অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ ~ শংকর
==========
অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ – শংকর
সার্ধশতবর্ষ উৎসবের প্রস্তুতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিস্ময়কর বিবেকানন্দ-জীবনের নানা অজানা তথ্য সংগ্রহের বিপুল প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। তাঁর পারিবারিক-জীবন, পরিব্রাজক-জীবন, সন্ন্যাস-জীবন ও সঙ্ঘ-জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আজও সীমাহীন। সেই সঙ্গে নবযুগের নবাগতদের মনেও নানা প্রশ্ন।পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত কেন অন্য নামে ভিটেবাড়ির শরিকদের নিয়ে উপন্যাস লিখলেন? গর্ভধারিণী জননীকে সাহায্য করার জন্য যে-টাকা মঠের তহবিল থেকে স্বামীজি নিয়েছিলেন তার ওপর সত্যিই কি সুদ দিতে হত তাকে?
দেশে-বিদেশে ভক্তের বেশে এসে বেশ কয়েকজন পুরুষ ও নারী কীভাবে বিবেকানন্দকে বিড়ম্বিত করেছিলেন? সমকালের বাঙালিরা কেন তাকে অর্থসাহায্য করেননি? আবার কারা গুরুনির্দেশে অসাধ্যসাধন করার জন্য তিলে তিলে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছিলেন? কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার কি সত্যিই সহায়-সম্বলহীন রোগজর্জরিত সন্ন্যাসীর কাছ থেকে চেম্বারে চল্লিশ টাকা নিলেন?
হিসেবের কড়ি সম্পর্কে স্বামীজির সুচিন্তিত মতামতই কি শেষপর্যন্ত বিবেকানন্দনমিকসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করল? তবু কেউ কেউ তাকে কেন জোচ্চোর অপবাদ দিল? ব্র্যান্ড রামকৃষ্ণ কি ব্র্যান্ড বিবেকানন্দ থেকে সত্যিই আলাদা? দীর্ঘদিন ধরে এমন সব সংখ্যাহীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সন্ধানী লেখক শংকর।
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে শংকর-এর প্রথম পরিচয় নিতান্ত বাল্যবয়সে ১৯৪২ সালে, যার চল্লিশ বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের মহাসমাধি বেলুড়ে। তারই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অতি অল্পবয়সে শংকর-এর বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানের শুরু। তারপরেই তো একের পর এক বিস্ময়।
‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দের’ পরে ‘অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ’ বাংলা জীবনীসাহিত্যে আর এক অবিশ্বাস্য সংযোজন।
.
চতুর্দশ সংস্করণ – নভেম্বর ২০১৮
.
উৎসর্গ – শ্ৰীমতী বন্দনা মুখোপাধ্যায়
বন্দনা,
যাওয়া তো নয় যাওয়া।
তাই তোমাকেই আবার।
শংকর
২৯ নভেম্বর ২০১০
.==============
লেখকের নিবেদন
‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ প্রকাশিত হয়েছিল নভেম্বর ২০০৩ সালে, কিন্তু তার পিছনে ছিল সাত বছরের প্রস্তুতি-নানা সূত্র থেকে খুঁটে-খুঁটে ছোট ছোট তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে সময় লেগে যায়। এবারেও অনেক সময় লেগে গেল। যে-বিবেকানন্দ বিস্ময়কর, যার বহু কীর্তিই অবিশ্বাস্য এবং সমকাল যাঁকে জয়মাল্য দেবার আগে কারণে অকারণে বার বার নানা অগ্নিপরীক্ষায় আহ্বান করেছিল তাকে খুঁজে বার করতে, জানতে এবং বুঝতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হল।এই কঠিন কাজে আমাকে অবশ্য কখনও নিঃসঙ্গ বোধ করতে হয়নি, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা আমাকে বারবার উৎসাহ জুগিয়েছেন, কেউ কেউ সস্নেহে লুপ্ত পথের সন্ধানও দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হবার আগেই বিভ্রান্ত লেখককে যথাসম্ভব সচেতন করে দিয়েছেন।
আরও একটি কথা, স্বদেশে এবং বিদেশে বহুজনের হাতে বিড়ম্বিত বিবেকানন্দের কাছাকাছি এবং পাশাপাশি এমন কিছু অবিশ্বাস্য ভক্তকে এবার খুঁজে পাওয়া গেল যাঁদের নিঃশব্দ আত্মনিবেদনের কথা বিশ্বজনের কাছে প্রায় অজ্ঞাত। এঁদের কথা বলতে গিয়ে মূল ঘটনাপ্রবাহ যদি কোথাও-কোথাও একটু বিলম্বিত হয়ে থাকে তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তবে অনুসন্ধানকালে মনে হয়েছিল যে এইসব আশ্চর্য মানুষকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করার অলৌকিক শক্তি না-থাকলে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কিছুতেই অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দে রূপান্তরিত হতে পারতেন না।
শংকর
৭ ডিসেম্বর ২০১০
.=========
প্রচ্ছদ চিত্র
১৮৮৬-১৯০১ এই পনেরো বছরে দেশে-বিদেশে স্বামীজির যত ছবি ভোলা হয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ১০৬টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ছবিগুলি সম্বন্ধে বিস্তারিত তদন্ত করেছেন বেদান্ত সোসাইটি অফ নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া।প্রচ্ছদের ছবিটি কবে কোথায় তোলা হয় সে নিয়ে মতভেদ আছে। প্রথমে ধারণা ছিল ছবির তারিখ ১৮৯৭, কিন্তু পরবর্তীকালে অনুসন্ধানীদের সিদ্ধান্ত ছবিটি কলকাতায় তোলা হয় স্বামীজির দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার দিনে, অর্থাৎ ২০ জুন ১৮৯৯। ওইদিন রামকৃষ্ণজায়া সারদামণি তার সন্ন্যাসীসন্তানদের মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়ন করেন বশীশ্বর সেনের বাগবাজার ৮ বোসপাড়া লেনের ভাড়াটে বাড়িতে। পরবর্তীকালে বশীশ্বর জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হয়েছিলেন।
স্মরণীয় এক গ্রুপ ফটো থেকে স্বামীজিকে সাবধানে বার করে আনা হয়েছে। মুখের কোথাও অসুস্থতার চিহ্ন নেই। মূল গ্রুপ ফটোতে যে ছ’জন ছিলেন তাদের নাম : স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং বিবেকানন্দশিষ্য স্বামী সদানন্দ। শ্রীমা এই সময়ে বাগবাজার বোসপাড়া লেনেই থাকতেন।
সেবারের বিদেশযাত্রায় জাহাজে স্বামীজির সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা। সেবারেই জাহাজে স্বামীজি তাঁর অনন্য ভ্রমণকাহিনি ‘পরিব্রাজক’ রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই ছবির ফটোগ্রাফার কে অবশেষে তাও নির্ধারিত হয়েছে-ইনি। স্বামীজির শিষ্য, একদা বেলগাঁওয়ের ফরেস্ট অফিসার শ্রীহরিপদ মিত্র। এঁর স্ত্রী ইন্দুমতী মিত্র স্বামীজির প্রথম দীক্ষিতা মন্ত্রশিষ্যা।
স্বামী ত্রিগুণাতীতার বিদেশিনী শিষ্যা শ্রীমতী কারা ফ্রেঞ্চ তাঁর সংগ্রহের ছবিটির পিছনে লিখে রেখেছেন : “ফটো টেন বাই এইচ মিত্র, বিবেক কুটীর, ভাইতা পোস্ট (বার্ডওয়ান), বেঙ্গল।”
স্মরণীয় গ্রুপ ফটোটি বেলুড়মঠে স্বামীজির ঘরে পশ্চিমমুখো দেওয়ালে টাঙানো আছে।
.============
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অদ্বৈত আশ্রমস্বামী রমানন্দ
স্বামী প্রভানন্দ
স্বামী বামনানন্দ
স্বামী চেতনানন্দ
স্বামী বোধসারানন্দ
শ্বামী বিশোকানন্দ
স্বামী বিভাত্মানন্দ
স্বামী আত্মজ্ঞেয়ানন্দ
প্রয়াত সুনীলবিহারী ঘোষ
শ্রীদিলীপকুমার দে
শ্রীজয়ন্ত ঘোষাল
শ্রীঅভীক দত্ত
শ্রীপ্রণব গোস্বামী
শ্ৰীমতী গোপা বসুমল্লিক
শ্রীপবন লোহিয়া
শ্ৰীমতী পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়
শ্ৰীনির্মল সাহা
শ্রীপ্রদীপকুমার সাহা
শ্রীসুধাংশুশেখর দে
শ্রীশুভঙ্কর দে
শ্রীশিবশঙ্কর ঘোষ
শীরবিশঙ্কর বল
শ্রীপ্রশান্ত নন্দী
শ্রীবিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়
শ্ৰীমতী রিনি সেন
ডাঃ সুব্রত সেন
ডাঃ সত্যজিৎ মুখার্জি
শ্রীবঙ্কিম কোনার
শ্রীসোমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
এবং অবশ্যই শ্রীঅরুণকুমার দে
.===========
তথ্যসূত্র (১)
সুলোচনা–বিশ্বনাথ দত্তবাণী ও রচনা ১-১০ খণ্ড–স্বামী বিবেকানন্দ
রামকৃষ্ণদেবের জীবনবৃত্তান্ত–রামচন্দ্র দত্ত
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত–শ্ৰীম-কথিত
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (৫ ভাগ)–স্বামী সারদানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ ১-২ খণ্ড–প্রমথনাথ বসু
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি–অক্ষয়কুমার সেন
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত–বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল
স্বামী-শিষ্য-সংবাদ (২ কাণ্ড)–শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী
আমার জীবনকথা–স্বামী অভেদানন্দ
স্মৃতিকথা–স্বামী অখণ্ডন
স্বামী অখনন্দকে যেমন দেখিয়াছি–সংকলক স্বামী চেতনানন্দ
যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ ১-৩ খণ্ড–স্বামী গম্ভীরানন্দ
লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ ১-৩ খণ্ড–মহেন্দ্রনাথ দত্ত
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান–মহেন্দ্রনাথ দত্ত
শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলী ১-৩ খণ্ড–মহেন্দ্রনাথ দত্ত
কাশীধামে স্বামী বিবেকানন্দ–মহেন্দ্রনাথ দত্ত
স্বামী নিশ্চয়ানন্দের অনুধ্যান–মহেন্দ্রনাথ দত্ত
স্বামী শুদ্ধানন্দ : জীবনী ও রচনা স্বামীজির পদপ্রান্তে–স্বামী অজজানন্দ
চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ–স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত
স্মৃতির আলোয় স্বামী বিবেকানন্দ–স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সম্পাদিত
বিবেকানন্দের জীবন–রোমাঁ রোলাঁ
শ্ৰীম-দর্শন ১-১৬ খণ্ড–স্বামী নিত্যাত্মানন্দ
সেবা–স্বামী নরোত্তমান
স্বামী বিবেকানন্দ–ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ জীবনালোকে–স্বামী নির্লেপানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ণের কথা–ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য
বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ ১-৭ খণ্ড–শঙ্করীপ্রসাদ বসু
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের এক বিস্মৃত অধ্যায়–ড. বেণীশঙ্কর শর্মা
বিবেকানন্দ চরিত–সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার
আদালতে বিপন্ন বিবেকানন্দ–চিত্রগুপ্ত
রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা–স্বামী প্রভানন্দ
আনন্দরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ–স্বামী প্রভানন্দ
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ অন্ত্যলীলা–স্বামী প্রভানন্দ
ইউরোপে স্বামী বিবেকানন্দ–স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ণলীলার শেষ অধ্যায়–নির্মলকুমার রায়
শ্রীরামকৃষ্ণ-পরিক্রমা–-কালীজীবন সেনশর্মা
সংসদ চরিতাভিধান
অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর–ডাক্তার তারকনাথ তরফদার–স্বাস্থ্য শারদীয়া সংখ্যা ১৪০৮
আমি বিবেকানন্দ বলছি–সংগ্রহ শংকর
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ–শংকর
.=======
তথ্যসূত্র (২)
The Complete Works of Swami Vivekananda Vol 1-9The Life of Swami Vivekananda By His Eastern & Western Disciples
The Master as I Saw Him–Sister Nivedita
The Complete Works of Sister Nivedita Vols I-V
Letters of Sister Nivedità Vol. 1-11-Edited by Shankari Prasad Basu
Swami Vivekananda in the West : New Discoveries Vol I-VI–Marie Louise Burke
A Comprehensive Biography of Swami Vivekananda Vol I-II–Sailendranath Dhar
Swami Vivekananda–Romain Rolland
Days in the Indian Monastery–Sister Devmata
Six Lighted Windows–Swami Yogesananda
Swami Vivekenanda : A Forgotten Chapter of His Life–Dr. Beni Shankar Sarma
Swami Vivekananda–Patriot and Prophet–Dr Bhupendranath Datta
A Concordance to Swami Vivekananda Vol I-III
God Lived with Them–Swami Chetanananda
You Will be a Paramahansa–Swami Sarbagatananda
Western Admirers of Ramakrishna and His Disciples–Dr Gopal Stavig
.
“ঈর্ষাই আমাদের দাসসুলভ জাতীয়চরিত্রের কলঙ্কস্বরূপ। ঈর্ষা থাকলে সর্বশক্তিমান ভগবানও কিছু করে উঠতে পারেন না।”
৩ মার্চ ১৮৯৪
শিকাগো থেকে ‘কিডি’-কে লেখা স্বামীজির চিঠি
“আমি লিখতেও পারি না, বক্তৃতা করতেও পারি না; কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি, আর তার ফলে যখন উদ্দীপ্ত হই, তখন আমি বক্তৃতায় অগ্নি বর্ষণ করতে পারি।”১৫ মার্চ ১৮৯৪
ডেট্রয়েট থেকে হেল ভগিনীদের কাছে লেখা
“হে মাধব, অনেকে তোমায় অনেক জিনিস দেয়–আমি গরীব–আমার আর কিছু নেই, কেবল শরীর, মন ও আত্মা। আছে–এগুলি সব তোমার পাদপদ্মে সমর্পণ করলাম-হে জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, দয়া করে এগুলি গ্রহণ করতেই হবে–নিতে অস্বীকার করলে চলবে না।”৩১ জুলাই ১৮৯৪
গ্রীন একার থেকে হেল ভগিনীদের কাছে লেখা
“আমার বন্ধুদের বলবে যারা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর–একদম চুপ থাকা। আমি তাদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাদের সঙ্গে একদরের হয়ে পড়লুম।”২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪
আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠি
“আমি বাঙলা দেশ জানি, ইন্ডিয়া জানি-লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায় শূন্য।”৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫
নিউ ইয়র্ক থেকে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে লেখা
“পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয় এই তো আমরা বাঙালি জাতি। …বেকুবদের কথা মোটেই ভেবো না; কথায় বলে বুড়ো বেকুবের মত আর বেকুব নেই। ওরা একটু চেঁচাক না।”২৩ ডিসেম্বর ১৮৯৬
ফ্লোরেন্স থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা
“হিসেবের অভাবে…আমি যেন জোচ্চোর না বনি।”১২ অক্টোবর ১৮৯৭
স্বামী ব্রহ্মানন্দকে চিঠি
“অল্প বয়স থেকেই আমি ডানপিটে ছিলুম, নইলে কি নিঃসম্বলে দুনিয়া ঘুরে আসতে পারতুম রে।”ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮
শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে নীলাম্বরবাবুর
বাগানবাড়িতে
“ভারতের অনেকে..ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে আহার করার জন্য আপত্তি জানিয়েছেন, ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে খাই বলে আমায় একটি পারিবারিক দেবালয় থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে।”১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯
“লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হলো–এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি। ‘অব শিব পার করো মেরা নেইয়া’-হে শিব, হে শিব, আমার তরী পাড়ে নিয়ে যাও প্রভু।’”১৮ এপ্রিল ১৯০০
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে
==============
জন্মভিটেতে শরিকি সংঘাতের বিষবৃক্ষ
উনিশ শতকের ছয়ের দশকে বিস্ময়কর বিবেকানন্দের জন্মের সময় কেমন ছিল উত্তর কলকাতার জীবনযাত্রা? এ বিষয়ে নরেন্দ্রনাথ নিজে তেমন কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু তাঁর মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত বেশ কিছু বিবরণ রেখে গিয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কয়েকটি ছোট ছোট ছবি মনে রাখলে উত্তর কলকাতার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটকে বুঝতে সুবিধে হতে পারে।এখনকার অক্সফোর্ড মিশন ছিল কলুবাড়ি, তার পর হাড়িপাড়া। মহেন্দ্র গোঁসাই গলিটা ছিল ডোমপাড়া, মধু রায় গলি গয়লাপাড়া।
সিমলা থেকে জগন্নাথ ঘাট পর্যন্ত খুব উঁচু বাড়ি না থাকায়, দত্তদের ভিটেবাড়ির ছাদে উঠে জাহাজের মাস্তুল দেখা যেত।
ঘোড়ার গাড়ির প্রথা বেশ কম ছিল, মেয়েরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ত না, বাবুরা গদি-বিছানায় শুয়ে পাল্কিতে অফিস-আদালতে যেতেন।
গৃহস্থবাড়িতে কাঠের জ্বালে রান্না হত। ১৮৭৬ সালে লোকের বাড়িতে প্রচারের জন্য বিনামূল্যে কয়লা বিতরণ হত। ক্রমে কয়লার দাম এক আনা মণ হল।
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামীজির ভিটেবাড়িতে ছিল তিনটে পাতকুয়ো–এই জল রান্নায় ব্যবহার হত। পাতকুয়োতে একটা কচ্ছপ ছিল। সেকালের কলকাতার অনেক বাড়িতেই কচ্ছপ জল পরিষ্কার রাখত। বাড়ির চাকররা হেদুয়া থেকে বাঁকে জল আনত। “আমরা মাধব পালের পুকুরে স্নান করতাম,” লিখেছে স্বামীজির মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ।
সেকালের কলকাতায় দারুণ শীত পড়ত। তাই শোওয়ার সময় এক মালসা আগুন ঘরে রাখা প্রয়োজন হত।
জামা পিরানের তেমন প্রচলন ছিল না, কমবয়সী ছেলেরা খালি গায়ে, খালি পায়ে থাকত। নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার সময়ে পরতে হত চিনে কোট। বয়োজ্যেষ্ঠরা পরতেন বেনিয়ান।
গরমকালে লালদিঘি থেকে স্বামীজির ছোটকাকা অ্যাডভোকেট তারকনাথ দত্ত ঘোড়ার কম্বলে মুড়ে আমেরিকান বরফ আনতেন। গোঁড়া হিন্দুরা এবং বিধবারা এই বরফ খেতেন না।
সিমলে পাড়ায় বড় মাতালের উৎপাত ছিল। সেই জন্য প্রবাদ ছিল ‘সিমলার মাতাল আর বাগবাজারের গেঁজেল।
কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত, জুতো চুরি করত। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে।
শহরে লোকে দিনে আড়াই পোয়া চালের ভাত খেত, রাতে আধসের এবং উপযুক্ত পরিমাণ দুধ। দুধ পাওয়া যেত টাকায় দশ সের থেকে যোলো সের।
নগর কলকাতার রাস্তায় দূরে দূরে শাল কাঠের থামেতে রেড়ির তেলের আলো জ্বলত রাত্রে তেল চুরি হত এবং বাতিওয়ালা গালাগালি করত। রাত্রে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলে গৃহস্থরা যে-যার লণ্ঠন নিয়ে যেতেন।
সেকালের গান : হরে মুরারে মধুকৈটভারে, হরি ভজে কি হবে, চপ কাটলেট, কোপ্তা খাও বাবা গবাগব, খাও বাবা গবাগব, হরি ভজে কি হবে?’
গৌরমোহন স্ট্রিটের দত্ত বাড়িতেও চেঁকি ছিল, পরে বন্ধ হয়ে যায়।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “আমাদের সময় আট নয় বৎসরের মেয়ের বিবাহ হইত।” বিয়ের আগে কাঁচা দেখার প্রথা ছিল। পরে শুভদিনে পাকা দেখা হত। কাঁচা দেখা’ কথাটা এখন অভিধান থেকে মুছে গিয়েছে।
শহরের বৃদ্ধেরা অনেকে মাথা মুড়িয়ে শিখা রাখতেন। টেরি কাটার প্রথা ছিল না।
সব হিন্দু বাড়িতেই তুলসী গাছ রাখতে হত।
চাকররা গোঁফ রাখতে পারত না। পাইকরা কিন্তু সেই সুবিধা পেত।
*********
৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ দত্তর জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ সোমবার সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে। শৈশব, বাল্য ও যৌবনলীলা এখানেই সাঙ্গ করে তেইশ বছর বয়সে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি প্রথমে বিবিদিষানন্দ, পরে কিছু সময় সচ্চিদানন্দ এবং অবশেষে স্বামী বিবেকানন্দ।নামকরা উকিলবাড়ির আদরের সন্তান, কিন্তু ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা নরেন্দ্রনাথের কৈশোর, বাল্য, যৌবনের কোনও ফটো কারও সংগ্রহে নেই। বিদেশিনী অনুরাগিণী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড ভারতভ্রমণে এসে কোথাও নাকি কলেজের ছাত্র, তারুণ্যেভরা নরেন্দ্রনাথের একখানা ছবি দেখেছিলেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় দত্তবাড়িতে হৃদয়হীন ইংরেজ পুলিশের এমন কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল যে সব ইতিহাস তছনছ হয়ে গিয়েছে। ফলে এখনকার চিত্রসংগ্রহে তার প্রথম ছবিটি ২৩ বছর বয়সের সাধক নরেন্দ্রনাথের, কলকাতায় কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তোলা ১৮৮৬ সালে। এই ছবিটি কেমনভাবে তোলা হল তার কোনও বিস্তৃত বিবরণ নেই।
পিতৃদেব বিশ্বনাথ ও মাতা ভূবনেশ্বরীর সংসার ছোট ছিল না। ভাই মহেন্দ্রনাথ ছিলেন নরেন্দ্রনাথের ছ’বছরের ছোট। তার কাছে দত্তবাড়ির নানা নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। তার তুলনাহীন বর্ণনা : “গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ি খুব প্রশস্ত ছিল। বাড়ির অভ্যন্তর দেড় বিঘা ছিল এবং আশেপাশে অনেক জমিতে রেওয়ত ছিল। বাড়ির বর্ণনা বলিতে হইলে প্রথম ঠাকুরদালান হইতে আরম্ভ করিতে হয়। পাঁচফুকুরী ঠাকুরদালান পশ্চিমমুখী, অর্থাৎ ইহার পাঁচটি খিলান ও গোল ইটের থাম। ঠাকুরদালানের সম্মুখে বড় প্রাঙ্গণ। ঠাকুরদালানের উপরের দক্ষিণ দিকে দুইতলা বড় হলঘর। উত্তরদিকের ঘরটিকে ‘বড় বৈঠকখানা ঘর’ বলা হইত। দক্ষিণ দিকে নীচের ঘরটিকে বোধন ঘর’বলা হইত এবং উপরকার ঘরটিকে ‘ঠাকুরঘর’ বলা হইত। তাহার পর বাহিরের উঠানে চকমিলান দালান ও ঘর। অন্দরমহলে দুইদিকে দুটি উঠান ছিল এবং পিছন দিকে কানাচ বা পুকুর ছিল।”
কেমন ছিল সেকালের দত্তবাড়ির খাওয়াদাওয়া? শুনুন ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের নিজের মুখে : “তখন কলকাতায় পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হত না, আমরা পাঁঠাওয়ালাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেছিলাম যে, তার দোকানে যে কটা মুড়ি থাকবে, আমাদের জন্যে রেখে দেবে। …দশ বারোটা পাঁঠার মুড়ি, সের দুই আড়াই ওলন্দ কড়াইশুটি, এক সঙ্গে ফুটিয়ে একটা তরকারি হত। বিকেলবেলা স্বামীজি আর আমি স্কুল থেকে এসে, আমরা দু’জন ওই কড়াইশুটি দেওয়া ব্রেনের তরকারি দিয়ে, খান-যোলো করে রুটি খেতুম।”
অনেক দিন পরে দক্ষিণেশ্বরের শরৎকে (স্বামী সারদানন্দ) শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশ দিলেন, নরেনকে দেখে আয়, “নরেন্দ্রনাথ কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে”। ১৮৮৫ সালের জ্যৈষ্ঠমাসে শরৎ ও ভ্রাতা শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) বেলা আড়াইটার সময় ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে এলেন। পিতার মৃত্যুর পর ভূবনেশ্বরী পরিবারের শোচনীয় অবস্থা।”কেবল একখানি ভাঙা তক্তপোষ, একটা মাদুর ভাজকরা, ঘরের পশ্চিমদিকের তক্তপোষের উপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটান, কড়িকাঠ হইতে একটা টানা-পাখার ঘেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।”
এ বাড়ির ওপর দিয়ে তার পরে নানা সময়ে নানা রকম ঝড় বয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী হলেন ১৮৮৬ সালে, বাড়ির শরিকি মামলা একটু আয়ত্তে আসবার পরেই তিনি পরিব্রাজক হলেন এবং ১৮৯৩-তে মুম্বই থেকে জাহাজে চড়লেন আমেরিকার উদ্দেশে। বিশ্বজয়ী হয়ে প্রথম দেশে ফিরলেন ১৮৯৭ সালে। আবার বিদেশ যাত্রা ১৮৯৯ সালে, শেষবারের মতো ফিরে এলেন ১৯০০ সালের ৯ ডিসেম্বর।
ইতিমধ্যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নানা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির মহারাজের আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাদাকে অগ্রিম না জানিয়েই আচমকা হাজির হলেন লন্ডনে, উদ্দেশ্য ব্যারিস্টারি পড়বেন। নিজে কোথায় থাকবেন ঠিক নেই, এই অবস্থায় সহায় সম্বলহীন ভাইকে দেখে বিবেকানন্দ মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। তার ইচ্ছে ভাই ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকায় যান। অভিমানী মহেন্দ্রনাথ স্থির করলেন দাদার কাছে জাহাজ ভাড়া না নিয়ে পায়ে হেঁটেই ভারতে ফিরবেন। পদযাত্রায় বেশ কয়েক বছর লাগল। এই পর্যায়ে বাড়িতে তিনি কোনও চিঠি লেখেননি। ৪ জুলাই ১৯০২ সালে মহেন্দ্রনাথ বহু দেশ পেরিয়ে কাশ্মীরে, স্বামী সারদানন্দের কাছে দাদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দ্রুত ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এলেন।
জননী ভূবনেশ্বরীর কিন্তু জীবনে একবিন্দু শান্তি নেই। দারিদ্র ও শোকের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কিছুদিন পরেই শুনলেন ছোট ছেলে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে দেশের বিপ্লব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছে। ১৯০৭ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে কলকাতার আদালতে ভূপেন্দ্রনাথের এক বছর জেল হল। সেখানে ঘানি টানতে হত, জেল খাটার পরে আবার আটক হবার আশঙ্কায় মায়ের অর্থানুকূল্যে এবং সিস্টার নিবেদিতার পরামর্শে আত্মপরিচয় গোপন করে দেশ ছেড়ে প্রথমে আমেরিকায় চলে গেলেন ভূপেন্দ্রনাথ, মায়ের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। আমেরিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে রোমাঞ্চকর অংশ নিয়ে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দেশে ফেরেন ১৯২৫ সালে।
চিরদুঃখিনী ভূবনেশ্বরীর দেহাবসান হয় ২৫ জুলাই ১৯১১, মেনিনজাইটিস রোগে। শেষ নিঃশ্বাসের কয়েক ঘন্টা আগে সুখদুঃখের নিত্যসঙ্গিনী নিবেদিতার সঙ্গে তার দেখা হয়, শোনেও উপস্থিত ছিলেন নিবেদিতা। প্রায় একই সঙ্গে দেহ রাখলেন দিদিমা রঘুমণি বসু, ভূবনেশ্বরী তাঁর একমাত্র সন্তান।
মহেন্দ্রনাথের দেহাবসান ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে পূজার সময়। মহানবমীর দিনে গুরুতর অসুস্থ মহেন্দ্রনাথকে দেখতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এলেন। বিজয়া দশমীর রাত্রি ১২টা ৪২ মিনিটে মহেন্দ্রনাথের বিদায় মুহূর্তে ঘরের আলোটি হঠাৎ ফিউজ হয়ে গেল এবং সেই সময়েই নিঃশব্দে চলে গেলেন অসামান্য ভ্রাতা ও অসামান্য লেখক মহেন্দ্রনাথ। স্বামীজির বংশের শেষ পুরুষ অকৃতদার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ওই একই বাড়িতে দেহ রাখলেন ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১। শেষ হল দত্ত পরিবারের ইতিহাস।
*********
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দর জন্মভিটে যে শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচেষ্টায় এই ভাবে রক্ষা পাবে, তা এ দেশে তার অনুরাগীদের কাছে স্বপ্নেরও অতীত ছিল মাত্র ক’বছর আগেও।অসম্ভবকে সম্ভব করাটাই রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের স্বভাব। তারা আর একবার কাজটা করে দেখিয়ে দিলেন : স্বপ্ন থাকলে, প্রতিভা থাকলে, এবং বিশ্বাস থাকলে কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকেও বড় কাজ সেরে ফেলা যায়। এগারো বছরের বেশি সময় ধরে যে-সন্ন্যাসী অশেষ ধৈর্য ও চরম দুঃসাহস মূলধন করে এই প্রচেষ্টার অন্যতম রূপকার হলেন, সেই স্বামী বিশোকানন্দ (পার্থ মহারাজ) বললেন, “আত্মনেপদের কোনও স্থান নেই, রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসী হিসেবে যে দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তা পালন করা গেল বহু মানুষের, বহু প্রতিষ্ঠানের এবং বহু সরকারি সংস্থার অভূতপূর্ব সাহায্যে।”
নিজের কথা কিছুতেই বলবেন না এই কাজপাগল সন্ন্যাসী। শেষে অনেক চেষ্টায় বললেন, “১৯৯৩ সালে ত্রিপুরা থেকে বেলুড় মঠে এলাম, তখনকার জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী আত্মস্থানন্দ বললেন, আমরা এত কাজ করছি, কিন্তু বিবেকানন্দের জন্মস্থান উদ্ধার করতে পারছি না। অথচ এটা আমাদের দায়। একটু উঠেপড়ে লাগো। সঞ্জীব মহারাজের সঙ্গে ঠাকুরের নাম করে লেগে পড়া গেল। কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়েও গেল।”
ভিটেবাড়ি পুনরুদ্ধার-প্রচেষ্টার শুরু কিন্তু আরও তিরিশ বছর আগে, স্বামীজির জন্মশতবর্ষে ১৯৬৩-তে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে ইচ্ছাপ্রকাশ করা হয়, বাড়িটি অধিগ্রহণ করে স্মৃতিমন্দির করা হবে। তখনকার জেনারেল সেক্রেটারি স্বামী বীরেশ্বরানন্দ সেই কথা শুনে একটা পাল্টা প্রস্তাব দেন : শুধু ৩ নম্বর নয়, ১ থেকে ১০ নম্বর গৌরমোহন স্ট্রিট ও সিমলা স্ট্রিটের কিছু জমি নিয়ে প্রায় ধ্বংস হয়ে-যাওয়া বাড়িটিকে মেরামত করে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে এনে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি গবেষণাগার ইত্যাদি করা যেতে পারে।
পরে এক সময়ে রাজ্যসরকার জমি ও বাড়ি অধিগ্রহণের নোটিফিকেশন জারি করেন, কিন্তু বহুজন বিরক্ত হয়ে ওঠেন এবং আদালতের শরণাপন্ন হন। একটি সংস্থা বাধাদানে প্রধান ভূমিকা নিয়ে বলে, কিছুতেই আমরা অধিগ্রহণ করতে দেব না। পরিস্থিতি জটিলতর করার জন্য প্রশ্ন তোলানো হয়, রামকৃষ্ণ মিশন কেন? এখানে ন্যাশনাল মিউজিয়াম করতে হবে। সেই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছু করা গেল না।
স্বামী বিশোকানন্দ বলছেন, “১৯৯৩ সালে ভিটেবাড়ির মামলা তদ্বির করতে গিয়ে দেখলাম, যখনই সমস্যাটা একটা সিদ্ধান্তের পথে এগোয়, তখনই কোনো অদৃশ্য শক্তি অনেককে উসকে দিয়ে ব্যাপারটা বানচাল করে দেয়। এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ আছেন।
নিরাশ না হয়ে স্বামী বিশোকানন্দ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন, মিশনের পরিকল্পনাটা কী তা ব্যাখ্যা করলেন। প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। বলা হল, আপনাদের বিকল্প জায়গা দেব। মুরারিপুকুরে ২৮টি ফ্ল্যাট তৈরি করা হল। সরকারি হাউজিং বোর্ড থেকেও ফ্ল্যাট নেওয়া হল এবং পুনর্বাসনের আলোচনা পুরোদমে চালু হয়ে গেল। পার্থ মহারাজ প্রথম যখন সিমলেপাড়ায় এসেছিলেন, “তখন বাড়ি তো দূরের কথা, গলিতেও ঢুকতে পারতাম না। জেদ চেপে গিয়েছিল। আমি যদি ফিরে যাই, আর হবে না।”
বহু চেষ্টায় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে একজন ভাড়াটিয়াকে নতুন বাড়িতে সরানো গেল, তাকে সরসুনাতে শকুন্তলা পার্কে জায়গা দেওয়া হল। “এই প্রথম ভিটেবাড়িতে দাঁড়াবার একটা জায়গা পাওয়া গেল।” স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা চালালেন সন্ন্যাসীরা, আরও ছ’জন বাসিন্দাকে পুনর্বাসনে রাজি করানো সম্ভব হল, এবং যে দিন তারা উঠে যান, সে দিনই ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কর্তৃপক্ষ সরকারি ভাবে মিশনকে তা দিয়ে দেন।
এক সময় স্বামীজির ভিটেবাড়িতে কী ছিল না? পানের দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, রেস্তোরাঁ, জ্যোতিষী, অসংখ্য সোনার দোকান, ছাপাখানা, দফতরিখানা, প্রকাশনা, লন্ড্রি, ডেকরেটর, সাইনবোর্ড পেন্টিং কোম্পানি, ব্লেড ফ্যাক্টরি, পেরেক ফ্যাক্টরি, পিচবোর্ড বাক্স তৈরির ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন, জিংক প্লেট ফ্যাক্টরি, এমনকী একটা ক্লাব! স্বামী বিশোকানন্দ বললেন, “উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য ৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কাউকে বঞ্চিত করা হয়নি। ১৪৩টি পরিবার ও ব্যবসা সংস্থাকে অন্যত্র সরাতে হয়েছে। আর দেরি হলে বাড়িটাই ভেঙে পড়ত।”
যথাসময়ে রামকৃষ্ণ মিশন পরামর্শ ও সাহায্য নিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে সংস্থা এবং ডি সি পি এল নামক আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন কোম্পানির। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শ্ৰীমতী শান্তা ঘোষ একটি পয়সাও না নিয়ে সমস্ত কাজটি নিঃশব্দে করে দিলেন, যার আর্থিক মূল্য অন্তত এক কোটি টাকা।
স্বামী বিশোকানন্দ তার মিশন সম্পন্ন করেও সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে যেতে চান। বহু অনুরোধের পর তিনি শুধু বললেন, “এ সবই স্বামীজির কাজ, আমাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। এই সুযোগ পেয়ে আমরা কৃতার্থ।”
ভিটেবাড়ির কঠিনকর্ম সম্পন্ন করে নিস্পৃহ সন্ন্যাসী বিশোকানন্দ নিঃশব্দে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট ত্যাগ করে ভিন্ন দায়িত্বপালনের জন্য অন্যত্র চলে গিয়েছেন।
==========
সংঘাতের বিষবৃক্ষ
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মভিটা নিয়ে যত আইনি লড়াই হয়েছে তার পুরো ইতিহাস খাড়া করলে মস্ত একখানা বই হয়ে যায়। উকিলবাড়ির ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার অ্যাটর্নি পাড়ায় শিক্ষানবিশি করলেও এবং আইনপড়া সম্পূর্ণ করলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসেননি এবং পরবর্তী সময়ে ভাই মহেন্দ্রনাথকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে প্রবল বাধা দিয়েছিলেন। তবু আইন তাকে ছাড়েনি এবং সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমার রাহু তাকে কীভাবে ঘিরে ধরেছিল তা এক নিতান্ত দুঃখজনক কাহিনি।
আপাতত আমরা শুধু তার জন্মভিটের আইনি হাঙ্গামার খোঁজখবর করব যার বিস্তৃতি অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল ধরে। যদি জন্মভিটের পুনরুদ্ধারের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসীদের কথা ধরা যায় তাহলে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে মামলা-মোকদ্দমার অবস্থিতি উনিশ, বিশ এবং একুশ শতাব্দী জুড়ে।
দেরেটোনার দত্ত পরিবারের যে মানুষটি (রামসুন্দর) মধু রায় লেনে বসবাস করতে এসে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে অনেকখানি জমি-সহ বিশাল বসতবাড়ির পত্তন করলেন, তিনি প্রথমে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজ অ্যাটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক এবং পরে ফার্সি আইনজীবী। আইনপাড়ায় উপার্জন করা প্রভূত অর্থ থেকেই দত্তদের এই ভিটেবাড়ির পত্তন।
রামমোহনের দুই পুত্র (দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ) ও সাত কন্যা। পঁয়ত্রিশ বছরে কালীপ্রসাদের অকালমৃত্যু কলেরায়, আর নরেন্দ্রনাথের পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ নিতান্ত তরুণ বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে সংসারবন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলেও, ভিটেবাড়িতে প্রথম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটল তারই মাধ্যমে। সেই সময়ের হিন্দু আইন অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মোদ্দা কথা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত নিরুদ্দিষ্ট, টানা বারো বছর তার কোনও সন্ধান না পাওয়ায় আদালতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হোক।
সন্ন্যাসী হয়ে-যাওয়া দুর্গাপ্রসাদের পুত্র বিশ্বনাথ বি এ পাশ করে কিছু দিন ব্যবসা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আইনপাড়ার অ্যাটর্নি অফিসে আর্টিকেলড ক্লার্ক হন এবং পরে হেনরি জর্জ টেম্পলের অ্যাটর্নি অফিসে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা ভুবনমোহন দাশ ওই অফিসে তার সহকর্মী ছিলেন। পরে তিনি যে অ্যাটর্নি অফিস স্থাপন করেন তার নাম ধর অ্যান্ড দত্ত।
অ্যাটর্নি হিসেবে বিশ্বনাথ প্রচুর যশ অর্জন করলেও, দত্তবাড়ির শরিকরা পরবর্তী কালের পারিবারিক মামলায় তাকে বেহিসেবি এবং আর্থিক সঙ্গতিহীন বলে অভিযোগ করেন। আমরা জানি বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণীর দুঃখ ও নীরব বেদনা। বিশ্বনাথ একবার বলেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেট ভরে খেতে পায় না।”…বিশ্বনাথের অকালমৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, কিন্তু তার জীবিতকালেই শরিকি লড়াইয়ের সূচনা হয়ে যায়। এর প্রথম ইন্ধন জোগানো হয় ১৮৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন অর্থের প্রয়োজনে দত্ত পরিবারের দুই নিঃসন্তান বিধবা অবিভক্ত ভিটেতে নিজেদের অংশ নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীকে বেচে দেন। ভোলানাথ দত্তর বিধবা বামাসুন্দরী ও মাধব দত্তর বিধবা বিন্দুবাসিনী এর জন্যে যে পাঁচশো টাকা করে পেয়েছিলেন তা আসলে কার উপার্জিত টাকা এই নিয়ে পরবর্তী কালে মস্ত লড়াই আদালতে। নরেন্দ্রনাথের খুড়ো হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজ্ঞ তারকনাথ দত্তর বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম বিশ্বনাথ দত্তের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আইনি লড়াই স্বামী বিবেকানন্দর অবশিষ্ট জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
এই মামলার আগেও ১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাড়ির আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) ভিটেবাড়ি বিভাজন মামলা এনেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে যাতে অন্য সকলের সঙ্গে বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। পরের বছরে আদালতের নির্দেশে কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি রবার্ট বেলচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হন এবং চার বছর ধরে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে তিনি দত্তবাড়ির শরিকদের ভাগ ঠিক করে দেন। বেলচেম্বার্সের স্বাক্ষরিত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের নকশাই পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দ ভিটের পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে মঠ ও মিশনের খুব কাজে লেগে যায়।
নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর পরেই উকিল তারকনাথ ভূবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি তার বেনামি সম্পত্তি বলে দাবি করতে থাকেন। ১৮৮৫ বড়দিনের সময় এই বাড়ির একটা অংশে বাথরুম মেরামতির জন্য পুরনো দেয়াল ভাঙা নিয়ে ভূবনেশ্বরীর পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লেন। এই মামলায় যথাসময়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। হাইকোর্টে বিচারপতির নাম উইলিয়াম ম্যাকফারসন। নরেন্দ্রনাথ যখন সাক্ষ্য দেন (৮ মার্চ, ১৮৮৭) তখন শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করেছেন, তাঁর ত্যাগী সন্তানরা তখন তপস্যাদীপ্ত বরাহনগরের মঠবাসী। নিরুপায় নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে যেতেন পায়ে হেঁটে, আর ভূবনেশ্বরী যেতেন পাল্কিতে। নরেন্দ্রনাথের সাক্ষ্যের কিছু অংশ: “..কয়েক মাস পিত্রালয়ে থেকে আমার মা ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন তাঁরই জমির একটা অংশে তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন।..ঘটনাস্থলে মায়ের পক্ষ নিয়ে আমি আপত্তি তুলেছিলাম।”
দীর্ঘ শুনানির পরে ১৪ মার্চ ১৮৮৭ হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের সুচিন্তিত রায় প্রকাশিত হল। অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী। প্রমাণ হল, প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে নিয়মিত তার স্ত্রীকে টাকা পাঠাতেন। বিপদ সাধল তারকনাথের এক পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।
রায়ের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আপিল করেছিলেন জ্ঞানদাসুন্দরী। তখনকার প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যামও ভূবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন ১৫ নভেম্বর ১৮৮৭। কিন্তু জয় অত সহজ হলো না। শাখাপ্রশাখা মিলে এই মামলার রেশ চলল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত–সেই সঙ্গে অজস্র অর্থব্যয় ও সীমাহীন যন্ত্রণা।
পিতৃহীন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, আবার বৈরাগ্যের কঠিন সাধনা, অসহনীয় এই টানাপোড়েনে নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তার গুরুভাইদের অবিস্মরণীয় ভালবাসা ও সমর্থন। দুই গুরুভাই নরেনের টাকার অনটন মেটাবার জন্য বরাহনগর থেকে বালির স্কুলে গিয়ে মাস্টারি করতে চাইলেন। সে বড় করুণ কাহিনি। জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, রাখাল আমার শরীর ভাল নয়। শীগগিরই দেহত্যাগ করব। তুই আমার মার ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দিস। তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর ভারটি রইল।
হাইকোর্টের রায়ের পরেও গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মামলা কেমনভাবে পল্লবিত হয়ে তার তিরোধানের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার পরে খুড়ি তার অংশটি ৬ হাজার টাকায় স্বামীজিকে বেঁচে দেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে (মার্চ ১৯০২) সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখলেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই। ঝুলে থাকা মামলার জন্য লাগবে।”
বেলুড়ে স্বামীজির মহাসমাধি ৪ জুলাই ১৯০২। তার পাঁচ দিন আগে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কয়েক জন শরিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দ্বন্দ্ব মিটে গেল টাকার পরিবর্তে। দুই পক্ষের অ্যাটর্নি (পিন্টু কর ও এন সি বসু) খুব দ্রুত কাজ করলেন। কারণ, অপেক্ষা করবার মতো সময় আর স্বামীজির হাতে নেই। ২ জুলাই ১৯০২ মহাসমাধির দু’দিন আগে শরিক হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি স্বেচ্ছায় মিটমাট হয়ে গেল।
স্বামীজি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেও আইনের কালো মেঘ এরপরেও মাঝে মাঝে ৩নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
রাজনৈতিক অপরাধে কেউ আদালতে অভিযুক্ত হলে ভূপেন্দ্রনাথ অনেক সময় বাড়ির মালিক হিসেবে জামিনদার হনে, একজন আসামি মামলা চলাকালীন উধাও হওয়ায় ভূপেন্দ্রনাথকে জামিনদার হিসেবেও জরিমানা দিতে হয়। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির অংশ বিক্রি করে সেই টাকা যে জোগাড় করতে হয়েছিল তা এই প্রজন্মে আমরা ভুলে গিয়েছি।
স্বামীজির প্রাক্সন্ন্যাসজীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়ে চলেছে। শৈশবে, কৈশোরে, বাল্যে ও যৌবনে কেমন দেখতে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত? কোথায় গেল আদিপর্বের আলোকচিত্রমালা? তার মা, বাবা, ভাইবোন সম্পর্কে আমরা কেন আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না, ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছেন বিশিষ্ট বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানীরা।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা পর্বের আগে নরেন্দ্রনাথের কোনো ফটো তোলা হয়নি তা মানতে মন চায় না। যেমন বিশ্বাস হতে চায় না যে সফল আইনজীবী ও দেশে দেশে পরিভ্রমণকারী, অভিজাতরুচি পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের কোনো ফটোগ্রাফ তোলা হয়নি। এ বিষয়ে দত্তপরিবারের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য : সবই ছিল, কিন্তু সবই হারিয়ে গিয়েছে পারিবারিক বিরোধে ও বারংবার পুলিসি খানাতল্লাশিতে।
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের নিতান্ত আপনজনদের ভিটেবাড়ি থেকে আচমকা উৎখাতের প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসা যাবে। বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাসমাধির পরবর্তী দশকে ইংরেজ পুলিসের বিষদৃষ্টিতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তভিটেতে বহুবার তল্লাশি চলে এবং শাসকরা প্রতিবারই দেওয়ালের ছবি থেকে ট্রাঙ্কের কাগজপত্র, কাপড়চোপড় সব বাজেয়াপ্ত করে সঙ্গে নিয়ে যান।
এই অত্যাচারের ফলে ঐতিহ্যমণ্ডিত দত্ত পরিবারের অনেক নিদর্শন নষ্ট হয়েছে, বিবেকানন্দ ভিটেতে কাঠের দরজা জানলা, ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে এবং ছাদ ছাড়া আর কিছুই অতীতের ধারাবাহিকতা বহন করছে না। এবাড়ির যা কিছু খবরাখবর তা সংগ্রহ হয়েছে মানুষের স্মৃতিকথা থেকে এবং মূল্যবান আদালতি রেকর্ড থেকে।
দত্তপরিবারের শরিকি লড়াই প্রায় মহাপ্রয়াণের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কখনও প্রায় দেউলিয়া, কখনও সর্বস্বান্ত হয়েছেন দত্ত নামধারী পুরুষ ও মহিলারা। কিন্তু সব অমঙ্গলেরই একটা মঙ্গলময় দিক থাকে। স্বামীজির আপনজনদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন আদালতি সূত্র থেকেই অনুরাগীরা উদ্ধার করতে পেরেছেন।
তবু যতটুকু জানা গিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য এখনও অজানা থেকে গিয়েছে স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী, পিতৃদেব এবং আত্মঘাতিনী বোনদের সম্পর্কে। ভাইদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু জানি আবার অনেককিছু জানি নাও বটে। জননী ভূবনেশ্বরী সম্পর্কে আজও কৌতূহলের বিরাম নেই বহুযুগ আগের দুই ভুবনবিদিতা জননী শঙ্করাচার্যমাতা ও চৈতন্যজননী সম্পর্কেও ভক্তজনের একই ধরনের ব্যাকুলতা।
সুদূর প্রবাসেও স্বামীজি তার গর্ভধারিণী জননী সম্পর্কে মাঝে মাঝে কিছু হৃদয়গ্রাহী মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির বিদেশিনী অনুরাগিনীরাও তাদের গুরুদেবের জননীকে মার্কিনদেশ থেকে অভিনন্দন পাঠিয়েছেন।
ভূবনেশ্বরী সস্পর্কে প্রাচীনতম নিদর্শনটি হল কলকাতা হাইকোর্টের কাগজপত্রে একটি বাংলা সই, যা দেখে বোঝা যায় তার হস্তলিপি খুবই সুন্দর ছিল। আমরা জানি তিনি মেমদের কাছ থেকে ইংরিজি পাঠ নিয়েছিলেন এবং বড় ছেলেকে ইংরিজি শিখিয়েছেন। পরবর্তীকালে সাগরপারের কয়েকজন ভক্ত ও ভক্তিমতীর সঙ্গেও তিনি ইংরিজিতে কথা কইতেন, কিন্তু তার ইংরিজি লেখার কোনো নিদর্শন আজও উদ্ধার হয়নি। এতোদিন বিবেকানন্দ-জননীর একটিমাত্র আলোকচিত্রই ছিল ভরসা। স্বামীজির দেহাবসানের পর বিদেশিনীদের অর্থে সিস্টার নিবেদিতা এই ছবি তোলবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভূবনেশ্বরী দেবী ও নিতান্ত আদরের একমাত্র সন্তানের ভাগ্যবিপর্যয়ে সর্বদাকাতর বিবেকানন্দমাতামহী রঘুমণি দেবীর আলোকচিত্র মনে হয় একই সময়ে তোলা হয়েছিল।
অতিসম্প্রতি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভূবনেশ্বরী দাসীর দ্বিতীয় একটি ছবি অধ্যাপক শ্রীসুজিত বসুর সৌজন্যে আমাদের নজরে এসেছে। নির্মম : দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ, আত্মীয়দের অপমান ও অকালমৃত্যুতে জর্জরিত বিবেকানন্দজননীর এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ব্রহ্মানন্দ উপাধ্যায় সম্পাদিত স্বরাজ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩১৪ প্রকাশিত হয়েছিল।
স্বরাজ পত্রিকায় লেখা হয়, “আমরা নরেন্দ্রের মাতার চিত্র দিলাম। নরেন্দ্রের মাতা রত্নগর্ভা। মা–অমন রত্ন হারাইয়াছেন। হারাইয়াছেন কি ব্যবহারতঃ হারাইয়াছেন–পরমার্থতঃ হারান নাই। তাঁহার জ্যেষ্ঠ সুতের চরিত্রসৌরভে ভারত আমোদিত। আহা–মায়ের ছবিখানি দেখ– দেখিলে বুঝিতে পারিবে যে নরেন্দ্র মায়ের ছেলে বটে–আর মাতা ছেলের মা বটে।”
দুঃখের বিষয় ভূবনেশ্বরী দেবীকে লেখা অথবা তার নিজের হাতে পুত্রকে লেখা কোনো চিঠি এখনও সংগৃহীত হয়নি। আমরা জানি, মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ ভাগ্যসন্ধানে বিদেশে গমন করে অজ্ঞাত কারণে বহু বছর অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং দীর্ঘসময় ধরে পদব্রজে বহুদেশ ভ্রমণ করে স্বামীজির দেহাবসানের কয়েকদিন পরে কলকাতায় ফিরে আসেন। চার পাঁচবছর মাকে একখানাও চিঠি না লিখে মহেন্দ্রনাথ তাঁর মা ও নরেন্দ্রনাথের উদ্বেগ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন।
কিন্তু স্বামীজির মাতৃঅনুরাগের কথা তো আমাদের অজ্ঞাত নয়। দীর্ঘকাল স্বদেশ ও বিদেশের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজের মাকে তিনি কখনও কোনো চিঠি লেখেননি তা ভাবতে ইচ্ছে করে না। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, মহেন্দ্রনাথ বা তার ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ কোথাও দাদার লেখা কোনো চিঠির উল্লেখ করেননি। যতদূর জানা যায়, স্বামীজির দিদি স্বর্ণময়ীও এবিষয়ে কোনো মন্তব্য রেখে যাননি, স্বামীজির দেহাবসানের তিনদশক পরেও (১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) তিনি কিন্তু বেঁচে ছিলেন। স্বামীজির দিদির ক্ষেত্রে একটু নাম বিভ্রাটও আছে, মৃত্যু রেজিস্টারে তিনি স্বর্ণবালা, আবার কোথাও স্বর্ণলতা।
স্বামীজিরা ছিলেন দশ ভাইবোন (নরেন্দ্রনাথ ষষ্ঠ সন্তান), এঁদের সম্বন্ধেও আজও অনেক কিছু অজানা। আমরা বিশ্বনাথ দত্তের প্রথমপুত্র ও দুই কন্যার নাম জানি না। সন্ধানকারীদের মন্তব্য : নিতান্ত অল্প বয়সে মৃত্যু হওয়ায় এদের নামকরণ হয়নি, অথবা নামকরণ হলেও নামগুলি আমরা এখনও সংগ্রহ করতে সমর্থ হইনি। তার থেকেও যা দুঃখের, অন্য ভগ্নীদের প্রায় কোনো খবর হাতের গোড়ায় নেই। পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তর আকস্মিক প্রয়াণের সময় কন্যারা বিবাহিতা কি না তাও আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।
প্রথম যুগের ইংরিজি বিবেকানন্দ-জীবনীতে বিশ্বনাথের পারলৌকিক কাজ শেষ করে নরেনের বাড়ি ফেরার বর্ণনা আছে। এই বিবরণ থেকে আন্দাজ হয়, কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ তখন যেমন নিতান্তই শিশু তেমনই ভগ্নীদের কেউ কেউ অবিবাহিতা।
পরবর্তীসময়ে এদের বিবাহে কে কী ভূমিকা গ্রহণ করলেন, কোথা থেকে বিবাহের অর্থ এলো তাও অস্পষ্ট। আরও যা আলো-আঁধারিতে ভরা, তা হলো একজন নয়, দুই বোনের নিতান্ত অল্পবয়সে স্বামীগৃহে দুঃখজনক অকালমৃত্যু। এঁদের একজন যে ছোটবোন যোগীন্দ্ৰবালা তা জানা যায়, তিনি যে কলকাতা সিমলা অঞ্চল থেকে সুদূর সিমলা পাহাড়ের পতিগৃহে আত্মঘাতিনী হন তাও স্পষ্ট, কিন্তু দ্বিতীয় আত্মঘাতিনী ভগ্নীর প্রকৃত বিবরণ এখনও রহস্যময়।
এক নজরে বিশ্বনাথ-ভূবনেশ্বরীর পরিবারের ছবি আঁকার সময় আমরা আরও কিছু বিবরণ উপস্থাপন করব। সংসারত্যাগের পরে এবং বিদেশ থেকে প্রত্যাগমনের আগে গৈরিক বেশধারী নরেন্দ্রনাথকে যে কখনও ভিটেবাড়িতে দেখা যায়নি এমন ইঙ্গিত রয়েছে, তবে দিদিমা রঘুমণি বসুর ৭ রামতনু বসু লেনের বাড়িতে যে বেশ কয়েকবার গুরুভাই ও শিষ্যদের নিয়ে স্বামীজি এসেছে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
চরম অর্থনৈতিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ভূবনেশ্বরীর আশ্রয়স্থল এই রামতনু বসু লেনের পিত্রালয়। অল্পবয়সে বিধবা হওয়া অসহায় মেয়ের পাশে সারাজীবন দাঁড়াতে গিয়ে দিদিমা রঘুমণি বসু বড়ই কষ্ট পেয়েছে। অসহায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে স্বামীর ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভূবনেশ্বরী তার শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছেন স্নেহময়ী মায়ের কাছে। আদরিনী কন্যার মৃত্যু তারিখ ডেথ রেজিস্টার অনুযায়ী ২৫ জুলাই ১৯১১। অভাগিনী কন্যাকে আগে সব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে পাঠিয়ে দিয়ে, তার ঠিক দুদিন পরে ২৭ জুলাই ১৯১১ স্বামীজির দিদিমা রঘুমণি বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বামীজির জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ পেট্রিয়ট-প্রফেট’ বইতে জলঘোলা নেই, কিন্তু বাংলা রচনা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইতে দরিয়াটোনার দত্ত বংশের পরিচয় দিতে দিতে এবং পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত সম্পর্কে বলতে বলতে তিনি যে গোপন পারিবারিক তথ্য ফাঁস করেছে, তার মর্মার্থ হল, স্বামী বিবেকানন্দের পরমপ্রতিভাবান পিতা অকালমৃত বিশ্বনাথ দত্ত সুলোচনা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন যা সেকালের পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বহুদর্শী নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার কিছুটা গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরীর কাছ থেকে জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন তার জননী যে কবিতা রচনা করতেন তা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জানি, কিন্তু পিতৃদের বিশ্বনাথ দত্তের সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোনো ইঙ্গিত অনুরাগী মহলে ছিল না, যদিও নানা ভাষায় বিশ্বনাথের ব্যুৎপত্তি ও গ্রন্থপ্রেম কারুর অজানা ছিল না।
‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১০১ পাতায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তার পিতৃদেব সম্বন্ধে লিখেছেন : সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম। সুলোচনা’ নামে একটি বাংলা উপন্যাস তিনি রচনা। করেছিলেন।
এর পরেই বিস্ফোরণ। তার নিজের আর্থিক অবস্থা তখন সচ্ছল ছিল না বলে জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী গোপালচন্দ্র দত্তের নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
‘সুলোচনা’ সম্পর্কে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে কয়েকদশক অতিবাহিত হলেও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষকরা কেন এই বইটি সম্বন্ধে তেমন অনুসন্ধান করলেন না তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রকাশিত হওয়ার পরে “পাঠক সাধারণ কর্তৃক বিশেষভাবে সমাদৃত” ‘সুলোচনা’ পরবর্তীকালে দুষ্প্রাপ্য হলেও দুর্লভ নয়। স্বদেশে ও বিদেশে যেখানেই উনিশ শতকে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের সংগ্রহ আছে সেখানকার গ্রন্থতালিকায় এই উপন্যাসের নাম রয়েছে।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “১৮৮০ খৃষ্টাব্দে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।” কিন্তু কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে দেশবিদেশে খোঁজখবর করতে গিয়ে বিলেতে যে বাংলা বইয়ের হদিশ পাওয়া গেল তার প্রকাশ কলকাতায়, সময় ১৮৮২, বাংলা সন ১২৮৯।
তখনকার কলকাতায় প্রকাশিত বাংলা গল্প-উপন্যাসে একটা ইংরিজি ও একটা বাংলা ফ্লাই-লিফ থাকতো। ইংরিজি টাইটেল-পেজ অনুযায়ী বইটির প্রথম প্রকাশ ১৮৮২। প্রকাশক ২৫ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং। বাংলা ফ্লাইলিফে বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং হয়েছেন বি. বানুর্জি কোম্পানি। ব্যানার্জি পদবীটির উচ্চারণ ও বানান নিয়ে বাংলা ও ইংরিজিতে যে দীর্ঘকাল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে তার অকাট্য প্রমাণ।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের শেষপ্রান্তে উল্লেখ : “কলিকাতা বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে ৬৯ বাটীতে হিতৈষী যন্ত্রে শ্রী ব্রজনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক মুদ্রিত।”
সুলোচনা’ উপন্যাসের টাইটেল পেজে আরও কিছু খবরাখবর আছে। সেকালের বইতে মূল নামের সমর্থনে ও ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় একটি নাম দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। এক্ষেত্রে লেখা হয়েছে: সুলোচনা অথবা আদর্শ ভাৰ্য্যা। ইংরিজিতে : ‘সুলোচনা দ্য এগজেমপ্লরি ওয়াইফ।’
ইংরিজি পরিচয়পত্রে আরও ব্যাখ্যা আছে : ‘এ স্টোরি অফ বেঙ্গলি ফ্যামিলি লাইফ’ বাংলা করলে দাঁড়ায় : বাঙালির পারিবারিক জীবন নিয়ে একটি কাহিনী। কিন্তু দ্বিতীয় বাংলা টাইটেলে উপন্যাসের লেখক সাহস করে আরও একটু এগিয়ে গিয়েছেন : ‘বঙ্গবাসীদিগের সংসারিক ব্যবহারাবলম্বিত উপন্যাস।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আড়াই শ পাতার উপন্যাসের মূল্য এক টাকা, সেই সঙ্গে সেকালের ডাক খরচ সম্বন্ধেও একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে : ‘ডাকমাশুল আনা। পোস্টেজ 2 annas।
পরবর্তী প্রশ্ন স্বভাবতই ‘শ্রী গোপালচন্দ্র দত্ত প্রণীত’ ব্যক্তিটি কে? মুলপরিচয়ে পৌঁছবার আগে ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দরিয়াটোনার দত্ত পরিবারের যে বংশলতিকা দেওয়া হয়েছে তার দিকে নজর দিলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়ি প্রসঙ্গে আমরা জানি নরেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্র রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন ও পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে বর্ধমান জেলার দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় চলে আসেন।
এই রামসুন্দর দত্তের পাঁচপুত্র রামমোহন, রাধামোহন, মদনমোহন, গৌরমোহন ও কৃষ্টমোহন। জ্যেষ্ঠ রামমোহন দত্তই ভুবনবিদিত স্বামী বিবেকানন্দর প্রপিতামহ। কনিষ্ঠ কৃষ্টমোহূনের সেজ ছেলে গোপালচন্দ্র; অতএব শরিকী সম্পর্কে গোপালচন্দ্র হলেন নরেন্দ্রনাথের পিতৃদেব বিশ্বনাথের খুড়ো বা কাকা।
এই প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের রচনা থেকে বেশ কিছু তথ্য আমরা জানতে পারি। বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে গ্রন্থরচনার উপাদান সংগ্রহের জন্য ভূপেন্দ্রনাথ একসময় সিমুলিয়া দত্তদের আদি কুলগুরু আন্দুল-মৌরীর শ্ৰীতারাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারাপ্রসন্নবাবু তখন ভূপেন্দ্রনাথকে জানান যে তার মাতৃদেবী গোপালচন্দ্র দত্তকে দেখেছিলেন। আরও জানান, তাদের শিষ্যবংশের খাতায় রামনিধির প্রপৌত্র মদনমোহনের নাম পাওয়া যায়, সন ১২৬৩ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য, এই তারিখটি একটু গোলমেলে, কারণ ভিটেবাড়ির পার্টিশন মামলার কাগজপত্রে মদনমোহনের মৃত্যু তারিখ ১৮৪৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের বর্তমান অনুসন্ধানে অবশ্য এই মতপার্থক্যের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
আমরা এখন জানতে চাই উপন্যাসের টাইটেল পেজে উল্লিখিত গোপালচন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য। স্বামীজির ছোটভাই আমাদের হতাশ করেননি। তিনি একই বইতে জানিয়েছেন, “গোপালচন্দ্র দত্ত একজন বিদ্বান ও যশস্বী জননায়ক হয়েছিলেন।”
আরও খবর, গোপালচন্দ্র ডাকবিভাগে বড় পদে চাকরি করতেন এবং চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি কৃষ্ণদাস পালের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর হন। গোপালচন্দ্র বেথুন সোসাইটির শুরু থেকে আজীবন সভ্য ছিলেন এবং ১০ নভেম্বর ১৮৫৯ থেকে ২০ এপ্রিল ১৮৬৯ প্রায় দশ বছর সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, গোপালচন্দ্র ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ বেথুন সোসাইটীতে বাংলার শিক্ষিত শ্রেণী–তাদের অবস্থা ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করেন।
গোপালচন্দ্রের বড় জ্যাঠামশাই রামমোহনের দুই পুত্র ও সাতকন্যা। পুত্রদের নাম দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ। এই দুর্গাপ্রসাদই বিশ্বনাথের পিতা এবং পরবর্তীকালে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। পরবর্তীকালে বারাণসীতে তিনি নাকি কোনো মঠের অধ্যক্ষ হন।
আরও একজন সন্ন্যাসীর নাম দেখা যায় দত্তদের বংশলতিকায়, তিনি গোপালচন্দ্রের দাদা নবীনের বড় ছেলে–আদালতি বংশলতিকায় এঁর নামোল্লেখ নেই। বলা হয়েছে, এঁর ছোটভাই নীলমণি।
সন্ন্যাসের প্রতি দত্তপরিবারের আসক্তি সম্পর্কে উল্লেখ প্রয়োজন এই কারণে যে ‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও ঘুরে ফিরে এক সন্ন্যাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অঙ্কিত হয়েছে। কাহিনীতে এঁর নাম স্পষ্ট নয়। “সন্ন্যাসী কহিলেন–আমার নাম জানিবার আর আবশ্যক কি, আমার সাংসারিক নাম আমি ত্যাগ করিয়াছি। এখন আমার সম্প্রদায়ী উদাসীনেরা আমাকে অঘোরস্বামী বলিয়া ডাকে।”
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে অঘোরস্বামীর ভূমিকা এতোই নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত যে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উপন্যাসের সাসপেন্স নষ্ট করতে চাই না। তবে এই চরিত্রটির পিছনে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের পুত্র, বিবেকানন্দের পিতা ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথের যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সমর্থন রয়েছে সেবিষয়ে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। তাৎক্ষণিক কৌতূহল নিবারণের জন্য বিশ্বনাথের রচনা থেকে সামান্য একটু নমুনা দেওয়া যেতে পারে।
“কর্ম ভিন্ন কেবল চক্ষু মুদিয়া ভাবনায় কোন ফল নাই। কর্মের অর্থ অনেক। কেবল আপন শরীরকে যাতনা দেওয়া কর্ম নহে। সংসারের সুখখান্নতি, পরের ইষ্টসাধন ও অন্যায়, অনিষ্টসাধন হইতে বর্জিত থাকা, নিজের শরীর পালন ও শরীর পবিত্র রাখা, ক্ষুৎপীড়িতের ক্ষুধানিবৃত্তি, তৃষ্ণাতুরকে স্নিগ্ধবারি দান, শীতপীড়িতকে বস্ত্র দান, নগ্নভিক্ষুকের লজ্জা নিবারণ, রোগীর রোগের সেবা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান–এই সকল কর্ম।
“যাঁহারা এই রূপ কর্মসাধন করিতে যত্ন পান না তাহাদের ঈশ্বরধ্যানের অধিকার নাই। তাহাদিগের ঈশ্বর আরাধনা লৌকিক আড়ম্বর মাত্র। অনেকে ধর্মের জন্য এক কপর্দক ক্ষতি স্বীকার করেন না–কোন অংশে এক তিল বিলাস ভোগ হইতে বঞ্চিত থাকেন না–কোনো আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিতে পারেন না ও ত্যাগ করিবার চেষ্টাও পান না–তাহাদিগের ধর্মের ভেক ধারণ করা শঠতার রূপান্তর মাত্র।
“আবার আর এক শ্রেণীর প্রবঞ্চক আছেন তাঁহাদিগের মুখে দিবানিশি ধর্মসম্বন্ধীয় কাহিনী শুনিতে পাইবে। ইহাদিগের ধর্মালোচনা কেবল নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ ও নিজের স্বরূপ প্রচ্ছন্ন রাখিবার উপায়ন্তর মাত্র। ইহাদিগের ধর্মকথনের এই পর্যন্ত উপকার দৃশ্য হয় যে ইহারদ্বারা প্রকাশ পায় যে কত প্রকার সুললিত ভাষায় কত প্রকার সুযুক্তি দেখাইতে পারা যায় ও এক এক লোকের কি পর্যাপ্ত বচননিপুণতা আছে ও তাহারা কত প্রকার বাক্যপ্রণালী প্রয়োগ করিতে পারে।”
উপন্যাসের আরও একটি বক্তব্যের ওপর আলোকপাত প্রয়োজন হতো যদি না স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসী পিতামহের বৈরাগ্যময় জীবন সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত হতাম।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুরথনাথ প্রশ্ন করিলেন, “দিবানিশী ভজন সাধন করিলেই কি মনুষ্যের মুক্তি সম্ভাবনা, না তাহার সহিত আর কোন কর্তব্যকর্ম আছে?”
সন্ন্যাসী উত্তর করিলেন–”বাপু এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া অসাধ্য। মনুষ্যের যে প্রণালীতে জন্ম তাহাতে তাহার জন্মদাতার ও গর্ভিণীর শারীরিক ও মানসিক ও ধর্ম নৈসর্গিক গুণসমুদয় তাহাতে বর্তায়। সত্যপরায়ণ, নির্লোভী নিরাকাঙ্ক্ষী হিংসাদ্বেষ কাম ক্রোধ শূন্য হইয়া কেহ জন্মগ্রহণ করেন না। এই রিপুগুলির বীজ তাহার শোণিতে মিশ্রিত আছে এবং সংসারে থাকিয়া তাহা অন্যের সংসর্গে এবং পৃথিবীর ব্যবহার দেখিয়া দিন দিন উন্নতি প্রাপ্ত হয়।
“কি সংসারী কি ব্রহ্মচারী সকলেরই এক অনাদি পবিত্র আত্মার চিন্তা কর্তব্য যেহেতুক তদ্বারা কেবল নিজের প্রত্যক্ষ মঙ্গল সাধন হইবে তাহা নহে, মনুষ্যের আত্মা অত্যুৎকৃষ্ট সুনির্মল পবিত্র আত্মার আদর্শ দেখিয়া সেই উচ্চতা কালে প্রাপ্ত হইতে পারিবে। কিন্তু মনকে পবিত্র করা, রিপু সমুদয়কে কোমল করিয়া নিয়মাধীনে রাখা, এক জন্মের কর্ম, এটী এক দিনের কর্ম নহে, এক বৎসরের কর্ম নহে কিছু কাল অধ্যবসায়ের সহিত অভ্যাস করিলে হয় ত সিদ্ধ হওয়া যায়, হয় ত হওয়া যায় না।
“যেমন রোগীকে ঔষধ প্রয়োগ করিবার পূর্বে তাহার শরীর অন্তর্গত মলমূত্রাদি নিষ্কৃতি করিতে হয়–যেমন দেবদেবীর অর্চনার পূর্বে একটি পবিত্র বেদি নির্মাণ করিতে হয় তেমনি ঈশ্বর আরাধনার পূর্বে মনকে পরিশুদ্ধ করা সত্যপরায়ণ হওয়া কপটতা ত্যাগ করা সাংসারিক কৌশল বর্জিত হওয়া আবশ্যক। সাংসারিক সুখে কিছুমাত্র বঞ্চিত হইব না অথচ সময়ে এক এক বার চক্ষু মুদিত করিব–সে উপাসনা নহে–এবং যে সেই রূপ উপাসক সে ঈশ্বরের নামে আপন সৃষ্ট কোন দেবতার আরাধনা করে।
“অপবিত্র মনে অপবিত্র চিত্তে কি প্রকারে পবিত্র নির্মল আত্মার আরাধনা করা সাধ্য। কি উপায়ে অর্জিত অর্থের আগমন হইবে কাহার স্থাপ্য হরণ করিব কাহাকে প্রলোভন দর্শাইয়া নিজাধীনে আনিয়া তাহার সর্বস্ব হস্তগত করিব–যাঁহার অহর্নিশ এই চিন্তা–যিনি নিজ বিলাস ভোগে অধীর হইয়া অন্যকে স্ত্রী কন্যা লইয়া সংসার করিতে দেন না–যিনি ঐহিক পদমর্যাদা, প্রভুত্ব আকাঙ্ক্ষায় মুগ্ধ হইয়া কোন প্রবঞ্চনা প্রতারণা মিথ্যা কল্পনা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হন না, তিনি কি ঈশ্বরোপাসনা করিতে পারেন? সংসারে থাকিলেই কুক্রিয়াতে রত হইতে হইবে এটি সাংসারিক লোকের ছল মাত্র।”
এই উপন্যাসের অন্দরমহলে প্রবেশের আগে একটা কথা স্মরণ রাখা ভাল যে লেখকের ব্যক্তিজীবন ও অভিজ্ঞতা প্রায়ই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কখনও কখনও মনে হয়, প্রত্যেক উপন্যাসই একধরনের আত্মজীবনী, কখনও লেখকের জ্ঞানত এবং প্রায়ই অজ্ঞানত। ইদানিং তাই ব্যক্তিজীবনের চাবিকাঠি খুলে উপন্যাসের অনালোকিত গর্ভগৃহে প্রবেশের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ঘটনাবলী যে উপন্যাস লেখক সরলভাবে নকল করে যান তা নয়, কখনও কখনও অতিসাবধানে লেখক তার আত্মজীবনকে লুকিয়ে রাখতেও সচেষ্ট হন। কিন্তু তার সৃষ্টিটি যেন তার ছায়া। কখনও সামনের, কখনও পিছনের, কখনও পাশের। নিষ্ঠুর সত্যটি হল কেউ কখনও তার নিজের ছায়াকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন না।
এইভাবে চিন্তা করে সুলোচনা উপন্যাসের পাঠোদ্ধার করলে কি স্বামীজির পিতামহ (দুর্গাপ্রসাদ), পিতামহী শ্যামাসুন্দরী, পিতা বিশ্বনাথ, মাতা ভুবনেশ্বরী, পিতামহের ভাই কালীপ্রসাদ, পত্নী বিশ্বেশ্বরী, তাঁদের পুত্র তারকনাথ ও পুত্রবধূকে ছায়াচিত্রর মতন খুঁজে পাওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, বহু উপন্যাস সত্যঘটনার কার্বন কপি না হয়েও, প্রকৃত ঘটনাস্রোতের গতিরেখা নিশ্চিতভাবে এঁকে যায়।
বহুক্ষেত্রে এই ধরনের অনুমানের কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেখানে উপন্যাসের লেখক স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দর পিতৃদেব এবং দত্তদের শরিকি মামলার নথিপত্রের বাইরেও ভিটেবাড়িতে এক অদ্ভুত জীবনযাত্রা চলমান ছিল এবং যেখানে এক যুগনায়ক ভূমিষ্ঠ হয়ে শৈশব, বাল্য ও যৌবন অতিবাহিত করেছিলেন সেখানে ভক্তদের, অনুরাগীদের ও দুনিয়ার সংখ্যাহীন মানুষের সীমাহীন কৌতূহল নিতান্ত স্বাভাবিক। এই কারণেই বিবেকানন্দ-অনুরাগীরা ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পটভূমি, চরিতাবলী ও ঘটনাবলী বারবার খুঁটিয়ে দেখবেন।
নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশে তার পারিবারিক স্মৃতি অবগাহন করতে করতে একবার বলেন, তাঁর পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের বিবাহ হয়েছিল তিন বছর বয়সে শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে। এঁদের জ্যেষ্ঠা সন্তান একটি কন্যা, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। পরবর্তী সন্তান বিশ্বনাথের জন্ম ১৮৩৫। বিশ্বনাথের বিবাহ যে যোলো বছর বয়সে হয়েছিল একথাও নিবেদিতার এই পত্রে উল্লিখিত হয়েছে। স্ত্রীর বয়স তখন দশ।
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তরা বংশানুক্রমে আইনব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্বামীজি কথায় কথায় বলতেন, আমাদের সাতপুরুষ উকিল। পিতামহ রামমোহন ছিলেন তখনকার সুপ্রিমকোর্টের ফার্সী আইনজীবী। এই পেশায় তিনি যে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন তার প্রমাণ তার বিশাল সম্পত্তিসালকিয়ায় দুটো বাগানবাড়ি, খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা। বিধির খেয়ালে এই সালকিয়ার লাগোয়া বেলুড়েই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে কলেরায় রামমোহনের অকাল মৃত্যু হয়। সেকালের কলকাতায় দারুণ গ্রীষ্মে অশোধিত জল খেয়ে কলেরায় অকালমৃত্যু কোনো নতুন ঘটনা নয়।
রামমোহনের বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদও প্রথম জীবনে এটর্নি অফিসে কাজ করতেন এবং পরবর্তীকালে কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়। ভিটেবাড়িতে তখনই শরিকী টেনশন যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
ভূপেন্দ্রনাথের কথায় : “দুর্গাপ্রসাদ ফার্সী ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তিনি উত্তর কলকাতানিবাসী দেওয়ান রাজীবলোচন ঘোষের কনিষ্ঠা কন্যা শ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করেন। শ্যামাসুন্দরী বাংলাভাষায় বিদুষী ছিলেন। তার হস্তাক্ষর ছিল খুব চমৎকার। তিনি ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিণী’নামে একটি সুবৃহৎ বাংলা কাব্যও রচনা করেছিলেন।” রূপবতী শ্যামাসুন্দরীর প্রথমা কন্যাটি সাত বছর বয়সে মারা যায়।
এই গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনীর পাণ্ডুলিপি বিশ্বনাথ অনেকদিন সযত্নে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু রায়পুরে সংসার নিয়ে যাওয়ার সময় এই মূল্যবান সংরক্ষণটি নষ্ট হয়ে যায়। এইভাবে দত্তপরিবারের আরও কত সংগ্রহ অদৃশ্য হয়েছে তার হিসেব নেই।
তখনকার দত্তভিটের একটা অন্তরঙ্গ ছবি ভূপেন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন। “মনে হয় বিধবা বোন যিনি স্বামীর উইলের অধিকারিণী ছিলেন, তিনিই ছিলেন সংসারের কী। যে কারণেই হোক তিনি আমার পিতামহীকে ভাল চক্ষে দেখতেন না।”
শ্যামাসুন্দরী একবার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি এলে রায়বাঘিনী ননদিনী হুকুম দিলেন, পাল্কি হটাও। বিশ্বনাথ জননীকে তখনই বাপের বাড়ি ফিরতে হয়। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “স্ত্রীর এই অপমান দেখে দুর্গাপ্রসাদ বসতবাড়ি ত্যাগ করে চলে গেলেন। পরে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন।”
কালের ব্যবধান অমান্য করে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের স্মৃতি আজও স্বামীজির ভিটেবাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আগন্তুক তীর্থযাত্রীরা এখন জানতে চান, বাড়ির কোন ঘরে একসময় সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদকে শেষবারের মতন বন্দি করে রাখা হয়?
