ধর্ম, দর্শন ও সাধনা - স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
তৃতীয় খণ্ড

ধর্ম, দর্শন ও সাধনা

*************************************************************************************************************

ধর্মের উদ্ভব

ধর্মের উদ্ভব
[প্রথমবার আমেরিকায় অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নোত্তরে স্বামীজী-কর্তৃক লিখিত]

অরণ্যের বিচিত্র দল-মণ্ডিত সুন্দর কুসুমরাজি মৃদু পবনে নাচিতেছিল, ক্রীড়াচ্ছলে মাথা দোলাইতেছিল; অপরূপ পালকে শোভিত মনোরম পক্ষীগুলি বনভূমির প্রতিটি কন্দর মধুর কলগুঞ্জনে প্রতিধ্বনিত করিতেছিল—গতকাল পর্যন্ত সেগুলি আমার সাথী ও সান্ত্বনা ছিল; আজ আর সেগুলি নাই, কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে। কোথায় গেল তাহারা? যাহারা আমার খেলার সাথী, আমার সুখদুঃখের অংশীদার, আমার আনন্দ ও খেলার সহচর, তাহারাও চলিয়া গেল। কোথায় গেল? যাঁহারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করিয়াছিলেন, যাঁহারা জীবনভোর শুধু আমার কথাই ভাবিতেন, যাঁহারা আমার জন্য সব কিছু করিতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁহারাও আজ আর নাই। প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি বস্তু চলিয়া গিয়াছে, চলিয়া যাইতেছে এবং চলিয়া যাইবে। কোথায় যায় সব? আদিম মানুষের মনে এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য চাহিদা আসিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিতে পার, কেন এই প্রশ্ন জাগে? আদিম মানুষ কি লক্ষ্য করে নাই, তাহার চোখের সামনে সব কিছু বস্তু পচিয়া গলিয়া শুকাইয়া ধুলায় মিশিয়া যায়? এ-সব কোথায় গিয়াছে—সে সম্বন্ধে আদিম মানব আদৌ মাথা ঘামাইবে কেন?
আদিম মানুষের নিকট প্রথমতঃ সব কিছুই জীবন্ত, এবং মৃত্যু যে বিনাশ—ইহা তাহার কাছে একেবারেই অর্থহীন। তাহার দৃষ্টিতে মানুষ আসে, চলিয়া যায়, আবার ফিরিয়া আসে। কখনও কখনও তাহারা চলিয়া যায়, কিন্তু ফিরিয়া আসে না। সুতরাং পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষায় মৃত্যুকে বলা হয়, একপ্রকার চলিয়া যাওয়া। ইহাই ধর্মের প্রারম্ভ। এইভাবে আদিম মানুষ তাহার এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য সর্বত্র অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছিল—তাহারা সব যায় কোথায়?
সুপ্তিমগ্ন পৃথিবীতে আলোক, উত্তাপ এবং আনন্দ ছড়াইয়া স্বমহিমাদীপ্ত প্রভাত-সূর্য উদিত হয়। ধীরে ধীরে সূর্য আকাশ অতিক্রম করে। হায়! সূর্যও শেষে অতি নীচে অতলে অদৃশ্য হইয়া যায়, কিন্তু পরদিন আবার গৌরব ও লাবণ্য-মণ্ডিত হইয়া আবির্ভূত হয়।
সভ্যতার জন্মভূমি নীল, সিন্ধু ও টাইগ্রিস্ নদীর উপত্যকায় অপূর্ব পদ্মফুলগুলির মুদিত পাপড়িতে প্রাতঃকালীন সূর্যকিরণের স্পর্শ লাগিবামাত্র ফুলগুলি প্রস্ফুটিত হয়, এবং অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে পুনরায় নিমীলিত হয়। আদিম মানুষ ভাবিত, তাহা হইলে সেখানে এমন কেহ না কেহ ছিল, যে আসিয়াছিল, চলিয়া গিয়াছিল এবং সমাধিস্থান হইতে পুনরুজ্জীবিত হইয়া আবার উঠিয়া আসিয়াছে। ইহাই হইল প্রাচীন মানুষের প্রথম সমাধান। সেইজন্য সূর্য এবং পদ্ম অতি প্রাচীন ধর্মগুলির প্রধান প্রতীক ছিল। এ-সব প্রতীক আবার কেন? কারণ বিমূর্ত চিন্তা—সে-চিন্তা যাহাই হউক না কেন—যখন প্রকাশিত হয়, তখন উহা দৃশ্য, গ্রাহ্য ও স্থূল অবলম্বনের ভিতর দিয়া মূর্ত হইতে বাধ্য হয়। ইহাই নিয়ম। তিরোধানের অর্থ যে অস্তিত্বের বাহিরে যাওয়া নয়, অস্তিত্বের ভিতরেই থাকা—এই ভাবটি প্রকাশ করিতে হইবে; ইহাকে পরিবর্তন, বিকল্প বা সাময়িক রূপায়ণের অর্থেই ব্যাখ্যা করিতে হইবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে-বস্তুটি ইন্দ্রিয়গুলিকে আঘাত করিয়া মনের উপর স্পন্দন সৃষ্টি করে এবং একটি নূতন চিন্তা জাগাইয়া তোলে, সেই বস্তুটিকে অবলম্বন ও কেন্দ্র-রূপে গ্রহণ করিতেই হইবে। ইহাকেই অবলম্বন করিয়া নূতন চিন্তা অভিব্যক্তির জন্য সম্প্রসারিত হয় এবং এইজন্য সূর্য ও পদ্ম ধর্মজগতে প্রথম প্রতীক।
সর্বত্রই গভীর গহ্বর রহিয়াছে—এগুলি অতি অন্ধকার ও নিরানন্দ; তলদেশ সম্পূর্ণ তমিস্র ও ভয়াবহ। চক্ষু খুলিয়া রাখিলেও জলের নীচে আমরা কিছুই দেখিতে পাই না। উপরে আলো, সবই আলো—রাত্রিকালেও মনোরম নক্ষত্রপুঞ্জ আলো বিকিরণ করে। তাহা হইলে যাহাদের আমি ভালবাসি, তাহারা কোথায় যায়? নিশ্চয়ই তাহারা সেই তমসাবৃত স্থানে যায় না; তাহারা যায় ঊর্ধ্বলোকে, নিত্যজ্যোতির্ময় ধামে। এই চিন্তার জন্য একটি নূতন প্রতীকের প্রয়োজন হইল। এইবার আসিল অগ্নি—প্রজ্বলিত অদ্ভুত অগ্নির লেলিহান শিখা, যে-অগ্নি নিমেষে একটি বন গ্রাস করে, যে-অগ্নি খাদ্য প্রস্তুত করে, উত্তাপ দেয়, বন্যজন্তুদের বিতাড়িত করে। এই অগ্নি প্রাণদ, জীবনরক্ষক। আর অগ্নিশিখার গতি ঊর্ধ্বে, কখনও ইহা নিম্নমুখী হয় না। অগ্নি আরও একটি প্রতীকের কাজ করে; যে-অগ্নি মৃত্যুর পর মানুষকে ঊর্ধ্বে আলোকের দেশে লইয়া যায়, সেই অগ্নি পরলোকবাসী ও আমাদের মধ্যে যোগসূত্র। প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ বেদ বলেন, ‘হে অগ্নি, জ্যোতির্ময় দেবগণের নিকট তুমিই আমাদের দূত।’ এইজন্য তাহারা খাদ্য, পানীয় এবং এই জ্যোতির্ময় দেহধারীদের সন্তুষ্টিবিধায়ক বলিয়া বিবেচিত সব কিছুই অগ্নিতে আহুতি দিত। ইহাই যজ্ঞের সূচনা।
এ-পর্যন্ত প্রথম প্রশ্নের সমাধান হইল, অন্ততঃ আদিম মানুষের চাহিদা মিটাইতে যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু হইল। ইহার পর আর একটি প্রশ্ন আসিল। এই-সব আসিল কোথা হইতে? এই প্রশ্নটি প্রথমেই কেন জাগিল না?—কারণ আমরা একটি আকস্মিক পরিবর্তনকে বেশী মনে রাখি। সুখ, আনন্দ, সংযোগ, সম্ভোগ প্রভৃতি আমাদের মনে যতটা না দাগ রাখে, তাহা অপেক্ষা অধিক রেখাপাত করে অসুখ, দুঃখ এবং বিয়োগ। আমাদের প্রকৃতিই হইতেছে আনন্দ, সম্ভোগ ও সুখ। যাহা কিছু আমাদের এই প্রকৃতিকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, সে-সব স্বাভাবিক গতি অপেক্ষা গভীরতর ছাপ রাখে। মৃত্যু ভীষণভাবে সব কিছু তছনছ করিয়া দেয় বলিয়া মৃত্যুর সমস্যা সমাধান করাই হইল প্রথম কর্তব্য। পরে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উঠিল অপর প্রশ্নটিঃ তাহারা আসে কোথা হইতে? যাহা প্রাণবান্, তাহাই গতিশীল হয়। আমরা চলি, আমাদের ইচ্ছাশক্তি আমাদের অঙ্গগুলিকে চালনা করে, আমাদের ইচ্ছাবশে অঙ্গগুলি নানা আকার ধারণ করে। বর্তমান কালের শিশু-মানবের নিকট যেমন প্রতিভাত হয়, তেমনি প্রাচীনকালের মানব-শিশুর নিকটও প্রতিভাত হইয়াছিল যে, যাহা কিছু চলে, তাহারই পিছনে একটা ইচ্ছা আছে। বায়ুর ইচ্ছা আছে; মেঘ—এমন কি সমস্ত প্রকৃতি—স্বতন্ত্র ইচ্ছা, মন এবং আত্মায় পূর্ণ। আমরা যেমন বহু বস্তু নির্মাণ করি, তাহারাও তেমনি এই-সব সৃষ্টি করিতেছে। তাহারা অর্থাৎ দেবতারা—‘ইলোহিমরা’ এই-সবের স্রষ্টা।
ইতোমধ্যে সমাজেরও উন্নতি হইতে লাগিল। সমাজে রাজা থাকিতেন; কাজেই দেবতাদের ভিতর, ইলোহিমদের ভিতরেও একজন রাজা থাকিবেন না কেন? সুতরাং একজন দেবাদিদেব, একজন ইলোহিম-যিহোবা, পরমেশ্বর হইলেন, যিনি স্বীয় ইচ্ছামাত্রেই ঐসব—এমন কি দেবতাদেরও সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তিনি যেমন বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্র নিযুক্ত করিয়াছেন, তেমনি প্রকৃতির বিভিন্ন কার্যসাধনের অধিনায়করূপে বিভিন্ন দেবতা বা দেবদূতকে নিয়োজিত করিলেন। কেহ হইলেন মৃত্যুর, কেহ বা জন্মের, কেহ বা অন্যকিছুর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ধর্মের দুইটি বিরাট উৎস—আর্য ও সেমিটিক জাতির ধর্মের ভিতরে একটি সাধারণ ধারণা আছে যে, একজন পরমপুরুষ আছেন, এবং তিনি অন্যান্য সকলের অপেক্ষা বহুগুণে শক্তিশালী বলিয়াই পরমপুরুষ হইয়াছেন। কিন্তু ইহার পরই আর্যেরা একটি নূতন ধারা প্রবর্তন করিল; উহা পুরাতন ধারার এক মহান্ ব্যতিক্রম। তাহাদের দেবতা শুধু পরমপুরুষই নন, তিনি ‘দ্যৌঃ পিতরঃ’ অর্থাৎ স্বর্গস্থ পিতা। ইহাই প্রেমের সূচনা। সেমিটিক ভগবান্ কেবল সমুদ্যতবজ্র রুদ্র, দলের পরাক্রমশালী প্রভু। এই-সব ভাবের সহিত আর্যেরা একটি নূতন ভাব—পিতৃভাব সংযোজন করিল। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভেদ আরও সুস্পষ্ট হইতে লাগিল; মানবজাতির সেমিটিক শাখার ভিতর প্রগতি বস্তুতঃ এইস্থানে আসিয়াই থামিয়া গেল। সেমিটিকদিগের ঈশ্বরকে দেখা যায় না; শুধু তাহাই নয়, তাঁহাকে দেখাই মৃত্যু। আর্যদের ঈশ্বরকে শুধু যে দেখা যায়, তাহা নয়, তিনি সকল জীবের লক্ষ্য। জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য—তাঁহাকে দর্শন করা। শাস্তির ভয়ে সেমিটিক তাহার রাজাধিরাজকে মানে, তাঁহার আজ্ঞা ও অনুশাসন মানিয়া চলে। আর্যেরা পিতাকে ভালবাসে; মাতা এবং সখাকেও ভালবাসে। তাহারা বলে, ‘আমাকে ভালবাসিলে আমার কুকুরকেও ভালবাসিতে হইবে।’ সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রত্যেক জীবকে ভালবাসিতে হইবে, কারণ তাহারা সকলেই ঈশ্বরের সন্তান। সেমিটিকের নিকট এই জীবনটা যেন একটি সৈন্য-শিবির; এখানে আমাদিগকে আমাদের আনুগত্য পরীক্ষা করিবার জন্য নিযুক্ত করা হইয়াছে। আর্যের কাছে এই জীবন আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছিবার পথ। সেমিটিক বলে, যদি আমরা আমাদের কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করি, তাহা হইলে স্বর্গে আমরা একটি নিত্য আনন্দ-নিকেতন পাইব। আর্যের নিকট স্বয়ং ভগবানই সেই আনন্দ-নিকেতন। সেমিটিকের মতে ঈশ্বর-সেবা উদ্দেশ্যলাভের একটি উপায়মাত্র এবং সেই উদ্দেশ্য হইল আনন্দ ও সুখ। আর্যদের কাছে ভোগসুখ দুঃখকষ্ট—সবই উপায় মাত্র, উদ্দেশ্য হইল ঈশ্বরলাভ। স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য সেমিটিক ভগবানের ভজনা করে। আর্য ভগবানকে পাইবার জন্য স্বর্গ প্রত্যাখ্যান করে। সংক্ষেপে ইহাই হইল প্রধান প্রভেদ। আর্যজীবনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য ঈশ্বরদর্শন, প্রেমময়ের সাক্ষাৎকার, কারণ ঈশ্বরকে ছাড়া বাঁচা যায় না। ‘তুমি না থাকিলে সূর্য চন্দ্র ও নক্ষত্রগণের জ্যোতি থাকে না।’

