সপ্তদশ খণ্ড~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

সপ্তদশ খণ্ড

সপ্তদশ খণ্ড~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

গিরিশ-মন্দিরে জ্ঞানভক্তি-সমন্বয় কথাপ্রসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশ ঘোষের বসুপাড়ার বাটীতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন। বেলা ৩টা বাজিয়াছে। মাস্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। আজ বুধবার, ১৫ই ফাল্গুন, শুক্লা একাদশী — ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। গত রবিবার দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসব হইয়া গিয়াছে। আজ ঠাকুর গিরিশের বাড়ি হইয়া স্টার থিয়েটারে বৃষকেতুর অভিনয় দর্শন করিতে যাইবেন।
ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আসিয়াছেন। কাজ সারিয়া আসিতে মাস্টারের কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইয়াছে। তিনি আসিয়াই দেখিলেন, ঠাকুর উৎসাহের সহিত ব্রহ্মজ্ঞান ও ভক্তিতত্ত্বের সমন্বয় কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশ প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, জীবের এই তিন অবস্থা।
“যারা জ্ঞানবিচার করে তারা তিন অবস্থাই উড়িয়ে দেয়। তারা বলে যে ব্রহ্ম তিন অবস্থারই পার, স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ — তিনদেহের পার; সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনগুণের পার: সমস্তই মায়া, যেমন আয়নাতে প্রতিবিম্ব পড়েছে; প্রতিবিম্ব কিছু বস্তু নয়; ব্রহ্মই বস্তু আর সব অবস্তু।[1]
“ব্রহ্মজ্ঞানীরা আরও বলে, দেহাত্মবুদ্ধি থাকলেই দুটো দেখায়। প্রতিবিম্বটাও সত্য বলে বোধ হয়। ওই বুদ্ধি চলেগেলে, সোঽহম্‌ ‘আমিই সেই ব্রহ্ম’ এই অনুভূতি হয়।”
একজন ভক্ত — তাহলে কি আমরা সব বিচার করব?
[দুই পথ ও গিরিশ — বিচার ও ভক্তি — জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিচারপথও আছে, বেদান্তবাদীদের পথ। আর-একটি পথা আছে ভক্তিপথ। ভক্ত যদি ব্যাকুল হয়ে কাঁদে ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য, সে তাও পায়। জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ।
“দুই পথ দিয়াই ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে। কেউ কেউ ব্রহ্মজ্ঞানের পরও ভক্তি নিয়ে থাকে লোকশিক্ষার জন্য; যেমন অবতারাদি।
“দেহাত্মবুদ্ধি, ‘আমি’ বুদ্ধি কিন্তু সহজে যায় না; তাঁর কৃপায় সমাধিস্থ হলে যায় — নির্বিকল্পসমাধি, জড়সমাধি।
“সমাধির পর অবতারাদির ‘আমি’ আবার ফিরে আসে — বিদ্যার আমি, ভক্তের আমি এই ‘বিদ্যার আমি’ দিয়ে লোকশিক্ষা হয়। শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিল।
