ত্রয়োদশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

ত্রয়োদশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, জন্মোৎসবদিবসে বিজয়, কেদার, রাখাল, সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

ত্রয়োদশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

==========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৫শে মে
পঞ্চবটীমূলে জন্মোৎসবদিবসে বিজয় প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে 

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় পুরাতন বটবৃক্ষের চাতালের উপর বিজয়, কেদার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। কয়েকটি ভক্ত চাতালের উপর বসিয়া আছেন। অধিকাংশই চাতালের নিচে, চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া আছেন। বেলা ১টা হইবে। রবিবার, ২৫শে মে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ১৩ই জৈষ্ঠ; শুক্লা প্রতিপদ।

ঠাকুরের জন্মদিন ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। কিন্তু তাঁহার হাতে অসুখ বলিয়া এতদিন জন্মোৎসব হয় নাই। এখন অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন। তাই আজ ভক্তেরা আনন্দ করিবেন। সহচরী গান গাইবে। সহচরী প্রবীণা হইয়াছেন, কিন্তু প্রসিদ্ধ কীর্তনী।

মাস্টার ঠাকুরের ঘরে ঠাকুরকে দেখিতে না পাইয়া পঞ্চবটীতে আসিয়া দেখেন যে, ভক্তেরা সহাস্যবদন — আনন্দে অবস্থান করিতেছেন। ঠাকুর বৃক্ষমূলে চাতালের উপর যে বসিয়া আছেন, তিনি দেখেন নাই অথচ ঠাকুরের ঠিক সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তিনি ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন — তিনি কিথায়? এই কথা শুনিয়া সকলে উচ্চ হাস্য করিলেন। হঠাৎ সম্মুখে ঠাকুরকে দর্শন করিয়া, মাস্টার অপ্রস্তুত হইয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। দেখিলেন, ঠাকুরের বামদিকে কেদার (চাটুজ্যে) এবং বিজয় (গোস্বামী) চাতালের উপর বসিয়া আছেন। ঠাকুর দক্ষিণাস্য।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মাস্টারের প্রতি) — দেখ, কেমন দুজনকে (কেদার ও বিজয়কে) মিলিয়ে দিয়েছি!

শ্রীবৃন্দাবন হইতে মাধবীলতা আনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীতে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে রোপণ করিয়াছিলেন। আজ মাধবী বেশ বড় হইয়াছে। ছোট ছোট ছেলেরা উঠিয়া দুলিতেছে, নাচিতেছে — ঠাকুর আনন্দে দেখিতেছেন ও বলিতেছেন — “বাঁদুরে ছানার ভাব। পড়লে ছাড়ে না।” সুরেন্দ্র চাতালের নিচে দাঁড়াইয়া আছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, “তুমি উপরে এসো না। এমনটা (পা মেলা) বেশ হবে।”

সুরেন্দ্র উপরে গিয়া বসিলেন। ভবনাথ জামা পরিয়া বসিয়াছেন দেখিয়া সুরেন্দ্র বলিতেছেন, “কিহে বিলাতে যাবে নাকি?”

ঠাকুর হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “আমাদের বিলাত ঈশ্বরের কাছে।” ঠাকুর ভক্তদের সহিত নানা বিষয়ে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি মাঝে মাঝে কাপড় ফেলে, আনন্দময় হয়ে বেড়াতাম। শম্ভু একদিন বলছে, ‘ওহে তুমি তাই ন্যাংটো হয়ে বেড়াও! — বেশ আরাম! — আমি একদিন দেখলাম।’

সুরেন্দ্র — আফিস থেকে এসে জামা চাপকান খোলবার সময় বলি — মা তুমি কত বাঁধাই বেঁধেছ।

[সুরেন্দ্র আফিস — সংসার, অষ্টপাশ ও তিনগুণ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — অষ্টপাশ দিয়ে বন্ধন। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, অভিমান, সঙ্কোচ, গোপনের ইচ্ছা — এই সব।

ঠাকুর গান গাহিতেছেন:

আমি ওই খেদে খেদ করি শ্যামা।

গান – শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)

