দক্ষিণেশ্বরে রাখাল, প্রাণকৃষ্ণ প্রভৃতি সঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

প্রথম খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে শ্রীযুক্ত রাখাল, প্রাণকৃষ্ণ, কেদার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

দক্ষিণেশ্বরে রাখাল, প্রাণকৃষ্ণ প্রভৃতি সঙ্গে

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি
দক্ষিণেশ্বরে প্রাণকৃষ্ণ, মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীবাড়ির সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। নিশিদিন হরিপ্রেমে — মার প্রেমে — মাতোয়ারা!

মেঝেতে মাদুর পাতা; তিনি সেই মাদুরে আসিয়া বসিয়াছেন। সম্মুখে প্রাণকৃষ্ণ ও মাস্টার। শ্রীযুক্ত রাখালও ঘরে আছেন। হাজরা মহাশয় ঘরের বাহিরে দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় বসিয়া আছেন।

শীতকাল — পৌষ মাস; ঠাকুরের গায়ে মোলস্কিনের র‌্যাপার। সোমবার, বেলা ৮টা। ১৮ই পৌষ, কৃষ্ণা অষ্টমী। ১লা জানুয়ারি, ১৮৮৩।

এখন অন্তরঙ্গ ভক্তগণ অনেকেই আসিয়া ঠাকুরের সহিত মিলিত হইয়াছেন। ন্যূনাধিক এক বৎসর কাল নরেন্দ্র, রাখাল, ভবনাথ, বলরাম, মাস্টার, বাবুরাম, লাটু প্রভৃতি সর্বদা আসা-যাওয়া করিতেছেন। তাঁহাদের বৎসরাধিক পূর্ব হইতে রাম, মনোমোহন, সুরেন্দ্র, কেদার আসিতেছেন।

প্রায় পাঁচ মাস হইল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাটীতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। দুই মাস হইল শ্রীযুক্ত কেশব সেনের সহিত বিজয়াদি ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে নৌযানে (স্টীমার-এ) আনন্দ করিতে করিতে কলিকাতায় গিয়াছিলেন।

শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কলিকাতার শ্যামপুকুর পল্লীতে বাস করেন। তাঁহার আদি নিবাস জনাই গ্রামে। Exchange-এর বড়বাবু। নিলামের কাজ তদারক করেন। প্রথম পরিবারের সন্তান না হওয়াতে, তাঁহার মত লইয়া দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করিয়াছেন। তাঁহারই একমাত্র পুত্রসন্তান হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রাণকৃষ্ণ বড় ভক্তি করেন। একটু স্থূলকায়, তাই ঠাকুর মাঝে মাঝে ‘মোটা বামুন’ বলিতেন। অতি সজ্জন ব্যক্তি। প্রায় নয় মাস হইল ঠাকুর তাঁহার বাটীতে ভক্তসঙ্গে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রাণকৃষ্ণ নানা ব্যঞ্জন ও মিষ্টান্নাদি করিয়া অন্নভোগ দিয়াছিলেন।

ঠাকুর মেঝেতে বসিয়া আছেন। কাছে এক চ্যাঙড়া জিলিপি — কোন ভক্ত আনিয়াছেন। তিনি একটু জিলিপি ভাঙিয়া খাইলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণের প্রতি সহাস্যে) — দেখছ আমি মায়ের নাম করি বলে — এই সব জিনিস খেতে পাচ্ছি! (হাস্য)

“কিন্তু তিনি লাউ কুমড়ো ফল দেন না — তিনি অমৃত ফল দেন — জ্ঞান, প্রেম, বিবেক, বৈরাগ্য।”

ঘরে একটি ছয়-সাত বছরের ছেলে প্রবেশ করিল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বালকাবস্থা। একজন ছেলে যেমন আর একজন ছেলের কাছ থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে — পাছে সে খাইয়া ফেলে, ঠাকুরেরও ঠিক সেই অপূর্ব বালকবৎ অবস্থা হইতেছে। তিনি জিলিপির চ্যাংড়াটি হাত ঢাকা দিয়া লুকাইতেছেন। ক্রমে তিনি চ্যাংড়াটি একপার্শ্বে সরাইয়া রাখিয়া দিলেন।

প্রাণকৃষ্ণ গৃহস্থ বটেন, কিন্তু তিনি বেদান্তচর্চা করেন  —  বলেন, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; তিনিই আমি  — সোঽহম্‌। ঠাকুর তাঁহাকে বলেন, কলিতে অন্নগত প্রাণ — কলিতে নারদীয় ভক্তি।

“সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কে ধরতে পারে!” —

বালকের ন্যায় হাত ঢাকিয়া মিষ্টান্ন লুকাইতে লুকাইতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।
==============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি
ভাবরাজ্য ও রূপদর্শন

ঠাকুর সমাধিস্থ — অনেকক্ষণ ভাবাবিষ্ট হইয়া বসিয়া আছেন। দেহ নড়িতেছে না — চক্ষু স্পন্দহীন — নিঃশ্বাস পড়িতেছে কিনা — বুঝা যায় না।

অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন — যেন ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে আবার ফিরিয়া আসিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) — তিনি শুধু নিরাকার নন, তিনি আবার সাকার। তাঁর রূপ দর্শন করা যায়। ভাব-ভক্তির দ্বারা তাঁর সেই অতুলনীয় রূপ দর্শন করা যায়। মা নানারূপে দর্শন দেন।

[গৌরাঙ্গদর্শন — রতির মা বেশে মা]

“কাল মাকে দেখলাম। গেরুয়া জামা পরা, মুড়ি সেলাই নাই। আমার সঙ্গে কথা কচ্ছেন।

“আর-একদিন মুসলমানের মেয়েরূপে আমার কাছে এসেছিলেন। মাথায় তিলক কিন্তু দিগম্বরী। ছয় সাত বছরের মেয়ে — আমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতে লাগল ও ফচকিমি করতে লাগল।

“হৃদের বাড়িতে যখন ছিলাম — গৌরাঙ্গদর্শন হয়েছিল — কালোপেড়ে কাপড় পরা।

“হলধারী বলত তিনি ভাব-অভাবের অতীত। আমি মাকে গিয়ে বললাম, মা, হলধারী এ-কথা বলছে, তাহলে রূপ-টুপ কি সব মিথ্যা? মা রতির মার বেশে আমার কাছে এসে বললে, ‘তুই ভাবেই থাক।’ আমিও হলধারীকে তাই বললাম।

“এক-একবার ও-কথা ভুলে যাই বলে কষ্ট হয়। ভাবে না থেকে দাঁত ভেঙে গেল। তাই দৈববাণী বা প্রতক্ষ্য না হলে ভাবেই থাকব — ভক্তি নিয়ে থাকব। কি বল?”

প্রাণকৃষ্ণ — আজ্ঞা

[ভক্তির অবতার কেন? রামের ইচ্ছা]

শ্রীরামকৃষ্ণ — আর তোমাকেই বা কেন জিজ্ঞাসা করি। এর ভিতরে কে একটা আছে। সেই আমাকে নিয়ে এইরূপ কচ্ছে। মাঝে মাঝে দেবভাব প্রায় হত, — আমি পুজো না করলে শান্ত হতুম না।

“আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি যেমন করান, তেমনি করি। যেমন বলান, তেমনি বলি।

“প্রসাদ বলে ভবসাগরে, বসে আছি ভাসিয়ে ভেলা।

জোয়ার এলে উজিয়ে যাব, ভাটিয়ে যাব ভাটার বেলা ৷৷

“ঝড়ের এঁটো পাতা কখনও উড়ে ভাল জায়গায় গিয়ে পড়ল, কখন বা ঝড়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ল — ঝড় যেদিকে লয়ে যায়।

“তাঁতী বললে, রামের ইচ্ছায় ডাকাতি হল, রামের ইচ্ছায় আমাকে পুলিসে ধরলে — আবার রামের ইচ্ছায় ছেড়ে দিলে।

“হনুমান বলেছিল, হে রাম, শরণাগত, শরণাগত; — এই আশীর্বাদ কর যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়। আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই।

“কোলা ব্যাঙ মুমূর্ষ অবস্থায় বললে, রাম, যখন সাপে ধরে তখন ‘রাম রক্ষা কর’ বলে চিৎকার করি। কিন্তু এখন রামের ধনুক বিঁধে মরে যাচ্ছি, তাই চুপ করে আছি।

“আগে প্রত্যক্ষ দর্শন হতো — এই চক্ষু দিয়ে — যেমন তোমায় দেখছি। এখন ভাবাস্থায় দর্শন হয়।

