দক্ষিণেশ্বরে মহেন্দ্র, রাধিকা গােস্বামী প্রভৃতি সঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

বিংশ খণ্ড 
দক্ষিণেশ্বরে মহেন্দ্র, রাখাল, রাধিকা গোস্বামী প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

দক্ষিণেশ্বরে মহেন্দ্র, রাধিকা গােস্বামী প্রভৃতি সঙ্গে

==========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর
মহেন্দ্রাদির প্রতি উপদেশ — কাপ্তেনের ভক্তি ও পিতামাতার সেবা 

শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরৎকাল। শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪; ৪ঠা আশ্বিন, ১২৯১; বেলা দুইটা। আজ ভাদ্র অমাবস্যা। মহালয়া। শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁহার ভ্রাতা শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখোপাধ্যায়, মাস্টার, বাবুরাম, হরিশ, কিশোরী, লাটু, মেঝেতে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন, — কেহ বা ঘরে যাতায়াত করিতেছেন। শ্রীযুক্ত হাজরা বারান্দায় বসিয়া আছেন। রাখাল বলরামের সহিত বৃন্দাবনে আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রাদি ভক্তদের প্রতি) — কলিকাতায় কাপ্তেনের বাড়িতে গিছলাম। ফিরে আসতে অনেক রাত হয়েছিল।

“কাপ্তেনের কি স্বভাব! কি ভক্তি! ছোট কাপড়খানি পরে আরতি করে। একবার তিন বাতিওয়ালা প্রদীপে আরতি করে, — তারপর আবার এক বাতিওলা প্রদীপে। আবার কর্পূরের আরতি।

“সে সময়ে কথা হয় না। আমায় ইশারা করে আসনে বসতে বললে।

“পূজা করবার সময় চোখের ভাব — ঠিক যেন বোলতা কামড়েছে!

“এদিকে গান গাইতে পারে না। কিন্তু সুন্দর স্তব পাঠ করে।

“তার মার কাছে নিচে বসে। মা — আসনের উপর বসবে।

“বাপ ইংরাজের হাওয়ালদার। যুদ্ধক্ষেত্রে একহাতে বন্দুক আর-এক হাতে শিবপূজা করে। খানসামা শিব গড়ে গড়ে দিচ্ছে। শিবপূজা না করে জল খাবে না। ছয় হাজার টাকা মাহিনা বছরে।

“মাকে কাশীতে মাঝে মাঝে পাঠায়। সেখানে বার-তেরো জন মার সেবায় থাকে। অনেক খরচা। বেদান্ত, গীতা, ভাগবত — কাপ্তেনের কণ্ঠস্থ!

“সে বলে, কলিকাতার বাবুরা ম্লেচ্ছাচার।

“আগে হঠযোগ করেছিল — তাই আমার সমাধি কি ভাবাবস্থা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“কাপ্তেনের পরিবার — তার আবার আলাদা ঠাকুর, গোপাল। এবার তত কৃপণ দেখলাম না। সেও গীতা-টীতা জানে। ওদের কি ভক্তি! — আমি যেখানে খাব সেইখানেই আঁচাব। খড়কে কাঠিটি পর্যন্ত।

“পাঁঠার চচ্চড়ি করে, — কাপ্তেন বলে পনর দিন থাকে, — কিন্তু কাপ্তেনের পরিবার বললে — ‘নাহি নাহি, সাত রোজ’। কিন্তু বেশ লাগল। ব্যঞ্জন সব একটু একটু। আমি বেশ খাই বলে, আজকাল আমায় বেশি দেয়।

“তারপর খাবার পর, হয় কাপ্তেন, নয় তার পরিবার বাতাস করবে।”

[Jung Bahadur-এর ছেলেদের কাপ্তেনের সঙ্গে আগমন ১৮৭৫-৭৬ — নেপালী ব্রহ্মচারিণীর গীতগোবিন্দ গান — “আমি ঈশ্বরের দাসী” ]

“ওদের কিন্তু ভারী ভক্তি, — সাধুদের বড় সম্মান। পশ্চিমে লোকেদের সাধুভক্তি বেশি। জাঙ্‌-বাহাদুরের ছেলেরা আর ভাইপো কর্ণেল এখানে এসেছিল। যখন এলো পেন্টুলুণ খুলে যেন কত ভয়ে।

“কাপ্তেনের সঙ্গে একটি ওদের দেশের মেয়ে এসেছিল। ভারী ভক্ত, — বিবাহ হয় নাই। গীতগোবিন্দ গান কণ্ঠস্থ। তার গান শুনতে দ্বারিকবাবুরা এসে বসেছিল। আমি বললাম, এরা শুনতে চাচ্ছে, লোক ভাল। যখন গীতগোবিন্দ গান গাইলে তখন দ্বারিকবাবু১ রুমালে চক্ষের জল পুছতে লাগল। বিয়ে কর নাই কেন, জিজ্ঞাসা করাতে বলে, ‘ঈশ্বরের দাসী, আবার কার দাসী হব?’ আর সব্বাই তাকে দেবী বলে খুব মানে — যেমন পুঁথিতে (শাস্ত্রে) আছে।

(মহেন্দ্রাদির প্রতি) — “আপনারা যে আসছো, তাতে কিছু কি উপকার হচ্ছে? শুনলে মনটা বড় ভাল থাকে। (মাস্টারের প্রতি) এখানে লোক আসে কেন? তেমন লেখাপড়া জানি না –”

মাস্টার — আজ্ঞা, কৃষ্ণ যখন নিজে সব রাখাল গরুটরু হলেন (ব্রহ্মা হরণ করবার পর) তখন রাখালদের মা’রা নূতন রাখালদের পেয়ে যশোদার বাড়িতে আর আসেন না। গাভীরাও হাম্বা রবে ওই নূতন বাছুরদের পিছে পিছে গিয়ে পড়তে লাগল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাতে কি হলো?

মাস্টার — ঈশ্বর নিজেই সব হয়েছেন কি না, তাই এত আকর্ষণ। ঈশ্বর বস্তু থাকলেই মন টানে।

[কৃষ্ণলীলার ব্যাখ্যা — গোপীপ্রেম — বস্ত্রহরণের মানে ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ যোগমায়ার আকর্ষণ — ভেলকি লাগিয়ে দেয়। রাধিকা সুবোল বেশে বাছুর কোলে — জটিলার ভয়ে যাচ্ছে; যখন যোগমায়ার শরণাগত হলো তখন জটিলা আবার আশীর্বাদ করে।

“হরিলীলা সব যোগমায়ার সাহায্যে!

