দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে জন্মাষ্টমীদিবসে ভক্তসঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

ষড়বিংশ খণ্ড
দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে জন্মাষ্টমীদিবসে ভক্তসঙ্গে

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে জন্মাষ্টমীদিবসে ভক্তসঙ্গে

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

সুবোধের আগমন — পূর্ণ মাস্টার, গঙ্গাধর, ক্ষীরোদ, নিতাই
শ্রীরামকৃষ্ণ সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বিশ্রাম করিতেছেন। রাত আটটা। সোমবার ১৬ই ভাদ্র, শ্রাবণ-কৃষ্ণা-ষষ্ঠী, ৩১শে অগস্ট ১৮৮৫।
ঠাকুর অসুস্থ — গলায় অসুখের সূত্রপাত হইয়াছে। কিন্তু নিশিদিন এক চিন্তা, কিসে ভক্তদের মঙ্গল হয়। এক-একবার বালকের ন্যায় অসুখের জন্য কাতর। পরক্ষণেই সব ভুলিয়া গিয়া ঈশ্বরের প্রেমে মাতোয়ারা। আর ভক্তদের প্রতি স্নেহ ও বাৎসল্যে উন্মত্তপ্রায়।
দুইদিন হইল — গত শনিবার রাত্রে — শ্রীযুক্ত পূর্ণ পত্র লিখিয়াছেন — ‘আমার খুব আনন্দ হয়। মাঝে মাঝে রাত্রে আনন্দে ঘুম হয় না!’
ঠাকুর পত্রপাঠ শুনিয়া বলিয়াছিলেন, “আমার গায়ে রোমাঞ্চ হচ্ছে! ওই আনন্দের অবস্থা ওর পরে থেকে যাবে; দেখি চিঠিখানা।”
পত্রখানি হাতে করে মুড়ে টিপে বলিতেছেন, “অন্যের চিঠি ছুঁতে পারি না; এর বেশ ভাল চিঠি।”
সেই রাত্রে একটু শুইয়াছেন। হঠাৎ গায়ে ঘাম — শয্যা হইতে উঠিয়া বলিতেছেন, “আমার বোধ হচ্ছে, এ-অসুখ সারবে না।”
এই কথা শুনিয়া ভক্তেরা সকলেই চিন্তিত হইয়াছেন।
শ্রীশ্রীমা ঠাকুরের সেবা করিবার জন্য আসিয়াছেন ও অতি নিভৃতে নবতে বাস করেন। নবতে তিনি যে আছেন, ভক্তেরা প্রায় কেহ জানিতেন না। একটি ভক্ত স্ত্রীলোক (গোলাপ মা)-ও কয়দিন নবতে আছেন। তিনি ঠাকুরের ঘরে প্রায় আসেন ও দর্শন করেন।
আজ সোমবার। ঠাকুর অসুস্থ রহিয়াছেন। রাত প্রায় আটটা হইয়াছে। ঠাকুর ছোট খাটটিতে পেছন ফিরিয়া দক্ষিণদিকে শিয়র করিয়া শুইয়া আছেন। গঙ্গাধর সন্ধ্যার পর কলিকাতা হইতে মাস্টারের সহিত আসিয়াছেন। তিনি তাঁহার চরণপ্রান্তে বসিয়া আছেন। ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দুটি ছেলে এসেছিল। শঙ্কর ঘোষের নাতির ছেলে (সুবোধ) আর একটি তাদের পাড়ার ছেলে (ক্ষীরোদ)। বেশ ছেলে দুটি। তাদের বললাম, আমার এখন অসুখ, তোমার কাছে গিয়ে উপদেশ নিতে। তুমি একটু যত্ন করো।
মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ, আমাদের পাড়ায় তাদের বাড়ি।
[অসুখের সূত্রপাত — ভগবান ডাক্তার — নিতাই ডাক্তার ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — সেদিন আবার গায়ে দিয়ে ঘুম ভেঙে গিছল। এ অসুখটা কি হল!
