম ওরা সব কত কষ্ট করে গেছে। এখন তােমাদের মহারাজ - সেই রাখালকেও আমার কতদিন ভাতের হাল্ডা মাজতে হয়েছে। নরেন একবার গয়া কাশীর দিকে যেতে যেতে দুদিন না খেয়ে এক গাছতলায় পড়েছিল। খানিক পরে দেখে, কে তাকে ডাকছে। দেখে, একটি লোক খানকতক লুচি, তরকারি, মিষ্টি আর এক ঘটি ঠাণ্ডা জল সামনে ধরে বললে, “রামজীর প্রসাদ এনেছি, গ্রহন করুন। নরেন বললে, ‘আমার সঙ্গে তাে তােমার কোন পরিচয় নেই, তুমি ভুল করছ—আর কাউকে দিতে বলেছেন।’ লােকটি মিনতি করে বললে, ‘না মহা রাজজী, আপনার জন্যেই এই সব এনেছি। পরে আমি ঘুমিয়েছি, দেখি কি স্বপ্নে একজন বলছেন - শীগগির ওঠ, অমুক গাছতলায় যে সাধু; আছেন, তাঁকে খাবার দিয়ে আয়। স্বপ্ন ভেবে আমি তাতেও না উঠে পাশ ফিরে শুলুম। তখন আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে তিনি বললেন -- আমি উঠতে বলছি, আর তুই ঘুমােচ্ছিস শীগগির যা। তখন মনে হল মিথ্যা স্বপ্ন নয়, রামজীই হুকুম করছেন। তাই এই সব নিয়ে ছুটে এসেছি। তখন নরেন, ঠাকুরেরই দয়া ভেবে ঐ সব খাবার গ্রহণ করে।

“আর একবার এমনি হয়েছিল। তিন দিন পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে নরেনের খিদেয় মুর্ছা যাবার মতাে অবস্থা, এমন সময়ে এক মুসলমান ফকির একটি কাঁকুড় দেয়, সেইটি খেয়ে তবে বাঁচে। নরেন আমেরিকা হতে ফিরে এসে এক সভায় (আলমােড়ায়) একদিন ঐ মুসলমানটিকে একধারে দেখতে পেয়ে উঠে গিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে এসে সভার মাঝে বসালে। সকলে বললে, একি ? তখন নরেন বললে, ‘এ আমার জীবনদাতা।'—এই বলে ঘটনাটি সকলকে বললে। তাকে টাকাও দিয়েছিল। সে কিছুতেই নেবে না; বলে, ‘আমি কি করেছি যে টাকা দিচ্ছেন ?’ নরেন তা কি শােনে ?---’বলে দিয়ে দিলে।

“আহা! নরেন আমাকে মঠে নিয়ে গিয়ে প্রথম পূজা (দূর্গাপূজা) যেবার করায়  - সেবার পূজককে* আমার হাত দিয়ে পঁচিশ টাকা দক্ষিণে দেওয়ালে। চৌদ্দশ’ টাকা খরচ করেছিল। পুজোর দিন লােকে লােকারণ্য হয়ে গেছে। ছেলেরা সবাই খাটছে। নরেন এসে বলে কি, ‘মা, আমার জ্বর করে দাও?’ ওমা, বলতে না বলতে খানিক বাদেই হাড় কেঁপে জ্বর এল। আমি বলি, মা, একি হল, এখন কি হবে ? নরেন বললে, কোন চিন্তা নেই মা। আমি সেধে জ্বর নিলম এইজন্য যে, ছেলেগুলাে প্রাণপণ করে তাে খাটছে তবু, কোথায় কি এুটি হবে আর আমি রেগে যাব, বকবাে, চাই কি দুটো থাপ্পড়ই দিয়ে বসবাে, তখন ওদেরও কষ্ট হবে, আমারও কষ্ট হবে। তাই ভাবলুম - কাজ কি, থাকি কিছুক্ষণ জ্বরে পড়ে। তারপর কাজকর্ম চুকে আসতেই আমি বললুম, ও নরেন, এখন তা হলে ওঠ। নরেন বললে, ‘হাঁ মা, এই উঠলুম আর কি।’ এই বলে সুস্থ হয়ে যেমন তেমনি উঠে বসল।

“তাঁর মাকেও পূজার সময় মঠে নিয়ে এসেছিল। সে বেগুন তােলে, লঙ্কা তােলে আর এ বাগান, ও বাগান ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। মনে একটু অহং যে, আমার নরেন এ সব করেছে। নরেন তখন তাকে এসে বলে, ‘ওগাে, তুমি করছ কি? মায়ের কাছে গিয়ে বস না—লঙ্কা ছিঁড়ে বেগুন ছিঁড়ে বেড়াচ্ছ। মনে করছ বুঝি তােমার নরু এ সব করেছে। তা নয়, যিনি করবার তিনিই করেছেন, নরেন কিছু নয়।’ মানে ঠাকুরই করেছেন। আহা! আমার বাবুরাম নেই, কে এবার পুজো করবে?" 

* সেবার কৃষ্ণলাল মহারাজ পূজক ও শশী মহারাজের বাবা তন্ত্রধারক ছিলেন। কৃষ্ণলাল মহারাজ পূজা করলেও তন্ত্রধারকই সব দেখিয়ে শুনিয়ে দেওয়ায় কার্যতঃ তিনিই পূজক ছিলেন শ্রীশ্রীমা পূজক বলতে তাঁকেই লক্ষ্য করেছেন। 

২১শে শ্রাবণ, মঙ্গলবার, অমাবস্যা - ১৩২৫ 

আজ গিয়ে দেখি, মা উত্তরের বারাণ্ডায় বসে জপ করছেন। খানিক পরে পাঁচ-ছয়টি মেয়েলােক মাকে দেখতে এলেন। তাঁরা ঠাকুরপ্রণাম করে বসতেই মা জপ শেষ করে তাঁরা কোথা হতে আসছেন, জিজ্ঞাসা করলেন। নলিনী তাঁদের পরিচয় দিলেন। শুনলাম, তাঁদের মধ্যে একজন চিকিৎসার জন্য এসেছেন, পেটে ‘টিউমার’ (ফোড়া) হয়েছে, ডাক্তার সাহেব বলেছেন অস্ত্র করতে হবে, তাই শুনে তিনি বড় ভয় পেয়েছেন। কে জানে কেন, মা এদের কাউকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে দিলেন না। তাঁরা ঐজন্য বারবার প্রার্থনা করলেও স্বীকৃতা না হয়ে বললেন, “ঐ চৌকাঠ হতে ধুলে নাও।” তাঁরা শেষে অসুস্থ মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, “আপনি আশীর্বাদ করুন যেন ও সেরে উঠে আবার আপনার দর্শন পায়।” মা ভরসা দিয়ে বললেন, “ঠাকুরকে ভাল করে প্রণাম কর, উনিই সব।” পরে যেন একটু অতিষ্ঠভাবে বললেন, তবে তােমরা এখন এস, রাত হ’ল।” তারা ঠাকুরপ্রণাম করে চলে যাবার পর বললেন “গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘর ঝাঁট দিয়ে ফেল, ঠাকুরের ভােগ উঠবে।” বউ আদেশ পালন করলে মা উঠে এসে নীচের বিছানায় শুয়ে গায়ের কাপড় খুলে ফেলে আমার হাতে পাখা দিয়ে বললেন, “বাতাস কর তাে, মা, শরীর জ্বলে গেল। গড় (প্রণাম) করি, মা, কলকাতাকে। কেউ বলে আমার এ দুঃখ কেউ বলে আমার ও দুঃখ, আর সহ্য হয় না। কেউ বা কত কি করে আসছে, কারো বা পঁচিশটা ছেলেমেয়ে -- দশটা মরে গেল বলে কাঁদছে - মানুষ তাে নয়, সব পশু - পশু ! সংযম নেই কিছু নেই! ঠাকুর তাই বলতেন, ‘ওরে এক সের দুধে চার সের জল, ফুঁকতে ফুঁকতে আমার চোখজ্বলে গেল ! কে কোথায় ত্যাগী ছেলেরা আছিস - আয় রে, কথা ক'য়ে বাঁচি। ঠিক কথাই বলতেন। জোরে বাতাস কর মা, আজ বেলা চারটা হতে লােক আসছে, লােকের দুঃখ আর দেখতে পারি না। 

“আহা! আজ বলরামের পরিবারও এসেছিল, বাবুরামের জন্য কত কাঁদলে। বললে, ‘একি আমার যে - সে ভাই।’  তাই তাে, মা, দেবতা ভাই।” 

খানিক পরে তেল মালিশ করতে বললেন। মালিশ করতে করতে বললুম, ‘মা, ডাল রান্না করে এনেছি - ভক্তেরা খাবেন বলে।” মা বললেন, “বেশ করেছ, রাখালও দু'টো ইলিশ মাছ পাঠিয়েছে। বাবুরাম গিয়ে অবধি সে এখনও মাছ খায় নি।” 

এর পূর্বে একদিন রাধুর বর মাংস খেতে চেয়েছিল। সেই কথা এখন - একজন বলায় মা বললেন, “এখন এখানে কেমন করে হবে? এই বাবুরামটি আমার চলে গেছে, সবারই মন খারাপ। এ ঠাকুরের সংসার, তাই কাজকর্ম সব হচ্ছে। তা না হলে কান্নার রােলে বাড়ি ভরে যেতাে, কেউ কি উঠতে পারতাে। তবে খেতে চেয়েছে, দিতেই হবে। তা এরা যদি রান্না করে আনে, তবে হতে পারে।” এই বলে আমার পানে চাইতেই বললুম, ‘জামাই যদি আমাদের হাতে খান তবে অবশ্যই আনতে পারব।” মা বললেন, “তা খাবে না কেন ? খুব খাবে। রান্না করে বামুন ঠাকুরকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও। ছেলেদের কারু কারু; অরুচি হয়েছে, জগদম্বার প্রসাদ হলে তারাও একটু একটু খাবে - তা কত হলে হবে যােগীন?”

যােগীন - মা বললেন, “তা তিন-চার টাকার কম হবে না।” 

মা বললেন, “তবে কিছু টাকা নিয়ে যেয়ো।” 

আমি - তা হবে না, মা শােকহরণ রাগ করবে। 

মা হাসতে লাগলেন, বললেন, “তবে থাক।” 

পরের রবিবার কালীঘাট হতে মহাপ্রসাদ আনিয়ে রেঁধে পাঠানাে হল।

২৭শে শ্রাবণ, সােমবার 

আজ মায়ের কাছে যেতেই মা বললেন, “পাঁঠা বেশ হয়েছিল গাে, সব্বাই বেশ খেয়েছে। কেমন করে রাঁধলে? আমি যখন ঠাকুরের জন্য রাঁধতুম কাশীপুরে, কাঁচা জলে মাংস দিতুম, কখানা তেজপাতা ও অল্প মসলা দিতুম, তুলোর মতাে সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিলুম।” 

আমি -- সে বােধ হয় যুষ (সুরুয়া) হােত, মা। 

মা - তা হবে। নরেন আমার নানা রকমে মাংস রাঁধতে পারতাে। চিরে চিরে ভাজতাে, আলু চটকে কি সব রাঁধতো - তাকে কি বলে ? 

আমি - বােধ হয় চপ, কাটলেট হবে। 

মা জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি সে সব রাঁধতে পার ?” 

আমি - পারি। কাল জামাইর জন্যে ক'রে আনবাে। শােকহরণের বড় ইচ্ছা, আপনাকে কিছু খাবার তৈরি করে খাওয়ায়। তা আমি যদি রেঁধে আনি, খাবেন আপনি? 

মা - তা খাব না কেন, মা? তুমি হলে আমার মেয়ে। তবে বেশী করো না, অল্প-স্বল্প। দেহ সুস্থ নয় কি-না, আর এই রাস্তাটা দিয়ে আনতে হবে। 

আমি -- আচ্ছা, তাই হবে। 

এই বলে সেদিন বিদায় নিলুম। 

পর দিন কিছু খাবার করে নিয়ে যেতেই মা বলেছেন, “এই দেখ গাে, আবার কত কষ্ট করে এ সব নিয়ে এসেছে। “

নলিনীদিদি বললেন, “তুমি চাও কেন, তাই তাে নিয়ে আসে।” 

মা বললেন, “তা, ওদের কাছে চাইব না--আমার মেয়ে ? আর এটা কি কম সৌভাগ্যের কথা ! কি বল, মা ?” 

আমি - সে তাে ঠিক কথা। মা যে কৃপা করে আনতে বলেন, তাতেই আমরা ধন্য হয়ে যাই। 

আজ অনেক রাত্রি হতে তবে গিয়েছিলুম। ভােগের পর প্রসাদ নিয়ে বাড়ি আসবার সময় বললুম, ‘কাল বােধ হয় আসা হবে না, মা, এক বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে।” 

-“আচ্ছা, তা কাল না এলে ভাববো বিয়ে বাড়ি গেছ।” 

ঘিটা সেদিন ভাল ছিল না; “ভাজা জিনিসগুলো তেমন ভাল হয় নি” মা বলতে আর একদিন ভাল ঘিয়ে কয়েক রকম খাবার, পিঠে, ডাল ও তরকারি রেঁধে নিয়ে গিয়েছিলুম। খেয়ে মা খুব আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। মার ভাইঝি নলিনীদিদির একটু শুচিবাই ছিল। তিনিও সেদিন ঐ সব খাবার খেয়ে বলেছিলেন, “আমার তাে কারুর রান্না রােচে না, কিন্তু এর হাতে খেতে তাে ঘেন্না হচ্ছে না?” মা বললেন, “কেন হবে ?-ও যে আমার মেয়ে।” পরে আমাকে বলছেন, “দ্যাখ, সেদিন যে কচুশাকের অম্বল দিয়েছিলে, তা আমাকে ওরা দেয় নি।”

২৯শে শ্রাবণ, ১৩২৫ 

আজ গিয়ে দেখি মা ডাক্তার দুর্গাপদবাবুর ভগ্নীর সঙ্গে কথা কচ্ছেন। বােডিং-এর দুটি মেয়ে ও ঢাকা হতে একটি বউ এসেছেন। সকলে মাকে ঘিরে বসে আছেন। প্রণাম করে আমি বসলুম। ডাক্তারবাবুর ভগ্নী অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন। তাঁর স্বামীর বিষয় নিয়ে গােল বেঁধেছে, ভাগ্নেরা গােল করছে, উইলের ‘প্রবেট’ পেতে দেরী হচ্ছে, এইসব অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। শেষে মা বললেন, “দান-বিক্রয়ে যখন তােমার অধিকার নেই তখন ভাল লােকের হাতে বন্দোবস্তের ভার দিও। সংসারী বিষয়ী লােকদের কি বিশ্বাস আছে? টাকা কড়ির লোভ সামলে কাজ করতে পারে প্রকৃত সাধু-সন্ন্যাসীতে; তা মা, তুমি অত ভেব না। যা করবার হরি করবেন। তুমি সৎপথে আছ; ঠাকুর কি আর তােমায় কষ্টে ফেলবেন? তবে এখন এস, (গাড়ি এসেছে, বাহির হতে তাগিদ আসছিল) চিঠি পত্র দিও, আবার এস।” 

তিনি বিদায় নেবার পরে শ্রীযুক্ত শ্যামাদাস কবিরাজ গােলাপ-মাকে দেখতে এলেন। তিনি যদি দেখা করতে আসেন ভেবে মা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। পরে তিনি চলে গেছেন শুনে শয়ন করলেন এবং আমার দিকে চেয়ে বললেন, “এইবার তােমার কাজটি কর।” আমি তেল মালিশ করতে বসলুম। 

তেল মাখতে মাখতে মা বললেন, “আহা, গিরিশ ঘােষের বােন আমাকে বড় ভালবাসত, বাড়িতে যা রান্নাবান্না করত আমার জন্যে আগে রেখে নিয়ে আসত। কত রকম রান্না করিয়ে ব্রাহ্মণ দিয়ে নিয়ে এসে, বসে বসে আমাকে খাওয়াত। একদিন বলে কি, মা দুখানা ইলিশমাছ ভাজা খাও না, তােমার আর দোষ কি? আমি বললুম, তা কি হয়, মা? তার ভালবাসা মুখে-দেখান ছিল না। বড় ঘরের বউ ছিল, টাকা পয়সা ছিল সে সব পাঁচ জনে নিয়ে নষ্ট করলে। অতুল পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা খুলে বসল। তা ছাড়া এক বৎসর স্বামীর চিকিৎসায় অনেক টাকা ব্যয় করেছিল। শেষে মরবার সময় আমার জন্যে একুশ টাকা লিখে দিয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকতে হাতে করে দিতে লজ্জাবােধ করেছিল—কি বলে মাত্র একশ’টি টাকা দেয়। দেহ রাখাবার পরে, তার ভাই এসে আমাকে টাকাটা দিয়ে যায়। আহা! বোধনের দিন দুপরে আমার সঙ্গে শেষ দেখা করে গেল। যতক্ষণ ছিল সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। সেবার পূজোর পরেই আমাদের কাশী যাওয়া হবে বলে সেদিন জিনিসপত্র গুছাতে এঘর ওঘর করে একটু ব্যস্ত ছিলুম। যাবার সময় বললে, তবে আসি, মা। আমি অন্যমনস্ক হয়ে বললুম হাঁ, যাও।' বলতেই থপ থপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। সে যেতেই মনে হল, বললম কি ? যাও বললুম ? এমন তাে আমি কাউকে বলি নে! আহা! আর এল না। * কেনই বা অমন কথা মুখ দিয়ে বেরুল?” 

• তিনি সেই দিন রাত্রেই হঠাৎ দেহত্যাগ করেন। মা ঐ দিন বৈকালে মঠে পূজা দেখতে গিয়েছিলেন। 

কিছুক্ষণ অন্য মনে চুপ করে থাকবার পর আমাকে বললেন, “কাল এলে না, মা, কেমন লাল পদ্মগুলি পাঠিয়েছিল শোকহরণ। আমি নিজেই তা দিয়ে ঠাকুরপূজো করেছিলুম। কেমন ঠাকুর সাজিয়েছিলুম। তুমি এসে দেখবে বলে সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ রেখেছিলুম।”

আজ সন্ধ্যার সময় গিয়ে দেখি, মা শুয়ে আছেন ও রাধু, তার পাশে ভিন্ন পাটিতে শুয়ে গল্প বলবার জন্যে তাঁকে পীড়াপীড়ি করছে। আমাকে দেখেই মা, বললেন, একটি গল্প বলতাে, মা।” আমি মুশকিলে পড়ে গেলুম, মায়ের কাছে কি গল্প বলি। তারপর সেদিন মীরাবাঈ পড়ে গিয়েছিল সেই গল্প’ বললুম। মীরার ‘বিন, প্রেমসে নহি মিলে নন্দলালা” এই দোঁহাটি বলতেই মা: বললেন, “আহা, আহা! তাই তো, প্রেমভক্তি না হলে হয় না।” রাধুর কিন্তু এ গল্পটা বড় মনঃপূত হল না, শেষে সরলা এসে দুয়ােরানী সুয়ােরানীর গল্প বলতে সে খুশী হল। সরলাকে মা খুব ভালবাসেন, তিনি এখন গােলাপ-মার সেবায় নিযুক্তা। সেজন্য একটু পরেই চলে গেলেন। রাধু, বলছে, “আমার পা কামড়াচ্ছে। তাই আমি খানিক টিপে দিতে লাগলুম। রাধুর কিন্তু আমার টেপা পছন্দ হ’ল না, বললে, “খুব জোরে দাও।” মা তাই শুনে বললেন, ঠাকুর আমার গা টিপে দেখিয়ে দিয়ে বলতেন—এমনি করে টেপো।” ঐ কথা বলে মা আমাকে বললেন, “দাও তাে, মা, তােমার হাতখানা।” আমি এগিয়ে দিতেই আমার হাত টিপে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওকে এমনি করে টেপাে।” আমি তেমনি করে খানিকক্ষণ টিপতেই রাধু; ঘুমিয়ে পড়লাে। মা বললেন, “এইবার আমার পায় হাত বুলিয়ে দাও, মশা কামড়াচ্ছে। একটু চুপ করে মা আবার বললেন, “মঠের এবার বড়ই দুর্বৎসর পড়েছে। আমার বাবুরাম, দেবব্রত, শচীন সবাই চলে গেল।” দেবব্রত মহারাজের শরীরত্যাগের কয়েক দিন পূর্বে শ্রীশ্রীমহারাজ উদ্বোধনের বাড়িতে ভূত দেখেছিলেন। সেই কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতেই মা বললেন, “আস্তে - ওরা ভয় পাবে। ঠাকুরও অমন কত দেখতেন গাে! একবার বেণী পালের বাগানে রাখালকে সঙ্গে করে গেছেন। তিনি বাগানের দিকে বেড়াচ্ছেন। ভুত এসে বলে কি -- তুমি কেন এখানে এসেছ, জ্বলে গেলুম আমরা। তােমার হাওয়া আমাদের সহ্য হচ্ছে না, তুমি চলে যাও, চলে যাও।' তাঁর পবিত্র হাওয়া, তাঁর তেজ ওদের সহ্য হবে কেন ? তিনি তাে হেসে চলে এসে কারুকে কিছু না বলে খাওয়াদাওয়ার পরেই একখানা গাড়ি ডেকে দিতে বলেন। কথা ছিল - রাতটা ওখানে থাকবেন। তারা বললে, এত রাতে গাড়ি পাব কোথায় ? ঠাকুর বললেন, ‘তা পাবে, যাও। তারা তাে গিয়ে গাড়ি আনলে। তিনি সেই রাতেই গাড়ি করে চলে এলেন। অত রাতে ফটকে গাড়ির শব্দ পেয়ে কান পেতে শুনি - ঠাকুর রাখালের সঙ্গে কথা বলছেন। শুনেই ভাবলুম - ওমা, কি হবে, যদি না খেয়ে এসে থাকেন, কি খেতে দেবাে এই রাতে? অন্য দিন কিছু না কিছু ঘরে রাখতুম—এই সুজি হোক, যাই হােক। কেন না, কখন খেতে চেয়ে বসবেন ঠিক তো ছিল না। তা সেদিন আসবেন না জেনে কিছুই রাখি নি। মন্দিরের ফটক সব বন্ধ হয়ে গেছে, রাত তখন একটা। তিনি হাততালি দিয়ে ঠাকুরদের সব নাম করতে লাগলেন, কি করে যেন দরজা খুলিয়ে নিলেন। আমি বলছি, ও যদুর মা (ঝি), কি হবে ? তিনি শুনে বুঝতে পেরে তার ঘর থেকেই ডেকে বলছেন, ‘তােমরা ভেবো না গো, আমরা খেয়ে এসেছি।’ পরে রাখালকে সেই ভুতের কথা বলতে সে বলছে, ও বাবা, তখন বলনি ভালই করেছ, তা হলে আমার দাঁত কপাটি লেগে যেত; শুনে আমার এমনি ভয় পাচ্ছে।” 

এই বলে মায়ের এই হাসি। 

আমি - মা, ভূতগুলো তাে বড় বেকুব। ঠাকুরের কাছে কোথায় মুক্তি চাইবে তা নয়, চলে যেতে কেন বললে, মা ? 

মা বললেন, “ওদের কি আর মুক্তির বাকি রইল, ঠাকুরের যখন দর্শন পেলে ? নরেন একবার মাদ্রাজে ভুতের পিণ্ড দিয়ে মুক্ত করে দিয়েছিল।” 

আমি মাকে একটি স্বপ্নবৃত্তান্ত বললুম, “মা, একদিন স্বপ্নে দেখি কি যেন আমি স্বামীর সহিত কোথায় যাচ্ছি। যেতে যেতে দেখি-পথের মাঝে কুলকিনারা দেখা যায় না, এমনি এক নদী। গাছতলা দিয়ে নদীর ধারে যাবার সময় আমার হাতে সােনালি রংএর একটা লতা এমন জড়িয়ে গেল যে আর খুলতে পারছি না। সেটাকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে নদীর কাছে গিয়ে দেখি, ওপার হতে একটি কালো ছেলে একখানা পারের নৌকা নিয়ে এল। সে বললে, হাতের লতাটা সব কেটে ফেল, তবে পার করব। আমি সেটার প্রায় সবটা কেটে ফেলেছি, একটু কিন্তু আর কিছুতে পারছি না, ইতোমধ্যে আমার স্বামী যেন কোথায় চলে গেলেন, তাঁকে আর দেখতে পেলুম না। শেষে আমি বললুম, ‘একটু আর কাটতে পারছি না। আমাকে কিন্তু পার করতেই হবে।’ এই বলে নৌকায় উঠে পড়লুম। উঠবামাত্র নৌকা ছেড়ে দিলে, স্বপ্নও ভেঙে গেল।” 

মা ঐটি যে দেখলে ঐ ওঁর রূপে ধরে মহামায়া পার করে নিলেন। স্বামী বল, পত্র বল, দেহ বল, সব মায়া। এই সব মায়ার বন্ধন কাটাতে না পারলে পার হওয়া যায় না। দেহে মায়া দেহাত্মবুদ্ধি, শেষে এটাকেও কাটতে হবে। কিসের দেহ, মা, দেড় সের ছাই বই তাে নয়-তার আবার গরব কিসের ? যত বড় দেহখানাই হোক না, পুড়লে, ঐ দেড় সের ছাই। তাকে আবার ভালবাসা। হরিবােল, হরিবােল, জয় মা জগদম্বা, গােবিন্দ, গােবিন্দ, রাধাশ্যাম, গুরুদেব, গঙ্গা গঙ্গা ব্রহ্মবারি। দু'মাস আরা জেলায় কৈলােয়ার বলে এক দেশে ছিলুম সেখানকার জল-বায়ু; ভাল বলে। সঙ্গে গোলাপ, বাবুরামের মা, বলরামের পরিবার, এরা সব ছিল। সে দেশে কি হরিণ, মা, সব দল বেঁধে তিন কোণা ‘ব’-এর মত হয়ে চলেছে। দেখতে না দেখতে এমন ছুট দিলে, সে আর কি বলবাে, যেন পাখা ধরে উড়ে যাচ্ছে। এমন দৌড় দেখিনি। আহা! ঠাকুর বলতেন,’হরিণের নাভিতে কস্তুরী হয়, তখন তার গন্ধে হরিণগুলাে দিকে দিকে ছুটে বেড়ায়, জানে না কোথা হতে গন্ধটি আসছে।’ তেমনি ভগবান এই মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছেন, মানুষ তাঁকে জানতে না পেরে ঘুরে মরছে। ভগবানই সত্য, আর সব মিথ্যা। কি বল, মা ? 

মায়ের গায়ের আমবাত বড় বেড়েছে। মা বলছেন, “তিন বছর হল, মা, এই যে আমবাতে ধরেছে, মলুম এর জ্বালায়। জানি না, মা, কার পাপ আশ্রয় করলে, নইলে এ সব দেহে কি রােগ হয় ?” 

একদিন সন্ধ্যার পর গিয়েছি। দেখি নিবেদিতা স্কুলের কয়েকটি মেয়ে এসেছে-ওখানে দুটি মাদ্রাজী মেয়ে আছেন। তাঁরাও এসেছেন আর মা তাদের পড়াশুনার কথা জিজ্ঞাসা করছেন। তারা ইংরেজী জানেন শুনে মা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, আমরা এখন বাড়ি যাব-এর ইংরেজী কর তাে।” তাঁদের দুজনের মধ্যে একজন অন্যকে বলছেন, “তুমি কর।” তারপর ওঁদের মধ্যে বয়ােজ্যষ্ঠা যিনি তিনিই করলেন। মা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ি গিয়ে কি খাবে ?—এর ইংরেজী কি হবে ?” উত্তর শুনে মা খুব খুশি, হাসতে লাগলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, “তােমরা গান জান?” তাঁরা ‘জানি” বলাতে মাদ্রাজী গান গাইতে মা আদেশ করলেন। মেয়ে দুটি মাদ্রাজী গান গাইলেন। মাও শুনতে শুনতে খুব আনন্দ করতে লাগলেন। 

কয়েকদিন পরে আবার মাকে দর্শন করতে গিয়েছি। কিছুক্ষণ পরে দূর্গাদিদি তাঁদের আশ্রমের দুটি বালিকাকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে এলেন। তাঁরা মাকে প্রণাম করতেই মা আশীর্বাদ করে একটি ছােট মেয়েকে বছর আট হবে। জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি গান গাইতে জান?” মেয়েটি বললে, “জানি”। 

মা - গাও তাে, শুনি। 

মেয়েটি একটি গান গাইল। তার দুই-এক ছত্র মনে পড়ছে -

 ‘জয় সারদাবল্লভ, দেহি পদবপ্লব দীন জনে, 
কিঙ্করী গৌরী-তনয়া তােমারি রেখাে মনে।” 

মেয়েটি গৌরীমার শিক্ষিতা, অবিকল গৌরীমার স্বরে গাইল। মা বিস্মিতা হয়ে বললেন, “তাই তাে, ঠিক যেন গৌরদাসী ! সে বেঁচে আছে, তা নইলে বলতুম-“তার প্রেতাত্মা এসে ভর করেছে।” মেয়েটিকে আদর করে চুমাে খেয়ে আর এক দিন এসে গান শুনাতে বললেন। 

৫ই ভাদ্র, ১৩২৫ 

আজ সন্ধ্যার পরে গিয়েছি। মা তাঁর তত্তাপোশের পাশে মেজেতে একটি মাদুরে শুয়ে আছেন। প্রণাম করে কথাপ্রসঙ্গে মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, “মা, অনেক দিন এসেছি, এখন কি আমার কালীঘাটের বাসায় যাওয়া উচিত ?” 

মা - থাক না আরও কিছুদিন, সেখানে গেলে এখানটিতে তাে আর এমন করে আসতে পাবে না। একদিন যদি না আস তাে ভাবি কেন এল না গাে। এই কাল আসনি, ভাবলুম অসুখ করল না-কি, আজ না এলে বামুন ঠাকুরকে পাঠিয়ে দিতুম। তবে যদি তােমার স্বামীর কোন অসুখ-বিসুখ করে, আর তার মনের ভাবে বােঝ যে তার ইচ্ছা তুমি এখনি যাও, তা হলে অবিশ্যি যেতে হবে। 

আমি -- তিনি প্রসন্ন থাকলেও লােকে ত, মা, বলে, ঘর-সংসার ছেড়ে এতদিন বােনের বাড়িতে রয়েছে, স্বামীর সেবা, সংসার এ সবও তাে করা কর্তব্য।

মা - ঢের দিন তাে সংসার করলে। লােকের কথা ছেড়ে দাও, তারা অমন বলে থাকে। পুজোর সময় আশ্বিন মাসে তাে সেখানে যেতেই হবে।

আমি - সংসারের জন্য বড় একটা ভাবনা কখনাে ছিল বলে তাে মনে হয় না, 

মা! আপনার কাছে এমন আসতে পাব না, সেই ভাবনাই এখন সর্বদা মনে হয়।

মা - তবে আর কি? থাক না এ মাসটা। 

জনৈকা মহিলা মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, একজন ব্রহ্মচারী খবর দিয়ে গেলেন। ইতঃপূর্বে বিষম ক্লান্ত হয়ে মা শুয়ে ছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে ‘এই আবার একজনকে নিয়ে আসছে। -আঃ-গেলুম, মা’ --বলে বিরক্তিপ্রকাশ করে উঠে বসলেন। খানিক পরে সুন্দর বসন-ভূষণ-পরিহিতা একটি মহিলা মায়ের শয্যাপ্রান্তে এসে বসে মায়ের শ্রীচরণে মাথা রেখে প্রণাম করলেন। মা তাতে বললেন, “ওখানেই কর না, মা, পায়ে কেন ?” তারপর কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করলেন। 

তিনি বললেন, “জানেনই তাে, মা, তাঁর অসুখ।” 
মা - হাঁ শুনেছি। তা এখন কেমন আছেন ? কি অসুখ, কে দেখছেন ? 

তিনি — অসুখ বহুমুত্র ; ডাক্তার দেখছেন। পেটে জল হয়েছে, পা একটু ফুলেছে, ডাক্তার বলছেন—খুব শক্ত ব্যারাম! তা ডাক্তারদের কথা আমি মানি নে। মা, আপনাকে এর উপায় করতেই হবে। আপনি বলুন - তিনি ভাল হবেন। 

মা - আমি কি জানি, মা, ঠাকুরই সব। ঠাকুর যদি ভাল করেন তবেই হবে। তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাব। 

তিনি - তা হলেই হল। আপনার কথা কি ঠাকুর ঠেলতে পারেন ? 

এই বলে তিনি আবার শ্রীচরণে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। 

মা তাঁকে প্রবােধ দিয়ে বললেন, “ঠাকুরকে ডাকো। তিনি যেন তােমার হাতের নােয়া রাখেন। এখন খাওয়া-দাওয়া কি করেন?” 

তিনি -  এখন লুচি এই সব খান। 

এইরূপে দুই-চারি কথার পরে তিনি মায়ের শ্রীচরণে প্রণাম করে বিদায় নিলেন এবং নীচে পূজনীয় শরৎ মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। 

“সব লােকের জ্বালা-তাপে শরীর জ্বলে গেল, মা।” - এই বলে গায়ের কাপড় ফেলে মা শুলেন। আমি তেল মালিশ করার উদ্যোগ করছি এমন সময় আবার মহিলাটির কে আত্মীয় ( সঙ্গে এসেছেন ) প্রণাম করতে এলেন। আবার মাকে উঠতে হল। তিনি চলে যেতে মা পুনরায় শুয়ে বললেন, “এবার যেই আসুক আমি আর উঠছি নে। পায়ের ব্যথায় বারবার উঠতে কত কষ্ট দেখছ তাে, মা। তারপর আমবাতের জ্বালায় সারা পিঠটা এমন করছে। বেশ করে তেলটা ঘষে ঘষে দাও তাে।” তেল মালিশ করবার সময় পুর্বোক্ত মহিলাটির কথা উঠায় মা বললেন, “অমন বিপদ, ঠাকুরের কাছে এসেছে, মাথা মুড় খুঁড়ে মানসিক করে যাবে — তা নয়, কি সব গন্ধটন্ধ মেখে কেমন করে এসেছে দেখেছ ? অমন করে কি ঠাকুরদেবতার স্থানে আসতে হয়। এখানকার সবই কেমন এক রকম!” 

কিছুক্ষণ পরে বৌ এসে আমায় বললে, “লক্ষণ (চাকর) নিতে এসে বসে আছে গাে।” মা সাড়া পেয়ে বৌকে প্রসাদ দিতে বলে বললেন, “এই আমি মাথা তুলেহি, প্রণাম কর গো।” আমি প্রণাম করে রওনা হলুম। 

৬ই ভাদ্র, ১৩২৫ 

সন্ধ্যার পর আজ মার কাছে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে মাকে প্রণাম করতেই শুনি মা বলছেন (জনৈকা স্ত্রী-ভক্তের সম্বন্ধে কথা উঠেছে), “বৌয়ের উপর তার অতিরিক্ত শাসন। অত কি ভাল? পেছনে থেকে সামনে একটু আলগা দিতে হয়। আহা! ছেলেমানুষ বৌ, তার একটু পরতে খেতে ইচ্ছে হয় না? অমন করে সে যে বলে, যদি আত্মহত্যাই করলে বা কোন দিকে বেরিয়েই গেল তখন কি হবে ?" 

আমাকে দেখে বলছেন, “একটু আলতা পরেছে, তা আর কি হয়েছে। আহা! ওরা তাে স্বামীকে চোখেই দেখতে পায় না - স্বামী সন্ন্যাস নিয়েছে। আমি তাে চোখে দেখেছি, সেবাযত্ন করেছি, রেঁধে খাওয়াতে পেরেছি, যখন বলেছেন কাছে যেতে পেরেছি, যখন বলেন নি এমন কি দুমাস পর্ষন্ত নবত থেকে নামিই নি। দুর থেকে দেখে পেন্নাম করেছি। তিনি বলতেন, ‘ওরে, ওর নাম সারদা, ও সরস্বতী। তাই সাজতে ভালবাসে।’* হৃদয়কে বলেছিলেন, ‘দেখ তাে তাের সিন্দুকে কত টাকা আছে। ওকে ভাল করে দু ছড়া তাবিজ গড়িয়ে দে। তখন তাঁর অসুখ, তবুও আমায় তিনশ টাকা দিয়ে ** তাবিজ গড়িয়ে দেওয়ালেন -  তিনি নিজে টাকাকড়ি ছুঁতেই পারতেন না। 

“ঠাকুর চলে যাবার পর আমার যখন এখানে (কলকাতায়) আসার কথা হল, তখন আমি কামারপুকুরে। ওখানকার অনেকেই বলতে লাগল, ‘ওমা, সেই সব অল্প বয়সের ছেলে, তাদের মধ্যে গিয়ে কি থাকবে।’ আমি তো মনে জানি এখানেই থাকব। তবু সমাজ কি বলে একবার শুনতে হয় বলে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। কেউ কেউ আবার বলতে লাগল, তা, যাবে বই কি, তারা সব শিষ্য। আমি শুধু, শুনি। পরে আমাদের গায়ে একটি বৃদ্ধা বিধবা আছেন, তিনি ( লাহাদের প্রসন্নময়ী) ভারি ধার্মিক ও বুদ্ধিমতী বলে সকলে তাঁর কথা মানে, আমি তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি কি বল ? তিনি বললেন, “সে কি গো? তুমি অবিশ্যি যাবে। তারা শিষ্য, তােমার ছেলের মতাে। একি একটা কথা। যাবে বই কি।’ তাই শুনে তখন অনেকে যাবার মত দিলে। তখন এলুম। আহা! ওরা আমার জন্যে গুরুভক্তির জন্যে জয়রামবাটীর বেড়ালটাকেও পুষছে।”

“মা দুঃখ করতেন, ‘এমন পাগল জামায়ের সঙ্গে আমার সারদার বে দিলুম, আহা ! ঘর-সংসারও করলে না, ছেলেপিলেও হ’ল না, মা বলাও শুনলে না। একদিন ঠাকুর তাই শুনতে পেয়ে বলছেন, ‘শাশুড়ী ঠাকরুণ, সেজন্য আপনি দুঃখ করবেন না -- আপনার মেয়ের এত ছেলেমেয়ে হবে, শেষে দেখবেন মা ডাকের জ্বালায় আবার অস্থির হয়ে উঠবে। তা যা বলে গেছেন তা ঠিক হয়েছে মা।” 

কিছুক্ষণ পরে রাত্রি হ’তে আমি প্রণাম করে বিদায় নিলুম। 

আজ বৈকালে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মায়ের কাছে যাবার সময় হল, কেমন করে যাই। সন্ধ্যার আধার ঘনিয়ে এসেছে। শোকহরণের ওয়াটার প্রফটা ( সে বুদ্ধিটা শ্রীমানই দিয়েছিলেন) সারা গায়ে জড়িয়ে তাে চললুম। বৃষ্টির ঝাপটা নাকে-মুখে লেগে অস্থির করতে লাগল। তবু সে যে কি আনন্দে, কি টানে ছুটে চলেছি তা বলবার নয়। খিড়কিদরজা দিয়ে গেলুম। সামনে দিয়ে গেলে স্বামীজীরা দেখতে পেয়ে কি ভাববেন, লজ্জা হল। মার কাছে যেতেই আমার বেশ দেখে, মায়ের এই হাসি। কিন্তু যখন প্রণাম করতে গিয়ে তাঁর পায়ে ভিজে কাপড় লাগল (কারণ মাথার কাপড়টা ভিজে গিয়েছিল)

তখন ব্যস্ত হয়ে মা বললেন, “এই যে ভিজে গেছ। শীগগির কাপড় ছাড়, এই রাধুর কাপড়খানা পর।" 

আমি বললুম, “দেখুন, মা, গায়ে হাত দিয়ে, আর কোথাও ভেজেনি, কাপড় ছাড়তে হবে না।”

মা দেখে বললেন, “তাই বটে।” 

মা একখণ্ড ফ্লানেলের কথা বলেছিলেন, তা নিয়ে গিয়েছিলুম। পট্টি বাঁধবার সুবিধা হবে বলে দুদিকে নতুন কাপড় দিয়ে ফিতের মতো করে দিয়েছি দেখে মা ভারি খুশী হলেন। কথায় কথায় জয়রামবাটীর কথা উঠল। 

মা—একবার সেখানে কি দুর্ভিক্ষই লাগল। *** কত লােক যে খেতে না পেয়ে আমাদের বাড়ি আসত ! আমাদের আগের বছরের ধান মরাইবাঁধা ছিল। বাবা সেই সব স্থানে চাল করিয়ে কড়াইয়ের ডাল দিয়ে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি রাঁধিয়ে রাখতেন, বলতেন, বাড়ির সবাই এই খাবে, আর যে আসবে তাকেও দেবে। আমার সারদার জন্যে খালি ভাল চালের দুটি ভাত করবে। সে আমার তাই খাবে।’ এক একদিন এমন হােত, এত লােক এসে পড়তে যে খিচুড়িতে কুলাত না। তখনি আবার চড়ান হােত। আর সেই গরম গরম খিচুড়ি সব যেই ঢেলে দিত, শিগ়্গির জুড়ােবে বলে আমি দু'হাতে বাতাস করতুম। আহা! খিদের জ্বালায় সকলে খাবার জন্যে বসে আছে। একদিন একটি মেয়েলোক এসেছে, মাথায় রুখো চুল, চোখ উম্মাদের মতাে। এসেই গরুর ডাবায় কুঁড়ো ভিজান ছিল তাই খেতে আরম্ভ করলে। আমরা এত বলছি বাড়ির ভিতরে খিচুড়ি আছে ‘দিচ্ছি, তা আর তার ধৈয্য মানছে না। খিদের জ্বালা কি কম। দেহ ধরলেই খিদে তেষ্টা সব আছে। এবার বাড়িতে অসুখের সময় একদিন মাঝরাতে আমার এমনি খিদে পেলাে। সরলা টরলা সব ঘুমিয়েছে। আহ! ওরা এই খেটে খুটে শুয়েছে, ওদের আবার ডাকবাে? নিজেই শুয়ে শুয়ে চারদিকে হাতড়াতে লাগলুম। দেখি, চারটি খুদভাজা একটা বাটিতে রয়েছে। আবার মাথার বালিশের পাশে দু'খানা বিস্কুটও পেলুম। তখন ভারি খুশী। তাই খেয়ে তো জল খেলুম - জল ঘটিতে সামনেই ছিল। খিদের জ্বালায় খুদভাজা যে খাচ্ছি তা জ্ঞান নেই। 

এই বলে হাসতে লাগলেন। 
তারপর মা বললেন, “সেই সময়ে রাঁচি থেকে একটি ভক্ত বড় বড় পেঁপে এনেছিল। পেঁপেটা আমি বড় ভালবাসি, মা। আমি টুক টুক করে তাকাচ্ছি - আহা! এই পেঁপে আমাকে ওরা একটু দেয় তাে খাই। তা,ওরা দেবে কেন? তখন যে আমার খুব জ্বর। কোয়ালপাড়ায় কি অসুখই করেছিল, মা ! বেহুশ - এই বিছানাতেই বাহ্যে, পেচ্ছাব সব। সে সময় সরলা ও বৌ আমার খুব করেছে। (ক্রন্দনের স্বরে) তাই ভাবছি, মা, আবার তাে তেমনি ভুগতে হবে। তা সেবারে কাঞ্জিলালের ওষুধে সেরে গেল। আহা! মা, কি হাত পায়ের জ্বালা! কাঞ্জিলালের ঠাণ্ডা মােটা পেটটিতে হাত দিয়ে থাকতুম। শরৎও সেবার গিয়েছিল।” 

একটু পরে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা, মা জয়রামবাটী থেকে চিঠি লিখে কেন সেই স্ত্রী - ভক্তটির সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছিলেন ?” 

মা - ওর ভাব আলাদা। এ ভাবের ( ঠাকুরের ভাবের) নয়। 

বিস্মিত হয়ে গেলুম। ঐ অসুখ-বিসুখে অত ঝঞ্চাটের মধ্যে দূরে থেকেও আমাদের কিসে মঙ্গল হবে তাই চিন্তা। 

আমি তার পরদিন ভাল দেখে পাকা পেঁপে ও আম নিয়ে গেছি। মা কি খুশী, আর আমাদের খুশী করবার জন্য তাঁর কি আনন্দ প্রকাশ করা ! 

মা বলছেন, “এই যে গো কাল যে পেঁপের গল্প হ’ল ঠিক সেই রকম, বেশ আম।" তারপর এই আমটি শরৎকে দিও, এইটি গণেনকে, এইটি জামাইকে - এমনি করে কিছু ভাগ করা হ’ল। ভারি গরম, মায়ের বড় ঘামাচি বেরিয়েছে। 

মা বলছেন, “চন্দন মাখলে ঘামাচি কমতে পারে, কিন্তু তাতে ঠাণ্ডা লাগে।” 

আমি - কাল পাউডার নিয়ে আসব ? মাখলে ঘামাচি কমবে। 

মা - তা এনাে গাে, দেখি তােমাদের পাউডার-ই মেখে। এক ঘটি জল আনতে বলতো, মা, একবার বাইরে যাব। 

বৌ বললে, “জল রেখেছি।” 

মা রাস্তার ধারের বারাণ্ডায় গিয়ে হাসতে হাসতে ডাকছেন, “ও মেয়ে, ও মেয়ে একবার এদিকে এস, শীগগির এস।” আমি কাছে যেতেই বলছেন, “দেখ, দেখ ঐ বেশ্যাবাড়ির সামনে জানালার ধারে একটা লােক, একবার এ-জানালা একবার ও-জানালা করে মরছে - ঢুকতে পারছে না। দেখাে, কি মােহ, কি প্রবৃত্তি! ভিতর থেকে ঐ গানের শব্দ আসছে, আর ও ঢুকতে পারছে না। আহা! মলো গাে ছটফটিয়ে।” মা এমনি করে ঐ কথাগুলি বলছেন যে, হাসি আর চাপতে পারলুম না। তখন মাও হাসেন, আমিও হাসি। হাসতে হাসতে দুজনে ঘরে এলুম।

আমি -- আহা! ভগবানের জন্যে যদি ঐরপ ছটফটানিটুকু হয়। তা হয় না, মা ! 

