দক্ষিণেশ্বরে মণি, বলরাম প্রভৃতি সঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

তৃতীয় খণ্ড
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺বিজয়াদিবসে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

তৃতীয় খণ্ড শ্রীরামকৃষ্ণ ৺বিজয়াদিবসে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮২, ২২শে অক্টোবর
চিন্ময়ী মুর্তি ধ্যান-মাতৃধ্যান 
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বিরাজ করিতেছেন। বেলা ৯টা হইবে — ছোট খাটটিতে বিশ্রাম করিতেছেন, মেঝেতে মণি বসিয়া আছেন। তাঁহার সহিত কথা কহিতেছেন।

আজ বিজয়া, রবিবার, ২২শে অক্টোবর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, আশ্বিন শুক্লা দশমী তিথি (৬ই কার্তিক, ১২৮৯)। আজকাল রাখাল ঠাকুরের কাছে আছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ মাঝে মাঝে যাতায়াত করেন। ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত রামলাল ও হাজরা মহাশয় বাস করিতেছেন। রাম, মনোমহন, সুরেশ, মাস্টার, বলরাম ইঁহারাও প্রায় প্রতি সপ্তাহে — ঠাকুরকে দর্শন করিয়া যান। বাবুরাম সবে দু-একবার দর্শন করিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার পূজার ছুটি হয়েছে?

মণি — আজ্ঞা হাঁ। আমি সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার দিনে কেশব সেনের বাড়িতে প্রত্যহ গিছলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বল কি গো!

মণি — দুর্গাপূজার বেশ ব্যাখ্যা শুনেছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল দেখি।

মণি — কেশব সেনের বাড়িতে রোজ সকালে উপাসনা হয়, — দশটা-এগারটা পর্যন্ত। সেই উপাসনার সময় তিনি দুর্গাপূজার ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বললেন, যদি মাকে পাওয়া যায় — যদি মা-দুর্গাকে কেউ হৃদয়মন্দিরে আনতে পারে — তাহলে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আপনি আসেন। লক্ষ্মী অর্থাৎ ঐশ্বর্য, সরস্বতী অর্থাৎ জ্ঞান, কার্তিক অর্থাৎ বিক্রম, গণেশ অর্থাৎ সিদ্ধি — এ-সব আপনি হয়ে যায় — মা যদি আসেন।

[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নরেনদ্রাদি অন্তরঙ্গ ]

শ্রীযুক্ত ঠাকুর সকল বিবরণ শুনিলেন ও মাঝে মাঝে কেশবের উপাসনা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। অবশেষে বলিতেছেন, তুমি এখানে ওখানে যেও না — এইখানেই আসবে।

“যারা অন্তরঙ্গ তারা কেবল এখানেই আসবে। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল — এরা আমার অন্তরঙ্গ। এরা সামান্য নয়। তুমি এদের একদিন খাইও! নরেন্দ্রকে তোমার কিরূপ বোধ হয়?”

মণি — আজ্ঞা, খুব ভাল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, নরেন্দ্রের কত গুণ — গাইতে, বাজাতে, বিদ্যায়, আবার জিতেন্দ্রিয়, বলেছে বিয়ে করবে না — ছেলেবেলা থেকে ঈশ্বরেতে মন।

ঠাকুর মণির সহিত আবার কথা কহিতেছেন।

[সাকার না নিরাকার — চিন্ময়ী মূর্তি ধ্যান — মাতৃধ্যান ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার আজকাল ঈশ্বরচিন্তা কিরূপ হচ্ছে? তোমার সাকার ভাল লাগে — না নিরাকার?

