দক্ষিণেশ্বরে বাবুরাম, মাষ্টার, নীল কণ্ঠ, মনােমোহন প্রভৃতি সঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

দ্বাবিংশ খণ্ড 
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে — বাবুরাম, মাস্টার, নীলকণ্ঠ, মনোমোহন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

দক্ষিণেশ্বরে বাবুরাম, মাষ্টার, নীল কণ্ঠ, মনােমোহন প্রভৃতি সঙ্গে

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর

হাজরা মহাশয় — অহেতুকী ভক্তি

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, ভক্তসঙ্গে মধ্যাহ্নসেবার পর নিজের ঘরে বসিয়া আছেন (৫ই অক্টোবর, ১৮৮৪)। কাছে মেঝেতে মাস্টার, হাজরা, বড় কালী, বাবুরাম, রামলাল, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি — কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন। শ্রীযুক্ত কেশবের মাতাঠাকুরানীর নিমন্ত্রণে গতকল্য তাঁহাদের কলুটোলার বাড়িতে গিয়া ঠাকুর কীর্তনানন্দ করিয়াছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — আমি কাল কেশব সেনের এ বাটীতে (নবীন সেনের বাটীতে) বেশ খেলুম — বেশ ভক্তি করে দিলে।

[হাজরা মহাশয় ও তত্ত্বজ্ঞান — হাজরা ও তর্কবুদ্ধি ]

হাজরা মহাশয় অনেকদিন ঠাকুরের কাছে রহিয়াছেন। “আমি জ্ঞানী”; এই বলিয়া তাঁহার একটু অভিমান আছে। লোকজনের কাছে ঠাকুরের একটু নিন্দাও করাও হয়। এদিকে বারান্দাতে নিজের আসনে বসিয়া একমন হইয়া মালা জপও করেন। চৈতন্যদেবকে “হালের অবতার” বলিয়া সামান্য জ্ঞান করেন। বলেন, “ঈশ্বর যে শুদ্ধ ভক্তি দেন, তা নয়; তাঁহার ঐশ্বর্যের অভাব নাই, — তিনি ঐশ্বর্যও দেন। তাঁকে লাভ করলে অষ্টসিদ্ধি প্রভৃতি শক্তিও হয়।” বাড়ির দরুন কিছু দেনা আছে — প্রায় হাজার টাকা। সেগুলির জন্য তিনি ভাবিত আছেন।

বড় কালী অফিসে কর্ম করেন। সামান্য বেতন। ঘরে পরিবার ছেলেপুলে আছে। পরমহংসদেবের উপর খুব ভক্তি; মাঝে মাঝে আফিস কামাই করিয়াও তাঁহাকে দর্শন করিতে আসেন।

বড় কালী (হাজরার প্রতি) — তুমি যে কষ্টিপাথর হয়ে, কে ভালো সোনা, কে মন্দ সোনা, পরখ করে করে বেড়াও — পরের নিন্দা অত করো কেন?

হাজরা — যা বলতে হয়, ওঁর কাছেই বলছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বটে।

হাজরা তত্ত্বজ্ঞান মানে ব্যাখ্যা করিতেছেন।

হাজরা — তত্ত্বজ্ঞান মানে কি — না চব্বিশ তত্ত্ব আছে, এইটি জানা।

একজন ভক্ত — চব্বিশ তত্ত্ব কি?

হাজরা — পঞ্চভূত, ছয় রিপু, পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটা কর্মেন্দ্রিয়, এই সব।

মাস্টার (ঠাকুরকে, সহাস্যে ) — ইনি বলছেন, ছয় রিপু চব্বিশ তত্ত্বের ভিতরে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ওই দেখ না। তত্ত্বজ্ঞানের মানে কি করছে আবার দেখ। তত্ত্বজ্ঞান মানে আত্মজ্ঞান! তৎ মানে পরমাত্মা, ত্বং মানে জীবাত্মা। জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক জ্ঞান হলে তত্ত্বজ্ঞান হয়।

হাজরা কিয়ৎক্ষণ পরে ঘর হইতে বারান্দায় গিয়া বসিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে) — ও কেবল তর্ক করে। এই একবার বেশ বুঝে গেল — আবার খানিক পরে যেমন তেমনি।

“বড় মাছ জোর করছে দেখে আমি সুতো ছেড়ে দিই। তা নাহলে সুতো ছিঁড়ে ফেলবে, আর যে ধরেছে, সে শুদ্ধ জলে পড়বে। আমি তাই আর কিছু বলি না।

[হাজরা ও মুক্তি ও ষড়ৈশ্বর্য — মলিন ও অহেতুকী ভক্তি ]

(মাস্টারকে) — “হাজরা বলে, ‘ব্রাহ্মণ শরীর না হলে মুক্তি হয় না।’ আমি বললাম, সে কি! ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হবে। শবরী ব্যাধের মেয়ে, রুহিদাস যার খাবার সময় ঘন্টা বাজত — এরা সব শূদ্র। এদের ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হয়েছে! হাজরা বলে তবু!

“ধ্রুবকে ল্যায়। প্রহ্লাদকে যত ল্যায়, ধ্রুবকে তত না। নটো বললে ‘ধ্রুবের ছেলেবেলা থেকে অত অনুরাগ’ — তখন আবার চুপ করে।

“আমি বলি কামনাশূন্য ভক্তি, অহেতুকী ভক্তি — এর বাড়া আর কিছুই নাই। ও-কথা সে কাটিয়ে দেয়। যারা কিছু চাইবে, তারা এলে, বড়মানুষ ব্যাজার হয় — বিরক্ত হয়ে বলে, ওই আসছেন। এলে পরে একরকম স্বর করে বলে ‘বসুন’! — যেন কত বিরক্ত। যারা কিছু চায়, তাদের এক গাড়িতে নিয়ে যায় না।

“হাজরা বলে, তিনি এ-সব ধনীদের মতো নয়। তাঁর কি ঐশ্বর্যের অভাব যে দিতে কষ্ট হবে?

