শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত~দ্বিতীয় ভাগ ~ষড়বিংশ খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
দ্বিতীয় ভাগ 

ষড়বিংশ খণ্ড

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে

ষড়বিংশ খণ্ড ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে

==========

প্রথম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানে — গিরিশ ও মাস্টার
কাশীপুর বাগানের পূর্বধারে পুষ্করিণীর ঘাট। চাঁদ উঠিয়াছে। উদ্যানপথ ও উদ্যানের বৃক্ষগুলি চন্দ্রকিরণে স্নাত হইয়াছে। পুষ্করিণীর পাশ্চিমদিকে দ্বিতল গৃহ। উপরের ঘরে আলো জ্বলিতেছে, পুষ্করিণীর ঘাট হইতে সেই আলো খড়খড়ির মধ্য দিয়া আসিতেছে, তাহা দেখা যাইতেছে। কক্ষমধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যার উপর বসিয়া আছেন। একটি-দুটি ভক্ত নিঃশব্দে কাছে বসিয়া আছেন বা এ-ঘর হইতে ও-ঘর যাইতেছেন। ঠাকুর অসুস্থ, চিকিৎসার্থে বাগানে আসিয়াছেন। ভক্তেরা সেবার্থ সঙ্গে আছেন। পুষ্করিণীর ঘাট হইতে নিচের তিনটি আলো দেখা যাইতেছে। একটি ঘরে ভক্তেরা থাকেন, তাহার আলো দেখা যাইতেছে। মা ঠাকুরের সেবার্থ আসিয়াছেন। তৃতীয় আলোটি রান্নাঘরের। সেই ঘর গৃহের উত্তরদিকে। উদ্যান মধ্যস্থিত ওই দুতলা বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণ হইতে একটি পথ পুষ্করিণীর ঘাটের দিকে গিয়াছে। পূর্বাস্য হইয়া ওই পথ দিয়া ঘাটে যাইতে হয়। পথের দুই ধারে, বিশেষতঃ দক্ষিণ পার্শ্বে, অনেক ফল-ফুলের গাছ।
চাঁদ উঠিয়াছে। পুকুরঘাটে গিরিশ, মাস্টার, লাটু আরও দুই-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুরের কথা হইতেছে। আজ শুক্রবার, ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৬, ৪ঠা বৈশাখ, ১২৯৩। চৈত্র শুক্লা ত্রয়োদশী।
কিয়ৎক্ষণ পরে গিরিশ ও মাস্টার ওই পথে বেড়াইতেছেন ও মাঝে মাঝে কথাবার্তা কহিতেছেন।
মাস্টার — কি সুন্দর চাঁদের আলো! কতকাল ধরে এই নিয়ম চলছে!
গিরিশ — কি করে জানলে?
মাস্টার — প্রকৃতির নিয়ম বদলায় না (Uniformity of Nature) আর বিলাতের লোকেরা নূতন নূতন নক্ষত্র টেলিস্‌কোপ দিয়ে দেখেছে। চাঁদে পাহাড় আছে, দেখেছে।
গিরিশ — তা বলা শক্ত, বিশ্বাস হয় না।
মাস্টার — কেন, টেলিস্‌কোপ দিয়ে ঠিক দেখা যায়।
গিরিশ — কেমন করে বলব, ঠিক দেখেছে। পৃথিবী আর চাঁদের মাঝখানে যদি আর কোন জিনিস থাকে, তার মধ্যে দিয়ে আলো আসতে আসতে হয়তো অমন দেখায়।
