চতুর্থ ভাগ -শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-অষ্টাদশ খণ্ড

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

অষ্টাদশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাম, বাবুরাম, মাস্টার, চুনি, অধর, ভবনাথ, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

চতুর্থ ভাগ -শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-অষ্টাদশ খণ্ড

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর
শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত — ঘোষপাড়া ও কর্তাভজাদের মত 

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সেই ঘরে নিজের আসনে ছোট খাটটিতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা এগারটা হইবে, এখনও তাঁহার সেবা হয় নাই।

গতকল্য শনিবার ঠাকুর শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে ভক্তসঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। হরিনাম-কীর্তন মহোৎসব করিয়া সকলকে ধন্য করিয়াছিলেন। আজ এখানে শ্যামদাসের কীর্তন হইবে। ঠাকুরের কীর্তনানন্দ দেখিবার জন্য অনেক ভক্তের সমাগম হইতেছে।

প্রথমে বাবুরাম, মাস্টার, শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণ, মনোমোহন, ভবনাথ, কিশোরী। তৎপরে চুনিলাল, হরিপদ প্রভৃতি; ক্রমে মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, রাম, সুরেন্দ্র, তারক, অধর, নিরঞ্জন। লাটু, হরিশ ও হাজরা আজকাল দক্ষিণেশ্বরেই থাকেন। শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তী বিষ্ণুঘরে সেবা করেন। তিনিও মাঝে মাঝে আসিয়া ঠাকুরের তত্ত্বাবধান করেন। লাটু, হরিশ ঠাকুরের সেবা করেন। আজ রবিবার, ভাদ্র কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি, ২৩শে ভাদ্র, ১২৯১। ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪।

মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলে পর ঠাকুর বলিতেছেন, “কই নরেন্দ্র এলো না?”

নরেন্দ্র সেদিন আসিতে পারেন নাই। শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণটি রামপ্রসাদের গানের বই আনিয়াছেন ও সেই পুস্তক হইতে মাঝে মাঝে গান পড়িয়া ঠাকুরকে শুনাইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মণের প্রতি) — কই পড় না?

ব্রাহ্মণ — বসন পরো, মা বসন পরো, মা বসন পরো।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-সব রাখো, আকাট বিকাট! এমন পড় যাতে ভক্তি হয়।

ব্রাহ্মণ — কে জানে কালী কেমন ষড়্‌দর্শনে না পায় দর্শন।

[ঠাকুরের ‘দরদী’ — পরমহংস, বাউল ও সাঁই ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কাল অধর সেনের ভাবাবস্থায় একপাশে থেকে পায়ে ব্যথা হয়েছিল। তাই তো বাবুরামকে নিয়ে যাই। দরদী!

এই বলিয়া ঠাকুর গান গাইতেছেন:

মনের কথা কইবো কি সই কইতে মানা। দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না ৷৷
মনের মানুষ হয় যে-জনা, নয়নে তার যায় গো চেনা,
সে দু-এক জনা; সে যে রসে ভাসে প্রেমে ডোবে,
কচ্ছে রসের বেচাকেনা। (ভাবের মানুষ)
মনের মানুষ মিলবে কোথা, বগলে তার ছেঁড়া কাঁথা;
ও সে কয় না গো কথা; ভাবের মানুষ উজান পথে, করে আনাগোনা।
(মনের মানুষ, উজান পথে করে আনাগোনা)।

“বাউলের এই সব গান। আবার আছে —

দরবেশে দাঁড়ারে, সাধের করোয়া ধারী,
দাঁড়ারে, তোর রূপ নেহারি!

“শাক্তমতের সিদ্ধকে বলে কৌল। বেদান্তমতে বলে পরমহংস। বাউল বৈষ্ণবদের মতে বলে সাঁই। ‘সাঁইয়ের পর আর নাই!’

“বাউল সিদ্ধ হলে সাঁই হয়। তখন সব অভেদ। অর্ধেক মালা গোহাড়, অর্ধেক মালা তুলসীর। ‘হিন্দুর নীর — মুসলমানের পীর’।”

[আলেখ, হাওয়ার খপর, পইঠে, রসের কাজ, খোলা নামা ]

“সাঁইয়েরা বলে — আলেখ! আলেখ! বেদমতে বলে ব্রহ্ম; ওরা বলে আলেখ। জীবদের বলে — ‘আলেখে আসে আলেখে যায়’; অর্থাৎ জীবাত্মা অব্যক্ত থেকে এসে তাইতে লয় হয়!

“তারা বলে, হাওয়ার খবর জান?

“অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ হলে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না — এদের ভিতর দিয়ে যে মহাবায়ু উঠে, তাহার খবর!

