অধর, ৺যদু মল্লিক ও ৺খেলাত ঘোষের বাটীতে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

চতুর্থ খণ্ড

অধর, ৺যদু মল্লিক ও ৺খেলাত ঘোষের বাটীতে

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২১শে জুলাই
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতা রাজপথে ভক্তসঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়ি করিয়া দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ি হইতে বাহির হইয়া কলিকাতা অভিমুখে আসিতেছেন। সঙ্গে রামলাল ও দু-একটি ভক্ত। ফটক হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলেন চারিটি ফজলি আম হাতে করিয়া মণি পদব্রজে আসিতেছেন। মণিকে দেখিয়া গাড়ি থামাইতে বলিলেন। মণি গাড়ির উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিলেন।

শনিবার, ২১শে জুলাই, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, (৬ই শ্রাবণ), আষাঢ় কৃষ্ণা প্রতিপদ, বেলা চারিটা। ঠাকুর অধরের বাড়ি যাইবেন, তৎপরে শ্রীযুক্ত যদু মল্লিকের বাটী, সর্বশেষে ৺খেলাৎ ঘোষের বাটী যাইবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি, সহাস্যে) — তুমিও এস না — আমরা অধরের বাড়ি যাচ্ছি।

মণি যে আজ্ঞা বলিয়া গাড়িতে উঠিলেন।

মণি ইংরেজী পড়িয়াছেন, তাই সংস্কার মানিতেন না, কিন্তু কয়েকদিন হইল ঠাকুরের নিকটে স্বীকার করিয়া গিয়াছিলেন যে, অধরের সংস্কার ছিল তাই তিনি অত তাঁহাকে ভক্তি করেন। বাটীতে ফিরিয়া গিয়া ভাবিয়া দেখিলেন যে, সংস্কার সম্বন্ধে এখনও তাঁহার পূর্ণ বিশ্বাস হয় নাই। তাই ওই কথা বলিবার জন্যই আজ ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, অধরকে তোমার কিরূপ মনে হয়?

মণি — আজ্ঞে, তাঁর খুব অনুরাগ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — অধরও তোমার খুব সুখ্যাতি করে।

মণি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া আছেন; এইবার পূর্বজন্মের কথা উত্থাপন করিতেছেন।

[কিছু বুঝা যায় না — অতি গুহ্যকথা ]

মণি — আমার ‘পূর্বজন্ম’ ও ‘সংস্কার’ এ-সব তাতে তেমন বিশ্বাস নাই; এতে কি আমার ভক্তির কিছু হানি হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে এই বিশ্বাস থাকলেই হল; আমি যা ভাবছি — তাই সত্য; আর সকলের মত মিথ্যা; এরূপ ভাব আসতে দিও না। তারপর তিনিই বুঝিয়ে দিবেন।

“তাঁর কাণ্ড মানুষে কি বুঝবে? অনন্ত কাণ্ড! তাই আমি ও-সব বুঝতে আদপে চেষ্টা করি না। শুনে রেখেছি তাঁর সৃষ্টিতে সবই হতে পারে। তাই ও-সব চিন্তা না করে কেবল তাঁরই চিন্তা করি। হনুমানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি, হনুমান বলেছিল, ‘আমি তিথি নক্ষত্র জানি না, কেবল এক রাম চিন্তা করি।’

“তাঁর কাণ্ড কি কিছু বুঝা যায় গা! কাছে তিনি — অথচ বোঝবার জো নাই, বলরাম কৃষ্ণকে ভগবান বলে জানতেন না।”

মণি — আজ্ঞা হাঁ! আপনি ভীষ্মদেবের কথা যেমন বলেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হাঁ, কি বলেছিলাম বল দেখি।