বাগানে ছোকরা ভক্তেরা ঠাকুরের সেবার জন্য সর্বদা থাকেন। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, বাবুরাম, কালী, যোগীন, লাটু ইত্যাদি; তাঁহারা থাকেন। যে ভক্তেরা সংসার করিয়াছেন, কেহ কেহ প্রত্যহ আসেন ও মাঝে মাঝে রাত্রেও থাকেন। কেহ বা মধ্যে মধ্যে আসেন। আজ নরেন্দ্র, কালী ও তারক দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির বাগানে গিয়াছেন। নরেন্দ্র সেখানে পঞ্চবটী বৃক্ষমূলে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তা করিবেন; সাধন করিবেন। তাই দুই-একটি গুরুভাই সঙ্গে গিয়াছেন।
=============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঠাকুর গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে — ভক্তের প্রতি ঠাকুরের স্নেহ
[গিরিশ, লাটু, মাস্টার, বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাখাল ]
গিরিশ, লাটু, মাস্টার উপরে গিয়া দেখেন, ঠাকুর শয্যায় বসিয়া আছেন। শশী ও আরও দু-একটি ভক্ত সেবার্থ ওই ঘরে ছিলেন, ক্রমে বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাখাল, ইঁহারাও আসিলেন।
ঘরটি বড়। ঠাকুরের শয্যার নিকট ঔষাধি ও নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসাদি রহিয়াছে। ঘরের উত্তরে একটি দ্বার আছে, সিঁড়ি হইতে উঠিয়া সেই দ্বার দিয়া ঘরে প্রবেশ করিতে হয়। সেই দ্বারের সামনাসামনি ঘরের দক্ষিণ গায়ে আর-একটি দ্বার আছে। সেই দ্বার দিয়া দক্ষিণের ছোট ছাদটিতে যাইয়া যায়। সেই ছাদের উপর দাঁড়াইলে বাগানের গাছপালা, চাঁদের আলো, অদূরে রাজপথ ইত্যাদি দেখা যায়।
ভক্তদের রাত্রি জাগরণ করিতে হয়, তাঁহারা পালা করিয়া জাগেন। মশারি টাঙ্গাইয়া ঠাকুরকে শয়ন করাইয়া যে ভক্তটি ঘরে থাকিবেন, তিনি ঘরের পূর্বধারে মাদুর পাতিয়া কখনও বসিয়া, কখনও শুইয়া থাকেন। অসুস্থতানিবন্ধন ঠাকুরের প্রায় নিদ্রা নাই! তাই যিনি থাকেন, তিনি কয়েক ঘণ্টা প্রায় বসিয়া কাটাইয়া দেন।
আজ ঠাকুরের অসুখ কিছু কম। ভক্তেরা আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন এবং ঠাকুরের সম্মুখে মেঝের উপর বসিলেন।
ঠাকুর আলোটি কাছে আনিতে মাস্টারকে আদেশ করিলেন। ঠাকুর গিরিশকে সস্নেহ সম্ভাষণ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — ভাল আছ? (লাটুর প্রতি) এঁকে তামাক খাওয়া। আর পান এনে দে।
কিয়ৎক্ষণ পরে আবার বলিলেন, “কিছু জলখাবার এনে দে।”
লাটু — পানটান দিয়েছি। দোকান থেকে জলখাবার আনতে যাচ্ছে।
ঠাকুর বসিয়া আছেন। একটি ভক্ত কয়গাছি ফুলের মালা আনিয়া দিলেন। ঠাকুর নিজের গলায় একে একে সেগুলি ধারণ করিলেন। ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে হরি আছেন, তাঁকেই বুঝি পূজা করিলেন। ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। দুইগাছি মালা গলা হইতে লইয়া গিরিশকে দিলেন।
ঠাকুর মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “জলখাবার কি এলো?”
