একবিংশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

একবিংশ খণ্ড 
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে লাটু, মাস্টার, মণিলাল, মুখুজ্জে প্রভৃতি

একবিংশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

==========

প্রথমপরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা অক্টোবর

ব্রাহ্ম মণিলালকে উপদেশ — বিদ্বেষভাব (Dogmatism) ত্যাগ কর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।

আজ বৃহস্পতিবার, ২রা অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ১৭ই আশ্বিন ১২৯১। আশ্বিন শুক্লা দ্বাদশী-ত্রয়োদশী। শ্রীশ্রীবিজয়া দশমীর দুই দিন পরে। গতকল্য ঠাকুর কলিকাতায় অধরের বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। সেখানে নারাণ, বাবুরাম, মাস্টার, কেদার, বিজয় প্রভৃতি অনেকে ছিলেন। ঠাকুর সেখানে ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে নৃত্য করিয়াছিলেন।

ঠাকুরের কাছে আজকাল লাটু, রামলাল, হরিশ থাকেন। বাবুরামও মাঝে মাঝে আসিয়া থাকেন। শ্রীযুক্ত রামলাল শ্রীশ্রীভবতারিণীর সেবা করেন। হাজরা মহাশয়ও আছেন।

আজ শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিক, প্রিয় মুখুজ্জে, তাঁহার আত্মীয় হরি, শিবপুরের একটি ব্রাহ্ম (দাড়ি আছে), বড় বাজার ১২নং মল্লিক স্ট্রীটের মারোয়াড়ী ভক্তেরা — উপস্থিত আছেন। ক্রমে দক্ষিণেশ্বরের কয়েকটি ছোকরা, সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ প্রভৃতি ভক্তেরা আসিলেন। মণিলাল পুরাতন ব্রাহ্ম ভক্ত।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিলাল প্রভৃতির প্রতি) — নমস্কার মানসেই ভাল। পায়ে হাত দিয়ে নমস্কারের কি দরকার। আর মানসে নমস্কার করলে কেউ কুণ্ঠিত হবে না।

“আমারই ধর্ম ঠিক, আর সকলের মিথ্যা — এ-ভাব ভাল নয়।

“আমি দেখি তিনিই সব হয়েছেন — মানুষ, প্রতিমা, শালগ্রাম সকলের ভিতরেই এক দেখি। এক ছাড়া দুই আমি দেখি না!

“অনেকে মনে করে আমাদের মত ঠিক, আর সব ভুল, — আমরা জিতেছি, আর সব হেরেছে। কিন্তু যে এগিয়ে এসেছে সে হয়তো, একটুর জন্য আটকে গেল। পেছনে যে পড়েছিল সে তখন এগিয়ে গেল। গোলোকধাম খেলায়, অনেক এগিয়ে এসে, পোয়া (ঘুঁটি) আর পড়ল না।

“হার-জিত তাঁর হাতে। তাঁর কার্য কিছু বোঝা যায় না। দেখ না, ডাব অত উঁচুতে থাকে, রোদ পায়, তবু ঠাণ্ডা শক্তি! — এ-দিকে পানিফল জলে থাকে — গরম গুণ।

“মানুষের শরীর দেখ। মাথা যেটা মূল (গোড়া), সেটা উপরে চলে গেল।”

[শ্রীরামকৃষ্ণ, চার আশ্রম ও যোগতত্ত্ব — ব্রাহ্মসমাজ ও ‘মনোযোগ’ ]

মণিলাল — আমাদের এখন কর্তব্য?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কোনরকম করে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়ে থাকা। দুইপথ আছে, — কর্মযোগ আর মনোযোগ।

“যারা আশ্রমে আছে, তাদের যোগ কর্মের দ্বারা। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস। সন্ন্যাসীরা১কাম্য কর্মের ত্যাগ করবে কিন্তু নিত্যকর্ম কামনাশূন্য হয়ে করবে। দণ্ডধারণ, ভিক্ষা করা, তীর্থযাত্রা, পূজা, জপ এ-সব কর্মের দ্বারা তাঁর সঙ্গে যোগ হয়।

“আর যে কর্মই কর, ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কামনাশূন্য হয়ে করতে পারলে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়।

“আর-একপথ মনোযোগ। এরূপ যোগীর বাহিরের কোন চিহ্ন নাই। অন্তরে যোগ। যেমন জড়ভরত, শুকদেব। আরও কত আছে — এরা নামজাদা। এদের শরীরে চুল, দাড়ি, যেমন তেমনই থাকে।

“পরমহংস অবস্থায় কর্ম উঠে যায়। স্ম রণ-মনন থাকে। সর্বদাই মনের যোগ। যদি কর্ম করে সে লোকশিক্ষার জন্য।

“কর্মের দ্বারাই যোগ হউক, আর মনের দ্বারাই যোগ হউক ভক্তি হলে সব জানতে পারা যায়।

“ভক্তিতে কুম্ভক আপনি হয় — একাগ্র মন হলেই বায়ু স্থির হয়ে যায়, আর বায়ু স্থির হলেই মন একাগ্র হয়, বুদ্ধি স্থির হয়। যার হয় সে নিজে টের পায় না।”

[পূর্বকথা — সাধনাবস্থায় জগন্মাতার কাছে প্রার্থনা — ভক্তিযোগ ]

“ভক্তিযোগে সব পাওয়া যায়। আমি মার কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, ‘মা, যোগীরা যোগ করে যা জেনেছে, জ্ঞানীরা বিচার করে যা জেনেছে — আমায় জানিয়ে দাও — আমায় দেখিয়ে দাও!’ মা আমায় সব দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্যাকুল হয়ে তাঁর কাছে কাঁদলে তিনি সব জানিয়ে দেন। বেদ-বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র — এ-সব শাস্ত্রে কি আছে; সব তিনি আমায় জানিয়ে দিয়েছেন।”

মণিলাল — হঠযোগ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হঠযোগীরা দেহাভিমানী সাধু। কেবল নেতি ধৌতি করছে — কেবল দেহের যত্ন। ওদের উদ্দেশ্য আয়ু বৃদ্ধি করা। দেহ নিয়ে রাতদিন সেবা। ও ভাল নয়।

[মণি মল্লিক, সংসারী ও মনের ত্যাগ — কেশব সেনের কথা ]

“তোমাদের কর্তব্য কি? তোমরা মনে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করবে। তোমরা সংসারকে কাকবিষ্ঠা বলতে পার না।

“গোস্বামীরা গৃহস্থ, তাই তাদের বললাম, তোমাদের ঠাকুর সেবা রয়েছে, তোমরা সংসারত্যাগ কি করবে? — তোমরা সংসারকে মায়া বলে উড়িয়ে দিতে পার না।

“সংসারীদের যা কর্তব্য চৈতন্যদেব বলেছিলেন — জীবে দয়া, বৈষ্ণবসেবা, নামসংকীর্তন।

“কেশব সেন বলেছিল, উনি এখন দুই-ই কর বলছেন। একদিন কুটুস করে কামড়াবেন। তা নয় — কামড়াব কেন?”