“গোপীদের ভালবাসা — পরকীয়া রতি। কৃষ্ণের জন্য গোপীদের প্রেমোন্মাদ হয়েছিল। নিজের সোয়ামীর জন্য অত হয় না। যদি কেউ বলে, ওরে তোর সোয়ামী এসেছে! তা বলে, ‘এসেছে, তা আসুকগে, — ওই খাবে এখন! কিন্তু যদি পর পুরুষের কথা শুনে, — রসিক, সুন্দর, রসপণ্ডিত, — ছুটে দেখতে যাবে, — আর আড়াল থেকে উঁকি মেরে — দেখবে।

“যদি খোঁচ ধর যে, তাঁকে দেখি নাই, তাঁর উপর কেমন করে গোপীদের মতো টান হবে? তা শুনলেও সে টান হয় —

“না জেনে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হলো।”

একজন ভক্ত — আজ্ঞা, বস্ত্রহরণের মানে কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — অষ্টপাশ, — গোপীদের সব পাশই গিয়েছিল, কেবল লজ্জা বাকী ছিল। তাই তিনি ও পাশটাও ঘুচিয়ে দিলেন। ঈশ্বরলাভ হলে সব পাশ চলে যায়।

[যোগভ্রষ্টের ভোগান্তে ঈশ্বরলাভ ]

(মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — “ঈশ্বরের উপর টান সকলের হয় না, আধার বিশেষ হয়। সংস্কার থাকলে হয়। তা না হলে বাগবাজারে এত লোক ছিল কেবল তোমরাই এখানে এলে কেন? আদাড়েগুলোর হয় না।

“মলয় পর্বতের হাওয়া লাগলে সব গাছ চন্দন হয়; কেবল শিমূল, অশ্বত্থ, বট আর কয়েকটা গাছ চন্দন হয় না।

“তোমাদের টাকা-কড়ির অভাব নাই। যোগভ্রষ্ট হলে ভাগ্যবানের ঘরে জন্ম হয়, — তারপর আবার ঈশ্বরের জন্য সাধনা করে।”

মহেন্দ্র মুখুজ্জে — কেন যোগভ্রষ্ট হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — পূর্বজন্মে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে হয়তো হঠাৎ ভোগ করবার লালসা হয়েছে। এরূপ হলে যোগভ্রষ্ট হয়। আর পরজন্মে ওইরূপ জন্ম হয়।

মহেন্দ্র — তারপর, উপায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কামনা থাকতে — ভোগ লালসা থাকতে — মুক্তি নাই। তাই খাওয়া-পরা, রমণ-ফমন সব করে নেবে। (সহাস্যে) তুমি কি বল? স্বদারায় না পরদারায়? (মাস্টার, মুখুজ্জে, এঁরা হাসিতেছেন)

১ দ্বারিকবাবু মথুরের জেষ্ঠপুত্র। ১৮৭৭ খ্রী: প্রায় ৪০ বৎসর বয়সে মৃত্যু হয় — পৌষ ১২৮৪। কাপ্তেন প্রথম আসেন ১৮৭৫-৭৬ খ্রী:। অতএব এই গীতগোবিন্দ গান ১৮৭৫ ও ১৮৭৭ খ্রী: মধ্যে হইবে।
==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত — ঠাকুরের নানা সাধ
[পূর্বকথা — প্রথম কলিকাতায় নাথের বাগানে — গঙ্গাস্নান ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগ লালসা থাকা ভাল নয়। আমি তাই জন্য যা যা মনে উঠতো আমনি করে নিতাম।

“বড়বাজারের রঙকরা সন্দেশ দেখে খেতে ইচ্ছা হল। এরা আনিয়া দিলে। খুব খেলুম, — তারপর অসুখ।

“ছেলেবেলা গঙ্গা নাইবার সময়, তখন নাথের বাগানে, একটি ছেলের কোমরে সোনার গোট দেখেছিলাম। এই অবস্থার পর সেই গোট পরতে সাধ হল। তা বেশিক্ষণ রাখবার জো নাই, — গোট পরে ভিতর দিয়ে সিড়সিড় করে উপরে বায়ু উঠতে লাগল — সোনা গায়ে ঠেকেছে কি না? একটু রেখেই খুলে ফেলতে হল। তা না হলে ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

“ধনেখালির খইচুর, খানাকুল কৃষ্ণনগরের সরভাজা, তাও খেতে সাধ হয়েছিল।” (সকলের হাস্য)

[পূর্বকথা — শম্ভুর ও রাজনারায়ণের চন্ডী শ্রবণ — ঠাকুরের সাধুসেবা ]

“শম্ভুর চন্ডীর গান শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল! সে গান শোনার পর আবার রাজনারায়ণের চন্ডী শুনতে ইচ্ছা হয়েছিল। তাও শোনা হল।

“অনেক সাধুরা সে সময়ে আসত। তা সাধ হল, তাদের সেবার জন্য আলাদা একটি ভাঁড়ার হয়। সেজোবাবু তাই করে দিলে। সেই ভাঁড়ার থেকে সাধুদের সিদে কাঠ, এ-সব দেওয়া হত।

“একবার মনে উঠল যে খুব ভাল জরির সাজ পরব। আর রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সেজোবাবু নূতন সাজ, গুড়গুড়ি, সব পাঠিয়ে দিলে। সাজ পরা হল। গুড়গুড়ি নানারকম করে টানতে লাগলুম। একবার এপাশ থেকে, একবার ওপাশ থেকে, — উঁচু থেকে নিচু থেকে। তখন বললাম, মন এর নাম রূপার গুড়গুড়িতে তামাক খাওয়া! এই বলে গুড়গুড়ি ত্যাগ হয়ে গেল। সাজগুলো খানিক পরে খুলে ফেললাম, — পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম — আর তার উপর থু থু করতে লাগলাম — বললাম, এর নাম সাজ! এই সাজে রজোগুণ হয়!”

[বৃন্দাবনে রাখাল ও বলরাম — পূর্বকথা — রাখালের প্রথম ভাব ১৮৮১ ]

বলরামের সহিত রাখাল বৃন্দাবনে আছেন। প্রথম প্রথম বৃন্দাবনের খুব সুখ্যাত করিয়া আর বর্ণনা করিয়া পত্রাদি লিখিতেন। মাস্টারকে পত্র লিখিয়াছিলেন, ‘এ বড় উত্তম স্থান, আপনি আসবেন, — ময়ূর-ময়ূরী সব নৃত্য করছে — আর নৃত্যগীত, সর্বদাই আনন্দ!’ তারপর রাখালের অসুখ হইয়াছে — বৃন্দাবনের জ্বর। ঠাকুর শুনিয়া বড়ই চিন্তিত আছেন। তাঁর জন্য চন্ডীর কাছে মানসিক করেছেন। ঠাকুর রাখালের কথা কহিতেছেন — “এইখানে বসে পা টিপতে টিপতে রাখালের প্রথম ভাব হয়েছিল। একজন ভাগবতের পণ্ডিত এই ঘরে বসে ভাগবতের কথা বলছিল। সেই সকল কথা শুনতে শুনতে রাখাল মাঝে মাঝে শিউরে উঠতে লাগল; তারপর একেবারে স্থির!

“দ্বিতীয় বার ভাব বলরামের বাটীতে — ভাবেতে শুয়ে পড়েছিল।

“রাখালের সাকারের ঘর — নিরাকারের কথা শুনলে উঠে যাবে।

“তার জন্য চন্ডীকে মানলুম। সে যে আমার উপর সব নির্ভর করেছিল — বাড়িঘর সব ছেড়ে! তার পরিবারের কাছে তাকে আমিই পাঠিয়ে দিতাম — একটু ভোগের বাকী ছিল।

বৃন্দাবন থেকে এঁকে লিখেছে, এ বেশ জায়গা — ময়ূর-ময়ূরী নৃত্য করছে — এখন ময়ূর-ময়ূরী বড়ই মুশকিলে ফেলেছে!