“চৈতন্যদেব এই ‘আমি’ দিয়ে ভক্তি আস্বাদন করতেন, ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকতেন; ঈশ্বরীয় কথা কইতেন; নামসংকীর্তন করতেন।
“আমি তো সহজে যায় না, তাই ভক্ত জাগ্রত স্বপ্ন প্রভৃতি অবস্থা উড়িয়ে দেয় না। ভক্ত সব অবস্থাই লয়; সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, তিনগুণও লয়; ভক্ত দেখে তিনিই চর্তুবিংশতি তত্ত্ব হয়ে রয়েছেন, জীবজগৎ হয়ে রয়েছেন; আবার দেকে সাকার চিন্ময়রূপে তিনি দর্শন দেন।
“ভক্ত বিদ্যামায়া আশ্রয় করে থাকে। সাধুসঙ্গ, তীর্থ, জ্ঞান, ভক্তি, বৈরাগ্য — এই সব আশ্রয় করে থাকে। সে বলে যদি ‘আমি’ সহজে চলে না যায়, তবে থাক্‌ শালা ‘দাস’ হয়ে, ‘ভক্ত’ হয়ে।
“ভক্তেরও একাকার জ্ঞান হয়; সে দেখে ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই নাই। ‘স্বপ্নবৎ’ বলে না, তবে বলে তিনিই এই সব হয়েছেন; মোমের বাগানে সবই মোম, তবে নানা রূপ।
“তবে পাকা ভক্তি হলে এইরূপ বোধ হয়। অনেক পিত্ত জমলে ন্যাবা লাগে; তখন দেখে যে সবই হলদে। শ্রীমতী শ্যামকে ভেবে ভেবে সমস্ত শ্যামময় দেখলে; আর নিজেকেও শ্যাম বোধ হল। পারার হ্রদে সীসে অনেকদিন থাকলে সেটাও পারা হয়ে যায়। কুমুরেপোকা ভেবে ভেবে আরশুলা নিশ্চল হয়ে যায়। নড়ে না; শেষে কুমুরেপোকাই হয়ে যায়। ভক্তও তাঁকে ভেবে ভেবে অহংশূন্য হয়ে যায়। আবার দেখে ‘তিনিই আমি’, ‘আমিই তিনি’।
“আরশুলা যখন কুকুরেপোকা হয়ে যায়, তখন সব হয়ে গেল। তখনই মুক্তি।”
[নানা ভাবে পূজা ও গিরিশ — “আমার মাতৃভাব” ]
“যতক্ষণ আমিটা তিনি রেখে দিয়েছেন, ততক্ষণ একটি ভাব আশ্রয় করে তাঁকে ডাকতে হয় — শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য — এই সব।
“আমি দাসীভাবে একবৎসর ছিলাম — ব্রহ্মময়ীর দাসী। মেয়েদের কাপড় ওড়না এই সব পরতাম। আবার নথ পরতাম! মেয়ের ভাব থাকলে কাম জয় হয়।
“সেই আদ্যাশক্তির পূজা করতে হয়, তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনিই মেয়েদের রূপ ধারণ করে রয়েছেন। তাই আমার মাতৃভাব।
“মাতৃভাব অতি শুদ্ধভাব। তন্ত্রে বামাচারের কথাও আছে; কিন্তু সে ভাল নয়; পতন হয়। ভোগ রাখলেই ভয়।
“মাতৃভাব যেন নির্জলা একাদশী; কোন ভোগের গন্ধ নাই। আর আছে ফলমূল খেয়ে একাদশী; আর লুচি ছক্কা খেয়ে একাদশী। আমার নির্জলা একাদশী; আমি মাতৃভাবে ষোড়শীর পূজা করেছিলাম। দেখলাম স্তন মাতৃস্তন, যোনি মাতৃযোনি।
“এই মাতৃভাব — সাধনের শেষ কথা — ‘তুমি মা, আমি তোমার ছেলে’। এই শেষ কথা।”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম — গৃহস্থদের নিয়ম ও গিরিশ ]
