পরিশিষ্ট (ক) ~ শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কীম

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

পরিশিষ্ট (ক) 
শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কীম

পরিশিষ্ট (ক) ~ শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কীম

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

শ্রীযুক্ত অধরলাল সেনের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ ও শ্রীযুক্ত বঙ্কীমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদির সঙ্গে কথোপকথন
আজ ঠাকুর অধরের বাড়িতে আসিয়াছেন; ২২শে অগ্রহায়ণ, কৃষ্ণা চতুর্থী তিথি, শনিবার, ইংরেজী ৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর পুষ্যানক্ষত্রে আগমন করিয়াছেন।
অধর ভারী ভক্ত, তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বয়ঃক্রম ২৯/৩০ বৎসর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে অতিশয় ভালবাসেন। অধরের কি ভক্তি! সমস্ত দিন অফিসের খাটুনির পর মুখে ও হাতে একটু জল দিয়াই প্রায় প্রত্যহই সন্ধ্যার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে যাইতেন। তাঁহার বাড়ি শোভাবাজার বেনেটোলা। সেখান হইতে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে ঠাকুরের কাছে গাড়ি করিয়া যাইতেন। এইরূপ প্রত্যহ প্রায় দুই টাকা গাড়িভাড়া দিতেন। কেবল ঠাকুরকে দর্শন করিবেন, এই আনন্দ। তাঁহার শ্রীমুখের কথা শুনিবেন, এমন সুবিধা প্রায় হইত না। পৌঁছিয়াই ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেন; কুশল প্রশ্নাদির পর তিনি মা-কালীকে দর্শন করিতে যাইতেন। পরে মেঝেতে মাদুর পাতা থাকিত সেখানে বিশ্রাম করিতেন। অধরের শরীর পরিশ্রমের জন্য এত অবসন্ন থাকিত যে, তিনি অল্পক্ষণমধ্যে নিদ্রাভিভূত হইতেন। রাত্রে ৯/১০টা সময় তাঁহাকে উঠাইয়া দেওয়া হইত। তিনিও উঠিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আবার গাড়ীতে উঠিতেন। তৎপরে বাড়িতে ফিরিয়া যাইতেন।
অধর ঠাকুরকে প্রায়ই শোভাবাজারের বাড়িতে লইয়া যাইতেন। ঠাকুর আসিলে তথায় উৎসব পড়িয়া যাইত। ঠাকুর ও ভক্তদের লইয়া অধর খুব আনন্দ করিতেন ও নানারূপে তাঁহাদিগকে পরিতোষ করিয়া খাওয়াইতেন।
একদিন তাঁহার বাড়িতে গিয়াছেন। অধর বলিলেন, আপনি অনেকদিন এ-বাড়িতে আসেন নাই, ঘর মলিন হইয়াছিল; যেন কি একরকম গন্ধ হইয়াছিল; আজ দেখুন, ঘরের কেমন শোভা হইয়াছে! আর কেমন একটি সুগন্ধ হইয়াছে। আমি আজ ঈশ্বরকে ভারি ডেকেছিলাম। এমন কি চোখ দিয়ে জল পড়েছিল। ঠাকুর বলিলেন, “বল কি গো!” ও অধরের দিকে সস্নেহে তাকাইয়া হাসিতে লাগিলেন।
আজও উৎসব হইবে। ঠাকুরও আনন্দময় ও ভক্তেরা আনন্দে পরিপূর্ণ। কেননা যেখানে ঠাকুর উপস্থিত, সেখানে ঈশ্বরের কথা বৈ আর কোন কথাও হইবে না। ভক্তেরা আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবার জন্য অনেকগুলি নূতন নূতন লোক আসিয়াছে। অধর নিজে ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি তাঁহার কয়েকটি বন্ধু ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। তাঁহারা নিজে ঠাকুরকে দেখিবেন ও বলিবেন, যথার্থ তিনি মহাপুরুষ কিনা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহাস্যবদনে ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। এমন সময় অধর কয়েকটি বন্ধু লইয়া ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিলেন।
অধর (বঙ্কিমকে দেখাইয়া ঠাকুরের প্রতি) — মহাশয়, ইনি ভারি পণ্ডিত, অনেক বই-টই লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইঁহার নাম বঙ্কিমবাবু।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভাবে বাঁকা গো!
