শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - দ্বিতীয় ভাগ ~ তৃতীয় খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
দ্বিতীয় ভাগ

তৃতীয় খণ্ড

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে —  শ্রীযুক্ত অধর সেনের দ্বিতীয় দর্শন
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - দ্বিতীয় ভাগ ~ তৃতীয় খণ্ড


===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

মণিলাল ও কাশীদর্শন

আইস ভাই, আজ আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে দর্শন করিতে যাই। তিনি ভক্তসঙ্গে কিরূপ বিলাস করিতেছেন, ঈশ্বরের ভাবে সর্বদা কিরূপ সমাধিস্থ আছেন দেখিব। কখন সমাধিস্থ, কখন কীর্তনানন্দে মাতোয়ারা আবার কখন বা প্রাকৃত লোকের ন্যায় ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন, দেখিব। শ্রীমুখে ঈশ্বরকথা বই আর কিছুই নাই; মন সর্বদা অন্তর্মুখ, ব্যবহার পঞ্চমবর্ষীয় বালকের ন্যায়। প্রতি নিঃশ্বাসের সহিত মায়ের নাম করিতেছেন। একেবারে অভিমানশূন্য পঞ্চমবর্ষীয় বালকের ন্যায় ব্যবহার। পঞ্চমবর্ষীয় বালক বিষয়ে আসক্তিশূন্য, সদানন্দ, সরল ও উদার প্রকৃতি। এক কথা — “ঈশ্বর সত্য, আর সমস্ত অনিত্য”, দুইদিনের জন্য। চল, সেই প্রেমোন্মত্ত বালককে দিখিতে যাই। মহাযোগী! অনন্ত সাগরের তীরে একাকী বিচরণ করিতেছেন। সেই অনন্ত সচ্চিদানন্দ-সাগরমধ্যে কি যেন দেখিতেছেন! দেখিয়া প্রেমে উন্মত্ত হইয়া বেড়াইতেছেন।

আজ চৈত্র মাসের শুরু প্রতিপদ তিথি, রবিবার। গতকল্য শনিবার অমাবস্যাতে ঠাকুর বলরামের বাড়ীতে গিয়াছিলেন। অমাবস্যা; নিবিড় আঁধার মধ্যে একাকী মহাকালী; মহাকালের সহিত রমণ করিতেছেন। তাই ঠাকুর অমাবস্যাতে আর স্থির থাকিতে পারেন না। তাই বালকের অবস্থা। যিনি মাকে অহর্নিসি দেখিতেছেন, আর যার 'মা' না হলে চলে না, তিনি বালক।

আজ রবিবার, ৮ই এপ্রিল, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২৬শে চৈত্র, প্রাতঃকাল। এই যে ঠাকুর বালকের ন্যায় বসিয়া আছেন। কাছে বসিয়া একটি ছোকরা ভক্ত — রাখাল।

মাস্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল আছেন, কিশোরী ও আরও কয়েকটি ভক্ত আসিয়া জুটিলেন। পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিক আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করিলেন।

মণি মল্লিক কাশীধামে গিয়াছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী লোক, কাশিতে তাঁহাদের কুঠি আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁগা, কাশীতে গেলে, কিছু সাধু-টাধু দেখলে?

মণিলাল — আজ্ঞে হাঁ, ত্রৈলঙ্গ স্বামী, ভাস্করানন্দ — এঁদের সব দেখতে গিছলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিরকম সব দেখলে বল?

মণিলাল — ত্রৈলঙ্গ স্বামী সেই ঠাকুরবাড়িতেই আছেন, মণিকর্ণিকার ঘাটে বেণীমাধবের কাছে। লোকে বলে, আগে তাঁর উচ্চ অবস্থা ছিল। কত আশ্চর্য আশ্চর্য কার্য করতে পারতেন। এখন অনেকটা কমে গেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-সব বিষয়ী লোকের নিন্দা।

মণিলাল — ভাস্করানন্দ সকলের সঙ্গে মেশেন, ত্রৈলঙ্গ স্বামীর মতো নয় — একেবারে কথা বন্ধ।

[সিদ্ধের পক্ষে “ঈশ্বর কর্তা” — অন্যের পক্ষে পাপপূণ্য — ফ্রি উইল]

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভাস্করানন্দের সঙ্গে তোমার কথা হল?

মণিলাল — আজ্ঞে হাঁ, অনেক কথা হল। তার মধ্যে পাপপুণ্যের কথা হল! তিনি বললেন, পাপ পথে যেও না, পাপচিন্তা ত্যাগ করবে, ঈশ্বর এই সব চান। যে-সব কাজ কল্লে পুণ্য হয়, এমন সব কর্ম কর।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ ও একরকম আছে, ঐহিকদের জন্য। যাদের চৈতন্য হয়েছে, যাদের ঈশ্বর সৎ আর-সব অসৎ অনিত্য বলে বোধ হয়ে গেছে, তাদের আর-একরকম ভাব। তারা জানে যে, ঈশ্বরই একমাত্র কর্তা, আর সব অকর্তা। যাদের চৈতন্য হয়েছে তাদের বেতালে পা পড়ে না, হিসাব করে পাপ ত্যাগ করতে হয় না, ঈশ্বরের উপর এত ভালবাসা যে, যে-কর্ম তারা করে সেই কর্মই সৎকর্ম! কিন্তু তারা জানে, এ-কর্মের কর্তা আমি নই, আমি ঈশ্বরের দাস। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি যেমন করান, তেমনি করি, যেমন বলান তেমনি বলি, তিনি যেমন চালান, তেমনি চলি।

