পঞ্চম খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

পঞ্চম খণ্ড 

পঞ্চম খণ্ড  ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল

শ্রীরামকৃষ্ণ সিঁথির ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীযুক্ত বেণী পালের সিঁথির বাগানে শুভাগমন করিয়াছেন। আজ সিঁথির ব্রাহ্মসমাজের ষান্মাসিক মহোৎসব। চৈত্র পূর্ণিমা (১০ই বৈশাখ, রবিবার), ২২শে এপ্রিল, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; বৈকাল বেলা। অনেক ব্রাহ্মভক্ত উপস্থিত; ভক্তেরা ঠাকুরকে ঘিরিয়া দক্ষিণের দালানে বসিলেন। সন্ধ্যার পর আদি সমাজের আচার্য শ্রীযুক্ত বেচারাম উপাসনা করিবেন।

ব্রাহ্মভক্তেরা ঠাকুরকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করিতেছেন।

ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, উপায় কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — উপায় অনুরাগ, অর্থাৎ তাঁকে ভালবাসা। আর প্রার্থনা।

ব্রাহ্মভক্ত — অনুরাগ না প্রার্থনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — অনুরাগ আগে, পরে প্রার্থনা।

“ডাক দেখি মন ডাকার মতো, কেমন শ্যামা থাকতে পারে” —

শ্রীরামকৃষ্ণ সুর করিয়া এই গানটি গাইলেন।

“আর সর্বদাই তাঁর নামগুণগান-কীর্তন, প্রার্থনা করতে হয়। পুরাতন ঘটি রোজ মাজতে হবে, একবার মাজলে কি হবে? আর বিবেক, বৈরাগ্য, সংসার অনিত্য, এই বোধ।”

[ব্রাহ্মভক্ত ও সংসারত্যাগ — সংসারে নিষ্কামকর্ম]

ব্রাহ্মভক্ত — সংসারত্যাগ কি ভাল?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সকলের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। যাদের ভোগান্ত হয় নাই তাদের পক্ষে সংসারত্যাগ নয়। দুআনা মদে কি মাতাল হয়?

ব্রাহ্মভক্ত — তারা তবে সংসার করবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তারা নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করবে। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙবে। বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কর্ম করে, কিন্তু দেশে মন পড়ে থাকে; এরই নাম নিষ্কামকর্ম।১ এরই নাম মনে ত্যাগ। তোমরা মনে ত্যাগ করবে। সন্ন্যাসী বাহিরের ত্যাগ আবার মনে ত্যাগ দুইই করবে।

[ব্রাহ্মভক্ত ও ভোগান্ত — বিদ্যারূপিণী স্ত্রীর লক্ষণ — বৈরাগ্য কখন হয়]

ব্রাহ্মভক্ত — ভোগান্ত কিরূপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কামিনী-কাঞ্চন ভোগ। যে ঘরে আচার তেঁতুল আর জলের জালা, সে ঘরে বিকারের রোগী থাকলে মুশকিল! টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, দেহসুখ এই সব ভোগ একবার না হয়ে গেলে — ভোগান্ত না হলে — সকলের ইশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আসে না

ব্রাহ্মভক্ত — স্ত্রীজাতি খারাপ, না আমরা খারাপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে, আবার অবিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে। বিদ্যারূপিণী স্ত্রী ভগবানের দিকে লয়ে যায়, আর অবিদ্যারূপিণী ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়, সংসারে ডুবিয়ে দেয়।

“তাঁর মহামায়াতে এই জগৎসংসার। এই মায়ার ভিতর বিদ্যা-মায়া অবিদ্যা-মায়া দুই-ই আছে। বিদ্যা-মায়া আশ্রয় করলে সাধুসঙ্গ, জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, বৈরাগ্য — এই সব হয়। অবিদ্যা-মায়া — পঞ্চভূত আর ইন্দ্রিয়ের বিষয় — রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ; যত ইন্দ্রিয়ের ভোগের জিনিস; এরা ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

ব্রাহ্মভক্ত — অবিদ্যাতে যদি অজ্ঞান করে, তবে তিনি অবিদ্যা করেছেন কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর লীলা, অন্ধকার না থাকলে আলোর মহিমা বোঝা ঝায় না। দুঃখ না থাকলে সুখ বোঝা যায় না। ‘মন্দ’ জ্ঞান থাকলে তবে ‘ভাল’ জ্ঞান হয়।

