চতুর্দশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

চতুর্দশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সুরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল,
লাটু, মাস্টার, অধর প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

চতুর্দশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২০শে জুন
শ্রীযুক্ত বাবুরাম, রাখাল, লাটু, নিরঞ্জন, নরেন্দ্র প্রভৃতির চরিত্র

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। সন্ধ্যা হইয়াছে, তাই জগন্মাতার নাম ও চিন্তা করিতেছেন। ঘরে রাখাল, অধর, মাস্টার, আরও দু-একজন ভক্ত আছেন।

আজ শুক্রবার (৭ই আষাঢ়), জৈষ্ঠ কৃষ্ণা দ্বাদশী, ২০শে জুন, ১৮৮৪। পাঁচ দিন পরে রথযাত্রা হইবে।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরবাড়িতে আরতি আরম্ভ হইল। অধর আরতি দেখিতে গেলেন। ঠাকুর মণির সহিত কথা কহিতেছেন ও আনন্দে মণির শিক্ষার জন্য ভক্তদের গল্প করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, বাবুরামের কি পড়বার ইচ্ছা আছে?

“বাবুরামকে বললাম, তুই লোকশিক্ষার জন্য পড়। সীতার উদ্ধারের পর বিভীষণ রাজ্য করতে রাজী হল না। রাম বললেন, তুমি মূর্খদের শিক্ষার জন্য রাজ্য করো। না হলে তারা বলবে, বিভীষণ রামের সেবা করেছে তার কি লাভ হল? — রাজ্যলাভ দেখলে খুশি হবে।

“তোমায় বলি সেদিন দেখলাম — বাবুরাম, ভবনাথ আর হরিশ এদের প্রকৃতি ভাব।

“বাবুরামকে দেখলাম — দেবীমূর্তি। গলায় হার। সখী সঙ্গে। ও স্বপ্নে কি পেয়েছে, ওর দেহ শুদ্ধ। একটু কিছু করলেই ওর হয়ে যাবে।

“কি জানো, দেহরক্ষার অসুবিধা হচ্ছে। ও এসে থাকলে ভাল হয়। এদের স্বভাব সব একরকম হয়ে যাচ্ছে। নোটো (লাটু) চড়েই রয়েছে (সর্বদাই ভাবেতে রয়েছে)। ক্রমে লীন হবার জো!

“রাখালের এমনি স্বভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, তাকে আমার জল দিতে হয়! (আমার) সেবা করতে বড় পারে না।

“বাবুরাম আর নিরঞ্জন — এদের ছাড়া কই ছোকরা? — যদি আর কেউ আসে, বোধ হয়, ওই উপদেশ নেবে; চলে যাবে।

“তবে টানাটানি করে আসতে বলি না, বাড়িতে হাঙ্গাম হতে পারে। (সহাস্যে) আমি যখন বলি ‘চলে আয় না’ তখন বেশ বলে, — ‘আপনি করে নিন না!’ রাখালকে দেখে কাঁদে। বলে, ও বেশ আছে!

“রাখাল এখন ঘরের ছেলের মতো আছে; জানি, আর ও আসক্ত হবে না। বলে, ‘ও-সব আলুনী লাগে!’ ওর পরিবার এখানে এসেছিল। ১৪ বৎসর বয়স। এখান হয়ে কোন্নগরে গেল। তারা ওকে কোন্নগরে যেতে বললে। ও গেল না। বলে — ‘আমোদ-আহ্লাদ ভাল লাগে না।’

“নিরঞ্জনকে তোমার কিরূপ বোধ হয়?”

মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ চেহারা!

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, চেহারা শুধু নয়। সরল। সরল হলে ঈশ্বরকে সহজে পাওয়া যায়। সরল হলে উপদেশে শীঘ্র কাজ হয়। পাট করে জমি কাঁকর কিছু নাই, বীজ পড়লেই গাছ হয় আর শীঘ্র ফল হয়।

“নিরঞ্জন বিয়ে করবে না। তুমি কি বল, — কামিনী-কাঞ্চনই বদ্ধ করে?”

মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — পান তামাক ছাড়লে কি হবে? কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগই ত্যাগ।

“ভাবে দেখলাম, যদিও চাকরি করছে, ওকে কোন দোষ স্পর্শ করে নাই। মার জন্য কর্ম করে, — ওতে দোষ নাই।

“তোমার কর্ম যা করো, — এতে দোষ নাই। এ ভাল কাজ।

“কেরানি জেলে গেল — বদ্ধ হল — বেড়ি পরলে — আবার মুক্ত হল। মুক্ত হওয়ার পর সে কি ধেই ধেই করে নাচবে? সে আবার কেরানিগিরিই করে। তোমার উপায়ের ইচ্ছা নাই। ওদের খাওয়ানো পরানো। তারা তা না হলে কোথায় যাবে?”

