কবিতা (অনুবাদ) - স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
সপ্তম খণ্ড

কবিতা (অনুবাদ)

*******************

সন্ন্যাসীর গীতি

সন্ন্যাসীর গীতি


সন্ন্যাসীর গীতি১

উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
হিমাদ্রিশিখরে উঠিল যে গান—
গভীর অরণ্যে পর্বত-প্রদেশে
সংসারের তাপ যথা নাহি পশে,
যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরী
সংসারের রোল উঠে ভেদ করি;
কাঞ্চন কি কাম কিম্বা যশ-আশ
যাইতে না পারে কভু যার পাশ;
যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী
—সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি,
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও, গাও সেই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১
ভেঙে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল—
সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,
হে ধীমান্, তারা তোমার বন্ধনে?
ভাঙ শীঘ্র তাই ভাঙ প্রাণপণে।
ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,
ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।
আদর’ দাসেরে, কশাঘাত কর,
দাসত্ব-তিলক ভালের উপর;
স্বাধীনতা-বস্তু কখনও জানে না,
স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।
তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর;
কর কর গান, কর নিরন্তর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ২
যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,
আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রম
ঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারে
লয়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।
জীবনের এই তৃষা চিরতরে
মিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।
এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরে
জন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।
সে-ই সব জিনে—নিজে জিনে যেই,
ফাঁদে পা দিও না—জেনে তত্ত্ব এই।
বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্‌—
করহ আনন্দে কর এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৩
‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে’
বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,
শুভ কর্মে—শুভ, মন্দে—মন্দ ফল,
এ নিয়ম রোধে নাহি কারও বল।
এ মর-জগতে সাকার যে জন,
শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’
সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারে
নিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দে বিহরে।
জান ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা‚
করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৪
সত্য কিবা তারা জানে না কখনও,
সবাই যাহারা দেখয়ে স্বপন—
পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব—
আত্মা তো কখনও নহে এই সব;
নাহি তাহে কোন লিঙ্গালিঙ্গভেদ,
নাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।
কার পিতা তবে, কাহার সন্তান?
কার বন্ধু শত্রু কাহার ধীমান?
একমাত্র যেবা—যেবা সর্বময়,
যাহা বিনা কোন অস্তিত্বই নয়,
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
উচ্চরবে তাই এই তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৫
একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,
অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয়;
তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়া
দেখিছে এ সব স্বপনের ছায়া;
সাক্ষীর স্বরূপ—সদাই বিদিত,
প্রকৃতি-জীবাত্মারূপে প্রকাশিত;
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
ধর ধর ধর, উচ্চ তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৬
অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর?
পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর;
শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ;
নিজ হস্তে রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।
ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,
ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৭
দাও দাও দাও সবারে অভয়,
বল—‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয়;
ত্রিদিব পাতাল থাক যে যেখান,
সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান;
স্বরগ নরক, ইহামুত্রফল
আশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’
এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন,
গাও গাও গাও করে প্রাণপণ—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৮
ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,
থাকে কিম্বা যায়—অনন্ত নিয়তি;
কার্য অবশেষ হয়েছে উহার,
এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার;
কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,
কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে;
চিত্তের প্রশান্তি ভেঙো না কখনও,
সদাই আনন্দে রহিবে মগন;
কোথা অপযশ—কোথা বা সুখ্যাতি?
স্তাবক-স্তাব্যে একত্ব-প্রতীতি,
অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।
জানি এ একত্ব আনন্দ-অন্তরে,
গাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৯
পশিতে পারে না কভু তথা সত্য,
কাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত;
কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,
হয় না তাহার বন্ধন-মোচন;
কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,
হউক সামান্য—বন্ধন অপার;
ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,
হইতে না পারে কভু মায়া পার।
ত্যজ অতএব এ সব বাসনা,
আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১০
সুখ তরে গৃহ করো না নির্মাণ,
কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্‌?
গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,
শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস;
দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,
সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও;
হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,
ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।
শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারে,
কোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে?
হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,
স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।
উঠাও আনন্দে উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও সদা এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১১
তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,
অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয়;
হে মহান্‌, তোমা করিবেক ঘৃণা,
তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।
স্বাধীন উন্মুক্ত—যাও স্থানে স্থানে,
অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে—
মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,
নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।
বিপদের ভয় করো না গণনা,
সুখ অন্বেষণে যেন হে মেতো না;
যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমিপারে,
গাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১২
এইরূপে বন্ধো, দিন পর দিন,
করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ;
আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,
জনম তাহার আর না হইবে;
‘আমি’ বা ‘আমার’ কোথায় তখন?
ঈশ্বর—মানব—তুমি—পরিজন—
সকলেতে ‘আমি’, আমাতে সকল—
আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।
সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,
তাই হে আনন্দে ধর তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১৩

*******************

প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি

প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি

                                                 জাগো আরও একবার!

মৃত্যু নহে, এ যে নিদ্রা তব,
জাগরণে পুনঃ সঞ্চারিতে
নবীন জীবন, আরও উচ্চ
লক্ষ্য ধ্যান তরে, প্রদানিতে
বিরাম পঙ্কজ-আঁখি-যুগে।
হে সত্য! তোমার তরে হের
প্রতীক্ষায় আছে বিশ্বজন,
—তব মৃত্যু নাহি কদাচন। ১

                                                  হও পুনঃ অগ্রসর,

তব সেই ধীর পদক্ষেপে
নাহি যাহে হরে শান্তি তার,
নিরুদ্বেগে পথিপার্শ্বে স্থিত
দীন হীন ধূলি-কণিকার;
শক্তিমান্‌ তবু, মতি স্থির,
আনন্দ-মগন, মুক্ত, বীর;
হে সুপ্তিনাশন, চিরাগ্রণি!
ব্যক্ত কর তব বজ্রবাণী। ২

