শ্রীরামকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনী ~ Short Biography of Sri Ramakrishna

শ্রীরামকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনী 

শ্রীরামকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনী

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ - কথাসার


হুগলি জেলার আরামবাগ থানা হইতে চারি ক্রোশ পশ্চিমে বর্ধমান হইতে প্রায় ষােলাে ক্রোশ দক্ষিণে কামারপুকুর গ্রাম অবস্থিত। তাহার পশ্চিমে দেড় ক্রোশ দূরে ‘দেরে’ নামক গ্রামে সত্যনিষ্ঠ ঋষিকল্প ও পরম ভক্ত ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় বাস করিতেন। তাঁহার পূতস্বভাবা পত্নী চন্দ্রমণি দেবী সরলতা ও করুণার প্রতিমূর্তি ছিলেন। সেই গ্রামের জমিদারের পক্ষে মােকদ্দমায় সাক্ষ্য দিতে অসম্মত হওয়ায় জমিদার তাহার উপর বিষম অত্যাচার করেন; পরিশেষে, সন ১২২০ সালে (১৮১৪ খ্রিঃ) স্বজন লইয়া ক্ষুদিরাম কামারপুকুরে আসিয়া বাস করেন। তখন তাঁহার বয়স ৩৯ বৎসর।

সন ১২৪১ সালে (১৮৩৫ খ্রিঃ) ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের ৺গয়াধামে অবস্থিতিকালে একদিন রাত্রিতে তিনি স্বপ্নে দেখিলেন, যেন তাঁহাকে ৺গদাধর বলিলেন যে, তিনি তাঁহার পুত্ররূপে অবতীর্ণ হইবেন। ১২৪২ সালের বৈশাখে ক্ষুদিরাম কামারপুকুর বাটিতে প্রত্যাগমন করিয়া চন্দ্রমণি দেবীর মুখে শুনিলেন যে, একদিন তিনি বাটির সন্নিকটস্থ শিবমন্দিরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, ৺মহাদেবের শ্রীঅঙ্গ হইতে দিব্যজ্যোতিঃ বাহির হইয়া বায়ুর আকারে তাঁহার শরীরের ভিতর প্রবেশ করিল। ক্রমে ক্রমে চন্দ্রমণি দেবীর গর্ভলক্ষণসকল প্রকাশ পাইতে লাগিল। ১২৪২ সালের ৬ ফাণ্ডন, (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ খ্রিঃ) বুধবার, শুক্লা দ্বিতীয়ায় ব্রাহ্মমুহূর্তে চন্দ্রমনি দেবী এক পুত্রসন্তান প্রসব করিলেন। ক্ষুদিরাম ৺গদাধরের নামানুসারে পুত্রের নাম ‘গদাধর’ রাখিলেন। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের বংশানুক্রমিক নাম।।

পাঁচ বৎসর বয়সে গদাধর গ্রামের জমিদার লাহাবাবুদের পাঠশালায় প্রবেশ করেন। শুভঙ্করীতে তাঁহার ধাঁধা লাগত। সাত বৎসর বয়সে ১২৪৯ সালে (১৮৪৩ খ্রিঃ) তিনি পিতৃহীন হন। নয় বৎসর বয়সে তাঁহার উপনয়ন ও পাঠশালার শিক্ষা সমাপন হইলে তিনি গৃহদেবতা ৺রঘুবীর বিগ্রহের পূজাভার প্রাপ্ত হন। বাড়ির পার্শ্বে লাহাবাবুদের অতিথিশালায় প্রায়ই সাধুসন্ন্যাসীদিগের সমাগম হইত। গদাধর তথায় যাইয়া সাধুদিগের শাস্ত্রপাঠ, পূজা ও ভজন একাগ্রচিত্তে শুনিতেন; পূজার দ্রব্যাদি স্বহস্তে আহরণ করিয়া তাঁহাদের সাহায্য করিতেন। কথকদিগের পুরাণপাঠকালে অনন্যমনে সমস্ত শ্রবণ করিতেন। এইরূপে তিনি রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত কথা সমস্ত হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন।

সন ১২৫৬ সালে (১৮৫০ খ্রিঃ) তাহার অগ্রজ রামকুমার কলিকাতার ঝামাপুকুরে এক চতুষ্পঠী স্থাপন করেন। ১২৫৯ সালে (১৮৫৩ খ্রিঃ) ঠাকুর অগ্রজের সহিত কলিকাতায় আসিয়া এই চতুষ্পাঠীতে থাকিতেন। তখন তাঁহার বয়স ১৬ বৎসর। কিছুদিন নাথের বাগানে, কিছুদিন ঝামাপুকুরে গােবিন্দ চাটুজ্জের বাড়িতে থাকিয়া পূজা করিয়া বেড়াইতেন।

