শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের দাম্পত্য জীবন - সঙ্ঘগুরু শ্রীমতিলাল
বাঙ্গালীর চরিত্রে আজ এই দিক্টা পরিস্ফুট করিয়া তােলার দিন আসিয়াছে। জাতি ও সমাজ - খাপখােলা তলােয়ার সন্ন্যাসীরই সমষ্টি নহে। সমাজের প্রতিষ্ঠা দিব্য সম্বন্ধময় জীবনে। ভােগের উর্দ্ধে এই নিত্য সম্বন্ধ-তত্ত্বের আবিষ্কার-সমাজ-সাধনারই মূলগত লক্ষ্য। শ্রীশ্রীঠাকুর এই সাধনারই অগ্রদূত, ইহা বলিলে বােধ হয় অত্যুক্তি হয় না। প্রত্যেক পুরুষ কি নারী, ঈশ্বর-সাধনায় যারা আত্মসমর্পণ করিয়াছে, তাহাদের জীবনে চিরসঙ্গী ও সঙ্গিনীর সাক্ষাৎকার অসম্ভব নহে। দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর কামকাঞ্চনবিরাগী হইয়া ও, যেচ্ছায় স্বপত্নীর সন্ধান পাইয়া বিবাহ করিয়াছিলেন। পূর্ণাঙ্গ জীবনের সাধনায় এ বিবাহের প্রয়ােজন অস্বীকার করা যায় না। জীবনকে খণ্ড করিয়া দেখিলে, আমরা জীবনের মাপে অনেক অসম্পূর্ণ আত্মবিকাশকে দোষ ও ত্রুটির হিসাবেই দেখি ; কিন্তু জীবন প্রবাহের অনন্তত্ব যার অনুভূতির মধ্যে ফুটিয়াছে, সে তার অভেদ সম্বন্ধ-তত্ত্বকে ছাড়িবে কেন? ঠাকুরের জীবন যুগ-ধৰ্ম্ম-সাধনে অখণ্ড ব্রহ্মচর্ষ-মূর্তি; কিন্তু তবুও তিনি স্ত্রী গ্রহণ করিলেন। কাল-ধৰ্ম্ম অপেক্ষা কালাতীত ধৰ্ম্ম শ্রেষ্ঠ ! পুরুষ-প্রকৃতির মিলন—সৃষ্টিলীলার মুল-তত্ত্ব। সত্যান্বেষী তুরীয় জীবনের ক্ষেত্রে যে বস্তুর সাধন-নিরত সেখানে তার চির-সঙ্গিনী যদি তাহাকে সাহায্য করে, তবে সে পরিপূর্ণ তৃপ্তি লইয়াই সে কাৰ্যে আত্মনিয়ােগ করে। শান্তি ও আলােয় তার সবখানি ভরা থাকিলে, জীবন শক্তিপূর্ণ হয়। নারীপুরুষের মিলনের মধ্যে বিরংসার তাড়না থাকিতে মিলনের মধুষাদ বরং ক্ষুন্ন হয়। যেখানে কাম-কুক্কুরের লেলিহান রসনা নাগাল পায় না, সেইখানেই জগতের দান বিশুদ্ধ মূর্তিতে ফলিতে পারে।
প্রশ্ন উঠে—যে বিবাহে নারীপুরুষের রক্তমাংসের সম্বন্ধ নাই, সে বিবাহের প্রয়ােজন কি ? ইহার উত্তর দিতে গিয়া, জাতি-ধর্মের প্রতীক মহাত্মা গান্ধীও বিব্রত হইয়াছিলেন, শুনিতে পাই। সমাজবিধানে পরিণয়-নীতি সমাজপুষ্টির অপরিহার্ঘ্য ব্যবস্থা, ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হয় ; যেখানে ইহার অভাব, সেখানে পরিণম অর্থহীন। কিন্তু সত্য ধর্মের সাধনায় যে জাতি গড়িয়া উঠিবে, তাহার ভিত্তি যদি অপূৰ্ব সংযমের উপর ভর দিয়া না দাঁড়ায়, তাহার ভবিষ্যৎ নিঃসংশয় নহে। একেবারে জাতির মূলে এইরূপ অপার্থিব সংযমের বনিয়াদ গড়িয়া তুলিতে পারিলেই, প্রবৃত্তির টানে সে জাতি আর কখনও অধােগামী হইবে না।