“সন্ন্যাসীর নির্জলা একাদশী; সন্ন্যাসী যদি ভোগ রাখে, তা হলেই ভয়। কামিনী-কাঞ্চন ভোগ, যেমন থুথু ফেলে আবার থুথু খাওয়া। টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রম, ইন্দ্রিয়সুখ — এই সব ভোগ। সন্ন্যাসীর ভক্ত স্ত্রীলোকের সঙ্গে বসা বা আলাপ করাও ভাল নয় — নিজের ক্ষতি আর অন্য লোকেরও ক্ষতি। অন্য লোকের শিক্ষা হয় না, লোকশিক্ষা হয় না। সন্ন্যাসীর দেহধারণ লোকশিক্ষার জন্য।
“মেয়েদের সঙ্গে বসা কি বেশিক্ষণ আলাপ, তাকেও রমণ বলেছে। রমণ আট প্রকার। মেয়েদের কথা শুনছি; শুনতে শুনতে আনন্দ হচ্ছে; ও একরকম রমণ। মেয়েদের কথা বলছি (কীর্তনম্‌) ও একরকম রমণ; মেয়েদের সঙ্গে নির্জনে চুপি চুপি কথা কচ্ছি, ও একরকম। মেয়েদের কোন জিনিস কাছে রেখে দিয়েছি, আনন্দ হচ্ছে, ও একরকম। স্পর্শ করা একরকম। তাই গুরুপত্নী যুবতী হলে পাদস্পর্শ করতে নাই; সন্ন্যাসীদের এই সব নিয়ম।
“সংসারীদের আলাদা কথা; দু-একটি ছেলে হলে ভাই-ভগ্নীর মতো থাকবে; তাদের অন্য সাতরকম রমণে দোষ নাই।
“গৃহস্থের ঋণ আছে। দেবঋণ, পিতৃঋণ, ঋষিঋণ; আবার মাগঋণও আছে, একটি-দুটি ছেলে হওয়া আর সতী হলে প্রতিপালন করা।
“সংসারীরা বুঝতে পারে না, কে ভাল স্ত্রী, কে মন্দ স্ত্রী; কে বিদ্যাশক্তি, কে অবিদ্যাশক্তি। যে ভাল স্ত্রী; বিদ্যাশক্তি, তার কাম ক্রোধ এ-সব কম, ঘুম কম; স্বামীর মাথা ঠেলে দেয়। যে বিদ্যাশক্তি তার স্নেহ, দয়া, ভক্তি, লজ্জা — এই সব থাকে। সে সকলেরই সেবা করে বাৎসল্যভাবে, আর স্বামীর যাতে ভগবানে ভক্তি হয় তার সাহায্য করে। বেশী খরচ করে না, পাছে স্বামীর বেশী খাটতে হয়, পাছে ঈশ্বরচিন্তার অবসর না হয়।
“আবার পুরুষ মেয়ের অন্য অন্য লক্ষণ আছে। খারাপ লক্ষণ — টেরা, চোখ কোটর, ঊনপাঁজর, বিড়াল-চোখ, বাছুরে গাল।”
[সমাধি-তত্ত্ব ও গিরিশ — ঈশ্বরলাভের উপায় — গিরিশের প্রশ্ন ]
গিরিশ — আমাদের উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভক্তিই সার। আবার ভক্তির সত্ত্ব, ভক্তির রজঃ, ভক্তির তমঃ আছে।
“ভক্তির সত্ত্ব দীনহীন ভাব; ভক্তির তমঃ যেন ডাকাত-পড়া ভাব। আমি তাঁর নাম করছি, আমার আবার পাপ কি? তুমি আমার আপনার মা, দেখা দিতেই হবে।”
গিরিশ (সহাস্যে) — ভক্তির তমঃ আপনিই তো শেখান —
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তাঁকে দর্শন করবার কিন্তু লক্ষণ আছে। সমাধি হয়। সমাধি পাঁচপ্রকার; ১ম: — পিঁপড়ের গতি, মহাবায়ু উঠে পিঁপড়ের মতো। ২য়: — মীনের গতি। ৩য়: তির্যক্‌ গতি। ৪র্থ: — পাখির গতি, পাখি যেমন এ-ডাল থেকে ও-ডালে যায়। ৫ম: — কপিবৎ, বানরের গতি; মহাবায়ু যেন লাফ দিয়ে মাথায় উঠে গেল আর সমাধি হল।
“আবার দুরকম আছে; ১ম: — স্থিতসমাধি; একেবারে বাহ্যশূন্য; অনেকক্ষণ হয়তো অনেকদিন, রহিল। ২য়: — উন্মনাসমাধি; হঠাৎ মনটা চারিদিক থেকে কুড়িয়ে এনে ঈশ্বরেতে যোগ করে দেওয়া।”
[উন্মনাসমাধি ও মাস্টার ]
(মাস্টারের প্রতি) — “তুমি ওটা বুঝেছ?”
মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ।
গিরিশ — তাঁকে কি সাধন করে পাওয়া যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — নানারকমে তাঁকে লোকে লাভ করেছে। কেউ অনেক তপস্যা সাধন-ভজন করে; সাধনসিদ্ধ। কেউ জন্মাবধি সিদ্ধ; যেমন নারদ, শুকদেবাদি, এদের বলে নিত্যসিদ্ধ। আবার আছে হঠাৎসিদ্ধ; হঠাৎ লাভ করেছে। যেমন হঠাৎ কোন আশা ছিল না, কেউ নন্দ বসুর মতো বিষয় পেয়ে গেছে।
————————
১ মাণ্ডূক্যোপনিষদ্‌।
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

গিরিশের শান্তভাব, কলিতে শূদ্রের ভক্তি ও মুক্তি
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর আছে স্বপ্নসিদ্ধ আর কৃপাসিদ্ধ।
এই বলিয়া ঠাকুর ভাবে বিভোর হইয়া গান গাহিতেছেন:
শ্যামাধন কি সবাই পায়,
অবোধ মন বোঝে না একি দায়।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মনমজানো রাঙা পায়।।
ইন্দ্রাদি সম্পদ সুখ তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায়।
সদানন্দ সুখে ভাসে, শ্যামা যদি ফিরে চায়।।
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্রদ্র যে চরণ ধ্যানে না পায়।
নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়।।
ঠাকুর কিয়ৎক্ষণ ভাবাবিষ্ট হইয়া রহিয়াছেন। গিরিশ প্রভৃতি ভক্তেরা সম্মুখে আছেন। কিছুদিন পূর্বে স্টার থিয়েটারে গিরিশ অনেক কথা বলিয়াছিলেন; এখন শান্তভাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — তোমার এ ভাব বেশ ভাল; শান্তভাব, মাকে তাই বলেছিলাম, মা ওকে শান্ত করে দাও, যা তা আমায় না বলে।
গিরিশ (মাস্টারে প্রতি) — আমার জিব কে যেন চেপে ধরেছে। আমায় কথা কইতে দিচ্ছে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ এখনও ভাবস্থ অনতর্মুখ। বাহিরের ব্যক্তি, বস্তু ক্রমে ক্রমে সব ভুলে যাচ্ছেন। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া মনকে নাবাচ্ছেন। ভক্তদের আবার দেখিতেছেন। (মাস্টার দৃষ্টে) এরা সব সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) যায়; — তা যায় তো যায়; মা সব জানে।
(প্রতিবেশী ছোকরার প্রতি) — “কিগো! তোমার কি বোধ হয়? মানুষের কি কর্তব্য?”
সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর কি বলিতেছেন যে ঈশ্বরলাভই জীবনের উদ্দেশ্য?
শ্রীরামকৃষ্ণ (নারায়ণের প্রতি) — তুই পাস করবিনি? ওরে পাশমুক্ত শিব, পাশবদ্ধ জীব।
ঠাকুর এখন ভাবাবস্থায় আছেন। কাছে গ্লাস করা জল ছিল, পান করিলেন। তিনি আপনা-আপনি বলিতেছেন, কই ভাবে তো জল খেয়ে ফেললুম!
