বাঙলা ও বাঙালী সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ

বাঙলা ও বাঙালী

বাঙলা ও বাঙালী সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ

বাঙলা ও বাঙালী সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ


এই অনন্ত শস্যশ্যামলা সহস্রস্রোতস্বতী-মাল্যধারিণী বাঙলা দেশের একটি রূপ আছে। সেরূপ—কিছু আছে মলয়ালমে (মালাবার), আর কিছু কাশ্মীরে। জলে কি আর রূপ নাই? জলে জলময়, মুষলধারে বৃষ্টি কচুর পাতার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, রাশি রাশি তাল-নারিকেলখেজুরের মাথা একটু অবনত হয়ে সে ধারাসম্পাত বইছে, চারিদিকে ভেকের ঘর্ঘর আওয়াজ—এতে কি রূপ নাই?...সে নীল-নীল আকাশ, তার কোলে কালাে মেঘ, সােনালী কিনারাদার, তার নিচে ঝােপ-ঝােপ তাল-নারিকেল-খেজুরের মাতা বাতাসে যেন লক্ষ লক্ষ চামরের মতাে হেলছে, তার নিচে ফিকে ঘন ঈষৎ পীতাভ, একটু কালাে মেশানাে—ইত্যাদি হরেক রকম সবুজের কাঁড়ি-ঢালা আঁব-নিচু-জাম-কাঁঠাল-পাতাই পাতাগাছ ডাল পালা আর দেখা যাচ্ছে না, আশে পাশে ঝাড় ঝাড় বাঁশ হেলছে, দুলছে, আর সকলের নিচে—যার কাছে ইয়ারকান্দি ইরানী তুর্কিস্তানি গালচে-দিলচে কোথায় হার মেনে যায়! সেই ঘাস, যতদূর চাও—সেই শ্যাম-শ্যাম ঘাস, কে যেন হেঁটেঘুটে ঠিক করে রেখেছে; জলের কিনারা পর্যন্ত সেই ঘাস; গঙ্গার মৃদুমন্দ হিল্লোল যে অবধি জমিকে ঢেকেছে, যে অবধি অল্প অল্প লীলাময় ধাক্কা দিচ্ছে, সে অবধি ঘাসে আঁটা। আবার তার নিচে আমাদের গঙ্গাজল। আবার পায়ের নিচে থেকে দেখ, ক্রমে উপরে যাও, উপর উপর মাথার উপর পর্যন্ত, একটি রেখার মধ্যে এত রঙের খেলা! ৬।৬৩
******
আমাদের কর্দমাবিলা, হরগাত্রবিঘর্ষণ শুভ্রা, সহস্র-পিেতবক্ষা এ কলকাতার গঙ্গায় কি এক টান আছে তা ভােলবার নয়। সে কি স্বদেশপ্রিয়তা বা বাল্যসংস্কার কে জানে? ৬।৬১
******
বাঙলা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোটি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকাতার ভাষা। ৬।৩৫
******
বাংলা ভাষায় নূতন ওজস্বিতা আনতে হবে। এই যেমন—কেবল ঘণ ঘন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলে ভাষার দম কমে যায়। বিশেষণ দিয়ে Verb (ক্রিয়াপদ)-এর ব্যবহারগুলি কমিয়ে দিতে হবে। ৯।১৭৩
******
নূতন অবশ্য শিখতে হবে, করতে হবে, কিন্তু তা বলে কি পুরানােগুলাে জলে ভাসিয়ে দিয়ে না কি? নূতন তাে শিখেছ কচুপােড়া, খালি বাক্যিচচ্চড়ি!! কাজের বিদ্যা কি শিখেছ?..নিজেদের যা ছিল, তা তাে সব যাচ্ছে; অথচ বিদেশী শেখবার মধ্যে বাক্যি-যন্ত্রণা মাত্র!! খালি পুঁথি পড়ছ! আমাদের বাঙালী আর বিলেতে আইরিশ—এ দুটো এক ধাতের জাত। খালি বকাবকি করছে। বক্তৃতায় এ দু-জাত বেজায় পটু। কাজের—এক পয়সাও নয়, বাড়ার ভাগ দিনরাত পরস্পরের খেয়াে-খেয়ি করে মরছে!!!