“সেখানে বলরামের সঙ্গে আছে! বলরামের কি স্বভাব! আমার জন্য ওদেশে (উড়িষ্যায় কোঠারে) যায় না। ভাই মাসহারা বন্ধ করেছিল আর বলে পাঠিয়েছিল, ‘তুমি এখানে এসে থাকো, মিছামিছি কেন অত টাকা খরচ কর।’ — তা সে শুনে নাই — আমাকে দেখবে বলে।

“কি স্বভাব! — রাতদিন কেবল ঠাকুর লয়ে; — মালীরা ফুলের মালাই গাঁথছে! টাকা বাঁচবে বলে বৃন্দাবনে চার মাস থাকবে। দুশ টাকা মাসহারা পায়।“

[পূর্বকথা — নরেন্দ্রের জন্য ক্রন্দন — নরেন্দ্রের প্রথম দর্শন ১৮৮১ ]

“ছোকরাদের ভালবাসি কেন? — ওদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন এখনও ঢুকে নাই। আমি ওদের নিত্যসিদ্ধ দেখি!

“নরেন্দ্র যখন প্রথম এলো — ময়লা একখানা চাদর গায়ে, — কিন্তু চোখ মুখ দেখে বোধ হল ভিতরে কিছু আছে। তখন বেশি গান জানতো না। দুই-একটা গাইলে,:

‘মন চল নিজ নিকেতনে’ আর ‘যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।’

“যখন আসত, — একঘর লোক — তবু ওর দিক পানে চেয়েই কথা কইতাম। ও বলত, ‘এঁদের সঙ্গে কথা কন’, — তবে কইতাম।

“যদু মল্লিকের বাগানে কাঁদতুম, — ওকে দেখবার জন্য পাগল হয়েছিলাম। এখানে ভোলানাথের হাত ধরে কান্না! — ভোলানাথ বললে, ‘একটা কায়েতের ছেলের জন্য মশায় আপনার এরূপ করা উচিত নয়।’ মোটা বামুন একদিন হাতজোড় করে বললে, ‘মশায়, ওর সামান্য পড়াশুনো, ওর জন্য আপনি এত অধীর কেন হন?’

“ভবনাথ নরেন্দ্রের জুড়ি — দুজনে যেন স্ত্রী-পুরুষ! তাই ভবনাথকে নরেন্দ্রের কাছে বাসা করতে বললুম। ওরা দুজনেই অরূপের ঘর।”

[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম, লোকশিক্ষার্থ ত্যাগ — ঘোষপাড়ার সাধনের কথা ]

“আমি ছোকরাদের মেয়েদের কাছে বেশি থাকতে বা আনাগোনা করতে বারণ করে দিই।

“হরিপদ এক ঘোষপাড়ার মাগীর পাল্লায় পড়েছে। সে বাৎসল্যভাব করে। হরিপদ ছেলেমানুষ, কিছু বোঝে না। ওরা ছোকরা দেখলে ওইরকম করে। শুমলাম হরিপদ নাকি ওর কোলে শোয়। আর সে হাতে করে তাকে খাবার খাইয়ে দেয়। আমি ওকে বলে দিব — ও-সব ভাল নয়। ওই বাৎসল্যভাব থেকেই আবার তাচ্ছল্যভাব হয়।

“ওদের বর্তমানের সাধন — মানুষ নিয়ে সাধন। মানুষকে মনে করে শ্রীকৃষ্ণ। ওরা বলে ‘রাগকৃষ্ণ’। গুরু জিজ্ঞাসা করে, ‘রাগকৃষ্ণ পেয়েছিস?’ সে বলে ‘হাঁ, পেয়েছি।’

“সেদিন সে মাগী এসেছিল। তার চাহুনির রকম দেখলাম, বড় ভাল নয়। তারি ভাবে বললাম, ‘হরিপদকে নিয়ে যেমন কচ্চো কর — কিন্তু অন্যায় ভাব এনো না।’

“ছোকরাদের সাধনার অবস্থা। এখন কেবল ত্যাগ। সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। আমি ওদের বলি, মেয়েমানুষ ভক্ত হলেও তাদের সঙ্গে বসে কথা কবে না; দাঁড়িয়ে একটু কথা কবে। সিদ্ধ হলেও এইরূপ করতে হয় — নিজের সাবধানের জন্য, — আর লোকশিক্ষার জন্য। আমিও মেয়েরা এলে একটু পরে বলি, তোমরা ঠাকুর দেখগে। তাতে যদি না উঠে, নিজে উঠে পড়ি। আমার দেখে আবার সবাই শিখবে।”

[পূর্বকথা — ফুলুই শ্যামবাজার দর্শন ১৮৮০ — অবতারের আকর্ষণ ]

“আচ্ছা, এই যে সব ছেলেরা আসছে, আর তোমরা সব আসছো, এর মানে কি? এর (অর্থাৎ আমার) ভিতরে অবশ্য কিছু আছে, তা না হলে টান হয় কেমন করে — কেন আকর্ষণ হয়?

“ও-দেশে যখন হৃদের বাড়িতে (কামারপুকুরের নিকট, সিওড়ে) ছিলাম। তখন শ্যামবাজারে নিয়ে গেল। বুঝলাম গৌরাঙ্গভক্ত। গাঁয়ে ঢোকবার আগে দেখিয়ে দিলে। দেখলাম গৌরাঙ্গ! এমনি আকর্ষণ — সাতদিন সাতরাত লোকের ভিড়! কেবল কীর্তন আর নৃত্য। পাঁচিলে লোক! গাছে লোক!

“নটবর গোস্বামির বাড়িতে ছিলাম। সেখানে রাতদিন ভিড়। আমি আবার পালিয়ে গিয়ে এক তাঁতীর ঘরে সকালে গিয়ে বসতাম। সেখানে আবার দেখি, খানিক পরে সব গিয়েছে। সব খোল-করতাল নিয়ে গেছে! — আবার ‘তাকুটী! তাকুটী!’ করছে। খাওয়া দাওয়া বেলা তিনটার সময় হতো!

“রব উঠে গেল — সাতবার মরে, সাতবার বাঁচে, এমন এক লোক এসেছে! পাছে আমার সর্দিগর্মি হয়, হৃদে মাঠে টেনে নিয়ে যেতো; — সেখানে আবার পিঁপড়ের সার! আবার খোল-করতাল। — তাকুটী! তাকুটী! হৃদে বকলে, আর বললে, ‘আমরা কি কখনও কীর্তন শুনি নাই?’

“সেখানকার গোঁসাইরা ঝগড়া করতে এসেছিল। মনে করেছিল, আমরা বুঝি তাদের পাওনাগণ্ডা নিতে এসেছি। দেখলে, আমি একখানা কাপড় কি একগাছা সুতাও লই নাই। কে বলেছিল ‘ব্রহ্মজ্ঞানী’। তাই গোঁসাইরা বিড়তে এসেছিল। একজন জিজ্ঞাসা করলে, ‘এঁর মালা তিলক, নাই কেন?’ তারাই একজন বললে, ‘নারকেলের বেল্লো আপনা-আপনি খসে গেছে’। ‘নারকেলের বেল্লো’ ও কথাটি ওইখানেই শিখেছি। জ্ঞান হলে উপাধি আপনি খসে পড়ে যায়।

“দূর গাঁ থেকে লোক এসে জমা হতো। তারা রাত্রে থাকত। যে বাড়িতে ছিলাম, তার উঠানে রাত্রে মাগীরা অনেক সব শুয়ে আছে। হৃদে প্রস্রাব করতে রাতে বাহিরে যাচ্ছিল, তা বলে, ‘এইখানেই (উঠানে) করো।’

“আকর্ষণ কাকে বলে, ওইখানেই (শ্যামবাজারে) বুঝলাম। হরিলীলায় যোগমায়ার সাহায্যে আকর্ষণ হয়, যেন ভেলকি লেগে যায়!”
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী

মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ভক্তগণের সহিত কথা কহিতে কহিতে বেলা প্রায় তিনটা বাজিয়াছে। শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এই প্রথম দর্শন করলেন। বয়স আন্দাজ ত্রিশের মধ্যে। গোস্বামী আসন গ্রহণ করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আপনারা কি অদ্বৈতবংশ?