“আবার আছে খোসাটি আছে বলে তবে আমটি বাড়ে ও পাকে। আমটি তয়ের হয়ে গেলে তবে খোসা ফেলে দিতে হয়! মায়ারূপ ছালটি থাকলে তবেই ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। বিদ্যা-মায়া, অবিদ্যা-মায়া আমের খোসার ন্যায়; দুই-ই দরকার।”

ব্রাহ্মভক্ত — আচ্ছা, সাকারপূজা, মাটিতে গড়া ঠাকুরপূজা — এ-সব কি ভাল?২

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমরা সাকার মান না, তা বেশ; তোমাদের পক্ষে মূর্তি নয়, ভাব। তোমরা টানটুকু নেবে, যেমন কৃষ্ণের উপর রাধার টান, ভালবাসা। সাকারবাদীরা যেমন মা-কালী, মা-দুর্গার পূজা করে, ‘মা’ ‘মা’ বলে কত ডাকে কত ভালবাসে — সেই ভাবটিকে তোমরা লবে, মূর্তি না-ই বা মানলে।

ব্রাহ্মভক্ত — বৈরাগ্য কি করে হয়? আর সকলের হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগের শান্তি না হলে বৈরাগ্য হয় না। ছোট ছেলেকে খাবার আর পুতুল দিয়ে বেশ ভুলানো যায়। কিন্তু যখন খাওয়া হয়ে গেল, আর পুতুল নিয়ে খেলা হয়ে গেল, তখন “মা যাব” বলে। মার কাছে নিয়ে না গেলে পুতুল ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে কাঁদে।

[সচ্চিদানন্দই গুরু — ঈশ্বরলাভের পর সন্ধ্যাদি কর্মত্যাগ]

ব্রাহ্মভক্তেরা গুরুবাদের বিরোধী। তাই ব্রাহ্মভক্তটি এ-সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।

ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, গুরু না হলে কি জ্ঞান হবে না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সচ্চিদানন্দই গুরু; যদি মানুষ গুরুরূপে চৈতন্য করে তো জানবে যে, সচ্চিদানন্দই ওই রূপ ধারণ করেছেন। গুরু যেমন সেথো; হাত ধরে নিয়ে যান। ভগবানদর্শন হলে আর গুরুশিষ্য বোধ থাকে না। ‘সে বড় কঠিন ঠাঁই, গুরুশিষ্যে দেখা নাই!’ তাই জনক শুকদেবকে বললেন, ‘যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও আগে দক্ষিণা দাও।’ কেননা, ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর শিষ্য ভেদবুদ্ধি থাকবে না। যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন না হয়, ততদিনই গুরুশিষ্য সম্বন্ধ।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল। ব্রাহ্মভক্তেরা কেহ কেহ ঠাকুরকে বলিতেছেন, “আপনার বোধহয় এখন সন্ধ্যা করতে হবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, সেরকম নয়। ও-সব প্রথম প্রথম এক-একবার করে নিতে হয়। তারপর আর কোশাকুশি বা নিয়মাদি দরকার হয় না।

১ কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।         [গীতা, ২/৪৭]
যৎ করোষি যদশ্নাসি … কুরুষ্ব মদর্পণম্‌।        [গীতা, ৯/২৭]
২ “মৃণ্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী” — কেশবের উপদেশ।
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল

শ্রীরামকৃষ্ণ ও আচার্য শ্রীবেচারাম — বেদান্ত ও ব্রহ্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে

সন্ধ্যার পর আদিসমাজের আচার্য শ্রীযুক্ত বেচারাম বেদীতে বসিয়া উপাসনা করিলেন। মাঝেমাঝে ব্রহ্মসঙ্গীত ও উপনিষদ্‌ হইতে পাঠ হইতে লাগিল। উপাসনান্তে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বসিয়া আচার্য অনেক আলাপ করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, নিরাকারও সত্য আর সাকারও সত্য; আপনি কি বল?