মণি — ভীষ্মদেব শরশয্যায় কাঁদছিলেন, পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ভাই, একি আশ্চর্য! পিতামহ এত জ্ঞানী, অথচ মৃত্যু ভেবে কাঁদছেন! শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা কর না, কেন কাঁদছেন! ভীষ্মদেব বললেন, এই ভেবে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না! হে কৃষ্ণ, তুমি এই পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে ফিরছ, পদে পদে রক্ষা করছ, তবু এদের বিপদের শেষ নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর মায়াতে সব ঢেকে রেখেছেন — কিছু জানতে দেন না। কামিনী-কাঞ্চন মায়া। এই মায়াকে সরিয়ে যে তাঁকে দর্শন করে সেই তাঁকে দেখতে পায়। একজনকে বোঝাতে বোঝাতে (ঈশ্বর একটি আশ্চর্য ব্যাপার) দেখালেন, হঠাৎ সামনে দেখলাম, দেশের (কামারপুকুরের) একটি পুকুর, আর-একজন লোক পানা সরিয়ে যেন জলপান করলে। জলটি স্ফটিকের মতো। দেখালে যে, সেই সচ্চিদানন্দ মায়ারূপ পানাতে ঢাকা, — যে সরিয়ে জল খায় সেই পায়।

“শুন, তোমায় অতি গুহ্য কথা বলছি! ঝাউতলার দিকে বাহ্যে করতে করতে দেখলাম — চোর কুঠরির দরজার মতো একটা সামনে, কুঠরির ভিতর কি আছে দেখতে পাচ্ছি না। আমি নরুন দিয়ে ছেঁদা করতে লাগলাম, কিন্তু পারলুম না। ছেঁদা করি কিন্তু আবার পুরে আসে! তারপর একবার এতখানি ছেঁদা হল!”

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। এইবার আবার কথা কহিতেছেন, “এ-সব বড় উঁচু কথা — ওই দেখ আমার মুখ কে যেন চেপে চেপে ধরছে!

“যোনিতে বাস স্বচক্ষে দেখলাম! — কুকুর-কুক্কুরীর মৈথুন সময়ে দেখেছিলাম।

“তাঁর চৈতন্যে জগতের চৈতন্য। এক-একবার দেখি, ছোট ছোট মাছের ভিতর সেই চৈতন্য কিলবিল করছে!”

গাড়ি শোভাববাজারের চৌমাথায় দরমাহাটার নিকট উপস্থিত হইল। ঠাকুর আবার বলিতেছেন:

“এক-একবার দেখি বরষায় যেরূপ পৃথিবী জরে থাকে, — সেইরূপ এই চৈতন্যতে জগৎ জরে রয়েছে।

“কিন্তু এত তো দেখা হচ্ছে, আমার কিন্তু অভিমান হয় না।”

মণি (সহাস্যে) — আপনার আবার অভিমান!

শ্রীরামকৃষ্ণ — মাইরি বলছি, আমার যদি একটুও অভিমান হয়।

মণি — গ্রীস দেশে একটি লোক ছিলেন, তাঁহার নাম সক্রেটিস। দৈববাণী হয়েছিল যে, সকল লোকের মধ্যে তিনি জ্ঞানী। সে ব্যক্তি অবাক্‌ হয়ে গেল। তখন নির্জনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারলে। তখন সে বন্ধুদের বললে, আমিই কেবল বুঝেছি যে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু অন্যান্য সকল লোকে বলছে, “আমাদের বেশ জ্ঞান হয়েছে।” কিন্তু বস্তুতঃ সকলেই অজ্ঞান।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি এক-একবার ভাবি যে, আমি কি জানি যে এত লোকে আসে! বৈষ্ণবচরণ খুব পণ্ডিত ছিল। সে বলত, তুমি যে-সব কথা বল সব শাস্ত্রে পাওয়া যায়, তবে তোমার কাছে কেন আসি জানো? তোমার মুখে সেইগুলি শুনতে আসি।

মণি — সব কথা শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে। নবদ্বীপ গোস্বামীও সেদিন পেনেটীতে সেই কথা বলছিলেন। আপনি বললেন যে, “গীতা গীতা” বলতে বলতে “ত্যাগী ত্যাগী” হয়ে যায়। বস্তুতঃ তাগী হয়, কিন্তু নবদ্বীপ গোস্বামী বললেন, ‘তাগী’ মানেও যা ‘ত্যাগী’ মানেও তা, তগ্‌ ধাতু একটা আছে তাই থেকে ‘তাগী’ হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার সঙ্গে কি আর কারু মেলে? কোন পণ্ডিত, কি সাধুর সঙ্গে?

