শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত~অষ্টাদশ খণ্ড~দ্বিতীয় ভাগ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
দ্বিতীয় ভাগ 

অষ্টাদশ খণ্ড
শ্রীরামকৃষ্ণের অধরের বাড়ি আগমন ও ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ

অষ্টাদশ খণ্ড শ্রীরামকৃষ্ণের অধরের বাড়ি আগমন ও ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১লা অক্টোবর

[কেদার, বিজয়, বাবুরাম, নারাণ, মাস্টার, বৈষ্ণবচরণ]

আজ (১৬ই) আশ্বিন, শুক্লা একাদশী, বুধবার, ১লা অক্টোবর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর হইতে অধরের বাড়ি আসিতেছেন। সঙ্গে নারাণ,গঙ্গাধর। পথিমধ্যে হঠাৎ ঠাকুরের ভাবাবস্থা হইল। ঠাকুর ভাবে বলিতেছেন, “আমি মালা জোপব? হ্যাক থু! এ শিব যে পাতাল ফোঁড়া শিব, স্বয়ম্ভূলিঙ্গ!”

অধরের বাড়িতে আসিয়াছেন। এখানে অনেক ভক্তের সমাবেশ হইয়াছে। কেদার বিজয়, বাবুরাম প্রভৃতি অনেকে উপস্থিত। কীর্তনিয়া বৈষ্ণবচরণ আসিয়াছেন। ঠাকুরের আদেশক্রমে অধর প্রত্যহ আফিস হইতে আসিয়াই বৈষ্ণবচরনের সংকীর্তন শুনেন বৈষ্ণবচরণের সংকীর্তন অতি মিষ্ট। আজও সংকীর্তন হইবে। ঠাকুর অধরের বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। ভক্তেরা সকলেই গাত্রোত্থান করিয়া তাঁহার চরণবন্দনা করিলেন। ঠাকুর সহাস্যে আসন গ্রহণ করিলে পর তাঁহারাও উপবেশন করিলেন। কেদার ও বিজয় প্রণাম করিলে পর ঠাকুর নারাণ ও বাবুরামকে তাঁহাদের প্রণাম করিতে বলিলেন। আর বলিলেন, আপনারা আশীর্বাদ করো, যেন এদের ভক্তি হয়। নারাণকে দেখাইয়া বলিলেন, এ বড় সরল; ভক্তেরা বাবুরামও নারাণকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদারাদি ভক্তের প্রতি) — তোমাদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হল — তা না হলে তোমরা কালীবাড়ি গিয়ে পড়তে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় দেখা হয়ে গেল।

কেদার (বিনীতভাবে, কৃতাঞ্জলি) — ঈশ্বরের ইচ্ছা — সে আপনার ইচ্ছা।

ঠাকুর হাসিতেছেন।
=============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১লা অক্টোবর

ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে

এইবার কীর্তন আরম্ভ হইল। বৈষ্ণবচরণ অভিসার আরম্ব করিয়া রাসকীর্তন করিয়া পালা সমাপ্ত করিলেন। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন কীর্তন যাই আরম্ভ হইল, ঠাকুর প্রেমানন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া নাচিতে লাগিলেন ও সংকীর্তন করিতে লাগিলেন। কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি) — ইনি বেশ গান!

এই বলিয়া বৈষ্ণবচরণকে দেখাইয়া দিলেন ও তাঁহাকে ‘শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর’ এই গানটি গাহিতে বলিলেন। বৈষ্ণবচরণ গান ধরিলেন:

শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব নটবর, তপত কাঞ্চনকায় ইত্যাদি।

গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর বিজয়কে বলিলেন, ‘কেমন?’ বিজয় বলিলেন, ‘আশ্চর্য।’ ঠাকুর গৌরাঙ্গের ভাবে নিজে গান ধরিলেন:

ভাব হবে বইকি রে!
ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের ভাব হবে বইকিরে ৷৷
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।
বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে; সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।
যার অন্তঃকৃষ্ণ বহির্গৌর (ভাব হবে) ।
গোরা ফুকরি ফুকরি কান্দে; গোরা আপনার পায় আপনি ধরে।
বলে কোথা রাই প্রেমময়ী।

মণি সঙ্গে সঙ্গে গাইতেছেন।

ঠাকুরের গান সমাপ্ত হইলে বৈষ্ণবচরণ আবার গাইলেন:

হরি হরি বল রে বীণে!
হরির করুণা বিনে, পরম তত্ত্ব আর পাবিনে ৷৷
হরিনামে তাপ হরে, মুখে বল হরে কৃষ্ণ হরে,
হরি যদি কৃপা করে, তবে ভবে আর ভাবিনে!
বীণে একবার হরি বল, হরিনাম বিনে নাই সম্বল,
দাস গোবিন্দ কয়, দিন গেলে, অকূলে যেন ডুবিনে।