একটি মেয়ের কথা উঠল। মা বললেন, “কি মােহ হয়েছে, মা, ওর স্বামীর জন্যে! খেয়ে শুয়ে সুস্থির নেই, খেতে খেতে উঠে গিয়ে দেখে আসে। দিনরাত ঘরে বন্দী করে নিয়ে বসে আছে। ওর জন্যে সে তাে কোন জায়গায় বেরতে পর্যন্ত পারে না। ছি! ছি ! আর শরীর কি হচ্ছে দেখ ! একটা ছেলে টেলে হলে যদি ওর এই ভাব কমে।”

বৌ এসে বললে, “তােমায় নিতে এসেছে গাে।” রাতও হয়েছিল অনেক, প্রণাম করে বিদায় নিলুম।

পরদিন মা রাস্তার ধারের বারাণ্ডায় বসে জপ করছেন। ঘরে তাঁকে দেখতে না পেয়ে বারাণ্ডায় গিয়েছি। মা বলছেন, “কিগাে এলে, ব’স!” জপ সারা হ’ল, হরিনামের ঝুলিটি নিজের মাথায় ঠেকিয়ে রেখে দিলেন। মার বাড়ির সামনে তখন মাঠ ছিল, তার পশ্চিম ধারে খােলার ঘরে যে কতকগুলি দরিদ্র লােক ভাড়াটে ছিল এইবার তাদের লক্ষ্য করে বললেন, “এই দেখ সারাদিন খেটে খুটে এসে এখন সব নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছে গাে - দীনার্তরাই ধন্য।” যীশুখ্রীষ্টের মুখ দিয়ে একদিন ঐ কথা বেরিয়েছিল বাইবেলে পড়েছিলুম, মনে পড়লাে। আজ মায়ের মুখেও সেই কথা শুনলুম। একটু পরে মা বললেন, “চল, ঘরে যাই।” বৌ নীচে বিছানা করে রেখেছিল, এসে শুলেন। সকালেই লক্ষণকে দিয়ে পাউডার পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। মা বলছেন, “ওগাে, তােমার দেওয়া পাউডার মেখেছিলুম, তাই তাে এই দেখ, ঘামাচিগুলাে মিলিয়ে মজে এসেছে। এই খানটায় বড় হয়েছে, দাও। চুলকানিটাও যেন কমে গেছে। শরতেরও বড় ঘামাচি উঠেছে — আহা! তাকেও কেউ এইটি মাখিয়ে দেয়।” 

আমি বললাম, “ও বাবা, তাকে একথা কে বলতে যাবে মা! ও জিনিসটা যে সৌখিন লােকেরাই ব্যবহার করে থাকে।” শুনে মা হাসতে লাগলেন। 

মায়ের হাঁটুর বাত বড় বেড়েছে। কাল জনৈক ভক্তের দুটি ছেলে ইলেকট্রিক ব্যাটারী লাগিয়েছিল, তাতে একটু কমেছে। আজও সেই দুটি ছেলে এসেছে। ছােট মামী বলছেন, “আমারও কাল থেকে বাত বেড়েছে, আমিও ঐ কলটা লাগাবাে গাে!” মা শুনে হাসতে লাগলেন, বললেন - “দাও তাে বাছা, ওকে।” ছেলে দু’টি তাড়াতাড়ি যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে নিয়ে যেই মামীর পায়ে এক বার ব্যাটারী ধরেছে, আর সে কি চীৎকার - “গাে, মলুম গো, সর্ব শরীর ঝিন ঝিন করছে, ছাড় ছাড়!” শুনে সকলের হাসি। এ তাে আর সর্বংসহা জননী নন। তখন ছােট মামী মাকে বলছেন, “কই তুমি তাে এমন হবে বললে নি ?” 

মা — সেরে যাবে, চেচাস নে, একটু সহ্য কর।

তারপর মামী বললেন, “সত্যিই, যেন একটু কমেছে।” 

বিলাস মহারাজ আরতি করে গেলেন। বৌ বছে, “আচ্ছা, এর নামে কোন ‘আনন্দ’ নেই?” 

মা হেসে বলছেন, “আছে বই কি গাে -- ওর নাম বিশ্বেশ্বরানন্দ।” তারপর বলছেন, একজনকে ডাকে কপিল। আচ্ছা, ওর সঙ্গে কি আনন্দ আছে ? কপিলানন্দ নাকি?” (এই সময়ে সরলাদিদি ঘরে ঢুকলেন)

মা - আচ্ছা, কপিল মানে কি ? 

সরলাদিদি বললেন, “কি জানি - বানর বােধ হয়।” 

আমি - সে কি সরলাদিদি, কপি মানে বানর, কপিল মানে নয়। আর সকলের হাসি। 

মা - আবার একজনের নাম আছে ভুমানন্দ। আচ্ছা, এর মানে কি? 

আমি - সে তাে আপনিই ভাল জানেন, মা। 

মা - না, না, তােমরাই বল শুনি। 

আমি - ভুমা মানে তাে সেই অনন্ত বা সর্বব্যাপী পুরুষকেই বুঝায় শুনেছি, মা। 

মা ঐকথা শুনে খুশী হয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছেন। সত্যই মা এক এক সময় এমন ভাব দেখান যেন ছেলে মানুষটি - কিছুই জানেন না। আবার অন্য সময়ে দেখেছি, কঠিন আধ্যাত্মিক তত্ত্বের কেমন ব্যাখ্যা করে দিচ্ছেন। যেখানে মানুষের পুঁথিগত বিদ্যায় কুলায় না, তখন আর এক ভাব, যেন সব বুঝেন। মা বললেন, “আর কপিল মানে কি হল ?” মা ওটি শুনতেই চান। 
আমি - কি জানি, মা। কপিল নামে তাে সাংখ্যদর্শন প্রণেতা এক মুনি ছিলেন, আবার কপিল রংও আছে। ওরা কি অর্থে নাম রেখেছেন কি জানি, ঐ কথার আরও হয় তাে অর্থ আছে - মনে পড়ছে না। কাল অভিধান দেখে আসবাে। 

এই সময়ে একদিন বৈকালে গিয়েছি। একজন সন্ন্যাসী শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করতে এসে বলছেন,—“মা মাঝে মাঝে প্রাণে এত অশান্তি আসে কেন? কেন সর্বক্ষণ আপনার চিন্তা নিয়ে থাকতে পারি না? পাঁচটা বাজে চিন্তা কেন এসে পড়ে? মা, ছােটখাটো অনেক জিনিস তাে চাইলেই পাওয়া যায়, পেয়েও এসেছি, আপনাকে কি কোন দিনই পাব না? মা, কিসে শান্তি পাব বলে দিন -~-আপনার কৃপা কি কখনও পাব না? আজকাল দর্শন-টর্শনও বড় একটা হয় না। আপনাকেই যদি না পেলুম তবে বেঁচে থেকেই বা লাভ কি? শরীরটা গেলেই ভাল।” 

মা - সে কি বাছা, ও কথা কি ভাবতে আছে ? দর্শন কি রোজই হয় ? ঠাকুর বলতেন, “ছিপ ফেলে বসলেই কি রোজই রুই মাছ পড়ে? অনেক মাল মসলা নিয়ে একাগ্র হয়ে বসলে কোন দিন বা একটা রুই এসে পড়লাে, কোন দিন বা নাই পড়লো, তাই বলে বসা ছেড়াে না।' জপ বাড়িয়ে দাও। 

যােগীন -মা - হ্যাঁ, নামব্রহ্ম। প্রথম প্রথম মন একাগ্ন না হলেও হবে নিশ্চয়। 

সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করলেন, “কত সংখ্যা জপ করবো আপনি বলে দিন, মা, তবে যদি মনে একাগ্রতা আসে।" 

মা - আচ্ছা, রোজ দশ হাজার করাে, দশ হাজার - বিশ হাজার, যা পার। 

সন্নাসী - মা, একদিন সেখানে ঠাকুরঘরে পড়ে কাঁদছি, এমন সময় দেখলুম, আপনি মাথার পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘তুই কি চাস? আমি বললুম, “মা, আমি আপনার কৃপা চাই, যেমন সুরথকে করেছিলেন।’ আবার বললুম, 'না, মা, সে তাে দূর্গারূপে; আমি সেইরূপে চাই না, এইরূপে!' আপনি একটু হেসে চলে গেলেন। মন তখন আরও ব্যাকুল হল, কিছুই ভাল লাগে না। মনে হল, যখন তাঁকে লাভ করতে পারলুম না, তখন আর আছি কেন? 

মা - কেন, ঐ যেটুকু পেয়েছ তাই ধরে থাক না কেন? মনে ভাববে, আর কেউ না থাক, আমার একজন ‘মা’ আছেন। ঠাকুর যে বলে গেছেন, এখানকার সকলকে তিনি শেষদিনে দেখা দেবেনই—দেখা দিয়ে সব নিয়ে যাবেন। 

সন্ন্যাসী - যেখানে ছিলুম, তিনি খুব ভক্ত-গৃহস্থ। তার স্বী এক বড় লােকের কন্যা, খুব খরচ করেন। মাছ খাবার জন্যে আমাকে বড় অনুরােধ করেন। আমি খাই না। 

মা - মাছ খাবে। খাবার ভিতর আছে কি? মাছ খেলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। তাকে বেশী বাজে খরচ করতে বারণ করবে। ভক্ত গৃহস্থের টাকা থাকলে সাধুদের কত উপকারে লাগে। তাদের টাকাতেই তাে সাধুরা বর্ষাকালে একস্থানে বসে চাতুর্মাস্য করতে পারে। তখন তাে সাধুদের ভ্রমণ করে ভিক্ষা করবার সুবিধা হয় না।

সন্ন্যাসীটি প্রণাম করে নীচে গেলেন। 

* ঠাকর গােলাপ-মাকেও বলেছিলেন, “ও (শ্রীশ্রীমা) সারদা সরস্বতী - জ্ঞান দিতে এসেছে, রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লােকের অকল্যাণ হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে। 

** তাবিজের জন্য ঠাকুর ৩০০ টাকাই দিয়েছিলেন, কিন্তু তাবিজ গড়াতে কম (২০০ টাকা) লেগেছিল। বাকী ১০০, টাকা শুনেছি শ্রীশ্রীমাকে নগদ দেওয়া হয়েছিল। 

*** ১২৭৯, মায়ের বয়স তখন ১১ বছর। 

১৭ই ভাদ্র, ১৩২৫ 

আমার অসুখ করেছিল, একটু ভাল হতে আজ সন্ধ্যারতির পরে গেছি। মা তখন শুয়েছিলেন। দেখেই বললেন, “কি গাে, ভাল আছ ? অসুখ সেরেছে ?” 

আমি বললাম, “হ্যাঁ, মা।” মা সাংসারিক কুশলপ্রশ্নাদি করতে লাগলেন। ঢাকার একটি শিষ্যা মাসখানেক হতে চললো ‘উদ্বোধনে’ আছেন, তিনি বললেন, “মা, তেল মালিশ করে দেবাে ? দিদির (আমার) তাে শরীর ভাল নয়।”

মা - তা হােক, ও দিতে পারবে। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করবার পরও বললেন, “না, না, ও তেল দিতে পারবে। তুমি না হয় একটু বাতাস কর।” তিনি বাতাস করতে লাগলেন। একটু বাতাস করার পর মা বললেন, “হয়েছে, ঠাণ্ডা লাগছে, এখন একটু শােওগে। জল খেয়েছ ? মিষ্টি নিয়ে জল খাও না।” মা এমনি করে সকলের মনস্তুষ্টি করে থাকেন। তিনি উঠে মায়ের কথামত জল খেয়ে শুলেন।

মা - (আমাকে) কাল কেমন ঠাকুরের বই পড়া হল, সরলা পড়েছিল। কি সব কথা। তখন কি জানি মা, এত সব হবে। কি মানুষই এসেছিলেন। কত লােক জ্ঞান পেয়ে গেল! কি সদানন্দ পুরুষই ছিলেন। হাসি কথা, গল্প কীর্তন চব্বিশ ঘণ্টা লেগেই থাকত। আমার জ্ঞানে তাে আমি কখন তাঁর অশান্তি দেখি নি। আমাকে এমন কত সব ভাল ভাল কথা বলতেন। আহা! যদি লেখাপড়া জানতুম, তা হলে অমনি করে সেই সব টুকে টুকে রাখতুম। কই গাে, সরলা আজ আবার একটু পড় না। 

সরলাদি কথামৃত পড়তে লাগলেন। রাখাল মহারাজের বাবা এসেছেন, ঐখান থেকে পাঠ আরম্ভ হ'ল। পড়া শুনতে শুনতে মা বলছেন, “ঐ যে রাখালের কথায় তার বাপকে বললেন, ‘যেমন ওল তেমন মুখীটি তো হবে।' সত্যই তিনি অমনি করে রাখালের বাবার মন খুশী রাখতেন। তিনি এলেই যত্ন করে এটি ওটি দেখাতেন, খাওয়াতেন, কত কথা বলতে - মনে ভয় পাছে রাখালটিকে ওখানে না রাখে, নিয়ে যায়। রাখালের সৎমা ছিল। সে যখন দক্ষিণেশ্বরে আসতাে, ঠাকুর রাখালকে বলতেন, “ওরে, ওঁকে ভাল করে দেখাশুনা, যত্ন কর, তা হলে জানবে ছেলে আমাকে ভালবাসে।” পড়তে পড়তে বৃন্দে ঝির লুচির কথা এল, মা বললেন, “হ্যাঁ গো, সে কি কম ছিল ? তার জল খাবারের বরাদ্দের লুচি যদি কোন দিন খরচ হয়ে যেত, তবে বকে অনর্থ করতাে; বলতো - ‘ওমা, কেমন সব ভদ্দর লােকের ছেলে গাে, আমারটি সব খেয়ে বসে থাকে - মিষ্টিটাও পাই না?”

“ঐ সব কথা পাছে ছেলেদের কানে যায়, তাই ঠাকুর আবার ভয় করতেন। একদিন ভােরে উঠে এসেই নবতে আমাকে বলছেন, ‘ওগো, বৃন্দের খাবারটি তাে খরচ হয়ে গেছে, তা তুমি তাকে রুটি লুচি যা হয় ক'রে দিও, নইলে এক্ষণি এসে আবার বকাবকি করবে। দুর্জনকে পরিহার করে চলতে হয়।” 

“আমি তাে বৃন্দে আসতেই তাড়াতাড়ি বললুম, “বন্দে, তােমার খাবার তৈয়ের করে দি, খরচ হয়ে গেছে। তখন সে বললে, “থাক আর তৈয়ের করতে হবে না, এমনি দাও।' তখন যেমন সিধে সাজায়, তেমনি ক'রে ঘি, ময়দা, আলু, পটল সব দিলুম।” 

এক অধ্যায় পাঠ হলে সয়লাদিদি গােলাপ - মার সেবায় গেলেন, তাঁর অসুখ। 

মা আস্তে আস্তে বলছেন, “ঠাকুর ভগবানের বিষয় ছাড়া কোন কথাই বলতেন না। আমাকে বলতেন, “দেখছ তাে মানুষের দেহ কি! - এই আছে, এই নাই, আবার সংসারে এসে কত দুঃখ কত জ্বালা পায়। এ দেহের আবার পয়দা করা কেন? এক ভগবানই নিত্যসত্য, তাঁকে ডাকতে পারলেই ভাল। দেহ ধরলেই নানা উপসর্গ। সে দিন বিলাস এসে বলছে, ‘কত সাবধানে আমাদের থাকতে হয়, মা, পাছে মনেও কিছু উঠে এই ভয়েও সশস্ক থাকতে হয়।’ তাই তাে, ওর হল সাদা কাপড় আর সংসারীর হল কাল কাপড়। কাল কাপড়ে কালি পড়লেও অত ঠাওর হয় না, কিন্তু সাদা কাপড়ে এক বিন্দু পড়লেই সকলের চোখে পড়ে। দেহ ধরলেই বিপদ। সংসার তাে এই কাম- কাঞ্চন নিয়েই আছে। ওদের (সাধুদের) কত ত্যাগ করে চলতে হয়। তাই ঠাকুর বলতেন, ‘সাধু সাবধান’।” 

ইতােমধ্যে হরিহর মহারাজ ঠাকুরের ভােগ দিতে এসেছেন। তাঁকে দেখিয়ে মা বলছেন, “এই দেখ একটি ত্যাগী ছেলে, ঠাকুরের নাম নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সংসারী লোক খালি গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলের জন্ম দিতে থাকে, ঐ যেন কাজ। ঠাকুর বলতেন ‘দু-একটি ছেলে হওয়ার পর সংযত থাকতে।’ ইংরেজেরা নাকি বিষয় বুঝে ছেলের জন্ম দেয় — যে এই (সম্পত্তি) আছে, এতে একটি ছেলে হলে বেশ চলবে এবং তাই হবার পর স্ত্রী পুরুষ দু'জনে বেশ আলাদা আপন আপন কাজ নিয়ে থাকে। আর আমাদের জাতের ?” 

মা হাসতে হাসতে বলছেন, “কাল একটি বৌ এসেছিল, মা। গ্যাঁড়া, গোঁড়া ছােট্রটি, তার কোলে পিঠে ছেলে, ভাল করে সামলে নিতেও পারছে না। তারপর বলে কি, ‘মা, সংসার ভাল লাগে না। আমি বলি, “সে কি গাে, তােমার এই সব কাচ্চাবাচ্চা!' তাতে বললে, ঐ পর্যন্তই, আর হবে না। বললুম, তা পার যদি ভালোই তাে গো।” এই বলে হাসতে লাগলেন। 

আমি - আচ্ছা, মা, সংসারে তো স্ত্রীলোক দের স্বামী একান্ত পূজ্য ও গুরু। তাঁর সেবায় সালোক্য, সাযুজ্য পর্যন্ত মিলে থাকে - শাস্ত্রে বলে। সেই স্বামীর কতকটা মতের বিরুদ্ধে কোন স্ত্রী যদি অনুনয়-বিনয় বা সদালাপ দ্বারা সংযমী হয়ে থাকতে চেষ্টা করে তাতে কি পাপ হয় ? 

মা - ভগবানের জন্য হলে কোন পাপ হয় না, মা। কেন হবে? ইন্দ্রিয় সংযম চাই, এই যে বিধবাদের এত ব্যবস্থা সব ইন্দ্রিয়সংযমের জন্যে। ঠাকুরের কোন বিষয়ই ভগবান ছাড়া ছিল না। আমাকে যে-সব জিনিস দিয়ে ষোড়শী পূজা করেছিলেন সেই সব শাঁখা শাড়ী ইত্যাদি—আমার তাে গুরু-মা ছিলেন না—কি করবাে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি ভেবে বললেন, ‘তা তােমার গর্ভধারিণী মাকে দিতে পার’ - তখন বাবা বেঁচে ছিলেন  - ‘কিন্তু দেখাে তাঁকে যেন মানুষজ্ঞান করে দিও না, সাক্ষাৎ জগদম্বা ভেবে দেবে।' তাই করলুম । এমনি শিক্ষা তাঁর ছিল। 

শােকহরণ মাসিক যে পাঁচ টাকা দেয়, তা মাকে দিতে দিয়েছিল। দিতেই মা বললেন, “কেন মা, এখন তার কষ্ট, এখন নাই বা দিলে।” 

আমি - কত দিকে কত খরচ হয়ে যাচ্ছে, মা, এ তাে আর বেশী নয়। যে আপনার সেবায় দিতে পারে তারই মনের তৃপ্তি, নইলে -

মা বললেন, “হাঁ, তা বটে। এখানে দিলে সাধুভক্তদের সেবায় লাগে।” 

মালপাে এনেছিলুম, খুলে ঠাকুরের কাছে দিতে বললেন। রাত অনেক হয়েছিল, প্রায় সাড়ে দশটা - ভােগ হয়ে গেছে, মায়ের আহারের পর প্রসাদ নিয়ে বিদায় নিলুম। 
 ১৮ই ভাদ্র ১৩২৫ 

মা জপের আসনে বসে আছেন। আরতি হয়ে গেছে। রাধুর স্বামীর জন্য মাংস রেঁধে এনেছিলুম, রাধুকে ডেকে তেতলায় তার ঘরে রেখে আসতে বললেন। আমি রেখে এসে প্রণাম করে বসলুম। মা কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। একটি আত্মীয়া মেয়ে এসে মাকে বলছেন, “তুমি আমার মনটি ভাল করে দাও, আমার মনে বড় অশান্তি, আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে নেই, যা আছে তােমাকে লিখে পড়ে দিয়ে যাব। আমি মরবার পরে তুমি সেই মতো কাজ কোরো।” 

মা হেসে বললেন, “তা কবে মরবি গাে!” শেষে গম্ভীর হয়ে মা বললেন, “তা হলে আস্তে আস্তে বাড়ি চলে যাও, এ সব জায়গায় যেন একটা বিপদ ক'রে বসাে না। এমন জায়গায় থেকে, আর আমার কাছে থে - (থে বলেই সামলে নিয়ে বললেন) এই সব সাধু-ভক্ত, ঠাকুর এমন স্থানে থেকেও যদি তাের মনের অশান্তি না ঘােচে, তবে তুই কি চাস বল দেখি? কি জীবন তুই পেয়েছিস বল দেখি? কোনও ঝঞ্জাট নেই। এ জন্মটা যে কিনে নিয়ে যেতে পারতিস। এ স্থান যখন চিনলি নি - চিনবি একদিন যখন অভাব হবে, তবে এখন বুঝলি নি। তাের পাপ মন, তাই শান্তি পাস নে। কাজকর্ম না করে বসে থেকে মাথা গরম হয়ে উঠেছে। একটা ভাল চিন্তা কি তাের কিছু করতে নেই ? কি অশুদ্ধ মন গাে!” এই বলেই আবার হেসে উঠে আমার পানে তাকিয়ে বলছেন, “কি ঠাকুরের লীলা মা দেখছ। মায়ের বংশটি আমার কেমন দিয়েছেন। কি কুসংসর্গই করছি দেখ ! এইটি তাে পাগলই, আর একটিও পাগল হবার গতিক হয়েছে। আর ঐ দেখ আর একটি, কাকেই বা মানুষ করেছিলুম, মা, একটুও বুদ্ধি নেই। ঐ বারাণ্ডার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কখন স্বামী ফিরবে। মনে ভয়, ঐ যে গানবাজনা যেখানে হচ্ছে, পাছে ঐখানেই ঢুকে পড়ে। দিনরাত সামলে নিয়ে আছে, কি আসক্তি, মা! ওর যে এত আসক্তি হবে তা জানতুম না।” 

আত্মীয়াটি বিষন্ন মুখে উঠে গিয়ে শুলেন।

মা - কত সৌভাগ্যে, মা এই জম্ম, খুব করে ভগবানকে ডেকে যাও। খাটতে হয়, না খাটলে কি কিছু হয় ? সংসারে কাজকর্মের মধ্যেও একটি সময় করে নিতে হয়। আমার কথা কি বলবাে, মা, আমি তখন দক্ষিণেশ্বরে রাত তিনটের সময় উঠে জপে বসতুম। কোন হুশ থাকতো না। একদিন জোছনা রাতে নবতে সিড়ির পাশে * বসে জপ করছি, চারিদিক নিস্তদ্ধ। ঠাকুর যে সেদিন কখন ঝাউতলায় শৌচে গেছেন, কিছুই জানতে পারি নি - অন্যদিন জুতাের শব্দে টের পাই। খুব ধ্যান জমে গেছে। তখন আমার অন্য রকম চেহারা ছিল গয়না পরা, লালপেড়ে শাড়ী। গা থেকে আঁচল খসে বাতাসে উড়ে উড়ে পড়ছে, কোন হুশ নেই। ছেলে যােগেন সেদিন ঠাকুরের গাড় দিতে গিয়ে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখেছিল। সে সব কি দিনই গিয়েছে, মা! জোছনা রাতে চাঁদের পানে তাকিয়ে জোড় হাত করে বলেছি, তােমার ঐ জোছনার মতাে আমার অন্তর নির্মল করে দাও।' জপধ্যান করতে করতে দেখবে - (ঠাকুরকে দেখিয়ে) উনি কথা কবেন, মনে যে বাসনাটি হবে তক্ষুণি পূর্ণ করে দেবেন কি শান্তি প্রাণে আসবে ! আহা! তখন কি মনই ছিল আমার ! বৃন্দে (ঝি ) একদিন আমার সামনে একটি কাঁসি গড়িয়ে (ঠেলা মেরে) দিলে, আমার বুকের মধ্যে যেন এসে লাগল (মা নবতে ধ্যানস্থা ছিলেন, তাই শব্দটা যেন বজ্রের মতাে লেগেছিল -- কেঁদে ফেলেছিলেন )। সাধন করতে করতে দেখবে আমার মাঝে যিনি, তােমার মাঝেও তিনি, দুলে বাগদি ডোমের মাঝেও তিনি - তবে তাে মনে দীন ভাব আসবে। ওর (পূর্বোক্ত আত্মীয়ার) কথা কি বলবাে, মা, জয়রাম বাটীতে ডােমেরা বিড়ে পাকিয়ে দিয়েছে, ঘরে দিতে এসেছে। আমি বললুম, ‘ঐখানকে রাখ, তা তারা কত সাবধান হ'য়ে রেখে গেল। ও বলে কি-না ‘ঐ ছোঁয়া গেল, ওসব ফেলে দাও' এই বলে তাদের গালাগাল -- ‘তােরা ডোম হয়ে কোন সাহসে এমন করে রাখতে যাস?’ তারা তাে ভয়ে মরে। আমি তখন বলি, ‘তােদর কিছু হবে না, কোন ভয় নেই। আবার তাদের মুড়ি খেতে পয়সা দিত—এমন মন ওর! রাত তিনটের সময় উঠে আমার ঐ দিকের (উত্তরের) বারাণ্ডায় বসে জপ করুক না, দেখি কেমন মনে শান্তি না আসে। তাতে করবে না, কেবল অশান্তি অশান্তি - কিসের অশান্তি তাের ? আমি তাে, মা, তখন অশান্তি কেমন জানতুম না। এখন ঐ ওদের জন্য, আর কিক্ষণে ছােট বৌ ঘরে এল, আর তার মেয়েকে মানুষ করতে গেলুম, সেই হতে যত জ্বালা। যাক, সব চলে যাক, কাউকে আমি চাই নে। এ কি মেয়ে সব হ’ল গা ! একটা কথা শােনে না। মেয়েলোক এত অবাধ্য !

গােলাপ-মা  - আবার কেমন করে সাজে দেখ না । ভাবে, তবেই বুঝি বর ভালবাসবে।

মা - আহা! তিনি আমার সঙ্গে কি ব্যবহারই করতেন! একদিনও মনে ব্যথা পাবার মতাে কিছু বলেন নি। কখনও ফুলটি দিয়েও ঘা দেন নি। এক দিন দক্ষিণেশ্বরে আমি তাঁর ঘরে খাবার **রাখতে গেছি, লক্ষী রেখে যাচ্ছে মনে করে তিনি বললেন, “দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস। আমি বললুম, “আচ্ছা। আমার গলার স্বর শুনে তিনি চমকে উঠে বললেন, ‘কে, তুমি? তুমি এসেছ বুঝতে পারি নি। আমি মনে করেছিলুম লক্ষী; কিছু মনে করো নি। আমি বললুম, তা বললেই বা। কখনাে আমাকে তুমি ছাড়া ‘তুই’ বলেন নি। কিসে ভাল থাকবাে তাই করেছেন। তিনি বলতেন, “কর্ম করতে হয় ; মেয়েলােকের বসে থাকতে নেই, বসে থাকলে নানা রকম বাজে চিন্তা কুচিন্তা সব আসে। একদিন কতকগুলি পাট এনে আমাকে দিয়ে বললেন, “এইগুলি দিয়ে আমাকে শিকে পাকিয়ে দাও, আমি সন্দেশ রাখবে, লুচি রাখবাে ছেলেদের জন্য। আমি শিকে পাকিয়ে দিলুম আর ফেঁসােগুলো দিয়ে থান ফেলে বালিশ করলুম। চটের উপর পটপটে মাদুর পাততুম আর সেই ফেঁসাের বালিশ মাথায় দিতুম। তখনও তাইতে শুয়ে যেমন ঘুম হােত এখন এই সবে ( খাট বিছানা দেখিয়ে) শুয়েও তেমনি ঘুমােই - কোন তফাত বােধ হয় না, মা। তিনি বলতেন, ওরে হৃদু, আমার বড় ভাবনা ছিল যে পাড়া-গেঁয়ে মেয়ে, কে জানে - এখানে কোথায় শৌচে যাবে, আর লােকে নিন্দে করবে তখন লজ্জা পেতে হবে। তা, ও কিন্তু এমন যে কখন কি করে, কেউ টেরই পায় না, বাইরে যেতে আমিও কখনাে দেখলুম না। তাঁর ঐ কথা শুনে আমার এমন ভাবনা হ’ল যে কি বলব। ভাবলুম - ওমা, উনি তাে যা চান তাই মা ওকে দেখিয়ে দেন, এইবার বাইরে গেলেই ওঁর চোখে পড়তে হবে দেখছি। ব্যাকুল হয়ে জগদম্বাকে ডাকতে লাগলুম, “হে মা, আমার লজ্জা রক্ষা কর। তা আমার এমনি মা -টি যেন দুই পাখা দিয়ে আমাকে ঢেকে রাখতেন! এত বছর ছিলুম, একদিনও কারও সামনে পড়ি নি। লােকে আমাকে ভগবতী বলে, আমিও ভাবি—সত্যিই বা তাই হব। নইলে আমার জীবনে অদ্ভুত অদ্ভুত যা সব হয়েছে! এই গােলাপ, যােগীন এরা তার অনেক কথা জানে। আমি যদি ভাবি -- এইটি হােক, কি এইটি খাব, তা ভগবান কোথা হতে সব জুটিয়ে দেন। আহা। দক্ষিণেশ্বরে কি সব দিনই গেছে, মা ! ঠাকুর কীর্তন করতেন, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা নহবতের ঝাপড়ির ভিতর দিয়ে *** চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতুম, হাতজোড় করে পেন্নাম করতুম। কি আনন্দই ছিল । দিনরাত লােক আসছে, আর ভগবানের কথা হচ্ছে। আহা! বিষ্ণু বলে একটি ছেলে সংসারের ভয়ে আত্মহত্যাই করলে। তা ভক্তদের মধ্যে কে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ও যে আত্মহত্যা করলে, ওর পাপ হ’ল না? তিনি বললেন, “ও ভগবানের জন্যে দেহ দিয়েছে, ওর আবার পাপ কি ? কোন পাপ নেই, তবে এ কথাটি সবাইকে বলো না। সবাই ভাবটি বুঝবে না - তা দেখ এখন বইয়েই ছাপিয়ে দিয়েছে। 

“মন না মত্ত হস্তী, মা। হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছােটে। তাই সদসৎ বিচার করে সব দেখতে হয়, আর খুব খাটতে হয় ভগবানের জন্যে। তখন আমার মন এমন ছিল -- দক্ষিণেশ্বরে রেতে কে বাঁশী বাজাত, শুনতে শুনতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠত, মনে হােত সাক্ষাৎ ভগবান, বাঁশী বাজাচ্ছেন - অমনি সমাধি হয়ে যেত। আহা! বেলুড়েও কেমন ছিলুম ! কি শান্ত জায়গাটি, ধ্যান লেগেই থাকত। তাই ওখানে একটি স্থান করতে নরেন ইচ্ছা করেছিল। আর এই বাড়িটি যে হল, এই চার কাঠা জমি কেদার দাস দিয়েছিল। এখন জমির দাম কত ! এখন কি আর হয়ে উঠত? কে জানে সব ঠাকুরের ইচ্ছা।” 

এমন সময়ে মাকু ছেলে কোলে করে এসে তাকে ঘরে ছেড়ে দিয়ে বসলেন, “কি করব, মা, ঘুম নেই।” 

মা বললেন, “ও সত্ত্বগুণী ছেলে, তাই ঘুম নেই।” 

আমবাতের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মা বললেন, “আঃ, আমবাতের জ্বালায় গেলুম, মা মুখেও আবার বেরিয়েছে। এই দেখ মুখে হাত বুলিয়ে। এ কি যাবে না ? এই দেখ পেটেও উঠেছে, দাও তাে পেটে ঐ তেলটি দিয়ে। ঐটি আমার প্রাণ গাে, দিলেই একটু কমে।” 

তেলমালিশ করতে করতে বললুম, “মা, বাড়িতে একদিন ঠাকুরপুজো করে সংসারের কাজ করতে গেছি, কিছু পরে ঠাকুরঘরে এসে দেখি - ঠাকুরের ছবি বিন্দু, বিন্দু ঘেমেছে। জানালা খােলা ছিল, ছবিতে রােদ লাগছিল। কিন্তু আমি ভাবলুম পুজা করবার সময় হয় তাে জল লেগেছিল। বেশ করে মুছে রেখে গেলুম। রােদে ঘেমেছে কি - না বুঝবার জন্য কিছু পরে আবার এলুম। এবারও এসে দেখি ঠাকুর ঘেমে রয়েছেন। তখন জানালা বন্ধ করে দিলুম।”

মা - হ্যাঁ , মা, তা অমন দেখা যায়। ঠাকুর বলতেন, “ছায়া, কায়া, ঘট, পট সমান।’ 

মা এইবার একটু চুপ করে রইলেন। বাসা হতে লক্ষ্মণ এসেছিল। মা বললেন, “তবে এস, মা, এস।” প্রণাম করে প্রসাদ নিয়ে বাসায় ফিরলুম।

একদিন মা উত্তরের বারাণ্ডায় বসে আছেন, জনৈক গৃহস্থ যুবক-ভক্ত মায়ের সঙ্গে কি কথা বলছেন। তিনি মায়ের পায়ে মাথা রেখে বলছেন, “মা, আমি সংসারে অনেক দাগা পেয়েছি, তুমি আমার গুরু, তুমিই আমার ইষ্ট, আমি আর কিছু জানি না। সত্যই আমি এত সব অন্যায় কাজ করেছি যে, লজ্জায় তােমার কাছেও বলতে পারি না। তবু তােমার দয়াতেই আমি আছি।” 

মা স্নেহভরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, “মায়ের কাছে ছেলে - ছেলে।” 

তিনি - হ্যাঁ, মা, কিন্তু এত দয়া তোমার কাছে পেয়েছি বলে যেন কখন মনে আসে না যে তােমার দয়া পাওয়া বড় সুলভ। 

* শ্রীশ্রীমা নহবতে নীচের কুঠরিতে থাকতেন। উহার পশ্চিমের বারান্ডায় সিঁড়ির পাশে গঙ্গার দিকে দক্ষিণমুখ হয়ে তিনি ধ্যান করতেন। 

** সেদিন সরুচাকলি পিঠে আর সুজির পায়েস করে অন্য লােক নেই দেখে শ্রীশ্রীমা নিজেই সন্ধ্যার পর ঐ সব ঠাকুরের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

*** নহবতের রাস্তায় দরমার বেড়া দেওয়া ছিল। 

২ আশ্বিন, ১৩২৫ 

রাত প্রায় সাড়ে আটটা। মায়ের তত্তাপােশের পাশে নীচে মাদুর পাতা হয়েছে। মা শােবার উদ্যোগ করছেন। আমি যেতেই বললেন, “এস, এস, আমার কাছে এসে বস। ওকে একটু মিষ্টি দিয়ে জল খেতে দাও তো, সরলা, সারাদিন খেটে আবার এই ছুটে আসছে। আমি জল খেতে আপত্তি করলুম, কিন্তু তা কানেও তুললেন না; বললেন, “দেহের প্রতি একটু নজর রাখতে হয়, মা; সুমতি তিন ছেলের মা হয়েই যেন বুড়ী হয়ে গেছে।” মা তাঁর আমবাতের কথা তুলে বললেন, “এ কি হ’ল, মা ! লােকের হয়, যায় । আমার যেটি হবে সেটি আর যেতে চায় না। ঠাকুর যে বলতেন, যত লােকে রােগ, শােক, দুঃখ, তাপ নিয়ে কত কি করে এসে ছোঁয়, সেই সব এই দেহে আশ্রয় করে,’ তা ঠিক, মা; আমারও বােধ হয় তাই হবে। ঠাকুরের তখন অসুখ, কে সব ভক্তের ( দক্ষিণেশ্বরের) মায়ের (কালীর ).ওখানে পুজো দেবে বলে জিনিসপত্র এনে ছিল, তা ঠাকুর কাশীপুরে জেনে সেই সব ঠাকুরের কাছেই ভােগ লাগিয়ে প্রসাদ পেলে। ঠাকুর বলতে লাগলেন, “দেখছ, কি অন্যায় করলে। জগদম্বার জন্যে এনে এখানেই সব দিয়ে দিলে*।’ আমি তাে ভয়ে মরি, ভাবি—এই অসুখ, কি জানি কি হবে। একি বাপু কেন ওরা এমন করলে! ঠাকুর তখন বারবার তাই বলতে লাগলেন। কিন্তু পরে যখন রাত অনেক হয়েছে তখন আমাকে বললেন, “দেখ, এর পর ঘর ঘর আমার পুজো হবে। পরে দেখবে - একেই সবাই মানবে, তুমি কোন চিন্তা করাে না। সেই দিনই ‘আমার’ বলতে শুনলুম। কখনও ‘আমার’ বলতেন না। বলতেন, ‘এই খােলটার’ বা আপনার শরীর দেখিয়ে এই ‘এর’। সংসারে কত রকমের লােক সব দেখলুম। ত্রৈলােক্য**  আমাকে সাতটি করে টাকা দিত। ঠাকুর দেহ রাখার পর (দক্ষিণেশ্বরের) দীনু খাজাঞ্চী ও অন্য সকলে লেগে ঐ টাকাটা বন্ধ করলে***। আত্মীয় যারা ছিল তারাও মানুষ - বুদ্ধি করলে ও তাদের সঙ্গে যােগ দিলে। নরেনও কত বলেছিল, ‘মায়ের ও-টাকাটা বন্ধ কোর না।’ তবু করলে। তা দেখ, ঠাকুরের ইচ্ছায় অমন কত সাত গন্ডা এল, গেল। দীনু ফিনু সব কে কোথায় গেছে। আমার তাে এ পর্যন্ত কোন কষ্টই হয় নি। কেনই বা হবে? ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার চিন্তা যে করে সে কখনও খাওয়ার কষ্ট পায় না।’ 

“ঠাকুরের দেহরক্ষার পর তাঁর সব ভাল জিনিসপত্র - বনাত, আলােয়ান, জামা কারা নেবে এই কথা নিয়ে গােল বাধে। তা ওসব হ’ল ভক্তদের ধন, তারা ওসব চিরকাল যত্ন করে রাখবে। তারাই শেষে ঐ সব গুছিয়ে নিয়ে বাক্সে পুরে বলরামের বৈঠকখানায় এনে রাখলে। কিন্তু মা ঠাকুরের কি ইচ্ছা—সেখান থেকে চাকরদের কে চাবি দিয়ে খুলে তার অনেকগুলি চুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেললে -- কি কি করলে। তা ওসব কি বৈঠকখানায় রাখতে হয়? বাড়ির ভিতরে নিয়ে রাখলেই পারতো। তাঁর ব্যবহারের জিনিসপত্র আর জামা কাপড় যা বাকি ছিল, তা এখন বেলুড় মঠে আছে।

“আমার যে শ্বশুর ছিলেন, মা, বড় তেজস্বী, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তিনি অপরিগ্রাহী ছিলেন। কেহ কোন জিনিস বাড়িতে দিতে এলেও নেবার নিষেধ ছিল। আমার শ্বাশুড়ির কাছে কিন্তু কেউ কিছু লুকিয়ে এনে দিলে তিনি রেঁধেবেড়ে রঘুবীরকে ভােগ দিয়ে সকলকে প্রসাদ দিতেন। শ্বশুর তা জানতে পারলে খুব রাগ করতেন। কিন্তু জ্বলন্ত ভক্তি ছিল তার। মা শীতলা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফিরতেন। শেষ রাত্রে উঠে ফুল তুলতে যাওয়া তাঁর অভ্যাস ছিল। একদিন লাহাদের বাগানে গিয়েছেন, একটি ন'বছরের মতাে মেয়ে এসে তাঁকে বলছে, বাবা, এদিকে এস। এদিকের ডালে খুব ফুল আছে। আচ্ছা, নুয়ে ধরছি, তুমি তােল। তিনি বললেন, এ সময়ে এখানে তুমি কে, মা?’ ‘আমি গাে, আমি এই হালদার বাড়ির।’ অমন ছিলেন বলেই ভগবান তাঁর ঘরে এসে জন্মেছিলেন, তিনি এসেছিলেন আর তাঁর এই সব সাঙ্গোপাঙ্গরাও এসেছিল -  নরেন, রাখাল, বলরাম, ভবনাথ, মনােমােহন - কত বলব, মা। ছােট নরেন শেষে বড় কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত হয়ে পড়লো, টাকা-পয়সায় জড়িয়ে পড়লো। ঠাকুর এদের যার যার সম্বন্ধে যা যা বলে গেছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য হয়েছে। 

“কামারপুকরের হবিদাসী বলে একটি মেয়ে নবদ্বীপ যাবে বলে এসে ওখানেই রয়ে গেল। আমাকে কত ভালবাসত! তার কি বিশ্বাস ছিল, মা ! ঠাকুরের জন্মস্থানের ধূলো কুড়িয়ে রেখেছিল, বলতো - ‘এই তাে নবদ্বীপ, স্বয়ং গৌরাঙ্গ এইখানেই এসেছিলেন। আবার কি করতে নবদ্বীপ যাব ?’ আহা কি বিশ্বাস ! ঠাকুরের দেহ রাখবার পর একজন উড়ে সাধু এসে কামারপুকুরে ছিলেন। আমি তাঁর চাল ডাল ইত্যাদি যা যা প্রয়ােজন সব দিতুম, আর সকালে বিকালে খবর নিতুম, ‘সাধু বাবা, কেমন আছ গাে।’

“আহা! তার একখানি কুঁড়ে কি করেই যে বেঁধেছিলুম, মা! রােজ আকাশ ভরে মেঘ হােত, এই বৃষ্টি হয় - হয় আর কি। তখন হাতজোড় করে বললুম, ‘ঠাকুর, রাখ গাে, রাখ; ওঁর কুঁড়ােটুকু হয়ে যাক, তারপর যত পার ঢেলাে।’ তা গ্রামের লোকেও কাঠকুটো যা লাগল দিয়ে সাহায্য করলে। রােজ বৃষ্টি আসব আসব করতাে। যা হােক, এমনি করে কুঁড়েখানি তাে হয়ে গেল, কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সাধুটি সেই কুঁড়েতে দেহ রাখলেন।” 

মা বলছেন, “চল, এখন ঘরে যাই।” উঠতে উঠতে বললেন, “ঠাকুর বলতেন, ‘এই দেহটি গয়া হ’তে এসেছে। তাঁর মা দেহ রাখবার পর আমাকে বললেন, ‘তুমি গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এস।’ আমি বললাম, “পুত্র বর্তমান ; আমি দেব, সেকি হয় ?’ ঠাকুর বললেন, “তা হবে গাে, আমার কি ওখানে যাবার জো আছে ? গেলে কি আর ফিরবাে?' আমি বললুম, “তবে গিয়ে কাজ নেই।' পরে গয়া করতে আমিই গিয়েছিলুম**** রাত প্রায় নয়টা হয়েছে। প্রণাম করে বিদায় নিলুম। 

* কাশীপুরে এই ঘটনা হয়েছিল। কয়েকটি ভক্ত মাকালীর জন্য একদিন অনেক রকম মিষ্টি খাবারদাবার এনে হলঘরে ঠাকুরের ছবির সামনে ভােগ দিয়েছিলেন। 

** ত্রৈলােক্য বিশ্বাস রানী রাসমণির জামাত্য মথুরবাবর পত্র। ঠাকুর যখন আর পূজা করতে পারলেন না তখন হতে তার মাইনের টাকাটা বন্ধ না করে শ্রীশ্রীমাকে দিতেন। 

***মা তখন বৃন্দাবনে। চিঠি যেতে মা বলেছিলেন, “বন্ধ করেছে করুক। এমন ঠাকুরই চলে গেছেন; টাকা নিয়ে আর আমি কি করবাে।”

**** ঠাকরের দেহ-রক্ষার পর শ্রীশ্রীমা প্রথমবার বৃন্দাবন হ'তে ফিরে কামারপুকুর গিয়েছিলেন। বছর খানেক সেখান থেকে পরে বেলুড়ে গঙ্গাতীরে রাজু গােমস্তার ভাড়াটে বাড়িতে বাস করেন তারপর গয়া যাবার জন্যে মাস্টার মহাশয়ের বাড়ি এসে তথা হ'তে স্বামী অদ্বৈতানদের (বুড়ো গােপাল } সঙ্গে গয় যান। 
 
৩রা আশ্বিন, ১৩২৫ 

আজও মার ওখানে গিয়েছি। মা দেখেই বলছেন, “এসেছ, মা, এস।” নবাসনের বৌকে বললেন, “তেলটি এনেছ? দাও তে, বৌমা পিঠে মালিশ করে।” বৌ আমাকে দিতে বলায় মা বললেন, “আহা! ও এই সারাদিন খেটেখুটে ছুটে আসছে, একে একটু বিশ্রাম করতে দাও। ( আমাকে) ব’স, মা, বস। এই ওরা ভাস্করানন্দের কথা বলছিল। আমিও কাশীতে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলুম। সঙ্গে অনেক মেয়েরা ছিল। তখন মন খুব খারাপ, ঠাকুরের দেহ রাখার পর। সেই বারই বৃন্দাবনে প্রথম গিয়েছিলুম। তা ভাস্করানন্দের ওখানে যখন গেলুম, দেখি নির্বিকার মহাপুরুষ উলঙ্গ হয়ে বসে আছেন। আমরা যেতেই মেয়েদের সব বললেন, ‘শঙ্কা মৎ কর, মায়ী। তােমরা সব জগদম্বা, সরম কেয়া? এই ইন্দ্রিয়টি? এর জন্য? এ তাে হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যেমন তেমন একটি। আহা, কি নির্বিকার মহাপুরুষ! শীত-গ্রীষ্মে সমান উলঙ্গ হয়ে বসে আছেন।” 

তেলমালিশ শেষ হবার পর মা বললেন, “চল, এখন ঠাকুরের বই একটু পড়বে। সরলাটি বােডিংএ চলে গেছে, মা, অন্য দিন সে পড়তাে।” পড়তে পড়তে সাধনের কথা, দর্শনাদির কথা উঠল। 

মা — এই গােলাপ, যােগীন, এরা কত ধ্যানজপ করেছে। এসব আলােচনা করা ভাল। পরস্পরেরটা শুনে ওদেরও (ঢাকার বৌ, নবাসনের বৌ প্রভৃতি) এতে মতি হবে। 

দর্শনের কথা উঠলে, মা অনেক কথা চেপে গেলেন, সকলের সামনে সে সব বলবেন না বলে বােধ হয়। 

নলিনী  - পিসীমা, লােকের কত ধ্যানজপ হয়, দর্শন-স্পর্শন হয় শুনি, আমার কিছু হয় না কেন? তোমার সঙ্গে এতদিন যে রইলুম, কই আমার কি হল?

