পরিশিষ্ট~পঞ্চম ভাগ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট~পঞ্চম ভাগ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

=============

প্রথম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্র (স্বামী বিবেকানন্দ)
[VIVEKANANDA IN AMERICA AND IN EUROPE]

৺রথযাত্রার পরদিন (১৫ই জুলাই) ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, আষাঢ় — সংক্রান্তি শ্রীশ্রীভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে সকালবেলা ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। নরেন্দ্রের (স্বামী বিবেকানন্দের) মহত্ত্ব-কথা বলিতেছেন —
[নরেন্দ্রের মহত্ত্ব — ‘A prince among men’ ]
“নরেন্দ্রের খুব উঁচু ঘর — নিরাকারের ঘর। পুরুষের সত্তা। এত ভক্ত আসছে, ওর মতো একটিও নাই।
“এক-একবার বসে বসে আমি খতাই। তা দেখি, অন্য পদ্ম কারুর দশদল, কারুর ষোড়শদল, কারুর শতদল, কিন্তু পদ্মমধ্যে নরেন্দ্র সহস্রদল।
“অন্যেরা কলসী, ঘটি এ-সব হতে পারে; নরেন্দ্র জালা।
“ডোবা পুষ্করিণির মধ্যে নরেন্দ্র বড় দীঘি। যেমন হালদার-পুকুর।
“মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙ্গাচক্ষু বড় রুই, আর সব নানারকম মাছ — পোনা, কাঠি-বাটা এই সব।
“খুব আধার, — অনেক জিনিস ধরে। বড় ফুটোওলা বাঁশ।
“নরেন্দ্র কিছুর বশ নয়। ও আসক্তি, ইন্দ্রিয়সুখের বশ নয়। পুরুষ পায়রা। পুরুষ পায়রা ঠোঁট ধরলে ঠোঁট ছিনিয়ে লয় — মাদী পায়রা চুপ করে থাকে।”
[আগে ঈশ্বরলাভ — আদেশ হলে লোকশিক্ষা ]
তিন বৎসর পূর্বে (১৮৮২ খ্রী:) নরেন্দ্র দু-একটি ব্রাহ্মবন্ধু সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। রাত্রিতে ওইখানেই ছিলেন। প্রত্যূষ হইলে ঠাকুর বলিলেন, “যাও পঞ্চবটীতে ধ্যান কর গিয়ে।” কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর গিয়া দেখেন, তিনি বন্ধুসঙ্গে পঞ্চবটীমূলে ধ্যান করিতেছেন। ধ্যানান্তে ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “দেখ, ঈশ্বরদর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য; ব্যাকুল হয়ে নির্জনে গোপনে তাঁর ধ্যান-চিন্তাকরতে হয় ও কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতে হয়, ‘ঠাকুর আমাকে দেখা দাও’।” ব্রাহ্মসমাজের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের লোকহিতকর কর্ম যথা স্ত্রীশিক্ষা, স্কুল স্থাপন, বক্তৃতা (lecture) দেওয়া সম্বন্ধে বলিলেন, “আগে ঈশ্বরদর্শন কর। নিরাকার-সাকার দুই দর্শন। বাক্যমনের অতীত যিনি, তিনিই আবার ভক্তের জন্য রূপধারণ করে দর্শন দেন আর কথা কন। দর্শনের পর তাঁর আদেশ লয়ে লোকহিতকর কর্ম করতে হয়। একটা গানে আছে — মন্দিরে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা হয় নাই, পোদো কেবল শাঁখ বাজাচ্ছে, যেন আরতি হচ্ছে; একজন তাই তাকে ধিক্কার দিয়ে বলছে:
মন্দিরে তোর নাহিক মাধব।
(ওরে) পোদো, শাঁক ফুঁকে তুই করলি গোল।
তায় চামচিকে এগার জনা,
দিবানিশি দিচ্ছে থানা —
“যদি হৃদয়মন্দিরে মাধব প্রতিষ্ঠা করতে চাও, যদি ভগবানলাভ করতে চাও, তাহলে শুধু ভোঁ ভোঁ করে শাঁখ ফুঁকলে কি হবে। আগে চিত্তশুদ্ধি কর; মন শুদ্ধ হলে ভগবান পবিত্র আসনে এসে বসবেন। চামচিকার বিষ্ঠা থাকলে মাধবকে আনা যায় না। এগার জন চামচিকে অর্থাৎ একাদশ ইন্দ্রিয়।
“আগে ডুব দাও। ডুব দিয়ে রত্ন তোল, তারপর অন্য কাজ। আগে মাধব প্রতিষ্ঠা, তারপর ইচ্ছা হয় বক্তৃতা (lecture) দিও।
“কেউ ডুব দিতে চায় না। সাধন নাই, ভজন নাই, বিবেক-বৈরাগ্য নাই, দুই-চারটে কথা শিখেই অমনি লেকচার।
“লোকশিক্ষা দেওয়া কঠিন। ভগবানকে দর্শনের পর যদি কেউ তাঁর আদেশ পায়, তাহলে লোকশিক্ষা দিতে পারে।”
১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের রথযাত্রার দিন কলিকাতায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত পণ্ডিত শশধরের দেখা হয়। নরেন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পণ্ডিতকে বলিলেন, “তুমি লোকের মঙ্গলের জন্য বক্তৃতা করছ, তা বেশ। কিন্তু বাবা, ভগবানের আদেশ ব্যতিরেকে লোকশিক্ষা হয় না। ওই দুদিন লোক তোমার লেকচার শুনবে তারপর ভুলে যাবে। হালদার-পুকুরের পাড়ে লোক বাহ্যে করত; লোক গালাগাল দিন কিন্তু কিছুই ফল হয় নাই। অবশেষে সরকার যখন একটি নোটিস মেরে দিলে, তখন তা বন্ধ হল। তাই ঈশ্বরের আদেশ না হলে লোকশিক্ষা হয় না।”
তাই নরেন্দ্র গুরুদেবের কথা শিরিধার্য করিয়া সংসারত্যাগ করিয়া নির্জনে গোপনে অনেক তপস্যা করিয়াছিলেন। অতঃপর তাঁহার শক্তিতে শক্তিমান হইয়া এই লোকশিক্ষাব্রত অবলম্বন করিয়া দুরূহ প্রচারকার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন।
কাশীপুরে যখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পীড়িত হইয়া আছেন (১৮৮৬ খ্রী:) একদিন একটি কাগজে লিখিয়াছিলেন — “নরেন্দ্র শিক্ষে দিবে।”
স্বামী বিবেকানন্দ মাদ্রাজীদের নিকট আমেরিকা হইতে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের দাস; তাঁহারই দূত হইয়া তাঁহার মঙ্গলবার্তা তিনি সমগ্র জগৎকে বলিয়াছেন।
“It was your generous apreciation of Him whose message ti India and to the whole world, I, the most unworthy of His servants, had the privilege to bear, it was your innate spiritual instinct which saw in Him and His message the first murmurs of that tidal wave of spirituality which is destined at no distant future to break upon India in all its irresistible powers.” etc.
— Reply to Madras Address
মাদ্রাজে তৃতীয় বক্তৃতায় বলিয়াছেন যে, আমি সারগর্ভ যাহা কিছু বলিয়াছি, সমস্তই পরমহংসদেবের, অসার যদি কিছু বলিয়া থাকি, সে সব আমার —
“Let me conclude by saying that if in my life I have told one word of truth it was his and his alone; and if I have told you many things which were not true, correct and beneficial to the human race, it was all mine and on me is the responsibility.”
— Third lecture, Madras.
কলিকাতায় ৺রাধাআকান্ত দেবের বাড়িতে যখন তাঁহার অভ্যর্থনা হয়, তখনও তিনি বলিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শক্তি আজ জগদ্ব্যাপী! হে ভারতবাসিগণ, তোমরা তাঁহাকে চিন্তা কর তাহা হইলে সকল বিষয়ে মহত্ত্ব লাভ করিবে। তিনি বলিলেন —
“If this nation wants to rise, it will have to come enthusiastically round his name. It does not matter who preaches Ramakrishna, whether I or you or anybody. But him I place before you and it is for you to judge, and for the good of our race, for the good of our nation, to judge now that you shall do with this great ideal of life. * *
* * * Within ten years of his passing away this power has encircled the globe. Judge him not through me. I am only a weak instrument. His character was so great that I or any of his disciples, if we spent hundreds of lives, could do no justice to a millionth part of what he really was.”
গুরুদেবের কথা বলিতে বলিতে স্বামী বিবেকান্দ একেবারে পাগল হইয়া যাইতেন। ধন্য গুরুভক্তি!
==============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

নরেন্দ্র কর্তৃক শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচারকার্য
আজ আমরা একটু আলচনা করিব, পরমহংসদেবের সেই বিশ্বজনীন সনাতন হিন্দুধর্ম স্বামীজী কিরূপ প্রচার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।
(REALISATION OF GOD)
শ্রীরামকৃষ্ণের কথা — ঈশ্বরকে দর্শন করিতে হইবে। কতকগুলি মত মুখস্থ বা শ্লোক মুখস্থ করার নাম ধর্ম নহে। এই ঈশ্বরদর্শন হয়, যদি ভক্ত ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে ডাকে, এই জন্মেই হউক অথবা জন্মান্তরেই হউক। একদিনের তাঁহার কথাবার্তা আমাদের মনে পড়ে। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে কথা হইতেছিল।
পরমহংসদেব কাশীপুরের মহিমাচরণ চক্রবর্তীকে বলিতেছিলেন — (রবিবার, ২৬শে অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ।)
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণ ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — শাস্ত্র কত পড়বে? শুধু বিচার করলে কি হবে? আগে তাঁকে লাভ করবার চেষ্টা কর। বই পড়ে কি জানবে? যতক্ষণ না হাটে পৌঁছান যায়, ততঁন দূর হতে কেবল হো-হো শব্দ। হাটে পৌঁছিলে আর-একরকম, তখন স্পষ্ট স্পষ্ট দেখতে পাবে, শুনতে পাবে, ‘আলু লও’ ‘পয়সা দাও’।
বই পড়ে ঠিক অনুভব হয় না। অনেক তফাত। তাঁহাকে দর্শনের পর শাস্ত্র, সায়েন্স সব খড়কুটো বোধ হয়।
“বড়বাবুর সঙ্গে আলাপ দরকার। তাঁর কখানা বাড়ি, কটা বাগান, কত কোম্পানির কাগজ; এ-সব আগে জানবার জন্য অত ব্যস্ত কেন? কিন্তু জো-সো করে বড়বাবুর সঙ্গে একবার আলাপ কর, তা ধাক্কা খেয়েই হউক আর বেড়া ডিঙ্গিয়েই হউক, তখন ইচ্ছা হয় তো তিনিই বলে দিবেন, তাঁর কখানা বাড়ি, কত বাগান, কত কোম্পানির কাগজ। বাবুর সঙ্গে আলাপ হলে আবার চাকর দ্বারবান সব সেলাম করবে।” (সকলের হাস্য)
একজন ভক্ত — এখন বড়বাবুর সঙ্গে আলাপ কিসে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাই কর্ম চাই। সাধন চাই। ঈশ্বর আছেন বলে বসে থাকলে হবে না। তাঁর কাছে যেতে হবে। নির্জনে তাঁকে ডাকো, প্রার্থনা করো — ‘দেখা দাও’ বলে। ব্যকুল হয়ে কাঁদো। কামিনী-কাঞ্চনের জন্য পাগল হয়ে বেড়াতে পার, তবে তাঁর জন্য একটু পাগল হও। লোক বলুক যে, ঈশ্বরের জন্য অমুক পাগল হয়ে গেছে। দিনকতক না হয় সব ত্যাগ করে তাঁকে একলা ডাকো। শুধু ‘তিনি আছেন’ বলে বসে থাকলে কি হবে? হালদার-পুকুরে বড় মাছ আছে, পুকুরের পাড়ে শুধু বসে থাকলে কি মাছ পাওয়া যায়? চার কর, চার ফেল। ক্রমে গভীর জল থেকে মাছ আসবে আর জল নড়বে। তখন আনন্দ হবে। হয়তো মাছের খানিকটা একবার দেখা গেল, মাছটা ধপাং করে উঠলো। যখন দেখা গেল, আরও আনন্দ।[1]
ঠিক এই কথা স্বামীজীও চিকাগোর ধর্মসমিতি সমক্ষে বলিলেন — অর্থাৎ ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে লাভ করা, দর্শন করা —
“The Hindu does not want to live upon words and theories. He must see God and that alone can destroy all doubts. So the best proof of a Hindu sage gives about the soul, about God, is ‘I have seen the soul; I have seen God’. * * * The whole struggle in their system is a constant struggle to become perfect, to become divine, to reach God and see God; and their reaching God, seeing God, becoming perfect even ‘as the Father in Heaven is perfect’ constitutes the religion of the Hindus.”
— Lecture on Hinduism (Chicago Parliament of Religions.)
আমেরিকার অনেক স্থানে স্বামী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সকল স্থানেই এই কথা। Hartford নামক স্থানে বলিয়াছিলেন —
“The next idea that I want to bring to you is that religion does not consist in doctrines or dogmas. * * * The end of all religions is the realisation of God in the soul. Ideals and methods may differ but that is the central point. That is the realisation of God, something behind this world of sense — this world of eternal eating and drinking and talking nonsense — this world of shadows and selfishness. There is that beyond all books, beyond all creeds, beyond the vanities of this world, and that is the realisation of God within yourself. A man may believe in all the churches in the world, he may carry on his head all the sacred books ever written, he may baptise himself in all the rivers of the earth; still if he has no perception of God I would class him with the rankest atheist.”