মাস্টার — আজ্ঞা, আমরা একবার ভগবান রুদ্রকে দেখাব, ঠিক করেছি। এম. ডি. পাশ করা। খুব ভাল ডাক্তার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কত নেবে?
মাস্টার — অন্য জায়গা হলে কুড়ি-পঁচিশ টাকা নিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে থাক।
মাস্টার — আজ্ঞা, আমরা হদ্দ চার-পাঁচ টাকা দেব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, এইরকম করে যদি একবার বলো, ‘দয়া করে তাঁকে দেখবেন চলুন।’ এখানকার কথা কিছু শুনে নাই?
মাস্টার — বোধ হয় শুনেছে। একরকম কিছু নেবে না বলেছে তবে আমরা দেব; কেন না, তাহলে আবার আসবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নিতাইকে (ডাক্তার) আনো তো সে বরং ভাল। আর ডাক্তাররা এসেই বা কি করছে? কেবল টিপে বাড়িয়ে দেয়।
রাত নয়টা — ঠাকুর একটু সুজির পায়স খাইতে বসিলেন।
খাইতে কোন কষ্ট হইল না। তাই আনন্দ করিতে করিতে মাস্টারকে বলিতেছেন, “একটু খেতে পারলাম, মনটায় বেশ আনন্দ হল।”
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

জন্মাষ্টমীদিবসে নরেন্দ্র, রাম, গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[বলরাম, মাস্টার, গোপালের মা, রাখাল, লাটু, ছোট নরেন, পাঞ্জাবী সাধু, নবগোপাল, কাটোয়ার বৈষ্ণব,রাখাল ডাক্তার ]
আজ জন্মাষ্টমী, মঙ্গলবার। ১৭ই ভাদ্র; ১লা সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫। ঠাকুর স্নান করিবেন। একটি ভক্ত তেল মাখাইয়া দিতেছেন। ঠাকুর দক্ষিণের বারান্দায় বসিয়া তেল মাখিতেছেন। মাস্টার গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
স্নানান্তে ঠাকুর গামছা পরিয়া দক্ষিণাস্য হইয়া সেই বারান্দা হইতেই ঠাকুরদের উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিতেছেন। শরীর অসুস্থ বলিয়া কালীঘরে বা বিষ্ণুঘরে যাইতে পারিলেন না।
আজ জন্মাষ্টমী — রামাদি ভক্তেরা ঠাকুরের জন্য নববস্ত্র আনিয়াছেন। ঠাকুর নববস্ত্র পরিধান করিয়াছেন — বৃন্দাবনী কাপড় ও গায়ে লাল চেলী। তাঁহার শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ দেহ নববস্ত্রে শোভা পাইতে লাগিল। বস্ত্র পরিধান করিয়াই তিনি ঠাকুরদের প্রণাম করিলেন।
আজ জন্মাষ্টমী। গোপালের মা গোপালের জন্য কিছু খাবার করিয়া কামারহাটি হইতে আনিয়াছেন। তিনি আসিয়া ঠাকুরকে দুঃখ করিতে করিতে বলিতেছেন, “তুমি তো খাবে না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই দেখো, অসুখ হয়েছে।
গোপালের মা — আমার অদৃষ্ট! — একটু হাতে করো!
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি আশীর্বাদ করো।
গোপালের মা ঠাকুরকেই গোপাল বলিয়া সেবা করিতেন।
ভক্তেরা মিছরি আনিয়াছেন। গোপালের মা বলিতেছেন, “এ মিছরি নবতে নিয়ে যাই।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “এখানে ভক্তদের দিতে হয়। কে একশ বার চাইবে, এখানেই থাক।”
বেলা এগারটা। কলিকাতা হইতে ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে আসিতেছেন। শ্রীযুক্ত বলরাম, নরেন্দ্র, ছোট নরেন, নবগোপাল, কাটোয়া হইতে একটি বৈষ্ণব, ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিলেন। রাখাল, লাটু আজকাল থাকেন। একটি পাঞ্জাবী সাধু পঞ্চবটীতে কয়দিন রহিয়াছেন।
ছোট নরেনের কপালে একটি আব আছে। ঠাকুর পঞ্চবটীতে বেড়াইতে বেড়াইতে বলিতেছেন, ‘তুই আবটা কাট না, ও তো গলায় নয় — মাথায়। ওতে আর কি হবে — লোকে একশিরা-কাটাচ্ছে।” (হাস্য)
পাঞ্জাবী সাধুটি উদ্যানের পথ দিয়া যাইতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “আমি ওকে টানি না। জ্ঞানীর ভাব। দেখি যেন শুকনো কাঠ!”