মা - ওদের হবে না কেন? খুব হবে। ওদের কত ভক্তি বিশ্বাস ! বিশ্বাস ভক্তি চাই, তবে হয়। তােদের কি তা আছে ? 

নলিনী - আচ্ছা, পিসীমা, লোকে যে তােমাকে অন্তর্যামী বলে, সত্যিই কি তুমি অন্তর্যামী ? আচ্ছা, আমার মনে কি আছে তুমি বলতে পার ? 

মা একটু হাসলেন। নলিনী আবার শক্ত করে ধরলেন। তখন মা বললেন, “ওরা বলে ভক্তিতে। তারপর বললেন, ‘আমি কি, মা? ঠাকুরই সব। তােমরা ঠাকুরের কাছে এই বল - (হাতজোড় করে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন) আমার ‘আমিত্ব’ যেন না আসে।” 

মার ভাব দেখে হাসি এল, ধরাছোঁয়া না দেওয়ার ভান, আর আমরা তাে এক একটি অহঙ্কারে ভরা। এ শিক্ষার মর্ম বুঝবার আমাদের ক্ষমতা কোথায়? 

ঢাকার বৌ বলছেন, “আমার ছেলে বলে--মার কাছে আর কি বলব, মা তাে জগদম্বা, অন্তরের কথা সব জানেন।”

আমি বললুম, “অনেকেই তাে মাকে জগদম্বা বলেন, কিন্তু কার কত বিশ্বাস তা ঠাকুরই জানেন। অবিশ্বাসী আমাদের মুখে এই কথা যেন নিতান্ত মুখস্থ করা কথার মতাে শুনায়।” 

মা হেসে বললেন, “তা ঠিক, মা।” 

আমি - মা যে সাক্ষাৎ ভগবতী, একথা মা যদি নিজে দয়া করে বুঝিয়ে না দেন, তা হলে আমাদের সাধ্য কি বুঝি। তবে মায়ের ঈশ্বরত্ব এখানেই যে, মায়ের ভিতরে আদৌ ‘অহঙ্কার’ নেই। জীবমাত্রই অহং-এ ভরা। এই যে হাজার হাজার লোক মায়ের পায়ের কাছে ‘তুমি লক্ষী, তুমি জগদম্বা’ বলে লুটিয়ে পড়ছে, মানুষ হলে মা অহঙ্কারে ফেঁপে ফুলে উঠতেন। অত মান হজম করা কি মানুষের শক্তি ! 

মা প্রসন্নমুখে একবার আমার দিকে চাইলেন মাত্র। মনে মনে বললুম, “মা, দয়া কর, মা, মুখে বলতে আমার লজ্জা করে, মনে যেন বলতে পারি।” 

যাবার সময় হয়ে এসেছে। মা উঠে প্রসাদ হাতে দিয়ে বললেন, “প্রসাদে ও হরিতে কোন প্রভেদ নেই, ( আমার বুকে হাত দিয়ে) মনে এটি স্থির বিশ্বাস রেখাে।” আজ বিশেষ করে কেন এটি বললেন? আজ তিন মাস হ’ল প্রায় রােজই আসি, যাই। যাবার সময় মা রােজই হাতভরে প্রসাদ দেন। অনেককে দেওয়ার জন্য কোন কোন দিন প্রসাদের অভাব হতেও দেখেছি। মা তাই নিজের তক্তাপােশের নীচে একটি সরায় করে প্রসাদ রেখে দিতেন এবং বলে রাখতেন, “ওরটি রেখে আর সবাইকে দিও গাে।” তাতেও আমার লজ্জা করতো। এই লজ্জা ভেঙ্গে দেবার জন্যই কি আজ বিশেষ করে ও কথাটি বললেন ? 

১১ই আশ্বিন, (নবম্যাদিকল্পারম্ভ দেবীর বােধন)-১৩২৫ 

প্রাতে গিয়েছি। মা ফল কাটছিলেন, দেখেই বললেন, “এসেছ, মা, এস। আজ বােধন ( আমার এই কথা মনেই ছিল না)। ঠাকুরের এই ফুলগুলি বেছে সাজিয়ে রাখ, ফলের থালা এই পাশটিতে রেখে দাও।” আদেশ পালন করলুম। ফল ইত্যাদি কাটা হয়ে গেলে মা পাশের ঘরে এলেন। স্নান করবেন। তেলের ভাঁড়, চিরুণি নিয়ে আমার কোলের কাছে এসে বসলেন। মাথায় হাত দিতে আমি ইতস্তত করছি দেখে মা বললেন, “দাও না গাে মাথাটা আঁচড়ে।” — যেন বালিকাটি। আদেশ পেয়ে আমি আঁচড়ে দিচ্ছি। রাধু নেয়ে এসে বলছে, “চিঁড়ে দিয়ে দই খাবাে।” 

মা সেখানেই একটি বাটিতে চিঁড়ে দই মেখে নিজে একটু মুখে দিয়ে রাধুকে দিলেন। আমি মাথা-আঁচড়ান রেখে তেল মাখিয়ে দিচ্ছি। মা বলছেন, “দেখ, জয়রামবাটীতে ক’টি ছেলে দীক্ষা নিতে গিয়েছিল। তা, তাদের দিলুম না। তখন তারা কাকুতি করে বললে, ‘তবে পায়ের একটু ধূলো দিন, মাদুলি করে রাখব’-এমনি তাদের ভক্তি-বিশ্বাস।” 

মাথা আঁচড়াতে মায়ের অনেকগুলি চুল উঠেছিল। মা বললেন, “এই নাও গাে, রাখ।” বস্তুতঃই আমি ধন্য হয়ে গেলুম -  আমার নেবার ইচ্ছা ছিল। 

মায়ের সঙ্গে গঙ্গায় নাইতে গেলুম। স্নান করে এসে পুজা শেষ হলেই মা প্রসাদবিতরণ করতে লাগলেন। তাতে অনেক সময় কেটে গেল। 

শ্যামাদাস কবিরাজ মশায় রাধুকে দেখতে এলেন। মা রাধুকে ডেকে দিতে বললেন। আমি ডাকতে গেলুম। একটু পরে রাসবিহারী মহারাজ গিয়ে কবিরাজ মহাশয়কে ডেকে নিয়ে এলেন। দেখবার পর মা ( কবিরাজ মশায়কে)  প্রণাম করতে রাধুকে বললেন। রাধু নত হয়ে প্রণাম করলাে। তিনি চলে যেতে, কেউ কেউ বললে, “উনি কি ব্রাহ্মণ ?” 

মা - না, বৈদ্য। 

“তবে যে প্রণাম করতে বললেন ?” 

মা—তা করবে না ? কতবড় বিজ্ঞ ! ওঁরা ব্রাহ্মণতুল্য, ওঁকে প্রণাম করবে তাে কাকে করবে ? কি বল, মা। 

ঠাকুরের ভোগ হয়ে গেল। মায়ের খাওয়া হয়ে যেতে আমরা সকলে প্রসাদ পেতে বসলুম। মা আমাকে বললেন, “কড়াইয়ের ডালটি বেশ হয়েছে, খাও।” নলিনী দিদি বলছেন, “তুমি রােজ এসে চলে যাও, খাও তাে না, আজ বেশী করে মাছ খাও।” এই বলে অনেকগুলি মাছ দেওয়ালেন। মাছের চেয়ে ডালটাই আমার বিশেষ প্রিয় মা ঠিকই ধরেছিলেন। 

মা এইবার বিশ্রাম করবেন। গােলমাল হবে বলে আমরা পাশের ঘরে গেলুম। খানিক পরে এসেছি। মা বলছেন, “দেখছ, সব দরজা বন্ধ করে রেখেছে, গরমে প্রাণ গেল। খুলে দাও তাে।” খুলে দিলুম। একটু পরেই মা উঠে কাপড় কাচতে গেলেন। ঠাকুরের বৈকালী ভােগ দেওয়া হ’ল। মা এসে উত্তরের বারাণ্ডায় আসন পেতে বসলেন। কিছু পরে বৌ, মাকু এরা সব থিয়েটার দেখতে গেলেন। মায়ের কাছে চুপ করে বসে তাকিয়ে দেখি মায়ের মাথার সামনে অনেকগলি পাকা চুল দেখা যাচ্ছে। মনে হল প্রাতে তখন যদি তুলতুম। মাও বলছেন, “এস তাে, মা, আমার পাকা চুল তুলে দাও।” টের তােলা হ’ল, অনেক সময় লাগল। এইবার ভক্তেরা সব প্রণাম করতে আসবেন, আমারও গাড়ি এসেছে, কালীঘাটের বাসায় যেতে হবে। এখন থেকে মায়ের কাছে এমন করে রোজ রোজ যখন তখন আসবার সুবিধা হবে না ভেবে কষ্ট হতে লাগল। প্রণাম করে বিদায় নেবার সময় মা বললেন, “মহাষ্টমীর দিন আসতে পার যদি এস।” 

২৬শে আশ্বিন, রবিবার, ১৩২৫ 

আজ মহাষ্টমী। মা আসতে বলেছিলেন। সকালেই আমরা দু’বোনে এসেছি। এসে দেখি কয়েকটি স্ত্রী-ভক্ত ফুল নিয়ে এলেন। মায়ের শ্রীচরণ পূজা করে তাঁরা গঙ্গায় নাইতে গেলেন। মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি থাকবে তাে ? আজ মহাষ্টমী।” আমি বললুম, “থাকব।” কিছুক্ষণ পরেই পূজনীয় শরৎ মহারাজ মায়ের চরণে প্রণাম করতে এলেন। আমরা পাশের ঘরে গেলুম। মা তক্তাপােশে বসে আছেন, পা দুটি মেজেই রেখে। আরও অনেক ভক্ত প্রণাম করলেন। 

পরে মাকু প্রভৃতির সঙ্গে গঙ্গাস্নানে গেলুম। মা আজ বাড়িতেই স্নান করলেন। কারণ, মা একদিন অন্তর একদিন গঙ্গাস্নান করতেন। বাতের জন্য রোজ যেতেন না। এসে দেখি বিস্তর মেয়েরা মাকে পুজা করছেন। অনেকেই কাপড় এনেছেন। কালীঘাটে মা কালীর গায়ে যেমন কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হয়, পূজান্তে তেমনি করে সকলে মায়ের গায়ে কাপড় জড়িয়ে দিচ্ছেন। মাও এক একখানি করে দেখে নামিয়ে রাখছেন। কাউকে বা বলছেন, “বেশ কাপড় খানি।” একজন ব্রহ্মচারী সংবাদ দিলেন—এখন সব পুরুষ-ভক্তেরা মাকে প্রণাম করতে আসবেন। সে কি সুন্দর দৃশ্য ! হাতে ফুল, প্রস্ফুটিত পাদ্ম,বিল্বদল -- একে একে সকলে পূজা ও প্রণাম করে সরে দাঁড়াচ্ছেন। এইরূপে অনেকক্ষণ গেল। ডাক্তার কাঞ্জিলাল সপরিবারে (প্রথম পক্ষের স্ত্রীসহ) এসেছেন। গােলাপ-মা বলছেন, “যার জিনিস সেই পেলে।” মাও বলছেন, “হ্যাঁ, যার-- তারই হল। মাঝখানে দুদিন কি গােলমাল হয়ে আর একজনের (পরলােকগতা দ্বিতীয়া স্ত্রীর) একটু ভােগ হয়ে গেল। এ জন্ম-জন্মান্তরের যােগ।” বলরাম বাবুর বাড়ির সকলে এসে পুজা করে গেলেন। শেষে আমি গেলুম। পূজা করে কাপড়খানি গায়ে দিতে যেতেই মা বললেন, “ওখানা পরবে। আজ তাে একখানি নূতন কাপড় পরতে হবেই।” এই বলে কাপড়খানা পরলেন। আমার চোখে জল এল। সামান্য কাপড়খানা ! সকলে কত ভাল কাপড় দিয়েছেন। আমি মায়ের গরীব মেয়ে। মায়ের অত স্নেহে আমার লজ্জাও করতে লাগল। মা বলছেন, “বেশ পাড়টি গাে।” 

একটি গেরুয়াবসনধারিণী মেয়ে মাকে পূজা করে দু’টি টাকা পদতলে রাখতে, মা বললেন, “ওকি ! তুমি আবার কেন গো ! গেরুয়া নিয়েছ, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।” 

মা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় দীক্ষিত হয়েছ ?” 

মেয়েটি বললে, “দীক্ষা হয় নি।” 

মা বললেন, “দীক্ষা না নিয়ে, কোন বস্তু লাভ না করে এই বেশ ধরেছ, এ তাে ভাল করনি। বেশটি যে বড় - আমারই যে জোড়হাত হয়ে প্রণাম আসছিল; ও করতে নেই, আগে বস্তুলাভ হোক। সকলে যে পায়ে মাথা দিতে আসবে, তা নেবার শক্তি লাভ হওয়া চাই।”

মেয়েটি বললে, “আপনার কাছেই দীক্ষা নেবার ইচ্ছা করেছি।” 

মা বললেন, “সে কি করে হবে ?” তবুও সেই মেয়েটি মিনতি করতে লাগল। গােলাপ-মাও একটু সহায় হলেন। মা অনেকটা সদয় হয়ে এসেছেন দেখলুম। মা বললেন, “দেখা যাবে পরে।” 

গৌরীমা তার আশ্রমের মেয়েদের নিয়ে এসেছেন। সকলেই পূজা করে প্রসাদ নিয়ে বিদায় নিলেন। 

ঠাকুরপূজা শেষ করে বিলাস মহারাজ এসে চুপি চুপি মাকে বলছেন, “আজ ঠাকুর ভােগ নিলেন কি-না কি জানি, মা। একটা প্রসাদী শালপাতা উড়ে এসে নৈবেদ্যের উপর পড়লো। এরূপ কেন হ’ল ? অনেকেই বাড়ি হতে সৰ এনেছে, কি হ’ল কি জানি।” 

মা বললেন, “গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়েছ তাে?” 

“তা তাে দিয়েছি” বলে তিনি চলে গেলেন। শুনে মনটা বড় খুঁৎ খুঁৎ করতে লাগল। মহাষ্টমী - মায়ের চরণপূজা সমভাবেই চলতে লাগল। স্তুপাকারের ফুল বেলপাতা বারান্ডায় রেখে আসতে-না-আসতেই আবার তত ফুল পাতা শ্রীচরণতলে জমে উঠতে লাগল। 


ক্রমে মধ্যাহ্ন - ভােগের সময় হ’ল। এমন সময়ে দূর দেশ হতে তিনটি পুরুষ ও তিনজন স্ত্রীলােক মায়ের দর্শনার্থে এলেন। বড়ই দরিদ্র-একবস্ত্রে, ভিক্ষা করে টাকা সংগ্রহ করে পথ খরচ চালিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে একজন পুরুষ-ভক্ত মায়ের সঙ্গে গােপনে অনেক কথা বলতে লাগলেন। কথা আর ফুরায় না। শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যাহ্নভােগের বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে (কারণ, মা ভােগ দেবেন) মায়ের ভক্ত ছেলেরা বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। একজন স্পষ্টই বললেন, “আর যা বলবার থাকে নীচে মহারাজদের কারাে কাছে গিয়ে বলুন না।” মা কিন্তু একটু দৃঢ়ভাবেই বললেন, “তা এখন বেলা হলে, কি হবে, ওদের কথাটি তাে শুনতে হবে। এই বলে বেশ ধৈর্যের সহিত তাঁর কথা শুনতে লাগলেন। পরে ধীরে ধীরে কি আদেশ করলেন। তাঁর স্ত্রীকেও ডেকে নিলেন। অনুমানে যতটা বুঝা গেল, স্বপ্নে কোন কিছু পেয়েছেন। পরে জানা গেল স্বপ্নে মন্ত্র পেয়েছিলেন। প্রায় একঘণ্টা পরে তাঁরা প্রসাদ নিয়ে বিদায় নিলেন। মা এসে বললেন, “আহ! বড় গরীব। কত কষ্ট করে এসেছে।” 

পরে ভােগ হয়ে গেলে সকলে প্রসাদ পেলুম। এবার মা একটু বিশ্রাম করবেন। আমরা পাশের ঘরে গেলুম। 

চারটা বেজেছে। মা উঠলেন। ঠাকুরের বৈকালী ভােগ হয়ে গেল। রাসবিহারী মহারাজ এসে বললেন, “একটি মেম তােমাকে দর্শন করতে এসেছেন। নীচে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন।” মা আসতে বললেন। মেমটি এসে মাকে প্রণাম করতেই, মা “এস” বলে তার হাত ধরলেন (হ্যাণ্ড-শেক করার মতাে। মা যে বলেন, ‘যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যখন যেমন তখন তেমন’ সেটি প্রত্যক্ষ করা গেল। তারপর মেয়েটির মুখে হাত দিয়ে চুমাে খেলেন। মেমটি বাংলা জানেন, বললেন, “আমি তাে আসিয়া আপনার কোন অসুবিধা করি নাই ? আমি অনেকক্ষণ হইল আসিয়াছি। আমি বড় কাতর আছি। আমার একটি মেয়ে, বড় ভাল মেয়ে, তার কঠিন পীড়া হইয়াছে। তাই, মা, আপনার করুণা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি। আপনি দয়া করিবেন, মেয়েটি যেন ভাল হয়। সে এত ভাল মেয়ে, মা! ভাল বলিতেছি কেন—আমাদের মধ্যে স্ত্রীলােক ভাল বড় একটা নাই। অনেকেই বড় বদমাশ, দুষ্ট—এ আমি সত্য বলিতেছি। এ মেয়েটি সেরুপ নহে—আপনি কৃপা করিবেন।” 

মা বললেন, “আমি প্রার্থনা করব তােমার মেয়ের জন্যে - ভাল হবে। 

মেমটি এ কথায় খুব আশ্বস্তা হলেন ; বললেন, “তবে আর ভাবনা নাই। আপনি যখন বলিতেছেন, ‘ভাল হইবে’ তখন ভাল হইবেই-নিশ্চয়, নিশ্চয়, নিশ্চয়।” কথায় খুব জোর ও বিশ্বাস প্রকাশ পেলাে। মা সদয় হয়ে গােলাপ মাকে বললেন, “ঠাকুরের ফুল একটি একে দাও, একটি পদ্ম আন।” বিল্বপত্রের সঙ্গে একটি পদ্ম এনে গােলাপ-মা মায়ের হাতে দিলে, মা ফুলটি হাতে করে চোখ বুজে একটু রইলেন; পরে ঠাকুরের পানে একদৃষ্টে চেয়ে ফুলটি মেমটির হাতে দিয়ে বললেন, “তােমার মেয়ের মাথায় বুলিয়ে দেবে।” 

মেম হাতজোড় করে ফুল নিয়ে প্রণাম করে বললেন, “তারপর কি করিব ?” 

 গােলাপ-মা বললেন, “কি আর করবে? শুকিয়ে গেলে গঙ্গায় ফেলে দেবে।”

মেমটি বললেন, “না, না, এ ভগবানের জিনিস ফেলিয়া দিব। একটি নতুন কাপড়ের থলে করিয়া রাখিয়া দিব, সেই থলেটি মেয়ের মাথায় গায়ে বােজ বুলাইয়া দিব!” 

মা বললেন, “হ্যাঁ, তাই করো।” 

মেম - ঈশ্বর সত্য বস্তু, তিনি আছেন। আপনাকে একটি কথা বলিতে চাই। কিছুদিন পূর্বে আমার একটি শিশুর খুব জ্বর হয়, আমি খুব ব্যাকুল হইয়া একদিন বসিয়া বলি, “হে ঈশ্বর, তুমি যে আছ ইহা তাে আমি অনুভব করি ; কিন্তু আমাকে প্রত্যক্ষ কিছু দাও।' এই বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে একটি রুমাল পাতিয়া রাখি। অনেকক্ষণ পরে দেখি সেই রুমালের ভাঁজের মধ্যে তিনটি কাঠি। আমি অবাক হইয়া সেই কাঠি তিনটি লইয়া উঠিয়া আসিয়া শিশুটির গায়ে ক্রমান্বয়ে তিনবার বুলাইয়া দিলাম, সেইক্ষণে তাহার জ্বর ছাড়িয়া গেল। 

ইহা বলতেই টস টস করে মেমটির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তারপর বললেন, “আপনার অনেক সময় নষ্ট করিলাম, আমায় মাফ করিবেন।” 

মা বললেন, “না, না, তােমার সঙ্গে কথা কয়ে আমি ভারি খুশি, তুমি এক দিন মঙ্গলবারে এস।” মেমটি প্রণাম করে বিদায় নিলেন। 

যােগীন-মার পিঠে ফোড়া হয়েছে; অস্ত্র হয়েছে। মা বলছেন “আহা! আজকার দিনে যােগীন পড়ে রইল। কত কি করবে মনে সাধ ছিল। একবার এ ঘরে আসতে পারলে না। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি যােগীনের কাছে যাচ্ছ কি! বােলাে - আমি একটু পরেই আসছি।” যােগীন-মাকে দেখে মায়ের কাছে ফিরে এসে দেখি শ্রীমান প্রিয়নাথ প্রণাম করছে। মা মুখে হাত দিয়ে চুমাে খেলেন। প্রিয়নাথের চোখে ছাতির শিকে ভয়ানক খোঁচা লেগেছে, ব্যাণ্ডেজ করা রয়েছে। তাই দেখে মা ভারি ব্যস্ত হয়েছেন; বারে বারে বলছেন, “আহা ভাগ্যে চোখটি নষ্ট হয়নি গাে।” এইবার আমার রওনা হবার সময় হয়ে এসেছে। একটু পরে প্রণাম করে বিদায় চাইতে মা বললেন, “আবার এস।” 

২রা কার্তিক শনিবার, ৺লক্ষীপূজা—১৩২৫ 

সকালেই আমরা দুবােনে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে গিয়েছি। সুমতির ছেলেমেয়েরাও সঙ্গে গিয়েছে। মা ঠাকুরঘরে বসে ফল কাটছিলেন; দেখে বললেন, “এই যে সব গাে, বস। কবে এলে?”

আমি বললুম, ‘মহাষ্টমীর দিন রাত্তিরেই চলে গিয়েছিলুম, আবার কাল রাত্তিরে এসেছি।” 

মা - এখন কি থাকা হবে? 

না, মা।” 

মা সুমতিকে বললেন, “বৌমা, ভাল আছ ? ভাসুরঝিটি কেমন আছে ?” 

দুটি মহিলা দীক্ষা নিতে এসেছেন। তাঁরা এসে প্রার্থনা জানাতেই মা বললেন, “হাঁ, আরও দুটি ছেলে আছে।” বলতে বলতে আর একটি মহিলা এসে বললেন, তিনিও দীক্ষা নিতে এসেছেন। মা বললেন, “তবে তাে অনেক গলি হ’ল গাে।”

সুমতি শ্রীশ্রীমাকে চণ্ডীজ্ঞানে পুজা করা ও লালপেড়ে শাড়ী দেওয়া স্বপ্নে দেখেছে। তাই দেবে বলে নিয়ে এসে লজ্জায় মাকে বলতে পারছে না; বলছে, “দিদি, তুমি বল।” আমি ঐকথা মাকে বলতেই, মা হেসে বললেন, “জগদম্বাই স্বপ্ন দিয়েছেন কি বল, মা ? তা দাও, শাড়ীখানি তাে পরতে হবে।” চওড়া লালপেড়ে শাড়ীখানি মা পরলেন; কি চমৎকার দেখাতে লাগল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলুম-চোখে জল এল। সুমতি বলছে “একটু সিঁদুর দিলে বেশ হতাে।” 

মা সহাস্যে বললেন, “তা দেয় তাে।” কিন্তু সিদুঁর নিয়ে যায়নি বলে দেওয়া হল না। আমরা বাসায় ফিরবাে বলে প্রণাম করছি। মা বললেন, 
“তুমিও যাবে এখুনি?” 

আমি -- হ্যাঁ, মা, যেতে হবে। বাসায় একটু বেশী রান্নার কাজ আছে। 

মা - আবার আসবে? 

আমি - হ্যাঁ, বিকেলে আসব। 

মা অনেকগুলি রসগােল্লা নিয়ে ঠাকুরকে ভােগ দিয়ে ছেলেদের হাতে দিলেন। আমরা বিদায় নিলুম। বিকেলে লক্ষ্মী পূজা বলে নারকেলের খাবার সব নিয়ে গেছি। দেখে মা বলছেন, “কি গো, আজ লক্ষ্মী পূজা, তাই বুঝি এ সব।” ক্রমে ক্রমে অনেক স্ত্রী-ভক্ত নানারূপ মিষ্টদ্রব্য নিয়ে মায়ের শ্রীচরণদর্শন করতে এলেন। কোন বাড়ি থেকে মিষ্টির সঙ্গে ডাব চিঁড়ে এই সবও দিয়েছে। দেখে মা বলছেন, “কোন দিনে কি দিতে হয়, তা ওরা সব বেশ জানে।” সন্ধ্যারতির পর ঠিক সময়ের মধ্যে ভােগ দেওয়া হ’ল। শ্রীশ্রীমা নীচে ভক্তদের জন্য চিঁড়ে নারকেল ইত্যাদি প্রসাদ সব পাঠালেন। উপরে মেয়েরাও সকলে পেলেন। 

একটি স্ত্রীলােক লক্ষ্মী পূজার  তাবৎ উপকরণ নিয়ে এসে মায়ের শ্রীচরণপূজা করলেন। পরে চারি পয়সা পদতলে রেখে প্রণাম করলেন। মা আমাদের বললেন, “আহা! ওর বড় দুঃখ, * মা, বড় গরীব।” মা তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। 

মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘মঙ্গলবারে সেই মেমটি এসেছিলেন, মা?” 

মা বললেন, হ্যাঁ, মা, এসেছিল।” মেমটির উপর মায়ের বিশেষ কৃপা। তাঁকে দীক্ষা দিয়েছেন, খুব ভালবাসেন। তাঁর মেয়েটিও সেরে উঠেছে। 

রাত হ’ল দেখে প্রণাম করে বিদায় নিলুম। 

* একমাত্র পুত্র বি.এ পাশ করে পাগল হয়েছে এবং তদবধি নিরুদ্দেশ। স্বামীও পুত্রশােকে প্রায় উন্মাদের মতাে হয়েছেন।

১১ই চৈত্র, ১৩২৬ 

শ্রীশ্রীমা দেশে গিয়েছিলেন, প্রায় এক বৎসর পরে ফাগুন মাসে বাগবাজারের বাটীতে শুভাগমন করেছেন। শরীর নিতান্ত অসুস্থ। অনেকদিন যাবৎ মাঝে মাঝে জ্বর হচ্ছে-ম্যালেরিয়া। শ্রীচরণদর্শন করতে গিয়ে দেখি মা কাপড় কাচতে গেছেন। কলঘর হতে বেরিয়ে বললেন, “বস, আমি আসছি।” মিনিট পাঁচ পরেই কাপড় ছেড়ে, সর্ব দক্ষিণের ঘরে মায়ের বিছানা করা ছিল, সেখানে এসে দাঁড়ালেন। শ্রীচরণে প্রণাম করতেই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, “বস, কেমন আছ?” সেবার জন্য কিছু দিলাম-টাকা হাতে করে নিয়ে রাখলেন। মায়ের শরীর দেখে আমার আর কথা বেরুচ্ছে না - শুধু মুখের পানে চেয়ে আছি, আর ভাবছি -- সেই শরীর এমন হয়ে গেছে! সঙ্গে সুমতিদের ঝি গিয়েছিল, সে প্রণাম করবার উদ্যোগ করতেই মা তাকে বললেন, “তুমি ওখান হতেই কর।” সে দরজার গােড়ায় প্রণাম করে চলে গেল। 

মা এত দুর্বল যেন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হল। নীচেই বসে আছি। ইতােমধ্যে রাসবিহারী মহারাজ এসে মাকে বেশী কথা কইতে নিষেধ করে গেলেন। তবু মা মাঝে মাঝে দু'চারটি কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। যথাসম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে বসে আছি, এই সময় রাধারানী ছেলে কোলে করে এলেন, ছেলেটির অসুখ। আমি ছেলেটির হাতে কিছু দিয়ে দেখলুম। রাধু তাে কিছুতেই তা নেবে না। মা বললেন, “সে কি রাধু, দিদি আদর করে দিচ্ছে, আর তুই নিবি নে ?” এই বলে নিজেই তুলে রাখলেন। ছেলেটি শুধু মা ও দিদিমার জন্যই নাইবার খাবার অনিয়মে অসুখে ভুগছে বলে কত আক্ষেপ করলেন। রাধু তো ঢের কটুক্তি করে তার প্রতিবাদ করতে লাগল। “ওকে বলে কোন ফল নেই” বলে মা চুপ করে গেলেন। খানিক পরে সরলা, কৃষ্ণময়ী দিদি প্রভৃতি এলেন। মা শুয়েই তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। সরলা কৃষ্ণময়ীদিদির নাতনির অসুখে শুশ্রুষা করতে গিয়েছিলেন, সেই সব কথা হতে লাগল। 

১৭ই চৈত্র, ১৩২৬ 

পাঁচ-ছদিন পরে গেছি, সন্ধ্যারতি হচ্ছিল। শ্রীশ্রীমা খাটের উপর শুয়ে ছিলেন। নিকটে গিয়ে দাঁড়াতে উঠে বসলেন। প্রণাম করে আদেশমত বসলুম। ঘরে সরলা, নলিনী ও বৌ আছেন ; বৌ ও নলিনী জপ করছেন। কিছু সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলুম। আরতি শেষ হলে মা বিলাস মহারাজকে তা ভােগ দিতে বললেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “পরে দিলে হবে না?” মা বললেন, “না, এখনি দাও।” তিনি আদেশ পালন করলেন। তিনি ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীদর্শনে গিয়েছিলেন, প্রসাদ এনেছেন। ঐ কথা বলে দেবীর প্রসাদ একটু মাকে দিয়ে আমাদের সকলকেও কিছু কিছু দিলেন। 

মা সরলা নলিনী প্রভৃতিকে পূর্বোক্ত প্রসাদ নিয়ে জল খেতে বললেন এবং আমাকেও দিতে বললেন। শেষে কে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করে বললেন, “আজ দু’দিন জ্বর হয় নি - একটু ভালই আছি, মা। আর, মা, এই রাধুর জন্যই আমার সব গেল - দেহ, ধর্ম, কর্ম, অর্থ, যা কিছু বল। ছেলেটাকে তাে মেরেই ফেলবার জো করেছে। এই এখানে এসে সরলার হাতে দিয়ে তবে রক্ষে। আর কাঞ্জিলাল দেখছে। কাঞ্জিলাল বলেইছে, ‘এ রাধুর কাছে থাকলে আমি চিকিৎসা করতে পারব না। ঠাকুরের যে কি ইচ্ছে - ওকে আবার ছেলে দেওয়া কেন -- যে নিজের দেহেরই যত্ন জানে না। আবার তাে এক নূতন রােগ করে বসেছে। একি হ’ল, মা ? যা হােক গে, আমি আর ওদের নিয়ে পারি নে। বাড়িতে কি অত্যাচারই করতাে ! আমাকে কি ওরা গ্রাহ্য করতাে?” এমন সময় খবর এল ডাক্তার কাঞ্জিলাল এসেছেন। আমরা পাশের ঘরে গেলুম। ডাক্তারবাবু, মাকে দেখছেন এমন সময় রাধু এসে বললে, “আমার হাতটা দেখ তাে। নীচে লোহার থামে লেগে ফুলছে, ছড়ে গিয়ে জায়গায় জায়গায় রক্ত বেরিয়েছে।” বৌ তার ওপর একটা ময়লা ন্যাকড়া রেডির তেলে ভিজিয়ে বেঁধে দিয়েছিল। ডাক্তার বাবু বললেন, “শীগগির খুলে ফেল, সাবান দিয়ে ধুয়ে দাও। অমন ন্যাকড়া দিয়েও বাঁধতে হয় ? এখনি বিষিয়ে উঠবে। কলকাতার হাওয়ার সঙ্গে বিষ চলে।” এই ব’লে তিনি উঠে গেলেন। মা তখন দুঃখ করছেন, “আহ, বাছার আমার কতই লগেছে ! মরে যাই। আহা, ও জনমদুঃখী আমার। শরীরে কি আর আছে ! আহা, কাঞ্জিলালকে একটু ওষুধ দিতে বলে। ভাল করে দাও গাে ।” 

একে একে ঠাকুরঘর থেকে সকল উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বৌ এসে বললেন, “ভাল করে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে।” 

পরে মা শুয়ে বললেন, “পায়ে হাত বুলিয়ে দাও, মা।” পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললুম, “মা, একটি কথা বলতে চাই আপনার কোন অসুবিধা হবে না তাে?” 

মা - না, না বল না কি ? 

আমি বললুম। ….. শুনে মা বললেন, “আহা! সে আনন্দ কি আর রােজ রােজ হয়, মা ? সব সত্যি, সব সত্যি, কিছু মিথ্যা নয়, মা - উনিই সব। উনিই প্রকৃতি, উনিই পুরুষ। ও (ঠাকুর) হতেই সব হবে।” 

আমি — মা, এক একদিন একমনে মন্ত্র জপ করবার পরে দেখি অনেক সময় কেটে গেছে। আর যে সব করতে বলেছেন সে সব কিছুই করা হয় নি। তখন তাড়াতাড়ি সেই সব সেরে উঠে পড়তে হয়, কারণ সংসারের কাজে এুটি হলে তো আবার চলে না - এতে কি অপরাধ হয়, মা ? 

মা - না, না, এতে কোন অপরাধ হয় না। 

আমি - একজন বললে, কোন কোন দিন গভীর রাত্রে ধ্যানে একটা ধ্বনি শুনতে পাই - বেশীর ভাগই শুনি যেন শরীরের ডান দিক হতে উঠছে। কখনাে ( মন একটু নাবলে পর) বাঁদিক হতেও হচ্ছে শুনি।

মা - (একটু চিন্তা করে)  হ্যাঁ, ডানদিক হতেই হয়। বাঁ দিক দেহভাবের। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলে এই সব অনুভব হয়—ডানদিক হতে যেটি হয়, এ-ই ঠিক। শেষে মনই গুরু হয়। মন স্থির করে দু’মিনিট ডাকতে পারাও ভাল। 

‘দেহভাবের’ কথাটি যতটুকু বােঝা গেল, তা বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল না - মায়ের দেহ অসুস্থ। 

বৌ এসে মশারি ফেলে দিতে চাইলে। আমি বিদায় নেব ভাবছি। মা অমনি মাথাটি বালিশ হতে তুলে বললেন, “এই নাও গাে, আমি মাথা তুলেছি।” শয়নাবস্থায় না-কি প্রণাম করতে নেই। প্রণাম করতেই বললেন, “এস, মা, আবার এস। একটু বেলাবেলি এস। কাজকর্ম সারা হয়ে ওঠে না বুঝি ? “দূর্গা, দূর্গা, এস মা, এস।” বৌ মশারি ফেলে দিয়েছে, তবু মশারি হ’তে মা শ্রীমুখখানি বের করে রেখে বিদায় দিচ্ছেন। ঘরের বাইরে বারাণ্ডায় এসেছি, তখনও শুনেছি মা করুণাপ্লুতে স্বরে বলছেন, “দূর্গা, দূর্গা।” কি অসীম ভালবাসা। যতক্ষণ কাছে থাকা যায় সংসারের শোক-তাপ সব ভুল হয়ে যায়। 

মায়ের অসুখ সমভাবেই চলেছে। শরীর ক্রমশঃ খুব দুর্বল হচ্ছে। সেদিন বিকেলবেলা গেছি। মা উঠে কলঘরে যাবেন ; বলছেন, হাতখানা দাও তাে, মা, ধ'রে উঠি। প্রায়ই জ্বর হয়, শরীর নিতান্ত দুর্বল।” মা কষ্টে উঠলেন। উঠে এসে বলছেন, “এই দেখ গাে, দোর-গােড়ায় কে একগাছি লাঠি রেখে গেছে। কদিন থেকেই ভাবছি—একগাছি লাঠি পাই তাে ভর দিয়ে একটু যেতে আসতে পারি। তা দেখে ঠাকুর ঠিক এনে জুগিয়ে রেখে দিয়েছেন।” হাতে করে তুলে লাঠিগাছা দেখালেন ! হাসতে হাসতে বলছেন, “জিজ্ঞাসা করলুম - কে লাঠি ফেলে গেছে গাে? তা কেউ বলতে পারলে না!”

আর একদিন গিয়ে শুনি, মায়ের এত কষ্ট দেখে মায়ের সাধু ছেলেরা বলছেন, “এবার, মা, ভাল হয়ে উঠলে আর কাউকে দীক্ষা নিতে দেব না। যত লােকের পাপের ভােগ নিয়ে আপনার কষ্টভােগ।” মা শুনে মৃদু, মৃদু; হাসলেন, বললেন, “কেন গাে ? ঠাকুর কি এবার খালি রসগােল্লা খেতেই এসেছেন?” সকলেই নিরুত্তর। হায় মা, তােমার এ করুণাপূর্ণ কথায় যে কত কথাই না ব্যক্ত করলে, মূঢ় আমরা তার কি বুঝি? 

এই কথায় মনে পড়ে - একটি সম্ভ্রান্ত কুলমহিলা কর্মবিপাকে দুস্প্রবৃন্তি পরায়ণা হয়ে পড়েন। তবে তাঁর পূর্বজন্মের সুকৃতিও ছিল, তাই একদিন কোন সাধুর দৃষ্টিপথে পড়ে সদুপদেশ পেয়ে নিজের দুস্কৃতি ও ভ্ৰম বুঝতে পেরে বিশেষ অনুতপ্ত হন এবং সেই সাধুর উপদেশে একদিন বাগবাজারের বাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের চরণপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। ঠাকুরঘরে প্রবেশ করতে সকুচিত হয়ে দোরগােড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি নিজের সমস্ত পাপের কথা মায়ের কাছে ব্যক্ত করে বললেন, “মা, আমার উপায় কি হবে । আমি আপনার কাছে এই পবিত্র মন্দিরে প্রবেশ করবার যােগ্য নই।” শ্রীশ্রীমা তখন অগ্রসর হয়ে নিজের পবিত্র বাহুদ্বারা মহিলাটির গলদেশ বেষ্টন করে ধরে সস্নেহে বললেন, “এস, মা, ঘরে এস। পাপ কি তা বুঝতে পেরেছ, অনুতপ্ত হয়েছ। এস, আমি তােমাকে মন্ত্র দেবাে। ঠাকুরের পায়ে সব অর্পণ করে দাও - ভয় কি?”

মানুষের পাপতাপ রোগশােকের ভার নিজের স্কন্ধে নিয়ে তাঁর মতাে দয়া ময়ী পতিতাদ্ধারিণীই হাসিমুখে বলতে পারেন, “কেন গো, ঠাকুর কি খালি রসগােল্লা খেতেই এসেছিলেন?” 
১লা বৈশাখ, ১৩২৭ 

সন্ধ্যারতি শেষ হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি মায়ের জ্বর। রাসবিহারী মহারাজ মায়ের হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ব্রহ্মচারী বরদা পদসেবা করছেন। থার্মোমিটার দেওয়া হয়েছে। মা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে। মা একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে?” রাসবিহারী মহারাজ কি যেন মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন। বৌ কাছে আছে। জ্বর দেখে ১০০.১ বললেন যেন শুনলুম। 

সুধীরাদিদি নববর্ষ ব'লে মেয়েদের ভােজ দিচ্ছেন। তাই সরলাদিদি চারটের সময় স্কুল বােডিং-এ গেছেন। বরদা ব্রহ্মচারীকে মা বললেন সরলাদিদিকে ডেকে আনতে। তিনি এসে রাধুর ছেলেকে খাওয়াবেন। এখনও সময় হয়নি খাওয়াবার; কিন্তু কাঁদছে বলে রাধু আবার তাকে এখনি খাওয়াতে চাইছে। মা বারণ করছেন বলে রাধারাণী রেগে তাঁকে গালাগালি দিতে লাগল - “তুই মর, তাের মুখে আগুন।” শুনে আমাদের মহা বিরক্তি বোধ হতে লাগল - মায়ের এই অসুখ! আর এই সময় অমন সব গালাগালি দেওয়া। রাধু কিন্তু আরও কত কি বলে চেঁচাতে লাগল। এইরূপ প্রায়ই হয়, কিন্তু মায়ের অসীম ধৈর্য - চিরদিনই চুপ করে সহ্য করে যান। এবার দীর্ঘকাল অসুখে ভুগে আজ তিনিও বড় ত্যক্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, “হ্যাঁ, টের পাবি, আমি মলে তাের কি দশা হয় । কত লাথি ঝাঁটা তাের অদৃষ্টে আছে, জানি না। আজ এই বৎসর কার দিনে আমি সত্য বলছি তুই আগে মর, তারপর আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।” একথা শুনে রাধু যে - সব কথা বললে তা আর লিখতে ইচ্ছা হয় না। খানিক পরে সরলাদিদি এলেন এবং ছেলেকে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গেলেন। আমাদের মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। মা আবেগভরে বললেন, বাতাস কর, মা, আমার হাড় জ্বলে গেল ওর জ্বালায়।” একটু বাতাস করতেই আবার পায়ে হাত বুলুতে বললেন। পদসেবা করছি এমন সময় রাসবিহারী মহারাজ এসে মশারি ফেলে দিতে ব্যস্ত হলেন। অগত্যা আমি বললুম, “তবে আমি আসি, মা।” 

মা বললেন, “এস।”—এই-ই শেষ আদেশ ও শেষ কথা শুনে এলুম। আমাকে কালীঘাট চলে আসতে হল। তারপর সকলের অসুখ-বিসুখে আর যাবার সুবিধা করেই উঠতে পারিনি। মায়ের দেহ ক্রমেই খারাপ হচ্ছে - খবর পাচ্ছি। শেষে যে দিন গেলুম, দেখে মনে হল আমাদের সব শেষ - তথাপি আশা । 

- ৺সরযু বালা 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রীশ্রীশচন্দ্র ঘটক

১৯১০ খ্রিস্টাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে শিলং হইতে আমরা কয়েকজনে মিলিয়া জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের দর্শন-মানসে যাই। মায়ের পূর্বেকার ফটোগ্রাফ আমরা সকলেই দেখিয়াছিলুম। এই সময় পথে মায়ের বর্তমান সময়ের মূর্তি একজন স্বপ্নে দেখিয়া এবং পরে জয়রামবাটী যাইয়া প্রত্যক্ষের সঙ্গে স্বপ্নদৃষ্ট চেহারার খুব মিল হওয়ায় আমাদের অপার আনন্দ ও বিস্ময় হইল। আমাদের একজন পূর্বেই জনৈক সন্ন্যাসীর নিকট দীক্ষিত হইয়াছিলেন। তাঁহার দীক্ষার কথায় শ্রীশ্রীমা বলিলেন, “সন্ন্যাসীর মন্ত্র-চৈতন্য হবে।” তিনি ব্যতীত আমরা সকলেই এবারে শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মহামন্ত্র পাইলাম। দীক্ষার পরেই কামারপুকুর যাইবার ইচ্ছা করিয়া আমরা শ্রীশ্রীমায়ের অনুমতি প্রার্থনা জানাইলে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘তা কি হয় ? আমি ছেলেদের আজ ভাল করে খাওয়াব।” 

“কিং কর্ম কিমকর্মেতি কবয়ােহপ্যত্র মােহিতাঃ। 
তৎ তে কর্ম প্রবক্ষ্যামি যজজ্ঞাত্বা মােক্ষ্যসেহশুভাৎ।” 

ইত্যাদি গীতায় পড়িয়াছি। অতএব ভব-বন্ধন-মােচনের জন্য শ্রীশ্রীমায়ের কৃপা লাভের পরে আমাকে আর কি করিতে হইবে জিজ্ঞাসা করিয়া লওয়া উচিত ভাবিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলুম, “মা, আমাকে আর কি করতে হবে ?”

মা - তােমার কিছুই করতে হবে না। 

আমি - আমার কিছুই করতে হবে না? 

মা - না। 

আমি -  কিছু না ? 

মা বলিলেন, “না, কিছুই না।” বারত্রয় এই একই উত্তরে তখনকার মতো বুঝিলাম যে তিনি কৃপা করিয়াছেন, তিনিই ভব-বন্ধন-মােচনের সব ভার গ্রহণ করিয়াছেন। 

আমি ভানু পিসীর* হাত দেখিয়া বলিয়াছিলাম, “পিসি, তুমি আরও ২৫ বৎসর বাঁচবে।” তিনি গিয়ে মাকে বলিয়াছিলেন, “মা, তােমার ছেলে হাত গুণতে জানে।” মা আমাকে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাবা, তুমি হাত দেখতে জান? বল তাে আমার পায়ের অসুখ ( বাত) সারবে কি না ?” প্রশ্ন শুনিয়া তাে আমি অবাক! কারণ, জ্যোতিষের কিছুই জানি না। ভানু পিসীকে আন্দাজে অমনি একটা বলিয়াছিলাম। আমি শুনিয়াছিলাম - ভক্তদের শরীরস্থ পাপ গ্রহণ করিয়াই শ্রীশ্রীমায়ের এই পায়ের অসুখ; তাই বলিলাম, “আমাদের জন্যই তাে 

এই অসুখ, তা আমরা থাকতে পারবে কি?” শুনিবামাত্র মা নিতান্ত ব্যথিত হইয়া দাঁড়ানাে অবস্থা হইতে হঠাৎ ভূমিতে বসিয়া পড়িলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, “ও মা, বলে কি গাে !” মাকে এরূপ দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া বলিলাম, “মা, তােমার ভাল হতে ইচ্ছা হয় ?” 

মা - হ্যাঁ।  

আমি বলিলাম, “তবে তাে ভাল হবেই।” তখন মায়ের মুখে প্রফুল্লতা আসিল। ক্ষণপরেই মা বলিলেন, “দেখছ গা, কি ভক্তি! সবই আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর !”