মণি — আজ্ঞা, সাকারে এখন মন যায়ে না। আবার নিরাকারে কিন্তু মন স্থির করতে পারি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখলে? নিরাকারে একেবারে মন স্থির হয় না। প্রথম প্রথম সাকার তো বেশ।

মণি — মাটির এই সব মূর্তি চিন্তা করা?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? চিন্ময়ী মূর্তি।

মণি — আজ্ঞা, তাহলেও তো হাত-পা ভাবতে হবে? কিন্তু এও ভাবছি যে, প্রথমাবস্থায় রূপ চিন্তা না করলে মন স্থির হবে না — আপনি বলে দিয়েছেন। আচ্ছা, তিনি তো নানারূপ ধরতে পারেন। নিজের মার রূপ কি ধ্যান করতে পারা যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ তিনি (মা) গুরু — আর ব্রহ্মময়ী স্বরূপা।

মণি চুপ করিয়া আছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে আবার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন —

মণি — আজ্ঞা, নিরাকারে কিরকম দেখা যায়? — ও কি বর্ণনা করা যায় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু চিন্তা করিয়া) — ও কিরূপ জানো? —

এই কথা বলিয়া ঠাকুর একটু চুপ করিলেন। তৎপরে সাকার-নিরাকার দর্শন কিরূপ অনুভূতি হয়, একটি কথা বলিয়া দিলেন। আবার ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, এটি ঠিক বুঝতে সাধন চাই। ঘরের ভিতরের রত্ন যদি দেখতে চাও, আর নিতে চাও, তাহলে পরিশ্রম করে চাবি এনে দরজার তালা খুলতে হয়। তারপর রত্ন বার করে আনতে হয়। তা না হলে তালা দেওয়া ঘর — দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছি, “ওই আমি দরজা খুললুম, সিন্দুকের তালা ভাঙলুম — ওই রত্ন বার করলুম।” শুধু দাঁড়িয়ে ভাবলে তো হয় না। সাধন করা চাই।

============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮২, ২২শে অক্টোবর
ঠাকুর অনন্ত ও অনন্ত ঈশ্বর — সকলই পন্থা — শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন

[জ্ঞানীর মতে অসংখ্য অবতার — কুটীচক — তীর্থ কেন]

শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানীরা নিরাকার চিন্তা করে। তারা অবতার মানে না। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে স্তব করছেন, তুমি পূর্ণব্রহ্ম; কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, আমি পূর্ণব্রহ্ম কি না দেখবে এস। এই বলে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কি দেখছ? অর্জুন বললে, আমি এক বৃহৎ গাছ দেখছি, — তাতে থোলো থোলো কালো জামের মতো ফল ফলে রয়েছে। কৃষ্ণ বললেন, আরও কাছে এস দেখ দেখি ও থোলো থোলো ফল নয় — থোলো থোলো কৃষ্ণ অসংখ্য ফলে রয়েছে — আমার মতো। অর্থাৎ সেই পূর্ণব্রহ্মরূপ থেকে অসংখ্য অবতার হচ্ছে যাচ্ছে।

“কবীর দাসের নিরাকারের উপর খুব ঝোঁক ছিল। কৃষ্ণের কথায় কবীর দাস বলত, ওঁকে কি ভজব? — গোপীরা হাততালি দিত আর উনি বানর নাচ নাচতেন! (সহাস্যে) আমি সাকারবাদীর কাছে সাকার, আবার নিরাকারবাদীর কাছে নিরাকার।”

মণি (সহাস্যে) — যাঁর কথা হচ্ছে তিনিও (ঈশ্বর) যেমন অনন্ত, আপনিও তেমনি অনন্ত! — আপনার অন্ত পাওয়া যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি বুঝে ফেলেছ! — কি জানো — সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়। — সব পথ দিয়ে চলে আসতে হয়। খেলার ঘুঁটি সব ঘর না পার হলে কি চিকে উঠে? — ঘুঁটি যখন চিকে উঠে কেউ তাকে ধরতে পারে না।

মণি — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — যোগী দুই প্রকার, — বহুদক আর কুটীচক। যে সাধু অনেক তীর্থ করে বেড়াচ্ছে — যার মনে এখনও শান্তি হয় নাই, তাকে বহুদক বলে। যে-যোগী সব ঘুরে মন স্থির করেছে, যার শান্তি হয়ে গেছে — সে এক জায়গায় আসন করে বসে — আর নড়ে না। সেই এক স্থানে বসেই তার আনন্দ। তার তীর্থে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন করে না যদি সে তীর্থে যায়, সে কেবল উদ্দীপনের জন্য।

