Shri Shri Mayer Katha ~ 2nd Part

শ্রীশ্রীমায়ের কথা (দ্বিতীয় ভাগ)

দ্বিতীয় ভাগ
Shri Shri Mayer Katha ~ 2nd Part
 
============

শ্রীশ্রীমায়ের জীবনী 

শ্রীশ্রীমা বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে ১২৬০ সালের ৮ই পৌষ বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম রামচন্দ্র মুখােপাধ্যায়, মাতার নাম শ্যামা দেবী। মা তাঁহার জন্মকথা এইরূপ বলিয়াছেন, “আমার জন্মও তাে ঐ রকমের (ঠাকুরের মতাে)। আমার মা শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছে হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান। শৌচের কিছুই হল না, কিন্তু বােধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদরমধ্যে ঢোকায়, উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল। বসেই আছেন। তখন মা দেখেন যে লাল চেলি পরা একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তার কাছে এসে কোমল বাহু দুটি দিয়ে পিঠের দিক থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তােমার ঘরে এলাম মা। তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে ; তা থেকেই আমার জন্ম। বাড়িতে ফিরে এসে মা এই ঘটনাটি বলেছিলেন।” 

মায়ের পিতা তখন কার্যোপলক্ষে কলিকাতা গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া তিনি এই সকল কথা শুনিলেন। তদবধি মা ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত তিনি আর স্ত্রীর অঙ্গ স্পর্শ করেন নাই। শুনিয়াছি, মাকে তাঁহার পিতা দেবতার ন্যায় ভক্তিশ্রদ্ধা করিতেন। মায়ের মা একবার যােগেন-মাকে বলিয়াছিলেন, “গর্ভাবস্থায় আমার এই রূপ। মাথায় চুল আর ধরে না। সেবার সাধে কত লােক যে কাপড় দিয়েছিল তার আর অবধি নেই।” 
মায়ের জন্মস্থান এখন যেখানে মন্দির হইয়াছে সেইখানে ছিল। বসত ঘরখানি উত্তরের জমিতে ছিল। পূর্বদিকের জমিতে একখানি দোচালা ঘর ছিল। মধ্যে দেওয়াল, বহির্ভাগ সদর এবং ভিতরের ভাগ অন্দর। দক্ষিণের জমিতে রান্নাঘর, ঢেঁকিশাল প্রভৃতি ছিল। মা বলিয়াছিলেন, “পুরান (জন্মস্থানের) বাড়িতে বিয়ে হয়। আমার ন বছর বয়সের সময় নূতন বাড়িতে (এখন যেটি বরদা মামার বাড়ি ) আসি। ও বাড়িতে আর ধরে না।" 
মায়ের পিতা দরিদ্র হইলেও অতি নিষ্ঠাবান এবং মাতা বিশেষ ভক্তিমতী ও কর্তব্যপরায়ণা ছিলেন। মা শৈশবে দরিদ্রের সন্তানের মতােই লালিত পালিত হইয়াছিলেন। রম্বনাদি গৃহকার্যে তিনি নিজ মাতাকে সহায়তা করতেন। আমাদের নিকট বলিয়াছিলেন, “ছেলেবেলায় গলা সমান জলে নেমে গুরুর জন্য দলঘাস কেটেছি। ক্ষেতে মুনিষদের জন্য মুড়ি নিয়ে যেতুম। এক বছর পঙ্গপালে সব ধান কেটেছিল; ক্ষেতে ক্ষেতে সেই ধান কুড়িয়েছি।” 
বাল্যকালে ছােট ভাইদের রক্ষণাবেক্ষণ করাই মায়ের প্রধান কাজ ছিল। তিনি বলিয়াছিলেন, “ভাইদের নিয়ে গঙ্গায় নাইতে যেতুম। আমোদর নদীই ছিল যেন আমাদের গঙ্গা। গঙ্গাস্নান করে সেখানে বসে মুড়ি খেয়ে আবার ওদের নিয়ে বাড়ি আসতুম। আমার বরাবরই একটু গঙ্গাবাই ছিল।” 
ছােট ভাইদের সঙ্গে মা কখনও কখনও পাঠশালায় যাইতেন। তাহার ফলে তখন অতি সামান্য লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। অবশ্য পরে তিনি বেশ পড়িবার অভ্যাস করিয়াছিলেন, এবং বাংলা রামায়ণাদি পড়িতেন কিন্তু পত্রাদি লিখিতে তাঁহাকে কখনও দেখা যাইত না। 

পাঁচ বৎসর বয়সের সময় মায়ের বিবাহ হয়। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার সাত বছর বয়সের সময় ঠাকুর জয়রামবাটী এসেছিলেন। বিয়ের পর জোড়ে যায় না? তখন আমাকে বলেছিলেন, তােমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ক’বছরে বিয়ে হয়েছে, তখন পাঁচ বছর ব’লো, সাত বছর ব’লাে না।” জোড়ে যাওয়াকেই মা পাছে বিবাহ মনে করেন, এই জন্য ঠাকুর ঐ কথা বলিয়া থাকিবেন। 
বিবাহের সময় সম্বন্ধে মা বলিতেন, “খেজুরের দিনে আমায় বিয়ে হয়, মাস 'মনে নেই। দশ দিনের মধ্যে যখন কামারপুুকুর গেলুম তখন সেখানে খেজুর কুড়িয়েছি। ধর্মদাস লাহা এসে বললে, 'এই মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ? সুয্যুর (জ্ঞাতিভাই) বাপ কোলে করে আমাকে কামারপুকুর নিয়ে গিয়েছিল।” 
শ্রীশ্রীঠাকুরের জয়রামবাটী যাওয়া সম্বন্ধে মায়ের এইটুকুই মনে ছিল যে, ভাগিনেয় হৃদয় কতকগুলি পদ্মফুল সংগ্রহ করিয়া তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছিল এবং তিনি নিতান্ত সঙ্কুচিত হইলেও তাহার পাদপদ্ম পুজা করিয়াছিল। 
মায়ের সাত বৎসর বয়সেই ঠাকুর দ্বিতীয়বার জয়রামবাটী যান। তখন কেহ বলিয়া দিলেও মা ঠাকুরের পা ধুইয়া দিয়া তাঁহাকে বাতাস করিয়াছিলেন। তাহা দেখিয়া অন্যান্য সকলে হাসিয়াছিল। 
মায়ের ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী রাজ মুখুয্যের ভগিনী অঘােরমণি বলেন, “মা খুব সাদাসিদে ছিলেন। তাঁতে সরলতা যেন মূর্তিমতী ছিল। খেলায় তাঁর সঙ্গে কখনাে কারও ঝগড়া হয়নি। মা প্রায়ই কর্তা বা গিন্নী সাজতেন। পুতুল গড়ে খেলা করতেন বটে, কিন্তু কালী ও লক্ষ্মী গড়ে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করতে ভালবাসতেন। অন্যান্য মেয়েদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হলে মা এসে মিটিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে ভাব করিয়ে দিতেন।” 
অঘােরমণি বলিয়াছিলেন, “একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় হলদেপুকুরের রামহৃদয় ঘােষাল উপস্থিত ছিলেন। মাকে জগধাত্রীর সামনে ধ্যান করতে দেখে তিনি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন; কিন্তু কে জগদ্ধাত্রী, কে মা, কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। তখন ভয়ে পালিয়ে গেলেন।” 
মায়ের এগার বৎসর বয়সের সময়, ১২৭১ সালে, ওদেশে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়। মায়ের পিতার কিছু ধান্য সঞ্চিত ছিল। গরীব ব্রাহ্মণ, নিজের পােষ্যবর্গ কি খাইবে সেদিকে লক্ষ্য না রাখিয়া, অন্নসত্র খুলিয়া দিলেন। কড়াইয়ের ডালের খিচুড়ি হাঁড়ি হাঁড়ি রন্ধন করাইয়া কয়েকটি ডাবায় ঢালিয়া রাখিতেন। গরম খিচুড়ি খাইতে লােকের কষ্ট হইত বলিয়া মা দুই হাতে পাখার বাতাস করিয়া তাহা ঠাণ্ডা করিয়া দিতেন। ক্ষুধার্ত লোকদের দুর্দশা মা এই রূপে বর্ণনা করিতেন, “আহা, এই খিদের জ্বালায় সকলে খাবার জন্য বসে আছে। একদিন একটি বাগদী না ডােমের মেয়ে এসেছে। মাথায় চুলগুলাে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া হয়ে গেছে তেলের অভাবে, চোখ উন্মাদের মতাে ছুটে এসে গরুর ডাবায় যে কুঁড়াে ভেজান ছিল তাই খেতে আরম্ভ করেছে। এত যে সকলে ডাকছে, বাড়ির ভিতরে এসে খিচুড়ি খা’—তা আর ধৈর্য মানছে না। খানিকটা কুঁড়াে খেয়ে তবে কথা তার কানে গেল। এমন ভীষণ দুর্ভিক্ষ। সেই বছর দুঃখ পেয়ে তবে লােকে ধান মরাইয়ে রাখতে আরম্ভ করলে।” 
তের বৎসর বয়সের সময় মা মাসখানেকের জন্য কামারপুকুর যান। ঠাকুর তখন দক্ষিণেশ্বরে। পাঁচ-ছয় মাস পরে পুনরায় কামারপুকুরে গিয়া প্রায় দেড় মাস থাকেন। তখনও ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে। তারপর ঠাকুর ব্রাহ্মণীকে লইয়া কামারপুকুরে যান এবং শ্রীশ্রীমাকে তথায় আনাইয়া লন। সেবার মা কামারপরে মাস তিনেক ছিলেন। 
এই সময়ে লৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে ঠাকুর মাকে নানাপ্রকার শিক্ষা দিয়াছিলেন। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে চলিয়া গেলে মাও জয়রামবাটী ফিরিয়া যান। কিন্তু এই সামান্য তিন মাসের ব্যবহারেই মায়ের মনে ঠাকুরের মহৎ জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা উৎপন্ন হইয়াছিল। 
তারপর মা সর্বদা লােকের মুখে শুনিতে লাগিলেন যে, ঠাকুর পাগল হইয়া গিয়াছেন। এই বিষয়ের সত্যাসত্যতা নির্ণয়ের জন্য তিনি নিজে দক্ষিণেশবরে গিয়া উপস্থিত হন। ইহার সাত-আট মাস পূর্বে মথুরবাবু দেহত্যাগ করিয়াছেন। ঠাকুর মাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং নিজ জননীর সঙ্গে নহবতে তাহার থাকিবার ব্যবস্থা করেন। সেই অবধি ঠাকুরের শেষ অসুখের চিকিৎসার জন্য দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ পর্যন্ত মা প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে থাকিতেন। নহবতে নীচের তলায় অতি ক্ষুদ্র ঘরখানিতে বহু কষ্টে বাস করায় মধ্যে মধ্যে তাঁহার অসুখ হইত এবং বাধ্য হইয়া তাহাকে দেশে যাইতে হইত। তখন পল্লীগ্রামে চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। কঠিন অসুখ হইলে লােকে দেবস্থানে হত্যা দিত ও মানত করিত। মাও একবার সিংহবাহিনীর মন্দিরে হত্যা দিয়া কঠিন রোগের হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করেন। ত
মায়ের এই বিষম শারীরিক ক্লেশ সম্বন্ধে ঠাকুর উদাসীন ছিলেন না। অসুখ হইলে চিকিৎসাদির বন্দোবস্ত তাে করিতেনই, এতন্নি তাঁহার শরীর যাহাতে ভাল থাকে তদ্বিষয়ে যথাসাধ্য যত্ন করিতেন। মা বলিয়াছিলেন, তিনি বলতেন, ‘বুনাে পাখী খাঁচায় রাত দিন থাকলে বেতে যায় ; মাঝে মাঝে পাড়ায় বেড়াতে যাবে।' পরে কালীবাড়ীর সকলে খাওয়া দাওয়ার পর যখন বিরাম করত, সেই সময় ঠাকুর পঞ্চবটীর দিকে গিয়ে দেখে আসতেন কোন লােকজন আছে কিনা। যদি দেখতেন কোন লোকজন নেই, তখন বলতেন, এই সময় যাও, কেউ, নেই। তিনি ঘরের কাছে একটু দাঁড়াতেন, আমি খিড়কি ফটক দিয়ে রামলালের বাড়ির দিকে পাঁড়ে গিন্নীদের ওখানে বেড়াতে যেতুম। সমস্ত দিন কথাবার্তা কয়ে, সন্ধ্যার পর যখন আরতি হত, আর সব লােক আরতি-টারতি দেখতে যেত, আমি সেই সময় আসতুম।” গৌর-মা বলেন, এই যে দু’জনের মাত্র পনর-বিশ হাত দুরে থেকেও, কখনও কখনও ছ'মাসেও হয়তাে একদিন দেখা নেই, তবু দুজনের ভাবই ছিল কত ! দেখেছি, একদিন মায়ের মাথা ধরেছে, ঠাকুর তাই শুনে মহা ব্যস্ত হয়ে বার বার রামলাল দাদাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ওরে রামলাল, মাথা ধরল কেন রে? আবার একাকী থাকার অবসাদ নিবারণের জন্য যাহাতে মন্দ লােকের সঙ্গে মা না মিশেন, সে বিষয়ে ঠাকুর তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিতেন।” 
মেয়েরা অলঙ্কার পরিতে ভালবাসেন। এই বিষয়েও মায়ের মনে যাহাতে কোন দুঃখ না থাকে সেইজন্য ঠাকুর হৃদয়কে দিয়া অলঙ্কার গড়াইয়া মাকে দিয়াছিলেন। মা বলিতেন, “তখন তার অসুখ, তবুও আমার জন্য অত টাকা দিয়ে তাবিজ গড়িতে দেওয়ালেন। ঠাট্টা করে বলতেন, 'ওরে, আমার সঙ্গে ওর এই সম্বন্ধ। এদিকে নিজে তাে টাকা ছুঁতে পারতেন না। পঞ্চবটীতে সীতাকে দেখেছিলেন—হাতে ডায়মন-কাটা বাল। সীতার সেই বল দৃষ্টে আমাকে সােনার বালা গড়িয়ে দিয়েছিলেন।” 
নহবতে থাকিতে মায়ের বড় কষ্ট হয় জানিয়া শম্ভু বাবু দক্ষিণেশ্বর গ্রামে মায়ের জন্য একখানি কুটির নির্মাণ করিয়া দেন। এখন যেখানে রামলাল দাদার বাড়ি আছে তাহারই পাশের জমিতে মায়ের ঘর ছিল। ঠাকুরের কঠিন আমাশয় হওয়ায় তাহার সেবার জন্য মাকে পুনরায় নহবতে আসিয়া থাকিতে হয় এবং কিছুদিন পরে তাহার নিজের ঐ অসুখ হয়। রোগ কিছুতেই না সারায়, মা পিত্রালয়ে যান। সেখানেও তাঁহাকে দীর্ঘকাল ভুগিতে হইয়াছিল। সুস্থ হইয়া ফিরিয়া আসিলে হৃদয়ের অসদ্ব্যবহারে, যেদিন আসিয়াছিলেন সেইদিনই তিনি দেশে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হন। ইহার এক বৎসর পরে, ঠাকুরের খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ অসুবিধা হইতেছে জানিয়া, মা পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে আসেন। তখন হৃদয় নির্বুদ্ধিতার জন্য মন্দির হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। 
১২৯২-৯৩ সালে ঠাকুরের শেষ অসুখের সময় মা প্রাণপণে তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন। কিন্তু মা ও ভক্তগণের শত চেষ্টা সত্ত্বেও রােগের হ্রাস না পাইয়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হয় এবং ১২৯৩ সালের ৩১শে শ্রাবণ, রবিবার রাত্রি প্রায় একটার সময় ঠাকুর হঠাৎ মহাসমাধি মগ্ন হন। পরদিন সন্ধ্যায় দেহসংকারের পর শ্রীশ্রীমা যখন অন্যান্য অলঙ্কার খুলিয়া সর্বশেষে হাতের সােনার বালা খুলিতেছেন, তখন ঠাকুর তাঁহাকে দেখা দিয়া নিষেধ করেন। বলরামবাবু মার জন্য সাদা কাপড় আনিয়াছেন। উহা মাকে দিবার জন্য গােলাপ-মাকে বলায় তিনি বলিলেন, “বাপরে, এ সাদা থান কাপড় কে তাঁর হাতে দিতে যাবে?” এদিকে গােলাপ-মা আসিয়া দেখেন, মা নিজের কাপড়গুলির পাড় ছিঁড়িয়া সরু; করিয়া লইয়াছেন। সেই অবধি মা খুব সরু লালপেড়ে কাপড়ই পারিতেন। তৃতীয় দিন মধ্যাহ্নে ঠাকুরের অস্থির কলসের সম্মুখে ভােগ নিবেদন করা হয়। ৬ই ভাদ্র  বৈকালে মাকে বলরামবাবুর বাড়িতে আনয়ন করা হয়। সঙ্গে লক্ষীদিদি। ঠাকুরের অস্থি লইয়া ভক্তগণের মধ্যে বিরােধ উপস্থিত হওয়ায় ত্যাগী শিষ্যগণ কলস হইতে অস্থিগুলি বাছিয়া লইয়া একটি কৌটায় রাখিয়া দিয়াছিলেন। ঐ কৌটাও শ্রীশ্রীমার সঙ্গে আনা হইল। ঠাকুরের অস্থি লইয়া বিরােধের কথা শুনিয়া মা গােলাপ-মাকে বলিয়াছিলেন, “এমন সােনার মানুষই চলে গেলেন; দেখেছ, গােলাপ, ছাই নিয়ে ঝগড়া করছে!” ১৫ই ভাদ্র সন্ধ্যায় মা বৃন্দাবন যাত্রা করিলেন। সঙ্গে গােলাপ-মা, লক্ষীদিদি, মাস্টার মহাশয়ের স্ত্রী, এবং পূজনীয় যােগীন মহারাজ, কালী মহারাজ ও লাটু মহারাজ ছিলেন। 
বৃন্দাবন যাইবার পথে মা কাশীতে তিন দিন অবস্থান করেন। বৃন্দাবনে তিনি এক বৎসরকাল ছিলেন। মধ্যে একবার লক্ষীদিদি, যােগেন-মা ও শ্রীযুক্ত যোগানন্দ স্বামীর সহিত মা হরিদ্বার গিয়া ব্ৰহ্মকুণ্ডে ঠাকুরের নখ ও কেশ দেন এবং জয়পুর হইয়া বৃন্দাবনে ফিরিয়া আসেন। তথায় কালাবাবুর কুঞ্জে থাকিতেন। বৃন্দাবনে মা, যােগেন-মা প্রভৃতি ঠাকুরের অদর্শনে খুব কাঁদিতেন। একদিন ঠাকুর তাঁহাদিগকে দেখা দিয়া বলেন, “তােমরা অত কাঁদছ কেন? গেছি আর কোথায় ? এই এঘর আর ওঘর।” বৃন্দাবনে অনেক সময় শ্রীশ্রীমায়ের দেহে ঠাকুরের আবেশ হইত। কখনও বা তিনি ভাবাবেশে একাকী চড়া অতিক্রম করিয়া যমুনায় চলিয়া যাইতেন। সঙ্গীরা তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া খুঁজিতে খুঁজিতে সেখানে গিয়া তাঁহাকে লইয়া আসিতেন। 
বৃন্দাবনে এক বৎসর বাসের পর মা কলিকাতায় আসেন এবং কয়েকদিন বলরামবাবুর বাড়িতে থাকিয়া কামারপুকুর যান। সেখানেও তিনি প্রায়ই ঠাকুরের দেখা পাইতেন। ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “তুমি কামারপুকুরে থাকবে। শাক বুনবে : শাক ভাত খাবে, আর হরিনাম করবে।” মাকে এই সময় সেই ভাবেই জীবনযাপন করিতে হইয়াছিল। অনেক সময়ে বাড়িতে অপর কেহ থাকিত না। এমন দিনও গিয়াছে যে শুধু, দুটি ভাত সিদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু লবণ আর জোটে নাই। শ্রীযুত যােগীন মহারাজ, শরৎ মহারাজ প্রভৃতি যাঁহারা পরে মায়ের রক্ষণাবেক্ষণের ভার লইয়াছিলেন, তাহারা তখন ঠাকুরের অদর্শনে তীব্র বৈরাগ্যের প্রেরণায় তীর্থাদি ভ্রমণ করিতেছেন। পূজনীয় শরৎ মহারাজ বলিতেন, “আমাদের এ ধারণাই তখন ছিল না যে, মার নুনটুকুও জোটেনি।” কামারপুকুরে প্রায় এক বৎসর থাকিবার পর মাকে ভক্তেরা বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর ভাড়াটিয়া বাড়িতে প্রায় ছয়মাস কাল আনিয়া রাখেন (১৮৮৮ এীঃ)। পরে কার্তিক মাসে সে বাড়ি ছাড়িয়া দিয়া কলিকাতায় বলরামবাবুর বাড়িতে দুই একদিন থাকিয়া মা পুরী যাত্রা করেন। তখনও রেল হয় নাই। কাজেই চাঁদবালী পর্যন্ত জাহাজে তথা হইতে কটক পর্যন্ত স্টিমারে এবং অবশিষ্ট পথ গােযানে যাইতে হইয়াছিল। পুরীতে মা বলরামবাবুদের ক্ষেত্রবাসীর” বাড়িতে অগ্রহায়ণ হইতে ফাল্গুন পর্যন্ত ছিলেন। বলরামবাবুদের পুরীতে বিশেষ নাম আছে। সেজন্য পাণ্ডা গােবিন্দ শিঙ্গারী শ্রীশ্রীমাকে পালকি করিয়া জগন্নাথ দর্শনে লইয়া যাইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাহাতে মা বলিয়া ছিলেন, “না, গােবিন্দ, তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলবে, আমি দীনহীন কাঙালিনীর মতাে তােমার পেছনে পেছনে জগন্নাথ দর্শনে যাব।” 
পুরী হইতে ফিরিয়া মা কলিকাতায় মাষ্টার মহাশয়ের বাড়িতে তিন চার সপ্তাহ থাকিয়া আঁটপুর ও তথা হইতে তারকেশ্বর হইয়া কামারপুকুর যান। তথায় প্রায় এক বৎসর থাকিয়া মা দোলের পূর্বে কলিকাতায় আসেন ও মাস্টার মহাশয়ের কম্বুলিয়াটোলার বাড়িতে মাসখানেক থাকেন। তারপর বলরামবাবুর শেষ অসুখের সময় তাঁহার দেহত্যাগ পর্যন্ত মা বলরামবাবুর বাড়িতেই ছিলেন। পরে বেলুড়ে শ্মশানের নিকট ঘুসুড়ীর বাড়িতে জ্যৈষ্ঠ হইতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত (১৮৯০ খ্রীঃ) ছিলেন। সেখানে রক্ত আমাশয় হওয়ায় বরাহনগরে সৌরীন্দ্রমােহন ঠাকুরের ভাড়াটিয়া বাড়িতে তাহাকে রাখিয়া চিকিৎসা করান হয়। তারপর তিনি বলরামবাবুর বাড়ি আসেন এবং দুর্গাপূজার পর কামারপুকুর হইয়া জয়রামবাটী যান। পর বৎসর (১৮৯৩ খ্রীঃ) আষাঢ় মাসে মা বেলুড়ে নীলাম্বর বাবুর ভাড়াটিয়া বাড়িতে আসেন ও মাঘ কিংবা ফাল্গুনে কৈলােয়ার যাইয়া দুই মাস থাকেন। তথা হইতে তাঁহার মাতা ও ভ্রাতাদের সহিত মা পুনরায় কাশী ও বৃন্দাবন গিয়াছিলেন। সেখান হইতে ফিরিয়া মাস্টার মহাশয়ের কম্বুলিয়াটোলার বাড়িতে প্রায় একমাস থাকিয়া মা দেশে যান। তথা হইতে ফিরিবার পর বাগবাজারে গঙ্গার ধারের গুদামওয়ালা বাড়িতে পাঁচ ছয় মাস ছিলেন। এই বাড়িতে শ্রীযুক্ত নাগ মহাশয় মাকে দর্শন করেন। পুনরায় দেশে যাইয়া প্রায় দেড় বৎসর পরে মা কলিকাতা আসেন এবং বাগবাজারে বিভিন্ন ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকিয়া আবার দেশে যান। ১৯০৪ সন হইতে তিনি প্রায় দেড় বৎসর বাগবাজার স্ট্রীটের একটি ভাড়াটিয়া বাড়িতে (রামকৃষ্ণ লেনের সামনে) ছিলেন। ১৯০৭ সনে গিরিশবাবুর দুর্গাপুজো উপলক্ষে জয়রামবাটী হইতে কলিকাতা আসিয়া মা বলরামবাবুর বাড়িতে থাকেন। পূজার কয়দিন গিরিশবাবু শ্ৰীশ্রীমাকে প্রত্যহ বাটীতে আনিয়া পূজা করেন। অষ্টমীর দিন রাত্রে সন্ধিপূজার সময় মাকে আর সংবাদ দেওয়া হয় নাই। মা কিন্তু ঠিক সেই সময় নিজেই বলরামবাবুর বাড়ি হইতে হাঁটিয়া গিরিশবাবুর বাড়ির পিছনের ফটকে গিয়া বলেন, “দরজা খােল, আমি এসেছি।” সকলে দরজা খুলিয়া দেখিয়া বিস্মিত হন। 
দেশে ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়া মা এইবার খুব রােগা হইয়া গিয়াছিলেন। পরে আবার দেশে গিয়া উদ্বোধনের নতুন বাড়ি হইলে মা ১৯০৯ সনে তথায় শুভাগমন করেন। তারপর কোঠার, মান্দ্রাজ, ব্যাঙ্গালাের, রামেশ্বর প্রভৃতি ভ্রমণ করিয়া উদ্বোধনে ফিরিয়া আসেন এবং অল্প কয়েকদিন পরে দেশে গিয়া রাধুর বিবাহ দেন। ইহার প্রায় এক বৎসর পরে উদ্বোধনের বাড়িতে আসেন। পরবর্তী কার্তিক মাসে কাশী গিয়া মা কিরণবাবুদের বাড়িতে তিন মাস থাকেন, এবং কলিকাতা ফিরিয়া অল্প দিন পরেই দেশে যান। পুরাতন বাটীতে (প্রসন্ন মামার বাটীতে) ভক্তদের স্থান সংকুলান হইত না বলিয়া ১৯১৫ সনে জয়রাম বাটীতে মায়ের জন্য পথৃক বাড়ি নির্মিত হয়-মাটির কোঠা, খড়ের চাল। অতঃপর মা যখনই দেশে যাইতেন, এই নতুন বাড়িতেই থাকতেন। 
বেলুড়ে লীলাম্বর বাবুর ভাড়াটিয়া বাড়িতে শ্রীশ্রীমার গভীর নির্বিকল্প সমাধি হয়। বহুক্ষণ পরে একটু হুঁশ হইলেও হস্তপদাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের জ্ঞান অতি কষ্টে আসিয়াছিল। মা কপিল মহারাজকে বলিয়াছিলেন, “এই সময় লাল জ্যোতি, নীল জ্যোতি, এই সব জ্যোতিতে মন লীন হত। আর দু-চার দিন এ ভাব থাকলে দেহ থাকত না।” এই বাড়িতেই মা একদিন দেখেন যে, ঠাকুর গঙ্গায় গিয়া নামিলেন। অমনি গঙ্গাজলে তাঁহার দেহ গলিয়া গেল। স্বামীজী জয় রামকৃষ্ণ, জয় রামকৃষ্ণ” বলিয়া সেই জল দুই হাতে চারিদিকে অসংখ্য লােকের মাথায় ছিটাইয়া দিতেছেন, আর তাহারা ঐ জলস্পর্শে সদ্য মুক্ত হইয়া চলিয়া যাইতেছে। এত লােক যে কোথাও একটু ফাঁক নাই। এই 
দৃশ্য মায়ের মনে এতই গাঁথিয়া গিয়াছিল যে, কয়েকদিন কিছুতেই গঙ্গায় নামিতে পারেন নাই। বলিতেন, “এ যে ঠাকুরের দেহ; কি করে আমি এতে পা দিই।” প্রতিমা বিসর্জনের পর দেবদেবীর দেহ জলে মিশিয়া গিয়াছে, মনে করিয়াই হিন্দুগণ সেই “শান্তিজল” সকলের মাথায় ছিটাইয়া দিয়া থাকেন। 
মায়ের দৈনন্দিন জীবন বড় অদ্ভুত ছিল। তিনি রাত্রি প্রায় তিনটার সময় নিদ্রা হইতে উঠিতেন এবং সর্বপ্রথমে শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবি দেখিতেন। উঠিবার সময় ঠাকুরদের নাম করিতেন। তারপর প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া ঠাকুর তুলিতেন এবং পরে জপে বসিতেন। সেই যে দক্ষিণেশ্বরে থাকিবার সময় শেষরাতে উঠিয়া শৌচশানাদি শেষ করিয়া সকলের অজ্ঞাতসারে ঘরে ঢুকিতেন, সেই অভ্যাস তাঁহার আজীবন ছিল। শরীর খুব খারাপ থাকিলেও যথাসময়ে উঠিয়া মুখ-হাত ধুইয়া বরং পরে আবার একটু শুইতেন। তথাপি ঠিক সময়ে উঠা চাই। মা বলিতেন, “রাত তিনটে বাজলেই যেখানেই থাকি, কানের কাছে যেন বাঁশীর ফু শুনতে পেতুম।” যখন যেটি করিবার সে বিষয়ে তাহার আদৌ আলস্য ছিল না। 
সকালের পূজার জন্য ফুল, বেলপাতা প্রভৃতি গুছান, ফল ছাড়ন ইত্যাদি সব কাজ মা নিজেই করিয়া আটটার সময় আন্দাজ পূজায় বসিতেন। ইদানিং স্ত্রী-ভক্তেরা এই সকল কাজে তাঁহাকে সাহায্য করিলেও মা নিজে যথাসাধ্য প্রায় রােজই করিতেন। তবে শেষ কয়েকবার উদ্বােধনে যখন ছিলেন, সাধুদের কেহ কেহ পূজা করিতেন। মা নিজে যখন পূজা করিতেন, এক ঘণ্টার মধ্যে পূজা শেষ করিয়া প্রসাদ বিতরণের জন্য শালপাতা সাজাইতেন এবং সকলকে প্রসাদ দিতেন। কখনও কখনও কাহারও পূজায় স্তবাদি পাঠের জন্য বিলম্ব হইলে মা বিরক্ত হইতেন। একদিন বলিয়াছিলেন, “আগে পুজা ও ভোগ সেরে নিয়ে পরে যত পারে স্তব পাঠ করুক না। এ কি, লোক সব জল খেতে পায় না, বেলা হয়ে যায়। যথাসময়ে প্রয়ােজনমত এই সকল কাজ শীঘ্র শীঘ্র করাই মা পছন্দ করতেন। 
মধ্যাহ্নভােজনের পর মা একটু বিশ্রাম করিতে শুইতেন বটে, কিন্তু তখন আবার স্ত্রী-ভক্তেরা প্রায়ই আসিতেন, কারণ তাঁহাদের অনেককেই চারটা, সাড়ে চারটার মধ্যে গৃহে ফিরিতে হইত। এই সময়ে মা শুইয়া শুইয়াই তাহাদের সঙ্গে দু-একটি কথা বলতেন, কখনও বা কিছু পরেই উঠিয়া পড়তেন। সাড়ে তিনটা আন্দাজ উঠিয়া-দুপরের খাওয়া শেষ হইতেই দুইটা বাজিত-শৌচাদির পর কাপড় কাচিয়া আসিয়া ঠাকুরের বৈকালের ভােগ দিতেন। ক্রমে অন্যান্য স্ত্রী-ভক্তেরা আসিয়া জুটিতেন। মা জপের মালা লইয়া বসিতেন। ঐ সঙ্গে মাঝে মাঝে তাঁহাদের সহিত কথাবার্তা কহিতেন, বা তাহাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যে সকল পুরুষ-ভক্ত বৈকালে আসতেন, তাহাদের সাধারণতঃ প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় ডাক পড়িত। মা চাদরে মাথা অবধি ঢাকিয়া নিজের তক্তাপোশের উপর মেঝেতে পা ঝুলাইয়া বসিয়া থাকিতেন। গ্রীষ্মকাল হইলে ঐ সময়ে আমাদের কেহ, কখনও বা কোন পরিচিত ভক্ত, তাঁহাকে বাতাস করিত। একে একে সকলে প্রণাম করিয়া যাইতেন। স্ত্রী-ভক্তেরা তখন অন্য ঘরে থাকিতেন। এই সময়ে ভক্তদের “কেমন আছেন?” ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে মা সাধারণতঃ ঘাড় নাড়িয়া, অথবা আস্তে সামান্য দুই এক কথায় উত্তর দিতেন। আমরা তাহা একটু উচ্চস্বরে বলিতাম। কাহারও বিশেষ কিছু জিজ্ঞাস্য থাকিলে তিনি সর্বশেষে প্রণাম করিতেন। তখন, পরিচিত হইলে মা নিজেই আস্তে আস্তে কথা বলিতেন, আর অপরিচিত বা বেশী বয়সের ভক্ত হইলে মা অনুচ্চস্বরে যাহা বলিতেন, আমরা তাহা একটু স্পষ্ট করিয়া বলিতাম।
মা সন্ধ্যার পর জপ সমাপন করিয়া ভােগের পূর্ব পর্যন্ত মেজেয় বিশ্রাম করিতেন এবং এই সময়ে কেহ তাঁহার পায়ে বাতের তেল বা আমবাতের জন্য মরিচাদি তেল মালিস করিয়া দিত। সাধারণতঃ নবাসনের বৌ দিতেন, কখনও কখনও অপর একটি স্ত্রী-ভক্ত। রাতে ঠাকুরের ভােগ শেষ হইতে দশটা এবং আহারাদি শেষ করিয়া শুইতে এগারটা সাড়ে এগারটা বাজিত। 
মায়ের আহার সম্বন্ধে অনেক বিষয় লক্ষ্য করিবার ছিল। তিনি বেশী মিষ্ট আম অপেক্ষা অম্লমধুতক- “টক টক, মিষ্টি মিষ্টি”-আমই অধিক ভাল বাসিতেন। বোম্বাই হইতে বরেনবাবু আলফনসাে আম পাঠাইতেন ; মা তাহা পছন্দ করতেন। পেয়ারাফুলি ও ছোট ল্যাংড়া আমও তিনি ভালবাসতেন। কিন্তু কেহ ভক্তির সহিত খুব টক আম দিলেও তাহা পরম প্রিয় বােধে আহার করিতেন। উদ্বোধনের বাড়িতে একদিন জনৈক ভক্ত কতকগুলি আম কিনিয়া আনেন। অগ্রভাগ খাইতে নাই বলিয়া, তিনি দোকানদারের কথায় বিশ্বাস করিয়া না চাখিয়াই আমগুলি লইয়া আসেন। মধ্যাহ্ন ভােগের পর যখন সকলকে সেই আম-প্রসাদ দেওয়া হইল, টক বলিয়া কেহই উহা খাইতে পারিলেন না, এবং ভক্তটিকে বােকা বলিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিতে লাগিলেন। মা কিন্তু একটি আম খাইয়া বলিলেন, “না, এ বেশ টক টক আম।” সাধারণতঃ মা জানিতেন না, কে কোন বস্তু দিয়াছে; কিন্তু দেখা যাইত, কোন কোন মিষ্টি ইত্যাদি খারাপ হইলেও উহার দুই একটি খাইতেন। শাকের মধ্যে ছােলাশাক, মূলোশাক প্রভৃতি ভালবাসিতেন। একবার দেশ হইতে ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়া খুব অরুচি লইয়া আসেন। তখন তাঁহাকে এই ছােলাশাক খাইতে দেওয়া হইত। শীতকালে মুড়ি, ফুটকড়াই এবং উড়িয়ার দোকানের বেগুনি, ফুলুরি, ঝালবড়া, আলুর চপ ইত্যাদি সকালের পূজায় ঠাকুরকে মাঝে মাঝে ভােগ দেওয়া হইত। এই সব তেলে ভাজা জিনিস মা পছন্দ করিতেন। মুগের নাড়ু, ঝুরিভাজা ইত্যাদিও তাঁহার প্রিয় ছিল। তিনি রাতাবি সন্দেশ এবং (রাঙা আলুর) রসপুলি পিঠা প্রভৃতিও ভালবাসিতেন। ইদানিং আমরুল শাক মায়ের প্রিয় ছিল। তাঁহার আমাশয়ের ধাত ছিল বলিয়া কবিরাজ দুর্গাপ্রসাদ সেন এই শাক ব্যবস্থা করেন। তাই মঠ হইতে কেহ উদ্বোধনে যাইলে পূজনীয় বাবুরাম মহারাজ তাহাকে দিয়া মায়ের জন্য এই শাক পাঠাইতেন। সকালে মা একটি মিছিরির পানা খাইতেন। তাঁহার জন্য যে জলখাবার প্রসাদ রাখা হইত, আগত ভক্তদিগকে কিছু কিছু দিতে দিতে তাহা অনেক সময়ই নিঃশেষ হইয়া যাইত। আর যেদিন তিনি নিজ হাতে প্রসাদ ভাগ করিয়া দিতেন সেদিন মিছরির পানা টুকুও অবশিষ্ট থাকিত না, অথবা অতি অল্পমাত্ৰ থাকিত। ডানহাটুর বাতের জন্য মা দই ইত্যাদি নামমাত্র খাইতেন। কলাই-এর পাতলা ডাল ও (হাতায় করিয়া) পােস্তপােড়া তাঁহার খুব প্রিয় ছিল। পেটের অসুখ ও বাতের জন্য শেষাশেষি তিনি একটু করিয়া আফিম খাইতেন; সেইজন্য মধ্যাহ্নে ও রাতে আধসের করিয়া দুধের ব্যবস্থা ছিল। তিনি মধ্যাহ্নে দুধের অর্ধেক আন্দাজ খাইতেন এবং বাকি দুধে ভাত মাখিয়া তাদের জন্য প্রসাদ রাখিয়া দিতেন; কারণ পূজনীয় শরৎ মহারাজ ও অন্যান্য ভক্তগণ প্রত্যহ অন্ন-প্ৰসাদ চাহিতেন। দুই এক দানা প্রায় সকলেই গ্রহণ করতেন। যে-সব ভক্ত বৈকালে আসিতেন, তাহাদের জন্যও এই প্রসাদ রাখা হইত। তিনি নিজে খাইবার জন্য যে ভাত মাখিতেন তাহাতে ডাল, সুক্ত, ঝোল ইত্যাদি অল্প অল্প করিয়া মাখিতেন এবং 'উহাতে নেবুর রস মিশাইয়া লইতেন। সে প্রসাদ আমাদের বেশ ভাল লাগত। কোন কোন দিন তাহাতে বড়ি, চচ্চড়ি ইত্যাদি মিশাইয়া একটি উপাদেয় খাদ্য তৈয়ার করিতেন। পূজনীয় শরৎ মহারাজ উহা খাইয়া প্রশংসা করতেন। বৈকালে পান ও জল ছাড়া বিশেষ কিছু তাঁহাকে খাইতে দেখি নাই। মাত্র  লুচি, তরকারী ও দুধ দেওয়া হইত। লুচি দই-তিনখানার বেশী খাইতেন না, এবং দুধ প্রায় দেড় পােয়া খাইতেন। 
তিনি দাঁতে প্রত্যহ চারিবার করিয়া গুল দিতেন। নারিকেল পাতা ও দোক্তা পোড়াইয়া উহা তৈয়ারি করা হইত। মায়ের দেহ যাইবার কিছুদিন পর, নীরোদ মহারাজের মা স্বপ্ন দেখেন যে, মা তাঁহাকে বলিতেছেন, “বউমা, ওরা আমাকে সবই দেয়, কিন্তু গুলটি দেয় না। তুমি গুল করে ওখানে ( উদ্বোধনের বাড়িতে) শরৎকে পাঠিয়ে দিও।” তিনি তদনুযায়ী গুল তৈয়ারি করিয়া পাঠাইলে সকলে লক্ষ্য করিলেন, বাস্তবিকই মায়ের সেবার এই নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যটি বাদ পড়িয়াছে। 
মা যখন জয়রামবাটীতে পুরাতন বাটীতে থাকিতেন সকালবেলা প্রায় সাতটা হইতে নয়টা পর্যন্ত বারান্দায় বসিয়া তরকারি কুটিতেন। এই সময়ে আমরা গিয়া নানা কথাবার্তা বলিতাম ও শাকসব্জির পাতা বাছিতাম। এমন সস্নেহে সুপ্রসন্ন মূর্তিতে মা এই সময় কথাবার্তা বলিতেন যে, যাঁহারা একদিনও সেই সৌভাগ্য লাভ করিয়াছেন তাঁহারাই জানেন। সেইজন্য মা যখন কলিকাতায় আসিতেন তখন ভক্তেরা পত্রে প্রায়ই জানিতে চাহিতেন, মা কতদিনে দেশে যাইবেন। জয়রামবাটীতে মায়ের সঙ্গে মিশিবার ও কথাবার্তা বলিবার যে সুযােগ ছিল, এমন আর কোথাও মিলিত না। ভক্ত সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া, থাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা মা নিজেই সযত্নে করিতেন। ভক্তেরাও এখানে আপন মায়ের স্নেহ অনুভব করিতেন। মা নয়টার সময় স্নান করিয়া আসিয়া ঠাকুরপূজা করিতেন, এবং উহা সমাপ্ত হইলে ভক্তদের প্রসাদ দিতেন। সাধারণত মুড়ি, মিষ্টি এবং হালুয়া তৈয়ারি করিয়া দিতেন-কখনও বা ঐ সঙ্গে ফলমূল যাহা ওখানে পাওয়া যাইত বা ভক্তেরা আনিতেন, তাহাও থাকিত। 
রাঁধুনীকে জল খাইতে বসাইয়া মা নিজেই ঐ সময়ে রান্না করিতেন। তাঁহার রান্নার বিশেষত্ব এই ছিল যে, তিনি তরকারিতে নুন, ঝাল ও মশলা সাধারণতঃ একটু কমই দিতেন। 
খাওয়ার সময় ছাড়া অন্য যে সময় ভক্তেরা বাড়ির মধ্যে মাকে দর্শন করিতে যাইতেন, তখনই তিনি তাঁহাদিগকে মিষ্টি, জল ও পান খাইতে দিতেন। পান কাহাকেও খিলির কম দিতেন না। এইসব দ্রব্য অতি সামান্য হইলেও এমন সস্নেহে দিতেন যে, সকলেই এক অপূর্ব আকর্ষণ অনুভব করতেন। আবার কেহ তাঁহার জন্য অতি সামান্য জিনিস লইয়া যাইলেও তিনি কতই না আনন্দিত হইতেন। জয়রামবাটীর নিকটবর্তী শ্যামবাজারে ভাল পান পাওয়া যায়। ঐ অঞ্চলে গরীব ভক্তের কখনও কখনও একগােছ পান লইয়া মাকে দর্শন করিতে আসিতেন। দেখিতাম, মা তাহা পাইয়াই কত খুশী। ভক্তেরা মিষ্টি ইত্যাদি যাহা লইয়া যাইতেন, মা তাহা সযত্নে তাহাদের জন্যই রাখিয়া দিতেন। পূজনীয় শরৎ মহারাজ কলিকাতা হইতে কড়াপাকের সন্দেশ পাঠাইলে মা তাহা ভক্তদের জন্য তুলিয়া রাখিয়া যে ভাবে দুবেলা সকলকে দিতেন, তাহা দেখিয়া মনে হইত যেন উহা ভক্তসেবার জন্যই প্রেরিত হইয়াছে। আবার জয়রামবাটীতে পাড়ার অনেক বৃদ্ধ স্ত্রী-পুরুষে বাড়ির ছোট ছােট ছেলেমেয়েদের লইয়া একবার তাঁহাদের “দিদি ঠাকরুনকে” প্রণাম করিতে প্রায় রোজই আসিত। মাও যেজন্য যে আসিয়া তাহা বুঝিয়া তাহাদের হাত ভরিয়া ফল, মিষ্টি প্রভৃতি যাহা থাকিত প্রসাদ দিতেন। শ্রীমতী কৃষ্ণভাবিনীর প্রেরিত বেদানা এবং পূজনীয় শরৎ মহারাজ যে আম পাঠাইতেন, তাহা ভাগ করিয়া প্রথমে সিংহবাহিনীকে এবং ধর্মঠাকুর ও অন্যান্য দেবতাকে দিতেন। তারপর আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদিগকে দিতেন। একবার কোন পর্বোপলক্ষে পুলিপিঠা হইয়াছে। ছুটি পাইলেই বাঁকুড়া হইতে বিভুতি প্রায়ই জয়রামবাটী আসিয়া থাকে। তাই মা তাহার জন্য পিঠা রাখিয়া দিয়াছেন। দুইদিন গেল, কিন্তু বিভুতি আর আসিতেছে না। তথাপি মা রােজ ঐ পিঠা পুনরায় ভাজিয়া রাখিয়া দিতেছেন। ভাবিতেছেন, “কাল হয়তো আসিতে পারে; যদি আসে, মনে হবে, আহা, খেতে পেলে না।” এইভাবে চারদিন রাখিবার পর বিভুতি গিয়া সেই পিঠা খাইয়াছিল। 
মানুষের অপার স্নেহযত্ন যে পাইয়াছে সেই জানে। জ্ঞান যখন জয়রামবাটী থাকিত তখন তাহার একবার খুব পাঁচড়া হইয়াছিল। নিজ হাতে খাইতে পারিত না। এই সময় মা নিজে ভাত মাখিয়া তাহাকে খাওয়াইয়া দিতেন এবং তাঁহার উচ্ছিষ্ট পাতা পর্যন্ত ফেলিতেন। 
জয়রামবাটীতে মায়ের গৃহনির্মাণের সময় আমি একদিন সকালে কার্যোপলক্ষে পাশের গ্রামে গিয়াছিলাম। জরুরী কাজ থাকায় মধ্যাহ্নে খাইবার সময় আসিয়া পেীঁছিতে পারি নাই। তখন শীতকাল। সুর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক পূর্বে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, মা তখনও খান নাই, আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। বিস্মিত হইয়া মাকে গিয়া বলিলাম, “মা, তােমার শরীর ভাল নয়, আর তুমি এই সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাসী রয়েছ!” মা বলিলেন, “বাবা, তােমার খাওয়া হয়নি, আমি কি করে খাই?” আমি তাড়াতাড়ি খাইতে বসিলাম। আমার খাওয়া হইলে মা এবং মেয়েদের দুই-একজন যাঁহারা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, তাহারা খাইতে বসিলেন। এরুপ ব্যবহার কয়জন জননী নিজের সন্তানের প্রতিই করিয়া থাকেন। তবে মা অন্তরে সকলকেই এইরুপ স্নেহ করিলেও বাহিরে সর্ববিধ ব্যবহারেই গাম্ভীর্য, সঙ্কোচন ও লজ্জাশীলতা রক্ষা করিয়া চলিতেন।
কখনও কখনও মা আমাদিগকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুদির দোকান হইতে জিনিসপত্র কিনিয়া আনিবার জন্য পাঠাইতেন। আমরা হয়তাে ভক্তদের দুইএকজনকে সঙ্গে লইয়া যাইতাম। দেখিয়াছি, তাহারা মায়ের সেবার জন্য এতটুকুও করিতে পারিলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিতেন। ভক্তেরা যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলিতে ইচ্ছা করিতেন, আমরা মায়ের অনুমতি লইয়া তাহাদিগকে ভিতরে লইয়া যাইতাম। মা বলিতেন, “আহ, লােকে কত কষ্ট করে এখানে আসে! গয়া, কাশী যাওয়া বরং সহজ, এখানে আসা তার চেয়েও কষ্টকর।” তাই দুরদেশাগত ভক্তগণকে মা প্রায়ই দুই-একদিন বিশ্রাম করিতে বলিতেন। আমরা বা আগন্তুক ভক্তেরা নিজেরাই তাঁহার অসুবিধার কথা ভাবিয়া যাইবার জন্য তাড়াতাড়ি করিলেও তিনি ছাড়িতেন না। যাঁহারা মায়ের কৃপালাভের জন্য আসিতেন, শরীর নিতান্ত অসুস্থ না থাকিলে মা তাহাদের কাহাকেও বড় একটা ফিরাইতেন না। ভাল আধার দেখিলে কখনও কখনও নিজেই যাচিয়া দীক্ষা দিয়াছেন, অথবা প্রার্থনামাত্র তৎক্ষণাৎ কৃপা করিয়াছেন।
একবার মা দেশ হইতে ম্যালেরিয়ায় জীর্ণশীর্ণ হইয়া কলিকাতা আসিয়াছেন। চিকিৎসায় জ্বর থামিয়াছে মাত্র, কিন্তু খুব দুর্বল আছেন। ভক্তদের কাহাকেও দর্শন করিতে দেওয়া হইতেছে না। এই সময় বােম্বাই হইতে পার্শী একটি যুবক তাহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছে। অতদুর হইতে আসিয়াছে এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী, ইহা মনে করিয়াই বােধ হয় পুজনীয় শরৎ মহারাজ তাহাকে দর্শন করিতে অনুমতি দিলেন। যুবকটির ভ্রাতা কার্যোপলক্ষে যখন আফ্রিকায় ছিলেন তখন ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-পাঠে আকৃষ্ট হইয়া স্বামীজীর কিছু পুস্তক আনাইয়া পড়েন। তিনি বােম্বাই ফিরিলে সেই সকল পুস্তক উক্ত যুবকটি পড়িয়াছে এবং ক্রমশঃ ঐ বিষয়ে আগ্রহ হওয়ায় কলিকাতা আসিয়া। যুবকটি মাকে প্রণাম করিয়া প্রার্থনা করিল, “মাঈজী, কছ মূলমন্ত্র দীজিয়ে জিসসে খােদা পহচান যায়।” শুনিয়াই মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “দেবো? দিই দিয়ে।” আমি বলিলাম, “সে কি। কাউকে দর্শন পর্যন্ত করতে দেওয়া হয় না, সবে অসুখ হতে উঠেছ ; শরৎ মহারাজ শুনলে কি বলবেন! এখন নয়, এর পরে হবে।” মা বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি শরৎকে জিজ্ঞাসা করে এস।” আমি তাড়াতাড়ি গিয়া পূজনীয় শরৎ মহারাজকে সব কথা বলায় তিনি বলিলেন, “আমি আর কি বলব? মার যদি একটা পার্শী চেলা করতে ইচ্ছা হয়ে থাকে, করুন। ব’লে আর কি হবে।” ফিরিয়া গিয়া দেখি, মা ইতােমধ্যেই দীক্ষা দিবার জন্য নিজেই দুইখানি আসন পাতিয়া গঙ্গাজল লইয়া প্রস্তুত হইয়াছেন। দীক্ষা হইলে আমাকে বলিতেছেন, “বেশ ছেলেটি, যা বললাম, ঠিক বুঝে নিলে।” বুঝিলাম, মা কেন বলিতেন, “এসব ঠাকুরই পাঠাচ্ছেন। এই সকল ভিন্ন ভাষাভাষীদের দীক্ষার সময় মা যাহা বলিবার বাংলাতেই বলিয়া যাইতেন, কিন্তু তাহারা বুঝিতে পারিত। যখন দক্ষিণদেশে গিয়াছিলেন, সেখানেও মা বলিতেন, “লােক এসে বলত, 'মন্ত্রম' ‘উপদেশম’ আর কোন কথা তাে বুঝতে পারছি নে।” সেখানেও তিনি ঐরুপে অনেককে দীক্ষা দিয়াছেন। দীক্ষা দিবার সময় তাঁহার মনের অন্তস্তল হইতে যে মন্ত্র উদিত হইত তাহাই দীক্ষাপ্রার্থীর যথার্থ মন্ত্র জানিয়া মা উহাই তাহাকে দিতেন। বলিতেন, ‘কাউকে মন্ত্র দিতে গিয়েই মন থেকে ওঠে, এই দাও, এই দাও। আবার কাউকে মন্ত্র দিতে গিয়ে মনে হয় যেন কিছুই জানিনে, কিছুই মনে আসে না। বসেই আছি, পরে অনেক ভাবতে ভাবতে তবে দেখতে পাই।” ইহার কারণ মা বলিতেন, “যে ভাল আধার তার বেলায় তক্ষণি মন থেকে উঠে।”
অনেক সময় মা অল্প বয়সের ছেলেদেরও দীক্ষা দিয়াছেন। আমার মনে আছে, একবার উদ্বোধনে একটি ছেলে, বছর বার বয়সের, বৈকালে ভক্তদের সঙ্গে প্রণাম করিবার পর কাঁদিতে থাকে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলিল, “মায়ের কৃপা চাই।” আমি বলিলাম, “কৃপা কিরে! হবে এখন, চল।” তবুও কাঁদে। তখন বুঝা গেল, মন্ত্র চায়। ভাবিলাম, কাহারও কাছে শােনা কথা বলিতেছে ; অত ছােট ছেলে মন্ত্রের কি বুঝে? পরদিন দেখি সেই ছেলেটি বাইরের রোয়াকে বসিয়া আছে। সেখানে ছেলে বুড়াে অনেকেই আসিয়া বসে, তাই কেহ খোঁজখবর নেয় নাই। আমি বাজার হইতে ফিরিবার সময় দেখি, সে হাসিতে হাসিতে চলিয়া যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হয়েছে?” সে আনন্দে উত্তর দিল, “আমার দীক্ষা হয়েছে।” শুনিলাম, মা রাধুকে বলেন, “দেখবে নীচে রোয়াকে একটি ছেলে বসে আছে, তাকে নিয়ে এস, এবং তাহার দ্বারা ছেলেটিকে ডাকাইয়া মন্ত্ৰ দিয়াছেন; এখন সে বাজারে শ্রীশ্রীমার জন্য ফলমিষ্টি কিনিতে যাইতেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা হইতেই জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, অতটুকু ছেলেকে আবার কি দীক্ষা দিলে ? ও কি বােঝে ?” মা উত্তর দিলেন, “তা যা হােক, বাপু, ছেলেমানুষ-কাল তাে অমন ক'রে পায়ে পড়ে কাঁদলে। কে ভগবানের জন্য কাঁদছে বল দেখি? এ মতি ক'জনের হয়?”
মা নম্রতার প্রতিমুর্তি ছিলেন। এত লােক তাঁহার পদধুলি পাইলে আপনাদিগকে কৃতাৰ্থ বােধ করিত, তথাপি তিনি নিজেকে ঠাকুরের একজন কৃপাপ্রাপ্তা চরণাশ্রিত বলিয়াই মনে করিতেন। দীক্ষাপ্রদানের পর ঠাকুরকে দেখাইয়া বলিতেন, “ঐ উনিই গুরু।” যদিও কখনও কখনও খুব অন্তরঙ্গভাবে কথা বলিতে বলিতে ‘তিনি কে'—এই সব কথা অলক্ষ্যে মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়িত, কিন্তু ঐ ভাবকে তিনি মনেও স্থান দিতেন না। তাঁহার যাহা কিছু সবই ঠাকুর। জনৈকা প্রাচীন স্ত্রীভক্ত একদিন মার শেষ অসুখের সময় তাঁহাকে “তুমি জগদম্বা, তুমিই সব” ইত্যাদি বলিয়া যেমন প্রশংসা করিতেছেন, অমনি মা রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “যাও, যাও, জগদম্বা'! তিনি দয়া করে পায়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে বর্তে গেছি। ‘তুমি জগদম্বা। তুমি হেন!' বেরোও এখান থেকে।” যদিও তিনি তাঁহার সম্বন্ধে কোন ভক্তের আন্তরিক বিশ্বাসকে বিচলিত করিতেন না, তথাপি এইরপ প্রশংসাবাদ তাঁহার সহ্য হইত না।
তাঁহার নিজের ইচ্ছা বা ন্যায্য বিবেচনার বিরুদ্ধে কেহ কোন কথা বলিলে তিনি প্রথমে উহা মানিয়া লইতেন। পরে ধীরে ধীরে নিজে যেটি ইচ্ছা করিতেন বা ন্যায্য বিবেচনা করিতেন তাহা বলিয়া প্রশ্নকারীকেই জিজ্ঞাসা করিতেন, “আচ্ছা, এ রকম হলে কেমন হয়?” এইরপে ক্ৰমশঃ তাহাকে স্বমতে আনয়ন করিতেন। কখনও তাহার মুখের উপর “তােমার ওকথা কিছু না” বলিয়া উত্তর দিতেন না। একদিন পুর্ণবাবুর স্ত্রী দীক্ষার কথা উত্থাপন করিয়া মাকে বলিলেন, “মা, আপনি তাে শীঘ্রই দেশে চলে যাচ্ছেন, আর আমরাও সিমা পাহাড়ে যাব। আবার কবে দেখা হবে। মন্ত্র নেবার ইচ্ছা, কিন্তু আমার জাতাশৌচ হয়েছে।” গােলাপ-মা ও যােগেন-মা নিকটে ছিলেন। তাঁহারা বলিলেন, “অশৌচে কি দীক্ষা হয় ? এখন কি করে নেবে?" মাও তাঁহাদের কথায় সায় দিয়া বলিলেন, “তাই তাে, কি করে হবে তাহলে?" সেই সময় বরেনবাবুর পিসীও সেখানে ছিলেন। একদিন তিনি মাকে একা পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আপনি কি জাতাশৌচ মানেন ?” মা বলিলেন, ‘কায়াপ্রাণে ন সম্বন্ধ, আবার জাতাশৌচ ! কালীপুজার দিন ওকে গঙ্গাস্নান করিয়ে নিয়ে এসাে।” পরে পূর্ণবাবু নিজেই নির্দিষ্ট দিনে তাহাকে মায়ের নিকট লইয়া যান।
মায়ের গৃহ-প্রতিষ্ঠার সময় ললিতবাবু জয়রামবাটী গিয়াছিলেন। ঐ সময় তিনি তথায় একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করিতে ইচ্ছা করিয়া মাকে একদিন অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিতেছিলেন, “মা, আপনার নামে ভক্তদের কাছে আবেদন বের করলে এই গরীব লােকদের মহা উপকার হবে।” লােক-কল্যাণের জন্য তাহার এই পুনঃপুনঃ অনুরােধে চক্ষুলজ্জায় মা কিছুই বলতে পারিতেছেন না। এই সময় হেমেন্দ্র (৺ব্রহ্মচারী রূপচৈতন্য) উপস্থিত হওয়ায় সে উহাতে ঘাের আপত্তি করিল। মা এতক্ষণে যেন হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। ললিতবাবু চলিয়া যাইবার পর আমি বাড়ির মধ্যে যাইলে মা আমাকে হেমেন্দ্রর কথায় বলিতেছেন, “এ দেখছি আমার যােগীনের মতাে আমায় রক্ষা করলে। ছি! ছি! টাকা চাওয়া !”
যদিও তাঁহার ব্যবহার সর্বদা শিষ্টাচারপুর্ণ ছিল এবং তিনি উহাই পছন্দ করিতেন, তথাপি কলিকাতায় তিনি সকল সময়ে নিঃসঙ্কোচে কথাবার্তা বলিতে কুণ্ঠাবােধ করিতেন। একবার আমাকে বলিয়াছিলেন, “এখানে আমাকে সর্বদা হিসাব করে কথাটি বলতে হয়, চলতে হয়। কে কোন কথাটিতে অসন্তুষ্ট হবে। তার চেয়ে দেশে আমি থাকি ভাল। আমি তাদের হড় হড় করে যা মুখে এল দু-কথা বলে গেলুম। তারাও আমাকে যা হোক কথা বলে গেল। তারাও কিছু মনে করলে না, আমিও কিছু মনে করলুম না, বাস। আর এখানকার লােকেরা কথার একটু এদিক ওদিক হলেই ক্ষয় হয়ে গেল।”
মায়ের সরল, স্নেহপুর্ণ অথচ ধীর গম্ভীর ব্যবহারে সকলে তাঁহার নিকট নিঃসঙ্কোচে কিন্তু সসম্ভ্রমে কথা বলিত। জয়রামবাটীর কাছে শিরোমণিপুৱে বহু মুসলমানের বাস। তাহারা পূর্বে তুঁতের (রেশমকীটের) চাষ করিত।
বিদেশী রেশমের প্রতিযােগিতায় তাহাদের ঐ ব্যবসায় ক্রমশঃ নষ্ট হওয়ায় শেষে চুরি ডাকাতিই তাহাদের জীবিকা হইয়া দাঁড়ায়। পাশ্ববর্তী গ্রামের লােকেরা এই তুঁতে ডাকাতদের ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকিত। কোন গ্রামের মধ্য দিয়া একটি তুঁতে কোন দিন চলিয়া গেলে গ্রামবাসীর শীঘ্রই গ্রামে ডাকাতি হইবে মনে করিয়া সশগক থাকিত। মায়ের শেষ জীবনে যখন ভক্তদের যাতায়াত বাড়িতে থাকে, তখন মা মামাদের বাড়িতে থাকিলে ভক্তদের অসুবিধা হয় দেখিয়া পুজনীয় শরৎ মহারাজ শ্রীশ্রীমার ইচ্ছা অনুসারে তাঁহার জন্য নতূন স্থানে বাড়ি নির্মাণ করেন। সে বৎসর ওদেশে ভীষণ দুভিক্ষ হওয়ায় আমরা বহু তুঁতে মজুর নিযুক্ত করিয়াছিলাম। গ্রামবাসীরা প্রথমে উহাতে ভয় পাইলেও শেষে বলিত, ‘মায়ের কৃপায় ডাকাতগুলাে পর্যন্ত ভক্ত হয়ে গেল রে !" একদিন মা একটি তুঁতে মুসলমানকে (যে মায়ের বাড়ির দেওয়াল নির্মাণ করিয়াছিল) বাড়ির ভিতরে তাঁহার নিজের ঘরের বারান্দায় খাইতে দিয়াছেন। তাহার ভাইঝি নলিনী উঠানে দাঁড়াইয়া তাহাকে দুর হইতে ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া পরিবেশন করিতেছিল। মা তাহা দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “অমন করে দিলে মানুষের কি খেয়ে সুখ হয় ? তুই না পারিস আমি দিচ্ছি।” খাওয়ার শেষে মা উচ্ছিষ্ট স্থানটি নিজেই ধুইয়া দিলেন। নলিনী মাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া, “ও পিসিমা, তােমার জাত গেল,” ইত্যাদি বলিয়া বড়ই আপত্তি করিতে লাগিল। মা তাঁহাকে এই বলিয়া ধমক দিলেন, “আমার শরৎ ( স্বামী সারদানন্দ) যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে। তিনি যে জগতের মা। এইরুপ ব্যবহারেই তাে দুর্বল, অধম মানবের প্রাণে বিশ্বাস আসিবে যে, সেও জগন্মাতার আপন সন্তান। 
বাস্তবিকই তিনি মন্দকেও ভাল চক্ষে দেখিয়া সকলকে উন্নত করিতেন। মা বলিতেন, “দোষ তাে মানুষের লেগেই আছে। কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে তা জানে কজনে?” একদিন একজন তুঁতে মুসলমান কয়েকটি কলা আনিয়া বলিল, “মা, ঠাকুরের জন্য এইগুলি এনেছি, নেবেন কি?" মা লইবার জন্য হাত পাতিলেন ; বলিলেন, ‘খুব নেব, বাবা দাও। ঠাকুরের জন্য এনেছ, নেব বই কি।” মায়ের সাংসারিক কার্যে সাহায্যার্থ নিকটবর্তী গ্রামের জনৈকা স্ত্রীভক্ত কাছেই ছিলেন। তিনি বলিলেন, “ওরা চোর, আমরা জানি। ওর জিনিস ঠাকুরকে দেওয়া কেন?” মা এ কথার কোন উত্তর না দিয়া মুসলমানটিকে মুড়ি মিষ্টি দিতে বলিলেন। সে চলিয়া যাইলে মা ঐ স্ত্রীভক্তটিকে তিরস্কার করিয়া গভীরভাবে বলিলেন, “কে ভাল, কে মন্দ, আমি জানি।” আমরা দেখিতাম, যাহাকে কেহ দেখিতে পারে না, মা ঠিক তাহাকেই আরও আদর যত্ন করিতেন। কেহ কোন মহা গর্হিত কার্য করিয়াও যদি তাহার নিকট অনুতপ্ত হইয়া যাইত, তিনি তাঁহাকে অভয় দিতেন। একবার একটি যুবতী এইরূপে তাহার শরণাপন্ন হইলে মা তাহাকে কোল দিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, যা করেছ করেছ, আর করাে না এবং তাহার পাপরাশি নিজে গ্রহণ করিয়া তাহাকে মন্ত্রদীক্ষা দিলেন, যাহাতে তাহার সুমতি হয়।
একবার জনৈক যুবক ভক্তের কোন অন্যায় আচরণের জন্য ঠাকুরের কোন বিশিষ্ট অন্তরঙ্গ ভক্ত শ্রীশ্রীমাকে অনুরােধ করিয়াছিলেন, যেন তাহাকে মায়ের নিকট আসিতে না দেওয়া হয়। তাহাতে মা বলিয়াছিলেন, “আমার ছেলে যদি ধুলােকাদা মাখে, আমাকেই তাে ধুলাে ঝেড়ে কোলে নিতে হবে!” এই মাতৃসুলভ স্নেহ ও ক্ষমা দ্বারাই তিনি বিপথগামীকে সুপথে আনিতেন!
মায়ের সহনশীলতার সীমা ছিল না। কত লােক নানাপ্রকার পাপতাপের বােঝা লইয়া তাহার চরণ স্পর্শ করিত; শরীরে ভীষণ জ্বালা অনুভব করিলেও মা উহা নীরবে সহ্য করিতেন। একদিন বৈকালে দর্শনার্থীদের প্রণামের পর দেখি, মা বারান্দায় আসিয়া হাটু অবধি পা কেবল ধুইতেছেন। জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, “আর কাউকে পায়ে মাথা দিয়ে প্রণাম করতে দিও না। যত পাপ এসে ঢোকে, আমার পা জ্বলে যায় ; পা ধুয়ে ফেলতে হয়। এইজন্যই তাে ব্যাধি। দূর থেকে প্রণাম করতে বলবে।" বলিয়াই আবার বলিতেছেন, “এসব কথা শরৎকে বলাে না। তাহলে প্রণাম করা বন্ধ করে দেবে।”
নিজ পছন্দমত কাজ মানুষ যেরুপ প্রীতির সহিত দুই-চারি দিন করিয়া থাকে, মাকে জীবনব্যাপী দৈনিক কার্যগুলিও সেইরূপ প্রীতির সহিত করিতে দেখিতাম। জয়রামবাটীতে নিত্যকার সেই রান্নাবাড়া, খাওয়ান ইত্যাদি একঘেয়ে কাজ, তাহার উপর যখন তখন ভক্তসমাগম, আবার তাঁহার সংসারের এক একজন এক এক রকমের ছিল ; ইহা সত্বেও তিনি এই সকল কাজ আনন্দের সহিত করিয়া যাইতেন। অন্যে সাহায্য করে ভাল, না করিলেও কিছু মনে করিতেন না। যেন তাঁহারই সকল দায়িত্ব, বাড়ির অপর সকলে অভ্যাগত! জয়রামবাটীতে দেখিতাম, সকালবেলা সেই ঘন্টা দুই ধরিয়া শাক তরকারি কুটা, রান্নার জন্য ভাঁড়ার বাহির করিয়া দেওয়া, পুজার সব যােগাড় করিয়া নিজে পুজা করা, আবার দীক্ষাদান, প্রসাদ ও জলখাবার বাঁটিয়া দেওয়া, অন্ততঃ একশ খিলি পান সাজা, ভক্তগণকে ও বাড়ির লােকদিগকে খাওয়ান, বৈকালে নিজহাতে লুচি রুটি তরকারি প্রভৃতি করা, দুধ জাল দেওয়া, লন্ঠন পরিষ্কার করা—সবই যেন নিত্য নতূন প্রীতির সহিত করিয়া যাইতেছেন। ইদানীং স্ত্রীভক্তেরা ও নলিনী প্রভৃতি তাঁহাকে সাহায্য করিতেন বটে, তথাপি অধিকাংশ কাজ তাঁহাকেই করিতে ও দেখিতে হইত। মা বলিতেন, “শরীর এদিকে পড়ে যাচ্ছে, আর কাজও ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে।”
ছোট ছোট খুঁটিনাটি কাজেও মায়ের আচরণ আদর্শ স্থানীয় ছিল। উদ্বোধনে আমরা স্নানের পর কাপড় শুকাইতে দিতাম। বৈকালে বর্ষা হইলে সেগুলি ভাল করিয়া শুকাইত না, কোনখানি হয়তাে পুনরায় ভিজিত, কোনখানির জলে হয়তাে ভাল করিয়া নিংড়ান হইত না। দেখিতাম, মা আস্তে আস্তে সেই কাপড়গুলি আবার নিংড়াইয়া দোতলার দক্ষিণের ঘরে লম্বা করিয়া দড়িতে বা জানালার গরাদের সহিত বাঁধিয়া শুকাইতে দিতেছেন। একদিন বৃষ্টির পরে তাহাকে ঐরুপ করিতে দেখিয়া আমি বলিলাম, “মা, এত লােক রয়েছে, তুমি আবার কেন জল ঘাঁটছ ? বৃষ্টিতে বারাণ্ডা সব ভিজে গেছে, পায়ে বাত-আর কি লােক নেই ?” মা বলিলেন, “না, বাবা, এই যাচ্ছি, এই সামান্য একটু।” স্বামীজী বলিতেন, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনায় মানুষকে চিনতে হয়।
সামান্য সামান্য বিষয়েও মায়ের অদ্ভুত দৃষ্টি ছিল। জয়রামবাটীতে তাঁহার নতূন বাড়ি হওয়ার পর গ্রাম পঞ্চায়েত চার টাকা ট্যাক্স ধার্য করিয়া জ্ঞানানন্দের নিকট হইতে উহা আদায় করে। মা তখন কলিকাতায় ছিলেন। পর বৎসর মা দেশে যাইলে চৌকিদার যখন উহা আদায় করিতে আসিল তখন মা বলিলেন, “এত বেশী কেন? কমাবার চেষ্টা কর। আমি না হয় দিলুম। কিন্তু আমি যখন থাকব না তখন সন্নাসী ব্রহ্মচারী যে থাকবে সে কি করে দেবে? তার খাওয়া পরাই হয়তাে ভিক্ষা করে চালাতে হবে। আর একবার জ্ঞান যখন জয়রামবাটীতে, তখন সে গােয়ালাকে খাঁটি দুধ দিবার জন্য বিশেষ করিয়া বলিত, “টাকায় আট সের দেবে, তবু খাঁটি চাই। এইভাবে সে চড়া দরে দুষ কিনিত। একদিন মা উহা শুনিতে পাইয়া তাহাকে তিরস্কার করিলেন, “ওকি, জ্ঞান, এখানে পয়সায় পােয়া দুধ মেলে, গরীবে খেতে পায়। আর তুমি অমনি করে দর বাড়াচ্ছ! গােয়ালা—সে তাে জল দেবেই। দর বাড়ালে তখন তো পয়সা বেশী পাবে বলে আরও জল মেশাতে চাইবে।
অন্যদিকে কতকগুলি বিষয় মায়ের বড়ই চমৎকার ছিল। কেহ নির্লজ্জ হইয়া নাচুক না কেন, মা সেইস্থান দিয়া চলিয়া যাইলেও তাহার দৃষ্টি আদৌ সেদিকে পড়িবে না। যদি দৈবাৎ কখনও পড়িল, তথাপি তাহার তৎকালীন উদাসীন দৃষ্টি ও মুখের ভাব হইতে স্পষ্ট বােধ হইত, তিনি ইহার কিছুই লক্ষ্য করেন নাই বা উহা বিসদৃশ বলিয়া মনে করেন নাই। যেন বালিকার দৃষ্টি ভালমন্দের বােধই নাই।
লােককে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া তাহার দোষগুণ দেখার অভ্যাস মায়ের কখনই ছিল না। একবার চাহিয়া দেখিলেন, এইমাত্র। দৃষ্টিমাত্র লােকের অন্তরবাহির জানিবার শক্তি যাঁহার ছিল, অন্যায় করিয়া তাহার কাছে নিঃসঙ্কোচে দাঁড়াইতাম। জানিতাম যে, তাঁহার দৃষ্টি ঐদিকে পড়িবে না অথবা যতক্ষণ না বলিব, তিনি জানিতে পারিবেন না। আর বলিলে তাে ক্ষমা আছেই। যিনি যত বেশী শক্তি হজম করিতে পারেন, তিনি তততা অধিক শক্তিমান। নিবেদিতা ঠিকই লিখিয়াছেন, “স্ত্রীভক্তেরা মায়ের সঙ্গে বসিয়া যখন কথাবার্তা বলতেন, তাঁহারা কিছুতেই মনে করিতে পারিতেন না যে, ঠাকুরের সঙ্গে মায়ের সব বা তাঁহার উপর মায়ের দাবি তাঁহাদের চেয়ে বেশী ছিল। মনে হইত যেন তিনি তাঁহাদের মতােই ঠাকুরের আশ্রিত ও কৃপাপ্রার্থীদের একজন।”
যদিও তাঁহার নিকট ত্যাগী ও গৃহস্থ সমান আদর পাইয়াছে, তথাপি ত্যাগীরা সমধিক প্রিয় ছিল। তিনি বলিতেন, “বাবা, ত্যাগীদের না হলে কাদের নিয়ে থাকব?” একবার বেলুড় মঠে ঠাকুরের উৎসবে মা গিয়াছেন। মধ্যাহ্নে তাঁহার আহারের পর আমি জাগ হইতে জল ঢালিয়া দিতেছি, মা দাঁড়াইয়া আঁচাইতেছেন। আঁচাইবার পর মা সাধারণতঃ পা ধুইয়া থাকেন। আমি সেইজন্য পায়ে জল ঢালিয়া দিতেছি এবং হাটুর বাতের জন্য মায়ের নীচু হইতে কষ্ট হইবে মনে করিয়া নিজেই হাত দিয়া পায়ের পাতার উপরের জলটা একটু মুছিয়া দিতেছি। অমনি মা মহা সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, “না, না, বাবা, তুমি। তােমরা দেবের আরাধ্য ধন।” এই বলিয়া নিজেই হাত দিয়া পা মুছিলেন। আমি তাে তখন কাছা দিয়া কাপড় পরি, আর তাঁহার পায়ে জল ঢালিয়া দিবারও যােগ্য নহি।
মঠের সাধু-ব্রক্ষচারীরা আসিলে রাধু প্রভৃতিকে মা প্রায়ই বলতেন, “দাদাদের প্রণাম কর।” একদিন উদ্বোধনের বাড়িতে কোন প্রাচীন স্ত্রীভক্ত জনৈক সাধুর সঙ্গে কোন ব্যাপারে কথা কাটাকাটি হওয়ায় এই বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন, “ও এখানে থাকিলে আমি কিছুতেই আসব না।" অনেকে তাহাকে অনুনয়-বিনয় করিয়া ফিরাইতে চেষ্টা করিয়াও পারিলেন না। মায়ের কানে সব ঘটনা পেীঁছিতেই মা উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “ও কে ? গৃহস্থ ! যায় এখান থেকে, যাক না। সাধু আমার জন্য সব ত্যাগ করে এখানে রয়েছে।” অথচ যাঁহাকে মা এইরূপ তিরস্কার করিলেন, ঠাকুরের স্ত্রীভক্তদের মধ্যে তাঁহার স্থান অতি উচ্চে। জনৈক ত্যাগী ভক্ত মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মা, সন্ন্যাসীই হােক, আর গৃহস্থই হােক, ঠাকুরের যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা সবই তাে সমান—কারণ সকলেই মুক্ত হবে ?” মা বলিলেন, “সে কি! ত্যাগী আর গৃহস্থ কি সমান? ওদের কামনা বাসনা কত কি রয়েছে, আর এরা তাঁর জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছে। এদের আর তিনি ভিন্ন কি আছে ? সাধুদের সঙ্গে কি ওদের তুলনা হয়?”
যুবক ভক্তেরা অনেক সময় মাকে জিজ্ঞাসা করিত, “বিবাহ করিব কি না?” তিনি মন বুঝিয়া কাহাকেও বলিতেন, “সংসারীদের কত কষ্ট! তােমরা হাঁপ ছেড়ে ঘুমিয়ে বাঁচবে।” কাহাকেও বা বলিতেন, “আমি ও সম্বন্ধে কোন মতামত দিতে পারব না। বিয়ে করে যদি অশান্তি হয়, তখন বলবে, ‘ম, আপনি বিয়ে করতে মত দিয়েছিলেন।” আবার জনৈক ভক্ত যখন বলিল, “মা, আমি বিয়ে করব না, তখন মা হাসিয়া বলিয়াছিলেন, “সে কি গো? সংসারে সবই দুটি দুটি। এই দেখ না, চোখ দুটি, কান দুটি, হাত দুটি, পা দুটি-তেমন পুরুষ ও প্রকৃতি।” বাস্তবিক সে ভক্তটি পরে বিবাহ করিয়াছিল। আবার কেহ হয়তাে লিখিয়াছে, “মা, আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা নেই, বাড়িতে বাপ-মা জোর করে বিয়ে দিতে চায়।” মা শুনিয়াই বলিলেন, “দেখ, দেখ, কি অত্যাচার।” একবার একটি ভক্ত মাকে গিয়া বলিল, “মা, আমি এতকাল বিয়ে না করে থাকবার চেষ্টা করেছিলাম। এখন দেখছি পেরে উঠব না” ইত্যাদি। মা তাহাকে অভয় দিয়া বলিলেন, “ভয় কি? ঠাকুরের কত গৃহস্থ ভক্ত ছিলেন। তােমার কোন ভয় নেই - তুমি বিয়ে করবে।” এই বলিয়া তাহাকে খুব আশীর্বাদ করিলেন। সে যে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাতেই মা খুব খুশী হইয়াছিলেন। নিবৃত্তির দিকে যাহাদের একটুও স্পৃহা হইয়াছে, তাহাদের বিবাহ না করাই ভাল—এইরূপ উপদেশ মা প্রায়ই দিতেন। মেয়েদের মধ্যেও যাহাদের বিবাহে তেমন ইচ্ছা নাই, মা তাহাদিগকে নিবৃত্তির উপদেশই দিতেন। একবার জনৈক ভক্তের কন্যা বিবাহে রাজী না হওয়ায় তাহার মাতা শ্রীশ্রীমাকে সব নিবেদন করিলেন যাহাতে তিনি মেয়েটিকে বিবাহের আদেশ দেন। তদুত্তরে মা বলিলেন, “সারাজীবন পরের দাসত্ব করা, পরের মন যােগান, এ কি কম কষ্টের কথা!” তারপর এই মর্মে বলিলেন যে, যদিও অবিবাহিত জীবনে বিপদের সম্ভাবনা আছে, তথাপি যাহার বিবাহে ইচ্ছা নাই তাহাকে বিবাহ দিয়া স্থায়ী ভােগে লিপ্ত করা কিছুতেই উচিত নহে। 
১৩২৬ সালের পৌষ মাসে মা জয়রামবাটীতে ছিলেন। জন্মতিথির দিন বৈকালে তাঁহার সামান্য জন্ম হয়। মাঝে মাঝে ভাল থাকিলেও এই জ্বরে ক্রমশঃ ভুগিতে ভুগিতে মা খুব দুর্বল হইয়া পড়েন। এই অসুস্থতার মধ্যেও অনেক ভক্ত তথায় দীক্ষা লইতে গিয়াছেন এবং তাহার কৃপালাভ করিয়াছেন। হয়তাে একবার জ্বর হইয়া গেল ; জ্বর ছাড়িতেই—অন্নপথ্য পাইবার পূর্বেও মা দীক্ষা দিয়াছেন, কারণ ভক্তেরা কত আশা করিয়া তাহার নিকট যাইতেন। কলিকাতা আসিবার দুই-একদিন পূর্বে মা সিংহবাহিনীকে প্রণাম করিতে গিয়াছিলেন। তিনি তখন এত দুর্বল হইয়াছেন যে, ঐটুকু গিয়া ফিরিয়া আসিতেই অত্যন্ত ক্লান্তিবােধ করেন। বলিয়াছিলেন, “কালঘাম ছটিয়ে দিয়েছিল।” কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই নিজের জ্বর বা ঐরুপ অত্যধিক দুর্বলতার কথা প্রকাশ করিতেন না, পাছে ভক্তদের দর্শনাদির ব্যাঘাত হয়, অথবা তাঁহার জন্য অপরে ভাবিত হয়।
তাঁহার এইরুপ অসুখের সংবাদ পাইয়া পুজনীয় শরৎ মহারাজ চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে কলিকাতায় আনাইলেন। ফাগুন মাসের মধ্যভাগে মা কলিকাতা পৌঁছিলেন। তখন তাঁহার শরীর অতি শীর্ণ; খুব দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত শ্যামাদাস কবিরাজের চিকিৎসায় কিছুদিন তাঁহার জ্বর বন্ধ থাকে। শরীর তখন অনেকটা ভাল মনে হইতেছিল। একদিন ভক্তেরা অনেকে প্রণামও করেন। 
কবিরাজী ঔষধের মধ্যে একটি তিক্ত পাচন ছিল। সকালে মা তাহা খাইতেন। খুব তিক্ত বলিয়া অনেকক্ষণ ঐজন্য অস্বস্তি বােধ করিতেন, এমন কি দ্বিপ্রহরে আহারের সময়েও যেন মুখে সেই তিক্ত স্বাদ বােধ হইত; তাই ভাত খাইতে পারিতেন না। ঔষধ বদলানর কথায় কবিরাজ বলিলেন যে, ঐ রােগের তিক্ত ছাড়া তাহার ঔষধ নাই। তখন কবিরাজীর পরিবর্তে ডাক্তারী চিকিৎসা আরম্ভ হয় এবং ডাক্তার বিপিন ঘোষকে দেখান হয়। জ্বরও পুনরায় দেখা দিল। বিপিনবাবু প্রায় দেড় মাস চিকিৎসা করেন।
তারপর ডাক্তার প্রাণধন বসুকে দেখান হয়। এই সময় ডাক্তার সুরেশ ভট্টাচার্য ও ডাক্তার নীলরতন সরকারকেও এক দিন আনা হয়। নীলরতনবাবু কালাজ্বর বলিয়া নির্দেশ করেন। প্রাণধনবাবু খুব যত্নের সহিত চিকিৎসা করিয়াছিলেন। দুই-তিন দিন আসিবার পর বলিলেন, “আমাকেও আপনাদের মায়ের একজন সেবক মনে করবেন।” মা তাঁহাকে খুব ভালবাসিতেন; তাঁহার জন্য আম, লিচু প্রভৃতি পাঠাইয়া দিতে বলিতেন। রােগের উপশম না হওয়ায় কবিরাজী চিকিৎসা আরম্ভ হয় এবং শ্ৰীযুত শ্যামাদাস বিশেষ অসুস্থ থাকায় কবিরাজ রাজেন্দ্রনাথ সেন দেখিতে থাকেন। তাঁহার সঙ্গে শ্ৰীযুত কালীভুষণ সেন ও শ্ৰীযুত রাম কবিরাজকেও আনা হইত। 
কিছুতেই কিছু হইল না। রােগ দিন দিন বাড়িতেই লগিল। প্রত্যহ তিন-চারবার করিয়া জ্বর উঠিত। পিত্তপ্রধান জ্বর, শরীরে অসহ্য জ্বালা হইত। মা বলিতেন, “পানাপুকুরের জলে গা ডুবিয়ে থাকব।” বরফে হাত রাখিয়া আমরা সেই হাত মায়ের শরীরে বুলাইয়া দিতাম। জ্বরবৃদ্ধির সময় প্রায়ই হুশ থাকিত না। তখন গ্রীষ্মকাল। একদিন দ্বিপ্রহরে বহুদূর গিয়া তবে বরফ পাওয়া গেল। আসিয়া দেখিলাম অসহ্য গাত্রদাহ। বরফ কাপড় দিয়া ঢাকিয়া তাহার উপর মায়ের হাত রাখিয়া দিতেই মা আরাম পাইয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ও রাসবেহারী, তুমি এ কোথায় পেলে।" গাত্রদাহের জন্য, যাহাদের গা ঠাণ্ডা তাহারা কাছে গেলেই মা তাহাদের গায়ে হাত রাখিতেন। ভুগিয়া ভূগিয়া তিনি যেন ছেলেমানুষের মতাে হইয়া গিয়াছিলেন। একদিন সকালবেলা আমাকে ডাকাইলেন। আমি যাইবামাত্র বলিলেন, “আমাকে কোলে করে বস।” এই দীর্ঘকাল শুইয়া থাকিতে থাকিতে রােগের যন্ত্রণা শরীরে যেন আর সহ্য হইতেছে না। সরলা কাছে ছিলেন। তাঁহাকে বলিলাম, “মাকে একটু কোলে করে বস। তােমরা মেয়েছেলে।” তিনি চুপ করিয়া থাকায় শেষে বালিশ উচু করিয়া তাহাই ঠেশান দিয়া মাকে বসাইয়া গায়ে ও মুখে একটু হাত বুলাইয়া সান্ত্বনা করিলাম।
এইরপে অসুখের মধ্যেও সকালবেলা কবিরাজের নিকট যাইবার পূর্বে রােগের বিবরণ লইতে যখন মায়ের কাছে যাইতাম, তিনি বলিতে ভুলিতেন না, “খেয়ে যাও, বেলা হবে।” কবিরাজেরা দেখিয়া যাইবার পর প্রায়ই বলিতেন, “বুড়াের ( ৺দুর্গাপ্রসাদ সেনের) নাতিকে (কবিরাজ কালীভুষণকে) জল খেতে দাও, সন্দেশ দাও, আম দাও। রাম কবিরাজকে দাও, বড়াে কবিরাজকে (শ্ৰীযুত রাজেন্দ্রনাথ সেনকে) দাও।” ডাক্তার কাঞ্জিলাল, দুর্গাপদ, শ্যামাপদ প্রভৃতি যে কেহ আসিতেন, মা সকলেরই কুশল জিজ্ঞাসা করিতেন। একদিন আরামবাগ হইতে প্রভাকরবাবু ও মণীন্দ্রবাবু আসিয়াছেন। খুব ক্ষীণস্বরে থামিয়া থামিয়া মা তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “ভাল আছ, বাবা? বাঁচব কি ? কিছু খেতে পারি না, বড় দুর্বল। বরদা ( শ্রীশ্রীমার ভাই) মারা গিয়েছে।” দেশেরও খবর লইতেছেন, “জল হয়েছে কি ?” মণীন্দ্রবাবু বলিলেন, “না, মা।” মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে প্রসাদ পাবে তাে?" মণীন্দ্রবাবু বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ।” রমণী নামক একটি স্ত্রীলােক দ্বারা তিনি শ্রীশ্রীমায়ের জন্য কচি তাল পাঠাইয়াছিলেন। এই স্ত্রীলােকটি মণীন্দ্রবাবুর প্রেরিত জিনিসপত্র লইয়া কয়েকবার জয়রামবাটীও গিয়াছিল। মা তাহার কথায় বলিলেন, “রমণী কখন এসেছিল জানি না; জ্বরে হুঁশ ছিল না। তাকে বলো, সে যেন মনে দুঃখ না করে।” কাশী হইতে শান্তানন্দ স্বামী প্রভৃতি যিনি যখন আসিয়াছেন সকলকেই জিজ্ঞাসা করিতেন, “লাটু কেমন আছে ?” মা অসুখে পড়িয়া শুনিয়াছিলেন, পুজনীয় লাটু মহারাজের খুব অসুখ। কাশী হইতে ইহার যখন আসেন তখন লাটু মহারাজের শরীর গিয়াছে। এ দুঃসংবাদ তাঁহাকে শুনান হয় নাই। বােধ হয় মা অন্তরে জানিতে পারিয়াছিলেন, তাই বারংবার তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন।
নবাসনের বউ এবং সরলা মার খুব সেবা করিয়াছিলেন। যতক্ষণ কিছুমাত্র সামর্থ্য ছিল, মা কাহাকেও সেবা করিতে দিতে এতই সঙ্কুচিত হইতেন যে, তাঁহার সেবা করার সুযােগই হইত না। এই শেষ অসুখের সময় একদিন বেলা প্রায় এগারটার সময় মায়ের পথ্য হইয়া গিয়াছে, তক্তপােশের উপর আড়ভাবে শুইয়া আছেন। একটু ঘুম পাড়াইবার জন্য হাওয়া করিতেছিলাম। চার-পাঁচ মিনিট পরেই বলিলেন, “আর না, তােমার হাত ব্যথা করছে। আমি বলিলাম, “না মা, এ হাতপাখা, আমার একটুও হাত ব্যথা করছে না। করলে আমি আপনিই থামব।” একটু চক্ষ বুজিয়া থাকিয়াই আবার বলিলেন, “না, বাবা, তােমার হাত ব্যথা করবে। থাক, আমি অমনি ঘুমচ্ছি।” একটু চুপ করিয়াই আবার বলিলেন, “বাবা, তােমার হাত ব্যথা করবে ভেবে আমার ঘুম আসছে না। তুমি পাখা বন্ধ কর, তা হলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুই।” অগত্যা আমি পাখা বন্ধ করিলাম। মাও চুপ করিয়া শুইয়া রহিলেন। বােধ হয় দশ মিনিটও হাওয়া করা হইল না।
ক্রমশঃ অসুখ খুব বাড়িতে লাগিল। ঘরের তক্তপােশ সরাইয়া দিয়া মেঝেতেই বিছানা করা হইল। এ রােগ যে সারিবে না, মা তাহা জানিতেন বলিয়াই মনে হয়। পুনর্বারের অসুখের পর বলিয়াছিলেন, “আবার তাে সেই রকম ভুগতে হবে।” জীবের কল্যাণের জন্য যে রাধুর মায়া অবলম্বন করিয়া তিনি ঠাকুরের অদর্শনের পরও এই দীর্ঘকাল বর্তমান ছিলেন, সেই রাধুর সম্পর্কও তিনি ছিন্ন করিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, “কুটোছেঁড়া করে দিয়েছি।” একদিন অনেক অনুনয় করিয়া বলিয়াছিলাম, “মা, তুমি তাে ইচ্ছা করলেই থাকতে পার।” তাহাতে শুধু, বলিলেন, “মরতে কার সাধ ?” তাঁহার নিজের ইচ্ছা বলিয়া কিছু ছিল না। বলিতেন, “ঠাকুর যখন নিয়ে যাবেন, যাব।” 
ক্রমে রক্তহীনতায় হাত-পায়ে শােথ দেখা দিল। উঠিবার শক্তি না থাকায় বিছানাতেই শৌচাদি করান হইত। শ্রীমতী সুধীরা ও নিবেদিতা স্কুলের মেয়েরা পালা করিয়া থাকিয়া সব সময়ে পরিচর্যা করিতেছিলেন। ভাল ব্রাহ্মণের দ্বারা যথাবিহিত শান্তি-স্বস্ত্যয়নাদিও করান হইয়াছিল। কিন্তু কিছুতেই ফল হইল না। কবিরাজ রাজেন্দ্রনাথ সেন দুই মাস পূর্ব হইতেই বলিয়াছিলেন, “আপনাদের ভক্তদের মধ্যে যাঁহারা দেখিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদিগকে সংবাদ দিতে পারেন, কারণ এ রােগে আর আশা নাই।” দেহ যাইবার পাঁচদিন মাত্র বাকী আছে। জনৈক স্ত্রী-ভক্ত (অন্নপূর্ণার মা) দেখিতে আসিয়াছেন। ভিতরে যাইতে নিষেধ বলিয়া তিনি ঠাকুরঘরের দুয়ারেই বসিয়াছিলেন। হঠাৎ পাশ ফেরায় মা তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া হাতে ইশারা করিয়া কাছে ডাকিলেন। তিনি প্রণাম করিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, “মা, আমাদের কি হবে ?” চিরকরুণাময়ী অভয় দিয়া ধীরে ধীরে ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন, “ভয় কি? তুমি ঠাকুরকে দেখেছ, তােমার আবার ভয় কি?" একটু পরে আবার ক্ষীণকণ্ঠে থামিয়া থামিয়া বলিলেন, “তবে একটি কথা বলি-যদি শান্তি চাও, মা, কারাে দোষ দেখাে না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ, কেউ পর নয়, মা; জগৎ তােমার।”
যাহাদের দুঃখে কাতর হইয়া মা স্বয়ং তাহাদের পাপভার গ্রহণপূর্বক এই দুঃসহ রােগযাতনা ভােগ করিতেন, তাহাদের প্রতি ইহাই তাঁহার শেষ বাণী। ১৩২৭ সালের ৪ঠা শ্রাবণ, মঙ্গলবার, রাত্রি দেড়টার সময় ভক্তসন্তানগণকে কাঁদাইয়া তিনি মহাসমাধিযােগে শ্রীশ্রীঠাকুরের সহিত মিলিত হইলেন। পরদিন বেলুড় মঠে তাঁহার দিব্যদেহের যথারীতি সৎকার করা হইল। শ্রীশ্রীমায়ের স্থূলদেহ লােকচক্ষুর অন্তরাল হইলেও সুক্ষ্মশরীরে তিনি প্রতি ভক্তের হৃদয়মন্দিরে চিরবিরাজমানা রহিয়াছেন।
~স্বামী অরুপানন্দ।

শ্রীশ্রীমার কোষ্ঠী 

(শ্ৰীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র জ্যোতির্ভূষণ-কৃত)
শ্রীশ্রীমার কোষ্ঠী


স্বামী অরুপানন্দ

জয়রামবাটীতে প্রথম দর্শন। ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯০৭। 