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত অতুল — ব্যাকুলতা ]
এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ঠাকুর গিরিশের ভ্রাতা শ্রীযুক্ত অতুলের সহিত কথা কহিতেছেন। অতুল ভক্তসঙ্গে সম্মুখেই বসিয়া আছেন। একজন ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীও বসিয়া আছেন। অতুল হাইকোর্ট-এর উকিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অতুলের প্রতি) — আপনাদের এই বলা, আপনারা দুই করবে, সংসারও করবে, ভক্তি যাতে হয় তাও করবে।
ব্রাহ্মণ প্রতিবেশী — ব্রাহ্মণ না হলে কি সিদ্ধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? কলিতে শূদ্রের ভক্তির কথা আছে। শবরী, রুইদাস, গুহক চণ্ডাল — এ-সব আছে।
নারায়ণ (সহাস্যে) — ব্রাহ্মণ, শুদ্র, সব এক।
ব্রাহ্মণ — এক জন্মে কি হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর দয়া হলে কি না হয়। হাজার বৎসরের অন্ধকার ঘরে আলো আনলে কি একটু একটু করে অন্ধকার চলে যায়? একেবারে আলো হয়।
(অতুলের প্রতি) — “তীব্র বৈরাগ্য চাই — যেন খাপখোলা তরোয়াল। সে বৈরাগ্য হলে, আত্মীয় কালসাপ মনে হয়, গৃহ পাতকুয়া মনে হয়।
“আর আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। আন্তরিক ডাক তিনি শুনবেনই শুনবেন।”
সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর যাহা বলিলেন, একমনে শুনিয়া সেই সকল চিন্তা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অতুলের প্রতি) — কেন? অমন আঁট বুঝি হয় না — ব্যাকুলতা?
অতুল — মন কই থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — অভ্যাসযোগ! রোজ তাঁকে ডাকা অভ্যাস করতে হয়। একদিনে হয় না; রোজ ডাকতে ডাকতে ব্যাকুলতা আসে।
“কেবল রাতদিন বিষয়কর্ম করলে ব্যাকুলতা কেমন করে আসবে? যদু মল্লিক আগে আগে ঈশ্বরীয় কথা বেশ শুনত, নিজেও বেশ বলত; আজকাল আর তত বলে না, রাতদিন মোসাহেব নিয়ে বসে থাকে, কেবল বিষয়ের কথা!”
[সন্ধ্যা সমাগমে ঠাকুরের প্রার্থনা — তেজচন্দ্র ]
সন্ধ্যা হইল; ঘরে বাতি জ্বালা হইয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরদের নাম করিতেছেন, গান গাহিতেছেন ও প্রার্থনা করিতেছেন।
বলিতেছেন, “হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল”; আবার “রাম রাম রাম”; আবার ‘নিত্যলীলাময়ী’। ওমা, উপায় বল মা! “শরণাগত, শরণাগত, শরণাগত”!
গিরিশকে ব্যস্ত দেখিয়া ঠাকুর একটু চুপ করিলেন। তেজচন্দ্রকে বলিতেছেন, তুই একটু কাছে এসে বোস।
তেজচন্দ্র কাছে বসিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টারকে ফিস্‌ফিস্‌ করিয়া বলিতেছেন, আমায় যেতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি ওদের অত টানি কেন? ওরা নির্মল আধার — বিষয়বুদ্ধি ঢোকেনি। থাকলে উপদেশ ধারণা করতে পারে না। নূতন হাঁড়িতে দুধ রাখা যায়, দই পাতা হাঁড়িতে দুধ রাখলে দুধ নষ্ট হয়।
“যে বাটিতে রসুন গুলেছে, সে বাটি হাজার ধোও, রসুনের গন্ধ যায় না।”
==========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে — বৃষকেতু অভিনয়দর্শনে, নরেন্দ্র প্রভৃতি সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বৃষকেতু অভিনয়দর্শন করিবেন। বিডন স্ট্রীটে যেখানে পরে মনোমোহন থিয়েটার হয়, পূর্বে সেই মঞ্চে স্টার-থিয়েটার আভিনয় হইত। থিয়েটারে আসিয়া বক্সে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়াছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — নরেন্দ্র এসেছে?
