পঞ্চদশ খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

পঞ্চদশ খণ্ড

পঞ্চদশ খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে মে
দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ — ফলহারিণীপূজা ও বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা

[দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ, রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), অধর, হরি (স্বামী তুরীয়ানন্দ) প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বসিয়া আছেন; বেলা ১১টা হইয়াছে। রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা সেই ঘরে উপস্থিত আছেন। গত রাত্রে ৺ফলহারিণী কালীপূজা হইয়া গিয়াছে; সেই উৎসব উপলক্ষে নাটমন্দিরে শেষ রাত্রি হইতে যাত্রা হইয়াছে — বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা। শ্রীরামকৃষ্ণ সকালে মন্দিরে মাকে দর্শন করিতে গিয়া একটু যাত্রাও শুনিয়াছেন। যাত্রাওয়ালা স্নানান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন।

আজ শনিবার, ১২ই জ্যৈষ্ঠ (১২৯১), ২৪শে মে, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, অমাবস্যা।

যে গৌরবর্ণ ছোকরাটি বিদ্যা সাজিয়াছিলেন তিনি সুন্দর অভিনয় করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার সহিত আনন্দে অনেক ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন। ভক্তেরা আগ্রহের সহিত সমস্ত শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যা অভিনেতার প্রতি) — তোমার অভিনয়টি বেশ হয়েছে। যদি কেউ গাইতে, বাজাতে, নাচতে, কি একটা কোন বিদ্যাতে ভাল হয়, সে যদি চেষ্টা করে, শীঘ্রই ঈশ্বরলাভ করতে পারে।

[যাত্রাওয়ালাকে ও চানকের সিপাইদিগকে শিক্ষা — অভ্যাস যোগ; “মৃত্যু স্মরণ কর” ]

“আর তোমারা যেমন অনেক অভ্যাস করে গাইতে, বাজাতে বা নাচতে শিখ, সেইরূপ ঈশ্বরেতে মনের যোগ অভ্যাস করতে হয়; পূজা, জপ, ধ্যান — এ-সব নিয়মিত অভ্যাস করতে হয়।১

“তোমার কি বিবাহ হয়েছে? ছেলেপুলে?”

বিদ্যা — আজ্ঞা একটি কন্যা গত; আরও একটি সন্তান হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এর মধ্যে হল, গেল! তোমার এই কম বয়স। বলে — ‘সাঁজ সকালে ভাতার ম’লো কাঁদব কত রাত’। (সকলের হাস্য)

“সংসারে সুখ তো দেখেছ! যেমন আমড়া, কেবল আঁটি আর চামড়া। খেলে হয় অমলশূল।

“যাত্রাওয়ালার কাজ করছ তা বেশ। কিন্তু বড় যন্ত্রণা। এখন কম বয়স, তাই গোলগাল চেহারা। তারপর সব তুবড়ে যাবে। যাত্রাওয়ালারা প্রায় ওইরকমই হয়। গাল তোবড়া, পেট মোটা, হাতে তাগা। (সকলের হাস্য)

“আমি কেন বিদ্যাসুন্দর শুনলাম? দেখলাম — তাল, মান, গান বেশ। তারপর মা দেখিয়ে দিলেন যে নারায়ণই এই যাত্রাওয়ালাদের রূপ ধারণ করে যাত্রা করছেন।”

বিদ্যা — আজ্ঞা, কাম আর কামনা তফাত কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কাম যেন গাছের মূল, কামনা যেন ডালপালা।

“এই কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি ছয় রিপু একেবারে তো যাবে না; তাই ঈশ্বরের দিকে মোড় ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি কামনা করতে হয়, লোভ করতে হয়, তবে ঈশ্বরে ভক্তি কামনা করতে হয়, আর তাঁকে পাবার লোভ করতে হয়। যদি মদ অর্থাৎ মত্ততা করতে হয়, অহংকার করতে হয়, তাহলে আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের সন্তান এই বলে মত্ততা, অহংকার করতে হয়।

“সব মন তাঁকে না দিলে তাঁকে দর্শন হয় না।”

[ভোগান্তে যোগ — ভ্রাতৃস্নেহ ও সংসার ]

“কামিনী-কাঞ্চনে মনের বাজে খরচ হয়। এই দেখ না, ছেলেমেয়ে হয়েছে, যাত্রা করা হচ্ছে — এই সব নানা কাজে ঈশ্বরেতে মনের যোগ হয় না।

“ভোগ থাকলেই যোগ কমে যায়। ভোগ থাকলেই আবার জ্বালা। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে — অবধূত চিলকে চব্বিশ গুরুর মধ্যে একজন করেছিল। চিলের মুখে মাছ ছিল, তাই হাজার কাক তাকে ঘিরে ফেললে, যেদিকে চিল মাছ মুখে যায় সেই দিকে কাকগুলো পেছনে পেছনে কা কা করতে যায়। যখন চিলের মুখ থেকে মাছটা আপনি হঠাৎ পড়ে গেল তখন যত কাক মাছের দিকে গেল, চিলের দিকে আর গেল না।২

