১৮৮৬ সালে বরাহনগর মঠের অবস্থা
আশ্বিন বা কার্তিক মাসে, ১৮৮৬ সালে, বরাহনগর মঠে সকলে আসিয়া একত্র হইলেন। মঠের বাড়ীটা অতি প্রাচীন, ভগ্ন, নীচেকার ঘরগুলি মাটিতে ডুবিয়া বসিয়া গিয়াছে; শৃগাল ও সর্পের আবাসস্থান। উপরে উঠিবার সিঁড়ির ধাপগুলি খানিকটা আছে, অনেকটা পড়িয়া গিয়াছে । দ্বিতলের দালানের মেঝের খোয়া দুই হাত আছে ত দুই হাত উঠিয়া গিয়াছে। দরজা জানালার তক্তাগুলির খানিকটা আছে, খানিকটা নাই; ছাতের বরগা পড়িয়া গিয়াছে, বাঁশ চিরিয়া ইটগুলি রাখা হইয়াছে। চতুর্দিকে জঙ্গল। ভূতের বাড়ী ত সত্যই ভূতের বাড়ী। সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া উত্তরদিকে, অর্থাৎ দক্ষিণ হাতে যাইতে প্রথম একটি নাতিবৃহৎ গৃহ- যেটাকে কালী বেদান্তীর বা “কালী তপস্বীর ঘর” বলা হইত। তাহার পর দুই ধাপ উঠিয়া একটা ছোট দরজা এবং ভিতরে যাইবার পথ। আর একটু ঢুকিলে বাঁ দিকে ঠাকুরের ঘর এবং সম্মুখে একটী লম্বা দালান ও দালানের পশ্চিমে একটী বড় ঘর। বড় ঘরের ভিতর দিয়া যাইলে উত্তর-পশ্চিম দিকে ছোট একটা ঘর, সেখানে জল থাকিত ও সকলে বসিয়া খাইত। তাহার পর উত্তর-পশ্চিম দিকে পায়খানা। আর ভোজনগৃহের পূর্বদিকে একটা গৃহে রান্না হইত। এইটা হইল বরাহনগরের মঠ। কাশীপুরের বাগানে শ্রীশ্রীরামকষ্ণদেবের যে শয্যা, বালিশ ও ব্যবহৃত-দ্রব্যাদি ছিল, তাহা সংরক্ষিত হইল। মেঝের উপর শয্যা স্থাপন করা হইয়াছিল, পালঙ্ক তখন একটাও ছিল না। দানাদের ঘরে (কালী তপস্বীর ঘরটী ব্যতীত অপর যে একটী বড় গৃহ তাহার নাম “দানাদের ঘর”) বালন্দা পটপটীর খান দুই-তিন মাদুর সংযুক্ত করিয়া মেঝেতে বিস্তীর্ণ রহিয়াছে; অপর এক জায়গায় সতরঞ্চি রহিয়াছে-“চোরের বিশ্বাসী”, কোনও জায়গায় টানাটা রহিয়াছে, অপর জায়গায় পড়েনটা রহিয়াছে- জেলের জালবৎ। মাথার বালিশ-বালন্দার চ্যাটাই-এর নীচে নরম নরম ইট দেওয়া। শীত করিলে পরস্পর সংলগ্ন হইয়া শয়ন, বা তাহাতে শীত না ভাঙ্গিলে রাত্রিতে উঠিয়া একবার কুস্তি লড়িয়া লওয়া ; শরীর গরম হইলে শীত পলাইয়া যাইত।
বরাহনগর মঠে আহারের বন্দোবস্ত ।
আহারের কোন বন্দোবস্ত না থাকায় এবং কাহারও প্রদত্ত কিছু গ্রহণ করিবেন না ইহা স্থির করিয়া সকলেই মুষ্টিভিক্ষা করিতে লাগিলেন! ভিক্ষার যে চাউল আসিত তাহা সিদ্ধ করা হইত। তৎপরে এক বস্ত্র খণ্ডের উপর তৎসমুদয় ঢালিয়া তাঁহার চতুদিকে সকলে মিলিয়া বসিতেন এবং লবণ ও লঙ্কার ঝোল করিয়া তাহাই দিয়া ভোজন সমাপ্ত করিতেন; কখনও বা তেলাকুচা পত্রের ঝোল হইত। জলপানের জন্য একটামাত্র ঘটি ছিল। একটি বাটিতে নুন-লঙ্কার ঝোল থাকিত; সকলেই একগ্রাস করিয়া একবার ভাত মুখে লইতেন ও একবার এ ঝোল হাতে করিয়া মুখে দিতেন; জিহ্বায় অত্যন্ত ঝাল ঝাল লাগিত।