মণি ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন। ঠাকুরের কাছে একটি ভক্তপ্রদত্ত চন্দনকাষ্ঠের পাখা ছিল। ঠাকুর সেই পাখাখানি মণির হাতে দিলেন। মণি সেই পাখা লইয়া বাতাস করিতেছেন। মণি পাখা করিতেছেন, ঠাকুর দুইগাছি মালা গলা হইতে লইয়া তাঁহাকেও দিলেন।
লাটু ঠাকুরকে একটি ভক্তের কথা বলিতেছেন। তাঁহার একটি সাত-আট বৎসরের সন্তান প্রায় দেড় বৎসর হইল দেহত্যাগ করিয়াছে। সে ছেলেটি ঠাকুরকে কখন ভক্তসঙ্গে কখন কীর্তনানন্দে অনেকবার দর্শন করিয়াছিল।
লাটু (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — ইনি এঁর ছেলেটির বই দেখে কাল রাত্রে বড় কেঁদেছিলেন। পরিবারও ছেলের শোকে পাগলের মতো হয়ে গেছে। নিজের ছেলেপুলেকে মারে, আছড়ায়। ইনি এখানে মাঝে মাঝে থাকেন তাই বলে ভারী হেঙ্গাম করে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই শোকের কথা শুনিয়া যেন চিন্তিত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
গিরিশ — অর্জুন অত গীতা-টীতা পড়ে অভিমন্যুর শোকে একেবারে মূর্চ্ছিত। তা এঁর ছেলের জন্য শোক কিছু আশ্চর্য নয়।
[সংসারে কি হলে ঈশ্বরলাভ হয়? ]
গিরিশের জন্য জলখাবার আসিয়াছে। ফাগুর দোকানের গরম কচুরি, লুচি ও অন্যান্য মিষ্টান্ন। বরাহনগরে ফাগুর দোকান। ঠাকুর নিজে সেই সমস্ত খাবার সম্মুখে রাখাইয়া প্রসাদ করিয়া দিলেন। তারপর নিজে হাতে করিয়া খাবার গিরিশের হাতে দিলেন। বলিলেন, বেশ কচুরি।
গিরিশ সম্মুখে বসিয়া খাইতেছেন। গিরিশকে খাইবার জল দিতে হইবে। ঠাকুরের শয্যার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কুঁজায় করিয়া জল আছে। গ্রীষ্মকাল, বৈশাখ মাস। ঠাকুর বলিলেন, “এখানে বেশ জল আছে।”
ঠাকুর অতি অসুস্থ। দাঁড়াইবার শক্তি নাই।
ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া কি দেখিতেছেন? দেখিতেছেন — ঠাকুরের কোমরে কাপড় নাই। দিগম্বর! বালকের ন্যায় শয্যা হইতে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিজে জল গড়াইয়া দিবেন। ভক্তদের নিশ্বাসবায়ু স্থির হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জল গড়াইলেন। গেলাস হইতে একটু জল হাতে লইয়া দেখিতেছেন, ঠাণ্ডা কিনা। দেখিতেছেন জল তত ঠাণ্ডা নয়। অবশেষে অন্য ভাল জল পাওয়া যাইবে না বুঝিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওই জলই দিলেন।
গিরিশ খাবার খাইতেছেন। ভক্তগুলি চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। মণি ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন।
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — দেবেনবাবু সংসারত্যাগ করবেন।
ঠাকুর সর্বদা কথা কহিতে পারেন না, বড় কষ্ট হয়। নিজের ওষ্ঠাধর অঙ্গুলি দ্বারা স্পর্শ করিয়া ইঙ্গিত করিলেন, “পরিবারদের খাওয়া-দাওয়া কিরূপে হবে — তাদের কিসে চলবে?”
গিরিশ — তা কি করবেন জানি না।
সকলে চুপ করিয়া আছেন। গিরিশ খাবার খাইতে খাইতে কথা আরম্ভ করিলেন।
গিরিশ — আচ্ছা, মহাশয় — কোনটা ঠিক! কষ্টে সংসার ছাড়া না সংসারে থেকে তাঁকে ডাকা?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — গীতায় দেখনি? অনাসক্ত হয়ে সংসারে থেকে কর্ম করলে, সব মিথ্যা জেনে জ্ঞানের পর সংসারে থাকলে, ঠিক ঈশ্বরলাভ হয়।
“যারা কষ্টে ছাড়ে, তারা হীন থাকের লোক।
“সংসারী জ্ঞানী কিরকম জানো? যেমন সার্সীর ঘরে কেউ আছে। ভিতর বার দুই দেখতে পায়।”
আবার সকলে চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কচুরি গরম আর খুব ভাল।
মাস্টার (গিরিশের প্রতি) — ফাগুর দোকানের কচুরি! বিখ্যাত।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিখ্যাত!