“ঈশ্বরলাভ হলে বালকের স্বভাব হয়। যে যাকে চিন্তা করে তার সত্তা পায়। ঈশ্বরের স্বভাব বালকের ন্যায়। বালক যেমন খেলাঘর করে, ভাঙে গড়ে — তিনিও সেইরূপ সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কচ্ছেন। বালক যেমন কোনও গুণের বশ নয় — তিনিও তেমনি সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণের অতীত।

“তাই পরমহংসেরা দশ-পাঁচজন বালক সঙ্গে রাখে, স্বভাব আরোপের জন্য।”

আগরপাড়া হইতে একটি বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা আসিয়াছেন। ছেলেটি যখন আসেন ঠাকুরকে ইশারা করিয়া নির্জনে লইয়া যান ও চুপি চুপি মনের কথা কন। তিনি নূতন যাতায়াত করিতেছেন। আজ ছেলেটি কাছে আসিয়া মেঝেতে বসিয়াছেন।

[প্রকৃতিভাব ও কামজয় — সরলতা ও ঈশ্বরলাভ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ছেলেটির প্রতি) — আরোপ করলে ভাব বদলে যায়। প্রকৃতিভাব আরোপ করলে ক্রমে কামাদি রিপু নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক মেয়েদের মতন ব্যবহার হয়ে দাঁড়ায়। যাত্রাতে যারা মেয়ে সাজে তাদের নাইবার সময় দেখেছি — মেয়েদের মতো দাঁত মাজে, কথা কয়।

“তুমি একদিন শনি-মঙ্গলবারে এস।”

(প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) — ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। শক্তি না মানলে জগৎ মিথ্যা হয়ে যায়, আমি-তুমি, ঘরবাড়ি, পরিবার — সব মিথ্যা। ওই আদ্যাশক্তি আছেন বলে জগৎ দাঁড়িয়ে আছে। কাঠামোর খুঁটি না থাকলে কাঠামোই হয় না — সুন্দর দুর্গা ঠাকুর-প্রতিমা হয় না।

“বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ না করলে চৈতন্যই হয় না — ভগবানলাভ হয় না — বিষয়বুদ্ধি থাকলেই কপটতা হয়। সরল না হলে তাঁকে পাওয়া যায় না —

“এইসি ভক্তি কর ঘট ভিতর ছোড় কপট চতুরাই।

সেবা বন্দি আউর অধীনতা সহজে মিলি রঘুরাই ৷৷

“যারা বিষয়কর্ম করে — অফিসের কাজ কি ব্যবসা — তাদেরও সত্যেতে থাকা উচিত। সত্যকথা কলির তপস্যা।”

প্রাণকৃষ্ণ — অস্মিন্‌ ধর্মে মহেশি স্যাৎ সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়ঃ।

পরোপকারনিরতো নির্বিকারঃ সদাশয়ঃ ৷৷

“মহানির্বাণতন্ত্রে এরূপ আছে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ওইগুলি ধারণা করতে হয়।
============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের যশোদার ভাব ও সমাধি

ঠাকুর ছোট খাটটির উপর গিয়া নিজের আসনে উপবিষ্ট হইয়াছেন। সর্বদাই ভাবে পূর্ণ। ভাবচক্ষে রাখালকে দর্শন করিতেছেন। রাখালকে দেখিতে দেখিতে বাৎসল্য রসে আপ্লুত হইলেন; অঙ্গে পুলক হইতেছে। এই চক্ষে কি যশোদা গোপালকে দেখিতেন?

দেখিতে দেখিতে আবার ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। ঘরের মধ্যস্থ ভক্তেরা অবাক ও নিস্তব্ধ হইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই অদ্ভুত ভাবাবস্থা দর্শন করিতেছেন।

কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন, রাখালকে দেখে উদ্দীপন কেন হয়? যত এগিয়ে যাবে ততই ঐশ্বর্যের ভাগ কম পড়ে যাবে। সাধকের প্রথম দর্শন হয় দশভুজা ঈশ্বরী মূর্তি। সে-মূর্তিতে ঐশ্বর্যের বেশি প্রকাশ। তারপর দর্শন দ্বিভুজা — তখন দশ হাত নাই — অত অস্ত্রশস্ত্র নাই। তারপর গোপাল-মূর্তি দর্শন — কোন ঐশ্বর্য নাই — কেবল কচি ছেলের মূর্তি। এরও পারে আছে — কেবল জ্যোতিঃ দর্শন।

[সমাধির পর ঠিক ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা — বিচার ও আসক্তি ত্যাগ]