ণি — আপনাকে ঈশ্বর স্বয়ং হাতে গড়েছেন। অন্য লোকদের কলে ফেলে তয়ের করেছেন — যেমন আইন অনুসারে সব সৃষ্টি হচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — (সহাস্যে রামলালাদিকে) — ওরে, বলে কিরে!

ঠাকুরের হাস্য আর থামে না। অবশেষে বলিতেছেন, মাইরি বলছি, আমার যদি একটুও অভিমান হয়।

মণি — বিদ্যাতে একটা উপকার হয়, এইটি বোধ হয় যে, আমি কিছু জানি না, আর আমি কিছুই নই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক ঠিক। আমি কিছুই নই! — আমি কিছুই নই! — আচ্ছা, তোমার ইংরেজী জ্যোতিষে বিশ্বাস আছে?

মণি — ওদের নিয়ম অনুসারে নূতন আবিষ্ক্রিয়া (Discovery) হতে পারে, ইউরেনাস (Uranus) গ্রহের এলোমেলো চলন দেখে দূরবীন দিয়ে সন্ধান করে দেখলে যে, নূতন একটি গ্রহ (Neptune) জ্বলজ্বল করছে। আবার গ্রহণ গণনা হতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হয়ে বটে।

গাড়ি চলিতেছে, — প্রায় অধরের বাড়ির নিকট আসিল। ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন:

“সত্যেতে থাকবে, তাহলেই ইশ্বরলাভ হবে।”

মণি — আর-একটি কথা আপনি নবদ্বীপ গোস্বামীকে বলেছিলেন, “হে ঈশ্বর! আমি তোমায় চাই। দেখো, যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ার ঐশ্বর্যে মুগ্ধ করো না! — আমি তোমায় চাই।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ওইটি আন্তরিক বলতে হবে।
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২১শে জুলাই

শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে কীর্তনানন্দে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি আসিয়াছেন। রামলাল, মাস্টার, অধর আর অন্য অন্য ভক্ত তাঁহার কাছে অধরের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। পাড়ার দু-চারিটি লোক ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন। রাখালের পিতা কলিকাতায় আছেন — রাখাল সেইখানেই আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি) — কই রাখালকে খবর দাও নাই?

অধর — আজ্ঞে হাঁ, তাঁকে খবর দিয়াছি।

রাখালের জন্য ঠাকুরকে ব্যস্ত দেখিয়া অধর দ্বিরুক্তি না করিয়া রাখালকে আনিতে একটি লোক সঙ্গে নিজের গাড়ি পাঠাইয়া দিলেন।

অধর ঠাকুরের কাছে বসিলেন। আজ ঠাকুরকে দর্শনজন্য অধর ব্যাকুল হইয়াছেন। ঠাকুরের এখানে আসিবার কথা পূর্বে কিছু ঠিক ছিল না। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি আসিয়া পড়িয়াছেন।

অধর — আপনি অনেকদিন আসেন নাই। আমি আজ ডেকেছিলাম, — এমন কি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রসন্ন হইয়া, সহাস্যে) — বল কি গো!

সন্ধ্যা হইয়াছে। বৈঠকখানায় আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর জোড় হস্তে জগন্মাতাকে প্রণাম করিয়া নিঃশব্দে বুঝি মূলমন্ত্র করিলেন। তৎপরে মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। বলিতেছেন, গোবিন্দ, গোবিন্দ, সচ্চিদানন্দ, হরিবোল! হরিবোল! নাম করিতেছেন, আর যেন মধু বর্ষণ হইতেছে। ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া সেই নাম-সুধা পান করিতেছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল এইবার গান গাইতেছেন:

ভুবন ভুলাইলি মা, হরমোহিনী।
মূলাধারে মহোৎপলে, বীণাবাদ্য-বিনোদিনী।
শরীর শারীর যন্ত্রে সুষুম্নাদি ত্রয় তন্ত্রে,
গুণভেদ মহামন্ত্রে গুণত্রয়বিভাগিনী ৷৷
আধারে ভৈরবাকার ষড়দলে শ্রীরাগ আর,
মণিপুরেতে মহ্লার, বসন্তে হৃৎপ্রকাশিনী
বিশুদ্ধ হিল্লোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে,
তান লয় মান সুরে, তিন গ্রাম-সঞ্চারিণী।
মহামায়া মোহপাশে, বদ্ধ কর অনায়াসে,
তত্ত্ব লয়ে তত্ত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী।
শ্রীনন্দকুমারে কয়, তত্ত্ব না নিশ্চয় হয়,
তব তত্ত্ব গুণত্রয়, কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী।