কাহিনীটা এই রকম : উত্তর ভারত থেকে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টাটু ঘোড়ায় চড়ে কলকাতায় আসতেন। থাকতেন তার ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে, এই বাড়িটি একসময় তিনিই ভিক্ষাপুত্রকে দান করেছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, মতের পরিবর্তন হতে পারে এই আশায় ভ্রাতা কালীপ্রসাদ একবার তার সন্ন্যাসী ভাইকে ভিটেবাড়িতে এনে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখেছিলেন।
ফল ভাল হয়নি, বন্দি দুর্গাপ্রসাদ তিন দিন ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগলেন দরজা খুলে দেবার জন্য। এক সময় তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা শঙ্কিত হয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে বললেন।
বিশ্বনাথ দত্তের বাবা সেই যে গৃহত্যাগ করলেন, আর কখনও দত্ত বাড়িতে ফেরেননি। শোনা যায়, গৈরিক গ্রহণের পর বিদেশেযাত্রার আগে পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দকেও ভিটেবাড়িতে পদার্পণ করতে দেখা যায়নি। মা ও দিদিমাকে দেখতে তিনি যেতেন ৭ রামতনু বোস লেনের বাড়িতে, এই রামতনু বসু ছিলেন দিদিমা রঘুমণি দাসীর পিতামহ।
দুর্গাপ্রসাদের কোষ্ঠিতে একটি ইঙ্গিত পরিবারের মধ্যে বিশেষ আশা জাগিয়েছিল, জাতক ৩৬ বছর বয়সে গৃহে ফিরে আসবেন। অত্যন্ত বিস্ময়ের কথা, ঠিক ঐ বয়সেই দুর্গাপ্রসাদ পরিবারের জনৈক সভ্যের হাত দিয়ে তার ভিক্ষাপাত্র ও জপমালা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এই লক্ষণ দেখে প্রতিবেশীরা শ্যামাসুন্দরীকে পরামর্শ দিলেন, দুর্গাপ্রসাদের মধ্যাহ্নিক শয়নের সময়ে গিয়ে তাঁর পদসেবা করতে।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও নায়কের বিদেশযাত্রার পূর্বে স্ত্রীর পদসেবার একটি মনোগ্রাহী ছবি এঁকেছেন বিশ্বনাথ। শ্যামাসুন্দরীর ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামীর সেবা প্রচেষ্টার ফল মোটেই ভাল হয়নি। পারিবারিক বর্ণনাটা এইরকম : “শ্যামাসুন্দরী স্বামীর ঘরে গিয়ে তাঁর মশারি তুলে পদসেবা করবার চেষ্টা করতেই দুর্গাপ্রসাদ চীৎকার করে বলে উঠলেন, চণ্ডালী আমাকে স্পর্শ করেছে। একথা বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর আর তিনি দেশে আসেন নি।”
যে রায়বাঘিনী ননদিনীর হাতে দুর্গাপ্রসাদের পত্নী শ্যামাসুন্দরী প্রায়ই নিগৃহীতা হতেন তার সূত্র ধরেই দত্তদের ভিটেবাড়িতে নানারকম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটে।
রামমোহনের এই কন্যাটির বিয়ে হয়েছিল খুবই বড়লোকের বাড়িতে। একদিন পুকুরে স্নান করতে যাবার সময় জামায়ের সঙ্গে এক গণকের দেখা হলো। এই গণকটি ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন, সর্পদংশনে শীঘ্রই তার মৃত্যু হবে। সময় নষ্ট না করে নিরুপায় জামাতা সামনের এক কুমোরের দোকানে গিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা মাটির হাঁড়ি কিনলেন এবং আর কিছু না পেয়ে সেই হাঁড়ির ওপরে উইল লিখলেন যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি পাবেন তার বালবিধবা।
বিধির বিধানে জামাতা সত্যিই হঠাৎ মারা গেলেন। শোকাহত রামমোহন তখন সদ্যবিধবা কন্যা, মাটির হাঁড়িতে লেখা উইলটি ও কন্যার শ্বশুরবাড়ির শালগ্রামশিলাটি নিয়ে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়িতে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মধ্যে বারুইপুরের চৌধুরীরা প্রয়াত জামায়ের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আদালতে মামলা করলেন।
এই মামলা চলেছিল তিন প্রজন্ম ধরে এবং শেষপর্যন্ত রামমোহনকন্যারই জয় হয়েছিল। কিন্তু মামলার খরচ সামলাতে গিয়ে লাখ টাকার সম্পদ কমতে কমতে যোলো হাজার টাকায় দাঁড়ায়।
উইল বা পারিবারিক সম্পত্তির পার্টিশন মামলায় সেকালের কলকাতায় এরকম আর্থিক সর্বনাশই হতো। উইল করা সম্পর্কে বিশ্বনাথ দত্তের ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে সুন্দর একটি দৃশ্য আছে। সেখানে উইলের চমৎকার বাংলা করা হয়েছে ‘মানসপত্র’–এই শব্দটির বদলে এখন সাধারণত আমরা ব্যবহার করে থাকি ইচ্ছাপত্র।
দুর্গাপ্রসাদ সংসার ত্যাগ করার পরে সংসারের প্রধান হলেন তার ছোটভাই কালীপ্রসাদ দত্ত। এঁর পত্নীর নাম বিশ্বেশ্বরী, ইনি জয়নগর ২৪ পরগনার মেয়ে। কালীপ্রসাদের নিজস্ব উপার্জন ছিল না, রোজগারের একমাত্র সূত্র দত্ত পরিবারের সম্পত্তির থেকে আয়। খাজনা এবং ভাড়া থেকে চলতো দুর্গাপ্রসাদহীন সংসার।
যথাসময়ে দত্ত ভিটেতে আরও একটি আইনি সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সেকালের হিন্দু আইন অনুযায়ী সন্ন্যাসীদের পারিবারিক সম্পত্তির কী অবস্থা হবে? হিন্দু আইন মতে কেউ বারো বছর নিরুদ্দিষ্ট থাকলে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আদালতের আদেশে তাকে মৃত ঘোষণা করা যায়। স্বামীজির পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের ক্ষেত্রেও এই পথ অনুসরণ করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই মামলাটির কাগজপত্র এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
সিমলে দত্ত পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের স্পষ্ট অভিযোগ, কালীপ্রসাদ তার সন্ন্যাসী দাদার ছেলেকে তেমনভাবে দেখাশোনা করেননি, ফলে অত্যন্ত অযত্ন ও অবহেলায় বিশ্বনাথের ছোটবেলা কেটেছিল।
ভূপেন্দ্রনাথ অবশ্য তার বাবার ধনবান মামার বাড়ির কিছু খবরাখবর আমাদের দিয়েছেন। শ্যামাসুন্দরীর পিতৃদেব সেকালের ডাকসাইটে ব্যক্তিত্ব রাজীবলোচন ঘোষ ছিলেন ভারত সরকারের তোষাখানার দেওয়ান। এঁর আর্থিক সমৃদ্ধি সম্বন্ধে ছড়া ও গান নাকি একসময় প্রাচীন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় লোকের মুখে মুখে ফিরত।
ছ’বছর বয়সে দুর্গাপূজার সময় মামার বাড়িতে গিয়ে বিশ্বনাথ নাকি চরম অপমানের পাত্র হন। তাঁর জামাকাপড় ভাল না থাকায়, বালকটি যে এবাড়ির ভাগ্নে তা কয়েকজন অভ্যাগতর কাছে মামার বাড়ির লোকরা চেপে গিয়েছিলেন। নিদারুণ মনোকষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বালক বিশ্বনাথ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন এবং শোনা যায় এরপর তিনি আর কোনোদিন মামার বাড়িতে পা দেননি।
সংসারত্যাগী দাদার নিঃসহায় স্ত্রী-পুত্রর সঙ্গে ভাই কালীপ্রসাদ কী ধরনের ব্যবহার করেছিলেন তার আরও কিছু বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। কালীপ্রসাদ একবার মামলার খরচ চালানোর জন্যে ভ্রাতৃবধূ শ্যামাসুন্দরীর বেশ কিছু গহনা নিয়ে গিয়ে দোকানে বন্ধক রেখে নগদ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন।
বিবেকানন্দ-পিতার উপন্যাসে এমন একটি দৃশ্য আছে যেখানে উপার্জনহীন গৃহকর্তা তাঁর ভ্রাতৃবধুর গহনা চাইছে। দত্ত ভিটেবাড়িতে গহনা বার করে দেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য অত সহজ হয়নি। শ্যামাসুন্দরী যখন গহনা ফেরত দেবার জন্যে চাপ দিতে লাগলেন তখন অনন্যোপায় কালীপ্রসাদ বালক বিশ্বনাথের নামে কয়েকটি তালুক লিখে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, চোদ্দ বছরের বালক বিশ্বনাথকে লাঠিয়াল সহ তালুকের দখল নিতে যেতে হয়েছিল। পরে দেখা গেল তালুকসংক্রান্ত দলিলে বহু গোলমাল আছে।
কালীপ্রসাদের লোভ ও বোকামির শেষ ছিল না। এই বাড়িতে ভূবনেশ্বরীর বিয়ের আগে কালীপ্রসাদ এক ভণ্ড তান্ত্রিকের খপ্পরে পড়েছিলেন। তিনি নাকি কয়লাকে হিরেয় রূপান্তরিত করতে পারেন কিছু পয়সা পেলে। কালীপ্রসাদ দত্ত সরল মনে এই অষ্টসিদ্ধ যোগীর পিছনে তখনকার দিনে আঠারো হাজার টাকা খরচ করেন।
.
বিশ্বনাথের বয়স যখন সতেরো তখন মাতামহ রাজীবলোচন ঘোষের দেহাবসান ঘটে। পিতৃসান্নিধ্যে বঞ্চিত নাতিকে তিনি একটি বাগানবাড়ি লিখে দিয়ে যান, কিন্তু কিছুদিন পরেই বিশ্বনাথের বড়মামা বাড়িতে এসে ভাগ্নের কানে কানে কী বললেন, বিশ্বনাথ সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পত্তি মামাকে লিখে দিলেন।
পরবর্তী সময়ে স্বামীজির মা অল্পবয়সী স্বামীর এই কাজকে সমর্থন করতেন। তার ধারণা ছিল, মামাকে লিখে না দিলে, দত্তবাড়ির শরিকরা এই সম্পত্তি বিশ্বনাথের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন।
মধু রায় লেনে সিমুলিয়ায় দত্তপরিবারের একটা যৌথ সম্পত্তি ছিল। কালীপ্রসাদের অনুরোধে বিশ্বনাথ এই সম্পত্তিতে তার ভাগটা কাকাকে লিখে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই ভূবনেশ্বরী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে সব সম্পত্তি লিখে দিলে নিজের ছেলে, মেয়ে, বউয়ের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিন্তু সংসারবিরাগী বাবার অনুপস্থিতিতে যে কাকা তাকে ছোটবেলায় মানুষ করেছেন তার প্রতি বিশ্বনাথের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন। ছোট বয়সে যিনি আমাকে দেখেছেন তিনি চাইলে দেহের মাংস পর্যন্ত কেটে দিতে পারি, এই হল কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথের মনোভাব।
কাকার দেহাবসান পর্যন্ত বিশ্বনাথের এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে তিনি বড়ছেলে নরেনের কাছে নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখেননি, গভীর দুঃখের সঙ্গে তিনি বর্ণনা করতেন, কাকা এবং তার পরিবারের কাছে তিনি কীভাবে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পাঠক বসুপরিবারের তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠ ভজহরির মধ্যে সিমুলিয়ার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের কালীপ্রসাদকে খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
আরও এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য। দত্তপরিবারের প্রথম চারপুরুষ সকলেই রাম রামনিধি, রামজীবন, রামসুন্দর, রামমোহন। আর বিশ্বনাথের লেখা উপন্যাসের আদিচরিত্র কেনারাম ও প্রধান চরিত্র রামহরি।
পিতৃদেব কেনারাম বসুর আশি বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জমিজমা বাগবাগিচা ও তালুক ছাড়াও নগদ নিতান্ত কম ছিল না। তাছাড়া সম্পত্তির বাৎসরিক আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা এমন এক সময়ে যখন বাৎসরিক চার হাজার টাকা আয়ের লোকরা নিজেদের বড়মানুষ বলে গণ্য করতেন।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের মধ্যে লেখক বিশ্বনাথ দত্ত লুকিয়ে আছেন? উপন্যাস শেষ করে পাঠক-পাঠিকারা অবশ্যই তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন। আপাতত বলা যেতে পারে, একটি নয়, দুটি চরিত্রে তার ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলি বারবার উঁকি মারছে। একটি অবশ্যই নায়ক রামহরি–সেই চরিত্রে আছে তার জীবনসংগ্রাম ও নানা সংঘাত। গল্প একটু এগোলেই কিন্তু মনে হয়, রামহরির একমাত্র সন্তান সুরথনাথের মধ্যেও লেখক বিশ্বনাথ উঁকি মারছেন। বিশ্বনাথের বাল্য, যৌবন ও জীবনসায়াহ্নের ঘটনাবলি একটু বিস্তারিত জানা থাকলে চরিত্ৰবিচার সহজতর হতে পারে।
সরলমনে গরিব ছেলেটি উত্তর করল, “আমার বাবা বারাণসীতে থাকেন। তিনি আমার জন্যে জুতো পাঠাবেন। এখনও জুতো আসেনি, এলেই পরবো।” আমরা জানি পিতা দুর্গাপ্রসাদ তখন বারাণসীতে মঠাধীশ। গৌরমোহন আঢ্যের ইস্কুলেই বিশ্বনাথের শিক্ষক ছিলেন রসিকচন্দ্র চন্দ্র। বিধির বিধানে পরবর্তীকালে এঁরই পুত্র কালীপ্রসাদ চন্দ্র স্বামী অভেদানন্দ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কালীবেদান্তি ছিলেন স্বামীজির প্রিয়বন্ধু ও গুরুভাই। স্বামীজি তাঁর এই গুরুভাইকে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য আহ্বান করেছিলেন।
‘জুনিয়র’ ও ‘সিনিয়র’ পরীক্ষা পেরিয়ে কোনো এক সময়ে বিশ্বনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, অর্থোপার্জনের জন্য বিশ্বনাথ কিছুদিন ব্যবসায়ে হাত পাকিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন সুবিধে করতে পারেননি।
পরবর্তী পর্যায়ে তার ওকালতিজীবনও আমাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যেত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তী উচ্চ আদালতের রেকর্ড ঘেঁটে কিছু আলোকপাত করে গিয়েছেন। আর আছে কলকাতা হাইকোর্টে বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আবেদনপত্র যেখানে মায়ের সঙ্গে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই আবেদনের তারিখ কলকাতায় সুলোচনা প্রকাশের প্রায় সাড়ে চার বছর পরে।
মামলা মোকদ্দমার ছায়া থেকে সিমুলিয়ার দত্তরা কখনও নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের বিষয়-সম্পত্তি অধিকারের জন্য হাইকোর্টের মামলায় দীর্ঘ বারো বছর তার কোনো সংবাদ বা সন্ধান না পাওয়ার অভিযোগে তাঁকে আইনমতে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।
কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তের সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজখবরের জন্য ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র একসময় মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হন। ফণীভূষণের ৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ তারিখের লিখিত বিবরণ সব সন্দেহের অবসান ঘটায়। ব্যাপারটা এই রকম :
আদালতের কাগজপত্রে বিশ্বনাথের ইংরিজি বানান Bisso Nath Dutt: ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি বার্নের্স পিককের কাছে এটর্নি ও প্রক্টর হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য তিনি আবেদন করেন। প্রক্টর শব্দটির আভিধানিক অর্থ মকদ্দমার তদ্বিরকারি আম-মোক্তার হিসেব অনুযায়ী পুত্র নরেন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর।
আদালতের আবেদনপত্রের বাঁদিকে লেখা হয়েছে “তাই হোক” (বি ইট সো)–যে বিচারক বিশ্বনাথের আবেদনপত্র মঞ্জুর করেন তার নাম মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। তখন কলকাতা হাইকোর্টের লেটারস্ পেটেন্ট ১৮৬২ অনুযায়ী বিচারকের সংখ্যা তেরো জন। মরগ্যান পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ জাস্টিস হন।
পিটিশনের সঙ্গে জমা দেওয়া পরীক্ষকদের সার্টিফিকেট (১২ মার্চ ১৮৬৬) থেকে দেখা যায় এটর্নি মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পল-এর কাছে বিশ্বনাথ আর্টিকেল্ড ছিলেন। এঁর নামানুসারেই সম্ভবত ৬ ওল্ড পোস্টপিস স্ট্রিটের বিখ্যাত টেম্পল চেম্বার্স ভবনের নামকরণ হয় যেখানে প্রায় এক শতাব্দী পরে আমি ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল মহোদয়ের বাবু বা ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিই।
দেখা যাচ্ছে, মিস্টার চার্লস এফ পিটারের কাছে বিশ্বনাথ দত্তের আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপের শুরু ১১ এপ্রিল ১৮৫৯–শেষ ৩১ জুলাই ১৮৬০। প্রায় ছ’মাসের ব্যবধানে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) তিনি আর্টিকেল হন মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পলের কাছে। এই বিখ্যাত এটর্নির অধীনে তিনি থাকেন ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত। এটর্নি হিসেবে নথীভুক্ত হবার আবেদনের সঙ্গে দুটি চরিত্র সার্টিফিকেট (দুটিরই তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫) দেন শ্রী গ্ৰীশ (গিরিশ) চুন্দার (চন্দ্র) বনার্জি ও শ্রী দিগম্বর মিটার। এই গিরিশই পরবর্তীকালে বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বনার্জির পিতৃদেব। দিগম্বর মিটার পরে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণের রিপোর্টে পরলোকগত বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর (Bhubannessary Dassee) ১১আগস্ট ১৮৮৬র লেটারস অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদনের বিবরণ আছে। এই আবেদনপত্রে সম্মতি জানিয়ে সই করেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
পরের দিনই (১২ আগস্ট ১৮৮৬) এই আবেদন গৃহীত হয়। আবেদনপত্রের তিন নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে বিশ্বনাথের বিধবা ছাড়া তিন পুত্রসন্তান রয়েছে, এদের নাম নরেন্দ্রনাথ (২২ বছর) ও নাবালক মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথ। প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকে স্পষ্ট যে বিশ্বনাথ দত্ত কোনো উইল রেখে যাননি–তাঁর দেহাবসান হাইকোর্ট রেকর্ড অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
কলকাতা কর্পোরেশনের ডেথ রেজিস্টারে বিশ্বনাথের মৃত্যুদিন শনিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি, বয়স ৫২, মৃত্যুর কারণ বহুমূত্র রোগ, মৃত্যুকালীন বাসস্থান ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট। (পীড়ার পূর্বে নিবাস : একই।) সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কর্পোরেশন রেকর্ড অনুযায়ী মৃত্যু রেজিসট্রির তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
অনুসন্ধানী লেখক চিত্রগুপ্ত দত্তবাড়ির আদালতি কাগজপত্র অনেক খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পান। বিশ্বনাথ সম্পর্কে তার মন্তব্য : “আয় আশানুরূপ হলেও বেহিসেবী এবং অপরিণামদর্শী হওয়ায় তিনি দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসে, যার পরবর্তী নাম মধ্যপ্রদেশ। প্রবাসে থাকাকালীন তিনি কিছুদিন পাঞ্জাবেও ওকালতি করেছিলেন।”
১৮৭৯ সালে বিশ্বনাথ কলকাতায় ফিরে এসে আবার আইন প্র্যাকটিশ শুরু করেন। পরবর্তীকালে স্বামীজির কাকা তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী যে মামলা করেন সেই আবেদনে অভিযোগ, বিশ্বনাথ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ১৮৭১ সালের মাঝামাঝি কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর বিরুদ্ধে পাওনাদারদের কয়েকটি ডিক্রি জারির আশঙ্কায় তিনি সাত বছর প্রবাসে কাটান।
জ্ঞানদাসুন্দরীর অভিযোগের জবাবে ভূবনেশ্বরী আদালতে যে বক্তব্য দাখিল করেন তার মর্মার্থ : “আমার স্বামী বিশ্বনাথ দত্ত, এই মামলার বাদী জ্ঞানদাসুন্দরীর স্বামী তারকনাথ দত্ত এবং তারকের সহোদর ভাই কেদারনাথ দত্ত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে থেকে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন। আমার স্বামী বিশ্বনাথ শেষজীবনে কলকাতা ছেড়ে উত্তর পশ্চিম প্রদেশে চলে গিয়ে কয়েক বছর সেখানে আইনজীবীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সে সময়ে আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসতবাড়িতেই ছিলাম। আমার এবং আমার পোষ্যদের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ আমার স্বামী পাঠানে। একথা অত্যন্ত অসত্য ও অমূলক যে তারকের আনুকূল্যে আমার ও আমার ছেলেমেয়েদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হত, বিশেষ করে যখন আমার স্বামী প্রবাসে ছিলেন। তবে, একথা সত্যি যে আমার স্বামীর অনুপস্থিতে তারকনাথ সংসারের কর্তা হিসেবে আমাদের দেখাশোনা করতেন।”
বিবেকানন্দজননীর আদালতে এইসব নিবেদন বিশ্বনাথের দেহান্তের কয়েকবছর পরে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সুলোচনা’ উপন্যাসে বিশ্বনাথ এই ধরনের ছবিই এঁকেছেন। ভাই কাজের সূত্রে বিদেশ গিয়েছে, সেখানে বেশ ভাল উপার্জন করেন এবং সেই টাকা অভিভাবক দাদার কাছে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু তিনি ও তার পরিবার তা হজম করে ফেলেন। ভ্রাতৃবধূর দৈনন্দিন জীবনে কষ্টের অভাব নেই।
ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ কি মানসচক্ষে অনাগত ভবিষ্যৎকে দেখে ফেলেছিলেন? দত্ত পরিবারের বৃহৎ পারিবারিক বিরোধের বিবরণ দেওয়ার পূর্বে জ্ঞাতিদের সম্বন্ধে আরও কিছু বিবরণ সংগ্রহ করা মন্দ হবে না। দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই কিছুটা জেনেছি। কালীপ্রসাদের দুই পুত্ৰকেদারনাথ ও তারকনাথ। কেদারনাথের এক কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে দুই পুত্র (হাবুবাবু ও তমুবাবু) সঙ্গীতজগতের নামকরা ব্যক্তিত্ব। জেনে রাখা ভাল জগদ্বিখ্যাত আলাউদ্দীন খাঁ সায়েব এ বাড়িরই শিষ্য। রামকৃষ্ণভক্ত হাবুবাবু, ঠাকুরের দেহাবসানের পরে তাঁর অস্থি দিয়ে একটি জপমালা তৈরি করেছিলেন। এঁদের ছোটভাই শরৎচন্দ্র ১৬ বছরে মারা যান।
কেদারনাথের ভ্রাতা তারকনাথের স্ত্রীই পরবর্তীকালে স্বামীজির মায়ের নামে মামলা আনেন। এঁদের একপুত্র ও ছয় কন্যা। তারকনাথ একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বসত সেখানে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন। পরে বি এল পাশ করে তিনি হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তারকনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির হয়ে ওকালতি করতেন, সেই সূত্রে তার মেয়ের বিয়েতে দেবেন্দ্রনাথ ও বিখ্যাত ঠাকুররা দত্তবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে আসলে। হয়তো বাংলার যৌথপরিবারে, এমন ব্যাপার সেযুগে প্রায়ই ঘটতো।
ভুক্তভোগী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত দুঃখ করেছেন, “পারিবারিক কাহিনীর গোপন তথ্য এখানে প্রকাশ করবার উদ্দেশ্য, হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যক্ত করা। যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার প্রথার পবিত্রতা সম্পর্কে গলাবাজি করে থাকেন তারা হয় এর বাস্তব অবস্থার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন, নতুবা পারিবারিক কলহ বিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী উপেক্ষা করে থাকেন। ব্যবসায়িক ও শিল্পনীতিক সমাজে এই প্রথা এখন অচল। বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালুরাখার সপক্ষে কোন কারণই থাকতে পারে না।”
সিমুলিয়ার দত্তবাড়ির অবস্থান কলকাতার ছয়ের পল্লীতে, যাকে বাংলার এথেন্স বলা হতো। কারণ যথেষ্ট। এই এথেন্সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রমেশচন্দ্র দত্ত, তরু দত্ত, অরু দত্তর জন্ম। পুরো উত্তর কলকাতা ধরলে এক সহস্র নামেও বিশিষ্টদের তালিকা শেষ হবে না। দত্তদের বংশে বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য : নরেন্দ্রনাথের পিতৃপুরুষের বংশে প্রভূত বিত্তশালী, সন্ন্যাসী, সরকারি চাকুরে, জনকল্যাণমূলক কার্যে ও দেশ সেবায় আত্মনিয়োগকারী মহান ব্যক্তিরা জন্মেছেন। আবার সাধারণ গৃহীর বেশে কেউ কেউ গুপ্তযোগীরূপে জীবনযাপন করেছেন।”
কলকাতা হাইকোর্টে জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম ভূবনেশ্বরীর মামলার শুনানি শুরু হয় বিশ্বনাথের দেহাবসানের কয়েক বছর পরে ১৮৮৭ সালের গোড়ায়।
এই মামলায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টারের জেরার সম্মুখীন হন ৮ মার্চ ১৮৮৭।
এই মামলার বীজবপন ও ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ কীভাবে হলো তার কিছু বিবরণ রয়েছে আমার ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইয়ের প্রথম অংশে। সেই বিবরণের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
শুধু এইটুকু বলা যায় বিচারপতি ম্যাকফারসন তার রায়ে বলেন, বিশ্বনাথ, যিনি পাওনাদারদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তিনি ১৮৭৯ সালে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে যৌথপরিবারেই আশ্রয় নেন। মধ্যবর্তী সময়ে তিনি পাঞ্জাব ও মধ্যপ্রদেশে ওকালতি করেন। তবে প্রমাণিত হয়েছে, প্রবাসে উপার্জনকালে বিশ্বনাথ দত্ত তাঁর স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। এই মামলায় বিতর্কিত বিষয় সম্পত্তি জ্ঞানদার স্বামী তারকনাথ কি তাঁর ভ্রাতৃবধূ ভূবনেশ্বরীর বেনামীতে কিনেছিলেন অথবা তা বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরী নিজেই কিনেছিলেন তার স্বামী বিশ্বনাথের পাঠানো টাকায়? শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়, জ্ঞানদাসুন্দরী তার অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যাঁরা এই মামলা সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চান তারা জেনে রাখুন, তারকনাথের একটি চিঠি তাঁর স্ত্রীর মামলাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই চিঠিতে তারকনাথ নিজেই পরিবারের একজনকে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, “শরিকী সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।”
আরও প্রমাণ হয়, ১৮৭৯ সালে কেনা সম্পত্তি কালেকটরেট অফিসে নথিভুক্ত করার সময় তারকনাথ সানন্দে ভূবনেশ্বরীর হয়ে আদালতে উকিলের কাজ করেছিলেন। পরের বছর অবশ্য ভূবনেশ্বরী তার স্বামীকেই অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেছিলেন।
এই পরবর্তী সময়টি ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পক্ষে খুবই মূল্যবান। সম্ভবত এই সময়েই ‘সুলোচনা’ রচিত হয়। ভূপেন্দ্রনাথ ভুল করে বলেছেন, বইয়ের প্রকাশকাল ১৮৮০। আসলে উপন্যাসের প্রকাশের বছর ১৮৮২।
১৪ মার্চ ১৮৮৭ আদালতের রায়ে পরাজিত হয়ে জ্ঞানদাসুন্দরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ আপীল আদালতে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রেখে দিলেন।
এই মামলা চলার সময় টানা একবছর নরেন্দ্রনাথকে নিয়মিত কলকাতা হাইকোর্টে ছুটতে হয়েছিল। শোনা যায় তিনি পায়ে হেঁটে হাইকোর্টে যেতেন এবং পরে মায়ের কাছে সবিস্তারে সব ঘটনার বিবরণ দিতেন। আমাদের এই দেশে মহামানবরা সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও পার্থিব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেন না। এই ১৮৮৭ সাল সন্ন্যাসী ও সাধক বিবেকানন্দর জীবনে স্মরণীয় সময়। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বিরজাহোম করে নরেন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম সন্ন্যাস নাম বিবিদিষানন্দ গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরের কোনোসময় চিরতরে গৃহত্যাগ করেন।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনা : “কালীপ্রসাদ একদিকে ছিলেন অমিতব্যয়ী, অপরদিকে তেমনি ভ্রাতুস্পুত্র বিশ্বনাথের আয়ের উপর রাখিতেন পূর্ণ দাবি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি তিনি তো নষ্ট করিতেনই, অধিকন্তু বিশ্বনাথের অর্থেও ভাগ বসাইনে। শেষদিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁহার কলিকাতার এটর্নি অফিসের উপর নজর রাখিতে পারিতেন না। জনৈক বন্ধুর উপর উহার ভার অর্পণ করিতে বাধ্য হন। বন্ধু এই সুযোগে বিশ্বনাথবাবুর নামে ঋণ করিয়া সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করিতে থাকেন। …বিশ্বনাথের জীবনসন্ধ্যায় যৌথপরিবারে মনোমালিন্য বর্ধিত হওয়ায় তাহাকে বাস্তুভিটা ছাড়িয়া স্ত্রীপুত্রসহ পৃথক অম্নের ব্যবস্থা করিতে হয় এবং তজ্জন্য অস্থায়ীভাবে ৭ নং ভৈরব বিশ্বাস লেনের এক ভাড়াবাড়িতে চলিয়া যাইতে হয়। নরেন্দ্র তখন (১৮৮৩) বি. এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। …ইহারই কোন এক সময়ে তিনি পিতার আদেশে পিতৃবন্ধু নিমাইচন্দ্র বসু মহাশয়ের অফিসে এটর্নির কাজ শিখিবার জন্য শিক্ষানবিশরূপে ভর্তি হইয়া প্রতিদিন পিতা ও খুল্লতাতের সহিত অফিসে বাহির হইতে থাকেন।”
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য আরও স্পষ্ট। “কাকা ও কাকীমার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে” একান্নবর্তী পরিবার থেকে ছিন্ন হওয়ার কোন ইচ্ছা বিশ্বনাথের ছিল না। তাই ভূবনেশ্বরীর প্রতি অন্যায় ও অসম ব্যবহার চলল দীর্ঘদিন।
বিশ্বনাথের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পূর্বে কাকার পরিবার সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে তাঁকে পৃথক করে দেন। পৃথক হবার পর আমাদের পরিবার সাময়িকভাবে ৭নং ভৈরব বিশ্বাস লেনে বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করেন। সেখানে থেকেই নরেন্দ্রনাথ বি এ পরীক্ষার জন্য পড়া তৈরি করেছিলেন।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কাহিনীতে যে অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা আছে তা এখানে ফাস করে সাসপেন্স নষ্ট করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। তবু মূল গল্পের পটভূমির আরও একটু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
কিন্তু তার আগে বিশ্বনাথের জীবনের অন্তিমপর্ব ও তার থেকে তার স্ত্রীপুত্রদের দুঃখজনক শিক্ষা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।
অভিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন বিশ্বনাথ, তার খ্যাতি এতোই ছিল যে দেহাবসানের কিছু আগে হায়দ্রাবাদের নিজামের এজেন্টরা একটা মামলায় বিশ্বনাথকে হায়দ্রাবাদে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন। “স্থির হয়েছিল যে, তিনি মাঘমাসের শেষে হায়দ্রাবাদে রওনা হবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।”
বাংলার বাইরে থাকাকালে বিশ্বনাথ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হন–পরবর্তীকালে স্বামীজিও এই ব্যাধির শিকার হন।
আমাদের ধারণা স্বামীজির এই রোগ আমেরিকায় ধরা পড়েনি, তার ডায়াবিটিস ধরা পড়ে প্রথমবার দেশে ফেরার পথে কলঘোয়। কিন্তু রোমা নোলাঁর মতে স্বামীজির ডায়াবিটিসের লক্ষণ দেখা যায় সতেরো-আঠারো বছর বয়সে। তবে স্বামী গম্ভীরানন্দর সিদ্ধান্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ ক্লাশে পড়ার সময় তার প্রায়ই ম্যালেরিয়া হতো। প্রমাদাস মিত্রকে নরেন বাবাজী সম্পর্কে লেখা একখানি চিঠিতে ‘পুরনো রোগের উল্লেখ থেকে গবেষক শৈলেন্দ্র নাথ ধরের আশঙ্কা ইঙ্গিতটা ডায়াবিটিসের দিকে।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে বিশ্বনাথের অন্তিমপর্বের বর্ণনা এই রকম : “মৃত্যুর একমাস পূর্বে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী শয্যাগ্রহণ করেন। ইহার পরেই একটি কার্যস্থলে যাইতে হয়। সেখান হইতে ফিরিয়া পত্নীকে বলেন যে, মক্কেল তাঁহাকে বহুদূরে আলিপুরে দলিলপত্র দেখাইতে লইয়া গিয়াছিল, তিনি হৃদয়ে বেদনা অনুভব করিতেছেন। অতঃপর রাত্রে আহারের পর বুকে ঔষধ মালিশ করাইয়া তামাক সেবন করিতে করিতে তিনি কিছু লেখাপড়ার কাজে মন দেন; নয়টায় উঠিয়া বমি করেন এবং তারপরেই রাত্রি দশটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়।”
স্বামীজির ইংরিজি জীবনী গ্রন্থ ‘দ্য লাইফ’-এ বলা হয়, বি এ পরীক্ষার ফল বেরুবার আগে পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু হয়। শৈলেন্দ্রনাথ ধর অনুসন্ধান করে জানিয়েছেন বিশ্বনাথের মৃত্যুর অন্তত তিন সপ্তাহ আগে বি এ পরীক্ষার ফল বের হয়। ঐ বছর বি এ পরীক্ষা শুরু ৩১ ডিসেম্বর ১৮৮৩, গেজেটে ফল প্রকাশ ৩০ জানুয়ারি ১৮৮৪। বিশ্বনাথের দেহাবসান ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
অভিজ্ঞ আইনজীবী হয়েও বিশ্বনাথ কোনো উইল করেননি। ফলে মক্কেলদের কাছ থেকে পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্যও ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সময় ও অর্থব্যয় হলেও এর একটা সুবিধা আমরা পেয়েছি, হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদনপত্রে ভূবনেশ্বরী দাসীর বাংলা স্বাক্ষর এবং তার তলায় ইংরিজিতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের স্বাক্ষরের অমূল্য দলিলটি, যা আজও কলকাতা হাইকোর্টে সংরক্ষিত আছে।
১১ আগস্ট ১৮৮৬তে লেটার্স অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের এই আবেদনে ভূবনেশ্বরী বলেন, মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামী কোনো উইল করেননি। এইরকম কোনো দলিল তার অফিসে বা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই আবেদনের সময় নরেন্দ্রনাথের বয়স বাইশ, অন্য দুই ভাই নাবালক। বিশ্বনাথের কয়েকজন মক্কেল যাঁদের কাছে টাকা পাওনা আছে তাদের নাম ঠিকানার বিবরণ এই আবেদনে আছে। তাদের নিয়ে কোনো অনুসন্ধান আজও হয়নি।
আবেদনপত্রে মায়ের বাংলা স্বাক্ষর সনাক্ত করে পুরো নাম সই করেন নরেন্দ্রনাথ। জানান, মায়ের দরখাস্ত তিনি পূর্ণ সমর্থন করছেন। এই মামলায় ভূবনেশ্বরীর অ্যাটর্নি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাস, ভুবনেশ্বরীকে সনাক্ত করেন কালীচন্দ্র দত্ত এবং ইংরিজি অনুবাদের বাংলা ব্যাখ্যা করে শোনান অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, ইনটারপ্রেটার।
দত্তরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে, চলতি ভাষায় কোথাও দেরেটোন, কোথাও দাড়িয়াটোন। দরিয়াটোনার দত্তরা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত, দক্ষিণ-রাঢ়ী কায়স্থদের যে ত্রিশটি সমাজ ছিল দরিয়াটোনার দত্তরা তাদের অন্যতম। কোনো নবাব বাহাদুর প্রীত হয়ে গ্রামের নাম দত্ত-দরিয়াটোনা বলে ঘোষণা করেন। স্বামীজির পূর্বপুরুষ রামনিধি এই দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় এসে গড়-গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করেন।
বিশ্বনাথের উপন্যাসের নায়ক রামহরির ঠিকানা : শৰ্ষা গ্রাম, জয়পুর পরগণা, জেলা নবদ্বীপ। আদিপুরুষ কেনারাম বসু, যাঁর সম্বন্ধে পাঠক পাঠিকারা ইতিমধ্যেই কিছুটা জানতে পেরেছেন। কেনারামের একটি উক্তি থেকে লেখকের মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করা যায় : “বাপের নাম জানিনে। পিতামহের নাম জানিনে কিন্তু চিনের বাদশার চোদ্দপুরুষের পরিচয় জানবার জন্য ব্যগ্র!”
কেনারাম বসুর জ্যেষ্ঠপুত্ৰ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ভজহরি তেরোটি পুত্রকন্যার পিতা। নায়ক রামহরি দ্বিতীয়পুত্র, তার একটি মাত্র সন্তান সুরথনাথ। অসামান্যা স্ত্রী সুলোচনার নামেই উপন্যাসের নামকরণ। সুলোচনার পিছনে কি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী উঁকি মারছেন? না বিশ্বনাথ জননী শ্যামাসুন্দরী? ব্যক্তিজীবনে শ্যামাসুন্দরীর একটি মাত্র পুত্র; ভূবনেশ্বরী চারপুত্র ও ছয়কন্যার জননী।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে নায়ক রামহরি ও সুলোচনার একমাত্র পুত্র সুরথনাথ। চরিত্রটির ওপর লেখক সব ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে পৈত্রিক বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রেখে রামহরি বসু একদা কর্মসন্ধানে দিল্লি পাড়ি দিয়েছিলেন।
বাড়ির কর্তা ভজহরি বসু সবসময়েই এত ব্যস্ত যে “মাথা চুলকাইবার” অবকাশ হতো না। এইপ্রসঙ্গে লেখকের ব্যঙ্গোক্তি : “শয্যা হইতে গাত্রোত্থান, নিত্যক্রিয়া সমাপন, মুহুর্মুহু তাম্রকুট ধূমপান, দণ্ডে দণ্ডে তীব্র মুখব্যাদান করিয়া হায়ি তোলা ইত্যাদি কর্মসমূহ একজন পুরুষের পক্ষে সাধ্য নহে।”
বসুদের যৌথ পরিবারে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মীনশীরাম গুরুমহাশয় ও ভোলো খানসামা। মুহুরি নশীরাম কেনারামের রেখে যাওয়া সম্পত্তির দেখভাল করতেন ও পাওনা টাকা আদায় করতেন। রেগে গেলে তিনি ভজহরিকে বলতেন, “আমি না থাকলে তোমার প্রত্যহ চারকাটা মুড়ি, দুরেক চালের ভাত কোথা থেকে হবে?”
রামহরি যেমন লেখাপড়ায় পটু তেমনি নম্র ও সুশীল। সাহেবী কোম্পানিতে একটা সামান্য কাজ নিয়ে প্রবাস যাত্রার উদ্যোগ করেছিলেন।
বিদায়কালে দাদা ভজহরিকে প্রণাম করে রামহরি অন্তঃপুরে গেলেন এবং দেখলেন প্রিয়তমা ভার্যা ধুলোয় পড়ে অশ্রুনয়নে ক্রন্দন করছেন, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছেন। সেকালের বাঙালি পরিবারের যেসব পুরুষ কর্ম উপলক্ষে বিদেশ যেতেন তাদের মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি এই উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে। রামহরি তার স্ত্রীকে প্রিয়পুত্র সুরথনাথের লেখাপড়ায় নজর রাখতে বললেন, সেই সঙ্গে বললেন, “আমি দাদার কাছে টাকা পাঠাবো। আর তোমার জন্যে লুকিয়ে প্রহ্লাদ সেনের (বন্ধু) কাছেও টাকা পাঠাব।”…বন্ধুর বিধবাভগ্নী “ক্ষমাদিদি এসে তোমার হাতে টাকা দিয়ে যাবে।”…পত্নী সুলোচনা আবার ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
প্রবাসে রামহরি যে কাজ করতেন তার মাইনে তেমন বেশি নয়। নায়ক ভাবছেন, এতো কম অর্থের জন্যে কেন বিদেশে আসা? বিশ্বনাথ যে তার নিজস্ব প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এইখানে বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা স্পষ্ট।
এই সময় একদিন দিল্লির প্রসিদ্ধ বণিক রঘুরামজী কুঠিওয়ালার সঙ্গে রামহরির যোগাযোগ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশে মাড়ওয়ারি বণিকদের বাণিজ্যপদ্ধতি সম্বন্ধে অতি চমৎকার একটা ছবি বিশ্বনাথের এই উপন্যাস থেকে আমাদের বাড়তি প্রাপ্তি। সমস্ত ভারতবর্ষে রঘুরামজীর কুঠি ও কারবার, তখনকার দিনে তার অর্থের পরিমাণ চার পাঁচ কোটি, যা একুশ শতকের গোড়ায় প্রায় হাজার কোটি টাকার মতন।
ব্যবসা ছাড়াও রঘুরামজীর ছিল “সুবিস্তারিত রোকড়ের ও বেণেতি কার্য।” ধনপতি কুঠিয়ালরা সেযুগে নিজের দেশের লোক ছাড়া কাউকে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি দিতেন না বলেই আমার ধারণা ছিল, কিন্তু বিশ্বনাথের উপন্যাস থেকে স্পষ্ট হচ্ছে এঁদের দু’একজন কৃতী বাঙালি কর্মীও থাকতেন।
চাকরির ইন্টারভিউতে রঘুরামজীর কাছে রামহরির সরল স্বীকারোক্তি, যে উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হয়েছিলেন তা সিদ্ধ হবার কোনো পথ দেখছেন না
। রঘুরামজীর স্মরণীয় মন্তব্য : “বাঙালি লোক ঝাঁকে ঝাঁকে এ অঞ্চলে আসছে। এরা শুনেছি লেখাপড়া জানে, কিন্তু এদের কর্মকাণ্ড দেখলে লেখাপড়ার কোনো ফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ পঁচিশ টাকার একটা চাকরি পেলেই এরা কৃতার্থ হয়। কিন্তু দেখো আমাদের দেশের লোক এমন নয়বাঁধা মাইনের চাকরি পাবার জন্যে এরা মরে গেলেও চেষ্টা করে না। এরা সকলেই কারবার করে খায়।”
দেখা যাচ্ছে, বিশ্বনাথ বর্ণিত বাঙালির বাণিজ্যমানসিকতা দেড়শ বছর আগের ভারতবর্ষে যা ছিল একুশ শতকেও তাই রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, সঙ্গতিহীন মাড়ওয়ারিরা কুঠি থেকে চটা সুদে কুড়ি পঁচিশ টাকা কর্জ করে বাংলায় যাচ্ছেন এবং দু’বছর পরে ধারের টাকা মিটিয়ে দিচ্ছেন। তারপর উত্তর ভারতের ভাগ্যসন্ধানী বণিকদের নির্ভরযোগ্য জীবনযাত্রা বর্ণনা, কলকাতার রাস্তায় এঁরা কাপড়ের গাঁট পিঠে করে বেড়ান। এঁরাই ক্রমশ হাউসের দালাল হন, কেউ কেউ নিজে কুঠিয়াল হন।
রঘুরামজীর প্রশ্ন : “তোমরা বল কাপড় বিক্রি ও দালালি ইতর কাজ–তবে কি মনে করো সাহেবের মুনসিগিরি সম্মানের কাজ?”
যে রঘুরামজীর ব্যবসায় রামহরি অবশেষে কাজ নিলেন তা আকারে বৃহৎ। হিন্দুস্থানের এমন জায়গা নেই যেখানে তার কুঠি বা কারবার নেই। দিল্লির সদর কুঠিতে প্রায় পাঁচশত কর্মচারী।
রঘুরামজীর ব্যবসার অতি আকর্ষণীয় বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসে, যা কেবল পাঠক-পাঠিকার ভাল লাগবে তা নয়, একালের বিজনেস ঐতিহাসিকদেরও কাজে লাগবে। মাড়ওয়ারি অফিসে তথাকথিত দেশওয়ালী কর্মীরা কিরকমভাবে তাদের মনিবের পয়সা আত্মসাৎ করত তার ছবিও রয়েছে। আর আছে শেয়ানে-শেয়ানে কোলাকুলি!
একটি চমৎকার চরিত্র হুকুমাদ সুখদয়াল, মীরাটে কুঠিয়াল। এই মীরাটেই অনেকদিন পরে লেখকের প্রিয় সন্তান যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ হিসেবে নানা ইতিহাস রচনা করবেন তা কে জানত?
সেকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভাল ছিল না। আমরা দেখেছি নাগপুর থেকে রায়পুর যেতে ভূবনেশ্বরী ও সন্তানদের একমাস লেগেছিল। দিল্লি থেকে কলকাতা আসতে পঁচিশ দিন লেগে যেতো সেইসময়। ফলে গল্পের রামহরি যে সাত আট বছর বাড়ি এলেন না, কেবল চিঠি লিখলেন এবং টাকা পাঠালেন সেটা তেমন কিছু আশ্চর্যজনক নয়।
কিন্তু যৌথপরিবারে স্ত্রীপুত্রের প্রকৃত অবস্থা রামহরি জানতে পারতেন না। স্ত্রী সুলোচনার কাছ থেকে যেসব চিঠি পেতেন তা অস্পষ্ট এবং কিছু কিছু মুছে দেওয়া।
সুলোচনা ভাল বাংলা লিখতেন, অথচ চিঠিগুলো বোধ হয় অন্য কারুর হাতে পড়তে এবং তিনি লেখার ওপর চিত্রবিচিত্র কেটে দিতেন। বিশ্বনাথের উপন্যাসের এই অংশ পাঠ করলে স্পষ্ট হয়, যৌথ পরিবারে প্রোষিতভর্তৃকা ভূবনেশ্বরী কিভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন এবং সন্তানদের নিয়ে মাঝে মাঝে তার কেমন অসহায় অবস্থা হতো। আজকের যুগের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যৌথপরিবারের এই ব্যাপারটা নিতান্ত অসম্ভব এবং অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা যৌথপরিবারের ঘটনাবলি সে যুগের লেখকদের রচনা থেকে পুনরুদ্ধার করছেন তারা জানেন কোনো কিছুই সে যুগে অসম্ভব ছিল না।
সুলোচনার শুভানুধ্যায়িনী, স্বামীর বন্ধুর অগ্রজা, গ্রামের বিধবা ক্ষমা দিদির মন্তব্য : “ওমা শুনছি দশ পনেরো দিন অন্তর আঁজলা-আঁজলা টাকা পাঠায়, কিন্তু মেজো খুঁড়ির হাল দেখে কান্না পায়রুক্ষ্ম মাথা, ময়লা কাপড়–আর দিন দিন যেন পোড়া কাঠখানা হয়ে যাচ্ছে।”
একই সঙ্গে নজর দেওয়া যাক, বিদেশে কর্মরত বিশ্বনাথের যৌথ পরিবারে-ফেলে-আসা স্ত্রীর ছবি। পরবর্তীকালে পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর স্বামী বিবেকানন্দ বইতে বলেছেন, তিনি মায়ের মুখ থেকে শুনেছেন, এমন সময়ও গেছে যখন ভূবনেশ্বরীকে একটিমাত্র শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে অথচ জায়েদের পরনে যথেষ্ট কাপড় থাকতো।
ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, সেকালের অনেক অ্যাটর্নির মতন বিশ্বনাথ আদালতের নীলাম থেকে কলকাতায় সম্পত্তি ক্রয় করে তা আবার বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রত্যেক সম্পত্তিই তিনি ভূবনেশ্বরীর নামে ক্রয় করতেন।
মহেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটভাইকে বলেছিলেন, আপার সার্কুলার রোডে মানিকপীরের দরগা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পিতৃদেব কিনেছিলেন ভূবনেশ্বরীর নামে। জননী স্বয়ং তার কনিষ্ঠ পুত্রকে বলেছিলেন, কারবালা ট্যাঙ্ক রোডের দরগা থেকে প্রত্যহ তিনি পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা প্রণামী পেতেন।
বিশ্বনাথ একসময় স্ত্রীর নামে সুন্দরবনে এগারো হাজার বিঘার বিস্তৃত তালুক কেনেন। কিন্তু খুড়শ্বশুর কালীপ্রসাদ তার ভ্রাতুষ্পত্রের বধূকে বলেন ‘তোমার কি বাবার তালুক’। ভূবনেশ্বরী বেশী কথা বলতেন না। এই গালি শুনে নরেন্দ্ৰজননী সম্পত্তির পাট্টাটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। আমরা জানি, বিশ্বনাথ পরে বুঝতে পারেন তার স্ত্রীর দুঃখ, পীড়া ও বেদনা। তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে একদিন প্রকাশ করলেন অভিযোগ, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”
এসব বলা সত্ত্বেও বিশ্বনাথ যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, ফলে ভূবনেশ্বরীর কষ্ট শেষ হয়নি। কিন্তু যা ঘটবার তা ঘটল যথাসময়ে। পারিবারিক সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য কাকার পরিবার বিশ্বনাথকে পৃথক করে দিলেন। এই সময়ে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান।
প্রায় একই পরিস্থিতিতে সুলোচনা উপন্যাসের যৌথপরিবারে কী হল এবং কীভাবে জটীল সমস্যার অপ্রত্যাশিত সমাধান হল তা এখানে ফাঁস করতে চাই না, তাতে উপন্যাসপাঠের আনন্দ ও আকর্ষণ কমে যেতে পারে। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে বসে একজন কথাসাহিত্যিক যে কাল্পনিক উপন্যাস লিখছেন তার প্রায় সমস্ত উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে একই বাড়ির বাস্তবতা থেকে।
শুভার্থিনী ক্ষমা দিদি সুলোচনাকে চুপি চুপি বলছেন, “তুই বলে এই ঘর করিস, আমরা হলে এতোদিনে কাপড় ফেলে পালাতুম।”
এরপরে ক্ষমাদি খবর দিচ্ছেন, “রাম বলেছে বেশি টাকা না পাঠিয়ে তোমার নামে একখানা তালুক কিনবে।”
সুলোচনার উত্তর : “তালুকের নাম শুনে তো আমার পেট ভরবে না।…বাপের এক মেয়ে বটে কিন্তু রোজ রোজ কে আব্দার শুনবে গা! লোক বলে, তুই বড় মানুষের মেয়ে, বড় মানুষের বউ, তোর দশা এমন কেন? তোর ভাবনা কিসের? লোকে তো ঘরের কথা জানে না তা বলবো কি বলল। রোজ রোজ বাবাকে কত বলে পাঠাবো বলো–আবার তিনি মনে করেন তাঁর মেয়ে কত সুখে ভাসছে।”
বিশ্বনাথ এই ডায়ালগে রামতনু বসু লেনে নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা বলেছেন কিনা তা পাঠক-পাঠিকারা বিবেচনা করে দেখবেন। কুঞ্জবিহারী দত্তর জ্যেষ্ঠা কন্যা রাইমণি, তার স্বামী গোপালচন্দ্র ঘোষ। গোপালচন্দ্রের একমাত্র সন্তান রঘুমণি। এঁর স্বামী নন্দলাল বসুই বিশ্বনাথের শ্বশুর। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে রামহরির শ্বশুরের নাম নিধিরাম সরকার। তিনি সম্মৌলিক কায়স্থ।
ক্ষমাদিদি মারফৎ দুঃখিনী সুলোচনা তার প্রবাসী স্বামীর কাছে যে খবর পাঠিয়েছিলেন তা আমাদের এই তুলনামূলক আলোচনার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ।”যদি তিনি আমাদের জ্যাস্ত দেখতে চান একবার যেন ফিরে আসেন–তার যক্ষের ধন নিয়ে কি স্বর্গে যাবো?”
সুরসিকা মাদিদির প্রতিশ্রুতি তিনি রামহরিকে খবর পাঠাচ্ছেন– “জনকনন্দিনী ধুলোয় পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন– এইবার বুঝি সীতা ঠাকরুণ প্রাণত্যাগ করেন।”
উপন্যাসকে অবলম্বন করে বাস্তবের ছবি আঁকা অপরাধ না হলে, বিশ্বনাথ তাঁর উপন্যাসে রামহরির তরুণ পুত্র সুরথনাথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কৌতূহলের উদ্রেক করে। সুদীর্ঘকায় কিন্তু কৃষ অথচ বাহুদ্বয়ের ও উরুদেশের অস্থি স্থূল ও সবল। গৌরাঙ্গ, মস্তকটি সুগঠিত ও সুগোল। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কোমল কেশাবৃত ললাট প্রশস্ত ও সুবিস্তারিত। যুগল সুব ধনুকের ন্যায় ঘন কেশরঞ্জিত, নেত্রদ্বয় সুদীর্ঘ ও ভাসমান।…গ্রীবা সমুন্নত ও স্কন্ধদ্বয় সুবিস্তারিত, দুই বাহু লম্বমান করিলে প্রায় দুই জানু স্পর্শ করিত। সুরথনাথের বয়স বোড়শ বর্ষ। ঠিক যে বয়সে স্বয়ং বিশ্বনাথ বিবাহ করেছিলেন উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের ভূবনেশ্বরীকে।
.
উপন্যাসে বসু পরিবারের ছেলেপুলেদের নামগুলি মজার–’ছেঁড়া’, ‘ভাঙ্গা’, ‘গোঁড়া, ‘খেঁদি’, ‘ভূতী’, ‘পদী’, ইত্যাদি।
পরবর্তী পর্বে রামহরি দেশে ফিরেছেন, সুলোচনা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বলতে লাগলেন।”ছেলেটির হাত ধরে পথের ভিখারিনী হয়ে বেড়াব?”
রামহরি তখনও যৌথপরিবারে বিশ্বাস হারাননি। “দেখো মেজো বউ, লোকে তোমার কথা শুনলে বলবে তুমি ঘর ভাঙতে চাও, আর তুমি দাদার ছেলেমেয়ের হিংসা করো। না হলে তোমার কান্নাকাটির কোনো কারণই তো দেখতে পাইনে।”
বিবেকানন্দপিতার উপন্যাসের সুবিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পুত্র সুরথনাথের বিবাহবর্ণনা।
উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বিবাহ উপলক্ষে যে বেহিসেবী কাণ্ডকারখানা চলত তার হৃদয়গ্রাহী কিন্তু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এই বিবাহবাসরের সঙ্গে স্বয়ং বিশ্বনাথের বসুপরিবারে বিবাহের তুলনীয় কিছু আছে কি না তা এতদিন পরে কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়; তবে পাঠকপাঠিকারা মানসচক্ষে একটা ধারণা করে নেবার স্বাধীনতা অবশ্যই দাবি করতে পারেন।
যাঁরা কল্পনার সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে দেখবার জন্য সব সময় তেমন ব্যস্ত নন তারা বুঝতে পারবেন, নানা পারিবারিক উৎসবের ঘূর্ণিপাকে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ে অষ্টাদশ, উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি কেন অর্থসঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীজি বলেছিলেন, যারা কখনও লাখ টাকার ওপর বসলো না তারা কেমন করে বৈরাগ্যে আগ্রহী হবে?
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে যৌথ পরিবারের নানা সমস্যা ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। লেখক নিপুণভাবে নানা ঘটনার মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন তা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব।
মূল উপন্যাসে যেমন সমস্যা আছে তেমন সমাধানসূত্রও রয়েছে। যথাসময়ে আসরে উপস্থিত হয়েছে এক সন্ন্যাসী। বাল্যকালে গৌরমোহন মুখার্জির ভিটে থেকে বেরিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসগ্রহণকারী পিতৃদেব দুর্গাপ্রসাদের কথাই কি অজান্তে বিশ্বনাথের কল্পনায় উপস্থিত হয়েছে? বড়ই কঠিন প্রশ্ন। তবে গল্প-উপন্যাসে আজও ‘উইশফুল থিংকিং’-এর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়নি। নিপুণ পাইলটের মতন আকাশচারী বিমানকে নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সন্ন্যাসীর পুত্র এবং সন্ন্যাসীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত।
আড়াইশ পৃষ্ঠার সুলোচনা’ উপন্যাস পড়া শেষ করে কোনো সন্দেহই। থাকে না ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সুলোচনা সম্বন্ধে যা লিখে গিয়েছেন তা সত্য, এই উপন্যাস স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃদেবেরই রচনা।
ভূপেন্দ্রনাথ পারিবারিক সূত্র থেকে বলেছেন, আর্থিক অনটনেই এই উপন্যাস ছাপানো হয় জ্ঞাতি কাকা গোপালচন্দ্রের নামে। কিন্তু উপন্যাস প্রকাশকাল [১৮৮২] বিবেচনা করলে আন্দাজ করা যায়, এই সময় স্বামীজির ভিটেবাড়িতে যে গৃহবিবাদ পাকিয়ে উঠছে, মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে তা পরিবারের আর্থিক সর্বনাশ অবধারিত করবে এবং তার রেশ চলবে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত।
পটভূমি হিসেবে এইটুকু বলা যায়, হাইকোর্টের আপীলে জিতেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
মামলায় হেরে গিয়েও জ্ঞানদাসুন্দরী বাড়ির অংশ অধিকার করে বসে আছেন। পরবর্তীকালে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি স্বামীজির কাছে অর্থভিক্ষা করছেন। স্বামীজি তাঁকে অর্থ না দিয়ে থাকতে পারলেন না।
৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামীজি তার বিদেশিনী অনুরাগিনী মিসেস সারা বুলকে লিখছেন : “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্যে তলে-তলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তার পক্ষের লোকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রয় করবেন, আর তা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকায় কিনি। তাদের আসল মতলব, তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না, এই বিশ্বাসে যে, আমি সন্ন্যাসী হয়ে জোর করে বাড়ির দখল নেবার জন্য কোর্টে যাব না।”
স্বামীজি অবশ্য হাল ছাড়েন নি। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন, মায়ের অপমান যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। মামলার জন্যে মঠের তহবিল থেকে তিনি ৫০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেজন্যে কিছু সমালোচনাও হয়, তবে স্বামীজি সেই দেনা শোধও করেন।
সংখ্যাহীন মামলায় জর্জরিত স্বামীজির বিধবা জননী ভূবনেশ্বরী। ১৯০২ জুন মাসে মর্ত্যলীলার শেষ শনিবার স্বামীজি বেলুড়মঠে বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়িতে গিয়েছিলেন। বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষাও করেছিলেন, তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক কুরুক্ষেত্রের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভিটেবাড়ির শরিক হাবু দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবু দত্ত।
স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তা হলে আরও হাজার টাকা দেবেন। হাবু দত্ত ও তমু দত্ত রাজি। প্রিয় বন্ধু ও গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুর সঙ্গে অ্যাটর্নি পন্টুবাবুর কলকাতা অফিসে গেলেন।
দুই পক্ষের অ্যাটর্নিদের মধ্যে বারবার আলোচনা চললো। ২রা জুলাই (স্বামীজির মহাসমাধির মাত্র দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী চারশ টাকা দেওয়া হল। অর্থাৎ আপাতত শেষ হল দীর্ঘদিনের সংঘাত। নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, শেষ দেখার সময়ে স্বামীজি তাকে বলেন, মামলারও নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তাঁর কোনো খেদ নেই। অর্থাৎ অভাগিনী মায়ের সব সমস্যা অবিশ্বাস্যভাবেই সমাধান করে গেলেন আমাদের চিরপ্রণম্য স্বামী বিবেকানন্দ।
.
অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে সুলোচনা অবশ্যই পঠনীয়।
স্বামীজির বিচিত্র জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর দূরত্ব পেরিয়ে পিতৃদেব রচিত উপন্যাসের সামাজিক গুরুত্ব অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। যাঁরা স্বামী বিবেকানন্দর বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তাঁদের কাছে অধুনা-দুষ্প্রাপ্য সুলোচনা উপন্যাসটি নিতান্ত ছোট প্রাপ্তি নয়।
১৮৩৬ পিতা দুর্গাপ্রসাদের ২২ বছর বয়সে গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাস গ্রহণ।
? শিক্ষা, গৌরমোহন আঢ্যের বিদ্যালয়, পরবর্তীকালে যার নাম ওরিয়েন্টাল সেমিনারি।
? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮৪১ ভাবী-পত্নী ভূবনেশ্বরী বসুর জন্ম। (পিতা নন্দলাল বসু, মাতা রঘুমণি।)।
১৮৫১ বিবাহ ভুবনেশ্বরী (বসু)-স্ত্রীর বয়স ১০।
? প্রথম পুত্রের জন্ম (শৈশবে মৃত)
? প্রথম কন্যার জন্ম (শৈশবে মৃত)
১৮৫৬ কন্যা হারামণির জন্ম (এঁর মৃত্যু ২২ বছরে, মতান্তরে ২৬ বছরে)।
১৮৫৯ অ্যাটর্নি চার্লস এফ পিটারের অধীনে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক।
১৮৬০ চার্লস পিটারের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
১৮৬১ অ্যাটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পলের অধীনে আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপ। এই অফিসে তার সহকর্মী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পিতা ভুবনমোহন দাশ।
১৮৬৩ পুত্র নরেন্দ্রনাথের (ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দ) জন্ম। (স্বামীজির মহাসমাধি ১৯০২)। ভুমিষ্ঠ হবার পরে দুর্গাপ্রসাদের ভগ্নী বলেন, “সেই চেহারা, সেই সবই, দুর্গাপ্রসাদ কি আবার ফিরে এল?” আনন্দিত বিশ্বনাথ নিজের পরিধেয় বস্ত্রটি পর্যন্ত দান করেন।
১৮৬৪ অ্যাটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পল-এর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
১৮৬৫ ব্যারিস্টার ডবলু সি বনার্জির পিতা গিরিশচন্দ্র বনার্জি ও দিগম্বর মিটারের কাছ থেকে চরিত্র সার্টিফিকেট।
১৮৬৬ অ্যাটর্নি ও প্রক্টর হিসেবে নথিভুক্ত হবার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন ও অনুমতি লাভ।
১৮৬৭ কাকা কালীপ্রসাদের মৃত্যু। অন্য মতে কালীপ্রসাদের মৃত্যু ১৮৬৯, মৃত্যুশয্যায় শাস্ত্রপাঠ করেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ। এঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী, পুত্র কেদারনাথ ও তারকনাথ। বিশ্বেশ্বরীর মৃত্যু ৯৭ বছর বয়সে ১৫ ডিসেম্বর ১৯১২।
১৮৬৮ অ্যাটর্নি আশুতোষ ধরের সঙ্গে পার্টনারশিপে ‘ধর অ্যান্ড দত্ত’ অ্যাটর্নি ব্যবসার শুরু।
১৮৬৯ পুত্র মহেন্দ্রনাথের জন্ম (এঁর মৃত্যু ১৯৫৬)।
১৮৭১ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে কলকাতার বাইরে ভাগ্যসন্ধানে যাত্রা।
১৮৭২ ওকালতি লখনৌ (বার লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় উল্লেযোগ্য ভূমিকা)
১৮৭৬ ওকালতি লাহোর, সেখানে বঙ্গীয় সমাজে প্রথম ঘটে দুর্গাপূজা।
১৮৭৭ তখনকার সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস পরে মধ্যপ্রদেশ রায়পুরে ভাগ্যসন্ধানে এলেন বিশ্বনাথ, ১৪ বছরের পুত্র নরেন্দ্রনাথ তখন থার্ড ক্লাশের ছাত্র।
ভূবনেশ্বরী, পুত্র নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও কন্যা যোগীন্দ্রবালার রায়পুরে যোগদান কয়েকমাস পরে। কলকাতা থেকে নাগপুর ৭১০ মাইল। নাগপুর থেকে গোরুর গাড়িতে রায়পুরপথে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, সেখানে ডাকাত ও বাঘের উপদ্রব। এঁদের সহযাত্রী পরবর্তীকালে বিখ্যাত হরিনাথ দে’র পিতা রায়পুরের উকিল রায়বাহাদুর ভূতনাথ দে। তাঁর স্ত্রী এলোকেশী। একই বছরে ভূবনেশ্বরী দুই আত্মীয়াকে ৫০০ টাকা করে দিয়ে বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর কাছ থেকে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়ির এক আনা ছ গণ্ডা দু’কড়া দু ক্রান্তি ভাগ কিনলেন।
পরবর্তীকালে অভিযোগ, ভিটেবাড়িতে বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর শেয়ার ভূবনেশ্বরীর বেনামে কেনেন বিশ্বনাথের খুড়তুতো ভাই তারকনাথ।
১৮৭৯ সপরিবারে কলকাতার যৌথপরিবারে প্রত্যাবর্তন। নরেন্দ্রনাথ ঐ বছরেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বাবার কাছ থেকে রুপোর ঘড়ি পেলেন। পুত্র নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ ক্লাশে ভর্তি হলেন।
১৮৮০ ৪ঠা সেপ্টেম্বর কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথের জন্ম (মৃত্যু ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১)।
গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী শচীমণি দাসীর যৌথ সম্পত্তি বিভাজনের জন্য হাইকোর্টে মামলা।
১৯৮১ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পুত্র নরেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিভাগে এফ এ পাশ করলেন।
নভেম্বর : ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ।
১৮৮২ ১৫ জানুয়ারি দক্ষিণেশ্বরে নরেন ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ।
এপ্রিল : সুলোচনা উপন্যাসের প্রকাশ; লেখকের জায়গায় জ্ঞতিকাকা গোপালচন্দ্র দত্তের নাম।
৮ই অক্টোবর কন্যা হারামণির মৃত্যু ২৬ বছরে (মতান্তরে ২২ বছর)
১৮৮৩ বাস্তুভিটা ছেড়ে পৃথক অন্ন ও ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনে বাড়িভাড়া।
বি এ পাশ করার আগেই নরেনকে বি. এল পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি ও চাঁদনি থেকে কোটপ্যান্টের অর্ডার। বন্ধু অ্যাটর্নি নিমাই বসুর অফিসে নরেন্দ্রনাথের শিক্ষানবিশি শুরু।
১৮৮৪ ৩০ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথের বি.এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। ২৩ ফেব্রুয়ারি সাতকড়ি মৈত্রের বরাহনগর বাসভবনে নরেন্দ্রনাথ গানবাজনার পরে সবে শয্যাগ্রহণ করেছেন, এমন সময় বন্ধু ‘হেমালী’ রাত্রি প্রায় দুইটার সময় খবর দিল, পিতা বিশ্বনাথ অকস্মাৎ ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে। নরেন্দ্রনাথ যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন বিশ্বনাথের মরদেহ একটি ঘরে শায়িত। অন্য মতে, নরেন্দ্রনাথ সোজা নিমতলা ঘাটে চলে আসেন। এইসময় মহেন্দ্রনাথের বয়স পনেরো। কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টারে নরেন্দ্রনাথের সই রয়েছে। মৃত্যুর কারণ : ডায়াবিটিস।
১৮৮৫ শরিকী বিরোধে স্বামীর ভিটেবাড়ির পরিবেশ বসবাসের
অযোগ্য হয়ে ওঠায় ভূবনেশ্বরী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ৭ রামতনু বসু লেনে নিজের মায়ের কাছে চলে গেলেন। কিন্তু কয়েক মাস পরে আবার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন পরলোকগত স্বামীর খুড়তুতো ভাই উকিল তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন। মায়ের নির্দেশে, তারকনাথের বেআইনি কাজ নিয়ে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে উত্তেজনাময় বচসা।
মার্চ : নরেন্দ্রনাথের গৃহত্যাগের সঙ্কল্প।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অসুখ, তাকে শ্যামপুকুরে আনা হল।
১৮৮৬ ২৫শে ফেব্রুয়ারি উকিল তারকনাথের মৃত্যু ৪৮ বছর বয়সে। ১৫ জুলাই তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরী দাসীর বিরুদ্ধে মামলা করলেন, অভিযোগ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির কিছু অংশ ভূবনেশ্বরীর বেনামে তার স্বামীই কিনেছিলেন।
১১ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন : প্রয়াত স্বামীর মক্কেলদের কাছ থেকে অনাদায়ী টাকা আদায়ের ছাড়পত্রের জন্য। মায়ের বাংলা সই সনাক্ত করলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১২ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন মঞ্জুর–আদালত থেকে বেরিয়েই নরেন্দ্রনাথ ছুটলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে–গলায় ক্যানসার রোগে ঠাকুর সেখানে মৃত্যুশয্যায়।
১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রাত্রি ১টা ২ মিনিটে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মর্তলীলার অবসান।
২৮ নভেম্বর জ্ঞানদাসুন্দরী ভিটেবাড়ির মালিকানা নিয়ে যে মামলা দায়ের করেছেন অ্যাটর্নি নিমাই বসুর মাধ্যমে ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথ তার বিস্তারিত জবাব দিলেন।
১৮৮৭ কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি উইলিয়ম ম্যাকফারলেনের কক্ষে বিচার শুরু। দু’পক্ষের সাক্ষীসাবুদ অনেক। এঁদের মধ্যে আছেন প্রতিবেশী ডাক্তার চন্দ্রনাথ ঘোষ ও দত্ত বাড়ির পুরোহিত সারদাপ্রসাদ মজুমদার।
৮মার্চ স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। তাকে জেরা করলেন বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ সায়েব। পেশা কি এই প্রশ্নের উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, আমি বেকার।
১৪ মার্চ হাইকোর্টের রায়–জ্ঞানদাসুন্দরী অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, মামলার সব ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে। জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে আপীল ফাঁইল করলেন।
১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রাখলেন, জয় বিশ্বনাথ পত্নী নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীর।
১৮৮৮ ২০ জানুয়ারি সম্পত্তি বিভাজনের জন্য শচীমণির মামলা আদালতের এক স্থগিতাদেশে এতোদিন ঝুলে ছিল। পূর্বতন বাঁটোয়ারা রায় কার্যকরী করার জন্যে ভুবনেশ্বরীর পক্ষে আদালতে আবেদন। আদালতের হস্তক্ষেপে ভূবনেশ্বরী তার অংশ বুঝে পেলেন।
নট আউট শুরুর নট আউট শিষ্য
স্বামী বিবেকানন্দ এবং তার আচার্য শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক ব্যাপারেই আলাদা, তাদের আচার ও আচরণও অবিশ্বাস্য। এঁদের প্রথম মিলনে বাংলার রসগোল্লার মস্ত ভূমিকা রয়েছে। ঠাকুরের ভক্ত এবং নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত তার নরেনকে আধ্যাত্মিক কথা বলেননি, বলেছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলে ভটচায্যিমশাই খুব ভাল রসগোল্লা খাওয়ান।
দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ থেকেই অবিশ্বাস্য এক আন্দোলন গড়ে উঠল। বিবেকানন্দজীবনে বিস্তারিতভাবে প্রবেশের আগে গুরুটিকে একটু ভালভাবে জেনে রাখা দরকার এবং সেই সঙ্গে শিষ্যটির কী সম্পর্ক দাঁড়াল।
হিসেব মতে, ২০১০ সালে আমাদের পরমপুরুষ ১৭৫ নট আউট, যদিও তাঁর নশ্বর দেহত্যাগ এই কলকাতা শহরে মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তারপরেও হেসে খেলে ১২৫ বছর কেমন করে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের ছোটভচায্যি বেঁচে রইলেন তা ঐতিহাসিকদের এবং সমাজতত্ত্ববিদদের কাছে এক পরমবিস্ময়। ইতিহাসের ফর্মুলা অনুযায়ী ব্যাপারটা ভীষণই কঠিন, কিন্তু খেয়ালি মহাকাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন, রানি রাসমণির ভবতারিণী মন্দিরের প্রায়-নিরক্ষর, জুনিয়র পুরোহিত একদিন এদেশের হৃদয়েশ্বর হয়ে উঠবেন এবং তাঁর জীবন ও বাণী সাগরপারের অনুসন্ধিৎসুদেরও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
তাকে যুগাবতারও বলা হয়েছে, ঘরে ঘরে তার জন্য মঙ্গলশঙ্খ বাজে। তাকে যাঁরা ঠিকমতন বুঝতে পেরেছেন তারা নিশ্চিত ১৭৫ নট আউটটা ঠাকুর রামকৃষ্ণের পক্ষে কিছুই নয়, তার প্রধান চেলার অতিশয়োক্তি দোষ ছিল না। সেই উনিশ শতকের শেষপ্রান্তের বেলুড় মঠের পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন, দেড় হাজার বছরের মধ্যে তার পুনরাবির্ভাব হবে এবং তার আগের দেড় হাজার বছর তিনি রামকৃষ্ণসঘের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সার্ধশতবর্ষ নয়, সাধসহস্রবছর ধরে শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিহত ঠিকানা এই রামৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
গুরু তাঁর দিব্যচক্ষু দিয়ে প্রধান চেলাটিকে সযত্নে নির্বাচন করে সস্নেহে লালন করেছিলেন। হাতে তেমন সময় ছিল না, যন্ত্রণাময় ক্যানসার-কণ্টকিত রোগভোগের মধ্যেই দূরদর্শী ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞর মতো তিনি সকল ভক্তের নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ নিয়ে নরেন্দ্রনাথকেই নির্বাচন করেছিলেন।
অসাধ্য সাধন হয়েছিল, শিষ্য তার বিস্ময়কর শক্তিতে কপর্দকহীন হয়েও প্রিয় প্রভুর নামাঙ্কিত যে আন্দোলন ও সদ্য তৈরি করলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের তা প্রথম। ভগবান বুদ্ধের ভুবনবিজয়ের পর যেন এই প্রথম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল, দেশ দেশ নন্দিত করে মন্দ্রিত হল বৈপরীত্যে ভরা এক বিস্ময়কর ব্রাহ্মণের বাণী, যিনি নৈষ্ঠিক পুরোহিত হয়েও নিজের কাজের জন্য নির্বাচন করে গেলেন এক কায়স্থ সন্তানকে। এদেশের ইতিহাসে একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেল।
ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রবিদরা অকারণে অষ্টোত্তর শতনামে মুখরিত হওয়ায় বিশ্বাস করেন না। প্রশস্তির সঙ্গে তারা সমালোচনাও করে থাকেন। তাদের শাস্ত্রীয় বিশ্বাস, বিধাতার এই সৃষ্টিতে ‘পারফেকশন’ অথবা নিখুঁত বলে কিছুই নেই, যা আছে তা কেবল পারফেকশনের সন্ধান–নিরন্তর সন্ধান।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান চেলাটি বয়সে তার থেকে পঁচিশ বছরের ছোট–তাঁর জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ আর নরেন্দ্রনাথের ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩। ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ মধ্যযামিনীতে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যখন তাঁর জীবনলীলা সাঙ্গ হল তখন প্রধান শিষ্যের বয়স মাত্র তেইশ, প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নবীন এক সন্ন্যাসীকুলের সৃষ্টি হল, তারপর ভাগ্যসন্ধানে বিশ্বপরিক্রমা এবং অবশেষে কয়েক হাজার বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তুলনাহীন এক সন্ন্যাসীসঙ্ঘের সৃষ্টি যার নাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
সময়াভাব ছিল। নির্বাচিত শিষ্যটি পঞ্চাশ বছরও বাঁচলেন না, হিসেব অনুযায়ী আচার্যের দেহাবসানের পরে মাত্র পনেরোটি বছর এবং কয়েকটি মাস। ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের মতে অকালমৃত্যু আদর্শ সাকসেশন প্ল্যানের পরিপন্থী। অর্থাৎ নিজে পঞ্চাশ বছরে বিদায় নিয়ে, পরবর্তী দায়িত্ববানের চল্লিশ বছরের আগেই চলে যাওয়াটা ভালো কথা নয়। সত্যি কথাটা হল, রামকৃষ্ণসঙ্রে অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয় তার প্রমাণ রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের স্বল্পপরিসর জীবন।
রামকৃষ্ণ আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট্য সন্ন্যাসী ও গৃহী উভয়েরই সগৌরব উপস্থিতি। মূল মঠ ও মিশনে ত্যাগী সন্ন্যাসীদের ওপর নির্ভরতা, কিন্তু গৃহীদের সমর্থন ছাড়া যে, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতে পারে তাও পুরোপুরি উপস্থিত।
১৭৫ বছরের পরও কেমন করে নট আউট? এই বিপুল প্রাণশক্তির গোপন উৎস কোথায়? তা খোঁজ করলে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্ন্যাসী হওয়া সহজ নয়, সে এক দুর্গম জীবনযাত্রা। তবু এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে দেশজননী নিয়মিতভাবে সন্তান দান করে চলেছেন সন্ন্যাসী সঙ্ঘকে এবং তাদের বিপুল নিষ্ঠায় এবং দিবারাত্রের সাধনায় সন্ন্যাসজীবন সকলের শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। নবীন এই সন্ন্যাসীসঙ্রে কাছে বিপুল প্রত্যাশা ছিল প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের। “শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যচরণ স্পর্শে যে মুষ্টিমেয় যুবকদলের অভ্যুদয় হয়েছে, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তারা আসাম থেকে সিন্ধু, হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত তাঁর উপদেশামৃত প্রচার করছে। তারা পদব্রজে ২৩,০০০ ফুট উধ্বে হিমালয়ের তুষাররাশি অতিক্রম করে তিব্বতের রহস্য ভেদ করেছে। তারা চীরধারী হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছে।”
সন্ন্যাসী ব্যাপারটা কী তা বিবেকানন্দ একবার বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। “আমি যে-সম্প্রদায়ভুক্ত তাকে বলা হয় সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়। সন্ন্যাসী’ শব্দের অর্থ “যে ব্যক্তি সম্যকভাবে ত্যাগ করেছে। এটি অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুর জন্মের ৫৬০ বছর আগে বুদ্ধও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের অন্যতম সংস্কারক মাত্র। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও আপনারা সন্ন্যাসীর উল্লেখ পাবেন। সন্ন্যাসী-সম্প্রদায় বলতে চার্চ বোঝায় না এবং এই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা পুরোহিত নন। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ। সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি থাকে না, তারা বিয়ে করেন না, তাদের কোনো সংস্থা নেই। তাদের একমাত্র বন্ধন গুরুশিষ্যের বন্ধন। এই বন্ধনটি ভারতবর্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শুধু শিক্ষাদানের জন্য যিনি আসেন এবং সেই শিক্ষার জন্য কিছু মূল্য বিনিময় করেই যাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ চুকে যায়, তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন। ভারতবর্ষে এটি প্রকৃত অর্থে দত্তক গ্রহণের মতো। শিক্ষাদাতা গুরু আমার পিতার অধিক, আমি তার সন্তান। সর্বাগ্রে পিতারও আগে, তাকে শ্রদ্ধা করব এবং তার বশ্যতা স্বীকার করব, কারণ ভারতবাসীরা বলেন, পিতা আমার জন্মদান করেছেন কিন্তু গুরু আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, সুতরাং পিতা অপেক্ষা গুরু মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করি।”
গুরু সম্বন্ধে স্বামীজির মন্তব্য আজও পাঠযোগ্য। “এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পেয়েছিলাম, তিনি অদ্ভুত লোক।” ‘বৃদ্ধ’ শব্দটি হিসেবিদের কানে একটু ধাক্কা দেয়, কারণ রামকৃষ্ণ-নরেন্দ্রর সাক্ষাৎকার ১৮৮১ সালে, গুরুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ এবং তৎকালীন ফটোগ্রাফে তাঁকে বার্ধক্যতাড়িত মনে হয় না। শারীরিক বিপর্যটা ঘটেছিল তিরোধানের কয়েক মাস আগে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ১৮৮৬ সালে। সদাশয় ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহানিদ্রায় শায়িত শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ যে ছবিটি তোলবার জন্য দশ টাকা অর্থসাহায্য করেছিলেন সেটি দেখলে মন দুঃখে ভরে ওঠে।
এবার গুরু-শিষ্যের প্রথম পরিচয় নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা। নরেন্দ্রনাথের মেজ ভাই এ-বিষয়ে রসগোল্লার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা কমবয়সিদের বেশ ভালো লাগে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বিসূচিকা রোগে তিনটি ছোট মেয়ে (মেয়ে ও ভাগ্নি) সাতদিনের মধ্যে মারা যায়। শোকার্ত রাম দত্ত এই সময় শান্তি সন্ধানে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। লোকেরা তখন হাসি ও ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংসদেবকে great goose বলত। রামদাদার মাধ্যমেই সিমলের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের যোগাযোগের সূত্রপাত।
রামদাদা এঁর কাছে দীক্ষা নেওয়ায় নানা নিন্দার সম্মুখীন হতেন, কিন্তু তাঁর গুরুপ্রশস্তিতে ভাটা পড়েনি। তিনি নরেন্দ্রর পড়শি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রকে (পরবর্তীকালে ঠাকুর যাকে আদর করে সুরেশ’ বলে ডাকতেন) ঠাকুরের কথা বলেন। সুরেশ নরম না হয়ে পরিহাস করেছিলেন, “ওহে রাম, তোমার গুরু পরমহংস যদি আমার কথার উত্তর দিতে পারে, তবে ভালো, নইলে তার কান মলে দিয়ে আসব।”
সেকালের কলকাতার কথার স্টাইল অনুযায়ী আর একজন ডাক্তার (স্যর কৈলাসচন্দ্র বসু) একই ভাষায় বলেছিলেন, “রাম, তোমার পরমহংস যদি ভালো লোক হয় ভালো, নইলে তার কান মলে দেব।” বোঝা যাচ্ছে, কান মলে দেবার ইচ্ছা প্রকাশই অবজ্ঞা প্রকাশ করবার রীতি ছিল!
বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেন উত্তর কলকাতায় মধু রায় লেনে রামদাদার বাড়িতে। স্মরণীয় সেই দর্শনের মনোগ্রাহী বিবরণ তিনি রেখে গিয়েছেন। “বিকালে পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে এলেন। দিনটি শনিবার কি রবিবার হবে। ঘরে ও বাইরে মোট চল্লিশ জনের মতন লোক। পরমহংস মশাই পশ্চিমদিকের আলমারির বা সার্শি দেওয়া তাকের কাছে বসে আছেন, পিছনে তাকিয়া। দুটি গ্যাসের বাতি জ্বলছে।
“আমার প্রথম এইরূপ মনে হইল–দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে ‘পরমহংস’? দেখিলাম লোকটির চেহারাতে কোন বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মত, বর্ণ খুব কালো নয়, তবে কলিকাতার সাধারণ লোকের বর্ণ হইতে কিছু মলিন। গালে একটু একটু দাড়ি আছে, কপচানো দাড়ি। চোখ দুটি ছোট–যাহাকে বলে হাতি চোখ। চোখের পাতা অনবরত মিট মিট করিতেছে, যেন অধিক পরিমাণে চোখ নড়িতেছে। ঠোঁট দুটি পাতলা নয়। নিচুকার ঠোঁট একটু পুরু। ঠোঁট দুটির মধ্য হইতে উপরের দাঁতের সারির মাঝের কয়েকটি দাঁত একটু বাহির হইয়া রহিয়াছে। গায়ে জামা ছিল; তাহার আস্তিনটা কনুই ও কবজির মাঝবরাবর আসিয়াছে। খানিকক্ষণ পরে, জামা খুলিয়া পাশে রাখিয়া দিল এবং কোঁচার কাপড়টি লম্বা করিয়া বাঁ কাঁধে দিল। ঘরটি বেশ গরম হইয়াছিল। একজন লোক বড় এড়ানী পাখ অর্থাৎ বড় পাখা লইয়া পিছন দিক হইতে বাতাস করিতে লাগিল। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের ভাষার মতো নয়, অতি গ্রাম্য ভাষা, এমনকি, কলিকাতার শহরের রুচি বিগর্হিত। কথাগুলি একটু তোতলার মতো। রাঢ়দেশীয় লোকের মতো উচ্চারণ। ন এর জায়গায় ল উচ্চারণ করিতেছে, যেমন লরেনকে বললুম’ ইত্যাদি। সম্মুখে একটি রঙিন বটুয়া রহিয়াছে, তাহার মধ্যে কি মসলা আছে; মাঝে মাঝে একটু মসলা লইয়া মুখে দিতেছে।
আমাদের বয়স তখন অল্প এবং আমরা শিক্ষিত সমাজে পরিবর্ধিত, এইজন্য, ভাষা ও উচ্চারণ শুনিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রতি মনে একটি অবজ্ঞার ভাব আসিল–এই লোকটাকে রামদাদা কেন এত সম্মান ও শ্রদ্ধা ভক্তি করেন? চুপ করিয়া বসিয়া সব দেখিতে লাগিলাম। মনে মনে আবার ভাবিতে লাগিলাম–কেন রামদাদা এই লোকটাকে এত সম্মান করেন; দুর্ধর্ষ সুরেশ মিত্তির এবং বুদ্ধিমান নরেন্দ্রনাথই বা কেন কয়েকবার এর কাছে গেছেন? লোকটার কি ব্যাপার?”
মহেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণর প্রথম দর্শনের যে বিবরণ রেখে গিয়েছেন তার মধ্যে আকস্মিক ভাবসমাধিরও বর্ণনা আছে।
আরও মনোগ্রাহী বর্ণনা মহেন্দ্রনাথ শুনেছিলেন লীলাপ্রসঙ্গর রচয়িতা স্বামী সারদানন্দের কাছে। স্বামী সারদানন্দ ও মহেন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে কিছুদিন একত্রে লন্ডনে সময় কাটিয়েছিলেন।
একবার পুজোর সময় পরমহংসদেব ডস্ট কোম্পানির মুছুদী গৃহীভক্ত সুরেশ মিত্তিরের (১৮৫০-৯০) বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদালানে মারবেল পাথরের মেঝের উপর তাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল।
“মেয়েরা ঘরে জানালা হইতে পরমহংস মশাইকে দেখিতেছিলেন। পরমহংস মশাই-এর সম্মুখে অনেক লোক দাঁড়াইয়া তাহাকে আহার করাইতেছিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেছিলেন। এইরূপ বসিয়া আহার করাই তাঁহার দেশের প্রথা। আমরাও দেখিয়াছি যে, পরমহংস মশাই আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া আহার করিতেন না, হাঁটু দুইটি উঁচু করিয়া উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেন।
“তিনি আহার করিতেছেন ও বলিতেছেন যে, পূর্বে তিনি বড় বিভোর থাকিতেন, বাহ্যজ্ঞান কিছুই থাকিত না, কাপড় পরার কথা মনে থাকিত না, একেবারেই বে-ভুল, বে-এক্তিয়ার হইয়া থাকিতেন, কিন্তু এখন তাহার সে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে, এখন তিনি কাপড় পরিয়া থাকেন এবং লোকজনের সম্মুখে বেশ সভ্যভব্য হইয়া বসিয়া থাকেন। এই কথা শুনিয়া উপস্থিত লোকসকল ও যে সকল মেয়েরা জানালা হইতে দেখিতেছিলেন, একটু হাসিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে ও-কথা ঠিক তো বটেই। সকলে এই বলিয়া আমোদ করিয়া তাহাকে একটু উপহাস করিতে লাগিলেন।
পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া একটু একটু খাইতেছেন ও এইরূপ কথা চলিতেছে। সকলেই মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বাঁদিকের বগলের প্রতি হঠাৎ পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি পড়িল। তিনি দেখেন যে, কাপড়খানি বাঁ-বগলের ভেতর জড়ানো রহিয়াছে আর তিনি দিগবসন হইয়া বসিয়া আছেন।
“এইরূপ দেখিয়া তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “আরে ছ্যা! আমার ওটা গেল না; কাপড় পরাটা আর মনে থাকে না! এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি কাপড়খানি লইয়া কোমরে জড়াইতে লাগিলেন। যে সকল পুরুষ দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার সকলে উচ্চতরালে হাসিয়া উঠিলেন, মেয়েরাও জানালা হইতে হাসিয়া উঠিলেন।
“কিন্তু পরমহংস মশাই-এর ভাব এত সরল, স্নিগ্ধ ও উচ্চ ছিল যে, কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ না আসিয়া এক অতীন্দ্রিয় ভাব আসিল। কেহ কেহ বলিলেন মশাই, আপনার কাপড় পরবার দরকার নেই। আপনি যেমন আছেন, তেমনি থাকুন। আপনার কোন দোষ হয় না।”
এদেশে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথায় স্মরণীয় মানুষদের দেহবর্ণনা খুবই কম থাকে। ফলে, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দর দৈহিক উচ্চতা কত ছিল, গায়ের রং কীরকম, মুখের ভাস্কর্য কীরকম এসব জানতেও হিমশিম খেতে হয়। পশ্চিমের লেখকরা তাদের স্বাভাবিক বিচক্ষণতায় নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই কাজগুলি প্রথমেই সেরে নেন। এই সমস্যা পরমহংসদেবের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট। সাবধানী মহেন্দ্রনাথ দত্ত তার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান নামক ছোট্ট বইতে দাদা নরেন্দ্রনাথ ও গুরু রামকৃষ্ণের সম্বন্ধে কিছু দৈহিক বিবরণ রেখে দিয়েছেন।
“শ্রীরামকৃষ্ণের চোখ হইল ক্ষুদ্র যাহাকে বলে–হাতিচোখ। মুখে বিশেষ ওজস্বী ভাব নাই; বাহু-সঞ্চালন অতি ধীর ও করুণাব্যঞ্জক। সাধারণ অবস্থায় কণ্ঠস্বর মৃদু, এক প্রকার কাতর স্বর বলা যাইতে পারে। দেখিলে বোধহয়, যেন জগতের সম্পর্ক হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া স্বতন্ত্র থাকিবার–নিরিবিলি ও একাকী থাকিবার তাঁহার ইচ্ছা, জগৎ যেন তাহাকে স্পর্শ করিতে না পারে।”
এবার দাদার শরীর বিবরণ। “বিবেকানন্দের চোখ হইল বিস্ফারিত; দৃষ্টি তীক্ষ্ণ; মুখ–সুডৌল, পুরুষ। মুখে আজ্ঞাপ্রদ ভাব, defiant attitude-বাধাবিঘ্ন-তুচ্ছকারী ভাব যেন জগৎকে গ্রাহ্যই করিতেছে না। বাহু-সঞ্চালন ও তর্জনী-নির্দেশ যেন জগৎকে শাসন করিবার বা আজ্ঞা দিবার মতো, যাহাকে বলে নাপোলিঅঁ-র মতো অঙ্গভঙ্গী ও অঙ্গ-সঞ্চালন, আজ্ঞা শুনিয়া যেন সকলে স্তব্ধ হইয়া যাইবে। প্রথম দৃষ্টিতে দুই জনের ভিতর এই পার্থক্য দেখা যায়।”
এরপর মহেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ, “শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিশেষ লক্ষণ হইল–বহুবিধ স্নায়ু দিয়া বহু প্রকার চিন্তা করা। শক্তি-বিকাশ করা বা যাহাতে ক্ষাত্রশক্তির আবশ্যক, এইরূপ কার্য তাহার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল গভীর চিন্তা করা মুখ্য, শক্তি-বিকাশ করা গৌণ। এইজন্য প্রথম অবস্থায় সাধারণ লোক তাঁহাকে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া উন্মাদ ও বাতুল বলিয়া বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করিত।”
“বিবেকানন্দের হইল শক্তিবিকাশ করাই মুখ্য, গভীর চিন্তা করা হইল গৌণ।”
মহেন্দ্রনাথের মন্তব্য : “এই দুইটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া উভয়ের জীবনী আলোচনা করিলে, উভয় ব্যক্তির মধ্যে বেশ একটি সামঞ্জস্য দেখা যায়। এ স্থলে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অনুকরণ করেন না। একজন অপরের অনুকরণ করিয়াছিলেন–ইহা অতীব ভুল মত। উভয়েই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিত্ব অটুট রাখিয়াছিলেন। পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল; কিন্তু উভয়ের কার্যক্ষেত্র ও বিকাশ-প্রণালী ভিন্ন ছিল। উভয়েই নিজ নিজ ভাবে চিন্তা করিয়াছিলেন। উভয়েই জগৎকে এবং জগতের সম্পর্কিত ও সংশ্লিষ্ট ভাবসমূহ নিজ নিজ চিন্তা অনুযায়ী উপলব্ধি করিয়াছিলেন। উভয়েই নিজ ভাবে জগতের প্রশ্ন সকল মীমাংসা করিয়াছিলেন এবং সেইরূপ শক্তি বিকাশ করিয়াছিলেন। এইরূপ তেজঃপূর্ণ, বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষ যাঁহারা, তাহারা কেহ কাহাকেও অনুকরণ করিতে পারেন না। নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাই হইল এইরূপ পুরুষদিগের বৃত্তি।
“মনোবিজ্ঞান দিয়া বুঝিতে হইলে দেখা যায় যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব হইল ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাওয়া। বিবেকানন্দের ভাব হইল অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে চলিয়া আসা। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল ঈশ্বর কেন্দ্র, জীব বা মনুষ্য পরিধি। বিবেকানন্দের হইল জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র, ঈশ্বর পরিধি।”
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই যে, যদি দুই জনের মধ্যে এইসব বিষয়ের পার্থক্য থাকে, তবে উভয়ের ভিতর সামঞ্জস্য কোথায়?
তার উত্তর সন্ধান করেছেন মহেন্দ্রনাথ। “ইহা জানা আবশ্যক যে, শক্তির প্রবাহ যদি কেন্দ্র হইতে খুব গভীর স্তরে যায়, তাহা হইলে উপবৃত্ত–Theory of Motion-গতিবার-এর নিয়ম। এই নিয়ম সূক্ষ্ম–স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বর কেন্দ্র হইলেও, জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয় এবং বিবেকানন্দের জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র হইলেও, পরিশেষে জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বরদর্শন হয়। দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র–এই দুই শাস্ত্র দিয়া পর্যালোচনা করিলে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মনোবৃত্তি ও ক্রিয়াকলাপ বিশেষভাবে বুঝা যাইতে পারে।”
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহবর্ণনার আর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র লাহোর ট্রিবিউনের খ্যাতনামা সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তিনি ১৮৮১ সালে (যে বছর নরেন্দ্রর সঙ্গে ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ) স্টিমারে রামকৃষ্ণের সহযাত্রী হয়েছিলেন। এই জাহাজের মালিক কেশবচন্দ্র সেনের জামাতা কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ। দক্ষিণেশ্বর ঘাটে পরমহংসদেব তার ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে জাহাজে উঠলেন, সঙ্গে এক ধামা মুড়ি ও সন্দেশ। তিনি লালপেড়ে ধুতি ও পাঞ্জাবি পরেছিলেন–পাঞ্জাবির বোম খোলা ছিল।
নগেন্দ্রনাথের বর্ণনা : “শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামবর্ণ ছিলেন। দাড়ি রাখতেন এবং তাঁর চোখ দুটি কখনও সম্পূর্ণরূপে উন্মীলিত হতো না–অন্তর্মুখী ছিল। তার দৈর্ঘ্য ছিল মাঝারি। গড়ন ছিল পাতলা, প্রায় শীর্ণ বলা যায়, এবং চেহারা ছিল অত্যন্ত ছিপছিপে।…একটু তোতলা ছিলেন, কিন্তু সেই তোতলামি শ্রুতিমধুর ছিল। তিনি খুব সরল বাংলায় কথা বলতেন এবং প্রায়ই ‘আপনি’ ও ‘তুমি’ মিলিয়ে ফেলতেন।”
এই বিবরণ মিলছে না পরমাপ্রকৃতি সারদামণির স্বামী-বর্ণনার সঙ্গে। শ্রীশ্রী মায়ের কথা’ বইতে ঠাকুরের চেহারা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য : “তার গায়ের রঙ যেন হরিতালের মতো ছিল–সোনার ইষ্ট কবচের সঙ্গে গায়ের রং মিশে যেত। যখন তেল মাখিয়ে দিতাম, দেখতুম সব গা থেকে যেন জ্যোতি বেরুচ্ছে।…যখনই কালীবাড়িতে বার হতেন, সব লোক দাঁড়িয়ে দেখত, বলত, ‘ঐ তিনি যাচ্ছেন’ বেশ মোটাসোটা ছিলেন। মথুরবাবু একখানা বড় পিঁড়ে দিয়েছিলেন, বেশ বড় পিঁড়ে। যখন খেতে বসতেন তখন তাতেও বসতে কুলাত না। ছোট তেল ধুতিটি পরে যখন থপ থপ করে গঙ্গায় নাইতে যেতেন, লোকে অবাক হয়ে দেখত।”
মঠের আমেরিকান সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ পরবর্তী সময়ে অনেক খোঁজখবর করে লিখেছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণের দেহের ওজন ও দৈর্ঘ লিপিবদ্ধ করা হয়নি।” বিদ্যাত্মানন্দ জানাচ্ছেন, ১৯৫৫ সালে ভাস্করকে নির্দেশ দিতে গিয়ে স্বামী নির্বাণানন্দ হিসেব করেছিলেন যে ঠাকুরের দৈর্ঘ ছিল ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। এই সিদ্ধান্তে আসতে তিনি নির্ভর করেছিলেন ঠাকুরের কোটপরা আলোকচিত্র এবং সেই কোটটি থেকে। কোটটি মেপে এবং কোটটির সঙ্গে আকৃতির সম্বন্ধ হিসাব করে দেহের দৈর্ঘ্য প্রতিপাদন করা হয়েছিল।
স্বামী নির্বাণানন্দ একসময় স্বামী ব্রহ্মানন্দের সেবক ছিলেন। ১৯১৮ সালে উকিল অচলকুমার মৈত্রের পত্নী এক ভক্তিমতি মহিলা ঝাউতলায় কর্মরত এক প্রতিভাবান মারাঠি ভাস্করের স্টুডিওতে গিয়ে মর্মর মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
এই মূর্তিটির মডেল অনুমোদন করার জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট মহারাজকে অনুরোধ জানালেন স্বয়ং স্বামী সারদানন্দ।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রথমে তেমন উৎসাহিত হলেন না। তারপর বললেন : “ঠাকুরের কোন মূর্তি অনুমোদন করব? তাকে একই দিনে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে দেখেছি। কখনো দেখেছি তিনি কৃশ ও ক্ষীণকায়, একটি কোণে চুপ করে বসে আছেন। আবার খানিকক্ষণ পরে দেখা গিয়েছে, তিনি দেহ ও বেশভূষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়ে সর্বক্ষণ হাততালি দিতে কীর্তন করছেন। কখনো বা গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হতেন; তখন তাঁর মুখমণ্ডল এক স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত এবং দেহ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বিকীর্ণ হতো। কখনো কখনো দেখা যেত তার আকৃতি স্বাভাবিক অপেক্ষা দীর্ঘতর ও বলবত্তর এবং তিনি দক্ষিণের বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বড় বড় পা ফেলে জোরে জোরে পায়চারি করছেন।”
স্বামী সারদানন্দ বিনীতভাবে বললেন, “মহারাজ, ঠাকুর যে ছবি সম্বন্ধে নিজে বলছিলেন, যে ঘরে ঘরে পূজিত হবে, আমি সেই ছবির কথা বলছি। তারই প্রতিমূর্তির মডেল তোমাকে অনুমোদন করতে যেতে হবে।”
মহারাজ হাসিমুখে উত্তর দিলেন, “চল যাই।”
সেইদিন বিকালবেলাই মহারাজকে ঝাউতলা স্টুডিওতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হল। এই উপলক্ষে তার সঙ্গে স্বামী সারদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ও অন্যান্য সাধুরাও গেলেন। গোলাপমা ও যোগীনমাও গেলেন।
মহারাজ মডেলটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর শিল্পীকে দেখালেন “দেখ তুমি ঠাকুরকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বসিয়েছ।”
শিল্পী বললেন, “মহাশয়, আপনি দেখবেন যদি কেউ এইভাবে পায়ের সামনের হাতজোড় করে বসেন, তাহলে তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে যেতে বাধ্য হবেন।”
মহারাজ উত্তর দিলেন, “আমরা কখনো ঠাকুরকে এইভাবে বসতে দেখিনি। তুমি যা বলছ তা সাধারণ লোকেদের পক্ষে প্রযোজ্য। কিন্তু ঠাকুরের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। তিনি দীর্ঘবাহু ছিলেন। হাঁটু পর্যন্ত তার হাত পৌঁছত।”
প্রেসিডেন্ট মহারাজ এরপর শিল্পীকে ঠাকুরের কান সম্বন্ধে নির্দেশ দিলেন, “দেখ, সাধারণ মানুষের কান জ্বরেখার উপরে আরম্ভ হয় এবং তুমি ঠাকুরের কান সেইভাবে রূপায়িত করেছ। কিন্তু ঠাকুরের কান জ্বরেখার নীচে থেকে আরম্ভ হয়েছিল।”
“উপস্থিত সকলে ঠাকুরের চেহারা সম্বন্ধে এইরূপ খুঁটিনাটি বিবরণ শুনে অত্যন্ত আকৃষ্ট হলেন। মহারাজের নির্দেশ অনুসারে ভাস্কর মডেলটি সংশোধন করতে সম্মত হলেন। তিনি বললেন, অনুগ্রহ করে এক সপ্তাহ পরে আসুন, ইতোমধ্যে আমি মডেলটি সম্পূর্ণ করে রাখব।”
এক সপ্তাহ পরে মহারাজ সদলবলে স্টুডিওতে পুনর্বার পদার্পণ করলেন। সংশোধিত মডেলটি দেখে মহারাজ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, “এখন এটি অবিকল হয়েছে।”
বিবেকানন্দের নির্ভরযোগ্য দেহবিবরণ দিয়েছেন রোমাঁ রোলাঁ তাঁর ‘বিবেকানন্দের জীবন’ বইতে। তার হিসেব মতো বিবেকানন্দের ওজন ছিল ১৭০ পাউন্ড। “দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণ দেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু। তাঁহার চক্ষু দেখিলে প্রাচীন সাহিত্যের সেই পদ্মপলাশের উপমা মনে পড়িত। বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চক্ষু; ভাবাবেগে ছিল তন্ময়; চেতনার গভীরে তাহা অবলীলায় অবগাহন করিত; রোষে হইয়া উঠিত অগ্নিবর্ষী; সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল হইতে কাহারও অব্যাহতি ছিল না।”
রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, “বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বর ছিল ভায়োলন সেলো’ বাদ্যযন্ত্রের মতন। তাহাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তাহার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে এবং সকল শ্রোতার হৃদয়ে ঝক্তৃত হইত।…এমা কাভে বলেন, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যারিটোন’, তাহার গলার স্বর ছিল চিনা গঙের আওয়াজের মতো।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রর প্রথম সাক্ষাৎ কবে কোথায় তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিনিময় ও গবেষণা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দর্শন ও প্রথম বাক্যলাপ একইদিনে হয়নি। বিবেকানন্দ জীবনীকার অনেক অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতেই প্রথম দর্শন। রোমা রোলাঁ জানিয়েছেন, এই ভদ্রলোক সঙ্গতিপন্ন ব্যবসায়ী এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ সেবার ভজন গান শোনালেন। নবাগত গায়কের শারীরিক লক্ষণ ও ভাবতন্ময়তা লক্ষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ আকৃষ্ট হলেন এবং খোঁজখবর নিয়ে ভক্ত রামচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন একে একদিন দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যেতে।
ঘোড়ার গাড়িতে সুরেন্দ্রনাথ ও দু’জন বয়স্যের সঙ্গে ১৮৮১ সালের পৌষ মাসে (নভেম্বর) নরেন্দ্রনাথ দত্ত দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হলেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐতিহাসিক এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব এবং নরেন্দ্রনাথ দুজনেই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য সচরাচর হয় না। অযথা সময় নষ্ট না করে, আমরা স্বামী সারদানন্দ বিরচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গর স্মরণ নিচ্ছি।
“দেখিলাম, নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও বেশভূষার কোনরূপ পারিপাট্য নাই, বাহিরের কোন পদার্থেই ইতর-সাধারণের মতো একটা আঁট নাই, সবই যেন তার আলগা এবং চক্ষু দেখিয়া মনে হইল তাহার মনের অনেকটা ভিতরের দিকে কে যেন সর্বদা জোর করিয়া টানিয়া রাখিয়াছে। দেখিয়া মনে হইল বিষয়ী লোকের আবাস কলিকাতায় এত বড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভবে!
“মেঝেতে মাদুর পাতা ছিল, বসিতে বলিলাম। যেখানে গঙ্গজলের জালাটি রহিয়াছে তাহার নিকটেই বসিল। তাহার সঙ্গে সেদিন দুই-চারি জন আলাপী ছোকরাও আসিয়াছিল। বুঝিলাম, তাহাদিগের স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীত–সাধারণ বিষয়ী লোকের যেমন হয়; ভোগের দিকেই দৃষ্টি।
“গান গাহিবার কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বাংলা গান সে দুই-চারিটি মাত্র তখন শিখিয়াছে। তাহাই গাহিতে বলিলাম, তাহাতে সে ব্রাহ্মসমাজের ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ গানটি ধরিল ও ষোল আনা মনপ্রাণ ঢালিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যেন উহা গাহিতে লাগিল–শুনিয়া আর সামলাইতে পারিলাম না, ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম।
“পরে সে চলিয়া যাইলে, তাহাকে দেখিবার জন্য প্রাণের ভিতরটা চব্বিশ ঘন্টা এমন ব্যাকুল হইয়া রহিল যে, বলিবার নহে। সময়ে সময়ে এমন যন্ত্রণা হইত যে, মনে হইত বুকের ভিতরটা যেন কে গামছা-নিংড়াইবার মতো জোর করিয়া নিংড়াইতেছে। তখন আপনাকে আর সামলাইতে পারিতাম না, ছুটিয়া বাগানের উত্তরাংশে ঝাউতলায়, যেখানে কেহ বড় একটা যায় না, যাইয়া ‘ওরে তুই আয়রে, তোকে না দেখে আর থাকতে পারছি না’ বলিয়া ডাক ছাড়িয়া কাদিতাম। খানিকটা এইরূপে কাঁদিয়া তবে আপনাকে সামলাইতে পারিতাম। ক্রমান্বয়ে ছয় মাস এইরূপ হইয়াছিল। আর সব ছেলেরা যারা এখানে আসিয়াছে, তাদের কাহারও কাহারও জন্য কখন কখন মন কেমন করিয়াছে, কিন্তু নরেন্দ্রর জন্য যেমন হইয়াছিল তাহার তুলনায় সে কিছুই নয় বলিলে চলে।”
একই সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে স্বামী সারদানন্দ পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকান্দের স্মৃতিকথাও সংগ্রহ করেছিলেন।
“গান তো গাহিলাম, তাহার পরেই ঠাকুর সহসা উঠিয়া আমার হাত ধরিয়া তাহার ঘরের উত্তরে যে বারান্ডা আছে, তথায় লইয়া যাইলেন। তখন শীতকাল, উত্তরে-হাওয়া নিবারণের জন্য উক্ত বারান্ডার থামের অন্তরালগুলি ঝাঁপ দিয়া ঘেরা ছিল, সুতরাং উহার ভিতরে ঢুকিয়া ঘরের দরজাটি বন্ধ করিয়া দিলে ঘরের ভিতরের বা বাহিরের কোন লোককে দেখা যাইত না। বারান্ডার প্রবিষ্ট হইয়াই ঠাকুরঘরের দরজাটি বন্ধ করায় ভাবিলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দিবেন। কিন্তু যাহা বলিলেন ও করিলেন তাহা একেবারে কল্পনাতীত। সহসা আমার হাত ধরিয়া দরদরিতধারে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন এবং পূর্বপরিচিতের ন্যায় আমাকে পরম স্নেহে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, এতদিন পরে আসিতে হয়? আমি তোমার জন্য কিরূপে প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি তাহা একবার ভাবিতে নাই? লোকের কথা বাজে প্রসঙ্গ শুনিতে শুনিতে আমার কান ঝলসিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে; প্রাণের কথা কাহাকেও বলিতে না পাইয়া আমার পেট ফুলিয়া রহিয়াছে!’–ইত্যাদি কত কথা বলেন ও রোদন করেন। পরক্ষণেই আবার আমার সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া দেবতার মত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীর ধারণ করিয়াছ ইত্যাদি।
“আমি তো তাঁহার ওইরূপ আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত! মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম এ কাহাকে দেখিতে আসিয়াছি, এ তো একেবারে উন্মাদনা হইলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এইসব কথা বলে? যাহা হউক, চুপ করিয়া রহিলাম, অদ্ভুত পাগল যাহা ইচ্ছা বলিয়া যাইতে লাগিলেন। পরক্ষণে আমাকে তথায় থাকিতে বলিয়া তিনি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন এবং মাখন, মিছরি ও কতকগুলি সন্দেশ আনিয়া আমাকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। আমি যত বলিতে লাগিলাম, আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি সঙ্গীদের সহিত ভাগ করিয়া খাইগে’, তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না। বলিলেন, “উহারা খাইবে এখন, তুমি খাও।’–বলিয়া সকলগুলি আমাকে খাওয়াইয়া তবে নিরস্ত হইলেন। পরে হাত ধরিয়া বলিলেন, বল, তুমি শীঘ্র একদিন এখানে আমার নিকট একাকী আসিবে?’ তাঁহার ঐরূপ একান্ত অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া অগত্যা ‘আসিব’ বলিলাম এবং তাঁহার সহিত গৃহমধ্যে প্রবেশপূর্বক সঙ্গীদিগের নিকটে উপবিষ্ট হইলাম।
“বসিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম ও ভাবিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তাহার চালচলনে, কথাবার্তায় অপর সকলের সহিত আচরণে উন্মাদের মতো কিছুই নাই। তাহার সদালাপ ও ভাবসমাধি দেখিয়া মনে হইল সত্য সত্যই ইনি ঈশ্বরার্থে সর্বত্যাগী এবং যাহা বলিতেছেন তাহা স্বয়ং অনুষ্ঠান করিয়াছেন।…নির্বাক হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, উন্মাদ হইলেও ঈশ্বরের জন্য ওইরূপ ত্যাগ জগতে বিরল ব্যক্তিই করিতে সক্ষম, উন্মাদ হইলেও এ ব্যক্তি মহাপবিত্র, মহাত্যাগী এবং ওইজন্য মানব হৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাইবার যথার্থ অধিকারী! ওইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেদিন তাহার চরণ-বন্দনা ও তাহার নিকটে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।”
অবিস্মরণীয় এই প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণ আজও হয়নি। এ বিষয়ে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথেরও কিছু সংযোজন আছে।
“শুনিয়াছি যে, নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর নিকট যাইবার কিছু কাল পরে, কোনো এক যুবক আর একজনের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যান। যুবকটির সঙ্গে যে লোকটি ছিলেন তাহার কাছে নরেন্দ্রনাথের কুশল সংবাদ পাইয়া পরমহংস মশাই বলিলেন, লরেন অনেকদিন আসেনি, দেখতে ইচ্ছে হয়েছে এক বার আসতে বলো। পরমহংস মশাই-এর সহিত কথাবার্তা কহিয়া, রাত্রে তাহার ঘরের পূর্বদিকের বারান্ডায় উভয়ে শয়ন করিলে কিছু কাল পরেই, পরমহংস মশাই বালকের মতো তাহার পরনের কাপড়খানি বগলে করিয়া তাহাদের একজনকে ডাকিয়া জিজ্ঞেস করিলেন, ‘তুমি কি ঘুমোচ্ছ? যাঁহাকে ডাকিয়া পরমহংস মশাই জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি উত্তরে করিলেন, “আজ্ঞে না।” পরমহংস মশাই বলিলেন, ‘দেখ লরেনের জন্য প্রাণের ভেতর যেন গামছা-নেংড়ানোর মতো মোচড় দিচ্ছে!’ সে রাত্রিতে নাকি পরমহংস মশাই-এর নরেন্দ্রনাথের জন্য উৎকণ্ঠ ভাব কিছুমাত্র কমে নাই। কারণ তিনি কিছুক্ষণ শয়ন করিবার পর, আবার আসিয়া ওই কথাই বলিতে লাগিলেন যেন, নরেন্দ্রনাথের অদর্শনের জন্য বড়ই ব্যথিত হইয়া পড়ায় তাহার ঘুম হইতেছিল না।
“পরমহংস মশাই, আমাদের গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিটের বাড়িতে, নরেন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে খুঁজিতে আসিতেন। কিন্তু কখনো বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেন নাই, রাস্তায় অপেক্ষা করিতেন। তিনি বাড়ির একটু কাছে আসিলে অনেক সময় আমি অগ্রসর হইয়া যাইতাম। আমায় বলিতেন, ‘লরেন কোথায় লরেনকে ডেকে দাও’ আমি তাড়াতাড়ি আসিয়া দাদাকে সন্ধান করিয়া ডাকিয়া দিতাম। অনেক সময় পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথের সহিত কথাবার্তা কহিয়া তাহাকে ডাকিয়া লইয়া যাইতেন।
“পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে আদর করিয়া ‘শুকদেব’ বলিয়া ডাকিতেন। শুকদেব যেন দ্বিতীয় বার জগতে আসিয়াছেন। নরেন্দ্রনাথ শুকদেবের মতো জ্ঞানী হইবে, জগতে সমস্ত কার্য করিবে, কিন্তু জগৎকে চুইবে না, প্রভৃতি বহুবিধ অর্থে তিনি নরেন্দ্রনাথকে শুকদেব বলিতেন। বাবা এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া বলিতেন, “হ্যাঁ, হয়েছে বটে, ব্যাসদেবের বেটা শুকদেব। ম্যাকনামারার বেটা কফিন-চোর!”–অর্থাৎ ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব মহৎ হইয়াছিলেন, এ কথা সত্য কিন্তু বড়সাহেব ম্যাকনামারার পুত্র হইল কিনা শবাধার-চোর। নরেন্দ্রনাথ সেইরকম হইবে। তখনকার দিনে কফিন-চোর’ কথাটির বড় প্রচলন ছিল। নরেন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ লোক হইবে, এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া তিনি বিদ্রূপ করিয়া এইরূপ বলিতেন। তিনি বিরক্ত হইতেন না, বরং খুশি হইতেন।
“নরেন্দ্রনাথ ছুটি পাইলে, নিজে নৌকা বাহিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাইত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের সময় নরেন্দ্রনাথ গঙ্গা দিয়া নৌকা বাহিয়া যাইত, এইজন্য বাবা অনেক সময় বিরক্ত হইতেন। তিনি বলিতেন, যাতায়াতের একখানা গাড়ি করে গেলেই তো হয়। এরকম ঝড়-তুফানে গঙ্গা দিয়ে যাবার কি দরকার? রাম তো টানা গাড়ি করে যায়।-একেই বলে ডানপিটে ছেলের মরণ গাছের আগায়। এরকম ডানপিটেমি করার কি দরকার?’কিন্তু নরেন্দ্রনাথ এ সকল কথায় বিশেষ কান না দিয়া, নিজের মনোমত দুই-একটি বন্ধু সঙ্গে লইয়া নৌকা করিয়া অনেক সময় দক্ষিণেশ্বরে যাইত। হেদোর পুকুরে নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি সকলে নৌকার দাঁড় টানিতে বেশ পারদর্শী হইয়াছিল। আহিরীটোলার ঘাটে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া, অনেক সময় নিজেরাই মাঝিদের দাঁড় লইয়া টানিতে টানিতে দক্ষিণেশ্বরে যাইত। এইরূপ যাওয়াতে কতকটা নৌকা বাহিয়া আমোদ করা হইত। এবং পরমহংস মশাইকে দর্শন করিতে যাওয়াও হইত।
“তখনকার দিনে দক্ষিণেশ্বরে গাড়ি করিয়া যাইবার পথ অতি কষ্টকর ছিল। গরানহাটা হইতে বরানগরের বাজার পর্যন্ত গাড়ি যাইত, তাহার পর, সমস্ত পথটা হাঁটিয়া যাইতে হইত।
“নরেন্দ্রনাথ সব সময় পরমহংস মশাইকে বলিত, তুমি মুখু লোক, লেখাপড়া জান না, তোমার কাছে আবার দর্শনশাস্ত্রের কথা কি শিখব? আমি এসব বিষয় ঢের জানি। কখনো কখনো তর্কের ছলে তাহার কথার মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইত। অপরে ইহাতে বিরক্ত বা মনঃক্ষুণ্ণ হইতেন। পরমহংস মশাই হাসিতে হাসিতে বলিতেন, “ও আমাকে গাল দেয়, কিন্তু ভেতরে যে শক্তি আছে, তাকে গাল দেয় না। পরমহংস মশাই-এর কী গুণগ্রাহী ভাব, কী উদার ভাব। সংকীর্ণ ভাব, গুরুগিরির ভাব–এসব কিছুই তাঁহার ছিল না। এইজন্য তিনি ঝাঝালো ও তেজী নরেন্দ্রনাথের এত প্রশংসা করিতেন এবং তাহাকে এত ভালোবাসিতেন। ইহাকেই বলে কদর দান, গুণের আদর করা।
“নরেন্দ্রনাথ এইরূপ আঁঝালো মেজাজে পরমহংস মশাই-এর সহিত সমান সমান ভাবে তর্ক করিত। পরমহংস মশাইও তাতে হাসিয়া আনন্দ করিতেন। এক ব্যক্তি নরেন্দ্রনাথের অনুকরণ করিয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত কথা কহিতে গিয়াছিলেন। পরমহংস মশাই অমনি বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, লরেন বলে–লরেন বলতে পারে, তা বলে তুই বলতে যাসনি। তুই আর লরেন এক না। এই বলিয়া তাহাকে ধমক দিয়াছিলেন।”
মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, নরেন্দ্রনাথ একবার এক যুবককে বলেছিলেন, “ওঁর কাছে যাই, সমাজ বা অন্য বিষয় শেখবার জন্য নয় …ওঁর কাছে spirituality (ব্রহ্মজ্ঞান) শিখতে হবে। এটা ওঁর কাছে আশ্চর্যরকম আছে।”
তবু মাঝে-মাঝে গুরু-শিষ্যে তর্কবিতর্ক চলত। এমনকি নরেন্দ্রনাথ মুখঝামটা দিয়ে পরমহংসমশাইকে বলেছেন, “তুমি দর্শনশাস্ত্রের কি জানো? তুমি তো একটা মুখু লোক।”
পরমহংস মশাই হাসতে হাসতে বলতেন, “লরেন আমাকে যত মুখু বলে, আমি তত মুখু লই।…আমি অক্ষর জানি।” রোমাঁ রোলাঁ জানিয়েছেন, সংস্কৃতে কথা বলতে না পারলেও শ্রীরামকৃষ্ণ সংস্কৃত বুঝতেন। “আমার বাল্যকালে আমার একজন পড়শির বাড়িতে সাধুরা কি পরতেন, তা আমি বেশ বুঝতে পারতাম।”
শুরুতে গুরু-শিষ্য যতই তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাটি হোক, এঁরা দুজনে মিলেই বিশ্ববিজয় করেছেন। একালের ভারতবর্ষে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার চেলা বিবেকানন্দ সমস্ত বাধা অতিক্রম করে যে নট আউট রয়েছেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৭৫তম জন্মজয়ন্তী এবং স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উৎসব তারই ইঙ্গিত করে।
স্বামী সারদানন্দের এই বইটি বাংলা জীবনীসাহিত্যে এক দিকচিহ্ন, তবু যা সাবধানী পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না তা হ’ল কাশীপুর উদ্যানবাটীপর্বের কিছু উল্লেখ পঞ্চম খণ্ডে থাকলেও শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তিমকালের কোনও বর্ণনা এই বইতে নেই।
লীলাপ্রসঙ্গকে যাঁদের কাছে অসমাপ্ত বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে অনুরোধ সম্প্রতি বেদান্ত সোসাইটি অফ সেন্ট লুইস, ইউ. এস. এ. থেকে লীলাপ্রসঙ্গের যে পূর্ণাঙ্গ ইংরিজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে অনুবাদক স্বামী চেতনানন্দের মহামূল্যবান ভূমিকাটি পড়ে দেখুন। স্বামী চেতনানন্দ সবিনয়ে আমাদের জানিয়েছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের তেইশ বছর পরে স্বামী সারদানন্দ পরমপূজ্য ঠাকুরের জীবনকথা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেন। ১৯০৯ সালে বাংলা উদ্বোধন পত্রিকায় যে ধারাবাহিক জীবনকথা প্রথম প্রকাশিত হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯১৯ সালে। লীলাপ্রসঙ্গ সম্বন্ধে যে সংবাদটি কৌতূহলোদ্দীপক তা হলো প্রথমে লেখা হয় তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড, তারপর দ্বিতীয়, প্রথম এবং সর্বশেষে পঞ্চম খণ্ড। লীলাপ্রসঙ্গের পঞ্চম খণ্ড যে অসম্পূর্ণ তা স্বামী সারদানন্দের অজানা ছিল না, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের বিবরণ লিপিবদ্ধ করার অনুপ্রেরণা তিনি অন্তর থেকে অনুভব করেননি, তাই ওই পথে আর এগনো হয়নি।
শেষজীবনের এই শূন্যস্থানটি পূরণের জন্য রামকৃষ্ণ পুঁথির কবি অক্ষয়কুমার সেন থেকে শুরু করে এক শতাব্দী পরে স্বামী প্রভানন্দ পর্যন্ত অনেকে যথেষ্ট ধৈর্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন, তবু এইসব রচনায় অনুসন্ধিৎসুর মন পরিপূর্ণ হয় না। অন্য সমস্যা আছে, বিভিন্ন স্মৃতিকথার বিবরণে কিছু কিছু সংঘাতও রয়েছে। সময়ের দীর্ঘদূরত্বে, বিভিন্ন বিবরণের মধ্যে কোনটা সত্য এবং কোনটা অনিচ্ছাকৃত প্রমাদ তা ঠিকভাবে বলা ইদানিং কঠিন হয়ে উঠেছে।
যেমন ধরুন শ্রাবণসংক্রান্তির রবিবার ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধিলগ্নে নরেন্দ্রনাথ কি তার শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন? পরের দিন ১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্মশানযাত্রার আগে দ্য বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স দুটি গ্রুপ ফটো নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এই ছবির একটিতে অর্ধশত শোকার্তজনের উপস্থিতি, কেন্দ্রস্থলে নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু পুঁথিতে বলছে, ঠাকুরের যাতে ঘুম আসে তার জন্য পদসেবায় স্বয়ং শ্রীনরেন্দ্র নরবর। প্রভুকে অতঃপর সুস্থ দেখে নরেন্দ্র দোতলা থেকে একতলায় নেমে গেলেন বিশ্রামের জন্যে। ঘরে সেবকের তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে জেগে রইলেন শশী যিনি পরবর্তীকালে সব গুরুভাইদের মত অনুযায়ী স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামের জন্য যোগ্যতম বিবেচিত হয়েছিলেন।
এই শশী যে স্বামী সারদানন্দের সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই তা ভক্তমহলে সবাই জানেন। কাশীপুরে তখন রাত্রি ১টা বেজে ২ মিনিট। এক বিদেশিনী কুমারী লরা এফ গ্লেন (ভগিনী দেবমাতা), ১৯০৯ সালে মাদ্ৰাজমঠে এসে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের সঙ্গে কাশীপুর সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলেন। শশী মহারাজ তাকে জানান, “অকস্মাৎ রাত একটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ একপাশে ঢলে পড়লেন। তার গলা থেকে ক্ষীণ শব্দ বেরুতে থাকে।…নরেন্দ্র চট করে ঠাকুরের পা দুখানি বিছানার ওপর রেখে দৌড়ে নিচে নেমে গেল, যেন ঠাকুরের দেহের এই পরিণতি সে সইতে পারছিল না।”
তা হলে শেষমুহূর্তে নরেন্দ্রর উপস্থিতি সম্পর্কে দুটো মতামত পাওয়া যাচ্ছে। সময় সম্পর্কেও রয়েছে কিছু মতপার্থক্যরাত একটা, একটা দুই এবং ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত (ঠাকুরের নিতান্ত ঘনিষ্ঠ, কঁকুড়গাছি যোগোদ্যানের স্রষ্টা, নরেন্দ্রনাথের দিদিমা রঘুমণিদেবীর মামাতো ভাই) তার শ্রীরামকৃষ্ণ বৃত্তান্তে জানিয়েছেন, তখন রাত্রি ১টা বেজে ৬ মিনিট। মহাসমাধির সময় রামদাদা কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন না, সুতরাং তার বর্ণনা ঠিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নয়।
শ্রাবণের শেষ রবিবারে কাশীপুরের ঘটনাবলী সম্পর্কে যেখানে যতটুকু জানা যায় তা একত্রিত করার সবচেয়ে কঠিন কাজটি করেছেন স্বামী প্রভানন্দ তার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা গ্রন্থে। এই বইয়ের প্রধান তথ্যসূত্র কথামৃত রচনাকার শ্রীম’র অপ্রকাশিত ডায়েরি যা এই লেখক দেখবার ও ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরেও কিছু অনুসন্ধানকার্য চালু রয়েছে। যেমন গবেষক শ্ৰীনির্মলকুমার রায়, প্রমাণ করেছেন ঠাকুরের চিকিৎসক দুর্গাচরণ ব্যানার্জি বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পিতৃদেব নন। ঐসময়ে একই নামে তালতলায় আর একজন চিকিৎসক ছিলেন। এঁর বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ চিকিৎসার জন্যে যেতেন, কিন্তু তাঁর বাড়ির হদিশ পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানকর্মে অশেষ ধৈর্য ছিল প্রয়াত নির্মলকুমার রায়ের। তাঁর মতে, কলকাতায় অন্তত ১৪টি বাড়ি, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও না কোনও সময়ে গিয়েছিলেন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। খোদ কলকাতায় রামকৃষ্ণস্মৃতিধন্য আরও ১৭টি বাড়ির হদিশ পাওয়া যায়নি, এরই মধ্যে রয়েছে তালতলায় ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
মহাপুরুষদের শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে নির্ভরযোগ্য অথচ রুদ্ধশ্বাস গ্রন্থ রচনার রেওয়াজ রয়েছে পাশ্চাত্যে। এদেশে কয়েকবছর আগে শ্রীরামকৃষ্ণের বিভিন্ন অসুখ সম্বন্ধে সুদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন ডাঃ তারকনাথ তরফদার। এই লেখককে না দেখলেও তার ছবি দেখেছি, তরুণ এই গবেষকের প্রবন্ধের নাম ‘অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর’। ডাঃ তরফদার বলেছেন, দুর্গাচরণ ব্যানার্জির চেম্বারে রোগী শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন ঘটেছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫।
ইদানীং আরও কিছু সংবাদ এসেছে বিদেশ থেকে। মার্কিন দেশের সন্ন্যাসী স্বামী যোগেশানন্দর ইংরিজি বই (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) সিক্স লাইটেড উইনডোজ’ এদেশে বিক্রি হয় না, কিন্তু অনুসন্ধানীদের অবশ্যপাঠ্য। যোগেশানন্দ সাবধানী লেখক, তাঁর স্মৃতিকথায় প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছে, ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সন্ন্যাসীরা আত্মজীবনী রচনা করেন না, কারণ সন্ন্যাসপূর্ব জীবনের মৃত্যু ঘটিয়ে, আত্মশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে, বিরজা হোমের শেষে সন্ন্যাসীরা নবজীবনে প্রবেশ করেন, পূর্বাশ্রমের সঙ্গে তারা সম্পর্কহীন। পশ্চিমে যেসব খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসী এই ধরনের কাজ করেছেন, তাদের অনেকে বইয়ের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, চার্চের প্রবীণতরদের নির্দেশেই সঙ্রে প্রয়োজনে তারা নিজেদের জীবনকথা রচনায় হাত দিয়েছেন। রামকৃষ্ণ মঠের এই সন্ন্যাসী তাঁর স্মৃতিকথার শুরুতে বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিমের ক্ৰশকালচারাল মিলনের প্রথমপর্বে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয় তার কিছু কিছু লিখিত নিদর্শন থাকলে পরবর্তীকালের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসী উভয়েরই কাজে লাগতে পারে।
স্বামী যোগেশানন্দ তাঁর ইংরিজি বইতে দীর্ঘকাল আমেরিকা প্রবাসী প্রাণবন্ত সন্ন্যাসী স্বামী নিখিলানন্দের মুখে কাশীপুরে রবিবারের সেই রাত্রি সম্পর্কে যা শুনেছেন তা লিপিবদ্ধ করেছেন। স্বামী নিখিলানন্দ এই কাহিনি শুনেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের অধ্যক্ষ, ঠাকুরের পরমপ্রিয় এবং স্বামী বিবেকানন্দর আমৃত্যু অনুরাগী স্বামী অখণ্ডানন্দের কাছ থেকে। এঁকেই আদর করে স্বামী বিবেকানন্দ ডাকতেন ‘গ্যাঞ্জেস’ বলে (ওঁর ডাকনাম গঙ্গাধর) এবং ভগ্নী নিবেদিতা তার কালজয়ী দুর্ভিক্ষ ত্ৰাণকার্যের জন্য ডাকতেন ‘দ্য ফেমিন স্বামী’ বলে। স্বামী অখণ্ডানন্দ বিবেকানন্দর দেহত্যাগের পরও পঁয়ত্রিশ বছর (১৯৩৭ সাল পর্যন্ত) বেঁচেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির তারিখের এই কাহিনিটি বাংলা কোনও পত্রিকা বা বইতে আজও আমার নজরে পড়েনি। স্বামী নিখিলানন্দ যখন তার আপনজনদের কাছে এই কথা বলে গিয়েছেন তখন তা অবিশ্বাস করার কথা ওঠে না।
১৮৮৫ রবিবার ১৫ আগস্ট পরমহংসদেবের শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ, কোনও কিছুই ক্যানসার রোগাক্রান্ত গলা দিয়ে প্রবেশ করতে চায় না। আগেকার নিয়মকানুন না মেনে ঠাকুর কিছুদিন আগে ডাক্তারের নির্দেশে কচি পাঁঠার মাংসের সুরুয়া পান করতে রাজি হয়েছে। শর্ত একটি ছিল, “যে দোকান থেকে মাংস কিনে আনবি সেখানে যদি কালীমুর্তি না থাকে তবে কিনবি না।” একজন সেবক প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই অনুযায়ী মাংস কিনে আনতেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীসারদামণির স্মৃতিকথায় পাওয়া যাচ্ছে : “কাশীপুরে কঁচা জলে মাংস দিতুম, কখনও তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মতন সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম।..মাংসের জুস হ’ত। দুটো কুকুর তার ছিবড়ে খেয়ে এই মোটা হ’ল।” কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যে একটি রাঁধুনি বামুন আনানো হয়েছিল তার উল্লেখ আছে মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর দিনলিপিতে। আরও জানা যায়, রাঁধুনিটি এসেছিল ঠাকুরের গ্রাম থেকে, কিন্তু রান্নাবাড়া সে প্রায় কিছুই জানত না।
স্বামী যোগেশানন্দের ইংরাজি বইতে ঠাকুরের শেষদিনের বর্ণনা : মর্তলীলার শেষদিনে শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি ডিম সেদ্ধ খাবেন। (অবশ্যই হাঁসের ডিম, মুরগী তখন বাঙালির ঘরে নিষিদ্ধ।) অবাক কাণ্ড, কারণ এই ধরনের ইচ্ছে আগে তিনি কখনও প্রকাশ করেননি। সেই মতো দুটো ডিম সেদ্ধও করা হয়েছিল, কিন্তু সারাদিন ধরে যেসব বিপর্যয় গেল তার পরে এই ডিম তার খাওয়া হয়নি। এরপরেই স্বামী অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথন, মধ্যরাতে যখন সব শেষ হয়ে গেল, তখন নরেন্দ্র বললেন, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, কী করা যায়? এই বিবরণ শুনে স্বামী নিখিলানন্দ পরে বলেছিলেন, এই সময়ে তো খিদে পাবার কথা নয়। স্বামী অখণ্ডানন্দর উত্তর : ”যা হয়েছিল তা বলছি। ডিম সিদ্ধর খবর পেয়ে খিদেয় পাগল নরেন্দ্রনাথ ডিম দুটি খেয়ে ফেলে নিজেকে সামলালেন।” অখণ্ডানন্দের মতে, নরেন ও রামকৃষ্ণ যে একাত্ম হয়ে গিয়েছে, এইভাবে ডিম খাওয়াটা তারই নিদর্শন।
কাশীপুরে দীর্ঘদিন ধরে বিরতিহীন সেবাকার্যে নিয়ত জর্জরিত হয়ে বারোজন ত্যাগী সন্তানের শরীরে তখন কিছুই ছিল না। কে কতক্ষণ রোগীর পাশে ডিউটি দেবে, কে কলকাতায় ডাক্তারের কাছে যাবে, কে পথ্য সংগ্রহ করে এনে কীভাবে তা প্রস্তুত করবে তা বুঝিয়ে দেবে, এসবই ঠিক করে দিতেন নেতা নরেন্দ্রনাথ। ঘড়ির কাঁটার মতন কাজ হ’ত, কিন্তু সময়ের নির্দেশ মানতে চাইতেন না শশী ও তার ভাই শরৎ (সারদানন্দ)।
ঠাকুরের সেবার সময় শশীর খাওয়াদাওয়ার কথা মনেই থাকত না, বারবার ছুটে আসতেন অমৃতপথযাত্রীর শয্যাপার্শ্বে। এই প্রসঙ্গে স্বামী প্রভানন্দ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ঠাকুর’ কথাটি তাঁর দেহাবসানের পরে সৃষ্টি হয়, ভক্তগণ জীবিতকালে বলতেন ‘পরমহংসদেব’, অন্যেরা ‘পরমহংসমশাই’, অনেকে ব্যাঙ্গ করে ‘গ্রেটগুজ্’!
কাশীপুর থানার ডেথ রেজিস্টারেও ইংরিজিতে লেখা, রাম কিষ্টো প্রমোহংস’, নিবাস: ৪৯ কাশিপুর রোড, জাতি : ব্রাহ্মণ, বয়স ৫২, পেশা : ‘প্রিচার’ অর্থাৎ প্রচারক। মৃত্যুর কারণ : গলায় আলসার, অর্থাৎ ক্ষত। সংবাদদাতা গোপালচন্দ্র ঘোষকে ‘বন্ধু’ বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই ‘বন্ধু’টি আসলে ভক্তমহলের সুপরিচিত বুড়োগোপাল, যিনি পরে স্বামী অদ্বৈতানন্দ নামে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
শ্রাবণের শেষ রাতে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত ত্যাগী সন্তানদের আর একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা রেখে গিয়েছেন স্বামীজির মধ্যমভ্রাতা শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘শ্রীমৎ সারদানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলি’ গ্রন্থে।
শোকার্ত সময়ে চা খাওয়া সম্বন্ধে শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) একটি গল্প বলতেন, “ওহে, শিবরাত্রির উপোস করে, আমাদের চা খেতে কোনও দোষ নেই। কেন জান? যেদিন তাঁর (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের) দেহত্যাগ হয় সকলেই বিষণ্ণ, খাওয়া-দাওয়া কিছুই হল না। কেই বা উনোন জ্বালে। আর কেই বা রান্না করে। অবশেষে দরমা জ্বালিয়ে কেটলি করে জল গরম করে চা হ’ল আর ঢক ঢক করে খাওয়া গেল। অমন শোকর দেহত্যাগের দিনেও চা খেয়েছিলুম, তা শিবরাত্রির উপোস করে চা কেন খাওয়া চলবে না বল?”
প্রসঙ্গত বলি, স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত একবার প্রিয় শরৎ মহারাজকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি এত চা খেতে শিখলে কোথা থেকে?” স্বামী সারদানন্দ হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমার ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে। তোমাদের বাড়িতে যে চায়ের রেওয়াজ ছিল সেইটা মঠে ঢুকিয়ে দিলে আর আমাদের চা-খোর করে তুললে! তোমরা হচ্ছ একটা নারকটিক’ ফ্যামিলি!”
কঠিন সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কঠিনতম দুঃখের মোকাবিলার দুর্লভ শিক্ষা পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্ররা। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরম অবজ্ঞাভরে তারা তাই বলতে পেরেছেন, আমার তো জন্মই হয়নি, সুতরাং মৃত্যু হবে কী করে?
তবু দুরন্ত দুঃখ এবং প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা, হৃদয়বান সন্ন্যাসীকেও ক্ষণকালের জন্য অশ্রুভারাক্রান্ত করে তোলে, স্বামীজি নিজেই একবার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, “কী বলেন মশাই, সন্ন্যাসী হয়েছি বলে হৃদয় থাকবে না?”
বৈরাগ্য ও ভালবাসার, আকর্ষণ ও বিকর্ষণের পরস্পরবিরোধী শক্তি, রামকৃষ্ণতনয়দের ব্যক্তিজীবন ও সন্ন্যাসজীবনকে এক আশ্চর্য রঙিন আভায় বারবার আলোকিত রেখেছিল। এই জন্যেই বোধ হয় যখন আমরা শুনি, ঠাকুরের দেহাবসানের পর শোকার্ত নরেন্দ্রনাথ আত্মহননে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন আশ্চর্য হই না। প্রেমের ঠাকুর এবং সর্বস্বত্যাগী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ দু’জনেই আমাদের বোধের ঊর্ধ্বে থেকে যান।
.
শুরুতেই আরও কয়েকটা সহজ কথা বলে রাখা ভাল। দক্ষিণেশ্বরে অনেকদিন শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য জানিয়েছেন, সুস্থ অবস্থায় তিনি আধসের থেকে দশ ছটাক চালের ভাত খেতেন। ব্যাধি বলতে আমাশয়, প্রায়ই পেট গোলমাল হত। আরও রিপোর্ট, একবার বায়ুবৃদ্ধি রোগে কাতর হলে, আগরপাড়ার বিশ্বনাথ কবিরাজ তার চিকিৎসা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্ন, “হারে তামুক খেলে কী হয়?” কবিরাজ শেষপর্যন্ত পরামর্শ দেন, ছিলিমের ওপর ধানের চাল ও মৌরী দিয়ে তামাক খেও। ঠাকুর সেই পরামর্শ মেনে চলতেন। কিন্তু ধূমপানের সঙ্গে ক্যান্সারের নিবিড় সম্পর্ক সম্বন্ধে ডাক্তার ও নাগরিক তখনও সচেতন হননি।
যথেচ্ছ ধূমপানটা হয়ে উঠেছিল সেকালের বঙ্গীয় জীবনের অঙ্গ। প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথ যে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েই ধূমপান শুরু করেন তার ইঙ্গিত রয়েছে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-লীলামৃত নামক গ্রন্থে। “পাঠাগারদ্বার আবদ্ধ থাকিত, অর্থাৎ যখন-তখন তামাক খাইতেন বলিয়া পিতা (বিশ্বনাথ দত্ত) কহিতেন বাবাজি বুঝি ঠাকুরকে ধূপধুনা দিতেছেন, তাই দ্বার বন্ধ। কিন্তু লেখাপড়ায় উন্নতি দেখিয়া কিছু বলিতেন না।”
ঠাকুরের ধূমপানপ্ৰীতিকে ভক্ত জনেরা তাঁর দেহাবসানের পরেও নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আজও বেলুড়মঠে সন্ধ্যায় ঠাকুরের শেষ সেবাটির নাম হুঁকোভোগ। সুগন্ধী তামাক প্রজ্জ্বলিত কলকেতে স্থাপন করে ঠাকুরের কক্ষে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে রাতের বিশ্রামের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতেও হুঁকো কলকের অন্য ব্যবহার হয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর ত্যাগী ভাইরা যখন ধুনি জ্বালিয়ে সন্ন্যাসীদের মতন অঙ্গে ভস্ম লেপন করতেন তখন অন্য ছাইয়ের অভাবে হুঁকোর টিকের ছাই ব্যবহার করতেন। এই অবস্থায় নরেন্দ্রনাথের যে ফটোগ্রাফটি কালের অবহেলা সহ্য করে আজও টিকে আছে তা বিশেষজ্ঞদের মতে কাশীপুরে গৃহীত হয় ১৮৮৬ সালে। এইটাই এখনকার সংগ্রহে নরেন্দ্রনাথের প্রথম ছবি, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কে এই ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন, ফটোগ্রাফার কে–তা আজও স্পষ্ট নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির সংখ্যা হাতে গোনা হলেও ছবির বিস্তারিত বিবরণ আমাদের জানা নেই। ঠাকুরের যে ছবিটি এখন সারা বিশ্বে বন্দিত তা যে ভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দক্ষিণেশ্বরে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের শিক্ষানবিশ অবিনাশচন্দ্র দাঁয়ের তোলা এবং স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ বিশেষ সাহায্য না করলে সমাধিমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণের এই অমূল্য ছবিটি আমরা পেতাম না তা গ্রন্থিত হয়েছে।
আমরা জানি, অসাবধানতাবশতঃ অবিনাশ দায়ের হাত থেকে কাঁচের নেগেটিভাটি পড়ে তা ফেটে যায়, কিন্তু ফটোগ্রাফার খুব সাবধানে পিছনের অংশটি গোলাকৃতিতে কেটে ফেলে মূল ছবিটি রক্ষা করেন। পিছনের অর্ধ গোলাকার দাগটি ভারি সুন্দর মানিয়ে গিয়ে ছবিটিকে বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত লেখক বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল কাশীপুর পর্বে এই পদ্মাসনাস্থ ধ্যানমূর্তি সম্পর্কে ঠাকুরের নিজস্ব মন্তব্য আমাদের জন্য সংগ্রহ করে রেখে গিয়েছেন। ঠাকুর বলছেন, “ভবনাথের জেদে ছবি তোলাতে বিষ্ণুঘরের রকে বসে এমন সমাধিস্থ হই যে, ফটো উঠালেও ধ্যানভঙ্গ হ’ল না দেখে, আমি মরে গেছি ভেবে ফটোওয়ালা অবিনাশ যন্ত্রপাতি ফেলে পালায়।”
কাশীপুরে শ্রাবণের শেষরাতে শ্রীরামকৃষ্ণ মৃত না গভীর সমাধিমগ্ন তা স্থির করতে সেবকরা অক্ষম হন। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “তাই আমরা আশায় বুক বাঁধিয়া, এই জাগিবেন, এই উঠিবেন, ভাবিয়া সারারাত্রি প্রভুকে ঘিরিয়া তাহার অপূর্বভাব দেখিতে লাগিলাম।”
অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবন্ধে ডাঃ তারকনাথ তরফদার শ্রীরামকৃষ্ণের একটা মেডিক্যাল হিস্ট্রি খাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কথামৃতে এই অসুখের প্রথম উল্লেখ ২৪ এপ্রিল ১৮৮৫ : গলায় বিচি, শেষ রাত্রে কষ্ট হচ্ছে, মুখ শুকনো লাগছে। ডাক্তার তরফদারের আন্দাজ, অসুখের সূত্রপাত সম্ভবত বেশ কিছু আগে। অন্তিম রোগের প্রথম লক্ষণ, গলায় বিচি, ১৫-১৬ মাস পরে জীবনাবসান।
কথামৃত ও অন্যান্য সূত্র থেকে ডাক্তার গবেষকের রচনা থেকে আরও কয়েকটি উদ্ধৃতি।
২৬মে ১৮৮৫ : পানিহাটি মহোৎসবে মাতামাতির পর রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি।
১৩ জুন ১৮৮৫ : ফের গলায় বিচির উল্লেখ, সেই সঙ্গে সর্দি গয়েরে ‘বিশ্রী গন্ধ’।
২৮ জুলাই ১৮৮৫ : কথামৃত অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে শেষ গান। কিন্তু কাশীপুরে তিনি দু’এককলি গেয়েছেন।
আগস্ট ১৮৮৫: গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ শুরু। খেতে বা গিলতেও কষ্ট।
১১ আগস্ট ১৮৮৫ : ধর্মপ্রচারে অত্যধিক কথা বলায় এই রোগ। ডাক্তারি ভাষায়, ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’,এই দিন কিছুক্ষণের জন্যে মৌনীভাব।
৩১ আগস্ট ১৮৮৫ : রাত্রে সুজির পায়েস খেতে কোনো কষ্ট হ’ল না। অর্থাৎ খাবার খেতে কষ্ট শুরু হয়েছে। খেয়ে ঠাকুরের আনন্দ : “একটু খেতে পারলাম, মনটায় বেশ আনন্দ হল।” তবে রাত্রে গায়ে ঘাম।
১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার রাখালদাস ঘোষ ল্যারিনজোসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করলেন।
২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার দেখলেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় এলেন। কাশির প্রকোপ বৃদ্ধি।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি।
১ অক্টোবর ১৮৮৫ : রাত্রে যন্ত্রণা বৃদ্ধি, ঘুম নেই।
২ অক্টোবর ১৮৮৫ : শ্যামপুকুরের বাড়িতে এলেন।
৪ অক্টোবর ১৮৮৫ : রক্তপাত, প্রথমে কাঁচা, পরে কালো ঘন।
১২ অক্টোবর ১৮৮৫ : ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন।
১৫-১৭ অক্টোবর ১৮৮৫: এর মধ্যে কোনো একদিন ডাঃ সরকার ও তার বন্ধু সমাধির সময় শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন।
৪ নভেম্বর ১৮৮৫ : ঠাকুর গুরুতর পীড়িত।
৮ নভেম্বর ১৮৮৫ : রক্তমেশা কফ পরীক্ষা–এই রিপোর্টের বিবরণ কারও কাছে নেই।
২৯ নভেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার সরকারের সিদ্ধান্ত, রোগ ক্যানসার। এর আগে সেপ্টেম্বরে কবিরাজরা বলেছেন ‘রোহিণী’ রোগ।
রোগ লক্ষণ বিচার করে ডাঃ তরফদারের অনুমান, “রামকৃষ্ণদেবের অসুখ প্রাথমিকভাবে ‘হাইপোফ্যারিস’ (অথবা তার পরে ‘অরোফ্যারিন্কস’) অংশে শুরু হয়েছিল, স্বরযন্ত্রে নয়।”
.