                                                  লুপ্ত সে জনম-গৃহ,

যেথা বহু স্নেহসিক্ত হিয়া
পালিলা শৈশবে, হর্ষভরে
নিরখিলা যৌবন-উন্মেষ;
কিন্তু হের নিয়তি সে ধরে অমোঘ প্রভাব—সৃষ্ট যাহা
প্রকৃতি-নিয়মে সবে-ফিরে
যেথা স্থান উদ্ভব-কারণ
লভিবারে প্রাণশক্তি পুনঃ। ৩

                                                  উরহ আবার তবে,

সেই তব জন্মস্থান হতে,
হিম-স্তূপ অভ্রকটিহার
আশীষিবে যেথায় সতত,
শক্তি দিবে করিয়া সঞ্চার
নব নব অসাধ্য সাধনে;
যেথা সুরনদী তব স্বর
বাঁধিবে অমর গীতি-সুরে;
দেবদারু ছায়া বিধানিবে
নিত্য শান্তি যেথা তব শিরে। ৪

                                                  সর্বোপরি, যিনি উমা

শান্তপূতা হিমগিরিসুতা
শক্তিরূপে প্রাণরূপে আর
জননী যে সর্বভূতে স্থিতা,
কার্য যাহা সবি কার্য যাঁর,
এক ব্রহ্ম করে প্রপঞ্চিত,
কৃপা যাঁর সত্যের দুয়ার
খুলি এক বহুতে দেখায়,
দিবে শক্তি সে জননী তোমা
ক্লান্তিহীন, স্বরূপ যাঁহার
অসীম, সে প্রেম পারাবার। ৫

                                                  আশীষিবে তোমা তাঁরা,

পরমর্ষি সবে, যাঁহাদের
কোন দেশ, কোন কাল নারে
শুধু আপনার বলিবারে,
—এ জাতির জনয়িতৃগণ—
সত্যের মরম যাঁরা সবে,
একই রূপ করি অনুভব,
নিঃসঙ্কোচে প্রচারিল ভবে ভাল মন্দ যেমন ভাষায়,
তুমি দাস তাঁহাদের, তায়
লভিয়াছ রহস্য সে মূল।
—বস্তু এক, ইথে নাহি ভুল। ৬

                                                  হে প্রেম! কহ সে তব

শান্ত স্নিগ্ধবাণী, মায়া-সৃষ্টি
যাহার স্পন্দনে লয় পায়,
স্তরে স্তরে ছায়াস্বপ্ন আর
হের সব শূন্যেতে মিলায়,
অবশেষে সত্য নিরমল
‘স্বে মহিম্নি’ বিরাজে কেবল। ৭

                                                  কহ আর বিশ্বজনে …

উঠ, জাগ, স্বপ্ন নহে আর।
স্বপন-রচনা শুধু ভবে—
কর্ম হেথা গাঁথে মালা যার
নাহি সূত্র বৃন্তমূলহীন
ভাল মন্দ পুষ্প ভাবনার,
জন্ম লভে, গর্ভে অসতের,
সত্যের মৃদুল শ্বাসে ধায়
আদিতে যে শূন্য ছিল তায়!
অভী হও, দাঁড়াও নির্ভয়ে
সত্যগ্রাহী, সত্যের আশ্রয়ে,
মিশি সত্যে যাও এক হয়ে,
মিথ্যা কর্ম-স্বপ্ন ঘুচে যাক—
কিম্বা থাকে স্বপ্নলীলা যদি,
হের সেই, সত্যে গতি যার,
থাক স্বপ্ন নিষ্কাম সেবার
আর থাক প্রেম নিরবধি। ৮
*******************

মৃত্যুরূপা মাতা

মৃত্যুরূপা মাতা
মৃত্যুরূপা মাতা৩

নিঃশেষে নিভেছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘে,
স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণ-বায়ুবেগে!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরাণ, বহির্গত বন্দীশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি’ ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে!
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, উঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
নভস্তল পরশিতে চায়! ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তার মৃত্যুর কালিমা মাখা গায়।

লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!

করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালি, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।

সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।

*******************

খেলা মোর হল শেষ

খেলা মোর হল শেষ৪

কভু উঠি, কখনও বা পড়ি                          কালের তরঙ্গ সনে
গড়াইয়া চলিয়াছি হায়,
ক্ষণস্থায়ী এক দৃশ্য হতে                          স্বল্পস্থায়ী দৃশ্যান্তরে
জীবনের জোয়ার-ভাঁটায়।
অন্তহীন এই প্রহসনে                          তিক্ত আজি প্রাণ মোর;
আর ইহা নাহি লাগে ভাল,
মিছে ছোটা, পাব নাতো কভু,                          দেখা নাহি যায় দূরে,
সাগরের পারে তীর কালো!
জন্ম হতে জন্মান্তরাবধি                          দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছি,
কভু দ্বার খুলিল না হায়,
আঁখি মম ক্ষীণ হল তবু,                          বৃথা আশা ধরিবারে
সে আলোর একটি ছটায়।
অতি ক্ষুদ্র এই জীবনের                          সমুচ্চ সঙ্কীর্ণ সেই
সেতু ’পরে দাঁড়াইয়া চাহি—
অগণিত জনগণ নীচে                         যুঝিছে, কাঁদিছে কেহ
হাসিতেছে—কেন জানি নাহি,
সম্মুখেতে ভীষণ কপাট                          ভ্রূভঙ্গে চাহিয়া বলে,
‘আর নাহি হও অগ্রসর,
এই সীমা অদৃষ্টের তব;                         প্রলুদ্ধ করো না আর,
যত পার সব সহ্য কর।
মিশে যাও ইহাদের সাথে                         পান কর হলাহল
নাচো গাও উহাদের সনে
জানিবারে বাসনা যাহার,                          দুঃখ আছে তার ভালে,
অতএব রহ এই স্থানে।’
আমি কিন্তু থাকিতে না চাই,                          জলবুদ্বুদের সম
ভাসমান এই পৃথ্বীতল,
শূন্যগর্ভ গঠন ইহার,                          শূন্যগর্ভ নাম তার,
জন্মমৃত্যু-শূন্য সে সকল।
মোর কাছে মিছা এই সব,                         আমি চাই ভেদিবারে
নামরূপ মিথ্যা অবয়বে,
খুলিবারে চাহি আমি ওই                          সম্মুখের প্রশস্ত কপাট—
মোর লাগি খুলিতেই হবে।
দুয়ার খুলিয়া দাও মাতঃ!                         হেরি পথ আলোক-ছটায়
খেলা মোর হইয়াছে শেষ—
অতি শ্রান্ত পুত্র তব মা গো,                          আকুল আকাঙ্ক্ষা হৃদে
গৃহে আজি করিবে প্রবেশ।
ঘন ঘোর অন্ধকার মাঝে                          খেলিতে ছাড়িয়া দিয়ে
বিভীষিকা দেখাও আমারে,
আশা মোর হল আজি শেষ,                          ভয় আসি দেখা দিল
খেলার আনন্দ গেল দূরে।
তপ্ত স্ফীত সাগর সমান                          গভীর দুঃখের মাঝে
রিপুদল প্রবল তাড়নে,
তরঙ্গে বিক্ষিপ্ত হেথা সেথা                          কত কষ্ট পাই মা গো
ভবিষ্যৎ সুখের ছলনে।
জীবনের অর্থ হেথা হায়                          জীবন্ত মরণ, আর
মরণ যে কেবা বলো জানে—
সুখদুঃখ নিয়ত-চক্রের                          পুনঃ সেই প্রবর্তন
নব আবর্তন নাহি আনে।
শিশু দেখে মধুর স্বপন—                          স্বর্ণসম সমুজ্জ্বল,
ধূলিতে তা হয় পরিণত,
পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে হায়—                          ভগ্ন তার শত আশা,
পুঞ্জীভূত মরিচার মত।
জীবনের শেষপ্রান্তে যবে                          বিলম্বে লভিয়া জ্ঞান
চক্র ছাড়ি যাই মোরা চলি,
অন্যজন নবতেজ লয়ে                          সে চক্র ঘুরাতে আসে
দিন যায় বর্ষ পড়ে ঢলি।
ঘোরে চক্র অবিরত বেগে                         মায়া-ক্রীড়নক মাত্র
কামনা ইহার কেন্দ্রস্থল,
বৃথা আশা দেয় গতিবেগ                          এ চক্রের দণ্ড যত
সুখ দুঃখ অনিত্য কেবল।
ভাসিয়া চলেছি আজ আমি,                          কোথা তাহা নাহি জানি,
এ অনলে বাঁচাও গো আসি,
করুণা-আধার তুমি মা গো,                          রক্ষা কর মোরে, যেন
কামনা-সাগরে নাহি ভাসি।
ফিরায়ো না দেখায়ো না মোরে,                         ভয়ঙ্কর মুখ তব
সহিতে পারি না আমি এত,
ক্ষমা কর দেহ মা অভয়                          সদয়া হও গো আজি
দোষ মম নাহি ধর মাতঃ!
নিয়ে যাও জননি গো মোরে                          সেই দূরে পরপারে,
যেথায় সকল দ্বন্দ্ব শেষ,
সকল দুঃখের পারে, অশ্রু                          যেথা নাহি দেখা দেয়
পার্থিব সুখেরও নাহি লেশ।
যাহার গরিমা রবি শশী,                          অনন্ত তারকারাজি
উজলিত আকাশের পটে,
ক্ষণপ্রভা রূপের ছটায়                          প্রকাশিতে নাহি পারে
মাত্র তার প্রতিবিম্ব রটে।
দেখো যেন মিছা স্বপ্নে মা গো                         তোমার মু’খানি হতে
আমারে আড়াল নাহি করে,
খেলা মোর হল আজি শেষ,                         শৃঙ্খল ভাঙিয়া দাও,
মুক্ত আজি কর মা আমারে।

*******************

দোষ কারও নয়

দোষ কারও নয়৫

দিনমণি ডুবে অস্তাচলে,
রেখে যায় রক্তরাঙা কর,
আলোকিত ক্ষীণ দিনমানে
এই যেন শেষ অবসর!
রাখি আঁখি দেখি সচকিতে
বিজয়ের রাশি পিছে রয়,
জয়ে গণি হীন লজ্জা বলে
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।
জীবনেরে গড়ি দিন দিন
কিম্বা উহা করে চলি ক্ষয়,
যথাকর্ম সেইরূপ ফল—
শুভে শুভ, মন্দে মন্দ হয়।
স্রোত যদি একবার ধায়
রোধ কিম্বা নিয়ন্ত্রণ তার
সাধ্য নহে কভু আর কারও,
আমা ছাড়া দোষ তবে কার?
আমি হই রূপধারী সেই,
ছিল যাহা অতীত আমার,
সৃষ্টিবীজ সুপ্ত সেখানেই
বিকশিতে ভুবনে আবার।
ইচ্ছা, চিন্তা—যে অতীত ধরি
মনোমাঝে সদা ব্যক্ত হয়,
বাহিরের আকৃতিও তাই,
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।

প্রেমরূপে ফিরে আসে প্রেম
ঘৃণা আনে ঘৃণা তীব্রতর,
পরিমাপ নিজে তারা করে
রেখে যায় ছাপ মোর ’পর।
জীবনের শেষে মরণেও
তাহাদের দাবী জমা রয়,
এই ভোগ—দায় আমারি তো
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।

