~ দক্ষিণেশ্বরে মা সারদা ~
প্রণবেশ চক্রবর্তী
নিবেদন
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলন যখন বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত এবং বিশ্বজীবনের অন্তরলােকে যখন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, তখন এই জীবন-জাগানিয়া আন্দোলনের মূলে পবিত্রতা-স্বরূপিণী এবং অবগুণ্ঠন বতী মা সারদার তাৎপর্যপূর্ণ। ভূমিকা ঐতিহাসিক কারণেই অনুধাবন করার সময় উপস্থিত।
শুধুমাত্র রামকৃষ্ণ ঘরনী রূপে নয়, স্বীয় জীবনের অনন্ত মাধুর্যে এবং অসীম ঋজুতায় মা সারদা ঐতিহাসিক মহিমায় উদ্ভাসিতা। তিনি নারী দেহে এ পৃথিবীতে ৬৭ বছর প্রতিভাত ছিলেন। এই ৬৭ বছরকে আমরা সুস্পষ্ট তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথম ৩ বছর তিনি অন্তরালবর্তিনী, অবগুণ্ঠনবতী। শ্রীরামকৃষ্ণ সামনে, তিনি আড়ালে। তারপর শ্রীরামকৃষ্ণের অবর্তমানে এক বছর তীর্থে তীর্থে তিনি ঘুরেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পথের নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে ভাবীকালের সঙ্ঘ জননী রূপে প্রস্তুত করেছেন। তিনি প্রস্তুত হয়েছেন। তারপর বাকি ৩৩ বছর—তিনিই এই ভাব-আন্দোলনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের অকাল-দেহত্যাগের পরও প্রায় ১৮ বছর তিনি তার সন্ন্যাসী সন্তানদের জীবনকে মাতৃস্নেহের ফল্গুধারায় প্রেরণা-সিক্ত করেছেন, বরাভয় দায়িনী বেশে সতেজ ও সবল করে তুলেছেন।
এই দিব্যসুন্দর মাতৃজীবনের প্রকাশ, বিকাশ এবং বিস্তারের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হয়েছিল মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বরের ভূমিতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে পূজার বেদিতে বসিয়ে এই মাতৃপীঠেই এক অভিনব মাতৃসাধনার ইতিহাস রচনা করেছেন। আবার মা সারদা তার অভূতপূর্ব ত্যাগের পরম ঐশ্বর্য দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অপরূপ সাধনাকে সুষমামণ্ডিত করে তুলেছেন। দক্ষিণেশ্বরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তাই বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। কিন্তু মা সারদায় মহান জীবন ব্রতের এই অধ্যায়টি বাস্তব অর্থেই অনালোচিত। অথচ এই অধ্যায়টিকে ইতিহাসের আলােকে অনুভব করতে না পারলে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের মূল শক্তি বিন্দুকে নির্মোহ দৃষ্টিতে অনুসরণ করা সম্ভব হবে না।
অশােকবনে সীতা বন্দিনী ছিলেন। আর দক্ষিণেশ্বরের নহবতে মা সারদা স্বেচ্ছায় বন্দিনী জীবন বরণ করে নিয়েছিলেন। কত কাছে রামকৃষ্ণ, তবু কত দূরে তিনি। মা সারদা ইচ্ছে করলেও স্বামীর কাছে যেতে পারতেন না। তারপর এক সময় যাওয়ার অধিকারটুকুও স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ তাে তার একার নয়, তিনি যে সকলের। তার এই বিশ্ব-উদার সর্বজনীনতায় শ্রীমা অতুলনীয়।
তাই দক্ষিণেশ্বরে মাতৃজীবনের অধ্যায়টিকে উন্মােচন করার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস —যদিও জানি, আমার মত এক দীন-অভাজন লেখকের পক্ষে সেই প্রয়াসে সার্থক হওয়া অসম্ভব। দক্ষিণেশ্বরে আসা-যাওয়ার প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিবৃত্ত সঙ্গত কারণেই এই সুত্রে আলােচিত হয়েছে, যেমন আলােচিত হয়েছে ১৮৭২ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত কামারপুকুর ও জয়রামবাটির বিভিন্ন ঘটনাও। এইসব ঘটনার আলোকেই দক্ষিণেশ্বরের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করা সহজ হবে।
এই গ্রন্থ রচনায় আমি শুধু প্রকাশিত প্রামাণ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধের আশ্রয় নিয়েছি। ইতিহাসের আলােকে জীবনকথা রচনায় সচেষ্ট হয়েছি। জানি না, মায়ের আশীর্বাদ আমার উপর বর্ষিত হয়েছে কিনা। তবে, আশা আছে, মা তো অধম সন্তানকেই বেশি স্নেহ করেন।
এই গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যাপারে নাথ পাবলিশিং-এর সমীর নাথ প্রথম থেকেই উৎসাহী ছিলেন। তাঁর উৎসাহ আমাকে উৎসাহিত করেছে। এখন এই মহাজীবন-কথা পাঠকদের প্রত্যাশা সামান্যমাত্র পূর্ণ করতে পারলেই আমি নিজেকে ধন্য ও কৃতার্থ মনে করব। ইতি--
বিনীত
প্রণবেশ চক্রবর্তী
Read PDF Online
=========================
0 Comments