এই সংযম কৃচ্ছ্রতামূলক আদর্শের দায় হইলে, আমরা বিব্রত হইব, লক্ষ্যভ্রষ্ট হইব। এখানে কৃচ্ছ, তার কোন কথা নাই । সাধনার অমৃতপরশে জীবন ভরাইয়া, যুগধর্মসাধনে আমার সত্য জীবন-সঙ্গিনীর আনুকুল্য হিতকর হইবে। বরং জীবনের এই সত্যটাকে অস্বীকার করিয়া চলায়, একটা ক্ষুণ্ণতা অজানা ভাবে প্রতি পদে আঘাত দিতে থাকে। দেশে নিঃসঙ্গ জীবনের সংখ্যা বড় অল্প নয়; কিন্তু তেমন বিদ্যুচ্ছক্তি-বিচ্ছুরণের অবকাশ জীবনে কেন ঘটে না, তার কারণ অন্বেষণ করিলে শতকরা নব্বই জনের মধ্যে বােধ হয় এই সত্যই আবিষ্কৃত হইয়া পড়িবে।
যুগধৰ্ম্মের সন্ধান যাহারা পাইয়াছে, জাতির জীবনে সত্যনীতির আবিষ্কার ও অধ্যাত্মবলবিধানের ভার তাহাদেরই গ্রহণ করিতে হইবে। নারীপুরুষের মিলন সতাই যদি অধ্যাত্মদর্শনের ভিত্তি ধরিয়া সাধিত না হয়, সমাজে ব্যভিচার নিবারণ করা সম্ভবপর নহে। নারী যদি তার অভেদ-স্বরূপ পুরুষ ও পুরুষ যদি তার সত্য-সঙ্গিনী নারীর সন্ধান পায়, নারী অথবা পুরুষ কখনও সমাজ-সঙ্কর-দোষে আত্মঘাতী হইবে না। কিন্তু শুধু স্বাধীনভাবে নারী বা পুরুষ পতি ও পত্নীনিৰ্ব্বাচনের অধিকার লাভ করিলেই যে ইহা হইবে, এমন কথা আমরা বলি না-ইউরােপীয় সমাজে তাহা হইলে প্রতিদিন পতিপত্নীত্যাগের আবেদনপত্র হস্তে ধৰ্ম্মাধিকরণে উপস্থিত হইত না?
মানুষকে অন্ধ করে-কাম। ভারত চাহিয়াছে—এই আত্মকামের শােধন ও নবজন্ম। আত্মশুদ্ধি হইলেই দিব্য দৃষ্টি ফুটে; ইহা অলৌকিক ব্যাপার নহে। সত্যসঙ্কল্পপরায়ণ ব্যক্তি যদি দ্বাদশ বর্ষ কায়িক, বাচিক, মানসিক, ত্রিবিধভাবে সত্যের সাধনা করে, শাস্ত্রে বলে—তার মনে মিথ্যা কল্পনার পর্যন্ত উদয় হয় না, তার ভাবে, চিন্তায়, ভাষায় সত্যই ব্যক্ত হয় । নিষ্কাম উৎসর্গ-যােগীর অন্তরে যে দৃষ্টি ফুটে, তাহা যে তার অন্তরের সত্য অভিব্যক্তি, সে বিষয়ে সংশয় নাই। ভারতের নর-নারী উৎসর্গ-সাধনায় যেদিন উদ্বুদ্ধ হইবে, যেদিন তাহাদের সত্যদৃষ্টি ফুটিয়া উঠিবে, সেদিন সমাজে, শিক্ষায়, জীবনের সর্বাবস্থায় একটা দিব্য ছন্দ ও শৃঙ্খলার সৃষ্টি হইবে। সেদিন জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে মানুষ নিজের ধন নিজেই বাছিয়া লইবে ; পাইয়া আর হইতে হইবে না—যাহা হইবে তাহা অব্যর্থ ও সনাতন।
0 Comments