বিবিধ~পার্ট ২

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা 
দশম খণ্ড

বিবিধ~পার্ট ২

===============

ইতিহাসের প্রতিশোধ

ইতিহাসের প্রতিশোধ

১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে অগষ্ট মাসের শেষের দিকে বিবেকানন্দ অধ্যাপক জে. এইচ রাইটের এনিস্কোয়াম গ্রামের বাড়ীতে ছিলেন। নিউ ইংলণ্ডের একটি ছোট্ট শান্ত পল্লীতে স্বামীজীর আবির্ভাব এমন এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল যে, তিনি এখানে আসামাত্র এই অপরূপ সুন্দর বিরাট-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি কোথা থেকে এসেছেন, তাই নিয়ে পল্লীবাসীদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত করলেন যে, তিনি একজন ভারতীয় ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্পর্কে তাঁদের ধারণার সঙ্গে স্বামীজীর আচার-ব্যবহার কিছুই মিলল না। তখন তাঁকে সঠিক জানবার জন্য এবং তাঁর কথা শোনবার জন্য একদিন রাত্রির আহারের পর সকলে আধ্যাপক রাইটের বাড়ীতে এসে হাজির হলেন। বৈঠকখানায় কথোপকথনরত স্বামীজী তখন মধুর স্বরে বলছিলেনঃ

‘এই সেদিন—মাত্র কয়েকদিন আগেও—চার-শ বছরেরও বেশী হবে না—হঠাৎ তাঁর কণ্ঠস্বর বদলে গেল, তিনি বলতে লাগলেনঃ দুর্গত জাতির উপর তারা কি নিষ্ঠুর ব্যবহার ও অত্যাচারই না করেছে। কিন্তু ঈশ্বরের বিচার তাদের ওপর নিশ্চয়ই একদিন নেমে আসবে। ইংরেজ! মাত্র অল্পকাল আগেও এরা ছিল অসভ্য। এদের গায়ে পোকা কিলবিল করত, আর তারা তাদের গায়ের দুর্গন্ধ ঢেকে রাখত নানা সুগন্ধ দিয়ে। … কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! সবেমাত্র বর্বরতার অবস্থা পেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

যাদের সমালোচনা তিনি করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন শ্রোতা বলে উঠলেন, ‘এটা একেবারে বাজে কথা। এটা অন্ততঃ পাঁচ-শ বছর আগেকার ব্যাপার।’

আমি কি বলিনি, ‘এই কিছুদিন আগেও? মানুষের আত্মার অনন্তত্বের পরিমাপে কয়েক-শ বছর আর কতটুকু?’ তারপর গলার স্বর পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ শান্ত ও যুক্তিপূর্ণ সুরে বললেনঃ তারা একেবারে অসভ্য। উত্তরাঞ্চলের প্রচণ্ড শীত, অভাব অনটন এদের বন্য করে তুলেছে। এরা কেবল পরকে হত্যা করার কথাই ভাবে। … কোথায় তাদের ধর্ম? মুখে তারা পবিত্র ঈশ্বরের নাম নেয়, প্রতিবেশীকে তারা ভালবাসে বলে দাবী করে, খ্রীষ্টের নামে তারা পরকে সভ্য করার কথা বলে। কিন্তু এ-সবই মিথ্যা। ঈশ্বর নয়—ক্ষুধাই এদের সভ্য করে তুলেছে। মানুষের প্রতি ভালবাসার কথা কেবল তাদের মুখে, অন্তরে পাপ আর সর্ব প্রকার হিংসা ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা মুখে বলে, ‘ভাই, আমি তোমাকে ভালবাসি,’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গলায় ছুরি চালায়। তাদের হাত রক্তরাঙা।

তারপর তাঁর সুমিষ্ট গলার স্বর গম্ভীর হয়ে এল, তিনি আরও ধীরে বলতে লাগলেনঃ কিন্তু ঈশ্বরের বিচার একদিন তাদের উপরেও নেমে আসবে। প্রভু বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নেব আমি, প্রতিফল দেব।’ মহাধ্বংস আসছে। এই পৃথিবীতে তোমাদের খ্রীষ্টানেরা সংখ্যায় কত? সমগ্র পৃথিবীর লোকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশও নয়। চেয়ে দেখ লক্ষ লক্ষ চীনাদের দিকে, ঈশ্বরের হাতিয়ার হিসাবে তারাই নেবে এর প্রতিশোধ। তারাই তোমাদের উপর আক্রমণ চালাবে। আর একবার চালাবে হুন অভিযান। তারপর একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘তারা সমগ্র ইওরোপকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোন কিছুরই অস্তিত্ব রাখবে না। নারী, পুরুষ, শিশু—সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে নেমে আসবে আবার অন্ধকার-যুগ।’ এ-কথা বলার সময় তাঁর গলার স্বর এত বিষণ্ণ হয়েছিল যে, তা অবর্ণনীয়। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আমি—আমি কিছুই গ্রাহ্য করি না। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে পৃথিবী আরও ভালভাবে গড়ে উঠবে। কিন্তু মহাধ্বংস আসছে। ঈশ্বরের প্রতিশোধ ও অভিশাপ নেমে আসতে আর দেরী নেই।’

তারা সকলেই প্রশ্ন করলেন, ‘শীগ্‌গিরই কি সেই অভিশাপ নেমে আসবে?’

‘এক হাজার বছরের মধ্যে ঘটনা ঘটবে।’

বিপদ আসন্ন নয় শুনে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

স্বামীজী বলতে লাগলেন, ‘ঈশ্বর এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেনই। আপনারা ধর্মের মধ্যে, রাজনীতির মধ্যে হয়তো তা দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এর সন্ধান করতে হবে। বারে বারে এমনই ঘটেছে, ভবিষ্যতেও এমনই ঘটবে। আপনারা যদি জনগণকে অত্যাচার ও পীড়ন করেন, তবে তার জন্য আপনাদের দুঃখভোগ করতেই হবে। চেয়ে দেখুন না ভারতের দিকে, কি করে ঈশ্বর আমাদের কাজের প্রতিশোধ নিচ্ছেন। ভারতের ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতে যারা ছিল ধনী মানী, তারা ধন-দৌলত বাড়াবার জন্য দরিদ্রকে নিষ্পেষণ করেছে, তাদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার করেছে। দুর্গত জনের কান্না তাদের কানে পৌঁছয়নি। তারা যখন অন্নের জন্য হাহাকার করেছে, ধনীরা তাদের সোনারূপার থালায় অন্নগ্রহণ করেছে। তারপরই ঈশ্বরের প্রতিশোধরূপে এল মুসলমানরা, এদের কেটে কুচি-কুচি করলে। তরবারির জোরে তারা তাদের উপর জয়ী হল। তারপর বহুকাল ও বহু বছর ধরে ভারত বার বার বিজিত হয়েছে এবং সর্বশেষে এসেছে ইংরেজ। যত জাতি ভারতে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হল এই ইংরেজ। ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, হিন্দুরা রেখে গেছে অপূর্ব মন্দির, মুসলমানরা সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। আর ইংরেজরা?—স্তূপীকৃত ব্র্যাণ্ডির ভাঙা বোতল—আর কিছু নয়। তবুও ঈশ্বর আমাদের দয়া করেননি, কারণ আমরা অন্যের প্রতি কোন দয়া-মমতা দেখাইনি। আমাদের দেশবাসীরা তাদের নিষ্ঠুরতায় সমগ্র সমাজকে নীচে টেনে এনে নামিয়েছে। তারপর যখন তাদের প্রয়োজন হল জনসাধারণের, তখন জনসাধারণের কোন ক্ষমতা রইল না তাদের সাহায্য করার। ঈশ্বর প্রতিশোধ নেন—মানুষ এ-কথা বিশ্বাস না করলেও ইতিহাসের প্রতিশোধ গ্রহণের অধ্যায়টি সে অবশ্যই অস্বীকার করতে পারবে না। ইতিহাস ইংরেজের কৃতকার্যের প্রতিশোধ নেবেই। আমাদের গ্রামে গ্রামে—দেশে দেশে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষে মরছে, তখন ইংরেজরা আমাদের গলায় পা দিয়ে টিপে ধরেছে, আমাদের শেষ রক্তটুকু তারা নিজ-তৃপ্তির জন্য পান করে নিয়েছে, আর আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকা তাদের নিজেদের দেশে চালান দিয়েছে। চীনারাই আজ তার প্রতিশোধ নেবে—তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজ যদি চীনারা জেগে ওঠে ও ইংরেজকে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দেয়, যা তাদের উচিত প্রাপ্য—তাহলে সুবিচারই হবে।

তারপর তাঁর সব কথা বলা হলে তিনি চুপ করে রইলেন। সমবেত জনগণের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে চাপা গুঞ্জরন উঠল; তিনি সব শুনলেন, বাইরে থেকে মনে হল যেন কান দিলেন না। উপরের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, ‘শিব! শিব!’ ক্ষুদ্র শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি ও ভাববন্যার প্রবাহে চঞ্চল ও অশান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল এই অদ্ভুত লোকটির শান্ত মনোভাবের অন্তরালে যেন আগ্নেয়গিরির গলিত লাভাস্রোতের মত এই ভাবাবেগ ও ভাববন্যা প্রবহমান। সভা ভঙ্গ হল, শ্রোতারা বিক্ষুব্ধ মনে চলে গেলেন।

প্রকৃতপক্ষে এ ছিল সপ্তাহের শেষের একটি দিন। তিনি কয়েকদিনই এখানে ছিলেন।… এখানে যেসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তিনি বরাবরই সেগুলি ছবির মত নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে সুন্দর সুন্দর গল্প উপাখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

এই সুন্দর গল্পটিও স্বামীজী কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেনঃ এক নারী তার স্বামীকে তার দুঃখ-কষ্টের জন্য গালাগালি দিত, অন্যের সাফল্য দেখে তাকে গঞ্জনা করত এবং তার দোষত্রুটিগুলির কথা তাকে সবিস্তারে বলত। স্ত্রী বলতঃ ভগবানকে এত বছর সেবা করার পর তোমার ভগবান্ কি তোমার জন্য এই করলেন? এই তার প্রতিদান? স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী বললেন, ‘আমি কি ধর্মের ব্যবসা করি? এই পর্বতের দিকে তাকিয়ে দেখ। এ আমার জন্য কি করে, আর আমিই বা তার জন্য কি করেছি? কিন্তু তা হলেও আমি এ পর্বতকে ভালবাসি। আমি সুন্দরকে ভালবাসি বলেই একে (হিমালয়কে) ভালবাসি—আমাকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আমার প্রকৃতি। ভগবানকে আমি এজন্যই ভালবাসি।’

তারপর স্বামীজী এক রাজার কাহিনী বললেন। এক রাজা জনৈক সাধুকে কিছু দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধু তাঁর প্রস্তাব প্রথমে প্রত্যাখান করেন। প্রাসাদে এসে রাজা তাঁর দান গ্রহণের জন্য সাধু্কে আবার বিশেষ পীড়াপীড়ি করতে থাকেন এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাজবাড়ীতে এসে সাধু দেখলেন, রাজা ধন-সম্পদ ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন, ভিক্ষা চাইছেন। সাধু কিছুক্ষণ তাঁর এই প্রার্থনা অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর তাঁর মাদুরটি গুটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। রাজা চোখ বুঁজে প্রার্থনা করছিলেন। প্রার্থনার পর চোখ খোলা-মাত্র দেখলেন যে, সাধু চলে যাচ্ছেন। রাজা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনি তো আমার দান গ্রহণ করলেন না?’ সাধু উত্তরে বললেন, ‘আমি ভিক্ষুকের কাছে দান নেব?’