শ্যামপুকুরের বাড়ি ছাড়বার জন্যে বাড়িওয়ালা প্রবল তাগাদা লাগাচ্ছিল। নতুন বাড়ির খোঁজ হচ্ছে। ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, আমি কি জানি? কাশীপুরনিবাসী ভক্ত মহিমাচরণ চক্রবর্তী একটা বাড়ির খবর দিলেন। রানী কাত্যায়নীর জামাই গোপালচন্দ্র ঘোষের উদ্যানবাটী, ঠিকানা : ৯০ কাশীপুর রোড, মাসিক ভাড়া ৮০।
যে তথ্যটি অস্বস্তিকর ও অপ্রচলিত, শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর ফিরে গিয়ে জীবনের শেষ ক’টি দিন সেখানে অতিবাহিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মন্দিরের পরিচালকদের অনুমতি মেলেনি।
কাশীপুর উদ্যানবাটির বাড়ি ভাড়া শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশ চিন্তিত করেছিল, ভক্তরা প্রতিমাসে চাদা তুলুক তা তাঁর পক্ষে অস্বস্তিকর। তখন গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রর ডাক পড়ল। ঠাকুর তাকে ‘সুরেন্দর’বা সুরেশ বলতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “দেখ সুরেন্দ্র, এরা সব কেরানি-মেরানি ছাপোষা লোক, এরা এত টাকা চাঁদা তুলতে পারবে কেন?…বাড়ি ভাড়ার টাকাটা তুমি দিও।”
সুরেন্দ্র সানন্দে রাজি হয়ে যান এবং বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তিপত্রে ছ’মাসের গ্যারান্টর হন। ৮০ টাকা ছাড়াও কাশীপুরপর্বে তিনি মাসে ২৩০ দিতেন। মদ খেয়ে রাত্রে গোলমাল করতেন বলে সুরেন্দ্রকে এক সময় দক্ষিণেশ্বরে পাঠানো হয়েছিল। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “দক্ষিণেশ্বর যাইয়া দেখেন, ঠাকুর নহবখানার নিকট বকুলতলায় দণ্ডায়মান। প্রণাম করিবামাত্র কহেন, ও “সুরন্দর! খাবি, খা, বারণ করিনে, তবে পা না টলে, আর জগদম্বার পাদপদ্ম হতে মন না টলে; আর খাবার আগে নিবেদন করে বলিস, মা তুমি এর বিষটুকু খাও, আর সুধাটুকু আমাকে দাও, যাতে প্রাণভরে তোমার নাম করতে পারি।”
মাসিক টাকা ছাড়াও কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের শোয়ার ঘরের খসখস পর্দা, ফুলের মালা, ফল প্রভৃতির খরচও বহন করতেন সুরেন্দ্র। মহাসমাধির পর ব্রাহনগরে বাড়িভাড়া (১১ টাকা) এবং খাওয়াদাওয়া বাবদ মাসিক ১০০ সুরেন্দ্রনাথই দিতেন।
কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে যে প্রচুর মশা ছিল তা জানা যাচ্ছে। দোতলার ঘরে ঠাকুর শায়িত, লণ্ঠন জ্বলে ও একটা মশারি টাঙানো। গিরিশ ও শ্ৰীমকে ঠাকুর বললেন, “কাশি কফ বুকের টান এসব নেই। তবে পেট গরম। ঘরেই পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরে যেতে পারব বলে মনে হয় না।” সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবক লাটু (পরে স্বামী অদ্ভুতানন্দ) তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “যে আজ্ঞা মশাই, হামি ত আপনার মেস্তর হাজির আছি।”
লাটুর (পূর্বনাম রাখতুরাম) মাধ্যমে আমরা জানি, একদিন টাকা পয়সার হিসেব রাখা নিয়ে কথা উঠল। নরেন বললেন, এত হিসেব রাখারাখি কেন? এখানে কেউ তো চুরি করতে আসেনি? লাটু বললেন, হিসেব রাখা ভাল।
গোপালদার ওপর হিসেব রাখার দায়িত্ব পড়ল। লাটু (স্বামীজি এঁকে প্লেটো বলে ডাকতেন) জানিয়েছেন, গেরস্তর পয়সা ঠাকুর বেফজল খরচ হতে দিতেন না। একবার দক্ষিণেশ্বরে একটা প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে কেউ তিন-চারটে কাঠি নষ্ট করেছিল। তক্তা থেকে নেমে ঠাকুর নিজেই দেশলাই ধরালেন এবং বললেন, “ওগো, গেরস্থরা অনেক কষ্টে পয়সা বাঁচিয়ে তবে সাধুকে দেয়, সে পয়সার বাজে খরচ হতে দেওয়া উচিত কি?”
ঠাকুরের গলার অসুখ সম্পর্কে লাটু মহারাজ আরও দুটি কথা বলেছেন। একবার দেশে ঠাকুরের দাদার বিকার হয়েছিল, ঠাকুর তাঁকে জল খেতে দিতেন না। তাই তিনি বলেছিলেন, মরবার সময় তোমার গলা দিয়ে জল গলবে না। দেখো। আর একবার কাকা কানাইরামের বড় ছেলে হলধারী (রামতারক চট্টোপাধ্যায়) দাদার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে, মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে এই অভিশাপ দিয়েছিলেন। হলধারী ঠাকুরের অবতার রূপ বিশ্বাস করতেন না।
.
কাশীপুর উদ্যানবাটিতে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে। একটা শুনুন কালীর (পরে স্বামী অভেদানন্দ) মুখে।
“নরেন্দ্রনাথ আমার অপেক্ষা প্রায় চারি বৎসরের বড় ছিল। আমি নরেন্দ্রনাথকে সেই অবধি আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতার ন্যায় দেখিতাম ও ভালবাসিতাম। নরেন্দ্রনাথও আমায় আপনার সহোদরতুল্য ভালবাসিত। তাহা ছাড়া আমি যে তাহাকে শুধু ভালবাসিতাম তাহা নহে, তাহার আজ্ঞানুবর্তী হইয়া সকল কাজই করিতাম। বলিতে গেলে আমি ছায়ার মতো সর্বদা নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে-সঙ্গে থাকিতাম ও নরেন্দ্রনাথ যাহা করিত আমিও নির্বিবাদে তাহা করিতাম। তাহা ছাড়া নরেন্দ্রনাথ যাহা করিতে বলিত অকুণ্ঠিত হৃদয়ে তৎক্ষণাৎ তাহা করিতাম।
“আত্মজ্ঞান লাভ করা-সম্বন্ধে বিচার করিতে করিতে একদিন নরেন্দ্রনাথ হিন্দুদিগের আহারাদি-সম্বন্ধে যে সকল কুসংস্কার (prejudice) আছে তাহার বিরুদ্ধে জোর করিয়া আমাদিগকে বলিতে লাগিল। শরৎ, যোগেন, তারকদাদা ও আমি এই বিষয় লইয়া তাহার সহিত বিচার করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথ বলিল, ব্রহ্মজ্ঞান হলে সকলের হাতে খাওয়া চলে। তখন কেউ কাকেও ঘৃণা করে না। যতদিন কুসংস্কার থাকবে ততদিন ঠিক ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।”
স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, “আমরা কেহই মুসলমানের হাতের রান্নাকরা খাদ্য পূর্বে কখনও খাই নাই। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মদিগের ন্যায় জাতিবিচার মানিত না। তাহার মত ছিল উদার, তাই সে সকলের হাতের রান্না খাদ্য খাইয়াছে। সেইদিন নরেন্দ্রনাথ আমাদের বলিল : ‘চলো, আজ তোমাদের কুসংস্কার ভেঙে আসি। আমি তৎক্ষণাৎ নরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে রাজি হইলাম এবং শরৎ ও নিরঞ্জন আমার কথায় সায় দিল। সন্ধ্যার সময়ে কাশীপুর বাগান হইতে পদব্রজে নরেন্দ্রনাথ আমাদের লইয়া বিডন স্ট্রিটে (বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার হইয়াছে) পীরুর রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হইল। নরেন্দ্রনাথ ফাউলকারীর অর্ডার দিল এবং আমরা সকলে বেঞ্চিতে নীরবে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। ফাউলকারী আসিলে আমরা সকলে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে কুসংস্কার ভাঙিতেছি ও ঘৃণা দূর করিতেছি এই ধারণা হৃদয়ে রাখিয়া তাহার অল্পমাত্র গ্রহণ করিলাম। নরেন্দ্রনাথ মহানন্দে প্রায় সমস্তটাই আহার করিল। আমরা একটুতেই সন্তুষ্ট। নরেন্দ্রনাথের কাণ্ডকারখানা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম এবং তাহার খাওয়া শেষ হইলে সকলে মহানন্দে পুনরায় কাশীপুরের বাগানে ফিরিয়া আসিলাম।
“তখন রাত্রি প্রায় দশটা। কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আমি শশব্যস্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করিবার জন্য তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর বহুক্ষণ আমাদের কাহাকেও কাশীপুরের বাগানে দেখিতে না পাইয়া উদ্বিগ্ন ছিলেন দেখিলাম। আমাকে সম্মুখে দেখিয়া তিনি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন : ‘কিরে, কোথায় সব গিয়েছিলি?’
আমি বলিলাম : কলকাতায় বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানে।
–‘কে কে গিছলি?’
আমি সকলের নাম করিলাম। তিনি সহাস্যে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সেখানে কি খেলি?’
আমি বলিলাম : মু–র ডালনা।
তিনি বলিলেন : ক্যামন লাগলো তোদের?
আমি : আমার ও শরৎ প্রভৃতির খুব ভাল লাগেনি। তাই একটুখানি মুখে দিয়ে কুসংস্কার ভাঙলাম।
শ্রীশ্রীঠাকুর উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, ‘বেশ করেছিস। ভাল হ’ল, তোদের সব কুসংস্কার দূর হয়ে গেল।’
আমি শ্রীশ্রীঠাকুরের অভয়বাণী শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম।”
.
ঠাকুরের ডাক্তারি বিবরণের দিকে আবার নজর দেওয়া যাক।
১২ ডিসেম্বর ১৮৮৫ : ঠাকুরের কাশি নেই, কিন্তু পেট গরম। কচি পাঁঠার সুরুয়া খেলেন।
২৭ ডিসেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তারি ওষুধ ছাড়াও দৈব ওষুধের প্রয়োগ।
।এই ওষুধ এসেছিল শ্রীরামপুর থেকে। শ্ৰীমকে “দেখিয়ে” ঠাকুর বলেন, ইনি দাম দেবেন। কিন্তু নবগোপাল ঘোষ ও চুনীলাল ইতিমধ্যেই দাম দিয়ে দিয়েছেন।
ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত এই পর্যায়ে লিখেছেন, ব্যাধির বিভীষিকা দেখালে রামকৃষ্ণ হেসে উঠতেন, বলতেন, “দেহ জানে, দুঃখ জানে, মন তুমি আনন্দে থাক।”
চণ্ডীগড় থেকে প্রকাশিত স্বামী নিত্যাত্মানন্দের বহুখণ্ডের বই শ্ৰীম দর্শনে, কাশীপুরের যে বর্ণনা আছে তা এইরকম : পশ্চিমের জানলার তিন চার হাত পূর্বে ঠাকুরের বিছানা। তার শিয়র থাকত দক্ষিণ দেওয়ালের গায়ে। বাঁদিকে তিন হাত দূরে খড়খড়ির জানলা। মেঝেতে মাদুরের ওপর পাতা শতরঞ্চি, তার ওপর শ্রীরামকৃষ্ণের বিছানা।
১লা জানুয়ারি ১৮৮৬ : সকালে শ্রীরামকৃষ্ণ দোতলা থেকে নিচেয় নেমে এসে অকাতরে যে আশীর্বাদ বিলিয়েছিলেন তা কল্পতরু উৎসব মারফত এখন লিজেন্ডে পরিণত হয়েছে। মঠ ও মিশনে এই অভাবনীয় ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। যে যা চেয়েছে তা দেওয়া ছাড়াও যে কিছু চায়নি তাকেও রামকৃষ্ণ বলেছেন, তোমার চৈতন্য হোক।
লীলাপ্রসঙ্গে এর ব্যাখ্যা : “রামচন্দ্র প্রমুখ কোনো কোনো ভক্ত এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়া বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদিগের বোধ হয়, উহাকে ঠাকুরের অভয়-প্রকাশ অথবা আত্মপ্রকাশপূর্বক সকলকে অভয়প্রদান বলিয়া অভিহিত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রসিদ্ধি আছে, ভাল বা মন্দ যে যাহা প্রার্থনা করে কল্পতরু তাহাকে তাহাই প্রদান করে। কিন্তু ঠাকুর তো ওইরূপ করেন নাই, নিজ দেব-মানবত্বের এবং জনসাধারণকে নির্বিচারে অভয়াশ্রয় প্রদানের পরিচয় ওই ঘটনার সুব্যক্ত করিয়াছিলেন।”
আশ্চর্য বিষয় ঠাকুরের যেসব ভক্ত পরে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন তাদের একজনও কল্পতরুর দিনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। নরেন্দ্রনাথ আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত ঠাকুরের সেবা করে ক্লান্ত হয়ে উদ্যানবাটির এক তলায় ঘুমোচ্ছিলেন।
পরের দিন ২ জানুয়ারি ১৮৮৬ শনিবার যে ঠাকুরের শরীরের অবস্থার প্রবল অবনতি হয়েছিল তা ডাক্তার গবেষকরা খুঁজে বার করেছেন। পরের দিন রবিবার অন্তত দু’বার রক্তক্ষরণ। এর ক’দিন আগে তিনি কবিরাজের দেওয়া হরিতালভস্ম সেবন করেন, কিন্তু তা বমি হয়ে যায়।
১১ই জানুয়ারি ১৮৮৬ : কবিরাজ নবীন পালের ওষুধ প্রয়োগ। বাগবাজারের এই কবিরাজ শ্যামপুকুরেও এসেছিলেন এবং মর্তলীলার শেষ দিনে (১৫ আগস্ট) কাশীপুরে এসে তার অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণার কথা শোনেন।
১৩ জানুয়ারি ১৮৮৬ : ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেন, গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত সমস্ত ডান দিক ফুলে গিয়েছে। ওজন বেশ কমেছে। একমাত্র ‘কোনিয়াম’ প্রয়োগে সুফল।
২৮ জানুয়ারি ১৮৮৬ : ধর্মতত্ত্ব পত্রিকায় রিপোর্ট : ‘গলার স্বর একেবারে বন্ধ’, প্রায় দু-আড়াই সের রক্তক্ষরণ ও বাড়াবাড়ি হয় এদিন রাত্রে।
শ্যামপুকুরে এসে খরচের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত বলরাম বসুকে বলেছিলেন, “তুমি আমার খাবার খরচটা দিও। আমি চাঁদার খাওয়া পছন্দ করি না।” বলরাম বসু কৃতার্থ হয়েছিলেন।
.
এরপরের বিবরণ শোনা যাক স্বামী অভেদানন্দের ‘আমার জীবনকথা’ থেকে। “কাশীপুর বাগানে ক্রমশ সেবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।…রামবাবু প্রভৃতি গৃহস্থ ভক্তরা খাইবার খরচ কমাইবার জন্য সেবকের সংখ্যা যাহাতে অল্প হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বলিলেন, দুইজন সেবক থাকিলেই যথেষ্ট হইবে, অপর সকলে নিজ নিজ বাড়িতে থাকিবে।
“এই সংবাদ যখন শ্রীশ্রীঠাকুরের কর্ণে উপস্থিত হইল তখন তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আমার এখানে আর থাকবার ইচ্ছে নেই। ইন্দ্রনারায়ণ জমিদারকে টানবো নাকি?-না, বড়বাজারের মাড়ওয়ারীটাকে ডেকে আনব। সেই মাড়োয়ারী অনেক টাকা নিয়ে একবার এসেছিল, কিন্তু সে টাকা আমি গ্রহণ করিনি। তাহার পর বলিলেন, না, কাকেও ডাকার প্রয়োজন নেই। জগন্মাতা যা করেন তাই হবে।
“তখন নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি আমরা সকলে বসিয়া আছি, তিনি আমাদিগকে বলিলেন, ‘তোরা আমাকে নিয়ে অন্যত্র চল। তোরা আমার জন্য ভিক্ষে করতে পারবি? তোরা আমাকে যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই যাব। তোরা ক্যামন ভিক্ষে করতে পারিস দ্যাখা দেখি। ভিক্ষার অন্ন বস্ত্র শুদ্ধ। গৃহস্থের অন্ন খাবার আর আমার ইচ্ছে নেই।”
ভিক্ষেতে বেরিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের নানা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কেউ চাল, আলু, কাঁচকলা ভিক্ষা দিল, কেউ বলল, “হোঁকা মিনসে, চাকরি করতে পারিনি, আবার ভিখিরি সেজে ভিক্ষে করতে বার হয়েছিস।” কেউ বলল,”এরা ডাকাতের দল, সন্ধান নিতে এসেছে।” কেউ গুণ্ডার লোক বলে তাড়া করল। শ্রীমা ভিক্ষার চাল থেকে তরল মণ্ড বেঁধে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দিলেন, “ভিক্ষান্ন খেয়ে আমি পরমানন্দ লাভ করলাম”, তিনি বললেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীরামকৃষ্ণের স্বাস্থ্যবিবরণও অনুসন্ধানী ডাক্তার তারকনাথ তরফদার পরম যত্নে সাজিয়েছেন।
৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : বৈদ্য মহাফেজের নির্দেশ বুড়িগোপানের পাতা চিবনো, সাতপুরু কলাপাতা দিয়ে ঘা বাঁধতে হ’ল।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : কানের দিকে ফুলো বেড়েছে। নিত্য আহার পাঁচ-ছটাক বার্লি।
১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : গাঁদা পাতার পুলটিস লাগানো হল।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঘায়ের মুখ নীচের দিকে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঠাকুরের জামরুল খাবার ইচ্ছে, কিন্তু খেতে পারলেন না।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঘি দিয়ে ক্ষতের ড্রেসিং।
মার্চ মাসের ২৫ তারিখে অপরাহে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নবম অধ্যক্ষ ডাক্তার জে এম কোর্টুসকে সঙ্গে নিয়ে কাশীপুরে এলেন।
পরবর্তী বর্ণনাটুকু স্বামী প্রভানন্দের রচনা থেকে : “অপরাহুঁকাল। ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত মেডিকেল কলেজের প্রধান চিকিৎসক ও অধ্যক্ষ ডাঃ কোর্ট সাহেবকে নিয়ে কাশীপুর বাগানবাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন।”
এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “যদিচ প্রসিদ্ধ ডাক্তার দ্বারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হইতেছে, তথাপি প্রায় আট মাস হইতে যায় আশামতো উপশম না দেখিয়া ভক্তগণ বড়ই উদ্বিগ্ন হন; এবং কি রোগ, বা কি উপায়ে শান্তি হইতে পারে, এই আশায় মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বিজ্ঞ ডাক্তার কোটস সাহেবকে আনয়ন করেন।”
ডাঃ কোটুসের পুরো নাম Dr. J. M. Coates। চিকিৎসাবিদ্যায় তার পরিচায়ক উপাধি M.B.B.S., M.D., L.FP.S.G.। তিনি মেডিকেল কলেজের নবম অধ্যক্ষ। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একাজে যোগদানের পূর্বে তিনি ছিলেন মিলিটারিতে এবং সেখানে তিনি Brigadier Surgeon-এর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
ডাঃ কোট্র জবরদস্ত সাহেব। তিনি রামবাবুর সঙ্গে বাগানবাড়ির দোতলার হলঘরের সামনে উপস্থিত হয়েছে। জুতো-পায়ে গটমট করে তিনি ঘরে ঢুকে পড়লেন। নিকটে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেবক শশী। তার হাতে ডাক্তারি ব্যাগটি তিনি ধরবার জন্য এগিয়ে দেন। শশী আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। খ্রিস্টান সাহেবের ব্যাগ স্পর্শ করতে তাঁর দ্বিধা লক্ষ্য করে কোস সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা হন। তিনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন : You go from here. you ullu. উপস্থিত অন্য একজন ডাক্তারের ব্যাগ ধরেন। এদিকে শশীর প্রতি সাহেব ডাক্তারের রূঢ় আচরণ লক্ষ্য করে শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর মর্মাহত হন। শ্রীরামকৃষ্ণ বাধা দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আহা! থাক্ থাক্।
ডাঃ কোক্স মাদুরের উপর বসেছিলেন। ঠাকুরের ব্যবহার্য তাকিয়া ডাক্তারকে দেওয়া হয়েছিল ঠেসান দিয়ে বসবার জন্য। এদিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন দেখে মাস্টারমশাই তাকিয়া নিয়ে ঠাকুরের পিঠের পিছনে স্থাপন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ তাতে হেলান দিয়ে বসেন। তারপর তাকিয়া সরিয়ে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তারের হাত ধরে বলেন, তাকিয়ার উপর হেলান দিয়ে বসতে। ঠাকুরের মিষ্ট আচরণ দেখে ডাক্তারের মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। হৃষ্টচিত্ত ডাক্তার কোট্স বলেন : He (Sri Ramakrishna) is naturally a gentleman.
অতঃপর ডাক্তারসাহেব গলদেশ চাপিয়া পরীক্ষা করিতে প্রয়াস পাইলে, ঠাকুর যেন শিহরিয়া উঠেন এবং ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতে বলিয়া তার স্বভাবসমাধিতে নিমগ্ন হন। ডাক্তার তখন ইচ্ছামত পরীক্ষা করিয়া কহেন-ইহাকে ক্যান্সার অর্থাৎ কণ্ঠনালীর ক্ষতরোগ বলে। বহুদিন ব্যাপিয়া
অবিরাম ঐশ্বরিক কথায় গলমধ্যস্থ সূক্ষ্ম শিরা ও ঝিল্লীর উত্তেজনায় ইহার উৎপত্তি। আমাদের দেশে ইহাকে ধর্মযাজকের কণ্ঠরোগ কহে। আমাদের উগ্র ঔষধ এ-অবস্থায় ক্লেশদায়ক, সুতরাং বর্তমান চিকিৎসাই শুভ।
আর ডাক্তারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল সম্বন্ধে রামচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘তিনি (ডাক্তার কোটু) তাহার অবস্থা দেখিয়া চিকিৎসাতীত বলিয়া ব্যক্ত করেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে ভাগবৎ-প্রসঙ্গ শুনবেন। তার অনুরোধে শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলেন যে ঈশ্বর এক বৈ দুই নন। তিনিই সর্বভূতে বিরাজ করছেন।
স্বামী সারদানন্দের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় আরও এক টুকরো তথ্য। তিনি বলেছিলেন, কোনো বিলাতফেরত ডাক্তার অসুখের সময় তার কাছে এসেছেন। ঠাকুরের শরীর বিশেষ অসুস্থ দেখে তিনি বললেন, “আপনার শরীর অসুস্থ, তা না হলে আমি আপনার কাছে অনেক শিখতে পারতুম, আপনিও আমার কাছে অনেক শিখতে পারতেন।” কথাপ্রসঙ্গে পুনঃ পুনঃ তিনবার এই কথাটি আবৃত্তি করাতে ঠাকুর উত্তর দেন, “তোমার কাছে আমার কিছুই শিখবার নাই।” ডাক্তার কোটস বিদায় নেবার পর ঠাকুরের নির্দেশে তার বিছানাপত্রে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়া হয়! শ্রীরামকৃষ্ণ বিছানা স্পর্শ করে ‘ওঁ তৎ সৎ মন্ত্র জপ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ দেখে উপস্থিত ভক্ত ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় হেসে ওঠেন। উপস্থিত মাস্টারমশাই প্রমুখ ভক্তগণও হাসতে থাকেন।
সাহেব ডাক্তারের ফি নিয়ে তিনটি লোকশ্রুতি। প্রথম মত, কল্পতরুর দিনে ঠাকুরের কৃপাধন্য ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায় (ভাই ভূপতি) ডাক্তার কোটসকে বত্রিশ টাকা দেন। স্বামী প্রভানন্দর ফুটনোট :”৪ মার্চ ১৮৮৬ তারিখের বিবরণী থেকে জানা গেছে ভূধর চাটুজ্যে এই টাকা দিতে চেয়েছিলেন। ইনি শশধর তর্কচূড়ামণির শিষ্য, এঁদের কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িতে (২০৩/১/১ বিধান সরণি) ঠাকুর গিয়েছিলেন। তৃতীয় মতে ডাক্তার কোট্র ভিজিট নেননি, তিনি এই অর্থ ঠাকুরের সেবার জন্য ব্যয় করতে বলেছিলেন।
ডাক্তার কোটস যেদিন কাশীপুরে এলেন সেই রাত্রে কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি হ’ল। রোগীর দম বন্ধ হবার উপক্রম। ডাঃ কোটস অবশ্য বলেই গিয়েছিলেন, রোগ চিকিৎসাতীত।
শনিবার ৮ মার্চ, ১৮৮৬ দোলপূর্ণিমার দিনে কাশীপুর উদ্যানবাটির এক হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছেন স্বামী প্রভানন্দ। রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী এলেন ঠাকুরের পায়ে আবির দিতে, বসে বসে পাখার হাওয়া করলেন। কোন্নগর থেকে হাজির হলেন মনোমোহন মিত্র। এঁরই বোন বিশ্বেশ্বরীর সঙ্গে রাখালচন্দ্র ঘোষ (পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দের) বিবাহ হয়। পরবর্তীকালে মনোমাহন আমার জীবনকথা’ নামে স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন, কিন্তু সম্পূর্ণ করতে পারেননি। দোলের দিন ঠাকুরের জন্য মনোমাহন এনেছিলেন, পুন্নাগের ডাল। ঠাকুর কয়েকটি ডালপালা নাকের কাছে ধরেন, কিন্তু এর রুক্ষ গন্ধ সহ্য করতে পারেননি। মনোমোহনের দলে সেদিন ভগ্নী বিশ্বেশ্বরীও ছিলেন।
সেদিনের আরও এক ঘটনা নজর এড়ানো উচিত নয়। বড়বাজারের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি ভক্তরা সদলে এসেছিলেন। বড়বাজারেই শ্রীরামকৃষ্ণ এক সময় সংবর্ধিত হয়েছিলেন, আজও তারা প্রণাম করলেন এবং জয় সচ্চিদানন্দ’ বলতে বলতে বিদায় নেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাই হাইকোর্টের উকিল অতুলচন্দ্র মাঝে-মাঝে ঠাকুরের নাড়ি দেখতেন। অতুলের নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা করতেন ঠাকুর। নাড়িজ্ঞান ব্যাধিজ্ঞান এত অতুলের। যেন তেঁহ ধন্বন্তরি বেশে মানুষের।
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের লীলামৃতে লেখা হয়েছে, অতুল একসময় ঠাকুরকে বলেন, “নরেন এখনও ওকালতি পরীক্ষায় সচেষ্ট, অথচ উকিল ও ডাক্তারদের সম্বন্ধে ঠাকুরের ধারণা তেমন ভাল নয়।” অতুলের অনুযোগের দু’চারদিন পরে হঠাৎ একদিন নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো এক বস্ত্রে নগ্নপদে গিরিশ-ভবনে উপস্থিত। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলেন অবিদ্যামাতার মৃত্যু ও বিবেক পুত্রের জন্ম-অশৌচে এই অবস্থা। এরপর কাশীপুর উদ্যানে যাইয়া চিরদিনের মতো আত্মনিবেদনছলে প্রভুর শ্রীপাদপদ্মে নিপতিত হইলেন।
বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এই পর্বে ঠাকুরকে দেখেন। ঠাকুর তার ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন, “দেখ দেখি, এইটা ভাল করে দাও না।” ডাঃ দত্ত ওষুধপত্র দেন, তিনি ঠাকুরের রোগকে ক্যান্সার মনে করেননি।
ডাক্তার মহেন্দ্রনাথ সরকারের ডাইরি অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণকে লাইকোপোডিয়াম ২০০ দিয়ে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। ২২ মার্চ রাত্রে ভারমিশেলি সেদ্ধ দুধ খেলেন। ৩০ মার্চ তিনি শীতবোধ করতে লাগলেন। এরপরেই সেই বিখ্যাত ঘটনা। নরেন্দ্রনাথ, তারকনাথ ঘোষাল (পরে স্বামী শিবানন্দ) ও কালীপ্রসাদ চন্দ্র (পরে স্বামী অভেদানন্দ) কাউকে কিছু না বলে কাশীপুর থেকে বুদ্ধদেবের সিদ্ধিলাভের পুণ্যক্ষেত্র বোধগয়ায় চলে গেলেন।
অভেদানন্দ তাঁর ‘আমার জীবনকথায়’ এপ্রিল মাসের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু প্রাসঙ্গিক তথ্যদির বিশ্লেষণ করে স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত, ৩১ মার্চ ১৮৮৫ সন্ধ্যায় এঁরা চলে যান।– বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল তখনকার পরিস্থিতির একটি সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এই সময় ঠাকুর বিমর্ষভাবে কোনো যুবককে বলেন-”দ্যাখ, নরেন্দ্র এতই নিষ্ঠুর যে, এই অসুখের সময় আমাকে ছেড়ে কানাই ঘোষালের (পূর্ববন্ধু) ছেলে, যাকে নরেন্দ্র এখানে আশ্রয় দিল, সেই তারকের সঙ্গে কোথায় গেছে, বা তারক তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে, আর কালীও সঙ্গে গেছে।” [বলিয়া রাখা ভাল যে, প্রভুর কৃপা পাইয়াও তারকদাদা কর্মবিপাকে ইতিপূর্বে ছায়ার মতন নিত্যগোপালের (পরে জ্ঞানানন্দ অবধূত) সঙ্গে ফিরিতেন।]
ঠাকুরকে প্রবোধ দেবার জন্য একজন যুবক বললেন, “কোথা যাবে নরেন্দ্র? হট্ করিয়া যাইলেও আপনাকে ছাড়িয়া ক’দিন থাকবে?” তখন প্রভু হাসিমুখে কহেন–ঠিক বলেছিস। যাবে কোথায়? এ তলা বেল তলা, সেই বুড়ীর পোঁদ তলা। আমার কাজের জন্যে মহামায়া যখন তাকে এনেছেন, তখন আমারই পিছনে তাকে ঘুরতে হবে। বলাবাহুল্য, দু’চারদিন পরে নরেন্দ্রনাথ যেন অপরাধীর মতো প্রভুসমীপে উপস্থিত হ’ল।” (৮ এপ্রিল, ১৮৮৬ সন্ধ্যায় তারা ফেরেন)।
ব্যাপারটা কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে আমার জীবনকথায়’ (স্বামী অভেদানন্দ)।
“নরেন্দ্রনাথ, তারকদাদা (স্বামী শিবানন্দ) ও আমি প্রায়ই বুদ্ধদেবের জীবনী পাঠ করিতাম এবং তাঁহার ত্যাগ ও কঠোর সাধনার বিষয় আলোচনা করিতাম। তখন আমরা ললিতবিস্তরের গাথাগুলি বেশ মুখস্থ করিয়াছিলাম। মধ্যে মধ্যে ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম’ ইত্যাদি আবৃত্তি করিয়া ধ্যান করিতাম। ক্রমে আমাদের তিনজনেরই বুদ্ধদেবের তপস্যার স্থান দেখিবার ইচ্ছা বলবতী হইল।
“একদিন নরেন্দ্রনাথ, তারকদাদা ও আমি কলিকাতা হইতে নগ্নপদে হাঁটিতে হাঁটিতে সন্ধ্যার পূর্বে কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইলাম। ইচ্ছা এত বলবতী হইল যে, আমরা আর থাকিতে পারিলাম না।
“নরেন্দ্রনাথ বলিল, ‘চ, কাকে কিছু না বলেই আমরা বুদ্ধগয়ায় চলে যাই। শ্রীশ্রীঠাকুরকে আমরা বুদ্ধগয়ায় যাওয়ার কোনো কথা বলিলাম না। নরেন্দ্রনাথ আমাদের তিনজনের জন্য রেলভাড়া সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইল। আমরা কৌপীন, বহির্বাস ও কম্বল লইয়া প্রস্তুত হইলাম।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বরানগর-খেয়াঘাট হইতে গঙ্গা পার হইয়া আমরা তিনজনে বালির দিকে যাত্রা করিলাম। রাস্তার ধারে একটি মুদির দোকানের রকে সেই রাত্রি কাটাইলাম। তার পরদিন অতি প্রত্যুষে উঠিয়া বালি স্টেশনে গিয়া রেলগাড়িতে উঠিলাম। পরদিন গয়াধাম দর্শন করিয়া বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হইলাম।
“বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হইয়া আমরা মন্দিরে প্রবেশ করিলাম, পরে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করিয়া আনন্দে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলাম।
মন্দিরের অভ্যন্তরে গম্ভীর শান্ত পরিবেশ। মন অমনি সমাধি-সাগরে ডুবিয়া যায়। আমরা ধ্যানের সময়ে অপূর্ব-নির্বাণসুখের আভাস ও আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলাম।
“পরে মন্দিরের বাহিরে বোধিদ্রুমের সম্মুখে সম্রাট অশোক-নির্মিত বজ্রাসনে বসিয়া আবার তিনজনে ধ্যান করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথ অপূর্ব এক জ্যোতিঃ দর্শন করিল। আমার সর্বশরীরেও যেন শান্তিস্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিল। তারক দাদাও গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়া রহিলেন।
দুই ঘণ্টা ধ্যানের পর আমরা তিনজনে নিরঞ্জনা নদীতে স্নান করিয়া মাধুকরি করিলাম এবং কিছু জলযোগ করিয়া তথাকার ধর্মশালায় বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। ওই ধর্মশালায় রাত্রিযাপনও করিলাম। আমাদের সঙ্গে কোনো গরম কাপড় ছিল না, সুতরাং রাত্রিতে শীতের জন্য আর নিদ্রা হইল না। তাহাতে আবার মধ্যরাত্রে নরেন্দ্রনাথের পেটের অসুখ হইল। যাহা আহার করিয়াছিল তাহা সম্ভবতঃ হজম হয় নাই। দুই-চারিবার দাস্ত হইল এবং পেটের যন্ত্রণায় সে কষ্ট পাইতে লাগিল।
“আমরা বিশেষ চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তখন কাতর হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি নরেন্দ্রনাথ একটু সুস্থ বোধ করিল। তখন শ্রীশ্রীঠাকুরকে কিছু বলিয়া আসা হয় নাই, তাহার অসুখের সময়ে আমরা তাঁহাকে ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি এবং তাহার অনুমতি না লইয়া আসা অন্যায় হইয়াছে–এই সকল কথাই ক্রমাগত মনে হইতে লাগিল।
“ক্রমশই আমাদের মন অস্থির হইয়া উঠিল। যেন এক আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথের পেটের অসুখ তখনও সম্পূর্ণ সারে নাই অথচ কাহারও নিকট কোনোরূপ সাহায্য পাইবার উপায় নাই। দেখিলাম রেলভাড়াও সঙ্গে নাই। কাজেই আমরা বিষম বিভ্রাটে পড়িলাম, কিছু স্থির করিতে পারিলাম না। সুতরাং শীঘ্র কাশীপুরে ফিরিয়া যাওয়া কর্তব্য মনে করিলাম। কিন্তু ফিরিয়া যাইবার কোন পাথেয় তো আমাদের কাছে ছিল না।
“তখন নরেন্দ্রনাথ বলিল : চল্, আমরা বুদ্ধগয়ার মোহন্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ও কিছু অর্থ ভিক্ষা করি।আমি ও তারকদাদা তাহাতে সম্মত হইলাম।
“প্রাতঃকালে নিরঞ্জনা নদীর বালির চর পার হইলাম। নদীর বালি এত ঠাণ্ডা ছিল যে, আমাদের খালি-পা যেন পুড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠাণ্ডায় আগুন পোড়ার ন্যায় পা জ্বালা করে তাহা পূর্বে আমরা জানিতাম না। অতিকষ্টে হাঁটিয়া নিরঞ্জনা নদী পার হইয়া মোহন্তের মঠে উপস্থিত হইলাম। মঠের দশনামী সন্ন্যাসীদের সহিত আমাদের আলাপ হইল। সেখানে সাধুদের পঙ্গদে বসিয়া মধ্যাহ্নভোজন করিয়া বিশ্রাম করিলাম। “নরেন্দ্রনাথ সঙ্গীতের অত্যন্ত ভক্ত শুনিয়া মঠের মোহন্ত মহারাজ তাহাকে গান শুনাইতে অনুরোধ করিলেন। নরেন্দ্রনাথ যদিও পেটের অসুখে অত্যন্ত দুর্বল হইয়াছিল, তথাপি তাহার গলার তেজস্বিতা কমে নাই। সে কয়েকটি ভজন-গান গাহিল। তাহার অপূর্ব সঙ্গীত-পরিবেশনে মোহন্ত মহারাজ অত্যন্ত প্রীত হইলেন। পরে আমরা বিদায় লইবার সময়ে আমাদের পাথেয় নাই শুনিয়া তিনি কিছু পাথেয় দিলেন।
“আমরা পুনরায় নিরঞ্জনা নদী পার হইয়া বুদ্ধগয়ায় আসিলাম এবং গয়াধামে বাঙালি ভদ্রলোক উমেশবাবুর বাড়িতে অতিথি হইলাম। সেখানে সন্ধ্যার পর নরেন্দ্রনাথ আবার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও ভজনগান করিল। তথায় অপূর্ব সঙ্গীত পরিবেশনে সকলে মুগ্ধ হইলেন। উমেশবাবু আমাদের বিশেষ যত্ন করিয়া রাত্রে থাকিবার স্থান দিলেন। পরদিন প্রাতে রেলে চড়িয়া আমরা কলিকাতা-অভিমুখে যাত্রা করিলাম ও পরদিন সন্ধ্যার সময় কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইলাম।
“এইদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের জন্য বিশেষ চিন্তিত ছিলেন এবং ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া মহানন্দে সাগ্রহে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন। আমরা বুদ্ধগয়ার সমস্ত ঘটনাই আনুপূর্বিক তাহাকে নিবেদন করিলাম। সকল ঘটনা শুনিয়া তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং প্রশান্তভাবে বলিলেন, বেশ করেছিস।”
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ সবদিক থেকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বই। নরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণই বলেছিলেন, “কেন ভাবছিস? কোথায় যাবে সে? ক’দিন বাইরে থাকতে পারবে? দেখ না এল বলে।” তারপর তিনি হাসতে হাসতে বলেন : “চারখুট ঘুরে আয়, দেখবি কোথাও কিছু নেই; যা কিছু আছে সব (নিজের শরীর দেখিয়ে) এইখানে।”
বাবুরাম মহারাজ (পরে স্বামী প্রেমানন্দ) এই প্রসঙ্গে বলে গিয়েছেন, “পরমহংসদেব কেঁদেছিলেন তিনি বললেন যে, ও (নরেন্দ্র) যেরকম উঠে-পড়ে লেগেছে যা চাচ্ছে তা শীঘ্র পেয়ে যাবে।”
৬ এপ্রিল ১৮৮৬ : ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন কাশীপুরে, পরে শ্ৰীমকে ডাক্তার বলেন, প্রথম টের পেলুম যে ওঁর ছেলেবেলায় গলায় গণ্ডমালা (স্ক্রোফুলা) ছিল।
ঠাকুরের পেটে পোড়া দাগ দেখে ডাঃ দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি?
মাস্টারমশাই বলেন, পিলের চিকিৎসা হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিতে বলেন, সে বড় ছোটবেলায়।
ডাক্তার দত্ত : কর্তা দেখছি সবরকমই করে বসে আছেন।
.
অসুখ যতই থাক, আনন্দকে কখনও বিসর্জন দেওয়া হয়নি কাশীপুর থেকে। তারক (পরে স্বামী শিবানন্দ) একদিন পাঁচক অসুস্থ হওয়ায় সবার জন্য রান্না করছিলেন–ডাল, ভাত, রুটি আর চচ্চড়ি। “চচ্চড়িতে তখন ফোড়ন দিয়েছি, ঠাকুর উপর হতে সে ফোড়নের গন্ধ পেয়ে জনৈক সেবককে জিজ্ঞাসা করলেন-”হাঁরে, কি রান্না হচ্ছে রে তোদের? বাঃ! চমৎকার ফোড়নের গন্ধ ছেড়েছে তো! কে রাঁধছে?” আমি রাঁধছি শুনে তিনি বললেন-”যা, আমার জন্যে একটু নিয়ে আয়।” সেই চচ্চড়ি ঠাকুর একটু খেয়েছিলেন।
২৯ এপ্রিল ১৮৮৬ : কোনো কোনো চিকিৎসকের আশা রামকৃষ্ণ সম্পূর্ণ আরোগ্যের পথে। ভক্ত নাগ মশাই ঐদিন অনেক খুঁজে ঠাকুরের জন্যে টাটকা আমলকী এনেছেন। নাগমশাইকে ভাত বেড়ে দেওয়া হ’ল, তিনি জানালেন, আজ একাদশী।
এর পরের ঘটনা শ্রীশ্রীমায়ের কথা থেকে স্বামী প্রভানন্দ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মাকে ঠাকুর বললেন, “ঝাল দিয়ে একটু চচ্চড়ি বেঁধে দাও। ওরা পূর্ববঙ্গের লোক, ঝাল বেশি খায়।” ঠাকুর আরও বললেন, “একখানা থালায় সব বেড়ে দাও। ও প্রসাদ না হলে খাবে না।” ঠাকুর তা প্রসাদ করে দিতে বসলেন। সেসব দিয়ে ভাত প্রায় এত কটা খেলেন।
মা বললেন, “এই তো বেশ খাচ্ছ, তবে আর সুজি খাওয়া কেন? ভাত দুটি দুটি খাবে।” ঠাকুর বললেন, “না, না, শেষ অবস্থায় এই আহারই ভাল।” মে মাসের ১৭ তারিখে শারীরিক অবস্থার অবনতি। দুদিন পরের রিপোর্ট, শরীরে অসহ্য জ্বালা। পরের সপ্তাহে তিনি ইঙ্গিতে ফিসফিস কথা বলছেন। দেহ কঙ্কালসার।
.
এরপর থেকেই বেশ কয়েক মাস ধরে কাশীপুর সংবাদের অপ্রতুলতা। রোগে জর্জরিত হয়েও শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অনুগত সেবকদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। যোগীন (পরে স্বামী যোগানন্দ) অসুস্থ শুনে তিনি বললেন, “সেবার ত্রুটি হবে বলে, তোমরা শরীরের যত্ন নিচ্ছ না। তোমাদের শরীর ভেঙে গেলে আমার যত্ন করবে কে? তোমরা বাপু অসময়ে খাওয়াদাওয়া করো না।”
এরপর থেকেই কাশীপুরের বিস্তারিত বিবরণের ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডাক্তার সরকারও অনেকদিন অনুপস্থিত, ডাক্তার রাজেন দত্তের ভিজিটও অনিয়মিত। শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার কি হবে ভেবে উপস্থিত সবাই বেশ চিন্তিত।
কথামৃতের কথক মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্ভবত এই সময় কম আসতেন। তার তখন খুব বিপদ, চাকরি গিয়েছে। বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রদের ফল আশানুরূপ না হওয়ায় বিদ্যাসাগর তাকে ডেকে অপমানকর কথাবার্তা বলেছেন। বিদ্যাসাগর মুখের ওপর বলেছেন, পরমহংসদেবের কাছে অত্যধিক যাতায়াতের ফলেই এ ধরনের অবহেলা ঘটেছে।
অপমানিত মাস্টারমশাই পরেরদিন (শুক্রবার) রেজিগনেশন চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। সংসার চলবে কিভাবে তা না চিন্তা করেই পদত্যাগ। কাশীপুরে শয্যাশায়ী ঠাকুর সব শুনলেন, তারপর সাড়ে তিনটে পাশ’ ভক্তকে তিনবার বললেন, বেশ করেছ, বেশ করেছ, বেশ করেছ।
রবিবারও মাস্টারমশাই কাশীপুর বাগানবাড়িতে এসেছিলেন। ওইদিন একসময় গঙ্গাধর নরেন্দ্রনাথকে বললেন, রাজ চ্যাটার্জি বলেছে, ছাত্রেরা মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। মাস্টারমশাই নাকি একথা শুনে বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়েন।
“নরেন্দ্রনাথ ফোঁস করে ওঠেন। তিনি বলেন : কি বলছিস, মাস্টারমশাই কি কেয়ার করেন? তোর বিদ্যাসাগর বুঝি মনে করলে মাস্টারমশাইয়ের পরিবার ছেলেপুলে আছে, তিনি আর চাকরি ছাড়তে পারবেন না।”
.
এর পরেই প্রায় লক্ষ্য দিয়ে ১৮৮৬ আগস্ট মাসে এসে পড়া। এবার আমরা শ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃতের লেখক বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের ওপর একটু বেশি নির্ভর করব।
ঠাকুর “ক্ষুধা সত্ত্বেও অনুমাত্র তরল পদার্থ গ্রহণে অসমর্থ হন। কোনোমতে যদি কিঞ্চিৎ পান করিলেন, অমনি দ্বিগুণমাত্রায় ক্লেদ নির্গত হওয়ায় আরও ক্লেশ বোধ করেন।…একদিন শ্রীমুখ-বিগলিত ক্লেদমিশ্রিত পায়স হস্তে নরেন্দ্রনাথ কাতরভাবে কহেন–প্রভুর সুব্যবস্থায় তাঁহার প্রসাদ ধারণে আমাদের চিত্তপ্রসাদ হইয়াছে, কিন্তু এখন বিধি বিরূপ। আইস, তাহার সত্তাস্বরূপ ইহা পান করিয়া আমাদের অস্থিমজ্জায় যেন তাহার অবাধ অধিষ্ঠান বোধ করিতে পারি। এই বলিয়া কিয়দংশ স্বয়ং পান করিলেন এবং আমাদিগকেও করাইলেন।…”
রসিক চূড়ামণি ঠাকুর। তিনি বলছেন : “দেখছি সাগরপারে অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আছে, তাদের সঙ্গে মিশতে হলে তাদের মত পোশাকের দরকার। তাই ইচ্ছে হয় ইজের পরে ডিশবাটিতে খাই। কহিবামাত্র সকলই সংগ্রহ হইল এবং প্রভুও উহা ব্যবহারে আনন্দ করিলেন। প্রভুর প্রেরণায় পাশ্চাত্য দেশে তাঁহার মহিমা প্রচারকালে, নরেন্দ্রনাথ তাঁহারই কথা স্মরণ করিয়া ওই দেশের উপযোগী পরিচ্ছদ ব্যবহার করেন। নচেৎ সন্ন্যাসী হইয়া সাহেব সাজিবার বাসনায় নহে।”
স্বামী সারদানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ ঠাকুরের বিষয়ে আমাদের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে কাশীপুর পর্বটি যে প্রায় অনুপস্থিত তা গ্রন্থকার নিজেও অনুভব করতেন। স্বামী নির্লেপানন্দ এ বিষয়ে মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন : “শেষ জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের চরিতকথার বাকিটুকু (কাশীপুর বাগানের ঘটনাবলী) লিখিয়া লীলাপ্রসঙ্গ-কে পূর্ণ অবয়ব ও সম্পূর্ণ গঠন দিবার জন্য অনুরুদ্ধ হইলে, একদিন তিনি বলিয়াছিলেন-”দ্যাখো, এখন দেখছি, ঠাকুরের সম্বন্ধে কিছুই বোঝা হয়নি। তার ইচ্ছা হয়, লেখা হবে।”
সে প্রত্যাশা থেকে অনুরাগীরা বঞ্চিত হলেও, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লীলাপ্রসঙ্গের এখানে ওখানে যা আছে তাও মন্দ নয়। কিন্তু সে সবের খোঁজখবর করার আগে দ্রুত গোটা কয়েক টুকরো খবর দেওয়া যাক। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ কখনই তার কর্তব্য ভুলতে চাইতেন না। নিজের দিদি কাত্যায়নীর সন্তানদের সম্বন্ধে দাদার ছেলে রামলালকে বললেন, “ওদের খবর নিসরে রামলাল, নয়তো ওরা বলবে আমাদের মামার বাড়িতে কেউ নেই। পুজোর সময় এক একখানা কাপড় দিস।” এই ভাইপোকে ঠাকুর আদর করে রামনেলো’ বলে ডাকতেন।
শ্রীশ্রীসারদামণিকে ঠাকুর বলেছিলেন, “তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে, শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।” বরং পরতী ভাল, পরঘরী ভাল নয়, কামারপুকুরে নিজের ঘরখানি কখনও নষ্ট কোরো না। কারও কাছে একটি পয়সার জন্যে চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। সারদামণিকেই ব্যধিযুক্ত কণ্ঠে তিনি যে গানটি গেয়েছিলেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ :
‘এসে পড়েছি যে দায়, সে দায় বলব কায়।
যার দায় সে আপনি জানে, পর কি জানে পরের দায়।’
শেষ গানও শুনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ এই কাশীপুরে ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত কণ্ঠে। ভক্ত সেবকরা গানের মধ্য দিয়ে প্রায়ই দুঃখকে ভুলবার চেষ্টা চালাতেন কাশীপুরে।
স্বামীজির মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, মহাপ্রয়াণের কদিন আগেও চলতো নরেন্দ্রনাথের গানের মহড়া। রাত্রে তারা “উদ্দাম কীর্তন শুরু করলেন। চীৎকার ধ্বনিতে বাড়ি কাপিতে লাগিল। শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তনের দলের ভিতর থেকে একজনকে ডেকে বললেন, তোরা বেশ রে, কেউ মরে, কেউ হরিবোল বলে…পরক্ষণেই আহ্লাদ করে বললেন, ওর সুরটা এইরকম, অমুক জায়গায় এক কলি তোরা ভুলেছিলি। ঐখানে ঐ কলিটা দিতে হয়।”
কাশীপুরে শেষ পর্ব সম্বন্ধে ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র তার ‘জীবনবৃত্তান্তে’ লিখেছেন : “অবস্থার দিন দিন পরিবর্তন হইতে লাগিল। যখন… উত্থান শক্তি রহিত হইল, একেবারে স্বরভঙ্গ হইয়া গেল, তখন অনেকেই হতাশ হইয়া পড়িলেন। ডাক্তারি, কবিরাজি, আধিভৌতিক, টোটকা প্রভৃতি সকলেরই সাহায্য লওয়া হইয়াছিল, কিন্তু কিছুই হইল না। কোনো কোনো ভক্ত স্ত্রীলোক তারকনাথের সোমবার করিতেন এবং নারায়ণের চরণে তুলসী দিতেন, কোন ভক্ত তারকনাথের চরণামৃত ও বিল্বপত্র আনাইয়া ধারণ করাইলেন, কেহ কেহ (শ্রীমা) হত্যা দিয়াছিলেন। কিন্তু সকলই বিফল।”
অসুস্থ অবস্থায় ভাবসমাধি সম্পর্কে একালের বিশ্লেষক ডাক্তার তরফদারের ব্যাখ্যা : “ভাব বা সমাধি হলে গলায় ব্যথা বাড়ে। সম্ভাব্য কারণ : সমাধিকালে কুম্ভক’ বা শ্বাসবন্ধ থাকে। হয়তো এসময় তোকাল কর্ড দুটি পরস্পর চেপে লেগে গ্লটিসকে সজোরে বন্ধ করে রাখে। ফুসফুস থেকে নিশ্বাসবায়ু তাতে ধাক্কা মারে।” সমাধিকালে ক্যান্সার কোষ থেকে যন্ত্রণাদায়ক রাসায়নিক বের হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তবুও রামকৃষ্ণের সমাধি বাধা মানেনি কোনো। শেষদিনেও প্রায় দু’ঘণ্টা তিনি ছিলেন গভীর সমাধিমগ্ন।”
ডাক্তারি বিশ্লেষণে রবিবার ৩১শে শ্রবণ ১২৯৩ (১৫ আগস্ট ১৮৮৬) সকালে কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ “বেশ ভালো”।
অন্য বিবরণ :”এইদিন সকাল থেকেই ঠাকুরের ব্যাধি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। তাঁকে বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় যন্ত্রণা লাঘবের জন্যে।”
শ্রীশ্রীমা একবার কাছে যেতেই তিনি বলেন, “এসেচ? দেখ, আমি যেন কোথায় যাচ্ছি–জলের ভিতর দিয়ে—অ-নেক দূর।”
শ্রীশ্রীমা কাঁদতে থাকায় ঠাকুর বলেন, “তোমার ভাবনা কী? যেমন ছিলে, তেমন থাকবে। আর এরা আমায় যেমন করচে, তোমায়ও তেমনি করবে।”
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “প্রিয়তম নরেন্দ্রনাথকে পরমতত্ত্ব উপদেশ-মানসে তগতপ্রাণ শশিভূষণকেও নিম্নতলে যাইতে বলিয়া নরেন্দ্রনাথকে কহেন–ভালো করে দেখ যেন উপরে কেহ না থাকে। এইবার প্রভু তাহাকে অতিনিকটে বসাইয়া, যে ব্রহ্মতান সৃষ্টিকাল হইতে গুরু পরম্পরায় উপদিষ্ট হইয়াছে, তাহাই উদ্দেশ করিয়া কহিলেন–যদিও আমাতে তোমাতে অভেদাত্মা তথাপি বাহ্যদৃষ্টিতে গুরু-শিষ্যরূপে পৃথক ছিলাম। আজ তোমাকে আমার যথাসর্বস্ব অর্পণ করে ভিখারি হয়ে নামে রামকৃষ্ণ রহিলাম; তুমি রাজরাজেশ্বর হয়ে দ্বিতীয় রামকৃষ্ণ হলে।”
আরও বর্ণনা রয়েছে। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখছেন : “আজ ধারা শ্রাবণের শেষদিন, অথবা ভাগ্যহীন আমাদের অশ্রুধারার প্রথম দিন।…কিছু না খাওয়ায় সেবকগণ ভাবিলেন-বোধহয় বেদনা বৃদ্ধিতে আহারে অনিচ্ছা।” আজ ভাতের পায়স খাব, শুনিয়া সকলে আশ্বস্ত। পায়স আনিলে বলিলেন, বসে খাব।
এই খাওয়া প্রসঙ্গে বর্ননা চাররকম খাবারের প্রসঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে : ভাতের পায়েস, ভাতের মণ্ড, সুজির মণ্ড ও খিচুড়ি। বৈকুণ্ঠনাথের বর্ণনা অনুযায়ী গলা দিয়ে কিছুই যখন ঢুকছে না তখন ঠাকুর তার সেবকদের বলেন, “ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি-হাঁড়ি খিচুড়ি খাই; কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।”
“আজীবন কার্যকলাপ যার সবই নতুন, তাঁর খিচুড়ি খাইবার ইচ্ছাও এক নতুন ব্যাপার। অনুশীলনে দেখা যায়, অবতার পুরুষমাত্রেই এক এক প্রকার ভোজ্য প্রিয় ছিল। অযোধ্যানাথের রাজভোগ, বৃন্দাবনচন্দ্রের ক্ষীরসর, অমিতাভের ফাণিত (এক প্রকার মিষ্টান্ন), শঙ্করের প্রিয় ভোজ্য কি জানা যায় না; তবে তার সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ভোজে পুড়ীলাড়ুর সমাদর হয়। নিমাইচাঁদের মালসাভোগ (মৃৎপাত্র-পূরিত চিড়া মুড়কি দধি) …দক্ষিণেশ্বর-ভূষণ প্রভু এক অভিনব সুখসাধ্য খেচরান্ন ভোজনের ইচ্ছা করিলেন। তাই প্রিয়তম নরেন্দ্রনাথ প্রভুর জন্মোৎসবে তাহারই অভীপ্সিত খেচরান্ন দ্বারা তাহার বিরাট রূপের এরূপ বিরাট ভোগের ব্যবস্থা করেন, যাহা ভারতের কেন, জগতের কোনো প্রদেশেই দেখা যায় না।”
শেষের সেই রবিবারে কাশীপুরে খিচুড়ি নিয়ে আরও গোলোযোগ। সেবকদের জন্য শ্রীমা খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নিচের অংশ ধরে গেল। ছেলেরা তাই খেল। তার একটা শাড়ি ছাদে শুকতে দেওয়া হয়েছিল। সেটা আর পাওয়া গেল না। তুলবার সময় পড়ে একটা জলের কুঁজো চুরমার হয়ে গেল।
রবিবারের অপরাহে জনৈক ব্যক্তি ঠাকুরের কাছে এসেছিলেন। যোগ সম্বন্ধে আলোচনা করতে। ঠাকুর তার সঙ্গে পুরো দু’ঘণ্টা কথা বললেন। বুদ্ধের ইহ-জীবনের শেষ দিনটিতে নাকি এরূপ ঘটেছিল। একজন সেবক শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার নবীন পালকে ধরে নিয়ে, গাড়িতে চড়িয়ে তাকে কাশীপুরে নিয়ে আসেন।
ঠাকুর তখন ডাক্তারকে বললেন, “আজ আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। নাড়ী পরীক্ষা করে ডাঃ পাল তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না।
ডাক্তারকে ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, “সারবে?” ডাক্তার নিরুত্তর।
ঠাকুর : “কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রোগ দুঃসাধ্য হয়েছে?”
“তাই তো” বলে ডাক্তার পাল মাথা নিচু করে রইলেন।
ভক্ত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারকে লক্ষ্য করে ঠাকুর বললেন, “বলে কি গো? এরা এতদিন পরে বলে সারবে না।”
গিরিশের ভ্রাতা অতুলকৃষ্ণ ঘোষ নাড়ী পরীক্ষা করে আশঙ্কা করলেন, ক্ষয় নাড়ি। ঠাকুর ভক্তদের বললেন, একেই নাভিশ্বাস বলে।
তাঁর কথায় ভক্তদের বিশ্বাস হল না, তারা সুজির বাটি নিয়ে এল। অন্য মতে, সেবকরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ভাতের মণ্ড খেতে দেন।
পারিপার্শ্বিক বিবেচনা করে স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত, তখন প্রায় রাত ন’টা। এই সময় আবার সমাধি। নরেন্দ্রনাথ সবাইকে হরি ওঁ তৎ সৎনাম কীর্তন করতে বললেন।
যখন সমাধি ভঙ্গ হল তখন রাত প্রায় এগারোটা। সেবকগণ তাকে উঠে বসিয়ে পথ্য খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। “উঠব? ভিরমি খাব যে,” ঠাকুর বললেন।
শ্ৰীম : “মাথায় একটু জল ও বাতাস দিলে হয় না?”
শশীকে ঠাকুর বললেন, “নাড়ছিস কেন?” তখন তুলো ভিজিয়ে মুখে জল দেওয়া হচ্ছিল।
ঠাকুর এখন ক্ষুধার্ত। সুজির পায়েস পথ্য হিসেবে নিলেন। অন্য মতে ভাতের মণ্ড। সেবক শশীর ইংরিজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, “খাবার হিসেবে পুরো এক গেলাস পায়সম পান করেন। তার পর নাকি ঠাকুর বললেন, “আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নাই।”
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল এই পর্বে নৈষ্ঠিক পূজারী ব্রাহ্মণ রামকৃষ্ণের একটি ছবি এঁকেছেন, যাকে স্বামী প্রভানন্দ ‘বিবৃতি নির্ভরযোগ্য নয়’ বলেছেন।
বৈকুণ্ঠনাথের লেখাটি এইরকম : ঠাকুর পায়স গ্রহণোদ্যত, এমতকালে দেখেন দুই অব্রাহ্মণ সেবক শয্যা ধারণ করে আছেন।
“ওদের বিছানা ছেড়ে দিতে বল।”
“কেন করবে?” নরেন্দ্রর এই প্রশ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “ওরে ভাত যে রে।”
“আপনি তো বিধি-নিষেধের পার, তথাপি এ আদেশ কেন?”
নরেন্দ্রকে ঠাকুর বললেন, “ওরে ব্রাহ্মণ-শরীর যে রে। তাই ব্রাহ্মণ সংস্কার যাবার নয়।”
বৈকুণ্ঠনাথের ব্যাখ্যা, “ঠাকুর সকলের আলয়ে অনুগ্রহণ করেন নাই। বলতেন, “লুচি-তরকারি খেতে পারা যায়, কিন্তু অন্ন নহে।”
কাশীপুরের সবদিক সাবধানে বিচার করে স্বামী প্রভানন্দের সঙ্গে একমত এই লেখক, এই বিবৃতি নির্ভরযোগ্য নয়।
ঠাকুরের শেষ পর্ব সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দের ‘আমার জীবনকথা একটি নির্ভরযোগ্য রচনা। “সেইদিন রাত্রে ১টার সময় আমরা তাঁহার নিকট বসিয়াছিলাম। সাধারণত যেমন সমাধি হইত, সেইরূপ হইল। তাঁহার দৃষ্টি নাগ্রের উপর স্থির হইয়া রহিল। নরেন্দ্রনাথ উচ্চৈঃস্বরে ‘ওঁকার উচ্চারণ করিতে আরম্ভ করিল। আমরাও সমবেত স্বরে ওঁকার ধ্বনি করিতে লাগিলাম।…সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল, শ্রীশ্রীঠাকুরের বাহ্যজ্ঞান আর ফিরিয়া আসিল না।”
শ্রাবণের শেষদিনে কাশীপুরে ঠাকুরের মহাপ্রস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে রোমাঁ রোঁলা স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। “শেষ দিন রামকৃষ্ণ শেষপর্যন্ত আমাদের সহিত আলাপ করেন।… তিনি আমার দেহের উপর পাঁচ ছয়টি বালিশে ভর করিয়া বসেন। আমি বাতাস করিতেছিলাম। নরেন্দ্র তাহার পা লইয়া টিপিয়া দিতেছিলেন। রামকৃষ্ণ তাহার সহিত কথা বলিতেছিলেন। কহিতেছিলেন, কি করিতে হইবে। তিনি বারে বারে বলেন, এ ছেলেদের সাবধানে দেখো’.. তারপর তিনি শুইতে যান। একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাহার গলায় ঘড় ঘড় শব্দ হইতে থাকে।… নরেন তাড়াতাড়ি তাহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। ডাক্তার নাড়ী দেখিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, নাড়ী বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমরা সকলে ভাবিলাম উহা সমাধি।”
রোলাঁর নিজস্ব সংযোজন : ১৫ আগস্ট ১৮৮৬-”সেদিন অপরাহেও তার যথেষ্ট শক্তি ছিল। তিনি ক্ষত-পীড়িত কণ্ঠ নিয়েও শিষ্যদের সঙ্গে দু’ঘণ্টা কাল আলাপ করেন যোগ সম্বন্ধে। সন্ধ্যার দিকে তার চৈতন্য বিলুপ্ত হয়। সকলেই ভাবেন, মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দুপুর রাত্রে পুনরায় তাকে জীবিত দেখা যায়। শিষ্য রামকৃষ্ণানন্দের দেহের উপর পাঁচ-ছ’টি বালিশ হেলান দিয়ে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় শিষ্য নরেনের সঙ্গে আলাপ করেন এবং অনুচ্চস্বরে তাঁর শেষ উপদেশগুলো দিয়ে যান। তারপর তিনি উচ্চৈঃস্বরে তিনবার তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ‘কালী’র নাম উচ্চারণ করেন এবং এলিয়ে পড়েন।… পরদিন মধ্যাহ্নের পূর্বে আধঘণ্টা পর্যন্ত এই সমাধিস্থ অবস্থায় থাকে। তারপর মৃত্যু ঘটে। তার নিজের কথায়–তিনি এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে চলে যান।
শ্মশানে শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তরা বলতে থাকেন : জয় ভগবান রামকৃষ্ণের জয়।
নরেন্দ্রনাথ সেই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে লোক পাঠালেন ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দিতে। রামলাল তৎক্ষণাৎ এসে দেহ পরীক্ষা করে বললেন, “এখনও ব্রহ্মতালু গরম আছে, তোমরা একবার কাপ্তেন উপাধ্যায়কে খবর দাও। নেপালের কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়…তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের মেরুদণ্ডে গব্যঘৃত মালিশ করিলে চৈতন্যোদয় হইবে বলিল।”
শশিভূষণ, শরৎচন্দ্র ও বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল যথাক্রমে গ্রীবায়, বক্ষে এবং পদমূলে ঘৃত মালিশ করতে লাগলেন, কিন্তু তিন ঘণ্টারও বেশি মালিশ করে কোনও ফল হ’ল না।
এরপরে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কাশীপুরে আবির্ভাব। কিন্তু ক’টার সময়? ঠাকুরকে এই মহেন্দ্রলাল ‘তুমি’ বললেও, সমধিক শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। বৈকুণ্ঠনাথের রচনা অনুযায়ী : “পরদিন প্রত্যুষে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সর্বপ্রথম উদ্যানে উপস্থিত হন; এবং প্রভুর আনন্দপূর্ণ আনন, রোমাঞ্চিত তনু এবং অঙ্গ জ্যোতিতে গৃহপূর্ণ দর্শনে মুগ্ধ হইয়া কহেন-এই দিব্যাবস্থার প্রতিকৃতি গ্রহণ আমি বাঞ্ছনীয় বোধ করি। অতএব কলিকাতায় যাইয়া আমি এখনই ইহার ব্যবস্থা করিতেছি।”
মা-ঠাকরুণ “প্রাণের আবেগে ‘মা কালী গো! তুমি কি দোষে আমায় ছেড়ে চলে গেলে গো’ বলিয়া ভূপতিত হইয়া উচ্চরোলে ক্রন্দন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন।”
গ্রুপ ছবি সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠনাথের মন্তব্য : “পরিতাপের বিষয়, অত্যধিক বিলম্ববশতঃ প্রাতঃকালের সে জ্যোতির্ময় প্রাণটি তখন অন্তর্হিত হইয়াছিল।”
স্বামী অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডাক্তার সরকার “বেলা দশঘটিকায় এসে নাড়ী দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।”
অনেক বিচারবিবেচনার পর স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত : ডাক্তার সরকার “কাশীপুরে পৌঁছান বেলা একটায়।”
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের দিনলিপি। খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eys open, mouth partly open.” এরপরে লেখা, মহেন্দ্রলাল ছবি তোলার পরামর্শ দিলেন এবং নিজের চাদা হিসেবে দশ টাকা রেখে গেলেন।
বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের ছবি তোলা সম্বন্ধে স্বামী অভেদানন্দের বর্ণনা : “রামবাবু নিজে খাটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে বলিলেন। আমরা পশ্চাতে সকলে নির্বাক হইয়া সিঁড়ির উপর দাঁড়াইলাম। বেঙ্গল ফটোগ্রাফার কোম্পানি দুইখানা গ্রুপ ফটো তুলিয়া লইলেন।”
কাশীপুর মহাশ্মশানের উদ্দেশে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল বিকাল ছ’টার পর।
লাহোরের ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত শেষ দর্শনের এক চমৎকার বিবরণ রেখে গিয়েছেন। তাঁর পূতদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যাবার জন্য দিনের তাপমাত্রা কমার অপেক্ষায় বসেছিলাম, সে সময় একখণ্ড মেঘ থেকে বড় বড় দানার বৃষ্টি ঝরে পড়ল। উপস্থিত সকলে বলতে থাকল এই হচ্ছে পুরাণকথিত স্বর্গ থেকে ঝরে পড়া পুষ্পবৃষ্টি। অমর দেবতাগণ স্বৰ্গমর্ত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নশ্বরতা থেকে অমরতায় উত্তরণকালে অভিনন্দন জানাচ্ছে।”
স্বামীজির পূজনীয় আচার্য, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তিমযাত্রার বিবরণ এখনও সম্পূর্ণ সংগৃহীত হয়নি, তবু তার শেষ জীবনের শেষ মুহূর্তগুলির বর্ননায় গুরু রামকৃষ্ণ ও পরবর্তী নেতা নরেন্দ্রনাথ দু’জনেই বেশ কিছুটা নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন।
ঠাকুরের চিকিৎসক অনুসন্ধানে ৩৮ জনের নাম পেয়েছি–এঁরা ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ও নাড়িজ্ঞানী। কেউ এম. ডি., কেউ অ্যালোপাথ হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ, কেউ পারিবারিক পেশায় বৈদ্য। এই ৩৮ জনের মধ্যে অন্তত ২৭ জন যে কোনো না কোনো সময় শ্রীরামকৃষ্ণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাও লক্ষ্য করেছি, বাকি ১১ জন সম্পর্কে ব্যাপারটা এখনও অস্পষ্ট।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের নাম নিচে দেওয়া হল। কিছুক্ষেত্রে পুরো নাম সহজলভ্য নয়, সেকালের রীতি অনুযায়ী অমুক ডাক্তার, অমুক কবিরাজ বলেই তারা সুপরিচিত থাকতেন :
• অতুলচন্দ্র ঘোষ
• আব্দুল ওয়াজিদ
• ঈশানচন্দ্ৰ কবিরাজ
• উপেন্দ্রনাথ ঘোষ
• কালী ডাক্তার।
• কৈলাশচন্দ্র বসু
• গঙ্গাপ্রসাদ সেন।
• গোপাল কবিরাজ
• গোপীমোহন কবিরাজ
• জ্ঞানেন্দ্রমোহন কাঞ্জিলাল
• ত্রৈলোক্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
• ত্রৈলোক্যনাথ বসু।
• দাড়িওয়ালা ডাক্তার
• দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
• দ্বারিকানাথ কবিরাজ
• দু’কড়ি ডাক্তার
• নবগোপাল কবিরাজ
• নবীন পাল
• নিতাই মল্লিক
• নিতাই হালদার
• প্রতাপচন্দ্র মজুমদার
• ভগবান দাস
• ভগবান রুদ্র
• মধুসূদন ডাক্তার
• মহলানবীশ ডাক্তার
• মহেন্দ্রনাথ পাল
• মহেন্দ্রনাথ সরকার
• রাখালদাস ঘোষ।
রাজেন্দ্রলাল দত্ত
• রাম কবিরাজ।
• রামনারায়ণ ডাক্তার
• বিপিনবিহারী ঘোষ
• বিশ্বনাথ কবিরাজ।
• বিহারীলাল ভাদুড়ি
• বৈদ্য মহারাজ
• শশীভূষণ ঘোষ
• শশীভূষণ সান্যাল ও
• শ্রীনাথ ডাক্তার।
এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্ঘগুলি পূজ্যপাদ মহামানবদের স্পর্শে ধন্য হয়েও কিছুদিনের মধ্যে কেন টুকরো টুকরো হয়ে যায়, অথবা দলীয় দ্বন্দ্বের বিষে আত্মহননের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ এ দেশের প্রতিষ্ঠান-পরিচালকদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জানা দরকার, শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য বেলুড়মঠের সন্ন্যাসীসঙ্ঘ কোন শক্তির বলে এমনভাবে কালজয়ী হল এবং বৃহৎ অরণ্যবনস্পতির মতো সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন ও বিস্ময় ধরে রাখতে সমর্থ হল? দার্শনিক, দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমী বিবেকানন্দকে নিয়ে গত একশো বছরে দেশেবিদেশে নেহাত কম আলোচনা হয়নি, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাবনা-চিন্তার প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি।
অর্থ সম্বন্ধে, বিশেষ করে অপরের অর্থ সম্বন্ধে, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও রেখেঢেকে কথা বলেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ তার অন্তিমপর্বে প্রিয়জন ও ভক্তজনের আর্থিক সাহায্যের উপর বিশেষ নির্ভরশীল হয়েছে, কিন্তু তিনি একবারও ভুলে যাননি অর্থ হল গৃহস্থের রক্ত এবং সেই অর্থের যথাযোগ্য সম্মান বিশেষ প্রয়োজন।
কোনও অবস্থাতেই অপচয় অথবা বাজে খরচ ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হওয়া শ্রীরামকৃষ্ণের সমর্থন বা প্রশ্রয় পায়নি। অপরের কাছ থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেই তার যে হিসেব প্রয়োজন, এই চিন্তা তরুণকালে অনভিজ্ঞ নরেন্দ্রনাথের মাথায় ঢোকেনি, তাই কাশীপুর-পর্বে ঠাকুরের অসুখের সময় খরচপাতির হিসেবপত্তর রাখা সম্পর্কে দাতাদের কথা ওঠায় তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। অতি সাবধানে নিতান্ত প্রয়োজনে যৎসামান্য খরচ করা হচ্ছে এই তো যথেষ্ট, যারা যথাসর্বস্ব দিতে এসেছে তাদের কাছে হিসেবের কথা তোলাকে অভিমানী নরেন্দ্রনাথ প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। শোনা যায় কাশীপুরে নিতান্ত কঠিন মন্তব্য করে তিনি খাতাপত্তর ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু এই মানুষটিই পরবর্তীকালে স্বদেশে ও বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে বিস্তারিত হিসেবপত্তর রাখায় প্রবল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যাঁরা সামান্যতম অর্থ সাহায্যও করেছেন তারা অ্যাকাউন্ট চাইবার আগেই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হিসেব দাখিল করা যে সঙ্ঘস্বাস্থ্যের পক্ষে নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছতা ও আর্থিক পরিচ্ছন্নতাকে সঙ্ঘজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করার জন্য যে ব্যাকুলতা স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, তা মঠ ও মিশনের পরবর্তীকালের পরিচালকরা পরিত্যাগ করেননি।
ইদানীং কেউ কেউ বলছেন, এই হিসাব-পরিচ্ছন্নতা রামকৃষ্ণ মঠ মিশনকে এক বিশেষ মহিমায় আলোকিত করেছে। ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞরা এই আদর্শের সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্বন্ধে বিশ্লেষণকালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন থেকে অনেক নতুন তথ্যের ও তত্ত্বের সন্ধান পাবেন।
সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা নিজেরা অর্থ উপার্জন করেন না, কিন্তু অপরের আর্থিক সাহায্যে বহু বড় বড় কাজ করতে তারা সমর্থ হয়েছেন বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে। কিন্তু পরের অর্থ মানেই তো হিসেবের কড়ি। এর জন্যে নিয়মকানুনের বন্ধন প্রয়োজন, নিজের যৎসামান্য ব্যক্তিগত অর্থ ও সঙ্ঘের কাজের জন্য সংগৃহীত অর্থের মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর দূরত্ব রাখাও প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার হিসেব সম্পর্কে স্বামীজির সেই মহামূল্যবান মন্তব্য, শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ করা চলবে না। হিসেব বিশেষজ্ঞরা আজকাল প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, যে কোনও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টিং প্রিন্সিপলের শেষ কথাটি এমন সহজভাবে পৃথিবীর কোনও ম্যানেজমেন্ট গুরু আজও বলে যেতে পারেননি!
স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিপত্রে এবং কথাবার্তায় ব্যক্তিগত-অর্থ ও সঙ্ঘ অর্থের এই নৈতিক পার্থক্য ভীষণভাবে এসে গিয়েছে, এমনকী এর জন্য স্বামীজি নিজেও মৃত্যুর পরেও অসুবিধায় পড়েছে।
একেবারে শেষ পর্যায় থেকে শুরু করা যেতে পারে। বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২-এ স্বামীজির অপ্রত্যাশিত দেহাবসানের পরও হিসেবের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। দেহাবসানের ১৮ দিন পরে, ২২ জুলাই ১৯০২ মঠের ট্রাস্টিদের সভায় আলোচনার প্রথম বিষয় স্বামীজির ‘প্রাইভেট ফান্ড’, যা সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। গভর্নমেন্ট পেপার ৩,৭০০ টাকা ও নগদ ১৭০০। স্বামীজির শেষ ইচ্ছা, টাকাটি তার গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হয়। কিন্তু হিসেবের কড়ি! ট্রাস্টিরা সামান্য পরিমাণ অর্থ থেকেও বাদ দিলেন :
১) শান্তিরাম ঘোষের কাছে স্বামীজির ধার ৯ টাকা।
২) স্বামীজি তাঁর শিষ্যদের জন্য মশারি কিনতে দেন ২০ টাকা।
৩) স্বামী অদ্বৈতানন্দের চোখ অপারেশন করবার ফি দেওয়ার জন্য স্বামীজির নির্দেশ ৩০ টাকা। মোট ৫৯ টাকা।
.