ঘরে ঠাকুর ফিরিয়াছেন। শ্যামাপদ ভট্টাচার্যের কথা হইতেছে।
বলরাম — তিনি বলেছেন যে, নরেন্দ্রের যেমন বুকে পা দিলে (ভাবাবেশ) হয়েছিলো, কই আমার তো তা হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে ছড়ান মন কুড়ান দায়। ওর সালিসী করতে হয়, বলছে। আবার বাড়ির ছেলেদের বিষয় ভাবতে হয়। নরেন্দ্রাদির মন তো ছড়ানো নয় — ওদের ভিতে এখনো কামিনী-কাঞ্চন ঢোকে নাই।
“কিন্তু (শ্যামাপদ) খুব লোক!”
কাটোয়ার বৈষ্ণব ঠাকুরকে প্রশ্ন করিতেছেন। বৈষ্ণবটি একটু ট্যারা।
[জন্মান্তরের খপর — ভক্তিলাভের জন্যই মানুষজন্ম ]
বৈষ্ণব — মশায়, আবার জন্ম কি হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতায় আছে, মৃত্যুসময় যে যা চিন্তা করে দেহত্যাগ করবে তার সেই ভাব লয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়। হরিণকে চিন্তা করে ভরত রাজার হরিণ-জন্ম হয়েছিল।
বৈষ্ণব — এটি যে হয়, কেউ চোখে দেখে বলে তো বিশ্বাস হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা জানি না বাপু। আমি নিজের ব্যামো সারাতে পারছি না — আবার মলে কি হয়!
“তুমি যা বলছো এ-সব হীনবুদ্ধির কথা। ঈশ্বরে কিসে ভক্তি হয়, এই চেষ্টা করো। ভক্তিলাভের জন্যই মানুষ হয়ে জন্মেছ। বাগানে আম খেতে এসেছ, কত হাজার ডাল, কত লক্ষ পাতা, এ-সব খপরে কাজ কি? জন্ম-জন্মান্তরের খপর!”
[গিরিশ ঘোষ ও অবতারবাদ! কে পবিত্র? যার বিশ্বাস-ভক্তি ]
শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ দুই-একটি বন্ধু সঙ্গে গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত। কিছু পান করিয়াছেন। কাঁদিতে কাঁদিতে আসিতেছেন ও ঠাকুরের চরণে মাথা দিয়া কাঁদিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সস্নেহে তাঁহার গা চাপড়াইতে লাগিলেন। একজন ভক্তকে ডাকিয়া বলিতেছেন — “ওরে একে তামাক খাওয়া।”
গিরিশ মাথা তুলিয়া হাতজোড় করিয়া বলিতেছেন, তুমিই পূর্ণব্রহ্ম। তা যদি না হয়, সবই মিথ্যা!
“বড় খেদ রইল, তোমার সেবা করতে পেলুম না! (এই কথাগুলি এরূপ স্বরে বলিতেছেন যে, দু-একটি ভক্ত কাঁদিতেছেন!)
“দাও বর ভগবন্‌, এক বৎসর তোমার সেবা করব? মুক্তি ছড়াছড়ি, প্রস্রাব করে দি। বল, তোমার সেবা এক বৎসর করব?”
শ্রীরামকৃষ্ণ — এখানকার লোক ভাল নয় — কেউ কিছু বলবে।
গিরিশ — তা হবে না, বলো —
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, তোমার বাড়িতে যখন যাব —
গিরিশ — না, তা নয়। এইখানে করব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (জিদ দেখিয়া) — আচ্ছা, সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।
ঠাকুরের গলায় অসুখ। গিরিশ আবার কথা কহিতেছেন, “বল, আরাম হয়ে যাক! — আচ্ছা, আমি ঝাড়িয়ে দেব। কালী! কালী!”