ধর্মই সকলকে রক্ষা করতে পারে এবং খ্রীষ্টানধর্মে সকলকে রক্ষা করার শক্তি আছে—কোন ব্যক্তি এরূপ মন্তব্য করলে স্বামীজী তাঁর বড় বড় চোখ দুটি মেলে বললেন, ‘খ্রীষ্টানধর্মে যদি রক্ষা করার শক্তি থাকত, তবে এই ধর্ম কেন ইথিওপিয়া ও আবিসিনিয়ার লোকদের রক্ষা করতে পারল না?’

স্বামীজীর মুখে প্রায় এই কথাটি শোনা যেতঃ কোন সন্ন্যাসীর প্রতি ইংরেজরা এ-রকম করতে সাহস পাবে না। কোন কোন সময়ে তিনি তাঁর আকুল মনের এই ইচ্ছাও প্রকাশ করতেন ও বলতেন, ‘ইংরেজ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলুক। তাহলে আমার মৃত্যুই হবে তাদের ধ্বংসের সূত্রপাত।’ তারপর হাসির ঝিলিক লাগিয়ে বলতেন, ‘আমার মৃত্যু-সংবাদ সমগ্র দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে।’

সিপাহী বিদ্রোহে ঝাঁসির রাণীই ছিলেন তাঁর কাছে সবচেয়ে বীর নারী। তিনি রণক্ষেত্রে নিজেই সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন। বিদ্রোহীদের অনেকেই পরে আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সাধুদের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর রকমের জেদী মনোভাব দেখা যায়, এই হল তার অন্যতম ইতিহাস। এই বিদ্রোহীদেরই একজন তার চার-চারটি সন্তানকে হারিয়েছিল, শান্ত সুস্থির ভাবে তার সেই হারান সন্তানদের কথা বলত, কিন্তু ঝাঁসির রাণীর কথা উঠলেই তিনি আর চোখের জল রাখতে পারতেন না, দরদর ধারায় বুক ভেসে যেত। তিনি বলতেন, রাণী তো মানবী নন, দেবী। সৈন্যদল যখন পরাজিত হল, রাণী তখন তলোয়ার নিয়ে পুরুষের মত যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করলেন। এই সিপাহী বিদ্রোহের অন্য দিকের কাহিনী অদ্ভুত মনে হয়। এর যে অন্য দিক্‌ আছে, তা আপনারা ভাবতেই পারবেন না। কোন হিন্দু সিপাহী যে কোন নারীকে হত্যা করতে পারে না, সে-বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
===========

ধর্ম ও বিজ্ঞান

জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল অভিজ্ঞতা। জগতে ধর্মই একমাত্র বিজ্ঞান যাহাতে নিশ্চয়তা নাই, কেননা অভিজ্ঞতামূলক সত্য হিসাবে ইহা শিখান হয় না। এইরূপ উচিত নয়। যাহা হউক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে ধর্মশিক্ষা দেন, এমন কিছু লোক সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহাদিগকে অতীন্দ্রিয়বাদী বা মরমী (mystic) বলা হইয়া থাকে, এবং প্রতি ধর্মেই এই মরমীগণ একই ভাষায় কথা বলিয়া থাকেন এবং একই সত্য প্রচার করেন। ইহাই প্রকৃত ধর্ম- বিজ্ঞান। জগতে স্থানভেদে যেরূপ গণিতের (গাণিতিক সত্যের) তারতম্য হয় না, এই অতীন্দ্রিয় সত্যদ্রষ্টাগণের মধ্যেও কোন পার্থক্য দেখা যায় না। তাঁহাদের প্রকৃতি একই প্রকার, অবস্থান-রীতিও একই ধরনের। তাঁহাদের উপলব্ধি এক এবং এই উপলব্ধ সত্যই নিয়মরূপে পরিগণিত হইয়া থাকে।

ধর্মসংস্থার তথাকথিত ধার্মিক ব্যক্তিগণ প্রথমে ধর্ম-সম্বন্ধীয় একটি মতবাদ শিক্ষা করেন, পরে সেইগুলি অনুশীলন করেন। প্রত্যক্ষানুভূতিকে তাঁহারা বিশ্বাসের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেন না। কিন্তু মরমী হইলেন সত্যসন্ধানী, তিনি আধ্যাত্মিক সত্য প্রথমে উপলব্ধি করেন, মতবাদ সৃষ্টি করেন পরে। ধর্মযাজক-প্রচারিত ধর্ম অপরের উপলব্ধি-প্রসূত, মরমী- প্রচারিত ধর্ম স্বীয় উপলব্ধি-প্রসূত। যাজকীয় ধর্ম বাহিরকে অবলম্বন করিয়া অন্তরে প্রবিষ্ট হয়, অতীন্দ্রিয়বাদীর যাত্রা অন্তর হইতে বাহিরে।

রসায়নশাস্ত্র ও অপরাপর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ যেমন জড়জগতের সত্য অন্বেষণ করে, ধর্মের লক্ষ্য সেরূপ অতীন্দ্রিয় জগতের সত্য। রসায়নশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করিতে হইলে প্রকৃতি-রাজ্যের গ্রন্থখানি অধ্যয়ন করিতে হয়। অপরপক্ষে ধর্ম-শিক্ষার গ্রন্থ হইল স্বীয় মন ও হৃদয়। ঋষিগণ প্রায়শঃ জড়বিজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ, কেননা তাঁহারা যে গ্রন্থ পাঠ করেন অর্থাৎ অন্তর-গ্রন্থ, তাহাতে উহার খবর নাই। বৈজ্ঞানিকও সেরূপ ধর্মবিজ্ঞানে প্রায়শঃ অনভিজ্ঞ, কেননা তিনিও ধর্মবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানদানে সম্পূর্ণ অসমর্থ কেবল বাহিরের পুস্তকখানি অধ্যয়ন করিয়া থাকেন।

প্রতি বিজ্ঞানেরই একটি বিশেষ ধারা (পদ্ধতি) আছে; ধর্মবিজ্ঞান অনুরূপ ধারা-বিশিষ্ট। বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হইতে হয় বলিয়া ইহার অনুশীলন-ধারাও অনেক।অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ সমজাতীয় নয়। স্বভাবের বিভিন্নতাবশতঃ ধর্মবিজ্ঞান প্রণালী বিভিন্ন হইবেই। যেমন কোন একটি ইন্দ্রিয়ের প্রখরতা হেতু কাহারও শ্রবণশক্তি প্রখর, কাহারও বা দর্শনশক্তি, সেইরূপ মানস ইন্দ্রিয়ের প্রাবল্যও সম্ভব এবং এই বিশেষ দ্বারপথেই মানুষকে তাহার অন্তর্জগতে উপনীত হইতে হয়। তথাপি সকল মনের মধ্যে একটা ঐক্য আছে এবং এমন একটি বিজ্ঞানও আছে, যাহা সকল মনের পক্ষেই প্রযোজ্য হইতে পারে। এই ধর্ম- বিজ্ঞান মানবাত্মার বিশ্লেষণমূলক। ইহার কোন নির্দিষ্ট মতবাদ নাই।

কোন একটি ধর্ম সকলের জন্য নির্দিষ্ট হইতে পারে না। প্রত্যেকটি ধর্মমত একসূত্রে গ্রথিত এক একটি মুক্তার ন্যায়। সর্বোপরি আমাদের উচিত প্রত্যেক ধর্মমতের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটি বুঝিতে চেষ্টা করা। মানুষ কোন বিশেষ ধর্মমত লইয়া জন্মগ্রহণ করে না; ধর্ম তাহার ভিতরেই রহিয়াছে। যে-কোন ধর্মমত ব্যক্তিত্ব বিনাশ করিতে চায়, তাহাই পরিণামে ভয়াবহ। প্রত্যেক জীবন এক একটি স্রোত-প্রবাহের ন্যায় এবং সেই স্রোত-প্রবাহই তাহাকে ঈশ্বরের দিকে লইয়া যায়। ঈশ্বরোপলব্ধিই সকল ধর্মের চরম উদ্দেশ্য। ঈশ্বরোপাসনাই সর্বশিক্ষার সার। যদি প্রত্যেক মানব তাহার আদর্শ নির্বাচনপূর্বক নিষ্ঠার সহিত তাহা অনুশীলন করে, তবে ধর্মসম্বন্ধীয় সকল বিসম্বাদ ঘুচিয়া যাইবে।
===========

উপলব্ধিই ধর্ম

মানুষ এ পর্যন্ত ঈশ্বরকে যত নামে অভিহিত করিয়াছে, তন্মধ্যে ‘সত্য’ই সর্বশ্রেষ্ঠ। সত্য উপলব্ধির ফলস্বরূপ; অতএব আত্মার মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান কর। পুস্তক ও প্রতীকসকল দূর করিয়া আত্মাকে তাহার স্ব-স্বরূপ দর্শন করিতে দাও। শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, ‘আমরা গ্রন্থ- রাজির চাপে অভিভূত ও উন্মত্ত হইয়া গিয়াছি।’ যাবতীয় দ্বৈতভাবের ঊর্ধ্বে যাও। যে মুহূর্তে তুমি মতবাদ, প্রতীক ও অনুষ্ঠানকে সর্বস্ব মনে করিলে সেই মুহূর্তেই তুমি বন্ধনে পড়িলে; অপরকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত ঐ-সকলের সম্পর্ক রাখিতে পার, কিন্তু সাবধান, ঐগুলি যেন তোমার বন্ধন না হইয়া পড়ে। ধর্ম এক, কিন্তু উহার প্রয়োগ বিভিন্ন হইবেই। সুতরাং প্রত্যেকে তাহার মতবাদ প্রচার করুক, কিন্তু কেহ যেন অপর ধর্মের দোষানুসন্ধান না করে। যদি তত্ত্বালোক প্রত্যক্ষ করিতে চাও, তাহা হইলে সকল প্রকার বেষ্টনী হইতে মুক্ত হও। ভগবদ্‌-জ্ঞান-সুধা আকণ্ঠ পান কর। ছিন্নবস্ত্র পরিহিত হইয়া যে ‘সোঽহম্’ উপলব্ধি করে, সেই ব্যক্তিই সুখী। অনন্তের রাজ্যে প্রবেশ কর ও অনন্ত শক্তি লইয়া ফিরিয়া আইস। ক্রীতদাস সত্যের অনুসন্ধানে যায়, এবং মুক্ত হইয়া ফিরিয়া আসে।
==============