স্বামী তাঁহার ‘রাজযোগ’ নামক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, আজকাল লোক বিশ্বাস করে না যে, ঈশ্বরদর্শন হয়; লোকে বলে, হাঁ ঋষিরা অথবা খ্রীষ্ট প্রভৃতি মহাপুরুষগণ আত্মদর্শন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আজকাল আর তাহা হয় না। স্বামীজী বলেন, অবশ্য হয় — মনের যোগ (Concentration) অভ্যাস কর, অবশ্য হদয় মধ্যে তাঁহাকে পাইবে —
“The teachers all saw God; they all saw their own souls and what they saw preached. Only there is this difference that in most of these religions, especially in modern times, a peculiar claim is put before us and that claim is that these experiences are impossible at the present day; they were only possible with a few men, who were the first founders of the religions that subsequently bore their names. At the present time these experiences have become obsolete and therefore we have now to take religion on belief. This I entirely deny. Uniformity is the rigorous law of nature; what once happened can happen always.”
— Raja-yoga: Introductory.
স্বামী New York নামক নগরে ৯ই জানুয়ারি, ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বজনীন ধর্ম কাহাকে বলে (Ideal of a Universal Religion) এই বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন — অর্থাৎ যে ধর্মে জ্ঞানী, ভক্ত, যোগী বা কর্মী সকলেই মিলিত হইতে পারে। বক্তৃতা সমাপ্ত হইবার সময় ঈশ্বরদর্শন যে সব ধর্মের উদ্দেশ্য, এই কথা বলিলেন — জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি এগুলি নানা পথ, নানা উপায় — কিন্তু গন্তব্যস্থান একই অর্থাৎ ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার। স্বামী বলিলেন —
“Then again all these various yogas (work or woরship, psychic control or philosophy) have to be carried out into practice, theories will not do. We have to meditate upon it, realise it until it becomes our whole life. Religion is realisation, nor talk nor doctrine nor theories, however beautiful they may be. It is being and beoming, not hearing or acknowledging. It is not an intellectual assent. By intellectual assent we can come to hundred sorts of foolish things and change them next day, but this being and becoming is what is Religion.”
মাদ্রাজীদের নিকট তিনি যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতেও ওই কথা। — হিন্দুধর্মের বিশেষত্ব ঈশ্বরদর্শন — বেদের মুখ্য উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন —
“The one idea which distinguishes the Hindu religion from every other in the world, the one idea to express which the sages almost exhaust the vocabulary of the Sanskrit language, is that man must realise God. * * * Thus to realise God, the Brahman as the Dvaitas (dualists) say, or to become Brahman as the Advaitas say — is the aim and end of the whole teachings of the Vedas.”
— Reply to Madras Address.
স্বামী ২৯শে অক্টোবর (১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) লণ্ডন নগরে বক্তৃতা করেন, বিষয়, ঈশ্বরদর্শন (Realisation)z এই বক্তৃতায় কঠোপনিষৎ পাঠ করিয়া নচিকেতার কথা উল্লেখ করিলেন। নচিকেতা ঈশ্বরকে দেখিতে চান, ব্রহ্মজ্ঞান চান। ধর্মরাজ যম বলিলেন, বাপু, যদি ঈশ্বরকে জানিতে চাও, দেখিতে চাও, তাহা হইলে ভোগ আসক্তি ত্যাগ করিতে হইবে; ভোগ থাকিলে যোগ হয় না, অবস্তু ভালবাসিলে বস্তুলাভ হয় না। স্বামী বলিতে লাগিলেন, আমরা বলিতে গেলে সকলেই নাস্তিক, কতকগুলি বাক্যের আড়ম্বর লইয়া ধর্ম ধর্ম বলিতেছি। যদি একবার ঈশ্বরদর্শন হয়, তাহা হইলেই প্রকৃত বিশ্বাস আসিবে।
“We are all atheists and yet we try to fight the man who tries to confess it. We are all in the dark; religion is to us a mere nothing, mere intellectual assent, mere talk — this man talks well and that man evil. Religion will begin when that actual realisation in our own souls begins. That will be the dawn of religion. * * * Then will real faith begin.”
——————-
১ যীশুখ্রীষ্ট তাঁহার শিষ্যদের বলিতেন –“Blessed are the pure in spirit, for they shall see God.’
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্র ও সর্বধর্ম-সমন্বয়
(HARMONY OF ALL RELIGIONS)
নরেন্দ্র ও অন্যান্য কৃতবিদ্য যুবকগণ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সকল ধর্মের উপর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন। সকল ধর্মে সত্য আছে, এ-কথা পরমহংসদেব মুক্তকণ্ঠে বলিতেন। কিন্তু তিনি আরও বলিতেন, সকল ধর্মই সত্য — অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্ম দিয়া ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যাইতে পারে। একদিন, ২৭শে অক্টোবর (১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে) কেশবচন্দ্র সেন কোজাগর লক্ষ্মীপূজার দিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে স্টীমারে করিয়া দেখিতে গিয়াছিলেন ও তাঁহাকে তুলিয়া লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। পথে জাহাজের উপরে অনেক বিষয়ে কথা হয়। ঠিক এই সকল কথা ১৩ই অগস্ট অর্থাৎ কয়েক মাস পূর্বে হইয়াছিল। এই সর্বধর্ম-সমন্বয় কথা আমাদের diary হইতে উদ্ধৃত করিলাম।
“কেদারনাথ চাটুজ্যে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে মহোৎসব করিয়াছিলেন। উৎসবান্তে দক্ষিণের বারান্দায় বসিয়া বেলা ৩।৪ টার সময় কথাবার্তা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — মত পথ। সকল ধর্মই সত্য। যেমন কালীঘাটে নানা পথ দিয়া যাওয়া যায়। ধর্ম কিছু ঈশ্বর নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম আশ্রয় করে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়।
“নদী সব নানাদিক দিয়ে আসে কিন্তু সব নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেখানে সব এক।
“ছাদে নানা উপায়ে উঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি আর শুধু একটা দড়ি দিয়াও উঠা যায়! তবে উঠবার সময় একটা ধরে উঠতে হয় — দু-তিনরকম সিঁড়িতে পা দিলে উঠা যায় না। তবে ছাদে উঠবার পর সবরকম সিঁড়ি দিয়ে নামা যায়, উঠা যায়।
“তাই প্রথমে একটা ধর্ম আশ্রয় করতে হয়। ঈশ্বরলাভ হলে সেই ব্যক্তি সব ধর্মপথ দিয়ে আনাগোনা করতে পারে; যখন হিন্দুদের ভিতর থাকে, তখন সকলে মনে করে হিন্দু; যখন মুসলমানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে মনে করে মুসলমান; আবার যখন খ্রীষ্টানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে ভাবে ইনি বুঝি খ্রীষ্টান।
“সব ধর্মের লোকেরা একজনকেই ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম, কেউ হরি, কেউ আল্লা, কেউ ব্রহ্ম। নাম আলাদা, কিন্তু একই বস্তু।
“একটা পুকুরে চার ঘাট আছে। একঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, তারা বলছে ‘জল’। আর-একঘাটে মুসলমান, তারা বলছে ‘পানি’। আর-একঘাটে খ্রীষ্টান, তারা বলছে ‘ওয়াটার’। আবার একঘাটে কতকগুলো ওক বলছে ‘aqua’ (সকলের হাস্য)। বস্তু এক — জল, নাম আলাদা। তবে ঝগড়া করবার কি দরকার? সকলেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে ও সকলেই তাঁর কাছে যাবে।”
একজন ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — যদি অন্য ধর্মে ভ্রম থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা ভ্রম কোন ধর্মে নাই? সকলেই বলে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে। কিন্তু কোন ঘড়িই একেবারে ঠিক যায় না। সব ঘড়িকেই মাঝে মাঝে সূর্যের সঙ্গে মিলাতে হয়।
“ভুল কোন্‌ ধর্মে নাই? আর যদি ভুল থাকে, যদি আন্তরিক হয়, যদি ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকে, তাহলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।
“মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে — ছোট বড়। সকলেই ‘বাবা’ বলতে পারে না। কেউ বলে ‘বাবা’, কেউ বলে ‘বা’, কেউ বা কেবল ‘পা’। যারা ‘বাবা’ বলতে পারলে না, তাদের উপর বাপ রাগ করবে নাকি? (সকলের হাস্য) না, বাপ সকলকেই সমান ভালবাসবে।[1]
“লোক মনে করে, আমার ধর্ম ঠিক; আমি ঈশ্বর কি বস্তু বুঝেছি, ওরা বুঝতে পারে নাই। আমি ঠিক তাঁকে ডাকছি, ওরা ঠিক ডাকতে পারে না; অতএব ঈশ্বর আমাকেই কৃপা করেন, ওদের করেন না। এ-সব লোক জানে না যে, ঈশ্বর সকলের বাপ-মা, আন্তরিক হলে তিনি সকলকেই দয়া করেন।”
কি প্রেমের ধর্ম! এ-কথা তিনি তো বারবার বলিলেন, কিন্তু কয়জন ধারণা করিতে পারিল? শ্রীযুক্ত কেশব সেন কতকটা পারিয়াছিলেন। আর স্বামী বিবেকানন্দ জগতের সম্মুখে এই প্রেমের ধর্ম অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া প্রচার করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) করিতে বারবার নিষেধ করিয়াছিলেন। “আমার ধর্ম সত্য ও তোমার মিথ্যা” এটির নাম ‘মতুয়ার বুদ্ধি’ — এইটি যত অনর্থের মূল। স্বামী এই অনর্থের কথা চিকাগো ধর্মসমিতিসমক্ষে বলিলেন। বলিলেন, খ্রীষ্টান, মুসলমান ইত্যাদি অনেকেই ধর্মের নামে রক্তারক্তি, কাটাকাটি, মারামারি করিয়াছেন।
“Sectarianism, bigotry and its horrible descendant fanaticism have long possessed this beautiful earth. They have filled the earth with violence, drenched it often and often with human blood, destroyed civilization and sent whole nations to despair.”
— Lecture on Hinduism, (Chicago Parliament of Religions.)
স্বামী অপর এক বক্তৃতায় ‘সকল ধর্ম সত্য’, এ-কথা বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রমাণ দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, —
“If any one here hopes that this unity will come by the triumph of any one of these religions and the destruction of the others, to him I say, Brother, yours is an impossible hope. Do I wish that the Christian would become Hindu? God forbid. Di I wish that the Hindu or Buddhist would become Christian? God forbid.
“The seed is put in the ground, and earth and air and water are placed around it. Does the seed become the earth or the air or the water? No, it becomes a plant, it assimilates the air, the earth and the water, converts them into plant substance and grows a plant.
“Similar is the case with religion. The Christian is not to become a Hindu or a Buddhist nor the Hindu or the Buddhist to become a Christian. But each must assimilate the others and yet preserve its own law of growth.”
আমেরিকায় স্বামী Brooklyn Ethical Society নামক সভায় হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন। অধ্যাপক Dr. Lewis James সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেখানেও প্রথম কথা, সর্বধর্ম-সমন্বয়। স্বামী বলিলেন, একজনের ধর্ম সত্য বলা একটি ব্যাধিবিশেষ বলিতে হইবে। সকলের পাঁচটি আঙুল, আর-একজনের যদি ছয়টি হয়, বলিতে হইবে যে ইহা তাহার একটি রোগবিশেষ।
“Truth has always been universal. If I alone were to have six fingers on my hand while all of you have only five, you would not think that my hand was the true intent of nature, but rather that it was abnormal and diseased. Just so with religion. If one creed alone were to be true and all the others untrue, you would have again to say that, that religion is diseased. If one religion is true all the others must be true. Thus the Hindu religion is your property as well as mine.”
— Lecture at Brooklyn.
স্বামী চিকাগো ধর্ম-মহাসভা সম্মুখে যে দিন প্রথম বক্তৃতা করিতে দণ্ডায়মান হয়েন, যে বক্তৃতা শুনিয়া প্রায় ছয় সহস্র লোক মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠে আসন ত্যাগ করিয়া অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন[2] সেই বক্তৃতামধ্যে এই সমন্বয়বার্তা ছিল। স্বামী বলিয়াছিলেন, —
“I am proud to belong to a religion which taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all Religions as true. I belong to a religion into whose sacred language, the Sanskrit, the word ‘exclusion’ is untranslatable.”
—————–
১ ঠিক এই কথা একখানি ইংরেজী গ্রন্থে আছে – Maxmuller’s Hibbert Lectures. মোক্ষ মূলরও এই উপমা দিয়া বুঝাইয়াছেন যে, যাঁহারা দেবদেবী পূজা করেন, তাঁহাদের ঘৃণা করা উচিত নহে।
২ “When Vivekananda addressed the audience as sisters and brothers of America, there arose a peal of applause that lasted for several minutes.” (Dr. Barrow’s Report) “But eloquent as were many of the brief speeches, no one expressed so well the spirit of the Parliament of Religions and its limitations as the Hindu monk. * * He is an Orator by divine right.”
— New York Critique, 1893.
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্র, কর্মযোগ ও স্বদেশহিতৈষণা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদা বলিতেন, “আমি ও আমার” এইটি অজ্ঞান, “তুমি ও তোমার” এইটি জ্ঞান। একদিন শ্রীসুরেশ মিত্রের বাগানে মহোৎসব হইতেছিল, রবিবার, ১৫ই জুন ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তেরা অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের কয়েকজন ভক্তও আসিয়াছিলেন। ঠাকুর প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও অন্যান্য ভক্তদের বলিলেন, “দেখ, ‘আমি ও আমার’ এইটির নাম অজ্ঞান। কালীবাড়ি রাসমনী করেছেন, এই কথাই লোকে বলে। কেউ বলে না যে ঈশ্বর করেছেন। ব্রাহ্মসমাজ অমুক করে গেছেন, এই কথাই লোকে বলে। এ-কথা আর কেউ বলে না, ঈশ্বর ইচ্ছায় এটি হয়েছে। ‘আমি করেছি’ এটির নাম অজ্ঞান। হে ঈশ্বর আমার কিছুই নয়, এ মন্দির আমার নয়, এ কালীবাড়ি আমার নয়, এ সমাজ আমার নয়, এ-সব তোমার জিনিস, এ স্ত্রী-পুত্র-পরিবার এ-সব কিছুই আমার নয়, সব তোমারই জিনিস, জ্ঞানীর এসব কথা।
“আমার জিনিস, আমার জিনিস বলে সেই সকল জিনিসকে ভালবাসার নাম মায়া। সবাইকে ভালবাসার নাম দয়া। শুধু ব্রাহ্মসমাজের লোকগুলিকে ভালবাসি, এর নাম মায়া। শুধু দেশের লোকগুলিকে ভালবাসি, এর নাম মায়া। সব দেশের লোককে ভালবাসা, সব ধর্মের লোককে ভালবাসা এট দয়া থেকে হয়, ভক্তি থেকে হয়। মায়াতে মানুষ বদ্ধ হয়ে যায়, ভগবান থেকে বিমুখ হয়। দয়া থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। শুকদেব, নারদ এঁরা দয়া রেখেছিলেন।”
ঠাকুরের কথা — শুধু দেশের লোকগুলিকে ভালবাসা, এর নাম মায়া। সব দেশের লোককে ভালবাসা, সব ধর্মের লোকদের ভালবাসা, এট দয়া থেকে হয় — ভক্তি থেকে হয়। তবে স্বামী বিবেকানন্দ অত স্বদেশের জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন?