১২৬২ সালের ১৮ জ্যৈষ্ঠ (৩১ মে ১৮৫৫ খ্রিঃ) বৃহস্পতিবার স্নানযাত্রার দিন কলিকাতা জানবাজারের প্রসিদ্ধ মাড়বংশীয় ৺রাজচন্দ্র দাসের পত্নী স্বনামধন্যা রানি রাসমণি (জন্ম ১২০০ সালের ১১ আশ্বিন, বিবাহ হয় ১২১১ সালের ৮ বৈশাখ, বিধবা হন ১২৪৩ সালে) কলিকাতা হইতে আড়াই ক্রোশ উত্তরে দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রামকুমার সেই সময় হইতে কালীমাতার পূজারি নিযুক্ত হইলেন এবং পরে ঠাকুর বিষ্ণুঘরের পূজক হইলেন। এই সময় ঠাকুর কেনারাম ভট্টাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৬২ সালের শেষভাগে বৃদ্ধ রামকুমারের শরীর অপটু হওয়ায় ১২৬৩ সালে (১৮৫৬ খ্রিঃ) জন্মাষ্টমীর সময় রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবু ৺দেবীপূজার ভার ঠাকুরকে দিলেন ও ক্ষুদিরামের ভগিনী রামশীলার কন্যা হেমাঙ্গিনির পুত্র হৃদয়রামকে ৺রাধাগােবিন্দজীর পূজক করিলেন। ইতঃপূর্ব হইতেই হৃদয়রাম দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সহিত বাস করিতেছিলেন। ইহার কিছুদিন পরেই রামকুমারের মৃত্যু হইল।

১২৬৪ সালে (১৮৫৭/৫৮ খ্রিঃ) ঠাকুর পঞ্চবটীতে সাধন করিতেন। কয়েক দিন পূজা করিতে করিতে তাঁহার প্রেমােন্মাদ অবস্থা হইল; ক্রমে পূজাকার্য ছাড়িয়া দিলেন। ১২৬৫ সালের (১৮৫৮ খ্রিঃ) আশ্বিনে ঠাকুর বাড়ি আসিলে তাঁহার মাতা ও আত্মীয়েরা ভাবিলেন, গদাধরের বিবাহ হইলে অবস্থান্তর হইতে পারে। ১২৬৬ সালের বৈশাখের শেষভাগে (১৮৫৯ খ্রিঃ) কামারপুকুর হইতে দুই ক্রোশ দূরে বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামস্থ রামচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের ষষ্ঠবর্ষীয়া কন্যা শ্রীশ্রীসারদামণি দেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ হইল। [শ্রীশ্রীমার জন্ম—৮ পৌষ ১২৬০ সাল (২২ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ খ্রিঃ)]

বিবাহের পর ১২৬৭ সালে (১৮৬০-৬১ খ্রিঃ) ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিয়া পূর্ববৎ শ্রীশ্রীজগদম্বার সেবাকার্যে ব্রতী হইলেন। কিছুদিন পরেই তাহার দিব্যোন্মাদ অবস্থা হইল—পূজা করিতে করিতে কখনও বা অদ্ভুত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করিতেন, কখনও বা উন্মাদের ন্যায় বিচরণ করিতেন। মথুরানাথবাবু ঠাকুরের এই দিব্যোম্মাদ অবস্থা দেখিয়া তাহাকে মহাপুরুষবােধে সেবা করিতে লাগিলেন এবং হৃদয়ের উপর পূজার ভার ও শ্রীরামকৃষ্ণের সেবার ভার দিলেন।

উদরাময় রােগে ১২৬৭ সালের মাঘ মাসে পুণ্যবতী রানি রাসমণির মৃত্যুর পর ১২৬৮ সালে (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১ খ্রিঃ) ব্রাহ্মণী (ভৈরবী যােগেশ্বরী) দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে আসিয়াছিলেন। ১২৬৯ সালে (১৮৬২-৬৩ খ্রিঃ) তিনি ঠাকুরকে তন্ত্রোক্ত অনেক সাধন করাইয়াছিলেন।

এই সময় ঠাকুরের স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ায় তিনি কামারপুকুরে আসেন। কিছুদিন তথায় থাকিয়া সুস্থ হইলে তিনি ১২৭০ সালে (১৮৬৩ খ্রিঃ) জননী চন্দ্রমণি দেবীকে সঙ্গে লইয়া বৈদ্যনাথ দর্শনানন্তর কাশীধাম ও প্রয়াগ দর্শন করেন। 