*************************************************************************************************************

ধর্মের মূলতত্ত্ব

ধর্মের মূলতত্ত্ব
[আমেরিকায় প্রদত্ত একটি ভাষণের সারাংশ]

ফরাসীদেশে দীর্ঘকাল ধরে জাতির মূলমন্ত্র ছিল ‘মানুষের অধিকার’, আমেরিকায় এখনও ‘নারীর অধিকার’ জনসাধারণের কানে আবেদন জানায়; ভারতবর্ষে কিন্তু আমাদের মাথাব্যথা ঈশ্বরের বিভিন্নভাবে প্রকাশের অধিকার নিয়ে।
সর্বপ্রকার ধর্মমতই বেদান্তের অন্তর্ভুক্ত। ভারতবর্ষে আমাদের একটা স্বতন্ত্র ভাব আছে। আমার যদি একটি সন্তান থাকত, তাকে মনঃসংযমের অভ্যাস এবং সেই সঙ্গে একপঙ‍্ক্তি প্রার্থনার মন্ত্রপাঠ ছাড়া আর কোন প্রকার ধর্মের কথা আমি শিক্ষা দিতাম না। তোমরা যে অর্থে প্রার্থনা বলো, ঠিক তা নয়, সেটি হচ্ছে এইঃ ‘বিশ্বের স্রষ্টা যিনি, আমি তাঁকে ধ্যান করি; তিনি আমার ধীশক্তি উদ্বুদ্ধ করুন।’ তারপর সে বড় হয়ে নানা মত এবং উপদেশ শুনতে শুনতে এমন কিছু একটা পাবে, যা তার কাছে সত্য বলে মনে হবে। তখন সেই সত্যের যিনি উপদেষ্টা, সে তাঁরই শিষ্য হবে। খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদ—যাঁকে ইচ্ছা সে উপাসনা করিতে পারে; এঁদের প্রত্যেকের অধিকার আমরা মানি, আর সকলের নিজ নিজ ইষ্ট বা মনোনীত পন্থা অনুসরণ করবার অধিকারও আমরা স্বীকার করি। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ, আমার স্ত্রী খ্রীষ্টান এবং আমি নিজে মুসলমান হতে পারি।
আমরা জানি যে, সব ধর্মপথ দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছান যায়—কেবল আমাদের চোখ দিয়ে ভগবানকে না দেখলে যে পৃথিবীর উন্নতি হবে না, তা নয়, আর পৃথিবী-সুদ্ধ লোক আমার বা আমাদের চোখে ঈশ্বরকে দেখলেই সব ভাল হয়ে যাবে, তাও নয়। আমাদের মূল ভাব হচ্ছে এই যে, তোমার ধর্মবিশ্বাস আমার হতে পারে না, আবার আমার মতবাদও তোমার হতে পারে না। আমি আমার নিজেরই একটি সম্প্রদায়। এটা ঠিক যে, ভারতবর্ষে আমরা এমন এক ধর্মমত সৃষ্টি করেছি, যাকে আমরা একমাত্র যুক্তিপূর্ণ ধর্মপদ্ধতি বলে বিশ্বাস করি, কিন্তু এর যুক্তিবত্তায় আমাদের বিশ্বাস নির্ভর করছে সকল ঈশ্বরান্বেষীকে এর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার ওপর—সর্বপ্রকার উপাসনাপদ্ধতির প্রতি সম্পূর্ণ উদারতা দেখান এবং জগতে ভগবদভিমুখী চিন্তাপ্রণালীগুলি গ্রহণ করবার ক্ষমতার ওপর। আমাদের নিয়মপদ্ধতির মধ্যেও অপূর্ণতা আছে, তা আমরা স্বীকার করি, কেন না তত্ত্ববস্তু হচ্ছে সকল নিয়মপদ্ধতির ঊর্ধ্বে; আর এই স্বীকৃতির মধ্যেই আছে অনন্ত বিকাশের ইঙ্গিত ও প্রতিশ্রুতি। মত, উপাসনা এবং শাস্ত্র মানুষের স্বরূপোপলব্ধির উপায় হিসাবে ঠিকই, কিন্তু উপলব্ধির পরে সে সবই পরিহার করে। বেদান্তদর্শনের শেষ কথা, ‘আমি বেদ অতিক্রম করেছি’—আচার-উপাসনা, যাগযজ্ঞ এবং শাস্ত্রগ্রন্থ, যার সাহায্যে এই মুক্তির পথে মানুষ পরিভ্রমণ করেছে, তা সবই তার কাছে বিলীন হয়ে যায়। ‘সোঽহং, সোঽহম্’—আমিই তিনি—এই ধ্বনি তখন তার কণ্ঠে উদ্‌গীত হয়। ঈশ্বরকে ‘তুমি’ সম্বোধন তখন অসহনীয়, কারণ সাধক তখন তার ‘পিতার সঙ্গে অভিন্ন।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য বেদের ততখানিই গ্রহণ করি, যতখানি যুক্তির সঙ্গে মেলে। বেদমতের অনেক অংশ বাহ্যতঃ পরস্পরবিরুদ্ধ। পাশ্চাত্যে যাকে ‘প্রত্যাদিষ্ট বাণী’ বলে এগুলি তা নয়, কিন্তু এগুলি ঈশ্বরের সমষ্টি জ্ঞান বা সর্বজ্ঞত্ব, যা আমাদের ভিতরেও আছে। তা বলে যে-বইগুলিকে আমরা বেদ বলি, শুধুমাত্র ঐগুলির মধ্যেই এই জ্ঞানভাণ্ডার নিঃশেষিত—এ-কথা বলা বাতুলতা। আমরা জানি, সব সম্প্রদায়ের শাস্ত্রের মধ্যেই তা বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে আছে। মনু বলেন, বেদের যে অংশটুকু বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত, ততটুকুই যথার্থ বেদ; আমাদের আরও অনেক মনীষী এই মত পোষণ করেন। পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে একমাত্র বেদই ঘোষণা করেন, বেদের নিছক অধ্যয়ন অতি গৌণ ব্যাপার।
স্বাধ্যায় তাকেই বলে, ‘যার দ্বারা আমরা শ্বাশ্বত-সনাতন সত্য উপলব্ধি করি’, এবং তা নিছক পাঠ, বিশ্বাস বা তর্ক-যুক্তির দ্বারা সম্ভব নয়; সম্ভব একমাত্র অপরোক্ষানুভূতি ও সমাধির দ্বারা। সাধক যখন এই অবস্থা প্রাপ্ত হন, তখন তিনি সগুণ ঈশ্বরের ভাব লাভ করেন। অর্থাৎ তখন ‘আমি আর আমার পিতা এক।’ নির্বিশেষ ব্রহ্মের সঙ্গে এক বলেই তিনি নিজেকে জানেন এবং সগুণ ঈশ্বরের মত নিজেই নিজেকে প্রক্ষিপ্ত করেন। মায়ার আবরণ—অজ্ঞানের মধ্য দিয়ে দেখলে ব্রহ্মকে সগুণ ঈশ্বর বলে বোধ হয়।
পঞ্চেন্দ্রিয়ের সহায়ে যখন তাঁর কাছে সমুপস্থিত হই, তখন আমরা তাঁকে শুধু সগুণ ভগবান্-রূপেই ধারণা করিতে পারি। ভাবটি হচ্ছে এই, আত্মা কখনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারেন না। জ্ঞাতা আবার নিজেকে জানবে কেমন করে? কিন্তু তিনি যেমন, ঠিক তেমনই নিজেকে প্রতিবিম্বিত করতে পারেন, আর এই প্রতিবিম্বের সর্বোচ্চরূপ, আত্মার এই ইন্দ্রিয়ানুভবগম্য অভিব্যক্তিই সগুণ ঈশ্বর। পরমাত্মাই হচ্ছেন সনাতন জ্ঞাতা এবং তাঁকে জ্ঞেয় করবার জন্যই আমরা অনন্তকাল ধরে চেষ্টা করছি, আর এই প্রচেষ্টার ফলে এই বিশ্ব-প্রপঞ্চ ফুটে উঠেছে—যাকে আমরা জড় বলে থাকি। কিন্তু এ-সব খুব দুর্বল প্রয়াস; আমাদের জ্ঞানের বিষয়রূপে আত্মার সম্ভবপর সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে সগুণ ঈশ্বর।
