সপ্তবিংশ খণ্ড~দ্বিতীয় ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
দ্বিতীয় ভাগ 

সপ্তবিংশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে

সপ্তবিংশ খণ্ড ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে

============

প্রথম পরিচ্ছেদ

রাখাল, শশী, মাস্টার, নরেন্দ্র, ভবনাথ, সুরেন্দ্র, রাজেন্দ্র, ডাক্তার
কাশীপুরের বাগান। রাখাল, শশী ও মাস্টার সন্ধ্যার সময় উদ্যানপথে পাদচারণ করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পীড়িত — বাগানে চিকিৎসা করাইতে আসিয়াছেন। তিনি উপরে দ্বিতলের ঘরে আছেন, ভক্তেরা তাঁহার সেবা করিতেছেন। আজ বৃহস্পতিবার, ২২শে এপ্রিল ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ, গুড ফ্রাইডে-এর পূর্বদিন।
মাস্টার — তিনি তো গুণাতীত বালক।
শশী ও রাখাল — ঠাকুর বলেছেন, তাঁর ওই অবস্থা।
রাখাল — যেমন একটা টাওয়ার। সেখানে বসে সব খবর পাওয়া যায়, দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু কেউ যেতে পারে না, কেউ নাগাল পায় না।
মাস্টার — ইনি বলেছেন, এ-অবস্থায় সর্বদা ঈশ্বরদর্শন হতে পারে। বিষয়রস নাই, তাই শুষ্ক কাঠ শীঘ্র ধরে যায়।
শশী — বুদ্ধি কত রকম, চারুকে বলছিলেন। যে বুদ্ধিতে ভগবানলাভ হয়, সেই ঠিক বুদ্ধি। যে বুদ্ধিতে টাকা হয়, বাড়ি হয়, ডেপুটির কর্ম হয়, উকিল হয় সে বুদ্ধি চিঁড়েভেজা বুদ্ধি। সে বুদ্ধিতে জোলো দইয়ের মতো চিঁড়েটা ভেজে মাত্র। শুকো দইয়ের মতো উঁচুদরের দই নয়। যে বুদ্ধিতে ভগবানলাভ হয়, সেই বুদ্ধিই শুকো দইয়ের মতো উৎকৃষ্ট দই।
মাস্টার — আহা! কি কথা!
শশী — কালী তপস্বী ঠাকুরের কাছে বলেছিলেন, ‘কি হবে আনন্দ? ভীলদের তো আনন্দ আছে। অসভ্য হো-হো নাচছে-গাইছে।’
রাখাল — উনি বললেন, সে কি? ব্রহ্মানন্দ আর বিষয়ানন্দ এক? জীবেরা বিষয়ানন্দ নিয়ে আছে। বিষয়াসক্তি সব না গেলে ব্রহ্মানন্দ হয় না। একদিকে টাকার আনন্দ, ইন্দ্রিয়সুখের আনন্দ, আর-একদিকে ঈশ্বরকে পেয়ে আনন্দ। এই দুই কখন সমান হতে পারে? ঋষিরা এ ব্রহ্মানন্দ ভোগ করেছিলেন।
মাস্টার — কালী এখন বুদ্ধদেবকে চিন্তা করেন কিনা তাই সব আনন্দের পারের কথা বলছেন।
রাখাল — তাঁর কাছেও বুদ্ধদেবের কথা তুলেছিল। পরমহংসদেব বললেন, “বুদ্ধদেব অবতার, তাঁর সঙ্গে কি ধরা? বড় ঘরের বড় কথা।” কালী বলেছিল, “তাঁর শক্তি তো সব। সেই শক্তিতেই ঈশ্বরের আনন্দ আর সেই শক্তিতেই তো বিষয়ানন্দ হয় –
মাস্টার — ইনি কি বললেন?
রাখাল — ইনি বললেন, সে কি? সন্তান উৎপাদনের শক্তি আর ঈশ্বরলাভের শক্তি কি এক?
[শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে — “কামিনী-কাঞ্চন বড় জঞ্জাল” ]
বাগানের সেই দোতলার ‘হল’ ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরীর উত্তরোত্তর অসুস্থ হইতেছে, আজ আবার ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ও ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত দেখিতে আসিয়াছেন — যদি চিকিৎসার দ্বারা কোন উপকার হয়। ঘরে নরেন্দ্র, রাখাল, শশী, সুরেন্দ্র, মাস্টার, ভবনাথ ও অন্যন্য অনেক ভক্তেরা আছেন।
বাগানটি পাকপারার বাবুদের। ভাড়া দিতে হয় — প্রায় ৬০ – ৬৫ টাকা। ছোকরা ভক্তেরা প্রায় বাগানেই থাকেন। তাঁহারাই নিশিদিন ঠাকুরের সেবা করেন। গৃহী ভক্তেরা সর্বদা আসেন ও মাঝে মাঝে রাত্রেও থাকেন। তাঁহাদেরও নিশিদিন ঠাকুরের সেবা করিবার ইচ্ছা। কিন্তু সকলে কর্মে বদ্ধ — কোন না কোন কর্ম করিতে হয়। সর্বদা ওখানে থাকিয়া সেবা করিতে পারেন না। বাগানের খরচ চালাইবার জন্য যাহার যাহা শক্তি ঠাকুরের সেবার্থ প্রদান করেন; অধিকাংশ খরচ সুরেন্দ্র দেন! তাঁহারই নামে বাগানভাড়ার লেখাপড়া হইয়াছে। একটি পাচক ব্রাহ্মণ ও একটি দাসী সর্বদা নিযুক্ত আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তার সরকার ইত্যদির প্রতি) — বড় খরচা হচ্ছে।
ডাক্তার (ভক্তদিগকে দেখাইয়া) — তা এরা সব প্রস্তুত। বাগানের খরচ সমস্ত দিতে এদের কোন কষ্ট নাই। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — এখন দেখ, কাঞ্চন চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — বল্‌ না?