তখন কালীবাড়িতে সাধু-সন্ন্যাসীরা সর্বদা আসিতেন। ১২৭০ সালে যখন জটাধারী নামক রামাইত সাধু তথায় আসেন, ঠাকুর তাহার নিকট রাম’ মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৭১ সালের শেষভাগে (১৮৬৪-৬৫ খ্রিঃ) পরমহংস পরিব্রাজক তােতাপুরী কালীবাড়িতে অবস্থিতিকালে ঠাকরকে বেদান্তের উত্তম অধিকারী ভাবিয়া কয়েক মাস ধরিয়া বেদান্ত শুনাইতেন। তাহার নিকট ঠাকুর সন্ন্যাসগ্রহণের অভিপ্রায় জানাইলেন এবং ৺জগন্মাতার আদেশ লইয়া পঞ্চবটীস্থ নিজ সাধনকুটিরে শুভক্ষণে সন্ন্যাসগ্রহণ করিলেন। সেই দিনই অল্পক্ষণ মধ্যেই তােতাপুরীর প্রেরণায় ঠাকুর নির্বিকল্প সমাধি লাভ করিলেন। বেদান্ত-বিচারে ও ঈশ্বরীয় নানা প্রসঙ্গে ঠাকুরের অসাধারণ ঐশী শক্তি দেখিয়া তােতাপুরী বিমােহিত হইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ‘পরমহংস’ উপাধিমণ্ডিত করেন। 

  সর্ববিধ ধর্মের মূল অবগত হইবার মানসে তিনি বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ইত্যাদি ভাব সাধন করিয়াছিলেন। ১২৭৩ সালে (১৮৬৬-৬৭ খ্রিঃ) তিনি সুফি গােবিন্দ রায়ের নিকট মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হইয়া আল্লা’ মন্ত্র জপ করিতেন। তিনি যিশুখ্রিস্টের ভাবও সাধন করিয়াছিলেন।

১২৭৪ সালের (২৭ জানুয়ারি ১৮৬৮ খ্রিঃ) মাঘ মাসে ঠাকুর দ্বিতীয়বার তীর্থে গমন করেন। এইবারে হৃদয়, মথুরবাবু ও মথুর-পত্নী জগদম্বা দাসী তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। এ-যাত্রায় বৈদ্যনাথধাম, কাশীধাম, প্রয়াগ, শ্রীবৃন্দাবন দর্শন করেন। কাশীধামে মৌনব্রতধারী ত্রৈলঙ্গস্বামীর সহিত তিনি আলাপ করেন। ১২৭৫ সালের (১৮৬৮ খ্রিঃ) জ্যৈষ্ঠ মাসে ঠাকুর তীর্থ হইতে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসেন। 

শ্রীনবদ্বীপধাম দর্শন করিতে ঠাকুরের অভিলাষ হওয়ায় মথুরবাবু ১২৭৭ সালে (১৮৭০-৭১ খ্রিঃ) তাহাকে সঙ্গে লইয়া বজরায় করিয়া কালনা, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে গমন করিয়াছিলেন। ঐ-সময় কালনায় ঠাকুর সিদ্ধভক্ত ভগবানদাস বাবাজিকে দর্শন করেন।

১২৭৮ সালের আষাঢ় মাসে মথুরবাবু দুরারােগ্য জ্বর রােগে আক্রান্ত হইয়া একেবারে শয্যাগত হইলেন। পরমভক্ত মথুরবাবু চৌদ্দ বৎসর ঠাকুরের সেবা করিয়া ১ শ্রাবণ (১৬ জুলাই ১৮৭১ খ্রিঃ) অপরাহু পাঁচটার সময় দেহত্যাগ করেন।

১২৭৮ সালের ফাল্গন মাসে (১৮৭২ খ্রিঃ) শ্রীশ্রীমা দক্ষিণেশ্বরে প্রথম আসিলেন। মনের সংযম পরীক্ষায় ঠাকুর আপনাকে উত্তীর্ণ বুঝিয়া ১২৮০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে (১৮৭৩ খ্রিঃ) ফলহারিণী কালীপূজার দিন রাত্রিতে শ্রীশ্রীমাকে ৺জগদম্বার অংশভাবে অভিষেকপূর্বক ৺যােড়শী পূজা করেন।