মণি মল্লিক — তাই কামড়ান।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কেন? তুমি তো, তাই আছ — তোমার ত্যাগ করবার কি দরকার?

১ কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ।
সর্বকর্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ ৷৷
ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ।
য়জ্ঞদানতপঃ কর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে ৷৷ [গীতা, ১৮।২, ৩]
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা অক্টোবর

আচার্যের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ, তবে লোকশিক্ষার অধিকার — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম — ব্রাহ্ম মণিলালকে শিক্ষা

শ্রীরামকৃষ্ণ — যাদের দ্বারা তিনি লোকশিক্ষা দেবেন, তাদের সংসারত্যাগ দরকার। তা না হলে উপদেশ গ্রাহ্য হয় না। শুধু ভিতরে ত্যাগ হলে হবে না। বাহিরে ত্যাগও চাই, তবে লোকশিক্ষা হয়। তা না হলে লোকে মনে করে, ইনি যদিও কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলছেন, ইনি নিজে ভিতরে ভিতরে ওই সব ভোগ করেন।

“একজন কবিরাজ ঔষধ দিয়ে রোগীকে বললে, তুমি আর-একদিন এসো, খাওয়া-দাওয়ার কথা বলে দিব। সেদিন তাঁর ঘরে অনেকগুলি গুড়ের নাগরি ছিল। রোগীর বাড়ি অনেক দূরে। সে আর-একদিন এসে দেখা করলে। কবিরাজ বললে ‘খাওয়া দাওয়া সাবধানে করবি, গুড় খাওয়া ভাল নয়।’ রোগী চলে গেলে একজন বৈদ্যকে বললে, ‘ওকে অত কষ্ট দিয়ে আনা কেন? সেই দিন বললেই তো হত!’ বৈদ্য হেসে বললে, ‘ওর মানে আছে। সেদিন ঘরে অনেকগুলি গুড়ের নাগরি ছিল। সেদিন যদি বলি, রোগীর বিশ্বাস হত না। সে মনে করত ওঁর ঘরে যেকালে এত গুড়ের নাগরি, উনি নিশ্চয় কিছু খান। তাহলে গুড় জিনিসটা এত খারাপ নয়।’ আজ আমি গুড়ের নাগরি লুকিয়ে ফেলেছি, এখন বিশ্বাস হবে।

“আদি সমাজের আচার্যকে দেখলাম। শুনলাম নাকি দ্বিতীয় না তৃতীয় পক্ষের বিয়ে করেছে! — বড় বড় ছেলে!

“এই সব আচার্য! এরা যদি বলে ‘ঈশ্বর সত্য, আর সব মিথ্যা’ কে বিশ্বাস করবে! — এদের শিষ্য যা হবে, বুঝতেই পারছ।

“হেগো গুরু তার পেদো শিষ্য! সন্ন্যাসীও যদি মনে তাগ করে, বাহিরে কামিনী-কাঞ্চন লয়ে থাকে — তার দ্বারা লোকশিক্ষা হয় না। লোকে বলবে লুকিয়ে গুড় খায়।”

[শ্রীরামকৃষ্ণের কাঞ্চনত্যাগ — কবিরাজের পাঁচটাকা প্রত্যর্পণ ]

“সিঁথির মহেন্দ্র (কবিরাজ) রামলালের কাছে পাঁচটা টাকা দিয়ে গিছল — আমি জানতে পারি নাই।

“রামলাল বললে পর, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে দিয়েছে? সে বললে, এখানকার জন্য। আমি প্রথমটা ভাবলুম, দুধের দেনা আছে না হয় সেইটে শোধ দেওয়া যাবে। ও মা! খানিক রাত্রে ধড়মড় করে উঠে পড়েছি। বুকে যেন বিল্লি আঁচড়াচ্ছে! রামলালকে তখন গিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলুম, — ‘তোর খুড়ীকে কি দিয়েছে?’ সে বললে, ‘না’। তখন তাকে বললাম, ‘তুই এক্ষণই ফিরিয়ে দিয়ে আয়!’ রামলাল তার পরদিন টাকা ফিরিয়ে দিলে।

“সন্ন্যাসীর পক্ষে টাকা লওয়া বা লোভে আসক্ত হওয়া কিরূপ জানো? যেমন ব্রাহ্মণের বিধবা অনেক কাল হবিষ্য খেয়ে, ব্রহ্মচর্য করে, বাগ্‌ দী উপপতি করেছিল! (সকলে স্তম্ভিত)

“ও-দেশে ভগী তেলীর অনেক শিষ্য সামন্ত হল। শূদ্রকে সব্বাই প্রণাম করে দেখে, জমিদার একটা দুষ্ট লোক লাগিয়ে দিলে। সে তার ধর্ম নষ্ট করে দিলে — সাধন-ভজন সব মাটি হয়ে গেল। পতিত সন্ন্যাসী সেইরূপ।”

[সাধুসঙ্গের পর শ্রদ্ধা — কেশব সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ]

“তোমারা সংসারে আছ, তোমাদের সৎসঙ্গ (সাধুসঙ্গ) দরকার।

“আগে সাধুসঙ্গ, তারপর শ্রদ্ধা। সাধুরা যদি তাঁর নামগুণানুকীর্তন না করে, তাহলে কেমন করে লোকের ঈশ্বরে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভক্তি হবে? তিন পুরুষে আমির জানলে তবে তো লোকে মানবে?

(মাস্টারের প্রতি) — “জ্ঞান হলেও সর্বদা অনুশীলন চাই। ন্যাংটা বলত, ঘটি একদিন মাজলে কি হবে — ফেলে রাখলে আবার কলঙ্ক পড়বে!

