দশম খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

দশম খণ্ড

দশম খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১০ই অক্টোবর

শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোৎসবে

শ্রীযুক্ত অধরের বাড়িতে ৺নবমীপূজার দিনে ঠাকুরদালানে শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। সন্ধ্যার পর শ্রীশ্রীদুর্গার আরতি দর্শন করিতেছেন। অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোৎসব, তাই তিনি ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন।

আজ বুধবার, ১০ই অক্টোবর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২৪শে আশ্বিন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন, তন্মধ্যে বলরামের পিতা ও অধরের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইনস্পেক্টর সারদাবাবু আসিয়াছেন। অধর প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের ৺পূজা উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, তাঁহারাও অনেকে আসিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ধ্যার আরতি দর্শন করিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুরদালানে দাঁড়াইয়া আছেন। ভাবাবিষ্ট হইয়া মাকে গান শুনাইতেছেন।

অধর গৃহীভক্ত, আবার অনেক গৃহীভক্ত উপস্থিত, ত্রিতাপে তাপিত। তাই বুঝি শ্রীরামকৃষ্ণ সকলের মঙ্গলের জন্য জগন্মাতাকে স্তব করিতেছেন:

তার তারিণী। এবার তারো ত্বরিত করিয়ে,
তপন-তনয়-ত্রাসে ত্রাসিত, যায় মা প্রাণী ৷৷
জগত অম্বে জন-পালিনী, জন-মোহিনী জগত-জননী।
যশোদা জঠরে জনম লইয়ে সহায় হরিলীলায় ৷৷
বৃন্দাবনে রাধাবিনোদিনী, ব্রজবল্লভবিহারকারিণী।
রাসরঙ্গিনী রসময়ী হয়ে রাস করিলে লীলাপ্রকাশ ৷৷
গিরিজা গোপজা গোবিন্দ মোহিনী তুমি মা গঙ্গে গতিদায়িনী;
গান্ধার্বিকে গৌরবরণী গাওয়ে গোলকে গুণ তোমার।
শিবে সনাতনী সর্বাণী ঈশানী সদানন্দময়ী সর্বস্বরূপিণী,
সগুণা নির্গুণা সদাশিবপ্রিয়ে কে জানে মহিমা তোমার!

[শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেশে জগন্মাতার সঙ্গে কথা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ির দ্বিতল বৈঠকখানায় গিয়া বসিয়াছেন। ঘরে অনেক নিমন্ত্রিত ব্যক্তি আসিয়াছেন।

বলরামের পিতা ও সারদাবাবু প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন।

ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “ও বাবুরা, আমি খেয়েছি, এখন তোমরা নিমন্ত্রণ খাও।”

অধরের নৈবেদ্য পূজা মা গ্রহণ করিয়াছেন, তাই কি শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার আবেশে বলিতেছেন, “আমি খেয়েছি, এখন তোমরা প্রসাদ পাও?”

ঠাকুর জগন্মাতাকে ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “মা আমি খাব? না, তুমি খাবে? মা কারণানন্দরূপিণী।”

শ্রীরামকৃষ্ণ কি জগন্মাতাকে ও আপনাকে এক দেখিতেছেন? যিনি মা তিনিই কি সন্তানরূপে লোকশিক্ষার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন? তাই কি ঠাকুর “আমি খেয়েছি” বলছেন?

এইবার ভাবাবেশে দেহের মধ্যে ষট্‌চক্র, তার মধ্যে মাকে দেখিতেছেন! তাই আবার ভাবে বিভোর হইয়া গান গাইতেছেন:

ভুবন ভুলিইলি মা, হরমোহিনী।
মূলাধারে মহোৎপলে, বীণাবাদ্য-বিনোদিনী ৷৷
আধার ভৈরবাকার, ষড়্‌ দলে শ্রীরাগ আর।
মণিপুরেতে মহ্লার বসন্তে হৃৎপ্রকাশিনী ৷৷
বিশুদ্ধ হিল্লোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে।
তান-লয়-মান-সুরে ত্রিসপ্ত-সুরভেদিনী ৷৷
মহামায়া মোহপাশে বদ্ধ কর আনায়াসে।
তত্ত্ব লয়ে তত্ত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী ৷৷
শ্রীনন্দকুমারে কয়, তত্ত্ব না নিশ্চয় হয়।
তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী ৷৷