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে) — আর মহাশয়! জুতোর চোটে। (সকলের হাস্য) সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা।
[বঙ্কিম ও রাধাকৃষ্ণ — যুগলরূপের ব্যাখ্যা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — না গো, শ্রীকৃষ্ণ বঙ্কিম হয়েছিলেন। শ্রীমতীর প্রেমে ত্রিভঙ্গ হয়েছিলেন। কৃষ্ণরূপের ব্যাখ্যা কেউ কেউ করে, শ্রীরাধার প্রেমে ত্রিভঙ্গ। কালো কেন জানো? আর চৌদ্দপো, অত ছোট কেন? যতক্ষণ ঈশ্বরদূরে, ততক্ষণ কালো দেখায়, যেমন সমুদ্রের জল দূর থেকে নীলবর্ণ দেখায়। সমুদ্রের জলের কাছে গেলে ও হাতে করে তুললে আর কালো থাকে না, তখন খুব পরিষ্কার, সাদা। সূর্য দূরে বলে খুব ছোট দেখায়; কাছে গেলে আর ছোট থাকে না। সে অনেক দূরের কথা সমাধিস্থ না হলে হয় না। যতক্ষণ আমি তুমি আছে, ততক্ষণ নাম-রূপও আছে। তাঁরই সব লীলা। আমি তুমি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তিনি নানারূপে প্রকাশ হন।
“শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, শ্রীমতী তাঁর শক্তি — আদ্যাশক্তি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলমূর্তির মানে কি? পুরুষ আর প্রকৃতি অভেদ, তাঁদের ভেদ নাই। পুরুষ, প্রকৃতি না হলে থাকতে পারে না; প্রকৃতিও পুরুষ না হলে থাকতে পারে না। একটি বললেই আর একটি তার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নিকে ভাবা যায় না। আর অগ্নি ছাড়া দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। তাই যুগলমূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি শ্রীমতীর দিকে, ও শ্রীমতীর দৃষ্টি কৃষ্ণের দিকে। শ্রীমতীর গৌর বর্ণ বিদ্যুতের মতো, তাই কৃষ্ণ পীতাম্বর পরেছেন। শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ নীল মেঘের মতো; তাই শ্রীমতী নীলাম্বর পরেছেন। আর শ্রীমতী নীলকান্ত মণি দিয়ে অঙ্গ সাজিয়েছেন। শ্রীমতীর পায়ে নূপুর, তাই শ্রীকৃষ্ণ নূপুর পরেছেন; অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের অন্তরে-বাহিরে মিল।”
এই কথাগুলি সমস্ত সাঙ্গ হইল, এমন সময়ে অধরের বঙ্কিমাদি বন্ধুগণ পরস্পর ইংরেজীতে আস্তে আস্তে কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে বঙ্কিমাদির প্রতি) — কি গো। আপনারে ইংরাজীতে কি কথাবার্তা করছো? (সকলের হাস্য)
অধর — আজ্ঞে, এই বিষয় একটুকথা হচ্ছিল, কৃষ্ণরূপের ব্যাখ্যার কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য সকলের প্রতি) — একটা কথা মনে পড়ে আমার হাসি পাচ্ছে। শুন, একটা গল্প বলি। একজন নাপিত কামাতে গিয়েছিল। একজন ভদ্রলোককে কামাচ্ছিল। এখন কামাতে কামাতে তার একটু লেগেছিল। আর সে লোকটি ড্যাম (Damn) বলে উঠেছিল। নাপিত কিন্তু ড্যামের মানে জানে না। তখন সে ক্ষুর-টুর সব সেখানে রেখে, শীতকাল, জামার আস্তিন গুটিয়ে বলে, তুমি আমায় ড্যাম বললে, এর মানে কি, এখন বল। সে লোকটি বললে, আরে তুই কামা না; ওর মানে এমন কিছু নয়, তবে একটু সাবধানে কামাস। নাপিত, সে ছাড়বার নয়, সে বলতে লাগল, ড্যাম মানে যদি ভাল হয়, তাহলে আমি ড্যাম, আমার বাপ ড্যাম, আমার চৌদ্দপুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য) আর ড্যাম মানে যদি খারাপ হয়, তাহলে তুমি ড্যাম, তোমার বাবা ড্যাম, তোমার চৌদ্দপুরুষ ড্যাম। (সকলের হাস্য) আর শুধু ড্যাম নয়। ড্যাম ড্যাম ড্যাম ড্যা ড্যাম ড্যাম। (সকলের উচ্চ হাস্য)
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও প্রচারকার্য
সকলের হাস্য থামিলে পর, বঙ্কিম আবার কথা আরম্ভ করিলেন।
বঙ্কিম — মহাশয়, আপনি প্রচার করেন না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — প্রচার! ওগুলো অভিমানের কথা। মানুষ তো ক্ষুদ্র জীব। প্রচার তিনিই করবেন, যিনি চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করে এই জগৎ প্রকাশ করেছেন। প্রচার করা কি সামান্য কথা? তিনি সাক্ষাৎকার হয়ে আদেশ না দিলে প্রচার হয় না। তবে হবে না কেন? আদেশ হয়নি তুমি বকে যাচ্ছ; ওই দুদিন লোকে শুনবে তারপর ভুলে যাবে। যেমন একটা হুজুক আর কি! যতক্ষণ তুমি বলবে ততক্ষণ লোকে বলবে, আহা ইনি বেশ বলছেন। তুমি থামবে, তারপর কোথাও কিছুই নাই!
“যতক্ষণ দুধের নিচে আগুন জ্বাল রয়েছে, ততঁন দুধটা ফোঁস করে ফুলে উঠে। জ্বালও টেনে নিলে, আর দুধও যেমন তেমনি! কমে গেল।
“আর সাধন করে নিজের শক্তি বাড়াতে হয়। তা না হলে প্রচার হয় না। ‘আপনি শুতে স্থান পায় না, শঙ্করাকে ডাকে।’ আপনারই শোবার জায়গা নাই, আবার ডাকে ওরে শঙ্করা আয়, আমার কাছে শুবি আয়। (হাস্য)
“ও-দেশে হালদার পুকুরের পাড়ে রোজ বাহ্যে করে যেত, লোকে সকালে এসে দেকে গালাগালি দিত। লোক গালাগালি দেয় তবু বাহ্যে আর বন্ধ হয় না। শেষে পাড়ার লোক দরখাস্ত করে কোম্পানিকে জানালে। তারা একটি নোটিশ মেরে দিলে — ‘এখানে বাহ্যে, প্রস্রাব করিও না; তা করিলে শাস্তি পাইবে।’ তখন একেবারে সব বন্ধ। আর কোনও গোলযোগ নাই। কোম্পানির হুকুম — সকলের মানতে হবে।
“তেমনি ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হয়ে যদি আদেশ দেন, তবেই প্রচার হয়; লোকশিক্ষা হয়, তা না হলে কে তোমার কথা শুনবে?”
এই কথাগুলি সকলে গম্ভীরভাবে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিলেন।
[শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও পরকাল ]
[Life after Death — argument from analogy]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — আচ্ছা, আপনি তো খুব পণ্ডিত, আর কত বই লিখেছ; আপনি কি বলো, মানুষের কর্তব্য কি? কি সঙ্গে যাবে? পরকাল তো আছে?