“যাদের চৈতন্য হয়েছে, তারা পাপপুণ্যের পার। তারা দেখে ঈশ্বরই সব করছেন। এক জায়গায় একটি মঠ ছিল। মঠের সাধুরা রোজ মাধুকরী (ভিক্ষা) করতে যায়। একদিন একটি সাধু ভিক্ষা করতে করতে দেখে যে, একটি জমিদার একটি লোককে ভারী মারছে, সাধুটি বড় দয়ালু; সে মাঝে পড়ে জমিদারকে মারতে বারণ করলে। জমিদার তখন ভারী রেগে রয়েছে, সে সমস্ত কোপটি সাধুটির গায়ে ঝাড়লে। এমন প্রহার করলে যে, সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল। কেউ গিয়ে মঠে খপর দিলে, তোমাদের একজন সাধুকে জমিদার ভারী মেরেছে। মঠের সাধুরা দৌড়ে এসে দেখে, সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে! তখন তারা পাঁচজনে ধরাধরি করে তাকে মঠের ভিতর নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে শোয়ালে। সাধু অজ্ঞান, চারিদিকে মঠের লোকে ঘিরে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে, কেউ কেউ বাতাস কচ্ছে। একজন বললে, মুখে একটু দুধ দিয়ে দেখা যাক। মুখে দুধ দিতে দিতে সাধুর চৈতন্য হল। চোখ মেলে দেখতে লাগল। একজন বললে, ‘ওহে দেখি, জ্ঞান হয়েছে কি না? লোক চিনতে পারছে কিনা?’ তখন সে সাধুকে খুব চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘মহারাজ! তোমাকে কে দুধ খাওয়াচ্ছে?’ সাধু আস্তে আস্তে বলছে, ‘ভাই! যিনি আমাকে মেরেছিলেন, তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।’

“ঈশ্বরকে জানতে না পারলে এরূপ অবস্থা হয় না।”

মণিলাল — আজ্ঞে আপনি যে-কথা বললেন, সে বড় উচ্চ অবস্থা! ভাস্করানন্দের সঙ্গে এই সব পাঁচরকম কথা হয়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কোনও বাড়িতে থাকেন?

মণিলাল — একজনের বাড়িতে থাকেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কত বয়স?

মণিলাল — পঞ্চান্ন হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আর কিছু কথা হল?

মণিলাল — আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ভক্তি কিসে হয়? তিনি বললেন, “নাম কর, রাম রাম বোলো!”

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ বেশ কথা।

=============


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

গৃহস্থ ও কর্মযোগ

ঠাকুরবাড়িতে শ্রীশ্রীভবতারিণী, শ্রীশ্রীরাধাকান্ত ও দ্বাদশ শিবের পূজা শেষ হইল। ক্রমে ভোগারতির বাজনা বাজিতেছে। চৈত্রমাস দ্বিপ্রহর বেলা। ভারী রৌদ্র। এই মাত্র জোয়ার আরম্ভ হইয়াছে। দক্ষিণদিক হইতে হাওয়া উঠিয়াছে। পূতসলিলা ভাগীরথী এইমাত্র উত্তরবাহিনী হইয়াছেন। ঠাকুর আহারান্তে কক্ষমধ্যে একটু বিশ্রাম করিতেছেন। রাখালের দেশ বসিরহাটের কাছে। দেশে গ্রীষ্মকালে বড় জলকষ্ট।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণি মল্লিকের প্রতি) — দেখ রাখাল বলছিল, ওদের দেশে বড় জলকষ্ট। তুমি সেখানে একটা পুষ্করিণী কাটাও না কেন। তাহলে কত লোকের উপকার হয়। (সহাস্যে) তোমার তো অনেক টাকা আছে, অত টাকা নিয়ে কি করবে? তা শুনেছি, তেলিরা নাকি বড় হিসাবী। (ঠাকুরের ও ভক্তগণের হাস্য)

মণিলাল মল্লিকের বাড়ি কলিকাতা সিন্দুরিয়াপটি। সিন্দুরিয়াপটির ব্রাহ্মসমাজের সাংবাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে তিনি অনেককে নিমন্ত্রণ করিয়া থাকেন। উৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ করিয়া থাকেন। মণিলালের বরাহনগরে একখানি বাগান আছে। সেখানে তিনি প্রায় একাকী আসিয়া থাকেন ও সেই সঙ্গে ঠাকুরকে দর্শন করিয়া যান। মণিলাল যথার্থ হিসাবী লোক বটে! সমস্ত গাড়িভাড়া করিয়া বরাহনগরে প্রায় আসেন না; ট্রামে চাপিয়া প্রথমে শোভাবাজারে আসেন, সেখানে শেয়ারের গাড়িতে চাপিয়া বরাহনগরে আসেন। অর্থের অভাব নাই; কয়েক বৎসর পরে গরিব ছাত্রদের ভরণপোষণের জন্য এককালে প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন।

মণিলাল চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে এ-কথা ও-কথার পর, কথার পিঠে বলিলেন, “মহাশয় পুষ্করিণীর কথা বলছিলেন। তা বললেই হয়, তা আবার তেলি-ফেলি বলা কেন?”