“হাজরা তখন আরও বলে — ‘আকাশের জল যখন পড়ে তখন গঙ্গা আর সব বড় বড় নদী, বড় বড় পুকুর — এসব বেড়ে যায়; আবার ডোবা টোবাগুলোও পরিপূর্ণ হয়। তাঁর কৃপা হলে জ্ঞান-ভক্তিও দেন, — আবার টাকা-কড়িও দেন।’

“কিন্তু একে মলিন ভক্তি বলে। শুদ্ধাভক্তিতে কোন কামনা থাকবে না। তুমি এখানে কিছু চাও না কিন্তু (আমাকে) দেখতে আর (আমার) কথা শুনতে ভালবাস; — তোমার দিকেও আমার মন পড়ে থাকে — কেমন আছে — কেন আসে না — এই সব ভাবি।

“কিছু চাও না অথচ ভালবাস — এর নাম অহেতুকী ভক্তি। প্রহ্লাদের এটি ছিল; রাজ্য চায় না, ঐশ্বর্য চায় না, কেবল হরিকে চায়।

মাস্টার — হাজরা মহাশয় কেবল ফড়র ফড়র করে বকে। চুপ না করলে কিছু হচ্ছে না।

[হাজরার অহংকার ও লোকনিন্দা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — এক-একবার বেশ কাছে এসে নরম হয়! — কি গ্রহ, আবার তর্ক করে। অহংকার যাওয়া বড় শক্ত। অশ্বত্থগাছ, এই কেটে দিলে আবার তার পর দিন ফেঁ কড়ি বেরিয়েছে। যতক্ষণ তার শিকড় আছে ততক্ষণ আবার হবে।

“আমি হাজরাকে বলি, কারুকে নিন্দা করো না।

“নারায়ণই এই সব রূপ ধরে রয়েছেন। দুষ্ট খারাপ লোককেও পূজা করা যায়।

“দেখ না কুমারীপূজা। একটা হাগে মোতে, নাক দিয়ে কফ পড়ছে এমন মেয়েকে পূজা করা কেন? ভগবতীর একটি রূপ বলে।

“ভক্তের ভিতর তিনি বিশেষরূপে আছেন। ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা।

“নাউ-এর খুব ডোল হলে তানপুরা ভাল হয়, — বেশ বাজে।

(সহাস্য, রামলালের প্রতি) — “হ্যারে রামলাল, হাজরা ওটা কি করে বলেছিস — অন্তস্‌ বহিস্‌ যদি হরিস্‌ (স-কার দিয়ে)? যেমন একজন বলেছিল মাতারং ভাতারং খাতারং অর্থাৎ মা ভাত খাচ্ছে ।” (সকলের হাস্য)

রামলাল (সহাস্যে) — অনতর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — এইটে তুমি অভ্যাস করো, আমায় মাঝে মাঝে বলবে।

ঠাকুরের ঘরের রেকাবি হারাইয়াছে। রামলাল ও বৃন্দে ঝি রেকাবির কথা বলিতেছেন — ‘সে রেকাবি কি আপনি জানেন?’

শ্রীরামকৃষ্ণ — কই, এখন আর দেখতে পাই না! আগে ছিল বটে — দেখেছিলাম।
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুদ্বয় সঙ্গে — ঠাকুরের পরমহংস অবস্থা

আজ পঞ্চবটীতে দুইটি সাধু অতিথি আসিয়াছেন। তাঁহারা গীতা, বেদান্ত এ সব অধ্যয়ন করেন। মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুরকে আসিয়া দর্শন করিতেছেন। তিনি ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। সাধুরা প্রণাম করিয়া মেঝেতে মাদুরের উপর আসিয়া বসিলেন। মাস্টার প্রভৃতিও বসিয়া আছেন। ঠাকুর হিন্দিতে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আপনাদের সেবা হয়েছে?

সাধুরা — জী, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি খেলেন?

সাধুরা — ডাল-রুটি; আপনি খাবেন?

[সাধু ও নিষ্কামকর্ম — ভক্তি কামনা — বেদান্ত — সংসারী ও ‘সোঽহম্‌’ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, আমি দুটি ভাত খাই। আচ্ছা জী, আপনারা যা জপ ধ্যান করেন তা নিষ্কাম করেন; না?

সাধু — জী, মহারাজ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই আচ্ছা হ্যায়, আর ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করতে হয়; — না? গীতাতে ওইরূপ আছে।

সাধু (অন্য সাধুর প্রতি) —

য়ৎ করোষি য়দশ্নাসি য়জ্জুহোষি দদাসি য়ৎ।
য়ৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্‌ ৷৷১

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে একগুণ যা দেবে সহস্রগুণ তাই পাবে। তাই সব কাজ করে জলের গণ্ডুষ অর্পণ — কৃষ্ণে ফল সমর্পণ।

“যুধিষ্ঠির যখন সব পাপ কৃষ্ণকে অর্পণ করতে যাচ্ছিল, তখন একজন (ভীম) সাবধান করলে, ‘অমন কর্ম করো না — কৃষ্ণকে যা অর্পণ করবে, সহস্রগুণ তাই হবে!’ আচ্ছা জী, নিষ্কাম হতে হয় — সব কামনা ত্যাগ করতে হয়?”