“তোমার বাড়িটায় একবার যেতে হবে। তোমার আড্ডাটা জানা থাকলে, সেখানে আরও ভক্তদের সঙ্গে দেখা হবে। ঈশানের কাছে একবার যাবে।

(মণিলালের প্রতি) — “কেশব সেনের মা এসেছিল। তাদের বাড়ির ছোকরারা হরিনাম করলে। সে তাদের প্রদক্ষিণ করে হাততালি দিতে লাগল। দেখলাম শোকে কাতর হয় নাই। এখানে এসে একাদশী করলে, মালাটি লয়ে জপ করে! বেশ ভক্তি দেখলাম।”

মণিলাল — কেশববাবুর পিতামহ রামকমল সেন ভক্ত ছিলেন। তুলসীকাননের মধ্যে বসে নাম করতেন। কেশবের বাপ প্যারীমোহনও ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বাপ ওরূপ না হলে ছেলে অমন ভক্ত হয় না। দেখো না, বিজয়ের অবস্থা।

“বিজয়ের বাপ ভাগবত পড়তে পড়তে ভাবে অজ্ঞান হয়ে যেত। বিজয় মাঝে মাঝে ‘হরি! হরি!’ বলে উঠে পড়ে।

“আজকাল বিজয় যা সব (ঈশ্বরীয় রূপ) দর্শন করছে, সব ঠিক ঠিক!

“সাকার-নিরাকারের কথা বিজয় বললে — যেমন বহুরূপীর রঙ — লাল, নীল, সবুজও হচ্ছে — আবার কোনও রঙই নাই । কখন সগুণ কখন নির্গুণ।”

[বিজয় সরল — “সরল হলে ঈশ্বরলাভ হয়” ]

“বিজয় বেশ সরল — খুব উদার সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।

“বিজয় কাল অধর সেনের বাড়িতে গিছল। তা যেন আপনার বাড়ি — সবাই যেন আপনার।

“বিষয়বুদ্ধি না গেলে উদার সরল হয় না।

এই বলিয়া ঠাকুর গান গাহিতেছেন —

“অমূল্যধন পাবি রে মন হলে খাঁটি!

“মাটি পাট করা না হলে হাঁড়ি তৈয়ার হয় না। ভিতরে বালিঢিল থাকলে হাঁড়ি ফেটে যায়। তাই কুমোর আগে মাটি পাট করে।

“আরশিতে ময়লা পড়ে থাকলে মুখ দেখা যায় না। চিত্তশুদ্ধি না হলে স্ব-স্বরূপদর্শন হয় না।

“দেখো না, যেখানে অবতার, সেখানেই সরল। নন্দঘোষ, দশরথ, বসুদেব — এঁরা সব সরল।

“বেদান্তে বলে শুদ্ধবুদ্ধি না হলে ঈশ্বরকে জানতে ইচ্ছা হয় না। শেষ জন্ম বা অনেক তপস্যা না থাকলে উদার সরল হয় না।”
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা অক্টোবর

শ্রীরামকৃষ্ণের বালকের অবস্থা।

ঠাকুরের পা একটু ফুলো ফুলো বোধ হওয়াতে তিনি বালকের ন্যায় চিন্তিত আছেন।

সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ আসিয়া প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রিয় মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — কাল নারাণকে বললাম, তোর পা টিপে দেখ দেখি, ডোব হয় কি না। সে টিপে দেখলে — ডোব হল; — তখন বাঁচলুম। (মুখুজ্জের প্রতি) — তুমি একবার তোমার পা টিপে দেখো তো; ডোব হয়েছে?

মুখুজ্জে — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আঃ! বাঁচলুম।

মণি মল্লিক — কেন? আপনি স্রোতের জলে নাইবেন। সোরা ফোরা কেন খাওয়া।

শ্রীরামকৃষ্ণ — না গো, তোমাদের রক্তের জোর আছে, — তোমাদের আলাদা কথা!

“আমায় বালকের অবস্থায় রেখেছে।

“ঘাস বনে একদিন কি কামড়ালে। আমি শুনেছিলাম, সাপে যদি আবার কামড়ায়, তাহলে বিষ তুলে লয়। তাই গর্তে হাত দিয়ে রইলাম। একজন এসে বললে — ও কি কচ্ছেন? — সাপ যদি সেইখানটা আবার কামড়ায়, তাহলে হয়। অন্য জায়গায় কামড়ালে হয় না।

“শরতের হিম ভাল, শুনেছিলাম — কলকাতা থেকে গাড়ি করে আসবার সময় মাথা বার করে হিম লাগাতে লাগলাম। (সকলের হাস্য)

(সিঁথির মহেন্দ্রের প্রতি) — “তোমাদের সিঁথির সেই পণ্ডিতটি বেশ। বেদান্তবাগীশ। আমায় মানে। যখন বললাম, তুমি অনেক পড়েছ, কিন্তু ‘আমি অমুক পণ্ডিত’ এ-অভিমান ত্যাগ করো, তখন তার খুব আহ্লাদ।

“তার সঙ্গে বেদান্তের কথা হল।”

[মাস্টারকে শিক্ষা — শুদ্ধআত্মা, অবিদ্যা; ব্রহ্মমায়া — বেদান্তের বিচার ]

(মাস্টারের প্রতি) — যিনি শুদ্ধ আত্মা, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁতে মায়া বা অবিদ্যা আছে। এই মায়ার ভিতরে তিন গুণ আছে — সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। যিনি শুদ্ধ আত্মা তাঁতে এই তিনগুণ রয়েছে, অথচ তিনি নির্লিপ্ত। আগুনে যদি নীল বড়ি ফেলে দাও, নীল শিখা দেখা যায়; রাঙা বড়ি ফেলে দাও, লাল শিখা দেখা যায়। কিন্তু আগুনের আপনার কোন রঙ নাই।

“জলে নীল রঙ ফেলে দাও, নীল জল হবে। আবার ফটকিরি ফেলে দিলে সেই জলেরই রঙ।

“মাংসের ভার লয়ে যাচ্চে চণ্ডালে — সে শঙ্করকে ছুঁয়েছিল। শঙ্কর যেই বলেছেন, আমায় ছুঁলি! — চণ্ডাল বললে, ঠাকুর, আমিও তোমায় ছুঁই নাই, — তুমিও আমায় ছোঁও নাই! তুমি শুদ্ধ আত্মা — নির্লিপ্ত।