ভক্তেরা কেহ কেহ মুখ টিপিয়া হাসিতেছেন। ঠাকুরও হাসিতেছেন।

===============


তৃতীয় পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ ও ব্রাহ্মগণ — প্রেমতত্ত্ব

কিয়ৎক্ষণ পরে কলিকাতা হইতে কয়েকটি পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তন্মধ্যে একজন — শ্রীযুক্ত ঠাকুরদাস সেন। ঘরে অনেকগুলি ভক্তের সমাগম হইয়াছে। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন, বালকমূর্তি। উত্তরাস্য হইয়া বসিয়াছেন। ব্রাহ্মভক্তদের সঙ্গে আনন্দে আলাপ করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্ম ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — তোমরা ‘প্যাম’ ‘প্যাম’ কর; কিন্তু প্রেম কি সামান্য জিনিস গা? চৈতন্যদেবের ‘প্রেম’ হয়েছিল। প্রেমের দুটি লক্ষণ। প্রথম — জগৎ ভুল হয়ে যাবে। এত ঈশ্বরেতে ভালবাসা যে বাহ্যশূন্য! চৈতন্যদেব “বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে, সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।”

“দ্বিতীয় লক্ষণ — নিজের দেহ যে এত প্রিয় জিনিস, এর উপরও মমতা থাকবে না, দেহাত্মবোধ একেবারে চলে যাবে।

“ঈশ্বরলাভের কতকগুলি লক্ষণ আছে। যার ভিতর অনুরাগের ঐশ্বর্য প্রকাশ হচ্ছে তার ঈশ্বরলাভের আর দেরি নাই।

“অনুরাগের ঐশ্বর্য কি কি? বিবেক, বৈরাগ্য, জীবে দয়া সাধুসেবা, সাধুসঙ্গ, ঈশ্বরের নামগুণকীর্তন, সত্যকথা — এই সব।

“এই সকল অনুরাগের লক্ষণ দেখলে ঠিক বলতে পারা যায়, ঈশ্বর দর্শনের আর দেরি নাই। বাবু কোন খানসামার বাড়ি যাবেন, এরূপ যদি ঠিক হয়ে থাকে, খানসামার বাড়ির অবস্থা দেখে ঠিক বুঝতে পারা যায়! প্রথমে বন-জঙ্গল কাটা হয়, ঝুলঝাড়া হয়; ঝাঁটপাট দেওয়া হয়। বাবু নিজেই সতরঞ্চি, গুড়গুড়ি এই সব পাঁচরকম জিনিস পাঠিয়ে দেন। এই সব আসতে দেখলেই লোকের বুঝতে বাকি থাকে না, বাবু এসে পড়লেন বলে।”

একজন ভক্ত — আজ্ঞে, আগে বিচার করে কি ইন্দ্রিয়নিগ্রহ করতে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও এক পথ আছে। বিচারপথ। ভক্তিপথেও অন্তরিন্দ্রিয় নিগ্রহ আপনি হয়। আর সহজে হয়। ঈশ্বরের উপর যত ভালবাসা আসবে, ততই ইন্দ্রিয়সুখ আলুনী লাগবে।

“যেদিন সন্তান মারা গেছে, সেই শোকের উপর স্ত্রী-পুরুষের দেহ-সুখের দিকে কি মন থাকতে পারে?”

একজন ভক্ত — তাঁকে ভালবাসতে পারছি কি?

[নাম-মাহাত্ম্য — উপায় — মায়ের নাম]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর নাম কল্লে সব পাপ কেটে যায়! কাম, ক্রোধ, শরীরে সুখ-ইচ্ছা — এ-সব পালিয়ে যায়।

একজন ভক্ত — তাঁর নাম করতে ভাল কই লাগে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুল হয়ে তাঁকে প্রার্থনা কর, যাতে তাঁর নামে রুচি হয়। তিনিই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন —

এই বলিয়া ঠাকুর দেবদুর্লভ কণ্ঠে গাহিতেছেন। জীবের দুঃখে কাতর হইয়া মার কাছে হৃদয়ের বেদনা জানাইতেছেন। প্রাকৃত জীবের অবস্থা নিজে আরোপ করিয়া মার কাছে জীবের দুঃখ জানাইতেছেন:

দোষ কারু নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা ৷
ষড়রিপু হল কোদণ্ডস্বরূপ, পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ,
সে কূপে বেড়িল কালরূপ জল, কাল-মনোরমা ৷৷
আমার কি হবে তারিণী, ত্রিগুণধারিণী — বিগুণ করেছে স্বগুণে,
কিসে এ-বারি নিবারি, ভেবে দাশরথির অনিবার বারি নয়নে ৷
ছিল বারি কক্ষে, ক্রমে এল বক্ষে, জীবনে জীবন কেমনে হয় মা রক্ষে,
আছি তোর অপিক্ষে, দে মা মুক্তিভিক্ষে, কটাক্ষেতে করে পার ৷৷

আবার গান গাহিতেছেন। জীবের বিকাররোগ! তাঁর নামে রুচি হলে বিকার কাটবে:

এ কি বিকার শঙ্করী, কৃপা-চরণতরী পেলে ধন্বন্তরি!
অনিত্য গৌরব হল অঙ্গদাহ, আমার আমার একি হল পাপ মোহ;
(তায়) ধনজনতৃষ্ণা না হয় বিরহ, কিসে জীবন ধরি ৷৷
অনিত্য আলাপ, কি পাপ প্রলাপ, সতত সর্বমঙ্গলে;
মায়া-কাকনিদ্রা তাহে দাশরথির নয়নযুগলে;
হিংসারূপ তাহে সে উদরে কৃমি, মিছে কাজে ভ্রমি, সেই হয় ভ্রমি,
রোগে বাঁচি কি না বাঁচি ত্বন্নামে অরুচি দিবা শর্বরী ৷৷

