শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - দ্বিতীয় ভাগ ~ চতুর্থ খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
দ্বিতীয় ভাগ

চতুর্থ খণ্ড

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সুরেন্দ্র ভবনে উৎসব মন্দিরে
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - দ্বিতীয় ভাগ ~ চতুর্থ খণ্ড

==========

প্রথম পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ১৫ই এপ্রিল

শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণাপূজা উপলক্ষে ভক্তসঙ্গে সুরেন্দ্রভবনে

সুরেন্দ্রের বাড়ির উঠানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সভা আলো করিয়া বসিয়া আছেন, অপরাহ্ন বেলা ছয়টা হইল।

উঠান হইতে পূর্বাস্য হইয়া ঠাকুরদালানে উঠিতে হয়। দালানের ভিতর সুন্দর ঠাকুর-প্রতিমা। মার পাদপদ্মে জবা, বিল্ব, গলায় পুষ্পমালা। মাও ঠাকুরদালান আলো করিয়া বসিয়া আছেন।

আজ শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণাপূজা। চৈত্র শুক্লাষ্টমী, ১৫ই এপ্রিল, ১৮৮২ রবিবার, ৩রা বৈশাখ, ১২৯০। সুরেন্দ্র মায়ের পূজা আনিয়াছেন তাই ঠাকুরের নিমন্ত্রণ। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন, আসিয়া ঠাকুরদালানে উঠিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রতিমা দর্শন করিলেন, প্রণাম ও দর্শনানন্তর দাঁড়াইয়া মার দিকে তাকাইয়া শ্রীকরে মূলমন্ত্র জপ করিতেছেন, ভক্তেরা ঠাকুর-প্রতিমাদর্শন ও প্রণামানন্তর প্রভুর কছে দাঁড়াইয়া আছেন।

উঠানে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন। উঠানে সতরঞ্চি পাতা হইয়াছে, তাহার উপর চাদর, তাহার উপর কয়েকটি তাকিয়া। এক ধারে খোল-করতাল লইয়া কয়েকটি বৈষ্ণব বসিয়া আছেন — সংকীর্তন হইবে। ঠাকুরকে ঘেরিয়া ভক্তেরা সব বসিলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে একটি তাকিয়া লইয়া বসিতে বলা হইল। তিনি তাকিয়ার কাছে বসিলেন না। তাকিয়া সরাইয়া বসিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসা! কি জানো, অভিমান ত্যাগ করা বড় কঠিন। এই বিচার কচ্ছ, অভিমান কিছু নয়। আবার কোথা থেকে এসে পড়ে!

“ছাগলকে কেটে ফেলা গেছে, তবু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়ছে।

“স্বপ্নে ভয় দেখেছ; ঘুম ভেঙে গেল, বেশ জেগে উঠলে তবু বুক দুড়দুড় করে। অভিমান ঠিক সেইরকম। তাড়িয়ে দিলেও আবার কোথা থেকে এসে পড়ে! অমনি মুখ ভার করে বলে, আমায় খাতির কল্লে না।”

কেদার — তৃণাদপি সুনীচেন, তরোরিব সহিষ্ণুনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি ভক্তের রেণুর রেণু।   [বৈদ্যনাথের প্রবেশ]

বৈদ্যনাথ কৃতবিদ্য। কলিকাতার বড় আদালতের উকিল, ঠাকুরকে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিলেন ও একপার্শ্বে আসন গ্রহণ করিলেন।

সুরেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — ইনি আমার আত্মীয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, এঁর স্বভাবটি বেশ দেখছি।