[সাকার-নিরাকার চিন্ময়রূপ ও ভক্ত]

আচার্য — আজ্ঞা, নিরাকার যেমন Electric Current (তড়িৎ-প্রবাহ) চক্ষে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, দুই সত্য। শুধু নিরাকার বলা কিরূপ জানো? যেমন রোশনচৌকির একজন পোঁ ধরে থাকে — তার বাঁশির সাত ফোকর সত্ত্বেও। কিন্তু আর-একজন দেখ কত রাগ-রাগিণী বাজায়! সেরূপ সাকারবাদীরা দেখ ঈশ্বরকে কতভাবে সম্ভোগ  করে! শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর — নানাভাবে।

“কি জানো, অমৃতকুণ্ডে কোনও রকমে পড়া। তা স্তব করেই হোক অথবা কেউ ধাক্কা মেরেছে আর তুমি কুণ্ডে পড়ে গেছ, একই ফল। দুই জনেই অমর হবে!১

“ব্রাহ্মদের পক্ষে জল বরফ উপমা ঠিক। সচ্চিদানন্দ যেন অনন্ত জলরাশি। মহাসাগরের জল, ঠান্ডা দেশে স্থানে স্থানে যেমন বরফের আকার ধারণ করে, সেইরূপ ভক্তি হিমে সেই সচ্চিদানন্দ (সগুণ ব্রহ্ম) ভক্তের জন্য সাকার রূপ ধারণ করেন। ঋষিরা সেই অতীন্দ্রিয় চিন্ময় রূপ দর্শন করেছিলেন, আবার তাঁর সঙ্গে কথা কয়েছিলেন। ভক্তের প্রেমের শরীর,২ ‘ভাগবতীতনু’ দ্বারা সেই চিন্ময় রূপ দর্শন হয়।

“আবার আছে, ব্রহ্ম অবাঙ্মনসোগোচর। জ্ঞানসূর্যের তাপে সাকার বরফ গলে যায়। ব্রহ্মজ্ঞানের পর, নির্বিকল্পসমাধির পর, আবার সেই অনন্ত, বাক্যমনের অতীত, অরূপ নিরাকার ব্রহ্ম!

“ব্রহ্মের স্বরূপ মুখে বলা যায় না, চুপ হয়ে যায়। অনন্তকে কে মুখে বোঝাবে! পাখি যত উপরে উঠে, তার উপর আরও আছে, আপনি কি বল?”

আচার্য — আজ্ঞা হাঁ, বেদান্তে ওইরূপ কথাই আছে।

[নির্গুণ ব্রহ্ম ‘অবাঙ্মনসোগোচরম্‌’ — ত্রিগুণাতীতম্‌]

শ্রীরামকৃষ্ণ — লবণপুত্তলিকা সাগর মাপতে গিছিল, ফিরে এসে আর খবর দিলে না। এক মতে আছে শুকদেবাদি দর্শন-স্পর্শন করেছিল, ডুব দেয় নাই।

“আমি বিদ্যাসগরকে বলেছিলাম, সব জিনিস এঁটো হয়ে গেছে, কিন্তু ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হয় নাই।৩ অর্থাৎ ব্রহ্ম কি, কেউ মুখে বলতে পারে নাই। মুখে বললেই জিনিসটা এঁটো হয়। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত, শুনে ভারী খুশি।

“কেদারের ওদিকে শুনেছি বরফে ঢাকা পাহাড় আছে। বেশি উচ্চে উঠলে আর ফিরতে হয় না। যারা বেশি উচ্চেতে কি আছে, গেলে কিরূপ অবস্থা হয় — এ-সব জানতে গিয়েছে, তারা ফিরে এসে, আর খবর দেয় নাই।

“তাঁকে দর্শন হলে মানুষ আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়, চুপ৪ হয়ে যায়। খবর কে দেবে? বুঝাবে কে?

“সাত দেউড়ির পর রাজা। প্রত্যেক দেউড়িতে এক-একজন মহা ঐশ্বর্যবান পুরুষ বসে আছেন। প্রত্যেক দেউড়িতেই শিষ্য জিজ্ঞাসা করছে, এই কি রাজা? গুরুও বলছেন, না; নেতি নেতি। সপ্তম দেউড়িতে গিয়ে যা দেখলে, একেবারে অবাক!৫ আনন্দে বিহ্বল। আর জিজ্ঞাসা করতে হল না ‘এই কি রাজা?’ দেখেই সব সংশয় চলে গেল।”

আচার্য — আজ্ঞে হাঁ, বেদান্তে এইরূপই সব আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — যখন তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন তখন তাঁকে সগুণ ব্রহ্ম, আদ্যাশক্তি বলি। যখন তিনি তিন গুণের অতীত তখন তাঁকে নির্গুণ ব্রহ্ম, বাক্য-মনের অতীত বলা যায়; পরব্রহ্ম।

