চাবি কিন্তু আমার হাতে রইল.......বলিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেনঃ- চাবি কিন্তু আমার হাতে রইল.......

চাবি কিন্তু আমার হাতে রইল.......বলিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

কোন একদিন নির্বিকল্প সমাধিলাভের ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হওয়ায় নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণকে এজন্য ধরিয়া বসিলেন। ঠাকুর তাহাকে নিরস্ত করিবার জন্য প্রথমে বলিলেন, “আমি ভাল হলে তুই যা চাইবি দেব ।” নরেন্দ্র তাহাতেও নিবৃত্ত না হইয়া বলিলেন, “কিন্তু আপনি যদি আর ভাল না হন, তাহলে আমার কি হবে?”  ঠাকুর কতকটা অন্যমনস্ক ও স্বগতভাবে বলিলেন, “শালা বলে কি?”  তারপর ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, তুই কি চাস বল।” নরেন্দ্র জানাইলেন, “আমার ইচ্ছা হয়, শুকদেবের মতো পাঁচ-ছয় দিন ক্রমাগত একেবারে সমাধিতে ডুবে থাকি, তারপর শুধু শরীররক্ষার জন্য খানিকটা নিচে নেমে এসে আবার সমাধিতে চলে যাই।” শ্রীরামকৃষ্ণ তখন কতকটা উত্তেজিতকঠে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, “ ছি ছি, তুই এতবড় আধার, তোর মুখে এই কথা! আমি ভেবেছিলাম, কোথায় তুই একটা বিশাল বটগাছের মতো হবি, তোর ছায়ায় হাজার হাজার লোক আশ্রয় পাবে, তা না হয়ে তুই কিনা শুধু নিজের মুক্তি চাস! এ তো অতি তুচ্ছ হীন কথা! নারে, এত ছোট নজর করিসনি। আমি বাপু সব ভালবাসি । মাছ খাব তো, ভাজাও খাব, সিদ্ধও খাব, ঝোলেও খাব, অন্বলেও খাব। তাকে সমাধি অবস্থায় নির্গুণ ভাবেও উপলব্ধি করি, আবার নানা মূর্তির ভেতর ঐহিক সন্বন্ধবোধেও ভোগ করি। একঘেয়ে ভাল লাগে না। তুইও তাই কর - একাধারে জ্ঞানী ও ভক্ত দুই হ।”