সাধু — জী, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার কিন্তু ভক্তিকামনা আছে। ও মন্দ নয়, বরং ভালই হয়। মিষ্ট খারাপ জিনিস — অমল হয়, কিন্তু মিছরিতে বরং উপকার হয়। কেমন?

সাধু — জী, মহারাজ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা জী, বেদান্ত কেমন?

সাধু — বেদান্তমে খট্‌ শাস্ত্র (ষড়দর্শন) হ্যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু বেদান্তের সার — ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। আমি আলাদা কিছু নই; আমি সেই ব্রহ্ম। কেমন?

সাধু — জী, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু যারা সংসারে আছে, আর যাদের দেহবুদ্ধি আছে, তাদের সোঽহম্‌ এ-ভাবটি ভাল নয়। সংসারীর পক্ষে যোগবাশিষ্ঠ, বেদান্ত — ভাল নয়। বড় খারাপ।

সংসারীরা সেব্য-সেবক ভাবে থাকবে। ‘হে ঈশ্বর, তুমি সেব্য — প্রভু, আমি সেবক — আমি তোমার দাস।’ “যাদের দেহবুদ্ধি আছে তাদের সোঽহম্‌ এ-ভাব ভাল না।”

সকলেই চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আপনা-আপনি একটু হাসিতেছেন। আত্মারাম। আপনার আনন্দে আনন্দিত।

একজন সাধু অপরকে ফিসফিস করিয়া বলিতেছেন — “আরে, দেখো দেখো! এস্‌ কো পরমহংস অবস্থা বোল্‌ তা হ্যায়।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে, তাহার দিকে তাকাইয়া) — হাসি পাচ্ছে।

ঠাকুর বালকের ন্যায় আপনা-আপনি ঈষৎ হাসিতেছেন।

১ গীতা [৯/২৭]
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ‘কামিনী’ — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম

[পূর্বকথা — শ্বশুরঘর যাবার সাধ — উলোর বামনদাসের সঙ্গে দেখা ]

সাধুরা দর্শন করিয়া চলিয়া গেলেন।

ঠাকুর ও বাবুরাম, মাস্টার, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি ভক্তেরা ঘরে ও বারান্দায় বেড়াইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) — নবীন সেনের ওখানে তুমি গিছলে?

মাস্টার — আজ্ঞা, গিছলাম। নিচে বসে সব গান শুনেছিলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বেশ করেছ। তোমার ওরা গিছল। কেশব সেন ওদের খুড়তাতো ভাই?

মাস্টার — একটু তফাত আছে।

শ্রীযুক্ত নবীন সেনেরা একজন ভক্তের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কীয় লোক।

মণির সহিত বেড়াইতে বেড়াইতে ঠাকুর নিভৃতে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — লোকে শ্বশুরবাড়ি যায়। এত ভেবেছিলুম, বিয়ে করব, শ্বশুরঘর যাব — সাধ আহ্লাদ করব! কি হয়ে গেল!

মণি — আজ্ঞা, ‘ছেলে যদি বাপকে ধরে, সে পড়তে পারে; বাপ যে ছেলেকে ধরেছেন সে আর পড়ে না।’ — এই কথা আপনি বলেন। আপনারও ঠিক সেই অবস্থা। মা আপনাকে ধরে রয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — উলোর বামনদাসের সঙ্গে — বিশ্বাসদের বাড়িতে — দেখা হল। আমি বললাম, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। যখন চলে এলাম, শুনতে পেলাম, সে বলছে, ‘বাবা, বাঘ যেমন মানুষকে ধরে, তেমনই ঈশ্বরী এঁকে ধরে রয়েছেন!’ তখন সমর্থ বয়স — খুব মোটা। সর্বদাই ভাবে!

“আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে! আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি। সব রাক্ষসীর মতো দেখি।

“আগে ভারী ভয় ছিল! কারুকে কাছে আসতে দিতাম না। এখন তবু অনেক করে মনকে বুঝিয়ে, মা আনন্দময়ীর এক-একটি রূপ বলে দেখি।

“ভগবতীর অংশ। কিন্তু পুরুষের পক্ষে — সাধুর পক্ষে — ভক্তের পক্ষে — ত্যাজ্য।

“হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশিক্ষণ কাছে বসতে দিই না। একটু পরে, হয়ে বলি, ঠাকুর দেখো গে যাও; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।

“দেখতে পাই, কারু কারু মেয়েমানুষের দিকে আদপে মন নাই। নিরঞ্জন বলে, ‘কই আমার মেয়েমানুষের দিকে মন নাই’।”

[হরিবাবু, নিরঞ্জন, পাঁড়ে খোট্টা, জয়নারায়ণ ]

“হরি (উপেন ডাক্তারের ভাই)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলে, ‘না, মেয়েমানুষের দিকে মন নাই।’

“যে মন ভগবানকে দিতে হবে, সে মনের বারো আনা মেয়েমানুষ নিয়ে ফেলে। তারপর তার ছেলে হলে প্রায় সব মনটাই খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভগবানকে আর কি দেবে?