শ্রীরামকৃষ্ণ — ত্বন্নামে অরুচি! বিকারে যদি অরুচি হল, তাহলে আর বাঁচবার পথ থাকে না। যদি একটু রুচি থাকে, তবে বাঁচবার খুব আশা। তাই নামে রুচি। ঈশ্বরের নাম করতে হয়; দুর্গানাম, কৃষ্ণনাম, শিবনাম, যে নাম বলে ঈশ্বরকে ডাক না কেন? যদি নাম করতে অনুরাগ দিন দিন বাড়ে, যদি আনন্দ হয় তাহলে আর কোন ভয় নাই, বিকার কাটবেই কাটবে। তাঁর কৃপা হবেই হবে।

[আন্তরিক ভক্তি ও দেখানো ভক্তি — ঈশ্বর মন দেখেন]

“যেমন ভাব তেমনি লাভ। দুজন বন্ধু পথে যাচ্ছে। এক যায়গায় ভাগবত পাঠ হচ্ছিল। একজন বন্ধু বললে, ‘এস ভাই, একটু ভাগবত শুনি।’ আর-একজন একটু উঁকি মেরে দেখল। তারপর সে সেখান থেকে চলে গিয়ে বেশ্যালয়ে গেল। সেখানে খানিকক্ষণ পরে তার মনে বড় বিরক্তি এল। সে আপনা-আপনি বলতে লাগল, ‘ধিক্‌ আমাকে! বন্ধু আমার হরি কথা শুনছে, আর আমি কোথায় পড়ে আছি!’ এদিকে যে ভাগবত শুনছে, তারও ধিক্কার হয়েছে। সে ভাবছে, ‘আমি কি বোকা! কি ব্যাড় ব্যাড় করে বকছে, আর আমি এখানে বসে আছি! বন্ধু আমার কেমন আমোদ-আহ্লাদ করছে।’ এরা যখন মরে গেল, যে ভাগবত শুনেছিল, তাকে যমদূত নিয়ে গেল; যে বেশ্যালয়ে গিছিল, তাকে বিষ্ণুদূত বৈকুণ্ঠে নিয়ে গেল।

“ভগবান মন দেখেন। কে কি কাজে আছে, কে কোথায় পড়ে আছে তা দেখেন না। ‘ভাবগ্রাহী জনার্দন।’

“কর্তাভজারা মন্ত্র দিবার সময় বলে এখন ‘মন তোর’। অর্থাৎ এখন সব তোর মনের উপর নির্ভর করছে।

“তারা বলে, ‘যার ঠিক মন, তার ঠিক করণ, তার ঠিক লাভ।’

“মনের গুণে হনুমান সমুদ্র পার হয়ে গেল। ‘আমি রামের দাস, আমি রামনাম করেছি, আমি কি না পারি!’ এই বিশ্বাস।”

[কেন ঈশ্বরদর্শন হয় না? অহংবুদ্ধির জন্য]

“যতক্ষণ অহংকার ততক্ষণ অজ্ঞান। অহংকার থাকতে মুক্তি নাই।

“গরুগুলো হাম্‌মা হাম্‌মা করে, আর ছাগলগুলো ম্যা ম্যা করে। তাই ওদের কত যন্ত্রণা। কসায়ে কাটে; জুতো, ঢোলের চামড়া তৈয়ার করে। যন্ত্রণার শেষ নাই। হিন্দিতে ‘হাম্‌’ মানে আমি, আর ‘ম্যায়’ মানেও আমি। ‘আমি’ ‘আমি’ করে বলে কত কর্মভোগ। শেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে ধুনুরীর তাঁত তৈয়ার করে। তখন ধুনুরীর হাতে ‘তুঁহু তুঁহু’ বলে, অর্থাৎ ‘তুমি তুমি’। তুমি তুমি বলার পর তবে নিস্তার! আর ভুগতে হয় না।

“হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা, এরই নাম জ্ঞান।

“নিচু হলে তবে উঁচু হওয়া যায়। চাতক পাখির বাসা নিচে, কিন্তু ওঠে খুব উঁচুতে। উঁচু জমিতে চাষ হয় না। খাল জমি চাই, তবে জল জমে! তবে চাষ হয়!”

[গৃহস্থলোকের সাধুসঙ্গ প্রয়োজন — যথার্থ দরিদ্র কে?]