১২৮২ সালে (মার্চ ১৮৭৫ খ্রিঃ) ঠাকুর হৃদয়কে সঙ্গে লইয়া শ্ৰীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের বেলঘরিয়ার বাগানে তাহাকে দেখিতে যান।

১২৮২ সালের ফাঙ্গুন মাসে (১৮৭৬ খ্রিঃ) ঠাকুরের জন্মতিথি দিবসে তাহার জননী চন্দ্রমণি দেবী দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে ইহলােক ত্যাগ করেন। তখন চন্দ্রমণি দেবীর বয়স ৮৫ বৎসর। 

১২৮৬ সালে (১৮৮০ খ্রিঃ) ঠাকুর শেষবার জন্মভূমি দর্শন করেন।

হৃদয়রাম ২৩ বৎসরকাল ঠাকুরের সেবা করিবার পর ১২৮৭ সালে (১৮৮১ খ্রিঃ) মথুরবাবুর পুত্রের অসন্তোষভাজন হওয়ায় কালীবাড়ির কর্ম হইতে চিরকালের জন্য অবসরপ্রাপ্ত হন।

ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ভক্তগণ ১২৮৫ সাল (১৮৭৯ খ্রিঃ) হইতে তাহার নিকট আগমন করিতে আরম্ভ করেন। ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ অনেক ব্রাহ্মভক্ত সর্বদা ঠাকুরের নিকট আসিতেন। ঠাকুরও ভক্তদিগের বাটিতে মধ্যে মধ্যে যাইতেন। ১২৮৯ সালে (১৫ নভেম্বর ১৮৮২ খ্রিঃ) ঠাকুর উইলসনের সার্কাস দেখিয়াছিলেন। ১২৯১ সালের ৬ আশ্বিন (২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪ খ্রিঃ) কলিকাতায় স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ ও ২৯ অগ্রহায়ণ (১৪ ডিসেম্বর) ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ অভিনয় দেখিয়াছিলেন। ১২৯১ সালের ১২ ফাল্গুন (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫ খ্রিঃ) তিনি স্টার থিয়েটারে ‘বৃষকেতু’ অভিনয় দেখিয়াছিলেন।

১২৯২ সালের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল ১৮৮৫ খ্রিঃ) তাঁহার গলদেশে ক্ষতরােগ দেখা দিল। কলিকাতা হইতে বিচক্ষণ চিকিৎসক আনাইয়া চিকিৎসা করাইয়াও উপশম হইল না। তখন আশ্বিনের প্রথমে তাহাকে কলিকাতায় আনাইয়া প্রথমে ৫৭নং রামকান্ত বসু স্ট্রিটে বলরাম বসুর বাটিতে ও তথা হইতে সপ্তাহকাল মধ্যেই ৫৫ এ/বি শ্যামপুকুর স্ট্রিটে গােকুলচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাটিতে আনাইয়া চিকিৎসা করানাে হয়। শ্রীশ্রীসারদাদেবী ঠাকুরের সেবার জন্য দক্ষিণেশ্বর হইতে আসিলেন; এছাড়া নরেন্দ্র, রাখাল, যােগীন, শশী, বাবুরাম, লাটু, সারদা, শরৎ, গােপাল প্রমুখ অন্তরঙ্গ ভক্তগণ তাহার সেবার জন্য তথায় আসিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ১২৯২ সালের ২৭ অগ্রহায়ণ (১১ ডিসেম্বর ১৮৮৫ খ্রিঃ)। ঠাকুরকে কলিকাতার উত্তরে কাশীপুরে গােপালচন্দ্র ঘােষের উদ্যানবাটীতে আনা হয়।

ভক্তদিগের প্রতি তাঁহার এত করুণা যে, এরূপ পীড়িত অবস্থাতেও তিনি ১২৯২ সালের পৌষ মাসে (১ জানুয়ারি ১৮৮৬ খ্রিঃ) অপরাহু তিনটার সময়, পায়ে চটিজুতা, পরনে লালপেড়ে ধুতি, একটা পিরান, গায়ে লালপাড় মােটা চাদর, মাথায় কান-ঢাকা টুপি দিয়া নিচে নামিয়া আসিলেন। তখন একটি আমগাছের নিচে গিরিশচন্দ্র, অতুল, রাম প্রমুখকে দেখিয়া গিরিশ ঘােষকে ডাকিয়া বলিলেন, “গিরিশ, তুমি যে সকলকে এত কথা বলিয়া বেড়াও, তুমি কী দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?” মহাকবি গিরিশচন্দ্র ছিলেন ঠাকুরের পরম ভক্ত। তিনি ঠাকুরের দেবত্ব মনে-প্রাণে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাই সকলকেই তিনি তাহার অবতারত্ব সম্পর্কে নানা কথা বলিয়া বেড়াইতেন। গিরিশচন্দ বলিলেন, “ব্যাস-বাল্মীকি যাহার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তাহার সম্বন্ধে অধিক কী আর বলিতে পারি।” গিরিশের এই অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় দেখিয়া ঠাকুর পুলকে রােমাঞ্চিত হইয়া উঠিলেন। পথিমধ্যেই তিনি সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। ঠাকুরের অপূর্ব দেবজ্যোতি-বিচ্ছুরিত মুখমণ্ডল দর্শনে গিরিশ

