সমাজ ও যুবকদের প্রতি স্বামীজীর ১০টি আহ্বান

স্বামীজীর আহ্বান
০৩.সমাজ ও যুবকদের প্রতি স্বামীজীর ১০টি আহ্বান


হে মহাপ্রাণ, ওঠ, জাগাে! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তােমার কি নিদ্রা সাজে? এস, আমরা ডাকতে থাকি, যতক্ষণ না নিদ্রিত দেবতা জাগ্রত হন, যতক্ষণ না অন্তরের দেবতা বাইরের আহ্বানে সাড়া দেন। জীবনে এর চেয়ে আর বড় কি আছে, এর চেয়ে মহত্তর কোন কাজ আছে? আমার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি সব এসে পড়বে। আমি আট-ঘাট বেঁধে কোন কাজ করি না। কার্যপ্রণালী আপনি গড়ে ওঠে ও নিজের কার্য সাধন করে। আমি শুধু বলি—ওঠ, জাগাে। ৭।২৫১
******
আমি চাই এমন লােক—যাদের পেশীসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত-নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব ক্ষাত্রবীর্য, ব্রহ্মতেজ! ৭।২৮৭
******
মানুষ চাই, মানুষ চাই; আর সব হইয়া যাইবে। বীর্যবান, সম্পূর্ণ অকপট, তেজস্বী, বিশ্বাসী যুবক আবশ্যক। এইরূপ একশত যুবক হইলে সমগ্র জগতের ভাবস্রোত ফিরাইয়া দেওয়া যায়। ৫|১১৩
******
প্রত্যেকে পূর্ণ উদ্যম প্রকাশ না করলে কি কোন কাজ সম্পন্ন হয়?...সিংহহৃদয় কাজের লক্ষ্মী দেবী এসে থাকেন। পেছন ফিরে তাকানাের প্রয়ােজন নেই। আগে চল! আমাদের চাই অনন্ত শক্তি, অফুরন্ত উৎসাহ, সীমাহীন সাহস, অসীম ধৈর্য, তবেই আমরা বড় বড় কাজ করতে পারব। ৮|২২১
******
প্রবল বিশ্বাসই বড় বড় কার্যের জনক। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। দরিদ্র ও পদদলিতদের আমরণ সহানুভূতি ও সহায়তা করিতে হইবে—ইহাই আমাদের মূলমন্ত্র। এগিয়ে যাও, বীরহৃদয় যুবকবৃন্দ! ৬।৩৯৩
******
ভাব ও সঙ্কল্প যাহাতে কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর, হে বীরহৃদয় মহান বালকগণ! উঠে পড়ে লাগ! নাম, যশ বা অন্য কোন তুচ্ছ জিনিসের জন্য পশ্চাতে চাহিও না। স্বার্থকে একেবারে বিসর্জন দাও এবং কাজ কর। ৬।৪৩০
******
তােমরা কি করছ? সারা জীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের [জাপানীদের] দেখে যাও গিয়ে লজ্জায় লুকোও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরেছে! তােমরা দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তােমাদের জাত যায়!! এই হাজার ভছরের খ্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বােঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ, হাজার বছর ধরে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতার বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ! পৌরােহিত্য-রূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ। শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তােমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে—তােমরা কি বল দেখি? আর তােমরা এখন করছই বা কি? আহাম্মক, তােমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ! ইওরােপীয় মস্তিষ্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিস নয়—সেই চিন্তার বদহজমখানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছে, আর তােমাদের প্রাণমন সেই ৩০০০ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; না হয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ। ইহাই ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা।

এস, মানুষ হও।... নিজেদের সংকীর্ণ গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তােমরা কি মানুষকে ভালবাস? তােমরা কি দেশকে ভালবাস? তাহলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য—উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি! পেছনে চেও না—অতি প্রিয় আত্মীয়-স্বজন কাঁদুক, পেছনে চেও না। সামনে এগিয়ে যাও।

ভারতমাতা অন্ততঃ সহস্র যুবক বলি চান। মনে রেখাে—মানুষ চাই, পশু নয়। প্রভু তােমদের এই বাঁধাধরা সভ্যতা ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্নমেন্টকে প্রেরণ করেছেন, আর মাদ্রাজের লােকই ইংরেজদের ভারতে বসবার প্রধান সহায় হয়। এখন জিজ্ঞাসা করি, সমাজের এই নূতন অবস্থা আনবার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রাণপণ যত্ন করবে, মাদ্রাজ এমন কতগুলি নিঃস্বার্থ যুবক দিতে প্রস্তুত—যারা দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে, তাদের ক্ষুধার্ত মুখে অন্ন দান করবে, সরবসাধারণের অত্যাচার যারা পশুপদবীতে উপনীত হয়েছে, তাদের মানুষ করবার জন্য আমরণ চেষ্টা করবে?