“আমায় সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়েছিল — হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান আবার শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত — এ-সব পথ দিয়েও আসতে হয়েছে। দেখলাম, সেই এক ঈশ্বর — তাঁর কাছেই সকলি আসছে — ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে।

“তীর্থে গেলাম তা এক-একবার ভারী কষ্ট হত। কাশীতে সেজোবাবুদের বৈঠকখানায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি তারা বিষয়ের কথা কচ্ছে! — টাকা, জমি, এই সব কথা। কথা শুনে আমি কাঁদতে লাগলাম। বললাম, মা, কোথায় আনলি! দক্ষিণেশ্বরে যে আমি বেশ ছিলাম। পইরাগে দেখলাম, সেই পুকুর, সেই দুর্বা, সেই গাছ, সেই তেতুঁল পাতা! কেবল তফাত পশ্চিমে লোকের ভুষির মতো বাহ্য। (ঠাকুর ও মণির হাস্য)

“তবে তীর্থে উদ্দীপন হয়ে বটে। মথুরবাবুর সঙ্গে বৃন্দাবনে গেলাম। মথুরবাবুর বাড়ির মেয়েরাও ছিল — হৃদেও ছিল। কালীয়দমন ঘাট দেখবামাত্রই উদ্দীপন হত — আমি বিহ্বল হয়ে যেতাম! — হৃদে আমায় যমুনার সেই ঘাটে ছেলেটির মতন নাওয়াত।

“যমুনার তীরে সন্ধ্যার সময়ে বেড়াতে যেতাম। যমুনার চড়া দিয়ে সেই সময় গোষ্ঠ হতে গরু সব ফিরে আসত। দেখবামাত্র আমার কৃষ্ণের উদ্দীপন হল, উন্মত্তের ন্যায় আমি দৌড়তে লাগলাম — ‘কৃষ্ণ কই, কৃষ্ণ কই’ এই বলতে বলতে!

“পালকি করে শ্যামকুণ্ড রা ধাকুণ্ডের পথে যাচ্ছি, গোবর্ধন দেখতে নামলাম, গোবর্ধন দেখবামাত্রই একেবারে বিহ্বল, দৌড়ে গিয়ে গোবর্ধনের উপরে দাঁড়িয়ে পড়লুম। — আর বাহ্যশূন্য হয়ে গেলাম। তখন ব্রজবাসীরা গিয়ে আমায় নামিয়া আনে। শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড পথে সেই মাঠ, আর গাছপালা, পাখি, হরিণ — এই সব দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম। চক্ষের জলে কাপড় ভিজে যেতে লাগল। মনে হতে লাগল, কৃষ্ণ রে, সবই রয়েছে, কেবল তোকে দেখতে পাচ্ছি না। পালকির ভিতরে বসে, কিন্তু একবার একটি কইবার শক্তি নাই — চুপ করে বসে! হৃদে পালকির পিছনে আসছিল। বেয়ারাদের বলে দিল ‘খুব হুঁশিয়ার।’

“গঙ্গামায়ী বড় যত্ন করত। অনেক বয়স। নিধুবনের কাছে কুটিরে একলা থাকত। আমার অবস্থা আর ভাব দেখে, বলত — ইনি সাক্ষাৎ রাধা দেহধারণ করে এসেছেন। আমায় ‘দুলালী’ বলে ডাকত! তাকে পেলে আমার খাওয়া-দাওয়া, বাসায় ফিরে যাওয়া সব ভুল হয়ে যেত। হৃদে এক-একদিন বাসা থেকে খাবার এনে খাইয়ে যেত — সেও খাবার জিনিস তয়ের করে খাওয়াত।