মণি — কেউ নেয় তো ছাড়া যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বইকি! এখন এ-ও করো, ও-ও করো।

মণি — সব ত্যাগ করতে পারা ভাগ্য!

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বইকি! তবে যেমন সংস্কার। তোমার একটু কর্ম বাকী আছে। সেটুকু হয়ে গেলেই শান্তি — তখন তোমায় ছেড়ে দেবে। হাসপাতালে নাম লেখালে সহজে ছাড়ে না। সম্পূর্ণ সারলে তবে ছাড়ে।

“ভক্ত এখানে যারা আসে — দুই থাক। একথাক বলছে, আমায় উদ্ধার করো! হে ঈশ্বর! আর-একথাক তারা অন্তরঙ্গ, তারা ও-কথা বলে না। তাদের দুটি জিনিস জানলেই হল; প্রথম, আমি (শ্রীরামকৃষ্ণ) কে? তারপর, তারা কে — আমার সঙ্গে সম্বন্ধ কি?

“তুমি এই শেষ থাকের। তা না হলে এতো সব করে. . .”

[নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জনের পুরুষভাব; বাবুরাম, ভবনাথের প্রকৃতিভাব ]

“ভবনাথ, বাবুরাম এদের প্রকৃতিভাব। হরিশ মেয়ের কাপড় পরে শোয়। বাবুরাম বলেছে, ওই ভাবটা ভাল লাগে। তবেই মিললো। ভবনাথেরও ওই ভাব। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, এদের ব্যাটাছেলের ভাব।”

[হাত ভাঙার মানে — সিদ্ধাই (Miracles) ও শ্রীরামকৃষ্ণ ]

“আচ্ছা হাত ভাঙার মানেটা কি? আগে একবার ভাবাবস্থায় দাঁত ভেঙে গিছল, এবার ভাবাবস্থায় হাত ভাঙল।”

মণি চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর নিজেই বলিতেছেন —

“হাত ভেঙেছে সব অহংকার নির্মূল করবার জন্য! এখন আর ভিতরে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজতে গিয়ে দেখি, তিনি রয়েছেন। অহংকার একেবারে না গেলে তাঁকে পাবার জো নাই।

“চাতকের দেখ মাটিতে বাসা, কিন্তু কত উপরে উঠে!

“আচ্ছা, কাপ্তেন বলে, মাছ খাও বলে তোমার সিদ্ধাই হয় নাই।

“এক-একবার গা কাঁপে পাছে ওই সব শক্তি এসে পড়ে। এখন যদি সিদ্ধাই হয়, এখানে ডাক্তারখানা, হাসপাতাল হয়ে পড়বে। লোক এসে বলবে, ‘আমার অসুখ ভাল করে দাও!’ সিদ্ধাই কি ভাল?”

মাস্টার — আজ্ঞে, না। আপনি তো বলেছেন, অষ্ট সিদ্ধির মধ্যে একটি থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক বলেছ! যারা হীনবুদ্ধি, তারাই সিদ্ধাই চায়।

“যে লোক বড় মানুষের কাছে কিছু চেয়ে ফেলে, সে আর খাতির পায় না! সে লোককে এক গাড়িতে চড়তে দেয় না; — আর যদি চড়তে দেয় তো কাছে বসতে দেয় না। তাই নিষ্কাম ভক্তি, অহেতুকি ভক্তি — সর্বাপেক্ষা ভাল।

[সাকার-নিরাকার দুই-ই সত্য — ভক্তের বাটী ঠাকুরের আড্ডা ]

“আচ্ছা, সাকার-নিরাকার দুই-ই সত্য। কি বল? — নিরাকারে মন অনেকক্ষণ রাখা যায় না — তাই ভক্তের জন্য সাকার।

“কাপ্তেন বেশ বলে। পাখি উপরে খুব উঠে যখন শ্রান্ত হয়, তখন আবার ডালে এসে বিশ্রাম করে। নিরাকারের পর সাকার।

“তোমার আড্ডাটায় একবার যেতে হবে। ভাবে দেখলাম — অধরের বাড়ি, সুরেন্দ্রের বাড়ি — এ-সব আমার আড্ডা।

“কিন্তু ওরা এখানে না এলে আমার ইষ্টাপত্তি নাই।”

[ভক্তসঙ্গে লীলা পর্যন্ত বাজিকরের খেলা — চন্ডী — দয়া ঈশ্বরের ]

মাস্টার — আজ্ঞা, তা কেন হবে? সুখবোধ হলেই দুঃখ। আপনি সুখ-দুঃখের অতীত।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, আর আমি দেখছি, বাজিকর আর বাজিকরের খেলা। বাজিকরই সত্য। তাঁর খেলা সব অনিত্য — স্বপ্নের মতো।