স্বার্থ-বিলোপই ধর্ম

বিশ্বের অধিকারসমূহ কেহ বণ্টন করিতে পারে না। ‘অধিকার’ শব্দটিই ক্ষমতার সীমা-নির্দেশক। ‘অধিকার’ নয়, পরন্তু দায়িত্ব। জগতের কোথাও কোন অনিষ্ট সাধিত হইলে আমরা প্রত্যেকে তাহার জন্য দায়ী। কেহই নিজেকে তাহার ভ্রাতা হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে পারে না। যাহা ভূমার সহিত সংযোগ স্থাপন করে, তাহাই পুণ্য; এবং যাহা উহা হইতে আমাদিগকে বিচ্যুত করে, তাহাই পাপ। তুমি অনন্তের একটি অংশ, উহাই তোমার স্বরূপ। সেই অর্থে ‘তুমি তোমার ভ্রাতার রক্ষক’।

জীবনের প্রথম উদ্দেশ্য জ্ঞানলাভ, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আনন্দলাভ; জ্ঞান ও আনন্দ মুক্তির পথে পরিচালিত করে। কিন্তু যে পর্যন্ত না জগতের প্রত্যেকটি প্রাণী—পিপীলিকা বা কুকুর পর্যন্ত মুক্ত না হয়, ততক্ষণ কেহই মুক্তিলাভ করিতে পারে না। সকলে সুখী না হওয়া পর্যন্ত কেহই সুখী হইতে পারে না। যেহেতু তুমি ও তোমার ভ্রাতা মূলতঃ এক, অন্যকে আঘাত করিলে নিজেকেই আঘাত করা হয়। যিনি সর্বভূতে আত্মাকে ও আত্মাতে সর্বভূত প্রত্যক্ষ করেন, তিনিই প্রকৃত যোগী। আত্মপ্রতিষ্ঠা নয়, আত্মোৎসর্গই বিশ্বের উচ্চতম বিধান।

‘অন্যায়ের প্রতিরোধ করিও না’—যীশুর এই উপদেশ কার্যে পরিণত না করাতেই জগতে এত অন্যায় পরিলক্ষিত হয়। একমাত্র নিঃস্বার্থতাই এই সমস্যার সমাধানে সক্ষম। প্রচণ্ড আত্মোৎসর্গের দ্বারা ধর্ম সাধিত হয়। নিজের জন্য কোন বাসনা রাখিও না। তোমার সকল কর্ম অপরের জন্য অনুষ্ঠিত হউক। এইভাবে জীবন যাপন করিয়া ঈশ্বরে স্বীয় অস্তিত্ব উপলব্ধি কর।
==========

আত্মার মুক্তি

আত্মার মুক্তি

দৃশ্যবস্তুর সংস্পর্শে না আসা পর্যন্ত যেমন আমরা আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অবহিত হইতে পারি না, সেইরূপ আত্মাকেও তাহার কার্যের ভিতর দিয়া ছাড়া আমরা প্রত্যক্ষ করিতে পারি না। ইন্দ্রিয়ানুভূতির নিম্নভূমিতে আত্মাকে আনিতে পারা যায় না। আত্মা স্বয়ং কারণের বিষয়ীভূত না হইয়াও এই বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের কারণ। যখন আমরা নিজেদের আত্মা বলিয়া জানিতে পারি, তখনই আমরা মুক্ত হইয়া যাই। আত্মা অপরিণামী। ইহা কদাপি কারণের বিষয় হইতে পারে না, কেননা ইহা স্বয়ং কারণ। আত্মা স্বয়ম্ভূ। আমাদের মধ্যে যদি এমন কোন বস্তুর সন্ধান পাই, যাহা কোন কারণের দ্বারা সাধিত নয়, তখনই বুঝিতে হইবে, আমরা আত্মাকে জানিয়াছি।।

অমৃতত্ব ও মুক্তি অবিচ্ছেদ্যভাবে সংশ্লিষ্ট। মুক্ত হইতে হইলে প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে যাইতে হইবে। বিধিনিষেধ ততদিন, যতদিন আমরা অজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞান হইলে আমরা হৃদয়ঙ্গম করি যে, আমাদের ভিতরে যে স্বাধীনতা রহিয়াছে উহারই নাম নিয়ম। ইচ্ছা কখনও স্বাধীন হইতে পারে না, কারণ ইহা কার্য-কারণ-সাপেক্ষ। কিন্তু ইচ্ছাশক্তির পশ্চাতে অবস্থিত ‘অহং’ স্বাধীন, এবং উহাই আত্মা। ‘আমি মুক্ত’ এই বুদ্ধিকে ভিত্তি করিয়া জীবন গঠন করিতে হইবে ও বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। মুক্তির অর্থ অমৃতত্ব।।
=======================

বেদান্ত-বিষয়ক বক্তৃতার অনুলিপি

হিন্দুধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি—অনুধ্যান ও গভীরচিন্তা-মূলক দর্শনশাস্ত্র এবং বেদের বিভিন্ন অংশে নিহিত নৈতিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলির মতে এই বিশ্ব অনন্ত ও নিত্যকাল স্থায়ী। ইহার কখনও আদি ছিল না, অন্তও হইবে না। এই জড়-জগতে আত্মার চৈতন্য- শক্তির—সীমার রাজ্যে অসীমের শক্তির অসংখ্য প্রকাশ ঘটিয়াছে; কিন্তু অনন্ত নিজে স্বয়ং বিদ্যমান—শাশ্বত ও অপরিণামী। কালের গতি অনন্তের চক্রের উপর কোন রেখাপাত করিতে পারে না।

মানব-বুদ্ধির অগোচর সেই অতীন্দ্রিয় রাজ্যে অতীত বা ভবিষ্যৎ বলিয়া কিছু নাই।

মানবাত্মা অমর—ইহাই বেদের শিক্ষা। দেহ ক্ষয়-বৃদ্ধিরূপ নিয়মের অধীন, কারণ যাহার বৃদ্ধি আছে, তাহা অবশ্যই ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। কিন্তু দেহী আত্মা দেহমধ্যে অবস্থিত, অনন্ত ও শাশ্বত জীবনের সহিত যুক্ত। ইহার জন্ম কখনও হয় নাই, মৃত্যুও কখনও হইবে না। বৈদিকধর্ম ও খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হইল এই যে, খ্রীষ্টধর্ম শিক্ষা দেয়—এই পৃথিবীতে জন্ম-পরিগ্রহই মানবাত্মার আদি, অপরপক্ষে—বৈদিক ধর্ম দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিয়া থাকে, মানবাত্মা অনন্ত সত্তার অভিব্যক্ত মাত্র এবং পরমেশ্বরের মতই ইহার কোন আদি নাই। সেই শাশ্বত পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত, আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশের নিয়মানুসারে দেহ হইতে দেহান্তরে—অবস্থা হইতে অবস্থান্তরে গমনকালে সেই আত্মা বহুরূপে প্রকাশিত হইয়াছে ও হইবে। অবশেষে সেই পূর্ণত্ব-প্রাপ্তির পর তাহার আর অবস্থান্তর ঘটিবে না।

==================

বেদ ও উপনিষদ্‌-প্রসঙ্গে

বৈদিক যজ্ঞের বেদী হইতেই জ্যামিতির উদ্ভব হইয়াছিল।

দেবতা বা দিব্যপুরুষের আরাধনাই ছিল পূজার ভিত্তি। ইহার ভাব এইঃ যে দেবতা আরাধিত হন, তিনি সাহায্যপ্রাপ্ত হন ও সাহায্য করেন। বেদের স্তোত্রগুলি কেবল স্তুতিবাক্য নয়, পরন্তু যথার্থ মনোভাব লইয়া উচ্চারিত হইলে উহারা শক্তিসম্পন্ন হইয়া দাঁড়ায়।।

স্বর্গলোকসমূহ অবস্থান্তর মাত্র, যেখানে ইন্দ্রিয়জ্ঞান ও উচ্চতর ক্ষমতা আরও অধিক। পার্থিব দেহের ন্যায় ঊর্ধ্বস্থিত সূক্ষ্ম দেহও পরিণামে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। ইহজীবনে এবং পরজীবনে সর্বপ্রকার দেহেরই মৃত্যু ঘটিবে। দেহগণও মরণশীল এবং তাঁহারা কেবল ভোগ সুখ-প্রদানেই সমর্থ।।

দেবগণের পশ্চাতে এক অখণ্ড সত্তা—ঈশ্বর বর্তমান, যেমন এই দেহের পশ্চাতে এক উচ্চতর সত্তা অবস্থিত, যিনি অনুভব ও দর্শন করেন।

বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় বিধানের শক্তি সর্বত্রবিদ্যমানতা, সর্বজ্ঞতা এবং সর্বশক্তিমত্তা প্রভৃতি গুণাবলী দেবগণেরও নিয়ন্তা একমাত্র ঈশ্বরেই বিদ্যমান।।

‘অমৃতের পুত্রগণ শ্রবণ কর, ঊর্ধ্বলোক-নিবাসী সকলে শ্রবণ কর, সকল সংশয় ও অন্ধকারের পারে আমি এক জ্যোতির দর্শন পাইয়াছি। আমি সেই সনাতন পুরুষকে জানিয়াছি।’ উপনিষদের মধ্যে এই পথের নির্দেশ আছে।।

পৃথিবীতে আমরা মরণশীল। স্বর্গেও মৃত্যু আছে। ঊর্ধ্বতম স্বর্গলোকেও আমরা মৃত্যুর কবলে পতিত হই। কেবল ঈশ্বরলাভ হইলেই আমরা সত্য ও প্রকৃত জীবন লাভ করিয়া অমরত্ব প্রাপ্ত হই।।

উপনিষদ্ কেবল এই তত্ত্বগুলিরই অনুশীলন করে। উপনিষদ্‌ শুদ্ধ পথের প্রদর্শক। উপনিষদে যে পথের নির্দেশ আছে, তাহাই পবিত্র পন্থা। বেদের বহু আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ও স্থানীয় প্রসঙ্গ বর্তমানে বোঝা যায় না। কিন্তু উহাদের মাধ্যমে সত্য পরিস্ফুট হয়। সত্যের আলোক-প্রাপ্তির জন্য স্বর্গ ও মর্ত্য ত্যাগ করিতে হয়।

উপনিষদ্ ঘোষণা করিতেছেনঃ।

সেই ব্রহ্ম সমগ্র জগতে ওতপ্রোত হইয়া আছেন। এই জগৎ-প্রপঞ্চ তাঁহারই। তিনি সর্বব্যাপী, অদ্বিতীয়, অশরীরী, অপাপবিদ্ধ, বিশ্বের মহান্ কবি, শুদ্ধ, সর্বদর্শী; সূর্য ও তারকাগণ যাঁহার ছন্দ—তিনি সকলকে যথানুরূপ কর্মফল প্রদান করিয়া থাকেন।।।

যাঁহারা কর্মানুষ্ঠানের দ্বারাই জ্ঞানের আলোক লাভ করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তাঁহারা গভীর অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। পক্ষান্তরে যাঁহারা মনে করেন, এই জগৎ-প্রপঞ্চই সর্বস্ব, তাঁহারাও অন্ধকারে রহিয়াছেন। এই-সকল ভাবনার দ্বারা যাঁহারা প্রকৃতির বাহিরে যাইতে অভিলাষ করেন, তাঁহারা গভীরতর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।

তবে কি কর্মানুষ্ঠান মন্দ? না, যাহারা প্রবর্তক মাত্র, তাহারা এই-সকল অনুষ্ঠানের দ্বারা উপকৃত হইবে।