“গঙ্গামায়ীর ভাব হত। তার ভাব দেখবার জন্য লোকের মেলা হত। ভাবেতে একদিন হৃদের কাঁধে চড়েছিল।

“গঙ্গামায়ীর কাছ থেকে দেশে চলে আসবার আমার ইচ্ছা ছিল না। সব ঠিক-ঠাক, আমি সিদ্ধ চালের ভাত খাব; — গঙ্গামায়ীর বিছানা ঘরের এদিকে হবে, আমার বিছানা ওদিকে হবে। সব ঠিক-ঠাক। হৃদে তখন বললে, তোমার এত পেটের অসুখ — কে দেখবে? গঙ্গামায়ী বললে, কেন, আমি দেখব, আমি সেবা করব। হৃদে একহাত ধরে টানে আর গঙ্গামায়ী একহাত ধরে টানে — এমন সময় মাকে মনে পড়ল! — মা সেই একলা দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ির নবতে। আর থাকা হল না। তখন বললাম, না, আমায় যেতে হবে!

“বৃন্দাবনের বেশ ভাবটি। নতুন যাত্রী গেলে ব্রজ বালকেরা বলতে থাকে, ‘হরি বোলো, গাঁঠরী খোলো!’

বেলা এগারটার পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা-কালীর প্রসাদ গ্রহণ করিলেন। মধ্যাহ্নে একটু বিশ্রাম করিয়া বৈকালে আবার ভক্তদের সঙ্গে কথাবার্তায় কাটাইতেছেন — কেবল মধ্যে মধ্যে এক-একবার প্রণবধ্বনি বা “হা চৈতন্য” এই নাম উচ্চারণ করিতেছেন।

ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যার আরতি হইল। আজ বিজয়া, শ্রীরামকৃষ্ণ কালীঘরে আসিয়াছেন, মাকে প্রণামের পর ভক্তেরা তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। রামলাল মা-কালীর আরতি করিয়াছেন। ঠাকুর রামলালকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “ও রামনেলো! কই রে!”

মা-কালীর কাছে সিদ্ধি নিবেদন করা হইয়াছে। ঠাকুর সেই প্রসাদ স্পর্শ করিবেন — সেইজন্য রামলালকে ডাকিতেছেন। আর আর ভক্তদের সকলকে একটু দিতে বলিতেছেন।
=============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮২, ২৪শে অক্টোবর
দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বলরামাদি সঙ্গে — বলরামকে শিক্ষা
[লক্ষণ — সত্যকথা — সর্বধর্মসমন্বয় — “কামিনী-কাঞ্চনই মায়া” ]

মঙ্গলবার অপরাহ্ন, ২৪শে অক্টোবর (৮ই কার্তিক, ১২৮৯, শুক্লা ত্রয়োদশী)। বেলা ৩টা-৪টা হইবে। ঠাকুর খাবারের তাকের নিকট দাঁড়াইয়া আছেন। বলরাম ও মাস্টার কলিকাতা হইতে একগাড়িতে আসিয়াছেন ও প্রণাম করিতেছেন। প্রণাম করিয়া বসিলে ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, তাকের উপরে খাবার নিতে গিছিলাম, খাবারে হাত দিয়েছি, এমন সময় টিকটিকি পড়েছে, আর অমনি ছেড়ে দিইছি। (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ গো, ও-সব মানতে হয়। এই দেখ না রাখালের অসুখ, আমারও হাত-পা কামড়াচ্ছে। হল কি জানো? আমি সকালে বিছানা থেকে উঠবার সময় রাখাল আসছে মনে করে অমুকের মুখ দেখে ফেলেছি! (সকলের হাস্য) হাঁ গো, লক্ষণ দেখতে হয়। সেদিন নরেন্দ্র এক কানা ছেলে এনেছিল, তার বন্ধু, চক্ষুটা সব কানা নয়; যা হোক, আমি ভাবলুম এ-আবার কি ঘটালে!

