দ্বাদশ খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
পঞ্চম ভাগ 

দ্বাদশ খণ্ড

দ্বাদশ খণ্ড ~পঞ্চম ভাগ ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত

=============

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৮ই ডিসেম্বর

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদাই সমাধিস্থ; কেবল রাখালাদি ভক্তদের শিক্ষার জন্য তাঁহাদের লইয়া ব্যস্ত — কিসে চৈতন্য হয়।

তাঁহার ঘরের পশ্চিমের বারান্দায় সকাল বেলা বসিয়া আছেন। আজ মঙ্গলবার, অগ্রহায়ণ চতুর্থী; ১৮ই ডিসেম্বর, ১৮৮ত খ্রীষ্টাব্দ। ৺দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তি ও বৈরাগ্যের কথায় তিনি তাঁহার প্রশংসা করিতেছেন। রাখালাদি ছোকরা ভক্তদের দেখিয়া বলিতেছেন, তিনি ভাল লোক; কিন্তু যারা সংসারে না ঢুকিয়া ছেলেবেলা থেকে শুকদেবাদির মতো অহর্নিশ ঈশ্বরের চিন্তা করে, কৌমারবৈরাগ্যবান, তারা ধন্য!

“সংসারী লোকদের একটা না একটা কামনা বাসনা থাকে। এদিকে ভক্তিও বেশ দেখা যায়। সেজোবাবু কি একটা মোকদ্দমায় পড়েছিল — মা-কালীর কাছে, আমায় বলছে, বাবা, এই অর্ঘ্যটি মাকে দাও তো — আমি উদার মনে দিলাম।

“কিন্তু কেমন বিশ্বাস যে আমি দিলেই হবে।

“রতির মার এদিকে কত ভক্তি! প্রায় এসে কত সেবা। রতির মা বৈষ্ণবী। কিছুদিন পরে যাই দেখলে আমি মা-কালীর প্রসাদ খাই — অমনি আর এলো না! একঘেয়ে! লোককে দেখলে প্রথম প্রথম চেনা যায় না।”

শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের ভিতর পূর্বদিকের দরজার নিকট বসিয়া আছেন। শীতকাল, গায়ে মোলস্কিনের র‌্যাপার। হঠাৎ সূর্যদর্শন ও সমাধিস্থ। নিমেষশূন্য! বাহ্যশূন্য!

এই কি গায়ত্রী মন্ত্রের সার্থকতা — “তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি”?

অনেকক্ষণ পরে সমাধি ভঙ্গ হইল। রাখাল, হাজরা, মাস্টার প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — সমাধি, ভাব, প্রেমের বটে। ও-দেশে (শ্যামবাজারে) নটবর গোস্বামীর বাড়িতে কীর্তন হচ্ছিল — শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীগণ দর্শন করে সমাধিস্থ হলাম! বোধ হল আমার লিঙ্গ শরীর (সূক্ষ্ম শরীর) শ্রীকৃষ্ণের পায় পায় বেড়াচ্ছে!

“জোড়াসাঁকো হরিসভায় ওইরূপ কীর্তনের সময় সমাধি হয়ে বাহ্যশূন্য! সেদিন দেহত্যাগের সম্ভাবনা ছিল।”

শ্রীরামকৃষ্ণ স্নান করিতে গেলেন। স্নানান্তর ওই গোপী প্রেমের কথা বলিতেছেন।

(মণি প্রভৃতির প্রতি) — “গোপীদের ওই টানটুকু নিতে হয়!

“এই সব গান গাইবে:

সখি, সে বন কতদূর!
(যেখানে আমার শ্যামসুন্দর)
(আর চলিতে যে নারি!)

গান —   ঘরে যাবই যে না গো!
যে ঘরে কৃষ্ণ নামটি করা দায়। (সঙ্গিনীয়া)”

==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৮ই ডিসেম্বর

ঠনঠনিয়া ৺সিদ্ধেশ্বরী  মন্দিরে  শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীরামকৃষ্ণ রাখালের জন্য ৺সিদ্ধেশ্বরীকে ডাব-চিনি মানিয়াছেন। মণিকে বলিতেছেন, “তুমি ডাব, চিনির দাম দিবে।”

বৈকালে শ্রীরামকৃষ্ণ রাখাল, মণি প্রভৃতির সঙ্গে ঠনঠনের ৺সিদ্ধেশ্বরী-মন্দির অভিমুখে গাড়ি করিয়া আসিতেছেন। পথে সিমুলিয়ার বাজার, সেখানে ডাব, চিনি কেনা হইল।