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার লাগবে!
গিরিশ — ভাল হয়ে যা! (ফুঁ)। ভাল যদি না হয়ে থাকে তো — যদি আমার ও-পায়ে কিছু ভক্তি থাকে, তবে অবশ্য ভাল হবে! বল, ভাল হয়ে গেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — যা বাপু, আমি ও-সব বলতে পারি না। রোগ ভাল হবার কথা মাকে বলতে পারি না। আচ্ছা ঈশ্বরের ইচ্ছায় হবে।
গিরিশ — আমায় ভুলোনো! তোমার ইচ্ছায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ — ছি, ও-কথা বলতে নাই। ভক্তবৎ ন চ কৃষ্ণবৎ। তুমি যা ভাবো, তুমি ভাবতে পারো। আপনার গুরু তো ভগবান — তাবলে ও-সব কথা বলায় অপরাধ হয় — ও-কথা বলতে নাই।
গিরিশ — বল, ভাল হয়ে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, যা হয়েছে তা যাবে।
গিরিশ নিজের ভাবে মাঝে মাঝে ঠাকুরকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন,
“হ্যাঁগা, এবার রূপ নিয়ে আস নাই কেন গা?”
কিয়ৎক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন, ‘এবার বুঝি বাঙ্গালা উদ্ধার!’
কোন কোন ভক্ত ভাবিতেছেন, বাঙ্গালা উদ্ধার, সমস্ত জগৎ উদ্ধার!
গিরিশ আবার বলিতেছেন, “ইনি এখানে রয়েছেন কেন, কেউ বুঝেছো? জীবের দুঃখে কাতর হয়ে সেছেন; তাঁদের উদ্ধার করবার জন্যে!”
গাড়োয়ান ডাকিতেছিল। গিরিশ গাত্রোত্থান করিয়া তাহার কাছে যাইতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখো, কোথায় যায় — মারবে না তো।” মাস্টারও সঙ্গে সঙ্গে গমন করিলেন।
গিরিশ আবার ফিরিয়াছেন ও ঠাকুরকে স্তব করিতেছেন — “ভগবন্‌, পবিত্রতা আমায় দাও। যাতে কখনও একটুও পাপ-চিন্তা না হয়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি পবিত্র তো আছ। — তোমার যে বিশ্বাস-ভক্তি! তুমি তো আনন্দে আছ।
গিরিশ — আজ্ঞা, না। মন খারাপ — অশান্তি — তাই খুব মদ খেলুম।
কিয়ৎক্ষণ পরে গিরিশ আবার বলিতেছেন, “ভগবন্‌, আশ্চর্য হচ্ছি যে, পূর্ণব্রহ্ম ভগবানের সেবা করছি! এমন কি তপস্যা করিছি যে এই সেবার অধিকারী হয়েছি!”
ঠাকুর মধ্যাহ্নের সেবা করিলেন। অসুখ হওয়াতে অতি সামান্য একটু আহার করিলেন।
ঠাকুরের সর্বদাই ভাবাবস্থা — জোর করিয়া শরীরের দিকে মন আনিতেছেন। কিন্তু শরীর রক্ষা করিতে বালকের ন্যায় অক্ষম। বালকের ন্যায় ভক্তদের বলিতেছেন, “এখন একটু খেলুম — একটু শোব! তোমরা একটু বাহিরে গিয়ে বসো।”
ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। ভক্তেরা আবার ঘরে বসিয়াছেন।
[গিরিশ ঘোষ — গুরুই ইষ্ট — দ্বিবিধ ভক্ত ]
গিরিশ — হ্যাঁ গা, গুরু আর ইষ্ট; — গুরু-রূপটি বেশ লাগে — ভয় হয় না — কেন গা? ভাব দেখলে দশহাত তফাতে যাই। ভয় হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — যিনি ইষ্ট, তিনিই গুরুরূপ হয়ে আসেন। শবসাধনের পর যখন ইষ্টদর্শন হয়, গুরুই এসে শিষ্যকে বলেন — এ (শিষ্য) ওই (তোর ইষ্ট)। এই কথা বলেই ইষ্টরূপেতে লীন হয়ে যান। শিষ্য আর গুরুকে দেখতে পায় না। যখন পূর্ণজ্ঞান হয়, তখন কে বা গুরু, কে বা শিষ্য। ‘সে বড় কঠিন ঠাঁই। গুরুশিষ্যে দেখা নাই।’
একজন ভক্ত — গুরুর মাথা শিষ্যের পা।
গিরিশ — (আনন্দে) হাঁ।
নবগোপাল — শোনো মানে! শিষ্যের মাথাটা গুরুর জিনিস, আর গুরুর পা শিষ্যের জিনিস। শুনলে?