“জড়ভরতও ওই সকল কথা রাজা রহুগণকে বলেছিল।

“শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত। আর শুদ্ধ আত্মাকে দেখা যায় না। জলে লবণ মিশ্রিত থাকলে লবণকে চক্ষের দ্বারা দেখা যায় না।

“যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনিই মহাকারণ — কারণের কারণ। স্থূল, সূক্ষ্ম কারণ মহাকারণ। পঞ্চভূত স্থূল। মন বুদ্ধি অহংকার, সূক্ষ্ম। প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তি সকলের কারণ। ব্রহ্ম বা শুদ্ধ আত্মা কারণের কারণ।

“এই শুদ্ধ আত্মাই আমাদের স্বরূপ।

“জ্ঞান কাকে বলে? এই স্ব-স্বরূপকে জানা আর তাঁতে মন রাখা! এই শুদ্ধ আত্মাকে জানা।”

[কর্ম কতদিন? ]

“কর্ম কতদিন? — যতদিন দেহ অভিমান থাকে; অর্থাৎ দেহই আমি এই বুদ্ধি থাকে। গীতায় ওই কথা আছে।১

“দেহে আত্মবুদ্ধি করার নামই অজ্ঞান।

(শিবপুরের ব্রাহ্মভক্তের প্রতি) — “আপনি কি ব্রাহ্ম?”

ব্রাহ্মভক্ত — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — আমি নিরাকার সাধকের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারি। আপনি একটু ডুব দেবেন। উপরে ভাসলে রত্ন পাওয়া যায় না। আমি সাকার-নিরাকার সব মানি।

[মারোয়াড়ী ভক্ত ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — জীবাত্মা — চিত্ত ]

বড়বাজারের মারিয়াড়ী ভক্তেরা আসিয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর তাঁহাদের সুখ্যাতি করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আহা! এরা যে ভক্ত। সকলে ঠাকুরের কাছে যাওয়া — স্তব করা — প্রসাদ পাওয়া! এবার যাঁকে পুরোহিত রেখেছেন, সেটি ভাগবতের পণ্ডিত।

মারোয়াড়ী ভক্ত — “আমি তোমার দাস” যে বলে সে আমিটা কে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — লিঙ্গশরীর বা জীবাত্মা। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার — এ চারিটি জড়িয়ে লিঙ্গশরীর।

মারোয়াড়ী ভক্ত — জীবাত্মাটি কে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — অষ্টপাশ জড়িত আত্মা। আর চিত্ত কাকে বলে? যে ওহো! করে উঠে।

[মাড়োয়াড়ী — মৃত্যুর পর কি হয়? মায়া কি? “গীতার মত” ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতার মতে, মরবার সময় যা ভাবে, তাই হবে। ভরত রাজা হরিণ ভেবে হরিণ হয়েছিল। তাই ঈশ্বরকে লাভ করবার জন্য সাধন চাই। রাতদিন তাঁর চিন্তা করলে মরবার সময়ও সেই চিন্তা আসবে।

মারোয়াড়ী ভক্ত — আচ্ছা মহারাজ, বিষয় বৈরাগ্য হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — এরই নাম মায়া। মায়াতে সৎকে অসৎ, অসৎকে সৎ বোধ হয়।

“সৎ অর্থাৎ যিনি নিত্য, — পরব্রহ্ম। অসৎ — সংসার অনিত্য।”

মারোয়াড়ী ভক্ত — শাস্ত্র পড়ি, কিন্তু ধারণা হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — পড়লে কি হবে? সাধনা — তপস্যা চাই। তাঁকে ডাকো। “সিদ্ধি সিদ্ধি” বললে কি হবে, কিছু খেতে হয়।

“এই সংসার কাঁটাগাছের মতো। হাত দিলে রক্ত বেরোয়। যদি কাঁটাগাছ এনে, বসে বসে বল, ওই গাছ পুড়ে গেল, তা কি অমনি পুড়ে যাবে? জ্ঞানাগ্নি আহরণ কর। সেই আগুন লাগিয়ে দাও, তবে তো পুড়বে!

“সাধনের অবস্থায় একটুখাটতে হয় তারপর সোজা পথ। ব্যাঁক কাটিয়ে অনুকূল বায়ুতে নৌকা ছেড়ে দাও।”

[আগে মায়ার সংসার ত্যাগ, তারপর জ্ঞানলাভ — ঈশ্বরলাভ ]

“যতক্ষণ মায়ার ঘরের ভিতরে আছ, যতক্ষণ মায়া-মেঘ রয়েছে, ততক্ষণ জ্ঞান-সূর্য কাজ করে না। মায়াঘর ছেড়ে বাহিরে এসে দাঁড়ালে (কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের পর) তবে জ্ঞানসূর্য অবিদ্যা নাশ করে। ঘরের ভিতর আনলে আতস কাচে কাগজ পুড়ে না। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালে, রোদটি কাচে পড়ে, — তখন কাগজ পুড়ে যায়।

“আবার মেঘ থাকলে আতস কাচে কাগজ পুড়ে না। মেঘটি সরে গেলে তবে হয়।

“কামিনী-কাঞ্চন ঘর থেকে একটু সরে দাঁড়ালে — সরে দাঁড়িয়ে একটু সাধনা-তপস্যা করলে — তবেই মনের অন্ধকার নাশ হয় — অবিদ্যা অহংকার মেঘ পুড়ে যায় — জ্ঞানলাভ হয়!

“আবার কামিনী-কাঞ্চনই মেঘ।”

১ ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ।
য়স্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ৷৷ [গীতা, ১৮।১১]
============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা অক্টোবর

পূর্বকথা — লক্ষ্মীনারায়ণের দশ হাজার টাকা দিবার কথায় শ্রীরামকৃষ্ণের অচৈতন্য হওয়া — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম

শ্রীরামকৃষ্ণ (মারোয়াড়ীর প্রতি) — ত্যাগীর বড় কঠিন নিয়ম। কামিনী-কাঞ্চনের সংস্রব লেশমাত্রও থাকবে না। টাকা নিজের হাতে তো লবে না, — আবার কাছেও রাখতে দেবে না।

“লক্ষ্মীনারায়ণ মারোয়াড়ী, বেদান্তবাদী, এখানে প্রায় আসত। বিছানা ময়লা দেখে বললে, আমি দশ হাজার টাকা লিখে দোব, তার সুদে তোমার সেবা চলবে।

“যাই ও-কথা বললে অমনি যেন লাঠি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম!