বঙ্গভূমির অবস্থা বড়ই শােচনীয়। ত্যাগ কাহাকে বলে এদেশের লােকে স্বপ্নেও ভাবে না: কেবল বিলাস, ইন্দ্রিয়পরতা ও স্বার্থপরতা এদেশের অস্থিমজ্জা ভক্ষণ করছে। ৬।৩৩০
******
বাঙলা দেশের সম্প্রদায়গুলির এই এক বিশেষ দোষ যে, যদি তাহাদের মধ্যে কাহারও একটু ভিন্নমত হয়, অমনি সে একটি নতুন সম্প্রদায় করিয়া বসে, তাহার আর অপেক্ষা করিবার সহিষ্ণুতা থাকে না। ৫|৩৫৭
******
পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপরায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয়—এই তাে আমরা বাঙালী জাতি। ৭।৩১৩
******
মেকলে ও আর আর অনেকে বাঙালী জাতকে যে ভয়ানক গালাগাল দিয়েছেন, তার কারণ কিছু কিছু বুঝতে পারছি। এরা সর্বাপেক্ষা কাপুরুষ, আর সেই কারণেই এতদূর ঈর্ষাপরায়ণ ও পরনিন্দাপ্রবণ। ৭।৫৫
******
লােকে বলিয়া থাকে, বাঙালী জাতির কল্পনাশক্তি অতি প্রখর, আমি উহা বিশ্বাস করি। আমাদিগকে লােকে কল্পনাপ্রিয় ভাবুক জাতি বলিয়া উপহাস করিয়া থাকে। কিন্তু বন্ধুগণ! আমি তােমাদিগকে বলিতেছি, ইহা উপহাসের বিষয় নয়, কারণ প্রবল উচ্ছ্বাসেই হৃদয়ে তত্ত্বালােকের স্ফুরণ হয়। বুদ্ধিবৃত্তি—বিচারশক্তি খুব ভাল জিনিস, কিন্তু এগুলি বেশি দূর যাইতে পারে না। ভাবের মধ্য দিয়াই গভীররতম রহস্যসমূহ উঘাটিত হয়। অতএব বাঙালী দ্বারাই—ভাবুক বাঙালী দ্বারাই—ঐ কার্য সাধিত হইবে। ৫।২১৫
******
উঠ—জাগাে, জগৎ তােমাদিগকে আহ্বান করিতেছে। ভারতের অন্যান্য স্থানে বুদ্ধিবল আছে, কিন্তু কেবল আমার মাতৃভূমিতেই উৎসাহাগ্নি প্রজ্বলিত করিতে হইবে; অতএব হে কলিকাতাবাসী যুবকগণ! হৃদয়ে এই উৎসাহের আগুন জ্বালিয়া জাগরিত হও। ৫|২১৬
******
আমি তাে এখনও কিছুই করিতে পারি নাই, তােমাদিগকেই সব করিতে হইবে। যদি কাল আমার দেহত্যাগ হয়, সঙ্গে সঙ্গে এই কার্য লােপ পাইবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জনসাধারণের মধ্য হইতে সহস্র সহস্র ব্যক্তি আসিয়া এই ব্রত গ্রহণ করিবে এবং এই কার্যের এতদূর উন্নতি ও বিস্তার হইবে যাহা আমি কখনও কল্পনাও করি নাই। আমার দেশের উপর আমি বিশ্বাস রাখি, বিশেষতঃ আমার দেশের যুবকদলের উপর।

বঙ্গীয় যুবকগণের স্কন্ধে অতি গুরুভার সমর্পিত। আর কখনও কোন দেশের যুবক দলের উপর এত গুরুভার পড়ে নাই। আমি প্রায় গত দশবৎসর যাবৎ সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করিয়াছি—তাহাতে আমার দৃঢ় প্রতীতি হইয়াছে যে, বঙ্গীয় যুবকগণের ভিতর দিয়াই সেই শক্তি প্রকাশিত হইবে, যাহা ভারতকে তাহার উপযুক্ত আধ্যাত্মিক অধিকারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবে। নিশ্চয় বলিতেছি, এই হৃদয়বান উৎসাহী বঙ্গীয় যুবকগণের মধ্য হইতেই শত শত বীর উঠিবে, যাহারা আমাদের পূর্বপুরুষগণের প্রচারিত সনাতন আধ্যাত্মিক সত্য প্রচার করিয়া ও শিক্ষা দিয়া জগতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত—এক মেরু হইতে অপর মেরু পর্যন্ত ভ্রমণ করিবে। ৫|২১৭
******
বঙ্গীয় যুবকগণ, তােমরা ধনী ও বড় লােকের মুখ চাহিয়া থাকিও না; দরিদ্রেরাই পৃথিবীতে চিরকাল মহৎ ও বিরাট কার্যসমূহ সাধন করিয়াছে।...যেহেতু তােমরা কিছুই নাই, সেহেতু তােমরা অকপট হইবে। অকপট বলিয়াই তােমরা সর্বত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইবে।…

হে দরিদ্র বঙ্গবাসিগণ, ওঠ, তােমরা সব করিতে পার, আর তােমাদিগকে সব করিতেই হইবে। যদিও তােমরা দরিদ্র, তথাপি অনেকে তােমাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিবে। দৃঢ়চিত্ত হও; সর্বোপরি পবিত্র ও সম্পূর্ণ অকপট হও; বিশ্বাস কর যে, তােমাদের ভবিষ্যৎ অতি গৌরবময়। ৫|৩৫৪
******

Post a Comment

0 Comments