“আবার কারু কারু তাকে আগলাতে আগলাতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। পাঁড়ে জমাদার খোট্টা বুড়ো — তার চৌদ্দ বছরের বউ! বুড়োর সঙ্গে তার থাকতে হয়! গোলপাতার ঘর। গোলপাতা খুলে খুলে লোক দেখে। এখন মেয়েটা বেরিয়ে এসেছে।

“একজনের বউ — কোথায় রাখে এখন ঠিক পাচ্ছে না। বাড়িতে বড় গোল কয়েছিল। মহা ভাবিত। সে কথা আর কাজ নাই।

“আর মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকলেই তাদের বশ হয়ে যেতে হয়। সংসারীরা মেয়েদের কথায় উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। সকলেই আপনার পরিবারদের সুখ্যাত করে।

“আমি একজায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়ীকে জিজ্ঞাসা করাতে বারণ করলে, আর যাওয়া হল না। খানিক পরে ভাবলুম — উঃ, আমি সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাতেই এই! — সংসারীরা না জানি পরিবারদের আছে কিরকম বশ!”

মণি — কামিনী-কাঞ্চনের মাঝখানে থাকলেই একটু না একটু গায়ে আঁচ লাগবেই। আপনি বলেছিলেন, জয়নারায়ণ অতো পণ্ডিত — বুড়ো হয়েছিল — আপনি যখন গেলেন, বালিস-টালিস শুকুতে দিচ্ছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু পণ্ডিত বলে অহংকার ছিল না। আর যা বলেছিল, শেষে আইন মাফিক্‌ কাশীতে গিয়ে বাস হল।

“ছেলেগুনো দেখলাম, বুট পায়ে দেওয়া ইংরাজী পড়া।”

[ঠাকুরের প্রেমোন্মাদ প্রভৃতি নানা অবস্থা ]

ঠাকুর মণিকে প্রশ্নচ্ছলে নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আগে খুব উন্মাদ ছিল, এখন কমলো কেন? — কিন্তু মাঝে মাঝে হয়।

মণি — আপনার একরকম অবস্থা তো নয়। যেমন বলেছিলেন, কখনও বালকবৎ — কখনও উন্মাদবৎ — কখনও জড়বৎ — কখনও পিশাচবৎ — এই সব অবস্থা মাঝে মাঝে হয়। আবার মাঝে মাঝে সহজ অবস্থাও হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, বালকবৎ। আবার ওই সঙ্গে বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা — এ-সব অবস্থা হয়। যখন জ্ঞান উপদেশ দেবে, তখন যুবার অবস্থা।

“আবার পৌগণ্ড অবস্থা! বারো-তেরো বছরের ছোকরার মতো ফচকিমি করতে ইচ্ছা হয়। তাই ছোকরাদের নিয়ে ফষ্টিনাষ্টি হয়।”

[নারাণের গুণ — কামিনী-কাঞ্চনত্যাগই সন্ন্যাসীর কঠিন সাধনা ]

“আচ্ছা, নারাণ কেমন?”

মণি — আজ্ঞা, লক্ষণ সব ভাল আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — নাউ-এর ডোলটা ভাল — তানপুরা বেশ বাজবে।

“সে আমায় বলে, আপনি সবই (অর্থাৎ অবতার) । যার যা ধারণা, সে তাই বলে। কেউ বলে, এমনি শুধু সাধুভক্ত।

“যেটি বারণ করে দিয়েছি, সেটি বেশ ধারণা করে। পরদা গুটোতে বললাম। তা গুটোলে না।

“গেরো দেওয়া, সেলাই করা, পরদা গুটোনো, দোর বাস্ক চাবি দিয়ে বন্ধ করা — এসব বারণ করেছিলাম — তাই ঠিক ধারণা। যে ত্যাগ করবে, তার এই সব সাধন করতে হয়। সন্ন্যাসীর পক্ষে এই সব সাধন।

“সাধনের অবস্থায় ‘কামিনী’ দাবানল স্বরূপ — কালসাপের স্বরূপ। সিদ্ধ অবস্তায় ভগবানদর্শনের পর — তবে মা আনন্দময়ী! তবে মার এক-একটি রূপ বলে দেখবে।”

কয়েকদিন হইল, ঠাকুর নারাণকে কামিনী সম্বন্ধে অনেক সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন — ‘মেয়েমানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাদের হাওয়া গায় লাগে; — আর মা ছাড়া সকলের সঙ্গে আটহাত, নয় দুহাত, নয় অন্ততঃ একহাত সর্বদা তফাত থাকবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — তার মা নারাণকে বলেছে, তাঁকে দেখে আমরাই মুগ্ধ হই, তুই তো ছেলেমানুষ! আর সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। নিরঞ্জন কেমন সরল!

মণি — আজ্ঞা, হাঁ।

[নিরঞ্জন, নরেন্দ্র কি সরল? ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — সেদিন কলকাতা যাবার সময় গাড়িতে দেখলে না? সব সময়েই এক ভাব — সরল। লোক ঘরের ভিতর একরকম আবার বাড়ির বাহিরে গেলে আর-একরকম হয়! নরেন্দ্র এখন (বাপের মৃত্যুর পর) সংসারের ভাবনায় পড়েছে। ওর একটু হিসাব বুদ্ধি আছে। সব ছোকরা এদের মতো কি হয়?

[শ্রীরামকৃষ্ণ নবীন নিয়োগীর বাড়ি — নীলকণ্ঠের যাত্রা ]

“নীলকণ্ঠের যাত্রা আজ শুনতে গিছলাম — দক্ষিণেশ্বরে। নবীন নিয়োগীর বাড়ি। সেখানকার ছোঁড়াগুলো বড় খারাপ। কেবল এর নিন্দা, ওর নিন্দা! ওরকম স্থলে ভাব সম্বরণ হয়ে যায়।

“সেবার যাত্রার সময় মধু ডাক্তারের চক্ষে ধারা দেখে, তার দিকে চেয়েছিলাম। আর কারু দিকে তাকাতে পারলাম না।”
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর

শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব ও ব্রাহ্মসমাজ — সমন্বয় উপদেশ
The Universal Catholic Church of Sree Ramkrishna

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আচ্ছা, লোক যে এত আকর্ষণ হয়ে আসে এখানে, তার মানে কি?