গোস্বামী — আজ্ঞা, হাঁ।

ঠাকুর অদ্বৈতবংশ শুনিয়া গোস্বামীকে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতেছেন।

[গোস্বামী বংশ ও ব্রাহ্মণ পূজনীয় — মহাপুরুষের বংশে জন্ম ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — অদ্বৈতগোস্বামী বংশ, — আকরের গুণ আছেই!

“নেকো আমের গাছে নেকো আমই হয়। (ভক্তদের হাস্য) খারাপ আম হয় না। তবে মাটির গুণে একটু ছোট বড় হয়। আপনি কি বলেন?”

গোস্বামী (বিনীতভাবে) — আজ্ঞে, আমি কি জানি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি যাই বল, — অন্য লোকে ছাড়বে কেন?

“ব্রাহ্মণ, হাজার দোষ থাকুক — তবু ভরদ্বাজ গোত্র, শাণ্ডিল্য গোত্র বলে সকলের পূজনীয়। (মাস্টারের প্রতি) শঙ্খচিলের কথাটি বল তো!”

মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন —

শ্রীরামকৃষ্ণ — বংশে মহাপুরুষ যদি জন্মে থাকেন তিনিই টেনে নেবেন — হাজার দোষ থাকুক। যখন গন্ধর্ব কৌরবদের বন্দী করলে যুধিষ্ঠির গিয়ে তাদের মুক্ত করলেন। যে দুর্যোধন এত শত্রুতা করেছে, যার জন্য যুধিষ্ঠিরের বনবাস হয়েছে তাকেই গিয়ে মুক্ত করলেন!

“তা ছাড়া ভেকের আদর করতে হয়। ভেক দেখলে সত্য বস্তুর উদ্দীপন হয়। চৈতন্যদেব গাধাকে ভেক পরিয়ে সাষ্টাঙ্গ হয়েছিলেন।

“শঙ্খচিলকে দেখলে প্রণাম করে কেন? কংস মারতে যাওয়াতে ভগবতী শঙ্খচিল হয়ে উড়ে গিয়েছিলেন। তা এখনও শঙ্খচিল দেখলে সকলে প্রণাম করে।”

[পূর্বকথা — চানকে কোয়ার সিং কর্তৃক ঠাকুরের পূজা — ঠাকুরের রাজভক্তি Loyality]

“চানকের পল্টনের ভিতর ইংরাজকে আসতে দেখে সেপাইরা সেলাম করলে। কোয়ার সিং আমাকে বুঝিয়ে দিলে, ‘ইংরাজের রাজ্য তাই ইংরাজকে সেলাম করতে হয়’।”

[গোস্বামীর কছে সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা — শাক্ত ও বৈষ্ণব ]

“শাক্তের তন্ত্র মত বৈষ্ণবের পুরাণ মত। বৈষ্ণব যা সাধন করে তা প্রকাশে দোষ নাই। তান্ত্রিকের সব গোপন। তাই তান্ত্রিককে সব বোঝা যায় না।

(গোস্বামীর প্রতি) — “আপনারা বেশ — কত জপ করেন, কত হরিনাম করেন।”

গোস্বামী (বিনীতভাবে) — আজ্ঞা, আমরা আর কি করছি! আমি কত অধম।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — দীনতা; আচ্ছা ও তো আছে। আর এক আছে, ‘আমি হরিনাম কচ্ছি, আমার আবার পাপ! যে রাতদিন ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ ‘আমি অধম’ ‘আমি অধম’ করে, সে তাই হয়ে যায়। কি অবিশ্বাস! তাঁর নাম এত করেছে আবার বলে, ‘পাপ, পাপ!’

গোস্বামী এই কথা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

[পূর্বকথা — বৃন্দাবনে বৈষ্ণবের ভেক গ্রহণ ১৮৬৮ খ্রী: ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমিও বৃন্দাবনে ভেক নিয়েছিলাম; — পনর দিন রেখেছিলাম। (ভক্তদের প্রতি) সব ভাবই কিছুদিন করতাম, তবে শান্তি হতো।

(সহাস্যে) “আমি সবরকম করেছি — সব পথই মানি। শাক্তদেরও মানি, বৈষ্ণবদেরও মানি, আবার বেদান্তবাদীদেরও মানি। এখানে তাই সব মতের লোক আসে। আর সকলেই মনে করে, ইনি আমাদেরই মতের লোক। আজকালকার ব্রহ্মজ্ঞানীদেরও মানি।

“একজনের একটি রঙের গামলা ছিল। গামলার আশ্চর্য গুণ যে, যে রঙে কাপড় ছোপাতে চাইবে তার কাপড় সেই রঙেই ছুপে যেত।

“কিন্তু একজন চালাক লোক বলেছিল, ‘তুমি যে-রঙে রঙেছো, আমায় সেই রঙটি দিতে হবে।’ (ঠাকুর ও সকলের হাস্য)

“কেন একঘেয়ে হব? ‘অমুক মতের লোক তাহলে আসবে না।’ এ ভয় আমার নাই। কেউ আসুক আর না আসুক তাতে আমার বয়ে গেছে; — লোক কিসে হাতে থাকবে, এমন কিছু আমার মনে নাই। অধর সেন বড় কর্মের জন্য মাকে বলতে বলেছিল — তা ওর সে কর্ম হল না। ও তাতে যদি কিছু মনে করে, আমার বয়ে গেছে!”

[পূর্বকথা — কেশব সেনের বাটীতে নিরাকারের ভাব — বিজয় গোস্বামীর সঙ্গে এঁড়েদর গদাধরের পাঠবাড়িদর্শন — বিজয়ের চরিত্র ]

“আবার কেশব সেনের বাড়ি গিয়ে আর এক ভাব হল। ওরা নিরাকার নিরাকার করে; — তাই ভাবে বললুম, ‘মা এখানে আনিসনি, এরা তোর রূপ-টুপ মানে না’।”

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সকল কথা শুনিয়া গোস্বামী চুপ করিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বিজয় এখন বেশ হয়েছে।

“হরি হরি বলতে বলতে মাটিতে পড়ে যায়!

“চারটে রাত পর্যন্ত কীর্তন, ধ্যান এই সব নিয়ে থাকে। এখন গেরুয়া পরে আছে। ঠাকুর-বিগ্রহ দেখলে একেবারে সাষ্টাঙ্গ!

“চৈতন্যদেবের পটের সম্মুখে আবার সাষ্টাঙ্গ!”