রামালাল আবার গাইলেন:

ভবদারা ভয়হরা নাম শুনেছি তোমার,
তাইতে এবার দিয়েছি ভার তারো তারো না তারো মা।
তুমি মা ব্রহ্মাণ্ডধারী ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিকে,
কে জানে তোমারে তুমি কালী কি রাধিকে,
ঘটে ঘটে তুমি ঘটে আছ গো জননী,
মূলাধার কমলে থাক মা কুলকুণ্ডলিনী।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নামে স্বাধিষ্ঠান,
চতুর্দল পদ্মে তথায় আছ অধিষ্ঠান,
চর্তুদলে থাক তুমি কুলকুণ্ডলিনী,
ষড়দল বজ্রাসনে বস মা আপনি।
তদূর্ধ্বেতে নাভিস্থান মা মণিপুর কয়,
নীলবর্ণের দশদল পদ্ম যে তথায়,
সুষুম্নার পথ দিয়ে এস গো জননী,
কমলে কমলে থাক কমলে কামিনী।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো সুধা সরোবর,
রক্তবর্ণের দ্বাদশদল পদ্ম মনোহর,
পাদপদ্মে দিয়ে যদি এ পদ্ম প্রকাশ।
(মা), হৃদে আছে বিভাবরী তিমির বিনাশ।
তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নাম কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের পদ্ম আছে হয়ে ষোড়শদল।
সেই পদ্ম মধ্যে আছে অম্বুজে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ।
তদূর্ধ্বে ললাটে স্থান মা আছে দ্বিদল পদ্ম,
সদায় আছয়ে মন হইয়ে আবদ্ধ।
মন যে মানে না আমার মন ভাল নয়,
দ্বিদলে বসিয়া রঙ্গ দেখয়ে সদায়।
তদূর্ধ্বে মস্তকে স্থান মা অতি মনোহর,
সহস্রদল পদ্ম আছে তাহার ভিতর।
তথায় পরম শিব আছেন আপনি,
সেই শিবের কাছে বস শিবে মা আপনি।
তুমি আদ্যাশক্তি মা জিতেন্দ্রিয় নারী,
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ভাবে নগেন্দ্র কুমারী।
হর শক্তি হর শক্তি সুদনের এবার,
যেন না আসিতে হয় মা ভব পারাবার।
তুমি আদ্যাশক্তি মাগো তুমি পঞ্চতত্ত্ব,
কে জানে তোমারে তুমি তুমিই তত্ত্বাতীত।
ওমা ভক্ত জন্য চরাচরে তুমি সে সাকার,
পঞ্চে পঞ্চ লয় হলে তুমি নিরাকার।

[নিরাকার সচ্চিদানন্দ দর্শন — ষট্‌চক্রভেদ — নাদভেদ ও সমাধি ]

শ্রীযুক্ত রামলাল যখন গাহিতেছেন:

“তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো নাম কণ্ঠস্থল,
ধূম্রবর্ণের পদ্ম আছে হয়ে ষোড়শদল।
সেই পদ্ম মধ্যে আছে অম্বুজে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ।”

তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন —

“এই শুন, এরই নাম নিরাকার সচ্চিদানন্দ-দর্শন। বিশুদ্ধচক্র ভেদ হলে সকলি আকাশ।”

মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এই মায়া-জীব-জগৎ পার হয়ে গেলে তবে নিত্যতে পৌঁছানো যায়। নাদ ভেদ হলে তবে সমাধি হয়। ওঁকার সাধন করতে করতে নাদ ভেদ হয়, আর সমাধি হয়।
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২১শে জুলাই

যদু মল্লিকের বাড়ি — সিংহবাহিনী সম্মুখে — ‘সমাধিমন্দিরে’

অধরের বাটিতে অধর ঠাকুরকে ফলমূল মিষ্টান্নাদি দিয়া সেবা করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, আজ যদু মল্লিকের বাড়ি যাইতে হইবে।