মণি — আমার ব্রজের লীলা মনে পড়ে। কৃষ্ণ যখন রাখাল আর বৎস হলেন, তখন রাখালদের উপর গোপীদের, আর বৎসদের উপর গাভীদের, বেশি আকর্ষণ হতে লাগল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে ঈশ্বরের আকর্ষণ। কি জানো, মা এইরূপ ভেলকি লাগিয়ে দেন আর আকর্ষণ হয়।

“আচ্ছা, কেশব সেনের কাছে যত লোক যেত, এখানে তো তত আসে না। আর কেশব সেনকে কত লোক গণে মানে, বিলাতে পর্যন্ত জানে — কুইন (রানী ভিক্টোরিয়া) কেশবের সঙ্গে কথা কয়েছে। গীতায় তো বলেছে, যাকে অনেকে গণে মানে, সেখানে ঈশ্বরের শক্তি। এখানে তো অত হয় না?”

মণি — কেশব সেনের কাছে সংসারী লোক গিয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তা বটে। ঐহিক লোক।

মণি — কেশব সেন যা করে গেলেন, তা কি থাকবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন, সংহিতা করে গেছে, — তাতে কত নিয়ম!

মণি — অবতার যখন নিজে কাজ করেন, তখন আলাদা কথা। যেমন চৈতন্যদেবের কাজ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হাঁ, ঠিক।

মণি — আপনি তো বলেন, — চৈতন্যদেব বলেছিলেন, আমি যা বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেলাম, কখন না কখন এর কাজ হবে। কার্ণিশের উপর বীজ রেখেছিল, বাড়ি পড়ে গেলে সেই বীজ আবার গাছ হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, শিবনাথরা যে সমাজ করেছে, তাতেও অনেক লোক যায়।

মণি — আজ্ঞা, তেমনি লোক যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — হাঁ, হাঁ সংসারী লোক সব যায়। যারা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল — কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে চেষ্টা করছে — এমন সব লোক কম যায় বটে।

মণি — এখান থেকে একটা স্রোত যদি বয়, তাহলে বেশ হয়। সে স্রোতের টানেতে সব ভেসে যাবে। এখান থেকে যা হবে সে তো আর একঘেয়ে হবে না।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান — বৈষ্ণব ও ব্রহ্মজ্ঞানী ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — আমি যার যা ভাব তার সেই ভাব রক্ষা করি। বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবের ভাবটিই রাখতে বলি, শাক্তকে শাক্তের ভাব। তবে বলি, ‘এ কথা বলো না — আমারই পথ সত্য আর সব মিথ্যা, ভুল।’ হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান — নানা পথ দিয়ে এক জায়গায়ই যাচ্ছে। নিজের নিজের ভাব রক্ষা করে, আন্তরিক তাঁকে ডাকলে, ভগবান লাভ হবে!

“বিজয়ের শাশুড়ি বলে, তুমি বলরামদের বলে দাও না, সাকার পুজোর কি দরকার? নিরাকার সচ্চিদানন্দকে ডাকলেই হল।

“আমি বললাল, ‘অমন কথা আমিই বা বলতে যাব কেন — আর তারাই বা শুনবে কেন?’ মা মাছ রেঁধেছে — কোনও ছেলেকে পোলোয়া রেঁধে দেয়, যার পেট ভাল নয় তাকে মাছের ঝোল করে দেয়। রুচিভেদ, অধিকারীভেদে, একই জিনিস নানারূপ করে দিতে হয়।”

মণি — আজ্ঞা, হাঁ। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সব আলাদা রাস্তা। তবে যে রাস্তা দিয়েই যাওয়া হোক না কেন, শুদ্ধমন দিয়ে আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তবে তাঁকে পাওয়া যায়। এই কথা আপনি বলেন।

[মুখুজ্জেদের হরি — শ্রীরামকৃষ্ণ ও দান-ধ্যান ]

ঘরের ভিতর ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। মেঝেতে মুখুজ্জেদের হরি, মাস্টার প্রভৃতি বসিয়া আছেন। একটি অপরিচিত ব্যক্তি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বসিলেন। ঠাকুর পরে বলিয়াছিলেন, তাঁহার চক্ষুর লক্ষণ ভাল না — বিড়ালের ন্যায় কটাচক্ষু।

ঠাকুরকে হরি তামাক সাজিয়া আনিয়া দিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হুঁকা হাতে করিয়া, হরির প্রতি) — দেখি তোর — হাতদেখি। এই যে যব রয়েছে — এ বেশ ভাল লক্ষণ।

“হাত আলগা কর দেখি। (নিজের হাতে হরির হাত লইয়া যেন ওজন করিতেছেন) — ছেলেমানষি বুদ্ধি এখনও আছে; — দোষ এখনও কিছু হয় নাই। (ভক্তদের প্রতি) — আমি হাত দেখলে খল কি সরল বলতে পারি। (হরির প্রতি) — কেন, শ্বশুরবাড়ি যাবি — বউর সঙ্গে কথাবার্তা কইবি — আর ইচ্ছে হয় একটু আমোদ-আহ্লাদ করবি।

(মাস্টারের প্রতি) — “কেমন গো?” (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য)

মাস্টার — আজ্ঞা, নতুন হাঁড়ি যদি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে আর দুধ রাখা যাবে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — এখন যে হয় নাই তা কি করে জানলে?