গিরিশ — না, ও মানে নয়। বাপের ঘাড়ে ছেলে কি চড়ে না? তাই শিষ্যের পা।
নবগোপাল — সে তেমনি কচি ছেলে থাকলে তো হয়।
[পূর্বকথা — শিখভক্ত — দুই থাক ভক্ত — বানরের ছা ও বিল্লির ছা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — দুরকম ভক্ত আছে। একথাকের বিল্লির ছার স্বভাব। সব নির্ভর — মা যা করে। বিল্লির ছা কেবল মিউ মিউ করে। কোথায় যাবে, কি করবে — কিছুই জানে না। মা কখন হেঁশালে রাখছে — কখন বা বিছানার উপরে রাখছে। এরূপ ভক্ত ঈশ্বরকে আমমোক্তারি (বকলমা) দেয়। আমমোক্তারি দিয়ে নিশ্চিন্ত।
“শিখরা বলেছিল — ঈশ্বর দয়ালু। আমি বললাম, তিনি আমাদের মা-বাপ, তিনি আবার দয়ালু কি? ছেলেদের জন্ম দিয়ে বাপ-মা লালন-পালন করবে না, তো কি বামুনপাড়ার লোকেরা এসে করবে? এ-ভক্তদের ঠিক বিশ্বাস — তিনি আপনার মা, আপনার বাপ।
“আর-এক থাক ভক্ত আছে, তাদের বানরের ছার স্বভাব। বানরের ছা নিজে জো-সো করে মাকে আঁকড়ে ধরে। এদের একটু কর্তৃত্ব বোধ আছে। আমায় তীর্থ করতে হবে, জপতপ করতে হবে, ষোড়শোপচারে পূজা করতে হবে, তবে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারব, — এদের এই ভাব।
“দুজনেই ভক্ত (ভক্তদের প্রতি) — যত এগোবে, ততই দেখবে তিনিই সব হয়েছেন — তিনিই সব করছেন। তিনিই গুরু, তিনিই ইষ্ট। তিনিই জ্ঞান, ভক্তি সব দিচ্ছেন।”
[পূর্বকথা — কেশব সেনকে উপদেশ ‘এগিয়ে পড়ো’ ]
“যত এগোবে, দেখবে, চন্দন কাঠের পরও আছে, — রূপার খনি, — সোনার খনি, — হীরে মাণিক! তাই এগিয়ে পড়।
“আর ‘এগিয়ে পড়’ এ-কথাই বা বলি কেমন করে! — সংসারী লোকদের বেশি এগোতে গেলে সংসার-টংসার ফক্কা হয়ে যায়! কেশব সেন উপাসনা কচ্ছিল, — বলে, ‘হে ঈশ্বর, তোমার ভক্তিনদীতে যেন ডুবে যাই।’ সব হয়ে গেলে আমি কেশবকে বললাম, ওগো, তুমি ভক্তিনদীতে ডুবে যাবে কি করে? ডুবে গেলে, চিকের ভিতর যারা আছে তাদের কি হবে। তবে এককর্ম করো — মাঝে মাঝে ডুব দিও, আর এক-একবার আড়ায় উঠো।” (সকলের হাস্য)
[বৈষ্ণবের ‘কলকলানি’ — ‘ধারণা করো’! সত্যকথা তপস্যা ]
কাটোয়ার বৈষ্ণব তর্ক করিতেছিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “তুমি কলকলানি ছাড়। ঘি কাঁচা থাকলেই কলকল করে।
“একবার তাঁর আনন্দ পেলে বিচারবুদ্ধি পালিয়ে যায়। মধুপানের আনন্দ পেলে আর ভনভনানি থাকে না।
“বই পড়ে কতকগুলো কথা বলতে পারলে কি হবে? পণ্ডিতেরা কত শ্লোক বলে — ‘শীর্ণা গোকুলমণ্ডলী!’ — এই সব।
“সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি হবে? কুলকুচো করলেও কিছু হবে না। পেটে ঢুকুতে হবে! তবে নেশা হবে। ঈশ্বরকে নির্জনে গোপনে ব্যাকুল হয়ে না ডাকলে, এ-সব কথা ধারণা হয় না।”