শিবচতুর্দশীর পূর্ব তৃতীয়া, সকাল প্রায় সাড়ে আটটা।

বরদা মামা আসিয়া সংবাদ দিলেন, “মা ডাকছেন।”
বাড়ির মধ্যে গিয়ে দেখি মা তাহার ঘরের ভিতরে দুয়ারে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছেন। প্রণাম করিতেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথা থেকে এসেছ ?”
আমি জেলার নাম বলিলাম। 
মা—এখন বুঝি ঠাকুরের কথাটথা নিয়েই আছ ?
আমি ঐকথার কোন উত্তর দিলাম না। যেন পূর্বপরিচিতের মতাে কথাবার্তা । সেই সস্নেহ দৃষ্টি আমার এখনও মনে পড়িতেছে।
মা—তুমি কায়স্থ ? (আমার সব শরীর কিন্তু শীতকাল বলিয়া র‍্যাপারে ঢাকা।)
আমি - হাঁ। 
মা - তােমরা কটি ভাই ? 
আমি - চার ভাই। 
মা - বস, জল খাও।
এই বলিয়া নিজেই বারান্দায় আসন পাতিয়া দিয়া রাত্রের প্রসাদী লুচি ও গুড় একটা বাটিতে করিয়া আনিয়া দিলেন।
পূর্বদিন তারকেশ্বর হইতে হাঁটিয়া গিয়াছি। সন্ধ্যায় দেশড়া (জয়রামবাটীর উত্তর পাশের গ্রাম) পেীঁছি। সঙ্গে দেশড়ার একটি ছেলে (গােবিন্দ রায়ের বড় ছেলে)। তাহার সঙ্গে হরিপাল স্টেশনে আলাপ হয়। রাত্রিতে তাহাদের বাড়িতে ছিলাম। 
মা এই সব শুনিলেন এবং আমার খাওয়ার পর বলিলেন, “স্নান করাে না। অনেক পথ হেঁটে এসেছ।” পান দিলেন।
মধ্যাহ্নে ঠাকুরের ভােগ হইতেই আমাকে ডাকাইলেন এবং প্রথমেই খাইতে দিলেন। নিজেই শালপাতায় ভাত-তরকারি সব বাড়িয়া দিয়া গেলেন। আমি মায়ের ঘরের বারান্দায় বসিয়া খাইতেছি। খাওয়ার সময় মা বলিলেন, “পেট ভরে খেও, জান?” খাওয়ার পর পান দিলেন।
বৈকালে তিন-চারিটার সময় বাড়ির মধ্যে গিয়া দেখি মা ময়দা মাখিতেছেন। তাঁহার ঘরের বারান্দার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পূর্বমুখে পা মেলিয়া বসিয়াছেন। পাশেই ছােট উনুন, বৈকালে লুচি, তরকারি ইত্যাদি সেখানেই রান্না হয়। আমাকে দেখিয়া মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি চাও?”
আমি - তােমার সঙ্গে কথা আছে। 
মা - কি কথা? বস। 
এই বলিয়া বসিতে আসন দিলেন। 
আমি — মা, এই যে ঠাকুরকে সকলে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন বলে, তুমি কি বল ? 
মা - হাঁ, তিনি আমার পূর্ণব্রহ্ম সনাতন।
‘আমার’ বলায় আমি বলিলাম, “তা প্রত্যেক স্ত্রীলােকেরই স্বামী পূর্ণব্রহ্ম সনাতন। আমি সেভাবে জিজ্ঞাসা করছি না।”
মা - হাঁ, তিনি পূর্ণব্রহ্ম সনাতন-স্বামিভাবেও, এমনি ভাবেও।
তখন আমার মনে হইল, তিনি পূর্ণব্রহ্ম হইলে মা জগদম্বা স্বয়ং - যেমন সীতা-রাম, রাধা-কৃষ্ণ পরষ্পর অভিন্ন। আমিও এই বিশ্বাস লইয়াই মাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে যে তােমাকে এই দেখছি যেন সাধারণ স্ত্রীলােকের মতাে বসে রুটি বেলছ, এসব কি ? মায়া, না কি!” 
মা - মায়া বইকি। মায়া না হলে আমার এ দশা কেন? আমি বৈকুণ্ঠে নারায়ণের পাশে লক্ষী হয়ে থাকতুম। বলিয়াই আবার বলিতেছেন, “ভগবান, নরলীলা করতে ভালবাসেন কি-না। শ্রীকৃষ্ণ গােয়ালার ছেলে ছিলেন। রাম দশরথের বেটা।”
আমি -  তােমার কি আপনার স্বরুপ মনে পড়ে না ?
মা—হাঁ, এক একবার মনে পড়ে। তখন ভাবি, এ কি করছি, এ কি করছি। আবার এইসব বাড়িঘর, ছেলে-পিলে (হাত চিৎ করিয়া সামনের সব দেখাইয়া) মনে আসে ও ভুলে যাই। 
আমি প্রায় রােজই সন্ধ্যার পর মায়ের ঘরে গিয়া বসিতাম, মা খাটে শুইয়া থাকিয়া কথাবার্তা বলিতেন। রাধু (মায়ের ভাইঝি। মায়ের পাশে ঘুমাইয়া থাকিত। ঘরে পিলসুজের উপর প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিত। কোন কোন দিন ঝিকে মায়ের পায়ের বাতের তেল মালিশ করিতে দেখিতাম। 
কথাপ্রসঙ্গে মা বলিতেছেন, “যখন আমার কোন ভক্তকে মনে পড়ে, আমার প্রাণ ব্যাকুল হয় তখন হয়, সে নিজে আসে, নয় তার চিঠিপত্র আসে।”
“এই যে এখানে এসেছ, একটা কিছু ভাব নিয়ে এসেছ। হয়তাে জগন্মাতা* ভেবে এসেছ।”
আমি — তুমি কি সকলেরই মা? 
মা —  হাঁ। 
আমি — এই সব ইতর জীবজন্তুরও? 
মা — হাঁ, ওদেরও। 
আমি — তবে ওরা এত কষ্ট পাচ্ছে কেন?
মা — ওদের এসব জন্ম এই-ই (অর্থাৎ ইতর জীবজন্তুর এই সকল জন্মে এই প্রকারই হইয়া থাকে)।
মাকু (মায়ের আর এক ভাইঝি) ও রাধু পাঠশালে যাইত। সন্ধ্যার পূর্বে তাহারা আসিলে মা আগে তাহাদের খাওয়াইতেন। আমি বলিলাম, “কি হচ্ছে ?” —তখন একটু একটু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলিতে শিখিয়াছি। 
মা হাসিয়া আমার ‘হচ্ছে' কথাটির উচ্চারণ নকল করিয়া বলিলেন ‘বালিকা ভােজন হচ্ছে।”
* শ্রীশ্রীমা নিজের সম্বন্ধে কদাচিৎ এই ভাবের কথা বলিতেন। পরে শিবুদাদার মুখে শুনিয়াছি, ঠাকুরের দেহত্যাগের পর একবার মা কামারপুকুর হইতে জয়রামবাটী আসিতেছিলেন। সঙ্গে শিবুদাদা (তখন ছেলেমানুষ) কাপড়ের পুঁটলি লইয়া। জয়রামবাটীর প্রায় কাছে মাঠের মধ্যে আসিয়া শিবুদাদার হঠাৎ কিরূপ মনে হওয়ায় দাঁড়াইয়া পলে। মা কিছুদূর আসিয়া পিছনে কাহারও পায়ের শব্দ শুনিতে না পাইয়া ফিরিয়া দেখেন, শিবুদা দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। মা বলিলেন, “ও কিরে, শিবু, এগিয়ে আয়।” শিবুদাদা বলিলেন, “একটি কথা বলতে পার, তাহলে আসতে পারি। মা–“কি কথা?” শিবুদাদা —“তুমি কে, বলতে পার ?" মা - “আমি কে? আমি তাের খুড়ী। শিবুদাদা—“তবে যাও, এই তাে বাড়ির কাছে এসেছ। আমি আর যাব না। (এদিকে বেলা শেষ হইয়াছে।) মা--“দেখ দেখি, আমি আবার কে রে? আমি মানুষ, তাের খুড়ী।" শিবুদাদা-“বেশ তাে, তুমি যাও না।" শিবুদাদাকে না খাইতে দেখিয়া মা শেষে বলিলেন, “লােকে বলে কালী।” শি্বুদাদা - ”কালী তাে? ঠিক?" মা - “হা।" শিবুদাদা —“তবে চল।” বলিয়া সঙ্গে সঙ্গে জয়রামবাটী যাইলেন।
সন্ধ্যার পর মায়ের ঘরে কথাবার্তা হইতেছে। 
মা—এই যে তোমরা এসেছ ; আপনার না হলে আসবে কেন? 
আমি—আমি কি তােমার আপনার ?
মা—হাঁ, আপনার বই কি, ‘যে যার সে তার, যুগে যুগে অবতার’ (যে যাহার আপনার জন, সে তাহার সহিত যুগে যুগে আসে)।
কিছুক্ষণ কথার পর বলিতেছেন, “আবার সুক্ষ্ম শরীরে দেখা হবে।” বুঝিলাম দেহান্তে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হইবে।
আমি—মা, আমি গত আশ্বিন মাসে এখানে আসব বলে হাওড়া স্টেশনে এক রাত্রি শুয়েই কাটালাম। পর দিনও বেলা ১১টা পর্যন্ত স্টেশনে। টিকিট আর কাটতে পারছি না। স্বদেশী আন্দোলনের জন্য ধর্মঘট করায় কেরানীর আসে নাই, কাজকর্ম বন্ধ। মিনিট কয়েক থাকতে একটি মেম কেরানী এল। তখন টিকিটের জন্য লাঠালাঠি। পুজার সময় কি না। টিকিট কিনতে না পেরে বাসায় ফিরে যাই। শেষে বাড়ির চিঠি পাই, এক ভাইয়ের খুব অসুখ। তাই বাড়ি ফিরে গেলাম, সেবার আসা হল না।
মা—একটা যােগাযােগ হওয়া চাই, তবে দেখা হয়।
আমি—সকলে তােমায় ‘আপনি’ বলেন, আমি কিন্তু বলতে পারলাম না, আমার মুখে এল না।
মা—তা ভাল। এ খুব আপনা-আপনি ভাব।
আমি কথায় কথায় বলিলাম, “মা, তুমি যাদের মন্ত্র দিয়েছ তাদের ভার তাে তুমি নিয়েছ। তবে আমাদের কথা বললে ঠাকুরের কাছে বলব’ একথা বল কেন ? আমাদের ভার তুমি নিতে পার না? (আমার তখনও মন্ত্রের আবশ্যকতা বােধ হয় নাই, তাই ঐরুপ প্রশ্ন করিয়াছিলাম)।
মা—তােমার তাে ভার নিয়েছি।
আমি—মা, আশীর্বাদ কর যেন শুদ্ধ মন আর অনুরাগ হয়। মা, আমি একটি ছেলের সঙ্গে পড়েছি, তাকে যা ভালবাসতাম, তার সিকি ভালবাসাও যদি ঠাকুরের প্রতি হত, তা হলেও সন্তুষ্ট হতাম।
মা—আহা, তাই তো ; আচ্ছা, ঠাকুরের কাছে বলব।
আমি—কেবল ‘ঠাকুরের কাছে বলব’ বলছ কেন? তুমি আর ঠাকুর কি ভিন্ন ? তুমি আশীর্বাদ করলেই হবে।
মা—বাবা, তােমার পূর্ণজ্ঞান আমার আশীর্বাদে যদি হয়, আমি হাড় ভেঙে আশীর্বাদ করব।
—মানুষের কি সাধ্য যে আপনি এ মায়ার হাত থেকে তরতে পারে? তাই তাে ঠাকুর এত সাধনা করলেন, সব ফল জীবোদ্ধারে দিয়ে গেলেন।
আমি—তাঁকে না দেখলে কি করে ভালবাসা যায় ? 
মা—তাই তাে, হাওয়ার সঙ্গে কে ভাব করতে পারে ? 
আমি—মা, কবে ঠাকুরের দেখা পাব ? 
মা—পাবে পাবে, সময় হলেই ঠাকুরের দেখা পাবে।
অন্য একদিন সন্ধ্যার পর মা শুইয়া আছেন। কামিনী ঝি মায়ের পায়ে ( হাঁটুতে) বাতের তেল মালিশ করিতেছে।
মা বললেন, “দেহ একটি, দেহী একটি ! দেহী সব শরীর জুড়ে রয়েছেন, তাই পায়ে ব্যথা। যদি এখান (হাঁটু) থেকে মন তুলে নিই, তা হলে আর বেদনা নেই।”
আমি মন্ত্রদীক্ষার কথা তুলিয়া বলিলাম, “আচ্ছা মা, মন্ত্র নেবার কি দরকার ? মন্ত্রজপ না করে কেউ যদি ‘মা কালী, মা কালী' বলে ডাকে, তাতে হয় না?"
মা—মন্ত্রের দ্বারা দেহশুদ্ধি হয়। ভগবানের মন্ত্র জপ করে মানুষ পবিত্র হয়। ইহা বলিয়া একটি গল্প বলিলেন
নারদ বৈকুণ্ঠে গিছলেন। বসে ঠাকুরের সঙ্গে অনেক কথা কইলেন। নারদ যখন চলে গেলেন, ঠাকুর লক্ষ্মীকে বললেন, 'ওখানে গােবর দাও।' লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন, ঠাকুর? নারদ যে পরম ভক্ত, তবে কেন এরুপ বলছ। ঠাকুর বললেন, ‘নারদের এখনও মন্ত্র নেওয়া হয় নি। মন্ত্র না নিলে দেহ শুদ্ধ হয় না।'
অন্ততঃ দেহশুদ্ধির জন্যও মন্ত্র দরকার। বৈষ্ণবেরা মন্ত্র দিয়ে বলে, “এখন মন তাের।” তাই তো—
‘মানুষ গুরু মন্ত্র দেন কানে।
জগদগুরু মন্ত্র দেন প্রাণে ।” 
মনেতেই সব। মন শুদ্ধ না হলে কিছুই হয় না।
“গুরু, কৃষ্ণ, বৈষ্ণব, এ তিনের দয়া হল। 
একের দয়া বিনে জীব ছারেখারে গেল।”
একের কিনা মনের। নিজ মনের কৃপা হওয়া চাই।
আমি—মা, আমার কিন্তু জপতপে প্রবৃত্তি নেই। 
মা—হয়তাে তােমার পুর্বজন্মে ও সব করা আছে।
বাংলায় তখন খুব স্বদেশী আন্দোলন চলিতেছে। তাই জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, এ দেশের দুঃখ-দুর্দশা কি দুর হবে না?”
মা—ঠাকুর তাে এসেছিলেনই তার জন্যে।
মায়ের মাতার কথা উঠিল। মা বলিতেছেন, “মা ছিলেন—কোন ভক্ত এলে “নাতিন এসেছে, নাতিন এসেছে বলে কত খুশী হতেন, কত যত্ন করতেন। এ—সংসারটি ছিল যেন তাঁর গায়ের রক্ত। কত করে এটি ঠিকঠাক রাখতেন। আমার মায়ের নাম ছিল শ্যামা।” (দিদিমা পূর্ব বৎসর—১৯০৬ সনের গোড়ায় দেহত্যাগ করিয়াছেন)। | ঠাকুরকে দর্শনের কথা বলিলেন—
“যখন ঠাকুর চলে গেলেন, আমারও ইচ্ছা হল আমিও চলে যাই। তিনি দেখা দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি থাক। অনেক কাজ বাকী আছে। শেষে দেখলুম, তাই তাে অনেক কাজ বাকী।”
“তিনি বলতেন, ‘কলকাতার লােকগুলাে যেন অন্ধকারে পােকার মতাে কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখবে।” 
“তিনি শতবৎসর সুক্ষ্মশরীরে ভক্তহৃদয়ে বাস করবেন বলেছেন। আর তাঁর অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আসবে।” 
‘যখন ঠাকুর চলে গেলেন, প্রথম প্রথম ভয় হত। পরনে লাল কাপড় (সরু লালপেড়ে কাপড়), হাতে বালা-লােকে কি বলবে। তখন কামারপুকুরে রয়েছি। তারপর ঠাকুরের দেখা পেতে লাগলুম। তখন সে-সব ভয় ক্রমে দূর হল। একদিন ঠাকুর এসে বললেন, “খিচুড়ি খাওয়াও।’ খিচুড়ি রেঁধে রঘুবীরকে ভােগ দিলুম। মারােয়াড়ী (অর্থাৎ হিন্দুস্থানী) কিনা তাই খিচুড়ি। তারপর বসে ভাবে ঠাকুরকে খাওয়াতে লাগলুম।”
“হরিশ এই সময় কামারপুকুরে এসে কিছুদিন ছিল। একদিন আমি পাশের বাড়ি থেকে আসছি। এসে বাড়ির ভিতর যেই ঢুকেছি, অমনি হরিশ আমার পিছুপিছু ছুটছে। হরিশ তখন ক্ষেপা। পরিবার পাগল করে দিয়েছিল। তখন বাড়িতে আর কেউ নেই। আমি কোথায় যাই। তাড়াতাড়ি ধানের হামারের (তখন ঠাকুরের জন্মস্থানের উপর ধানের গােলা ছিল।) চারদিকে ঘুরতে লাগলাম। ও আর কিছুতেই ছাড়ে না। সাতবার ঘুরে আমি আর পারলাম না। তখন নিজ মূর্তি এসে পড়ল। আমি নিজ মূর্তি ধরে দাঁড়ালাম। তারপর ওর বুকে হাঁটু দিয়ে জিভ টেনে ধরে গালে এমন চড় মারতে লাগলুম যে, ও হে হে করে হাঁপাতে লাগল। আমার হাতের আঙুল লাল হয়ে গিছল। তারপর নিরঞ্জন এলে তাকে বললাম, ‘ওকে পাঠিয়ে দাও’।” 
যােগীন মহারাজের কথা উঠিল। মা বলিলেন, “যােগীনের মত আমাকে কেউ ভালবাসত না। আমার যােগীনকে কেউ যদি আট আনা পয়সা দিত, সে রেখে দিত; বলত, “মা তীর্থে টীর্থে যাবেন, তখন খরচ করবেন।’ সর্বক্ষণ আমার কাছে থাকত, মেয়েদের কাছে থাকত বলে ওরা (ছেলেরা) সকলে তাকে ঠাট্টা করত। 
যােগীন আমাকে বলত, “মা, তুমি আমাকে যােগা, যােগা বলে ডাকবে। যােগীন যখন দেহ রাখলে, সে বললে, “মা, আমায় নিতে এসেছিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ঠাকুর।”
আমি মাকে বললাম, কোন কোন ভক্ত কে কে, আমাকে বলতে হবে। 
মা—কাউকে না বলতে পার? 
আমি—তা, তুমি দেখবে যাতে কাউকে না বলি।
বলিয়াই ভাবিলাম, হয়তাে কাহাকেও বলিয়া ফেলিব, কথা রক্ষা হইবে না। তাই তখনই বলিলাম, “তবে থাক।” 
মা—যােগীনকে অর্জুন বলতেন। নরেনকে সপ্তর্ষি থেকে এনেছিলেন। ঈশ্বরকোটীর পূর্ণ। শরৎ আর যােগীন এ দুটি আমার অন্তরঙ্গ।
এইরূপ দুই-এক জনের কথা আপনা হইতেই বলিলেন।
নিজের কথা বলিতেছেন—“বলরামবাবু বলতেন, ‘ক্ষমারূপা তপস্বিনী'।” বলিয়াই আবার বলিলেন, “দয়া যার শরীরে নেই, সে কি মানুষ? সে তাে পশু। আমি কখনও কখনও দয়ায় আত্মহারা হয়ে যাই, ভুলে যাই যে আমি কে।”
কথাবার্তার শেষে মা বলিলেন, “বাবা, তোমার সঙ্গে আমার যেমন খােলাখুলি কথা হয়েছে এমন আর কারও সঙ্গে হয়নি।” পরে মা বলিলেন, “আমি যখন কলকাতায় যাব তখন তুমি আসবে, আমার কাছে থাকবে।” 
যদিও আমার ভিতরে ভিতরে সাধু হইবার খুব ইচ্ছা, তথাপি আমি তখন বাড়িতে থাকি। মনে ভাবিলাম, হয়তাে ভবিষ্যতে মায়ের ইচ্ছায় আমার তাঁহার কাছে থাকা এবং সাধু হওয়া সম্ভব হইবে।
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আশুকে চেন? কাঞ্জিলাল, কৃষ্ণলাল ?” 
আমি বলিলাম, “না, আমি চিনি না।”
আমি যখন জয়রামবাটী যাই তখন ছােট মামী (রাধুর মা) পাগল হইয়াছেন। রাধুর গহনাগুলি লইয়া তিনি বাপের বাড়ি গিয়াছিলেন ; তাঁহার বাপ গহনাগুলি কাড়িয়া লইযাছেন; তজ্জন্য আরও ক্ষেপিয়াছেন। পাগলী মামী সিংহবাহিনীর মন্দিরে “মা, গয়না দাও, মা, গয়না দাও” বলিয়া কাঁদিতেছেন। তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়াছে। ঘরে মা আর আমি। কথাবার্তা হইতেছে। হঠাৎ মা বলিলেন, “যাই, যাই, বাবা, ওর আমি ছাড়া কেউ নেই। পাগলী সিংহবাহিনীর কাছে গহনার জন্য কাঁদছে।” এই বলিয়া মা চলিয়া গেলেন। আমি কিন্তু কান্না আদৌ শুনিতে পাই নাই এবং অত দূর হইতে শােনাও সম্ভব নয়। কিন্তু তাহার কানে পৌঁছিয়াছে। সিংহবাহিনীর মন্দিরে গিয়া ক্ষেপীকে লইয়া আসিলেন। 
পাগলী বলিতেছেন, “ঠাকুরঝি, তুমিই আমার গয়না আটক করে রেখেছ। তুমিই দিচ্ছ না।” মা বলিলেন, “আমার হলে আমি কাকবিষ্ঠাবৎ এই দণ্ডে ফেলে দিতুম।” ক্ষেপীর কথায় আমাকে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “গিরিশবাবু, বলতেন, এটা মায়ের সঙ্গের পাগলী।” 
আমার প্রথম প্রথম ‘মা’ বলতে একটু লজ্জা বােধ হইত, কারণ গর্ভধারিণী মা অল্প বয়সেই চলিয়া গিয়াছেন। একদিন সকালবেলা আমাকে দিয়া এক জ্ঞাতি-ভাইকে সংবাদ পাঠাইতেছেন। যাইবার সময় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলবে বল দেখি?” আমি বলিলাম, “তিনি আপনাকে এই এই বলতে বললেন।” শুনিয়া মা বলিলেন, “বলবে মা বললেন।” ‘মা’ শব্দটি জোর দিয়া উচ্চারণ করিলেন।
একদিন বেলা আটটা নয়টার সময় মা তাঁহার ঘর হইতে বাহিরে আসিতেছিলেন। উঠানে একটি ছেলে দাঁড়াইয়া অনন্যদৃষ্টিতে মাকে দেখিতেছিল। মা আসিতে আসিতে হঠাৎ ছেলেটির দিকে ফিরিয়া আসিয়া সস্নেহে তাহার চিবুকে হাত দিয়া সহাস্যে আমাকে বলিলেন, “এটি আমার গণেশ।” বোধ হইল, ছেলেটি কোন ভক্ত বা আত্মীয় হইবে।
একদিন সকালে মায়ের ঘরের বারান্দায় ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি’ পাঠ হইতেছিল। আমি পড়িতেছিলাম এবং মা ও আরও দুই একজন শুনিতেছিলেন। বিবাহের অংশটি পড়া হইতেছিল। সেখানে মাকে ‘জগন্মাতা' বলিয়া উল্লেখ করিয়া খুব প্রশংসা ছিল ; মা উহার খানিকটা শুনিয়াই উঠিয়া গেলেন। ইহারই অল্পক্ষণ পূর্বে তাহাকে মাঘ মাসের ‘উদ্বোধন’ হইতে পড়িয়া শুনাইতেছিলাম। মা একমনে শুনিতেছিলেন। ইহাতে মাস্টার মহাশয়ের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের’ কিয়দংশ বাহির হইয়াছে। আর কেহ তথায় ছিল না। একস্থানে পড়িতেছিলাম
“গিরিশ—একটি সাধ। 
ঠাকুর—কি ? 
গিরিশ—অহেতুকী ভক্তি। 
ঠাকুর—অহেতুক ভক্তি ঈশ্বরকোটীর হয়, জীবকোটীর হয় না।”
আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা জীবকোটীর হয় না, ঈশ্বরকোটীর হয়, এর মানে কি ?”
মা—ঈশ্বরকোটী পূর্ণকাম কিনা, তাই অহেতুক। কামনা থাকতে অহেতুক ভক্তি হয় না।
আমি—মা, তােমার এইসব বিশেষ ভক্তরা ও ভাইরা—এরা কি সমান ?
আমার মনের ভাব এই যে, ভাই হইয়া যখন জন্মিয়াছেন, তখন ইহারাও উচ্চ আধার ও অন্তরঙ্গ হইবেন, যেমন মঠের মহারাজরা। 
মা তদুত্তরে ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া এরুপ ভাব প্রকাশ করিলেন যেন কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা। শুধু ভাই হইলে কি হইবে? অন্তরঙ্গ পৃথক বস্তু।
একদিন সকালে ধানভানা হইতেছিল ; মা উহাতে সাহায্য করিতেছিলেন। প্রায় রােজই ঐরুপ করিতেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, “মা, তােমার এত খাটুনি কেন?” মা বলিলেন, “বাবা, আদর্শ হিসাবে যা করতে হয় তার ঢের বাড়া (বেশী) করেছি।” 
একদিন রাত্রে সকলে ঘুমাইতেছেন। নলিনীর (মায়ের আর একটি ভাইঝি ) স্বামী গরুর গাড়ি লইয়া উপস্থিত ; নলিনীকে লইয়া যাইবে। সে বশরেবাড়ি হইতে চলিয়া আসিয়াছে এবং ফিরিয়া যাইতে চাহে না ; স্বামীর আগমন-সংবাদ পাইয়াই ঘরের দরজা বন্ধ করিয়াছে। আত্মহত্যা করিতে চাহে। অনেক সাধাসাধির পর, তাহাকে এবার ‘শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইবে না, মা এইরুপ কথা দেওয়ায় সে দরজা খুলিল। এইরূপ গােলমালে রাত্রি কাটিল। মা নলিনীর ঘরের বারান্দায় বসিয়াছিলেন। প্রভাত হইলে তিনি তাঁহার সম্মুখের লণ্ঠনটি নিবাইলেন; বলিতে লাগিলেন, “গঙ্গা, গীতা, গায়ত্রী, ভাগবত, ভক্ত, ভগবান, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ।”
পরে নলিনীর কথায় মা আমাকে বলিলেন, “ওর পিসীর (শ্রীশ্রীমার) বাতাস লেগেছে, বাবা, তাই যেতে চায় না।”
একদিন সকালে মা আমাকে বাড়ির একজন পুরাতন চাকর সঙ্গে দিয়া পাগলীর বাপকে বুঝাইয়া লইয়া আসিতে, কিংবা গহনা ফিরাইয়া দিতে রাজী হইলে উহা আনিতে, তাহার নিকট পাঠাইলেন। আমরা গিয়া অনেক অনুনয় করায় তিনি পরদিন আসিলেন, কিন্তু গহনা আনেন নাই। মা তাঁহাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিলেন, পায়ে হাত দিয়া পর্যন্ত অনুরােধ করিলেন, যাহাতে তিনি গহনাগুলি ফেরত দেন এবং বলিলেন, “আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করুন।” কিন্তু তথাপি সেই লােভী ব্রাহ্মণের মন গলিল না, তিনি নানা বাজে ওজর করিতে লাগিলেন। শিবরাত্রির পূর্ব দিবস আমি রওয়ানা হইব স্থির করিলাম। কারণ মঠে ঠাকুরের উৎসব দেখিবার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। মাকেও তাহাই বলিয়াছিলাম। মধ্যাহ্নে ভােজনের পর মাকে প্রণাম করিতে গেলাম-রওয়ানা হইব। মা বলিলেন, “এই শশীর সঙ্গে যাবে।” শশী স্ত্রীলােক, ইহা দেখিয়া আমি একটু ভাবিতেছি। তখন মা বলিলেন, “ও যে আমাদের শশী গাে। আমার সঙ্গে থাকত দক্ষিণেশ্বরে।” শশীকে বলিলেন, “একে আমাদের ঘরে (যে ঘরে মা ও ঠাকুর কামারপুকুরে থাকিতেন) থাকতে দেবে। রামলালের মাসীকে বলে দেবে।” তখন আর কেহ ঠাকুরের বাটীতে ছিলেন না।
আমাকে বলিলেন, “কামারপুকুরে এক-আধ দিন থেকে শেষে মঠে যাবে। ঠাকুরের জন্মস্থান হয়ে যেতে হয়।” আমার কিন্তু কামারপুকুরে যাইবার কল্পনা ছিল না। আমি শুধু, মাকে দেখিতেই গিয়াছিলাম। তাঁহার জন্যই ব্যাকুল হইয়া বাড়ি হইতে ছুটিয়াছিলাম ; সঙ্গে কাপড়, ছাতাটি পর্যন্ত আনিতে ভুল হইয়াছিল। কিছু দূরে আসিয়া মনে পড়িলেও আর ফিরি নাই, পাছে কোন বিঘ্ন ঘটে। 
আমার সঙ্গে কাপড় ছিল না। মা একখানি কাপড় পরিতে দিয়াছিলেন। বলিলেন, “ওখানা সঙ্গে নিয়ে যাও।” জিজ্ঞাসা করিলেন, “সঙ্গে টাকা আছে ? গাড়ি-ভাড়া এসব লাগবে, টাকা নিয়ে যাও।” আমি বললাম, “আমার কাছে টাকা আছে, নিতে হবে না।” বলিলেন, “গিয়ে পত্র লিখবে।”
মা বলিতেছেন, “আমার ছেলেটিকে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না, মাছ ধরাতে পারিনি।” কারণ তখন পাগলী ও নলিনীকে লইয়া বড় অশান্তি চলিতেছিল। আমি মাকে প্রণাম করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বাহির হইলাম। মা সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত আসিলেন; পরে যতক্ষণ দেখা গেল চাহিয়া রহিলেন। মনের আবেগে কামারপুকুর পর্যন্ত সম্পূর্ণ পথ আমার আর চোখের জল থামিল না।
কামারপুকুরে পেীঁছিলাম। শশী মাসীমাকে আমার পরিচয় দিল। মায়ের ঘরে মায়ের ছবি দেখিয়া প্রাণ আরও ব্যাকুল হইল। যেন বিশ্বহিতধ্যানে মগ্না মাতৃমূর্তি!
রাত্রে মায়ের ঘরে শুইলাম। মাসীমা লেপ বিছানাদি দিলেন। পরদিন (শিবরাত্রির দিন) কামারপুকুরের বুড়ো শিব দর্শন করিলাম। বৈকালে মাষ্টার মহাশয় ও প্রবােধবাবু কামারপুকুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলাম, মাস্টার মহাশয়ের (তখন চিনিতাম না) ঠাকুরের বাড়ি দেখিয়াই চক্ষে জল। গাড়ি বাড়ির দরজায় থামিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার কি নাম?” তিনি বলিলেন, “আমার নাম মাস্টার।” মাস্টার বলাতেই চিনিলাম। ‘কথামৃত’ পড়া ছিল। মাস্টার মহাশয় মায়ের জন্য মিঠাই আনিয়াছিলেন। উহা বাহিরবাড়ির ঘরে রাখা হইল। মাস্টার মহাশয় আমাকে বলিলেন, “দেখুন তো বাড়ির মধ্যে গঙ্গাজল আছে কিনা।” আমি গঙ্গাজল আনিয়া দিলাম। তিনি কাপড় কম্বল প্রভৃতিতে গঙ্গাজলের ছিটা দিলেন। মায়ের জন্য খাবার লইয়া যাইতেছেন, তাই। 
তাঁহারা কামারপুকুরে রঘুবীরের প্রসাদ গ্রহণ করিয়া জয়রামবাটী রওয়ানা হইলেন। আমি তাঁহাদিগকে ভুতির খালের ওপারে মানিক রাজার আমবাগান পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া আসিলাম। তাঁহাদের সঙ্গে দুইজন ভারী। তখনও আমার ইচ্ছা, শীঘ্র মঠে যাইয়া উৎসব দেখিব। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ললিতবাবু সামলা মাথায়, পেল্টুলুন-চাপকান-পরা কামারপুকুরে পেীঁছিলেন। আমি তখন খাইতেছিলাম। তাড়াতাড়ি খাওয়া সারিলাম। সধ্যা হইল। শশী বলিল, “তুমি ললিতবাবুর সঙ্গে যাও। ওঁদের সঙ্গেই মঠে যাবে। একা কোথা যাবে? সঙ্গে তেমন টাকা-পয়সা নেই, পথও চেন না।” আমি সম্মত হইলাম। ললিতবাবু গ্রামের দুইজন চৌকিদার ডাকাইয়া সঙ্গে লইলেন। জয়রামবাটী যাইতে মাঠে রাস্তা ভুল হইল। চৌকিদারেরা তখন রাস্তা ঠিক করিবার জন্য ‘অশ্বিকে’ ( জয়রামবাটীর চৌকিদারের নাম) বলিয়া একসঙ্গে হাঁক মারিল। জয়রামবাটীর একজন লােক কামারপুকুরের দিকে গিয়াছিল, তখনও ফিরে নাই। তাই জয়রামবাটীর লােকেরা মাঠে তাহার উপর ডাকাত পড়িয়াছে মনে করিয়া লাঠি-ঠেঙ্গা লইয়া চৌকিদার সমেত মাঠের দিকে দৌড়িয়া আসিল। তাহাদের সহিত আমরা জয়রামবাটী পেীঁছিলাম। বাড়ির মধ্যে গিয়া মাকে বলিলাম, “মা, এসেছি।” মা খুব খুশী হইয়া বলিলেন, “বেশ করেছ, এদের সঙ্গে যাবে।”
শিবচতুর্দশী উপলক্ষে ঘাটালের উকিল শ্ৰীযুক্ত রামচন্দ্র মুখােপাধ্যায় আসিয়াছেন। ভক্তদের কেহ কেহ উপবাস করিয়াছেন। পরদিন মধ্যাহ্নে তাহারা মায়ের প্রসাদ চাহিলে মা রাধুকে দিয়া একটি শালপাতায় করিয়া প্রসাদ পাঠাইলেন। সকলে খাইতেছেন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ কি খাচ্ছেন?” তাহারা বলিলেন, “মায়ের প্রসাদ।” তখন আমিও একটু খাইলাম। মাকে গিয়া। বলিলাম, “মা, এরা সব তোমার প্রসাদ খাচ্ছেন, তা আমাকে এত দিন দাও নাই কেন?” মা বলিলেন, “বাবা, তুমি তাে চাওনি, আমি কি করে বলি ?” কি নিরহঙ্কার ভাব।
পর দিবস মধ্যাহ্নে পালকি চড়িয়া ললিতবাবু রাধুর গহনা আনিতে গেলেন। তিনি কলিকাতা পুলিশের একজন খুব বড় কর্মচারীর চিঠি লইয়া সরকারী লােক সাজিয়া গিয়াছিলেন। মা মাষ্টার মহাশয়কে সঙ্গে পাঠাইলেন, ললিতবাবুর ছােকরা বয়স, ব্রাহ্মণ গহনা না দিলে পাছে তাহার কোন অপমান করেন। কিছু বেলা থাকিতে তাহারা গহনা সমেত ছােট মামীর বাপকেই লইয়া উপস্থিত হইলেন।
রাত্রি প্রায় দুইটার সময় বাড়ির ভিতর হইতে সংবাদ আসিল, মায়ের সমস্ত রাত্রি নিদ্রা হয় নাই, মাথা ঘুরিতেছে। তৎক্ষণাৎ মাস্টার মহাশয় ও আমরা কেহ কেহ বাড়ির মধ্যে গেলাম। সকলে ঔষধ খুজিতে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় আমি গিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, এমন কেন হল?” মা এতক্ষণ কাহাকেও কারণ বলেন নাই। জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, 'ওরা তাে সব চলে গেল গহনা আনতে। আমি সমস্ত দিন ভেবে ভেবে অস্থির, পাছে ব্রাহ্মণের কোনরুপ অপমান হয়। এই ভাবনায় বায়ু প্রবল হয়ে এমন হয়েছে।" আমি আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া মাস্টার মহাশয়কে সব কথা বলিলাম। ভাবিলাম, যে, ব্রাহ্মণ এত ঝঞ্জাট ঘটাইল, কত কষ্ট দিল, তাহার জন্য ভাবনা।
তৃতীয় দিন বৈকালে আমরা রওয়ানা হইলাম। মা ললিতবাবুকে বলিয়া দিয়াছিলেন, “ছেলেটি খুব ভক্ত। একে সঙ্গে করে নিও।” আমরা একে একে মাকে প্রণাম করিলাম। মায়ের চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছিল-কাঁদিতেছেন। সামনের ফটকের দুয়ার পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইলেন। আমরা দেশড়া হইয়া বিষ্ণুপুরের রাস্তায় আসিলাম। বিষ্ণুপুরে মাস্টার মহাশয়, প্রবােধবাবু, প্রভৃতি লালবাঁধে মৃন্ময়ী দেবী দেখিতে গেলেন। আমি ও ললিতবাবু ট্রেনে উঠিয়াছি। দেখি মাস্টার মহাশয় প্রবােধবাবুকে পাঠাইয়াছেন। তিনি বলিলেন, “মাস্টার মহাশয় বলছেন, মৃন্ময়ী দেখে যাবেন।” আমরা চিন্ময়ী দেখিয়া আসিয়াছি, আর মৃন্ময়ী-দর্শনে সাধ হইল না। মঠে আসিয়া উৎসবাদি দর্শন করিয়া দেশে ফিরিলাম।
১৯০৭ সালে দুর্গাপূজার পর মাকে দর্শন করিতে কলিকাতায় আসি। একটি ভক্তের পত্রের উত্তরে মা জানাইয়াছিলেন, আমি পুজা উপলক্ষে গিরিশবাবুর বাড়িতে আসিয়া এখন বলরামবাবুর বাড়িতে আছি ইত্যাদি। আমি সকালবেলা বলরামবাবুর বাড়ি গিয়া উপস্থিত। পূজনীয় বাবুরাম মহারাজকে দেখিয়া প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা কোথায় ?” তিনি মস্তকে হাত দিয়া দেখাইলেন, মা মাথায়। যাহা হউক, আমি কিছুক্ষণ একা হলবরে বসিয়া থাকিয়া ভগবানকে (শান্তিরামবাবুর পুত্র) আমার নাম বলিয়া দিয়া মাকে সংবাদ পাঠাইলাম। মা তাহাকে বলিলেন, “নিয়ে এস।” আমি বাড়ির ভিতরে গিয়া প্রণাম করিয়া বসিলাম। মা দেশে ম্যালেরিয়ায় খুব ভুগিয়া আসিয়াছেন। চেহারা শীর্ণ ও মলিন। পুর্বে জয়রামবাটীতে যেরুপ দেখিয়াছিলাম তদপেক্ষা অনেক রুগ্ন। মা বড় মামীর দেহত্যাগের কথা বলিলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বলিলেন, “কাল শরৎ চক্রবর্তী এসেছিল। এখানে এসে আমাকে গান শুনালে। আহা, তার কি ভাব! কি গান। তুমি আসলে না?” আমি যে সেই বেলাই কলিকাতায় আসিয়াছি তখনও বুঝিতে পারেন নাই। একটু পরে গৌরবাবু আসিয়া বলিলেন, “গাড়ি এসেছে।” মা গঙ্গাস্নান করিতে যাইবেন। আমি বাহিরে আসিলাম। মধ্যাহ্নে ওখানেই প্রসাদ পাইলাম। আমার একটু জ্বরভাব হওয়ায় বৈকালেই বরিশালে ফিরিব স্থির করিলাম। পুজনীয় শরৎ মহারাজ তখন এই বাড়িতে থাকেন। তিনি কুইনাইনের বড়ি দিলেন। সন্ধ্যার সময় মাকে প্রণাম করিয়া বলিলাম, “মা, আমি আজকেই যাব। রাত্রে গাড়ি, শরীর ভাল নয়।” কলিকাতায় আমার থাকিবারও কোন সুবিধা ছিল না। মা বলিতে লাগিলেন, “আহা, আজই চলে যাবে ? আজ এলে, আবার আজকেই যেতে হবে?”
যাইবার সময় মাকে বলিলাম, “মা, যা ভাল হয় করো।”
ইহার পরের বারে মাকে বাগবাজারে তাহার নূতন বাটীতে দর্শন করি। পূর্বে কলিকাতায় আসিলে মা ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকিতেন। উহ। সকল সময় পছন্দমত মিলিত না বলিয়া মার যখন ইচ্ছা আসিতে এবং থাকিতে অসুবিধা হইত। তাই এই নূতন বাড়ি পূজনীয় শরৎ মহারাজের বহু চেষ্টায় নির্মিত হয়। আমি কলিকাতা পৌঁছিয়া সেই দিনই বৈকালে অনেক খোঁজ করিয়া এই বাড়িতে আসি এবং দেখি কাঞ্জিলাল ডাক্তার রােয়াকে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন। মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, “মায়ের বসন্ত হয়েছিল, এখনও আরোগ্য স্নান হয়নি। সম্প্রতি ভাল আছেন। পনের দিন পরে দেখা হতে পারে।” আমি এ সংবাদ জানিতাম না। শেষে পুজনীয় শরৎ মহারাজের সঙ্গে দেখা হইলে তিনি বলিলেন, “কাল সকালে এসে দেখা করো এবং এখানে প্রসাদ পেও।”
পরদিন সকালে আসিয়া দেখা করিলাম। মা তাঁহার হাতের ও মুখের বসন্তের দাগগুলি দেখাইতে লাগিলেন। অসুখের কথা সব বলিয়া বলিলেন, “বসন্তের দাগগুলি এখন আর তেমন নাই।” মায়ের গায়ে বসন্তের দাগ পরে। মােটেই ছিল না।
এইবারেই পুজনীয় শরৎ মহারাজের কথায় এবং শ্রীশ্রীমায়ের আশীর্বাদে আমার মঠে থাকা হয়। মাকে বলায় বলিলেন, “আরে, এর সাধুর হাওয়া লেগেছে। আচ্ছা বেশ, মঠে থাকগে, ঠাকুরে ভক্তি হ’ক, আমি খুব আশীর্বাদ করছি।”
মঠ হইতে মাঝে মাঝে দুধ লইয়া যাইতাম এবং মাকে দেখিতে আসিতাম। এক সময় কিছুদিন না যাওয়ায়, মা একজনকে (তিনিও দুধ লইয়া যাইতেন) আমার কথা অনেকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “কই, সে অনেক দিন আসে না কেন?”
ইহার পর একদিন দুধ লইয়া গিয়াছি। মাকে প্রণাম করিতে গিয়া দেখি, মা পাশের ঘরে পান সাজিতেছেন। কাছে নলিনী, সেও পান সাজিতেছিল। আমি যাওয়াতে নলিনী সরিয়া যাইতেছিল। মা তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, “যেও না, যেও না, ও ছেলেমানুষ, তুমি এইখানেই বস” এবং আমাকে বললেন, “বস।” কথায় কথায় মাকুর “শ্বশুরবাড়ির কথা উঠিল। মা বলিলেন, “তাদের খুব আদর-যত্ন না করলে একটুতেই ফোঁস করে। তােমরা আমার ছেলে, তােমাদের আমি যা দিই, যা বলি, তাতে কিছু হয় না, এটি হলেও তােমরা কিছু মনে করবে না, কিন্তু তাদের ভাল জিনিস, ভাল সব না দিলে, একটু এটি হলে অমনি অসন্তুষ্ট হবে। কিছুক্ষণ পরে আমি বলিলাম, “শুদ্ধ মন আর অনুরাগ কিসে হয়?”
মা—হবে, হবে; যখন ঠাকুরের শরণাগত হয়েছ, সব হবে। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করবে।
আমি—না, সে তুমি তাঁকে বলবে? 
মা—আমি তাে বলছি, ঠাকুর, আমার এর মনটি ভাল করে দাও, শুদ্ধ করে দাও।
আমি—হাঁ, তুমি বলবে, তা হলেই আমার হবে।
ইহার কয়েক মাস পরে ঘাটালে বন্যাক্লিষ্টদের সেবাকার্য হইতে তিনদিনের ছুটি লইয়া ৺জগদ্ধাত্রীপুজার সময় জয়রামবাটী যাই। মা তাহার কিছু পূর্বে দেশে আসিয়াছেন। আমার সঙ্গে অতুল। সে এইবার শ্রীশ্রীমাকে প্রথম দর্শন করে। আমরা কামারপুকুর হইয়া এবং রঘুবীরের প্রসাদ পাইয়া গিয়াছিলাম। যাইতেই আশু মহারাজ বলিলেন, “এসেছ, বেশ করেছ ; মা কেবল বলছেন, ‘ভক্তেরা কেউ এল না; চল, প্রসাদ পেতে বস।” আমরা গিয়া মাকে প্রণাম করিলাম। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথা থেকে এলে?” বলিলাম, 'ঘটাল থেকে।” মা বলিলেন, “বস, প্রসাদ পাও।” সকলে তখন প্রসাদ পাইতে বসিতেছেন। খাইবার সময় মা আমাদিগকে খুব করিয়া মাছ দেওয়াইলেন।
পরদিন সকাল আটটা-নয়টার সময় মায়ের উঠানে তরকারি কোটা হইতেছিল। কুসুম প্রভৃতি ভক্ত-মেয়েরা তরকারি কুটিতেছিলেন। ভানু পিসী নিকটেই দাঁড়াইয়া ছিলেন। আমি বাড়ির মধ্যে গিয়া শুনিলাম, ভানু পিসী বলিতেছেন, “কুসুম দিদি তােমরা তাে ভর্তি হয়ে আছি, তাই মুখে কথাটি নেই।” কুসুম বললেন, “কুসুম অত শত জানে না।” মা পাশ দিয়া যাইতেছিলেন, শুনিয়া বলিলেন, “ভর্তি হলে কি হবে ? ভর্তি হলে তাে উপচে পড়বে। স্বভাব বদলালে তাে হয়।”
তার পরদিন সকালেই আমরা রওয়ানা হইব। ভােরে বাড়ির মধ্যে গিয়া দেখি মা ভিজা কাপড়ে উঠানে দাঁড়াইয়া আছেন। কাপড় ছাড়িলে মাকে প্রণাম করিয়া আমি বিদায় লইলাম। বলিলাম, “আবার আসব।” অতুল স্কুলের ছেলের মতাে বলিল, “মনে রাখবেন।”
ঘাটালের সেবাকার্য শেষ করিয়া ১লা পৌষ আমি পুনরায় জয়রামবাটী রওয়ানা হইলাম। অতুল বহুদূর অবধি সঙ্গে আসিয়া পথ দেখাইয়া দিয়া গেল। সন্ধ্যার কিছু পুর্বে পেীঁছিয়া দেখি মা তাহার ঘরের বারান্দায় পা মেলিয়া হাঁটুতে (বাতের জন্য) ঔষধ দিতেছেন। আমি প্রণাম করিয়া বসিলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ আবার কি ওষুধ দিচ্ছ?” মা বলিলেন, “এ একজন বলেছিল এই পাতা বেটে দিতে। সমস্ত দিন খাওনি?” চেহারা দেখিয়া বুঝিয়াছিলেন। আমি ‘না’ বলায় বলিলেন, “পথে মিস্টি-টিষ্টি কিছু খেলে না কেন ? রামজীবনপুরে দোকান আছে।”
উপেন মহারাজ ঘাটাল হইতে মঠে যাইবার খরচ বাবত একটাকা দিয়াছিলেন। সেই টাকাটি মঠে ফিরিবার সময় প্রয়ােজন হইবে ভাবিয়া ব্যয় করি নাই। কিন্তু মাকে আর এই কথা বললাম না। মা বলিলেন, “বস, আমি ভাত দিই, গরম ভাত হয়েছে। আবার বলিতেছেন, “যার জগৎ সে দেখবে, তােমাদের ওসবে দরকার নেই।” (আমার খাওয়া হয় নাই দেখিয়া দুঃখ হইয়াছিল।) মা তাড়াতাড়ি ভাত, ডাল, তরকারি এবং আরও কি কি নিজেই আনিয়া দিলেন। খাওয়ার পর পান দিলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিল। মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা হইতেছে।
মা তােমাকে দিয়ে ঠাকুর অনেক কাজ করিয়ে নেবেন। এই তাে ঘাটালে তােমরা এসেছিলে, কত লােককে দিলে, কত লােকের উপকার হল। কাজ শেষ হলে সময়ে আপনার ধন তিনি আপনার কোলে টেনে নেবেন।
আমি—কেন ঠাকুরের দেখা পাই না ?
মা—পাবে, পাবে, সময় হলেই পাবে। ললিত (চাটুয্যে) আমার এমন কথা কখনও বলত না, “কেন ঠাকুরের দেখা পাই না ? তার ভাব—তিনি আপনার জন, যখন হােক, দেখা পাবই।
আমি—মা, দেখাে আমার যাতে ভাল হয়। যেন শুদ্ধ ভক্তি হয়। 
মা—হবে, হবে। শুধা ভক্তি হবে।
একখানি কম্বল দিয়া বলিলেন, “এই কম্বল নাও, রাত্রে গায়ে দেবার জন্য।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এ কার কম্বল ?” মা বলিলেন, “আমারই, আমি ব্যবহার করি।”

৩রা পৌষ, জয়রামপুর

মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় দ্বারের সম্মুখে বসিয়া পান সাজিতেছিলেন। বেলা প্রায় নয়টা। আমাকে মুড়ি খাইতে দিয়াছেন। খাইবার পর কথা হইতেছে।
আমি—মা, এবার আমাকে বেশী দিন রেখাে না।
মা—থাকতে ইচ্ছা না হয় আমার সঙ্গে যাবে। সময় হলে (দেহান্তে) সকলে (সব ভক্তরা) যাবে।
আমি – ঠিক মনে যেন থাকে। 
মা—সে তাে বললুম, তােমাকে এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
আমি—এবার আমাকে নিয়ে যাও, পরবারে ঠাকুর যখন আসবেন তখন সঙ্গে আসব।
মা হাসিয়া বলিলেন, “আমি তাে আর আসছি না।”
আমি—তুমি আস আর না আস, আমি আসব, আমার আসতে ইচ্ছা আছে।
মা—তুমি তখন হয়তাে আর আসতে চাইবে না। এ জগতে কি আর আছে ? কোন জিনিসটা ভাল, বল না? তাই ঠাকুর সজনে খাড়া (ডাঁটা), পলতা শাক, এই সব ছাড়া আর কিছু খেলেন না। মুখে সন্দেশ দিতে যেতুম, বলতেন “ওতে কি আর আছে ? সন্দেশও যা, মাটিও তা।”
আমি—তা তুমি ঠাকুরের কথা কেন বলছ? তার কি তুলনা?
মা—তাই তাে, অমন আর একটি কি আর আছে? থাকলে তাে হত।
এই সময় বরদা মামা মাকে চিঠি পড়িয়া শুনাইতে আসিলেন। এই চিঠির মধ্যে আমার সেজ ভাই-এর এক চিঠি ছিল। তাহাতে আমাকে বাড়ি পাঠাইতে মাকে অনুরােধ করিয়াছেন। চিঠিখানি সংক্ষিপ্ত হইলেও ভাষা ও ভাব বেশ ছিল। শুনিয়া মা বলিলেন, “আহা, কেমন লিখেছে।” আমাকে বলিতেছেন, “কেন, সংসারে থাকবে, ঘরকন্না করবে, টাকা করবে।” আমাকে পরীক্ষা করিতেছিলেন। আমি বলিলাম, “মা, ওগুলাে আর বলো না।” 
মা—তা এত লোেক সংসার করছে, তুমি নয় না করলে।
আমি তখন কাঁদিতেছি। দেখিয়াই সকরুণ হইয়া বলিতে লাগিলেন, “কেঁদো না, কেঁদো না, বাছা, তােমরাই ভগবান। ভগবানের জন্য কে সব ত্যাগ করতে পেরেছে। ঈশ্বরের শরণাগত হলে বিধির বিধি খণ্ডন হয়ে যায়। তাঁর নিজের কলম নিজ হাতে কাটতে হয়। ভগবান লাভ হলে কি আর হয়? দুটো কি শিং বেরােয় ? না, সদসৎ-বিচার আসে, জ্ঞানচৈতন্য হয়, জম্মমত্যু তরে যায়। ভাবে লাভ-এ ছাড়া কে ভগবান দেখেছে, কার সঙ্গে ভগবান কথা কয়েছেন? ভাবে দর্শন, ভাবে কথাবার্তা, সব ভাবে হয়।”
আমি—না, মা, এছাড়াও কিছু আছে—প্রত্যক্ষ লাভ। 
মা—সে এক নরেন পেয়েছিল ; তাঁর ( ঠাকুরের) হাতে মুক্তির চাবি ছিল।
“আর কি, জপ ধ্যান করা, আর ঠাকুরকে ডাকা, এই তাে?” বলিয়াই আবার সহাস্যে বলিতেছেন, “আর ঠাকুর ঠাকুরেই বা আছে কি? তিনি তাে চিরদিনই আপন জন।”
আমি—মা, দেখাে যেন আমার ঠিক ঠিক হয়। অমনটি, 'আপনার’। 
মা—তা কি আর বারবার বলতে আছে ? ( দৃঢ়তার সহিত) হবে হবে।

৪ঠা পৌষ, জয়রামবাটী 

রাত্রে মায়ের ঘরে কথা হইতেছে। মা তক্তাপােশে শুইয়া আছেন। বেদান্তের কথা উঠিয়াছে। আমি বলিলাম, “নামরুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জড় পদার্থ বলে কিছুই প্রমাণ করা যায় না। তাই শেষে বলে, ঈশ্বর-টীশ্বর কিছুই নেই।” (আমার মনের ভাব-ঠাকুর, মা, এসবও মিথ্যা।)
মা শুনিয়াই আমার কথার ভাব বুঝিতে পারিয়াছেন। অমনি বলিতেছেন, “নরেন বলেছিল, ‘মা, যে জ্ঞানে গুরু পাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে তাে অজ্ঞান। গুরু পাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে জ্ঞান দাঁড়ায় কোথায় ? তুমি জ্ঞানচচ্চড়ি ছেড়ে দাও। তাঁকে কে জানতে পেরেছে? শুক, ব্যাস, শিব হন্দ ডেও পিঁপড়ে।”
আমি—না, জানবার ইচ্ছা আছে, কিছু কিছু বুঝতেও পারি। কি করে বিচার বন্ধ হবে ?
মা—ঠিক ঠিক পূর্ণজ্ঞান না হলে বিচার যায় না। 
আবার সৃষ্টির কথা উঠিল।
আমি–আচ্ছা, এই যে সব অসংখ্য প্রাণী—ছােট, বড়, সব কি এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে না কি?
মা—চিত্রকর যেমন তুলি দিয়ে চোখটি, মুখটি, নাকটি—এমনি একটু একটু করে পুতুলটি তয়ের করে, ভগবান কি অমনি একটি একটি করে সৃষ্টি করেছেন?
না, তাঁর একটা শক্তি আছে। তাঁর হাতে জগতের সব হচ্ছে, ‘না’তে লােপ পাচ্ছে। যা হয়েছে সব এককালে হয়েছে। একটি একটি করে হয়নি।
মায়ের ঘরে ডেও পিঁপড়ে খাবারের গন্ধে আশেপাশে ঘুরিতেছিল। হঠাৎ তাহার একটি চক্ষে পড়ায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া বলিলাম, “তবে এই পিঁপড়েটা এত পাছে পড়ল কেন? ওর তাে মানুষ হতেই অনেক দেরি।” মা বলিলেন, “হাঁ, অনেক দেরি।” পরে এই সৃষ্টি-প্রসঙ্গেই বলিলেন, “কম্পান্তে সব যেন ঘুম থেকে ওঠে।”
ইহার পরে আমি জপতপের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। মা বলিলেন, “জপতপের দ্বারা কর্মপাশ কেটে যায়। কিন্তু ভগবানকে প্রেমভক্তি ছাড়া পাওয়া যায় না। জপ-টপ কি জান? ওর দ্বারা ইন্দ্রিয়-টিন্দ্রিয়গুলাের প্রভাব কেটে যায়।”
ললিতবাবুর (চাটুজ্যে) কথা উঠিল। কয়েক মাস যাবৎ তাঁহার খুব ব্যারাম সঙ্কটাপন্ন অবস্থা। মা তাঁহাকে খুব ভালবাসেন এবং তাঁহার জন্য বিশেষ চিন্তিত আছেন। বলিতেছেন, “ললিত আমাকে কত টাকা দিত। তার গাড়িতে করে বেড়াতে নিয়ে যেত। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সেবায় ও (কামারপুকুরে) রঘুবীরের সেবায় অনেক টাকা দেয়। আমার ললিতের লাখ টাকার প্রাণ। অনেকে টাকা থেকেও কৃপণ।” পরে বলিলেন, ‘যার আছে সে মাপো, যার নেই সে জপাে।”(যার অর্থাদি আছে সে ভক্ত-ভগবানের সেবা করুক। আর যার নেই সে ভগবানের নামজপ করুক। এই উভয় উপায়েই ভগবানের কৃপা লাভ করা যায়।)
আবার কথায় কথায় প্রেমভক্তির কথা উঠিল। 
মা— বৃন্দাবনে রাখালরা কি কৃষ্ণকে জপধ্যান করে পেয়েছিল? না, তারা ‘আয় রে, খা রে, নে রে’-এই করে কৃষ্ণকে পেয়েছিল।
আমি— তাঁর ভালবাসা না পেলে তাঁর জন্য প্রাণ কেন ব্যাকুল হবে? 
মা—তাই তাে, সেটি তাঁর কৃপা।

১৫ই পৌষ, জয়রামবাটী 

সকালে আটটা-নয়টার সময় আমি গিয়া দেখি মা ঘরে বসিয়া পান সাজিতেছেন। আমি কাছে বসিয়া কথা কহিতে লাগিলাম।
আমি—মা, এত দেখি শুনি, তবু আপনার মা বলে জানতে পারলাম না।
মা—বাবা, আপনার না হলে এত আসবে কেন? যে যার সে তার, যুগে যুগে অবতার। আপন মা, সময়ে চিনবে।
কিছুক্ষণ পরে আমি আমার মা-বাপ ও ভাইদের কথায় বলিলাম, “বাপ-মা মানুষ করেছেন, এখন (দেহান্তে) তারা কোথায় কি ভাবে আছেন জানি না। মা, ভাইদের যাতে সুমতি হয়, তাই আশীর্বাদ কর।” মা বলিলেন, “সবাই কি তাঁকে চায়? এই বাড়িতেই এত লােক আছে, সবাই কি (আমাকে) চায়?” একটু পরে আমাকে বলিতেছেন, “বিয়ে করাে না, সংসার করাে না। বিয়ে না করলে আর কি? যেখানে থাক সেইখানেই স্বাধীন। বিয়ে করাই হচ্ছে মহাপাপ।”
আমি—মা, আমার ভয় হয়। 
মা—না, কোন ভয় নেই, ঠাকুরের ইচ্ছা।
আমি—মন নিয়ে কথা। মন ভাল থাকলে যেখানেই থাকি না কেন। মা, তুমি দেখাে, আমার মন যেন ভাল থাকে। 
মা—তাই হবে।

১৮ই পৌষ 

আজ মায়ের জন্মতিথি। প্রবােধবাবু কয়েক দিন হইল আসিয়াছেন। গতকল্য তিনি মায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে ঠাকুরকে ভােগ দিবার জন্য মামাদের পাঁচটি টাকা দিয়াছেন। মা আমাকে বলিলেন, “তােমরা তাে আর বিশেষ কিছু করছ না। আমি একখানা নুতন কাপড় পরব, ঠাকুরকে একটু মিষ্টান্নাদি করে ভােগ দেওয়া হবে, আমি প্রসাদ পাব। এই আর কি?” 
পূজার পর মা তাঁহার ঘরে চৌকির উপর দক্ষিণ পাশে দুয়ারের নিকট পা ঝুলাইয়া বসিয়াছেন। একখানি নূতন কাপড় পরিয়াছেন। প্রবােধবাবু গিয়া মায়ের পায়ে ফুল দিলেন। আমি দুয়ােরের পাশে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছি। মা আমাকে বলিলেন, “কই, তুমি দেবে না ? নাও, এই ফুল নাও।” আমি ফুল লইয়া পায়ে দিলাম। মধ্যাহ্নে খুব প্রসাদ পাওয়া গেল। প্রবােধবাবুর অফিস, তাই তিনি কলিকাতা রওনা হইলেন। আমার আমাশয় হওয়াতে যাওয়া হইল না।

২১শে পৌষ 

কথাপ্রসঙ্গে মা বলিলেন-“ভগবানকে কে বাধঁতে পেরেছে বল না। তিনি নিজে ধরা দিয়েছিলেন বলে তাে যশােদা তাঁকে বাঁধতে পেরেছিল, গােপগােপীরা তাঁকে পেয়েছিল।
“বাসনা থাকতে জীবের যাতায়াত ফুরায় না, বাসনাতেই দেহ হতে দেহান্তর হয়। একটু সন্দেশ খাবার বাসনা থাকলেও পুনর্জন্ম হয়। তাই তাে মঠে এত জিনিস আসে। বাসনাটি সূক্ষ্ম বীজ—যেমন বিন্দুপরিমাণ বটবীজ হতে কালে প্রকাণ্ড বৃক্ষ হয়, তেমনই। বাসনা থাকলে পুনর্জন্ম হবেই, যেন এক খােল থেকে নিয়ে আর এক খােলে ঢুকিয়ে দিলে। একেবারে বাসনাশূন্য হয় দু-একটি। তবে বাসনায় দেহান্তর হলেও পূর্বজন্মের সুকৃতি থাকলে চৈতন্য একেবারে হারায় না।
“বৃন্দাবনের গােবিন্দের এক কামদার (পূজারী) ঠাকুরের ভোগ নিয়ে তার উপপত্নীকে খাওয়াত। এই পাপে দেহান্তে তার প্রেতযােনি হয়। কিন্তু সে ঠাকুরের সেবা করেছিল, এই সুকৃতির ফলে একদিন সে সশরীরে সকলকে দেখা দেয়। সুকৃতিটুকু ছিল বলে দেখা দিতে পারল এবং সবাইকে তার অধােগতির কারণ বললে। তাদের বললে, তােমরা আমার উদ্ধারের জন্য ঠাকুরের মহােৎসব-কীৰ্তনাদি কর। তাহলেই আমার উদ্ধার হবে।”
আমি—মহােৎসব-কীর্তনে কি উদ্ধার হয় ? 
মা—হাঁ, বৈষ্ণবদের ওতেই হয়। তাদের শ্রাদ্ধাদি করে না।
“যখন পুরীতে জগন্নাথদর্শন করি, এত লােকে জগন্নাথদর্শন করছে দেখে আনন্দে কাঁদলুম, ভাবলুম-আহা, বেশ, এত লােক মুক্ত হবে। শেষে দেখি যে না, যার বাসনাশূন্য সেই এক-আধটিই মুক্ত হবে। যােগেনকে বলায় সেও তাই বললে, “না মা, যারা বাসনাশূন্য তারাই মুক্ত হবে।”
একদিন সকালবেলা মায়ের বারান্দায় মুড়ি খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, মঠে থাকলে কি সন্ন্যাস নিতে হবে ?মা বললেন, “তা হবে।”
আমি—মা, বড় অভিমান আসে সন্ন্যাসে।
মা—হাঁ, বড় অভিমান—আমায় প্রণাম করলে না, মান্য করলে না, হেন করলে না। তার চেয়ে বরং(নিজের সাদা কাপড় লক্ষ্য করিয়া) এই আছি বেশ (অর্থাৎ অন্তরে ত্যাগ) । বন্দাবনে গৌর শিরােমণি বুড়ো বয়সে সন্ন্যাস নিলেন, যখন ইন্দ্রিয়-টিন্দ্রিয়গুলাের প্রভাব কমে গেছে। রুপের অভিমান, গুণের অভিমান, বিদ্যার অভিমান, সাধুর অভিমান কি যায়, বাছা।
আমাকে ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইতে বলিতেছেন, “বাড়ি গিয়ে ওদের (ভাইদের) একবার বলে আসবে চাকরি-বাকরি আমি করতে পারব না। মা তো নেই যে দাসত্ব করব। আমি ওসব পারব না। তােমরা ঘরকন্না কর, বেশ থাক।”
সাধুজীবনের খাওয়া-দাওয়া কঠোরতার কথা উঠিল। মা বলিলেন, “মঠে ছেলেরা সব কষ্ট করছে-না খাওয়া, না দাওয়া, না কিছু। ওসব আমারভাল লাগে না। যােগীনের (যােগানন্দ স্বামী) কঠোর করে করে শেষটা অত ভুগে ভুগে দেহ গেল।”

১.যােগেন-মা বলেন, “একদিন জগন্নাথের মন্দিরের ভিতর লক্ষীর মন্দিরে মা ও আমি পাশাপাশি বসে ধ্যান করছি। আমি মনে মনে ভাবছি, আহা এত সব লােক রথে জগন্নাথ দেখছে, সব তাে মুক্ত হবে। তখন শুনি কে যেন বলছে, “না, যারা বাসনাশূন্য, তারাই মুক্ত হবে। আমি মাকে যখন এই কথা বললুম, মা বললেন, “ও যােগেন, আমার মনেও তখন এই চিন্তা উঠেছিল, আর আমিও এই উত্তর শুনতে পেলুম।”
২.একজন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব সাধু। ইনি কালাবাবুর কুঞ্জে শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করেন।

রাত্রে মায়ের সঙ্গে কথা হইতেছে। আমি বলিলাম, “মা, ভগবানের কৃপা হলে যখন তখন হয়, সময়ের অপেক্ষা রাখে না।” উত্তরে মা বলিলেন, “তা বটে। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসে যে আমটি হয় তা যেমন মিষ্টি, অন্য মাসে কি তেমনটি হয়? মানুষ অকালে ফলাবার চেষ্টা করছে। দেখ না এখন আশ্বিন মাসে কাঁঠাল হয়, আম হয়। কিন্তু কালের মতাে কি (মিষ্টি) হয় ? ঈশ্বরলাভের পথেও অমনি। এজন্মে হয়তাে জপতপ করলে, পরজন্মে হয়তাে ভাব একটু ঘনীভূত হ’ল, তার পর জম্মে হয়তাে আর একটু হ’ল—এই ভাবে আর কি।”
হঠাৎ কিছু করিয়া দেওয়া সম্বন্ধে বলিলেন, “ভগবান বালকস্বভাব। কেউ চায় না, তাকে দেবে ; আবার কেউ চায়, তাকে দেবে না—সব খেয়াল।"
আর একদিন সকালবেলা মা বারান্দায় পান সাজিতেছেন। আমি বলিলাম, “কালে তোমার জন্য লােকে কত সাধন করবে।'
মা হাসিয়া বলিলেন, “বল কি ! সকলে বলবে আমার মায়ের এমনি বাত ছিল, এমনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত।”
আমি—তা তুমি বলগে।
মা—উটি ভাল। তাই তাে ঠাকুর বলতেন-তখন কাশীপুরে ব্যারাম-“যারা লাভের আশায় এসেছিল, তারা সব চলে গেল, বললে, “উনি অবতার, ওর আবার ব্যারাম কি ? ও সব মায়া। কিন্তু যারা আমার আপনার জন তাদের আমার এ কষ্ট দেখে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার জ্বর হয়েছে, বিকারে প্রলাপ বকছি। কুসুম গিয়ে বললে, “গােলাপ দিদি, দেখ এসে, মা প্রলাপ বকছেন।” গােলাপ বললে, “মা ওরকম বলে থাকেন।” ‘না, দেখ এসে, সত্য সত্যই।” “না, ও কিছু না।” শেষে কুসুম গিয়ে আশুকে ডাকলে। সকলে এসে দেখে সত্যই বিকার।
মন্ত্র লইবার পূর্বদিন গিয়া মাকে বলিলাম, “মা, আমি মন্ত্র নেব।” মা বলিলেন, “তুমি মন্ত্র নাওনি এখনও?” আমি ‘না’ বলায় বলিলেন, “আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি মন্ত্র নিয়েছ।” দীক্ষার পর বলিলেন, “ভগবানের মন্ত্রজপ করে দেহ-মন শুদ্ধ হােক।”
আমি—আঙুলে মন্ত্রজপ করবার কি দরকার? এমনি জপ করলেই তাে হয়।
মা—ভগবান আঙুল দিয়েছেন, মন্তজপ করে এর সার্থকতা করবে।

২৫-৯-১০, উদ্বোধন, ঠাকুরঘর 

সকালবেলা মায়ের সহিত কথা হইতেছে।
আমি—মা, যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তবে জগতে এত দুঃখকষ্ট কেন ? তিনি কি দেখছেন না? তাঁর কি এসব দুর করবার শক্তি নেই ?
মা—সৃষ্টিই সুখদুঃখময়। দুঃখ না থাকলে সুখ কি বােঝা যায় ? আর সকলের সুখ হওয়া সম্ভব কি করে? সীতা বলেছিলেন রামকে, তুমি সকলের দুঃখকষ্ট দূর করে দাও না কেন ? রাজ্যে যত প্রজা লােজন আছে সকলকে সুখে রাখ। তুমি তাে ইচ্ছা করলেই পার।' রাম বললেন, “সকলের সুখ একসঙ্গে কি হয়?
‘না, তুমি ইচ্ছা করলেই হয়, যার যা অভাব হয় রাজভাণ্ডার হতে দিয়ে দাও।'
‘আচ্ছা, তােমার কথামতই হবে।'
“তখন লক্ষণকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘যাও, রাজ্যমধ্যে সকলকে জানাও, যার যা অভাব থাকে চাইলেই রাজকোষ হতে পাবে।’ সকলে সংবাদ পেয়ে এসে দুঃখ জানালে। রাজকোষ অবারিত। বেশ সকলে সুখে দিন কাটাতে লাগল। রামের এমনি মায়া যে শীঘ্র যে দালানে রাম-সীতা থাকতেন তার ছাদ ফেটে জল পড়তে আরম্ভ হল। মেরামতির চেষ্টায় লােকজন ডাকতে পাঠালেন। কোথায় লােকজন? কুলীমজুর কি আর আছে ? রাজ্যমধ্যে কুলী-মজুরের অভাবে প্রজাদের ঘরদরজা, কাজকর্ম সব নষ্ট হতে চলেছে—প্রজারা জানালে। তখন নিরুপায় হয়ে সীতা রামকে বললেন, ‘আর ভিজে ভিজে কষ্ট সহ্য হয় না । যেমনটি ছিল তুমি তেমনটি করে দাও, তাহলে কুলী-মজুর সব মিলবে। সকলের একসঙ্গে সুখ হওয়া সম্ভব নয়।' রাম বললেন, “তথাস্তু। তখন দেখতে দেখতে সব পূর্বের মতাে হল। কুলী-মজুর মিস্ত্রী সব মিলল। সীতা বললেন, ‘ঠাকুর, এ সৃষ্টি তোমারই অদ্ভুত খেলা। 
“চিরদিন কেউ সুখী থাকবে না, সব জম্ম কারও দুঃখে যাবে না। যেমন কর্ম তেমন ফল, তেমন যােগাযােগ হয়।”
আমি—সবই কর্ম থেকে হয় ? 
মা—কর্ম না তাে কি ? দেখছ না, এই যে মেথর বিষ্ঠার ভার বইছে।
আমি — এ ভালমন্দ কর্মপ্রবন্তুি প্রথম কোথা থেকে আসে? এ জন্মে বলবে তার পূর্বজন্ম থেকে, সে জন্মে আবার তার পূর্বজন্ম থেকে ; আদি কোথা?
মা—ঈশ্বরেচ্ছা ছাড়া কিছুই হবার সাধ্য নেই, তৃণটিও নড়ে না। যখন জীবের সুসময় আসে, তখন ধ্যানচিন্তা আসে; কুসময়ে কুপ্রবৃত্তি কুযােগাযােগ হয়। তাঁর যেমন ইচ্ছা তেমনি কালে সব আসে, তিনিই তার ভেতর দিয়ে কার্য করেন। নরেনের কি সাধ্য ? তিনি তার ভেতর দিয়ে সব করলেন বলে তাে নরেন সব করতে পেরেছিল ?
“ঠাকুর যেটি করবেন তাঁর তা ঠিক করা আছে। তবে ঠিক ঠিক যদি কেউ ওঁর উপর ভার দেয়, উনি তা ঠিক করে দেবেন।”
“সব সয়ে যেতে হয়। কারণ কর্মানুসারে সব যােগাযােগ হয়। আবার কর্মের দ্বারা কর্মের খণ্ডন হয়।” 
আমি—কর্মের দ্বারা কর্মের খণ্ডন হয়।
মা—তা হবে না? তুমি একটি সৎকার্য করলে, তাতে তােমার পাপটুকু কেটে গেল। ধ্যান, জপ ঈশ্বরচিন্তায় পাপ কাটে।
মির্জাপুর স্ট্রীটে একটি ছেলের উপর নাকি মৃতাত্মাদের আবেশ হয়। ‘উদ্বােধনের’ কেহ কেহ পূর্বদিন উহা দেখিতে গিয়াছিলেন। সেই কথা উঠিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা, প্রেতদেহে কতদিন থাকতে হয় ?”
মা—উন্নত পুরুষ ছাড়া আর সকলকে একবছর প্রেতযযানিতে থাকতে হয়। তারপর গয়ায় পিণ্ডদান, মহােৎসব—তাদের উদ্দেশে এ সব করলে প্রেতযোনি মুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে যায়। অথবা অন্যান্য লােকে গিয়ে সুখটুক ভােগ করে। আবার কালে বাসনা অনুসারে জন্ম হয়। কারও বা সেখান থেকেই মুক্তি হয়। তবে ইহজম্মের কিছু সুকৃতি থাকলে প্রেতদেহেও চৈতন্য একেবারে হারায় না।
মা বৃন্দাবনের সেই বৈষ্ণব ভুতের ( গােবিন্দজীর পূজারীর) কথা বলিলেন।
আমি—গয়ায় পিণ্ড দিলেই কি ভগবানের কাছে যায় ?
মা—হাঁ যায়। 
আমি—তবে আর ভজন-সাধনের কি দরকার?
মা—তাঁর কাছ থেকে যে আবার বাসনা কর্মানুসারে পৃথিবীতে এসে জন্মায়। এখান থেকে কেউ বা মুক্তিলাভ করে, কেউ বা নীচ যােনি সব ভােগ করে। চক্রের মতাে সৃষ্টি চলছে। যে জন্মে মন বাসনাশূন্য হয়, সেইটি শেষ জন্ম।
আমি—এই যে ভগবানের কাছে যায় বললে, কেউ কি এসে নিয়ে যায়, না আপনিই যায় ?
মা—না, আপনিই যায়, সুক্ষ্ম শরীর হাওয়ার শরীর কি না? 
আমি—যাদের গয়ায় পিণ্ডাদি না হয়, তাদের কি গতি হয়? 
মা—যতদিন না বংশে কোন ভাগ্যবান জন্মে গয়ায় পিণ্ড দেয়, কি ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়াদি করে, ততকাল প্রেতদেহে থাকতে হয়।
আমি—এই যে ভুত প্রেত, এসব কি শিবের চেলা ভুত ? না যারা মরে গেছে তারা। মা—না, মৃত যারা তারা ; শিবের চেলা ভুত, সে সব আছে আলাদা।
‘ভারী সাবধানে চলতে হয়। প্রত্যেক কর্মের ফল ফলে। কাউকে কষ্ট দেওয়া, কটু বলা ভাল নয়।”
আমি—মা, নিমগাছেও আম ফলে না, আর আম গাছেও নিম ফলে না। যার যেমনটি হবার, তার তেমনটি হয়।

১.এই প্রসঙ্গে আমার একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। ১৯৯২ সালে মা যখন কাশীতে যান, ফিরিবার সময় আমি গয়ায় পিতৃপুরুষদের পিণ্ড দিবার জন্য তাহার দুই-এক দিন পূর্বে রওনা হই। যাত্রা করিবার সময় মাকে বলিয়াছিলাম, “দেখাে যেন তাদের সদগতি হয়।” আমি যেদিন গয়ায় পিণ্ড দিই, সেদিন রাত্রে ভূদেব (মায়ের ভাইপাে, সঙ্গে কাশী গিয়াছিল) স্বপ্ন দেখে যে, মা পঞ্চপাএ লইয়া জপ করিতে বসিয়াছেন, আর অনেক লােক আসিয়া বলিতেছে, “আমাকে উদ্ধার করুন, আমাকে উদ্ধার করুন।" মা তাহাদের গায়ে শান্তি জল (পঞ্চপাত্র হইতে) ছিটাইয়া দিতেছেন আর বলিতেছেন, “যা উদ্ধার হয়ে যা।” তাহারা সকলে আনন্দে চলিয়া যাইতেছে। শেষে একটা লােক আসিয়াছে। মা বলিলেন, “আমি আর পারব না।" অনেক মিনতি করাতে তাহাকেও কৃপা করিলেন। পরদিন ভূদেব মার কাছে এই স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিয়াছিল। মা শুনিয়া বলিয়াছিলেন,”এই রা—গয়ায় পিন্ড দিতে গেছে, তাই এত লােক উদ্ধার হয়েছে।” বাস্তবিকই, গয়ায় পিতুপুরুষদের পিণ্ড দিবার পর মনের আবেগে যাঁহার নাম মনে পড়িয়াছে, তাঁহারই নামে পিণ্ড দিয়াছিলাম সকলেই উদ্ধায় হউক।
মা—ঠিক বলেছ, বাবা, কালে ঈশ্বর-টীশ্বর কিছু থাকে না। জ্ঞান হলে মানুষ দেখে ঠাকুর-ঠুকুর সবই মায়া - কালে আসছে, যাচ্ছে।

উদ্বােধন ঠাকুর ঘর 

সকালবেলা মায়ের সঙ্গে কথা হইতেছে।
মা—যখন ঠাকুর চলে গেলেন, একা একা বসে ভাবতুম—তখন কামারপুকুরে রয়েছি—ছেলে নেই, কিছ; নেই, কি হবে? একদিন ঠাকুর দেখা দিয়ে বললেন, ‘ভাবছ কেন? তুমি একটি ছেলে চাচ্ছ—আমি তােমাকে এই সব রত্ন ছেলে দিয়ে গেলুম। কালে কত লােকে তােমাকে ‘মা, মা' বলে ডাকবে।
‘বৃন্দাবন যখন যাই, পথে রেলে যেতে যেতে দেখি কি ঠাকুর জানলা ( রেলগাড়ির) দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলছেন, ‘কবচটি যে সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে, দেখাে যেন না হারায়।”
“তাঁর ইষ্টকবচটি আমার হাতে ছিল। আমি পুজা করতুম। তারপর উটি মঠে দিলুম। এখন মঠে পূজা হয়।” 
আমি— ও কবচটি এবার ঠাকুরের তিথিপূজার দিন হারিয়েছিল। ফুল বেলপাতার সঙ্গে গঙ্গায় ফেলে দেয়। কারও খেয়াল ছিল না। ভাটায় গঙ্গার জল কমে গেলে রামবাবুর ছেলে ঋষি ওখানে খেলতে খেলতে গিয়ে ওটি পেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে আসে।
মা—তাঁর ইষ্টকবচ, সাবধানে রাখতে হয়। 
বেলুড় মঠের কথা উঠিল। 
মা—আমি কিন্তু বরাবরই দেখতুম, ঠাকুর যেন গঙ্গার ওপার ঐ জায়গাটিতে —যেখানে এখন মঠ, কলাবাগান-টাগান—তার মধ্যে ঘর, সেখানে বাস করছেন। (তখন মঠ হয় নাই।) মঠের নূতন জমি কেনা হলে পর নরেন একদিন আমাকে নিয়ে জমির চতুঃসীমা ঘুরে ঘুরে দেখালে, বললে, “মা, তুমি আপনার জায়গায় আপন মনে হাঁপ ছেড়ে বেড়াও।'
“বােধগয়ায় মঠ, তাদের অত সব জিনিসপত্র, কোন অর্থের অভাব নেই, কষ্ট নেই—দেখে কাঁদতুম, আর ঠাকুরকে বলতুম, ঠাকুর, আমার ছেলেরা থাকতে পায় না, খেতে পায় না, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের যদি অমন একটি থাকবার জায়গা হত। তা ঠাকুরের ইচ্ছায় মঠটি হ’ল।
“একদিন নরেন এসে বললে, “মা, এই ১০৮ বিল্বপত্র ঠাকুরকে আহুতি দিয়ে এলুম, যাতে মঠের জমি হয়। তা কর্ম কখনও বিফলে যাবে না। ও হবেই একদিন'।”
রাত্রে খাইবার পর উপরে পান আনিতে গিয়া শুনি, মা বলিতেছেন, “নরেন বলছিল, “মা, আমার আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে। সব দেখছি উড়ে যায়। আমি বললুম (হাসিয়া বলিতেছেন), “দেখাে দেখাে, আমাকে কিন্তু উড়িয়ে দিও না।' নরেন বললে, “মা, তােমাকে উড়িয়ে দিলে থাকি কোথায় ? যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে তাে অজ্ঞান। গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে দাঁড়ায় কোথায়?”
ইহা বলিয়াই আবার বলিতেছেন, “জ্ঞান হলে ঈশ্বর-টীশ্বর সব উড়ে যায়। ‘মা, মা শেষে দেখে, মা আমার জগৎ জুড়ে! সব এক হয়ে দাঁড়ায়। এই তাে সােজা কথাটা !”
উদ্বোধন, ঠাকুরঘর 

মা পুজার জন্য ফুল বেলপাতা বাছিতেছিলেন। তাঁহার একখানি ফটো নুতন ছাপা হইয়া আসিয়াছে, তাহাই মাকে দেখাইতেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা এ ফটো কি ঠিক?”
মা—হাঁ, এটি ঠিক। তবে পূর্বে আরও মােটা ছিলুম। যখন ছবি উঠায় তখন যােগীনের (যােগানন্দ স্বামীর ) খুব অসুখ। তার জন্য ভেবে ভেবে শরীর শুকিয়ে গিছল। মন ভাল নয়, যােগীনের অসুখ বাড়ছে তাে, কাঁদছি, আবার যােগীন ভাল থাকছে তাে ভাল থাকছি। সারা মেম ( Sara Buil) এসে এইটি উঠালে। আমি কিছুতেই দেব না। সে অনেক করে বললে, “মা, আমি আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে পুজা করব।' তাই শেষে এই ছবি উঠায়।
আমি—মা, তােমার কাছে এই যে ঠাকুরের ফটো রয়েছে এখানি বেশ। দেখলে বুঝা যায়। আচ্ছা, এখনি কি ঠিক ? 
মা—এটি খুব ঠিক ঠিক। ওখানি এক ব্রাহ্মণের ছিল। প্রথম কখানি যেমন উঠান হয়। একখানি সে ব্রাহ্মণটি নিয়েছিল। আগে এখানি খুব কাল (deep) ছিল—ঠিক যেন কালীমূর্তিটি, তাই ঐ ব্রাহ্মণকে দিয়েছিল। সে ব্রাহ্মণ দক্ষিণেশ্বর থেকে কোথায় যাবার সময় ওখানি আমার কাছে রেখে যায়। আমি এখানি অন্যান্য ঠাকুর-দেবতার ছবির সঙ্গে রেখে দিয়েছিলাম—পূজা করতুম। নহবতের নিচের ঘরে থাকতুম। একদিন ঠাকুর গিয়েছেন। ছবি দেখে বলছেন, ওগাে, তােমাদের আবার এসব কি ? আমরা (বােধ হয় মা ও লক্ষী দিদি) ও পাশে সিঁড়ির নীচে রাঁধছি। তারপর দেখলুম, বিল্বপত্র আর কি কি যা পুজার জন্য ছিল, একবার না দুবার ঐ ছবিতে দিলেন—পূজা করলেন। সেই ছবিই এই। সে ব্রাহ্মণ আর ফিরে এল না। এখানি আমারই রইল।
আমি—মা, ঠাকুরের সমাধি-অবস্থায় ঠাকুরের মুখে কখন স্মান দেখেছ কি ? | মা—কই, আমি তাে কখন দেখিনি। সমাধির অবস্থায় মুখে হাসিই দেখেছি।
আমি—ভাবসমাধিতে মুখে হাসি থাকতে পারে। কিন্তু বসা ছবির সবধে ঠাকুরও বলেছেন, ‘এ অতি উচ্চ অবস্থার ছবি’। এতেও কি হাসি থাকে ?
মা— আমি তাে সব সমাধির অবস্থায়ই হাসিমুখ দেখেছি। 
আমি—রং কি রকম ছিল ?
মা—তাঁর গায়ের রং যেন হরিতালের মতাে ছিল—সােনার ইষ্ট-কবচের সঙ্গে গায়ের রং মিশে যেত। যখন তেল মাখিয়ে দিতুম, দেখতুম সব গা থেকে যেন জ্যোতিঃ বেরচ্ছে। কালীবাড়ীতে দক্ষিণেশ্বরের একজনদের জামাই এসেছিল খুব গৌরবর্ণ। ঠাকুর আমায় বলছেন, আমরা দুজনে পাশাপাশি পঞ্চবটীতে বেড়াব, তুমি দেখবে কার রং ফরসা। তাঁরা বেড়াতে লাগলেন, দেখলাম ঠাকুরের চেয়ে তার রং একটু ফরসা—উনিশ-বিশ হবে।
“যখনই কালীবাড়িতে বার হতেন, সব লােক দাঁড়িয়ে দেখতাে, বলতাে ঐ তিনি যাচ্ছেন। বেশ মােটাসােটা ছিলেন। মথুরবাবু একখানা বড় পিঁড়ে দিয়েছিলেন, বেশ বড় পিঁড়ে। যখন খেতে বসতেন তখন তাতেও বসতে কুলাতা না। ছােট তেলধুতিটি পরে যখন থস থস করে গঙ্গায় নাইতে যেতেন, লােকে অবাক হয়ে দেখতে।
“কামারপুকুরে যখন যেতেন, ঘরের বার হলেই মেয়েমন্দ হাঁ করে চেয়ে থাকত। একদিন ভুতির খালের দিকে বেরিয়েছেন, চারদিকে মেয়েগুলো -যারা জল আনতে গেছে-হাঁ করে দেখছে আর বলছে, ‘ঐ ঠাকুর যাচ্ছেন’।
“ঠাকুর হৃদয়কে বলছেন, ‘ও হৃদু, আমায় ঘোমটা দিয়ে দে, আমায় ঘােমটা দিয়ে দে—দে, দে, নইলে আমি এখুনি ন্যাংটা হব। হৃদয় বললে, 'না, মামা, এখানে ন্যাংটা হয়াে না, লােকে কি বলবে? ন্যাংটা হলে মেয়েগুলাে পালাবে কিনা। হৃদয় তাড়াতাড়ি গায়ের চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে দিলে।
“তাঁকে কখনও নিরানন্দ দেখিনি। পাঁচ বছরের ছেলের সঙ্গেই বা কি, আর বুড়াের সঙ্গেই বা কি, সকলের সঙ্গে মিশেই আনন্দে আছেন। কখনও বাপু নিরানন্দ দেখিনি। আহা! কামারপুকুরে সকালে উঠেই বলতেন, 'আজ এই শাক খাব, এইটি রেখাে। শুনতে পেয়ে আমরা (মা ও লক্ষীদিদির মা) সব যােগাড় করে রাখতুম। কয়েক দিন পরে বলছেন, ‘আঃ, আমার একি হল? সকাল থেকে উঠেই কি খাব, কি খাব! রাম রাম ! আমাকে বলছেন, আর আমার কিছু খাবার সাধ নেই, তোমরা যা রাঁধ, যা দেবে, তাই খাব।' শরীর। সারতে দেশে যেতেন। দক্ষিণেশ্বরে থাকতে খুব পেটের অসুখে ভুগতেন কিনা। বলতেন, ‘রাম রাম ! পেটটা কেবল মলেই ভর্তি, কেবল মলই বেরুচ্ছে।' এই সবে তারপর শরীরে ঘেন্না ধরে গেল, আর শরীরের যত্ন করতেন না। “একদিন ভূতির খালের দিক থেকে আসছেন, বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটা মাগুর মাছ পুকুর থেকে রাস্তায় উঠেছে, ঠাকুরের পায়ে ঠেকেছে। ঠাকুর সেটাকে পায়ে করে ঠেলে ঠেলে এনে পুকুরে ছেড়ে দিলেন বললেন, ‘পালা, পালা, হৃদে দেখতে পেলে এখনি তােকে মেরে ফেলবে।' এসে হৃদয়কে বলছেন,’ হৃদু, এই এত বড় একটা মাগুর মাছ, হলদে রং, রাস্তায় উঠেছিল, পুকুরে ছেড়ে দিলাম। হৃদয় বললে, ‘ও মামা, তুমি করলে কি গো, ও মামা, তুমি করলে কি গাে! আঃ, এত বড় মাছটা ছেড়ে দিলে। আনলে বেশ ঝােল হত।
“এখন তাে কত ভক্ত, চারিদিকে হই হই। তাঁর অসুখের সময় একজন ভেগে গেল বিশ টাকার জন্য—চাঁদা ধরেছিল। এখন তাে আর ঠাকুরের সেবা কঠিন নয়, ঠাকুরকে ভােগ দিয়ে নিজেরাই খায়। ঠাকুরকে বসিয়ে রাখ, বসেই আছেন । শুইয়ে রাখ, শয়েই আছেন-ছবি তাে!
“বলরামবাবুকে দেখেছিলেন, মা কালীর পাশে হাতজোড় করে রয়েছেন, মাথায় পাগড়ি। বলরাম সেই বরাবরই হাতজোড় করে ছিল, কখনও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত না। ঠাকুর তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, 'ও বলরাম, এই পা-টা চুলকাচ্ছে, একটু হাত বুলিয়ে দাও না। বলরাম অমনি নরেন, কি রাখাল-টাখাল যে কেউ কাছে থাকত তাকেই টেনে এনে বলত, ‘এই ঠাকুরের পা-টায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তাে, চুলকাচ্ছে’।”
আমি—মহারাজকে আমি ঠাকুরের রংএর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেন, “এই আমাদের গায়ের রংএর মতই ছিল।'
মা—সে তারা যখন দেখেছে। তখন তার সে শরীরও ছিল না, সে রংও ছিল না। এই আমারই দেখ না, এখন কেমন রং হয়েছে –কেমন শরীর হয়েছে। আগে আমার কি এইরকম ছিল ? আগে খুব সুন্দর ছিলাম। আমি প্রথমে বেশী মােটা ছিলাম না। শেষে ( ঠাকুরের শরীরত্যাগের পর) মােটা হয়েছিলুম। দক্ষিণেশ্বরে যখন ছিলাম তখন তাে বার হতুম না। খাজাঞ্চী বলতেন, “তিনি আছেন শুনেছি, কিন্তু কখনও দেখতে পাইনি।'
‘কখনও কখনও দুমাসেও হয়তাে একদিন ঠাকুরের দেখা পেতুম না। মনকে বােঝাতুম, ‘মন, তুই এমন কি ভাগ্য করেছিস যে রােজ রােজ ওর দর্শন পাবি ! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে (দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে) কীর্তনের আখর শুনতুম—পায়ে বাত ধরে গেল। তিনি বলতেন, বুনাে পাখী খাঁচায় রাতদিন রাখলে বেতে যায়; মাঝে মাঝে পাড়ায় বেড়াতে যাবে। রাত চারটেয় নাইতুম। দিনের বেলায় বৈকালে সিঁড়িতে একটু রােদ পড়ত, তাইতে চুল শকাতুম। তখন মাথায় অনেক চুল ছিল। ( নহবতের) নীচের একটুখানি ঘর, তা আবার জিনিসপতে ভরা। উপরে সব শিকে ঝুলছে। রাত্রে শুয়েছি, মাথার উপর হাড়ি কলকল করছে-ঠাকুরের জন্য শিঙ্গি মাছের ঝােল হত কিনা! তবু আর কোন কষ্ট জানিনি, কেবল যা শৌচে যাবার কষ্ট। দিনের বেলায় দরকার হলে রাতে যেতে পারতুম গঙ্গার ধারে, অন্ধকারে। কেবল বলতুম, ‘হরি হরি, একবার শৌচে যেতে পারতুম !’ ( মা একটু পেটরােগা ছিলেন)। 
“তখন কত কীর্তন, কত ভাব! এই যে গৌরদাসী, এরই বা কত ভাব হত। কেবল ‘নিত্যগােপাল, নিত্যগােপাল’ করত ! ‘নিত্য কোথায়? নিত্য কোথায়?’ আমি বলতুম, কে জানে তাের নিত্য কোথায় ? দেখগে গঙ্গার ধারে টারে ভাব হয়ে রয়েছে।”
পূজার সময় হইয়াছে, মা পুজা করিতে বসিবেন। আমি নীচে আসিলাম। পুজা হইয়া যাইবার পর উপরে প্রসাদ আনিতে গিয়াছি। মা ঠাকুরঘরে দক্ষিণমুখে পা ছড়াইয়া বসিয়া শালপাতায় প্রসাদ ভাগ করিয়া রাখিতেছেন। দক্ষিণধারের বারান্দায় বসিয়া আমি দেখাইয়া দেখাইয়া বলিতেছি, “আমাকে এটা দাও, ঐটা দাও।” তারপর আর একটা জিনিস চাহিয়াছি। সেটি মায়ের হাতের কাছে ছিল না। পায়ের বাতের জন্য তাহার উঠিয়া আসিতে কষ্ট হইবে ভাবিয়া আমি নিজেই উহা হাত বাড়াইয়া লইতে গেলাম। সেই সময় মায়ের পায়ে আমার হাতের কনুইয়ের উপরের অংশটা ঠেকিয়া গেল। মা অমনি “আহা” বলিয়া হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিলেন। আমি বলিলাম, “সে কি, কি আর হয়েছে।” মা শুধু, নমস্কারে তৃপ্ত না হইয়া বলিলেন, “এস, এস, একটা চুমু খাই।” অগত্যা আমি মুখ বাড়াইয়া দিলাম। তিনি হস্ত দ্বারা চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম খাইলেন, তবে তাঁহার মন শান্ত হইল।
এমনই ভাবে তিনি ভক্তগণকে ভক্ত-ভগবান-জ্ঞানে নমস্কার, আবার আপন সন্তানজ্ঞানে স্নেহ করিতেন।

২৯-১০-১০, উছােধন, ঠাকুরঘর 

সকালে মায়ের তত্ত্বাপােশের দক্ষিণপাশে বসিয়া কথা হইতেছে। ঠাকুরের কথা উঠিয়াছে। মা বলিতেছেন, “পুরীতে প্রথম দিন গিয়েই সকালবেলা একটা ঘিয়ের টিনে ঠেসান দিয়ে ঠাকুরের ছবি রেখে পূজা করে তাড়াতাড়ি জগন্নাথ দেখতে গিয়েছিলাম। ঘর দোর সব বন্ধ। এসে দেখি ঠাকুরের ছবি টিনের নীচে। সবাই এসে দেখলে। সকলে মনে করলে চোর ঢুকেছে। কিন্তু ঘরের কোথাও জিনিসপত্রের একটুও নড়চড় হয়নি। শেষে দেখি বড় লাল পিপড়ে ধরেছে টিনে-ঘিয়ের টিন কিনা—সেই পিঁপড়ে ঠাকুরের ছবিতে ধরেছিল, তাই ঠাকুর নেমে বসেছেন।”
আমি—ছবিতে কি ঠাকুর আছেন ? 
মা—আছেন না? ছায়া কায়া সমান। ছবি তাে তাঁর ছায়া।
আমি—সব ছবিতে তিনি আছেন ?

১. এইজন্যই বােধ হয় বলে, গুরুজনদের ছায়া ডিঙাইতে নাই। জয়রামবাটীতে একদিন স্নান করিয়া আসিতেছি। মাও বাঁড়ুয্যে পুকুর হইতে স্নান করিয়া আসিতেছেন। রৌদ্রে মায়ের মা যে পাশে পড়িয়াছে, আমি সেই পাশ দিয়া মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছি দেখিয়া মা থামিয়া আমাকে বলিতেছেন, “ওপাশ দিয়ে এগিয়ে যাও।” আমি প্রথমটা বুঝিতে পারি নাই। মাকে বার দুই থামিতে দেখিয়া তখন খেয়াল হইল।

মা—হাঁ, ডাকতে ডাকতে ছবিতে তার আবির্ভাব হয়। স্থানটি একটি পীঠ হয়। যেমন এই জায়গায় (উদ্বোধনের উত্তরদিকে মাঠ দেখাইয়া) কেউ তাঁর পুজা দিলে। ঐটি তার একটি স্থান হল। 
আমি—তা, ও সব স্থানের সঙ্গে ঐ সব ভাল স্মৃতি জড়িত আছে বলে অমন মনে হয়।
মা—তা নয়, ও স্থানটিতে তাঁর দৃষ্টি থাকে। 
আমি–আচ্ছা, ঠাকুরকে যে-সব ভােগ দাও তা কি ঠাকুর খান ? 
মা—হাঁ খান। 
আমি— কই, কোন চিহ্ন দেখি না কেন?
মা—তাঁর চোখ থেকে একটি জ্যোতিঃ বার হয়ে সব জিনিস চুষে দেখে। তাঁর অমৃত-স্পর্শে সেটি আবার পরিপূর্ণ হয়, তাই কমে না।
“ভগবান বৈকুণ্ঠ থেকে নেমে আসেন যেথায় ভক্ত ডাকে। কোজাগর পূর্ণিমার দিন লক্ষী বৈকুণ্ঠ থেকে পৃথিবীতে আসেন। যেখানে যেখানে তার দৃষ্টি থাকে, যান, পূজা গ্রহণ করেন। আমার শাশুড়ী কামারপুকুরে দেখেছিলেন, চৌদ্দ-পনর বছরের মেয়ে, গৌরবর্ণ, কানে শঙ্খের কুণ্ডল, হাতে হীরার বালা (ডায়মনকাটা বালা)। বকুলতলায় (ঠাকুরের বাড়ির সামনে) দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কথা কয়েছিলেন। শাশুড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাগা, কে তুমি ? লক্ষী বললেন, “এই আমি এইখানেই আসছি। শাশুড়ী বললেন, “আমার ছেলেকে (শ্ৰীযুত রামকুমারকে ) দেখেছ? পুজো করতে গেছে, রাত হয়েছে, এখনও এল না। লক্ষী বললেন, 'হাঁ গো, সে আসছে, চালকলা বেঁধেছে, এই যে আমিও সেইখান থেকেই তোমাদের বাড়ি আসছি। আমার শাশুড়ি বললেন, 'না মা, বাড়িতে কেউ নেই, এখন এস না।’ এইরুপে বারবার প্রত্যাখ্যান করায় ‘আচ্ছা, আমার অমনিই দৃষ্টি থাকবে’ বলে দেবী অন্তর্ধান হলেন। দেখছ না ওদের অবস্থা কখনও তেমন ভাল হ’ল না, মােটা ভাত কাপড় চলে যাচ্ছে।
“আমার শাশুড়ী দেখেছিলেন, লক্ষী লাহাদের বাড়ির দিক থেকে তাদের ধানের মরাইগুলির ওখান ঘুরে এসেছিলেন। আমার ভাসুর এসে সব শুনে বললেন, “মা তুমি বুঝতে পারনি, স্বয়ং লক্ষী এসেছিলেন কোজাগর পূর্ণিমা কিনা আজ।' তিনি গণনা জানতেন, খড়ি পেতে দেখেছিলেন।
“তার খাবার কি দরকার? তিনি ভক্তের সন্তোষের জন্য আসেন, খান। প্রসাদ খেলে চিত্তশুদ্ধি হয়। এমনি অন্ন খেলে চিত্ত মলিন হয়।'* 
আমি—সত্যই কি ঠাকুর খান!
মা—হাঁ, আমি কি দেখি না যে ঠাকুর খেলেন কি না? ঠাকুর খেতে বসেন, খান।
আমি—তুমি দেখ ?
মা—হাঁ, কারুরটা দেখি তিনি খেলেন, কারুরটা হয়তাে দুষ্টিমাত্র করলেন। তা তােমারও কি সব জিনিস সব সময় খেতে ভাল লাগে, না সকলের জিনিস খেতে পার ? অমনি। যার যেমন ভাব ভক্তি। ভক্তিটিই প্রধান।
আমি—ভক্তি কি করে হবে? আপন ছেলেও যদি অনো পালন করে তাে মাকে মা বলে জানে না।
মা—হাঁ, তাইতাে তাঁর কৃপা চাই। কৃপার পাত্র হওয়া চাই। 
আমি—কৃপার আবার পাত্রপাত্র কি? কৃপা সকলের উপর সমান। 
মা—নদীর কুলে বসে ডাকতে হয়, সময়ে তিনি পার করবেন। 
আমি—সময়ে তাে সবই হয় ; তাতে তাঁর কৃপা কি ? 
মা—তা মাছটি ধরতে হলে ছিপটি ফেলে বসতে হয় না ?
আমি—তিনি আপনার জন হলে আবার বসে থাকা কেন ? 
মা—তা বটে। তা অসময়েও হয়। আজকাল লােকে অসময়েও আম কাঁটাল ফলাচ্ছে। ভাদ্র মাসেও কত আম হচ্ছে।
আমি—আমাদের কি দৌড় ঐ পর্যন্ত, যে যা চায়, তাকে তাই দিয়ে তিনি বিদায় করে দিলেন? না এ ছাড়া আপনার মতাে করে তাঁকে পাওয়া যায় ? তিনি আমার আপনার কি না?
মা—হাঁ, তিনি আপনার। চিরসম্বদ্ধ। তিনি সকলের আপনার, যেমন ভাব তেমনি লাভ।
আমি—ভাব তাে স্বপ্নবৎ, যেমন ভাবতে ভাবতে শেষে তাই স্বপ্ন দেখছে। 

*জনৈক ভক্তমার নিকট হইতে গৈরিক বস্ত্র লইয়াছিল। সে কয়েক বৎসর অসুখে ভোগে। ঐ সময় পরিবর্তনের অন্য নানাস্থানে ছিল। পরে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদের আশ্রমের পরিবর্তে বাড়িতে গিয়া থাকে এবং একদিন জয়রামবাটী গিয়া মাকে গৈরিক বস্ত্র ফিরাইয়া দেয়। এই উপলক্ষে মা বলিয়াছিলেন, “আহা। এর বিষয়ীর অন্ন খেয়ে বুদ্ধি মলিন হয়ে গেছে।”

মা—স্বপ্ন বইকি। জগৎই স্বপ্লবৎ। এটাও (এই জাগ্ৰৎ অবস্থা) একটা স্বপ্ন ।
আমি—না, এতটা স্বপ্ন নয়। তা হলে পলকে ভাঙত। এ যে অনেক জন্ম ধরে রয়েছে!
মা—তা হােক। স্বপ্ন বই আর কিছু নয়। এই যে রাত্রে স্বপ্ন দেখেছ, এখন তা নেই। (বাস্তবিকই গত রাত্রে আমি একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম।) চাষা স্বপ্ন দেখেছিল—রাজা হয়েছে, আট ছেলের বাপ হয়েছে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে বলেছিল, ‘সেই আট ছেলের জন্য কাঁদব, না এই এক ছেলের জন্য কাঁদব?
এইরুপ তর্কের পর শেষে বলিলাম, “মা, ওসব যা বলি, ওর জন্য আমি মাথা ঘামাই না। আমি জানতে চাই আমার কেউ আপনার আছে কি না ?”
মা—আছে বৈকি, নিশ্চয় আছে। 
আমি–ঠিক ? 
মা—হাঁ।
আমি—আপনার জন হলে তার দেখা পেতে ডাকতে হবে কেন? আপনার জন যে, সে না ডাকলেও দেখা দেয়। বাপ মা যেমন করেন, তিনি কি তেমন করছেন ?
মা–করছেন বইকি, বাছা, তিনিই বাপ-মা হয়েছেন। তিনিই বাপ-মাপে পালন করছেন। তিনিই দেখছেন। নইলে কোথা ছিলে, কোথা এলে। তারা প্রতিপালন করলে, শেষে দেখলে এ আমাদের নয়। যেমন কাকের বাসায় কোকিল পালে না?
আমি–ঠিক ঠিক আপনার জন পাব কি না?
মা—পাবে, পাবে, তুমি সব পাবে। যা ভাব সব পাবে। স্বামীজী পেয়েছিলেন না ? স্বামীজী যেমন পেয়েছিলেন তেমন পাবে।
আমি—মা, যাতে আমার ভয়-সঙ্কোচ না থাকে (মায়ের প্রতি)। 
মা—না, সঙ্কোচ কি! আমি তাে রুই গেঁথেছি। 
আমি—বেশ তাে, আমরা খাব। 
মা—হাঁ, তাইতাে। একজনে ছাঁচ করলে তা থেকে অনেক গড়ন হয়। 
আমি—তুমি করলেই আমাদের হবে। তুমি আর ছাড়িয়ে যেতে পারছ না।
মা—হাঁ, বাবা, আমি করলেই তােমাদের হবে।

২৬-১১-১০, উদ্বোধন, সকাল ৭টা 

পূর্বদিনে মা গুপ্ত-মহারাজের অসুখ দেখিতে গিয়াছিলেন। বশী ও টাবু গুপ্ত-মহারাজের খুব সেবা করিতেছে। মা সেই কথার উল্লেখ করিয়া তাহাদিগকে প্রশংসা করিতেছেন-“ওরাই সাধ, ওরাই ধন্য। আর সাধু কি ?”
“যােগীন চাটুজ্যেকেও (নিত্যানন্দ স্বামীকে) তার ছেলেরা (শিষ্যেরা) খুব সেবা করছে। পূর্ববঙ্গের তারা সব। কাশীপুরে ঠাকুরের সেবা ছেলেরা সব করত। তিনি তাদের নানা কথায় আনন্দে রাখতেন। বলতেন, “একটু আনন্দ না পেলে ওরা কেমন করে পারবে। তিনি সদ্বায়ের মন বুঝে চলতেন। সেবার তেমন দরকার হত না। হয়ত দশ-বার দিন অন্তর একটু বাহ্যে হত। তবে রাত জাগতে হত। খাওয়া তাে বড় ছিল না—একটু সুজি, তাও ছেঁকে দিতে হত। মাংসের যুষ হত। দুটো মরা কুকুর তার ছিবড়ে খেয়ে এই মােটা হ’ল। একদিন-তখন অকাল-আমলকী খেতে চাইলেন। দুর্গাচরণ (নাগ মহাশয়) তিনদিন পরে গােটা দুই-তিন আমলকী নিয়ে উপস্থিত হ'ল। বেশ বড় আমলকী। তিন দিন তার খাওয়া-দাওয়া নেই। ঠাকুরের আমলকী হাতে করে কান্না। বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ঢাকা-টাকা চলে গেছ।” আমাকে বললেন, ‘ঝাল দিয়ে একটা চচ্চড়ি রেঁধে দাও। ওরা পূর্ববঙ্গের লােক, ঝাল বেশী খায়। আর আর সব রাঁধা ছিল। বললেন, ‘একখানা থালায় সব বেড়ে দাও। ও প্রসাদ না হলে খাবে না।' ঠাকুর তা প্রসাদ করে দিতে বসলেন। সে সব দিয়ে ভাত প্রায় এত কটা খেলেন। তবে দুর্গাচরণ প্রসাদ পেল। তখন বাগানে খুব খরচ হয়। তিনটা রান্না-ঠাকুরের একটা, নরেনদের একটা, অপর সবার একটা। চাঁদা করলে টাকার জন্য। তাই চাঁদার ভয়ে একজন আবার ভেগে গেল। 
“পাপগ্রহণ করে তার শরীরে ব্যাধি। বলতেন, “গিরিশের পাপ। ও কষ্ট ভােগ করতে পারবে না। তার ইচ্ছামত্যু ছিল। সমাধিতে অনায়াসে দেহ ছাড়তে পারতেন। বলতেন, আহা, ওদের (ছেলেদের) একটা ঐক্য করে বেঁধে দিতে পারতুম। এতদিন তাে এ বলছে, ‘নরেনবাবু কেমন আছেন ?’ ও বলছে, ‘রাখালবাবু কেমন আছেন?’—এইরকম ছিল। তাই অত কষ্টেও দেহ ছাড়েননি।”

১৪-৪-১১, উদ্বোধন, ঠাকুরঘর, সকালবেলা। 

রােজ ঠাকুরপূজার জন্য যে ফুল আসে তাহা লইয়া উপরে গিয়াছি। বেলা অধিক হইয়াছে, তাই মা বলিলেন, “ফুলটি যখন আসে দিয়ে যাবে।” মা নিজেই পুজার সব যােগাড় করিতেন এবং পূজা করিতেন। হাত ইসারা করিয়া আমাকে কাছে ডাকিলেন। মা তক্তাপােশের উপর বসিয়া আছেন। জনৈক ভক্তের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
মা—ও নীচে আছে ? 
আমি— হাঁ। 
মা—কি করে ? পড়ে উড়ে ? 
আমি—মধ্যে মধ্যে হয়তাে পড়ে। 
মা–মঠে বুঝি যাবে না? 
আমি—না, তার যেতে ইচ্ছা নেই। 
মা—তােমরা বুঝিয়ে বলবে।
আমি—আমি ঢের বলেছি, তুমি বল যাতে গিয়ে অন্ততঃ দু-চারদিন থাকেন।
মা—বাবা, আমিও ঢের বলেছি, আমি বললেও শুনবে না। মঠে গেলে পাঁচজনে হাসিঠাট্টা করবে, তাই সে কিছুতেই যেতে চায় না। শরৎ কত করে আমাকে বললে, মহারাজের কথা, আমাদের কথা কি মােটেই শুনতে নেই ? মঠে গিয়ে অন্ততঃ দুদিন থেকে মহারাজের কথাটা মান্য করে আসুক না। তাই তাে, রাখালের সঙ্গে গিয়ে কিছুদিন পুরীতে থাকুক না। একা একা কোথায় যাবে ? কোথায় খাওয়াটি জুটবে?
আমি—খাওয়ার জন্য কিছু নয়, ভিক্ষা করে খাবে। তবে মহারাজ এবং অন্যান্য গুরুজন বলছেন, এঁদের কথা মান্য করবার জন্যও তাে একবার যাওয়া উচিত।
মা—হ্যাঁ, তাই তাে, গুরুজনের কথা। ওর কাজ করতেই ইচ্ছে নেই। কাজ না করলে কি মন ভাল থাকে। চব্বিশ ঘণ্টা কি ধ্যান চিন্তা করা যায় ? তাই কাজ নিয়ে থাকতে হয়, ওতে মন ভাল থাকে। তােমাদের এখানে কাজকর্ম কেমন চলছে?
আমি —একরকম চলে যাচ্ছে।
মা—তুমি রামেশ্বর যাবার কথা লিখেছিলে। তা যাওনি, বাবা, বেশ করেছ, পথে যা ওঠানামা।
আমি—শরৎ মহারাজ চেষ্টা করেছিলেন। তা অত টাকা কোথায় জুটবে ? গেলে শশী মহারাজের উপরই খরচ পড়ত।
মা—হাঁ, হাজার টাকা খরচ হয়েছে শশীর।
পরদিন মা ঠাকুরঘরের দক্ষিণপাশের ঘরে পান সাজিতেছিলেন। বেলা এগারটা হইবে। উপরে গিয়াছি। মা পূর্বোক্ত ভক্তটির কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও চলে গেল ?”
আমি—হাঁ, কাঞ্জিলালের বাড়িতে আজ থাকবে, হয়তাে কালও থাকতে পারে। শরৎ মহারাজ বলিলেন, ‘যদি অভিমান অহঙ্কার করে গিয়ে থাকে তাে দিন দিন আরও খারাপ হবে। আর যদি লজ্জায় কি করে মুখ দেখাবে এই ভাব থেকে গিয়ে থাকে তবে ঠাকুরের ইচ্ছায় হয়তাে মােড় ফিরে ভালও হতে পারে।' 
মা— কিই বা হয়েছে ? বেটাছেলে, মেয়ে তাে নয় ?ভাঙতে সব্বাই পারে, গড়তে পারে ক’জনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সবাই, কিন্তু তাকে ভাল করতে পারে কজনে? দুর্বলতা তাে মানুষের আছেই।
আমি—শরৎ মহারাজ বললেন, “একা থাকা উন্নত মন হলে সম্ভব, নতুবা যার দোষী মন, তার আরও অধােগতি হয় ওতে।”
মা—কি ভয় ? ঠাকুর রক্ষা করবেন। কত সাধু একা থাকে না? 
আমি—হৃদয় মুখুজ্যেও শেষটায় ঠাকুরের সঙ্গছাড়া হয়েছিল। 
মা—তা ভাল জিনিসটি কি কেউ চিরদিন ভােগ করতে পায় ? 
আমি—তিনি ঠাকুরকে অনেক কষ্টও নাকি দিতেন, গালমন্দ করতেন। 
মা—যে অত সেবা করে পালন করেছে, সে একটু মন্দ বলবে না? যে যত্ন করে সে অমন বলে থাকে।
আমি—ইনিও তােমার এত সেবা করলেন, শেষে এই হ’ল 
মা—তা শাসন না থাকলে চলবে কেন? ভাল হবে কি করে।

জয়রামবাটী 

একবার আশ্বিন মাসে ৺দুর্গাপুজার সপ্তমীর দিন দুইটি যুবক ভক্ত শ্রীশ্রীমার নিকট জয়রামবাটীতে উপস্থিত হইল। অষ্টমীর দিন তাহারা পদ্মফুল সংগ্রহ করিয়া মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিল। তারপর একজন বলিল, “মা আমায় সন্ন্যাস দাও।” অপরটিও তাহাতে যােগ দিল। মা একটু হাসিয়া বলিলেন (দৃষ্টি একটু অস্বাভাবিক), “সব হবে, বাবা, চিন্তা কি ?” ভক্তটি জেদ করিয়া আবার বলিল, “তা সন্ন্যাস দিতেই হবে মা; আমাদের গেরুয়া দাও।” এবার মা একটু গম্ভীরভাবেই বলিলেন, “গেরুয়ায় কি হবে, বাবা? গেরুয়াতে কি আছে? তােমরা তাে বে করনি, সন্ন্যাসী তাে আছই। আর যা যা দরকার সব ক্রমে হবে।” ভক্তটি আবার বলিল, “মা, আমার ইচ্ছা হয় পৈতা-কাপড়-চোপড় ফেলে দিয়ে তৈলঙ্গ স্বামীর মতাে সর্বদা ভগবৎ-চিন্তায় বিভাের হয়ে থাকি।” মা হাসিয়া বলিলেন, “হবে বাবা, হবে।” এবার ভক্তটি একটু অস্থিরভাবেই বলিতে লাগিল, “মা, দিই ফেলে, পৈতে-কাপড় ফেলে দিই।” কেবল কথায় নহে, কাজেও তাহাই করিতে যাইতেছে। মা তাহাতে একটু ব্যস্ত হইয়াই বলিলেন, “থাক না, থাক না-সময় হলে আপনি খসে যাবে।” 
তথাপি তাহার আবদার ফুরায় না। বলিতেছে, “মা, ঠাকুরের পাগলামির একটু ছিটেফোঁটা আমায় দাও, আমায় পাগল করে দাও।” আবার বলিল, “মা, ভক্তি-টক্তি কিছুই দিচ্ছ না, ঠাকুরকে দেখাবে না?” মা বলিলেন, “হবে, বাবা, সব হবে।” উভয়ে প্রণাম করিয়া বাহিরে গেল।
মধ্যাহ্নে সকলে প্ৰসাদ পাইতেছেন। পায়েস খাইয়া ভক্তটি বলিয়া উঠিল, “মা, এ কি পায়েস রেঁধেছ ? একটুও ভাল হয়নি।” মা হাসিয়া বলিলেন, “কি করব, বাবা, এখানে দুধ তেমন পাওয়া যায় না।” কেদারের মা নিকটে ছিলেন। তিনি বলিলেন, “বেশ তাে বাবা, তােমার সব ছেলে আছ, খুব ক'রে জিনিসপত্র এনে দিও, মা ভাল করে খাওয়াবেন।” একথা তাহার কানেও গেল না; বলিল, “মা, এবার কিন্তু খেয়ে পেট ভরল না। আবার এসে পেট ভরে খেয়ে যাব, আর ‘উদ্বোধনে’ আমায় আর একবার দেখা দিও।” মা এ কথায় সম্মতি জানাইলেন।
পূর্বাহে শিলং হইতে একটি ভক্ত আসিয়াছেন। শ্রীশ্রীমায়ের অবতারত্বে নিঃসন্দেহ হইবার জন্য ইনি পণ করেন, সাতবার মাকে স্বপ্নে দর্শন না পাইলে দর্শনে যাইবেন না। মায়ের কৃপায় সাতবার পূর্ণ হইয়াছে। তাই এবার আসিয়াছেন। তিনি অপরাহ্নে বিদায় লইবেন। মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মা, আসি তবে। আর কি কোন দরকার আছে?”
মা—হাঁ, বাবা, আছে বইকি। দীক্ষাটা নিয়েই যেও। 
ভক্ত—তা বাগবাজারেই হবে। 
মা—না, বাবা, ওটা হয়েই যাক, আজই না হয় হবে। 
ভক্ত—প্রসাদ পেলুম যে? 
মা—ওতে দোষ হবে না। 
তারপর দীক্ষাগ্রহণ করিয়া তিনি বিদায় লইলেন।
জয়রামবাটী হইতে বাড়ি আসিয়া পূর্বোক্ত ক্ষেপা ভক্তটির মনােভাবে ক্ৰমশঃ খুব পরিবর্তন হইতে চলিয়াছে। ঠাকুরের দর্শনের জন্য সে অস্থির। শ্রীশ্রীমা ইচ্ছা করিলেই ঠাকুরকে দর্শন করাইতে পারেন, অথচ দেখাইতেছেন না—এই বিশ্বাসে তাঁহার মনে বড় অভিমান হইয়াছে। অত্যন্ত বিরক্তিভাবেই সে পুনরায় জয়রামবাটী গিয়া মাকে বলিল, “মা, ঠাকুরকে দেখাবে না?” মা স্নেহমাখা স্বরে বলিলেন, “হবে, বাবা, কেন ব্যস্ত হচ্ছ?” 
তাহার আর সহ্য হইল না। ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “কেবল ফাঁকি দিচ্ছ ? এই নাও তােমার জপের মালা, আমি আর কিছু চাই নে’ এবং জপের মালা মায়ের দিকে ছুড়িয়া দিল। মা বলিলেন, “আচ্ছা, থাক, ঠাকুরের ছেলে হয়ে থাক।” সে কিন্তু আর অপেক্ষা করিল না, চলিয়া গেল। কোয়ালপাড়া মঠে তাহার মালা গচ্ছিত রহিল। 
ইহার পর ভক্তটি রীতিমত পাগল হয়। সব মহারাজাদিগকে গালাগালি দিয়া পত্রাদি লিখিত। শ্রীশ্রীমাকেও কটুক্তিপূর্ণ পত্র লিখিত। তাহার নানা উৎপাতের জন্য সে মারও খাইয়াছিল।
এই ভক্তটির সম্বন্ধেই আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, সে কি মন্ত্রও ফেরত দিয়াছিল ? মালা তাে ছুড়ে মারল। মন্ত্র কি কখনও ফেরত দিতে পারে ?” 
মা—তা কি কখনও হয়? এ সজীব মন্ত্র। ও কি ফেরত হয় ? যে মন্ত্র একবার পেয়েছে—মহামন্ত্র। যাঁর (যে গুরুর) উপর একবার ভালবাসা হয়েছে, তা কি কখনও যায়? ও একদিন না একদিন, যখন প্রকৃতিস্থ হবে তখন এদের সবার পায়ে ধরবে।
আমি—মা, কেন এমন হয় ? 
মা—তা হয়ে থাকে। এক গুরুই কতজনকে মন্ত্র দেন, সবাই কি সমান হয় ? যে যেমন আধার তাতে তেমনি বিকাশ হয়। ও জয়রামবাটীতে বললে, ‘মা,আমায় পাগল করে দাও।' আমি বললাম, পাগল হবে কেন ? অনেক পাপ না হলে কি পাগল হয় ? বলে, ‘আমার ছােট ভাই ঠাকুরকে দর্শন করেছে, আমায়ও দেখিয়ে দাও।’ আমি বললাম, সাদা চোখে কে কবে দেখছে ? তবে চোখ বুজে দেখতে পারে। চোখ বুজলেও ছবি মনে পড়ে না ? ছেলেমানুষ, হয়তাে তাই দেখে ভাবছে ঠাকুর দেখছি। বললুম, তা তুমিও সাধনভজন কর, তাঁকে প্রার্থনা কর, তােমারও দর্শন হবে। মানুষ আপন মনে জানতে পারে সে কতদূর এগিয়েছে, কতদূর জ্ঞানচৈতন্য হয়েছে। অন্তরে অন্তরে বুঝতে পারে যে কতদূর তার ঈশ্বরলাভ হয়েছে। নতুবা সাদা চোখে কে দেখছে ?
‘উদ্বোধনে’ ধমক খাইয়া ভক্তটি বাগবাজারে গঙ্গার ধারে পড়িয়া থাকিত। কখনও বা উদ্বোধনের রোয়াকে বসিয়া থাকিত। আসিলে দুপুরে রোয়াকে বসিয়াই দুটি খাইয়া যাইত। এইভাবে কিছুদিন গত হইলে একদিন তাহাকে নানাপ্রকারে বুঝাইয়া রাজী করাইয়া শ্ৰীশ্রীমায়ের অনুমতিক্রমে ( উদ্বোধনে) তাঁহার নিকট লইয়া যাওয়া হইল। মা তাহাকে বুঝাইতে লাগিলেন, “ঠাকুর বলতেন, যারা আমাকে ডাকবে তাদের জন্য আমাকে অন্তিমে দাঁড়াতে হবে। এটি তাঁর নিজ মুখের কথা। তুমি আমার ছেলে, তােমার ভয় কি? তুমি কেন অমন পাগল হয়ে চলবে ? এতে যে তাঁর দুর্নাম হবে ! লােকে বলবে, তার ভক্ত পাগল হয়েছে। তােমার কি এমন করা উচিত, যাতে তার দুর্নাম হয় ? যাও, বাড়ি যাও, দশজনে যেমন আছে, বেশ খাও-দাও, থাক। যখন তােমার দেহ যাবে তখন তিনি দেখা দিয়ে নিয়ে যাবেন। কে তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখছে বল না? এক নরেন দেখেছিল। সেও যখন তার খুব ব্যাকুলতা—ঐ সব দেশে (আমেরিকায়)। তখন তিনি (ঠাকুর) তার হাত ধরে রয়েছেন, বােধ করত। তাও কিছুদিনের জন্য। বেশ, যাও, বাড়ি গিয়ে থাক। সংসারীদের কত কষ্ট । এই সেদিন রামের ছেলে মারা গেল। তােমরা ঘুমিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচ।” তারপর বলিলেন, “সেদিন আমি পূজা করছিলাম। পূজা করতে করতে দেখি এর মুখটি-ঝাঁকড়াঝাঁকড়া চুল, গােপালটির মতাে। সেইদিনেই খানিক পরে এসে উপস্থিত।”
মায়ের এই সকল উপদেশ ও সান্ত্বনায় ভক্তটিকে অনেকটা শান্ত দেখা গেল। সেদিন দুপুরে প্রসাদ পাইয়া সে দেশে চলিয়া গেল। বাড়ি গিয়া ক্রমশঃ প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল।