ত্যজিলাম মিছে ভয়রাশি
বৃথা যত পরিতাপ আর
বুঝিয়াছি গূঢ় অনুভবে
স্বকর্মের কিবা অধিকার।
হর্ষ-ব্যথা অপমান যশ—
মোর কর্মে জাত প্রেতচয়,
ইহাদের সম্মুখে দাঁড়ানু
আমি ছাড়া কেহ দোষী নয়।

ভাল মন্দ প্রেম আর ঘৃণা
সুখ তথা দুঃখ যাহা বলি
একে ছাড়ি অন্য নাহি থাকে,
যুগ্মভাবে বাঁধা তো সকলি।
দুঃখ ছাড়া সুখস্বপ্ন দেখি
ভ্রান্তি শুধু! সত্য নাহি হয়,
আসিল না, আসিবে না কভু
আমি ছাড়া কেহ দোষী নয়।

অতএব ত্যজিলাম ঘৃণা
ত্যজিলাম তুচ্ছ ভালবাসা,
দূর করি দ্বন্দ্বের সংঘাত
মিটিয়াছে জীবনের তৃষা।
চিরমৃত্যু—ইহাই তো চাই
—নির্বাণ এ জীবন-শিখার,
ঘুচে-যাওয়া কর্মের আশ্রয়
রহিবে না দোষী কেহ আর।

একমাত্র নরবর, এক সেই প্রভু
একমাত্র সিদ্ধ আত্মা যিনি
কুহেলী-সন্দেহঘেরা যত পথ ছিল
ঘৃণাভরে ত্যজিলেন তিনি,
অসীম সাহসভরে করিয়া মনন,
অসঙ্কোচে উদ্দেশ্য দেখান—
‘মৃত্যু মহা-অভিশাপ, জীবনেও তাই
শ্রেষ্ঠ বস্তু জানিও নির্বাণ।’

ওঁ নমো ভগবতে সম্বুদ্ধায়
ওঁ নতি মোর ভগবান্ বুদ্ধ যিনি তাঁয়।

*******************

ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়

ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়৬

সূর্য যদি মেঘাচ্ছন্ন হয় কিছুক্ষণ
যদি বা আকাশ হের বিষণ্ণ গম্ভীর,
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়,
জয় তব জেনো সুনিশ্চয়।
শীত যায়, গ্রীষ্ম আসে তার পাছে পাছে,
ঢেউ পড়ে, ওঠে পুন তারি সাথে সাথে,
আলো ছায়া আগাইয়া দেয় পরস্পরে;
হও তবে ধীর, স্থির, বীর।
জীবনকর্তব্য-ধর্ম বড় তিক্ত জানি,
জীবনের সুখচয় বৃথা ও চঞ্চল,
লক্ষ্য আজ বহুদূরে ছায়ায় মলিন;
তবু চল অন্ধকারে হে বীর হৃদয়,
সবটুকু শক্তি সাথে লয়ে।
কর্ম নষ্ট নাহি হবে, কোন চেষ্টা হবে না বিফল,
আশা হোক উন্মূলিত, শক্তি অস্তমিত,
কটিদেশ হতে তব জনমিবে উত্তরপুরুষ,
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়
কল্যাণের নাহিক বিলয়।
জ্ঞানী গুণী মুষ্টিমেয় জীবনের পথে—
তবুও তাঁরাই হেথা হন কর্ণধার,
জনগণ তাঁহাদের বোঝে বহু পরে;
চাহিও না কারও পানে, ধীরে লয়ে চল।
সাথে তব ক্রান্তদর্শী দূরদর্শী যাঁরা,
সাথে তব ভগবান্ সর্বশক্তিমান্‌,
আশিস ঝরিয়া পড়ে তব শিরে—তুমি মহাপ্রাণ—
সত্য হোক, শিব হোক সকলি তোমার।

*******************

অজানা দেবতা

অজানা দেবতা

অজানা দেবতা৭


অন্ধকার নিরাশার বিসর্পিল পথে ক্লান্ত পদে
এ নির্মম নিরানন্দ জীবনের ভারনত
চলেছে পথিক।
হৃদয়ের মননের কোন প্রান্ত হতে
কোথাও মেলে না প্রাণে
নিমেষের প্রেরণা-স্পন্দন।
অবশেষে একদা যখন
লুপ্তপ্রায় সীমারেখা
ভালমন্দ সুখদুঃখ জন্মমরণের—
অকস্মাৎ উদ্ভাসিল পুণ্যরজনীতে
অপরূপ জ্যোতিরেখা হৃদয়েতে তার।
কোন্ উৎস হতে এল অচেনা এ আলো—
কিছুই তো জানে না সে।
তবুও জানাল
আলোক-ঈশ্বরে তার প্রাণের প্রণাম।
অজানা আশার বাণী
ব্যাপ্ত হল সমগ্র সত্তায়,
স্বপ্নাতীত মহিমায়
পূর্ণ করে দিল তার সমস্ত ভুবন,
সে ভুবন পার হয়ে আভাসিল আর এক জগৎ।
বলিলেন মৃদু হেসে পণ্ডিতের দল—
‘অন্ধ এ বিশ্বাস।’
সে আলোর দীপ্ত শান্তি অনুভব করি’
বলিল সে নম্র প্রত্যুত্তরে,
‘ধন্য মানি এ অন্ধবিশ্বাস।’


