শ্রীশ্রীরথযাত্রা বলরাম-মন্দিরে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

ত্রয়োবিংশ খণ্ড
শ্রীশ্রীরথযাত্রা বলরাম-মন্দিরে

শ্রীশ্রীরথযাত্রা বলরাম-মন্দিরে

========

প্রথম পরিচ্ছেদ

পূর্ণ, ছোট নরেন, গোপালের মা
শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাড়ির বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। (৩০শে আষাঢ়, ১২৯২) আষাঢ় শুক্লা প্রতিপদ, সোমবার, ১৩ই জুলাই, ১৮৮৫, বেলা ৯টা।
কল্য শ্রীশ্রীরথযাত্রা। রথে বলরাম ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। বাড়িতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বিগ্রহের নিত্য সেবা হয়। একখানি ছোট রথও আছে, — রথের দিন রথ বাহিরের বারান্দায় টানা হইবে।
ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কাছে নারাণ, তেজচন্দ্র, বলরাম ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা। পূর্ণ সম্বন্ধে কথা হইতেছে। পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কাছে নারাণ, তেজচন্দ্র, বলরাম ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা। পূর্ণ সম্বন্ধে কথা হইতেছে। পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আচ্ছা, সে (পূর্ণ) কোন পথ দিয়ে এসে দেখা করবে? — দ্বিজকে ও পূর্ণকে তুমিই মিলিয়ে দিও।
“এক সত্তার আর এক বয়সের লোক, আমি মিলিয়ে দিই। এর মানে আছে। দুজনেরই উন্নতি হয়। পূর্ণর কেমন অনুরাগ দেখেছ।”
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, আমি ট্রামে করে যাচ্ছি, ছাদ থেকে আমাকে দেখে, রাস্তার দিকে দৌড়ে এল, — আর ব্যাকুল হয়ে সেইখান থেকেই নমস্কার করলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সাশ্রুনয়নে) — আহা! আহা! — কি না ইনি আমার পরমার্থের (পরমার্থলাভের জন্য) সংযোগ করে দিয়েছেন। ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল না হলে এইরূপ হয় না।
[পূর্ণের পুরুষত্তা, দৈবস্বভাব, — তপস্যার জোরে নারায়ণ সন্তান ]
“এ তিনজনের পুরুষসত্তা — নরেন্দ্র, ছোট নরেন আর পূর্ণ। ভবনাথের নয় — ওর মেদী ভাব (প্রকৃতিভাব)।
“পূর্ণর যে অবস্থা, এতে হয় শীঘ্র দেহনাশ হবে — ঈশ্বরলাভ হল, আর কেন; — বা কিছুদিনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে বেরুবে।
“দৈবস্বভাব — দেবতার প্রকৃতি। এতে লোকভয় কম থাকে। যদি গলায় মালা, গায়ে চন্দন, ধূপধুনার গন্ধ দেওয়া যায়; তাহলে সমাধি হয়ে যায়! — ঠিক বোধ হয়ে যায় যে, অন্তরে নারায়ণ আছেন — নারায়ণ দেহধারণ করে এসেছেন। আমি টের পেয়েছি।”
[পূর্বকথা — সুলক্ষণা ব্রাহ্মণির সমাধি — রণজিতের ভগবতী কন্যা ]
“দক্ষিণেশ্বরে যখন আমার প্রথম এইরুপ অবস্থা হল, কিছুদিন পরে একটি ভদ্রঘরে বামুনের মেয়ে এসেছিল। বড় সুলক্ষণা। যাই গলায় মালা আর ধূপধুনা দেওয়া হল অমনি সমাধিস্থ। কিছুক্ষণ পরে আনন্দ, — আর ধারা পড়তে লাগল। আমি তখন প্রণাম করে বললুম, ‘মা, আমার হবে?’ তা বললে, ‘হাঁ!’ তবে পূর্ণকে আর একবার দেখা। তা দেখবার সুবিধা কই?
“কলা বলে বোধ হয়। কি আশ্চর্য অংশ শুধু নয়, কলা!
“কি চতুর! — পড়াতে নাকি খুব। — তবে তো ঠিক ঠাওরেছি!
“তপস্যার জোরে নারায়ণ সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ও-দেশে যাবার রাস্তায় রণজিত রায়ের দীঘি আছে। রণজিত রায়ের ঘরে ভগবতী কন্যা হয়ে জন্মেছিলেন। এখনও চৈত্রমাসে মেলা হয়। আমার বড় যাবার ইচ্ছা হয়! — আর এখন হয় না।
“রণজিত রায় ওখানকার জমিদার ছিল। তপস্যার জোরে তাঁকে কন্যারূপে পেয়েছিল। মেয়েটিকে বড়ই স্নেহ করে। সেই স্নেহের গুণে তিনি আটকে ছিলেন, বাপের কাছ ছাড়া প্রায় হতেন না। একদিন সে জমিদারির কাজ করছে, ভারী ব্যস্ত; মেয়েটি ছেলের স্বভাবে কেবল বলছে, ‘বাবা, এটা কি; ওটা কি।’ বাপ অনেক মিষ্টি করে বললে — ‘মা, এখন যাও, বড় কাজ পড়েছে।’ মেয়ে কোনমতে যায় না। শেষে বাপ অন্যমনস্ক হয়ে বললে, ‘তুই এখান থেকে দূর হ’। মা তখন এই ছুতো করে বাড়ি থেকে চলে গেলেন। সেই সময় একজন শাঁখারী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডেকে শাঁখা পরা হল। দাম দেবার কথায় বললেন, ঘরের অমুক কুলুঙ্গিতে টাকা আছে, লবে। এই বলে সেখান থেকে চলে গেলেন, আর দেখা গেল না। এদিকে শাঁখারী টাকার জন্য ডাকাডাকি করছে। তখন মেয়ে বাড়িতে নাই দেখে সকলে ছুটে এল। রণজিত রায় নানাস্থানে লোক পাঠালে সন্ধান করবার জন্য। শাঁখারীর টাকা সেই কুলুঙ্গিতে পাওয়া গেল। রণজিত রায় কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় লোকজন এসে বললে, যে, দীঘিতে কি দেখা যাচ্ছে। সকলে দীঘির ধারে গিয়ে দেখে যে শাঁখাপরা হাতটি জলের উপর তুলেছেন। তারপর আর দেখা গেল না। এখনও ভগবতীর পূজা ওই মেলার সময় হয় — বারুণীর দিনে।
(মাস্টারকে) — “এ সব সত্য।”
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নরেন্দ্র এখন এ-সব বিশ্বাস করে।
“পূর্ণর বিষ্ণুর অংশে জন্ম। মানসে বিল্বপত্র দিয়ে পূজা করলুম, তা হল না; — তুলসী-চন্দন দিলাম, তখন হল!
“তিনি নানারূপে দর্শন দেন। কখন নররূপে, কখন চিন্ময় ঈশ্বরীয় রূপে। রূপ মানতে হয়। কি বল?”
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ!
[গোপালের মার প্রকৃতিভাব ও রূপদর্শন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — কামারহাটির বামনী (গোপালের মা) কত কি দেখে! একলাটি গঙ্গার ধারে একটি বাগানে নির্জন ঘরে থাকে, আর জপ করে। গোপাল কাছে শোয়! (বলিতে বলিতে ঠাকুর চমকিত হইলেন)। কল্পনায় নয়, সাক্ষাৎ! দেখলে গোপালের হাত রাঙা! সঙ্গে সঙ্গে বেড়ায়! — মাই খায়! — কথা কয়! নরেন্দ্র শুনে কাঁদলে!
“আমি আগে অনেক দেখতুম। এখন আর ভাবে তত দর্শন হয় না। এখন প্রকৃতিভাব কম পড়ছে। বেটাছেলের ভাব আসছে। তাই ভাব অন্তরে, বাহিরে তত প্রকাশ নাই।
“ছোট নরেনের পুরুষভাব, — তাই মন লীন হয়ে যায়। ভাবাদি নাই। নিত্যগোপালের প্রকৃতিভাব। তাই খ্যাঁচা ম্যাঁচা; — ভাবে তার শরীর লাল হয়ে যায়।”
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ ও পূর্ণাদি
[বিনোদ, দ্বিজ, তারক, মোহিত, তেজচন্দ্র, নারাণ, বলরাম, অতুল ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আচ্ছা, লোকের তিল তিল করে ত্যাগ হয়, এদের কি অবস্থা।
“বিনোদ বললে, ‘স্ত্রীর সঙ্গে শুতে হয়, বড়ি মন খারাপ হয়।’
“দেখো, সঙ্গ হউক আর নাই হউক, একসঙ্গে শোয়াও খারাপ। গায়ের ঘর্ষণ, গায়ের গরম!