গিরিশ (খাইতে খাইতে, সহাস্যে) — বেশ কচুরি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — লুচি থাক, কচুরি খাও। (মাস্টারকে) কচুরি কিন্তু রজোগুণের।
গিরিশ খাইতে খাইতে আবার কথা তুলিলেন।
[সংসারীর মন ও ঠিক ঠিক ত্যাগীর মনের প্রভেদ ]
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আচ্ছা মহাশয়, মনটা এত উঁচু আছে, আবার নিচু হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সংসারে থাকতে গেলেই ও-রকম হয়। কখনও উঁচু, কখনও নিচু। কখনও বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা, তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখন ঈশ্বরচিন্তা, হরিনাম করে; কখন বা কামিনী-কাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে। যেমন সাধারণ মাছি — কখন সন্দেশে বসছে, কখন বা পচা ঘা বা বিষ্ঠাতেও বসে।
“ত্যাগীদের আলাদা কথা। তারা কামিনী-কাঞ্চন থেকে মন সরিয়ে এনে কেবল ঈশ্বরকে দিতে পারে; কেবল হরিরস পান করতে পারে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে ঈশ্বর বই তাদের আর কিছু ভাল লাগে না। বিষয়কথা হলে উঠে যায়; ঈশ্বরীয় কথা হলে শুনে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে নিজেরা ঈশ্বরকথা বই আর অন্যবাক্য মুখে আনে না।
“মৌমাছি কেবল ফুলে বসে — মধু খাবে বলে। অন্য কোন জিনিস মৌমাছির ভাল লাগে না।”
গিরিশ দক্ষিণের ছোট ছাদটির উপর হাত ধুইতে গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাই, তবে তাঁতে সব মন হয়। অনেকগুলো কচুরি খেলে, ওকে বলে এসো আজ আর কিছু না খায়।
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

অবতার বেদবিধির পার — বৈধীভক্তি ও ভক্তি উন্মাদ
গিরিশ পুনর্বার ঘরে আসিয়া ঠাকুরের সম্মুখে বসিয়াছেন ও পান খাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — রাখাল-টাখাল এখন বুঝেছে কোন্‌টা ভাল, কোন্‌টা মন্দ; কোন্‌টা সত্য, কোন্‌টা মিথ্যা। ওরা যে সংসারে গিয়ে থাকে, সে জেনেশুনে। পরিবার আছে, ছেলেও হয়েছে — কিন্তু বুঝেছে যে সব মিথ্যা। অনিত্য। রাখাল-টাখাল এরা সংসারে লিপ্ত হবে না।
“যেমন পাঁকাল মাছ। পাঁকের ভিতর বাস, কিন্তু গায়ে পাঁকের দাগটি পর্যন্ত নাই!”
গিরিশ — মহাশয়, ও-সব আমি বুঝি না। মনে করলে সব্বাইকে নির্লিপ্ত আর শুদ্ধ করে দিতে পারেন। কি সংসারী কি ত্যাগী সব্বাইকে ভাল করে দিতে পারেন! মলয়ের হাওয়া বইলে, আমি বলি, সব কাঠ চন্দন হয় —
শ্রীরামকৃষ্ণ — সার না থাকলে চন্দন হয় না। শিমূল আরও কয়টি গাছ, এরা চন্দন হয় না।
গিরিশ — তা শুনি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আইনে এরূপ আছে।
গিরিশ — আপনার সব বে-আইনি!
ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন। মণির হাতের পাখা এক-একবার স্থির হইয়া যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তা হতে পারে; ভক্তি-নদী ওথলালে ডাঙ্গায় একবাঁশ জল।
“যখন ভক্তি উন্মাদ হয়, তখন বেদবিধি মানে না। দূর্বা তোলে; তা বাছে না! যা হাতে আসে, তাই লয়। তুলসী তোলে, পড়পড় করে ডাল ভাঙে! আহা কি অবস্থাই গেছে!
(মাস্টারের প্রতি) — “ভক্তি হলে আর কিছুই চাই না!”