“চৈতন্য হবার পর তাকে বললাম, তুমি অমন কথা যদি আর মুখে বলো, তা হলে এখানে আর এসো না। আমার টাকা ছোঁবার জো নাই, কাছেও রাখবার জো নাই।

“সে ভারী সূক্ষ্মবুদ্ধি, — বললে, ‘তাহলে এখনও আপনার ত্যাজ্য, গ্রাহ্য আছে। তবে আপনার জ্ঞান হয় নাই।”

“লক্ষ্মীনারায়ণ তখন হৃদের কাছে দিতে চাইলে, আমি বললাম, তাহলে আমায় বলতে হবে ‘একে দে, ওকে দে’; না দিলে রাগ হবে! টাকা কাছে থাকাই খারাপ! সে-সব হবে না!

“আরশির কাছে জিনিস থাকলে প্রতিবিম্ব হবে না?

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুক্তিতত্ত্ব — “কলিতে বেদমত নয় পুরাণমত” ]

মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ, গঙ্গায় শরীরত্যাগ করলে তবে মুক্তি হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞান হলেই মুক্তি। যেখানেই থাকো — ভাগাড়েই মৃত্যু হোক, আর গঙ্গাতীরেই মৃত্যু হোক জ্ঞানীর মুক্তি হবে।

“তবে অজ্ঞানের পক্ষে গঙ্গাতীর।”

মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ কাশীতে মুক্তি হয় কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কাশীতে মৃত্যু হলে শিব সাক্ষাৎকার হন। — হয়ে বলেন, আমার এই যে সাকার রূপ এ মায়িক রূপ — ভক্তের জন্য এই রূপ ধারণ করি, — এই দেখ্‌, অখণ্ড সচ্চিদানন্দে মিলিয়ে যাই! এই বলে সে রূপ অন্তর্ধান হয়!

“পুরাণমতে চণ্ডালেরও যদি ভক্তি হয়, তার মুক্তি হবে। এ মতে নাম করলেই হয়। যাগযজ্ঞ, তন্ত্রমন্ত্র — এ-সব দরকার নাই।

“বেদমত আলাদা। ব্রাহ্মণ না হলে মুক্তি হয় না। আবার ঠিক মন্ত্র উচ্চারণ না হলে পূজা গ্রহণ হয় না। যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র — সব বিধি অনুসারে করতে হবে।”

[কর্মযোগ বড় কঠিন — কলিতে ভক্তিযোগ ]

“কলিকালে বেদোক্ত কর্ম করবার সময় কই?

“তাই কলিতে নারদীয় ভক্তি।

“কর্মযোগ বড় কঠিন। নিষ্কাম না করতে পারলে বন্ধনের কারণ হয়। তাতে আবার অন্নগত প্রাণ — সব কর্ম বিধি অনুসারে করবার সময় নাই। দশমূল পাঁচন খেতে গেলে রোগীর এদিকে হয়ে যায়। তাই ফিভার মিক্‌শ্চার।

“নারদীয় ভক্তি — তাঁর নামগুনকীর্তন করা।

“কলিতে কর্মযোগ ঠিক নয়, — ভক্তিই ঠিক।

“সংসারে কর্ম যতদিন ভোগ আছে করো। কিন্তু ভক্তি অনুরাগ চাই। তাঁর নামগুণকীর্তন করলে কর্মক্ষয় হবে।

“কর্ম চিরকাল করতে হয় না। তাঁতে যত শুদ্ধাভক্তি-ভালবাসা হবে, ততই কর্ম কমবে। তাঁকে লাভ করলে কর্মত্যাগ হয়। গৃহস্থের বউ-এর পেটে ছেলে হলে শাশুড়ী কর্ম কমিয়ে দেয়। সন্তান হলে আর কর্ম করতে হয় না।”

[সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম — সংস্কার থাকলে ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা হয় ]

দক্ষিণেশ্বর গ্রাম হইতে কতকগুলি ছোকরা আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহারা আসন গ্রহণ করিয়া ঠাকুরকে প্রশ্ন করিতেছেন। বেলা ৪টা হইবে।

দক্ষিণেশ্বরনিবাসী ছোকরা — মহাশয়, জ্ঞান কাকে বলে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর সৎ, আর সমস্ত ব্রহ্ম অসৎ; এইটি জানার নাম জ্ঞান।

“যিনি সৎ তাঁর একটি নাম ব্রহ্ম, আর একটি নাম কাল (মহাকাল) । তাই বলে ‘কালে কত গেল — কত হলো রে ভাই!’

“ ‘কালী’ যিনি কালের সহিত রমণ করেন। আদ্যাশক্তি। কাল ও কালী, ব্রহ্ম — ব্রহ্ম ও শক্তি — অভেদ।

“সেই সৎরূপ ব্রহ্ম নিত্য — তিনকালেই আছেন — আদি অন্তরহিত। তাঁকে মুখে বর্ণনা করা যায় না। হদ্দ বলা যায়, — তিনি চৈতন্যস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ।

“জগৎ অনিত্য, তিনিই নিত্য! জগৎ ভেলকিস্বরূপ। বাজিকরই সত্য। বাজিকরের ভেলকি অনিত্য।”

ছোকরা — জগৎ যদি মায়া — ভেলকি — এ মায়া যায় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সংস্কার-দোষে মায়া যায় না। অনেক জন্ম এই মায়ার সংসারে থেকে থেকে মায়াকে সত্য বলে বোধ হয়।

“সংস্কারের কত ক্ষমতা শোন। একজন রাজার ছেলে পূর্বজন্মে ধোপার ঘরে জন্মেছিল। রাজার ছেলে হয়ে যখন খেলা করছে, তখন সমবয়সীদের বলছে, ও-সব খেলা থাক! আমি উপুড় হয়ে শুই, আর তোরা আমার পিঠে হুস্‌ হুস্‌ করে কাপড় কাচ।

[সংস্কারবান গোবিন্দ পাল, গোপাল সেন, নিরঞ্জন, হীরানন্দ — পূর্বকথা — গোবিন্দ, গোপাল ও ঠাকুরদের ছেলেদের আগমন — ১৮৬৩-৬৪ ]