স্বামী চিকাগো ধর্মমহাসভায় একদিন বলিয়াছিলেন, আমার গরিব স্বদেশবাসীদের জন্য এখানে অর্থ ভিক্ষা করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিলাম ভারী কঠিন, — খ্রীষ্টটধর্মাবলম্বীদের নিকট যাহারা খ্রীষ্টান নয় তাহাদের জন্য টাকা যোগাড় করা কঠিন।
“The crying evil in the East is not religion — they have religion enough, but it is the bread that the suffering millions of burning India cry out for with parched throats;” …
“I came here to ask aid for my impoverished people and fully realised how difficult it was to get help for heathens from Christians in a Christian land.”
— Speech before the Parliament of Religions. (Chicago Tribune)
স্বামীর একজন প্রধান শিষ্যা সিষ্টার নিবেদিতা (Miss Margaret Noble) বলেন যে, স্বামী যখন চিকাগো নগরে বাস করেন, তখন ভারতবাসীদের কাহারও সহিত দেখা হইলে তিনি অতিশয় যত্ন করিতেন, তা তিনি যে জাতিই হউন — হিন্দু হউন বা মুসলমান বা পার্শী বা যাহাই হউন। তিনি নিজে কোন ভাগ্যবানের বাটীতে অতিথিরূপে থাকিতেন। সেইখানেই নিজের দেশের লোককে লইয়া যাইতেন। গৃহস্বামীরাও তাঁহাদের খুব যত্ন করিতেন, আর তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, তাঁহাদের যত্ন যদি না করেন, তাহা হইলে স্বামীজী নিশ্চয়ই তাঁহাদের গৃহত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে যাইবেন; —
“At Chicago any Indian man attending the great world Bazar, rich or poor, high or low, Hindu, Mahomedan, Parsi, what not, might at any moment be brought by him to his hosts for hospitality and entertainment and they well knew that any failure of kindness on their part to the least of these would immediately have lost them his presence.”
দেশের লোকের কিরূপে দারিদ্র-দুঃখ বিমোচন হয়, তাহাদের কিসে সৎশিক্ষা হয়, কিসে তাহাদের ধর্মসঞ্চয় হয়, এই জন্য স্বামী সর্বদা ভাবিতেন। কিন্তু তিনি দেশের লোকের জন্য যেরূপ দুঃখিত ছিলেন, আফ্রিকাবাসী নিগ্রোর জন্যও সেইরূপ দঃখিত থাকিতেন। শ্রীমতী নিবেদিতা বলেন, স্বামী যখন দক্ষিণ United States মধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন, কেহ কেহ তাঁহাকে আফ্রিকাবাসী (coloured man) মনে করিয়া গৃহ হইতে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন তাঁহারা শুনিলেন, ইনি তাহা নহেন, ইনি হিন্দু সন্ন্যাসী ও বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ তখন তাঁহারাই অতি সমাদরে তাঁহাকে লইয়া গিয়া সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহারা বলিলেন, “স্বামী, যখন আমরা তোমাকে বলিলাম, ‘তুমি কি আফ্রিকাবাসী?’ তখন তুমি কিছু না বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলে কেন?”
স্বামী বলিলেন, “কেন, আফ্রিকাবাসী নিগ্রো কি আমার ভাই নয়?” অর্থাৎ স্বদেশবাসী কি জগৎছাড়া? নিগ্রোকেও যেমন ভালবাসা, স্বদেশবাসীকেও সেইরূপ ভালবাসা, তবে তাহাদের সঙ্গে সর্বদাই থাকা, তাই তাহাদের সেবা আগে। ইহারই নাম অনাসক্ত হইয়া সেবা। ইহারই নাম কর্মযোগ। সকলেই কর্ম করে, কিন্তু কর্মযোগ বড় কঠিন। সব ত্যাগ করে অনেকদিন ধরিয়া নির্জনে ভগবানের ধ্যান-চিন্তা না করিলে এরূপ স্বদেশের উপকার করা যায় না। ‘আমার দেশ’ বলিয়া নয়, তাহা হইলে তো মায়া হইল; ‘তোমার (ঈশ্বরের) এরা’ তাই এদের সেবা করিব। তোমার আদেশ, তাই দেশের সেবা করিব; ‘তোমারই এ কাজ’ আমি তোমার দাস, তাই এই ব্রত পালন করিতেছি, সিদ্ধি হউক, অসিদ্ধি হউক; সে তুমি জান, আমার নামের জন্য নয়, এতে তোমার মহিমা প্রকাশ হইবে।
যথার্থ স্বদেশহিতৈষিতা (Ideal Patriotism) কাহাকে বলে, লোকশিক্ষার জন্য স্বামী তাই এই দুরূহ ব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহাদের গৃহপরিজন আছে, কখনও ভগবানের জন্য যাহারা ব্যাকুল হয় নাই, যাহারা ‘ত্যাগ’ এই কথা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করে, যাহাদের মন সর্বদা কামিনী-কাঞ্চন ও এই পৃথিবীর মানসম্ভ্রমের দিকে, যাহারা ঈশ্বরদর্শন জীবনের উদ্দেশ্য শুনিয়া অবাক্‌ হয়, তাহারা স্বদেশহিতৈষিতার এই মহান উচ্চ আদর্শ কিরূপে গ্রহণ করিবে? স্বামী স্বদেশের জন্য কাঁদিতেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা এটিও মনে রাখিতেন যে, এই অনিত্য সংসারে ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। স্বামী বিলাত হইতে ফিরিবার পর হিমাচল দর্শন করিতে আলমোড়ায় গিয়াছিলেন। আলমোড়াবাসীরা তাঁহাকে সাক্ষাৎ নারায়ণবোধে পূজা করিতে লাগিলেন। স্বামী নগাধিরাজ দেবতাত্মা হিমগিরির অত্যুচ্চ শৃঙ্গাবলী সন্দর্শন করিয়া ভাবে বিভোর হইয়া রহিলেন। বলিলেন, আজ এই পবিত্র উত্তরাখণ্ডে সেই পবিত্র তপোভূমি দেখিতেছি, যেখানে ঋষিগণ সর্বত্যাগ করিয়া এই সংসারের কোলাহল হইতে প্রস্থান করিয়া নিশিদিন ঈশ্বরচিন্তা করিতেন। তাহাদেরই শ্রীমুখ হইতে বেদমন্ত্র বিনির্গত হইয়াচিল। হায়! কবে আমার সে দিন হইবে? আমার কতকগুলি কাজ করিবার ইচ্ছা আছে বটে, কিন্তু এই পবিত্র ভূমিতে অনেকদিন পরে আবার আসিবার পর সকল বাসনা এককালে অন্তর্হিত হইতেছে। ইচ্ছা হয়, বিরলে বসিয়া শেষ কয়দিন হরিপাদপদ্ম চিন্তায় গভীর সমাধিমধ্যে নিমগ্ন হইয়া কাটাইয়া যাই।
“It is the hope of my life to end my days somewhere within this Father of Mountains, where Rishis lived — where Philosophy was born.
— Speech at Almora.
হিমালয় দেখিলে আর কর্ম করিতে ইচ্ছা হয় না — মনে একচিন্তায় উদয় হয় — কর্মসন্ন্যাস।
“As peak after peak of this Father of Mountains began to appear before my sight, all those propensities to work, that ferment that had been going on in my brain for years seemed to quiet down and mind reverted to that one eternal theme which the Himalayas always teach us, the one theme which is reverberating in the very atmosphere of the place, the one theme that I hear in the rushing whirlpools of its rivers — Renunciation.”
এই কর্মসন্ন্যাস, এই ত্যাগ, করিতে পারিলে মানুষ অভয় হয় — আর সকল বস্তুই ভয়াবহ।
‘সর্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্‌।’
“Everything in this life is fraught with fear.
It is renunciation that makes one fearless.”
“এখানে আসিলে আর সাম্প্রদায়িক ভাব থাকে না, ধর্ম লইয়া ঝগড়াবিবাদ কোথায় পলাইয়া যায়। কেবল একটি মহান সত্যের ধারণা হয় — ঈশ্বরদর্শনই সত্য, আর যাহা কিছু জলের ফেনার ন্যায় — ভগবানের পূজাই একমাত্র জীবনে প্রয়োজন, আর সকলই মিথ্যা।
“ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। অথবা মধুকর পদ্মের উপর বসিতে পাইলে আর ভনভন করে না!”
“Strong souls will be attracted to this Father of Mountains in time to come, when all this fight between sects and all those differences in dogmas will not be remembered any more, and quarrel between your religion and my religion will have vanished altogether, when mankind will understand that there is but one Eternal Religion and that is the perception of the Divine within an the rest is mere forth. Such ardent souls will come here, knowing that the world is but Vanity, knowing that everything is useless except the worship of the Lord and the Lord alone.” —
— Speech at Almora.
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধিয়া যেখানে ইচ্ছা যাও”, স্বামী বিবেকানন্দ অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধিয়া কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করিয়াছিলেন। সন্ন্যাসীর গৃহ, ধন, পরিজন, আত্মীয়, কুটুম্ব, স্বদেশ, বিদেশ আবার কি? যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলিলেন, ঈশ্বরকে না জানলে এ-সব ধন, বিদ্যা কি হবে? হে মৈত্রেয়ী, আগে তাঁকে জান, তারপর অন্য কথা। স্বামী এইটি জগৎকে দেখাইলেন। তিনি যেন বলিলেন, হে জগদ্‌বাসিগণ, আগে বিষয়ত্যাগ করিয়া নির্জনে ভগবানের আরাধনা কর, তাহার পর যাহা ইচ্ছা কর, কিছুতেই দোষ নাই; স্বদেশের সেবা কর; ইচ্ছা হয় কুটুম্ব পালন কর, কিছুতেই দোষ নাই; কেননা, তুমি এখন বুঝিতেছ যে সর্বভূতে তিনি আছেন — তিনি ছাড়া কিছুই নাই — সংসার, স্বদেশ তিনি ছাড়া নহে। ভগবানের সাক্ষাৎকারের পর দেখিবে তিনিই পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছেন। বশিষ্ঠদেব রামচন্দ্রকে বলিয়াছেন, রাম, তুমি যে সংসারত্যাগ করিবে বলিতেছ, আমার সঙ্গে বিচার কর; যদি ঈশ্বর এ-সংসার ছাড়া হন তবে ত্যাগ করিও।[1] রামচনদ্র আত্মার সাক্ষাৎকার করিয়াছিলেন তাই চুপ করিয়া রহিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “ছুরির ব্যবহার জানিয়া ছুরি হাতে কর!” স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থ কর্মযোগী কাহাকে বলে, দেখাইলেন। দেশের কি উপকার করিবে? স্বামী জানিতেন যে, দেশের দরিদ্রের ধন দিয়া সাহায্য করা অপেক্ষা অনেক মহৎ কার্য আছে। ঈশ্বরকে জানাইয়া দেওয়া প্রধান কার্য। তৎপরে বিদ্যাদান; তাহার পর জীবনদান; তাহারপরে অন্নবস্ত্রদান। সংসার দুঃখময়। এই দুঃখ তমি কয়দিনের ঘুচাইবে? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কৃষ্ণদাস পালকে[2] জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, জীবনের উদ্দেশ্য কি?” কৃষ্ণদাস বলিলেন, “আমার মতে জগতের উপকার করা, জগতের দুঃখ দূর করা।” ঠাকুর বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তোমার ওরূপ রাঁড়ীপুতী বুদ্ধি[3] কেন? জগতের দুঃখনাশ তুমি করবে? জগৎ কি এতটুকু? বর্ষাকালে গঙ্গায় কাঁকড়া হয় জান? এইরূপ অসংখ্য জগৎ আছে। এই জগতের পতি যিনি তিনি সকলের খবর নিচ্ছেন। তাঁকে আগে জানা — এই জীবনের উদ্দেশ্য। তারপর যা “হয় করো।” স্বামীও একস্থানে বলিয়া গিয়াছেন —
“Spiritual knowledge is the only thing that can remove our miseries for ever, any other knowledge satisfies wants only for a time * * * He who gives spiritual knowledge is the greatest benefactor of mankind, * * * Next to spiritual help (ব্রহ্মজ্ঞান) comes intellectual help (বিদ্যাদান) — the gift of secular knowledge. This is far higher than the giving of food and clothes; the next gift is the gift of life and the fourth, the gift of food.”