“দ্বিজর কি অবস্থা! কেবল গা দোলায় আর আমার পানে তাকিয়ে থাকে, একি কম? সব মন কুড়িয়ে আমাতে এল, তাহলে তো সবই হল।”
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? ]
“আমি আর কি? — তিনি। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। এর (আমার) ভিতর ঈশ্বরের সত্তা রয়েছে! তাই এত লোকের আকর্ষণ বাড়ছে। ছুঁয়ে দিলেই হয়! সে টান সে আকর্ষণ ঈশ্বরেরই আকষর্ণ।
“তারক (বেলঘরের) ওখান থেকে (দক্ষিণেশ্বর থেকে) বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। দেখলাম, এর ভিতর থেকে শিখার ন্যায় জ্বল্‌ জ্বল্‌ করতে করতে কি বেরিয়ে গেল, — পেছু পেছু!
“কয়েকদিন পরে তারক আবার এল (দক্ষিণেশ্বরে)। তখন সমাধিস্থ হয়ে তার বুকে পা দিলে — এর ভিতর যিনি আছেন।
“আচ্ছা, এমন ছোকরাদের মতন আর কি ছোকরা আছে!”
মাস্টার — মোহিতটি বেশ। আপনার কাছে দু-একবার গিয়েছিল। দুটো পাশের পড়া আছে, আর ঈশ্বরে খুব অনুরাগ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হতে পারে, তবে অত উঁচু ঘর নয়। শরীরের লক্ষণ তত ভাল নয়। মুখ থ্যাবড়ানো।
“এদের উঁচুঘর। তবে শরীরধারণ করলেই বড় গোল। আবার শাপ হল তো সাতজন্ম আসতে হবে। বড় সাবধানে থাকতে হয়! বাসনা থাকলেই শরীরধারণ।”
একজন ভক্ত — যাঁরা অবতার দেহধারণ করে এসেছেন, তাঁদের কি বাসনা — ?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — দেখেছি, আমার সব বাসনা যায় নাই। এক সাধুর আলোয়ান দেখে বাসনা হয়েছিল, ওইরকম পরি। এখনও আছে। জানি কিনা আর-একবার আসতে হবে।
বলরাম (সহাস্যে) — আপনার জন্ম কি আলোয়ানের জন্য? (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — একটা সৎ কামনা রাখতে হয়। ওই চিন্তা করতে করতে দেহত্যগ হবে বলে। সাধুরা চারধামের একধাম বাকী রাখে। অনেকে জগন্নাথক্ষেত্র বাকী রাখে। তাহলে জগন্নাথ চিন্তা করতে করতে শরীর যাবে।
গেরুয়া পরা একব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করিয়া অভিবাদন করিলেন। তিনি ভিতরে ভিতরে ঠাকুরের নিন্দা করেন, তাই বলরাম হাসিতেছেন। ঠাকুর অন্তর্যামী, বলরামকে বলিতেছেন — “তা হোক, বলুকগে ভণ্ড।”
[তেজচন্দ্রের সংসারত্যাগের প্রস্তাব ]
ঠাকুর তেজচন্দ্রের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (তেজচন্দ্রের প্রতি) — তোকে এত ডেকে পাঠাই, — আসিস না কেন? আচ্ছা, ধ্যান-ট্যান করিস, তা হলেই আমি সুখী হব। আমি তোকে আপনার বলে জানি, তাই ডাকি।
তেজচন্দ্র — আজ্ঞা, আপিস যেতে হয়, — কাজের ভিড়।
মাস্টার (সহাস্যে) — বাড়িতে বিয়ে, দশদিন আপিসের ছুটি নিয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে! — অবসর নাই, অবসর নাই! এই বললি সংসারত্যাগ করবি।
নারাণ — মাস্টার মহাশয় একদিনে বলেছিলেন — wilderness of this world — সংসার অরণ্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তুমি ওই গল্পটা বল তো, এদের উপকার হবে। শিষ্য ঔষধ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে আছে। গুরু এসে বললেন, এর প্রাণ বাঁচতে পারে, যদি এই বড়ি কেউ খায়। এ বাঁচবে কিন্তু বড়ি যে খাবে সে মরে যাবে।
“আর ওটাও বল — খ্যাঁচা ম্যাঁচা। সেই হঠযোগী যে মনে করেছিল যে পরিবারাদি — এরাই আমার আপনার লোক।”
মধ্যাহ্নে ঠাকুর শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের প্রসাদ পাইলেন। বলরামের জগন্নাথদেবের সেবা আছে। তাই ঠাকুর বলেন, ‘বলরামের শুদ্ধ অন্ন।’ আহারান্তে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিলেন।
বৈকাল হইয়াছে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। কর্তাভজা চন্দ্রবাবু ও রসিক ব্রাহ্মণটিও আছেন। ব্রাহ্মণটির স্বভাব একরকম ভাঁড়ের ন্যায়, — এক-একটি কথা কন আর সকলে হাসে।
ঠাকুর কর্তাভজাদের সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন, — রূপ, স্বরূপ, রজঃ, বীজ, পাকপ্রণালী ইত্যাদি।
[ঠাকুরের ভাবাবস্থা — শ্রীযুক্ত অতুল ও তেজচন্দ্রের ভ্রাতা ]
ছটা বাজে। গিরিশের ভ্রাতা অতুল, ও তেজচন্দ্রের ভ্রাতা আসিয়াছেন। ঠাকুর ভাবসমাধিস্থ হইয়াছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ভাবে বলিতেছেন, “চৈতন্যকে ভেবে কি অচৈতন্য হয়? — ঈশ্বরকে চিন্তা করে কেউ কি বেহেড হয়? — তিনি যে বোধস্বরূপ!”
আগন্তুকদের ভিতর কেউ কি মনে করিতেছিলেন যে, বেশি ঈশ্বরচিন্তা করিয়া ঠাকুরের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে?
[‘এগিয়ে পড়' — কৃষ্ণধনের সামান্য রসিকতা ]
ঠাকুর কৃষ্ণধন নামক ওই রসিক ব্রাহ্মণকে বলিতেছেন — “কি সামান্য ঐহিক বিষয় নিয়ে তুমি রাতদিন ফষ্টিনাষ্টি করে সময় কাটাচ্ছ। ওইটি ঈশ্বরের দিকে মোড় ফিরিয়ে দাও। যে নুনের হিসাব করতে পারে, সে মিছরির হিসাবও করতে পারে।”
কৃষ্ণধন (সহাস্যে) — আপনি টেনে নিন!
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি করব, তোমার চেষ্টার উপর সব নির্ভর করছে। ‘এ মন্ত্র নয় — এখন মন তোর!’
“ও সামান্য রসিকতা ছেড়ে ঈশ্বরের পথে এগিয়ে পড়, — তারে বাড়া, তারে বাড়া, — আছে! ব্রহ্মচারী কাঠুরিয়াকে এগিয়ে পড়তে বলেছিল। সে প্রথমে এগিয়ে দেখে চন্দনের কাঠ, — তারপর দেখে রূপার খনি, — তারপর সোনার খনি, — তারপর হীরা মাণিক!”
কৃষ্ণধন — এ-পথের শেষ নাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ — যেখানে শান্তি সেইখানে ‘তিষ্ঠ’।
ঠাকুর একজন আগন্তুক সম্বন্ধে বলিতেছেন —
“ওর ভিতর কিছু বস্তু দেখতে পেলেম না। যেন ওলম্বাকুল।”
সন্ধ্যা হইল। ঘরে আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার চিন্তা ও মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন।
কাল রথযাত্রা। ঠাকুর আজ এই বাটীতেই রাত্রিবাস করিবেন।
অন্তঃপুরে কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া আবার ঘরে ফিরিলেন। রাত প্রায় দশটা হইবে। ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন, ‘ওই ঘর থেকে (অর্থাৎ পার্শ্বের পশ্চিমের ছোট ঘর থেকে) গামছাটা আন তো’।
ঠাকুরের সেই ছোট ঘরটিতেই শয্যা প্রস্তুত হইয়াছে। রাত সাড়ে দশটা হইল। ঠাকুর শয়ন করিলেন।
গ্রীষ্মকাল। ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন, “বরং পাখাটা আনো।” তাঁহাকে পাখা করিতে বলিলেন। রত বারটার সময় ঠাকুরের একটু নিদ্রাভঙ্গ হইল। বলিলেন, “শীত করছে, আর কাজ নাই।”
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীশ্রীরথযাত্রা দিবসে বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
আজ শ্রীশ্রীরথযাত্রা। মঙ্গলবার (৩১শে আষাঢ়, ১২৯২, শুক্লা দ্বিতীয়া, ১৪ই জুলাই, ১৮৮৫)। অতি প্রতূষ্যে ঠাকুর উঠিয়া একাকী নৃত্য করিতেছেন ও মধুর কণ্ঠে নাম করিতেছেন।
মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। ক্রমে ভক্তেরা আসিয়া প্রণাম করিয়া ঠাকুরের কাছে উপবিষ্ট হইলেন। ঠাকুর পূর্ণর জন্য বড় ব্যাকুল। মাস্টারকে দেখিয়া তাঁরই কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি পূর্ণকে দেখে কিছু উপদেশ দিতে?