১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৮, জয়রামবাটী 

শ্রীশ্রীমা ৺রামেশ্বরদর্শনের পর কলিকাতায় কয়েকদিন অবস্থান করিয়া ৫ই জ্যৈষ্ঠ জয়রামবাটী পৌঁছিয়াছেন। পুরাতন বাড়িতে মায়ের ঘরের বারান্দায় সন্ধ্যার সময় কথা হইতেছে। মা জনৈক ভক্তের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। 
মা—সে কি বললে?
আমি—তাঁর প্রাণটা তােমার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়েছে তিন-চার মাস ধরে। 
মা—সে কি ? সাধু সব মায়া কাটাবে। সােনার শিকলও বন্ধন, লােহার শিকলও বন্ধন। সাধুর মায়ায় জড়াতে নেই। কি কেবল ‘মাতৃস্নেহ’ ‘মাতৃস্নেহ’ করে মায়ের ভালবাসা পেলুম না। ওসব কি ? বেটাছেলে সর্বক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে ফেরা-আমি ওসব ভালবাসি না। মানুষের আকৃতিটা তাে ? ভগবান তাে পরের কথা। আমাকে কুলের ঝি বউ নিয়ে থাকতে হয়। আশু, উপরে আনাগােনা করত, চন্দন ঘষা, এটি সেটি। আমি ধমকে দিলুম।
আমি—বেদান্তবাদী সাধু যারা, তারা সব কি নিবার্ণে যাবে ? 
মা—তা বইকি। মায়া কাটিয়ে কাটিয়ে নির্বাণ হবে-ভগবানে মিশে যাবে। বাসনা হতেই তাে দেহ। একটু বাসনা না থাকলে দেহ থাকে না। একেবারে নির্বাসনা হ’ল তাে সব ফুরাল।
“কোন ছেলে এল, খেলে দেলে, চলে গেল। মায়া কি? হাজরা ঠাকুরকে বলেছিল, ‘আপনি নরেন-টরেন ওদের জন্য অত ভাবেন কেন? তারা আপনার মনে খাচ্ছে দাচ্ছে, আছে। আপনি ভগবানের চিন্তায় মন স্থির করুন। আপনার আবার মায়া কেন ? ঠাকুর তার কথামত সব মায়া কাটিয়ে ভগবানে মন লীন করলেন। দাড়ির চুল, মাথার চুল এমনি (দেখাইয়া) সােজা হয়ে কাঁটা দিলে, কদমফুলের মতাে। একবার ভাব দেখি, সে লােকটি কি ছিলেন। ঠাকুর তখন বাহ্যে গিয়েছিলেন। রামলাল আর শৌচ করাতে পারলে না। কাকে শৌচ করাবে? সব শরীর জড়, কাঠ-শক্ত! তখন রামলাল বলতে লাগল, ‘যেমনটি ছিলে তেমনটি হও, যেমনটি ছিলে তেমনটি হও।' বলতে বলতে শেষে দেহে মন এল। দয়ায় মনকে নামিয়ে রাখতেন।
“যােগীন যখন দেহ রাখলে, নির্বাণ চাইলে। গিরিশবাবু বললেন, ‘দ্যাথ যােগীন, নির্বাণ নিসনি নিসনি। ঠাকুর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে, চন্দ্র সূর্ষে তাঁর চক্ষু-এত বড় ভাবিসনি। যেমন ঠাকুরটি ছিলেন, তেমনটি ভেবে ভেবে তাঁর কাছে চলে যা।
“দেবতা বল, যা বল—সব এসে পৃথিবীতে জন্মাচ্ছে। সুক্ষ্মদেহে তাে আর খাওয়া-পরা, কথাবার্তা কিছু নেই, তাই বেশী দিন থাকতে পারে না।”
আমি—খাওয়া-পরা কথাবার্তা নেই, তবে কি নিয়ে সময় কাটায় ?
মা—কাঠের পুতুলটির মতাে যুগযুগান্তর ধরে যেখানে আছে সেখানেই থাকে। রামেশ্বরে যেমন দেখলুম, রাজাদের সব পাথরের মূর্তি পােশাক পরা রয়েছে। আবার ভগবানের দরকার হয় তাে তিনি নিয়ে আসেন সেখান থেকে। বিভিন্ন দেবলােক সব আছে কিনা—জনলোক, সত্যলােক, ধ্রুবলােক। স্বামীজীকে সপ্তর্ষি থেকে এনেছিলেন, ঠাকুর বলেছেন। তাঁর কথা বেদবাক্য তাে, মিথ্যা হবার জো নেই। 
আমি—তবে আমাদেরও কি কাঠ-মাটির পুতুলের মতাে হয়ে থাকতে হবে ?
মা—না, তােমরা তাঁর সেবা করবে। দুটি থাক আছে। একটি এখানকার মতাে ভগবানের সেবাদি নিয়ে থাকে। অপরটি ঐ রকম পুতুলের মতাে যুগযুগান্তর ধরে ধ্যানমগ্ন।
আমি—মা, ঠাকুর বলতেন যে ঈশ্বরকোটি নির্বাণের (নির্বিকল্প সমাধির ) পরও ফেরে, আর কেউ পারে না, এর মানে কি ?
মা—ঈশ্বরকোটি নির্বাণের পরও মনটি গুছিয়ে আনতে পারে।
আমি—যে মন লীন হয়ে গেল, সে মন কি করে ফিরে আসে? একটি জল পুকুরে ফেলে দিলে কি করে সেই জলটুকুই বেছে আনবে ?
মা—সব্বাই পারে না। যাঁরা পরমহংস তাঁরা পারেন। হাঁস, জল দুধ একত্র করে দাও, দুধটুকু বেছে খাবে।
আমি—সবাই কি নির্বাসনা হতে পারে ? 
মা—তা পারলে তাে সৃষ্টি ফুরিয়ে যেত। পারে না বলেই তাে সৃষ্টি চলছে পুনঃপুনঃ জন্মাচ্ছে। 
আমি—যদি গঙ্গায় দেহত্যাগ হয় ?
মা—বাসনা ফুরুলেই হয়, নইলে কিছুতেই কিছু নয়। বাসনা না ফুরুলে শেষ জন্ম হলেই বা কি হবে?
আমি—মা, এই অনন্ত সৃষ্টিতে কোথায় কি হচ্ছে কে জানে ? এই যে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র, ওতে কোন জীবের বাস আছে কি না কে বলবে? 
মা—মায়ার রাজ্যে সর্বজ্ঞ হওয়া একমাত্র ঈশ্বরেই সম্ভবে। ওসব গ্রহ-নক্ষত্রে কোন জীবের বাস নেই।
এই বৎসর বর্ষাকালে একদিন পুজনীয় শরৎ মহারাজ, যােগেন-মাও কয়েকজন ভক্ত জয়রামবাটী হইতে কামারপুকুর গিয়াছেন। সেখানে আছাড় খাওয়ায় যােগেন মার শরীরের কয়েক স্থান হইতে রক্ত পড়িয়াছে। আমি পূর্বেই ফিরিয়া মাকে যােগেনমার কথা বলাতে মা দুঃখ করিয়া বলিলেন, “গােলাপ বলেছিল, ‘যােগেন যে যায়, দেখি কটা আছাড় খায়।’ তার এই কথাটির মানরক্ষার জন্য যােগেন এই আছাড়টি খেলে। সাধুবাক্য তাে? জপ তপ করে কিনা, না ফলে যায় না। তাই সাধুদের কাউকে কিছু বলতে নেই।”

১৬-১-১২ (২রা মাঘ, ১৩১৮)
উদ্বোধন মায়ের ঘর, সকালবেলা 

আমি বলিলাম, “মা, চৈতন্যদেব নারায়ণীকে আশীর্বাদ করলেন, ‘নারায়ণি, তােমার কৃষ্ণে ভক্তি হােক’। তিন-চার বছরের মেয়ে অমনি ‘হা কৃষ্ণ' বলে ধুলােয় গড়াগড়ি দিতে লাগল। একটি গল্প আছে যে নারদের সিদ্ধিলাভের পর একটা পিঁপড়ে দেখে হঠাৎ কি রকম দয়া এল। ভাবলেন, “আমার কত জম্ম তপস্যার পর তবে সিদ্ধিলাভ হল, আর এর মানুষ হতেই তাে কত দেরি।' দয়ায় পিঁপড়ে টাকে আশীর্বাদ করলেন, ‘মুক্ত হয়ে যাও, মুক্ত হয়ে যাও।' অমনি পিঁপেড়টা পক্ষী, পশু, ইত্যাদি ইতর জীব-দেহ ধারণ করে ক্রমে মানুষ হ’ল। মানুষদেহে অনেক জন্ম ভােগ ক'রে ক'রে ক্রমে তপস্যায় মন এল এবং ভগবানকে আরাধনা করে মুক্ত হল। এ সব অসংখ্য জন্মের খেলা নারদের চোখের সামনে যেন মুহূর্তমধ্যে হয়ে গেল। তা মহাপুরুষের কৃপা হলে তাে যখন তখন হয়।” 
মা—তা হয়।
আমি—তবে শুনেছি, অপরের পাপের বােঝা নিয়ে শরীর থাকে না। যে শরীর দ্বারা অনেকের উদ্ধার হত, সেই শরীর হয়তাে একজনের জন্যই ক্ষয় হয়। 
মা—হাঁ, তার শক্তিও কমে যায়। যে সাধন-তপস্যায় শক্তির দ্বারা অনেকের উদ্ধার হত তা একজনের জন্যই ক্ষয় হয়ে যায়। ঠাকুর বলতেন, “গিরিশের পাপ নিয়ে আমার শরীরে এই ব্যাধি।’ তা গিরিশও এখন ভুগছে।
আমি—মা, আমি একদিন স্বপ্ন দেখি যে একটা লােক, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, এসে তােমাকে খুব ধরে বসেছে, তুমি যাতে তাকে সদ্য সদ্যই কিছু করে দাও। সে তােমার কাছ থেকে পূর্বে মন্ত্র নিয়েছে। কিন্তু নিজে কোন সাধনভজন করবে না। তুমি বলছ, ‘একে যদি আমি এখন কিছু করে দিই, তা হলে আর আমি বাঁচব না, আমার দেহ থাকবে না। আমি দুহাতে তােমাকে নিষেধ করছি আর বলছি, ‘ওকে কেন করে দেওয়া? ও নিজে করতে পারবে, সাধন করুক।’ সে ঐরকম বারবার বলাতে তুমি যেন ত্যক্ত হয়ে তার বুক ও ঘাড় স্পর্শ করে কি করে দিচ্ছ এবং খানিক করতেই কেবল ঐ বলছ, ‘একে যদি আমি এখনি কিছু করে দি, তা হলে আমি আর বাঁচব না, আমার দেহ থাকবে না।' তখন স্বপন ভেঙে গেল। আচ্ছা, দেহধারণ করলে কি শক্তি সীমাবদ্ধ হয় ?
মা—হাঁ, তা হয়। এক একটা লোকের জ্বালায় ত্যক্ত হয়ে অনেক সময় মনে হয়, আর এ দেহ তাে যাবেই, তা যাক না এক্ষণি, দিয়ে দিই। এই যে রাধী রাধী করি, এ তাে একটা মোহ নিয়ে আছি। আমার পাগলা-টাগলাকে ভয় করে। আবার সেইটে আসে, না কি করে। তুমি (মঠে) চলে যাচ্ছ, ভয় হয়।
আমি—মা, ভগবান-দর্শন মানে কি জ্ঞানচৈতন্যলাভ? না আর কিছু? মা—জ্ঞানচৈতন্যলাভ না তো আর কি? নতুবা কি দুটো শিং বেরোয় ? 
আমি—এদের ( এখানকার অনেক ভক্তদের) ভগবান-দর্শন মানে অন্য রকম—তাঁকে চোখে দেখা, কথা বলা।
মা—’বাবাকে দেখিয়ে দাও, বাবাকে দেখিয়ে দাও’ বলছে। তিনি এত কারুর বাবা নন। ‘গুরু, কর্তা, বাবা’—এই তিনে তাঁর গায়ে কাঁটা বিঁধত। কত মুনি ঋষি যুগ-যুগান্তর তপস্যা করে পেলে না; তা সাধন নেই, তপস্যা নেই, এখনই দেখিয়ে দাও। আমি এত পারব না। তিনি কাকে দেখিয়ে দিয়েছেন বল না? 
আমি—আচ্ছা, মা, কেউ চাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। আবার কেউ চাচ্ছে মা, তাকে দিচ্ছেন—এ কথার মানে কি? 
মা—ঈশ্বর বালকস্বভাব কি না। কেউ চাচ্ছে, তাকে দিচ্ছেন না। আবার কেউ চায় না, তাকে সেধে দিচ্ছেন। হয়তাে তার পূর্বজন্মে অনেক এগুনো ছিল। তাই তার উপর কৃপা হয়ে গেল।
আমি—তা হলে কৃপাতেও বিচার আছে? 
মা—তা আছে বইকি। যার যেমন কর্ম করা থাকে। কর্ম শেষ হলেই ভগবান-দর্শন হয়। সেটি শেষ জন্ম।
আমি—মা, জ্ঞানচৈতন্যলাভ করতে হলে সাধন, কর্ম-ক্ষয়, সময়, এসব দরকার মানলুম। কিন্তু তিনি যদি আপন জন হন, তবে কি তিনি ইচ্ছা করলেই দেখা দিতে পারেন না?
মা—ঠিক কথা, তবে এ সুক্ষ্মটি তুমি যেমন ধরে বসেছ তেমনটি আর কে ধরে বসেছে ? সবাই ওটা একটা করতে হয় তাই করে যাচ্ছে; ঈশ্বরকে চায় ক'জনে? 
আমি—আমি তােমাকে আগে একদিন বলেছিলাম যে আপন মায়েরও যদি যত্ন স্নেহ না পায় তবে ছেলে মাকেও মা বলে জানে না।
মা—তা তাে ঠিক কথাই। দেখা না পেলে কোথা থেকে ভালবাসা হয় ? এই তােমার সঙ্গে দেখাটি হয়েছে—আমি তােমার মা, তুমি আমার ছেলে।

১২-১২, উদ্বোধন 

আজ রাত প্রায় সাড়ে নয়টার সময় মায়ের নিকট গিয়াছি। সমস্ত দিন যাই নাই দেখিয়া মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আজ কোথায় ছিলে?”
আমি—নীচে হিসাব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
মা—প্রকাশ তাই বলছিল। যে ত্যাগ করেছে তার কি আর ওসব ভাল লাগে? ঠাকুরের মাইনে নিয়ে হিসাবে কি গোল ছিল, কম দিয়েছিল। আমি খাজাঞ্চীকে বলতে বলায় বললেন, “ছি ছি! হিসাব করব?
“ঠাকুর এইটি আমাকে বলেছিলেন, “যে তাঁর নাম নেয়, তার কোন দুঃখ থাকে না; তা আবার তােমার (শ্রীশ্রীমার) কথা? এটি তাঁর নিজ মুখের কথা। তাঁর ত্যাগই ছিল ভূষণ।”

৮-২-১২, উদ্বোধন 

ঠাকুরঘরের পাশের ঘরটির উত্তরধারে মাদুর কিংবা কম্বল পাতিয়া দেওয়া হইত। মা সকালবেলা ঐখানটিতে অনেক সময় বসিতেন। কখনও একটু জপ করিতেন-পূর্ব মুখ হইয়া বসিয়া। আমরা যখন এই ঘরে মার সঙ্গে কথাবার্তা বলিতাম, তখন প্রায়ই এইখানে বসিতাম। আজও মা এই স্থানে বসিয়া আছেন।
আমি—মা, তুমি দক্ষিণেশ্বরে কত দিন ছিলে? 
মা—তা অনেকদিন ছিলাম। যােল বছরের সময় এসেছি। তদবধি বরাবর ছিলুম। মধ্যে মধ্যে বাড়ি যেতুম। রামলালের বিয়ের সময় গিছছুল। দু-তিন বছর অন্তর যেতুম।
আমি—একা থাকতে ? 
মা—কখনও কখনও একা ছিলাম। আমার শাশুড়ী থাকতেন। মধ্যে মধ্যে গােলাপ, গৌরদাসী এর সব থাকত। ঐটুকু ঘর, ওরই মধ্যে রান্না, থাকা, খাওয়া সব। ঠাকুরের রান্না হত—প্রায়ই পেটের অসুখ ছিল কি না, কালীর ভােগ সহ্য হত না। অপর সব ভক্তদের রান্না হত। লাটু ছিল ; রামদত্তের সঙ্গে রাগারাগি করে এল। ঠাকুর বললেন, এ ছেলেটি বেশ, ও তােমার ময়দা ঠেসে দেবে। দিনরাত রান্নাই হচ্ছে। এই হয়তাে রামদত্ত এল। গাড়ি থেকে নেমেই বলছে, আজ ছােলার ডাল আর রুটি খাব।' আমি শুনতে পেয়েই এখানে রান্না চাপিয়ে দিতুম। তিন-চার সের ময়দার রুটি হতাে। রাখাল থাকত; তার জন্য প্রায়ই খিচুড়ি হতাে। সুরেন মিত্তির মাসে মাসে ভক্তসেবায় দশ টাকা করে দিত। বুড়ো গােপাল বাজার করত। নাচ, গান, কীর্তন, ভাব, সমাধি দিনরাতই চলছে। সামনে বাঁশের চেটাইয়ের বেড়া দেওয়া ছিল। তাই ফুটোফুটো করে দাঁড়িয়ে দেখতুম। তাই তাে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে হাত ধরে গেল। 
 “যদুর মা বলে একটি ঝি কিছুদিন ছিল। এক বুড়ি আসত, পূর্বে অসৎ ছিল। এখন বুড়াে হয়েছে, হরিনাম করে। একাটি একাটি; তবু ও আসছে ওর সঙ্গে কথা কইতুম। একদিন ঠাকুর দেখে বললেন, ওটাকে এখানে কেন?” আমি বললুম ‘ও এখন ভাল কথাই তাে কয়, হরিকথা কয় ; তাতে দোষ কি? মানুষের তাে আর মনে সব সময় পূর্বভাব থাকে না। তিনি বললেন, “ছি ছি। বেশ্যা ওর সঙ্গে কি কথা? শত হােক, রাম রাম!' পাছে কুবুদ্ধি শিখায় এই ভয়ে তিনি ওসব লােকেদের সঙ্গে কথাটি পর্যন্ত কইতে নিষেধ করতেন। এত করে আমাকে রক্ষা করতেন।
“কামারপুকুরে একজন তাঁকে দেখতে এসেছিল। লােকটা ভাল নয়। সে চলে যাবার পর ঠাকুর বললেন, ‘ওরে, দে, দে, ওখানটার এক ঝোড়া মাটি ফেলে দে।’ কেউ ফেলতে না যাওয়ায় নিজেই কোদালটা নিয়ে ঠনঠন করে খানিকটা মাটি ফেলে দিয়ে তবে ছাড়লেন। বললেন, ‘ওরা, যেখানে বসে, মাটিসুখ অশুদ্ধ হয়।’
“বাঙাল-দেশীয় দুর্গাচরণ আসত। তার কি গুরুভক্তিই ছিল! ঠাকুরের অসুখের সময় তার জন্য তিন দিন খুঁজে খুঁজে আমলকী এনে দিলে। তিন দিন আহার-নিদ্রা নেই। একবার শালপাতে প্রসাদ দিলুম (বাগবাজারের গঙ্গার ধারের গুদামওয়ালা বাড়িতে)। পাতাসুদ্ধ খেয়ে ফেললে ! কাল, শুকনাে চেহারা - কেবল চোখ দুটি বড় আর উজ্জ্বল ছিল। প্রেমের চক্ষু, সর্বক্ষণ প্রেমাশ্রুতে ভেজা থাকত।
“তখনকার কত সব কেমন ভক্ত ছিল। এখন যারা আসছে, কেবল বলছে, ঠাকুর দেখিয়ে দাও।' সাধন নেই, ভজন নেই, জপ-তপ নেই, কত জন্মে কত কি করেছে—কত গােহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, ভ্রুণহত্যা করেছে ! সে সব ক্রমে ক্রমে কাটবে, তবে তাে ? আকাশে চাঁদটি মেঘে ঢেকেছে। ক্রমে ক্রমে হাওয়ায় মেঘটি 'সরে যাবে, তবে তাে চাঁদটি দেখতে পাবে। ফস করে কি যায় ? এও তাে তেমনি।
“ধীরে ধীরে কমক্ষয় হয়। ভগবানলাভ হলে ভেতরে ভেতরে তিনি জ্ঞানচৈতন্য দেন—নিজে জানতে পারে।”

৯-২-১২, উদ্বোধন 

গতরাতে গিরিশবাবু, দেহত্যাগ করিয়াছেন, সেই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, যারা মত্যুর পূর্বে অজ্ঞান হয়ে দেহত্যাগ করে, তাদের কি করে সদগতি হয়?
মা—অজ্ঞান হবার পূর্বে যে চিন্তাটি ছিল, যে চিন্তাটি নিয়ে অজ্ঞান হয়েছে, সেই চিন্তাটি অনুসারে গতি হয়।
আমি—হাঁ, গিরিশবাবুও সন্ধ্যা ছটার একটু পরে যে ‘জয় রামকৃষ্ণ, চল’ বলে -শুলেন, তারপর আর তেমন চৈতন্য হয় নাই। এর খানিকক্ষণ আগে কেবল ‘চল চল’ করছিলেন। ‘একটু, ধর না রে, বাপ’-এই সব। আমি বললুম, “কি আপনি কেবল ‘চল চল’ কচ্ছেন? আপনি এখন ঠাকুরের নাম করুন, যাতে ভাল হবেন।’ বার দুই আমি এই কথা বলাতে তিনি বললেন, ‘তা কি আর আমি জানি না?’ আমি ভাবলুম, বাবা, বুঝি ভেতরে ভেতরে হুশ রয়েছে।
মা—যে চিন্তাটি নিয়ে অজ্ঞান হ’ল, যেন ঐ চিন্তাটিতে ডুবে রইল। সব তাঁর কাছ থেকে এসেছে, তাঁর কাছে চলে যাবে। কেউ তাঁর বাহু হতে, কেউ পা হতে, কেউ লােম হতে হয়েছে—সব তাঁর অঙ্গ, অংশ।
গৌরমা উপস্থিত ছিলেন। তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, “ঠাকুর আর দুবার আসবেন বলেছেন। একবার বাউল সেজে।” 
মা—হাঁ, ঠাকুর বলেছিলেন, তােমার হুঁকোকলকে হাতে থাকবে। ভাঙা একটু পাথরের বাসন ঠাকুরের হাতে থাকবে। হয়তাে ভাঙা কড়ায় রান্না হবে। যাচ্ছেন তাে যাচ্ছেন—কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
“লক্ষী বলেছিল, ‘আমাকে তামাককাটা করলেও আর আসছি না।' তিনি হেসে বললেন, ‘আমি যদি আসি তাে থাকবে কোথা ? প্রাণ টিকবে না। কলমীর দল, এক জায়গায় বসে টানলেই সব আসবে।
‘বৃন্দাবনে রেল থেকে নামছি। ছেলেরা আগে নেমেছে। গােলাপ গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে দিচ্ছে। লাটুর হুকোকলকেগুলাে পড়ে ছিল, আমার হাতে দিয়েছে। লক্ষী বলছে, ‘এই তােমার হুকোকলকে ধরা হয়ে গেল।’ আমিও ‘ঠাকুর, ঠাকুর, এই আমার হুকোকলকে ধরা হয়ে গেল’ বলে ধূপ করে মাটিতে ফেলে দিয়েছি।”

২১-২-১২, উদ্বোধন, মায়ের ঘর 

মা চৌকির পার্শ্বে নীচে বসিয়া—সকাল সাতটা। স্বামী নির্ভয়ানন্দ দ্বারকাধাম গিয়াছেন। তিনি শ্রীশ্রীমাকে পত্র লিখিয়াছেন এবং গীর্ণারের দত্তাত্রেয়ের চাউল-প্ৰসাদ উহার মধ্যে পাঠাইয়াছেন। মাকে দিলে মা বলিতেছেন, “দত্তাত্রেয় কে?”
* গিরিশবাবুর গঙ্গায় যাইবার খুব ইচ্ছা হইয়াছিল। তাই ঐরুপ করিতেছিলেন। তাঁহার ভাতা অতুলবাবু বলিয়াছিলেন, “আমার ভাইকে আবার গঙ্গাযাত্রা।” আমি গিরিশবাবুর ইচ্ছা তখন বুঝিতে পারি নাই।
আমি—জড়ভরত, দত্তাত্রেয়—সেই ব্ৰক্ষর্ষি, ঈশ্বরকোটি।
মা—যেমন ঠাকুরের ছেলেরা? এরা সব ঈশ্বরকোটি না ? যােগীনকে অর্জুন বলতেন। স্বামীজীকে সপ্তর্ষি থেকে এনেছিলেন। বাবুরামকে নৈকষ্যকুলীন বলতেন। নিরঞ্জন, পূর্ণ, রাখাল।
আমি—বেলঘরিয়ার তারকবাবু ?
মা—হাঁ, ভবনাথ। ভবনাথকে নরেন্দ্রের প্রকৃতি বলতেন। শরৎকে কিছু বলতেন ?
আমি—জানি নে। বল না আর কে কি ? 
মা—কি জানি, আর জানি নে। শরৎকে ঈশ্বরকোটি বলেননি।
আমি—তুমি তো বলেছিলে, ‘শরৎ আর যােগীন (যােগানন্দ স্বামী) এ দুটি আমার অন্তরঙ্গ। আচ্ছা, ঈশ্বরকোটি কেউ কেউ সংসারে এমন হয়ে রয়েছে কেন ? স্ত্রী-পুত্র নিয়ে? 
মা—হাঁ, পচে মরছে ; পূর্ণকে জোর করে বিয়ে দিলে। বললে, ঠাকুরের ওখানে গেলে ইট পাটকেল মেরে তার গাড়ি ভেঙে দেব যখন কলকাতায় আসবেন।
আমি—বিয়েই নয় করলে। নাগ মহাশয়ও তাে বিয়ে করেছিলেন। এদের সব ছেলেপুলে, সংসার।
মা—হয়তাে বাসনা ছিল। কি জান? এ সৃষ্টির মধ্যে কত গােলমেলে (ব্যাপার)—ঠাকুর এটাকে দিয়ে সেটা করেন, হাড়ীর মাকে নিয়ে তাড়ীর মা, এটাকে দিয়ে সেটা কত কি!
পরে বলিতেছেন, “তা সংসার করলেও ঈশ্বরকোটি হতে পারে, তাতে দোষ কি?”
রাধুর অসুখ করিয়াছে—জর ও বেদনা। মা সেজন্য বড় চিন্তিত। বলিতেছেন, “আমি থাকতেই এর ভাল হ’ল না, তা এর পর কে আর ওকে দেখবে? তা হলে ও আর বাঁচবে কি?”
আমি—আর, যে ভক্তের ভিড় সমস্ত দিন! তোমার আর একটুও বিশ্রাম নেই।
মা—আমি তাে ঠাকুরকে দিনরাতই বলি, “ঠাকুর, এ সব কমিয়ে দাও, একটু বিশ্রাম পেতে দাও। তা হয় কই ? যে কদিন আছি এমনি হবে। এখন সব চারদিকে প্রচার হয়ে পড়েছে কিনা, তাই এত লােক। ব্যাঙ্গালােরে-বাপরে কত লােক। পথে রেল থেকে নামতে সব পুস্প বৃষ্টি হতে লাগল। এত উঁচু হয়ে গেল রাস্তা। ঠাকুরেরও শেষটায় কত লােক। আমি তাে এত বলি, ‘কুলগুরুর কাছে মন্ত্র নাও, তারা প্রত্যাশা করে। আমার তাে কিছু প্রত্যাশা নেই।' তা ছাড়ে না, কাঁদে। দেখে দয়া হয়। আর আমারও শেষ হয়ে এল। এখন যে কদিন আছি, এমনি হবেই।
আমি—না, না, তুমি এমন কথা কেন বলছ ? তােমার শরীর ভাল আছে। বিশেষ কোন কষ্ট তাে নেই। তবে কেন যেতে চাও? ও কথা বলে না।
এই সময়ে মায়ের মন কিছুদিন যাবৎ বড়ই উদাস ও বিষয় ছিল। 
নীচে গােলাপ-মা কাহারাে সহিত তর্ক করিতেছিলেন। 
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওখানে কি তর্ক হচ্ছে আবার ?” 
আমি—গােলাপ-মা কি বকছেন।
মা—কথায় মত্ত হওয়া ভাল নয়। মন্দটাই ভেবে ভেবে দুঃখ পেতে হয়। গােলাপের সত্য কথা বলতে বলতে চক্ষুলজ্জা ভেঙে গেছে। আমি তাে চক্ষু লজ্জা কিছুতেই ছাড়তে পারি না। “অপ্রিয় বচন সত্য কদাপি না কয়।”
আর একদিনও গােলাপ-মা এইরূপ একজনকে অপ্রিয় সত্য বলিয়াছিলেন। তাহাতে মা বলিলেন, “ও কি গােলাপ, এ তােমার কি রকম স্বভাব হচ্ছে ?”
দুপুরে একটা মাথা-পাগলা লোক মার কাছে আসিয়া ভারী গােলমাল করিয়াছিল। সেই কথায় মা বলিতেছেন, “তিনি (ঠাকুর) কাউকে জানতেও দেননি—কত সাবধানে রেখেছিলেন। এখন আবার তেমনি বাজারে ঢাক পিটিয়ে দিয়েছে। মাস্টারই এরুপ করলে, যত কথা ‘কথামৃতে’ ছাপিয়ে দিয়ে মাথা বিগড়ে দিয়েছে। গিরিশবাবু ঠাকুরের উপর ঐ রকম জোর, গালমন্দ করেছে কি না, তাই ওরাও অমন করতে চাচ্ছে। 
“আর, কি কেবল এখানেই মন্ত্র নেওয়া ! মঠে সব ছেলেরা আছে। তাদের কাছে মন্ত্র নিতে পারে না? তাদের কি শক্তি নেই ? সবাই আমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি এমন কথা পর্যন্ত বলেছি যে কুলগুরত্যাগে মহাপাপ হয়। তবু ফিরবে না।”
আমি—তুমি যে মন্ত্ৰ দাও, সে তাে ইচ্ছা করেই দাও।
মা—দয়ায় মন্ত্র দিই। ছাড়ে না, কাঁদে, দেখে দয়া হয়। কৃপায় মন্ত্ৰ দিই। নতুবা আমার কি লাভ? মন্ত্র দিলে তার পাপগ্রহণ করতে হয়। ভাবি, শরীরট তাে যাবেই, তবু এদের হােক।

২৪-৪-১২, উদ্বােধন, মায়ের ঘর 

দেড়টা বাজিয়াছে। দুপুরে খাওয়ার পর উপরে পান আনিতে গিয়াছি। শুনিলাম কাহারও সম্বন্ধে মা বলিতেছেন—
“স্বভাব ছাড়িতে নারে জীবের দায়, দায়। 
স্বভাব ছাড়িয়ে ভজে, ভক্তি তার পায়।” 
আমি—মা, এর মানে কি?
মা—মানুষ স্বভাব ছাড়তে পারে না। চৈতন্যদেব বলেছিলেন, ( পূর্ব) স্বভাব ছেড়ে যে আমার ভজনা করে, তাকে আমি ভজনা করি।
আমি—তুমি জয়রামবাটীতে সেই যে বলেছিলে, ‘স্বভাব বদলালে তাে হয়। আর একদিন বললে, কার কার প্রকৃতিটি এমন যে দেখলে ভালবাসতে ইচ্ছা করে, আবার কাউকে দেখলে কি রকম মনে হয়।’
মা–ঠিক বলেছ, বাবা। তাই তাে, স্বভাবই তাে সব। আর কি আছে ?
আমি—শরৎ মহারাজ গােলাপ-মার কথায় বলেছিলেন, “একটা ডাব দেবে তাে বাড়িসুদ্ধ চেঁচিয়ে বলবে। 
মা—হাঁ, এদের কি স্বভাব হয়েছে এখন। একটুতেই চেঁচিয়ে মেচিয়ে অস্থির করে। যােগেন আগে এমন ছিল, ধীর স্থির। এখন তা নেই। বাবা সহ্যগুণ বড় গুণ-এর চেয়ে আর গুণ নেই।
আমার বড় মাথা ধরিয়াছে। বৈকালে চারিটার সময় উপরে গিয়াছি। মাকে বলিলাম, “মা, বড় মাথা ধরেছে।” মা সব শুনিয়া বলিলেন, “বােধ হয় গরমে হয়েছে।” এই বলিয়া নিজে তাড়াতাড়ি গিয়া একটা পাতায় করিয়া খানিকটা ঘি ও কর্পুর জলে মিশাইয়া হাত দিয়া মাড়িতে মাড়িতে আনিয়া আমার সমস্ত কপালে মালিশ করিতে লাগিলেন। বলিলেন, “এ ওষুধ ঠাকুর লাগাতেন—তার যখন মাথা ধরত।” কয়েক মিনিট মালিশ করিবার পর আমারও একটু ভাল বােধ হইল! আমি নীচে আসিলাম। খানিক পরেই মাথাধরা ছাড়িয়া গেল। মাকে গিয়া বলিলাম, “মা, মাথাধরা থেমেছে।”
পােল্যান্ডের একটি মেম বেদান্তশিক্ষার জন্য ভারতবর্ষে আসিয়াছেন। কলিকাতায় শ্রীশ্রীমায়ের সংবাদ পাইয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। মেমটি মায়ের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা কহিলেন। তিনি ‘বাহাই’-সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করিয়া বলিলেন, উহাও শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষার অনুরুপ-সর্বধর্ম-সমম্বয়। কথায় মনে হইল মেমটি ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত। 
মেমটি চলিয়া গেলে মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই যে মেম এসেছিল, কেমন দেখলে ? 
মা—বেশ সব।
আমি—এরা কতদুর থেকে এসেছে। পােল্যাণ্ড রুশের রাজ্য। রুশজাপানে যুদ্ধ হয়েছিল না? সেই রুশের দেশ। 
মা—রুশিয়াদেশের লােক? ভয়ানক যােদ্ধার জাত! ধর্মশিক্ষার জন্য এদেশে এসেছে। লঙ্কায় তিন-চার মাস ছিল। 
আমি—এখন সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায় পােল্যান্ড, আর কোথায় ‘উদ্বোধন’ আফিস ! তোমার তাে মা ধারণাও নেই।
মা—ঠাকুর ভাবাবস্থায় বলেছিলেন, ‘এর পর ঘরে ঘরে আমার পূজা হবে। আমার যে কত লোক তার কুলকিনারা নেই।’ নিবেদিতা বলেছিল, 'মা, আমরাও বাঙালী। কর্মবিপাকে ওদেশে জম্মেছি। তা দেখবে আমরাও এমন বাঙালী হয়ে যাব যে ঠিক ঠিক।’ ওদের (নিবেদিতা প্রভৃতির) এই শেষ জন্ম।

১৯শে বৈশাখ, ১৩১৯, উদ্বোধন, ঠাকুরঘর, সকাল সাতটা 

শ্ৰীযুক্ত সুরেন্দ্র চক্রবর্তী কয়েকদিন পূর্বে সস্ত্রীক শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। পরে একদিন তিনি একা আসিয়াছেন। মাকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেদিন ওটিকে (স্ত্রীকে) কেমন দেখলেন ?” মা বলিলেন, “বেশ ভাল।”
সুরেনবাবু—আমার কিন্তু ভাল লাগে না। 
মা—তােমাদের এখন ঐ এক ভাব হয়েছে। 
সুরেনবাবু—মা, আমরাই কেবল ঠাকুরের দর্শন পেলুম না।
মা—পাবে বইকি। তােমাদের এই শেষ জন্ম। নিবেদিতা বলেছিল, 'মা, আমরাও বাঙালী, কর্মের ফেরে প্রীষ্টান হয়ে জন্মেছি।’ ওদেরও এই শেষ জন্ম।
মা এইরুপ মাঝে মাঝে অনেকের শেষ জন্ম বলিতেন। তাই মনে করিয়া আজ তাঁহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, ‘শেষ জন্ম' কথাটার মানে কি? ঠাকুর অনেকের শেষ জন্ম বলেছেন, তুমিও বলছ।” 
মা—শেষ জন্ম মানে—তার আর যাতায়াত হবে না, এই জন্মেই শেষ হয়ে গেল। আমি—এদের তাে অনেকের বাসনা আছে দেখা যায়-সংসার, ছেলেপুলে, পরিবার। বাসনা না গেলে কি করে যাতায়াত ফুরুবে ? 
মা—তা তিনি (ঠাকুর) যাকে যা বলেছেন সব সত্য তাে। মিথ্যা তাে হবার জা নেই। এখন বাসনা থাকুক, আর যাই করুক, তিনি দেখেছেন শেষে তা থাকবে না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
আমি—তা হলে শেষ জন্ম মানে কি নির্বাণ ? 
মা—তা বইকি। হয়তাে দেহ যাবার সময় মন নির্ব্বাসনা হবে।
আমি—মা, ঠাকুর অনেককে আপনার জন বলেছেন, এর মানে কি ? 
মা—ঠাকুর বলতেন, তারা কেউ শরীর থেকে, কেউ লােমকুপ থেকে, কেউ হাত-পা থেকে বেরিয়েছে। তারা সব সঙ্গের সঙ্গী।’ যেমন যখন রাজা কোথাও যায়, সব সঙ্গের লােকজন তথায় যায়। আমি যদি জয়রামবাটী যাই, আমার সঙ্গের যারা তারা সব যাবে না। তেমনি যারা আপনার, তারা সব যুগে যুগে সঙ্গী। ঠাকুর বলতেন, যারা অন্তরঙ্গ তারা ব্যথার ব্যথী।’ এই সব ছেলেদের দেখিয়ে বলতেন, “এরা আমার সুখে সুখী, দুঃখে দুখী, ব্যথার ব্যথী।' তিনি যখন আসেন, তখন সব হাজির। নরেনকে সপ্তর্ষি থেকে এনেছিলেন তাও সবটা আসেনি। শম্ভু মল্লিককে মা কালীর পেছনে দেখেছিলেন-দক্ষিণেশ্বরে কালীঘরে ধ্যান করবার সময়। বলরামবাবুকে যেমন চেহারা অমনি দেখেছিলেন। প্রথম দেখাতেই বলেছিলেন, 'ঠিক অমনি দেখেছি, মাথায় পাগড়ি, গৌরবর্ণ।’ আর সুরেন মিত্তির। বলতেন, এই তিনজন রসদদার।’ একদিন ঠাকুর বললেন, ‘ওর মা কালীকে ভােগ নিবেদন না করে ছবিকে ( ঠাকুরের ছবিকে) কেন দিলে?* আমরা অকল্যাণ হবে বলে মনে মনে ভয় পেলুম। ঠাকুর বললেন,ওগাে, তােমরা কিছু ভেবাে না-এর পর ঘরে ঘরে আমার পূজা হবে। মাইরি বলছি-বাপান্ত দিব্যি।’

* একবার কতকগুলি ভক্ত মিষ্টান্নাদি লইয়া দক্ষিণেশ্বরে যায়। গিয়া দেখে ঠাকুর সেখানে নাই। তখন তিনি চিকিৎসা কাশীপুরে আছেন। ভক্তেরা সেই সব দ্রব্য ঠাকুরের ছবির সামনেই দিয়া প্রসাদ গ্রহণ করে।

“এত করে বলা আবার কার জন্য? না আমার আর লক্ষীর জন্য। আমাদের তখন অল্প বয়স। অত কি বুঝি?
“এখনকার লােক সব সেয়ানা—ছবিটি তুলে নিয়েছে। এই যে মাস্টার মশায়—এরা কি কম লােক গা? যত কথা সব লিখে নিয়েছে। কোন অৰতারের ছবি আছে, বা কথাবার্তা এই রকম করে লেখা আছে?” 
আমি—'কথামৃত’ সম্বন্ধে মাষ্টার মশায় বলেছিলেন যে দশ-বার খণ্ড বেরুলে তবে সব কথা বের হতে পারে। তা এত কথা আর কবে বের হবে ?
মা—হাঁ, বয়েস হয়েছে, হয়তাে পূর্বেই বা সরে পড়লে।
আমি—মা, তুমি যে আমাকে জয়রামবাটীতে বলেছিলে, ঠাকুর শ্বেতকায় ভক্তদের ভেতর আসবেন। না কি ?
মা—না, তাঁর অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আসবে, তাই বলেছি। যেমন এখন সব খ্রীষ্টানরা আসছে না? ঠাকুর বলেছিলেন যে একশো বছর পর আবার আসবেন। এই একশ বছর ভক্ত হৃদয়ে থাকবেন। গােল বারান্দা হতে বালি, উত্তরপাড়ার দিকে দেখিয়ে বলছিলেন। আমি বললুম, ‘আমি আর আসতে পারব না।' লক্ষী বলেছিল, ‘আমাকে তামাককাটা করলেও আর আসব না।' ঠাকুর হেসে বললেন, ‘যাবে কোথা ? কলমীর দল, এক জায়গায় বসে টানলেই সব এসে পড়বে।'
“আর এত কথারই বা দরকার কি? ঠাকুর বলতেন, “আম খেতে এসেছ, আম খেয়ে যাও। অত পাতা ডাল গুণে কি হবে?” 
আমি—কিন্তু মা, কিছু প্রত্যক্ষ না দেখলে কি করে কি হবে? একবার এক মুসলমান ফকিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘পুকুরে কি নদীতেই লােকে মাছের আশায় ছিপ ফেলে বসে, গােপদের জলে তাে মাছ ধরবার জন্য ছিপ ফেলে বসে না ! কিছু টের পেয়েছেন কি, যার আশায় ফকির হয়েছেন? 
মা—সে কি বললে? 
আমি—কি আর বলবে?
এই কথা শুনিয়া মা ঐ বিষয়ে একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “ঠিক কথা, তাই তাে। কিন্তু উপলদ্ধি না হলে কি করে কি হবে? তবে বিশ্বাস করে যেতে হয়।”
আমি—শরং মহারাজ সেদিন বললেন এবং স্বামীজীও বলেছিলেন, ‘মনে কর পাশের ঘরে একতাল সােনা রয়েছে। একটা চোর এ পাশের ঘর থেকে তা জানতে পেরেছে। মাঝে দেয়াল, তাই নিতে পারছে না। সে লােকটার কি আর ঘুম আসবে? সব সময় ঐ ভাববে—কি করে সােনার তালটা নিতে পারবে। তেমনি এহেন ঈশ্বর বলে কেউ আছেন, এ যদি মানুষ ঠিক ঠিক বুঝতে পারত, তাহলে কি আর এই সব সংসার-ফংসার করতে পারত? 
মা—সে তাে ঠিক কথাই।। 
আমি—যাই বল মা, ত্যাগ-বৈরাগ্যই প্রধান। আমাদের কি হবে না ?
মা—হবে বই কি। ঠাকুরের শরণাগত হলে সব হয়। তাঁর ত্যাগই ছিল ঐশ্বর্য। তিনি ত্যাগ করেছিলেন বলে এখন আমরা সব তাঁর নামে খাচ্ছি দাচ্ছি। লােকে ভাবে, তিনি এত বড় ত্যাগী ছিলেন, তার ভক্ত এরা না জানি কত বড় হবে। 
“আহা, একদিন খেয়ে নবতের ঘরে গেছেন। বেটুয়ায় মসলা ছিল না। দুটি যােয়ান মৌরি খেতে দিলুম, আর দুটি কাগজে মুড়ে হাতে দিলুম, বললুম, নিয়ে যাও।' তিনি নহবতের ঘর থেকে ঘরে যাচ্ছেন। কিন্তু ঘরে না গিয়ে সােজা দক্ষিণদিকের নহবতের কাছের গঙ্গার ধারের পােস্তায় চলে গেছেন—পথ দেখতে পান নি, হুশও নেই। বলছেন, ‘মা’, ডুবি ? মা, ডুবি?' আমি এদিকে ছটফট করছি -ভরতি গঙ্গা। বউ মানুষ, বেরুই না, কোথাও কাউকে দেখিও না। কাকে পাঠাই ? শেষে মা কালীর একটি বামুন এদিকে এল। তাকে দিয়ে হৃদয়কে ডাকালাম। হৃদয় খেতে বসেছিল, তাড়াতাড়ি এঁটো হাতেই দৌড়ে একেবারে ধরে তুলে নিয়ে এল। আর একটু হলেই গঙ্গায় পড়ে যেতেন।”
আমি—দক্ষিণমুখাে কেন গেলেন?
মা—হাতে দুটি যােয়ান দিয়েছিলুম কিনা। সাধুর সঞ্চয় করতে নেই, তাই পথ দেখতে পান নি। তাঁর যে যােল আনা ত্যাগ।
“পঞ্চবটীতে এক বৈষ্ণব সাধু এসেছিল। প্রথমটায় তার বেশ ত্যাগ ছিল। আহা, শেষে ইদুরের মতাে টেনে হিঁচড়ে ক্রমে ঘটিটি, বাটিটি, হাঁড়ি, কলসী, চাল, ডাল, এসব গােছাতে লাগল। ঠাকুর একদিন তাই দেখে বললেন, যাঃ রে, এবার মারা পড়বে।'—কিনা মায়ায় বন্ধ হতে চলল। ঠাকুর তাকে খুব ত্যাগের উপদেশ দিলেন, আর সে স্থান ছেড়ে যেতে বললেন। তবে সে পালাল।”
জনৈক ভক্ত প্রণাম করিতে আসিয়াছিলেন। প্রণাম করিয়া যাইবার পর মা বলিতেছেন, “আমি একবার ঠকেছি কি না সেই হরিশকে আদর কয়ে। তাই এখন আর যত্ন স্নেহ কাউকে দেখাই না।”

১৫-১২, বৈশাখী পূর্ণিমা, উদ্বোধন 

সকালবেলা মায়ের চিঠি পড়িয়া শুনাইতে গিয়াছি। মা তাঁহার ঘরের দক্ষিণপাশের ঘরে উত্তরদিকে দরজার নিকট বসিয়া। আমি ঠাকুরঘর হইতে পড়িয়া মাকে কি একটা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। মা বলিলেন, “এদিকে এসে বসে কথা বল।” আমি গিয়া বসিলাম। 
আমি—এক ভক্তের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি লিখেছে আসবে বলে। প্রণাম জানিয়েছে। সে যে চিঠি লিখেছে এ কথা যেন তার শ্বশুরবাড়িতে না জানে। 
মা—থাক, তবে আর জবাব দিয়ে কাজ নেই। আবার বাড়িতে জানবে না। আমি অত লুকোচুরি জানি নে। জয়রামবাটীতে যােগেন্দ্র (পিয়ন) চিঠির জবাব লিখে দিত। অনেকে বলত, “পিয়ন চিঠি পড়ে?'—কিনা যাকে তাকে দিয়ে চিঠি পড়ান। কেন? আমার কাছে কোন কপট কিছু, তাে নেই? আমার চিঠি যে ইচ্ছা সে দেখবে। এক ভক্ত লিখিয়াছে, মা কবে জয়রামবাটী যাইবেন। আমি মাকে বলিলাম, “লিখে দিই, অগ্রহায়ণ মাসে যাবেন—জগদ্ধাত্রী পূজার সময়।”
মা—না, না, ওসব কি ঠিক বলা যায় ? কখন কোথায় থাকি ; সব তাঁর হাত। মানুষ এই আছে, এই নাই। 
আমি—না, তুমি অমন কেন বলছ ? তুমি আছ বলে এত লােক আসছে, শান্তি পাচ্ছে।
মা—তাই তাে। 
আমি—তুমি আমাদের জন্য থাক।
মা করুণস্বরে ভক্তদের জন্য কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিতেছেন, চক্ষে জল,-“আহা, এরা আমাকে যত ভালবাসে আমিও এদের তত ভালবাসি।” আমি হাওয়া করিতেছিলাম। করুণকণ্ঠে বলিলেন, “আশীর্বাদ করি বাবা, বেঁচে থাক, ভক্তি হােক, শান্তিতে থাক—শান্তিই প্রধান, শান্তিই চাই।”
আমি—মা, এইটিই কেবল আমার মনে জাগে-ঠাকুরের কেন দেখা পাই না? তিনি যখন আপনার জন, আর ইচ্ছা করলেই দেখা দিতে পারেন, তখন কেন তিনি দেখা দেন না ?
মা—তাই তাে, এত দুঃখকষ্টেও যে কেন তিনি দেখা দেন না, কে জানে ? রামের মার (বলরামবাবুর স্ত্রীর) অসুখ হয়েছিল। ঠাকুর আমায় বললেন, ‘যাও, দেখে এসগে।’ আমি বললুম, ‘যাব কিসে? গাড়ি টাড়ি নেই।' ঠাকুর বললেন, “আমার বলরামের সংসার ভেসে যাচ্ছে আর তুমি যাবে না? হেঁটে যাবে। হেঁটে যাও।' শেষে পালকি পাওয়া গেল। দক্ষিণেশ্বর থেকে আসলুম। দুবার এসেছিলুম। আর একবার—তখন আমি শ্যামপুকুরে রাত্রে হেঁটে রামের মার অসুখ দেখতে আসলুম। দেখ, সেই বলরামের পৌত্র কি সময়ে (নিতাইবাবুর মার শ্রাদ্ধদিনে) মারা গেল। একদিনও কি আগ পাছ হতে নেই ? তিনি যদি এ বিপদে না দেখবেন, না দেখা দেবেন, তবে মানুষ যাবে কোথা? 
আমি—দুঃখকষ্ট শরীরধারণ করলে আছেই। তাকে দুঃখ দূর করতেও বলি না। কিন্তু তিনি কি দুঃখকষ্টে  দেখা দিয়ে প্রবােধ দিতেও পারেন না।
মা—আহা, তাই তাে। এই রামের মা, রামের বউ, এরা আসল। ভাবলে যাই, মায়ের কাছে যাই। এখানে এসে তবু খানিকটা শান্তি পেলে। তাই তাে ঠাকুরকে বলতুম। তিনি বলতেন, “আমার লাখ লাখ আছে। আমার তা ( জিনিস) আমি পেছন দিকে কাটব, ন্যাজে কাটব, মারব।’
আমি—আমরা যে কষ্ট পাই তা তিনি দেখবেন না ?
মা—তা তােমার মত কত আছে তাঁর। তিনি বলতেন, “চিদানন্দসিন্ধু’ এমন কত উঠছে, কত ডুবছে, কুলকিনারা নেই।
আমি—মা, যারা এমনিভাবে এই ডালগােলার লোকগুলির মতাে আছে (তখন ‘উদ্বোধনের’ সামনে ডালগােলা ছিল।) তারা বেশ আছে। কিন্তু মা, যাদের খানিক হুশ হয়েছে, যারা তাঁকে চায়, তারা যদি দেখা না পায় তাদের যে কি কষ্ট, তারাই জানে।

১. রামবাবুর এই একমাত্র পুত্র মারা যাইবার পর তাঁহারা সান্ত্বনা পাইয়া চলিয়া গেলে মা আমাকে বলিলেন, “পেটের ছেলে, রক্তমাংসের শরীর থেকে বেরােয়, তাই এত মায়া। মাগুলােয় যত কষ্ট। মায়া কি করে যাবে?"

মা—হাঁ, তাই তাে। ওরা বেশ আছে। খাচ্চে দাচ্চে, আছে। ভক্তদেরই যত কষ্ট।
আমি—তােমার কি এদের ( ভক্তদের) দুঃখকষ্ট দেখে কষ্ট হয় না? 
মা—আমার কি কষ্ট ? যাঁর জগৎ তিনিই দেখছেন। 
আমি—ভক্তদের জন্য তােমার আসতে ইচ্ছা হয় না? 
মা—দেহধারণে যা কষ্ট! আর না, আর না—আর যেন আসতে না হয়। ঠাকুরের অসুখের সময় দুর্গাচরণ, তিন দিন খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, খুঁজে খুঁজে আমলকী আনলে। ঠাকুর খেতে চেয়েছিলেন। ঠাকুর তাকে প্ৰসাদ করে দিতে গিয়ে ভাত বেশ এত কটা খেলেন। বললুম, এই তাে বেশ খাচ্ছ, তবে আর সুজি খাওয়া কেন? ভাত দুটি দুটি খাবে।' ঠাকুর বললেন, “না, না, শেষ অবস্থায় এই আহারই ভাল।’ এক একদিন নাক দিয়ে, গলা দিয়ে সুজি বেরিয়ে পড়ত—অসহ্য কষ্ট হত। আহা, তারকেশ্বরে বাবার কাছে হত্যা দিতে গেলুম, তাতেও কিছু হ’ল না। একদিন যায়, দুদিন যায়, পড়েই আছি। রাতে একটা শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম—যেমন অনেকগুলো হাড়ি সাজান থাকলে তার উপর ঘা মেরে যদি কেউ একটা হাঁড়ি ভেঙে দেয়, সেই রকম শব্দ। জেগেই হঠাৎ আমার মনে এমন ভাব এল, ‘এ জগতে কে কার স্বামী? এ সংসারে কে কার? কার জন্য আমি এখানে প্রাণহত্যা করতে বসেছি ?’—একবারে সব মায়া কাটিয়ে এমনি বৈরাগ্য এনে দিলে ! আমি উঠে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে মন্দিরের পিছনে কুণ্ড থেকে স্নানজল নিয়ে চোখে মুখে দিলাম, খানিকটা খেলুম—পিপাসায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, না খেয়ে পড়েছিলুম কিনা। তবে প্রাণ একটু সুস্থ হ'ল। তার পরদিনই চলে আসি। আসতেই ঠাকুর বললেন, “কিগো, কিছু হ’ল?—কিছুই না!' ঠাকুরও স্বপ্নে দেখেন ওষুধ আনতে হাতী গেল। হাতী মাটি খুঁড়ছে ওষুধের জন্য। এমন সময় গােপাল এসে স্বপ্ন ভেঙে দিলে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি স্বপ্নটপ্ন দেখ ?
“দেখলুম, মা কালী ঘাড় কাত করে রয়েছেন। বললুম, ‘মা, তুমি কেন এমন করে আছ?' মা কালী বললেন, 'এর ঐটের জন্য (ঠাকুরের গলার বা দেখিয়ে), আমারও হয়েছে।' ঠাকুর বললেন, ‘যা ভোগ আমার উপর দিয়েই হয়ে গেল। তােমাদের আর কারুকে কষ্ট ভােগ করতে হবে না। জগতের সকলের জন্য আমি ভােগ করে গেলুম।’ গিরিশের পাপ নিয়ে এই ব্যাধি। তা গিরিশও শেষটায় ভুগলে।
“যত ভােগ, সব এখানেই তাে (পৃথিবীতে) হচ্ছে। আর কোথায় কি ? ভুগে ভুগে, ঢাক ঢােল সব বাজিয়ে শেষে ধুনুরীর হাতে পড়ে তবে তুঁহু, তুঁহু ডাক ছাড়ে।”
আমি—তা এর পর কি আর তােমার আমাদের মনে থাকবে?
মা—সেখানের আনন্দ পেলে হয়তাে এ মনে থাকবে না। বাবা, কালই প্রধান। কালবেশে কি হবে কে জানে?
আমি—কালবশেও হচ্ছে, আবার কালজয়ীও তাে আছে? 
মা—হাঁ, তাও আছে। 
আমি—মা, তুমি সুস্থ থাক, তবেই তাে হয়।
আটটা বাজিয়াছে। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আটটা কি বেজেছে ? বােধ হয় বেজেছে। যাই, বাবা, পুজো করতে যাই।”
এই বলিয়া উঠিতেছেন ও বলিতেছেন, “আর, বাবা, আশীর্বাদ কর, যাতে সুস্থ থাকি।” 
পূজা হইয়া গেলে মায়ের চিঠি পড়িয়া শুনাইতে গিয়াছি। তাঁহার কৃপাপ্রাপ্ত জনৈক ভক্তের কাশীলাভ হইয়াছে। শুনিয়া মা বলিলেন, “মরতে তাে হবেই একদিন। কোথায় কোন পুকুরপাড়ে ডোবায় মরত—তা না হয়ে কাশীলাভ হল।”
মামাদের পত্রে অর্থের আকাক্ষা ও ঝগড়া-বিরােধের কথা আছে। আমি বলিলাম, “তাদের খুব ক'রে টাকা দাও। ঠাকুরকে বল। বেশ ভােগ করুক, যাতে নিবৃত্তি হয়।”
মা—ওদের কি আর নিবৃত্তি আছে ? ওদের কিছুতেই নিবৃত্তি হবে না। শত দিলেও না। সংসারী লােকদের কি আর নিবৃত্তি হয় ? 
“ওদের ওখানে কেবল দুঃখের কাহিনী। কেলেটাই কেবল টাকা টাকা করে। আবার ওর দেখাদেখি প্রসন্নও এখন করছে। বরদা কখনও চায় না, বলে-দিদি কোথায় টাকা পাবে?
আমি—পাগলীও না। 
মা—তাকে দিলেও নেয় না।
আমি—ওঁদের ওখানে কেন জন্ম নিলে ?
মা—কেন? আমার বাপ মা বড় ভাল ছিলেন। বাবা বড় রামভক্ত ছিলেন। নৈষ্ঠিক, অন্য বর্ণের গ্রহণ করতেন না। মায়ের কত দয়া ছিল। লােকদের কত খাওয়াতেন, যত্ন করতেন, কত সরল। বাবা তামাক খেতে খুব ভালবাসতেন। তা এমন সরল অমায়িক ছিলেন যে, যে কেউ বাড়ির কাছ দিয়ে যেত, ডেকে বসাতেন, আর বলতেন, ‘বস ভাই, তামাক খাও।' এই বলে নিজেই ছিলিম ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াতেন। বাপ মায়ের তপস্যা না থাকলে কি (ভগবান) জন্ম নেয় ?

২৫-৬-১২, উদ্বোধন 

ঠাকুরঘরের পাশের ঘরে মায়ের তত্ত্বাপোশের নিকটেই বসিয়া সকালবেলা কথা হইতেছে।
আমি—মা, এই যে কেউ কেউ বলেন, মঠের সেবাশ্রম, হাসপাতাল, বইবেচা, হিসাব-নিকাশ প্রভৃতি সাধুরা যে করছে, এ ভাল নয়। ঠাকুর কি এসব কিছু করেছিলেন। নুতন নূতন যারা ব্যাকুলতা নিয়ে মঠে ঢুকছে, তাদের ঘাড়ে এই সব কর্ম চাপিয়ে দিচ্ছে। কর্ম করতে হয়তাে পূজা, জপ, ধ্যান, কীর্তন-এই সব করবে। অন্য সব কর্ম বাসনা জড়িয়ে ঈশ্বর থেকে বিমুখ করে।
মা—তােমরা ওদের কথা শুনো না। কাজ করবে না তো দিনরাত কি নিয়ে থাকবে? চব্বিশ ঘণ্টা কি ধ্যানজপ করা যায় ? ঠাকুরের কথা বলছে—তাঁর আলাদা। আর তাঁর মাছের ঝােল, ঘিয়ের বাটি মথুর যােগাত। এখানে একটি কাজ নিয়ে আছ বলে খাওয়াটি জুটছে। নইলে দুয়ারে দুয়ারে কোথায় একমুঠোর জন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। শরীরে অসুখ হয়ে পড়বে। আর কেই বা এখন সাধুদের এত ভিক্ষা দিচ্ছে ? তােমরা ওসব কথা কিছু শুনাে না। ঠাকুর যেমন চালাচ্ছেন তেমনি চলবে। মঠ এমনিভাবেই চলবে। এতে যারা পারবে না তারা চলে যাবে।
“মণি মল্লিক সাধু, দেখে এসে ঠাকুরকে বললে। ঠাকুর বললেন, “কি গাে, কেমন সব সাধু দেখলে ? সে বললে, ‘হাঁ, দেখলুম তাে, তবে।' ঠাকুর বললেন, “তবে কি ?' মণি মল্লিক বললে, ‘সব্বাই পয়সা চায়।' ঠাকুর বললেন, “কি আর পয়সা চায়? হয়তাে একটা পয়সা, গাজা কি তামাক খাবে—এই পর্যন্ত। তােমার বিয়ের বাটি, দুধের বাটি, গদি—এ সব চাই। আর তার একটা আধটা পয়সা মাত্র—হয়তাে একটু তামাক কি গাঁজা খাবে। এও চাই নে ? সব ভােগ তােমারই করবে? আর তারা এক পয়সার তামাকও খাবে না?
আমি—বাসনা থেকেই ভােগ। চৌতলা বাড়িতে বাস করলেও যার বাসনা নেই তার কিছুই না। আর গাছতলায় বাস করেও বাসনা থাকলে ঐ থেকেই সব ভােগ এসে পড়ে। ঠাকুর বলতেন, ‘মহামায়ার এমনি খেলা যে, যার তিন কুলে কেউ নেই তাকে দিয়েও একটা বেরাল পুষিয়ে সংসার করাবে।’
মা—তাই তো; বাসনা থেকেই সব। বাসনা না থাকলে কিসের কি ? এই যে আমি এসব নিয়ে আছি, কই, আমার তাে কোন বাসনা হয় না—কিছুই না। 
আমি—তা তােমার আবার বাসনা কি ? মা, আমাদের ভেতরে কত কি তুচ্ছ বাসনা উঠছে, এসব কি করে যাবে ? 
মা—তােমাদের ওসব কোন বাসনা নয়। ও কিছু নয়। মনের খেয়ালে অমনি উঠছে, যাচ্ছে। ওসব যত বেরিয়ে যায় তত ভাল।”*
আমি—কাল বসে বসে ভাবছিলুম যে ঈশ্বর যদি রক্ষা না করেন তাে কাঁহাতক মনের সঙ্গে লড়াই করা যায়? এক বাসনা যাচ্ছে তাে অন্য বাসনা উঠছে।
মা—যতক্ষণ ‘আমি’ রয়েছে ততক্ষণ বাসনা তাে থাকবেই। ওসব বাসনায় তােমাদের কিছু হবে না। তিনিই রক্ষা করবেন। যে তাঁর শরণাগত, যে সব ছেড়ে তাঁর আশ্রয় নিয়েছে, যে ভাল হতে চায়, তাকে তিনি যদি রক্ষা না করেন, সে তাে তাঁরই মহাপাপ। তাঁর উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। তিনি ভাল করতে হয় করুন, ডােবাতে হয় ডােবান। তবে ভাল কাজটি করে যেতে হয় আর তাও তিনি যেমন শক্তি দেন।
আমি—আমার কি সেই নির্ভর আছে ? হয়তাে খানিকটা নির্ভর আসে, আবার তা চলে যায়। তিনি যদি নিজে রক্ষা না করেন তাে উপায় কি ? মনে ভাবি, এখন মা, তুমি আছ, আপদ হােক, বিপদ হােক, এসে তােমার কাছে বলি,তােমার মুখ চেয়ে শান্তি পাই। এর পর কে রক্ষা করবে ? তুমি যদি ফিরে চাও, তবে তাে হয় ?

*জনৈক ত্যাগী ভক্ত একবার মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, 'মা, সাধন-ভজন তাে করা যাচ্ছে, চেষ্টাও কম করছি না, কিন্তু মনের আবর্জনা যেন কমছে না।” মা বলিলেন, 'নাটাইতে সুতে যেভাবে গুটিয়েছে- লাল সুতো,কাল, সাদা - খোলবার সময় তেমনি করে করে খুলবে তো?”

মা—ডয় কি বাবা ? তােমার কোন ভয় নেই। তােমাদের সংসার, পরিবার, ছেলেপুলে—এসব তাে কিছু হবে না, তােমাদের ভয় কি ? আর এর মধ্যে, আমি থাকতেই তােমরা তৈরী হয়ে যাবে।
আমি—ভাবি, ঈশ্বর যদি ফিরে না চান তাে জপতপেই বা কি হবে ? তিনি যদি রক্ষা করেন, তবেই রক্ষা।
মা—না, তোমার কোন ভয় নেই। তিনি রক্ষা করবেন। তুমি কিছু, ভেবাে না।

৭-৭-১২, উদ্বােধন 

আমি—মা, তুমি রথযাত্রার সময় জগন্নাথ যাবে, কথা ছিল না?
মা—এখন এত লােকের ভিড়ের মধ্যে যেতে আছে ? কলেরা টলেরা হবে। লক্ষীকান্ত (পাণ্ডা) বললে, এখনই ঘর সব ভাড়া হয়ে গেছে, স্থান নেই। ছােট ছােট ঘরগুলি পর্যন্ত দশ টাকা। শীতকালে যাবেন।’
আমি—জগন্নাথ কি মূর্তি ? 
মা—আমি কিন্তু স্বপনে দেখেছিলুম শিবমূর্তি। 
আমি—তখন তুমি সেখানে এই জগন্নাথ-মূর্তি দেখনি?
মা—না, শুধু, শিবমূর্তি—শিবলিঙ্গ। লক্ষ শালগ্রামের বেদী, তার উপর জগন্নাথ শিব। একটা কিছু না থাকলে কি আর এত লোক হয় ? বিমলা দেবী আছেন। তাঁর বলি হয় মহাষ্টমীর রাত্রে। বিমলা দুর্গা তাে? কাজেই শিব থাকবেন না?
আমি—কেউ কেউ বলে বৌদ্ধমন্দির, বুদ্ধমূর্তি। তারপর শঙ্করাচার্য যখন বৌদ্ধদের তাড়ালেন, তখন ঐ মূর্তিকেই আবার শিবমূর্তি করে তুললে। পরে আবার বৈষ্ণবধর্ম-প্রচারের সঙ্গে শিবকে জগন্নাথ-বিষ্ণু করে দিলে।
মা—কি জানি, আমি কিন্তু শিব দেখেছিলাম।
আমি—মুসলমানেরা কত মন্দির, কত দেবদেবী ভেঙেছে, কারও নাক কেটেছে, কারও কান কেটেছে।
মা—মুসলমানের ভয়ে বৃন্দাবনের গােবিন্দজী জয়পুরে পালালেন। পাণ্ডারা ধন্না দিলে। শেষে দৈববাণী হ’লে, ‘মূর্তি গিয়েছে, আমি যাইনি। তােমরা আবার মূর্তি কর, সেই মূর্তিতেই আমি থাকব।'
আমি—গুজরাটে সােমনাথের মন্দির, গঙ্গোত্রীর জলে রােজ স্নান হত। মানুষের মাথায় মাথায় রােজ নূতন জল আসত। সুলতান মামুদ ভেঙে চুরমার করে দিলে। মন্দিরের চন্দনকাঠের দরজা নিয়ে গেল। এমন কেন হয় ?
মা—দুষ্টলোকের ভয়ে তিনি পালান। তাই বা কেন? তিনি ইচ্ছা করলে তাে সবই পারেন। তবে এ-ও তার এক লীলা। 
আমি—মা, কর্মের ফল কি খণ্ডন হয়? শাস্ত্রে বলে জ্ঞান হলে খণ্ডন হয়। তাও প্রারন্ধ ভােগ করতে হয় ।
মা–কর্ম হতেই সুখ দুঃখ সব। তাঁকেও কর্মফল ভােগ করতে হয়েছিল। ঠাকুরের বড় ভাই বিকারের সময় জল খাচ্ছিলেন। একটুখানি খেতেই ঠাকুর হাত থেকে গ্লাসটি টেনে নিলেন। তিনি তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘তুই আমাকে জল খেতে দিলিনি, তুইও এমনি কষ্ট পাবি, তােরও গলায় এমনি যাতনা হবে।' ঠাকুর বললেন, “দাদা, আমি তাে তোমার মন্দ করিনি। তােমার অসুখ, জল খেলে অনিষ্ট হবে, তাই দিইনি। তবে কেন তুমি আমায় এমন শাপ দিলে ?” তিনি কেঁদে বললেন, “কি জানি, ভাই, আমার মুখ থেকে ওকথা বেরিয়ে পড়ল। এ তাে অন্যথা হবে না।' ঠাকুরের অসুখের সময় আমাকে বললেন, “এই তার শাপে গলার ঘা। তা তােমাদের আর কার কিছু হবে না; যা ভোগ আমারই হ'ল। আমি বললুম, ‘এমন হলে মানুষ কি করে থাকবে, যখন তােমারই এরূপ হ’ল?' তিনি বললেন, ‘তার সে সিদ্ধ-বাক্য ছিল, ভাল লােক। এমনি যে-সে। বললে কি হয় ?
“কর্মফল ভুগতে হবেই। তবে ঈশ্বরের নাম করলে যেখানে ফাল সেঁধুত, সেখানে ছুঁচ ফুটবে। জপ তপ করলে কর্ম অনেকটা খন্ডন হয়। যেমন সুরথ রাজা লক্ষ বলি দিয়ে দেবীর আরাধনা করেছিল বলে লক্ষ পাঠায় মিলে তাঁকে এক কোপে কাটলে। তার আর পৃথক লক্ষ বার জন্ম নিতে হ’ল না। দেবীর আরাধনা করেছিল কিনা। ভগবানের নামে কমে যায়।” 
আমি—তাহলে কর্মের প্রাধান্যেই তাে জগৎ চলছে। তবে আর ভগবান মানা কেন ? বৌদ্ধেরাও কর্ম মানে, ঈষর মানে না।
মা—তবে কি কালী, কৃষ্ণ, দূর্গা, এসব নেই বলতে চাও?
আমি—জপতপের দ্বারা খণ্ডন হয় ?
মা—তা হবে না? ভাল কাজটি করা ভাল। ভালটি করলে ভাল থাকে, মন্দটি করলে কষ্ট পেতে হয়।
আমি—আচ্ছা মা, তুমি জয়রামবাটীতে বলেছিলে, সব এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। যা হয়েছে সব এক কালে হয়েছে, একটি একটি করে হয়নি। 
মা—তিনি কি আর একটি একটি করে সৃষ্টি করেছেন? এ যেন তাঁর একটা কল চলছে—এই যেমন ময়দার কল। কলওয়ালা দেখছে, কলটি যাতে নষ্ট না হয়। সে কি কোথায় একটি একটি করে গম গূঁড়ো হচ্ছে দেখছে ? তেমনি তাঁর কলটি তিনি ঠিক রাখছেন। কোথায় কে কি খুঁটিনাটি করছে তা কি তিনি অত দেখছেন? তাঁর অনন্ত সৃষ্টি, তাঁকে সর্বক্ষণ দেখতে হচ্ছে। অত খুঁটিনাটি দেখলে কি চলে?

উদ্বোধন—সকালবেলা 

আমি—মা, তােমাকে কখন কখন রামায়ণ পড়তে দেখি। পড়তে কবে শিখলে ?
মা—ছেলেবেলায় প্রসন্ন, রামনাথ ওরা সব পাঠশালায় যেত। ওদের সঙ্গে কখন কখন যেতুম। তাতেই একটু শিখেছিলাম। পরে কামারপুকুরে লক্ষী আর আমি ‘বর্ণ-পরিচয়’ একটু একটু পড়তুম। ভাগনে (হৃদয়) বই কেড়ে নিলে। বললে, “মেয়েমানুষের লেখা-পড়া শিখতে নেই, শেষে কি নাটক নভেল পড়বে?” লক্ষী তার বই ছাড়লে না। ঝিয়ারী মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে। আমি আবার গােপনে আর একখানি এক আনা দিয়ে কিনে আনালুম। লক্ষী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত। সে এসে আবার আমায় পড়াত। ভাল করে শেখা হয় দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তখন চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুরে। একাটি একাটি আছি। ভব মুখুজ্জ্যেদের একটি মেয়ে আসত নাইতে। সে মধ্যে মধ্যে অনেকক্ষণ আমার কাছে থাকত। সে রােজ নাইবার সময় পাঠ দিত ও নিত। আমি তাকে শাকপাতা, বাগান হতে যা আমার এখানে দিত, তাই খুব করে দিতুম।
আমি—মা, ঠাকুর জয়রামবাটী কি অনেকবার গিয়েছিলেন, না এক আধ বার।
মা—অনেক বার গেছেন। এক একবার গিয়ে দশ বার দিন থাকতেন। যখন দেশে যেতেন, তখন জয়রামবাটী, শিওড়, এসব হয়ে আসতেন। শিওড়ে রাখাল বালকদের খাওয়ালেন।
আমি—এ কোন সময়? সাধনার সময় না তারপর ? 
মা—সাধনার পর। সাধনার সময় তাে উন্মাদ। তখন ‘শ্বশুরবাড়ি গেলে তাে লােকে পাগল বলবে। শিব শ্বশুরবাড়ি গেলেন। সবাই বলতে লাগল, ‘ওমা উমা, তাের এই ছিল কপালে! শেষে ভাঙ্গড়ের হাতে গেলে। সেই তখন (বিবাহের পর) ঠাকুরকে কত কি সবাই বলত—’পাগলা জামাই, কি হবে গাে?'
আমি—কাল যে মণীন্দ্র গুপ্ত এসেছিলেন, এঁকে তাে আর কখনও দেখিনি।
মা—এ আর একবার এসেছিল। ঠাকুরের কাছে যেত, তখন খুব ছােটটি। 
আমি—ছােট নরেনকে এখানে একবারও দেখিনি।
মা—সে আসে না। ঠাকুরের কাছে যেত। কাল ছিপছিপে, মুখে বসন্তের দাগ। ঠাকুর তাকে খুব ভালবাসতেন। তার জন্য ভাবতেন; “এই ছােট নরেনকে মনে পড়েছে, এই ছােট নরেন এল,”—ভাবে দেখতেন।
আমি—পলটুবাবু একদিন মাত্র এখানে এসেছিলেন। তারকবাবু (বেলঘরিয়া) মধ্যে মধ্যে আসেন।
মা—পতুও মাঝে মাঝে আসে। আমাকে মাস মাস একটি করে টাকা দেয়। বড় গরীব। আমি যখন জয়রামবাটীতে থাকি তখন সেখানে পাঠায়। পতু আর মণীন্দ্র এরা দুটিতে যখন ঠাকুরের কাছে যেত তখন ছেলেমানুষ, দশ-এগার বছরের। দোলের দিন সব বাইরে চলে গেছে, আবীর দিচ্ছে, কাশীপুর বাগানে। এরা দুটি গেল না। ঠাকুরকে হাওয়া করতে লাগল—এই এ হাতে, এই সে হাতে। ছেলেমানুষ কি না, হাতে পায় না। এই পা টিপছে। ঠাকুরের তখন কাশি ছিল, তাই মাথায় জ্বালা করত। হাওয়া দরকার হত। ঠাকুর বলছেন, যা যা, তােরা নীচে যা, আবীর খেলগে না, সব্বাই গেছে।” পতু বলছে, ‘না, মশাই, আমরা যাব না। আমরা এইখানে আছি। আপনি রয়েছেন, আমরা কি ফেলে যেতে পারি?’
“ওরা কিছুতেই গেল না। ঠাকুর কেঁদে বললেন, “আরে, এরাই আমার সেই রামলালা, আমাকে সেবা করতে এসেছে। ছেলেমানুষ, তবু আমাকে ফেলে আমােদের দিকে ফিরে চাইলে না', বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ল
আমি—ঠাকুরের কাছে কত ভক্ত যেত, তারা সব এখন কোথায় ? কেউ তাে আসে না। 
মা—তার সব আপন মনে আনন্দে আছে।
আমি—যে আনন্দে আছে ! 
মা—তা তাে বটেই। সংসারে মাগ ছেলে নিয়ে কি আর সুখ আছে ? কামিনী আর কাঞ্চন, ওতেই ভুলে রয়েছে। সংসারে সবই ভােগের।
আমি—তাতে আবার বহির্মুখ মন।
মা—জগদম্বা কালী। তিনিই সকলের মা, তা থেকেই ভালমন্দ সব হয়েছে। তিনি সব প্রসব করেছেন। স্বতঃসিদ্ধ, সাধনসিদ্ধ, কৃপাসিন্ধ, হঠাৎসিদ্ধ—এই রকম সব আছে ?
আমি—হঠাৎসিদ্ধ কি ? 
মা—যেমন পরের ধন পেয়ে হঠাৎ বড়মানুষ হয়ে গেল।
এই সময় নলিনী স্নান করিয়া আসিল। উপরের পায়খানা একটু অপরিষ্কার ছিল, তাহাতে দুই-এক ঘটি জল ঢালিয়া দিয়া ধুইয়াছিল। সেইজন্য গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়াছে। মা দেখিয়া বলিলেন, “নলিনী, গঙ্গা নেয়ে এলি নাকি?” নলিনী কারণ বলিল। 
আমি—কলে নাইলেই তাে হত।
মা—তাই তাে, কলে নেয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করলেই তাে হত। (নলিনীর শরীর ভাল ছিল না)।
নলিনী—তা কি হয়, পায়খানা। 
মা—তাতে কি! বিষ্ঠা তাে আর ছুঁসনি। আর ছুঁলেই বা কি ? পেটের মধ্যেও তাে রয়েছে। ঠাকুর বলতেন, একটা গামলায় ডাল, ভাত, তরকারি, ছানা, মাখন রেখে দাও, দুদিন পরে পচে দুর্গন্ধ হবে। বিষ্ঠাও তো তাই। তিনি দক্ষিণেশ্বরে নিজের মল মুখে দিলেন। ন্যাংটা (তোতাপুরী) বললে, ‘ও তাে আপনার মল।’ তখন ঠাকুর কোথা গিয়ে চাখলেন।
 “আমিও তাে দেশে কত শুকনাে বিষ্ঠা মাড়িয়ে চলেছি। দুবার ‘গােবিন্দ গােবিন্দ বললুম, বস, শুদ্ধ হয়ে গেল। মনেতেই সব, মনেই শুদ্ধ, মনেই অশুদ্ধ। মানুষ নিজের মনটি আগে দোষী করে নিয়ে তবে পরের দোষ দেখে। পরের দোষ দেখলে তাদের কি হয় ?—নিজেরই ক্ষতি। আমার এইটি ছেলেবেলা থেকেই স্বভাব যে আমি কারও দোষ দেখতে পারতুম না। আমার জন্য যে এত টুকু করে আমি তাকে তাই দিয়ে মনে রাখতে চেষ্টা করি। তা আবার মানুষের দোষ দেখা ? মানুষের কি দোষ দেখতে আছে! ওটি শিখিনি। ক্ষমারূপ তপস্যা।”
আমি—স্বামীজী বলতেন, ‘ঘরে চোর ঢুকে কিছু নিয়ে গেল, তােমার মনে উঠবে—চোর, চোর। কিন্তু শিশুর মনে চোর-বুদ্ধি নেই; সে চোর বলে কিছুই দেখলে না।’
মা—তা তাে বটেই। যার শুদ্ধ মন, সে সব শুদ্ধ দেখে। এই গােলাপের (তখন গােলাপ মা কিজন্য আসিয়াছেন) মনটি শুদ্ধ। বৃন্দাবনে মাধবজীর মন্দিরে কাদের ছেলেমেয়ে বাহ্যে করে গেছে। সব্বাই বলছে, ‘বিষ্ঠা, বিষ্ঠা’, কিন্তু কেউ ফেলবার চেষ্টা করছে না। গােলাপ তাই দেখে অমনি নিজের ধুতি —নূতন মলমলের ধুতি—ছিঁড়ে পুঁছে ফেলে দিলে। স্ত্রীলােকগুলাে দেখে বলছে, ‘এ যখন ফেলেছে, তখন এরই ছেলে বাহ্যে করেছে।’ আমি মনে মনে বলছি, “দেখ মাধব, কি বলছে।’ কেউ বা বলছে, এরা সাধুলােক (যােগীন স্বামী প্রভৃতি ছিলেন), এদের আবার ছেলেপিলে কি ? এঁরা ফেলছেন সকলের দর্শনের অসুবিধা হচ্ছে, মন্দিরে বিষ্ঠা রয়েছে, এ জন্য।'
“এই গঙ্গার ঘাটে যদি কোন ময়লা থাকে তাে গােলাপ হেথা সেথা থেকে ন্যাকড়া কুড়িয়ে এনে পরিষ্কার করে ঘটি ঘটি জল ঢেলে ধুয়ে দিলে। এতে দশজনের সুবিধা হ’ল। তারা যে শান্তি পেলে, ওতে গােলাপের মঙ্গল হবে, তাদের শান্তিতে এরও শান্তি হবে।
“অনেক সাধন তপস্যা করলে, পুর্বজন্মের অনেক তপস্যা থাকলে, তবে এ জন্মে মনটি শুদ্ধ হয়।”
কিছু পরে আমি বলিলাম, “মা, আমার তাে জপ করতে মন লাগে না।” 
মা হাসিয়া বলিলেন, “কেন, মােটেই না?”
আমি—ঐ একটু আধটু, কোনমতে বেগারশােধ। একটু করেই ভাবি, বিড়বিড় করে কি হবে? ঈশ্বর যদি থাকেন তাে আছেনই। বরং ধ্যান করতে চেষ্টা করি। 
মা—ধ্যান হয় ?
আমি—না, হয় কই ? সব তাে বুঝি, তবে শক্তি কোথা ? দক্ষিণেশ্বরে কোন রাস্তায় যেতে হবে, তা তাে জান, কিন্তু হেঁটে যেতে পার কি ?
মা—ও জপ বিড়বিড় করা মেয়েদের কর্ম, তােমাদের জ্ঞান আছে।
বৈকালে ললিতবাবু, প্রণাম করিতে আসিয়াছেন। তাঁহার সহিত কথা হইতেছিল। আমিও মাঝে মাঝে বলিতেছিলাম।
মা বলিতেছেন, “ঠাকুর বলতেন, 'ক্ষুরের ধারের ন্যায় পথ বড় কঠিন রাস্তা।” বলিয়াই একটু পরে আবার বলিতেছেন, “তা তিনিই কোলে করে রয়েছেন, তিনিই দেখছেন।”
আমি—কই, কিছু জানতে দিচ্ছেন না যে ! 
মা—সেই তাে দুঃখ ( তােমাদের)। 
আমি —হাঁ।
ললিতবাবু—মরলে পর ঠাকুর কোলে করে নেবেন, সে আর বেশী কি? যদি এই দেহেই নিতেন!
মা—এই দেহেই কোলে করে রয়েছেন। মাথার উপরে তিনি আছেন, ঠিক ধরে রয়েছেন।
আমি–ঠিক আমাদের ধরে রয়েছেন? 
মা—হাঁ, ঠিক ধরে রয়েছেন। 
আমি —সত্যি বলছ ? 
মা—হাঁ, সত্যি বলছি, ঠিক ধরে রয়েছেন। 
আমি –ঠিক? 
মা—(দৃঢ়তার সহিত) হাঁ, ঠিক।
সকালের পূজা শেষ করিয়া মা শালপাতায় করিয়া ভক্তগণকে প্রসাদবিতরণ করিলেন। তারপর ঘরঝাঁট দিয়া ও চলাগুলি হাতে তুলিয়া লইবার সময় হঠাৎ একটা আলপিন তাহার অঙ্গুষ্ঠে ফুটিয়া গেল। উহাতে রক্ত বাহির হইল এবং খুব যাতনা হইতে লাগিল। আমি নীচে সংবাদ পাইয়াই ছুটিয়া আসিয়া দেখি, খুব যাতনা হইতেছে। আসিবার সময় কে যেন বলিলেন, “চুন গরম করে দাও।” আমি তাড়াতাড়ি চুন গরম করিয়া উপরে লইয়া গেলাম এবং আঙুলে লাগাইয়া দিলাম। দিতেই যাতনার অনেকটা উপশম হইল। মা বললেন, “বাবা, তােমরাই আমার আপনার লােক, তােমরাই আমার আপনার।”

১৬-৮-১২ (৩১শে শ্রাবণ), বৈকাল ৫টা 

মা–তের বছরের সময় কামারপুকুরে যাত্রার দিন হয়, কামারপুকুর যাই। তখন ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে। আমি কামারপুকুরে মাস খানেক থেকে জয়রামবাটী আসি। আবার পাঁচ ছয় মাস পরে গিয়ে কামারপুকুরে প্রায় দেড় মাস থাকি - তখনও ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে। কামারপুকুরে আমার ভাসুর, জা, এরা সব ছিলেন। ঠাকুর তারপর যখন ব্রাহ্মণীকে নিয়ে দেশে এলেন (ইং ১৮৬৭), তখন আমাকে খবর দিলেন, ‘ব্রাহ্মণী এসেছেন, তুমি এস।’ আমি খবর পেয়ে কামারপুকুর গেলাম। সেবার প্রায় মাস তিনেক ছিলাম। বামুন ঠাকরুন জয়রামবাটী, শিওড়, এসব ঘুরে দেখলেন। একদিন চিনু শাঁখারীর এঁটো নেয়া নিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হয়।
আমি—চিনু তখন বেঁচে আছেন। 
মা—হাঁ, বেঁচে আছে, বুড়াে অথর্ব।
আমি—কেউ কেউ বইয়ে ঠাকুরের ছেলেবেলাতেই যেন চিনু মারা গেছেন, এই ভাব দিয়েছেন।
মা—সে তার অনেক পরে মারা গেছে। ওখানে তার সমাজ আছে, শীতল দেয়।
“বামুন ঠাকরুন বললেন, “চিনু ভক্ত লােক, তার এঁটো নেবাে তাতে কি?” হৃদয় বললে, “তুমি শাঁখারীর এঁটো নেবে, থাকবে কোথা ? কোথা শােবে ? বামুন ঠাকরুন বললেন, “কেন? শীতলার ঘরে মনসা শােবে।'
“হৃদয় বললে, “দেখি কেমন শীতলার ঘরে মনসা শােয়।' ঐসব নিয়ে হৃদয়ের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি হয়। হৃদয় তাঁকে কি একটা ছুড়ে মারলে, তাঁর কানে লেগে রক্ত পড়তে লাগল। বামুন ঠাকরুন কাঁদতে লাগলেন। ঠাকুর বললেন, ‘ওরে হৃদু , তুই কেন এমন করলি ? এ সৎলােক, ভক্তিমতী। ওরে, এমন হলে যে সব লোক জড় হবে, কেলেঙ্কারি হবে।'
“তারপর একদিন ঠাকুর তাঁকে (ব্রাহ্মণীকে) কি রকম ভয় দেখিয়ে দিলেন। কি রকম ভাবাবস্থা দেখে ভয় পেলেন যেন হরিণীর মতাে। ভয়ে সর্বক্ষণ এইরকম (উপরের দিকে চাহিয়া) করতে লাগলেন। বললেন, “ওরে প্রসণ্ণ (লাহাদের প্রসন্নময়ী), কোথা যাব ? ওরে কি করব? জগন্নাথ যাব, না বৃন্দাবন যাব? তারপর একদিন কোথায় যে কখন চলে গেলেন কেউ টের পেলে না। তদবধি আর আসেননি। পাছে হৃদয়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়—লাহাদের বাড়ি কাছে—এই সব জন্য ঠাকুর তাঁকে ঐ রকম ভয় দেখিয়েছিলেন।
“একদিন আবার বামুন ঠাকরুন ঠাকুরকে মালাটালা দিয়ে গৌরাঙ্গের মতাে সাজালেন। তখন ঠাকুরের কি রকম ভাব হয়েছে। বামুন ঠাকরুন আমাকে ডেকে নিলেন। যেতেই ঠাকুর বললেন, “কেমন হয়েছে ? আমি বেশ হয়েছে’ বলে, কোনমতে যা হয় একটা বলে, প্রণাম করেই চলে এলুম। ভাবাবেশ দেখে আমার ভয় হয়েছিল।
“এর পর আবার জয়রামবাটী এলুম। নানা লােকের কাছে শুনতুম তিনি পাগল, উন্মাদ হয়েছেন, উলঙ্গ হয়ে বেড়ান। কেউ তাে আর তখন তার ভাব বুঝত না। আমি মনে ভাবলুম, সবাই এমন বলছে, আমি গিয়ে একবার দেখে আসি কি রকম আছেন। তখন কি যােগ উপলক্ষে আমাদের দেশ থেকে মেয়েরা গঙ্গাস্নানে আসছিল। ফাগুন-চৈত্র মাস (১২৭৮ সন) আমি একজনকে বললুম, “আমি দক্ষিণেশ্বরে তাঁকে দেখতে যাব কেমন আছেন। সে বাবাকে সব বলে দিলে। আমি তাে আর বাবাকে কিছু বলতে পারিনি লজ্জায়, ভয়ে।
“বাবা বললেন, ‘যাবে বেশ তাে।' তিনি আমাদের সঙ্গে এলেন। পথে জ্বর হ’ল। খুব জ্বর, কোন জ্ঞান নেই। রাতে স্বপ্নে দেখি কি একটি কাল কুচকুচে মেয়ে আমার বিছানার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। বললে, ‘দক্ষিণেশ্বর থেকে আসছি। আমি বললুম, আমিও তাঁর ওখানে যাব। তুমি আমাদের কে হও ? সে বললে, “আমি তােমার বােন। ভয় কি ? সেরে যাবে।”
“পরদিন জ্বল ছেড়ে গেল। বাবা শেষে পালকি করলেন। রাত প্রায় নটার সময় দক্ষিণেশ্বরে পেীঁছলুম। আমি একেবারেই ঠাকুরের ঘরে গিয়ে উপস্থিত। এরা সব নহবতের ঘরেটরে গিয়েছেন (যেখানে ঠাকুরের মা আছেন)। ঠাকুর দেখে বললেন, “তুমি এসেছ? বেশ করেছ।' বললেন, ‘মাদুর পেতে দেবে। ঘরেই মাদুর পেতে দিলে। ঠাকুর বললেন, এখন কি আর আমার সেজবাবু আছেন ? আমার ডান হাত ভেঙে গেছে।’ তখন কয়েক মাস হয় মথুরবাবু মারা গেছেন। অক্ষয় (ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র) তারও কয়েকমাস আগে মারা গেছে।”
আমি—মথুরবাবু, তখন নেই ?
মা—না, কয়েক মাস, সাত-আট মাস আগে মারা গেছেন। মথুরবাবু, থাকলে কি আর আমাকে ঐ কুঁড়েঘরে (নবতে) বাস করতে হয়? শৌচের যা কষ্ট। তিনি অট্টালিকায় রাখতেন। আমরা নবতের ঘরে যেতে চাইলুম। ঠাকুর বললেন, ‘না না, ওখানে ডাক্তার দেখাতে অসুবিধা হবে। এ ঘরেই থাক।” আমরা তার ঘরেই শুলুম। একটি সঙ্গী মেয়ে আমার কাছেই শুল। হৃদয় দু, ধামা না তিন ধামা মুড়ি আনলে। তখন সকলের খাওয়া হয়ে গেছে কিনা।
“পরদিন ডাক্তার দেখালেন। কয়েকদিন পরে জ্বর সারতে নবতের ঘরে গেলুম। তখন আমার শাশুড়ী কুঠিঘর ছেড়ে নবতের ঘরে এসে রয়েছেন। কুঠিঘরের একটি কোঠা তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। অক্ষয় তাঁর ঐ কুঠিতেই মারা যায়। সে মারা যেতে মা ঠাকরুন কুঠিঘর ছেড়ে এলেন। বললেন, ‘আর আমি ওখানে থাকব না। আমি এই নবতের ঘরেই থাকব, গঙ্গাপানে মুখ করে রইব, কুঠিতে আর আমার দরকার নেই।’
‘দক্ষিণেশ্বরে মাস দেড়েক থাকবার পরেই যােড়শীপজা করলেন (১২৭৯, জ্যৈষ্ঠ)। আমি তখন যােল বছরে পড়েছি। (সম্ভবতঃ ফলহারিণী কালীপূজার) রাত্রে প্রায় নটায় আমাকে তাঁর ঘরে আনালেন। পুজোর সব যােগাড়। ভাগনে সব যােগাড় করে দিয়েছে। আমাকে বসতে বললেন। আমি তাঁর চৌকির উত্তর পাশে (গঙ্গাজলের) জালার পানে মুখ করে (পশ্চিম মুখে) বসলুম। ঠাকুর পূর্বমুখ হয়ে পশ্চিমদিকের দরজার কাছে বসেছেন। দরজা সব বন্ধ। আমার ডান পাশে সব পুজার জিনিস।”
আমি—পূজার সময় কি করলেন ? 
মা—আমি একটু পরেই বেহুশ হয়ে গেলুম। পূজার মধ্যে কি হয়েছে জানতে পারিনি।

১.শ্ৰীশ্ৰীমার জন্ম ৮ই পৌষ, ১২৬০ সাল। কোষ্ঠীর হিসাবে ১৯ বছরে পড়িলে। মার কিন্তু ধারণা ছিল তিনি তখন ষােল বছরে পড়িয়াছেন। অন্যত্রও যােল বছর বলিয়াছেন। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুথি'তেও এই ভুল আছে।
২.লক্ষী দিদির মুখে শুনিয়াছি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “পুজার প্রথমে পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, কাপড় পরিয়ে দিলেন। পান, মিষ্টি খাওয়ালেন।" লক্ষী দিদি হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তাে অত লজ্জা কর-কাপড় কি করে পরালেন গাে? মা বলিলেন, “আমি তখন কি রকম যেন। অর্ধবাহ্যদশা ? হয়ে গিছলুম।”

আমি—হুশ হতে তুমি কি করলে? 
মা—আমি মনে মনে প্রণাম করলুম। পরে চলে এলুম। 
আমি—কালীপুজোর রাত, এত লােক, কেউ এ পূজা টের পায়নি?
মা—দরজা যে বন্ধ। কালীবাড়িতে গানবাজনা, হই রই। সবাই তা নিয়ে ব্যস্ত। আর তাঁর সঙ্গে তাঁদের অন্য সম্পর্কই বা কি?—একমাত্র দর্শন-স্পর্শন, আর তাে কিছু না।
আমি—পূজোর সময় আর কেউ ছিল?
মা—দীনু বলে একটি ছেলে, আমার ভাসুরপাে হয়, মুকুন্দপুরের জ্ঞাতির ছেলে, ঠাকুরের কাছে থাকত। তিনি খুব ভালবাসতেন। সে সব ফুল বেলপাতা যােগাড় করে এনে দিতে লাগল। হৃদয় সব ঠিকঠাক করে দিলে। পূজার সময় আর কেউ ছিল না, একা তিনি ছিলেন। পূজার শেষাশেষি হৃদয় এসেছিল। 
“রামবাবু বইয়ে লিখেছেন জয়রামবাটীতে ঘােড়শী পুজা হয়েছে। আমাদের দেশে এমনিই রক্ষা নেই। এতেই ‘কাকে মেয়ে দিলে-উন্মাদ, পাগল!' বলত, তা আবার মেয়েমানুষকে পূজা করা ! তা হলে তাে হয়েছে !
“এরপর দক্ষিণেশ্বরে প্রায় এক বছর ছিলাম। শেষটায় অসুখ হতে দেশে যাই ।* শম্ভুবাবু ডাক্তার প্রসাদবাবুকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন (দক্ষিণেশ্বরে)।” 
আমি—ঠাকুরের মার শরীর যাবার সময় (১২৬২, ১৬ই ফাগুন) দক্ষিণেশ্বরে ছিলে কি?
মা—না, জয়রামবাটীতে ছিলাম। তখন আমার অসুখ। দক্ষিণেশ্বরে এক বছর ভুগে দেশে গেছি। বদনগঞ্জে বাজারের শিবমন্দিরে পীলের দাগ নিলাম।** 

মা জানানন্দকেও এই ঘটনা বলিয়াছিলেন। সে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মা, ঠাকুর যখন আপনার পায়ে ফুল দিতে গিয়ে হাত দিলেন, মিষ্টি খাওয়ালেন, তখন আপনার সঙ্কোচ বােধ হল না ?" মা বলিলেন, “না, আমি তখন সব দেখছি বটে, কিন্তু কিছু বলতে কইতে ইচ্ছা ছিল না।”

*রামলাল দাদা বলিতেন, তাঁহার পিতার ( ঠাকুরের মধ্যমাগ্রজ শ্ৰীযুত রামেশ্বরের) মৃত্যুকালে (১২৮০, ২৭শে অগ্রহায়ণ ) শ্রীশ্রীমা জয়রামবাটীতে ছিলেন ।
**বদনগঞ্জ জয়রামবাটী হতে প্রায় ৪ মাইল। এই দাগ দেওয়া সেকালের এক অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। স্নানের পর রােগীকে শােয়াইয়া তিন-চারি জন লােক তাহার হাত-পা চাপিয়া ধরিত, যাহাতে সে যন্ত্রণায় উঠিয়া না পালায়। তারপর একব্যক্তি একটা জ্বলন্ত কুলকাঠ দিয়া পেটের উপরকার কতকটা স্থান ঘষিত। সে সময় চামড়া পুড়িয়া যাওয়ায় রােগী চিৎকার করিত। শ্রীশ্রীমা

“দু-তিনবার আসবার পর একবার কাপ্তেন (বিশ্বনাথ উপাধ্যায়) বাহাদুরী কাঠ দিলেন। এখন যেখানে রামলালের বাড়ি তার পাশে আমার জন্য ঘর হ’ল। শম্ভুবাবু করালেন। একখানা গুঁড়িকাঠ জোয়ারে ভেসে গেল। হৃদয় এসে “তােমার ভাগ্য মন্দ।'—এই সব বলে আমাকে বলে। কাপ্তেন শুনে বললেন, ‘যা কাঠ লাগে আমি দেব। ঘরে কিছুদিন রইলাম। একদিন বর্ষাকালে ঠাকুর গেছেন। শেষে এমন বৃষ্টি যে ঠাকুর আর সে রাত্রে ফিরে আসতে পারলেন না। সেখানেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে রইলেন। আমাকে ঠাট্টা করে বললেন, ‘কালীর বামুনরা রাত্রে বাড়ি যায়, না? এ যেন আমি এসেছি।'
“পরে কাশীর একটি প্রাচীন মেয়ে আমাকে বলে ওবাড়ি থেকে নহবতের ঘরে আনালে। তখন ঠাকুরের অসুখ, সেবার কষ্ট হচ্ছে। বাহ্যে গিয়ে গিয়ে মলদ্বার হেজে গেছে। আমি এসে সেবা করতে লাগলাম।”
“কাশীতে গিয়ে এই মেয়েটির অনেক খোঁজ করেছিলুম, দেখা পাইনি।* তার পরের বার (চতুর্থ বার) তাে আমি, মা, লক্ষী, আরও কে কে দক্ষিণেশ্বরে আসি। তারকেশ্বরে গত অসুখের মানসিক নখ চুল দিয়ে এলুম। প্রসন্ন সঙ্গে থাকায় প্রথমে কলিকাতায় তার বাসায়। (গিরিশ বিদ্যারত্নের বাসায় ) উঠি। ফাগুন-চৈত্র মাস হবে (১২৮৭)। পরদিন সকলে দক্ষিণেশ্বরে যাই। যেতেই হৃদয় কি ভেবে বলতে থাকে, কেন এসেছে ? কি জন্য এসেছে ? এখানে কি?'—এই সব বলে তাদের অশ্রদ্ধা করে। আমার মা সে কথায় কোন জবাব দেন নি। হৃদয় শিওড়ের লােক, আমার মাও শিওড়ের মেয়ে। কাজেই হৃদয় মাকে আদৌ মান্য করলে না। মা বললেন, 'চল, ফিরে দেশে যাই ।এখানে কার কাছে মেয়ে রেখে যাব? ঠাকুর হৃদয়ের ভয়ে আগাগােড়া ‘হাঁ, না কিছুই বলেননি। আমরা সকলে সেই দিনই চলে গেলুম। রামলাল পারের নৌকা এনে দিলে। আমি মনে মনে মা কালীকে বললুম, “মা, যদি কোন দিন আনাও তাে আসব।' তারপর হৃদয় ওখান হতে চলে গেল, ত্রৈলােক্যবাবুর মেয়ের পায়ে ফুল দিয়ে (১২৮৮, জ্যৈষ্ঠ)। রামলাল কালীঘরের (স্থায়ী) পুজারী, হল। পুজারী হয়ে ভাবলে, “আর কি, এবার মা-কালীর পুজারী হয়েছি। সে ঠাকুরের অত খোঁজ-খবর নিত না। উনি ভাব-টাব হয়ে হয়তাে পড়ে থাকতেন। এদিকে মা কালীর প্রসাদ শুকনা হয়ে থাকত। ঠাকুরের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হতে লাগল। তখন অন্য কেউ নেই। ঠাকুর পুনঃপুনঃ আমাকে আসবার জন্য খবর দিতে লাগলেন। ওদেশের যে আসত তাকে দিয়েই বলে পাঠাতেন আসবার জন্য। কামারপুকুরের লক্ষ্মণ পানকে দিয়ে বলে পাঠালেন, এখানে আমার কষ্ট হচ্ছে, রামলাল মা-কালীর পুজারী হয়ে বামুনের দলে মিশেছে, এখন আমাকে আর অত খোঁজ করে না। তুমি অবশ্য আসবে, ডুলি করে হােক, পালকি করে হােক, দশ টাকা লাগুক, বিশ টাকা লাগুক, আমি দেব।' ঠাকুরের এই সব সংবাদ পেয়ে আমি শেষে আসলুম (১২৮৮, মাঘ বা ফাগুন)। এক বছর আসিনি।**
আমি—রাসমণি যখন দেহত্যাগ করেন তখন ঠাকুর কোথায় ?
মা—তখন ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে। তার মুখে ও আরও লােকজনের মুখে, শুনেছিলাম, রাসমণির দেহত্যাগের সময় কালীঘাটের মা-কালীর মন্দিরের সব আলাে একটা দমকা হাওয়া এসে নিবে যায়। তখন মা রাসমণিকে দেখা দেন। ওদের সকলেই কালীঘাটে মারা যায়। কেবল মথুরবাবু জানবাজারে মারা যান।
স্নান করিয়া আসিবার পর যখন দাগ দিবার জন্য সকলে তাঁহাকে ধরিবার উপক্ৰম করিতেছিল, তখন তিনি বলিলেন, “না কাউকে ধরতে হবে না, নিজেই চুপ করে শুয়ে পড়ে থাকব।” বাস্তবিকই তিনি ঐ অসহ্য যন্ত্রণা স্থিরভাবে সহ্য করিলেন। দেশের লােকদের বিশ্বাস ছিল যে উহাতে ম্যালেরিয়া জ্বর সারে। শ্রীশ্রীঠাকুরও উহা লইয়াছিলেন।

* যােগেনমার নিকট শুনিয়াছি, মা পূর্বে ঠাকুরকে খুব সঙ্কোচ করিতেন; মুখের ঘোমটা লিতেন না। ঐ কাশীয় মেয়েটিই এই সঙ্কোচ ভাঙিয়া দেয়। একদিন রাত্রে সে মাকে লইয়া ঠাকুরের ঘরে গেল এবং মায়ের মুখের ঘােমটা সরাইয়া দিল। ঠাকুরও মাকে কত ভগবৎ কথা শুনাইতে লাগিলেন। মা এবং ঐ মেয়েটি যেন বাহ্যজ্ঞান শূন্য হইয়া কথা শুনিতে লাগিলেন। এত সময় হইয়াছেন যে ঐদিকে যে সূর্যোদয় হইয়াছে সে বিষয়ে কাহারও আর হল নাই।

** ইহার পরের বার মা দেশে গিয়া ৭/৮ মাস পরেই (১২৯০ সনের মাঘ মাসে) দক্ষিণেশ্বরে আসেন। আসিয়া ঠাকুরের ঘরে কাপড়ের পটুলিটি রাখিয়া প্রণাম করিতেই ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কবে রওনা হয়েছে?” তখন শ্রীশ্রীমায়ের উত্তরে ঠাকুর জানিলেন যে তিনি বৃহস্পতিবারের বারবেলায় রওয়ানা হইয়াছেন। অমনি বলিলেন, “এই তুমি বৃহস্পতিবার বারবেলায় রওনা হয়ে এসেছ বলে আমার হাত ভেঙেছে। যাও, যাও, যাত্রা বদলে এসগে।” শ্রীশ্রীমা সেইদিনই ফিরিয়া যাইতেছিলেন। ঠাকুর বলিলেন, “আজ থাক কাল যেও।” পরদিনই মা যাত্রা বদলাইতে দেশে ফিরিয়া যান।

১৬-১০-১২, বুধবার, বেলুড় মঠ। 

মঠে দুর্গাপূজা। আজ দেবীর বােধন। শ্ৰীশ্ৰীমা আজ বৈকালে মঠে আসিবেন। সন্ধ্যা সমাগত। মায়ের আসিতে বিলম্ব দেখিয়া পুজনীয় বাবুরাম মহারাজ ছুটাছুটি করিতেছেন। মঠের প্রবেশদ্বারে মঙ্গলঘট ও কলাগাছ-স্থাপন হয় নাই দেখিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, “এসব এখনও হয়নি, মা আসবেন কি?” দেবীর বােধন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীশ্রীমায়ের গাড়ি মঠে পৌঁছিল। গােলাপমা মাকে হাত ধরিয়া গাড়ি হইতে নামাইতেছেন। নামিবার পরই সমস্ত দেখিয়া মা বলিতেছেন, “সব ফিটফাট, আমরা যেন সেজেগুজে মা-দুর্গা-ঠাকরুন এলুম।”
অষ্টমীর দিন অনেক লােক শ্ৰীশ্রীমাকে প্রণাম করিল, তিন শতের উপর হইবে। উত্তর পাশের বাড়িতে মা ও স্ত্রী-ভক্তদের থাকিবার স্থান হইয়াছিল। দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে মা থাকিতেন। তক্তপােশের উপর পশ্চিমমুখে পা ঝুলাইয়া বসিয়া সব ভক্তদের প্রণাম গ্রহণ করিলেন। তিন-চারি জন মন্ত্র লইলেন।
বৈকালে ন-দিদির (গিরিশবাবুর ভগিনীর) মৃত্যুপ্রসঙ্গ হইতেছিল। বােধনের দিন রাতে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হইয়াছে। মা বলিলেন, “আর মানুষ, এই আছে, এই নাই। কিছুই সঙ্গে যাবে না। একমাত্র ধর্মাধর্মই সঙ্গে যাবে। পাপপুণ্য মৃত্যুর পরও সঙ্গে যায়।” 
একটি ছেলে স্বপ্নে মন্ত্র পাইয়াছিল। ঠাকুর তাহাকে কোলে করিয়া মন্ত্র দিয়াছেন। সে মায়ের নিকট হইতে সব জানিয়া লইল। মা সেই কথায় বলিলেন, “এই তাে সেই বামুনের ছেলেটিকে ঠাকুর মন্ত্র দিয়েছেন, কোলে করে।” 
আমি—তুমি তাকে ফের মন্ত্র দিলে?
মা—না; আমি বললুম, তুমি কৃপাসিদ্ধ। তুমি এই মন্ত্র জপ করেই সিদ্ধ হবে। আমি তার মন্ত্র কেন শুনতে যাব? আমি তাকে জপ দেখিয়ে দিলুম।
বিজয়ার দিন ডাক্তার কাঞ্জিলাল যে নৌকাতে প্রতিমা গঙ্গায় ভাসান হইতেছিল উহাতে দেবীর সামনে নানাপ্রকার মুখভঙ্গী রঙ্গব্যঙ্গ করিতেছিলেন এবং অনেকেই সেই সব দেখিয়া হাসিয়া অধীর হইতেছিল। একজন ব্রক্ষচারী কিছু মার্জিত-রুচি ছিল। সে উহাতে খুবই চটিতেছিল। মঠের উত্তর পাশের বাগানে থাকিয়া মাও নৌকার এই সব ব্যাপার দেখিতেছিলেন এবং আনন্দিত হইতেছিলেন। আমি মাকে বলিলাম, “মা, দেবীর সামনে ওরূপ করার জন্য কাঞ্জিলাল ডাক্তারকে গাল দিচ্ছে।” মা বলিলেন, “না, না, এসব ঠিক। গানবাজনা, রঙ্গব্যঙ্গ, এ সব দিয়ে সকল রকমে দেবীকে আনন্দ দিতে হয়।
পূজার কয়দিন থাকিয়া বিজয়ার পরদিন মা কলিকাতায় প্রত্যাগমন করেন এবং কয়েকদিন মাত্র তথায় থাকিয়া কাশীধামে গমন করেন।

কাশীধাম, ২০ শে কার্তিক, ১৩১৯ 
(৫ই নভেম্বর, ১৯১২), মঙ্গলবার, একাদশী

বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশ্রীমা কাশী অদ্বৈতাশ্রমে শুভাগমন করেন। তথায় কিছুক্ষণ থাকিয়া পরে কিরণবাবুদের নূতন বাড়িতে (লক্ষীনিবাস) গমন করেন। বাড়িটি একেবারে নূতন, আশ্রমের নিকটেই। বেশ প্রশস্ত বারান্দা, দেখিয়া মা প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “ভাগ্যবান না হলে এমন হয় না। ক্ষুদ্র জায়গায় থাকলে মনও ক্ষুদ্র হয়, খােলা জায়গায় দিলও খােলা হয়।”
মা এই বাড়িতে দোতলায় উঠিয়াই প্রথম ঘরটিতে ছিলেন। গােলাপ-মা, মাস্টার মহাশয়ের স্ত্রী ও আরও অনেক স্ত্রী-ভক্তেরা সঙ্গে ছিলেন। নীচে প্রজ্ঞানন্দ স্বামী ও আমরা থাকিতাম।
পরদিনই সকালবেলা পালকি করিয়া মা বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণা দর্শন করিতে যান। ২৪শে কার্তিক, শ্যামাপূজোর পরদিন সকালে মা পুনরায় অদ্বৈতাশ্রমে আসেন এবং সেবাশ্রম দর্শন করেন। পূজ্যপাদ মহারাজ, হরি মহারাজ, চারবাবু, ডাক্তার কাঞ্জিলাল প্রভৃতি অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কেদার বাবা শ্রীমার পালকির সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া সমস্ত ওয়ার্ড দেখাইলেন ও প্রত্যেকটির পরিচয় দিলেন। অন্যান্য সমস্ত দেখিয়া মা দক্ষিণের বারান্দায় চেয়ারে আসন গ্রহণ করিলেন এবং কেদার বাবার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে সেবাশ্রমের বাড়ি, বাগান ও ব্যবস্থা সম্বন্ধে অতিশয় প্রীতি প্রকাশ করিলেন। বলিলেন, “এখানে ঠাকুর নিজে বিরাজ করছেন, আর মা লক্ষী পূর্ণ হয়ে আছেন। আচ্ছা এটি প্রথমে কি করে আরম্ভ হ'ল? এ ভাবটি কার মাথায় প্রথমে ঢুকেছিল?” কেদার বাবা চারবাবু প্রভৃতি যত্ন ও অধ্যবসায়ের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, “বাড়ি-তৈরীর সময় বড়ো বাবা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করিয়েছিলেন।” মহারাজ কেদার বাবার যত্ন, উদ্যম ও পরিশ্রমের কথা বলিলেন। মা আনন্দিত হইয়া বলিতেছেন, “স্থানটি এত সুন্দর যে আমার ইচ্ছা হচ্ছে কাশীতে থেকে যাই।” মা বাসায় ফিরিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই একজন ভক্ত আসিয়া অধ্যক্ষকে বলিলেন, “শ্রীশ্রীমার সেবাশ্রমে দান এই দশটাকা জমা করে নেবেন।”
২৮শে অগ্রহায়ণ, শুক্রবার, শ্রীশ্রীমা পালকিতে প্রথমে কালভৈরব, বেণীমাধব, ত্রৈলঙ্গস্বামী, নাগপুররাজার মন্দির, গােয়ালিয়ররাজার মন্দির, সংকটা, বীরেশবর ও মণিকর্ণিকা প্রভৃতি দর্শন করিয়া সন্ধ্যায় বাসস্থানে ফিরিয়া আসেন। গোলাপ-মা ও মায়ের স্ত্রী-ভক্তেরা গাড়িতে এবং খগেন মহারাজ পালকির সঙ্গে সঙ্গে হাটিয়া গিয়াছিলেন। অন্য আর একদিন বৈদ্যনাথ ও তিলভাণ্ডেশ্বর দর্শন করিয়া মা বলিলেন, “এ স্বয়ম্ভুলিঙ্গ।” পরে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে কেদারনাথ দর্শন করিতে গেলেন। কিছুক্ষণ গঙ্গাদর্শন করিয়া সন্ধ্যারতি দর্শন করিলেন। বলিলেন, “এ কেদার ও সেই কেদার ( হিমালয়ের) এক-যোগ আছে। একে দর্শন করলেই তাঁকে দর্শন করা হয়, বড় জাগ্রত।”
একদিন মা সারনাথ দেখিতে যান। কয়েকজন সাহেবও দেখিতে গিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলে অবাক হইয়া সারনাথের পুরাতন কীর্তি দেখিতেছেন। মা বলিলেন, “যারা করেছিল, তারাই আবার এসেছে। আর দেখে অবাক হয়ে বলছে, কি আশ্চর্য সব করে গেছে।” সারনাথ হইতে ফিরিবার সময় মহারাজ নিজের গাড়িতে মাকে পাঠাইলেন। প্রথমে মা কিছুতেই রাজী হন না, বলেন, “না, না, ও গাড়িতে রাখাল এসেছে, রাখাল ওরা যাবে। আমার এ গাড়িতে কষ্ট হবে না।” মায়ের গাড়ি রওয়ানা হইয়া দৃষ্টির বাহিরে যাইতেই মহারাজ যে গাড়িতে উঠিয়াছিলেন উহার ঘোড়া ক্ষেপিয়া গিয়া গাড়িসমেত রাস্তার পাশে খানায় পড়িল। মহারাজের শরীর বহু স্থানে ছড়িয়া গিয়া রক্তারক্তি হইয়াছিল।
মা এই ঘটনায় বলিয়াছিলেন, “এ বিপদ আমারই অদৃষ্টে ছিল। রাখাল জোর করে নিজের ঘাড়ে টেনে নিলে। না হলে ছেলেপিলে (রাধু, ভুদেব প্রভৃতি) গাড়িতে, কি যে হত।”
মা একবার কাশীতে দুইজন সাধুকে দর্শন করেন। গঙ্গাতীরে এক নানকপন্থী সাধু; এবং চামেলী পুরী। চামেলী পুরীকে যখন দর্শন করেন, গােলাপ-মা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে খেতে দেয়।” বৃদ্ধ তদুত্তরে খুব তেজ ও বিশ্বাসের সহিত বলিয়াছিলেন, “এক দুগা মাঈ দেতী হ্যায়, ঔর কোন দেতা ?” উত্তরটি শুনিয়া মা খুব খুশী হইয়াছিলেন। বাড়িতে ফিরিয়া সন্ধ্যার পর আমাদিগকে বলিতেছেন, “আহা, বুড়াের মুখটি মনে পড়ছে। যেন ছেলেমানুষটির মতাে।” পরদিন তাহার জন্য কমলালেবু, সন্দেশ ও একখানি কম্বল পাঠাইয়া দেন। পরে একদিন আমি অন্যান্য সাধু দেখিবার কথা বলতে মা বলিলেন, “আবার সাধু কি দেখব? ঐ তাে সাধু, দেখেছি, আবার সাধু কোথা ?”
একদিন কাশীর কয়েকটি স্ত্রীলােক শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে আসিয়া দেখেন, মা রাধু ভুদেব প্রভৃতি ছেলেমেয়েদের লইয়া খুব ব্যস্ত, আবার নিজের পরিধেয় বস্ত্রখানি ছিড়িয়া যাওয়ায় একটু সেলাই করিয়া দিতে গােলাপ-মাকে বলিতেছেন। ঐ সবল দেখিয়া তাহাদের একজন বলিয়া উঠিলেন, ‘মা, আপনি দেখছি মায়ায় ঘোর বন্ধ।" অস্ফুট-স্বরে মা বলিলেন, “কি করব, মা, নিজেই মায়া।” 
আর একদিন বৈকালে তিন-চারিটার সময় কয়েকটি স্ত্রীলােক শ্ৰীশ্রীমায়ের নাম শুনিয়া দর্শন করিতে আসিলেন। মা বারান্দায় বসিয়া আছেন। গােলাপ মা প্রভৃতি এক পাশে বসিয়া। একটি স্ত্রীলােক গােলাপ-মাকে প্রাচীন এবং ভব্যআকৃতি-বিশিষ্টা দেখিয়া তাহাকেই মাতাঠাকুরানী মনে করিয়া প্রণাম করিয়া কথা বলিতে যাওয়ায় গােলাপ-মা বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, ঐ উনিই মা-ঠাকরুন।” মায়ের সাদাসিধা চেহারা দেখিয়া তিনি ভাবিলেন, মাতাঠাকুরানী বুঝি রহস্য করিতেছেন। গোলাপ-মা আবার বলায় তিনি যেমন মাকে প্রণাম করিত গেলেন, অমনি মাও হাসিয়া বলিলেন, “না, না, ঐ উনিই মা ঠাকরুন।” তখন স্ত্রীলােকটি মহা সমস্যায় পড়িলেন। গোলাপ-মা এবং মা বারবার পরস্পরকে দেখাইয়া বলিতেছেন, “ঐ উনিই মা-ঠাকরুন।” আমরা দেখিয়া হাসিতেছি। শেষে যখন তিনি গােলাপ-মাকেই মাতাঠাকুরানী সাব্যস্ত করিয়া তাহার দিকে ফিরিতে গেলেন, তখন গােলাপ-মা তাহাকে ধমক দিয়া বলিলেন, “তােমার কি বুদ্ধি-বিবেচনা নেই ? দেখছ না, মানুষের মুখ, কি দেবতার মুখ। মানুষের চেহারা কি অমন হয়?”
বাস্তবিকই মায়ের সরল, প্রসন্ন দৃষ্টিতে এমন একটি বিশেষত্ব ছিল যাহাতে ঘতই তাহাকে একটু অসাধারণ বলিয়া ধারণা হইত।

কিরণবাবুর বাড়ি, কাশীধাম, প্রাতঃকাল 

আমি—বিশ্বনাথকে রােজ সব লােকে ছোঁয়, সেজন্য সন্ধ্যার পর অভিষেক হয়ে তবে আরতি ও ভােগ হয়। (তখন দিনের বেলায় ভােগ হইত না।)
মা—পাড়াগুলাে টাকার জন্য ওরূপ ছুঁতে দেয়। কেন হতে দেওয়া ? দুর থেকে দর্শন করলেই তাে হয়। যত লােকের পাপ এসে লাগে। কত অসচ্চরিত্র নানারকমের লোক সব ছোঁয়।
“এক একটা লোক এমন আছে যে ছুলে সব শরীর গরম হয়, জ্বালা করে। তাই হাত পা ধুয়ে ফেলতে হয়। এখানে তবু লোকের ভিড় কলকাতার চেয়ে কম।
আমি—এখানে যে মহারাজদের অনুমতি নিয়ে এলে তবে দর্শন হয়—ভিড় কম:বার জন্য এই ব্যবস্থা করেছেন।
মা—হাঁ, কে এত সাত জায়গায় দরবার দিয়ে আসতে চায় ?
পাগলী মামী এখানেও মাকে জ্বালাতন করিতেছেন। সেই কথার উল্লেখ করিয়া মা বলিলেন, “হয়তাে কাটাসুদ্ধ বেলপাতা শিবের মাথায় দিয়েছি, তাই আমার এই কণ্টক হয়েছে।”
আমি—সে কি ? না জেনে দিলে দোষ কি ?
মা—না, না ; শিবপূজা বড় কঠিন। ওতেও বড় দোষ হয়। কি জান, যাদের শেষ জন্ম তাদের কর্মগুলাে সেই জন্মেই ভােগ হয়ে যায় ।*
“আমি তাে জন্মাবধি কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। পাঁচ বছরের সময় তাঁকে ছুঁয়েছি। আমি না হয় তখন না বুঝি, তিনিও তাে ছুঁয়েছেন। আমার কেন এত জ্বালা? তাকে ছুঁয়ে অন্য সকলে মায়ামুক্ত হচ্ছে, আর আমারই কি এত মায়া ? আমার যে মন রাত দিন উঁচুতে উঠে থাকতে চায়, জোর করে তা আমি নীচে নামিয়ে রাখি—দয়ায়, এদের জন্য, আর আমার এত জ্বালাতন ?” 
আমি— মা, যতই করুক না কেন, সহ্য করে যাবে। মানুষ হুঁশে থাকলে রাগে না।
মা—ঠিক কথা, বাবা! সহ্যর চেয়ে কিছুই নাই। তবে কি জান। রক্তমাংসের শরীর, হয়তাে রেগেমেগে কিছু বলে ফেললুম।
আপন মনে বলিতেছেন, “যে সময়ে বলে সে বান্ধব। অসময়ে ‘আহা' করলে কি হয় ?”