“মানুষ তাঁর মায়াতে পড়ে স্ব-স্বরূপকে ভুলে যায়। সে যে বাপের অনন্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী তা ভুলে যায়। তাঁর মায়া ত্রিগুণময়ী। এই তিনগুণই ডাকাত, সর্বস্ব হরণ করে; স্ব-স্বরূপকে ভুলিয়ে দেয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ — তিন গুণ। এদের মধ্যে সত্ত্বগুণই ঈশ্বরের পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে সত্ত্বগুণও নিয়ে যেতে পারে না।

“একজন ধনী বনপথ দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় তিনজন ডাকাত এসে তাকে ঘিরে ফেলল ও তার সর্বস্ব হরণ করলে। সব কেড়ে-কুড়ে নিয়ে একজন ডাকাত বললে, ‘আর একে রেখে কি হবে? একে মেরে ফেল’ — এই বলে তাকে কাটতে এল। দ্বিতীয় ডাকাত বললে, ‘মেরে ফেলে কাজ নেই, একে আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে এইখানেই ফেলে রেখে যাওয়া যাক। তাহলে পুলিসকে খবর দিতে পারবে না।’ এই বলে ওকে বেঁধে রেখে ডাকাতরা চলে গেল। খানিকক্ষণ পরে তৃতীয় ডাকাতটি ফিরে এল। এসে বললে, ‘আহা তোমার বড় লেগেছে, না? আমি তোমার বন্ধন খুলে দিচ্ছি।’ বন্ধন খুলবার পর লোকটিকে সঙ্গে করে নিয়ে ডাকাত পথ দেখিয়ে দেখিয়ে চলতে লাগল। সরকারী রাস্তার কাছে এসে বললে, ‘এই পথ ধরে যাও, এখন তুমি অনায়াসে নিজের বাড়িতে যেতে পারবে।’ লোকটি বললে, ‘সে কি মহাশয়, আপনিও চলুন; আপনি আমার কত উপকার করলেন। আমাদের বাড়িতে গেলে আমরা কত আনন্দিত হব।’ ডাকাতটি বললে, ‘না, আমার ওখানে যাবার জো নাই, পুলিশে ধরবে।’ এই বলে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।

“প্রথম ডাকাতটি তমোগুণ, যে বলেছিল, ‘একে রেখে আর কি হবে, মেরে ফেল।’ তমোগুণে বিনাশ হয়। দ্বিতীয় ডাকাতটি রজোগুণ; রজোগুণে মানুষ সংসারে বদ্ধ হয়, নানা কাজ জড়ায়। রজোগুণ ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়। সত্ত্বগুণ যেন সিঁড়ির শেষ ধাপ। তারপরেই ছাদ। মানুষের স্বধাম হচ্ছে পরব্রহ্ম। ত্রিগুনাতীত না হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।”

আচার্য — বেশ সব কথা হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — (সহাস্যে) — ভক্তের স্বভাব কি জানো? আমি বলি তুমি শুন, তুমি বল আমি শুনি! তোমরা আচার্য, কত লোককে শিক্ষা দিচ্ছ। তোমরা জাহাজ, আমরা জেলেডিঙি। (সকলের হাস্য)

১ অমৃত কুণ্ড — ব্রহ্মৈবেদমমৃতং পুরস্তাদ্‌ব্রহ্ম পশ্চাদ্‌ব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ ৷
অধশ্চোর্ধ্বঞ্চ প্রসৃতং ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্‌ ৷৷                  [মুন্ডকোপনিষদ্‌, ২।২।১১]

২ নারদ বলিলেন — আমি শুদ্ধা সর্বময়ী ভাগবতীতনু প্রাপ্ত হলাম।
প্রযুজ্যমানে ময়ি তাং শুদ্ধাং ভাগবতীতনুম্‌।
আরব্ধকর্মনির্বাণো নাপতং পাঞ্চভৌতিকঃ।                                           [শ্রীমদ্ভাগবত, ১।৬।২৯]

৩ উচ্ছিষ্ট হয় নাই — অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যম্‌ … অদ্বৈতম্‌                  [মাণ্ডুক্যোপনিষদ্‌, ৭]

৪ যতো বাচো নির্বতন্তে। অপ্রাপ্য মনসা সহ।                  [তৈত্তরীয়োপনিষদ্‌, ২।৪]