ডাক্তার রাখাল ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন। তিনি ব্যস্ত হইয়া বলিতেছেন — “এসো গো বসো।” বৈষ্ণবের সহিত কথা চলিতে লাগিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — মানুষ আর মানহুঁশ। যার চৈতন্য হয়েছে, সেই মানহুঁশ। চৈতন্য না হলে বৃথা মানুষ জন্ম!
[পূর্বকথা — কামারপুকুরে ধার্মিক সত্যবাদী দ্বারা সালিসী ]
“আমাদের দেশে পেটমোটা গোঁফওয়ালা অনেক লোক আছে। তবু দশ ক্রোশ দূর থেকে ভাল লোককে পালকি করে আনে কেন — ধার্মিক সত্যবাদী দেখে। তারা বিবাদ মিটাবে। শুধু যারা পণ্ডিত, তাদের আনে না।
ঠাকুর বালকের মতো ডাক্তারকে বলিতেছেন — “বাবু আমার এটা ভাল করে দাও।”
ডাক্তার — আমি ভাল করব?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ডাক্তার নারায়ণ। আমি সব মানি।
[Reconciliation of Free Will and God’s Will — of Liberty and Necessity — ঈশ্বরই মাহুত নারায়ণ ]
“যদি বলো সব নারায়ণ, তবে চুপ করে থাকলেই হয়, তা আমি মাহুত নারায়ণও মানি।
“শুদ্ধমন আর শুদ্ধ-আত্মা একই! শুদ্ধমনে যা উঠে, সে তাঁরই কথা। তিনিই ‘মাহুত নারায়ণ।’
“তাঁর কথা শুনব না কেন? তিনিই কর্তা। ‘আমি’ যতক্ষণ রেখেছেন, তাঁর আদেশ শুনে কাজ করব।”
ঠাকুরের গলার অসুখ এইবার ডাক্তার দেখিবেন। ঠাকুর বলিতেছেন — “মহেন্দ্র সরকার জিব টিপেছিল, যেমন গরুর জিবকে টিপে।”
ঠাকুর আবার বালকের ন্যায় ডাক্তারের জামায় বারংবার হাত দিয়ে বলিতেছেন, “বাবু! বাবু! তুমি এইটে ভাল করে দাও!”
Laryngoscope দেখিয়া ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন — “বুঝেছি, এতে ছায়া পড়বে।”
নরেন্দ্র গান গাইলেন। ঠাকুরের অসুখ বলিয়া বেশি গান হইল না।
=========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীযুক্ত ডাক্তার ভগবান রুদ্র ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্নে সেবা করিয়া নিজের আসনে বসিয়া আছেন। ডাক্তার ভগবান রুদ্র ও মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। ঘরে লাটু প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন।
আজ বুধবার, নন্দোৎসব, ১৮ই ভাদ্র; শ্রাবণ অষ্টমী-নবমী তিথি; ২রা সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুরের অসুখের বিষয় সমস্ত ডাক্তার শুনিলেন। ঠাকুর মেঝেতে আসিয়া ডাক্তারের কাছে বসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখো গা, ঔষধ সহ্য হয় না! ধাত আলাদা।
[টাকা স্পর্শন, গিরোবান্ধা, সঞ্চয় — এ-সব ঠাকুরের অসম্ভব ]
“আচ্ছা, এটা তোমার কি মনে হয়? টাকা ছুঁলে হাত এঁকে বেঁকে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়! আর যদি আমি গিরো (গ্রন্থি) বাঁধি যতক্ষণ না গিরো খোলা হয়, ততক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে থাকবে!”
