আমার কান ধরে টানবেন না বলছি ~ স্বামী বিবেকানন্দ

  আমার কান ধরে টানবেন না বলছি! 

আমার কান ধরে টানবেন না বলছি! স্বামী বিবেকানন্দ


পাঁচ বছর বয়স হলেই যথানিয়মে নরেনের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল। তাকে পড়াবার জন্যে যে গৃহশিক্ষক ছিলেন, তিনি এই ছাত্রটিকে নিয়ে বেশ বিব্রত বোধ করতেন। তখনকার দিনে মারধোর ক'রে ছাত্রদের লেখ পড়া শেখাবার যে সনাতন রীতি চালু ছিল, গুরুমশায় তা প্রয়োগ করতে গিয়ে সুবিধা করতে পারলেন না। তাতে ছাত্র সহজে বিগড়ে বসতো । শেষ পর্যন্ত গুরুমশায় সনাতন রীতি ছেড়ে মিষ্ট কথায় ছাত্রটকে বশে আনতে সচেষ্ট হলেন। তাতে কিছুটা সুফল দেখা দিল। দু বছর বাদে, ১৮৭১ খ্রীষ্টাবে, নরেনের বয়স যখন আট, তখন তাকে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইনুস্টিট্যুশনে তখনকার নবম শ্রেণীতে (এখনকার দ্বিতীয় শ্রেনীতে ) ভর্তি ক'রে দেওয়া হ'লো।। বিদ্যালয়ে এসে নরেন শীঘ্রই সহপাঠীদের দলপতি হয়ে উঠলো। তার বুদ্ধি ও মেধা সম্পর্কে শিক্ষকরা শীঘ্রই সচেতন হলেন। তবে এই অশান্ত বালকটি বিদ্যালয়ের নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে কিছুটা অসুবিধা বোধ করতে লাগলো । সে অনেকক্ষণ একভাবে চুপচাপ বসে থাকতে পারতো না; একটানা বসে থাকাটা অসহ্য বোধ হলে সে কখনও কখনও উঠে দাঁড়াতো, কখনো বা ক্লাসের বাইরে চ'লে যেতো, আবার কখনও বসে বসে নিজের কাপড় বই ছি'ড়তো। তাকে নিয়ে তার বাপ-মার মতো শিক্ষকরাও প্রথমটা বিব্রত বোধ করতেন। শাসন করতে গেলে ফল হ'তো বিপরীত। তাই তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিষ্ট কথায় শান্ত করতে হ'তো।

নরেনের শরীর যেমন সুন্দর ও সুগঠিত ছিল, তেমনি শরীরে ছিল শক্তি। তার বুদ্ধি ও শারীরিক শক্তির জন্যে সমবয়সীরা তাকে মেনে চলতো! । খেলার সময় সামান্য বিষয় নিয়ে সাথীদের মধ্যে বিবাদ সে আদৌ পছন্দ করতো না; তাই বিবাদ ঘটলেই সে মীমাংসা ক'রে দিতো । সে মীমাংসা না মেনে উপায় ছিল না। তার ঘুষিকে দুষ্টু ছেলেরাও ভয় করতো । লাফানো, দৌড়ানো, মুষ্টিযুদ্ধ ও গুলিখেলা নরেন্দ্রের খুবই প্রিয় ছিল। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে নরেন সবার আগেই ক্লাস থেকে খেলার মাঠে পৌঁছতো। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে নরেনের নেতৃত্বে ছেলেরা ক্লাসেই খেলাধুলো শুরু ক'রে দিতো, অনেক সময় শ্রেণীকক্ষ হলদিঘাটে পরিণত হ'তো। শিক্ষক উপস্থিত থাকলেই বা কি! অনেক সময় ওদিকে শিক্ষকমশায় পড়াচ্ছেন, আর এদিকে নরেন তার দলবল নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে । একবার এক শিক্ষক তাদের এই সমস্ত লক্ষ্য করে নরেন ও তার সঙ্গীদের তিনি যা পড়াচ্ছিলেন, তা জিজ্ঞাসা করলেন। সকলেই নিরুত্তব রইলো। কিন্তু নরেনের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ; সে গল্প করলেও তার মনের একাংশ শিক্ষকমশায়ের দিকেও ছিল। তাই সে শিক্ষকমশায় যা পড়াচ্ছিলেন তা হুবহু ব'লে গেল! অন্যরা বলতে না পারায় শিক্ষকমশায় তাদের দাঁড় করিয়ে দিলেন । নরেনও তাদের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো । শিক্ষকমশায় তাকে বসতে বললেন। সে বললে, না, তার সঙ্গীরা যদি দোষী হয়, তবে সেও দোষী, কারণ সে গল্প করছিল। শিক্ষকমশায় নরেনের সততা ও বন্ধুদের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখে মুগ্ধ হলেন ।

তখনকার দিনে শিক্ষকরা প্রায়ই ছাত্রদের দৈহিক শাস্তি দিতেন। মেট্রোপলিটন ইনস্ট্যিটুশনে এক অত্যন্ত বদমেজাজী শিক্ষক ছিলেন। তিনি একদিন নরেনের এক সহপাঠীকে বেদম প্রহার করতে থাকেন। এই দৃশ্য দেখে বালক নরেন নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ হেসে ওঠে। তখন শিক্ষকমশায় তার শিকার ছেড়ে নরেনের ওপর এসে পড়েন, বেদম তাঁকে প্রহার করতে থাকেন এবং নরেন কখনও আর এভাবে হাসবে না, এই প্রতিশ্রুতি দাবি করেন। নরেন তাতে স্বীকৃত না হ'লে শিক্ষকমশায় তাকে আবার প্রহার করতে থাকেন এবং তার দুই কানে ধ'রে টেনে তাকে বেঞ্চির উপরে তুলতে চেষ্টা করেন। ফলে নরেনের একটি কানের গোড়া ছিঁড়ে বায় ও প্রচুর রক্তপাত ঘটে। নরেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বলতে থাকে, “আমার কান ধরে টানবেন না বলছি! খবরদার, আমার গায়ে হাত দেবেন না!”

সৌভাগ্যবশতঃ এই সময়ে বিদ্যাসাগর মশায় ক্লাসে এসে ঢোকেন। ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়ে নরেন বললে, সে এই স্কুলে আর পড়বে না এবং বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিদ্যাসাগর নরেন্দ্রনাথকে নিজের কক্ষে নিয়ে গিয়ে তাকে নানাভাবে শান্ত করলেন। তিন সমস্ত ব্যাপারটির তদন্ত করলেন, এবং এই ধরনের ব্যাপার যাতে আর না ঘটে, সেজন্যে শিক্ষকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন। মা ভুবনেশ্বরীদেবী বিদ্যালয়ে পুত্রের এই ধরনের নির্যাতনের কথা শুনে খুবই বিচলিত হলেন । বললেন, নরেন আর ও স্কুলে পড়বে না। কিন্ত নরেন পরদিন হাসিমুখে আবার স্কুলে গেল। তবে কানের ঘা-টা সারতে আরও কিছুদিন সময় লেগেছিল ।

গ্রন্থসূত্রঃ-স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী, ব্রহ্মচারী স্বরূপানন্দ

Post a Comment

0 Comments