৫ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ .. তস্মিন্‌ দৃষ্টে পরাবরে।                  [মুণ্ডকোপিনিষদ্‌, ২।২।৮]

===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৩ই মে
শ্রীরামকৃষ্ণ হরিকীর্তনানন্দে — হরিভক্তি-প্রদায়িনী সভায় ও রামচন্দ্রের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় কাঁসারীপাড়া হরিভক্তি-প্রদায়িনী সভায় শুভাগমন করিয়াছেন; রবিবার (৩১শে) বৈশাখ, শুক্লা সপ্তমী, ১৩ই মে, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ সভার বার্ষিক উৎসব হইতেছে। মনোহরসাঁই-এর কীর্তন হইতেছে।

‘মান’ এই পালা গান হইতেছে। সখীরা শ্রীমতীকে বলছেন, “মান কেন করলি, তবে তুই বুঝি কৃষ্ণের সুখ চাস না।” শ্রীমতী বলছেন, “চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে, যাবার জন্য নয়। সেখানে যাওয়া কেন? সে যে সেবা জানে না!”

পরের রবিবার (২০-৫-৮৩) রামচন্দ্রের বাটীতে আবার কীর্তন হইতেছে, মাথুর গান। ঠাকুর আসিয়াছেন। বৈশাখ, শুক্লা চতুর্দশী; ৭ই জ্যৈষ্ঠ। মাথুর গান হইতেছে, শ্রীমতী কৃষ্ণের বিরহে অনেক কথা বলিতেছেন, ”বালিকা অবস্থা থেকেই শ্যামকে দেখতে ভালবাসতাম। সখি, নখের ছনদ দিন গুণিতে ক্ষয় হয়ে গেছে। দেখ, তিনি যে মালা দিয়েছেন, সে মালা শুকায়ে গিয়েছে, তবু ফেলি নাই। কৃষ্ণচন্দ্রের উদয় কোথা হল? সে চন্দ্র, মান রাহুর ভয়ে বুঝি চলে গেল! হায়, সেই কৃষ্ণ মেঘকে আবার কবে দর্শন হবে; আর কি দেখা হবে! বঁধু, প্রাণ ভরে তোমায় কখনও দেখিতে পাই নাই; একে দুটি চোখ তাতে নিমিখ্‌, তাতে বারিধারা। তাঁর শিরে ময়ূর পাখা যেন স্থির বিজলী। ময়ূরগণ সেই মেঘ দেখে পাখা তুলে নৃত্য করত।

“সখি, এ প্রাণ তো থাকিবে না — রেখো দেহ তমালের ডালে, আর আবার গায়ে কৃষ্ণনাম লিখে দিও!”

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “তিনি আর তাঁর নাম অভেদ; তাই শ্রীমতী এইরূপ বলছেন। যেই রাম সেই নাম।” ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া এই মাথুর কীর্তন গান শুনিতেছেন। গোস্বামী কীর্তনিয়া এই সকল গান গাইতেছেন। আগামী রবিবারে আবার দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ওই গান হইবে। তাহার পরের শনিবারে আবার অধরের বাড়িতে ওই কীর্তন হইবে।
============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২৭শে মে
দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে দাঁড়াইয়া আছেন ও ভক্তসঙ্গে কথা কহিতেছেন। আজ রবিবার, ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, কৃষ্ণা পঞ্চমী; ২৭শে মে, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা ৯টা হইবে। ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — বিদ্বেষভাব ভাল নয়, শাক্ত, বৈষ্ণব, বৈদান্তিক এরা ঝগড়া করে, সেটা ভাল নয়। পদ্মলোচন বর্ধমানের সভাপণ্ডিত ছিল; সভায় বিচার হচ্ছিল, — শিব বড় না ব্রহ্মা বড়। পদ্মলোচন বেশ বলেছিল — আমি জানি না, আমার সঙ্গে শিবেরও আলাপ নেই, ব্রহ্মারও আলাপ নেই। (সকলের হাস্য)

“ব্যাকুলতা থাকলে সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়। তবে নিষ্ঠা থাকা ভাল। নিষ্ঠাভক্তির আর-একটি নাম অব্যভিচারিণী ভক্তি। যেমন এক ডেলে গাছ, সোজা উঠেছে। ব্যভিচারিণী ভক্তি যেমন পাঁচ ডেলে গাছ। গোপীদের এমনি নিষ্ঠা যে, বৃন্দাবনের মোহনচূড়া, পীতধড়াপরা রাখালকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু ভালবাসবে না। মথুরায় যখন রাজবেশ, পাগড়ি মাথায় কৃষ্ণকে দর্শন করলে তখন তারা ঘোমটা দিলে। আর বললে, ইনি আবার কে? এঁর সঙ্গে আলাপ করে আমরা কি দ্বিচারিণী হব?