আনন্দে আত্মহারা হইয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’, ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন। গিরিশচন্দ্র প্রমুখ ভক্তরা বিভাের হইয়া ঠাকুরের পদধূলি লইতে লাগিলেন। অর্ধবাহ্যদশায় হাসিমুখে ঠাকুর উপস্থিত ভক্তদিগকে দক্ষিণহস্ত উত্তোলনপূর্বক বলিলেন, “তােমাদের কী আর বলিব, আশীর্বাদ করি তােমাদের চৈতন্য হউক”। সেই অভয়বাণী শুনিয়া ভক্তরা আনন্দে বিভাের হইয়া প্রণাম করিতে থাকিলেন ঠাকুরকে। কেউ বা দেবপদে ফুল নিবেদন করিলেন। তিনি তাঁহাদের স্পর্শ করিয়া আবার বলিলেন, “তােমাদের চৈতন্য হউক।” ঠাকুরের বাসগৃহের পশ্চিমদিকে উত্তর-দক্ষিণমুখী রাস্তার মাঝপথে তিনি কল্পতরু' হইয়াছিলেন। ঠাকুরের দেহত্যাগের দুই-তিন দিন পূর্বে যখন ঠাকুর রােগের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়াছেন, তখন নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটে বসিয়া ভাবিতেছেন—’এই যন্ত্রণার মধ্যে ঠাকুর যদি বলেন, আমি সেই ঈশ্বরের অবতার, তাহলে বিশ্বাস হয়!’ তৎক্ষণাৎ ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, এখন সে-ই রামকৃষ্ণ। এবং তা তাের বেদান্তভাবের কথা নয়।” 

ঠাকুরের রােগ দিন দিন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে লাগিল। চিকিৎসার ত্রুটি নাই; কিন্তু সকলই নিষ্ফল হইল। ১২৯৩ সালের ৩১ শ্রাবণ (১৫ আগস্ট ১৮৮৬ খ্রিঃ), সংক্রান্তি, রবিবার, পূর্ণিমা—প্রাতঃকালে তিনি এক ভক্তকে পঞ্জিকা দেখিতে বলিলেন। ৩১ শ্রাবণের সকল বিবরণ শ্রবণ করিয়া ১ ভাদ্র তারিখটি কর্ণগােচর হইবামাত্র তাহাকে চুপ করিতে বলিলেন। অপরাহ্রে কিছু পরে তাহার নাড়ির অবস্থা শঙ্কাজনক হইল। ক্রমে সন্ধ্যার সময় নাভিশ্বাস আরম্ভ হইল। রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় শয্যায় বসিয়া ক্ষুধাশান্তির জন্য অন্নের মণ্ড অতি সহজে আহার করিলেন এবং তাঁহার সহজ সুমিষ্ট কণ্ঠে ‘কালী!’ ‘কালী!’ ‘কালী!’’ তিন বার মা-র নাম উচ্চারণ করিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। রাত্রি ১টা ২ মিনিটের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ ৫১ বৎসর ৫ মাস ২৫ দিন বয়সে লীলাসংবরণ করিলেন।

ঠাকুরের দেহত্যাগের পর সন্ন্যাসী ও গৃহস্থ সন্তানগণ শ্রীশ্রীমার নিকট আসিয়া নানা উপদেশ শুনিতেন। সন ১৩২৭ সালের ৪ শ্রাবণ (২০ জুলাই ১৯২০ খ্রিঃ) রাত্রি ১টা ৩০ মিনিটের সময় ৬৭ বৎসর বয়সে সেই চিন্ময়ী জননীও ধরিত্রীকে কৃতার্থ করিয়া মৃন্ময় ঘট ভাঙিয়া দিয়াছেন।

সঙ্কলনঃ শ্রী কুমারকৃষ্ণ নন্দী






Post a Comment

1 Comments