বঙ্কিম — পরকাল! সে আবার কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, জ্ঞানের পর আর অন্যলোকে যেতে হয় না, — পুনর্জন্ম হয় না। কিন্তু যতক্ষণ না জ্ঞান হয়, ঈশ্বরলাভ হয়, ততক্ষণ সংসারে ফিরে আসতে হয়, কোনমতে নিস্তার নাই। ততক্ষণ পরকালও আছে। জ্ঞানলাভ হলে, ঈশ্বরদর্শন হলে মুক্তি হয়ে যায় — আর আসতে হয় না। সিধোনো-ধান পুঁতলে আর গাছ হয় না। জ্ঞানাগ্নিতে সিদ্ধ যদি কেহ হয় তাকে নিয়ে আর সৃষ্টির খেলা হয় না। সে সংসার করতে পারে না, তার তো কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি নাই। সিধোনো-ধান আর ক্ষেতে পুতলে কি হবে?
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে) — মহাশয়, তা আগাছাতেও কোন গাছের কাজ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানী তা বলে আগাছা নয়। যে ঈশ্বরদর্শন করেছে, সে অমৃত ফল লাভ করেছে — লাউ, কুমড়া ফল নয়! তার পুনর্জন্ম হয় না। পৃথিবী বল, সূর্যলোক বল, চন্দ্রলোক — কোনও জায়গায় তার আসতে হয় না।
“উপমা — একাদেশী। তুমি তো পণ্ডিত, ন্যায় পড় নাই? বাঘের মতো ভয়ানক বললে যে বাঘের মতো একটা ভয়ানক ন্যাজ কি হাঁড়ি মুখ থাকবে তা নয়। (সকলের হাস্য)
“আমি কেশব সেনকে ওই কথা বলেছিলাম। কেশব জিজ্ঞাসা করলে — মহাশয়, পরকাল কি আছে? আমি না এদিক না ওদিক বললাম! বললাম, কুমোররা হাঁড়ি শুকোতে দেয়, তার ভিতর পাকা হাঁড়িও আছে, আবার কাঁচা হাঁড়িও আছে। কখনও গরুটরু এলে হাঁড়ি মাড়িয়ে দেয়। পাকা হাঁড়ি ভেঙে গেলে কুমোর সেগুলোকে ফেলে দেয়। কিন্তু কাঁচা হাঁড়ি ভেঙে গেলে সেগুলি কুমোর আবার ঘরে আনে; এনে জল দিয়ে মেখে আবার চাকে দিয়ে নূতন হাঁড়ি করে, ছাড়ে না। তাই কেশবকে বললুম, যতক্ষণ কাঁচা থাকবে কুমোর ছাড়বে না; যতক্ষণ না জ্ঞানলাভ হয়, যতক্ষণ না ঈশ্বর দর্শন হয়, ততক্ষণ কুমোর আবার চাকে দেবে; ছাড়বে না, অর্থাৎ ফিরে ফিরে এ সংসারে আসতে হবে, নিস্তার নাই। তাঁকে লাভ করলে তবে মুক্তি হয়, তবে কুমোর ছাড়ে, কেননা, তার দ্বারা মায়ার সৃষ্টির কোন কাজ আসে না। জ্ঞানী মায়াকে পার হয়ে গেছে। সে আর মায়ার সংসারে কি করবে।
“তবে কারুকে কারুকে তিনি রেখে দেন, মায়ার সংসারে লোকশিক্ষার জন্য। লোকশিক্ষা দিবার জন্য জ্ঞানী বিদ্যামায়া আশ্রয় করে থাকে। সে তাঁর কাজের জন্য তিনিই রেখে দেন; যেমন শুকদেব, শঙ্করাচার্য।
(বঙ্কিমের প্রতি) — “আচ্ছা, আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি?”
বঙ্কিম (হাসিতে হাসিতে) — আজ্ঞা, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — এঃ! তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া! তুমি যা রাতদিন কর, তাই তোমার মুখে বেরুচ্ছে। লোকে যা খায়, তার ঢেকুর উঠে। মূলো খেলে মূলোর ঢেকুর উঠে। ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর উঠে। কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর রাতদিন রয়েছো আর ওই কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয়চিন্তা করলে পাটোয়ারি স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বরচিন্তা করলে সরল হয়, ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হলে ও-কথা কেউ বলবে না।
[শ্রীযুক্ত বঙ্কিম — শুধু পাণ্ডিত্য ও কামিনী-কাঞ্চন ]
(বঙ্কিমের প্রতি) — “শুধু পাণ্ডিত্য হলে কি হবে, যদি ঈশ্বরচিন্তা না থাকে? যদি বিবেক-বৈরাগ্য না থাকে? পাণ্ডিত্য কি হবে, যদি কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকে?
“চিল শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের কদিকে কেবল নজর! পণ্ডিত অনেক বই শাস্ত্র পড়েছে, শোলোক ঝাড়তে পারে, কি বই লিখেছে, কিন্তু মেয়েমানুষে আসক্ত, টাকা, মান সার বস্তু মনে করেছে; সে আবার পণ্ডিত কি? ঈশ্বরে মন না থাকলে পণ্ডিত কি?