সুরেন্দ্র — ইনি আপনাকে কি জিজ্ঞাসা করবেন, তাই এসেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈদ্যনাথের প্রতি) — যা কিছু দেখছ, সবই তাঁর শক্তি। তাঁর শক্তি ব্যতিরেকে কারু কিছু করবার জো নাই। তবে একটি কথা আছে, তাঁর শক্তি সব স্থানে সমান নয়। বিদ্যাসাগর বলেছিল, “ঈশ্বর কি কারুকে বেশি শক্তি দিয়েছেন?” আমি বললুম, শক্তি কমবেশি যদি না দিয়ে থাকেন, তোমায় আমরা দেখতে এসেছি কেন? তোমার কি দুটো শিঙ বেরিয়েছে? তবে দাঁড়ালো যে, ঈশ্বর বিভূরূপে সর্বভূতে আছেন, কেবল শক্তিবিশেষ।

[স্বাধীন ইচ্ছা না ঈশ্বরের ইচ্ছা? Free will or God’s Will ]

বৈদ্যনাথ — মহাশয়! একটি সন্দেহ আমার আছে। এই যে বলে Free Will অর্থাৎ স্বাধীন ইচ্ছা — মনে কল্লে ভাল কাজও কত্তে পারি, মন্দ কাজও কত্তে পারি, এটি কি সত্য? সত্য সত্যই কি আমরা স্বাধীন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সকলই ঈশ্বরাধীন। তাঁরই লীলা। তিনি নানা জিনিস করেছেন। ছোট, বড়, বলবান, দুর্বল, ভাল, মন্দ। ভাললোক; মন্দলোক। এ-সব তাঁর মায়া, খেলা। এই দেখ না, বাগানের সব গাছ কিছু সমান হয় না।

“যতক্ষণ ঈশ্বরকে লাভ না হয়, ততক্ষণ মনে হয় আমরা স্বাধীন। এ-ভ্রম তিনিই রেখে দেন, তা না হলে পাপের বৃদ্ধি হত। পাপকে ভয় হত না। পাপের শাস্তি হত না।

“যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁর ভাব কি জানো? আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও, তেমনি চলি। যেমন বলাও, তেমনি বলি।”

[ঈশ্বরদর্শন কি একদিনে হয়? সাধুসঙ্গ প্রয়োজন]

শ্রীরামকৃষ্ণ (বৈদ্যনাথের প্রতি) — তর্ক করা ভাল নয়; আপনি কি বল?

বৈদ্যনাথ — আজ্ঞে হাঁ, তর্ক করা ভাবটি জ্ঞান হলে যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — Thank you (সকলের হাস্য)। তোমার হবে! ঈশ্বরের কথা যদি কেউ বলে, লোকে বিশ্বাস করে না। যদি কোন মহাপুরুষ বলেন, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি তবুও সাধারণ লোকে সেই মহাপুরুষের কথা লয় না। লোকে মনে করে, ও যদি ঈশ্বর দেখেছে, আমাদের দেখিয়ে দিগ্‌। কিন্তু একদিনে কি নাড়ী দেখতে শেখা যায়? বৈদ্যের সঙ্গে অনেকদিন ধরে ঘুরতে হয়; তখন কোন্‌টা কফের কোন্‌টা বায়ূর কোন্‌টা পিত্তের নাড়ী বলা যেতে পারে। যাদের নাড়ী দেখা ব্যবসা, তাদের সঙ্গ করতে হয়। (সকলের হাস্য)

“অমুক নম্বরের সুতা, যে-সে কি চিনতে পারে? সুতোর ব্যবসা করো, যারা ব্যবসা করে, তাদের দোকানে কিছুদিন থাক, তবে কোন্‌টা চল্লিশ নম্বর, কোন্‌টা একচল্লিশ নম্বরের সুতা ঝাঁ করে বলতে পারবে।”

=============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ১৫ই এপ্রিল

ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে — সমাধিমন্দিরে

এইবার সংকীর্তন আরম্ভ হইবে। খোল বাজিতেছে। গোষ্ঠ খোল বাজাইতেছে। এখনও গান আরম্ভ হয় নাই। খোলের মধুর বাজনা, গৌরাঙ্গমণ্ডল ও তাঁহাদের নামসংকীর্তন কথা উদ্দীপন করে। ঠাকুর ভাবে মগ্ন হইতেছেন। মাঝেমাঝে খুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিতেছেন, “আ মরি! আ মরি! আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে।”