মাস্টার — আজ্ঞা, চৈতন্যচরিত পড়তে বলেছিলাম, — তা সে সব কথা বেশ বলতে পারে। আর আপনি বলেছিলেন, সত্য ধরে রাখতে, সেই কথাও বলেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা ‘ইনি অবতার’ এ-সব কথা জিজ্ঞাসা করলে কি বলত।
মাস্টার — আমি বলেছিলাম, চৈতন্যদেবের মতো একজনকে দেখবে তো চল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর কিছু?
মাস্টার — আপনার সেই কথা। ডোবাতে হাতি নামলে জল তোলপাড় হয়ে যায়, — ক্ষুদ্র আধার হলেই ভাব উপছে পড়ে।
“মাছ ছাড়ার কথায় বলেছিলাম, কেন অমন করলে। হইচই হবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাই ভাল। নিজের ভাব ভিতরে ভিতরে থাকাই ভাল।
[ভূমিকম্প ও শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানীর দেহ ও দেহনাশ সমান ]
প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। বলরামের বাটী হইতে মাস্টার গঙ্গাস্নানে যাইতেছেন। পথে হঠাৎ ভূমিকম্প। তিনি তৎক্ষণাৎ ঠাকুরের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে দাঁড়াইয়া আছেন। ভক্তেরাও দাঁড়াইয়া আছেন। ভূমিকম্পের কথা হইতেছে। কম্প কিছু বেশি হইয়াছিল। ভক্তেরা অনেকে ভয় পাইয়াছেন।
মাস্টার — আমাদের সব নিচে যাওয়া উচিত ছিল।
[পূর্বকথা — আশ্বিনের ঝড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ — ৫ই অক্টোবর, ১৮৬৪ খ্রী: ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — যে ঘরে বাস, তারই এই দশা! এতে আবার লোকে অহংকার। (মাস্টারকে তোমার আশ্বিনের ঝড় মনে আছে?
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ। তখন খুব কম বয়স — নয়-দশ বছর বয়স — একঘরে একলা ঠাকুরদের ডাকছিলাম!
মাস্টার বিস্মিত হইয়া ভাবিতেছেন — ঠাকুর হঠাৎ আশ্বিনের ঝড়ের দিনের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন কেন? আমি যে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে একাকী একঘরে বসে ঈশ্বরকে প্রার্থনা করেছিলাম, ঠাকুর কি সব জানেন ও আমাকে মনে করাইয়া দিতেছেন? উনি কি জন্মাবধি আমাকে গুরুরূপে রক্ষা করিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — দক্ষিণেশ্বরে অনেক বেলায় — তবে কি কি রান্না হল। গাছ সব উলটে পড়েছিল! দেখ যে ঘরে বাস, তারই এ-দশা!
“তবে পূর্ণজ্ঞান হলে মরা মারা একবোধ হয়। মলেও কিছু মরে না — মেরে ফেল্লেও কিছু মরে না[1] যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য। সেই একরূপে নিত্য, একরুপে লীলা। লীলারূপ ভেঙে গেলেও নিত্য আছেই। জল স্থির থাকলেও জল, — হেললে দুললেও জল। হেলা দোলা থেমে গেলেও সেই জল।”
ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে ভক্তসঙ্গে আবার বসিয়াছেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে, হরিবাবু, ছোট নরেন ও অন্যান্য অনেকগুলি ছোকরা ভক্ত বসিয়া আছেন। হরিবাবু একলা একলা থাকেন ও বেদান্তচর্চা করেন। বয়স ২৩।২৮ হবে। বিবাহ করেন নাই। ঠাকুর তাহাকে বড় ভালবাসেন। সর্বদা তাঁহার কাছে যাইতে বলেন। তিনি একলা একলা থাকতে চান বলিয়া হরিবাবু ঠাকুরের কাছে অধিক যাইতে পারেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরিবাবুকে) — কি গো, তুমি অনেকদিন আস নাই।
[হরিবাবুকে উপদেশ — অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ — বিজ্ঞান ]
“তিনি একরূপে নিত্য, একরূপে লীলা। বেদান্তে কি আছে? — ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। কিন্তু যতক্ষণ ‘ভক্তের আমি’ রেখে দিয়েছে, ততক্ষণ লীলাও সত্য। ‘আমি’ যখন তিনি পুছে ফেলবেন, তখন যা আছে তাই আছে। মুখে বলা যায় না। যতক্ষণ ‘আমি’ রেখে দিয়েছেন, ততক্ষণ সবই নিতে হবে। কলাগাছের খোল ছাড়িয়া ছাড়িয়া মাজ পাওয়া যায়। কিন্তু খোল থাকলেই মাজ আছে। মাজ থাকলেই খোল আছে। খোলেরই মাজ, মাজেরই খোল। নিত্য বললেই লীলা আছে বুঝায়। লীলা বললেই নিত্য আছে বুঝায়।
“তিনি জীবজগৎ হয়েছেন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। যখন নিষ্ক্রিয় তখন তাঁহাকে ব্রহ্ম বলি। যখন সৃষ্টি করছেন, পালন করছেন, সংহার করছেন, — তখন তাঁকে শক্তি বলি। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল।
“আমিবোধ যায় না। যতক্ষণ ‘আমি’বোধ থাকে, ততক্ষণ জীবজগৎ মিথ্যা বলবার জো নাই! বেলের খোলটা আর বিচিগুলো ফেলে দিলে সমস্ত বেলটার ওজন পাওয়া যায় না।
“যে ইট, চুন, সুরকি থেকে ছাদ, সেই ইট, চুন, সুরকি থেকেই সিঁড়ি। যিনি ব্রহ্ম, তাঁর সত্তাতেই জীবজগৎ।
“ভক্তেরা — বিজ্ঞানীরা — নিরাকার-সাকার দুইই লয়, অরূপ-রূপ দুইই গ্রহণ করে। ভক্তি হিমে ওই জলেরই খানিকটা বরফ হয়ে যায়। আবার জ্ঞান-সূর্য উদয় হলে ওই বরফ গলে আবার যেমন জন তেমনি হয়।”
[বিচারান্তে মনের নাশ ও ব্রহ্মজ্ঞান ]
“যতক্ষণ মনের দ্বারা বিচার ততক্ষণ নিত্যেতে পৌঁছানো যায় না। মনের দ্বারা বিচার করতে গেলেই জগৎকে ছাড়বার জো নাই, — রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ, — ইন্দ্রিয়ের এই সকল বিষয়কে ছাড়বার জো নাই। বিচার বন্ধ হলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান। এ মনের দ্বারা আত্মাকে জানা যায় না। আত্মার দ্বারাই আত্মাকে জানা যায়। শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধি, শুদ্ধ-আত্মা, একই।
“দেখ না, একটা জিনিস দেখতেই কতকগুলো দরকার — চক্ষু দরকার, আলো দরকার, আবার মনের দরকার। এই তিনটার মধ্যে একটা বাদ দিলে তার দর্শন হয় না। এই মনের কাজ যতক্ষণ চলছে, ততক্ষণ কেমন করে বলবে যে, জগৎ নাই, কি আমি নাই?