“মাছ অর্থাৎ ভোগের বস্তু। কাকগুলো ভাবনা চিন্তা। যেখানে ভোগ সেখানেই ভাবনা চিন্তা; ভোগ ত্যাগ হয়ে গেলেই শান্তি।

“আবার দেখ, অর্থ-ই আবার অনর্থ হয়। তোমরা ভাই ভাই বেশ আছ, কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে হিস্যে নিয়ে গোল হয়। কুকুররা গা চাটাচাটি করছে, পরস্পর বেশ ভাব। কিন্তু গৃহস্থ যদি ভাত দুটি ফেলে দেয় তাহলে পরস্পর কামড়াকামড়ি করবে।

“মাঝে মাঝে এখানে আসবে। (মাস্টার প্রভৃতিকে দেখাইয়া) এঁরা আসেন। রবিবার কিম্বা অন্য ছুটিতে আসেন।”

বিদ্যা — আমাদের রবিবার তিন মাস। শ্রাবণ, ভাদ্র আর পৌষ — বর্ষা আর ধান কাটার সময়। আজ্ঞা, আপনার কাছে আসব সে তো আমাদের ভাগ্য।

“দক্ষিণেশ্বরে আসবার সময় দুজনের কথা শুনেছিলাম — আপনার আর জ্ঞানার্ণবের।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভাইদের সঙ্গে মিল হয়ে থাকবে। মিল থাকলেই দেখতে শুনতে সব ভাল। যাত্রাতে দেখ নাই? চারজন গান গাইতেছে কিন্তু প্রত্যেকে যদি ভিন্ন সুর ধরে, তাহলে যাত্রা ভেঙে যায়।

বিদ্যা — জালের নিচে অনেক পাখি পড়েছে, যদি একসঙ্গে চেষ্টা করে একদিকে জালটা নিয়ে যায় তাহলে অনেকটা রক্ষা হয়। কিন্তু নানাদিকে যদি নানান পাখি উড়বার চেষ্টা করে তাহলে হয় না।

“যাত্রাতেও দেখা যায় মাথায় কলসী রেখেছে অথচ নাচছে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — সংসার করবে, অথচ মাথার কলসী ঠিক রাখবে, অর্থাৎ ঈশ্বরের দিকে মন ঠিক রাখবে।

“আমি চানকে পল্টনের সিপাইদিগকে বলেছিলাম, তোমরা সংসারের কাজ করবে, কিন্তু কালরূপ (মৃত্যুরূপ) ঢেঁকি হাতে পড়বে, এটি হুঁশ রেখো।

“ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা ঢেঁকি দিয়ে চিঁড়ে কাঁড়ে। একজন পা দিয়ে ঢেঁকি টেপে, আর-একজন নেড়ে চেড়ে দেয়। সে হুঁশ রাখে যাতে ঢেঁকির মুষলটা হাতের উপর না পড়ে। এদিকে ছেলেকে মাই দেয়, আর-একহাতে ভিজে ধান খোলায় ভেজে লয়। আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা হচ্ছে, ‘তোমার কাছে এত বাকী পাওনা আছে দিয়ে যেও।’

“ঈশ্বরেতে মন রেখে তেমনি সংসারে নানা কাজ করতে পার। কিন্তু অভ্যাস চাই; আর হুঁশিয়ার হওয়া চাই; তবে দুদিকে রাখা হয়।”

[আত্মদর্শন বা ঈশ্বরদর্শনের উপায় — সাধুসঙ্গ — NOT SCIENCE ]

বিদ্যা — আজ্ঞা, আত্মা যে দেহ থেকে পৃথক তার প্রমাণ কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ — প্রমাণ? ঈশ্বরকে দেখা যায়; তপস্যা করলে তাঁর কৃপায় ঈশ্বরদর্শন হয়। ঋষিরা আত্মার সাক্ষাৎকার করেছিলেন। সায়েন্‌স্‌এ ঈশ্বরতত্ত্ব জানা যায় না, তাতে কেবল এটার সঙ্গে ওটা মিশালে এই হয়; আর ওটার সঙ্গে এটা মিশালে এই হয় — এই সব ইনিদ্রয়গ্রাহ্য জিনিসের খবর পাওয়া যায়।

“তাই এ-বুদ্ধির দ্বারা এ-সব বুঝা যায় না। সাধুসঙ্গ করতে হয়। বৈদ্যের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে নাড়ী টেপা শেখা যায়।”

বিদ্যা — আজ্ঞা, এইবার বুঝেছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তপস্যা চাই, তবে বস্তুলাভ হবে। শাস্ত্রের শ্লোক মুখস্থ করলেও কিছু হবে না। “সিদ্ধি সিদ্ধি” মুখে বললে নেশা হয় না। সিদ্ধি খেতে হয়।

“ঈশ্বরদর্শনের কথা লোককে বোঝানো যায় না। পাঁচ বৎসরের বালককে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের আনন্দের কথা বোঝানো যায় না।”

বিদ্যা (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আজ্ঞে, আত্মদর্শন কি উপায়ে হতে পারে?