গায়কেরা জিজ্ঞাসা কল্লেন, কিরূপ পদ গাহিবেন? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিনীতভাবে বলিলেন “একটু গৌরাঙ্গের কথা গাও।”

কীর্তন আরম্ভ হইল। প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা। তৎপরে অন্য গীত:

লাখবান কাঞ্চন জিনি। রসে ঢর ঢর গোরা মুঁজাঙ নিছনি ৷৷
কি কাজ শরদ কোটি শশী। জগৎ করিলে আলো গোরা মুখের হাসি ৷৷

কীর্তনে গৌরাঙ্গের রূপবর্ণনা হইতেছে। কীর্তনিয়া আখর দিতেছে।

(সখি! দেখিলাম পূর্ণশশী।) (হ্রাস নাই মৃগাঙ্ক নাই)

(হৃদয় আলো করে।)

কীর্তনিয়া আবার বলছে, কোটি শশীর অমৃতে মুখ মাজা।

এইকথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।

গান চলিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ভঙ্গ হিল। তিনি ভাবে বিভোর হইয়া হঠাৎ দণ্ডায়মান হইলেন ও প্রেমোন্মত্ত গোপিকার ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের রূপের বর্ণনা করিতে করিতে কীর্তনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আখর দিতেছেন:

(সখি! রূপের দোষ, না মনের দোষ?)
(আন্‌ হেরিতে শ্যামময় হেরি ত্রিভুবন!)

ঠাকুর নৃত্য করিতে করিতে আখর দিতেছেন। ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। কীর্তনীয়া আবার বলছেন। গোপীকার উক্তি — বাঁশি বাজিস না! তোর কি নিদ্রা নাই কো?

আখর দিয়া বলছেন:

(আর নিদ্রা হবেই বা কেমন করে!) (শয্যা তো করপল্লব!)
(আহার তো শ্রীমুখের অমৃত।) (তাতে অঙ্গুলির সেবা!)

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আসন পুনর্বার গ্রহণ করিয়াছেন। কীর্তন চলিতে লাগিল। শ্রীমতী বলছেন, চক্ষু গেল, শ্রবণ গেল, ঘ্রাণ গেল, ইন্দ্রিয় সকলে চলে গেল, — (আমি একেলা কেন বা রলাম গো)।

শেষে শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন গান হইল:

ধনি মালা গাঁথে, শ্যামগলে দোলাইতে,
এমন সময়ে আইল সম্মুখে শ্যাম গুণমনি।

[গান — যুগলমিলন]

নিধুবনে শ্যামবিনোদিনী ভোর।
দুঁহার রূপের নাহিক উপমা প্রেমের নাহির ওর ৷৷
হিরণ কিরণ আধ বরণ আধ নীল মণি-জ্যোতিঃ।
আধ গলে বন-মালা বিরাজিত আধ গলে গজমতি ৷৷
আধ শ্রবণে মকর-কুণ্ডল আধ রতন ছবি।
আধ কপালে চাঁদের উদয় আধ কপালে রবি ৷৷
আধ শিরে শোভে ময়ূর শিখণ্ড আধ শিরে দোলে বেণী।
করকমল করে ঝলমল, ফণী উগারবে মণি ৷৷

কীর্তন থামিল। ঠাকুর, ‘ভগবত-ভক্ত-ভগবান’ এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া বারবার ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন। চতুর্দিকে ভক্তদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিতেছেন ও সংকীর্তনভূমির ধূলি গ্রহণ করিয়া মস্তকে দিতেছেন।