“তাঁকে লাভ হলে, তাঁতে সমাধিস্থ হলে — জ্ঞানবিচার আর থাকে না।

“জ্ঞানবিচার আর কতক্ষণ? যতক্ষণ অনেক বলে বোধ হয় —

“যতক্ষণ জীব, জগৎ, আমি, তুমি — এ-সব বোধ থাকে। যখন ঠিক ঠিক এক জ্ঞান হয় তখন চুপ হয়ে যায়। যেমন ত্রৈলঙ্গ স্বামী।

“ব্রাহ্মণ ভোজনের সময় দেখ নাই? প্রথমটা খুব হইচই। পেট যত ভরে আসছে ততই হইচই কমে যাচ্ছে। যখন দধি মুণ্ডি পড়ল তখন কেবল সুপ-সাপ! আর কোনও শব্দ নাই। তারপরই নিদ্রা — সমাধি। তখন হইচই আর আদৌ নাই।

(মাস্টার ও প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) — “অনেকে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা কয়, কিন্তু নিচের জিনিস লয়ে থাকে। ঘরবাড়ি, টাকা, মান, ইনিদ্রয়সুখ। মনুমেন্টের নিচে যতক্ষণ থাক ততক্ষণ গাড়ি, ঘোড়া, সাহেব, মেম — এইসব দেখা যায়। উপরে উঠলে কেবল আকাশ, সমুদ্র, ধু-ধু কচ্ছে! তখন বাড়ি, ঘোড়া, গাড়ি, মানুষ এ-সব আর ভাল লাগে না; এ-সব পিঁপড়ের মতো দেখায়!

“ব্রহ্মজ্ঞান হলে সংসারাসক্তি, কামিনী-কাঞ্চনে উৎসাহ — সব চলে যায়। সব শান্তি হয়ে যায়। কাঠ পোড়বার সময় অনেক পড়পড় শব্দ আর আগুনের ঝাঁঝ। সব শেষ হয়ে গেলে, ছাই পড়ল — তখন আর শব্দ থাকে না। আসক্তি গেলেই উৎসাহ যায় — শেষে শান্তি।

“ঈশ্বরের যত নিকটে এগিয়ে যাবে ততই শান্তি। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ প্রশান্তিঃ। গঙ্গার যত নিকটে যাবে ততই শীতল বোধ হবে। স্নান করলে আরও শান্তি।

“তবে জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব, এ-সব, তিনি আছেন বলে সব আছে। তাঁকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। ১-এর পিঠে অনেক শূন্য দিলে সংখ্যা বেড়ে যায়। ১-কে পুঁছে ফেললে শূন্যের কোনও পদার্থ থাকে না।”

প্রাণকৃষ্ণকে কৃপা করিবার জন্য ঠাকুর কি এইবার নিজের অবস্থা সম্বন্ধে ইঙ্গিত করিতেছেন?

ঠাকুর বলিতেছেন —

[ঠাকুরের অবস্থা — ব্রহ্মজ্ঞানের পর “ভক্তির আমি”]

“ব্রহ্মজ্ঞানের পর — সমাধির পর — কেহ কেহ নেমে এসে ‘বিদ্যার আমি’, ‘ভক্তির আমি’ লয়ে থাকে। বাজার চুকে গেলে কেউ কেউ আপনার খুশি বাজারে থাকে। যেমন নারদাদি। তাঁরা লোকশিক্ষার জন্য ‘ভক্তির আমি’ লয়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।

“একটুও আসক্তি থাকলে তাঁকে পাওয়া যায় না। সূতার ভিতর একটু আঁশ থাকলে ছুঁচের ভিতর যাবে না।

“যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁর কাম-ক্রোধাদি নামমাত্র। যেমন পোড়া দড়ি। দড়ির আকার। কিন্তু ফুঁ দিলে উড়ে যায়।

“মন আসক্তিশূন্য হলেই তাঁকে দর্শন হয়। শুদ্ধ মনে যা উঠবে সে তাঁরই বাণী। শুদ্ধ মনও যা শুদ্ধ বুদ্ধিও তা — শুদ্ধ আত্মাও তা। কেননা তিনি বই আর কেউ শুদ্ধ নাই।

“তাঁকে কিন্তু লাভ করলে ধর্মাধর্মের পার হওয়া যায়।”

এই বলিয়া ঠাকুর সেই দেবদুর্লভকন্ঠে রামপ্রসাদের গান ধরিলেন:

আয় মন বেড়াতে যাবি।
কালী-কল্পতরুমূলে রে, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ৷৷
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।
বিবেক নামে তার বেটারে তত্ত্বকথা তায় শুধাবি ৷৷
============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীরাধার ভাব

ঠাকুর দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। প্রাণকৃষ্ণাদি ভক্তগণও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন। হাজরা মহাশয় বারান্দায় বসিয়া আছেন। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে প্রাণকৃষ্ণকে বলিতেছেন —

“হাজরা একটি কম নয়। যদি এখানে বড় দরগা হয়, তবে হাজরা ছোট দরগা।” (সকলের হাস্য)

বারান্দার দরজায় নবকুমার আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। ভক্তদের দেখিয়াই চলিয়া গেলেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “অহংকারের মূর্তি”।

বেলা সাড়ে নয়টা হইয়াছে। প্রাণকৃষ্ণ প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন — কলিকাতার বাটীতে ফিরিয়া যাইবেন।

একজন বৈরাগী গোপীযন্ত্রে ঠাকুরের ঘরে গান করিতেছেন:

নিত্যানন্দের জাহাজ এসেছে।
তোরা পারে যাবি তো ধর এসে ৷৷

ছয় মানোয়ারি গোরা, তারা দেয় সদা পারা,
বুক পিঠে তার ঢাল খাঁড়া ঘেরা।

তারা সদর দুয়ার আলগা করে রত্নমাণিক বিলাচ্ছে।

গান —      এই বেলা নে ঘর ছেয়ে।

এবারে বর্ষা ভারি, হও হুঁশিয়ারি, লাগো আদা জল খেয়ে।

যখন আসবে শ্রবণা, দেখতে দেবে না।
বাঁশ বাখারি পচে যাবে, ঘর ছাওয়া হবে না।

যেমন আসবে ঝটকা, উড়বে মটকা, মটকা জাবে ফাঁক হয়ে।

(তুমিও যাবে হাঁ হয়ে)।

গান —      কার ভাবে নদে এসে, কাঙাল বেশে, হরি হয়ে বলছি হরি।

কার ভাবে ধরেছ ভাব, এমন স্বভাব, তাও তো কিছু বুঝতে নারি।

ঠাকুর গান শুনিতেছেন, এমন সময় শ্রীযুক্ত কেদার চাটুজ্যে আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি আফিসের বেশ পরিয়া আসিয়াছেন, চাপকান, ঘড়ি, ঘড়ির চেন। কিন্তু ঈশ্বরের কথা হইলেই তিনি চক্ষের জলে ভাসিয়া যান। অতি প্রেমিক লোক। অন্তরে গোপীর ভাব।

কেদারকে দেখিয়া ঠাকুরের একেবারে শ্রীবৃন্দাবনলীলা উদ্দীপন হইয়া গেল। প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন ও কেদারকে সম্বোধন করিয়া গান গাহিতেছেন:

সখি, সে বন কতদূর।

(যথা আমার শ্যামসুন্দর) (আর চলিতে যে নারি)

শ্রীরাধার ভাবে গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিস্থ। চিত্রার্পিতের ন্যায় দণ্ডায়মান। কেবল চক্ষের দুই কোণ দিয়া আনন্দাশ্রু পড়িতেছে।

কেদার ভূমিষ্ঠ। ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়া স্তব করিতেছেন:

হৃদয়কমলমধ্যে নির্বিশেষং নিরীহম্‌।
হরিহরবিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্‌ ৷৷
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিৎ স্বরূপম্‌।
সকল ভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে ৷৷

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিস্থ হইতেছেন। কেদার নিজ বাটী হালিসহর হইতে কলিকাতায় কর্মস্থলে যাইবেন। পথে দক্ষিণেশ্বর কালী-মন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া যাইতেছেন। একটু বিশ্রাম করিয়া কেদার বিদায় গ্রহণ করিলেন।

এইরূপে ভক্তসঙ্গে কথা কহিতে কহিতে বেলা প্রায় দু-প্রহর হইল। শ্রীযুক্ত রামলাল ঠাকুরের জন্য থালা করিয়া মা-কালীর প্রসাদ আনিয়া দিলেন। ঘরের মধ্যে ঠাকুর দক্ষিণাস্য হইয়া আসনে বসিলেন ও প্রসাদ পাইলেন। আহার বালকের ন্যায় — একটু একটু সব মুখে দিলেন।

আহারান্তে ঠাকুর ছোট খাটটিতে একটু বিশ্রাম করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মারোয়াড়ী ভক্তেরা আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি
অভ্যাসযোগ — দুই পথ — বিচার ও ভক্তি