দেশে ফিরিবার দিনে মাকে প্রণাম করিতে গেলাম। আমি বলিলাম, “মা, আমি জপের সংখ্যা ঠিক রাখতে পারি না। হাত চলে তাে মুখ চলে না, হাত মুখ চলে তো মন স্থির হয় না।” 

মা উত্তর করিলেন, “এর পর দেখবে, হাত, জিবও চলবে না - শুধু মনে।” 

আসিবার সময় প্রণাম করিয়া বলিলাম, “মা, যাই।” মা শুনিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, ‘আসি’ বল, ‘যাই’ বলতে নেই।” 

ভুল সংশােধনপূর্বক মায়ের প্রসন্ন দৃষ্টি লাভ করিয়া রওনা হইলাম। 

১৯১২ খ্রীঃ দূর্গাপূজোর পরে শ্রীশ্রীমা যখন কাশী গিয়াছিলেন সেইবার মায়ের জন্মতিথির সময় ডিসেম্বর মাসে আমরা কাশীতে যাই। জন্মতিথির দিনে সকাল বেলা ‘লক্ষী-নিবাসে’ মাকে প্রণাম করিয়া ফুলের মালা দিয়া পুজা করিলাম। মা এক একটি প্রসাদী মালা সকলকে দিলেন। পরে শ্রীশ্রীমায়ের প্রসাদ (মিষ্টি) গ্রহণ করিয়া ‘অদ্বৈত আশ্রমে’ আসিলাম। তথায় জন্মতিথিপূজান্তে যখন হােম হইতেছিল এবং সকলে মিলিয়া হেমাগ্নিতে আহুতি দিতেছিলেন, আমরাও তখন আহুতি দিতে উদ্যত হইলে কেহ কেহ আপত্তি করিয়া বলিলেন, “তােমরা খেয়েছ, আহুতি দিওনা।” কিন্তু আমি বাদে অপর সকলে আহুতি দিলেন। শ্ৰীশ্রীমাও এই সময়ে আশ্রমে আসিয়াছিলেন। ইহা লক্ষ্য করিয়া মা স্ত্রী-ভক্তদিগকে বলিয়াছিলেন, “এরা তাে আমার প্রসাদ পেয়েছে ; খেল কখন ? আহুতি দেবে বই কি।” স্ত্রী-ভক্তদের নিকট পরে এই কথা শুনিয়াছিলাম। 

* জয়রামবাটীর জনৈকা প্রাচীন স্ত্রী-ভক্ত, ঠাকুয়ের সময়কার

১৯১৩ খ্রীঃ মাঘী অষ্টমীতে শ্রীশ্রীমায়ের অনুমতি পাইয়া পরিবার ও বিধবা ভগ্নীকে মায়ের কৃপালাভের আশায় তাঁহার শ্রীচরণসমীপে লইয়া যাই। ঐদিন মা উভয়কেই দীক্ষা দেন। পরিবার মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মা, আমার শিবপূজা করতে ইচ্ছা হয়। তা করবাে কি ?” তদুত্তরে মা বলিয়াছিলেন, এখন তুমি ছেলেমানুষ, পারবে না। পরে সময় হলে শিখে নিয়ে শিবপূজা করে। এখন শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা কর।” মা আমার ভগ্নীর প্রশংসা করিয়া বলিয়াছিলেন, “ওর মন খুব ভাল।” আমরা আম লইয়া গিয়াছিলাম । ঐ সময় আমের মূল্য বেশী ছিল ? মা ঐ আম দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “এত পয়সা দিয়ে আম কেন ? আর এই আম এখন খেতেও ভাল নয়-টক।” 

১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের জন্মাষ্টমীর ছুটিতে আমরা কয়েকজন গুরভ্রাতা মিলিয়া জয়রামবাটী যাই। সঙ্গে একজনের একটি অল্পবয়স্ক পুত্রও ছিল। সন্ধ্যায় কোয়ালপাড়া মঠে পৌঁছলাম। ছুটির সময় অল্প বলিয়া উক্ত মঠে থাকিবার অনুরােধ রক্ষা না করিয়া সেই রাত্রিতেই জয়রামবাটী রওনা হইলাম। পথে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। ভীষণ অন্ধকার। পথঘাট কাদা জলে পূর্ণ। এই সব দুর্যোগ অতিক্রম করিতে করিতে জয়রামবাটী পৌঁছলাম। কিন্তু আমাদের পৌঁছিতে রাত্রি অধিক হইয়া যাওয়ায় সে রাতে মাকে আর কোন সংবাদ দেওয়া হয় নাই। পরদিন সকালে যখন মাকে প্রণাম করিতে যাইলাম তখন মা এই সকল শুনিয়া আমাদের ভর্ৎসনা করিয়া বলিয়াছিলেন, “বাবা, ঠাকুর রক্ষা করেছেন। অন্ধকারে অত বৃষ্টি-জল-কাদায় কত সাপ মাড়িয়ে এসেছ ! এইভাবে চলায় আমার কষ্ট হয়। গোঁভরে চলা ভাল নয়।” 

আমরা বলিলাম, “মা, তােমাকে দেখবার জন্য মন খুব ব্যাকুল হয়েছিল, তার উপর ছুটিও অল্প, তাই অত তাড়াতাড়ি।”

মা - তােমাদের তো এরূপ ইচ্ছা হবেই, কিন্তু এতে আমার কষ্ট হয়। 

নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব প্রধানা পরিচালিকা শ্ৰীযুক্তা সুধীরাদিদি তখন জয়রামবাটীতে ছিলেন। এই দিন দুপুরবেলা মা আমাকে ডাকাইয়া বলিলেন, “দেখ, সুধীরা তােমাদের সঙ্গে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত যাবে। খুব সাবধানে যেও। ওর গাড়ি তােমাদের দুই গাড়ির মধ্যে রেখাে। তােমরা আমার আপনার জন, আমার ছেলে।” 

আমি - হ্যাঁ, নেব বৈকি। তুমি যেমন বললে ঠিক তেমনি ভাবে নেব। 

রাত্রিতে আহারের সময় মা আমাদের নিকট বসিয়া কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন। সেই সময় সেই ছােট ছেলেটির দীক্ষার কথা উথাপন করায় মা বলিলেন, “এখন ছেলেমানুষ, হেগে ছোঁচাতে পারে না; (৭।৮ বছর বয়স) এখন কি দীক্ষা হয় ? ছেলেটি ভক্ত, বেঁচে থাকি। ভক্তদাস হােক।” আমাকে বলিলেন, “ওর ভাত মেখে দাও।” 

আমি কথায় কথায় বলিলাম, “মা, আমরা যার তার খাই - এতে কোন হানি হয় কি?” 

মা - শ্রাদ্ধের অন্নটা খেতে ঠাকুর বিশেষ নিষেধ করতেন, ওতে ভক্তির হানি হয়। সকল কর্মে যজ্ঞেশ্বর নারায়ণের অর্চনা হয় বটে, তবু তিনি শ্রাদ্ধান্নটা খেতে নিষেধ করতেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আত্মীয়-স্বজনের শ্রাদ্ধে কি করবাে ?” 

মা - আত্মীয়-স্বজনের বেলা না খেয়ে উপায় কি? 

পরদিন বৈকালে প্রায় ২টার সময় মাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। মা আলু থালুভাবে মাটিতেই বসিয়া আছেন। ঐ বৎসরেই উহার কিছুদিন পূর্বে দামোদরের ভীষণ বন্যা হইয়াছিল। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, বন্যায় লােকের কি খুব কষ্ট হচ্ছে ?” খবরের কাগজে ও লােকমুখে যাহা জানিয়াছিলাম তাই বলিতে লাগিলাম। মা নিবিষ্টচিত্তে শুনিয়া করুণকণ্ঠে বলিলেন, “বাবা, জগতের হিত কর।” মায়ের এই কথা শুনিয়া মনে মনে তাঁহার এই বিরাট বিগ্রহের সেবাধিকার প্রার্থনা করিয়া বাহির বাটীতে আসিব বলিয়া প্রণাম করিতেই শুনি - মা আপন মনে বলিতেছেন, “কেবল টাকা, টাকা, টাকা।” মায়ের মুখে “টাকা, টাকা” শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। মা বােধ হয় আমার ভিতর ভাবের আতিশয্য লক্ষ্য করিয়াই এরূপ বলিতেছেন। অমনি মা আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “না বাবা, টাকা দরকার। এই দেখ না কালী (মামা) কেবল টাকা টাকা করে।” 

১৯১৫ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে (২৪শে) সপরিবারে মাকে দর্শন করিতে ‘উদ্বোধনে’ গিয়াছি। পরিবাবের হাতে কিছু মিষ্টি ছিল। শ্রীযুক্তা গােলাপ-মা উহা অন্যদিন ঠাকুরকে দিবেন ভাবিয়া উঠাইয়া রাখিতেছিলেন। মা নিষেধ করিয়া বলিলেন, “না গো, না, বৌমা যে মিষ্টি নিয়ে এসেছে তা এবেলাই ঠাকুরকে দাও, এতে বৌমার কল্যাণ হবে।” পরদিন প্রত্যুষে পরিবার মায়ের নিকট গিয়াছিল এবং সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরিয়া আমাকে বলিল ---

‘আজ মা আমাকে কত কৃপা করেছেন। জীবনে চিরকাল তা আনন্দ দেবে। বেলা নটা-দশটার সময় মা তিন পয়সার মুড়ি ও কড়াইভাজা আনিয়ে আঁচলে নিয়ে মাটিতে বসে দু-চারটি করে নিজে মুখে দিচ্ছিলেন এবং এক মুঠো করে আমাকে দিচ্ছিলেন  - বৌমা, খাও। জীবনে অনেক ভাল জিনিস খেয়েছি, কিন্তু আজকের ঐ মূড়ি খাওয়ার আনন্দের তুলনা মেলে না। দুপুরে আমাকে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে বললেন এবং তাঁর বিছানাপত্র ঝেড়ে রােদে দিতে বললেন। এই সব ছােটখাট সেবা গ্রহণ করে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। আজ আমার সঙ্গে এই কথাবার্তাও হয়েছে - আমি বলছিলাম, মা, ঠাকুরকে অন্নভােগ দেব?” 

মা — হ্যাঁ, ঠাকুরকে অন্নভােগ দেবে। তিনি সুক্ত খেতে ভালবাসেন। 

আমি - ঠাকুরকে মাছভােগ দেব কি ? 

মা - হ্যাঁ, তাঁকে মাছ দেবে। ঠাকুরের মন্ত্র উচ্চারণ করে তাঁকে নিবেদন করবে। 

মা জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলে মাছ খায় কি ?’

আমি — হ্যাঁ, খান। 

মা - খাবে বই কি, খুব খাবে। 

কথায় কথায় আমি বলেছিলাম, ‘মা, এই যুদ্ধে দেশব্যাপী হাহাকার, লােকের কত কষ্ট, অন্নবস্ত্র দুর্মূল্য।’

মা - এতেও তাে লােকের চৈতন্য হয় না। 

আমি - মা, এই যুদ্ধে কি আমাদের ভাল হবে ? 

মা - ঠাকুর যখনই আসেন, তখনই এরূপ হয়ে থাকে। আরও কত কি হবে।”••• 

ঐদিন বৈকালে আমি যখন মাকে প্রণাম করিতে গিয়াছিলাম, মা সেই জন্মাষ্টমী ছুটিতে রাত্রে অন্ধকারে বৃষ্টিতে জয়রামবাটী যাওয়ার কথা উল্লেখ করিয়া আবার তিরস্কার করিলেন, “গোঁভরে চলা ভাল নয়।” 

আমি - না, আর যাব না। 

মা বােধ হয় এ কথায় বুঝিলেন আমি আর জয়রামবাটী যাইব না। অমনি মা বলিয়া উঠিলেন, “যাবে বই কি। বাবা, তােমাদের পায়ে কাঁটা ফুটলে আমার বুকে শেল বাজে।” পরিবারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বউ মা, তুমি ওকে দেখাে, এইভাবে যেন না চলে।” 

১৯১৭ খ্রীঃ দুর্গাপূজার ছুটিতে ‘উদ্বোধনের’ বাটীতে আমি ও আর একটি গুরুভ্রাতা (যতীন) শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাই। আমরা মায়ের জন্য দুই খানি বস্ত্র লইয়া গিয়াছিলাম। বস্ত্র দুইখানি মায়ের শ্রীচরণপ্রান্তে রাখিয়া প্রণাম করিলাম। আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “বাবা, তােমাদের অবস্থা খারাপ, তােমাদের কাপড় দেওয়া কেন ?” উভয়ে কিছু মনঃক্ষুন্ন হইয়া বলিয়াছিলাম, “মা, তােমার ধনী ছেলেরা তােমাকে দামী কাপড় দেয়। তােমার গরীব ছেলেরা এই মােটা কাপড় নিয়ে এসেছে। তুমি গ্রহণ করে তাদের মনােবাসনা পূর্ণ কর।” শুনিয়াই সস্নেহে মা বলিলেন, “বাবা, এই আমার গরদ, ক্ষীরােদ, নীরদ।” ইহা বলিয়া বস্ত্র দুইখানি সযত্নে হাত পাতিয়া লইলেন। মা দাঁতের বেদনায় তখন খুব কষ্ট পাইতেছিলেন। সেই কথা উল্লেখ করিয়া আমাদের বলিলেন, “বাবা, ঠাকুর বলতেন, যার দাঁতের বেদনা হয় নাই, সে দাঁতের যন্ত্ৰণা বুঝতে পারে না।” 

১৯১৭ খ্রীঃ রাঁচীতে ঠাকুরের উৎসবের পূর্বে মাকে পত্র লিখিয়া নিবেদন করিয়াছিলাম যাহাতে উৎসব সুসম্পন্ন হয়। মা তদুত্তরে জানাইয়াছিলেন, “তােমাদের পত্র পাইয়া কত আনন্দিত হইয়াছি তাহা চিঠিতে লেখা অসম্ভব। তােমরা শ্রীশ্রীঠাকুরের সন্তান। তােমাদের এই সকল সৎকার্যের সহায় তিনি নিজে। তার জন্য তোমাদের ভয়-ভাবনা কি?” 

১৯১৯ এীঃ জ্যৈষ্ঠমাসে জয়রামবাটীতে আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, ঠাকুরের নিকট মনে মনে প্রার্থনা করলে তিনি শুনেন কি ? আর তােমার নিকট না বলে ঠাকুরের নিকট বলতে হয় কি?” 

তদুত্তরে মা উত্তেজিত কণ্ঠে বলিয়াছিলেন, “ঠাকুর যদি সত্য হন, শুনেনই শুনেন।”

এবারে আমি শ্রীশ্রীমার শ্রীচরণ বন্দনা করিয়া জয়রামবাটী হইতে রওনা হইবার সময় তাঁহাকে বলিয়াছিলাম, “যদি দিনের বেলা বলে গরুর গাড়ি না পাই, তবে কোতলপুর হ’তে হেঁটেই বিষ্ণুপুর যাব, মা।” 

মা বললেন, “বাবা, শরীরটাকে আর কষ্ট দেওয়া কেন ? গাড়ি পাবে।” মায়ের কথা ঠিক হইল। গাড়ি পাইলাম। ইহাই দেহাশ্রিতা মাকে আমার শেষ দর্শন। 

-শ্রীশ্রীশচন্দ্র ঘটক 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রী প্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলী

১৯১৬ খ্রীঃ মঠে দূর্গা পূজা। শ্রীশ্রীমা সপ্তমী পূজার দিনে দুপুরে মাঠে আসিয়া উত্তর পাশের বাগানবাড়িতে আছেন। অষ্টমীর দিন সকালবেলা আটটা-নয়টার সময়ে মঠ ও প্রতিমাদর্শন করিতে আসিয়াছেন। রান্নাঘরের পাশের ‘হলে’ ভক্তেরা ও সাধু - ব্রহ্মচারিগণ অনেক কুটনাে কুটিতেছিলেন। মা দেখিয়া বলিতেছেন, “ছেলেরা তাে বেশ কুটনাে কুটে।” জগদানন্দজী বলিলেন, ব্রহ্মময়ীর প্রসন্নতালাভই হ’ল উদ্দেশ্য, তা সাধন-ভজন করেই হােক আর কুটনাে কুটেই হােক।” 

এই দিনে বহুলােক শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতেছিলেন। শ্রীশ্রীমাকে বারবার গঙ্গাজলে পা ধুইতে দেখিয়া যােগীন-মা বলিয়াছিলেন, “মা, ও কি হচ্ছে ? সর্দি করে বসবে যে।” 

মা বলিলেন, “যােগেন, কি বলবাে, এক একজন প্রণাম করে, যেন গা ঠাণ্ডা হয়; আবার এক একজন প্রণাম করে, যেন গায়ে আগুন ঢেলে দেয়। গঙ্গাজলে না ধূলে বাঁচিনে।” 

পরে একদিন কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, এক একজন প্রণাম করলে তােমার খুব কষ্ট হয়, একবার পূজার সময় তােমার এই কথা শুনেছিলাম।” 

মা বলিলেন, “হ্যাঁ বাবা, এক একজন প্রণাম করলে যেন বােলতার হুল ফুটিয়ে দেয়। কাউকে কিছু বলিনে।” এই কথা বলিয়াই সস্নেহ দৃষ্টিতে বলিলেন, “তা বাবা, তােমাদের কিছু বলছি না।” 

আমি বলিলাম, “মা, ভয় হয় তােমার মতাে মা পেয়েও কিছু যেন হ’ল না মনে হয়।” 

মা - ভয় কি, বাবা, সর্বদার তরে জানবে যে ঠাকুর তােমাদের পেছনে রয়েছেন। আমি রয়েছি  - আমি মা থাকতে ভয় কি? ঠাকুর যে বলে গেছেন, ‘যারা তােমার কাছে আসবে, আমি শেষকালে এসে তাদের হাতে ধরে নিয়ে যাব।’ যে যা-খুশি কর না কেন, যে-ভাবে খুশি চল না কেন, ঠাকুরকে শেষকালে আসতেই হবে তােমাদের নিতে। ঈশ্বর হাত পা (ইন্দ্রিয়াদি) দিয়েছেন, তারা তাে ছুঁড়বেই, তারা তাদের খেলা খেলবেই।

একবার ঠাকুরকে ভােগ দিতে গিয়ে দেখি—ছবি হইতে একটা আলাের স্রোত নৈবেদ্যের উপর পড়িয়াছে। তাই মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, যা দেখি সে কি মাথায় ভুল, না সত্যি? যদি ভুল হয় তবে যাতে মাথা ঠাণ্ডা হয় তাই করে দাও।” 

মা একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “না বাবা, ও সব ঠিক।” 

আমি -- তুমি কি জান, কি দেখি ?

মা -- হ্যাঁ। 

আমি - ঠাকুরকে ও তােমাকে যে ভােগ দিই তা কি ঠাকুর পান? তুমি কি তা পাও ? 

মা - হ্যাঁ। 

আমি - বুঝবাে কি করে ? 

মা - কেন, গীতায় পড় নাই - ফল, পুষ্প, জল ভগবানকে ভক্তি করে যা দেওয়া যায়, তা তিনি পান। 

এ উত্তরে বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “তবে কি তুমি ভগবান ?” এই কথায় মা হাসিয়া উঠিলেন। আমরাও হাসিতে লাগিলাম। 

~শ্রীপ্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলী 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত অজ্ঞাত ব্যক্তি 

২৭শে চৈত্র, ১৩২৩, জয়রামবাটীতে সন্ধ্যার পর মায়ের সঙ্গে কথা হইতেছিল। 

আমি - মা, সবাই বলে কল্পতরুর কাছে গেলে কিছু চাইতে হয়। কিন্তু ছেলেরা আবার মার কাছে কি চাইবে ? যার যা দরকার মা তাকে তাই দেন। ঠাকুর যেমন বলতেন, ‘যার যা পেটে সয়, মা তাকে তাই দেন।’ তা কোনটা ঠিক। 

মা - মানুষের আর কতটুকু বুদ্ধি ? কি চাইতে কি চাইবে। শেষে কি শিব গড়তে বানর হয়ে যাবে। তাঁর শরণাগত হয়ে থাকা ভাল। তিনি যখন যেমন দরকার, তেমন দিবেন। তবে ভক্তি ও নির্বাসনা কামনা করতে হয়  - এ কামনা কামনার মধ্যে নয়। 

আমি - ঠাকুর বলেছেন, ‘এখানে যাঁরা আসবে তাদের শেষ জন্ম।’ আবার স্বামীজী বলেছেন, ‘সন্ন্যাস না হলে কারও মুক্তি নেই।'  গৃহীদের তবে উপায়? 

মা - হ্যাঁ, ঠাকুর যা বলেছেন তাও ঠিক, আবার স্বামীজী যা বলেছেন তাও ঠিক। গৃহীদের বহিঃ-সম্যাসের দরকার নেই। তাদের অন্তর-সন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তবে বহিঃ-সন্ন্যাস আবার কারাে কারো দরকার। তােমাদের আর ভয় কি? তাঁর শরণাগত হয়ে থাকবে। আর সর্বদা জানবে যে, ঠাকুর তােমাদের পেছনে আছেন। 

১৩২১, চৈত্র - ‘উদ্বোধন” বাটীতে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। একবার আমার গর্ভধারিণী মাকে তীর্থদর্শনে কাশী লইয়া যাইতে ইচ্ছা করায় তিনি অকাল বলিয়া অমত করেন। আমি এই কথা শ্রীশ্রীমাকে নিবেদন করিলাম। তিনি তদুত্তরে বলিলেন, “বাবা, অকালে তীর্থদর্শন করলে পূর্ব ধর্ম নষ্ট হয় বলে, কিন্তু আবার পূণ্যকার্য শীঘ্র শীঘ্র সেরে ফেলা ভাল।” 

মায়ের এই দ্ব্যর্থক বাক্য বুঝিতে না পারিয়া পুনরায় সংশয় জ্ঞাপন করিলাম এবং, এইরূপ স্থলে কি করা কর্তব্য জিজ্ঞাসা করিলাম। 

মা - সংসারীদের মতে একটা কথা আছে যে অকালে তীর্থদর্শন করে না। দেখ, কালাকালের অপেক্ষা করে পূণ্যকার্য স্থগিত রাখা যায়, কিন্তু কালের (মত্যুর) নিকট কালাকালের বিচার নেই। মৃত্যুর যখন অবধারিত কাল নেই, তখন সুযােগ উপস্থিত হলেই কালাকালের অপেক্ষা না করে পূণ্যকার্য করে ফেলা ভাল। 

অপর এক সময়ে আমার একটি বন্ধুর হাসপাতালে নিতান্ত নিঃসহায় অবস্থায় অকালে মত্যু হয়। তাহার বিমল স্বভাব ও ঈশ্বরানুরক্তির কথা মায়ের নিকট চিঠিতে জানাইয়া তাহার মুক্তিভিক্ষা করিয়াছিলাম। শ্রীশ্রীমা তদুত্তরে জানাইয়া ছিলেন, “আমি আশীর্বাদ করি যে তােমার বন্ধুটির মুক্তিলাভ হউক। ঠাকুর তাহাকে সমস্ত বন্ধন হইতে মুক্ত করুন।”

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রীইন্দুভূষণ সেনগুপ্ত

১৯১০ খ্রীষ্টাব্দের কার্তিক মাসে কালীপূজার পূর্বে শিলং-এর চন্দ্রকান্ত ঘােষের অনুরােধে ও উৎসাহে আমি শিলং হইতে শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করিতে আসি। কলিকাতা আসিয়া জনৈক বন্ধুর সহিত (ইনি পূর্বেই শ্ৰীশ্রীমায়ের কৃপা লাভ করিয়াছিলেন) ‘উদ্বোধনের’ বাটীতে যাই। শ্রীশ্রীমাকে দর্শনের পর উক্ত বন্ধুটি হঠাৎ আমার দীক্ষার কথা মায়ের নিকট উত্থাপন করেন। উত্তরে মা বলিলেন, “বেশ তাে, কালকে হবে।” হঠাৎ এ উত্তরে আমি প্রথমে চমকিয়া উঠিলাম ; কারণ আমি দীক্ষার কথা বলিতে তাঁহাকে বলি নাই; এবং আমার মনেও দীক্ষার কথা উঠে নাই। যাহা হউক পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে পুনরায় তথায় যাইলাম। শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিয়া শ্রীপাদপদ্মে পুম্পাঞ্জলি দিতে যাইতেছি, তখন শ্রীশ্রীমা বলিলেন, “এখন নয়, আমি বলে দেব কখন দিতে হবে।” দীক্ষা হইয়া গেলে পর পা দুটি আমার সম্মুখে স্থাপন করিয়া তিনি বলিলেন, “এখন দিতে পার।” পুষ্পাঞ্জলি দিয়া আমি অকপট ভাবে বলিলাম, “আমি যে ফুল দিয়ে পুজো করলুম এ আমার ভক্তি-বিশ্বাস থেকে নয়, চন্দ্রকান্তবাবু আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যেরূপ বলে দিয়েছেন তাই মাত্র করে গেলুম। চন্দ্রকান্তবাবুই আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।” 

শ্রীশ্রীমা সহাস্যে বলিলেন, “চন্দ্রকান্ত তাে তােমায় ভাল পথই দেখিয়েছে, বাবা” এই বলিয়া সস্নেহে আমার মাথায় হাত দিলেন।

ইহার পর একবার শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়া কথাবার্তা বলিতেছিলাম, কথায় কথায় দুঃখ করিয়া মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, সাংসারিক নানা ঝঞ্চাট, তার উপর চাকরি আছে, কাজেই জপ-তপ আর হয়ে উঠে না। মনের উন্নতিও হচ্ছে না।” মা অভয় দিয়া অমনি বলিলেন, “এখন যাই হােক, শেষটায় ঠাকুরকে আসতেই হবে (তােমাদের নিতে)। তিনি নিজে বলে গেছেন; তাঁর মুখের কথা কি ব্যর্থ হতে পারে ? যা প্রাণে আসে করে যাও।” 

আমি - মা, যারা তােমার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছে তাদের না-কি আর আসতে হবে না? 

মা - না, তাদের আর আসতে হবে না। তােমরা সর্বদা জেনাে -- তােমাদের পেছনে একজন রয়েছেন। 

আমি - মা, তােমায় পেয়েছি, এই আমাদের ভরসা। 

মা - তােমার চিন্তা কি, বাবা, তােমাদের কথা আমার খুব মনে হয়। 

আর একবার কোয়ালপাড়া মঠ শ্রীশ্রীমার সহিত কথাপ্রসঙ্গে মাকে বলিয়া ছিলাম, “মা, সাধন-ভজন কিছু হয়ে উঠছে না।”

মা অভয় ও আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “তােমাকে কিছু করতে হবে না, যা করতে হয় আমি করবাে।”

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “আমার কিছু করতে হবে না?” 

মা - না। 

আমি — তবে এখন হতে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতি আমার নিজ কৃত কর্মের উপর নির্ভর করে না? 

মা - না, তুমি কি করবে ? যা করতে হয় আমি করবাে। 

শ্রীশ্রীমায়ের এই অহেতুক কৃপায় আমি নির্বাক হইলাম। পুনরায় কথাপ্রসঙ্গে মায়ের পায়ের ব্যথার কথা উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনেছি কেউ কেউ পা ছুঁলে তােমার কষ্ট হয়, মা?” 

মা - হ্যাঁ বাবা, কেউ কেউ ছুঁলে শরীরটি যেন শীতল হয়ে যায়, আবার এক একজন আছে ছুঁলে মনে হয় যেন বোলতায় কামড়ে দিলে। কাউকে কিছু, বলিনি। 

মনে মনে ভাবছি - তবে আমারও কি ঐ বােলতা-শ্রেণীর ? অন্তর্যামিনী বলিয়া উঠিলেন, “বাবা, তােমরা নও।” 

ইহার মাস খানেক পরে পুনরায় রথযাত্রার ছুটিতে কোয়ালপাড়া মঠে যাই। রথযাত্রার দিন শ্রীশ্রীমায়ের সহিত নিম্নলিখিত কথা হইয়াছিল । 

আমি — মা, তােমার কৃপা পেয়েছি এই আমার বল ভরসা। 

মা - তােমার চিন্তা কি, বাবা, তুমি আমার অন্তরে রয়েছ। কোন অভাব, প্রয়ােজনে মনে চিন্তা এলে অমনি তােমাদের কথা মনে ওঠে - ইন্দু টিন্দু রয়েছে, ভাবনা কি ? তােমার কিছু করতে হবে না। তোমার জন্যে আমি করছি। 

আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “তােমার যেখানে যত সন্তান আছে সকলের জন্যই তােমার করতে হয়?”

মা - সকলের জন্যেই আমায় করতে হয়। 

আমি - তােমার এত ছেলে রয়েছে, সকলকে তােমার মনে পড়ে? 

মা - না, সকলকে কিছু মনে আসে না। 

আমি — তবে যে বললে, তুমি সকলেরই জন্যেই করে থাক? 

মা - যার যার নাম মনে আসে, তাদের জন্যে জপ করি। আর যাদের নাম মনে না আসে, তাদের জন্যে ঠাকুরকে এই বলে প্রার্থনা করি - ‘ঠাকুর, আমার অনেক ছেলে অনেক জায়গায় রয়েছে, যাদের নাম আমার মনে হচ্ছে না, তুমি তাদের দেখাে, তাদের যাতে কল্যাণ হয় তাই কোরো ' 

~শ্রীইন্দুভূষণ সেনগুপ্ত 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত অজ্ঞাত ব্যক্তি

শ্রীশ্রীমা যখন কোঠারে ছিলেন সেই সময় আমার মেজদাদা আমাদের গ্রামবাসী তাঁহার জনৈক বন্ধুকে ৺পুরীধাম ‘শশিনিকেতন’ হইতে পত্রে জানাইলেন “শ্রীশ্রীমা এখন কোঠারে আছেন, তােমরা তাঁহার দর্শনে যাইতে পার।” ইহার পূর্বে একটা মোটামুটি ধারণা ছাড়া শ্ৰীশ্ৰীমা কিংবা শ্রীশ্রীঠাকুরের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিতাম না বা কোন পুস্তকেও পড়ি নাই। কিন্তু এই সংবাদ পাইয়া অবধি আমার মন তাঁহার দর্শনলাভের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল। দু-চার দিন এইরূপে ব্যাকুল হওয়ার পর তাঁহাকে দর্শন করিতে কোঠারে গেলাম। তথায় বেলা প্রায় বারটার পর পৌঁছিলাম। কিন্তু সেখানে পৌঁছিয়া আর আমার এতটা ব্যাকুলতা ছিল না। এই সময় ভক্তদের প্রসাদ পাওয়ার ডাক পড়ায় আমিও সেই সঙ্গে গেলাম। প্রসাদ পাইয়া পুজনীয় কৃষ্ণলাল মহারাজ, কেদার বাবা ও আমরা বৈঠকখানায় বসিয়া আছি, এমন সময় রামবাবু (৺বলরামবাবুর পুত্র) আসিয়া কৃষ্ণলাল মহারাজকে বলিলেন, “যে ছেলেটি কটক থেকে এসেছে, মা তাকে ডাকছেন, সে এখন প্রণাম করে আসবে।” কৃষ্ণলাল মহারাজ বললেন, “তাকে আমি বলেছি, বিকেলে মাকে দর্শন করতে যাবে।” 

রামবাবু বলিলেন, ‘না, মা অপেক্ষা করছেন, দর্শন করে আসলে তিনি খেতে যাবেন।” আমি রামবাবুর সঙ্গে গিয়া মাকে প্রণাম করিয়া আসিলাম, কোন কথাবার্তা হইল না। পরদিন আমি বাড়ি চলিয়া আসি। 

বাড়ি আসিয়া আবার মন ব্যাকুল হওয়ায় পুনরায় কোঠারে যাই এবং সেখানে দুই-চারি দিন থাকার পর একদিন সকালে শ্রীশ্রীমায়ের দর্শনে গিয়া মাকে বলিলাম, ‘মা, কাল সকালে আমি বাড়ি যাব।” 

মা বলিলেন, “আচ্ছা, কাল থেকো, পরশু যেয়ে।” এই কথার পর আমি বাহিরে চলিয়া আসি। কিছুক্ষণ পর জনৈক সন্ন্যাসী মহারাজ আসিয়া আমাকে বলিলেন, “তােমার উপর মায়ের দয়া হয়েছে, কাল সকালবেলা স্নান করে প্রস্তুত থাকবে।” আমি ভাবিতেছি--“দয়া কি ? কিন্তু কিছু বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া থাকিলাম। পরদিন সকালে স্নান করিয়া একা বসিয়া আছি এমন সময় রাধুদিদি আসিয়া বলিলেন, “বৈকুণ্ঠবাবু কে? তাঁকে মা ডাকছেন।” 

আমি বললাম, “আমারই নাম বৈকুণ্ঠ। আমি মায়ের নিকট যাব ?” 

রাধুদিদির সম্মতি পাইয়া তাঁহার সঙ্গে শ্রীশ্রীমায়ের সাক্ষাতে উপস্থিত হইলাম। মা দেখিয়া বলিলেন, “এস, এ ঘরের ভিতরে এস।” পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি মন্ত্র নেবে?” 

আমি বললাম, “আপনার যদি ইচ্ছা হয়, দিন। আমি কিছু জানি না।” 

মা বলিলেন, “বেশ, বস এখানে।” 

মা - তুমি কোন দেবতার মন্ত্র নেবে? 

আমি বললাম, “আমি কিছুই জানি না।” 

তখন মা বলিলেন, “বেশ, তােমার এই মন্ত্রই ভাল।” মায়ের নিকট আমি সেই দিনই দীক্ষিত হইলাম - ১৩১৭ সালের মাঘ মাসের সপ্তমী তিথিতে। এইখানেই একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, যােগশিক্ষার জন্য অন্য গুরু করতে পারা যায় কি-না?” উত্তরে মা বলিয়াছিলেন, “অন্যান্য বিষয় শিক্ষার জন্য তুমি গুরু করতে পার, কিন্তু দীক্ষাগুরু আর করতে নেই।” 

যে দিন কোঠার হইতে রওনা হই তাহার পূর্বে রাত্রিতে প্রায় বারটার সময় রামবাবু কিছু, মিষ্টি হাতে লইয়া আমাকে ঘুম হইতে জাগাইয়া বলিলেন, “বৈকুণ্ঠ, মা এই মিষ্টি দিয়েছেন, তুমি সঙ্গে নিয়ে যেয়াে। রাস্তার কোন বাজারে খাবার কিনে খেতে মা নিষেধ করলেন।” 

আর একবার আমি একাকী শ্রীশ্রীমায়ের দর্শনে গিয়াছিলাম। মা তখন কয়েক দিনের জন্য জয়রামবাটী হইতে কামারপুকুরে আসিয়াছিলেন। আমারও কামার পুকুরে এই প্রথম যাওয়া। শ্রীযুক্ত রামলালদাদা ও লক্ষীদিদি তখন কামারপুকুরে। প্রথম দিন রামলালদাদা ও আমি বারান্ডায় খাইতে বসিয়াছি, মা মাঝে মাঝে আমাদিগকে পরিবেশন করিতেছিলেন এবং আমাকে বলিতেছিলেন, “বৈকুণ্ঠ, সমস্ত খেয়ে, পাতে কিছু ফেলাে না।” এই কথা বলিতে বলিতে আরাে জিনিস আমার পাতে দিতে লাগিলেন। রামলালদাদাও “আরাে খাও, লজ্জা কোরাে না”—এইরূপ বলিতেছিলেন। তখন আমি এত খেয়েছি যে পেটে আর ধরে না, অথচ সঙ্কোচবশতঃ কিছু বলিতেও পারিতেছি না। রামলালদাদার এই কথা শুনিয়া মা বলিলেন, “থাক, ও ক্ষ্যাপা ছেলে, যা খেয়েছে -- খেয়েছে, আর কিছু বোলাে না এবং আমাকে বলিলেন, “বৈকুণ্ঠ, এখন পাতা গ্লাস বাটি উঠিয়ে নিয়ে যাও, গুরুগৃহে* ওসব রেখে যেতে নেই।” 

দ্বিতীয় দিন যখন প্রণাম করিতে যাই তখন মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি বাড়ি যাচ্ছ কবে?” 

আমি বলিলাম, “মা, আমি বেলুড় মঠ দেখি নাই, মঠ হয়ে পরে বাড়ি যাব।” 

তাহাতে মা বলিলেন, “এখন মঠে গিয়ে কাজ নেই, তুমি আজই বাড়ি যাও।” 

আমি বলিলাম, “মা, এতদূর এসেছি। একবার মঠে না গিয়ে এখন বাড়ি ফিরছি না।” 

মা বলিলেন, “না, তুমি বাড়ি যাও, গুরুর আজ্ঞা লঙ্ঘন করতে নেই।” এই কথার পর আমি আর কোন আপত্তি করিলাম না, কিন্তু মনে মনে ভাবিয়া রাখিলাম, এখান হইতে সরিতে পারিলেই মঠে যাইব, তখন আর মা জানিতে পারিবেন না। সেই সময় এলাহাবাদ হইতে একটি স্ত্রী-ভক্ত ও তাঁহার সঙ্গে একটি পুরুষ-ভক্ত আসিয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে মা সেইদিনই দীক্ষা দিলেন। মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি এদের সঙ্গে যাও।” কিন্তু আমি সঙ্গে যাইলে তাহাদের অসুবিধা হইবে বলায় আমি আর গেলাম না। তাঁহাদিগকে বিদায় দিবার জন্য মা সদর-দরজা পর্যন্ত আসিয়াছিলেন। ইতঃপূর্বে আমি আমার টাকার ব্যাগটি সদরের কুলুঙ্গিতে রাখিয়াছিলাম। উক্ত কুলুঙ্গিতে মায়ের দৃষ্টি পড়ায় তিনি উহা ঘরে রাখিয়াছিলেন। তারপর লক্ষীদিদিকে দিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন, “বৈকুণ্ঠ তার টাকার ব্যাগ কি করলে?” এই কথা শুনিয়া আমি সেখানে খুঁজিতে যাইয়া উহা পাইলাম না দেখিয়া লক্ষীদিদি গিয়া মাকে এই সংবাদ জানাইলেন। মা আমাকে ডাকাইয়া বলিলেন, “এত অসাবধান হ'লে কি সংসার চলে? এইটুকু সাবধানতা যার নেই, সে আবার কিসের সংসার করবে ? তােমার টাকার ব্যাগ আমার কাছে আছে। তুমি তাদের সঙ্গে গেলে না কেন?” আমি কারণ বলায় মা তাঁহাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। আমি মাকে বলিলাম, “আপনি সেজন্য এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, আমি একটা লােক ঠিক করে কাল যাব।” মা এই কথা শুনিয়া নিজের ঘরে গেলেন। 

সেইদিন দুপুরবেলা আমাকে ভিতরে ডাকাইয়া বলিলেন, “এ চিঠিগুলি খুলে পড়, দেখি কি সংবাদ আছে।” আমি চিঠিগুলি পড়িলাম। তম্মধ্যে একখানির কথা বিশেষ মনে আছে - বাগবাজার মঠ হইতে আসিয়াছে এই মর্মে লেখা ছিল যে, পূজনীয় শশী মহারাজ শ্রীশ্রীমাকে একবার দেখিতে চান এবং মা তাঁহাকে যে চিকিৎসায় থাকিতে বলিবেন, তিনি সেই চিকিৎসাতেই থাকিতে চান। মা চিঠি শুনিয়া বলিলেন, “আমি আর কি চিকিৎসার কথা বলবাে? শরৎ, রাখাল, বাবুরাম আছে, তারা পরামর্শ করে যেটি ভাল মনে করে তাই করুক। আমি সেখানে গেলে তাে রােগীকে সরাতে হবে। সেটা ভাল হবে? এমন রােগীকে কি সরাতে আছে? আমি যাব না। যদি শশীর কিছু ভালমন্দ হয়, তবে কি আমি সেখানে থাকতে পারবাে? তুমি বুঝিয়ে লিখে দাও তো - আমি এ জন্য যাব না।” 

পরদিন প্রসাদ খাওয়ার পর বাড়ি রওনা হইবার জন্য বিদায় লইতে বাড়ির মধ্যে গিয়া দেখি - মা তাহার ঘরের বারাণ্ডায় পান সাজিতেছেন। আমাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘুবীরকে প্রণাম করেছ ?” 

আমি বলিলাম, “না, মা।” তাহাতে মা বলিলেন, “এখানে এলে কিছু দিতে হয়, তুমি রঘুবীরকে প্রণাম করে কিছু প্রণামী দিও। তােমার কাছে যদি টাকা-পয়সা না থাকে, আমার কাছ থেকে নিও।”

আমি বলিলাম, “না, আমার কাছে টাকা আছে।” এই বলিয়া রঘুবীরকে প্রণাম করিয়া আসিলাম। বিদায় লইবার জন্য মাকে প্রণাম করিয়া উঠিতেছি, এমন সময় মা সহসা বলিয়া উঠিলেন, “বৈকুণ্ঠ, আমায় ডাকিস।” এই কথার পূর্বমুহুর্তেই আবার বলিলেন, “ঠাকুরকে ডেকো, ঠাকুরকে ডাকলেই সব হবে।” এই সময় লক্ষীদিদি সেখানে ছিলেন, তিনি বলিয়া উঠিলেন, “না, মা, একি কথা? এতাে বড় অন্যায়। ছেলেদের এমন করে ভুলালে তারা কি করবে!” 

মা বলিলেন, “কই, আমি কি করলুম? 

লক্ষ্মীদিদি - মা, তুমি এই মুহূর্তে বৈকুণ্ঠকে বললে, আমায় ডাকিস, আবার বলছ ঠাকুরকে ডেকো।' 

মা বলিলেন, “ঠাকুরকে ডাকলেই তাে সব হ’ল। 

তখন লক্ষ্মীদিদি মাকে বলিলেন, “মা, এরকম ভাবে ভুলানাে তােমার অন্যায়।” আর আমাকে বিশেষ করিয়া বলিলেন, “দেখ, বৈকুণ্ঠ, আমি আজ এই নতুন শুনলুম যে, মা বলেছেন - আমায় ডেকো। তুমি একথা যেন ভুলো না ! ঠাকুর আর কে? তুমি মাকেই ডেকো। তােমার বড় ভাগ্য যে মা নিজে তােমায় একথা বললেন। তুমি মাকেই ডেকো।” আমাকে এইরূপ বলিয়া মাকে বলিলেন, “কেমন, মা হয়েছে এখন ?” লক্ষ্মীদিদির এই কথায় মা মৌন রহিয়া সম্মতির লক্ষণ জানাইয়াছিলেন। 

আসিবার সময় মা আবার আমাকে বলিলেন, “তুমি এখান থেকে একেবারে ঘরে যেয়ো, এখন মঠে বা এখানে ওখানে কোথাও গিয়ে কাজ নেই। ঘরে গিয়ে বাপমায়ের সেবা কর। এখন বাবার সেবা করা উচিত।” এই কথা বলিয়া আমার হাতে চার খিলি পান দিয়া আমাকে আসিতে বলিলেন। আমিও মার আজ্ঞা শিরােধার্য করিয়া আমার পূর্ব সঙ্কল্প পরিত্যাগপূর্বক কোয়ালপাড় মঠ হইয়া বাড়ি আসিলাম। যাইবার সময় বাবার শরীর ভাল দেখিয়া গিয়া ছিলাম। বাড়ি ফিরিয়া দেখি - বাবার বড়ই শক্ত ব্যারাম হইয়াছে। আমার পৌঁছিবার ছয় সাত দিন পরেই বাবা দেহরক্ষা করিলেন। 

এবার কামারপুকুর যাইবার সময় আমার এক গুরুভাই আমার হাতে মায়ের নিকট একখানি পত্ৰ দিয়াছিলেন। উক্ত পত্র মাকে দিবার সময় মা বলিলেন, “তুমি খুলে পড়।” তাতে নিয়লিখিত দুইটি প্রশ্ন ছিলঃ (১) আমি চাকরি করিতে যাইতেছি, চাকরি করিলে মায়ায় জড়াইব কি, মা? শুনিয়া মা বলিলেন, “চাকরি করলে আবার মায়ায় কি জড়াবে?” (২) বিবাহ করলে আমায় ভাল হবে কি-না। মা এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, তুমি বিয়ে করেছ কি?” আমি বলিলাম, “না, মা, আমি বিবাহ করি নাই।” শুনিয়া বলিলেন, “বেশ তাে, তুমি বিয়ে করাে না, বিয়ে করা বড় জঞ্জাল।” 

কামারপুকুরে অবস্থানকালে একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, মাছ মাংস খেলে দোষ কি?” তদুত্তরে মা বলিলেন, “এদেশ মাছের দেশ, মাছ খেতে পার।” 

সেই সময় আমি একবার মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, আপনার পদ-চিহ্ন নিতে চাই।” তাহাতে মা বলিয়াছিলেন, “এখন এখানে সুবিধা নয়। তােমরা আমাকে যেমন (যে চক্ষে) দেখ, সকলে তাে তেমন দেখে না। এই লাহাবাবুদের বাড়ির অনেকে এখানে আসে টাসে। সে জন্যে আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে - পায়ে আলতার চিহ্ন থাকবে কি না!” 

