শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলী ~প্রথম ভাগ
-: শ্রী মহেন্দ্রনাথ দত্ত :-
প্রাগবাণী
১৯২৩/২৪ সালের শীতকালে কনখলে অবস্থানকালে আশ্রমে ‘বিনয় পিটক’, ‘জাতক’ ও অপরাপর বৌদ্ধ গ্রন্থ সকল পাঠ হইতেছিল। সেই সময় এই গ্ৰন্থখানি লিখিবার প্রথম প্রয়াস হয়, এইজন্য এই গ্রন্থখানিতে অনেক পরিমাণে বিনয় পিটক বা জাতকের রীতি অনুসৃত হইয়াছে।
জীবনী বা ইতিহাস অনেক লিখিত আছে এবং তাহা প্রায় একজনেরই হইয়া থাকে। কিন্তু এই গ্রন্থ জীবনী বা ইতিহাস নহে, ইহাকে ঘটনাবলী বলে। যতদূর সম্ভব ঘটনাগুলি সন্নিবেশিত করা হইয়াছে তবে পারম্পর্য বা নির্ধারিত সময় দেওয়া হয় নাই, কারণ এস্থলে তাহার কোন আবশ্যক নাই। ঘটনাগুলিতে নিজের কোন মত প্রকাশ করা হয় নাই, পাঠ করিয়া যিনি যাহা বুঝিবেন সেইরূপ মীমাংসা করিবেন। ঘটনার কোন কোন অংশ অনাবশ্যক বা অপ্রাসঙ্গিক বুঝিয়া ত্যাগ করা হইয়াছে, তাহাতে মূল উপাখ্যান কিছু বিপর্যস্ত হয় নাই।
প্রত্যেক লেখক আপনার উদ্দেশ্য অনুযায়ী ঘটনাবলী পব পর সন্নিবেশিত করিয়া পাঠকের মনকে অতকিতভাবে গন্তব্যস্থানে লইয়া যান, এই নিমিত্ত প্রত্যেক লেখকের লিপিবার নিয়ম পদ্ধতি পৃথক পৃথক হইয়া থাকে, কারণ একই ঘটনা বিভিন্ন প্রকারে প্রকাশ করা যাইতে পারে।
স্বামিজীর জীবনীর বিষয় অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে। আমি যতদূর পড়িয়া দেখিয়াছি, প্রত্যেক গ্রন্থই সুন্দর হইয়াছে। প্রত্যেক লেখক নিজের ইচ্ছামত কতকগুলি উপাখ্যান সংযােগ বা পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাহাতে বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নাই। প্রচলিত সব গ্রন্থগুলি না পাঠ করিলে ভিতরকার ভাবটী বুঝিতে পারা যায় না, এইজন্য কয়েকখানি গ্রন্থ প্রত্যেকের পাঠ করা উচিত, কারণ প্রত্যেক লােকই স্বামিজীকে আপনভাবে দেখিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। স্বামীজীর বহুমুখী ভাব ছিল, বহুপ্রকারে তাহা প্রকাশ করিলেও তাঁহার ভাবের অল্পমাত্র বলা হয়।
প্রচলিত গ্রন্থগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যাহারা ভক্তলােক তাহারা ভক্তির ভাব হইতে গ্রন্থখানি প্রণয়ন করিয়াছেন। যাহারা ঐতিহাসিক তাহার ইতিহাসের দিক হইতে লিখিয়াছেন। ইচ্ছামত একটী ভাবকে মুখ্য ও অপরটাকে গৌণ করিয়া লেখা হইয়াছে, কিন্তু কার্যতঃ তাহাতে কোন প্রভেদ হয় নাই।
এই গ্রন্থখানিতে যেসকল ঘটনা সন্নিবেশিত হইয়াছে, অধিকস্থলে বর্তমান লেখক উপস্থিত ছিলেন ; যেগুলি কোন বিশিষ্ট লােকের নিকট শ্রবণ করিয়াছেন, তাহাদের নাম যথাস্থানে উল্লেখ করা হইয়াছে। কতকগুলি ঘটনা একত্রিত সন্নিবেশিত করা এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। প্রত্যেক ঘটনাটীতে একটা বাস্তব চিত্র, অর্থাৎ কোন ব্যক্তি কিরূপ বসিয়াছিলেন বা হাত পা নাড়িয়াছিলেন, পরস্পরের প্রতি কিরূপ শ্রদ্ধাভক্তি ছিল এইরূপ অলক্ষিত-চিত্র দেখান এই গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য। জীবন্ত ভালবাসা ও স্পর্শনীয় জাগ্রত শক্তি কিরূপ ছিল পাঠক যদি সেইটী স্পষ্টভাবে দেখিতে পান ও আপনার ভিতর সেই জীবন্ত শক্তি জাগ্রত হইয়াছে অনুভব করেন, তাহা হইলে গ্রন্থখানি সফল হইল মনে করিব। এই গ্রন্থে ঘটনাগুলির আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে, জীবন্ত চিত্র দেখানই আমার প্রধান উদ্দেশ্য। গ্রন্থের তারতম্য বিচার করিতে হইলে উল্লিখিত উপাখ্যানটা চিত্রাকারে সুস্পষ্টভাবে চক্ষের সামনে দণ্ডায়মান হয় কি না সেইটী দেখিতে হইবে, কারণ ইহাই হইল গ্রন্থের প্রাণ। শব্দবিন্যাসে বা ভাষায় কিছুই আসিয়া যায় না। সেই জীবন্তচিত্তের ভিতর অলক্ষিতভাবে এক প্রবল শক্তি হৃদয়ের ভিতর প্রবেশ করে। ইহাকে কবিতা বা গ্রন্থের জীবনীশক্তি বা চিত্ৰ-বৰ্ণনা বা প্রকৃত ধ্যান বলে। ইহারই উপর গ্রন্থের বিচার হইয়া থাকে। যদি এই গ্রন্থ পাঠ করিয়া পাঠক একটা জীবন্ত শক্তি অনুভব করেন, তাহা হইলে সকল শ্রম সফল হইল মনে করিব। ইতি
কলিকাতা গ্রন্থকার
২৫শে আষাঢ়, ১৩৩১
Read PDF Online
=================================================
0 Comments