মঠের অছিদের কাছে দ্বিতীয় প্রস্তাব, মার্কিন-নিবাসিনী মিসেস ওলি বুল স্বামীজিকে ৭০০ টাকার চেক দিয়েছিলেন জনৈক বিদেশিনী ভক্তের আমেরিকা ফিরবার জাহাজ-ভাড়ার জন্য। যদি এই ভাড়া অন্য কেউ দিয়ে দেন, তা হলে এই ৭০০ টাকাও স্বামীজির মা ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হবে।
শুরু থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের হিসেবপত্তর কত কড়া তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ৭০০ টাকা দিয়ে পরে সঙ্ঘগুরু স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামীজির মা’কে তীর্থ করান এবং দত্ত বাড়ির পারিবারিক মামলাতেও কিছু খরচ করেন।
বহু বছর আগে শ্রীমতী সরলাবালা সরকার রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে লিখে গিয়েছে, প্রত্যেক ব্যাপারের জন্য আলাদা-আলাদা ফান্ড। যে যে কাজের জন্য টাকা দিয়েছে, তা অন্য খাতে খরচ করা চলবে না। এ-বিষয়ে স্বামীজির বক্তব্য : “যদি তোমাকে অনাহারে মরতেও হয় তবু অন্য বাবদের টাকা থেকে একটা পয়সাও খরচ করবে না।” অর্থাৎ কাশীপুরের পরে বিরাট মানসিক পরিবর্তন।
দুর্বল হিসেব বোধহয় অনেকটা ব্লাড সুগারের মতো, যে-কোনও প্রতিষ্ঠানকে নিঃশব্দে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। শ্ৰীমতী সরলাবালার সংযোজন, “মঠ আর মিশন দুই-ই আলাদা। তাই যদি কোনও ভক্ত প্রণামী দেন বা ঠাকুরসেবার জন্য টাকা দেন, সেটি মঠের অর্থভাণ্ডারে সঞ্চিত হইবে, আর জনহিতকর কার্যের জন্য জনসাধারণ যে টাকা দান করিবে সেটি হইবে মিশনের টাকা। সেই টাকার পাই-পয়সার হিসাব পর্যন্ত হিসাব-পরীক্ষক দিয়া মিলাইয়া লইতে হইবে।”
মৃত্যুর পরেও বিষয়সম্পত্তি নিয়ে যাতে কোনও আইনি গোলমাল আরম্ভ না হয়, তার জন্য সুদূর মার্কিনদেশে পরিব্রাজক বিবেকানন্দের চিন্তার শেষ ছিল না। দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে যখনই তিনি বিব্রত হয়েছেন, তখনই তিনি চটপট নিজের হাতে একটি উইল লিখে ফেলেছেন, ব্যাঙের আধুলির কতটুকু কোথায় যাবে, কে তার দায়িত্ব নেবে তা স্পষ্ট ভাষায় বলে গিয়েছেন। স্বামীজির এইসব উইল সম্বন্ধে নানা পরিস্থিতিতে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু মানসপত্রগুলির নির্দেশগুলি খুঁটিয়ে দেখে আরও বিস্তারিত আলোচনা হলে দূরদর্শী সন্ন্যাসীটিকে আরও ভালভাবে জানা যেত। সাতপুরুষের উকিলবাড়ির ছেলে সন্ন্যাস নিলেও প্রয়োজন মতো যে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করতেন না।
শুধু নিজের উপার্জিত সামান্য অর্থের জন্য নয়, অন্যের নামেও যেসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, সে বিষয়ে সব রকম নিরাপত্তা নেওয়ার ব্যাপারে স্বামীজি যে বেজায় একগুঁয়ে ছিলেন, তারও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিদেশিনী মিস হেনরিয়েটা মুলারের অর্থে বেলুড়ের যে-জমি কেনা হয়, তার বায়না করা হয় ১৮৯৮ সালে (১০০১ টাকা)। বাকি ৩৮,৯৯৯ টাকা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় ৫ মার্চ ১৮৯৮। এর মধ্যে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ তার ব্যক্তিগত উইল করেন ১৯ জানুয়ারি ১৮৯৮, কারণ বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে সামান্য যা অর্থ এনেছিলেন, তা তিনি ব্রহ্মানন্দকেই দিয়েছিলেন। যদি স্বামী ব্রহ্মানন্দ লোকান্তরিত হন, তা হলে কী হবে, এই আশঙ্কায় এই ইচ্ছাপত্র।
“লিখিতং স্বামী ব্রহ্মানন্দ, দক্ষিণেশ্বরনিবাসী পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য, সন্ন্যাসী, সাকিন আলমবাজার মঠ, আলমবাজার, জেলা চৰ্বিশ পরগণা কস্য চরমপত্ৰমিদং– আমি এত দ্বারা নির্দেশ করিতেছি যে, আমার ত্যক্ত আমার স্বামী বা বেনামী নগদ অর্থ, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি এবং স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি আমার অভাবে উক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য আলমবাজার মঠনিবাসী স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ সন্ন্যাসীদ্বয় পাইবেন এবং তাহাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তে ও অধীনে থাকিবে। আমি তাহাদিগকে এই উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিলাম। এত দ্বারা স্বেচ্ছায় এই শেষ উইল বা চরমপত্র সম্পাদন করিলাম।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দর এই উইলের সাক্ষী ছিলেন বিখ্যাত সলিসিটর প্রমথনাথ কর ও ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ।
হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দর দু’খানি মারাত্মক চিঠি বাংলায় লেখা হয়েছিল পরের বছর লন্ডন থেকে। বন্ধু ব্রহ্মানন্দকে লেখা প্রথম চিঠির তারিখ ১০ আগস্ট ১৮৯৯। নতুন কাগজ ‘উদ্বোধন’ সম্পর্কে প্রবল বিরক্তি দিয়ে এই চিঠির শুরু।– “মনে জেনো যে, আমি গেছি। এই বুঝে স্বাধীনভাবে তোমরা কাজ কর। টাকাকড়ি, বিদ্যাবুদ্ধি সমস্ত দাদার ভরসা’ হইলেই সর্বনাশ আর কি! কাগজটার পর্যন্ত টাকা আমি আনব, আবার লেখাও আমার সব– তোমরা কি করবে? সাহেবরা কি করছেন?
“আমার হয়ে গেছে! তোমরা যা করবার কর। একটা পয়সা আনবার কেউ নেই, একটা প্রচার করবার কেউ নেই, একটা বিষয় রক্ষা করবার বুদ্ধি কারু নেই। এক লাইন লিখবার… ক্ষমতা কারুর নাই– সব খামকা মহাপুরুষ!
“…তোমাদের যখন এই দশা, তখন ছেলেদের হাতে ছমাস ফেলে দাও সমস্ত জিনিস– কাগজ-পত্র, টাকা-কড়ি, প্রচার ইত্যাদি। তারাও কিছু পারে তো সব বেচেকিনে যাদের টাকা তাদের দিয়ে ফকির হও।
“মঠের খবর তো কিছু পাই না। শরৎ কি করছে? আমি কাজ চাই। মরবার আগে দেখতে চাই যে, আজীবন কষ্ট করে যা খাড়া করেছি, তা একরকম চলছে। তুমি টাকাকড়ির বিষয় কমিটির সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করবে। কমিটির সই করে নেবে প্রত্যেক খরচের জন্য। নইলে তুমিও বদনাম নেবে আর কি!
“লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায়– এই দস্তুর। প্রতি পদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়। …ওইরকম প্রথমে কুঁডেমি করতে করতেই লোকে জোচ্চোর হয়। মঠে যারা আছে, তাদের নিয়ে একটি কমিটি করবে, আর প্রতি খরচ তারা সই না দিলে হবে না।– একদম! …আমি কাজ চাই, vigour (উদ্যম) চাই– যে মরে যে বাঁচে; সন্ন্যাসীর আবার মরা বাঁচা কি?”
.
তিন মাস পরে (২১ নভেম্বর ১৮৯৯) নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা আর এক চিঠি থেকে স্পষ্ট যে, হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামীজির মনোভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে তিনি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টসের নিয়মকানুনে বাঁধতে উদগ্রীব।
স্বামীজি লিখছেন, “হিসাব ঠিক আছে। আমি সে-সব মিসেস বুলের হাতে সঁপে দিয়েছি এবং তিনি বিভিন্ন দাতাকে হিসাবের বিভিন্ন অংশ জানাবার ভার নিয়েছেন।
“আগেকার কঠোর চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি, তাতে কিছু মনে করো না। প্রথমত ওতে তোমার উপকার হবে– এর ফলে তুমি ভবিষ্যতে যথানিয়মে কেতাদুরস্ত হিসাব রাখতে শিখবে এবং গুরুভাইদেরও এটা শিখিয়ে নেবে।
“দ্বিতীয়ত এই-সব ভৎর্সনাতেও যদি তোমরা সাহসী না হও, তা হলে তোমাদের সব আশা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাই তোমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তোমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মতো আজ্ঞাপালন করে মরে যাও এবং নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোনও প্রকার ভীরুতা চলবে না।”
হিসেব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হওয়ার পিছনে স্বামী বিবেকানন্দের যে বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল, তা পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড স্টার্ডিকে লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বামীজির বিদেশি অনুরাগীদের কেউ কেউ অজ্ঞাত কারণে তার সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। যে মিস হেনরিয়েটা মুলার বেলুড়ের জমি কেনার জন্য প্রধান অর্থ জুগিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বিবেকানন্দর প্রকাশ্য বিচ্ছেদের কথা রামকৃষ্ণ অনুরাগীদের অজানা নয়। আর একটি অপ্রীতিকর ঘটনা, স্টার্ডির অহেতুক সমালোচনার বিরুদ্ধে স্বামীজির পত্রবিস্ফোরণ। এই ধরনের ধৈর্যহীন বিস্ফোরণ স্বামীজির জীবনে কমই ঘটেছে, কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট, আর্থিক ব্যাপারে কোনওরকম অশোভন ইঙ্গিত তাঁকে গভীর বেদনা দিত।
স্টার্ডির সঙ্গে পত্রাবলী থেকে স্পষ্ট, ইংল্যান্ডের মাটিতে অসহায় মানুষটিকে কী কষ্ট পেতে হয়েছিল, অথচ বিদেশের অনুরাগীদের ভুল ধারণা, তাঁরা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট সুখে রেখে দিয়েছেন। হিসেবপত্র প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক থেকে মিস্টার স্টার্ডিকে লেখা তারিখহীন চিঠিতে আসবার আগে নভেম্বর ১৮৯৯-তে স্বামীজির লেখা পরবর্তী চিঠির আলোচনা প্রয়োজন। আর্থিক সাহায্য যৎসামান্য হলেও সায়েবরা তার পরিবর্তে সন্ন্যাসীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন, তা এই পত্র থেকে স্পষ্ট।
অপমানিত হয়ে বিবেকানন্দ সোজাসুজি প্রতিবাদ জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। ”বিলাসিতা, বিলাসিতা, গত কয় মাস থেকে কথাটি বড্ড বেশি শুনতে পাচ্ছি। পাশ্চাত্যবাদীরা নাকি তার উপকরণ জুগিয়েছে, আর সর্বক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে ভণ্ড আমি নাকি নিজে সেই বিলাসিতা ভোগ করে আসছি। …তোমাদের সমালোচনায় আমার আর কোনও আস্থা নেই। এসব বিলাসব্যসনের কথায় আর কান দিই না…”
এর পরে কিছু অপ্রিয় সত্যের তিক্ত তালিকা। “ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও মিসেস সেভিয়ারের কথা বাদ দিলে ইংল্যান্ড থেকে আমি রুমালের মতো এক টুকরো বস্ত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ ইংল্যান্ডে শরীর ও মনের উপর অবিরত পরিশ্রমের চাপের ফলেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা, ইংরেজরা আমাকে এই তত দিয়েছ, আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ আমাকে অমানুষিক খাঁটিয়ে। এখন আবার বিলাস-ব্যসন নিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে বিরক্ত স্বামীজির লেখা আগের দুটি চিঠির কারণ বুঝতে হলে স্টার্ডির অন্তর্বর্তী পত্রগুলি পাঠ করা বিশেষ প্রয়োজন। রিজলি ম্যানর, নিউ ইয়র্ক থেকে লেখা চিঠিতে ঘুরেফিরে সেই হিসেবপত্রের কথা। স্বামীজি লিখছেন, “হিসেবপত্র পূর্বে পেশ করা হয়নি, কারণ কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি; সমস্ত ব্যাপারটা চুকে গেলে দাতার কাছে সম্পূর্ণ হিসাব দাখিল করব ভেবেছিলাম। টাকার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার ফলে কাজ মাত্র গত বছর শুরু হতে পেরেছে এবং আমার নীতি হল, টাকার জন্যে হাত পেতে স্বেচ্ছায় দানের জন্য অপেক্ষা করা।”
শেষের লাইনটি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারা এই নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলায় কোনও দিনই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য লাভ করেননি। কিন্তু কারণে-অকারণে সাহায্যের জন্য জনসাধারণের কাছে। হাতপাতা তাঁদের কালচারের বিরোধী। স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতার মনোভাবকে সন্ন্যাসীরা শত অভাবের মধ্যেও বিসর্জন দেননি। কিছুদিন আগে ভাটিকানে পোপের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রামকৃষ্ণ মিশনের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীর তরুণতম, ক্ষুদ্রতম এবং নিঃসন্দেহে দরিদ্রতম সন্ন্যাসী সঙ্ঘের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কাছে এসেছি।”
সাধারণ ও অসাধারণ মানুষদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যথেষ্ট পরিমাণে মিললেও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ যে শতবর্ষের প্রবাহেও অর্থ বিষয়ে তেমন সম্পন্ন হতে পারেনি, এ বিষয়ে দ্বিমত হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও বাইরে থেকে অনেকের ধারণা, অপর্যাপ্ত অর্থ সন্ন্যাসীদের আয়ত্তে রয়েছে এবং সঙ্ঘসভ্যরা কোনওরকম অর্থচিন্তা ছাড়াই নিজেদের অভীষ্ট কাজ করে যেতে সমর্থ হচ্ছেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে আরও একটু আলোচনার প্রয়োজন হবে। অনুমানের উপর নির্ভর করে কোনও মতামত সৃষ্টি হলে সেখানে অবশ্যই ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। যে
আপাতত আমরা শুধু তার জন্মভিটের আইনি হাঙ্গামার খোঁজখবর করব যার বিস্তৃতি অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল ধরে। যদি জন্মভিটের পুনরুদ্ধারের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সন্ন্যাসীদের কথা ধরা যায় তাহলে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে মামলা-মোকদ্দমার অবস্থিতি উনিশ, বিশ এবং একুশ শতাব্দী জুড়ে।
দেরেটোনার দত্ত পরিবারের যে মানুষটি (রামসুন্দর) মধু রায় লেনে বসবাস করতে এসে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে অনেকখানি জমি-সহ বিশাল বসতবাড়ির পত্তন করলেন, তিনি প্রথমে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজ অ্যাটর্নির ম্যানেজিং ক্লার্ক এবং পরে ফার্সি আইনজীবী। আইনপাড়ায় উপার্জন করা প্রভূত অর্থ থেকেই দত্তদের এই ভিটেবাড়ির পত্তন।
রামমোহনের দুই পুত্র (দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ) ও সাত কন্যা। পঁয়ত্রিশ বছরে কালীপ্রসাদের অকালমৃত্যু কলেরায়, আর নরেন্দ্রনাথের পিতামহ দুর্গাপ্রসাদ নিতান্ত তরুণ বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে সংসারবন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলেও, ভিটেবাড়িতে প্রথম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটল তারই মাধ্যমে। সেই সময়ের হিন্দু আইন অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মোদ্দা কথা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত নিরুদ্দিষ্ট, টানা বারো বছর তার কোনও সন্ধান না পাওয়ায় আদালতে তাকে মৃত ঘোষণা করা হোক।
সন্ন্যাসী হয়ে-যাওয়া দুর্গাপ্রসাদের পুত্র বিশ্বনাথ বি এ পাশ করে কিছু দিন ব্যবসা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে আইনপাড়ার অ্যাটর্নি অফিসে আর্টিকেলড ক্লার্ক হন এবং পরে হেনরি জর্জ টেম্পলের অ্যাটর্নি অফিসে যোগ দেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা ভুবনমোহন দাশ ওই অফিসে তার সহকর্মী ছিলেন। পরে তিনি যে অ্যাটর্নি অফিস স্থাপন করেন তার নাম ধর অ্যান্ড দত্ত।
অ্যাটর্নি হিসেবে বিশ্বনাথ প্রচুর যশ অর্জন করলেও, দত্তবাড়ির শরিকরা পরবর্তী কালের পারিবারিক মামলায় তাকে বেহিসেবি এবং আর্থিক সঙ্গতিহীন বলে অভিযোগ করেন। আমরা জানি বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণীর দুঃখ ও নীরব বেদনা। বিশ্বনাথ একবার বলেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেট ভরে খেতে পায় না।”…বিশ্বনাথের অকালমৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, কিন্তু তার জীবিতকালেই শরিকি লড়াইয়ের সূচনা হয়ে যায়। এর প্রথম ইন্ধন জোগানো হয় ১৮৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন অর্থের প্রয়োজনে দত্ত পরিবারের দুই নিঃসন্তান বিধবা অবিভক্ত ভিটেতে নিজেদের অংশ নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীকে বেচে দেন। ভোলানাথ দত্তর বিধবা বামাসুন্দরী ও মাধব দত্তর বিধবা বিন্দুবাসিনী এর জন্যে যে পাঁচশো টাকা করে পেয়েছিলেন তা আসলে কার উপার্জিত টাকা এই নিয়ে পরবর্তী কালে মস্ত লড়াই আদালতে। নরেন্দ্রনাথের খুড়ো হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজ্ঞ তারকনাথ দত্তর বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম বিশ্বনাথ দত্তের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আইনি লড়াই স্বামী বিবেকানন্দর অবশিষ্ট জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
এই মামলার আগেও ১৮৮০ সালে অবিভক্ত বাড়ির আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) ভিটেবাড়ি বিভাজন মামলা এনেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টে যাতে অন্য সকলের সঙ্গে বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। পরের বছরে আদালতের নির্দেশে কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি রবার্ট বেলচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হন এবং চার বছর ধরে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে তিনি দত্তবাড়ির শরিকদের ভাগ ঠিক করে দেন। বেলচেম্বার্সের স্বাক্ষরিত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের নকশাই পরবর্তী সময়ে বিবেকানন্দ ভিটের পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে মঠ ও মিশনের খুব কাজে লেগে যায়।
নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর পরেই উকিল তারকনাথ ভূবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি তার বেনামি সম্পত্তি বলে দাবি করতে থাকেন। ১৮৮৫ বড়দিনের সময় এই বাড়ির একটা অংশে বাথরুম মেরামতির জন্য পুরনো দেয়াল ভাঙা নিয়ে ভূবনেশ্বরীর পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ উত্তপ্ত কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়লেন। এই মামলায় যথাসময়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। হাইকোর্টে বিচারপতির নাম উইলিয়াম ম্যাকফারসন। নরেন্দ্রনাথ যখন সাক্ষ্য দেন (৮ মার্চ, ১৮৮৭) তখন শ্রীরামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করেছেন, তাঁর ত্যাগী সন্তানরা তখন তপস্যাদীপ্ত বরাহনগরের মঠবাসী। নিরুপায় নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে যেতেন পায়ে হেঁটে, আর ভূবনেশ্বরী যেতেন পাল্কিতে। নরেন্দ্রনাথের সাক্ষ্যের কিছু অংশ: “..কয়েক মাস পিত্রালয়ে থেকে আমার মা ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন তাঁরই জমির একটা অংশে তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন।..ঘটনাস্থলে মায়ের পক্ষ নিয়ে আমি আপত্তি তুলেছিলাম।”
দীর্ঘ শুনানির পরে ১৪ মার্চ ১৮৮৭ হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের সুচিন্তিত রায় প্রকাশিত হল। অভিযোগ প্রমাণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী। প্রমাণ হল, প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে নিয়মিত তার স্ত্রীকে টাকা পাঠাতেন। বিপদ সাধল তারকনাথের এক পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।
রায়ের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আপিল করেছিলেন জ্ঞানদাসুন্দরী। তখনকার প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যামও ভূবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন ১৫ নভেম্বর ১৮৮৭। কিন্তু জয় অত সহজ হলো না। শাখাপ্রশাখা মিলে এই মামলার রেশ চলল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত–সেই সঙ্গে অজস্র অর্থব্যয় ও সীমাহীন যন্ত্রণা।
পিতৃহীন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, আবার বৈরাগ্যের কঠিন সাধনা, অসহনীয় এই টানাপোড়েনে নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তার গুরুভাইদের অবিস্মরণীয় ভালবাসা ও সমর্থন। দুই গুরুভাই নরেনের টাকার অনটন মেটাবার জন্য বরাহনগর থেকে বালির স্কুলে গিয়ে মাস্টারি করতে চাইলেন। সে বড় করুণ কাহিনি। জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, রাখাল আমার শরীর ভাল নয়। শীগগিরই দেহত্যাগ করব। তুই আমার মার ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দিস। তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর ভারটি রইল।
হাইকোর্টের রায়ের পরেও গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের মামলা কেমনভাবে পল্লবিত হয়ে তার তিরোধানের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হাইকোর্টে হেরে যাওয়ার পরে খুড়ি তার অংশটি ৬ হাজার টাকায় স্বামীজিকে বেঁচে দেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে (মার্চ ১৯০২) সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখলেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই। ঝুলে থাকা মামলার জন্য লাগবে।”
বেলুড়ে স্বামীজির মহাসমাধি ৪ জুলাই ১৯০২। তার পাঁচ দিন আগে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কয়েক জন শরিকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় দ্বন্দ্ব মিটে গেল টাকার পরিবর্তে। দুই পক্ষের অ্যাটর্নি (পিন্টু কর ও এন সি বসু) খুব দ্রুত কাজ করলেন। কারণ, অপেক্ষা করবার মতো সময় আর স্বামীজির হাতে নেই। ২ জুলাই ১৯০২ মহাসমাধির দু’দিন আগে শরিক হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি স্বেচ্ছায় মিটমাট হয়ে গেল।
স্বামীজি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেও আইনের কালো মেঘ এরপরেও মাঝে মাঝে ৩নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
রাজনৈতিক অপরাধে কেউ আদালতে অভিযুক্ত হলে ভূপেন্দ্রনাথ অনেক সময় বাড়ির মালিক হিসেবে জামিনদার হনে, একজন আসামি মামলা চলাকালীন উধাও হওয়ায় ভূপেন্দ্রনাথকে জামিনদার হিসেবেও জরিমানা দিতে হয়। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির অংশ বিক্রি করে সেই টাকা যে জোগাড় করতে হয়েছিল তা এই প্রজন্মে আমরা ভুলে গিয়েছি।
=================
পিতৃদেবের বেনামা উপন্যাসে পরিবারের গোপনকথা
অবশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তার ভিটেবাড়ির আত্মীয়স্বজনদেরও যে বোঝা দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।স্বামীজির প্রাক্সন্ন্যাসজীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়ে চলেছে। শৈশবে, কৈশোরে, বাল্যে ও যৌবনে কেমন দেখতে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত? কোথায় গেল আদিপর্বের আলোকচিত্রমালা? তার মা, বাবা, ভাইবোন সম্পর্কে আমরা কেন আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না, ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছেন বিশিষ্ট বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানীরা।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা পর্বের আগে নরেন্দ্রনাথের কোনো ফটো তোলা হয়নি তা মানতে মন চায় না। যেমন বিশ্বাস হতে চায় না যে সফল আইনজীবী ও দেশে দেশে পরিভ্রমণকারী, অভিজাতরুচি পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের কোনো ফটোগ্রাফ তোলা হয়নি। এ বিষয়ে দত্তপরিবারের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য : সবই ছিল, কিন্তু সবই হারিয়ে গিয়েছে পারিবারিক বিরোধে ও বারংবার পুলিসি খানাতল্লাশিতে।
পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের নিতান্ত আপনজনদের ভিটেবাড়ি থেকে আচমকা উৎখাতের প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসা যাবে। বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাসমাধির পরবর্তী দশকে ইংরেজ পুলিসের বিষদৃষ্টিতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তভিটেতে বহুবার তল্লাশি চলে এবং শাসকরা প্রতিবারই দেওয়ালের ছবি থেকে ট্রাঙ্কের কাগজপত্র, কাপড়চোপড় সব বাজেয়াপ্ত করে সঙ্গে নিয়ে যান।
এই অত্যাচারের ফলে ঐতিহ্যমণ্ডিত দত্ত পরিবারের অনেক নিদর্শন নষ্ট হয়েছে, বিবেকানন্দ ভিটেতে কাঠের দরজা জানলা, ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে এবং ছাদ ছাড়া আর কিছুই অতীতের ধারাবাহিকতা বহন করছে না। এবাড়ির যা কিছু খবরাখবর তা সংগ্রহ হয়েছে মানুষের স্মৃতিকথা থেকে এবং মূল্যবান আদালতি রেকর্ড থেকে।
দত্তপরিবারের শরিকি লড়াই প্রায় মহাপ্রয়াণের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কখনও প্রায় দেউলিয়া, কখনও সর্বস্বান্ত হয়েছেন দত্ত নামধারী পুরুষ ও মহিলারা। কিন্তু সব অমঙ্গলেরই একটা মঙ্গলময় দিক থাকে। স্বামীজির আপনজনদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন আদালতি সূত্র থেকেই অনুরাগীরা উদ্ধার করতে পেরেছেন।
তবু যতটুকু জানা গিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য এখনও অজানা থেকে গিয়েছে স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী, পিতৃদেব এবং আত্মঘাতিনী বোনদের সম্পর্কে। ভাইদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু জানি আবার অনেককিছু জানি নাও বটে। জননী ভূবনেশ্বরী সম্পর্কে আজও কৌতূহলের বিরাম নেই বহুযুগ আগের দুই ভুবনবিদিতা জননী শঙ্করাচার্যমাতা ও চৈতন্যজননী সম্পর্কেও ভক্তজনের একই ধরনের ব্যাকুলতা।
সুদূর প্রবাসেও স্বামীজি তার গর্ভধারিণী জননী সম্পর্কে মাঝে মাঝে কিছু হৃদয়গ্রাহী মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির বিদেশিনী অনুরাগিনীরাও তাদের গুরুদেবের জননীকে মার্কিনদেশ থেকে অভিনন্দন পাঠিয়েছেন।
ভূবনেশ্বরী সস্পর্কে প্রাচীনতম নিদর্শনটি হল কলকাতা হাইকোর্টের কাগজপত্রে একটি বাংলা সই, যা দেখে বোঝা যায় তার হস্তলিপি খুবই সুন্দর ছিল। আমরা জানি তিনি মেমদের কাছ থেকে ইংরিজি পাঠ নিয়েছিলেন এবং বড় ছেলেকে ইংরিজি শিখিয়েছেন। পরবর্তীকালে সাগরপারের কয়েকজন ভক্ত ও ভক্তিমতীর সঙ্গেও তিনি ইংরিজিতে কথা কইতেন, কিন্তু তার ইংরিজি লেখার কোনো নিদর্শন আজও উদ্ধার হয়নি। এতোদিন বিবেকানন্দ-জননীর একটিমাত্র আলোকচিত্রই ছিল ভরসা। স্বামীজির দেহাবসানের পর বিদেশিনীদের অর্থে সিস্টার নিবেদিতা এই ছবি তোলবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভূবনেশ্বরী দেবী ও নিতান্ত আদরের একমাত্র সন্তানের ভাগ্যবিপর্যয়ে সর্বদাকাতর বিবেকানন্দমাতামহী রঘুমণি দেবীর আলোকচিত্র মনে হয় একই সময়ে তোলা হয়েছিল।
অতিসম্প্রতি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভূবনেশ্বরী দাসীর দ্বিতীয় একটি ছবি অধ্যাপক শ্রীসুজিত বসুর সৌজন্যে আমাদের নজরে এসেছে। নির্মম : দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ, আত্মীয়দের অপমান ও অকালমৃত্যুতে জর্জরিত বিবেকানন্দজননীর এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ব্রহ্মানন্দ উপাধ্যায় সম্পাদিত স্বরাজ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩১৪ প্রকাশিত হয়েছিল।
স্বরাজ পত্রিকায় লেখা হয়, “আমরা নরেন্দ্রের মাতার চিত্র দিলাম। নরেন্দ্রের মাতা রত্নগর্ভা। মা–অমন রত্ন হারাইয়াছেন। হারাইয়াছেন কি ব্যবহারতঃ হারাইয়াছেন–পরমার্থতঃ হারান নাই। তাঁহার জ্যেষ্ঠ সুতের চরিত্রসৌরভে ভারত আমোদিত। আহা–মায়ের ছবিখানি দেখ– দেখিলে বুঝিতে পারিবে যে নরেন্দ্র মায়ের ছেলে বটে–আর মাতা ছেলের মা বটে।”
দুঃখের বিষয় ভূবনেশ্বরী দেবীকে লেখা অথবা তার নিজের হাতে পুত্রকে লেখা কোনো চিঠি এখনও সংগৃহীত হয়নি। আমরা জানি, মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ ভাগ্যসন্ধানে বিদেশে গমন করে অজ্ঞাত কারণে বহু বছর অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং দীর্ঘসময় ধরে পদব্রজে বহুদেশ ভ্রমণ করে স্বামীজির দেহাবসানের কয়েকদিন পরে কলকাতায় ফিরে আসেন। চার পাঁচবছর মাকে একখানাও চিঠি না লিখে মহেন্দ্রনাথ তাঁর মা ও নরেন্দ্রনাথের উদ্বেগ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন।
কিন্তু স্বামীজির মাতৃঅনুরাগের কথা তো আমাদের অজ্ঞাত নয়। দীর্ঘকাল স্বদেশ ও বিদেশের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজের মাকে তিনি কখনও কোনো চিঠি লেখেননি তা ভাবতে ইচ্ছে করে না। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, মহেন্দ্রনাথ বা তার ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ কোথাও দাদার লেখা কোনো চিঠির উল্লেখ করেননি। যতদূর জানা যায়, স্বামীজির দিদি স্বর্ণময়ীও এবিষয়ে কোনো মন্তব্য রেখে যাননি, স্বামীজির দেহাবসানের তিনদশক পরেও (১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) তিনি কিন্তু বেঁচে ছিলেন। স্বামীজির দিদির ক্ষেত্রে একটু নাম বিভ্রাটও আছে, মৃত্যু রেজিস্টারে তিনি স্বর্ণবালা, আবার কোথাও স্বর্ণলতা।
স্বামীজিরা ছিলেন দশ ভাইবোন (নরেন্দ্রনাথ ষষ্ঠ সন্তান), এঁদের সম্বন্ধেও আজও অনেক কিছু অজানা। আমরা বিশ্বনাথ দত্তের প্রথমপুত্র ও দুই কন্যার নাম জানি না। সন্ধানকারীদের মন্তব্য : নিতান্ত অল্প বয়সে মৃত্যু হওয়ায় এদের নামকরণ হয়নি, অথবা নামকরণ হলেও নামগুলি আমরা এখনও সংগ্রহ করতে সমর্থ হইনি। তার থেকেও যা দুঃখের, অন্য ভগ্নীদের প্রায় কোনো খবর হাতের গোড়ায় নেই। পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তর আকস্মিক প্রয়াণের সময় কন্যারা বিবাহিতা কি না তাও আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।
প্রথম যুগের ইংরিজি বিবেকানন্দ-জীবনীতে বিশ্বনাথের পারলৌকিক কাজ শেষ করে নরেনের বাড়ি ফেরার বর্ণনা আছে। এই বিবরণ থেকে আন্দাজ হয়, কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ তখন যেমন নিতান্তই শিশু তেমনই ভগ্নীদের কেউ কেউ অবিবাহিতা।
পরবর্তীসময়ে এদের বিবাহে কে কী ভূমিকা গ্রহণ করলেন, কোথা থেকে বিবাহের অর্থ এলো তাও অস্পষ্ট। আরও যা আলো-আঁধারিতে ভরা, তা হলো একজন নয়, দুই বোনের নিতান্ত অল্পবয়সে স্বামীগৃহে দুঃখজনক অকালমৃত্যু। এঁদের একজন যে ছোটবোন যোগীন্দ্ৰবালা তা জানা যায়, তিনি যে কলকাতা সিমলা অঞ্চল থেকে সুদূর সিমলা পাহাড়ের পতিগৃহে আত্মঘাতিনী হন তাও স্পষ্ট, কিন্তু দ্বিতীয় আত্মঘাতিনী ভগ্নীর প্রকৃত বিবরণ এখনও রহস্যময়।
এক নজরে বিশ্বনাথ-ভূবনেশ্বরীর পরিবারের ছবি আঁকার সময় আমরা আরও কিছু বিবরণ উপস্থাপন করব। সংসারত্যাগের পরে এবং বিদেশ থেকে প্রত্যাগমনের আগে গৈরিক বেশধারী নরেন্দ্রনাথকে যে কখনও ভিটেবাড়িতে দেখা যায়নি এমন ইঙ্গিত রয়েছে, তবে দিদিমা রঘুমণি বসুর ৭ রামতনু বসু লেনের বাড়িতে যে বেশ কয়েকবার গুরুভাই ও শিষ্যদের নিয়ে স্বামীজি এসেছে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
চরম অর্থনৈতিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ভূবনেশ্বরীর আশ্রয়স্থল এই রামতনু বসু লেনের পিত্রালয়। অল্পবয়সে বিধবা হওয়া অসহায় মেয়ের পাশে সারাজীবন দাঁড়াতে গিয়ে দিদিমা রঘুমণি বসু বড়ই কষ্ট পেয়েছে। অসহায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে স্বামীর ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভূবনেশ্বরী তার শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছেন স্নেহময়ী মায়ের কাছে। আদরিনী কন্যার মৃত্যু তারিখ ডেথ রেজিস্টার অনুযায়ী ২৫ জুলাই ১৯১১। অভাগিনী কন্যাকে আগে সব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে পাঠিয়ে দিয়ে, তার ঠিক দুদিন পরে ২৭ জুলাই ১৯১১ স্বামীজির দিদিমা রঘুমণি বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
*********
উত্তর কলকাতায় ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দর ভিটেবাড়ির শেষ উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা, কনিষ্ঠভ্রাতা ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত জীবনসায়াহ্নে তাঁর বাংলা বইতে একটি ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গিয়েছেন।স্বামীজির জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ পেট্রিয়ট-প্রফেট’ বইতে জলঘোলা নেই, কিন্তু বাংলা রচনা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইতে দরিয়াটোনার দত্ত বংশের পরিচয় দিতে দিতে এবং পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত সম্পর্কে বলতে বলতে তিনি যে গোপন পারিবারিক তথ্য ফাঁস করেছে, তার মর্মার্থ হল, স্বামী বিবেকানন্দের পরমপ্রতিভাবান পিতা অকালমৃত বিশ্বনাথ দত্ত সুলোচনা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন যা সেকালের পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বহুদর্শী নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার কিছুটা গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরীর কাছ থেকে জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন তার জননী যে কবিতা রচনা করতেন তা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জানি, কিন্তু পিতৃদের বিশ্বনাথ দত্তের সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোনো ইঙ্গিত অনুরাগী মহলে ছিল না, যদিও নানা ভাষায় বিশ্বনাথের ব্যুৎপত্তি ও গ্রন্থপ্রেম কারুর অজানা ছিল না।
‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১০১ পাতায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তার পিতৃদেব সম্বন্ধে লিখেছেন : সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম। সুলোচনা’ নামে একটি বাংলা উপন্যাস তিনি রচনা। করেছিলেন।
এর পরেই বিস্ফোরণ। তার নিজের আর্থিক অবস্থা তখন সচ্ছল ছিল না বলে জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী গোপালচন্দ্র দত্তের নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
‘সুলোচনা’ সম্পর্কে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে কয়েকদশক অতিবাহিত হলেও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষকরা কেন এই বইটি সম্বন্ধে তেমন অনুসন্ধান করলেন না তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রকাশিত হওয়ার পরে “পাঠক সাধারণ কর্তৃক বিশেষভাবে সমাদৃত” ‘সুলোচনা’ পরবর্তীকালে দুষ্প্রাপ্য হলেও দুর্লভ নয়। স্বদেশে ও বিদেশে যেখানেই উনিশ শতকে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের সংগ্রহ আছে সেখানকার গ্রন্থতালিকায় এই উপন্যাসের নাম রয়েছে।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “১৮৮০ খৃষ্টাব্দে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।” কিন্তু কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে দেশবিদেশে খোঁজখবর করতে গিয়ে বিলেতে যে বাংলা বইয়ের হদিশ পাওয়া গেল তার প্রকাশ কলকাতায়, সময় ১৮৮২, বাংলা সন ১২৮৯।
তখনকার কলকাতায় প্রকাশিত বাংলা গল্প-উপন্যাসে একটা ইংরিজি ও একটা বাংলা ফ্লাই-লিফ থাকতো। ইংরিজি টাইটেল-পেজ অনুযায়ী বইটির প্রথম প্রকাশ ১৮৮২। প্রকাশক ২৫ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং। বাংলা ফ্লাইলিফে বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং হয়েছেন বি. বানুর্জি কোম্পানি। ব্যানার্জি পদবীটির উচ্চারণ ও বানান নিয়ে বাংলা ও ইংরিজিতে যে দীর্ঘকাল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে তার অকাট্য প্রমাণ।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের শেষপ্রান্তে উল্লেখ : “কলিকাতা বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে ৬৯ বাটীতে হিতৈষী যন্ত্রে শ্রী ব্রজনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক মুদ্রিত।”
সুলোচনা’ উপন্যাসের টাইটেল পেজে আরও কিছু খবরাখবর আছে। সেকালের বইতে মূল নামের সমর্থনে ও ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় একটি নাম দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। এক্ষেত্রে লেখা হয়েছে: সুলোচনা অথবা আদর্শ ভাৰ্য্যা। ইংরিজিতে : ‘সুলোচনা দ্য এগজেমপ্লরি ওয়াইফ।’
ইংরিজি পরিচয়পত্রে আরও ব্যাখ্যা আছে : ‘এ স্টোরি অফ বেঙ্গলি ফ্যামিলি লাইফ’ বাংলা করলে দাঁড়ায় : বাঙালির পারিবারিক জীবন নিয়ে একটি কাহিনী। কিন্তু দ্বিতীয় বাংলা টাইটেলে উপন্যাসের লেখক সাহস করে আরও একটু এগিয়ে গিয়েছেন : ‘বঙ্গবাসীদিগের সংসারিক ব্যবহারাবলম্বিত উপন্যাস।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আড়াই শ পাতার উপন্যাসের মূল্য এক টাকা, সেই সঙ্গে সেকালের ডাক খরচ সম্বন্ধেও একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে : ‘ডাকমাশুল আনা। পোস্টেজ 2 annas।
পরবর্তী প্রশ্ন স্বভাবতই ‘শ্রী গোপালচন্দ্র দত্ত প্রণীত’ ব্যক্তিটি কে? মুলপরিচয়ে পৌঁছবার আগে ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দরিয়াটোনার দত্ত পরিবারের যে বংশলতিকা দেওয়া হয়েছে তার দিকে নজর দিলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়ি প্রসঙ্গে আমরা জানি নরেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্র রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন ও পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে বর্ধমান জেলার দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় চলে আসেন।
এই রামসুন্দর দত্তের পাঁচপুত্র রামমোহন, রাধামোহন, মদনমোহন, গৌরমোহন ও কৃষ্টমোহন। জ্যেষ্ঠ রামমোহন দত্তই ভুবনবিদিত স্বামী বিবেকানন্দর প্রপিতামহ। কনিষ্ঠ কৃষ্টমোহূনের সেজ ছেলে গোপালচন্দ্র; অতএব শরিকী সম্পর্কে গোপালচন্দ্র হলেন নরেন্দ্রনাথের পিতৃদেব বিশ্বনাথের খুড়ো বা কাকা।
এই প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের রচনা থেকে বেশ কিছু তথ্য আমরা জানতে পারি। বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে গ্রন্থরচনার উপাদান সংগ্রহের জন্য ভূপেন্দ্রনাথ একসময় সিমুলিয়া দত্তদের আদি কুলগুরু আন্দুল-মৌরীর শ্ৰীতারাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারাপ্রসন্নবাবু তখন ভূপেন্দ্রনাথকে জানান যে তার মাতৃদেবী গোপালচন্দ্র দত্তকে দেখেছিলেন। আরও জানান, তাদের শিষ্যবংশের খাতায় রামনিধির প্রপৌত্র মদনমোহনের নাম পাওয়া যায়, সন ১২৬৩ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য, এই তারিখটি একটু গোলমেলে, কারণ ভিটেবাড়ির পার্টিশন মামলার কাগজপত্রে মদনমোহনের মৃত্যু তারিখ ১৮৪৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের বর্তমান অনুসন্ধানে অবশ্য এই মতপার্থক্যের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
আমরা এখন জানতে চাই উপন্যাসের টাইটেল পেজে উল্লিখিত গোপালচন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য। স্বামীজির ছোটভাই আমাদের হতাশ করেননি। তিনি একই বইতে জানিয়েছেন, “গোপালচন্দ্র দত্ত একজন বিদ্বান ও যশস্বী জননায়ক হয়েছিলেন।”
আরও খবর, গোপালচন্দ্র ডাকবিভাগে বড় পদে চাকরি করতেন এবং চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি কৃষ্ণদাস পালের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর হন। গোপালচন্দ্র বেথুন সোসাইটির শুরু থেকে আজীবন সভ্য ছিলেন এবং ১০ নভেম্বর ১৮৫৯ থেকে ২০ এপ্রিল ১৮৬৯ প্রায় দশ বছর সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, গোপালচন্দ্র ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ বেথুন সোসাইটীতে বাংলার শিক্ষিত শ্রেণী–তাদের অবস্থা ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করেন।
গোপালচন্দ্রের বড় জ্যাঠামশাই রামমোহনের দুই পুত্র ও সাতকন্যা। পুত্রদের নাম দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ। এই দুর্গাপ্রসাদই বিশ্বনাথের পিতা এবং পরবর্তীকালে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। পরবর্তীকালে বারাণসীতে তিনি নাকি কোনো মঠের অধ্যক্ষ হন।
আরও একজন সন্ন্যাসীর নাম দেখা যায় দত্তদের বংশলতিকায়, তিনি গোপালচন্দ্রের দাদা নবীনের বড় ছেলে–আদালতি বংশলতিকায় এঁর নামোল্লেখ নেই। বলা হয়েছে, এঁর ছোটভাই নীলমণি।
সন্ন্যাসের প্রতি দত্তপরিবারের আসক্তি সম্পর্কে উল্লেখ প্রয়োজন এই কারণে যে ‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও ঘুরে ফিরে এক সন্ন্যাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অঙ্কিত হয়েছে। কাহিনীতে এঁর নাম স্পষ্ট নয়। “সন্ন্যাসী কহিলেন–আমার নাম জানিবার আর আবশ্যক কি, আমার সাংসারিক নাম আমি ত্যাগ করিয়াছি। এখন আমার সম্প্রদায়ী উদাসীনেরা আমাকে অঘোরস্বামী বলিয়া ডাকে।”
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে অঘোরস্বামীর ভূমিকা এতোই নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত যে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উপন্যাসের সাসপেন্স নষ্ট করতে চাই না। তবে এই চরিত্রটির পিছনে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের পুত্র, বিবেকানন্দের পিতা ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথের যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সমর্থন রয়েছে সেবিষয়ে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। তাৎক্ষণিক কৌতূহল নিবারণের জন্য বিশ্বনাথের রচনা থেকে সামান্য একটু নমুনা দেওয়া যেতে পারে।
“কর্ম ভিন্ন কেবল চক্ষু মুদিয়া ভাবনায় কোন ফল নাই। কর্মের অর্থ অনেক। কেবল আপন শরীরকে যাতনা দেওয়া কর্ম নহে। সংসারের সুখখান্নতি, পরের ইষ্টসাধন ও অন্যায়, অনিষ্টসাধন হইতে বর্জিত থাকা, নিজের শরীর পালন ও শরীর পবিত্র রাখা, ক্ষুৎপীড়িতের ক্ষুধানিবৃত্তি, তৃষ্ণাতুরকে স্নিগ্ধবারি দান, শীতপীড়িতকে বস্ত্র দান, নগ্নভিক্ষুকের লজ্জা নিবারণ, রোগীর রোগের সেবা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান–এই সকল কর্ম।
“যাঁহারা এই রূপ কর্মসাধন করিতে যত্ন পান না তাহাদের ঈশ্বরধ্যানের অধিকার নাই। তাহাদিগের ঈশ্বর আরাধনা লৌকিক আড়ম্বর মাত্র। অনেকে ধর্মের জন্য এক কপর্দক ক্ষতি স্বীকার করেন না–কোন অংশে এক তিল বিলাস ভোগ হইতে বঞ্চিত থাকেন না–কোনো আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিতে পারেন না ও ত্যাগ করিবার চেষ্টাও পান না–তাহাদিগের ধর্মের ভেক ধারণ করা শঠতার রূপান্তর মাত্র।
“আবার আর এক শ্রেণীর প্রবঞ্চক আছেন তাঁহাদিগের মুখে দিবানিশি ধর্মসম্বন্ধীয় কাহিনী শুনিতে পাইবে। ইহাদিগের ধর্মালোচনা কেবল নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ ও নিজের স্বরূপ প্রচ্ছন্ন রাখিবার উপায়ন্তর মাত্র। ইহাদিগের ধর্মকথনের এই পর্যন্ত উপকার দৃশ্য হয় যে ইহারদ্বারা প্রকাশ পায় যে কত প্রকার সুললিত ভাষায় কত প্রকার সুযুক্তি দেখাইতে পারা যায় ও এক এক লোকের কি পর্যাপ্ত বচননিপুণতা আছে ও তাহারা কত প্রকার বাক্যপ্রণালী প্রয়োগ করিতে পারে।”
উপন্যাসের আরও একটি বক্তব্যের ওপর আলোকপাত প্রয়োজন হতো যদি না স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসী পিতামহের বৈরাগ্যময় জীবন সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত হতাম।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুরথনাথ প্রশ্ন করিলেন, “দিবানিশী ভজন সাধন করিলেই কি মনুষ্যের মুক্তি সম্ভাবনা, না তাহার সহিত আর কোন কর্তব্যকর্ম আছে?”
সন্ন্যাসী উত্তর করিলেন–”বাপু এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া অসাধ্য। মনুষ্যের যে প্রণালীতে জন্ম তাহাতে তাহার জন্মদাতার ও গর্ভিণীর শারীরিক ও মানসিক ও ধর্ম নৈসর্গিক গুণসমুদয় তাহাতে বর্তায়। সত্যপরায়ণ, নির্লোভী নিরাকাঙ্ক্ষী হিংসাদ্বেষ কাম ক্রোধ শূন্য হইয়া কেহ জন্মগ্রহণ করেন না। এই রিপুগুলির বীজ তাহার শোণিতে মিশ্রিত আছে এবং সংসারে থাকিয়া তাহা অন্যের সংসর্গে এবং পৃথিবীর ব্যবহার দেখিয়া দিন দিন উন্নতি প্রাপ্ত হয়।
“কি সংসারী কি ব্রহ্মচারী সকলেরই এক অনাদি পবিত্র আত্মার চিন্তা কর্তব্য যেহেতুক তদ্বারা কেবল নিজের প্রত্যক্ষ মঙ্গল সাধন হইবে তাহা নহে, মনুষ্যের আত্মা অত্যুৎকৃষ্ট সুনির্মল পবিত্র আত্মার আদর্শ দেখিয়া সেই উচ্চতা কালে প্রাপ্ত হইতে পারিবে। কিন্তু মনকে পবিত্র করা, রিপু সমুদয়কে কোমল করিয়া নিয়মাধীনে রাখা, এক জন্মের কর্ম, এটী এক দিনের কর্ম নহে, এক বৎসরের কর্ম নহে কিছু কাল অধ্যবসায়ের সহিত অভ্যাস করিলে হয় ত সিদ্ধ হওয়া যায়, হয় ত হওয়া যায় না।
“যেমন রোগীকে ঔষধ প্রয়োগ করিবার পূর্বে তাহার শরীর অন্তর্গত মলমূত্রাদি নিষ্কৃতি করিতে হয়–যেমন দেবদেবীর অর্চনার পূর্বে একটি পবিত্র বেদি নির্মাণ করিতে হয় তেমনি ঈশ্বর আরাধনার পূর্বে মনকে পরিশুদ্ধ করা সত্যপরায়ণ হওয়া কপটতা ত্যাগ করা সাংসারিক কৌশল বর্জিত হওয়া আবশ্যক। সাংসারিক সুখে কিছুমাত্র বঞ্চিত হইব না অথচ সময়ে এক এক বার চক্ষু মুদিত করিব–সে উপাসনা নহে–এবং যে সেই রূপ উপাসক সে ঈশ্বরের নামে আপন সৃষ্ট কোন দেবতার আরাধনা করে।
“অপবিত্র মনে অপবিত্র চিত্তে কি প্রকারে পবিত্র নির্মল আত্মার আরাধনা করা সাধ্য। কি উপায়ে অর্জিত অর্থের আগমন হইবে কাহার স্থাপ্য হরণ করিব কাহাকে প্রলোভন দর্শাইয়া নিজাধীনে আনিয়া তাহার সর্বস্ব হস্তগত করিব–যাঁহার অহর্নিশ এই চিন্তা–যিনি নিজ বিলাস ভোগে অধীর হইয়া অন্যকে স্ত্রী কন্যা লইয়া সংসার করিতে দেন না–যিনি ঐহিক পদমর্যাদা, প্রভুত্ব আকাঙ্ক্ষায় মুগ্ধ হইয়া কোন প্রবঞ্চনা প্রতারণা মিথ্যা কল্পনা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হন না, তিনি কি ঈশ্বরোপাসনা করিতে পারেন? সংসারে থাকিলেই কুক্রিয়াতে রত হইতে হইবে এটি সাংসারিক লোকের ছল মাত্র।”
*********
সুলোচনা নিয়ে বিশেষ কৌতূহলের কারণ, এই উপন্যাসে বিবেকানন্দ পিতৃদেব বিশ্বনাথ কিছু ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশ্বনাথ দত্তের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমরা অন্যান্য সূত্র থেকে তেমন কিছু জানতে না পারায় সুলোচনা উপন্যাসটিই আমাদের প্রধান ভরসা।এই উপন্যাসের অন্দরমহলে প্রবেশের আগে একটা কথা স্মরণ রাখা ভাল যে লেখকের ব্যক্তিজীবন ও অভিজ্ঞতা প্রায়ই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কখনও কখনও মনে হয়, প্রত্যেক উপন্যাসই একধরনের আত্মজীবনী, কখনও লেখকের জ্ঞানত এবং প্রায়ই অজ্ঞানত। ইদানিং তাই ব্যক্তিজীবনের চাবিকাঠি খুলে উপন্যাসের অনালোকিত গর্ভগৃহে প্রবেশের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ঘটনাবলী যে উপন্যাস লেখক সরলভাবে নকল করে যান তা নয়, কখনও কখনও অতিসাবধানে লেখক তার আত্মজীবনকে লুকিয়ে রাখতেও সচেষ্ট হন। কিন্তু তার সৃষ্টিটি যেন তার ছায়া। কখনও সামনের, কখনও পিছনের, কখনও পাশের। নিষ্ঠুর সত্যটি হল কেউ কখনও তার নিজের ছায়াকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন না।
এইভাবে চিন্তা করে সুলোচনা উপন্যাসের পাঠোদ্ধার করলে কি স্বামীজির পিতামহ (দুর্গাপ্রসাদ), পিতামহী শ্যামাসুন্দরী, পিতা বিশ্বনাথ, মাতা ভুবনেশ্বরী, পিতামহের ভাই কালীপ্রসাদ, পত্নী বিশ্বেশ্বরী, তাঁদের পুত্র তারকনাথ ও পুত্রবধূকে ছায়াচিত্রর মতন খুঁজে পাওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, বহু উপন্যাস সত্যঘটনার কার্বন কপি না হয়েও, প্রকৃত ঘটনাস্রোতের গতিরেখা নিশ্চিতভাবে এঁকে যায়।
বহুক্ষেত্রে এই ধরনের অনুমানের কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেখানে উপন্যাসের লেখক স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দর পিতৃদেব এবং দত্তদের শরিকি মামলার নথিপত্রের বাইরেও ভিটেবাড়িতে এক অদ্ভুত জীবনযাত্রা চলমান ছিল এবং যেখানে এক যুগনায়ক ভূমিষ্ঠ হয়ে শৈশব, বাল্য ও যৌবন অতিবাহিত করেছিলেন সেখানে ভক্তদের, অনুরাগীদের ও দুনিয়ার সংখ্যাহীন মানুষের সীমাহীন কৌতূহল নিতান্ত স্বাভাবিক। এই কারণেই বিবেকানন্দ-অনুরাগীরা ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পটভূমি, চরিতাবলী ও ঘটনাবলী বারবার খুঁটিয়ে দেখবেন।
নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশে তার পারিবারিক স্মৃতি অবগাহন করতে করতে একবার বলেন, তাঁর পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের বিবাহ হয়েছিল তিন বছর বয়সে শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে। এঁদের জ্যেষ্ঠা সন্তান একটি কন্যা, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। পরবর্তী সন্তান বিশ্বনাথের জন্ম ১৮৩৫। বিশ্বনাথের বিবাহ যে যোলো বছর বয়সে হয়েছিল একথাও নিবেদিতার এই পত্রে উল্লিখিত হয়েছে। স্ত্রীর বয়স তখন দশ।
গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তরা বংশানুক্রমে আইনব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্বামীজি কথায় কথায় বলতেন, আমাদের সাতপুরুষ উকিল। পিতামহ রামমোহন ছিলেন তখনকার সুপ্রিমকোর্টের ফার্সী আইনজীবী। এই পেশায় তিনি যে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন তার প্রমাণ তার বিশাল সম্পত্তিসালকিয়ায় দুটো বাগানবাড়ি, খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা। বিধির খেয়ালে এই সালকিয়ার লাগোয়া বেলুড়েই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে কলেরায় রামমোহনের অকাল মৃত্যু হয়। সেকালের কলকাতায় দারুণ গ্রীষ্মে অশোধিত জল খেয়ে কলেরায় অকালমৃত্যু কোনো নতুন ঘটনা নয়।
রামমোহনের বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদও প্রথম জীবনে এটর্নি অফিসে কাজ করতেন এবং পরবর্তীকালে কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়। ভিটেবাড়িতে তখনই শরিকী টেনশন যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
ভূপেন্দ্রনাথের কথায় : “দুর্গাপ্রসাদ ফার্সী ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তিনি উত্তর কলকাতানিবাসী দেওয়ান রাজীবলোচন ঘোষের কনিষ্ঠা কন্যা শ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করেন। শ্যামাসুন্দরী বাংলাভাষায় বিদুষী ছিলেন। তার হস্তাক্ষর ছিল খুব চমৎকার। তিনি ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিণী’নামে একটি সুবৃহৎ বাংলা কাব্যও রচনা করেছিলেন।” রূপবতী শ্যামাসুন্দরীর প্রথমা কন্যাটি সাত বছর বয়সে মারা যায়।
এই গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনীর পাণ্ডুলিপি বিশ্বনাথ অনেকদিন সযত্নে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু রায়পুরে সংসার নিয়ে যাওয়ার সময় এই মূল্যবান সংরক্ষণটি নষ্ট হয়ে যায়। এইভাবে দত্তপরিবারের আরও কত সংগ্রহ অদৃশ্য হয়েছে তার হিসেব নেই।
তখনকার দত্তভিটের একটা অন্তরঙ্গ ছবি ভূপেন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন। “মনে হয় বিধবা বোন যিনি স্বামীর উইলের অধিকারিণী ছিলেন, তিনিই ছিলেন সংসারের কী। যে কারণেই হোক তিনি আমার পিতামহীকে ভাল চক্ষে দেখতেন না।”
শ্যামাসুন্দরী একবার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি এলে রায়বাঘিনী ননদিনী হুকুম দিলেন, পাল্কি হটাও। বিশ্বনাথ জননীকে তখনই বাপের বাড়ি ফিরতে হয়। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “স্ত্রীর এই অপমান দেখে দুর্গাপ্রসাদ বসতবাড়ি ত্যাগ করে চলে গেলেন। পরে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন।”
কালের ব্যবধান অমান্য করে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের স্মৃতি আজও স্বামীজির ভিটেবাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আগন্তুক তীর্থযাত্রীরা এখন জানতে চান, বাড়ির কোন ঘরে একসময় সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদকে শেষবারের মতন বন্দি করে রাখা হয়?
কাহিনীটা এই রকম : উত্তর ভারত থেকে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টাটু ঘোড়ায় চড়ে কলকাতায় আসতেন। থাকতেন তার ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে, এই বাড়িটি একসময় তিনিই ভিক্ষাপুত্রকে দান করেছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, মতের পরিবর্তন হতে পারে এই আশায় ভ্রাতা কালীপ্রসাদ একবার তার সন্ন্যাসী ভাইকে ভিটেবাড়িতে এনে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখেছিলেন।
ফল ভাল হয়নি, বন্দি দুর্গাপ্রসাদ তিন দিন ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগলেন দরজা খুলে দেবার জন্য। এক সময় তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা শঙ্কিত হয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে বললেন।
বিশ্বনাথ দত্তের বাবা সেই যে গৃহত্যাগ করলেন, আর কখনও দত্ত বাড়িতে ফেরেননি। শোনা যায়, গৈরিক গ্রহণের পর বিদেশেযাত্রার আগে পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দকেও ভিটেবাড়িতে পদার্পণ করতে দেখা যায়নি। মা ও দিদিমাকে দেখতে তিনি যেতেন ৭ রামতনু বোস লেনের বাড়িতে, এই রামতনু বসু ছিলেন দিদিমা রঘুমণি দাসীর পিতামহ।
*********
সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদ কলকাতায় এলে বালক বিশ্বনাথ তার সঙ্গে দেখা করতে পিতার ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে যেতেন।বলাবাহুল্য দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও স্বগৃহে আসেননি।দুর্গাপ্রসাদের কোষ্ঠিতে একটি ইঙ্গিত পরিবারের মধ্যে বিশেষ আশা জাগিয়েছিল, জাতক ৩৬ বছর বয়সে গৃহে ফিরে আসবেন। অত্যন্ত বিস্ময়ের কথা, ঠিক ঐ বয়সেই দুর্গাপ্রসাদ পরিবারের জনৈক সভ্যের হাত দিয়ে তার ভিক্ষাপাত্র ও জপমালা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এই লক্ষণ দেখে প্রতিবেশীরা শ্যামাসুন্দরীকে পরামর্শ দিলেন, দুর্গাপ্রসাদের মধ্যাহ্নিক শয়নের সময়ে গিয়ে তাঁর পদসেবা করতে।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও নায়কের বিদেশযাত্রার পূর্বে স্ত্রীর পদসেবার একটি মনোগ্রাহী ছবি এঁকেছেন বিশ্বনাথ। শ্যামাসুন্দরীর ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামীর সেবা প্রচেষ্টার ফল মোটেই ভাল হয়নি। পারিবারিক বর্ণনাটা এইরকম : “শ্যামাসুন্দরী স্বামীর ঘরে গিয়ে তাঁর মশারি তুলে পদসেবা করবার চেষ্টা করতেই দুর্গাপ্রসাদ চীৎকার করে বলে উঠলেন, চণ্ডালী আমাকে স্পর্শ করেছে। একথা বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর আর তিনি দেশে আসেন নি।”
যে রায়বাঘিনী ননদিনীর হাতে দুর্গাপ্রসাদের পত্নী শ্যামাসুন্দরী প্রায়ই নিগৃহীতা হতেন তার সূত্র ধরেই দত্তদের ভিটেবাড়িতে নানারকম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটে।
রামমোহনের এই কন্যাটির বিয়ে হয়েছিল খুবই বড়লোকের বাড়িতে। একদিন পুকুরে স্নান করতে যাবার সময় জামায়ের সঙ্গে এক গণকের দেখা হলো। এই গণকটি ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন, সর্পদংশনে শীঘ্রই তার মৃত্যু হবে। সময় নষ্ট না করে নিরুপায় জামাতা সামনের এক কুমোরের দোকানে গিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা মাটির হাঁড়ি কিনলেন এবং আর কিছু না পেয়ে সেই হাঁড়ির ওপরে উইল লিখলেন যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি পাবেন তার বালবিধবা।
বিধির বিধানে জামাতা সত্যিই হঠাৎ মারা গেলেন। শোকাহত রামমোহন তখন সদ্যবিধবা কন্যা, মাটির হাঁড়িতে লেখা উইলটি ও কন্যার শ্বশুরবাড়ির শালগ্রামশিলাটি নিয়ে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়িতে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মধ্যে বারুইপুরের চৌধুরীরা প্রয়াত জামায়ের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আদালতে মামলা করলেন।
এই মামলা চলেছিল তিন প্রজন্ম ধরে এবং শেষপর্যন্ত রামমোহনকন্যারই জয় হয়েছিল। কিন্তু মামলার খরচ সামলাতে গিয়ে লাখ টাকার সম্পদ কমতে কমতে যোলো হাজার টাকায় দাঁড়ায়।
উইল বা পারিবারিক সম্পত্তির পার্টিশন মামলায় সেকালের কলকাতায় এরকম আর্থিক সর্বনাশই হতো। উইল করা সম্পর্কে বিশ্বনাথ দত্তের ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে সুন্দর একটি দৃশ্য আছে। সেখানে উইলের চমৎকার বাংলা করা হয়েছে ‘মানসপত্র’–এই শব্দটির বদলে এখন সাধারণত আমরা ব্যবহার করে থাকি ইচ্ছাপত্র।
দুর্গাপ্রসাদ সংসার ত্যাগ করার পরে সংসারের প্রধান হলেন তার ছোটভাই কালীপ্রসাদ দত্ত। এঁর পত্নীর নাম বিশ্বেশ্বরী, ইনি জয়নগর ২৪ পরগনার মেয়ে। কালীপ্রসাদের নিজস্ব উপার্জন ছিল না, রোজগারের একমাত্র সূত্র দত্ত পরিবারের সম্পত্তির থেকে আয়। খাজনা এবং ভাড়া থেকে চলতো দুর্গাপ্রসাদহীন সংসার।
যথাসময়ে দত্ত ভিটেতে আরও একটি আইনি সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সেকালের হিন্দু আইন অনুযায়ী সন্ন্যাসীদের পারিবারিক সম্পত্তির কী অবস্থা হবে? হিন্দু আইন মতে কেউ বারো বছর নিরুদ্দিষ্ট থাকলে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আদালতের আদেশে তাকে মৃত ঘোষণা করা যায়। স্বামীজির পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের ক্ষেত্রেও এই পথ অনুসরণ করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই মামলাটির কাগজপত্র এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
সিমলে দত্ত পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের স্পষ্ট অভিযোগ, কালীপ্রসাদ তার সন্ন্যাসী দাদার ছেলেকে তেমনভাবে দেখাশোনা করেননি, ফলে অত্যন্ত অযত্ন ও অবহেলায় বিশ্বনাথের ছোটবেলা কেটেছিল।
ভূপেন্দ্রনাথ অবশ্য তার বাবার ধনবান মামার বাড়ির কিছু খবরাখবর আমাদের দিয়েছেন। শ্যামাসুন্দরীর পিতৃদেব সেকালের ডাকসাইটে ব্যক্তিত্ব রাজীবলোচন ঘোষ ছিলেন ভারত সরকারের তোষাখানার দেওয়ান। এঁর আর্থিক সমৃদ্ধি সম্বন্ধে ছড়া ও গান নাকি একসময় প্রাচীন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় লোকের মুখে মুখে ফিরত।
ছ’বছর বয়সে দুর্গাপূজার সময় মামার বাড়িতে গিয়ে বিশ্বনাথ নাকি চরম অপমানের পাত্র হন। তাঁর জামাকাপড় ভাল না থাকায়, বালকটি যে এবাড়ির ভাগ্নে তা কয়েকজন অভ্যাগতর কাছে মামার বাড়ির লোকরা চেপে গিয়েছিলেন। নিদারুণ মনোকষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বালক বিশ্বনাথ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন এবং শোনা যায় এরপর তিনি আর কোনোদিন মামার বাড়িতে পা দেননি।
*********
কাকা কালীপ্রসাদ ও বিশ্বনাথ জননী সম্পর্ক সম্বন্ধে এত কিছু বলার কারণ, ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে সেকালের যৌথপরিবারের নিজস্ব উপার্জনহীন কর্তা ও তাঁর ভ্রাতৃবধুর বেশ কিছু বিস্ময়কর ছবি আছে। তফাত এই, সুলোচনার স্বামী সংসারত্যাগী নন, ভাগ্যসন্ধানে ও কর্মসূত্রে তিনি বাংলা থেকে বেশ দূরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। উপন্যাসের নায়ক সেকালের প্রথা অনুযায়ী নিজের স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেননি। যাঁরা দত্তভিটের তখনকার সাংসারিক ছবিটি মাথায় রাখবেন, তাদের মনে হতে পারে, উপন্যাস লেখক বিশ্বনাথ দত্ত কি তার কাকা কালীপ্রসাদ ও জননী শ্যামাসুন্দরীর বিচিত্র ঘটনাগুলি পরবর্তীকালেও বিস্মৃত হননি?সংসারত্যাগী দাদার নিঃসহায় স্ত্রী-পুত্রর সঙ্গে ভাই কালীপ্রসাদ কী ধরনের ব্যবহার করেছিলেন তার আরও কিছু বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। কালীপ্রসাদ একবার মামলার খরচ চালানোর জন্যে ভ্রাতৃবধূ শ্যামাসুন্দরীর বেশ কিছু গহনা নিয়ে গিয়ে দোকানে বন্ধক রেখে নগদ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন।
বিবেকানন্দ-পিতার উপন্যাসে এমন একটি দৃশ্য আছে যেখানে উপার্জনহীন গৃহকর্তা তাঁর ভ্রাতৃবধুর গহনা চাইছে। দত্ত ভিটেবাড়িতে গহনা বার করে দেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য অত সহজ হয়নি। শ্যামাসুন্দরী যখন গহনা ফেরত দেবার জন্যে চাপ দিতে লাগলেন তখন অনন্যোপায় কালীপ্রসাদ বালক বিশ্বনাথের নামে কয়েকটি তালুক লিখে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, চোদ্দ বছরের বালক বিশ্বনাথকে লাঠিয়াল সহ তালুকের দখল নিতে যেতে হয়েছিল। পরে দেখা গেল তালুকসংক্রান্ত দলিলে বহু গোলমাল আছে।
কালীপ্রসাদের লোভ ও বোকামির শেষ ছিল না। এই বাড়িতে ভূবনেশ্বরীর বিয়ের আগে কালীপ্রসাদ এক ভণ্ড তান্ত্রিকের খপ্পরে পড়েছিলেন। তিনি নাকি কয়লাকে হিরেয় রূপান্তরিত করতে পারেন কিছু পয়সা পেলে। কালীপ্রসাদ দত্ত সরল মনে এই অষ্টসিদ্ধ যোগীর পিছনে তখনকার দিনে আঠারো হাজার টাকা খরচ করেন।
.