“একটু কষ্ট করে সৎসঙ্গ করতে হয়। বাড়িতে কেবল বিষয়ের কথা। রোগ লেগেই আছে। পাখি দাঁড়ে বসে তবে রাম রাম বলে। বনে ডড়ে গেলে আবার ক্যাঁ ক্যাঁ করবে।

“টাকা থাকলেই বড় মানুষ হয় না। বড় মানুষের বাড়ির একটি লক্ষণ যে, সব ঘরে আলো থাকে। গরিবেরা তেল খরচ করতে পারে না, তাই তত আলো বন্দোবস্ত করে না। এই দেহমন্দির অন্ধকারে রাখতে নাই, জ্ঞানদীপ জ্বেলে দিতে হয়।

“জ্ঞানদীপ জ্বেলে ঘরে ব্রহ্মময়ীর মুখ দেখ না।”

[প্রার্থনাতত্ত্ব — চৈতন্যের লক্ষণ]

“সকলেরই জ্ঞান হতে পারে। জীবাত্মা আর পরমাত্মা। প্রার্থনা কর — সেই পরমাত্মার সঙ্গে সব জীবেরই যোগ হতে পারে। গ্যাসের নল সব বাড়িতেই খাটানো আছে। গ্যাস কোম্পানির কাছে গ্যাস পাওয়া যায়। আরজি কর, করলেই গ্যাস বন্দোবস্ত করে দেবে — ঘরেতে আলো জ্বলবে। শিয়ালদহে আপিস আছে। (সকলের হাস্য)


“কারুর চৈতন্য হয়েছে। তার কিন্তু লক্ষণ আছে। ঈশ্বরীয় কথা বই আর কিছু শুনতে ভাল লাগে না। আর ঈশ্বরীয় কথা বই আর কিছু বলতে ভাল লাগে না। যেমন সাত সমুদ্র, গঙ্গা, যমুনা, নদী — সব তাতে জল রয়েছে, কিন্তু চাতক বৃষ্টির জল চাচ্ছে। তৃষ্ণাতে ছাতি ফেটে যাচ্ছে, তবু অন্য জল খাবে না।”

=============


চতুর্থ পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

শ্রীরামলাল প্রভৃতির গান ও শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাহিতে বলিলেন। রামলাল ও কালীবাড়ির একটি ব্রাহ্মণ কর্মচারী গাহিতেছেন। সঙ্গতের মধ্যে একটি বাঁয়ার ঠেকা —

(১)    —    হৃদি-বৃন্দাবনে বাস যদি কর কমলাপতি ৷
ওহে ভক্তিপ্রিয়, আমার ভক্তি হবে রাধাসতী ৷৷
মুক্তি কামনা আমারি, হবে বৃন্দে গোপনারী,
দেহ হবে নন্দের পুরী, স্নেহ হবে মা যশোমতী ৷৷
আমার ধর ধর জনার্দন, পাপভার গোবর্ধন,
কামাদি ছয় কংসচরে ধ্বংস কর সম্প্রতি ৷৷
বাজায়ে কৃপা বাঁশরি, মনধেনুকে বশ করি,
তিষ্ঠ হৃদিগোষ্ঠে পুরাও ইষ্ট এই মিনতি ৷৷
আমার প্রেমরূপ যমুনাকুলে, আশাবংশীবটমূলে,
স্বদাস ভেবে সদয়ভাবে, সতত কর বসতি ৷
যদি বল রাখাল-প্রেমে, বন্দী থাকি ব্রজধামে,
জ্ঞানহীন রাখাল তোমার, দাস হবে হে দাশরথি ৷৷

(২)    —    নবনীরদবরণ কিসে গণ্য শ্যামচাঁদ রূপ হেরে,
করেতে বাঁশি অধরে হাসি, রূপে ভুবন আলো রে ৷৷
জড়িত পীতবসন, তড়িত জিনি ঝলমল,
আন্দোলিত চরণাবধি হৃদিসরোজে বনমাল,
নিতে যুবতী-জাতিকুল, আলো করে যমুনাকুল,
নন্দকুল চন্দ্র যত চন্দ্র জিনি বিহরে ৷৷
শ্যামগুণধাম পশি, হাম হদিমন্দিরে,
প্রাণ মন জ্ঞান সখি হরে নিল বাঁশির স্বরে,
গঙ্গানারায়ণের যে দুঃখ সে-কথা বলিব কারে,
জানতে যদি যেতে গো সখী যমুনায় জল আনিবারে ৷৷

(২)    —    শ্যামাপদ-আকাশেতে মন ঘুড়িখান উড়তেছিল;
কলুষের কুবাতাস পেয়ে গোপ্তা খেয়ে পড়ে গেল।

[ঈশ্বরলাভের উপায় অনুরাগ — গোপীপ্রেম — “অনুরাগ বাঘ”]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — বাঘ যেমন কপকপ করে জানোয়ার খেয়ে ফেলে, তেমনি “অনুরাগ বাঘ” কাম ক্রোধ এই সব রিপুদের খেয়ে ফেলে। ঈশ্বরে একবার অনুরাগ হলে কামক্রোধাদি থাকে না। গোপীদের ওই অবস্থা হয়েছিল। কৃষ্ণে অনুরাগ।

“আবার আছে ‘অনুরাগ অঞ্জন’। শ্রীমতী বলছেন, ‘সখি, চতুর্দিক কৃষ্ণময় দেখছি!’ তারা বললে, ‘সখি, অনুরাগ-অঞ্জন চোখে দিয়েছ তাই ওইরূপ দেখছ।’ এরূপ আছে যে, ব্যাঙের মুণ্ডু পুড়িয়ে কাজল তৈয়ার করে, সেই কাজল চোখে দিলে চারিদিক সর্পময় দেখে!