“মনের নাশ হলে, সঙ্কল্প-বিকল্প চলে গেলে, সমাধি হয়, ব্রহ্মজ্ঞান হয়। কিন্তু সা রে গা মা পা ধা নি — নি-তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না।”
[ছোট নরেনকে উপদেশ — ঈশ্বরদর্শনের পর তাঁর সঙ্গে আলাপ ]
ছোট নরেনের দিকে তাকাইয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “শুধু ঈশ্বর আছেন, বোধে বোধ করলে কি হবে? ঈশ্বরদর্শন হলেই যে সব হয়ে গেল, তা নয়।
“তাঁকে ঘরে আনতে হয় — আলাপ করতে হয়।
“কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ দুধ খেয়েছে।
“রাজাকে কেউ কেউ দেখেছে। কিন্তু দু-একজন বাড়িতে আনতে পারে, আর খাওয়াতে-দাওয়াতে পারে।”
মাস্টার গঙ্গাস্নান করিতে গেলেন।
১ … ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। … নায়ং হন্তি ন হন্যতে। [গীতা, ২।১৯, ২০]
==========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পূর্বকথা — ৺কাশীধামে শিব ও সোনার অন্নপূর্ণাদর্শন — অদ্য ব্রহ্মাণ্ডকে শালগ্রাম রূপে দর্শন
বেলা দশটা বাজিয়াছে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে কথা কহিতেছেন। মাস্টার গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন ও কাছে বসিলেন।
ঠাকুর ভাবে পূর্ণ হইয়া কত কথাই বলিতেছেন। মাঝে মাঝে অতি গুহ্য দর্শনকথা একটু একটু বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সেজোবাবুর সঙ্গে যখন কাশী গিয়েছিলাম, মণিকর্ণিকার ঘাটের কাছ দিয়ে আমাদের নৌকা যাচ্ছিল। হঠাৎ শিবদর্শন। আমি নৌকার ধারে এসে দাঁড়িয়ে সমাধিস্থ। মাঝিরা হৃদেকে বলতে লাগল — ‘ধর! ধর!’ পাছে পড়ে যাই। যেন জগতের যত গম্ভির নিয়ে সেই ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে তারপর কাছে আসতে দেখলাম, তারপর আমার ভিতরে মিলিয়ে গেলেন!
“ভাবে দেখলাম, সন্ন্যাসী হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। একটি ঠাকুরবাড়িতে ঢুকলাম — সোনার অন্নপূর্ণাদর্শন হল!
“তিনিই এই সব হয়েছেন, — কোন কোন জিনিসে বেশি প্রকাশ।
(মাস্টারাদির প্রতি) — “শালগ্রাম তোমরা বুঝি মান না — ইংলিশম্যানরা মানে না। তা তোমরা মানো আর নাই মানো। সুলক্ষণ শালগ্রাম, — বেশ চক্র থাকবে, — গোমুখী। আর সব লক্ষণ থাকবে — তাহলে ভগবানের পূজা হয়।”
মাস্টার — আজ্ঞা, সুলক্ষণযুক্ত মানুষের ভিতর যেমন ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নরেন্দ্র আগে মনের ভুল বলত, এখন সব মানছে।
ঈশ্বরদর্শনের কথা বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবাবস্থা হইয়াছে। ভাব-সমাধিস্থ। ভক্তেরা একদৃষ্টে চুপ করিয়া দেখিতেছেন। অনেকক্ষণ পরে ভাব সম্বরণ করিলেন ও কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কি দেখছিলাম। ব্রহ্মাণ্ড একটি শালগ্রাম। — তার ভিতর তোমার দুটো চক্ষু দেখছিলাম!
মাস্টার ও ভক্তেরা এই অদ্ভুত, অশ্রুতপূর্ব দর্শনকথা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন। এই সময় আর-একটি ছোকরা ভক্ত, সারদা, প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সারদার প্রতি) — দক্ষিণেশ্বরে যাস না কেন? কলিকাতায় যখন আসি, তখন আসিস না কেন?
সারদা — আমি খবর পাই না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এইবার তোকে খবর দিব। (মাস্টারকে সহাস্যে) একখানা ফর্দ করো তো — ছোকরাদের। (মাস্টার ও ভক্তদের হাস্য)
[পূর্ণের সংবাদ — নরেন্দ্রদর্শনে ঠাকুরের আনন্দ ]
সারদা — বাড়িতে বিয়ে দিতে চায়। ইনি (মাস্টার) বিয়ের কথায় আমাদের কতবার বকেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখন বিয়ে কেন? (মাস্টারের প্রতি) সারদার বেশ অবস্থা হয়েছে। আগে সঙ্কোচ ভাব ছিল। যেন ছিপের ফাতা টেনে নিত। এখন মুখে আনন্দ এসেছে।
ঠাকুর একজন ভক্তকে বলিতেছেন, “তুমি একবার পূর্ণর জন্য যাবে?”
এইবার নরেন্দ্র আসিয়াছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে জল খাওয়াইতে বলিলেন। নরেন্দ্রকে দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছেন। নরেন্দ্রকে খাওয়াইয়া যেন সাক্ষাৎ নারায়ণের সেবা করিতেছেন। গায়ে হাত বুলাইয়া আদর করিতেছেন, যেন সূক্ষ্মভাবে হাত-পা টিপিতেছেন! গোপালের মা (‘কামারহাটির বামনী’) ঘরের মধ্যে আসিলেন। ঠাকুর বলরামকে কামারহাটিতে লোক পাঠাইয়া গোপালের মাকে আনিতে বলিয়াছিলেন। তাই তিনি আসিয়াছেন। গোপালের মা ঘরের মধ্যে আসিয়াই বলিতেছেন, “আমার আনন্দে চক্ষে জল পড়ছে।” এই বলিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া নমস্কার করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি গো। এই তুমি আমাকে গোপাল বল — আবার নমস্কার!
“যাও, বাড়ির ভিতর গিয়ে একটি বেন্নন রাঁধ গে — খুব ফোড়ন দিও — যেন এখানে পর্যন্ত গন্ধ আসে।” (সকলের হাস্য)
গোপালের মা — এঁরা (বাড়ির লোকেরা) কি মনে করবে?
গোপালের মা কি ভাবিতেছেন যে, এখানে নূতন এসেছি, — যদি আলাদা রাঁধব বলে বাড়ির লোকেরা কিছু মনে করে!
বাড়ির ভিতর যাইবার আগে তিনি নরেন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া কাতরস্বরে বলিতেছেন, “বাবা! আমার কি হয়েছে; না বাকী আছে?”
আজ রথযাত্রা — শ্রীশ্রীজগন্নাথের ভোগরাগাদি হইতে একটু দেরি হইয়াছে। এইবার ঠাকুর সেবা হইবে। অন্তঃপুরে যাইতেছেন। মেয়ে ভক্তেরা ব্যাকুল হইয়া আছেন, — তাঁহাকে দর্শন ও প্রণাম করিবেন।
ঠাকুরের অনেক স্ত্রীলোক ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁহাদের কথা পুরুষ ভক্তদের কাছে বেশী বলিতেন না। কেহ মেয়ে ভক্তদের কাছে যাতায়াত করিলে, বলিতেন, ‘বেশী যাস নাই; পড়ে যাবি!’ কখন কখন বলিতেন, ‘যদি স্ত্রীলোক ভক্তিতে গড়াগড়ি যায়, তবুও তার কাছে যাতায়াত করবে না।’ মেয়েভক্তেরা আলাদা থাকবে — পুরুষ-ভক্তেরা আলাদা থাকবে। তবেই উভয়ের মঙ্গল। আবার বলিতেন, “মেয়েভক্তদের গোপাল ভাব — ‘বাৎসল্য ভাব’ বেশি ভাল নয়। ওই ‘বাৎসল্য’ থেকেই আবার একদিন ‘তাচ্ছল্য’ হয়।”
===========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বলরামের রথযাত্রা — নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে
বেলা ১টা হইয়াছে। ঠাকুর আহারান্তে আবার বৈঠকখানা গরে আসিয়া ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। একটি ভক্ত পূর্ণকে ডাকিয়া আনিয়াছেন। ঠাকুর মহানন্দে মাস্টারকে বলিতেছেন, “এই গো! পূর্ণ এসেছে।” নরেন্দ্র, ছোট নরেন, নারাণ, হরিপদ ও অন্যান্য ভক্তেরা কাছে বসিয়া আছেন ও ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন।
[স্বাধীন ইচ্ছা (ফ্রি উইল) ও ছোট নরেন — নরেন্দ্রের গান ]
ছোট নরেন — আচ্ছা, আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা (ফ্রি উইল) আছে কি না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কে খোঁজ দেখি। আমি খুঁজতে খুঁজতে তিনি বেরিয়ে পড়েন! ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী’। চীনের পুতুল দোকানে চিঠি হাতে করে যায় শুনেছ! ঈশ্বরই কর্তা! আপনাকে অকর্তা জেনে কর্তার ন্যায় কাজ করো।
“যতক্ষণ উপাধি, ততক্ষণ অজ্ঞান; আমি পণ্ডিত, আমি জ্ঞানী, আমি ধনী, আমি মানী; আমি কর্তা বাবা গুরু — এ-সব অজ্ঞান থেকে হয়। ‘আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী’ — এই জ্ঞান। অন্য সব উপাধি চলে গেল। কাঠ পোড়া শেষ হলে আর শব্দ থাকে না — উত্তাপও থাকে না। সব ঠাণ্ডা! — শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ!