গান — ভাব কি ভেবে পরাণ গেল।
যাঁর নামে হরে কাল, পদে মহাকাল, তাঁর কেন কালরূপ হল ৷৷
কালরূপ অনেক আছে, এ-বড় আশ্চর্য কালো,
যাঁরে হৃদিমাঝে রাখলে পরে হৃদপদ্ম করে আলো ৷৷
রূপে কালী, নামে কালী কাল হতে অধিক কালো।
ও-রূপ যে দেখেছে, সে মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভাল ৷৷
প্রসাদ বলে কুতুহলে এমন মেয়ে কোথায় ছিল।
না দেখে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হল ৷৷

অভয়ার শরণাগত হলে সকল ভয় যায়, তাই বুঝি ভক্তদের অভয় দিতেছেন ও গান গাইতেছেন:

অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি।
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি ৷৷

শ্রীযুক্ত সারদাবাবু পুত্রশোকে অভিভূত, তাই তাঁর বন্ধু অধর তাঁহাকে ঠাকুরের কাছে লইয়া আসিয়াছেন। তিনি গৌরাঙ্গ ভক্ত। তাঁহাকে দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীগৌরাঙ্গের উদ্দীপন হইয়াছে। ঠাকুর গাহিতেছেন:

আমার অঙ্গ কেন গৌর হল।
কি করলে রে ধনী, অকালে সকাল কৈলে, অকালেতে বরণ ধরালে ৷৷
এখন তো গৌর হতে দিন, বাকি আছে!
এখন তো দ্বাপর লীলা, শেষ হয় নাই!
একি হল রে! কোকিল ময়ূর, সকলই গৌর।
যেদিকে ফিরাই আঁখি (একি হল রে)।
একি, একি, গৌরময় সকল দেখি ৷৷
রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতো অঙ্গ বুঝি গৌর হল!
ধনী কুমুরিয়ে পোকা ছিল, তাইতে আপনার বরণ ধরাইল।
এখনি যে অঙ্গ কালো ছিল, দেখতে দেখতে গৌর হল!
রাই ভেবে কি রাই হলাম। (একি রে)
যে রাধামন্ত্র জপ না করে, রাই ধনী কি আপনার বরণ ধরায় তারে।
মথুরায় আমি, কি নবদ্বীপে আমি, কিছু ঠাওরাতে নারি রে!
এখনও তো, মহাদেব অদ্বৈত হয় নাই (আমার অঙ্গ কেন গৌর)।
এখনও তো বলাই দাদা নিতাই হয় নাই, বিশাখা রামানন্দ হয় নাই।
এখনও তো ব্রহ্মা হরিদাস হয় নাই, এখনও তো নারদ শ্রীবাস হয় নাই।
এখনও তো মা যশোদা শচী হয় নাই।
একাই কেন আমি গৌর (যখন বলাইদাদা নিতাই হয় নাই তখন)
তবে রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতে কি অঙ্গ আমার গৌর হল।
(অতএব বুঝি আমি গৌর) এখনও তো, পিতা নন্দ জগন্নাথ হয় নাই।
এখনও তো শ্রীরাধিকা গদাধর হয় নাই। আমার অঙ্গ কেন গৌর হল ৷৷

এইবার শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবে আবিষ্ট হইয়া গান গাহিতেছেন। বলিতেছেন, সারদাবাবু এই গান বড় ভালবাসেন:

ভাব হবে বই কি রে (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।
বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে। সুরধনী দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।
গোরা ফুকরি ফুকরি কান্দে! (যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহির্গৌর)
গোরা আপনার পা আপনি ধরে ৷৷