মন্দিরে আসিয়া ভক্তদের বলিতেছেন, একটা ডাব কেটে চিনি দিয়ে মার কাছে দাও।

যখন মন্দিরে আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন পূজারীরা বন্ধু লইয়া মা-কালীর সম্মুখে তাস খেলিতেছিলেন। ঠাকুর দেখিয়া ভক্তদের বলিতেছেন, দেখেছ, এ-সব স্থানে তাস খেলা! এখানে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়।

এইবার শ্রীরামকৃষ্ণ যদু মল্লিকের বাটীতে আসিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে অনেকগুলি বাবু বসিয়া আছেন।

যদু বলিতেছেন, ‘এস’ ‘এস’। পরস্পর কুশল প্রশ্নের পর, শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি অত ভাঁড়, মোসাহেব রাখ কেন?

যদু (সহাস্যে) — তুমি উদ্ধার করবে বলে। (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — মোসাহেবরা মনে করে বাবু তাদের টাকা ঢেলে দেবে। কিন্তু বাবুর কাছে আদায় করা বড় কঠিন। একটা শৃগাল একটা বলদকে দেখে তার সঙ্গ আর ছাড়ে না। সে চরে বেড়ায়, ওটাও সঙ্গে সঙ্গে। শৃগালটা মনে করেছে ওর অণ্ডের কোষ ঝুলছে সেইটে কখন না কখন পড়ে যাবে আর আমি খাব। বলদটা কখন ঘুমোয়, সেও কাছে ঘুমোয়; আর যখন উঠে চড়ে বেড়ায়, সেও সঙ্গে সঙ্গে থাকে। কতদিন এইরূপে যায়, কিন্তু কোষটা পড়ল না; তখন সে নিরাশ হয়ে চলে গেল। (সকলের হাস্য) মোসাহেবের এইরূপই অবস্থা।

যদু ও তাঁহার মাতাঠাকুরানী শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তদের জলসেবা করাইলেন।

===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ মণি সঙ্গে—জ্ঞান ভক্তি কি দুই-ই কি হয় না ? 
বুধবার ১৯শে ডিসেম্বর ১৮৮৩ খৃঃ অঃ, বেলা ১টা হইয়া গিয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মণির কথা চলিতেছে (চতুর্থ ভাগ, ৭ম খণ্ডে বিবৃত) পঞ্চবটীমূলে।
মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—জ্ঞান ভক্তি দুইই কি হয় না ? .
শ্রীরামকৃষ্ণ—খুব উঁচু ঘরের হয়। ঈশ্বরকোটির হয় যেমন চৈতন্যদেবের।জীবকোটিদের আলাদা কথা।আলো (জ্যোতিঃ) পাঁচ প্রকার। দীপ আলােক, অন্যান্য অগ্নির আলো, চান্দ্র হলাে, সৌর আলাে ও চান্দ্র সৌর একাধারে। ভক্তি চন্দ্র ; জ্ঞানসূৰ্য্য। 
“কখনাে কখনাে আকাশে সূর্য অস্ত যেতে না যেতে চন্দ্রোদয় দেখা যায়। অবতারাদির ভক্তি-চন্দ্র জ্ঞান-সূৰ্য্য একাধানে দেখা যায়। মনে করলেই কি সকলের জ্ঞান ভক্তি একাধারে দুই হয়, আধার বিশেষ। কোন বাঁশের ফুটো বেশী, কোন বাঁশের খুব সরু ফুটো। ঈশ্বর বস্তু ধারণা কি সকল আধারে হয়। একসের ঘটীতে কি দু সের দুধ ধরে।” 
মণি—কেন, তার কৃপায় ? তিনি কৃপা করলে তাে ছুঁচের ভিতর উট যেতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু কৃপা কি এমনি হয় ? ভিখারী যদি পয়সা চায় দেওয়া যায়। কিন্তু একবারে যদি রেলভাড়া চেয়ে বসে ! 
মণি নিঃশব্দে দণ্ডায়মান। রামকৃষ্ণও চুপ করিয়া আছেন। হঠাৎ বলিতেছেন, হাঁ বটে , কারু কারু আধারে তার কৃপা হলে হতে পারে ; দুইই হতে পারে।
প্রণাম পূৰ্ব্বক মণি বেলতলার দিকে যাইতেছেন। 
বেলতলা হইতে ফিরিতে দুপ্রহর হইয়া গিয়াছে। দেরী দেখিয়া রামকৃষ্ণ বেলতলার দিকে আসিতেছেন। মণি সতরঞ্জি, আসন, জলের ঘটি লইয়া ফিরিতেছেন, পঞ্চবটীর কাছে ঠাকুরের সহিত দেখা হইল। তিনি অমনি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি )—আমি যাচ্ছিলাম তােমায় খুঁজতে। ভাবলাম এতাে বেলা, বুঝি পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে পালালো। তােমার চোখ তখন যা দেখছিলাম—ভাবলাম বুঝি নারাণ শাস্ত্রীর মত পালালাে। তারপর ভাবলাম, না সে পালাবে না; সে অনেক ভেবে চিন্তে কাজ করে।