(নরেন্দ্রকে) “একটু গা না।”
নরেন্দ্র — ঘরে যাই — অনেক কাজ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বাছা, আমাদের কথা শুনবে কেন? ‘যার আছে কানে সোনা, তার কথা আনা আনা। যার আছে পোঁদে ট্যানা তার কথা কেউ শোনে না!’ (সকলের হাস্য)
তুমি গুহদের বাগান যেতে পারো। প্রায় শুনি, আজ কোথায়, না গুহদের বাগানে! — এ কথা বলতুম না, তুই কেঁড়েলি করলি –”
নরেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া আছেন। বলছেন, “যন্ত্র নাই শুধু গান –”
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমাদের বাছা যেমন অবস্থা — এইতে পার তো গাও। তাতে বলরামের বন্দোবস্ত!
“বলরাম বলে, ‘আপনি নৌকা করে আসবেন, একান্ত না হয় গাড়ি করে আসবেন’, — (সকলের হাস্য) খ্যাঁট দিয়েছে। আজ তাই বৈকালে নাচিয়ে নেবে (হাস্য)। একান থেকে একদিন গাড়ি করে দিছলো — বারো আনা ভাড়া; — আমি বললাম, বার আনায় দক্ষিণেশ্বরে যাবে? তা বলে, ‘ও অমন হয়।’ গাড়ি রাস্তায় যেতে যেতে একধার ভেঙে পড়ে গেল — (সকলের উচ্চ হাস্য)। আবার ঘোড়া মাঝে মাঝে একেবারে থেমে যায়। কোন মতে চলে না; গাড়োয়ান এক-একবার খুব মারে, আর এক-একবার দৌড়ায়! (উচ্চ হাস্য) তারপর রাম খোল বাজাবে — আর আমরা নাচব — রামের তালবোধ নাই। (সকলের হাস্য) বলরামের ভাব, আপনারা গাও, নাচো, আনন্দ করো। (সকলের হাস্য)
ভক্তেরা বাটী হইতে আহারাদি করিয়া ক্রমে ক্রমে আসিতেছেন।
মহেন্দ্র মুখুজ্জেকে দূর হইতে প্রণাম করিতে দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে প্রণাম করিতেছেন — আবার সেলাম করিতেছেন। কাছের রকটি ছোকরা ভক্তকে বলিতেছেন, ওকে বল্‌না ‘সেলাম করলে’, — ও বড় অলকট্‌ অলকট্‌ করে। (সকলের হাস্য) গৃহস্থ ভক্তেরা অনেকে নিজেদের বাটীর পরিবারদের আনিয়াছেন; — তাঁহারা শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করিবেন ও রথের সম্মুখে কীর্তনানন্দ দেখিবেন। রাম, গিরিশ প্রভৃতি ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে আসিয়াছেন। ছোকরা ভক্তেরা অনেকে আসিয়াছেন।
এইবার নরেন্দ্র গান গাইতেছেন:
(১) কত দিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার।
হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম,
নয়নে বহিবে প্রেম-অশ্রুধার ৷৷
(২) নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী ৷৷
বলরাম আজ কীর্তনের বন্দোবস্ত করিয়াছেন, — বৈষ্ণবচরণ ও বেনোয়ারীর কীর্তন। এইবার বৈষ্ণবচরণ গাহিতেছেন — শ্রীদুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার। দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে নিস্তার।
গান একটু শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ! দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ! — ছোট নরেন ধরিয়া আছেন। সহাস্যবদন। ক্রমে সব স্থির! একঘর ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। মেয়ে ভক্তেরা চিকের মধ্য হইতে দেখিতেছেন। সাক্ষাৎ নারায়ণ বুঝি দেহধারণ করিয়া ভক্তের জন্য আসিয়াছেন। কি করে ঈশ্বরকে ভালবাসতে হয়, তাই বুঝি শিখাতে এসেছেন!
নাম করিতে করিতে অনেকক্ষণ পরে সমাধিভঙ্গ হইল। ঠাকুর আসন গ্রহণ করিলে বৈষ্ণবচরণ আবার গান ধরিলেন:
(১) হরি হরি বল রে বীণে!
(২) বিফলে দিন যায় রে বীণে, শ্রীহরির সাধন বিনে।
এইবার আর এক কীর্তনীয়া, বেনোয়ারী, রূপ গাহিতেছেন। কিন্তু সদাই গান গাহিতে ‘আহা! আহা!’ বলিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করেন। তাহাতে শ্রোতারা কেহ হাসে, কেহ বিরক্ত হয়।
অপরাহ্ন হইয়াছে। ইতিমধ্যে বারান্দায় শ্রীশ্রীজগন্নাথের সেই ছোট রথখানি ধ্বজা পতাকা দিয়া সুসজ্জিত করিয়া আনা হইয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম চন্দনচর্চিত ও বসন-ভূষণ ও পুষ্পমালা দ্বারা সুশোভিত হইয়াছেন। ঠাকুর বেনোয়ারীর কীর্তন ফেলিয়া বারান্দায় রথাগ্রে গমন করিলেন, — ভক্তেরাও সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। রথের রজ্জু ধরিয়া একটু টানিলেন — তৎপরে রথাগ্রে ভক্তসঙ্গে নৃত্য ও কীর্তন করিতেছেন। অন্যান্য গানের সঙ্গে ঠাকুর পদ ধরিলেন:
যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে, তারা তারা দুভাই এসেছে রে!
যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে, তারা তারা দুভাই এসেছে রে!
আবার — নদে টলমল টলমল করে, গৌরপ্রেমে হিল্লোলে রে।
ছোট বারান্দাতে রথের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন ও নৃত্য হইতেছে। উচ্চ সংকীর্তন ও খোলের শব্দ শুনিয়া বাহিরের লোক অনেকে বারান্দা মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। ঠাকুর হরিপ্রেমে মাতোয়ারা। ভক্তেরাও সঙ্গে সঙ্গে প্রেমোন্মত্ত হইয়া নাচিতেছেন।
==========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

নরেন্দ্রের গান — ঠাকুরের ভাবাবেশে নৃত্য
রথাগ্রে কীর্তন ও নৃত্যের পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। মণি প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহার পদসেবা করিতেছেন।
নরেন্দ্র ভাবে পূর্ণ হইয়া তানপুরা লইয়া আবার গান গাহিতেছেন:
(১) এসো মা এসো মা, ও হৃদয়-রমা, পরাণ-পুতলী গো,
হৃদয়-আসনে, হও মা আসীন, নিরখি তোমারে গো।
(২) মা ত্বং হি তারা, তুমি ত্রিগুণধরা পরাৎপরা।
আমি জানি গো ও দীন-দয়াময়ী, তুমি দুর্গমেতে দুখহারা ৷৷
তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী, তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা।
তুমি অকূলের ত্রাণকর্ত্রী, সদাশিবের মনোরমা ৷৷
তুমি জলে, তুমি স্থলে, তুমি আদ্যমূলে গো মা।
তুমি সর্বঘটে অর্ঘপুটে, সাকার আকার নিরাকারা ৷৷
(৩) তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ-সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ৷৷
একজন ভক্ত নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, তুমি ওই গানটা গাইবে? —
অন্তরে জাগিছো গো মা অন্তরযামিনী!
শ্রীরামকৃষ্ণ — দূর! এখন ও-সব গান কি! এখন আনন্দের গান — ‘শ্যামা সুধা-তরঙ্গিণী।’
নরেন্দ্র গাইতেছেন:
কখন কি রঙ্গে থাক মা, শ্যামা, সুধা-তরঙ্গিনী!