স্বাস্থ্য, শক্তি, সম্পদের সুরামত্ত
আর এক পথিক,
জীবনের ঘূর্ণাবর্তে ছুটে চলে
উন্মাদের মত,
অবশেষে একদা যখন
এ পৃথিবী মনে হয় বিলাস-কানন
খেলার পুতুল যত কীটসম মানুষের দল,
নিয়তচঞ্চল যত বিলাসের বিচ্ছুরিত আলো
দৃষ্টিরে আচ্ছন্ন করে, ইন্দ্রিয় অবশ,
সুখদুঃখ একাকার, অনুভূতিহীন;
প্রমোদমদিরামত্ত মহামূল্য এ দেহচেতনা
শবসম লগ্ন হয়ে থাকে তার দুই বাহুপাশে,
যত সে ছাড়াতে চায়,
তত তার বক্ষ জুড়ে আসে;
উন্মাদ-কল্পনা-ভরে বহুরূপে মৃত্যুরে সে চায়,
ফিরে আসে আরবার মুগ্ধ আকর্ষণে।
তারপর একদিন
দুর্ভাগ্যের দাহ এল নেমে—
হৃতশক্তি, সম্পদবিহীন,
বেদনায়, অশ্রুধারে, মর্মযন্ত্রণায়—
আত্মীয়তা ফিরে পেল সারা নিখিলের।
বন্ধুজন করে পরিহাস।
কৃতজ্ঞ হৃদয় তার করে উচ্চারণঃ
‘ধন্য দুঃখ; ধন্য এ বেদনা।’


সুন্দর সুঠাম দেহ,
শুধু মন তার শক্তিহীন
দুর্বার গভীর কোন আবেগ-সংযমে,
অমোঘ-প্রবৃত্তি-স্রোত
রুদ্ধ করা অসাধ্য তাহার।
সংসারে সবাই তারে—
সদাশয়, ভাল—বলে জানে।
পরম নিশ্চিন্ত ছিল আপনারে নিয়ে।
দূর হতে দেখেছে সে চেয়ে—
সংসার-তরঙ্গসাথে বৃথা যুদ্ধে রত
নরনারী যত।
দেখিতে দেখিতে মন, মক্ষিকার মত
কেবলি ক্লেদাক্ত দেখে সকল সংসার,
সব গ্লানিময়।
তারপর একদা কখন,
সহসা সৌভাগ্যসূর্য দেখা দিল হেসে,
তারি সঙ্গে ঘটে গেল নির্মম পতন।
সেই তার দৃষ্টি-উন্মোচন।
বুঝিল সেঃ নিয়ম ভাঙে না কভু
তরু ও প্রস্তর,
তবু তারা প্রস্তর ও তরু হয়ে থাকে।
নিয়মবন্ধন হতে ঊর্ধ্বে এসে
সংগ্রামসাধনা দিয়ে
ভাগ্যেরে সে করে নেবে জয়—
এ পরম অধিকার মানুষেরই তরে।
চিত্তের জড়তা ঘুচি নবীন জীবন
হল মুক্ত, প্রসারিত—
সংগ্রাম-সমুদ্রপারে যে অনন্ত শান্তি বিরাজিত
তাহারি আলোক-রশ্মি
উদ্ভাসিল জীবনের দিগন্ত-রেখায়।
পশ্চাতে রয়েছে পড়ি’
অতীতের
অকৃতার্থ নিষ্ফল জীবন,
তরু ও প্রস্তর সম চেতনাবিহীন,
আর একদিকে তার স্খলনপতন,
যার লাগি’ বর্জন করেছে তারে সমস্ত সংসার।
সানন্দ-অন্তরে তবু
ধন্য মানি এ অধঃপতন
ঘোষিল সেঃ ‘ধন্য এই পাপ।’

*******************

হে স্বপন!

হে স্বপন!

হে স্বপন!৮

ভাল মন্দ যাই হয় হোক,
সুখের সুস্মিত হাসি দেখা দেয় যদি,
অথবা উদ্বেল হয় দুঃখ-পারাবার,
সবারি আপন অংশ আছে অভিনয়ে,
কারও হাসি কারও কান্না, যখন যেমন,
রয়েছে আপন সাজ প্রত্যেকের তরে—
রৌদ্র জলে আবর্তিয়া চলে দৃশ্যান্তর।

হে স্বপন! সার্থক স্বপন!
কাছে দূরে প্রসারিত কর মায়াজাল,
পেলব কোমল কর তীব্র রেখা যত,
সব রুক্ষতারে তুমি নম্র করে তোলো।

তোমারি মাঝারে আছে সব ইন্দ্রজাল।
তোমারি পরশে
প্রাণপুষ্পে হিল্লোলিত
জাগে মরুভূমি,
মধুর সঙ্গীতে ভরে
ঘনঘোর অশনি-গর্জন,
মৃত্যু আনে মধুময় মুক্তির আস্বাদ।

*******************

অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি

অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি

অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি৯

তুষার-কঠিন মাটিই না হয় হোক না তোমার শয্যা,
আবরণ তব শীতার্ত ঝঞ্ঝার,
জীবনের পথে নাই বা জুটিল বন্ধুজনার হর্ষ,
ব্যর্থ তোমার সৌরভ-বিস্তার;

প্রেম যদি হয় নিজেই ব্যর্থ তবু কী-বা আসে যায়
না হয় ব্যর্থ সৌরভসঞ্চার—
অকল্যাণের জয় যদি হয়, কল্যাণ পরাজিত,
পুণ্যের ’পরে পাপের অত্যাচার;

তবু প্রশান্ত বিকশিত থাক, পবিত্র মধুময়
থাক অবিচল আপনার মহিমায়,
দাও, ঢেলে দাও স্নিগ্ধ উদার মধু সৌরভ তব
চির-প্রসন্ন অযাচিত করুণায়।

*******************

কে জানে মায়ের খেলা!১০

কে জানে—হয়তো তুমি ক্রান্তদর্শী ঋষি!
সাধ্য কার স্পর্শ করে সে অতল গভীর গহন,
যেখানে লুকান রয় মা’র হাতে অমোঘ অশনি!

হয়তো পড়েছে ধরা উৎসুক করুণনেত্র শিশুর দৃষ্টিতে,
দৃশ্যের আড়ালে কোন ছায়ার সঙ্কেত,
মুহূর্তে যা হতে পারে দুর্নিবার ঘটনাপ্রবাহ।
আসে তারা কখন কোথায়, মা ছাড়া কে জানে!