ঠাকুর নরেন্দ্রকে উত্তর দিতে আদেশ করিলেন। নরেন্দ্র চুপ করিয়া আছেন। ডাক্তার আবার কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার — কাঞ্চন চাই। আবার কামিনীও চাই।
রাজেন্দ্র ডাক্তার — এঁর পরিবার রেঁধে বেড়ে দিচ্ছেন।
ডাক্তার সরকার (ঠাকুরের প্রতি) — দেখলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাস্য করিয়া) — বড় জঞ্জাল!
ডাক্তার সরকার — জঞ্জাল না থাকলে তো সবাই পরমহংস।
শ্রীরামকৃষ্ণ — স্ত্রীলোক গায়ে ঠেকলে অসুখ হয়; যেখানে ঠেকে সেখানটা ঝনঝন করে, যেন শিঙি মাছের কাঁটা বিঁধলো।
ডাক্তার — তা বিশ্বাস হয়, — তবে না হলে চলে কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — টাকা হাতে করলে হাত বেঁকে যায়! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। টাকাতে যদি কেউ বিদ্যার সংসার করে, — ঈশ্বরের সেবা — সাধু-ভক্তের সেবা করে — তাতে দোষ নাই।
“স্ত্রীলোক নিয়ে মায়ার সংসার করা! তাতে ঈশ্বরকে ভুলে যায়। যিনি জগতের মা, তিনিই এই মায়ার রূপ — স্ত্রীলোকের রূপ ধরেছেন। এটি ঠিক জানলে আর মায়ার সংসার করতে ইচ্ছা হয় না। সব স্ত্রীলোককে ঠিক মা বোধ হলে তবে বিদ্যার সংসার করতে পারে। ঈশ্বর দর্শন না হলে স্ত্রীলোক কি বস্তু বোঝা যায় না।”
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খাইয়া ঠাকুর কয়দিন একটু ভাল আছেন।
রাজেন্দ্র সেরে উঠে আপনার হোমিওপ্যাথি মতে ডাক্তারি করতে হবে। আর তা না হলে বেঁচে বা কি ফল? (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র — Nothing like leather (যে মুচির কাজ করে, সে বলে, চামড়ার মতো উৎকৃষ্ট জিনিস এ জগতে আর কিছু নাই।) (সকলের হাস্য)
কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তারেরা চলিয়া গেলেন।
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ কেন কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করেছেন
ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। ‘কামিনী’ সম্বন্ধে আপনার অবস্থা বলিতেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — এরা কামিনী-কাঞ্চন না হলে চলে না, বলছে। আমার যে কি অবস্থা তা জানে না।
“মেয়েদের গায়ে হাত লাগলে হাত আড়ষ্ট, ঝনঝন করে।
“যদি আত্মীয়তা করে কাছে গিয়ে কথা কইতে যাই, মাঝে যেন কি একটা আড়াল থাকে, সে আড়ালের ওদিকে যাবার জো নাই।
“ঘরে একলা বসে আছি, এমন সময় যদি কোন মেয়ে এসে পড়ে, তাহলে একেবারে বালকের অবস্থা হয়ে যাবে; আর সেই মেয়েকে মা বলে জ্ঞান হবে।”
মাস্টার অবাক্‌ হইয়া ঠাকুরের বিছানার কাছে বসিয়া এই সকল কথা শুনিতছেন। বিছানা হইতে একটু দূরে ভবনাথের সহিত নরেন্দ্র কথা কহিতেছেন। ভবনাথ বিবাহ করিয়াছেন; — কর্ম কাজের চেষ্টা করিতেছেন। কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরকে দেখিতে আসিতে বেশি পারেন না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভবনাথের জন্য বড় চিন্তিত থাকেন, কেন না ভবনাথ সংসারে পড়িয়াছেন। ভবনাথের বয়স ২৩।২৪ হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — ওকে খুব সাহস দে।
নরেন্দ্র ও ভবনাথ ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া একটু হাসিতে লাগিলেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া আবার ভবনাথকে বলিতেছেন — “খুব বীরপুরুষ হবি। ঘোমটা দিয়ে কান্নাতে ভুলোসনে। শিকনি ফেলতে ফেলতে কান্না! (নরেন্দ্র ও মাস্টারের হাস্য)
“ভগবানেতে মন ঠিক রাখবি; যে বীরপুরুষ সে রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ! পরিবারের সঙ্গে কেবল ঈশ্বরীয় কথা কবি।”
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর আবার ইশারা করিয়া ভবনাথকে বলিতেছেন, “আজ এখানে খাস।”
ভবনাথ — জে আজ্ঞা। আমি বেশ আছি।
সুরেন্দ্র আসিয়া বসিয়াছেন। বৈশাখ মাস। ভক্তেরা ঠাকুরকে সন্ধ্যার পর প্রত্যহ মালা আনিয়া দেন। সেই মালাগুলি ঠাকুর এক-একটি করিয়া গলায় ধারণ করেন। সুরেন্দ্র নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুর প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে দুইগাছি মালা দিলেন। সুরেন্দ্রও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া সেই মালা মস্তকে ধারণ করিয়া গলায় পরিলেন।
সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছেন ও ঠাকুরকে দেখিতেছেন। এইবার সুরেন্দ্র ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন; তিনি বিদায় গ্রহণ করিবেন। যাইবার সময় ভবনাথকে ডাকিয়া বলিলেন, খসখসের পর্দা টাঙিয়ে দিও। বড় গ্রীষ্ম পড়িয়াছে। ঠাকুরের উপরের হলঘর দিনের বেলায় বড় গরম হয়। তাই সুরেন্দ্র খসখসের পর্দা করিয়া আনিয়াছেন।
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ হীরানন্দ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে
[ঠাকুরের উপদেশ — “যো কুছ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়” — নরেন্দ্র ও হীরানন্দের চরিত্র ]
কাশীপুরের বাগান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপরের হলঘরে বসিয়া আছেন। সম্মুখে হীরানন্দ, মাস্টার, আরও দু-একটি ভক্ত, আর হীরানন্দের সঙ্গে দুইজন বন্ধু আসিয়াছেন। হীরানন্দ সিন্ধুদেশনবাসী। কলিকাতার কলেজে পড়াশুনা করিয়া দেশে ফিরিয়া গিয়া সেখানে এতদিন ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ হইয়াছে শুনিয়া তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। সিন্ধুদেশ কলিকাতা হইতে প্রায় এগার শত ক্রোশ হইবে। হীরানন্দকে দেখিবার জন্য ঠাকুর ব্যস্ত হইয়াছিলেন।
ঠাকুর হীরানন্দের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মাস্টারকে ইঙ্গিত করিলেন, — যেন বলিতেছেন, ছোকরাটি খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আলাপ আছে?
মাস্টার — আজ্ঞে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দ ও মাস্টারের প্রতি) — তোমরা একটু কথা কও, আমি শুনি।
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নরেন্দ্র আছে? তাকে ডেকে আন।”
নরেন্দ্র উপরে আসিলেন ও ঠাকুরের কাছে বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্র ও হীরানন্দকে) — একটু দুজনে কথা কও।
হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন। অনেক ইতস্তত করিয়া তিনি কথা আরম্ভ করিলেন।
হীরানন্দ (নরেন্দ্রের প্রতি) — আচ্ছা, ভক্তের দুঃখ কেন?
হীরানন্দর কথাগুলি যেন মধুর ন্যায় মিষ্ট। কথাগুলি যাঁহারা শুনিলেন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে, এঁর হৃদয় প্রেমপূর্ণ।
নরেন্দ্র — The scheme of the universe is devilish! I could have created a beter world! (এ জগতের বন্দোবস্ত দেখে বোধ হয় যে, শয়তানে করেছে, আমি এর চেয়ে ভাল জগৎ সৃষ্টি করতে পারতাম।)
হীরানন্দ — দুঃখ না থাকলে কি সুখ বোধ হয়?
নরেন্দ্র — I am giving no scheme of the universe but simply my opinion of the present scheme. (জগৎ কি উপাদানে সৃষ্টি করতে হবে, আমি তা বলছি না। আমি বলছি — যে বন্দোবস্ত সামনে দেখছি, সে বন্দোবস্ত ভাল নয়।)
“তবে একটা বিশ্বাস করলে সব চুকে যায়। Our only refuge is in pantheism: সবই ঈশ্বর, — এই বিশ্বাস হলেই চুকে যায়! আমিই সব করছি।”
হীরানন্দ — ও-কথা বলা সোজা।
নরেন্দ্র নির্বাণষট্‌কম্‌ সুর করিয়া বলিতেছেন:
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ১
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পঞ্চবায়ুর্ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পঞ্চকোষাঃ।
না বাক্‌পাণিপাদং ন চোপস্থপায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ২
ন মে দ্বেষরাগৌ ন মে লাভমোহৌ মদো নৈব মে নৈব মাৎসর্যভাবঃ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ৩
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা চিদানন্দরূপং শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ৪
ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম।
ন বন্ধুর্নমিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ৫
অহং নির্বিকল্পো নিরাকাররূপো বিভুত্বা সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়াণাম্‌।
ন চাসঙ্গতং নৈব মুক্তির্নমেয়শ্চিদানন্দরূপং শিবোঽহং শিবোঽহম্‌।। ৬
হীরানন্দ — বেশ।
ঠাকুর হীরানন্দকে ইশারা করিলেন, ইহার জবাব দাও।
হীরানন্দ — এককোণ থেকে ঘর দেখাও যা, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘর দেখাও তা। হে ঈশ্বর! আমি তোমার দাস — তাতেও ঈশ্বরানুভব হয়, আর সেই আমি, সোঽহম্‌ — তাতেও ঈশ্বরানুভব। একটি দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়, আর নানা দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়।