একটি উপনিষদে কিশোর নচিকেতা কর্তৃক এই প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছেঃ মানুষের মরণ হইলে কেহ বলেন, তিনি থাকেন না; কেহ কেহ বলেন, তিনি থাকেন। আপনি যম, মৃত্যু স্বয়ং—আপনি নিশ্চিতই এই সত্য অবগত আছেন; আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। যম উত্তর করিলেন, ‘মানুষ তো দূরের কথা, দেবতাগণের মধ্যেও অনেকে ইহা জ্ঞাত নন। হে বালক, তুমি আমাকে ইহার উত্তর জিজ্ঞাসা করিও না।’ কিন্তু নচিকেতা স্বীয় প্রশ্নে অবিচলিত রহিলেন। যম পুনরায় বলিলেন, ‘দেবতাগণের ভোগ্যবিষয়সকল আমি তোমাকে প্রদান করিব। ঐ-প্রশ্ন বিষয়ে আমাকে আর অনুরোধ করিও না।’ কিন্তু নচিকেতা পর্বতের ন্যায় অটল রহিলেন। অতঃপর মৃত্যুদেবতা বলিলেন, ‘বৎস, তুমি তৃতীয়বারেও সম্পদ্, শক্তি, দীর্ঘজীবন, যশ, পরিবার সকলই প্রত্যাখ্যান করিয়াছ। চরম সত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিবার মত যথেষ্ট সাহস তোমার আছে। আমি তোমাকে এই বিষয়ে উপদেশ প্রদান করিব। দুইটি পথ আছে—একটি শ্রেয়ের অপরটি প্রেয়ের। তুমি প্রথমটি নির্বাচন করিয়াছ।’

এখানে সত্যবস্তু প্রদানের শর্তগুলি লক্ষ্য কর। প্রথম হইল পবিত্রতা—একটি অপাপবিদ্ধ নির্মল চিত্ত বালক বিশ্বের রহস্য জানিবার জন্য প্রশ্ন করিতেছে। দ্বিতীয়তঃ কোন পুরস্কার বা প্রতিদানের আশা না রাখিয়া কেবল সত্যের জন্যই সত্যকে গ্রহণ করিতে হইবে। যিনি স্বয়ং আত্ম-সাক্ষাৎকার করিয়াছেন, সত্যকে উপলব্ধি করিয়াছেন—এইরূপ ব্যক্তির নিকট হইতে সত্য সম্বন্ধে উপদেশ না আসিলে উহা ফলপ্রদ হয় না। গ্রন্থ উহা দান করিতে পারে না, তর্কবিচারে উহা প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। যিনি সত্যের রহস্য অবগত, তাঁহার নিকটই সত্য উদ্ঘাটিত হয়।

এই রহস্য জানিবার পর শান্ত হইয়া যাও। বৃথা তর্কে উত্তেজিত হইও না। আত্মসাক্ষাৎকারে লাগিয়া যাও। তুমিই সত্যলাভ করিতে সমর্থ।

ইহা সুখ নয়, দুঃখ নয়; পাপ নয়, পুণ্যও নয়; জ্ঞান নয়, অজ্ঞানও নয়। ইহা তোমাকে বোধে বোধ করিতে হইবে। ভাষার মাধ্যমে আমি কেমন করিয়া তোমার নিকট ইহা বর্ণনা করিব?

যিনি অন্তর হইতে কাঁদিয়া বলেন, প্রভু, আমি একমাত্র তোমাকেই চাই—প্রভু তাঁহারই নিকট নিজেকে প্রকাশ করেন। পবিত্র হও, শান্ত হও; অশান্ত চিত্তে ঈশ্বর প্রতিফলিত হন না।

‘বেদ যাঁহাকে ঘোষণা করে, যাঁহাকে লাভ করিবার জন্য আমরা প্রার্থনা ও যজ্ঞ করিয়া থাকি, ওম্ (ওঁ) সেই অব্যক্ত পুরুষের পবিত্র নামস্বরূপ।’ এই ওঙ্কার সমুদয় শব্দের মধ্যে পবিত্রতম। যিনি এই শব্দের রহস্য অবগত, তিনি প্রার্থিত বস্তু লাভ করেন। এই শব্দের আশ্রয় গ্রহণ কর। যে কেহ এই শব্দের আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাঁহার নিকট পথ উদ্ঘাটিত হয়।
========

জ্ঞানযোগ

প্রথমতঃ ধ্যান নেতিমূলক হইবে। সমস্ত চিন্তা বিলয় করিয়া দাও। যাহা মনে আসে, তাহা প্রবল ইচ্ছাশক্তি সহায়ে বিশ্লেষণ করিয়া নিরস্ত কর।

অতঃপর দৃঢ়তার সহিত আমাদের যাহা প্রকৃত স্বরূপ, তৎসম্বন্ধে অভিনিবিষ্ট হও—সৎ, চিৎ, আনন্দ—অস্তি-ভাব, জ্ঞান-স্বভাব এবং প্রেমস্বরূপ।

ধ্যানের মধ্য দিয়াই দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ঐক্যানুভব হইয়া থাকে। ধ্যান করঃ

ঊর্ধ্ব আমা-দ্বারা পরিপূর্ণ; অধঃ আমাতে পরিপূর্ণ; মধ্য আমাতে পরিপূর্ণ। আমি সর্বভূতে এবং সর্বভূত আমাতে বিরাজিত। ওম্ তৎ সৎ, আমিই সেই। আমি মনের ঊর্ধ্বে সৎস্বরূপ। আমি বিশ্বের একমাত্র আত্মাস্বরূপ। আমি সুখ নই, দুঃখ নই।

দেহই পান করে, আহার করে ইত্যাদি। আমি দেহ নই, মন নই। সোঽহ‍ম্।

আমি সাক্ষি-স্বরূপ, আমি দ্রষ্টা। যখন দেহ সুস্থ থাকে, আমি সাক্ষী; যখন রোগ আক্রমণ করে, তখনও আমি সাক্ষি-স্বরূপ বর্তমান।

আমি সচ্চিদানন্দ। আমিই সার পদার্থ, জ্ঞানামৃত-স্বরূপ। অনন্তকালে আমার পরিবর্তন নাই। আমি শান্ত, দীপ্যমান, পরিবর্তন-রহিত।
============

সত্য এবং ছায়া

সত্য এবং ছায়া

দেশ, কাল ও নিমিত্ত এক বস্তু হইতে অপর বস্তুর পার্থক্য নির্ণয় করে। পার্থক্য আকারেই বিদ্যমান, বস্তুতে নয়। রূপ (আকার) বিনষ্ট হইলে উহা চিরতরে লোপ পায়; কিন্তু বস্তু একরূপই থাকে। বস্তুকে কখনও ধ্বংস করিতে পারে না। প্রকৃতির মধ্যেই ক্রম-বিবর্তন, আত্মায় নয়—প্রকৃতির ক্রমবিবর্তন, আত্মার প্রকাশ।

সাধারণতঃ যেরূপ ব্যাখ্যা করা হইয়া থাকে, মায়া সেরূপ ভ্রম নয়। মায়া সৎ, আবার সৎ নয়। মায়া সৎ, কারণ উহার পশ্চাতে প্রকৃত সত্তা বিদ্যমান, উহাই মায়াকে প্রকৃত সত্তার আভাস প্রদান করে। মায়ার মধ্যে যাহা সৎ, তাহা হইল মায়ার মধ্যে ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান প্রকৃত সত্তা। তথাপি ঐ প্রকৃত সত্তা কখনও দৃষ্ট হয় না; সুতরাং যাহা দৃষ্ট হয়, তাহা অসৎ, এবং উহার প্রকৃত স্বতন্ত্র সত্তা নাই, প্রকৃত সত্তার উপরেই উহার অস্তিত্ব নির্ভর করে।

অতএব মায়া হইল কূটাভাস—সৎ অথচ সৎ নয়, ভ্রম অথচ ভ্রম নয়। যিনি প্রকৃত সত্তাকে (সৎস্বরূপকে) জানিয়াছেন, তিনি মায়াকে ভ্রম বলিয়া দেখেন না, সত্য বলিয়াই দেখেন। যিনি সৎস্বরূপ জ্ঞাত নন, তাঁহার নিকট মায়া ভ্রম এবং উহাকেই তিনি সত্য বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকেন।
===============

জীবন-মৃত্যুর বিধান

প্রকৃতির অন্তর্গত সমুদয় বস্তু নিয়ম অনুযায়ী কর্ম করিয়া থাকে। কিছুই ইহার ব্যতিক্রম নয়।মন ও বহিঃপ্রকৃতির সমুদয় বস্তু নিয়ম দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।

আন্তর ও বহিঃপ্রকৃতি, মন ও জড়বস্তু, কাল ও দেশের মধ্যে অবস্থিত এবং কার্য-কারণ সম্বন্ধ দ্বারা বদ্ধ।

মনের মুক্তি ভ্রমমাত্র। যে মন নিয়ম দ্বারা বদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত, তাহার মুক্তি কিরূপে সম্ভব? কর্মবাদই কার্য-কারণবাদ।

আমাদিগকে মুক্ত হইতেই হইবে। আমরা মুক্তই আছি; আমরা যে মুক্ত—উহা জানিতে পারাই প্রকৃত কাজ। সর্বপ্রকার দাসত্ব ও সর্বপ্রকার বন্ধন পরিত্যাগ করিতে হইবে। আমাদিগকে যে কেবল সর্বপ্রকার পার্থিব বন্ধন এবং জগদন্তর্গত সর্বপ্রকার বস্তু ও ব্যক্তির প্রতি বন্ধন ত্যাগ করিতে হইবে—তাহা নয়, পরন্তু স্বর্গ ও সুখ সম্বন্ধে সর্বপ্রকার কল্পনা ত্যাগ করিতে হইবে।

বাসনার দ্বারা আমরা পৃথিবীতে বদ্ধ, আবার ঈশ্বর স্বর্গ দেবদূতের নিকটও বদ্ধ। ক্রীতদাস ক্রীতদাসই, মানব ঈশ্বর অথবা দেবদূত যাহারই ক্রীতদাস সে হউক না কেন। স্বর্গের কল্পনা পরিত্যাগ করিতে হইবে।

সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়া অনন্ত সুখময় জীবন যাপন করে—এই ধারণা বৃথা স্বপ্নমাত্র। ইহার বিন্দুমাত্র অর্থ বা যৌক্তিকতা নাই। যেখানে সুখ, সেখানে কোন না কোন সময় দুঃখ আসিবেই। যেখানে আনন্দ, সেখানে বেদনা নিশ্চিত। ইহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, যেভাবে হউক প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকিবেই।

স্বাধীনতার আদর্শই হইতেছে মোক্ষলাভের প্রকৃত আদর্শ। তাহা ইন্দ্রিয়ের সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব আনন্দ বা বেদনা, ভাল বা মন্দ যাবতীয় বিষয় হইতে মুক্তি।

ইহা হইতেও অধিক—আমাদিগকে মৃত্যুর কবল হইতেও মুক্তিলাভ করিতে হইবে; এবং মৃত্যু হইতে মুক্তিলাভ করিতে হইলে জীবন হইতেও মুক্ত হইতে হইবে। জীবন মৃত্যুরই ছায়া মাত্র। জীবন থাকিলেই মৃত্যু থাকিবে; সুতরাং মৃত্যুকে অতিক্রম করিতে হইলে জীবন হইতেও মুক্ত হও।

আমরা চিরকালই মুক্ত, কেবল আমাদিগকে উহা বিশ্বাস করিতে হইবে, যথেষ্ট বিশ্বাস থাকা চাই। তুমি অনন্ত মুক্ত আত্মা, চিরস্বাধীন—চিরধন্য। যথেষ্ট বিশ্বাস রাখ—মুহূর্ত মধ্যে তুমি মুক্ত হইয়া যাইবে।

দেশ কাল ও নিমিত্তের সমুদয় বস্তু বদ্ধ। আত্মা সর্বপ্রকার দেশ কাল ও নিমিত্তের বাহিরে। যাহা বদ্ধ, তাহাই প্রকৃতি—আত্মা নয়!