*এখানে গুরুগৃহ বলিতে শ্রীশ্রীমা ঠাকুরকেই লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেন। কারণ, তিনি নিজে এই সব ভক্তদের গুরু হইলেও জয়রামবাটী - অবস্থানকালে কখনও তাহাদিগকে উচ্ছিষ্ট ফেলিতে দিতেন না। ঝি-চাকর দ্বারা পরিষ্কার করাইতেন। অনেক সময় নিজেই করিতেন— গুরু হইলেও তিনি যে ‘মা’ তবে উচ্ছিষ্ট পাতা হাওয়ায় উড়িয়ে অসুবিধা করবে ৰ'লে কখনাে কখনাে ভক্তেরা শুধু পাতাটি তুলে নিয়ে যেতেন।

অন্য এক সময় আমাদের দেশের কয়েকটি গুরুভাই মিলিয়া জয়রামবাটী গিয়াছিলাম। সেখানে যাইয়া আমার এইরূপ মনে হইতেছিল যে, ‘এতদূর ছুটিয়া আসিয়াছি। জীবনে তাে কিছুই করিতে পারিলাম না। শ্রীশ্রীমায়ের যদি সেবা করিতে পারিতাম, নিজেকে বড়ই ধন্য মনে করিতাম।’ একদিন সব গুরুভাইরা কামারপুকুর গেলেন। আমি কিন্তু গেলাম না। বৈকালে মায়ের কাছে গিয়াছি। তিনি ভাঁড়ার ঘরের বারান্ডায় (নুতন বাড়িতে ) বসিয়াছিলেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “বাবা, ভাঁড়ার থেকে আটার হাঁড়িটা নিয়ে এস তাে।” আমি আনিয়া দিলাম। তিনি খানিকটা আটা বাহির করিয়া জল মাখিলেন এবং উহা ঠাসিতে বলিলেন। আমি আটা ঠাসিয়া দিয়া বাহির বাটীতে আসিলাম। পুনরায় সন্ধ্যার সময় মায়ের কাছে গিয়াছি, তখন মা তাঁহার নিজের ঘরের বারাণ্ডায় বিশ্রাম করিতেছিলেন। আমি তথায় বসিয়া আছি, কিছুক্ষণ পরে মা আমাকে বলিলেন, “বৈকুণ্ঠ, পা-টা একটু টিপে দাও তাে, বাবা।” আমি পা টিপছি, মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছেলেরা কামারপুকুর থেকে এখনাে এল না কেন? রাস্তাটাস্তা ভুলে গেল নাকি?” এই কথা বলিয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইলেন। ব্রহ্মচারী জ্ঞানকে ডাকিয়া বলিলেন, “জ্ঞান, একবার দেখ তাে, ওদের এত দেরি কেন হচ্ছে ?” ব্রহ্মচারী জ্ঞান দেখিবার জন্য কিছুদূর অগ্রসর হইয়া গেলেন। বাস্তবিক তাঁহাদের সেদিন রাস্তা ভুল হইয়াছিল। খোঁজ না লইলে তাহাদের বাড়ি পৌঁছিতে আরাে অনেক দেরি হইত। 

রাত্রিতে আমরা সকলে মায়ের সদর-ঘরের বারাণ্ডায় ঘুমাইয়াছিলাম। শেষ রাত্রে চারটার সময় আমাদের সকলের ঘুম ভাঙিল। একজন বলিলেন, “এই সন্ধিক্ষণে যদি একবার মায়ের দর্শন মিলতাে।” এই বলিয়া তিনি একটি গান ধরিলেন,-“ওঠ গাে করুণাময়ী, খােল গাে কুটীরদ্বার” ইত্যাদি। গান শেষ হইতেই দেখি, মা বাহির দরজা খুলিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা হঠাৎ তাহার দর্শন পাইয়া মহানন্দে একে একে সকলে প্রণাম করিলাম। মা আবার দরজা বধ করিয়া ভিতরে গেলেন। 

আর একদিন আমরা কয়েকজন মিলিয়া ৺বাসন্তীপূজার সময় জয়রামবাটী গিয়াছিলাম। রাস্তায় সাদা পদ্মফুল দেখিতে পাইয়া কিছু সংগ্রহ করিয়া লইয়াছিলাম। যখন আমরা ঐ ফুল শ্রীশ্রীমায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দিব বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিলাম, সেই সময় মা বলিয়া পাঠাইলেন, “দেবীর পূজাতে সাদা ফুল লাগে না।” এ সংবাদ পাইয়া আমরা পুনরায় লালপদ্ম সংগ্রহ করিয়া তাহার পাদপদ্মে অঞ্জলি দিয়াছিলাম। 

একদিন তাঁহার সাংসারিক কোন কথায় শুনিলাম — মা যেন কাহাকে বলিতেছেন, “আমাকে বেশী জ্বালাবে না, কারণ আমি যদি চটেমটে কাউকে কিছু বলে ফেলি তাে কারাে সাধ্য নেই যে আর রক্ষা করে।” 

সেবার মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, আজকাল সরকার যে ছেলেদের ধরে ধরে আটক করে রাখছে, এর পরিণাম কি হবে ?" তদুওরে মা বলিয়া ছিলেন, তাই তো বড় অন্যায়। এর একটা প্রতিকার শীঘ্র হবে। আর বেশী দিন নয় - ভাল হবে।” 

একদিন আমি মাকে বললাম, “মা, আমার একটা কিছু করে দিন?” তাহাতে মা বলিলেন, “শরৎ, রাখাল এরা রয়েছে। ভয় কি?” তখন আমি বলিয়াছিলাম, “মা, আমার বড়ই ইচ্ছা হয় কিছুদিন মঠে গিয়ে থাকি।” মায়ের মত হইল না, বলিলেন, “এখন মঠে গিয়ে কাজ নেই, বাড়িতেই থাকো।” 

এবার আমাদের গ্রামের ক্ষীবােদ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রীমা কৃপা করিয়াছিলেন। ক্ষীরােদবাবুর মুখে শুনিয়াছি দীক্ষার সময় মা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “আজ থেকে তােমার ইহকাল ও পরকালের পাপ গেল।” 

একদিন কলকাতায় বাগবাজারে মায়ের বাটীতে ( উদ্বোধন কার্যালয়ে। মাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া আছি। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাস্টার মশায়কে প্রণাম করেছো ?” 

আমি বিললাম, “না, মা, আমি তাঁকে চিনি না।” 

মা বলিলেন, “যাও, নীচে সে আছে। সে মহাপুরুষ লােক, তাকে প্রণাম করে এস।” এই বলিয়া পুজনীয়া গােলাপ-মাকে আমার সঙ্গে পাঠাইলেন মাস্টার মহাশয়কে চিনাইয়া দিতে। আমি নীচে আসিয়া মাষ্টার মহাশয়কে প্রণাম করিয়া আবার উপরে গেলাম। দুইজন লােক এই সময় মাকে প্রণাম করিয়া নীচে চলিয়া গেলেন। মা ঠাকুরঘরে নিজ তক্তাপোশে বসিয়াছিলেন। তিনি আপনমনে বলিতেছিলেন, “যে-সে লোক পা ছুঁয়ে বড় যন্ত্রণা দিলে।” 

একবার কোন বৈষয়িক ব্যাপার উপলক্ষে আমার সঙ্গে মেজদাদার ঝগড়া হওয়ায় আমি কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র থাকিবার ইচ্ছা করিয়া ঐ বিষয় শ্রীশ্রীমাকে জানাইতে এবং তাঁহার অনুমতি লইতে বাগবাজার গিয়াছিলাম। মাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া আছি। মা গােলাপ-মাকে বলিতেছেন, “ও গােলাপ, শুনেছ, বৈকুণ্ঠকে তার দাদা একটা চড় মেরেছে বলে সে এতদূরে ছুটে এসেছে। ঘর করলে কি ঝগড়া হয় না? তার জন্যে এতটা কেন? আমাকে বলিলেন, “যাও বাবা, বাড়ি যাও। ঘর করলে একটু আধটু ঝগড়া হয় বই কি।” 

********

আমার এক গুরুভ্রাতা ঠাকুরের গায়ত্রী মন্ত্র ভুলিয়া গিয়া আমাকে উক্ত মন্ত্র জিজ্ঞাসা করায় আমি মাকে চিঠিতে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ‘মন্ত্র কাহাকেও বলা যায় কি না।” মা তখন মাদ্রাজে। তদুত্তরে চিঠিতে মা আমাকে জানাইয়াছিলেন, ‘মন্ত্র কাহারও নিকট বলিতে নাই, তবে তোমার গুরুভায়ের নিকট বলিতে পার, তাহাতে দোষ নাই।”

********

একদিন মনের দুঃখে বাগবাজারে ‘উদ্বোধন’-এর বাটীতে গিয়া শ্ৰীশ্রীমাকে বলিয়াছিলাম, “মা, আমি আপনার নিকট কিছু বলতে এসেছি।”

মা - কি, বল। 

আমি - মা, কবে আপনার এ অভাগা ছেলেকে দয়া হবে ?

মা - বাবা, ঠাকুর দয়া করবেন, তাঁকে ডাকো। আর সৎসঙ্গ কর, সাধনভজন কর। ঠাকুরকে ডাকলেই সব হবে।  

আমি  - ঐ ক'রে তাে মা, কিছু, হ’ল না। আমি ঠাকুরকে দেখিনি -- কি ডাকবাে.? আপনার দয়া পেয়েছি। যদিও আপনি বলছেন, তবে আপনার এ অভাগা ছেলের জন্যে আপনি-ই তাঁকে বলুন। 

মা - জপ-ধ্যান না করলে কি হয় ? সে-সব যে করতে হয়। 

আমি  - আর আমার জপটপ করতে মা ইচ্ছে নেই। ক'রে তাে কিছুই হচ্ছে না । কাম ক্রোধ মােহ আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনি আছে। মনের ময়লা একটুও কাটে নাই।

মা - বাবা, মন্ত্রজপ করতে করতে কাটবে। না করলে চলবে কেন? পাগলামি কোরাে না। যখন সময় পাবে, মন্ত্রজপ কোরাে। ঠাকুরকে ডেকো। 

আমি - “না, মা, আমার সে ক্ষমতা নেই। জপ করতে বসি তো মন চঞ্চল। হয়—আমার মন তন্ময় করে দিন যেন একটুও কুচিন্তা না আসে, না হয় -- আপনার মন্ত্র আপনি ফেরত নিন। বৃথা আপনাকে কষ্ট দিতে আমার ইচ্ছে নেই। কারণ, শুনেছি - শিষ্য মন্ত্রজপ না করলে সেজন্য গুরুকেই ভুগতে হয়।

মা - দেখ, একি কথা। তােমাদের জন্যে যে আমি ভেবে ভেবে অস্থির হলুম। ঠাকুর তােমাদের যে কবে (অর্থাৎ পূর্বেই) দয়া করেছেন। 

এই কথা বলিতে বলিতে মার চোখে জল আসিল। আবেগভরে বলিলেন, “আচ্ছা, তােমাকে আর মন্ত্রজপ করতে হবে না। ”-- অর্থাৎ যা হয় তিনি নিজেই আমার জন্য করিবেন। 

কিন্তু তখন তাঁর কথার এই মর্ম বুঝিতে না পারিয়া ভয় ও আতঙ্কে আমার মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে; ভাবিলাম - সব সম্বন্ধ বুঝি ফুরাইল। প্রাণের আবেগে বলিলাম, “মা, আমার সব কেড়ে নিলেন। এখন আমি করি কি? তবে কি, মা, আমি রসাতলে গেলুম?” 

এই কথা শুনিয়া মা খুব জোরের সহিত বলিলেন, “কি, আমার ছেলে হয়ে তুমি রসাতলে যাবে। এখানে যে এসেছে, যারা আমার ছেলে, তাদের মুক্তি হয়ে আছে। বিধির সাধ্য নাই যে আমার ছেলেদের রসাতলে ফেলে।”

আমি - তবে, মা, এখন কি করবাে? 

মা - আমার উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাক। আর এটা সর্বদা স্মরণ রেখ যে, তােমাদের পেছনে এমন একজন রয়েছেন যিনি সময় আসলে তােমাদের সেই নিত্যধামে নিয়ে যাবেন। 

আমি — মা, যতক্ষণ আপনার নিকট থাকি, খুব ভাল থাকি। সংসাবের কোন চিন্তা আমার থাকে না। আর যেমন বাড়ি যাই, অমনি মনে নানা কুচিন্তা আসে। আবার সেই পুরনাে অসৎ সঙ্গীদের সঙ্গে মিশি, আর অন্যায় কাজ করি। যত চেষ্টা করি, কিছুতেই কুচিন্তা দূর করতে পারি না। 

মা - ও তােমার পূর্বজন্মের সংস্কারে হচ্ছে। জোর করে (হঠাৎ) কি ও ছাড়া যায় ? সৎসঙ্গে মেশাে, ভাল হতে চেষ্টা কর, ক্রমে সব হবে। ঠাকুরকে ডাক। আমি রইলুম। তুমি এ জনমে মুক্ত হয়ে রয়েছ, জানবে। ভয় কি? সময় আসলে তিনিই সব করে দেবেন। 

শ্রী--------

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রীসুরেন্দ্রনাথ সরকার  

শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করি ইংরেজী ১৯১০ সনের ডিসেম্বর মাসে বড়দিনের সময় উড়িষ্যার কোঠারে*। আমার সহিত হেমন্ত মিত্র ও বীরেন্দ্র মজুমদার নামক আরও দুইজন ভক্ত শিলং হইতে আসিয়াছিলেন। কোঠারে তখন রামকৃষ্ণবাবু, স্বামী ধীরানন্দজী, স্বামী অচলানন্দজী, স্বামী আত্মানন্দজী, শ্রীশ্রীনাগমহাশয়ের ভক্ত শ্ৰীযুক্ত হরপ্রসন্ন মজুমদার প্রভৃতি ছিলেন। আমরা কিছু ফল, কমলা-মধু, প্রভৃতি লইয়া গিয়াছিলাম। বেলা প্রায় একটার সময় পৌঁছিলাম। জিনিসপত্র রামকৃষ্ণবাবু শ্ৰীশ্রীমায়ের নিকট পৌঁছাইয়া দিলেন। স্নানান্তে আমাদিগকে আহার করিতে ডাকা হইল। ইতােমধ্যে উপস্থিত সন্ন্যাসিগণ পরস্পর বলাবলি 
*কোঠার - শ্রীশ্রীঠাকুরের ভক্ত ৺বলরাম বসুর জমিদারী। বায়ুপরিবর্তনের জন্য শ্রীশ্রীমাকে কিছুদিন তথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মা এখান হতেই পরে মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালাের, রামেশ্বর প্রভৃতি দর্শন করতে গিয়েছিলেন। 
করিতে লাগিলেন-“যখন এত দূর দেশ হতে এসেছে, মাকে দর্শন করতে দিতেই হবে—তবে বেশী কথাবার্তার সুবিধা হবে না। বীরেনবাবু শুনিয়া আমাকে এই কথা বলিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, “মার যা ইচ্ছা তাই হবে। ভয় কি?” সকলেই আহার করিতে গেলেন। আমি রামকৃষ্ণবাবুকে বলিলাম, “মাকে দর্শন না করে আমরা কিছু খাব না।” রামকৃষ্ণবাবু শ্রীশ্রীমাকে ঐ কথা জানাইলেন এবং আমাদের দর্শনের অনুমতি লইয়া আসিলেন। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখি - মা বারাণ্ডায় রীতিমত ঘােমটা টানিয়া চাদর মুড়ি দিয়া বসিয়া আছেন। নিকটে যাইতেই ' গােলাপ-মা বলিলেন, “ছেলেমানুষ গাে, ছেলেমানুষ; মা, কোথায় শিলং আর কোথায় কোঠার, তােমাকে দেখতে সাত সমুদ্দর তের নদী পার হয়ে এসেছে।” এ কথা শুনিয়াই মা ঘােমটা টানিয়া মাথার উপর উঠাইলেন, মায়ের শ্রীমূর্তি ভাল করিয়া দেখিবার সুবিধা হইল। সেইদিন হইতে মা আর কখনাে আমাকে দেখিয়া ঘােমটা দেন নাই। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া মনে মনে ‘শরণাগত শরণাগত’ এই কথা বলিলাম। মা আমার মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন -- “ভত্তিলাভ হােক।” 

আমি - মা, এখানে দু-এক দিন থাকবাে ইচ্ছা। বড় মানুষের বাড়ি, তােমাকে দর্শন করা বড়ই মুশকিল। 

মা - আমি তােমাদিগকে ডেকে পাঠাব। এখন খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করগে। 

আমরা আহারান্তে বিশ্রাম করিলাম। বৈকালে পূজনীয়া গােলাপ-মা শ্রীশ্রীমায়ের প্রসাদী পায়েস একটি বাটিতে আমাদের দিয়া গেলেন ; বলিলেন, “মা তােমাদের এই পায়েস দিয়েছেন।” 

কিছুক্ষণ পরে একজন আসিয়া বলিলেন, ‘মা আপনাদের ডেকেছেন।” আমরা পুনর্বার দর্শন পাইলাম। প্রণামান্তে মাকে বলিলাম, “মা, তােমাকে দু একটি কথা বলবাে, তা সকলের সামনে বলতে ইচ্ছে হয় না।” 

মা বলিলেন, “বেশ তাে।” যিনি আমাদের ডাকিয়া আনিয়াছিলেন তাঁহাকে বলিলেন, “তুমি একটু এখান থেকে যাও।” তিনি মায়ের কথামত বাহিরে চলিয়া গেলেন। 

আমি ইতঃপূর্বে স্বপ্নে শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমাকে দর্শনাদি করিয়াছিলাম, সেই সকল কথা বললাম। মা ঐ সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “ঠিক দেখেছ।” অপর ভক্ত দুইটি সম্বন্ধে মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “এদের কি ইচ্ছে ?” 

আমি বলিলাম, “মা, তােমার কাছে এসেছে দীক্ষার জন্যে, এখন তােমার যা ইচ্ছা।” 

মা - বেশ, কাল সকালে স্নান করে এস। 

আমি — মা, ঠাকুর তােমার পাদপদ্ম পূজা করেছিলেন, আমাদেরও ইচ্ছে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তােমার পাদপদ্ম পূজা করবাে। 

মা - আচ্ছা, তাই হবে। 

আমি — ফুল কোথায় পাব? 

মা - এরা যােগাড় করে দেবে। 

আমরা প্রণাম করিয়া বাহির বাটীতে আসিলাম। 

শ্রীশ্রীমা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এদের কি ইচ্ছে ?” কিন্তু আমার নিজের সম্বন্ধে কোন কথাই তুলিলেন না। মায়ের নিকট হইতে চলিয়া আসিবার পর আমার একটু চিন্তা হইল, ভাবিলাম-মায়ের যা ইচ্ছা তাহাই হইবে, আমি নিজে বলিব না। 

পরদিন আমরা স্নান করিয়া পুম্পাদিসহ প্রস্তুত হইলাম। আদেশ হইল-- ‘এক একজন করিয়া এস। আমিই প্রথম গেলাম। পূজাদি সাঙ্গ করিয়া বসিয়া আছেন - মনে হইল। আমি প্রবেশ করিলে বলিলেন, “ঠাকুর তােমাকে যা দিয়েছেন, তা তুমি করবে। আমিও তােমাকে কিছু দিচ্ছি।” এই বলিয়া মহামন্ত্র দিলেন। 

পরে শ্রীপাদপদ্ম পূজা করিলাম। মা দাঁড়াইয়া পূজা গ্রহণ করিলেন। আমি বলিলাম, “মা, আমি তাে মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি না।” মা বলিলেন, “অমনিই দাও না।” আমি ‘জয় মা’ বলিয়া পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিলাম। একটি ধুতরা ফুল ছিল - মা বলিলেন, “ওটি দিও না - ও শিবের পূজায় লাগে।” 

মায়ের জন্য কাপড় হইয়া গিয়াছিলাম, সেই কাপড়খানি আর একটি টাকাও দিলাম। টাকা দেওয়াতে মা বলিলেন, “তােমার টানাটানি অভাব-আবার টাকা কেন ?” সাংসারিক অভাব সম্বন্ধে তাে কোন কথাই হয় নাই, অথচ দেখিলাম মা সবই জানেন। আমি বলিলাম, “এ-তাে তােমারই টাকা, তােমাকেই দেওয়া হচ্ছে। আমাদের পরিশ্রমে যা কিছু আসে, তার সামান্যও যদি তােমার সেবায় লাগে, আমরা ধন্য মনে করি।” 

মা বলিলেন, “আহা! কি টান গাে, কি টান।” 

আমি — মা, তােমাকে ভক্তগণ সাক্ষাৎ কালী, আদ্যাশক্তি, ভগবতী এসব বলেন। গীতায় আছে, অসিত, দেবল, ব্যাস প্রভৃতি মুনিগণ শ্রীকৃষ্ণকে সাক্ষাৎ নারায়ণ বলেছিলেন; স্বয়ং তিনিও একথা অজুর্নকে বলেছিলেন*। এই ‘স্বয়ং’ বলায় ঐ কথার আরও জোর হয়েছে। তােমার কথা যা শুনেছি, তা আমি বিশ্বাস করি। তবে তুমি স্বয়ং যদি সে কথা বল, তা হলে আর কোনই সন্দেহ থাকে না। তােমার নিজের মুখেই শুনতে চাই ও কথা সত্য কি না। 

মা - হ্যাঁ, সত্য। 

ইহার পর ভবিষ্যতে আর কোনদিনই মায়ের স্বরূপ সম্বন্ধে আমি কোন প্রশ্ন করি নাই। 

আমি বলিলাম, “মা, আমি এই চাই - যেমন তােমাকে প্রত্যক্ষ দেখছি, কথাবার্তা বলছি, আমি যেন এইরুপই ইষ্টকে দর্শন, স্পর্শন, আলাপ করতে পারি—এই আশীর্বাদ কর।” 

মা — হ্যাঁ, তাই হবে। 

তার পরদিন বিদায়গ্রহণের সময় শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিয়া উঠিয়া মায়ের বড়ই প্রসন্ন মূর্তি ও হাসিমাখা মুখ দেখিলাম। গােলাপ-মা আমাকে বললেন, “পুরীধাম দর্শন করে যাও না।” আমি বলিলাম, “আর কি দেখব? মায়ের পাদপদ্মই আমার অনন্তকোটি তীর্থ। আর কিছুই চাই না।” 

মা আমার কথা শুনিয়া বলিলেন, “থাকগে, নাই বা গেল, দরকার নেই।” 

দ্বিতীয় দর্শন - ১৯৯২ সনে মে মাসে, ‘উদ্বোধন’-এর বাটীতে। এবারে শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের ও আমার সহধর্মিণীর দীক্ষা হয়। শ্ৰীমতী রাধুর অসুখ থাকায় বিশেষ কোন কথাবার্তা হয় নাই। আমার গর্ভধারিণী ও মাতামহী আমার সঙ্গে ছিলেন। আমার দুটি ছেলেও ঐ সঙ্গে গিয়াছিল। তাঁহারাও শ্রীশ্রীমাকে দর্শন, স্পৰ্শন করিয়া ধন্য হইলেন। 

তার পর দর্শন - জয়রামবাটীতে ১৯১৩ সনে; শ্রীশ্রীমার ভ্রাতুস্পত্র ভুদেবের বিবাহের তিন-চার দিন পূর্বে। সেবারে কোয়ালপাড়া মঠ পৌঁছিয়া শুনিবার 

আহুক্তামৃবয়ঃ সর্বে দেবর্ষি নারদস্তথা। 
অসিতো দেবলাে ব্যাসঃ স্বয়ং চৈব ব্ৰবীষি মে। 

- সম্প্রতি একটি ভক্ত* শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিয়া ফিরিবার সময় উক্ত মঠে দেহরক্ষা করিয়াছেন। কেশবানন্দজী বলিলেন, “এখন জয়রামবাটী যাওয়া মার নিষেধ বড় গরম পড়েছে, বৃষ্টি না হলে কাউকে যেতে দেওয়া হবে না।” একটু চিন্তিত হইলাম-এতদূর আসিয়াছি, মায়ের নিষেধ ঠেলিয়া কেমন করিয়া যাই। আহারান্তে বিশ্রাম করিলাম। কিছুক্ষণ পরেই মায়ের কৃপায় খুব এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল। পরদিন প্রাতে জয়রামবাটী গিয়া শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিলাম। কুশলাদি জিজ্ঞাসান্তে মা বলিলেন, “বাবা, কাল বেশ বৃষ্টি হয়েছে—আজ বেশ একটু ঠাণ্ডা।” পরলােকগত ভক্তটির কথা তুলিয়া মা বলিলেন, “সাধুর যা মৃত্যু, তা ওর হয়েছে। আমি তাকে এখনাে দেখছি। তবে ওর বুড়ো বাপ আছে, তার জন্যই কষ্ট হয়।” এই বলিয়া মা অশ্রুবিসৰ্জন করিলেন। 

কাশীধাম হইতে ব্রহ্মচারী দেবেন্দ্রনাথ এই সময় জয়রামবাটী উপস্থিত হন। উক্ত ব্রহ্মচারী পূর্ব জন্মের কথা জানিতে পারিয়াছিলেন-বলিতেন। চার পাঁচ বৎসর পূর্বে আমাকে বলিয়াছিলেন, “আমি না - কি পূর্ব জন্মে তাঁহার গুরু ছিলাম।” আমি কিন্তু কিছুই জানি না। তাঁহার এবম্বিধ সকল কথাই পাগলের প্রলাপ বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম। আমরা দুইজন একত্র হইয়া শ্ৰীশ্রীমায়ের নিকট উপস্থিত হইতেই মা আপনা হইতে বলিলেন, “তােমরা দুজন এক জায়গায় ছিলে, আবার ঠিক এক জায়গায় এসেছ।” 

ইহা শুনিয়া দেবেন্দ্র চুপি চুপি আমাকে বলিলেন, “কেমন, আমি যা বলেছিলাম, মায়ের কথায় বুঝলেন তাে যে তা ঠিক ঠিক।” 

আমি - হবে, আমি তাে কিছু জানি না। 

শ্রীশ্রীমায়ের নিকট হইতে বাহিরে আসিয়া দেবেন্দ্র আমাকে বলিলেন, “আমি মার কাছে সন্ন্যাস নিতে এসেছি, কিন্তু যতক্ষণ আপনি মাকে সে বিষয়ে অনুরােধ না করবেন, ততক্ষণ আমার মনােবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। ঠাকুরের ইচ্ছায় আমি এ সময়ে এসেছি। আপনি না বললে হবে না বলেই ঠাকুর আমাকে এ সময়ে উপস্থিত করিয়েছেন। আমি শ্রীশ্রীঠাকুর ও মাকে কাশীতে প্রত্যক্ষ দর্শন করে এসেছি, কথাবার্তাও হয়েছিল-এ সব সত্য কথা।” 

আমি বলিলাম, “আমি সহজে বলবাে না-দেখি কি হয়।” 

দেবেন্দ্র - কিছুতেই হবে না। 

আমরা সাত আট দিন ছিলাম। দেবেন্দ্র ইতােমধ্যে বড়ই উতলা হইয়া পড়িল ; আমারও উহাতে আশ্চর্য বােধ হইল। যাহা হউক, একদিন প্রাতে আমি একাকী শ্রীশ্রীমায়ের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলাম, “মা, তােমাকে একটা কথা বলবাে।” 

মা হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, একটু পরে এস, যখন আমি তরকারি কুটতে বসবে, তখন।” 

কিছুক্ষণ পরে মা তরকারি কুটিতে বসিলেন এবং আমি উপস্থিত হইলে বলিলেন, “তুমি কি বলবে, এখন বল।” 

আমি বলিলাম, “তুমি তাে সবই জান-কাশীতে দেবেন্দ্রকে দেখাও দিয়েছ, ঠাকুর দর্শন দিয়েছেন। এখন তার ইচ্ছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে। সে তাে আর সংসার করবে না - তবে দাও না কেন?' 

শুনিয়া মা একটু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “ও যদি সন্ন্যাস নেয় তবে কি কারো কোন কষ্ট হবে না?” 

আমি - তার বাপ মা কেউ জীবিত নেই। এক বড় ভাই আছে, সে ব্রাহ্ম এবং উপার্জনক্ষম। কারো যে কোন কষ্ট হবে এমন তো দেখি নে। 

মা - আচ্ছা, তবে হবে। কোয়ালপাড়া থেকে নতুন কাপড় গেরুয়া রং-এ ছুপিয়ে আনবে। কালই হবে। 

আমি আসিয়া দেবেন্দ্রকে সব বলিলাম। শুনিয়া দেবেন্দ্রের খুব আনন্দ -  সকল জিনিস যােগাড় করা হইল। 

পরদিন শ্রীশ্রীমায়ের ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুরের মূর্তি সম্মুখে রাখিয়া মা পূজাদি করিলেন এবং দেবেন্দ্রকে গেরুয়া বস্ত্র ও কৌপীন দিয়া বাহিরে যাইয়া পরিয়া আসিতে বলিলেন। আমি তখনাে শ্রীশ্রীমায়ের নিকট বসিয়া। আমার মন্দ ভাগ্যের কথা ভাবিতেছিলাম এমন সময় মা যেন আমার মনের ভাব বুঝিয়াই সস্নেহে বলিলেন, “বাবা, ঠাকুরের প্রসাদী সরবৎ খাবে?” আমি বলিলাম, “হ্যাঁ, মা, দাও।” 

মা সরবৎ লইয়া নিজে একটু পান করিয়া সরবতের গ্লাসটি সযত্নে আমার হাতে দিলেন। আমি শ্রীমায়ের প্রসাদী সরবৎ পান করিয়া ধন্য হইলাম, মনে হইল - ‘এর কাছে আবার সন্ন্যাস কি? এ যে দেবদুর্লভ। এক আশ্চর্য ভাবে হয় পূর্ণ হইল। 

দেবেন্দ্র গেরুয়া কাপড় পরিয়া মাকে প্রণাম করিতে আসিলে মা আমাকে বলিলেন, “দেখছ, যেন আর একটি হয়েছে, সে-মানুষ আর নেই।” 

কালী মামা (শ্রীশ্রীমায়ের মধ্যম ভাতা, ভুদেবের পিতা) আসিয়া আমাকে অনুরােধ করিতে লাগিলেন, আমি যাহাতে ভুদেবের বিবাহে যাই- কিন্তু আমার নিজের ইচ্ছা মায়ের নিকটেই থাকি। ভাব বুঝিয়াই মা বলিলেন, “না, ওর গিয়ে কাজ নেই, ও এখানেই থাকবে।” 

বিবাহােপলক্ষে পাচক ব্রাহ্মণেরা রান্না করিতেছিল। দেবেন্দ্র ও আমি একটু দূরে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলাম। তাহা দেখিয়া মা উহাদের বলিলেন, “এদের গলায় একটা পৈতা নেই - তাই ভাবছ এরা ছােট। আহা, এদের তুল্য কি আছে ?” 

বিবাহে খেলুড়েদের একজন বুকে পাথর ভাঙিয়া খেলা দেখাইয়াছিল। ভাঙিবার সময় মা কেবল বলিতেছিলেন, “ঠাকুর, রক্ষা কর ; ঠাকুর, রক্ষা কর।” পাথর ভাঙা হইয়া গেলে মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, ওরা কি মন্তর টন্তর জানে ?”

আমি - না, মা, মন্তর টন্তর কিছু নয়; এই রকম ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করেছে। আমি একটা গল্প শুনেছি - আমেরিকার কোন সাহেব একটি বাছুরকে প্রত্যহ কোলে করে দূরে গােচারণের মাঠে নিয়ে যেতাে। ক্রমশঃ বাছুরটি বড় হয়ে ষাঁড় হ’ল। তখনও সে কোলে করে নিতে পারতাে, আর সকলকে এই খেলা দেখাতাে। এ সবই অভ্যাসের কাজ। 

মা - বটে, দেখলে অভ্যাসের কত শক্তি। এমনি, জপ অভ্যাস করতে করতে মানুষ সিদ্ধ হয় - জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ।

নাগমহাশয়ের জীবনচরিতে আছে, শ্রীশ্রীমা স্বয়ং প্রসাদ করিয়া নিজ হাতে নাগমহাশয়কে খাওয়াইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি আনন্দে আত্মহারা হইয়া বলিয়াছিলেন, “বাপের চেয়ে মা দয়াল - বাপের চেয়ে মা দয়াল।” ইহা পড়িয়া আমার মনে হইয়াছিল - “মা কি আমাকে তেমনি করিয়া খাওয়াইয়া দিবেন? একথা কিন্তু মাকে বলা হবে না, তিনি নিজে দয়া করিয়া দেন তাে হবে।’

আশ্চর্য, সত্যসত্যই একদিন তিনি আমায় ঐরুপে প্রসাদ খাওয়াইয়া দিলেন। 

এই সময় জয়রামবাটীতে একটি সন্ন্যাসী আসিয়াছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণ মঠের নহেন, কিন্তু দেখিলাম শ্রীশ্রীমায়ের পরিচিত। একদিন সকালে খাইতে বসিয়াছি, উক্ত সন্ন্যাসীও পাশে একটু দূরে বসিয়াছেন। মা আমাকে বললেন, “বাবা, গেরুয়া কি নিলেই হ’ল ? (উক্ত সন্ন্যাসীকে দেখাইয়া) ঐ দেখনা গেরুয়া নিয়েছে।” 

আমাকে বলিলেন, “তােমার এমনিই সব হবে। গেরুয়ার দরকার কি?” 

শ্রীশ্রীমায়ের জন্য একজোড়া কাপড় লইয়া গিয়াছিলাম। মাকে বলিলাম, “মা, শুনেছি তুমি কাপড় সকলকে বিলিয়ে দাও। তুমি যদি নিজে কাপড় দুখানি পর, তবে আমার খুব আনন্দ হয়।” শুনিয়া মা কিছু বলিলেন না একটু হাসিলেন। পরদিন আমি যাইতেই বলিলেন, “এই দেখ, বাবা, তুমি যে কাপড় এনেছে তা পরেছি।” 

আমার প্রার্থনায় শ্রীশ্রীমা আমাকে তাঁহার ব্যবহৃত একখানি কাপড় দিয়া বলিয়াছিলেন, “বড় ময়লা, তুমি ধুইয়ে নিও।” 

আমি বলিলাম, “না, মা তুমি যেমনটি দিয়েছ, ঠিক তেমনি রাখতে ইচ্ছা, ধােপার ঘরে দেওয়া হবে না।” 

মা — আচ্ছা, সেই ভাল। 

একদিন মা খাইতে বসিয়াছেন। আমি ও দেবেন্দ্র এমন সময় সেখানে উপস্থিত হইলাম। মা বলিলেন, “প্রসাদ নেবে?” আমরা উভয়ে হাত পাতিলাম। নিজমুখে একটু দিয়া আমাদের হাতে প্রসাদ দিলেন। হাত হইতে পড়িয়া যায় দেখিয়া নিজেই বেশ করিয়া চাপিয়া দিলেন। মায়ের ব্রাহ্মণ শরীর, আমি কায়স্থ - কোন বর্ণবিচার নাই, আমার হাতে দিলেন। পরে নিজে খাইতে আরম্ভ করিলেন। আমাদের দেখিতেন - ঠিক যেন নিজের ছেলে। 

শ্রীশ্রীমাকে যখনই দর্শন করিতে যাইতাম, কিছু ফল কি অন্য জিনিস যাহা সুবিধা হইত লইয়া যাইতাম। আমি শুনিয়াছিলাম যে, মা সকলের জিনিস ঠাকুরকে দিতে পারেন না। এ জন্য অনেক সময় মনে ভয় করত--কি জানি, আমরা তাে ভাল মানুষ নই, মা গ্রহণ করতে পারেন কি - না, কে জানে। মা , কিন্তু প্রায়ই বলতেন, “বাবা তুমি যে অমুক জিনিস এনেছিলে, ঠাকুরকে দিয়েছি, বেশ জিনিস, বেশ মিষ্টি - আমি খেয়েছি।” 

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, ভগবানের নাম করলেও কি প্রারব্ধ ক্ষয় হয় না?” 

মা বলিলেন, “প্রারব্ধের ভােগ ভুগতেই হয়। তবে ভগবানের নাম করলে এই হয় - যেমন একজনের পা কেটে যাবার কথা ছিল, সেখানে একটা কাঁটা ফুটে ভােগ হল।” 

মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, সাধন-ভজন তাে কিছুই করতে পারি না, আর কখনও যে কিছু করতে পারবাে এমনও মনে হয় না।” 

মা ভরসা দিয়া বলিলেন, “কি আর করবে, যা করছ তাই করে যাও। মনে রাখবে, তােমাদের পেছনে ঠাকুর আছেন—আমি আছি।” 

রাধু একদিন অসুখে একটু ছটফট করিতেছিল। মা বলিলেন, “দেখ তাে, বাবা, ওর কি হয়েছে ?” আমার কোন নাড়ী-জ্ঞান নাই, তবু মাকে আশ্বস্ত করিবার জন্য আমি রাধুর নাড়ী টিপিয়া বলিলাম, “বিশেষ কিছু নয়, একটু দুর্বল হয়েছে। একটু দুধ খাইয়ে দাও।” মায়ের ছেলেমানুষের মতাে স্বভাব - তখনই দুধ খাওয়াইতে বসিলেন। একটু পরে রাধুর মা আসিয়া রাধুর নিকটে বসিলেন। তাহাতে রাধু বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিল, কারণ তাহার ইচ্ছা নয় যে তাহার গর্ভধারিণী নিকটে থাকেন। মা রাধুর মাকে একটু সরাইয়া দিবার ইচ্ছায় হাত দিয়া ঠেলিয়া বলিলেন, “তুমি এখন যাও না।” উহাতে হঠাৎ শ্রীশ্রীমায়ের হাত ধরে মায়ের পায়ে ঠেকিয়া দাওয়াতে তিনি অত্যন্ত অস্থির হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “কেন তুমি আমার পায়ে হাত দিলে ? আমার কি হবে গাে।” তাঁহার ঐ ভাব দেখিয়া মায়ের হাসি আর থামে না। রাসবিহারীদাদা নিকটে ছিলেন ; বলিলেন, “মা, দেখেছ, এদিকে পাগলী তােমাকে এত গালাগাল করে, মারতে আসে, কিন্তু তােমার হাত তার পায়ে লেগেছে বলে তাে খুব ভয়।” 


মা বলিলেন, “বাবা, রাবণ কি জানতাে না যে রাম পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ, সীতা আদ্যাশক্তি জগন্মাতা - তবুও ঐ করতে এসেছিল। ও (পাগলী) কি আমাকে জানে না। সব জানে, তবু এই করতে এসেছে।”

মায়ের পায়ের বাতের ব্যথার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলাম, “মা, শুনতে পাই ভক্তদের পাপ গ্রহণ করেই তােমার এই ব্যাধি। আমার একটি আন্তরিক নিবেদন -- তুমি আমার জন্যে ভুগাে না; আমার কমের ভােগ আমার দ্বারাই ভােগ করিয়ে নাও।” 

মা - সে কি বাবা, সে কি বাবা, তােমরা ভাল থাক, আমিই ভুগি। 

আহা। সে সময়ে মায়ের কি এক অপূর্ব করুণামূর্তিই দেখিলাম ।

জয়রামবাটী হইতে রওনা হইবার সময় মাকে গিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি আমার মাথায় জপ করিয়া দিলেন এবং স্নেহভরে বলিলেন, “আহা! এদের ইচ্ছে আমার কাছে থাকে, কিন্তু কি করবে সংসারের অনেক কাজ করতে হয়।” 

ছেলে বিদেশে যাইবার সময় মায়ের মতাে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কিছুদূর আসিলেন এবং সজলনয়নে চাহিয়া রহিলেন। 

* ৺দ্বারকানাথ মজুমদার

একবার আমি তিন সপ্তাহ কলিকাতায় থাকি। বাগবাজারে শ্রীশ্রীমায়ের বাটীতে গিয়া তাঁহাকে দর্শন ও প্রণামানন্তর বলিয়াছিলাম, “মা, কিছুদিন কলকাতায় থাকবে। এখানে তােমাকে দান করবার নিয়ম হয়েছে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন। যদি অনুমতি কর, তবে মাঝে মাঝে আসবাে।” 

মা - আসবে বৈকি। যখন সুবিধা হয় আসবে, আমাকে সংবাদ দেবে।

একদিন গিয়া বলিলাম, “মা আমার তাে শান্তি হয় না। মন সর্বদা চঞ্চল --- কাম যায় না।” এই কথা শুনিয়া মা একদৃষ্টে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন, কিছুই বললেন না। মায়ের মুখ দেখিয়া আমার আত্মগ্লানি আসিল - কেন মাকে ইহা বলিতে গেলাম। তাঁহার পদধুলি লইয়া শ্ৰীযুক্ত মাস্টার মহাশয়ের বাড়ি গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে উপস্থিত হইলাম। মাস্টার মহাশয়ের পদধুলি গ্ৰহণ করিয়া বলিলাম, “আপনি ঠাকুরের অনেক পদসেবা করেছেন, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন--মাথাটা গরম।” 

তিনি বলিলেন, “সে কি ? আপনি মায়ের ছেলে, মা আপনাকে খুব স্নেহ করেন। আপনি আমার নিকট কিসের কাঙাল ? মা কি আপনাকে চেয়ে দেখেন নাই?” 

আমি - হ্যাঁ, অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে দেখেছেন। 

মাস্টার মহাশয় - তবে আর কি? ‘সদানন্দসুখে ভাসে শ্যামা যদি ফিরে চায়।’

তিনবার খুব আবেগের সহিত তিনি এই কথাটি বলিলেন। মায়ের অনেকক্ষণ চাহিয়া দেখিবার অর্থ বুঝিলাম। আমি শান্ত হইলাম। মনে হইল— মা যেন তাঁহার কৃপাদৃষ্টির অর্থ বুঝাইতেই মাস্টার মহাশয়ের নিকট আমায় পাঠাইয়াছেন।

একদিন ভােরে আমার পরিবার ও একটি মেয়েকে শ্রীশ্রীমায়ের নিকট লইয়া গিয়া বলিলাম, “মা, ওরা তো সর্বদা আসতে পারে না। এরা আজ সারাদিন 'তােমার এখানে থাকবে, আমি বিকেল এসে নিয়ে যাব।” 

মা - আচ্ছা, বেশ তাে।

আমার স্ত্রীর কপালে সিঁদুর ছিল না; স্ত্রী-ভক্তদের মধ্যে কে একজন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “হ্যাঁ গা, তােমার কপালে সিঁদুর নেই কেন ?” ঐ কথা শুনিয়া মা বলিয়াছিলেন, “তা আর কি হয়েছে? ওর এমন স্বামী সঙ্গে, নাই বা পয়েছে।” এই বলিয়া মা স্বয়ং তাহার কপালে সিঁদুর পরাইয়া দিলেন। 

আমার স্ত্রীর মনে হইয়াছিল  - ‘মা যদি অনুমতি করেন তবে পদসেবা করি।’ মা কিছুক্ষণ পরে তাহাকে বলিলেন, “এস, বৌমা, আমার গায়ে মাথায় তেল মাখিয়ে দাও।” তেল মাখাইয়া চিরুনি দিয়া চুল আঁচড়াইয়া দিতে দিতে তাহার ইচ্ছা হইয়াছিল, ‘যদি এই চুল কিছু নিতে অনুমতি দেন তাে নিই’। মা ঈষৎ হাসিয়া নিজেই বলিলেন, “এই নাও, মা।” তারপর চিরুনির গাত্রসংলগ্ন চুল ছাড়াইয়া তাহার হাতে দিলেন। 

একটি স্ত্রী-ভক্ত জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এই বৌটি কে, মা?” 

মা - রাঁচিতে সুরেন থাকে, তার বউ। ঠাকুরের উপর সুরেনের অগাধ বিশ্বাস। 

সেদিন মা তাহাকে সঙ্গে লইয়া গঙ্গাস্নানে যান। আমরা যে কাপড় গামছা মায়ের জন্য লইয়া গিয়াছিলাম, ব্রহ্মচারিগণ তাহা অনেকগুলি নূতন কাপড়ের মধ্যে রাখিয়া দিয়াছিলেন। মা কিন্তু উহার ভিতর হইতে আমাদের দেওয়া কাপড় ও গামছা লইয়া স্নান করিতে গেলেন। গঙ্গাস্নান করিয়া ঘাটের ব্রাহ্মণকে মা একটি পয়সা দিয়া বলিলেন, “বৌমাকে চন্দন পরিয়ে দাও।” আহারের সময় নিজ পাত হইতে তাহাকে প্রসাদ দেন এবং আহারান্তে বিশ্রামের সময় পদসেবা করিতে বলেন। আমার মেয়েটি একখানি কম্বলে শুইয়া তাহা নােংরা করিয়াছিল। আমার স্ত্রী তাহা ধুইয়া দিতে উদ্যত হইলে মা তাহার হাত হইতে উহা কাড়িয়া লইয়া নিজেই ধুইয়া আনিলেন। পরিবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মা তুমি কেন ধােবে?” মা উত্তর করিয়াছিলেন, “কেন ধোব না, ও কি আমার পর ?” 

বৈকালে আমি ‘উদ্বোধন’ অফিসে গিয়া দেখি একমাত্র উপেনবাবু রহিয়াছেন। শুনিলাম - অন্য সকলে বিবেকানন্দ সােসাইটির উৎসবে গিয়াছেন। আমি নিজেই উপরে উঠিয়া মাকে প্রণাম করিতে তিনি বলিলেন, “দেখ, আজ ছেলেরা কেউ নেই, ভক্তদের দর্শনের দিন। তুমি আজ সকলকে ডেকে আনবে, প্রসাদ দেবে।” কিছুক্ষণ পরে আমি ভক্তদের ডাকিয়া আনিলাম ও প্রণামান্তে প্রসাদ বিতরণ করিলাম। ক্রমশ ভক্তগণ চলিয়া গেলেন। 

মা বলিলেন, “আজ তুমি আমার ঘরের ছেলেটি হয়েছ - সকলকে ডেকে আনলে, প্রসাদ দিলে।” 

আমি - কেন, আমি কি তােমার ঘরের ছেলে নই ? 

মা - হ্যাঁ, তা বই কি - তুমি আমার আপনার ছেলে। 

এই বলিয়া আমার পরিবারকে বলিলেন, “হ্যাঁ, মা, সকলেই আমার ছেলে, তবে কারাে কারাে সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক। ওর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক। দেখছ না সর্বদা যায় আসে, খুব আপনার।” 

তারপর আমাদিগকে প্রসাদ ও পান দিয়া মা আমার চিবুক ধরিয়া সন্দেহে বলিলেন, “আর ভয় কি ? খুব সহজ হয়ে গেছ তাে ? তােমাদের এই-ই শেষ জন্ম।” 

আমি বলিলাম, “সহজ বই কি? তােমার কৃপা হলেই সব সহজ।” 

আমার স্ত্রী শ্রীশ্রীমায়ের জন্য একখানি আসন তৈয়ারী করিয়া লইয়া গিয়া ছিল। তাহা পাইয়া মায়ের খুব আনন্দ। সকলকে দেখান আর বলেন, “আহা! দেখ, বাঁমা কেমন সুন্দর আসন তৈরী করেছে।” ভক্তের একটি সামান্য জিনিস পাইয়াই তাঁহার এই আনন্দ! 

আর একবার অপর চারিজন ভক্তসহ জয়রামবাটী গিয়াছিলাম। কোয়ালপাড়া মঠ হইতে এমন সময় রওনা হই যে বেলা থাকিতেই শ্রীশ্রীমায়ের বাড়ি পৌঁছিবার কথা। সঙ্গে ঐদেশী একটি কুলিও ছিল। আমার জানা রাস্তা, কিন্তু মায়ের বাড়ির নিকটে গিয়া পথ ভুল হইয়া গেল। কিছুতেই আর পথ খুঁজিয়া পাই না। ঐদেশী লােকটিরও গােলমাল হইয়া গিয়াছে। ক্রমে রাত্রি হইল। সঙ্গীরা প্রমাদ গণিলেন। তখন আমরা সকলেই ক্লান্ত। কি করি - এক বাঁশবনের ভিতরে আমি কম্বল পাতিয়া বসিয়া পড়িলাম। মায়ের উপর বড় অভিমান হইল - ‘মা, আমরাই শুধু, তােমাকে খুঁজবো, আর তুমি কিছুই দেখবে না।’ এমন সময় দেখি, একটি আলাে সইয়া রাসবিহারীদাদা ও হেমেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত। এই রাত্তিরে এ পথে তাঁহাদের আগমনে বিস্মিত হইলাম। তাহারা বলিলেন, আমরা এ দিকে আসবাে - কোন কথাই ছিল না। ভাগ্যে এ পথে এসে পড়েছি।” শ্রীশ্রীমাকে দর্শন ও প্রণাম করিবার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ, বাবা, তােমরা বুঝি খুব ঘুরেছ?” 