“যখন চন্ডী শুনতাম, তখন ওইটি বোধ হয়েছিল। এই শুম্ভ নিশুম্ভের জন্ম হল। আবার কিছুক্ষণ পরে শুনলাম বিনাশ হয়ে গেল।”

মাস্টার — আজ্ঞা, আমি কালনায় গঙ্গাধরের সঙ্গে জাহাজে করে যাচ্ছিলাম। জাহাজের ধাক্কা লেগে একনৌকা লোক, কুড়ি-পঁচিশজন ডুবে গেল! স্টীমারের তরঙ্গের ফেনার মতো জলে মিশিয়ে গেল!

“আচ্ছা, যে বাজি দেখে, তার কি দয়া থাকে? — তার কি কর্তৃত্ববোধ থাকে? — কর্তৃত্ববোধ থাকলে তবে তো দয়া থাকবে?”

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে একেবারে সবটা দেখে, — ঈশ্বর, মায়া, জীব, জগৎ।

“সে দেখে যে মায়া (বিদ্যা-মায়া, অবিদ্যা-মায়া), জীব, জগৎ — আছে অথচ নাই। যতক্ষণ নিজের ‘আমি’ আছে ততক্ষণ ওরাও আছে। জ্ঞান অসির দ্বারা কাটলে পর, আর কিছুই নাই। তখন নিজের ‘আমি’ পর্যন্ত বাজিকরের বাজি হয়ে পড়ে!

মণি চিন্তা করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “কিরকম জানো? — যেমন পঁচিশ থাক পাপড়িওয়ালা ফুল। এক চোপে কাটা!

কর্তৃত্ব! রাম! রাম! — শুকদেব, শঙ্করাচার্য এঁরা জ্ঞবিদ্যার আমিঞ্চ রেকেছিলেন। দয়া মানুষের নয়, দয়া ঈশ্বরের। বিদ্যার আমির ভিতরেই দয়া, বিদ্যার জ্ঞআমিঞ্চ তিনিই হয়েছেন। ঞ্চঞ্চ

[অতি গুহ্যকথা — কালীব্রহ্ম — আদ্যাশক্তির এলাকা — কল্কি অবতার ]

“কিন্তু হাজার বাজি দেখো, তবু তাঁর অণ্ডরে (Under – অধীন)। পালাবার জো নাই। তুমি স্বাধীন নও। তিনি যেমন করান তেমনি করতে হবে। সেই আদ্যাশক্তি ব্রহ্মজ্ঞান দিলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান হয় — তবে বাজির খেলা দেখা যায়। নচেৎ নয়।

“যতক্ষণ একটু ‘আমি’ থাকে, ততক্ষণ সেই আদ্যাশক্তির এলাকা। তাঁর অণ্ডরে — তাঁকে ছাড়িয়ে যাবার জো নাই।

“অদ্যাশক্তির সাহায্যে অবতারলীলা। তাঁর শক্তিতে অবতার। অবতার তবে কাজ করেন। সমস্তই মার শক্তি।

“কালীবাড়ির আগেকার খাজাঞ্চী কেউ কিছু বেশিরকম চাইলে বলত ‘দু-তিনদিন পরে এসো’। মালিককে জিজ্ঞাসা করবে।

“কলির শেষে কল্কি অবতার হবে। ব্রাহ্মণের ছেলে — সে কিছু জানে না — হঠাৎ ঘোড়া আর তরবার আসবে –”

[কেশব সেনের মাতা ও ভগিনী — ধাত্রী ভুবনমোহিনী ]

অধর আরতি দেখিয়া আসিয়া বসিলেন। ধাত্রী ভুবনমোহিনী মাঝে মাঝে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন। ঠাকুর সকলের জিনিস খাইতে পারেন না — বিশেষতঃ ডাক্তার, কবিরাজের, ধাত্রির। অনেক যন্ত্রণা দেখেও তাহারা টাকা লন, এইজন্য খাইতে পারেন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (অধর প্রভৃতি ভক্তের প্রতি) — ভুবন এসেছিল। পঁচিশটা বোম্বাই আম আর সন্দেশ, রসগোল্লা এনেছিল। আমায় বললে, আপনি একটা আঁব খাবে? আমি বললাম — আমার পেট ভার। আর সত্যই দেখ না, একটু কচুরি সন্দেশ খেয়েই পেট কিরকম হয়ে গেছে।

“কেশব সেনের মা বোন এরা এসেছিল। তাই আবার খানিকটা নাচলাম। কি করি! — ভারী শোক পেয়েছে।”
===========

Post a Comment

0 Comments