অতএব তোমার মুক্তি ঘোষণা কর, এবং তুমি প্রকৃত যাহা, তাহাই হও—সদামুক্ত, সদানন্দময়।

দেশ কাল ও নিমিত্তকেই আমরা মায়া বলিয়া থাকি।
============

আত্মা ও ঈশ্বর

যাহা কিছু স্থান ব্যাপ্ত করিয়া আছে, তাহারই রূপ আছে। স্থান (দেশ) নিজেই রূপ বা আকার ধারণ করে। হয় তুমি স্থানের (দেশের) মধ্যে অবস্থিত, নতুবা স্থান তোমাতে অবস্থিত। আত্মা সর্বপ্রকার দেশের অতীত। দেশ আত্মায় অবস্থিত, আত্মা দেশে অবস্থিত নয়।

আকার বা রূপ কাল ও দেশের দ্বারা সীমাবদ্ধ এবং কার্য-কারণের দ্বারা আবদ্ধ। সমুদয় কাল আমাদের মধ্যে বিদ্যমান, আমরা কালের মধ্যে অবস্থিত নই। যেহেতু আত্মা স্থান ও কালের মধ্যে অবস্থিত নন, সমুদয় কাল ও দেশ আত্মায় অবস্থিত; অতএব আত্মা সর্বব্যাপী।

ঈশ্বর-সম্বন্ধে আমাদের ধারণা আমাদের নিজ নিজ চিন্তার প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন ফরাসী এবং সংস্কৃতের মধ্যে মিল আছে।

প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সহিত ঈশ্বরের অভেদ-কল্পনা অর্থাৎ প্রকৃতি-পূজাই ছিল ঈশ্বর-সম্বন্ধে প্রাচীন যুগের ধারণা। পরবর্তী ধাপ হইল গোষ্ঠীগত দেবতা। রাজাকে ঈশ্বর-জ্ঞানে পূজা করা হইল পরবর্তী ক্রম।

ঈশ্বর স্বর্গে অবস্থান করেন—এই ধারণা ভারতবর্ষ ব্যতীত সকল জাতির মধ্যেই প্রবল। ঐ ধারণা অত্যন্ত অপরিণত।

অবিচ্ছিন্ন জীবনের কল্পনা হাস্যজনক। যে পর্যন্ত আমরা জীবন হইতে মুক্তিলাভ না করি, সে পর্যন্ত মৃত্যু হইতেও মুক্তি নাই।
================

চরম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য

চরম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য

দ্বৈতবাদীর মতে ঈশ্বর এবং প্রকৃতি চিরকাল পৃথক্‌। বিশ্ব ও প্রকৃতি অনন্তকাল ধরিয়া ঈশ্বরাধীন।

চরম অদ্বৈতবাদিগণ এইরূপ তারতম্য করেন না। সর্বশেষ বিচারে তাঁহারা ঘোষণা করিয়া থাকেন যে, যাহা কিছু আছে সবই ব্রহ্ম, তাঁহাতেই বিশ্বপ্রপঞ্চ লয়প্রাপ্ত হয়; ঈশ্বর এই বিশ্বের অনন্ত জীবনস্বরূপ।

তাঁহাদের মতে অসীম ও সসীম—কেবল শব্দমাত্র। ভেদবুদ্ধিবশতই বিশ্বজগৎ প্রকৃতি প্রভৃতি স্বতন্ত্রভাবে দণ্ডায়মান। প্রকৃতি স্বয়ং বিভিন্নতার স্বরূপ।

‘ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করিলেন কেন?’ ‘যিনি স্বয়ং পূর্ণ, তিনি এই অপূর্ণ সৃষ্টি করিলেন কেন?’ ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না, কারণ এই ধরনের প্রশ্নগুলি তর্কানুসারে অযৌক্তিক। যুক্তির স্থান প্রকৃতির এলাকার মধ্যে; প্রকৃতির ঊর্ধ্বে উহার কোন অস্তিত্ব নাই। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান্‌, সুতরাং ‘কেন তিনি এইরূপ করিলেন, কেন তিনি ঐরূপ করিলেন?’— ইত্যাদি প্রশ্ন করিলে তাঁহাকে সীমাবদ্ধ করা হয়। যদি তাঁহার কোন উদ্দেশ্য থাকে, তবে তাহা নিশ্চয় কোন লক্ষ্যপ্রাপ্তির উপায়স্বরূপ এবং উহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ঐ উপায় ব্যতিরেকে ঈশ্বর লক্ষ্য সিদ্ধ করিতে পারেন না। ‘কেন? ও কোথা হইতে?’—ইত্যাদি প্রশ্নগুলি সেই বস্তুর সম্বন্ধেই উঠিতে পারে, যাহার অস্তিত্ব অপর কোন বস্তুর উপর নির্ভর করে।
==============

ধর্মের প্রমাণ-প্রসঙ্গে

ধর্ম সম্বন্ধে একটি বড় প্রশ্ন হইলঃ কি কারণে ধর্ম এত অবৈজ্ঞানিক? ধর্ম যদি একটি বিজ্ঞান, তবে অপরাপর বিজ্ঞানের ন্যায় উহার সত্যতা অবধারিত নয় কেন? ঈশ্বর, স্বর্গ প্রভৃতি সম্বন্ধে সমুদয় ধারণা—অনুমান ও বিশ্বাস মাত্র। ইহার সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা নাই, মনে হয়। ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হইতেছে। মন সর্বদা পরিবর্তনশীল প্রবাহস্বরূপ!

মানব কি আত্মা, এক অপরিবর্তনীয় সত্তা (পদার্থ) অথবা নিত্য পরিবর্তনশীলতার সমষ্টিমাত্র? প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম ব্যতীত সমুদয় ধর্ম বিশ্বাস করে যে, মানুষ আত্মা, এক অভিন্ন সত্তা, এক, অদ্বিতীয়—যাহার মৃত্যু নাই, অবিনশ্বর।

প্রাচীন বৌদ্ধমতাবলম্বিগণ বিশ্বাস করিয়া থাকেন যে, মানুষ নিত্য পরিবর্তনশীল অবস্থাবিশেষ এবং অসংখ্য দ্রুত অবস্থান্তরের প্রায় অনন্ত পারম্পর্যের মধ্যেই তাহার চৈতন্য নিহিত। প্রত্যেকটি পরিবর্তন অপর পরিবর্তনগুলি হইতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একক অবস্থান করিতেছে। এইভাবে কার্যকারণবাদ ও পরিণামবাদের কোন অবসর নাই।

যদি অদ্বিতীয় ‘সমগ্র’ বলিয়া কিছু থাকে, তবে বস্তুও (সত্তা) আছে। অখণ্ড সর্বদাই মৌলিক। মৌলিক কোন পদার্থের সংমিশ্রণ নয়। অন্য কোন পদার্থের উপর উহার অস্তিত্ব নির্ভর করে না। উহা একাকী বিরাজমান ও অবিনশ্বর।

প্রাচীন বৌদ্ধগণ এইরূপ যুক্তি প্রদর্শন করিয়া থাকেন যে, সমুদয় বস্তু পরস্পর বিচ্ছিন্ন; অখণ্ড বলিয়া কিছু নাই; এবং মানব একটি পূর্ণ বা অখণ্ড—এই মতবাদ কেবল বিশ্বাসমাত্র, উহা প্রমাণ করা যাইতে পারে না।

এখন প্রধান প্রশ্ন হইলঃ মানুষ কি এক পূর্ণ অথবা নিত্য পরিবর্তনশীলতার স্তূপমাত্র? এই প্রশ্নের উত্তর দিবার—প্রমাণ করিবার একটি মাত্র উপায় আছে। মনের চাঞ্চল্য রুদ্ধ কর, দেখিবে মানুষ পূর্ণ মৌলিক বা অবিমিশ্র, ইহা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইবে। সমুদয় পরিবর্তন আমার মধ্যে চিত্তে বা মনরূপ পদার্থে, আমি পরিবর্তনসমূহ নই। যদি তাহা হইতাম, তবে পরিবর্তনসমূহ রোধ করিতে পারিতাম না।

প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ও অপরের মধ্যে এই বিশ্বাস উৎপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে যে, জগতের সবই অতি সুন্দর, এবং সে সম্পূর্ণ সুখী। কিন্তু যখন সে স্থির হইয়া জীবনের উদ্দেশ্য কি তাহা অনুসন্ধান করে, তখন উপলব্ধি করে, সে যে ইহার এবং উহার পশ্চাতে ছুটিয়া চলিয়াছে—নানা বিষয়ের জন্য সংগ্রাম করিয়া চলিয়াছে, তাহার কারণ—উহা না করিয়া উপায় নাই। তাহাকে অগ্রসর হইতেই হইবে। সে স্থির হইয়া থাকিতে পারে না। সুতরাং সে নিজেকে বিশ্বাস করাইতে চেষ্টা করে যে, সত্য সত্যই তাহার নানা বস্তুর প্রয়োজন আছে। যে ব্যক্তি নিজেকে যথার্থভাবে বুঝাইতে সমর্থ হয় যে, তাহার সময় খুব ভাল যাইতেছে, বুঝিতে হইবে—তাহার শারীরিক স্বাস্থ্য অতি উত্তম। ঐ ব্যক্তি কোনরূপ প্রশ্ন না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাহার বাসনা চরিতার্থ করে। তাহার ভিতরে যে শক্তি রহিয়াছে, তাহার বশেই সে কার্য করিয়া থাকে। ঐ শক্তি তাহাকে বলপূর্বক কার্যে প্রবৃত্ত করে এবং দেখায় যেন সে ঐরূপ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিল বলিয়াই করিয়াছে। কিন্তু যখন সে প্রকৃতির নিকট হইতে প্রচণ্ড বাধাপ্রাপ্ত হয়, যখন বহু আঘাত সহ্য করিতে হয়, তখন তাহার মনে প্রশ্ন জাগে, এ-সকলের অর্থ কি? যত অধিক সে আঘাত লাভ করে ও চিন্তা করে, ততই সে দেখে যে, তাহার আয়ত্তের বাহিরে এক শক্তির দ্বারা সে ক্রমাগত চালিত হইতেছে এবং সে কার্য করিয়া তাকে, তাহার কারণ—তাহাকে করিতেই হইবে। অতঃপর সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তখনই সংগ্রাম শুরু হয়।