বিশ্বনাথের বয়স যখন সতেরো তখন মাতামহ রাজীবলোচন ঘোষের দেহাবসান ঘটে। পিতৃসান্নিধ্যে বঞ্চিত নাতিকে তিনি একটি বাগানবাড়ি লিখে দিয়ে যান, কিন্তু কিছুদিন পরেই বিশ্বনাথের বড়মামা বাড়িতে এসে ভাগ্নের কানে কানে কী বললেন, বিশ্বনাথ সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পত্তি মামাকে লিখে দিলেন।
পরবর্তী সময়ে স্বামীজির মা অল্পবয়সী স্বামীর এই কাজকে সমর্থন করতেন। তার ধারণা ছিল, মামাকে লিখে না দিলে, দত্তবাড়ির শরিকরা এই সম্পত্তি বিশ্বনাথের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন।
মধু রায় লেনে সিমুলিয়ায় দত্তপরিবারের একটা যৌথ সম্পত্তি ছিল। কালীপ্রসাদের অনুরোধে বিশ্বনাথ এই সম্পত্তিতে তার ভাগটা কাকাকে লিখে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই ভূবনেশ্বরী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে সব সম্পত্তি লিখে দিলে নিজের ছেলে, মেয়ে, বউয়ের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিন্তু সংসারবিরাগী বাবার অনুপস্থিতিতে যে কাকা তাকে ছোটবেলায় মানুষ করেছেন তার প্রতি বিশ্বনাথের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন। ছোট বয়সে যিনি আমাকে দেখেছেন তিনি চাইলে দেহের মাংস পর্যন্ত কেটে দিতে পারি, এই হল কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথের মনোভাব।
কাকার দেহাবসান পর্যন্ত বিশ্বনাথের এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে তিনি বড়ছেলে নরেনের কাছে নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখেননি, গভীর দুঃখের সঙ্গে তিনি বর্ণনা করতেন, কাকা এবং তার পরিবারের কাছে তিনি কীভাবে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পাঠক বসুপরিবারের তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠ ভজহরির মধ্যে সিমুলিয়ার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের কালীপ্রসাদকে খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
*********
বিশ্বনাথ দত্তের উপন্যাসটি একটি কায়স্থ পরিবারকে কেন্দ্র করে। এই উপন্যাসের প্রথম পুরুষ কেনারামও অনেকটা দত্ত পরিবারের রামমোহনের মতন। ইনিও ছিলেন আধা-উকিল। উপন্যাসের কেনারাম আইনের ব্যাপারে কখনও কাউকে কুপরামর্শ দিতেন না, কেউ এমন কথা বলতে পারত না যে কেনারামের পরামর্শে তার ক্ষতি হয়েছে। এই কেনারামও রামমোহনের মতন বুদ্ধি ও কৌশলে নিজের পৈতৃক ভদ্রাসনের সুবিস্তার ঘটিয়েছিলেন।আরও এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য। দত্তপরিবারের প্রথম চারপুরুষ সকলেই রাম রামনিধি, রামজীবন, রামসুন্দর, রামমোহন। আর বিশ্বনাথের লেখা উপন্যাসের আদিচরিত্র কেনারাম ও প্রধান চরিত্র রামহরি।
পিতৃদেব কেনারাম বসুর আশি বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জমিজমা বাগবাগিচা ও তালুক ছাড়াও নগদ নিতান্ত কম ছিল না। তাছাড়া সম্পত্তির বাৎসরিক আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা এমন এক সময়ে যখন বাৎসরিক চার হাজার টাকা আয়ের লোকরা নিজেদের বড়মানুষ বলে গণ্য করতেন।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের মধ্যে লেখক বিশ্বনাথ দত্ত লুকিয়ে আছেন? উপন্যাস শেষ করে পাঠক-পাঠিকারা অবশ্যই তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন। আপাতত বলা যেতে পারে, একটি নয়, দুটি চরিত্রে তার ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলি বারবার উঁকি মারছে। একটি অবশ্যই নায়ক রামহরি–সেই চরিত্রে আছে তার জীবনসংগ্রাম ও নানা সংঘাত। গল্প একটু এগোলেই কিন্তু মনে হয়, রামহরির একমাত্র সন্তান সুরথনাথের মধ্যেও লেখক বিশ্বনাথ উঁকি মারছেন। বিশ্বনাথের বাল্য, যৌবন ও জীবনসায়াহ্নের ঘটনাবলি একটু বিস্তারিত জানা থাকলে চরিত্ৰবিচার সহজতর হতে পারে।
*********
বাল্যে বিশ্বনাথের লেখাপড়া নিয়ে দত্ত পরিবারের কেউ তেমন মাথা ঘামাননি। পাড়াপড়শিদের প্রশ্নে ধৈর্যহীন হয়ে নিজের মুখরক্ষার জন্য অনাথ ভ্রাতুস্পুত্রকে অবশেষে কালীপ্রসাদ পাঠিয়েছিলেন আজকের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, সেকালে যার নাম ছিল গৌরমোহন আঢ্যর স্কুল। বালকটির জুতো ছিল না, খালিপায়ে প্রতিদিন সিমলা থেকে আহিরিটোলায় যাতায়াত করতে হত। এক মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, জুতো নেই কেন?সরলমনে গরিব ছেলেটি উত্তর করল, “আমার বাবা বারাণসীতে থাকেন। তিনি আমার জন্যে জুতো পাঠাবেন। এখনও জুতো আসেনি, এলেই পরবো।” আমরা জানি পিতা দুর্গাপ্রসাদ তখন বারাণসীতে মঠাধীশ। গৌরমোহন আঢ্যের ইস্কুলেই বিশ্বনাথের শিক্ষক ছিলেন রসিকচন্দ্র চন্দ্র। বিধির বিধানে পরবর্তীকালে এঁরই পুত্র কালীপ্রসাদ চন্দ্র স্বামী অভেদানন্দ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কালীবেদান্তি ছিলেন স্বামীজির প্রিয়বন্ধু ও গুরুভাই। স্বামীজি তাঁর এই গুরুভাইকে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য আহ্বান করেছিলেন।
‘জুনিয়র’ ও ‘সিনিয়র’ পরীক্ষা পেরিয়ে কোনো এক সময়ে বিশ্বনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, অর্থোপার্জনের জন্য বিশ্বনাথ কিছুদিন ব্যবসায়ে হাত পাকিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন সুবিধে করতে পারেননি।
পরবর্তী পর্যায়ে তার ওকালতিজীবনও আমাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যেত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তী উচ্চ আদালতের রেকর্ড ঘেঁটে কিছু আলোকপাত করে গিয়েছেন। আর আছে কলকাতা হাইকোর্টে বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আবেদনপত্র যেখানে মায়ের সঙ্গে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই আবেদনের তারিখ কলকাতায় সুলোচনা প্রকাশের প্রায় সাড়ে চার বছর পরে।
মামলা মোকদ্দমার ছায়া থেকে সিমুলিয়ার দত্তরা কখনও নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের বিষয়-সম্পত্তি অধিকারের জন্য হাইকোর্টের মামলায় দীর্ঘ বারো বছর তার কোনো সংবাদ বা সন্ধান না পাওয়ার অভিযোগে তাঁকে আইনমতে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।
কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তের সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজখবরের জন্য ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র একসময় মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হন। ফণীভূষণের ৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ তারিখের লিখিত বিবরণ সব সন্দেহের অবসান ঘটায়। ব্যাপারটা এই রকম :
আদালতের কাগজপত্রে বিশ্বনাথের ইংরিজি বানান Bisso Nath Dutt: ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি বার্নের্স পিককের কাছে এটর্নি ও প্রক্টর হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য তিনি আবেদন করেন। প্রক্টর শব্দটির আভিধানিক অর্থ মকদ্দমার তদ্বিরকারি আম-মোক্তার হিসেব অনুযায়ী পুত্র নরেন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর।
আদালতের আবেদনপত্রের বাঁদিকে লেখা হয়েছে “তাই হোক” (বি ইট সো)–যে বিচারক বিশ্বনাথের আবেদনপত্র মঞ্জুর করেন তার নাম মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। তখন কলকাতা হাইকোর্টের লেটারস্ পেটেন্ট ১৮৬২ অনুযায়ী বিচারকের সংখ্যা তেরো জন। মরগ্যান পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ জাস্টিস হন।
পিটিশনের সঙ্গে জমা দেওয়া পরীক্ষকদের সার্টিফিকেট (১২ মার্চ ১৮৬৬) থেকে দেখা যায় এটর্নি মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পল-এর কাছে বিশ্বনাথ আর্টিকেল্ড ছিলেন। এঁর নামানুসারেই সম্ভবত ৬ ওল্ড পোস্টপিস স্ট্রিটের বিখ্যাত টেম্পল চেম্বার্স ভবনের নামকরণ হয় যেখানে প্রায় এক শতাব্দী পরে আমি ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল মহোদয়ের বাবু বা ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিই।
দেখা যাচ্ছে, মিস্টার চার্লস এফ পিটারের কাছে বিশ্বনাথ দত্তের আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপের শুরু ১১ এপ্রিল ১৮৫৯–শেষ ৩১ জুলাই ১৮৬০। প্রায় ছ’মাসের ব্যবধানে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) তিনি আর্টিকেল হন মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পলের কাছে। এই বিখ্যাত এটর্নির অধীনে তিনি থাকেন ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত। এটর্নি হিসেবে নথীভুক্ত হবার আবেদনের সঙ্গে দুটি চরিত্র সার্টিফিকেট (দুটিরই তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫) দেন শ্রী গ্ৰীশ (গিরিশ) চুন্দার (চন্দ্র) বনার্জি ও শ্রী দিগম্বর মিটার। এই গিরিশই পরবর্তীকালে বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বনার্জির পিতৃদেব। দিগম্বর মিটার পরে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণের রিপোর্টে পরলোকগত বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর (Bhubannessary Dassee) ১১আগস্ট ১৮৮৬র লেটারস অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদনের বিবরণ আছে। এই আবেদনপত্রে সম্মতি জানিয়ে সই করেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
পরের দিনই (১২ আগস্ট ১৮৮৬) এই আবেদন গৃহীত হয়। আবেদনপত্রের তিন নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে বিশ্বনাথের বিধবা ছাড়া তিন পুত্রসন্তান রয়েছে, এদের নাম নরেন্দ্রনাথ (২২ বছর) ও নাবালক মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথ। প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকে স্পষ্ট যে বিশ্বনাথ দত্ত কোনো উইল রেখে যাননি–তাঁর দেহাবসান হাইকোর্ট রেকর্ড অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
কলকাতা কর্পোরেশনের ডেথ রেজিস্টারে বিশ্বনাথের মৃত্যুদিন শনিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি, বয়স ৫২, মৃত্যুর কারণ বহুমূত্র রোগ, মৃত্যুকালীন বাসস্থান ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট। (পীড়ার পূর্বে নিবাস : একই।) সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কর্পোরেশন রেকর্ড অনুযায়ী মৃত্যু রেজিসট্রির তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
*********
আইনজ্ঞ হিসেবে বিশ্বনাথের কর্মজীবন সম্পর্কে নানারকম কাহিনী আজও বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে আছে। অ্যাটর্নি হওয়ার পরেই তিনি আশুতোষ ধরের সঙ্গে ধর অ্যান্ড দত্তর অংশীদার হয়েছিলেন। পরে তিনি এই যৌথ ব্যবসায়ে উদ্বিগ্ন হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।অনুসন্ধানী লেখক চিত্রগুপ্ত দত্তবাড়ির আদালতি কাগজপত্র অনেক খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পান। বিশ্বনাথ সম্পর্কে তার মন্তব্য : “আয় আশানুরূপ হলেও বেহিসেবী এবং অপরিণামদর্শী হওয়ায় তিনি দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসে, যার পরবর্তী নাম মধ্যপ্রদেশ। প্রবাসে থাকাকালীন তিনি কিছুদিন পাঞ্জাবেও ওকালতি করেছিলেন।”
১৮৭৯ সালে বিশ্বনাথ কলকাতায় ফিরে এসে আবার আইন প্র্যাকটিশ শুরু করেন। পরবর্তীকালে স্বামীজির কাকা তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী যে মামলা করেন সেই আবেদনে অভিযোগ, বিশ্বনাথ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ১৮৭১ সালের মাঝামাঝি কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর বিরুদ্ধে পাওনাদারদের কয়েকটি ডিক্রি জারির আশঙ্কায় তিনি সাত বছর প্রবাসে কাটান।
জ্ঞানদাসুন্দরীর অভিযোগের জবাবে ভূবনেশ্বরী আদালতে যে বক্তব্য দাখিল করেন তার মর্মার্থ : “আমার স্বামী বিশ্বনাথ দত্ত, এই মামলার বাদী জ্ঞানদাসুন্দরীর স্বামী তারকনাথ দত্ত এবং তারকের সহোদর ভাই কেদারনাথ দত্ত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে থেকে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন। আমার স্বামী বিশ্বনাথ শেষজীবনে কলকাতা ছেড়ে উত্তর পশ্চিম প্রদেশে চলে গিয়ে কয়েক বছর সেখানে আইনজীবীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সে সময়ে আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসতবাড়িতেই ছিলাম। আমার এবং আমার পোষ্যদের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ আমার স্বামী পাঠানে। একথা অত্যন্ত অসত্য ও অমূলক যে তারকের আনুকূল্যে আমার ও আমার ছেলেমেয়েদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হত, বিশেষ করে যখন আমার স্বামী প্রবাসে ছিলেন। তবে, একথা সত্যি যে আমার স্বামীর অনুপস্থিতে তারকনাথ সংসারের কর্তা হিসেবে আমাদের দেখাশোনা করতেন।”
বিবেকানন্দজননীর আদালতে এইসব নিবেদন বিশ্বনাথের দেহান্তের কয়েকবছর পরে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সুলোচনা’ উপন্যাসে বিশ্বনাথ এই ধরনের ছবিই এঁকেছেন। ভাই কাজের সূত্রে বিদেশ গিয়েছে, সেখানে বেশ ভাল উপার্জন করেন এবং সেই টাকা অভিভাবক দাদার কাছে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু তিনি ও তার পরিবার তা হজম করে ফেলেন। ভ্রাতৃবধূর দৈনন্দিন জীবনে কষ্টের অভাব নেই।
ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ কি মানসচক্ষে অনাগত ভবিষ্যৎকে দেখে ফেলেছিলেন? দত্ত পরিবারের বৃহৎ পারিবারিক বিরোধের বিবরণ দেওয়ার পূর্বে জ্ঞাতিদের সম্বন্ধে আরও কিছু বিবরণ সংগ্রহ করা মন্দ হবে না। দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই কিছুটা জেনেছি। কালীপ্রসাদের দুই পুত্ৰকেদারনাথ ও তারকনাথ। কেদারনাথের এক কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে দুই পুত্র (হাবুবাবু ও তমুবাবু) সঙ্গীতজগতের নামকরা ব্যক্তিত্ব। জেনে রাখা ভাল জগদ্বিখ্যাত আলাউদ্দীন খাঁ সায়েব এ বাড়িরই শিষ্য। রামকৃষ্ণভক্ত হাবুবাবু, ঠাকুরের দেহাবসানের পরে তাঁর অস্থি দিয়ে একটি জপমালা তৈরি করেছিলেন। এঁদের ছোটভাই শরৎচন্দ্র ১৬ বছরে মারা যান।
কেদারনাথের ভ্রাতা তারকনাথের স্ত্রীই পরবর্তীকালে স্বামীজির মায়ের নামে মামলা আনেন। এঁদের একপুত্র ও ছয় কন্যা। তারকনাথ একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বসত সেখানে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন। পরে বি এল পাশ করে তিনি হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তারকনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির হয়ে ওকালতি করতেন, সেই সূত্রে তার মেয়ের বিয়েতে দেবেন্দ্রনাথ ও বিখ্যাত ঠাকুররা দত্তবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে আসলে। হয়তো বাংলার যৌথপরিবারে, এমন ব্যাপার সেযুগে প্রায়ই ঘটতো।
ভুক্তভোগী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত দুঃখ করেছেন, “পারিবারিক কাহিনীর গোপন তথ্য এখানে প্রকাশ করবার উদ্দেশ্য, হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যক্ত করা। যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার প্রথার পবিত্রতা সম্পর্কে গলাবাজি করে থাকেন তারা হয় এর বাস্তব অবস্থার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন, নতুবা পারিবারিক কলহ বিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী উপেক্ষা করে থাকেন। ব্যবসায়িক ও শিল্পনীতিক সমাজে এই প্রথা এখন অচল। বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালুরাখার সপক্ষে কোন কারণই থাকতে পারে না।”
সিমুলিয়ার দত্তবাড়ির অবস্থান কলকাতার ছয়ের পল্লীতে, যাকে বাংলার এথেন্স বলা হতো। কারণ যথেষ্ট। এই এথেন্সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রমেশচন্দ্র দত্ত, তরু দত্ত, অরু দত্তর জন্ম। পুরো উত্তর কলকাতা ধরলে এক সহস্র নামেও বিশিষ্টদের তালিকা শেষ হবে না। দত্তদের বংশে বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য : নরেন্দ্রনাথের পিতৃপুরুষের বংশে প্রভূত বিত্তশালী, সন্ন্যাসী, সরকারি চাকুরে, জনকল্যাণমূলক কার্যে ও দেশ সেবায় আত্মনিয়োগকারী মহান ব্যক্তিরা জন্মেছেন। আবার সাধারণ গৃহীর বেশে কেউ কেউ গুপ্তযোগীরূপে জীবনযাপন করেছেন।”
কলকাতা হাইকোর্টে জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম ভূবনেশ্বরীর মামলার শুনানি শুরু হয় বিশ্বনাথের দেহাবসানের কয়েক বছর পরে ১৮৮৭ সালের গোড়ায়।
এই মামলায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টারের জেরার সম্মুখীন হন ৮ মার্চ ১৮৮৭।
এই মামলার বীজবপন ও ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ কীভাবে হলো তার কিছু বিবরণ রয়েছে আমার ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইয়ের প্রথম অংশে। সেই বিবরণের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
শুধু এইটুকু বলা যায় বিচারপতি ম্যাকফারসন তার রায়ে বলেন, বিশ্বনাথ, যিনি পাওনাদারদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তিনি ১৮৭৯ সালে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে যৌথপরিবারেই আশ্রয় নেন। মধ্যবর্তী সময়ে তিনি পাঞ্জাব ও মধ্যপ্রদেশে ওকালতি করেন। তবে প্রমাণিত হয়েছে, প্রবাসে উপার্জনকালে বিশ্বনাথ দত্ত তাঁর স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। এই মামলায় বিতর্কিত বিষয় সম্পত্তি জ্ঞানদার স্বামী তারকনাথ কি তাঁর ভ্রাতৃবধূ ভূবনেশ্বরীর বেনামীতে কিনেছিলেন অথবা তা বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরী নিজেই কিনেছিলেন তার স্বামী বিশ্বনাথের পাঠানো টাকায়? শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়, জ্ঞানদাসুন্দরী তার অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যাঁরা এই মামলা সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চান তারা জেনে রাখুন, তারকনাথের একটি চিঠি তাঁর স্ত্রীর মামলাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই চিঠিতে তারকনাথ নিজেই পরিবারের একজনকে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, “শরিকী সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।”
আরও প্রমাণ হয়, ১৮৭৯ সালে কেনা সম্পত্তি কালেকটরেট অফিসে নথিভুক্ত করার সময় তারকনাথ সানন্দে ভূবনেশ্বরীর হয়ে আদালতে উকিলের কাজ করেছিলেন। পরের বছর অবশ্য ভূবনেশ্বরী তার স্বামীকেই অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেছিলেন।
এই পরবর্তী সময়টি ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পক্ষে খুবই মূল্যবান। সম্ভবত এই সময়েই ‘সুলোচনা’ রচিত হয়। ভূপেন্দ্রনাথ ভুল করে বলেছেন, বইয়ের প্রকাশকাল ১৮৮০। আসলে উপন্যাসের প্রকাশের বছর ১৮৮২।
১৪ মার্চ ১৮৮৭ আদালতের রায়ে পরাজিত হয়ে জ্ঞানদাসুন্দরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ আপীল আদালতে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রেখে দিলেন।
এই মামলা চলার সময় টানা একবছর নরেন্দ্রনাথকে নিয়মিত কলকাতা হাইকোর্টে ছুটতে হয়েছিল। শোনা যায় তিনি পায়ে হেঁটে হাইকোর্টে যেতেন এবং পরে মায়ের কাছে সবিস্তারে সব ঘটনার বিবরণ দিতেন। আমাদের এই দেশে মহামানবরা সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও পার্থিব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেন না। এই ১৮৮৭ সাল সন্ন্যাসী ও সাধক বিবেকানন্দর জীবনে স্মরণীয় সময়। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বিরজাহোম করে নরেন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম সন্ন্যাস নাম বিবিদিষানন্দ গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরের কোনোসময় চিরতরে গৃহত্যাগ করেন।
*********
বিশ্বনাথের উপন্যাসে বড় ভাই অনেকটা দত্তবাড়ির উপার্জনহীন কর্তা কালীপ্রসাদের মতন।যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনা : “কালীপ্রসাদ একদিকে ছিলেন অমিতব্যয়ী, অপরদিকে তেমনি ভ্রাতুস্পুত্র বিশ্বনাথের আয়ের উপর রাখিতেন পূর্ণ দাবি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি তিনি তো নষ্ট করিতেনই, অধিকন্তু বিশ্বনাথের অর্থেও ভাগ বসাইনে। শেষদিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁহার কলিকাতার এটর্নি অফিসের উপর নজর রাখিতে পারিতেন না। জনৈক বন্ধুর উপর উহার ভার অর্পণ করিতে বাধ্য হন। বন্ধু এই সুযোগে বিশ্বনাথবাবুর নামে ঋণ করিয়া সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করিতে থাকেন। …বিশ্বনাথের জীবনসন্ধ্যায় যৌথপরিবারে মনোমালিন্য বর্ধিত হওয়ায় তাহাকে বাস্তুভিটা ছাড়িয়া স্ত্রীপুত্রসহ পৃথক অম্নের ব্যবস্থা করিতে হয় এবং তজ্জন্য অস্থায়ীভাবে ৭ নং ভৈরব বিশ্বাস লেনের এক ভাড়াবাড়িতে চলিয়া যাইতে হয়। নরেন্দ্র তখন (১৮৮৩) বি. এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। …ইহারই কোন এক সময়ে তিনি পিতার আদেশে পিতৃবন্ধু নিমাইচন্দ্র বসু মহাশয়ের অফিসে এটর্নির কাজ শিখিবার জন্য শিক্ষানবিশরূপে ভর্তি হইয়া প্রতিদিন পিতা ও খুল্লতাতের সহিত অফিসে বাহির হইতে থাকেন।”
ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য আরও স্পষ্ট। “কাকা ও কাকীমার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে” একান্নবর্তী পরিবার থেকে ছিন্ন হওয়ার কোন ইচ্ছা বিশ্বনাথের ছিল না। তাই ভূবনেশ্বরীর প্রতি অন্যায় ও অসম ব্যবহার চলল দীর্ঘদিন।
বিশ্বনাথের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পূর্বে কাকার পরিবার সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে তাঁকে পৃথক করে দেন। পৃথক হবার পর আমাদের পরিবার সাময়িকভাবে ৭নং ভৈরব বিশ্বাস লেনে বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করেন। সেখানে থেকেই নরেন্দ্রনাথ বি এ পরীক্ষার জন্য পড়া তৈরি করেছিলেন।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কাহিনীতে যে অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা আছে তা এখানে ফাস করে সাসপেন্স নষ্ট করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। তবু মূল গল্পের পটভূমির আরও একটু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
কিন্তু তার আগে বিশ্বনাথের জীবনের অন্তিমপর্ব ও তার থেকে তার স্ত্রীপুত্রদের দুঃখজনক শিক্ষা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।
অভিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন বিশ্বনাথ, তার খ্যাতি এতোই ছিল যে দেহাবসানের কিছু আগে হায়দ্রাবাদের নিজামের এজেন্টরা একটা মামলায় বিশ্বনাথকে হায়দ্রাবাদে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন। “স্থির হয়েছিল যে, তিনি মাঘমাসের শেষে হায়দ্রাবাদে রওনা হবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।”
বাংলার বাইরে থাকাকালে বিশ্বনাথ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হন–পরবর্তীকালে স্বামীজিও এই ব্যাধির শিকার হন।
আমাদের ধারণা স্বামীজির এই রোগ আমেরিকায় ধরা পড়েনি, তার ডায়াবিটিস ধরা পড়ে প্রথমবার দেশে ফেরার পথে কলঘোয়। কিন্তু রোমা নোলাঁর মতে স্বামীজির ডায়াবিটিসের লক্ষণ দেখা যায় সতেরো-আঠারো বছর বয়সে। তবে স্বামী গম্ভীরানন্দর সিদ্ধান্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ ক্লাশে পড়ার সময় তার প্রায়ই ম্যালেরিয়া হতো। প্রমাদাস মিত্রকে নরেন বাবাজী সম্পর্কে লেখা একখানি চিঠিতে ‘পুরনো রোগের উল্লেখ থেকে গবেষক শৈলেন্দ্র নাথ ধরের আশঙ্কা ইঙ্গিতটা ডায়াবিটিসের দিকে।
যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে বিশ্বনাথের অন্তিমপর্বের বর্ণনা এই রকম : “মৃত্যুর একমাস পূর্বে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী শয্যাগ্রহণ করেন। ইহার পরেই একটি কার্যস্থলে যাইতে হয়। সেখান হইতে ফিরিয়া পত্নীকে বলেন যে, মক্কেল তাঁহাকে বহুদূরে আলিপুরে দলিলপত্র দেখাইতে লইয়া গিয়াছিল, তিনি হৃদয়ে বেদনা অনুভব করিতেছেন। অতঃপর রাত্রে আহারের পর বুকে ঔষধ মালিশ করাইয়া তামাক সেবন করিতে করিতে তিনি কিছু লেখাপড়ার কাজে মন দেন; নয়টায় উঠিয়া বমি করেন এবং তারপরেই রাত্রি দশটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়।”
স্বামীজির ইংরিজি জীবনী গ্রন্থ ‘দ্য লাইফ’-এ বলা হয়, বি এ পরীক্ষার ফল বেরুবার আগে পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু হয়। শৈলেন্দ্রনাথ ধর অনুসন্ধান করে জানিয়েছেন বিশ্বনাথের মৃত্যুর অন্তত তিন সপ্তাহ আগে বি এ পরীক্ষার ফল বের হয়। ঐ বছর বি এ পরীক্ষা শুরু ৩১ ডিসেম্বর ১৮৮৩, গেজেটে ফল প্রকাশ ৩০ জানুয়ারি ১৮৮৪। বিশ্বনাথের দেহাবসান ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।
অভিজ্ঞ আইনজীবী হয়েও বিশ্বনাথ কোনো উইল করেননি। ফলে মক্কেলদের কাছ থেকে পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্যও ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সময় ও অর্থব্যয় হলেও এর একটা সুবিধা আমরা পেয়েছি, হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদনপত্রে ভূবনেশ্বরী দাসীর বাংলা স্বাক্ষর এবং তার তলায় ইংরিজিতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের স্বাক্ষরের অমূল্য দলিলটি, যা আজও কলকাতা হাইকোর্টে সংরক্ষিত আছে।
১১ আগস্ট ১৮৮৬তে লেটার্স অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের এই আবেদনে ভূবনেশ্বরী বলেন, মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামী কোনো উইল করেননি। এইরকম কোনো দলিল তার অফিসে বা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই আবেদনের সময় নরেন্দ্রনাথের বয়স বাইশ, অন্য দুই ভাই নাবালক। বিশ্বনাথের কয়েকজন মক্কেল যাঁদের কাছে টাকা পাওনা আছে তাদের নাম ঠিকানার বিবরণ এই আবেদনে আছে। তাদের নিয়ে কোনো অনুসন্ধান আজও হয়নি।
আবেদনপত্রে মায়ের বাংলা স্বাক্ষর সনাক্ত করে পুরো নাম সই করেন নরেন্দ্রনাথ। জানান, মায়ের দরখাস্ত তিনি পূর্ণ সমর্থন করছেন। এই মামলায় ভূবনেশ্বরীর অ্যাটর্নি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাস, ভুবনেশ্বরীকে সনাক্ত করেন কালীচন্দ্র দত্ত এবং ইংরিজি অনুবাদের বাংলা ব্যাখ্যা করে শোনান অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, ইনটারপ্রেটার।
*********
ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ সুলোচনার উপাদান কতখানি নিজের পরিবার থেকে সংগ্রহ করেছেন? নায়কের আদিপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে মূলগায়িন’ বলে একটি শব্দ বিশ্বনাথ ব্যবহার করেছেন।দত্তরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে, চলতি ভাষায় কোথাও দেরেটোন, কোথাও দাড়িয়াটোন। দরিয়াটোনার দত্তরা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত, দক্ষিণ-রাঢ়ী কায়স্থদের যে ত্রিশটি সমাজ ছিল দরিয়াটোনার দত্তরা তাদের অন্যতম। কোনো নবাব বাহাদুর প্রীত হয়ে গ্রামের নাম দত্ত-দরিয়াটোনা বলে ঘোষণা করেন। স্বামীজির পূর্বপুরুষ রামনিধি এই দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় এসে গড়-গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করেন।
বিশ্বনাথের উপন্যাসের নায়ক রামহরির ঠিকানা : শৰ্ষা গ্রাম, জয়পুর পরগণা, জেলা নবদ্বীপ। আদিপুরুষ কেনারাম বসু, যাঁর সম্বন্ধে পাঠক পাঠিকারা ইতিমধ্যেই কিছুটা জানতে পেরেছেন। কেনারামের একটি উক্তি থেকে লেখকের মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করা যায় : “বাপের নাম জানিনে। পিতামহের নাম জানিনে কিন্তু চিনের বাদশার চোদ্দপুরুষের পরিচয় জানবার জন্য ব্যগ্র!”
কেনারাম বসুর জ্যেষ্ঠপুত্ৰ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ভজহরি তেরোটি পুত্রকন্যার পিতা। নায়ক রামহরি দ্বিতীয়পুত্র, তার একটি মাত্র সন্তান সুরথনাথ। অসামান্যা স্ত্রী সুলোচনার নামেই উপন্যাসের নামকরণ। সুলোচনার পিছনে কি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী উঁকি মারছেন? না বিশ্বনাথ জননী শ্যামাসুন্দরী? ব্যক্তিজীবনে শ্যামাসুন্দরীর একটি মাত্র পুত্র; ভূবনেশ্বরী চারপুত্র ও ছয়কন্যার জননী।
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে নায়ক রামহরি ও সুলোচনার একমাত্র পুত্র সুরথনাথ। চরিত্রটির ওপর লেখক সব ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে পৈত্রিক বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রেখে রামহরি বসু একদা কর্মসন্ধানে দিল্লি পাড়ি দিয়েছিলেন।
বাড়ির কর্তা ভজহরি বসু সবসময়েই এত ব্যস্ত যে “মাথা চুলকাইবার” অবকাশ হতো না। এইপ্রসঙ্গে লেখকের ব্যঙ্গোক্তি : “শয্যা হইতে গাত্রোত্থান, নিত্যক্রিয়া সমাপন, মুহুর্মুহু তাম্রকুট ধূমপান, দণ্ডে দণ্ডে তীব্র মুখব্যাদান করিয়া হায়ি তোলা ইত্যাদি কর্মসমূহ একজন পুরুষের পক্ষে সাধ্য নহে।”
বসুদের যৌথ পরিবারে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মীনশীরাম গুরুমহাশয় ও ভোলো খানসামা। মুহুরি নশীরাম কেনারামের রেখে যাওয়া সম্পত্তির দেখভাল করতেন ও পাওনা টাকা আদায় করতেন। রেগে গেলে তিনি ভজহরিকে বলতেন, “আমি না থাকলে তোমার প্রত্যহ চারকাটা মুড়ি, দুরেক চালের ভাত কোথা থেকে হবে?”
রামহরি যেমন লেখাপড়ায় পটু তেমনি নম্র ও সুশীল। সাহেবী কোম্পানিতে একটা সামান্য কাজ নিয়ে প্রবাস যাত্রার উদ্যোগ করেছিলেন।
বিদায়কালে দাদা ভজহরিকে প্রণাম করে রামহরি অন্তঃপুরে গেলেন এবং দেখলেন প্রিয়তমা ভার্যা ধুলোয় পড়ে অশ্রুনয়নে ক্রন্দন করছেন, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছেন। সেকালের বাঙালি পরিবারের যেসব পুরুষ কর্ম উপলক্ষে বিদেশ যেতেন তাদের মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি এই উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে। রামহরি তার স্ত্রীকে প্রিয়পুত্র সুরথনাথের লেখাপড়ায় নজর রাখতে বললেন, সেই সঙ্গে বললেন, “আমি দাদার কাছে টাকা পাঠাবো। আর তোমার জন্যে লুকিয়ে প্রহ্লাদ সেনের (বন্ধু) কাছেও টাকা পাঠাব।”…বন্ধুর বিধবাভগ্নী “ক্ষমাদিদি এসে তোমার হাতে টাকা দিয়ে যাবে।”…পত্নী সুলোচনা আবার ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
প্রবাসে রামহরি যে কাজ করতেন তার মাইনে তেমন বেশি নয়। নায়ক ভাবছেন, এতো কম অর্থের জন্যে কেন বিদেশে আসা? বিশ্বনাথ যে তার নিজস্ব প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এইখানে বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা স্পষ্ট।
এই সময় একদিন দিল্লির প্রসিদ্ধ বণিক রঘুরামজী কুঠিওয়ালার সঙ্গে রামহরির যোগাযোগ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশে মাড়ওয়ারি বণিকদের বাণিজ্যপদ্ধতি সম্বন্ধে অতি চমৎকার একটা ছবি বিশ্বনাথের এই উপন্যাস থেকে আমাদের বাড়তি প্রাপ্তি। সমস্ত ভারতবর্ষে রঘুরামজীর কুঠি ও কারবার, তখনকার দিনে তার অর্থের পরিমাণ চার পাঁচ কোটি, যা একুশ শতকের গোড়ায় প্রায় হাজার কোটি টাকার মতন।
ব্যবসা ছাড়াও রঘুরামজীর ছিল “সুবিস্তারিত রোকড়ের ও বেণেতি কার্য।” ধনপতি কুঠিয়ালরা সেযুগে নিজের দেশের লোক ছাড়া কাউকে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি দিতেন না বলেই আমার ধারণা ছিল, কিন্তু বিশ্বনাথের উপন্যাস থেকে স্পষ্ট হচ্ছে এঁদের দু’একজন কৃতী বাঙালি কর্মীও থাকতেন।
চাকরির ইন্টারভিউতে রঘুরামজীর কাছে রামহরির সরল স্বীকারোক্তি, যে উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হয়েছিলেন তা সিদ্ধ হবার কোনো পথ দেখছেন না
। রঘুরামজীর স্মরণীয় মন্তব্য : “বাঙালি লোক ঝাঁকে ঝাঁকে এ অঞ্চলে আসছে। এরা শুনেছি লেখাপড়া জানে, কিন্তু এদের কর্মকাণ্ড দেখলে লেখাপড়ার কোনো ফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ পঁচিশ টাকার একটা চাকরি পেলেই এরা কৃতার্থ হয়। কিন্তু দেখো আমাদের দেশের লোক এমন নয়বাঁধা মাইনের চাকরি পাবার জন্যে এরা মরে গেলেও চেষ্টা করে না। এরা সকলেই কারবার করে খায়।”
দেখা যাচ্ছে, বিশ্বনাথ বর্ণিত বাঙালির বাণিজ্যমানসিকতা দেড়শ বছর আগের ভারতবর্ষে যা ছিল একুশ শতকেও তাই রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, সঙ্গতিহীন মাড়ওয়ারিরা কুঠি থেকে চটা সুদে কুড়ি পঁচিশ টাকা কর্জ করে বাংলায় যাচ্ছেন এবং দু’বছর পরে ধারের টাকা মিটিয়ে দিচ্ছেন। তারপর উত্তর ভারতের ভাগ্যসন্ধানী বণিকদের নির্ভরযোগ্য জীবনযাত্রা বর্ণনা, কলকাতার রাস্তায় এঁরা কাপড়ের গাঁট পিঠে করে বেড়ান। এঁরাই ক্রমশ হাউসের দালাল হন, কেউ কেউ নিজে কুঠিয়াল হন।
রঘুরামজীর প্রশ্ন : “তোমরা বল কাপড় বিক্রি ও দালালি ইতর কাজ–তবে কি মনে করো সাহেবের মুনসিগিরি সম্মানের কাজ?”
যে রঘুরামজীর ব্যবসায় রামহরি অবশেষে কাজ নিলেন তা আকারে বৃহৎ। হিন্দুস্থানের এমন জায়গা নেই যেখানে তার কুঠি বা কারবার নেই। দিল্লির সদর কুঠিতে প্রায় পাঁচশত কর্মচারী।
রঘুরামজীর ব্যবসার অতি আকর্ষণীয় বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসে, যা কেবল পাঠক-পাঠিকার ভাল লাগবে তা নয়, একালের বিজনেস ঐতিহাসিকদেরও কাজে লাগবে। মাড়ওয়ারি অফিসে তথাকথিত দেশওয়ালী কর্মীরা কিরকমভাবে তাদের মনিবের পয়সা আত্মসাৎ করত তার ছবিও রয়েছে। আর আছে শেয়ানে-শেয়ানে কোলাকুলি!
একটি চমৎকার চরিত্র হুকুমাদ সুখদয়াল, মীরাটে কুঠিয়াল। এই মীরাটেই অনেকদিন পরে লেখকের প্রিয় সন্তান যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ হিসেবে নানা ইতিহাস রচনা করবেন তা কে জানত?
সেকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভাল ছিল না। আমরা দেখেছি নাগপুর থেকে রায়পুর যেতে ভূবনেশ্বরী ও সন্তানদের একমাস লেগেছিল। দিল্লি থেকে কলকাতা আসতে পঁচিশ দিন লেগে যেতো সেইসময়। ফলে গল্পের রামহরি যে সাত আট বছর বাড়ি এলেন না, কেবল চিঠি লিখলেন এবং টাকা পাঠালেন সেটা তেমন কিছু আশ্চর্যজনক নয়।
কিন্তু যৌথপরিবারে স্ত্রীপুত্রের প্রকৃত অবস্থা রামহরি জানতে পারতেন না। স্ত্রী সুলোচনার কাছ থেকে যেসব চিঠি পেতেন তা অস্পষ্ট এবং কিছু কিছু মুছে দেওয়া।
সুলোচনা ভাল বাংলা লিখতেন, অথচ চিঠিগুলো বোধ হয় অন্য কারুর হাতে পড়তে এবং তিনি লেখার ওপর চিত্রবিচিত্র কেটে দিতেন। বিশ্বনাথের উপন্যাসের এই অংশ পাঠ করলে স্পষ্ট হয়, যৌথ পরিবারে প্রোষিতভর্তৃকা ভূবনেশ্বরী কিভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন এবং সন্তানদের নিয়ে মাঝে মাঝে তার কেমন অসহায় অবস্থা হতো। আজকের যুগের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যৌথপরিবারের এই ব্যাপারটা নিতান্ত অসম্ভব এবং অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা যৌথপরিবারের ঘটনাবলি সে যুগের লেখকদের রচনা থেকে পুনরুদ্ধার করছেন তারা জানেন কোনো কিছুই সে যুগে অসম্ভব ছিল না।
সুলোচনার শুভানুধ্যায়িনী, স্বামীর বন্ধুর অগ্রজা, গ্রামের বিধবা ক্ষমা দিদির মন্তব্য : “ওমা শুনছি দশ পনেরো দিন অন্তর আঁজলা-আঁজলা টাকা পাঠায়, কিন্তু মেজো খুঁড়ির হাল দেখে কান্না পায়রুক্ষ্ম মাথা, ময়লা কাপড়–আর দিন দিন যেন পোড়া কাঠখানা হয়ে যাচ্ছে।”
একই সঙ্গে নজর দেওয়া যাক, বিদেশে কর্মরত বিশ্বনাথের যৌথ পরিবারে-ফেলে-আসা স্ত্রীর ছবি। পরবর্তীকালে পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর স্বামী বিবেকানন্দ বইতে বলেছেন, তিনি মায়ের মুখ থেকে শুনেছেন, এমন সময়ও গেছে যখন ভূবনেশ্বরীকে একটিমাত্র শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে অথচ জায়েদের পরনে যথেষ্ট কাপড় থাকতো।
ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, সেকালের অনেক অ্যাটর্নির মতন বিশ্বনাথ আদালতের নীলাম থেকে কলকাতায় সম্পত্তি ক্রয় করে তা আবার বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রত্যেক সম্পত্তিই তিনি ভূবনেশ্বরীর নামে ক্রয় করতেন।
মহেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটভাইকে বলেছিলেন, আপার সার্কুলার রোডে মানিকপীরের দরগা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পিতৃদেব কিনেছিলেন ভূবনেশ্বরীর নামে। জননী স্বয়ং তার কনিষ্ঠ পুত্রকে বলেছিলেন, কারবালা ট্যাঙ্ক রোডের দরগা থেকে প্রত্যহ তিনি পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা প্রণামী পেতেন।
বিশ্বনাথ একসময় স্ত্রীর নামে সুন্দরবনে এগারো হাজার বিঘার বিস্তৃত তালুক কেনেন। কিন্তু খুড়শ্বশুর কালীপ্রসাদ তার ভ্রাতুষ্পত্রের বধূকে বলেন ‘তোমার কি বাবার তালুক’। ভূবনেশ্বরী বেশী কথা বলতেন না। এই গালি শুনে নরেন্দ্ৰজননী সম্পত্তির পাট্টাটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। আমরা জানি, বিশ্বনাথ পরে বুঝতে পারেন তার স্ত্রীর দুঃখ, পীড়া ও বেদনা। তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে একদিন প্রকাশ করলেন অভিযোগ, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”
এসব বলা সত্ত্বেও বিশ্বনাথ যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, ফলে ভূবনেশ্বরীর কষ্ট শেষ হয়নি। কিন্তু যা ঘটবার তা ঘটল যথাসময়ে। পারিবারিক সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য কাকার পরিবার বিশ্বনাথকে পৃথক করে দিলেন। এই সময়ে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান।
প্রায় একই পরিস্থিতিতে সুলোচনা উপন্যাসের যৌথপরিবারে কী হল এবং কীভাবে জটীল সমস্যার অপ্রত্যাশিত সমাধান হল তা এখানে ফাঁস করতে চাই না, তাতে উপন্যাসপাঠের আনন্দ ও আকর্ষণ কমে যেতে পারে। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে বসে একজন কথাসাহিত্যিক যে কাল্পনিক উপন্যাস লিখছেন তার প্রায় সমস্ত উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে একই বাড়ির বাস্তবতা থেকে।
শুভার্থিনী ক্ষমা দিদি সুলোচনাকে চুপি চুপি বলছেন, “তুই বলে এই ঘর করিস, আমরা হলে এতোদিনে কাপড় ফেলে পালাতুম।”
এরপরে ক্ষমাদি খবর দিচ্ছেন, “রাম বলেছে বেশি টাকা না পাঠিয়ে তোমার নামে একখানা তালুক কিনবে।”
সুলোচনার উত্তর : “তালুকের নাম শুনে তো আমার পেট ভরবে না।…বাপের এক মেয়ে বটে কিন্তু রোজ রোজ কে আব্দার শুনবে গা! লোক বলে, তুই বড় মানুষের মেয়ে, বড় মানুষের বউ, তোর দশা এমন কেন? তোর ভাবনা কিসের? লোকে তো ঘরের কথা জানে না তা বলবো কি বলল। রোজ রোজ বাবাকে কত বলে পাঠাবো বলো–আবার তিনি মনে করেন তাঁর মেয়ে কত সুখে ভাসছে।”
বিশ্বনাথ এই ডায়ালগে রামতনু বসু লেনে নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা বলেছেন কিনা তা পাঠক-পাঠিকারা বিবেচনা করে দেখবেন। কুঞ্জবিহারী দত্তর জ্যেষ্ঠা কন্যা রাইমণি, তার স্বামী গোপালচন্দ্র ঘোষ। গোপালচন্দ্রের একমাত্র সন্তান রঘুমণি। এঁর স্বামী নন্দলাল বসুই বিশ্বনাথের শ্বশুর। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে রামহরির শ্বশুরের নাম নিধিরাম সরকার। তিনি সম্মৌলিক কায়স্থ।
ক্ষমাদিদি মারফৎ দুঃখিনী সুলোচনা তার প্রবাসী স্বামীর কাছে যে খবর পাঠিয়েছিলেন তা আমাদের এই তুলনামূলক আলোচনার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ।”যদি তিনি আমাদের জ্যাস্ত দেখতে চান একবার যেন ফিরে আসেন–তার যক্ষের ধন নিয়ে কি স্বর্গে যাবো?”
সুরসিকা মাদিদির প্রতিশ্রুতি তিনি রামহরিকে খবর পাঠাচ্ছেন– “জনকনন্দিনী ধুলোয় পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন– এইবার বুঝি সীতা ঠাকরুণ প্রাণত্যাগ করেন।”
উপন্যাসকে অবলম্বন করে বাস্তবের ছবি আঁকা অপরাধ না হলে, বিশ্বনাথ তাঁর উপন্যাসে রামহরির তরুণ পুত্র সুরথনাথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কৌতূহলের উদ্রেক করে। সুদীর্ঘকায় কিন্তু কৃষ অথচ বাহুদ্বয়ের ও উরুদেশের অস্থি স্থূল ও সবল। গৌরাঙ্গ, মস্তকটি সুগঠিত ও সুগোল। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কোমল কেশাবৃত ললাট প্রশস্ত ও সুবিস্তারিত। যুগল সুব ধনুকের ন্যায় ঘন কেশরঞ্জিত, নেত্রদ্বয় সুদীর্ঘ ও ভাসমান।…গ্রীবা সমুন্নত ও স্কন্ধদ্বয় সুবিস্তারিত, দুই বাহু লম্বমান করিলে প্রায় দুই জানু স্পর্শ করিত। সুরথনাথের বয়স বোড়শ বর্ষ। ঠিক যে বয়সে স্বয়ং বিশ্বনাথ বিবাহ করেছিলেন উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের ভূবনেশ্বরীকে।
.
উপন্যাসে বসু পরিবারের ছেলেপুলেদের নামগুলি মজার–’ছেঁড়া’, ‘ভাঙ্গা’, ‘গোঁড়া, ‘খেঁদি’, ‘ভূতী’, ‘পদী’, ইত্যাদি।
পরবর্তী পর্বে রামহরি দেশে ফিরেছেন, সুলোচনা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বলতে লাগলেন।”ছেলেটির হাত ধরে পথের ভিখারিনী হয়ে বেড়াব?”
রামহরি তখনও যৌথপরিবারে বিশ্বাস হারাননি। “দেখো মেজো বউ, লোকে তোমার কথা শুনলে বলবে তুমি ঘর ভাঙতে চাও, আর তুমি দাদার ছেলেমেয়ের হিংসা করো। না হলে তোমার কান্নাকাটির কোনো কারণই তো দেখতে পাইনে।”
বিবেকানন্দপিতার উপন্যাসের সুবিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পুত্র সুরথনাথের বিবাহবর্ণনা।
উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বিবাহ উপলক্ষে যে বেহিসেবী কাণ্ডকারখানা চলত তার হৃদয়গ্রাহী কিন্তু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এই বিবাহবাসরের সঙ্গে স্বয়ং বিশ্বনাথের বসুপরিবারে বিবাহের তুলনীয় কিছু আছে কি না তা এতদিন পরে কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়; তবে পাঠকপাঠিকারা মানসচক্ষে একটা ধারণা করে নেবার স্বাধীনতা অবশ্যই দাবি করতে পারেন।
যাঁরা কল্পনার সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে দেখবার জন্য সব সময় তেমন ব্যস্ত নন তারা বুঝতে পারবেন, নানা পারিবারিক উৎসবের ঘূর্ণিপাকে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ে অষ্টাদশ, উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি কেন অর্থসঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীজি বলেছিলেন, যারা কখনও লাখ টাকার ওপর বসলো না তারা কেমন করে বৈরাগ্যে আগ্রহী হবে?
‘সুলোচনা’ উপন্যাসে যৌথ পরিবারের নানা সমস্যা ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। লেখক নিপুণভাবে নানা ঘটনার মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন তা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব।
মূল উপন্যাসে যেমন সমস্যা আছে তেমন সমাধানসূত্রও রয়েছে। যথাসময়ে আসরে উপস্থিত হয়েছে এক সন্ন্যাসী। বাল্যকালে গৌরমোহন মুখার্জির ভিটে থেকে বেরিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসগ্রহণকারী পিতৃদেব দুর্গাপ্রসাদের কথাই কি অজান্তে বিশ্বনাথের কল্পনায় উপস্থিত হয়েছে? বড়ই কঠিন প্রশ্ন। তবে গল্প-উপন্যাসে আজও ‘উইশফুল থিংকিং’-এর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়নি। নিপুণ পাইলটের মতন আকাশচারী বিমানকে নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সন্ন্যাসীর পুত্র এবং সন্ন্যাসীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত।
আড়াইশ পৃষ্ঠার সুলোচনা’ উপন্যাস পড়া শেষ করে কোনো সন্দেহই। থাকে না ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সুলোচনা সম্বন্ধে যা লিখে গিয়েছেন তা সত্য, এই উপন্যাস স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃদেবেরই রচনা।
ভূপেন্দ্রনাথ পারিবারিক সূত্র থেকে বলেছেন, আর্থিক অনটনেই এই উপন্যাস ছাপানো হয় জ্ঞাতি কাকা গোপালচন্দ্রের নামে। কিন্তু উপন্যাস প্রকাশকাল [১৮৮২] বিবেচনা করলে আন্দাজ করা যায়, এই সময় স্বামীজির ভিটেবাড়িতে যে গৃহবিবাদ পাকিয়ে উঠছে, মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে তা পরিবারের আর্থিক সর্বনাশ অবধারিত করবে এবং তার রেশ চলবে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত।
পটভূমি হিসেবে এইটুকু বলা যায়, হাইকোর্টের আপীলে জিতেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
মামলায় হেরে গিয়েও জ্ঞানদাসুন্দরী বাড়ির অংশ অধিকার করে বসে আছেন। পরবর্তীকালে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি স্বামীজির কাছে অর্থভিক্ষা করছেন। স্বামীজি তাঁকে অর্থ না দিয়ে থাকতে পারলেন না।
৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামীজি তার বিদেশিনী অনুরাগিনী মিসেস সারা বুলকে লিখছেন : “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্যে তলে-তলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তার পক্ষের লোকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রয় করবেন, আর তা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকায় কিনি। তাদের আসল মতলব, তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না, এই বিশ্বাসে যে, আমি সন্ন্যাসী হয়ে জোর করে বাড়ির দখল নেবার জন্য কোর্টে যাব না।”
স্বামীজি অবশ্য হাল ছাড়েন নি। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন, মায়ের অপমান যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। মামলার জন্যে মঠের তহবিল থেকে তিনি ৫০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেজন্যে কিছু সমালোচনাও হয়, তবে স্বামীজি সেই দেনা শোধও করেন।
সংখ্যাহীন মামলায় জর্জরিত স্বামীজির বিধবা জননী ভূবনেশ্বরী। ১৯০২ জুন মাসে মর্ত্যলীলার শেষ শনিবার স্বামীজি বেলুড়মঠে বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়িতে গিয়েছিলেন। বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষাও করেছিলেন, তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক কুরুক্ষেত্রের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভিটেবাড়ির শরিক হাবু দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবু দত্ত।
স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তা হলে আরও হাজার টাকা দেবেন। হাবু দত্ত ও তমু দত্ত রাজি। প্রিয় বন্ধু ও গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুর সঙ্গে অ্যাটর্নি পন্টুবাবুর কলকাতা অফিসে গেলেন।
দুই পক্ষের অ্যাটর্নিদের মধ্যে বারবার আলোচনা চললো। ২রা জুলাই (স্বামীজির মহাসমাধির মাত্র দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী চারশ টাকা দেওয়া হল। অর্থাৎ আপাতত শেষ হল দীর্ঘদিনের সংঘাত। নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, শেষ দেখার সময়ে স্বামীজি তাকে বলেন, মামলারও নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তাঁর কোনো খেদ নেই। অর্থাৎ অভাগিনী মায়ের সব সমস্যা অবিশ্বাস্যভাবেই সমাধান করে গেলেন আমাদের চিরপ্রণম্য স্বামী বিবেকানন্দ।
.
অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে সুলোচনা অবশ্যই পঠনীয়।
স্বামীজির বিচিত্র জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর দূরত্ব পেরিয়ে পিতৃদেব রচিত উপন্যাসের সামাজিক গুরুত্ব অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। যাঁরা স্বামী বিবেকানন্দর বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তাঁদের কাছে অধুনা-দুষ্প্রাপ্য সুলোচনা উপন্যাসটি নিতান্ত ছোট প্রাপ্তি নয়।
==========
বাবাও সন্ন্যাসী, ছেলেও সন্ন্যাসী : একনজরে বিশ্বনাথ দত্ত
১৮৩৫ বিশ্বনাথ দত্তের জন্ম। পিতা দুর্গাপ্রসাদ, মাতা শ্যামাসুন্দরী (ঘোষ)।১৮৩৬ পিতা দুর্গাপ্রসাদের ২২ বছর বয়সে গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাস গ্রহণ।
? শিক্ষা, গৌরমোহন আঢ্যের বিদ্যালয়, পরবর্তীকালে যার নাম ওরিয়েন্টাল সেমিনারি।
? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮৪১ ভাবী-পত্নী ভূবনেশ্বরী বসুর জন্ম। (পিতা নন্দলাল বসু, মাতা রঘুমণি।)।
১৮৫১ বিবাহ ভুবনেশ্বরী (বসু)-স্ত্রীর বয়স ১০।
? প্রথম পুত্রের জন্ম (শৈশবে মৃত)
? প্রথম কন্যার জন্ম (শৈশবে মৃত)
১৮৫৬ কন্যা হারামণির জন্ম (এঁর মৃত্যু ২২ বছরে, মতান্তরে ২৬ বছরে)।
১৮৫৯ অ্যাটর্নি চার্লস এফ পিটারের অধীনে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক।
১৮৬০ চার্লস পিটারের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
১৮৬১ অ্যাটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পলের অধীনে আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপ। এই অফিসে তার সহকর্মী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পিতা ভুবনমোহন দাশ।
১৮৬৩ পুত্র নরেন্দ্রনাথের (ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দ) জন্ম। (স্বামীজির মহাসমাধি ১৯০২)। ভুমিষ্ঠ হবার পরে দুর্গাপ্রসাদের ভগ্নী বলেন, “সেই চেহারা, সেই সবই, দুর্গাপ্রসাদ কি আবার ফিরে এল?” আনন্দিত বিশ্বনাথ নিজের পরিধেয় বস্ত্রটি পর্যন্ত দান করেন।
১৮৬৪ অ্যাটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পল-এর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
১৮৬৫ ব্যারিস্টার ডবলু সি বনার্জির পিতা গিরিশচন্দ্র বনার্জি ও দিগম্বর মিটারের কাছ থেকে চরিত্র সার্টিফিকেট।
১৮৬৬ অ্যাটর্নি ও প্রক্টর হিসেবে নথিভুক্ত হবার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন ও অনুমতি লাভ।
১৮৬৭ কাকা কালীপ্রসাদের মৃত্যু। অন্য মতে কালীপ্রসাদের মৃত্যু ১৮৬৯, মৃত্যুশয্যায় শাস্ত্রপাঠ করেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ। এঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী, পুত্র কেদারনাথ ও তারকনাথ। বিশ্বেশ্বরীর মৃত্যু ৯৭ বছর বয়সে ১৫ ডিসেম্বর ১৯১২।
১৮৬৮ অ্যাটর্নি আশুতোষ ধরের সঙ্গে পার্টনারশিপে ‘ধর অ্যান্ড দত্ত’ অ্যাটর্নি ব্যবসার শুরু।
১৮৬৯ পুত্র মহেন্দ্রনাথের জন্ম (এঁর মৃত্যু ১৯৫৬)।
১৮৭১ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে কলকাতার বাইরে ভাগ্যসন্ধানে যাত্রা।
১৮৭২ ওকালতি লখনৌ (বার লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় উল্লেযোগ্য ভূমিকা)
১৮৭৬ ওকালতি লাহোর, সেখানে বঙ্গীয় সমাজে প্রথম ঘটে দুর্গাপূজা।
১৮৭৭ তখনকার সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস পরে মধ্যপ্রদেশ রায়পুরে ভাগ্যসন্ধানে এলেন বিশ্বনাথ, ১৪ বছরের পুত্র নরেন্দ্রনাথ তখন থার্ড ক্লাশের ছাত্র।
ভূবনেশ্বরী, পুত্র নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও কন্যা যোগীন্দ্রবালার রায়পুরে যোগদান কয়েকমাস পরে। কলকাতা থেকে নাগপুর ৭১০ মাইল। নাগপুর থেকে গোরুর গাড়িতে রায়পুরপথে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, সেখানে ডাকাত ও বাঘের উপদ্রব। এঁদের সহযাত্রী পরবর্তীকালে বিখ্যাত হরিনাথ দে’র পিতা রায়পুরের উকিল রায়বাহাদুর ভূতনাথ দে। তাঁর স্ত্রী এলোকেশী। একই বছরে ভূবনেশ্বরী দুই আত্মীয়াকে ৫০০ টাকা করে দিয়ে বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর কাছ থেকে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়ির এক আনা ছ গণ্ডা দু’কড়া দু ক্রান্তি ভাগ কিনলেন।
পরবর্তীকালে অভিযোগ, ভিটেবাড়িতে বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর শেয়ার ভূবনেশ্বরীর বেনামে কেনেন বিশ্বনাথের খুড়তুতো ভাই তারকনাথ।
১৮৭৯ সপরিবারে কলকাতার যৌথপরিবারে প্রত্যাবর্তন। নরেন্দ্রনাথ ঐ বছরেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে বাবার কাছ থেকে রুপোর ঘড়ি পেলেন। পুত্র নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ ক্লাশে ভর্তি হলেন।
১৮৮০ ৪ঠা সেপ্টেম্বর কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথের জন্ম (মৃত্যু ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১)।
গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী শচীমণি দাসীর যৌথ সম্পত্তি বিভাজনের জন্য হাইকোর্টে মামলা।
১৯৮১ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পুত্র নরেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিভাগে এফ এ পাশ করলেন।
নভেম্বর : ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ।
১৮৮২ ১৫ জানুয়ারি দক্ষিণেশ্বরে নরেন ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ।
এপ্রিল : সুলোচনা উপন্যাসের প্রকাশ; লেখকের জায়গায় জ্ঞতিকাকা গোপালচন্দ্র দত্তের নাম।
৮ই অক্টোবর কন্যা হারামণির মৃত্যু ২৬ বছরে (মতান্তরে ২২ বছর)
১৮৮৩ বাস্তুভিটা ছেড়ে পৃথক অন্ন ও ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনে বাড়িভাড়া।
বি এ পাশ করার আগেই নরেনকে বি. এল পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি ও চাঁদনি থেকে কোটপ্যান্টের অর্ডার। বন্ধু অ্যাটর্নি নিমাই বসুর অফিসে নরেন্দ্রনাথের শিক্ষানবিশি শুরু।
১৮৮৪ ৩০ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথের বি.এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। ২৩ ফেব্রুয়ারি সাতকড়ি মৈত্রের বরাহনগর বাসভবনে নরেন্দ্রনাথ গানবাজনার পরে সবে শয্যাগ্রহণ করেছেন, এমন সময় বন্ধু ‘হেমালী’ রাত্রি প্রায় দুইটার সময় খবর দিল, পিতা বিশ্বনাথ অকস্মাৎ ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে। নরেন্দ্রনাথ যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন বিশ্বনাথের মরদেহ একটি ঘরে শায়িত। অন্য মতে, নরেন্দ্রনাথ সোজা নিমতলা ঘাটে চলে আসেন। এইসময় মহেন্দ্রনাথের বয়স পনেরো। কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টারে নরেন্দ্রনাথের সই রয়েছে। মৃত্যুর কারণ : ডায়াবিটিস।
১৮৮৫ শরিকী বিরোধে স্বামীর ভিটেবাড়ির পরিবেশ বসবাসের
অযোগ্য হয়ে ওঠায় ভূবনেশ্বরী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ৭ রামতনু বসু লেনে নিজের মায়ের কাছে চলে গেলেন। কিন্তু কয়েক মাস পরে আবার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে দেখেন পরলোকগত স্বামীর খুড়তুতো ভাই উকিল তারকনাথ দত্ত একটি পাকা ঘর তৈরি শুরু করেছেন। মায়ের নির্দেশে, তারকনাথের বেআইনি কাজ নিয়ে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে উত্তেজনাময় বচসা।
মার্চ : নরেন্দ্রনাথের গৃহত্যাগের সঙ্কল্প।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অসুখ, তাকে শ্যামপুকুরে আনা হল।
১৮৮৬ ২৫শে ফেব্রুয়ারি উকিল তারকনাথের মৃত্যু ৪৮ বছর বয়সে। ১৫ জুলাই তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরী দাসীর বিরুদ্ধে মামলা করলেন, অভিযোগ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়ির কিছু অংশ ভূবনেশ্বরীর বেনামে তার স্বামীই কিনেছিলেন।
১১ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন : প্রয়াত স্বামীর মক্কেলদের কাছ থেকে অনাদায়ী টাকা আদায়ের ছাড়পত্রের জন্য। মায়ের বাংলা সই সনাক্ত করলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১২ আগস্ট হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদন মঞ্জুর–আদালত থেকে বেরিয়েই নরেন্দ্রনাথ ছুটলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে–গলায় ক্যানসার রোগে ঠাকুর সেখানে মৃত্যুশয্যায়।
১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে রাত্রি ১টা ২ মিনিটে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মর্তলীলার অবসান।
২৮ নভেম্বর জ্ঞানদাসুন্দরী ভিটেবাড়ির মালিকানা নিয়ে যে মামলা দায়ের করেছেন অ্যাটর্নি নিমাই বসুর মাধ্যমে ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথ তার বিস্তারিত জবাব দিলেন।
১৮৮৭ কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি উইলিয়ম ম্যাকফারলেনের কক্ষে বিচার শুরু। দু’পক্ষের সাক্ষীসাবুদ অনেক। এঁদের মধ্যে আছেন প্রতিবেশী ডাক্তার চন্দ্রনাথ ঘোষ ও দত্ত বাড়ির পুরোহিত সারদাপ্রসাদ মজুমদার।
৮মার্চ স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ হাইকোর্টে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। তাকে জেরা করলেন বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ সায়েব। পেশা কি এই প্রশ্নের উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, আমি বেকার।
১৪ মার্চ হাইকোর্টের রায়–জ্ঞানদাসুন্দরী অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, মামলার সব ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে। জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে আপীল ফাঁইল করলেন।
১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রাখলেন, জয় বিশ্বনাথ পত্নী নরেন্দ্ৰজননী ভূবনেশ্বরীর।
১৮৮৮ ২০ জানুয়ারি সম্পত্তি বিভাজনের জন্য শচীমণির মামলা আদালতের এক স্থগিতাদেশে এতোদিন ঝুলে ছিল। পূর্বতন বাঁটোয়ারা রায় কার্যকরী করার জন্যে ভুবনেশ্বরীর পক্ষে আদালতে আবেদন। আদালতের হস্তক্ষেপে ভূবনেশ্বরী তার অংশ বুঝে পেলেন।
নট আউট শুরুর নট আউট শিষ্য
স্বামী বিবেকানন্দ এবং তার আচার্য শ্রীরামকৃষ্ণ অনেক ব্যাপারেই আলাদা, তাদের আচার ও আচরণও অবিশ্বাস্য। এঁদের প্রথম মিলনে বাংলার রসগোল্লার মস্ত ভূমিকা রয়েছে। ঠাকুরের ভক্ত এবং নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত তার নরেনকে আধ্যাত্মিক কথা বলেননি, বলেছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গেলে ভটচায্যিমশাই খুব ভাল রসগোল্লা খাওয়ান।
দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ থেকেই অবিশ্বাস্য এক আন্দোলন গড়ে উঠল। বিবেকানন্দজীবনে বিস্তারিতভাবে প্রবেশের আগে গুরুটিকে একটু ভালভাবে জেনে রাখা দরকার এবং সেই সঙ্গে শিষ্যটির কী সম্পর্ক দাঁড়াল।
হিসেব মতে, ২০১০ সালে আমাদের পরমপুরুষ ১৭৫ নট আউট, যদিও তাঁর নশ্বর দেহত্যাগ এই কলকাতা শহরে মাত্র ৫০ বছর বয়সে। তারপরেও হেসে খেলে ১২৫ বছর কেমন করে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের ছোটভচায্যি বেঁচে রইলেন তা ঐতিহাসিকদের এবং সমাজতত্ত্ববিদদের কাছে এক পরমবিস্ময়। ইতিহাসের ফর্মুলা অনুযায়ী ব্যাপারটা ভীষণই কঠিন, কিন্তু খেয়ালি মহাকাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন, রানি রাসমণির ভবতারিণী মন্দিরের প্রায়-নিরক্ষর, জুনিয়র পুরোহিত একদিন এদেশের হৃদয়েশ্বর হয়ে উঠবেন এবং তাঁর জীবন ও বাণী সাগরপারের অনুসন্ধিৎসুদেরও আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
তাকে যুগাবতারও বলা হয়েছে, ঘরে ঘরে তার জন্য মঙ্গলশঙ্খ বাজে। তাকে যাঁরা ঠিকমতন বুঝতে পেরেছেন তারা নিশ্চিত ১৭৫ নট আউটটা ঠাকুর রামকৃষ্ণের পক্ষে কিছুই নয়, তার প্রধান চেলার অতিশয়োক্তি দোষ ছিল না। সেই উনিশ শতকের শেষপ্রান্তের বেলুড় মঠের পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন, দেড় হাজার বছরের মধ্যে তার পুনরাবির্ভাব হবে এবং তার আগের দেড় হাজার বছর তিনি রামকৃষ্ণসঘের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে সার্ধশতবর্ষ নয়, সাধসহস্রবছর ধরে শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিহত ঠিকানা এই রামৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
গুরু তাঁর দিব্যচক্ষু দিয়ে প্রধান চেলাটিকে সযত্নে নির্বাচন করে সস্নেহে লালন করেছিলেন। হাতে তেমন সময় ছিল না, যন্ত্রণাময় ক্যানসার-কণ্টকিত রোগভোগের মধ্যেই দূরদর্শী ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞর মতো তিনি সকল ভক্তের নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ নিয়ে নরেন্দ্রনাথকেই নির্বাচন করেছিলেন।
অসাধ্য সাধন হয়েছিল, শিষ্য তার বিস্ময়কর শক্তিতে কপর্দকহীন হয়েও প্রিয় প্রভুর নামাঙ্কিত যে আন্দোলন ও সদ্য তৈরি করলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের তা প্রথম। ভগবান বুদ্ধের ভুবনবিজয়ের পর যেন এই প্রথম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল, দেশ দেশ নন্দিত করে মন্দ্রিত হল বৈপরীত্যে ভরা এক বিস্ময়কর ব্রাহ্মণের বাণী, যিনি নৈষ্ঠিক পুরোহিত হয়েও নিজের কাজের জন্য নির্বাচন করে গেলেন এক কায়স্থ সন্তানকে। এদেশের ইতিহাসে একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেল।
ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রবিদরা অকারণে অষ্টোত্তর শতনামে মুখরিত হওয়ায় বিশ্বাস করেন না। প্রশস্তির সঙ্গে তারা সমালোচনাও করে থাকেন। তাদের শাস্ত্রীয় বিশ্বাস, বিধাতার এই সৃষ্টিতে ‘পারফেকশন’ অথবা নিখুঁত বলে কিছুই নেই, যা আছে তা কেবল পারফেকশনের সন্ধান–নিরন্তর সন্ধান।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান চেলাটি বয়সে তার থেকে পঁচিশ বছরের ছোট–তাঁর জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ আর নরেন্দ্রনাথের ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩। ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ মধ্যযামিনীতে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যখন তাঁর জীবনলীলা সাঙ্গ হল তখন প্রধান শিষ্যের বয়স মাত্র তেইশ, প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নবীন এক সন্ন্যাসীকুলের সৃষ্টি হল, তারপর ভাগ্যসন্ধানে বিশ্বপরিক্রমা এবং অবশেষে কয়েক হাজার বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তুলনাহীন এক সন্ন্যাসীসঙ্ঘের সৃষ্টি যার নাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
সময়াভাব ছিল। নির্বাচিত শিষ্যটি পঞ্চাশ বছরও বাঁচলেন না, হিসেব অনুযায়ী আচার্যের দেহাবসানের পরে মাত্র পনেরোটি বছর এবং কয়েকটি মাস। ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের মতে অকালমৃত্যু আদর্শ সাকসেশন প্ল্যানের পরিপন্থী। অর্থাৎ নিজে পঞ্চাশ বছরে বিদায় নিয়ে, পরবর্তী দায়িত্ববানের চল্লিশ বছরের আগেই চলে যাওয়াটা ভালো কথা নয়। সত্যি কথাটা হল, রামকৃষ্ণসঙ্রে অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয় তার প্রমাণ রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের স্বল্পপরিসর জীবন।
রামকৃষ্ণ আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট্য সন্ন্যাসী ও গৃহী উভয়েরই সগৌরব উপস্থিতি। মূল মঠ ও মিশনে ত্যাগী সন্ন্যাসীদের ওপর নির্ভরতা, কিন্তু গৃহীদের সমর্থন ছাড়া যে, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতে পারে তাও পুরোপুরি উপস্থিত।
১৭৫ বছরের পরও কেমন করে নট আউট? এই বিপুল প্রাণশক্তির গোপন উৎস কোথায়? তা খোঁজ করলে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্ন্যাসী হওয়া সহজ নয়, সে এক দুর্গম জীবনযাত্রা। তবু এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে দেশজননী নিয়মিতভাবে সন্তান দান করে চলেছেন সন্ন্যাসী সঙ্ঘকে এবং তাদের বিপুল নিষ্ঠায় এবং দিবারাত্রের সাধনায় সন্ন্যাসজীবন সকলের শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। নবীন এই সন্ন্যাসীসঙ্রে কাছে বিপুল প্রত্যাশা ছিল প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দের। “শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যচরণ স্পর্শে যে মুষ্টিমেয় যুবকদলের অভ্যুদয় হয়েছে, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তারা আসাম থেকে সিন্ধু, হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত তাঁর উপদেশামৃত প্রচার করছে। তারা পদব্রজে ২৩,০০০ ফুট উধ্বে হিমালয়ের তুষাররাশি অতিক্রম করে তিব্বতের রহস্য ভেদ করেছে। তারা চীরধারী হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছে।”
সন্ন্যাসী ব্যাপারটা কী তা বিবেকানন্দ একবার বিদেশিদের কাছে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। “আমি যে-সম্প্রদায়ভুক্ত তাকে বলা হয় সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়। সন্ন্যাসী’ শব্দের অর্থ “যে ব্যক্তি সম্যকভাবে ত্যাগ করেছে। এটি অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুর জন্মের ৫৬০ বছর আগে বুদ্ধও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের অন্যতম সংস্কারক মাত্র। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও আপনারা সন্ন্যাসীর উল্লেখ পাবেন। সন্ন্যাসী-সম্প্রদায় বলতে চার্চ বোঝায় না এবং এই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা পুরোহিত নন। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ। সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি থাকে না, তারা বিয়ে করেন না, তাদের কোনো সংস্থা নেই। তাদের একমাত্র বন্ধন গুরুশিষ্যের বন্ধন। এই বন্ধনটি ভারতবর্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শুধু শিক্ষাদানের জন্য যিনি আসেন এবং সেই শিক্ষার জন্য কিছু মূল্য বিনিময় করেই যাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ চুকে যায়, তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন। ভারতবর্ষে এটি প্রকৃত অর্থে দত্তক গ্রহণের মতো। শিক্ষাদাতা গুরু আমার পিতার অধিক, আমি তার সন্তান। সর্বাগ্রে পিতারও আগে, তাকে শ্রদ্ধা করব এবং তার বশ্যতা স্বীকার করব, কারণ ভারতবাসীরা বলেন, পিতা আমার জন্মদান করেছেন কিন্তু গুরু আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, সুতরাং পিতা অপেক্ষা গুরু মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করি।”
গুরু সম্বন্ধে স্বামীজির মন্তব্য আজও পাঠযোগ্য। “এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পেয়েছিলাম, তিনি অদ্ভুত লোক।” ‘বৃদ্ধ’ শব্দটি হিসেবিদের কানে একটু ধাক্কা দেয়, কারণ রামকৃষ্ণ-নরেন্দ্রর সাক্ষাৎকার ১৮৮১ সালে, গুরুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ এবং তৎকালীন ফটোগ্রাফে তাঁকে বার্ধক্যতাড়িত মনে হয় না। শারীরিক বিপর্যটা ঘটেছিল তিরোধানের কয়েক মাস আগে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ১৮৮৬ সালে। সদাশয় ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার মহানিদ্রায় শায়িত শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ যে ছবিটি তোলবার জন্য দশ টাকা অর্থসাহায্য করেছিলেন সেটি দেখলে মন দুঃখে ভরে ওঠে।
এবার গুরু-শিষ্যের প্রথম পরিচয় নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা। নরেন্দ্রনাথের মেজ ভাই এ-বিষয়ে রসগোল্লার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা কমবয়সিদের বেশ ভালো লাগে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় ডাক্তার রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বিসূচিকা রোগে তিনটি ছোট মেয়ে (মেয়ে ও ভাগ্নি) সাতদিনের মধ্যে মারা যায়। শোকার্ত রাম দত্ত এই সময় শান্তি সন্ধানে দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। লোকেরা তখন হাসি ও ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংসদেবকে great goose বলত। রামদাদার মাধ্যমেই সিমলের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের যোগাযোগের সূত্রপাত।
রামদাদা এঁর কাছে দীক্ষা নেওয়ায় নানা নিন্দার সম্মুখীন হতেন, কিন্তু তাঁর গুরুপ্রশস্তিতে ভাটা পড়েনি। তিনি নরেন্দ্রর পড়শি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রকে (পরবর্তীকালে ঠাকুর যাকে আদর করে সুরেশ’ বলে ডাকতেন) ঠাকুরের কথা বলেন। সুরেশ নরম না হয়ে পরিহাস করেছিলেন, “ওহে রাম, তোমার গুরু পরমহংস যদি আমার কথার উত্তর দিতে পারে, তবে ভালো, নইলে তার কান মলে দিয়ে আসব।”
সেকালের কলকাতার কথার স্টাইল অনুযায়ী আর একজন ডাক্তার (স্যর কৈলাসচন্দ্র বসু) একই ভাষায় বলেছিলেন, “রাম, তোমার পরমহংস যদি ভালো লোক হয় ভালো, নইলে তার কান মলে দেব।” বোঝা যাচ্ছে, কান মলে দেবার ইচ্ছা প্রকাশই অবজ্ঞা প্রকাশ করবার রীতি ছিল!
বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেন উত্তর কলকাতায় মধু রায় লেনে রামদাদার বাড়িতে। স্মরণীয় সেই দর্শনের মনোগ্রাহী বিবরণ তিনি রেখে গিয়েছেন। “বিকালে পরমহংস মশাই রামদাদার বাড়িতে এলেন। দিনটি শনিবার কি রবিবার হবে। ঘরে ও বাইরে মোট চল্লিশ জনের মতন লোক। পরমহংস মশাই পশ্চিমদিকের আলমারির বা সার্শি দেওয়া তাকের কাছে বসে আছেন, পিছনে তাকিয়া। দুটি গ্যাসের বাতি জ্বলছে।
“আমার প্রথম এইরূপ মনে হইল–দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে ‘পরমহংস’? দেখিলাম লোকটির চেহারাতে কোন বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মত, বর্ণ খুব কালো নয়, তবে কলিকাতার সাধারণ লোকের বর্ণ হইতে কিছু মলিন। গালে একটু একটু দাড়ি আছে, কপচানো দাড়ি। চোখ দুটি ছোট–যাহাকে বলে হাতি চোখ। চোখের পাতা অনবরত মিট মিট করিতেছে, যেন অধিক পরিমাণে চোখ নড়িতেছে। ঠোঁট দুটি পাতলা নয়। নিচুকার ঠোঁট একটু পুরু। ঠোঁট দুটির মধ্য হইতে উপরের দাঁতের সারির মাঝের কয়েকটি দাঁত একটু বাহির হইয়া রহিয়াছে। গায়ে জামা ছিল; তাহার আস্তিনটা কনুই ও কবজির মাঝবরাবর আসিয়াছে। খানিকক্ষণ পরে, জামা খুলিয়া পাশে রাখিয়া দিল এবং কোঁচার কাপড়টি লম্বা করিয়া বাঁ কাঁধে দিল। ঘরটি বেশ গরম হইয়াছিল। একজন লোক বড় এড়ানী পাখ অর্থাৎ বড় পাখা লইয়া পিছন দিক হইতে বাতাস করিতে লাগিল। কথাবার্তার ভাষা কলিকাতার শিক্ষিত সমাজের ভাষার মতো নয়, অতি গ্রাম্য ভাষা, এমনকি, কলিকাতার শহরের রুচি বিগর্হিত। কথাগুলি একটু তোতলার মতো। রাঢ়দেশীয় লোকের মতো উচ্চারণ। ন এর জায়গায় ল উচ্চারণ করিতেছে, যেমন লরেনকে বললুম’ ইত্যাদি। সম্মুখে একটি রঙিন বটুয়া রহিয়াছে, তাহার মধ্যে কি মসলা আছে; মাঝে মাঝে একটু মসলা লইয়া মুখে দিতেছে।
আমাদের বয়স তখন অল্প এবং আমরা শিক্ষিত সমাজে পরিবর্ধিত, এইজন্য, ভাষা ও উচ্চারণ শুনিয়া পরমহংস মশাই-এর প্রতি মনে একটি অবজ্ঞার ভাব আসিল–এই লোকটাকে রামদাদা কেন এত সম্মান ও শ্রদ্ধা ভক্তি করেন? চুপ করিয়া বসিয়া সব দেখিতে লাগিলাম। মনে মনে আবার ভাবিতে লাগিলাম–কেন রামদাদা এই লোকটাকে এত সম্মান করেন; দুর্ধর্ষ সুরেশ মিত্তির এবং বুদ্ধিমান নরেন্দ্রনাথই বা কেন কয়েকবার এর কাছে গেছেন? লোকটার কি ব্যাপার?”
মহেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণর প্রথম দর্শনের যে বিবরণ রেখে গিয়েছেন তার মধ্যে আকস্মিক ভাবসমাধিরও বর্ণনা আছে।
আরও মনোগ্রাহী বর্ণনা মহেন্দ্রনাথ শুনেছিলেন লীলাপ্রসঙ্গর রচয়িতা স্বামী সারদানন্দের কাছে। স্বামী সারদানন্দ ও মহেন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে কিছুদিন একত্রে লন্ডনে সময় কাটিয়েছিলেন।
একবার পুজোর সময় পরমহংসদেব ডস্ট কোম্পানির মুছুদী গৃহীভক্ত সুরেশ মিত্তিরের (১৮৫০-৯০) বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদালানে মারবেল পাথরের মেঝের উপর তাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল।
“মেয়েরা ঘরে জানালা হইতে পরমহংস মশাইকে দেখিতেছিলেন। পরমহংস মশাই-এর সম্মুখে অনেক লোক দাঁড়াইয়া তাহাকে আহার করাইতেছিলেন। পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেছিলেন। এইরূপ বসিয়া আহার করাই তাঁহার দেশের প্রথা। আমরাও দেখিয়াছি যে, পরমহংস মশাই আসনপিড়ি হইয়া বসিয়া আহার করিতেন না, হাঁটু দুইটি উঁচু করিয়া উপু হইয়া বসিয়া আহার করিতেন।
“তিনি আহার করিতেছেন ও বলিতেছেন যে, পূর্বে তিনি বড় বিভোর থাকিতেন, বাহ্যজ্ঞান কিছুই থাকিত না, কাপড় পরার কথা মনে থাকিত না, একেবারেই বে-ভুল, বে-এক্তিয়ার হইয়া থাকিতেন, কিন্তু এখন তাহার সে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে, এখন তিনি কাপড় পরিয়া থাকেন এবং লোকজনের সম্মুখে বেশ সভ্যভব্য হইয়া বসিয়া থাকেন। এই কথা শুনিয়া উপস্থিত লোকসকল ও যে সকল মেয়েরা জানালা হইতে দেখিতেছিলেন, একটু হাসিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ হাসিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে ও-কথা ঠিক তো বটেই। সকলে এই বলিয়া আমোদ করিয়া তাহাকে একটু উপহাস করিতে লাগিলেন।
পরমহংস মশাই উপু হইয়া বসিয়া একটু একটু খাইতেছেন ও এইরূপ কথা চলিতেছে। সকলেই মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বাঁদিকের বগলের প্রতি হঠাৎ পরমহংস মশাই-এর দৃষ্টি পড়িল। তিনি দেখেন যে, কাপড়খানি বাঁ-বগলের ভেতর জড়ানো রহিয়াছে আর তিনি দিগবসন হইয়া বসিয়া আছেন।
“এইরূপ দেখিয়া তিনি অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “আরে ছ্যা! আমার ওটা গেল না; কাপড় পরাটা আর মনে থাকে না! এই বলিয়া তিনি তাড়াতাড়ি কাপড়খানি লইয়া কোমরে জড়াইতে লাগিলেন। যে সকল পুরুষ দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার সকলে উচ্চতরালে হাসিয়া উঠিলেন, মেয়েরাও জানালা হইতে হাসিয়া উঠিলেন।
“কিন্তু পরমহংস মশাই-এর ভাব এত সরল, স্নিগ্ধ ও উচ্চ ছিল যে, কাহারো মনে দ্বিধা বা সংকোচ না আসিয়া এক অতীন্দ্রিয় ভাব আসিল। কেহ কেহ বলিলেন মশাই, আপনার কাপড় পরবার দরকার নেই। আপনি যেমন আছেন, তেমনি থাকুন। আপনার কোন দোষ হয় না।”
এদেশে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথায় স্মরণীয় মানুষদের দেহবর্ণনা খুবই কম থাকে। ফলে, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দর দৈহিক উচ্চতা কত ছিল, গায়ের রং কীরকম, মুখের ভাস্কর্য কীরকম এসব জানতেও হিমশিম খেতে হয়। পশ্চিমের লেখকরা তাদের স্বাভাবিক বিচক্ষণতায় নিতান্ত প্রয়োজনীয় এই কাজগুলি প্রথমেই সেরে নেন। এই সমস্যা পরমহংসদেবের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট। সাবধানী মহেন্দ্রনাথ দত্ত তার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের অনুধ্যান নামক ছোট্ট বইতে দাদা নরেন্দ্রনাথ ও গুরু রামকৃষ্ণের সম্বন্ধে কিছু দৈহিক বিবরণ রেখে দিয়েছেন।
“শ্রীরামকৃষ্ণের চোখ হইল ক্ষুদ্র যাহাকে বলে–হাতিচোখ। মুখে বিশেষ ওজস্বী ভাব নাই; বাহু-সঞ্চালন অতি ধীর ও করুণাব্যঞ্জক। সাধারণ অবস্থায় কণ্ঠস্বর মৃদু, এক প্রকার কাতর স্বর বলা যাইতে পারে। দেখিলে বোধহয়, যেন জগতের সম্পর্ক হইতে বিশ্লিষ্ট হইয়া স্বতন্ত্র থাকিবার–নিরিবিলি ও একাকী থাকিবার তাঁহার ইচ্ছা, জগৎ যেন তাহাকে স্পর্শ করিতে না পারে।”
এবার দাদার শরীর বিবরণ। “বিবেকানন্দের চোখ হইল বিস্ফারিত; দৃষ্টি তীক্ষ্ণ; মুখ–সুডৌল, পুরুষ। মুখে আজ্ঞাপ্রদ ভাব, defiant attitude-বাধাবিঘ্ন-তুচ্ছকারী ভাব যেন জগৎকে গ্রাহ্যই করিতেছে না। বাহু-সঞ্চালন ও তর্জনী-নির্দেশ যেন জগৎকে শাসন করিবার বা আজ্ঞা দিবার মতো, যাহাকে বলে নাপোলিঅঁ-র মতো অঙ্গভঙ্গী ও অঙ্গ-সঞ্চালন, আজ্ঞা শুনিয়া যেন সকলে স্তব্ধ হইয়া যাইবে। প্রথম দৃষ্টিতে দুই জনের ভিতর এই পার্থক্য দেখা যায়।”
এরপর মহেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ, “শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের বিশেষ লক্ষণ হইল–বহুবিধ স্নায়ু দিয়া বহু প্রকার চিন্তা করা। শক্তি-বিকাশ করা বা যাহাতে ক্ষাত্রশক্তির আবশ্যক, এইরূপ কার্য তাহার নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল গভীর চিন্তা করা মুখ্য, শক্তি-বিকাশ করা গৌণ। এইজন্য প্রথম অবস্থায় সাধারণ লোক তাঁহাকে কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া উন্মাদ ও বাতুল বলিয়া বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করিত।”
“বিবেকানন্দের হইল শক্তিবিকাশ করাই মুখ্য, গভীর চিন্তা করা হইল গৌণ।”
মহেন্দ্রনাথের মন্তব্য : “এই দুইটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিয়া উভয়ের জীবনী আলোচনা করিলে, উভয় ব্যক্তির মধ্যে বেশ একটি সামঞ্জস্য দেখা যায়। এ স্থলে বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে অনুকরণ করেন না। একজন অপরের অনুকরণ করিয়াছিলেন–ইহা অতীব ভুল মত। উভয়েই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তিত্ব অটুট রাখিয়াছিলেন। পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল; কিন্তু উভয়ের কার্যক্ষেত্র ও বিকাশ-প্রণালী ভিন্ন ছিল। উভয়েই নিজ নিজ ভাবে চিন্তা করিয়াছিলেন। উভয়েই জগৎকে এবং জগতের সম্পর্কিত ও সংশ্লিষ্ট ভাবসমূহ নিজ নিজ চিন্তা অনুযায়ী উপলব্ধি করিয়াছিলেন। উভয়েই নিজ ভাবে জগতের প্রশ্ন সকল মীমাংসা করিয়াছিলেন এবং সেইরূপ শক্তি বিকাশ করিয়াছিলেন। এইরূপ তেজঃপূর্ণ, বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষ যাঁহারা, তাহারা কেহ কাহাকেও অনুকরণ করিতে পারেন না। নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাই হইল এইরূপ পুরুষদিগের বৃত্তি।
“মনোবিজ্ঞান দিয়া বুঝিতে হইলে দেখা যায় যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব হইল ব্যক্ত হইতে অব্যক্তে চলিয়া যাওয়া। বিবেকানন্দের ভাব হইল অব্যক্ত হইতে ব্যক্তে চলিয়া আসা। শ্রীরামকৃষ্ণের হইল ঈশ্বর কেন্দ্র, জীব বা মনুষ্য পরিধি। বিবেকানন্দের হইল জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র, ঈশ্বর পরিধি।”
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই যে, যদি দুই জনের মধ্যে এইসব বিষয়ের পার্থক্য থাকে, তবে উভয়ের ভিতর সামঞ্জস্য কোথায়?