সকলে চুপ করিয়া আছেন। হীরানন্দ নরেন্দ্রকে বলিলেন, একটু গান বলুন।
নরেন্দ্র সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম্‌ গাইতেছেন:
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ১
মূলং তরোঃ কেবলমাশ্রয়ন্তঃ, পাণিদ্বয়ং ভোক্তুমামন্ত্রয়ন্তঃ।
কন্থামিব শ্রীমপি কুৎসয়ন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ২
স্বানন্দভাবে পরিতুষ্টিমন্তঃ, সুশান্তসর্বেনিদ্রয়বৃত্তিমন্তঃ।
অহনির্শ ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৩
ঠাকুর যেই শুনিলেন — অহনির্শ ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ — অমনি আস্তে আস্তে বলিতেছেন, আহা! আর ইশারা করিয়া দেখাইতেছেন, “এইটি যোগীর লক্ষণ।”
নরেন্দ্র কৌপীনপঞ্চকম্‌ শেষ করিতেছেন:
দেহাদিভাবং পরিবর্তয়ন্তঃ, স্বাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তঃ।
নান্তং ন মধ্যং ন বহিঃ সমরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৪
ব্রহ্মাক্ষরং পাবনমুচ্চরন্তো, ব্রহ্মাহমস্মীতি বিভাবয়ন্তঃ
ভিক্ষাশিনো দিক্ষু পরিভ্রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৫
নরেন্দ্র আবার গাইতেছেন:
পরিপূর্ণমানন্দম্‌।
অঙ্গ বিহীনং স্মর জগন্নিধানম্‌।
শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্বাচোঽবাচং।
বাগতীতং প্রাণস্য প্রাণং পরং বরেণ্যম্‌।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — আর ওইটে “যো কুছ্‌ হ্যায় সব্‌ তুঁহি হ্যায়!”
নরেন্দ্র ওই গানটি গাইতেছেন:
তুঝ্‌সে হাম্‌নে দিলকো লাগায়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সব্‌ তুঁহি হ্যায়!।
এক তুঝ্‌কো আপ্‌না পায়া, যো কুছ হ্যায় সব্‌ তুঁহি হ্যায়।
দিল্‌কা মকাঁ সব্‌কী মকী তু, কৌন্‌সা দিল্‌ হ্যায় জিস্‌মে নহি তুঁ,
হরিয়েক্‌ দিল্‌মে তুনে সমায়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
কেয়া মলায়েক্‌ কেয়া ইন্‌সান্‌, কেয়া হিন্দু কেয়া মুসলমান্‌,
জায়্‌সা চাহা তুনে বানায়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
কাবা মে কেয়া অওর্‌ দায়ের্‌ মে কেয়া, তেরী পারাস্তিস্‌ হায়গী সাব জাঁ,
আগে তেরে সির সভোঁনে ঝুকায়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
আর্‌স্‌ সে লে ফার্স জমী তাক্‌। আওর জমীন সে আর্‌স্‌ বারী তক্‌,
যাহাঁ মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
সোচা সম্‌ঝা দেখা ভালা, তু জায়সা না কোই ঢুঁড়্‌ নিকালা,
আব ইয়ে সমঝ্‌ মে জাফার কী আয়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
“হরিয়েক্‌ দিল্‌মে” এই কথাগুলি শুনিয়া ঠাকুর ইশারা করিয়া বলিতেছেন যে, তিনি প্রত্যেকের হৃদয়ে আছেন, তিনি অন্তর্যামী। “যাঁহা মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্‌ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়!” হীরানন্দ এইটি শুনিয়া নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, — সব্‌ তুঁহি হ্যায়; এখন তুঁহুঁ তুঁহুঁ। আমি নয়; তুমি!
নরেন্দ্র — Give me one and I will give you a million (আমি যদি এক পাই, তাহলে নিযুত কোটি এ-সব আনায়াসে করতে পারি — অর্থাৎ ১-এর পর শূন্য বসাইয়া।) তুমিও আমি, আমিও তুমি, আমি বই আর কিছু নাই।
এই বলিয়া নরেন্দ্র অষ্টাবক্রসংহিতা হইতে কতকগুলি শ্লোক আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আবার সকলে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি, নরেন্দ্রকে দেখাইয়া) — যেন খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে বেড়াচ্চে।
(মাস্টারের প্রতি, হীরানন্দকে দেখাইয়া) — “কি শান্ত! রোজার কাছে জাতসাপ যেমন ফণা ধরে চুপ করে থাকে!’
========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ঠাকুরের আত্মপূজা — গুহ্যকথা — মাস্টার, হীরানন্দ প্রভৃতি সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তর্মুখ। কাছে হীরানন্দ ও মাস্টার বসিয়া আছেন। ঘর নিস্তব্ধ। ঠাকুরের শরীরে অশ্রুতপূর্ব যন্ত্রণা; ভক্তেরা যখন এক-একবার দেখেন, তখন তাঁহাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। ঠাকুর কিন্তু সকলকেই ভুলাইয়া রাখিয়াছেন। বসিয়া আছেন সহাস্যবদন!