গান — পাড়ার লোকে গোল করে মা,

আমায় বলে গৌর কলঙ্কিনী।
একি কইবার কথা কইবো কোথা;
লাজে মলাম ওগো প্রাণ সজনী।
একদিন শ্রীবাসের বাড়ি, কীর্তনের ধুম হুড়াহুড়ি;
গৌরচাঁদ দেন গড়াগড়ি শ্রীবাস আঙিনায়;
আমি একপাশে দাঁড়িয়া ছিলাম, (একপাশে নুকায়ে),
আমি পড়লাম অচেতন হয়ে, চেতন করায় শ্রীবাসের রমণী।
একদিন কাজীর দলন, গৌর করেন নগর কীর্তন,
চণ্ডালাদি যতেক যবন, গৌর সঙ্গেতে;
হরিবোল হরিবোল বলে, চলে যান নদের বাজার দিয়ে,
আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে,
দেখেছিলাম রাঙা চরণ দুখানি।
একদিন জাহ্নবীর তটে; গৌরচাঁদ দাঁড়ায়ে ঘাটে,
চন্দ্রসূর্য উভয়েতে, গৌর অঙ্গেতে;
দেখে গৌর রূপের ছবি, ভুলে গেল শাক্ত শৈবী,
আমার কলসী পড়ে গেল দৈবী, দেখেছিল পাপ ননদিনী ৷৷

বলরামের পিতা বৈষ্ণব। তাই বুঝি এবার শ্রীরামকৃষ্ণ গোপীদের উদ্‌ভ্রান্ত প্রেমের গান গাহিতেছেন:

শ্যামের নাগাল পেলাম না গো সই।
আমি কি সুখে আর ঘরে রই।
শ্যাম যদি মোর হত মাথার চুল।
যতন করে বাঁধতুম বেণী সই, দিয়ে বকুল ফুল ৷৷
শ্যাম যদি মোর কঙ্কন হত বাহু মাঝে সতত রহিত।
(কঙ্কন নাড়া দিয়ে চলে যেতুম সই) (বাহু নাড়া দিয়ে)
(শ্যাম-কঙ্কন হাতে দিয়ে) (চলে যেতুম সই) (রাজপথে)
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১০ই অক্টোবর

শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্ম-সমন্বয়ে — বলরামের পিতার সঙ্গে কথা

বলরামের পিতার ভদ্রক প্রভৃতি উড়িষ্যার নানাস্থানে জমিদারী আছে ও তাঁহাদের বৃন্দাবন, পুরী, ভদ্রক প্রভৃতি নানাস্থানে দেবসেবা অতিথিশালা আছে। তিনি শেষ জীবনে শ্রীবৃন্দাবনে ৺শ্যামসুন্দরের কুঞ্জে তাঁহার সেবা লইয়া থাকিতেন।

বলরামের পিতা মহাশয় পুরাতন বৈষ্ণব। অনেক বৈষ্ণবভক্তেরা শাক্ত, শৈব ও বেদান্তবাদীদের সঙ্গে সহানুভূতি করেন না; কেহ কেহ তাঁদের বিদ্বেশ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু এরূপ সঙ্কীর্ণ মত ভালবাসেন না। তিনি বলেন যে, ব্যকুলতা থাকিলে সব পথ, সব মত দিয়া ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। অনেক বৈষ্ণবভক্ত বাহিরে মালা, গ্রন্থ পাঠ ইত্যাদি করেন কিন্তু ভগবানলাভের জন্য ব্যাকুলতা নাই। তাই বুঝি ঠাকুর বলরামের পিতা মহাশয়কে উপদেশ দিতেছেন।

[পূর্বকথা — শ্রীরামকৃষ্ণের বৈষ্ণব-বৈরাগীর ভেক গ্রহণ ও রামমন্ত্র গ্রহণ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — ভাবলাম কেন একঘেয়ে হব। আমিও বৃন্দবনে বৈষ্ণব-বৈরাগীর ভেক লয়েছিলাম; তিনদিন ওই ভাবে ছিলাম। আবার দক্ষিণেশ্বরে রামমন্ত্র লয়েছিলাম; দীর্ঘ ফোঁটা, গলায় হীরা; আবার কদিন পরে সব দূর করে দিলাম।

[বলরামের পিতাকে শিক্ষা — “ঈশ্বর সগুণ নির্গুণ, সাকার আবার নিরাকার” ]

“একজনের একটি গামলা ছিল। লোকে তার কাছে কাপড় ছোপাতে আসত। গামলায় রঙ গোলা আছে; কিন্তু যার যে রঙ দরকার ওই গামলাতে কাপড় ডোবালেই সেই রঙ হয়ে যেত। একজন তাই দেখে অবাক্‌ হয়ে রঙওয়ালাকে বলছে, এখন তুমি যে রঙে রঙেছ সেই রঙটি আমাকে দাও।”