“স্ত্রী যে স্বামীর সেবা করে সেও নিষ্ঠাভক্তি, দেবর ভাসুরকে খাওয়ায়, পা ধোয়ার জল দেয়, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে অন্য সম্বন্ধ। সেইরূপ নিজের ধর্মতেও নিষ্ঠা হতে পারে। তা বলে অন্য ধর্মকে ঘৃণা করবে না। বরং তাদের সঙ্গে মিষ্ট ব্যবহার করবে।”

[জগন্মাতার পূজা ও আত্মপূজা — ‘বিপদনাশিনী’ মন্ত্র ও নৃত্য]

ঠাকুর গঙ্গাস্নান করিয়া কালীঘরে গিয়াছেন। সঙ্গে মাস্টার। ঠাকুর পূজার আসনে উপবিষ্ট হইয়া, মার পাদপদ্মে ফুল দিতেছেন, মাঝে মাঝে নিজের মাথায়ও দিতেছেন ও ধ্যান করিতেছেন।

অনেকক্ষণ পরে ঠাকুর আসন হইতে উঠিলেন। ভাবে বিভোর, নৃত্য করিতেছেন। আর মুখে মার নাম করিতেছেন। বলিতেছেন, “মা বিপদনাশিনী গো, বিপদনাশিনী!” দেহধারণ করলেই দুঃখ বিপদ, তাই বুঝি জীবকে শিখাইতেছেন তাঁহাকে ‘বিপদনাশিনী’ এই মহামন্ত্র উচ্চারণ করিয়া কাতর হইয়া ডাকিতে।

[পূর্বকথা — শ্রীরামকৃষ্ণ ও ঝামাপুকুরের নকুড় বাবাজী]

এইবার ঠাকুর নিজের ঘরের পশ্চিম বারান্দায় আসিয়া উপবিষ্ট হইয়াছেন। এখনও ভাবাবেশ রহিয়াছে। কাছে রাখাল, মাস্টার, নকুড়, বৈষ্ণব প্রভৃতি। নকুড় বৈষ্ণবকে ঠাকুর ২৮/২৯ বৎসর ধরিয়া জানেন। যখন তিনি প্রথম কলিকাতায় আসিয়া ঝামাপুকুরে ছিলেন ও বাড়ি বাড়ি পূজা করিয়া বেড়াইতেন, তখন নকুড় বৈষ্ণবের দোকানে আসিয়া মাঝে মাঝে বসিতেন ও আনন্দ করিতেন। পেনেটীতে রাঘব পণ্ডিতের মহোৎসবে উপলক্ষে নকুড় বাবাজী ইদানীং ঠাকুরকে প্রায় বর্ষে বর্ষে দর্শন করিতেন। নকুড় ভক্ত বৈষ্ণব, মাঝে মাঝে তিনিও মহোৎসব দিতেন। নকুড় মাস্টারের প্রতিবেশী। ঠাকুর ঝামাপুকুরে যখন ছিলেন, গোবিন্দ চাটুজ্যের বাড়িতে থাকিতেন। সেই পুরাতন বাটী নকুড় মাস্টারকে দেখাইয়াছিলেন।

[শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার নামকীর্তনানন্দে]

ঠাকুর ভাবাবেশে গান গাইতেছেন:

কীর্তন

১।     
সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী ৷
তুমি আপন সুখে আপনি নাচ, আপনি দাও মা করতালি ৷৷
আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশিভালি ৷
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন (তুই) মুণ্ডমালা কোথায় পেলি ৷৷
সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, আমরা তোমার তন্ত্রে চলি ৷
যেমন করাও তেমনি করি মা, যেমন বলাও তেমনি বলি ৷৷
নির্গুণে কমলাকান্ত দিয়ে বলে মা গালাগালি ৷
সর্বনাশী ধরে অসি ধর্মাধর্ম দুটো খেলি ৷৷