তার উত্তর সন্ধান করেছেন মহেন্দ্রনাথ। “ইহা জানা আবশ্যক যে, শক্তির প্রবাহ যদি কেন্দ্র হইতে খুব গভীর স্তরে যায়, তাহা হইলে উপবৃত্ত–Theory of Motion-গতিবার-এর নিয়ম। এই নিয়ম সূক্ষ্ম–স্নায়ু বা সূক্ষ্ম-শরীর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বর কেন্দ্র হইলেও, জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বর-দর্শন হয় এবং বিবেকানন্দের জীব বা মনুষ্য কেন্দ্র হইলেও, পরিশেষে জীবেও ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয় বা ঈশ্বরদর্শন হয়। দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র–এই দুই শাস্ত্র দিয়া পর্যালোচনা করিলে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মনোবৃত্তি ও ক্রিয়াকলাপ বিশেষভাবে বুঝা যাইতে পারে।”
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহবর্ণনার আর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র লাহোর ট্রিবিউনের খ্যাতনামা সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তিনি ১৮৮১ সালে (যে বছর নরেন্দ্রর সঙ্গে ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ) স্টিমারে রামকৃষ্ণের সহযাত্রী হয়েছিলেন। এই জাহাজের মালিক কেশবচন্দ্র সেনের জামাতা কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ। দক্ষিণেশ্বর ঘাটে পরমহংসদেব তার ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে জাহাজে উঠলেন, সঙ্গে এক ধামা মুড়ি ও সন্দেশ। তিনি লালপেড়ে ধুতি ও পাঞ্জাবি পরেছিলেন–পাঞ্জাবির বোম খোলা ছিল।
নগেন্দ্রনাথের বর্ণনা : “শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামবর্ণ ছিলেন। দাড়ি রাখতেন এবং তাঁর চোখ দুটি কখনও সম্পূর্ণরূপে উন্মীলিত হতো না–অন্তর্মুখী ছিল। তার দৈর্ঘ্য ছিল মাঝারি। গড়ন ছিল পাতলা, প্রায় শীর্ণ বলা যায়, এবং চেহারা ছিল অত্যন্ত ছিপছিপে।…একটু তোতলা ছিলেন, কিন্তু সেই তোতলামি শ্রুতিমধুর ছিল। তিনি খুব সরল বাংলায় কথা বলতেন এবং প্রায়ই ‘আপনি’ ও ‘তুমি’ মিলিয়ে ফেলতেন।”
এই বিবরণ মিলছে না পরমাপ্রকৃতি সারদামণির স্বামী-বর্ণনার সঙ্গে। শ্রীশ্রী মায়ের কথা’ বইতে ঠাকুরের চেহারা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য : “তার গায়ের রঙ যেন হরিতালের মতো ছিল–সোনার ইষ্ট কবচের সঙ্গে গায়ের রং মিশে যেত। যখন তেল মাখিয়ে দিতাম, দেখতুম সব গা থেকে যেন জ্যোতি বেরুচ্ছে।…যখনই কালীবাড়িতে বার হতেন, সব লোক দাঁড়িয়ে দেখত, বলত, ‘ঐ তিনি যাচ্ছেন’ বেশ মোটাসোটা ছিলেন। মথুরবাবু একখানা বড় পিঁড়ে দিয়েছিলেন, বেশ বড় পিঁড়ে। যখন খেতে বসতেন তখন তাতেও বসতে কুলাত না। ছোট তেল ধুতিটি পরে যখন থপ থপ করে গঙ্গায় নাইতে যেতেন, লোকে অবাক হয়ে দেখত।”
মঠের আমেরিকান সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ পরবর্তী সময়ে অনেক খোঁজখবর করে লিখেছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণের দেহের ওজন ও দৈর্ঘ লিপিবদ্ধ করা হয়নি।” বিদ্যাত্মানন্দ জানাচ্ছেন, ১৯৫৫ সালে ভাস্করকে নির্দেশ দিতে গিয়ে স্বামী নির্বাণানন্দ হিসেব করেছিলেন যে ঠাকুরের দৈর্ঘ ছিল ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। এই সিদ্ধান্তে আসতে তিনি নির্ভর করেছিলেন ঠাকুরের কোটপরা আলোকচিত্র এবং সেই কোটটি থেকে। কোটটি মেপে এবং কোটটির সঙ্গে আকৃতির সম্বন্ধ হিসাব করে দেহের দৈর্ঘ্য প্রতিপাদন করা হয়েছিল।
স্বামী নির্বাণানন্দ একসময় স্বামী ব্রহ্মানন্দের সেবক ছিলেন। ১৯১৮ সালে উকিল অচলকুমার মৈত্রের পত্নী এক ভক্তিমতি মহিলা ঝাউতলায় কর্মরত এক প্রতিভাবান মারাঠি ভাস্করের স্টুডিওতে গিয়ে মর্মর মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
এই মূর্তিটির মডেল অনুমোদন করার জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট মহারাজকে অনুরোধ জানালেন স্বয়ং স্বামী সারদানন্দ।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রথমে তেমন উৎসাহিত হলেন না। তারপর বললেন : “ঠাকুরের কোন মূর্তি অনুমোদন করব? তাকে একই দিনে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে দেখেছি। কখনো দেখেছি তিনি কৃশ ও ক্ষীণকায়, একটি কোণে চুপ করে বসে আছেন। আবার খানিকক্ষণ পরে দেখা গিয়েছে, তিনি দেহ ও বেশভূষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়ে সর্বক্ষণ হাততালি দিতে কীর্তন করছেন। কখনো বা গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হতেন; তখন তাঁর মুখমণ্ডল এক স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত এবং দেহ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বিকীর্ণ হতো। কখনো কখনো দেখা যেত তার আকৃতি স্বাভাবিক অপেক্ষা দীর্ঘতর ও বলবত্তর এবং তিনি দক্ষিণের বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বড় বড় পা ফেলে জোরে জোরে পায়চারি করছেন।”
স্বামী সারদানন্দ বিনীতভাবে বললেন, “মহারাজ, ঠাকুর যে ছবি সম্বন্ধে নিজে বলছিলেন, যে ঘরে ঘরে পূজিত হবে, আমি সেই ছবির কথা বলছি। তারই প্রতিমূর্তির মডেল তোমাকে অনুমোদন করতে যেতে হবে।”
মহারাজ হাসিমুখে উত্তর দিলেন, “চল যাই।”
সেইদিন বিকালবেলাই মহারাজকে ঝাউতলা স্টুডিওতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হল। এই উপলক্ষে তার সঙ্গে স্বামী সারদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ও অন্যান্য সাধুরাও গেলেন। গোলাপমা ও যোগীনমাও গেলেন।
মহারাজ মডেলটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর শিল্পীকে দেখালেন “দেখ তুমি ঠাকুরকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বসিয়েছ।”
শিল্পী বললেন, “মহাশয়, আপনি দেখবেন যদি কেউ এইভাবে পায়ের সামনের হাতজোড় করে বসেন, তাহলে তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে যেতে বাধ্য হবেন।”
মহারাজ উত্তর দিলেন, “আমরা কখনো ঠাকুরকে এইভাবে বসতে দেখিনি। তুমি যা বলছ তা সাধারণ লোকেদের পক্ষে প্রযোজ্য। কিন্তু ঠাকুরের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। তিনি দীর্ঘবাহু ছিলেন। হাঁটু পর্যন্ত তার হাত পৌঁছত।”
প্রেসিডেন্ট মহারাজ এরপর শিল্পীকে ঠাকুরের কান সম্বন্ধে নির্দেশ দিলেন, “দেখ, সাধারণ মানুষের কান জ্বরেখার উপরে আরম্ভ হয় এবং তুমি ঠাকুরের কান সেইভাবে রূপায়িত করেছ। কিন্তু ঠাকুরের কান জ্বরেখার নীচে থেকে আরম্ভ হয়েছিল।”
“উপস্থিত সকলে ঠাকুরের চেহারা সম্বন্ধে এইরূপ খুঁটিনাটি বিবরণ শুনে অত্যন্ত আকৃষ্ট হলেন। মহারাজের নির্দেশ অনুসারে ভাস্কর মডেলটি সংশোধন করতে সম্মত হলেন। তিনি বললেন, অনুগ্রহ করে এক সপ্তাহ পরে আসুন, ইতোমধ্যে আমি মডেলটি সম্পূর্ণ করে রাখব।”
এক সপ্তাহ পরে মহারাজ সদলবলে স্টুডিওতে পুনর্বার পদার্পণ করলেন। সংশোধিত মডেলটি দেখে মহারাজ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, “এখন এটি অবিকল হয়েছে।”
বিবেকানন্দের নির্ভরযোগ্য দেহবিবরণ দিয়েছেন রোমাঁ রোলাঁ তাঁর ‘বিবেকানন্দের জীবন’ বইতে। তার হিসেব মতো বিবেকানন্দের ওজন ছিল ১৭০ পাউন্ড। “দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মতো সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণ দেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু। তাঁহার চক্ষু দেখিলে প্রাচীন সাহিত্যের সেই পদ্মপলাশের উপমা মনে পড়িত। বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চক্ষু; ভাবাবেগে ছিল তন্ময়; চেতনার গভীরে তাহা অবলীলায় অবগাহন করিত; রোষে হইয়া উঠিত অগ্নিবর্ষী; সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল হইতে কাহারও অব্যাহতি ছিল না।”
রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, “বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বর ছিল ভায়োলন সেলো’ বাদ্যযন্ত্রের মতন। তাহাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তাহার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে এবং সকল শ্রোতার হৃদয়ে ঝক্তৃত হইত।…এমা কাভে বলেন, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যারিটোন’, তাহার গলার স্বর ছিল চিনা গঙের আওয়াজের মতো।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রর প্রথম সাক্ষাৎ কবে কোথায় তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিনিময় ও গবেষণা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দর্শন ও প্রথম বাক্যলাপ একইদিনে হয়নি। বিবেকানন্দ জীবনীকার অনেক অনুসন্ধানের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতেই প্রথম দর্শন। রোমা রোলাঁ জানিয়েছেন, এই ভদ্রলোক সঙ্গতিপন্ন ব্যবসায়ী এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ সেবার ভজন গান শোনালেন। নবাগত গায়কের শারীরিক লক্ষণ ও ভাবতন্ময়তা লক্ষ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বিশেষ আকৃষ্ট হলেন এবং খোঁজখবর নিয়ে ভক্ত রামচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন একে একদিন দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যেতে।
ঘোড়ার গাড়িতে সুরেন্দ্রনাথ ও দু’জন বয়স্যের সঙ্গে ১৮৮১ সালের পৌষ মাসে (নভেম্বর) নরেন্দ্রনাথ দত্ত দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হলেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐতিহাসিক এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব এবং নরেন্দ্রনাথ দুজনেই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য সচরাচর হয় না। অযথা সময় নষ্ট না করে, আমরা স্বামী সারদানন্দ বিরচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গর স্মরণ নিচ্ছি।
“দেখিলাম, নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও বেশভূষার কোনরূপ পারিপাট্য নাই, বাহিরের কোন পদার্থেই ইতর-সাধারণের মতো একটা আঁট নাই, সবই যেন তার আলগা এবং চক্ষু দেখিয়া মনে হইল তাহার মনের অনেকটা ভিতরের দিকে কে যেন সর্বদা জোর করিয়া টানিয়া রাখিয়াছে। দেখিয়া মনে হইল বিষয়ী লোকের আবাস কলিকাতায় এত বড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভবে!
“মেঝেতে মাদুর পাতা ছিল, বসিতে বলিলাম। যেখানে গঙ্গজলের জালাটি রহিয়াছে তাহার নিকটেই বসিল। তাহার সঙ্গে সেদিন দুই-চারি জন আলাপী ছোকরাও আসিয়াছিল। বুঝিলাম, তাহাদিগের স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীত–সাধারণ বিষয়ী লোকের যেমন হয়; ভোগের দিকেই দৃষ্টি।
“গান গাহিবার কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বাংলা গান সে দুই-চারিটি মাত্র তখন শিখিয়াছে। তাহাই গাহিতে বলিলাম, তাহাতে সে ব্রাহ্মসমাজের ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ গানটি ধরিল ও ষোল আনা মনপ্রাণ ঢালিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যেন উহা গাহিতে লাগিল–শুনিয়া আর সামলাইতে পারিলাম না, ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম।
“পরে সে চলিয়া যাইলে, তাহাকে দেখিবার জন্য প্রাণের ভিতরটা চব্বিশ ঘন্টা এমন ব্যাকুল হইয়া রহিল যে, বলিবার নহে। সময়ে সময়ে এমন যন্ত্রণা হইত যে, মনে হইত বুকের ভিতরটা যেন কে গামছা-নিংড়াইবার মতো জোর করিয়া নিংড়াইতেছে। তখন আপনাকে আর সামলাইতে পারিতাম না, ছুটিয়া বাগানের উত্তরাংশে ঝাউতলায়, যেখানে কেহ বড় একটা যায় না, যাইয়া ‘ওরে তুই আয়রে, তোকে না দেখে আর থাকতে পারছি না’ বলিয়া ডাক ছাড়িয়া কাদিতাম। খানিকটা এইরূপে কাঁদিয়া তবে আপনাকে সামলাইতে পারিতাম। ক্রমান্বয়ে ছয় মাস এইরূপ হইয়াছিল। আর সব ছেলেরা যারা এখানে আসিয়াছে, তাদের কাহারও কাহারও জন্য কখন কখন মন কেমন করিয়াছে, কিন্তু নরেন্দ্রর জন্য যেমন হইয়াছিল তাহার তুলনায় সে কিছুই নয় বলিলে চলে।”
একই সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে স্বামী সারদানন্দ পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকান্দের স্মৃতিকথাও সংগ্রহ করেছিলেন।
“গান তো গাহিলাম, তাহার পরেই ঠাকুর সহসা উঠিয়া আমার হাত ধরিয়া তাহার ঘরের উত্তরে যে বারান্ডা আছে, তথায় লইয়া যাইলেন। তখন শীতকাল, উত্তরে-হাওয়া নিবারণের জন্য উক্ত বারান্ডার থামের অন্তরালগুলি ঝাঁপ দিয়া ঘেরা ছিল, সুতরাং উহার ভিতরে ঢুকিয়া ঘরের দরজাটি বন্ধ করিয়া দিলে ঘরের ভিতরের বা বাহিরের কোন লোককে দেখা যাইত না। বারান্ডার প্রবিষ্ট হইয়াই ঠাকুরঘরের দরজাটি বন্ধ করায় ভাবিলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দিবেন। কিন্তু যাহা বলিলেন ও করিলেন তাহা একেবারে কল্পনাতীত। সহসা আমার হাত ধরিয়া দরদরিতধারে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন এবং পূর্বপরিচিতের ন্যায় আমাকে পরম স্নেহে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, এতদিন পরে আসিতে হয়? আমি তোমার জন্য কিরূপে প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি তাহা একবার ভাবিতে নাই? লোকের কথা বাজে প্রসঙ্গ শুনিতে শুনিতে আমার কান ঝলসিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে; প্রাণের কথা কাহাকেও বলিতে না পাইয়া আমার পেট ফুলিয়া রহিয়াছে!’–ইত্যাদি কত কথা বলেন ও রোদন করেন। পরক্ষণেই আবার আমার সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া দেবতার মত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীর ধারণ করিয়াছ ইত্যাদি।
“আমি তো তাঁহার ওইরূপ আচরণে একেবারে নির্বাক-স্তম্ভিত! মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম এ কাহাকে দেখিতে আসিয়াছি, এ তো একেবারে উন্মাদনা হইলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি, আমাকে এইসব কথা বলে? যাহা হউক, চুপ করিয়া রহিলাম, অদ্ভুত পাগল যাহা ইচ্ছা বলিয়া যাইতে লাগিলেন। পরক্ষণে আমাকে তথায় থাকিতে বলিয়া তিনি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন এবং মাখন, মিছরি ও কতকগুলি সন্দেশ আনিয়া আমাকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। আমি যত বলিতে লাগিলাম, আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি সঙ্গীদের সহিত ভাগ করিয়া খাইগে’, তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না। বলিলেন, “উহারা খাইবে এখন, তুমি খাও।’–বলিয়া সকলগুলি আমাকে খাওয়াইয়া তবে নিরস্ত হইলেন। পরে হাত ধরিয়া বলিলেন, বল, তুমি শীঘ্র একদিন এখানে আমার নিকট একাকী আসিবে?’ তাঁহার ঐরূপ একান্ত অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া অগত্যা ‘আসিব’ বলিলাম এবং তাঁহার সহিত গৃহমধ্যে প্রবেশপূর্বক সঙ্গীদিগের নিকটে উপবিষ্ট হইলাম।
“বসিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম ও ভাবিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তাহার চালচলনে, কথাবার্তায় অপর সকলের সহিত আচরণে উন্মাদের মতো কিছুই নাই। তাহার সদালাপ ও ভাবসমাধি দেখিয়া মনে হইল সত্য সত্যই ইনি ঈশ্বরার্থে সর্বত্যাগী এবং যাহা বলিতেছেন তাহা স্বয়ং অনুষ্ঠান করিয়াছেন।…নির্বাক হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, উন্মাদ হইলেও ঈশ্বরের জন্য ওইরূপ ত্যাগ জগতে বিরল ব্যক্তিই করিতে সক্ষম, উন্মাদ হইলেও এ ব্যক্তি মহাপবিত্র, মহাত্যাগী এবং ওইজন্য মানব হৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাইবার যথার্থ অধিকারী! ওইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেদিন তাহার চরণ-বন্দনা ও তাহার নিকটে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।”
অবিস্মরণীয় এই প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণ আজও হয়নি। এ বিষয়ে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথেরও কিছু সংযোজন আছে।
“শুনিয়াছি যে, নরেন্দ্রনাথ পরমহংস মশাই-এর নিকট যাইবার কিছু কাল পরে, কোনো এক যুবক আর একজনের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যান। যুবকটির সঙ্গে যে লোকটি ছিলেন তাহার কাছে নরেন্দ্রনাথের কুশল সংবাদ পাইয়া পরমহংস মশাই বলিলেন, লরেন অনেকদিন আসেনি, দেখতে ইচ্ছে হয়েছে এক বার আসতে বলো। পরমহংস মশাই-এর সহিত কথাবার্তা কহিয়া, রাত্রে তাহার ঘরের পূর্বদিকের বারান্ডায় উভয়ে শয়ন করিলে কিছু কাল পরেই, পরমহংস মশাই বালকের মতো তাহার পরনের কাপড়খানি বগলে করিয়া তাহাদের একজনকে ডাকিয়া জিজ্ঞেস করিলেন, ‘তুমি কি ঘুমোচ্ছ? যাঁহাকে ডাকিয়া পরমহংস মশাই জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি উত্তরে করিলেন, “আজ্ঞে না।” পরমহংস মশাই বলিলেন, ‘দেখ লরেনের জন্য প্রাণের ভেতর যেন গামছা-নেংড়ানোর মতো মোচড় দিচ্ছে!’ সে রাত্রিতে নাকি পরমহংস মশাই-এর নরেন্দ্রনাথের জন্য উৎকণ্ঠ ভাব কিছুমাত্র কমে নাই। কারণ তিনি কিছুক্ষণ শয়ন করিবার পর, আবার আসিয়া ওই কথাই বলিতে লাগিলেন যেন, নরেন্দ্রনাথের অদর্শনের জন্য বড়ই ব্যথিত হইয়া পড়ায় তাহার ঘুম হইতেছিল না।
“পরমহংস মশাই, আমাদের গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিটের বাড়িতে, নরেন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে খুঁজিতে আসিতেন। কিন্তু কখনো বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেন নাই, রাস্তায় অপেক্ষা করিতেন। তিনি বাড়ির একটু কাছে আসিলে অনেক সময় আমি অগ্রসর হইয়া যাইতাম। আমায় বলিতেন, ‘লরেন কোথায় লরেনকে ডেকে দাও’ আমি তাড়াতাড়ি আসিয়া দাদাকে সন্ধান করিয়া ডাকিয়া দিতাম। অনেক সময় পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথের সহিত কথাবার্তা কহিয়া তাহাকে ডাকিয়া লইয়া যাইতেন।
“পরমহংস মশাই নরেন্দ্রনাথকে আদর করিয়া ‘শুকদেব’ বলিয়া ডাকিতেন। শুকদেব যেন দ্বিতীয় বার জগতে আসিয়াছেন। নরেন্দ্রনাথ শুকদেবের মতো জ্ঞানী হইবে, জগতে সমস্ত কার্য করিবে, কিন্তু জগৎকে চুইবে না, প্রভৃতি বহুবিধ অর্থে তিনি নরেন্দ্রনাথকে শুকদেব বলিতেন। বাবা এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া বলিতেন, “হ্যাঁ, হয়েছে বটে, ব্যাসদেবের বেটা শুকদেব। ম্যাকনামারার বেটা কফিন-চোর!”–অর্থাৎ ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব মহৎ হইয়াছিলেন, এ কথা সত্য কিন্তু বড়সাহেব ম্যাকনামারার পুত্র হইল কিনা শবাধার-চোর। নরেন্দ্রনাথ সেইরকম হইবে। তখনকার দিনে কফিন-চোর’ কথাটির বড় প্রচলন ছিল। নরেন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে একজন শ্রেষ্ঠ লোক হইবে, এই কথা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া তিনি বিদ্রূপ করিয়া এইরূপ বলিতেন। তিনি বিরক্ত হইতেন না, বরং খুশি হইতেন।
“নরেন্দ্রনাথ ছুটি পাইলে, নিজে নৌকা বাহিয়া দক্ষিণেশ্বরে যাইত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের সময় নরেন্দ্রনাথ গঙ্গা দিয়া নৌকা বাহিয়া যাইত, এইজন্য বাবা অনেক সময় বিরক্ত হইতেন। তিনি বলিতেন, যাতায়াতের একখানা গাড়ি করে গেলেই তো হয়। এরকম ঝড়-তুফানে গঙ্গা দিয়ে যাবার কি দরকার? রাম তো টানা গাড়ি করে যায়।-একেই বলে ডানপিটে ছেলের মরণ গাছের আগায়। এরকম ডানপিটেমি করার কি দরকার?’কিন্তু নরেন্দ্রনাথ এ সকল কথায় বিশেষ কান না দিয়া, নিজের মনোমত দুই-একটি বন্ধু সঙ্গে লইয়া নৌকা করিয়া অনেক সময় দক্ষিণেশ্বরে যাইত। হেদোর পুকুরে নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি সকলে নৌকার দাঁড় টানিতে বেশ পারদর্শী হইয়াছিল। আহিরীটোলার ঘাটে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া, অনেক সময় নিজেরাই মাঝিদের দাঁড় লইয়া টানিতে টানিতে দক্ষিণেশ্বরে যাইত। এইরূপ যাওয়াতে কতকটা নৌকা বাহিয়া আমোদ করা হইত। এবং পরমহংস মশাইকে দর্শন করিতে যাওয়াও হইত।
“তখনকার দিনে দক্ষিণেশ্বরে গাড়ি করিয়া যাইবার পথ অতি কষ্টকর ছিল। গরানহাটা হইতে বরানগরের বাজার পর্যন্ত গাড়ি যাইত, তাহার পর, সমস্ত পথটা হাঁটিয়া যাইতে হইত।
“নরেন্দ্রনাথ সব সময় পরমহংস মশাইকে বলিত, তুমি মুখু লোক, লেখাপড়া জান না, তোমার কাছে আবার দর্শনশাস্ত্রের কথা কি শিখব? আমি এসব বিষয় ঢের জানি। কখনো কখনো তর্কের ছলে তাহার কথার মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইত। অপরে ইহাতে বিরক্ত বা মনঃক্ষুণ্ণ হইতেন। পরমহংস মশাই হাসিতে হাসিতে বলিতেন, “ও আমাকে গাল দেয়, কিন্তু ভেতরে যে শক্তি আছে, তাকে গাল দেয় না। পরমহংস মশাই-এর কী গুণগ্রাহী ভাব, কী উদার ভাব। সংকীর্ণ ভাব, গুরুগিরির ভাব–এসব কিছুই তাঁহার ছিল না। এইজন্য তিনি ঝাঝালো ও তেজী নরেন্দ্রনাথের এত প্রশংসা করিতেন এবং তাহাকে এত ভালোবাসিতেন। ইহাকেই বলে কদর দান, গুণের আদর করা।
“নরেন্দ্রনাথ এইরূপ আঁঝালো মেজাজে পরমহংস মশাই-এর সহিত সমান সমান ভাবে তর্ক করিত। পরমহংস মশাইও তাতে হাসিয়া আনন্দ করিতেন। এক ব্যক্তি নরেন্দ্রনাথের অনুকরণ করিয়া পরমহংস মশাই-এর সহিত কথা কহিতে গিয়াছিলেন। পরমহংস মশাই অমনি বিরক্ত হইয়া বলিয়াছিলেন, লরেন বলে–লরেন বলতে পারে, তা বলে তুই বলতে যাসনি। তুই আর লরেন এক না। এই বলিয়া তাহাকে ধমক দিয়াছিলেন।”
মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন, নরেন্দ্রনাথ একবার এক যুবককে বলেছিলেন, “ওঁর কাছে যাই, সমাজ বা অন্য বিষয় শেখবার জন্য নয় …ওঁর কাছে spirituality (ব্রহ্মজ্ঞান) শিখতে হবে। এটা ওঁর কাছে আশ্চর্যরকম আছে।”
তবু মাঝে-মাঝে গুরু-শিষ্যে তর্কবিতর্ক চলত। এমনকি নরেন্দ্রনাথ মুখঝামটা দিয়ে পরমহংসমশাইকে বলেছেন, “তুমি দর্শনশাস্ত্রের কি জানো? তুমি তো একটা মুখু লোক।”
পরমহংস মশাই হাসতে হাসতে বলতেন, “লরেন আমাকে যত মুখু বলে, আমি তত মুখু লই।…আমি অক্ষর জানি।” রোমাঁ রোলাঁ জানিয়েছেন, সংস্কৃতে কথা বলতে না পারলেও শ্রীরামকৃষ্ণ সংস্কৃত বুঝতেন। “আমার বাল্যকালে আমার একজন পড়শির বাড়িতে সাধুরা কি পরতেন, তা আমি বেশ বুঝতে পারতাম।”
শুরুতে গুরু-শিষ্য যতই তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাটি হোক, এঁরা দুজনে মিলেই বিশ্ববিজয় করেছেন। একালের ভারতবর্ষে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার চেলা বিবেকানন্দ সমস্ত বাধা অতিক্রম করে যে নট আউট রয়েছেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৭৫তম জন্মজয়ন্তী এবং স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উৎসব তারই ইঙ্গিত করে।
=========
শ্রাবণের শেষ দিনে কাশীপুর উদ্যানে
রসগোল্লার লোভে শিষ্যের দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আগমন। তারপর মাত্র কয়েক বছর, এরই মধ্যে পরস্পরকে প্রথম আবিষ্কার এবং ভাবের আদানপ্রদান। এরই মধ্যে দুরারোগ্য ব্যধির আক্রমণ, তবু যাবার আগে প্রিয় শিষ্যের প্রতি নিঃশেষে ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর সমস্ত শক্তি ও উপলব্ধি। শেষ পর্ব কাশীপুরে ১২৯৩ সালে শ্রাবণমাসের শেষ দিনে।কৃষ্ণাপ্রতিপদেনরেন্দ্রনাথের আচার্য যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটী থেকে মহাপ্রস্থানের পথে পা দিয়েছিলেন। তারপর বহু বছর ধরে তার অন্ত্যলীলা সম্পর্কে সর্বস্তরে অন্তহীন আলোচনা চলেছে। কবি, পুঁথিকার, সন্ন্যাসীসন্তান, গৃহীভক্ত এবং অনুরাগীরা যেসব ইতিবৃত্ত রেখে গিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করে বিশিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণ গবেষকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন নানা ভাষায়। সেবিষয়ে তথ্যানুসন্ধানীদের প্রধান অবলম্বন স্বামী সারদানন্দের অমর সৃষ্টি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ নামক পাঁচ খণ্ডের সুবিশাল গ্রন্থ।স্বামী সারদানন্দের এই বইটি বাংলা জীবনীসাহিত্যে এক দিকচিহ্ন, তবু যা সাবধানী পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না তা হ’ল কাশীপুর উদ্যানবাটীপর্বের কিছু উল্লেখ পঞ্চম খণ্ডে থাকলেও শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তিমকালের কোনও বর্ণনা এই বইতে নেই।
লীলাপ্রসঙ্গকে যাঁদের কাছে অসমাপ্ত বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে অনুরোধ সম্প্রতি বেদান্ত সোসাইটি অফ সেন্ট লুইস, ইউ. এস. এ. থেকে লীলাপ্রসঙ্গের যে পূর্ণাঙ্গ ইংরিজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে অনুবাদক স্বামী চেতনানন্দের মহামূল্যবান ভূমিকাটি পড়ে দেখুন। স্বামী চেতনানন্দ সবিনয়ে আমাদের জানিয়েছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের তেইশ বছর পরে স্বামী সারদানন্দ পরমপূজ্য ঠাকুরের জীবনকথা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেন। ১৯০৯ সালে বাংলা উদ্বোধন পত্রিকায় যে ধারাবাহিক জীবনকথা প্রথম প্রকাশিত হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯১৯ সালে। লীলাপ্রসঙ্গ সম্বন্ধে যে সংবাদটি কৌতূহলোদ্দীপক তা হলো প্রথমে লেখা হয় তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড, তারপর দ্বিতীয়, প্রথম এবং সর্বশেষে পঞ্চম খণ্ড। লীলাপ্রসঙ্গের পঞ্চম খণ্ড যে অসম্পূর্ণ তা স্বামী সারদানন্দের অজানা ছিল না, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের বিবরণ লিপিবদ্ধ করার অনুপ্রেরণা তিনি অন্তর থেকে অনুভব করেননি, তাই ওই পথে আর এগনো হয়নি।
শেষজীবনের এই শূন্যস্থানটি পূরণের জন্য রামকৃষ্ণ পুঁথির কবি অক্ষয়কুমার সেন থেকে শুরু করে এক শতাব্দী পরে স্বামী প্রভানন্দ পর্যন্ত অনেকে যথেষ্ট ধৈর্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন, তবু এইসব রচনায় অনুসন্ধিৎসুর মন পরিপূর্ণ হয় না। অন্য সমস্যা আছে, বিভিন্ন স্মৃতিকথার বিবরণে কিছু কিছু সংঘাতও রয়েছে। সময়ের দীর্ঘদূরত্বে, বিভিন্ন বিবরণের মধ্যে কোনটা সত্য এবং কোনটা অনিচ্ছাকৃত প্রমাদ তা ঠিকভাবে বলা ইদানিং কঠিন হয়ে উঠেছে।
যেমন ধরুন শ্রাবণসংক্রান্তির রবিবার ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধিলগ্নে নরেন্দ্রনাথ কি তার শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন? পরের দিন ১৬ আগস্ট কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্মশানযাত্রার আগে দ্য বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স দুটি গ্রুপ ফটো নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এই ছবির একটিতে অর্ধশত শোকার্তজনের উপস্থিতি, কেন্দ্রস্থলে নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু পুঁথিতে বলছে, ঠাকুরের যাতে ঘুম আসে তার জন্য পদসেবায় স্বয়ং শ্রীনরেন্দ্র নরবর। প্রভুকে অতঃপর সুস্থ দেখে নরেন্দ্র দোতলা থেকে একতলায় নেমে গেলেন বিশ্রামের জন্যে। ঘরে সেবকের তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে জেগে রইলেন শশী যিনি পরবর্তীকালে সব গুরুভাইদের মত অনুযায়ী স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামের জন্য যোগ্যতম বিবেচিত হয়েছিলেন।
এই শশী যে স্বামী সারদানন্দের সম্পর্কে খুড়তুতো ভাই তা ভক্তমহলে সবাই জানেন। কাশীপুরে তখন রাত্রি ১টা বেজে ২ মিনিট। এক বিদেশিনী কুমারী লরা এফ গ্লেন (ভগিনী দেবমাতা), ১৯০৯ সালে মাদ্ৰাজমঠে এসে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের সঙ্গে কাশীপুর সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলেন। শশী মহারাজ তাকে জানান, “অকস্মাৎ রাত একটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ একপাশে ঢলে পড়লেন। তার গলা থেকে ক্ষীণ শব্দ বেরুতে থাকে।…নরেন্দ্র চট করে ঠাকুরের পা দুখানি বিছানার ওপর রেখে দৌড়ে নিচে নেমে গেল, যেন ঠাকুরের দেহের এই পরিণতি সে সইতে পারছিল না।”
তা হলে শেষমুহূর্তে নরেন্দ্রর উপস্থিতি সম্পর্কে দুটো মতামত পাওয়া যাচ্ছে। সময় সম্পর্কেও রয়েছে কিছু মতপার্থক্যরাত একটা, একটা দুই এবং ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত (ঠাকুরের নিতান্ত ঘনিষ্ঠ, কঁকুড়গাছি যোগোদ্যানের স্রষ্টা, নরেন্দ্রনাথের দিদিমা রঘুমণিদেবীর মামাতো ভাই) তার শ্রীরামকৃষ্ণ বৃত্তান্তে জানিয়েছেন, তখন রাত্রি ১টা বেজে ৬ মিনিট। মহাসমাধির সময় রামদাদা কাশীপুরে উপস্থিত ছিলেন না, সুতরাং তার বর্ণনা ঠিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নয়।
শ্রাবণের শেষ রবিবারে কাশীপুরের ঘটনাবলী সম্পর্কে যেখানে যতটুকু জানা যায় তা একত্রিত করার সবচেয়ে কঠিন কাজটি করেছেন স্বামী প্রভানন্দ তার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা গ্রন্থে। এই বইয়ের প্রধান তথ্যসূত্র কথামৃত রচনাকার শ্রীম’র অপ্রকাশিত ডায়েরি যা এই লেখক দেখবার ও ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরেও কিছু অনুসন্ধানকার্য চালু রয়েছে। যেমন গবেষক শ্ৰীনির্মলকুমার রায়, প্রমাণ করেছেন ঠাকুরের চিকিৎসক দুর্গাচরণ ব্যানার্জি বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পিতৃদেব নন। ঐসময়ে একই নামে তালতলায় আর একজন চিকিৎসক ছিলেন। এঁর বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ চিকিৎসার জন্যে যেতেন, কিন্তু তাঁর বাড়ির হদিশ পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানকর্মে অশেষ ধৈর্য ছিল প্রয়াত নির্মলকুমার রায়ের। তাঁর মতে, কলকাতায় অন্তত ১৪টি বাড়ি, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও না কোনও সময়ে গিয়েছিলেন তার কোনও অস্তিত্ব নেই। খোদ কলকাতায় রামকৃষ্ণস্মৃতিধন্য আরও ১৭টি বাড়ির হদিশ পাওয়া যায়নি, এরই মধ্যে রয়েছে তালতলায় ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
মহাপুরুষদের শরীর ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে নির্ভরযোগ্য অথচ রুদ্ধশ্বাস গ্রন্থ রচনার রেওয়াজ রয়েছে পাশ্চাত্যে। এদেশে কয়েকবছর আগে শ্রীরামকৃষ্ণের বিভিন্ন অসুখ সম্বন্ধে সুদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন ডাঃ তারকনাথ তরফদার। এই লেখককে না দেখলেও তার ছবি দেখেছি, তরুণ এই গবেষকের প্রবন্ধের নাম ‘অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর’। ডাঃ তরফদার বলেছেন, দুর্গাচরণ ব্যানার্জির চেম্বারে রোগী শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন ঘটেছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫।
ইদানীং আরও কিছু সংবাদ এসেছে বিদেশ থেকে। মার্কিন দেশের সন্ন্যাসী স্বামী যোগেশানন্দর ইংরিজি বই (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) সিক্স লাইটেড উইনডোজ’ এদেশে বিক্রি হয় না, কিন্তু অনুসন্ধানীদের অবশ্যপাঠ্য। যোগেশানন্দ সাবধানী লেখক, তাঁর স্মৃতিকথায় প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছে, ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সন্ন্যাসীরা আত্মজীবনী রচনা করেন না, কারণ সন্ন্যাসপূর্ব জীবনের মৃত্যু ঘটিয়ে, আত্মশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে, বিরজা হোমের শেষে সন্ন্যাসীরা নবজীবনে প্রবেশ করেন, পূর্বাশ্রমের সঙ্গে তারা সম্পর্কহীন। পশ্চিমে যেসব খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসী এই ধরনের কাজ করেছেন, তাদের অনেকে বইয়ের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, চার্চের প্রবীণতরদের নির্দেশেই সঙ্রে প্রয়োজনে তারা নিজেদের জীবনকথা রচনায় হাত দিয়েছেন। রামকৃষ্ণ মঠের এই সন্ন্যাসী তাঁর স্মৃতিকথার শুরুতে বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিমের ক্ৰশকালচারাল মিলনের প্রথমপর্বে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয় তার কিছু কিছু লিখিত নিদর্শন থাকলে পরবর্তীকালের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসী উভয়েরই কাজে লাগতে পারে।
স্বামী যোগেশানন্দ তাঁর ইংরিজি বইতে দীর্ঘকাল আমেরিকা প্রবাসী প্রাণবন্ত সন্ন্যাসী স্বামী নিখিলানন্দের মুখে কাশীপুরে রবিবারের সেই রাত্রি সম্পর্কে যা শুনেছেন তা লিপিবদ্ধ করেছেন। স্বামী নিখিলানন্দ এই কাহিনি শুনেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের অধ্যক্ষ, ঠাকুরের পরমপ্রিয় এবং স্বামী বিবেকানন্দর আমৃত্যু অনুরাগী স্বামী অখণ্ডানন্দের কাছ থেকে। এঁকেই আদর করে স্বামী বিবেকানন্দ ডাকতেন ‘গ্যাঞ্জেস’ বলে (ওঁর ডাকনাম গঙ্গাধর) এবং ভগ্নী নিবেদিতা তার কালজয়ী দুর্ভিক্ষ ত্ৰাণকার্যের জন্য ডাকতেন ‘দ্য ফেমিন স্বামী’ বলে। স্বামী অখণ্ডানন্দ বিবেকানন্দর দেহত্যাগের পরও পঁয়ত্রিশ বছর (১৯৩৭ সাল পর্যন্ত) বেঁচেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির তারিখের এই কাহিনিটি বাংলা কোনও পত্রিকা বা বইতে আজও আমার নজরে পড়েনি। স্বামী নিখিলানন্দ যখন তার আপনজনদের কাছে এই কথা বলে গিয়েছেন তখন তা অবিশ্বাস করার কথা ওঠে না।
১৮৮৫ রবিবার ১৫ আগস্ট পরমহংসদেবের শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ, কোনও কিছুই ক্যানসার রোগাক্রান্ত গলা দিয়ে প্রবেশ করতে চায় না। আগেকার নিয়মকানুন না মেনে ঠাকুর কিছুদিন আগে ডাক্তারের নির্দেশে কচি পাঁঠার মাংসের সুরুয়া পান করতে রাজি হয়েছে। শর্ত একটি ছিল, “যে দোকান থেকে মাংস কিনে আনবি সেখানে যদি কালীমুর্তি না থাকে তবে কিনবি না।” একজন সেবক প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই অনুযায়ী মাংস কিনে আনতেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীসারদামণির স্মৃতিকথায় পাওয়া যাচ্ছে : “কাশীপুরে কঁচা জলে মাংস দিতুম, কখনও তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মতন সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম।..মাংসের জুস হ’ত। দুটো কুকুর তার ছিবড়ে খেয়ে এই মোটা হ’ল।” কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যে একটি রাঁধুনি বামুন আনানো হয়েছিল তার উল্লেখ আছে মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর দিনলিপিতে। আরও জানা যায়, রাঁধুনিটি এসেছিল ঠাকুরের গ্রাম থেকে, কিন্তু রান্নাবাড়া সে প্রায় কিছুই জানত না।
স্বামী যোগেশানন্দের ইংরাজি বইতে ঠাকুরের শেষদিনের বর্ণনা : মর্তলীলার শেষদিনে শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি ডিম সেদ্ধ খাবেন। (অবশ্যই হাঁসের ডিম, মুরগী তখন বাঙালির ঘরে নিষিদ্ধ।) অবাক কাণ্ড, কারণ এই ধরনের ইচ্ছে আগে তিনি কখনও প্রকাশ করেননি। সেই মতো দুটো ডিম সেদ্ধও করা হয়েছিল, কিন্তু সারাদিন ধরে যেসব বিপর্যয় গেল তার পরে এই ডিম তার খাওয়া হয়নি। এরপরেই স্বামী অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথন, মধ্যরাতে যখন সব শেষ হয়ে গেল, তখন নরেন্দ্র বললেন, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, কী করা যায়? এই বিবরণ শুনে স্বামী নিখিলানন্দ পরে বলেছিলেন, এই সময়ে তো খিদে পাবার কথা নয়। স্বামী অখণ্ডানন্দর উত্তর : ”যা হয়েছিল তা বলছি। ডিম সিদ্ধর খবর পেয়ে খিদেয় পাগল নরেন্দ্রনাথ ডিম দুটি খেয়ে ফেলে নিজেকে সামলালেন।” অখণ্ডানন্দের মতে, নরেন ও রামকৃষ্ণ যে একাত্ম হয়ে গিয়েছে, এইভাবে ডিম খাওয়াটা তারই নিদর্শন।
কাশীপুরে দীর্ঘদিন ধরে বিরতিহীন সেবাকার্যে নিয়ত জর্জরিত হয়ে বারোজন ত্যাগী সন্তানের শরীরে তখন কিছুই ছিল না। কে কতক্ষণ রোগীর পাশে ডিউটি দেবে, কে কলকাতায় ডাক্তারের কাছে যাবে, কে পথ্য সংগ্রহ করে এনে কীভাবে তা প্রস্তুত করবে তা বুঝিয়ে দেবে, এসবই ঠিক করে দিতেন নেতা নরেন্দ্রনাথ। ঘড়ির কাঁটার মতন কাজ হ’ত, কিন্তু সময়ের নির্দেশ মানতে চাইতেন না শশী ও তার ভাই শরৎ (সারদানন্দ)।
ঠাকুরের সেবার সময় শশীর খাওয়াদাওয়ার কথা মনেই থাকত না, বারবার ছুটে আসতেন অমৃতপথযাত্রীর শয্যাপার্শ্বে। এই প্রসঙ্গে স্বামী প্রভানন্দ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ঠাকুর’ কথাটি তাঁর দেহাবসানের পরে সৃষ্টি হয়, ভক্তগণ জীবিতকালে বলতেন ‘পরমহংসদেব’, অন্যেরা ‘পরমহংসমশাই’, অনেকে ব্যাঙ্গ করে ‘গ্রেটগুজ্’!
কাশীপুর থানার ডেথ রেজিস্টারেও ইংরিজিতে লেখা, রাম কিষ্টো প্রমোহংস’, নিবাস: ৪৯ কাশিপুর রোড, জাতি : ব্রাহ্মণ, বয়স ৫২, পেশা : ‘প্রিচার’ অর্থাৎ প্রচারক। মৃত্যুর কারণ : গলায় আলসার, অর্থাৎ ক্ষত। সংবাদদাতা গোপালচন্দ্র ঘোষকে ‘বন্ধু’ বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই ‘বন্ধু’টি আসলে ভক্তমহলের সুপরিচিত বুড়োগোপাল, যিনি পরে স্বামী অদ্বৈতানন্দ নামে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।
শ্রাবণের শেষ রাতে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত ত্যাগী সন্তানদের আর একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা রেখে গিয়েছেন স্বামীজির মধ্যমভ্রাতা শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত তার ‘শ্রীমৎ সারদানন্দ স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলি’ গ্রন্থে।
শোকার্ত সময়ে চা খাওয়া সম্বন্ধে শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) একটি গল্প বলতেন, “ওহে, শিবরাত্রির উপোস করে, আমাদের চা খেতে কোনও দোষ নেই। কেন জান? যেদিন তাঁর (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের) দেহত্যাগ হয় সকলেই বিষণ্ণ, খাওয়া-দাওয়া কিছুই হল না। কেই বা উনোন জ্বালে। আর কেই বা রান্না করে। অবশেষে দরমা জ্বালিয়ে কেটলি করে জল গরম করে চা হ’ল আর ঢক ঢক করে খাওয়া গেল। অমন শোকর দেহত্যাগের দিনেও চা খেয়েছিলুম, তা শিবরাত্রির উপোস করে চা কেন খাওয়া চলবে না বল?”
প্রসঙ্গত বলি, স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত একবার প্রিয় শরৎ মহারাজকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি এত চা খেতে শিখলে কোথা থেকে?” স্বামী সারদানন্দ হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমার ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে। তোমাদের বাড়িতে যে চায়ের রেওয়াজ ছিল সেইটা মঠে ঢুকিয়ে দিলে আর আমাদের চা-খোর করে তুললে! তোমরা হচ্ছ একটা নারকটিক’ ফ্যামিলি!”
কঠিন সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কঠিনতম দুঃখের মোকাবিলার দুর্লভ শিক্ষা পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্ররা। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরম অবজ্ঞাভরে তারা তাই বলতে পেরেছেন, আমার তো জন্মই হয়নি, সুতরাং মৃত্যু হবে কী করে?
তবু দুরন্ত দুঃখ এবং প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা, হৃদয়বান সন্ন্যাসীকেও ক্ষণকালের জন্য অশ্রুভারাক্রান্ত করে তোলে, স্বামীজি নিজেই একবার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, “কী বলেন মশাই, সন্ন্যাসী হয়েছি বলে হৃদয় থাকবে না?”
বৈরাগ্য ও ভালবাসার, আকর্ষণ ও বিকর্ষণের পরস্পরবিরোধী শক্তি, রামকৃষ্ণতনয়দের ব্যক্তিজীবন ও সন্ন্যাসজীবনকে এক আশ্চর্য রঙিন আভায় বারবার আলোকিত রেখেছিল। এই জন্যেই বোধ হয় যখন আমরা শুনি, ঠাকুরের দেহাবসানের পর শোকার্ত নরেন্দ্রনাথ আত্মহননে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন আশ্চর্য হই না। প্রেমের ঠাকুর এবং সর্বস্বত্যাগী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ দু’জনেই আমাদের বোধের ঊর্ধ্বে থেকে যান।
.
শুরুতেই আরও কয়েকটা সহজ কথা বলে রাখা ভাল। দক্ষিণেশ্বরে অনেকদিন শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য জানিয়েছেন, সুস্থ অবস্থায় তিনি আধসের থেকে দশ ছটাক চালের ভাত খেতেন। ব্যাধি বলতে আমাশয়, প্রায়ই পেট গোলমাল হত। আরও রিপোর্ট, একবার বায়ুবৃদ্ধি রোগে কাতর হলে, আগরপাড়ার বিশ্বনাথ কবিরাজ তার চিকিৎসা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রশ্ন, “হারে তামুক খেলে কী হয়?” কবিরাজ শেষপর্যন্ত পরামর্শ দেন, ছিলিমের ওপর ধানের চাল ও মৌরী দিয়ে তামাক খেও। ঠাকুর সেই পরামর্শ মেনে চলতেন। কিন্তু ধূমপানের সঙ্গে ক্যান্সারের নিবিড় সম্পর্ক সম্বন্ধে ডাক্তার ও নাগরিক তখনও সচেতন হননি।
যথেচ্ছ ধূমপানটা হয়ে উঠেছিল সেকালের বঙ্গীয় জীবনের অঙ্গ। প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথ যে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েই ধূমপান শুরু করেন তার ইঙ্গিত রয়েছে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-লীলামৃত নামক গ্রন্থে। “পাঠাগারদ্বার আবদ্ধ থাকিত, অর্থাৎ যখন-তখন তামাক খাইতেন বলিয়া পিতা (বিশ্বনাথ দত্ত) কহিতেন বাবাজি বুঝি ঠাকুরকে ধূপধুনা দিতেছেন, তাই দ্বার বন্ধ। কিন্তু লেখাপড়ায় উন্নতি দেখিয়া কিছু বলিতেন না।”
ঠাকুরের ধূমপানপ্ৰীতিকে ভক্ত জনেরা তাঁর দেহাবসানের পরেও নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আজও বেলুড়মঠে সন্ধ্যায় ঠাকুরের শেষ সেবাটির নাম হুঁকোভোগ। সুগন্ধী তামাক প্রজ্জ্বলিত কলকেতে স্থাপন করে ঠাকুরের কক্ষে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে রাতের বিশ্রামের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতেও হুঁকো কলকের অন্য ব্যবহার হয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর ত্যাগী ভাইরা যখন ধুনি জ্বালিয়ে সন্ন্যাসীদের মতন অঙ্গে ভস্ম লেপন করতেন তখন অন্য ছাইয়ের অভাবে হুঁকোর টিকের ছাই ব্যবহার করতেন। এই অবস্থায় নরেন্দ্রনাথের যে ফটোগ্রাফটি কালের অবহেলা সহ্য করে আজও টিকে আছে তা বিশেষজ্ঞদের মতে কাশীপুরে গৃহীত হয় ১৮৮৬ সালে। এইটাই এখনকার সংগ্রহে নরেন্দ্রনাথের প্রথম ছবি, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কে এই ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন, ফটোগ্রাফার কে–তা আজও স্পষ্ট নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণের ছবির সংখ্যা হাতে গোনা হলেও ছবির বিস্তারিত বিবরণ আমাদের জানা নেই। ঠাকুরের যে ছবিটি এখন সারা বিশ্বে বন্দিত তা যে ভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দক্ষিণেশ্বরে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের শিক্ষানবিশ অবিনাশচন্দ্র দাঁয়ের তোলা এবং স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ বিশেষ সাহায্য না করলে সমাধিমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণের এই অমূল্য ছবিটি আমরা পেতাম না তা গ্রন্থিত হয়েছে।
আমরা জানি, অসাবধানতাবশতঃ অবিনাশ দায়ের হাত থেকে কাঁচের নেগেটিভাটি পড়ে তা ফেটে যায়, কিন্তু ফটোগ্রাফার খুব সাবধানে পিছনের অংশটি গোলাকৃতিতে কেটে ফেলে মূল ছবিটি রক্ষা করেন। পিছনের অর্ধ গোলাকার দাগটি ভারি সুন্দর মানিয়ে গিয়ে ছবিটিকে বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত লেখক বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল কাশীপুর পর্বে এই পদ্মাসনাস্থ ধ্যানমূর্তি সম্পর্কে ঠাকুরের নিজস্ব মন্তব্য আমাদের জন্য সংগ্রহ করে রেখে গিয়েছেন। ঠাকুর বলছেন, “ভবনাথের জেদে ছবি তোলাতে বিষ্ণুঘরের রকে বসে এমন সমাধিস্থ হই যে, ফটো উঠালেও ধ্যানভঙ্গ হ’ল না দেখে, আমি মরে গেছি ভেবে ফটোওয়ালা অবিনাশ যন্ত্রপাতি ফেলে পালায়।”
কাশীপুরে শ্রাবণের শেষরাতে শ্রীরামকৃষ্ণ মৃত না গভীর সমাধিমগ্ন তা স্থির করতে সেবকরা অক্ষম হন। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “তাই আমরা আশায় বুক বাঁধিয়া, এই জাগিবেন, এই উঠিবেন, ভাবিয়া সারারাত্রি প্রভুকে ঘিরিয়া তাহার অপূর্বভাব দেখিতে লাগিলাম।”
অন্তিমশয্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবন্ধে ডাঃ তারকনাথ তরফদার শ্রীরামকৃষ্ণের একটা মেডিক্যাল হিস্ট্রি খাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কথামৃতে এই অসুখের প্রথম উল্লেখ ২৪ এপ্রিল ১৮৮৫ : গলায় বিচি, শেষ রাত্রে কষ্ট হচ্ছে, মুখ শুকনো লাগছে। ডাক্তার তরফদারের আন্দাজ, অসুখের সূত্রপাত সম্ভবত বেশ কিছু আগে। অন্তিম রোগের প্রথম লক্ষণ, গলায় বিচি, ১৫-১৬ মাস পরে জীবনাবসান।
কথামৃত ও অন্যান্য সূত্র থেকে ডাক্তার গবেষকের রচনা থেকে আরও কয়েকটি উদ্ধৃতি।
২৬মে ১৮৮৫ : পানিহাটি মহোৎসবে মাতামাতির পর রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি।
১৩ জুন ১৮৮৫ : ফের গলায় বিচির উল্লেখ, সেই সঙ্গে সর্দি গয়েরে ‘বিশ্রী গন্ধ’।
২৮ জুলাই ১৮৮৫ : কথামৃত অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে শেষ গান। কিন্তু কাশীপুরে তিনি দু’এককলি গেয়েছেন।
আগস্ট ১৮৮৫: গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ শুরু। খেতে বা গিলতেও কষ্ট।
১১ আগস্ট ১৮৮৫ : ধর্মপ্রচারে অত্যধিক কথা বলায় এই রোগ। ডাক্তারি ভাষায়, ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’,এই দিন কিছুক্ষণের জন্যে মৌনীভাব।
৩১ আগস্ট ১৮৮৫ : রাত্রে সুজির পায়েস খেতে কোনো কষ্ট হ’ল না। অর্থাৎ খাবার খেতে কষ্ট শুরু হয়েছে। খেয়ে ঠাকুরের আনন্দ : “একটু খেতে পারলাম, মনটায় বেশ আনন্দ হল।” তবে রাত্রে গায়ে ঘাম।
১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার রাখালদাস ঘোষ ল্যারিনজোসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করলেন।
২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার দেখলেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় এলেন। কাশির প্রকোপ বৃদ্ধি।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ : রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি।
১ অক্টোবর ১৮৮৫ : রাত্রে যন্ত্রণা বৃদ্ধি, ঘুম নেই।
২ অক্টোবর ১৮৮৫ : শ্যামপুকুরের বাড়িতে এলেন।
৪ অক্টোবর ১৮৮৫ : রক্তপাত, প্রথমে কাঁচা, পরে কালো ঘন।
১২ অক্টোবর ১৮৮৫ : ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন।
১৫-১৭ অক্টোবর ১৮৮৫: এর মধ্যে কোনো একদিন ডাঃ সরকার ও তার বন্ধু সমাধির সময় শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেন।
৪ নভেম্বর ১৮৮৫ : ঠাকুর গুরুতর পীড়িত।
৮ নভেম্বর ১৮৮৫ : রক্তমেশা কফ পরীক্ষা–এই রিপোর্টের বিবরণ কারও কাছে নেই।
২৯ নভেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তার সরকারের সিদ্ধান্ত, রোগ ক্যানসার। এর আগে সেপ্টেম্বরে কবিরাজরা বলেছেন ‘রোহিণী’ রোগ।
রোগ লক্ষণ বিচার করে ডাঃ তরফদারের অনুমান, “রামকৃষ্ণদেবের অসুখ প্রাথমিকভাবে ‘হাইপোফ্যারিস’ (অথবা তার পরে ‘অরোফ্যারিন্কস’) অংশে শুরু হয়েছিল, স্বরযন্ত্রে নয়।”
.
শ্যামপুকুরের বাড়ি ছাড়বার জন্যে বাড়িওয়ালা প্রবল তাগাদা লাগাচ্ছিল। নতুন বাড়ির খোঁজ হচ্ছে। ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, আমি কি জানি? কাশীপুরনিবাসী ভক্ত মহিমাচরণ চক্রবর্তী একটা বাড়ির খবর দিলেন। রানী কাত্যায়নীর জামাই গোপালচন্দ্র ঘোষের উদ্যানবাটী, ঠিকানা : ৯০ কাশীপুর রোড, মাসিক ভাড়া ৮০।
যে তথ্যটি অস্বস্তিকর ও অপ্রচলিত, শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর ফিরে গিয়ে জীবনের শেষ ক’টি দিন সেখানে অতিবাহিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মন্দিরের পরিচালকদের অনুমতি মেলেনি।
কাশীপুর উদ্যানবাটির বাড়ি ভাড়া শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশ চিন্তিত করেছিল, ভক্তরা প্রতিমাসে চাদা তুলুক তা তাঁর পক্ষে অস্বস্তিকর। তখন গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রর ডাক পড়ল। ঠাকুর তাকে ‘সুরেন্দর’বা সুরেশ বলতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “দেখ সুরেন্দ্র, এরা সব কেরানি-মেরানি ছাপোষা লোক, এরা এত টাকা চাঁদা তুলতে পারবে কেন?…বাড়ি ভাড়ার টাকাটা তুমি দিও।”
সুরেন্দ্র সানন্দে রাজি হয়ে যান এবং বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তিপত্রে ছ’মাসের গ্যারান্টর হন। ৮০ টাকা ছাড়াও কাশীপুরপর্বে তিনি মাসে ২৩০ দিতেন। মদ খেয়ে রাত্রে গোলমাল করতেন বলে সুরেন্দ্রকে এক সময় দক্ষিণেশ্বরে পাঠানো হয়েছিল। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “দক্ষিণেশ্বর যাইয়া দেখেন, ঠাকুর নহবখানার নিকট বকুলতলায় দণ্ডায়মান। প্রণাম করিবামাত্র কহেন, ও “সুরন্দর! খাবি, খা, বারণ করিনে, তবে পা না টলে, আর জগদম্বার পাদপদ্ম হতে মন না টলে; আর খাবার আগে নিবেদন করে বলিস, মা তুমি এর বিষটুকু খাও, আর সুধাটুকু আমাকে দাও, যাতে প্রাণভরে তোমার নাম করতে পারি।”
মাসিক টাকা ছাড়াও কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের শোয়ার ঘরের খসখস পর্দা, ফুলের মালা, ফল প্রভৃতির খরচও বহন করতেন সুরেন্দ্র। মহাসমাধির পর ব্রাহনগরে বাড়িভাড়া (১১ টাকা) এবং খাওয়াদাওয়া বাবদ মাসিক ১০০ সুরেন্দ্রনাথই দিতেন।
কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে যে প্রচুর মশা ছিল তা জানা যাচ্ছে। দোতলার ঘরে ঠাকুর শায়িত, লণ্ঠন জ্বলে ও একটা মশারি টাঙানো। গিরিশ ও শ্ৰীমকে ঠাকুর বললেন, “কাশি কফ বুকের টান এসব নেই। তবে পেট গরম। ঘরেই পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরে যেতে পারব বলে মনে হয় না।” সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সেবক লাটু (পরে স্বামী অদ্ভুতানন্দ) তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “যে আজ্ঞা মশাই, হামি ত আপনার মেস্তর হাজির আছি।”
লাটুর (পূর্বনাম রাখতুরাম) মাধ্যমে আমরা জানি, একদিন টাকা পয়সার হিসেব রাখা নিয়ে কথা উঠল। নরেন বললেন, এত হিসেব রাখারাখি কেন? এখানে কেউ তো চুরি করতে আসেনি? লাটু বললেন, হিসেব রাখা ভাল।
গোপালদার ওপর হিসেব রাখার দায়িত্ব পড়ল। লাটু (স্বামীজি এঁকে প্লেটো বলে ডাকতেন) জানিয়েছেন, গেরস্তর পয়সা ঠাকুর বেফজল খরচ হতে দিতেন না। একবার দক্ষিণেশ্বরে একটা প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে কেউ তিন-চারটে কাঠি নষ্ট করেছিল। তক্তা থেকে নেমে ঠাকুর নিজেই দেশলাই ধরালেন এবং বললেন, “ওগো, গেরস্থরা অনেক কষ্টে পয়সা বাঁচিয়ে তবে সাধুকে দেয়, সে পয়সার বাজে খরচ হতে দেওয়া উচিত কি?”
ঠাকুরের গলার অসুখ সম্পর্কে লাটু মহারাজ আরও দুটি কথা বলেছেন। একবার দেশে ঠাকুরের দাদার বিকার হয়েছিল, ঠাকুর তাঁকে জল খেতে দিতেন না। তাই তিনি বলেছিলেন, মরবার সময় তোমার গলা দিয়ে জল গলবে না। দেখো। আর একবার কাকা কানাইরামের বড় ছেলে হলধারী (রামতারক চট্টোপাধ্যায়) দাদার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে, মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে এই অভিশাপ দিয়েছিলেন। হলধারী ঠাকুরের অবতার রূপ বিশ্বাস করতেন না।
.
কাশীপুর উদ্যানবাটিতে অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে। একটা শুনুন কালীর (পরে স্বামী অভেদানন্দ) মুখে।
“নরেন্দ্রনাথ আমার অপেক্ষা প্রায় চারি বৎসরের বড় ছিল। আমি নরেন্দ্রনাথকে সেই অবধি আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতার ন্যায় দেখিতাম ও ভালবাসিতাম। নরেন্দ্রনাথও আমায় আপনার সহোদরতুল্য ভালবাসিত। তাহা ছাড়া আমি যে তাহাকে শুধু ভালবাসিতাম তাহা নহে, তাহার আজ্ঞানুবর্তী হইয়া সকল কাজই করিতাম। বলিতে গেলে আমি ছায়ার মতো সর্বদা নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে-সঙ্গে থাকিতাম ও নরেন্দ্রনাথ যাহা করিত আমিও নির্বিবাদে তাহা করিতাম। তাহা ছাড়া নরেন্দ্রনাথ যাহা করিতে বলিত অকুণ্ঠিত হৃদয়ে তৎক্ষণাৎ তাহা করিতাম।
“আত্মজ্ঞান লাভ করা-সম্বন্ধে বিচার করিতে করিতে একদিন নরেন্দ্রনাথ হিন্দুদিগের আহারাদি-সম্বন্ধে যে সকল কুসংস্কার (prejudice) আছে তাহার বিরুদ্ধে জোর করিয়া আমাদিগকে বলিতে লাগিল। শরৎ, যোগেন, তারকদাদা ও আমি এই বিষয় লইয়া তাহার সহিত বিচার করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথ বলিল, ব্রহ্মজ্ঞান হলে সকলের হাতে খাওয়া চলে। তখন কেউ কাকেও ঘৃণা করে না। যতদিন কুসংস্কার থাকবে ততদিন ঠিক ঠিক ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।”
স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, “আমরা কেহই মুসলমানের হাতের রান্নাকরা খাদ্য পূর্বে কখনও খাই নাই। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মদিগের ন্যায় জাতিবিচার মানিত না। তাহার মত ছিল উদার, তাই সে সকলের হাতের রান্না খাদ্য খাইয়াছে। সেইদিন নরেন্দ্রনাথ আমাদের বলিল : ‘চলো, আজ তোমাদের কুসংস্কার ভেঙে আসি। আমি তৎক্ষণাৎ নরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে রাজি হইলাম এবং শরৎ ও নিরঞ্জন আমার কথায় সায় দিল। সন্ধ্যার সময়ে কাশীপুর বাগান হইতে পদব্রজে নরেন্দ্রনাথ আমাদের লইয়া বিডন স্ট্রিটে (বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার হইয়াছে) পীরুর রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হইল। নরেন্দ্রনাথ ফাউলকারীর অর্ডার দিল এবং আমরা সকলে বেঞ্চিতে নীরবে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। ফাউলকারী আসিলে আমরা সকলে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে কুসংস্কার ভাঙিতেছি ও ঘৃণা দূর করিতেছি এই ধারণা হৃদয়ে রাখিয়া তাহার অল্পমাত্র গ্রহণ করিলাম। নরেন্দ্রনাথ মহানন্দে প্রায় সমস্তটাই আহার করিল। আমরা একটুতেই সন্তুষ্ট। নরেন্দ্রনাথের কাণ্ডকারখানা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম এবং তাহার খাওয়া শেষ হইলে সকলে মহানন্দে পুনরায় কাশীপুরের বাগানে ফিরিয়া আসিলাম।
“তখন রাত্রি প্রায় দশটা। কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আমি শশব্যস্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করিবার জন্য তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর বহুক্ষণ আমাদের কাহাকেও কাশীপুরের বাগানে দেখিতে না পাইয়া উদ্বিগ্ন ছিলেন দেখিলাম। আমাকে সম্মুখে দেখিয়া তিনি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন : ‘কিরে, কোথায় সব গিয়েছিলি?’
আমি বলিলাম : কলকাতায় বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানে।
–‘কে কে গিছলি?’
আমি সকলের নাম করিলাম। তিনি সহাস্যে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সেখানে কি খেলি?’
আমি বলিলাম : মু–র ডালনা।
তিনি বলিলেন : ক্যামন লাগলো তোদের?
আমি : আমার ও শরৎ প্রভৃতির খুব ভাল লাগেনি। তাই একটুখানি মুখে দিয়ে কুসংস্কার ভাঙলাম।
শ্রীশ্রীঠাকুর উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, ‘বেশ করেছিস। ভাল হ’ল, তোদের সব কুসংস্কার দূর হয়ে গেল।’
আমি শ্রীশ্রীঠাকুরের অভয়বাণী শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম।”
.
ঠাকুরের ডাক্তারি বিবরণের দিকে আবার নজর দেওয়া যাক।
১২ ডিসেম্বর ১৮৮৫ : ঠাকুরের কাশি নেই, কিন্তু পেট গরম। কচি পাঁঠার সুরুয়া খেলেন।
২৭ ডিসেম্বর ১৮৮৫ : ডাক্তারি ওষুধ ছাড়াও দৈব ওষুধের প্রয়োগ।
।এই ওষুধ এসেছিল শ্রীরামপুর থেকে। শ্ৰীমকে “দেখিয়ে” ঠাকুর বলেন, ইনি দাম দেবেন। কিন্তু নবগোপাল ঘোষ ও চুনীলাল ইতিমধ্যেই দাম দিয়ে দিয়েছেন।
ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত এই পর্যায়ে লিখেছেন, ব্যাধির বিভীষিকা দেখালে রামকৃষ্ণ হেসে উঠতেন, বলতেন, “দেহ জানে, দুঃখ জানে, মন তুমি আনন্দে থাক।”
চণ্ডীগড় থেকে প্রকাশিত স্বামী নিত্যাত্মানন্দের বহুখণ্ডের বই শ্ৰীম দর্শনে, কাশীপুরের যে বর্ণনা আছে তা এইরকম : পশ্চিমের জানলার তিন চার হাত পূর্বে ঠাকুরের বিছানা। তার শিয়র থাকত দক্ষিণ দেওয়ালের গায়ে। বাঁদিকে তিন হাত দূরে খড়খড়ির জানলা। মেঝেতে মাদুরের ওপর পাতা শতরঞ্চি, তার ওপর শ্রীরামকৃষ্ণের বিছানা।
১লা জানুয়ারি ১৮৮৬ : সকালে শ্রীরামকৃষ্ণ দোতলা থেকে নিচেয় নেমে এসে অকাতরে যে আশীর্বাদ বিলিয়েছিলেন তা কল্পতরু উৎসব মারফত এখন লিজেন্ডে পরিণত হয়েছে। মঠ ও মিশনে এই অভাবনীয় ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। যে যা চেয়েছে তা দেওয়া ছাড়াও যে কিছু চায়নি তাকেও রামকৃষ্ণ বলেছেন, তোমার চৈতন্য হোক।
লীলাপ্রসঙ্গে এর ব্যাখ্যা : “রামচন্দ্র প্রমুখ কোনো কোনো ভক্ত এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়া বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদিগের বোধ হয়, উহাকে ঠাকুরের অভয়-প্রকাশ অথবা আত্মপ্রকাশপূর্বক সকলকে অভয়প্রদান বলিয়া অভিহিত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। প্রসিদ্ধি আছে, ভাল বা মন্দ যে যাহা প্রার্থনা করে কল্পতরু তাহাকে তাহাই প্রদান করে। কিন্তু ঠাকুর তো ওইরূপ করেন নাই, নিজ দেব-মানবত্বের এবং জনসাধারণকে নির্বিচারে অভয়াশ্রয় প্রদানের পরিচয় ওই ঘটনার সুব্যক্ত করিয়াছিলেন।”
আশ্চর্য বিষয় ঠাকুরের যেসব ভক্ত পরে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন তাদের একজনও কল্পতরুর দিনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। নরেন্দ্রনাথ আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত ঠাকুরের সেবা করে ক্লান্ত হয়ে উদ্যানবাটির এক তলায় ঘুমোচ্ছিলেন।
পরের দিন ২ জানুয়ারি ১৮৮৬ শনিবার যে ঠাকুরের শরীরের অবস্থার প্রবল অবনতি হয়েছিল তা ডাক্তার গবেষকরা খুঁজে বার করেছেন। পরের দিন রবিবার অন্তত দু’বার রক্তক্ষরণ। এর ক’দিন আগে তিনি কবিরাজের দেওয়া হরিতালভস্ম সেবন করেন, কিন্তু তা বমি হয়ে যায়।
১১ই জানুয়ারি ১৮৮৬ : কবিরাজ নবীন পালের ওষুধ প্রয়োগ। বাগবাজারের এই কবিরাজ শ্যামপুকুরেও এসেছিলেন এবং মর্তলীলার শেষ দিনে (১৫ আগস্ট) কাশীপুরে এসে তার অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণার কথা শোনেন।
১৩ জানুয়ারি ১৮৮৬ : ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেন, গলা থেকে কাঁধ পর্যন্ত সমস্ত ডান দিক ফুলে গিয়েছে। ওজন বেশ কমেছে। একমাত্র ‘কোনিয়াম’ প্রয়োগে সুফল।
২৮ জানুয়ারি ১৮৮৬ : ধর্মতত্ত্ব পত্রিকায় রিপোর্ট : ‘গলার স্বর একেবারে বন্ধ’, প্রায় দু-আড়াই সের রক্তক্ষরণ ও বাড়াবাড়ি হয় এদিন রাত্রে।
শ্যামপুকুরে এসে খরচের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্ত বলরাম বসুকে বলেছিলেন, “তুমি আমার খাবার খরচটা দিও। আমি চাঁদার খাওয়া পছন্দ করি না।” বলরাম বসু কৃতার্থ হয়েছিলেন।
.