এই বলিয়া একটি টাকা আনিতে বলিলেন। ডাক্তার দেখিয়া অবাক্‌ যে হাতের উপর টাকা দেওয়াতে হাত বাঁকিয়া গেল; আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। টাকাটি স্থানান্তরিত করিবার পর, ক্রমে ক্রমে তিনবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িয়া, তবে হাত পুনর্বার শিথিল হইল।
ডাক্তার মাস্টারকে বলিতেছেন, Action on the nerves (স্নায়ুর উপর ক্রিয়া)।
[পূর্বকথা — শম্ভু মল্লিকের বাগানে আফিম সঞ্চয় — জন্মভূমি কামারপুকুরে আম পাড়া — সঞ্চয় অসম্ভব ]
ঠাকুর আবার ডাক্তারকে বলিতেছেন, ‘আর একটি অবস্থা আছে। কিছু সঞ্চয় করবার জো নাই! শম্ভু মল্লিকের বাগানে একদিন গিছলাম। তখন বড় পেটের অসুখ। শম্ভু বললে — একটু একটু আফিম খেও তাহলে কম পড়বে। আমার কাপড়ের খোঁটে একটু আফিম বেঁধে দিলে। যখন ফিরে আসছি, ফটকের কাছে, কে জানে ঘুরতে লাগলাম — যেন পথ খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর যখন আফিমটা খুলে ফেলে দিলে, তখন আবার সহজ অবস্থা হয়ে বাগানে ফিরে এলাম।
“দেশেও আম পেড়ে নিয়ে আসছি — আর চলতে পারলাম না, দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর সেগুলো একটা ডোবের মতন জায়গায় রাখতে হল — তবে আসতে পারলাম! আচ্ছা, ওটা কি?”
ডাক্তার — ওর পেছনে আর একটা (শক্তি) আছে, মনের শক্তি।
মণি — ইনি বলেন, এটি ঈশ্বরের শক্তি (Godforce) আপনি বলছেন মনের শক্তি (Willforce)
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — আবার এমনি অবস্থা, যদি কেউ বললে, ‘কমে গেছে’ তো অমনি অনেকটা কমে যায়। সেদিন ব্রাহ্মণী বললে, ‘আট-আনা কমে গেছে’ — অমনি নাচতে লাগলুম!
ঠাকুর ডাক্তারের স্বভাব দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছেন। তিনি ডাক্তারকে বলিতেছেন, ‘তোমার স্বভাবটি বেশ। জ্ঞানের দুটি লক্ষণ — শান্ত ভাব, আর অভিমান থাকবে না।”
মণি — এঁর (ডাক্তারের) স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি) — আমি বলি, তিন টান হলে ভগবানকে পাওয়া যায়। মায়ের ছেলের উপর টান, সতীর পটির উপর টান, বিষয়ীর বিষয়ের উপর টান।
“যা হোক, আমার বাবু এটা ভাল করো!”
ডাক্তার এইবার অসুখের স্থানটি দেখিবেন। গোল বারান্দায় একখানি কেদারাতে ঠাকুর বসিলেন। ঠাকুর প্রথমে ডাক্তার সরকারের কথা বলিতেছেন, “শ্যালা, যেন গরুর জিব টিপলে!”
ভগবান — তিনি বোধ হয় ইচ্ছা করে ওরূপ করেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, তা নয় খুব ভাল করে দেখবে বলে টিপেছিল।
==========

Post a Comment

0 Comments