নূতন ভারতের কথা ~ স্বামী বিবেকানন্দ

নূতন ভারত

নূতন ভারতের কথা ~ স্বামী বিবেকানন্দ

নূতন ভারতের কথা ~ স্বামী বিবেকানন্দ


আর্য-বাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন গৌরব ঘােষণা দিনরাতই কর, আর যতই কেন তােমরা ‘ড’ বলে ডফাই কর, তােমরা উচ্চবর্ণেরা কি বাঁচে আছ? তােমরা হচ্ছ দশ হাজার বছরের মমি!! যাদের ‘চলমান শশান’ বলে তােমাদের পূর্বপুরুষেরা ঘৃণা করেছেন, ভারতে যা কিছু বর্তমান জীবন আছে, তা তাদেরই মধ্যে। আর 'চলমান শ্মশান' হচ্ছ তােমরা। তােমাদের বাড়ি-ঘর-দুয়ার মিউজিয়াম, তােমাদের আচার-ব্যবহার, চাল-চলন দেখলে বােধ হয় যেন ঠানদিদির মুখে গল্প শুনছি! তােমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করেও ঘরে এসে মনে হয়, যেন চিত্রশালিকায় ছবি দেখে এলুম। এ মায়ার সংসারে আসল প্রহেলিকা, আসল মরুমরীচিকা তােমরা—ভারতের উচ্চবর্ণেরা। তােমরা ভূতকাল—লু লুঙ লিট সব এক সঙ্গে। বর্তমানকালে তােমাদের দেখছি বলে যে বােধ হচ্ছে, ওটা অজীর্ণতাজনিত দুঃস্বপ্ন। ভবিষ্যতের তােমরা শূন্য, তােমরা ইৎ-লােপ লুপ। স্বপ্নরাজ্যের লােক তােমরা, আর দেরি করছ কেন? ভূত-ভারত-শরীরের রক্তমাংসহীন কঙ্কালকুল তােমরা, কেন শীঘ্র শীঘ্র ধূলিতে পরিণত হয়ে বায়ুতে মিশে যাচ্ছ না?

হুঁ, তােমাদের অস্থিময় অঙ্গুলে পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত কতকগুলি অমূল্য রত্নের অঙ্গুরীয়ক আছে, তােমাদের পূতিগন্ধ শরীরের আলিঙ্গনে পূর্বকালের অনেকগুলি রত্নপেটিকা রক্ষিত রয়েছে। এতদিন দেবার সুবিধা হয় নাই।...অবাধ বিদ্যাচর্চার দিনে উত্তরাধিকারীদের দাও, যত শীঘ্র পার দাও, আর নূতন ভারত বেরুক।

বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝােড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভােগ করেছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারবে, আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলােকে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণ-সম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচার-বল, যা ত্রৈলােক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালবাসা, এত মুখটি চুপ করে দিনরাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহের বিক্রম!! অতীতের কঙ্কালচয়! এই সামনে তােমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত! ঐ তােমার রত্নপেটিকা, তােমার মাণিকের আংটি–ফেলে দাও এদের মধ্যে, যত শীঘ্র পার ফেলে দাও; আর তুমি যাও হাওয়ায় বিলীন হয়ে, অদৃশ্য হয়ে যাও, কেবল কান খাড়া রেখাে; তােমার যাই বিলীন হওয়া, অমনি শুনবে কোটিজীমুতস্যন্দী ত্রৈলােক্যকম্পনকারী ভবিষ্যৎ ভারতের উদ্বোধন-ধ্বনি—‘ওয়াহ্ গুরু কি ফতে'। ৬।৮১
******
ঐ যারা চাষাভূষা তাঁতি-জোলা ভারতের নগণ্য মনুষ্য-বিজাতি-বিজিত স্বজাতি-নিন্দিত ছােট জাত, তারাই আবহমানকাল নীরবে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের পরিশ্রমফলও তারা পাচ্ছে না!... হে ভারতের শ্রমজীবী! তােমার নীরব অনবরত-নিন্দিত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাবিল, ইরান, আলকসন্দ্রিয়া, গ্রীস, রােম, ভিনিস, জেনােয়া, বােন্দাদ, সমরকন্দ, স্পেন, পাের্তুগাল, ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য। আর আমি তুমি?—কে ভাবে এ কথা!

তােমাদের পিতৃপুরুষ দুখানা দর্শন লিখেছেন, দশখানা কাব্য বানিয়েছেন, দশটা মন্দির করেছেন—তােমাদের ডাকের চোটে গগনা ফাটছে আর যাদের রুধিরস্রাবে মনুষ্যজাতির যা কিছু উন্নতি—তাদের গুণগান কে করে? লােকজয়ী ধর্মবীর রণবীর কাব্যবীর সকলের চোখের উপর, সকলের পূজ্য; কিন্তু কেউ যেখানে দেখে না, কেউ যেখানে একটা বাহবা দেয় না, যেখানে সকলে ঘৃণা করে, সেখানে বাস করে অপার সহিষ্ণুতা, অনন্ত প্রীতি ও নির্ভীক কার্যকারিতা; আমাদের গরিবরা ঘরদুয়ারে দিনরাত যে মুখ বুজে কর্তব্য করে যাচ্ছে, তাতে কি বীরত্ব নাই? বড় কাজ হাতে এলে অনেকেই বীর হয়, দশহাজার লােকের বাহবার সামনে কাপুরুষও অক্লেশে প্রাণ দেয়, ঘাের স্বার্থপরও নিষ্কাম হয়; কিন্তু শতি ক্ষুদ্র কার্যে সকলের অজান্তেও যিনি সেই নিঃস্বার্থপরতা, কর্তব্যপরায়ণতা দেখান, তিনিই ধন্য—সে তােমরা, ভারতের চিরপদদলিত শ্রমজীবী!—তােমাদের প্রণাম করি। ৬।১০৬
******
উদ্দেশ্য অনেক আছে, উপায় এদেশে নাই। আমাদের মস্তক আছে, হস্ত নাই। আমাদের বেদান্ত-মত আছে, কার্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা নাই। আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে, আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি। মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম ভারতেই প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু কার্যে আমরা অতি নির্দয়, অতি হৃদয়হীন, নিজের মাংসপিণ্ড—শরীর ছাড়া অন্য কিছুই ভাবিতে পারি না।

তথাপি উপস্থিত অবস্থার মধ্য দিয়াই কেবল কার্যে অগ্রসর হইতে পারা যায়, অন্য উপায় নাই। ভাল-মন্দ বিচারের শক্তি সকলের আছে; কিন্তু তিনি বীর, যিনি এই সমস্ত ভ্ৰম-প্রমাদ ও দুঃখপূর্ণ সংসারের তরঙ্গে পশ্চাদপদ না হইয়া, একহস্তে অশ্রুবারি মােচন করেন ও অপর অকম্পিত হস্তে উদ্ধারের পথপ্রদর্শন করেন! ৭।৩২৩
******
যদি কেউ এই হতশ্রী বিগতভাগ্য লুপ্ত-বুদ্ধি পরপদদলিত চিরবুভুক্ষিত কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তবে ভারত আবার জাগিবে। যবে শত শত মহাপ্রাণ নরনারী সকল বিলাসভােগসুখেচ্ছা বিসর্জন করিয়া কায়মনােবাক্যে দারিদ্র্য ও মূখতার ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশঃ উত্তরােত্তর-নিমজ্জনকারী কোটি কোটি স্বদেশীয় নরনারীর কল্যাণ কামনা করিবে, তখন ভারত জাগিবে। ৭।৩২৪
******

Post a Comment

0 Comments