“কেউ কেউ মনে করে এরা কেবল ঈশ্বর ঈশ্বর করছে, পাগলা। এরা বেহেড হয়েছে। আমরা কেমন স্যায়না, কেমন সুখভোগ করছি; টাকা, মান, ইন্দ্রিয়সুখ। কাকও মনে করে, আমি বড় স্যায়না, কিন্তু সকালবেলা উঠেই পরের গু খেয়ে মরে। কাক দেখো না কত উড়ুর পুড়ুর করে, ভারী স্যায়না! (সকলে স্তব্ধ)
“যারা কিন্তু ঈশ্বরচিন্তা করে, বিষয়ে আসক্তি, কামিনী-কাঞ্চনে ভালবাসা চলে যাবার জন্য রাতদিন প্রার্থনা করে, যাদের বিষয়রস তেঁতো লাগে, হরিপাদপদ্মের সুধা বই আর কিছু ভাল লাগে না, তাদের স্বভাব যেমন হাঁসের স্বভাব। হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। আর হাঁসের গতি দেখেছো? একদিকে সোজা চলে যাবে। শুদ্ধভক্তের গতিও কেবল ঈশ্বরের দিকে। সে আর কিছু চায় না; তার আর কিছু ভাল লাগে না।
(বঙ্কিমের প্রতি কোমলভাবে) — “আপনি কিছু মনে করো না।”
বঙ্কিম — আজ্ঞা, মিষ্টি শুনতে আসিনি।
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরোপকার
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। এরই নাম মায়া। ঈশ্বরকে দেখতে, চিন্তা করতে দেয় না; দুই-একটি ছেলে হলে স্ত্রীর সঙ্গে ভাই-ভগ্নীর মতো থাকতে হয়, আর তার সঙ্গে সর্বদা ঈশ্বরের কথা কইতে হয়। তাহলে দুজনেরই মন তাঁর দিকে যাবে আর স্ত্রী ধর্মের সহায় হবে। পশুভাব না গেলে ঈশ্বরের আনন্দ আস্বাদন করতে পারে না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যাতে পশূভাব যায়। ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা। তিনি অন্তর্যামী, শুনবেনই শুনবেন। যদি আন্তরিক হয়।
“আর — ‘কাঞ্চন’। আমি পঞ্চবটীর[1] তলায় গঙ্গার ধারে বসে ‘টাকা মাটি’ ‘টাকা মাটি’ ‘মাটিই টাকা’, ‘টাকাই মাটি’ বলে জলে ফেলে দিছলুম!”
বঙ্কিম — টাকা মাটি! মহাশয় চারটা পয়সা থাকলে গরিবকে দেওয়া যায়। টাকা যদি মাটি, তাহলে দয়া পরোপকার করা হবে না?
[শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ‘জগতের উপকার’ ও কর্মযোগ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — দয়া! পরোপকার! তোমার সাধ্য কি যে তুমি পরোপকার কর? মানুষের এতো নপর-চপর কিন্তু যখন ঘুমোয়, তখন যদি কেউ দাঁড়িয়ে মুখে মুতে দেয়, তো টের পায় না, মুখ ভেসে যায়। তখন অহংকার, অভিমান, দর্প কোথায় যায়?
“সন্ন্যাসীর কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে হয়! তা আর গ্রহণ করতে পারে না। থুথু ফেলে আবার থুথু খেতে নাই। সন্ন্যাসী যদি কারুকে কিছু দেয়, সে নিজে দেয়, মনে করে না। দয়া ঈশ্বরের; মানুষে আবার কি দয়া করবে? দানটান সবই রামের ইচ্ছা। ঠিক সন্ন্যাসী মনেও ত্যাগ করে, বাহিরেও ত্যাগ করে। যে গুড় খায় না, তার কাছে গুড় থাকাও ভাল নয়। কাছে গুড় থেকে যদি সে বলে খেয়ো না, তা লোকে শুনবে না।
“সংসারী লোকের টাকার দরকার আছে, কেননা মাগছেলে আছে। তাদের সঞ্চয় করা দরকার, মাগছেলেদের খাওয়াতে হবে। সঞ্চয় করবে না কেবল পঞ্ছী আউর দরবেশ, অর্থাৎ পাখি আর সন্ন্যাসী। কিন্তু পাখির ছানা হলে সে মুখে করে খাবার আনে। তারও তখন সঞ্চয় করতে হয়। তাই সংসারী লোকের টাকার দরকার। পরিবার ভরণপোষণ করতে হয়।
“সংসারী লোক শুদ্ধভক্ত হলে অনাসক্ত হয়ে কর্মকরে। কর্মের ফল — লাভ, লোকশান, সুখ, দুঃখ ঈশ্বরকে সমর্পণ করে। আর তাঁর কাছে রাতদিন ভক্তে প্রার্থনা করে, আর কিছু চায় না। এরই নাম নিষ্কাম কর্ম — অনাসক্ত হয়ে কর্ম করা। সন্ন্যাসীরও সব কর্ম নিষ্কাম করতে হয়। তবে সন্ন্যাসী সংসারীদের মতো বিষয়কর্ম করে না।
“সংসারী ব্যক্তি নিষ্কামভাবে যদি কাউকে দান করে সে নিজের উপকারের জন্য, ‘পরোপকারের’ জন্য নয়। সর্বভূতে হরি আছেন তাঁরই সেবা করা হয়। হরিসেবা হলে নিজেরই উপকার হলো, ‘পরোপকার’ নয়। এই সর্বভূতে হরির সেবা — শুধু মানুষের নয়, জীবজন্তুর মধ্যেও হরির সেবা, যদি কেউ করে, আর যদি সে মান চায় না, যশ চায় না, মরবার পর স্বর্গ চায় না, যাদের সেবা করছে, তাদের কাছ থেকে উলটে কোন উপকার চায় না, এরূপ ভাবে যদি সেবা করে, তাহলে তার যথার্থ নিষ্কাম কর্ম, অনাসক্ত কর্ম করা হয়। এইরূপ নিষ্কাম কর্ম করলে তার নিজের কল্যাণ হয়, এরই নাম কর্মযোগ। এই কর্মযোগও ঈশ্বরলাভের একটি পথ। কিন্তু বড় কঠিন, কলিযুগের পক্ষে নয়।
তাই বলছি, যে অনাসক্ত হয়ে এরূপ কর্ম করে, দয়া দান করে, সে নিজেরই মঙ্গল করে। পরের উপকার পরের মঙ্গল সে ঈশ্বর করেন — যিনি চন্দ্র, সূর্য, বাপ মা, ফল, ফুল, শস্য জীবের জন্য করেছেন! বাপ-মার ভিতর যা স্নেহ দেখ, সে তাঁরই স্নেহ, জীবের রক্ষার জন্যই দিয়েছেন। দয়ালুর ভিতর যা দয়া দেখ, সে তাঁরই দয়া, নিঃসহায় জীবের রক্ষার জন্য দিয়েছেন। তুমি দয়া কর আর না কর, তিনি কোন না কোন সূত্রে তাঁর কাজ করবেন। তাঁর কাজ আটকে থাকে না।
“তাই জীবের কর্তব্য কি? আর কি, তাঁর শরণাগত হওয়া, আর তাঁকে যাতে লাভ হয়, দর্শন হয়, সেইজন্য ব্যাকুল হয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা।”
[ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু ]