তোমাদেরই জনৈক পাশ্চাত্য চিন্তাশীল ব্যক্তি বলেছেন, ‘একটি উত্তম ভগবান্ গড়াই মানুষের মহত্তম কীর্তি’; যেমন মানুষ, তেমন ভগবান্। এই রকম মানবিক প্রকাশ ছাড়া, অন্য কোন উপায়েই মানুষ ঈশ্বরকে দর্শন করতে পারে না। যা ইচ্ছা বলো, যত খুশী চেষ্টা কর, তুমি ভগবান্‌কে মানুষ ব্যতীত অন্য কিছুই কল্পনা করতে পার না এবং তিনি ঠিক তোমারই মত। একজন নির্বোধ লোককে বলা হয়েছিল—শিবের একটি মূর্তি নির্মাণ করতে; বেশ কিছুদিন দারুণ হাঙ্গামা করে অবশেষে—সে একটি বানরের মূর্তি তৈরী করতে পেরেছিল মাত্র! ঠিক তেমনই, যখনই আমরা ঈশ্বরের পরিপূর্ণ সত্তা ভাবতে চেষ্টা করি, তখনই নিদারুণ ব্যর্থতার সম্মুখীন হই, কারণ আমাদের মনের বর্তমান প্রকৃতি অনুযায়ী ঈশ্বরকে ব্যক্তিরূপে দেখতেই আমরা বাধ্য। যদি মহিষেরা কখনও ভগবানকে পূজা করবার বাসনা করে, তবে তাদের নিজ-প্রকৃতি অনুযায়ী তারা তাঁকে মস্ত একটা মহিষ বলেই ভাববে; একটা মাছ যদি ভগবানকে উপাসনা করতে ইচ্ছা করে, তা হলে ঈশ্বর সম্বন্ধে তার কল্পনা হবে যে, তিনি নিশ্চয়ই প্রকাণ্ড এক মাছ; ঠিক সেই প্রকার মানুষ তাঁকে মানুষ বলেই চিন্তা করে। মনে কর যেন এই মানুষ, মহিষ এবং মাছ সব এক-একটি ভিন্ন ভিন্ন পাত্র, নিজ নিজ আকার ও সামর্থ্যানুযায়ী তারা ঈশ্বররূপ সমুদ্রজলে পূর্ণ হতে চলেছে। মানুষের মাঝে সে-জল মানুষের আকার নেবে, মহিষের মধ্যে মহিষের আকার এবং মাছেতে মাছের আকার; কিন্তু প্রতি পাত্রে ঈশ্বরসমুদ্রের সেই একই জল।
দু-রকম মানুষ ভগবানকে ব্যক্তিরূপে উপাসনা করে না—নরপশু, যাদের ধর্ম বলে কিছু নেই; এবং পরমহংস, যিনি মনুষ্য-প্রকৃতির সকল সীমা অতিক্রম করেছেন। সমস্ত প্রকৃতিই তাঁর কাছে স্ব-স্বরূপ হয়ে গেছে, তিনিই শুধু ঈশ্বরকে তাঁর স্ব-রূপে পূজা করতে পারেন। সেই নরপশু উপাসনা করে না তার অজ্ঞতার জন্য, আর জীবন্মুক্তেরা উপাসনা করেন না, তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভগবানকে দেখছেন বলে। তাঁদের কোন সাধনা থাকে না, ঈশ্বরকে তাঁরা স্বীয় আত্মার স্বরূপ বলে বোধ করেন। তাঁরা বলেন, ‘সোঽহং, সোঽহম্’—আমিই তিনি; তাঁরা নিজেদের উপাসনা নিজেরা আর করবেন কিভাবে?
একটা গল্প বলছি তোমাদের। একটি সিংহশিশু তার মরণাপন্ন জননীর দ্বারা কোনভাবে পরিত্যক্ত হয়ে একদল মেষের মধ্যে এসে জুটেছিল। মেষেরাই তাকে খাওয়াত আর আশ্রয়ও দিয়েছিল। সিংহটি ক্রমশঃ বড় হয়ে হাঁটতে শিখল এবং মেষেরা যখন ‘ব্যা ব্যা’ করে, সেও ‘ব্যা ব্যা’ করতে লাগল। একদিন অপর একটি সিংহ কাছাকাছি এসে পড়ে। অবাক হয়ে দ্বিতীয় সিংহটি জিজ্ঞাসা করে উঠল, ‘আরে, তুমি এখানে কি করছ?’ কারণ সে শুনে ফেলেছিল, সিংহ-শিশুটিও বাকী সকলের সঙ্গে ‘ব্যা ব্যা’ করে ডাকছে।
ছোট সিংহটি ‘ব্যা ব্যা’ করে বললে, ‘আমি ছোট মেষশিশু, আমি নেহাৎ শিশু, বড় ভয় পেয়েছি আমি।’ প্রথম সিংহটি গর্জন করে উঠল, ‘আহাম্মক! চলে এসো, তোমাকে একটা মজা দেখাব।’ তারপর সে তাকে একটা শান্ত জলাশয়ের ধারে নিয়ে গিয়ে, তার প্রতিবিম্বটি দেখিয়ে তাকে বলল, ‘তুমি হচ্ছ একটা সিংহ—আমার দিকে তাকাও, ঐ মেষটিকে দেখ, আর তোমার নিজের চেহারাও এই দেখ।’ সিংহশিশুটি তখন তাকিয়ে দেখল আর বলল, ‘ব্যা ব্যা, আমি তো মেষের মত দেখতে নই—ঠিক আমি সিংহই বটে!’ তারপর এমন গর্জন সে করে উঠল, যেন পাহাড়ের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।
আমাদেরও ঠিক এই অবস্থা। মেষ-সংস্কারের আবরণে আমরা সকলেই সিংহ। আমাদের পরিবেশই আমাদিগকে দুর্বল ও মোহগ্রস্থ করে ফেলেছে। বেদান্তের কার্য হচ্ছে এই মোহ-বিমোচন। মুক্তিই আমাদের চরম লক্ষ্য। প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতি আনুগত্য মুক্তি—এ-কথা আমি স্বীকার করি না। এ-কথার অর্থ যে কী, তা আমি বুঝি না। মানুষের উন্নতির ইতিহাস অনুযায়ী প্রাকৃতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে যাওয়াই উন্নতির কারণ। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, সাধারণ নিয়মকে জয় করা তো উচ্চতর নিয়মের সাহায্যেই হয়ে থাকে, কিন্তু বিজয়ী মন সেখানেও মুক্তিকেই খুঁজে বেড়ায়, আর যখনই জানতে পারে, নিয়মের মধ্য দিয়েই সংগ্রাম, তখনই সে তাও জয় করতে চায়। সুতরাং মুক্তিই হল সর্বকালের আদর্শ। বৃক্ষ কখনও নিয়মকে অমান্য করে না; কোন গরুকে কখনও চুরি করতে দেখিনি। ঝিনুক কদাপি মিথ্যা কথা বলে না; তথাপি তারা মানুষের চেয়ে বড় নয়। নিয়মের প্রতি অনুরক্তি শেষ পর্যন্ত আমাদের জড় পদার্থেই পরিণত করে—তা সমাজে হোক, রাজনীতিতে হোক বা ধর্মেই হোক। এ-জীবন তো মুক্তিরই উদাত্ত নির্ঘোষ; আচার-নিয়মের আধিক্য মানে মৃত্যু। হিন্দুদের মত অন্য কোন জাতির এত বেশী সামাজিক নিয়ম-কানুন নেই, যার ফল জাতীয় মৃত্যু। কিন্তু হিন্দুদের স্বাতন্ত্র্য এই যে, ধর্মের মধ্যে তারা কোন মতবাদ বা নিয়মাদি আনেনি। তাদের ধর্মের তাই সর্বোচ্চ বিকাশ হয়েছে। এই ধর্মের ক্ষেত্রেই আমরা সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্ন—আর তোমরা সেখানেই সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিহীন।
আমেরিকাতে জনকয়েক লোক এসে বলল, ‘আমরা একটা যৌথ কারবার করব’, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তা হয়ে গেল। ভারতবর্ষে কুড়িজন লোক মিলে দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে যৌথ কারবার সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে অথচ তাতেও হয়তো তা গঠিত হবে না; কিন্তু কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, চল্লিশ বৎসর ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যা করলে সে জ্ঞানলাভ করবে—তা সে তৎক্ষণাৎ করবে! কাজেই আমরা আমাদের ভাবে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, তোমরাও তেমনি তোমাদের ভাবে।
কিন্তু অনুভব-রাজ্যে প্রবেশের যত পথ, তার সেরা পথ হচ্ছে অনুরাগ। ঈশ্বরে অনুরাগ হলে সমস্ত বিশ্বকেই আপন বোধ হয়, কারণ সবই তাঁর সৃষ্টি। ভক্ত বলেন, ‘তাঁরই তো সব, আর তিনিই আমার প্রেমাস্পদ; আমি তাঁকেই ভালবাসি।’ এমনি করে ভক্তের কাছে সব কিছু পবিত্র হয়ে ওঠে, কারণ সকল বস্তুই তাঁর। তা হলে আমরা কি করেই বা কাউকে কষ্ট দিতে পারি? কেমন করে তবে অপরকে ভাল না বেসে পারি? ঈশ্বরকে ভালবাসবার সঙ্গে সঙ্গে—তারই ফলরূপে অবশেষে প্রত্যেকের প্রতিই ভালবাসা এসে যাবে। যতই ঈশ্বরের কাছাকাছি যাব, ততই দেখতে থাকব যে, তাঁতেই সবকিছু রয়েছে, আমাদের হৃদয় হবে তখন প্রেমের অনন্ত প্রস্রবণ। প্রেমের দিব্যালোকে মানুষ রূপান্তরিত হয়ে যায়, আর শেষ পর্যন্ত সেই মধুর এবং উদ্দীপনাময় সত্যটি উপলব্ধি করে—প্রেম, প্রেমিক আর প্রেমাস্পদ—তত্ত্বতঃ একই।