[রাখালের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের গোপালভাব ]

এই সময়ে রাখাল ঘরের মধ্যে আহার করিতে বসিতেছেন। কিন্তু অনেকে ঘরে আছেন বলিয়া ইতস্তত করিতেছেন। ঠাকুর আজকাল রাখালকে গোপালের ভাবে পালন করিতেছেন; ঠিক যেমন যশোদার বাৎসল্যভাব।

শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি) — খা না রে! এরা না হয় উঠে দাঁড়াক্‌! (একজন ভক্তপ্রতি) রাখালের জন্য বরফ রাখো। (রাখালের প্রতি) বনহুগলি তুই আবার যাবি। রৌদ্রে যাসনি।

রাখাল আহার করিতে বসিলেন। ঠাকুর আবার বিদ্যা অভিনেতা যাত্রাওয়ালা ছোকরাটির সঙ্গে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যার প্রতি) — তোমরা সকলে ঠাকুরবাড়িতে প্রসাদ পেলে না কেন? এখানে খেলেই হত।

বিদ্যা — আজ্ঞা, সবাইয়ের মত তো সমান নয়, তাই আলাদা রান্নাবাড়া হচ্ছে। সকলে অতিথিশালায় খেতে চায় না।

রাখাল খাইতে বসিয়াছেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বারান্দায় বসিয়া আবার কথা কহিতেছেন।

১ অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয়।                  [গীতা, ১২।৯]

২ সামিষং কুররং জঘ্নুর্বলিনোঽন্যে নিরামিষাঃ

তদামিষং পরিত্যজ্য স সুখং সমবিন্দত৷৷                  [শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/৯/২]

=============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে মে

যাত্রাওয়ালা ও সংসারে সাধনা — ঈশ্বরদর্শনের (আত্মদর্শনের) উপায়

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যা অভিনেতার প্রতি) — আত্মদর্শনের উপায় ব্যাকুলতা। কায়মনোবাক্যে তাঁকে পাবার চেষ্টা। যখন অনেক পিত্ত জমে তখন ন্যাবা লাগে; সকল জিনিস হলদে দেখায়। হলদে ছাড়া কোন রঙ দেখা যায় না।

“তোমাদের যাত্রাওয়ালাদের ভিতর যারা কেবল মেয়ে সাজে তাদের প্রকৃতি ভাব হয়ে যায়। মেয়েকে চিন্তা করে মেয়ের মতো হাবভাব সব হয়। সেইরূপ ঈশ্বরকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁরই সত্তা পেয়ে যায়।

“মনকে যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যায়। মন ধোপাঘরের কাপড়।”

বিদ্যা — তবে একবার ধোপাবাড়ি দিতে হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁ, আগে চিত্তশুদ্ধি; তারপর মনকে যদি ঈশ্বরচিন্তাতে পেলে রাখ তবে সেই রঙই হবে। আবার যদি সংসার করা, যাত্রাওয়ালার কাজ করা — এতে ফেলে রাখো, তাহলে সেই রকমই হয়ে যাবে।

==========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে মে

হরি (তুরীয়ানন্দ) নারাণ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতে না করিতেই কলিকাতা হইতে হরি, নারাণ, নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি আসিয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় “প্রেসিডেন্সী কলেজ”-এর সংস্কৃত অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। বাড়িতে বনিবনাও না হওয়াতে শ্যামপুকুরে আলাদা বাসা করিয়া স্ত্রী-পুত্র লইয়া আছেন। লোকটি ভারী সরল। এক্ষণে বয়স ২৯/৩০ হইবে। শেষজীবনে তিনি এলাহাবাদে বাস করিয়াছিলেন। ৫৮ বৎসর বয়সে তাঁর শরীরত্যাগ হইয়াছিল।

তিনি ধ্যানের সময় ঘন্টা-নিনাদ প্রভৃতি অনেকরকম শুনিতে ও দেখিতে পাইতেন। ভূটান, উত্তর-পশ্চিমে ও নানা স্থানে অনেক ভ্রমণ করিয়াছিলেন। ঠাকুরকে মাঝে মাঝে দর্শন করিতে আসিতেন।

হরি (স্বামী তুরীয়ানন্দ) তখন তাঁর বাগবাজারের বাড়িতে ভাইদের সঙ্গে থাকিতেন। জেনার‌্যাল অ্যাসেমব্লি-তে প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়িয়া আপাতত বাড়িতে ঈশ্বরচিন্তা, শাস্ত্রপাঠ ও যোগাভ্যাস করিতেন। মাঝে মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া দর্শন করিতেন। ঠাকুর বাগবাজারে বলরামের বাটীতে গমন করিলে তাঁহাকে কখন কখন ডাকাইয়া পাঠাইতেন।

[বৌদ্ধধর্মের কথা — ব্রহ্ম বোধ-স্বরূপ — ঠাকুরকে তোতাপুরীর শিক্ষা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — বুদ্ধদেবের কথা অনেক শুনেছি, তিনি দশাবতারের ভিতর একজন অবতার। ব্রহ্ম অচল, অটল, নিষ্ক্রিয় বোধ স্বরূপ। বুদ্ধি যখন এই বোধ-স্বরূপে লয় হয় তখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়; তখন মানুষ বুদ্ধ হয়ে যায়।