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।
[সীতা ও শ্রীরাধা — রামাবতার ও কৃষ্ণাবতারের বিভিন্ন ভাব ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। রামাবতারে শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য ফখ্য। কৃষ্ণাবতারে ও-সবও ছিল, আবার মধুরভাব।
“শ্রীমতীর মধুরভাব — ছেনালি আছে। সীতার শুদ্ধ সতীত্ব — ছেনালি নাই।
“তাঁরই লীলা। যখন যে ভাব।”
বিজয়ের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে একটি পাগলের মতো স্ত্রীলোক ঠাকুরকে গান শুনাইতে যাইত। শ্যামাবিষয়ক গান ও ব্রহ্ম সঙ্গীত। সকলে পাগলী বলে। সে কাশীপুরের বাগানেও সর্বদা আসে ও ঠাকুরের কাছে যাবার জন্য বড় উপদ্রব করে। ভক্তদের সেই জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশাদি ভক্তের প্রতি) — পাগলীর মধুরভাব। দক্ষিণেশ্বরে একদিন গিছল। হঠাৎ কান্না। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন কাঁদছিস? তা বলে, মাথাব্যথা করছে। (সকলের হাস্য)
“আর-একদিন গিছল। আমি খেতে বসেছি। হঠাৎ বলছে, ‘দয়া করলেন না?’ আমি উদারবুদ্ধিতে খাচ্চি। তারপর বলছে, ‘মনে ঠেল্লেন কেন?’ জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তোর কি ভাব?’ তা বললে, ‘মধুরভাব!’ আমি বললাম, ‘আরে আমার যে মাতৃযোনি! আমার যে সব মেয়েরা মা হয়!’ তখন বলে, ‘তা আমি জানি না।’ তখন রামলালকে ডাকলাম। বললাম, ‘ওরে রামলাল, কি মনে ঠ্যালাঠেলি বলছে শোন দেখি।’ ওর এখনও সেই ভাব আছে।”
গিরিশ — সে পাগলী — ধন্য! পাগল হোক আর ভক্তদের কাছে মারই খাক আপনার তো অষ্টপ্রহর চিন্তা করছে! সে যে ভাবেই করুক, তার কখনও মন্দ হবে না!
“মহাশয়, কি বলব! আপনাকে চিন্তা করে আমি কি ছিলাম, কি হয়েছি! আগে আলস্য ছিল, এখন সে আলস্য ঈশ্বরে নির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে! পাপ ছিল, তাই এখন নিরহংকার হয়েছি! আর কি বলব!”
ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন। রাখাল পাগলীর কথা উল্লেখ করিয়া দুঃখ করিতেছেন। বললেন, দুঃখ হয়, সে উপদ্রব করে আর তার জন্য অনেকে কষ্টও পায়।
নিরঞ্জন (রাখালের প্রতি) — তোর মাগ আছে তাই তোর মন কেমন করে। আমরা তাকে বলিদান দিতে পারি।
রাখাল (বিরক্ত হইয়া) — কি বাহাদুরি! ওঁর সামনে ওই সব কথা!
[গিরিশকে উপদেশ — টাকায় আসক্তি — সদ্ব্যবহার — ডাক্তার কবিরাজের দ্রব্য ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। অনেকে টাকা গায়ের রক্ত মনে করে। কিন্তু টাকাকে বেশি যত্ন করলে একদিন হয়তো সব বেরিয়ে যায়।
“আমাদের দেশে মাঠা আল বাঁধে। আল জানো? যারা খুব যত্ন করে চারিদিকে আল দেয়, তাদের আল জলের তোড়ে ভেঙে যায়। যরা একদিকে খুলে ঘাসের চাপড়া দিয়ে রাখে, তাদের কেমন পলি পড়ে, কত ধান হয়।
“যারা টাকার সদ্ব্যবহার করে, ঠাকুরসেবা, সাধু ভক্তের সেবা করে, দান করে তাদেরই কাজ হয়। তাদেরই ফসল হয়।
“আমি ডাক্তার কবিরাজের জিনিস খেতে পারি না। যারা লোকের কষ্ট থেকে টাকা রোজগার করে! ওদের ধন যেন রক্ত-পুঁজ!”
এই বলিয়া ঠাকুর দুইজন চিকিৎসকের নাম করিলেন।
গিরিশ — রাজেন্দ্র দত্তের খুব দরাজ মন; কারু কাছে একটি পয়সা লয় না। তার দান-ধ্যান আছে।
==========

Post a Comment

0 Comments