“এখানে অনেক ছোকরা আসে, — কিন্তু কেউ কেউ ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল। তারা সংস্কার নিয়ে এসেছে।

“সে-সব ছোকরা বিবাহের কথায় অ্যাঁ, অ্যাঁ করে! বিবাহের কথা মনেই করে না! নিরঞ্জন ছেলেবেলা থেকে বলে, বিয়ে করব না।

“অনেকদিন হল (কুড়ি বছরের অধিক) বরাহনগর থেকে দুটি ছোকরা আসত। একজনের নাম গোবিন্দ পাল আর-একজনের নাম গোপাল সেন। তাদের ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরেতে মন। বিবাহের কথায় ভয়ে আকুল হত। গোপালের ভাবসমাধি হত! বিষয়ী দেখলে কুণ্ঠিত হত; যেমন ইন্দুর বিড়াল দেখে কুণ্ঠিত হয়। যখন ঠাকুরদের (Tagore) ছেলেরা ওই বাগানে বেড়াতে এসেছিল, তখন কুঠির ঘরের দ্বার বন্ধ করলে, পাছে তাদের সঙ্গে কথা কইতে হয়।

“গোপালের পঞ্চবটীতলায় ভাব হয়েছিল। ভাবে আমার পায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘আমি তবে যাই। আমি আর এ সংসারে থাকতে পারছি না — আপনার এখন অনেক দেরি — আমি যাই।’ আমিও ভাবাবস্থায় বললাম — Change this in doc ‘আবার আসবে’। সে বললে — ‘আচ্ছা, আবার আসব।’

“কিছুদিন পরে গোবিন্দ এসে দেখা করলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, গোপাল কই? সে বললে, গোপাল (শরীরত্যাগ করে) চলে গেছে।

“অন্য ছোকরারা কি করে বেড়াচ্ছে! — কিসে টাকা হয় — বাড়ি — গাড়ি — পোশাক, তারপর বিবাহ — এইজন্য ব্যস্ত হয়ে বেড়ায়। বিবাহ করবে, — আগে কেমন মেয়ে খোঁজ নেয়। আবার সুন্দর কি না, নিজে দেখতে যায়!

“একজন আমায় বড় নিন্দে করে। কেবল বলে, ছোকরাদের ভালবাসি। যাদের সংস্কার আছে — শুদ্ধ আত্মা, ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল, — টাকা, শরীরের সুখ এ-সবের দিকে মন নাই — তাদেরই আমি ভালবাসি।

“যারা বিয়ে করেছে, যদি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তাহলে সংসারে আসক্ত হবে না। হীরানন্দ বিয়ে করেছে। তা হোক সে বেশি আসক্ত হবে না।”

হীরানন্দ সিন্ধুদেশবাসী, বি.এ.পাস, ব্রাহ্মভক্ত।

মণিলাল, শিবপুরের ব্রাহ্মভক্ত, মারোয়াড়ী ভক্তেরা ও ছোকরারা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
===========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা অক্টোবর

কর্মত্যাগ কখন? ভক্তের নিকট ঠাকুরের অঙ্গীকার

সন্ধ্যা হইল। দক্ষিণের বারান্দা ও পশ্চিমের গোল বারান্দায় ফরাশ আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধুনা দেওয়া হইল।

ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া মার নাম করিতেছেন ও মার চিন্তা করিতেছেন। ঘরে মাস্টার, শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে, তাঁহার আত্মীয় হরি মেঝেতে বসিয়া আছেন।

কিয়ৎক্ষণ ধ্যান চিন্তার পর ঠাকুর আবার ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। এখনও ঠাকুরবাড়ির আরতির দেরি আছে।

[বেদান্ত ও শ্রীরামকৃষ্ণ — ওঁকার ও সমাধি — “তত্ত্বমসি” — ওঁ তৎ সৎ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — যে নিশিদিন তাঁর চিন্তা করছে, তার সন্ধ্যার কি দরকার!

ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা-সন্ধ্যা সে কি চায়।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে, কভু সন্ধি নাহি পায় ৷৷
দয়া ব্রত, দান আদি আর কিছু না মনে লয়।
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায় ৷৷

“সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়, গায়ত্রী ওঁকারে জয়হয়।

“একবার ওঁ বললে যখন সমাধি হয় তখন পাকা।

“হৃষীকেশে একজন সাধু সকালবেলায় উঠে ভারী একটা ঝরনা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত দিন সেই ঝরনা দেখে আর ঈশ্বরকে বলে — ‘বাঃ বেশ করেছ! বাঃ বেশ করেছ! কি আশ্চর্য!’ তার অন্য জপতপ নাই। আবার রাত্রি হলে কুটিরে ফিরে যায়।

“তিনি নিরাকার কি সাকার সে-সব কথা ভাববারই বা কি দরকার? নির্জনে গোপনে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে বললেই হয় — হে ঈশ্বর, তুমি যে কেমন, তাই আমায় দেখাদাও!

“তিনি অন্তরে বাহিরে আছেন।

“অন্তরে তিনিই আছেন। তাই বেদে বলে ‘তত্ত্বমসি’ (সেই তুমি)। আর বাহিরেও তিনি। মায়াতে দেখাচ্ছে, নানা রূপ; কিন্তু বস্তুত তিনিই রয়েছেন।

“তাই সব নাম রূপ বর্ণনা করবার আগে, বলতে হয় ওঁ তৎ সৎ।

“দর্শন করলে একরকম, শাস্ত্র পড়ে আর-একরকম। শাস্ত্রে আভাস মাত্র পাওয়া যায়। তাই কতকগুলো শাস্ত্র পড়বার কোন প্রয়োজন নাই। তার চেয়ে নির্জনে তাঁকে ডাকা ভাল।

“গীতা সমস্ত না পড়লেও হয়। দশবার গীতা গীতা বললে যা হয় তাই গীতার সার। অর্থাৎ ‘ত্যাগী’। হে জীব, সব ত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনা কর — এই গীতার সার কথা।”

[শ্রীরামকৃষ্ণের ভবতারিণীর আরতিদর্শন ও ভাবাবেশ ]

ঠাকুর ভক্তসঙ্গে মা-কালীর আরতি দেখিতে দেখিতে ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। আর ঠাকুর-প্রতিমা সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতে পারিতেছেন না।

অতি সন্তর্পণে ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসনে উপবিষ্ট হইলেন। এখনও ভাবাবিষ্ট। ভাবাবস্থায় কথা কহিতেছেন।