ঠাকুর কীর্তনিয়ার মতন গানের সঙ্গে সঙ্গে সুর করিতেছেন। বৈষ্ণবচরণকে বলিতেছেন, ওইরকম করে বলো — কীর্তনিয়া ঢঙে।

বৈষ্ণবচরণ আবার গাইলেন:

শ্রীদুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার।
দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে নিস্তার ৷৷

দুর্গানাম তরী ভবার্ণব তরিবারে,
ভাসিতেছে, সেই তরী শ্রদ্ধাসরোবরে।
শ্রীগুরু করুণা করি যেই ধন দিলে,
সাধনা করহ তরী মিলিবে গো কূলে ৷৷
যদি বল ছয় রিপু হইয়ে পবন,
ধরিতে না দিবে তরী করিবে তুফান।
তুফানেতে কি করিবে শ্রীদুর্গানাম যার তরী,
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত্য মা, তুমি সে পাতাল; তোমা হতে হরি ব্রহ্মা দ্বাদশ গোপাল।
দশ মহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার,
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার ৷৷
চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি মা তুমি বিশ্বমূল।
ত্রিলোকজননী তুমি, ত্রিলোক তারিণী;
সকলের শক্তি তুমি মা তোমার শক্তি তুমি ৷৷

ঠাকুর গায়কের সঙ্গে পুনঃ পুনঃ গাহিতে লাগিলেন:

চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি মা তুমি বিশ্বমূল,
ত্রিলোকজননী তুমি, ত্রিলোক তারিণী;
সকলের শক্তি তুমি মা তোমার শক্তি তুমি ৷৷

কীর্তনীয়া আবার আরম্ভ করিলেন:

বায়ু অন্ধকার আদি শূন্য আর আকাশ,
রূপ দিক্‌ দিগন্তর তোমা হ’তে প্রকাশ।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু আদি করি যতেক অমরে,
তব শক্তি প্রকাশিছে সকল শরীরে ৷৷
ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না বজ্রা চিত্রিণীতে,
ক্রমযোগে আছে জেগে সহস্রা হইতে।
চিত্রিণীর মধ্যে ঊর্ধ্বে আছে পদ্ম সারি সারি,
শুক্লবর্ণ সুবর্ণবর্ণ বিদ্যুতাদি করি ৷৷
দুই পদ্ম প্রস্ফুটিত একপদ্ম কোঢ়া,
অধোমুখে ঊর্ধ্ব মুখে আছে দুই পদ্ম জোড়া।
হংসরূপে বিহার তথায় কর গো আপনি,
আধার কমলে হও মা কুলকুণ্ডলিনী ৷৷
তদূর্ধ্বে মণিপুর নাম নাভিস্থল,
রক্তবর্ণ পদ্ম তাহে আছে দশদল।
সেই পদ্মে তব শক্তি অনল আছয়,
সে অনল নিবৃত্তি হ’লে সকলই নিভায় ৷৷
হৃদিপদ্মে আছে মানস সরোবর,
অনাহত পদ্ম ভাসে তাহার উপর।
সুবর্ণবর্ণ দ্বাদশদল তথায় শিব বাণ,
যেই পদ্মে তব শক্তি জীব আর আণ ৷৷
তদূর্ধ্বে কণ্ঠদেশ ধুম্রবর্ণ পদ্ম,
ষোড়শদল নাম তাঁর পদ্ম বিশুদ্ধাখ্য।
সেই পদ্মে তব শক্তি আছয়ে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হঞ্চলে সকলি আকাশ ৷৷
তদূর্ধে শিরসি মধ্যে পদ্ম সহস্রদল,
গুরুদেবের স্থান সেই অতি গুহ্য স্থল।
সেই পদ্মে বিম্বরূপে পরমশিব বিরাজে,
একা আছেন শুক্লবর্ণ সহস্রদল পঙ্কজে ৷৷
ব্রহ্মরন্ধ্র আছে যথা শিব বিম্বরূপ,
তুমি তথা গেলে, শিব হন স্বীয়রূপ।
তথাশিবসঙ্গে রঙ্গে কর গো বিহার,
বিহার সমাপনে শিব হন বিম্বাকার ৷৷
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১লা অক্টোবর

বিজয় প্রভৃতির সঙ্গে সাকার-নিরাকার কথা — চিনির পাহাড়

কেদার ও কয়েকটি ভক্ত গাত্রোত্থান করিলেন — বাড়ি যাইবেন। কেদার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন, আর বলিলেন, আজ্ঞা তবে আসি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি অধরকে না বলে যাবে? অভদ্রতা হয় না?