তুমি রঙ্গে ভঙ্গে অপাঙ্গে অনঙ্গে ভঙ্গ দাও জননী ৷৷
ভাবোন্মত্ত হইয়া নরেন্দ্র বারবার গাইতে লাগিলেন:
কভু কমলে কমলে থাকো মা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী।
ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন, — ও গাইতেছেন, ওমা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী! অনেকক্ষণ নৃত্যের পর ঠাকুর আবার আসন গ্রহণ করিলেন। নরেন্দ্র ভাবাবিষ্ট হইয়া সাশ্রুনয়নে গান গাহিতেছেন দেখিয়া ঠাকুর অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন।
রাত্রি প্রায় নয়টা হইবে, এখনও ভক্তসঙ্গে ঠাকুর বসিয়া আছেন।
আবার বৈষ্ণবচরণের গান শুনিতেছেন।
(১) শ্রীগৌরাঙ্গ সুন্দর নটবর তপত কাঞ্চন কায়।
(২) চিনিব কেমনে হে তোমায় (হরি)।
ওহে বঙ্কুরায়, ভুলে আছ মথুরায় ৷৷
হাতিচড়া জোড়াপরা, ভুলেছ কি ধেনুচরা
ব্রজের মাখন চুরি করা, মনে কিছু হয়।
রাত্রি দশটা-এগারটা। ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় লইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, আর সব্বাই বাড়ি যাও — (নরেন্দ্র ও ছোট নরেনকে দেখাইয়া) এরা দুইজন থাকলেই হল! (গিরিশের প্রতি) তুমি কি বাড়ি গিয়ে খাবে? থাকো তো খানিক থাক। তামাক্‌! — ওহ বলরামের চাকরও তেমনি। ডেকে দেখ না — দেবে না। (সকলের হাস্য) কিন্তু তুমি তামাক খেয়ে যেও।
শ্রীযুক্ত গিরিশের সঙ্গে একটি চশমাপরা বন্ধু আসিয়াছেন। তিনি সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া চলিয়া গেলেন। ঠাকুর গিরিশকে বলিতেছেন, — “তোমাকে আর হরে প্যালাকে বলি, জোর করে কারুকে নিয়ে এসো না, — সময় না হলে হয় না।”
একটি ভক্ত প্রণাম করিলেন। সঙ্গে একটি ছেলে। ঠাকুর সস্নেহে কহিতেছেন — “তবে তুমি এসো — আবার উটি সঙ্গে।” নরেন্দ্র, ছোট নরেন, আর দু-একটি ভক্ত, আর একটু থাকিয়া বাটী ফিরিলেন।
==========

সপ্তম পরিচ্ছেদ

সুপ্রভাত ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — মধুর নৃত্য ও নামকীর্তন
শ্রীরামকৃষ্ণ বৈঠকখানার পশ্চিমদিকের ছোট ঘরে শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন। রাত ৪টা। ঘরের দক্ষিণে বারান্দা, তাহাতে একখানি টুল পাতা আছে। তাহার উপর মাস্টার বসিয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরেই ঠাকুর বারান্দায় আসিলেন। মাস্টার ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। সংক্রান্তি, বুধবার, ৩২শে আষাঢ়; ১৫ই জুলাই, ১৮৮৫।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি আর-একবার উঠেছিলাম। আচ্ছা, সকালবেলা কি যাব?
মাস্টার — আজ্ঞা, সকালবেলায় ঢেউ একটু কম থাকে।
ভোর হইয়াছে — এখনও ভক্তেরা আসিয়া জুটেন নাই। ঠাকুর মুখ ধুইয়া মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। পশ্চিমের ঘরটির উত্তর দরজার কাছে দাঁড়াইয়া নাম করিতেছেন। কাছে মাস্টার। কিয়ৎক্ষণ পরে অনতিদূরে গোপালের মা আসিয়া দাঁড়াইলেন। অন্তঃপরে দ্বারের অন্তরালে ২/১টি স্ত্রীলোক ভক্ত আসিয়া ঠাকুরকে দেখিতেছেন। যেন শ্রীবৃন্দাবনের গোপীরা শ্রীকৃষ্ণদর্শন করিতেছেন! অথবা নবদ্বীপের ভক্ত মহিলারা প্রেমোন্মত্ত হইয়া শ্রীগৌরাঙ্গকে আড়াল হইতে দেখিতেছেন।
রামনাম করিয়া ঠাকুর কৃষ্ণনাম করিতেচেন, কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! গোপীকৃষ্ণ! গোপী! গোপী! রাখালজীবন কৃষ্ণ! নন্দনন্দন কৃষ্ণ! গোবিন্দ! গোবিন্দ!
আবার গৌরাঙ্গের নাম করিতেছেন —
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ। হরেকৃষ্ণ হরে রাম, রাধে গোবিন্দ!
আবার বলিতেছেন, আলেখ নিরঞ্জন! নিরঞ্জন বলিয়া কাঁদিতেছেন। তাঁহার কান্না দেখিয়া ও কাতর স্বর শুনিয়া, কাছে দণ্ডায়মান ভক্তেরা কাঁদিতেছেন। তিনি কাঁদিতেছেন, আর বলিতেছেন, ‘নিরঞ্জন! আয় বাপ — খারে নেরে — কবে তোরে খাইয়ে জন্ম সফল করব! তুই আমার জন্য দেহধারণ করে নররূপে এসেছিস।’
জগন্নাথের কাছে আর্তি করিতেছেন — জগন্নাথ! জগবন্ধু! দীনবন্ধু! আমি তো জগৎছাড়া নই নাথ, আমায় দয়া কর!
প্রেমোন্মত্ত হইয়া গাহিতেছেন — “উড়িষ্যা জগন্নাথ ভজ বিরাজ জী!”
এইবার নারায়ণের নামকীর্তন করিতে করিতে নাচিতেছেন ও গাহিতেছেন — শ্রীমন্নারায়ণ! শ্রীমন্নারায়ণ! নারায়ণ! নারায়ণ!
নাচিতে নাচিতে আবার গান গাইতেছেন:
হলাম যার জন্য পাগল, তারে কই পেলাম সই।
ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব,
তিন পাগলে যুক্তি করে ভাঙলে নবদ্বীপ
আর এক পাগল দেখে এলাম বৃন্দাবনের মাঠে,
রাইকে রাজা সাজায়ে আপনি কোটাল সাজে!
এইবার ঠাকুর ভক্তসঙ্গে ছোট ঘরটিতে বসিয়াছেন। দিগম্বর! যেন পাঁচ বৎসরের বালক! মাস্টার, বলরাম আরও দুই-একটি বক্ত বসিয়া আছেন।
[রূপদর্শন কখন? গুহ্যকথা — শুদ্ধ-আত্মা ছোকরাতে নারায়ণদর্শন ]
(রামলালা, নিরঞ্জন, পূর্ণ, নরেন্দ্র, বেলঘরের তারক, ছোট নরেন)
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করা যায়! যখন উপাধি সব চলে যায়, — বিচার বন্ধ হয়ে যায়, — তখন দর্শন। তখন মানুষ অবাক্‌ সমাধিস্থ হয়। থিয়েটারে গিয়ে বসে লোকে কত গল্প করে, — এ-গল্প সে গল্প। যাই পর্দা উঠে যায় সব গল্প-টল্প বন্ধ হয়ে যায়। যা দেখে তাইতেই মগ্ন হয়ে যায়।
“তোমাদের অতি গুহ্যকতা বলছি। কেন পূর্ণ, নরেন্দ্র, এদের সব এত ভালবাসি। জগন্নাথের সঙ্গে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে গিয়ে হাত ভেঙে গেল। জানিয়ে দিলে, “তুমি শরীরধারণ করেছ — এখন নররূপের সঙ্গে সখ্য, বাৎসল্য এইসব ভাব লয়ে থাকো।”
“রামলালার উপর যা যা ভাব হত, তাই পূর্ণাদিকে দেখে হচ্ছে! রামলালাকে নাওয়াতাম, খাওয়াতাম, শোয়াতাম, –সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতাম, — রামলালার জন্য বসে বসে কাঁদতাম, ঠিক এই সব ছেলেদের নিয়ে তাই হয়েছে! দেখ না নিরঞ্জন। কিছুতেই লিপ্ত নয়। নিজের টাকা দিয়ে গরিবদের ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। বিবাহের কথায় বলে, ‘বাপরে! ও বিশালাক্ষীর দ!’ ওকে দেখি যে, একটা জ্যোতিঃর উপর বসে রয়েছে।
“পূর্ণ উঁচু সাকার ঘর — বিষ্ণুর অংশে জন্ম। আহা কি অনুরাগ!