*************************************************************************************************************

ধর্মের দাবী

ধর্মের দাবী

আপনাদের অনেকেরই স্মরণ আছে যে আপনারা শিশুকালে উদীয়মান জ্যোতির্ময় সূর্যকে কত আনন্দের সহিতই না অবলোকন করিতেন; আর আপনারা সকলেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ভাস্বর অস্তাচলগামী সূর্যকে স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করিয়া অন্ততঃ কল্পনাসহায়ে অদৃশ্য লোকে অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টাও করেন। বস্তুতঃ এই ব্যাপারটি সমগ্র বিশ্বের ভিত্তিমূলে রহিয়াছে—অদৃশ্যলোক হইতে উদয় এবং উহাতেই পুনরায় অস্তগমন, অজানা হইতে এই সমগ্র বিশ্বের উদ্ভব, পুনরায় অজানার ক্রোড়ে অনুপ্রবেশ; শিশুর মত অন্ধকার হইতে হামাগুড়ি দিয়া আবির্ভূত হওয়া এবং পুনরায় বৃদ্ধ বয়সে হামাগুড়ি দিয়া কোনপ্রকারে অন্ধকারের মধ্যে ফিরিয়া যাওয়া।
আমাদের এই বিশ্ব, এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, এই যুক্তি ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্রহ্মাণ্ডটি উভয় প্রান্তেই অসীম, অজ্ঞেয় ও চির অজ্ঞাতের দ্বারা আবৃত। অনুসন্ধান—এই অজ্ঞাত সম্বন্ধেই অনুসন্ধান চলে, প্রশ্ন এখানেই চলে, তথ্যও এইখানেই রহিয়াছে, ইহারই মধ্য হইতে সেই আলোক বিচ্ছুরিত হয়, যাহা জগতে ‘ধর্ম’ নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোকের বস্তু নয়; ইহা অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ইহা যুক্তি-বিচারের অতীত, ইহা বুদ্ধিগ্রাহ্য স্তরের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইহা এমন একটি প্রত্যক্ষ দর্শন, এমন একটি দৈব-প্রেরণা, অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ের মধ্যে এমন এক আত্ম-নিমজ্জন যাহার ফলে অজ্ঞেয়কে জ্ঞাত অপেক্ষাও নিবিড়ভাবে জানা যায়; কারণ লৌকিক অর্থে ইহার জ্ঞান সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস মানব-মনের এই অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টির আদি হইতেই চলিয়া আসিতেছে। জগতের ইতিহাসে এমন কোন সময়েই ছিল না, যখন মানুষের বিচারশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা ছিল অথচ এই প্রচেষ্টা—এই অতীন্দ্রিয় বস্তুর অনুসন্ধিৎসা ছিল না। আমরা হয়তো দেখিতে পাইলাম, আমাদের এই ক্ষুদ্র বিশ্বে, এই মানব-মনে একটি ভাবনার উদয় হইল, কিন্তু কোথা হইতে ইহার উদ্ভব হইল, তাহা আমরা জানি না, এবং যখন ইহা বিলুপ্ত হয়, তখনই বা ইহা কোথায় যায়, তাহাও আমরা জানি না। এই ক্ষুদ্র জগৎ ও বিরাট ব্রহ্মাণ্ড, একই উৎস হইতে উদ্ভূত হয়, একই ধারায় চলে, একই প্রকার স্তরসমষ্টি অতিক্রম করে এবং একই পর্দায় ঝঙ্কৃত হয়।
আমি আপনাদের সম্মুখে হিন্দুদের এই মতবাদ উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিব যে, ধর্ম বাহির হইতে আসে না, অন্তর হইতে উৎসারিত হয়। আমার বিশ্বাস—ধর্ম মানুষের এমনই মজ্জাগত যে, যতক্ষণ মানুষ দেহ ও মন ত্যাগ না করে, চিন্তা ও প্রাণের গতি নিরুদ্ধ না করে, ততক্ষণ ধর্ম ত্যাগ করিতে পারিবে না। যতক্ষণ মানুষ চিন্তা করিতে সমর্থ থাকিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত—এই প্রয়াস থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষের কোন-না-কোন রকম ধর্ম থাকিবেই, এইরূপে আমরা দেখিতে পাই—জগতে নানা ধর্মের উৎপত্তি হইয়াছে। এইগুলির অনুশীলনে মানুষ দিশেহারা হইয়া যায়, কিন্তু অনেকে যদিও মনে করেন যে এ জাতীয় গবেষণা বৃথা, তথাপি বস্তুতঃ উহা বৃথা নয়। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি সামঞ্জস্য আছে, এই-সকল বেতাল বেসুরের মধ্যেও একটি সঙ্গীতের ছন্দ পাওয়া যায়; যিনি শুনিতে চেষ্টা করিবেন, তিনিই সে ছন্দ শুনিতে পাইবেন।
বর্তমান সময়ে সকল প্রশ্নের বড় প্রশ্ন হইল, যদি ইহাই সত্য হয় যে, জ্ঞেয় এবং জ্ঞাত বস্তুর উভয় প্রান্তে অজ্ঞেয় এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অনন্তের বেষ্টন রহিয়াছে, তবে সেই অজানাকে জানিবার জন্য এত প্রয়াস কেন? কেন আমরা জ্ঞাত বস্তু লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিব না, কেন আমরা পানাহার এবং সমাজের মঙ্গলসাধনকল্পে সামান্য কিছু করিয়াই পরিতৃপ্ত থাকিব না? এই ধারণাই সর্বত্র আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া আছে। পণ্ডিত অধ্যাপক হইতে আরম্ভ করিয়া অস্ফুট-ভাষাভাষী শিশু পর্যন্ত সকলেই বলেঃ জগতের উপকার কর; ধর্ম বলিতে এইটুকুই বুঝায়; ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু সম্পর্কে মাথা ঘামাইও না। এই কথা এত বেশী ক্ষেত্রে বলা হইয়া থাকে যে, এখন ইহা একটি অবধারিত সত্যে পরিণত হইয়া গিয়াছে।
কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমরা স্বভাবতই ইহারও ঊর্ধ্বে অনুসন্ধান করিতে বাধ্য। এই যে বর্তমান, এই যে ব্যক্ত, তাহা অব্যক্তের এক অংশ মাত্র। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্ব যেন সেই অনন্ত অধ্যাত্মলোকের এমন একটি অংশ, এমন একটি খণ্ড, যাহা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চেতনস্তরের মধ্যে প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছে। সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্বকে বাদ দিয়া কেবল এই প্রসারিত ক্ষুদ্র অংশটিকে কিরূপে বুঝা যায় বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব? সক্রেটিস সম্বন্ধে কথিত আছে যে, এথেন্স নগরীতে একদা বক্তৃতা করিবার কালে তিনি এমন একজন ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পান, যিনি ভ্রমণ ব্যপদেশে গ্রীসে উপস্থিত হইয়াছিলেন। সক্রেটিস তাঁহাকে বলিলেন, মানুষের প্রধান জ্ঞাতব্য বিষয় হইল ‘মানুষ’। ব্রাহ্মণ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, ‘ঈশ্বরকে না জানিয়া আপনি মানুষকে জানিবেন কিরূপে?’ এই যে ঈশ্বর, এই যে সদা অজ্ঞেয় সত্তা, অথবা পরমতত্ত্ব, অথবা অনন্ত বস্তু, অথবা নামহীন সত্তা—আপনি তাঁহাকে যে নামে ইচ্ছা অভিহিত করিতে পারেন—একমাত্র তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই জ্ঞাত ও জ্ঞেয় অর্থাৎ এই বর্তমান জীবনের যৌক্তিকতা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা বা অবস্থিতির মূল কারণ প্রদর্শন করা সম্ভব। আপনার সম্মুখস্থ যে-কোন অতি-জড়বস্তুই ধরুন—যে-সব বিদ্যা অতীব জড়-বিষয়সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান বলিয়া পরিচিত, তাহার যে-কোনটি—যথা রসায়ন-বিদ্যা, পদার্থ-বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা প্রাণী-বিজ্ঞান অধ্যয়ন করুন; ক্রমাগত তাহার অনুশীলন করিয়া চলুন—দেখিবেন স্থূল রূপগুলি ক্রমেই বিলীন হইয়া সূক্ষ্মে পরিণত হইতেছে, অবশেষে এমন একটি বিন্দুসদৃশ কেন্দ্রে আসিয়া পৌঁছিতেছে, যেখানে আপনি জড় হইতে অ-জড়ে উপনীত হইবার জন্য একটি বৃহৎ লম্ফ প্রদান করিতে বাধ্য। স্থূল বিগলিত হইয়া সূক্ষ্মাকার গ্রহণ করে, পদার্থ-বিজ্ঞান দর্শন-শাস্ত্রে পরিণত হয়; জ্ঞানরাজ্যের সকল ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের যাহা কিছু আছে—আমাদের সমাজ, আমাদের পরস্পরের সহিত সম্পর্ক, আমাদের ধর্ম এবং আপনারা যাহাকে নীতিশাস্ত্র নামে অভিহিত করেন—সর্ব ক্ষেত্রেই এই একই কথা প্রযোজ্য। কেবলমাত্র উপযোগিতার (utility) ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র গড়িয়া তুলিবার বহু প্রচেষ্টা দেখা যায়। আমি প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে যে কোন ব্যক্তিকে এইরূপ কোন ন্যায়সম্মত নীতিশাস্ত্র গড়িয়া তুলিতে আহ্বান করিতেছি। তিনি হয়তো অপরের উপকার সাধন করিতে উপদেশ দিবেন। ‘কেন ঐরূপ করিব? যেহেতু ঐরূপ করাই মানবের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অধিক উপযোগী।’ এখন ধরা যাক, কোন ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি উপযোগিতা গ্রাহ্য করি না, আমি অপরের কণ্ঠচ্ছেদ করিয়া নিজে ধনী হইব।’ আপনি তাহাকে কি উত্তর দিবেন? সে তো আপনার প্রয়োজনবাদেরই আশ্রয় লইয়া ঐ প্রয়োজনবাদকেই নস্যাৎ করিয়া দিল। আমি যদি জগতের উপকার সাধন করি, তাহাতে আমার কোন্‌ প্রয়োজন সিদ্ধ হইবে? আমি কি এতই নির্বোধ যে, অপরে যাহাতে সুখে থাকিতে পারে, তাহার জন্য পরিশ্রম করিয়া জীবনপাত করিব? যদি সমাজ ব্যতীত অপর কোন চেতন বস্তু না থাকে, পঞ্চেন্দ্রিয় ব্যতীত জগতে অপর কোন শক্তি না থাকে, তাহা হইলে আমি নিজেই বা সুখী হইব না কেন? যদি আইন-রক্ষীদের করতল হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিতে পারি, তবে আমি কেন আমার ভ্রাতৃবর্গের কণ্ঠচ্ছেদ করিয়া নিজে সুখী না হইব? আপনি ইহার কি উত্তর দিবেন? আপনাকে ইহার সমর্থনে কোন উপযোগিতা দেখাইতে হইবে। এইরূপে যখনই আপনার যুক্তির ভিত্তি শিথিল করিয়া দেওয়া হয়, তখনই আপনি বলেন, ‘ওহে বন্ধুবর, জগতে ভাল করাই ভাল।’ মানব-মনের অন্তর্নিহিত যে শক্তি বলে, ‘ভাল হওয়াই ভাল’, যে শক্তি আমাদের নিকট অতি সমুজ্জ্বল আত্মার মহিমা প্রকাশ করে, সাধুত্বের সৌন্দর্য—পুণ্যের সর্বমনোহর আকর্ষণ প্রকটিত করে, মঙ্গলের অনন্ত শক্তির পরিচয় দেয়, সেই শক্তিটির স্বরূপ কি? তাহাকেই তো আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। তাই নয় কি?
দ্বিতীয়তঃ এবার আমি এমন এক ক্ষেত্রে আসিয়া পড়িতেছি, যেখানে সাবধানে কথা বলিতে হয়। আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছি এবং অনুরোধ করিতেছি, যাহাতে আপনারা আমার বক্তব্য শুনিয়াই দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত না করিয়া ফেলেন। আমরা এই জগতে উপকার সাধন বিশেষ কিছুই করিতে পারি না। জগতের কল্যাণ করা ভাল কথা। কিন্তু এই জগতের কোন বিশেষ উপকার আমরা করিতে পারি কি? এই যে শত শত বৎসর ধরিয়া আমরা চেষ্টা করিতেছি, তাহাতে কি খুব বেশী কিছু উপকার করিতে পারিয়াছি, জগতের মোট সুখের পরিমাণ কি বৃদ্ধি করিতে পারিয়াছি? জগতে সুখ-সৃষ্টির জন্য নিত্যই অসংখ্য উপায় উদ্ভাবিত হয়, এবং এই প্রক্রিয়া শত-সহস্র বৎসর ধরিয়া চলিতেছে। আমি আপনাদিগকে প্রশ্ন করি, এক শতাব্দীকাল পূর্বের তুলনায় বর্তমানে মোট সুখের পরিমাণ কি বৃদ্ধি পাইয়াছে? তাহা সম্ভব নয়। মহাসাগরের বুকে কোথাও না কোথাও গভীর গহ্বর সৃষ্টি করিয়াই উত্তাল তরঙ্গ উঠিতে পারে। যদি কোন জাতি ধনী ও শক্তিশালী হইয়া উঠে, তাহা অন্য কোন জাতির ধনসম্পদ্ ও ক্ষমতার হ্রাস করিয়াই হইয়া থাকে। প্রতিটি নবাবিষ্কৃত যন্ত্র বিশ জনকে ধনী করিতেছে আর বিশ সহস্রকে দরিদ্র করিতেছে। সর্বত্রই দেখা যায়—প্রতিযোগিতার এই সাধারণ নিয়মের অভিব্যক্তি। মোট স্ফূর্ত শক্তির পরিমাণ সর্বদা একই থাকে। আরও দেখুন এই কার্যটাই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক; দুঃখকে বাদ দিয়া আমরা সুখের ব্যবস্থা করিতে পারি—ইহা অযৌক্তিক কথা। ভোগের এই-সকল উপকরণ সৃষ্টি করিয়া আপনারা জগতের অভাব বৃদ্ধি করিতেছেন এই মাত্র। আর অভাবের বৃদ্ধির অর্থ হইল অতৃপ্ত বাসনা, যাহা কখনও প্রশমিত হইবে না। কোন্ বস্তু এই অভাব—এই তৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করিতে পারে? যতক্ষণ এই তৃষ্ণা থাকিবে, ততক্ষণ দুঃখ অনিবার্য। জীবনের স্বাভাবিক ধারাই এই যে, পর পর দুঃখ এবং সুখ ভোগ করিতে হয়। তারপর আপনি কি মনে করেন যে, পৃথিবীর মঙ্গল-সাধনের কর্ম আপনার উপরই অর্পণ করা হইয়াছে? আর কি কোন শক্তি এই বিশ্বে কার্য করিতেছে না? যিনি সনাতন, সর্বশক্তিমান্, করুণাময়, চিরজাগ্রত—যিনি সমগ্র বিশ্ব নিদ্রামগ্ন হইলেও নিজে কখনও নিদ্রিত হন না, যাঁহার চক্ষু সতত নির্নিমেষ, সেই ঈশ্বর কি আমার ও আপনার হস্তে তাঁহার বিশ্বকে সমর্পণ করিয়া মৃত্যু বরণ করিয়াছেন বা বিশ্ব হইতে বিদায় লইয়াছেন? এই অনন্ত আকাশ যাঁহার সদা উন্মীলিত চক্ষু-সদৃশ, তিনি কি মৃত্যু-কবলিত হইয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছেন? তিনি কি আর এই বিশ্বের পালনাদি করেন না? বিশ্ব তো বেশ ভালভাবেই চলিতেছে, আপনার ব্যস্ত হইবার তো কোন প্রয়োজন নাই; এ-সকল ভাবিয়া আপনার দুঃখ ভোগ করিবার প্রয়োজন নাই।

[স্বামীজী এখানে সেই লোকটির গল্প বলিলেন, যে ভূতের দ্বারা আপনার কর্ম করাইতে চাহিয়াছিল, এবং ভূতকে ক্রমাগত কর্মের নির্দেশ দিয়াছিল; কিন্তু পরিশেষে আর তাহাকে নিযুক্ত রাখিবার মত কোন কর্ম না পাওয়ায় একটি কুকুরের বাঁকা লেজকে সোজা করিতে দিয়াছিল।]