গোস্বামী — রাধাকৃষ্ণ মূর্তির সম্মুখে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাষ্টাঙ্গ! আর আচারী খুব।

গোস্বামী — এখন সমাজে নিতে পারা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে লোকে কি বলবে, তা অত চায় না।

গোস্বামী — না, সমাজ তাহলে কৃতার্থ হয় — অমন লোককে পেলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমায় খুব মানে।

“তাকে পাওয়াই ভার। আজ ঢাকায় ডাক, কাল আর এক জায়গায় ডাক। সর্বদাই ব্যস্ত।

“তাদের সমাজে (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে) বড় গোল উঠেছে।”

গোস্বামী — আজ্ঞা, কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাকে বলছে, ‘তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো! — তুমি পৌত্তলিক।’

“আর অতি উদার সরল। সরল না কলে ঈশ্বরের কৃপা হয় না।”

[মুখুজ্জেদিগকে শিক্ষা — গৃহস্থ, “এগিয়ে পড়” — অভ্যাসযোগ ]

এইবার ঠাকুর মুখুজ্জেদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। জ্যেষ্ঠ মহেন্দ্র ব্যবসা করেন কাহারও চাকরি করেন না। কনিষ্ঠ প্রিয়নাথ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এখন কিছু সংস্থান করিয়াছেন। আর চাকরি করেন না। জ্যেষ্ঠের বয়স ৩৫/৩৬ হইবে। তাঁহাদের বাড়ি কেদেটি গ্রামে। কলিকাতা বাগবাজারের তাঁহাদের বসতবাটী আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — একটু উদ্দীপন হচ্চে বলে চুপ করে থেকো না। এগিয়ে পড়। চন্দন কাঠের পর আরও আছে — রূপার খনি, সোনার খনি!

প্রিয় (সহাস্যে) — আজ্ঞা, পায়ে বন্ধন — এগুতে দেয় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — পায়ে বন্ধন থাকলে কি হবে? — মন নিয়ে কথা।

“মনেই বদ্ধ মুক্ত। দুই বন্ধু — একজন বেশ্যালয়ে গেল, একজন ভাগবত শুনছে। প্রথমটি ভাবছে — ধিক্‌ আমাকে — বন্ধু হরিকথা শুনছে আর আমি কোথা পড়ে রয়েছি। আর-একজন ভাবছে, ধিক্‌ আমাকে, বন্ধু কেমন আমোদ-আহ্লাদ করছে, আর আমি শালা কি বোকা! দেখো প্রথমটিকে বিষ্ণুদূতে নিয়ে গেল — বৈকুণ্ঠে। আর দ্বিতীয়টিকে যমদূতে নিয়ে গেল”।

প্রিয় — মন যে আমার বশ নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি! অভ্যাস যোগ। অভ্যাস কর, দেখবে মনকে যেদিকে নিয়ে যাবে, সেইদিকেই যাবে।

“মন ধোপাঘরের কাপড়। তারপর লালে ছোপাও লাল — নীলে ছোপাও নীল। যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যাবে।

(গোস্বামীর প্রতি) — “আপনাদের কিছু কথা আছে?”

গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে) — আজ্ঞে না, — দর্শন হল। আর কথা তো সব শুনছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠাকুরদের দর্শন করুন।

গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে) — একটু মহাপ্রভুর গুণানুকীর্তন —

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গোস্বামীকে গান শুনাইতেছেন:

গান — আমার অঙ্গ কেন গৌর হলো!

গান — গোরা চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে ৷৷
ভাব হবে বইকি রে!) (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
(যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহিঃ গৌর) (ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়)
(বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে) (সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে)
(গোরা আপনার পা আপনি ধরে)

[শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামীকে সর্বধর্ম-সমন্বয় উপদেশ ]

গান সমাপ্ত হইল — ঠাকুর কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গোস্বামীর প্রতি) — এ তো আপনাদের (বৈষ্ণবদের) হল। আর যদি কেউ শাক্ত, কি ঘোষপাড়ার মত আসে, তখন কি বলব!

“তাই এখানে সব ভাবই আছে — এখানে সবরকম লোক আসবে বলে; বৈষ্ণব, শাক্ত, কর্তাভজা, বেদান্তবাদী; আবার ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানী।

“তাঁরই ইচ্ছায় নানা ধর্ম নানা মত হয়েছে।

“তবে তিনি যার যা পেটে সয় তাকে সেইটি দিয়েছেন। মা সকলকে মাছের পোলোয়া দেয় না। সকলের পেটে সয় না। তাই কাউকে মাছের ঝোল করে দেন।

“যার যা প্রকৃতি, যার যা ভাব, সে সেই ভাবটি নিয়ে থাকে।

“বারোয়ারিতে নানা মূর্তি করে, — আর নানা মতের লোক যায়। রাধা-কৃষ্ণ, হর-পার্বতী, সীতা-রাম; ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি রয়েছে, আর প্রত্যেক মূর্তির কাছে লোকের ভিড় হয়েছে। যারা বৈষ্ণব তারা বেশি রাধা-কৃষ্ণের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। যারা শাক্ত তারা হর-পার্বতীর কাছে। যারা রামভক্ত তারা সীতা-রাম মূর্তির কাছে।

“তবে যাদের কোন ঠাকুরের দিকে মন নাই তাদের আলাদা কথা। বেশ্যা উপপতিকে ঝাঁটা মারছে, — বারোয়ারিতে এমন মূর্তিও করে। ও-সব লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখে, আর চিৎকার করে বন্ধুদের বলে, ‘আরে ও-সব কি দেখছিস, এদিকে আয়! এদিকে আয়!”

সকলে হাসিতেছেন। গোস্বামী প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
==========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

ছোকরা ভক্তদের সঙ্গে আনন্দ — মা-কালীর আরতিদর্শন ও চামর ব্যঞ্জন — মায়ে-পোয়ে কথা — “কেন বিচার করাও”

বেলা পাঁচটা। ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। বাবুরাম, লাটু। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি) — কেন একঘেয়ে হব? ওরা বৈষ্ণব আর গোঁড়া, মনে করে আমাদের মতই ঠিক, আর সব ভুল। যে কথা বলেছি, খুব লেগেছে। (সহাস্যে) হাতির মাথায় অঙ্কুশ মারতে হয়। মাথায় নাকি ওদের কোষ থাকে। (সকলের হাস্য)

ঠাকুর এইবার ছোকরাদের সঙ্গে ফষ্টিনাষ্টি করতে লাগলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আমি এদের (ছোকরাদের) কেবল নিরামিষ দিই না। মাঝে মাঝে আঁশ ধোয়া জল একটু একটু দিই। তা না হলে আসবে কেন।

মুখুজ্জেরা বারান্দা হইতে চলিয়া গেলেন। বাগানে একটু বেড়াইবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আমি জপ … করতাম। সমাধি হয়ে যেত, কেমন এর ভাব?

মাস্টার (গম্ভীরবাবে) — আজ্ঞা, বেশ!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) সাধু! সাধু! — কিন্তু ওরা (মুখুজ্জেরা) কি মনে করবে?

মাস্টার — কেন কাপ্তেন তো বলেছিলেন, আপনার বালকের অবস্থা। ঈশ্বর-দর্শন করলে বালকের অবস্থা হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আর বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা। পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি করে, হয়তো খেউর মুখ দে বেরোয়। আর যুবা অবস্থায় সিংহের ন্যায় লোকশিক্ষা দেয়।

“তুমি না হয় ওদের (মুখুজ্জেদের) বুঝিয়ে দিও।”

মাস্টার — আজ্ঞা, আমার বোঝাতে হবে না। ওরা কি আর জানে না?