মুখুজ্জের আত্মীয় হরির বয়ঃক্রম আঠার-কুড়ি হইবে। তাঁহার বিবাহ হইয়াছে। আপাততঃ মুখুজ্জেদের বাড়িতেই থাকেন — কর্মকাজ করিবেন। ঠাকুরের উপর খুব ভক্তি।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মন্ত্রগ্রহণ — ভক্তের নিকট শ্রীরামকৃষ্ণের অঙ্গীকার ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবাবেশে, হরির প্রতি) — তুমি তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করে মন্ত্র নিও। (শ্রীযুক্ত প্রিয়কে) — এঁকে (হরিকে) বলেও দিতে পারলাম না, মন্ত্র তো দিই না।

“তুমি যা ধ্যান-জপ কর তাই করো।

প্রিয় — যে আজ্ঞা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আর আমি এই অবস্থায় বলছি — কথায় বিশ্বাস করো। দেখো, এখানে ঢঙ-ফঙ নাই।

“আমি ভাবে বলেছি, — মা, এখানে যারা আন্তরিক টানে আসবে; তারা যেন সিদ্ধ হয়।

সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ বারান্দায় বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল হাজরা প্রভৃতির সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর নিজের আসন হইতে তাঁহাকে ডাকিতেছেন — “মহিন্দর!” “মহিন্দর!”

মাস্টার তাড়াতাড়ি গিয়া কবিরাজকে ডাকিয়া আনিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কবিরাজের প্রতি) — বোসো না — একটু শোনো।

কবিরাজ কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া উপবেশন করিলেন ও ঠাকুরের অমৃতোপম কথা শ্রবণ করিতে লাগিলেন।

[নানা ছাঁদে সেবা — বলরামের ভাব — গৌরাঙ্গের তিন অবস্থা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — তাঁকে নানা ছাঁদে সেবা করা যায়।

“প্রেমিক ভক্ত তাঁকে নানারূপে সম্ভোগ করে। কখনও মনে করে ‘তুমি পদ্ম, আমি অলি’। কখনও ‘তুমি সচ্চিদানন্দ, আমি মীন!’

“প্রেমিক ভক্ত আবার ভাবে ‘আমি তোমার নৃত্যকী!’ — আর তাঁর সম্মুখে নৃত্যগীত করে। কখনও বা দাসীভাব। কখনও তাঁর উপর বাৎসল্যভাব — যেমন যশোদার। কখনও বা পতিভাব — মধুরভাব — যেমন গোপীদের।

“বলরাম কখনও সখার ভাবে থাকতেন, কখনও বা মনে করতেন, আমি কৃষ্ণের ছাতা বা আসন হয়েছি। সবরকমে তাঁর সেবা করতেন।”

ঠাকুর প্রেমিক ভক্তের অবস্থা বর্ণনা করিয়া কি নিজের অবস্থা বলিতেছেন? আবার চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা বর্ণনা করিয়া ইঙ্গিত করিয়া বুঝি নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা ছিল। অন্তর্দশায় সমাধিস্থ — বাহ্যশূন্য। অর্ধবাহ্যদশায় আবিষ্ট হইয়া নৃত্য করতে পারতেন, কিন্তু কথা কইতে পারতেন না। বাহ্যদশায় সংকীর্তন।

(ভক্তদের প্রতি) — তোমরা এই সব কথা শুনছো — ধারণার চেষ্টা করবে। বিষয়ীরা সাধুর কাছে যখন আসে তখন বিষয়কথা, বিষয়চিন্তা, একেবারে লুকিয়ে রেখে দেয়। তারপর চলে গেলে সেই গুলি বার করে। পায়রা মটর খেলে; মনে হল যে ওর হজম হয়ে গেল। কিন্তু গলার ভিতর সব রেখে দেয়। গলায় মটর গিড়গিড় করে।

[সন্ধ্যাকালীন উপাসনা — শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুসলমানধর্ম — জপ ও ধ্যান ]

“সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার সময় তোমরা তাঁকে ডাকবে।

“অন্ধকারে ঈশ্বরকে মনে পড়ে; সব এই দেখা যাচ্ছিল! — কে এমন করলে! মোসলমানেরা দেখো সব কাজ ফেলে ঠিক সময়ে নমাজটি পড়বে।

মুখুজ্জে — আজ্ঞা, জপ করা ভাল?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, জপ থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। নির্জনে গোপনে তাঁর নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শন।

“যেমন জলের ভিতর ডুবানো বাহাদুরী কাঠ আছে — তীরেতে শিকল দিয়ে বাঁধা; সেই শিকলের এক এক পাপ ধরে ধরে গেলে, শেষে বাহাদুরী কাঠকে স্পর্শ করা যায়।

“পূজার চেয়ে জপ বড়। জপের চেয়ে ধ্যান বড়। ধ্যানের চেয়ে ভাব বড়। ভাবের চেয়ে মহাভাব প্রেম বড়। চৈতন্যদেবের প্রেম হয়েছিল। প্রেম হলে ঈশ্বরকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া গেল।

হাজরা আসিয়া বসিয়াছেন।

[রাগভক্তি, মালাজপা ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — নারাণ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরাকে) — তাঁর উপর ভালবাসা যদি আসে তার নাম রাগভক্তি। বৈধী ভক্তি আসতেও যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ। রাগভক্তি স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মতো। তার জড় খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের জড় কাশী পর্যন্ত। রাগভক্তি, অবতার আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গের হয়।

হাজরা — আহা!