“যারা কেবল কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে আছে — ঈশ্বরকে একবারও ভাবে না, তারা বদ্ধজীব। তাদের নিয়ে কি মহৎ কাজ হবে? যেমন কাকে ঠোকরানো আম, ঠাকুর সেবায় লাগে না, নিজের খেতেও সন্দেহ।

“বদ্ধজীব — সংসারী জীব, এরা যেমন গুটিপোকা। মনে করলে কেটে বেরিয়ে আসতে পারে; কিন্তু নিজে ঘর বানিয়েছে, ছেড়ে আসতে মায়া হয়। শেষে মৃত্যু।

“যারা মুক্তজীব, তারা কামিনী-কাঞ্চনের বশ নয়। কোন কোন গুটিপোকা অত যত্নের গুটি কেটে বেরিয়ে আসে। সে কিন্তু দু-একটা।

“মায়াতে ভুলিয়ে রাখে। দু-একজনের জ্ঞান হয়; তারা মায়ার ভেলকিতে ভোলে না; কামিনী-কাঞ্চনের বশ হয় না। আঁতুড়ঘরের ধূলহাঁড়ির খোলা যে পায়ে পরে, তার বাজিকরের ড্যাম্‌ ড্যাম্‌ শব্দের ভেলকি লাগে না। বাজিকর কি করছে সে ঠিক দেখতে পায়।

“সাধনসিদ্ধ আর কৃপাসিদ্ধ। কেউ কেউ অনেক কষ্টে ক্ষেত্রে জল ছেঁচে আনে; আনতে পারলে ফসল হয়। কারু জল ছেঁচতে হল না, বৃষ্টির জলর ভেসে গেল। কষ্ট করে জল আনতে হল না। এই মায়ার হাত থেকে এড়াতে গেলে কষ্ট করে সাধন করতে হয়। কৃপাসিদ্ধের কষ্ট করতে হয় না। সে কিন্তু দু-এক জনা।

“আর নিত্যসিদ্ধ, এদের জন্মে জন্মে জ্ঞানচৈতন্য হয়ে আছে। যেমন ফোয়ারা বুজে আছে। মিস্ত্রী এটা খুলতে ফোয়ারাটাও খুলে দিলে, আর ফরফর করে জল বেরুতে লাগল! নিত্যসিদ্ধের প্রথম অনুরাগ যখন লোকে দেখে, তখন অবাক্‌ হয়। বলে এত ভক্তি-বৈরাগ্য-প্রেম কোথায় ছিল?”

ঠাকুর অনুরাগের কথা বলিতেছেন। গোপীদের অনুরাগের কথা। আবার গান হইতে লাগিল। রামলাল গাহিতেছেন:

নাথ! তিমি সর্বস্ব আমার। প্রাণাধার সারাৎসার;
নাহি তোমা বিনে কেহ ত্রিভুবনে, বলিবার আপনার ৷৷
তুমি সুখ শান্তি, সহায় সম্বল, সম্পদ ঐশ্বর্য, জ্ঞান বুদ্ধি বল,
তুমি বাসগৃহ, আরামের স্থল, আত্মীয় বন্ধু পরিবার ৷৷
তুমি ইহকাল, তুমি পরিত্রাণ, তুমি পরকাল, তুমি স্বর্গধাম,
তুমি শাস্ত্রবিধি গুরুকল্পতরু, অনন্ত সুখের আধার ৷৷
তুমি হে উপায়, তুমি হে উদ্দেশ্য, তুমি স্রষ্টা পাতা তুমি হে উপাস্য,
দণ্ডদাতা পিতা, স্নেহময়ী মাতা, ভবার্ণবে কর্ণধার (তুমি) ৷৷

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আহা কি গান! “তুমি সর্বস্ব আমার!” গোপীরা অক্রুর আসবার পর শ্রীমতীকে বললে, রাধে! তোর সর্বস্ব ধন হরে নিতে এসেছে! এই ভালবাসা। ভগবানের জন্য এই ব্যাকুলতা।

আবার গান চলিতে লাগিল:

(১)    —    ধোরো না ধোরো না রথচক্র রথ কি চক্রে চলে,
যে চক্রের চক্রের চক্রী হরি যার চক্রে জগৎ চলে।

(২)    —    প্যারী! কার তরে আর, গাঁথ হার যতনে।

গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিসিন্ধুমধ্যে মগ্ন হইলেন! ভক্তেরা একদৃষ্টে ঠাকুরের দিকে অবাক্‌ হইয়া দেখিতেছেন। আর সাড়াশব্দ নাই। ঠাকুর সমাধিস্থ! হাতজোড় করিয়া বসিয়া আছেন, যেমন ফটোগ্রাফে দেখা যায়। কেবল চক্ষের বাহিরের কোণ দিয়া আনন্দধারা পড়িতেছে।

[ঈশ্বরের সহিত কথা — শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন — কৃষ্ণ সর্বময়]

অনেকক্ষণ পরে ঠাকুর একটু প্রকৃতস্থ হইলেন। কিন্তু সমাধির মধ্যে যাঁকে দর্শন করিতেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কি কথা কহিতেছেন। একটি-আধটি কেবল ভক্তদের কানে পৌঁছিতেছে। ঠাকুর আপনা-আপনি বলিতেছেন, “তুমিই আমি আমিই তুমি। তুমি খাও, তুমি আমি খাও!… বেশ কিন্তু কচ্ছ।

“এ কি ন্যাবা লেগেছে। চারিদিকেই তোমাকে দেখছি!

“কৃষ্ণ হে দীনবন্ধু প্রাণবল্লভ! গোবিন্দ!”