ঘুড়ি আশাবায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি।

“মায়া দড়ি কিনা মাঘছেলে। বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা কর্কশা হয়েছে দড়ি। বিষয় — কামিনী-কাঞ্চন।

গান – ভবে আসা খেলতে পাশা, বড় আশা করেছিলাম।

আশার আশা ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পেলাম।
প’বার আঠার ষোল, যুগে যুগে এলাম ভাল,
(শেষে) কচে বারো পেয়ে মাগো, পঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হলাম।
ছ-দুই-আট, ছ-চার-দশ, কেউ নয় মা আমার বশ;
খেলাতে না পেলাম যশ, এবার বাজী ভোর হইল।

“পঞ্জুড়ি অর্থাৎ পঞ্চভূত। পঞ্জা ছক্কায় বন্দী হওয়া অর্থাৎ পঞ্চভূত ও ছয় রিপুর বশ হওয়া। ‘ছ তিন নয়ে ফাঁকি দিব।’ ছয়কে ফাঁকি দেওয়া অর্থাৎ ছয় রিপুর বশ না হওয়া। ‘তিনকে ফাঁকি দেওয়া’ অর্থাৎ তিন গুণের অতীত হওয়া।

“সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ — এই তিন গুণেতেই মানুষকে বশ করেছে। তিন ভাই; সত্ত্ব থাকলে রজঃকে ডাকতে পারে, রজঃ থাকলে তমঃকে ডাকতে পারে। তিন গুণই চোর। তমোগুণে বিনাশ করে, রজোগুণে বদ্ধ করে, সত্ত্ব গুণে বন্ধন খোলে বটে; কিন্তু ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে না।”

বিজয় (সহাস্যে) — সত্ত্বও চোর কি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু পথ দেখিয়ে দেয়।

ভবনাথ — বাঃ! কি চমৎকার কথা!

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ এ খুব উঁচু কথা।

ভক্তেরা এই সকল কথা শুনিয়া আনন্দ করিতেছেন।

============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৫শে মে

বিজয়, কেদার প্রভৃতির প্রতি কামিনী-কাঞ্চন সম্বন্ধে উপদেশ

শ্রীরামকৃষ্ণ — বন্ধনের কারণ কামিনী-কাঞ্চন। কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। কামিনী-কাঞ্চনই ঈশ্বরকে দেখতে দেয় না

এই বলিয়া ঠাকুর নিজের গামছা লইয়া সম্মুখ আবরণ করিলেন। আর বলিতেছেন,  আর আমায় তোমরা দেখতে পাচ্চ? — এই আবরণ! এই কামিনী-কাঞ্চন আবরণ গেলেই চিদানন্দলাভ।

“দেখো না — যে মাগ সুখ ত্যাগ করেছে, সে তো জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে! ইশ্বর তার অতি নিকট।”

কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া নিশশব্দে এই কথা শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদার, বিজয় প্রভৃতির প্রতি) — “মাগ সুখ যে ত্যাগ করেছে, সে জগৎ সুখ ত্যাগ করেছে। — এই কামিনী-কাঞ্চনই আবরণ। তোমাদের তো এত বড় বড় গোঁফ, তবু তোমরা ওইতেই রয়েছ! বল! মনে মনে বিবেচনা করে দেখ!–”

বিজয় — আজ্ঞা, তা সত্য বটে।

কেদার অবাক্‌ হইয়া চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর বলিতেছেন,

“সকলকেই দেখি, মেয়েমানুষের বশ। কাপ্তেনের বাড়ি গিছলাম; — তার বাড়ি হয়ে রামের বাড়ি যাব। তাই কাপ্তেনকে বললাম, ‘গাড়িভাড়া দাও’। কাপ্তেন তার মাগ্‌কে বললে! সে মাগও তেমনি — ‘ক্যা হুয়া’ ‘ক্যা হুয়া’ করতে লাগল। শেষে কাপ্তেন বললে যে, ওরাই (রামেরা) দেবে। গীতা, ভাগবত, বেদান্ত সব ওর ভিতরে! (সকলের হাস্য)

“টাকা-কড়ি সর্বস্ব সব মাগের হাতে! আবার বলা হয়, ‘আমি দুটো টাকাও আমার কাছে রাখতে পারি না — কেমন আমার স্বভাব!’