হয়তো বা জ্ঞানদীপ্ত মহান্‌ তাপস,
বলেছেন যতটুকু,
তারও বেশী পেয়েছেন প্রাণে।
কে জানে কখন,
কার হৃদি-সিংহাসনে
মা আমার পাতেন আসন।

মুক্তিরে বাঁধিবে কোন্ নিয়মশৃঙ্খলে,
ইচ্ছারে ফিরাবে তাঁর কোন্ পুণ্যবলে,
সংসারের শ্রেষ্ঠ বিধি—খেয়াল তাঁহার
ইচ্ছামাত্র অমোঘ বিধান।

হয়তো শিশুর চোখে দিব্যদৃষ্টি জাগে,
স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা পিতার হৃদয়,
হয়তো সহস্র শক্তি কন্যার অন্তরে
রেখেছেন বিশ্বমাতা সযত্ন সঞ্চয়।

*******************

পানপাত্র

পানপাত্র
পানপাত্র১১

এই তব পানপাত্র, তোমারি উদ্দেশে
সৃষ্টির উন্মেষ হতে এ পাত্র-রচনা।
জানি জানি এ পানীয় কালকূট ঘোর,
তোমারি মন্থিত সুরা—দূর অতীতের
বাসনা বেদনা ভ্রান্তি যুগযুগান্তের।

দুর্গম দুঃসহ পন্থা—এই তব পথ,
প্রতি পদে অবিশ্রান্ত উপল-সঙ্ঘাত
সে আমারি দান। দিয়েছি বন্ধুরে তব
স্নিগ্ধ স্বচ্ছ পত্রখানি সানন্দযাত্রার।
তোমারি মতন সেও পাবে মোর বক্ষে
পরম আশ্রয়। তোমারে চলিতে হবে
এই পথ ধরে—এ নির্মম নিরানন্দ
নিঃসঙ্গ সাধন—আর কারও তরে নয়,
এ শুধু তোমার। মোর বিশ্বরচনায়
আছে তারও স্থান। লও এই পানপাত্র—
বুঝিতে বলিনি আমি, কি অর্থ ইহার,
শুধু চোখ বুঝে দেখ স্বরূপ আমার।

*******************

জাগ্রত দেবতা

জাগ্রত দেবতা

জাগ্রত দেবতা ১২

সেই এক বিরাজিত অন্তরে বাহিরে,
সব হাতে তাঁরি কাজ,
সব পায়ে তাঁরি চলা,
তাঁরি দেহ তোমরা সবাই,

কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।

মহামহীয়ান যিনি, দীন হতে দীন,
একাধারে কীট ও দেবতা যিনি,
পাপী পুণ্যবান,
দৃশ্যমান, জ্ঞানগম্য, সর্বব্যাপী, প্রত্যক্ষ মহান্‌,
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।

অতীত জীবনধারা নাই তাঁর মাঝে,
অথবা আগামী কোন জনম মরণ,
নিয়ত ছিলাম মোরা তাঁহাতে বিলীন,
চিরকাল এক হয়ে রব তাঁরি বুকে।
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।

ওরে মূর্খদল!
জীবন্ত দেবতা ঠেলি’,
অবহেলা করি’
অনন্ত প্রকাশ তাঁর এ ভুবনময়,
চলেছিস ছুটে মিথ্যা মায়ার পিছনে
বৃথা দ্বন্দ্ব কলহের পানে—
কর তাঁর উপাসনা, একমাত্র প্রত্যক্ষ দেবতা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।

*******************

আলোক

আলোক

আলোক ১৩

সম্মুখে পশ্চাতে চেয়ে দেখি—
সব ঠিক, সকলি সার্থক।
বেদনার গভীর আমার
জ্বলে এক চিন্ময় আলোক।

*******************

শান্তিতে সে লভুক বিশ্রাম



চল আত্মা, শীঘ্রগতি, তারকা-খচিত তব পথে,
ধাও হে আনন্দময়, যেথা নাহি বাঁধে মনোরথে;
দেশকাল দৃষ্টিপথ যেথা নাহি করে আবরণ!
চিরশান্তি আশীর্বাদ যেথা করে তোমারে বরণ!

সার্থক তোমার সেবা, পরিপূর্ণ তব আত্মদান,
অপার্থিব প্রেমপূর্ণ হৃদয়েতে হোক তব স্থান;
মধুময় তব স্মৃতি দেশকাল দিয়াছে মিলায়ে,
বেদীতলে পুষ্পসম রেখে গেলে সৌরভ বিছায়ে!

টুটেছে বন্ধন তব, পেয়েছ সে আনন্দ-সন্ধান,
জন্মমৃত্যুরূপে যিনি, তাঁর সাথে হলে একপ্রাণ,
তুমি যে সহায় ছিলে, স্বার্থত্যাগী চির এ ধরায়,
আগে চল, সংসার-সংগ্রামে আনো প্রীতির সহায়

*******************

আশীর্বাদ

আশীর্বাদ ১৫

আশীর্বাদ ১৫

বীরের সঙ্কল্প আর মায়ের হৃদয়,
দক্ষিণের সমীরণ—মৃদুমধুময়,
আর্যবেদী ’পরে দীপ্ত মুক্ত হোমানলে
যে পুণ্য সৌন্দর্য আর যে শৌর্য বিরাজে—
সকলই তোমার হোক, আরও, আরও কিছু
স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা অতীতের কেহ।