“জিজ্ঞাসা করে, কোন্‌ পইঠেতে আছ? — ছটা পইঠে — ষট্‌চক্র।

“যদি বলে পঞ্চমে আছে, তার মানে যে, বিশুদ্ধ চক্রে মন উঠেছে।

(মাস্টারের প্রতি) — “তখন নিরাকার দর্শন। যেমন গানে আছে।”

এই বলিয়া ঠাকুর একটু সুর করিয়া বলিতেছেন — ‘তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো অম্বুজে আকাশ। সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ।’

[পূর্বকথা — বাউল ও ঘোষপাড়ার কর্তাভজাদের আগমন ]

“একজন বাউল এসেছিল। তা আমি বললাম, ‘তোমার রসের কাজ সব হয়ে গেছে? — খোলা নেমেছে?’ যত রস জ্বাল দেবে, তত রেফাইন (refine) হবে। প্রথম, আকের রস — তারপর গুড় — তারপর দোলো — তারপর চিনি — তারপর মিছরি, ওলা এই সব। ক্রমে ক্রমে আরও রেফাইন হচ্ছে।

“খোলা নামবে কখন? অর্থাৎ সাধন শেষ হবে কবে? — যখন ইন্দ্রিয় জয় হবে — যেমন জোঁকের উপর চুন দিলে জোঁক আপনি খুলে পড়ে যাবে — ইন্দ্রিয় তেমনি শিথিল হয়ে যাবে। রমনীর সঙ্গে থাকে না করে রমণ।

“ওরা অনেকে রাধাতন্ত্রের মতে চলে। পঞ্চতত্ত্ব নিয়ে সাধন করে পৃথিবীতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব, — মল, মূত্র, রজ, বীজ — এই সব তত্ত্ব! এ-সব সাধন বড় নোংরা সাধন; যেমন পায়খানার ভিতর দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকা!

“একদিন আমি দালানে খাচ্ছি। একজন ঘোষপাড়ার মতের লোক এলো। এসে বলছে, ‘তুমি খাচ্ছ, না কারুকে খাওয়াচ্ছ?’ অর্থাৎ যে সিদ্ধ হয় সে দেখে যে, অন্তরে ভগবান আছেন!

“যারা এ মতে সিদ্ধ হয়, তারা অন্য মতের লোকদের বলে ‘জীব’। বিজাতীয় লোক থাকলে কথা কবে না। বলে, এখানে ‘জীব’ আছে।

[পূর্বকথা — জন্মভূমি দর্শন; সরী পাথরের বাড়ি হৃদুসঙ্গে ]

“ও-দেশে এই মতের লোক একজন দেখেছি। সরী (সরস্বতী) পাথর — মেয়েমানুষ। এ মতের লোকে পরস্পরের বাড়িতে খায়, কিন্তু অন্য মতের লোকের বাড়ি খাবে না। মল্লিকরা সরী পাথরের বাড়িতে গিয়ে খেলে তবু হৃদের বাড়িতে খেলে না। বলে ওরা ‘জীব’। (হাস্য)

“আমি একদিন তার বাড়িতে হৃদের সঙ্গে বেড়াতে গিছলাম। বেশ তুলসী বন করেছে। কড়াই মুড়ি দিলে, দুটি খেলুম। হৃদে অনেক খেয়ে ফেললে, — তারপর অসুখ!

“ওরা সিদ্ধাবস্থাকে বলে সহজ অবস্থা। একথাকের লোক আছে, তারা ‘সহজ’ ‘সহজ’ করে চ্যাঁচায়। সহজাবস্থার দুটি লক্ষণ বলে। প্রথম — কৃষ্ণগন্ধ গায়ে থাকবে না। দ্বিতীয় — পদ্মের উপর অলি বসবে, কিন্তু মধু পান করবে না। ‘কৃষ্ণগন্ধ’ নাই, — এর মানে ঈশ্বরের ভাব সমস্ত অন্তরে, — বাহিরে কোন চিহ্ন নাই, — হরিনাম পর্যন্ত মুখে নাই। আর একটির মানে, কামিনীতে আসক্তি নাই — জিতেন্দ্রিয়।

“ওরা ঠাকুরপূজা, প্রতিমাপূজা — এ-সব লাইক করে না, জীবন্ত মানুষ চায়। তাই তো ওদের একথাকের লোককে বলে কর্তাভজা, অর্থাৎ যারা কর্তাকে — গুরুকে — ঈশ্বরবোধে ভজনা করে — পূজা করে।”

==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর

শ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্বধর্ম-সমন্বয়
Why all scriptures — all Religions — are true

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখছো কত রকম মত! মত, পথ। অনন্ত মত অনন্ত পথ!

ভবনাথ — এখন উপায়!

শ্রীরামকৃষ্ণ — একটা জোর করে ধরতে হয়। ছাদে গেলে পাকা সিঁড়িতে উঠা যায়, একখানা মইয়ে উঠা যায়, দড়ির সিঁড়িতে উঠা যায়; একগাছা দড়ি দিয়ে, একগাছা বাঁশ দিয়ে উঠা যায়। কিন্তু এতে খানিকটা পা, ওতে খানিকটা পা দিলে হয় না। একটা দৃঢ় করে ধরতে হয়। ঈশ্বরলাভ করতে হলে, একটা পথ জোর করে ধরে যেতে হয়।

“আর সব মতকে এক-একটি পথ বলে জানবে। আমার ঠিক পথ, আর সকলের মিথ্যা — এরূপ বোধ না হয়। বিদ্বেষভাব না হয়।”

[“আমি কোন্‌ পথের?” কেশব, শশধর ও বিজয়ের মত ]

“আচ্ছা, আমি কোন্‌ পথের? কেশব সেন বলত, আপনি আমাদেরই মতের, — নিরাকারে আসছেন। শশধর বলে, ইনি আমাদের। বিজয়ও (গোস্বামী) বলে, ইনি আমাদের মতের লোক।”

ঠাকুর কি বলিতেছেন যে, আমি সব পথ দিয়াই ভগবানের নিকট পৌঁছিয়াছি — তাই সব পথের খবর জানি? আর সকল ধর্মের লোক আমার কাছে এসে শান্তি পাবে?