“বড়বাবুর হাতে অনেক কর্ম, কিন্তু করে দিচ্চে না। একজন বললে, ‘গোলাপীকে ধর, তবে কর্ম হবে।’ গোলাপী বড়বাবুর রাঁড়।”

[পূর্বকথা — ফোর্টদর্শন — স্ত্রীলোক ও “কলমবাড়া রাস্তা” ]

“পুরুষগুলো বুঝতে পারে না, কত নেমে গেছে।

“কেল্লায় যখন গাড়ি করে গিয়ে পৌঁছিলাম তখন বোধ হল যেন সাধারণ রাস্তা দিয়ে এলাম। তারপরে দেখি যে চারতলা নিচে এসেছি! কলমবাড়া (Sloping) রাস্তা! যাকে ভূতে পায়, সে জানতে পারে না যে আমায় ভূতে পেয়েছে। সে ভাবে আমি বেশ আছি।”

বিজয় (সহাস্যে) — রোজা মিলে গেলে রোজা ঝাড়িয়ে দেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও-কথার বেশি উত্তর দিলেন না। কেবল বলিলেন —

“সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।”

তিনি আবার স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — যাকে জিজ্ঞাসা করি, সেই বলে আজ্ঞে হাঁ, আমার স্ত্রীটি ভাল। একজনেরও স্ত্রী মন্দ নয়। (সকলের হাস্য)

“যারা কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে, তারা নেশায় কিছু বুঝতে পারে না। যারা দাবাবোড়ে খেলে, তারা অনেক সময় জানে না, কি ঠিক চাল। কিন্তু যারা অন্তর থেকে দেখে, তারা অনেকটা বুঝতে পারে।

“স্ত্রী মায়ারূপিণী। নারদ রামকে স্তব করতে লাগলেন — ‘হে রাম। তোমার অংশে যত পুরুষ; তোমার মায়ারূপিণী সীতার অংশে যত স্ত্রী। আর কোন বর চাই না — এই করো, যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার জগৎমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই’!”

[গিরীন্দ্র, নগেন্দ্র প্রভৃতির প্রতি উপদেশ ]

সুরেন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা গিরীন্দ্র ও তাঁহার নগেন্দ্র প্রভৃতি ভ্রাতুষ্পুত্রেরা আসিয়াছেন। গিরীন্দ্র আফিসের কর্মে নিযুক্ত হইয়াছেন। নগেন্দ্র ওকালতির জন্য প্রস্তুত হইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরীন্দ্র প্রভৃতির প্রতি) — তোমাদের বলি — তোমরা সংসারে আসক্ত হইও না। দেখো, রাখালের জ্ঞান অজ্ঞান বোধ হয়েছে, — সৎ অসৎ বিচার হয়েছে! এখন তাকে বলি, ‘বাড়িতে যা; কখন এখানে এলি, দুই দিন থাকলি।’

“আর তোমরা পরস্পর প্রণয় করে থাকবে — তবেই মঙ্গল হবে। আর আনন্দে থাকবে। যাত্রাওয়ালারা যদি একসুরে গায়, তবেই যাত্রাটি ভাল হয়, আর যারা শুনে তাদেরও আহ্লাদ হয়।

“ঈশ্বরে বেশি মন রেখে খানিকটা মন দিয়ে সংসারে কাজ করবে।

“সাধুর মন ঈশ্বরে বার আনা, — আর কাজে চার আনা। সাধুর ঈশ্বরের কথাতেই বেশি হুঁশ। সাপের ন্যাজ মাড়ালে আর রক্ষা নাই! ন্যাজে যেন তার বেশি লাগে।”

[পঞ্চবটীতে সহচরীর কীর্তন — হঠাৎ মেঘ ও ঝড় ]