এরপরের বিবরণ শোনা যাক স্বামী অভেদানন্দের ‘আমার জীবনকথা’ থেকে। “কাশীপুর বাগানে ক্রমশ সেবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।…রামবাবু প্রভৃতি গৃহস্থ ভক্তরা খাইবার খরচ কমাইবার জন্য সেবকের সংখ্যা যাহাতে অল্প হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বলিলেন, দুইজন সেবক থাকিলেই যথেষ্ট হইবে, অপর সকলে নিজ নিজ বাড়িতে থাকিবে।
“এই সংবাদ যখন শ্রীশ্রীঠাকুরের কর্ণে উপস্থিত হইল তখন তিনি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, আমার এখানে আর থাকবার ইচ্ছে নেই। ইন্দ্রনারায়ণ জমিদারকে টানবো নাকি?-না, বড়বাজারের মাড়ওয়ারীটাকে ডেকে আনব। সেই মাড়োয়ারী অনেক টাকা নিয়ে একবার এসেছিল, কিন্তু সে টাকা আমি গ্রহণ করিনি। তাহার পর বলিলেন, না, কাকেও ডাকার প্রয়োজন নেই। জগন্মাতা যা করেন তাই হবে।
“তখন নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি আমরা সকলে বসিয়া আছি, তিনি আমাদিগকে বলিলেন, ‘তোরা আমাকে নিয়ে অন্যত্র চল। তোরা আমার জন্য ভিক্ষে করতে পারবি? তোরা আমাকে যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই যাব। তোরা ক্যামন ভিক্ষে করতে পারিস দ্যাখা দেখি। ভিক্ষার অন্ন বস্ত্র শুদ্ধ। গৃহস্থের অন্ন খাবার আর আমার ইচ্ছে নেই।”
ভিক্ষেতে বেরিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের নানা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কেউ চাল, আলু, কাঁচকলা ভিক্ষা দিল, কেউ বলল, “হোঁকা মিনসে, চাকরি করতে পারিনি, আবার ভিখিরি সেজে ভিক্ষে করতে বার হয়েছিস।” কেউ বলল,”এরা ডাকাতের দল, সন্ধান নিতে এসেছে।” কেউ গুণ্ডার লোক বলে তাড়া করল। শ্রীমা ভিক্ষার চাল থেকে তরল মণ্ড বেঁধে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দিলেন, “ভিক্ষান্ন খেয়ে আমি পরমানন্দ লাভ করলাম”, তিনি বললেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীরামকৃষ্ণের স্বাস্থ্যবিবরণও অনুসন্ধানী ডাক্তার তারকনাথ তরফদার পরম যত্নে সাজিয়েছেন।
৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : বৈদ্য মহাফেজের নির্দেশ বুড়িগোপানের পাতা চিবনো, সাতপুরু কলাপাতা দিয়ে ঘা বাঁধতে হ’ল।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : কানের দিকে ফুলো বেড়েছে। নিত্য আহার পাঁচ-ছটাক বার্লি।
১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : গাঁদা পাতার পুলটিস লাগানো হল।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঘায়ের মুখ নীচের দিকে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঠাকুরের জামরুল খাবার ইচ্ছে, কিন্তু খেতে পারলেন না।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : ঘি দিয়ে ক্ষতের ড্রেসিং।
মার্চ মাসের ২৫ তারিখে অপরাহে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নবম অধ্যক্ষ ডাক্তার জে এম কোর্টুসকে সঙ্গে নিয়ে কাশীপুরে এলেন।
পরবর্তী বর্ণনাটুকু স্বামী প্রভানন্দের রচনা থেকে : “অপরাহুঁকাল। ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত মেডিকেল কলেজের প্রধান চিকিৎসক ও অধ্যক্ষ ডাঃ কোর্ট সাহেবকে নিয়ে কাশীপুর বাগানবাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন।”
এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “যদিচ প্রসিদ্ধ ডাক্তার দ্বারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হইতেছে, তথাপি প্রায় আট মাস হইতে যায় আশামতো উপশম না দেখিয়া ভক্তগণ বড়ই উদ্বিগ্ন হন; এবং কি রোগ, বা কি উপায়ে শান্তি হইতে পারে, এই আশায় মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বিজ্ঞ ডাক্তার কোটস সাহেবকে আনয়ন করেন।”
ডাঃ কোটুসের পুরো নাম Dr. J. M. Coates। চিকিৎসাবিদ্যায় তার পরিচায়ক উপাধি M.B.B.S., M.D., L.FP.S.G.। তিনি মেডিকেল কলেজের নবম অধ্যক্ষ। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একাজে যোগদানের পূর্বে তিনি ছিলেন মিলিটারিতে এবং সেখানে তিনি Brigadier Surgeon-এর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
ডাঃ কোট্র জবরদস্ত সাহেব। তিনি রামবাবুর সঙ্গে বাগানবাড়ির দোতলার হলঘরের সামনে উপস্থিত হয়েছে। জুতো-পায়ে গটমট করে তিনি ঘরে ঢুকে পড়লেন। নিকটে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেবক শশী। তার হাতে ডাক্তারি ব্যাগটি তিনি ধরবার জন্য এগিয়ে দেন। শশী আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। খ্রিস্টান সাহেবের ব্যাগ স্পর্শ করতে তাঁর দ্বিধা লক্ষ্য করে কোস সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা হন। তিনি চেঁচিয়ে বলতে থাকেন : You go from here. you ullu. উপস্থিত অন্য একজন ডাক্তারের ব্যাগ ধরেন। এদিকে শশীর প্রতি সাহেব ডাক্তারের রূঢ় আচরণ লক্ষ্য করে শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর মর্মাহত হন। শ্রীরামকৃষ্ণ বাধা দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আহা! থাক্ থাক্।
ডাঃ কোক্স মাদুরের উপর বসেছিলেন। ঠাকুরের ব্যবহার্য তাকিয়া ডাক্তারকে দেওয়া হয়েছিল ঠেসান দিয়ে বসবার জন্য। এদিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন দেখে মাস্টারমশাই তাকিয়া নিয়ে ঠাকুরের পিঠের পিছনে স্থাপন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ তাতে হেলান দিয়ে বসেন। তারপর তাকিয়া সরিয়ে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তারের হাত ধরে বলেন, তাকিয়ার উপর হেলান দিয়ে বসতে। ঠাকুরের মিষ্ট আচরণ দেখে ডাক্তারের মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। হৃষ্টচিত্ত ডাক্তার কোট্স বলেন : He (Sri Ramakrishna) is naturally a gentleman.
অতঃপর ডাক্তারসাহেব গলদেশ চাপিয়া পরীক্ষা করিতে প্রয়াস পাইলে, ঠাকুর যেন শিহরিয়া উঠেন এবং ক্ষণকাল অপেক্ষা করিতে বলিয়া তার স্বভাবসমাধিতে নিমগ্ন হন। ডাক্তার তখন ইচ্ছামত পরীক্ষা করিয়া কহেন-ইহাকে ক্যান্সার অর্থাৎ কণ্ঠনালীর ক্ষতরোগ বলে। বহুদিন ব্যাপিয়া
অবিরাম ঐশ্বরিক কথায় গলমধ্যস্থ সূক্ষ্ম শিরা ও ঝিল্লীর উত্তেজনায় ইহার উৎপত্তি। আমাদের দেশে ইহাকে ধর্মযাজকের কণ্ঠরোগ কহে। আমাদের উগ্র ঔষধ এ-অবস্থায় ক্লেশদায়ক, সুতরাং বর্তমান চিকিৎসাই শুভ।
আর ডাক্তারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল সম্বন্ধে রামচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, ‘তিনি (ডাক্তার কোটু) তাহার অবস্থা দেখিয়া চিকিৎসাতীত বলিয়া ব্যক্ত করেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে ভাগবৎ-প্রসঙ্গ শুনবেন। তার অনুরোধে শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলেন যে ঈশ্বর এক বৈ দুই নন। তিনিই সর্বভূতে বিরাজ করছেন।
স্বামী সারদানন্দের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় আরও এক টুকরো তথ্য। তিনি বলেছিলেন, কোনো বিলাতফেরত ডাক্তার অসুখের সময় তার কাছে এসেছেন। ঠাকুরের শরীর বিশেষ অসুস্থ দেখে তিনি বললেন, “আপনার শরীর অসুস্থ, তা না হলে আমি আপনার কাছে অনেক শিখতে পারতুম, আপনিও আমার কাছে অনেক শিখতে পারতেন।” কথাপ্রসঙ্গে পুনঃ পুনঃ তিনবার এই কথাটি আবৃত্তি করাতে ঠাকুর উত্তর দেন, “তোমার কাছে আমার কিছুই শিখবার নাই।” ডাক্তার কোটস বিদায় নেবার পর ঠাকুরের নির্দেশে তার বিছানাপত্রে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়া হয়! শ্রীরামকৃষ্ণ বিছানা স্পর্শ করে ‘ওঁ তৎ সৎ মন্ত্র জপ করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রিয়াকলাপ দেখে উপস্থিত ভক্ত ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় হেসে ওঠেন। উপস্থিত মাস্টারমশাই প্রমুখ ভক্তগণও হাসতে থাকেন।
সাহেব ডাক্তারের ফি নিয়ে তিনটি লোকশ্রুতি। প্রথম মত, কল্পতরুর দিনে ঠাকুরের কৃপাধন্য ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায় (ভাই ভূপতি) ডাক্তার কোটসকে বত্রিশ টাকা দেন। স্বামী প্রভানন্দর ফুটনোট :”৪ মার্চ ১৮৮৬ তারিখের বিবরণী থেকে জানা গেছে ভূধর চাটুজ্যে এই টাকা দিতে চেয়েছিলেন। ইনি শশধর তর্কচূড়ামণির শিষ্য, এঁদের কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িতে (২০৩/১/১ বিধান সরণি) ঠাকুর গিয়েছিলেন। তৃতীয় মতে ডাক্তার কোট্র ভিজিট নেননি, তিনি এই অর্থ ঠাকুরের সেবার জন্য ব্যয় করতে বলেছিলেন।
ডাক্তার কোটস যেদিন কাশীপুরে এলেন সেই রাত্রে কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি হ’ল। রোগীর দম বন্ধ হবার উপক্রম। ডাঃ কোটস অবশ্য বলেই গিয়েছিলেন, রোগ চিকিৎসাতীত।
শনিবার ৮ মার্চ, ১৮৮৬ দোলপূর্ণিমার দিনে কাশীপুর উদ্যানবাটির এক হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছেন স্বামী প্রভানন্দ। রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী এলেন ঠাকুরের পায়ে আবির দিতে, বসে বসে পাখার হাওয়া করলেন। কোন্নগর থেকে হাজির হলেন মনোমোহন মিত্র। এঁরই বোন বিশ্বেশ্বরীর সঙ্গে রাখালচন্দ্র ঘোষ (পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দের) বিবাহ হয়। পরবর্তীকালে মনোমাহন আমার জীবনকথা’ নামে স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেন, কিন্তু সম্পূর্ণ করতে পারেননি। দোলের দিন ঠাকুরের জন্য মনোমাহন এনেছিলেন, পুন্নাগের ডাল। ঠাকুর কয়েকটি ডালপালা নাকের কাছে ধরেন, কিন্তু এর রুক্ষ গন্ধ সহ্য করতে পারেননি। মনোমোহনের দলে সেদিন ভগ্নী বিশ্বেশ্বরীও ছিলেন।
সেদিনের আরও এক ঘটনা নজর এড়ানো উচিত নয়। বড়বাজারের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি ভক্তরা সদলে এসেছিলেন। বড়বাজারেই শ্রীরামকৃষ্ণ এক সময় সংবর্ধিত হয়েছিলেন, আজও তারা প্রণাম করলেন এবং জয় সচ্চিদানন্দ’ বলতে বলতে বিদায় নেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাই হাইকোর্টের উকিল অতুলচন্দ্র মাঝে-মাঝে ঠাকুরের নাড়ি দেখতেন। অতুলের নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা করতেন ঠাকুর। নাড়িজ্ঞান ব্যাধিজ্ঞান এত অতুলের। যেন তেঁহ ধন্বন্তরি বেশে মানুষের।
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের লীলামৃতে লেখা হয়েছে, অতুল একসময় ঠাকুরকে বলেন, “নরেন এখনও ওকালতি পরীক্ষায় সচেষ্ট, অথচ উকিল ও ডাক্তারদের সম্বন্ধে ঠাকুরের ধারণা তেমন ভাল নয়।” অতুলের অনুযোগের দু’চারদিন পরে হঠাৎ একদিন নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো এক বস্ত্রে নগ্নপদে গিরিশ-ভবনে উপস্থিত। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলেন অবিদ্যামাতার মৃত্যু ও বিবেক পুত্রের জন্ম-অশৌচে এই অবস্থা। এরপর কাশীপুর উদ্যানে যাইয়া চিরদিনের মতো আত্মনিবেদনছলে প্রভুর শ্রীপাদপদ্মে নিপতিত হইলেন।
বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এই পর্বে ঠাকুরকে দেখেন। ঠাকুর তার ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন, “দেখ দেখি, এইটা ভাল করে দাও না।” ডাঃ দত্ত ওষুধপত্র দেন, তিনি ঠাকুরের রোগকে ক্যান্সার মনে করেননি।
ডাক্তার মহেন্দ্রনাথ সরকারের ডাইরি অনুযায়ী শ্রীরামকৃষ্ণকে লাইকোপোডিয়াম ২০০ দিয়ে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। ২২ মার্চ রাত্রে ভারমিশেলি সেদ্ধ দুধ খেলেন। ৩০ মার্চ তিনি শীতবোধ করতে লাগলেন। এরপরেই সেই বিখ্যাত ঘটনা। নরেন্দ্রনাথ, তারকনাথ ঘোষাল (পরে স্বামী শিবানন্দ) ও কালীপ্রসাদ চন্দ্র (পরে স্বামী অভেদানন্দ) কাউকে কিছু না বলে কাশীপুর থেকে বুদ্ধদেবের সিদ্ধিলাভের পুণ্যক্ষেত্র বোধগয়ায় চলে গেলেন।
অভেদানন্দ তাঁর ‘আমার জীবনকথায়’ এপ্রিল মাসের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু প্রাসঙ্গিক তথ্যদির বিশ্লেষণ করে স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত, ৩১ মার্চ ১৮৮৫ সন্ধ্যায় এঁরা চলে যান।– বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল তখনকার পরিস্থিতির একটি সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এই সময় ঠাকুর বিমর্ষভাবে কোনো যুবককে বলেন-”দ্যাখ, নরেন্দ্র এতই নিষ্ঠুর যে, এই অসুখের সময় আমাকে ছেড়ে কানাই ঘোষালের (পূর্ববন্ধু) ছেলে, যাকে নরেন্দ্র এখানে আশ্রয় দিল, সেই তারকের সঙ্গে কোথায় গেছে, বা তারক তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে, আর কালীও সঙ্গে গেছে।” [বলিয়া রাখা ভাল যে, প্রভুর কৃপা পাইয়াও তারকদাদা কর্মবিপাকে ইতিপূর্বে ছায়ার মতন নিত্যগোপালের (পরে জ্ঞানানন্দ অবধূত) সঙ্গে ফিরিতেন।]
ঠাকুরকে প্রবোধ দেবার জন্য একজন যুবক বললেন, “কোথা যাবে নরেন্দ্র? হট্ করিয়া যাইলেও আপনাকে ছাড়িয়া ক’দিন থাকবে?” তখন প্রভু হাসিমুখে কহেন–ঠিক বলেছিস। যাবে কোথায়? এ তলা বেল তলা, সেই বুড়ীর পোঁদ তলা। আমার কাজের জন্যে মহামায়া যখন তাকে এনেছেন, তখন আমারই পিছনে তাকে ঘুরতে হবে। বলাবাহুল্য, দু’চারদিন পরে নরেন্দ্রনাথ যেন অপরাধীর মতো প্রভুসমীপে উপস্থিত হ’ল।” (৮ এপ্রিল, ১৮৮৬ সন্ধ্যায় তারা ফেরেন)।
ব্যাপারটা কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে আমার জীবনকথায়’ (স্বামী অভেদানন্দ)।
“নরেন্দ্রনাথ, তারকদাদা (স্বামী শিবানন্দ) ও আমি প্রায়ই বুদ্ধদেবের জীবনী পাঠ করিতাম এবং তাঁহার ত্যাগ ও কঠোর সাধনার বিষয় আলোচনা করিতাম। তখন আমরা ললিতবিস্তরের গাথাগুলি বেশ মুখস্থ করিয়াছিলাম। মধ্যে মধ্যে ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম’ ইত্যাদি আবৃত্তি করিয়া ধ্যান করিতাম। ক্রমে আমাদের তিনজনেরই বুদ্ধদেবের তপস্যার স্থান দেখিবার ইচ্ছা বলবতী হইল।
“একদিন নরেন্দ্রনাথ, তারকদাদা ও আমি কলিকাতা হইতে নগ্নপদে হাঁটিতে হাঁটিতে সন্ধ্যার পূর্বে কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইলাম। ইচ্ছা এত বলবতী হইল যে, আমরা আর থাকিতে পারিলাম না।
“নরেন্দ্রনাথ বলিল, ‘চ, কাকে কিছু না বলেই আমরা বুদ্ধগয়ায় চলে যাই। শ্রীশ্রীঠাকুরকে আমরা বুদ্ধগয়ায় যাওয়ার কোনো কথা বলিলাম না। নরেন্দ্রনাথ আমাদের তিনজনের জন্য রেলভাড়া সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইল। আমরা কৌপীন, বহির্বাস ও কম্বল লইয়া প্রস্তুত হইলাম।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বরানগর-খেয়াঘাট হইতে গঙ্গা পার হইয়া আমরা তিনজনে বালির দিকে যাত্রা করিলাম। রাস্তার ধারে একটি মুদির দোকানের রকে সেই রাত্রি কাটাইলাম। তার পরদিন অতি প্রত্যুষে উঠিয়া বালি স্টেশনে গিয়া রেলগাড়িতে উঠিলাম। পরদিন গয়াধাম দর্শন করিয়া বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হইলাম।
“বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হইয়া আমরা মন্দিরে প্রবেশ করিলাম, পরে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করিয়া আনন্দে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলাম।
মন্দিরের অভ্যন্তরে গম্ভীর শান্ত পরিবেশ। মন অমনি সমাধি-সাগরে ডুবিয়া যায়। আমরা ধ্যানের সময়ে অপূর্ব-নির্বাণসুখের আভাস ও আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলাম।
“পরে মন্দিরের বাহিরে বোধিদ্রুমের সম্মুখে সম্রাট অশোক-নির্মিত বজ্রাসনে বসিয়া আবার তিনজনে ধ্যান করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথ অপূর্ব এক জ্যোতিঃ দর্শন করিল। আমার সর্বশরীরেও যেন শান্তিস্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিল। তারক দাদাও গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়া রহিলেন।
দুই ঘণ্টা ধ্যানের পর আমরা তিনজনে নিরঞ্জনা নদীতে স্নান করিয়া মাধুকরি করিলাম এবং কিছু জলযোগ করিয়া তথাকার ধর্মশালায় বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। ওই ধর্মশালায় রাত্রিযাপনও করিলাম। আমাদের সঙ্গে কোনো গরম কাপড় ছিল না, সুতরাং রাত্রিতে শীতের জন্য আর নিদ্রা হইল না। তাহাতে আবার মধ্যরাত্রে নরেন্দ্রনাথের পেটের অসুখ হইল। যাহা আহার করিয়াছিল তাহা সম্ভবতঃ হজম হয় নাই। দুই-চারিবার দাস্ত হইল এবং পেটের যন্ত্রণায় সে কষ্ট পাইতে লাগিল।
“আমরা বিশেষ চিন্তিত হইয়া পড়িলাম। কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তখন কাতর হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি নরেন্দ্রনাথ একটু সুস্থ বোধ করিল। তখন শ্রীশ্রীঠাকুরকে কিছু বলিয়া আসা হয় নাই, তাহার অসুখের সময়ে আমরা তাঁহাকে ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি এবং তাহার অনুমতি না লইয়া আসা অন্যায় হইয়াছে–এই সকল কথাই ক্রমাগত মনে হইতে লাগিল।
“ক্রমশই আমাদের মন অস্থির হইয়া উঠিল। যেন এক আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম। নরেন্দ্রনাথের পেটের অসুখ তখনও সম্পূর্ণ সারে নাই অথচ কাহারও নিকট কোনোরূপ সাহায্য পাইবার উপায় নাই। দেখিলাম রেলভাড়াও সঙ্গে নাই। কাজেই আমরা বিষম বিভ্রাটে পড়িলাম, কিছু স্থির করিতে পারিলাম না। সুতরাং শীঘ্র কাশীপুরে ফিরিয়া যাওয়া কর্তব্য মনে করিলাম। কিন্তু ফিরিয়া যাইবার কোন পাথেয় তো আমাদের কাছে ছিল না।
“তখন নরেন্দ্রনাথ বলিল : চল্, আমরা বুদ্ধগয়ার মোহন্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ও কিছু অর্থ ভিক্ষা করি।আমি ও তারকদাদা তাহাতে সম্মত হইলাম।
“প্রাতঃকালে নিরঞ্জনা নদীর বালির চর পার হইলাম। নদীর বালি এত ঠাণ্ডা ছিল যে, আমাদের খালি-পা যেন পুড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠাণ্ডায় আগুন পোড়ার ন্যায় পা জ্বালা করে তাহা পূর্বে আমরা জানিতাম না। অতিকষ্টে হাঁটিয়া নিরঞ্জনা নদী পার হইয়া মোহন্তের মঠে উপস্থিত হইলাম। মঠের দশনামী সন্ন্যাসীদের সহিত আমাদের আলাপ হইল। সেখানে সাধুদের পঙ্গদে বসিয়া মধ্যাহ্নভোজন করিয়া বিশ্রাম করিলাম। “নরেন্দ্রনাথ সঙ্গীতের অত্যন্ত ভক্ত শুনিয়া মঠের মোহন্ত মহারাজ তাহাকে গান শুনাইতে অনুরোধ করিলেন। নরেন্দ্রনাথ যদিও পেটের অসুখে অত্যন্ত দুর্বল হইয়াছিল, তথাপি তাহার গলার তেজস্বিতা কমে নাই। সে কয়েকটি ভজন-গান গাহিল। তাহার অপূর্ব সঙ্গীত-পরিবেশনে মোহন্ত মহারাজ অত্যন্ত প্রীত হইলেন। পরে আমরা বিদায় লইবার সময়ে আমাদের পাথেয় নাই শুনিয়া তিনি কিছু পাথেয় দিলেন।
“আমরা পুনরায় নিরঞ্জনা নদী পার হইয়া বুদ্ধগয়ায় আসিলাম এবং গয়াধামে বাঙালি ভদ্রলোক উমেশবাবুর বাড়িতে অতিথি হইলাম। সেখানে সন্ধ্যার পর নরেন্দ্রনাথ আবার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও ভজনগান করিল। তথায় অপূর্ব সঙ্গীত পরিবেশনে সকলে মুগ্ধ হইলেন। উমেশবাবু আমাদের বিশেষ যত্ন করিয়া রাত্রে থাকিবার স্থান দিলেন। পরদিন প্রাতে রেলে চড়িয়া আমরা কলিকাতা-অভিমুখে যাত্রা করিলাম ও পরদিন সন্ধ্যার সময় কাশীপুরের বাগানে উপস্থিত হইলাম।
“এইদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের জন্য বিশেষ চিন্তিত ছিলেন এবং ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া মহানন্দে সাগ্রহে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন। আমরা বুদ্ধগয়ার সমস্ত ঘটনাই আনুপূর্বিক তাহাকে নিবেদন করিলাম। সকল ঘটনা শুনিয়া তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং প্রশান্তভাবে বলিলেন, বেশ করেছিস।”
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ সবদিক থেকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বই। নরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণই বলেছিলেন, “কেন ভাবছিস? কোথায় যাবে সে? ক’দিন বাইরে থাকতে পারবে? দেখ না এল বলে।” তারপর তিনি হাসতে হাসতে বলেন : “চারখুট ঘুরে আয়, দেখবি কোথাও কিছু নেই; যা কিছু আছে সব (নিজের শরীর দেখিয়ে) এইখানে।”
বাবুরাম মহারাজ (পরে স্বামী প্রেমানন্দ) এই প্রসঙ্গে বলে গিয়েছেন, “পরমহংসদেব কেঁদেছিলেন তিনি বললেন যে, ও (নরেন্দ্র) যেরকম উঠে-পড়ে লেগেছে যা চাচ্ছে তা শীঘ্র পেয়ে যাবে।”
৬ এপ্রিল ১৮৮৬ : ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন কাশীপুরে, পরে শ্ৰীমকে ডাক্তার বলেন, প্রথম টের পেলুম যে ওঁর ছেলেবেলায় গলায় গণ্ডমালা (স্ক্রোফুলা) ছিল।
ঠাকুরের পেটে পোড়া দাগ দেখে ডাঃ দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি?
মাস্টারমশাই বলেন, পিলের চিকিৎসা হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিতে বলেন, সে বড় ছোটবেলায়।
ডাক্তার দত্ত : কর্তা দেখছি সবরকমই করে বসে আছেন।
.
অসুখ যতই থাক, আনন্দকে কখনও বিসর্জন দেওয়া হয়নি কাশীপুর থেকে। তারক (পরে স্বামী শিবানন্দ) একদিন পাঁচক অসুস্থ হওয়ায় সবার জন্য রান্না করছিলেন–ডাল, ভাত, রুটি আর চচ্চড়ি। “চচ্চড়িতে তখন ফোড়ন দিয়েছি, ঠাকুর উপর হতে সে ফোড়নের গন্ধ পেয়ে জনৈক সেবককে জিজ্ঞাসা করলেন-”হাঁরে, কি রান্না হচ্ছে রে তোদের? বাঃ! চমৎকার ফোড়নের গন্ধ ছেড়েছে তো! কে রাঁধছে?” আমি রাঁধছি শুনে তিনি বললেন-”যা, আমার জন্যে একটু নিয়ে আয়।” সেই চচ্চড়ি ঠাকুর একটু খেয়েছিলেন।
২৯ এপ্রিল ১৮৮৬ : কোনো কোনো চিকিৎসকের আশা রামকৃষ্ণ সম্পূর্ণ আরোগ্যের পথে। ভক্ত নাগ মশাই ঐদিন অনেক খুঁজে ঠাকুরের জন্যে টাটকা আমলকী এনেছেন। নাগমশাইকে ভাত বেড়ে দেওয়া হ’ল, তিনি জানালেন, আজ একাদশী।
এর পরের ঘটনা শ্রীশ্রীমায়ের কথা থেকে স্বামী প্রভানন্দ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মাকে ঠাকুর বললেন, “ঝাল দিয়ে একটু চচ্চড়ি বেঁধে দাও। ওরা পূর্ববঙ্গের লোক, ঝাল বেশি খায়।” ঠাকুর আরও বললেন, “একখানা থালায় সব বেড়ে দাও। ও প্রসাদ না হলে খাবে না।” ঠাকুর তা প্রসাদ করে দিতে বসলেন। সেসব দিয়ে ভাত প্রায় এত কটা খেলেন।
মা বললেন, “এই তো বেশ খাচ্ছ, তবে আর সুজি খাওয়া কেন? ভাত দুটি দুটি খাবে।” ঠাকুর বললেন, “না, না, শেষ অবস্থায় এই আহারই ভাল।” মে মাসের ১৭ তারিখে শারীরিক অবস্থার অবনতি। দুদিন পরের রিপোর্ট, শরীরে অসহ্য জ্বালা। পরের সপ্তাহে তিনি ইঙ্গিতে ফিসফিস কথা বলছেন। দেহ কঙ্কালসার।
.
এরপর থেকেই বেশ কয়েক মাস ধরে কাশীপুর সংবাদের অপ্রতুলতা। রোগে জর্জরিত হয়েও শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অনুগত সেবকদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। যোগীন (পরে স্বামী যোগানন্দ) অসুস্থ শুনে তিনি বললেন, “সেবার ত্রুটি হবে বলে, তোমরা শরীরের যত্ন নিচ্ছ না। তোমাদের শরীর ভেঙে গেলে আমার যত্ন করবে কে? তোমরা বাপু অসময়ে খাওয়াদাওয়া করো না।”
এরপর থেকেই কাশীপুরের বিস্তারিত বিবরণের ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডাক্তার সরকারও অনেকদিন অনুপস্থিত, ডাক্তার রাজেন দত্তের ভিজিটও অনিয়মিত। শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার কি হবে ভেবে উপস্থিত সবাই বেশ চিন্তিত।
কথামৃতের কথক মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্ভবত এই সময় কম আসতেন। তার তখন খুব বিপদ, চাকরি গিয়েছে। বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ছাত্রদের ফল আশানুরূপ না হওয়ায় বিদ্যাসাগর তাকে ডেকে অপমানকর কথাবার্তা বলেছেন। বিদ্যাসাগর মুখের ওপর বলেছেন, পরমহংসদেবের কাছে অত্যধিক যাতায়াতের ফলেই এ ধরনের অবহেলা ঘটেছে।
অপমানিত মাস্টারমশাই পরেরদিন (শুক্রবার) রেজিগনেশন চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। সংসার চলবে কিভাবে তা না চিন্তা করেই পদত্যাগ। কাশীপুরে শয্যাশায়ী ঠাকুর সব শুনলেন, তারপর সাড়ে তিনটে পাশ’ ভক্তকে তিনবার বললেন, বেশ করেছ, বেশ করেছ, বেশ করেছ।
রবিবারও মাস্টারমশাই কাশীপুর বাগানবাড়িতে এসেছিলেন। ওইদিন একসময় গঙ্গাধর নরেন্দ্রনাথকে বললেন, রাজ চ্যাটার্জি বলেছে, ছাত্রেরা মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। মাস্টারমশাই নাকি একথা শুনে বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়ে পড়েন।
“নরেন্দ্রনাথ ফোঁস করে ওঠেন। তিনি বলেন : কি বলছিস, মাস্টারমশাই কি কেয়ার করেন? তোর বিদ্যাসাগর বুঝি মনে করলে মাস্টারমশাইয়ের পরিবার ছেলেপুলে আছে, তিনি আর চাকরি ছাড়তে পারবেন না।”
.
এর পরেই প্রায় লক্ষ্য দিয়ে ১৮৮৬ আগস্ট মাসে এসে পড়া। এবার আমরা শ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃতের লেখক বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের ওপর একটু বেশি নির্ভর করব।
ঠাকুর “ক্ষুধা সত্ত্বেও অনুমাত্র তরল পদার্থ গ্রহণে অসমর্থ হন। কোনোমতে যদি কিঞ্চিৎ পান করিলেন, অমনি দ্বিগুণমাত্রায় ক্লেদ নির্গত হওয়ায় আরও ক্লেশ বোধ করেন।…একদিন শ্রীমুখ-বিগলিত ক্লেদমিশ্রিত পায়স হস্তে নরেন্দ্রনাথ কাতরভাবে কহেন–প্রভুর সুব্যবস্থায় তাঁহার প্রসাদ ধারণে আমাদের চিত্তপ্রসাদ হইয়াছে, কিন্তু এখন বিধি বিরূপ। আইস, তাহার সত্তাস্বরূপ ইহা পান করিয়া আমাদের অস্থিমজ্জায় যেন তাহার অবাধ অধিষ্ঠান বোধ করিতে পারি। এই বলিয়া কিয়দংশ স্বয়ং পান করিলেন এবং আমাদিগকেও করাইলেন।…”
রসিক চূড়ামণি ঠাকুর। তিনি বলছেন : “দেখছি সাগরপারে অনেক শ্বেতকায় ভক্ত আছে, তাদের সঙ্গে মিশতে হলে তাদের মত পোশাকের দরকার। তাই ইচ্ছে হয় ইজের পরে ডিশবাটিতে খাই। কহিবামাত্র সকলই সংগ্রহ হইল এবং প্রভুও উহা ব্যবহারে আনন্দ করিলেন। প্রভুর প্রেরণায় পাশ্চাত্য দেশে তাঁহার মহিমা প্রচারকালে, নরেন্দ্রনাথ তাঁহারই কথা স্মরণ করিয়া ওই দেশের উপযোগী পরিচ্ছদ ব্যবহার করেন। নচেৎ সন্ন্যাসী হইয়া সাহেব সাজিবার বাসনায় নহে।”
স্বামী সারদানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ ঠাকুরের বিষয়ে আমাদের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে কাশীপুর পর্বটি যে প্রায় অনুপস্থিত তা গ্রন্থকার নিজেও অনুভব করতেন। স্বামী নির্লেপানন্দ এ বিষয়ে মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন : “শেষ জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের চরিতকথার বাকিটুকু (কাশীপুর বাগানের ঘটনাবলী) লিখিয়া লীলাপ্রসঙ্গ-কে পূর্ণ অবয়ব ও সম্পূর্ণ গঠন দিবার জন্য অনুরুদ্ধ হইলে, একদিন তিনি বলিয়াছিলেন-”দ্যাখো, এখন দেখছি, ঠাকুরের সম্বন্ধে কিছুই বোঝা হয়নি। তার ইচ্ছা হয়, লেখা হবে।”
সে প্রত্যাশা থেকে অনুরাগীরা বঞ্চিত হলেও, ছড়িয়ে ছিটিয়ে লীলাপ্রসঙ্গের এখানে ওখানে যা আছে তাও মন্দ নয়। কিন্তু সে সবের খোঁজখবর করার আগে দ্রুত গোটা কয়েক টুকরো খবর দেওয়া যাক। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ কখনই তার কর্তব্য ভুলতে চাইতেন না। নিজের দিদি কাত্যায়নীর সন্তানদের সম্বন্ধে দাদার ছেলে রামলালকে বললেন, “ওদের খবর নিসরে রামলাল, নয়তো ওরা বলবে আমাদের মামার বাড়িতে কেউ নেই। পুজোর সময় এক একখানা কাপড় দিস।” এই ভাইপোকে ঠাকুর আদর করে রামনেলো’ বলে ডাকতেন।
শ্রীশ্রীসারদামণিকে ঠাকুর বলেছিলেন, “তুমি কামারপুকুরে থাকবে, শাক বুনবে, শাকভাত খাবে আর হরিনাম করবে।” বরং পরতী ভাল, পরঘরী ভাল নয়, কামারপুকুরে নিজের ঘরখানি কখনও নষ্ট কোরো না। কারও কাছে একটি পয়সার জন্যে চিতহাত কোরো না, তোমার মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে না। সারদামণিকেই ব্যধিযুক্ত কণ্ঠে তিনি যে গানটি গেয়েছিলেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ :
‘এসে পড়েছি যে দায়, সে দায় বলব কায়।
যার দায় সে আপনি জানে, পর কি জানে পরের দায়।’
শেষ গানও শুনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ এই কাশীপুরে ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত কণ্ঠে। ভক্ত সেবকরা গানের মধ্য দিয়ে প্রায়ই দুঃখকে ভুলবার চেষ্টা চালাতেন কাশীপুরে।
স্বামীজির মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, মহাপ্রয়াণের কদিন আগেও চলতো নরেন্দ্রনাথের গানের মহড়া। রাত্রে তারা “উদ্দাম কীর্তন শুরু করলেন। চীৎকার ধ্বনিতে বাড়ি কাপিতে লাগিল। শ্রীরামকৃষ্ণ কীর্তনের দলের ভিতর থেকে একজনকে ডেকে বললেন, তোরা বেশ রে, কেউ মরে, কেউ হরিবোল বলে…পরক্ষণেই আহ্লাদ করে বললেন, ওর সুরটা এইরকম, অমুক জায়গায় এক কলি তোরা ভুলেছিলি। ঐখানে ঐ কলিটা দিতে হয়।”
কাশীপুরে শেষ পর্ব সম্বন্ধে ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র তার ‘জীবনবৃত্তান্তে’ লিখেছেন : “অবস্থার দিন দিন পরিবর্তন হইতে লাগিল। যখন… উত্থান শক্তি রহিত হইল, একেবারে স্বরভঙ্গ হইয়া গেল, তখন অনেকেই হতাশ হইয়া পড়িলেন। ডাক্তারি, কবিরাজি, আধিভৌতিক, টোটকা প্রভৃতি সকলেরই সাহায্য লওয়া হইয়াছিল, কিন্তু কিছুই হইল না। কোনো কোনো ভক্ত স্ত্রীলোক তারকনাথের সোমবার করিতেন এবং নারায়ণের চরণে তুলসী দিতেন, কোন ভক্ত তারকনাথের চরণামৃত ও বিল্বপত্র আনাইয়া ধারণ করাইলেন, কেহ কেহ (শ্রীমা) হত্যা দিয়াছিলেন। কিন্তু সকলই বিফল।”
অসুস্থ অবস্থায় ভাবসমাধি সম্পর্কে একালের বিশ্লেষক ডাক্তার তরফদারের ব্যাখ্যা : “ভাব বা সমাধি হলে গলায় ব্যথা বাড়ে। সম্ভাব্য কারণ : সমাধিকালে কুম্ভক’ বা শ্বাসবন্ধ থাকে। হয়তো এসময় তোকাল কর্ড দুটি পরস্পর চেপে লেগে গ্লটিসকে সজোরে বন্ধ করে রাখে। ফুসফুস থেকে নিশ্বাসবায়ু তাতে ধাক্কা মারে।” সমাধিকালে ক্যান্সার কোষ থেকে যন্ত্রণাদায়ক রাসায়নিক বের হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তবুও রামকৃষ্ণের সমাধি বাধা মানেনি কোনো। শেষদিনেও প্রায় দু’ঘণ্টা তিনি ছিলেন গভীর সমাধিমগ্ন।”
ডাক্তারি বিশ্লেষণে রবিবার ৩১শে শ্রবণ ১২৯৩ (১৫ আগস্ট ১৮৮৬) সকালে কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ “বেশ ভালো”।
অন্য বিবরণ :”এইদিন সকাল থেকেই ঠাকুরের ব্যাধি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। তাঁকে বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় যন্ত্রণা লাঘবের জন্যে।”
শ্রীশ্রীমা একবার কাছে যেতেই তিনি বলেন, “এসেচ? দেখ, আমি যেন কোথায় যাচ্ছি–জলের ভিতর দিয়ে—অ-নেক দূর।”
শ্রীশ্রীমা কাঁদতে থাকায় ঠাকুর বলেন, “তোমার ভাবনা কী? যেমন ছিলে, তেমন থাকবে। আর এরা আমায় যেমন করচে, তোমায়ও তেমনি করবে।”
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখেছেন, “প্রিয়তম নরেন্দ্রনাথকে পরমতত্ত্ব উপদেশ-মানসে তগতপ্রাণ শশিভূষণকেও নিম্নতলে যাইতে বলিয়া নরেন্দ্রনাথকে কহেন–ভালো করে দেখ যেন উপরে কেহ না থাকে। এইবার প্রভু তাহাকে অতিনিকটে বসাইয়া, যে ব্রহ্মতান সৃষ্টিকাল হইতে গুরু পরম্পরায় উপদিষ্ট হইয়াছে, তাহাই উদ্দেশ করিয়া কহিলেন–যদিও আমাতে তোমাতে অভেদাত্মা তথাপি বাহ্যদৃষ্টিতে গুরু-শিষ্যরূপে পৃথক ছিলাম। আজ তোমাকে আমার যথাসর্বস্ব অর্পণ করে ভিখারি হয়ে নামে রামকৃষ্ণ রহিলাম; তুমি রাজরাজেশ্বর হয়ে দ্বিতীয় রামকৃষ্ণ হলে।”
আরও বর্ণনা রয়েছে। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লিখছেন : “আজ ধারা শ্রাবণের শেষদিন, অথবা ভাগ্যহীন আমাদের অশ্রুধারার প্রথম দিন।…কিছু না খাওয়ায় সেবকগণ ভাবিলেন-বোধহয় বেদনা বৃদ্ধিতে আহারে অনিচ্ছা।” আজ ভাতের পায়স খাব, শুনিয়া সকলে আশ্বস্ত। পায়স আনিলে বলিলেন, বসে খাব।
এই খাওয়া প্রসঙ্গে বর্ননা চাররকম খাবারের প্রসঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে : ভাতের পায়েস, ভাতের মণ্ড, সুজির মণ্ড ও খিচুড়ি। বৈকুণ্ঠনাথের বর্ণনা অনুযায়ী গলা দিয়ে কিছুই যখন ঢুকছে না তখন ঠাকুর তার সেবকদের বলেন, “ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি-হাঁড়ি খিচুড়ি খাই; কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।”
“আজীবন কার্যকলাপ যার সবই নতুন, তাঁর খিচুড়ি খাইবার ইচ্ছাও এক নতুন ব্যাপার। অনুশীলনে দেখা যায়, অবতার পুরুষমাত্রেই এক এক প্রকার ভোজ্য প্রিয় ছিল। অযোধ্যানাথের রাজভোগ, বৃন্দাবনচন্দ্রের ক্ষীরসর, অমিতাভের ফাণিত (এক প্রকার মিষ্টান্ন), শঙ্করের প্রিয় ভোজ্য কি জানা যায় না; তবে তার সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ভোজে পুড়ীলাড়ুর সমাদর হয়। নিমাইচাঁদের মালসাভোগ (মৃৎপাত্র-পূরিত চিড়া মুড়কি দধি) …দক্ষিণেশ্বর-ভূষণ প্রভু এক অভিনব সুখসাধ্য খেচরান্ন ভোজনের ইচ্ছা করিলেন। তাই প্রিয়তম নরেন্দ্রনাথ প্রভুর জন্মোৎসবে তাহারই অভীপ্সিত খেচরান্ন দ্বারা তাহার বিরাট রূপের এরূপ বিরাট ভোগের ব্যবস্থা করেন, যাহা ভারতের কেন, জগতের কোনো প্রদেশেই দেখা যায় না।”
শেষের সেই রবিবারে কাশীপুরে খিচুড়ি নিয়ে আরও গোলোযোগ। সেবকদের জন্য শ্রীমা খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নিচের অংশ ধরে গেল। ছেলেরা তাই খেল। তার একটা শাড়ি ছাদে শুকতে দেওয়া হয়েছিল। সেটা আর পাওয়া গেল না। তুলবার সময় পড়ে একটা জলের কুঁজো চুরমার হয়ে গেল।
রবিবারের অপরাহে জনৈক ব্যক্তি ঠাকুরের কাছে এসেছিলেন। যোগ সম্বন্ধে আলোচনা করতে। ঠাকুর তার সঙ্গে পুরো দু’ঘণ্টা কথা বললেন। বুদ্ধের ইহ-জীবনের শেষ দিনটিতে নাকি এরূপ ঘটেছিল। একজন সেবক শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার নবীন পালকে ধরে নিয়ে, গাড়িতে চড়িয়ে তাকে কাশীপুরে নিয়ে আসেন।
ঠাকুর তখন ডাক্তারকে বললেন, “আজ আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। নাড়ী পরীক্ষা করে ডাঃ পাল তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না।
ডাক্তারকে ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, “সারবে?” ডাক্তার নিরুত্তর।
ঠাকুর : “কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রোগ দুঃসাধ্য হয়েছে?”
“তাই তো” বলে ডাক্তার পাল মাথা নিচু করে রইলেন।
ভক্ত দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারকে লক্ষ্য করে ঠাকুর বললেন, “বলে কি গো? এরা এতদিন পরে বলে সারবে না।”
গিরিশের ভ্রাতা অতুলকৃষ্ণ ঘোষ নাড়ী পরীক্ষা করে আশঙ্কা করলেন, ক্ষয় নাড়ি। ঠাকুর ভক্তদের বললেন, একেই নাভিশ্বাস বলে।
তাঁর কথায় ভক্তদের বিশ্বাস হল না, তারা সুজির বাটি নিয়ে এল। অন্য মতে, সেবকরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ভাতের মণ্ড খেতে দেন।
পারিপার্শ্বিক বিবেচনা করে স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত, তখন প্রায় রাত ন’টা। এই সময় আবার সমাধি। নরেন্দ্রনাথ সবাইকে হরি ওঁ তৎ সৎনাম কীর্তন করতে বললেন।
যখন সমাধি ভঙ্গ হল তখন রাত প্রায় এগারোটা। সেবকগণ তাকে উঠে বসিয়ে পথ্য খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। “উঠব? ভিরমি খাব যে,” ঠাকুর বললেন।
শ্ৰীম : “মাথায় একটু জল ও বাতাস দিলে হয় না?”
শশীকে ঠাকুর বললেন, “নাড়ছিস কেন?” তখন তুলো ভিজিয়ে মুখে জল দেওয়া হচ্ছিল।
ঠাকুর এখন ক্ষুধার্ত। সুজির পায়েস পথ্য হিসেবে নিলেন। অন্য মতে ভাতের মণ্ড। সেবক শশীর ইংরিজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, “খাবার হিসেবে পুরো এক গেলাস পায়সম পান করেন। তার পর নাকি ঠাকুর বললেন, “আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নাই।”
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল এই পর্বে নৈষ্ঠিক পূজারী ব্রাহ্মণ রামকৃষ্ণের একটি ছবি এঁকেছেন, যাকে স্বামী প্রভানন্দ ‘বিবৃতি নির্ভরযোগ্য নয়’ বলেছেন।
বৈকুণ্ঠনাথের লেখাটি এইরকম : ঠাকুর পায়স গ্রহণোদ্যত, এমতকালে দেখেন দুই অব্রাহ্মণ সেবক শয্যা ধারণ করে আছেন।
“ওদের বিছানা ছেড়ে দিতে বল।”
“কেন করবে?” নরেন্দ্রর এই প্রশ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “ওরে ভাত যে রে।”
“আপনি তো বিধি-নিষেধের পার, তথাপি এ আদেশ কেন?”
নরেন্দ্রকে ঠাকুর বললেন, “ওরে ব্রাহ্মণ-শরীর যে রে। তাই ব্রাহ্মণ সংস্কার যাবার নয়।”
বৈকুণ্ঠনাথের ব্যাখ্যা, “ঠাকুর সকলের আলয়ে অনুগ্রহণ করেন নাই। বলতেন, “লুচি-তরকারি খেতে পারা যায়, কিন্তু অন্ন নহে।”
কাশীপুরের সবদিক সাবধানে বিচার করে স্বামী প্রভানন্দের সঙ্গে একমত এই লেখক, এই বিবৃতি নির্ভরযোগ্য নয়।
ঠাকুরের শেষ পর্ব সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দের ‘আমার জীবনকথা একটি নির্ভরযোগ্য রচনা। “সেইদিন রাত্রে ১টার সময় আমরা তাঁহার নিকট বসিয়াছিলাম। সাধারণত যেমন সমাধি হইত, সেইরূপ হইল। তাঁহার দৃষ্টি নাগ্রের উপর স্থির হইয়া রহিল। নরেন্দ্রনাথ উচ্চৈঃস্বরে ‘ওঁকার উচ্চারণ করিতে আরম্ভ করিল। আমরাও সমবেত স্বরে ওঁকার ধ্বনি করিতে লাগিলাম।…সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল, শ্রীশ্রীঠাকুরের বাহ্যজ্ঞান আর ফিরিয়া আসিল না।”
শ্রাবণের শেষদিনে কাশীপুরে ঠাকুরের মহাপ্রস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে রোমাঁ রোঁলা স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। “শেষ দিন রামকৃষ্ণ শেষপর্যন্ত আমাদের সহিত আলাপ করেন।… তিনি আমার দেহের উপর পাঁচ ছয়টি বালিশে ভর করিয়া বসেন। আমি বাতাস করিতেছিলাম। নরেন্দ্র তাহার পা লইয়া টিপিয়া দিতেছিলেন। রামকৃষ্ণ তাহার সহিত কথা বলিতেছিলেন। কহিতেছিলেন, কি করিতে হইবে। তিনি বারে বারে বলেন, এ ছেলেদের সাবধানে দেখো’.. তারপর তিনি শুইতে যান। একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাহার গলায় ঘড় ঘড় শব্দ হইতে থাকে।… নরেন তাড়াতাড়ি তাহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। ডাক্তার নাড়ী দেখিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, নাড়ী বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমরা সকলে ভাবিলাম উহা সমাধি।”
রোলাঁর নিজস্ব সংযোজন : ১৫ আগস্ট ১৮৮৬-”সেদিন অপরাহেও তার যথেষ্ট শক্তি ছিল। তিনি ক্ষত-পীড়িত কণ্ঠ নিয়েও শিষ্যদের সঙ্গে দু’ঘণ্টা কাল আলাপ করেন যোগ সম্বন্ধে। সন্ধ্যার দিকে তার চৈতন্য বিলুপ্ত হয়। সকলেই ভাবেন, মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দুপুর রাত্রে পুনরায় তাকে জীবিত দেখা যায়। শিষ্য রামকৃষ্ণানন্দের দেহের উপর পাঁচ-ছ’টি বালিশ হেলান দিয়ে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় শিষ্য নরেনের সঙ্গে আলাপ করেন এবং অনুচ্চস্বরে তাঁর শেষ উপদেশগুলো দিয়ে যান। তারপর তিনি উচ্চৈঃস্বরে তিনবার তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ‘কালী’র নাম উচ্চারণ করেন এবং এলিয়ে পড়েন।… পরদিন মধ্যাহ্নের পূর্বে আধঘণ্টা পর্যন্ত এই সমাধিস্থ অবস্থায় থাকে। তারপর মৃত্যু ঘটে। তার নিজের কথায়–তিনি এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে চলে যান।
শ্মশানে শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তরা বলতে থাকেন : জয় ভগবান রামকৃষ্ণের জয়।
নরেন্দ্রনাথ সেই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে লোক পাঠালেন ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দিতে। রামলাল তৎক্ষণাৎ এসে দেহ পরীক্ষা করে বললেন, “এখনও ব্রহ্মতালু গরম আছে, তোমরা একবার কাপ্তেন উপাধ্যায়কে খবর দাও। নেপালের কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়…তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের মেরুদণ্ডে গব্যঘৃত মালিশ করিলে চৈতন্যোদয় হইবে বলিল।”
শশিভূষণ, শরৎচন্দ্র ও বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল যথাক্রমে গ্রীবায়, বক্ষে এবং পদমূলে ঘৃত মালিশ করতে লাগলেন, কিন্তু তিন ঘণ্টারও বেশি মালিশ করে কোনও ফল হ’ল না।
এরপরে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কাশীপুরে আবির্ভাব। কিন্তু ক’টার সময়? ঠাকুরকে এই মহেন্দ্রলাল ‘তুমি’ বললেও, সমধিক শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। বৈকুণ্ঠনাথের রচনা অনুযায়ী : “পরদিন প্রত্যুষে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সর্বপ্রথম উদ্যানে উপস্থিত হন; এবং প্রভুর আনন্দপূর্ণ আনন, রোমাঞ্চিত তনু এবং অঙ্গ জ্যোতিতে গৃহপূর্ণ দর্শনে মুগ্ধ হইয়া কহেন-এই দিব্যাবস্থার প্রতিকৃতি গ্রহণ আমি বাঞ্ছনীয় বোধ করি। অতএব কলিকাতায় যাইয়া আমি এখনই ইহার ব্যবস্থা করিতেছি।”
মা-ঠাকরুণ “প্রাণের আবেগে ‘মা কালী গো! তুমি কি দোষে আমায় ছেড়ে চলে গেলে গো’ বলিয়া ভূপতিত হইয়া উচ্চরোলে ক্রন্দন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন।”
গ্রুপ ছবি সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠনাথের মন্তব্য : “পরিতাপের বিষয়, অত্যধিক বিলম্ববশতঃ প্রাতঃকালের সে জ্যোতির্ময় প্রাণটি তখন অন্তর্হিত হইয়াছিল।”
স্বামী অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডাক্তার সরকার “বেলা দশঘটিকায় এসে নাড়ী দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।”
অনেক বিচারবিবেচনার পর স্বামী প্রভানন্দের সিদ্ধান্ত : ডাক্তার সরকার “কাশীপুরে পৌঁছান বেলা একটায়।”
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের দিনলিপি। খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eys open, mouth partly open.” এরপরে লেখা, মহেন্দ্রলাল ছবি তোলার পরামর্শ দিলেন এবং নিজের চাদা হিসেবে দশ টাকা রেখে গেলেন।
বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের ছবি তোলা সম্বন্ধে স্বামী অভেদানন্দের বর্ণনা : “রামবাবু নিজে খাটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে বলিলেন। আমরা পশ্চাতে সকলে নির্বাক হইয়া সিঁড়ির উপর দাঁড়াইলাম। বেঙ্গল ফটোগ্রাফার কোম্পানি দুইখানা গ্রুপ ফটো তুলিয়া লইলেন।”
কাশীপুর মহাশ্মশানের উদ্দেশে শবযাত্রা শুরু হয়েছিল বিকাল ছ’টার পর।
লাহোরের ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত শেষ দর্শনের এক চমৎকার বিবরণ রেখে গিয়েছেন। তাঁর পূতদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যাবার জন্য দিনের তাপমাত্রা কমার অপেক্ষায় বসেছিলাম, সে সময় একখণ্ড মেঘ থেকে বড় বড় দানার বৃষ্টি ঝরে পড়ল। উপস্থিত সকলে বলতে থাকল এই হচ্ছে পুরাণকথিত স্বর্গ থেকে ঝরে পড়া পুষ্পবৃষ্টি। অমর দেবতাগণ স্বৰ্গমর্ত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নশ্বরতা থেকে অমরতায় উত্তরণকালে অভিনন্দন জানাচ্ছে।”
স্বামীজির পূজনীয় আচার্য, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তিমযাত্রার বিবরণ এখনও সম্পূর্ণ সংগৃহীত হয়নি, তবু তার শেষ জীবনের শেষ মুহূর্তগুলির বর্ননায় গুরু রামকৃষ্ণ ও পরবর্তী নেতা নরেন্দ্রনাথ দু’জনেই বেশ কিছুটা নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন।
==========
ঠাকুরের চিকিৎসক-সংবাদ
চিকিৎসক ও উকিলদের প্রবল সমালোচনা করতেন বটে, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ যে এঁদের বেশ ভালোবাসতেন তার যথেষ্ট প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে নানা লেখায়। একজন ডাক্তার তাকে জুতো উপহার দিয়েছিলেন এবং তা তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। এর আগে তার জুতো চুরি যায়। আর একজন চিকিৎসকের কাছে সযত্নে রক্ষিত ছিল তার পাদুকা। উকিলদের কথা বলাই বাহুল্য, যাঁকে তিনি সবচেয়ে ভালোবাসতেন ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের সেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত তো সবসময় বলতেন সাতপুরুষ উকিলের বংশ। নরেন্দ্রনাথ নিজেও একসময় এটর্নি অফিসে কাজে বেরুতেন। শেষ মুহূর্তে কাশীপুরে যাতায়াতকালে ফাঁইনাল আইন পরীক্ষায় বসা হয়নি।ঠাকুরের চিকিৎসক অনুসন্ধানে ৩৮ জনের নাম পেয়েছি–এঁরা ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য ও নাড়িজ্ঞানী। কেউ এম. ডি., কেউ অ্যালোপাথ হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ, কেউ পারিবারিক পেশায় বৈদ্য। এই ৩৮ জনের মধ্যে অন্তত ২৭ জন যে কোনো না কোনো সময় শ্রীরামকৃষ্ণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাও লক্ষ্য করেছি, বাকি ১১ জন সম্পর্কে ব্যাপারটা এখনও অস্পষ্ট।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের নাম নিচে দেওয়া হল। কিছুক্ষেত্রে পুরো নাম সহজলভ্য নয়, সেকালের রীতি অনুযায়ী অমুক ডাক্তার, অমুক কবিরাজ বলেই তারা সুপরিচিত থাকতেন :
• অতুলচন্দ্র ঘোষ
• আব্দুল ওয়াজিদ
• ঈশানচন্দ্ৰ কবিরাজ
• উপেন্দ্রনাথ ঘোষ
• কালী ডাক্তার।
• কৈলাশচন্দ্র বসু
• গঙ্গাপ্রসাদ সেন।
• গোপাল কবিরাজ
• গোপীমোহন কবিরাজ
• জ্ঞানেন্দ্রমোহন কাঞ্জিলাল
• ত্রৈলোক্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
• ত্রৈলোক্যনাথ বসু।
• দাড়িওয়ালা ডাক্তার
• দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
• দ্বারিকানাথ কবিরাজ
• দু’কড়ি ডাক্তার
• নবগোপাল কবিরাজ
• নবীন পাল
• নিতাই মল্লিক
• নিতাই হালদার
• প্রতাপচন্দ্র মজুমদার
• ভগবান দাস
• ভগবান রুদ্র
• মধুসূদন ডাক্তার
• মহলানবীশ ডাক্তার
• মহেন্দ্রনাথ পাল
• মহেন্দ্রনাথ সরকার
• রাখালদাস ঘোষ।
রাজেন্দ্রলাল দত্ত
• রাম কবিরাজ।
• রামনারায়ণ ডাক্তার
• বিপিনবিহারী ঘোষ
• বিশ্বনাথ কবিরাজ।
• বিহারীলাল ভাদুড়ি
• বৈদ্য মহারাজ
• শশীভূষণ ঘোষ
• শশীভূষণ সান্যাল ও
• শ্রীনাথ ডাক্তার।
========
স্বামীজির অবিশ্বাস্য অ্যাকাউন্টিং পলিসি
অকালমৃত্যু ও অকালবার্ধক্যের এই দেশে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কীভাবে শতবর্ষের সীমা পেরিয়ে কালজয়ী হল, তা একালের ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে এখনও কৌতূহলের বিষয়।এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্ঘগুলি পূজ্যপাদ মহামানবদের স্পর্শে ধন্য হয়েও কিছুদিনের মধ্যে কেন টুকরো টুকরো হয়ে যায়, অথবা দলীয় দ্বন্দ্বের বিষে আত্মহননের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ এ দেশের প্রতিষ্ঠান-পরিচালকদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জানা দরকার, শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্য বেলুড়মঠের সন্ন্যাসীসঙ্ঘ কোন শক্তির বলে এমনভাবে কালজয়ী হল এবং বৃহৎ অরণ্যবনস্পতির মতো সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন ও বিস্ময় ধরে রাখতে সমর্থ হল? দার্শনিক, দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমী বিবেকানন্দকে নিয়ে গত একশো বছরে দেশেবিদেশে নেহাত কম আলোচনা হয়নি, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাবনা-চিন্তার প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে তেমন নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি।
অর্থ সম্বন্ধে, বিশেষ করে অপরের অর্থ সম্বন্ধে, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও রেখেঢেকে কথা বলেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ তার অন্তিমপর্বে প্রিয়জন ও ভক্তজনের আর্থিক সাহায্যের উপর বিশেষ নির্ভরশীল হয়েছে, কিন্তু তিনি একবারও ভুলে যাননি অর্থ হল গৃহস্থের রক্ত এবং সেই অর্থের যথাযোগ্য সম্মান বিশেষ প্রয়োজন।
কোনও অবস্থাতেই অপচয় অথবা বাজে খরচ ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা হওয়া শ্রীরামকৃষ্ণের সমর্থন বা প্রশ্রয় পায়নি। অপরের কাছ থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেই তার যে হিসেব প্রয়োজন, এই চিন্তা তরুণকালে অনভিজ্ঞ নরেন্দ্রনাথের মাথায় ঢোকেনি, তাই কাশীপুর-পর্বে ঠাকুরের অসুখের সময় খরচপাতির হিসেবপত্তর রাখা সম্পর্কে দাতাদের কথা ওঠায় তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। অতি সাবধানে নিতান্ত প্রয়োজনে যৎসামান্য খরচ করা হচ্ছে এই তো যথেষ্ট, যারা যথাসর্বস্ব দিতে এসেছে তাদের কাছে হিসেবের কথা তোলাকে অভিমানী নরেন্দ্রনাথ প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল। শোনা যায় কাশীপুরে নিতান্ত কঠিন মন্তব্য করে তিনি খাতাপত্তর ছুঁড়ে ফেলেছিলেন।
কিন্তু এই মানুষটিই পরবর্তীকালে স্বদেশে ও বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার আলোকে বিস্তারিত হিসেবপত্তর রাখায় প্রবল বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। যাঁরা সামান্যতম অর্থ সাহায্যও করেছেন তারা অ্যাকাউন্ট চাইবার আগেই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হিসেব দাখিল করা যে সঙ্ঘস্বাস্থ্যের পক্ষে নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছতা ও আর্থিক পরিচ্ছন্নতাকে সঙ্ঘজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করার জন্য যে ব্যাকুলতা স্বামীজি দেখিয়েছিলেন, তা মঠ ও মিশনের পরবর্তীকালের পরিচালকরা পরিত্যাগ করেননি।
ইদানীং কেউ কেউ বলছেন, এই হিসাব-পরিচ্ছন্নতা রামকৃষ্ণ মঠ মিশনকে এক বিশেষ মহিমায় আলোকিত করেছে। ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞরা এই আদর্শের সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্বন্ধে বিশ্লেষণকালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন থেকে অনেক নতুন তথ্যের ও তত্ত্বের সন্ধান পাবেন।
সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা নিজেরা অর্থ উপার্জন করেন না, কিন্তু অপরের আর্থিক সাহায্যে বহু বড় বড় কাজ করতে তারা সমর্থ হয়েছেন বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে। কিন্তু পরের অর্থ মানেই তো হিসেবের কড়ি। এর জন্যে নিয়মকানুনের বন্ধন প্রয়োজন, নিজের যৎসামান্য ব্যক্তিগত অর্থ ও সঙ্ঘের কাজের জন্য সংগৃহীত অর্থের মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর দূরত্ব রাখাও প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার হিসেব সম্পর্কে স্বামীজির সেই মহামূল্যবান মন্তব্য, শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ করা চলবে না। হিসেব বিশেষজ্ঞরা আজকাল প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, যে কোনও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টিং প্রিন্সিপলের শেষ কথাটি এমন সহজভাবে পৃথিবীর কোনও ম্যানেজমেন্ট গুরু আজও বলে যেতে পারেননি!
স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিপত্রে এবং কথাবার্তায় ব্যক্তিগত-অর্থ ও সঙ্ঘ অর্থের এই নৈতিক পার্থক্য ভীষণভাবে এসে গিয়েছে, এমনকী এর জন্য স্বামীজি নিজেও মৃত্যুর পরেও অসুবিধায় পড়েছে।
একেবারে শেষ পর্যায় থেকে শুরু করা যেতে পারে। বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২-এ স্বামীজির অপ্রত্যাশিত দেহাবসানের পরও হিসেবের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। দেহাবসানের ১৮ দিন পরে, ২২ জুলাই ১৯০২ মঠের ট্রাস্টিদের সভায় আলোচনার প্রথম বিষয় স্বামীজির ‘প্রাইভেট ফান্ড’, যা সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। গভর্নমেন্ট পেপার ৩,৭০০ টাকা ও নগদ ১৭০০। স্বামীজির শেষ ইচ্ছা, টাকাটি তার গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হয়। কিন্তু হিসেবের কড়ি! ট্রাস্টিরা সামান্য পরিমাণ অর্থ থেকেও বাদ দিলেন :
১) শান্তিরাম ঘোষের কাছে স্বামীজির ধার ৯ টাকা।
২) স্বামীজি তাঁর শিষ্যদের জন্য মশারি কিনতে দেন ২০ টাকা।
৩) স্বামী অদ্বৈতানন্দের চোখ অপারেশন করবার ফি দেওয়ার জন্য স্বামীজির নির্দেশ ৩০ টাকা। মোট ৫৯ টাকা।
.
মঠের অছিদের কাছে দ্বিতীয় প্রস্তাব, মার্কিন-নিবাসিনী মিসেস ওলি বুল স্বামীজিকে ৭০০ টাকার চেক দিয়েছিলেন জনৈক বিদেশিনী ভক্তের আমেরিকা ফিরবার জাহাজ-ভাড়ার জন্য। যদি এই ভাড়া অন্য কেউ দিয়ে দেন, তা হলে এই ৭০০ টাকাও স্বামীজির মা ভূবনেশ্বরী দাসীকে দেওয়া হবে।
শুরু থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের হিসেবপত্তর কত কড়া তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ৭০০ টাকা দিয়ে পরে সঙ্ঘগুরু স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামীজির মা’কে তীর্থ করান এবং দত্ত বাড়ির পারিবারিক মামলাতেও কিছু খরচ করেন।
বহু বছর আগে শ্রীমতী সরলাবালা সরকার রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে লিখে গিয়েছে, প্রত্যেক ব্যাপারের জন্য আলাদা-আলাদা ফান্ড। যে যে কাজের জন্য টাকা দিয়েছে, তা অন্য খাতে খরচ করা চলবে না। এ-বিষয়ে স্বামীজির বক্তব্য : “যদি তোমাকে অনাহারে মরতেও হয় তবু অন্য বাবদের টাকা থেকে একটা পয়সাও খরচ করবে না।” অর্থাৎ কাশীপুরের পরে বিরাট মানসিক পরিবর্তন।
দুর্বল হিসেব বোধহয় অনেকটা ব্লাড সুগারের মতো, যে-কোনও প্রতিষ্ঠানকে নিঃশব্দে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। শ্ৰীমতী সরলাবালার সংযোজন, “মঠ আর মিশন দুই-ই আলাদা। তাই যদি কোনও ভক্ত প্রণামী দেন বা ঠাকুরসেবার জন্য টাকা দেন, সেটি মঠের অর্থভাণ্ডারে সঞ্চিত হইবে, আর জনহিতকর কার্যের জন্য জনসাধারণ যে টাকা দান করিবে সেটি হইবে মিশনের টাকা। সেই টাকার পাই-পয়সার হিসাব পর্যন্ত হিসাব-পরীক্ষক দিয়া মিলাইয়া লইতে হইবে।”
মৃত্যুর পরেও বিষয়সম্পত্তি নিয়ে যাতে কোনও আইনি গোলমাল আরম্ভ না হয়, তার জন্য সুদূর মার্কিনদেশে পরিব্রাজক বিবেকানন্দের চিন্তার শেষ ছিল না। দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে যখনই তিনি বিব্রত হয়েছেন, তখনই তিনি চটপট নিজের হাতে একটি উইল লিখে ফেলেছেন, ব্যাঙের আধুলির কতটুকু কোথায় যাবে, কে তার দায়িত্ব নেবে তা স্পষ্ট ভাষায় বলে গিয়েছেন। স্বামীজির এইসব উইল সম্বন্ধে নানা পরিস্থিতিতে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু মানসপত্রগুলির নির্দেশগুলি খুঁটিয়ে দেখে আরও বিস্তারিত আলোচনা হলে দূরদর্শী সন্ন্যাসীটিকে আরও ভালভাবে জানা যেত। সাতপুরুষের উকিলবাড়ির ছেলে সন্ন্যাস নিলেও প্রয়োজন মতো যে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করতেন না।
শুধু নিজের উপার্জিত সামান্য অর্থের জন্য নয়, অন্যের নামেও যেসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, সে বিষয়ে সব রকম নিরাপত্তা নেওয়ার ব্যাপারে স্বামীজি যে বেজায় একগুঁয়ে ছিলেন, তারও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিদেশিনী মিস হেনরিয়েটা মুলারের অর্থে বেলুড়ের যে-জমি কেনা হয়, তার বায়না করা হয় ১৮৯৮ সালে (১০০১ টাকা)। বাকি ৩৮,৯৯৯ টাকা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় ৫ মার্চ ১৮৯৮। এর মধ্যে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ তার ব্যক্তিগত উইল করেন ১৯ জানুয়ারি ১৮৯৮, কারণ বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে সামান্য যা অর্থ এনেছিলেন, তা তিনি ব্রহ্মানন্দকেই দিয়েছিলেন। যদি স্বামী ব্রহ্মানন্দ লোকান্তরিত হন, তা হলে কী হবে, এই আশঙ্কায় এই ইচ্ছাপত্র।
“লিখিতং স্বামী ব্রহ্মানন্দ, দক্ষিণেশ্বরনিবাসী পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য, সন্ন্যাসী, সাকিন আলমবাজার মঠ, আলমবাজার, জেলা চৰ্বিশ পরগণা কস্য চরমপত্ৰমিদং– আমি এত দ্বারা নির্দেশ করিতেছি যে, আমার ত্যক্ত আমার স্বামী বা বেনামী নগদ অর্থ, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি এবং স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি আমার অভাবে উক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য আলমবাজার মঠনিবাসী স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ সন্ন্যাসীদ্বয় পাইবেন এবং তাহাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তে ও অধীনে থাকিবে। আমি তাহাদিগকে এই উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিলাম। এত দ্বারা স্বেচ্ছায় এই শেষ উইল বা চরমপত্র সম্পাদন করিলাম।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দর এই উইলের সাক্ষী ছিলেন বিখ্যাত সলিসিটর প্রমথনাথ কর ও ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ।
হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দর দু’খানি মারাত্মক চিঠি বাংলায় লেখা হয়েছিল পরের বছর লন্ডন থেকে। বন্ধু ব্রহ্মানন্দকে লেখা প্রথম চিঠির তারিখ ১০ আগস্ট ১৮৯৯। নতুন কাগজ ‘উদ্বোধন’ সম্পর্কে প্রবল বিরক্তি দিয়ে এই চিঠির শুরু।– “মনে জেনো যে, আমি গেছি। এই বুঝে স্বাধীনভাবে তোমরা কাজ কর। টাকাকড়ি, বিদ্যাবুদ্ধি সমস্ত দাদার ভরসা’ হইলেই সর্বনাশ আর কি! কাগজটার পর্যন্ত টাকা আমি আনব, আবার লেখাও আমার সব– তোমরা কি করবে? সাহেবরা কি করছেন?
“আমার হয়ে গেছে! তোমরা যা করবার কর। একটা পয়সা আনবার কেউ নেই, একটা প্রচার করবার কেউ নেই, একটা বিষয় রক্ষা করবার বুদ্ধি কারু নেই। এক লাইন লিখবার… ক্ষমতা কারুর নাই– সব খামকা মহাপুরুষ!
“…তোমাদের যখন এই দশা, তখন ছেলেদের হাতে ছমাস ফেলে দাও সমস্ত জিনিস– কাগজ-পত্র, টাকা-কড়ি, প্রচার ইত্যাদি। তারাও কিছু পারে তো সব বেচেকিনে যাদের টাকা তাদের দিয়ে ফকির হও।
“মঠের খবর তো কিছু পাই না। শরৎ কি করছে? আমি কাজ চাই। মরবার আগে দেখতে চাই যে, আজীবন কষ্ট করে যা খাড়া করেছি, তা একরকম চলছে। তুমি টাকাকড়ির বিষয় কমিটির সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করবে। কমিটির সই করে নেবে প্রত্যেক খরচের জন্য। নইলে তুমিও বদনাম নেবে আর কি!
“লোকে টাকা দিলেই একদিন না একদিন হিসাব চায়– এই দস্তুর। প্রতি পদে সেটি তৈয়ার না থাকা বড়ই অন্যায়। …ওইরকম প্রথমে কুঁডেমি করতে করতেই লোকে জোচ্চোর হয়। মঠে যারা আছে, তাদের নিয়ে একটি কমিটি করবে, আর প্রতি খরচ তারা সই না দিলে হবে না।– একদম! …আমি কাজ চাই, vigour (উদ্যম) চাই– যে মরে যে বাঁচে; সন্ন্যাসীর আবার মরা বাঁচা কি?”
.
তিন মাস পরে (২১ নভেম্বর ১৮৯৯) নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা আর এক চিঠি থেকে স্পষ্ট যে, হিসেবপত্তর সম্বন্ধে স্বামীজির মনোভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে তিনি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টসের নিয়মকানুনে বাঁধতে উদগ্রীব।
স্বামীজি লিখছেন, “হিসাব ঠিক আছে। আমি সে-সব মিসেস বুলের হাতে সঁপে দিয়েছি এবং তিনি বিভিন্ন দাতাকে হিসাবের বিভিন্ন অংশ জানাবার ভার নিয়েছেন।
“আগেকার কঠোর চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি, তাতে কিছু মনে করো না। প্রথমত ওতে তোমার উপকার হবে– এর ফলে তুমি ভবিষ্যতে যথানিয়মে কেতাদুরস্ত হিসাব রাখতে শিখবে এবং গুরুভাইদেরও এটা শিখিয়ে নেবে।
“দ্বিতীয়ত এই-সব ভৎর্সনাতেও যদি তোমরা সাহসী না হও, তা হলে তোমাদের সব আশা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাই তোমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তোমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মতো আজ্ঞাপালন করে মরে যাও এবং নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোনও প্রকার ভীরুতা চলবে না।”
হিসেব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হওয়ার পিছনে স্বামী বিবেকানন্দের যে বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল, তা পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড স্টার্ডিকে লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বামীজির বিদেশি অনুরাগীদের কেউ কেউ অজ্ঞাত কারণে তার সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। যে মিস হেনরিয়েটা মুলার বেলুড়ের জমি কেনার জন্য প্রধান অর্থ জুগিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বিবেকানন্দর প্রকাশ্য বিচ্ছেদের কথা রামকৃষ্ণ অনুরাগীদের অজানা নয়। আর একটি অপ্রীতিকর ঘটনা, স্টার্ডির অহেতুক সমালোচনার বিরুদ্ধে স্বামীজির পত্রবিস্ফোরণ। এই ধরনের ধৈর্যহীন বিস্ফোরণ স্বামীজির জীবনে কমই ঘটেছে, কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট, আর্থিক ব্যাপারে কোনওরকম অশোভন ইঙ্গিত তাঁকে গভীর বেদনা দিত।
স্টার্ডির সঙ্গে পত্রাবলী থেকে স্পষ্ট, ইংল্যান্ডের মাটিতে অসহায় মানুষটিকে কী কষ্ট পেতে হয়েছিল, অথচ বিদেশের অনুরাগীদের ভুল ধারণা, তাঁরা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট সুখে রেখে দিয়েছেন। হিসেবপত্র প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক থেকে মিস্টার স্টার্ডিকে লেখা তারিখহীন চিঠিতে আসবার আগে নভেম্বর ১৮৯৯-তে স্বামীজির লেখা পরবর্তী চিঠির আলোচনা প্রয়োজন। আর্থিক সাহায্য যৎসামান্য হলেও সায়েবরা তার পরিবর্তে সন্ন্যাসীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন, তা এই পত্র থেকে স্পষ্ট।
অপমানিত হয়ে বিবেকানন্দ সোজাসুজি প্রতিবাদ জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। ”বিলাসিতা, বিলাসিতা, গত কয় মাস থেকে কথাটি বড্ড বেশি শুনতে পাচ্ছি। পাশ্চাত্যবাদীরা নাকি তার উপকরণ জুগিয়েছে, আর সর্বক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে ভণ্ড আমি নাকি নিজে সেই বিলাসিতা ভোগ করে আসছি। …তোমাদের সমালোচনায় আমার আর কোনও আস্থা নেই। এসব বিলাসব্যসনের কথায় আর কান দিই না…”
এর পরে কিছু অপ্রিয় সত্যের তিক্ত তালিকা। “ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও মিসেস সেভিয়ারের কথা বাদ দিলে ইংল্যান্ড থেকে আমি রুমালের মতো এক টুকরো বস্ত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ ইংল্যান্ডে শরীর ও মনের উপর অবিরত পরিশ্রমের চাপের ফলেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা, ইংরেজরা আমাকে এই তত দিয়েছ, আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ আমাকে অমানুষিক খাঁটিয়ে। এখন আবার বিলাস-ব্যসন নিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে বিরক্ত স্বামীজির লেখা আগের দুটি চিঠির কারণ বুঝতে হলে স্টার্ডির অন্তর্বর্তী পত্রগুলি পাঠ করা বিশেষ প্রয়োজন। রিজলি ম্যানর, নিউ ইয়র্ক থেকে লেখা চিঠিতে ঘুরেফিরে সেই হিসেবপত্রের কথা। স্বামীজি লিখছেন, “হিসেবপত্র পূর্বে পেশ করা হয়নি, কারণ কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি; সমস্ত ব্যাপারটা চুকে গেলে দাতার কাছে সম্পূর্ণ হিসাব দাখিল করব ভেবেছিলাম। টাকার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার ফলে কাজ মাত্র গত বছর শুরু হতে পেরেছে এবং আমার নীতি হল, টাকার জন্যে হাত পেতে স্বেচ্ছায় দানের জন্য অপেক্ষা করা।”
শেষের লাইনটি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারা এই নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলায় কোনও দিনই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য লাভ করেননি। কিন্তু কারণে-অকারণে সাহায্যের জন্য জনসাধারণের কাছে। হাতপাতা তাঁদের কালচারের বিরোধী। স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতার মনোভাবকে সন্ন্যাসীরা শত অভাবের মধ্যেও বিসর্জন দেননি। কিছুদিন আগে ভাটিকানে পোপের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রামকৃষ্ণ মিশনের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীর তরুণতম, ক্ষুদ্রতম এবং নিঃসন্দেহে দরিদ্রতম সন্ন্যাসী সঙ্ঘের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার কাছে এসেছি।”
সাধারণ ও অসাধারণ মানুষদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যথেষ্ট পরিমাণে মিললেও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ যে শতবর্ষের প্রবাহেও অর্থ বিষয়ে তেমন সম্পন্ন হতে পারেনি, এ বিষয়ে দ্বিমত হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও বাইরে থেকে অনেকের ধারণা, অপর্যাপ্ত অর্থ সন্ন্যাসীদের আয়ত্তে রয়েছে এবং সঙ্ঘসভ্যরা কোনওরকম অর্থচিন্তা ছাড়াই নিজেদের অভীষ্ট কাজ করে যেতে সমর্থ হচ্ছেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে আরও একটু আলোচনার প্রয়োজন হবে। অনুমানের উপর নির্ভর করে কোনও মতামত সৃষ্টি হলে সেখানে অবশ্যই ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। যে