ঠাকুর পঞ্চবটীর দিকে মাস্টার প্রভৃতি দু-একটি ভক্তের সঙ্গে যাইতেছেন — মুখ ধুইবেন। বেলা বারটা, এইবার বান আসিবে। তাই শুনিয়া ঠাকুর পঞ্চবটীর পথে একটু অপেক্ষা করিতেছেন।

[ভাব মহাভাবের গূঢ় তত্ত্ব — গঙ্গার জোয়ার-ভাটা দর্শন ]

ভক্তদের বলিতেছেন — “জোয়ার-ভাটা কি আশ্চর্য!

“কিন্তু একটি দেখো, — সমুদ্রের কাছে নদীর ভিতর জোয়ার-ভাটা খেলে। সমুদ্র থেকে অনেক দূর হলে একটানা হয়ে যায়। এর মানে কি? — ওই ভাবটা আরোপ কর। যারা ঈশ্বরের খুব কাছে, তাদের ভিতরই ভক্তি, ভাব — এই সব হয়; আবার দু-একজনের (ঈশ্বরকোটির) মহাভাব, প্রেম — এ-সব হয়।

(মাস্টারের প্রতি) — “আচ্ছা, জোয়ার-ভাটা কেন হয়?”

মাস্টার — ইংরেজী জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলে যে, সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে ওইরূপ হয়।

এই বলিয়া মাস্টার মাটিতে অঙ্ক পাতিয়া পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্যের গতি দেখাইতেছেন। ঠাকুর একটু দেখিয়াই বলিতেছেন, “থাক, ওতে আমার মাথা ঝনঝন করে!”

কথা কহিতে কহিতে বান ডাকিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে জলোচ্ছ্বাস — শব্দ হইতে লাগিল। ঠাকুরবাড়ির তীরভূমি আঘাত করিতে করিতে উত্তর দিকে বান চলিয়া গেল।

ঠাকুর একদৃষ্টে দেখিতেছেন। দূরের নৌকা দেখিয়া বালকের ন্যায় বলিয়া উঠিলেন — দেখো, দেখো, ওই নৌকাখানি বা কি হয়!

ঠাকুর পঞ্চবটীমূলে মাস্টারের সহিত কথা কহিতে কহিতে আসিয়া পড়িয়াছেন। একটি ছাতা সঙ্গে, সেইটি পঞ্চবটীর চাতালে রাখিয়া দিলেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণের মতো দেখেন, তাই বড় ভালবাসেন। নারাণ ইস্কুলে পড়ে, এবার তাহারই কথা কহিতেছেন।

[মাস্টারের শিক্ষা, টাকার সদ্ব্যবহার — নারাণের জন্য চিন্তা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — নারাণের কেমন স্বভাব দেখেছ? সকলের সঙ্গে মিশতে পারে — ছেলে-বুড়ো সকলের সঙ্গে! এটি বিশেষ শক্তি না হলে হয় না। আর সব্বাই তাকে ভালবাসে। আচ্ছা, সে ঠিক সরল কি?

মাস্টার — আজ্ঞা, খুব সরল বলে বোধ হয়

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ওখানে নাকি যায়?

মাস্টার — আজ্ঞা, দু-একবার গিছল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — একটি টাকা তুমি তাকে দেবে? না কালীকে বলব?

মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ তো, আমি দিব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বেশ তো — ঈশ্বরে যাদের অনুরাগ আছে, তাদের দেওয়া ভাল। টাকার সদ্ব্যবহার হয়। সব সংসারে দিলে কি হবে?

কিশোরীর ছেলেপুলে হয়েছে। কম মাহিনা — চলে না। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “নারাণ বলেছিল, কিশোরীর একটা কর্ম করে দেব। নারাণকে একবার মনে করে দিও না।”

মাস্টার পঞ্চবটীতে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ পরে ঝাউতলা হইতে ফিরিলেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “বাহিরে একটা মাদুর পাত্তে বল তো। আমি একটু পরে যাচ্ছি — একটু শোব।”

ঠাকুর ঘরে পৌঁছিয়া বলিতেছেন, “তোমাদের কারুরই ছাতাটা আনতে মনে নাই। (সকলের হাস্য) ব্যস্তবাগীশ লোক নিজের কাছের জিনিসও দেখতে পায় না! একজন আর-একটি লোকের বাড়িতে টিকে ধরাতে গিছল, কিন্তু হাতে লণ্ঠন জ্বলছে!

“একজন গামছা খুঁজে খুঁজে তারপর দেখে, কাঁধেতেই রয়েছে!”

[ঠাকুরের মধ্যাহ্ন-সেবা ও বাবুরামাদি সাঙ্গোপাঙ্গ ]

ঠাকুরের জন্য মা-কালীর অন্নপ্রসাদ আনা হইল। ঠাকুর সেবা করিবেন। বেলা প্রায় একটা। আহারান্তে একটু বিশ্রাম করিবেন। ভক্তরা তবুও ঘরে সব বসিয়া আছেন। বুঝাইয়া বলার পর বাহিরে গিয়া বসিলেন। হরিশ, নিরঞ্জন, হরিপদ রান্না-বাড়ি গিয়া প্রসাদ পাইবেন। ঠাকুর হরিশকে বলিতেছেন, তোদের জন্য আমসত্ত্ব নিয়ে যাস।

ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন, বাবুরাম, কাছে একটু আয় না? বাবুরাম বলিলেন, আমি পান সাজছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন — রেখে দে পান সাজা।

ঠাকুর বিশ্রাম করিতেছেন। এদিকে বকুলতলায় ও পঞ্চবটীতলায় কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন, — মুখুজ্জেরা, চুনিলাল, হরিপদ, ভবনাথ, তারক। তারক শ্রীবৃন্দাবন হইতে সবে ফিরিয়াছেন। ভক্তরা তাঁর কাছে বৃন্দাবনের গল্প শুনিতেছেন। তারক নিত্যগোপালের সহিত বৃন্দাবনে এতদিন ছিলেন।

=============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর

ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে — ভক্তসঙ্গে নৃত্য

ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। সম্প্রদায় লইয়া শ্যামদাস মাথুর কীর্তন গাইতেছেন:

“নাথ দরশসুখে ইত্যাদি —

“সুখময় সায়র, মরুভূমি ভেল। জলদ নেহারই, চাতকী মরি গেল।”

শ্রীমতীর এই বিরহদশা বর্ণনা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। তিনি ছোট খাটটির উপর নিজের আসনে, বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাম, মনোমোহন, মাস্টার, সুরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। কিন্তু গান ভাল জমিতেছে না।

কোন্নগরের নবাই চৈতন্যকে ঠাকুর কীর্তন করিতে বলিলেন। নবাই মনোমোহনের পিতৃব্য। পেনশন লইয়া কোন্নগরে গঙ্গাতীরে ভজন-সাধন করেন। ঠাকুরকে প্রায় দর্শন করিতে আসেন।

নবাই উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর আসন ত্যাগ করিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। অমনি নবাই ও ভক্তেরা তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নৃত্য ও কীর্তন করিতে লাগিলেন। কীর্তন বেশ জমিয়া গেল। মহিমাচরণ পর্যন্ত ঠাকুরের সঙ্গে নৃত্য করিতেছেন।

কীর্তনান্তে ঠাকুর নিজের আসনে উপবেশন করিলেন। হরিনামের পর এবার আনন্দময়ী মায়ের নাম করিতেছেন। ঠাকুর ভাবে মত্ত হইয়া মার নাম করিতেছেন। নাম করিবার সময় ঊর্ধ্বদৃষ্টি।

গান – গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না।

গান – ভাবিলে ভাবের উদয় হয়!
যেমন ভাব, তেমনি লাভ, মূল সে প্রত্যয়।
যে-জন কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময় ৷৷
কালীপদ সুদাহ্রদে চিত্ত যদি রয়।
পূজা হোম জপ বলি কিছুই কিছু নয় ৷৷

গান – তোদের খ্যাপার হাট বাজার মা (তারা)।
কব গুণের কথা কার মা তোদের ৷৷
গজ বিনে গো আরোহণে ফিরিস কদাচার।
মণি-মুক্তা ফেলে পরিস গলে নরশির হার ৷৷
শ্মশানে-মশানে ফিরিস কার বা ধারিস ধার।
রামপ্রসাদকে ভবঘোরে করতে হবে পার ৷৷

গান – গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়।
কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ৷৷

গান – আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে।
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে ৷৷

গান – মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে।

গান – যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণি শ্যামা মাকে।
মন তুই দেখ, আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে ৷৷

ঠাকুর এই গানটি গাইতে গাইতে দণ্ডায়মান হইলেন। মার প্রেমে উন্মত্তপ্রায়! ‘আদরিণী শ্যামা মাকে হৃদয়ে রেখো।’ — এ-কথাটি যেন ভক্তদের বারবার বলিতেছেন।

ঠাকুর এইবার যেন সুরাপানে মত্ত হইয়াছেন। নাচিতে নাচিতে আবার গান গাহিতেছেন:

মা কি আমার কালো রে।
কালোরূপ দিগম্বরী, হৃদিপদ্ম করে আলো রে!

ঠাকুর গাইতে গাইতে বড় টলিতেছেন দেখিয়া নিরঞ্জন তাঁহাকে ধারণ করিতে গেলেন। ঠাকুর মৃদুস্বরে “য়্যাই! শালা ছুঁসনে” বলিয়া বারণ করিতেছেন। ঠাকুর নাচিতেছেন দেখিয়া ভক্তেরা দাঁড়াইলেন। ঠাকুর মাস্টারের হস্ত ধারণ করিয়া বলিতেছেন, “য়্যাই শালা নাচ।”

[বেদান্তবাদী মহিমার প্রভুসঙ্গে সংকীর্তনে নৃত্য ও ঠাকুরের আনন্দ ]

ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। ভাবে গরগর মাতোয়ারা!