— Karmayoga (New York); My plan of Campaign (Madras)
ঈশ্বরদর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য। আর এ দেশের ওই এককথা। আগে ওই কথা তাহার পর অন্য কথা। ‘রাজনীতি’ (Politics) প্রথম হইতে বলিলে চলিবে না। আগে অনন্যমন হইয়া ভগবানের ধ্যানচিন্তা কর, হৃদয়মধ্যে তাঁহার অপরূপ রূপ দর্শন কর। তাঁহাকে লাভ করিয়া তখন ‘স্বদেশে’র মঙ্গলসাধন করিতে পারিবে; কেননা, তখন মন অনাসক্ত; ‘আমার দেশ’ বলিয়া সেবা নহে — সর্বভূতে ভগবান আছেন বলিয়া তাঁহার সেবা। তখন স্বদেশ-বিদেশ ভেদবুদ্ধি থাকিবে না। তখন কিসে জীবের মঙ্গলসাধন হয়, ঠিক বুঝিতে পারা যাইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “দাবাবোড়ে যারা খেলে, তারা ঠিক চাল বুঝতে তত পারে না; যারা উদাসীন, কেবল বসে খেলা দেখে, তারা উপর চাল বেশ বলে দিতে পারে।” কেননা, উদাসীনের নিজের কোন দরকার নাই, রাগদ্বেষবিমুক্ত উদাসীন অনাসক্ত জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ নির্জনে অনেকদিন সাধন করিয়া যাহা লাভ করিয়া বসিয়া আছেন, তাহার কাছে আর কিছুই ভাল লাগে না:-
যং লব্‌ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।
হিন্দুর রাজনীতি, সমাজনীতি, তাই সমস্তই ধর্মশাস্ত্র। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি মহাপুরুষ এই সকল ধর্মশাস্ত্রের প্রণেতা। তাঁহাদের কিছুরই প্রয়োজন নাই। তথাপি ভগবান কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হইয়া গৃহস্থের জন্য তাঁহারা শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহারা উদাসীন হইয়া দাবাবোড়ের চাল বলিয়া দিতেছেন, তাই দেশকালপাত্রবিশেষে তাঁহাদের কথায় একটি ভুল হবার সম্ভাবনা নাই।
স্বামী বিবেকানন্দও কর্মযোগী। অনাসক্ত হইয়া পরোপকার-ব্রতরূপ, জীবসেবারূপ কর্ম করিয়াছেন। তাই কর্মীদের সম্বন্ধে তাঁহার এত মূল্য। তিনি অনাসক্ত হইয়া এই দেশের মঙ্গলসাধন করিয়াছেন, যেমন পূর্বতন মহাপুরুষগণ জীবের মঙ্গলার্থে বরাবর করিয়া গিয়াছেন। এই নিষ্কাম ধর্ম পালনার্থ যেন আমরাও তাঁহার পদানুসরণ করিতে পারি। কিন্তু এটি কি কঠিন ব্যাপার! প্রথমে হরিপাদপদ্মলাভ করিতে হইবে। তজ্জন্য বিবেকানন্দের ন্যায় ত্যাগ ও তপস্যা করিতে হইবে। তবে এই অধিকার হইতে পারে।
ধন্য ত্যাগী মহাপুরুষ! তুমি যথার্থই গুরুদেবের পদানুসরণ করিয়াছ। গুরুদেবের মহামন্ত্র — আগে ঈশ্বরলাভ, তাহার পর অন্য কথা, তুমিই সাধন করিয়াছ! তুমিই বুঝিয়াছিলে, ভগবানকে ছাড়িয়া দিলে ‘অতিবাদী’ হইলে, এ-সংসার যথার্থই স্বপ্নবৎ, ভেলকিবাজি; তাই সর্বত্যাগ করিয়া তাঁহার সাধন আগে করিয়াছিলে। যখন দেখিলে সর্ববস্তুর প্রাণ তিনি, যখন দেখিলে, তিনি ছাড়া কিছুই নাই, তখন আবার এই সংসারে মনোনিবেশ করিলে, তখন হে মহাযোগিন! সর্বভূতস্থ সেই হরির সেবার জন্য আবার কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করিলে; তখন তোমার গভীর অপার প্রেমের অধিকারী সকলেই হইল — হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বিদেশী, স্বদেশবাসী, ধনী, দরিদ্র, নর-নারী সকলকেই তুমি প্রেমালিঙ্গন দান করিয়াছ! তখন তীব্র বৈরাগ্যবশতঃ যে গর্ভধারিণী মাতৃদেবীকেও ত্যাগ করিয়া, চক্ষুর জলে ভাসাইয়া, গৈরিকবস্ত্র ধারণ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলে, তখন সেই মাকে আবার দর্শন দিলে ও বাৎসল্য স্বীকার করিয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলে! তুমি নারদাদি জনকাদির ন্যায় লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করিয়াছিলে!
—————–
১ যোগবাশিষ্ঠ।
২ শ্রীকৃষ্ণদাস পাল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছিলেন।
৩ রাঁড়ীপুতী বুদ্ধি — বিধবার ছেলের বুদ্ধি; হীন বুদ্ধি; কেননা, সে ছেলে অনেক নীচ উপায়ে মানুষ হয়; পরের তোষামোদ করিয়া, ইত্যাদি।
===========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্র, কেশব সেন ও সাকারপূজা
[ঈশ্বর সাকার না নিরাকার ]
একদিন কেশবচন্দ্র সেন শিষ্যবৃন্দ লইয়া দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। কেশবের সঙ্গে নিরাকার সম্বন্ধে অনেক কথা হইত। পরমহংসদেব তাঁহাকে বলিতেন, ‘আমি মাটির বা পাথরের কালী মনে করি না। চিন্ময়ী কালী। যিনি ব্রহ্ম তিনি কালী। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন ‘ব্রহ্ম’; যখন সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, তখন কালী, অর্থাৎ যিনি কালের সঙ্গে রমণ করেন। কাল অর্থাৎ ব্রহ্ম। তাঁহাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা একদিন হইতেছিল —
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি) — কিরকম জানো? যেন সচ্চিদানন্দসমুদ্র — কূলকিনারা নাই। ভক্তিহিমে এই সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হয়ে যায়; স্থানে স্থানে যেন জল বরফ আকারে জমাট বাঁধে; অর্থাৎ ভক্তের কাছে তিনি সাক্ষাৎ হয়ে কখন কখন সাকাররূপ হয়ে দেখা দেন। আবার ব্রহ্ম-জ্ঞান-সূর্য উঠলে সে বরফ গলে যায় — অর্থাৎ ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই বিচারের পর সমাধি হলে রূপ-টুপ সব উড়ে যায়। তখন কি তিনি, মুখে বলা যায় না — মন বুদ্ধি অহংতত্ত্ব দ্বারা তাঁকে ধরা যায় না।
“যে লোক একটা ঠিক জানে, সে আর একটাও জানতে পারে। যে নিরাকার জানতে পারে, সে সাকারও জানতে পারে। সে পাড়াতেও গেলে না — কোন্‌টা শ্যামপুকুর, কোন্‌টা তেলিপাড়া, জানবে কেমন করে!”
সকলে নিরাকার পূজার অধিকারী নয়, তাই সাকার পূজার বিশেষ প্রয়োজন, এ-কথাও পরমহংসদেব বুঝাইতেছেন। তিনি বলিলেন —
“এক মার পাঁচ ছেলে। মা মাছের নানারকম আয়োজন করেছেন, যার যা পেটে সয়। কারু জন্য মাছের পোলাও করেছেন। যার পেটের অসুখ তার জন্য মাছের ঝোল করেছেন। যেটা যার পেটে সয়।”
এ দেশে সাকার পূজা হয়। খ্রীষ্টান মিশনারীরা আমেরিকা ও ইওরোপে এদেশবাসীকে অসভ্য জাতি বলিয়া বর্ণনা করেন। তাঁহারা বলেন যে, ভারতবাসীরা পুতুল পূজা করেন — ও তাঁহাদের অবস্থা বড় শোচনীয়।
স্বামী বিবেকানন্দ এই সাকার পূজার অর্থ আমেরিকায় প্রথমেই বুঝাইলেন; বলিলেন, ভারতবর্ষে পুতুল পূজা হয় না।
“At the very outset I may tell you there is no polytheism in India. In every temple, if one stands by and listens, he will find the worshippers applying the attributes of God to these images.”
— Lecture on Hinduism (Chicago).
ঈশ্বরকে ভাবিতে গেলেই সাকার চিন্তা বই আর কিছু আসিতে পারে না, এ-কথা মনোবিজ্ঞান (Psychology) সাহায্যে স্বামী বুঝাইতে লাগিলেন। তিনি বলিলেন —
“Why does a Christian go to Church? Why is the Cross holy? Why is the face turned towards the sky in prayers? Why are there so many images in the Catholic Church? Why are there so many images in the minds of the Protestants when they pray? My brethren, we can no more think about anything without a material image than we can live without breathing. Omnipresence to almost the whole world means nothing. Has God superficial area? If not, then when we repeat the word we think of the extended earth; that is all.”
— Lecture on Hinduism (Chicago).
স্বামীজী আরও বলিলেন, “অধিকারীভেদে সাকার পূজা ও নিরাকার পূজা। সাকার পূজা কুসংস্কার নহে — মিথ্যা নহে, নিম্ন স্থানীয় সত্য।
“If a man can realise his divine nature most easily with the help of an image, would it be right to call it a sin? Nor even when he has passed that stage, should he call it an error? To the Hindu, man is not travelling from error to truth but lower to higher truth.”
স্বামীজী বলিলেন, সকলের পক্ষে এক নিয়ম হইতে পারে না। ঈশ্বর এক; কিন্তু তিনি নানা ভক্তের নিকট নানাভাবে প্রকাশ হইতেছেন। হিন্দু এইটি বুঝেন।
“Unity in variety is the plan of nature and the Hindu has recognised it. Other religions lay down certain fixed dogmas and try to force society to adopt them; they place before society one kind of coat which must fit Jack and John and Henry, all alike. If it does not fit John or Henry, he must go without a coat to cover his body. The Hindus have discovered that the Absolute can be realised, thought of or stated, only through the Relative.”
===========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, ব্রাহ্মসমাজ, নরেন্দ্র ও পাপবাদ
[THE DOCTRINE OF SIN]
স্বামীজীর গুরুদেব ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “ঈশ্বরের নাম লইলে ও আন্তরিক তাঁহার চিন্তা করিলে পাপ পলাইয়া যায়। যেমন তুলার পাহাড় অগ্নিস্পর্শে একক্ষণে পুড়িয়া যায়; অথবা যেমন বৃক্ষে পাখি অনেক বসিয়াছে, হাততালি দিলে সব উড়িয়া যায়।”
একদিন কেশববাবুর সহিত কথা হইতেছিল —
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি) — মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত! আমি মুক্ত পুরুষ — সংসারেই তাকি, আর অরণ্যেই থাকি — আমার বন্ধন কি? আমি ঈশ্বরের সন্তান, রাজাধিরাজের ছেলে, আমায় আবার বাঁধে কে? যদি সাপে কামড়ায়, — ‘বিষ নাই’, ‘বিষ নাই’; জোর করে বললে বিষ ছেড়ে যায়। তেমনিই ‘আমি বদ্ধ নই’ ‘আমি বদ্ধ নই’ ‘আমি মুক্ত’ এই কথাটি রোক করে বলতে বলতে তাই হয়ে যায়। মুক্তই হয়ে যায়।
“খ্রীষ্টানদের একখানা বই (বাইবেল) একজন দিলে। আমি পড়ে শুনাতে বললাম। তাতে কেবল ‘পাপ’ আর ‘পাপ’। তোমাদের ব্রাহ্মসমাজেও কেবল ‘পাপ’ আর ‘পাপ’। যে ব্যক্তি আমি বদ্ধ বারবার বলে, সে শেষে বদ্ধই হয়ে যায়। যে রাতদিন ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ এই করে, সে তাই হয়ে যায়।
“ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই — কি! আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে? আমার আবার বন্ধন কি, পাপ কি? কৃষ্ণকিশোর পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। সে বৃন্দাবনে গিয়েছিল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে, ‘ওরে, তুই আমায় একঘটি জল দিতে পারিস? তুই কি জাত?’ সে বললে, ‘ঠাকুর মশাই, আমি হীন জাত — মুচি।’ কৃষ্ণকিশোর বললে, ‘তুই বল, শিব, আর জল তুলে দে।’
“ভগবানের নাম করলে দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়। কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এ-সব কথা কেন? একবার বল যে অন্যায় কর্ম যা করেছি, তা আর করবো না। আর তাঁহার নামে বিশ্বাস কর।”
স্বামীজীও খ্রীষ্টানদের এই পাপবাদ সম্বন্ধে বলিলেন, পাপ কি! তোমরা অমৃতের অধিকারী, Sons of Immortal Bliss. তোমাদের ধর্মযাজকেরা রাত্রদিন নরকাগ্নির কথা বলেন, সে-কথা শুনিও না।
“Ye are the children of God, the sharers of immortal bliss, holy and perfect beings. Ye divinities on earth — Sinners! It is a sin to call a man so. Come up, O lions! and shake off the delusion that you are sheep! You are souls immortal spirits free and blest — and eternal, ye are not bodies; matter is your servant, not you the servant of matter.”
— Lecture on Hinduism (Chicago)
আমেরিকার হার্টফোর্ড নামক স্থানে স্বামী বক্তৃতা করিবার জন্য নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। এখানকার American Consul Patterson তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ও সভাপতির কার্য করিয়াছিলেন। স্বামী আবার খ্রীষ্টানদের পাপবাদ সম্বন্ধে বলিলেন, যদি ঘর অন্ধকার হয়, তাহলে ‘অন্ধকার’ ‘অন্ধকার’ করিলে কি হইবে? আলো জ্বালো তবে ত হবে —
“Shall we advise men to kneel down and cry — Oh miserable sinner that I am! No, rather let us remind them of their divine nature…..If the room is dark, do you go about striking your breast and crying, “It is dark!’ No, the only way to get into light is to strike a light and then the darkness goes. — The only way to realise the Light above you, is to strike the spiritual light within you and the darkness of impurity and sin will flee away. Think of your higher Self, not of your lower.”