আমি - হ্যাঁ, মা, পথ ভুল হয়েছিল। 

তখন শ্রীশ্রীমায়ের জন্য নূতন বাড়ি হইতেছিল। পূর্বোক্ত ব্রক্ষচারিদ্বয় ঐ কাজে খুব ব্যস্ত থাকিতেন। শ্রীহট্ট হইতে দুইটি ভক্ত আসিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একটি পূর্বে (অরুণাচলের) দয়ানন্দ স্বামীর ভক্ত ছিলেন। তিনি ইহাকে প্রহলাদের অবতার বলিয়া নিজ ভক্তগণ মধ্যে প্রচার করিতেন। আমি উক্ত ভক্ত দুইটিকে শ্রীশ্রীমায়ের নিকট লইয়া যাই। তাঁহার প্রণাম করিলে আমি বলিলাম, “মা, অরুণাচলে দয়ানন্দ নামে এক সাধু নিজেকে অবতার বলেন, এটি তাঁরই ভক্ত ছিল। তিনি বলিতেন - এ প্রহলাদ।” মা হাসিয়া উত্তর করিলেন, “অবতারই বটে!” 

এবার মা এই ভক্ত দুটিকে দীক্ষা দিয়াছিলেন। 

আমি আর একজন সাধুর নাম করিয়া বলিলাম যে, তিনিও অনেক লােককে দীক্ষা দিতেছেন। মা বলিলেন, “এ সব অনেকটা ব্যবসাদার সাধু। তবে কি জান, এতেও উপকার হবে। মানুষ তাে কিছু করে না, এদের কথাতেও কিছু, কিছু ভগবানের নাম করবে।” 

“আন্তরিক হলে শেষটা কমে এখানেই এসে পড়বে। দেখছ না এখন তারকব্রহ্ম নামের ছড়াছড়ি। একটু সার থাকলে কেউ বড় বাদ যাবে না।” 

আমাদের সঙ্গী ভক্ত চারটিকে মা দীক্ষা দিয়াছিলেন। তন্মধ্যে একটি ছেলে মানুষ ভক্তকে মা দীক্ষান্তে বলিয়াছিলেন, “একশ আট বার জপ করবে।” তাহাতে সে সন্তুষ্ট হয় নাই। তাহার ইচ্ছা হাজার লক্ষ বার জপ করে। মা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, এখন মনে করছ বটে -- সে তাে তােমরা পারবে না, কত কাজ তােমাদের করতে হয়। বেশী পার ভালই। 

মাকে পূজা করিবার জন্য একদিন কিছু পদ্মফুল সংগ্রহ করিয়া আনিলাম। মা বলিলেন, “কয়েকটি সিংহবাহিনীকে দিয়ে এস, আর কিছু রেখে যাও।” 

একটি ভক্ত বলিলেন, “সব ফুল আপনার পায়ে দিয়ে পুজো করবাে।” 

মা - আচ্ছা, সে হবে। এইতাে আমার পা, তার আবার পুজো। 

মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, ঠাকুর বলতেন—’শুদ্ধা ভক্তি সকলের সার।’ আমাকে আশীর্বাদ কর যেন তাই লাভ হয়।” নিকটে আরও কয়েকজন ভক্ত ছিলেন; মা চুপ করিয়া রহিলেন। ক্রমে সকলে চলিয়া গেলে মা আমাকে একান্তে বলিলেন, “ও কি সকলেরই হয় গা? তবে তােমার হবে।” 

মা রাধুকে বলিয়াছিলেন, “রাধু তাের দাদা এসেছে, প্রণাম কর।” আমি ভাবিলাম-সে কি ? আমি যে কায়স্থ। সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল-মা তাে আর আমার অমঙ্গল করবেন না। তখন উভয়েই উভয়কে প্রণাম করিলাম। 

একদিন পান্তাভাত খাইতে ইচ্ছা হওয়ায় মায়ের কাছে গিয়া চাহিলাম। মা বলিলেন, “দাঁড়াও, আমি লঙ্কা মরিচ আর বড়া ভেজে দিই। তােমাদের দেশে খব লঙ্কা ভালবাসে!” গ্রামােফোনের অনুকরণে - “অষ্ট গড়ার একটাও কম দিমু না” বলিয়া মা খুব হাসিতে লাগিলেন। 

জয়রামবাটীতে অন্য একদিন মা বলিয়াছিলেন, “বাবা, সারাদিন যেন কুস্তি করছি, এই ভক্ত আসছে তো এই ভক্ত আসছে। এ শরীরে আর বয় না। ঠাকুরকে বলে ‘রাধু রাধু’ করে মনটা রেখেছি।” আমার মনে হইল - ঠাকুর যেমন ‘জল খাব, তামাক খাব’ বলিয়া মনকে বাহ্য জগতে একটু নামাইয়া রাখিতেন, একি তাই ? এত কষ্ট সহ্য করিয়া মা বহুজনহিতায় শরীর রাখিতেছেন ? 

বিদায় গ্রহণের সময় বলিলাম, “মা, আমার মতাে তােমার লাখ লাখ ছেলে আছে, কিন্তু তােমার মতো মা আর আমার নেই।” এই কথা শুনিয়া মা সজল নয়নে সন্দেহে আমার চিবুকে হাত দিয়া চুম্বন করিলেন। 

একবার শ্রীশ্রীমায়ের অসুখের পর হাওয়া-পরিবর্তনের জন্য তাহাকে রাঁচি আনিবার প্রস্তাব করিতে আমি জয়রামবাটী গিয়াছিলাম। তখন চৈত্র মাস। প্রস্তাব শুনিয়া মা বলিলেন, “চৈত্র মাসে কোথাও যেতে নেই। তারপর শরৎ* নিতে এসে এতদিন থেকে গেল, কলকাতায় না গিয়ে আর কোথাও কি করে যাই?” 

সেই সময় স্বামী কেশবানন্দের একটি ভগ্নী মারা যান। আমি মাকে বলিয়া ছিলাম, “মা, বুড়াে বয়সে স্বামী কেশবানন্দের মা একটা শােক পেলেন-বড়ই দুঃখের কথা।”

মা বলিলেন, “শোকে তার কিছু করতে পারবে না।” 

মায়ের কথা শুনিয়া ফিরিবার পথে কোয়ালপাড়ায় আমি তাহাকে দর্শন করিতে গিয়া দেখিলাম - তাঁহার শােকের নামগন্ধও নাই, সেই সদা হাস্যমুখে। ভাবিলাম --’স্বয়ং বশিষ্ঠ ঋষির শােক হয়েছিল, এ ঘরের যেন সবই নূতন। 

*স্বামী সারদানন্দ 

উদ্বোধনের বাটীতে একবার শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাই। মাকে প্রণাম করিবার পর মা করজোড়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করিলেন, “ঠাকুর, এদের সকল বাসনা পূর্ণ কর।” 

আমি বলিলাম, “সে কি, মা, সকল বাসনা পূর্ণ করলে তাে উপায় নেই। মনে যে কত কু-বাসনা রয়েছে।” 

মা হাসিয়া বলিলেন, “তােমাদের সে ভয় নেই। তােমাদের যা দরকার, যাতে ভাল হয়, ঠাকুর তাই দেবেন। তােমরা যা করছ করে যাও। ভয় কি ? আমরা তো রয়েছি।” 

জয়রামবাটীতে একদিন রাত্রি প্রায় ভােরের সময় বহির্বাটীতে এবটি গাে-বৎস বড়ই চীৎকার করিতেছিল। দুধের জন্য তাহাকে তাহার মায়ের নিকট হইতে দূরে বাঁধিয়া রাখা হইয়াছিল। চীৎকার শুনিয়া মা এই বলিতে বলিতে ছুটিয়া আসিলেন—“যাই মা, যাই, আমি এক্ষুণি তােকে ছেড়ে দেবাে, এক্ষুণি ছেড়ে দেবাে।” আসিয়াই গাে-বংসের বন্ধন মত্ত করিয়া দিলেন। আমি অবাক হইয়া জগন্মাতার সর্বভুতে করুণাময়ী মূর্তি দেখিলাম। হায়! এমনি করিয়া ডাকিতে পারিলেই তাে বন্ধন মুক্ত হয়। 

শ্রীশ্রীমায়ের অপার স্নেহ, অসীম করুণা এবং অনন্ত দয়ার কথা লিখিয়া বুঝাইবার ভাষা নাই। আমরা তাঁহার শ্রীপাদপদ্ম দর্শন, স্পর্শন ও কৃপালাভ করিয়া ধন্য হইয়াছি - কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা । শত শত ভক্ত সেই পরশমণি স্পর্শে সােনা হইয়াছেন। 


~শ্রীসুরেন্দ্রনাথ সরকার 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত অজ্ঞাত মহিলা 

১৫ই পৌষ, মঙ্গলবার, শুক্লপক্ষ, তৃতীয়া তিথি 
সন ১৩২০ সাল 

কয়েক দিন যাবৎ শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে দেখিবার জন্য মনটা বড়ই ব্যাকুল হইয়াছে; কিন্তু দেখিতে যাইবার কোন উপায় নাই, কাহাকে লইয়া যাই। মা যদি অধম সন্তানকে দয়া করিয়া দর্শন দেন তবেই দেখিব—এইরূপ বসিয়া ভাবিতেছি এমন সময় কমলা ও বিমলা আসিয়া বলিল, “দিদি, তােমায় মা ডাকছেন।” এই কথা শুনিয়া আমার মনে হইল - অভিষ্টসিন্ধির বুঝি একটি পন্থা বাহির হইবে। কে যেন কানে কানে বলিয়া দিল - “ওরে, মা ডেকেছেন।”

আমি শীঘ্র প্রস্তুত হইয়া বিমলাদের বাড়ি গেলাম, তখন সকাল ৭টা হইবে। গিয়া দেখি ললিত ও তাহার মা বসিয়া কথা বলিতেছেন ; আমাকে দেখিয়াই ললিতের মা বলিয়া উঠিলেন, “এই তাে বিনু এসেছে, মেয়ে আমার কি পাগল দেখ, অমনি ছুটে এসেছে।”

ললিত বলিল, “দিদি, আপনি নাকি শ্রীশ্রীমাকে দেখতে চেয়েছেন? যান তাে আমি আজ নিয়ে যেতে পারি।”

আমি - সে তােমার অনুগ্রহ।

ললিতের মা বলিলেন, “সে কি গাে? ছােট ভাইকে অনুগ্রহ বলতে আছে।” 

আমি বলিলাম, “তবে আর কি বলি বলুন, যদি ওদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর না করবাে তবে তাে আমি অনেক আগেই মাকে দেখতে যেতে পারতুম।” 

এই আনন্দ সংবাদ - সত্যিই মাকে দেখিতে যাইব, সহসা যেন বিশ্বাস করিতে পারিলাম না, তাই ললিতকে বলিলাম, “ভাই, সত্যি বল যাবে কি - না? যদি যাও তাে গাড়ি নিয়ে এস।” এই সময় আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভাই, মাকে তুমি দেখেছ?” আমার এই কথায় ললিত আনন্দিত হইয়া বলিতে লাগিল, “দিদি, আমি মাকে একবার দেখতে গিয়েছিলুম। আহা! মায়ের কি দয়া, অপূর্ব স্নেহ, দিদি তােমায় কি বলবাে। মা আবার আমায় যেতে বলেছেন।”

ললিত গাড়ি আনিতে চলিয়া গেল; যাইবার সময় বলিয়া গেল, “আমি গাড়ি আনতে যাচ্ছি, তােমরা প্রস্তুত হয়ে থেকো।” 

আমি, ললিতের মা ও তাহার ভগ্নীগণ শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিবার জন্য যাত্রা করিলাম। আমার সঙ্গে পাঁচুও গেল। 

পারুল বলিল, “দিদি, তুমি সত্যি জান তাে মা বাগবাজারে আছেন?” আমি তাহার এই কথা শুনিয়া চমকিত হইলাম - মা আছেন কি-না তাতে ঠিক জানি না। প্রাণ শঙ্কিত হইয়া উঠিল; মনে মনে ঠাকুরকে বলিতে লাগিলাম, হে ঠাকুর, আমায় নিরাশ কোরাে না। বেলা ১০টার সময় গাড়ি ‘উদ্বোধন’ অফিসের সম্মুখে আসিয়া লাগিল। গাড়ি থামিতেই আমি দ্রুত নামিয়া গেলাম। সম্মুখে ‘উদ্বোধন’ অফিস ; মহারাজগণ কাজ করিতেছেন, সেদিকে আমার ভ্রূক্ষেপ নাই। আমার তখন জগৎ শুন্যময় বােধ হইতেছে! যদি এখনই শুনি মা এখানে নাই, তবে আমি কি করিব—ভাবিয়া যেন জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। সম্মুখে যাহাকে দেখিতেছি তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিতেছি, “মা আছেন?” আমার কথা শুনিয়া মহারাজগণ মস্তক অবনত করিয়া চলিয়া যাইতেছেন, কেহ কোনও উত্তর দিতেছেন না। ইতােমধ্যে ললিত গাড়ি হইতে নামিয়া উপরে চলিয়া গেল দেখিয়া আমিও উহার পিছনে খানিক দূর গিয়াছি, এমন সময় ললিত ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “মা আছেন। আমার প্রাণের ভিতর হইতে একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তা সরিয়া গেল, আমি তখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। সম্মুখের ঘর ডান দিকে রাখিয়া আমি বাঁদিকের বারাণ্ডা দিয়া চলিলাম। সম্মুখে দেখিলাম—একটি স্ত্রীলােক অর্ধাবগুন্ঠনে দাঁড়াইয়া আছেন। দুই-তিনটি পুরুষ-ভক্ত তাঁহাকে প্রণাম করিতেছেন দেখিয়া আমি বুঝিলাম ইনিই শ্রীশ্রীমা, যাহাকে দেখিবার জন্য আমি উন্মত্ত হইয়া ছুটিয়া আসিয়াছি। আমি যে তখন কি করিয়াছি মনে নাই। আমাকে দেখিয়াই ভক্তগণ চলিয়া গেলেন। আমি ছুটিয়া গিয়া মায়ের পা দুটি ধরিয়া বসিয়া পড়িলাম।

মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথা হতে এসেছ, কেন এসেছ ?” 

আমি - কেন এসেছি তা জানি না, মা। মা, আপনি এনেছেন তাই এসেছি।

এমন সময় ললিতের মা প্রভৃতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন; খানিক দাঁড়াইয়া বলিলেন, “ইনিই কি শ্রীশ্রীমা ?” 

আমি - হ্যাঁ। 

তখন সকলেই তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। এবার শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের পূজার ঘরে উপস্থিত হইলেন, আমরাও তাঁহার সঙ্গে গিয়া ঠাকুর-প্রণাম করিলাম। মা  সম্মুখে তক্তাপোশে উপর বসিয়া আমাদের বলিলেন, “বস, মা, বস।” আমরা তাঁহার পদতলে বসিলাম। ললিতের মা সংসার লােক, মা তাঁহার সহিত সংসারীর ন্যায় কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন। 

ললিতের মা বলিলেন, “মা, ঠাকুরের কথা আমাদের কিছু বলুন, আমরা সংসারী লোক, আমাদের কিছু উপদেশ দিন।” 

মা - আমি কিছুই জানি না, মা, ঠাকুরের মুখে শুনেছি; তা মা, ঠাকুরের ‘কথামৃত’ পড়ো, তাতেই সব উপদেশ পাবে। 

নীচে গাড়িভাড়া মিটাইয়া ললিত উপরে আসিয়াই একেবারে মায়ের শ্রীচরণে মাথা রাখিয়া সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া পড়িল এবং নিতান্ত আর্তস্বরে দর্শকবৃন্দকে আকুলিত করিয়া অজস্র অশ্রুধারায় ভাসিয়া মায়ের চরণে প্রার্থনা জানাইতে লাগিল, “মা দয়াময়ি গাে, দয়া করুন। মাগাে, আপনি এই জগৎ উদ্ধার করতে এসেছেন, আমাকেও টেনে নিন, মা। আমি আপনার চরণ ছাড়ব না, আমাকে পায়ে স্থান দিতেই হবে।” এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিল। মা স্থির নিশ্চল প্রতিমার ন্যায় দাঁড়াইয়া আছেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, “অমন কোরাে না, বাবা, ওঠ।” 

ললিত পনের-ষােল বৎসরের বালক মাত্র। বালকের ছদ্মবেশে আবরিত মহাশক্তি এখন বিকাশােদ্মুখ। দিব্য শ্যামবর্ণ সুগঠন চেহারা, ভিতরে ভাগব ভক্তি রূপ সুধাস্রোত যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ, বাহিরেও সেই অনুরাগ প্রতিভাত হইতেছে। “আমায় শ্রীচরণে স্থান দিন, মা। বলুন, না হলে আমি উঠবাে না, বলুন আমায় নিয়েছেন” - বলিয়া ললিত আবার কাঁদিতে লাগিল। এমন সময় সহসা একটি ঘিয়ের ভাঁড়ে পা ঠেকিয়া যাওয়ায় সে অপ্রস্তুত হইয়া উঠিয়া বসিল এবং বলিতে লাগিল, “আমি এ কি করলাম, কেউ ভক্তি করে মাকে ঘি দিয়েছে, আমার তাতে পা লেগে গেল, ছি! ছি! আমি এ কি করেছি।” ইহা বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল। সেই সময় ঠাকুরঘরে মস্তকের উর্ধ্বভাগে চুল বাঁধিয়া এক গৌরবর্ণা বিধবা বৃদ্ধা ঠাকুরের সেবাকার্যে নিবিষ্টা ছিলেন। তিনি বলিলেন, “বাবা, তুমি মনে দুঃখ করাে না, পা লেগেছে তা আর কি করবে? পা তাে আর সৃষ্টিছাড়া নয়, এ সৃষ্টির ভিতরে পা দুটোও যে আছে, পা শরীরেরই একটা অংশ।” আমরা তাহার দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহার সৌম্য মুখমণ্ডল ও সরল উদার কথাগুলি আমাদের বড়ই ভাল লাগিল। ললিত তাহার কথায় যেন অনেকটা সান্ত্বনা লাভ করিল এবং প্রকৃতিস্থ হইয়া মাকে প্রণাম করিয়া বলিল, “মা, আমায় আশীর্বাদ করুন।” “ঠাকুর তােমায় আশীর্বাদ করবেন” বলিয়া মা তাহার মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন। তারপর ললিত নীচে চলিয়া গেল। 

একটি ষােল-সতের বছরের মেয়ের হাত ধরিয়া একটি প্রৌঢ়বয়স্ক ভদ্রলােক এই সময়ে দরজার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং মাকে বলিলেন, “মা, এটি আমার মেয়ে। এর একটি মেয়ে হয়েছিল, আজ সকালে সেটি মারা গিয়েছে। এ বড়ই শােকাবিহুলা, তাই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি, সান্ত্বনা পাবে বলে।” ইহা শুনিয়া আমরা সকলে চমকিত হইয়া উঠিলাম। মা বলিলেন, “এস, মা, এস।” মেয়েটি ঘরের মধ্যে আসিয়া মায়ের কাছে বসিল এবং পদধুলি লইবার জন্য হাত বাড়াইল। মা ঈষৎ সরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হ্যাঁ, গা, আমায় ছোঁবে কি ? এর যে অশৌচ হয়েছে।” এই কথা শুনিয়া মেয়েটির মুখখানি আরও মলিন হইয়া গেল, সে সঙ্কুচিত হইয়া বসিয়া রহিল। মা তাহার মুখপানে চাহিয়াই সকরুণ হইয়া বলিলেন, “আহা, বাছা! বড় ব্যথা পেয়ে আমার কাছে এসেছ সান্ত্বনা পাবে বলে। আমি তােমার মনে কি কষ্ট দিলুম! তা হােক অশৌচ ; এস, মা, আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কর।” এই বলিয়া মেয়েটির আরও কাছে সরিয়া বসিলেন। সে তখন অশ্রুজলে ভাসিয়া মায়ের শ্রীচরণে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল; মাও তাহার মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন। মা মেয়েটির কাছে বসিয়া মিষ্টবাক্যে তাহাকে প্রবােধ দিতে লাগিলেন - “আমি তােমায় কি বলবাে, মা, আমি তাে কিছুই জানি না। ঠাকুরের একখানি ছবি নিজের কাছে রেখাে, আর জানবে তিনি সত্য - ঠাকুর তােমার কাছে রয়েছেন। তাঁর কাছে কেঁদে কেঁদে মনের দুঃখ জানাবে, ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে বলো - ঠাকুর, আমায় তােমার দিকে নাও, আমায় শাস্তি দাও। এ রকম করতে করতে তােমার প্রাণে শান্তি আপনি আসবে। ঠাকুরে ভক্তি রেখাে, যখনই কষ্ট হবে, ঠাকুরকে জানিয়ে।” তারপর আমাদের দিকে চাহিয়া মা বলিলেন, “আহা! আজই শােক পেয়েছে। আজ কি স্থির হতে পারে ?” মেয়েটির পিতা স্বারদেশে দাঁড়াইয়াছিলেন ; পিতাপুত্রী উভয়ে মাকে প্রণামপূর্বক দুঃখ নিবেদন করিয়া শান্ত হইয়া চলিয়া গেলেন। 

এখন ঘর নীরব দেখিয়া আমি বলিলাম, “মা, আমার একটি কথা আছে। যদি আপনি অনুমতি করেন তবে বলি।” আমাকে ইতস্ততঃ করতে দেখিয়া সেই সেবানিরতা সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধাটি (পরে জানিলাম তিনি পূজনীয়া গােলাপ - মা) বলিলেন, “বল, মা, বল, তােমার মনের কথা নিঃসঙ্কোচে মায়ের কাছে বল, মার কাছে লজ্জা কি!” তখন আমি বলিলাম, “মা, কথা আর কিছু নয় আমি স্বপ্নে ঠাকুরকে ও আপনাকে দেখেছিলুম, যেন আপনি আমার মন্ত্র দিচ্ছেন, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। সেই থেকে আপনার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় নেবার জন্যে আমি বড় ব্যাকুল হয়েছি।” 

মা প্রসন্নমুখে বলিলেন, “বেশ তাে, আজই তােমায় দীক্ষা দেব, কিন্তু তোমার স্বামীর মত আছে তাে?” 

আমি - আমার স্বামীকে আমি একথা বলেছিলাম, তিনি বলেছেন, ‘আমার অমত নেই, আমি এখন দীক্ষা নেব না, তুমি নিতে পার।’

মা - তােমার স্বামী কোথায় ? 

আমি - রায়পুরে। 

মা কলের ঘর দেখাইয়া বলিলেন, “ওখান হতে হাত পা ধুয়ে এস।” 

আমি - মা, আমি এখনাে স্নান করিনি। 

মা - তা হােক, স্নান করতে হবে না। 

আমি কলঘর হইতে হাত পা ধুইয়া মায়ের নিকট ঠাকুরঘরে গিয়া দেখি মা দুখানা আসন পাতিয়াছেন। সামনের কোশাকোশীতে গঙ্গাজল লইয়া নিজে ঠাকুরের পানে মুখ করিয়া বসিলেন। তাঁহার বাম হাতের নিকট আসনে আমাকে বসিতে বলিলেন, কোশা হইতে গঙ্গাজল লইয়া মা আচমন করিলেন এবং আমায় সেইরুপ করাইলেন ; পরে বলিলেন, “কোন দেবতায় তােমার ভক্তি?” আমি বলিলে, তিনি আমায় দীক্ষা দিয়া কিরুপে জপ করিব, দেখাইয়া দিলেন। সেই মুহুর্তে একটা পরমানন্দের প্রবাহ হৃদয়মধ্যে বহিয়া গেল, ভিতরে বাহিরে বিপুল আনন্দোচ্ছ্বাস উঠিয়া আমায় অভিভূত করিয়া ফেলিল। আমি কিছুই জানি না, মা সব শিখাইয়া দিলেন। দীক্ষান্তে মা বলিলেন, “দক্ষিণা দাও।” 

আমি — মা, আমি তাে কিছুই জানিনে, আপনি বলে দিন আমি কি করবো, আমি তাে কিছুই আনিনি। 

মা তখন উঠিয়া গিয়া ফুল, কমলালেবু, কুল প্রভৃতি দুই হাতে অঞ্জলি করিয়া আনিয়া আমার হাতে দিলেন এবং বলিলেন, ‘বল - আমার পূর্বজন্মের ইহজন্মের জানত অজানত যাহা কিছু পাপপূণ্য করিয়াছি, সব তােমাকে সমর্পণ করিলাম।” আমিও তাই বলিলাম, মা হাত পাতিয়া সব গ্রহণ করিলেন। 

মা। এই দীন হীন কাঙাল অধমের উপর একি অহৈতুকী দয়া তােমার। আমার প্রাণ মন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল—একি দেখিলাম! একি শুনিলাম। আমি কায়-মন-প্রাণ মায়ের শ্রীপাদপদ্মে সমর্পণ করিয়া আজ ধন্য হইলাম। 

মাকে প্রণাম করিয়া বারাণ্ডায় আসিয়া আবিষ্টের ন্যায় ঘণ্টাখানেক রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। এমন সময় ঘরে একটি বালিকার চীৎকার কোলাহল আর মায়ের কথা শুনিয়া ঘরের ভিতরে গেলাম। আমাকে দেখিয়া মা বলিলেন, “বস, মা, বস।” আমি বসিলে মা বলিলেন, “এটি আমার ভাইঝি, নাম রাধারানী। ওর মা পাগল হতে আমিই ওকে মানুষ করি।” মা তাহাকে ধরিয়াছিলেন, কিন্তু সে অস্থির হইয়া পালাইবার চেষ্টা করিতেছিল। মা তাহাকে কত রকম বুঝাইতেছিলেন। তাহার চুল বাঁধিয়া দিলেন, তাহাকে কাপড় পরাইলেন, নিজের হাতে খাওয়াইয়া দিলেন আর কতই স্নেহপূর্ণ কথা বলিতে লাগিলেন। আমি শ্রীশ্রীমায়ের এই প্রাকৃত লােকের ন্যায় ব্যবহার অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলাম। এমন সময় আমায় গঙ্গাস্নান করিবার জন্য ডাকায় আমি উঠিয়া গেলাম। স্নানের পর ফিরিয়া আসিয়া দেখি, মা ঠাকুরের ভােগ দিতেছেন। ঠাকুর ঘর হইতেই আসিয়া তিনি ঠাকুরের ভােগের ঘরে গেলেন, সেখানে ভােগ সজ্জিত রহিয়াছে; পরে সেই ঘরের দোর বদ্ধ করিয়া আমাদের ঘরে আসিলেন। কিছু ক্ষণ পরে মহারাজগণ আহারে বসিলেন। গােলাপ-মা পরিবেশন করিতেছেন, আহার শেষ হইলে মহারাজগণ চলিয়া গেলেন। ঠাকুরের ভােগের থালা মায়ের জন্য মাঝের ঘরে আনা হইল এবং আমরা যে কয়েকটি স্ত্রীলোক আছি আর পাঁচু (পাঁচ বৎসরের একটি বালক, যে আমার সঙ্গে আসিয়াছিল) এই কয়জনের জন্য সেই ঘরে জায়গা হইল। শ্রীশ্রীমা এবং আমরা সকলেই আহারে বসিলাম। আমার ইচ্ছা মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করিব, তাই চুপ করিয়া বসিয়া আছি। সকলে ভাত মাখিয়া লইলেন, আমি হাতও দিলাম না। মা দুই-তিন বার বলিলেন, “খাও, খাও।” এমন সময় গােলাপ-মা আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে গা?” তাঁহাকে বলিলাম, “আমাকে দুটি প্রসাদ দিন।” মা তখন ভাত মাখিয়া অল্প দুটি খাইয়া আমার পাতে তুলিয়া দিলেন। আহা! কি অমৃতই সেদিন খাইলাম, কি বলিব। অড়হর ডাল, কপির চচ্চড়ি, চালতের অম্বল, আর গােলাপ মা মাছ রাঁধিয়াছিলেন, ভারি সুন্দর হইয়াছিল। পাঁচু তাে “আরাে চচ্চড়ি খাব” বলিয়া গোলমাল আরম্ভ করিয়া দিল। তাহাকে চুপি চুপি ধমকাইলেও শুনে না। এ সময় গোলাপ-মা আবার আসিয়া বলিলেন, “কি হয়েছে, অমন করছে কেন ছেলেটি ?” 

আমি বলিলাম, “ওকে আনতে চাইনি, মা। আমি লুকিয়ে আসছিলুম, গাড়ি যেই কিছুদূরে গিয়েছে, ও রাস্তায় খেলা করছিল, অমনি ছটে এসে গাড়িতে উঠলাে, আর এখন আরও চচ্চড়ি খাব’ বলে গােলমাল করছে।” এই কথা শুনিয়া মা, গােলাপ-মা, সকলে হাসিতে লাগিলেন। গােলাপ-মা বলিলেন, “তুমি ওকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিলে—পারবে কেন? ওর সুকৃতি ছিল, তাই মাকে দেখতে পেলে, এ কি কম ভাগ্য গা। ওর ভাল হবে।” মা-ও “হ্যাঁ, তাই তাে বলিয়া ‘সায়’ দিলেন। 

আহারের পর আমি সারাদিন মায়ের কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার রায়পুর যাইবার কথা ছিল। সে দূর দেশ, আর শীঘ্র যদি মাকে না দেখিতে পাই সেই আশঙ্কায়, পারুল ও কমলা আমায় ডাকিয়াছিল, তবুও আমি গেলাম না। ছাদে মা চুল শুকাইতেছিলেন, শীতকাল তাই রােদে বসিয়াছেন আর আমার কাছে বাপের বাড়ির গল্প করিতেছেন, “রাধুকে মানষ করলুম, সেটি পাগল, খাইয়ে না দিলে খায় না। আর আমারও শরীর ভাল নয়, মা, বাতের বেদনায় কষ্ট পাচ্ছি। এই অসুখের জন্যে কাশী বৃন্দাবন গেলুম, কিন্তু কিছুই হল না।”

আমি - কাশী বৃন্দাবন গিয়েছিলেন ? 

মা - কি করে বলবাে। 

একথা সেকথার পর মা বলিলেন, “তােমার এই অল্প বয়স, ছেলেমানুষ তুমি, তােমার এ সময় দীক্ষা নেবার ইচ্ছে কেন হ’ল ?” 

আমি - কি জানি, মা, সংসার আমার ভালাে লাগে না। প্রাণ যেন সংসার চায় না, প্রাণে বড়ই অশান্তি ছিল, আজ আমি শান্তি লাভ করেছি। আর এ সংসারও অনিত্য, দুদিনের জন্য, দেখছি সবই মিথ্যা। কি করে তাতেইে বা মন বসবে, মা? 

এই সময়ে মায়ের সমবয়স্কা একটি স্ত্রীলােক আসিয়া তাহার নিকট বসিলেন। আমি মায়ের খুব কাছে বসিয়াছিলাম, তাহার ছায়া আমার গায়ে পড়িয়াছে দেখিয়া উক্ত স্ত্রীলােকটি আমায় ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “তুমি কেমন মেয়ে গা, মায়ের ছায়ার উপর বসেছ? পাপ হবে যে, সরে বস।” আমি ইহা জানিতাম না। মা যে আপন হইতেও আপনার, তাই একেবারে কাছে বসিয়া ছিলাম, এখন একটু অপ্রতিভ হইয়া সরিয়া বসিলাম। উক্ত স্ত্রীলােকটি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ মেয়েটি কে?” 

মা - এ মেয়েটি আজ দীক্ষা নিয়েছে, বড় ভক্তিমতী মেয়ে। 

মায়ের এই কথায় আমি লজ্জিত হইয়া পাশের ঘরে পারুলরা গল্প করিতেছিল সেখানে উঠিয়া গেলাম। এমন সময় ললিত আসিয়া বলিল, “দিদি, চল, গাড়ি প্রস্তুত। বেলা গিয়েছে। আমি মায়ের নিকট বিদায় লইতে গেলাম। 

মা বলিলেন, “আবার কবে আসবে, মা?” 

আমি - আপনি যেদিন মনে করে আনবেন সেই দিনই আসবাে ; আমার কোন সাধ্য নেই। মা, আশীর্বাদ করুন; আমায় মনে রাখবেন মা। 

মা - আবার এস, মা। 

আমি কাতর নয়নে তাঁহার পানে চাহিয়া রহিলাম; তিনি দুই খিলি পান আনিয়া আমায় দিলেন। আমি মায়ের পদতলে লুন্ঠিত হইয়া যেন ‘আমাকে রাখিয়া’ দেহটি লইয়া বিদায় লইলাম। মা-ও সজল নয়নে সিঁড়িতে আসিয়া দাঁড়াইলেন। আমার অন্তর-বাহির আজ পরিপূর্ণ; গাড়িতে বসিয়াও যেন তাঁহার কথা শুনিতে লাগিলাম। মায়ের কথা মা রক্ষা করাইয়াছিলেন ; দুই বৎসর পরে রায়পুর হইতে ফিরিয়া মায়ের অসুখের সময় আবার তাঁহার দর্শন পাইয়াছিলাম। 

শ্ৰীমতী --

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত ব্রঃ অশােককৃষ্ণ

শ্রীশ্রীমায়ের শেষ অসুখের সময় একদিন সকাল বেলা মাকে দর্শন করিতে যাই। তখন ঘরে আর কেই ছিলেন না। মা সর্ব-দক্ষিণের ঘরে ছিলেন। সেই সময় কয়েক দিন একটু ভাল ছিলেন। দিনের বেলায় ঐ ঘরেই মায়ের বিছানা করিয়া দেওয়া হইত। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ। শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতেই মা বাড়ির সব কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। মায়ের শরীর খুব রুগ্ন দেখিয়া আমি বলিলাম, “মা, আপনার শরীর এবার বিশেষ খারাপ হয়ে গেছে। এত দুর্বল শরীর কখনও দেখি নাই।” 

মা বলিলেন, “হ্যাঁ, বাবা, দুর্বল খুব হয়েছে। মনে হয় এ শরীর দিয়ে ঠাকুরের যা করবার ছিল, শেষ হয়েছে। এখন মনটা সর্বদা তাঁকে চায়, অন্য কিছু আর ভাল লাগে না। এই দেখ না, রাধুকে এত ভালবাসতুম, ওর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কত করেছি, এখন ভাব ঠিক উলটে গেছে। ও সামনে এলে ব্যাজার বােধ হয়, মনে হয়-ও কেন সামনে এসে আমার মনটাকে নীচে নামাবার চেষ্টা করছে ? ঠাকুর তাঁর কাজের জন্যে এত কাল এই সব দিয়ে মনটাকে নামিয়ে রেখেছিলেন। নইলে তিনি যখন চলে গেলেন, তারপর কি আমার থাকা সম্ভব হােত ?” 

আমি - মা, আপনি এরূপ কথা বললে আমাদের বড় কষ্ট হয়। আপনি যদি চলে যান, আমাদের উপায় কি হবে? আমাদের ত্যাগ-তপস্যার বিশেষ অভাব। বৈরাগ্য তাে একেবারে নেই বললেই চলে। আপনার শরীর না থাকলে আমরা কিসের জোরে মহামায়ার রাজত্বে বেঁচে থাকবাে? মনে যখন কোন দুর্বলতা এসেছে, আপনার কাছে বলে তা হতে বাঁচবার রাস্তার খবর পেয়েছি। এখন আমরা কোথায় যাব? আমাদের যে একেবারেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়তে হবে।

মা - (দৃঢ়তার সহিত বলিলেন) কি! তােমরা নিরাশ্রয় হবে কেন ? ঠাকুর কি তােমাদের ভালমন্দ দেখছেন না? অত ভাবো কেন? তােমাদের যে তার পায়ে সঁপে দিয়েছি। একটা গণ্ডির মধ্যে তােমাদের ঘুরতে হবেই, অন্য কোথাও যাবার জো নেই। তিনি সর্বদা তােমাদের রক্ষা করছেন। 

আমি -  ঠাকুরের দয়ার কথা অনেক সময় মনে হলেও সব সময় ঠিক বুঝতে পারি না। অনেক সময় বিশ্বাস হয়, অনেক সময় সন্দেহও আসে। আপনাকে সাক্ষাৎ দেখছি, ভাল মন্দ অনেক কথা বলেছি, আপনিও তার ভাল মন্দ বিচার করে কখন কিভাবে চললে আমার ভাল হবে, বলে দিয়েছেন। এতে আপনার কাছে আশ্রয় পেয়েছি, এটা বিশ্বাস হয়। 

মা বলিলেন, “ঠাকুর একমাত্র রক্ষাকর্তা-এটি সর্বদা মনে রাখবে। এটি ভুললে সব ভুল। আজ যে তােমার বাড়ির কথা, মার কথা এত জিজ্ঞাসা করলুম, কেন জান? প্রথম গণেনের মুখে তােমার বাপ মরার খবর শুনলুম। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তােমার মার আর কে আছে, খাবার-সংস্থান আছে কিনা, তুমি না থাকলে তার চলবে কিনা; যখন শুনলুম তুমি না থাকলেও তার চলবে, তখন মনে হ’ল ‘যাক, ছেলেটার যদি একটু সৎ বুদ্ধি হয়েছে, ঠাকুরের ইচ্ছায় তার সৎপথে থাকবার বিশেষ বাধা পড়বে না।’

“মার সেবা করা সকলের উচিত, বিশেষ যখন তােমরা সকলের সেবা করবার জন্য এখানে এসেছ। তােমার বাপ যদি টাকা না রেখে যেতেন তা হলে তােমাকে টাকা রােজগার করে মার সেবা করতে বলতুম। ঠাকুরের ইচ্ছায় তিনি তােমার কোন উৎপাত রাখেন নি। কেবল মেয়েমানুষের হাতে থেকে টাকাগুলাে নষ্ট না হয়ে যায়, এর একটা বন্দোবস্ত করা ও দেখাশুনা করলেই হয়ে যাবে। এটা কি কম সুবিধে ? টাকা-রােজগার মানুষ সৎভাবে করতে পারে না---মন বড় মলিন করে দেয়। এজন্যে তােমায় বলছি, টাকা-কড়ির ব্যাপার যত শিগ়্গির সম্ভব সেরে ফেল। বেশী দিন ওসব নিয়ে থাকলেই ওতে একটা টান পড়বে, টাকা এমনি জিনিস! মনে করছ ওতে আমার টান নেই, যখন একবার ছাড়তে পেরেছি তখন আর টান হবে না, যখন ইচ্ছে চলে আসব। না, একথা কখনো মনে ভেব না। কোন ফাঁক দিয়ে তােমার গলা টিপে ধরবে, তােমায় বুঝতে দেবে না। বিশেষ তােমরা কলকাতার ছেলে, টাকা নিয়ে খেলা করতে তোমরা জান। যত শীঘ্র পার মার বন্দোবস্ত করে কলকাতা থেকে পালিয়ে যাও। আর মাকে যদি কোন তীর্থস্থানে নিয়ে যেতে পার, দু’জনে বেশ ভগবানকে ডাকবে, মা-ব্যাটা-সম্পর্ক ভুলে। এই শােকের সময় মার মনে খুব কষ্ট, এটি হলে বেশ হয়। তােমার মারও তাে বয়স হয়েছে। তাঁকে খুব বােঝাবে। এই সব কথা মার সঙ্গে কইবে। 

“মার পথের সঞ্চয় করবার সাহায্য করতে পার তবেই তাে ঠিক ছেলের কাজ করলে। তাঁর বুকের রক্ত খেয়ে যে এত বড় হয়েছ, কত কষ্ট করে তােমায় মানুষ করেছেন। তাঁর সেবা করা তোমার সব চেয়ে বড় ধর্ম জানবে। তবে তিনি যদি ভগবানের পথে যেতে বাধা দেন তখন অন্য কথা। তােমার মাকে একবার এখানে নিয়ে এস না, দেখব কেমন। যদি ভাল বুঝি, দু-একটা কথা বলে দেব। কিন্তু সাবধান, মার সেবা করছি ভেবে বিষয় নিয়ে মেতাে না, একটা বিধবার খাওয়া পরা বই তাে না। কত টাকাই বা চাই। কিছু লােকসান দিয়েও যদি তাড়াতাড়ি বন্দোবস্ত হয়, তার চেষ্টা করবে। ঠাকুর তাে টাকা ছুঁতেই পারতেন না। তােমরা তার নামে বেরিয়েছ, সব সময় তাঁর কথা মনে ভাববে। জগতে যত অনর্থের মূল-টাকা। তােমাদের কাঁচা বয়স, হাতে টাকা থাকিলেই মন লােভ দেখাবে। সাবধান!” 

আমি - আমার মনে হয়েছিল আমার মাকে একদিন আপনার কাছে আনবাে। কিন্তু আপনার শরীর দেখে আর আনবার ইচ্ছে হচ্ছে না। 

মা - না , না, একদিন নিয়ে এস। কত লােক তো আসছে। আর শরীর তাে দিন দিন খারাপ হবেই। শিগ়্গির শিগ়্গির নিয়ে এস। সকাল বেলাটায় শরীর মন্দ থাকে না। সকাল বেলা আনতে পারবে না? বেশী বেলা কোরাে না, দেরি হলে এরা তাে আসতে দেবে না। 

আমি - মা, আপনার কথা শুনে বড় কষ্ট হচ্ছে। বারবার নিজের শরীর সম্বন্ধে যে সব কথা বলছেন, তাতে মনে হয়, শরীর ধরবার আর আপনার ইচ্ছে নেই। 

মা বলিলেন, “এ শরীর থাকা না থাকা আমার হাত নয়-তাঁর ইচ্ছা। তােমরা এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এই আমার কাছে তােমরা কত সময়ই বা থাক? কখন মঠে, কখন বা বাইরে থাক। আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইবার বা কাছে থাকবার কয়জনের সুবিধা হয় ? তােমরা তাে কখন কোথায় থাক খবর পর্যন্ত দাও না।” 

আমি - আমাদের থাকবার সুবিধা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের মনে বিশ্বাস আছে আপনি আছেন, মনে যখন কোন দুর্বলতা আসবে আপনার কাছে আসলেই তা দূর হয়ে যাবে। 

মা — তােমরা কি মনে কর, যদি ঠাকুর এ শরীরটা না রাখেন, তা হলেও যাদের ভার নিয়েছি তাদের একজনও বাকি থাকতে আমার ছুটি আছে। তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। তাদের ভাল-মন্দের ভার যে নিতে হয়েছে। মন্ত্র দেওয়া কি চারটিখানি কথা! কত বােঝা ঘাড়ে তুলে নিতে হয়। তাদের জন্যে কত চিন্তা করতে হয়। এই দেখ না, তােমার বাপ মারা গেলেন, আমারও মনটা খারাপ হল। মনে হল—ছেলেটাকে ঠাকুর কি আবার এক পরীক্ষায় ফেললেন। কিসে ঠেলেঠুলে বেঁচে উঠবে-এই চিন্তা। সেইজন্যই তাে এত কথা বললুম। তােমরা কি সব বুঝতে পার ? যদি তােমরা সব বুঝতে পারতে, আমার চিন্তার ভার অনেক কমে যেত। ঠাকুর নানান ভাবে নানা জনকে খেলাচ্ছেন-টাল সামলাতে হয় আমাকে। যাদের নিজের বলে নিয়েছি, তাদের তাে আর ফেলতে পারিনে। 

আমি - মা, আপনার অবর্তমানে কার কাছে যাব, কি হবে, ভাবতে গেলে বড় ভয় হয়। 

মা বলিলেন, “কেন, এই রাখাল টাখাল এই সব ছেলেরা রয়েছে, এরা কি কম? তুমি তাে রাখালকেও খুব ভালবাস। তার কাছে জিজ্ঞাসা করে নেবে। কি আর জিজ্ঞাসাই বা করবে। বেশী জিজ্ঞাসা করা ভাল নয়। একটা জিনিস হজম করতে পারে না, আবার দশটা জিনিস মনের মধ্যে পরে এটা না ওটা কেবল এই চিন্তা। যে জিনিস পেয়েছ, তাইতে ডুবে যাও। জপধ্যান করবে, সৎসঙ্গে থাকবে, অহঙ্কারকে কিছুতেই মাথা তুলতে দেবে না। দেখছ না রাখালের কেমন বালকভাব, এখনও যেন ছােট ছেলেটি । শরৎকে দেখ না, কত কাজ করে, কত হাঙ্গামা পােহায় - মুখ বুঁজে থাকে। ও সাধু মানুষ, ওর এত সব কেন? ওরা ইচ্ছা করলে দিনরাত ভগবানে মন লাগিয়ে বসে থাকতে পারে। কেবল তােমাদের মঙ্গলের জন্যে এদের নেমে থাকা। এদের চরিত্র চোখের সামনে ধরে রাখবে, এদের সেবা করবে; আর সর্বদা মনে ভাববে আমি কার সন্তান, কার আশ্রিত। যখনই মনে কোন কু-ভাব আসবে, মনকে বলবে - তাঁর ছেলে হয়ে আমি কি এ কাজ করতে পারি ? দেখবে—মনে বল পাবে, শান্তি পাবে।” 

ব্রঃ অশােককৃষ্ণ

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত অজ্ঞাত মহিলা 

শ্রীশ্রীমা আমাকে দীক্ষাদানের পর বলেছিলেন, “দেখ, মা, আমি কড়ে রাঁড়ীকে মন্ত্র দিই না, তবে তুমি ভাল, তাই দিলুম। দেখাে, যেন আমায় ডুবিয়াে না। শিষ্যের পাপে গুরুকে ভুগতে হয়। সব সময় ঘড়ির কাঁটার মতাে ইষ্ট-মন্ত্র জপ করবে।” 

আর একবার শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় বলেছিলেন, “কারু সঙ্গে মিশবে না, কারু জামাই, বেয়াই কুটুম আসুক, তার কোন কিছুতেই থাকবে না। ‘আপনাতে আপনি থেকো, যেয়াে না মন কারো ঘরে।’ ঠাকুর নারকেলের লাড়ু ভালবাসতেন, দেশে গিয়ে তাই করে তাঁকে ভােগ দেবে, আর তাঁর সেবা জপ-ধ্যান বাড়াবে, ঠাকুরের বই সব পড়বে।” 

একদিন মা ও আমি ছিলুম, আর কেউ ছিলেন না। মা বললেন, “দেখ, মা, পুরুষ-জাতকে কখনও বিশ্বাস কোরাে না — অন্য-পরের কথা কি, নিজের বাপকেও না, ভাইকেও না, এমন কি স্বয়ং ভগবান যদি পুরুষরূপ ধারণ করে তােমার সামনে আসেন, তাঁকেও বিশ্বাস কোরাে না।” 

মঠে বা যে-সব স্থানে সাধুসন্ন্যাসীরা থাকেন সেসব জায়গায় বেশী যেতে বারণ করতেন। বলতেন, “দেখ, মা, তােমরা তাে ভাল মনে ভত্তি করেই যাবে কিন্তু তাতে তাদের মনে ক্ষতি হলে সেই সঙ্গে তােমারও পাপ হবে।” 

যখন-তখন যার-তার সঙ্গে তীর্থে যেতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, “তােমার হাতে দু'পয়সা হয়, দশ-বিশ জন বামুন খাইয়ে দিও।” একটি  - স্ত্রী-ভক্ত সামনে বসেছিলেন, তাঁকে দেখিয়ে বললেন, “এই দেখ একজন, তীর্থ করতে গিয়ে কেমন ঠোক্কর খেয়ে এসেছে--’তীর্থগমন দুঃখভ্রমণ মন-উচাটন হয়াে নারে; ‘ভ্রমিয়ে বারাে, ঘরে বসে তের, যদি করতে পার’।” 

একদিন স্ত্রী-ভক্তেরা অপর একজনের নামে পাঁচ জনে পাঁচ রকম সমালােচনা করছিলেন। সেই সময় মা আমায় বললেন, “তুমি তাকে ভক্তি করবে। সে-ই তােমায় প্রথমে এখানে এনেছিল।” 

পরের একটি ছেলে নিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিলুম। তার উত্তরে রাধুর জন্য নিজের অবস্থা দেখিয়ে মা বলেছিলেন, “অমন কাজও করাে না। যার উপর যেমন কর্তব্য করে যাবে, কিন্তু ভাল এক ভগবান ছাড়া আর কাউকে বেসাে না। ভালবাসলে অনেক দুঃখ পেতে হয়।” 

শ্রীশ্রীমায়ের নিকট আমার মন্ত্রগ্রহণের কথা শুনে আমাদের বাড়ির গুরু আমায় শাপ দিয়েছিলেন, মাকে সে কথা লিখেছিলুম। মা চিঠিতে উত্তর জানালেন, “যে ঠাকুরের শরণাগত হয়, তার ব্রহ্মশাপেও কিছু হয় না। তােমার কোন ভয় নাই।” 

জনৈকা প্রাচীনা স্ত্রী-ভক্ত একদিন আমায় বলেছিলেন, “মঠে ফটে আর এখন কিছু নেই। - তাই আমি মাকে গিয়ে বলেছিলুম। মা শুনে চমকে উঠে বললেন, ‘যদি এখনও ধর্ম কিছু থাকে তাে সে এখানে, আর মঠে।” 

একদিন জনৈকা স্ত্রী-ভক্তের কথা আলােচনা করতে করতে আমি ও নলিনী দিদি মাকে বললুম, কিন্তু তার উপর তাে আমাদের কোন অভক্তি আসছে না ?” 