এই বিশ্বের উপকার-সাধন করিতে গিয়া আমাদেরও সেই একই অবস্থায় পড়িতে হইয়াছে। হে ভ্রাতৃবৃন্দ, আমরাও ঠিক তেমনি এই শতসহস্র বৎসর ধরিয়া কুকুরের লেজ সোজা করিবার কাজে লাগিয়া আছি। ইহা বাতব্যাধির মত। পাদদেশ হইতে বিতাড়িত করিলে উহা মস্তকে আশ্রয় লয়, মস্তক হইতে বিতাড়িত করিলে অপর কোন অঙ্গে আশ্রয় লয়।
আপনাদের অনেকেরই নিকট জগৎ সম্বন্ধে আমার এই মতটি ভয়াবহভাবে নৈরাশ্যজনক বলিয়া মনে হইবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নয়। নৈরাশ্যবাদ ও আশাবাদ, দুই-ই ভ্রান্ত মত—দুই-ই অতিমাত্রায় চরম। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির অপর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় থাকে, পরিধানে উত্তম বস্ত্র থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে অত্যন্ত আশাবাদী, কিন্তু সেই মানুষই যখন সবকিছু হারায়, তখন চরম নৈরাশ্যবাদী হইয়া উঠে। যখন কোন ব্যক্তি সর্বপ্রকার ধনসম্পদ্ হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় এবং একেবারে দীন-দরিদ্র হইয়া যায়, কেবল তখনই মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব সংক্রান্ত ধারণারাশি তাহার নিকট সবেগে আবির্ভূত হয়। সংসারের স্বরূপই এই। যতই দেশদেশান্তর ভ্রমণ করিয়া জগতের সহিত অধিক পরিচিত হইতেছি, যতই আমার বয়স হইতেছে, ততই আমি নিরাশাবাদ ও আশাবাদের মত চরম মত পরিহার করিবার চেষ্টা করিতেছি। এই জগৎ ভালও নয়, মন্দও নয়; ইহা প্রভুর জগৎ। ইহা ভাল-মন্দ উভয়ের অতীত, নিজের দিক্ হইতে ইহা সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ। ভগবানেরই ইচ্ছায় কাজ চলিতেছে, এবং এই সকল বিভিন্ন চিত্র আমাদের সম্মুখে আসিতেছে; অনাদি অনন্ত কাল ধরিয়া ইহা চলিতে থাকিবে। ইহা একটি সুবৃহৎ ব্যায়ামাগার তুল্য; এখানে আমাকে আপনাকে ও লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে আসিয়া ব্যায়াম অভ্যাস করিতে হইবে এবং নিজদিগকে সরল ও দোষশূন্য করিয়া লইতে হইবে। জগৎ এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হইয়াছে। ভগবান্ যে ত্রুটিহীন জগৎ সৃষ্টি করিতে পারিতেন না বা জগতে দুঃখের ব্যবস্থা করা ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না, তাহা নয়।
আপনারা সেই ধর্মযাজক ও তরুণীর কাহিনী স্মরণ করুন; একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে উভয়েই চন্দ্র অবলোকন করিয়া কলঙ্করেখাগুলি দেখিতে পাইলেন। ধর্মযাজক বলিলেন, ‘ওইগুলি নিশ্চয়ই গীর্জার চূড়া।’ তরুণী বলিলেন, ‘বাজে কথা, ওরা নিশ্চয়ই চুম্বনরত তরুণ প্রণয়িযুগল।’ এই পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের দর্শনও অনুরূপ। আমরা যখন জগতের ভিতরে থাকি, তখন মনে করি, উহার অন্তর্ভাগ দেখিতেছি। আমরা জীবনের যে স্তরে থাকি, তদনুযায়ী বিশ্বকে দেখি। রান্নাঘরের অগ্নি ভালও নয়, মন্দও নয়। যখন এই অগ্নি আপনার আহার্য প্রস্তুত করিয়া দেয়, তখন আপনি তাহার প্রশংসা করিয়া বলেন, ‘অগ্নি কত ভাল!’ অগ্নি যখন আপনার আঙুল দগ্ধ করে, তখন আপনি বলেন, ‘ইহা কি জঘন্য!’ ঠিক একইভাবে এবং সমযুক্তিসহায়ে এ-কথা বলা যায়, ‘এই বিশ্ব ভালও নয়, মন্দও নয়।’ এই সংসারটি সংসার ছাড়া আর কিছু নয়; এবং চিরকাল তাহাই থাকিবে। যখনই আমরা নিজদিগকে ইহার নিকট এমনভাবে খুলিয়া ধরিতে পারি যে, জাগতিক কার্যাবলী আমাদের অনুকূল হয়, তখন আমরা ইহাকে ভাল বলি। আবার যদি আমরা নিজেদের এমন অবস্থায় উপস্থাপিত করি যে, ইহা আমাদের দুঃখসাগরে ভাসাইয়া দেয়, তাহা হইলে ইহাকে আমরা মন্দ বলি। ঠিক এইভাবে আপনারা সর্বদাই দেখিতে পাইবেন, নির্দোষ ও আনন্দময় যে শিশুর মনে কাহারও প্রতি কোন অনিষ্টচিন্তা জাগ্রত হয় নাই, তাহারা আশাবাদী হয়, তাহারা সোনার স্বপ্ন দেখে। এদিকে যেসব বয়স্ক ব্যক্তির অন্তর বাসনায় পূর্ণ, অথচ উহা পূর্ণ করিবার কোন উপায় নাই, বিশেষতঃ যাহারা সংসারে প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাতে আবর্তিত হইয়াছে, তাহারা নৈরাশ্যবাদী হয়। ধর্ম সত্যকে জানিতে চায়; এবং প্রথম যে তত্ত্ব সে আবিষ্কার করিয়াছে, তাহা হইল এই—সত্যের অনুভূতি ব্যতীত বাঁচিয়া থাকার কোন অর্থ নাই।
আমরা যদি লোকাতীতকে জানিতে না পারি, তাহা হইলে আমাদের জীবন মরুভূমিতে পরিণত হইবে, মানব-জন্ম বৃথা যাইবে। ‘বর্তমানের বস্তু লইয়া সন্তুষ্ট থাক’—ইহা বলিতে বেশ। গাভী, কুকুর এবং অন্যান্য পশুদের ক্ষেত্রে এইরূপ হওয়া সম্ভব, এবং এই সন্তোষই তাহাদের পশু করিয়া রাখিয়াছে। সুতরাং মানুষ যদি বর্তমানেই সন্তুষ্ট থাকে এবং লোকাতীতের উদ্দেশ্যে সমস্ত অনুসন্ধান পরিত্যাগ করে, তাহা হইলে মানুষকে পুনরায় পশুত্বের স্তরে ফিরিয়া যাইতে হইবে। এই ধর্ম, এই লোকাতীতের জন্য অনুসন্ধিৎসাই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করিয়াছে। এ-কথাটা বেশ বলা হইয়াছে যে, মানুষই একমাত্র জীব যে স্বভাবতঃ ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করে, অন্যান্য প্রাণী স্বভাব-বশেই নিম্নদৃষ্টি। এই যে ঊর্ধ্বদৃষ্টি এবং ঊর্ধ্বাভিমুখে গতি ও পূর্ণতালাভের আকূতি—ইহাকেই মুক্তি বলা হয়, এবং যত শীঘ্র মানুষ ঊর্ধ্বস্তরাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করে, তত শীঘ্রই সে এইরূপ ধারণায় উপনীত হয় যে, মুক্তি বলিতে সত্যকেই বুঝায়। তোমার পকেটে কত টাকা আছে, কিংবা তুমি কিরূপ পোষাক-পরিচ্ছদ পরিতেছ—কিংবা কি প্রকার গৃহে বাস করিতেছ, তাহার উপর মুক্তি নির্ভর করে না, নির্ভর করে তোমার মস্তিষ্কে কতটুকু অধ্যাত্ম-চিন্তা আছে, তাহার উপর। ইহারই ফলে মানুষের উন্নতি হয়, ইহাই জড়জগতে ও বুদ্ধিজগতে সর্বপ্রকার উন্নতির উৎস; ইহাই সেই মৌলিক আকূতি, সেই উৎসাহ যাহা মানুষকে প্রগতির পথে পরিচালিত করে।
তাহা হইলে মানব-জীবনের লক্ষ্য কি? সুখ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভোগই কি লক্ষ্য? পুরাকালে বলা হইত, মানুষ স্বর্গে গিয়া তুরী নিনাদ করিবে এবং রাজ-সিংহাসনের নিকটে বাস করিবে। বর্তমান যুগে দেখিতেছি, এই ধারণাকে অতি হীন বলিয়া মনে করা হয়। বর্তমান যুগে এই ধারণাটির উৎকর্ষ সাধন করা হইয়াছে এবং বলা হয় যে, স্বর্গে সকলেই বিবাহ করিতে পাইবে এবং ঐ জাতীয় সবকিছুই সেখানে পাইবে। এই দুইটি ধারণার মধ্যে যদি কোনটির অগ্রগতি হইয়া থাকে, তাহা হইলে দ্বিতীয়টির অগ্রগতি হইয়াছে মন্দেরই দিকে। স্বর্গ সম্পর্কে এই যে-সকল ধারণা উপস্থাপিত করা হইল, তাহা মনের দুর্বলতারই পরিচায়ক। এবং এই দুর্বলতার কারণঃ প্রথমতঃ মানুষ মনে করে, ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের লক্ষ্য; দ্বিতীয়তঃ পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতীত কোন বস্তুর ধারণা সে করিতে পারে না। এই মতবাদীরা প্রয়োজনবাদীদের মতই যুক্তিহীন। তথাপি ইহারা অন্ততঃপক্ষে আধুনিক নাস্তিক প্রয়োজনবাদীদের তুলনায় অনেক ভাল। পরিশেষে বলিতে হয়, প্রয়োজনবাদীদের এই মতবাদটি বালকোচিত। আপনার এ-কথা বলিবার কি অধিকার আছে যে, ‘এই আমার বিচারের মাপকাঠি এবং সমগ্র বিশ্বকে এই বিচারের মাপকাঠি অনুযায়ী চলিতে হইবে?’ যে মাপকাঠির শিক্ষা হইল—শুধু অন্ন, অর্থ ও পোষাকই ঈশ্বর, সেই মাপকাঠি দ্বারা সকল সত্যকেই বিচার করিতে হইবে, এইরূপ বলিবার আপনার কি অধিকার আছে?
ধর্ম কোন খাদ্যের মধ্যে বা বাসস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আপনারা প্রায়ই এবংবিধ সমালোচনা শুনিতে পান যে, ‘ধর্ম আবার মানুষের কি হিতসাধন করিতে পারে? ইহা কি দরিদ্রের দারিদ্র্য দূর করিতে পারে, তাহাদিগকে পরিধানের বস্ত্র দিতে পারে?’ ধরুন ধর্ম তাহা পারে না, ইহা দ্বারাই কি ধর্মের অসত্যতা প্রমাণিত হইবে? ধরুন জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত কোন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হইতেছে, এমন সময় আপনাদের মধ্যে একটি শিশু উঠিয়া প্রশ্ন করিল, ‘এই তত্ত্ব কি কোন ভাল খাবার উৎপন্ন করিতে পারিবে?’ আপনি হয়তো বলিলেন, ‘না, পারে না।’ শিশুটি তখন বলিল, ‘তাহা হইলে ইহা নিরর্থক।’ শিশুরা সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখে—অর্থাৎ খাবার প্রস্তুতের দৃষ্টি দিয়া; আর এই সংসারে যাহারা শিশুসম, তাহারাও এইরূপ করে।
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে এ-কথা বলিতে দুঃখ হয় যে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যাঁহাদিগকে পণ্ডিত, সর্বাধিক যুক্তিবাদী, সর্বাপেক্ষা ন্যায়কুশল এবং সর্বোত্তম মনীষাসম্পন্ন বলিয়া আমরা জানি, এই-সব ব্যক্তি ঐ শিশুদেরই মধ্যে পরিগণিত। উচ্চ তত্ত্বগুলিকে আমাদের এই হীন দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করা সঙ্গত নয়। প্রত্যেক বস্তুকে তাহার নিজস্ব মাপকাঠি দিয়া বিচার করিতে হইবে এবং অসীমকে অসীমেরই মান অনুসারে পরীক্ষা করিতে হইবে—অনন্তের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিতে হইবে। ধর্ম মানুষের সমগ্র জীবন, শুধু বর্তমান নয়, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সমগ্র জীবনধারাকে ব্যাপ্ত করিয়া রাখিয়াছে। অতএব ধর্ম হইল সনাতন আত্মার সহিত সনাতন ঈশ্বরের শাশ্বত সম্পর্ক। পাঁচ মিনিটের মানব-জীবনের উপর ইহা কি প্রকার প্রভাব বিস্তার করে, তাহা দেখিয়া ইহার মূল্যনির্ধারণ করা কি ন্যায়সঙ্গত হইবে? কখনই নয়। এগুলি সমস্তই নেতিবাচক যুক্তি।