২।     
আমার মা ত্বং হি তারা
তুমি ত্রিগুণধরা পরাৎপরা।
আমি জানি মা ও দীন-দয়াময়ী, তুমি দুর্গমেতে দুখহরা ৷
তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী, তুমি জগধাত্রী, গো মা
তুমি অকুলের ত্রাণকর্ত্রী, সদাশিবের মনোরমা ৷
তুমি জলে, তুমি স্থলে, তুমি আদ্যমূলে গো মা
আছ সর্বঘটে অর্ঘ্যপুটে সাকার আকার নিরাকারা।

৩।      গোলমালে মাল রয়েছে, গোল ছেড়ে মাল বেছে নাও।

৪।      মন চল যাই, আর কাজ নাই, তারাও ও তালুকে রে!

৫।      পড়িয়ে ভবসাগরে, ডোবে মা তনুর তরী;
মায়া-ঝড় মোহ-তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।

৬।      মায়ে পোয়ে দুটো দুখের কথা কি।
কারুর হাতির উপর ছি, কারু চিঁড়ের উপর খাসা দই ৷

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের বলিতেছেন, সংসারীদের সম্মুখে কেবল দুঃখের কথা ভাল নয়। আনন্দ চাই। যাদের অন্নাভাব, তারা দুদিন বরং উপোস করতে পারে; আর যাদের খেতে একটু বেলা হলে অসুখ হয়, তাদের কাছে কেবল কান্নার কথা, দুঃখের কথা ভাল নয়।

“বৈষ্ণবচরণ বলত, কেবল পাপ পাপ — এ-সব কি? আনন্দ কর।”

ঠাকুর আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিতে না করিতে মনোহরসাঁই গোস্বামী আসিয়া উপস্থিত।

[শ্রীরাধার ভাবে মহাভাবময় শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠাকুর কি গৌরাঙ্গ!]

গোস্বামী পূর্বরাগ কীর্তন গান করিতেছেন। একটু শুনিতে শুনিতেই ঠাকুর রাধার ভাবে ভাববিষ্ট।

প্রথমেই গৌরচন্দ্রিকা কীর্তন। “করতলে হাত — চিন্তিত গোরা — আজ কেন চিন্তিত? — বুঝি রাধার ভাবে হয়েছে ভাবিত।”

গোস্বামী আবার গান গাইতেছেন:

ঘরের বাহিরে, দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আসে যায়
কিবা মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন, কদম্ব কাননে চায়।
(রাই, এমন কেন বা হল গো!)

গানের এই লাইনটি শুনিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাবের অবস্থা হইয়াছে। গায়ের জামা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিলেন।

কীর্তনিয়া যখন গাইতেছেন:

শীতল তছু অঙ্গ।
তনু পরশে, অমনি অবশ অঙ্গ!
মহাভাবে ঠাকুরের কম্প হইতেছে!

(কেদার দৃষ্টে) ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলিতেছেন, “প্রাণনাথ, হৃদয়বল্লভ তোরা কৃষ্ণ এনে দে; সুহৃদের তো কাজ বটে; হয় এনে দে, না হয় আমায় নিয়ে চল; তোদের চিরদাসী হব।”

গোস্বামী কীর্তনিয়া ঠাকুরের মহাভাবের অবস্থা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছেন। তিনি করজোড়ে বলিতেছেন, “আমার বিষয়বুদ্ধি ঘুচিয়ে দিন।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — “সাধু বাসা পাকড় লিয়া।” তুমি এত বড় রসিক; তোমার ভিতের থেকে এত মিষ্ট রস বেরুচ্ছে!

গোস্বামী — প্রভু, আমি চিনির বলদ, চিনির আস্বাদন করতে কই পেলাম?

আবার কীর্তন চলিতে লাগিল। কীর্তনিয়া শ্রীমতীর দশা বর্ণনা করিতেছেন —

“কোকিল-কুলকুর্বতি কলনাদম্‌”

কোকিলের কলনাদ শুনে শ্রীমতির বজ্রধ্বনি বলে মনে হচ্ছে। তাই জৈমিনির নাম কচ্ছেন। আর বলছেন, “সখি, কৃষ্ণ বিরহে এ প্রাণ থাকিবে না — রেখো দেহ তমালের ডালে।”

গোস্বামী রাধাশ্যামের মিলন গান গাহিয়া কীর্তন সমাপ্ত করিলেন।
=============

Post a Comment

0 Comments