ঠাকুর ঝাউতলায় যাইবার সময় সিঁথির গোপালকে ছাতির কথা বলিয়া গেলেন। গোপাল মাস্টারকে বলিতেছেন, “উনি বলে গেলেন, ছাতি ঘরে রেখে আসতে।” পঞ্চবটীতলায় কীর্তনের আয়োজন হইল। ঠাকুর আসিয়া বসিয়াছেন। সহচরী গান গাইতেচেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন।

গতকল্য শনিবার অমাবস্যা গিয়াছে। জ্যৈষ্ঠ মাস। আজ মধ্যে মধ্যে মেঘ করিতেছিল। হঠাৎ ঝড় উপস্থিত হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। কীর্তন ঘরেই হবে স্থির হইল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সিঁথির গোপালের প্রতি) — হ্যাঁগা ছাতিটা এনেছ?

গোপাল — আজ্ঞা, না। গান শুনতে শুনতে ভুলে গেছি!

ছাতিটি পঞ্চবটীতে পড়িয়া আছে; গোপাল তাড়াতাড়ি আনিতে গেলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি যে এতো এলোমেলো, তবু অত দূর নয়!

“রাখাল এক জায়গায় নিমন্ত্রণের কথায় ১৩ই-কে বলে ১১ই!

“আর গোপাল — গোরুর পাল! (সকলের হাস্য)

“সেই যে স্যাকরাদের গল্পে আছে — একজন বলছে, ‘কেশব’, একজন বলছে, ‘গোপাল’, একজন বলছে, ‘হরি’, একজন বলছে, ‘হর’। সে ‘গোপালের’ মানে গোরুর পাল!” (সকলের হাস্য)

সুরেন্দ্র গোপালের উদ্দেশ্য করিয়া আনন্দে বলিতেছেন — ‘কানু কোথায়?’

==========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৫শে মে

বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে — সহচরীর গৌরাঙ্গসন্ন্যাস গান

কীর্তনী গৌরসন্ন্যাস গাইতেছেন ও মাঝে মাঝে আখর দিতেছেন —

(নারী হেরবে না!) (সে যে সন্ন্যাসীর ধর্ম!)
(জীবের দুঃখ ঘুচাইতে,) (নারী হেরিবে না!)
(নইলে বৃথা গৌর অবতার!)

ঠাকুর গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস কথা শুনিতে শুনিতে দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। অমনি ভক্তেরা গলায় পুষ্পমালা পরাইয়া দিলেন। ভবনাথ, রাখাল, ঠাকুরকে ধারণ করিয়া আছেন — পাছে পড়িয়া যান। ঠাকুর উত্তরাস্য, বিজয়, কেদার, রাম, মাস্টার, মনোমোহন। লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা মণ্ডলাকার করিয়া তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ কি আসিয়া ভক্তসঙ্গে হরিণাম-মহোৎসব করিতেছেন!

[শ্রীকৃষ্ণই অখন্ড সচ্চিদানন্দ — আবার জীব-জগৎ — স্বরাট্‌বিরাট্‌ ]

অল্পে অল্পে সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। ঠকুর সচিদানন্দ কৃষ্ণের সহিত কথা কহিতেছেন। ‘কৃষ্ণ’ এই কথা এক-একবার উচ্চারণ করিতেছেন, আবার এক-একবার পারিতেছেন না। বলিতেছেন — কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ, সচ্চিদাননদ! — কই তোমার রূপ আজকাল দেখি না! এখন তোমায় অন্তরে বাহিরে দেখছি — জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব — সবই তুমি! মন বুদ্ধি সবই তুমি! গুরুর প্রণামে আছে —

অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্‌।
তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।

“তুমিই অখণ্ড, তুমিই আবার চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছ! তুমিই আধার। তুমিই আধেয়! প্রাণকৃষ্ণ! মনকৃষ্ণ! বুদ্ধিকৃষ্ণ! আত্মাকৃষ্ণ! প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন!”

বিজয়ও আবিষ্ট হইয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “বাবু, তুমিও কি বেহুঁশ হয়েছ?”