ভারতের ভবিষ্যৎ সন্তানের তরে
তুমি হও বন্ধু, দাসী, গুরু—একাধারে।

*******************

মুক্তি

১৬. মুক্তি

মুক্তি১৬

ওই দেখ মিলাইয়া যায় কালো মেঘপুঞ্জ যত
রাত্রির আঁধারে আরও ঘন করি, ধরণীর ’পরে
তাহারা থমকি ছিল, অবসন্ন বিষাদ কালিমা!
তোমার মোহন-স্পর্শে জগৎ জাগিয়া উঠে ওই!
পাখীরা তুলিছে তান—ফুলদল তুলে ধরে তার
শিশির-খচিত শত তারার মুকুট; সুস্বাগত
জানায় তোমায় তারা দুলিয়া দুলিয়া। সরোবর
প্রেমভরে মেলিয়াছে শত শত আঁখিশতদল—
তোমারে বরিয়া নিতে, তার সারা গভীরতা দিয়া।
এস, এস, এস তুমি, আলোকের ওগো অধিরাজ!
তোমারি লাগিয়া আজ অন্তরের স্বাগত আহ্বান!
ওগো সূর্য, আজ তুমি ছড়াইছ মুক্তি দিকে দিকে!

ভাব দেখি, কেমন পৃথিবী আছিল প্রতীক্ষারত
কত কাল; তোমারি সন্ধানে প্রতি দেশে প্রতি যুগে
কত না ছাড়িল গৃহ, কত প্রিয় পরিজন প্রীতি
তোমারি লাগিয়া তারা চলিয়াছে আত্ম-নির্বাসিত
ভয়ঙ্কর সাগর চিরিয়া—আদিম বনানী মাঝে;
প্রতি পদক্ষেপে তার দেয় তাল জীবন মরণ।
তারপর এল দিন—সফলিয়া উঠিল যখন
সকল সাধনা কর্ম পূজা প্রেম আত্মবলিদান—
গ্রহণ করিলে আসি—সব হল—সম্পূর্ণ সার্থক!
তখন উঠিলে তুমি—হে প্রসন্ন, ছড়াবার তরে
মুক্তির আলোক শুভ্র—সারা বিশ্ব-মানবের ’পরে!

চল প্রভু, চল তব বাধাহীন পথে ততদিন—
যতদিন ওই তব মাধ্যন্দিন প্রখর প্রভায়
প্লাবিত না হয় বিশ্ব, পৃথিবীর প্রতি দেশে দেশে
সেই আলো না হয় ফলিত, যতদিন নরনারী
তুলি উচ্চ শির—নাহি দেখে টুটেছে শৃঙ্খলভার—
না জানে শিহরানন্দে তাহাদের জীবন নূতন।

*******************

শান্তি

শান্তি

শান্তি ১৭

ওই দেখ—আসে মহাবেগে
মহাশক্তি, যাহা শক্তি নয়-—
অন্ধকারে আলোকস্বরূপ
তীব্রালোকে ছায়ার আভাস

আনন্দ যা হয়নি প্রকাশ,
অবেদিত দুঃখ সুগভীর,
অযাপিত অমৃত জীবন—
অশোচিত মৃত্যু সনাতন।

দুঃখ নয়, আনন্দও নয়
মাঝে তার তারে বোধ হয়,
রাত্রি নয়, ঊষাও সে নয়—
উভয়ের মাঝে জুড়ে রয়।
সঙ্গীতের মাঝে মধু সম—
সুপবিত্র ছন্দ মাঝে যতি,
নীরবতা কথার অন্তরে,
মাঝে দুই রিপু তাড়নার
হৃদয়ের শান্ত ভাব সে যে!
অদেখা সে সৌন্দর্যসম্ভার,
সে যে প্রেম একাকী অদ্বয়,
অগাহিত জাগে মহাগান—
অজানিত পরিপূর্ণ জ্ঞান!

মৃত্যু দুই জীবনের মাঝে,
স্তব্ধতা সে ঝঞ্ঝাদ্বয় মাঝে,
শুদ্ধতা সে ঝঞ্ঝাদ্বয় মাঝে,
মহাশূন্য—যা হতে সৃজন—
যাহে পুনঃ আসিছে ফিরিয়া।

এরি লাগি ঝরে আঁখিজল
সারা বিশ্বে হাসি ছড়াবারে,
এ যে শান্তি—লক্ষ্য জীবনের —
একমাত্র আশ্রয় নিশ্চয়।

*******************

জীবন্মুক্তের গীতি

জীবন্মুক্তের গীতি

জীবন্মুক্তের গীতি ১৮

বিস্তারে বিশাল ফণা দলিতা ফণিনী;
প্রজ্বলিত হুতাশন যথা সঞ্চালনে,
শূন্য ব্যোম-পথে যথা উঠে প্রতিধ্বনি
মর্মাহত কেশরীর কুপিত গর্জনে।

প্লাবনের ধারা ঢালে যথা মহা ঘন,
দামিনী ঝলকে তার হৃদি বিদারিয়া,
আত্মার গভীর দেশে করিলে স্পন্দন,
মহাপ্রাণ উচ্চ তত্ত্ব দেয় প্রকাশিয়া।

স্তিমিত হউক নেত্র, অন্তর মূর্ছিত,
বিফল বন্ধুত্ব—প্রেম প্রতারণা হোক,
নিয়তি পাঠাক তার ভীতি অগণিত
পুঞ্জীকৃত অন্ধকারে পথ রুদ্ধ হোক।

রোষ-দীপ্ত মূর্তি ধরি আসুক জগৎ
চূর্ণিতে তোমায়—তবু জানিও নিশ্চয়,
হে আত্মা, তুমি হে দেব, তুমি সে মহৎ,
মুক্তিই গন্তব্য তব—অন্য গতি নয়।

নহি স্বর্গবাসী আমি—নর পশু নয়,
পুরুষ কি নারী নহি, নহি দেহ মন,
স্তম্ভিত নির্বাক যত জ্ঞান-গ্রন্থচয়,
স্বরূপ বর্ণিতে মোর—আমি সেই, ‘সোঽহম্’।