“শম্ভু বলেছিল, আমার ইচ্ছা যে খুব কতকগুলো ডিস্পেনসারি, হাসপাতাল করে দিই, তাহলে গরিবদের অনেক উপকার হয়। আমি বললুম, হাঁ, অনাসক্ত হয়ে যদি এ-সব কর, তো মন্দ নয়। তবে ইশ্বরের উপর আন্তরিক ভক্তি না থাকলে অনাসক্ত হওয়া বড় কঠিন। আবার অনেক কাজ জড়ালে কোনদিক থেকে আসক্তি এসে পড়ে, জানতে দেয় না। মনে করছি নিষ্কামভাবে করছি, কিন্তু হয়তো যশের ইচ্ছা হয় গেছে, নাম বার করবার ইচ্ছা হয়ে গেছে। আবার বেশি কর্ম করতে গেলে, কর্মের ভিড়ে ঈশ্বরকে ভুলে যায়। আরও বললুম, শম্ভু! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। যদি ঈশ্বর তোমার সম্মুখে এসে সাক্ষাৎকার হন, তাহলে তুমি তাঁকে চাইবে, না কতকগুলি ডিস্পেনসারি বা হাসপাতাল চাইবে? তাঁকে পেলে আর কিছু ভাল লাগে না। মিছরির পানা পেলে আর চিটেগুড়ের পানা ভাল লাগে না।
“যারা হাসপাতাল, ডিস্পেনসারি করবে, আর এতেই আনন্দ করবে তারাও ভাল লোক, কিন্তু থাক্‌ আলাদা। যে শুদ্ধভক্ত, সে ঈশ্বর বই আর কিছু চায় না; বেশি কর্মের ভিতর যদি সে পড়ে, সে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করে, হে ঈশ্বর, কৃপা করে আমার কর্ম কমিয়ে দাও; তা না হলে যে মন তোমাতেই নিশিদিন লেগে থাকবে, সেই মন বাজে খরচ হয়ে যাচ্ছে; সেই মনেতে বিষয়চিন্তা করা হচ্ছে। শুদ্ধভক্তির থাক্‌ একটি আলাদা থাক্‌। ঈশ্বর বস্তু আর সব অবস্তু, এ বোধ না হলে শুদ্ধভক্তি হয় না। এ-সংসার অনিত্য, দুদিনের জন্য, আর এ-সংসারের যিনি কর্তা, তিনিই সত্য, নিত্য; এ-বোধ না হলে শুদ্ধভক্তি হয় না।
“জনকাদি প্রত্যাদিষ্ট হয়ে কর্ম করেছেন।”
————————-
১ পঞ্চবটী — রাসমণির কালীবাটীতে পঞ্চবটীতলায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক সাধনা তপস্যা করিয়াছিলেন। অতি নির্জন স্থান। সহজেই ঈশ্বর উদ্দীপন হয়।
============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আগে বিদ্যা (Science) না আগে ঈশ্বর
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে, বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়, জীবের বিষয় জানতে হয়, আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এ-সব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। তুমি কি বল? আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?
বঙ্কিম — হাঁ, আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশুনা করে জানতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই তোমাদের এক। আগে ঈশ্বর, তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে, দরকার হয়তো সবই জানতে পারবে।
“যদি যদু মল্লিকের সঙ্গে আলাপ করতে পারো জো-সো করে, তাহলে যদি তোমার ইচ্ছা থাকে, যদু মল্লিকের কখানা বাড়ি, কত কোম্পানির কাগজ, কখানা বাগান, এও জানতে পারবে। যদু মল্লিকই বলে দেবে। কিন্তু তার সঙ্গে যদি আলাপ না হয়, বাড়ি ঢুকতে গেলে দারোয়ানেরা যদি না ঢুকতে দেয়, তাহলে কখানা বাড়ি, কত কোম্পানির কাগজ, কখানা বাগান, এ-সব ঠিক খবর কেমন করে যানবে? তাঁকে জানলে সব জানা যায়,[1] কিন্তু সামান্য বিষয় জানবার আকাঙ্ক্ষা থাকে না। বেদেও এ-কথা আছে। যতক্ষণ না লোকটিকে দেখা যায়, ততক্ষণ তার গুণের কথা কওয়া যায়; সে যেই সামনে আসে, তখন ও-সব কথা বন্ধ হয়ে খায়। লোকে তাকে নিয়েই মত্ত হয়, তার সঙ্গে আলাপ করে বিভোর হয়, তখন আর অন্য কথা থাকে না।
“আগে ঈশ্বরলাভ[2], তারপর সৃষ্টি বা অন্য কথা। বাল্মীকিকে রামমন্ত্র জপ করতে দেওয়া হল, কিন্তু তাকে বলা হল, ‘মরা’ ‘মরা’ জপ করো। ‘ম’ মানে ঈশ্বর আর ‘রা’ মানে জগৎ। আগে ঈশ্বর তারপর জগৎ, এককে জানলে সব জানা যায়। ১-এর পর যদি পঞ্চাশটা শূন্য থাকে অনেক হয়ে যায়। ১কে পুছে ফেললে কিছুই থাকে না। ১কে নিয়েই অনেক। এক আগে, তারপর অনেক; আগে ঈশ্বর[3] তারপর জীবজগৎ।
“তোমার দরকার ঈশ্বরকে লাভ করা! তুমি অত জগৎ, সৃষ্টি, সায়েন্স, ফায়েন্স এ-সব করছো কেন? তোমার আম খাবার দরকার। বাগানে কত শ আমগাছ, কত হাজার ডাল, কত লক্ষ কোটি পাতা, এ-সব খবরে তোমার কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিস আম খেয়ে যা। এ-সংসারে মানুষ এসেছে ভগবানলাভের জন্য। সেটি ভুলে নানা বিষয়ে মন দেওয়া ভাল নয়। আম খেতে এসেছিস আম খেয়েই যা।”
বঙ্কিম — আম পাই কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর। আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। হয়তো এমন কোনও সৎসঙ্গ জুটিয়ে দিলেন, যাতে সুবিধা হয়ে গেল। কেউ হয়তো বলে দেয়, এমনি এমনি কর তাহলে ঈশ্বরকে পাবে।
বঙ্কিম — কে? গুরু! তিনি আপনি ভাল আম খেয়ে, আমায় খারাপ আম দেন! (হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন গো! যার যা পেটে সয়। সকলে কি পলুয়া-কালিয়া খেলে হজম করতে পারে? বাড়িতে মাছ এলে মা সব ছেলেকে পমুয়া-কালিয়া দেন না। যে দুর্বল, যার পেটের অসুখ, তাকে মাছের ঝোল দেন; তা বলে কি মা সে ছেলেকে কম ভালবাসেন?