বেলা ৩টা। মারোয়াড়ী ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া ঠাকুরকে প্রশ্ন করিতেছেন। মাস্টার, রাখাল ও অন্যান্য ভক্তেরা ঘরে আছেন।

মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ, উপায় কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — দুইরকম আছে। বিচারপথ — আর অনুরাগ বা ভক্তির পথ।

“সৎ-অসৎ বিচার। একমাত্র সৎ বা নিত্যবস্তু ঈশ্বর, আর সমস্ত অসৎ বা অনিত্য। বাজিকরই সত্য, ভেলকি মিথ্যা। এইটি বিচার।

“বিবেক আর বৈরাগ্য। এই সৎ-অসৎ বিচারের নাম বিবেক। বৈরাগ্য অর্থাৎ সংসারের দ্রব্যের উপর বিরক্তি। এটি একবারে হয় না। — রোজ অভ্যাস করতে হয়। — তারপর তাঁর ইচ্ছায় মনের ত্যাগও করতে হয়, বাহিরের ত্যাগও করতে হয়। কলকাতার লোকদের বলবার জো নাই ‘ঈশ্বরের জন্য সব ত্যাগ কর’ — বলতে হয় ‘মনে ত্যাগ কর।’

“অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে — কাম, ক্রোধ বশ করতে — কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির করে না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।”

মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ, দুই পথ বললেন; আর-এক পথ কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — অনুরাগের বা ভক্তির পথ। ব্যাকুল হয়ে একবার কাঁদ — নির্জনে, গোপনে — দেখা দাও বলে।

“ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে!”

মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ, সাকারপূজার মানে কি? আর নিরাকার, নির্গুণ — এর মানেই বা কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — যেমন বাপের ফটোগ্রাফ দেখলে বাপকে মনে পড়ে, তেমনি প্রতিমায় পূজা করতে করতে সত্যের রূপ উদ্দীপন হয়।

“সাকাররূপ কিরকম জান? যেমন জলরাশির মাঝ থেকে ভুড়ভুড়ি উঠে সেইরূপ। মহাকাশ চিদাকাশ থেকে এক-একটি রূপ উঠছে দেখা যায়। অবতারও একটি রূপ। অবতারলীলা সে আদ্যাশক্তিরই খেলা।”

[পাণ্ডিত্য — আমি কে? আমিই তুমি]

“পাণ্ডিত্যে কি আছে? ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। নানা বিষয় জানবার দরকার নাই।

“যিনি আচার্য তাঁরই পাঁচটা জানা দরকার। অপরকে বধ করবার জন্য ঢাল-তরোয়াল চাই; আপনাকে বধ করবার জন্য একটি ছুঁচ বা নরুন হলেই হয়।

”আমি কে, এইটি খুঁজতে গেলে তাঁকেই পাওয়া যায়। আমি কি মাংস, না হাড়, না রক্ত, না মজ্জা — না মন, না বুদ্ধি? শেষে বিচারে দেখা যায় যে, আমি এ-সব কিছুই নয়। ‘নেতি’ ‘নেতি’। আত্মা ধরবার ছোঁবার জো নাই। তিনি নির্গুণ — নিরুপাধি।

“কিন্তু ভক্তি মতে তিনি সগুণ। চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম — সব চিন্ময়।”

মারোয়াড়ী ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

[দক্ষিণেশ্বরে সন্ধ্যা ও আরতি]

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর গঙ্গাদর্শন করিতেছেন। ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল, শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার নাম করিতেছেন ও খাটটিতে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার চিন্তা করিতেছেন।

ঠাকুরবাড়িতে এইবার আরতি হইতেছে। যাঁহারা এখনও পোস্তার উপর বা পঞ্চবটী মধ্যে পাদচারণ করিতেছেন তাঁহারা দূর হইতে আরতির মধুর ঘন্টা-নিনাদ শুনিতেছেন। জোয়ার আসিয়াছে — ভাগীরথী কুলকুল শব্দ করিয়া উত্তরবাহিনী হইতেছেন। আরতির মধুর শব্দ কুলকুল শব্দের সহিত মিশ্রিত হইয়া আরও মধুর হইয়াছে। এই সকলের মধ্যে প্রেমোন্মত্ত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। সকলই মধুর! হৃদয় মধুময়! মধু, মধু, মধু!
===========

Post a Comment

0 Comments