মাস্টার — আজ্ঞে হাঁ।
অভিনয় হইতেছে। কর্ণ ও পদ্মাবতী করাত দুইদিকে দুইজন ধরিয়া বৃষকেতুকে বলিদান করিলেন। পদ্মাবতী কাঁদিতে কাঁদিতে মাংস রন্ধন করিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অতিথি আনন্দ করিতে করিতে কর্ণকে বলিতেছেন, এইবার এস, আমরা একসঙ্গে বসে রান্না মাংস খাই। অভিনয়ে কর্ণ বলিতেছেন, তা আমি পারব না; পুত্রের মাংস খেতে পারব না।
একজন ভক্ত সহানুভূতি-ব্যঞ্জক অস্ফুট আর্তনাদ করিলেন। ঠাকুরও সেই সঙ্গে দুঃখপ্রকাশ করিলেন।
অভিনয় সমাপ্ত হইলে ঠাকুর রঙ্গমঞ্চের বিশ্রাম ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। গিরিশ, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে প্রবেশ করিয়া নরেন্দ্রের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন, আমি এসেছি।
[Concert বা সানাইয়ের শব্দে ভাবাবিষ্ট ]
ঠাকুর উপবেশন করিয়াছেন। এখনও ঐকতান বাদ্যের (কনসার্ট) শব্দ শুনা যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — এই বাজনা শুনে আমার আনন্দ হচ্ছে। সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) সানাই বাজত, আমি ভাবিবিষ্ট হয়ে যেতাম; একজন সাধু আমার অবস্থা দেখে বলত, এ-সব ব্রহ্মজ্ঞানের লক্ষণ।
[গিরিশ ও “আমি আমার” ]
কনসার্ট থামিয়া গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — এ কি তোমার থিয়েটার, না তোমাদের?
গিরিশ — আজ্ঞা আমাদের।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমাদের কথাটিই ভাল; আমার বলা ভাল নয়! কেউ কেউ বলে আমি নিজেই এসেছি; এ-সব হীনবুদ্ধি অহংকারে লোকে বলে।
[শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র প্রভৃতি সঙ্গে ]
নরেন্দ্র — সবই থিয়েটার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ হাঁ ঠিক। তবে কোথাও বিদ্যার খেলা, কোথাও অবিদ্যার খেলা।
নরেন্দ্র — সবই বিদ্যার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ হাঁ; তবে উটি ব্রহ্মজ্ঞানে হয়। ভক্তি-ভক্তের পক্ষে দুইই আছে; বিদ্যা মায়া, অবিদ্যা মায়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুই একটু গান গা।
নরেনদ্র গান গাহিতেছেন:
চিদানন্দ সিন্ধুনীর প্রেমানন্দের লহরী।
মহাভাব রাসলীলা কি মাধুরী মরি মরি।
বিবিধ বিলাস রঙ্গ প্রসঙ্গ, কত অভিনব ভাবতরঙ্গ,
ডুবিছে উঠিছে করিছে রঙ্গ নবীন রূপ ধরি।
(হরি হরি বলে)
মহাযোগে সমুদায় একাকার হইল,
দেশ-কাল, ব্যবধান, ভেদাভেদ ঘুচিল (আশা পুরিল রে, —
আমার সকল সাধ মিটে গেল)
এখন আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া
বল রে মন হরি হরি।
নরেন্দ্র যখন গাহিতেছেন, ‘মহাযোগে সব একাকার হইল’ তখন শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, এটি ব্রহ্মজ্ঞানে হয়; তুই যা বলছিলি, সবই বিদ্যা।
নরেন্দ্র যখন গাহিতেছেন, “আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া বল রে মন হরি হরি,” তখন শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, ওইটি দুবার করে বল্‌।
গান হইয়া গেলে আবার ভক্তসঙ্গে কথা হইতেছে।
গিরিশ — দেবেন্দ্রবাবু আসেন নাই; তিনি অভিমান করে বললেন, আমাদের ভিতরে তো ক্ষীরের পোর নাই; কলায়ের পোর। আমরা এসে কি করব?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিস্মিত হইয়া) — কই, আগে তো উনি ওরকম করতেন না?