শ্রীরামকৃষ্ণ ছোকরাদের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করিয়া একজন ভক্তকে বলিতেছেন, “আজ অমাবস্যা, মার ঘরে যেও!”

সন্ধ্যার পর আরতির শব্দ শুনা যাইতেছে। ঠাকুর বাবুরামকে বলিতেছেন, “চল রে চল। কালীঘরে!” ঠাকুর বাবুরামের সঙ্গে যাইতেছেন — মাস্টারও সঙ্গে আছেন। হরিশ বারান্দায় বসিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “এর আবার বুঝি ভাব লাগলো।ম”

উঠান দিয়া চলিতে চলিতে শ্রীশ্রীরাধাকান্তের আরতি একটু দেখিলেন। তৎপরেই মা-কালীর মন্দিরের অভিমুখে যাইতেছেন। যাইতে যাইতে হাত তুলিয়া জগন্মাতাকে ডাকিতেছেন — “ও মা! ও মা! ব্রহ্মময়ী!” মন্দিরের সম্মুখের চাতালে উপস্থিত হইয়া মাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। মার আরতি হইতেছে। ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করিলেন ও চামর লইয়া ব্যজন করিতে লাগিলেন।

আরতি সমাপ্ত হইল। যাহারা আরতি দেখিতেছিলেন এককালে সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও মন্দিরের বাহিরে আসিয়া প্রণাম করিলেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তেরাও প্রণাম করিলেন।

আজ অমাবস্যা। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। গরগর মাতোয়ারা! বাবুরামের হাত ধরিয়া মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে নিজের ঘরে ফিরিলেন।

ঘরের পশ্চিমের গোল বারান্দায় ফরাশ একটি আলো জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। ঠাকুর সেই বারান্দায় আসিয়া একটু বসিলেন, মুখে ‘হরি ওঁ! হরি ওঁ! হরি ওঁ’! ও তন্ত্রোক্ত নানাবিধ বীজমন্ত্র।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর ঘরের মধ্যে নিজের আসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়াছেন।

[Origin of Language — The Philosophy of Prayer]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া মার সহিত কথা কহিতেছেন — বলিতেছেন, “মা, আমি বলব তবে তুমি করবে — এ কথাই নয়।

“কথা কওয়া কি? — কেবল ঈশারা বই তো নয়! কেউ বলছে, ‘আমি খাব’, — আবার কেউ বলছে, ‘যা! আমি শুনব না।’

“আচ্ছা, মা! যদি না বলতাম ‘আমি খাব’ তাহলে কি যেমন খিদে তেমনি খিদে থাকত না? তোমাকে বললেই তুমি শুনবে, আর ভিতরটা শুধু ব্যাকুল হলে তুমি শুনবে না, — তা কখন হতে পারে।

“তুমি যা আছ তাই আছ — তবে বলি কেন — প্রার্থনা করি কেন?

“ও! যেমন করাও তেমনি করি।

“যা! সব গোল হয়ে গেল! — কেন বিচার করাও!”

ঠাকুর ঈশ্বরের সহিত কথা কহিতেছেন। — ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

[সংস্কার ও তপস্যার প্রয়োজন — ভক্তদিগকে শিক্ষা — সাধুসেবা ]

এইবার ভক্তদের উপর ঠাকুরের দৃষ্টি পড়িয়াছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — তাঁকে লাভ করতে হলে সংস্কার দরকার। একটু কিছু করে থাকা চাই। তপস্যা। তা এ জন্মেই হোক আর পূর্বজন্মেই হোক।

“দ্রৌপদীর যখন বস্ত্রহরণ করছিল, তাঁর ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন শুনে ঠাকুর দেখা দিলেন। আর বললেন — ‘তুমি যদি কারুকে কখনও বস্ত্র দান করে থাক, তো মনে করে দেখ — তবে লজ্জা নিবারণ হবে।’ দ্রৌপদী বললেন, ‘হাঁ, মনে পড়েছে। একজন ঋষি স্নান কচ্ছিলেন, — তাঁর কপ্‌নি ভেসে গিছলো। আমি নিজের কাপড়ের আধখানা ছিঁড়ে তাকে দিছলাম। ঠাকুর বললেন — তবে আর তোমার ভয় নাই’।”

মাস্টার ঠাকুরের আসনের পূর্বদিকে পাপোশে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — “তুমি ওটা বুঝেছ।”

মাস্টার — আজ্ঞা, সংস্কারের কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — একবার বল দেখি, কি বললাম।

মাস্টার — দ্রৌপদী নাইতে গিছলেন ইত্যাদি। (হাজরার প্রবেশ)
=========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

হাজরা মহাশয়

হাজরা মহাশয় এখানে দুই বৎসর আছেন। তিনি ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুরের নিকটবর্তী সিওড় গ্রামে প্রথম তাঁহাকে দর্শন করেন, ১৮৮০ খ্রী:। এই গ্রামে ঠাকুরের ভাগিনেয়, পিসতুতো ভগিনী হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র, শ্রীযুক্ত হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের বাস। ঠাকুর তখন হৃদয়ের বাটীতে অবস্থিতি করিতেছিলেন।

সিওড়ের নিকটবর্তী মরাগোড় গ্রামে হাজরা মহাশয়ের নিবাস। তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি, জমি প্রভৃতি একরকম আছে। পরিবার, সন্তান-সন্ততি আছে। একরকম চলিয়া যায়। কিছু দেনাও আছে, আন্দাজ হাজার টাকা।

যৌবনকাল হইতে তাঁহার বৈরাগ্যের ভাব — কোথায় সাধু, কোথায় ভক্ত, খুঁজিয়া বেড়ান। যখন দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে প্রথম আসেন ও সেখানে থাকিতে চান ঠাকুর তাঁহার ভক্তিভাব দেখিয়া ও দেশের পরিচিত বলিয়া, ওখানে যত্ন করিয়া নিজের কাছে রাখেন।

হাজরার জ্ঞানীর ভাব। ঠাকুরের ভক্তিভাব ও ছোকরাদের জন্য ব্যাকুলতা পছন্দ করেন না। মাঝে মাঝে তাঁহাকে মহাপুরুষ বলিয়া মনে করেন। আবার কখনও সামান্য বলিয়া জ্ঞান করেন।

তিনি ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় আসন করিয়াছেন। সেইখানেই মালা লইয়া অনেক জপ করেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরা বেশি জপ করেন না বলিয়া লোকের কাছে নিন্দা করেন।

তিনি আচারের বড় পক্ষপাতী। আচার আচার করিয়া তাঁহার একপ্রকার শুচিবাই হইয়াছে। তাঁহার বয়স প্রায় ৩৮ হইবে।

হাজরা মহাশয় ঘরে প্রবেশ করিলেন। ঠাকুর আবার ঈষৎ ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন ও কথা কহিতেছেন।

[ঈশ্বর প্রার্থনা কি শুনেন? ঈশ্বরের জন্য ক্রন্দন কর, শুনবেন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — তুমি যা করছ তা ঠিক, — কিন্তু ঠিক ঠিক বসছে না।

“কারু নিন্দা করো না — পোকাটিরও না। তুমি নিজেই তো বল, লোমস মুনির কথা। যেমন ভক্তি প্রার্থনা করবে তেমনি ওটাও বলবে — ‘যেন কারু নিন্দা না করি’।”

হাজরা — (ভক্তি) প্রার্থনা করলে তিনি শুনবেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — এক — শো — বার! যদি ঠিক হয় — যদি আন্তরিক হয়। বিষয়ী লোক যেমন ছেলে কি স্ত্রীর জন্য কাঁদে সেরূপ ঈশ্বরের জন্য কই কাঁদে?