ভাব কিঞ্চিৎ উপশম হইলে বলিতেছেন — ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ ওঁ কালী। আবার বলিতেছেন, তামাক খাব। ভক্তেরা অনেকে দাঁড়াইয়া আছেন। মহিমাচরণ দাঁড়াইয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — আপনারা বোসো।

“আপনি বেদ থেকে একটু কিছু শুনাও।

মহিমাচরণ আবৃত্তি করিতেছেন — ‘জয় জজ্বমান’ ইত্যাদি।

আবার মহানির্বাণতন্ত্র হিতে স্তব আবৃত্তি করিতেছেন —

ওঁ নমস্তে সতে তে জগৎকারণায়, নমস্তে চিতে সর্বলোকাশ্রয়ায়।
নমোঽদ্বৈততত্ত্বায় মুক্তিপ্রদায়, নমো ব্রহ্মণে ব্যাপিনে শাশ্বতায় ৷৷
ত্বমেকং শরণ্যং ত্বমেকং বরেণ্যং, ত্বমেকং জগৎপালকং স্বপ্রকাশম্‌।
ত্বমেকং জগৎকতৃপাতৃপ্রহর্তৃ, ত্বমেকং পরং নিশ্চলং নির্বিকল্পম্‌ ৷৷
ভয়ানাং ভয়ং ভীষণং ভীষণানাং, গতিঃ প্রাণিনাং পাবণং পাবনানাম্‌।
মহোচ্চৈঃপদানাং নিয়ন্তৃ ত্বমেকং, পরেষাং পরং রক্ষণং রক্ষণানাম্‌ ৷৷
বয়ন্ত্বাং সমরামো বয়ন্ত্বান্‌ভজামো, বয়ন্ত্বাং জগৎসাক্ষিরূপং নমামঃ।
সদেকং নিধানং নিরালম্বমীশং, ভবাম্ভোধিপোতং শরণ্যং ব্রজামঃ ৷৷

ঠাকুর হাতজোড় করিয়া স্তব শুনিলেন। পাঠান্তে ভক্তিভরে নমস্কার করিলেন। ভক্তেরাও নমস্কার করিলেন।

অধর কলিকাতা হইতে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আজ খুব আনন্দ হল! মহিম চক্রবর্তী এদিকে আসছে। হরিনামে আনন্দ কেমন দেখলে! না?

মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।

মহিমাচরণ জ্ঞানচর্চা করেন। তিনি আজ হরিনাম করেছেন, আর কীর্তনসময়ে নৃত্য করিয়াছেন — তাই ঠাকুর আহ্লাদ করিতেছেন।

সন্ধ্যা আগতপ্রায়। ভক্তেরা অনেকেই ক্রমে ক্রমে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর

প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি — অধরের কর্ম — বিষয়ীর উপাসনা ও চাকরি

সন্ধ্যা হইল। ফরাশ দক্ষিণের লম্বা বারান্দায় ও পশ্চিমের গোল বারান্দায় আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধুনা দেওয়া হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে চাঁদ উঠিলেন। মন্দিরপ্রাঙ্গণ, উদ্যানপথ, গঙ্গাতীর, পঞ্চবটী, বৃক্ষশীর্ষ, জ্যোৎস্নায় হাসিতে লাগিল।

ঠাকুর নিজাসনে বসিয়া আবিষ্ট হইয়া মার নাম ও চিন্তা করিতেছেন।

অধর আসিয়া বসিয়াছেন। ঘরে মাস্টার ও নিরঞ্জনও আছেন। ঠাকুর অধরের সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি গো তুমি এখন এলে! কত কীর্তন নাচ হয়ে গেল। শ্যামদাসের কীর্তন — রামের ওস্তাদ। কিন্তু আমার তত ভাল লাগল না, উঠতে ইচ্ছা হল না। ও লোকটার কথা তারপর শুনলাম। গোপীদাসের বদলী বলেছে — আমার মাথায় যত চুল তত উপপত্নী করেছে। (সকলের হাস্য) তোমার কর্ম হল না?

অধর ডেপুটি, তিন শত টাকা বেতন পান। কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান-এর কর্মের জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন — মাহিনা হাজার টাকা। কর্মের জন্য অধর কলিকাতার অনেক বড় বড় লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন।

[নিবৃত্তিই ভাল — চাকরির জন্য হীনবুদ্ধি বিষয়ীর উপাসনা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও নিরঞ্জনের প্রতি) — হাজরা বলেছিল — অধরের কর্ম হবে, তুমি একটু মাকে বল। অধরও বলেছিল। আমি মাকে একটু বলেছিলাম — ‘মা, এ তোমার কাছে আনাগোনা কচ্ছে, যদি হয় তো হোক না।’ কিন্তু সেই সঙ্গে মাকে বলেছিলাম — ‘মা, কি হীনবুদ্ধি! জ্ঞান, ভক্তি না চেয়ে তোমার কাছে এই সব চাচ্ছে!’

(অধরের প্রতি) — “কেন হীনবুদ্ধি লোকগুনোর কাছে অত আনাগোনা করলে? এত দেখলে শুনলে! — সাতকাণ্ড রামায়ণ, সীতা কার ভার্যে! অমুক মল্লিক হীনবুদ্ধি। আমার মাহেশে যাবার কথায় চলতি নৌকা বন্দোবস্ত করেছিল, — আর বাড়িতে গেলেই হৃদুকে বলত — হৃদু, গাড়ি রেখেছ?”

অধর — সংসার করতে গেলে এ-সব না করলে চলে না। আপনি তো বারণ করেন নাই?

[উন্মাদের পর মাহিনা সই করণার্থ খাজাঞ্চীর আহ্বান-কথা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — নিবৃত্তিই ভাল — প্রবৃত্তি ভাল নয়। এই অবস্থার পর আমার মাইনে সই করাতে ডেকেছিল — যেমন সবাই খাজাঞ্চীর কাছে সই করে। আমি বললাম — তা আমি পারব না। আমি তো চাচ্ছি না। তোমাদের ইচ্ছা হয় আর কারুকে দাও।

“এক ঈশ্বরের দাস। আবার কার দাস হব?