*জনৈক ত্যাগী ও জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মা, আমাদের এত রােগ-ভােগ কেন ?” মা তদুত্তরে বলেন, “তােমাদের এই শেষ জন্ম, তাই বাকী সব  জন্মের কর্মফল এ  জন্মে ভােগ হয়ে যাচ্ছে।

১১ই ডিসেম্বর, ১৯১২ 

মায়ের ওখানে কাশীখণ্ড-পাঠ হইত। সন্ধ্যায় পাঠের পর কথাবার্তা হইতেছে।
আমি—কাশীতে ম'লে কি সবারই মুক্তি হয় ? 
মা—শাস্ত্রে বলছে ‘হয়। 
আমি—তুমি কি দেখলে? ঠাকুর তাে দেখেছিলেন শিব তারকব্রহ্ম-মন্ত্র দেন। 
মা—কি জানি বাপু, আমি তাে কিছু দেখিনি। 
আমি—তােমার মুখে না শুনলে বিশ্বাস করি নে। 
মা—ঠাকুরকে বলব, ‘ঠাকুর, এ বিশ্বাস করতে চায় না, আমাকে কিছু দেখিয়ে দাও।’
ইহার পর আমি মুসলমানরাজত্বে ভারতের নানাস্থানে মন্দির ধ্বংসের উল্লেখ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এই যে এত অত্যাচার, তার তিনি কি করলেন?” 
মা—তাঁর অনন্ত ধৈর্য। এই যে তাঁর মাথায় ঘটি ঘটি জল ঢালছে দিনরাত, তাতেই বা তার কি? আর শুকনাে কাপড় দিয়ে ঢেকে পুজা কর, তাতেই বা তাঁর কি? তাঁর অসীম ধৈর্য। 
পরদিন সকালে খগেন মহারাজ মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শ্রীশ্রীঠাকুর কাশীতে এত সব দর্শন করেছিলেন, আপনি কি দেখলেন ?" উত্তরে মা বলিলেন, “রাতে বিছানায় শুয়ে জেগে আছি, হঠাৎ দেখি যে বৃন্দাবনের শেঠের বাড়ি নারায়ণমূর্তি পাশে দাঁড়িয়ে। মুর্তির গলার ফুলের মালা পা পর্যন্ত, ঝুলছে।
ঠাকুর ঐ মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। আমি মনে ভাবছি, ঠাকুর এখানে কি করে এলেন?' বললুম, ও বিশ্বাস করতে চায় না। ঠাকুর বললেন ‘বিশ্বাস করবে বইকি, সব সত্য। (অর্থাৎ কাশীতে মরিলে মুক্তি হয়।)
“সেই নারায়ণ মূর্তি আমাকে দুটি কথা বললেন। তার একটি এই‘ঈশ্বরতত্ব না করলে কি তত্বজ্ঞানের উদয় হয় ?’ অপরটি মনে করতে পারছি না।”
খগেন মহারাজ—ঠাকুর নারায়ণমূর্তির সামনে হাতজোড় করে কেন? 
মা—ও তাঁর ওরকম ভাব ছিল—সকলের সামনে দীনতা।
সকালে পূজার পর যখন প্রসাদ আনিতে গিয়াছি, পূর্বদিনের কথা মনে করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বল, কাশীতে মলে মুক্তি হয় কি না, কি দেখলে ?”
মা—শাস্ত্রাদিতে আছে, আর এত লোক আসছে মুক্তি হয়। তার শরণাগত যে তার মুক্তি হবে না তাে হবে কি ?
আমি—শরণাগত যে তার তাে মুক্তি হবেই। যে শরণাগত নয়, ভক্ত নয়, বিধর্মী—এদের মুক্তি হবে কি না?
মা—তাদেরও হবে। কাশী চৈতন্যময় স্থান। এখানে সব জীব চৈতন্যময় --পােকাটা মাকড়টা পর্যন্ত। ভক্তাভক্ত, বিধর্মী, যে এখানে মরবে-কীটপতঙ্গ পর্যন্ত তারই মুক্তি হবে।
আমি—সত্য বলছ ? 
মা—হাঁ, সত্য বইকি! নইলে আর স্থানমাহাত্ম কি ?
প্রসাদী মিষ্টির গন্ধে আমার হাতে একটা মাছি বসিয়াছিল ; সেটিকে দেখাইয়া বলিলাম, “এই মাছিটারও?”
মা—হাঁ, মাছিটারও হবে। এখানের সব চৈতন্যময় জীব। ভুদেব দুটো পায়রা নিতে চেয়েছিল, উপরে সিঁড়ির কোথায় বাচ্চা হয়েছিল। আমি বললুম, ‘ওরে, না, না। এরা কাশীবাসী, এদের নিতে নেই।'
“বাঙালিদেশের মেয়েছেলে সব, দেখগে বাঙালীটোলায়। এদের কি ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজনের মায়া নেই ? এরা সব কাশীলাভের জন্য এখানে এসেছে। বেশ জ্ঞান, মায়া নেই।”
আমি—দেখলে বাঙালিদের কেমন জ্ঞান ?
মা—হাঁ, ও দেশের (মায়ের দেশের) লােকগুলাের কান নেই। এই তাজপু্রের (রাধুর শ্বশুরবাড়ীর)ওয়া—ওদের তাে এখানে বাড়ি রয়েছে। তবু কাশীবাসের নামে ভয় পায়। মনে করে, বাড়িতে থাকলে যেন মরবে না। মরণ ভাে সঙ্গে সঙ্গেই আছে। 
আমি—সত্য বলছ এখানে মলে মুক্তি হয় ?
মা—(বিরক্ত হইয়া) আমি তােমার কাছে তেসত্য করতে পারব না। এক সত্যেই রক্ষা নেই, তা আবার তেসত্য, কাশীতে!
আমি—(হাসিয়া) দেখাে, আমার যেন কাশীতে মৃত্যু না হয়। তা হলে আমিই বা কোথায়, আর তুমিই বা কোথায় থাকবে—দেখাই হবে না।
মা—( সহাস্যে) কি বলে—’আমার কাশী চাইনি'। 
আমি—মা, একটা কিছু প্রত্যক্ষ হলে তবে তাে সত্য বিশ্বাস হয় ?
মা—তা মানুষ মহাজনদের কথা নেবে না তাে কি করবে? মুনি ঋষিরা যা বলে গেছেন, মহাজনেরা যে পথে গেছেন, তা ছাড়া আর পথ কি ? 
আমি—প্রত্যক্ষ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কথা শুনব না তাে কি করব? তাইতাে তােমাকে জিজ্ঞাসা করি। তুমি বললে তবে তোমাকে ছাড়ব। 
মা—তুমি বিশ্বাস করলে আর না করলে তাতে তার কি ? শুকদেব তাে ডেয়াে পিঁপড়ে। অনন্ত তিনি, তাঁর কি বুঝবে? ঠাকুর ছিলেন—তিনি একটি দেখা ( প্রত্যক্ষদশী) লােক, তিনি সব দেখেছেন, তিনি সব জানেন, তার কথা বেদবাক্য। তাঁর কথা যদি বিশ্বাস না করবে তাে কি করবে ? 
আমি—শাস্ত্রে তাে কত কথা বলে। এ বলছে এই, ও বলছে ঐ ; কার কথা নেব ? তাই তােমাকে জিজ্ঞাসা করি।
মা—তা তাে বটে। পাঁজিতে বিশ আড়া জল লিখেছে, নেংড়ালে এক ফোঁটাও বেরােয় না। আর শাস্ত্রে অনেক বাজে কথাও ভরেছে। শাস্ত্রবিধি অত আর পারা যায় না। তিনি বলতেন, “বৈধী-ভক্তি ভক্তিই নয়।”
“কামারপুকুরে যখন ছিলুম, বৃন্দাবন থেকে আসবার পর তখন সব লােকের ভয়ে-এ ও বলছে ও তা বলছে—হাতের বালা খুলে ফেললুম। আর ভাবতুম গঙ্গাহীন স্থানে কি করে থাকব, গঙ্গাস্নানে যাব মনে করলুম। আমার বরাবরই একটা গঙ্গাবাই ছিল। একদিন দেখি কি সামনের রাস্তা দিয়ে ঠাকুর আসছেন আগে আগে (ভূতির খালের দিক থেকে) , পিছনে নরেন, বাবুরাম, রাখাল, সব যত ভক্তেরা—কত লােক। দেখি কি ঠাকুরের পা থেকে জলের ফোয়ারা ঢেউ খেলে খেলে আগে আগে আসছে—এই জলের স্রোত! আমি ভাবলুম, দেখছি ইনিই তাে সব, এর পাদপদ্ম থেকেই তাে গঙ্গা! আমি তাড়াতাড়ি রঘুবীরের ঘরের পাশের জবাফুল গাছ থেকে মুটো মুটো ফুল ছিড়ে এনে গঙ্গায় দিতে লাগলুম। তারপর ঠাকুর আমাকে বললেন, “তুমি হাতের বালা ফেলাে না। বৈষ্ণব-তন্ত্র জান তাে? আমি বললুম, ‘বৈষ্ণব-তন্ত্র কি ? আমি তাে কিছু জানি নে।' তিনি বললেন, আজ বৈকালে গৌরমণি আসবে, তার কাছে শুনবে। সেইদিনই বৈকালে গৌরদাসী এল। তার কাছে শুনলুম, ‘চিন্ময় স্বামী।’*
“এ কলিতে শুধু সত্যের আঁট থাকলেই ভগবানলাভ হয়। ঠাকুর বলতেন, “যে সত্যকথাটি ধরে আছে সে ভগবানের কোলে শুয়ে আছে। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের অসুখের সময় তাঁকে রোজ যে দুধ দিতুম তা জ্বাল দিয়ে বেশ ঘন করে দিতুম আর এক সের দুধ হলে বলতুম আধ সের কম করে বলতুম। ঠাকুর একদিন টের পেয়ে বললেন, সেকি! সত্য ধরে থাকবে। এই আমার বেশী দুধ। খেয়ে পেটের অসুখ হয়েছে। যাই মনে করা, অমনি সেদিন পেটের অসুখ হ'ল।
“তার সব সুযােগ ছিল। আমাদের সে সব কই?” 
শেষে আমি বললাম, “মা, আমি এসব যা জিজ্ঞাসা করি, ও অমনি বলি, আমি ওসবের জন্য অত ভাবি না। আমার মনের ভাব অন্য রকম। আমি নিজে জানতে চাই, তােমাকে যে মা বলে ডাকি, তুমি আপন মা কিনা।”
মা—আপনার মা নয় তাে কি ? আপনারই মা।
আমি—তুমি তাে বললে, আমি যে ভাল বুঝতে পারছি না। গর্ভধারিণী মাকে যেমন আপনা হতেই মা বলে জানি, এমন তােমাকে মনে হয় কই ? 
মা—আহা, তাই তাে।
পরক্ষণেই বলিতেছেন, “তিনিই মা-বাপ, বাছা, তিনিই মা-বাপ হয়েছেন।” ( অর্থাৎ যে মা-বাপের দৃষ্টান্ত দিলাম তাঁহারাও তিনিই)।

*যােগেন মা কামারপুকুর যাইলে মা তাঁহাকে এই ঘটনা বর্ণনা করিয়া বলিয়াছিলেন, “ঐ অশ্বথগাছের গােড়ায় ঠাকুর তখন দাঁড়িয়েছিলেন। শেষে দেখলুম, ঠাকুর নরেনের দেহে মিলিয়ে গেলেন। তারপর যােগেন-মাকে বলিলেন, “এইখানকার ধুলি খাও, প্রণাম কর।" এই কথা স্বামীজীর কানে পৌঁছিলে তিনি বলিয়াছিলেন, “একথা (অথাৎ ঠাকুরের স্বামীজীর দেহে প্রবেশ করার কথা ) আমাকে বলা ভাল হয়নি।”

১লা পৌষ, সন্ধ্যা ৭টা 

মা তাহার ঘরে শুইয়া শুইয়াই কথা বলিতেছেন। ‘কাশীখণ্ডে’ আছে, কাশীতে মাছ খাওয়া উচিত নয়। সেই প্রসঙ্গ হইতেছিল।
আমি—তা মাছ খেলে প্রাণীহত্যা হয় তো। 
মা—ওসব মানুষের খাদ্য, মানুষ খাবে না তাে কি করবে ? 
আমি—খাদ্যের নাম করে প্রাণীকে ব্যথা দেবে?
মা— (অন্য কথার পর) তা বিচার করতে গেলে ওতেও হিংসা হয় বইকি প্রাণী তাে? কাশীপুরে ঠাকুরের জন্য শামুকের ঝােল ব্যবস্থা হল। ঠাকুর আমাকে করতে বললেন। আমি বললুম, এগুলাে জীয়ন্ত প্রাণী, ঘাটে দেখি চলে বেড়ায়। আমি এদের মাথা ইট দিয়ে ছেঁচতে পারব না।' শুনে ঠাকুর বললেন, ‘সেকি! আমি খাব, আমার জন্য করবে। তখন রেিখ করে করতে লাগলুম। 
“সব সময় মনের এক অবস্থা থাকে না। (আমার প্রতি) তুমি সব খাবে। তােমার ওসব বিচার করবার দরকার নেই।” 
আমি দর্শনাদির কথা উত্থাপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, লােকে এই যে দর্শনাদি করে, এসব কি ভাবে, না সাদা চোখে ?” 
মা—সবই ভাবে। আমি কিন্তু সাদা চোখে দেখেছিলাম—কামারপুকুরে গৈরিকপরা, রাধুর মতাে অতটুকু মেয়ে (১১/১২ বছরের), মাথায় রুখাে রুখো চুল, রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, যেখানে যাই সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে—এই সামনে, এই পিছনে!
“তারপর বেলুড়ে তখন নীলাম্বর বাবুর বাড়িতে-পঞ্চতপা করলুম। যােগেনও করলে। সেই সাধন-টাধনের পর মিশে গেল—আর দেখিনি।”
আমি—তপস্যার কি দরকার? 

১.কাশীতে আমি মাছ খাইতাম। কিন্তু মার জীবহিংসা সম্বন্ধীয় পর্বোক্ত কথাটি আমা্র মনে লাগায় কলিকাতায় গিয়া প্রায় এক বৎসর মাছ খাই নাই। মা তাহা জানিতেন না। পরে তাহার সহিত যখন জয়রামবাটী যাই, সেখানে আমি মাছ খাইতেছি না দেখিয়া মা উহা খাইবার জন্য আমাকে বলেন; কিন্তু আমি খাইলাম না। আবার একদিন বিশেষ করিয়া বলেন, সেদিনও আমি খাই নাই। তৃতীয়বার পুনরায় খুব বলেন। “তোমরা মাছ খাবে এতে দােষ কি? তােমরা তো। বিধবা নও। বিধবাদের খেতে নেই-ইত্যাদি অনেক বলায় শেষে আমি খাই। ভাবিলাম, উনি অত করিয়া বলিতেছেন। আর দেশে মাছ ছাড়া খাইতেই বা কি দিবেন?

মা—তপস্যা দরকার। এই যােগেন এখনও কত উপবাস করে। এ তপস্বী। গােলাপ জপে সিদ্ধ।
“নরেনের মা আমাকে দেখতে এসেছিল। নরেন তাকে বললে, “এই তুমি হয়তাে তপস্যা করেছিলে বলে বিবেকানন্দকে পুত্র পেলে। আবার তপস্যা কর, আবার হয়ত একটা পাবে।”
ঠাকুরের পঞ্চবটীতে তপস্যার কথা মা বলিলেন। তাহাতে আমি বলিলাম, ‘তাঁর ব্যাকুলতায় হুঁশ থাকত না, গঙ্গার জোয়ার মাথা বয়ে যেত। তুমি তাঁর কথা কেন বলছ ? পঞ্চতপা-টপ এসব করে শরীরকে কেন কষ্ট দেওয়া ?"
মা—পার্বতীও শিবের জন্য করেছিলেন। 
আমি—শিবও তাে করেছেন-ধ্যানস্থ।
মা—হাঁ, তবে এসব করা লােকের জন্য। নইলে লােকে বলবে, কই সাধারণের মতাে খায় দায় আছে। আর পঞ্চতপা-টপা, এসব মেয়েলী-যেমন ব্রত সব করে না?
আমি—হাঁ বুঝেছি। যেমন ব্রত করে, 'এসবও তেমনি ব্রত।
মা—ঠাকুর সব সাধনা করেছেন। বলতেন, ‘আমি ছাঁচ করে গেলুম, তােরা সব ছাঁচে ঢেলে তুলে নে।
আমি—“ছাঁচে ঢালা মানে কি? 
ভুদেব—মানে ঠাকুরকে চিন্তা করা।
মা—ও বুঝেছে। ‘ছাঁচে ঢালা’ মানে ঠাকুরকে ধ্যান-চিন্তা করা। ঠাকুরকে ভাবলেই সব ভাব আসবে। তিনি যে-সব করেছেন তা চিন্তা করা। ঠাকুর বলতেন, ‘আমাকে যে স্মরণ করে তার কখনও খাওয়ার কষ্ট থাকে না।
মাকু—তিনি নিজে বলেছেন?
মা—হাঁ, তাঁর নিজ মুখের কথা। তাঁকে স্মরণ করলে কোন দুঃখ থাকে না। দেখছ না, তাঁর ভক্তেরা সকলেই ভাল আছে। তার ভক্তের মতাে এমনটি কোথাও দেখা যায় না। এই তাে কাশীতে এত সাধু দেখেছি, তার ভক্তগুলির মতো কোনটি?
আমি—তার কারণ আছে, মা। যেন এইমাত্র একটা বাজার ভেঙেছে। সব চিহ্ন, লােকজন এখনও রয়েছে—ঠাকুরের সব অন্তরঙ্গ ভক্ত-টক্ত রয়েছেন কিনা? মনে হয়, এই যেন কাছে, বেশী দুর যান নি–ডাকলেই তার সাড়া পাওয়া যাবে।
মা—আর কত লােক পাচ্ছে যে!
আমি—কৃষ্ণ, রাম এরা যেন কত কালের। যেন পাওয়ার মতাে কাছে নাই।
মা—হাঁ, ঠিক কথা। 
আমি কাশীপুর বাগানের কথা উল্লেখ করিয়া বলিলাম, “এমন স্থানে এখন কে এক সাহেব বাস করছে।”
মা—কাশীপুর বাগান তাঁর অন্ত্যলীলার স্থান। কত তপস্যা, ধ্যান, সমাধি। তাঁর মহাসমাধির স্থান-সিদ্ধস্থান। ওখানে ধ্যান করলে সিদ্ধ হয়। 
“ঠাকুর যদি তাদের (মালিকদের) স্বপ্ন দিয়ে স্থানটি করে নেন তবে হতে পারে।
“ঐ কাশীপুরে একদিন নিরঞ্জন-টিরঞ্জন ওর কাঁচা রস খাবে বলে রস চুরি করতে যাচ্ছে। আমি দেখি কি ঠাকুরও তাদের পিছে-পিছে যাচ্ছেন। পরদিন তাঁকে একথা বলায় তিনি বললেন, ‘ও রেঁধে তােমার মাথা গরম।'

১. এই ঘটনার একটু বিস্তৃত বিবরণ নীরদ মহারাজের মাতা শ্রীশ্রীমার নিকট এইরুপ শুনিয়াছিলেন। ঠাকুর তখন কাশীপুরের বাগানে অত্যন্ত পীড়িত। এত দুর্বল যে একেবারে শয্যাশায়ী। স্বামীজী প্রভৃতি অন্তরঙ্গ ভক্তগণ সর্বদা তাহার সেবা করিতেছেন। একদিন তাহারা স্থির করিলেন, বাগানের এক পাশের একটি খেজুর গাছ হইতে সন্ধ্যার সময় জিরেনের রস খাইবেন। ঠাকুরকে কিন্তু সে সম্বন্ধে কিছুই জানাইলেন না। সন্ধ্যার সময় তাহারা সকলে সেই গাছটির দিকে চলিলেন। শ্রীশ্রীমা তখন সেই বাড়িতেই থাকিতেন। তিনি হঠাৎ দেখিলেন, ঠাকুর তীরবেগে নীচে চলিয়া গেলেন। দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন। ভাবিলেন, ইহা কি সম্ভব। যাহাকে পাশ ফিরাইয়া দিতে হয়, তিনি ইহা কিরুপে করিলেন। অথচ চাক্ষুষ দেখিলেন। তখন ঠাকুরের ঘরে যাইয়া দেখিলেন, ঠাকুর বিছানায় নাই, ঘর শূন্য। মা ভয়বিহুল হইয়া চারিদিক খুঁজিয়াও তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না এবং নিজ স্থানে ফিরিয়া গিয়া উৎকট চিন্তায় অভিভূত হইলেন—এ কি ঘটনা হইল। কিছুক্ষণ পরে দেখিলেন, ঠাকুর পূর্বের ন্যায় তীরবেগে আপন ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। মা পরে তাহার নিকট গিয়া ঐ সম্বন্ধে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় ঠাকুর বলিলেন, “তুমি দেখেছ নাকি?” তারপর বলিলেন, “ছেলেরা সব এখানে এসেছে সকলেই ছেলেমানুষ। তারা আনন্দ করে এই বাগানের একপাশে একটা খেজুর গাছ আছে, তারই রস খেতে যাচ্ছিল। আমি “দেখলাম, ঐ গাছতলায় একটা কালসাপ রয়েছে। সে এত রাগী যে সকলকেই কামড়াত। ছেলেরা তা জানত না। তাই আমি অন্য পথে সেখানে গিয়ে সাপটাকে বাগান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এলুম। বলে এলুম, “আর কখনও ঢুকিস নে'।” মা ইহা শুনিয়া অবাক হইলেন। ঠাকুর তাঁহাকে উহা তখন প্রকাশ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন।

“ঢাকায় বিজয় গোসাইও দেখেছিল ( ঠাকুরকে)-গা টিপে। 
 ‘তাঁর যাবার পর নরেন এরা বললে, “বাড়িটা তিন দিনও থাক, আমরা ভিক্ষা করে খাওয়াব মাকে—সদ্য সদ্য মায়ের মনে কষ্ট।' রামদত্ত-টত্ত এরা বললে, “তােদের আর ভিক্ষে করে খাওয়াতে হবে না। বাড়ি চুকিয়ে দিলে।
“এই যে গিরিশবাবু এখন সব বড় ভক্ত হয়েছে ! বলরামবাবু তবে গৃহীদের মধ্যে বলরামবাবু সব চেয়ে বড়। সব ভক্ত হিসাবে ভক্ত। কে এলেন ? না ভক্ত এলেন! এলে গেলে, প্রণাম করলে ! *
“শরৎ যে কদিন আছে, সে কদিন আমার ওখানে থাকা চলবে। তারপর আমার বােঝা নিতে পারে এমন কে আছে দেখি না। যোগীন ছিল। কৃষ্ণলালও আছে, ধীর, স্থির—যােগীনের চেলা। •••শরৎটি সর্বপ্রকারে পারে। শরৎ হচ্ছে আমার ভারী। রাখাল, শরৎ-টরৎ, এরা সব আপনার শরীর থেকে বেরিয়েছে।”
আমি—মহারাজ পারেন না ?
মা—না; রাখালের সে ভাব নয়। ঝঞ্জাট পারে না। মনে মনে পারে, কি কারুকে দিয়ে করাতে পারে। রাখালের ভাবই আলাদা।
আমি—বাবুরাম মহারাজ ? 
মা—না, সেও পারে না। 
আমি—মঠ চালাচ্ছেন যে। 
মা—তা হােক। মেয়েমানুষের ঝঞ্জাট ! দুর থেকে খবর নিতে পারে।
“এই রাধুর বিয়ের কথা—এটি মায়ের বােঝা। আপনার মায়ের বােঝা কে মনে করছে ? আপনার জন কয়টি আর ? দু-চারটি। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কটিই বা অন্তরঙ্গ।’
আমি—কোন কোন ভক্ত কে, বল না; কিছুই চিনতে পারলুম না। 
মা—কি জানি। তবে যারা সব (পূর্বে) এসেছিল তারাই এসেছে।
একটি ভক্তের কথায় বলিলেন, “হাঁ, তাই হবে। ওর ভিতরের স্বভাবটি আনন্দময়। বাহিরে এ রকম।”
আমি –চতুর্ভুজ প্রভৃতি দর্শনের সাধ আমার হয় না, আমার যা আছে তাই।
মা–আমারও তাই। ওসব দেখে কি হবে ? আমাদের এই ঠাকুর আছেন–উনিই সব।
২রা মাঘ বুধবার, মা কাশী হইতে কলিকাতা রওনা হন।

*প্রথমবার বৃন্দাবন হইতে ফিরিয়া মা বর্ধমানের রাস্তায় কামারপুকুর যান। টাকার অভাবে বর্ধমান হইতে উচালন পর্যন্ত তাঁহাকে হাঁটিয়া যাইতে হয়। উহাতে মা খুব ক্লান্ত হইয়া পড়ে। সঙ্গে গােলাপ-মা, যোগানন্দ স্বামী প্রভৃতি ছিলেন। উচালান গােলাপ-মা কোনপ্রকারে দুটি খিচুড়ি সিদ্ধ করেন। মা ক্ষুধায় তাহাই খাইয়া বার বার বলিয়াছিলেন, “ও গোলাপ, তুমি কি অমৃতই রেঁখেছ।

১১-২-১৯১৩, উদ্বোধন 

আমি—মা, এই যে স্বামীজী কত লােককে মন্ত্র দিয়েছেন, তুমিও কত লােককে দিচ্ছ, এ যেন কেউ এলে দুটো টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হ’ল, আর মনে রইল না।
মা—এত লােক আসছে, কটিকে মনে রাখা যায় ? আগুন জ্বাললে বাদলে পােকা আসে না ? সেই রকম।
আমি—এই যে মন্ত্র নেয়, কি পায় ? এমনি তাে বাহ্য দৃষ্টিতে দেখি, লােকটি যেমন ছিল তেমনি আছে।
মা–মন্ত্রের মধ্য দিয়ে শক্তি পায়। গুরুর শক্তি শিষ্যে যায়, শিষ্যের গুরুতে আসে। তাই তাে মন্ত্র দিলে পাপ নিয়ে শরীরে এত ব্যাধি হয়। গুরু, হওয়া বড় কঠিন-শিষ্যের পাপ নিতে হয়। শিষ্য পাপ করলে গুরুও লাগে। ভাল শিষ্য হলে গুরুও উপকার হয়। কারও বা হঠাৎ উন্নতি হয়, কারও বা ক্ৰমে হয়। তা যার যেমন সংস্কার।
“রাখাল তাই মন্ত্র দিতে চায় না। বলে, 'মা, মন্ত্র দিলে অমনি শরীর অসুস্থ হয়। মন্তরের নামে আমার গায়ে জ্বর আসে!”
জনৈক মহারাজ একটি ছেলেকে মন্ত্র লইবার জন্য মার কাছে পাঠাইয়াছে। মা তাহার সমস্ত পরিচয় শুনিয়া বলিলেন, “তােমাদের সব গােসাই গােবিন্দ আছেন। তাঁদের কাছ থেকে মন্ত্র নেবে।” যে কোন কারণে হউক মা তাহাকে দীক্ষা দিলেন না। 
প্রসঙ্গক্রমে বলিলেন, “কুলধর্মানুযায়ী চলা উচিত। জাতিবিচার সংসারে থাকলে মেনে চলতে হয়।” 
রাত্রে খাইবার পর পান আনিতে গিয়াছি। মা পাশের ঘরে ছেলেমেয়েদের মশারি খাটাইয়া দিতেছিলেন। শুনিলাম মা পাগলী মামীকে বলিতেছেন,‘তুই আমাকে সামান্য লােক মনে করিসনি। তুই যে আমাকে অত বাপান্ত মা-অন্ত করে গাল দিচ্ছিস, আমি তাের অপরাধ নিই না। ভাবি দুটো শব্দ বই তাে নয়। আমি যদি তাের অপরাধ নিই তা হলে কি তাের রক্ষা আছে ? আমি যে কদিন বেঁচে আছি, তােরই ভাল। তাের মেয়ে হারই হবে। যে কদিন না মানুষ হয়, সে কদিনই আমি। নতুবা আমার কি মায়া ? এক্ষণি কেটে দিতে পারি। কপূর্রের মতাে কবে একদিন উড়ে যাব, টেরও পাবিনি। 
পাগলী–আমি তােমাকে বাপান্ত করে কবে গাল দিয়েছি? আমি বাপান্ত করিনি-অমনি বলেছি। তুমি যাকে দাও, সব যে দিয়ে ফেল।
তাঁহার মনের ভাব মা যেন টাকা-পয়সা সব রাঁধুর জন্য রাখিয়া দেন।
ম—আমার বালকস্বভাব। আমার কি অত আগপাছ হিসাব থাকে? যে চাইলে দিলুম।
কাশী হইতে ফিরিয়া মা অল্প কয়েকদিন কলিকাতায় থাকিয়া জয়রামবাটী রওয়ানা হইলেন। ১৩ই ফাগুন কোয়ালপাড়া মঠে পেীঁছিলেন। ঠাকুরঘরের পাশের ঘরে মাকে থাকিতে দেওয়া হইয়াছে। একটি বটফলের বীজ বাহির করিয়া মাকে বলিতেছিলাম, “মা, দেখছ, লাল শাকের বীজের চেয়েও ছােট। এ থেকে অত প্রকাণ্ড গাছ! কি আশ্চর্য !” মা বলিলেন, “তা হবে না? এই দেখ না, ভগবানের নামের বীজ কতটুকু ? তা থেকেই কালে ভাব, ভক্তি, প্রেম, এসব কত কি হয়।” 
জয়রামবাটীতে আসিয়া রাত্রে আমরা খাইতে বসিয়াছি। আমাদের মধ্যে একজন বলিলেন, “মা, দেখলেন, এদের (মামাদের) কি আক্কেল ? আপনি এলেন, তা একটি লোকও নদীর ধারে পাঠালে না।” এই কথার উল্লেখ করিয়া মা বড় মামাকে বলিলেন, “এই যে আমি এলুম, তুই নদীর ধারে লােক পাঠালি না কেন? আমার এই ছেলেগুলি এল। তুই একটি লােকও পাঠালি নে, নিজেও গেলি নে।”
প্রসন্ন মামা-দিদি আমি কালীর ভয়ে পাঠাইনি। পাছে কালী বলে ‘দিদিকে হাত ক'রে নিতে যাচ্ছে। আমি কি বুঝি না, তুমি কি বস্তু, আর এরা ( ভক্তেরা) কি বস্তু? সব জানি, কিন্তু কিছু করবার সাধ্য নেই। ভগবান এবার আমাকে সে ক্ষমতা দেয়নি। এই আশীর্বাদ কর, যেন তােমাকে এবার যে ভাবে পেয়েছি, এই ভাবে জন্মে জন্মে পাই, অন্য আর কিছুই চাই নে।
মা—তােদের ঘরে আর ? এই যা হয়ে গেল। রাম বলেছিল, ‘মরে যেন আর না জন্মাই কৌশল্যার উদরে।' আরও তােদের মধ্যে ? বাবা পরম রামভক্ত ছিলেন, পরোপকারী, মায়ের কত দয়া ছিল ; তাই এ ঘরে জন্মেছি।
একদিন প্রসন্ন মামা আসিয়া মাকে বলিলেন, “দিদি, শুনলাম তুমি নাকি কাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছ, তাকে মন্ত্র দিয়েছ, আবার এও বলে দিয়েছ যে তার মুক্তি হবে। আর আমাদের তুমি কোলে করে মানুষ করেছ—আমরা কি চিরদিনই এমনি থাকব।” মা উত্তরে তাঁহাকে বলিলেন, “ঠাকুর যা করবেন, তাই হবে। আর দেখ, শ্রীকৃষ্ণ রাখাল-বালকদের সঙ্গে কত খেলেছেন, হেসেছেন, বেড়িয়েছেন, তাদের এটো খেয়েছেন, কিন্তু তারা কি জানতে পেরেছিল কৃষ্ণ কে ?”
একদিন আমরা কয়েকটি ভক্ত আহারান্তে উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করিতে যাইতেছি । মা তাহাতে বাধা দিয়া বলিলেন, “না, না, ওসব রেখে দাও—তােমরা দেবের দূর্লভ জিনিস।” ভক্তেরা আপত্তি করায় বলিলেন, “ও ফেলবার লােক আছে, ঝি আছে।”

১৪-৩-১৩ (ফাল্গুন-সংক্রান্তি, ১৯১৯) জয়রামবাটী 

শ্যামবাজারের ললিত ডাক্তার ও প্রবােধবাবু আসিয়াছেন। বৈকালে প্রায় চারটার সময় তাঁহারা শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতে গিয়া কথাবার্তা বলিতেছেন।
ললিতবাবু – মা, খাওয়া-দাওয়ার কি রকম নিয়ম পালন করা উচিত।
মা—আদ্যশ্রাদ্ধের অন্ন খেতে নেই, ভক্তির বড় হানি হয়। বরং অন্য শ্রাদ্ধের অন্ন খাবে, তব; আদ্যশ্রাদ্ধের নয়, ঠাকুর নিষেধ করতেন। আর যা কিছু খাবে, ভগবানকে দিয়ে খাকে, অপ্রসাদী অন্ন খেতে নেই। যেমন অন্ন খাবে তেমন রক্ত হবে। শুদ্ধ অন্ন খেলে শুদ্ধ রক্ত হয়, শুদ্ধ মন হয়, বল হয়। শুদ্ধ মনে শুদ্ধা ভক্তি হয়, প্রেম হয়।
ললিতবাবু—মা, আমরা তাে গৃহী, আত্মীয় স্বজনের শ্রাদ্ধে কি করব ?
মা—শ্রাদ্ধে গিয়ে কাজকর্ম দেখবে, খাটবে, যেন তারা কিছু মনে না করতে পারে। কিন্তু সে দিনটা কোন রকম করে খাওয়াটা এড়াতে চেষ্টা করবে। নেহাৎ না পারলে শ্রাদ্ধে বিষ্ণু বা দেবতাদিগকে যা নিবেদন হয়, তাই গ্রহণ করবে। প্রসাদীহ'লে আদ্যশ্রাদ্ধের অন্নও ভক্তেরা খেতে পারে।
ললিতবাবু অনেক সময় শ্রাদ্ধের জন্য আনা জিনিস-পত্র বাড়তি থাকে, তা খাওয়া চলে। 
মা—তা চলতে পারে, তাতে দোষ নেই, বাবা। গৃহী আর কি করবে। 
প্রবােধবাবু—মা, তিনি যে ত্যাগ ভালবাসতেন। আমাদের ত্যাগ কোথায় ?
মা—হবে ক্রমে ক্রমে। এ জন্মে খানিকটা হ’ল পরজন্মে আবার হবে। খােলটাই তাে বদলায়, আত্মা তাে একই থাকে।
“কামিনীকাঞ্চন-ত্যাগ। তিনি বলতেন, “আমি ইচ্ছা করলে কামারপুকুরটাকে সােনার করে দিতে পারি, সেজবাবুকে বলে। কিন্তু ওতে কি হবে ? ওগুলাে তাে অনিত্য।’ কারও কারও তিনি বলতেন শেষ জন্ম। বলতেন, “আরে, এর কিছুতেই আকাক্ষা নাই রে ! এর শেষ জম্ম।”
তাঁহারা প্রণাম করিয়া বিদায় লইলেন। সন্ধ্যার সময় মায়ের বারান্দায় বসিয়া কথাবার্তা হইতেছিল। কায়স্থের উপবীতের কথা উঠিল।
আমি—কেউ কেউ স্বামীজীকে বলেছিল, ‘শূদ্রের সন্ন্যাসে অধিকার কি ?’ তুমি যখন কাশী গিয়েছিলে তখন কাশীর ‘ত্রিশূল’ পত্ৰ মহারাজকে গালি দিয়েছিল। স্বামীজী কিন্তু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কায়স্থ ক্ষত্রিয়’ সুতরাং সন্ন্যাসে অধিকার আছে।' 
মা—(অন্য কথার পর) আর কিছু বুঝি না, সপ্তর্ষির মধ্য থেকে একটি ঋষি এসেছিলেন—এইটি জানি। আর ঠাকুরের ভক্তেরা জ্ঞানী সন্ন্যাসী। জ্ঞানীর সন্ন্যাস হতে পারে। এই যে গৌরদাসী; মেয়েদের তাে সন্ন্যাস নেই। গৌরদাসী কি মেয়ে ? ও তাে পুরষ। ওর মতাে কটা পুরষ আছে ? এই স্কুল, গাড়ি, ঘােড়া সব করে ফেললে। ঠাকুর বলতেন, “মেয়ে যদি সন্ন্যাসী হয়, সে কখনও মেয়ে নয়'—সে তাে পুরুষ। গৌরদাসীকে বলতে, ‘আমি জল ঢালছি, তুই কাদা মাখ।'

১৫ই চৈত্র, ১৩১৯, জয়রামবাটী 

সকালে বাড়ির মধ্যে গিয়া দেখি মা কলমি শাক কুটিতেছেন। আমি বললাম, “কলমি শাকের সঙ্গে এ কি কুটছ ? এ যে ঘাস।” মা বলিলেন, “এ ঘাসফুলের শাক (ও দেশে খায় বােধ হয়,) কৃষ্ণের গায়ের এই ঘাসফুলের রং ছিল।”
মধ্যাহ্নে খাইতে বসিয়াছি। পাগলী মামী তাঁহার ঘরের বারান্দায় একটি ছেলেকে (বােধ হয় আত্মীয় ) পাতা ও জলের গ্লাস দিয়াছেন। বিড়ালে সে জলে মুখে দেওয়ায় পুনরায় জল আনিয়া দিয়াছেন। আবার মুখ দেওয়ার সে জলও বদলাইয়া দিলেন। এবারেও একটা বিড়াল সে জল খাইতেছে। পাগলী বিড়ালটাকে তাড়া করিয়া বলিতেছেন, “পোড়ারমুখাে বেরাল মেরে ফেলব।” তখন চৈত্র মাস। মা কাছেই ছিলেন, বলিলেন, “না, না, পিপাসার সময় বাধা দিতে নেই। আর ও জলে তাে মুখ দিয়ে ফেলেছে।” 
পাগলী মামী চিৎকার করিয়া বলিতেছেন, “তােমায় আর বেরালকে অত দয়া দেখাতে হবে না। মানুষকেই বড় দয়া করছেন! মানুষকে দয়া কর না।”
মা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “আমার দয়া যার উপর নেই সে নেহাত হতভাগ্য। আমার দয়া যে কার উপর নেই তা বুঝি না—প্রাণীটা পর্যন্ত।” 
রাতে খাইতে বসিয়াছি। মা নিজে ঝিঙ্গে, আলু প্রভৃতি দিয়া একটি ব্যঞ্জন রাঁধিয়াছিলেন। তাই আনিয়া দিয়া বলিলেন, “খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে।” আমি একটু খাইয়া বলিলাম, “এ যেন রোগীর পথ্য, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। কে রেঁখেছে ?”
মা—আমি। 
আমি—তুমি নিজে ? 
মা—হাঁ। 
আমি —কই, তেমন হয় নি। আমাদের দেশের পছন্দ মতাে হয়নি। 
মা—তুমি শুধু, ঝোল মুখে দিয়ে দেখ।
নলিনী—ও পিসীমা, তুমি যে রান্নায় মােটেই ঝাল দাও না; ও কি খাওয়া যায়।
মা (নলিনীকে)—তুই ওর কথা শুনিস নি। খেয়ে দেখবি ভাল হয়েছে।
আমি—আমি কদিন তােমার রান্না কোনটা এদের জিজ্ঞাসা করে একটু একটু চেখে দেখেছি। সব ঐ রকম।
মা—বেশ তাে, একদিন তােমাদের দেশের মতাে রাঁধব, দেখিয়ে দেবে। লঙ্কা বেশী দিতে হয়, না? 
আমি—তত বেশী নয়। আর ঝাল কম হলেও রান্না কি খারাপ হয় ?
মা—(নলিনীকে) কাল ছােলার ডাল আনিস, রাঁধব। আমি আগে বেশ রাঁধতে পারতুম। এখন অভ্যাস নেই তাে। কামারপুকুরে লক্ষ্মীর মা আর আমি রাঁধতুম। একদিন খেতে বসেছেন - ঠাকুর আর হৃদয়। লক্ষীর মা ভাল রাঁধতে পারত। সে যেটা রেঁধেছে, খেয়ে বললেন, ‘ও হৃদু, এ যে রেঁধেছে, এ রামদাস বদ্যি।' আমি যেটা রেঁধেছি, খেয়ে বললেন, 'আর এই ছিনাথ সেন। শ্রীনাথ সেন হাতুড়ে। লক্ষীর মা হ’ল রামদাস বদ্যি, আর আমি হলুম ছিনাথ সেন- হাতুড়ে। শুনে হৃদয় বলছে, ‘তা বটে, তবে তোমার এ হাতুড়ে বদ্যি তুমি সব সময় পাবে-গা টিপতে, পা টিপতে পর্যন্ত। ডাকলেই হল। রামদাস বদ্যি —“তার অনেক টাকা ভিজিট, তাকে তাে আর সব সময় পাবে না। আর লােকে আগে হাতুড়েকে ডাকে—সে তােমার সব সময় বান্ধব।' ঠাকুর বললেন, তা বটে, তা বটে। এ সব সময় আছে।
“নরেনের জন্য দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর একদিন বললেন, “বেশ করে রাঁধাে। আমি মুগের ডাল, রুটি করলাম। খাবার পর নরেনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওরে কেমন খেলি?' নরেন বললে, “বেশ খেলুম, যেন রােগীর পথ্য।' ঠাকুর শুনে বললেন, ‘ওকে ওসব কি রেঁধে দিয়েছ ? ওর জন্য ছােলার ডাল আর মোটা মােটা রুটি করে দেবে। আমি শেষে তাই করলুম। তবে নরেন খেয়ে তুষ্ট হল।”

২৫শে বৈশাখ, ১৩২০, জয়রামবাটী 

রাধুর কি অসুখ করায় পাগলী মামী তাকে তিরস্কার করিতেছেন। “তুমিই ওষুধ খাইয়ে খাইয়ে আমার মেয়েকে মেরে ফেললে' ইত্যাদি বলিয়া আরম্ভ করিরা শেষে যা তা বলিতে লাগিলেন। বরদা মামাকে ডাকায় তিনি পাগলীকে তাড়া করিলেন। মাও অত্যন্ত অসহ্য হওয়ায় ধমকাইয়া বলিলেন, “তোকে আজই মেরে ফেলব। আমি যদি তােকে মারি, দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে তোকে রক্ষা করতে পারে। আর এতে আমার পাপও নেই, পূণ্যও নেই।”
কিছুক্ষণ পরে আমাদিগকে বলতেছেন “আমি এমন স্বামীর কাছে পড়েছিলাম যে তিনি কখনও আমাকে ‘তুই’ পর্যন্ত বলেন নি। দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরের ঘরে খাবার দিতে গেছি। রেখে চলে আসছি; তিনি লক্ষ্মী খাবার দিয়ে গেল মনে করে বলছেন, ‘দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস।’ আমি বললাম, “হাঁ,দরজা ভেজিয়ে রাখলুম। তিনি আমার গলার স্বর টের পেয়ে সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, ‘আহা, তুমি! আমি ভেবেছিলাম লক্ষী—কিছু মনে কোরা না।” দিয়ে যাস’ বলেছিলেন, তার জন্যই এত সঙ্কোচ। পরদিন পর্যন্ত নবতের সামনে গিয়ে বলছেন, “দেখ গাে, সারারাত আমার ঘুম হয়নি, ভেবে ভেবে—কেন এমন রূঢ়বাক্য বলে ফেললুম। আর এটা (রাধুর মা) কিনা আমাকে দিনরাত গাল দিচ্ছে। কি পাপে যে আমার এমন হচ্ছে জানি না। হয়তাে শিবের মাথায় কাঁটাসুদ্ধ বেলপাতা দিয়েছি। সেই কণ্টকে আমার এই কন্টক।”

.সরুচাকলী ও সুজীর পায়েস প্রস্তুত করিয়া, অন্য কেহ ঠাকুরের ওখান নাই জানিয়া, সন্ধার পর নিজেই লইয়া গিয়াছিলেন।

২৯শে বৈশাখ, ১৩২, জয়রামবাটী। 

রাধুর সেই জ্বর ও বেদনা। মা বলিতেছেন-“এই রাধীর উপর আমার আর একটুও মন নেই। রোগ ঘেঁটে ঘেঁটে বিতৃষ্ণা হয়েছে। জোর করে মন টেনে রাখি। বলি, “ঠাকুর রাধীর উপর একটু মন দাও, নইলে ওকে কে দেখবে? এমন রােগও আর দেখিনি। জন্মান্তরীন রােগ নিয়ে মরেছিল, প্রায়শ্চিত্ত করেনি। আমার এই দুইটি করাবার ইচ্ছা আছে -- একটি চন্ডদেখানাে কেন এমন হচ্ছে, আর এই চন্দ্রায়ণ করা। “ঠাকুরের যখন মহাভাব হ’ত বুকের ভেতর যেন সাতটা আগুনের তাওয়া জ্বলছে। বইয়েতে সব পড়েছ তাে ? তখন আমার ভাসুর তাকে দেশে নিয়ে এলেন। পাণ্ডবা থেকে একজন চণ্ড আনলেন। দেবতার ভর হতে সেই চড় বললে, তার ছেলেবেলার নাম করে, ও অমুক (গদাই) , তােমার এ মহাভাব ঈশ্বরের মহাকৃপায় হয়। এ রােগ নয়। তুমি অত সুপারি খেও না।' সুপারি বেশী খেলে পুরুষের ইন্দ্রিয়দোষ হয়।
“মানুষ যে রােগ নিয়ে মরে, যদি প্রায়শ্চিত্ত না করে মরে, তবে পরজম্মেও সেই রােগ হয়। সাধুদের পক্ষে এসব কিছু নয়।”
কেদারের মা-- তারা ভগবানের নাম করে মরে, ভগবানকে পায়।
মা--হাঁ, তাই তো। এই যে ছেলেটি* কোয়ালপাড়ায় মারা গেল, এর কি গার পূর্নজন্ম হবে ? এর আর জম্ম হবে না।
“কাশীপুরে তাঁর অসুখের সময় তিনি বললেন, ‘এই অসুখ, খাজাঞ্চী-টাজাঞ্চী লােকে কেউ কিছু বলবে—প্রায়শ্চিত্ত করলে না। ও রামলাল, তুই দশটা টাকা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যা, মা কালীকে নিবেদন করে বামুন-টামুনদের বিলিয়ে দে।'
“সাধুর তো কর্ম নেই, তাই টাকা ইষ্টকে নিবেদন করে দিয়ে বিতরণ করতে বললেন। মুনি-ঋষিরা বনে থাকতেন। তারা কি চন্দ্রায়ণ করতে পারতেন ? তারা ফলমূল নিজ ইষ্টকে নিবেদন করে সবাইকে বিতরণ করতেন। তাঁদের ওতেই হয়।”
পাগলী মামী—এই আমার মাসী রােগ নিয়ে মরেছে। তাহলে তারও কি সে রোগ হয়েছে ?
মা—তাের মাসী মরে জন্ম নেয়নি। সে মরে জন্মও নিয়েছে, সেই রােগও তার সঙ্গে এসেছে।
“অনেক সময় কর্মের ফলে বংশের লােক সেই বংশেই পুনঃপুনঃ জন্মায় আর মরে। গয়ায় পিণ্ড দিলে তবে উদ্ধার হয়ে যায়।”
রাত্রে আহারের পর মার ঘরে পান আনিতে গিয়াছি। রাঁচিতে একটি ভক্ত ঠাকুরকে দর্শন করিয়াছেন, সেই কথা মাকে বলিলাম—একটি লােক সাধুদর্শন করবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে কখনও কখনও যেতেন। তিনি পাতলা ও বেটে ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে ‘ঝুনাে সরষে' বলে ডাকতেন। ঠাকুরের দেহ যাবার অনেক বছর পরে যখন তিনি শিলং-এ চাকরি করেন, সেই সময় ঠাকুরের বিশেষ ভক্ত হন। তাঁদের আফিস শিলং থেকে ঢাকায় আসে এবং পরে রাঁচি যায়। রাঁচিতে রাত্রে তিনি শুয়ে আছেন, হঠাৎ কার ডাকে তার ঘুম ভেঙে যেতে শােনন যে, কে ডাকছে-“ও ঝুনাে সরষে !” অবাক হয়ে ভাবছেন, আমার-এ নাম তাে কেউ জানে না—ঠাকুর ডাকতেন। দরজা খুলে দেখলেন ঠাকুর রাস্তায় দাঁড়িয়ে-গেরুয়া পরা, খড়ম পায়ে, চিমটে হাতে ! জ্যোৎস্না রাত। বলছেন, ‘এখানকার কিছু কথা হতাে। তা ঢাকায় নয় দরকার না ছিল, এখানে ওটি বন্ধ কেন করলে ? উটি করাে না’বলে অন্তর্ধান হলেন।
শিলং-এ ইহাদের একটি সমিতির মতাে ছিল। তাহাতে ‘কথামৃত' প্রভৃতি পাঠ হইত। ঢাকায় পূর্ব হইতেই একটি সমিতি থাকায় শিলং হইতে আসিয়া ভক্তেরা উহাতেই যােগ দেন। নিজেদের সমিতির আর পৃথক অস্তিত্ব রহিল না। কিন্তু ইহারা যখন রাঁচিতে আসিলেন, তখন আর নূতন করিয়া শিলং-এর মতাে কথামৃত পাঠ আরম্ভ না হওয়ায় তাহা বন্ধই হইয়া গিয়াছিল। 
মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, খড়ম পায়ে, চিমটে হাতে কেন দেখলে?”
মা—সন্ন্যাসীর বেশ। তিনি যে বাউলবেশে আসবেন বলেছেন। বাউলবেশ—গায়ে আলখাল্লা, মাথায় ঝুটি, এতখানা দাড়ি। বললেন, ‘বর্ধমানের রাস্তায় দেশে যাব, পথে কাদের ছেলে বাহ্য করবে, ভাঙা পাথরের বাসন হাতে, ঝুলি বগলে।” যাচ্ছেন তাে যাচ্ছেন, খাচ্ছেন তাে খাচ্ছেন—কোন দিক-বিদিক খেয়ালই নেই।
আমি—বর্ধমানের রাস্তা কেন ? 
মা—এইদিকে দেশ (জম্মস্থান)। 
আমি—তবে কি বাঙালী?
মা—হাঁ, বাঙালী। আমি শুনে বললাম, ‘ও কিগাে, তােমার একি সাধ ?’ তিনি হেসে বললেন, ‘হাঁ, তােমার হাতে হুকো-কলকে থাকবে।'
ইহা বলিয়া মা বৃন্দাবনের সেই হুকো-কলকে ধরার ঘটনাটি বলিলেন।
আমি বলিলাম, “আমাদের দেশে কেউ এল না। তুমি আমাদের দেশে যাবে (জন্ম নেবে)।”
এইবার যাইতে বলিতেছি ভাবিয়া মা বলিতেছেন, “তােমাদের দেশে কি করে যেতে হয় ? রেল, জাহাজ, স্টিমার ? তােমাদের ও দেশে একবার গেলে হয়। তাঁর যদি ইচ্ছা হয় তাে হবে। ওদিকে যাওয়া হয়নি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার যেসব স্থানে যাওয়া হয়নি, তুমি সে-সব জায়গায় যাবে।’ তাই তাঁর আশীর্বাদে রামেশ্বর এসব যাওয়া হল।”
আমি—মা, শাস্ত্রে তাে দশ অবতারের কথা আছে। চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, এসব অবতারের তাে কথা নেই।
মা—তার কি জান, সব খেলা, খেয়াল! 
আমি—কোন গ্রামে জন্ম নেবেন ? 
মা—“কি জানি, জানি নে” বলিয়া এ প্রসঙ্গ চাপা দিলেন।

*বারিক মজুমদার। ছেলেটি বি-এ পরীক্ষা দিয়াই জয়রামবাটী গিয়াছিল। গরীব বাপ-মা তাহাকে কষ্ট করিয়া পড়াইয়াছেন এবং একমাত্র পুত্র বলিয়া তাহার বিবাহ দেওয়া স্থির রিয়াছেন। ছেলেটি পিতামাতার অনুরােধে উহাতে সম্মত হইয়াছে। শ্রীশ্রীমাকে সমস্ত ঘটনা বলায় তিনি আশীবার্দ করিয়া বলিলেন, “ভয় কি, ঠাকুরের গৃহস্থ ভক্ত সব ছিল, বলরামবাবু, এর ছিলেন এবং তাহাকে অভয় দেন। ফিরিবার পথে ছেলেটি কোয়ালপাড়া আসিয়া হঠাৎ ভীষণ আমাশয়ে আক্রান্ত হয় এবং ছয়-সাত দিনের মধ্যেই দেহত্যাগ করে। অন্তিম সময়ে সজ্ঞানে ঠাকুরের নাম করিতে থাকে এবং রামকৃষ্ণ প্রেমানন্দে হরি হরি বােল বলিয়া তাহার শেষ নিশ্বাস বহির্গত হয়। মায়ের কাছে সংবাদ যাইলে তিনি খুব দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, এখানে এসে এমন কার হয়নি।” (অর্থাৎ তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া কেহ মারা যায় নাই)।

১৩২০ সাল, ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, জয়রামবাটী
মায়ের পুরাতন বাড়ি 

শ্ৰীযুত সুরেন্দ্রনাথ ভৌমিক ও ডাক্তার দুর্গাপদ ঘােষ আসিয়াছেন। আজ অপরাহুে তাঁহারা রওয়ানা হইবেন। পূর্বাহ্নে স্নানান্তে তাঁহারা শ্ৰীশ্ৰীমাকে প্রণাম করিতে গেলেন। মা তাহাদিগকে মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন এবং বসিতে বলিলেন। দুই-এক কথার পর সুরেনবাবু মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, ঠাকুরকে পুজা করতে গিয়ে একটা খটকা বাধে। যেমন, একজনের হয়তাে ইষ্টদেবী ও ঠাকুরকে এক বলে সাধারণ বিশ্বাস আছে। কিন্তু ঠাকুরের মূর্তিতে ইষ্টদেবীর পূজা করে জপ-বিসর্জনের সমর “ত্বৎপ্ৰসাদাদ্মহেশ্বরী” বলতে তার কেমন একটু খটকা বাধে। 
মা—(সহাস্যে) তা বাবা, তিনিই মহেশ্বর, তিনিই মহেশ্বরী। তিনিই সর্বদেবময়, তিনিই সর্ববীজময়। তাঁতে সব দেবদেবীর পূজা হয়। ও মহেশ্বর বললেও হবে, মহেশ্বরী বললেও হবে।
সুরেনবাবু—মা, ধ্যানট্যান তাে কিছুই হয় না। 
মা—তা নাই বা হ’ল। ঠাকুরের ছবি দেখলেই হবে। ঠাকুরের তখন অসুখ, কাশীপুরে। ছেলেরা পালা করে থাকত। তখন গােপাল রয়েছে। ঠাকুরকে ফেলে সে গিয়ে ধ্যান করতে বসেছে। অনেকক্ষণ ধ্যান করছে। গিরিশবাবু এসে শুনে বললেন, ‘চোখ বুজে যার ধ্যান করছে তিনি এখানে রােগশয্যায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আর ও কি না ধ্যান করতে গেল! গােপালকে ডেকে পাঠালেন। ঠাকুর তাকে পা টিপে দিতে বললেন। বললেন, ‘পায়ে ব্যথা হয়েছে বলে টিপতে বলছি কি? তা নয়, তাের অনেক করা ছিল (জন্মান্তরে) , তাই।
“ওকে দেখবে, তাহলেই হবে।” 
সুরেনবাবু—মা, যথানিয়মে নি বেলা জপ করাও সব সময় হয়ে ওঠে না।
মা—তা নাই বা হ’ল,স্মরণ-মনন রাখবে। যখন পার জপ করবে। অন্ততঃ প্রণামটা তাে করতে পারবে?
দুর্গাবাবু—মা আহারাদির সম্বন্ধে কি রকম নিয়ম পালন করে চলতে হবে। বুঝতে পারি নে।
মা—আহারাদি সম্বন্ধে ঠাকুর একটা নিয়ম বেশী মানতেন, প্রথম শ্রাদ্ধের অন্নটা খেতে সব ভক্তদের নিষেধ করতেন। বলতেন, ‘ওতে ভক্তির হানি হয়। তা ছাড়া তাঁকে মনে করে খাবে দাবে। 
দুর্গাবাবু—মা, হাসপাতালে কাজকর্ম করতে অনেক সময় হয়তাে পিপাসায় সেইখানেই যার-তার জল খেতে হয়, খেয়ে থাকি। তার কি হবে, মা?
মা—তা কি করবে? কাজের জন্য করতে হয়। ঠাকুরকে স্মরণ করে খাবে। কাজের জন্য, ওতে দোষ হবে না। যাদের কাজকর্ম করতে হয় তাদের অত মেনে চলা হয় কি ?১
সুরেনবাবু—এই তাে, মা, সংসারে দশজন নিয়ে বাস। রান্না হতে হয়তাে দুজন অগ্রভাগ খেয়ে গেছে। তারপর সেই অন্ন এল! তা নিবেদন করতেও দ্বিধা লাগে। মা—তা সংসারে ওরকম হবেই। আমাদেরও হয়।২ ধর না, একজন হয়ত রােগা, তার জন্য আগে একটু উঠিয়ে রাখতে হ’ল। তা খাবার এলে, তিনিই খেতে দিলেন মনে করে তাঁকে স্মরণ করে খাবে। দোষ হবে না।
সুরেনবাবু—মা, মনের যা অবস্থা তা আর কি বলব। আপনি অন্তর্যামিনী, বুঝতেই পারছেন। আর যে ভােগ ক’বছর ভুগছি। আপনার আশীর্বাদ না থাকলে হয়তাে এতদিনে মরে যেতুম।
মা—হাঁ, বাবা, সংসারে যা কষ্ট তা আর বলতে ! কষ্টের পার নেই। তােমাদের তাে আছেই; আমাকেই, বাবা, যেভাবে ঠাকুর রেখেছেন। এই মেয়েটাকে (রাধুকে) নিয়ে কি কষ্টই পাচ্ছি!
সুরেনবাবু— হ্যাঁ মা, এখানকার এই ভাব দেখেই মনকে প্রবােধ দিই, আর ভরসা হয়। মা তাে সংসারের যন্ত্রণা নিজে দেখছেন, কাজেই দয়া হবে। 
মা—তা ভয় নেই, বাবা, ঠাকুর আছেন। তিনিই তােমাদের ইহকাল পরকাল সব রক্ষা করবেন।
সুরেনবাবু—মা, দুরে পড়ে থাকি ; স্বপ্ন কি সত্য?
মা—হাঁ, সত্য বইকি! তাঁর স্বপ্ন সত্য। তাঁর স্বপ্ন আবার তিনি তাঁর কাছেই বলতে নিষেধ করতেন।
সুরেনবাবু—মা, ঠাকুর কেমন জানিনি, দেখিনি। আমাদের ঠাকুর বলুন, যা বলুন সবই এখানে (আপনি)।
মা—ভয় নেই, ঠাকুর দেখবেন, বাবা। ইহকাল পরকাল সব দেখবেন, সব রক্ষা করবেন।
আহারাদির পর তাঁহারা রওয়ানা হইলেন। সঙ্গে বরদা মামা; তিনি কলিকাতা আসিবেন। তাহারা ক্রমে উত্তরদিকের মাঠে পড়িলেন। মা কিছুদুর পর্যন্ত আসিয়া যতক্ষণ দেখা গেল চাহিয়া রহিলেন।
এই সুরেনবাবু যখন বল্লারতনগঞ্জ স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন, সেই সময় তিনি তথাকার কসাইগণ জীবন্ত গরুর চামড়া খসাইয়া লয় জানিয়া বড়ই ব্যথিত হন। দুবুৰ্ত্তেরা একদিন স্কুলের সামনেই ঐরূপ করিল। হিন্দু ও মুসলমান ছাত্র ও শিক্ষকগণ এবং সুরেনবাবু ইহার খুব প্রতিবাদ করেন। কসাইগণ মারও খায়। ইহা লইয়া তথায় একটা গণ্ডগােল বাধে। কসাইগণ সুরেনবাবুর উপর অত্যাচার করিবে বলিয়া তাঁহাকে ভয় দেখায়। এই সময় স্কুলের দুই-তিনটি ছাত্র শ্রীশ্রীমার কৃপালাভের জন্য জয়রামবাটী যায়। সুরেনবাবু, ঐসঙ্গে পত্র দেন; তাহারাও সব ঘটনা শ্রীশ্রীমাকে নিবেদন করে। মা শুনিয়া শিহরিতে লাগিলেন, এবং সুরেনবাবুকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, “তােমরা যদি এমন কাজের প্রতিবাদ না কর, তবে কে করবে? মায়ের কথামত সুরেনবাবুকে খুব অভয় দিয়া পত্র লেখা হইল এবং যাহাতে এরূপ নৃশংস ব্যাপার আর না ঘটে তাহারই বিশেষ চেষ্টা করিতে বলা হইল। সুরেনবাবুর দ্বিতীয় পত্রের উত্তরে মা লিখতে বলিলেন, “ভগবান যদি সত্য হন, তবে নিশ্চয়ই এর প্রতিবিধান হবে।” এই ঘটনা উপলক্ষে মকদ্দমা হইয়াছিল। ইহার ফল আশানুরুপ না হইলেও ক্রমে প্রকাশ্যভাবে ঐ নৃশংস কর্মের অনুষ্ঠান একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।

১. মা যে সব সময় সকলের ছোঁয়া জিনিস খাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তাই মনে হয় না। জয়রামবাটীতে একদিন এই প্রসঙ্গে ঠাকুরের কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, “ঠাকুর বলতেন, ওরে আমি তাে এখনি মুচি মেথর সম্বায়ের খেয়ে আসতে পারি। তা হলে তােরা যে এখনি সব একাকার করে দিবি।” মার শেষ অসুখের সময় যখন তাঁহাকে পাউরুটি দিবার ব্যবস্থা হয়, মা আমাকে বলিলেন, “বাবা, আমার এই শেষকালটায় আর আমাকে মুসলমানের ছোঁয়াটোয়া খাইও না। যদিও তাঁহাকে এই সময় পাউরুটি দেওয়া হইয়াছিল, তাহা ব্রাহ্মণের তৈয়ারী। পরে কলের তৈয়ারী বলিয়া বুঝাইয়া Milk-roll পাউরুটি দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু অন্য সময়ে কখনও কখনও ব্রাহ্মণের ত্যাগী ভক্তের রান্না খাইয়াছেন, ইহাও দেখা গিয়াছে।

২.কিন্তু ইহাও দেখিয়াছি যে, জয়রামবাটীতে ভােগের পূর্বে বাড়ির ছেলে-মেয়ে কেহ খাবার কথা বলায় ধমক দিয়া বলিলেন, “এখন কি খাওয়া ? ঠাকুরদেবতার ভোগ হল না, কিছু না”। একবার কার্যোপলক্ষে মামাকে সকাল সকাল রওয়ানা হইতে হইবে। তাঁহার জন্য পৃথক রাঁধিয়া দিলেন, তথাপি যে রান্না হইতে ঠাকুরের ভােগ হইবে তাহা দিলেন না। একদিন ‘উদ্বােধনে' ঠাকুরের জন্য ফল ছাড়াইতেছেন, মাকুর শিশুপুত্র খাইতে চাওয়ায় তাহাকে যাহা দিবেন তাহাতে করিয়া ঠাকুরকে দেখাইয়া ( নিবেদন করিয়া) দিলেন। শেষ অসুখের পূর্ববারের অসুখে একদিন অনেক বলিকহিয়া মাকে ভােগের পূর্বে খাওয়ান গেল। অবশ্য যাহা খাইলেন তাহা ঠাকুরকে নিবেদন করিয়া লইলেন। পরদিনও ভােগর পূর্বে খাইতে দেওয়া হইল। কিন্তু যাই যাই বলিয়া কোনরকমে বিলম্ব করিয়া সকলের অনুরােধে যখন খাইতে বসিলেন, তখন ঠাকুরের ভােগ উঠিয়াছে। এদিকে ঠাকুরের ভােগও হইয়া গেল, মাও খাইতে আরম্ভ করিলেন। পরদিন ঠাকুরের ভােগ হইয়া গেলে তবে খাইতে বসিলেন।

২৮শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০, জয়রামবাটী 

মধ্যাহ্নে মায়ের ঘরের বারান্দায় আমি ও আর একজন খাইতে বসিয়াছি।
মা—রাধু বললে, এবার নাকি আশ্বিন মাসে খুব মারামারি হবে, পাঁজিতে লিখেছে।
আমি—মারামারি নয়, মহামারী। 
কথাপ্রসঙ্গে মা বলিলেন, “ঠাকুরের আবির্ভাব থেকে সত্যযুগ আরম্ভ হয়েছে। বিশেষ বিশেষ লােক তাঁর সঙ্গে এসেছেন। এই নরেন সপ্ত ঋষির মধ্যে প্রধান ঋষি। তিনি তাে শত ঋষির মধ্যে বলতে পারতেন; তা না বলে সেই বড় সাতজনের মধ্যে একজন বললেন। অর্জুন যােগীন হয়ে এলেন। তেমন প্রধান প্রধান কটি থাকে ? অনেক থাকে কি ? টোকো আম অনেক পাওয়া যায়, ফজলি আম কি বেশী পাওয়া যায়? সাধারণ লােক কত জন্মাচ্ছে, মরছে। এই সব সর্ব-প্রধান যাঁরা, তারাই ভগবানের কার্যের জন্য সঙ্গে সঙ্গে আসেন।”
আমি—স্বামীজীও বলেছেন, ঠাকুরের আবির্ভাব থেকে সহাযুগ আরম্ভ। 
মা—তাই তাে।

২৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০, জয়রামবাটী 

দ্বিপ্রহরে মায়ের বারান্দায় খাইতে বসিয়াছি; রাধুকেও মা একধারে বসিয়া খাওয়াইতেছেন। মা রাধুকে বলিতেছেন, “খা, খা, গাঁদাল-ঝােল, এ ঠাকুর খেতেন। তিনি ভালবাসতেন—গাঁদাল, ডুমুর, কাঁচকলা। পেটের অসুখ ছিল কিনা। এই দুধ খা।”
রাধু—না, আর খাব না।
মা—খা, একটু খা। ( আমাদিগকে) ঠাকুরের অসুখের সময় কুমারটুলির গঙ্গাপ্রসাদ সেনকে দেখালেন। কবিরাজ জল বন্ধ করে ওষুধ খাবার ব্যবস্থা করলেন। ঠাকুর এসে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, 'হ্যাঁগা, জল না খেয়ে পারব?' যাকে দেখেন তাকেই জিজ্ঞাসা করেন, পাঁচ বছরের ছেলেদের পর্যন্ত, ‘হ্যাঁগা, জল না খেয়ে কি থাকা যায় ? তারা বললে, ‘হাঁ, পারবেন বইকি, মশায়। আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘পারব? আমি বললুম, ‘পারবে বইকি। তিনি বললেন, “বেদানা পর্যন্ত জল পুঁছে দিতে হবে, দেখ যদি তােমরা পার।' আমি বললুম, ‘তা মা কালী যেমন করবেন, যথাসাধ্য তাঁর ইচ্ছায় হবে।’ শেষে মন স্থির করে জল বন্ধ করে ওষুধ খেলেন। রােজ তিন-চার সের, শেষে পাঁচ-ছ সের পর্যন্ত দুধ দিতুম। গাই দুইয়ে যে লােকটি দুধ দিত সে আমাকে বেশী বেশী দুধ দিয়ে যেত। বলত, ওখানে দিলে কালীর ভােগ বেটারা বাড়ি নিয়ে যাবে। কাকে না কাকে খাওয়াবে। আর এখানে দিলে উনি খাবেন।’ তাই পাঁচ-ছয় সের পর্যন্ত দিয়ে যেত। বেশ ভাল ভক্তিমান লােকটি ছিল। আমি সন্দেশ, রসগোল্লা, এসব মিষ্টি-টিষ্টি যা থাকত—আর তখন অনেক আসত—সব দিতুম। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে কমিয়ে এক সের, দেড় সের করে দিতুম। জিজ্ঞাসা করতেন, কত দুধ?' বলতাম, ‘কত আর-এক সের, পাঁচপাে হবে।' তিনি বলতেন, ‘না, এই যে পুরু, সর দেখা যাচ্ছে। 
 “একদিন গােলাপ ছিল, তাঁকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘হ্যাঁগা, কত দুধে হবে?” গোলাপ বলে দিয়েছে।
‘এ্যাঁ, এত দুধ। তাই তাে আমার পেটের অসুখ হয়। ডাক, ডাক। আমি গেলুম। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত দুধ? আমি বললুম, “পাঁচপাে হবে আর কি।”
“তবে যে গােলাপ বলে এত ?”
“গােলাপ জানে না। এখানের মাপ গােলাপ জানে? ঘটিতে কত দুধ ধরে গােলাপ জানবে কি করে?
“আর একদিন গােলাপকে জিজ্ঞাসা করেছেন। গােলাপ বলে দিয়েছে, “এখানের এক বাটি, আর কালীঘরের এক বাটি।” শুনে বললেন, ‘এ্যা, এত দুধে ? ডাক, ডাক, জিজ্ঞাসা কর। যেতেই বলছেন, ‘বাটীতে কত ধরে? ক ছটাক, ক পাে?’ আমি বললুম, ‘ক ছটাক, ক পাে, অত জানি নে। দুধ খাবে, তা ক ছটাকের ঘটি কত পো, অত কেন? অত হিসাব কে জানে? তিনি বললেন, ‘এত কি হজম হয় ? তাই তাে পেটের অসুখ হবে।' বাস্তবিকই সেদিন পেটের অসুখ করল। জিজ্ঞাসা করলুম, “কি রকম দাস্ত হচ্ছে ? বললেন, ‘পালাে পালাে, সাদা সাদা, একটু একটু পনর বার বাহ্যে গেলুম। তােমাদের এমন সেবা চাই না।' সেদিন আর বিকালে কিছু খেলেন না। ভাত টাত পড়ে রইল। একটু সাগু করে দিলুম। গােলাপ বললে, “মা, বলে দিতে হয়। আমি কি জানি? তাইতাে, খাওয়া নষ্ট হ’ল। আমি বললুম, খাওয়ার জন্য মিথ্যা বললে দোষ নেই, আমি এই রকম করে ভুলিয়ে টুলিয়ে খাওয়াই।' (আমাদিগকে) এই এতখানি শরীর হয়েছিল। বেশ সেরে গিয়েছিলেন।”
আমি—এ তো দেখছি মনেই সব।
মা—তাই তাে, মনেই। নতুবা না বললে এমনি বেশ খেতেন।
রাত্রে আমি ও বিভুতি খাইতে বসিয়াছি। আমি বিভুতিকে বলিলাম, ‘রাধুর জন্য একটি হিস্টিরিয়া রােগের কবচ ভাল লােকের কাছ থেকে এনে দিলে হয়।’
মা—হাঁ, বেলটের স্বরূপনারায়ণ ধর্মের পণ্ডিতরা ঔষধ দেয়। রাধুর জন্য তাই দেব মনে করেছি। এখন কিছুদিন দৈবী টৈবী দেখাবার ইচ্ছা। আমার মা ঐ স্বরূপনারায়ণের ফুল পেয়ে ভাল হয়েছিলেন। সেই হতে আমার এটিতে বিশ্বাস।
বিভূতি—ওঃ, ধর্মের পণ্ডিত (সেবাইত )? বৌদ্ধরা ঔষধপত্র দিত কিনা। ধর্ম হচ্ছে বুদ্ধদেব।
মা—আমাদেরও আছে ধর্ম মাড়ো (মন্দির), ঐ যে ওখানে। 
আমি—ধর্ম তাে সব জায়গায় জানি বুদ্ধমূর্তি। 
মা—এখানে কচ্ছপমুর্তি, নারায়ণ বলে। 
বিভূতি—আসনের মতাে না? নীচে চারটি পুরাে দেওয়া ?
মা—হাঁ, মাঝখানটি একটু উচু।
বিভুতি—ও কচ্ছপ নয়, বুদ্ধাসন। বুদ্ধাবস্থা অস্তি-নাস্তির পারে কিনা। তাঁর কোন মূর্তি হতে পারে না। তাই তাঁর শুদ্ধ আসন করেছে।
মা—তা হতে পারে। আমাদের এই ধর্মকে ছেলেরা পুজো করছে। যা দেয় ; কোন বিধি-নিষেধ নেই। হয়তাে দুটো লাল ফুল, কি যা হ’ল তাই দিলে । কোন অপরাধ নেন না। যে যা দেয় তাতেই খুশী।
আমি—বেদনা প্রভৃতির লােকে দৈব ঔষধ পায়, এর অদৃষ্টে তা আর হল না।
মা—না, কেউ ফিরে চাইলেন না। এই যে এত ডাকি, কিছুই না। আমার অসুখের সময়, তখন সব শরীর ফুলে গেছে, নাক কান দিয়ে রস ঝরছে। উমেশ (মায়ের ভাই) বললে, “দিদি, এখানে সিংহবাহিনী আছেন, হত্যা দেবে ?” সে ই আমাকে রাজী করে ধরে ধরে নিয়ে গেল। পূর্ণিমার রাত আমার কাছে অমাবস্যা-চক্ষে দেখতে পাই না, জল পড়ে পড়ে চক্ষু গেছে। গিয়ে মায়ের মাড়াতে পড়ে রইলুম। আবার আমাশা; তিন-চারবার হাতড়ে হাতড়ে রাত্রেই শৌছে গেলুম। ভিক্ষে মা ছিল ; ঐখানেই তার ঘর। সে মাঝে মাঝে গলা খ্যাঁকার দিত, আমি ভয় না পাই। পড়ে রইলুম। কিছুক্ষণ পরেই আমার মাকে এসে বলছেন, কামারদের একটি মেয়ের বেশে, রাধুর মতাে অত বড় (১২। ১৩ বছরের) মেয়েটিকে, 'যাও যাও, উঠিয়ে আনগে। অমন অসুখ, তাকে ফেলে রাখতে আছে? এক্ষনি আনগে। এই ওষুধ দিও, এতেই ভাল হয়ে যাবে।” এদিকে আমাকে বললেন, লাউফুল নুন দিয়ে রগড়ে তার রস চোখে ফুট (ফোঁটা ফোঁটা করে) দিও, ভাল হয়ে যাবে। তারপর মা যে ওষুধ পেলেন তাই নিলুম। আর লাউফুলের ফুট চোখে দিলাম। দিতেই যেমন জাল টেনে আনে, অমনি চোখের সব ময়লা টেনে বের করে দিলে। সেইদিনই চোখ ভাল হয়ে গেল। আর শরীরের সব ফুলাে-টুলাে কমে গেল। বেশ ঝরঝরে হলুম। সেরে গেলুম। যে জিজ্ঞাসা করত, বলতুম, ‘মা ওষুধ দিয়েছেন।’ সেই হতেই মায়ের মাহাত্ম প্রচার হ’ল। আমিও ওষুধ পেলুম, জগৎও ধন্য হল। আগে আগে মাকে অত কেউ জানত না। আমার খুড়ো মায়ের ওখানে হত্যা দিলেন। তাঁকে কিন্তু এমন ডেয়াে ছেড়ে দিলেন যে টিকতে দিলে না। মাকে এসে স্বপ্নে বলছেন, আমি যে শয়নে আছি, এখন কেন হত্যা দিয়েছে? ও বামুন মানুষ, এ সব জানে না ? যাও, যাও, উঠিয়ে আনগে। মা বললেন, ‘এত কথা বললে, আর ওষুধটুকু বলে দিলেই তাে হত।’
“আমার মা একবার দেখেছিলেন। একবার গ্রামের কালীপূজার সময় নব মুখুজ্যে আড়াআড়ি করে আমাদের চাল নিলে না। মা চাল-টাল তয়ের করে রেখেছিলেন-পূজার যােগান। আমাদের ঘর থেকে আর নিলে না। মা সমস্ত রাক্তির কেবল কাঁদলেন, কালীর জন্যে চাল করেছি, আমার চাল নিলে না ? এ চাল আমার কে খাবে? এ কালীর চাল তাে কেউ খেতে পারবে না। তারপর রাত্রে দেখেন কি জগদ্ধাত্রী, লাল রং, দুয়ারের ধারে পায়ের উপর পা দিয়ে বসেছেন। তখন ঐ একটি ঘর, বরদার ঘরটি। তিনি (ঠাকুর) আসলেও ঐ ঘরে থাকতেন। জগদ্ধাত্রী আমার মাকে গা চাপড়ে চাপড়ে ওঠালেন। উঠিয়ে বলছেন, “তুমি কাঁদছ কেন ? কালীর চাল আমি খাব। তােমার ভাবনা কি ? মা বললেন, ‘কে তুমি?’ জগদ্ধাত্রী বললেন, 'আমি জগদম্বা, জগদ্ধাত্রীরূপে তােমার পূজা গ্রহণ করব। পরদিন মা আমাকে বলছেন, “আরে সারদা, লাল রং, পায়ে পা ঠেসান দিয়ে ও কি ঠাকুর ? আমি জগদ্ধাত্রী পূজো করব।' ‘জগদ্ধাত্রী পূজা করব, জগদ্ধাত্রী পুজা করব'—তাঁর একটা বাই হয়ে গেল! বিশ্বাসদের কাছ থেকে দু আড়া (প্রায় ১৩ মণ) ধান আনলেন। এমন বৃষ্টি তখন, একদিনও ফাঁক নেই। মা বললেন ‘মা, কি করে তােমার পূজা হবে, ধানই শুকাতে পারলাম না। শেষটায় মা জগদ্ধাত্রী এমন রােদ দিলেন যে, চারিদিকে বৃষ্টি হচ্ছে, মায়ের চাটাইয়ে রােদ ! কাঠ জ্বেলে সেঁকে সেঁকে মূর্তি শুকনাে করে রং দেওয়া হল। প্রসন্ন তাঁকে ( ঠাকুরকে) দক্ষিণেশ্বরে খবর দিতে গেল। তিনি শুনে বললেন, “মা আসবেন, মা আসবেন, বেশ, বেশ। তােদের বড় খারাপ অবস্থা ছিল যে রে।' প্রসন্ন বললে, আপনি যাবেন, আপনাকে নিতে এলুম। তিনি বললেন, “এই আমার যাওয়া হ’ল ; যা, বেশ, পুজা করগে। বেশ, বেশ, তােদের ভাল হবে।’ জগদ্ধাত্রীপুজা হ'ল। দেশাম (দেশসুদ্ধ নিমন্ত্রণ) হ’ল। ঐ চালেই সব খরচ-পত্ৰ কুলিয়ে গেল। প্রতিমা বিসর্জনের সময় মা জগদ্ধাত্রী-মূর্তির কানে কানে আবার বলে দিলেন, ‘মা জগাই, আবার আর বছর এসাে। আমি তোমার জন্য সমস্ত বছর ধরে সব যােগাড় করে রাখব। পরের বছর মা আমাকে বললেন, “দেখ, তুমি কিছু দিও, আমার জগাইয়ের পূজা হবে। আমি বললুম, “অত ল্যাঠা আমি পারব না! হল, একবার পূজা হ'ল, আবার ল্যাঠা কেন? দরকার নেই, ও পারব না। রাত্রে স্বপ্নে দেখি কি তিনজনে এসে হাজির। ওরে বাপ! সেই মনে পড়ছে।”
আমি—তিনজন কে কে ? 
মা—জগদ্ধাত্রী ও জয়া বিজয়া সখী। বলছেন, ‘আমরা তবে যাব?’ আমি বললুম, “কে তােমরা। বললেন, ‘আমি জগদ্ধাত্রী।’ আমি বললুম, ‘না, তােমরা কোথা যাবে? না, না, তােমরা কোথা যাবে ? তােমরা থাক, তােমাদের যেতে বলি নি।’
“সেই থেকে বরাবর জগদ্ধাত্রীপূজার সময় এখানে আসি। বাসন-টাসন মাজতে হয় কিনা। আর তখন তাে আমাদের সংসারে লােকজন বেশী ছিল না। বাসন মাজতে আসতুম। তারপর যােগীন (মহারাজ) সব কাঠের বাসন করে দিলে। বললে, মা, তােমাকে আর বাসন মাজতে যেতে হবে না।' জগদ্ধাত্রীপূজার জমিও করে দিলে। আহা! আমার মা ছিলেন যেন লক্ষ্মী; সমস্ত বছর সব জিনিষটি-পত্রটি গুছিয়ে-টুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখতেন। বলতেন, ‘আমার ভক্ত-ভগবানের সংসার, আমার সারদা (স্বামী ত্রিগুণাতীত) হয়তাে কখনও আসবে, যােগীন (মহারাজ) আসবে। এসব দরকার।' ভাল চাল টাল যা পেতেন সব ঠিকঠাক করে রাখতেন। বলতেন, “আমি যতক্ষণ আছি, ব্রহ্ম আছেন, বিষ্ণু আছেন, জগদম্বা আছেন, শিব আছেন, সব আছেন। আমিও যাব, এরাও সঙ্গে সঙ্গে যাবেন। তােরা কি যত্ন করতে পারবি ! আমার ভক্ত ভগবানের সংসার।
“আমার একটু আমাশয়ের মতো হইয়াছিল। তাহা শুনিয়া মা বলিলেন, ‘ওর আমাশার ধাত, কাশীতেও হ’ল। আমি বলিলাম, ‘কাশী যাবার আগে কলকাতায় হয়েছিল। আমাদের বংশেরই এই রােগ। বাবা এবং আরও অনেকে আমাশায় মারা গেছেন। 
বিভুতি—ও সব কি? কবে বাপ কিসে মারা গেছেন, তাতে কি ?
মা—হাঁ, ও কি ? দুষ্টান্ত দেওয়া ভাল নয়। দৃষ্টান্ত দিলে ভুগতে হয়। কে কবে মরেছে। কেবা বাপ, কেবা মা ? ঈশ্বরই সব।

৩০শে আষাঢ়, ১৩২০, জয়রামবাটী
 
মধ্যাহ্নে মায়ের ঘরের বারান্দায় আমি ও মুকুন্দ (সাহা) খাইতে বসিয়াছি।
মা বড় মামার বারান্দার পূর্বপাশে বসিয়া আছেন, এমন সময় নলিনী ভিজা কাপড়ে আসিয়া বলিল, কাকে তাহার কাপড়ে প্রস্রাব করিয়াছে বলিয়া সে আবার স্নান করিয়া আসিয়াছে। 
মা—বুড়াে হতে চললুম, কাকে প্রস্রাব করে, কখনও শুনিনি! বহু, পাপ, মহাপাপ না হলে কি মন অশুদ্ধ হয় ? কৃষ্ণ বােসের বােনের অমনি শুচিবাই ছিল। ‘টিকিটা ডুবল কি ?'—গঙ্গায় নাইতে গিয়ে ডুব দিচ্ছে, আর লােকদের জিজ্ঞাসা করছে। শুচিবাই, মন আর কিছুতেই শুদ্ধ হচ্ছে না। অশুদ্ধ মন অনায়াসে যায় না। আর শুচিবাই যত বাড়াবে তত বাড়বে। সবই যত বাড়াবে তত বাড়বে।
আমি—মহাপুরষকে দেখেছি ভজা প্রভৃতি কুকুরগুলােকে ঘেঁটে তারপর হয়তাে ঠাকুরপূজা করতে গেলেন। যাবার সময় কেউ হাতে জল (তখন গঙ্গাজলই সব কাজে ব্যবহার হত) ঢেলে দিলে, আচমনের মতাে একটু হাত ধুলেন মাত্র।
মা—তাদের কথা স্বতন্ত্র। তাদের মন কত শুদ্ধ-সাধুর মন! গঙ্গাতীরে যারা বাস করে তারা সব দেবতা। দেবতা না হলে কি গঙ্গাতীরে বাস হয় ? আর গঙ্গাস্নানে রোজের পাপ রােজ ক্ষয় হয়। 
নলিনী—গােলাপ দিদি একদিন ‘উদ্বোধনে’ (উপরের) পায়খানা সাফ করে এসে, আবার কাপড় ছেড়েই ঠাকুরের ফল ছাড়াতে গেল। আমি বললুম, ‘ও কি, গােলাপ দিদি। গঙ্গায় ডুব দিয়ে এস। গােলাপ দিদি বললে, “তাের ইচ্ছা হয় তুই যা না।'
মা—গােলাপের মন কত শুদ্ধ, কত উঁচু মন। তাই ওর অত শুচি-অশুচি বিচার নেই—অত শুচি-বাই-টাই-এর ধার ধারে না। ওর এই শেষ জন্ম। তােদের অমন মন হতে আলাদা দেহ দরকার।
“আর চারক্রোশী গঙ্গাতীর, পবিত্র হাওয়া বয়। হাওয়ার,রূপী নারায়ণ। বহু তপস্যা করলে এই মন শুদ্ধ হয়। সাধন বিন শুদ্ধ বহু কভু না মিলয়।'
“ভগবানলাভ হলে কি আর হয় ? দুটো কি শিং বেরোয় ? না, মন শুদ্ধ হয়। শব্দ মনে জ্ঞানচৈতন্যলাভ হয়।”
আমি—যারা ভগবানের উপর নির্ভর করে পড়ে থাকে তাদের (বিনা। সাধনে) কি করে হয় ?
মা—ভগবানের উপর নির্ভর করে, বিশ্বাস করে যে পড়ে থাকে, এইটিই তাদের সাধন। আহা, নরেন বলেছিল, ‘লাখ জন্ম হলেই বা, তাতে ভয় কি ? তাইতাে জ্ঞানীর জন্ম নিতে ভয় কি ? তাদের তাে আর পাপ হয় না। অজ্ঞানীরই যত ভয়। তারাই বন্ধ হয়, পাপে লিপ্ত হয়। কত লাখ লাখ জন্ম। ভুগে ভুগে, যাতনা পেয়ে পেয়ে শেষে ভগবানকে চায়।
আমি—ঘেঁট ঘেঁটে তবে তাে শিক্ষা হয়, জ্ঞান হয়।
মা—হাঁ, ঢাক, ঢােল, বীণা, সব যন্ত্র বাজিয়ে বাজিয়ে শেষে ধুনুরীর হাতে পড়ে তবে তুহ, তুহু ডাক ছাড়ে। 
শ্ৰীযুত রামলাল দাদার মেয়েটি বিধবা হইয়াছে শুনিয়া বলিলেন, “ঠাকুর বলেছিলেন, “ওসব দেববংশের মেয়ে ওরা কখনও সংসারী হবে না। তাই সব বিধবা। রামলালের কষ্ট আর কি। ছেলেটি মারা গেল। আজ থাকলে বার-তেরো বছরের হ'ত। ছেলেগুলাে১ ‘দাদামশায়, দাদামশায়’ করে নাচছে। আর ওদেরও এই শেষ জন্ম। তাই সব এসে জন্মেছে তাে।”

১. এত রামলাল দাদা ও শিবু দাদার শিশুপুত্রগণ শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতিকৃতি দর্শনে ঐরূপে আনন্দপ্রকাশ করিত।

২রা আশ্বিন, জয়রামবাটী

মা একজনকে পত্রে জানাইতেছেন, “শরীরধারণে কিছুমাত্র সুখ নাই। দুঃখপূর্ণই জগৎ। সুখ কেবল একটি নাম মাত্র। ঠাকুরের কৃপা যাহার উপর হইয়াছে সেই কেবল তাঁহাকে ভগবান বলিয়া জানিতে পারিয়াছে এবং তাহার সেইটুকুই সুখ জানিবে।”
একটি ত্যাগী ভক্ত জয়রামবাটীতে মাকে দর্শন করিয়া হৃষীকেশ গিয়াছেন। কিছুদিন পরেই তিনি মাকে লিখিয়াছেন, “মা, তুমি বলেছিলে, ‘সময়ে ঠাকুরের দর্শন পাবে। কই তা হল?” ইত্যাদি। মা চিঠি শুনিয়া আমাকে বলিতেছেন, “দাও তাে, দাও তাে ওকে লিখে, ‘তুমি হৃষীকেশ গিয়াছ বলে ঠাকুর তােমার জন্য সেখানে এগিয়ে থাকেননি।’ সাধু হয়েছে, ভগবানকে ডাকবে না তাে কি করবে? তিনি যখন ইচ্ছা দেখা দেবেন।”

উদ্বােধন 

একটি ছেলে মায়ের কৃপালাভের জন্য দুই-একবার আসিয়াছিল। ছেলেটি গরীব, অনেক কষ্টে আসিয়াছিল। কিন্তু তাহার দুভাগ্যবশতঃ মায়ের শরীর অসুস্থ থাকায় কৃপালাভ করিতে পারে নাই। এবারে সে আমাদিগকে অনুযোেগ করিয়া লিখিয়াছে, “আপনারা আর দুয়ার বন্ধ রাখিবেন না, আমাকে বহু কষ্টে যাইতে হয়। আমি জানিতে চাই, এবার যাইলে হইবে কিনা” ইত্যাদি। তাহার পত্র মাকে পড়িয়া শুনান হইল। মা তদুত্তরে বলিলেন, “আমার শরীর যখন খারাপ থাকে তখন যেই আসুক না কেন, ফিরে যাবে। শরীর ভাল থাকলেও কাকেও নিয়ন্ত্রণ করে আনতে পারব না। যার যেমন ভাগ্য, যার যেমন কর্ম, তার তেমনি সুযােগ-সুবিধা হয়ে থাকে। কেউ বা বহুবার এসেও দর্শনের সুবিধা পায় না, হয়তাে আমার অসুখ, বা অন্য কোন ব্যাঘাত ঘটল। সে তার অদৃষ্ট ; তার আমি কি করব ? যাতায়াতে তাদের বহু অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে, সকলের টাকা নাই, বলবে। তা গুরু যতবারই ফিরিয়ে দেন না কেন, যে কৃপা চায়, সে ভিক্ষা করেও আসে। কথা এই, যার ভবপারে যাবার সময় হবে সে দড়ি ছিড়ে আসবে, তাকে বেধেও কেউ রাখতে পারে না। অর্থাভাব, চিঠির অপেক্ষা, এসে ফিরে যাওয়ার ভয়—এসব কিছুই কিছু নয়। পরিশেষে বলিলেন, “আজকাল শরীর একটু ভাল আছে, এখন আসতে পারে, লিখে দাও।”
একটি স্ত্রীলোেক লিখিয়াছেন, “মা, আমার অল্প বয়স। শ্বশুর-শাশুড়ী আসতে দিচ্ছেন না। তাঁদের অমতে কি করে আসি। আপনার কৃপালাভ ইচ্ছা” ইত্যাদি। মা তাঁহাকে লিখিতে বলিলেন, “মা, তােমার এখানে আসিবার আবশ্যকতা নাই। যে ভগবান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়িয়া রহিয়াছেন তুমি তাঁহাকেই ডাক। তিনিই তােমাকে কৃপা করিবেন।”

৩০-৯-১৮ উদ্বোধন, ঠাকুরঘর 

সকালে মা পূজার জন্য ফল ছাড়াইতেছিলেন। জনৈক ভক্তের পত্র পড়িয়া শুনাইতেছিলাম। পত্রখানি ভগবানের উপর অভিমানের ভাবে লেখা। মা তদুত্তরে বলিলেন, “ঠাকুর বলতেন, শুক, ব্যাস তাে ডেয়াে-পিঁপড়ে। তাঁর অনন্ত রয়েছে। তুমি যদি ঈশ্বরকে না ডাক—আর কত লােক তাে তাঁকে মনেই করছে না—তাতে তাঁর কি? সে তােমারই দুর্ভাগ্য। ভগবানের এমনি মায়া যে তিনি এই রকম করে সব ভুলিয়ে রেখেছেন-“বেশ আছে ওরা, থাক।”
আমি –মা, এরা (পত্ৰলেখক) যে চায় না তা নয়। না চাইলে এমন প্রশ্ন এদের মনে উঠবে কেন? তবে যাকে আপনার ব’লে ধরতে যাচ্ছি, তিনি ধরাছোঁয়া দিচ্ছেন না, এটা বড় প্রাণে লাগে। বুদ্ধ, চৈতন্যদেব, যীশুখ্রীষ্ট এরা ভক্তদের জন্য কত করতেন—কিসে তাদের কল্যাণ হবে।
মা —আমাদের ঠাকুরেরও তাে ঐ ভাব ছিল। তবে আমার তাে সব সময় মনে থাকে না (সকল ভক্তকে)। আমি ঠাকুরকে বলি, ‘ঠাকুর, তুমি সকলের কল্যাণ কর, যে যেখানে আছে, আমার তাে সকলকে মনে থাকে না।’ আর দেখ, তিনিই সব করছেন, তা না হলে এত সব আসছে ? 
আমি—তাতাে বটেই। মানুষ কালী, দুর্গ, এ সবকে বরং ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু মানুষকে ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করা—একি হতে চায় ?
মা—এইটি তার কৃপা।
পরে একদিন ভক্তটি আসিলে মাকে বলিলাম, “মা, এই সেই চিঠি লিখেছিল।” মা বলিলেন, “এ ? এত ভাল ছেলে।” ভক্তটিকে বলিয়াছিলেন, “এমন যে জল, যার স্বভাব নীচের দিকে যাওয়া, তাকেও সূর্যকিরণ আকাশে টেনে তােলে। তেমনি মনের তো স্বভাবই নীচুদিকে—ভােগে। তাকেও ভগবানের কৃপা উর্ধ্বগামী করে।”
বেলা প্রায় সাড়ে দশটা হইবে। একটি গৃহস্থ শিষ্য মাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছেন। প্রণাম করিয়া মাকে বলিতেছেন, “মা, কেন ঠাকুরের দর্শন হচ্ছে না?” ইত্যাদি। মা বলিলেন, “ডাকতে থাক ক্রমে হবে। কত মুনি ঋষি যুগযুগান্তর ধরে তপস্যা করে পেলে না, আর তােমাদের ফস করে হবে? এজন্মে না হয়, পরজন্মে হবে, পরজন্মে না হয়, তার পরজম্মে হবে। ভগবানলাভ | কি এতই সােজা? তবে এবার ঠাকুরের সােজা পথ, তাই।” 
ভক্তটি বাহিরে গেলে মা বলিলেন
“এই সংসার করে এলুম, এই কুড়িগণ্ডা ছেলের বাপ হয়ে এলুম! বলে কিনা, ঠাকুরের দেখা কেন পাই না ?
“ঠাকুরের কাছে মেয়েমানুষগুলো যেত। বলত, “কেন ঈশ্বরে মন হয় ?” কেন মন স্থির হয় না?'—এই সব। ঠাকুর তাদের বলতেন, “আরে, গা থেকে এখনও আঁতুড়-গন্ধ যায় নি। আগে আঁতুড়-গন্ধ ছাড়ক। এখন কিরে? ক্রমে হবে। এজন্মে এই দেখা হল, পরজন্মে আবার দেখাটেখা হবে, তখন হবে।'
“যখন দেহ থাকে তখন অনায়াসেই দর্শন মেলে। এই এখানে রয়েছি এলেই দেখা হয়। এখন ঠাকুরকে চাক্ষুষ দেখা কজনের ভাগ্যে হয়? বিজয় গোঁসাই ঢাকায় দেখেছিল—গা টিপে। ঠাকুর বললেন, ‘আত্মাটা যে বেরিয়ে যায়, এ ভাল নয়; দেহ বুঝি এবার বেশীদিন থাকবে না।
‘কার হয়েছে বল না ? নরেনের তিনি করে দিয়েছিলেন। শুক, ব্যাস, শিব তাে ডেয়াে-পিঁপড়ে। স্বপ্নে-টপ্লে হয়তাে দর্শন হয়। নতুবা তিনি দেহ ধরে দেখা দেবেন, সে বহু ভাগ্যের কথা।
( উত্তেজিতকণ্ঠে) “যদি শুদ্ধ মন হয়, কেন ধ্যানধারণা হবে না? কেন দর্শন হবে না? জপ করতে কলম তাে আপনা হতেই ভিতর থেকে গুরু গুরু করে নাম উঠতে থাকবে, চেষ্টা করে নয়।
“জপধ্যান সব যথাসময়ে আলস্য ত্যাগ করে করতে হয়। দক্ষিণেশ্বরে একদিন শরীরটা খারাপ লাগায় একটু দেরিতে উঠেছি। তখন রাত তিনটায় উঠতুম। পরদিন আরও দেরিতে উঠলুম। ক্রমে দেখি আর সকালে উঠতেই ইচ্ছা যাচ্ছে না। তখন মনে হল, ওরে এইতাে আলস্যে পেয়েছে। তারপর জোর করে উঠতে লাগলুম, তখন সব পবের মতাে হতে লাগল। এসব বিষয়ে রােক করে অভ্যাস রাখতে হয়।
“সাধন বল, ভজন বল, তীর্থদর্শন বল, অথোপার্জন বল—সব প্রথম বয়সে করে নিতে হয়। এই আমি তখন হেঁটে হেঁটে কাশী-বৃন্দাবনে কত দর্শন করেছি। এখন দুহাত যেতে হলে পালকি চাই—ধরে ধরে নিতে হয়। বৃদ্ধ বয়সে কফ-শ্লেমায় ভরা, শরীরে সামর্থ্য নেই, মনে বল থাকে না তখন কি কোন কাজ হয় ? এই যে এখানকার ছােকরারা সব প্রথম বয়সেই ভগবানে মন দিচ্ছে, এ ঠিক দিচ্ছে, ঠিক সময়ে হচ্ছে। (আমাকে) বাবা, সাধন বল, ভজন বল, সব এখন, এই বয়সেই করে নেবে। শেষে কি আর হয় ? যা করতে পার, এখন।”
আমি এখন যারা তােমার কৃপা পাচ্ছে, তারা তাে ভাগ্যবান। এর পর যারা আসবে তাদের কি করে হবে ?
মা—সে কি ? তা হবে না? ভগবান সর্বত্র সব সময়ে রয়েছেন। ঠাকুর রয়েছেন। তাঁর কৃপায় হবে। অন্য সব দেশে হচ্ছে না?
আমি—ভালবাসা পেলে তবে তাে প্রাণ ব্যাকুল হয়। তুমি আমাদের ভালবাস কই?
মা—তােমাকে আবার ভালবাসি না ? যে আমার জন্য এতটুকু করে, তাকে ভালবাসি । আর তুমি এত করেছ! বাড়িতে যখনই যে জিনিসটি ধরি, তােমার কথা মনে পড়ে। ভাল খুবই বাসি। তবে শরীর নিয়ে তো আর মেশামেশি করতে পারি না। আর সেগুলাে করা কি ভাল? তােমরা যে কয়টি এখানে রয়েছ তাদের প্রায়ই মনে পড়ে। তবে যারা দূরে আছে তাদের জন্য ঠাকুরকে জানাই—“ঠাকুর, তুমি ওদের দেখো, আমার তাে আর মনে থাকে না।'