[ঈশ্বরলাভের উপায়, — ব্যাকুলতা, বালকের বিশ্বাস ]
“গুরুবাক্যে বিশ্বাস করতে হয়। গুরুই সচ্চিদানন্দ, সচ্চিদানন্দই গুরু, তাঁর কথা বিশ্বাস করলে, — বালকের মতো বিশ্বাস করলে — ঈশ্বরলাভ হয়। বালকের কি বিশ্বাস! মা বলেছে, ‘ও তোর দাদা হয়’, অমনি জেনেছে, ‘ও আমার দাদা।’ একেবারে পাঁচ সিকা পাঁচ আনা বিশ্বাস! তা সে ছেলে হয়তো বামুনের ছেলে, আর দাদা হয়তো ছুতোর কামারের ছেলে। মা বলেছে, ও ঘরে জুজু। তো পাকা জেনে আছে, ও ঘরে জুজু। এই বালকের বিশ্বাস; গুরুবাক্যে এমন বিশ্বাস ছাই। স্যায়না বুদ্ধি, পাটোয়ারী বুদ্ধি, বিচার বুদ্ধি করলে, ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। বিশ্বাস আর সরল হওয়া, কপট হলে চলবে না। সরলের কাছে তিনি খুব সহজ। কপট থেকে তিনি অনেক দূর।
“কিন্তু বালক যেমন মাকে না দেখলে দিশেহারা হয়, সন্দেশ মিঠাই হাতে দিয়ে ভোলাতে যাও কিছুই চায় না, কিছুতেই ভোলে না, আর বলে, ‘না, আমি মার কাছে যাব’, সেইরকম ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা চাই। আহা! কি অবস্থা! বালক যেমন মা মা করে পাগল হয়। কিছুতেই ভোলে না! যার সংসারে এ-সব সুখভোগ আলুনী লাগে, যার আর কিছু ভাল লাগে না — টাকা, মান, দেহের সুখ, ইন্দ্রিয়ের সুখ, যার কিছুই ভাল লাগে না, সেই আন্তরিক মা মা করে কাতর হয়। তারই জন্যে মার আবার সব কাজ ফেলে দৌড়ে আসতে হয়।
“এই ব্যাকুলতা। যে পথেই যাও, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, ব্রহ্মজ্ঞানী — যে পথেই যাও, ওই ব্যাকুলতা নিয়েই কথা। তিনি তো অন্তর্যামী, ভুলপথে গিয়ে পড়লেও দোষ নাই — যদি ব্যাকুলতা থাকে। তিনি আবার ভালপথে তুলে লন।
“আর সব পথেই ভুল আছে, — সব্বাই মনে করে আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে, কিন্তু কারও ঘড়ি ঠিক যায় না। তা বলে কারু কাজ আটকায় না। ব্যাকুলতা থাকলে সাধুসঙ্গ জুটে যায়, সাধুসঙ্গে নিজের ঘড়ি অনেকটা ঠিক করে লওয়া যায়।”
—————————
১ তস্মিন্‌ বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিঞ্চাতং ভবতি।
২ মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য (End of Life) ঈশ্বরলাভ।
৩ আগে ঈশ্বর Seek ye first the kingdom of Heaven and all other things shall be added unto you — Jesus.