কথা হইল এই যে, যদি এই-সকল উৎপাত হইতে পরিত্রাণের কোন উপায় থাকে, তবে তাহা আমাদের অন্তরেই অবস্থিত। আমরা সর্বদাই প্রকৃত সত্তা কি, তাহা উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছি। সহজাত সংস্কারবশেই উহা করিয়া থাকি। জীবাত্মার অন্তর্গত সৃষ্টিই ঈশ্বরকে আবৃত করিয়া থাকে; আর এই কারণেই ঈশ্বরের আদর্শ সম্বন্ধে এত প্রভেদ বিদ্যমান। সৃষ্টির বিরাম ঘটিলেই আমরা নির্বিশেষ সত্তাকে জানিতে পারি। নির্বিশেষ পূর্ণ বা অসীম সত্তা আত্মাতেই বিদ্যমান, সৃষ্টর মধ্যে নয়। সুতরাং সৃষ্টির অবসান ঘটিলেই আমরা পূর্ণকে জানিতে পারি। নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করিতে গেলে আমরা শরীর সম্বন্ধেই চিন্তা করিয়া থাকি; এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে চিন্তা করিতে গেলে তাঁহাকে দেহধারীরূপেই চিন্তা করিয়া থাকি। যাহাতে আত্মার প্রকাশ ঘটে, সেজন্য মনের চাঞ্চল্য দমন করাই প্রকৃত কাজ। শিক্ষার আরম্ভ শরীরে। প্রাণায়াম শরীরকে শিক্ষিত করিয়া সৌষ্ঠব দান করে। প্রাণায়াম–অভ্যাসের উদ্দেশ্য ধ্যান ও একাগ্রতালাভ। যদি মুহূর্তের জন্য তুমি সম্পূর্ণ স্থির বা নিশ্চল হইতে পার, তবে লক্ষ্যে উপনীত হইয়াছ—বুঝিতে হইবে। মন উহার পরেও কাজ করিয়া যাইতে পারে; কিন্তু পূর্বে মন যে অবস্থায় ছিল, তাহা আর পাইবে না। তুমি নিজেকে জানিতে পারিবে, তোমার প্রকৃত স্বরূপ সত্তা উপলব্ধি করিবে। এক মুহূর্তের জন্য মন স্থির কর, তোমার যথার্থ স্বরূপ সহসা উদ্ভাসিত হইবে এবং বুঝিবে মুক্তি আসন্ন; আর কোন বন্ধন থাকিবে না। তত্ত্বটি এইরূপ—যদি তুমি সময়ের এক মুহূর্ত অনুধাবন করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলে সমগ্র সময় বা কাল জানিতে পারিবে, যেহেতু একেরই দ্রুত অবিচ্ছিন্ন পারম্পর্য হইল ‘সমগ্র’। এক-কে আয়ত্ত কর, এক মুহূর্তকে সম্পূর্ণভাবে জান—মুক্তি লাভ হইবেই।

প্রাচীন বৌদ্ধগণ ব্যতীত সকল ধর্ম ঈশ্বর ও আত্মায় বিশ্বাসী। আধুনিক বৌদ্ধগণ ঈশ্বর ও আত্মায় বিশ্বাস করেন। ব্রহ্ম, শ্যাম, চীন প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধগণ প্রাচীন বৌদ্ধগণের পর্যায়ে পড়েন।

আর্নল্ডের ‘লাইট অব্ এশিয়া’ পুস্তকে বৌদ্ধবাদ অপেক্ষা বেদান্তবাদই অধিক প্রদর্শিত।
================

উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টিবাদ

প্রকৃতির সুশৃঙ্খল বিধি-ব্যবস্থা বিশ্বস্রষ্টার এক অভিপ্রায় প্রদর্শন করিতেছে, এই ধারণা বা ‘কিণ্ডারগার্টেন’ শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে উত্তম। যেহেতু ঐ ধারণা ধর্মজগতে যাহারা শিশু তাহাদিগকে ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় দার্শনিক তত্ত্বে পরিচালিত করিবার জন্য ঈশ্বরের সৌন্দর্য, শক্তি ও মাহাত্ম্য প্রদর্শন করিয়া থাকে। এতদ্ভিন্ন এই ধারণা বা মতবাদের কোন উপকারিতা নাই, এবং উহা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান্ বলিয়া স্বীকার করিলে দার্শনিক তত্ত্ব হিসাবে উহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

বিশ্ব-সৃষ্টির মধ্য দিয়া প্রকৃতি যদি ঈশ্বরের শক্তি প্রকাশ করিয়া থাকে, তবে সৃষ্টির মূলে কোন অভিপ্রায় বা পরিকল্পনা আছে, এই তত্ত্ব তাহার ত্রুটিও প্রদর্শন করে। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান্ হইলে কোন কার্যের জন্য তাঁহার পরিকল্পনা বা মতলবের প্রয়োজন হয় না। তাঁহার ইচ্ছামাত্রেই উহা সম্পন্ন হয়। সুতরাং প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের কোন বিতর্ক, কোন উদ্দেশ্য বা কোন পরিকল্পনা নাই।

মানুষের সীমাবদ্ধ চৈতন্যের পরিণাম হইতেছে জড়জগৎ। মানুষ যখন তাহার দেবত্ব জানিতে পারে, তখন আমরা এখন জড়বস্তু এবং প্রকৃতি বলিয়া যাহা জানিতেছি তৎসমুদয়ই লোপ পায়।

কোন উদ্দেশ্য-সাধনের প্রয়োজনরূপে এই জড়জগতের স্থান সেই সর্বব্যাপী ঈশ্বরে নাই। যদি তাহা থাকিত, তবে ঈশ্বর বিশ্ব দ্বারা সীমাবদ্ধ হইতেন। ঈশ্বরের অনুজ্ঞাক্রমে এই জগৎ বিদ্যমান, এ-কথা বলার অর্থ ইহা নয় যে, মানুষকে পূর্ণ করিবার উদ্দেশ্যে বা অন্য কোন কারণবশতঃ বা ঈশ্বরের প্রয়োজনের নিমিত্ত এই জগৎ বিদ্যমান।

মানুষের প্রয়োজনেই জগতের সৃষ্টি, ঈশ্বরের প্রয়োজনে নয়। বিশ্ব-পরিকল্পনায় ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য থাকিতে পারে না। তিনি সর্বশক্তিমান্ হইলে ঐরূপ কোন উদ্দেশ্য কিরূপে থাকিতে পারে? কোন কার্য-সাধনের জন্য তাঁহার কোন পরিকল্পনা, মতলব বা উদ্দেশ্যের প্রয়োজন হইবে কেন? তাঁহার কোন প্রয়োজন আছে, ইহা বলার অর্থ তাঁহাকে সীমাবদ্ধ করা ও তাঁহার সর্বশক্তিমত্তারূপ বৈশিষ্ট্য তাঁহার নিকট হইতে কাড়িয়া লওয়া।

উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, কোন প্রশস্ত নদীর তীরে উপস্থিত হইয়া তুমি দেখিলে—নদীটি এত চওড়া যে, সেতু-নির্মাণ ব্যতীত ঐ নদী উত্তীর্ণ হওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। নদী উত্তীর্ণ হইবার জন্য সেতু-নির্মাণের প্রয়োজন, এই ঘটনার দ্বারা সেতু নির্মাণ করিবার সামর্থ্য তোমার শক্তির পরিচয় প্রদান করিলেও উহা দ্বারাই তোমার সীমাবদ্ধ শক্তি ও অকিঞ্চিৎকরতাও প্রকাশ পাইবে। তোমার ক্ষমতা যদি সীমাবদ্ধ না হইত, যদি তুমি উড়িয়া অথবা নদীতে ঝাঁপ দিয়া নদী অতিক্রম করিতে পারিতে, তবে তোমাকে সেতু নির্মাণ- রূপ প্রয়োজনীয়তার বশবর্তী হইতে হইত না। সেতু-নির্মাণ দ্বারা তোমার মধ্যে সেতু-নির্মাণের শক্তি প্রমাণিত হইলেও উহা দ্বারা আবার তোমার অপূর্ণতাও প্রদর্শিত হইল। অন্য কিছু অপেক্ষা তোমার ক্ষুদ্রতাই অধিক প্রকাশ পাইল।

অদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ মুখ্যতঃ এক। ভেদ শুধু প্রকাশে। দ্বৈতবাদিগণ যেমন পিতা ও পুত্র ‘দুই’ বলিয়া গ্রহণ করেন, অদ্বৈতবাদিগণ তেমন উভয়কে প্রকৃতপক্ষে ‘এক’ বলিয়া মনে করেন। দ্বৈতবাদের অবস্থান প্রকৃতির মধ্যে, বিকাশের মধ্যে এবং অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা বিশুদ্ধ আত্মার স্বরূপে।

প্রত্যেক ধর্মেই ত্যাগ ও সেবার আদর্শ ঈশ্বরের নিকট উপনীত হইবার উপায়স্বরূপ।
=============

চৈতন্য ও প্রকৃতি

চৈতন্যকে চৈতন্যরূপে প্রত্যক্ষ করাই ধর্ম, জড়রূপে দেখা নয়।

ধর্ম হইতেছে বিকাশ। প্রত্যেককে নিজে উহা উপলব্ধি করিতে হইবে। খ্রীষ্টানগণের বিশ্বাস, মানবের পরিত্রাণের নিমিত্ত যীশুখ্রীষ্ট প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। তোমাদের নিকট উহা একটি বিশিষ্ট মতবাদের উপর বিশ্বাস, এবং এই বিশ্বাসেই নিহিত তোমাদের মুক্তি। আমাদের নিকট মুক্তির সহিত বিশিষ্ট মতবাদের কোন প্রকার সম্পর্ক নাই। প্রত্যেকেরই স্বীয় মনোমত কোন মতবাদে বিশ্বাস থাকিতে পারে; অথবা সে কোন মতবাদে বিশ্বাস না করিতেও পারে। যীশুখ্রীষ্ট কোন এক সময়ে ছিলেন, অথবা তিনি কোনদিন ছিলেন না, তোমার নিকট এই উভয়ের পার্থক্য কি? জ্বলন্ত ঝোপের (burning bush) মধ্যে মুশার ঈশ্বর-দর্শনের সহিত তোমার কি সম্পর্ক? মুশা জ্বলন্ত ঝোপে ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছিলেন, এই তত্ত্বের দ্বারা তোমার ঈশ্বর-দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই যদি হয়, তবে মুশা যে আহার করিয়াছিলেন, ইহাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট; তোমার আহার-গ্রহণে নিবৃত্ত হওয়া উচিত। একটি অপরটির মতই সমভাবে যুক্তিযুক্ত। আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণের বিবরণসমূহ আমাদিগকে তাঁহাদের পথে অগ্রসর হইতে ও স্বয়ং ধর্ম উপলব্ধি করিতে প্রণোদিত করে, ইহা ব্যতীত অপর কোন কল্যাণ সাধন করে না। যীশুখ্রীষ্ট, মুশা বা অপর কেহ যাহা কিছু করিয়াছেন, তাহা আমাদিগকে অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করা ব্যতীত আর কিছুমাত্র সাহায্য করিতে পারে না।