ভক্তেরা ফুল ও মালা আনিয়া দিয়াছেন। ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে নারায়ণ, তাঁহারই বুঝি পূজা করিতেছেন। এই যে ফুল লইয়া মাথায় দিতেছেন। কণ্ঠে, হৃদয়ে, নাভিদেশে। একটি বালক ফুল লইয়া খেলা করিতেছে।
ঠাকুরের যখন ঈশ্বরীয়ভাব উপস্থিত হয়, তখন বলেন যে, শরীরের মধ্যে মহাবায়ু ঊর্ধ্বগামী হইয়াছে। মহাবায়ু উঠিলে ঈশ্বরের অনুভূতি হয়, — সর্বদা বলেন। এইবার মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — বায়ু কখন উঠেছে জানি না।
“এখন বালকভাব। তাই ফুল নিয়ে এই রকম কচ্ছি। কি দেখছি জানো? শরীরটা যেন বাঁখারিসাজানো কাপড়মোড়া, সেইটে নরছে। ভিতরে একজন আছে বলে তাই নড়ছে।
“যেন কুমড়ো-শাঁসবিচি ফেলা। ভিতরে কামাদি-আসক্তি কিছুই নাই। ভিতর সব পরিষ্কার। আর –”
ঠাকুরের বলিতে কষ্ট হইতেছে। বড় দুর্বল। মাস্টার তাড়াতাড়ি ঠাকুর কি বলিতে যাইতেছেন একটা আন্দাজ করিয়া বলিতেছেন, “আর অন্তরে ভগবান দেখছেন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — অন্তরে বাহিরে, দুই দেখছি। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ কেবল একটা খোল আশ্রয় করে এই খোলের অন্তরে-বাহিরে রয়েছেন! এইটি দেখছি।
মাস্টার ও হীরানন্দ এই ব্রহ্মদর্শনকথা শুনিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর তাঁহাদের দিকে দৃষ্টি করিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি) — তোমাদের সব আত্মীয়বোধ হয়। কেউ পর বোধ হয় না।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগাবস্থা — অখণ্ডদর্শন ]
“সব দেখছি একটা খোল নিয়ে মাথা নাড়ছে।
“দেখছি, যখন তাঁতে মনের যোগ হয়, তখন কষ্ট একধারে পড়ে থাকে।[1]
“এখন কেবল দেখছি একটা চামড়া ঢাকা অখণ্ড, আর-একপাশে গলার ঘা-টা পড়ে রয়েছে।”
ঠাকুর আবার চুপ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন, জড়ের সত্তা চৈতন্য লয়, আর চৈতন্যের সত্তা জড় লয়। শরীরের রোগ হলে বোধ হয় আমার রোগ হয়েছে।
হীরানন্দ ওই কথাটি বুঝিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। তাই মাস্টার বলিতেছেন — “গরম জলে হাত পুড়ে গেলে বলে, জলে হাত পুড়ে গেল। কিন্তু তা নয়, হীট (Heat)-এতেa হাত পুড়ে গেছে।
হীরানন্দ (ঠাকুরের প্রতি) — আপনি বলুন, কেন ভক্ত কষ্ট পায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেহের কষ্ট।
ঠাকুর আবার কি বলিবেন। উভয়ে অপেক্ষা করিতেছেন।
ঠাকুর বলিতেছেন — “বুঝতে পারলে?”
মাস্টার আস্তে আস্তে হীরানন্দকে কি বলিতেছেন —
মাস্টার — লোকশিক্ষার জন্য। নজির। এত দেহের কষ্টমধ্যে ঈশ্বরে মনের ষোল আনা যোগ!
হীরানন্দ — হাঁ, যেমন Christ-Hl Crucifixion। তবে এই Mystery, এঁকে কেন যন্ত্রণা?
মাস্টার — ঠাকুর যেমন বলেন, মার ইচ্ছা। এখানে তাঁর এইরূপই খেলা।
ইঁহারা দুজন আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া হীরানন্দকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন। হীরানন্দ ইশারা বুঝিতে না পারাতে ঠাকুর আবার ইশারা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “ও কি বলছে?”