প্রাচীন চিন্তাধারায় চলিতে চলিতে নরেন্দ্র আজ অকম্মাৎ যুগাবতারের নবীন বাণী স্বমুখে স্পষ্টতমরূপে শুনিলেন – বুঝিলেন কেবল নিজ মুক্তির জন্য লালায়িত থাকাও এক প্রকার স্বার্থপরতা ; আজ মনে হইল,, পরমহংসদেব যে বলিয়া থাকেন,"চোখ বুজিলেই ভগবান আছেন, আর চোখ চাহিলে কি তিনি নাই ?" - একথার একটা গভীর তাৎপর্য আছে। কিন্তু বুদ্ধিতে এই নবালোক প্রতিফলিত হইলেও, হৃদয় দিয়া ইহা গ্রহণ করিতে বেশ কিছু সময় লাগিয়াছিল; এই নবতত্ব লাভের পরেও হৃদয়ের আকাঙক্ষা অতৃপ্ত রহিয়া গেল; তাই ঠাকুরের ধিক্কারবচনে নরেন্দ্রনাথের চক্ষে অজস্র অশ্রু বিগলিত হইলেও তাঁহার প্রাণ তখনও নির্বিকল্প সমাধির জন্য লালায়িত রহিল । অবশেষে ঘটনাক্রমে একদিন সন্ধ্যার পরে তিনি চিরবাঞ্ছিত নির্বিকল্পভূমিতে আরূঢ় হইলেন। সেখানে তখন ছিলেন কেবল তিনি ও বুড়ো গোপালদা, বাকি সেবক্রা হয় ঠাকুরের সেবায় ব্যস্ত, নতুবা সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে প্রকৃতির নিস্তব্তার সহিত হৃদয়ের সামঞ্জস্য স্থাপনপূর্বক কোন নিভৃত স্থানে ভগবচ্চিন্তায় নিমগ্ন কিংবা দূরে বৃক্ষতলে ভগবৎ-সঙ্গীতে নিরত। এমন সময় ধ্যানমগ্ন নরেন্দ্রনাথের বোধ হইল যেন তাঁহার মস্তকের পশ্চাদভাগে উজ্জ্বল আলোকরাশি প্রজ্বলিত হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে উহার ক্রমবর্ধমান জ্যোতিঃ যেন চন্দ্র, সূর্য, আকাশ প্রভৃতিকে দূরে সরাইয়া দিয়া স্বয়ং সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইতেছে- তখন বিশ্বসংসার টলটলায়মান এবং মন বাহ্য জগৎ ছাড়িয়া এক অখণ্ড জ্যোতিঃসমুদ্রে নিমজ্জিত হইতে চলিয়াছে। দেশ-কাল-পাত্রের বোধ আর রহিল না - রহিল শুধু অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মসত্তা। নরেন্দ্রনাথ .বলিয়াছিলেন, “সেদিন দেহাদিবুদ্ধির এককালে অভাব হয়েছিল, প্রায় লীন হয়ে গিয়েছিলুম, আর কি ? একটু অহং ছিল, তাই সেই সমাধি থেকে ফিরেছিলুম। এরূপ সমাধিকালেই আমি আর ব্রহ্মের ভেদ চলে যায়-সব এক হয়ে যায়-যেন মহাসমুদ্রে জল, আর কিছুই নাই। ভাব আর ভাষা সব ফুরিয়ে যায়।” সমাধি হইতে ব্যুখানের পর তাঁহার মনে হইল যেন মস্তক ব্যতীত সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একেবারে শুন্যে মিশাইয়া গিয়াছে। এই বোধের সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ কাতর চিৎকার করিয়া উঠিলেন। এই আকস্মিক শব্দে গোপালদা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন; কর্ণে গেল, নরেন্দ্র বলিতেছেন, “গোপালদা, গোপালদা, আমার শরীর কোথায় গেল? গোপালদা ব্যস্তসমস্ত হইয়া তাঁহার দেহের বিভিন্ন স্থান টিপিয়া বলিতে লাগিলেন, “কেন নরেন, এই যে ?” তবু নরেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, শুধু মুখখানি আছে, আর কিছু নাই। অগত্যা কিংকর্তব্যবিমূঢ় গোপালদা অপরদের ডাকিয়া আনিলেন; কিন্তু কেহই কিছু বুঝিতে পারিলেন না । অবশেষে উপরে ঠাকুরকে সংবাদ দেওয়া হইলে তিনি ঈষৎ ভঙ্গি সহকারে বলিলেন, “বেশ হয়েছে, থাক খানিকক্ষণ এ রকম হয়ে। ওরই জন্য যে আমায় জ্বালাতন করে  তুলেছি।"

রাত্রি এক প্রহর পরে অনেকটা সহজাবস্থাপ্রাপ্ত নরেন্দ্রনাথ শ্রীগুরুর পদপ্রান্তে উপনীত হইলেন। তখনও তিনি সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হন নাই, ধীরপদক্ষেপে সোপানারোহণকালে মনে  হইতেছিল, চরণদ্বয় যেন চলিতেছে না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে দেখিয়া বলিলেন, “কেমন, মা তো আজ তোকে সব দেখিয়ে দিলেন ? চাবি কিন্তু আমার হাতে রইল। এখন তোকে কাজ করতে হবে। যখন আমার কাজ শেষ হবে তখন আবার চাবি খুলব।” তারপর তিনি তাহাকে শরীরের প্রতি যত্ব লইতে এবং সঙ্গি-নির্বচন-বিষয়ে অধিকতর সাবধান হইতে বলিয়া দিলেন।

স্বামীজী বলছেনঃ-

সেই অবস্থায় বোধ হলো যেন আমার শরীর নাই, শুধু মুখটি দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুর উপরের ঘরে ছিলেন, আমার নিচে এ অবস্থাটি হলো। আমি সেই অবস্থাতে কাঁদতে লাগলাম, বলতে লাগলাম, “আমার কি হলো ?” বুড়োগোপাল উপরে গিয়ে ঠাকুরকে বললেন, “নরেন্দ্র কাঁদছে'। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, 'এখন টের পেলি, চাবি আমার কাছে রইল।” আমি বললাম, “আমার কি হলো?  তিনি অন্য ভক্তদের দিকে চেয়ে বললেন, “ও আপনাকে জানতে পারলে দেহ রাখবে না; আমি ভুলিয়ে রেখেছি ।” (কথামৃত”, ৩। পরিশিষ্ট)।


গ্রন্থসূত্রঃ-যুগনায়ক বিবেকানন্দ,প্রথম খণ্ড,স্বামী গম্ভীরানন্দ

পৃষ্ঠাঃ-১৫১

Post a Comment

0 Comments