সূর্য সোম বসুন্ধরা জন্মে নাই যবে,
তারাদল ধূমকেতু জন্মেনি যখন,
কালের-ও উদ্ভব যবে হয়নি এ ভবে,
ছিলাম, আছি ও আমি থাকিব তখন।

মেদিনী সুষমাময়ী, ভাস্বর তপন,
এই শান্ত সুধাকর, উজ্জ্বল আকাশ
নিমিত্ত-অধীনে করে গমনাগমন,
জীবন তাদের-ও বদ্ধ, বন্ধনে বিনাশ।

বিশ্ব-মন বিস্তারিয়া অনিত্যের জাল
ধরিয়া তাদের রাখে দৃঢ়বদ্ধ করে,
পৃথিবী নরক স্বর্গ—মন্দ আর ভাল
সে চিন্তা-তন্তুর মাঝে উঠে আর পড়ে।

দেশ আর কাল, আর কার্য ও কারণ,
এ সকলি হয় মাত্র বহিরাবরণ!
ইন্দ্রিয়-মনের পারে মোর অবস্থান।
আমি দ্রষ্টা এ বিশ্বের—সাক্ষী সে মহান্‌!

নহে দ্বৈত, নহে বহু—অদ্বৈতের ভূমি,
একত্বে মিলিত তাই সকলি আমায়।
ভেদ ঘৃণা নাহি মোর, নহি ভিন্ন আমি,
থাকি আমি মগ্ন মাত্র প্রেমের চিন্তায়।

ভাঙ মায়া, মুক্ত হও বন্ধন হইতে,
ভীত নাহি হও—বুঝ রহস্য পরম!
নিজ প্রতিবিম্ব মোরে নারে সন্ত্রাসিতে,
জেনো স্থির—আমি সেই, ‘সোঽহং, সোঽহং’।

*******************

আমারই আত্মাকে

আমারই আত্মাকে

আমারই আত্মাকে ১৯

ধরে থাক আরও কিছুকাল, অটল হৃদয়,
ছিন্ন করো নাকো এই আজন্ম বন্ধন,
যদিও অস্পষ্ট ক্ষীণ এই বর্তমান—ভবিষ্যৎ ঘনতমোময়!

কেটে গেছে যেন এক যুগ—তোমাতে আমাতে মিলে
যাত্রা শুরু করিলাম—জীবনের উঁচু-নীচু পথে,
অপূর্ব সমুদ্রে কভু ভেসে যাই শান্ত ধীর পালে,
আমি মোর তব কাছে, তার চেয়ে তুমি আরও কাছে, মাঝে মাঝে,
মনের তরঙ্গগুলি উঠিবার আগে প্রকাশিত করেছ তুমিও!

অবিকল প্রতিভাস! তোমার স্পন্দন মেলান আমার সাথে,
সূক্ষ্মতম চিন্তা, তবু পূর্ণরূপে ধ্বনিত তোমাতে।
হে সংস্কার-লিপিকার! এখন কি আমাদের বিদায়ের পালা?

তোমাতেই রহিয়াছে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস,
অশুভ বাসনা যবে ফেনাইয়া ওঠে, সতর্ক করেছ তুমি,
সাবধান-বাণী তব হেলায় দিয়েছি ফেলে,
তবু তুমি সত্য শুভ শক্তি মোর—পূর্বের মতন!

*******************

আমন্ত্রণ

আমন্ত্রণ

আমন্ত্রণ ২০

রোদন কি হেতু সখা? সর্বশক্তি তোমারি তো অন্তরে নিহিত!
জ্ঞান-বীর্য-প্রদ সেই নিজ দিব্য স্বরূপেরে কর উদ্বোধিত—
ত্রিলোকে যা কিছু আছে সবই তব পাদমূলে আসিবে তখন!
আত্মার শক্তিই হয় চিরজয়ী—জড়শক্তি নহে কদাচন।

ত্রিভুবন উপাড়িব, তারকা চিবায়ে খাব [করি অট্টহাস]!
জান না কি কেবা মোরা? বীর গতভয় মোরা রামকৃষ্ণ দাস।

দেহকেই ‘আমি’ ভাবে—নাস্তিক্য ইহারি নাম—যারা অনিক্ষণ
‘ক্ষীণ মোরা, দীন মোরা’ বলি করে তাহারাই করুণ ক্রন্দন।
রামকৃষ্ণ-দাস মোরা—[দেহাতীত অবিকারী অমৃত অভয়
সত্তাকেই ‘আমি’ জানি] অভয়-পদেতে স্থিত হয়েছি যখন—
আস্তিক্য ইহারি নাম—হইয়াছি মোরা সবে বীর, গতভয়।
সংসার-আসক্তি ত্যজি, ত্যজি সর্ব-দ্বন্দ্ব-মূল স্বার্থপরতায়,
পরামৃত পান করি, ধ্যান করি সর্ববিধ কল্যাণ-নিলয়
শ্রীগুরু-চরণাম্বুজ, ধরাবাসী সবাকারে করি নমস্কার
অমৃতের পূর্ণপাত্রে পান তরে আমন্ত্রণ করি বারংবার—
পূর্ণ যেই পাত্রখানি অনাদি-অনন্ত-বেদ-
পয়োধি-মন্থন-লব্ধ অতুলন ধনে,
যাহে শক্তি প্রদানিলা প্রজাপতি-নারায়ণ-
মহেশাদি শক্তিমান্‌ সর্ব দেবগণে,
পরিপূর্ণ যাহা সর্ব-অবতার-প্রাণসারে—
পূর্ণ যহা সবাকার মিলিত সত্তায়—
সে অমৃত-পূর্ণপাত্র ধরিয়া মানবদেহ
রামকৃষ্ণ-রূপ লয়ে এসেছে ধরায়।

*******************

Post a Comment

0 Comments