এখন প্রশ্ন উঠিতেছে—ধর্ম কি মানুষের জন্য সত্যই কিছু করিতে পারে? পারে। ধর্ম কি সত্যই মানুষের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করিতে পারে? অবশ্যই পারে। ধর্ম সর্বদাই তাহা করে, এবং তদপেক্ষা অনেক বেশী কিছু করেঃ ইহা মানুষকে অনন্ত মহাজীবন আনিয়া দেয়। ইহা মানুষকে মানুষ করিয়াছে, এবং এই পশুমানবকে দেবত্বে উন্নীত করিবে। ইহাই হইল ধর্মের ফল। মানব-সমাজ হইতে ধর্মকে বাদ দিন, কি থাকিবে? বর্বরে পরিপূর্ণ একটি অরণ্যানী ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। যেহেতু এইমাত্র আমি তোমাদের নিকট প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি যে, ইন্দ্রিয়-সুখকে মানবজীবনের লক্ষ্য মনে করা অসম্ভব, সেহেতু আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিতেছি যে, জ্ঞানই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। আমি আপনাদের ইহাও দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি যে, এই সহস্র বৎসর ধরিয়া সত্যানুসন্ধানের জন্য এবং মানব-কল্যাণের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নতি করিতে পারিয়াছি—খুবই অল্প। কিন্তু মানুষ জ্ঞানের অভিমুখে বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে। জৈব-ভোগের ব্যবস্থা করাকেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ উপযোগিতা বলা চলে না; পরন্তু পশু-মানব হইতে দেবতার সৃষ্টি করাই হইবে ইহার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। অতঃপর জ্ঞানলাভ হইলে উহা হইতে স্বভাবতই পরমানন্দ আবির্ভূত হয়। শিশুগণ মনে করে, ইন্দ্রিয়সুখই হইল তাহাদের লভ্য সুখগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আপনারা প্রায় সকলেই জানেন যে, মানবজীবনে ইন্দ্রিয়সম্ভোগ অপেক্ষা বুদ্ধিজ সম্ভোগ অধিকতর তৃপ্তিপ্রদ। কুকুর আহার করিয়া যে আনন্দ পায়, আপনারা কেহ তাহা পাইবেন না। আপনারা সকলেই ইহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে পারেন। মানুষের মধ্যে কোথা হইতে তৃপ্তিবোধ জাগ্রত হয়? আহার হইতে শূকর বা কুকুর যে আনন্দ পায়, আমি তাহার কথা বলিতেছি না। লক্ষ্য করুন—শূকর কিভাবে আহার করে। সে যখন খায়, তখন সমগ্র বিশ্ব ভুল হইয়া যায়; তাহার গোটা মন ঐ আহারের মধ্যে ডুবিয়া যায়। আহার-গ্রহণকালে তাহাকে হত্যা করিলেও সে গ্রাহ্য করিবে না। ভাবিয়া দেখুন, ঐ কালে শূকরটির আনন্দসম্ভোগ কত তীব্র। কোন মানুষেরই এই তীব্র সম্ভোগানুভূতি নাই। মানুষের সে অনুভূতি কোথায় গেল? মানুষ ইহাকে বুদ্ধিজ ভোগে পরিণত করিয়াছে। শূকর ধর্মসম্বন্ধীয় বক্তৃতা উপভোগ করিতে পারে না। বুদ্ধিসাহায্যে উপভোগ অপেক্ষাও উহা উচ্চতর ও তীব্রতর স্তরে ঘটিয়া থাকে; ইহাই হইল আধ্যাত্মিক স্তর, ইহাই ঐশী বস্তুর আত্মিক সম্ভোগ, ইহা বুদ্ধি ও যুক্তির ঊর্ধ্বে অবস্থিত। ইহা লাভ করিতে হইলে আমাদের এই-সকল ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিতে হইবে। জীবনে ইহারই সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোগিতা আছে। উপযোগিতা বলিতে তাহাই বুঝায়, যাহা আমি উপভোগ করিতে পারি, অপর সকলেও ভোগ করিতে পারে; এবং ইহারই দিকে আমরা সকলে ধাবমান। আমরা দেখিতে পাই, পশুগণের ইন্দ্রিয়সুখ অপেক্ষা মানুষ নিজ বুদ্ধিমত্তা হইতে অধিকতর আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকে এবং ইহাও দেখি যে, মানুষ তাহার বুদ্ধিমত্তা অপেক্ষাও আধ্যাত্মিক স্বরূপ হইতে অধিকতর আনন্দ লাভ করিয়া থাকে। অতএব এই আধ্যাত্মিক অনুভূতিই হইল সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। এই অনুভূতির সহিত আনন্দলাভও হইবে। এই জগৎ—এই যে-সকল দৃশ্যমান বস্তু—এ-সকল তো সেই প্রকৃত সত্য এবং আনন্দের ছায়ামাত্র, উহার তৃতীয় অথবা চতুর্থ স্তরের নিম্নতর বিকাশমাত্র।
মানবপ্রেমের মধ্য দিয়া এই পরমানন্দই তোমাদের নিকট আসে; মানবীয় ভালবাসা এই আধ্যাত্মিক আনন্দেরই ছায়ামাত্র, কিন্তু মানবীয় আনন্দের সহিত ইহাকে এক করিয়া ফেলিও না। এই একটি বড় রকমের ভুল সর্বদাই হইতেছে। আমরা প্রতিমুহূর্তে আমাদের এই দৈহিক ভালবাসা, এই মানবীয় প্রেম, এই তুচ্ছ সসীমের প্রতি আকর্ষণ, সমাজের অন্তর্গত অপরাপর মানুষের প্রতি এই বিদ্যুৎসদৃশ আকর্ষণকে আমরা সর্বদাই পরমানন্দ বলিয়া ভুল করিতেছি। আমরা ইহাকেই সেই শাশ্বত বস্তু বলিয়া অভিহিত করিতেছি, প্রকৃতপক্ষে ইহা সেই বস্তু নয়। ইহার ঠিক কোন সমার্থক শব্দ ইংরেজী ভাষায় না থাকায়, আমি ইহাকে bliss বা পরমানন্দ বলিব। এই পরমানন্দ শাশ্বত জ্ঞানের সহিত অভিন্ন এবং ইহাই আমাদের লক্ষ্য। বিশ্বের যেখানে যত ধর্ম আছে বা ভবিষ্যতে থাকিতে পারে, সকলেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত—এই একই উৎস হইতে উদ্ভূত হইয়াছে এবং হইবে। এই পাশ্চাত্য দেশে তোমরা যাহাকে দিব্য প্রেরণা বল, তাহাও এই উৎস ভিন্ন আর কিছু নয়। এই প্রেরণার স্বরূপ কি? প্রেরণাই ধর্মানুভূতির একমাত্র উৎস। আমরা দেখিয়াছি, ধর্ম অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ধর্ম সেই বস্তু ‘যেখানে চক্ষু বা কর্ণ গমন করিতে পারে না, মন যেখানে পৌঁছাইতে পারে না, বাক্য যাহাকে প্রকাশ করিতে পারে না।’ ইহাই ধর্মের ক্ষেত্র এবং লক্ষ্য; যাহাকে আমরা প্রেরণা নামে অভিহিত করিতেছি, তাহাও এখান হইতে উদ্গত হয়। অতএব স্বভাবতই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এই ইন্দ্রিয়াতীত লোকে পৌঁছিবার কোন না কোন পথ অবশ্যই আছে। ইহা সম্পূর্ণ সত্যকথা যে, যুক্তি ইন্দ্রিয়সমূহকে অতিক্রম করিতে পারে না, সমস্ত যুক্তি ইন্দ্রিয়ের পরিধির মধ্যে, ইন্দ্রিয়বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ; ইন্দ্রিয়গুলি যে-সকল তথ্যে উপস্থিত হইতে পারে, যুক্তি তাহারই ভিত্তিতে গড়িয়া উঠে। কোন মানুষ কি ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করিতে পারে? কোন মানুষ কি এই অজ্ঞেয়কে জানিতে পারে? এই একটি প্রশ্নের ভিত্তিতেই ধর্মসম্বন্ধীয় সকল প্রশ্নের সমাধান করিতে হইবে, ইতঃপূর্বে তাহাই করা হইয়াছে। স্মরণাতীতকাল হইতেই সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর—ইন্দ্রিয়ের বাধা বিদ্যমান রহিয়াছে; স্মরণাতীত কাল হইতে শত-সহস্র নরনারী এই প্রাচীর ভেদ করিবার জন্য সংগ্রাম করিয়াছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ অকৃতকার্য হইয়াছে; অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কৃতকার্যও হইয়াছে। ইহাই হইল এই জগতের ইতিহাস। আবার আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, যাহারা এ-কথা বিশ্বাস করে না যে, সত্যই কেহ কখনও কৃতকার্য হইয়াছে। ইহারাই পৃথিবীর আধুনিক সন্দেহবাদী (sceptics)। মানুষ চেষ্টা করিলেই এই প্রাচীর ভেদ করিতে পারে। মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র যে যুক্তি আছে তাহা নয়, কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়সমূহ আছে তাহা নয়—তাহার মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে, যাহা ইন্দ্রিয়ের অতীত। আমরা এ-কথা একটু ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিব। আশা করি, তোমরাও অনুভব করিতে পারিবে যে, ইহা তোমাদের মধ্যেও আছে।
আমি যখন আমার হস্ত সঞ্চালন করি—তখন অনুভব করি এবং জানি যে, আমি হস্ত সঞ্চালন করিতেছি। ইহাকে আমরা চেতনা বলি। আমি এ বিষয়ে সচেতন যে, আমি হস্ত সঞ্চালন করিতেছি। আমার হৃৎপিণ্ডও স্পন্দিত হইতেছে। সে বিষয়ে আমি সচেতন নই; তথাপি আমার হৃৎপিণ্ড কে সঞ্চালন করিতেছে? ইহাও অবশ্য সেই একই সত্তা হইবে। সুতরাং আমরা দেখিতেছি যে, যে-সত্তা হস্ত-সঞ্চালন ঘটাইতেছে, বাক্যস্ফুরণ করাইতেছে, অর্থাৎ সচেতন কর্ম সম্পন্ন করিতেছে, তাহাই অচেতন কার্যও সম্পন্ন করিতেছে। অতএব আমরা দেখিতেছি যে, এই সত্তা উভয় স্তরেই কার্য করিতে পারে—একটি চেতনার স্তর, অপরটি তাহার নিম্নবর্তী স্তর। অবচেতন-স্তর হইতে যে-সকল সঞ্চালন ঘটে, সেগুলিকে আমরা সহজাতবৃত্তি নামে অভিহিত করি; এবং যখনই সেই সঞ্চালন চেতনার স্তর হইতে ঘটে, আমরা তাহাকে যুক্তি বলি। কিন্তু আর একটি উচ্চতর স্তর আছে, তাহা মানুষের অতি-চেতন স্তর। ইহা আপাততঃ অচেতন অবস্থার তুল্য, কারণ ইহা চেতন স্তরের অতীত; বস্তুতঃ ইহা চেতনার ঊর্ধ্বে অবস্থিত, নিম্নে নয়। ইহা সহজাত-বৃত্তি নয়, ইহা ‘দিব্য প্রেরণা।’ ইহার সপক্ষে প্রমাণ আছে। সমগ্র জগতে যে সকল অবতার পুরুষ ও সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কথা স্মরণ করুন; ইহা সর্বজনবিদিত যে, তাঁহাদের জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসিয়াছে, যখন আপাতদৃষ্টিতে তাঁহাদিগকে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে অচেতন বলিয়া মনে হয়; অতঃপর তাঁহাদের ভিতর হইতে যে জ্ঞানরাশি উৎসারিত হয়, সে সম্বন্ধে তাঁহারা বলেন, উহা তাঁহারা অতিচেতন স্তর হইতে পাইয়াছেন। সক্রেটিস সম্বন্ধে কথিত আছে যে, তিনি যখন একদা সৈনিকদলের সহিত চলিতেছিলেন, তখন অতি সুন্দর সূর্যোদয় হইয়াছিল, ঐ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার মনে কি এক চিন্তাপ্রবাহ শুরু হইল, যাহাতে তিনি উক্ত স্থানে রৌদ্রের মধ্যে বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া একাদিক্রমে দুইদিন দাঁড়াইয়া রহিলেন। এই সকল মুহূর্তই জগৎকে সক্রেটিসীয় জ্ঞান প্রদান করিয়াছে। এইরূপে জগতের যাবতীয় অবতার ও সাধক পুরুষদের জীবনে এমন মুহূর্ত আসে, যখন তাঁহারা চেতন-স্তর হইতে উঠিয়া ঊর্ধ্বতন স্তরে আরোহণ করেন এবং যখন তাঁহারা পুনরায় চেতনার স্তরে আগমন করেন, তখন তাঁহারা জ্ঞানজ্যোতিতে উজ্জ্বল হইয়া আসেন এবং সেই সর্বাতীত লোকের সংবাদ প্রদান করেন। ইঁহারাই জগতের দিব্যভাবে আরূঢ় ঋষি।
কিন্তু এখানে একটি বড় বিপদ রহিয়াছে। অনেকেই দাবী করিতে পারেন যে, তাঁহারা দিব্যভাবে অনুপ্রাণিত; প্রায়ই এইরূপ দাবী শোনা যায়। এ বিষয়ে পরীক্ষার উপায় কি? নিদ্রার সময় আমরা অচেতন থাকি; ধরুন—একটি মূর্খ নিদ্রামগ্ন হইল, তিন ঘণ্টা তাহার সুনিদ্রা হইল; যখন সে উক্ত অবস্থা হইতে ফিরিল, সে যে বোকা সে বোকাই রহিয়া গেল, যদি না তাহার আরও অবনতি হইয়া থাকে। এদিকে নাজারেথের যীশু দিব্যভাবে আরূঢ় হইলেন; তিনি যখন ফিরিলেন, তখন তিনি যীশুখ্রীষ্টে পরিণত হইয়া গেলেন। এখানেই যা কিছু প্রভেদ। একটি হইল দিব্য প্রেরণা, অপরটি হইল সহজাত প্রবৃত্তি। একজন শিশু, অপরজন প্রবীণ অভিজ্ঞ ব্যক্তি। এই দিব্য প্রেরণা আমরা যে কেহ লাভ করিতে পারি; ইহা যাবতীয় ধর্মের উৎপত্তিস্থল এবং চিরকাল ধরিয়া ইহা উচ্চতর জ্ঞানের উৎস হইয়া থাকিবে। তথাপি এ পথে বহু বিপদের সম্ভাবনা। অনেক সময়েই ভণ্ডব্যক্তি জনসমাজকে প্রতারিত করিতে চায়। বর্তমান যুগে ইহাদের বিশেষ প্রাদুর্ভাব দেখা যাইতেছে। আমার জনৈক বন্ধুর একখানি চমৎকার চিত্রপট ছিল, অপর একজন অনেকাংশে ধর্মভাবাপন্ন অথচ ধনী ভদ্রলোকের উহার উপর লোভ ছিল; কিন্তু আমার বন্ধু উহা বিক্রয় করিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অপর ভদ্রলোকটি একদিন আমার বন্ধুর নিকটে আসিয়া বলিলেন, ‘আমি দৈব প্রেরণা লাভ করিয়াছি, এবং ঈশ্বর কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হইয়া আসিয়াছি।’ আমার বন্ধু প্রশ্ন করিলেন, ‘ভগবানের নিকট হইতে আপনি কি আদেশ পাইয়াছেন?’ ‘আদেশটি এই যে, আপনাকে এই চিত্রটি আমায় অর্পণ করিতে হইবে।’ আমার বন্ধুও ধূর্ততায় তাঁহার সমান; তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘ঠিক কথা; কি চমৎকার! আমিও ঠিক অনুরূপ প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছি যে, ছবিখানি আপনাকে দিতে হইবে। আপনি কি টাকাটা আনিয়াছেন?’ ‘টাকা? কিসের টাকা?’ আমার বন্ধু বলিলেন, ‘তাহা হইলে আপনার প্রত্যাদেশ ঠিক বলিয়া আমি মনে করি না। আমি যে প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছি, তাহাতে বলা হইয়াছে যে, যে-ব্যক্তি একলক্ষ ডলার মূল্যের চেক দিবে, তাহাকেই যেন চিত্রখানি আমি দিই। আপনাকে নিশ্চয়ই চেকখানি আগে আনিতে হইবে।’ অপর ব্যক্তি দেখিলেন, তিনি ধরা পড়িয়া গিয়াছেন। তখন তিনি প্রত্যাদেশের কথা পরিহার করিলেন। এই হইল বিপদ। বোষ্টন শহরে একদা এক ব্যক্তি আসিয়া আমাকে বলিল, তাহার এমন এক দৈবদর্শন হইয়াছে, যাহাতে তাহার সহিত হিন্দু-ভাষায় কথা বলা হইয়াছে। তখন আমি বলিলাম, ‘যে যে কথা শুনিয়াছেন, সেগুলি শুনিলে আমি বিশ্বাস করিব।’ কিন্তু ঐ ব্যক্তি কতগুলি অর্থহীন কথা লিখিল। আমি তাহা অনুধাবন করিবার অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু সফল হইলাম না। তখন আমি তাহাকে বলিলাম, আমার জ্ঞানমতে এইরূপ ভাষা ভারতবর্ষে কখনও ছিল না, কখনও হইবে না। তাহারা এখনও এরূপ ভাষা লাভ করিবার মত যথেষ্ট সুসভ্য হইয়া উঠিতে পারে নাই। ইহাতে অবশ্য সে মনে করিল যে, আমি ভাল লোক নই এবং সংশয়বাদী; সুতরাং সে প্রস্থান করিল। ইহার পর যদি আমি শুনিতে পাই যে, ঐ ব্যক্তি উন্মাদাগারে আশ্রয়লাভ করিয়াছে, তাহা হইলে বিস্মিত হইব না। সংসারে এই দুই প্রকার বিপদের সম্ভাবনা সর্বদাই রহিয়াছে—এই বিপদ আসে হয় ভণ্ডদের নিকট হইতে, অথবা মূর্খদের নিকট হইতে। কিন্তু এজন্য আমাদের দমিয়া যাওয়া উচিত নয়, কারণ জগতে যে-কোন মহৎ বস্তুলাভের পথই বিপদাকীর্ণ। কিন্তু আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইবে। অনেক সময় দেখিতে পাই, অনেক ব্যক্তি যুক্তি-অবলম্বনে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে অক্ষম। কেহ হয়তো আসিয়া বলিল, ‘আমি এই দেবতার নিকট হইতে এই বাণী লাভ করিয়াছি’ এবং জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি ইহা অস্বীকার করিতে পারেন? ইহা কি সম্ভব নয় যে, এরূপ দেবতা আছেন এবং তিনি এরূপ আদেশ দিয়া থাকেন?’ শতকরা নব্বইজন মূর্খ এ কথা গলাধঃকরণ করিয়া লইবে। তাহারা মনে করে যে, ঐরূপ যুক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু একটি কথা আপনাদের জানা উচিত, যে-কোন ঘটনাই সম্ভবপর হইতে পারে; এবং ইহাও সম্ভব হইতে পারে যে, লুব্ধক নক্ষত্রের সংস্পর্শে আসিয়া পৃথিবী আগামী বৎসরে বিদীর্ণ হইয়া যাইবে। আমি যদি এইরূপ সম্ভাবনা উপস্থাপিত করি, তবে আপনাদেরও অধিকার আছে যে, আপনারা আমাকে ইহা প্রমাণ করিতে বলিবেন। আইনজ্ঞেরা যাহাকে বলেন, ‘প্রমাণ করার দায়িত্ব’, সে দায়িত্ব তাহার উপরই বর্তাইবে, যে ঐ জাতীয় মতবাদ উপস্থিত করিবে। যদি আমি কোন দেবতার নিকট হইতে প্রত্যাদেশ লাভ করিয়া থাকি, তাহা হইলে তাহা প্রমাণ করিবার দায়িত্ব আমার, আপনার নহে, কারণ আমিই আপনাদের সম্মুখে প্রকল্পটি উপস্থিত করিয়াছি। যদি আমি ইহা প্রমাণ করিতে না পারি, তাহা হইলে আমার জিহ্বাকে শাসন করা উচিত ছিল। এই উভয় বিপদকে পরিহার করুন, তারপর আপনি যদৃচ্ছা বিচরণ করিতে পারেন। আমরা জীবনে অনেক দৈববাণী শুনিয়া থাকি, অথবা মনে করি যে, শুনিতে পাইলাম; যতক্ষণ পর্যন্ত এইগুলি আপনাদের নিজেদের বিষয় হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন; কিন্তু সেইগুলি যদি অপরের সহিত আপনার সম্বন্ধ বা অপরের প্রতি আচরণ বিষয়ে হয়, তবে সে সম্পর্কে কিছু করিবার পূর্বে একশ-বার বিবেচনা করিয়া দেখুন; তাহা হইলে আর বিপদের সম্ভাবনা থাকিবে না।
আমরা দেখিলাম যে, দিব্য প্রেরণা ধর্মের উৎস; অথচ উহা নানা বিপদাকীর্ণ। সর্বশেষ ও সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বিপদ হইল অতিরিক্ত দাবী। এমন লোকও আছেন, অকস্মাৎ যাঁহাদের অভ্যুদয় হয়, আর তাঁহারা বলেনঃ ভগবানের নিকট হইতে তাঁহারা বার্তা লাভ করিয়াছেন, এবং তাঁহারা সর্বশক্তিমান্ ভগবানের বাণীই উচ্চারণ করিতেছেন এবং অপর কাহারও ঐরূপ বার্তালাভের অধিকার নাই। শুনিলেই মনে হয়, উহা অত্যন্ত অযৌক্তিক। এই বিশ্বে যাহা কিছু থাকুক না কেন, উহা সকলের পক্ষে সমভাবে থাকা উচিত। এই বিশ্বে এমন কোন স্পন্দনই নাই, যাহা বিশ্বজনীন নয়, কারণ সমগ্র বিশ্বই নিয়মের অধীন। ইহা আগাগোড়া বিধিবদ্ধ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজেই কোথাও যদি কোন কিছু থাকে তো তাহার সর্বত্র থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। সর্বাপেক্ষা বৃহদাকার সূর্য ও নক্ষত্রাদি যেভাবে গঠিত, একটি অণুও সেইভাবে গঠিত। যদি কখনও কেহ দিব্যভাবে অনুপ্রেরিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাদের প্রত্যেকের পক্ষেই দিব্য-প্রেরণার সম্ভাবনা আছে। আর ইহাই হইল ধর্ম। এই-সকল বিপদ্-বিভ্রম, প্রহেলিকা ও ভণ্ডামি এবং অতিরিক্ত দাবী পরিহার করুন; ধর্মতথ্যগুলিকে প্রত্যক্ষ করুন, এবং ধর্মবিজ্ঞানের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসুন। ধর্ম মানে কতকগুলি মতবাদ ও বিধিনিষেধ স্বীকার করা, বিশ্বাস করা, গীর্জা বা মন্দিরে যাওয়া অথবা কোন বিশেষ গ্রন্থ অধ্যয়ন করা নয়। আপনি কি ঈশ্বরকে দেখিয়াছেন? আপনার কি আত্মদর্শন হইয়াছে? যদি না হইয়া থাকে, আপনি কি সেজন্য প্রয়াস করিতেছেন? ইহা এখনই—এই বর্তমানেই লভ্য, ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করিতে হইবে না। ভবিষ্যৎ তো সীমাহীন বর্তমান ব্যতীত আর কিছু নয়। যাবতীয় সময় একটি মুহূর্তের পুনরাবর্তন ব্যতীত আর কি? ধর্ম এখানে এখনই আছে, এই বর্তমান জীবনেই রহিয়াছে।
আর একটি প্রশ্ন এইঃ মানব জীবনের লক্ষ্য কি? বর্তমানে প্রচার করা হইতেছে যে, মানুষ ক্রমেই উন্নত হইতেছে; অনন্ত প্রগতি-পথের সে যাত্রী; এই উন্নতিলাভের কোন নির্দিষ্ট সীমা বা লক্ষ্য নাই। সর্বদা সে কোন কিছুর দিকে ক্রমেই অগ্রসর হইতেছে, অথচ লক্ষ্যে সে কোন কালেই পৌঁছিবে না—এ-কথার অর্থ যাহাই হউক, ইহা যত বিস্ময়করই হউক না কেন, শুনিলেই মনে হয় ইহা অত্যন্ত অসম্ভব ব্যাপার। সরলরেখা অবলম্বনে কোন প্রকার গতি কি সম্ভব হয়? কোন সরলরেখাকে অনন্তরূপে প্রসারিত করিলে ঐ রেখাটি এক বৃত্তে পরিণত হয়, যেখান হইতে রেখাটি প্রসারিত হইয়াছিল, আবার সেই বিন্দুতে ফিরিয়া আসে। যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেখানেই ফিরিয়া যাইতে হইবে। এবং যেহেতু ঈশ্বর হইতেই আপনার যাত্রারম্ভ হইয়াছে, সেহেতু তাঁহাতেই ফিরিয়া যাইতে হইবে। তাহা হইলে আর কি রহিল? রহিল আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি। অনন্তকাল ধরিয়া আপনাকে এই-সকল আনুষঙ্গিক কর্ম করিয়া যাইতে হইবে।
আরও একটি প্রশ্ন আছে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদিগকে কি নূতন নূতন ধর্মতত্ত্ব আবিষ্কার করিতে হইবে? হাঁ-ও বটে, না-ও বটে। প্রথমতঃ ধর্ম সম্বন্ধে আর নূতন কিছু জানা সম্ভব নয়; তাহার সবটুকুই জানা হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর সকল ধর্মেই দেখা যায়, এই দাবী করা হইয়াছে যে, আমাদেরই মধ্যে কোথাও একটি মিলন-ভূমি আছে। যেহেতু ঈশ্বরের সহিত আমরা অভিন্ন, অতএব ঐ অর্থে আর কোন অগ্রগতি সম্ভব নয়। জ্ঞানের অর্থই হইল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য দর্শন করা। আমি আপনাদিগকে বিভিন্ন নর-নারীরূপে দেখিতেছি—ইহাই বৈচিত্র্য। যখন আপনাদের সকলকে গোষ্ঠীভুক্ত করিয়া একত্র মানব বলিয়া ভাবিব, তখনই তাহা বিজ্ঞান-জাতীয় জ্ঞানে পরিণত হইবে। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ রসায়ন-বিজ্ঞানের কথা ধরুন; রাসায়নিকেরা সমগ্র জ্ঞাত বস্তুকে মূল ভৌতিক উপাদানে পরিণত করিতে সচেষ্ট আছেন এবং সম্ভব হইলে তাঁহারা এমন একটিমাত্র পদার্থ আবিষ্কার করিতে চান, যাহা হইতে এই বিবিধ পদার্থের উৎপত্তি দেখান যাইতে পারে। হয়তো এমন সময় আসিবে, যখন তাঁহারা উহা আবিষ্কার করিতে পারিবেন। উহাই হইবে সমস্ত পদার্থের মূল উপাদান। সেখানে উপনীত হইলে তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারিবেন না; তখন রসায়ন-বিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করিবে। ধর্মবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা চলে। আমরা যদি এই পূর্ণ ঐক্য আবিষ্কার করিতে পারি, তাহা হইলে আর অধিকতর উন্নতি সম্ভব হইবে না। যখন আবিষ্কৃত হইল, ‘আমি ও আমার পিতা অভিন্ন’ তখনই ধর্ম সম্বন্ধে শেষকথা বলা হইয়া গিয়াছে—তারপর বাকী রহিল শুধু খুঁটিনাটি। প্রকৃত ধর্মে—অন্ধবিশ্বাসবশতঃ কোন কিছু বিশ্বাস করা বা মানিয়া লওয়ার স্থান নাই। কোন ধর্মপ্রচারক মহাত্মা এরূপ প্রচার করেন নাই। অধঃপতনের সময়ে ইহা আসিয়া জোটে। বুদ্ধিহীন ব্যক্তিরা কোন কোন ধর্মনেতাদের অনুসরণকারী বলিয়া ভান করে, এবং তাঁহাদের কোন ক্ষমতা না থাকিলেও তাঁহারা মানবসমাজকে অন্ধবিশ্বাস শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন। কি বিশ্বাস করিবে তাহারা? অন্ধবিশ্বাস করার অর্থ হইল মানবাত্মার অধঃপতন। নাস্তিক হইতে চাও তো তাহাই হও; কিন্তু বিনা প্রশ্নে কোন কিছু গ্রহণ করিবে না। মানবের আত্মাকে পশুত্বের স্তরে নামাইবে কেন? তোমরা যে ইহাতে শুধু নিজেদেরই অনিষ্ট করিতেছ তাহা নয়, তোমরা সমাজেরও ক্ষতি করিতেছ, এবং যাহারা তোমাদের পরে আসিবে, তাহাদের পথ বিপদসঙ্কুল করিতেছ। উঠিয়া দাঁড়াও, বিচার কর, অন্ধবিশ্বাসের অনুবর্তী হইও না। ধর্মের অর্থ হইল—তদাকারকারিত হওয়া বা হইতে চেষ্টা করা, শুধু বিশ্বাস করা নয়। ইহাই ধর্ম; আর তুমি যখন সেই অবস্থা প্রাপ্ত হইবে, তখনই ধর্মলাভ করিবে। তাহার পূর্বে তুমি পশু অপেক্ষা উচ্চতর নও। মহাত্মা বুদ্ধ বলিয়াছেন, ‘শুনিবামাত্র কিছু বিশ্বাস করিও না; বংশানুক্রমে কোন মতবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ বলিয়াই তাহাতে বিশ্বাস করিও না; অপরে যেহেতু নির্বিচারে বিশ্বাস করিতেছে, সেহেতু কোন কিছুতে আস্থা স্থাপন করিও না; কোন এক প্রাচীন ঋষি বলিয়াছেন বলিয়া কোন কিছু মানিয়া লইও না; যে-সকল তত্ত্বের সহিত নিজেকে অভ্যাসবশে জড়াইয়া ফেলিয়াছ, তাহাতে বিশ্বাস করিও না; শুধু আচার্য ও গুরুবাক্যের প্রমাণবলে কোন কিছু মানিয়া লইও না। বিচার ও বিশ্লেষণ কর, এবং যখন ফলগুলি যুক্তির সহিত মিলিয়া যাইবে, এবং সকলের পক্ষে হিতকারী হইবে, তখন তাহা গ্রহণ কর এবং তদনুযায়ী জীবন যাপন কর।’