উদ্বোধন, ঠাকুরঘর 

মা তাঁহার তক্তপােশের উপর বসিয়া আছেন, আমি ভক্তদের পত্র পড়িয়া শুনাইতেছিলাম। কৃষ্ণলাল মহারাজও ছিলেন। পত্র লিখিয়াছে, মন স্থির হয় না, ইত্যাদি। মা এই সকল কথায় বেশ একটু উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “রােজ পনর-বিশ হাজার করে জপ করতে পারে, তাহলে হয়। আমি দেখেছি, কৃষ্ণলাল, বাস্তবিক হয়। আগে করুক ; না হয়, তখন বলবে। তবে একটু মন দিয়ে করতে হয়। তা তাে নয়, কেউ করবে না, কেবল বলে—কেন হয় না ?"
একটি ভক্ত প্রণাম করিতে গিয়া ধ্যানজপের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেন। মা বলিলেন “জপ, সংখ্যা, করগণনা- এসব শুধু মন আনবার জন্য। মন এদিক ওদিক যেতে চায়, তবু ঐ সবের দ্বারা এদিকে আকৃষ্ট হয়। যখন জপ করতে করতে ভগবানের রূপ-দর্শন হয়, ধ্যান হয়, তখন জপও থাকে না। ধ্যান হ’ল তাে সবই হল।
“মন চঞ্চল, তাই প্রথম প্রথম মন স্থির করবার জন্য একটু একটু নিঃশ্বাস বন্ধ করে ধ্যানের চেষ্টা করতে হয়। তাতে মন স্থির হবার সাহায্য করে। কিন্তু ওভাবে বেশী করতে নাই, মাথা গরম হয়। ভগবানদর্শন বল, ধ্যান বল, সবই মন। মন স্থির হলে সবই হয়।
“মানুষ তাে ভগবানকে ভুলেই আছে। তাই যখন যখন দরকার, তিনি নিজে এক একবার এসে সাধন করে পথ দেখিয়ে দেন। এবার দেখালেন ত্যাগ। তিনি শতবর্ষ ছেলেপুলে নিয়ে থাকবেন বলছেন।”

স্বামী ঈশানানন্দ

১৩১৬ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে একদিন সকালে শুনিলাম, সেইদিন বৈকালে চারিটার সময় শ্রীশ্রীমা পূজনীয় শরৎ মহারাজ, যােগেন-মা, গােলাপ-মা প্রভৃত্রি সহিত কলিকাতার পথে কোয়ালপাড়া পৌঁছিবেন এবং আমাদের শিক্ষক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ দত্তের (স্বামী কেশবানন্দের) বাটীর ঠাকুরঘরখানিতে শ্রীশ্রীমার ও আমাদের স্কুলে আর সকলের বিশ্রামের ব্যবস্থা হইয়াছে। কিন্তু সন্ধ্যা হইয়া গেলেও তাহারা আসিয়া পৌঁছিলেন না। পরে সংবাদ আসিল তাঁহাদের গাড়ি নদীর নিকট দ”কে পড়িয়াছে। তৎক্ষণাৎ ভক্তদের কয়েকজন সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। ক্রমে রাত্রি দশটা আন্দাজ সকলে আসিয়া পেীঁছিলেন।
মা গাড়ি হইতে নামিয়া বেশ ঘোমটা দিয়া একটু পা টানিতে টানিতে কেদারবাবুর মার সহিত তাঁহাদের ঠাকুরঘরে গেলেন। তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলে সমবেত স্ত্রী ও পুরুষ ভক্তগণ তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। আমিও করিলাম। কেদারবাবুর মা কানে একটু কম শুনিতেন। বলিয়া মা আমার দ্বারাই পুরষ ভক্তগণের সহিত কথাবার্তা কহিয়াছিলেন। এদিকে বেশী রাত্রি হইতেছে বলিয়া পুজনীয় শরৎ মহারাজ সংবাদ পাঠাইলে মা শশব্যস্ত থালা হইতে একটি সন্দেশের কিছু ভাঙিয়া গ্ৰহণ করিলেন ও একটু জল খাইয়া রওয়ানা হইবার জন্য গাত্রোখান করিলেন। সকলের সঙ্গে আমিও তাড়াতাড়ি ভিড়ের মধ্যে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া, বাবা যাহা প্রণামী দিতে দিয়াছিলেন তাহা তাঁহার হাতে দিলাম। মা সস্নেহে চিবুকে হাত দিয়া চুম খাইয়া বলিলেন, “বাবা, যা কিছু দিতে হয় সব পায়ে দিতে হয়।” তিনি ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠিলেন। 
সেই সামান্য কয়েকটি কথার ভিতর দিয়া তাঁহার যে স্নেহের আস্বাদ পাইয়াছিলাম তাহার তুলনায় পিতামাতার ভালবাসাও সেই বয়সে তুচ্ছ বােধ হইয়াছিল। 
একবার জগদ্ধাত্রীপূজার সময় মা কলিকাতা হইতে জয়রামবাটী আসিবার পথে সকালে কোয়ালপাড়া আশ্রমে পেীঁছিলেন। অপরাহ্নে রওয়ানা হইবার সময় আশ্রমের উৎসাহী কর্মীগণকে বলিলেন, “এখানে এখন তােমরাই আপনার জন। দেশে এখন তােমাদের ভরসাই ভরসা। এখানে দেখছি ঠাকুর তাহলে বসছেন।” একে একে সকলকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “মধ্যে মধ্যে জয়রামবাটী যেও। বিশেষ করে জগদ্ধাত্রীপূজার সময় তােমাদের সব যেতে হবে।”
জগদ্ধাত্রীপূজার দিন আমরা তিনজন আমাদের ক্ষেতের কতকগুলি শাকসবজি লইয়া জয়রামবাটী গেলাম। মা আমাদের দেখিয়া খুব আহলাদিত হইলেন ও বলিলেন, “এখানে তরকারিপাতি সব সময়ে মেলে না, মাঝে মাঝে বড় মুশকিলে পড়তে হয়। তা ঠাকুরই তোমাদের দিয়ে সব যােগাবেন দেখছি।” সেই সময় হইতে তিনি যখনই দেশে থাকিতেন, আমরা সপ্তাহে দুই-তিন দিন আশ্রমের দৈনন্দিন কার্য শেষ করিয়া কখনও বাগান হইতে, কখনও বা হাট হইতে কিনিয়া তাঁহার জন্য তরকারি লইয়া যাইতাম। কোন কোন দিন গিয়া দেখিতাম মা শুইয়া আছেন। আমরা তাঁহার নির্দেশমত জিনিসগুলি যথাস্থানে রাখিয়া প্রণাম করিলে তিনি মাথা একটু তুলিয়া “তােমাদের চৈতন্য হােক, ভক্তিবিশ্বাস হােক” বলিয়া আশীর্বাদ করিয়া কিছু মুড়ি লইতে বলিতেন। আমরাও উহা লইয়া খাইতে খাইতে কোন কোনদিন রাত্রি বারটায় আশ্রমে ফিরিতাম।
একদিন শীতকালে কতকগুলি তরকারি ও কিছু গাওয়া ঘি প্রভৃতি মাথায় লইয়া গলদঘর্ম অবস্থায় সন্ধার সময় আমরা জয়রামবাটী পেীঁছিলাম। মামীদের মধ্যে একজন আমাদের অবস্থা দেখিয়া বলিলেন, “ভক্ত হইলেই কি যত কষ্ট! বােঝা বয়ে ছেলেদের মাথা গেল।” শ্রীশ্রীমা ঐকথা শুনিয়া বলিলেন, “ওদের মাথা কি আর আছে ? যাঁর মাথা তাঁকে দিয়ে দিয়েছে। তারপর অতি স্নেহে মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন। পরে আশ্রমে আমাদের বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “একসঙ্গে অত জিনিস না পাঠিয়ে অল্প অল্প পাঠিও, নইলে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়।” ইহার পর আমরা অল্প মােট লইয়া ঘন ঘন তাঁহার নিকট যাইতাম।।
জগদ্ধাত্রীপূজার পর মা কলিকাতা যাইবেন। কোয়ালপাড়া আশ্রমে তখন খুব স্বদেশীচর্চা হয় এবং ধ্যান, জপ, পূজা, পাঠ প্রভৃতি অপেক্ষা তাঁত, চরকা প্রভৃতির উপরই সকলের বেশী ঝোঁক। মা চলিয়া যাইবেন শুনিয়া কেদারবাবু, জয়রামবাটীতে তাহাকে দর্শন করিতে গেলেন। মা তাঁহাকে বলিলেন, “দেখ, বাবা, তােমরা যখন ঠাকুরের জন্য ঘর ও আমাদের পথের বিশ্রামের স্থান একটু করেছ, তখন এবার যাবার সময় ওখানে ঠাকুরকে বসিয়ে দিয়ে যাব। সব আয়ােজন করে রেখাে। পূজা, অন্নভােগ, আরতি সব নিয়মিত করবে। শুধু স্বদেশী করে কি হবে? আমাদের যা কিছু সবার মূল ঠাকুর। তিনিই আদর্শ। যা কিছু কর না কেন, তাকে ধরে থাকলে কোন বেচাল হবে না।” কেদারবাবু বলিলেন, “স্বামীজীতে দেশের কাজ করতে খুব বলেছেন। তিনি আজ বেঁচে থাকলে কত কাজই না দেশের হ’ত?” ইহা শুনিয়া মা তাড়াতাড়ি বলিতেছেন, “ও বাবা, নরেন আমার আজ থাকলে কোম্পানি কি আর তাকে ছেড়ে দিত? জেলে পুরে রাখত। আমি তা দেখতে পারতুম না। নরেন যেন খাপখােলা তরোয়াল। বিলেত থেকে ফিরে এসে আমাকে বললে, “মা, আপনার আশীর্বাদে এ যুগে লাফিয়ে না গিয়ে তাদের তৈরী জাহাজে চড়ে সে মুলুকে গিয়েছি। সেখানেও দেখলাম ঠাকুরের কি মহিমা! কত সজ্জন লোক আমার কাছে তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে শুনেছে এবং এই ভাব নিয়েছে। তারপর বলিলেন, “তারাও তাে আমার ছেলে, কি বল ?”
প্রসঙ্গক্রমে দু-একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। একবার পুজোর সময় মামাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু কাপড় কিনিবার ভার মা আমার উপর দেন। আমি সব দেশী কাপড় লইয়া যাই। মেয়েরা অধিকাংশই অপছন্দ করিলেন এবং তাহাদের নিজেদের পছন্দমত ফরমাস করিতে লাগিলেন। আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, “ওসব তাে বিলিতী হবে, ও আবার কি আনব ?” শ্রীশ্রীমা একপাশে বসিয়াছিলেন। তিনি একটু হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বাবা, তারাও (বিলাতের লােক) তাে আমার ছেলে। আমার সকলকে নিয়ে ঘর করতে হয়। আমার কি একরোখা হলে চলে? ওরা যেমন যেমন বলছে তাই এনে দাও।” পরে দেখিতাম কাহারও অন্য কোন বিলাতী দ্রব্য আনাইতে হইলে মা আমাকে না বলিয়া অপরকে দিয়া আনাইতেন। কাহারও ভাবে আঘাত দেওয়া তাঁহার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল।
কিন্তু যেদিন সংবাদ আসিল কোন স্বদেশী মামলা সম্পর্কে যুথবিহার গ্রামের দেবেনবাবুর স্ত্রী ও ভগিনী সিন্ধুবালা দেবীদের (দুজনেরই নাম এক ছিল) গর্ভাবস্থায় বাঁকুড়ার পুলিশ-কর্তৃপক্ষ বন্দী করিয়া হাঁটাইয়া থানায় লইয়া গিয়াছেন, সেদিন মার অগ্নিময়ী মূর্তি দেখিয়া সকলে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল। মা প্রথমতঃ “বল কি।” বলিয়া যেন শিহরিয়া উঠিলেন। তারপর বলিলেন, “এটা কি কোম্পানির আদেশ, না পুলিশ সাহেবের কেরামতি ? নিরপরাধ স্ত্রীলােকের উপর এত অত্যাচার মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময় তাে কই শুনিনি! এ যদি কোম্পানির আদেশ হয়, তবে আর বেশীদিন নয়। এমন কোন বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না যে দু চড় দিয়ে মেয়ে দুটিকে ছাড়িয়ে আনতে পারত?” কিয়ৎক্ষণ পরে যখন তাহাদের ছাড়িয়া দিয়াছে এই সংবাদ শুনিলেন তখন অনেকটা শান্ত হইয়া বলিলেন, “এ খবর যদি না পেতাম তবে আজ আর ঘুমােতে পারতাম না।”
আর একবার মা কোয়ালপাড়ায় আছেন, সেইসময়ে একদিন পুজনীয় শরৎ মহারাজ রাসবিহারী মহারাজকে কতকগুলি আম সঙ্গে দিয়া মায়ের কাছে পাঠাইয়াছেন। তিনি পেীঁছিবার একটু পরেই প্রবােধবাবু মাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছেন। কুশলপ্রশ্নাদির পর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “হ্যাগাে, যুদ্ধের কি খবর ? কি লােকক্ষয়টাই না হল—কি মানুষমারা কলই না বের করেছে। আজকাল কতরকম যন্ত্রপাতি—টেলিগ্রাফ ইত্যাদি। এই দেখনা, রাসবিহারী কাল কলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে আজ এখানে পৌছে গেল। আমরা তখন কত হেঁটে, কত কষ্ট করে তবে দক্ষিণেশ্বরে গেছি।” প্রবােধবাবুর একটু উৎসাহিত হইয়া পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “ইংরেজ সরকার। আমাদের দেশের অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাড়িয়েছে।” মা সব কথায় সায় দিতে দিতে শেষে বলিলেন, “কিন্তু বাবা, ঐ সব সুবিধা হলেও আমাদের দেশে অন্নবস্ত্রের অভাব বড় বেড়েছে। আগে এত অন্নকষ্ট ছিল না।”
কলিকাতা যাইবার পথে মা কোয়ালপাড়া আশ্রমে ঠাকুর-প্রতিষ্ঠা করিলেন। নিজহাতে ঠাকুরের ও নিজের ফটো দুইখানি বসাইয়া বিশেষ পুজা করিলেন এবং কিশাের দাদাকে দিয়া হােম ও অন্যান্য ক্রিয়া করাইলেন। মধ্যাহ্নে মা হাঁটিয়া কেদারবাবুর মায়ের সঙ্গে তাঁহাদের বাড়িতে একটু বেড়াইতে গিয়াছেন। মা কেদারবাবুর বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় মধ্যপথে প্র মহারাজ তাঁহাকে পালকিতে উঠিতে বলায় তিনি একটু বিরক্ত হইয়াই উহাতে চড়িলেন। আশ্রমে আসিয়া মা তাঁহাকে খুব ভৎর্সনা করিয়া বলিলেন, “এ আমাদের পাড়াগা। কোয়ালপাড়া হ’ল আমার বৈঠকখানা। এইসব ছেলেরা আমার। আপনার লােক। আমি এদেশে এসে একটু স্বাধীনভাবে চলব ফিরব। কলকাতা থেকে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তােমরা তাে সেখানে আমাকে খাঁচার ভিতর পরে রাখ। আমাকে সর্বদা সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়। এখানেও যদি তােমাদের কথামত পাটি বাড়াতে হয়, তা আমি পারব না। শরৎকে লিখে দাও।” তখন প্র—মহারাজ ক্ষমা চাহিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “শরৎ মহারাজ আমাকে পথে খুব সাবধানে আপনাকে নিয়ে যেতে আদেশ করেছেন। আমার মনে হয়েছিল, বােধ হয় আমারই ত্রুটিতে আপনি হেঁটে গিয়েছেন। তা মা, আপনার যে অভিপ্রায় সেইরুপই করবেন।” 
প্র -মহারাজের কথামত ঠিক হইল সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বে তাঁহাদের খাবার আমরা প্রস্তুত করিয়া সঙ্গে দিব। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও আমরা সময়মত সব শেষ করতে পারিতেছি না দেখিয়া তিনি রাগ করিতে লাগিলেন। রাজেন দাদা বলিলেন, “বেশ, আপনার সময়মত এদের নিয়ে আপনি রওনা দেন। আমরা খাবার তৈরী করে যতদূর হােক মাথায় করে আপনাদের পেীঁছে দিয়ে আসবাে।” মা এই সকল শুনিতে পাইয়া প্ৰ- মহারাজকে বলিলেন, “তুমি মাথা গরম করে এত রাগারাগি করছ কেন? এ আমাদের পাড়াগা; কলকাতার মতাে এখানে কি সব ঘড়ির কাঁটাটিতে হয়ে ওঠে ? দেখছ সকাল থেকে ছেলেরা কি খাটাই খাটছে! তুমি যাই বলনা কেন, এখান থেকে না খেয়ে যাওয়া হবে না।” শেষে রাত্রি আটটা আন্দাজ আহারাদি করিয়া আটখানি গরুর গাড়িতে সকলে বিষ্ণুপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
মা রামেশ্বর তীর্থ হইতে কলিকাতায় ফিরিয়াছেন। আমরা তিনজন ‘উদ্বোধনে’র বাড়িতে তাহাকে দর্শন করিতে উপরে গিয়াছি। আমরা প্রণাম করিয়া বসিলে কোয়ালপাড়া আশ্রমের ও জয়রামবাটীর সকলের কুশল জিজ্ঞাসার পর মা কেদারবাবুকে বলিলেন, “তুমি আসবে শুনে তোমাদের আশ্রমের জন্যে দুখনি রামেশ্বরের ফটো রেখেছি। যাবায় সময় নিয়ে যেও। সেখানে পূজো করবে।” কেদারবাবু বলিলেন, “আপনিই তাে ঠাকুরকে বসিয়ে এসেছেন, আর তাঁকেই সকল দেবদেবীজ্ঞানে পূজা করতে বলেছেন। আবার এই ঠাকুর দিচ্ছেন। কত ঠাকুরের পুজো করব? আমরা অন্য ঠাকুরের পূজো করতে পারব না।” তখন মা বলিলেন, “আচ্ছা, এইগুলাে ভাল করে বাঁধিয়ে ঠাকুরঘরে টাঙিয়ে রেখাে।” কেদারবাবু, জিজ্ঞাসা করিলেন, “রামেশ্বর প্রভৃতি কেমন দেখলেন ?” মা বলিলেন, “বাবা, যেমনটি রেখে এসেছিলাম ঠিক তেমনটিই আছেন।” গােলাপ-মা তখন ঐ দিক দিয়া বারান্দায় যাইতেছিলেন। তিনি মায়ের ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “কি বললে, ?” মা একটু চমকিত হইয়া বলিলেন, “কই, কি বলব ? বলছি এই তােমাদের কাছে যেমনটি শুনেছিলাম ঠিক তেমনটিই দেখে বড় আনন্দ হয়েছিল। তখন গােলাপ মা বলিলেন, “না, মা, আমি সব শুনেছি, এখন আর কথা ফেরালে কি হবে ? কেমন গো, কেদার ?" এই কথা বলিতে বলিতে তিনি সেখান হইতে চলিয়া গেলেন ও যােগেন-মা প্রভৃতিকে সব বলিতে লাগিলেন। 
মা বলিলেন, “আহা, শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) আমাকে সােনার ১০৮টি বেলপাতা দিয়ে রামেশ্বরের পুজা করালে। রামনাদের রাজা, আমি এখানে এসেছি শুনে, তার দেওয়ানকে হুকুম দিলেন, মন্দিরের রত্নাগার খুলে আমাকে দেখাতে; আর যদি আমি কোন জিনিস পছন্দ করি, তখনই যেন তা আমাকে উপহার দেওয়া হয়। আমি আর কি বলব ? কিছু ঠিক করতে না পেরে বললাম, আমার আর কি প্রয়ােজন ? আমাদের যা কিছু দরকার সব শশীই ব্যবস্থা করছে। আবার তারা ক্ষুন্ন হবে ভেবে বললাম, আচ্ছা, রাধুর যদি কিছু দরকার হয়, নেবে এখন। রাধুকে বললাম, “দেখ, তাের যদি কিছু দরকার হয়, নিতে পারিস। তারপর যখন হীরা-জহরতের জিনিস সব দেখছি তখন কেবলই আমার বুক দরদর করছে। ঠাকুরের কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করছি, ঠাকুর, রাধুর যেন কোন বাসনা না জাগে। তা রাধু বললে, এ আবার কি নেব ? ও সব আমার চাই না। আমার লেখবার পেন্সিলটা হারিয়ে ফেলেছি, একটা পেন্সিল কিনে দাও। আমি এ কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাইরে এসে রাস্তায় দোকান থেকে দু পয়সার একটা পেন্সিল কিনিয়ে দিলাম।”
এই সকল কথাবার্তার পর মা ঠাকুরকে ভােগ দিতে উঠিয়া গেলেন। আমরাও নীচে নামিয়া আসিলাম।
জন্মাষ্টমীর দুই-এক দিন পূর্বে আমি মার নিকট ঐ দিন দীক্ষা লইবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় গােলাপ-মা শুনিতে পাইয়া তাহার স্বাভাবিক উচ্চ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ঐটুকু ছেলে (আমার বয়স তখন তের বৎসর), দুদিন পরে মন্ত্র ভুলে যাবে, এখন থেকেই দীক্ষা! কেদারের যেমন কাণ্ড। মা তাে তােমাদের দেশেরই। তিনি যখন সেখানে যাবেন তখন দেখে শুনে পরে দীক্ষা নিও।” ইহা বলিয়া গােলাপ-মা চলিয়া গেলেন। তখন মা বলিতেছেন, “গােলাপের কথা দেখ না। বালককালে যা ভাল করে শেখে তা কি ভােলে কখনও? এখন থেকে যা পারে করুক না। পরে তাে আমি আছিই।” জন্মাষ্টমীর দিন শ্রীশ্রীঠাকুরের পূজা সারিয়া মা আমাকে দীক্ষা দিলেন এবং আমাকে যেমন বলিয়াছিলেন সেইরুপ জপ করিতে দেখিয়া বলিলেন, “এই তাে ; এইটি আর মনে থাকবে না ? খুব থাকবে। পরে যেমন যেমন আবশ্যক সব সময়মত আবার দেখিয়ে দেব।” তারপর মাথায় ও বুকে হাত বুলাইতে বুলাইতে আশীর্বাদ করিলেন এবং আসন হইতে উঠিয়া বলিলেন, “আমার সঙ্গে এস।” আমি তাহাকে প্রণাম করিয়া তাঁহার সহিত পাশের ঘরে গেলে তিনি শিকা হইতে দুইটি পান্তুয়া লইয়া একটি হইতে সামান্য দাঁতে কাটিয়া খাইলেন এবং বাকী আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “খাও।” আমি উহা হাতে লইয়া তাঁহার সামনে খাইতে লজ্জা করিতেছি দেখিয়া বলিলেন, “লজ্জা করাে না, দীক্ষার পর প্রসাদ খেতে হয়।” বলিয়া এক গ্লাস জল দিলেন।
কয়েক দিন পরেই আমরা কেদারবাবুর মাকে ১ (তিনিও মায়ের সহিত রামেশ্বর প্রভৃতি তীর্থে গিয়াছিলেন।) সঙ্গে লইয়া কোয়ালপাড়ায় চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় মা কেদারবাবুকে কয়েকটি টাকা দিয়া বলিলেন, “জগদ্ধাত্রীপূজার জন্যে ধান কিনে কিছু চাল করিয়ে রাখবে।”
ফাগুন মাসে মা দেশে আসিতেছেন। কোয়ালপাড়া হইতে ভােরে আমরা তিনজন অনেকদুর আগাইয়া তাঁহাকে আনিতে গেলাম। মার গাড়িগুলি দৃষ্টিগােচর হইতেই আমাদের দুজন আশ্রমে খবর দিবার জন্য ফিরিয়া গেলেন। আমি গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ফিরিব বলিয়া থাকিয়া গেলাম। দূর হইতে মা আমাকে দেখিয়া বলিতেছেন, “কে গাে, ব-নয় ?” আমি কাছে গিয়া প্রণাম করিতেই মা সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। গাড়ি চলিতেছে, আমিও হাঁটিয়া যাইতেহি। মা ভিতর হইতে মুখ বাড়াইয়া “এটি কোন গ্রাম ? ওটা কাদের পুকুর ? কোয়ালপাড়া আর কতদূর?” ইত্যাদি নানা কথা বলিতে লাগিলেন।

১.এই বৃদ্ধা মহিলা মায়ের অনেক সেবা করিয়াছিলেন। যাট বৎসর বয়সে লেখাপড়া শিখিবার আগ্রহ হওয়ায় তিনি প্রথম ভাগ হইতে পড়িতে আরম্ভ করেন এবং শেষকালে রামায়ণ, মহাভারত পর্যন্ত পড়িতে ও বুঝিতে পারিতেন। রামেশ্বরেও তিনি প্রথম ভাগ ও স্লেট সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলেন। মায়ের দেহত্যাগের ছয়-সাত বৎসর পরে তাঁহার মৃত্যু হয়।

কোতুলপার ছাড়াইয়া আসিলে মা বলিলেন, “গাড়িতে উঠে এস না, আর কত হাঁটবে?” গাড়িতে মায়ের সহিত রাধুও ছিল। একটু পরে গাড়োয়ান গাড়ি হইতে নামিয়া বলিল, “আমি একটু হাঁটছি, আপনি এই সামনে বসুন।” আমি তখন গাড়িতে উঠিয়া গরু দুটিকে একটু তাড়া দিয়ে জোরে চালাইতেই মা খুব হাসিয়া উঠিয়া বলিতেছেন, “তুমি তাে বেশ গাড়ি হাঁকাতে জান। তা সব কাজই শিখে রাখা ভাল।” যথাসময়ে আশ্রমে আসিয়া পেীঁছিলাম। মায়ের বাতের শরীর । গরুর গাড়িতে বহুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া পা আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে। কেদারবাবুর মা হাত ধরিয়া তাঁহাকে গাড়ি হইতে নামাইয়া ধীরে ধীরে লইয়া গিয়া ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসাইলেন। মা একটু বিশ্রাম করিয়া স্নান করিলেন। আমাকে বলিলেন, “বাবা, কেদারের মার সঙ্গে আর বকতে পারি না (ইনি একটু কালা ছিলেন)। তুমি কাপড়খানা ছেড়ে গামছা পরে আমার পুজার যােগাড়টা করে দাও তাে।” 
আমি না জানিয়া মায়েরই ভিজা গামছাখানি পরিয়া সাজি লইয়া ফুল তুলিতে যাইতেছি। কেদারবাবুর মা তাহা দেখিয়া একেবারে অস্থির হইয়া বলিলেন, “ওরে মার গামছা পরেছিস যে রে, ছাড় ছাড়।” তখন মা বলিতেছেন, “তাতে কি ? ছেলেমানুষ—আমার গামছা পরেছে তাে কি হয়েছে ? যাও, যাও, ফুল নিয়ে এস।”
কেদারবাবু গল্প করিতে করিতে মাকে বলিলেন, “মা, আপনার সব ছেলেই বিদ্বান, আমরা এই কয়টি আপনার একেবারে মূর্খ সন্তান। শরৎ মহারাজ ঠাকুরের বই লিখে তাঁর কথা ও ভাব প্রচার করছেন। অন্যান্য ছেলেরা সব বক্তৃতা দিচ্ছেন-কত কাজ হচ্ছে।” মা শুনিয়া বলিতেছেন, “সে কি গাে ? ঠাকুর যে লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। ভগবানে মূর্তি হওয়াই আসল। তোমার দ্বারা এদেশে অনেক কাজ হবে। ঠাকুর এবার এসেছেন ধনী-নির্ধন, পণ্ডিতমূর্খ সকলকে উদ্ধার করতে। মলয়ের হাওয়া খুব বইছে। যে একটু পাল তুলে দেবে, শরণাগত হবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে। এবার বাঁশ ও ঘাস ছাড়া যার ভিতরে একটু সার আছে সেই চন্দন হবে। তােমাদের ভাবনা কি ? তোমরা আমার আপনার লোক। তবে কি জান, বিদ্বান সাধু, যেন হাতীর দাঁত সােনা দিয়ে বাঁধন।” এই কথা বলিয়া পুজা করিতে উঠিলেন। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মা পালকিতে জয়রামবাটী রওয়ানা হইলেন। 
জগদ্ধাত্রীপূজায় কোয়ালপাড়া হইতে যে লােকটির ভাণ্ডারী হইয়া যাইবার কথা ছিল তাহার হঠাৎ অসুখ হওয়াতে আমিই ওই কাজের ভার লইয়া পূজার পুর্বদিন জয়রামবাটী উপস্থিত হইলাম। মা আমাকে বলিলেন, “তা বেশ তুমিই পারবে। আজ সব দেখে শুনে রাখ। কাল খুব সকালে স্নান করে ভাড়ারে এস। একটু আলগোছ রেখে কাজগুলি করে তা হলেই হবে এখন।” ঐ অঞ্চলে সমাজের বাঁধাবাঁধি খুব বেশী বলিয়া মা শেষের কথাগুলি বলিলেন।১
জগদ্ধাত্রীপূজার দিন সকাল হইতে মা ভাণ্ডারে আসিয়া একটি বস্তার উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া রহিলেন এবং কেহ কিছু চাহিতে আসিলে আমি তাহাকে দেখাইয়া উহা দিতে লাগিলাম। পূজা শেষ হইলে পুম্পাঞ্জলি দিবার জন্য মা স্নান করিয়া মামীদের লইয়া মণ্ডপে গেলেন। তিনবার দেবীর চরণে পুম্পাঞ্জলি দিয়া গলবস্ত্রে জোড়হাতে একধারে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। পূজা নির্বিঘে শেষ হইল। মধ্যাহ্নে গ্রামের স্ত্রী-পুরুষ অনেকেই অন্নপ্রসাদ পাইলেন। দ্বিতীয় দিন (মা তিনদিন প্রতিমা রাখিতেন।) আমার জ্বর হওয়ায় মা নিজেই ভাঁড়ারের সব কাজ করিলেন।
সন্ধ্যারতির পর সাধু-ভক্তেরা সকলে মিলিয়া ভজন গান আরম্ভ করিলেন। “মাকে দেখবে বলে ভাবনা কেউ করাে না গাে আর ; সে যে তােমার আমার মা শুধু নয়, জগতের মা সবাকার।”—এই গানটি বার বার গাহিতে লাগিলেন। মা পাশের ঘরে বসিয়া মেয়েদের সহিত একমনে শুনিতেছেন। রাত্রে আমাকে বলিলেন, “আহা, গানটি বেশ জমেছিল। ভক্তের আবার জাত কি ? সব ছেলে এক। আমার ইচ্ছে হয় সবাইকে এক পাত্রে বসিয়ে খাওয়াই। তা এ পােড়া দেশে জাতের বড়াই আবার আছে। যাই হোক, মুড়িতে তাে আর দোষ নেই, কাল এক কাজ কর। খুব সকালে কামারপুকুরে সত্য ময়রার দোকান থেকে বড় বড় জিলিপি , দুসের নিয়ে এস।” পর দিন বেলা নয়টা আন্দাজ আমি জিলিপি লইয়া ফিরিলাম। মা উহা শ্রীশ্রীঠাকুরকে একবার দেখাইয়া একখানি বড় থালাতে বিস্তর মুড়ি ও তাহার চারিপাশে জিলিপিগলি সাজাইয়া ভক্তদের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। আমরা সকলে মহানন্দে উহা খাইতে লাগিলাম। পাশের ঘর হইতে মা দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।

১.একবার ভগিনী নিবেদিতা মার দেশে যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে মা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “না, মা, আমি বেঁচে থাকতে তােমরা সেখানে যেও না। তা হলে আমায় তারা ঠেকো (একঘরে) করবে।”

একবার বর্ষাকালে জয়রামবাটীতে খুব ম্যালেরিয়া ও আমাশয়ের প্রকোপ হয়। মাও কয়েকদিন আমাশয়ে খুব ভুগিয়া ডাক্তার কাঞ্জিলালের চিকিৎসায় আরােগ্যলাভ করেন। জল-কাঁদার মধ্যে হাঁটাহাঁটির ফলে কোয়ালপাড়া আশ্রমে আমাদের সকলেরও অল্পবিস্তর জ্বর হয়। দশ-পনর দিন আমাদের কেহ জয়রামবাটী আসিতেছে না দেখিয়া মা আমাদের সংবাদ লইতে একটি ঝিকে পাঠাইলেন। তাহার পরের দিনই রাধুকে দিয়া আমাদিগকে এই মর্মে একখানি পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন-“শ্রীমান কেদার, ওখানকার আশ্রমে আমি ঠাকুরকে বসিয়েছি। তিনি সিদ্ধ চালের ভাত খেতেন, মাছও খেতেন। অতএব আমি বলছি, ঠাকুরকে সিদ্ধ চালের ভােগ ও অন্ততঃ শনি-মঙ্গলবারে মাছভােগ দেবে। রবিবারে দিও না। আর যেমন করেই হােক, তিন তরকারি ছাড়া ভােগ দিতে পারবে না। অত কঠোরতা করলে দেশের ম্যালেরিয়ার সঙ্গে যুঝবে কি করে?”
মা ইহার কয়েকদিন পরে কেদারবাবুকে রাধুর সম্বধে বলিতেছেন, “অত বড় মেয়ে হ’ল,কোন জ্ঞান হ’ল না। ঠাকুর ওকে দিয়ে কি বন্ধনেই রেখেছেন। তাঁর শরীর ত্যাগের পর দেশে এসে যখন উদাসভাবে এইখানটিতে বসে থাকতাম, তখন দেখতুম লাল কাপড় পরে ছােট মেয়েটির রূপ ধরে সামনে ঘুরতে।" কেদারবাবু একটু হাসিয়া অন্যমনস্ক হইয়াছেন দেখিয়া মা বলিলেন, “ও কেদার, শুনছ ? ও হ’ল যােগমায়া।” কেদারবাবু বলিলেন, “না, মা, আমি সব শুনিনি আবার বলুন।” মা তখন বলিতে লাগিলেন, “ঠাকুরের শরীর যাবার পর যখন সংসারে আর কিছুই ভাল লাগছে না, মন হু হু করছে, আর প্রার্থনা করছি, আর আমার এ সংসারে থেকে কি হবে! সেই সময় হঠাৎ দেখলাম, লাল কাপড় পরা দশ-বার বছরের একটি মেয়ে সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর তাকে দেখিয়ে বললেন, একে আশ্রয় করে থাক। তােমার কাছে কত সব ছেলেরা এখন আসবে। পরক্ষণেই তিনি অন্তর্ধান হলেন, মেয়েটিকেও আর দেখতে পাইনি। তারপর একদিন ঠিক এই জায়গাটিতে বসে আছি, ছােট বউ (রাধুর মা) তখন বন্ধ পাগল, কতকগুলাে কাঁথা বগলে করে টানতে টানতে ঐ দিকে যাচ্ছে, আর রাধু হামা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার পেছনে যাচ্ছে। তাই দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। ছুটে গিয়ে রাধুকে তুলে নিলুম। মনে হ’ল তাই তাে, একে আমি না দেখলে কে আর দেখবে? বাবা নেই, মা ঐ পাগল। এই মনে করে যাই ওকে কোলে তুলে নিয়েছি, অমনি ঠাকুরকে সামনে দেখলাম। তিনি বলছেন, এই সেই মেয়েটি, ওকে আশ্রয় করে থাক, এটি যােগমায়া’। কি জানি বাবা, আগে আগে ও বেশ ছিল। আজকাল নানা রােগ, আবার বিয়েও হল। এখন ভয় হয় পাগলের মেয়ে শেষে পাগল না হয় ! শেষটায় কি একটা পাগলকে মানুষ করলাম!”
কলিকাতা হইতে মা একবার কেদারবাবুকে পত্র লেখেন, “তোমরা যদি কোয়ালপাড়ায় আমার জন্যে একখানা ঘর করে রাখতে পার, তা হলে দেশে গিয়ে মাঝে মাঝে তােমাদের ওখানে থাকি।” এই পত্র পাইয়া আমরা নিজেরা চেষ্টা করিয়া তাহার জন্য একটি বাড়ি প্রস্তুত করি। উহাই ‘জগদম্বা আশ্রম'। মা তথায় প্রথম বার প্রায় একপক্ষ কাল বাস করিয়া জয়রামবাটী যান। শেষে একদিন বিকালে তাঁহার দ্বিতীয়বার আসিবার দিন স্থির হইল। আমরা পালকি ঠিক করিয়া রাখিলাম। কিন্তু ঐ দিন সকাল হইতে মুসলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। নদীতে খুব জল বাড়িয়াছে, খবর আসিল। তথাপি কেদারবাবু বলিলেন, “তােমরা তাঁর আদেশ মতাে পালকি নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হও, তারপর মা যেমন বলেন তেমনি করাে।” নদীতে আসিয়া দেখিলাম সাঁতার জল। রাজেন মহারাজ সাঁতার দিয়া ওপার হইতে ডােঙ্গা লইয়া আসিলেন এবং পালকিসহ আমরা পার হইয়া বেলা তিনটা আন্দাজ জয়রামবাটী পেীঁছিলাম।
কালী মামা আমাদিগকে ভৎর্সনা করিয়া বলিলেন, “তােমরা এই বাদলে কি বলে দিদিকে নিতে এলে?” মা একটু একটু হাসিতেছেন। রাজেন দাদা বলিলেন, “আমাদের কি সাধ্য আছে যে মাকে নিয়ে যাই বা সেবা করি। আজ পালকি নিয়ে আসব বলে গেছি, তাই এসেছি।” মা তখন হাসিয়া বলিলেন, “তােমরা কথা রাখতে পার, আর আমি বুঝি পারি নে ? আমি একাই পালকিতে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে চল। ওরা সব পরে যাবে। তখন আমরা হার মানিয়া বলিলাম, “না, মা, তা কি হয় ? এই বাদলে কেউ বাড়ির বার হতে পারছে না, আর আপনাকে ভিজিয়ে নিয়ে গিয়ে কি অসুখ করব ?” তখন কালী মামা ও মা খুব হাসিতে লাগিলেন। আমরা পালকি লইয়া আশ্রমে ফিরিয়া আসিলাম। 
কিন্তু মা তাহার পরেই অসুস্থ হইয়া পড়ায় কয়েক মাস পরে কোয়ালপাড়া আসেন। একদিন বেলা এগারটা আন্দাজ ‘জগদম্বা আশ্রমে’ গিয়া দেখি মেয়েরা সব চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। কেদারবাবুর মা আস্তে আস্তে বলিতেছেন, “মায়ের ভাবসমাধি হয়েছে। ‘ঠাকুর’—এই কথাটি বলেই অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন।” মেয়েরা মাথায় ও চোখে জল দিতে লাগিলেন। কিছু পরে মা সুস্থ হইলে নলিনী দিদি জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিসীমা, অমন হলে কেন?” মা বলিলেন, “কই কি হু’ল? ও কিছু না, তােদের ছুঁচে সুতাে দিতে গিয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।" মায়ের এই কথা শুনিয়া আর কেহ উচ্চবাচ্য করিলেন না।
পরে এই ভাবসমাধির ঘটনাটি মা উদ্বোধনে তাঁহার শেষ অসুখের সময় আমাকে খুলিয়া বলিয়াছিলেন। সেদিন বেলা দেড়টা-দুটার সময় জ্বর বাড়িতেছে ; আমি নিত্যকার মতো তাঁহার বিছানার পাশে বসিয়া তাঁহাকে হাওয়া করিতেছি ও কপালে ভিজা হাত বুলাইয়া দিতেছি। মা আমার পিঠে ও বুকে হাত বুলাইতে বুলাইতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিতেছেন, “শরীরটা চলে গেলে তােমাদের খুব কষ্ট হবে, বুঝতে পাচ্ছি। আমি বলিলাম, “মা, ও কি সব কথা বলছেন? ওষুধেও যখন তেমন ফল হচ্ছে না, আপনি ঠাকুরকে শরীরটার জন্য একটু জানান না। তা হলেই তাে সব সেরে যায়।” মা সামান্য হাসিয়া বলিতেছেন, “কোয়ালপাড়াতে অত জ্বর হত, বেহুশ হয়ে বিছানাতেই অসামাল হয়ে পড়তাম; কিন্তু হুশ হলে শরীরটার জন্যে যখনই তাঁকে স্মরণ করতাম তখনই তাঁর দর্শন পেতাম।দুূর্বল শরীরে একদিন বারান্দায় বসে আছি ; নলিনীরা কি সেলাই করছে। খুব রােদ, চারদিক খাঁ খাঁ করছে। দেখি যেন সদর দরজা দিয়ে ঠাকুর এসে ঠাণ্ডা বারান্দায় বসে শুয়ে পড়েছেন। আমি তাই দেখে তাড়াতাড়ি নিজের আঁচল পেতে দিতে গেছি। পেতে দিতে গিয়ে কেমন হয়ে গেলাম। কেদারের মা-টা সব নানারকম গােলমাল করতে লাগল। তাই তাদের বলেছিলাম, ও কিছু না, ছুঁচে সুতাে দিতে গিয়ে মাথাটা কেমন হয়ে গেল! তােমাদের দিকে চেয়ে শরীরটার জন্যে ঠাকুরকে কি মাঝে মাঝে না জানাচ্ছি ? কিন্তু শরীরটার জন্যে যখন তাকে স্মরণ করি, কিছুতেই তাঁর দর্শন পাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে, তাঁর ইচ্ছা নয় যে শরীরটা থাকে। শরৎ রইল।” পরে কোয়ালপাড়া ফিরিয়া আসিয়া। কেদার মহারাজের মায়ের নিকটও ঠিক ঐরূপ শুনিলাম। মা তাহাকেও ঐরূপ বলিয়াছিলেন।
একদিন বেলা দুইটার সময় কোয়ালপাড়া পৌঁছিয়াছি। খুব গরম। মা একটু মিষ্টি ও জল আনাইয়া দিয়া বলিতেছেন, “বড় রােদ বাবা, একটু ঠাণ্ডা হও; বেলা পড়লে বেরিও। গােপেশ কেমন আছে ? আজ কি খেলে ? কি রান্না করলে ? যাবার সময় কিছু ফল ও আনাজ নিয়ে যেও।” আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “গােপেশদার কথামত কাঁচাকলা আলু প্রভৃতি খােসাসুদ্ধ সব একসঙ্গে মিশিয়ে ঝােল ও আলুভাতে রেঁধেছিলাম। কিন্তু আন্দাজ করতে না পারায় আট-দশ জনের মতাে তরকারি রাঁধা হয়েছিল।” শুনিয়া মা খুব হাসিতে লাগিলেন। এই সকল কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় আকাশে খুব মেঘ হইল। মা বলিতেছেন, “আঃ, একটু বৃষ্টি হলে ধরিত্রীটা ঠাণ্ডা হয়। কিয়ৎক্ষণ পরেই ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হইল। মা আনন্দ করিতে করিতে দু'-একটি শিল মুখে দিলেন। কিন্তু উহাতেই ঠাণ্ডা লাগিয়া আবার জ্বর হয় এবং সেই জ্বর পরে খুব ভীষণ আকার ধারণ করিয়াছিল।
রাসবিহারী মহারাজ ও আমি একদিন তাহার বিছানার দুইপাশে বসিয়া আছি। মা আমাদের বুকে পিঠে হাত রাখিয়া বলিতেছেন, “আঃ, এতগুলাে মেয়ে, কারাে গা ঠাণ্ডা নয়। এরা বেটা ছেলে, কেমন ঠাণ্ডা দেহ। আমার হাত জুড়াল।” অসুখের ঘােরে মা পূজনীয় শরৎ মহারাজকে খুব খুঁজিতেন। তিনি সংবাদ পাইয়া ডাক্তার কাঞ্জিলাল প্রভৃতিকে লইয়া উপস্থিত হইলেন এবং একেবারে মায়ের শয্যাপাশে গেলেন। মা তখন গাত্রদাহের জন্য ছটফট করিয়া হাত বাড়াইতেছেন। তাহা দেখিয়া পূজনীয় শরৎ মহারাজ গায়ের জামা খুলিয়া তাহার বিছানাতে গিয়া বসিলেন। মা তাঁহার পিঠে হাত দিয়া বলিতেছেন, “আঃ, আমার সমস্ত দেহটা ঠাণ্ডা হ’ল। শরতের গাটি যেন পাথর।” শরৎ মহারাজ বলিলেন, “এই তাে, মা, আমরা সব এসে পড়েছি, এখন সেরে উঠুন।” মা বলিলেন, “হা, বাবা, কাঞ্জিলাল একটু ওষুধ দিলেই ভাল হয়ে যাব।” এই কথা শুনিয়া শরৎ মহারাজের মুখে প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। কয়েক দিনের মধ্যেই জ্বর ছাড়িয়া গেল ও মা অন্নপথ্য করিলেন। শরৎ মহারাজ একদিন মাকে বলিলেন, “মা, এবার আর আপনাকে ছেড়ে যাব না; আমি সঙ্গে ক'রে কলিকাতায় নিয়ে যাব।” মাও বিশেষ আপত্তি না করিয়া বলিলেন, “কিন্তু বাবা, একবার জয়রামবাটী গিয়ে যাত্রাটা বদলে আসতে হবে।” শরৎ মহারাজ তাহাতেই রাজী হইলেন ও জয়রামবাটী যাত্রার দিন দেখিতে লাগিলেন।
মায়ের অসুখের সময়েই উদ্বোধনে স্বামী প্রজ্ঞানন্দের দেহত্যাগ হয়। পরে ঐ প্রসঙ্গে মা একদিন জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে তাঁহার ভগিনী ও নিবেদিতা স্কুলের পরিচালিকা শ্ৰীমতী সুধীরা সে সময় স্থিরভাবে পাশেই বসিয়াছিলেন। শুনিয়া মা বলিলেন, “আহা, একটু ডাক ছেড়ে কাঁদলে শােকটার কিছু লাঘব হত। দেখ, ওর আবার কোন অসুখ-বিসুখ না হয়। একেই হার্টের দোষ আছে।”
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। আমি তখন মায়ের নিকট জয়রামবাটীতে আছি। একদিন কোয়ালপাড়া হইতে কতকগুলি জিনিস এক বৃদ্ধা মজুরনীর মাথায় দিয়া বেলা দশটা আন্দাজ জয়রামবাটী ফিরিয়াছি। বৃদ্ধা মােট নামাইয়া মাকে প্রণাম করিল। মা বলিতেছেন, “মাঝি বউ, কই অনেক দিন তুমি আর আসনি কেন?” তখন বৃদ্ধা করুণস্বরে বলিল, “মা, আজকাল বড় কষ্টে পড়েছি। নানা স্থানে অন্নের চেষ্টায় বেড়াই। এখানে মােট নিয়ে আসবার দরকার হলে বাবুরা সব সময়ে আমার দেখা পায় না। কিছুদিন হলাে আমার জোয়ান রােজগারী ছেলেটি মারা গেছে।”
মা তাহা শুনিয়া বলিলেন, “বল কি মাঝি বউ!” বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষু, আর্দ্র হইয়া উঠিল। বাধা মায়ের সহানুভূতি পাইয়া ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল। মাও তাঁহার কাছে বসিয়া পড়িয়া বারান্দার খুঁটিতে মাথা রাখিয়া তাঁহার সহিত ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার কান্না শুনিয়া বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা সব ছুটিয়া আসিলেন এবং এই দৃশ্য দেখিয়া দূরে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ এই ভাবে কাটিল। পরে কান্নার বেগ কমিয়া আসিলে মা ধীরে ধীরে নবাসনের বউদিদিকে নারিকেল তেল আনিতে বলিলেন। তেল আনা হইলে তিনি উহা বৃদ্ধার মাথায় ঢালিয়া দিতে লাগিলেন। বৃদ্ধা একমাথা তেল মাখিলে পর মা তাহার কাপড়ে মুড়িও গুড় দিয়া বিদায় দিবার সময় ছলছল নেত্রে বলিলেন, “আবার এসো, মাঝি বউ।” মায়ের এই করুণ ব্যবহারে বৃদ্ধা কিরূপ সান্ত্বনা পাইয়া গেল তাহা তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিতে পারিয়াছিলাম।
একটু বল পাইলে মা নির্দিষ্ট দিনে শরৎ মহারাজ প্রভৃতিকে লইয়া জয়রামবাটীতে পেীঁছিলেন। গ্রামের সব স্ত্রী-পুরুষ মাকে দেখিতে আসিলেন। কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, “মা, আমরা যে আর আপনাকে দেখতে পাব, এ আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।” মা বলিলেন, “হাঁ, খুব অসুখটায় ভুগলাম। শরৎ, কাঞ্জিলাল, সব এসে পড়ল ; মা সিংহবাহিনীর কৃপায় এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম। শরৎ বলছে কলকাতায় যেতে। তা তােমরা সকলে মত কর তাে গিয়ে শরীরটা একটু সেরে আসি।” সকলে আনন্দের সহিত সম্মতি জানাইলেন। সাত-আট দিন পরে মা কলিকাতা রওয়ানা হইলেন।
কয়েক মাস পরে বেলুড় মঠে আসিয়া আছি। ‘উদ্বোধনে' রাধুর অসুখ। কোনও শব্দ সহ্য হয় না। সেই জন্য মা তাহাকে লইয়া নিবেদিতা স্কুলের বােডিং বাড়িতে আছেন। প্রায়ই সেখানে গিয়া দেখা করিয়া আসি। তিনি খুবই চিন্তিত। বলেন, “তাই তাে, একে নিয়ে কোথায় যাই? দেশে নির্জন হলেও ডাক্তার-কবিরাজের তাে তেমন সুবিধা নেই।”
স্বামীজীর উৎসবের দিন দুপুরবেলা হঠাৎ শুনিলাম, মা কল্য সকালে দেশে চলিয়া যাইতেছেন। পুজনীয় শরৎ মহারাজের আদেশে তাড়াতাড়ি মায়ের সঙ্গে যাইবার জন্য সন্ধ্যার সময় ‘উদ্বোধনে’ আসিলাম। উপরে গিয়া দেখি মা কিছু, নারিকেল-দড়ি গুছাইতেছেন। আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, “এই অগাধ দরিয়া নিয়ে দেশে যাচ্ছি। তােমার আমার সঙ্গে যাবার কি হবে ? তােমরাই সেখানে আমার ভরসা।” আমি প্রণাম করিয়া বলিলাম, “আপনি যখন যা আদেশ করবেন তাই হবে। আপনার সঙ্গে যাব, তাতে আর আপত্তি কি ?” মা বলিলেন, “তাই বল, বাবা, এই দড়ি টড়ি দেখে নিয়ে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে বেধে ফেল, এখনও কিছুই গােছান হয়নি। তােমার অপেক্ষায় বসে থেকে দড়ি গােছাচ্ছিলাম।” রাত্রি এগারটা পর্যন্ত মায়ের সহিত বিছানাপত্র সব বাঁধিলাম। পরদিন খুব সকালে তাঁহার সহিত রওয়ানা হইলাম।
বিষ্ণুপরে তিন দিন বিশ্রাম করিয়া আমরা প্রত্যুষে ছয়খানি গরুর গাড়িতে রওয়ানা হইলাম। আট মাইল দূরে জয়পুর গ্রামে এক চটিতে রম্বনের ব্যবস্থা হইল। উনুন হইতে নামাইবার সময় হাঁড়িটি হঠাৎ ভাঙিয়া যাওয়ায় ভাত ও ফেন চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলাম। মা কিন্তু আদৌ বিচলিত না হইয়া একটি খড়ের নুড়ো লইয়া ফেনগুলি সব সরাইয়া দিতে লাগিলেন। তারপর হাত ধুইয়া বাক্স হইতে ঠাকুরের ছবিখানি বাহির করিয়া একধারে বসাইলেন এবং একটি শালের কাঠির দ্বারা উহা হইতে কতকগুলি ভাত পৃথক করিয়া একখানি শালপাতায় ডাল, তরকারি সাজাইয়া ঠাকুরকে জোড়হাতে বলিতেছেন, “আজ এইরূপেই মেপেছ, শীগগির শীগগির গরম গরম দুটি খেয়ে নাও।” আমরা সকলে মায়ের কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে লাগিলাম। তাহা দেখিয়া তিনি বলিলেন, “যখন যেমন তখন তেমন তাে করতে হবে। নাও, তােমরা সব এখন বসে যাও দেখি।” তখন আমরা সকলে চারিধারে বসিয়া গেলাম। মা কাঠিতে করিয়া আমাদের পাতায় পাতায় পরিবেশন করিয়া নিজেও একধারে পা মেলিয়া বসিয়া খাইতে আরম্ভ করিলেন ও বলিলেন, “বেশ রান্না হয়েছে।” আহারাদি সারিয়াই গাড়ি ছাড়িয়া দিলাম। রাত্রি প্রায় এগারটায় আমরা কোয়ালপাড়া পেীঁছিলাম।
এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। একবার পুজনীয়া গৌরীমা মাকে দর্শন করিতে জয়রামবাটী যাইতেছেন। কোয়ালপাড়া হইতে আমাকে সঙ্গে লইয়া বিকালে রওয়ানা হইলেন। জয়রামবাটীর কাছে নদীর ধারে পৌঁছিয়া কিছু বেলা আছে দেখিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার একটু পরে মায়ের সদর দরজায় পৌঁছিয়া আমাকে তথায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি একটু ভিতরে ঢুকিলেন ও ভিখারীদের অনুকরণে বলিয়া উঠিলেন, “মা, দুটি ভিক্ষা পাই, মা।" তাহা শুনিয়া ছােট মামী বাহিরে আসিয়া বলিতেছেন, “কে গাে?” তখন গৌরী-মা আবার বলিয়া উঠিলেন, “দুটি, ভিক্ষা পাই, মা।” ছােট মামী তখন খুব ভয় পাইয়া চীৎকার করিয়া একেবারে মায়ের কাছে দুটিয়া গেলেন। মা চীৎকার শুনিয়া ধীরভাবে বাহির হইয়া আসিয়া দৃঢ়স্বরে বলিতেছেন, “কে রে?” গৌরী-মা পূর্ব স্থানেই দাঁড়াইয়া বলিলেন, “দুটি ভিক্ষা পাই মা, আমি রাতভিখারী।” অন্ধকারে মা গৌরী-মার গলার আওয়াজ পাইয়া বলিলেন, “ও গৌরদাসী, এস এস, কখন এলে?” তারপর খুব রহস্য হইতে লাগিল। 
কোয়ালপাড়ায় দুই-একদিন থাকিবার পর রাধুর ঐ স্থানটি বেশ নির্জন, বলিয়া পছন্দ হওয়ায় মা ছয়মাস তাহাকে লইয়া থাকিয়া যান। জগদ আশ্রম হইতে কিছু দূরে অপর একটি নির্জন বাড়িতে রাধুর থাকিবার ব্যবস্থা হয়। উহার তিনদিকে কাঁটাগাছের জঙ্গল ছিল। মা একদিন আমাকে বললেন, “আজকাল মনের কি যে হয়েছে, যা চিন্তা ওঠে তাই উপস্থিত হয়—তা ভালই হােক, আর মন্দই হােক। রাধুর তাে এই জঙ্গলটাই পছন্দ, নির্জন কিনা। আমার কদিন থেকে মনে হচ্ছে, সারাদিন কাজকর্মে বাইরে যাওয়া আসা কর, সন্ধ্যার সময় থেকে কিন্তু এইখানে এসে আমার কাছেই থেকো। বড় ভয় হয়, বাবা। রাজেনকেও বলেছি। সে রাত দশটা-এগারটার পর আসবে।” সেই দিন হইতে রাধুর বাড়ির বাহিরে একটি কতবেল-গাছের তলায় সন্ধ্যা হইতে রাত্রি এগারটা পর্যন্ত চৌকি পাতিয়া বসিয়া থাকিতাম। মাও বসিয়া থাকিলে এবং খুব আস্তে আস্তে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা কহিতেন। মা একদিন বলিতেছেন, “যে জঙ্গল ! কোন দিন ভালুক না বেরিয়ে পড়ে।” আমি বলিলাম, “কই মা, এদিকে তাে কখনও ভালুক দেখিনি।” কিন্তু সত্যই দুই-এক দিন পরে দুপুরবেলায় শােনা গেল, এক মাইল দূরে দেশড়ার মাঠে একটি প্রকাণ্ড ভালুক গােবর কুড়াইবার সময় একটি বন্ধুকে মারিয়া ফেলিয়াছে এবং ভালুকটিকেও গুলি করিয়া মারিয়া ফেলা হইয়াছে। সন্ধ্যার সময় মা বলিলেন, “দেখলে আজ ভালুকের কাণ্ড! অম্বিকের (জয়রামবাটীর চৌকিদার) শাশুড়ীকে নাকি মেরে ফেলেছে। তুমি যে বলেছিলে এদেশে ভালুক নেই।”
সন্ধ্যার সময়ে মা একটু মিষ্টি খাইয়া জল খাইতেন। আমি ঐ গাছতলায় আসিলে আমাকেও খাইতে দিতেন। বলিতেন, “সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সন্ধ্যার সময় একটু কিছু খেয়ে জল খেলে শরীরটা বেশ স্নিগ্ধ হয়। তারপর জপতপে বা যে কোন কাজে মনটি বেশ স্থির হয়ে বসে।" একদিন বলিতেছেন, “ঠাকুরের সেবার জন্যে যখন নহবতখানায় ছিলাম তখন কি কষ্টেই না ছােট ঘরখানিতে থাকতে হত! তারই ভিতর কত সব জিনিসপত্র। ঠাকুরের জন্যে হাঁড়িতে মাছ জীইয়ে রাখতাম। তাঁর সেবার জন্যে কোন কষ্টই গায়ে লাগত না। কোথায় দিয়ে আনন্দে দিন কেটে যেত। আর এখন পড়েছি রাধুর জন্যে এই কষ্টে। জঙ্গলে তােমাদের নিয়ে বসে আছি। ধর্মকর্ম, জপতপ, সব গেল। এখন তাঁর কৃপায় ভালয় ভালয় উদ্ধার হলে হয় (রাধু তখন আসন্নপ্রসবা)।” একটু পরে নবাসনের বউদিদি আসিয়া বলিতেছেন, “ও দাদা শুনেছেন? আজ দুপুরে এখানে মা ও আমি বসে আছি, বেশ নির্জন। মা বলছেন, সেই কাক দুটি কদিন এই সময়ে এসে এই গাছে বড় চীৎকার করত। রাধুও বড় বিরক্ত হত। কিন্তু কই, আজ কদিন থেকে তাদের দেখতে পাচ্ছিনি। কোথায় গেল সে দুটি, বল তাে? মা এই কথা বলতে না বলতে কাক দুটি এসে গাছে ডেকে উঠল।” মাও হাসিয়া “হাঁ, বাবা” বলিয়া ঐ কথার সমর্থন করিলেন। 
আর একদিন আষাঢ়ের প্রথমভাগে মা ও আমরা কয়েকজন গাছতলায় বসিয়া আছি। রাত্রি দশটা হইবে। মা হঠাৎ বলিতেছেন, “দেখ, সেই পাগলটি কই অনেকদিন আসে নি। বদ্ধ পাগল। গান-টানগুলি কিন্তু বেশ গায়। তবে বড় ভয় করে, বাবা, পাছে এখানে চেঁচিয়ে-মেঁচিয়ে ওঠে!” তখন নবাসনের বউদিদি বলিতেছেন, “আর তার নাম কেন, মা? যদি এখন এসে পড়ে এই রাত্রিবেলায় ?” মা বলিতেছেন, “কে জানে, মা।” “হাঁ, তুমিও যেমন; এই বাদলে নদী পার হবে কি করে, যে আসবে ?”আমি এই কথা বলিতে না বলিতে পাগলটি একটি তালপাতার পেখে মাথায় দিয়া এক বােঝা সজিনাশাক বগলে লইয়া সেখানে উপস্থিত হইল ও মাকে বলিল, “তােমার জন্যে সজনেশাক নিয়ে এলাম।” নবাসনের বউদিদি ভয় পাইয়া ভিতরে চলিয়া গেলেন। মা বলিলেন, “যা, যা, এত রাতে গােল করিস নি।” সে বলিল, “যাব কি করে ? নদীতে বান যে।” আমি বলিলাম, “এলি কি করে ?” সে বলিল, “সাঁতারে পার হয়ে এসেছি।” মা তাহাকে বলিলেন, “লক্ষ্মীটি, গােল করিস নি।” সে তখন আর কোন কথা না বলিয়া চলিয়া গেল। মাস দুই মায়ের এই ভাবটি ছিল।
ঐ সময়ে একদিন রাধুর ঘরের বারান্দায় মার নিকট বসিয়া বাজারের ফর্দ লিখিতেছি। পাশ দিয়া যাইবার সময় অসাবধানতাবশতঃ জনৈক স্ত্রীভক্তের কাপড়ের আঁচল আমার পিঠে একটু লাগিয়া যায়। মা তাহা লক্ষ্য করিরা অত্যন্ত বিরক্তির সহিত স্ত্রীলােকটিকে বলিতেছেন, “কিগাে, ছেলে আমার সামনে বসে লিখছে, বেটা ছেলে, তােমার একটু হুঁ'শ নেই—ওর পিঠে আঁচল লাগিয়ে যাচ্ছ ! ওরা ব্রহ্মচারী, তােমরা মেয়েমানুষ, ওদের সমীহ করে চলতে হয়, প্রণাম কর” ইত্যাদি। কথাগুলি মা এমন তেজের সহিত বলিলেন যে বাড়ির মেয়েরাও সন্ত্রস্ত হইলেন।
একটি নূতন ব্রহ্মচারী কোয়ালপাড়ায় মায়ের কাছে কিছুদিন থাকিতে চাহিলে মা বলিলেন, “তুমি থাকতে চাচ্ছ; কিন্তু তােমার এখানে থেকে কষ্ট হবে। আমার এখানে বড় কাজকর্ম। রাধুকে নিয়ে এই জঙ্গলে পড়ে আছি।” ছেলেটি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করায় মা বলিলেন, “আচ্ছা, কেদারকে বলে আশ্রমে দিন কতক থাক, তারপর দেখা যাবে।” ঐ সময়ে যে সেবকটি রাধুর পথ্য তৈয়ার করিত তাহাকে কয়েক দিনের জন্য কলিকাতায় যাইতে হইল। মা ঐ ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এটি পারবে, বাবা?” সে সম্মত হইলে বলিলেন, “ওদের কাছে সব দেখে শুনে নাও।” প্রথম দিনেই পথ্য প্রস্তুত করিয়া মায়ের নিকট লইয়া যাইবার সময় তাহার হাত হইতে সব পড়িয়া নষ্ট হইয়া যায়। তখন কি করা উচিত ঠিক করিতে না পারিয়া সে খালি পাত্রগুলি মায়ের নিকট উপস্থিত করে। সেদিন আর রাধুর খাওয়া হইল না। মা বিরক্ত হইলেন। পরে বলিয়াছিলেন, “সাধু হিসাবে তাে ছেলেটি বেশ ভালই। তবে আমার এখানে কাজকর্মে চৌকশ লােক চাই। “গাছতলার সাধু’ দিয়ে আমার কাজ হবে না। আবার হুজুগে পড়েও অনেকে অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলে। কিন্তু মানুষের প্রত্যেক খুঁটিনাটি কাজটিতে শ্রদ্ধা দেখলে ঠিক ঠিক মানুষটি চেনা যায়।” দুই-এক দিন পরেই সেবকটি ফিরিয়া আসায় ছেলেটির ওখানে থাকা হইল না। 
আর একদিন কোয়ালপাড়ায় একটি ছেলে পুলিশের নজরবন্দি হইতে মুক্তি পাইয়া মার নিকট সন্ধ্যাকালে উপস্থিত হয় ও দীক্ষা লইবার অভিপ্রায় জানায়। তখন ওখানকার আশ্রমের উপর পুলিসের তীক্ষদৃষ্টি থাকায় আশ্রমাধ্যক্ষ তাহাকে চলিয়া যাইতে বলিলেন। মা এই সংবাদ পাইয়া আমাকে বলিলেন, “আহা, ছেলেটি কত কষ্ট পেয়ে ব্যাকুল হয়ে এসেছে ! তুমি যদি আজ রাতিটা গ্রামের কোন লােকের বাড়িতে তাকে রাখবার ব্যবস্থা করতে পার তবে কাল সকালে আমি ওকে দীক্ষা দিয়ে চলে যেতে বলব।” তাঁহার ইঙ্গিতমত আমি তাহাকে একস্থানে রাখিয়া দিলাম।
পরদিন খুব সকালে মায়ের সহিত রাধুর বাড়ি যাইতেছি। ছেলেটি স্নান করিয়া মাঠের মাঝপথে মায়ের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। মা আমাকে নিকটবতী পুকুর হইতে একটু জল আনিতে বলিলেন। আমি একটা গ্লাসে জল আনিয়া দিলে মা যেন আসন খুজিতেছেন মনে হওয়ায় আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আসন এনে দেব কি ?” মা বলিলেন, “থাক, আর যেতে হবে না, দুটো খড় দাও, আমরা দুজনে বসি।” আমি ঐরূপ করিলে তাঁহারা ঐ খড় পাতিয়া মাটিতে বসিলেন এবং আমাকে একটু তফাতে থাকিতে বলিয়া মা আচমন করিয়া ছেলেটিকে দীক্ষা দিলেন।
একদিন সন্ধ্যায় মা কথাপ্রসঙ্গে বলিতেছেন, “আমি আর কারও দোষ দেখতে শুনতে পারিনে, বাবা, প্রারন্ধ কর্ম যার যা আছে। যেখানে ফালটি যেত সেখানে ছুঁচটি তাে যাবে ? আমার কাছের দোষের কথা বললে। তখন এরা সব কোথায় ছিল ? সে আমার কত সেবা করেছে। আমি তাে তখন ভাইদের ঘরে ধান সিদ্ধ করি। বউরা সব ছোট। সে শীত বর্ষা গ্রাহ্য না করে সকাল থেকে গায়ে কালি মেখে আমার সঙ্গে বড় বড় ধানের হাঁড়ি নামাত। এখন তাে অনেকে ভক্ত হয়ে আসে। তখন আমার কে ছিল। আমরা কি সেগুলাে সব ভুলে যাব ? তা লােকেরই বা দোষ কি? আমারও আগে লোকের কত দোষ চোখে ঠেকত। তারপর ঠাকুরের কাছে কেঁদে কেঁদে ‘ঠাকুর, আর দোষ দেখতে পারি নে’ বলে কত প্রার্থনা করে তবে দোষ-দেখাটা গেছে। মানুষের হাজার উপকার করে একটু দোষ কর, মুখটি তখনই বেকে যাবে। লােক কেবল দোষটি দেখে। গুণটি দেখা চাই।” 
জয়রামবাটীতে একদিন মহাপুরুষদের সেবকগণের দুর্বুদ্ধি প্রসঙ্গে মা। বলিলেন, “দেখ, সেবাপরাধ একটা আছে বটে। সেটা হচ্ছে—সেবা করতে করতে অধিকার পেয়ে অহংবুদ্ধি বেড়ে গেলে সে তখন পুতুলের মতাে নাচাতে চায়। উঠতে, বসতে, খেতে, সব তাতেই কর্তা। সেবার ভাব আর থাকে না। যারা  নিজের দেহসুখ ভুলে তার সুখদুঃখ নিজের সুখদুঃখ জ্ঞান করে সেবা করে, তাদের। ওরূপ হবে কেন? আর পতনের কথা বলছ ? অনেক মহাপুরুষের চারিদিকে ঐশ্বর্যের ভাব থাকে। তাই দেখে অনেকে তাদের সেবা করতে এসে ওতেই মত্ত থাকে, আর পরে ওতেই ডুবে মরে। ঠিক ঠিক তাঁর সেবা করে কজন, বল ?” তারপর মা একটি গল্প বলিলেন, “দেখ, কথায় আছে যে, পুকুরে চাঁদের প্রতিবিম্ব পড়েছে, তাই দেখে ছােট ছােট মাছেরা আনন্দে সেইখানে খুব লাফালাফি করে খেলা করছে—ভাবছে আমাদেরই একজন। কিন্তু যখন চাঁদ অন্ত গেল তখন তাদের সেই পূর্ব অবস্থা। লাফালাফির পর অবসাদ এল—কিছুই বুঝতে পারলে না।” আমি বললাম, “কেদার মহারাজ বলেন যে, গুরুর কাছে বেশী দিন থাকতে নেই। গুরুর অলৌকিক আচরণ দেখে অনেক সময়ে শিষ্যের নাকি ভক্তি শ্রদ্ধা কমে যায়।” মা হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, “তােমরা বাবা, ওসব কথায় মন খারাপ করাে না। তা হলে আমার কাজ চলে কি করে ? অত ভগবানবুদ্ধি
করে মানুষবুদ্ধিতে আমি যা বলি দেখে শুনে, কাজগুলি যা করছ করে যাও। তােমাদের কোন ভয় নেই।”
একদিন ভক্তদের অনেকগুলি পত্ৰ আসিয়াছে। সন্ধ্যার সময় মাকে পড়িয়া শুনাইলাম। পত্র শুনিয়া মা বলিতেছেন, “কতরকম ছেলেরা কত কি ইচ্ছা লিখেছে, দেখলে? কেউ বলছে, এত করে প্রার্থনা, জপধ্যান করছি, কিছুই হচ্ছে না; কেউ বা সংসারে নানা অশান্তি, অনটন, রােগশােকের কথা লিখছে। আর এসব শুনতে পারি নে। ঠাকুরকে বলি, “ঠাকুর, এদের ইহকাল পরকাল তুমিই রক্ষা করাে। আমি মা হয়ে আর কি বলব? কজন তাকে ঠিক ঠিক চায়? সে ব্যাকুলতা কোথায়? এত তাে ভক্তি, আগ্রহ—এদিকে সামান্য একটু ভােগ্যবস্তু পেলেই সন্তুষ্ট। বলে, ‘আহা, তাঁর কি দয়া।' বলে, ‘রাধু কেমন আছে ? আমার মন ভেজাবার জন্যে রাধুর খোঁজ আগে। আমি চোখ বুঁজলে রাধুর দিকে কেউ ফিরেও চাইবে না।” নবাসনের বউদিদি বলিতেছেন, “মা, আপনার তাে সব ছেলে সমান ; যে বিয়ে করার মতামত চেয়েছে তাকে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন, আর যে সংসারত্যাগ করতে চায় তাকে সেইমত ত্যাগের প্রশংসা করে উপদেশ দিচ্ছেন। আপনার তাে উচিত যেটি ভাল সেই পথেই সকলকে নিয়ে যাওয়া।” মা বলিতেছেন, “যার ভোগবাসনা প্রবল, আমি নিষেধ করলেই কি সে শুনবে? আর যে বহু, সুকৃতিবলে এই সব মায়ার খেলা বুঝতে পেরে তাকেই একমাত্র সার ভেবেছে, তাকে একটু সাহায্য করব না ! সংসারে দুঃখের কি অন্ত আছে ?” 
নলিনীদিদি প্রভৃতি কয়েকজন কিছুক্ষণ তর্কের পর মাকে বলিতেছেন, “পিসিমা, বল তাে কোন অপবাদ ভাল?” মা বলেছিলেন, “অপবাদের আবার ভালমন্দ।” এইরূপ একটু কথাবার্তার পর বলিতেছেন, “তবে ধনের অপবাদই ভাল। কোন লোককে যদি বলা যায়, তুমি বেশ ধনী’, সে তা শুনে মুখে দীনতা বা অসন্তোষ যাই দেখাক না কেন, তার অন্তরটি বেশ খুশী হয়।” এই কথা বলিয়া মা বলিতেছেন, “এ তাে হলাে। আচ্ছা, তােরা বল দেখি কোন জিনিসটা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হয়?” নলিনীদিদি বলিতেছেন, “কেন, পিসিমা, জ্ঞান, ভক্তি, মানুষ যাতে সংসারে সুখে থাকে, এই সব প্রার্থনা করতে হয়। মা বলিতেছেন, “এক কথায় বলতে গেলে, নিবাসনা প্রার্থনা করতে হয়। কেন না বাসনাই সকল দুঃখের মূল, বার বার জন্ম-মৃত্যুর কারণ, আর মুক্তিপথের অন্তরায়।” 
শ্রাবণ মাসে মা রাধুকে লইয়া কোয়ালপাড়া হইতে জয়রামবাটী আসিয়াছেন। তখন তাঁহার সংসারে আমরা পনর-কুড়ি জন লােক। সকলের খাওয়া-দাওয়া প্রভৃতি সব বিষয় মা নিজেই তত্ত্বাবধান করিতেছেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে মা আমাকে বলিতেছেন, “বাবা, সেদিন- আমাকে কি কথাটাই বললে। আমি জানতাম ওর খুব উদার মন। ওর মতাে লােকের ও কথাটা বলা মােটেই ভাল হয়নি। আমি তার মনের ভাব বুঝে, আসবার সময় এক মরাই ধান আশ্রমের খরচের জন্য দিয়ে এলুম।”১ তা তখন আর নিতে চায়নি—নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এল।” এই বলিয়া মা সমস্ত ঘটনাটি বলিলেন, “সেদিন সকালে প্রণাম করতে এসে বলছে, মা, এরা সব আগে আমার খুব বাধ্য ছিল, এখন চোখ ফুটেছে, আমার কথা সব সময় মনে থাকতে চায় না। আর শরৎ মহারাজ বা আপনাদের কাছে গেলে আপনারা আদরযত্ন করে কাছে রেখে দেন। ভাল খাবারও সুবিধা পায়। আপনারা যদি স্থান না দেন, একটু বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেন, তবে আমার বাধ্য থাকবে। আমি বললাম, “সেকি গাে? ও সব কি কথা বলছ ? ভালবাসাই তাে আমাদের আসল। ভালবাসাতেই তাে তার সংসার গড়ে উঠেছে। আর আমি মা, আমার কাছে তুমি ছেলেদের খাওয়া-পরার খোটা দিয়ে কি করে বললে?' আহা, এর জন্যে ঠাকুরের কাছে কত কেঁদেছি, প্রার্থনা করেছি। তবে তাে আজ তাঁর কৃপায় মঠ-টঠ যা কিছু। ঠাকুরের শরীর যাবার পর ছেলেরা সংসার ত্যাগ করে কয়েকদিন একটা আশ্রয় করে সব একসঙ্গে জুটল। তারপর একে একে স্বাধীনভাবে বেরিয়ে পড়ে এখানে ওখানে ঘুরতে থাকে। আমার তখন মনে খুব দুঃখ হ'ল। ঠাকুরের কাছে এই বলে প্রার্থনা করতে লাগলুম, ঠাকুর, তুমি এলে, এই কজনকে নিয়ে লীলা করে আনন্দ করে চলে গেলে, আর অমনি সব শেষ হয়ে গেল? তা হলে আর এত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল? কাশী বৃন্দাবনে দেখেছি, অনেক সাধু ভিক্ষা করে খায়, আর গাছতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সে রকম সাধুর তাে অভাব নেই। তােমার নাম করে সব ছেড়ে বেরিয়ে আমার ছেলেরা যে দুটি অন্নের জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়াবে তা আমি দেখতে পারব না। আমার প্রার্থনা, তােমার নামে যারা বেরুবে তাদের মােটা ভাত-কাপড়ের অভাব যেন না হয়। ওরা সব তােমাকে, আর তােমার সব ভাব, উপদেশ নিয়ে একত্রে থাকবে। আর এই সংসারতাপদগ্ধ লােকেরা তাদের কাছে এসে তোমার কথা শুনে শান্তি পাবে। এইজন্যই তাে তােমার আসা। ওদের ঘুরে ঘুরে বেড়ান দেখে আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠে। তারপর থেকে নরেন ধীরে ধীরে এই সব করলে।"

১.পরে ঐ ধানগুলির চাউল করিয়া মাকেই পাঠান হয়, এবং—অনুতপ্ত হইয়া মায়ের নিকট বিশেষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

জয়রামবাটীতে দুর্গাপূজার সময় অষ্টমীর দিন একটি ভক্ত কতকগুলি পদ্মফুল একটি ঝুড়িতে লইয়া আসিতেছেন। দুর হইতে আমাকে দেখিয়া ফুলসমেত হাত তুলিয়া আমাকে নমস্কার করিলেন। মা দুর হইতে উহা দেখিয়াছিলেন। পরে আমাকে বলিলেন, “ঐ ফুল দিয়ে আর ঠাকুরের পুজো হবে না; ওগুলি ফেলে দিও।”
আমাদের দুজনের পরিধানে সাদাপাড় কাপড় দেখিয়া মা বলিলেন, “এ কি! সাদাপেড়ে কাপড় কেন পরেছ ? তােমরা ছেলে মানুষ, পাড় দেওয়া কাপড় পরবে। নইলে মন বুড়ো হয়ে যাবে। মনে সর্বদা উৎসাহ রাখতে হয়। এই বলিয়া বাক্স হইতে দুজনকে দুখানি কাপড় বাহির করিয়া দিলেন।
সেইদিন সন্ধ্যার একটু পরেই সন্ধিপূজা। মায়ের পায়ে পদ্মফুল দিয়া অনেকে পুস্পাঞ্জলি দিলে মা বলিতেছেন, “আরও ফুল আন; রাখাল, তারক, শরৎ, খোকা, যােগেন, গােলাপ—এদের সব নাম করে ফুল দাও। আমার জানা-অজানা সকল ছেলের হয়ে ফুল দাও।” আমি ঐরুপ করিলে মা জোড়হাতে ঠাকুরের দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিতেছেন, “সকলের ইহকাল-পরকালের মঙ্গল হােক।”
কেদার মহারাজ একদিন সকালে জয়রামবাটীতে মায়ের নিকট বসিয়া বলিতেছেন, “মা, আমাদের দাতব্য চিকিৎসালয়ে যাদের অবস্থা ভাল তারাও সব ওষুধ নিতে আসে। আমরা তাে গরীবদের জন্যেই করেছি। ঐ সমস্ত লােককে ওষুধ দেওয়া কি উচিত?” মা একটু থামিয়া বলিলেন, “বাবা, এদেশের সকলেই গরীব। তবে ওরা এইসব জেনেশুনেও যদি প্রার্থী হয়ে এসে দাঁড়ায়, সামর্থ্য থাকলে দেবে বইকি। যে প্রার্থী সেই গরীব।” 
কেদার মহারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এবার কি ঠাকুর একটা নতুন জিনিস দিয়ে যাবার জন্যেই এসেছিলেন যে সর্বধর্ম সমন্বয় করে গেলেন ? মা বললেন, “দেখ, বাবা, তিনি যে সমন্বয়-ভাব প্রচার করবার মতলবে সব ধর্মমত সাধন করেছিলেন তা কিন্তু আমার মনে হয়নি। তিনি সর্বদা ভগবদভাবেই বিভাের থাকতেন। খ্রীষ্টানরা, মুসলমানরা, বৈষ্ণবরা যে যে ভাবে তাকে ভজনা করে বস্তুলাভ করে, তিনি সেই সেইভাবে সাধনা করে নানা লীলা আস্বাদ করতেন ও দিনরাত কোথা দিয়ে কেটে যেত, কোনও হুঁশ থাকত না। তবে কি জান, বাবা, এই যুগে তাঁর ত্যাগই হল বিশেষত্ব। ও রকম স্বাভাবিক ত্যাগ কি আর কখনও কেউ দেখেছে? সর্বসমম্বয়-ভাবটি যা বললে, ওটিও ঠিক। অন্যান্য বারে একটা ভাবকেই বড় করায় অন্য সব ভাব চাপা পড়েছিল।”
সেদিন সন্ধ্যার পর নিত্যকার মত রুটি ইত্যাদি করিয়া ভক্তদের চিঠি পড়িয়া শুনাইতে মায়ের ঘরে গিয়াছি। একটি স্ত্রী-ভক্ত প্রায়ই পত্র দেন-মায়ের নানারূপ স্তবস্তুতিতে ভরা, তাহার পত্রের মর্ম মাকে বলিলাম। মা সব শুনিয়া বলিতেছেন, “দেখ, অনেক সময় ভাবি যে আমি তাে সেই রাম মুখুয্যের মেয়ে, আমার সমবয়সী আরও তাে অনেক মেয়ে জয়রামবাটীতে আছে, তাদের সঙ্গে আমার তফাৎ কি? ভক্তেরা সব কোথা থেকে এসে প্রণাম করে। জিজ্ঞাসা করলে শুনি, কেউ হাকিম, কেউ উকিল। এরাই বা এমন, আসে কেন?” মা ইহা বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। কিছু পরে আমি বলিলাম, “আচ্ছা, আপনাদের কি সব সময়ে নিজের স্বরূপ মনে থাকে না?” মা বলিতেছেন, “তা কি সব সময়ে থাকে? তাহলে কি এইসব কাজকর্ম করা চলে? তবে কাজকর্মের ভেতর। যখন ইচ্ছা হয়, সামান্য চিন্তাতে দপ করে উদ্দীপনা হয়ে মহামায়ার খেলা সব বুঝতে পারা যায়। একজন বলিলেন, “কই মা, আমরা তাে এত চেষ্টাতেও কিছুই বুঝতে পারছি না।” মা বলিতেছেন, “হবে গাে হবে, তােমাদের ভাবনা কি? কালে সব হবে।” সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত কথাবার্তা হইতেছিল। আমি বলিলাম, “মা কেদার মহারাজ বলেন, এইসব কাজে কর্মে খুব খাট, তাহলেই যা হবার আপনিই হবে।” মা বলিলেন, “কাজকর্ম করবে বইকি, কাজে মন ভাল থাকে। তবে জপধ্যান, প্রার্থনাও বিশেষ দরকার। অন্ততঃ সকাল-সন্ধ্যায় একবার বসতেই হয়। ওটি হ’ল যেন নৌকার হাল। সন্ধ্যাকালে একটু বসলে সমস্ত দিন ভালমন্দ কি করলাম না করলাম তার বিচার আসে। তারপর গতকালের মনের অবস্থার সঙ্গে আজকের অবস্থার তুলনা করতে হয়। পরে জপ করতে করতে ইষ্টমূর্তির ধ্যান করতে হয়। ধ্যানের প্রথমে মুখটি আসে বটে, কিন্তু পা থেকে সমস্ত অঙ্গটি সাক্ষাৎ ধ্যান করতে হয়। কাজের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা জপ-ধ্যান না করলে কি করছ না করছ বুঝবে কি করে?” আমি বলিলাম, “কেউ কেউ আবার বলেন, কাজকর্মে কিছু হবে না, সর্বদা জপধ্যান করতে পারলেই হবে।” মা বলিলেন, “তারা কি করে বুঝলে, কি করলে হবে, আর কি করলে হবে না ? কয়েকদিন একটু জপধ্যান করলেই কি সব হয়ে গেল ? মহামায়া পথ ছেড়ে না দিলে কিছুতেই কিছু হবার নয়। সেদিন দেখলে তাে, একজন জোর করে জপধ্যান বেশী করে করতে গিয়ে মাথাটি বিগড়ে এলেন। মাথাটি যদি বিগড়াল তাে আর রইল কি? ইস্কুপের প্যাঁচের একটু এধার আর ওধার। এক প্যাঁচ আলগা হলেই হয় পাগল হ'ল, না হয় মহামায়ার ফাঁদে পড়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে মনে করে, আমি বেশ আছি। আর উলটো দিকে এক প্যাঁচ কষা হলেই ঠিক পথে চলে শান্তি ও আনন্দ পায়। সর্বদা তাঁর স্মরণ মনন করে প্রার্থনা করতে হয়, ‘প্রভু সুব্দ্ধুখি দাও।’ সব সময়ে জপধ্যান করতে পারে কজন? প্রথমটা একটু করে। শেষে ন-র মত বসে থেকে থেকে নীচের গরম মাথায় ওঠে ( অহঙ্কারী হয়)। গাছ পাথর ভেবে নানা অশান্তি। মনটাকে বসিয়ে আলগা না দিয়ে কাজ করা ঢের ভাল। মন আলগা পেলেই যত গােল বাধায়। নরেন আমার এইসব দেখেই তাে নিষ্কাম কর্মের পত্তন করলে।” মা ন-কে লক্ষ্য করিয়া আবার বলিলেন, “দেখনা, বসে থেকে থেকে কি অশুদ্ধ মনই না হয়ে গেছে! কেবল শুচিবাই বাড়ছে। আর বলে, অশান্তি। অত অশান্তি কেন ? এত দেখেশুনেও চৈতন্য হল না?”
পরদিন বেলা দশটা-এগারটার সময় মা সদর দরজার রোয়াকে বসিয়া আছেন। আমরা বৈঠকখানায় আছি। কালী মামা ও বরদা মামার মধ্যে রাস্তা লইয়া বচসা হইতে হইতে ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইয়াছে। মা আর স্থির থাকিতে না পারিয়া উহাদের নিকট গেলেন। কখনও একজনকে বলিতেছেন, “তাের অন্যায়, কখনও অপরকে ধরিয়া টানিতেছেন। খুব মাতিয়া গিয়াছেন। ঐ সময় আমরাও গিয়া পড়ায় ঝগড়া একটু কমিল, এবং বকিতে বকিতে যে যার বাড়ি চলিয়া গেলেন। মাও সক্রোধে বাড়ির মধ্যে আসিয়া বসিলেন। বসিয়াই হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “মহামায়ার কি মায়া গাে ! অনন্ত পৃথিবীটা পড়ে আছে, এও পড়ে থাকবে ! জীব এইটুকু আর বুঝতে পারে না।” এই পর্যন্ত বলিয়া মা হাসিয়া অস্থির- হাসি আর থামে না।
ছয়মাস হইল রাধুর সন্তান হইয়াছে, কিন্তু দুর্বলতাবশতঃ সে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারে না। বসিয়া বসিয়াই চলাফেরা করে। আবার খুব আফিম খাওয়া অভ্যাস করিয়া ফেলিয়াছে। ইদানীং মারও শরীর ভাল নয়, মাঝে মাঝে জল হইতেছে। তিনি রাধুর আফিম খাওয়াটা একটু কমাইতে চেষ্টা করিতেছেন। ইহা লইয়া রাধু সব সময়ে খুব জিদ করে। সেদিন সকালে মা তরকারি কুটিতেছেন। রাধু আফিমের জন্য আসিয়া বসিয়াছে। মা বুঝিতে পারিয়া বলিতেছেন, “রাধু, আর কেন, উঠে দাঁড়া না। তোকে নিয়ে আর পারি নে। তাের জন্যে আমার ধর্মকর্ম সব গেল। এত খরচপত্র কোথা থেকে জোগাই বল তাে?” এই সকল মৃদু, রােষবাক্য বলাতে রাধু রাগিয়া গিয়া সামনের চুবড়ী হইতে একটা বড় বেগুন লইয়া মায়ের পিঠে জোরে ছুড়িয়া মারিল। গুম করিয়া শব্দ হইতেই দেখি, মা পিঠটা বাঁকাইয়া উঠিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানটি ফুলিয়া উঠিল। মা ঠাকুরের দিকে চাহিয়া জোড়হাতে বলিতেছেন, “ঠাকুর ওর। অপরাধ নিও না, ও অবােধ !” নিজের পায়ের ধূলা লইয়া রাধুর মাথায় দিতেছেন ও বলিতেছেন, “রাধু, এই শরীরকে ঠাকুর কোনদিন একটি শাসনবাক্য বলেন নি, আর তুই এত কষ্ট দিচ্ছিস! তুই কি বুঝবি আমার স্থান কোথায় ? তােদের নিয়ে পড়ে আছি বলে তাের কি মনে করিস বল দেখি?” রাধু; তখন কাঁদিয়া ফেলিল।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে একদিন ছােট মামী (রাধুর পাগলী মা) মনের খেয়ালে জামাই মন্মথকে নানা স্থানে—এমন কি পুকুরে নামিয়া—খুঁজিয়া না পাইয়া স্থির করিলেন যে সে জলে ডুবিয়া গিয়াছে। পরে ভাবিলেন, এ সব ঠাকুরঝির কাজ। তখন ছুটিয়া আসিয়া ভিজা কাপড়ে মায়ের পায়ে পড়িয়া আকুলভাবে কাঁদিয়া বলিলেন, “ওগো, ঠাকুরঝি গো, আমার জামাই বাঁড়ুয্যে পুকুরে ডুবে গেছে গাে। কি হবে গাে !” মা হঠাৎ ইহা শুনিয়া আমাদের ডাকিয়া বলিলেন, “শীগগির এস, পাগলী কি বলছে শোন,” এবং ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। আমরা ছুটিয়া আসিলাম। হরি বলিল, “মম্মথ বেনেদের দোকানে তাস খেলছে, দেখে এলাম।” মা বলিলেন “শীগগির ছুটে খবর দিয়ে তাকে নিয়ে এস।” আমরা তৎক্ষণাৎ মন্মথকে লইয়া আসিলাম। তাহাকে দেখিয়া ছােটমামী অপ্রস্তুত হইয়া ক্রোধভরে বকিতে বকিতে চলিয়া গেলেন।
বিকালে মা রাত্রের কুটনাে লইয়া বসিয়াছেন। হঠাৎ ছােটমামী তাহার কাছে বসিয়া বলিতেছেন, “তুমিই তাে রাধুকে আফিম খাইয়ে পঙ্গু করে বশ করে রেখেছ। আমার নাতিকে, আমার মেয়েকে আমার কাছে পর্যন্ত যেতে দাও না।” মা বলিতেছেন, “নিয়ে যা না তাের মেয়েকে, ঐ তাে পড়ে আছে। আমি লুকিয়ে রেখেছি নাকি?” এইরূপ দুই-এক কথা হইতেই মামীর পাগলামী চরম সীমায় উঠিয়াছে। মাকে মারিবার জন্য তিনি একখানি জ্বালানি কাঠ আনিতে ছুটিয়াছেন। মা তখন চীৎকাব করিয়া বলিতেছেন, “ওগাে কে আছ, পাগলী আমায় মেরে ফেললে?” আমি দৌঁড়িয়া গিয়া দেখি, কাঠখানি প্রায় মায়ের মাথায় ফেলেন আর কি! তাড়াতাড়ি উহা দূরে ফেলিয়া দিয়া মামীকে সদর দরজা পার করিয়া দিলাম। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে তাহাকে ভৎর্সনা করিয়া পুনরায় সে বাড়িতে আসিতে নিষেধ করিলাম। মাও তখন উত্তেজিত হইয়া বলিয়া ফেলিলেন, “পাগলী, কি করতে বসেছিলি? ঐ হাত তাের খসে পড়বে।” ইহা বলিয়াই জিব কাটিয়া মা শিহরিয়া উঠিলেন। ঠাকুরের দিকে চাহিয়া জোড়হাতে বলিতেছেন, “ঠাকুর, একি করলাম! এখন উপায় কি হবে? আমার মুখ দিয়ে কোনদিন তাে কারও ওপর অভিসম্পাত-বাক্য বেরােয় নি, শেষটায় তাও হ’ল ? আর কেন?” মায়ের অপার করুণার ভাব দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।
কয়েক মাস পূর্বে ব্যাঙ্গালােরের শ্ৰীযুত ন–কিছুদিনের ছুটি লইয়া কোয়ালপাড়ায় মায়ের নিকট ছিলেন, এবং রাধুর জন্য মায়ের খুব খরচ হইতেছে দেখিয়া তাঁহাকে প্রতিমাসে প্রচুর অর্থ সাহায্য করিতেন। যাইবার সময় মাকে তিনি বলিয়া গিয়াছিলেন, “মা, খরচপত্রে যখনই অনটন পড়বে, কোনরুপ দ্বিধা না করে আমাকে যেন একটু জানান।” আজকাল জয়রামবাটীতে খরচ খুব বাড়িয়াছে। পূজনীয় শরৎ মহারাজ লিখিয়াছেন, যােগাড়যন্ত্র করিয়া সময়মত টাকা পাঠাইতে দেরি হইয়া যাইতেছে। এই পত্ৰ শুনিয়া মা বলিতেছেন, “তাহলে শরতের হাতে আর বেশী টাকা নেই; নইলে সে অমন কথা লিখবে কেন ? ন - সেদিন ঐ কথা বলে গেল। হাঁ গা, আমি তার কাছে কি বলে টাকা চাইব? ঠাকুর, তােমার শেষ আদেশটি কি রক্ষা করতে পারব না? রাধু, তাের জন্যে আমি সব খােয়াতে বসেছি। ঠাকুর বলেছিলেন, “দেখ, কারও কাছে একটি পয়সার জন্যেও চিৎহাত করাে না। তােমার মােটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। একটি পয়সার জন্যে যদি কারও কাছে হাত পাত, তবে তার কাছে মাথাটি কেনা হয়ে থাকবে। বরং পরভাতা ভাল, পরঘােরো ভাল নয়। তােমাকে ভক্তেরা যে যেখানেই নিজেদের বাড়িতে আদর করে রাখুক না কেন, কামারপুকুরের নিজের ঘরখানি কখনও নষ্ট করাে না।”
মনসা নামে একটি ছেলে মায়ের কাছে আসিয়াছে। দীক্ষা ও গৈরিক লওয়ার খুব ইচ্ছা। মাও তাহাকে আনন্দের সহিত উহা দিলেন। সে খুব আলাদিত হইয়া সন্ধ্যার সময় কালী মামার বৈঠকখানায় বসিয়া, “আর কিছু নাই সংসারের মাঝে, কেবল শ্যামা সার রে” এবং “মনছাঁচে তােমারে ফেলে, শ্যামা”—এই দুইটি গান গাহিল। মার খুব ভাল লাগিয়াছে। তাহার কাছে বসিয়া রাধু, মাকু, নলিনী, মামীর দু-একজন এবং আরও অনেকে শুনিতেছিলেন। মামীদের মধ্যে একজন বলিলেন, “ঠাকুরঝি ঐ ছেলেটিকে সাধু করে দিলেন।” মাকু তাহাতে সায় দিয়া বলিল, “তাই বটে, পিসীমার যেমন কাজ। অমন ভাল ভাল ছেলেদের সাধু করে দিচ্ছেন। বাপ মা কত কষ্ট করে মানুষ করে মুখ চেয়ে আছে। তাদের কত আশা! সে সব চুরমার হয়ে গেল। এখন উনি হয় হৃষীকেশে গিয়ে ভিক্ষে করে খাবেন, না হয় রােগীর সেবায় মলমূত্র ঘাটিবেন! বে থা করা- সেও তাে একটা সংসারধর্ম। তুমি যদি এ রকম সাধু, করে দাও, মহামায়া তােমার উপর চটে যাবেন। সাধু হয়, নিজেরা হােকগে। তােমার নিমিত্ত হতে যাওয়া কেন, পিসীমা?” মা তখন বলিতে লাগিলেন, “মা, ওরা সব দেবশিশু। সংসারে ফুলের মতাে পবিত্র হয়ে থাকবে। এর চেয়ে সুখের কি আছে বল দেখি? সংসারে যে কি সুখ তা তাে দেখছিস। স্বামীসুখও দেখলি। এখন লজ্জা হয় না, আবার স্বামীর কাছে যাস? এতদিন আমার কাছে থেকে কি দেখলি? এত আকর্ষণ, পশুভাব কেন ? কি সুখ পাচ্ছিস? ফের যদি স্বামীর কাছে যাবি, দূর করে দেব। পবিত্র ভাবটা কি স্বপ্নেও তােদের ধারণা হয় না? এখনও কি ভাই-বােনের মতাে থাকতে পারিস নে? খালি শুয়ােরের মত থাকতে চাস? তােদের সংসারের জ্বালায় আমার হাড় জ্বলে গেল।”১ সকলে লজ্জায় মাথা হেট করিয়া রহিলেন।
মা আবার বলিতেছেন, “ভগবানকে ডাকুক আর না ডাকুক, যে বে না করে সে তাে অর্ধমুক্ত। যে সময়ে ভগবানে একটু মন হবে, সে সময়ে হু হু করে এগুতে থাকবে। আর যাদের মহাপাপ তারাই বিয়ে করে সংসার করে। ভগবানে মন হলেও কিছুতেই আর উঠতে পারে না। হাত-পা সব বাঁধা।”
আজকাল প্রায় প্রত্যহ মার সামান্য সামান্য জ্বর হইতেছে। শরীর খুব দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। পুজনীয় শরৎ মহারাজ মাকে শীঘ্র কলিকাতায় লইয়া যাইতে চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু তিনি বিশেষ কার্য উপলক্ষ্যে কাশী গিয়াছেন। সেই সময় মাকে কলিকাতা যাইবার কথা বলাতে মা বলিতেছেন, “শরৎ কলকাতায় না থাকলে আমার সেখানে যাবার কথা উঠতেই পারে না। কার কাছে যাব ? আমি সেখানে আছি আর শরৎ যদি বলে, 'মা কয়েকদিন অন্যত্র যাচ্ছি, তা হলে আমি বলব, একটু থাম বাবা, আমি আগে এখান থেকে পা বাড়াই, তারপর তুমি যাবে। শরৎ ছাড়া আমার ঝক্কি কে পােয়াবে?”

