'মায়ের কথা'র স্মৃতিকীর্তন- শ্রীম

 'মায়ের কথা'র স্মৃতিকীর্তন- শ্রীম

'মায়ের কথা'র স্মৃতিকীর্তন- শ্রীম

শ্রীম আজ ধর্মালোচনা এক অভিনব উপায় অবলম্বন করিয়াছেন। বিগত দুই দিন স্বামী অরূপানন্দ “মায়ের কথা'র পাণ্ডুলিপি শ্রীমকে  পড়িয়া শুনাইয়াছেন। আজের সভায় সেই “মায়ের কথা'র অনুকীর্তন চলিতেছে। নিজে মায়ের কয়েকটি উপদেশ আবৃত্তি করিলেন। তৎপর  ভক্তগণকে “মায়ের কথা'র স্মৃতিকীর্তন করিতে বলিলেন। শ্রীম র  এই অনুকীর্তন প্রথা ভক্ত সংসদে নৃতন হইলেও শ্রীম-র নিকট নৃতন  নহে। স্কুল ও কলেজে অধ্যাপনার সময়ও সর্বদা উহা প্রয়োগ করিতেন।  এই অনুকীর্তন প্রথা শ্রীম-র আদর্শ শিক্ষকতার অন্যতম প্রধান কারণ।  তিনি উহা স্বীয় গুরুদেব পরমহংসদেবের নিকট শিক্ষা করিয়াছিলেন।  পরমহংসদেব প্রায়শঃ নিজের উপদেশসমূহ “মাষ্টারের” দ্বারা অনুকীর্তন করাইতেন। 

আজ শনিবার ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খৃষ্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন  ১৩৩০ সাল। 

শ্রীম বলিতেছেন, মা বলেছেন __ promise প্রেতিজ্ঞা) করেছেন, 

(১) ঠাকুরের শরণাপন্ন যারা, অন্ততঃ মৃত্যুর সময় হলেও ঠাকুরকে তাদের কাছে দেখা দিতেই হবে। 

(২) দেহ ধারণ করলে দুঃখকষ্ট আছেই। বিধাতারও ক্ষমতা নেই এ রোধ করবার। তবে শান্তি চাইলে সাধন ভজন কর। 

(৩) মৃত্যু কখন আসে তার যখন নিশ্চয় নাই তখন কালাকাল বিচার করে বসে না থেকে তীর্থ করা ভাল যত শীঘ্ব হয়। 

(8) মা কর্ম ফুরুচ্ছে না কেন __ এ প্রশ্নের উত্তরে মা বললেন, লাটাইয়ে অনেক সুতো আছে। সেই সব বের হলে তবে তো খালি হবে। 

(৫) ঠাকুর একদিনের জন্যও আমাকে কষ্ট দেননি। 

শ্রীম এই পঞ্চরত্ন উপহার দিয়া ভক্তদের আহ্বান করিলেন __ 

আপনারা বলুন যার যা মনে আছে “মায়ের কথা”। একের পর এক ভক্তগণ বলিতে লাগিলেন। 

(৬) (ঠাকুরের শরীর ত্যাগের পর) বৃন্দাবনে যাবার সময় আমাকে ঠাকুরের ইষ্ট কবচ পুজো করতে (ঠাকুর) বলেছিলেন রেলের পাদানে দাঁড়িয়ে। 

(৭) ঠাকুরের ভাবনা হয়েছিল আমার জন্য। বলেছিলেন, পাড়াগাঁয়ে মেয়ে (দক্ষিণেশ্বরে) এসে কত লঙ্জা না জানি দেয়। 

আমি মাকে (জগন্মাতাকে) প্রার্থনা করেছিলাম। তাই কিছু হয়নি। 

(৮) সাতবার স্বপ্ন দেখে শ্রীহট্ট থেকে একটি ভক্ত (আমাকে) দেখতে আসে। 

(৯) ঠাকুরের ঘরে তিনি ভক্তসঙ্গে নৃত্য কীর্তন করতেন, আমি ন'বতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। 

(১০) দেখতে সুশ্রী এমন লোকদের সঙ্গে কখনও বাগানে বেড়াতেন ঠাকুর। পরে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, বল দেখি কে সুন্দর? 