ঠাকুর যদু মল্লিকের বাটী আসিয়াছেন। আজ আষাঢ় কৃষ্ণ প্রতিপদ, রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী। যে-ঘরে ৺সিংহবাহিনীর নিত্যসেবা হইতেছে ঠাকুর সেই ঘরে ভক্তসঙ্গে উপস্থিত হইলেন। মা সচন্দন পুষ্প ও পুষ্প-মালা দ্বারা অর্চিত হইয়া অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছেন। সম্মুখে পুরোহিত উপবিষ্ট। প্রতিমার সম্মুখে ঘরে আলো জ্বলিতেছে। সাঙ্গোপাঙ্গের মধ্যে একজনকে ঠাকুর টাকা দিয়া প্রণাম করিতে বলিলেন; কেননা ঠাকুরের কাছে আসিলে কিছু প্রণামী দিতে হয়।

ঠাকুর সিংহবাহিনীর সম্মুখে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। পশ্চাতে ভক্তগণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

ঠাকুর অনেকক্ষণ ধরিয়া দর্শন করিতেছেন।

কি আশ্চর্য, দর্শন করিতে করিতে একেবারে সমাধিস্থ। প্রস্তরমূর্তির ন্যায় নিস্তব্ধভাবে দণ্ডায়মান। নয়ন পলকশূন্য!

অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। সমাধি ভঙ্গ হইল। যেন নেশায় মাতোয়ারা হইয়া বলিতেছেন, মা, আসি গো!

কিন্তু চলিতে পারিতেছেন না — সেই একভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।

তখন রামলালকে বলিতেছেন — “তুমি ওইটি গাও — তবে আমি ভাল হব।”

রামলাল গাহিতেছেন, ভুবন ভুলাইলি মা হরমোহিনী।

গান সমাপ্ত হইল।

এইবার ঠাকুর বৈঠকখানার দিকে আসিতেছেন — ভক্তসঙ্গে। আসিবার সময় মাঝে একবার বলিতেছেন, মা, আমার হৃদয়ে থাক মা।

শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক স্বজনসঙ্গে বৈঠকখানায় বসিয়া। ঠাকুর ভাবেই আছেন, আসিয়া গাহিতেছেন:

গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ করো না।
গান সমাপ্ত হইলে আবার ভাবোন্মত্ত হইয়া যদুকে বলিতেছেন, “কি বাবু, কি গাইব? ‘মা আমি কি আটাশে ছেলে’ — এই গানটি কি গাইব?” এই বলিয়া ঠাকুর গাহিতেছেন:

মা আমি কি আটাশে ছেলে।
আমি ভয় করিনে চোখ রাঙালে ৷৷
সম্পদ আমার ও রাঙাপদ শিব ধরেন যা হৃৎকমলে।
আমার বিষয় চাইতে গেলে বিড়ম্বনা কতই ছলে ৷৷
শিবের দলিল সই রেখেছি হৃদয়েতে তুলে।
এবার করব নালিশ নাথের আগে, ডিক্রি লর এক সওয়ালে ৷৷
জানাইব কেমন ছেলে মোকদ্দমায় দাঁড়াইলে।
যখন গুরুদত্ত দস্তাবিজ, গুজরাইব মিছিল চালে ৷৷
মায়ে-পোয়ে মোকদ্দমা, ধুম হবে রামপ্রসাদ বলে।
আমি ক্ষান্ত হব যখন আমায় শান্ত করে লবে কোলে ৷৷

ভাব একটু উপশম হইলে বলিতেছেন, “আমি মার প্রসাদ খাব।”

৺সিংহবাহিনীর প্রসাদ আনিয়া ঠাকুরকে দেওয়া হইল।

শ্রীযুক্ত যদু মল্লিক বসিয়া আছেন। কাছে কেদারায় কতকগুলি বন্ধুবান্ধব বসিয়াছেন; তন্মধ্যে কতকগুলি মোসাহেবও আছেন।

যদু মল্লিকের দিকে সম্মুখ করিয়া ঠাকুর চেয়ারে বসিয়াছেন ও সহাস্যে কথা কহিতেছেন। ঠাকুরের সঙ্গী ভক্ত কেউ কেউ পাশের ঘরে, মাস্টার ও দুই একটি ভক্ত ঠাকুরের কাছে বসিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আচ্ছা, তুমি ভাঁড় রাখ কেন?