হীরানন্দ — ইনি লোকশিক্ষার কথা বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-কথা অনুমানের বই তো নয়। (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি) — অবস্থা বদলাচ্ছে, মনে করিছি চৈতন্য হউক, সকলেকে বলব না। কলিতে পাপ বেশি, সেই সব পাপ এসে পড়ে।
মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি) — সময় না দেখে বলবেন না। যার চৈতন্য হবার সময় হবে, তাকে বলবেন।
———————
১ যং লব্‌ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ৷৷ [গীতা, ৬।২২]
=========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি? হীরানন্দকে উপদেশ — নিবৃত্তিই ভাল
হীরানন্দ ঠাকুরের পায়ে হাত বুলাইতেছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন। লাটু ও আর দু-একটি ভক্ত ঘরে মাঝে মাঝে আসিতেছেন। শুক্রবার, ২৩শে এপ্রিল, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। আজ গুড্‌ ফ্রাইডে, বেলা প্রায় দুই প্রহর একটা হইয়াছে। হীরানন্দ আজ এখানেই অন্নপ্রসাদ পাইয়াছেন। ঠাকুরের একান্ত ইচ্ছা হইয়াছিল যে, হীরানন্দ এখানে থাকেন।
হীরানন্দ পায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন। সেই মিষ্ট কথা আর মুখ হাসি হাসি। যেন বালককে বুঝাইতেছেন। ঠাকুর অসুস্থ। ডাক্তার সর্বদা দেখিতেছেন।
হীরানন্দ — তা অত ভাবেন কেন? ডাক্তারে বিশ্বাস করলেই নিশ্চিন্ত। আপনি তো বালক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — ডাক্তারে বিশ্বাস কই? সরকার (ডাক্তার) বলেছিল, “সারবে না”।
হীরানন্দ — তা অত ভাবনা কেন? যা হবার হবে।
মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি, জনান্তিকে) — উনি আপনার জন্য ভাবছেন না। ওঁর শরীররক্ষা ভক্তের জন্য।
বড় গ্রীষ্ম। আর মধ্যাহ্নকাল। খসখসের পর্দা টাঙ্গানো হইয়াছে। হীরানন্দ উঠিয়া পর্দাটি ভাল করিয়া টাঙ্গাইয়া দিতেছেন। ঠাকুর দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) — তবে পাজামা পাঠিয়ে দিও।
হীরানন্দ বলিয়াছেন, তাদের দেশের পাজামা পরিলে ঠাকুর আরামে থাকিবেন। তাই ঠাকুর স্মরণ করাইয়া দিতেছেন, যেন তিনি পাজামা পাঠাইয়া দেন।
হীরানন্দের খাওয়া ভাল হয় নাই। ভাত একটু চাল চাল ছিল। ঠাকুর শুনিয়া বড় দুঃখিত হইলেন, আর বার বার তাঁহাকে বলিতেছেন, জলখাবার খাবে? এত অসুখ, কথা কহিতে পারিতেছেন না; তথাপি বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
আবার লাটুকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তোদেরও কি ওই ভাত খেতে হয়েছিল?
ঠাকুর কোমড়ে কাপড় রাখিতে পারিতেছেন না। প্রায় বালকের মতো দিগম্বর হইয়াই থাকেন। হীরানন্দের সঙ্গে দুইটি ব্রাহ্ম ভক্ত আসিয়াছেন। তাই কাপড়খানি এক-একবার কোমরের কাছে টানিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) — কাপড় খুলে গেলে তোমরা কি অসভ্য বল?
হীরানন্দ — আপনার তাতে কি? আপনি তো বালক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটি ব্রাহ্ম ভক্ত প্রিয়নাথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া) — উনি বলেন।
হীরানন্দ এইবার বিদায় গ্রহণ করিবেন। তিনি দু-একদিন কলিকাতায় থাকিয়া আবার সিন্ধুদেশে গমন করিবেন। সেখানে তাঁহার কাজ আছে। দুইখানি সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে চার বৎসর ধরিয়া ওই কার্য করিয়াছিলেন। সংবাদপত্রের নাম, সিন্ধু টাইমস্‌ (Sind Times) এবং সিন্ধু সুধার (Sind Sudhar); হীরানন্দ ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বি. এ. উপাধি পাইয়াছিলেন। হীরানন্দ সিন্ধুবাসী। কলিকাতায় পড়াশুনা করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত কেশব সেনকে সর্বদা দর্শন ও তাঁহার সহিত সর্বদা আলাপ করিতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কালীবাড়িতে মাঝে মাঝে আসিয়া থাকিতেন।
[হীরানন্দের পরীক্ষা — প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি) — সেখানে নাই বা গেলে?
হীরানন্দ (সহাস্যে) — বাঃ আর যে সেখানে কেউ নাই! আর সব যে চাকরি করি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি মাহিনা পাও?
হীরানন্দ (সহাস্যে) — এ-সব কাজে কম মাহিনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কত?
হীরানন্দ হাসিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখানে থাক না?
[হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।]
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি হবে কর্মে?
হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।
হীরানন্দ আর একটু কথাবার্তার পর বিদায় গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কবে আসবে?
হীরানন্দ — পরশু সোমবার দেশে যাব। সোমবার সকালে এসে দেখা করব।
========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

মাস্টার, নরেন্দ্র, শরৎ প্রভৃতি
মাস্টার ঠাকুরের কাছে বসিয়া। হীরানন্দ এইমাত্র চলিয়া গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — খুব ভাল; না?
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ; স্বভাবটি বড় মধুর।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বললে এগার শো ক্রোশ। অত দূর থেকে দেখতে এসেছে।
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, খুব ভালবাসা না থাকলে এরূপ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বড় ইচ্ছা, আমায় সেই দেশে নিয়ে যায়।
মাস্টার — যেতে বড় কষ্ট হবে। রেলে ৪।৫ দিনের পথ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনটে পাস!