প্রাণবল্লভ! গোবিন্দ! বলিতে বলিতে আবার সমাধিস্থ হইলেন। ঘর নিস্তব্ধ। ভক্তগণ মহাভাবময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে — অতৃপ্ত-নয়নে বারবার দেখিতেছেন।

=============


পঞ্চম পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বরাবেশ, তাঁহার মুখে ঈশ্বরের বাণী

[শ্রীযুক্ত অধর সেনের দ্বিতীয় দর্শন — গৃহস্থের প্রতি উপদেশ]

শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ। ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে উপবিষ্ট। শ্রীযুক্ত অধর সেন কয়টি বন্ধুসঙ্গে আসিয়াছেন। অধর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্র্রেট। ঠাকুরকে এই দ্বিতীয় দর্শন করিতেছেন। অধরের বয়স ২৯/৩০। অধরের বন্ধু সারদাচরণ পুত্রশোকে সন্তপ্ত। তিনি স্কুলের ডেপুটি ইন্‌স্পেক্টর ছিলেন; পেনশন লইয়া, এবং আগেও তিনি সাধন-ভজন করিতেন। বড় ছেলেটি মারা যাওয়াতে কোনরূপে সান্ত্বনালাভ করিতে পারিতেছেন না। তাই অধর ঠাকুরের নাম শুনাইয়া তাঁহার কাছে লইয়া আসিয়াছেন। অধরের নিজেরও ঠাকুরকে দেখিবার অনেকদিন হইতে ইচ্ছা ছিল।

সমাধি ভঙ্গ হইল। ঠাকুর দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন, একঘর লোক তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন। তখন তিনি আপনা-আপনি কি বলিতেছেন।

ঈশ্বর কি তাঁর মুখ দিয়া কথা কহিতেছেন ও উপদেশ দিতেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিষয়ী লোকের জ্ঞান কখনও দেখা দেয়। এক-একবার দীপ শিখার ন্যায়। না, না, সূর্যের একটি কিরণের ন্যায়। ফুটো দিয়ে যেন কিরণটি আসছে। বিষয়ী লোকের ঈশ্বরের নাম করা — অনুরাগ নাই। বালক যেমন বলে, তোর পরমেশ্বরের দিব্যি। খুড়ী-জেঠীর কোঁদল শুনে “পরমেশ্বরের দিব্যি” শিখেছে!

“বিষয়ী লোকদের রোখ নাই। হল হল; না হল না হল। জলের দরকার হয়েছে কূপ খুঁড়ছে। খুঁড়তে, খুঁড়তে যেমন পাথর বেরুল, অমনি সেখানটা ছেড়ে দিলে। আর-এক জায়গা খুঁড়তে বালি পেয়ে গেল; কেবল বালি বেরোয়। সেখানটাও ছেড়ে দিলে। যেখানে খুঁড়তে আরম্ভ করেছে, সেইখানেই খুঁড়বে তবে তো জল পাবে।

“জীব যেমন কর্ম করে, তেমনি ফল পায়। তাই গানে আছে:

দোষ কারু নয় গো মা।
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।

“আমি আর আমার অজ্ঞান। বিচার করতে গেলে যাকে আমি আমি করছ, দেখবে তিনি আত্মা বই আর কেউ নয়। বিচার কর — তুমি শরীর না মাংস, না আর কিছু? তখন দেখবে, তুমি কিছুও নও। তোমার কোন উপাধি নাই। তখন আবার ‘আমি কিছু করি নাই, আমার দোষও নাই, গুণও নাই। পাপও নাই, পুণ্যও নাই।’

“এটা সোনা, এটা পেতল — এর নাম অজ্ঞান। সব সোনা — এর নাম জ্ঞান।”

[ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ — শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার?]

“ঈশ্বরদর্শন হলে বিচার বন্ধ হয়ে যায়। ঈশ্বরলাভ করেছে, অথছ বিচার করছে, তাও আছে। কি কেউ ভক্তি নিয়ে তাঁর নামগুণগান করছে।

“ছেলে কাঁদে কতক্ষণ? যতক্ষণ না স্তন পান করতে পায়। তারপরই কান্না বন্ধ হয়ে যায়। কেবল আনন্দ। আনন্দে মার দুধ খায়। তবে একটি কথা আছে। খেতে খেতে মাঝে মাঝে খেলা করে, আবার হাসে।

“তিনিই সব হয়েছেন। তবে মানুষে তিনি বেশি প্রকাশ। যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব বালকের স্বভাব — হাসে, কাঁদে, নাচে, গায় — সেখানে তিনি সাক্ষাৎ বর্তমান।”

[পুত্রশোক — “জীব সাজ সমরে”]

ঠাকুর অধরের কুশল পরিচয় লইলেন। অধর তাঁহার বন্ধুর পুত্রশোকের কথা নিবেদন করিলেন। ঠাকুর অপনার মনে গান গাহিতেছেন:

জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশ তোর ঘরে।
ভক্তিরথে চড়ি, লয়ে জ্ঞানতূণ, রসনাধনুকে দিয়ে প্রেমগুণ,
ব্রহ্মময়ীর নাম ব্রহ্ম-অস্ত্র তাহে সন্ধান করে ৷৷
আর এক যুক্তি রণে, চাই না রথরথী, শত্রুনাশে জীব হবে সুসঙ্গতি,
রণভূমি যদি করে দাশরথি ভাগীরথীর তীরে ৷৷

“কি করবে? এই কালের জন্য প্রস্তুত হও। কাল ঘরে প্রবেশ করেছে, তাঁর নামরূপ অস্ত্র লয়ে যুদ্ধ করতে হবে, তিনিই কর্তা। আমি বলি, যেমন করাও, তেমনি করি; যেমন বলাও তেমনি বলি; আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; আমি গাড়ি, তুমি ইঞ্জিনিয়ার।