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি যখন জপ একদিন কচ্ছিলে — বাহ্যে থেকে এসে বললাম মা, একি হীনবুদ্ধি, এখানে এসে মালা নিয়ে জপ কচ্ছে! — যে এখানে আসবে তার একেবারে চৈতন্য হবে। তার মালা জপা অত করতে হবে না। তুমি কলকাতায় যাও না — দেখবে হাজার হাজার মালা জপ করছে — খানকী পর্যন্ত।

ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “তুমি নারাণকে গাড়ি করে এনো। এঁকে (মুখুজ্জেকে) ও বলে রাখলুম — নারাণের কথা। সে এলে কিছু খাওয়াব। ওদের খাওয়ানোর অনেক মানে আছে।”
========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৪ঠা অক্টোবর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলুটোলায় শ্রীযুক্ত নবীন সেনের বাটীতে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে

আজ শনিবার কোজাগর পূর্ণিমা (চন্দ্রগ্রহণ)। শ্রীযুক্ত কেশব সেনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নবীন সেনের কলুটোলার বাটীতে ঠাকুর আসিয়াছেন। ৪ঠা অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; ১৯শে আশ্বিন, ১২৯১ সাল।

গত বৃহস্পতিবারে কেশবের মা ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া অনেক করিয়া যাইতে বলিয়া গিয়াছিলেন।

বাহিরের উপরের ঘরে গিয়া ঠাকুর বসিলেন। নন্দলাল প্রভৃতি কেশবের ভ্রাতুষ্পুত্রগণ, কেশবের মাতা ও তাঁহাদের আত্মীয় বন্ধুগণ ঠাকুরকে খুব যত্ন করিতেছেন। উপরের ঘরেই সংকীর্তন হইল। কলুটোলার সেনেদের অনেক মেয়েরাও আসিয়াছেন।

ঠাকুরের সঙ্গে বাবুরাম, কিশোরী, আরও দু-একটি ভক্ত। মাস্টারও আসিয়াছেন।

তিনি নিচে বসিয়া ঠাকুরের মধুর সংকীর্তন শুনিতেছেন।

ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের বলিতেছেন, — সংসার অনিত্য; আর সর্বদা মৃত্যু স্ম রণ করা উচিত। ঠাকুর গান গাইতেছেন:

ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।
ভুল না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে ৷৷
দিন দুই-তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে।
সেই কর্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কর্তা এলে ৷৷
যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে।
সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া অমঙ্গল হবে বলে ৷৷

ঠাকুর বলিতেছেন — ডুব দাও — উপরে ভাসলে কি হবে? দিন কতক নির্জনে সব ছেড়ে, ষোল আনা মন দিয়ে, তাঁকে ডাকো।

ঠাকুর গান গাইতেছেন:

ডুব্‌ ডুব্‌ ডুব্‌ রূপসাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন ৷৷

ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের, “তুমি সর্বস্ব আমার।” এই গানটি গাইতে বলিতেছেন।

তুমি সর্বস্ব আমার (হে নাথ) প্রাণাধার সারাৎসার।
নাহি তোমা বিনে, কেহ ত্রিভুবনে, আপনার বলিবার।

ঠাকুর নিজে গাইতেছেন:

যশোদা নাচাতো গো মা বলে নীলমণি।
সেরূপ লুকালে কোথা করালবদনী ৷৷
(একবার নাচ গো শ্যামা) (অসি ফেলে বাঁশী লয়ে)
(মুণ্ডমালা ফেলে বনমালা লয়ে) (তোর শিব বলরাম হোক)
(তেমনি তেমনি করে নাচ গো শ্যামা)
(যেরূপে ব্রজমাঝে নেচেছিলি)
(একবার বাজা গো মা, তোর মোহন বেণু)
(যে বেণুরবে গোপীর মন ভুলাতিস্‌)
(যে বেণুরবে ধেনু ফিরাতিস্‌)
(যে বেণুরবে যমুনা উজান বয়)।
গগনে বেলা বাড়িত, রানীর মন ব্যাকুল হতো,
বলে ধর ধর ধর, ধর রে গোপাল, ক্ষীর সর নবনী;
এলায়ে চাঁচর কেশ রানী বেঁধে দিত বেণী।
শ্রীদামের সঙ্গে, নাচিতে ত্রিভঙ্গ,
আবার তাথৈয়া তাথৈয়া, তাতা থৈয়া থৈয়া, বাজত নূপুরধ্বনি;
শুনতে পেয়ে আসত ধেয়ে যত ব্রজের রমণী (গো মা!) — ।

এই গান শুনিয়া কেশব ওই সুরের একটি গান বাঁধাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল সংযোগে সেই গান গাইতেছেন:

কত ভালবাস গো মা মানব সন্তানে,
মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে।

তাঁহারা আবার মার নাম করিতেছেন:

(১) – অন্তরে জাগিছ গো মা অন্তরযামিনী,
কোলে করে আছ মোরে দিবস যামিনী।

(২) – কেন রে মন ভাবিস এত দীন হীন কাঙালের মতো,
আমার মা ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরী সিদ্ধেশ্বরী ক্ষেমঙ্করী।

ঠাকুর এইবার হরিনাম ও শ্রীগৌরাঙ্গের নাম করিতেছেন ও ব্রাহ্মভক্তদের সহিত নাচিতেছেন।

(১) – মধুর হরিনাম নসে রে, জীব যদি সুখে থাকবি।

(২) – গৌরপ্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়।
হুঙ্কারে পাষণ্ড-দলন এ-ব্রহ্মাণ্ড তলিয়ে যায় ৷৷

(৩) – ব্রজে যাই কাঙ্গালবেশে কৌপিন দাও হে ভারতী।

(৪) – গৌর নিতাই তোমরা দুভাই, পরম দয়াল হে প্রভু।

(৫) – হরি বলে আমার গৌর নাচে।

(৬) – কে হরিবোল হরিবোল বলিয়ে যায়। যারে মাধাই জেনে আয়।
(আমার গৌর যায় কি নিতাই যায় রে) (যাদের সোনার নূপুর রাঙা পায়)
(যাদের নেড়া মাথা ছেঁড়া কাঁথা রে,) (যেন দেখি পাগলের প্রায়)।

ব্রাহ্মভক্তেরা আবার গাইতেছেন:

কত দিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার।
হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম, নয়নে বহিবে প্রেম-অশ্রুধার ৷৷

ঠাকুর উচ্চ সংকীর্তন করিয়া গাহিতেছেন ও নাচিতেছেন:

(১) – যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে,
তারা, দুভাই এসেছে রে!
(যারা মার খে য়ে প্রেম যাচে, তারা) (যারা আপনি কেঁদে জগৎ কাঁদায়)।

(২) – নদে টলমল টলমল করে ওই গৌর প্রেমের হিল্লোলে রে!

ঠাকুর মার নাম করিতেছেন:

গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ করো না।

ব্রাহ্মভক্তেরা তাঁহাদের দুইটি গান গাহিতেছেন:

(১) – আমায় দে মা পাগল করে।

(২) – চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেম চন্দ্রোদয় হে।
============

Post a Comment

0 Comments