[পূর্বকথা — স্ত্রীর অসুখে কামারপুকুরবাসীর থর থর কম্প ]

“ও-দেশে একজনের পরিবারে অসুখ হয়েছিল। সারবে না মনে করে লোকটা থর থর করে কাঁপতে লাগলো — অজ্ঞান হয় আর কি!

“এরূপ ঈশ্বরের জন্য কে হচ্ছে!”

হাজরা ঠাকুরের পায়ের ধুলা লইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সঙ্কুচিত হইয়া) — “উগুনো কি?”

হাজরা — যাঁর কাছে আমি রয়েছি তাঁর পায়ের ধুলা লব না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরকে তুষ্ট কর, সকলেই তুষ্ট হবে। তস্মিন্‌ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্‌। ঠাকুর যখন দ্রৌপদীর হাঁড়ির শাক খেয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত হয়েছি, তখন জগৎসুদ্ধ জীব তৃপ্ত — হেউ-ঢেউ হয়েছিল! কই মুনিরা খেলে কি জগৎ তুষ্ট হয়েছিল — হেউ-ঢেউ হয়েছিল?

ঠাকুর লোকশিক্ষার্থ কিছু কর্ম করতে হয়, এই কথা বলিতেছেন।

[পূর্বকথা — বটতলার সাধুর গুরুপাদুকা ও শালগ্রামপূজা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — জ্ঞানলাভের পরও লোকশিক্ষার জন্যে পূজাদি কর্ম রাখে।

“আমি কালীঘরে যাই, আবার ঘরের এই সব পট নমস্কার করি; তাই সকলে করে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে যদি না করে তাহলে মন হুস্‌ফুস্‌ করবে।

“বটতলায় সন্ন্যাসীকে দেখলাম। যে আসনে গুরুপাদুকা রেখেছে তারই উপরে শালগ্রামও রেখেছে! ও পূজা করছে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি এতদূর জ্ঞান হয়ে থাকে তবে পূজা করা কেন? সন্ন্যাসী বললে, — সবই করা যাচ্ছে — এ ও একটা করলাম। কখনও ফুলটা এ-পায়ে দিলাম; আবার কখনও একটা ফুল ও-পায়ে দিলাম।’

“দেহ থাকতে কর্মত্যাগ করবার জো নাই — পাঁক থাকতে ভুড়ভুড়ি হবেই।”১

[The three stages — শাস্ত্র, গুরুমুখ, সাধনা; Goal প্রত্যক্ষ ]

(হাজরাকে) — “এক জ্ঞান থাকলেই আনেক জ্ঞানও আছে। শুধু শাস্ত্র পড়ে কি হবে?

“শাস্ত্রে বালিতে চিনিতে মিশেল আছে — চিনিটুকু লওয়া বড় কঠিন। তাই শাস্ত্রের মর্ম সাধুমুখে গুরুমুখে শুনে নিতে হয়। তখন আর গ্রন্থের কি দরকার?

“চিঠিতে খবর এসেছে, — ‘পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবা — আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ এখন চিঠিখানি হারিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চারদিকে খোঁজে। অনেক খোঁজবার পর চিঠিখানি পেলে, পড়ে দেখে, — লিখেছে — ‘পাঁচ সের সন্দেশ আর একখানা রেলপেড়ে কাপড় পাঠাইবা।’ তখন চিঠিখানি আবার ফেলে দেয়। আর কি দরকার? এখন সন্দেশ আর কাপড়ের যোগাড় করলেই হল।

(মুখুজ্জে, বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — “সব সন্ধান জেনে তারপর ডুব দাও। পুকুরের অমুক জায়গায় ঘটিটা পড়ে গেছে, জায়গাটি ঠিক করে দেখে নিয়ে সেইখানে ডুব দিতে হয়।

“শাস্ত্রের মর্ম গুরুমুখে শুনে নিয়ে, তারপর সাধন করতে হয়। এই সাধন ঠিক হলে তবে প্রত্যক্ষ দর্শন হয়।

“ডুব দিলে তবে তো ঠিক ঠিক সাধন হয়! বসে বসে শাস্ত্রের কথা নিয়ে কেবল বিচার করলে কি হবে? শ্যালারা পথে যাবারই কথা — ওই নিয়ে মরছে — মর শ্যালারা, ডুব দেয় না!

“যদি বল ডুব দিলেও হাঙ্গর-কুমিরের ভয় আছে — কাম-ক্রোধাদির ভয় আছে। — হলুদ মেখে ডুব দাও — তারা কাছে আসতে পারবে না। বিবেক-বৈরাগ্য হলুদ।”

১ ন হি দেহভৃতা শক্যং ত্যক্তুং কর্মাণ্যশেষতঃ। গীতা, ১৮।১১
যস্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে ৷৷
=========