“ — মল্লিক, আমার খেতে বেলা হয় বলে, রাঁধবার বামুন ঠিক করে দিছল। একমাস একটাকা দিছল। তখন লজ্জা হল। ডেকে পাঠালেই ছুটতে হত। — আপনি যাই, সে এক।

“হীনবুদ্ধি লোকের উপাসনা। সংসারে এই সব — আরও কত কি?”

[পূর্বকথা — উন্মাদের পর ঠাকুরের প্রার্থনা — সন্তোষ — Contentment]

“এই অবস্থা যাই হলো, রকম-সকম দেখে অমনি মাকে বললাম — মা, ওইখানেই মোড় ফিরিয়ে দাও! — সুধামুখীর রান্না — আর না, আর না — খেয়ে পায় কান্না!” (সকলের হাস্য)

[বাল্য — কামারপুকুরে ঈশ্বর ঘোষাল ডিপুটি দর্শন কথা ]

“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। লোকে পঞ্চাশ টাকা একশ টাকা মাইনের জন্য লালায়িত! তুমি তিনশ টাকা পাচ্ছ। ও-দেশে ডিপুটি আমি দেখেছিলাম। ঈশ্বর ঘোষাল। মাথায় তাজ — সব হাড়ে কাঁপে! ছেলেবেলায় দেখেছিলাম। ডিপুটি কি কম গা!

“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। একজনের চাকরি কল্লেই মন খারাপ হয়ে যায়, আবার পাঁচজনের।”

[চাকরির নিন্দা, শম্ভু ও মথুরের আদর — নরেন্দ্র হেডমাস্টার ]

“একজন স্ত্রীলোক একজন মুছলমানের উপর আসক্ত হয়ে, তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য ডেকেছিল। মুছলমানটি সাধুলোক ছিল, সে বললে — আমি প্রস্রাব করব, আমার বদনা আনতে যাই। স্ত্রীলোকটি বললে — তা এইখানেই হবে, আমি বদনা দিব এখন। সে বললে — তা হবে না। আমি যে বদনার কাছে একবার লজ্জা ত্যাগ করেছি, সেই বদনাই ব্যবহার করব, — আবার নূতন বদনার কাছে নির্লজ্জ হব না। এই বলে সে চলে গেল। মাগীটারও আক্কেল হল। সে বদনার মানে বুঝলে উপপতি।”

নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর বড়ই কষ্টে পড়িয়াছেন। মা ও ভাইদের ভরণপোষণের জন্য তিনি কাজকর্ম খুঁজিতেছেন। বিদ্যাসাগরের বউবাজার স্কুলে দিন কতক হেডমাস্টারের কর্ম করিয়াছিলেন।

অধর — আচ্ছা, নরেন্দ্র কর্ম করবে কি না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ — সে করবে। মা ও ভাইরা আছে।

অধর — আচ্ছা, নরেন্দ্রের পঞ্চাশ টাকায়ও চলে, একশ টাকায়ও চলে। নরেন্দ্র একশ টাকার জন্য চেষ্টা করবে কি না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিষয়ীরা ধনের আদর করে, মনে করে, এমন জিনিস আর হবে না।

শম্ভু বললে — ‘এই সমস্ত বিষয় তাঁর পাদপদ্মে দিয়ে যাব, এইটি ইচ্ছা’ তিনি কি বিষয় চান? তিনি চান ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য।

“গয়না চুরির সময় সেজোবাবু বললে — ‘ও ঠাকুর! তুমি গয়না রক্ষা করতে পারলে না? হংসেশ্বরী কেমন রক্ষা করেছিল!”

[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম — মথুরের তালুক লিখে দিবার পরামর্শ ]

“একখানা তালুক আমার নামে লিখে দেবে (সেজোবাবু) বলেছিল। আমি কালীঘর থেকে শুনলাম। সেজোবাবু আর হৃদে একসঙ্গে পরামর্শ কচ্ছিল। আমি এসে সেজোবাবুকে বললাম, — দেখো, অমন বুদ্ধি করো না! — এতে আমার ভারী হানি হবে!”

অধর — যা বলেছেন, সৃষ্টির পর থেকে ছটি-সাতটি হদ্দ ওরূপ হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন, ত্যাগী আছে বইকি? ঐশ্বর্য ত্যাগ করলেই লোকে জানতে পারে। এমনি আছে — লোকে জানে না। পশ্চিমে নাই?

অধর — কলকাতার মধ্যে একটি জানি — দেবেন্দ্র ঠাকুর।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল! ও যা ভোগ করেছে, অমন কে করেছে! — যখন সেজোবাবু সঙ্গে ওর বাড়িতে গেলাম, দেখলাম, ছোট ছোট ছেলে অনেক — ডাক্তার এসেছে, ঔষধ লিখে দিচ্ছে। যার আট ছেলে আবার মেয়ে, সে ঈশ্বরচিন্তা করবে না তো কে করবে, এত ঐশ্বর্য ভোগ করার পর যদি ঈশ্বরচিন্তা না করত, লোকে বলত ধিক্‌!

নিরঞ্জন — দ্বারকানাথ ঠাকুরের ধার উনি সব শোধ করেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — রেখে দে ও-সব কথা! আর জ্বালাস নে! ক্ষমতা থেকেও যে বাপের ধার শোধ করে না, সে কি আর মানুষ?