স্বামী পরমহংসদেবের কাছে একটি গল্প[1] শুনিয়াছিলেন, সেই গল্পটই বলিলেন — একটা বাঘিনী একটা ছাগলের পাল আক্রমণ করেছিল। পূর্ণগর্ভা, তাই লাফ দিতে গিয়ে ছানা হয়ে গেল। বাঘিনীর মৃত্যু হল। ছানাটি ছাগলের সঙ্গে মানুষ হতে লাগল, আর তাদের সঙ্গে ঘাস খেতে লাগল ও ‘ভ্যা — অ্যা, ভ্যা — অ্যা’, করতে লাগল। কিছুদিন পরে সে ছানাটি বেশ বড় হল। একদিন ছাগলের পালে আর একটি বাঘ পড়ল। সে দেখে অবাক্‌ যে, একটা বাঘ ঘাস খাচ্ছে, আর ভ্যা — ভ্যা করছে, আবার তাকে দেখে ছাগলের মতো পালাচ্ছে। তখন তাকে ধরে জলের কাছে নিয়ে গেল ও বললে, ‘তুইও বাঘ, তুই ঘাস খাচ্ছিস কেন, আর ভ্যা — ভ্যা করছিল কেন — দেখ আমি কেমন মাংস খাচ্ছি। তুইও খা, ওই দেখ — জলে তোর মুখ দেখা যাচ্চে আমার মতো!’ বাঘটা সব দেখলে, মাংসেরও আস্বাদ পেলে।”
—————
১ এই আখ্যায়িকাটি সাংখ্যদর্শনে আছে। আখ্যায়িকা প্রকরণ।
==========

সপ্তম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, বিজয়, কেশব, নরেন্দ্র ও ‘কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ’ — সন্ন্যাস
(Renunciation)
একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে কথাবার্তা কহিতেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না করলে লোকশিক্ষা দেওয়া যায় না। দেখ না, কেশব সেন ওইটি পারলে না বলে, কি হল শেষটা! তুমি নিজে ঐশ্বর্যের ভিতর, কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর থেকে যদি বল ‘সংসার অনিত্য, ঈশ্বরই বস্তু’, অনেকে তোমার কথা শুনবে না। আপনার কাছে গুড়ের নাগরি রয়েছে, পরকে বলছো গুড় খেও না! তাই ভেবে-চিন্তে চৈতন্যদেব সংসারত্যাগ করলেন। তা না হলে জীবের উদ্ধার হয় না।
বিজয় — আজ্ঞে হাঁ, চৈতন্যদেব বলেছিলেন, কফ যাবে বলে পিপ্পলখণ্ড তৈয়ের করলাম[1] — কিন্তু উলটো উৎপত্তি হল, কফ বেড়ে গেল; নবদ্বীপের অনেক লোক ব্যঙ্গ করতে লাগল ও বলল, নিমাই পণ্ডিত বেশ আছে হে; সুন্দরী স্ত্রী, প্রতিষ্ঠা, অর্থের অভাব নেই; বেশ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশব যদি ত্যাগী হত অনেক কাজ হত। ছাগলের গায়ে ক্ষত থাকলে আর ঠাকুর সেবা হয় না। বলি দেওয়া হয় না। ত্যাগী না হলে লোকশিক্ষার অধিকারী হয় না। গৃহস্থ হলে কজন তার কথা শুনবে?
স্বামী বিবেকানন্দ কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাই তাঁহার ঈশ্বরবিষয়ে লোকশিক্ষা দেবার অধিকার। বিবেকানন্দ বেদান্তে ও ইংরেজী ভাষা ও দর্শনাদিতে পণ্ডিতাগ্রগণ্য, তিনি অসাধারণ বাগ্মী, সেই কি তাঁহার মাহাত্ম্য? ইহার উত্তর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দিবেন। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে ভক্তদের সম্বোধন করিয়া পরমহংসদেব ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলিতেছেন —
“এই ছেলেটিকে[2] দেখছো এখানে একরকম। দুরন্ত ছেলে, বাবার কাছে যখন বসে, যেন জুজুটি। আবার চাঁদনিতে যখন খেলে, তখন আর এক মূর্তি। এরা নিত্যসিদ্ধের থাক। এরা সংসারে কখন বদ্ধ হয় না। একটু বয়স হলেই চৈতন্য হয়, আর ভগবানের দিকে চলে যায়। এরা সংসারে আসে জীবশিক্ষার জন্য। এদের সংসারে বস্তু কিছু ভাল লাগে না — এরা কামিনী-কাঞ্চনে কখনও আসক্ত হয় না।
“বেদে আছে হোমাপাখির কথা। খুব উঁচু আকাশে সে পাখি থাকে। সেই আকাশেই সে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়লেই ডিমটা পড়তে থাকে। ডিম পড়তে পড়তে ফুটে যায়। তখন ছানাটা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার চোখ ফুটে আর ডানা বেরোয়। চোখ ফুটলেই দেখতে পায় যে, সে পড়ে যাচ্ছে, আর শরীর মাটিতে লাগলে একেবারে চুরমার হয়ে যাবে। তখন সে পাখি মার দিকে, ঊর্ধ্বদিকে চোঁচা দৌড় দেয়, আর উঁচুতে উঠে যায়।”
বিবেকানন্দ এই ‘হোমাপাখি’ — তাঁর জীবনের এক লক্ষ্য মার কাছে চোঁচা দৌড় দিয়ে উঠে যাওয়া — গায়ে মাটি না ঠেকতে ঠেকতে অর্থাৎ সংসার স্পর্শ না করতে করতে ভগবানের পতে অগ্রসর হওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺বিদ্যাসাগরকে বলিয়াছিলেন, “পাণ্ডিত্য! শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? শকুনিও অনেক উঁচুতে উঠে, কিন্তু নজর ভাগাড়ের দিকে — কোথায় পচা মড়া। পণ্ডিত অনেক শ্লোক ফড়র ফড়র করতে পারে, কিন্তু মন কোথায়? যদি হরিপাদপদ্মে থাকে, আমি তাকে মানি, যদি কামিনী-কাঞ্চনে থাকে, তাহলে আমার খড়কুটো বোধ হয়।”
স্বামী বিবেকানন্দ শুধু পণ্ডিত নহেন, তিনি সাধু, মহাপুরুষ! শুধু পাণ্ডিত্যের জন্য ইংরেজ ও আমেরিকাবাসিগণ ভৃত্যের ন্যায়, তাঁহার সেবা করেন নাই। তঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, ইনি আর এক জাতীয় লোক। সম্মান, টাকা, ইন্দ্রিয়সুখ, পাণ্ডিত্য প্রভৃতি লোকে রহিয়াছে; ইঁহার কিন্তু এক লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। সন্ন্যাসীর গীতিতে তিনিই বলিয়াছেন, সন্ন্যাসী কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ করিবে।
“Truth never comes where lust
and fame and greed
Of gain reside. No man who
thinks of woman
As his wife can ever perfect be.
Nor he who owns however little,
Nor he —
Whom anger chains — Can ever pass
thro’ Maya’s gates.
So give these up, sannyasin bold, Say —
“Om Tat Sat Om!”
— Song of the Sannyasin.
আমেরিকায় তাঁহার প্রলোভন কম হয় নাই। একে জগদ্‌ব্যাপী প্রতিষ্ঠা; তাহাতে সর্বদাই পরমাসুন্দরী উচ্চবংশীয়া সুশিক্ষিতা মহিলাগণ আসিয়া আলাপ ও সেবা করিতেন। তাঁহার এত মোহিনীশক্তি যে, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে তাঁহাকে বিবাহ করিতে চাহিতেন। একজন অতি ধনাঢ্যের কন্যা (heiress) সত্য সত্য একদিন আসিয়া তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “স্বামী! আমার সর্বস্ব ও আমাকে আপনাকে সমর্পণ করিলাম।” স্বামী তদুত্তরে বলিলেন, “ভদ্রে! আমি সন্ন্যাসী, আমার বিবাহ করিতে নাই। সকল স্ত্রীলোক আমার মাতৃস্বরূপা!” ধন্য বীর! তুমি গুরুদেবের উপযুক্ত শিষ্য! তোমার গাত্র যথার্থই পৃথিবীর মৃত্তিকা স্পর্শ করে নাই। তোমার গাত্রে কামিনী-কাঞ্চনের দাগটি পর্যন্ত লাগে নাই। তুমি প্রলোভনের রাজ্য হইতে পলায়ন কর নাই। তাহার মধ্যে থাকিয়া, শ্রীনগরে বাস করিয়া, ইশ্বরের পথে অগ্রসর হইয়াছ। তুমি সামান্য জীবের ন্যায় দিন কাটাইতে চাও নাই। তুমি দেবভাবের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রাখিয়া এ-মর্ত্যধাম ত্যাগ করিয়া গিয়াছ।
————
১ পিপুলখণ্ড — অর্থাৎ নবদ্বীপে হরিনাম প্রচার।
২ স্বামী বিবেকানন্দ তখন জেনার‌্যাল্‌ অ্যাসেমব্লি কলেজে পড়েন। বয়স ১৯।২০। তাঁহার বাড়ি তখন কলেজের কাছে সিমুলিয়ায়। পিতার নাম ৺বিশ্বনাথ দত্ত হাইকোর্টের এটর্ণি। বালকের নাম নরেনদ্র। কলেজে থাকিয়া বি. এ. পাশ করিয়াছিলেন। তখন Hastie সাহেব প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। এক্ষণে তাঁহার ভাই ভগ্নীরা আছেন। স্বামীর জন্মদিন — সোমবার, পৌষ সংক্রান্তি, ১২৬৯ সাল, প্রাতে ৬-৩১।৩৩ সময়, সূর্যোদয়ের ৬ মিনিট পূর্বে; বয়স — ৩৯ বৎসর ৫ মাস ২৪ দিন হইয়াছিল।
===========

অষ্টম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, কর্মযোগ, নরেন্দ্র ও দরিদ্রনারায়ণ সেবা
(নিষ্কাম কর্ম)
পরমহংসদেব বলিতেন, কর্ম সকলেরই করিতে হয়। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম এই তিনটি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার পথ। গীতায় আছে, — সাধু, গৃহস্থ, প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য গুরুর উপদেশ অনুসারে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করিবে। ‘আমি কর্তা’ এটি অজ্ঞান, ধন-জন কার্যকলাপ আমার, এটিও অজ্ঞান। গীতায় আছে, আপনাকে অকর্তা জেনে ইশ্বরকে ফল সমর্পণ করে কাজ করতে হয়। গীতায় আরও আছে যে, সিদ্ধিলাভের পরও প্রত্যাদিষ্ট হইয়া কেহ কেহ, যেমন জনকাদি, কর্ম করেন। গীতায় যে আছে কর্মযোগ সে এই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও ওই কথা বলিতেন।
তাই কর্মযোগ বড় কঠিন। অনেকদিন নির্জনে ঈশ্বরের সাধনা না করলে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করা যায় না। সাধনার অবস্থায় গুরুর উপদেশ সর্বদা প্রয়োজন। তখন কাঁচা অবস্থা, তাই কোন্‌ দিক থেকে আসক্তি এসে পড়ে জানতে পারা যায় না। মনে করছি, আমি অনাসক্ত হয়ে ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে, জীবসেবা দানাদি কার্য করছি; কিন্তু বাস্তবিক আমি হয় তো লোকমান্য হবার জন্য করছি, নিজেই বুঝতে পারছি না। যে ব্যক্তি গৃহস্থ, যার গৃহ, পরিজন, আত্মীয়-কুটুম্ব, আমার বলবার আছে, তাকে দেখে নিষ্কাম কর্ম ও অনাসক্তি, পরার্থে স্বার্থত্যাগ, এ-সকল শিক্ষা করা বড় কঠিন।
কিন্তু সর্বত্যাগী কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী সিদ্ধ মহাপুরুষ যদি নিষ্কাম কর্ম করে দেখান, তাহলে লোক সহজে উহা বুঝিতে পারে ও তাঁহার পদানুসরণ করে।
স্বামী বিবেকানন্দ কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী। তিনি নির্জনে গুরুর উপদেশে অনেকদিন সাধনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি যথার্থে কর্মযোগের অধিকারী। তবে তিনি সন্ন্যাসী, মনে করিলেই ঋষিদের মতো অথবা তাঁহার গুরুদেব পরমহংসদেবের মতো কেবল জ্ঞান-কর্ম লইয়া থাকিতে পারিতেন। কিন্তু তাঁহার জীবন কেবল ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখাইবার জন্য হয় নাই। সংসারীরা যে সকল বস্তু গ্রহণ করে, অনাসক্ত হইয়া তাহাদের কিরূপ ব্যবহার করিতে হয়, নারদ, শুকদেব ও জনকাদির ন্যায় স্বামীজী লোকসংগ্রহার্থ তাহাও দেখাইয়া গিয়াছেন। তিনি অর্থ ও মান, এ-সকলকে সন্ন্যাসীর ন্যায় কাকবিষ্ঠা জ্ঞান করিতেন বটে, অর্থাৎ নিজে ভোগ করিতেন না; কিন্তু তাহাদিগকে জীবসেবার্থে কিরূপে ব্যবহার করিতে হয়, তাহা উপদেশ দিয়া ও নিজে কাজ করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন। যে অর্থ বিলাত ও আমেরিকার বন্ধুবর্গের নিকট হইতে তিনি সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে সমস্ত অর্থ জীবের মঙ্গলকল্পে ব্যয় করিয়াছেন। স্থানে স্থানে, যথা কলিকাতার নিকটস্থ বেলুড়ে, আলমোরার নিকটস্থ মায়াবতীতে, কাশীধামে ও মাদ্রাজ ইত্যাদি স্থানে মঠ স্থাপন করিয়াছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িতদিগকে নানা স্থানে — দিনাজপুর, বৈদ্যনাথ, কিষেণগড়, দক্ষিণেশ্বর ও অন্যান্য স্থানে — সেবা করিয়াছেন। দুর্ভিক্ষের সময় পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালক-বালিকাগণকে অনাথাশ্রম করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন। রাজপুতনার অন্তর্গত কিষেণগড় নামক স্থানে অনাথাশ্রম স্থাপন করিয়াছিলেন। মুর্শিদাবাদের নিকট (ভাবদা) সারগাছী গ্রামে এখনও অনাথাশ্রম চলিতেছে। হরিদ্বার-নিকটস্থ কনখলে পীড়িত সাধুদিগের জন্য স্বামী সেবাশ্রম স্থাপন করিয়াছেন। প্লেগের সময় প্লেগব্যাধি-আক্রান্ত রোগীদিগকে অনেক অর্থব্যয় করিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাইয়াছেন। দরিদ্র কাঙালের কন্য একাকী বসিয়া কাঁদিতেন। আর বন্ধুদের সমক্ষে বলিতেন, “হায়! এদের এত কষ্ট, ঈশ্বরকে চিন্তা করিবার অবসর পর্যন্ত নাই।”
গুরূপদিষ্ট কর্ম, নিত্যকর্ম ছাড়া অন্য কর্মতো বন্ধনের কারণ। তিনি সন্ন্যাসী। তাঁহার কর্মের কি প্রয়োজন?