==========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৯শে ডিসেম্বর

শ্রীরামকৃষ্ণ মণি প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

আবার রাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত কথা কহিতেছেন। রাখাল, লাটু, হরিশ প্রভৃতি আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আচ্ছা, কেহ কেহ কৃষ্ণলীলার অধ্যাত্ম ব্যাখ্যা করে; তুমি কি বল?

মণি — নানা মত, তা হলেই বা। ভীষ্মদেবের কথা আপনি বলেছেন — শরশয্যায় দেহত্যাগের সময় বলেছিলেন, ‘কেন কাঁদছি? যন্ত্রণার জন্য নয়। যখন ভাবছি যে, সাক্ষাৎ নারায়ণ অর্জুনের সারথি হয়েছিলেন অথচ পাণ্ডবদের এত বিপদ, তখন তাঁর লীলা কিছুই বুঝতে পারলাম না — তাই কাঁদছি।’

“আবার হনুমানের কথা আপনি বলেছিলেন — হনুমান বলতেন, ‘আমি বার, তিথি, নক্ষত্র — এ-সব জানি না, আমি কেবল এক রামচিন্তা করি।’

“আপনি তো বলেছেন, দুটি জিনিস বই তো আর কিছু নাই — ব্রহ্ম আর শক্তি। আর বলেছেন, জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) হলে ওই দুইটি এক বোধ হয়; যে একের দুই নাই।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ বটে; চীজ নেবে তা কাঁটাবন দিয়েই হউক আর ভাল রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েই হউক।

“নানা মত বটে। ন্যাংটা বলত, মতের জন্য সাধুসেবা হল না। এক জায়গায় ভাণ্ডারা হচ্ছিল। অনেক সাধু সম্প্রদায়; সবাই বলে আমাদের সেবা আগে, তারপর অন্য সম্প্রদায়। কিছুই মিমাংসা হল না; শেষে সকলে চলে গেল! আর বেশ্যাদের খাওয়ানো হল!”

মণি — তোতাপুরী খুব লোক।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাজরা বলে অমনি (সামান্য)। না বাবু, কথায় কাজ নাই — সবাই বলে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে।

“দেখ, নারাণ শাস্ত্রীর খুব বৈরাগ্য হয়েছিল। অত বড় পণ্ডিত — স্ত্রী ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মন থেকে একেবারে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করলে তবে যোগ হয়। কারু কারু যোগীর লক্ষণ দেখা যায়।

“তোমায় ষট্‌চক্রের বিষয় কিছু বলে দিতে হবে। যোগীরা ষট্‌চক্র ভেদ করে তাঁর কৃপায় তাকে দর্শন করে। ষট্‌চক্র শুনেছ?”

“মণি — বেদান্তমতে সপ্তভূমি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বেদান্ত নয়, বেদ মত। ষট্‌চক্র কিরকম জান? সূক্ষ্মদেহের ভিতর সব পদ্ম আছে — যোগীরা দেখতে পায়। যেমন মোমের গাছের ফলপাতা।

মণি — আজ্ঞা হাঁ, যোগীরা দেখতে পায়। একটা বইয়ে আছে, একরকম কাচ (Magnifier) আছে, তার ভিতর দিয়ে দেখলে খুব ছোট জিনিস বড় দেখায়। সেইরূপ যোগের দ্বারা ওই সব সূক্ষ্মপদ্ম দেখা যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীর ঘরে থাকিতে বলিয়াছেন। মণি ওই ঘরে রাত্রিবাস করিতেছেন।

প্রত্যূষে ওই ঘরে একাকী গান গাহিতেছেন:

গৌর হে আমি সাধন-ভজনহীন
পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন ৷৷
চরণ পাবো পাবো বলে হে,
(চরণ তো আর পেলাম না, গৌর!)
আমার আশায় আশায় গেল দিন!