মাস্টার — আজ্ঞে, হাঁ।
ঠাকুর একটু শ্রান্ত হইয়াছেন। বিশ্রাম করিবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — পাখি খুলে দাও আর মাদুরটা পেতে দাও।
ঠাকুর খড়খড়ির পাখি খুলিয়া দিতে বলিতেছেন। আর বড় গরম, তাই বিছানার উপর মাদুর পাতিয়া দিতে বলিতেছেন।
মাস্টার হাওয়া করিতেছেন। ঠাকুরের একটু তন্দ্রা আসিয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু নিদ্রার পর, মাস্টারের প্রতি) — ঘুম কি হয়েছিল?
মাস্টার — আজ্ঞে, একটু হয়েছিল।
নরেন্দ্র, শরৎ ও মাস্টার নিচে হলঘরের পূর্বদিকে কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র — কি আশ্চর্য! এত বৎসর পড়ে তবু বিদ্যা হয় না; কি করে লোকে বলে যে, দু-তিনদিন সাধন করেছি, ভগবানলাভ হবে! ভগবানলাভ কি এত সোজা! (শরতের প্রতি) তোর শান্তি হয়েছে; মাস্টার নহাশয়ের শান্তি হয়েছে, আমার কিন্তু হয় নাই।
মাস্টার — তাহলে তুমি বরং জাব দাও, আমরা রাজবাড়ি যাই; না হয় আমরা রাজবাড়ি যাই আর তুমি জাব দাও! (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র (সহাস্যে) — ওই গল্প উনি (পরমহংসদেব) শুনেছিলেন — আর শুনতে শুনতে হেসেছিলেন।[1])
——————
১ কথাটি প্রহ্লাদ চরিত্রের। প্রহ্লাদের বাবা, ষণ্ড আর অমর্ক, দুই গুরু মহাশয়কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজা জিঞ্চাসা করিবেন, প্রহ্লাদকে তারা কেন হরিনাম শিখাইয়াছে? তাদের রাজার কাছে যেতে ভয় হয়েছিল। তাই ষণ্ড অমর্ককে ওই কথা বলছে।

==========

সপ্তম পরিচ্ছেদ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রাদি ভক্তের মজলিশ

বৈকাল হইয়াছে। উপরের হলঘরে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র, শরৎ, শশী, লাটু, নিত্যগোপাল, কেদার, গিরিশ, রাম, মাস্টার, সুরেশ অনেকেই আছেন।
সকলের অগ্রে নিত্যগোপাল আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবামাত্র তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া বন্দনা করিয়াছেন। উপবেশনানন্তর নিত্যগোপাল বালকের ন্যায় বলিতেছেন কেদারবাবু এসেছে।
কেদার অনেকদিন পরে ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। তিনি বিষয়কর্ম উপলক্ষে ঢাকায় ছিলেন। সেখানে ঠাকুরের অসুখের কথা শুনিয়া আসিয়াছেন। কেদার ঘরে প্রবেশ করিয়াই ঠাকুরের ভক্তসম্ভাষণ দেখিতেছেন।
কেদার ঠাকুরের পদধূলি নিকে মস্তকে গ্রহণ করিলেন ও আনন্দে সেই ধূলি লইয়া সকলেকে বিতরণ করিতেছেন। ভক্তেরা মস্তক অবনত করিয়া সেই ধূলি গ্রহণ করিতেছেন।
শরৎকে দিতে যাইতেছেন, এমন সময় তিনি নিজেই ঠাকুরের চরণধূলি লইলেন। মাস্টার হাসিলেন। ঠাকুরও মাস্টারের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের ভাব-লক্ষণ দেখা যাইতেছে। মাঝে মাযে নিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছেন, যেন ভাব চাপিতেছেন। অবশেষে কেদারকে ইঙ্গিত করিতেছেন — গিরিশ ঘোষের সহিত তর্ক কর। গিরিশ কান-নাক মলিতেছেন আর বলিতেছেন, “মহাশয় নাক-কান মলছি! আগে জানতাম না, আপনি কে! তখন তর্ক করেছি; সে এক!” (ঠাকুরের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কেদারকে দেখাইতেছেন ও বলিতেছেন, “সব ত্যাগ করেছে! (ভক্তদের প্রতি) কেদার নরেন্দ্রকে বলেছিল, এখন তর্ক কর বিচার কর, কিন্তু শেষে হরিনামে গড়াগড়ি দিতে হবে। (নরেন্দ্রের প্রতি) — কেদারের পায়ের ধুলা নাও।”
কেদার (নরেনদ্রকে) — ওঁর পায়ের ধুলা নাও; তাহলেই হবে।
সুরেন্দ্র ভক্তদের পশ্চাতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার দিকে তাকাইলেন। কেদারকে বলিতেছেন, আহা, কি স্বভাব! কেদার ঠাকুরের ইঙ্গিত বুঝিয়া সুরেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হইয়া বসিলেন।
সুরেনদ্র একটু অভিমানী। ভক্তেরা কেহ কেহ বাগানের খরচের জন্য বাহিরের ভক্তদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করিতে গিয়াছিলেন। তাই বড় অভিমান হইয়াছে। সুরেন্দ্র বাগানের অধিকাংশ খরচ দেন।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি) — অত সাধুদের কাছে কি আমি বসতে পারি! আবার কেউ কেউ (নরেন্দ্র) কয়দিন হইল, সন্ন্যাসীর বেশে বুদ্ধগয়া দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। বড় বড় সাধু দেখতে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সুরেন্দ্রকে ঠাণ্ডা করিতেছেন। বলছেন, হাঁ, ওরা ছেলেমানুষ, ভাল বুঝতে পারে না।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি) — গুরুদেব কি জানেন না, কার কি ভাব। উনি টাকাতে তুষ্ট নন; উনি ভাব নিয়ে তুষ্ট!