বিজয় (বিনীতভাবে) — আজ্ঞা, না।

কীর্তনী আবার গাইতেছেন — “আঁধল প্রেম!” কীর্তনী যাই আখর দিলেন — “সদাই হিয়ার মাঝে রাখিতাম, ওহে প্রাণবঁধু হে!” ঠাকুর আবার সমাধিস্থ! — ভবনাথের কাঁধে ভাঙা হাতটি রহিয়াছে!

কিঞ্চিৎ বাহ্য হইলে, কীর্তনী আবার আখর দিতেছেন — “যে তোমার জন্য সব ত্যাগ করেছে তার কি এত দুঃখ?”

ঠাকুর কীর্তনীকে নমস্কার করিলেন। বসিয়া গান শুনিতেছেন — মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট। কীর্তনী চুপ করিলেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।

[প্রেমে দেহ ও জগৎ ভুল — ঠাকুরের ভক্তসঙ্গে নৃত্য ও সমাধি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তের প্রতি) — প্রেম কাকে বলে। ঈশ্বরে যার প্রেম হয় — যেমন চৈতন্যদেবের — তার জগৎ তো ভুল হয়ে যাবে, আবার দেহ যে এত প্রিয়, এ পর্যন্ত ভুল হয়ে যাবে!

প্রেম হলে কি হয়, ঠাকুর গান গাইয়া বুঝাইতেছেন।

হরি বলিতে ধারা বেয়ে পড়বে। (সে দিন কবে বা হবে)
(অঙ্গে পুলক হবে) (সংসার বাসনা যাবে)
(দুর্দিন ঘুচে সুদিন হবে) (কবে হরির দয়া হবে)

ঠাকুর দাঁড়াইয়াছেন ও নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরা সঙ্গে সঙ্গে নাচিতেছেন। ঠাকুর মাস্টারের বাহু আকর্ষণ করিয়া মণ্ডলের ভিতর তাঁহাকে লইয়াছেন।

নৃত্য করিতে করিতে আবার সমাধিস্থ! চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া। কেদার সমাধী ভঙ্গ করিবার জন্য স্তব করিতেছেন —

“হৃদয়কমলমধ্যে নির্বিশেষং নিরীহম্‌
হরিহরবিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্‌।
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিৎস্বরূপম্‌,
সকল ভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে।।”

ক্রমে সমাধি ভঙ্গ হইল। ঠাকুর আসন গ্রহণ করিলেন ও নাম করিতেছেন — ওঁ সচ্চিদানন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! গোবিন্দ! যোগমায়া! — ভাগবত-ভক্ত-ভগবান!

কীর্তন ও নৃত্যস্থলের ধূলি ঠাকুর লইতেছেন।

===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৫শে মে

সন্ন্যাসির কঠিন ব্রত — সন্ন্যাসী ও লোকশিক্ষা

ঠাকুর গঙ্গার ধারের গোল বারান্দায় আসিয়াছেন। কাছে বিজয়, ভবনাথ, মাস্টার, কেদার প্রভৃতি ভক্তগণ। ঠাকুর এক-একবার বলিতেছেন — “হা কৃষ্ণচৈতন্য!”

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — ঘরে নাকি অনেক হরিনাম হয়েছে — তাই খুব জমে গেল!

ভবনাথ — তাতে আবার সন্ন্যাসের কথা!

শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘আহা! কি ভাব!’

এই বলিয়া গান ধরিলেন:

প্রেমধন বিলায় গোরারায়।
প্রেমকলসে কলসে ঢালে তবু না ফুরায়!
চাঁদ নিতাই ডাকে আয়! আয়! চাঁদ, গৌর ডাকে আয়!
(ওই) শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়।

(বিজয় প্রভৃতির প্রতি) — “বেশ বলেছে কীর্তনে, —

“সন্ন্যাসী নারী হেরবে না। এই সন্ন্যাসীর ধর্ম। কি ভাব!”

বিজয় — আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সন্ন্যাসীকে দেখে তবে সবাই শিখবে — তাই অত কঠিন নিয়ম। — নারীর চিত্রপট পর্যন্ত সন্ন্যাসী দেখবে না! এমনি কঠিন নিয়ম!