প্রত্যেক ব্যক্তির একটি বিশেষ স্বভাব আছে, উহা তাহার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। ঐ বৈশিষ্ট্য তাহাকে অনুসরণ করিতেই হইবে। উহার মধ্য দিয়াই তাহাকে মুক্তির পথ খুঁজিতে হইবে। তোমার গুরুই তোমাকে বলিয়া দিবেন, তোমার নির্দিষ্ট পথ কোন্‌টি এবং সেই পথে তোমাকে পরিচালিত করিবেন। তোমার মুখ দেখিয়া তিনি বলিয়া দিবেন, তুমি কোন্ অবস্থায় ও কিরূপ সাধনার অধিকারী এবং ঐ বিষয়ে তোমাকে নির্দেশ দিবার ক্ষমতাও তাঁহার থাকিবে। অপরের পথ অনুসরণ করিবার চেষ্টা করা উচিত নয়, কেননা উহা তাঁহার জন্যই নির্দিষ্ট, তোমার জন্য নয়। নির্দিষ্ট পথ পাইলে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকা ব্যতীত আর কিছুই করিবার নাই, স্রোতই তোমাকে মুক্তির দিকে টানিয়া লইয়া যাইবে। অতএব যখন সেই নির্ধারিত পথ পাইবে, তাহা হইতে ভ্রষ্ট হইও না। তোমার পন্থা তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ, কিন্তু উহা যে অপরের পক্ষেও শ্রেয়ঃ হইবে, তাহার কোন প্রমাণ নাই।

প্রকৃত আধ্যাত্মিক-শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি চৈতন্যকে চৈতন্যরূপেই প্রত্যক্ষ করেন, জড়রূপে নয়। চৈতন্যই প্রকৃতিকে গতিশীল করে, চৈতন্যই সত্য বস্তু। ক্রিয়ার অস্তিত্ব প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান, চৈতন্যে নয়। চৈতন্য সর্বদা এক, অপরিণামী ও শাশ্বত। চৈতন্য ও জড় প্রকৃতপক্ষে এক, কিন্তু চৈতন্য স্ব-স্বরূপে কখনই জড় নয়। জড় কখনও জড়সত্তা-রূপে চৈতন্য হইতে পারে না। আত্মা কখনও ক্রিয়া করেন না। কেনই বা করিবেন? আত্মা বিদ্যমান—ইহাই যথেষ্ট। আত্মা শুদ্ধ, সৎ ও নিরবচ্ছিন্ন। আত্মায় ক্রিয়ার কোন আবশ্যকতা নাই।

নিয়ম দ্বারা তুমি বদ্ধ নও। উহা তোমার মায়িক প্রকৃতির অন্তর্গত। মন প্রকৃতিরই এলাকায় ও নিয়মাধীন। সমগ্র প্রকৃতি স্বীয় কর্মজনিত নিয়মের অধীন এবং এই নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। প্রকৃতির একটি নিয়মও যদি লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হও, তবে মুহূর্তমধ্যে প্রকৃতি ধ্বংস হইবে, প্রকৃতি বলিয়া কিছু থাকিবে না। যিনি মুক্তিলাভ করেন, তিনিই প্রকৃতির নিয়ম ভাঙিয়া ফেলিতে সমর্থ, তাঁহার নিকট প্রকৃতি লয়প্রাপ্ত হয়; প্রকৃতির কোন প্রভাব আর তাঁহার উপর থাকে না। প্রত্যেকেই একদিন চিরকালের জন্য এই নিয়ম ভাঙিয়া ফেলিবে, আর তখনই প্রকৃতির সহিত তাহার দ্বন্দ্ব শেষ হইয়া যাইবে।

গভর্ণমেণ্ট, সমিতি প্রভৃতি অল্পবিস্তর ক্ষতিকর। সকল সমিতিই কতকগুলি দোষযুক্ত সাধারণ নিয়মের উপর স্থাপিত। যে মুহূর্তে তোমরা নিজেদের একটি সঙ্ঘে পরিণত করিলে, সেই মুহূর্ত হইতে ঐ সঙ্ঘের বহির্ভূত সকলের প্রতি বিদ্বেষ আরম্ভ হইল। যে কোন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের অর্থ নিজের উপর গণ্ডী টানা ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা। প্রকৃত কল্যাণ হইতেছে সর্বোত্তম স্বাধীনতা। প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হইতে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাধুতা যত বাড়ে কৃত্রিম নিয়মও তত হ্রাস পায়। ঐগুলি বাস্তবিক পক্ষে নিয়মই নয়। কারণ—উহা যদি সত্যই নিয়ম হইত, তবে কখনই উহা লঙ্ঘন করা যাইত না। এই তথাকথিত নিয়মগুলি যে ভাঙিয়া ফেলা যায়, তাহাতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, ঐগুলি প্রকৃত নিয়ম নয়। যথার্থ নিয়ম অলঙ্ঘনীয়।

যখন কোন চিন্তা দমন করিয়া ফেল, তখন উহা স্প্রিং-এর ন্যায় কুণ্ডলী পাকাইয়া অদৃশ্যভাবে চাপা পড়িয়া থাকে মাত্র। সুযোগ পাইলেই মুহূর্তমধ্যে—দমনের ফলে সংহত সমস্ত রুদ্ধশক্তি লইয়া সবেগে বাহির হইয়া আসে, এবং তারপর যাহা ঘটিতে বহু সময় লাগিত, কয়েক মুহূর্তে তাহা ঘটিয়া যায়।

প্রতিটি ক্ষুদ্র সুখ বৃহৎ দুঃখ বহন করে। শক্তি এক—এক সময়ে যাহা আনন্দরূপে ব্যক্ত হয়, অন্য সময়ে তাহারই অভিব্যক্তি দুঃখ। কতকগুলি অনুভূতির অবসান হইলেই অপর কতকগুলি আরম্ভ হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নততর ব্যক্তিগণের কাহারও মধ্যে দুইটি, এমন কি একশত বিভিন্ন চিন্তা একই সময়ে কার্য করিতে থাকে।

হইতেছে স্বীয় স্বভাবের পরিণতি—মানসী ক্রিয়া অর্থে সৃষ্ট। শব্দ চিন্তার ও রূপ (আকার) শব্দের অনুসরণ করে। মনে আত্মা প্রতিফলিত হইবার পূর্বে মানসিক ও শারীরিক সর্বপ্রকার কার্য করিবার সঙ্কল্প রুদ্ধ করা প্রয়োজন।
============

ধর্মের অনুশীলন

ধর্মের অনুশীলন

[১৮ মার্চ, ১৯০০ খ্রীঃ ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত আলামেডায় প্রদত্ত।]

আমরা বহু পুস্তক পড়িয়া থাকি, কিন্তু উহা দ্বারা আমাদের জ্ঞানলাভ হয় না। জগতের সমুদয় ‘বাইবেল’ আমরা পড়িয়া শেষ করিতে পারি, কিন্তু তাহাতে আমাদের ধর্মলাভ হইবে না। যে-ধর্ম কেবল কথায় পর্যবসিত, তাহা লাভ করা অতি সহজ, যে-কেহ উহা লাভ করিতে পারে। আমরা চাই কর্মে পরিণত ধর্ম। কর্মে পরিণত ধর্ম সম্বন্ধে খ্রীষ্টানদিগের ধারণা হইতেছে সৎকর্মের অনুষ্ঠান—জগতের হিতসাধন।

হিতসাধনের বা পরপোকারের ফল কি? হিতবাদিগণের দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা বিচার করিলে দেখা যায়, ধর্ম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। বহুসংখ্যক লোক হাসপাতালে আসুক—ইহাই প্রত্যেকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষা। পরহিতৈষণার অর্থ কি? উহা অত্যাবশ্যক নয়। প্রকৃতপক্ষে পরহিতৈষণার অর্থ জগতের দুঃখে কিঞ্চিৎ সাহায্য করা—দুঃখের উচ্ছেদ সাধন নয়। সাধারণ লোক নাম-যশের প্রার্থী, এবং নাম-যশোলাভের উদ্দেশ্যেই সে তাহার সমুদয় প্রচেষ্টা পরোপকার ও সৎকর্মের চাকচিক্যময় আবরণে ঢাকিয়া রাখে। অপরের জন্য কাজ করিতেছি, এই ভান করিয়া বস্তুতঃ সে নিজের কাজই গুছাইয়া লয়। প্রত্যেকটি তথাকথিত পরোপকারের উদ্দেশ্য হইতেছে—যে অশুভটি নিবারণ করিতে চাহিতেছ, উহাকেই উৎসাহ দান।

হাসপাতাল বা যে-কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি দাক্ষিণ্য দেখাইবার জন্য স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে মিলিয়া বলনৃত্যে যোগদান করে এবং সারারাত্রি নৃত্যগীতে অতিবাহিত করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর পশুর ন্যায় আচরণ শুরু করে; ফলে পৃথিবীতে দলে দলে পাষণ্ড ব্যক্তির উৎপত্তি হয় এবং কারাগার, পাগলাগারদ ও হাসপাতাল ঐ-প্রকার ব্যক্তির দ্বারা পূর্ণ হইয়া যায়। এইরূপই চলিতে থাকে, আর হাসপাতাল-স্থাপন প্রভৃতি সৎ কর্ম বলিয়া অভিহিত হয়। সৎ কর্মের আদর্শ হইতেছে জগতের সমুদয় দুঃখের হ্রাস অথবা উচ্ছেদ-সাধন। যোগী বলেন, মনঃসংযমে ব্যর্থতা হইতেই দুঃখের উৎপত্তি। যোগীর আদর্শ জড়-জগৎ হইতে মুক্তিলাভ। প্রকৃতিকে জয় করাই তাঁহার কর্মের মানদণ্ড। যোগী বলেন, সমুদয় শক্তি আত্মায় বিদ্যমান, এবং শরীর ও মন সংযত করিয়া আত্মশক্তিবলে যে-কেহ প্রকৃতিকে জয় করিতে সমর্থ।

দৈহিক কর্মের জন্য যতটা প্রয়োজন, তদতিরিক্ত মাংসপেশী যে পরিমাণ বেশী জমিবে, সেই পরিমাণে হ্রাস পাইবে। অত্যধিক কঠোর পরিশ্রম করা উচিত নয়, উহা ক্ষতিকর। কঠোর পরিশ্রম না করিলে দীর্ঘজীবী হইবে। অল্প আহার গ্রহণ কর ও অল্প পরিশ্রম কর। মস্তিষ্কের খাদ্য সংগ্রহ কর।

নারীর পক্ষে গৃহকর্মই যথেষ্ট। প্রদীপ তাড়াতাড়ি পুড়াইয়া শেষ করিও না, ধীরে ধীরে পুড়িতে দাও।

যুক্তাহারের অর্থ সাদাসিধা খাদ্য, অত্যধিক মশলাযুক্ত খাদ্য নয়।
===============

বেলুড় মঠ—আবেদন

হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্বগুলি প্রচার করিয়া পাশ্চাত্য দেশে বহুনিন্দিত আমাদের ধর্মমতের প্রতি কথঞ্চিৎ শ্রদ্ধা অর্জন করিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যগণ যেটুকু সফলতা লাভ করিয়াছেন, তাহাতে উদ্বুদ্ধ হইয়া ভারতবর্ষের ভিতরে ও বাহিরে প্রচারকার্যের জন্য একদল যুবক সন্ন্যাসীকে শিক্ষা দিবার আশা আমাদের মনে জাগ্রত হইয়াছে। একদল যুবককে বৈদিক গুরুগৃহবাস প্রথায় শিক্ষা দিবার চেষ্টাও করা হইতেছে।