১. ইহা অল্পদিন পূর্বে মাকুর একটি শিশুপুত্র মায়া গিয়াছে এবং সম্প্রতি একটি পুত্রসন্তান হইয়াছে। রাধু তখনও অসুস্থ।

তখন শীতকাল, মায়ের শরীরও এত খারাপ ; তথাপি পূর্ব অভ্যাস মতাে ভাের তিনটায় উঠিয়া প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করিয়া বিছানায় লেপমুড়ি দিয়া কিয়ৎক্ষণ বসিয়া পুনরায় শুইয়া পড়িতেন। সেই সময়ে আমরা তাহার ঘরে গিয়া অন্ধকারে দরজা বন্ধ করিয়া চুপচাপ বসিয়া থাকিতাম। মা হয়তাে বলিতেছেন, “এই সময় এই দেবতার মন্ত্রটি এইভাবে জপ কর দেখি,” ইত্যাদি। কিছু পরে কথা উঠিয়াছে, আমাদের সাধুরা অসুস্থ হইয়া গৃহস্থের বাড়িতে থাকে। মা বলিতেছেন “অসুস্থ হয়েছে বলে গৃহস্থ-বাড়িতে সন্ন্যাসী কেন থাকবে? মঠ রয়েছে, আশ্রম রয়েছে। সন্ন্যাসী ত্যাগের আদর্শ। কাঠের স্ত্রী মূর্তি পুতুল যদি রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে, সন্ন্যাসী কখনও পায়ে করেও উলটে দর্শন করবে না। আর সন্ন্যাসীর অর্থ থাকা একান্ত খারাপ। চাকি (টাকা) না করতে পারে এমন জিনিস নেই—প্রাণসংশয় পর্যন্ত। পুরীতে একটি সাধু থাকত, সমুদ্রের ধারে। তার কিছু টাকা ছিল। তাই টের পেয়ে দুজন চেলা লােভ সামলাতে না পেরে সাধুটিকে খুন করে টাকা নিয়ে চলে গেল।”
একদিন মা বেলা নয়টা-দশটার সময় বসিয়া তেল মাখিতেছেন। ঐ সময়ে একজন ঝাঁট দিয়া ঝাঁটাটি ছাড়িয়া একদিকে ফেলিয়া রাখিলেন। মা তাহা দেখিয়া বলিতেছেন, “ও কি গাে, কাজটি হয়ে গেল, আর অমনি ওটি অশ্রদ্ধা করে ছুড়ে দিলে ? ছুড়ে রাখতেও যতক্ষণ, আস্তে ধীর হয়ে রাখতেও ততক্ষণ। ছােট জিনিস ব'লে কি তুচ্ছবােধ করতে আছে ? যাকে রাখ সেই রাখে। আবার তাে ওটি দরকার হবে ? তা ছাড়া, এ সংসারে ওটিও তো একটি অঙ্গ। সেদিক দিয়েও তাে ওর একটা সম্মান আছে। যার যা সম্মান, তাকে সেটুকু দিতে হয়। ঝাঁটাটিকেও মান্য করে রাখতে হয়। সামান্য কাজটিও শ্রদ্ধার সঙ্গে করতে হয়।” 
একদিন রাধুর সর্বাপেক্ষা প্রিয় মিনি বিড়ালটি উঠানের ধারে শুইয়া আছে। জনৈকা মহিলা দাঁড়াইয়া পা দিয়া তাহাকে আদর করিতেছেন। ক্রমে তাহার মাথায়ও পা দিয়াছেন। মা তাহা দেখিয়া বলিতেছেন, “ও মা, ও কি করছ ? মাথা যে গুরু স্থান, মাথায় কি পা দিতে আছে ? নমস্কার কর।” উক্ত মহিলা বলিলেন, “তা তাে কোন দিন জানিনি, মা। আজ জানলাম।”
সকালে কলিকাতা হইতে কয়েকটি ভক্ত আসিয়াছেন, বেশ ফিটফাট। কাপড়-জামার খুব প্রাচুর্য। মায়ের জন্য ফল প্রভৃতি অনেক জিনিস আনিয়াছেন। মা বিকালে আপন মনে বলিতেছেন, “সব জ্বালিয়ে খেলে। আর পারিনে।
এক একটি ছেলে আসে, আমার সংসারটি যেন শান্তিপূর্ণ হয়ে যায়। কোথা থেকে সব তরিতরকারি জিনিসপত্রের যােগাযােগ হয়ে যায়। আমাকে কোন ভাবনা চিন্তা করতে হয় না। যা হ’ল,মুখটি বুজে খেয়ে পাতাটি গুটিয়ে নিয়ে উঠে গেল। আহা, তাদের মুখের কথাটিতেও যেন প্রাণটি শীতল হয় ! আর এই দেখ না, সকাল থেকে যেন উদ্ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। একগাদা ফল নিয়ে এল। তার অর্ধেক পচে গােবর হয়ে গেছে। সেগুলি ফেলি কোথায় তা খুজে পাই নে। এদিকে অমন ফরসা কাপড়-চোপড়, বলে, গামছা আনতে ভুলে গেছি। আমি গামছা পাই কোখেকে ? তখনতাে একটা দেখেশুনে দিলাম। এখন ভাবনা, রাতে কি যে তরকারি করি! আবার শুনছি, মশারির দড়ি নেই। হরি দড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠাকুর, তােমার সংসার তুমি দেখ গিয়ে। আমি তাে আর পেরে উঠছি না। এদিকে রাধু, আর ওদিকে এইসব।” ভক্তদের কেহ কেহ মাকে কত উত্যক্ত করিত তদ্বিষয়ে দুই-একটি ঘটনা মনে পড়িতেছে।
মা তখন জয়রামবাটীতে। সন্ধ্যার একটু পূর্বে শ্যামবাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, বারান্দায় একখানা মাদুর পাতিয়া মা শুইয়া আছেন। আমি যাইতেই মা বিরক্তি প্রকাশ করিয়া বলিতেছেন, “তােমরা সব থাক, কিন্তু কাজকর্মে বাইরেও যেতে হয়। আজ-র সঙ্গে একটা লােক এসেছিল বুড়ো গােছের। তাকে দূর থেকে দেখে আমি ঘরের ভিতর চৌকিতে বসে রইলাম। সে বাইরে থেকে প্রণাম করল বটে, কিন্তু পায়ের ধূলাে নিতে ব্যস্ত। আমি যত সঙ্কোচ করি, 'না, না, করি, সে কিছুতেই ছাড়ল না ; শেষে একরকম জোর করেই পায়ের ধুলাে নিলে। সেই থেকে অসহ্য পায়ের জ্বালা আর পেটের ব্যথায় মরছি। তিনবার চারবার পা ধুলম, তবুও সে জ্বালা যাচ্ছে না। তােমরা কাছে থাকলে আমার ইসারা বুঝে তাকে নিষেধ করতে পারতে। কলকাতায় ওরা ভক্তদের সম্বন্ধে যে কড়াক্কড় করে সেটি না করলেও চলে না। কত রকমের লােক যে আসে। তােমরা ছেলেমানুষ বুঝতে পার না।” 
 বাহিরের কাজকর্ম সারিয়া আমি সন্ধ্যাকালে মার কাছে আসিয়াছি। মা বলিলেন, “আজ বিকালে বি—একজন পুলিসের বড় কর্মচারীকে (তাহার নাম করিয়া) আমার কাছে আনিয়াছিল। লােকটি কি রকম প্রকৃতির গোঁফ পাকাতে পাকাতে এসে প্রণাম করে আমার পায়ের ধুলাে নিতে চায়। আমি সঙ্কুচিত হয়ে কিছুই পায়ের ধুলাে দিতে পারলাম না। কি রকম চনমনে স্বভাব! অথচ বি—আমার সামনে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার কত প্রশংসা করছে। এদিকে আমি তাে ব্যতিব্যস্ত, ভাবছি কি ভাবে তার অভ্যর্থনা করতে হবে, না হবে। শেষে কিছু হালুয়া করে সদরে পাঠিয়ে দিলাম।”
একদিন ‘উদ্বোধনে’র বাটীতে মা পূজা সারিয়া উঠিয়াছেন এমন সময় একটি ভক্ত কতকগুলি ফুল লইয়া মাকে দর্শন করিতে যান। মা তাে অপরিচিত ভক্তটিকে দেখিয়া সর্বাঙ্গ চাদর মুড়ি দিয়া বউ-মানুষটির মতো তক্তপােশে পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছেন। ভক্তটি মায়ের পায়ে ফুলগুলি দিয়া প্রণাম করিয়া সামনে আসন করিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া ন্যাস ও দীর্ঘ প্রাণায়াম আরম্ভ করিলেন। বাড়ির সকলে কাজে ব্যস্ত, মায়ের কাছে কেহই নাই। বসিয়া থাকিতে থাকিতে মায়ের সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল।
ভক্তটি মাকে পূজা করিতেছে দেখিয়া গােলাপ-মা কার্যোপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন। অনেকক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়াও সেই ব্যক্তিকে তদ্রপ বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিলেন এবং তাহাকে হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া তাঁহার স্বাভাবিক উচ্চগলায় বলিতে লাগিলেন, “এ কি কাঠের ঠাকুর পেয়েছ যে ন্যাস-প্রাণায়াম করে তাকে চেতনা করবে? আক্কেল নেই ? মা যে ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন।”
একবার একটি ভক্ত মাকে প্রণাম করিতে গিয়া মায়ের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর জোরে মাথা ঠুকিয়া দেয়। মা ব্যথা পাইয়া ‘উঃ করিয়া উঠিলেন, নিকটে যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি করলে?” তখন ভক্তটি জবাব দিল, “মায়ের পায়ে মাথা ঠুকে ব্যথা রেখে দিলাম। যতদিন এই ব্যথা থাকবে, ততদিন মা আমাকে স্মরণ করবেন।” 
পূর্বোক্ত ঘটনা দুইটি মা অনেকবার আমাদের নিকট হাসিতে হাসিতে বলিয়াছিলেন।
পুজনীয় শরৎ মহারাজ কাশী হইতে কলিকাতা আসিয়াই মাকে আনিতে জয়রামবাটীতে লােক পাঠাইয়াছেন। যথাসময়ে সকালবেলায় সকলকে লইয়া মা কলিকাতা রওয়ানা হইতেছেন। সকলের শেষে কি-মহারাজ ও হ-প্রণাম করিলেন। মা তাহাদিগকে তাঁহার ব্যবহৃত একখানি কাপড় ও চাদর দিয়া এগুলি রেখাে” বলিয়া মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন এবং সজলনয়নে যাত্রা করিলেন। আমি পালকির সঙ্গে সাইকেলে চলিলাম, পথে শিহোড়ে শান্তিনাথ মহাদেবের মন্দিরের নিকট পালকি নামাইয়া মা দুই টাকার সন্দেশ, চিনি ও নবাত (সরাগুড়) কিনিয়া শিবের পুজা দেওয়াইলেন। উপস্থিত সকলকে এবং আমাদিগকেও কিছু প্রসাদ দিয়া নিজে সামান্য গ্রহণ করিলেন ও কিছু রাধুর জন্য আঁচলে বাঁধিয়া লইলেন। যথাসময়ে সকলে কোয়ালপাড়া পেীঁছিলেন। সেই দিন সন্ধ্যায় রাধু প্রভৃতি মেয়েরা সকলে গরুর গাড়িতে বিষ্ণুপুর রওয়ানা হইলেন। পরদিন ভাের পাঁচটার সময় আমি জগদ্মবা আশ্রমে মায়ের কাছে গিয়া দেখি, তিনি ফুল মিষ্টি দিয়া ঠাকুরপূজা সারিয়া ঠাকুরের ফটোখানি কাপড়ে জড়াইয়া বাক্সের মধ্যে লইতেছেন এবং ঠাকুরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “ওঠ, এবার যাত্রার। সময় হ’ল।” আমাকে দেখিয়া বলিতেছেন, “এসেছ ? এত দেরি করলে যে? রােদ হবে। এই যাত্রার ফুলটি নাও।” এই বলিয়া ঠাকুরের পূজার একটি ফুল নিজের মাথায় ঠেকাইয়া আমার হাতে দিলেন। পরে সকলের নিকট বিদায় লইয়া পালকিতে উঠিলেন। কিছুদূর গিয়া মা বলিতেছেন, “সর্বদা আমাদের কাছে কাছে এবং সাবধানে চল। রাধু ও মাকুর গহনাগুলি সব মাকুর পালকিতে আছে।” জয়পুরে আসিয়া মা পালকি নামাইতে বলিলেন। পালকি হইতে নামিয়া যে চটিতে মা ও আমরা সেবার জয়রামবাটী যাইবার পথে রান্না করিয়া খাইয়াছিলাম সেখানি ভগ্নপ্রায় দেখিয়া মা হাসিয়া বলিতেছেন, “আহা, আমাদের সেই চটিখানি গো।” উহার নিকটে গিয়া কম্বল পাতিয়া বসিলেন ও বলিলেন, “বেহারাদের কিছু খাওয়াও।” দুটি টাকা দিয়া মুড়ি কিনিয়া দিতে বলিলেন। পরে মাকুর ছেলের দুধ গরম করিয়া দিয়া মা সামনের পুকুরটিতে হাত পা ধুইয়া আসিয়া বলিতেছেন, “আমার জন্যে এক পয়সার মুড়ি এনে দাও, আমিও দুটি চিবই। আর তােমার ও মাকুর জন্যে কিছু তেলেভাজা পাও তাে নিয়ে এস।” আমি ঐসব আনিয়া দিলে মা অল্প দু'টি খাইয়া আমাদের দিয়া দিলেন। বলিলেন, “আর চিবুতে পারি না।” বেহারাদের সকলের খাওয়া হইলে আবার পালকি ছাড়িয়া দিল। চার মাইল জঙ্গল পার হইয়া তাঁতিপকুরে আসিয়া দেখি, কতকগুলি মজুরশ্রেণী লােক একটি ছােট দোকানের পাশে বসিয়া জটলা করিতেছে। আমি ভাবিতেছি, এই জায়গাটা শীঘ্র পার হইয়া যাইতে পারিলে আর দু'মাইল পরে কিছু কিছু লোকালয় পাওয়া যাইবে এবং অনেকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারি। কিন্তু মা পালকি হইতে উঁকি মারিয়া, দোকানটি দেখিয়াই বলিতেছেন, “একটু নামাতে বল দেখি, আমার পালকিতে বসে পা-টা ধরে গেছে। ঐ দোকান থেকে আধা পয়সার তেল একটা শালপাতায় করে এনে দাও। পা-টায় মালিশ করি।” আমি তাে এই কথা শুনিয়া ভয়ে অস্থির ! শেষে মাকে বলিলাম, “এইখানে কারা সব রয়েছে। আপনার আর নেমে কাজ নেই। আপনি পালকিতেই বসে থাকুন, আমি তেল এনে দিচ্ছি।” মাকু সেই সময়ে বলিতেছে, “আমার মুড়ি খেয়ে খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল খাব।” মা বলিলেন, “খা না, ঐ পুকুরটায় খেয়ে আয়।” আমি বলিলাম, “ও জল কি খাবে? খুব খারাপ।” মা বলিলেন, “রাস্তায় ওই কত লােকে খাচ্ছে। কিছু হবে না, যা। তুমি যাও ওর সঙ্গে, খাইয়ে আন।” মাকে তেল কিনিয়া দিয়া মাকুর সহিত গিয়া তাহাকে জল খাওয়াইয়া আসিয়াই রওয়ানা হইলাম। বেলা বারটা আন্দাজ বিষ্ণুপুরে সুরেশ্বরবাবুর বাড়িতে পেীঁছিলাম। সুরেশ্বরবাবু, কয়েক মাস পবে দেহত্যাগ করিয়াছেন। মা তাহার কথা বলিতেছেন, “আহা! আমি এখানে এলে সুরেশ আমার সর্বদা জোড়হাত করে ঐখানটিতে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও বারান্দাটিতে পর্যন্ত উঠত না। কি ভক্তিই ছিল।”১ সেইদিন বিষ্ণুপুরে থাকিয়া পরের দিন মধ্যাহ্নে আহারাদির পর মাকে লইয়া আমরা সকলে একটি তৃতীয় শ্রেণীর গাড়িতে কলিকাতা রওয়ানা হইলাম এবং রাত্রিতে প্রায় দশটায় ‘উদ্বোধনে' পেীঁছিলাম। 
যােগেনমা ও গােলাপ-মা মায়ের শরীর দেখিয়া আমাদিগকে বলিতেছেন, “তােমরা কি মাকেই নিয়ে এলে গাে ! ভুতের মতন কাল। কেবল চামড়া ও হাড় কখানি এনে হাজির করলে গা? মায়ের শরীর যে এত খারাপ তা আমরা মােটেই বুঝতে পারিনি। পরের দিন হইতেই পুজনীয় শরৎ মহারাজ মায়ের চিকিৎসার সকল রকম ব্যবস্থা করিলেন।
মা শ্ৰীযুত শ্যামাদাস কবিরাজের চিকিৎসায় কয়েকদিন একটু ভাল আছেন। ঐ সময়ে একদিন বিকালে কয়েক জন স্ত্রী-ভক্ত দর্শন করিতে আসিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে একজনের অলঙ্কার বেশভুষার খুব পরিপাট্য। একটু চঞ্চল। মা তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “দেখ, স্ত্রীলােকের লজ্জাই হ’ল ভুষণ। ফুলটি দেবসেবায় লাগলেই সব চেয়ে সার্থক ; না হয় গাছেই শুকিয়ে যাওয়া ভাল। কিন্তু আমার দেখে বড় কষ্ট হয়, যখন বাবুরা ফুলটি কখনও তােড়া করে, কখনও বা এমনি হাতে নিয়ে নাকের কাছে একবার ধরে বলে, “বাঃ, বেশ তাে গন্ধটি। ও মা, পরক্ষণেই হয়তাে মেঝেয় ফেলে দিয়েছে। জুতােয় মাড়িয়েই হয়তাে চলেছে। চেয়েও দেখলে না।”২
ঐ সময়ে একদিন ইটালিতে উৎসব দেখিতে যাইবার পথে রামলাল দাদা, লক্ষ্মী দিদি ও রামলাল দাদার কন্যা দক্ষিণেশ্বর হইতে মায়ের নিকট আসিয়াছেন। রামলাল দাদা মাকে প্রণাম করিয়া নীচে শরৎ মহারাজের নিকট গেলেন। মা ও অন্যান্য সকলের অনুরােধে লক্ষ্মী দিদি চাপাগলায় কীর্তন গাহিয়া ও সঙ্গে সঙ্গে মুখে খােলের বােলের অনুকরণ করিয়া শুনাইলেন। তারপর কথায় কথায় শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মস্থান, মন্দির ও বিষয়সম্পত্তির কথা উঠিল।
লক্ষ্মী দিদি-ও হলে সেটি আমাদের হেপাজতে থাকবে তাে? এদের ( রামলাল দাদা ও শিবু দাদার) ছেলেপিলেরাই সব পুজাদি করবে, থাকবে।
মা - তা কি করে হবে? এরী সব সাধুভক্ত ; এদের জাতের বিচার আছে ? কত দেশের লােক সাহেববাে সব যাবে, ঐখানে থাকবে, প্রসাদ পাবে। আমাদের তাে সব ভক্ত নিয়েই কারবার। তােরা হলি সংসারী। তােদের সমাজ আছে, ছেলেমেয়েদের বে থা আছে। তােদের কি ওদের সঙ্গে থাকলে চলবে? 
এইরপে আরও কিছু কথাবার্তার পর মা আবার বলিতেছেন, “তােদের এখন যেমন ঘরগুলি আছে ঐ ধরনের, তবে করগেটের ছাউনি দিয়ে, যুগীদের খামারের কাছে, অথবা পশ্চিম দিকে যেখানে হােক একটু জায়গা নিয়ে বাড়ি আলাদা করে দেবে। '
লক্ষ্মী দিদি - তবে রঘুবীর ও শীতলা কি ঠাকুরের যে মন্দির হবে তাতেই থাকবেন?
মা - তা কি হয়! ও তােদের গৃহদেবতা ; পালপার্বণে তােদের বউঝিরা পূজা-অর্চনা করবে। তা হয় না। রঘুবীরের জন্য মন্দির আলাদা পাকা করে দেবে; পাশ দিয়ে একটু রাস্তা থাকবে; মেয়েরা যাতায়াত করবে। তুই রামলাল বা শিবু যখন যাবি, তােরা মন্দিরেই ভক্তদের সংসারে খাবি থাকবি ; তােদের আর কি?
উপরে শরৎ মহারাজের ঘরে রামলাল দাদা প্রভৃতি আসিলেন। শ্রীশ্রীমার প্রস্তাব রামলাল দাদা ও লক্ষ্মী দিদি সর্বান্তঃকরণে অনুমােদন করিলেন ও শরৎ মহারাজও সকল কথা শুনিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

১.মা মাঝে মাঝে বলিতে, “সরেশ যেন দ্বিতীয় গিরিশৰাৰ।”

২.পরেনিয়াছিলাম ঐশীলােকটি মাসী লাকি বহুদিন নিলেশ হইয়াছেন।

লক্ষী দিদি ও রামলাল দাদা প্রভৃতি চলিয়া গেলে মা আমাকে ডাকিয়া বলিতেছেন, “দেখ, তখন লক্ষ্মীর সঙ্গে কথা কইতে কইতে ওকে কাপড় ও টাকা দিতে ভুলে গেছি। তুমি কৃষ্ণলালের সঙ্গে ইটালিতে গিয়ে উৎসব দেখে এস, আর লক্ষীকে টাকা ও কাপড় দিয়ে এস। ইটালিতে ওরা ঠাকুরকে বেশ সাজায়। এই বলিয়া দুটি টাকা ও একখানি কাপড় বাহির করিয়া দিলেন। পরে বলিতেছেন, “লক্ষ্মী ঠাকুরের কাছে কীর্তনীয়াদের অনুকরণ করে গাইতে গাইতে নেচে অঙ্গভঙ্গী করে দেখাত। ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, ওর ওই ভাব। তুমি যেন ওর লয়ে লয় দিয়ে লজ্জা ভেঙো না।” 
একদিন জয়রামবাটী হইতে চিঠি আসিল যে ঐ অঞ্চলের একটি লােক ডাকাতি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে। মা শুনিয়াই বলিতেছেন, “ও বাবা, দেখলে ? আমি জানতাম তার ডাকাতি-বৃত্তিটা নষ্ট হয়নি। আমি কি সাধু করে তাকে অত আদর করতাম, অত জিনিসপত্র দিতাম? তাই আমার বাধ্য থাকত। আমার কাছে এলে কেঁচোটির মত থাকত। এই সব মেয়ের পাল নিয়ে, ওদের অত গয়নাগাটি নিয়ে বাস করি। তােমরা তাে কে কখন আছ, কিছুই ঠিক নেই। দুর্জনকে দুরে পরিহার, তা যে ভাবেই হােক।
মায়ের অসুখ ক্রমশই বাড়িয়া চলিয়াছে। আর মাত্র দুই-আড়াই পর্যন্ত উঠে, কিন্তু হাত-পা-জ্বালার জন্য অত্যন্ত অস্থিরতা। আজকাল সর্বদা বলিতেছেন, “আমাকে গঙ্গাতীরে নিয়ে চল, গঙ্গার ধারে আমি ঠাণ্ডা হব।” পূজনীয় শরৎ মহারাজ সেজন্য চেষ্টাও করিতেছেন। কিন্তু ডাক্তাররা এই অবস্থায় নাড়াচড়া করিতে নিষেধ করিতেছেন। একদিন মা আমাকে বলিতেছেন, “তুমি রাধুটা ওদের সবাইকে জয়রামবাটী রেখে এস।” আমরা ভাবিতেছি, মা রাধুগত-প্রাণ, তাহাকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকিতে পারেন না, আর আজ এই অবস্থায় তাহাদিগকে জয়রামবাটী পাঠাইয়া দিতে বলিতেছেন। একি ব্যাপার! মা ক্রমশই উহাদের উপর এত বিরক্ত হইয়া উঠিতেছেন যে নলিনী দিদি প্রভৃতি তাঁহার কাছে যাইতে সাহস করেন না। পুজনীয় শরৎ মহারাজ মাকে বুঝাইতে লাগিলেন, “আপনার এই অসুখ দেখে ওদের যেতে কষ্ট হবে। আপনি একটু সেরে উঠলে ওরা যাবে।” মা বলিতেছেন, “পাঠিয়ে দিলেই ভাল হত। তবে যেন আমার কাছে আর না আসে। আমার আর ওদের ছায়া দেখতেও ইচ্ছে নেই।”
একদিন দুপুরে রাধু পাশের ঘরে ঘুমাইতেছে, তাহার থােকা হামা দিতে দিতে মায়ের বিছানার নিকট আসিয়া তাহার বুকের উপর উঠিতেছে। মা তাহা দেখিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “তােদের মায়া একেবারে কাটিয়েছি। যা, যা, আর পারবি নে। আমাকে বলিলেন, “একে তুলে নিয়ে গিয়ে ওদিকে রেখে এস। এসব আর ভাল লাগে না।” আমি থােকাকে কোলে করিয়া তাহার দিদিমার নিকট দিয়া আসিলাম।
জয়রামবাটীতে একদিন একজন ছােট মামীকে একটু বড় কথা বলায় মা বলিতেছেন, “কি গাে, মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কি কথা বলতে আছে ? কথা সত্য হলেও অপ্রিয় করে বলতে নেই। শেষে ঐরুপ স্বভাব হয়ে যায়। মানুষের চক্ষুলজ্জা ভেঙে গেলে আর মুখে কিছু আটকায় না। ঠাকুর বলতেন, একজন খোঁড়াকে যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়, তুমি খোঁড়া হলে কি করে ? তাহলে বলতে হয়, তােমার পা-টি অমন মােড়া হ'ল কি করে?”
শেষাশেষি মায়ের শরীর খুব দুর্বল থাকায় বেশীক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিতেন না। কিন্তু দেখিতাম, তিনি এই শুইয়া থাকার সময়েও জপ করিতেছেন। জয়রামবাটীতে রাত্রি একটা-দুইটার সময় হঠাৎ কোন কার্য উপলক্ষে তাঁহাকে ডাকিয়া দেখিয়াছি, তিনি এক ডাকেই সাড়া দিতেন এবং “আপনি কি ঘুমান নাই ?”—জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, “কি করি, বাবা, ছেলেরা ব্যাকুল হয়ে এসে ধরে, দীক্ষা নিয়ে যায়। কিন্তু কই, কেউ নিয়মিত নিয়মিত কেন, কেউ বা কিছুই করে না। তা যখন ভার নিয়েছি, তখন তাদের আমাকে দেখতে হবে তাে? তাই জপ করি। আর ঠাকুরের কাছে তাদের জন্য প্রার্থনা করি, “হে ঠাকুর, ওদের চৈতন্য দাও, মুক্তি দাও। এই সংসারে বড়
দুখঃকষ্ট। আর যেন তাদের না আসতে হয়।” বলিতে বলিতে অতি ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিতেন। আবার বলিতেন, “এত আগ্রহ করে মন্ত্রটি তাে নিয়ে গেল, কিন্তু কিছু করে না কেন? এমন আর কি শক্ত ? একটু অভ্যাস করে করতে থাকলেই কেমন আনন্দ আসে। আহা, যােগেন ও আমরা বন্দাবনে কি আনন্দে কত জপ করতাম। চোখে মুখে মাছি বসে ঘা করে দিত হুশ হত না। ক
একদিন মা বলিতেছেন, “এত জপ করলামই বল, আর এত কাজ করলামই বল, কিছুই কিছু নয়। মহামায়া পথ ছেড়ে না দিলে কার কি সাধ্য! হে জীব, শরণাগত হও, কেবল শরণাগত হও। তবেই তিনি দয়া করে পথ ছেড়ে দেবেন।” এই বলিয়া কামারপুকুরে অবস্থানকালে ঠাকুরের জীবনের একটি ঘটনা বলিলেন, “একবার কামারপুকুরে জ্যৈষ্ঠমাসের দিন বৈকালে খুব বৃষ্টি হয়ে মাঠ সব জলে উপচে গেছে। ঠাকুর ডোমপাড়ার কাছে নীচু সদর রাস্তা দিয়ে এত খানি জল ভেঙে মাঠে শৌচে যাচ্ছেন। সেখানে অনেকে মাগুর মাছ উঠেছে দেখে লাঠি দিয়ে মারছে। একটি মাগুর মাছ ঠাকুরের পায়ে পায়ে কেবল ঘুরছে। তাই দেখে তিনি বলছেন, এটিকে মারিসনে রে, এটি আমার পায়ে পায়ে শরণাগত হয়ে কেমন ঘুরছে। কেউ যদি পারিস তাে একে পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আয়। তারপর নিজেই সেটিকে ছেড়ে দিয়ে এসে বাড়িতে বলছেন, “আহা, কেউ যদি এই রকম শরণাগত হয় তবেই সে রক্ষা পায়।”

জিতেন্দ্রমােহন চৌধুরী, পাটনা

জয়রামবাটীতে জনৈক ভক্ত জপ সম্বন্ধে মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “যখন রাস্তায় রেলে স্টীমারে থাকিতে হয়, তখন কিভাবে জপ করিব ?” মা তাহাতে বলিয়াছিলেন, “তখন মনে মনে করিবে।” আরও বলিয়াছিলেন, “বাবা, ক্রমে হাত মুখ সব বন্ধ হয়ে যাবে, কেবল মনে চলবে। মনই শেষে গুরু হবে।”
একদিন কথাপ্রসঙ্গে মঠের মহারাজদের সম্বন্ধে মা বলিয়াছিলেন, “জীবের মুক্তির চাবি এদের হাতে আছে।” 
কাশীতে একবার শ্রীশ্রীমার জন্মদিনে স্বামী কেশবানন্দের মাতা তাঁহার কোন আত্মীয়ের বিয়ােগ-কথা স্মরণ করিয়া কাঁদিতেছিলেন। তাহাতে মা বললেন, “ছি ! আজ কি কাঁদতে আছে, আজ যে আনন্দের দিন।”
কোয়ালপাড়ায় রথের দিন আমাদের জনৈক গুরুভ্রাতা মাকে বলে, “মা, মন বড়ই চঞ্চল। কিছুতেই ঠিক হয় না।” তদুত্তরে মা বলিয়াছিলেন, “যেমন ঝড়ে মেঘ উড়িয়ে নেয় তেমনি তাঁর নামে বিষয়-মেঘ কেটে যাবে।” 
আমি মাকে ঐদিন মনের দুর্বলতা সম্বন্ধে নিবেদন করায় মা উত্তরে বলিয়াছিলেন, “কাম কি একেবারে যায় গা, শরীর থাকলেই কিছু না কিছু থাকে। তবে কি জান, সাপের মাথায় ধূলপড়া পড়লে যেমনটি হয়, তেমনটি হয়ে যাবে।”
মা একবার বলিয়াছিলেন, “ভয় কি? সর্বদা জানবে, তােমাদের পিছনে একজন আছেন।” আরও বলিয়াছিলেন, “যতদিন (এ) শরীর আছে, আনন্দ করে চলে যাও।”
একদিন কথাপ্রসঙ্গে মা বলেন, ‘ঘাস আর বাঁশ ছাড়া সকলকেই এখানে আসতে হবে।' ইহার অর্থ আমি এই বুঝিয়াছি যে, যাহাদের কিছুমাত্র সার নাই তাহারাই কেবল এবার বাদ পড়িবে, নতুবা আর সকলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাব গ্রহণ করিবে। স্বামী কেশবানন্দ ও বিদ্যানন্দের নিকটও মা এইরুপ বলিয়াছিলেন।
জনৈক স্ত্রী-ভক্ত মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মা, অনেকে তাে শিবপূজা করে, আমরাও শিবপূজা করতে পারি কিনা?” তদুত্তরে মা বলিয়াছিলেন, “আমি যে মন্ত্র দিয়েছি তাতেই সব-দুর্গাপূজা, কালীপুজো সব ঐ মন্ত্রে হয়। তবে কারও ইচ্ছা হলে শিখে নিয়ে করতে পারে। তােমাদের ওসবের দরকার নেই, ওসব করলেই হাঙ্গাম-বাড়ান।” 
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভােগ নিবেদন করা সম্বন্ধে মাকে বলা হইয়াছিল, “মা, পূজাপদ্ধতি-মতে নিবেদন করবার মন্ত্র তাে কিছুই জানি না।” তাহাতে মা বলেন, “পূজাপদ্ধতির অত দরকার নেই। ইষ্টমন্ত্রেতেই সব কাজ হয়।”

নলিনবিহারী সরকার, চন্দ্রকোণা

ধ্যানজপের কথা উঠায় মা বলিলেন, “ধ্যানজপের একটা নিয়মিত সময় রাখা খুব দরকার। কারণ কখন যে ক্ষণ১ বয়, বলা যায় না। ও হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়—টের পাওয়া যায় না। সেজন্য যতই গােলমাল হােক, নিয়ম রাখা খুব দরকার।”

১. ক্ষণ অর্থাৎ অনূকুল সময়। কার্যের সফলতাপ্রসঙ্গে মা একদিন একটি বচন বলেন, ‘যা না করে ধনে জনে, তা করে করে গুণে।’

আমি—কাজের ঝঞ্জাট বা অসুখ প্রভৃতি আছে। সেজন্য সকল সময় নিয়ম রাখা সম্ভব হয় না। 
মা—অসুখ হলে তাে আর আয়ত্ত নেই। আর নেহাত যদি কাজের ঝঞ্জাট থাকে, তবে স্মরণ প্রণাম করলেও হয়।
আমি—কখন সময় করা কর্তব্য ?
মা—সন্ধিক্ষণেই তাঁকে ডাকা প্রশস্ত। রাত যাচ্ছে, দিন আসছে, দিন যাচ্ছে, রাত আসছে—এই হ’ল সন্ধি। এই সময় মন পবিত্র থাকে।
মনের দুর্বলতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় মা বলিয়াছিলেন, “বাবা, ওটা প্রকৃতির নিয়ম; যেমন অমাবস্যা, পুণিমা আছে না? তেমনি মনও কখন ভাল কখনও মন্দ হয়।”
মা যখন জয়রামবাটী হইতে বাগবাজার যাইতেন তখন আমাকে মাঝে মাঝে জয়রামবাটী যাইয়া সংবাদাদি রাখিতে বলিয়া যাইতেন। আমি তাঁহার এই আদেশ যথাসাধ্য পালন করিতে চেষ্টা করিতাম। কিন্তু তিনি জয়রামবাটী না থাকায় যাইতে তেমন আনন্দ হইত না। ইহা পত্রে মাকে জানাইয়াছিলাম। তিনি জয়রামবাটী প্রত্যাবর্তন করিয়া কথাচ্ছলে আমাকে বলিলেন, “ও ন-, রান্নী (রাঁধুনী) কি বলে শােন।” মা এবারে কলিকাতা যাইবার সময় রাঁধুনীকে বিদায় না দিয়া বড় মামীর সাহায্যার্থ রাখিয়া আসেন। গ্রীষ্মকাল; রাঁধুনী মায়ের ঘরের ( পুরাতন বাটীতে) দরজার সামনে বারান্দায় মশারি খাটাইয়া শুইয়াছিল। স্বপ্নে দেখে, মা এক হাতে ফুলের সাজি ও অন্য হাতে জলের ঘটি লইয়া যেন স্নান করিয়া আসিতেছেন। আসিয়া বলিতেছেন, “ওঠ, ওঠ এখান থেকে।” এই বলিয়া দয়ার জুড়িয়া শােওয়ার জন্য তাহাকে তিরস্কার করিতেছেন। রাঁধুনীর এই বর্ণনা শেষ হইলে মা হাসিয়া বলিলেন, “শােন, কে জানে বাবা, কি বলে।”
একদিন কথাপ্রসঙ্গে আমি বলিয়াছিলাম, “মা, সংসারে থেকে কোন কাজ হয় না।” তদুত্তরে তিনি বলেন, “বাবা, সংসার মহা দঁক (পাক), দঁকে পড়লে ওঠা মুস্কিল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু খাবি খান, মানুষ কোন ছার! তাঁর নাম করবে। নাম করতে করতে তিনিই একদিন কাটিয়ে দিবেন। তিনি না কাটালে কি উদ্ধার হওয়া যায়, বাবা? তাঁতে খুব বিশ্বাস রাখবে। সংসারে যেমন মা-বাপ ছেলেদের আশ্রয়স্থল, তেমনি ঠাকুরকে জ্ঞান করবে।”
একদিন ভগবানে বিশ্বাস সম্বদ্ধে কথা উঠিলে মা বলেন, “বাবা, শুধু পড়লে কি আর বিশ্বাস হয় ? বেশী পড়লে গুলিয়ে যায়। ঠাকুর বলতেন, ‘জগৎ মিথ্যা, তিনি সত্য—এইটি শাস্ত্র পড়ে জেনে নিতে হয়। এই যেমন তােমাকে চিঠি লিখলাম, এই এই জিনিসগুলি নিয়ে তুমি আসবে। তা চিঠির দরকার কতক্ষণ? যতক্ষণ তাতে কি আছে না জান। যাই জানা হয়ে গেল, আর চিঠির দরকার কি? সেই সব জিনিস নিয়ে তাে আমার সঙ্গে দেখা করবে। না হলে, দিনরত চিঠি পড়ে লাভ কি ?”
একদিন আবেগভরে বলিলাম, “মা, এত যে আসা-যাওয়া করছি, আপনার কৃপালাভও করলাম, তবু কেন কিছুই হচ্ছে না? আমার তাে মনে হয়, আমি যেমন ছিলাম তেমনি আছি।”
তদুত্তরে মা বলিলেন, “বাবা, তুমি যদি একটা খাটে ঘুমিয়ে থাক, আর কেউ সেই খাটখানাসমেত তােমাকে অন্যত্র নিয়ে যায়, তাহলে তুমি ঘুম ভাঙতেই কি বুঝতে পারবে যে স্থানান্তর হয়েছ ? না, যখন বেশ পরিষ্কারভাবে ঘুমের ঘাের কেটে যাবে, তখন দেখবে যে অন্যত্র এসেছ।”২
একবার বেলুড় মঠের উৎসবদর্শনার্থ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া রাস্তায় মেদিনীপুরে একটু প্রয়ােজনবশতঃ নামিয়াছিলাম। তাহাতে সেইদিন রাত্রের গাড়ি ধরিতে না পারায় পরদিন যাইতে হয়। সন্ধ্যার সময় কলিকাতা পৌঁছিয়া মায়ের সহিত সাক্ষাৎ করি। মা দেখিয়াই বলিলেন, “উৎসব দেখনি তাে?” “না, মা, উৎসব, দেখা হয় নাই” বলিয়া রাস্তার ঘটনা বলিলাম। তাহা শুনিয়া মা বললেন, “যাে সাে করে আগে উদ্দেশ্যসাধন করে নিতে হয়। এইতাে, বাবা, এত সব দেখতে পেলে না। আগের কাজ আগে করতে হয়। পরে বলিলেন, কালকে এখানে এসে ঠাকুরের প্রসাদ পেও।”
আহারসম্বন্ধে মা বলিতেন, ‘যখনই যা-কিছু আহার করবে, তা ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদস্বরূপ গ্রহণ করবে। তা হলে রক্ত শুদ্ধ হবে, রক্ত শুদ্ধ হলে মনও শুদ্ধ হবে।”
একদিন কোন কারণে মা তাঁহার ভাইদের উপর বিরক্ত হইয়াছিলেন। আমি ঐ সময়ে গিয়া উপস্থিত হইলে আমাদের ঐ সম্পর্কে দু-একটি কাহিনী বলিয়া বলিলেন, “বাবা, ওরা কেবল টাকা টাকা করেই গেল! কেবল ধন দাও, ধন দাও'—ভুলেও কখন জ্ঞান ভক্তি চাইলে না। যা চাচ্ছিস, তাই নে।”
জয়রামবাটীতে শেষ অসুখের পূর্ববার মা যখন কঠিন জ্বরে কষ্ট পাইতেছিলেন, তখন একদিন আমি তাঁহার পদসেবা করিতেছিলাম, এমন সময়ে বলিলেন, “দেখ, বাবা, কদিন ধরে ডাকছি কেউ শুনতে পায়নি; কত কেঁদেছি, তবুও কেউ আসেনি। আজ অবশেষে মা এসেছিলেন—জগদ্ধাত্রী, কিন্তু মুখটি ঠিক মায়ের মুখের মতো। এবার আমার অসুখ সেরে যাবে। আর একবার ছােটবেলায় দক্ষিণেশ্বরে যেতে আমার খুব জ্বর। কোন জ্ঞান নেই। এমন অবস্থায় দেখি যে একটি কাল কুচকুচে মেয়ে এক-পা ধুলাে নিয়ে আমার বিছানার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। এক-পা ধুলাে দেখে বললাম, মা, কেউ কি পা ধুতে জল দেয়নি ? সে বললে, “না, মা, আমি এক্ষনি চলে যাব। তােমাকে দেখতে এসেছি। ভয় কি ? ভাল হয়ে যাবে।' তা পরদিন থেকে আমি ক্রমে সেরে উঠি। এবার বাবা, বড় কষ্ট দিয়েছে ; কত ডাকবার পর তবে আজ দেখা পেয়েছি। এবারও আমি সেরে গেলাম। ভয় কি, বাবা, তাঁকে খুব ডাকলেই সব বিষয়ে তিনি এসে রক্ষা করবেন।”

২.মা বলিতেন, “আমার যা করে দেবার, আমি সেই এক সময়ে (দীক্ষাকালে) করে দিয়েছি। তবে যদি সদ্য শান্তি চাও, সাধনভজন কর, নতুবা দেহান্তে হবে।”

ডাঃ উমেশচন্দ্র দত্ত, ময়মনসিংহ

জয়রামবাটীতে মা একদিন বলিলেন, “দেখ, বাবা, ছেলেবেলা দেখতুম, আমারই মতাে একটি মেয়ে সর্বদা আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমার সকল কাজের সহায়তা করত, আমার সঙ্গে আমােদআহ্লাদ করত। দশ-এগার বছর বয়স পর্যন্ত এ রকম হত।”
একদিন মা বলিলেন, “ঠাকুর চলে যাবার কিছুকাল পর থেকে প্রায়ই দেখতুম দাড়িটাড়িওয়ালা এক সন্ন্যাসী আমাকে পঞ্চতপা করবার কথা বলতেন। প্রথম প্রথম আমি তেমন খেয়াল করিনি। পঞ্চতপা কি, তাও তত জানতুম না। তিনি ক্রমেই পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। তারপর যােগেনকে (যােগেন-মা) পঞ্চতপার কথা জিজ্ঞাসা করায় যােগেন বললে, “বেশ তাে, মা, আমিও করব। পরে পঞ্চতপার যােগাড় করা হ’ল। তখন বেলড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে। চারিদিকে ঘুঁটের আগুন, উপরে সূর্যের প্রখর তেজ। প্রাতে স্নান করে কাছে গিয়ে দেখি আগুন গমগম করে জ্বলছে। প্রাণে বড়ই ভয় হ'ল, কি করে ওর ভিত যাব, আর সূর্যাস্থ পর্যন্ত সেখানে বসে থাকব। পরে ঠাকুরের নাম করে ঢুকে দেখি, আগুনের কোন তেজ নেই। এভাবে সাতদিন কাজ করি। কিন্তু বাবা, শরীরের বর্ণ যেন কাল ছাই হয়ে গিছল। এর পর আর সে সন্ন্যাসীকে দেখি নাই।”
আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, ঠাকুর বলেছেন, যারা তার কাছে যাবে তাদের শেষ জন্ম। আপনার কাছে যারা আসবে তাদের কি হবে?” 
মা—কি আর হবে, বাবা? এখানেও তাই হবে?
আমি—মা, আপনার কাছ থেকে যারা মন্ত্র নিয়েছে, তারা যদি কোনরকম জপতপ না করে, তবে তাদের পরিণাম কি হবে? 
মা—কি আর হবে? তােমরা অত ভাবনা কর কেন? মনের বাসনা-কামনা যা আছে পুরণ করে নাও, পরে রামকৃষ্ণলোকে গিয়ে চির-শান্তিভােগ করবে। ঠাকুর তােমাদের জন্য নূতন রাজ্য তৈরী করেছেন।
কোন ভক্ত মন্ত্র কিভাবে অঙ্গুলিতে জপ করিতে হইবে ভুলিয়া যাওয়ায় উহা মার কাছে জানিয়া লইবার জন্য আমাকে অনুরােধ করিয়া পত্র দেন। মা উহা শুনিয়া বলিলেন, “ওতে আর কি আসে যায়? এক রকমে করলেই হয়। এ সকল তাে মন আনবার জন্য।”১
মুক্তি ও ভক্তি সম্বন্ধে একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। মা বলিলেন, “মুক্তি তো প্রতিক্ষণে দেওয়া যায়। কিন্তু ভক্তি ভগবান সহজে দিতে চান না।” কথাগুলি এমনভাবে বলিলেন যেন মুক্তি তাঁহার হাতের মুঠোর ভিতর। কথাটা বলিয়াই চলিয়া গেলেন।
শুচি-অশুচি-বিষয়ে মা একদিন বলিলেন, “দেখ, বাবা, ঠাকুর বড়ই পেটরােগা। ছিলেন। আমি নবতে থেকে ঠাকুরের ইচ্ছামত সুক্ত, ঝােল, এসব রেঁধে দিতুম। মাসের মধ্যে তিন দিন মেয়েরা ওসব করতে পারে না, সে কয়দিন মায়ের (মা কালীর।) ওধান হতে প্ৰসাদ আসত। তা খেলেই ঠাকুরের অসুখ বাড়ত। একদিন ঠাকুর আমাকে বললেন, “দেখ, তুমি এই তিন দিন রান্না না করাতে আমার অসুখটা বেড়েছে। তুমি ও কদিন কেন রাঁধলে না?” আমি বললুম, “মেয়েদের অশুচির তিনদিন কাউকে রেখে দিতে পারে না।' ঠাকুর বললেন, “কে বললে পারে না ? তুমি আমাকে দেবে, তাতে দোষ হবে না। বল তাে, অশুচি তােমার শরীরের কোন জিনিসটা ? চামড়া না মাংস, না হাড়, না মজ্জা? দেখ মনই শুচি-অশুচি। বাইরে অশুচি বলে কিছু নেই। এর পর হতে আমি সর্বদা রান্না করে দিতুম।” ২
 কোয়ালপাড়ায় মায়ের অসুখের সময় তাহার জন্য শরবত প্রস্তুত করিয়া ঠিক হইয়াছে কিনা দেখিবার জন্য আমি উহা চাখিয়া তাঁহাকে দিয়াছিলাম। মা কিন্তু তাহা জানিতেন না। উহার দুই-তিন দিন পরে মা নিজেই বলিলেন, “দেখ, বাবা, ভালবাসার জনকে কোন কিছু খেতে দিতে হলে আগে নিজে চেখে দেওয়া খুব ভাল।” তখন আমি বলিলাম, “মা, আমি তাে আপনার শরবত চেখে দেখেছিলাম।” তিনি বলিলেন, “বেশ করেছিলে, বাবা, ভালবাসার পাত্রকে ঐ ভাবেই দিতে হয়। শােননি, রাখালরা শ্রীকৃষ্ণকে ফল খেতে দেবার আগে নিজেরা চেখে দিত?”
একদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, রাস্তাঘাটে কোন কোন লােককে দেখামাত্র মনে হয় যেন তারা বিশেষ পরিচিত। পরে পরিচয়ে জানতে পারি তাঁর ঠাকুরের বা আপনার ভক্ত। হঠাৎ দেখলে অত পরিচিত বলে বােধ হয় কেন?” মা বলিলেন, “ঠাকুর বলতেন, ‘কলমীর দল, একটি ধরে টানলেই সবগুলি নাড়াচাড়া পড়ে।’ সব যে একগাছের শাখা-প্রশাখা।” 
আর একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, অন্যান্য অবতারগণ নিজ নিজ শক্তির পরে দেহরক্ষা করিয়াছেন। কিন্তু এবার আপনাকে রাখিয়া ঠাকুর পূর্বে চলিয়া গেলেন কেন?” মা বলিলেন, “বাবা, জান তাে ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল? সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন।”

১. একটি জন্তু একদিন ‘উদ্বোধনে’ মাকে প্রণাম করিবার সময় বলিলেন যে, তাঁর স্ত্রী মন্ত্র ভুলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাকে পুনরায় কলিকাতা আনাও তাঁহার পক্ষে কষ্টসাধ্য। মা শুনিয়া বলিলেন, “তা ভুলে গেছে, তাতে আর কি হয়েছে? ঠাকুরকে স্মরণমনন করলেই হবে।”
২. একবার ঐসময়ে পূজাদি না করায় মায়ের মন কেমন করে। তিনি ঠাকুরকে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। ঠাকুর বলেন, “যদি পূজা না করলে মনে কষ্ট হয় তবে করবে নতুবা নয়।” 

স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ

উদ্বোধন, ঠাকুরঘর সকালবেলা মা পূজার যােগাড় করিতেছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে আমি বলিলাম, “মা, আপনার কেন এত আসক্তি? রাতদিন ‘রাধু, রাধু' করছেন, ঘাের সংসারীর মতাে। অথচ এত ভক্ত আসছে, তাদের দিকে একটুও মন নেই। এত আসক্তি ! এগুলাে কি ভাল?" পূর্বে কখনও কখনও এরূপ বলিয়াছি। তাহাতে মা কখনও দীনতা করিয়া বলিতেন, “আমরা মেয়েমানুষ, আমরা এই রকমই।” আজ কিন্তু মা বেশ একটু উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “তুমি এরকম কোথায় পাবে? আমার মতো একটি বের কর দেখি ? কি জান, যারা পরমার্থ খুব চিন্তা করে, তাদের মন খুব সুক্ষ্ম, শুদ্ধ হয়ে যায়। সেই মন যা ধরে, সেটাকে খুব আঁকড়ে ধরে। তাই আসক্তির মতো মনে হয়। বিদ্যুৎ যখন চমকায় তখন শার্সিতেই লাগে, খড়খড়িতে লাগে না।”
একদিন বলিল,ম, “মা, আমার মনে খারাপ ভাব আসে না।” মা অমনি চমকিয়া উঠিয়া আমাকে বাধা দিয়া বলিতেছেন, “বলাে না, বলাে না, ওকথা বলতে নেই।” 
 আর একদিন তাঁহাকে বলিলাম, “আপনি যে এত লোককে মন্ত্র দিচ্ছেন, তাদের তো কখনও কোন খোঁজখবর রাখেন না। এদের কি হচ্ছে না হচ্ছে, কোন খেয়াল নেই। গুরু শিষ্যের কত খোঁজ রাখেন, উন্নতি হচ্ছে কিনা দেখেন। আপনার এত লােককে মন্ত্র না দিলেই হয়। যে কয়টির খবর রাখতে পারবেন, সে কয়টিকে দেওয়াই ভাল।” মা বলিলেন, “তা ঠাকুর আমাকে তো নিষেধ করেননি। তিনি আমাকে এত সব বুঝিয়েছেন, আর এটা তাহলে কি কিছু, বলতেন না? আমি ঠাকুরের উপর ভার দিই। তার কাছে রােজ বলি, যে যেখানে আছে, দেখাে। আর জান, এসব ঠাকুরের দেওয়া মন্ত্র, তিনি আমাকে দিয়েছিলেন-সিদ্ধমন্ত্র।”
একদিন বীজমন্ত্রের প্রসঙ্গে সব মন্ত্র আমাকে বলিয়া বলিলেন, “আমার সব থলে ঝেড়ে দিলুম। তুমি মন্ত্র দেবে নাকি?” . 
আমি—না মা, নিজেরই হল না। 
মা—দিলেই বা। দোষ কি? তােমরা দিতে পার।
আমি—মা, আমাকে সর্বত্যাগী করে দিন, যেন কিছুতেই টান না থাকে। মা—সর্বত্যাগী তাে আছই, আবার কি দুটো শিং বেরবে?
আর একদিন জয়রামবাটীতে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “কি করে ভগবান লাভ হয় ? পূজা, জপ, ধ্যান-এসবে হয়?”
মা—কিছুতেই না। 
আমি—কিছুতেই না? 
মা—কিছুতেই না।
আমি—কিছুতেই না? 
মা—কিছুতেই না।
আমি—তবে কিসে হয় ?
মা—শুধু তার কৃপাতে হয়। তবে ধ্যানজপ করতে হয়। তাতে মনের ময়লা কাটে। পুজা, জপ, ধ্যান-এসব করতে হয়। যেমন ফুল নাড়তে চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবৎতত্ব আলােচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। নির্বাসনা যদি হতে পার, এক্ষুণি হয়।
একদিন জয়রামবাটীতে খাইবার পর উচ্ছিষ্ট লইতে যাইতেছি, মা আমার হাত ধরিয়া বাধা দিয়া উচ্ছিষ্ট-থালা নিজেই লইলেন। আমি বলিলাম, “আপনি কেন? আমিই নিচ্ছি।” মা তাহাতে বলিলেন, “আমি তােমার আর কি করেছি ? মার কোলে ছেলে বাহ্যে করে, কত কি করে ! তােমরা দেবের দুর্লভ ধন।”

শ্রীমতী শৈলবালা চৌধুরী, বসিরহাট

কলিকাতা 

১৩১১ সালের ২রা শ্রাবণ, রবিবার, সকালে ঘোড়ার গাড়ি করিয়া পুজনীয়া গৌরী-মা, তাঁহার দূর্গা ও আমি বাগবাজারে পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমার (ভাড়াটিয়া) বাড়িতে যাই। মায়ের শ্রীচরণ দর্শন করিবার আমার এই প্রথম সুযােগ ঘটিল। গাড়িতে আসিবার সময়, যাহাতে আমার ভাল হয় তাহা করিবার জন্য গৌরীমার নিকট কাতরভাবে কাঁদিয়া জানাইয়াছিলাম। শ্রীশ্রীমার বাটীতে পেীঁছিয়া-সর্ব প্রথমে গৌরী-মা দোতলায় যান ; আমরা তাহার পরে যাই। উপরে গিয়া দেখিলাম, গৌরীমা আস্তে আস্তে মার সহিত কি বলিতেছেন। তাহাদের মধ্যে কখন কথা হইল জানি না, শ্রীশ্রীমা গৌরী-মাকে বলিলেন, “তুমি সেদিন সুরেনের বউকে নিয়ে এসেছিলে, আজ এই বৌমাকে এনেছ, তােমার এই কাজ।” এই কথা শুনিয়া গৌরী-মা জোরে বলিলেন, “দেবে না তাে কি? এসেছ কিসের জন্য?” তাহা শুনিয়া মা আস্তে আস্তে বলিলেন, “তবে এস, মা, এখন সময় ভাল আছে।” পরে দুর্গাকে লইয়া ঠাকুরঘরে গিয়া মা দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। গৌরী-মা ও আমি বারান্দায় দাঁড়াইয়া রহিলাম।
দুর্গার দীক্ষা হইয়া গেল। অল্পক্ষণ পরে সে বাহিরে আসিল। এইবার আমি ঠাকুরঘরের ভিতরে গেলাম। মা ভিতরেই ছিলেন। আমি ভিতরে গেলে দরজা বন্ধ করা হইল। গৌরী-মা ও দুর্গা বাহিরে বারান্দায় রহিলেন। মা আমাকে পুজার আসনে বসাইলেন এবং আমাকে দিয়া ঠাকুরের পূজা করাইলেন। দীক্ষা দিবার পূর্বে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমাদের কুলগুর, আছে ?” আমি বলিলাম, “আছে।” মা বলিলেন, “আবার দীক্ষা নেবে না তাে?” আমি বললাম, “না।” পরে ঘরের ভিতর হইতে গৌরী-মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গৌরদাসি, কোন ঠাকুর দেব ?” গৌরী-মার কথামত আমার দীক্ষা হইল। আমি পূর্ব হইতেই জপ করিতাম। মা আমাকে জপ করিতে বলিলেন; কিন্তু তখন আমার শরীর ও মনের অবস্থা এমন হইল যে, আমি জপ করিতে পারিলাম না। মা নিজে আমার কর ধরিয়া জপ করাইলেন। তারপর ঠাকুরঘরের দরজা খােলা হইল। গৌরীমা ভিতরে আসিলেন ও আমাকে মার পায়ে ফুল দিতে বলিলেন। আমিও তাহাই করিলাম।
আমরা যখন মার বাড়িতে পৌঁছাই, তখন মা গঙ্গাস্নানে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। আমরা যাওয়ায় তাঁহার আর গঙ্গাস্নানে যাওয়া হইল না। আমরা তথায় প্রসাদ পাইলাম ও সমস্ত দিন থাকিলাম। 
মা ঐদিন একটি চাবি খুঁজিতেছিলেন। চৌকির নিকট একটি চাবি দেখিতে পাইয়া মাকে বলিলাম, “এখানে একটি চাবি রয়েছে।” মা যে সেই চাবিটিই খুঁজিতেছিলেন, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই। চাবিটিতে হাত দিতেও আমার সাহস হইল না। মা চাবিটি হাতে করিয়া তুলিয়া লইয়া আমায় বলিলেন, “জন্মএয়োস্ত্রী হও, মা।”
 মাকে ছাড়িয়া আসিতে আমার যেন ইচ্ছা হইতেছিল না। আসিবার সময় মাকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম। মা বলিলেন, “আবার এসাে মা, চিঠি দিও।”
ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমীর দিন সেজদিদি ও আমি কাঁকুড়গাছির যোগােদ্যানে উৎসব দেখিতে গিয়াছি। তথায় গিয়া দেখিলাম শ্রীশ্রীমা আসিবেন বলিয়া তাহার অভ্যর্থনার বিশেষ আয়ােজন হইতেছে। ঠাকুরঘরের নিকট তাহার বসিবার জন্য একটি স্থান ভাল করিয়া ঘেরা হইয়াছে। মা আসিবেন, তাহার দর্শন পাইব, ভাবিয়া আমার মনে খুব আনন্দ হইতেছে। মা আসিলে একটা সাড়া পড়িয়া গেল। রাস্তায় নূতন কাপড় পাতা হইল, শাঁখ বাজিতে লাগিল। সেই কাপড়ের উপর দিয়া মা আসিলেন, সঙ্গে লক্ষীদিদি। মাকে দেখিবার জন্য অনেকে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। আমরাও তাঁহাকে দর্শন করিতে সেইদিকে গেলাম। দেখিলাম, মা ধীরভাবে আসিতেছেন, তাঁহার ঘােমটা দেওয়া রহিয়াছে। ঘােমটার মধ্য হইতে আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, “এসেছ, মা ?” অনেক লােকের ভিড় হইল; আমি কিছু বলিতে পারিলাম না, ঘাড় নাড়িলাম মাত্র। সেজদিদি পুত্রশােকে বড় কাতর ছিলেন। তিনি আমাকে বলিলেন, “আমি মাকে কখনও দেখিনি, তুমি মাকে বলাে যেন আমায় কৃপা করেন। বহুলােকের ভিড়ের ভেতর আমি মাকে বলিবার সুযােগ পাইতেছিলাম না। একটু ফাঁকা হইলেই মাকে বলিলাম, “মা, এই আমার জা।” এই কথা বলিতেই মা সস্নেহে বলিলেন, “সব জানি, মা।” আমার আর কোন কথা মাকে বলা হইল না।
একদিন সেজদিদি ও আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। মাকে প্রণাম করিয়া ঠাকুরঘরে ঠাকুরদর্শন করিয়া আসিলাম। মা বলিলেন, “বস।” আমরা বসিলাম। নানা কথাবার্তার পর আমি কথায় কথায় মাকে বলিলাম, “মা মহামায়া, বাপ-মা স্বামী-পুত্র দিয়ে বেশ ভুলিয়ে রেখেছেন!” তাহা শুনিয়াই মা বলিলেন, “ও কথা বলাে না। আমি ভুলিয়ে রেখেছি। সংসারীদের দুঃখকষ্ট দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। কি করব, মা, তারা চায় না।”
আর একদিন সেজদিদির সহিত মাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। নানা কথার পর সেজদিদি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, ঠাকুর কোথায় ?” মা বলিলেন, “মা, ঠাকুর আর কোথায় ? তিনি ভক্তের নিকটে। যেখানে সাধুরা শৌচাদি করে সেখানেও যদি সংসারীরা যায়, সেই বাতাসে তাদের মনের মলিনতা কেটে যায়।”
একদিন সেজদিদি, নদিদি, মানি ও আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। সেজদিদি মার নিকট মানি ও নদিদির দীক্ষার কথা বলিলেন। তাহাতে মা কোন কথা বলিলেন না। পরে সেজদিদি আবার দীক্ষার কথা তুলিলেন। মা বলিলেন, “কুলগুরু তাে আছে, সেখানে নিলেই হয়।” কথাগুলি মা যেন একটু গভীরভাবে বলিলেন। একটু পরেই সেজদিদি সে ঘর হইতে উঠিয়া গেলেন। আমি বসিয়া ছিলাম। তখন মা বলিলেন, “দীক্ষা দেওয়া কি অমনি কথা, তার পাপের ভার সব নিতে হয়।” 
একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, ঠাকুরের জপ তাে আমাকে বলে দিয়েছেন, আপনার জপ কি করে করব?” তাহা শুনিয়া মা বলিলেন, “রাধা ব’লে পার, কি অন্য কিছু বলে পার, যা তােমার সুবিধা হয় তাই করবে। কিছু না পার, শুধু মা বলে করলেই হবে।” 
একদিন আহারাদির পর সেজদিদি ও আমি মাকে দর্শন করিবার জন্য আসিয়া দেখিলাম সকল ঘরের দরজা বন্ধ। শুনিলাম মা বিশ্রাম করিতেছেন। কিছুক্ষণ পরে ঘরের দরজা খােলা হইল। আমরা ঘরে গিয়া মাকে প্রণাম করিয়া বসিলাম। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখন এলে, মা?” আমরা বলিলাম, “এই খানিকক্ষণ হ’ল এসেছি। আপনি ঘুমচ্ছেন, সেজন্য বাইরে ছিলাম।” অন্যান্য কথাবার্তার পর আমি মাকে বলিলাম, “মা, লােকে কত দর্শন পায়, আমার তাে কিছু হল না।” তাহাতে মা বলিলেন, “ওসব নীচের কথা।” ইহা শুনিয়া আমার মনে খুব আশা হইল। মনে হইল, ঐ সকল দর্শন অপেক্ষা আমার আরও ভাল হইবে। আমি মাকে বলিলাম, “মা, আমার কিছু হবে না।” মা বলিলেন, “হবে বইকি, মা, হবে।” 
একদিন মাকে ঠাকুরের পূজা করিবার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহাতে মা বলিলেন, “তােমরা সংসারী, ঠাকুরের পূজা পেরে উঠবে না।”
শ্রীশ্রীমাকে কোনও কথা বললে তিনি বলিতেন, “তােমরা ঠাকুরকে ডাক, তিনি সব করবেন। চাঁদামামা সকলের মামা।”
একদিন আমার মা ও আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাইতেছি। সুধীরা দিদি মাকে দর্শন করিয়া ফিরিতেছিলেন। পথে তাঁহার সহিত আমাদের দেখা হইল। মায়ের নিকট সুধীরা দিদির প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলে মা বলিলেন, “ঐ এক মেয়ে। বে করলে না। কেমন নিজের জোরের উপর রয়েছে, গাড়ি চড়ে বেড়াচ্ছে।’
আর একদিন মা ও আমি শ্ৰীশ্ৰীমার বাটীতে গিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিলাম, “মা, অনেকক্ষণ আসবার জন্য চেষ্টা করছি, কিন্তু গাড়ির জন্য আসতে দেরি হ’ল।” মা বলিলেন, “ঠাকুরদর্শন করবে, কেন গাড়ােয়ানকে পয়সা খাওয়াবে ? পায়ে হেঁটে আসবে।”
আমার মা ও আমি একদিন দুপুরবেলা শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। গােলাপ-মা আমাগিকে অসময়ে যাইতে দেখিয়া অসন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, ‘মাকে দর্শন করা তাে নয়, মাকে বিরক্ত করা। এখন সকলের রান্না হয়ে গেছে। যদি আসবে, সকালে খবর দিতে হয়। এখন তােমাদের না দিয়ে ওরা খায় কি করে ?” গােলাপ-মা শ্রীশ্রীমাকেও বলিলেন, “তােমার যেমন হয়েছে যে আসবে মা ব’লে, অমনি পা বাড়িয়ে দেবে।” মা বলিলেন, “কি করব, গােলাপ ? মা বলে এলে আমি যে থাকতে পারি নে।”
আমার মার সঙ্গে আমি যখনই শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাইতাম, মার ঘরকন্নার কাজ সারিয়া যাইতে রােজই বেলা হইয়া পড়িত। শ্রীশ্রীমার বাড়ি যাইবার আগেই ভয় হইত, পাছে গােলাপ-মার সামনে পড়ি। বেলায় যাইতাম বলিয়া তিনি বকিতেন। একদিন শ্রীশ্রীমা তাঁহাকে বলিলেন, “কি করবে গা ? ওরা সকল দিক সেরে তাে আসবে।” মাকে প্রণাম করিয়া আমরা বিদায় লইতেছি ; মা বলিলেন, “অমনি যাবে।” আমরা বলিলাম, “বাড়িতে ভাত রান্না আছে, আপনাকে দর্শন করে চলে যাব।” মার ইচ্ছা আমাদের প্রসাদ খাওয়ান। শেষে বলিলেন, “আচ্ছা, মা, এস ; গােলাপ আবার রাগ করে।” নারিকেলের মালায় করিয়া আমাদের একটু অন্ন প্রসাদ দিলেন। তাহা লইয়া আমরা বাটী ফিরিলাম। 
শ্রীশ্রীমার পাদপদ্মের দিবার মানসে আমার মা ও আমি একদিন ফুল বিল্বপত্র ও তুলসী লইয়া মায়ের বাটীতে যাই। গােলাপ-মা তাে আমাদের দেখিয়াই রাগিয়া উঠিলেন। আমরা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। পরে মাকে বলিলাম, “মা, এই ফুল এনেছি আপনার পায়ে দেব বলে।” মা বলিলেন, “দাও।” আমি বললাম, “মা, জল কোথা পাব?” মা বলিলেন, “ঐ যে, নাও না।” জল লইয়া সামান্যভাবে শ্রীশ্রীমার পায়ে একটু দিয়া ফুল বিল্বপত্র ইত্যাদি দিতে যাইতেছি, এমন সময়ে মা বলিলেন, “তুলসী-বিল্বপত্র দিও না, শুধ, ফুল দাও।” শুধ, ফুল মার পায়ে দেওয়া হইয়া গেলে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, এ ফুল কি করব?” মা বলিলেন, “নিয়ে যাও।”
কোনও ভক্তদ্বারা আমার পূর্বেকার জপকরা হরিনামের একছড়া মালা ও একছড়া নূতন রুদ্রাক্ষের মালা শ্রীশ্রীমার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। মা নুতন মালাটি নিজ হাতে জপ করিয়া দিয়াছিলেন। পুরাতন মালাটি সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন, “ও পুরান মালা।” কিন্তু ভক্তটি বলাতে উহাও জপ করিয়া দিয়াছিলেন। তারপর যখন মার নিকট যাই তখন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “রুদ্রাক্ষের মালা কি বলে জপ করব ?” মা বলিয়া দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হরিনামের মালাটিও কি ঐ বলে জপ করব ?” মা বলিলেন, “ও তাে হরিনামের মালা।” হরিনামের মালা জপ করিতে দেরি হয়। মা রুদ্রাক্ষের মালায় যে মন্ত্র জপ করিতে বলিলেন, সেই মন্ত্র জপ করিলে জপ তাড়াতাড়ি হইবে, ইহা মনে করিয়া আমি মাকে আবার হরিনামের মালাজপের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। মা তাহা অন্তরে জানিতে পারিয়া বলিলেন, “তাই করো, শীগগির হবে।” 
শ্রীশ্রীমাকে লালপেড়ে শাড়িকাপড় দিবার জন্য সেজদিদি এক রাত্রে স্বপ্ন পান। সে জন্য তিনি একখানি লালপেড়ে শাড়িকাপড় কিনিয়া শ্রীশ্রীমার বাটীতে যান। আমিও তাহার সহিত গিয়াছিলাম। সেজদিদি মাকে প্রণাম করিয়া স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিলেন ও কাপড়খানি মার পদতলে রাখিলেন। মা একটু হাসিয়া কাপড়খানি হাতে করিয়া লইলেন এবং পরিলেন। অল্পক্ষণ পরে কাপড়খানি ছাড়িয়া বলিলেন, “কি করে পরব, মা ? লােকে বলবে, “পরমহংসের স্ত্রী লালপেড়ে কাপড় পরেছে। থাক, এনেছ, ঐ কাপড় পরে নাইতে যাব।" মা শীঘ্রই উড়িষ্যা যাইবেন শুনিয়া অমিরা সেদিন চলিয়া আসিলাম।
তারপর তিনি যখন ফিরিয়া আসিলেন, আমি ও সেজদিদি তাহার শ্রীচরণদর্শন করিতে বাগবাজারে গেলাম। পুরীর কথা অনেক হইল। তারপর মা সেই কাপড় পরিয়াছিলেন কিনা, সেজদিদি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। মা বলিলেন, “হাঁ মা, পরেছিলাম, দিনকতক পরার পর একজনকে দিয়ে দিয়েছি।”
আর একবার সেজদিদি ও আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। মার সহিত অনেক প্রকার কথা হইতেছে। আমরা মাকে বলিলাম, “মা, আমাদের কি হবে?" মা বলিলেন, “ঠাকুরকে ডাক।” সেজদিদি বলিলেন, “আমরা তাে ঠাকুরকে দেখিনি, আমরা আপনাকে জানি।” মা বলিলেন, “তােমরা কি আমায় ডুবে মরতে বল? যেমন, একজন ‘জয় গুরু’ বলে গুরুনামে বিশ্বাস করে নদী পার হয়ে গেল। গুরু তা দেখলেন। দেখে ভাবলেন, আমার নামের এত জোর! তিনি ‘আমি, আমি ক'রে জলে নামলেন, পরে ডুবে মরলেন।”

অজ্ঞাত মহিলা

একদিন আমার পুত্র হরিচরণকে লইয়া শ্ৰীশ্ৰীমার বাটীতে যাই। তখন হরিচরণের মাথা খারাপ হইয়াছে। মার কাছে গিয়া সে নানাপ্রকার এলােমেলাে কথা কহিতেছে—যেমন, “ক্ষিদে পেয়েছে, খেতে দে” ইত্যাদি। মা প্রসাদ দিলেন। সে খাইতে খাইতে উচ্ছিষ্ট প্রসাদ এদিক-ওদিক ছড়াইতে লাগিল। আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম, “ঠাকুরবাড়ি, এটো ছড়াচ্ছে।” মা অমনি স্নেহভরে বলিলেন, “থাক, ওর খাওয়া হলে তুমি এটো পেড়ে দিও।”
আমি মাকে বলিলাম, “মা, ওর কি হয়েছে-বামুন দেখলে প্রণাম করে, গুরু, দেখলে প্রণাম করে!” মা বলিলেন, “জীবে দয়া হয়েছে।”
এক কোজাগরী পূর্ণিমার দিন মায়ের পাদপদ্মে ফুল দিবার মানসে উপবাস করিয়া হরিচরণ ও আমি ‘উদ্বোধনে’র বাটীতে যাই। মার পায়ে ফুল দিয়া আমরা প্রণাম করিলাম। মা হরিচরণকে আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “লক্ষীশ্রী হােক, দীর্ঘায়ু হও।”
শ্রীশ্রীমা আমাকে বলিলেন, “সকলকে দেখলে আমি শান্তি পাই; তােমার মুখের গ্রাস উপযুক্ত ছেলে চলে গেছে, তােমাকে দেখলে বড় কষ্ট হয়।”
একদিন মাকে বলিলাম, “মা, ঠাকুরের পাদপদ্মে যেন ভক্তি হয়। মা বলিলেন, “ভক্তি করতে করতে হবে।” যেদিন আমি সকালে মার ওখানে যাইতাম, মা রাধুর খাওয়ার পর ঠাকুরের ভােগের আগেই আমাকে ভাত খাওয়াইতেন। বলিতেন, “পুত্রশােকে তােমার বুক শুকিয়ে গেছে, তুমি আগে খাও।” আমি বলিলাম, “একে অন্নের কষ্ট, আবার ঠাকুরের ভােগের আগেই খাব ?” মা বলিলেন, “তুমি কখনও অন্নের কষ্ট পাবে না।”
একদিন মা বলিলেন, “তােমার ছেলে কিনা দেখবার জন্য আমি অনেক পাগলকে ডেকে দেখেছি। আমি বলছি, তােমার ছেলে বেঁচে আছে। শরৎও (শরৎ মহারাজ) বলেছে, বেঁচে আছে।”
আমার ছেলে ফিরিয়া আসিবে কি-না মাকে জিজ্ঞাসা করায় মা বলিলেন, “আসবে।” তারপর মা ঠাকুরের ছবির সম্মুখে আগ তুলিলেন। কতকগুলি কাঠির উপর অনেকগুলি কাপড়ের ফালি বেশ শক্ত করিয়া জড়াইলেন। সেটি ঠাকুরের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “ওর ছেলে আসবে কিনা যদি সত্যি করে না বল, তােমার ব্রহ্মহত্যা, স্ত্রীহত্যা ও গােহত্যার পাপ লাগবে।” ইতিমধ্যে কাপড়ের ফালির মধ্যস্থিত কাঠিগুলি আলগা হইয়া উপরে উঠিয়াছিল এবং মা উহা ধরিতেই ঝরিয়া পড়িয়া গেল। মা বলিলেন, “এই দেখলে, মা, আগ তােলা হ'ল। তােমার ছেলে আসবে। তুমিও বাড়িতে নিজে করে দেখ।” আমিও মার কথামত বাড়িতে আসিয়া ঐরুপ আগ তুলিলাম। তাহাতেও ঐরূপ ফল হইল। 
আমার মাকে সঙ্গে লইয়া একদিন শ্রীশ্রীমার জন্য একখানি কাপড় লইয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে যাই। একটি লােককে ঐ কাপড় কিনিতে দিয়াছিলাম, কিন্তু সে ভাল কাপড় আনিতে পারে নাই। কাপড়খানি মাকে দিয়া আমি বলিলাম, “মা, এ কাপড়খানি ভাল নয়, আমার পছন্দ হয় নাই।” মা তৎক্ষণাৎ নিজের কাপড় ছাড়িয়া আগ্ৰহ করিয়া ঐ কাপড়খানি পরিলেন ও বলিলেন, “দেখ, আমি তােমার কাপড় পরলাম। দুঃখ করাে না। আমি এই কাপড়খানা পরে গঙ্গাস্নান করব।”
একদিন বলরামবাবুর বাড়িতে আমি তাঁহাকে দর্শন করিতে যাই। সেই সময় একজন লােক মার নিকট টাকা রাখিয়া বলিল, “মা, অমুকের অসুখ, যাতে সে ভাল হয় তাই করবেন।” মা বলিলেন, “টাকা নিয়ে যাও, জন্মালেই মত্যু আছে। আমি কি করব ?” কিছুদিন পরে শুনা গেল ঐ লােকটি মারা গিয়াছে।

 শ্ৰীমতী -

অজ্ঞাত মহিলা

আমি একদিন মাকে বলিয়াছিলাম, “মা, ঠাকুরকে আমি যেদিন প্রথম দর্শন করি, তার দেহ থেকে একটা জ্যোতি বেরুচ্ছিল। কাচের উপর রােদ পড়লে যেমন আভা বেরােয় তেমনি।” ইহা শুনিয়া মা বলিলেন, “মা, তুমি ঠিক দেখেছ। আমি যখন তাঁকে তেল মাখাতুম, মাঝে মাঝে ঐরুপ জ্যোতি দেখতে পেতুম।”..
একদিন তাঁহার ভাইঝি নলিনী রাগ করিয়া সমস্ত দিন উপবাসী ছিল। মার অনেক চেষ্টাতে কোন ফল হয় নাই। শেষে মা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, “আমাকে তােমার পিসীমা মনে করাে না। আমি মনে করলে এক্ষনি এ দেহ ছেড়ে দিতে পারি।”
ঠাকুরের কথাপ্রসঙ্গে মা একদিন নিজের বুকে হাত রাখিয়া ললিতকে ( কমলেশ্বরানন্দকে) বলিয়াছিলেন, “আমি যদি ঠাকুরের কাছে যাই তােমরাও নিশ্চয় যাবে।”
 
শ্রীমতী-

শ্রীমতী সরলাবালা দেবী

উদ্বোধন 

আমি তখন কলিকাতার ১৭নং বােসপাড়া লেনে সিস্টার নিবেদিতার স্কুলে পড়ি। একদিন স্কুলের ছুটির পর সুধীরা দিদি আমাদের চার-পাঁচ জনকে সঙ্গে লইয়া মার বাড়িতে উপস্থিত হইলেন। মা ঠাকুরঘরে আসনে বসিয়া আছেন। কুসুমদিদি একখানি বই পড়িতেছেন। আমরা প্রণাম করিলে মা বলিলেন, “বস মা।” সুধীর দিদিকে বলিলেন, “ভাল আছ, মা? স্কুলের এই ছুটি হ’ল ? এই মেয়েরা তােমার কাছে পড়ে ?” 
সুধীরা দিদি—হাঁ, মা, এরা আমাদের কাছে পড়ে।
মা—মেয়েগুলি বেশ। ( আমাকে লক্ষ্য করিয়া) এটি কাদের মেয়ে ? বেশ মেয়েটি।
সুধীরা—এটি বামুনের মেয়ে, কাছেই বাড়ি।
এই সব কথার পর মা বলিলেন, “কুসুম পড়, এরা শুনবে।” পড়া আরম্ভ হইল। বইখানি বােধ হয় কৃষ্ণচরিত ছিল। কৃষ্ণের দই, দুধ কাড়িয়া খাওয়ার বর্ণনা শুনিয়া মা এবং অপর সকলেই খুব হাসিতে লাগিলেন, আর বলিতে লাগিলেন, “কি দুষ্ট ছেলে!” একটু পরেই আমাদের গাড়ি আসিল। মা বলিলেন, “তােমরা এখনই যাবে? একটু বসলে হত না?” সুধীর দিদির উত্তর শুনিয়া বলিলেন, “তবে সকাল করে এস, মা।” প্রসাদগ্ৰহণান্তে আমরা মাকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম। মা বলিলেন, “এস মা, আবার এস।”
আর একদিন বৈকালে সুধীরা দিদি আমাকে লইয়া মায়ের বাড়ি গেলেন। মা তক্তাপােশের উপর একখানি মাদুর পাতিয়া শুইয়া আছেন। আমাদের দেখিয়া বলিলেন, “বস, মা।” আমরা প্রণাম করিয়া বসিলাম।
মা—তোমাদের স্কুলের ছুটি হ’ল ? ক'টা বেজেছে ?
সুধীরা দিদি—আজ আমাদের সকাল সকাল ছুটি হয়েছে, এখন সাড়ে-তিনটে বেজেছে। তাই এদের নিয়ে এলাম। 
মা—তা বেশ করেছ।
পরে একটি মেয়ের কথা উঠিল। মা বলিলেন, “দেখ না, মা, শ্বশুরঘর করবে না, আমার কাছে এসেছে। জামাই কাল বলে মনে ধরেনি। কাল বলে কি তুই তাকে নিবি নে? সে তোর স্বামী। এ সব কি রকম মেয়ে মা, তা জানি নে। আবার শুনি তার স্বভাব খারাপ; সেই জন্যেও যেতে চায় না। তা হলেই বা, তােকে তাে অযত্ন করেনি। স্বামী তাে বটে। কি জানি মা, এ সব মেয়ে কি রকম ! লােকে শুনলে ভাববে কি ? যা মন চায় করুকগে।” ইহা বলিয়া তিনি কাপড় কাঁচিতে গেলেন। বিদায় লইবার সময় আমরা প্রণাম করিয়া বলিলাম, “যাই, মা।” মা বলিলেন, “যাই’ বলতে নেই, ‘আসি’ বলতে হয়। সময় পেলেই আবার এসো, মা।” 
এক শনিবারে সুধীরা দিদি আমাদের ক’জনকে লইয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে ফিরিবার পথে মার বাড়িতে আসিলেন। মা তক্তাপােশের উপর শুইয়া আছেন। আমাদের দেখিয়া যােগেন-মা বলিলেন, “এত রাতে তােমরা কোথা থেকে ?” মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে এসেছে?” যােগেন-মা বলিলেন, “সুধীরা এসেছে।” মা শুনিয়া উঠিয়া বসিলেন। আমরা সকলে তাহাকে প্রণাম করিয়া বসিলাম। 
মা—এত রাতে কোথা থেকে এলে?
সুধীরা দিদি— আজ এদের নিয়ে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলাম, আরতি দেখে ফিরতে রাত হয়ে গেল। মনে করলাম, এত কাছে এসে চলে যাব? তাই এখানে একবার এলুম।
মা ‘বেশ করেছ’ বলিয়া আবার শুইলেন। সুধীরা দিদি তাহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। আমি কাছে দাঁড়াইয়া বাতাস করিতে লাগিলাম। সুধীরা দিদি মার কাছে দক্ষিণেশ্বরের গল্প করিতে লাগিলেন।
মা—তােমরা নবত দেখেছ তাে? আমি ঐ নবতের নীচের ঘরে থাকতুম। সিঁড়ির নীচে রান্না করতুম। 
সুধীরা দিদি—হাঁ, মা, দেখে এলুম। এখনও সামনের দিকে দরমা দিয়ে ঘেরা সিঁড়ির নীচে একটা উনুন রয়েছে; আর মেছুনীদের ঝুড়িগুলি আপনার সেই বারান্দায় বসান রয়েছে। আমি মেয়েদের আপনার কথা বলছিলাম-আপনি কি ভাবে ঐ ঘরে ছিলেন। আচ্ছা, মা, আপনি কি করে ঐ ঘরে থাকতেন ? কোন কষ্ট হত না? 
মা—শৌচের আর নাওয়ার জন্যই যা কষ্ট হ'ত। বেগধারণ করে করে শেষে পেটের রোগ ধরে গিয়েছিল। আর ঐ মেছুনীরা ছিল আমার সঙ্গী। তারা গঙ্গা নাইতে এসে ঐ বারান্দায় চুবড়ি রেখে সব নাইতে নাবত ; আমার সঙ্গে কত গল্প করত। আবার যাবার সময় চুবড়িগুলি নিয়ে যেত। রাতে জেলেরা সব মাছ ধরত আর গান গাইত, শূনতম। ঠাকুরের কাছে কত ভক্ত আসত, গানকীৰ্তন হ'ত, তাই শুনতম আর ভাবতুম—আমি যদি ঐ ভক্তদের মতাে একজন হতুম তাে বেশ ঠাকুরের কাছে থাকতে পেতুম, কত কথা শুনতুম। ঐ যােগেন, গোলাপ সব জানে। ওরা আমার কাছে যেত, আর কখনও কখনও থাকত।
মা যােগেন-মার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “কি আনন্দই তখন ছিল, যােগেন।” বলিয়া যেন একটু অন্যমনস্ক হইয়া রহিলেন।
যােগেন-মা বলিলেন, “সে যে কি আনন্দ তা কি মুখে বলা যায় গাে ? মনে করলে আজও প্রাণ কি রকম করে ওঠে।”
এইবার মা আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “রাত হয়ে গেল, বাড়িতে বকুনি খাবে না?”
সুধীরা দিদি—তা আজ একটু বকুনি খাবে। ওদের বাড়ির লােকেরা এখানকার উপর ভারী চটা। যদি শােনে যে এখানে এসেছে, তা হলে মাথা আর রাখবে না।
মা—তাই তাে, মা, বাছারা কত বকুনি খাবে! কত রকমের লােক আছে তার কি ঠিক আছে ? যারা সমাজ নিয়ে চলে, তাদের কেবলই ভয়। তােমরা এস, মা। আহা, কত বকবে!
সুধীরা দিদি—এইটুকু যদি সহ্য না করতে পারে তাহলে ওরা করবে কি? আপনার আশীর্বাদে ওদের ভয় থাকবে না।
মা—ঠাকুরের কৃপায় সব সােজা হয়ে যাবে। যদি বকে, কোন কথাটি বােলাে না । সংসারে কতরকম লােক থাকে। সব সহ্য করে থাকতে হয়। ঠাকুর বলতেন, ‘শ, ষ, স—তিনটে স। যে সয় সেই রয়।’
আমাদের জন্য ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর রক্ষা কর।” আমরা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম। ছুটির ভেতর একদিন দুপুরবেলায় সুধীরা দিদি এবং আমরা তিনজন মার বাড়ি গিয়াছি। মা আমাদের দেখিয়া বলিলেন, “ঠাকুরঘরে বস। আমি ভােগ দিয়া আসি।” কিছুক্ষণ পরে মা ফিরিয়া আসিলে আমরা প্রণাম করিলাম। মা আমাদের কুশলপ্রশ্নের পর জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেদিন বাড়িতে বকেছিল?” আমরা বলিলাম, “বেশী খাইনি। সে আমাদের গায়েও লাগেনি।”
আহারান্তে মা সুধীরা দিদিকে হাতেমাখা প্রসাদ দিলেন। আমাদের মধ্যে দুইজন বিধবা। তাহারা সেই প্রসাদ খাইতে একটু ইতস্ততঃ করাতে মা বলিলেন, “প্রসাদে দোষ নেই, তােমরা খাও, মা।”
তারপর মা একটু শুইলেন এবং আমাদের মেজেয় মাদুর পাতিয়া শুইতে বলিলেন। বৈকালে মা ঠাকুর তুলিয়া আমাদের প্রসাদ দিলেন এবং বারান্দায় বসিয়া সুধীরা দিদির সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। একটি বউ একখানি কার্পেটের তৈয়ারী গােপালের ছবি মার হাতে দিয়া প্রণাম করিয়া বসিল। সেখানি দেখিয়া মা বলিলেন, “বউ মা, তুমি এখানি করেছ ?” বউ বলিল, “হাঁ, মা।” মা বলিলেন “আহা, বেশ হয়েছে। কি সুন্দর মুখের ভাব! কেমন করেছে দেখ।” বলিয়া আমাদের সকলকে দেখাইতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “বেশ হয়েছে, না?” আমরা বললাম, “হাঁ।” তিনি সেখানি আবার দেখিয়া মাথায় স্পর্শ করিয়া তুলিয়া রাখিতে বলিলেন এবং পরে বউটির বাড়ির কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া তাহাকে প্রসাদ দেওয়াইলেন।
গােলাপ-মা আসিতেই মা তাঁহাকে ছবিখানি দেখাইয়া বলিলেন, “কেমন সুন্দর হয়েছে দেখ।” সেই বউকে দেখাইয়া বলিলেন, “এই বউমা করেছে।” গােলাপ-মা সেখানি দেখিয়া বলিলেন, “সবই বেশ ভাল হয়েছে, কেবল বাঁ হাতটা একটু মােটা হয়েছে।”, আমরা হাসিতে লাগিলাম। মাও হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “গােলাপ এসে খুঁত বার করলে। ওদের পছন্দ আলাদা, মা। গােলাপ অনেক দেখেছে শুনেছে কি-না, তাই পছন্দ হয় না। গােলাপের কাজ বড় পরিষ্কার ; আবার অনেক রকম কাজ জানে। ঠাকুরের যত সব জিনিস, সব গােলাপের তৈরী। আবার ভক্তদের মশারি, বালিশ, তার ওয়াড়, সব গােলাপ করে। শরীরে একটুও আলস্য নেই।”
সন্ধ্যার একটু আগে বউটি মাকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইতেছে। মা বলিলেন, “আবার এস, মা।”
যােগেন-মা আসিয়া মাকে প্রণাম করিয়া বসিলেন। অন্যান্য কথার পর মা তাঁহাকেও সেই ছবিখানি দেখাইয়া বলিলেন, “কেমন করেছে দেখ! কি সুন্দর মুখের ভাব !” যােগেন-মা বলিলেন, “বেশ তাে করেছে ! কে করেছে ? বড় চমৎকার হয়েছে তাে!” মা সেই বউয়ের পরিচয় দিয়া বলিলেন, “গােলাপ বলেছে বা হাতটা মোটা হয়েছে।” যােগেন-মা বলিলেন, “ওর কথা ছেড়ে দাও।” 
সন্ধ্যা হইলে মা ঠাকুর প্রণাম করিয়া, “হরিবােল, হরিবােল, গুরুদেব, গুরু ভরসা” এইসব বলিয়া গঙ্গার দিকে ফিরিয়া প্রণাম করিলেন। মা ঘরে আসন পাতিয়া বসিলেন ও একটু গঙ্গাজল লইয়া জপ করিতে বসিলেন। আরতি আরম্ভ হইল। যােগেন-মা ঠাকুরের আরতির সঙ্গে মাকেও আরতি করিতে লাগিলেন। একঘর লোক বসিয়া জপ করিতেছে। কি চমৎকার দৃশ্য!
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন আমার সঙ্গীদের মধ্যে দুইজনের দীক্ষা হইয়া গেল। আমার ভাগ্যে সেদিন আর হইল না, কারণ আমি কলিকাতায় ছিলাম না। ইহার কিছু পরে একদিন বিকালে আমি সুধীরা দিদির সহিত মার বাড়ি যাইলাম। মার দেশে যাইবার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়া হয় নাই। আমরা প্রণাম করিয়া বসিতেই মা বলিলেন, “এস মা।” সুধীরা দিদির প্রশ্নের উত্তরে মা অন্য কথার পর বলিলেন, “ছােট বউয়ের মাথাটা বড় গরম হয়েছে। ও দেশে গেলেই ভাল থাকে। আর রাধুর বিয়ে। এই সবের জন্য আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হচ্ছে। সেই দিনই যাওয়ার সব ঠিক ছিল। কিন্তু দিনটা তত ভাল নয় বলে পেছিয়ে গেল।” আরতির পর মা একটু শুইলেন। সুধীরা দিদি তাহার পা টিপিয়া দিতে লাগিলেন। মা বলিলেন, “একটু জোরে জোরে দাও, মা। কাল পূর্ণিমা কি-না, তাই পায়ের বাতটা বেড়েছে। দেখ না, এই বাতটা এমন আশ্রয় করেছে যে যাবার নাম নেই। কত দিন হয়ে গেল তার ঠিক আছে কি? যখন দক্ষিণেশ্বরে থাকি তখন থেকে হয়েছে।”
পা টিপিয়া দিতে মা একটু ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমাদের গাড়ি আসিতেই আমরা ঠাকুর প্রণাম করিয়া বাহির হইতেছি, এমন সময় মা উঠিয়া বলিলেন, “তােমরা যাচ্ছ ? আবার এসাে।” যােগেন-মা আমার মন্ত্র লইবার কথা মাকে বলায় তিনি বলিলেন, “কাল সকালে এসাে।”
পরদিন সকালে মার বাড়ি গিয়া দেখি, মা ঠাকুরপূজা শেষ করিয়া গঙ্গাস্নানে যাইবার যােগাড় করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “এস মা, তাড়াতাড়ি, তােমাকে মন্ত্র দিয়ে আমি নাইতে যাব।” মন্ত্র দেওয়া শেষ হইলে মা বলিলেন, “ঐ ফুলগলি আমার পায়ে দাও।” আমি ভাবিতেছি, কি বলিয়া দিব। মা তখন ফুলগুলি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “ আমার যা কিছু সব তােমায় দিলুম’ বলে ফুলগলি আমার পায়ে দাও।” আমি ঐরূপ করিতে তিনি ঠাকুরকে দেখাইয়া বলিলেন, “ইনিই তোমার সর্বস্ব। একে ডেকো, তাহলেই তােমার সব হবে।”
মায়ের আদেশে তাঁহার পায়ে আমি তেল মাখাইয়া দিলাম। স্নানাদির পর সুধীরা দিদি আমাদের যাওয়ার কথা বলিলেন। মা বলিলেন, “তােমরা এখনই যাবে কি, মা? প্রসাদ পেয়ে বিকালে যেও।” যােগেন-মা উপরে আসিতেই মা তাহাকে বলিলেন, “এরা বাড়ি যেতে চাচ্ছে।” যােগেন-মা বলিলেন, “এখুনি যাবে কি? মন্ত্র নিয়ে প্রসাদ পেয়ে যাবে। আমি ওদের খাবার কথা বামুনকে বলে এলাম।” মা বলিলেন, “আমিও বলেছি বিকালে যেতে।” 
যােগেনমা বাড়ি যাইবেন, মাকে প্রণাম করিলেন। মা তাঁহার মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, ‘বড় বেলা হয়েছে। এখানে খেলে হত না? আবার গিয়ে রান্না করে খেতে কষ্ট হবে।” 
যােগেন-মা বলিলেন, “না, মা। মা রয়েছেন, আর তিনি সব যােগাড় করে রেখেছেন। আমি খালি একটু রাঁধব।” মা বলিলেন, “আর বেলা ক'রাে না, মা, এস গিয়ে। বড় রােদ ফুটেছে, অতটা রাস্তা যেতে হবে।”
তারপর ললিতবাবুর স্ত্রী আসিয়া প্রণাম করিয়া বসিলেন। সম্প্রতি তাঁহার মেয়েটি মারা গিয়াছে, সেজন্য বড় কাতর আছেন। মা তাহাকে নানাপ্রকারে বুঝাইতে লাগিলেন। বলিলেন, “আহা, মা, তিনটিই গেল! একটিও কি থাকতে নেই ? আবার ললিতটির কি রকম অসুখ ! ঠাকুরের কৃপায় ভাল হলে হয় না। ললিতটি বেঁচে থাকে, তব সান্ত্বনা।” মা তাঁহাকে প্রসাদ দিয়া বলিলেন, “খাও মা, কি রােগাই হয়ে গেছ! শরীরে আর কিছু নেই।" বিদায় লইবার সময়
সুধীরা দিদি মাকে বলিলেন, “আবার কতদিনে আপনাকে দেখব ?” মা বলিলেন, “আমি শীঘ্রই ফিরব। তুমি রাধুর বিয়েতে যেও না।” সুধীরা দিদি কিছু না বলিয়া বলিলেন, “আজ আসি, মা।” মা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “আমি এলে আবার এসাে।” 
মা দেশ হইতে ফিরিলে আমি ও সুধীরা দিদি একদিন বিকালে মার বাড়ি গিয়া তাহাকে দর্শন করিলাম। সুধীরা দিদি বলিলেন, “মা, আপনি বড় কাল ও রােগা হয়ে গেছেন।” মা বলিলেন, “আমাদের দেশটা মেঠো দেশ কি-না, তাই রং কাল হয়ে যায়। আর খাটুনিও পড়ছিল।”
সিস্টার নিবেদিতা আসিয়া মাকে প্রণাম করিয়া বসিলেন। মা তাঁহার কুশল জিজ্ঞাসা করিয়া একখানি ছােট পশমের তৈয়ারী পাখা তাঁহাকে দিয়া বলিলেন, “আমি এখনি তােমার জন্য করেছি।” সিস্টার উহা পাইয়া আনন্দে একবার মাথায় রাখেন, একবার বুকে ঠেকান, আর বলেন, “কি সুন্দর, কি চমৎকার !” আবার আমাদের দেখান এবং বলেন, “কি সুন্দর মা করেছেন দেখ!” মা বলিলেন, “কি একটা সামান্য জিনিস পেয়ে ওর আহলাদ দেখেছ। আহ, কি সরল বিশ্বাস। যেন সাক্ষাৎ দেবী। নরেনকে (স্বামীজী) কি ভক্তিই করে ! সে এই দেশে জম্মেছে বলে সব ছেড়ে এসে প্রাণ দিয়ে তার কাজ করছে। কি গুরুভক্তি ! এদেশের উপরই বা কি ভালবাসা!”
সিস্টার দার্জিলিং যাইবেন, সেই কথা মাকে বলিতেছেন। রাধু আসিলে মা তাহাকে বলিলেন, “দিদিদের প্রণাম কর, রাধু।” সুধীরা দিদি বলিলেন, “না, না, থাক। ও আবার আমাদের নমস্কার করবে কি?” মা বলিলেন, “তােমরা দিদি, তােমাদের নমস্কার করবে না?” একটি ব্রহ্মচারী আসিয়া ভক্তদের মাকে প্রণাম করিবার কথা বলিয়া গেলেন। “তাদের আসতে বল” বলিয়া মা একখানি চাদর ঢাকা দিয়া বসিলেন। যথাসময়ে আমরা মার আশীর্বাদ লইয়া বাড়ি ফিরিলাম।
একদিন সিস্টার আমাদের বলিলেন, “মাতাদেবী আজ আমাদের স্কুলে আসবেন। তােমরা সকলে খুব আনন্দ কর।” সকালের পরিবর্তে চারটার সময় মার গাড়ি আসিল। সঙ্গে রাধু, গােলাপ-মা প্রভৃতি। মা গাড়ি হইতে নামিতেই 'সিস্টার তাঁহাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া ঠাকুর-দালানে বসাইলেন। মার চরণে পুস্পাঞ্জলি দিবার জন্য আমাদের হাতে ফুল দিলেন। মেয়েরা পুম্পাঞ্জলি দিয়া উঠানে দাঁড়াইলে সিস্টার একে একে সকলের পরিচয় দিলেন। মা মেয়েদের একটু গান গাহিতে বলিলেন। মেয়েরা গান গাহিল এবং একটি কবিতা পড়িল। শুনিয়া মা বলিলেন, “বেশ পদ্যটি।” তারপর মিষ্টি প্রসাদ করিয়া দিয়া আমাদের দিতে বললেন। কিছুক্ষণ পরে সিস্টার মাকে লইয়া সমস্ত ঘর এবং মেয়েদের হাতের কাজ প্রভৃতি দেখাইতে লাগিলেন। মা দেখেন আর আনন্দ করেন এবং বলেন, “বেশ তাে শিখেছে মেয়েরা !” পরে সিস্টার বিশ্রামের জন্য মাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন।
যেবার সিস্টার নিবেদিতার দেহত্যাগ হয়, সেবার সুধীরা দিদির খুব অসুখ হয়। তাঁহার জন্য মার কি ভাবনা! বলেন, “ও ঠাকুর, সুধীরা যাবে কি? তার যে কত কাজ বাকী।” বলেন আর কাঁদেন।
শ্যামপুকুরের পিসীমাকে মা বলিলেন, “তুমি একবার সুধীরার খবরটা এনে দিতে পার, মা? আহা, তার বড় অসুখ।” তিনি স্বীকৃতা হইলে মা তাহার হাতে ঠাকুরের চরণামৃত, বেদানা ইত্যাদি দিয়া বলিলেন, “এগুলি তাকে দিও; আর খবরটা আমাকে এনে দেবে, কেমন আছে। আমি ঠাকুরের কাছে তার জন্য তুলসী দিচ্ছি।”
সুধীরা দিদি আরােগ্যলাভ করিলে তিনি, আমি ও সিস্টার কৃষ্টীন একদিন সন্ধ্যার সময় মার বাড়ি যাইলাম। আরতির পর আমরা প্রণাম করিয়া বসিতেই মা সুধীরা দিদিকে বলিলেন, “সেরেছ, মা?” সুধীরা দিদি বলিলেন যে অনেকটা সারিয়াছেন, তবে সাবধানে আছেন। মা বলিলেন, “তোমার জন্য বড় ভাবনা হয়েছিল। যা হোক, ঠাকুরের কৃপায় সেরেছ, মা। এই নিবেদিতাটি গেল, আবার তােমার অসুখ-শুনে ভাবি, সুধীরা গেলে স্কুল চালাবে কে? (সিস্টার কৃষ্টীনকে লক্ষ্য করিয়া) আহা দুটিতে একসঙ্গে ছিল, এখন একলা থাকতে কত কষ্ট হবে। আমাদেরই তার জন্য প্রাণ কেমন করে, তােমার তাে আরও বেশী হবে, মা। কি লােকই ছিল। তার জন্য আজ কত লােক কাঁদছে।” বলিয়া মা কাঁদিতে লাগিলেন। পরে মা সিস্টার কৃষ্টীনকে স্কুল সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। 
 সুধীরা দিদি বায়ু পরিবর্তনের জন্য আমাকে সঙ্গে লইয়া কাশী যাইবেন বলায় মা ঐসম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, “শীঘ্র শীঘ্র যেও ; শরীরটা সারাতে হবে তাে?”
ইহার বহুদিন পর একদিন মার চরণদর্শনে যাইতেছি। সঙ্গে ডাক্তারের স্ত্রী। এবারে সুধীরা দিদি সঙ্গে না থাকায় আমার বিশেষ ভয় হইতেছিল, মা যদি আমায় চিনিতে না পারেন। আমরা ঠাকুরঘরে গিয়া দেখি, মা পূজা করিয়া উঠিয়াছেন। আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “কি মা, এসেছ ? অনেকদিন আসনি যে ? তােমার জন্য কত ভাবছি কোথায় আছ ?” আমি প্রণাম করিতেই মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া সুধীরা দিদির কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বলিলাম, “তিনি কলকাতায় এসেছেন, আমি তার সঙ্গে এসেছি।” মা আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন, ইহা ভাবিয়া আমার প্রাণটা আনন্দে ভরিয়া গেল।
সেদিন বলরামবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল, সকলেই যাইবেন। রাধুর শরীর ভাল নাই। সেজন্য মা বলিলেন, “এ তাে যাবে না, রাধু আর এ থাকবে এখন।” 
মাকে লইতে গাড়ি আসিয়াছে। যাইবার সময় মা আমাদের বলিয়া গেলেন, “তােমরা দুজনে খেলা কর। আমি শীগগির আসব।” আবার রাধুকে বলিলেন, “দিদির সঙ্গে খেলা কর মা, কেমন ? আমি আসি।”
চারটার পর মা ফিরিয়া আসিলেন। আমাদেরও সেই গাড়িতে যাওয়া স্থির হইল। মা আমাকে তাড়াতাড়ি কতকটা প্রসাদ দিয়া বলিলেন, “আহা! মা, আমরা এলুম, আর তুমি চললে ? কি করবে বল? ওদের সঙ্গে এসেছ, আবার ওদের সঙ্গে যেতে হবে তাে ? বউমাটি অনেকক্ষণ এসেছে।”
রাধু—কেন, দিদি থাকুক না। 
মা–থাকবার কি জো আছে, মা? 
রাধু–না, থাকুক। ওরা চলে যাক না।
মা–পাগল আর কি। ও থাকলে তাদের চলবে কেন? না, মা, তুমি তাড়াতাড়ি এস গিয়ে, নীচে ডাকাডাকি করছে। 
আমি মাকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইতেছি। মা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “কতদিন যে তােমায় এমনি করে থাকতে হবে, মা, ঠাকুরই জানেন। আবার এসে, মা” বলিয়া সিঁড়ি পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসিলেন। সেদিন মায়ের কি করুণা অনুভব করিয়াছিলাম তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। “এটা কর, ওটা কর” বলিয়া কত আদেশই করিয়াছিলেন।

কাশী

পৌষমাসে বড়দিনের ছুটিতে শ্রীশ্রীমার কাছে থাকিবার ইচ্ছায় সুধীরা দিিদ আমাদের কয়েকজনকে লইয়া কাশী গেলেন। মার সহিত দেখা করিলে তিনি অন্যান্য কথার পর যােগেন-মার সংবাদ লইলেন ও বলিলেন, “আহা! মা, যােগেনটি আসতে পারলে না। যা অসুখ হয়েছিল ! ঠাকুর ও মা রক্ষা করেছেন। যােগেনের জন্য বড় ভাবনা হয়েছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর সুধীরা দিদি প্রভৃতি আমাদের থাকিবার জন্য যে বাড়ি ভাড়া হইয়াছে তাহা দেখিতে গেলেন। 
মা একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। বাড়ি প্রায় নিস্তদ্ধ। সকলেই বিশ্রাম করিতেছেন। এমন সময় বারান্দা হইতে একটি গান শােনা গেল

“আমার মা কোথায় গেলে ? 
অনেকদিন দেখি নাই, মা, নে আমায় কোলে। 
তুই গাে কেমন জননী, সন্তানে হও এত পাষাণী,
দেখা দে মা, আর কাদাঁস নে তনয়া বলে।” 

গানটি এত মৃদুস্বরে শােনা যাইতেছিল যে আমার মনে হইল, কে যেন খুব দূরে কাঁদিতেছে। মা হঠাৎ উঠিয়া বলিলেন, “কে গান গাচ্ছে ? চল তাে মা, বারান্দায় গিয়ে দেখি।” গিয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে আমি অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। একটি মেয়ে এই গানটি গাহিতেছে এবং তাহার চক্ষের জলে বুক ভাসিয়া যাইতেছে। মা সেখানে বসিতেই সে মাকে প্রণাম করিয়া বলিল, “মা, আমার অনেক দিনের আশা আজ পূর্ণ হ’ল। আজ আমার কি আনন্দ হচ্ছে বলতে পারছি না, মা।” মা তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন।
মেয়ে—আমি আপনার ভিখারিণী মেয়ে, মা। 
মা—কোথায় থাক ? 
মেয়ে—অন্নপুর্ণার দরজায়, নয় দশাশ্বমেধঘাটে বেহারী বাবার মন্দিরের কাছে বসে থাকি।
মা—ভিক্ষাতে তােমার বেশ চলে তাে ?
মেয়ে—আপনার আশীর্বাদে বেশ চলে যায়। এ সবের জন্য কোন ভাবনা নেই। অন্নপুর্ণার দয়ায় এখানে কেউ তাে উপােস করে থাকে না, মা। কিসে একটু ভক্তি হয় তাই ভাবি, মা।
মা—তা হবে বইকি, মা; তুমি এমন স্থানে রয়েছ। এখানে বিশ্বনাথ, মা। অন্নপুর্ণা সাক্ষাৎ বিরাজ করছেন। তাঁদের কৃপায় সব হয়ে যাবে। মা তাহাকে আর একটি গান গাইতে বলিলেন। সে গাহিল-

“মা, আমারে দয়া করে 
শিশুর মতাে করে রাখ, 
শৈশবের সৌন্দর্য ছেড়ে
বড় হতে দিও নাক। স
সুন্দর সরল প্রাণ,
মান অপমান নাহি জ্ঞান, 
হিংসা নিন্দা লজ্জা ঘৃণা,
কিছুই সে জানে না।” 