ঠাকুর মাথা নাড়িয়া সুরেন্দ্রের কথায় সায় দিতেছেন। “ভাব নিয়ে তুষ্ট”, এই কথা শুনিয়া কেদারও আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন।
ভক্তেরা খাবার আনিয়াছেন ও ঠাকুরের সামনে রাখিয়াছিলেন। ঠাকুর জিহ্বাতে কণিকামাত্র ঠেকাইলেন। সুরেন্দ্রের হাতে প্রসাদ দিতে বলিলেন ও অন্য সকলকে দিতে বলিলেন।
সুরেন্দ্র নিচে গেলেন। নিচে প্রসাদ বিতরণ হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদারের প্রতি) — তুমি বুঝিয়ে দিও। যাও একবার — বকাবকি করতে মানা করো।
মণি হাওয়া করিতেছেন। ঠাকুর বলিলেন, “তুমি খাবে না?” মণিকেও নিচে প্রসাদ পাইতে পাঠাইলেন।
সন্ধ্যা হয় হয়! গিরিশ ও শ্রীম — পুকুরধারে বেড়াইতেছেন।
গিরিশ — ওহে তুমি ঠাকুরের বিষয় — কি নাকি লিখেছো?
শ্রীম — কে বললে?
গিরিশ — আমি শুনেছি। আমায় দেবে?
শ্রীম — না; আমি নিজে না বুঝে কারুকে দেব না — ও আমি নিজের জন্য লিখেছি। অন্যের জন্য নয়!
গিরিশ — বল কি!
শ্রীম — আমার দেহ যাবার সময় পাবে।
[ঠাকুর অহেতুক-কৃপাসিন্ধু — ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত ]
সন্ধ্যার পর ঠাকুরের ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে। ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত (বসু) দেখিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। মাস্টার ও দুই-চারিজন ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুরের সম্মুখে কলাপাতায় বেল ও জুঁই ফুলের মালা রহিয়াছে। ঘর নিস্তব্ধ। যেন একটি মহাযোগী নিঃশব্দে যোগে বসিয়া আছেন। ঠাকুর মালা লইয়া এক-একবার তুলিতেছেন। যেন গলায় পরিবেন।
অমৃত (স্নেহপূর্ণস্বরে) — মালা পরিয়ে দেব?
মালা পরা হইলে, ঠাকুর অমৃতের সহিত অনেক কথা কহিলেন। অমৃত বিদায় লইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি আবার এসো।
অমৃত — আজ্ঞে, আসবার খুব ইচ্ছা। অনেক দুর থেকে আসতে হয় — তাই সব সময় পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি এসো। এখান থেকে গাড়িভাড়া নিও।
অমৃতের প্রতি ঠাকুরের অহেতুক স্নেহ দেখিয়া সকলে অবাক্‌।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তের স্ত্রী পুত্র ]
পরদিন শনিবার, ২৪শে এপ্রিল। একটি ভক্ত আসিয়াছেন। সঙ্গে পরিবার ও একটি সাত বছরের ছেলে। একবৎসর হইল একটি অষ্টমবর্ষীয় সন্তান দেহত্যাগ করিয়াছে। পরিবারটি সেই অবধি পাগলের মতো হইয়াছেন। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে মাঝে মাঝে আসিতে বলেন।
খাইতে খাইতে, ঠাকুর তাঁহাকে ঘরকন্নার কথা অনেক জিজ্ঞাসা করিলেন ও কিছুদিন ওই বাগানে আসিয়া শ্রীশ্রীমার কাছে থাকিতে বলিলেন। তাহা হইলে শোক অনেক কম পড়িবে। তাঁহার একটি কোলের মেয়ে ছিল। পরে শ্রীশ্রীমা তাহাকে মানময়ী বলিয়া ডাকিতেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, তাকেও আনবে।
ঠাকুরের খাওয়ার পর ভক্তটির পরিবার স্থানটি পরিষ্কার করিয়া লইলেন। ঠাকুরের সঙ্গে কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তার পর, শ্রীশ্রীমা যখন নিচের ঘরে গেলেন, তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া সেই সঙ্গে গমন করিলেন।
রাত্রি প্রায় নয়টা হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। ফুলের মালা পরিয়াছেন। মণি হাওয়া করিতেছেন।
ঠাকুর গলদেশ হইতে মালা লইয়া হাতে করিয়া আপন মনে কি বলিতেছেন। তারপর যেন প্রসন্ন হইয়া মণিকে মালা দিলেন।
শোকসন্তপ্তা ভক্তের পত্নীকে ঠাকুর শ্রীশ্রীমার কাছে ওই বাগানে আসিয়া কিছুদিন থাকিতে বলিয়াছেন, মণি সমস্ত শুনিলেন।

 ==========

Post a Comment

0 Comments