হঠাৎ জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। “পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন!” — এই কথা শুনিয়া তাঁহার চক্ষু, কি আশ্চর্য, অশ্রুপূর্ণ হইয়াছে।

আবার একটি গান হইতেছে:

আমি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে পরিব
শঙ্খের কুণ্ডল পরি।
আমি যোগিনীর বেশে যাব সেই দেশে,
যেখানে নিঠুর হরি ৷৷

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল বেড়াইতেছেন।

পরদিন শুক্রবার, ২১শে ডিসেম্বর (৭ই পৌষ, কৃষ্ণা অষ্টমী)। সকালবেলা শ্রীরামকৃষ্ণ একাকী বেলতলায় মণির সঙ্গে অনেক কথা কহিতেছেন। সাধনের নানা গুহ্যকথা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা। আর কখনও কখনও মনই গুরু হয় — এ-সব কথা বলিতেছেন।

আহারের পর পঞ্চবটীতে আসিয়াছেন — মনোহর পীতাম্বরধারী! পঞ্চবটীতে দু-তিনজন বাবাজী বৈষ্ণব আসিয়াছেন — একজন বাউল। তিনি বৈষ্ণবকে বলছেন, তোর ডোরকৌপীনের স্বরূপ বল দেখি!

অপরাহ্নে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুকে বলিতেছেন, ডুব দাও; উপর উপর ভাসলে রত্ন পাওয়া যায় না। আর ঈশ্বর নিরাকারও বটেন আবার সাকার। সাকার চিন্তা করলে শীঘ্র ভক্তি হয়। তখন আবার নিরাকার চিন্তা। যেমন পত্র পড়ে নিয়ে সে পত্র ফেলে দেয়। তারপর লেখা অনুসারে কাজ করে।

============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২২শে ডিসেম্বর

দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে — বলরামের পিতা প্রভৃতি

আজ শনিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। এখন বেলা নয়টা হইবে। বলরামের পিতা আসিয়াছেন। রাখাল, হরিশ, মাস্টার, লাটু এখানে বাস করিতেছেন। শ্যামপুকুরের দেবেন্দ্র ঘোষ আসিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।

একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করিতেছেন — ভক্তি কিসে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতা প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — এগিয়ে পড়। সাত দেউড়ির পর রাজা আছেন। সব দেউড়ি পার হয়ে গেলে তবে তো রাজাকে দেখবে।

“আমি চানকে অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠার সময় দ্বারিকবাবুকে বলেছিলাম, (১৮৭৪-৭৫) বড় দীঘিতে বড় মাছ আছে গভীর জলে। চার ফেলে, সেই চারের গন্ধে ওই বড় মাছ আসবে। এক-একবার ঘাই দেবে। প্রেম-ভক্তিরূপ চার।”

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব ]

“ঈশ্বর নরলীলা করেন। মানুষে তিনি অবতীর্ণ হন, যেমন শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, চৈতন্যদেব।

“আমি কেশব সেনকে বলেছিলাম যে, মানুষের ভিতর তিনি বেশি প্রকাশ। মাঠের আলোর ভিতে ছোট ছোট গর্ত থাকে; তাহাদের বলে ঘুটী। ঘুটীর ভিতর মাছ, কাঁকড়া জমে থাকে। মাছ, কাঁকড়া খুঁজতে গেলে ওই ঘুটীর ভিতর খুঁজতে হয়; ঈশ্বরকে খুঁজতে হলে অবতারের ভিতর খুঁজতে হয়।

“ওই চৌদ্দপোয়া মানুষের ভিতরে জগন্মাতা প্রকাশ হন। গানে আছে —

শ্যামা মা কি কল করেছে!
চৌদ্দপোয়া কলের ভিতরি কত রঙ্গ দেখাতেছে!
আপনি থাকি কলের ভিতরি       কল ঘুরায় ধরে কলডুরি,
কল বলে আপনি ঘুরি জানে না কে ঘোরাতেছে।

“কিন্তু ঈশ্বরকে জানতে হলে, অবতারকে চিনতে গেলে, সাধনের প্রয়োজন। দীঘিতে বড় বড় মাছ আছে, চার ফেলতে হয়। দুধেতে মাখন আছে, মন্থন করতে হয়। সরিষার ভিতর তেল আছে, সরিষাকে পিষতে হয়। মেথিতে হাত রাঙা হয়, মেথি বাটতে হয়।”

[নিরাকার সাধনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ ]

ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আচ্ছা, তিনি সাকার না নিরাকার?