“কালো পাঁঠা মার সেবার জন্য বলি দিতে হয় — কিন্তু একটু ঘা থাকলে হয় না। রমণীসঙ্গ তো করবে না — মেয়েদের সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করবে না।”

বিজয় — ছোট হরিদাস ভক্তমেয়ের সঙ্গে আলাপ করেছিল। চৈতন্যদেব হরিদাসকে ত্যাগ করলেন।

[পূর্বকথা — শ্রীরামকৃষ্ণের নামে মারোয়াড়ীর টাকা ও মথুরের জমি লিখিয়া দিবার প্রস্তাব ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী আর কাঞ্চন — যেমন সুন্দরীর পক্ষে তার গায়ের বোট্‌কা গন্ধ! ও-গন্ধ থাকলে বৃথা সৌন্দর্য।

“মারোয়াড়ী আমার নামে টাকা লিখে দিতে চাইলে; — মথুর জমি লিখে দিতে চাইলে; — তা লতে পারলাম না।

“সন্ন্যাসীর ভারী কঠিন নিয়ম। যখন সাধু-সন্ন্যাসী সেজেছে, তখন ঠিক সাধু-সন্ন্যাসীর মতো কাজ করতে হবে। থিয়েটারে দেখ নাই! — যে রাজা সাজে সে রাজাই সাজে, যে মন্ত্রী সাজে সে মন্ত্রীই সাজে।

“একজন বহুরূপী ত্যাগী সাধু সেজেছিল। বাবুরা তাকে একতোড়া টাকা দিতে গেল। সে ‘উঁহু’ করে চলে গেল, — টাকা ছুঁলেও না। কিন্তু খানিক পরে গা-হাত-পা ধুয়ে নিজের কাপড় পরে এল। বললে, ‘কি দিচ্ছিলে এখন দাও।’ যখন সাধু সেজেছিল, তখন টাকা ছুঁতে পারে নাই। এখন চার আনা দিলেও হয়।

“কিন্তু পরমহংস অবস্থায় বালক হয়ে যায়। পাঁচ বছরের বালকের স্ত্রী-পুরুষ জ্ঞান নাই। তবু লোকশিক্ষার জন্য সাবধান হতে হয়।”

[শ্রীযুক্ত কেশব সেনের দ্বারা লোকশিক্ষা হল না কেন ]

শ্রীযুক্ত কেশব সেন কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর ছিলেন। — তাই লোকশিক্ষার ব্যাঘাত হইল। ঠাকুর এই কথা বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ইনি (কেশব) — বুঝেচো?

বিজয় — আজ্ঞা, হাঁ

শ্রীরামকৃষ্ণ — এদিক-ইদিক দুই রাখতে গিয়ে তেমন কিছু পারলেন না।

[শ্রীচৈতন্যদেব কেন সংসারত্যাগ করিলেন ]

বিজয় — চৈতন্যদেব নিত্যানন্দকে বললেন, “নিতাই, আমি যদি সংসারত্যাগ না করি, তাহলে লোকের ভাল হবে না। সকলেই আমার দেখাদেখি সংসার করতে চাইবে। — কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে হরিপাদপদ্মে সমস্ত মন দিতে কেহ চেষ্টা করবে না!”

শ্রীরামকৃষ্ণ — চৈতন্যদেব লোকশিক্ষার জন্য সংসারত্যাগ করলেন।

“সাধু-সন্ন্যাসী নিজের মঙ্গলের জন্য কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করবে। আবার নির্লিপ্ত হলেও, লোকশিক্ষার জন্য কাছে কামিনী-কাঞ্চন রাখবে না। ন্যাসী — সন্ন্যাসী — জগদ্‌গুরু! তাকে দেখে তবে তো লোকের চৈতন্য হবে!”

সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। বিজয় কেদারকে বলিতেছেন, “আজ সকালে (ধ্যানের সময়) আপনাকে দেখেছিলাম; — গায়ে হাত দিতে যাই — কেউ নাই।”
===========

Post a Comment

0 Comments