“তবে সংসারীরা একেবারে ডুবে থাকে, তাদের তুলনায় খুব ভাল — তাদের শিক্ষা হবে।

“ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত আর সংসারীভক্ত অনেক তফাত। ঠিক ঠিক সন্ন্যাসী — ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত — মৌমাছির মতো। মৌমাছি ফুল বই আর কিছুতে বসবে না। মধুপান বই আর কিছু পান করবে না। সংসারীভক্ত অন্য মাছির মতো, সন্দেশেও বসছে, আবার পচা ঘায়েও বসছে। বেশ ঈশ্বরের ভাবেতে রয়েছে, আবার কামিনী-কাঞ্চন লয়ে মত্ত হয়।

“ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত চাতকের মতো। চাতক স্বাতী নক্ষত্রের মেঘের জল বই আর কিছু খাবে না! সাত সমুদ্র নদী ভরপুর! সে অন্য জল খাবে না! কামিনী-কাঞ্চন স্পর্শ করবে না! কামিনী-কাঞ্চন কাছে রাখবে না, পাছে আসক্তি হয়।”

============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর

চৈতন্যদেব, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও লোকমান্য

অধর — চৈতন্যও ভোগ করেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (চমৎকৃত হইয়া) — কি ভোগ করেছিলেন?

অধর — অত পণ্ডিত! কত মান!

শ্রীরামকৃষ্ণ — অন্যের পক্ষে মান। তাঁর পক্ষে কিছু নয়!

“তুমি আমায় মানো আর নিরঞ্জন মানে, আমার পক্ষে এক — সত্য করে বলছি। একজন টাকাওয়ালা লোক হাতে থাকবে, এ মনে হয় না। মনোমোহন বললে, ‘সুরেন্দ্র বলেছে, রাখাল এঁর কাছে থাকে — নালিশ চলে।’ আমি বললাম, ‘কে রে সুরেন্দ্র? তার সতরঞ্চ আর বালিশ এখানে আছে। আর সে টাকা দেয়’?”

অধর — দশ টাকা করে মাসে বুঝি দেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — দশ টাকায় দু মাস হয়। ভক্তেরা এখানে থাকে — সে ভক্তসেবার জন্য দেয়। সে তার পুণ্য, আমার কি? আমি যে রাখাল, নরেন্দ্র এদের ভালবাসি, সে কি কোন নিজের লাভের জন্য?

মাস্টার — মার ভালবাসার মতো।

শ্রীরামকৃষ্ণ — মা তবু চাকরি করে খাওয়াবে বলে অনেকটা করে। আমি এদের যে ভালবাসি, সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখি! — কথায় নয়।

[ঠিক ঠিক ত্যাগীর ভার ঈশ্বর লন — ‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তঃ’ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি) — শোনো! আলো জ্বাললে বাদুলে পোকার অভাব হয় না! তাঁকে লাভ কল্লে তিনি সব জোগাড় করে দেন — কোন অভাব রাখেন না। তিনি হৃদয়মধ্যে এলে সেবা করবার লোক অনেক এসে জোটে।

“একটি ছোকরা সন্ন্যাসী গৃহস্থবাড়ি ভিক্ষা করতে গিছিল। সে আজন্ম সন্ন্যাসী। সংসারের বিষয় কিছু জানে না। গৃহস্থের একটি যুবতী মেয়ে এসে ভিক্ষা দিলে। সন্ন্যাসী বললে, মা এর বুকে কি ফোঁড়া হয়েছে? মেয়েটির মা বললে, না বাবা! ওর পেটে ছেলে হবে বলে ঈশ্বর স্তন করে দিয়েছেন — ওই স্তনের দুধ ছেলে খাবে। সন্ন্যাসী তখন বললে, তবে আর ভাবনা কি? আমি আর কেন ভিক্ষা করব? যিনি আমায় সৃষ্টি করেছেন তিনি আমায় খেতে দেবেন।

“শোনো! যে উপপতির জন্য সব ত্যাগ করে এল, সে বলবে না; শ্যালা, তোর বুকে বসব আর খাব।”

[তোতাপুরীর গল্প — রাজার সাধুসেবা — ৺কাশীর দুর্গাবাড়ির নিকট নানকপন্থীর মঠে ঠাকুরের মোহন্তদর্শন ১৮৬৮ খ্রীঃ ]

“ন্যাংটা বললে, কোন রাজা সোনার থালা, সোনার গেলাস দিয়ে সাধুদের খাওয়ালে। কাশীতে মঠে দেখলাম, মোহন্তর কত মান — বড় বড় খোট্টারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে, কি আজ্ঞা!

“ঠিক ঠিক সাধু — ঠিক ঠিক ত্যাগী সোনার থালও চায় না, মানও চায় না। তবে ঈশ্বর তাদের কোন অভাব রাখেন না! তাঁকে পেতে গেলে যা যা দরকার, সব জোগাড় করে দেন। (সকলে নিঃশব্দ)

“আপনি হাকিম — কি বলবো! — যা ভালো বোঝ তাই করো। আমি মূর্খ।

অধর (সহাস্যে, ভক্তদিগকে) — উনি আমাকে এগজামিন কচ্ছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — নিবৃত্তিই ভাল। দেখ না আমি সই কল্লাম না। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু!