===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ১৫ই এপ্রিল

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও সাকার-নিরাকার

রাত্রি প্রায় সাড়ে নয়টা। শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা ঠাকুরদালান আলো করিয়া আছেন। সম্মুখে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দাঁড়াইয়া। সুরেন্দ্র, রাখাল, কেদার, মাস্টার, রাম, মনোমোহন ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা রহিয়াছেন। তাঁহারা সকলে ঠাকুরের সঙ্গে প্রসাদ পাইয়াছেন। সুরেন্দ্র সকলকে পরিতোষ করিয়া খাওয়াইয়াছেন। এইবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-বাগানে প্রত্যাবর্তন করিবেন। ভক্তেরাও স্ব স্ব ধামে চলিয়া যাইবেন। সকলেই ঠাকুরদালানে আসিয়া সমবেত হইয়াছেন।

সুরেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আজ কিন্তু মায়ের নাম একটিও হল না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঠাকুরের প্রতিমা দেখাইয়া) — আহা, কেমন দালানের শোভা হয়েছে। মা যেন আলো করে বসে আছেন। এরূপ দর্শন কল্লে কত আনন্দ হয়। ভোগের ইচ্ছা, শোক — এ-সব পালিয়ে যায়। তবে নিরাকার কি দর্শন হয় না — তা নয়। বিষয়বুদ্ধি একটুও থাকলে হবে না; ঋষিরা সর্বত্যাগ করে অখণ্ড সচ্চিদানন্দের চিন্তা করেছিলেন।

“ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীরা ‘অচল ঘন’ বলে গান গায়, — আমার আলুনী লাগে। যারা গান গায়, যেন মিষ্টরস পায় না। চিটেগুড়ের পানা দিয়ে ভুলে থাকলে, মিছরীর পানার সন্ধান কত্তে ইচ্ছা হয় না।

“তোমরা দেখ, কেমন বাহিরে দর্শন কচ্ছ আর আনন্দ পাচ্ছ। যারা নিরাকার নিরাকার করে কিছু পায় না, তাদের না আছে বাহিরে না আছে ভিতরে।”

ঠাকুর মার নাম করিয়া গান গাহিতেছেন:

গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ কর না।
ও দুটি চরণ বিনা আমার মন, অন্য কিছু আর জানে না ৷৷
তপন-তনয়, আমায় মন্দ কয়, কি দোষে তাতো জানি না।
ভবানী বলিয়ে, ভবে যাব চলে, মনে ছিল এই বাসনা,
অকূলপাথরে ডুবাবে আমারে, স্বপনেও তা জানি না ৷৷
অহরহর্নিশি শ্রীদুর্গানামে ভাসি, তবু দুখরাশি গেল না।
এবার যদি মরি, ও হরসুন্দরী, (তোর) দুর্গানাম কেউ আর লবে না ৷৷

আবার গাহিতেছেন:

বল রে বল শ্রীদুর্গানাম। (ওরে আমার আমার মন রে) ৷৷
দুর্গা দুর্গা দুর্গা বলে পথ চলে যায়।
শূলহস্তে শূলপাণি রক্ষা করেন তায় ৷৷
তুমি দিবা, তুমি সন্ধ্যা, তুমি সে যামিনী।
কখন পুরূষ হও মা, কখন কামিনী ৷৷
তুমি বল ছাড় ছাড় আমি না ছাড়িব।
বাজন নূপুর হয়ে মা চরণে বাজিব ৷৷
(জয় দুর্গা শ্রীদুর্গা বলে)।
শঙ্করী হইয়ে মাগো গগনে উড়িবে।
মীন হয়ে রব জলে নখে তুলে লবে ৷৷
নখাঘাতে ব্রহ্মময়ী যখন যাবে মোর পরাণী,
কৃপা করে দিও রাঙা চরণ দুখানি।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার প্রতিমার সম্মুখে প্রণাম করিলেন। এইবার সিঁড়িতে নামিবার সময় ডাকিয়া বলিতেছেন, “ও রা-জু-আ”? (ও রাখাল, জুতো সব আছে, না হারিয়ে গেছে?)

ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। সুরেন্দ্র প্রণাম করিলেন। অন্যান্য ভক্তেরাও প্রণাম করিলেন। রাস্তায় চাঁদের আলো এখনও আছে। ঠাকুরের গাড়ি দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে যাত্রা করিল।

==============

Post a Comment

0 Comments