ষষ্ট পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

পূর্বকথা — শ্রীরামকৃষ্ণের পুরাণ, তন্ত্র ও বেদ মতের সাধনা

[পঞ্চবটী, বেলতলা ও চাঁদনির সাধন — তোতার কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ — ১৮৬৬ ] 
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) -- তিনি আমায় নানারূপ সাধন করিয়েছেন। প্রথম, পুরাণ মতের -- তারপর তন্ত্র মতের, আবার বেদ মতের। প্রথমে পঞ্চবটীতে সাধনা করতাম। তুলসী কানন হল -- তার মধ্যে বসে ধ্যান করতাম। কখনও ব্যাকুল হয়ে ‘মা! মা!’ বলে ডাকতাম -- বা ‘রাম! রাম!’ করতাম। “যখন ‘রাম রাম’ করতাম তখন হনুমানের ভাবে হয়তো একটা ল্যাজ পরে বসে আছি! উন্মাদের অবস্থা। সে সময়ে পূজা করতে করতে গরদের কাপড় পরে আনন্দ হত -- পূজারই আনন্দ! “তন্ত্র মতের সাধনা বেলতলায়। তখন তুলসী গাছ -- সজনের খাড়া -- এক মনে হত! “সে অবস্থায় শিবানীর উচ্ছিষ্ট -- সমস্ত রাত্রি পড়ে আছে -- তা সাপে খেলে কি কিসে খেলে তার ঠিক নাই -- ওই উচ্ছিষ্টই আহার। “কুকুরের উপর চড়ে তার মুখে লুচি দিয়ে খাওয়াতাম, আর নিজেও খেতাম। সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ। -- মাটিতে জল জমবে তাই আচমন, আমি সে মাটিতে পুকুর থেকে জল দিয়ে আচমন কল্লাম। “অবিদ্যাকে নাশ না করলে হবে না। আমি তাই বাঘ হতাম -- হয়ে অবিদ্যাকে খেয়ে ফেলতাম! “বেদমতে সাধনের সময় সন্ন্যাস নিলাম। তখন চাঁদনিতে পড়ে থাকতাম -- হৃদুকে বলতাম, ‘আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, চাঁদনীতে ভাত খাব’!” 
[সাধনকালে নানা দর্শন ও জগন্মাতার বেদান্ত, গীতা সম্বন্ধে উপদেশ ] 
(ভক্তদের প্রতি) -- “হত্যা দিয়ে পরেছিলাম! মাকে বললাম, আমি মুখ্যু -- তুমি আমায় জানিয়ে দাও -- বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে -- নানা শাস্ত্রে -- কি আছে। “মা বললেন, বেদান্তের সার -- ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। যে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের কথা বেদে আছে, তাঁকে তন্ত্রে বলে, সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ -- আবার তাঁকেই পুরাণে বলে, সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ। “গীতা দশবার বললে যা হয়, তাই গীতার সার। অর্থাৎ ত্যাগী ত্যাগী! “তাঁকে যখন লাভ হয়, বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র -- কত নিচে পড়ে থাকে। (হাজরাকে) তখন ওঁ উচ্চারণ করবার জো নাই। -- এটি কেন হয়? সমাধি থেকে অনেক নেমে না এলে ওঁ উচ্চারণ করতে পারি না। “প্রত্যক্ষ দর্শনের পার যা যা অবস্থা হয় শাস্ত্রে আছে, সে সব হয়েছিল। বালকবৎ, উন্মাদবৎ, পিশাচবৎ, জড়বৎ। “আর শাস্ত্রে যেরূপ আছে, সেরূপ দর্শনও হত। “কখন দেখতাম জগৎময় আগুনের স্ফুলিঙ্গ! “কখন চারিদিকে পারার হ্রদ, -- ঝক্‌ঝক্‌ করছে। আবার কখনও রূপা গলার মতো দেখতাম। “কখন দেখতাম রঙমশালের আলো যেন জ্বলছে! “তাহলেই হল, শাস্ত্রের সঙ্গে ঐক্য হচ্ছে।” 
[শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থা -- নিত্যলীলাযোগ ] 
“আবার দেখালে, তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন! ছাদে উঠে আবার সিঁড়িতে নামা। অনুলোম বিলোম। “উঃ! কি অবস্থাতেই রেখেছে! -- একটা অবস্থা যায় তো আর একটা আসে। যেন ঢেঁকির পাট। একদিক নিচু হয় তো আর-একদিক উঁচু হয়। “যখন অন্তর্মুখ -- সমাধিস্থ -- তখনও দেখছি তিনি! আবার যখন বাহিরের জগতে মন এল, তখনও দেখছি তিনি। “যখন আরশির এ-পিঠ দেখছি তখনও তিনি! আবার যখন উলটো পিঠ দেখছি তখনও তিনি।” মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।
========

সপ্তম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর

পূর্বকথা — শম্ভু মল্লিকের অনাশক্তি — মহাপুরুষের আশ্রয়

শ্রীরামকৃষ্ণ (মুখুজ্জে প্রভৃতিকে) — কাপ্তেনের ঠিক সাধকের অবস্থা।

“ঐশ্বর্য থাকলেই যে তাতে আসক্ত হতেই হবে, এমন কিছু নয়। শম্ভু (মল্লিক) বলত, ‘হৃদু, পোঁটলা বেঁধে বসে আছি!’ আমি বলতাম কি অলক্ষণে কথা কও! —

“তখন শম্ভু বলে, ‘না, — বলো, এ-এব ফেলে যেন তাঁর কাছে যাই!’

“তাঁর ভক্তের ভয় নাই। ভক্ত তাঁর আত্মীয়। তিনি তাদের টেনে নেবেন। দুর্যোধনেরা গন্ধর্বের কাছে বন্দী হলে যুধিষ্ঠিরই উদ্ধার করলেন। বললেন, আত্মীয়দের ওরূপ অবস্থা হলে আমাদেরই কলঙ্ক।”

[ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মণ ও পরিচারকগণ মধ্যে ভক্তিদান ]

প্রায় নয়টা রাত্রি হইল। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় কলিকাতা ফিরিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। ঠাকুর একটু উঠিয়া ঘরে ও বারান্দায় পাদচারণ করিতে করিতে বিষ্ণুঘরে উচ্চ সংকীর্তন হইতেছে শুনিতে পাইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করাতে একজন ভক্ত বলিলেন, তাহাদের সঙ্গে লাটু ও হরিশ জুটিয়াছে। ঠাকুর বলিলেন, ও তাই!

ঠাকুর বিষ্ণুঘরে আসিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরাও আসিলেন। তিনি শ্রীশ্রীরাধাকান্তকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর দেখিলেন যে, ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মণেরা — যারা ভোগ রাঁধে, নৈবেদ্য করে দেয়, অতিথিদের পরিবেশন করে এবং পরিচারকেরা, অনেকে একত্র মিলিত হইয়া নাম সংকীর্তন করিতেছে। ঠাকুর একটু দাঁড়াইয়া তাহাদের উৎসাহ বর্ধন করিলেন।

উঠানের মধ্য দিয়া ফিরিয়া আসিবার সময় ভক্তদের বলিতেছেন —

“দেখো, এরা সব কেউ বেশ্যার বাড়ি যায়, কেউ বাসন মাজে!”

ঘরে আসিয়া ঠাকুর নিজ আসনে আবার বসিয়াছেন। যাঁহারা সংকীর্তন করিতেছিলেন, তাঁহারা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর তাঁহাদিগকে বলিতেছেন — “টাকার জন্য যেমন ঘাম বার কর, তেমনি হরিনাম করে নেচে গেয়ে ঘাম বার করতে হয়।

“আমি মনে করলাম, তোমাদের সঙ্গে নাচব। গিয়ে দেখি যে ফোড়ন-টোড়ন সব পড়েছে — মেথি পর্যন্ত। (সকলের হাস্য) আমি কি দিয়ে সম্বরা করব।

“তোমরা মাঝে মাঝে হরিনাম করতে অমন এসো।”

মুখুজ্জে প্রভৃতি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

ঠাকুরের ঘরের ঠিক উত্তরের ছোট বারান্দাটির পাশে মুখুজ্জেদের গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। গাড়িতে বাতি জ্বালা হইয়াছে।

[ভক্ত বিদায় ও ঠাকুরের স্নেহ ]

ঠাকুর এই বারান্দার চাতালের ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে উত্তরাস্য হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। একজন ভক্ত পথ দেখাইয়া একটি আলো আনিয়াছেন — ভক্তদের তুলিয়া দিবেন।

আজ অমাবস্যা — অন্ধকার রাত্রি। — ঠাকুরের পশ্চিমদিকে গঙ্গা, সম্মুখে নহবত, পুষ্পোদ্যান ও কুঠি, ঠাকুরের ডানদিকে সদর ফটকে যাইবার রাস্তা।

ভক্তেরা তাঁহার চরণে অবলুণ্ঠিত হইয়া একে একে গাড়িতে উঠিতেছেন। ঠাকুর একজন ভক্তকে বলিতেছেন — “ঈশানকে একবার বলো না — ওর কর্মের জন্য।”

গাড়িতে বেশি লোক দেখিয়া পাছে ঘোড়ার কষ্ট হয় — ঠাকুর বলিতেছেন — “গাড়িতে অত লোক কি ধরবে?”

ঠাকুর দাঁড়াইয়া আছেন। সেই ভক্তবৎসলমূর্তি দেখিতে দেখিতে ভক্তেরা কলিকাতা যাত্রা করিলেন।
==========

Post a Comment

0 Comments