মুখুজ্জেরা দুই ভাই — মহেন্দ্র ও প্রিয়নাথ। তাঁহারা চাকরি করেন না। তাঁহাদের ময়দার কল আছে। প্রিয়নাথ পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারের কর্ম করিতেন। ঠাকুর হরির নিকট মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হরির প্রতি) — বড় ভাইটি বেশ, না? বেশ সরল।

হরি — আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — ছোট নাকি বড় সন (কৃপণ)? — এখানে এসে নাকি অনেক ভাল হয়েছে। আমায় বললে আমি কিছু জানতুম না। (হরিকে) এরা কিছু দান-টান করে কি?

হরি — তেমন দেখতে পাই না। এদের বড়ভাই যিনি ছিলেন — তাঁর কাল হয়েছে — তিনি বড় ভাল ছিলেন — খুব দান-ধ্যান ছিল।

[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ওদেহের লক্ষণ — ৺ মহেশ ন্যায়রত্নের ছাত্র ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে) — শরিরে লক্ষণ দেখে অনেকটা বুঝা ঝায়, তার হবে কি না। খল হলে হাত ভারী হয়।

“নাক টেপা হওয়া ভাল না। শম্ভুর নাকটি টেপা ছিল। তাই অত জ্ঞান থেকেও তত সরল ছিল না।

“উনপাঁজুরে লক্ষণ ভাল না। আর হাড় পেকে — কনুয়ের গাঁট মোটা, হাত ছিনে। আর বিড়াল চক্ষু — বিড়ালের মত কটাচোখ।

“ঠোঁট — ডোমের মতো হলে — নীচবুদ্ধি হয়। বিষ্ণুঘরের পুরুত কয়মাস একটিং কর্মে এসেছিল। তার হাতে খেতুম না — হঠাৎ মুখ দিয়ে বলে ফেলেছিলুম, ‘ও ডোম’। তারপর সে একদিন বললে ‘হাঁ, আমাদের ঘর ডোম পাড়ায়। আমি ডোমের বাসন চাঙ্গারী বুনতে জানি’।

“আরও খারাপ লক্ষণ — এক চক্ষু আর ট্যারা। বরং এক চক্ষু কানা ভাল, তো ট্যারা ভাল নয়। ভারী দুষ্ট ও খল হয়।

”মহেশের (৺ মহেশ ন্যায়রত্নের) একজন ছাত্র এসেছিল। সে বলে, ‘আমি নাস্তিক’। সে হৃদেকে বললে, ‘আমি নাস্তিক, তুমি আস্তিক হয়ে আমার সঙ্গে বিচার কর’। তখন তাকে ভাল করে দেখলাম। দেখি, বিড়াল চক্ষু!

“আবার চলনেতে লক্ষণ ভাল মন্দ টের পাওয়া যায়।

পুরুষাঙ্গের উপর চামরাটি মুসলমানদের মতো যদি কাটা হয়, সে একটি খারাপ লক্ষণ। (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য) (মাস্টারকে সহাস্যে) তুমি ওটা দেখো — ও খারাপ লক্ষণ।” (সকলের হাস্য)

ঘর হইতে ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতেছেন। সঙ্গে মাস্টার ও বাবুরাম। শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — একজন এসেছিল, — দেখলাম বিড়ালের মতো চক্ষু। সে বলে, ‘আপনি জ্যোতিষ জানেন? — আমার কিছু কষ্ট আছে।’ আমি বললাম, ‘না, বরাহনগরে যাও, সেখানে জ্যোতিষের পণ্ডিত আছে।’

বাবুরাম ও মাস্টার নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা কহিতেছেন। বাবুরাম নবীন সেনের বাটী হইতে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিয়া কাল রাত্রে এখানে ছিলেন। সকালে ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে নবীন নিয়োগীর বাড়িতে নীলকণ্ঠের যাত্রা শুনিয়াছিলেন।

[শ্রীরামকৃষ্ণ, মণি ও নিভৃত চিন্তা — “ঈশ্বরের ইচ্ছা” — নারাণের জন্য ভাবনা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও বাবুরামের প্রতি) — তোমাদের কি কথা হচ্ছে?

মাস্টার ও বাবুরাম — আজ্ঞা নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা হচ্ছে, — আর সেই গানটির কথা — ‘শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।’

ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ মণিকে নিভৃতে হইয়া বলিতেছেন — ঈশ্বরচিন্তা যত লোকে টের না পায় ততই ভাল। হঠাৎ এই কথা বলিয়াই ঠাকুর চলিয়া গেলেন।

ঠাকুর হাজরার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।

হাজরা — নীলকণ্ঠ তো আপনাকে বলেছে, সে আসবে। তা ডাকতে গেলে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, রাত্রি জেগেছে, — ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি আসে, সে এক। বাবুরামকে নারাণের বাড়ি গিয়া দেখা করিতে বলিতেছেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন। তাই তাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন — “তুই বরং একখান ইংরাজী বই নিয়ে তার কাছে যাস।”
==========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর

নীলকণ্ঠ প্রভৃতি ভক্তগণসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে নিজের আসনে বসিয়া আছেন। বেলা প্রায় তিনটা হইবে। নীলকণ্ঠ পাঁচ-সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া ঠাকুরের ঘরে আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর পূর্বাস্য হইয়া তাহাকে যেন অভ্যর্থনা করিতে অগ্রসর হইলেন। নীলকণ্ঠ ঘরের পূর্ব দ্বার দিয়া আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন।