ঠাকুর কি বলিতেছেন, সকল ধর্মের লোকই তাঁর কাছে আসিবে ও চৈতন্যলাভ করিবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন, “একটি গাছের উপর একটি বহুরূপী ছিল। একজন লোক দেখে গেল সবুজ, দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখল কালো, তৃতীয় ব্যক্তি হলদে; এইরূপ অনেক লোক ভিন্ন ভিন্ন রঙ দেখে গেল। তারা পরস্পরকে বলছে, না জানোয়ারটি সবুজ। কেউ বলছে লাল, কেউ বলছে হলদে আর ঝগড়া করছে। তখন গাছতলায় একটি লোক বসেছিল তার কাছে সকলে গেল। সে বললে, আমি এই গাছতলায় রাতদিন থাকি, আমি জানি এইটু বহুরূপী। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। আবার কখন কখন কোন রঙ থাকে না।”

শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলিতেছেন যে, ঈশ্বর সগুণ, নানারূপ ধরেন? আবার নির্গুণ কোন রঙ নাই, বাক্যমনের অতীত? আর তিনি ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ সব পথ দিয়াই ঈশ্বরের মাধুর্য রস পান করেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতার প্রতি) — বই আর পড়ো না, তবে ভক্তিশাস্ত্র পড়ো যেমন শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।

[রাধাকৃষ্ণলীলার অর্থ — রস ও রসিক — The one thing needful]

“কথাটা এই, তাঁকে ভালবাসা, তাঁর মাধুর্য আস্বাদন করা। তিনি রস, ভক্ত রসিক সেই রস পান করে। তিনি পদ্ম, ভক্ত অলি। ভক্ত পদ্মের মধু পান করে।

“ভক্ত যেমন ভগবান না হলে থাকতে পারে না, ভগবানও ভক্ত না হলে থাকতে পারেন না। তখন ভক্ত হন রস, ভগবান হন রসিক, ভক্ত হন পদ্ম, ভগবান হন অলি। তিনি নিজের মাধুর্য আস্বাদন করবার জন্য দুটি হয়েছেন, তাই রাধাকৃষ্ণলীলা।”

[বলরামের পিতাকে শিক্ষা — তীর্থাদি কর্ম, গলায় মালা, ভেক আচার কতদিন? ]

“তীর্থ, গলায় মালা, আচার — এ-সব প্রথম প্রথম করতে হয়। বস্তুলাভ হলে ভগবানদর্শন হলে, বাহিরের আড়ম্বর ক্রমে কমে যায়। তখন তাঁর নামটি নিয়েথাকা আর সমরণ-মনন।১

“ষোল টাকার পয়সা এক কাঁড়ি, কিন্তু ষোলটি টাকা যখন করলে, তখন আর অত কাঁড়ি দেখায় না। তাদের বদলে যখন একটি মোহর করলে, তখন কত কম হয়ে গেল। আবার সেটি বদলে যদি একটু হীরা কর, তাহলে লোকে টেরই পায় না।২

গলায় মালা আচার প্রভৃতি না থাকলে বৈষ্ণবেরা নিন্দা করেন। তাই কি ঠাকুর বলিতেছেন যে, ঈশ্বরদর্শনের পর মালা ভেক এ-সবের আঁট তত থাকে না? বস্তুলাভ হলে বাহিরের কর্ম কমে যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতার প্রতি) — কর্তাভজারা বলে, প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ, সিদ্ধের সিদ্ধ। প্রবর্তক ফোঁটা কাটে, গলায় মালা রাখে; আর আচারী। সাধক — তাদের অত বাহিরে আড়ম্বর থাকে না, যেমন বাউল। সিদ্ধ — যার ঠিক বিশ্বাস যে ঈশ্বর আছেন। সিদ্ধের সিদ্ধ — যেমন চৈতন্যদেব। ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন, আর সর্বদা কতাবার্তা আলাপ। সিদ্ধের সিদ্ধকেই ওরা সাঁই বলে। “সাঁইয়ের পর আর নাই”।