“ন্যাংটা বলত মনের লয় বুদ্ধিতে, বুদ্ধির লয় বোধ-স্বরূপে।

“যতক্ষণ অহং থাকে ততক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ব্রহ্মজ্ঞান হলে, ঈশ্বরকে দর্শন হলে, তবে অহং নিজের বশে আসে; তা না হলে অহংকে বশ করা যায় না। নিজের ছায়াকে ধরা শক্ত; তবে সূর্য মাথার উপর এলে ছায়া আধহাতের মধ্যে থাকে।”

[বন্দ্যোপাধ্যায়কে শিক্ষা — ঈশ্বরদর্শন — উপায় সাধুসঙ্গ ]

ভক্ত — ঈশ্বরদর্শন কিরূপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — থিয়েটারে অভিনয় দেখ নাই? লোক সব পরস্পর কথা কচ্ছে, এমন সময় পর্দা উঠে গেল; তখন সকলের সমস্ত মনটা অভিনয়ে যায়; আর বাহ্যদৃষ্টি থাকে না — এরই নাম সমাধিস্থ হওয়া।

“আবার পর্দা পড়ে গেলে বাহিরে দৃষ্টি। মায়ারূপ যবনিকা পড়ে গেলে আবার মানুষ বহির্মুখ হয়।

(নরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি) — “তুমি অনেক ভ্রমণ করেছ, সাধুদের কিছু গল্প কর।”

বন্দ্যোপাধ্যায় ভূটানে দুইজন যোগী দেখেছিলেন, তাঁহারা আধসের নিমের রস খান; এই সব গল্প করিতেছেন। আবার নর্মদাতীরে সাধুর আশ্রমে গিয়াছিলেন। সেই আশ্রমের সাধু পেন্টেলুন-পরা বাঙালী বাবুকে দেখে বলেছিলেন, “ইসকা পেটমে ছুরি হ্যায়।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, সাধুদের ছবি ঘরে রাখতে হয়; তাহলে সর্বদা ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়।

বন্দ্যোপাধ্যায় — আপনার ছবি ঘরে রেখেছি; আর পাহাড়ে সাধুর ছবি, হাতে গাঁজার কলকেতে আগুন দেওয়া হচ্চে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ; সাধুদের ছবি দেখলে উদ্দীপন হয়; শোলার আতা দেখলে যেমন সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়; যুবতী স্ত্রীলোক দেখলে লোকের যেমন ভোগের উদ্দীপন হয়।

“তাই তোমাদের বলি — সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার।

(বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি) — “সংসারে জ্বালা তো দেখছ। ভোগ নিতে গেলেই জ্বালা। চিলের মুখে যতক্ষণ মাছ ছিল, ততক্ষণ ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে তাকে জ্বালাতন করেছিল।

“সাধুসঙ্গে শান্তি হয়; জলে কুম্ভীর অনেকক্ষণ থাকে; এক-একবার জলে ভাসে, নিঃশ্বাস লবার জন্য। তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।”

[যাত্রাওয়ালা ও ঈশ্বর ‘কল্পতরু’ — সকাম প্রার্থনার বিপদ ]

যাত্রাওয়ালা — আজ্ঞা, আপনি ভোগের কথা যে বললেন, তা ঠিক। ঈশ্বরের কাছে ভোগের কামনা করলে শেষকালে বিপদে পড়তে হয়। মনে কতরকম কামনা বাসনা উঠছে, সব কামনাতে তো মঙ্গল হয় না। ঈশ্বর কল্পতরু, তাঁর কাছে যা কামনা করে চাইবে তা এসে পড়বে। এখন মনে যদি উঠে, ‘ইনি কল্পতরু, আচ্ছা দেখি বাঘ যদি আসে।’ বাঘকে মনে করতে বাঘ এসে পড়ল; আর লোকটাকে খেয়ে ফেললে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ওই বোধ, যে বাঘ আসে।

“আর কি বলব, ওইদিকে মন রেখো, ঈশ্বরকে ভুলো না — সরলভাবে তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দিবেন।

“আর একটি কথা, — যাত্রা শেষে কিছু হরিনাম করে উঠো। তাহলে জারা গায় এবং যারা শুনে সকলে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে নিজ নিজ স্থানে যাবে।”

যাত্রাওয়ালারা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও গৃহস্থাশ্রমের ভক্ত-বধূগণের প্রতি উপদেশ ]

দুটি ভক্তদের পরিবারেরা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। তাঁহারা ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন, এই জন্য উপবাস করিয়া আছেন। দুই জা অবগুন্ঠনবতী, দুই ভায়ের বধূ। বয়স ২২/২৩-এর মধ্যে, দুই জনেই ছেলেদের মা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — (বধূদিগের প্রতি) — দেখ তোমরা শিবপূজা করো। কি করে করতে হয় ‘নিত্যকর্ম’ বলে বই আছে, সেই বই পড়ে দেখে লবে। ঠাকুর পূজা করতে হলে ঠাকুরের কাজ অনেকক্ষণ ধরে করতে পারবে। ফুল তোলা, চন্দন ঘষা, ঠাকুরের বাসন মাজা, ঠাকুরের জলখাবার সাজানো — এই সকল করতে হলে ওই দিকেই মন থাকবে। হীন বুদ্ধি, রাগ, হিংসা — এ-সব চলে যাবে। দুই জায়ে যখন কথাবার্তা কইবে তখন ঠাকুরদেরই কথাবার্তা কইবে।