যদু (সহাস্যে) — ভাঁড় হলেই বা, তুমি উদ্ধার করবে না!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — গঙ্গা মদের কুপোকে পারে না!

[সত্যকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণ — “পুরুষের এককথা” ]

যদু ঠাকুরের কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, বাটীতে চন্ডীর গান দিবেন। অনেকদিন হইয়া গেল চন্ডীর গান কিন্তু হয় নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কই গো, চন্ডীর গান?

যদু — নানা কাজ ছিল তাই এতদিন হয় নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি! পুরুষ মানুষের এককথা!

“পুরুষ কি বাত, হাতি কি দাঁত।

“কেমন, পুরুষের এককথা, কি বল?”

যদু (সহাস্যে) — তা বটে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি হিসাবী লোক। অনেক হিসাব করে কাজ কর, — বামুনের গড্ডী খাবে কম, নাদবে বেশি, আর হুড়হুড় করে দুধ দেবে! (সকলের হাস্য)

ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ পরে যদুকে বলিতেছেন, বুঝেছি, তুমি রামজীবনপুরের শীলের মতো — আধখানা গরম, আধখানা ঠাণ্ডা। তোমার ঈশ্বরেতেও মন আছে, আবার সংসারেও মন আছে।

ঠাকুর দু-একটি ভক্তসঙ্গে যদুর বাটীতে ক্ষীর প্রসাদ, ফলমূল, মিষ্টান্নাদি খাইলেন। এইবারে ৺খেলাৎ ঘোষের বাড়ি যাইবেন।
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২১শে জুলাই

৺খেলাৎ ঘোষের বাটীতে শুভাগমন — বৈষ্ণবকে শিক্ষা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ৺খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে প্রবেশ করিতেছেন। রাত্রি ১০টা হইবে। বাটী ও বাটীর বৃহৎ প্রাঙ্গণ চাঁদের আলোতে আলোকময় হইয়াছে। বাটীতে প্রবেশ করিতে করিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। সঙ্গে রামলাল, মাস্টার, আর দু-একটি ভক্ত। বৃহৎ চকমিলান বৈঠকখানাবাড়ি, দ্বিতলায় উঠিয়া বারান্দা দিয়া একবার দক্ষিণে অনেকটা গিয়া, তারপর পূর্বদিকে আবার উত্তরাস্য হইয়া অনেকটা আসিয়া অন্তঃপুরের দিকে যাইতে হয়।

ওইদিকে আসিতে বোধ হইল যেন বাটীতে কেহ নাই, কেবল কতকগুলি বড় বড় ঘর ও সম্মুখে দীর্ঘ বারান্দা পড়িয়া আছে।

ঠাকুরকে উত্তর-পূর্বের একটি ঘরে বসানো হইল, এখনও ভাবস্থ। বাটীর যে ভক্তটি তাঁহাকে আহ্বান করিয়া আনিয়াছেন, তিনি আসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন। তিনি বৈষ্ণব, অঙ্গে তিলকাদি ছাপ ও হাতে হরিনামের ঝুলি। লোকটি প্রাচীণ। তিনি খেলাৎ ঘোষের সম্বন্ধী। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে মাঝে মাঝে গিয়া দর্শন করিতেন। কিন্তু কোন কোন বৈষ্ণবের ভাব অতি সঙ্কীর্ণ। তাঁহারা শাক্ত বা জ্ঞানীদিগের বড় নিন্দা করিয়া থাকেন। ঠাকুর এবার কথা কহিতেছেন।

[ঠাকুরের সর্বধর্ম-সমন্বয় — The Religion of Love]

শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈষ্ণবভক্ত ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল — এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে — একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি — হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, — কিন্তু বস্তু এক। মত — পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, — ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।

“বেদ-পুরাণ-তন্ত্রে, প্রতিপাদ্য একই সচ্চিদানন্দ। বেদে সচ্চিদানন্দ (ব্রহ্ম)। পুরাণেও সচ্চিদানন্দ (কৃষ্ণ, রাম প্রভৃতি)। তন্ত্রেও সচ্চিদানন্দ (শিব)। সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ, সচ্চিদানন্দ শিব।”

সকলে চুপ করিয়া আছেন।

বৈষ্ণবভক্ত — মহাশয়, ঈশ্বরকে ভাববই বা কেন?