[বলরামের পিতাকে শিক্ষা — সাত্ত্বিক সাধনা, সব ধর্মের সমন্বয় ও গোঁরামী ত্যাগ করা ]

“সাধক নানারকম। সাত্ত্বিক সাধনা গোপনে, সাধক সাধন-ভজন গোপনে করে, দেখলে প্রাকৃত লোকের মতো বোধ হয়, মশারির ভিতর ধ্যান করে।

“রাজসিক সাধক বাহিরের আড়ম্বর রাখে, গলায় মালা, ভেক, গেরুয়া, গরদের কাপড়, সোনার দানা দেওয়া জপের মালা। যেমন সাইন বোর্ড মেরে বসা।”

বৈষ্ণবভক্তদের বেদান্তমতের অথবা শাক্তমতের উপর তত শ্রদ্ধা নাই। বলরামের পিতা মহাশয়কে ওইরূপ সঙ্কীর্ণ ভাব পরিত্যাগ করিতে ঠাকুর উপদেশ দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতা প্রভৃতির প্রতি) — যে ধর্মই হোক, যে মতই হোক, সকলেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে; তাই কোন ধর্ম, কোন মতকে অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা করতে নাই। বেদে তাঁকেই বলছে, সচ্চিদানন্দঃ ব্রহ্ম; ভাগবতাদি পুরাণে তাঁকেই বলছে, সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ, তন্ত্রে বলেছে, সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ। সেই এক সচ্চিদানন্দ।

বৈষ্ণবদের নানা থাক থাক আছে। বেদে তাঁকে ব্রহ্ম বলে, একদল বৈষ্ণবেরা তাঁকে বলে, আলেক নিরঞ্জন। আলেক অর্থাৎ যাঁকে লক্ষ্য করা যায় না, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখা যায় না। তারা বলে, রাধা আর কৃষ্ণ আলেকের দুটি ফুট।

“বেদান্তমতে অবতার নাই, বেদান্তবাদীরা বলে রাম, কৃষ্ণ, এরা সচ্চিদানন্দ সাগরের দুটি ঢেউ।

“এক বই তো দুই নাই; যে যা বলে, যদি আন্তরিক ঈশ্বরকে ডাকে, তাঁর কাছে নিশ্চয় পঁহুছিবে। ব্যাকুলতা থাকলেই হল।”

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে বিভোর হইয়া ভক্তদের এই সকল কথা বলিতেছিলেন। এইবার একটু প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন ও বলিতেছেন, “তুমি বলরামের বাপ?”

[বলরামের পিতাকে শিক্ষা — “ব্যকুল হও” ]

সকলে একটু চুপ করিয়া আছেন, বলরামের বৃদ্ধ পিতা নিঃশব্দে হরিনামের মালা জপ করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতির প্রতি) — আচ্ছা, এরা এত জপ করে, এত তীর্থ করেছে, তবু এরকম কেন? যেন আঠার মাসে এক বৎসর!

“হরিশকে বললুম, কাশী যাওয়া কি দরকার যদি ব্যাকুলতা না থাকে। ব্যাকুলতা থাকলে, এইখানেই কাশী।

“এত তীর্থ, এত জপ করে, হয় না কেন? ব্যাকুলতা নাই। ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দেন!

“যাত্রার গোড়ায় অনেক খচমচ খচমচ করে; তখন শ্রীকৃষ্ণকে দেখা যায় না। তারপর নারদ ঋষি যখন ব্যাকুল হয়ে বৃন্দাবনে এসে বীণা বাজাতে বাজাতে ডাকে আর বলে, প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন! তখন কৃষ্ণ আর থাকতে পারেন না। রাখালদের সঙ্গে সামনে আসেন, আর বলেন, ধবলী রও! ধবলী রও!”

১ যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাৎ … কার্যং ন বিদ্যতে ৷৷ [গীতা, ৩।১৭]
পরে ব্রহ্মণি বিঞ্চাতে সমস্তৈর্নিয়মৈরলম্‌।
তালবৃন্তেন কিং প্রয়োজনং প্রাপ্তে মলয়মারুতে ৷৷

২ A merhchantman sold all, woundup his business, and bought a pearl of great price. — Bible.
=============

Post a Comment

0 Comments