বরাহনগর মঠে সকলের শৌচাগার পরিস্কার করা।
গুরুসেবা ও গুরু-ভাইকে সেবা করা একই-এই ভাবটী তখন অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিল। উপরকার পায়খানাটাতে পশ্চাতের পুস্করিণীর জল আনিয়া রাখা হইত। গোটা দুই মাটির গামলা ছিল, তাহাতেই জল থাকিত। একদিন প্রসঙ্গক্রমে নরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “তিনি (পরমহংসদেব) “ষোল আনা” কঠোর করেছিলেন, আমরা কি তার এক আনাও করতে পারব না? পরমহংস মশাই অপরের পায়খানা ধুয়ে দিয়ে এসেছিলেন আর আমরা কি তার নাম ক'রে কিছুই করতে পারব না” তিনি এই কথা এরপ হ্বদয়-স্পর্শীভাবে বলিয়াছিলেন যে, সকলের ভিতর সেবার ভাব ও কঠোরতা করিবার ইচ্ছা অগ্নিশিখার ন্যায় প্রজ্ছলিত হইয়া উঠিল। প্রথমে একদিন সকলের অসাক্ষাতে একজন পায়খানাটা ধুইয়া দিয়া দু-তিনটি হুকাতে জল বদলাইয়া দিয়া কলকেতে তামাক টিকা ঠিক করিয়া রাখিলেন। নিদ্রাভঙ্গের পর সকলে পায়খানায় গিয়া দেখেন যে, পায়খানা পরিষ্কার, তামাক তৈয়ারী। পায়খানায় মলপতনের জন্য একটিমাত্র গর্ত। একজন শৌচে বসিলেন ত অপর কয়েকজন স্ব স্ব পাদদ্বয়ের উপর জানু নত করিয়া বসিয়া ধূমপান এবং বেদান্ত ও নানা শাস্ত্রের আলোচনা করিতেছেন। পুনরায় আর একজনের বেগ আসিয়াছে ত তিনি মলত্যাগে বসিলেন, অপর কয়জন ধূমপান করিতে করিতে শাস্ত্রচর্চা করিতেছেন; এইরূপে, পর্যায়ক্রমে এক একজন করিয়া শৌচে বসিতেছেন ও অন্য কয়জনে শাস্ত্রালোচনা করিতেছেন। শৌচস্থল বৈঠকখানায় পরিণত হইল । সকলেই দিগম্বর ও মধ্যে মধ্যে কৌতুক রহস্যাদিও চজিতেছে। ক্রমে ক্রমে অল্পদিনের ভিতর বিষ্ঠা-পরিস্কার একট মহা সাধনা হইয়া দাঁড়াইল; ইহা যেন তাহাদের একটা তপস্যা হইয়া উঠিল। একজন যযি ভোর রাত্রিতে করেন, পরদিন অন্য একজন শেষরাত্রিতে উঠিয়া অলক্ষিতে পরিস্কার করিয়া রাখিতেন এবং তৎপরদিন অর্ধরাত্রে উঠিয়া অপর একজন পায়খানা ধৌত করিয়া দিয়া স্বস্থানে শয়ন করিতেন। কে যে পায়খানা ধৌত করিয়া রাখিতেন, পরস্পর কাহাকেও জানিতে দিতেন না. এইরূপ অপূর্বভাব জগতে খুব কমই দেখা গিয়াছে।
গ্রন্থসূত্রঃ-শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী, প্রথম খণ্ড
0 Comments