শ্রীরামকৃষ্ণ — দাঁড়াও, আগে কলকাতায় যাও তবে তো জানবে, কোথায় গড়ের মাঠ, কোথায় এসিয়াটিক সোসাইটি, কোথায় বাঙ্গাল ব্যাঙ্ক!

“খড়দা বামুনপাড়া যেতে হলে আগে তো খড়দায় পৌঁছুতে হবে।

“নিরাকার সাধনা হবে না কেন; তবে বড় কঠিন। কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না হলে হয় না! বাহিরে ত্যাগ আবার ভিতরে ত্যাগ। বিষয়বুদ্ধির লেশ থাকলে হবে না।

“সাকার সাধনা সোজা। তবে তেমন সোজা নয়।

“নিরাকার সাধনা, জ্ঞানযোগের সাধনা, ভক্তদের কাছে বলতে নাই। অনেক কষ্টে একটু ভক্তি হচ্ছে, সব স্বপ্নবৎ বললে ভক্তির হানি হয়।

“কবীর দাস নিরাকারবাদী। শিব, কালী, কৃষ্ণ এদের মানত না। কবীর বলত, কালী চাল কলা খান; কৃষ্ণ গোপীদের হাততালিতে বানর নাচ নাচতেন। (সকলের হাস্য)

“নিরাকার সাধক হয়তো আগে দশভুজা দর্শন করলে; তারপর চতুর্ভুজ, তারপর দ্বিভুজ গোপাল; শেষে অখণ্ড জ্যোতিঃ দর্শন করে তাইতে লীন।

“দত্তাত্রেয়, জড়ভরত ব্রহ্মদর্শনের পর আর ফের নাই — এরূপ আছে।

“একমতে আছে শুকদেব সেই ব্রহ্ম-সমুদ্রের একটি বিন্দুমাত্র আস্বাদ করেছিলেন। সমুদ্রের হিল্লোল-কল্লোল দর্শন, শ্রবণ করেছিলেন; কিন্তু সমুদ্রে ডুব দেন নাই।

“একজন ব্রহ্মচারী বলেছিল, কেদারের ওদিকে গেলে শরীর থাকে না। সেইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানের পর আর শরীর থাকে না। একুশ দিনে মৃত্যু।

“প্রাচীরের ওপারে অনন্ত মাঠ। চারজন বন্ধু প্রাচীরের ওপারে কি আছে দেখতে চেষ্টা করলে। এক-একজন প্রাচিরের উপর উঠে, ওই মাঠ দর্শন করে হা হা করে হেসে অপরপারে পড়ে যেতে লাগল। তিনজন কোন খপর দিলে না। একজন শুধু খপর দিলে। তার ব্রহ্মজ্ঞানের পরও শরীর রইল, লোকশিক্ষার জন্য। যেমন অবতার আদির।

“হিমালয়ের ঘরে পার্বতী জন্মগ্রহণ করলেন; আর পিতাকে তাঁর নানান রূপ দেখাতে লাগলেন। হিমালয় বললেন, মা, এ-সব রূপ তো দেখলাম। কিন্তু তোমার একটি ব্রহ্মস্বরূপ আছে — সেইটি একবার দেখাও। পার্বতী বললেন, বাবা, তুমি যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও, তাহলে সংসারত্যাগ করে সাদুসঙ্গ করতে হবে।

“হিমালয় কোনমতে ছাড়েন না। তখন পার্বতী একবার দেখালেন। দেখতেই গিরিরাজ একেবারে মূর্ছিত।”

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তিযোগ ]

“এ যা বললুম সব বিচারের কথা। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা — এই বিচার। সব স্বপ্নবৎ! বড় কঠিন পথ। এ-পথে তাঁর লীলা স্বপ্নবৎ, মিথ্যা হয়ে যায়। আবার ‘আমি’টাও উড়ে যায়। এ-পথে অবতারও মানে না। বড় কঠিন। এ-সব বিচারের কথা ভক্তদের বেশি শুনতে নাই।

“তাই ঈশ্বর অবতীর্ণ হয়ে ভক্তির উপদেশ দেন। শরণাগত হতে বলেন। ভক্তি থেকে তাঁর কৃপায় সব হয় — জ্ঞান, বিজ্ঞান সব হয়।

“তিনি লীলা করছেন — তিনি ভক্তের অধীন।

“কোন কলের ভক্তিডোরে আপনি শ্যামা বাঁধা আছে!