“Who sows must reap,” they say
and “cause must bring
The sure effect. Good good;
bad bad; and none
Escape the law. But who so
wears a form
Must wear the chain.” Too true,
but far beyond
Both name and form is Atman,
ever free.
Know thou art That, sannyasin bold!
say “Om Tat Sat, Om.”
— Song of the Sannaysin
কেবল লোকশিক্ষার জন্য ঈশ্বর তাঁহাকে এই সকল কর্ম করাইলেন। এখন সাধু বা সংসারী সকলে শিখিবে যে, যদি তাহারাও কিছুদিন নির্জনে গুরুর উপদেশে ঈশ্বরের সাধনা করিয়া ভক্তিলাভ করে, তাহারাও স্বামীজীর ন্যায় নিষ্কাম কর্ম করিতে পারিবে, যথার্থা অনাসক্ত হইয়া দানাদি সৎকার্য করিতে পারিবে। স্বামীজীর গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আঠা লাগবে না।” অর্থাৎ নির্জনে সাধনের পর ভক্তিলাভ করিয়া প্রত্যাদিষ্ট হইয়া লোকশিক্ষার্থ পৃথিবীর কার্যে হাত দিলে ঈশ্বরের কৃপায় যথার্থ নির্লিপ্তভাবে কাজ করা যায়। স্বামী বিবেকানন্দের জীবন অনুধ্যান করিলে, নির্জনে সাধন কাহাকে বলে ও লোকশিক্ষার্থ কর্ম কাহাকে বলে, তাহার আভাস পাওয়া যায়।
বিবেকানন্দের এ-সকল কর্ম লোকশিক্ষার্থ।
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্‌ কর্তুমর্হসি ৷৷
এই গীতোক্ত কর্মযোগ অতিশয় কঠিন। জনকাদি কর্মের দ্বারা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন যে, জনক তাহার পূর্বে নির্জনে বনে অনেক কঠোর তপস্যা করিয়াছিলেন। তাই সাধুরা জ্ঞান ও ভক্তিপথ অবলম্বন করিয়া সংসার-কোলাহল ত্যাগ করিয়া নির্জনে ঈশ্বরসাধন করেন। তবে স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় উত্তম অধিকারী বীরপুরুষ কেবল এই কর্মযোগের অধিকারী। ভগবানকে অনুভব করিতেছেন, অথচ লোকশিক্ষার জন্য প্রত্যাদিষ্ট হইয়া সংসারে কর্ম করিতেছেন, এরূপ মহাপুরুষ পৃথিবীতে কয়টি? ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা, কামিণী-কাঞ্চনের দাগ একটিও লাগে নাই, অথচ জীবের সেবার জন্য ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন, এরূপ আচার্য কয়টি দেখা যায়?
স্বামীজী লণ্ডনে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ১০ই নভেম্বর বেদান্তের কর্মযোগ ব্যাখ্যায় গীতার কথা বলিলেন —
“Curiously enough the scene is laid on the battlefield where Krishna teaches the philosophy to Arjuna; and the doctrine which stands out luminously in every page of the Gita is intense activity, but in the midst of that, eternal calmness. And this idea is called the secret of work to attain which is the goal of the Vedanta.”
(London) — Practical Vedanta
বক্তৃতায় স্বামীজী কর্মের মধ্যে সন্ন্যাসীর ভাবের (‘Calmness in the midst of activity’) কথা বলিয়াছেন। স্বামী ‘রাগদ্বেষ-বিবর্জিত’ হইয়া কর্ম করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি যে এরূপ কর্ম করিতে পারিতেন, সে কেবল তাঁর তপস্যার গুণে, তাঁর ঈশ্বরানুভূতির বলে। সিদ্ধ পুরুষ অথবা শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় অবতারপুরুষ না হইলে এই স্থিরতা (‘Calmness’) হয় না।
===========

নবম পরিচ্ছেদ

স্ত্রীলোক লইয়া সাধনা বা বামাচার সম্বন্ধে ঠাকুর শ্রীরামককৃষ্ণ ও স্বামীজীর উপদেশ
স্বামী বিবেকানন্দ একদিন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। ভবনাথ ও বাবুরাম প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ২৯শে সেপ্টেম্বর। ঘোষপাড়া ও পঞ্চনামী সম্বন্ধে নরেন্দ্র কথা তুলিলেন ও জিজ্ঞাসা করিলেন, স্ত্রীলোক লইয়া তারা কিরূপ সাধনা করে?
ঠাকুর নরেন্দ্রকে বলিলেন, “তোর আর এ-সব কথা শুনে কাজ নাই। কর্তাভজা, ঘোষপাড়া ও পঞ্চনামী আবার ভৈরব-ভৈরবী এরা ঠিক ঠিক সাধনা করতে পারে না, পতন হয়। ও-সব পথ নোংরা পথ, ভাল পথ নয়। শুদ্ধ পথ দিয়ে যাওয়াই ভাল। কাশীতে আমায় ভৈরবীচক্রে নিয়ে গেল। একজন করে ভৈরব, একজন করে ভৈরবী; আমায় আবার কারণ পান করতে বললে। আমি বললাম, ‘মা, আমি কারণ ছুঁতে পারি না।’ তারা খেতে লাগল। ভাবলাম এইবার বুঝি জপ ধ্যান করবে। তা নয়, মদ খেয়ে নাচতে আরম্ভ করলে।”
নরেন্দ্রকে আবার বলিলেন, “কি জান, আমার মাতৃভাব — সন্তানভাব। মাতৃভাব অতি শুদ্ধভাব, এতে কোন বিপদ নাই। স্ত্রীভাব, বীরভাব — বড় কঠিন, ঠিক রাখা যায় না, পতন হয়। তোমরা আপনার লোক, তোমাদের বলছি, — শেষ এই বুঝেছি — তিনি পূর্ণ, আমি তার অংশ। তিনি প্রভু, আমি তাঁর দাস। আবার এক-একবার ভাবি, তিনিই আমি, আমিই তিনি। আর ভক্তিই সার।”
আর-একদিন ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর ভক্তদের বলিতেছেন, “আমার সন্তানভাব। অচলানন্দ এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকত, খুব কারণ করত। আমি স্ত্রীলোক লয়ে সাধন ভাল বলতাম না, তাই আমাকে বলেছিল, ‘তুমি বীরভাবের সাধন কেন মানবে না? তন্ত্রে আছে। — শিবের কলম মানবে না? তিনি (শিব) সন্তানভাবও বলেছেন — আবার বীরভাবও বলেছেন।’
“আমি বললাম, কে জানে বাপু আমার ও-সব ভাল লাগে না — আমার সন্তানভাব।
“ও-দেশে ভগী তেলীকে কর্তাভজার দলে দেখেছিলাম। — ওই মেয়েমানুষ নিয়ে সাধন। আবার একটি পুরুষ না হলে মেয়েমানুষের সাধন-ভজন হবে না। সেই পুরুষটিকে বলে রাগকৃষ্ণ। তিনবার জিজ্ঞাসা করে, তুই কৃষ্ণ পেয়েছিস। সেই মেয়েমানুষটিও তিনবার বলে কৃষ্ণ পেয়েছি।”
আর-একদিন ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ২৩শে মার্চ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ রাখাল, রাম প্রভৃতি ভক্তদের বলিতেছেন — বৈষ্ণবচরণের কর্তাভজার মত ছিল। আমি যখন ও-দেশে শ্যামবাজারে যাই, তাদের বললাম এরূপ মত আমার নয়, আমার মাতৃভাব। দেখলাম যে লম্বা লম্বা কথা কয়, আবার ব্যভিচার করে। ওরা ঠাকুর পূজা, প্রতিমা পূজা like করে না। জীবন্ত মানুষ চায়। ওরা অনেকে রাধাতন্ত্রের মতে চলে। পৃথিবীতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব — মল, মূত্র, রজ, বীজ এই সব তত্ত্ব। এ সাধন বড় নোংরা সাধন, যেমন পাইখানার মধ্যে দিয়া বাড়ির ভিতর ঢোকা।”
ঠাকুরের উপদেশ অনুসারে স্বামী বিবেকানন্দও বামাচারের খুব নিন্দা করিয়াছেন। তিনি বলেন, “ভারতবর্ষের প্রায় সকল স্থানে বিশেষত বাঙ্গালাদেশে গুপ্তভাবে অনেকে এরূপ সাধনা করেন, তাঁহারা বামাচারতন্ত্রের প্রমাণ দেখান। ও-সকল তন্ত্র ত্যাগ করিয়া উপনিষৎ, গীতাদি শাস্ত্র ছেলেদের পাঠ করিতে দেওয়া উচিত।”
শোভাবাজার ৺রাধাকান্তদেবের ঠাকুরবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ বিলাত হইতে ফিরিবার পর বেদান্ত সম্বন্ধে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দেন। তাহাতে স্ত্রীলোক লইয়া সাধনার নিন্দা করিয়া নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়াছেন —
“Give up this filthy Vamachara that is killing your country. You have not seen the other parts of India. When I see how much the Vamachara has entered our society, I find it a most disgraceful place with all its boast of culture. These Vamachara sects are honey-combing our society in Bengal. Those who came out in the day-time and preach most loudly about achara, it is they who carry on the most horrible debauchery at night, and are backed by the most dreadful books. They are ordered by the books to do these things. You who are of Bengal know it. The Bengali Shastras are the Vamachara Tantras. They are published by the cartload, and you poison the minds of your children with them instead of teaching them your Shrutis. Fathers of Calcutta, do you not feel ashamed that such horrible stuff as these Vamachara Tantras, with translation too, should be put into the hands of your boys and girls, and their minds poisoned, and that they should be brought up with the idea that these are the Shastras of the Hindus? If you are ashamed, take them away from your children, and let them read the true Shastras, the Vedas, the Gita, the Upanishads.”
— Reply to Calcutta address at Shovabazar.
কাশীপুর বাগানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন পীড়িত হইয়া আছেন (১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে), নরেন্দ্রকে একদিন ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, এখানে যেন কেহ কারণ পান না করে। ধর্মের নাম করে মদ্য পান করা ভাল নয়; আমি দেখেছি, যেখানে ওরূপ করেছে, সেখানে ভাল হয় নাই।”
============

দশম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ ও অবতারবাদ 
একদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন, ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দ ৭ই মার্চ, বেলা ৩টা ৪টা হইবে। 
ভক্তের পদসেবা করিতেছেন,—শ্রীরামকৃষ্ণ একটু হাসিয়া ভক্তদের বলিতেছেন, “এর (অর্থাৎ পদসেবার) অনেক মানে আছে।” আবার নিজের হৃদয়ে হাত রাখিয়া বলিতেছেন, “এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যাবে।” 
হঠাৎ রামকৃষ্ণ গম্ভীর হইলেন, যেন কি গুহ্য কথা বলিবেন। ভক্তদের বলিতেছেন, এখানে বাহিরের লোক কেউ নাই; তােমাদের একটা গুহ্য কথা বলছি। সেদিন দেখলাম, আমার ভিতর থেকে সচিচদানন্দ বাইরে এসে রূপ ধারণ করে বললে, আমিই যুগে যুগে অবতার। দেখলাম পূর্ণ আবির্ভাব ; তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বৰ্য্য।”
ভক্তেরা এই সকল কথা অবাক হইয়া শুনিতেছেন, কেহ কেহ গীতােক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাবাক্য স্মরণ করিতেছেন,
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। 
অভুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। 
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। 
আর একদিন ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে, ১লা সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমী দিবসে নরেন্দ্রাদি ভক্তের সমাগম হইয়াছে। শ্রীযুক্ত গিরীশ ঘােষ ২/১টি বন্ধু সঙ্গে করিয়া দক্ষিণেশ্বরে গাড়ী করিয়া আসিয়া উপস্থিত। কাঁদিতে কাঁদিতে আসিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সস্নেহে তাহার গা চাপড়াইতে লাগিলেন। 
‘গিরীশ মাথা তুলিয়া হাত জোড় করিয়া বলিতেছেন’—তুমিই পূর্ণব্রহ্ম। তা যদি না হয়, সবই মিথ্যা। বড় খেদ রইলাে, তােমার সেবা করতে পেলুম না। দাও বর ভগবান, এক বৎসর তােমার সেবা করব।” বার বার তাহাকে ঈশ্বর বলিয়া স্তব করাতে ঠাকুর বলিতেছেন,- “ছি, ও কথা বলতে নাই, ভক্তবৎ ন চ কৃষ্ণবৎ। তুমি যা ভাব ; তুমি ভাবতে পার। আপনার গুরু ত ভগবানা, তা ব’লে ও সব কথা বলার অপরাধ হয়।” 
গিরীশ ঠাকুরকে আবার স্তব করিতেছেন,- ভগবন পবিত্রতা আমায় দাও; যাতে কখনও একটু পাপচিন্তা না হয়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—“তুমি পবিত্র ত আছ—তােমার যে বিশ্বাসভক্তি।”
একদিন ১লা মার্চ ১৯৮৫ খৃষ্টাব্দে দোলযাত্রা দিবসে নরেন্দ্রাদি ভক্তগণ আসিয়াছেন। ঐদিন ঠাকুর নরেন্দ্রকে সন্ন্যাসের উপদেশ দিতেছেন ও বলিতেছেন, “বাবা, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না হলে হবে না। ঈশ্বরই একমাত্র সত্য, আর সব অনিত্য।” বলিতে বলিতে ভাবপূর্ণ হইয়া উঠিলেন। সেই করুণামাখা দৃষ্টি। ভাবােন্মত্ত হইয়া গান ধরিলেন
কথা বলতে ডরাই, না বললেও ডরাই, 
মনে সন্দ হয়, পাছে তােমা ধনে হারাই-হারাই। 
আমরা জানি যে মনতোর দিলাম তােকে সেই মনতোর,
এখন মন তাের ! 