(১১) ন'বতের এ ছোট্ট ঘরটিতে সব জিনিস থাকতো । ভক্ত- মেয়েরা __ গৌরদাসী, যোগেন, গোলাপ এরাও কখনও কখনও  আমার সঙ্গে এ ঘরেই থাকতো । আবার এ ঘরেই টিনে মাছ জিয়ান, কলকল করছে। এটুকুতে থেকেও আমার কোন কষ্টবোধ ছিল না __ এক পায়খানা ছাড়া। সকালে বাহ্যে পেলে রাত্রে যেতাম গঙ্গার ধারে। 

(১২) আমার অত কাজ তবুও ঠাকুর শিকা পাকাতে পাট এনে দিতেন। বলতেন, সন্দেশ রাখতে হবে, একটি শিকা পাকাও। অলস হয়ে বসে থাকলে স্ত্রীলোকের মনে কুভাব আসে। তাই এরূপ করতেন লোকশিক্ষার জন্য। 

(১৩) পুরীতে ঠাকুরের ছবির কাছে একটি ঘিয়ের টিন ছিল। ঘর দরজা বন্ধ করে আমরা মন্দিরে যাই। ফিরে এসে ঘর খুলে দেখি ঘিয়ের টিনে পিঁপড়ে উঠেছে। আর ঠাকুরের ছবি মেঝেতে শুয়ে আছে।

শ্রীম (ভক্তদের প্রতি) __ এতে বলা হচ্ছে ছবিতেও ঠাকুর আছেন। 

(১৪) ঠাকুর মাতৃভাব ভালবাসতেন খুব। লোকশিক্ষার জন্য তাই আমায় রেখেছিলেন। 

(১৫) অল্প বয়সের সুন্দরী বিধবাদের কোনও পুরুষকে বিশ্বাস করতে নেই, বাপ ভাইকেও না। 

(১৬) গর্ভপাত করেছে, কি বিশ পঁচিশটা সন্তান প্রসব করেছে, এরূপ অসংযমী, বা রুগ্ন সব লোক (পাদ) স্পর্শ করাতেই তো রোগ। নইলে এ শরীরের আবার রোগ কি? 

(১৭) ঠাকুরকে বলেছিলাম, একটিও ছেলে নেই কি করে আমি দিন কাটাব। তিনি প্রবোধ দিয়ে বলেছিলেন, একটি ছেলের জন্য তুমি ভাবছো। কত অমুল্যধন ছেলে আসবে এরপর। এখন তাই দেখছি। 

(১৮) কামারপুকুরে লাহাদের বাড়ি থেকে লক্ষ্মীপুজোর দিন মা লক্ষ্মী এসেছিলেন। ঠাকুরের মা চিনতে না পেরে বিদায় দিলেন। তখন মা লক্ষ্মী বলেছিলেন, এমনি আমার দৃষ্টি থাকবে। এইজন্য কামারপুকুরে মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হয় না। 

(১৯) দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে এই সন্ধিক্ষণে জপ ধ্যান করতে হয় নিয়মিতভাবে। কারণ কখন সুসময় এসে পড়ে। 

(২০) ঠাকুর সব খান, যা দাও সবই খান। তবে কোনটা ভাল করে খেলেন, কোনটায় দৃষ্টিভোগ। কোনটা বা মাত্র স্পর্শ করলেন।  ঠাকুর খেলেন কি না খেলেন তা কি আমি দেখি না? তিনি না খেলে কি আমি খেতে পারি? তিনি খান। তাঁর চক্ষু থেকে একটি জ্যোতি এসে সব রস শোষণ করে নেয়। তারপর তার অমৃত হস্তের স্পর্শে সব আবার পূর্ণ হয়ে যায়। 

(২১) যে স্থানে তার পুজো হয়, বা কথা হয়, কিন্বা তাঁর পীঠ হয় সেখানে তার দৃষ্টি থাকে। 

(২২) ঠাকুরের শরীর খুব মোটা ছিল আর খুব সুন্দর ছিল। পিঁড়িতে বসলে ধরতো না। 

(২৩) ষোড়শী পুজো হয়েছিল গঙ্গাজলের জালার কাছে। 

(২৪) কামারপুকুরে মাঠে শুকনো  গু  মাড়িয়ে আসতাম। বাড়ি সে শ্রীবিষ্ণু শ্রীবিষ্ণু বলে  শুদ্ধ  হয়ে যেতাম। 

(২৫) মঠ আজকাল খুব তীর্থস্থান। যোগেনের অসুখে বৃন্দাবনে আমার বড় ভাবনা হয়েছিল। 

(২৬) কাশীপুরে ঠাকুরকে খাইয়ে দিতাম। একবার পা মচকে যাওয়ায় কয়দিন যেতে পারিনি ওপরে। হাতে নথ দেখিয়ে নরেন্দ্রকে ইঙ্গিতে বললেন, ঝুড়িতে করে নিয়ে আয় না। রসিক পুরুষ ছিলেন ঠাকুর। 

(২৭) কখনও কখনও দু'মাস পর ঠাকুরের দর্শন পেয়েছি। 

আজের অনুকীর্তন এইখানে শেষ হইল।


গ্রন্থসূত্রঃ- শ্রীম-দর্শন (তৃতীয় ভাগ)- স্বামী নিত্যাত্মানন্দ

প্রকাশকঃ- শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীম প্রকাশন ট্রাস্ট

Post a Comment

0 Comments