“কখনও ঈশ্বর চুম্বক হন, ভক্ত ছুঁচ হয়। আবার কখনও ভক্ত চুম্বক হয়, তিনি ছুঁচ হন। ভক্ত তাঁকে টেনে লয় — তিনি ভক্তবৎসল, ভক্তাধীন।

“এক মতে আছে যশোদাদি গোপীগণ পূর্বজন্মে নিরাকারাবাদী ছিলেন। তাঁদের তাতে তৃপ্তি হয় নাই। বৃন্দাবনলীলায় তাই শ্রীকৃষ্ণকে লয়ে আনন্দ। শ্রীকৃষ্ণ একদিন বললেন, তোমাদের নিত্যধাম দর্শন করাবো, এসো যমুনায় স্নান করতে যাই। তাঁরা যাই ডুব দিয়েছেন — একেবারে গোলকদর্শন। আবার তারপর অখণ্ড জ্যোতিঃ দর্শন। যশোদা তখন বললেন, কৃষ্ণ রে ও-সব আর দেখতে চাই না — এখন তোর সেই মানুষরূপ দেখবো! তোকে কোলে করবো, খাওয়াবো।

“তাই অবতারে তিনি বেশি প্রকাশ। অবতারের শরীর থাকতে থাকতে তাঁর পূজা সেবা করতে হয়।

‘সে যে কোঠার ভিতর চোরকুঠরি
ভোর হলে সে লুকাবে রে।’

“অবতারকে সকলে চিনতে পারে না। দেহধারণ করলে রোগ, শোক, ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবই আছে, মনে হয়, আমাদেরই মতো। রাম সীতার শোকে কেঁদেছিলেন —

‘পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।’

“পুরাণে আছে, হিরণ্যাক্ষ বধের পর বরাহ অবতার নাকি ছানা-পোনা নিয়ে ছিলেন — তাদের মাই দিচ্ছিলেন। (সকলের হাস্য) স্বধামে যাবার নামটি নাই। শেষে শিব এসে ত্রিশূল দিয়ে শরীর নাশ করলে, তিনি হি-হি করে হেসে স্বধামে গেলেন।”
=========

ষষ্ট পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২২শে ডিসেম্বর

শ্রীরামকৃষ্ণ, ভবনাথ, রাখাল, মণি লাটু প্রভৃতি সঙ্গে

বৈকালে ভবনাথ আসিয়াছেন। ঘরে রাখাল, মাস্টার, হরিশ প্রভৃতি আছেন। শনিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি) — অবতারের উপর ভালবাসা এলেই হল। আহা গোপীদের কি ভালবাসা!

এই বলিয়া গান গাহিতেছেন গোপীদের ভাবে:

গান — শ্যাম তুমি পরাণের পরাণ।
গান — ঘরে যাবই যে না গো (সঙ্গিনীয়া)
গান — সেদিন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে।
(বঁধু যখন বিপিন যাও, বিপিন যাও)
(বঁধু ইচ্ছা হয়, ইচ্ছা হয় রাখাল হয়ে তোমার বাধা মাথায় বই!)

“রাসমধ্যে যখন শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন, গোপীরা একেবারে উন্মাদিনী। বৃক্ষ দেখে বলে, তুমি বুঝি তপস্বী, শ্রীকৃষ্ণকে নিশ্চয় দেখেছ! তা না হলে নিশ্চল, সমাধিস্থ হয়ে রয়েছ কেন? তৃণাচ্ছাদিত পৃথিবী দেখে বলে, হে পৃথিবী, তুমি নিশ্চিত তাঁকে দর্শন করেছ, না হলে তুমি রোমাঞ্চিত হয়ে রয়েছ কেন? অবশ্য তুমি তাঁর স্পর্শসুখ সম্ভোগ করেছ! আবার মাধবীকে দেখে বলে, ‘ও মাধবী, আমায় মাধব দে!’ গোপীদের প্রেমোন্মাদ!

“যখন অক্রূর এলেন, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম মথুরা যাবার জন্য তাঁর রথে উঠলেন, তখন গোপীরা রথের চাকা ধরে রইলেন, যেতে দেবেন না।”

এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ আবার গান গাহিতেছেন:

ধরো না ধরো না রথচক্র, রথ কি চক্রে চলে!
যে চক্রের চক্রী হরি, যাঁর চক্রে জগৎ চলে!

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “রথ কি চক্রে চলে” — এ-কথাগুলি আমার বড় লাগে। “যে চক্রে ব্রহ্মাণ্ড ঘোরে!” “রথীর আজ্ঞা লয়ে সারথি চালায়!”

Post a Comment

0 Comments