ঠাকুর সমাধিস্ত! — তাঁহার পশ্চাতে বাবুরাম, সম্মুখে মাস্টার, নীলকণ্ঠ ও চমৎকৃত অন্যান্য যাত্রাওয়ালারা। খাটের উত্তর ধারে দীননাথ খাজাঞ্চী আসিয়া দর্শন করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে ঘর ঠাকুরবাড়ির লোকে পরিপূর্ণ হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরের কিঞ্চিত ভাব উপশম হইতেছে। ঠাকুর মেঝেতে মাদুরে বসিয়াছেন — সম্মুখে নীলকণ্ঠ ও চতুর্দিকে ভক্তগণ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (আবিষ্ট হইয়া) — আমি ভাল আছি।

নীলকণ্ঠ (কৃতাঞ্জলি হইয়া) — আমায়ও ভাল করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি তো ভাল আছ। ‘ক’য়ে আকার ‘কা’, আবার আকার দিয়ে কি হবে? ‘কা’-এর উপর আবার আকার দিলে সেই ‘কা’-ই থাকে। (সকলের হাস্য)

নীলকণ্ঠ — আজ্ঞা, এই সংসারে পড়ে রয়েছি!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তোমায় সংসারে রেখেছেন পাঁচজনের জন্য।

“অষ্টপাশ। তা সব যায় না। দু-একটা পাশ তিনি রেখে দেন — লোকশিক্ষার জন্য! তুমি যাত্রাটি করেছো, তোমার ভক্তি দেখে কত লোকের উপকার হচ্ছে। আর তুমি সব ছেড়ে দিলে এঁরা (যাত্রাওয়ালারা) কোথায় যাবেন।

“তিনি তোমার দ্বারা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কাজ শেষ হলে তুমি আর ফিরবে না। গৃহিণী সমস্ত সংসারের কাজ সেরে, — সকলকে খাইয়ে-দাইয়ে, দাস-দাসীদের পর্যন্ত খাইয়ে-দাইয়ে — নাইতে যায়; — তখন আর ডাকাডাকি করলেও ফিরে আসে না।”

নীলকণ্ঠ — আমায় আশীর্বাদ করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কৃষ্ণের বিরহে যশোদা উন্মাদিনী, — শ্রীমতীর কাছে গিয়েছেন। শ্রীমতী তখন ধ্যান কচ্ছিলেন। তিনি আবিষ্ট হয়ে যশোদাকে বললেন — ”আমি সেই মূল প্রকৃতি আদ্যাশক্তি! তুমি আমার কাছে বর নাও!” যশোদা বললেন, ‘আর কি বর দেবে! এই বলো যেন কায়মনোবাক্যে তাঁর চিন্তা, তাঁর সেবা করতে পারি। কর্ণেতে যেন তাঁর নামগুণগান শুনতে পাই, হাতে যেন তাঁর ও তাঁর ভক্তের সেবা করতে পারি, — চক্ষে যেন তাঁর রূপ, তাঁর ভক্ত, দর্শন করতে পারি।

“তোমার যেকালে তাঁর নাম করতে চক্ষু জলে ভেসে যায়, সেকালে আর তোমার ভাবনা কি? — তাঁর উপর তোমার ভালবাসা এসেছে।

“অনেক জানার নাম অজ্ঞান, — এক জানার নাম জ্ঞান — অর্থাৎ এক ঈশ্বর সত্য সর্বভূতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের নাম বিজ্ঞান — তাঁকে লাভ করে নানাভাবে ভালবাসার নাম বিজ্ঞান।

“আবার আছে — তিনি এক-দুয়ের পার — বাক্য মনের অতীত। লীলা থেকে নিত্য, আবার নিত্য থেকে লীলায় আসা, — এর নাম পাকা ভক্তি।

“তাহলেই হল, — তাঁর কৃপার উপর সব নির্ভর করছে।

“কিন্তু তা বলে তাঁকে ডাকতে হবে — চুপ করে থাকলে হবে না। উকিল হাকিমকে সব বলে শেষে বলে — “আমি যা বলবার বললাম এখন হাকিমের হাত’।”

“কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন — তুমি সকালে অত গাইলে, আবার এখানে এসেছ কষ্ট করে। এখানে কিন্তু অনারারী (Honorary)।

নীলকণ্ঠ — কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বুঝেছি, আপনি যা বলবেন।

নীলকণ্ঠ — অমূল্য রতন নিয়ে যাব!!!

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে অমূল্য রতন আপনার কাছে। আবার ‘ক’য়ে আকার দিলে কি হবে? না হলে তোমার গান অত ভাল লাগে কেন? রামপ্রসাদ সিদ্ধ, তাই তার গান ভাল লাগে।

“সাধারণ জীবকে বলে মানুষ। যার চৈতন্য হয়েছে, সেই মানহুঁস। তুমি তাই মানহুঁস।

“তোমার গান হবে শুনে আমি আপনি যাচ্ছিলাম — তা নিয়োগীও বলতে এসেছিল।”

ঠাকুর ছোট তক্তপোশের উপর নিজের আসনে গিয়া বসিয়াছেন। নীলকণ্ঠকে বলিতেছেন, একটু মায়ের নাম শুনব।

নীলকণ্ঠ সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া গান গাইতেছেন:

গান – শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।

গান – মহিষমর্দিনী।

এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ!