মা—“আহা, কি চমৎকার গানটি।
মেয়ে—অনেকদিন ধরে আপনাকে দেখবার বড় সাধ ছিল। আপনি এখানে আছেন শুনে আসব ভাবি, কিন্তু ভয় করে পাছে কেউ কিছু বলে।
মা—কেউ কিছু বলবে না। তােমার যখন ইচ্ছা এসাে।
মা তাহাকে প্রসাদ দিতে বলিলেন। সে প্রসাদ পাইয়া বিদায় লইতেছে। মা তাহাকে বলিলেন, “আবার এসো, মা।” পরে তিনি আমাদিগকে বলিলেন, “মেয়েটির বেশ ভক্তি আছে।”
কাশীতে যে কয়দিন ছিলাম, প্রত্যহ দুইবেলাই মায়ের কাছে যাইতাম। একদিন বৈকালে যাইয়া দেখি, মা অদ্বৈত আশ্রমে ভাগবত পাঠ শুনিতে যাইতেছেন। আমাদের দেখিয়া তিনি বলিলেন, “আমরা মঠে ভাগবত শুনতে যাচ্ছি, কে একজন কথক পাঠ করবেন। তােমরা যাবে? চল না।” আমরা তাহার সঙ্গে গেলাম। দুই ঘণ্টা পর্যন্ত পাঠ হইল। পাঠ শেষ হইলে মা একটি টাকা দিয়া প্রণাম করিয়া আসিয়া কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, “আহা, কি চমৎকার পাঠ। কথকটি বেশ বলেছেন।”
একদিন সন্ধ্যার পর সুধীরা দিদি ও আমি মার কাছে বসিয়া আছি; মা বলিলেন, “যে একবার ঠাকুরকে ডেকেছে, তার আর ভয় নাই। ঠাকুরকে ডাকতে ডাকতে কৃপা হলে তবে প্রেমভক্তি হয়। এই প্রেমটা অতি গােপনীয় জিনিস, মা। জগােপীদের প্রেমভক্তি হয়েছিল। তারা এক কৃষ্ণকে ছাড়া আর কিছুই জানত না । নীলকণ্ঠের গানে আছে, ‘ও প্রেমরত্নধন রাখতে হয় অতি যতনে।” বলিয়া মা গানটি গাহিলেন। কি মিষ্ট গলায় মা এই গানটি গাহিয়াছিলেন তাহা আজ পর্যন্ত যেন কানে লাগিয়া আছে। গান শেষ হইলে মা বলিলেন, “আহা, নীলকণ্ঠের গান কি চমৎকার। ঠাকুর বড় ভালবাসতেন। ঠাকুর যখন দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন, নীলকণ্ঠ কখনও কখনও তাঁর কাছে আসতো ও গান গাইত। কি আনন্দেই ছিলাম। কত রকমের লােকই তার কাছে আসত ! দক্ষিণেশ্বরে যেন আনন্দের হাটবাজার বসে যেত !” 
একদিন মার বাড়ি গিয়াছি। মা বারান্দায় বসিয়া দুইজন স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিতেছিলেন। সেই ভিখারী মেয়েটি আসিয়া মাকে প্রণাম করিল। তাহার হাতে একটা পেয়ারা। উহা মাকে দিয়া বলিল, “মা, এটি আজ ভিক্ষায় পেয়েছি, তাই আপনার জন্য এনেছি। দিতে সাহস হচ্ছে না, মা।” মা বলিলেন, “তা বেশ করেছ ; আহা! দাও, মা।” ইহা বলিয়া পেয়ারাটি লইয়া মাথায় ঠেকাইলেন এবং বলিলেন, “ভিক্ষার জিনিস খুব পবিত্র, ঠাকুর বড় ভালবাসতেন। বেশ পেয়ারাটি তো ; আমি খাব এখন।” মেয়েটি বলিল, “আমি আপনার ভিখারিণী মেয়ে, আমার উপর এত দয়া !” ইহা বলিতে বলিতে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। মা বলিলেন, “তােমার গান বড় মিষ্টি। তুমি একটি গান গাও।” মেয়েটি গাহিতে লাগিল-
“গােপাল, সাজিয়ে দিই বাপ তোরে। 
একবার তেমনি, তেমনি, তেমনি ক'রে।
নাচরে ঘুরে ফিরে। 
চরণে নুপুর দিব বাপ আমি,
বাজবে ঝুনুরুনু করে। 
কটিতটে স্বর্ণপাটা দিব কোমর বেড়ে। 
গােপাল, খাইয়ে দিই বাপ তােরে।
স্বর্ণ-বলয় দিব বাপ আমি, তােমার যুগল দুটি করে।" 
গান শেষ হইলে সে বলিল, “মা, এই গানটি গাইলে দশাশ্বমেধ-ঘাটে যে বেহারীবাবা সাধু আছেন তিনি ঠিক গােপালের মতাে নাচতে থাকেন। তাঁর স্বভাব ঠিক বালকের মতাে।”
মা বলিলেন, “গানটি বেশ। আর একটি বল না।” 
সে আবার একটি গাহিল। মা তাহাকে প্রসাদ দিতে বলিলেন। প্রসাদ লইয়া মাকে প্রণাম করিয়া সে বলিল, “আজ তবে আসি, মা।” মা বলিলেন, “আবার এসাে, মা, যখন ইচ্ছে হবে এসাে।”
একদিন বেলা তিনটার সময় মা বৃদ্ধাদের আশ্রম দেখিতে যাইবার পথে আমাদের তুলিয়া লইয়া গেলেন। সেখানে নামিতেই একটি বউ আসিয়া মাকে উপরে লইয়া গেলেন। বৃদ্ধারা সকলে মার চরণে ফুল দিয়া প্রণাম করিতে লাগিলেন।
মা—একি গাে? এরা সব কাশীবাসী, এরা আবার প্রণাম করে কেন? 
বউ—তা করবে না, মা ? আপনার অন্নে এরা প্রতিপালিত। 
মা—বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণাই আছেন, মা। তুমি বুঝি এদের দেখাশুনা কর ?
বউ—হাঁ মা, যেমন করান। . 
মা—আহা, তা বেশ। এই অনাথা বুড়ীদের সেবা করলে নারায়ণের সেবা করা হয়। আহা, এই সব ছেলেরা কি কাজই করেছে। 
তারপর মা বৃদ্ধাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া এবং তাহাদের ঘরগুলি দেখিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
একদিন সন্ধ্যার পর আমরা সারনাথ হইতে ফিরিয়া মার বাড়ি গিয়া দেখি, মা শুইয়া আছেন। রাধুও পাশে শুইয়া আছে। সারনাথের বর্ণনা শুনিয়া সে মাকে বলিল, “মা, একদিন দেখতে যাবি?” 
মা বলিলেন, “কি করে যাব, মা? আমার কি পা আছে যে ঘুরে ঘুরে দেখব? এই দেখ না, মা, বিশ্বনাথদর্শনে যেতে পারি না। এরা সব যায় দেখে আমারও ইচ্ছা করে বিশ্বনাথদর্শন করে আসি; কিন্তু পা নেই তা যাব কি? কিছুই করতে পারি না। যখন পা ছিল তখন আমাদের দেশ থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। তখন কত হাঁটতে পারতুম। ঠাকুরের দেহ রাখার পর বৃন্দাবন গিয়েছিলাম। তা হেঁটে হেঁটেই সব দর্শন করতুম।”
আর একদিন গিয়া দেখি একটি স্ত্রীলোেক আর তাঁহার দশ-এগার বংসরের একটি মেয়ে মার কাছে বসিয়া আছে। স্ত্রীলােকটি বড় গরীব। 
মা—তােমার স্বামী কোথায় ?
স্ত্রীলােক—কোথায় বিবাগী হয়ে গেছে। এই মেয়ে যখন ছােট তখন গেছে।
মা—এতদিন কাজকর্ম নেই, কি করে চলে ?
স্ত্রীলােক—কাজকর্ম করে যা ছিল তাই দিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে চালিয়েছি। এখন আর চলে না, মা; বড় কষ্টে পড়েছি। আপনি ওদের বলে যদি কিছু করিয়ে দেন, মা।
মা—আমি বলে দেখতে পারি। ওরা তাে, মা, ভিক্ষে ক'রে আনে। কত লােককে দিচ্ছে তার ঠিক আছে কি? ওরা যেমন বুঝবে তেমনি দেবে তাে?
মা তাহাকে একটি টাকা ও একখানি কাপড় দিয়া বলিলেন, “আজকে এখানে দুটি খেয়ে যেও।” মা ছাদে বসিয়া আছেন। নীচে রান্না হইতেছে। স্ত্রীলােকটি বলিতেছে, “মা, খুকী বলছে, কি সুন্দর রান্নার গন্ধ!” 
মা বলিলেন, “কি গাে, ওসব কথা বলতে আছে ? ঠাকুরের ভােগ হবে।” প্রসাদ পাইবার সময় মা সেই মেয়েটিকে বেশী করিয়া মাছ তরকারী ইত্যাদি দিতে বামুন-ঠাকুরকে বলিয়া দিলেন। খাওয়া শেষ হইলে স্ত্রীলোকটি বলিল, “খুব খেয়েছি, মা, খুকী তাে উঠতেই চায় না।” 
মা—তা বেশ। এখন খাওয়া হয়েছে তাে, নীচে গিয়ে আঁচাও।
স্ত্রীলােকটি নীচে যাইলে মা বলিলেন, “কি দারিদ্র্যের দশা! এত লােভ এসে পর্যন্ত মেয়েটা খাই খাই করছে! অত বড় মেয়ের কিছু বুদ্ধি নেই। এ সব লােকের কিছু হয় না, লক্ষীছাড়ার দশা।” 
তাহারা উপরে আসিলে মা তাহাদের পান দিয়া বলিলেন, “এইবার এস গিয়ে।” তাহারা চলিয়া গেলে মা ঘরে তক্তপােশের উপর শুইয়া আমাদের সঙ্গে গল্প করিতে লাগিলেন। বলিলেন, “কাশীতে কত রকমের লোক আছে যে তার ঠিক নেই। এই রকম কত লােক যে আসে, আর আমাকে বলে, 'আপনার ছেলেদের বলে দিন আমাকে কিছু সাহায্য করতে। আমি আর কি বলব বল ? তারা যেমন বুঝবে তেমনি করবে তাে। মাগো, যত দরিদ্রের কি এখানে বাস ? ওরাই বা কি করবে বল ? এই দেখ না, অনাথা বুড়ীদের জন্য আপ্রম করেছে। তাদের কত সেবা, কত যত্ন! রোগীদের জন্য হাসপাতাল। আবার বাইরে যে কত লােককে সাহায্য করে তার ঠিক আছে কি? ছেলেগুলি কি খাটুনিই খাটে। সবই তাঁর ইচ্ছা, মা। কোথা থেকে কি করাচ্ছেন তিনিই জানেন।” 
একদিন বিকালে যাইয়া দেখি মা বারান্দায় বসিয়া কয়েকজন বিধবার সহিত কথা কহিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন গেরুয়াপরা। তিনি মাকে একটি গান শােনাইলেন—
“থাকরে জবা, বনের শােভা,
বনের ফুল তুই বনে ফুটি, 
তােরে হেরলে শিবের বক্ষে
মনে হয় মার চরণ দুটি।” ইত্যাদি 
গােলাপ-মা—আহা, কি চমৎকার গানটি । আর একটি গাও। 
মেয়েটি আর একটি গাহিলেন।
মা—তােমরা সেবাশ্রম দেখেছ ? 
সুধীরা দিদি—না, আমরা দেখিনি। 
মা—তবে গােলাপের সঙ্গে গিয়ে দেখে এস।
আর একদিন বৈকালে মার কাছে গিয়াছি। মা দেবব্রত মহারাজের ও শচীনের কথা বলিতে লাগিলেন। তাহারা হঠাৎ অন্যত্র চলিয়া গিয়াছেন। 
মা—আহা! মা, দেবব্রতটি আজ চলে গেল। কোম্পানি সেবাশ্রমের পাশের জায়গাটার কি সাহায্য করবে বলেছে ; ওরা থাকাতে আপত্তি তুলেছে, সেইজন্য রাখাল সরে যেতে বললে। জানিস তাে বাপ, তার কোন দোষ নেই, তবু একটা ফেউ লেগে থাকবে। আহা, বাছারা খেয়ে গেল না।
সুধীরা দিদি—দাদা আর শচীন আমাদের কাছে খেয়ে গেছে। 
মা—আহা! মা, খেয়ে গেছে তবু ভাল, আমি তাই ভাবছিলাম।
সুধীরা দিদি—দাদা যেখানেই যায়, ওরা তাদের খোঁজ নেয়। সেইজন্য দাদা বলেন, “আমার শ্বশুরবাড়ির লােক এসেছে, যাই দেখা করে আসি।”
মা–শ্বশুরবাড়ির লােকই বটে, মা। কবে স্বদেশীর হাঙ্গামে ধরেছিল, এখনও তাঁর খোঁজ রাখে! দেখ না, ছেলে দুটি খেয়ে যায়নি বলে সারাদিন মনটা কেমন করতে লাগল তার কি বলব, মা ! যা হােক, তােমার কাছে খেয়ে গেছে শুনে প্রাণটা ঠাণ্ডা হ'ল।
উদ্বোধন, কলিকাতা। আজ জগদ্ধাত্রীপূজা। সকাল হইতেই ভক্ত-সমাগম। যােগেন-মার বাড়িতে পূজা; তিনি সকালে আসিয়াই চলিয়া গিয়াছেন। মাকে যাইবার জন্য বলিয়া গিয়াছেন। একটি ভক্ত আসিয়া মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মা, কৃপা করিয়া যদি এই অধম সন্তানের বাড়িতে একবার চরণধূলি দেন।” মা বলিলেন, “আচ্ছা, দেখি বিকালে যেতে পারি কি-না, তুমি বিকালে একবার এস। যদি পারি তাে যাব।”
দুপুরবেলা মা ও আমরা সকলে যােগেনমার বাড়ি যাইয়া ঠাকুরদর্শন করিয়া আসিলাম। মা সারাদিন উপবাসী রহিয়াছেন, কারণ তাহার বাড়িতে পূজা। বেলা চারটার পর যখন সব পূজা শেষ হইল তখন মা প্রসাদ পাইয়া একটু বিশ্রাম করিলেন। 
ভক্তটি মাকে লইতে আসিয়াছে। মা শুনিয়া বলিলেন, “সকালে অত করে বললে, যাই একবার ঘুরে আসি।” তাঁহার বাড়ি বেশী দূরে নয়, রাজবল্লভপাড়ায়। মা গাড়ি হইতে নামিতেই তাঁহারা মার পা ধােয়াইয়া সেই জল রাখিয়া দিলেন। বাড়িখানি ছোট, আবার ভাঙা। আমরা ঠাকুরপ্রণাম করিয়া ভিতরে যাইলাম। মাকে তাহারা ঘরে একখানি আসন পাতিয়া বসিতে দিলেন। মা ঘরের দরজার সামনে আসনখানি পাতিয়া বলিলেন, “আমি এইখানেই বসি!” 
একটি বৃদ্ধা মার সহিত কথা কহিতে লাগিলেন।
বৃদ্ধা—মা, আশীর্বাদ কর আমার ছেলেকে। ওর পূজা করবার বড় সাধ, কিন্তু বাড়িঘর কিছুই নেই। যা হোক করে মায়ের পূজাটি হ’ল। নিজেই সব করেছে।
মা—আহ, তা বেশ করেছে। মা যখন এসেছেন তখন বাড়িঘর সব হয়ে যাবে। তোমার ছেলেটি বড় ভাল, খুব ভক্তি আছে।
একটু পরে প্রসাদ আনিয়া দিলে মা একটু মুখে ঠেকাইয়া যাইবার জন্য উঠিলেন। মা ঠাকুর দেখিয়া একটি টাকা দিয়া প্রণাম করিয়া বলিলেন, “প্রতিমা খানি বড় সুন্দর হয়েছে। চমৎকার মায়ের মুখের ভাব, ভক্তের পুজা কিনা।” বাড়ি আসিয়া নলিনী বলিতে লাগিল, “কি বাড়ি, মা! একটু বসবার জায়গা নেই। ঐ বাড়িতে কি করে পূজো করেছে গাে!” ' মা বলিলেন, “কি করবে বল? গরীব মানুষ, আহা, মাকে এনেছে। ব্রাহ্মণটি ভক্তলােক। মা কৃপা করে ওর বাড়িতে এসেছেন।”
জয়রামবাটী হইতে পত্ৰ আসিয়াছে যে মার পূজা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইয়াছে এবং অনেক লােক প্রসাদ পাইয়াছে। মা বলিলেন, “যা হােক, মার কৃপায় পূজাটি মঙ্গলমত শেষ হয়ে গেছে, মা। বড় ভাবনা হয়েছিল ওরা কি করবে। জ্ঞানটি আছে, তাই মায়ের পূজাটি ভালরকমে করেছে।”
একদিন সন্ধ্যার পর মা রাধুর কাছে বসিয়া তাহাকে সেঁক দিতেছেন।
তাহার দুই পাঁজরার নীচে খুব ব্যথা হইয়াছে। একটি স্ত্রীভক্ত মাকে প্রণাম করিয়া বসিলেন।
মাএস মা, কেমন আছ? 
ভক্ত—ভাল আছি, রাধুর কি হয়েছে, মা ? 
মা—রাধুর সেই ব্যথা ধরেছে, মা। দেখ না, ছেলে আমার সারা হয়ে গেল। পােড়া ব্যথা কোথা থেকে এল? এত দেখান হচ্ছে, কত ঠাকুরের মানসিক করেছি, কেউ শোনে না গা !
ভক্ত—ভাল হয়ে যাবে, মা। ভয় কি ? 
মা—তাই তােমরা আশীর্বাদ কর, মা।
অল্পক্ষণ কথাবার্তার পর ভক্তটি প্রসাদ লইয়া চলিয়া গেলে আমি মাকে বলিলাম, “এই কি -, মা? কি হয়ে গেছেন, চেনবার জো নেই।”
মা—চেনবার জো কি করে থাকবে, মা? পাপ ঢুকলে তার কি রক্ষা আছে ? আমাদের এখানে আসা ওর বারণ, তাই রাত্রে লুকিয়ে আসে।
আমি—আগে তাে আপনার কাছে থাকতে দেখেছি।
মা—হাঁ, আগে আমার কাছে দিনে থাকত, রাত্রে বাড়ি যেত। রাধুর কত সেবাই করেছে। কি একটু কর্মের ফেরে এমন হয়ে গেল, মা। আমার কাছে আসাই বন্ধ। ওর এ জন্মের কিছু নয়, সব পূর্বজন্মের।
আর একদিন বৈকালে মা ঘরে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের ভক্ত পূর্ণবাবুর খুব অসুখ, বাঁচিবার আশা নাই। তাঁহার মা আসিয়াছেন। তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া মা বলিলেন, “ঐ আসছে। কি রােজ রােজ এসে আমাকে বিরক্ত করে, ‘মা, আশীর্বাদ কর, পূর্ণকে ভাল করে দাও। জানি তাে পূর্ণ বাঁচবে না, তবু ওদের ভােলাবার জন্য বলতে হয়, ভাল হবে।” পূর্ণবাবুর মা মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মা, তােমার ছেলেকে ভাল করে দাও” এবং কাঁদিতে লাগিলেন।
মা—আমি কি করব, মা? ঠাকুরকে জানাও, উনি ভাল করে দেবেন। 
পূর্ণবাবুর মা—তােমরা তাে ইচ্ছা করলেই পার, মা। 
মা—আমি তাে ঠাকুরকে জানাই।
পরে মা আমাদিগকে বললেন, “ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ওর বিয়ে দিলে বেশী দিন বাঁচবে না। সে তখন শুনলে না; তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিলে, সন্ন্যাসী হয়ে যাবে বলে।”
কিছুদিন পরে একদিন সন্ধ্যারতির পর মা যােগেন-মা প্রভৃতি শুইয়া আছেন। মার একটু তন্দ্রার মতন আসিয়াছে। হঠাৎ তিনি বলিয়া উঠিলেন, “পূর্ণ মারা গেল নাকি, যােগেন?” যােগেন-মা এ প্রশ্নে আশ্চর্যান্বিতা হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমাকে কে বললে, মা ?” মা বলিলেন, “আমি ঘুমচ্ছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম, কে বললে, পূর্ণে মারা গেল।” যােগেন-মা তখন বলিলেন, “হাঁ মা, আজ বিকেলে এই সর্বনাশ হয়ে গেছে। তােমাকে শােনায় নি, মা।” সেই রাত্রিতে মা কেবল পূর্ণবাবুর কথাই বলিতে লাগিলেন ও তাহার জন্য দুঃখ করিতে লাগিলেন। 
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের অসুখের সময় মা তাঁহার সেবা করিতেছিলেন। পরে ভক্তেরা চিকিৎসার জন্য ঠাকুরকে কলিকাতায় লইয়া গিয়াছেন। সে সময় গােলাপমা একদিন কথায় কথায় যােগেন-মাকে বলেছিলেন, “দেখ যােগেন, ঠাকুর বােধ হয় মার উপর রাগ করে চলে গেছেন।” যােগেন-মার কাছে ঐ কথা শুনিয়া মা গাড়ি করিয়া কলিকাতায় গিয়া ঠাকুরের কাছে কাঁদিয়া বলেন, “তুমি নাকি আমার উপর রাগ করে চলে এসেছ ?” ঠাকুর বলিলেন, “না, কে তােমায় এ কথা বলেছে ?” মা বলিলেন, “গোলাপ বলেছে।” তখন ঠাকুর রাগিয়া গিয়া বলিলেন, “হাঁ সে এমন কথা বলে তােমায় কাঁদিয়েছে ? সে জানে না তুমি কে? গােলাপ কোথায় ? আসুক না ?” মা তখন শান্ত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে চলিয়া গেলেন। পরে গােলাপ-মা ঠাকুরের কাছে আসিলে ঠাকুর তাঁহাকে খুব ভৎর্সনা করিয়া বলিলেন, “তুমি কি কথা বলে ওকে কাঁদিয়েছ ? জান না ও কে ? এক্ষণি গিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাওগে।” গােলাপ-মা তখনই হাঁটিয়া দক্ষিণেশ্বরে মার কাছে কাঁদিতে কাঁদিতে গিয়া বলেন, “মা, ঠাকুর আমার উপর ভয়ানক রাগ করেছেন। আমি না বুঝতে পেরে অমন কথা বলে ফেলেছি।" মা কোন কথা না বলিয়া খালি হাসিয়া “ও গােলাপ, ও গােলাপ, ও গােলাপ” বলিয়া পিঠে তিনটি চাপড় দিতেই গােলাপ-মার সব দুঃখ যেন কোথায় চলিয়া গিয়া মন শান্ত হইয়া গেল। এই ঘটনাটি গােলাপ-মা নিজে আমার কাছে বলিয়াছিলেন। 
পূজনীয় বাবুরাম মহারাজ বেলুড় মঠে দুর্গাপুজা করিতেছেন। সেইজন্য তিনি মাকে লইয়া গিয়াছেন। মা মঠের উত্তরের বাগানে আছেন। জনৈক স্ত্রীভক্ত রাত্রিতে হঠাৎ মার কাছে গিয়া উপস্থিত। মা ভক্তটির আগ্রহ দেখিয়া বলিলেন, “দেখ, এই রকম টান না হলে কি তাঁকে পাওয়া যায়?”
১৯১৮ সালে গােলাপ-মার কঠিন অসুখ হয়। সেই সময় দেখি, মা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করিতেছেন, ঠাকুর, গােলাপকে সারিয়ে দাও। গােলাপ, যােগেন যদি না থাকে, তাহলে আমার আর এখানে থাকা চলবে না। ওরা গেলে আমি থাকব কি করে? তারপর বলিলেন, “যােগেন ও গােলাপ আমার জীবনের সব অবস্থাই জানে। আহা, গোলাপের কোন বিকার নেই, অভিমান বলে কিছু জানে না। আবার দেখ যোগেনটিও তেমনি। তখন যােগেন এমন ধ্যান করত যে চোখে মাছি ঢুকে বসে থাকলেও কোন হুশই থাকত না। আহা, ওদের হয়ে যারা বলবে তাদের কল্যাণ হবে।”
মার জনৈক ভক্তের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য একদিন যােগেন-মা মাকে বলিলেন, “মা, তুমি ওকে একটু সাবধান করে দাও, না হলে ও খারাপ হয়ে যাবে।” মা বলিলেন, “আমার বলা চলবে না, যোগেন। আমি যদি ওকে কিছু বলি, ও শুনতে পারবে না। আমি ওর গুরু; ও যদি আমার কথা না রাখতে পারে, তাহলে ওর অকল্যাণ হবে।” মা এই কথা বলাতে যােগেন-মা আর কিছুই বলিলেন না।
একদিন বৈকালে মা বসিয়া আছেন। একথা সে কথার পর বলিতেছেন, “দেখ, সব বলে কিনা আমি ‘রাধু রাধু’ করেই অস্থির, তার উপর আমার বড় আসক্তি! এই আসক্তিটুকু যদি না থাকত তাহলে ঠাকুরের শরীর যাবার পর এই দেহটা থাকত না। তার কাজের জন্যই না ‘রাধু, রাধু' করিয়ে এই শরীরটা রেখেছেন। যখন ওর উপর থেকে মন চলে যাবে তখন আর এ দেহ থাকবে না।"
১৯১৮ সালে কোয়ালপাড়ায় মার একবার খুব অসুখ হয়। সে সময় যােগেনমা ও পূজনীয় শরৎ মহারাজ সেখানে আছেন। রাধু মার ঐরূপ অসুখ দেখিয়াও “শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। মার ইচ্ছা ছিল না যে সে যায়। মা যােগেনমাকে বলিতেছেন, “দেখ যােগেন, রাধু আমাকে ফেলে চলে গেল।” যােগেন-মা বলিলেন, “তা কেন যাবে না, মা? তুমি যে দক্ষিণেশ্বরে হেঁটে গিয়ে ঠাকুরের কাছে উঠেছিলে, সে কথা কি মনে নেই ?” মা একটু হাসিয়া বলিলেন, “তা ঠিক, যােগেন।” মা সারিয়া উঠিয়া কলিকাতায় আসিলেন।  
‘উদ্বোধনে’ একদিন বলিতেছেন, “দেখ, রাধু, যখন আমার মায়া কাটিয়ে চলে গেল তখন মনে করলাম এবার বােধ হয় আমার শরীর থাকবে না। কিন্তু এখনও ঠাকুরের কাজ আছে দেখছি।”
যােগেন-মার মনে একবার সংশয় আসে-ঠাকুর অমন ত্যাগী ছিলেন, আর মাকে দেখছি ঘাের সংসারীর মতন-ভাই, ভাই-পাে, ভাই-ঝিদের জন্য অস্থির। কিছুই বুঝতে পারি না। একদিন গঙ্গার ঘাটে ধ্যান করিতে বসিয়া তিনি দেখিলেন, ঠাকুর সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, “দেখ, গঙ্গায় কি ভাসছে।” যােগেনমা দেখেন একটি সদ্যোজাত শিশু; নাড়িভুড়ি-জড়ান গঙ্গায় ভাসিয়া যাইতেছে। ঠাকুর বলিলেন, “গঙ্গা কি কখনও অপবিত্র হয় ? না তাকে কিছু স্পর্শ করে? ওকে তেমনি জানবে। ওর উপর সন্দেহ এনাে না, ওকে একে (নিজেকে দেখাইয়া) অভেদ জানবে।” গঙ্গা হইতে ফিরিয়া আসিয়া যােগেন-মা মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মা, আমায় ক্ষমা কর।” মা বলিলেন, “কেন যােগেন, কি হয়েছে?” তখন যােগেন-মা ঘটনাটি বলিয়া বলিলেন, “তােমার উপর অবিশ্বাস এসেছিল। তা আজ ঠাকুর আমাকে দেখিয়ে দিলেন।” মা একটু হাসিয়া বলিলেন, “তার আর কি হয়েছে ? অবিশ্বাস তাে আসবেই। সংশয় আসবে, আবার বিশ্বাস হবে। এই রকম করেই তাে বিশ্বাস হয়। এই রকম হতে হতে পাকা বিশ্বাস হয়।” 
‘উদ্বোধনে মায়ের কাছে একটি স্ত্রী-ভক্ত আসিত ; মা তাহাকে খুব ভালবাসিতেন। কিন্তু তাহার স্বভাব তত ভাল ছিল না। সেজন্য সাধুদের মধ্যে অনেকে চাহিতেন সে যেন কাছে না আসে। একথা মাকে বলাতে মা বলিলেন, “গঙ্গায় যে কত অপবিত্র জিনিস ভেসে যায়, তাতে গঙ্গা কি কখন অপবিত্র হয় ?
জনৈক ভক্ত মার নিকট প্রশ্নাদি করিয়া চলিয়া গেলেন। পরে মা নিজেই বলিতেছেন, “দেখ মা, শরণাগত হয়ে পড়ে থাকতে হয়, তবে তাে তার কৃপা হয়।”
আমি একবার মাকে জপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি, "কি ভাবে জপ করব ?” মা বলিলেন, “যেমন ভাবে করবে তেমনি ভাবেই হবে। ঠাকুরকে সর্বদা আপনার ভাববে !” পরে মা করে জপ করিবার নিয়ম দেখাইয়া দিলেন।
ঠাকুরের শরীরত্যাগের পর মা যখন বৃন্দাবনে ছিলেন, সেই সময়ের কথা বলিতে বলিতে তিনি একদিন উদ্বোধনের বাড়িতে বলিলেন, “দেখ মা, আমি রাধারমণের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, “ঠাকুর, আমার দোষদৃষ্টি ঘুচিয়ে দাও। আমি যেন কখনও কারও দোষ না দেখি।” 
মা বলিতেন, “দোষ তাে মানুষ করবেই! ও দেখতে নেই। ওতে নিজেরই ক্ষতি হয়। দোষ দেখতে দেখতে শেষে দোষই দেখে।’ একবার যােগেন-মাকে বলিয়াছিলেন, “যােগেন, দোষ কারও দেখােনা, শেষে দুষিত চোখ হয়ে যাবে।”
জয়রামবাটীতে রাত্রে মা শুইয়া আছেন। আমি প্রতিদিন যেমন তাঁহার পা টিপিয়া ও পায়ে হাত বুলাইয়া দিতাম সেইরূপ দিতেছি। মা কথাপ্রসঙ্গে কিরুপে তাহার প্রথম দীক্ষা দেওয়া আরম্ভ হয় সে বিষয়ে বলিতে লাগিলেন, “দেখ মা, ঠাকুরের শরীরত্যাগের পর বৃন্দাবনে আছি। সকলেই তার শােকে কাতর। একদিন রাত্রে ঠাকুর বলছেন, “তােমরা অত কাঁদছ কেন? আমি আর গেছি কোথা—এঘর আর ওঘর বইতাে নয় ? একদিন ঠাকুর ছেলে যােগেনকে ( স্বামী যােগানন্দকে) দীক্ষা দেবার কথা বললেন। শুনে আমার কেমন একটু ভয় হ'ল, লজ্জাও করতে লাগল। প্রথম দিন দেখে ভাবলাম, এ আবার কি ? লােকেই বা মনে করবে কি ? সকলে বলবে, মা এরই মধ্যে শিষ্য করতে লাগলেন।' ওপর ওপর তিন দিন ঠাকুর ঐ একই কথা বলেন, “আমি ওকে দীক্ষা দিইনি, তুমি দাও। কি মন্ত্র দিতে হবে তাও বলে দিলেন। আমি তখন ছেলে যােগেনের সঙ্গে কথা কই না। ঠাকুর মেয়ে যোগেনকে (যােগেন-মাকে) দিয়ে তাকে বলতে বললেন। আমি তখন মেয়ে যােগেনকে ঐ কথা বলি। সে ছেলে যােগেনকে জিজ্ঞাসা করে জানে যে ঠাকুর তাকে মন্ত্র দেননি। ঠাকুর ছেলে যােগেনকেও দেখা দিয়ে আমার কাছে মন্ত্র নিতে বলেছেন। সে ঐ কথা আমার কাছে বলতে সাহস করেনি। যখন দেখলাম দুজনকেই বলেছে, তখন তাকে মন্ত্র দিই। এই ছেলে যােগেন হ’তে আমার দীক্ষা দেওয়া আরম্ভ হয়। ছেলে যােগেন আমার খুব সেবা করেছে; তেমনটি আর কেউ করতে পারবে না। পারে কেবল শরৎ। ছেলে যােগেনের পর থেকেই শরৎ করছে। আমার ঝক্তি পােয়ান বড় শক্ত, মা। শরৎ ছাড়া আমার ভার কেউ নিতে পারবে না। গােলাপ, যােগেন, এরা না থাকলে আমার কলকাতা থাকা চলে না।” 
মা জয়রামবাটী থাকিতে রাঁচি হইতে এক ভক্ত গিয়া মাকে বলেন, “আপনাকে কিছুদিনের জন্য লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছি। বাড়িভাড়া ইত্যাদি সব ঠিক করিয়াছি।” মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “শরৎ জানে?” ভক্তটি বলিলেন, “না।” মা বলিলেন, “তবে আমার যাওয়া হতে পারে না। শরৎ এসে ফিরে গেছে। আগে কলকাতায় যাই। সে যদি বলে তখন দেখা যাবে।” ভক্তটি বলিলেন, “মা, আমরা যে সব যােগাড় করেছি।” মা বলিলেন, “তােমরা আগে জানিয়ে জোগাড় করলে কেন?” ভক্তটি চলিয়া গেলেন। মা পরে বলিতেছেন, “দেখ মা, ওরা মনে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া খুব সােজা। ওরা কেবল হজম করতেই জানে। আর একবার ঢাকাতে তারা কাগজে ছাপিয়ে দিলে আমি নাকি সেখানে যাব। অথচ আমি কিছুই জানি না! দু-চার দিন সবাই করতে পারে। আমার ভার নেওয়া কি সহজ? শরৎ ছাড়া কেউ ভার নিতে পারে এমন তাে দেখিনি। সে আমার বাসুকি, সহস্রফণা ধরে কত কাজ করেছে, যেখানে জল পড়ে সেখানেই ছাতা ধরে।”
একদিন এক স্ত্রী-ভক্ত মার নিকট তাহার বন্ধুর সহিত মনােমালিন্যের কথা বলায় মা তাঁহাকে বলিতেছেন, “দেখ মা, মানুষকে ভালবাসলে দুঃখকষ্ট পেতে হয়। ভগবানকে যে ভালবাসতে পারে সেই ধন্য হয়, তার দুঃখকষ্ট থাকে না।”
আর একদিন জনৈক স্ত্রী-ভক্ত মার কাছে ঠাকুরপূজা শিখিতে চাওয়ায় মা বলিলেন, “দেখ, তােমরা সংসারে থাক, অত পারবে না। তার নাম যেটুকু পেয়েছ ঐটুকুই কর দেখি। ঐটুকু করতে পারলে সব হবে।”
একবার মা আমাকে একখানি গরদের কাপড় দেন। একজন তাহাতে আপত্তি করিয়া বলেন, “কেবল ওকে কেন কাপড় দিচ্ছ, মা? আরও পাঁচজন তাে আছে।” মা উত্তর দিলেন, “আমি ওকে দেব না তাে দেবে কে? ওর আর আছে কে বল ?” 
রাধুর অসুখের জন্য মা বােসপাড়ায় নিবেদিতা স্কুলের ভাড়া বােডিং বাড়িতে আছেন। আমি তাহার সেবার জন্য সেখানে আছি। একদিন মা আমাকে ঠাকুরের ভােগ দিতে বলিলেন। আমি ভােগ দিবার কোন মন্ত্রাদি জানতাম না ; তাই মাকে বলিলাম, “আমি তাে মা, কি ক'রে ঠাকুরকে ভােগ দিতে হয় জানি না।” তখন মা বলিলেন, “দেখ মা, ঠাকুরকে আপনার ভেবে বলবে, এস, বস, নাও, খাও।' আর ভাববে তিনি এসেছেন, বসেছেন, খাচ্ছেন। আপনার লােকের কাছে কি মন্ত্রতন্ত্র লাগে? ওসব হচ্ছে যেমন কুটুম এলে তাদের আদরযত্ন করতে হয়, সেই রকম। আপনার লােকের কাছে ওসব লাগে না। তাকে যেমন ভাবে দেবে, তেমনি ভাবেই নেবেন।” তারপর ভােগ দিবার একটি মন্ত্র আমাকে শিখাইয়া দিলেন।
মা একবার জনৈক ভক্তকে বলিয়াছিলেন, “দেখ বাবা, বিপদ যে তােমাদের আসবে না, তা নয়, ও তাে আসবেই। তবে ও থাকবে না; দেখবে পায়ের তলা দিয়ে জলের মতন চলে যাবে।”
একটি ভক্ত মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “এত তত জপতপ করলাম, কিছুই তাে হ’ল না।” উত্তরে মা বলিলেন, “এ কি শাক মাছ যে দাম দিয়ে কিনে নিলুম?”
জয়রামবাটীতে মার আত্মীয়েরা মাকে নানা বিষয়ে জ্বালাতন করিতেন। মা একদিন বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ, তােরা আমাকে বেশী জ্বালাতন করিস নে। এর ভিতরে যিনি আছেন, যদি একবার ফোস করেন তাে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কারও সাধ্য নাই যে তােদের রক্ষা করে।”
১৯১৯ সালে মা তখন কোয়ালপাড়ায় ছিলেন। দশহরার দিন কয়েকজন ভক্ত মার পায়ে পদ্মফুল দিয়া পূজা করিয়া চলিয়া গেলেন। পরে মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কি যে ছেলেরা সব পায়ে ফুল দিয়ে গেল?” আমি বলিলাম, “আজ দশহরা, তাই।” মা একটু হাসিয়া বলিলেন, “ওমা, আমি মনসা নাকি?” পরে ঠাকুরের দিকে হাতজোড় করিয়া বলিলেন, “উনিই মনসা, গঙ্গা, সব।”
রাধু বায়ুরােগে পাগলের মতাে হইয়া কোয়ালপাড়ায় আছে। অনেক সময় মা তাহাকে খাওয়াইতেন। সে মুখে খাবার লইয়া প্রায়ই মার গায়ে ফেলিয়া দিত। একদিন মা বিরক্ত হইয়া আমাকে বলিতেছেন, “দেখ মা, এ শরীর ( নিজের শরীর দেখাইয়া) দেব-শরীর জেনাে। এতে আর কত অত্যাচার সহ্য হবে ? ভগবান না হলে কি মানুষে এত সহ্য করতে পারে ? ঠাকুর আমাকে কখনও ফুলের ঘা-টি পর্যন্ত দেননি। কখনও ‘তুমি ছাড়া ‘তুই' বলেননি। একবার আমাকে লক্ষী মনে করে ‘তুই’ বলে কি অপ্রস্তুত ! তিনি জিব কামড়ে বললেন, ‘ওমা, তুমি ? কিছু মনে করাে না, আমি লক্ষী মনে করে ‘তুই' বলে ফেলেছি। এরা আমাকে জ্বালিয়ে খেলে, মা। এবার রাধুকে কোনরকমে ঠাকুর ভাল করে দিলে আর নয়। দেখ মা, আমি থাকতে এরা কেউ আমাকে জানতে পারবে না, পরে বুঝবে সব।” 
 ‘উদ্বোধনে' মার শেষ অসুখের সময় একদিন জনৈক সাধু মাকে দেখিতে আসিয়াছেন। মা শুইয়া আছেন। সাধুটি মার পায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন। সে সময় মার মাথায় কাপড় দেওয়া ছিল না। সাধুটি চলিয়া গেলে মা আমাকে বলিতেছেন, “আমার মাথায় কাপড় দেওয়া নেই, কাপড়টা দিয়ে দাও নি কেন? আমি কি মরে গেছি ? এখনই এই করছ।”
এই সময় মার খুব অরুচি, কিছুই খাইতে পারেন না। অল্প করিয়া ভাত খান। একদিন খাইবার সময় ডাক্তার কাঞ্জিলাল সেখানে আসিয়া উপস্থিত। তিনি মার ভাতের পরিমাণ বেশী হইয়াছে মনে করিয়া মার সামনেই আমাকে বলিলেন, “তােমার দ্বারা মার সেবা হবে না। আমি কাল দুটো নার্স মার সেবার জন্যে আনব। তােমাকে করতে হবে না।” মা ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া পরে বলিলেন, “হাঁ, আমি সেই জুতােপরা মেয়েগুলোর সেবা নেব, ও মনে করছে ? তা আমি পারব না। তুমি আমার কাজকর্ম যেমন করছ করবে। কাঞ্জিলাল কেন আমার ভাতখাওয়া নিয়ে এত গােল করছে ? আমি ভাত কি খেতে পারি? তা তো সে জানে না!”
ইহার কয়েকদিন পরেই মার ভাত খাওয়া বন্ধ হইয়া গেল। একদিন মা বলিলেন, “দেখ, সেদিন কাঞ্জিলাল আমার ভাত খাওয়া নিয়ে চটে গিয়েছিল। সেই থেকে আমার ভাত খাওয়া একেবারে চলে গেল।”
ঐ সময়ে মায়ের স্বভাবটি একেবারে পাঁচ-বছরের বালিকার মত হইয়া গিয়াছিল। একদিন রাত্রি বারােটার সময় খাওয়াইতে গেলে বায়না ধরিলেন, “আমি খাব না। তাের একই কথা, মা, খাও আর বগলে কাঠি লাগাও।" মা খাইতে চাহিতেছেন না দেখিয়া বলিলাম, “তবে কি, মা, মহারাজকে ডাকব?” অনেক সময় মহারাজের নাম করিলে তিনি খাইতেন। কিন্তু এবার একেবারেই খাইতে নারাজ হইলেন। বলিলেন, “ডাক শরৎকে, আমি তাের হাতে খাব না।” মহারাজ শুনিয়াই তাড়াতাড়ি মার কাছে আসিলেন। মা মহারাজকে বসাইয়া বলিলেন, “একটু হাত বুলিয়ে দাও তাে, বাবা” এবং তাহার হাত দুখানি লইয়া বলিতেছেন, “দেখ না বাবা, এরা আমাকে কত বিরক্ত করছে। খালি খাও, খাও এদের রব, আর জানে খালি বগলে কাঠি দিতে। তুমি ওকে বলে দাও যেন বিরক্ত না করে।” মহারাজ বলিলেন, “না মা, ওরা আর আপনাকে বিরক্ত করবে না।” এই রকম সান্ত্বনা দিয়া পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এখন কি একটু খাবেন?” মা বলিলেন, “দাও।” মহারাজ আমাকে খাবার লইয়া আসিতে বলিলেন। মা এই কথা শুনিয়াই বলিলেন, “না, তুমি আমাকে খাইয়ে দাও, আমি ওর হাতে খাব না।” ফীডিং কাপে দুধ ঢালিয়া মহারাজের হাতে দিলাম, তিনি কোন রকমে একটু খাওয়াইলেন এবং বলিলেন, “মা, একটু জিরিয়ে খান।" শুনিয়াই মা বলিলেন, “দেখ তাে, কি সুন্দর কথা ‘মা একটু জিরিয়ে খান।' এ কথাটা আর ওরা বলতে জানে না ? দেখ তাে, বাছাকে এই রাতে কষ্ট দিলে। যাও বাবা, শােও গিয়ে” বলিয়া গায়ে হাত বুলইয়া দিলেন। পরে মহারাজ মশারি ফেলাইয়া দিয়া বলিলেন, “এখন আসি, মা।” মা বলিলেন, “এস বাবা, বাছার কত কষ্ট হল।”
শরীরত্যাগের কিছুদিন পূর্ব হইতে মা আর রাধুর কোন খোঁজখবর লইতেছেন না। একদিন মা তাহাকে বলিতেছেন, “দেখ, তুই জয়রামবাটী চলে যা। আর এখানে থাকিস নে।” আমাকে বলিলেন, ‘শরৎকে বল ওদের জয়রামবাটী পাঠিয়ে দিতে।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন ওদের পাঠিয়ে দিতে বলছেন? রাধুকে ছেড়ে থাকতে পারবেন কি ?” মা বলিলেন, “খুব পারব, মন তুলে নিয়েছি।” মার ঐ কথা যােগেন-মা ও শরৎ মহারাজকে বলিলাম। যােগেন-মা তখন মার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন মা, ওদের পাঠিয়ে দিতে বলছ?” উত্তরে মা বলিলেন, “যােগেন, এর পর ওদের সেখানেই থাকতে হবে যে। হ-যাচ্ছে, ঐ সঙ্গে পাঠিয়ে দাও। মন তুলে নিয়েছি, আর চাই না।” যােগেন-মা বলিলেন, “ও কথা বলাে না, মা। তুমি মন তুলে নিলে আমরা কি ক'রে থাকব ?” মা বলিলেন, “যােগেন, মায়া কাটিয়ে দিয়েছি, আর নয়।” যােগেন-মা কিছু না বলিয়া শরৎ মহারাজকে সমস্ত জানাইলেন। তিনি বলিলেন, “তবে আর মাকে রাখা গেল না। রাধুর উপর থেকে যখন মন তুলে নিয়েছেন তখন আর আশা নেই।" আমি সেখানে দাঁড়াইয়া ছিলাম। মহারাজ আমাকে বলিলেন, “দেখ, তােমরা সব মার কাছে অনেক সময় আছ, চেষ্টা করে দেখ, যদি মার মন রাধুর উপর একটু ফিরে আসে।” কিন্তু আমাদের সহস্র চেষ্টাতেও কিছুই হইল না। একদিন মা বেশ জোরের সহিত বলিলেন, “যে মন তুলে নিয়েছি তা আর নামবে না জেনাে।" 
শরীরত্যাগের দুই-তিন দিন পূর্বে মা শরৎ মহারাজকে ডাকিয়া বলিলেন, শরৎ, আমি চললুম। যােগেন, গােলাপ, এরা সব রইল, দেখাে।”

অজ্ঞাত মহিলা

জীবনে সেই আমার আনন্দের দিন গিয়াছে যখন শ্রীশ্রীমা ছিলেন। একদিন মায়ের কাছে গিয়া দেখি, তিনি একটি বাটিতে খইচুর মাখিয়া পরম আনন্দে দুইচারি বার নিজের মুখে দিলেন, তারপর ঘরে যত ভক্ত ছিলেন, তাহাদের হাতে হাতে দিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, “আহা! মা, আপনার খাওয়া হল ।” মা বলিলেন, “এই সব মেয়েরা খেলেই আমার খাওয়া হল।”
আর একদিন গিয়া দেখিলাম, মার গায়ে চাকা চাকা আমবাত বাহির হইয়াছে। মা বলিলেন, “এগুলো কি হয়েছে, মা? কিসে সারে?” আমি বলিলাম, “মা লােকে বলে, গােয়ালে কম্বল পেতে তার উপর আড়াই বার গড়াগড়ি দিলে নাকি সারে।” মা বলিলেন, “আহা, গােয়াল ও গঙ্গা বড়ই পবিত্র ; তাই বোধ হয় সারে।”
আমার একটি সাত বছরের বােনকে সঙ্গে লইয়া মাকে একদিন দর্শন করিতে যাই। কিছুদিন আগে সে নবদ্বীপে গিয়াছিল এবং তথা হইতে তুলসীর মালা পরিয়া আসিয়াছিল। মা তাহার মালা পরা দেখিয়া আনন্দিত হইলেন ও তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন, “আহা, এর এমন বেশ কবে হল?”
সেইদিন আমার দুই মাসের একটি কোলের মেয়ে বাড়িতে রাখিয়াছিলাম। আমাদের বাড়ি বসিরহাট। ভােরের ট্রেনে গিয়াছি, রাত্রির ট্রেনে ফিরিব। স্তনে দুধ আসিতেছে, আর আমি জড়সড় হইতেছি। তাহা লক্ষ্য করিয়া মা বলিলেন, ‘তুমি অমন করছ কেন?” আমি সব বলিলাম। শুনিয়া মা বলিতে লাগিলেন, “আহা, দু’মাসের মেয়ে রেখে এসেছ কেন, মা? আনলেই পারতে।” আমি বলিলাম, “মা, আপনার এস্থানে এসে অপবিত্র করে ফেলবে, তাই আনিনি।” মা বলিলেন, “তাতে কি হয়েছে?” উপস্থিত সকলকে মা বারবার বলিতে লাগিলেন, “আহা! দেখ, দু’মাসের মেয়ে বাড়ী রেখে কতদূর থেকে এসেছে। কত কষ্ট হচ্ছে!” আমি তাঁহার নিকট সিংহবাহিনীর একটু মাটি চাহিলে মা তাঁহার ভাইঝিকে উহা দিতে বলিয়া আমাকে বলিলেন, “বড় জাগ্রত দেবতা।” ফিরিবার সময় প্রণাম করিলে মা বলিলেন, “এস, আবার এসাে, মা।”

শ্ৰীমতী-

শ্রীমতী প্রিয়বালা দেবী, কাশী

১৯১৬ সালের ১২ই পৌষ আমি প্রথম শ্রীশ্রীমার পাদপদ্ম-দর্শন করি এবং তাঁহার কৃপালাভ করিয়া ধন্য হই। একটি গুরুভগিনীর সহিত যখন আমি কম্পিতকলেবরে মায়ের বাড়ীর দোতলায় উঠি, তখন যােগেন-মা আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া মার নিকট লইয়া যাইতে যাইতে বলিলেন, “মা, দেখ, দেখ, তােমার আর একটি মেয়ে এসেছে—এর চোখ মুখ কেমন দেখ!” মা তখন ঠাকুরঘরে বসিয়া ফল ছাড়াইতেছিলেন। বলিলেন, “হাঁ গাে, আমি একে জানি, এ রামদের মেয়ে।” আমি তাে অবাক, কি করিয়া মা আমাকে জানিলেন!!
মা আমাকে ডাকিয়া ঠাকুরঘরে আসনে তাঁহার পার্শ্বে বসাইলেন। আমার গুরুভগিনীটি আমাকে গঙ্গাস্নানের জন্য আহ্বান করিলে মা বলিলেন, “ওর গঙ্গাস্নান দরকার নেই” এবং আমার গায়ে গঙ্গাজল ছিটাইয়া দিলেন। তারপরই আমাকে কৃপা করিলেন। ঐ সময় আমাকে একটি কথা বলিয়া বলিলেন, “ঠাকুর আমার জন্য মন্ত্রের এই অংশটুকু রাখিয়া দিয়াছিলেন।” মার পাদপদ্মে অঞ্জলি দিবার সময় মা বলিলেন, ‘তুলসী ও বিল্বপত্র আমার হাতে দাও, ফুল পায়ে দাও।”
আমার সেই গুরুভগিনীটি একদিন কথাপ্রসঙ্গে মাকে বলিলেন, “একে নিবেদিতা স্কুলে পড়ালে ভাল হয়। তদুত্তরে মা বলিলেন, “না, ওখানে থাকার প্রয়ােজন নেই, আমার কাছে থাকলে ভাল হত।” কিন্তু আমার অদৃষ্টে সে সৌভাগ্য কখনও ঘটে নাই।
একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি কি করব? আমি তাে কিছুই জানি নে।” মা বলিলেন, “কি আর করবে ? যা করছ তাই করবে। সকালসন্ধ্যায় তার নাম করবে।”
আমাদের দেশের বিধবা মেয়েরা আহারাদি সম্বন্ধে খুব কঠোরতা করে; অন্য একটি ভক্ত মেয়ের নিকট এই কথা শুনিয়া মা আমাকে বলিলেন, “তুমি রাত্র রুটি-পরটা ইত্যাদি খেও, ঠাকুরকে নিবেদন করে খেও। দেশাচার মানতে হয়।”

শ্রীমতী সরয়ুবালা সেন

একদিন সকালবেলা শ্রীশ্রীমা ও গােলাপ-মা গঙ্গাস্নানে যাইতেছেন। গোলাপমা বলিলেন, “মা, তেল মাখ।” মা বলিলেন, “আমি তেল মাখব না।” গােলাপমা অনুরােধ করায় মা বলিলেন, “আমি মাখলে সকলেই মাখবে; তেল মেখে গঙ্গাস্নানে যেতে নেই।”
একদিন জনৈক স্ত্রীলােক অনুতপ্ত হইয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আমাদের উপায় কি হবে ?মা একটু বিরক্তি-প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “তােমাদের বছর বছর ছেলে হবে; একটুও সংযম নেই ; আমার কাছে এসে আমাদের উপায় কি?বললে কি হবে ?” 
শ্রীশ্রীমা রামেশ্বর হইতে ফিরিয়া আসিবার পর একদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, কি দেখে এলেন, বলুন।” মা বলিলেন, “অনেক লােক আমাকে দেখতে এসেছিল। সেখানকার মেয়েরা খুব লেখাপড়া জানে। আমাকে তারা লেকচার দিতে বলে। আমি বললুম, আমি লেকচার দিতে জানি না। যদি গৌরদাসী আসত তবে দিত।”
একদিন মা বলিলেন, “যে বড় হয় সে একটিই হয়, তার সঙ্গে অন্যের তুলনা হয় না। যেমন গৌরদাসী।”
আর একদিন মা রাধুর অসুখের জন্য তাহাকে মাদুলি পরাইয়া দেবতার উদ্দেশ্যে পয়সা তুলিয়া রাখিতেছেন। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, আপনি কেন এরূপ করছেন? আপনার ইচ্ছাতেই তাে সব হয়।” মা বলিলেন, “অসুখ হলে ঠাকুরদের মানত করলে বিপদ কেটে যায়। আর যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতে হয়।”
মানিকতলায় জনৈক ভক্তের বাটীতে একবার শ্রীগৌরীমাতা কঠিন বসন্তরােগে আক্রান্ত হন। ভক্তটির মাতা ও অন্যান্য সকল প্রাণপাত করিয়া তাহার সেবা করিয়াছিলেন। তাহা শুনিয়া শ্রীশ্রীমা বলিয়াছিলেন, “আ-র মা এ জন্মেই মক্ত হয়ে যাবে। গৌরদাসীর অসুখে যে সলতেটি পর্যন্ত উসকে দিয়েছে সেও মক্ত হয়ে যাবে।”

স্বামী ঋতা্নন্দ

মা তখন জয়রামবাটীতে। আজ মার বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজা, তাই মা অত্যন্ত ব্যস্ত। কেবল বলিতেছেন, “কি করে মার পূজাটি হবে ?” ঠাকুরের নিত্যপূজা আজ মা সকাল সকাল করিতেছেন। ঠাকুরকে ফল মিষ্টি প্রভৃতি অনেক নৈবেদ্য দেওয়া হইয়াছে। ভােগ দিবার সময় মা ঠাকুরকে উদ্দেশ করিয়া বলিতেছেন, “দেখ, আজ মার পূজা, শীগগির করে খেয়ে নাও, আমায় সেখানে যেতে হবে।” ধীরে ধীরে আরও কি বলিলেন। মনে হইল ঠিক যেন মানুষের সহিত কথা কহিতেছেন। তারপর পূজা শেষ করিয়া ৺জগদ্ধাত্রী-মণ্ডপে গিয়া বসিলেন এবং পূজা সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত করুণভাবে একদৃষ্টে প্রতিমার দিকে চাহিয়া রহিলেন।
কোয়ালপাড়া হইতে বাজার করিয়া ও মার ঠাকুরপুজার জন্য ফুল লইয়া জয়রামবাটী গিয়াছি। আমি যাইতেই মা বলিলেন, “এই আমি ভাবছিলাম, এখনই তুমি আসবে । তারপর আমি স্নান করতে যাব।" মা জিনিসগুলি রাখিয়া আমাকে মুড়ি খাইতে দিলেন। তারপর একখানি ছােট গামছা পরিয়া তেল মাখিতে মাখিতে আমাদের সম্বন্ধে কথা কহিতে লাগিলেন। হঠাৎ বলিতেছেন, “আমি মা, লজ্জা কি?” তারপর স্নান করিয়া পূজা করিতে গেলেন।
একদিন ভাবিলাম, মাকে জিজ্ঞাসা করিব কিরুপে সাধন-ভজন করিতে হইবে। মা বিকালে বারান্দায় বসিয়া মালাজপ করিতেছিলেন। কাছে গিয়া সে-সব কথা ভুলিয়া গেলাম ; প্রশ্ন করিবার ইচ্ছাই হইল না। কেবল বলিলাম, “মা, আপনি আমার ভার নিন” বলিয়াই কাঁদিয়া ফেলিয়াছি। মা তখন আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “কেঁদো না, তােমার ভার তাে আমি অনেকদিন নিয়েছি। ঠাকুর তােমার ভার অনেকদিন নিয়েছেন। ভাবনা কি?”
আমি একদিন স্বপ্ন দেখি যে মা আমাকে বলিতেছেন, “বহ্মচর্য লও।” পুজ্যপাদ হরি মহারাজকে উহা বলিলে তিনি বলিলেন, “এই কথা তুমি মাকে গিয়া বলিও।” কিছুদিন পরে কোয়ালপাড়ায় মাকে ঐ কথা বললাম। মা শুনিয়া এই হাসলেন এবং বলিলেন, “তবে কাল আমি যখন পূজা করব সে সময় এক খানি নতুন কাপড় নিয়ে এসাে। কেউ যেন না জানে।” পরদিন যখন মার নিকট গেল,তখন তিনি পূজা করিয়া জল খাবার খাইয়া বারান্দায় বসিয়া মুখে গুল দিতেছেন। আমাকে দেখিয়াই জিব কাটিয়া বলিতেছেন, “দেখ, পূজা হয়ে গেছে, আমি ভুলে গেছি। তা হােক, আমি মুখ ধুয়ে নিচ্ছি, তুমি ঠাকুরঘরে গিয়ে বস।” মা ঠাকুরঘরে আসিয়া বলিলেন, “দরজাটা ঠেসিয়া দাও, ওরা (মেয়েরা) আছে।” তারপর আমাকে বলিলেন, “গায়ের জামাটা খুলে ফেল।” কোশার জল লইয়া আমার শরীরে ছিটাইয়া দিলেন। তারপর আমার নাভিতে, বুকে ও মাথায় হাত দিয়া কি করিতে লাগিলেন। নুতন কাপড়খানি লইয়া আমাকে বলিলেন, “ঐ দেখ, ঠাকুর আছেন। বল, আজ তােমাকে আমার সব ভার দিলাম।” পরে কাপড়খানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “আজ তােমার প্রাণের ভিতর সন্ন্যাস দিলাম।” আমি তখন যেন দিশেহারার মতাে হইয়া গিয়াছি, মাকে প্রণাম করিতে পর্যন্ত ভুলিয়া গেলাম। আমার এই ভাবটা কয়েকদিন পর্যন্ত ছিল। 
মা রাধুকে লইয়া কোয়ালপাড়ায় আছেন। সেবার রাধুর সন্তান হইবে । সে তখন উন্মাদের মতাে। মার সর্বদাই ভাবনা, কি করিয়া রাধু, নির্বিঘ্নে ও বিপদ উত্তীর্ণ হইবে। সেইজন্য কত দেবদেবীকে মানত এবং কাতরভাবে প্রার্থনা করিতেছেন।
ঐ সময় একদিন মা বলিলেন, “দেখ, হনুমানচরিতে’ লেখা আছে নাকি ভাল-মন্দ কি হবে বলে দিতে পারে। তা রাধুর কি হবে, বলে দিতে পারে কি-না দেখ না।” আমি বইখানি আনিয়া পড়িয়া দেখিলাম, উহাতে ছক আঁকা আছে। তাহার কোন এক স্থানে হাত দিতে হয়। মা একটি জায়গায় হাত দিলেন। ফলাফল পড়িয়া শুনাইলাম। তাহাতে লেখা আছে, ভাল হইবে। এই ভাল ফল শুনিয়া মা খুব খুশী হইলেন এবং বলিলেন, “তবে রাধু, নিশ্চয় ভাল হবে। উনি (অর্থাৎ হনুমান) যখন বলিতেছেন, তখন নিশ্চয় ভাল হবে।”
এক সময় কোয়ালপাড়া মঠে কাজকর্ম লইয়া সেবকদের সহিত অধ্যক্ষের মত বিরোধ উপস্থিত হয়। মা তখন জয়রামবাটীতে আছেন। আমরা প্রায়ই কোয়াল পাড়া হইতে তাঁহার জন্য বাজার করিয়া লইয়া যাইতাম। মা কে কেমন আছে অল্প অল্প করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন। উক্ত মঠের সকল সংবাদ মা উত্তমরূপেই জানিতেন। একদিন তাঁহার ভাইঝি আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করিইে মা তাঁহাকে বলিলেন, “তাের অত খবরে দরকার কি?” তিনি চলিয়া গেলে মা বলিলেন, “দেখ, সব বনিয়ে বানিয়ে চলতে হয়। ঠাকুর তেল , ‘শ,ষ,স’- সব সয়ে যাও, তিনি আছেন।” পরে মা যখন কোয়ালপাড়ায় আসিয়া কিছুদিন থাকেন, তখন একদিন মঠাধ্যক্ষ মাকে বলিলেন, “মা, ছেলেরা সব এখানে থাকতে চায় না। আপনি ওদের বলে দিন, যাতে ওরা কোথাও গিয়ে থাকতে না পারে এবং এখানে আপনার কাজকর্ম সব করে। ওদের ইচ্ছা অন্য জায়গায় সব চলে যায়। আপনি যদি বলে দেন তা হলে ওরা আর কোথাও যাবে না।” এই কথা শুনিবামাত্র মা ক্রুদ্ধা হইয়া বলিলেন, “তুমি আমাকে দিয়ে কি বলিয়ে নিতে চাও? আমি বুঝি বলে দেব যে ওরা কোথাও থাকতে পাবে না! ওরা আমার ছেলে, ঠাকুরের কাছে এসেছে ; ওরা যেখানেই যাবে সেখানেই ঠাকুর ওদের দেখবেন। আর তুমি আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে চাও, যাতে ওরা কোথাও স্থান না পায়। একথা আমি বলতে পারব না।” মা তখন খুব জোরে জোরে কথা বলিতেছিলেন। সকলে ভয়ে অস্থির। মঠাধ্যক্ষ তখন মায়ের পায়ে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মা, ক্ষমা করুন, রক্ষা করুন।” মা তৎক্ষণাৎ একেবারে শান্ত হইলেন। 
একদিন জনৈক পর্ববঙ্গীয় ভক্ত মার নিকট দীক্ষা লইতে আসিয়াছেন। মা তখন কোয়ালপাড়ায়। মাকে ঐ কথা বলা হইলে তিনি বলিলেন, “না, তার দীক্ষা হবে না।” ভক্তটি ইহা শুনিয়া হতাশ হইয়া পড়িলেন। পরদিন তিনি কাহাকেও কিছু না বলিয়া মা যে বাড়িতে থাকিতেন সেই বাড়ির বাহিরে রৌদ্রে বসিয়া কাঁদিতেছিলেন। মা উহা জানিতে পারিয়া বলিলেন, “ও কেন এ রকম করে কাঁদছে ? ওকে চলে যেতে বল।” ভক্তটির ঐরুপ অবস্থা দেখিয়া আমি তাহাকে ঐ কথা বলিতে গিয়াও বলিতে পারিলাম না। ইতােমধ্যে দেখি মা নিজেই বাড়ির সদর দরজাটি অল্প খুলিয়া ভক্তটিকে দেখিতেছেন। আমি বাড়ির ভিতরে যাইতেই মা আমাকে বলিলেন, “বলে দাও, কাল ওর দীক্ষা হবে।” এই কথা শুনিয়া ভক্তটি আরও কাঁদিতে লাগিলেন। পরদিন তাহার দীক্ষা হইয়া গেল। 
কোয়ালপাড়া মঠে কৃষ্ণপ্রসন্ন নামক একজন শিক্ষিত ভক্ত কিছুদিন ছিল। মা একদিন আমাদের বলিলেন, “দেখ, ওদেশ থেকে অনেক সাহেব-সুবাে ভক্ত আসবে; তােমরা কৃষ্ণপ্রসন্নের কাছে ইংরাজী লেখাপড়া শিখে নাও।" মার কথামত আমরা পড়াশুনা আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরে কৃষ্ণপ্রসন্ন চলিয়া যাওয়ায় উহা বন্ধ হইয়া যায়। 
মায়ের পদচিহ্ন জনৈক স্ত্রী-ভক্তের নিকট ছিল। একদিন উহা চুরি হইয়া যায়। তাহা লইয়া মেয়েদের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়। মা তখন কোয়ালপাড়ায়। তিনি ঐ কথা শুনিয়া হাসিয়া বলিলেন, “ঐ নিয়ে তােমাদের এত কেন? আমি তাে আছি; কত নেবে নাও।” পরে কিছু, কাপড় ও তরল আলতা আনিয়া অনেকগুলি পদচিহ্ন দিলেন। ঝগড়াও মিটিয়া গেল।
একদিন মা প্রসন্ন মামার বাড়িতে কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, “দেখ, রাধু যখন জম্মায়নি তখন আমার সামনে সর্বদা ছায়ার মতাে ঘুরত। ঠাকুর দেখিয়ে দিয়েছিলেন, একে নিয়ে থাকবে। সেই রাধুকে নিয়ে আমার কত মায়া দেখ না। গৌরীদাসী কেমন তার মেয়েকে তৈরী করছে, আর আমি একটা বাঁদরী তৈরী করেছি।”
কোয়ালপাড়া মঠে আমরা তখন আতপ চাউলের ভাত খাইতাম। অর্থাভাবহেতু তরকারি তেমন জুটিত না। এইরূপ খাওয়া-দাওয়ার জন্য সকলেরই শরীর খারাপ হইয়া গেল। মা ইহা জানিয়া বলিলেন, “তােমরা মাছটাছ খাওনি কেন? না খেয়ে শরীরটি মাটি করে কি হবে? আমি বলছি, কোন দোষ নেই, মাছটাছ খেও।” তারপর মা জোর করিয়া পুনঃপুনঃ মঠাধ্যক্ষকে বলিয়া আমাদের মাছ খাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
একদিন জয়রামবাটীতে জনৈক মহারাজ কাগজ ও দোয়াতকলম লইয়া মার নিকট আসিয়া বলিলেন, “মা, দুধ বড় কম হচ্ছে, একটা গাইয়ে যা দুধ দেয় তাতে কুলিয়ে উঠছে না। তাই মনে করছি আর একটা গাই কিনব। আপনি যদি অনুমতি দেন তো একজনকে টাকার জন্য লিখি।” মা বলিলেন, “লেখ, কল পেয়েছ, লিখলেই টাকা, আর কি!” তিনি চলিয়া গেলে মা হাসিয়া বলিতেছেন, “ওর কি বাসনা দেখ! আমি বাবুরামকে একসময় একটু মিছরির পানা খেতে দিয়েছিলাম। বাবুরামের তখন পেটের অসুখ। ঠাকুর তা দেখতে পেয়েছিলেন। আমাকে একদিন বললেন, “তুমি বাবুরামকে কি খেতে দিয়েছিলে?” আমি বললুম, “মিছরির পানা। ঐ কথা শুনে ঠাকুর বললেন, ‘ওদের যে সাধু হতে হবে। ওসব কি অভ্যাস করাচ্ছ।" 
একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ভাবে আমি সাধন-ভজন করব ?" মা বলিলেন, “ঠাকুরকে ডাকলেই সব হবে।” ইহা আমার মনঃপুত না হওয়ায় আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম। মা তখন বিরক্ত হইয়া জোর গলায় বলিলেন, “আমি আর কিছু জানি নে ; ঠাকুরের কাছে যা চাইবে তাই পাবে।”
জনৈক ভক্ত যখন মার নিকট দীক্ষা লইতে যান, মা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমাদের বংশের কি মন্ত্র ?" ভক্তটি বলিলেন, “তা আমার জানা নেই।” তখন মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তােমাদের বংশের এই মন্ত্র এবং ভক্তটিকে দীক্ষা দিলেন। পরে অনুসন্ধান করিয়া জানা গিয়াছিল যে বাস্তবিক তাহাই।
কোয়ালপাড়ায় একদিন একটি পাগল আসিয়া বাড়ির বাহিরে পাগলামি করিতেছিল। মা উহার কাণ্ড দেখিয়া বলিলেন, “দেখ না, যত সব পাগলের মেলা। আমরা এসেছি কিনা, তাই যত সব পাগল আসছে। দেখ, রাধু পাগল, তার মা পাগল, এই সব নিয়ে আমার ঘর।” এই কথা বলিয়া একটু চুপ করিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন, “ঘরে আসবে চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী, আসবে কত দণ্ডী, যােগী, জটাধারী।”

স্বামী পরমেশ্বরানন্দ

জয়রামবাটী 

পৌষ মাস। আজ শ্রীশ্রীমার জন্মতিথি। তাঁহার ঘরে তক্তাপােশের উপর রাধুর ছেলেটিকে কোলে করিয়া বসিয়া আছেন। সকলেই মায়ের পাদপদ্মে পুষ্পচন্দন দিয়া পূজা করিতেছেন। আমি একটি গাঁদাফুলের গড়েমালা মাকে পরাইয়া শ্রীচরণে পুপাঞ্জলি প্রদান করিলাম এবং বলিলাম, “মা, আজ আপনার জন্মদিন। অনেকের ইচ্ছা আজ আপনাকে দর্শন ও পূজাদি করেন। কিন্তু তারা এই দুর্গম দেশে আসিবার সুযােগ পান না। আজ এই বিশেষ দিনে আমি সকলের আশীর্বাদ প্রার্থনা করছি। সকলের যাতে মঙ্গল হয় সেই আশীর্বাদ করুন, মা।” মা সুপ্রসন্নভাবে বলিলেন, “হাঁ, বাবা, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি সকলের মঙ্গল করুন।”
মার আদেশ অনুসারে আমি তাঁহার নিকটই থাকিতাম। ঠাকুরপূজা ও অন্যান্য কাজে খুব ব্যস্ত থাকিতে হইত। একদিন মঠের কয়েকজন সন্ন্যাসী তপস্যায় যাইবেন শুনিয়া আমি মাকে বলিলাম, “এই কর্মের মধ্যে থাকা যেন ভাল বােধ হচ্ছে না। আমি তপস্যা করতে যাব, আপনি অনুমতি দিন।” মা বলিলেন, “সে কি গাে, আমার কাজ করছ, ঠাকুরের কাজ করছ, একি তপস্যার চেয়ে কম হচ্ছে ? হাওয়া গুণতে কোথায় যাবে? যখন খুব যাবার ইচ্ছা হবে তখন দু-এক মাস কোথাও বেড়িয়ে আসবে।”
জয়রামবাটী ম্যালেরিয়ার দেশ। মার মধ্যে মধ্যে জ্বর হওয়ায় শরীর খুব খারাপ হইয়াছে। পুজনীয় শরৎ মহারাজের আদেশে কিছুদিনের জন্য দর্শনাদি বন্ধ আছে। এমন সময় বরিশাল হইতে জনৈক ভক্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মাকে দর্শনের জন্য তাঁহার অত্যন্ত আগ্রহ; আমিও তাঁহাকে যাইতে দিব না। সুতরাং আমাদের মধ্যে বেশ বাদানুবাদ হইতে লাগিল। গােলমাল ক্রমশঃ মার কর্ণগােচর হইল। মা একেবারে আলুথালুভাবে দরজায় আসিয়া উপস্থিত। বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কেন তুমি আসা বন্ধ করছ?” আমি বললাম, “শরৎ মহারাজ নিষেধ করেছেন। অসুস্থ শরীরে দীক্ষা দিলে আপনার শরীর আরও খারাপ হবে।” মা বলিলেন, “শরৎ কি বলবে? আমাদের ঐ জন্যেই আসা। আমি ওকে দীক্ষা দেব।” ভক্তটিকে বলিলেন, “এস, বাবা, আজ তুমি জল খাও, কাল তােমার দীক্ষা হবে।” ভদ্রলোেকটির সঙ্কল্প ছিল, দীক্ষা লইয়া তবে জল খাইবেন।
একদিন সন্ধ্যার সময় মা নতূন বাটীর বারান্দায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। আমরা সেই সময় প্রণাম করিতে গেলাম। মা নিজেই বলিতে লাগিলেন, “দেখ, ক-বলে, 'ছেলেগুলাে খাবার লােভে এ আশ্রম সে আশ্রম ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি রকম কথা দেখেছ ? আমার ছেলের, ঠাকুরের ছেলের খাবার কষ্ট কেন হবে? কখনই হবে না। আমি নিজে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছি, “হে ঠাকুর, তােমার ছেলেদের যেন খাবার কষ্ট কখন না হয়।' বলে কিনা লােভের বশে ছুটে বেড়ায়! কেন ভাল খাবে না? যার আসক্তি আছে সেই দুঃখ-কষ্ট পাবে।”
মা পূজার ঘরে বসিয়া আছেন—পূজা শেষ হইয়াছে। একজন গুরুভ্রাতা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আপনি ঠাকুরকে কিভাবে দেখেন?” মা কিছুক্ষণ নিস্তদ্ধ থাকিয়া গভীরভাবে বলিলেন, “সন্তানের মতাে দেখি।” 
একদিন মা নিজে হইতেই বলিলেন, “দেখ, তােমরা বন্দেমাতরম' করে হুজুগ করে বেড়িও না, তাঁত কর, কাপড় তৈরী কর। আমার ইচ্ছা হয়, আমি একটা চরকা পেলে সুতা কাটি। তােমরা কাজ কর।” 
কথাপ্রসঙ্গে একদিন মাকে বলিলাম, “মা, আমাদের মনের যে অবস্থা, সময়ে সময়ে মন যেরকম চঞ্চল হয়, তাতে ভয় হয়, ডুবে যাব নাকি?” মা বলিলেন, “সে কি, বাবা, ডুববে কি? ঠাকুরের সন্তান তােমরা ডুববে কি? কখনই না, ঠাকুর তােমাদের রক্ষা করবেন।” 
মা কোয়ালপাড়া জগদম্বা আশ্রমে আছেন। একদিন বলিতেছেন, “দেখ, অনেক দিনের পর আজ ঠাকুরকে এখানে দেখলাম। আহারের পর বেশ বিশ্রাম করছেন।”
একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, ব্রহ্মজ্ঞান কি করে হয়? একি প্রত্যেক বিষয়টি নিয়ে প্রথম প্রথম অভ্যাস করতে হয়, না আপনা আপনি হয়?” মা বলিলেন, “ঐ পথ বড় কঠিন, তােমরা ঠাকুরকে ডাক, তিনি সময় হলে জানিয়ে দেবেন।”

স্বামী তম্ময়ানন্দ

জয়রামবাটী 

একবার শূলবেদনায় বড় কষ্ট পাইতেছিলাম। সেই সময়ে একদিন তন্দ্রাবস্থায় অনুভব করি, কে যেন আমাকে গুরুর পাদোদক পান করিতে বলিতেছে। পরদিন জয়রামবাটী যাইয়া মার পাদোদক পান করিলাম এবং তাঁহাকে বলিলাম, “মা, আমার ইচ্ছা ছিল আপনার পা পূজা করব, কিন্তু জল খেয়ে ফেললুম।” মা বলিলেন, “তাতে কি ? চল ঐ ঘরের মধ্যে।”
চরণপূজা হইয়া গেলে আমি মায়ের পা দুখানি লইয়া মস্তকে ধারণ করিতেই মা বলিলেন, “ক্ষেপা ছেলে, পা কি মাথায় রাখতে আছে। ওখানে ঠাকুর আছেন।”
আমি—মা, আমি তাে ঠাকুরকে দেখিনি। 
মা—ঠাকুর সাক্ষাৎ ভগবান। 
আমি—ঠাকুর যদি ভগবান, তবে আপনি কে? 
মা—আমি আবার কে ?
আমি—আপনি তাে ইচ্ছা করলেই ঠাকুরকে দেখিয়ে দিতে পারেন।
মা—নরেনকে ঠাকুর ছুঁয়েছিলেন, তাতে নরেন চেঁচিয়ে উঠেছিল। সাধনভজন কর, দেখতে পাবে।
আমি—মা, আপনি যার গুরু; তার আবার সাধনভজন কি দরকার?
মা—তা বটে। তবে কি জান, ঘরে রাঁধবার সব জিনিস আছে ; রান্না করে খেতে হয়। যে যত সকাল রাঁধবে, সে তত সকাল খেতে পাবে। কেউ সকালে খায়, কেউ সন্ধ্যায়, কেউ কুড়েমি ক'রে রাঁধবার ভয়ে উপােস দেয়।
আমি—মা, এ কথাটা বুঝতে পারলাম না। 
মা—যে যত বেশী সাধনভজন করবে, সে তত শীগগির দর্শন পাবে। না করে, শেষ সময় পাবেই, নিশ্চয় পাবে। কিন্তু যে সাধনভজন না করে কেবল হইচই করে কাটাবে, তার দেরি হবে। সাধনভজন করবার জন্য সংসার ছেড়েছ। সর্বদা সাধনভজন করতে পার না বলেই ঠাকুরের কাজ ভেবে কাজ করা দরকার। তুমি বেশী কঠোরতা করাে না; তােমার শূল-বেদনা। খাওয়ার বিষয় নজর রাখবে। এ রোগ মারাত্মক নয়, কষ্টদায়ক।
যখন কোয়ালপাড়া আশ্রমে ছিলাম, তখন আমার কাজ ছিল দুবেলা রান্নাঘর পরিষ্কার করা ও পিতলের হাঁড়ি মজা। তখন বর্ষাকাল। হাঁড়ি মাজিতে মাজিতে হাতে হাজা লাগিয়া কষ্ট পাইতেছি। একদিন জয়রামবাটী যাইয়া মাকে প্রণাম করিতে মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি গাে, ভাল আছ তাে?”
আমি—বড় ভাল নয়। 
মা—কেন? আবার কি পেটে বেদনা হচ্ছে নাকি ?
আমি—না, মা, বেদনা হয় না বটে, কিন্তু হাতে হাজা ধরেছে, দুবেলা হাঁড়ি মাজতে হয়।
মা—টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেতুলতলায় বাস। কোথায় সংসার ছেড়ে এসে ভগবানের নাম করবে, না কেবল কাজ ! আশ্রম হ’ল দ্বিতীয় সংসার। লােকে সংসার ছেড়ে আশ্রমে আসে, কিন্তু এমন মােহ ধরে যায় যে আশ্রম ছেড়ে যেতে চায় না। তােমার শরীর ভাল নয়, তুমি ডহরকুণ্ডুতে যাও; যতটা পার ছেলে পড়াবে আর ধ্যানভজন করবে।
আমি—মা, আমার ইচ্ছা কোন জায়গায় গিয়ে সাধনভজন করি, কিন্তু শরীর ভাল নয়।
মা—এখন কিছুকাল সামান্য কাজ নিয়ে থাক; যখন মনে প্রবল ইচ্ছা হবে তখন যেও।
আমি—জপ তাে করি, কিন্তু মন বসে না।
মা–মন বসুক না বসুক, জপ করবে। রােজ যদি এত (সংখ্যা) করে জপ করতে পার তত ভাল হয়।
আমি—আপনি আশীর্বাদ করুন, যেন শ্রীশ্রীঠাকুরের দর্শন পাই। 
মা—তুমি তাে স্বপ্নে দেখেছ ; তা দর্শন পাবে।
আর একদিন জয়রামবাটী যাইতে যাইতে চিন্তা করিতেছি যে যদি মার একটু সেবা করিতে পারি তাে বড় আনন্দ হয়। গিয়া দেখি মা তেলের বাটিটি কাছে রাখিয়া পা দুখানি মেলিয়া বসিয়া আছেন। আমি ঐ তেল মার পায়ে মাখাইতে লাগিলাম। মা বলিলেন, “দেখ, এই পা-টায় একটু জোরে মাখাও তাে; এটাতে বড় বেদনা হয়।” আমার উহা করিতে প্রায় পঁচিশ মিনিট লাগিল। মা বলিলেন, “এবার হয়েছে তাে? এখন নাইতে যাই, ঠাকুরের পূজা করতে হবে। তুমি এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যেও।”
আমি বলিলাম, “না, মা, এখনই যেতে হবে, আর একদিন আসব।” মা বলিলেন, “না, না, আমি বলছি ; কেদার বুঝি বারণ করেছে ? আমার কথা শুনবে, না তার কথা শুনবে? তুমি কেদারকে বলাে, মা আসতে দিলেন না।”

শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বরিশাল

১৯১৪ সালের মার্চ মাসে ঠাকুরের উৎসবের দুই-তিন দিন পরে শ্রীশ্রীমার দর্শনমানসে একদিন বৈকালে বরিশালের জনৈক ভক্তের পরিচয়-পত্র সহ ‘উদ্বোধন’ কার্যালয়ে উপস্থিত হইলাম। রাসবিহারী মহারাজ পত্রখানি পড়িয়া মার নিকট গেলেন এবং ফিরিয়া আসিয়া আমাকে মার আদেশ জ্ঞাপন করিলেন, “দীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য সরলভাবে সাধনভজন করে ভগবানলাভ করতে চেষ্টা করা, কুলগুরুর বৃত্তি নষ্ট করা নয়। আমি ঐ ছেলেকে দীক্ষা দিলে সে যেভাবে আমাকে ভক্তি করবে, ঐভাবে যদি তার কুলগুরুকেও শ্রদ্ধা করে এবং তাঁর বার্ষিক বৃত্তি যথাশক্তি বাড়িয়ে দিতে রাজী থাকে, তাহলে হতে পারে।” আমি উহাতে সম্মত হওয়ায় মহারাজ আমাকে লইয়া মার নিকট গেলেন। ইহার দুই দিন পরে আমি মার কৃপালাভ করিলাম। দীক্ষার পর সপ্তাহকাল পর্যন্ত একটা অনির্বচনীয় ভাবে আমার মন বিভাের হইয়াছিল।
দীক্ষার সময় মা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “শাক্ত না বৈষ্ণব ?” আমি উত্তর দিলে তিনি যে মন্ত্র আমায় দিলেন, সাত-আট বৎসর পরে আমার জননীর নিকট প্রশ্ন করিয়া জানিয়াছিলাম যে উহাই আমাদের কৌলিক মন্ত্র-মা শুধু উহাতে বীজ সংযােগ করিয়া দিয়াছিলেন।
ইহার দুই মাস পরে আমার স্ত্রীর দীক্ষা লইবার আগ্রহ হওয়ায় তাহাকে লইয়া শ্রীশ্রীমার নিকট যাই। মা তাহাকে বলিলেন, “তােমাকে দেখে মনে হচ্ছে তােমার কোলে একটি ছেলে আছে। তাকে কার কাছে রেখে এসেছ ?” স্ত্রী বলিল, “খােকা এসে এস্থান অপবিত্র করে ফেলবে, এই ভয়ে তাকে আনিনি।” শিশুটি মাত্র তিন মাসের, ইহা জানিয়া মা আমার স্ত্রীকে বলিলেন, “সে কি গাে, এতটুকু ছেলের মলমূত্রে ঘর অপবিত্র হয়, একথা তােমাকে কে বললে? ওরা নারায়ণের মতাে। ওদের ঐরকম জ্ঞানে যত্ন করবে। তুমি এখনই বাসায় যাও। নচেৎ খোকা স্তনের অভাবে গলা শুকিয়ে মারা যেতে পারে। চারদিন পরে এসাে। ঠাকুরের ইচ্ছে হলে তােমার দীক্ষা হবে। কিন্তু খোকাকে সঙ্গে আনতে ভুলে না।” 
আমি নীচের তলায় বসিয়া ভাবিতেছি, মা যদি কিছু খাইতে খাইতে আমাকে প্রসাদ দেন তাহা হইলে বুঝিব তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। আধ ঘণ্টা পরে মাকে প্রণাম করিতে গিয়া দেখি তিনি একটি সন্দেশ খাইতেছেন। আমাকে দেখিবামাত্র বলিলেন, “বাবা, এইটুকু খেয়ে তারপর প্রণাম কর।” আমি অপ্রত্যাশিতভাবে ঐ প্রসাদ পাইয়া মাকে প্রণাম করিতেই ভুলিয়া গেলাম। কিছুক্ষণ পরে তিনিই আমাকে স্মরণ করাইয়া দিলেন, “এখনি প্রণাম করে বউমাকে নিয়ে বাসায় যাও।”
মা চারদিন পরে দেখা করতে বলায় একটু দুঃখিত ও চিন্তিত হইয়াছিলাম। কিন্তু বাসায় আসিয়া স্ত্রীর অবস্থা দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম, মা কেন অপেক্ষা করিতে বলিয়াছিলেন।
বরিশালে ফিরিবার পূর্বে মাকে প্রণাম করিতে যাই। মা বলিলেন, “সাবধানে যেও। পথে বিপদাদি থেকে ঠাকুর তােমাদের রক্ষা করবেন।” রাস্তায় ভয়ানক ঝড় উঠায় প্রাণসংশয় হইল। বাড়ি পৌঁছিয়া আমাদের সকলেরই ধারণা হইল যে মায়ের আশীর্বাদেই আমরা সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছি।
ইহার এক বৎসর পরে বৈশাখ মাসে জয়রামবাটীতে মাকে পুনরায় দর্শন করি। এইবারই তাহার সহিত খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার সুযােগ পাইয়াছিলাম। মা সামনে বসিয়া আদর করিয়া খাওয়াইতেন, আর আমি আনন্দে আত্মহারা হইয়া যাইতাম। 
মার কাছে থাকিয়া ধ্যানজপ করিলে বেশী ফল হইবে মনে করিয়া জয়রামবাটীতে একদিন খুব ধ্যানজপ চালাইলাম। ঐদিন প্রণাম করিবার সময় মা বলিলেন, “মায়ের কাছে এসেছ, এখন এত ধ্যানজপের কি দরকার? আমিই যে তােমাদের জন্যে সব করছি। এখন খাও দাও, নিশ্চিন্তমনে আনন্দ কর।”
পরদিন ইচ্ছা হইল মায়ের পায়ে ফুলচন্দন দিব। কিন্তু এ বিদেশে এ সব কোথায় পাইব? এইরূপ ভাবিতেছি এমন সময় মামাদের একটি ছোট মেয়েকে দিয়া মা ফুল-চন্দন পাঠাইয়া আমাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “ছেলে যদি অঞ্জলি দিতে চায় তাহলে এখন এসে দিতে পারে।” 
তৃতীয় দিবস মা পায়ের বেদনায় কষ্ট পাইতেছেন, একটু জ্বরও হইয়াছে। বেলা প্রায় দশটার সময় অপর একটি ভক্ত আসিয়া ঐ বিষয় না জানিয়া মাকে প্রণাম করিলে মা বলিলেন, “আমার পায়ে বড় ব্যথা হয়েছে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করো না। ঠাকুর এমনি তােমার কল্যাণ করবেন।” তথায় বিলাস মহারাজ ছিলেন। তিনি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “শাস্ত্রে নাকি অসুস্থাবস্থায় অথবা শায়িতাবস্থায় প্রণাম করতে নিষেধ আছে। ও করলে কি হয়?” অমনি মা বলিলেন, “হাঁ, বাবা, ওরকম করলে ব্যাধি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কাউকে তাহার অসুস্থাবস্থায় প্রণাম করা উচিত নয়।” 
প্রায় তিন বৎসর পরে বড়দিনের ছুটিতে মার জন্মতিথি উপলক্ষে তাঁহার শেষ দর্শনলাভ করি। উৎসবের দিন সকালে মা আমাকে ও কোয়ালপাড়া মঠের জনৈক সাধুকে বলিলেন, “তােমরা কামারপুকুরে শিবুর (শিবরাম দাদার) কাছে যাও। সে তােমাদের এক কলসী দুধ কিনে দেবে এবং কিছু ফুল যােগাড় করে দেবে। তােমরা শীগগির তাই নিয়ে ফিরে এস।” বিলাস মহারাজ বলিয়া দিলেন, “দেরিতে খেলে মার কষ্ট হয়। কাজেই তােমাদের নটার মধ্যে ফিরতে হবে। নইলে মাকে অঞ্জলি দিতে পাবে না।”
কিন্তু আমাদের ফিরতে সাড়ে-এগারটা বাজিয়া গেল। তখন অঞ্জলি দিতে পাইব না ভাবিয়া বড় দুঃখ হইল। বিলাস মহারাজ আমাদিগকে বিলম্বের জন্য ভৎর্সনা করিয়া বলিলেন, “মা তােমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।” ঠিক সেই সময়ে মা কোথা হইতে আসিয়া আমার মাথা হইতে ফুলের ডালাটি লইলেন এবং বলিলেন, “বড় সুন্দর ফুল তাে! এ দিয়ে আগে ঠাকুরপূজা করতে হয়। তােমরা শীগগির নেয়ে এস।” স্নান করিয়া আসিয়া দেখি, ঐ ফুল আমাদের অঞ্জলি দিবার জন্যই সাজান রহিয়াছে। মায়ের এই অহেতুক স্নেহদর্শনে আমরা মুগ্ধ হইয়া গেলাম।

অজ্ঞাত ব্যক্তি 

১৯০৮ সালের নভেম্বর মাসে জগদ্ধাত্রীপূজার পূর্বদিন আমি দীক্ষাপ্রার্থী হইয়া জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমার বাড়ি উপস্থিত হই। মার নিকট সংবাদ যাইলে তিনি বলিয়া পাঠাইলেন যে পরদিন কৃপা করিবেন।
যথাসময়ে আমার দীক্ষা হইয়া গেল। মার আদেশে আমরা কয়েকজন মিলিয়া কামারপুকুর দর্শন করিয়া আসিলাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই একজন স্বামীজীর সহিত সামান্য সামান্য ব্যাপার লইয়া আমার খুব বচসা হইল। বরদা মামা জয়রামবাটীতে ফিরিয়া মাকে সকল কথা বলিয়া দিলেন।
জগদ্ধাত্রী-প্রতিমার সম্মুখে আমি মনের উল্লাসে গান করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, তােমার খুব আনন্দের ভাব, তুমি ঐ রকম আনন্দ করেই থাকবে। মা জগদম্বার সামনে যেমন গান গেয়ে আনন্দ করছ ঠিক তেমনি করবে। সাধুটি ঐরকম স্বভাবের—ওর কথায় দুঃখিত হবে না। তবে তােমাকে জীবনে এই কথা কটি স্মরণ রেখে চলতে হবে। ঠাকুরের খুব দয়া, তাই তােমার ছেলেবয়স থেকে তাঁর প্রতি টান আপনি এসেছে। জানবে এই তিনটির সম্বন্ধে খুব সাবধানে চলতে হয়—প্রথম নদীর তীরে বাসস্থান ; কোন সময় নদী হুস, করে এসে বাসস্থান ভেঙে নিয়ে চলে যাবে। দ্বিতীয়, সাপ; দেখলেই খুব সাবধানে থাকতে হয়—কখন এসে কামড়ে দেবে ঠিক নেই। তৃতীয়, সাধু; তাদের কোন কথায় বা মনের ভাবে গৃহস্থের অমঙ্গল হতে পারে তা তুমি জান না। তাঁদের দেখলে ভক্তি করতে হয়। কোনও জবাব করে অবজ্ঞা দেখান উচিত নয়।” মার এই অমূল্য উপদেশ চিরদিনের জন্য হৃদয়ে গ্রথিত রহিয়াছে।

শ্রী-

স্বামী মহেশ্বরানন্দ

জয়রামবাটীতে একবার জন্মতিথির দিন সকাল হইতেই মা অসুস্থ বােধ করায় ভাবিয়াছিলেন যে স্নান করিবেন না। কিন্তু পাছে ছেলেরা ইহা শুনিয়া চিন্তিত হয়, এইজন্য অবশেষে স্নান করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন। সন্ধ্যার পর তাঁহার জ্বর হইল। আমি কাছে যাইতেই বলিলেন, “বাবা, প্রথমে মনের কথা শুনবে। প্রথম মনই গুরু। এই দেখ না, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মনে হল যে শরীরটা খারাপ, আজ আর নাইব না। আবার নানারকম ভেবে শেষে নেয়েই ফেললাম। এখন ভুগছি।”
মা বলিলেন, “ঠাকুর বলতেন, ‘খাবে গরম, শােবে নরম।”
কোয়ালপাড়া মঠে জনৈক বিশিষ্ট ভক্ত একদিন মাকে প্রণাম করিতে গিয়া কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, “আমরা পা ছুয়ে প্রণাম করলে যদি ওদের ঐরূপ কস্ট পেতে হয়, তবে তা নাই করলাম।” মা ইহা শুনিয়া বলিলেন, “না বাবা, আমরা তাে ঐ জন্যই এসেছি। আমরা যদি পাপতাপ না নেব, হজম না করব, তবে কে করবে? পাপীতাপীদের ভার আর কারা সহ্য করবে ? তবে যারা ভাল ছেলে তারা পা ছুঁলে কিছু হয় না। এক একজন আছে, তারা হলে যেন পা একেবারে জ্বলে যায়। তােমরা পা ছুঁয়ে প্রণাম করবে বইকি, বাবা।” 
জয়রামবাটীতে একদিন রাত্রে আমরা খাইতে বসিয়াছি। একটা জোনাকিপােকা প্রদীপের চারিধারে উড়িয়া বেড়াইতেছিল। জনৈক ভক্ত সেটাকে ধরিয়া বাহিরে ছাড়িয়া দিলেন। মা তাহাতে বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “ওতে অত দয়া করতে হয় না। ওটা মেরে ফেলো। এখনি প্রদীপে পড়লে খারাপ হবে।”

শ্রী ললিতামোহন  সাহা, ঢাকা

১৯৯৫ সালে একদিন ‘উদ্বোধনে’ শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাই। প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলে মা বলিলেন, “ঠাকুরের সত্যে কি আঁটই ছিল। আমাদের ওরকম হ’ল কই ? ঠাকুর বলতেন, কলিযুগে সত্যই তপস্যা। সত্যকে ধরে থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায়।”
পর বৎসর জয়রামবাটীতে এক সন্ন্যাসী ভক্তের নৈরাশ্যপূর্ণ পত্রের আলােচনাপ্রসঙ্গে মা হঠাৎ গম্ভীরভাবে তেজের সহিত বলিতে লাগিলেন, “সেকি গাে ! ঠাকুরের নাম কি চারটিখানি কথা যে অমনি যাবে ! ও নাম কিছুতেই ব্যর্থ হবে না। যারা ঠাকুরকে মনে করে এখানে এসেছে তাদের ইষ্টদর্শন হতেই হবে। যদি আর কোন সময়ে না হয় তাে অন্ততঃ মত্যুর পূর্বক্ষণে হবেই হবে।”
১৯৯৮ সালের এক রবিবারে মনের অস্থিরতার জন্য ঠাকুর ও মার উপর বড়ই অভিমান হয়। স্থির করিয়াছিলাম মার কাছে আর যাইব না। কিন্তু বন্ধুগণের নির্বন্ধে ‘উদ্বোধনে’ যাইতে হইল। গিয়া দেখি, বিস্তর ভক্ত মাকে প্রণাম করিবার জন্য দাঁড়াইয়া আছেন। তাহারা একে একে মাকে প্রণাম করিলেন, কিন্তু মা মুখ ফুটিয়া কাহারও সহিত কথা কহিলেন না। সর্বশেষে আমি প্রণাম করিতেই মা অতি স্নেহে বলিলেন, “ভাল আছ তাে?” আমি অভিমানভরে বলিয়া ফেলিলাম, “হাঁ মা, খুব ভাল আছি।” তদুত্তরে মা সহাস্যে আমার প্রতি দৃষ্টি করিয়া বলিলেন, “সেকি, বাবা! মনের স্বভাবই এই। তার জন্য কি এমনটি করতে আছে।”
আর একদিন আইন পড়িবার কালে মাকে প্রণামান্তে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ‘মা, এই তাে আমার মন ; তাতে আবার ওকালতি করতে চললাম। কি উপায় হবে ?” মা আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “ভয় কি, বাবা? ব্যবসা বই তাে নয়।”

শ্ৰীমতী সুশীলা মজুমদার, ঢাকা

উদ্বোধন 

ভবানীপুর হইতে পতিপুত্রসহ শ্রীশ্রীমার চরণদর্শনে যাই। দেখি, মা উপরের মাঝের ঘরে চৌকাঠের সামনে দাঁড়াইয়া কাহার সহিত কথা বলিতেছেন। প্রণাম করিতেই বলিলেন, “কোত্থেকে এলে, মা?" যেন কতদিনের পরিচিত। বললাম, “ঢাকায় আমাদের বাড়ি।” কথা শেষ না হইতেই গােলাপ-মা রামবাবু ও নিতাইবাবু দর্শন করিতে আসিয়াছেন বলিয়া মাকে ডাকিলেন। কপিল মহারাজ আমাকে বলিয়া গেলেন, “আপনি একটু সরে থাকুন, বলরামবাবুর ছেলে ও ভাইপাে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে মায়ের কথাবার্তা হলে আপনি যা বলতে হয় বলবেন।” নিতাইবাবু মার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার সহিত কথা বলিয়াই মা দুটি রসগােল্লা আমার হাতে দিয়া পাশেই ঠাকুরঘরে রামবাবুর সহিত দেখা করিতে গেলেন। আমি রসগােল্লা দুটি হাতে করিয়াই বসিয়া রহিলাম। রামবাবুর সহিত কথাবার্তা শেষ হইলে মা আমাকে ঠাকুরঘরে ডাকিলেন ও বলিলেন, ‘খাওনি কেন? প্রসাদ, খেয়ে ফেল।” জনৈক স্ত্রীভক্ত আসিয়া বলিলেন, “সব মিস্টিগুলি সকলকে খাইয়ে দিলে, মা, আমরা খাব কি?” আমি তাে সংকুচিত, কারণ তখনও আমার হাতে রসগােল্লা দুটি রহিয়াছে। বলিলাম, “আপনি এই দুটি খান। তিনি বলিলেন, “না, মা, তােমাকে কিছু বলিনি, তােমারটি নেব কেন?” মা তাঁহাকে বলিলেন, “ও—এসব বলাে না, ভক্তদের মনে কষ্ট হবে। বহু লােক, দুটি করেও কুলােয়নি। আহা, ওরা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এসেছে গাে।” মা আমাকে বার বার খাইতে বলায় খাইয়া ফেলিলাম। মা নিজেই জল আনিয়া দিলেন, পরে বলিলেন, “রসগােল্লার রস মেঝে পড়েছে, ভিজে ন্যাড়া দিয়ে মুছে ফেল, হাত ধােও।” এ সকল করা হইলে মা তক্তপােশে বসিলেন ও আমার পরিচয়াদি জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি যখন বলিলাম, “আমার একটি ছেলে," সেই সময় নী—প্রণাম করিতে আসিল। বলিলাম, “মা, এই ছেলে।” নী-প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলে মা বলিলেন, “ছেলের বে দাওনি?”
আমি–বে হয়নি। 
মা–এক ছেলে, বে দাওনি ? 
আমি–বে করতে চায় না।
মা—আহা, ছেলেদের আজকাল ঐ এক কথা! কেন, বে করলে কি সৎ হতে পারে না? মন দিয়েই সব হয়। ঠাকুর কি আমাকে বে করেননি? ছেলে দীক্ষা নিয়েছে ?
আমি—হাঁ, আপনারই তাে ছেলে।
মা–হাঁ! তবে বে করবে না কেন? আচ্ছা, আমি বলে দেব। দুঃখকষ্ট যেতে চায় না। দুঃখকষ্ট পেয়েও যে ঠাকুরকে ধরে থাকবে, সে অবশ্যই ঠাকুরকে লাভ করবে। তােমার কি ইচ্ছা তাই বল তাে? 
আমি—মা, কিসে তার মঙ্গল হবে তা তো আমি বুঝতে পারি না ; আপনি ওর মঙ্গলামঙ্গল জানেন, সুতরাং আপনি যা বলবেন তাই হবে। আমার অন্য মত নেই।
মা–দেখ, যাদের খুব উচু ঘর তারাই সাধু হয়ে সর্ববন্ধনমুক্ত হয়ে যায় । কেউ বা সংসারের আস্বাদ ভােগবার জন্য জন্ম নেয়। আমি বলি, একেবারে ভােগ কেটে যাওয়াই ভাল। ঠাকুরের সাঙ্গোপাঙ্গদের কথা আলাদা।
আমি—মা, ও তাে আপনারই ছেলে, আপনার হাতেই ওর মঙ্গলমঙ্গলের ভার। আপনি যা করতে হয় করবেন।
মা—আমি বলি কি, ও বে করুক ; ওর সব ভােগ একেবারে কেটে যাক। তা না হলে আবার কখন কি ভােগ এসে জোটে তা বলা যায় না। তবে জেনে রেখাে, ঠাকুর যখন ধরেছেন, ওর পতন কিছুতেই হবে না। তুমি নিশ্চিন্তমনে বসে থাক। ঠাকুরের দেওয়া সিদ্ধমন্ত্র ওকে দিয়েছি, ওর কি কখন অমঙ্গল হতে পারে ? 
তারপর বলিলেন, “এখানে প্রসাদ পাবে তাে?” আমি “হাঁ” বলায় মা ভাঁড়ারীকে বলিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিলেন।
মা–কার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছ ? ঠাকুরের নাম কার কাছে শুনেছ ?
আমি–দেওভােগে নাগ মহাশয়ের কাছে আমরা যাই এবং সেখানেই তাঁর কাছে ঠাকুরের মাহাত্ম্য শুনি। তার ভাব দেখে মনে সকল সময়ই ঠাকুরকে ও আপনাকে দেখবার জন্য বড়ই আকাক্ষা হ’ত। ঠাকুরের চরণদর্শনের সৌভাগ্য হয় নি; আপনার কৃপায় আপনার চরণদর্শন হ’ল এবং ঠাকুরকে দেখার আকাক্ষা আমার তৃপ্ত হয়ে গেল। দীক্ষা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে হয়নি। 
মা–স্বপ্নে পেয়েছ তাে?
আমি–হাঁ, মা, স্বপ্নে আপনাকে দর্শন করেছি ও দীক্ষা পেয়েছি। 
মা–আচ্ছা, মন্ত্র কি, মনে আছে তাে? আমাকে বলে ফেল।
আমি বীজটি বলিতেই মা বলিলেন, “হাঁ, এই তোমার ঘর; বেশ বেশ, তুমি ভাগ্যবতী।”
আমি–মা, আর কিছু বলবেন না?
মা–না, ঐ বীজই জপ করবে, ওতেই তোমার কল্যাণ নিশ্চয় জেনে রেখাে। কার সঙ্গে এলে ?
আমি–আমার স্বামীর সঙ্গে। 
মা–তিনি কোথায় থাকেন? কি কাজ করেন ? 
আমি—তিনি রা—বাবুদের এস্টেটে ম্যানেজার।
মা–ওমা, তুমি ম্যানেজার বাবুর স্ত্রী ? এতক্ষণ বলনি কেন? ও রাধু ও মাকু, ম্যানেজার বাবুর স্ত্রীকে এসে প্রণাম কর।
আমি মায়ের কাণ্ড দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া বলিলাম, “মা, এ বলেন কি ? আমি যে কায়স্থসন্তান, এরা ব্রাহ্মণের সন্তান হয়ে কি করে আমাকে প্রণাম করবে?” মা বলিলেন, “ওসব বলতে নেই। তুমি ভক্ত মানুষ, ভক্তের জাত নেই; তােমাকে প্রণাম করলে ওদের কল্যাণ হবে।” রাধু ও মাকু আসিলে আমি তাহাদের পা জড়াইয়া ধরিতেই মা বলিলেন, “থাক, থাক, দেবে না। ওরা ভক্ত কিনা, তাই সর্বভুতে ঠাকুরকে দেখছে। আচ্ছা, দেওভােগে দুর্গার কাছে কি শুনেছ? তার কাছে তােমার যাওয়া-আসা ও পরিচয় কি করে হ’ল ?" 
আমি–আমার স্বামী সাধুদর্শনে সেখানে একবার গিয়েছিলেন; তাতেই নাগ মহাশয় তাঁকে আপনার করে নিয়ে ঠাকুরের কথা পুনঃপনঃ বলেন ও আমাকে দেখতে দয়া করে আমাদের বাড়িতে যান। তাঁর ভাব ও ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে আমরা বহুদিন তার কাছেই যাতায়াত করি। তিনিও দয়া করে আমাদের আপনার করে নেন এবং আপনার ও ঠাকুরের মাহাত্ম্য আমাদের কাছে বলেন। তাতেই প্রাণের ভিতর আপনাদের উপর আমরা আকর্ষণ অনুভব করি। তিনি কেবলই বলতেন, ‘আমি কিছু না, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবই আমার সব। যদি মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা কর, মনে প্রাণে শরণাপন্ন হও; এ ছাড়া অন্য গতি নেই। অদৃষ্টে ছিল, ঠাকুরের ঐ শ্রীচরণদর্শন করেছিলুম, তাই ধন্য হয়ে গেছি। শিবাবতার স্বামীজীকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছি, সাক্ষাৎ মা ভগবতীকে দর্শন করেছি ও মায়ের কৃপা পেয়েছি। আর কি বলব, তােমরা সকলে কায়মনপ্রাণে মা ও ঠাকুরের শ্রীপাদপদে শরণ নাও, কল্যাণ হবে।’
মা–আহা, তার কথা আর কি বলবাে? আমাকে সাক্ষাৎ ভগবতী ভাবে দেখত। প্রথম যে দিন আমাকে দর্শন করতে এল, আমার ছিল একাদশী। তখন কোন পুরুষ ভক্ত আমাকে সাক্ষাৎ দর্শন করতে পেত না, সিঁড়িতে মাথা ঠুকে প্রণাম করত। একজন ঝি এসে নাম বলে আমাকে বলত, “মা, তােমাকে অমুক বাব, প্রণাম কচ্ছেন। আমিও আশীর্বাদ জানাতুম। সে দিন ঝি বললে, “মা, নাগ মহাশয় কে? তিনি প্রণাম কচ্ছেন, কিন্তু মাথা এত জোরে ঠুকছেন, মনে হয় রক্ত বেরুবে। মহারাজ পেছন থেকে কত বলছেন থামবার জন্য, কিন্তু কোন বাক্যই নেই—যেন হুশ নেই। পাগল নাকি, মা?' আমি বললাম, ওগাে, যােগেনকে বল এখানে পাঠিয়ে দিতে। যােগেন নিজেই ধরে নিয়ে এল। দেখি কপাল ফুলে গেছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, হেথায় পা ফেলতে হােথায় পড়ে, চোখের জলে আমায় দেখতে পাচ্ছে না। আমি ধরে বসালম। কেবল মা, মা শব্দ—যেন পাগল, অথচ শান্ত ধীর স্থির। চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। আমার খাবার ছিল, লুচি, মিষ্টি, ফল। আমি খেতে বসেছিলাম, এমন সময়ে এই ঘটনা। আমি কিছু খেয়ে তাকে খাইয়ে দিতে লাগলাম। খেতে পারে না গাে, খাবার জিনিস গিলতে পারলে না। বাইরের দিকে মন নেই, কেবল মা, মা রব ; আর আমার পায়ে হাত দিয়ে বসে রইল। আমাকে মেয়েরা বলতে লাগল, ‘মা, তােমার তাে খাওয়া হল না। মহারাজকে বলি একে সরিয়ে নিতে। আমি বললাম, “থাক, একটু স্থির হয়ে নিক। খানিক বাদে গায়ে মাথায় হাত বুলুতে বুলুতে ও ঠাকুরের নাম করতে করতে তার হুশ এল। আমিও খেতে লাগলুম, ওকেও খাইয়ে দিতে লাগলুম। খাওয়া হলে তাকে নীচে নিয়ে গেল। আমাকে কেবল যাবার সময় বলে গেল, ‘নাহং, নাহং, তুহুঁ তুহুঁ। যারা কাছে ছিল তাদের আমি বললুম, “দেখ কি বুদ্ধি! আমার জন্যে সব করতে পারত গাে।
“একবার একখানা ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে মাথায় করে বাড়ির গাছের ভাল ভাল আম এক টুকরি নিয়ে এল। মনের ভাব, বসে আমাকে খাওয়াবে। কিন্তু মুখে কিছুই বলা নেই। টুকরি মাথায় নিয়ে এখানে ওখানে কাঙালের মতাে ঘুরছে। যােগেন বলে পাঠালে, মাকে বল, নাগমহাশয় আম নিয়ে এসেছেন। কিছু বলেনও না, কারও কাছে দেনও না। আমি বললুম, “এখানে পাঠিয়ে দাও।' পাঠিয়ে দিলে টুকরি মাথায় করেই এল। একজন ব্রহ্মচারী মাথা থেকে টুকরি নাবিয়ে নিলে। তখনও ঠাকুরপূজা হয়নি। আমাকে প্রণাম করেই পূর্ববারেরই মতাে বেহুশ। মুখে ঠাকুরের নাম ও ‘মা, মা’ রব। দু চোখ ব’য়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। খুব ভাল আম-কতকগুলিতে চুনের ফোঁটা দেওয়া ; কেটে ঠাকুরকে ভােগ দেওয়া হ'ল। মেয়ে যােগেন এসে আমাকে একখানা শালপাতায় করে প্রসাদ দিলে। আমি কিছু খেলুম ও গােলাপকে বললুম, আর একখানা শালপাতা দাও।” পাতা দেওয়া হলে পাত থেকে প্রসাদ উঠিয়ে দিয়ে বললুম, ‘খাও'। কে খাবে, তার শরীরে হুশ নেই, হাত যেন অবশ! আমি ধরে অনেক বলতে বলতে খেলে তাে না-ই, একখানা আম নিয়ে মাথায় ঘষতে লাগল। আমি নীচে ব'লে পাঠাতেই তারা লােক পাঠিয়ে নিয়ে গেল। প্রণাম করতে করতে কপাল ফুলিয়ে দিলে, অন্নপ্ৰসাদ আর নিলে না। কিছু বাদে হুশ হতেই নাকি চলে গেছে, খবর পেলুম।”
একটু পরেই পাতা হইল। মা বলিলেন, “এস, প্রসাদ পাবে।” মার পিছু পিছু, খাবার ঘরে গেলে মা বলিলেন, “এস, আমার মুখাে হয়ে অপর পংক্তিতে বস।” মা মাখন দিয়া ভাত মাখিয়া তিন গ্রাস মুখে দিয়াই আমাকে বললেন, “প্রসাদ নেবে, হাত পেতে নাও।” উনি হাত বাড়াইতেই বা বলিলেন, “ও রকম করে কি প্রসাদ নেয়? দুহাত পেতে নাও।” আমি দুই হাত পাতিলে মা সমস্ত মাখন-মাখান ভাত আমার হাতে চাপিয়া দিয়া বলিলেন, ‘মাথায় ছুইয়ে খেয়ে ফেল।” আমি তাে অবাক। বলিলাম, “মা, আমি কায়স্থ ; আমাকে তাে খেতে খেতে ছুঁয়ে দিলেন। এখন আপনার কি করে খাওয়া হবে?" মা বলিলেন “তােমাদের সঙ্গে আবার আমার জাতের বিচার কি ? তোমরা যে আমারই সন্তান। প্রসাদ খেয়ে ফেল।” তখন আমি লজ্জিতভাবে প্রসাদ খাইতে লাগিলাম। মা খুব প্রসন্নভাবে খাইতে ও কথা বলিতে লাগিলেন এবং মাঝে মাঝে আমার কি চাই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।
মা—হাঁ গা, তােমাদের দেশে তীর্থ নেই ?
আমি—না, মা, তীর্থ কই, দেখি না তাে। তবে একটি স্নান আছে, তাকে ব্রহ্মপুত্ৰ স্নান বলে।
মা—হাঁ ও কথা শুনেছি বটে। আচ্ছা, এবার আমাকে নিয়ে যেও, তােমাদের দেশও দেখে আসব, তীর্থও করা হবে।
আমি–মা, পূর্ববঙ্গের কি সে সৌভাগ্য হবে ?
মা–কেন হবে না? সেখানে ঠাকুরের অনেক ভক্ত আছে। নরেন গেছে, শরৎ গেছে, আরও ওরা অনেকে গেছে। যেখানে ঠাকুরকে চায়, সেখানে আমি যাব না কেন?
ছােলার ডাল, চচ্চড়ি, ডালনা ও টক—ইহাই ছিল প্রসাদ। মা বলিলেন, “এদের মাছ এনে দাও।”
আমি–মা, প্রসাদ খেয়েই তৃপ্ত হয়েছি, মাছ আর খাব না।
মা—সেকি গাে, এয়ােস্ত্রী মানুষ, মাছ খাবে না! পায়ে আলতা পরনি কেন ? 
আমি—আমাদের দেশে আলতাপরার চল নেই। শাঁখা, সিঁদুর পরলেই লােকে এয়ােস্ত্রী বলে।
মা–তা হবে ; এদেশে শাঁখা, সিঁদুর সখ করে পরে, নােয়া আর আলতাই এয়ােস্ত্রীর লক্ষণ।
দুধ, একটি আম ও একটি সন্দেশ মাকে দেওয়া হইয়াছিল। উহা একত্র মাখিয়া একটু খাইয়া বলিলেন, “ছেলের (নী-র) জন্যে রইল।” এবার আচমনের পালা। আমি পাতা তুলিতেই লক্ষী দিদি তাড়াতাড়ি আমার পাতা ধরিয়া বসিলেন। আমি দিব না, তিনিও ছাড়িবেন না। মা দাঁড়াইয়া বলিলেন, “দাও, লক্ষীই নিক। তুমি সকলের বড় বয়সে ; ওরা থাকতে তুমি কেন নেবে?” তখন বাধ্য হইয়া ছাড়িয়া দিতে হইল। মার সঙ্গে কলতলায় যাইতেই তিনি ঘটিতে করিয়া বালতি হইতে জল উঠাইয়া দিয়া বলিলেন, “আঁচিয়ে নাও।” আমি তাে অপ্রস্তুত! বলিলাম, “মা, আমি পারব না।” মা বলিলেন, “কেন পারবে না। আমার কথা মেনে চললেই তােমাদের কল্যাণ। নাও, শীগগির ক'রে আঁচিয়ে ফেল, ওরা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটিটা মাথায় ঠেকিয়ে নাও না। অগত্যা মায়ের আদেশই বলবৎ রহিল। আমি সরিয়া যাইতেছি দেখিয়া মা বলিলেন “ওকি, পা ধুলে না?” বলিলাম, “পরে ধোব।” মা বলিলেন, “না না, এস, জল দিচ্ছি। এবার আমি মায়ের পিছনে যাইয়া বলিলাম, “মা, আমি ওসব পারব না।” মা বলিলেন, “কেন কি হয়েছে ? খানিকটা জল মাথায় দিয়ে নাও। আমার কথা মানলে তােমাদের মঙ্গল হবে।” অগত্যা সেই রুপ করিয়া মায়ের আদেশে তাঁহার পিছনে পিছনে তাঁহার ঘরে চলিলাম।
ঘরে ঢুকিতেই মা স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া একটু পরেই বলিয়া উঠিলেন, “ওকি করলে? ছেলে এসে কি খাবে?” দেখি নী-র জন্য যে প্রসাদ মা রাখিয়াছিলেন, জনৈক স্ত্রীভক্ত আনন্দে তাহাই খাইতেছেন, এবং বলিতেছেন, “সবই ওর ছেলেরা খাবে, আর আমরা শুকিয়ে মরব!” দেখিয়া আমার যা হাসি। শেষে লক্ষীদিদি ও অন্যান্য মেয়েরাও হাসিতে লাগিলেন। আমার তাে হাসি আর থামে না। মা কিন্তু বিশেষ চিন্তিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন, পাচক হেঁশেল তুলিয়াছে কি-না এবং না তুলিয়া থাকিলে কি আছে। ভাত, ডাল ও চচ্চড়ি আছে শুনিয়া মা বলিলেন, “আচ্ছা, খানিকটা এখানে দিতে বল।" ব্রাহ্মণ একখানি থালায় করিয়া উহা দিয়া গেল মা সব একসঙ্গে মাখিয়া একটু মুখে দিয়া ঢাকিয়া রাখিলেন এবং বলিলেন, “ছেলের জন্য রইল।” আমি পিছনে দাঁড়াইয়া ভাবিতেছি, তিনি দুইবার ভাত খাইলেন কিরূপে? আরও ভাবিতেছি, কি করিয়া মায়ের একটু সেবা করিব। তাঁহার জল লইয়া আঁচান ও পা ধােয়া হইল, অথচ তাঁহার সেবা কিছুই করিতে পারিলাম না। মার পিছনে চলিয়াছি। মা ঠাকুরঘরে গিয়া আমাকে বলিলেন, “কপাটের উপর আমার গামছাখানা আছে, নিয়ে এস। আমার পাটা মুছে দাও।” এই কথা শুনিয়া আমি আনন্দে আত্মহারা হইলাম। আমি ঐরূপ করিতেই মা বলিলেন, “আচ্ছা, তক্তাপােশে বসি, তুমি ভাল করে আমার পায়ের তলাখানা মুছে দাও।” আমি মায়ের পা দুখানি মুছিতে মুছিতে মাথায় ঠেকাইতে লাগিলাম। মা একটু হাসিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, এখন থাক।”
লক্ষী দিদি পান লইয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ধন্য মেয়ে তুমি, মা যেচে কৃপা দিলেন; ধর একটি পান খাও।” আমি চোখের জলে পান দেখিতে পাইলাম না। মা পানটি আনিয়া আমাকে দিয়া বলিলেন, “ঐ মাদুরথানা মেজেয় পাত, ঐ শতরঞ্জিখানা বিছিয়ে দাও, বালিস তিনটি দাও।” বিছানা হইলে মা শুইয়া পড়িলেন। আমি বসিয়া মায়ের পায়ে হাত বুলাইতেই মা বলিলেন, “এখন আমার পাশে শুয়ে পড়।” আমি সঙ্কুচিত হইতেছি দেখিয়া মা বলিলেন, “আমার বালিশেই মাথা রেখে শােও।” আমি বলিলাম, “না, মা, ঘুমিয়ে পড়লে আপনার গায়ে পা লাগতে পারে, আমি শোব না।” মা বললেন, “সেকি গাে? আমি বলছি, তুমি শুয়ে পড়।” কি করি মায়ের আদেশই পালন করিতে হইল। মা বলিলেন, “তােমাকে দেখে বড়ই আনন্দ হল, যেমন অনেকদিন পরে শ্বশুরঘর থেকে মেয়ে এলে মায়ের আনন্দ হয়। আচ্ছা, কবে যাবে?” আমি বলিলাম, “আজকে সন্ধ্যায়ই যাব, মা, মনে রাখবেন; জানবেন আমি আপনার ভিখারিণী মেয়ে" বলিয়াই কাঁদিতে লাগিলাম। মা বলিলেন, “ষাট, ষাট, ও কথা কেন বল, মা? তুমি আমার রাজরানী মেয়ে। তােমাকে আমি নিজে গিয়ে দীক্ষা দিয়েছি। তােমার দুঃখ করবার কিছু নেই। তােমার ভালমন্দ সবই আমি দেখব, তুমি কোন চিন্তা করাে না।” 
 বেলা চারটার সময় রাধু, স্কুল হইতে আসিল। তাহার খাওয়া-দাওয়া হইলে মা তাহাকে বলিলেন, “এস, চুল বেধে দিচ্ছি।” রাধু বলিল, “না, আমি নিজেই বাঁধব।” মা চিরুনি লইয়া চুলে হাত দিতেই রাধু চিরুনি দ্বারা মাকে মারিতে লাগিল। মা বলিলেন, “পাগল মেয়ে, একে কি করি বল !” যােগেন-মা আসিয়া মাকে প্রণাম করিলেন। রাধু মাকে মারিতেছে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “সেকি কথা। আমাদের মাকে রাধু কেন মারবে? আমি ওকে মেরে ফেলব।” তব রাধু ছাড়িতেছে না। তখন মা বলিলেন, “এখন শরৎকে ডাকি, আর তাে ব্যথা সইতে পারি না।” যােগেন-মা ডাকিয়া বলায় পূজনীয় শরৎ মহারাজ নীচের ঘর হইতে বাহির হইয়া বলিতে লাগিলেন, “এই রাধু মাকে মের না।” তার স্বর শুনিয়াই রাধু তাড়াতাড়ি সরিয়া বসিল। কুসুম দিদি বলিলেন, “এস, আমি বেঁধে দিচ্ছি।” রাধুও শান্ত মেয়েটির মতাে তাঁহার কাছে ঘেসিয়া বসিল। এমন সময়ে রাধুর মা আসিয়া বলিলেন, “দেখ গো, তােমার একটি ছেলে যেন কি নিয়ে এয়েছে। যদি কাপড় এনে থাকে, আমার মশারির চাঁদোয়া করব।" সত্যই নী —ফল, মিষ্টি ও কাপড় লইয়া আসিয়াছে। সে মাকে প্রণাম করিতেই মা বলিলেন, “আহা! বেশ কাপড়, বেশ মিষ্টি ফল। ও গােলাপ, এসব নিয়ে তুলে রাখ। ঠাকুর উঠলে ভােগ হবে। আহা! ছেলের মুখখানা শুকিয়ে গেছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে প্রসাদ খেয়ে এস। বাবা, বেচে থাক, ভক্তি হােক। কিন্তু তােমাকে বে করতে হবে।” নী—প্রণাম করিয়া নীচে গেল। গােলাপমাও প্রসাদের থালা লইয়া নীচে গেলেন। রাধুর মা আসিয়া বায়না ধরিলেন, “দাও না গাে কাপড় দুখানা, আমি মশারির চাঁদোয়া করব।” মা বলিলেন, “তা কি হয় ? ছেলে মনে দুঃখ পাবে।” পরে কুসুম দিদিকে বলিলেন, “একখানা। কাপড় দাও তাে, পরব।” যােগেনমা বলিলেন, “ভাগ্য দেখ এদের। এরা কারা গাে ? একদিন এসেই এত দয়া পেয়ে গেল। ধন্য মেয়ে তুমি, তােমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে যাচ্ছে। আমি তাে জড়সড-ইনি আবার কি বলেন। মা বলিলেন, “এরা পূর্ববঙ্গের লােক, এদের ভারি বিশ্বাস। এদের দেখলেও কল্যাণ হয়।” আমি গামছা দিয়া মায়ের পা দু'খানি আবার মুছাইয়া দিলাম। মা কাপড়খানি পরিয়া আসনে বসিয়া ঠাকুরকে বলিতে লাগিলেন, “ঠাকুর এদের মঙ্গল কর। এরা তােমাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে। এই সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আমার কাছে এসেছে।” পরে মা আমাকে লইয়া বসিলেন এবং বলিলেন, “কোন কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে কি?” 
আমি—মা, ছােট ছােট বিধবা মেয়েরা মাছ খেলে এ দেখে আশ্চর্য হলাম। আমাদের দেশে তাে এ রকম মাছ খেতে দেয় না, সমাজে বাধে।
মা—ও সব কি জান? দেশাচার ও লােকাচার। আমাদের দেশে ছােট বিধবাদের মাছ খেতে ও গহনা, কাপড় পরতে দেয়। ওদের আকাঙ্ক্ষা থাকে কিনা! না হলে চুরি করে খাবে। যখন বুঝতে পারবে এটা সমাজবিরুদ্ধ, তখন ছেড়ে দেবে। 
আমি—মা, ভােগের আকাক্ষা কি যায় ?
মা—না, মা; তা সত্য বলেছ। তবু বড় হলে দশজনকে দেখে লজ্জা হয়, ঝগড়া-বিবাদের সময়েও অপরের খোঁটা সইতে হয় । তাই আপনি সামলে চলে।
আমি–আচ্ছ, মা, আপনি বামুনের মেয়ে হয়ে দু’বার ভাত খেলেন—মুখ এঁটো করলেন ?
মা—সেকি গাে, কখন দু'বার খেলুম ? 
আমি—এই যে খােকাকে প্রসাদ করে দেবার সময় ?
মা—ছেলেদের কল্যাণের জন্য আমি সব করতে পারি। ওতে কোন দোষ হয় না। আর প্রসাদ হ'লে পাঁচবারও খেতে দোষ নেই। প্রসাদ কোন বস্তুর মধ্যে নয়। ঐ সব খুটিনাটি নিয়ে মনকে বিচলিত করবে না : ওতে ঠাকুরকে ভুল হয়ে যায়। যে যা বলে বলুক, ঠাকুরকে স্মরণ করে যেটা হিতকর বুঝবে, তাই করবে। ঠাকুর বলতেন, “লােককে দেখবে পােকের মতাে।” তাই বলে সকলকে নয়, নিন্দুক লােকের ও হীন সংস্কার যাদের, তাদের কথাই বলেছেন।
আমার বাড়ি যাইবার সময় হইল। গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। মা সজলনয়নে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিলেন, “আবার এসাে।” আমার যাইতে ইচ্ছা করিতেছিল না। মায়ের পা দুখানি জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলাম। মা বলিলেন, “কেঁদো না, মা, আমি তাে তােমাদেরই আছি। আবার এসাে।” মাকে আমার এই প্রথম ও শেষ দর্শন। মায়ের আশীর্বাদ ও স্নেহমাখা সান্ত্বনা-বাকাই আমার জীবনের সম্বল হইয়া আছে।