[বৈষ্ণবকে শিক্ষা — জীবন্মুক্ত কে? উত্তম ভক্ত কে? ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ-বোধ যদি থাকে, তাহলে তো জীবন্মুক্ত। কিন্তু সকলের এটি বিশ্বাস নাই, কেবল মুখে বলে। ঈশ্বর আছেন, তাঁর ইচ্ছায় এ-সমস্ত হচ্ছে, বিষয়ীরা শুনে রাখে — বিশ্বাস করে না।

“বিষয়ীর ঈশ্বর কেমন জান? খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে ছেলেরা যেমন যেমন ঝগড়া করতে করতে বলে, আমার ঈশ্বর আছেন।

“সব্বাই কি তাঁকে ধরতে পারে? তিনি ভাল লোক করেছেন, মন্দ লোক করেছেন, ভক্ত করেছেন, অভক্ত করেছেন — বিশ্বাসী করেছেন, অবিশ্বাসী করেছেন। তাঁর লীলার ভিতর সব বিচিত্রতা, তাঁর শক্তি কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ। সূর্যের আলো মৃত্তিকার চেয়ে জলে বেশি প্রকাশ, আবার জল অপেক্ষা দর্পণে বেশি প্রকাশ।

“আবার ভক্তদের ভিতর থাক থাক আছে, উত্তম ভক্ত, মধ্যম ভক্ত, অধম ভক্ত। গীতাতে এ-সব আছে।”

বৈষ্ণবভক্ত — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — অধম ভক্ত বলে, ঈশ্বর আছেন — ওই আকাশের ভিতর অনেক দূরে। মধ্যম ভক্ত বলে, ঈশ্বর সর্বভূতে চৈতন্যরূপে — প্রাণরূপে আছেন। উত্তম ভক্ত বলে, ঈশ্বরই নিজে সব হয়েছেন, যা কিছু দেখি ঈশ্বরের এক-একটি রূপ। তিনিই মায়া, জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন — তিনি ছাড়া আর কিছু নাই।

বৈষ্ণবভক্ত — এরূপ অবস্থা কি কারু হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে দর্শন না করলে এরূপ অবস্থা হয় না, কিন্তু দর্শন করেছে কিনা তার লক্ষণ আছে। কখনও সে উন্মাদবৎ — হাঁসে কাঁদে নাচে গায়। কখনও বা বালকবৎ — পাঁচ বৎসরের বালকের অবস্থা। সরল, উদার, অহংকার নাই, কোন জিনিসে আসক্তি নাই, কোন গুণের বশ নয়, সদা আনন্দময়। কখনও পিশাচবৎ — শুচি-অশুচি ভেদবুদ্ধি থাকে না, আচার-অনাচার এক হয়ে যায়! কখনও বা জড়বৎ, কি জেন দেখেছে! তাই কোনরূপ কর্ম করতে পারে না — কোনরূপ চেষ্টা করতে পারে না।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি নিজের অবস্থা সমস্ত ইঙ্গিত করিতেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈষ্ণবভক্তের প্রতি) — “তুমি আর তোমার” — এইটি জ্ঞান। “আমি আর আমার” — এইটি অজ্ঞান।

“হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আর আমি অকর্তা — এইটি জ্ঞান। হে ইশ্বর, তোমার সমস্ত — দেহ, মন, গৃহ, পরিবার, জীব, জগৎ — এ-সব তোমার, আমার কিছু নয় — এইটির নাম জ্ঞান।

“যে অজ্ঞান সেই বলে, ঈশ্বর ‘সেথায় সেথায়’, — অনেক দূরে। যে জ্ঞানী, সে জানে ঈশ্বর ‘হেথায় হেথায়’ — অতি নিকটে, হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামীরূপে, আবার নিজে এক-একটি রূপ ধরে রয়েছেন।”
==============

Post a Comment

0 Comments