“তাঁকে আম্‌মোক্তারি দাও! ভাল লোকের উপর ভার দিলে অমঙ্গল হয় না। তিনি যা হয় করুন।

“তা শোক হবে না গা? আত্মজ! রাবণ বধ হল; লক্ষণ দৌড়িয়ে গিয়ে দেখলেন। দেখেন যে, হাড়ের ভিতর এমন জায়গা নাই — যেখানে ছিদ্র নাই। তখন বললেন, রাম! তোমার বাণের কি মহিমা! রাবণের শরীরে এমন স্থান নাই, যেখানে ছিদ্র না হয়েছে! তখন রাম বললেন, ভাই হাড়ের ভিতর যে-সব ছিদ্র দেখছ, ও বাণের জন্য নয়। শোকে তার হাড় জরজর হয়েছে। ওই ছিদ্রগুলি সেই শোকের চিহ্ন। হাড় বিদীর্ণ করেছে।

“তবে এ-সব অনিত্য। গৃহ, পরিবার, সন্তান দুদিনের জন্য। তালগাছই সত্য। দু-একটা তাল খসে পড়েছে। তার আর দুঃখ কি?


“ঈশ্বর তিনটি কাজ করেছেন — সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়। মৃত্যু আছেই। প্রলয়ের সময় সব ধ্বংস হয়ে যাবে, কিছুই থাকবে না। মা কেবল সৃষ্টির বীজগুলি কুড়িয়ে রেখে দেবেন। আবার নূতন সৃষ্টির সময় সেই বীজগুলি বার করবেন। গিন্নীদের যেমন ন্যাতা-কাঁতার হাঁড়ি থাকে। (সকলের হাস্য) তাতে শশাবিচি, সমুদ্রের ফেনা নীলবড়ি ছোট ছোট পুটলিতে বাঁধা থাকে।”

===========


ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ


১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল

অধরের প্রতি উপদেশ — সম্মুখে কাল

ঠাকুর অধরের সঙ্গে তাঁর ঘরে উত্তরের বারান্দায় দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি) — তুমি ডিপুটি। এ-পদও ঈশ্বরের অনুগ্রহে হয়েছে। তাঁকে ভূলো না। কিন্তু জেনো, সকলের একপথে যেতে হবে।১ এখানে দুদিনের জন্য।

“সংসার কর্মভূমি। এখানে কর্ম করতে আসা। যেমন দেশে বাড়ি কলকাতায় গিয়ে কর্ম করে।

“কিছু কর্ম করা দরকার। সাধন। তাড়াতাড়ি কর্মগুলি শেষ করে নিতে হয়। স্যাকরারা সোনা গলাবার সময় হাপর, পাখা চোঙ দিয়ে হাওয়া করে যাতে আগুনটা খুব হয়ে সোনাটা গলে। সোনা গলার পর তখন বলে, তামাক সাজ্‌। এতক্ষণ কপাল দিয়ে ঘাম পড়ছিল। তারপর তামাক খাবে।

“খুব রোখ চাই। তবে সাধন হয়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

“তাঁর নামবীজের খুব শক্তি। অবিদ্যা নাশ করে। বীজ এত কোমল, অঙ্কুর এত কোমল, তবু শক্ত মাটি ভেদ করে। মাটি ফেটে যায়।

“কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর থাকলে মন বড় টেনে লয়। সাবধানে থাকতে হয়। ত্যাগীদের অত ভয় নাই। ঠিক ঠিক তাগী কামিনী-কাঞ্চন থেকে তফাতে থাকে। তাই সাধন থাকলে ঈশ্বরে সর্বদা মন রাখতে পারবে।

“ঠিক ঠিক ত্যাগী। যারা সর্বদা ঈশ্বরে মন দিতে পারে, তারা মৌমাছির মতো কেবল ফুলে বসে মধু পান করে। সংসারে কামিনী-কাঞ্চনের ভিতরে যে আছে, তার ঈশ্বরে মন হতে পারে, আবার কখন কখন কামিনী-কাঞ্চনেও মন হয়। যেমন সাধারণ মাছি, সন্দেশেও বসে আর পচা ঘায়েও বসে, বিষ্ঠাতেও বসে।

“ঈশ্বরেতে সর্বদা মন রাখবে। প্রথমে একটু খেটে নিতে হয়। তারপর পেনশন ভোগ করবে।”


১ শ্রীযুক্ত অধরচন্দ্র সেন দেড় বৎসর পরে দেহত্যাগ করেন। ঠাকুর ওই সংবাদ শুনিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া মার কাছে কাঁদিয়াছিলেন। অধর ঠাকুরের পরম ভক্ত। ঠাকুর বলেছিলেন, “তুমি আমার আত্মীয়।” অধরের বাড়ি কলিকাতা, শোভাবাজার, বেণেটোলা। তাঁহার কয়েকটি কন্যাসন্তান এখন বর্তমান। কলিকাতার বাটীতে শ্রীযুক্ত শ্যামলাল, শ্রীযুক্ত হীরালাল প্রভৃতি ভ্রাতারা কেহ কেহ এখনও আছেন। তাঁহাদের বাটীর বৈঠকখানা ও ঠাকুরদালান তীর্থ হইয়া আছে।

====================

Post a Comment

0 Comments