“আর একজন আসে, আমি তার জিনিস খেতে পারি না। সে আফিসে কর্ম করে, তার ২০৲‌ টাকা মাহিনা। আর ২০৲‌ টাকা কি মিথ্যা (bill) লিখিয়ে পায়। মিথ্যাকথা কয় বলে সে এলে বড় কথা কই না। হয়তো দু-চারদিন আফিসে গেল না, এইখানে পড়ে রইল। কি জানো, মতলব যে, যদি কারুকে বলে কয়ে দেয় তাহলে অন্য জায়গায় কর্ম কাজ হয়।”

বলরামের বংশ পরম বৈষ্ণববংশ। বলরামের পিতা বৃদ্ধ হইয়াছেন — পরম বৈষ্ণব। মাথায় শিখা, গলায় তুলসীর মালা, আর হস্তে সর্বদাই হরিনামের মালা, জপ করিতেছেন। ইহাদের উড়িষ্যায় অনেক জমিদারি আছে। আর কোঠরে, শ্রীবৃন্দাবনে ও অন্যান্য অনেক স্থানে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ-বিগ্রহের সেবা আছে ও অতিথিশালা আছে। বলরাম নূতন আসিতেছেন, ঠাকুর গল্পচ্ছলে তাঁহাকে নানা উপদেশ দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সেদিন অমুক এসেছিল; শুনেছি নাকি ওই কালো মাগ্‌টার গোলাম! — ঈশ্বরকে কেন দর্শন হয় না? কামিনী-কাঞ্চন মাঝে আড়াল হয়ে রয়েছে বলে। আর তোমার সম্মুখে কি করে সেদিন ও-কথাটা বললে যে, আমার বাবার কাছে একজন পরমহংস এসেছিলেন, বাবা তাঁকে কুঁকড়ো রেঁধে খাওয়ালেন! (বলরামের হাস্য) “আমার অবস্থা” এখন মাছের ঝোল মার প্রসাদ হলে একটু খেতে পারি। মার প্রসাদ মাংস এখন পারি না, — তবে আঙুলে করে একটু চাখি, পাছে মা রাগ করেন। (সকলের হাস্য)

[পূর্বকথা — বর্ধমানপথে — দেশযাত্রা — নকুড় আচার্যের গান — শ্রবণ ]

“আচ্ছা আমার একি অবস্থা বল দেখি। ও-দেশে যাচ্ছি বর্ধমান থেকে নেমে, আমি গরুর গাড়িতে বসে — এমন সময়ে ঝড়বৃষ্টি। আবার কোত্থেকে লোক এসে জুটল। আমার সঙ্গের লোকেরা বললে, এরা ডাকাত! — আমি তখন ঈশ্বরের নাম করতে লাগলাম। কিন্তু কখন রাম রাম বলছি, কখন কালী কালী, কখন হনুমান হনুমান — সবরকমই বলছি, এ কিরকম বল দেখি।”

ঠাকুর এই কথা কি বলিতেছেন যে, এক ঈশ্বর তাঁর অসংখ্য নাম, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা সম্প্রদায়ের লোক মিথ্যা বিবাদ করিয়া মরে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। ওর ভিতর অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায় — মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয় — বইতে বইতে আর ঘেন্না থাকে না। ঈশ্বরের নামগুণকীর্তন করা অভ্যাস করলেই ক্রমে ভক্তি হয়।

(মাস্টারের প্রতি) — “ওতে লজ্জা করতে নাই। ‘লজ্জা, ঘৃণা, ভয় — তিন থাকতে নয়।’

“ও-দেশে বেশ কীর্তন গান হয় — খোল নিয়ে কীর্তন। নকুড় আচার্যের গান চমৎকার! তোমাদের বৃন্দাবনে সেবা আছে?”

বলরাম — আজ্ঞে হাঁ। একটি কুঞ্জ আছে — শ্যামসুন্দরের সেবা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি বৃন্দাবনে গেছলাম। নিধুবন বেশ স্থানটি।

===========

Post a Comment

0 Comments