আমরা যে মন্ত্রে বিপদেতে তরি তরাই। 
শ্রীরামকৃষ্ণের যেন ভয়, বুঝি নরেন্দ্র আর কাহার হইল, আমার বুঝি হ’ল —ভয় পাছে নরেন্দ্র সংসারের হয়েন। আমরা জানি যে মন্ত্র, দিলাম তােরে সেই মন্ত্র, অর্থাৎ আমি তােকে জীবনের Highest ideal সৰ্বত্যাগ করে ঈশ্বরের শরণাগত হওয়া সেই মন্ত্র দিলাম। নরেন্দ্র অশ্রুপূর্ণ লােচনে চাহিয়া আছেন।
ঐদিনেই ঠাকুর নরেন্দ্রকে বলিতেছেন,-“গিরীশ ঘােষ যা বলে তাের সঙ্গে মিললাে।”
নরেন্দ্র—আমি কিছু বলি নাই, তিনিই বলেন, তাঁর অবতার বলে বিশ্বাস। আমি আর কিছু বলুম না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু খুব বিশ্বাস! দেখেছিস?
কিছুদিন পরে নরেন্দ্রকে সঙ্গে ঠাকুরের অবতার বিষয়ের কথা হইল। ঠাকুর বলিতেছেন,—“আচ্ছা, কেউ যে আমাকে ঈশ্বরের অবতার বলে, তাের কি বােধ হয় ?”
নরেন্দ্র বললেন, “অন্যের মত শুনে আমি কিছু করব না; আমি নিজে যখন বুঝব, নিজের যখন বিশ্বাস হবে, তখনই বলব।” 
কাশীপুর উদ্যানে ঠাকুর যখন ক্যানসার রােগে যন্ত্রণায় অস্থির হইয়াছেন, ভাতের তরল মণ্ড পৰ্যন্ত গলাধঃকরণ হইতেছে না, তখন একদিন নরেন্দ্র ঠাকুরের নিকট বসিয়া ভাবিতেছেন, এই যন্ত্রণামধ্যে যদি বলেন যে, আমি সেই ঈশ্বরের অবতার তা হলে বিশ্বাস হয়। চকিতের মধ্যে ঠাকুর বলিতেছেন,-“যে রাম যে কৃষ্ণ ইদানীং সে-ই রামকৃষ্ণরূপে ভক্তের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।” নরেন্দ্র এই কথা শুনিয়া অবাক হইয়া রহিলেন। ঠাকুর স্বধামে গমন করিলে পর নরেন্দ্র সন্ন্যাসী হইয়া অনেক সাধন ভজন তপস্যা করিলেন। তখন তাঁহার হৃদয়মধ্যে অবতার সম্বন্ধে ঠাকুরের মহাবাক্য সকল যেন আরও প্রস্ফুটিত হইল। তিনি স্বদেশে বিদেশে এই তত্ত্ব আরও পরিষ্কাররূপে বুঝাইতে লাগিলেন।
স্বামীজী যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন নারদসূত্রাদি গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া ভক্তিযােগ নামক গ্রন্থ ইংরাজীতে প্রণয়ন করেন। তাহাতেও বলিতেছেন যে, অবতারগণ স্পর্শ করিয়া লােকের চৈতন্য সম্পাদন করেন। তাহাদের স্পর্শে যাহারা দুরাচার, তাঁহারা পরম সাধু হইয়া যায়েন। “অপি চেৎ সুদুরাচারাে ভজতে মামনন্যভাক সাধুরেব স মন্তব্য: সম্যক্ ব্যবসিতো হি সঃ ॥” ঈশ্বরই অবতার রূপে আমাদের কাছে আইসেন। যদি ঈশ্বরদর্শন করিতে আমরা চাই, তাহা হইলে অবতার পুরুষের মধ্যেই তাহাকে দর্শন করিব। তাঁহাদিগকে আমরা পূজা না করিয়া থাকিতে পারি না।
"Higher and nobler than all ordinary ones, is another set of teachers, the Avataras of Ishvara, in the world. They can transmit spirituality with a touch, even with a mere wish. The lowest and the most degraded characters become in one second saints at their command. They are the Teachers of all teachers, the highest manifestations of God through man. We cannot see God except through them. We cannot help worshipping them; and indeed they are the only ones whom we are bound to worship.
[Bhakti-Yoga. 
আবার বলিতেছেন,যতক্ষণ আমাদের মনুষদেহ, ততক্ষণ আমরা ঈশ্বরের যদি পূজা করি, তবে একমাত্র অবতারপুরুষেরই করিতে হইবে। হাজার লম্বা লম্বা কথা কও, ঈশ্বরকে মনুষ্যরূপ ব্যতীত আর চিন্তাই হয় না। তােমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দ্বারা ঈশ্বরের স্বরূপ আবল-তাবল কি বলিতে চাও ? যাহা বলিলে, তাহার কিছুই মূল্য নাই। Mere froth!
As long as we are inen we must worship Him in man and as man. Talk as you may, try as you may, you cannot think of God except as a man. You may delive great intellectual discourses on God and on all things under the Sun, become great rationalists and prove to your satisfaction that all these accounts of the Avataras of God as man, are nonsense. But let us come for a moment to practical commonsense. What is there behind this kind of remarkable intellect? Zero; nothing ; simply so much froth. When next you hear a man delivering a great intellectual lecture against this worship of the Avataras of God, get hold of him and ask him what his idea of God is, what he understands by "Omnipotence," "Omnipresence and all similar terms, beyond the spelling of the word. He really means nothing by them, he can not formulate as their meaning any idea unaffected by his own human nature ;, he is no better off in this matter than the man in the street who has not read a single book,
[ Bhakti Yoga.
স্বামী দ্বিতীয়বার আমেরিকায় গমন করিয়াছিলেন ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে, সেই সময়ে ১৯০০ খৃষ্টাব্দে California প্রদেশে Los Angeles নামক নগরে christ the Messenger বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন। এই বক্তৃতায় আবার অবতারতত্ত্ব বিশদভাবে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। স্বামী বলিলেন, অবতারপুরুযেতেই (in the Son) ঈশ্বরকে দেখিতে হইবে। আমাদের ভিতরেও ঈশ্বর আছেন বটে, কিন্তু অবতারপুরুষেই তিনি বেশী প্রকাশ। আলাের স্পন্দন (vibration of light) সৰ্বস্থানেই হইতেছে, কিন্তু বড় বড় দীপ জ্বলিলেই অন্ধকার দূর হয়।
"It has been said by the same Messenger (Christ). None hath seen God, but they have seen the son.' And that is true. And where to see God but in the Son ? It is true that you and I, the poorest of us, the meanest even, em body that God,-even reflect that God.
The vibration of light is everywhere, omnipresent ; but we have to strike the light of the lamp there and then we human beings see that He is Omnipresent. The omnipresent God of the universe can not be seen until He is reflected by these giant lamps of the earth; the prophets, the Man-Gods, the Incarnations, the Embodyments of God."
[Christ the Messenger. 
স্বামী আবার বলিতেছেন—ঈশ্বরের স্বরূপ তুমি যতদূর পার কল্পনা করিতে পার; কিন্তু দেখিবে, তােমার কল্পিত ঈশ্বর, অবতারপুরুষ অপেক্ষা অনেক নীচু। তবে এই মানুষ দেবতাগুলিকে পূজা করা কি অন্যায় ? তাহাদের পূজা করাতে কোন দোষ নাই। শুধু তাহা নহে, ঈশ্বরকে পূজা করিতে হইলে অবতারকেই পূজা করিতে হইবে। তুমি যে মানুষ, তােমার মানুষরূপী ভগবানকে পূজা করিতে হইবে, অন্য উপায় নাই।
"Take one of these Messengers of Light'; compare his character with the highest Ideal of God you ever formed and you find that your God falls low and that that character rises. You can not even form of God a higher ideal than what the actually embodied have practically realized, and laid before us as an example. Is it wrong, therefore, to worship these as God ? Is it a sin to fall at the feet of these man-Gods, and worship them as the only Divine Beings in the world ? If they are really, actually, higher than all my conception of God, what harm that they should be worshiped ? Not only is there no harm, but it is the only possible and positive way of worship.
[Christ, the Messenger. 
অবতারের লক্ষ্মন(Jesus Christ)
অবতারপুরুষ কি বলিতে আইসেন? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলিয়াছিলেন, বাবা, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে হবে না ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। স্বামিজীও আমেরিকানদের বলিলেন—
"We see in the life of Christ the first watch ward, "Not this life, but something higher !' No faith in this world and all its belongings' ! it is evanesent : it goes ! 
“যীশু কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী। তিনি জেনেছিলেন, আত্মা স্ত্রীও নয়, পুরুষও নয়। টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, দেহসুখ, ইন্দ্রিয়সুখ অবতারপুরুষ কিছুই চান না। তাহার পক্ষে আমি ‘আমার’ কিছুই নাই। আমি কর্তা, আমার গৃহ, পরিবার ইত্যাদি শ্রম অজ্ঞান থেকে হয়।”
"We still have fondness for 'ine' and mine.' We want property, nioney, wealth. Woe-unto us! Let us confess! And do not put to shame that great Teacher of humanity ! He ( Jesus ) had no family ties. Do you think that that man had any physical ideas in him ? Do you think that this mass of Light, this God and Not-man, came down so low, as to be the brother of animals 7 And yet, they make him preach all sorts, even of low sexual things. He had none ! He was a soul I Nothing but a soul, just working, as it were, in a body for the good of humanity; and that was all his relation to the body. Oh, not that ! In the soul there is neither man nor woman. No, 10 ! The disembodied soul has no relationship to the animal, no relationship to the body. The ideal may be high ; away beyond us. Never mind ; It is the Ideal. Let us confess it is so :--that we cannot approach it yet."
[ Christ, lhe Messenger. 
আমেরিকানদের আবার বলিতেছেন—অবতার পুরুষ আর কি বলেন ? আমাকে দেখিতেছ আর ঈশ্বরকে দেখিতে পাইতেছ না? তিনি আর আমি যে এক। তিনি যে শুদ্ধ মনের গােচর।
"Thou hast seen me and not seen the Father'? I and my Father are one! The kingdom of Heaven is within you !' If I am pure enough I will also find in the heart of iny heart, I and my Father are one.' That was what Jesus of Nazareth said."
[ Christ, the Messenger. 
এই বক্তৃতামধ্যে স্বামী অন্য স্থলে বলিতেছেন, অবতারপুরুষ ধৰ্ম্মসংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে দেহ ধারণ করেন। যীসাস ক্রাইষ্টের ন্যায় দেশকালভেদে তাহারা অবতীর্ণ হয়েন। তাহারা মনে করিলে আমাদের পাপ মার্জনা ও মুক্তি দিতে (vicarious atonement) পারেন। আমরা যেন তাহাদের সৰ্ব্বদা পূজা করিতে পারি।
Let us therefore, find God not only in Jesus of Nazareth, but in all the great ones that have preceded hiin, in all that came after him, and all that are yet to come. Our worship is unbounded and free. They are all manifestations of the same infinite God. They were all pure, unselfish ; they struggled and gave up their lives for us, poor human beings. They all and each of them bore Vicarious attonement for everyone of us and also for all that are to come hereafter.
[ Christ, the messenger.
স্বামী বেদান্ত চর্চা করিতে বলিতেন, কিন্তু সেই সঙ্গে ঐ চর্চার যাহা বিপদ, তাহাও দেখাইয়া দিয়াছেন । ঠাকুর যেদিন ঠনঠনিয়াতে শ্ৰীযুক্ত শশধর পণ্ডিতের সহিত আলাপ করেন, সেদিন নরেন্দ্রাদি অনেক ভক্ত উপস্থিত ছিলেন ; ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে।
[ জ্ঞানযােগ ও স্বামী বিবেকানন্দ ] 
ঠাকুর বলিলেন,-“জ্ঞানযােগও এযুগে ভারী কঠিন। জীবের একে অন্নগত প্রাণ, তাতে আয়ু কম। আবার দেহবুদ্ধি কোন মতে যায় না। এদিকে দেহবুদ্ধি না গেলে একেবারে ব্রহ্মজ্ঞান হবে না। জ্ঞানী বলেন, আমি সেই ব্ৰহ্ম ; আমি শরীর নই, আমি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রােগ, শােক, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ এ সকলের পার। যদি রােগ, শােক, সুখ, দুঃখ, এসব বোধ থাকে তুমি জ্ঞানী কেমন করে হবে? এদিকে কাঁটায় হাত কেটে যাচ্ছে দর দর করে রক্ত পড়ছে খুব লাগছে—অথচ বলছে কৈ, হাত ত কাটে নাই। আমার কি হয়েছে ?”
“তাই এ যুগের পক্ষে ভক্তিযােগ। এতে অন্যান্য পথের চেয়ে সহজে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়। জ্ঞানযোগ বা কৰ্ম্মযােগ আর অন্যান্য পথ দিয়াও ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যেতে পারে; কিন্তু এসব পথ কঠিন।”
ঠাকুর আরও বলিয়াছেন, “কর্মীদের যেটুকু কৰ্ম্ম বাকী আছে, সেটুকু নিষ্কামভাবে করিবে। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধ হলে ভক্তি আসবে; ভক্তি দ্বারা ভগবান লাভ হয়।”
স্বামীও বলিলেন, “দেহবুদ্ধি থাকিতে সোহহং হয় না—অর্থাৎ সব বাসনা গেলে, সব ত্যাগ হলে তবে সমাধি হয়। সমাধি হলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। ভক্তিযোগ সহজ ও মধুর (natural and sweet ).”
"Juana-yoga is grand, it is high philosophy, and almost every human being thinks curiously enough, that he can surely do everything required of him by philosophy, but it is really very difficult to live truly the life of a philosopher. We are often apt to run into great dangers in trying to guide our life by philosophy. This world may be said to be divided between persons of demoniacal nature.' who thiuk care-taking of the body to be the be-all and end all of existence, and persons of godly nature who realize that the body is simply a means to an end, an instrument intended for the culture of the soul. The devil can and indeed does quote the scriptures for his own purpose ; and thus the way of knowledge often appears to offer justification to what the bad man does as much as it offers inducements to what the good man does. This is the great danger in Juana-yoga. But Bhakti-yoga is natural, sweet and gentle; the Bhakta does not take such hights as the Juan-Yogin, and therefore he is not apt to have such big falls. [ Bhakti-Yoga.