(মাস্টারের প্রতি) — “দেখলে না, — তোমার দিকে চাইতে লাগল — যেন গুরুভাই-এর উপর — যেন ইনি আমার আপনার লোক! আর-একবার দেখা করবে বলেছে। বলে কাপ্তেনের ওখানে দেখা হবে।”
[নরেন্দ্রের কত গুণ — ছোট নরেণের গুণ ]
“নরেন্দ্রের খুব উঁচু ঘর — নিরাকারের ঘর। পুরুষের সত্তা।
“এতো ভক্ত আসছে, ওর মতো একটি নাই।
“এক-একবার বসে বসে খতাই। তা দেখি, অন্য পদ্ম কারু দশদল, কারু ষোড়শদল, কারু শতদল কিন্তু পদ্মমধ্যে নরেন্দ্র সহস্রদল!
“অন্যেরা কলসী, ঘটি এ-সব হতে পারে, — নরেন্দ্র জালা।
“ডোবা পুষ্করিণী মধ্যে নরেন্দ্র বড় দীঘি! যেমন হালদার-পুকুর।
“মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙাচক্ষু বড় রুই, আর সব নানারকম মাছ — পোনা, কাঠি বাটা, এই সব।
“খুব আধার, — অনেক জিনিস ধরে। বড় ফুটোওলা বাঁশ!
“নরেন্দ্র কিছুর বশ নয়। ও আসক্তি, ইন্দ্রিয়-সুখের বশ নয়। পুরুষ পায়রা। পুরুষ পায়রার ঠোঁট ধরলে ঠোঁট টেনে ছিনিয়ে লয়, — মাদী পায়রা চুপ করে থাকে।
“বেলঘরের তারককে মৃগেল বলা যায়।
“নরেন্দ্র পুরুষ, গাড়িতে তাই ডান দিকে বসে। ভবনাথের মেদী ভাব ওকে তাই অন্যদিকে বসতে দিই!
“নরেন্দ্র সভায় থাকলে আমার বল।”
শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে আসিয়া প্রণাম করিলেন। বেলা আটটা হইবে। হরিপদ, তুলসীরাম, ক্রমে আসিয়া প্রণাম করিয়া বসিলেন। বাবুরামের জ্বর হইয়াছে, — আসিতে পারেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারাদির প্রতি) — ছোট নরেন এলো না? মনে করেছে, আমি চলে গেছি। (মুখুজ্জের প্রতি) কি আশ্চর্য! সে (ছোট নরেন) ছেলেবেলায় স্কুল থেকে এসে ঈশ্বরের জন্য কাঁদত। (ঈশ্বরের জন্য) কান্না কি কমেতে হয়!
“আবার বুদ্ধি খুব। বাঁশের মধ্যে বড় ফুটোওলা বাঁশ!
“আর আমার উপর সব মনটা। গিরিশ ঘোষ বললে, নবগোপালের বাড়ি যেদিন কীর্তন হয়েছিল, সেদিন (ছোট নরেন) গিছিল, — কিন্তু ‘তিনি কই’ বলে আর হুঁশ নাই, — লোকের গায়ের উপর দিয়েই চলে যায়!
“আবার ভয় নাই — যে বাড়িতে বকবে। দক্ষিণেশ্বরে তিনরাত্রি সমানে থাকে।”
=========

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ভক্তিযোগের গূঢ় রহস্য — জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়
[মুখুজ্জে, হরিবাবু, পূর্ণ, নিরঞ্জন, মাস্টার, বলরাম ]
মুখুজ্জে — হরি (বাগবাজারের হরিবাবু) আপনার কালকের কথা শুনে অবাক্‌! বলে, ‘সাংখ্যদর্শনে, পাতঞ্জলে, বেদান্তে — ও-সব কথা আছে। ইনি সামান্য নন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ — কই, আমি সাংখ্য, বেদান্ত পড়ি নাই।
“পূর্ণজ্ঞান আর পূর্ণভক্তি একই। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে বিচারের শেষ হলে, ব্রহ্মজ্ঞান। — তারপর যা ত্যাগ করে গিছিল, তাই আবার গ্রহণ। ছাদে উঠবার সময় সাবধানে উঠতে হয়। তারপর দেখে যে, ছাদও যে জিনিসে — ইট-চুন-সুরকি — সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারী!
“যার উচ্চ বোধ আছে, তার নিচু বোধ আছে। জ্ঞানের পর, উপর নিচে এক বোধ হয়।
“প্রহ্লাদের যখন তত্ত্বজ্ঞান হত, ‘সোঽহম্‌’ হয়ে থাকতেন। যখন দেহবুদ্ধি আসত ‘দাসোঽহম্‌’, ‘আমি তোমার দাস’, এই ভাব আসত।
“হনুমানের কখনও ‘সোঽহম্‌’, কখন ‘দাস আমি’, কখন ‘আমি তোমার অংশ’, এই ভাব আসত।
“কেন ভক্তি নিয়ে থাকো? — তা না হলে মানুষ কি নিয়ে থাকে! কি নিয়ে দিন কাটায়।
“‘আমি’ তো যাবার নয়, ‘আমি’ ঘট থাকতে সোঽহম্‌ হয় না। সমাধিস্থ হলে ‘আমি’ পুছে যায়, — তখন যা আছে তাই। রামপ্রসাদ বলে, তারপর আমি ভাল কি তুমি ভাল, তা তুমিই জানবে।
“যতক্ষণ ‘আমি’ রয়েছে ততক্ষণ ভক্তের মতো থাকাই ভাল! ‘আমি ভগবান’ এটি ভাল না। হে জীব, ভক্তবৎ এটি ভাল না। হে জীব, ভক্তবৎ ন চ কৃষ্ণবৎ! — তবে যদি নিজে টেনে লন, তবে আলাদা কথা। যেমন মনিব চাকরকে ভালবেসে বলছে, আয় আয় কাছে বোস আমিও যা তুইও তা। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউয়ের গঙ্গা হয় না!
“শিবের দুই অবস্থা। যখন আত্মারাম তখন সোঽহম্‌ অবস্থা, — যোগেতে সব স্থির। যখন ‘আমি’ একটি আলাদা বোধ থাকে তখন ‘রাম! রাম!’ করে নৃত্য।
“যাঁর অটল আছে, তাঁর টলও আছে।
“এই তুমি স্থির। আবার তুমিই কিছুক্ষণ পরে কাজ করবে।
“জ্ঞান আর ভক্তি একই জিনিস। — তবে একজন বলছে ‘জল’, আর-একজন ‘জলের খানিকটা চাপ’।”
[দুই সমাধি — সমাধি প্রতিবন্ধক — কামিনী-কাঞ্চন ]
“সমাধি মোটামুটি দুইরকম। — জ্ঞানের পথে, বিচার করতে করতে অহং নাশের পর যে সমাধি, তাকে স্থিতসমাধি বা জড়সমাধি (নির্বিকল্পসমাধি) বলে। ভক্তিপথের সমাধিকে ভাবসমাধি বলে। এতে সম্ভোগের জন্য, আস্বাদনের জন্য, রেখার মতো একটু অহং থাকে। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলে এ-সব ধারণা হয় না।
“কেদারকে বললুম, কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছা হল, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দি, — কিন্তু পারলাম না। ভিতরে অঙ্কট-বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ, ঢুকতে পারলাম না। যেমন স্বয়ম্ভু লিঙ্গ কাশী পর্যন্ত জড়। সংসারে আসক্তি, — কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি, — থাকলে হবে না।
“ছোকরাদের ভিতর এখনও কামিনী-কাঞ্চন ঢোকে নাই; তাইতো ওদের অত ভালবাসি। হাজরা বলে, ‘ধনীর ছেলে দেখে, সুন্দর ছেলে দেখে, — তুমি ভালবাস’। তা যদি হয়, হরিশ, নোটো, নরেন্দ্র — এদের ভালবাসি কেন? নরেন্দ্রের ভাত নুন দে খাবার পয়সা জোটে না।
“ছোকরাদের ভিতর বিষয়বুদ্ধি এখনও ঢোকে নাই। তাই অন্তর অত শুদ্ধ।
“আর অনেকেই নিত্যসিদ্ধ। জন্ম থেকেই ঈশ্বরের দিকে টান। যেমন বাগান একটা কিনেছ। পরিষ্কার করতে করতে এক জায়গায় বসানো জলের কল পাওয়া গেল। একবারে জল কলকল করে বেরুচ্ছে।”
[পূর্ণ ও নিরঞ্জন — মাতৃসেবা — বৈষ্ণবদের মহোৎসবের ভাব ]
বলরাম — মহাশয়, সংসার মিথ্যা, একবারে জ্ঞান, পূর্ণের কেমন করে হল?