স্বামী শান্তানন্দ

কাশীতে ‘বেণীমাধবের ধ্বজা’ দেখিয়া মা বলিয়াছিলেন, “আমাকে এখন এমন অসমর্থ দেখছ, কিন্তু ঠাকুরের শরীরত্যাগের পর আমি যখন কাশী এসেছিলাম, তখন এই বেণীমাধবের ধ্বজার উপর উঠেছিলাম। হরিদ্বারে চণ্ডীর পাহাড়, আর পুস্করে সাবিত্রী পাহাড়েও উঠেছিলুম।”
জনৈক সাধু কাশীতে মণিকণিকায় খুব তপস্যা করিতেছিলেন। আমি কলিকাতা আসিবার সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “মাকে জিজ্ঞাসা করাে কয়দিনে ভগবানের কৃপা আমার উপর হবে।” আমি মাকে এ কথা বলায় মা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “তাকে লিখে দাও যে, তপস্যা করছ বলেই যে ভগবানের কৃপা হবে, এমন নয়। আগে ঋষির উর্ধ্বপদে হেঁটমুণ্ড হয়ে নীচে আগুন জ্বেলে হাজার হাজার বছর কত তপস্যা করত ! তাতে কখনও কারও উপর কৃপা হত, কখনও বা হত না। সবই তাঁর দয়ার উপর নির্ভর করে।”
‘উদ্বোধনে একদিন একটি যুবক ভক্ত মাকে সাধু হইবার ইচ্ছা জানায়। মা একটু হাসিয়া নিকটস্থ একজন সাধুকে দেখাইয়া বলিলেন, “সকলেই যদি সাধু হবে তবে এদের দেখবে কে? এদের সব খাওয়া পরা কে দেবে?” ছেলেটি পরে বিবাহ করিয়াছে। 
একবার ঠাকুরের সময়ে জনৈক বিশিষ্ট গৃহস্থ ভক্তের সহিত আমার কাশী যাইবার কথা উঠে। তাহাতে আমার পাথেয় খরচ তিনিই বহন করিতেন। মা শুনিয়া আমায় বলিলেন, “তুমি সাধু তোমার কি আর যাওয়ার ভাড়া জুটবে না? ওরা গৃহস্থ, ওদের সঙ্গে কেন যাবে? এক গাড়ীতে যাচ্ছ; হয়ত বললে, ‘এটা কর, ওটা কর। তুমি সন্ন্যাসী, তুমি কেন সেসব করতে যাবে?”
আর একবার মায়ের কলকাতার বাড়ি হইতে আমার কাশী যাওয়ার কথা হয়। ঐ সম্বদ্ধে কিছু স্থির করিতে না পারিয়া আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিলে মা বলিয়াছিলেন, “দেখ, কলকাতায় সকাল থেকে উঠেই লােকে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা করতে ছুটেছে, আর কাশীতে সকাল থেকেই সকলে গঙ্গাস্নান, বিশ্বনাথদর্শন, জপধ্যান- এই সব নিয়ে আছে।” আমি বললাম, “এখানে আপনার সেবায় রয়েছি।” মা তাহাতে বলিলেন, “হাঁ, যে কয়দিন শরীর আছে, তাও বটে।”
একদিন প্রসঙ্গক্রমে মা বলিলেন, “ঠাকুরের চুল কি কম জিনিস। তাঁর শরীরত্যাগের পর যখন প্রয়াগ যাই,১ তখন তাঁর চুল তীর্থে দেবার জন্যে সঙ্গে নিয়েছিলুম। গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে স্থির জলের কাছে ঐ চুল হাতে নিয়ে জলে দেব মনে করছি, এমন সময় হঠাৎ একটি ঢেউ উঠে ওটি আমার হাত থেকে নিয়ে আবার জলে মিলিয়ে গেল। তীর্থ পবিত্র হবার জন্যে তার চুল আমার হাত থেকে নিয়ে গেল।'
একদিন আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “মা, যাদের মন্ত্রদাতা গুরু ও সন্ন্যাসের গুরু, পৃথক, তারা কাকে গুরুরূপে ধ্যান করবে?" মা উত্তরে বলিলেন, ‘মন্ত্রদাতা গুরুই গুরু, এই মন্ত্র থেকেই ক্রমে ত্যাগ, বৈরাগ্য, সন্ন্যাস লাভ হয়।”

১.বন্দন হইতে ফিরিবার পথে মা অযােধ্যা ও প্রয়াগে নামিয়াছিলেন (১৮৮৭)।

ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ রায়, বরিশাল


এক রবিবার শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিবার প্রবল আগ্রহে বেলা ২ টার সময় কলিকাতার বাসা হইতে রওনা হইয়া ঘর্মাক্তকলেবরে ‘উদ্বোধন’ অফিসে উপস্থিত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম—মা কোথাও গিয়াছিলেন, এইমাত্র ফিরিয়াছেন, একটু দেরিতে দেখা হইবে। কিন্তু আমার দেরি সহিল না। আমি দেখা করিতে যাইতেছি দেখিয়া পুজ্যপাদ স্বামী সারদানন্দ (তিনি সিঁড়ির কাছে ছিলেন) আমাকে যাইতে নিষেধ করিলেন। আমার তখন যুবা বয়স, হঠাৎ উত্তর দিলাম, “মা আপনার একার ?” মহারাজকে সরাইয়া দিয়া উপরে গেলাম। গিয়া দেখি মা পাখা করিতেছেন। আমি প্রণাম করিলে মা কুশল প্রশ্ন করিলেন এবং বলিলেন, “খুব যে ঘেমেছ।” উত্তর দিলাম, “পথে রৌদ্র ও গরম ছিল।”
মার নিকট হইতে পাখাখানি লইয়া তাঁহাকে বাতাস করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পর মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ কোথায় গিয়েছিলেন?” মা বলিলেন, “কালীঘাট।” তারপর বলিলেন, “কিছু প্রসাদ খাও, পরে কথা কইব।” প্রসাদ খাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মা, স্বরূপ-মানুষ ও দেবতার মধ্যে তফাত কি?” 
মা—মানুষই দেবতা হয়। কর্ম করলে সবই সম্ভব হয়।
আমি—কি রকম কর্ম ?
মা—ঠাকুরের বিধিনিষেধ মেনে অভীষ্টদেবতায় নিষ্ঠা রেখে ডাকলে সবই হয়ে যায়।
আজ আর কথা বলিতে পারিলাম না, কারণ দুই-এক জন স্ত্রীভক্ত আসিতেছেন। আমি প্রণাম করিয়া বিদায় লইবার সময় বলিলাম, “মা, আজ বড় অন্যায় করে এসেছি। সিঁড়ি দিয়ে আসবার সময় শরৎ মহারাজকে ধাক্কা দিয়ে এসেছি। কি করে আবার তার সঙ্গে দেখা করব? আমার অপরাধ ক্ষমা করুন।” মা বলিলেন, “ছেলেদের আবার অপরাধ কি? আমার ছেলেরা এমন নয় যে অপরাধ ধরবে। তুমি এজন্য ভেবাে না।” নামিয়া আসিতেই মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহাকে প্রণাম করিয়া ক্ষমা চাহিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, “এই রকম উৎকণ্ঠাই চাই" এবং আমাকে আলিঙ্গন করিলেন। তারপর বলিলেন, “এখন থেকে তােমায় কেউ কোন বাধা দেবে না।” তাঁহার আশীর্বাদ মাথায় করিয়া লইলাম। ইহার পর হইতে তিনি আমাকে দেখিলেই খুব হাসিতেন।
আর এক রবিবার মার কাছে উপস্থিত হইলাম। সেদিন ভক্তেরা কেহ আসিয়াছেন, কেহ আসিতেছেন। আমি প্রণাম করিলে মা বলিলেন, “একটু বস।” তিনি কিছু প্রসাদ দিলেন। উহা খাইতে খাইতে তাঁহাকে বলিলাম, “মা, একটি দিন সুযােগ হয় না যে অনেকক্ষণ ধরে মনের সকল কথা জিজ্ঞাসা করি।”
মা—আমার তাে সকল ছেলেরই কথা শুনতে হয়। তবে দু'একটি জিজ্ঞাসা কর, উত্তর দিচ্ছি।
আমি—মা, যারা খুব গরীব, কাশী কি অন্য কোন ধামে যেতে পারে না, তাদের ঐ রকম ফল আর কিসে হয়?
মা—কেন, তারা দক্ষিণেশ্বরে কিংবা বেলুড়ে গেলে সে ফল হয়, যদি সে রকম বিশ্বাস থাকে। যার জন্য কাশী যাওয়া, তিনি দক্ষিণেশ্বরে ও বেলুড়ে আছেন।
আমি—মা, আমাদের কি উপায় হবে?
মা—তােমাদের কি ভয় ? যারা ঠাকুরের কৃপা পেয়েছে কিংবা তার কোন সংস্রবে এসেছে তাদের জন্য ঠাকুরই সব করবেন।
ইহার পরই প্রণাম করিয়া বিদায় লইতে হইল। অন্য দু'এক দিনের সামান্য কথাবার্তা এখানে দিতেছি।
আমি—মা, আমাদের জপধ্যান কি পদ্ধতিতে করতে হবে ? 
মা—যেভাবে ও যেমন ইচ্ছা হয় ঠাকুরে একটু মন রেখে করবে। তাতেই সব মিলবে। তােমার ভাবনা কিসের?
আমি—মা, ভাবনা নেই, তবু, আপনার শ্রীমুখের আদেশ পাবার জন্য জিজ্ঞাসা করছি।
মা—তােমাদের জন্য সকলেই আছেন। ঠাকুর আছেন, আমাকে তাে দেখতেই পাচ্ছ।
আমি—মা, স্বামীজীকে ও ঠাকুরকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
মা—ভক্তি করে ডাক, সকলকেই পাবে। আমি বলছি, তােমরা ধন্য যে এমন সময় জন্মেছ। তাঁর লীলাখেলা দেখার সময় এখন। শ্রদ্ধা ও ভক্তির চোখে দেখলে সবই সহজ।
আমি—মা, মানুষের ইচ্ছামতই কি সব কাজ হয় এবং আশা পূর্ণ হয় ? 
মা—সৎ ইচ্ছাগুলিই পূর্ণ হয়।

অজ্ঞাত ব্যক্তি 

শ্রীশ্রীমার নিকট দীক্ষা লওয়ার কিছুদিন পরে লালমােহনের (কপিলেশ্বরানন্দের) মনে সন্দেহ হয়, “এ আবার কি করিলাম? স্ত্রীলােকের নিকট দীক্ষা লইলাম?” ক্রমে তাহার অত্যন্ত অশান্তি আসে। পরে সে স্থির করিল যে এক দিবসের মধ্যে ঠাকুর যদি এ বিষয়ে তাহাকে বুঝাইয়া না দেন তাহা হইলে সে মন্ত্র ত্যাগ করিবে। পরদিন পূজনীয় বাবুরাম মহারাজের আদেশে সে কলিকাতায় শ্রীশ্রীমায়ের বাড়িতে দুধ লইয়া গেল। মাকে প্রণাম করিয়া উঠিলে মা তাহাকে বলিলেন, “দেখ, আমি তাে তােমায় মন্ত্র দিইনি, ঠাকুর দিয়েছেন। কিছুদিন পরে আবার তাঁহার সন্দেহ হয়। মনে হইল, “যদি ঠাকুরই মন্ত্র দিলেন তবে হরেনবাবু এসে যদি বলেন, ‘মার কাছ থেকে শক্তি পেয়েছি, তাহলে জানব সব সত্য।' তাহার কিছুদিন পরে উৎসবের সময় হরেনবাবু মাকে প্রণাম করিয়া মঠে। আসিয়া লালমোহনকে বলিলেন, “আজ মার কাছ থেকে বিশেষ শক্তি পেয়েছি।” তখন তাহার সকল সন্দেহ মিটিল।
একবার ‘উদ্বোধনে’ পাচক-ব্রাহ্মণকে কোন বিশেষ কারণে ছাড়াইয়া দিবার কথা হয়। কিন্তু শ্রীশ্রীমার সেবার অসুবিধা হইবে বলিয়া তথাকার অধ্যক্ষ তাহাকে জবাব দিতে পারেন নাই। মা ইহা শুনিয়া বলিলেন, “তােমরা সন্ন্যাসী, তােমাদের ত্যাগই লক্ষ্য ; একটা চাকরকে তােমরা ত্যাগ করতে পার না?” 
মঠের কোন ভূত্য কথার অবাধ্য হওয়ায় জনৈক মহারাজ তাহাকে চাপড় মারিয়াছিলেন। উহা মার কানে যাইলে তিনি বলিয়াছিলেন, “ওরা তাে সন্ন্যাসী, গাছতলায় থাকবে। তাদের আবার মঠ, বাড়ি, চাকর-আবার সে চাকরকে মার।”
ব্ৰজেশ্বরানন্দ উত্তরাখণ্ডে তপস্যা করিতে যাইবার জন্য মায়ের অনুমতি চাহিতে গিয়াছিল। মা শুনিয়া বলিলেন, “এ কার্তিক মাস, যমের চার দুয়ার খােলা; আমি মা হয়ে কেমন করে তােমায় এখন যেতে বলি?"
একজন অতি গর্হিত কর্ম করিয়াছিল। তাহাকে কঠোর দণ্ড দিবার জন্য মাকে কেহ কেহ বলিয়াছিল। মা তাহাতে বলেন, “আমি মা যে গাে, আমি কেমন করে অমন কথা বলব?”
এক সময়ে একটি ভক্ত মাকে বলিয়াছিল, “মা, আমি বড় গরীব। ইচ্ছা হয়, যখন-তখন আপনার দর্শনে আসি। কিন্তু আপনার জন্য ইচ্ছামত কিছু আনতে পারিনে ব’লে সব সময় আসতে পারিনে।” শুনিয়া করুণাময়ী স্নেহবাক্যে বলিলেন, “বাবা, যখন আসবার ইচ্ছা হবে, একটা হরীতকী হাতে করে এসাে।”
জনৈক ভক্ত মাকে দর্শন করিতে গিয়াছেন। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আমার কাছে দীক্ষিত ?” ভক্ত বলিলেন, “হাঁ, মা। মা, আমি বড় সংসারী। নিজে বিবাহ করিনি, কিন্তু ভাইয়ের মেয়ের দ্বিরাগমন ইত্যাদি নিয়ে আছি। আমার কি হবে, মা ?” 
মা বলিলেন, “দেখি।” ইহা বলিয়া বক্ষ স্পর্শ করিবার জন্য হাত বাড়াইলেন। ভক্তটি তাড়াতাড়ি কোটের বোতাম খুলিতেছেন। কিছুদূর হাত লইয়া মা বলিলেন, “থাক, থাক, আর খােলবার দরকার নেই। তােমার তাে হবে। না হলে আমার হাত ওদিকে যেত না। আমার তাে নিজের কোন জিনিস দিইনি -ঠাকুরের দেওয়া জিনিস। না হলে তাকে আসতে হবে। আমি তাে, বাবা, ব্যবসা কতে বসিনি। দেখ না, কাকিকে (তার গুরু) ক্ষেপিয়ে দিলে। ভাল করতে পারলে না, মন্দ করলে।”
জনৈক ত্যাগী ভক্তের মাতা পুত্রের সংসারে ফিরিয়া যাইবার প্রস্তাব শ্ৰীশ্ৰীমার নিকট করায় মা বলিলেন, “ত্যাগী ছেলে গর্ভে ধরা বড় সৌভাগ্যের কথা। লােকে একটা পেতলের বাটির মায়া ত্যাগ করতে পারে না, আর সংসার ত্যাগ করা কি সােজা কথা। তুমি ওর মা, তােমার ভাবনা কি ? সাধু হলেই বা, সে তােমাদের সেবা করবে।”
ঠাকুরের কথাপ্রসঙ্গে মা জনৈক ভক্তকে বলিতেছেন, “বাস্তবিকই তিনি ভগবান, জীবের দুঃখে দেহধারণ করে এসেছিলেন - রাজা যেমন ছদ্মবেশে নগরভ্রমণে যান। একটু জানাজানি হলেই সরে পড়েন।
শেষবার জয়রামবাটীতে রাধুনী ব্রাহ্মণী রাত্রি নয়টার সময় আসিয়া বলিল, “কুকুর ছুঁয়েছি, স্নান করে আসি।” মা বলিলেন, “এত রাত্রে স্নান করাে না, হাত পা ধুয়ে এসে কাপড় ছাড়।” রাধুনী বলিল, “তাতে কি হয় ?" মা বললেন, “তবে গঙ্গাজল নাও।" তাহাতেও তাঁহার মন উঠিল না। তারপর মা বলিলেন, “তবে আমাকে স্পর্শ কর।”
নবাসন হইতে জ্ঞানানন্দ মধ্যে মধ্যে নানাপ্রকার খাবার প্রস্তুত করিয়া জয়রামবাটী লইয়া যাইত। পথে এক গ্রামের কতকগুলি লােক সর্বদা তাহাকে ঐরূপ করিতে দেখিয়া বিস্মিত হইত। একদিন তাহাদের মধ্যে একজন বলিল, “আহা, কি মােহেই পড়েছে!" জ্ঞান যাইয়া মাকে এই কথা বলিলে মা উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “দেখ, বাবা, এরা হচ্ছে সংসারী জীব, নরকের কীট, এদের থাক, আলাদা। এরা বারবার আসবে আর যাবে, সংসারে পড়ে পচবে। যদি কোনকালে ভগবানের কৃপা হয় তবে মুক্ত হবে।”
জনৈক গৃহস্থ শিষ্য (রাজেন্দ্রলাল দে) মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মা, আমি কায়স্থ। ঠাকুরকে অন্নভােগ দিতে পারি কিনা?” মা বলিলেন, “বাবা, তুমি তার সন্তান। অন্নভােগ দেবে, তাতে দোষ কি? স্বচ্ছন্দে দিতে পার।”
ঢাকার শ্ৰীযুত পীতাম্বর নাথ জয়রামবাটীতে মার বাড়ির বারান্দায় বসিয়া মার সঙ্গে কথা বলিতেছিলেন। মা ঘরের ভিতরে ছিলেন; বলিলেন, “বাবা ঘরে এসে ব'সে বল।” ভক্তটি বলিলেন, “মা এইখানেই (বারান্দায়) বসি, আমি হীন জাত।” মা তাহাতে বলিলেন, “কে বলেছে তুমি হীন জাত ? তুমি আমার ছেলে, ঘরে এসে বস।”
একদিন ‘উদ্বোধনে' মায়ের অপার করুণার প্রসঙ্গ হইতেছিল। যােগেন-মা হাসিতে হাসিতে মার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তা মা আমাদের যতই ভালবাসুন, তবু ঠাকুরের মতাে নয়। ছেলেদের জন্য তার কি ব্যাকুলতা, কি ভালবাসা দেখেছি, তা বলবার নয়।” মা বলিলেন, “তা হবে না? তিনি নিয়েছেন সব বাছা বাছা ছেলে কটি—তা আবার এখানে মন্ত্র টিপে, ওখানে মন্ত্র টিপে। আর আমার কাছে ঠেলে দিয়েছেন একেবারে সব পিঁপড়ের সার !” 
শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রসঙ্গে মা একদিন বলিলেন, “ঠাকুর যে অমন ত্যাগী ছিলেন, তবু, আমার জন্য ভাবনা ছিল। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, তােমার ক’টাকা হলে হাতখরচ চলে? আমি বললাম, এই পাঁচ-ছ টাকা হলেই চলে। তারপর জিজ্ঞাসা করছেন, বিকেলে ক’খানা রুটি খাও? আমি তাে লজ্জায় বাঁচি না-কি করে বলি। এদিকে বারবার জিজ্ঞাসা করছেন। তাই বলতে হ’ল, এই পাঁচ-দুখানা খাই।' 
রাধু, একদিন ক্রুদ্ধ হইয়া মাকে বলিল, “তুই কি জানিস! স্বামীর মর্ম তুই কি বুঝিস।” মা ইহা শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই তাে গাে! স্বামী তাে ছিলেন ন্যাংটা সন্ন্যাসী।”
কেশবানন্দ কথাপ্রসঙ্গে মাকে একদিন বলেন, “মা, আপনাদের পরে ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতি দেবতাকে আর কেউ মানবে না।” মা বলিলেন, ‘মানবে না কেন? তারা তো আমারই অংশ।”
কেশবানন্দ আর একদিন মাকে বলেন, “মা, হয় দেশের লােকের মতিগতি ভাল করে দিন, নয় আমার কাজের ঝোঁক কেড়ে নিন। গঁড়তে কেউ নেই, আরও ভাঙতে চায়।” মা তাহাতে উত্তর দেন, “বাবা, ঠাকুর বলতেন, ‘মলয়ের হাওয়া লাগলে যে-সব গাছের সার আছে তারা চন্দন হয়। মলয় বয়ে গেছে, এইবার সব চন্দন হবে। কেবল বাঁশ, কলা ছাড়া।” 
একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, ওঁরা (মায়ের আত্মীয়েরা) এত আপনার সঙ্গ করছেন, তবু, একটুও জ্ঞান হয় না কেন?” মা বলিলেন, “সব বাঁশ, শিমুলগাছ—চন্দনের কাছে থাকলে কি হবে ? সারবান বৃক্ষ হওয়া চাই।”
একটি ভক্ত মহিলা শ্রীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আপনি যে ভগবতী তা আমরা বুঝতে পারি না কেন ?” মা বলিলেন, “সকলেই কি করে চিনতে পারে, মা? ঘাটে একখানা হীরা পড়ে ছিল। সবাই পাথর মনে করে তাতে পা ঘষে স্নান করে উঠে যেত। একদিন এক জহুরী সেই ঘাটে এসে দেখে চিনলে যে সেখানা এক প্রকাণ্ড মহামূল্য হীরা।' 
একবার মা জয়রামবাটী হইতে কলিকাতা রওয়ানা হইবেন, এমন সময় সূর্য মামার মা আসিয়া বলিলেন, “মা সারদা, আমাদের ভুলাে না, আবার আসবে।” মা নিজের ঘরের ভিতরে ভুমি স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিয়া বলিতেছেন, “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।”
খুব অপ্রত্যাশিতভাবে কোন এক বিশিষ্ট বড় লােকের বাড়ি হইতে এক ভক্ত যুবকের বিবাহের প্রস্তাব আসে। তাঁহারা অনেক টাকা দিতে চাহিয়াছিলেন। উহাতে যুবকের প্রায় সারা জীবনের অর্থের অভাব ঘুচিয়া যাইতে পারিত। যুবক তখন এমএ পাস করিয়া এক স্কুলের হেডমাস্টারি করে। তাহার মন ভােগাকাক্ষাশূন্য ছিল না। তাই শ্রীশ্রীমার মত জানিবার জন্য জয়রামবাটীতে তাহার নিকট বিবাহের কথা উত্থাপন করে (মে, ১৯৯৫)। মা সব শুনিয়া বলিলেন, “বাবা, তুমি তাে বেশ আছ। কেন সংসার-অনলে দগ্ধ হতে যাবে? তুমি ভাল কাজ করছ। অনেক ছেলে তােমার সাহায্যে পড়াশুনা করছে। তারা সব ভাল হবে, তােমারও কল্যাণ হবে।” যুবকটি বলিল, “মা, মন যে মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়, ভােগের দিকে যায়, তাই ভয় হয়।” মা তাহাতে বলিলেন, “তুমি কিছু ভয় করাে না। আমি বলছি, কলিতে মনের পাপ পাপ নয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, তােমার কোন ভয় নেই। মায়ের এই অভয় বাণী শােনা অবধি ভক্তটি আর বিবাহের কথা ভাবে নাই, বা সাময়িক মনের উদ্বেগেও বিচলিত হয় নাই।
একদিন নিবেদিতা স্কুল বােডিং-এর একটি বালিকা সকালে শ্রীশ্রীমার নিকট যায়। মা তখন জপ করিতেছিলেন তিনি বােডিং -এর মেয়েদের কথা, কালু নামে একটি ছেলের বিষয়, এবং যে রাস্তা দিয়া মেয়েটি গিয়াছিল, তাহার আশেপাশে কি দেখিল না দেখিল ইত্যাদি নানা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। কিন্তু মেয়েটি সকল বিষয় যথাযথ উত্তর দিতে পারিল না দেখিয়া মা তাহাকে বলিলেন, “দেখ, মা, যেখান দিয়ে যাবে তার চতুর্দিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখে রাখবে। আর যেখানে থাকবে সেখানকারও সব খবরগুলি জানা থাকা চাই, কিন্তু কাউকে কিছু বলবে না।”
একদিন বিকালে উক্ত বোর্ডিং-এর মেয়েরা মায়ের কাছে যাইলে গােলাপ-মা আসিয়া বলিলেন, “মা, এদের একটু ঠাকুরের কথা বল না।” তাহার উত্তরে মা বলিলেন, “আমি আর ঠাকুরের কথা কি বলব? কত কত কথা মাস্টার মশায়ের লেখা ‘কথামৃতে' বেরিয়ে গেছে। আহা! মাস্টার মশায়ের দেহটি ভাল থাকলে আরও কত উপদেশ বেরুত এবং লােকের কত উপকার হত ! এখনও যা বেরিয়েছে, সব অমূল্য ধন। আমি কি ছাই অত জানতাম যে ঠাকুরের খুঁটিনাটি কথাটি পরে বেদবাক্য হয়ে দাঁড়াবে! ঠাকুরের উপদেশের প্রণালীটি কেমন সুন্দর দেখ দেখি! হালদারপুকুর দেখে কত কি বলেছিলেন। এই রকম যেটি সামনে দেখতেন সেটিকেই লক্ষ্য করে কিছু বলা ছিল তাঁর স্বভাব।”
জনৈক ভক্ত মাকে জিজ্ঞাসা করেন, “ঠাকুর বলেছেন, এখানে যারা আসবে তাদের শেষ জন্ম। আবার স্বামীজী বলেছেন, সন্ন্যাস না হলে কারও মুক্তি নেই।' গৃহীদের তবে উপায়?” মা তদুত্তরে বলিলেন, “হাঁ, ঠাকুর যা বলেছেন তাও ঠিক, আবার স্বামীজী যা বলেছেন তাও ঠিক। গৃহীদের বহিঃ-সন্ন্যাসের দরকার নেই, তাদের অন্তঃ-সন্ন্যাস আপনা হতে হবে। তবে বহিঃ-সন্ন্যাস আবার কারও কারও দরকার। তােমাদের ভয় কি? তাঁর শরণাগত হয়ে থাকবে, আর সর্বদা জানবে যে ঠাকুর তােমার পেছনে আছেন।”
১৯১০ সালে জয়রামবাটীতে সাধনভজন-প্রসঙ্গে মা জনৈক ত্যাগী ভক্তকে বলিয়াছিলেন, “সকাল-সন্ধ্যায় বসবে। আর মাথা ঠাণ্ডা রেখে জপধ্যান করবে। এর চেয়ে মাটি-কোপান সােজা কাজ।” ঠাকুরের ছবির দিকে দেখাইয়া বলিলেন, “ওর কৃপা না হলে কিছুই হবে না।” আশ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য নিয়মিত জপধ্যানে বিঘ্ন ঘটিতে পারে, এই কথা বলায় মা বলিলেন, “কাজ আর কার ? কাজ তাে তাঁরই।” প্রসঙ্গক্রমে আরও বলিলেন, “এর পর মনই গুরু হয়ে উপদেশ দেবে।”
মা একবার কথাপ্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন, “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।” তিনি আশ্রিত সন্তানগণকে বলিতেন, “তোমাদের ভাবনা কি?”

শ্রী-

শ্রীমতী ক্ষীরোদাবালা রায়, সিলেট 

আমি মফঃস্বল হইতে কলিকাতায় আসিয়া যেদিন প্রথম শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে যাই সেদিন আমার শরীর ছিল খুবই অসুস্থ। গাড়ি করিয়া বাগবাজার গিয়াছিলাম। যাওয়ার পথেই আমার অত্যন্ত মাথা ঘুরিতে লাগিল; মনে হইল যেন বমি আসিবে। কোনরুপে বাগবাজার মায়ের বাড়িতে ঢুকিয়াই সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে সিঁড়ির পাশে একটি লম্বা ঘরের দরজায় মাকে পাইলাম। স্নান করিতে চলিয়াছেন; যেন আমারই অপেক্ষায় দরজায় হাত দিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমাকে দেখিয়াই একটু হাসিয়া বলিলেন, “কোথা থেকে এসেছ, বাছা? কেন এসেছ ?” 
বলিলাম, “মাকে দর্শন করতে এসেছি।” অমনি মা বলিলেন, “বাছা, আমিই মা। ঐদিকের ঘরে ঠাকুর আছেন, ঠাকুরকে প্রণাম করে ঐখানে বস, আমি নেয়ে আসি।”
এই বলিয়া মা চলিয়া গেলেন। আমি ঠাকুরঘরের দরজায় গিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বসিলাম। ঠাকুরের ভােগের জন্য কিছু মিষ্টি লইয়া গিয়াছিলাম, নলিনীদিদি আসিয়া একটু গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া আমার হাত হইতে উহা লইয়া রাখিয়া দিলেন। ইহারই মধ্যে মা খুব তাড়াতাড়ি স্নান করিয়া চলিয়া আসিলেন। দেখিলাম, আমি যাওয়ার আগেই ঠাকুরের পূজা ও ফল-মিষ্টিভােগ হইয়া গিয়াছে। সব সাজানাে রহিয়াছে। আমি ভাবিলাম, আমাকে যদি মিষ্টি-প্রসাদ খাইতে দেন তাহা হইলে আমার বমি আসিয়া পড়িবে, কারণ তখনও আমার মাথা ঘুরিতেছিল। মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুরের জন্য কিছু এনেছ ?” আমি আমার আনীত মিষ্টি দেখাইয়া বলিলাম, “এনেছি, ঐখানে রেখেছেন।” মা ঠোঙাসহ ঠাকুরের মুখের কাছে ধরিয়া বলিলেন, ঠাকুর, খাও।”
ইহার পর পিতলের একখানা ছোট থালায় কিছু ফল এবং একটু শরবতপ্রসাদ আমাকে খাইতে দিলেন। বলিলেন, “প্রসাদ খাও, বমি হবে না।” কমণ্ডলু, হইতে একটু গঙ্গাজল আমার মাথায় দিলেন এবং কহিলেন, “আমি ঐদিকের ঘরে বসবাে, তুমি খেয়ে সেখানে যেও।” আশ্চর্যের বিষয়, প্রসাদ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ বােধ করিতে লাগিলাম। তাহার পর মা যে ঘরে বসিয়াছেন সে ঘরে গেলাম। দেখিলাম, মা আমার রাজরানীর মতাে বিশ্বজননীরূপে আসনে উপবিষ্টা; গােলাপ-মা, গৌরী-মা, যােগীন-মা তাহাকে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। দেখিয়া আমার মাকে খুব আপন বলিয়াই মনে হইল, কিন্তু অপর যাঁহারা বসিয়া আছেন তাহাদিগকে দেখিয়া কি রকম সঙ্কোচ হইতে লাগিল। আমার প্রাণের আবেদন মাকে জানাইতে পারিব কি-না ভাবিতে লাগিলাম। তাঁহাকে বলিলাম, “আট বৎসর যাবৎ প্রাণপণ চেষ্টা করেও আপনার দর্শন পাইনি, কলকাতা পর্যন্ত এসেও দর্শন না পেয়ে ঘরে গিয়েছি।” এই বলিতেই গৌরী-মা বলিলেন, “সময় না হলে কি মায়ের দর্শন পাওয়া যায় ?” আমি বলিলাম, “এখন বােধ হয় সময় হয়েছে, মা; এখন আপনাকে পেয়েছি। আমাকে গ্রহণ করুন। আমি আপনার কাছে দীক্ষা নেওয়ার সঙ্কল্প ক'রে এসেছি। শুনেছি সময় না হলে দীক্ষাও হয় না। আবার কাউকে কাউকে নাকি আপনি এখানকার লােক নয় বলে বিদায়ও দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমার বেলায় তা হলে আমি আর বাঁচব না।”
মা আমার দিকে এদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “না, তােমার দীক্ষা হয়ে যাবে।” জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা, তুমি একাদশীতে কি খাও?” 
বলিলাম, “আগে সাগুই খেতাম, এতে নানারকম ভেজালের কথা জেনে এখন আর খাই না।”
শুনিয়াই মা বলিলেন, “না না, আমি বলছি তুমি সাগু খেও, এতে শরীর ঠাণ্ডা থাকে।” তাহার পর অতি দুঃখের সহিত বলিতে লাগিলেন, “বাছা, অনেক কঠোর করেছ। আমি বলছি, আর কোরাে না। দেহটাকে একেবারে কাঠ করে ফেলছ। দেহ নষ্ট হলে কি নিয়ে ভজন করবে, মা ?” 
তেল মাখি কি-না মা জিজ্ঞাসা করিলেন। বলিলাম, “আমি বিধবা হয়ে আর তেল মাখিনি।” শুনিয়া মা বলিলেন, “তেল মাখলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে, তেলটি মেখাে।” আমি বলিলাম, “বহুদিনের অনভ্যাসে তেল যেন ছুঁতেই ঘৃণাবােধ করি, তেল মাখতে পারব না মা।” গােলাপ-মা বলিলেন, “নিতান্তই ছেলেমানুষ, কঠোর করে করে না খেয়ে দেহটাকে শেষ করে ফেলেছে।” গৌরীমা বলিলেন, “তুমি মাথার চুল কেটে ফেলে দিয়েছ কেন, বাছা?” বলিলাম, “আমাদের দেশের বিধবাদের চুল রাখে না।” তিনি বলিলেন, “চুল না থাকলে চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত দেহ, চুলটি বুঝি শুধু, তােমার ?” তখন যােগীন-মা বলিলেন, “এই দেহটি ভগবানের মন্দির। একে সুন্দর করে রাখাই ভাল।” মা বলিলেন, “বেশ তাে করেছে, চুল থাকলে একটু বিলাসিতার ভাব আসে; চুলের যত্ন করতে হয়। যাই হােক মা, কেশের সেতু পার হয়ে তুমি এখানে এসে পেীঁছেছ। যার জন্যে এত কঠোরতা, তােমার সে কাজ হয়ে গেছে। এখন আমি বলছি, আর কঠোরতা কোরাে না। কালকে তােমার দীক্ষা হয়ে যাবে। কালকে আটটার সময় এখানে এসে পৌঁছবে। দীক্ষা নেওয়ার দিন একটু গঙ্গাস্নান ও মাকালীকে দর্শন করলে ভাল হয়।"
মনে মনে ভাবিলাম, তােমাকে দর্শন করিয়াই আমার কালীদর্শন হইয়া গিয়াছে, তােমার পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়া পবিত্র হইয়া গিয়াছি। তৎপর মাকে প্রণাম করিয়া বাসায় চলিয়া আসিলাম।
আমার দেবর সতীশচন্দ্র রায় মায়ের আশ্রিত ছিল। তাহাকে লইয়াই মায়ের কাছে গিয়াছিলাম। আমার বাসস্থানে ফিরিয়া পরদিন পুনরায় আমাকে মায়ের বাড়িতে লইয়া যাইবার জন্য তাহাকে বলিয়া দিলাম। (সে অন্যস্থানে থাকিত।) বাগবাজার হইতে বাসায় আসিবার পর হইতে আবার আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল। যাহা হউক পরদিন আমি মায়ের নিকট যাইবার জন্য তৈরি হইলাম, কিন্তু নিদিষ্ট সময়ে সতীশ আমাকে লইতে আসিল না। অত্যন্ত হতাশ হইয়া বসিয়া আছি, বেলা বারটায় সতীশ আসিয়া আমাকে বলিল, “কাল রাত্রিতে। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী তাহাকে খবর দিয়াছেন, ‘কাল বৌমার দীক্ষা হবে না, বৌমার শরীর অসুস্থ ; পরশু দিন বেলা দশটার পূর্বে বৌমাকে নিয়ে তুমি এসাে।' সেইজন্যই সে দেরি করিয়া আসিয়াছে।” শ্রীশ্রীমায়ের দিব্য দরদৃষ্টির কথা ভাবিয়া বিস্মিত হইলাম। পরদিন সকালে আমিও বেশ সুস্থ আছি। সতীশ ঠিক সময়ে আমাকে লইয়া যাইবার জন্য আসিল। মায়ের আদেশ-অনুসারে কিছু ফল-মিষ্টি, ফুল-বেলপাতা এবং একখানা সরু লালপেড়ে কাপড় লইয়া বাগবাজারে তাঁহার বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। মাকে এক অপূর্ব মূর্তিতে দেখিলাম। হলদে রং-এর একখানা কাপড় পরিয়া মা যেন আমার ইষ্টরূপে দরজায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, “পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছে, শীগগির এসাে ঠাকুরঘরে।” ঠাকুরের সামনে তিনি নিজেই একখানা আসন পাতিয়া উহা হাত দিয়া ঘসিয়া মাজিয়া দিলেন। ভাবিলাম, এই আসনে কি করিয়া বসিব। সঙ্গে সঙ্গে মা তাঁহার দক্ষিণ পা দ্বারা আসনখানা ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন, “হয়েছে তাে? বাবা! মেয়েটি কম নয়।” আমি যাওয়ার সময় গাড়োয়ানকে দেওয়ার জন্য দুটি টাকা আঁচলে বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, কিন্তু সে সময় আমার সে টাকার কথা মনেও নাই। আমি আসনে বসিতে যাইব তখন মা বলিলেন, “বাছা, তুমি কামিনীকাঞ্চন-ত্যাগী ঠাকুরের আশ্রিত হতে এসেছ, তােমার আঁচলে দুটো টাকা বাঁধা রয়েছে। ওটা খুলে রেখে এসাে।” অমনি টাকা দুটি খুলিয়া দেয়ালের কাছে রাখিয়া দিলাম এবং আসনে বসিলাম। আমি সেদিন মাকে যাহা দেখিয়াছিলাম, ভাবিলাম সেই মা তাে এই মা নন। ভাবিয়াই আমি সংজ্ঞা হারাইয়া ফেলিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই মা আমাকে হাত ধরিয়া আসনে বসাইলেন এবং আমার মাথায় হাত দিয়া অতি মধুর কণ্ঠে মাভৈঃ এই আশ্বাসবাণী তিন বার উচ্চারণ করিলেন এবং বলিলেন, “ভয় নেই, এই তােমার জন্মান্তর হয়ে গেল। জন্মান্তরে যত কিছু করেছিলে, সব আমি নিয়ে নিলাম। এখন তুমি পবিত্র, কোন পাপ নেই।” সঙ্গে সঙ্গে আমারও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিল; মা আমাকে দীক্ষাদান করিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “জপ-বিসর্জনের কি মন্ত্র আছে?” মা বলিলেন, “বিসর্জন বলতে নেই, সমর্পণ বলতে হয়।” একটু মিষ্টিপ্রসাদ আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “দীক্ষা নিয়ে গুরুর কাছে বেশী সময় থাকতে নেই। আজকে চলে যাও, কালকে এসে এখানে প্রসাদ পাবে।” আমি মাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিলাম এবং পরদিন দুপুরবেলা গিয়া প্রসাদ পাইলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর তাহার কাছে গিয়া বসিয়াছি। মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “লেখাপড়া জান তো ? সর্বদাই গীতাখানা একটু একটু পাঠ করবে, ঠাকুরের ‘কথামৃত’ আর ‘রামকৃষ্ণ পুঁথি’খানা পড়ো। আরও ঠাকুরের কত বই বের হয়েছে, ঐসব পড়বে।”
আমি বলিলাম, “মা, সংসারে আমার মন মােটেই বসে না, আমি কত কষ্টে যে সংসারীর মধ্যে বাস করি তা তুমি অবশ্যই জান। আমার এই প্রার্থনা, আমাকে সংসারীর মধ্যে রেখাে না।” মা বলিলেন, “তােমাদের আবার সংসার কি, মা? তােমাদের সংসারও যা, গাছতলাও তা। সংসার কি তিনি ছাড়া ? তিনি সবখানেই আছেন। বিশেষ, মেয়েমানুষ কোথায় যাবে, মা? তিনি যেখানে যেভাবে রাখেন সেখানেই সন্তুষ্ট থেকো। উদ্দেশ্য তাঁকে ডাকা ও পাওয়া। তাঁকে ডাকলে তিনি তােমার হাত ধরে চালিয়ে নেবেন, তাঁতে নির্ভর করতে পারলে আর তােমার কোন ভয় নেই। আর একটি কথা  গুরু-শিষ্যে একত্র বসবাস করা ভাল নয়। কারণ, একত্র থাকলে গুরু কার্যকলাপ দেখে অনেক সময়ই গুরুকে মানুষ বলে মনে হয় এবং তাতে শিষ্যের ক্ষতি হয়। নিকটে অন্য কোথাও থেকে যদি রােজই কিছু সময় গুরুদর্শন, তাঁর সঙ্গ, উপদেশ পাওয়া যায় তবেই খুব ভাল। কিন্তু সর্বদাই একটু দেখা-সাক্ষাৎ না থাকলে গুরুরও শিষ্যের কথা সব সময় স্মরণে আসে না। রােজই এখানে এসাে।”
আমার অবশিষ্ট জীবনের অবস্থাটি যে কি আসবে ইহা মায়ের কথায় বেশ বুঝিলাম। আমার জন্য যে বন নয়, সংসার রহিয়াছে ইহা ভাবিয়া খুব কাঁদিলাম। আমার কান্না দেখিয়া মা খুব ব্যস্ত হইয়া আমাকে বুঝাইতে লাগিলেন। বলিলেন, “আমিও তাে মা সংসারেই চিরদিন কাটালাম ; তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ, ধর্মের জন্যে হেথা সেথা যাওয়া আরও বিপদ। আমি বলছি, যেখানে যে অবস্থায় যে ভাবে থাক, বাইরের আবিলতা তােমার ক্ষতি করতে পারবে না। ঠাকুর আছেন, তােমার কোন ভয় নেই, ভাবনা নেই।”
ইহার পরেই আমি প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিলাম। সেই দিন হইতে প্রায় প্রত্যহই সাধারণতঃ বিকালের দিকে মায়ের কাছে যাইতাম এবং সন্ধ্যার পূর্বে চলিয়া আসিতাম। সাধনভজন যতটুকু দরকার বলিয়া দিয়াছিলেন এবং মনে কোন খটকা বা প্রশ্ন জাগিলে তাহার কাছে জিজ্ঞাসা করিয়া ইহার মীমাংসা করিয়া লইতেও বলিয়াছিলেন, কিন্তু মাকে দেখিয়াই একেবারে ভরপুর হইয়া যাইতাম। মনে হইত সবই হইয়াছে, সবই পাইয়াছি, আর কিছু পাওয়ার বাকী নাই। মা আমার বিশ্বজননী, রাজরাজেশ্বরী ইষ্টদেবী; গুরুরূপে আমার সামনে দণ্ডায়মানা। আমার পাইবার আর কি থাকিতে পারে? ইহা ভাবিয়া অফুরন্ত আনন্দ হইত। আমি মাকে মােটেই প্রশ্ন করিতাম না। মা নিজ হইতে যাহা বলিতেন তাহা শুনিয়াই পরিতৃপ্ত। একদিন তাহাকে বলিয়াছিলাম, 'মা, তুমি অন্তর্যামিনী, তুমি সবই জান ; তথাপি জোরের সহিত বলছি, আমি সংসারীর যে সংসার তা অত্যন্ত ঘৃণা করি এবং ভয় করি। আমার সংসার বাড়িঘর টাকাপয়সা কিছুই নেই। আমি এসব জিনিস তােমার কাছে জীবনে একদিনও চাইব না। আমার প্রাণ যা চায় সেটা তুমি জান, সেটা আমাকে দিও এবং সংসারীয় কাছ থেকে আমাকে দূরে রেখাে।” এই বলিয়া অনেক কাঁদিলাম। এসব কথায় উওরে খুব ছোট কথায় নিতান্ত ছেলেমানুষকে মা যেমন সান্ত্বনা দেন, মাতাঠাকুরানী আমাকে সেইভাবে প্রবােধ দিলেন। আমিও মনের ব্যথা ভুলিয়া আনন্দে ভাসিতে লাগিলাম। মা সময়ে সময় বলিতেন, “তােমাদের ঠাকুর বলতেন, ‘মায়া-সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ােনি, হাঙ্গর-কুমীর খেয়ে ফেলবে।' তবে তােমাদের ভয় কি ? তােমাদের ঠাকুর আছেন।”
শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী অত্যন্ত পর্দানশিন ছিলেন। আমাদিগকেও তিনি সেই ভাবে রাখিয়াছেন। আমরা মেয়েভক্তই দেখিয়াছি, মঠের কোন সাধু-সন্ন্যাসীকে বড় বেশী দেখি নাই। আমরা শুধু মাকে দেখিয়াই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখা হইয়াছে বলিয়া ধারণা করিয়া নিয়াছি। এখন ভাবি, এই রকম মন ছিল বলিয়াই তিনি আমাদিগকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। মা শুধু বলিতেন, সকল অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে তার নাম কর। 
 একদিন সুধীরা দিদি নিবেদিতা স্কুলের কয়েকটি মেয়েকে লইয়া মায়ের ওখানে আসিয়াছেন। একটি মেয়ে মাকে বলিল, “মা, ক্ষীরােদ দিদিকে আমাদের ওখানে থাকতে দেন না কেন? সে মেয়েও পড়াবে, সেখানে থাকতেও পারবে।"
আমি কিন্তু ভুলিয়াও তাহাদের কাছে আমার থাকা-খাওয়ার কথা আলোচনা করি নাই। তাই একটু অসন্তুষ্ট হইয়াই ভাবিলাম, কেন এসব বলে ? মা বলিলেন, “সকলেই সংসারে এক কাজের জন্য আসে না। তােমরা পড়বে ও মেয়েদের পড়াবে, এই তােমাদের কাজ। ক্ষীরােদ এসব করতে আসেনি। পড়াশুনা ভাল কাজ বটে, কিন্তু সকলের জন্যে নয়। মেয়েরা চলিয়া যাইবার পর বলিলেন, “মেয়েপড়ানাে কি কম কথা?”
আমি মাঝে একবার দেশে আসিয়া পুনরায় কলিকাতা ফিরিবার সময় রাধারানীর জন্য একজোড়া শাঁখা লইয়া গিয়াছিলাম। তাহাকে শাঁখা পরাইতে গিয়া দেখি উহা মাপে খুবই ছোট হইয়া গিয়াছে, তাহার হাতে মোটেই যায় না। উহাতে রাধু, একেবারে কাঁদিয়া ফেলিল। আমারও চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। ভাবিলাম এত সাধ করিয়া লইয়া আসিলাম, রাধু হাতে দিতে পারিল না। নলিনীদিদি, সরলাদি, রাধু ও আমি চুপি চুপি এই কথাই আলােচনা করিতেছি, এমন সময় মা ঠাকুরঘর হইতে রাধুকে ডাকিয়া বলিলেন, “তােমরা সকলে এখানে এসাে।” আমরা যাওয়ার পর বলিলেন, “কি হয়েছে ?” রাধু তখন কাঁদিয়া বলিল, “দিদিমণি আমার জন্য এমন সুন্দর শাঁখা নিয়ে এসেছেন, সেই শাঁখা আমার হাতে উঠছে না-ছােট হয়েছে।” অমনি মা বলিলেন, “তােদের যা কথা! বৌমা শাঁখা এনেছে, সে শাঁখাও লাগবে না? শাঁখা নিয়ে আমার কাছেই আগে আসতে হয়। আয় তাে দেখি, কেমন শাখা লাগে না।” এই বলিয়া পাঁচ মিনিটেই মা রাধুর হাতে ঐ শাঁখা পরাইয়া দিলেন। আমরা সকলে আশ্চর্য হইয়া গেলাম ; রাধু, চোখে জল নিয়াই হাসিয়া ফেলিল। মা বলিলেন, “সুন্দর শাঁখা পরেছ, ঠাকুরকে প্রণাম কর, আমাকে প্রণাম কর ওবৌমাকে প্রণাম কর।” তিনি ঐ কথা বলিতেই আমার বুক দুরদুর করিতে লাগিল। ভাবিতে লাগিলাম, আমার বাড়িঘর কোথায়, আমি কোন জাতের মেয়ে এবং আমার কে কে আছেন সেসব কথা মা একদিনও জিজ্ঞাস করেন নাই। মাকে বলিলাম, “মা, আমি যে কায়েতের মেয়ে, আমাকে রাধু কেন প্রণাম করবে ?” মা জিভে কামড় দিয়া বলিলেন, “ওসব বলতে নেই, তুমি কায়েত কি ব্রাহ্মণ আমি জানি না? তুমি এতদিন ধরে এখানে আছি, এখনও তুমি কায়েতই রইলে?” এই কথা বলিয়া রাধুকে বলিলেন, “যা, তোর দিদিমণিকে প্রণাম কর।” অমনি রাধু ঠাকুর ও মাকে প্রণাম করিয়া আমাকে প্রণাম করিল। আমিও রাধুকে প্রণাম করিলাম। মা খুব হাসিতে লাগিলেন। বলিলেন, “প্রণামটা ফিরিয়ে দিলে?" আমি কিন্তু ব্যাপারটা বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইয়া গেলাম।
একদিন রাধু, নলিনীদিদি প্রভৃতি সকলে আমাকে ব্যস্ত হইয়া ধরিয়াছে আমার বাড়ি কোথায়, আমি কোন জাতের মেয়ে, আমার কে কে আছে, এইসব বলিতে হইবে। কিন্তু আমি কিছুই বলিতে রাজী নহি। সেইদিনও মা ডাকিয়া বলিলেন, “তােমরা বৌমাকে কি নিয়ে এত জ্বালাতন করছাে? আমার এখানে এসাে, আমি সব কথা বলে দেব।” সকলে ছুটিয়া আসিল, আমিও সঙ্গে সঙ্গে আসিলাম। ভাবিলাম মা ওসব কথা একদিনও আমাকে জিজ্ঞাসা করেন নাই ; আজ কি বলেন আমি শুনিব। ওরা সকলে বলিতে লাগিল, ক্ষীরােদ দিদি এতদিন এখানে আছে, কিন্তু তার বাড়ি কোথায়, সে কোন জাতের মেয়ে, তার কে কে আছে ওসব কিছুই আমাদের বলে না। আজকে আমরা এত করে বলছি, তবুও বলছে না। মা বলিলেন, “আমি সব বলে দিতে পারব, তার জন্মস্থান কমলনেবুর দেশে, “শ্বশুরবাড়ি অন্য জেলায়, সে চন্দ্ৰকান্তের অতি নিকটের লােক; তার কেউ নেই, মাও নেই, ভাই আছে।” এই বলিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠিক হয়েছে তো, বউমা?” মায়ের কথার সঙ্গে সঙ্গেই আমার জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস আসিয়া পড়িল। অন্তর্যামিনী বুঝিলেন, আমার মায়ের কথা বলিতেই আমি দুঃখের সহিত শ্বাস ফেলিয়াছি। অমনি বলিলেন, “আহা! তােমার মায়ের কথা বলতেই তােমার দুঃখ হয়েছে, না বউমা? তােমার গর্ভধারিণী যদি বেঁচেও থাকতেন, তবু, কি করতে পারতেন ? শুধু চেয়ে চেয়ে তােমার দুঃখই দেখতেন। আমার মত মা পেয়েও কি তােমার মায়ের দুখ রইল ?...” একথা শুনিয়া আমি আনন্দে কাঁদিতে লাগিলাম। নলিনীদিদি প্রভৃতিকে বলিলেন, “আর কি জানতে চাও?” তাহারা বলিল, “ও কোন জাতের মেয়ে?” মা বলিলেন, “ওসব আমি বলব না—ওরা ভক্ত, এক জাত।” আমি মায়ের কথা শুনিয়া আনন্দে অধীর হইয়া গেলাম, মুখে কিছু বলিতে পারিলাম না।
কালীপূজার দিন সন্ধ্যাবেলায় আমি শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিতে গিয়াছি। সেদিন মায়ের বাড়িতে অত্যন্ত ভিড়। যাওয়ার পথে আট আনা দিয়া পাঁচটি চাঁপাফুল কিনিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। অতি কষ্টে সেই ফুল কয়টি মায়ের পাদপদ্মে দিলাম। মা বলিলেন, “আজকে বড় ভিড়। এখানে থেকে কোন কাজ নেই। তুমি সুধীরার সঙ্গে দেখা করে গৌরদাসীর ওখানে যাও, তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাসায় ফিরে যেয়ো।” এই কথা শুনিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেলাম। মায়ের এরুপ আদেশ তাে কখনও পাই নাই। বলিলাম “গাড়ি করে যাব, না পায়ে হেটে যাব ?” মা বলিলেন, “পায়ে হেঁটে যাবে, একাই যাবে। চিরদিনই কি তুমি ছেলেমানুষ থাকবে ? যাও-এসাে গে।”
অমনি মায়ের নাম লইয়া, কোন বিষয়ের বিচার না করিয়া বাহির হইয়া পড়িলাম। রাস্তার লােককে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া খুব সহজেই সুধীরাদির কুলবাড়িতে পেীঁছিলাম। সুধীরাদি আমাকে দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাত্রিবেলা তুমি কি করে এলে আবার ? কেন এসেছ ?" বলিলাম, “জানি না কেন এসেছি ; মা এখানে আসতে বললেন তাই এলাম।” ইহা শুনিয়া সুধীরাদি তাঁহার স্কুলের মেয়েদের ডাকিয়া বলিলেন, “তােমরা পড়াশনা বন্ধ করে এখানে এসো। ক্ষীরােদ দিদি মার কাছ থেকে এসেছে, তাকে এসে দেখাে।"
সব মেয়েরা আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। মায়ের আদেশে এক্ষুণি আমাকে সারদেশ্বরী আশ্রমে যেতে হবে' বলিয়া আমি রওনা হইতে চাহিলাম । সুধীরাদি বলিলেন, “একাই যাবে?' আমি বলিলাম, “একা যাওয়ারই আদেশ।” 
রওনা হইয়াছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে ঐ বােডিং-এর বাহিরের ঘর হইতে এক ভদ্রলােক আমার পিছনে পিছনে চলিলেন। তাহার সঙ্গে আমার কোন পরিচয় নাই, অথচ তিনি আমার সঙ্গে চলিয়াছেন দেখিয়া আমার বুকটা দুরদুর করিতে লাগিল। গৌরী-মার যেরূপ কড়াপ্রকৃতি তাহাতে এই লােককে আমার সঙ্গে দেখিয়া হয়তাে আমাকে বকুনি দিবেন। আমি ঐ ভদ্রলােকের সঙ্গে কোন কথাবার্তা বলি নাই। সারদেশ্বরী আশ্রমের দরজায় উপস্থিত হইয়া দরওয়ানকে বলিলাম, “মাজীকে ডাক। বল, বাগবাজার মায়ের ওখান থেকে একজন মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
একটু পরেই গৌরী-মা একহাতে ঘৃতের প্রদীপ ও একহাতে ধুনচিতে ধুপ জ্বালাইয়া নীচে নামিলেন। আমি প্রণাম করিতে গেলে বলিলেন, “আজকে কি আমি তাের প্রণাম নিতে পারি?" কিছুতেই প্রণাম নিলেন না। গৌরী-মা অনেকক্ষণ ধরিয়া আমার মুখের কাছে আরতির মত করিতে লাগিলেন। আমি অবাক হইয়া গেলাম। ইহা করার পরই পূর্বোক্ত ভদ্রলােকটি তাঁহাকে প্রণাম করিতে গেলেন। তৎক্ষণাৎ গৌরী-মার চেহারা বদলাইয়া গেল। ঐ ভদ্রলােককে বলিলেন, “কোত্থেকে এসেছ ? তােমার বাড়ি কোথায় ? এখানে কেন এসেছ ?” তিনি বলিলেন ( আমাকে দেখাইয়া ), “উনি সুধীরা বসুর কাছে গিয়েছিলেন এবং তাঁর নিকট এখানে আসবেন বলে বললেন ; ভাবলাম আমি তাে আপনাকে দেখি নি, ওর সঙ্গে এলে আপনাকে দেখতে পাব, তাই এসেছি।”
গৌরীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার কি নাম?”
তিনি নাম বলাতে আমি তাহাকে চিনিতে পারিলাম। তাহার নাম শুনিয়াছি বটে। গৌরীমা বলিলেন, “চিনেছি ; তােমার বাড়ি সিলেটে। তা গৌরীমা তাে পর্দানশিন নন যে তাঁকে দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। সাধু দেখতে হলে বেলুড়ে যেয়াে ; মেয়েমানুষ সাধু কি দেখবে?" 
ঐ ভদ্রলােক বলিলেন, “রবিবারে এলে বােধ হয় আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব ?
গৌরী-মা বলিলেন, “না, না, এখানে আমার মেয়েরা সব রয়েছে, এখানে দেখা হবে না।” 
এই বলিতেই ভদ্রলােকটি প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলেন। তখন গৌরীমা আমার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, “শ্রীশ্রীমাকে তুমি কি মনে কর ? মা কি শুধুই কৈলাসেশ্বরী। তাঁকে মানুষ ভাবা চলে না। মা জগদগুরু, বিশ্বজননী,তাকে গুরুত্বে বরণ করেছ। আর ভাবনা কি আছে ?” তাহার পর প্রায় দুই ঘণ্টা কাল মায়ের এবং ঠাকুরের কথা বলিতে লাগিলেন। আমি দরজায় যেভাবে দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই ভাবেই দাঁড়াইয়া রহিলাম। গৌরী-মাও দাঁড়াইয়াই কথা কহিতে লাগিলেন। হঠাৎ গৌরী-মা আমাকে ধরিয়া বলিলেন, “চল, মাকে পূজা করতে যাব।” আমি বলিলাম, “বাগবাজারে পুনরায় যাওয়ার আদেশ আমার নেই। বিশেষ রাত হয়ে গেছে। পরে আমি কি করে যাব ?” গৌরী-মা বলিলেন, “চল, আমি মাকে বলব।” আমি গৌরী-মার সঙ্গে চলিলাম। ছােট দুইটি মেয়েকেও তিনি সাথে লইলেন। একটির হাতে ফুল-বেলপাতা ও অপরটির হাতে ফল-মিষ্টি। গৌরী-মার হাতে একটি কমন্ডলু ছিল। দুই পাশের লােক অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। মায়ের বাড়ির দরজায় যাইয়াই শুনিলাম, মা বলিতেছেন, “এই গৌরদাসী এসেছে রাস্তা গুলজার করে।” সেখানে যাইয়া বুঝিলাম গৌরী-মার পূজাই মায়ের আজিকার শেষ পূজা। আর সকলেই পূজা করিয়া ফেলিয়াছেন। গৌরী-মা কালীপূজার মতােই অনেক সময়ব্যাপী পূজা করিলেন। সেই পূজা একটি দেখিবার জিনিস বটে। পরে সকলেই প্রসাদ পাইলেন। গৌরীমা বলিলেন, “ক্ষীরােদকে আবার এখানে নিয়ে এলুম। সে বলেছিল, তােমার আদেশ নেই। আমি বললুম, মাকে বলব।”
মা বলিলেন, “বেশ করেছ।”
সেদিন মায়ের বাড়িতেই থাকা গেল। সে রাত্রিটা যে কি আনন্দে কাটিয়াছিল, তাহা জীবনে ভুলিব না।
আমার বিধবা হওয়ার একবৎসর পূর্বেই একদিন আমি অনেকগুলি পেঁপে কাটিয়া তরকারি রান্না করিয়াছিলাম। সেই পেঁপের কষ হাতে লাগিয়া হাত চুলকাইয়া ভীষণভাবে আঙ্গুলগুলি ফুলিয়া কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফাটিয়া গেল। এবং এমন ভীষণভাবে হাতে ঘা হইল যে, বহু চিকিৎসাতেও আর ভাল হইল না। সেই ঘা ১২ বৎসর থাকে। চামচাদ্বারা ভাত খাইতে হইত। সময় সময় একটু কম থাকিত। যখন বেশী হইত, তখন হাতে জল ঢালিলে মাংস পর্যন্ত পচিয়া উঠিত। শ্রীশ্রীমায়ের কাছে আজ এক বৎসর যাবৎ আছি, কিন্তু একদিনও মাকে হাতখানা দেখাই নাই। আমার অনিত্য দেহের কথা মাকে বলিব না এবং উৎকট ব্যাধি মা দেখিলে যদি তাঁহার দেহের কোন ক্ষতি হয় সেজন্য তাঁহার নিকট অতি গােপনে রাখিয়াছি। বেশী বাড়িলে মার ওখানে যাইতাম না। একদিন বেশী ঘা নিয়াই চলিয়া গেলাম। সেখানে যাইয়া মাকে প্রণাম করিলাম না, পাছে প্রণাম করিলে পায়ের ধূলা লইবার সময় মা ধরিয়া ফেলেন। এই চিন্তায় একেবারে অস্থির হইয়া পড়িয়াছি। এমন সময় দেখি একটি বিধবা মেয়ে মাকে প্রণাম করিয়া হাতে কাপড় জড়াইয়া পায়ের ধুলা লইলেন। ইহা দেখিয়া মনে খুব আনন্দ হইল। আমিও মাকে প্রণাম করিয়া হাতে কাপড় জড়াইয়া পায়ের ধুলা লইলাম। প্রণামের সঙ্গে সঙ্গে মা অতি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “বৌমা, হাতে কাপড় জড়িয়ে ধূলা নিলে কেন ? তোমার হাতে কি কোন অসুখ আছে ?”
তখন মহা বিপদে পড়িলাম, বুক কাঁপিতে লগিল। ভাবিলাম, ঐ মেয়েটিকে তাে বলিতে পারিতেন। তাহাকে না বলিয়া আমাকে বলিলেন, “এইভাবে কেন ধূলা নিলে?” বলিলাম, “হাতে অসুখ আছে।” আবার বলিলেন, “দেখি।” হাত দেখিয়া এমনভাবেই দুঃখ করিতে লাগিলেন যে, শুনিয়া অবাক হইয়া গেলাম। বলিলেন, “আহা! বাছা, তুমি এতদিন এখানে আছ, আর তােমার হাতে এরূপ ব্যাধি ! আমি তােমাদের মা, আমি জানি না। বাছা আমার এত কষ্ট হচ্ছে।” কতদিন ধরে এই রােগ হয়েছে এবং কি করে হ'ল, জিজ্ঞাসা করায় আমি সব কথা বললাম। মা বলিলেন, “বাছা, আমি এখন এমনই হয়েছি, আমাতেই আমি ডুবে থাকি। তােমাদের দিকে বড় তাকাই না। এই হাত দিয়ে ঠাকুরপূজো কর, এতেই রোগ ধরে রয়েছে। যাক, আমার সঙ্গে এস। ঠাকুরপূজোর নির্মাল্য ও চরণামৃত গঙ্গায় ফেলবার জন্য এখনই নিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি এস।” মায়ের সঙ্গে অন্য ঘরে গেলাম। মা বলিলেন, “ঐ দেখ কমণ্ডলুতে ঐ সব রয়েছে; সবটা হাত এতে ডুবিয়ে দাও।” তাহাই করিলাম। বলিলেন, আর হাতে অসুখ থাকবে না। তবে মাছ-মাংস, রসুন-পেয়াজে হাত না দিয়ে যতদুর পার থেকো। ওসব একেবারে না ধরেও তাে পারবে না। এসব ঘাটাঘাঁটি করলেই একটু ফুটতে পারে। ঠাকুরপুজো তাে রােজই করবে। একটু ফুটলেই ঠাকুরের চরণামৃত দিও। তবেই সেরে যাবে। যেদিন পেঁপে কেটেছিলে সেদিন কি খেউরি করেছিলে?” বলিলাম, “মনে নেই।” মা বলিলেন, “খেউরিও করেছিলে এবং পেঁপের কষও লেগেছে। দুটোতে মিলেই ঐ সব হয়েছে।” বিকালবেলা অন্যান্য মেয়েদের কাছে বলিলেন, “ওগো, তােমাদের সকলকেই বলছি, তােমাদের স্বামী, পুত্র এবং তােমরা নিজেরাও নাপিতের নরুন দিয়ে নখ কেটো না। এতে অনেক খারাপ রােগ হতে পারে। এইতাে বৌমার হাতে এরূপ হয়েছে। অবশ্য ঠাকুরের ইচ্ছায় এ থাকবে না।”
সেদিন, একসঙ্গে বসে খাওয়া, এক বিছানায় দুজন শােয়া, একজনের কাপড়গামছা অপরের ব্যবহার করার কত দোষ, কি ভাবে একজনের দেহের ভাল বা মন্দ অন্যের দেহে যায় এইসব বলিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, আমার জীবন-যাপন কি ভাবে হইতেছে, যেখানে থাকি সেখানে বাধ্য হইয়া আমাকে মাছমাংসও রান্না করিতে হয় আমি এইসব কথা মাকে কখনও বলি নাই। কিন্তু মা বলিলেন, “ও সব না করেও পারবে না, করলেই হাতে ফুটবে, ঠাকুরের চরণামৃত দিলেই সেরে যাবে।” আশ্চর্যের বিষয়, যেদিন চরণামৃতে হাত ডুবাইলাম, তাহার পরদিন হইতে জীবনের মতাে ভাল হইয়া গেলাম, কিন্তু মাছমাংস প্রভৃতিতে হাত দিলেই হাতে গুটি গুটি বাহির হইত এবং ঠাকুরের চরণামৃত দিলেই ঘণ্টাখানেক পরেই দেখিতাম যে কিছুই নাই। আমি কিন্তু ঐ ব্যাধি সারিবার পরই মাকে বলিয়াছি, “মা, দেহের ব্যাধি সারবার জন্য তোমার কাছে আসিনি। তুমি এই পর্যন্ত দিয়েই আমাকে বিদায় করতে পারবে না।” মা হাসিয়া বলিলেন, “তােমাদের দেহ যে, মা, আমার দেহ। তােমাদের দেহ ভাল না থাকলে আমি যে, মা, কষ্ট পাই।” দৈহিক বা আর্থিক কিংবা অন্য কোন বিষয় মুখে কেন, মনে মনেও চাহিব না—ইহা আমার সংকল্প। আমার ভয়, কি জানি মা ঐ সব দিয়াই বিদায় দেন। ভজনে কিছু হইতেছে কি-না বুঝিতেছি না বলিলে বলিতেন, “আমি গুরু, হয় কি না হয় আমি জানি ; তুমি কি করে বুঝবে? সব হবে, সব হবে-ভজনের অন্তরায় বাইরে বেশী থাকে না, ভিতরেই থাকে। ওসব ঠাকুরের নাম করতে করতে এবং ধ্যান-ধারণা করলে একটা একটা করে পড়ে যাবে। কাজ করে যাও, রইল কি গেল, সেদিকে তাকিও না।” বলিতেন, “নারকেল গাছের বালদো যেমন সময় হলে আপন হতেই পড়ে যায়, সময় না হলে সেটা ফেলতে অনেক জোর দিতে হয়, সেই রকম। সময় হলে সব যাবে।” তার জপে ও ধ্যানে ডুবিয়া থাকার অবস্থা কেন আসে না জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, “সবই তাে করছ, সবই হচ্ছে। যে বয়সে বিধবা হয়ে যেভাবে এখানে এসে পেীঁছেছ, মা, তাই যথেষ্ট। তােমার বেশী কিছু করতে হবে না, দিনান্তে ঠাকুরকে দুটো প্রণাম দিলেই হবে। মানুষের একটি জিনিস যদি ঠিক থাকে, তবে আর কিছুই লাগে না। আপনা আপনি তােমার সব হয়ে যাবে।”
দশ বৎসরে আমার বিবাহ হয়, ১৫ বৎসরে বিধবা হইয়াছিলাম। মায়ের পাদপদ্মে আশ্রয় লইয়া তাঁহাকে বলিয়াছিলাম, “মা, আমাকে তােমার পাদপদ্মে দিলাম, তুমি আমাকে রক্ষা করাে।” মা বলিয়াছিলেন, “কোন ভয় নেই। ঠাকুর তােমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবেন।” তাঁহার শ্রীমুখ দিয়া যাহা বাহির হইয়াছে তাহার একটি কথাও অযথা হয় নাই। এখন আমার বয়স ৬০-এর কাছাকাছি, মায়ের পদ্মহস্ত আমার মাথায় পড়িয়াছে, আমার হাত, মাথা মায়ের পায়ে ঠেকাইয়াছি, আমি ধন্য হইয়া গিয়াছি। মায়ের শ্রীমুখের বাক্য কোন ভয় নেই, ঠাকুর হাত ধরে নিয়ে যাবেন’—ইহাতেই এত দীর্ঘ জীবন যাপন করিলাম, একদিনও ভোগ-বাসনা বুঝিলাম না। শুধুই আনন্দ, শুধুই আনন্দ! দীক্ষার দিন ছাড়া আর একদিনও তিনি আমাকে বলেন নাই আমি কি করিব ; বলিতেন সবই ঠাকুর করিবেন। আমাদের বুঝিতে ভুল হইতে পারে, কিন্তু তাহার বাক্য সত্য। সব সময় তাঁহাকে না ডাকিলেও তাঁহার আশ্রিত সন্তানকে আপদে বিপদে তিনি রক্ষা করিয়া থাকেন। তাহার কৃপা ভিন্ন কেহই বাহাদুরি করিয়া সংসার-বন্ধন জয় করিতে পারিবে না, ইহা বেশ বুঝিয়াছি।
‘শুধু হাতে ঠাকুর-দেবতা দর্শন করতে নেই'—ইহা মায়েরই বাক্য; সেইজন্য রোজই একটু কিছু লইয়া মায়ের কাছে যাইতাম। একদিন মা বলিলেন, “তােমার পয়সা-কড়ি নেই, তুমি রােজই এসব নিয়ে আস কেন, মা? একটা হরীতকী হাতে করে নিয়ে এসাে—এতেই হবে। আমি তােমাদের মুখ দিয়ে যে খাই, মা! তােমরা খেলেই আমার খাওয়া হয়। ঠাকুরের রাজ্যে এসে কতই খেয়েছি।”
আমার মেজদার গুরুতর অসুখ হইয়াছে। চিকিৎসার জন্য তিনি কলিকাতায় গিয়াছেন। ডাক্তার সর্বাধিকারী অপারেশন করিবেন। আমাদের পরিবারের সকলেই কলিকাতা আসিয়াছেন। শুনিলাম, এই অপারেশনে রােগী বাঁচিবে কি মরিবে ডাক্তারই বলিতে পারেন না। আমি মায়ের কাছে মেজদাকে লইয়া গেলাম। সেদিন রবিবার। বিকালে ছেলেরা প্রণাম করিতে আসেন, যাওয়ার পথে মেজদা একছড়া ফুলের মালা মায়ের পায়ে দিবার জন্য লইয়া গিয়াছেন। সে মালা আমি দেখি নাই। সেখানে যাইয়া ভাবিতে লাগিলাম, এত লোকের সঙ্গে মাকে প্রণাম করিবেন, আমি কাছেও থাকিতে পারিব না। মা কি তাঁহাকে লক্ষ্য করিবেন ? যাহাই হউক, যখন প্রণামের সময় হইল আমরা এক ঘরে বন্ধ হইয়া গেলাম। প্রণাম শেষ হইয়া গেলে মা রাধুকে ও আমাকে ডাকিলেন। অনেকগুলি ফুল ও মালা সরাইয়া রজনীগন্ধার একটি মালা রাধুর হাতে দিয়া বলিলেন, “ইহা বৌমার ভাই আমাকে দিয়েছে।” বলিলেন, “আমি তােমার ভাইকে দেখেছি। আমি অবাক হইয়া গেলাম। আর কোন দিন মেজদা এখানে আসেন নাই; ভাবিতে লাগিলাম, রজনীগন্ধার মালাই তিনি আনিয়াছিলেন কি-না। অনেক মালার মধ্যে একটিমাত্র রজনীগন্ধার মালাই দেখিলাম। মাকে বলিলাম, “মা, এরই জন্যে সংসারে থাকতে ইচ্ছা নেই। এদের কাছ থেকে দূরে থাকবার জন্য তোমার কাছে এত কেঁদেছিলাম। যদি তিনি মরে যান তাহলে ওসব আমাকেই ভুগতে হবে। মা সংসারীদের মধ্যে রয়েছি বলেই তাে তােমার পদতলে থেকেও আর বাঁচতে পারি না। এখন কি হবে, কি করব বল?” মা বলিলেন, “তােমার ভাই এই অপারেশনে যদি নাও মরে, একদিন তাে মরবে ? আর বেঁচে থাকলেই বা তােমার কি উপকার হবে। সেজন্য এত ভাববে কেন?” ভাবিলাম, বুঝি এবার মেজদা রক্ষা পাইবেনই না। তখনই মা বলিলেন, “ভয় নেই, ঠাকুর আছেন। যে ঘরে অপারেশন হবে সে ঘরে ঠাকুরের একখানা ফটো রেখে দিও, তিনি রক্ষা করবেন।” ইহা শুনিয়াই বাসায় আসিয়া সকলের নিকট বলিলাম। সকলেই বলিতে লাগিলেন, “আর ভয় নেই, জীবন্ত কালী হয়ে এসেছে, ভয়ের কোনই কারণ নেই। সেই অপারেশন একটা বিরাট ব্যাপার যথাসময়ে হইয়া গেল। ঠাকুরের ফটোও রাখা হইল, মায়ের কৃপায় মেজদা সুস্থ হইয়া দেশে আসিলেন। আমার কাকা, বড়দা ইহার কালীদর্শনের কথা বলায়। এইরূপ মত প্রকাশ করেন—যে-কালী শ্রীশ্রীঠাকুর নিজে পূজা করিয়াছিলেন, সেই কালী, তাঁর পা আমরা দর্শন করেছি, স্পর্শ করেছি ; আর কোথাও যেতে হবে না। আমিই মায়ের কাছে প্রথম গিয়াছিলাম। এখন মায়ের কৃপায় এই পরিবারের প্রায় সকলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের পাদপদ্মে শরণ নিয়াছে।
একদিন বিকালবেলা আমি মায়ের ওখানে আছি, এমন সময় একটি বিধবা মাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন—গলায় তুলসীমালা, গায়ে নামাবলী। ওর অসিবার পূর্বেই মাতাঠাকুরানী গভীর ভাব ধারণ করিয়াছেন। মহিলাটি আসিয়া মাকে প্রণাম করিতে গেলেন। মা বলিলেন, “পায়ে হাত দিও না, মাটিতে প্রণাম কর।” কিন্তু তিনি তাহা শুনিলেন না, পা ছুঁইয়াই প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের ফটো প্রভৃতি দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া আমাকে বলিলেন, “দেখেছ, কেমন সুন্দর।” মা বলিলেন, “ওকে কি দেখাবে? তুমি যাকে দেখাচ্ছ, সে তাঁর পূজোই করে।” আমাকে দেখাইয়া বিধবাটি বলিলেন, “এটি কি আপনার মেয়ে ?” মা উত্তর দিলেন, “হাঁ, বাছা।” তিনি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কয়টি ছেলেমেয়ে ?” মা বলিলেন, “ব্ৰহ্মাণ্ড জুড়ে সকলেই আমার সন্তান।” মহিলাটি বলিলেন, “আপনার গর্ভজাত সন্তান ক’জন?” মা উত্তর দিলেন, “উনি ত্যাগী ছিলেন।' এই কথা বুঝিতে না পারিয়া মহিলাটি মাকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিলেন। আমি নিজেও আর ধৈর্য রাখিতে পারিলাম না। মা আমাকে বলিলেন, “তুমি ওকে বুঝাও, আমি আর পারি না। আমি তখন তাঁহাকে বলিতে লাগিলাম, “তুমি দেখছি মায়ের সম্বন্ধে কিছুই জান না। তবে কি ভেবে মাকে দেখতে এসেছ? মাকে যারা দর্শন করতে আসে, তারা শুধু, দর্শন ও প্রণামমাত্রই করে না। মায়ের সম্বন্ধে জানবার অনেক আছে। কত বই-এ মায়ের কথা রয়েছে ; কত ভক্ত রয়েছেন, এদের কাছেই সব জানা যায়। মায়ের সম্বন্ধে যদি তুমি বিন্দুমাত্রও জানতে, তাহলে মাকে এত প্রশ্ন করার সাহস তােমার হত না। যা বলতে হয় আমাকে বল, মার সঙ্গে কথা বলাে না। তবু সে মহিলাটি বলিলেন, “আমার মেয়ে এখানে আসে। খুব বড়াে মূলাে নিয়ে সেদিন এসেছিল।” মা উত্তর দিলেন, “কত লােক কত কিছু দেয়, সে সবের কি আমি খবর রাখি? তােমার মেয়েকে আমি জানি না।” ইহার পর বিধবাটি চলিয়া গেলেন। মা আমাকে বলিলেন, “বৌমা একটু জল এনে আমার পা ধুইয়ে দাও এবং একটু বাতাস কর।” আমি তাহাই করিলাম।
আমার একটি খুড়তুতাে ভাইয়ের নেত্রনালী হইয়াছে। ইহা অপারেশন করার জন্য আমাদের পরিবারের অনেকের সহিত তাহার মা ও বাবা তাহাকে লইয়া কলিকাতা আসিয়াছেন। অপারেশনের পূর্বে তাহাকে লইয়া মায়ের কাছে যাই। পূর্বেই এই অপারেশনের কথা মাকে বলিয়াছিলাম। মায়ের কাছে গিয়া মাকে প্রণাম করিয়াই বলিলাম ( ছেলেটিকে দেখাইয়া), “মা, এরই চোখের অপারেশন করা হবে। মা বলিলেন, “দেখি কেমন চোখ।" দেখিয়া বলিলেন, “বাবা, এখন হরেক রকম রােগও হয়েছে যেমন, ডাক্তার বা চিকিৎসকও হয়েছে তেমন। আগে এত রােগও হত না, এত চিকিৎসাও লােক জানত না। এই রাধুরই কত রকম রােগ, আর কত বা চিকিৎসা! আর কত দেবতারই বা মানত করলাম, কিন্তু সে আর কিছুতেই ভাল থাকে না। ঠাকুরের যে কি ইচ্ছা তিনিই জানেন।” মায়ের কথা শুনিয়া আমি একটু হাসিলাম। ভাবিলাম, তুমি কিছুই জান না। কথায় মনে হয় রাধুই যেন তাঁহার সর্বস্ব। মা নিজেকে অত্যন্ত চাপা রাখিতেন, তাঁহার চালচলন দেখিয়া কাহারও শক্তি নাই যে তাঁহাকে চিনিতে পারে। তিনি নিজে যাহাকে ধরা দিয়াছেন, একমাত্র তিনিই মাকে চিনিয়াছেন। মা ছেলেটির চোখ দেখিয়া কিন্তু ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিলাম। চোখ অপারেশন ভালভাবেই হইল। পরে দেশে ফিরিবার পূর্বে আমার খুড়ীমা তাহার ছেলেমেয়েদের লইয়া একদিন সকালবেলা মাকে দর্শন করিতে গেলেন। তখন মা পা মেলিয়া বসিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের ভােগের জন্য ফল কাটিতেছেন। তাহারা যাইয়াই মাকে প্রণাম করিলেন। মা খুড়ীমাকে বলিলেন, “এই সব ছেলেমেয়েই কি তােমার ?” তিনি বলিলেন, “হাঁ, মা, আমারই সব।” মা বলিলেন, “বেশ বেশ। দেখেছ এদের ভক্তি কত ! সবগুলি ছেলেমেয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছে। বৌমা এখানকার সব জানে, তবুও সকালবেলা তােমাদের নিয়ে এসেছে। এখন ঠাকুরপুজোর সময়, তােমার সঙ্গে একটু কথাও বলতে পারব না।” খুড়ীমা বলিলেন, “সে এখন আসতে বাধা দিয়েছিল। আমাদের আর সময় সেই, সেজন্যই এখন এসেছি। মা, আমরা দেশে যাওয়ার সময় ক্ষীরোদকে কিছুদিনের জন্য দেশে নিয়ে যেতে চাই। এতে আপনার কি মত জানতে ইচ্ছা।” মা বলিলেন, “দেশে নিয়ে যাবে, এতে দোষ কি আছে ? তবে রাস্তাখরচটি দিয়ে আবার পাঠিয়ে দিলেই হয়।” তা হবে, বলিয়া প্রণাম করিয়া তাঁহারা গাড়িতে উঠিলেন। 
আমার পরিচিতা একটি মেয়ে শ্রীশ্রীমাকে কখনও দেখে নাই, তাহার স্বামী ওসব খুব পছন্দও করেন না। মেয়েটি আমাকে একদিন জোর করিয়া ধরিল, তাঁহার স্বামী আফিসে চলিয়া গিয়াছেন, বাসায় ফিরিবার পূর্বে যেন তাহাকে লইয়া মাকে দর্শন করাইয়া আসি। বলিলাম, “এ-সময় মা বিশ্রাম করেন, এখন গেলে দেখা পাবে না!” সে বলিল, “চল না, পরে যা হয় হবে।” তাহাকে লইয়া মায়ের বাড়িতে ঢুকিয়াই দেখি গােলাপ-মা প্রসাদ খাইতে বসিয়াছেন। তাহার কাছেই গেলাম। ভাবিলাম, মা যখন জাগিবেন তখন দর্শন হইবে। গােলাপ-মা আমাকে দেখিয়া বলিতেছেন, “তাের যত সব কাণ্ড! এখন একে নিয়ে কেন এলি? জানিস না, এখন মায়ের বিশ্রামের সময় ?” বলিলাম, “কেন বকছেন ? মা-ঠাকরুন না জাগলে আমি তাঁর কাছে যাব, আমি কি এতই পাগল ?” একটু পরেই শুনিলাম মা আমাকে ডাকিতেছেন, “বৌমা, এদিকে এস।” মায়ের কাছে গিয়া দেখি, মা তক্তপােশের কাছে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। বলিলেন, “ঐ মেয়েটি কে, মা? এখন এসেছে বলে গােলাপ বুঝি তােমাদের মন্দ বলেছে ? এ যে ঠাকুরের রাজ্য। এখানে কোন আইন-কানুন নেই। এখানে সকলেরই অবারিত দ্বার। যখন যার সময় ও সুযােগ হবে, তখনই আসবে। তুমি কিছু মনে করাে না, মা।” আমরা মাকে প্রণাম করিয়াই চলিয়া আসিলাম। গােলাপ-মাকে বলিলাম, “দেখলেন ? মানুষ কতখানি আর্তি নিয়ে মাকে দর্শন করতে আসে! শুধু মা কেন, আপনাদেরও দর্শন করতে চায়। কিন্তু আপনারা মায়ের দ্বারী কিনা, মানুষকে ঠেলে বিদায় করতে চান। মা যে আমার এক-দুজনের মা নন, তিনি সকলের মা।” গােলাপ-মা হাসিয়া বলিলেন, “যা যা, তােরই জিত হয়েছে।” গােলাপ, যােগীন-মা, গৌরী-মা, লক্ষী দিদি প্রভৃতি আমাদের যেরুপ স্নেহ করিতেন তাহা অতুলনীয়। 
কলিকাতার লেডি ডাক্তার শ্রীমতী প্রমদা দত্তের বাড়ী আমাদের দেশে। তিনি আমাদেরই আত্মীয়া। তাঁহার স্বামীও ছিলেন ডাক্তার। তাহারা ব্রাহ্ম। শ্রীমতী প্রমদা দত্ত একদিন মাকে দর্শন করিতে চাহিলেন, আমাকে লইয়া যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে ধরিলেন। একদিন প্রস্তুত হইলাম। তিনি ডাক্তারী পােশাক না পরিয়া একখানা লালপেড়ে কাপড় পরিলেন। পায়ে জুতাও দিলেন না। মাথায় গঙ্গাজলের ছিটা লইয়া রওনা হইলেন। মায়ের বাড়িতে ঢুকিয়া উপরে উঠিয়া সিঁড়ির পাশের ঘরটিতেই মায়ের ধ্যানস্থ একখানা ফটো থাকিত। ইহা দেখিয়াই প্রমদা দেবী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কার ফটো ?” বলিলাম, “মায়েরই।” অনেক ক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “ইনিই স্বয়ং রাধা।” আমার হাসি পাইল, ব্রাহ্ম হইয়া এসব কি বলেন! উপরে যাইয়া মাকে প্রণাম করিলেন। কতক্ষণ পরে সরলাদিকে মা বলিলেম, “ ঐ খােকাকে এনে এঁকে দেখাও তাে।” খােকাটি যে কাহার, সেকথা আমার মনে নাই। মা এই কথা বলিতে প্রমদা দেবী আমাকে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কি করে জানলেন যে, আমি ডাক্তার ?” পরে ছেলেটিকে দেখানাে হইল। বিকাল চারটায় ঠাকুরকে মিষ্টিভােগ দেওয়া হইয়াছে। মা সকলকে প্রসাদ খাইতে দিলেন, কিন্তু প্রমদা দেবীকে দিলেন না। আমার যেন একটু লজ্জাই করিতে লাগিল। এদিকে শ্ৰীমতী প্রমদা কেবলই আমাকে বলিতেছেন, “সকলকে প্ৰসাদ দিলেন, আমাকে কেন দিলেন না?” আমি বলিলাম, “তুমি মাকে বল না।” আমার হাতে প্রসাদ যাহা আছে, তাহাও তাহাকে দিতে আমার সাহস হয় নাই। পরে প্রমদা দেবী মাকে বলিলেন, “মা, সকলকে প্রসাদ দিলেন, আমাকে দিলেন না কেন ?” মা বলিলেন, “তুমি যে, বাছা, ব্রাহ্ম ; তুমি ইচ্ছা করে না নিলে কি করে দিই ?” তিনি বলিলেন, “আমাকে একটু প্রসাদ দিন।” মাও ঠিক একটি রসােগোল্লা রাখিয়া দিয়াছিলেন। উহা তাহার হাতে দিলেন। প্রমদা দেবী প্রসাদ আঁচলে বাঁধিয়া মাকে প্রণাম করিয়া বাসায় ফিরিলেন। তাঁহার স্বামীকে বলিলেন, “দেখ, আজ আমি যেখানে গিয়াছিলাম তা স্বর্গ। যাঁকে দর্শন ও স্পর্শ করে এসেছি তিনি স্বয়ং রাধা। তােমার জন্য একটু প্রসাদ এনেছি, তুমি যদি শ্রদ্ধার সঙ্গে নাও তবে দেব।” তিনি বলিলেন, “আমার মতাে নগণ্য একজন মায়ের প্রসাদ না খেলে বিশ্বজননীর কি এসে যায় ?” এই বলিয়া প্রসাদ হাতে করিয়া মাথায় ঠেকাইয়া খাইলেন। প্রমদা দেবীও সব বর্ণনা করিয়া কেবলই বলিতে লাগিলেন, “আজ বৃন্দাবনে গিয়ে রাধারাণীর পাদপদ্ম দর্শন করে এসেছি, ধন্য হয়ে এসেছি।”
খুড়ীমা প্রভৃতির দেশে আসাকালীন আমি তাঁহাদের সঙ্গে যাই নাই। দেশে আসিয়া আমার কাকা আমাকে একখানা পত্র দিলেন। লিখিলেন, “মা, তুমি আস নাই বলিয়া বড় দুখ হইতেছে। তুমি জগন্মাতার পাদপদ্মে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়াছ, ইহা ভাবিলে আনন্দের অবধি থাকে না। যদি কোন দিন দেশে আস, তবে যত দোষের গোড়া মনটাকে মায়ের পায়ে বলি দিয়া আসিও। তবেই আর কোন ভাবনা থাকিবে না।” আমি মাকে সেই পত্ৰখানা পাঠ করিয়া শুনাইলাম। মা শুনিয়া বলিলেন, “মন কি শুধু দোষেরই গােড়া? ব্ৰহ্মপদলাভ করার জন্য ছুটেছ, এখন মনকেও সঙ্গে নিতে হবে। সেখানে পৌঁছলে তখন এরা কেউ থাকবে না। এখন মনের সহায়তারই বেশী দরকার। শুদ্ধ মনই তাে মানুষকে পথ দেখিয়ে নেয়।” আমি সে কথা আমার কাকাকে লিখিলাম। শ্রীশ্রীমা আর একটি কথা বলিয়াছিলেন, “দুষ্ট মনকে যদি মােড় ফিরিয়ে দাও, তবে সে-ই ইষ্টকে ধরতে পারে। তা তােমাদের ভাবনার কোনই কারণ নেই। ঠাকুর তােমাদের হাতে ধরেই আছেন। যে-কোন অবস্থায় তিনি সব সময় তােমাদের সঙ্গে আছেন।” মায়ের ওসব কথায় কত যে শক্তি রহিয়াছে, ইহা জীবনে অনেক অনুভব করিয়াছি। . 
একদিন বিকালবেলায় কয়েকজন স্ত্রীলােক আসিয়াছেন। একজন মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা অনেকেই বলে, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নাকি অবতার নন। এ কি সত্য?” মা বলিলেন, “তা তারা বলতে পারে, কারণ দেহধারী একজন মানুষকে অবতার বলে ধরে নেওয়া সহজ নহে। এক কথায়, সকলেই যদি অবতার বলে ধরে নিতে পারতাে তবে আর তাঁকে মার খেয়ে প্রেম বিলাতে হত না।” বলিতে বলিতে মায়ের চোখ দিয়া শতধারে জল পড়িতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে বলিতে লাগিলেন, “অবতার-পুরুষকে সকলে কি ধরতে পারে ? দুই-একজনে চিনতে পারে মাত্র। তার জীব-উদ্ধারের জন্য কত যাতনাই না সহ্য করেন। ঠাকুরের গলা দিয়া রক্ত বের হত, তবুও কথার বিরাম নেই, কিসে জীবের মঙ্গল হয়।” তাহার পর মা ‘মাগুরমাছের ঝােল, যুবতী মেয়ের কোল, বােল হরি বােল’—গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর এই কথাটি কি ভাবে বলা হইয়াছিল, কি ভাবে লােকে বুঝিয়াছিল, ইহার প্রকৃত অর্থ কি, সব বলিয়া সবশেষে বলিলেন, “অবতার দিয়ে তােমাদের কাজ কি? যার যার গুরুই তার কাছে অবতারের চেয়ে অনেক বড় জিনিস—এই মনে করে বসে থাক।”
বাগবাজারে শ্রীশ্রীমার নিকট যে মেয়েরা থাকিত তাহাদের চালচলন মা খুব লক্ষ্য করিতেন। একটি ঘটি বা বাটি জোরে ফেলিলেও মা খুবই বিরক্তি-প্রকাশ করিতেন, বিনা কারণে কাহারও সঙ্গে কথা বলিবারও আদেশ ছিল না। একদিন রাধারাণী উপর হইতে খুব জোরে নামিতেছে, তাহার পায়ে মল ছিল, উহার শব্দ শুনিয়া মা এমনিভাবে উপরের দিকে চাহিয়া রহিলেন, দেখিয়া ভয় হইতে লাগিল। রাধু আসিতেই মা বলিতে লাগিলেন, “রাধি, তাের লজ্জা নেই ? নীচে সব সন্ন্যাসী ছেলের রয়েছে, আর তুই মল পায়ে পরে উপর থেকে দৌড়ে নাবছিস, ছেলেরা কি ভাববে বলতাে? তুই পায়ের মল এখনি খুলে ফেল। এখানে ছেলে মেয়ে যারাই আছে, তারা তামাসা করার জন্যে আসেনি, সকলেই সাধন-ভজন করছে। এদের ভজনের ব্যাঘাত ঘটলে কি হবে জানিস?” এই সব বলিতেই রাধু পায়ের মলগুলি খুলিয়া মায়ের কাছে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। তাহার ভয় নাই, কিন্তু আমরা সকলে ভয়ে অস্থির হইলাম। আর একদিন রাধু, স্নানের পর চিরুনি দ্বারা মাথা আঁচড়াইয়া একখানা গামছায় চাপ দিয়া চুলের পাতা নামাইতেছে। ইহা দেখিয়া মা বলিতেছেন, “ওসব কি করছিস? ওসব করলে তােরা ভাবিস খুবই সুন্দর দেখা যায় ; তা নয়, আমার কাছে ও বিশ্রীই লাগে। আমি তাে জীবনে চুলই বাঁধিনি। গৌরদাসী এসে আমাকে কখনাে কখনাে চুল বেঁধে দিত, তাও আমি বেশী সময় রাখতে পারতুম না, খুলে ফেলতুম। এখন তােদেরই দেখছি অন্য রকম।” গােলাপ-মা কাছে ছিলেন। তিনি বলিলেন, “তুমি যে মা মুক্তকেশী, তাই চুল খােলা রাখবে না তাে কি করবে?”
একদিন এক মুনসেফের স্ত্রী মায়ের ওখানে আছেন। তখন মহাযুদ্ধের আলােচনা হইতেছে। ঐ মেয়েটি মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা সকলেই বলে এই যুদ্ধ নাকি এখানে পর্যন্ত এসে পৌছােবে। তাহলে আমাদের দশা কি হবে, মা?” মা বলিলেন, “ওসব কিছু না, এখানে কি করতে আসবে ? যেখানেই যেমনটি হওয়া দরকার তেমনটি হয় নি, আমার এখানে আসবে কেন?” ইহার পর অনেকেই এ বিষয়ে অনেক কথা বলিলেন। মা যেন একটু স্তব্দ হইয়া গিয়াছিলেন।
দেশে খুব দুর্ভিক্ষ লাগিয়াছে। রামকৃষ্ণ মিশন হইতে দুর্ভিক্ষপীড়িত লােককে অনেক সাহায্য করা হইতেছে। একদিন মা এমনভাবে দুর্ভিক্ষের কথা বলিতে লাগিলেন—কোথায় কত দুরবস্থা, মিশন হইতে কত টাকা ঐ কার্যের জন্য দেওয়া হইতেছে, ছেলেরা কত খাটিতেছে ইত্যাদি—যেন মনে হইল, জগতের সব দুঃখ তিনি আপন প্রাণে অনুভব করিতেছেন। 
আমি মাঝে মাঝে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে লক্ষীদিদির ওখানে যাইতাম। লক্ষীদিদি আমাকে গােপনে প্রায়ই বলিতেন, “মাকে বলিস আমি এখানে থাকব না। এই যে আমার ভাই-এর মেয়েরা আমার সেবা-যত্নের জন্য রয়েছে, এরা কোন ভক্তের আসা পছন্দ করে না। যেখানে ভক্ত নেই সেখানে আমি থাকতে পারবাে না। মাকে বলিস আমি বৃন্দাবনে চলে যাব, তাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।” আমি সব কথা মাকে বলিলাম। মা বলিলেন, “দেখ বৌমা, ভক্ত দেখলেই লক্ষী একেবারে পাগল হয়ে যায়। সেইজন্যই ঐ মেয়ে দুটি ভক্ত এলে বিরক্ত হয়। তাদের দোষ নেই, বাছা লক্ষীকে বলো, আমি একদিন যাব। আর তােমাকে তার সঙ্গে কোথাও যেতে হবে না। সে রাস্তায় যদি কোন ভক্ত দেখে, তবে সেখানেই সাতদিন থেকে যাবে। তাকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা সঙ্গে লােক থাকতে হয়। সে বৃন্দাবনে থাকতে চায় ; ওখানে যেরূপ বানরের উপদ্রব, ও কি থাকতে পারবে ?” আমি সকল কথা লক্ষীদিদিকে বলিলাম। আরও বলিলাম, “তােমার যা অবস্থা তাতে অন্যত্র তােমাকে পাঠাতে হলে বিশেষ বন্দোবস্ত করে পাঠাতে হবে। শ্রীশ্রীঠাকুরের যা হ’ত তােমারও নাকি তাই হয়।” বলিইে লক্ষনীদিদি আমাকে বকিতে লাগিলেন। বলিলেন, “ঠাকুরের যা হত তা কি মানুষের হয় ? আমার কি এক ব্যাধি হয়েছে, আমি তাই কোথাও যেতে পারি না।” লক্ষীদিদি নিতান্ত ছেলেমানুষের মতাে হইয়া গিয়াছিলেন। 
একদিন কম্বল বিক্রি করিবার জন্য একজন স্ত্রীলােক আসিয়াছে। নলিনদিদি কম্বল রাখিবার জন্য দর করিতেছে। কম্বলওয়ালী দাম ১lo আনা চাহিতেছে। নলিনদি ১ টাকা বলিতেছে। মা দুর হইতে শুনিয়া নলিনদিকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি এর সঙ্গে কি নিয়ে দামকসাকসি করছ ?" সে বলিল, “আমি কম্বলের দাম এত বলি, সে এত বলে।” অমনি মা একটু অসন্তুষ্ট হইয়া বলিতে লাগিলেন, “তুমি চারআনা পয়সার জন্য তার সঙ্গে এতক্ষণ যাবৎ খ্যাঁচ ম্যাচ করছ ? ছিঃ, সে দু’পয়সা পাওয়ার জন্যই মাথায় করে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। আর তুমি কিনা সামান্য পয়সার জন্য এতখানি সময় ওকে আটকে রেখেছ। বিশেষ, তােমার কম্বলের দরকারই বা কি? সবই তাে তোমার আছে, তবু কিনতে গিয়েছ। (আমাকে দেখাইয়া) বরং বৌমাকে একখানা দিলে ভাল হত। ও কম্বল ছাড়া অন্য জিনিস ব্যবহার করে না, তাও একখানা মাত্র কম্বল। এত শীতে সে এই নিয়ে থাকে, তবু, কার কাছে চায় না। দুখনা কাপড়ের বেশী বােধ হয় জীবনে তিনখানা কাপড় পরেনি। তবু, এতেই বেশ আনন্দে আছে। লোকের ভাল জিনিসটি তােদের চোখে পড়ে না।” আমি শুনিয়া অবাক হইয়া গেলাম, কম্বলের কথা বা কাপড়ের কথা একদিনও তাে মাকে বলি নাই, মা এতটা খবর রাখেন ! আমাদের মা যে সত্যিকার মা, ইহা কতবারই না তিনি বুঝাইয়া দিয়াছেন! স্থুলদেহের অন্তরালে গিয়া মা আমার এখন আরও বেশী করুণা বিতরণ করিতেছেন। মাকে এখন যাহারা ডাকে,অন্তর্যামিনী তাহাদের কাছে উপস্থিত হইয়া সকল গােল মিটাইয়া দেন। আগে মার কাছে যাইতে হইলে কত যােগাযােগের দরকার হইত—এখন মনপ্রাণ ঢালিলে এক জায়গায় বসিয়াই পাওয়া যায়। মায়ের সন্তান যাহারা, তাহারা বিপদে পড়িলে তাঁহাকে না ডাকিলেও তিনি যেন নিজের দরকারেই আসিয়া রক্ষা করিয়া থাকেন—এইরূপও কত ঘটনা শুনিতে পাইয়াছি।
একবার দেশ হইতে ঠিক সপ্তমীপূজার দিন কলিকাতায় আসিয়াছিলাম। আমার শরীর তখন নিতান্ত খারাপ, জ্বর হইতেছিল; সেই জ্বর লইয়াই মাকে পূজা করিব, সেই ভরসায় মনােমত কয়েকটি ফুলসহ মায়ের কাছে গিয়াছি। কিছুদিন আগে পূজ্যপাদ স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজের দেহ গিয়াছে। সেবার মাঠে দুর্গাপূজা হইবে না। কাশীর মঠে পূজা হইবে। আমি মায়ের কাছে যাইয়া মাকে পূজা করিলাম। মা আমাকে দেখিয়াই অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, “আহা, বাছা আমার কেমন হয়ে গেছে!” প্রেমানন্দ মহারাজের জন্যও দুঃখ করিলেন। বলিলেন, “আজ রাত্রেই তুমি কাশীতে রওনা হও। এখানের সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী কয়েকজনও কাশী যাবে। তােমার শরীর নিতান্ত খারাপ হয়ে গেছে, কাশীতে মাসখানেক থাকিও।” বলিলাম, “সেখানে যেয়ে কি হবে! আমার এখানে থাকতে ভাল লাগে।” মা বলিলেন, “বল কি ? সেটা হ’ল বিশ্বনাথের ধাম।” বলিলাম “এটাও অন্নপূর্ণার ধাম।" মা হাসিয়া বলিলেন, “তা হলেও কিছুদিন সেখানে থাকলে শরীর ঠিক হয়ে যাবে।” আমি কিছু তেতুলের আচার দেশ হইতে নিয়া গিয়াছিলাম। অনেক লােক দেখিয়া ভাবিলাম এত ভিড়ে আচারই বা কোথায় যাইবে, মায়ের সেবায় লাগিবে কি-না। অর্ন্তযামিনী মা আমার গােলাপ-মাকে ডাকিয়া বলিলেন, “এই আচারটুকু যত্ন করে রাখ, পরে খাওয়া যাবে ; বৌমাকে কিছু ফল রাস্তায় খাওয়ার জন্যে দিয়ে দাও।” উহা দেওয়া হইল। আমরা রওনা হইলাম। তখন কাশীতে ভীষণ ইনফ্লুয়েঞ্জা। সেখানকার মহারাজগণ আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, “এখন যেরুপ ব্যাধির আক্রমণ কাশীতে দেখা দিয়েছে, এতে আপনি সুস্থ হবেন এতাে দূরের কথা, না জানি এই রােগেই আবার কাতর হয়ে পড়েন। মায়ের আদেশে আসিয়াছি, যাহা হইবার হইবে ভাবিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। সেবার নলিনীদিদি প্রভৃতিও গিয়াছিলেন। তাহার পূজার পরই অন্যত্র চলিয়া গেলেন, আমি কাশীতেই রহিলাম। আমি রাণামহলে থাকিতাম। কিছুদিন পরে আমার সেই ব্যাধি হইল। তখন মহারাজগণ ডাক্তার ও ঔষধ পাঠাইয়া আমাকে খুবই সাহায্য করিতে লাগিলেন। একদিন স্বপ্নে দেখি, মা আসিয়া বলিতেছেন, “কোন ভয় নেই, আমি আছি। আমি তাের যত্ন নেব।” পরদিন হইতেই ভালর দিকে চলিলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হইয়া উঠিলাম। একমাস পূর্ণ হইতেই পুনরায় কলিকাতা চলিয়া আসিলাম। মা আমাকে দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, “বাঁচা গেল বাবা। যা অসুখ তােমার হয়েছিল, ভালর জন্য পাঠিয়ে মন্দ হতে চলেছিল।”
***********

দ্বিতীয় ভাগ
==========

Post a Comment

0 Comments