[Sree Ramakrishna and the value of Image Worship]

কোনরকম করে ঈশ্বরেতে মনের যোগ করা। একবারও যেন তাঁকে ভোলা না হয়; যেমন তেলের ধারা, তার ভিতর ফাঁক নাই। একটা ইটকে বা পাথরকে ঈশ্বর বলে যদি ভক্তিভাবে পূজা কর, তাতেও তাঁর কৃপায় ঈশ্বর দর্শন হতে পারে।

“আগে যা বললুম শিবপূজা — এই সব পূজা করতে হয়; তারপর পাকা হয়ে গেলে বেশিদিন পূজা করতে হয় না। তখন সর্বদাই মনের যোগ হয়ে থাকে; সর্বদাই স্মরণ মনন থাকে।”

বড় বধূ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আমাদের কি একটু কিছু বলে দিবেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — আমি তো মন্ত্র দিই না। মন্ত্র দিলে শিষ্যের পাপতাপ নিতে হয়। মা আমায় বালকের অবস্থায় রেখেছেন। এখন তোমরা শিবপূজা যা বলে দিলাম তাই করো। মাঝে মাঝে আসবে — পরে ঈশ্বরের ইচ্ছায় যা হয় হবে। স্নানযাত্রার দিন আবার আসবার চেষ্টা করবে।

“বাড়িতে হরিনাম করতে আমি যে বলেছিলাম, তা কি হচ্ছে?”

বধূ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমরা উপবাস করে এসেছ কেন? খেয়ে আসতে হয়।

“মেয়েরা আমার মার এক-একটি রূপ১ কি না; তাই তাদের কষ্ট আমি দেখতে পারি না; জগন্মাতার এক-একটি রূপ। খেয়ে আসবে, আনন্দে থাকবে।”

এই বলিয়া শ্রীযুক্ত রামলালকে বধূদের বসাইয়া জল খাওয়াইতে আদেশ করিলেন। ফলহারিণীপূজার প্রসাদ, লুচি, নানাবিধ ফল, গ্লাস ভরিয়া চিনির পানা ও মিষ্টান্নাদি তাঁহারা পাইলেন।

ঠাকুর বলিলেন, “তোমরা কিছু খেলে, এখন আমার মনটা শীতল হল; আমি মেয়েদের উপবাসী দেখতে পারি না।”

১ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু। [শ্রীদেবীমাহাত্ম্যম্‌, চন্ডী ১১/৬]

============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে মে

ভক্তসঙ্গে গুহ্যকথা — শ্রীযুক্ত কেশব সেন

শ্রীরামকৃষ্ণ শিবের সিঁড়িতে বসিয়া আছেন। বেলা অপরাহ্ন ৫টা হইয়াছে; কাছে অধর, ডাক্তার নিতাই, মাস্টার প্রভৃতি দু-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — দেখ, আমার স্বভাব বদলে যাচ্ছে।

এইবার কি গুহ্যকথা বলিবেন বলিয়া সিঁড়ির এক ধাপ নামিয়া ভক্তদের কাছে বসিলেন। আবার কি বলিতেছেন —

[God’s highest Manifestation in Man — The Mystery of Divine Incarnation]

“ভক্ত তোমরা, তোমাদের বলতে কি; আজকাল ঈশ্বরের চিন্ময় রূপ দর্শন হয় না। এখন সাকার নররূপ এইটে বলে দিচ্ছে। আমার স্বভাব ঈশ্বরের রূপ দর্শন-স্পর্শন-আলিঙ্গন করা। এখন বলে দিচ্ছে, ‘তুমি দেহধারণ করেছ, সাকার নররূপ লয়ে আনন্দ কর।’

“তিনি তো সকল ভূতেই আছেন, তবে মানুষের ভিতর বেশি প্রকাশ।

“মানুষ কি কম গা? ঈশ্বর চিন্তা করতে পারে, অনন্তকে চিন্তা করতে পারে, অন্য জীবজন্তু পারে না।

“অন্য জীবজন্তুর ভিতরে; গাছপালার ভিতরে, আবার সর্বভূতে তিনি আছেন; কিন্তু মানুষে বেশি প্রকাশ।

“অগ্নিতত্ত্ব সর্বভূতে আছে, সব জিনিসে আছে; কিন্তু কাষ্ঠে বেশি প্রকাশ।

“রাম লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, দেখ হাতি এত বড় জানোয়ার; কিন্তু ঈশ্বরচিন্তা করতে পারে না।

“আবার অবতারে বেশি প্রকাশ। রাম লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, যে মানুষে দেখবে ঊর্জিতা ভক্তি; ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়, সেইখানেই আমি আছি।”

ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার কথা কহিতেছেন।

[Influence of Sree Ramakrishna on Sj. Keshab Chandra Sen]

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, কেশব সেন খুব আসত। এখানে এসে অনেক বদলে গেল। ইদানীং খুব লোক হয়েছিল। এখানে অনেকবার এসেছিল দলবল নিয়ে। আবার একলা একলা আসবার ইচ্ছা ছিল।

“কেশবের আগে তেমন সাধুসঙ্গ হয় নাই।

“কলুটোলার বাড়িতে দেখা হল; হৃদে সঙ্গে ছিল। কেশব সেন যে-ঘরে ছিল, সেই ঘরে আমাদের বসালে। টেবিলে কি লিখছিল, অনেকক্ষণ পরে কলম ছেড়ে কেদারা থেকে নেমে বসল; তা আমাদের নমস্কার-টমস্কার করা নাই।

“এখানে মাঝে মাঝে আসত। আমি একদিন ভাবাবস্থাতে বললাম সাধুর সম্মুখে পা তুলতে নাই। ওতে রজোগুণ বৃদ্ধি হয়। তারা এলেই আমি নমস্কার করতুম, তখন ওরা ক্রমে ভূমিষ্ঠ হয়ে নমস্কার করতে শিখলে।”

[ব্রাহ্মসমাজে হরিনাম ও মার নাম — ভক্ত হৃদয়ে ঈশ্বরদর্শন ]

“আর কেশবকে বললাম, ‘তোমরা হরিনাম করো, কলিতে তাঁর নামগুণকীর্তন করতে হয়। তখন ওরা খোল-করতাল নিয়ে হরিনাম ধরলে।১

“হরিনামে বিশ্বাস আমার আরও হলো কেন? এই ঠাকুরবাড়িতে সাধুরা মাঝে মাঝে আসে; একটি মুলতানের সাধু এসেছিল, গঙ্গাসাগরের লোকের জন্য অপেক্ষা করছিল। (মাস্টারকে দেখাইয়া) এদের বয়সের সাধু। সেই বলেছিল, ‘উপায় নারদীয় ভক্তি’।”

[কেশবকে উপদেশ — কামিনী-কাঞ্চন আঁষচুপড়ি — সাধুসঙ্গ ফুলের গন্ধ — মাঝে মাঝে নির্জনে সাধন ]

“কেশব একদিন এসেছিল; রাত দশটা পর্যন্ত ছিল। প্রতাপ আর কেউ কেউ বললে, আজ থেকে যাব; সব বটতলায় (পঞ্চবটীতে) বসে; কেশব বললে, না কাজ আছে, যেতে হবে।

“তখন আমি হেসে বললাম, আঁষচুপড়ির গন্ধ না হলে কি ঘুম হবে না? একজন মেছুনী মালীর বাড়িতে অতিথি হয়েছিল; মাছ বিক্রি করে আসছে; চুপড়ি হাতে আছে। তাকে ফুলের ঘরে শুতে দেওয়া হল। অনেক রাত পর্যন্ত ফুলের গন্ধে ঘুম হচ্ছে না; বাড়ির গিন্নী সেই অবস্থা দেখে বললে, কিগো, তুই ছটফট করছিস কেন? সে বললে, কে জানে বাবু, বুঝি এই ফুলের গন্ধে ঘুম হচ্ছে না; আমার আঁষচুপড়িটা আনিয়ে দিতে পার? তা হলে বোধহয় ঘুম হতে পারে। শেষে আঁষচুপড়ি আনাতে জল ছিটে দিয়ে নাকের কাছে রেখে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাতে লাগল।

“গল্প শুনে কেশবের দলের লোকেরা হো-হো করে হাসতে লাগল।

“কেশব সন্ধ্যার পর ঘাটে উপাসনা করলে। উপাসনার পর আমি কেশবকে বললুম, দেখ, ভগবানই একরূপে ভাগবত হয়েছেন, তাই বেদ, পুরাণ, তন্ত্র — এ-সব পূজা করতে হয়। আবার একরূপে তিনি ভক্ত হয়েছেন, ভক্তের হৃদয় তাঁর বৈঠকখানা; বৈঠকখানায় গেলে যেমন বাবুকে অনায়াসে দেখা যায়। তাই ভক্তের পূজাতে ভগবানের পূজা হয়।

“কেশব আর তার দলের লোকগুলি এই কথাগুলি খুব মন দিয়ে শুনলে। পূর্ণিমা, চারিদিকে চাঁদের আলোক। গঙ্গাকূলে সিঁড়ির চাতালে সকলে বসে আছে। আমি বললাম, সকলে বল, ‘ভাগবত-ভক্ত-ভগবান।’

তখন সকলে একসুরে বললে, ‘ভাগবত-ভক্ত-ভগবান’। আবার বললাম, বল, ‘ব্রহ্মই শক্তি, শক্তিই ব্রহ্ম।’ তারা আবার একসুরে বললে, ‘ব্রহ্মই শক্তি, শক্তিই ব্রহ্ম।’ তাদের বললাম, যাঁকে তোমরা ব্রহ্ম বল, তাঁকেই আমি মা বলি; মা বড় মধুর নাম।