কয়েকজন ইওরোপীয় এবং আমেরিকান বন্ধুর সাহায্যে কলিকাতার নিকটবর্তী গঙ্গার তীরে একটি মঠ স্থাপিত হইয়াছে।

অল্প দিনে এই কাজের কোন প্রত্যক্ষ ফললাভ করিতে হইলে চাই অর্থ; অতএব যাঁহারা আমাদের এই চেষ্টার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন তাঁহাদের নিকট আমাদের এই আবেদন।

আমাদের ইচ্ছা—মঠের কাজের এইরূপ প্রসার করিতে হইবে, যাহাতে এই অর্থানুকূল্যে যতজন সম্ভব যুবককে মঠে রাখিয়া তাহাদিগকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও ভারতীয় আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়। উহাতে তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সহিত তাহাদের গুরুর নিকট বাস করিয়া পুরুষোচিত নিয়মানুবর্তিতা অর্জন করিবে।

লোকবল ও অর্থবল হইলে কলিকাতার নিকটস্থ প্রধান কেন্দ্র কর্তৃক দেশের অন্যান্য স্থানেও ক্রমশঃ শাখা-কেন্দ্র স্থাপিত হইবে।

এই কাজের স্থায়ী ফললাভ করিতে সময় লাগিবে। আমাদের যুবকদের পক্ষে এবং যাঁহাদের এই কার্যে সাহায্য করিবার সামর্থ্য আছে, তাঁহাদের পক্ষে এজন্য প্রচুর স্বার্থত্যাগের প্রয়োজন।

আমরা বিশ্বাস করি, এজন্য জনবল প্রস্তুত। অতএব যাঁহারা তাঁহাদের ধর্ম ও দেশকে সত্যিই ভালবাসেন এবং কার্যতঃ সহানুভূতি দেখাইতে পারেন, তাঁহাদের কাছে আমরা এই আবেদন জানাইতেছি।
=================

অদ্বৈত আশ্রম, হিমালয়

[১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে স্বামীজী এই লেখাটি মায়াবতী (আলমোড়া, হিমালয়) অদ্বৈত আশ্রমের পরিচয়-পুস্তিকায় (Prospectus) প্রকাশ করার জন্য পত্রযোগে প্রেরণ করেন।]

যাঁহার মধ্যে এই ব্রহ্মাণ্ড, যিনি এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত, আবার যিনিই এই ব্রহ্মাণ্ড; যাঁহার মধ্যে আত্মা, যিনি এই আত্মার মধ্যে অবস্থিত, এবং যিনিই এই মানবাত্মা; তাঁহাকে, অতএব এই ব্রহ্মাণ্ডকে, আত্মস্বরূপ বলিয়া জানিলে আমাদের সমস্ত ভয় ও দুঃখের অবসান হয় এবং পরম মুক্তিলাভ হয়। যেখানেই প্রেমের প্রসারণ কিম্বা ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উন্নতি দেখা যায়, সেখানেই উহা—‘সর্বপ্রাণীর একত্ব’রূপ শাশ্বত সত্যের উপলব্ধি, প্রত্যক্ষানুভূতি ও কার্যকারিত্বের মধ্য দিয়াই প্রকাশিত হইয়াছে। পরাধীনতাই দুঃখ; স্বাধীনতাই সুখ।

অদ্বৈতই একমাত্র সাধনপ্রণালী, যাহা মানুষকে তাহার পূর্ণ স্বাবলম্বন প্রদান করে, এবং তাহার সমস্ত পরাধীনতা ও তৎসংশ্লিষ্ট সকল কুসংস্কার দূর করিয়া আমাদিগকে সর্বপ্রকার দুঃখ সহ্য করিবার ক্ষমতা ও কার্য করিবার সাহস প্রদান করে; পরিশেষে উহাই আমাদিগকে পরম মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম করে।

দ্বৈতভাবের দুর্বলতা হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত করিয়া এতদিন এই মহান্‌ সত্য প্রচার করা সম্ভবপর হয় নাই। এই কারণে আমাদের ধারণা—এই ভাব মানবসমাজের কল্যাণে সম্যক প্রচারিত হয় নাই।

এই মহান্‌ সত্যকে ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীন ও পূর্ণতর প্রকাশের সুযোগ দিয়া মানব-সমাজকে উন্নত করিতে আমরা হিমালয়ের ঊর্ধ্ব প্রদেশে—যেখানে ইহা প্রথম উদ্গীত হইয়া- ছিল—এই অদ্বৈত আশ্রম স্থাপন করিতেছি।

এখানে সমস্ত কুসংস্কার এবং বলহানিকারক মলিনতা হইতে অদ্বৈত ভাব মুক্ত থাকিবে, আশা করা যায়। এখানে শুধু ‘একত্বের শিক্ষা’ ছাড়া অন্য কিছুই শিক্ষা দেওয়া বা সাধন করা হইবে না। যদিও আশ্রমটি সমস্ত ধর্মমতের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিসম্পন্ন, তবুও ইহা অদ্বৈত—কেবলমাত্র অদ্বৈত—ভাবের জন্যই উৎসর্গীকৃত হইল।
============================

বারাণসী শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমঃ আবেদন

[১৯০২ খ্রীঃ ফেব্রুআরী মাসে কাশী শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের প্রথম কার্যবিবরণীসহ প্রেরিত একটি পত্র।]
প্রিয় …

ইহার সহিত বারাণসী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের গত বৎসরের একটি কার্যবিবরণী আপনার জন্য পাঠাইতেছি।

এই শহরে যে-সকল ব্যক্তি, সাধারণতঃ বৃদ্ধ নরনারী দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পড়েন, তাঁহাদের দুঃখ মোচনের জন্য আমরা যে সামান্য চেষ্টা করিতে পারিয়াছি, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ইহা হইতে পাইবেন।

বর্তমান শিক্ষাজাগরণ ও জনমতের ক্রমবর্ধমানের দিনে হিন্দুর তীর্থসমূহ, তাহাদের বর্তমান অবস্থা ও কর্মপদ্ধতি সমালোচকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই। এই তীর্থ হিন্দুদিগের নিকট পবিত্রতম, সেজন্য ইহার সমালোচনাও কঠোরতম।

অন্যান্য তীর্থস্থানগুলিতে লোকে পাপমোচনের উদ্দেশ্যে যায়। সেজন্য তাহাদের সহিত তাহাদের সম্পর্কও সাময়িক—মাত্র কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু আর্য-সভ্যতার এই প্রাচীনতম ও সজীব ধর্মীয় কেন্দ্রে—এই নগরে—বৃদ্ধ ও জরাগ্রস্ত নর-নারীগণ বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের ছায়াতলে বসিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করিয়া যাহাতে চরম মোক্ষ লাভ করিতে পারেন, সেজন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করিতে থাকেন।

ইহা ছাড়াও আর যাঁহারা জগদ্ধিতায় সর্বত্যাগী হইয়াছেন ও তাঁহাদের আত্মীয়স্বজন ও শৈশবের সকল সম্পর্ক হইতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হইয়াছেন, তাঁহারাও এ শহরে বাস করেন। মানুষের সাধারণ নিয়তি—দৈহিক রোগাদির দ্বারা তাঁহারাও আক্রান্ত হন।

শহরের ব্যবস্থাপনায় হয়তো কিছু কিছু ত্রুটি আছে, পুরোহিতবর্গের উপর সাধারণতঃ যে-সকল কঠোর সমালোচনা বর্ষিত হয়, হয়তো তাহাও সত্য। তথাপি ভুলিলে চলিবে না—জনসাধারণ যেমন, পুরোহিতও তেমনি। যদি লোকে জোড়হাতে কেবল একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া থাকে ও দুঃখের এই দ্রুত প্রবাহ—যাহা তাহাদের গৃহের পাশ দিয়া প্রবাহিত হইয়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সন্ন্যাসী ও গৃহীদিগকে অসহায় দুর্ভোগের সাধারণ আবর্তে টানিয়া ফেলিতেছে—কেবল দেখিতে থাকে এবং ঐ প্রবাহ হইতে কাহাকেও বাঁচাইবার চেষ্টামাত্র না করিয়া তীর্থের পুরোহিতকুলের অন্যায় কার্যের শুধু বাগাড়ম্বরপূর্ণ সমালোচনা করে, তাহা হইলে এই দুর্ভোগের এককণাও কমিবে না, এক ব্যক্তিও সাহায্য পাইবে

প্রশ্ন এই—শিবের এই চিরন্তন স্থান মোক্ষলাভের অনুকূল বলিয়া আমাদের পূর্বপুরুষগণ যেরূপ বিশ্বাস করিতেন, আমরাও কি সেই বিশ্বাস পোষণ করিতে চাই? যদি তাই হয়, তবে মরণার্থী ব্যক্তিগণের বৎসরের পর বৎসর এখানে আসিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে দেখিয়া আমাদের আনন্দলাভ করাই উচিত। দুঃখিগণের মোক্ষলাভের এই চিরন্তন ঐকান্তিক আগ্রহ দেখিয়া আমাদের শ্রীভগবানের নামের জয়গান করাই কর্তব্য।

যে-সব দুঃখার্ত ব্যক্তি এই স্থানে মৃত্যুবরণ করিতে আসে, তাহারা স্বকীয় জন্মস্থানের প্রাপ্য সমস্ত সাহায্য হইতে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে; তাহারা যখন রোগাক্রান্ত হয়, তখন তাহাদের যে কী অবস্থা হয়, তাহা অনুভব করিবার ভার ও হিন্দু হিসাবে আপনারা উহার কি প্রতিকার করিতে পারেন, তাহা ভাবিয়া দেখিবার ভার আপনাদের বিবেকের উপর ন্যস্ত করিতেছি।

ভ্রাতৃগণ! অন্তিম বিশ্রামের প্রস্তুতির এই অদ্ভুত স্থানের আশ্চর্যকর আকর্ষণের বিষয় স্থিরচিত্তে আপনারা কি চিন্তা করিতে পারেন না? মৃত্যুর মাধ্যমে মোক্ষের দিকে অগ্রসর তীর্থযাত্রীদের বহু প্রাচীন বিরামহীন এই স্রোত আপনাদিগকে কি অনির্বচনীয় শ্রদ্ধার ভাবে আবিষ্ট করে না? যদি করে, তবে আসুন আমাদিগের এই কাজের জন্য আপনাদের সদয় হস্ত প্রসারিত করুন।

আপনাদের দান হয়তো অতি সামান্য, আপনাদের সাহায্য হয়তো নগণ্য, তবুও কুণ্ঠাবোধ করিবেন না। প্রাচীন প্রবাদ আছে—তৃণগুচ্ছগুলি একত্র করিয়া রজ্জু প্রস্তুত করিলে সর্বাপেক্ষা মদমত্ত হস্তীকেও উহা দ্বারা বাঁধিয়া রাখা যায়।

বিশ্বনাথাশ্রিত সর্বদা আপনাদের
বিবেকানন্দ
==============

Post a Comment

0 Comments