ঠাকুর জলসেবা করিতেছেন, নরেন্দ্রকেও খাইতে দিলেন।
যতীন দেব (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি — “নরেনদ্র খাও” “ নরেনদ্র খাও” বলছেন, আমরা শালারা ভেসে এসেছি!
যতীনকে ঠাকুর খুব ভালবাসেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরে গিয়া মাঝে মাঝে দর্শন করেন; কখন কখন রাত্রেও সেখানে গিয়া থাকেন। তিনি শোভাবাজারের রাজাদের বাড়ির (রাধাকান্ত দেবের বাড়ির) ছেলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে) — ওরে (যতীন) তোর কথাই বলছে।
ঠাকুর হাসিতে হাসিতে যতীনের থুঁতি ধরে আদর করিতে করিতে বলিলেন, “সেখানে যাস, গিয়ে খাস!” অর্থাৎ “দক্ষিণেশ্বরে যাস।” ঠাকুর আবার বিবাহ-বিভ্রাট অভিনয় শুনবেন; বক্সে গিয়ে বসিলেন। ঝির কথাবার্তা শুনে হাসিতে লাগিলেন।
[গিরিশের অবতারবাদ — শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? ]
খানিকক্ষণ শুনিয়া অন্যমনস্ক হইলেন। মাস্টারের সহিত আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আচ্ছা, গিরিশ ঘোষ যা বলছে (অর্থাৎ অবতার) তা কি সত্য?
মাস্টার — আজ্ঞা ঠিক কথা; তা না হলে সবার মনে লাগছে কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, এখন একটি অবস্থা আসছে; আগেকার অবস্থা উলটে গেছে। ধাতুর দ্রব্য ছুঁতে পারছি না।
মাস্টার অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই যে নূতন অবস্থা, এর একটি খুব গুহ্য মানে আছে।
ঠাকুর ধাতু স্পর্শ করিতে পারিতেছেন না। অবতার বুঝি মায়ার ঐশ্বর্য কিছুই ভোগ করেন না, তাই কি ঠাকুর এই সব কথা বলিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আচ্ছা, আমার অবস্থা কিছু বদলাচ্ছে দেখছ?
মাস্টার — আজ্ঞা, কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কার্যে?
মাস্টার — এখন কাজ বাড়ছে — যত লোক জানতে পারছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখছ! আগে যা বলতুম এখন ফলছে?
ঠাকুর কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলছেন, “আচ্ছা, পল্টুর ভাল ধ্যান হয় না কেন?”
[গিরিশ কি রসুন গোলা বাটি? The Lord’s message of hope for so-called ‘Sinners’]
এইবার ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বর যাইবার উদ্যোগ হইতেছে।
ঠাকুর কোন ভক্তের কাছে গিরিশের সম্বন্ধে বলেছিলেন, “রসুন গোলা বাটি হাজার ধোও রসুনের গন্ধ কি একেবারে যায়?” গিরিশও তাই মনে মনে অভিমান করিয়াছেন; যাইবার সময় গিরিশ ঠাকুরকে কিছু নিবেদন করিতেছেন।
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — রসুনের গন্ধ কি যাবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — যাবে।
গিরিশ — তবে বললেন ‘যাবে’?
শ্রীরামকৃষ্ণ — অত আগুন জ্বললে গন্ধ-ফন্ধ পালিয়ে যায়। রসুনের বাটি পুড়িয়ে নিলে আর গন্ধ থাকে না, নূতন হাঁড়ি হয়ে যায়।
“যে বলে আমার হবে না, তার হয় না। মুক্ত-অভিমানী মুক্তই হয়, আর বদ্ধ-অভিমানী বদ্ধই হয়। যে জোর করে বলে আমি মুক্ত হয়েছি, সে মুক্তই হয়। যে রাতদিন ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ বলে, সে বদ্ধই হয়ে যায়।”
=========== 

Post a Comment

0 Comments