===========

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তনানন্দে
ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য গান করিতেছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তন একটু শুনিতে শুনিতে হঠাৎ দণ্ডায়মান ও ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশূন্য হইলেন। একেবারে অন্তর্মুখ, সমাধিস্থ। দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ। সকলেই বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন। বঙ্কিম ব্যস্ত হইয়া ভিড় ঠেলিয়া ঠাকুরের কাছে গিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন। তিনি সমাধি কখনও দেখেন নাই।
কিয়ৎক্ষণ পরে একটু বাহ্য হইবার পর ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন, যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে ভক্ত সঙ্গে নাচিতেছেন। সে অদ্ভুত নৃত্য! বঙ্কিমাদি ইংরেজী পড়া লোকেরা দেখিয়া অবাক্‌। কি আশ্চর্য! এরই নাম কি প্রেমানন্দ? ঈশ্বরকে ভালবেসে মানুষ কি এত মাতোয়ারা হয়? এইরূপ কাণ্ডই কি নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গ করেছিলেন? এইরকম করেই কি তিনি নবদ্বীপে আর শ্রীক্ষেত্রে প্রেমের হাট বসিয়াছিলেন? এর ভিতর তো ঢঙ হতে পারে না। ইনি সর্বত্যাগী, এঁর টাকা, মান, নাম বেরুনো কিছুই দরকার নাই। তবে এই কি জীবনের উদ্দেশ্য? কোন দিকে মন না দিয়ে ঈশ্বরকে ভালবাসাই কি জীবনের উদ্দেশ্য? এখন উপায় কি? ইনি বললেন, মার জন্য দিশেহারা হয়ে ব্যাকুল হওয়া, ব্যাকুলতা, ভালবাসাই উপায়, ভালবাসাই উদ্দেশ্য। ঠিক ভালবাসা এলেই দর্শন হয়।
ভক্তরা এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন ও সেই অদ্ভুত দেবদুর্লভ নৃত্য ও কীর্তনানন্দ দেখিতে লাগিলেন। সকলেই দণ্ডায়মান — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চারিদিকে — আর একদৃষ্টে তাঁকে দেখিতেছেন।
কীর্তনান্তে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। “ভাগবত-ভক্ত-ভগবান” এই কথা উচ্চারণ করিয়া বলিতেছেন, জ্ঞানী-যোগী-ভক্ত সকলের চরণে প্রণাম।
আবার সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।
===========

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও ভক্তিযোগ — ঈশ্বরপ্রেম
বঙ্কিম (ঠাকুরের প্রতি) — মহাশয়, ভক্তি কেমন করে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুলতা। ছেলে যেমন মার জন্য মাকে না দেখতে পেয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদে, সেই রকম ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাঁদলে ঈশ্বরকে লাভ করা পর্যন্ত যায়।
“অরুণোদয় হলে পূর্বদিক লাল হয়, তখন বোঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের আর দেরি নাই। সেইরূপ যদি কারও ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে দেখা যায়, তখন বেশ বুঝতে পারা যায় যে, এ ব্যক্তির ঈশ্বরলাভের আর বেশি দেরি নাই।
“একজন গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মহাশয়, বলে দিন ঈশ্বরকে কেমন করে পাব। গুরু বললে, এসো আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। এই বলে তাকে সঙ্গে করে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে গেল। দুই জনেই জলে নামল, এমন সময় হঠাৎ গুরু শিষ্যকে ধরে জলে চুবিয়ে ধরলে। খানিক পরে ছেড়ে দিবার পর শিষ্য মাথা তুলে দাঁড়াল। গুরু জিজ্ঞাসা করলে, তোমার কি রকম বোধ হচ্ছিল? শিষ্য বললে, প্রাণ যায় যায় বোধ হচ্ছিল, প্রাণ আটু-পাটু করছিল। তখন গুরু বললে, ঈশ্বরের জন্য যখন প্রাণ ওইরূপ আটু-পাটু করবে, তখন জানবে যে, তাঁর সাক্ষাৎকারের দেরি নাই।
“তোমায় বলি, উপরে ভাসলে কি হবে? একটু ডুব দাও। গভীর জলের নিচে রত্ন রয়েছে, জলের উপর হাত-পা ছুঁড়লে কি হবে? ঠিক মাণিক ভারী হয়, জলে ভাসে না; তলিয়ে গিয়ে জলের নিচে থাকে। ঠিক মাণিক লাভ করতে গেলে জলের ভিতর ডুব দিতে হয়।”
ঙ্কিম — মহাশয়, কি করি, পেছনে শোলা বাঁধা আছে। (সকলের হাস্য) ডুবতে দেয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে স্মরণ করলে সব পাপ পেটে যায়। তাঁর নামেতে কালপাথ কাটে। ডুব দিতে হবে, তা না হলে রত্ন পাওয়া যাবে না। একটা গান শোন:
ডুব্‌ ডুব্‌ ডুব্‌ রূপ-সাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবে রে প্রেমরত্নধন ৷৷
খুঁজ খুঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন।
দীপ্‌ দীপ্‌ দীপ্‌ জ্ঞানের বাতি জ্বলবে হৃদে অনুক্ষণ ৷৷
ড্যাং ড্যাং ড্যাং ড্যাঙ্গায় ডিঙে চালায় আবার সে কোন্‌ জন।
কুবীর বলে শোন্‌ শোন্‌ শোন্‌ ভাব গুরুর শ্রীচরণ ৷৷
ঠাকুর তাঁহার সেই দেবদুর্লভ মধুর কণ্ঠে এই গানটি গাইলেন। সভাসুদ্ধ লোক আকৃষ্ট হইয়া একমনে এই গান শুনিতে লাগিলেন। গান সমাপ্ত হইলে আবার কথা আরম্ভ হইল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কেউ কেউ ডুব দিতে চায় না। তারা বলে, ঈশ্বর ঈশ্বর করে বাড়াবাড়ি করে শেষকালে কি পাগল হয়ে যাব? যারা ঈশ্বরের প্রেমে মত্ত, তাদের তারা বলে, বেহেড হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই সব লোক এটি বোঝে না যে সচ্চিদানন্দ অমৃতের সাগর।
আমি নরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মনে কর যে, এক খুলি রস আছে, আর তুই মাছি হয়েছিস; তুই কোন্‌খানে বসে রস খাবি? নরেন্দ্র বললে, আড়ায় (কিনারায়) বসে মুখ বাড়িয়ে খাব। আমি বললুম, কেন? মাঝখানে গিয়ে ডুবে খেলে কি দোষ? নরেন্দ্র বললে, তাহলে যে রসে জড়িয়া মরে যাব। তখন আমি বললুম, বাবা সচ্চিদানন্দ-রস তা নয়, এ-রস অমৃত রস, এতে ডুবলে মানুষ মরে না; অমর হয়।