কেদার — তস্মিন্‌ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্‌; আপনি যেকালে রইলেন, সকলেরই থাকা হল — আর কিছু অসুখ বোধ হয়েছে — আর বিয়ে থাওয়ার জন্য একটা ভয় হয় — সমাজ আছে — একবার তো গোল হয়েছে —

বিজয় — এঁকে রেখে যাওয়া —

সময় ঠাকুরকে লইয়া যাইতে অধর আসিলেন। ভিতরে পাতা হইয়াছে। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন ও বিজয় ও কেদারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, এসো গো আমার সঙ্গে। বিজয়, কেদার ও অন্যান্য ভক্তেরা ঠাকুরের সঙ্গে বসিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।

ঠাকুর আহারান্তে বৈঠকখানায় আসিয়া আবার বসিলেন। কেদার, বিজয় ও অন্যান্য ভক্তেরা চারিপার্শ্বে বসিলেন।

[কেদারের কাকুতি ও ক্ষমা প্রার্থনা — বিজয়ের দেবদর্শন ]

কেদার কৃতাঞ্জলি হইয়া অতি নম্রভাবে ঠাকুরকে বলিতেছেন, মাপ করুন, যা ইতস্ততঃ করেছিলাম। কেদার ভাবিতেছেন, ঠাকুর যেখানে আহার করিয়াছেন, সেখানে আমি কোন্‌ ছার!

কেদারের কর্মস্থল ঢাকায়। সেখানে অনেক ভক্ত তাঁহার কাছে আসেন ও তাঁহাকে খাওয়াইতে সন্দেশাদি নানারূপ দ্রব্য আনয়ন করেন। কেদার সেই সকল কথা ঠাকুরকে নিবেদন করিতেছেন।

কেদার (বিনীতভাবে) — লোকে অনেকে খাওয়াতে আসে। কি করব প্রভু, হুকুম করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভক্ত হলে চণ্ডালের অন্ন খাওয়া যায়। সাত বৎসর উন্মাদের পর ও-দেশে (কামারপুকুরে) গেলুম। তখন কি অবস্থাই গেছে। খানকী পর্যন্ত খাইয়ে দিলে! এখন কিন্তু পারি না।

কেদার (বিদায় গ্রহণের পূর্বে মৃদুস্বরে) — প্রভু, আপনি শক্তি সঞ্চার করুন। অনেক লোক আসে। আমি কি জানি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হয়ে যাবে গো! আন্তরিক ঈশ্বরে মতি থাকলে হয়ে যায়।

কেদার বিদায় লইবার পূর্বে বঙ্গবাসীর সম্পাদক শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্র প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

সাকার-নিরাকার সম্বন্ধে কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি সাকার, নিরাকার, আবার কত কি; তা আমরা জানি না! শুধু নিরাকর বললে কেমন করে হবে?

যোগেন্দ্র — ব্রাহ্মসমাজের এক আশ্চর্য! বারবছরের ছেলে, সেও নিরাকার দেখছে! আদিসমাজে সাকারে অত আপত্তি নাই। ওরা পূজাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে আসতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ইনি বেশ বলেছেন, সেও নিরাকার দেখছে।

অধর — শিবনাথবাবু সাকার মানেন না।

বিজয় — সেটা তাঁর বুঝবার ভুল। ইনি যেমন বলেন, বহুরূপী কখন এ রঙ কখন সে রঙ। যে গাছতলায় বসে থাকে, সেই ঠিক জানতে পারে। আমি ধ্যান করতে করতে দেখতে পেলাম চালচিত্র। কত দেবতা, তাঁরা কত কি বলেন। আমি বললুম, তাঁর কাছে যাব তবে বুঝব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ঠিক দেখা হয়েছে।

কেদার — ভক্তের জন্য সাকার। প্রেমে ভক্ত সাকার দেখে। ধ্রুব যখন ঠাকুরকে দর্শন কল্লেন, বলেছিলেম, কুণ্ডল কেন দুলছে না? ঠাকুর বললেন, তুমি দোলালেই দোলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সব মানতে হয় গো — নিরাকার-সাকার সব মানতে হয়। কালীঘরে ধ্যান করতে করতে দেখলুম রমণী খানকী! বললুম, মা তুই এইরূপেও আছিস! তাই বলছি, সব মানতে হয়। তিনি কখন কিরূপে দেখা দেন, সামনে আসেন, বলা যায় না।

এই বলিয়া ঠাকুর গান ধরিলেন — এসেছেন এক ভাবের ফকির।

বিজয় — তিনি অনন্তশক্তি — আর-একরূপে দেখা দিতে পারেন না? কি আশ্চর্য! সব রেণুর রেণু এরা সব কি না এই সব ঠিক করতে যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — একটু গীতা, একটু ভাগবত, একটু বেদান্ত পড়ে লোকে মনে করে, আমি সব বুঝে ফেলেছি। চিনির পাহাড়ে একটা পিঁপড়ে গিছল। একদানা চিনি খেয়ে তার পেটে ভরে গেল। আর-একদানা মুখে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় ভাবছে, এবারে এসে পাহাড়টা নিয়ে যাব! (সকলের হাস্য)
===========

Post a Comment

0 Comments