হাজরা আসিয়া ভক্তদের কাছে মেঝেতে বসিলেন। হাজরা কখন কখন সোঽহং সোঽহম্‌ করেন! লাটু প্রভৃতি ভক্তদের বলেন, তাঁকে পূজা করে কি হয়! — তাঁরই জিনিস তাঁকে দেওয়া। একদিন নরেন্দ্রকেও তিনি ওই কথা বলিয়াছিলেন। ঠাকুর হাজরাকে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — লাটুকে বলেছিলাম, কে কারে ভক্তি করে।

হাজরা — ভক্ত আপনি আপনাকেই ডাকে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ তো খুব উঁচু কথা। বলি রাজাকে বৃন্ধাবলী বলেছিলেন, তুমি ব্রহ্মণ্যদেবকে কি ধন দেবে?

“তুমি যা বলছ, ওইটুকুর জন্যই সাধন-ভজন — তাঁর নামগুণগান।

“আপনার ভিতর আপনাকে দেখতে পেলে তো সব হয়ে গেল! ওইটি দেখতে পাবার জন্যই সাধনা। আর ওই সাধনার জন্যই শরীর। যতক্ষণ না স্বর্ণপ্রতিমা ঢালাই হয়, ততক্ষণ মাটির ছাঁচের দরকার হয়। হয়ে গেলে মাটির ছাঁচটা ফেলে দেওয়া যায়। ঈশ্বরদর্শন হলে শরীরত্যাগ করা যায়।

“তিনি শুধু অন্তরে নয়। অন্তরে বাহিরে! কালীঘরে মা আমাকে দেখালেন সবই চিন্ময়! — মা-ই সব হয়েছেন! — প্রতিমা, আমি, কোশা, চুমকি, চৌকাট, মার্বেল পাথর, — সব চিন্ময়!

“এইটি সাক্ষাৎকার করবার জন্যই তাঁকে ডাকা — সাধন-ভজন — তাঁর নামগুন-কীর্তন। এইটির জন্যই তাঁকে ভক্তি করা। ওরা (লাটু প্রভৃতি) এমনি আছে — এখনও অত উচ্চ অবস্থা হয় নাই। ওরা ভক্তি নিয়ে আছে। আর ওদের (সোঽহম্‌ ইত্যাদি) কিছু বলো না।”

পাখি যেমন শাবকদের পক্ষাচ্ছাদন করিয়া রক্ষা করে, দয়াময় গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই রূপে ভক্তদের রক্ষা করিতেছেন!

অধর ও নিরঞ্জন জলযোগ করিতে বারান্দায় গেলেন। জল খাইয়া ঘরে ফিরিলেন। মাস্টার ঠাকুরের কাছে মেঝেতে বসিয়া আছেন।

[চারটে পাস ব্রাহ্ম ছোকরার কথা — “এঁর সঙ্গে আবার তর্ক-বিচার” ]

অধর (সহাস্যে) — আমাদের এত কথা হল, ইনি (মাস্টার) একটিও কথা কন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশবের দলের একটি চারটে পাস করা ছোকরা (বরদা?), সব্বাই আমার সঙ্গে তর্ক করছে, দেখে — কেবল হাসে। আর বলে, এঁর সঙ্গে আবার তর্ক! কেশব সেনের ওখানে আর-একবার তাকে দেখলাম — কিন্তু তেমন চেহারা নাই।

রাম চক্রবর্তী, বিষ্ণুঘরের পূজারী, ঠাকুরের ঘরে আসিলেন। ঠাকুর বলিতেছেন — “দেখো রাম! তুমি কি দয়ালকে বলেছ মিছরির কথা? না, না, ও আর বলে কাজ নাই। অনেক কথা হয়ে গেছে।

[ঠাকুরের রাত্রের আহার — “সকলের জিনিস খেতে পারি না” ]

রাত্রে ঠাকুরের আহার একখানি-দুখানি মা-কালীর প্রসাদী লুচি ও একটু সুজির পায়েস। ঠাকুর মেঝেতে আসনে সেবা করিতে বসিয়াছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন, লাটুও ঘরে আছেন। ভক্তেরা সন্দেশাদি মিষ্টান্ন আনিয়াছিলেন। সন্দেশ একটি স্পর্শ করিয়া ঠাকুর লাটুকে বলিতেছেন — ‘এ কোন্‌ শালার সন্দেশ?’ — বলিয়াই সুজির পায়েসের বাটি হইতে নিচে ফেলিয়া দিলেন। (মাস্টার ও লাটুর প্রতি) ‘ও আমি সব জানি। ওই আনন্দ চাটুজ্যেদের ছোকরা এনেছে — যে ঘোষপাড়ার মাগীর কাছে যায়।’

লাটু — এ গজা দিব?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিশোরী এনেছে।

লাটু — এ আপনার চলবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — হাঁ।

মাস্টার ইংরেজী পড়া লোক। — ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন — “সকলের জিনিস খেতে পারি না! তুমি এ-সব মানো?”

মাস্টার — আজ্ঞা, ক্রমে সব মানতে হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ

ঠাকুর পশ্চিমদিকের গোল বারান্দাটিতে হাত ধুইতে গেলেন। মাস্টার হাতে জল ঢালিয়া দিতেছেন।

শরৎকাল। চন্দ্র উদয় হওয়াতে নির্মল আকাশ ও ভাগীরথীবক্ষ ঝকমক করিতেছে। ভাটা পড়িয়াছে — ভাগীরথী দক্ষিণবাহিনী। মুখ ধুইতে ধুইতে মাস্টারকে বলিতেছেন, তবে নারাণকে টাকাটি দেবে?

মাস্টার — যে আজ্ঞা, দেব বইকি?
=========

Post a Comment

0 Comments