[ রামকৃষ্ণ কি অবতার? স্বামীজীর বিশ্বাস ] 
ভারতের মহাপুরুষগণ (the sages of India) সম্বন্ধে স্বামীজী বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহাতে অবতার পুরুষদিগের কথা অনেক বলিয়াছেন। শ্রীরামচন্দ্র, কৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, রামানুজ, শঙ্করাচার্য্য, চৈতন্যদেব সকলের কথাই বলিলেন। ধৰ্ম্মের গ্লানি হইয়া অধৰ্ম্মের অভুথান হইলে সাধুদের পরিত্রাণের জন্য ও পাপাচার বিনাশের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই—গীতােক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐ কথা উদ্ধার করিয়া বুঝাইতে লাগিলেন - 
Whenever virtue subsides and irreligion prevails I create myself, For the protection of the good and for the destruction of all immorality I ain coming form time to time" [Sages of India.
আবার বলিলেন, গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ধর্মসমন্বয় করিয়াছেন,
In the Gita we already hear the distant sound of the conflicts of sects, and the Lord comes in the middle to harmonise them all. He the great Preacher of Harmony, the greatest Treacher of Harmony, Lord Krishna himself,
“শ্রীকৃষ্ণ আবার বলিয়াছেন,-স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র, সকলেই পরম গতি লাভ করিবেন, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের ত কথাই নাই।”
“বুদ্ধদেব দরিদ্রের ঠাকুর। সৰ্ব্বভূতস্থমাত্মানম। ভগবান সৰ্ব্বভূতে আছেন এইটি তিনি কাজে দেখালেন। বুদ্ধদেবের শিষ্যরা আত্মা জীবাত্মা এসব মানেন নাই—তাই শঙ্করাচাৰ্য আবার বৈদিক ধর্মের উপদেশ দিলেন। তিনি বেদান্তের অদ্বৈত মত, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত মত বুঝাইতে লাগিলেন। তাহার পর চৈতন্যদেব প্রেমভক্তি শিখাইবার জন্য অবতীর্ণ হইলেন। শঙ্কর, রামানুজ জাতি বিচার করিয়াছিলেন, কিন্তু চৈতন্যদেব তাহা করিলেন না। তিনি বলিলেন, ভক্তের আবার জাতি কি ?”
এইবার স্বামীজী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলিতেছেন—শঙ্করের বিচারশক্তি ও চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তি এইবার একাধারে মূর্তিমন্ত হইল, আবার শ্রীরামকৃষ্ণের সৰ্ব্বধৰ্ম্মসমন্বয় বার্তা শােনা গেল, আবার দীন-দরিদ্র পাপী তাপীর জন্য বুদ্ধদেবের ন্যায় একজন ক্রন্দন করিতেছেন, শােনা গেল ; অবতারপুরুষগণ যেন অসম্পূর্ণ ছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়া তাহাদের পূর্ণ করিয়াছেন ( fulfilment of all sages.)
"The one (Sankara ) had a great head, the other ( Chaitanya ) a large heart, and the time was ripe for one to be born, the embodiment of both this head, and heart; the time was ripe for one to be born who in one body would have the brilliant intellect of Sankara and the wonderfully expansive, infinite heart of Chaitanya ; one who would see in every sect spirit working, the same God ! one who would see God in every being, one whose heart would weep for the poor, for the weak, for the out-cast, for the down trodden, for evey one in this world, inside India or outside India ; and at the same time whose grand brilliant intellect, would conceive of such noble thoughts as would harmonise all conflicting sects, not only in India but outside of India, and bring a marvellous harmony, the universal Religion of head and heart, into existence."
"Such a man was born, and I had the good fortune to sit at his feet for years. The time was ripe, it was necessary that such a man should be born, and he came; and the most wonderful part of it was, that his life's work was just near a city which had run mad after these accidental ideas, a city which had become more Europeanised than any other city in India. There he lived, without any book learning whatsoever ; this great intellect never learnt even to write his own name, but the most brilliant graduates of our University found in him an intellectual giant. He was a strange man, this Ramakrishna Paramahansa. It is a long long story, and I have no time to tell anything about him tonight. Let me now only invention the great Sri Ramakrishna, the fulfilment of the Indian sage, the sage for the time, one whose teaching is just now at the present time most beneficial. And mark the Divine power working behind the man. The son of a poor priest, born in an out of-the-way village, unknown and unthought of, to-day is worshipped literally by thousands in Europe, America, and to-morrow will be worshipped by thousands more, Who knows the plans of the Lord ! Now, my brothers, if you do not see the hand, the finger of Providence, it is because you are blind, born blind indeed." (Sages of India. 
 স্বামী আবার বলিতেছেন--যে বেদময় দেববাণী ঋষিরা সরস্বতী তীরে শুনিয়াছিলেন, যে বাণী গিরিরাজ হিমালয়ের শৃঙ্গে শৃঙ্গে মহাযােগী তাপসদের কর্ণে একদা প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল, যে বাণী সর্বগ্রাহী মহাবেগবতীর আকারে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবুদ্ধ চৈতন্য নাম ধারণ করিয়া মর্ত্যলােকে অবতরণ করিয়াছিল, আজ আবার সেই দেববাণী সকলে শুনিতেছি। এই ভগবাণীর মহাস্পন্দন অল্পদিনের মধ্যে সমগ্র ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া সর্ব স্থানে পৌছিবে - যতদূর বিস্তৃত মেদিনী। এই বাণী প্রতিদিন নবশক্তিতে শক্তিমতী হইতেছে। এই দেববাণী পূর্ব যুগে অনেকবার শুনা গিয়াছে, কিন্তু আজ যাহা আমরা শুনিতেছি, তাহা ঐ সমস্ত বাণীর সমষ্টি (summation of them all.)
"Once more the wheel is turning up, once more vibrations have been set in motion from India which are destined at no distant day to reach the farthest limits of the earth. One voice has spoken. whose echoes are rolling on and gathering strength every day, a voice even mightier than those which have preceded it, for it is the summation of them all. Once more the voice, that spoke to the sages on the banks of Saraswati the voice whose echoes reverberated from peak to peak of the "Father of Mountains" and descended upon the plains through Krishna, Buddha and Chaitanya, in all-carrying floods, has spoken again. Once more the doors have opened. Enter le into the realms of light, the gates have been opened wide once more."
[Refly to Khetri address. 
স্বামীজী আরও বলিলেন, আমি যদি একটিও ভাল কথা বলিয়া থাকিআপনারা জানিবেন যে সমস্তই ঠাকুর রামকৃষ্ণের। যদি কিছু কঁচা কথা প্রমাদপূর্ণ কথা—বলিয়া থাকি তাহা জানিবেন সে আমার ।
"Only let me say now, that if I have told you one word of Truth, it was his and his alone ; and if I have told you many things which were not true, were not correct, were not beneficial to the human race, they were all mine, and on me is the responsibility." 
এইরূপে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষে নানাস্থানে অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের আগমনবার্তা ঘােষণা করিলেন। যেখানে যেখানে মঠস্থাপনা হইয়াছে, সেইখানেই তাহার নিত্য সেবাপূজাদি হইতেছে। আরতির সময় স্বামীজীর রচিত স্তব সকল স্থানেই বাদ্য ও সুরসংযােগে গীত হয়। এই স্তবমধ্যে স্বামী ঠাকুর রামকৃষ্ণকে নিগুণ সগুণ নিরঞ্জন জগদীশ্বর বলিয়া সম্বােধন করিয়াছেন। আর বলিয়াছেন, হে ভবসাগরের কাণ্ডারি! তুমি নররূপ ধারণ করে আমাদের ভব বন্ধন খণ্ডন করিবার জন্য যােগের সহায় হইয়া আসিয়াছ! তােমার কৃপায় আমার সমাধি হইতেছে। তুমি কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করাইয়াছ। হে ভক্তশরণ তােমার পাদপদ্মে আমায় অনুরাগ দাও। তােমার পাদপদ্ম আমার পরম সম্পদ। উহাকে পাইলে ভবসাগর গােষ্পদের ন্যায় বােধ হয়।
স্বামীজী রচিত শ্রীরামকৃষ্ণ-আরত্রিক
মিশ্র চৌতাল 
খণ্ডন ভব-বন্ধন, জগ-বন্দ বলি তােমায়। 
নিবঞ্জন নররূপধর নির্গুন গুণময়।। 
মােচন অঘদূষণ জগভূষণ চিঘন কায় । 
জ্ঞানাঞ্জন বিমল-নয়ন বীক্ষণে মােহ যায় ।। 
ভাস্বর ভাবসাগর চির উন্মাদ প্রেম পাথার। 
ভক্তাৰ্জ্জন যুগলচরণ তারণ ভব-পার।। 
জম্ভিত যুগ-ঈশ্বর জগদীশ্বর যোগ সহায়। 
নারােধন সমাহিত মন নিরখি তব কৃপায় ।। 
ভঞ্জন দুঃখ-গঞ্জন করুণাদন কর্ম কঠোর। 
প্রাণার্পণ জগত-তারণ কৃন্তন কলি-ডাের ।। 
বঞ্চন কামকাঞ্চন অতি নিন্দিত ইন্দ্রিয়রাগ । 
ত্যাগীশ্বর হে নরবর ! দেহ পদে অনুরাগ।। 
নির্ভয় গত সংশয় দৃঢনিশ্চয়মানসবান।
নিস্কারণ ভকত-শরণ ত্যজি জাতি কুল মান ।। 
সম্পদ তব পদ ভব গােষ্পদ বারি যথায়। 
প্রেমার্পণ সম দরশন জগজন দুঃখ যায়।।
“যেই রাম, যেই কৃষ্ণ ইদানীং সেই রামকৃষ্ণ।” 
কাশীপুর উদ্যানে স্বামীজী এই মহাবাক্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীমুখ হইতে শুনিয়াছিলেন। এই মহাবাক্য স্মরণ করিয়া স্বামী বিলাত হইতে কলিকাতায় প্রত্যাগমনের পর বেলুড় মঠে একটি স্তব রচনা করিয়াছিলেন। তবে বলিতেছেন,—যিনি আচণ্ডাল দীন দরিদ্রের বন্ধু জানকীবল্লভ, জ্ঞান ভক্তির অবতার শ্রীরামচন্দ্র! যিনি আবার শ্রীকৃষ্ণরূপে কুরুক্ষেত্রে গীতারূপ গম্ভীর মধুর সিংহনাদ করিয়া ছিলেন, তিনিই ইদানীং প্রথিত পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন।
ওঁ নমাে ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আচণ্ডালা প্রতিহতরয়ে যস্য প্রেমপ্রবাহঃ
লােকাতীতােহপ্যহেহ ন জহৌ লােককল্যাণমার্গম্ । 
ত্রৈলােকেহপ্যপ্রতিমমহিলা জানকীপ্রাণবন্ধুঃ
ভক্ত্যাবৃতজ্ঞানবরবপুঃ সীতয়া যো হি রামঃ।।
স্তব্ধীকৃত্ব প্রলকলিতম্বাহৰোথং মহান্তং 
হিত্বা দূরং প্রকৃতিসমন্ধতমিশ্ৰমিশ্রাম্। 
গীতং শান্তং মধুমপি যঃ সিংহনাদং জগর্জ্জ
সোহয়ং জাতঃ প্রথিতপুরমে। রামকৃষ্ণস্তিদানীম্ ।
 আর একটি স্তোত্র বেলুড়মঠে ও কাশী, মাদ্রাজ, ঢাকা প্রভৃতি সকল মঠে আরতির সময় গীত হয়।
এই স্তোত্রে স্বামীজী বলিতেছেন—হে দীনবন্ধো, তুমি সগুণ আবার ত্রিগুণাতীত, তােমার পাদপদ্ম দিন রাত্রি ভজন করিতেছি না, তাই তােমার শরণাগত। আমি মুখে ভজন করিতেছি, জ্ঞানানুশীলন করিতেছি, কিন্তু কিছুই ধারণা হইতেছে না তাই তােমার শরণাগত। তােমার পাদপদ্ম চিন্তা করিলে মৃত্যু জয় হয়, তাই আমি তােমার শরণাগত। হে দীনবন্ধো তুমি জগতের একমাত্র প্রাপ্তব্য বস্তু, আমি তােমার শরণাগত। ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!
ওঁ - হ্রীং ঋতং মচলাে গুণজিৎ গুণেড্যঃ।
ন - ক্তন্দিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম্। 
মাে - হঙ্কষং বহুকৃতং ন ভজে যতােহহং।
তত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ১।। 

ভ - ক্তিৰ্ভগশ্চ ভজনং ভবভেদকারী। 
গ - চ্ছন্ত্যলং সুবিপুলং গমনায় তত্ত্ব 
ব - ত্ত্রোদ্ধৃতন্ত হৃদি মে ন চ ভাতি কিঞ্চিৎ ।  
তস্মাত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো। ২।।

তে - জস্তরস্তি তরসা ত্বয়ী তৃপ্ততৃষ্ণাঃ। 
রা - গে কতে ঋতপথে ত্বয়ি রামকৃষ্ণে। 
মা - র্ত্ত্যামৃতং তব পদং মরণাের্মিনাশং। 
তস্মাত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ৩।।

কৃ - ত্যং করােতি কলুষং কুহকান্তকারি। 
ষ্ণা - ন্তং শিবং সুবিমলং তব নাম নাথ। 
য - স্মাদাহং ত্বশরণে জগদেকগম্য।
তন্মাত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ৪।।
স্বামীজী আরতির পর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণাম শিখাইয়াছেন। উহাতে ঠাকুরকে অবতার শ্রেষ্ঠ বলিয়াছেন !
“স্থাপকায় চ ধৰ্ম্মস্ত সর্বধর্মস্বরূপিণে। 
অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ ||
===========

Post a Comment

0 Comments