ধীর, নিস্তব্ধ অথচ দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। খবরের কাগজে হুজুক করা নয়। সর্বদা মনে রাখবে নাম যশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ৬।৩৫৮
******
এগিয়ে যাও বৎসগণ। সমগ্র জগৎ জ্ঞানালােক চাইছে—উৎসুকনয়নে তার জন্য আমাদের তার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তােমরা বিশ্বাস কর যে, তােমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেচে। কুকুরের ঘেউ-ঘেউ-ডাকে ভয় পেও না—এমন কি আকাশ থেকে প্রবল বজ্রাঘাত হলেও ভয় পেও না—খাড়া হয়ে ওঠ; ওঠ, কাজ কর। ৬|৪৭৬
******
তােমার মতাে শত শত যুবক চাই, যারা সমাজের উপর গিয়ে মহাবেগে পড়বে এবং যেখানে যাবে সেখানেই নবজীবন ও আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করবে। ৭।১৮
******
হাজার হাজার পুরুষ চাই, নারী চাই—যারা আগুনের মতাে হিমাচল থেকে কন্যাকুমারী উত্তর-মেরু থেকে দক্ষিণ-মেরু—দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়বে। ছেলেখেলার কাজ নয়— ছেলেখেলার সময় নেই।...স্য চাই—কুড়েমি দূর করে দাও; ছড়াও ছড়াও—আগুনের মতাে যাও সব জায়গায়। ৭।৫০
******
দূর করে দাও যত আলস্য, দূর করে দাও ইহলােক ও পরলােকে ভােগের বাসনা। আগুনে ঝাঁপ দাও আর মানুষকে ভগবানের দিকে নিয়ে এস। ৭।৬৮
******
তােমরা কাজ করে চল। দেশবাসীর জন্য কিছু কর—তাহলে তারাও তােমাদের সাহায্য করবে, সমগ্র জাতি তােমার পিছনে থাকবে। সাহসী হও, সাহসী হও! মানুষ একবারই মরে। আমার শিষ্যেরা যেন কখনাে কোনমতে কাপুরুষ না হয়। ৭।১৩৪
******
আমি চাই তােমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তােমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মতাে আজ্ঞা পালন করে মরে যাও, নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোন প্রকার ভীরুতা চলবে না। ৮|৮২
******
জাগাে বীর, ঘুচায়ে স্বপন, 
শিয়রে শমন, ভয় কি তােমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, 
মন্দির তাঁহার প্রেতভূমি চিতা মাঝে।
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, 
সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তােমা।
চূর্ণ হােক স্বার্থ সাধ মান, 
হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহতে শ্যামা || ৬|২৭১
******
কলিকাতাবাসী যুবকগণ, উঠ—জাগাে, কারণ শুভ মুহূর্ত আসিয়াছে। এখন আমাদের সকল বিষয়ে সুবিধা হইয়া আসিতেছে। সাহস অবলম্বন কর, ভয় পাইও না, কেবল আমাদের শাস্ত্রেই ভগবানকে লক্ষ্য করিয়া ‘অভীঃ এই বিশেষণ প্রদত্ত হইয়াছে। আমাদিগকে ‘অভীঃ— নির্ভীক হইতে হইবে, তবেই আমরা কার্যে সিদ্ধিলাভ করিব। উঠ—জাগাে, কারণ তােমাদের মাতৃভূমি এই মহাবলি প্রার্থনা করিতেছেন।...আশিষ্ঠ দ্রঢ়িষ্ঠ বলিষ্ঠ মেধাবী’ যুবকদের দ্বারাই এই কার্য সাধিত হইবে। আর কলিকাতায় এইরূপ শত সহস্র যুবক রহিয়াছে।…

আমিও এক সময় এই কলিকাতার রাস্তায় তােমাদের রাস্তায় তােমাদের মতাে খেলিয়া বেড়াইতাম। যদি আমি এতখানি করিয়া থাকি, তবে তােমরা আমা অপেক্ষা কত অধিক কাজ করিতে পার।…

ভাবিও না তােমরা দরিদ্র। ভাবিও না তােমরা বন্ধুহীন; কে কোথায় দেখিয়াছে, টাকায় মানুষ করে? মানুষই চিরকাল টাকা করিয়া থাকে। জগতের যা কিছু উন্নতি—সব মানুষের শক্তিতে হইয়াছে, উৎসাহের শক্তিতে হইয়াছে, বিশ্বাসের শক্তিতে হইয়াছে। ৫|২১৫
******

Post a Comment

0 Comments