বুদ্ধদেব ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

পঞ্চবিংশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে

বুদ্ধদেব ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

প্রথম পরিচ্ছেদ

বুদ্ধদেব ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে আছেন। আজ শুক্রবার বেলা ৫টা, চৈত্র শুক্লা পঞ্চমী। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬।
নরেন্দ্র, কালী, নিরঞ্জন, মাস্টার নিচে বসিয়া কথা কহিতেছেন।
নিরঞ্জন (মাস্টারের প্রতি) — বিদ্যাসাগরের নূতন একটা স্কুল নাকি হবে? নরেনকে এর একটা কর্ম যোগাড় করে —
নরেন্দ্র — আর বিদ্যাসাগরের কাছে চাকরি করে কাজ নাই!
নরেনদ্র বুদ্ধগয়া হইতে সবে ফিরিয়াছেন। সেখানে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করিয়াছেন এবং সেই মূর্তির সম্মুখে গভির ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছিলেন। যে বৃক্ষের নিচে বুদ্ধদেব তপস্যা করিয়া নির্বাণ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেই বৃক্ষের স্থানে একটি নূতন বৃক্ষ হইয়াছে, তাহাও দর্শন করিয়াছিলেন। কালী বলিলেন, “একদিন গয়ার উমেশ বাবুর বাড়িতে নরেন্দ্র গান গাইয়াছিলেন, — মৃদঙ্গ সঙ্গে খেয়াল, ধ্রুপদ ইত্যাদি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ হলঘরে বিছানায় বসিয়া। রাত্রি কয়েক দণ্ড হইয়াছে। মণি একাকী পাখা করিতেছেন। — লাটু আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — একখানি গায়ের চাদর ও একজোড়া চটি জুতা আনবে।
মণি — যে আজ্ঞা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (লাটুকে) — চাদর দশ আনা ও জুতা, সর্বসুদ্ধ কত দাম?
লাটু — একটাকা দশ আনা।
ঠাকুর মণিকে দামের কথা শুনিতে ইঙ্গিত করিলেন।
নরেন্দ্র আসিয়া উপবিষ্ট হলেন। শশী, রাখাল ও আরও দু-একটি ভক্ত আসিয়া বসিলেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিত করিয়া নরেন্দ্রকে বলিতেছেন — “খেয়েছিস?”
[বুদ্ধদেব কি নাস্তিক? “অস্তি নাস্তির মধ্যের অবস্থা” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে) — ওখানে (অর্থাৎ বুদ্ধগয়ায়) গিছল।
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি) — বুদ্ধদেবের কি মত?
নরেন্দ্র — তিনি তপস্যার পর কি পেলেন, তা মুখে বলতে পারেন নাই। তাই সকলে বলে, নাস্তিক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ইঙ্গিত করিয়া) — নাস্তিক কেন? নাস্তিক নয়, মুখে বলতে পারে নাই। বুদ্ধ কি জানো? বোধ স্বরূপকে চিন্তা করে করে, — তাই হওয়া, — বোধ স্বরূপ হওয়া।
নরেন্দ্র — আজ্ঞে হাঁ। এদের তিন শ্রেণী আছে, — বুদ্ধ, অর্হৎ আর বোধিসত্ত্ব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এ তাঁরই খেলা, — নূতন একটা লীলা।
“নাস্তিক কেন হতে যাবে! যেখানে স্বরূপকে বোধ হয়, সেখানে অস্তি-নাস্তির মধ্যের অবস্থা।”
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি) — যে অবস্থায় contradictions meet, যে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন-এ শীতল জল তৈয়ার হয়, সেই হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়ে Oxyhydrogen-blowpipe (জ্বলন্ত অত্যুষ্ণ অগ্নিশিখা) উৎপন্ন হয়।
“যে অবস্থায় কর্ম, কর্মত্যাগ দুইই সম্ভবে, অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম।
“যারা সংসারী, ইন্দ্রিয়ের বিষয় নিয়ে রয়েছে, তারা বলেছে, সব ‘অস্তি’; আবার মায়াবাদীরা বলছে, — ‘নাস্তি’; বুদ্ধের অবস্থা এই ‘অস্তি’ ‘নাস্তির’ পরে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — এ অস্তি নাস্তি প্রকৃতির গুণ। যেখানে ঠিক ঠিক সেখানে অস্তি নাস্তি ছাড়া।
ভক্তেরা কিয়ৎক্ষণ সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
[বুদ্ধদেবের দয়া ও বৈরাগ্য ও নরেন্দ্র ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — ওদের (বুদ্ধদেবের) কি মত?
নরেন্দ্র — ঈশ্বর আছেন, কি, না আছেন, এ-সব কথা বুদ্ধ বলতেন না। তবে দয়া নিয়ে ছিলেন।
“একটা বাজ পক্ষী শিকারকে ধরে তাকে খেতে যাচ্ছিল, বুদ্ধ শিকারটির প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিজের গায়ের মাংস তাকে দিয়েছিলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র উৎসাহের সহিত বুদ্ধদেবের কথা আরও বলিতেছেন।
নরেন্দ্র — কি বৈরাগ্য! রাজার ছেলে হয়ে সব ত্যাগ করলে! যাদের কিছু নাই — কোনও ঐশ্বর্য নাই, তারা আর কি ত্যাগ করবে।