নীলকণ্ঠ গানে বলিতেছেন, ‘যার জটায় গঙ্গা, তিনি রাজরাজেশ্বরীকে হদয়ে ধারণ করিয়া আছেন।’

ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন। নীলকণ্ঠ ও ভক্তগণ তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া গান গাহিতেছেন ও নৃত্য করিতেছেন।

গান – শিব শিব।

এই গানের সঙ্গেও ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নৃত্য করিতে লাগিলেন।

গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর নীলকণ্ঠকে বলিতেছেন, — আমি আপনার সেই-গানটি শুনব, কলকাতায় যা শুনেছিলাম।

মাস্টার — শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হাঁ।

নীলকন্ঠ গাইতেছেন:

শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর, নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়।

‘প্রেমের বন্যে ভেসে যায়’ — এই ধুয়া ধরিয়া ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে আবার নাচিতেছেন, সে অপূর্ব নৃত্য যাঁহারা দেখিয়াছিলেন তাঁহারা কখনই ভুলিবেন না। ঘর লোকে পরিপূর্ণ সকলেই উন্মত্তপ্রায়। ঘরটি যেন শ্রীবাসের আঙ্গিনা হইয়াছে।

শ্রীযুক্ত মনোমোহন ভাবাবিষ্ট হইলেন। তাঁহার বাটীর কয়েকটি মেয়ে আসিয়াছেন; তাঁহারা উত্তরের বারান্দা হইতে এই অপূর্ব নৃত্য ও সংকীর্তন দর্শন করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যেও একজনের ভাব হইয়াছিল। মনোমোহন ঠাকুরের ভক্ত ও শ্রীযুক্ত রাখালের সম্বন্ধী।

ঠাকুর আবার গান ধরিলেন:

যাদের হরি বলতে নয়ন ঝুরে, তারা দুভাই এসেছে রে!

সংকীর্তন করিতে করিতে ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে নৃত্য করিতেছেন। ও আখর দিতেছেন —

‘রাধার প্রেমে মাতোয়ারা, তারা দুভাই এসেছে রে।’

উচ্চ সংকীর্তন শুনিয়া চতুর্দিকে লোক আসিয়া জমিয়াছে। দক্ষিণের, উত্তরের ও পশ্চিমের গোল বারান্দায়, সব লোক দাঁড়াইয়া। যাঁহারা নৌকা করিয়া যাইতেছেন, তাঁহারাও এই মধুর সংকীর্তনের শব্দ শুনিয়া আকৃষ্ট হইয়াছেন।

কীর্তন সমাপ্ত হইল। ঠাকুর জগন্মাতাকে প্রণাম করিতেছেন ও বলিতেছেন — ভাগবত-ভক্ত-ভগবান — জ্ঞানীদের নমস্কার, যোগীদের নমস্কার, ভক্তদের নমস্কার।

এইবার ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আজ কোজাগর পূর্ণিমার পরদিন। চতুর্দিকে চাঁদের আলো। ঠাকুর নীলকণ্ঠের সহিত আনন্দে কথা কহিতেছেন।

[ঠাকুর কে? ‘আমি’ খুঁজে পাই নাই — “ঘরে আনবো চণ্ডী” ]

নীলকণ্ঠ — আপনিই সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও গুনো কি! — আমি সকলের দাস।

“গঙ্গারই ঢেউ। ঢেউ-এর কখন গঙ্গা হয়?”

নীলকণ্ঠ — আপনি যা বলুন, আমরা আপনাকে তাই দেখছি!

শ্রীরামকৃষ্ণ (কিঞ্চিৎ ভাবাবিষ্ট হইয়া, করুণস্বরে) — বাপু, আমার ‘আমি’ খুঁজতে যাই, কিন্তু খুঁজে পাই না।

“হনুমান বলেছিলেন — হে রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ — তুমি প্রভু আমি দাস, — আবার যখন তত্ত্বজ্ঞান হয় — তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি!”

নীলকণ্ঠ — আর কি বলব আমাদের কৃপা করবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি কত লোককে পার করছ — তোমার গান শুনে কত লোকের উদ্দীপন হচ্ছে।

নীলকণ্ঠ — পার করছি বলছেন। কিন্তু আশীর্বাদ করুন, যেন নিজে ডুবি না!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — যদি ডোবো তো ওই সুধাহ্রদে!

ঠাকুর নীলকণ্ঠকে পাইয়া আনন্দিত হইয়াছেন। তাঁহাকে আবার বলিতেছেন “তোমার এখানে আসা! — যাকে অনেক সাধ্য-সাধনা করে তবে পাওয়া যায়! তবে একটা গান শোন:

গিরি! গণেশ আমার শুভকারী। —
পূজে গণপতি, পেলাম হৈমবতী
যাও হে গিরিরাজ, আন গিয়ে গৌরী।।
বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়ে বোধন,
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন।
ঘরে আনবো চণ্ডী, শুনবো কত চণ্ডী,
কত আসবেন দণ্ডী, যোগী জটাধারী।।

“চণ্ডী যেকালে এসেছেন — সেকালে কত যোগী জটাধারীও আসবে।”

ঠাকুর হাসিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টার, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তদের বলিতেছেন — “আমার বড় হাসি পাচ্ছে। ভাবছি — এঁদের (যাত্রাওয়ালাদের) আবার আমি গান শোনাচ্ছি।”

নীলকণ্ঠ — আমরা যে গান গেয়ে বেড়াই, তার পুরস্কার আজ হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — কোন জিনিস বেচলে এক খাঁমচা ফাউ দেয় — তোমরা ওখানে গাইলে, এখানে ফাউ দিলে। (সকলের হাস্য)
==========

Post a Comment

0 Comments