“যখন আবার তাদের বললাম, আবার বল, ‘গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব’। তখন কেশব বললে, মহাশয় অতদূর নয়! তাহলে সকলে আমাদের গোঁড়া বৈষ্ণব মনে করবে।

“কেশবকে মাঝে মাঝে বলতাম, তোমরা যাঁকে ব্রহ্ম বল, তাঁকেই আমি শক্তি, আদ্যাশক্তি বলি। যখন বাক্য-মনের অতীত, নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, তখন বেদে তাঁকে ব্রহ্ম বলেছে। যখন দেখি যে তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন তখন তাঁকে শক্তি, আদ্যাশক্তি — এই সব বলি।

“কেশবকে বললাম, সংসারে হওয়া বড় কঠিন — যে-ঘরে আচার আর তেঁতুল আর জলের জালা, সেই ঘরেই বিকারী রোগী কেমন করে ভাল হয়; তাই মাঝে মাঝে সাধন-ভজন করবার জন্য নির্জনে চলে যেতে হয়। গুঁড়ি মোটা হলে হাতি বেঁধে দেওয়া যায়, কিন্তু চারা গাছ ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে। তাই কেশব লেকচারে বললে, তোমরা পাকা হয়ে সংসারে থাক।”

[অধর, মাস্টার, নিতাই প্রভৃতিকে উপদেশ — “এগিয়ে পড়” ]

(ভক্তদের প্রতি) — “দেখ, কেশব এত পণ্ডিত ইংরাজীতে লেকচার দিত, কত লোকে মানত; স্বয়ং কুইন ভিক্টোরিয়া তার সঙ্গে বসে কথা কয়েছে। সে কিন্তু এখানে যখন আসত, শুধু গায়ে; সাধুদর্শন করতে হলে হাতে কিছু আনতে হয়, তাই ফল হাতে করে আসত। একেবারে অভিমানশূন্য।

(অধরের প্রতি) — “দেখ, তুমি এত বিদ্বান আবার ডেপুটি, তবু তুমি খাঁদী-ফাঁদির বশ। এগিয়ে পড়। চন্দন কাঠের পরেও আরও ভাল ভাল জিনিস আছে; রূপার খনি, তারপর সোনার খনি, তারপর হীরা মাণিক। কাঠুরে বনে কাঠ কাটছিল, তাই ব্রহ্মচারী তাকে বললে, ‘এগিয়ে পড়’।”

শিবের মন্দির হইতে অবতরণ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাঙ্গণের মধ্য দিয়া নিজের ঘরের দিকে আসিতেছেন। সঙ্গে অধর, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা। এমন সময় বিষ্ণুঘরের সেবক পূজারী শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে আসিয়া খবর দিলেন শ্রীশ্রীমার পরিচারিকার কলেরা হইয়াছে।

রাম চাটুজ্জে (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আমি তো দশটার সময় বললুম, আপনারা শুনলেন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি করব?

রাম চাটুজ্জে — আপনি কি করবেন? রাখাল, রামলাল এরা সব ছিল, ওরা কেউ কিছু করলে না।

মাস্টার — কিশোরী (গুপ্ত) ঔষধ আনতে গেছে আলমবাজারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি, একলা? কোথা থেকে আনবে?

মাস্টার — আর কেহ সঙ্গে নাই। আলমবাজার থেকে আনবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — যারা রোগীকে দেখেছে তাদের বলে দাও বাড়লে কি করতে হবে; কমলেই বা কি খাবে।

মাস্টার — যে আজ্ঞা।

ভক্তবধুগণ এইবারে আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহারা বিদায় গ্রহণ করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের আবার বললেন, “শিবপূজা যেমন বললাম ওইরূপ করবে। আর খেয়ে দেয়ে এসো, তা না হলে আমার কষ্ট হয়। স্নানযাত্রার দিন আবার আসবার চেষ্টা করো।”

১ শ্রীযুক্ত কেশব সেন খোল-করতাল লয়ে কয়েক বৎসর ধরিয়া ব্রহ্মনাম করিতেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত ১৮৭৫ সালে দেখা হইবার পর হইতে বিশেষভাবে হরিনাম ও মায়ের নাম খোল-করতাল লইয়া কীর্তন করিতে লাগিলেন।
=============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে মে

বন্দ্যোকে শিক্ষা — ভার্যা সংসারের কারণ — শরণাগত হও

শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়, হরি, মাস্টার প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন। বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসারে কষ্ট ঠাকুর সব জানেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, “এক কপ্নিকে বাস্তে” যত কষ্ট। বিবাহ করে, ছেলেপুলে হয়েছে, তাই চাকরি করতে হয়; সাধু কপ্নি লয়ে ব্যস্ত, সংসারী ভার্যা লয়ে। আবার বাড়ির সঙ্গে বনিবনাও নাই, তাই — আলাদা বাসা করতে হয়েছে। (সহাস্য) চৈতন্যদেব নিতাইকে বলেছিলেন, শুন শুন নিত্যানন্দ ভাই সংসারী জীবের কভু গতি নাই।