মা বললেন, “সে যে ঠাকুরকে ডাকে। যে ঠাকুরকে ডাকে সে যেমনই হােক, তার উপর অভক্তি হয় না।” 

শ্ৰীমতী  - 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত শ্রীপ্রবোধ ও শ্রীমণীন্দ্র 

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করি। ১৯০৮-এর মধ্যভাগে বর্ষাকালে দ্বিতীয় বার দর্শন হয়। এবার বেলা প্রায় ১১ টার সময় জয়রামবাটী উপস্থিত হই। প্রণাম করিলে পর শ্রীশ্রীমা জিজ্ঞাসা করলেন- 

“তুমি কি মাস্টার মশায়ের ছাত্র ?” 

আমি - না, মা; আমি তাঁর কাছে যাই। 

মা - তিনি কেমন আছেন? তুমি কি শীগগির গিয়েছিলে? 

আমি - ভাল আছেন। আমি আট দিন আগে গিয়েছিলুম। 

মধ্যাহে আহার করিবার সময় আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আপনার কলকাতা যাওয়া হবে কি?” 

মা - ইচ্ছে তাে আছে পুজোর সময় যাই। তারপর মা যা করেন। তােমাদের জমিতে ধান হয়? 

আমি - হ্যাঁ, মা, হয়। 

মা - বেশ। আমাদের দেশে ভাল ধান হয় না। তােমাদের কলাই হয় ? 

আমি - হ্যাঁ, মা। 

মা  - বেশ ভাল। 

রাতে আহারের সময় শ্রীশ্রীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি বাড়িতেই থাক এখন ?” 

আমি — হ্যাঁ, মা, বাড়িতেই আছি। আমার বড় বিপদ - খুব অসুখ হয়েছিল, তার পর বিবাহ। 

মা - বিবাহ কি হয়ে গেছে ? 

আমি - হ্যাঁ, মা। 

মা - মেয়েটির বয়স কত ? 

আমি  - প্রায় তের বছর। 

মা - যা হয়েছে ভালর জনাই হয়েছে ; আর কি করবে ? 

আমি - মাষ্টার মহাশয় বিবাহ করতে বারণ করেছিলেন। 

মা - আহা! নিজে অনেক কষ্ট পেয়েছেন কি-না। তাই বলেন আর তােরা কেউ বিয়ে করিস নি রে। 

আমি - সংসারে বড় ব্যাঘাত। সংসারে থাকলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। 

মা - নিশ্চয়। কেবল টাকা, টাকা, টাকা। 

আমি – বিষম যন্ত্রণা! 

মা - ঠাকুরের সংসারী ভক্তও তাে আছে। ভাবনা কি ? 

আমি নিস্তব্ধ হইয়া আছি। 

মা - আমার ভায়েরা বিবাহ করেছে। 

আমি - আপনার অনুমতি অনুসারে ?

মা - কি করবাে। ঠাকুর বলতেন, “বিষ্ঠার পোকা বিষ্ঠাতেই ভাল থাকে, ভাতের হাঁড়িতে রাখলে মরে যাবে।’ আর আমরা খুড়ো-জ্যাঠার যেমন সেবা শুশ্রষা করেছি, এখনকারের ভাইঝিরা তেমন করে না। 

আমি - ক্রমশঃ সব পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। 

মা - তা বটে। দেখ না, আগে আমি পিঁপড়ে মারতে পারতুম না, কিন্তু এখন বেরালকেও এক ঘা বসিয়ে দি। |

“ঠাকুর বলতেন, “এ-ও কর, ও-ও কর”। বলতেন, ‘তুঁহু তুঁহু। জীব অনেক দুঃখকষ্ট ভােগ করে তবে বলে, তুঁহু তুঁহু। 

“স্বার্থ! যতক্ষণমুটো করে ততক্ষণ আপনার, তার পর আর নয়।”

“ভয় কি, বিবাহ করেছ - ঠাকুরের ইচ্ছাতে সেও ভাল হয়ে যাবে। হয়তাে তার কোন সুকৃতি আছে। বলতেন, “বিদ্যার চেয়ে অদ্যিার জোর বেশী - অর্থাৎ অবিদ্যামায়া সংসারকে মুগ্ধ করে রেখেছে।” 

জগদম্বা আশ্রম - কোয়ালপাড়া, বাঁকুড়া এপ্রিল ২০, রবিবার, ১৯১৯ 

মণীন্দ্র, সাতু ও নারায়ণ আয়াঙ্গার ( জনৈক মাদ্রাজী ভক্ত ) প্রভৃতি সকাল বেলা প্রায় দশটার সময় শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতে গিয়াছেন। মা এক মাসের উপর হইল আসিয়াছেন। পুরুষ-ভক্তেরা কোয়ালপাড়া মঠে থাকেন এবং তথায় খাওয়া-দাওয়া করেন।

শ্রীশ্রীমায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী মাকুর ছেলের খুব অসুখ - ডিপথিরিয়া হইয়াছে, জয়রামবাটীতে আছে। বৈকুণ্ঠ মহারাজ তাঁহাকে দেখিতেছেন। মা সেজন্য খুব চিন্তিতা—কি হয়! 

ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বসিতেই প্রথমে ঐ কথাই উঠিল। 

নারায়ণ আয়াঙ্গার - মা, আপনার আশীর্বাদে ছেলে ভাল হয়ে যাবে। 

মা - (হাতজোড় করিয়া ঘরের ভিতরে শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবিকে দেখিয়া) উনি। আছেন। 

সাতু - মাকুর ছেলের জন্যে ইনি (নারায়ণ আয়াঙ্গার ) অনেক করছেন ( ডিপথিরিয়ার ইনজেকসন, আনিবার জন্য কলিকাতায় লােক পাঠানাে ইত্যাদি)। 

মা - হ্যাঁ, ভাল লােক। কালােকে কলিকাতায় পাঠানাে, টাকা খরচ করা উনি না থাকলে কে এত করতে? 

নারায়ণ আয়াঙ্গার — আমি যন্ত্র, ঠাকুর যন্ত্ৰী। আমাকে যন্ত্রের মতাে কাজ করাচ্ছেন। 

মা - ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যার (ধন-ধান্য) আছে সে মাপে (মেপে দেওয়া ); যার নাই সে জপাে।’ 

নারায়ণ আয়াঙ্গার -  জপ করবার সময় কি আচমন করা প্রয়ােজন ? 

মা - হ্যাঁ ; ঘরে হলে আসন-আচমন প্রয়ােজন। রাস্তায় বা অন্যত্র পথে বাটে নাম করলেই হবে। 

নারায়ণ আয়াঙ্গার - শুধু নাম? মন্ত্রজপ নয় ?

মা - হ্যাঁ, মন্ত্রজপও করবে বই কি। তবে মন স্থির করে একবার ডাকলে লক্ষ জপের কাজ হয়। নতুবা সারাদিন জপ করছে কিন্তু মন নেই, তাতে ফল কি ? মন চাই, তবে তাঁর কৃপা।। 

নারায়ণ আয়াঙ্গার — আমি যা করছি তাতেই হবে, না আরও প্রয়ােজন? 

মা - যা  করছ তাই কর। তুমি তো তাঁর কৃপাপাত্র আছই। 

নারায়ণ আয়াঙ্গার - দু-তিন দিন সরলভাবে ডাকলে দর্শন পাওয়া যায়; এতদিন ডাকছি দর্শন হয় না কেন? 

মা — হ্যাঁ, হবে বই কি। শিববাক্য, আর তাঁর মুখের কথা--সে কথা মিথ্যা হবার জো নেই। সুরেন্দ্রকে (মিত্র) তিনি বলেছিলেন, ‘যার আছে সে মাপো, যার নেই সে জপাে।' (সকলকে লক্ষ্য করিয়া) তাও না পার (ঠাকুরকে দেখাইয়া) শরণাগত, একটু মনে রাখলেই হ'ল--আমার একজন দেখবার আছেন, একজন মা কি বাবা আছেন।

নারায়ণ আয়াঙ্গার - আপনি বলছেন তাই আমার বিশ্বাস।•••

রাধুর একটি সন্তান হইয়াছে। সন্তান হইবার পর হইতেই রাধু শয্যাগত। তাহাকে খাওয়াইবার সময় হইয়াছে, তাই মা এবার উঠিবেন। 

মা - এখন রাধুকে খাওয়াতে যাব। 

ভক্তেরা প্রণাম করিয়া উঠিতেছেন। নারায়ণ আয়াঙ্গার শ্রীশ্রীমায়ের পাদপদ্মে মস্তক স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিতেছেন, মা মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন। 

মণীন্দ্র প্রণাম করিবার সময় মা বললেন, “বৌমার (মণীন্দ্রের মার) কি বিশ্বাস ! কাশীতে যেতে বলায় বলেছিল, “এই আমার কাশী, আমি কোথাও যাব না।” 

মণীন্দ্রের মা শ্রীশ্রীমায়ের কাছে থাকিতেন। এক বৎসরের উপর হইল তাঁহার দেহত্যাগ হইয়াছে। তিনি শ্রীশ্রীমায়ের খুব সেবা করিয়াছিলেন। মা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “আমার এখানে কেউ বেশী দিন থাকতে পারেনি, কেদারের মা ছিল আর তুমি আছ।” 

সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় সংবাদ আসিল মাকুর ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ। শুনিয়া মা অতিশয় উদ্বিগ্না হইলেন। ব্রহ্মচারী বরদাকে বলিলেন, “পাল্কী ঠিক করে রাখ, কাল সকালেই আমি যাব যদি ছেলে ততক্ষণ বেঁচে থাকে। সকালেই আমাকে সংবাদ এনে দেবার কি হবে ?” 

মণীন্দ্র - আমি ও সাতু খুব ভাের ভাের সংবাদ এনে দেব। 

একটু পরেই বৈকুণ্ঠ মহারাজ জয়রামবাটী হইতে ফিরিলেন। মাকে এই সংবাদ দিতেই চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি ছেলে নেই ?” 

সকলকে নিরুত্তর দেখিয়া বলিলেন, “কতক্ষণ মারা গেল ?” 

বৈকুণ্ঠ মহারাজ - সাড়ে পাঁচটার সময়। 

মা - এখন গেলে দেখতে পাব ? 

বৈকুণ্ঠ মহারাজ - না, মা, নিয়ে গেছে। 

মা খুব কাঁদিতে লাগিলেন। একটু থামছেন তাে আবার কাঁদছেন। 

স্বামী কেশবানন্দ মাকে সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করাতে মা কাঁদিয়া বলিলেন, “কেদার গাে, আমি ভুলতে পারছি নে।” 

ছেলেটি একবার মাকুর সঙ্গে জয়রামবাটী যাইবার সময় কোথা হইতে কতকগুলি গুলঞ্চ ফুল কুড়াইয়া আনিয়া মায়ের পায়ে দিয়া বলিয়াছিল, “দেখ, পিসীমা-কেমন হয়েছে ?” তারপর সে প্রণাম করিয়া শ্ৰীশ্রীমায়ের পায়ের ধুলা লইল। পরে ফুলগলি জামার পকেটে পুরিয়া লইয়া গিয়াছিল। শরৎ মহারাজ তাহাকে খুব ভালবাসিতেন। অসুখের সময় ছেলেটি ‘লালমামা লালমামা” বলিয়া শরৎ মহারাজকে খুব ডাকিয়াছিল। মা বলিলেন, “হয় তাে কোন ভক্ত এসে জন্মেছিল। শেষ জন্ম হবে। নইলে তিন বছরের ছেলের অত বুদ্ধি, অমন করে পূজো করে গা! লালনপালন করে আমার কষ্ট।” 

এই সব কান্নাকাটি ও শোকে অনেক রাত্রি হইয়া গেল। রাত্রিতে শ্রীশ্রীমা মেয়েদের সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন তাহাদের খাওয়া হইয়াছে কিনা। যখন শুনিলেন তাঁহারা কিছুই খান নাই (মা খান নাই বলিয়া }, তখন তিনি একটু দুধ ও দুখানি লুচি খাইলেন। 

পরদিন সন্ধ্যার সময় মণীন্দ্র ও প্রভাকর মায়ের কাছে গিয়াছেন। মাকুর ছেলের মৃত্যুতে মায়ের মন বিষন্ন। তাহারই কথা হইতেছে। 

মা - সে বলতাে, ফুল লাল করেছে কে? আমি বলতুম, ‘ঠাকুর করেছেন।' - ‘কেন ?'-তিনি পরবেন বলে। 

‘শরতের খুব লাগবে। সর্বদা কোলে করতাে, যদিও তার পায়ে ব্যথা। কোলে বসে বলতাে, ‘তােমার মা কোথায় ? শরৎ মাকুকে দেখিয়ে বলতাে, ‘এই যে আমার মা।’ ছেলে বলতাে, “তােমার মা, স্কুল বাড়িতে গেছে।” 

ঐ সময় রাধুর অসুখের জন্য মা তাহাকে লইয়া কিছুদিন নিবেদিতা স্কুল বেড়িং-এ ছিলেন। ‘উদ্বােধনে’র বাড়িতে গােলমাল রাধুর সহ্য হইত না। 

মণীন্দ্র - অক্ষয়ের মৃত্যুতেও ঠাকুরের খুব কষ্ট হয়েছিল। 

মা - তিনি বলেছিলেন, ‘গামছা যেমন মােচড় দেয় তেমনি হয়েছিল। আমার এক ভাসুরপো (জ্ঞাতির ছেলে) দীনু বলে বিষ্ণু-ঘরে পজো করতাে। হৃদয় কালীঘরে পুজো করতাে। দীনু, ‘যশােদা নাচাতাে তােমায় বলে নীলমণি’--- এই সব গান ঠাকুরকে শুনাতাে। তার কলেরা হয়েছিল। 

মণীন্দ্র - আপনি তখন দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন ? · 

মা - হ্যাঁ, আমি নবতে ছিলুম। ঠাকুরের পায়ের ধুলাে, আমার পায়ের ধূলাে, মা কালীর স্নানজল দিয়েছিলুম। তা বাঁচলো না-মারা গেল। ঠাকুরের খুব কষ্ট হয়েছিল।

“আমার ছােট ভাই এন্ট্রান্স পাশ করেছিল—বেশ লেখাপড়া শিখছিল, ডাক্তারী পড়ছিল। নরেনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে নরেন বলেছিল, ‘মার এমন ভাই আছে ? সব তাে চালকলাবাঁধা মনে। নরেন বললে, ‘পেটের ভিতর ফোঁড়া হবে, তােমাকে তা কাটতে হবে। যােগেন, তুমি এর পড়বার খরচ জোগাবে। যােগেন মারা গেল। রাখাল ৪০, টাকার বই কিনে দিয়েছিল। রাখাল, শরৎ তার সঙ্গে একসঙ্গে তাস খেলতো। সে ভাই মারা গেল। 

“সংসার মায়ার বন্ধন।•••(করুণ স্বরে) আহা! যাকে পাশ ফিরে শুইয়ে মনে প্রত্যয় হয় না, এমন ছেলে মাকুর! দেখ না কত যন্ত্রণা। 

“এই রাধুকে লালনপালন করে কত কষ্ট–পালার বড় জালা! রাধু যখন হয়, মা বলেছিলেন, “ছােট বউকে ওর মা বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়, তা যাক না। আমি সকালবেলা পুজোর সময় দেখলুম (কলিকাতায় ঠাকুরপূজা করিবার সময়) থিয়েটারে যেমন পদ ( drop-scene) এইরূপে (দুই হাত মেলিয়া দেখাইয়া) সরে যায়, সেইরূপ দেখেছিলুম — দেশে রাধুর মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, রাধুকে শুধু চারিটি মুড়ি দিয়েছে, বাইরে উঠানে পড়ে খড় ধূলাের উপরে মুড়ি খাচ্ছে। রাধুর মা হাতে কোথাও একটা লাল সুতাে, কোথাও নীল সুতো বেধেছে-পাগলের যেমন খেয়াল। অন্য সব ছেলেরা মুড়িটুড়ি মিষ্টি দিয়ে খাচ্ছে - এই দেখে, জলে চুবিয়ে ধরলে যেমন হাঁপিয়ে ওঠে তেমনি হাঁপিয়ে উঠলুম, বুঝলুম - আমি ছেড়ে দিলে রাধুর ঐ অবস্থা।” 

শ্রীশ্রীমা তাঁহার ছােট ভাই অভয়কে খুব ভালবাসিতেন। ভাইদের তিনিই মানুষ করিয়াছেন। অভয় মত্যুকালে বলিয়া গিয়াছিল, “দিদি, সব রইল দেখাে।” রাধু তখন মাতৃগর্ভে। প্রসবের পর রাধুর মা শ্রীশ্রীমায়ের সহিত কলিকাতায় আসেন। পরে পাগল হইলে তাঁহাকে জয়রামবাটী পাঠানাে হয়। রাধু সেখানে খুব দুঃখকষ্ট পাইতে থাকে। শ্রীশ্রীমা বাগবাজারের ভাড়াটিয়া বাটীতে অবস্থানকালে একদিন সকালবেলা পূজা করিবার সময় জয়রামবাটীর এই চিত্র (vision) দেখেন এবং অভয়ের অন্তিম কথা স্মরণ করিয়া চার দিনের মধ্যেই দেশে গিয়া রাধুর লালনপালনের ভার গ্রহণ করেন। মা বলিতেন, সেই হতেই আমাকে মায়ায় ধরলো।” আর একবার কোয়ালপাড়ায় শ্রীশ্রীমায়ের খুব অসুখ। তখন হঠাৎ রাধু শ্বশুরবাড়ি যাইবে বলিয়া জয়রামবাটী চলিয়া আসে। মাকে বলিয়াছিল, 'তােমাকে দেখবার কত ভক্ত আছে, আমার স্বামী ছাড়া আর কে আছে?” মা এই ঘটনা উপলক্ষে বলিয়াছিলেন, ‘কাল রাধু তাে অমন করে আমার মায়া কাটিয়ে চলে গেল। মনে ভয় হ’ল, ভাবলুম - ঠাকুর কি তা হলে আমাকে এবার রাখবেন না ?” মা আরও বলিয়াছিলেন, “এই যে ‘রাধি রাধি’ করি, এ একটা মায়া নিয়ে আছি বইতাে নয়।” 

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে। মণীন্দ্র ও প্রভাকর বিদায় লইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। রাত্রেই তাঁহারা আরামবাগ যাইবেন। 

মা বলিলেন, “তােমরা একটু কিছু খাও।” 

প্রভাকর - আমরা খেয়ে এসেছি। 

মা - একটু খাও না কেন ? ওগাে, একটু মিষ্টি এনে দাও তাে। 

পরে আমাদের বলিলেন, “তােমরা খাওয়া-দাওয়া করে যেও।” 

মণীন্দ্র - আচ্ছা, মা। 

মা - গাড়ি হয়েছে? 

মণীন্দ্র - হয়েছে। 

প্রণাম করিয়া বিদায়গ্রহণের সময় মা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “ভগবানে মতি হােক।" 

মণীন্দ্র - মা, আমাদের মায়া যেন কাটে। 

মা এ কথায় প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করিলেন।  
২৩শে এপ্রিল
ভক্তেরা মাকে প্রণাম করিতে গিয়াছেন। নারায়ণ আয়াঙ্গার মাকে বলিলেন, “মা, আপনার মনে এখন অশান্তি (মাকুর ছেলের মৃত্যুতে ), আমি সেজন্য শীঘ্র রওনা হব মনে করছি।”

মা বলিলেন, “সুখ-দুঃখ আর কোথায় যাবে। এরা তাে আছেই। তোমার তাতে কি ? তুমি এখন থাক। আগামী জ্যৈষ্ঠ মাসের ৪ঠা, ৫ই তারিখে যাবে।” 

১২ই জ্যৈষ্ঠ, সােমবার-১৩২৬ 

স্বামী শান্তানন্দ ও স্বামী হরানন্দ কাশী হইতে আসিয়াছেন। মণীন্দ্রও পুনরায় আসিয়াছেন। সকালে শান্তানন্দ ও মণীন্দ্র প্রভৃতি শ্ৰীশ্রীমাকে প্রণাম করিতে গিয়াছেন। ভক্তেরা কোয়ালপাড়া মঠে থাকেন, মা ‘জগদম্বা আশ্রমে’। 

শান্তানন্দ - মা, আপনার শরীর কেমন আছে ? 

মা - ভালই আছি। 

Internment (রাজদ্রোহিতার সন্দেহে আটক) হইতে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছেলে পূর্বদিনে আসিয়াছে। পুলিশ-হাঙ্গামার ভয়ে ভক্তেরা তাহাকে তখনি বিদায় দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। মাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “ওকে রেখে দাও; আজ থাক, কাল যাবে।” স্বামী কেশবানন্দ তাহাকে মঠে না রাখিয়া অন্য স্থানে রাখিয়াছিলেন। কারণ, তখনও রােজ রাতে চৌকিদার আসিয়া নবাগত ভক্তদের নামধাম লিখিয়া লইত। পরদিন মা তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “সেই ছেলেটি কোথায় ? চলে গেল নাকি?” 

মণীন্দ্র - সে আছে। আজ খাওয়া-দাওয়া করে যাবে। 

মা - (শান্তানন্দকে) রাত্তিরে কোথায় ছিল? 

শান্তানন্দ — জানি না, মা, আমাদের জানায় নাই। 

মা - এখানে যখন জল হয়, কাশীতেও কি সেই সময় জল হয় ? 

শান্তানন্দ - না, মা, শ্রাবণ মাসে সেখানে বর্ষারম্ভ। তবে কখনাে কখনাে বৈশাখ মাসে ঝড় হয়ে আমটাম নষ্ট করে দেয়। 

“কাশীতে যারা মরবে বলে যায় - বুড়ীরা, তাদের, মা, বড় কষ্ট। হয়তাে বাড়ী থেকে টাকা পাঠাত, বন্ধ করে দিয়েছে। নীচের সাঁৎসেঁতে অন্ধকার ঘরে থাকতে হয়।” 

মা - “হ্যাঁ, বুড়ীদের খুব কষ্ট দেখেছি, যখন কাশীতে বংশী দত্তের বাড়িতে ছিলুম। সামান্য চাল ভিক্ষে করে এনে হয়তাে ভিজিয়েই তা খেয়ে ফেলতো, রাঁধতো না।” 

শান্তানন্দ  - বুড়ীরা মরতে গিয়ে আবার দীর্ঘজীবি হয়। 

মা - বিশ্বনাথ-দর্শন-স্পর্শনে পাপক্ষয় হয়, তাতেই দীর্ঘজীবি হয়। বৃন্দাবনে শাঁখের জল গায়ে দেয়, প্রসাদ খাওয়ায় বলে দীর্ঘজীবি হয়। 

মা এবার রাধুর কথা বলিতেছেন, “রাধু একটু দাঁড়াতে পারলে হয়। ঘরেই শৌচাদি করছে। এ ভাবে আমাকে আর কদিন রাখবেন, ঠাকুর যে কি করবেন, জানি না।” 

মা শান্তানন্দ স্বামীকে মাকুর ছেলের কথা বলিতেছেন, “শােকে মানুষকে যা জব্দ করে এমন আর কিছুতেই পারে না। শরতেরও তার জন্য খুব কষ্ট হয়েছে। কালো ঔষধ আনতে কলকাতা গেল। এরা আবার তাকে বলে দিচ্ছি, শরতের সঙ্গে যেন দেখা না করে। আমি বলি, ‘কলকাতা যাবে, শরতের সঙ্গে দেখা করবে না-কি রকম কথা’ ?” 

মণীন্দ্ৰ - হ্যাঁ , শরৎ মহারাজ লিখেছিলেন—কালো যেন সটান আমার কাছে আসে। 

মা তরকারি কুটিতেছিলেন। চেলো (ফল) দেখিয়া শান্তানন্দ স্বামী বলিলেন, “এ কলকাতায় পাওয়া যায় না।” 

মা—এতে ছেঁচকি হয়, অম্বলে দেওয়া চলে, ঠাণ্ডা গুণ, ভাল জিনিস। ( মণীন্দ্রকে) জাহানাবাদে পাওয়া যায় ?

মণীন্দ্র - হ্যাঁ, মা। 

শান্তানন্দ স্বামী মায়ের নিকট দেশের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলিলেন।

শান্তানন্দ - ইনফ্লুয়েঞ্জাতে শুনছি ষাট লক্ষ লোক মরেছে। ধান চাল সব দুর্মুল্য - লােকের বড় কষ্ট। 

মা - হ্যাঁ, বাবা। লােকে খেতে পাচ্ছে না, আবার যার ঘরে ছেলেপিলে আছে তার আরও কষ্ট। এই তাে আরম্ভ হয়েছে। বর্ষা হয়ে ধানচাল হলে তবে তো কষ্ট যাবে। কে সাহেব না - কি এসেছিল কলকাতায় যেখানকার ধান চাল সেখানে থাকবে, আইন করবে ব'লে, সে না - কি চলে গেছে। 

মণীন্দ্র - সেরুপ তাে চেষ্টা হচ্ছে। 

শান্তানন্দ - লােকের কষ্ট তত দিন দিন বাড়ছে। এত কষ্ট দেশে ! এ কি, মা, কর্মফল ? 

মা — এত লােকের কি কর্মফল ? কি একটা হাওয়া এসেছে। 

শান্তানন্দ - যুদ্ধ থেমে গেছে, শুধু জিনিসপত্র সস্তা হচ্ছে না কেন?

মা - তবে যে বলে, আবার যুদ্ধ হচ্ছে ? 

শান্তানন্দ — সে এখানে - কাবুলে। এত দুঃখকষ্ট, যুদ্ধবিগ্রহ! এ কি, মা, যুগপরিবর্তন হবে আবার?

মা - (হাসিয়া) কি করে বলবাে? তাঁর ইচ্ছায় কি হবে কেমন করে জানবাে? রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট হয়। হিংসা, খলতা, ব্রহ্মহত্যা - এই সব পাপ; রাজার পাপে প্ৰজার কষ্ট ও দৈব-উৎপাত - যেমন যুদ্ধ, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ। সবাই একটু নরম হলে তাে যুদ্ধ থেমে যায়। 


“আহা, ভারতেশ্বরী (ভিক্টোরিয়া) কেমন ছিলেন ? লােকে কেমন সুখে স্বচ্ছন্দে ছিল। এখন একটি পাঁচ বছরের ছেলে - সেও দুঃখের কথা বােঝে, বলে আমার পরবার কাপড় নেই। আচ্ছা, শরৎ যে এখানে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কতগুলি চাল দেওয়া হ’ল ?” 

মণীন্দ্র - কত তা ঠিক বলতে পাচ্ছি না। তবে প্রতি সপ্তাহে চৌত্রিশ টাকার চাল দেওয়া হয়। 

মা - কত করে পাচ্ছে ? 

মণীন্দ্র - জন প্রতি এক পােয়া হিসাবে। 

মা - প্রত্যেকে কত পেলে ? 

মণীন্দ্র - ছয় সের, সাত সের, আট সের, যাদের যেমন লােক খেতে। 

মা - কতগুলি লােক পেলে ? 

মণীন্দ্র - ঠিক জানি না, মুসলমানের মেয়েরাই বেশী ভিখারী।

মা - হ্যাঁ , এখানে মুসলমানেরা গরীব বেশী। আচ্ছা, শরৎ আর কোথায় চাল দিচ্ছে ? 

মণীন্দ্র - বাঁকুড়া, ইন্দপুর, মানভুম। যেখানে দুর্ভিক্ষ সেখানে দিচ্ছেন। 

মা - ছেলেরা যাচ্ছে সেখানে ? 

শান্তানন্দ - মঠ থেকে যাচ্ছে। 

মণীন্দ্র - ইন্দপুর, যেখানে সাতুর যাবার কথা হয়েছিল। 

মা - সাতুর ভগ্নীটির শিওড়ে বিবাহ হয়েছে। 

মণীন্দ্র - হ্যাঁ, মা; সাতু বিবাহে না যাওয়ায় তার বাপ মা - 

মা — হ্যাঁ, বড় দুঃখিত হয়েছে; তা হবেই তাে, কিন্তু সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ বিয়েতে যাবে কেমন করে ? অন্য সময় যাবে বই কি। 

“প্রভাকরের ছেলেটি ভাল হলে হয়। ছেলে হওয়া এক পাপ। তিনি বলতেন --সংসারে সব ভেলকিবাজি। ভেলকিবাজি বটে, তবে মনে থাকে না এই-ই দুঃখ।” 

১৬ই আষাঢ় বৈকালে মণীন্দ্র, প্রভাকর, শ্যামবাজারের প্রবােধবাবু প্রভৃতি মাকে দর্শন করিতে গিয়াছেন। প্রণাম করিতেই মা প্রভাকরকে জিরাশা করিলেন, “ছেলে ভাল আছে তাে? অসুখ করেছিল।”

প্রভাকর - ভাল আছে। 

মা - তােমরা কতক্ষণ এলে? ভাত খাওয়া হয়েছে? 

প্রভাকর - হয়েছে।

মণীন্দ্র ও প্রবোধবাবু, নিবেদিতা স্কুলে মেয়েদের ভর্তি করিয়া দিতে ইচ্ছুক। 

সে কথা উত্থাপন করিয়া মায়ের অনুমোদন প্রার্থনা করায় তিনি বললেন, “বেশ তাে, শরৎকে লেখ।” 

প্রবােধবাবু — তাঁকে লেখা হয়েছে। 

স্ত্রী-ভক্তদের কে একজন বলিলেন, “থাকতে পারবে কি ? ছেলেমানুষ।” 

মা - খুব পারবে। পূর্ববঙ্গের মেয়েরা ছ'সাত বছর বয়স, থাকে তাে ? তাদের মা বাপ নিতে এলেও যেতে চায় না। 

প্রবােধবাবু - আজ গ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম। খুব কষ্ট লােকদের। পরনের কাপড় নেই - আমাদের সামনে বেরুতে পারলে না। চালে খড় নেই। ( প্রবােধবাবু প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত।) 

মা - তাদের চাল দেওয়া হ’ল কি ? 

প্রবােধবাবুদ - কাল রবিবারে দেওয়া হয়েছে। 

মা - কাপড় দেওয়া হয় কি ? 

প্রবােধবাবু - বেছে বেছে দেওয়া হয়। - মা, আপনি কি এক স্বপ্ন দেখেছিলেন শুনেছি - একটি স্ত্রীলােক কলসী ও ঝাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। 

মা — হ্যাঁ, একটি মেয়ে একটি কলসী ও ঝাঁটা হাতে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি কে গাে ? সে বললে—আমি সব ঝেটিয়ে যাব। আমি বললুম - তারপর কি হবে? সে বললে - অমৃতের কলসী ছড়িয়ে যাব। তাই বুঝি হচ্ছে। মার মুখে শুনতুম যে, যখন হয় উপর উপর তিন বছর দুর্ভিক্ষ হয়। দু-বছর হয়েছে কি ? 

মণীন্দ্র - যুদ্ধ তাে অনেক দিন হচ্ছে। 

মা - যুদ্ধ তাে চার-পাঁচ বছর হচ্ছে। তা নয়, দুর্ভিক্ষ কি দু-বছর হয়েছে ? তা হলে আর এক বছর হবে। 

“এখন ধানের দাম কত ?” মা জিজ্ঞাসা করিলেন। ও দেশের হিসাবে মূল্য বলা হইল। 

মা বলিলেন, “এত দাম? আর সব জিনিসই - কাপড়, তেল, এ সব তাে খুব চড়েছে। যাদের আছে, তাদেরও চিন্তাভাবনা। এবার ‘তােমার চামড়া আমি খাব, আমার চামড়া তুমি খাবে’।” 

“তিনি যত দুঃখকষ্ট দিচ্ছেন, তা তাে বুক পেতে নিতে হবে। ভগবান যা করবেন তাই হবে।” 

প্রবােধবাবু - মা, আপনাকেই যখন এত কষ্ট ভােগ করতে হচ্ছে তখন আর কারুরই কি পরিত্রাণ আছে ? 

মা - আমাকে ঠিক যেন খাঁচায় পুরে রেখেছে! নড়বার চড়বার জো নেই - কোন দিকে পালাবার উপায় নেই। 

প্রবোধবাবু - কামারপুকুরে আবার গােলমাল হচ্ছে ঠাকুরের জায়গা নিয়ে।* 

মা - কে গােলমাল করছে ? মহিমবাবু ?

প্রবােধবাবু - না, ফকিরবাবু আর হেমবাবু। 

মা - আচ্ছা, গােলমালে কাজ কি ? বেড়া সরিয়ে নিলে কি হয় না? 

প্রবােধবাবু - আমি তাে খুঁটো চারদিকে পুঁতে দিয়ে এসেছি। মহিমবাবু রাস্তার উপর মাটি পড়াতে বরং সন্তুষ্ট। আমাদের আরও খানিকটা এগিয়ে খুঁটো পুঁতলে ভাল হতাে। তারপর যত আপত্তি করতে, ক্ৰমশঃ সরিয়ে আনা হতাে। যেমন ব্যবসাদার, তেমনি ব্যবসাদারী বুদ্ধি দরকার। 

মা এই আশ্চর্য ব্যবস্থা শুনিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। 

প্রবােধবাবু - শরৎ মহারাজকে লিখেছি। তিনি যেমন বলবেন তেমনি করবাে। 

মা - পূর্বে মুনিষের (মজুরের) দাম চার পয়সা ছিল। আমার মনে আছে, এতখানা একটা কাগজে লিখে কলকাতায় লোক পাঠাতাে। সে হেঁটে যেতাে। তখন ডাক ছিল না। 

প্রবােধবাবু - এখন ডাক হয়ে কিন্তু সুবিধা হয়েছে, মা।

মা - তা হয়েছে। পূর্বে যা ছিল তাই বলছি। এক টাকায় অনেক তেল পাওয়া যেতাে। এখন ধান এক আঁজলাতেই টাকা বলে সকলে ধান বেচে দিচ্ছে টাকা বেশী পাওয়া যায় কি-না। বাকি সামান্য যা থাকছে তাও তাে রাখতে পারবে না, কেন না পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। খেতে হবে তো? 

 “প্ৰসন্ন ( বড় মামা)  চার-পাঁচ শ’ টাকার ধান বেচে দিলে। তার কিছু ধান চুরি গিয়েছিল। রাজ ঘোষও ধান বেচে ফেলেছে। তার অনেক ধান। 

তাকে নাকি চিঠি দিয়েছিল - তুমি এত টাকা দাও, না হলে তােমার বাড়ীতে চুরি হবে।’ সে পুলিসে চিঠি দেখিয়েছিল, বােধ হয় গ্রামের দুষ্ট লােকে ঐরুপ করছে।” 

মণীন্দ্র ও প্রবােধবাবু পরদিন শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতে গিয়াছেন। প্রবােধ বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, জোর করে সংসার ত্যাগ করা চলে ?” 

মা এ কথায় সম্মিত মুখে অমনি উত্তর দিলেন, “লােকে তাে করছে গাে।” 

প্রবােধবাবু - মহামায়ার প্রসন্নতা লাভ না করে যদি নিজের খেয়ালে কেউ সংসার ত্যাগ করে, তা হলে বােধ হয় গােল বাধে। 

মা - ঘরে ফিরে আসে। 

মণীন্দ্র - স্বামীজীও খুব কষ্ট করেছিলেন। তিনি কিন্তু উতরে গেলেন - শরীরে সয়ে গেল। 

মা - না, তাঁকেও খুব ভুগতে হয়েছে, পেচ্ছাবের অসুখ। সর্বদাই গা জ্বালা করতাে। তবু খেটে খেটে মুখ দিয়ে রক্ত উঠিয়েছিলেন। 

মণীন্দ্র - মুখ দিয়ে রক্ত পড়েছিল ! 

মা - মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে নি। এত পরিশ্রম করেছিলেন যে রক্তওঠা পরিশ্রম। 

প্রবােধবাবু - শুনেছি, স্বামীজী হরি মহারাজের গলা ধরে কেঁদেছিলেন দাজিলিং-এ-“ভাই, তােমরা শুধু তপস্যা নিয়ে থাকবে—আমি একা প্রাণ বার করছি।’ 

মা - হ্যাঁ, বাবা, তিনি ( স্বামীজী ) নিজের দেহের রক্ত দিয়েছিলেন পরের জন্যে। নরেনই তাে বিলাত থেকে ফিরে এসে এই সব করলে। তাই ছেলেদের দাঁড়াবার একটু জায়গা হয়েছে। এখন বিলাতে (বিলাত বলিতে শ্রীশ্রীমা আমেরিকা বুঝিয়াছিলেন) চার জন ছেলে আছে ?

প্রবােধবাবু - হ্যাঁ ; স্বামী অভেদানন্দ, স্বামী প্রকাশানন্দ, স্বামী পরমানন্দ ও স্বামী বােধানন্দ। 

মা - কালীর নামটি কি? 

মণীন্দ্র - স্বামী অভেদানন্দ। 

মা - বসন্ত [ স্বামী পরমানন্দ ] এখানে চিঠিপত্র লেখে টাকাকড়ি পাঠায়। 

সেখানে বক্তৃতা দেয়। যােগেন [ স্বামী যােগানন্দ ] খুব কঠোর করেছিল, তীর্থে গিয়ে আঁজলা (অঞ্জলি) করে জল খেত। রুটি শুকিয়ে গুড়িয়ে রেখে দিত। তাই কিছু কিছু খেত। তাতে খুব পেটের অসুখ করে। তাইতেই ভুগে ভুগে দেহ গেল।...সংসারে কি সুখ আছে ? এই আছে, এই নাই। সংসার বিষের গাছ। বিষে জেরে ফেলে। তবে যারা সংসার করে ফেলেছে, তারা আর কি করবে। বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারে না।

ভক্তেরা প্রণাম করিয়া মঠে (কোয়ালপাড়া-মঠে) ফিরিলেন। বৈকালে আবার মণীন্দ্র ও প্রবােধবাবু শ্রীশ্রীমায়ের নিকট গিয়াছেন। 

প্রবােধবাবু — শরৎ মহারাজ পত্রের উত্তর দিয়াছেন; পড়বাে, মা ? 

মা - পড়।

প্রবােধবাবু, চিঠি পড়িয়া মাকে শুনাইলেন। অন্যান্য কথার মধ্যে এই লেখা ছিল - “আমার মত হইলে কি হইবে। বীণাকে (প্রবোধবাবুর মেয়ে) এখানে রাখা সম্বন্ধে ঠাকুরের ইচ্ছা অন্যরূপ।” 

মা - তাই তাে, এমন কথাটা কেন লিখলে বল দেখি? একেবারে কাটিয়ে লিখে দিয়েছে। তা বােধ হচ্ছে — সুধীরার মত নেই। সুধীরা বলেছিল ‘মা, আর পারি নে। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। মেয়েদের জন্যে সে কত কষ্ট করে। যখন খরচ আর চলে না, বড়লােকের মেয়েদের গানবাজনা শিখিয়ে মাসে ৪০।৫০ টাকা আনে। স্কুলের মেয়েদের সব শিখিয়েছে - সেলাই করা, জামা তৈরী করা। সে বছর তিনশ’ টাকা লাভ হয়েছিল। ঐ টাকায় ওরা হেথা সেথা যায় - পুজোর সময়। সুধীরা দেবৱতের (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) ভগ্নী। তাই নিজে স্টেশনে আড়ালে থেকে ভগ্নীকে টিকিট কাটতে, একলা গাড়িতে উঠতে—এ সব শিখাতাে। 

“মাদ্রাজের দুটি মেয়ে বিশ-বাইশ বছর বয়স, বিবাহ হয় নাই, নিবেদিতা স্কুলে আছে। আহা! তারা সব কেমন কাজকর্ম শিখেছে। আর আমাদের। এখানে পােড়া দেশের লােকে কি আট বছর হতে না হতেই বলে—“পরগোত্র করে দাও, পরগােত্র করে দাও। আহা! রাধুর যদি বিয়ে না হােত, তা হলে কি এত দুঃখ-দুর্দশা হতাে।” 

* ঠাকুরের জন্মস্থানে মন্দির করিবার জন্য যে নূতন জমি কেনা হইয়াছে তাহা লইয়া তখন গােলমাল হইতেছিল। 

~শ্রীপ্রবােধ ও শ্রীমণীন্দ্র

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত পুজনীয়া যােগেন-মা

শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হইবার কিছুদিন পরে একদিন আমি দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলুম। তাড়াতাড়ি খাইয়া যাইতে পারি নাই। ঠাকুর তাহা শুনিয়া বলিলেন, “আহা, তুমি খাওনি, নহবতে যাও, সেখানে ভাত তরকারি আছে, খাও গে।” নহবতে মায়ের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা হইল। রামের মা প্রভৃতির সঙ্গে দুই-এক বার মায়ের পরিচয় হইয়াছিল। তাহারা মাকে বলিল যে আমি খেয়ে যাইনি। মা অমনি তাড়াতাড়ি ভাত তরকারি লুচি প্রভৃতি যা ছিল আমায় খাইতে দিলেন। সেই প্রথম দেখাতেই মায়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব হইয়া গেল। ইহার পর রামলালদাদার বিবাহের সময় মা যেদিন দেশে যাইবেন সেই দিন আমি দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছিলাম। অনেক দিন মায়ের সহিত দেখা হইবে না ভাবিয়া আমার মনে খুব কষ্ট হইল। যাইবার সময় মা ঠাকুরকে প্রণাম করিতে আসিলেন। উত্তরের বাৱান্দায় ঠাকুর গিয়া দাঁড়াইলে মা প্রণাম করিলেন, পায়ের ধুলা লইলেন। ঠাকুর বলিলেন, “সাবধানে যাবে। নৌকায় রেলে কিছু ফেলে টেলে যেও না।” মা ও ঠাকুরকে সেই আমি এক সঙ্গে দেখি। তাঁহাদিগকে একত্রে দেখিতে আমার সাধ ছিল। মা নৌকায় রওনা হইলেন। যতদূর দেখা গেল আমি নৌকার দিকে চাহিয়া রহিলাম। নৌকা অদৃশ্য হইলে নহবতে মা যেখানে বসিয়া ধ্যান করিতেন সেখানে বসিয়া খুব কাঁদিতে লাগিলাম। নহবতের পশ্চিম ধারের বারান্দায় দক্ষিণমুখে বসিয়া মা ধ্যান করিতেন। ঠাকুর এদিকে আসিবার সময় আমার কান্না শুনিতে পাইয়াছিলেন। নিজের ঘরে গিয়া আমায় ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি যাইলে তিনি বলিলেন, ‘ও চলে যেতে তোমার খুব দুঃখ হয়েছে ?” এই বলিয়া আমায় যেন ভুলাইবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর যে-সব সাধনা করিয়াছিলেন সেই-সব কথা বলিতে লাগিলেন ;, বলিলেন, “এ-সব কারুকে বােলো না।” ঐ দিন ঠাকুরের খুব কাছে বসিয়া কথাবার্তা হইল। বৌ-মানুষ—এতদিন সঙ্কোচ ছিল। প্রায় দেড় বৎসর পরে মা দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিলেন। ঠাকুর লিখিয়াছিলেন, “আমার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে।” মা আসিলে ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “সেই যে ডাগর-ডাগর চোখ মেয়েটি আসে সে তােমাকে খুব ভালবাসে। তুমি যাবার দিন সে নহবতে বসে খুব কেঁদেছিল।” মা বলিলেন, হ্যাঁ, তার নাম যােগেন।” আমি যখনি দক্ষিণেশ্বরে যাইতাম, মা আমাকে সব কথা বলিতেন পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতেন। আমি মায়ের চুল বাঁধিয়া দিতাম। আমার হাতের চুলধাঁধা মা এত ভালবাসিতেন , তিন-চার দিন পরেও স্নানের সময় মাথার চুল খুলিতেন না; বলিতেন, “না ও যােগেনের বাধা চুল, সে যেদিন আসবে সেই দিন খুলবাে।” আমি সাত-আট দিন পর পর ঠাকুরের কাছে যাইতাম। দক্ষিণেশ্বর হইতে শিবপূজার জন্য বেলপাতা লইয়া আসিতাম, সেই সব বেলপাতা শুকাইয়া গেলেও সেই শুকনো বেলপাতা দিয়া শিবপূজা করিতাম। একদিন মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “যােগেন, তুমি শুকনাে বেলপাতায় পূজো কর কি ?” 