শ্রীরামকৃষ্ণ — জন্মান্তরীণ। পূর্ব পূর্ব জন্মে সব করা আছে। শরীরটাই ছোট হয়ে আবার বৃদ্ধ হয় — আত্মা সেইরূপ নয়।
“ওদের কেমন জান, — ফল আগে তারপর ফুল। আগে দর্শন, — তারপর গুণ-মহিমাশ্রবণ, তারপর মিলন!
“নিরঞ্জনকে দেখ — লেনাদেনা নাই। — যখন ডাক পড়বে যেতে পারবে। তবে যতক্ষণ মা আছে, মাকে দেখতে হবে। আমি মাকে ফুল চন্দন দিয়ে পূজা করতাম। সেই জগতের মা-ই মা হয়ে এসেছেন। তাই কারু শ্রাদ্ধ, — শেষে ঈষ্টের পূজা হয়ে পড়ে। কেউ মরে গেলে বৈষ্ণবদের মহোৎসব হয়, তারও এই ভাব।
“যতক্ষণ নিজের শরীরের খপর আছে ততক্ষণ মার খপর নিতে হবে। তাই হাজরাকে বলি, নিজের কাশি হলে মিছরি মরিচ করতে হয়, মরিচ-লবণের যোগাড় করতে হয়; যতক্ষণ এ-সব করতে হয়, ততক্ষণ মার খপরও নিতে হয়।
“তবে যখন নিজের শরীরের খপর নিতে পাচ্ছি না, — তখন অন্য কথা। তখন ঈশ্বরই সব ভার লন।
“নাবালক নিজের ভার নিতে পারে না। তাই তার অছি (Guardian) হয়। নাবালকের অবস্থা — যেমন চৈতন্যদেবের অবস্থা।”
মাস্টার গঙ্গাস্নান করিতে গেলেন।
==========

নবম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণের কুষ্ঠি — পূর্বকথা — ঠাকুরের ঈশ্বরদর্শন
[রাম, লক্ষ্মণ ও পার্থসারথি-দর্শন — ন্যাংটা পরমহংসমূর্তি ]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সেই ছোট ঘরে কথা কহিতেছেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে, বলরাম, তুলসী, হরিপদ, গিরিশ প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। গিরিশ ঠাকুরের কৃপা পাইয়া সাত-আট মাস যাতায়াত করিতেছেন। মাস্টার ইতিমধ্যে গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিয়াছেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহার কাছে বসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহার অদ্ভুত ঈশ্বর-দর্শনকথা একটু একটু বলিতেছেন।
“কালীঘরে একদিন ন্যাংটা আর হলধারী অধ্যাত্ম (রামায়ণ) পড়ছে। হঠাৎ দেখলাম নদী, তার পাশে বন, সবুজ রঙ গাছপালা, — রাম লক্ষ্মণ জাঙ্গিয়া পরা, চলে যাচ্ছেন। একদিন কুঠির সম্মুখে অর্জুনের রথ দেখলাম। — সারথির বেশে ঠাকুর বসে আছেন। সে এখনও মনে আছে।
“আর একদিন, দেশে কীর্তন হচ্ছে, — সম্মুখে গৌরাঙ্গমূর্তি।
“একজন ন্যাংটা সঙ্গে সঙ্গে থাকত — তার ধনে হাত দিয়ে ফচকিমি করতুম। তখন খুব হাসতুম। এ ন্যাংটোমূর্তি আমারই ভিতর থেকে বেরুত। পরমহংসমূর্তি, — বালকের ন্যায়।
“ঈশ্বরীয় রূপ কত যে দর্শন হয়েছে, তা বলা যায় না। সেই সময়ে বড় পেটের ব্যামো। ওই সকল অবস্থায় পেটের ব্যামো বড় বেড়ে যেত। তাই রূপ দেখলে শেষে থু-থু করতুম — কিন্তু পেছেনে গিয়ে ভূত পাওয়ার মতো আবার আমায় ধরত! ভাবে বিভোর হয়ে থাকতাম, দিনরাত কোথা দিয়ে যেত! তার পরদিন পেট ধুয়ে ভাব বেরুত!” (হাস্য)
গিরিশ (সহাস্যে) — আপনার কুষ্ঠি দেখছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — দ্বিতীয়ার চাঁদে জন্ম। আর রবি, চন্দ্র, বুধ — এছাড়া আর কিছু বড় একটা নাই।
গিরিশ — কুম্ভরাশি। কর্কট আর বৃষে রাম আর কৃষ্ণ; — সিংহে চৈতন্যদেব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দুটি সাধ ছিল। প্রথম — ভক্তের রাজা হব, দ্বিতীয় শুঁটকে সাধু হবো না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কুষ্ঠি — ঠাকুরের সাধন কেন — ব্রহ্মযোনিদর্শন ]
গিরিশ (সহাস্যে) — আপনার সাধন করা কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ভগবতী শিবের জন্য অনেক কঠোর সাধন করেছিলেন, — পঞ্চতপা, শীতকালে জলে গা বুড়িয়ে থাকা, সূর্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা!
“স্বয়ং কৃষ্ণ রাধাযন্ত্র নিয়ে অনেক সাধন করেছিলেন। যন্ত্র ব্রহ্মযোনি — তাঁরই পূজা ধ্যান! এই ব্রহ্মযোনি থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তি হচ্ছে।
“অতি গুহ্যকথা! বেলতলায় দর্শন হত — লকলক করত!”
[পূর্বকথা — বেলতলায় তন্ত্রের সাধন — বামনীর যোগাড় ]
“বেলতলায় অনেক তন্ত্রের সাধন হয়েছিল। বড়ার মাথা নিয়ে। আবার … আসন। বামনী সব যোগাড় করত।
(হরিপদর দিকে অগ্রসর হইয়া) — “সেই অবস্থায় ছেলেদের ধন, ফুল-চন্দন দিয়ে পূজা না করলে থাকতে পারতাম না।
“আর-একটি অবস্থা হত। যেদিন অহংকার করতুম, তারপরদিনই অসুখ হত।”
মাস্টার শ্রীমুখনিঃসৃত অশ্রুতপূর্ব বেদান্তবাক্য শুনিয়া অবাক্‌ হইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। ভক্তেরাও যেন সেই পূতসলিলা পতিতপাবনী শ্রীমুখনিঃসৃত ভাগবতগঙ্গায় স্নান করিয়া বসিয়া আছেন।
সকলে চুপ করিয়া আছেন।
তুলসী — ইনি হাসেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভিতরে হাসি আছে। ফল্গুনদীর উপরে বালি, — খুঁড়লে জল পাওয়া যায়।
(মাস্টারের প্রতি) — “তুমি জিহ্বা ছোল না! রোজ জিহ্বা ছুলবে।”
বলরাম — আচ্ছা, এঁর (মাস্টারের) কাছে পূর্ণ আপনার কথা অনেক শুনেছেন —
শ্রীরামকৃষ্ণ — আগেকার কথা — ইনি জানেন — আমি জানি না।
বলরাম — পূর্ণ স্বভাবসিদ্ধ। তবে এঁরা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — এঁরা হেতুমাত্র।
নয়টা বাজিয়াছে — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিবেন তাহার উদ্যোগ হইতেছে। বাগবাজারের অন্নপূর্ণার ঘাটে নৌকা ঠিক করা আছে। ঠাকুরকে ভক্তেরা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন।
ঠাকুর দুই-একটি ভক্তের সহিত নৌকায় গিয়া বসিলেন, গোপালের মা ওই নৌকায় উঠিলেন, — দক্ষিণেশ্বরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিয়া বৈকালে হাঁটিয়া কামারহাটি যাইবেন।
ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরের ঘরের ক্যাম্পখাটটি সারাইতে দেইয়া হইয়াছিল। সেখানিও নৌকায় তুলিয়া দেওয়া হইল। এই খাটখানিতে শ্রীযুক্ত রাখাল প্রায় শয়ন করিতেন।
আজ কিন্তু মঘা নক্ষত্র। যাত্রা বদলাইতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আগত শনিবারে বলরামের বাটীতে আবার শুভাগমন করিবেন।
==========

Post a Comment

0 Comments