“তাই বলছি ডুব দাও। কিছু ভয় নেই, ডুবলে অমর হয়।”
এইবার বঙ্কিম ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন — বিদায় গ্রহণ করিবেন।
বঙ্কিম — মহাশয়, যত আহাম্মক আমাকে ঠাওরেছেন তত নয়। একটি প্রার্থনা আছে — অনুগ্রহ করে কুটিরে একবার পায়ের ধুলা —
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বেশ তো, ঈশ্বরের ইচ্ছা।
বঙ্কিম — সেখানেও দেখবেন, ভক্ত আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কি গো! কি রকম সব ভক্ত সেখানে? যারা গোপাল গোপাল, কেশব কেশব বলেছিল, তাদের মতো কি? (সকলের হাস্য)
একজন ভক্ত — মহাশয়, গোপাল, গোপাল, ও গল্পটি কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — তবে গল্পটি বলি শোন। এক জায়গায় একটি স্যাকরার দোকান আছে। তারা পরম বৈষ্ণব, গলায় মালা, তিলক সেবা, প্রায় হাতে হরিনামের ঝুলি আর মুখে সর্বদাই হরিনাম। সাধু বললেই হয়, তবে পেটের জন্য স্যাকরার কর্ম করা; মাগছেলেদের তো খাওয়াতে হবে। পরম বৈষ্ণব, এই কথা শুনে অনেক খরিদ্দার তাদেরই দোকানে আসে; কেননা, তারা জানে যে, এদের দোকানে সোনা-রূপা গোলমাল হবে না। খরিদ্দার দোকানে গিয়ে দেখে যে, মুখে হরিনাম, করছে, আর বসে বসে কাজকর্ম করছে। খরিদ্দার যাই গিয়ে বসল, একজন বলে উঠল, ‘কেশব! কেশব! কেশব!’ খানিকক্ষণ পরে আর-একজন বলে উঠল, ‘গোপাল! গোপাল! গোপাল!’ আবার একটু কতাবার্তা হতে না হতেই আর-একজন বলে উঠল — ‘হরি! হরি! হরি!’ গয়না গড়বার কথা যখন একরকম ফুরিয়ে এল, তখন আর-একজন বলে উঠলো — ‘হর! হর! হর! হর!’ কাজে কাজেই এত ভক্তি প্রেম দেখে তারা স্যাকরাদের কাছে টাকাকড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত হল; জানে যে এরা কখনও ঠকাবে না।
“কিন্তু কথা কি জানো? খরিদ্দার আসবার পর যে বলেছিল ‘কেশব! কেশব!’ তার মানে এই, এরা সব কে? অর্থাৎ যে খরিদ্দারেরা আসলো এরা সব কে? যে বললে, ‘গোপাল! গোপাল!’ তার মানে এই, এরা দেখছি গোরুর পাল, গোরুর পাল। যে বললে, ‘হরি! হরি!’ তার মানে এই, যেকালে দেখছি গোরুর পাল, সে স্থলে তবে ‘হরি’ অর্থাৎ হরণ করি। আর যে বললে, ‘হর! হর!’ তার মানে এই যেকালে গোরুর পাল দেখছো, সেকালে সর্বস্ব হরণ কর।’ এই তারা পরমভক্ত সাধু।” (সকলের হাস্য)
বঙ্কিম বিদার গ্রহণ করিলেন। কিন্তু একাগ্র হয়ে কি ভাবিতেছিলেন। ঘরের দরজার কাছে আসিয়া দেখেন, চাদর ফেলিয়া আসিয়াছেন। গায়ে শুধু জামা। একটি বাবু চাদরখানি কুড়াইয়া লইয়া ছুটিয়া আসিয়া চাদর তাঁহার হস্তে দিলেন। বঙ্কিম কি ভাবিতেছিলেন?
রাখাল আসিয়াছেন। তিনি বৃন্দাবনধামে বলরামের সঙ্গে গিয়াছিলেন। সেখান হইতে কিছুদিন ফিরিয়াছিলেন। ঠাকুর তাঁহার কথা শরৎ ও দেবেন্দ্রের কছে বলিয়াছিলেন ও তাঁহার সহিত আলপা করিতে তাঁহাদের বলিয়াছিলেন। তাই তাঁহারা রাখালের সঙ্গে আলাপ পরিতে উৎসুক হইয়া আসিয়াছিলেন। শুনিলেন, এঁরই নাম রাখাল।
শরৎ ও সান্যাল এঁরা ব্রাহ্মণ, অধর সুবর্ণবণিক। পাছে গৃহস্বামী খাইতে ডাকেন, তাই তাড়াতাড়ি পলাইয়া গেলেন। তাঁহারা নূতন আসিতেছেন; এখনও জানেন না, ঠাকুর অধরকে কত ভালবাসেন। ঠাকুর বলেন, “ভক্ত একটি পৃথক জাতি। সকলেই এক জাতীয়।”
অধর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ও সমবেত ভক্তদের অতি যত্নপূর্বক আহ্বান করিয়া পরিতোষ করিয়া খাওয়াইলেন। ভোজনানন্তে ভক্তগণ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মধুর কথাগুলি স্মরণ করিতে করিতে তাঁহার অদ্ভুত প্রেমের ছবি হৃদয়ে গ্রহণপূর্বক গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
অধরের বাটীতে শুভাগমনের দিনে শ্রীযুক্ত বঙ্কিম শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁহার বাটীতে যাইবার জন্য অনুরোধ করাতে তিনি কিছুদিন পরে শ্রীযুক্ত গিরিশ ও মাস্টারকে তাঁহার সান্‌কীভাঙার বাসায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাদের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনেক কথা হয়। ঠাকুরকে আবার দর্শন করিতে আসিবার ইচ্ছা বঙ্কিম প্রকাশ করেন, কিন্তু কার্যগতিকে আর আসা হয় নাই।
[দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীমূলে ‘দেবী চৌধুরানী’ পাঠ ]
৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত অধরের বাটীতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শুভাগমন করিয়াছিলেন ও শ্রীযুক্ত বঙ্কিমবাবুর সহিত আলাপ করিয়াছিলেন। প্রথম হইতে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে এই সব কথা বিবৃত হইল।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে অর্থাৎ ২৭শে ডিসেম্বর, শনিবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীমূলে দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে বঙ্কিম প্রণীত দেবী চৌধুরাণীর কতক অংশ পাঠ শুনিয়াছিলেন ও গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মের বিষয় অনেক কথা বলিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীমূলে চাতালের উপর অনেক ভক্তসঙ্গে বসিয়াছিলেন। মাস্টারকে পাঠ করিয়া শুনাইতে বলিলেন। কেদার, রাম, নিত্যগোপাল, তারক (শিবানন্দ), প্রসন্ন (ত্রিগুণাতীত), সুরেন্দ্র প্রভৃতি অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
===============

Post a Comment

0 Comments