“যখন বুদ্ধ হয়ে নির্বাণলাভ করে বাড়িতে একবার এলেন, তখন স্ত্রীকে, ছেলেকে — রাজ বংশের অনেককে — বৈরাগ্য অবলম্বন করতে বললেন। কি বৈরাগ্য! কিন্তু এ-দিকে ব্যাসদেবের আচরণ দেখুন, — শুকদেবকে বারণ করে বললেন, পুত্র! সংসারে থেকে ধর্ম কর!”
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। এখনও কোন কথা বলিতেছেন না।
নরেন্দ্র — শক্তি-ফক্তি কিছু (বুদ্ধ) মানতেন না। — কেবল নির্বাণ। কি বৈরাগ্য! গাছতলায় তপস্যা করতে বসলেন, আর বললেন — ইহৈব শুষ্যতু মে শরীরম্‌! অর্থাৎ যদি নির্বাণলাভ না করি, তাহলে আমার শরীর এইখানে শুকিয়ে যাক — এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা!
“শরীরই তো বদমাইস! — ওকে জব্দ না করলে কি কিছু! –”
শশী — তবে যে তুমি বল, মাংস খেলে সত্ত্বগুণ হয়। — মাংস খাওয়া উচিত, এ-কথা তো বল।
নরেন্দ্র — যেমন মাংস খাই, — তেমনি (মাংসত্যাগ করে) শুধু ভাতও খেতে পারি — লুন না দিয়েও শুধু ভাত খেতে পারি।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন। আবার বুদ্ধদেবের কথা ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — (বুদ্ধদেবের) কি, মাথায় ঝুঁটি?
নরেন্দ্র — আজ্ঞা না, রুদ্রাক্ষের মালা অনেক জড় করলে যা হয়, সেই রকম মাথায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — চক্ষু?
নরেন্দ্র — চক্ষু সমাধিস্থ।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ দর্শন — “আমিই সেই” ]
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র ও অন্যান্য ভক্তেরা তাঁহাকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন। হঠাৎ তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া আবার নরেন্দ্রের সঙ্গে কথা আরম্ভ করিলেন। মণি হাওয়া করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) — আচ্ছা, — এখানে সব আছে, না? — নাগাদ মুসুর ডাল, ছোলার ডাল, তেঁতুল পর্যন্ত।
নরেন্দ্র — আপনি ও-সব অবস্থা ভোগ করে, নিচে রয়েছেন! —
মণি (স্বগত) — সব অবস্থা ভোগ করে, ভক্তের অবস্থায়! —
শ্রীরামকৃষ্ণ — কে যেন নিচে টেনে রেখেছে!
এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির হাত হইতে পাখাখানি লইলেন এবং আবার কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই পাখা যেমন দেখছি, সামনে — প্রত্যক্ষ — ঠিক অমনি আমি (ঈশ্বরকে দেখেছি! আর দেখলাম —
এই বলিয়া ঠাকুর নিজের হৃদয়ে হাত দিয়া ইঙ্গিত করিতেছেন, আর নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, “কি বললুম বল দেখি?”
নরেন্দ্র — বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বল দেখি?
নরেন্দ্র ভাল শুনিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ইঙ্গিত করিতেছেন, — দেখলাম, তিনি (ঈশ্বর) আর হৃদয় মধ্যে যিনি আছেন এক ব্যক্তি।
নরেনদ্র — হাঁ, হাঁ, সোঽহম্‌।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে একটি রেখামাত্র আছে — (‘ভক্তের আমি’ আছে) সম্ভোগের জন্য।
নরেনদ্র (মাস্টারকে) — মহাপুরুষ নিজে উদ্ধার হয়ে গিয়ে জীবের উদ্ধারের জন্য থাকেন, — অহঙ্কার নিয়ে থাকেন — দেহের সুখ-দুঃখ নিয়ে থাকেন।
“যেমন মুটেগিরি, আমাদের মুটেগিরি on compulsion (কারে পড়ে)। মহাপুরুষ মুটেগিরি করেন সখ করে।”
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও গুরুকৃপা ]
আবার সকলে চুপ করিয়া আছেন। অহেতুক-কৃপাসিন্ধু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন। আপনি কে, এই তত্ত্ব নরেন্দ্রাদি ভক্তগণকে আবার বুঝাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) — ছাদ তো দেখা যায়! — কিন্তু ছাদে উঠা বড় শক্ত!
নরেন্দ্র — আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে যদি কেউ উঠে থাকে, দড়ি ফেলে দিলে আর-একজনকে তুলে নিতে পারে।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পাঁচপ্রকার সমাধি ]
“হৃষীকেশের সাধু এসেছিল। সে (আমাকে) বললে, কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!
“কখন কপিবৎ — দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।
“কখন মীনবৎ — মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
“কখন বা পক্ষীবৎ — দেহবৃক্ষে পাখির ন্যায় কখনও এডালে কখনও ও-ডালে।
“কখন পিপীলিকাবৎ — মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়। কখন বা তির্যক্‌বৎ — অর্থাৎ মাহবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”
রাখাল (ভক্তদের প্রতি) — থাক আর কথায়, — অনেক কথা হয়ে গেল; — অসুখ করবে।
===========

Post a Comment

0 Comments