মাস্টার (স্বগত) — ঠাকুর বুঝি অবিদ্যার, সংসারের কথা বলছেন। অবিদ্যার সংসারেই বুঝি “সংসারী জীব” থাকে।

(মাস্টারকে দেখাইয়া — সহাস্যে) “ইনিও আলাদা বাসা করে আছেন। তুমি কে, না ‘আমি বিদেশিনী’; আর তুমি কে, না ‘আমি বিরহিণী।’ (সকলের হাস্য) বেশ মিল হবে।

“তবে তাঁর শরণাগত হলে আর ভয় নাই। তিনিই রক্ষা করবেন।”

হরি প্রভৃতি — আচ্ছা, অনেকের তাঁকে লাভ করতে অত দেরি হয় কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, ভোগ আর কর্ম শেষ না হলে ব্যাকুলতা আসে না। বৈদ্য বলে দিন কাটুক — তারপর সামান্য ঔষধে উপকার হবে।

“নারদ রামকে বললেন, ‘রাম! তুমি অযোধ্যায় বসে রইলে রাবণবধ কেমন করে হবে? তুমি যে সেইজন্যে অবতীর্ণ হয়েছ!’ রাম বললেন, ‘নারদ! সময় হউক, রাবণের কর্ম-ক্ষয় হোক; তবে তার বধের উদ্যোগ হবে’।”১

[The problem of Evil and Hari (Turiyananda) — ঠাকুরের বিজ্ঞানীর অবস্থা ]

হরি — আচ্ছা, সংসারে এত দুঃখ কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ সংসার তাঁর লীলা; খেলার মতো। এই লীলায় সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, জ্ঞান-অজ্ঞান, ভাল-মন্দ — সব আছে। দুঃখ, পাপ — এ-সব গেলে লীলা চলে না।

“চোর চোর খেলায় বুড়ীকে ছুঁতে হয়। খেলার গোড়াতেই বুড়ী ছুঁলে বুড়ী সন্তুষ্ট হয় না। ঈশ্বরের (বুড়ির) ইচ্ছা যে খেলাটা খানিকক্ষণ চলে। তারপর। —

ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে,

হেসে দাও মা, হাত-চাপড়ী।

অর্থাৎ ঈশ্বরদর্শন করে দুই-একজন মুক্ত হয়ে যায়, অনেক তপস্যার পর, তাঁর কৃপায়। তখন মা আনন্দে হাততালি দেন, ‘ভো! কাটা!’ এই বলে।”

হরি — খেলায় যে আমাদের প্রাণ যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি কে বল দেখি; ঈশ্বরই সব হয়ে রয়েছেন — মায়া, জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব।২

“সাপ হয়ে খাই, আবার রোজা হয়ে ঝাড়ি! তিনি বিদ্যা-অবিদ্যা দুই-ই হয়ে রয়েছেন। অবিদ্যা মায়ার অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন, বিদ্যা মায়ার ও গুরুরূপে রোজা হয়ে ঝাড়ছেন।

“অজ্ঞান, জ্ঞান, বিজ্ঞান। জ্ঞানী দেখেন তিনিই আছেন, তিনিই কর্তা — সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার করছেন। বিজ্ঞানী দেখেন, তিনিই সব হয়ে রয়েছেন।

“মহাভাব, প্রেম হলে দেখে তিনি ছাড়া আর কিছুই নাই।

“ভাবের কাছে ভক্তি ফিকে, ভাব পাকলে মহাভাব, প্রেম।

(বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি) — “ধ্যানের সময় ঘন্টাশব্দ এখনও কি শোনা?”

বন্দ্যো — রোজ ওই শব্দ শোনা! আবার রূপদর্শন! একবার মন ধরলে কি আর বিরাম হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — হাঁ, কাঠে একবার আগুন ধরলে আর নেবে না। (ভক্তদের প্রতি) — ইনি বিশ্বাসের কথা অনেক জানেন।

বন্দ্যো — আমার বিশ্বাসটা বড় বেশি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিছু বল না।

বন্দ্যো — একজনকে গুরু গাড়োল মন্ত্র দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, “গাড়োলই তোর ইষ্ট।” গাড়োল মন্ত্র জপ করে সে সিদ্ধ হল।

“ঘেসুড়ে রামনাম করে গঙ্গা পার হয়ে গিছল!”

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার বাড়ির মেয়েদের বলরামের মেয়েদের সঙ্গে এনো।

বন্দ্যো — বলরাম কে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — বলরাম কে জানো না? বোসপাড়ায় বাড়ি।

সরলকে দেখিলে শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বিভোর হয়েন। বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সরল; নিরঞ্জনকেও সরল বলে খুব ভালবাসেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তোমায় নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে বলছি কেন? সে সরল, সত্য কি না। এইটি দেখবে বলে।

১ অধ্যাত্মরামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড।

২ ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী।

ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ।।              [শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৪।৩]
=============

Post a Comment

0 Comments