“হ্যাঁ, মা, তুমি তা কি করে জানলে?” 

“আজ আমি সকালে ধ্যান করবার সময় দেখতে পেলুম যে তুমি শুকনো বেলপাতায় পুজো করছ।” 

একদিন নহবতে বসিয়া মা পান সাজিতেছিলেন, আমি পাশে বসিয়া দেখি মা কতকগুলি পান ভাল করিয়া এলাচ দিয়া সাজিলেন, আর কয়েকটা শুধু, সুপারি-চুন দিয়া সাজিলেন। আমি বলিলাম, “কই এগুলিতে মসলা-এলাচ দিলে না? ওগুলি বা কার, এইগুলিই বা কার? 

মা বলিলেন, “যোগেন, এগুলি (ভালগুলি) ভক্তদের, এদের আমাকে আদর যত্ন করে আপনার করে নিতে হবে। আর ওগুলি (এলাচ-না-দেওয়াগুলি ) ওঁর জন্যে, উনি তো আপনার আছেন-ই।” 

মা বেশ গাহিতে পারিতেন। লক্ষীদিদি ও মা একদিন রাত্রিতে মৃদু, গলায় গান করিতেছিলেন। বেশ জমিয়াছে—ঠাকুর তাহা শুনিতে পাইয়াছিলেন । পরদিন বলিতেছেন, “কাল যে তােমাদের খুব গান হচ্ছিল। তা বেশ বেশ, ভাল।” 

দক্ষিণেশ্বরে সমস্ত দিন মায়ের একাটুকুও বিশ্রামের সময় ছিল না। ভক্তদের জন্য তিন সের–সাড়ে তিন সের আটার রুটি হইত। পানই সাজিতেন কত? তারপর ঠাকুরের দুধ খুব ঘন করিয়া জাল দিতেন; কারণ ঠাকুর সর ভাল বাসিতেন। তাঁহার জন্য ঝােল হইত। ঠাকুরের মা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন ঠাকুর ততদিন নহবতে খাইতেন। ঠাকুরের মা শরীর রক্ষা করিবার পর তিনি নিজের ঘরেই খাইতেন। ছেলেরা কেহ না থাকিলে স্নানের সময় মা ঠাকুরকে তেল মাখাইয়া দিতেন। গােলাপদিদি আসিলে ঠাকুর একদিন তাহাকে ভাতের থালা আনিতে বলেন। তদবধি গােলাপদিদি প্রত্যহই ভাত লইয়া যাইত। ভাত দিতে গিয়া মা রােজ ঠাকুরকে একবারটি দেখিতে পাইতেন, এইরূপে তাহাও বন্ধ হইল। গােলপদিদি সন্ধ্যার পর অনেকক্ষণ ঠাকুরের কাছে থাকিত, কোন দিন হয়তাে বা রাত দশটার সময় নহবতে ফিরিত। নহবতের বারান্দায় মাকে গােলাপদিদির খাবার লইয়া বসিয়া থাকিতে হইত, সেজন্য তিনি অসুবিধা বােধ করতেন। একদিন ঠাকুর শুনিতে পাইয়াছিলেন—মা বলিতেছেন, “খাবার বিড়াল কুরে খায় খাক, আমি আর আগাতে পারবাে না।” পরদিন ঠাকুর গােলাপদিদিকে বলিলেন, “তুমি এতক্ষণ থাক, ওর কষ্ট হয়। ওকে খাবার আগলে থাকতে হয়।” গােলাপদিদি বলিলেন, “না, মা আমাকে খুব ভালবাসেন, মেয়ের মতাে নাম ধরে ডাকেন।” গােলাপদিদির জন্য ঠাকুরের কাছে আসিবার সুযােগ বন্ধ হওয়ায় মা যে দুঃখিতা, একথা গােলাপদিদি বুঝিতে না পারিলেও ঠাকুর বুঝিতে পারিয়াছিলেন। 

একদিন গােলাপদিদি মাকে বলিয়াছিলেন, “মা, মনােমােহনের মা বলছিল - ‘উনি অত বড় ত্যাগী, আর মা এই মাকড়ী-টাকড়ী এত গয়না পরেন, এ ভাল দেখায় কি?” 

পরদিন সকালে আমি দক্ষিণেশ্বরে গিয়া দেখি -- কেবল হাতে সােনার বালা দুগাছি রাখিয়া মা আর সব গহনা খুলিয়া ফেলিয়াছেন। 

আমি একটু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, একি?” 

মা বলিলেন, “গােলাপ বললে”। 
আমি অনেক বুঝাইতে তবে মা মাকড়ী আর সামান্য দুই-একটি গহনা পরিলেন। সেই যে গহনা খােলা হইল আর পরা হইল না। কারণ, তার পরই ঠাকুরের অসুখ আরম্ভ হইয়াছিল। 

মা যখন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসেন তখন তিনি সংসারের বিশেষ কিছুই বুঝিতেন না এবং ভাবটাবও হইত না। নিষ্ঠার সহিত ভগবানের নিত্য জপ ধ্যান করলেও তাঁহার ভাব-সমাধি হইত—এ কথা আমরা শুনি নাই। বরং ঠাকুরের ভাব হইতে দেখিলে মা বড়ই ভীতা ও চিন্তিত হইয়া পড়িতেন। কারণ মায়ের মুখেই শুনিয়াছি-দক্ষিণেশ্বরে মা যেবার প্রথম আসেন, রাত্রে ঠাকুর তাঁহাকে নিজের কাছে রাখিতেন।* তখন মা ও ঠাকুর এক ঘরেই শুইতেন, 

ঠাকুর বড় তক্তাপোশে আর মা ছোট খাটটিতে। মা বলিতেন, “সমস্ত রাত ঠাকুরের ভাব হােত, তাই দেখে আমার ঘুম হােত না। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতুম, ভাবতুম- রাত কখন পােহাবে। একদিন ভাব আর ভাঙে না। তখন অস্থির, হয়ে কালীর মাকে (ঝি ) দিয়ে হৃদয়কে ডেকে পাঠালুম। সে এসে নাম শুনাতে তবে ভাব ভাঙে। পরদিন ঠাকুর যে রকম ভাব দেখলে যে মন্ত্র শুনাতে হবে আমায় সব শিখিয়ে দিলেন।”

আমার সহিত মায়ের পরিচয় হইবার কিছুদিন পরে একদিন মা আমাকে বলিলেন, “ওকে বােলো যাতে আমার একটু ভাবটাব হয়, লােকজনের জন্য ওকে এ কথা বলবার আমার সুযোগ হয়ে উঠছে না।” 

আমি ভাবিলাম হবেও বা; মা যখন অনুরোধ করিতেছেন তখন ঠাকুরকে ঐ কথা বলি। পরদিন সকালে ঠাকুর একা তক্তপােশে বসিয়া আছেন দেখিয়া আমি প্রণাম করিয়া তাঁহাকে মায়ের কথা বলিলাম। তিনি ঐ কথা শুনিলেন, কিন্তু কোন উত্তর না দিয়া গম্ভীর হইয়া রহিলেন। তিনি যখন ঐরুপ গম্ভীর হইয়া থাকিতেন, তখন কথা বলিতে কাহারও সাহস হইত না। তাই আমি কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিলাম। নহবতে আসিয়া দেখিলাম - মা পুজা করিতেছেন। দরজা একটু খুলিয়া দেখি মা খুব হাসিতেছেন। এই হাসিতেছেন আবার একটু পরেই কাঁদিতেছেন। দুই চক্ষু দিয়া ধারার বিরাম নাই। কতক্ষণ এইভাবে থাকিয়া ক্ৰমে স্থির হইয়া গেলেন একেবারে সমাধিস্থা। আমি ইহা দেখিয়া দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া আসিলাম, অনেকক্ষণ পর পুনরায় যাইতে মা বলিলেন, “( ঠাকুরের কাছ থেকে) এই এলে?” তখন আমি বলিলাম, “তবে, মা, তােমার না-কি ভাব হয় না?” মা তখন লজ্জা পাইয়া হাসিতে লাগিলেন। ঐ ঘটনার পর আমি দক্ষিণেশ্বরে কখন-কখনও রাত্রিতে মায়ের কাছে থাকিতাম। আমি আলাদা শুইতে চাহিলে মা কিছুতেই শুনিতেন না, আমায় কাছে টানিয়া লইয়া শুইতেন। একদিন রাত্রিতে কে বাঁশী বাজাইতেছিল। বাঁশীর স্বরে মায়ের ভাব হইল, থাকিয়া থাকিয়া হাসিতে লাগিলেন। আমি সঙ্কোচে বিছানার এক কোণে বসিয়া রহিলাম। ভাবিলাম -- আমি সংসারী মানষ, ওকে এই সময় ছোঁব না। অনেকক্ষণ পরে মায়ের ভাব উপশম হইল। 

মা বলরামবাবুর বাড়ীতে ছাতে বসিয়া একদিন ধ্যান করিতে করিতে সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। হুঁশ আসিতে বলিয়াছিলেন, “দেখলুম, কোথায় চলে গেছি। সেখানে সকলে আমায় কত আদর যত্ন করছে। আমার যেন খুব সুন্দর রূপ হয়েছে। ঠাকুর রয়েছেন সেখানে। তাঁর পাশে আমায় আদর করে বসালে। সে যে কি আনন্দ বলতে পারি নে ! একটু হুঁশ হতে দেখি যে, শরীরটা পড়ে রয়েছে। তখন ভাবছি, কি করে এই বিশ্রী শরীরটার ভেতর ঢুকবাে। ওটাতে আবার ঢুকতে মােটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। অনেক পরে তবে ওটাতেও ঢুকতে পারলুম এবং দেহে হুঁশ এলো।”

বেলড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়ীতে একদিন সন্ধ্যার পর মা, আমি ও গােলাপ দিদি ছাতে পাশাপাশি বসিয়া ধ্যান করিতেছিলাম। আমার ধ্যান শেষ হইলে দেখি, মা তখনও একভাবে বসিয়া আছেন--স্পন্দনহীন, সমাধিস্থা। অনেকক্ষণ পরে হুঁশ আসিলে মা বলিতে লাগিলেন, “ও যোগেন, আমার হাত কই-পা কই?” আমরা মায়ের হাত ও পা টিপিয়া দেখিতে লাগিলাম—এই যে পা—এই যে হাত; তবুও দেহটা যে রহিয়াছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত মা বুঝিতে পারেন নাই। 

বৃন্দাবনে কালাবাবার কুঞ্জে একদিন সকালে ধ্যান করিতে করিতে মায়ের সমাধি হইল। সমাধি কিছুতেই আর ভাঙ্গে না। আমি অনেকক্ষণ নাম শুনাইলাম, তাহাতেও সমাধি ভাঙিল না। শেষে যােগেন স্বামী আসিয়া নাম শুনাইবার পর সমাধির একটু উপশম হইলে ঠাকুর সমাধিভঙ্গের সময় যেরুপ বলিতেন, মা সেইরূপেই বলিলেন, “খাব”। কিছু খাবার, জুল ও পান তাঁহার সম্মুখে দেওয়া হইলে, ঠাকুর ভাবাবেশে যেরূপে খাইতেন, মা সেইরূপে ঐ সকল একটু একটু খাইলেন। পানটি পর্যন্ত ঠাকুর যে ভাবে সরু দিকটা কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া খাইতেন, মাও ঠিক সেই ভাবে খাইলেন। তখন তাহার ভাব-ভঙ্গি খাওয়া-দাওয়া সবই হুবহু ঠাকুরের মতাে হইয়াছিল। আমরা দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম। ভাব সম্পূর্ণ উপশম হওয়ার পর মা বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার উপর ঐ সময় ঠাকুরের আবেশ হইয়াছিল। যােগেন স্বামী মায়ের ঐরূপ ভাবস্থার সময় কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া ঠাকুর যেরূপ উত্তর দিতেন ঠিক সেইরুপ উত্তর পাইয়াছিলেন। 

ঠাকুরের দেহরক্ষার কয়েকদিন পরেই রাম দত্ত প্রভৃতি গৃহী ভক্তেরা ভাড়া চুকাইয়া দিয়া কাশীপুরের বাগান বাড়ি হইতে বাসা উঠাইয়া দিবার সঙ্কল্প করিলেন, সেইজন্য মাকে বলরামবাবুর বাড়িতে আনা হইল। তারপর মা তীর্থ দর্শন-মনসে যােগেন মহারাজ, কালী মহারাজ, লাটু মহারাজ, লক্ষীদিদি প্রভৃতির সঙ্গে কাশী আসেন। কাশীতে আট-দশ দিন থাকিবার পর বৃন্দাবনে আসিয়া কালাবাবুর কুঞ্জে প্রায় এক বৎসর ছিলেন। ঠাকুরের দেহ যাইবার দুই এক সপ্তাহ পূর্বে আমি বৃন্দাবনে গিয়াছিলাম। বৃন্দাবনে আমার সহিত দেখা হইতেই মা শােকাবেগে “যােগেন গাে” বলিয়া আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া অধীর হইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর আমার সহিত তাঁহার এই প্রথম দেখা। বৃন্দাবনে মা প্রথম প্রথম খুব কাঁদিতেন। একদিন ঠাকুর আমাকে দেখা দিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ গা, তােমরা এত কাঁদছ কেন? এই তো আমি রয়েছি, গেছি কোথায় ? এই যেমন এ ঘর, আর ও ঘর।” 

বৃন্দাবনে থাকিবার সময় পত্রপুষ্পে সাজাইয়া কীর্তন করিতে করিতে একদিন একটি শব লইয়া যাইতেছিল। মা উহা দেখিয়া বলিলেন, “দেখ, দেখ, মানুষটি কেমন বৃন্দাবন প্রাপ্ত হয়েছেন। আমরা এখানে মরতে এলুম, তা একদিন একটু জ্বরও হ’ল না ! কত বয়স হয়ে গেল বল দেখি, আমার বাপকে দেখেছি, ভাশুরকে দেখেছ?” আমরা শুনে হাসি আর বলি, “বল কি, মা বাপকে দেখেছ! বাপকে আবার কে দেখে না?” এমনি ছেলেমানুষের মতাে কথা মা তখন বলিতেন। প্রথম প্রথম যেমন ঠাকুরের জন্য খুব কাঁদিয়াছিলেন, শেষে কিন্তু ঠাকুর তেমনি আনন্দে মাকে ভরপুর করিয়া রাখিয়াছিলেন। তখন মাকে দেখিলে যেন একটি বালিকা বলিয়া মনে হইত। নিত্য ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঠাকুর দর্শন করিতেন। একদিন রাধারমণ দেখিতে গিয়া মা দেখিয়াছিলেন - যেন নবগােপালবাবুর স্ত্রী রাধারমণের পাশে দাঁড়াইয়া হাওয়া করিতেছেন। তাই দেখিয়া ফিরিয়া আসিয়া মা আমাকে বলিলেন, “যােগেন, নবগোপালের পরিবার বড় শুদ্ধ। আমি এই রকম দেখলুম।” 

বৃন্দাবনে ঠাকুর একদিন মাকে দেখা দিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি যােগেনকে ( স্বামী যােগানন্দকে) এই মন্ত্র দাও।” প্রথম দিন মা ঐ দর্শন মাথার গােলমালে হইয়াছে মনে করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় দিনও ঐরুপ দেখিয়া গ্রাহ্য করেন নাই। তৃতীয় দিন ঐ দর্শন আবার উপস্থিত হইলে মা ঠাকুরকে বলেন, “আমি তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত কই না, কি করে মন্ত্র দিই।” 

ঠাকুর বলিলেন, “তুমি মেয়ে-যােগেনকে (আমাকে) বলো, সে থাকবে।” 

মা আমার দ্বারা যােগানন্দ স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তাঁহার মন্ত্র হইয়াছে কি-না। যােগানন্দ স্বামী বলিলেন, “না, মা, বিশেষ কোন ইষ্টমন্ত্র ঠাকুর আমায় দেন নাই। আমি নিজের রুচিমত একটি নাম জপ করি।” ঐ কথা জানিয়া মা তাহাকে একদিন মন্ত্র দিলেন। ঠাকুরের ছবি ও দেহাবশেষ রক্ষিত কৌটা সম্মুখে রাখিয়া মা পুজা করিতেছিলেন। তিনি যােগানন্দ স্বামীকে ডাকাইয়া বসিতে বলিলেন। পুজা করিতে করিতে মায়ের ভাবাবেশ হইল, সেই ভাবাবেশেই মা মন্ত্র দিলেন। এমন জোরে মন্ত্র বলিলেন যে পাশের ঘর হইতে আমি উহা শুনিতে পাইলাম। 

বৃন্দাবন হইতে মায়ের সহিত আমরা সকলে হরিদ্বার গিয়াছিলাম ; যােগানন্দ স্বামী সঙ্গে ছিলেন। পথে রেলগাড়িতে যােগেন মহারাজের ভীষণ জ্বর হয়। আমি তাহাকে বেদানা খাওয়াইতেছিলাম। মা দেখিয়াছিলেন, আমি যেন ঠাকুরকেই উহা খাওয়াইতেছি। যােগেন স্বামী জ্বরে বেহুশ হইয়া দেখিয়াছিলেন, ভীষণ এক মূর্তি সম্মুখে আসিয়া বলিতেছে, ‘তােকে দেখে নিতুম, কিন্তু কি করবাে, পরমহংসদেবের আদেশ - এখনই আমাকে চলে যেতে হবে, একদণ্ড আর থাকতে পারছি না।’ লালপেড়ে কাপড়-পরা একটি স্ত্রীলােককে দেখাইয়া বলিল, এই মাগীকে কিছু, রসগােল্লা খাওয়া।’ আশ্চর্যের বিষয়, ঐ দর্শনের পরই তাহার জ্বর ছাড়িয়া গেল। পরে হরিদ্বার হইতে আমরা জয়পুরে গিয়াছিলাম। সেখানে গোবিন্দজী দর্শন করিয়া অন্যান্য বিগ্রহ দেখিতে দেখিতে হঠাৎ এক মন্দিরের পার্শ্বের এক মূর্তি দেখিয়াই যােগানন্দ স্বামী বলিয়া উঠিলেন, “এই মূর্তিকেই রসগােল্লা খাওয়াতে বলেছিল।” আবার সামনে রসগােল্লার একটি দোকানও দেখা গেল। তখন আট আনার রসগোল্লা কিনিয়া ঐ মূর্তিকে ভােগ দেওয়া হইল এবং জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল যে উহা মা শীতলার  মূর্তি।

তারপর মা কলিকাতায় ফিরিলেন এবং বলরামবাবুর বাড়ীতে কয়েকদিন থাকিয়া কামারপুকুর গিয়াছিলেন। সেখানে প্রায় এক বৎসর থাকিবার পর ভক্তেরা তাঁহাকে বেলুড়ে নীলম্বরবাবুর ভাড়াটিয়া বাড়িতে প্রায় ছয়মাস আনিয়া রাখেন (১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দ)। পরে কার্তিক মাসে ভাড়াবাড়ি ছাড়িয়া কলিকাতায় বলরামবাবুর বাড়িতে দুই-এক দিন থাকিয়া মা শ্রীক্ষেত্র (পুরী) যাত্রা করিয়াছিলেন। কলিকাতা হইতে চাঁদবালি বড় জাহাজে, চাঁদবালি হইতে কটক ক্যানাল স্টীমারে এবং কটক হইতে গরুর গাড়ীতে পুরী যাওয়া হয়। শরৎ, রাখাল মহারাজ, যোগানন্দ স্বামী প্রভৃতি মায়ের সঙ্গে পুরী গিয়াছিলেন। পুরী গিয়া বলরামবাবুদের ‘ক্ষেত্রবাসীর’ বাড়ীতে অগ্রহায়ণ মাস হইতে ফাগুন মাস পর্যন্ত থাকা হইয়াছিল। সামনের রােয়াকওয়ালা পাকা ঘরটিতে মা থাকিতেন। ঠাকুর জগন্নাথ দেখেন নাই বলিয়া মা কাপড়ের ভিতর ঠাকুরের ছবি লইয়া একদিন ঠাকুরকে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শন করাইলেন। 

জগন্নাথ দর্শন করিয়া মা বলিয়াছিলেন, “জগন্নাথকে দেখলাম যেন পুরুষসিংহ, রত্নবেদীতে বসে রয়েছেন, আর আমি দাসী হয়ে তার সেবা করছি।” পুরী হইতে ফিরিয়া মা মাষ্টার মহাশয়ের বাড়িতে তিন-চার সপ্তাহ থাকিয়া আঁটপুর যান-সঙ্গে বাবুরাম, নরেন, মাষ্টার মহাশয়, সান্ন্যাল আরও সব ছিলেন। সেখানে ছয়-সাত দিন থাকিবার পর গরুর গাড়ীতে তারকেশ্বর হইয়া মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতির সঙ্গে তিনি কামারপুকুর গেলেন। কামারপুকুরে প্রায় এক বৎসর থাকিয়া দোলের পূর্বে মা পুনরায় কলিকাতা আসেন এবং মাস্টার মহাশয়ের কম্বুলিয়াটোলার বাড়িতে মাসখানেক থাকেন। তারপর বলরামবাবুর শেষ অসুখের সময় তাঁহার দেহত্যাগ কাল পর্যন্ত তিনি বলরামবাবুর বাড়িতে ছিলেন। পরে বেলুড়ে শ্মশানের কাছে ঘুসুড়ীর বাড়িতে জ্যৈষ্ঠ হইতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত (১৮৯০ খ্রীঃ) ছিলেন। সেখানে তাঁহার রক্ত আমাশয় হওয়ায় বরাহনগরে সৌরিন্দ্রমােহন ঠাকুরের ভাড়াটিয়া বাড়িতে তাহাকে রাখিয়া চিকিৎসা করান হয়। তথায় কিছুদিন থাকিয়া তিনি বলরামবাবুর বাড়ি আসেন এবং দুর্গাপূজার পর কামারপুকুর হইয়া জয়রামবাটী যান। তারপর আষাঢ় মাসে বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর ভাড়াটীয়া বাড়িতে (১৮৯৩ খ্রীঃ) আসেন ও পরবর্তী মাঘ-ফাল্গুনে কৈলােয়ার যাইয়া দুই মাস তথায় থাকেন। কৈলােয়ার হইতে তাঁহার মাতা ও ভাইদের সহিত মা পুনরায় কাশী বৃন্দাবন গিয়াছিলেন। সেখান হইতে ফিরিয়া মাস্টার মহাশয়ের কলুটোলার বাড়িতে প্রায় একমাস ছিলেন। তারপর দেশে যান। এবার দেশ হইতে ফিরিয়া বাগবাজার গঙ্গার ধারের গুদামওয়ালা বাড়িতে পাঁচ-ছয় মাস ছিলেন-এই বাড়িতে নাগ মহাশয় মাকে দর্শন করেন। পুনরায় দেশে যাইয়া প্রায় দেড়বৎসর পরে মা ফিরিয়া আসিয়া গিরিশবাবুর বাড়ির সামনের বাড়িতে থাকেন। এই বাড়িতেই নিবেদিত মায়ের সহিত প্রায় তিন সপ্তাহ বাস করিয়াছিলেন। তারপর গিরিশবাবুর বাড়ির নিকটে ১৬নং বােসপাড়া লেনে - যেখানে নিবেদিতা প্রথম স্কুল করিয়াছিলেন সেই বাড়িতে ছিলেন। ইহার পর বাগবাজার স্ট্রীটের বাড়িতে (রামকৃষ্ণ লেনের সম্মুখে) আসিয়া তিনি থাকেন। সেখানে শরৎ মহারাজ ছিলেন। তারপর মা দেশে যান। পুনরায় গিরিশবাবুর বাড়ির দূর্গাপূজা উপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া বলরামবাবুর বাড়িতে ছিলেন। দেশে ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়া মা তখন খুব রােগা হইয়া গিয়াছিলেন। পরে আবার দেশে গিয়া ‘উদ্বোধনের’ নূতন বাড়ি হইলে তথায় আসিয়াছিলেন। তারপর কোঠার, মাদ্রাজ, বাঙ্গালাের, রামেশ্বর প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করিয়া তিনি ‘উদ্বোধনে’ ফিরিয়া আসেন এবং অল্প কয়েকদিন পরে দেশে গিয়া রাধুর বিবাহ দেন। প্রায় এক বৎসর পর জয়রামবাটী হইতে কলিকাতায় (উদ্বোধনে) আসিয়াছিলেন। ‘উদ্বোধন’ হইতে কার্তিক মাসে (১৯১২ খ্রীঃ) মা কাশী গেলেন এবং প্রায় তিন মাস কাশীতে থাকিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন।

মাকে বাল্যকালে প্রায়ই রান্না করিতে হইত। তাঁহার মাতা বিশেষ কারণবশতঃ যখনই রান্না করিতে পারিতেন না, মা-ই তখন রান্না করিতেন। মা বলিতেন, “আমি রাঁধতুম, বাবা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দিতেন।” ইদানীং আত্মীয়-স্বজন ও ভক্ত সেবাতেই মায়ের কাল কাটিত। 

*তােতারুমী এক সময় ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন, “তুমি যে কাম জয় করেছ তার প্রমাণ কি স্ত্রীকে কাছে রেখে দাও তবে তাে বঝবাে।” ঠাকুর তাই আপনাকে পরীক্ষা করিবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে মা প্রথম যেবার আসেন সেবায় রাত্রিতে তাহার সহিত এক শয্যায় আট মাস একত্রে শয়ন করিয়াছেন। 

~ পুজনীয়া যােগেন-মা 

শ্রীশ্রীমায়ের সহিত স্বামী শান্তানন্দজী

১৫ই কার্তিক, ১৩১৭ 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, কি ভাবে জীবনযাপন করব ?” 

মা বলিলেন, “যেমন করছাে ঐ ভাবেই কাটিয়ে যাও। তাঁকে ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করবে; সদাসর্বদা স্মরণ-মনন রাখবে।” 

আমি - বড় বড় মহাপুরুষদেরই পতন হয় দেখে মনে বড় ভয় হয়, মা। 

মা - ভােগের জিনিস সব নিয়ে থাকলে তার ভােগের উপকরণও সব এসে থাকে। বাবা, কাঠেরও যদি মেয়েমানুষ হয়, তবে সেদিকে চাইবে না, সেদিক দিয়ে যাবে না। 

আমি — মানুষ তাে কিছুই করতে পারে না, তিনিই তাে সব করাচ্ছেন। 

মা - তিনি সব করাচ্ছেন বটে, কিন্তু সেরূপ বােধ থাকলে তাে হয়? লােকে অহঙ্কারে মত্ত হয়ে মনে করে, আমি সব করছি - তার উপর নির্ভর করে না। যে তাঁর উপর নির্ভর করে, তিনি তাকে সকল বিপদ হতে রক্ষা করেন। 

তারপর জনৈক সাধুকে লক্ষ্য করিয়া মা বলিতে লাগিলেন, “ঠাকুর বলতেন - ‘সাধু সাবধান!’ সাধুর সর্বদা সাবধানে থাকতে হয়। সাধু সর্বদা সাবধানে থাকবে। সাধুর রাস্তা বড় পিছল। পিছল পথে চলতে হলে সর্বদা পা টিপে চলতে হয়। সন্ন্যাসী হওয়া কি মুখের কথা? সাধু মেয়েমানুষের দিকে ফিরেও তাকাবে না। চলবার সময় পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে লক্ষ্য রেখে চলবে। সাধুর গেরুয়া কাপড় কুকুরের বগলসের মতাে তাকে রক্ষা করবে। কেউ তাকে মারতে পারে না। সাধুর সদর রাস্তা। সকলেই তার পথ ছেড়ে দেয়।

“মন্দ কাজে মন সর্বদা যায়। ভাল কাজ করতে চাইলে মন তার দিকে এগোতে চায় না। আমি আগে রাত তিনটার সময় উঠে প্রত্যহ ধ্যান করতুম। একদিন শরীর ভাল না থাকায় আলস্যবশতঃ করলুম না; তা কদিন বন্ধ হয়ে গেল। সেজন্য ভাল কাজ করতে গেলে আন্তরিক খুব যত্ন ও রােখ চাই। যখন নবতে থাকতুম, রাতে যখন চাঁদ উঠতো, গঙ্গার ভিতর স্থির জলে চাঁদ দেখে ভগবানের কাছে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতুম - ‘চন্দ্রতেও কলঙ্ক আছে, আমার মনে যেন কোন দাগ না থাকে। নবতে থাকবার সময় ঠাকুর এমনকি রামলালকেও আমার কাছে আসতে বারণ করতেন, রামলাল তাে ভাশুরপাে হয়। এখন তাে সকলের সঙ্গে কথা কই, সকলের সামনে বেরােই। 

“তুমি কলকাতার ছেলে, ইচ্ছা করলে বিয়ে করে সংসার করতে পারতে - সে সব যখন ত্যাগ করেছ, আবার সেদিকে লক্ষ্য করছো কেন? থুথ ফেলে আবার সেই থুথু-ঘাটা ?” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, আসন-প্রাণায়াম করা কি ভাল?” 

মা - আসন-প্রাণায়াম করলে সিদ্ধাই হয়। সিদ্ধাই লােককে পথভ্রষ্ট করে। 

আমি - সাধুর তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করা কি ভাল? 

মা—মন যদি একস্থানে শান্তিতে থাকে তবে তীর্থ-ভ্রমণের কি দরকার ? 

আমি - মা, ধ্যান হয় না। কুণ্ডলিনী জাগ্রত করে দিন। 

মা - জাগবে বই কি। একটু ধ্যানজপ করলেই জাগবে। আপনি কি আর লাগে? ধ্যানজপ কর। 'ধ্যান করতে করতে মন এমন স্থির হয়ে যাবে যে ধ্যান আর ছাড়তে ইচ্ছা হবে না। যেদিন ধ্যান না হবে, জোর করে ধ্যান করবার আবশ্যক নেই - সেদিন প্রণাম করেই উঠবে। যেদিন হবে আপনিই হবে। 

৫ই আষাঢ়, (১৯-৬-১২)-উদ্বোধন 

আমি - মা, মন স্থির হয় না কেন? যখন ভগবানের বিষয় চিন্তা করি, তখন মন নানা বিষয়ে যায়। 

মা - বিষয় বলতে টাকাকড়ি, পুত্রপরিবার—এই সব বিষয়ে মন যাওয়া খারাপ। কাজকর্ম সম্বন্ধে মন তাে যাবেই। ধ্যান না হয় জপ করবে, ‘জপাৎ সিদ্ধিঃ'। জপ করলেই সিদ্ধিলাভ করবে। ধ্যান হ’ল ভাল, না হয় জোর করে ধ্যান করবার দরকার নেই। 

২৬শে অগ্রহায়ণ, (১৯১২)-কাশীধাম 

আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কাশীতে মঠে থেকে সাধন-ভজন করা ভাল, না নির্জনে সাধন-ভজন করা ভাল ?” 
মা বলিলেন, “নির্জনে হৃষীকেশ প্রভৃতি স্থানে কিছুকাল সাধন-ভজন করে মন পাকলে তারপর মনকে যেখানেই রাখ, যে-লােকের সঙ্গেই মেশো একরূপই থাকবে। যখন গাছ চারা থাকে তখন চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বড় হলে ছাগল গরুতেও কিছু করতে পারে না। নির্জনে সাধন করা খুব দরকার। যখন মনে কোন বিষয় উদিত হবে, জানবার ইচ্ছা হবে, তখন একাকী কেঁদে কেঁদে তাঁর নিকট প্রার্থনা করবে। তিনি সমস্ত মনের ময়লা ও কষ্ট দূর করে দেবেন, আর বুঝিয়ে দেবেন।” 

আমি - আমার তাে সাধন-ভজনের শক্তি নেই, আপনার পাদপদ্ম ধরে পড়ে আছি, যা হয় করুন। 

মা হাতজোড় করিয়া ঠাকুরকে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “ঠাকুর তােমার সন্ন্যাস রক্ষা করুন। তিনি দেখছেন, তােমার ভয় কি? ঠাকুরের কাজ করবে, আর সাধন-ভজন করবে, কিছু কিছু কাজ করলে মনে বাজে চিন্তা আসে না। একাকী বসে থাকলে অনেক রকম চিন্তা আসতে পারে।” 

১৭ই পৌষ-কাশীধাম 

আমি - কিরূপ ভাবে কিরূপ স্থানে গিয়ে সাধন-ভজন করতে হবে ? 

মা - কাশী তােমাদের স্থান। সাধন মানে তাঁর পাদপদ্ম সর্বদা মনে রেখে তাঁর চিন্তাতে মনকে ডুবিয়ে রাখা। তাঁর নাম জপ করবে। 

আমি - অনুরাগ না থাকলে শুধু নামজপ করলে কি হবে ? 

মা - জলেতে ইচ্ছে করেই পড়, আর ঠেলেই ফেলে দিক - কাপড় ভিজবেই। নিত্য ধ্যান করবে। কাঁচা মন কি - না? ধ্যান করতে করতে মন স্থির হয়ে যাবে। সর্বদা বিচার করবে। যে বস্তুতে মন যাচ্ছে, তা অনিত্য চিন্তা করে ভগবানে মন সমর্পণ করবে। একটি লােক মাছ ধরছিল - পাশে বাজনা বাজিয়ে বর যাচ্ছে, কিন্তু তার ফাতনার দিকেই দৃষ্টি। 

আমি - জীবনের উদ্দেশ্য কি? 

মা - ভগবানলাভ করা ও তাঁর পাদপদে্ম সর্বদা মগ্ন হয়ে থাকা। তােমরা সন্ন্যাসী, তাঁর লােক। তােমাদের ইহকাল পরকাল তিনিই দেখছেন। তােমাদের ভাবনা কি ? সর্বদা কি ভগবানের চিন্তা করতে পারা যায় ? কখনাে বেড়াবে, কখনাে তাঁর চিন্তা করবে। 

১৮ই পৌষ, বৃহস্পতিবার-কাশীধাম 

মা - সাধুর রাগদ্বেষ থাকবে না, সব সহ্য করা সাধুর দরকার। হৃদয়কে ঠাকুর বলতেন, ‘তুই আমার কথা সহ্য করবি, আমি তাের কথা সহ্য করবাে, তবে হবে; তা না হলে খাজাঞ্চীকে ডাকতে হবে।’ 

২৩শে পৌষ, মঙ্গলবার, বেলা ৯টা-কাশীধাম 

মা - ঠাকুর আমাকে বলতেন ‘একটু একটু বেড়াবে। না হলে শরীর খারাপ হবে।’ আমি তখন নবতে থাকতুম। ভাের চারটায় গঙ্গাস্নান করে ঘরে ঢুক্তুম। একদিন ঠাকুর আমায় বললেন, “আজ একজন ভৈরবী আসবে, তার জন্যে একখানি কাপড় ছাপিয়ে রাখবে, তাকে দিতে হবে। ঐদিন কালীঘরের ভোগরাগের পর ভৈরবী আসলে ঠাকুর তার সঙ্গে নানা কথা কইতে লাগলেন। ভৈরবীটির একটু মাথা গরম ছিল। সে আমায় সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণ করতাে। কখনাে কখনাে আমায় বলতাে, ‘তুই আমার জন্যে পান্তা ভাত রাখবি। না রাখিস তাে তােকে ত্রিশূলে করে মেরে রেখে যাব। শুনে আমার ভর হােত। ঠাকুর বলতেন, 'তােমার ভয় নেই, ও ঠিক ঠিক ভৈরবী, সেজন্য একটি মাথা গরম। কখনাে কখনাে এত ভিক্ষা আনতে যে সাত-আট দিন চলতাে। তাতে খাজাঞ্চী বলতেন, “মা, তুমি কেন বাইরে ভিক্ষায় যাও, এখানেই নিতে পার।' সে বলতো, ‘তুই আমার কালনেমি মামা, তাের কথায় বিশ্বাস কি ? 

“ঠাকুরের সাধন-অবস্থায় কত রকম প্রলোভনের জিনিস দেখে তিনি জড়সড় হতেন এবং সে সব প্রলােভনের জিনিস তিনি চাইতেন না। একদিন তিনি পঞ্চবটীতে হঠাৎ দেখলেন, একটি ছেলে তার নিকটে এল। তিনি তাতে চিন্তা করতে লাগলেন, এ আবার কি হল ? তখন মা বুঝিয়ে দিলেন, মানস-পুত্ররূপে ব্রজের রাখাল আসবে। যখন রাখাল এলাে তখন তিনি বললেন, ‘এই আমার সেই রাখাল এসেছে। তােমার নামটি কি বল দেখি?’- ’রাখাল।’ “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক। ঠাকুর যেমন পঞ্চবটীতে দেখেছিলেন ঠিক তেমনি। 

“ঠাকুরকে হাজরা বলেছিল, “আপনি কেন নরেন্দ্র, রাখাল, এ সবের জন্যে এত ভাবেন ? সর্বদা ঈশ্বরের ভাবে থাকুন না।” ঠাকুর বললেন, “এই দ্যাখ, ঈশ্বরের ভাবে থাকি। এই বলে তাঁর সমাধি হ’ল। দাড়ি, চুল, লোম সব খাড়া হয়ে উঠলাে। এই অবস্থাতে তিনি ঘণ্টাখানেক ছিলেন। রামলাল তখন নানারূপ ঠাকুরদের নাম শুনাতে লাগল। নাম শুনতে শুনতে তবে তাঁর চৈতন্য হয়। সমাধিভঙ্গের পর তিনি রামলালকে বললেন, “দেখলি, ঈশ্বরের ভাবে থাকতে গেলে এই অবস্থা। তাই নরেন্দ্র, এদের নিয়ে মনকে নিচে নামিয়ে রাখি।’ রামলাল বললে, না, আপনি আপনার ভাবেই থাকুন।” 

আমি — একটু প্রাণায়াম-অভ্যাস করছি। করবাে কি? 

মা - একটু একটু করতে পার, বেশী করে মাথা গরম করা ভাল নয়। মন যদি আপনিই স্থির হয়, তবে প্রাণায়ামের আর কি দরকার? 

আমি - কুণ্ডলিনী না জাগলে কিছুই হল না। 

মা - জাগবে বই কি। তাঁর নাম করতে করতে সব হয়ে যাবে। মন স্থির হলেও তাে বসে বসে তার লক্ষ লক্ষ নাম জপ করা যায়। কুণ্ডলিনী জাগবার পূর্বে অনাহত ধ্বনি শােনা যায়। মা জগদম্বার কৃপা না হলে হয় না। 

তারপর মা বলিলেন--“শেষরাত্রে মনে মনে ভাবছিলুম, বাবা বিশ্বনাথকে বুঝি আর দর্শন করতে পারব না। ছােট লিঙ্গমূর্তি -- আর যা সব জল বিল্বপত্রে ডুবিয়ে রাখে, বাবাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। এইসব ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি কি কালাে কুচকুচে পাথরের শিবলিঙ্গ-বিশ্বনাথ। নটীর মা শিবের মাথায় হাত বুলুচ্ছে। আমিও তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর মাথায় হাত দিলুম।”

আমি - মা, আমাদের আর পাথরের শিবলিঙ্গ ভাল লাগে না।

মা - সে কি বাবা! কত মহা মহা পাপী কাশীতে আসছে, আর বিশ্বনাথকে স্পর্শ করে উদ্ধার হচ্ছে। তিনি সকলের পাপ নির্বিকার ভাবে গ্রহণ করছেন।  

“শনি-রবিবারে যখন সব লােক এসে প্রণাম করে, তখন পা একেবারে জ্বলতে থাকে। পা ধুয়ে এসে তবে বসতে পারি।” 

আমি - তিনি যদি সকলের বাপ-মা, তবে তিনি কেন পাপ করান? 

মা - তিনি জীবজন্তু সবই হয়েছেন বটে, তবে সংস্কার ও কর্ম-অনুসারে সকলে নিজ নিজ কর্মফল ভােগ করে। সূর্য এক-কিন্তু জায়গা ও বস্তুভেদে তার প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন রকমের।

১লা জানুয়ারি, ১৯১৭ 

আমি বলিলাম, “মা, আমার ধ্যান যাতে ভাল হয় এবং তাতে মগ্ন হয়ে যেতে পারি, এই আশীর্বাদ করুন।” মা মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন আর বলিলেন, “সর্বদা সদসৎ বিচার করবে।” 

আমি - মা, বসে বসে বিচার করতে পারি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিচার আসে না; তখন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়! শক্তি দিন যাতে সে সময় ঠিক থাকতে পারি। 

মা - বাবা, ঠাকুর তােমায় রক্ষা করবেন। 

তারপর বলিলেন, “তােমার জ্ঞান চৈতন্য হােক।” জনৈক সন্ন্যাসী ভক্তকে মা বলিতেছেন, “তোমরা সন্ন্যাসী, তােমাদের গৃহন্থের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখা অত্যন্ত খারাপ। বিষয়ী লোকদের বাতাস লাগাও খারাপ। 

২৭শে মে, ১৯১৯-কোয়ালপাড়া 

আমি — মা, এতদিন গেল ! কি হল? 

মা - তিনি সংসারের সব ঝঞ্জাট হতে টেনে এনে তাঁর পাদপদ্মে রেখেছেন, এ কি কম ভাগ্য! যোগীন ( স্বামী যােগানন্দ) বলতাে, জপ-ধ্যান করি আর না করি, সংসারের কোন ঝঞ্চাট নেই।’ দেখ না, আমি রাধুকে নিয়ে মায়ায় কত ভুগছি!

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “নির্জনে কোন বাগানে কিছুদিন সাধন করতে আমার ইচ্ছে হয়।” 

মা - এই তত করবার সময়। এই বয়সেই করতে হয়। করবে বই কি। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে। যােগীনের (স্বামী যোগানন্দ) কঠোর করে করে শেষে বড় কষ্ট পেয়ে শরীর গেল। 

২৯শে মে, ১৯১৯-কোয়ালপাড়া 

আমি - বাবু আর মঠে আসেন না। আপনার বাড়িতেও আসেন না। তাঁর কেন এরূপ হল ? 

মা - হ্যাঁ, আমি যখন কলকাতায় ছিলুম তখনও আমার কাছে আসত না। 

আমি - এত দিনের পুরােনাে ভক্ত, কেন এরূপ হল ? 

মা - সব কর্মফল। অনেক জন্মের কর্ম ছিল। শেষে আর থাকতে পারলে না। যে কটা ঢেউ আছে সব কেটে যাবে তাে! এক জন্মে যে মুক্তি হবে। 

আমি — তাঁর ইচ্ছায় যদি সব হচ্ছে তবে তিনি কাটিয়ে দেন না কেন? 

মা - তাঁর ইচ্ছে হলে তিনি সব কাটিয়ে দিতে পারেন। দেখ না, কর্মের ফল তাঁকেও ভােগ করতে হয়েছে। ঠাকুরের বড় ভাই (রামকুমার) বিকারের সময় জল খাচ্ছিলেন, ঠাকুর তাঁর হাত থেকে গ্লাসটা টেনে নেন, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, “তুই যেমন আমায় জল খেতে দিলি নি, তুইও তেমনি শেষ সময় কিছু খেতে পারবি নি।’ ঠাকুর বললেন, “দাদা, আমি তো তােমার ভালর জন্যে করেছি, তুমি আমায় শাপ দিলে। তাতে তিনি কেঁদে বললেন, ভাই, কেন আমার মুখ হতে এমন কথা বের হল জানি নে।' দেখ, অসুখের সময় তাঁকেও কর্মফল ভোগ করতে হয়েছে। কোন জিনিস খেতে পারতেন না। এরও অনেক জন্মের সংস্কারের ফলে এরূপ হয়েছে। দেখ না, আ-র কি হল? কোথা হতে যে কি হয়, বুঝতে পারা মুশকিল। 
৪ঠা জুন, ১৯১৯-কোয়ালপাড়া 

আমি - মা, সংখ্যা রেখে জপ করবাে কি?

মা - সংখ্যা রেখে জপ করলে সংখ্যার দিকে লক্ষ্য থাকে। এমনি জপ করবে। 

আমি -  জপ করতে করতে মন কেন তাঁতে মগ্ন হয় না? 

মা  - করতে করতেই হবে। মন না বসলেও জপ করতে ছাড়বে না। তােমার কাজ তুমি করে যাবে। নাম করতে করতে মন আপনি স্থির হবে বায়ুহীন স্থানে দীপশিখার মতাে। বাতাস থাকলে প্রদীপের শিখা স্থির থাকে না, মনেও কল্পনাবাসনা থাকলে মন স্থির হয় না। ঠিক ঠিক মন্ত্র-উচ্চারণ না হলে দেরী হয়। একটি স্ত্রীলােকের মন্ত্র ছিল ‘রুকি্মণী - নাথায়’ সে ‘রুকু ‘রুকু’ জপ করতাে। সেজন্যে তাকে কিছুদিন ঠেকতে হয়েছিল। পরে আবার তাঁর কৃপায় সে ঠিক মন্ত্র পায়। 
১২ই জুন,১৯১৯-কোয়ালপাড়া

আমি -  কিছুদিন হ’ল আসন অভ্যাস করছি - শরীর ভাল থাকবার জন্যে। এই আসন অভ্যাস করলে হজম হয় ও ব্রহ্মচর্যের সহায়তা করে। 

মা - শরীরের দিকে পাছে মন যায়, আবার ছেড়ে দিলেও পাছে শরীর খারাপ হয়, এই বুঝে করবে। 

আমি - মা, আমি পাঁচ-দশ মিনিট করি, ভাল হজম হবার জন্যে।  

মা - তা করবে। কোন ব্যায়াম করে ছেড়ে দিলে শরীর খারাপ হয়, তাই বলছিলুম। আশীর্বাদ করি, বাবা, চৈতন্য হােক। 

~ স্বামী শান্তানন্দ 
প্রথম ভাগ
*************

Post a Comment

0 Comments