*************************************************************************************************************

ধর্মসাধনা

০৪. ধর্মসাধনা

আমরা বহু গ্রন্থ, বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া থাকি। শিশুকাল হইতেই আমরা বিবিধ ভাব আহরণ করি এবং প্রায়ই ভাবের পরিবর্তনও করি। তত্ত্বের দিক্ হইতে ‘ধর্ম’ কাহাকে বলে, তাহা আমাদের জানা আছে। আমরা মনে করি, ধর্মের প্রয়োগের দিকও বুঝি। এখানে আমি আপনাদের নিকট ‘কর্মে পরিণত ধর্ম’ সম্বন্ধে আমার নিজস্ব ধারণা উপস্থিত করিব।
আমরা চারিদিকে প্রয়োগমূলক ধর্মের কথা শুনিতে পাই, এবং সেগুলিকে বিশ্লেষণ করিয়া এই কয়টি মূল কথায় পরিণত করা যায়ঃ আমাদের সমশ্রেণীর জীবনের প্রতি করুণা করিতে হইবে। উহাই কি ধর্মের সবটুকু? এই দেশে প্রতিদিন আমরা কার্যে পরিণত খ্রীষ্টধর্মের কথা শুনিয়া থাকি; শুনিতে পাই—কোন ব্যক্তি তাহার সমশ্রেণীর জীবদের জন্য কোন হিতকর কার্য করিয়াছে। উহাই কি সব?
জীবনের লক্ষ্য কি? এই ঐহিক জগৎই কি জীবনের লক্ষ্য? আর কিছুই কি নয়? আমরা যেরূপ আছি, আমাদের কি সেরূপই থাকিতে হইবে, আর বেশী কিছু নয়? মানুষকে কি শুধু এমন একটি যন্ত্রে পরিণত হইতে হইবে, যাহা কোথাও বাধা না পাইয়া সাবলীল গতিতে চলিতে পারে? এবং আজ সে যে দুঃখের ভাগ ভোগ করিতেছে, তাহাই কি শেষ প্রাপ্য, সে কি আর কিছুই চায় না?
বহু ধর্মমতের শ্রেষ্ঠ কল্পনা—ঐহিক জগৎ। বিশাল জনসমষ্টি এমন এক সময়েরই স্বপ্ন দেখিতেছে, যখন কোন রোগ, অসুস্থতা, দারিদ্র্য বা অপর কোন প্রকার দুঃখ এ জগতে আর থাকিবে না। সর্বতোভাবে তাহারা কেবল সুখময় জীবন উপভোগ করিবে। সুতরাং ‘কার্যে পরিণত ধর্ম’ বলিতে শুধু এইটুকু বুঝায়, ‘পথঘাট পরিষ্কার রাখ, আরও সুন্দর পথঘাট নির্মাণ কর।’ সকলে ইহাতে কত আনন্দ পায়, তাহা দেখিতেই পাওয়া যায়। ভোগই কি জীবনের লক্ষ্য? তাহাই যদি হইত, তবে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করা একটা প্রকাণ্ড ভুল হইয়া গিয়াছে। কুকুর কিংবা বিড়াল যে লোলুপতার সহিত আহার্য উপভোগ করে, কোন মানুষ অধিকতর আগ্রহের সহিত তাহা পারে কি? আবদ্ধ বন্যপশুদের প্রদর্শনীতে গিয়া দেখ—পশুগণ কিরূপে হাড় হইতে মাংস ছিন্ন করিতেছে। উন্নতির বিপরীত দিকে চলিয়া পক্ষিরূপে জন্মগ্রহণ কর। মানুষ হইয়া কি ভুলই না হইয়াছে! যে বৎসরগুলি—যে শত শত বৎসর ধরিয়া আমি শুধু এই ইন্দ্রিয়ভোগে পরিতৃপ্ত মানুষ হইবার জন্য কঠোর সাধনা করিয়াছি, (ঐ দৃষ্টিতে) তাহা বৃথাই গিয়াছে!
তাহা হইলে বাস্তব ধর্মের অর্থটি কি দাঁড়ায় এবং উহা আমাদিগকে কোথায় লইয়া যায়, তাহা ভাবিয়া দেখ। দান করা খুব ভাল কথা, কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি বলিবে ‘উহাই সব’, তখনই তোমার জড়বাদীর দলে গিয়া পড়িবার সম্ভাবনা। ইহা ধর্ম নয়, ইহা নাস্তিকতা অপেক্ষা কিছু ভাল নয়, বরং অপকৃষ্ট। তোমরা খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী, তোমরা কি সমগ্র বাইবেল পড়িয়া অপরের জন্য কর্ম করা, কিংবা আরোগ্য-নিকেতন নির্মাণ করা ব্যতীত অন্য কিছুই খুঁজিয়া পাও নাই? কেহ হয়তো দোকানদার; সে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিবে, যীশু দোকানী হইলে কিভাবে দোকান চালাইতেন! যীশু কখনও ক্ষৌরালয় বা দোকান চালাইতেন না, কিংবা সংবাদপত্রও সম্পাদনা করিতেন না। ঐ ধরনের কার্যকর ধর্ম ভাল বটে, মন্দ নয়; কিন্তু ইহা শিশুবিদ্যালয়ের স্তরের ধর্ম। ইহা আমাদের কোন লক্ষ্যে লইয়া যাইতে পারে না। তোমরা যদি সত্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, যদি সত্যই খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী হও এবং বারংবার উচ্চারণ কর ‘প্রভু, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক’, তবে ভাবিয়া দেখ, ঐ কথাটার তাৎপর্য কি? যখনই তোমরা বল ‘তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক’, তখন সত্য কথা বলিতে গেলে তোমরা বলিতে চাও ‘হে ঈশ্বর, আমার ইচ্ছা তোমার দ্বারা পূর্ণ হউক।’ সেই অনন্ত পরমাত্মা তাঁহার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্য করিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু আমরা যেন বলিতে চাই—তিনিও ভুল করিয়া ফেলিয়াছেন, আমাকে ও তোমাকে তাহা সংশোধন করিতে হইবে। এই বিশ্বের যিনি বিশ্বকর্মা, তাঁহাকে কিনা কতকগুলি সূত্রধর শিক্ষা দিবে? তিনি জগৎকে একটি আবর্জনার স্তূপরূপে সৃষ্টি করিয়াছেন, এখন তুমি তাহাকে সুন্দর করিয়া সাজাইবে?
এ সকলের (কর্মের) লক্ষ্য কি? ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কি কখনও লক্ষ্য হইতে পারে? সুখ-সম্ভোগ কি কখনও লক্ষ্য হইতে পারে? ঐহিক জীবন কি কখনও আত্মার লক্ষ্য হইতে পারে? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে বরং এই মুহূর্তে মরিয়া যাওয়া শ্রেয়, তবু ঐহিক জীবন চাওয়া উচিত নয়। ইহাই যদি মানুষের ভাগ্য হয় যে, সে একটি ত্রুটিহীন যন্ত্রে পরিণত হইবে, তাহা হইলে তাহার তাৎপর্য হইল এইঃ আমরা পুনরায় বৃক্ষ, প্রস্তর প্রভৃতিতে পরিণত হইতে যাইতেছি। তুমি কি কখনও গাভীকে মিথ্যা কথা বলিতে শুনিয়াছ, কিংবা বৃক্ষকে চুরি করিতে দেখিয়াছ? তাহারা নিখুঁত যন্ত্র। তাহারা ভুল করে না, তাহারা এমন জগতে বাস করে, যেখানে সব কিছুই নিয়মের পরাকাষ্ঠা লাভ করিয়া ফেলিয়াছে। এই বাস্তব ধর্মকে যদি আদর্শ ধর্ম বলা না চলে, তবে আদর্শটি কি? ব্যাবহারিক ধর্ম কখনও সেই আদর্শ হইতে পারে না। আমরা কি উদ্দেশ্যে এই পৃথিবীতে আসিয়াছি? আমরা এখানে আসিয়াছি মুক্তি ও জ্ঞান-লাভের জন্য। আমরা মুক্তিলাভের জন্যই জ্ঞানার্জন করিতে চাই। ইহাই আমাদের বাঁচিয়া থাকার অর্থ—এই মুক্তিলাভের জন্য সর্বব্যাপী আকূতি। বীজ হইতে বৃক্ষ কেন উদ্গত হয়? কেন সে ভূমি বিদীর্ণ করিয়া ঊর্ধ্বাভিমুখে অভিযান করে? পৃথিবীর কাছে সূর্যের দান কি? তোমার জীবনের অর্থ কি? উহাও তো মুক্তির জন্য সেই একই প্রকার সংগ্রাম। প্রকৃতি আমাদিগকে চারিদিক হইতে দমন করিতে চায়, আর আত্মা চায় নিজেকে প্রকাশ করিতে। প্রকৃতির সহিত সংগ্রাম সতত চলিতেছে। মুক্তির জন্য এই সংগ্রামের ফলে বহু জিনিষ দলিত-মথিত হইবে। ইহাই হইল তোমার দুঃখের প্রকৃত অর্থ। যুদ্ধক্ষেত্র প্রচুর পরিমাণ ধূলি ও জঞ্জালে পূর্ণ হইবে। প্রকৃতি বলে, ‘জয় হইবে আমার’, আত্মা বলে, ‘বিজয়ী হইতে হইবে আমাকেই।’ প্রকৃতি বলে, ‘একটু থামো। আমি তোমাকে শান্ত রাখিবার জন্য একটু ভোগ দিতেছি।’ আত্মা একটু ভোগ করে, মুহূর্তের জন্য সে বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু পরমুহূর্তে সে আবার মুক্তির জন্য ক্রন্দন করিতে থাকে। প্রত্যেকের বক্ষে এই যে চিরন্তন ক্রন্দন যুগ যুগ ধরিয়া চলিয়াছে, তাহা কি লক্ষ্য করিয়াছ? আমরা দারিদ্র্য দ্বারা প্রবঞ্চিত হই, তাই আমরা ধন অর্জন করি; তখন আবার ধনের দ্বারা প্রবঞ্চিত হই। আমরা হয়তো মূর্খ, তাই আমরা বিদ্যা অর্জন করিয়া পণ্ডিত হই; তখন আবার পাণ্ডিত্যের দ্বারা বঞ্চিত হই। মানুষ কখনই সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত হয় না। তাহাই দুঃখের কারণ, আবার তাহাই আশীর্বাদের মূল। ইহাই জগতের প্রকৃত লক্ষণ। তুমি কিরূপে এই জগতের মধ্যে তৃপ্তি পাইবে? যদি আগামীকাল এই পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হয়, তখনও আমরা বলিব, ‘ইহা সরাইয়া লও, অপর কিছু দাও।’
এই অসীম মানবাত্মা স্বয়ং অসীমকে লাভ না করিলে কখনও তৃপ্ত হইতে পারে না। অনন্ত তৃষ্ণা কেবলমাত্র অনন্ত জ্ঞানের দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়, তাহা ব্যতীত অন্য কিছুর দ্বারা নয়। কত জগৎ যাইবে ও আসিবে। তাহাতে কি আসে যায়? কিন্তু আত্মা বাঁচিয়া আছে এবং চিরকাল ধরিয়া অনন্তের দিকে চলিয়াছে। সমগ্র জগৎকে আত্মার মধ্যে লীন হইতে হইবে। মহাসাগরের বুকে যেমন জলবিন্দু মিলাইয়া যায়, সেইরূপ বিশ্ব জগৎ আত্মায় বিলীন হইবে। আর এই জগৎ কি আত্মার লক্ষ্য? যদি আমাদের সাধারণ বুদ্ধি থাকে, তবে আমরা পরিতৃপ্ত হইতে পারিব না—যদিও যুগ যুগ ধরিয়া ইহাই ছিল কবিদের রচনার বিষয়, যদিও সর্বদাই তাঁহারা আমাদের পরিতৃপ্ত থাকিতে উপদেশ দিয়াছেন, তথাপি আজ পর্যন্ত কেহই পরিতৃপ্ত হয় নাই। অসংখ্য ঋষিকল্প ব্যক্তি আমাদের বলিয়াছেন, ‘নিজ নিজ ভাগ্যে সন্তুষ্ট থাকো’; কবিরাও সেই সুরে গাহিয়াছেন। আমরা নিজেদের শান্ত ও পরিতৃপ্ত থাকিতে বলিয়াছি, কিন্তু থাকিতে পারি নাই। ইহা সনাতন বিধান যে, এই পৃথিবীতে বা ঊর্ধ্বে স্বর্গলোকে, কিংবা নিম্নে পাতালে এমন কিছুই নাই, যাহা দ্বারা আমাদের আত্মা পরিতৃপ্ত হইতে পারে। আমার আত্মার তৃষ্ণার কাছে নক্ষত্র ও গ্রহরাজি, ঊর্ধ্ব এবং অধঃ, সমগ্র বিশ্ব কতকগুলি ঘৃণ্য পীড়াদায়ক বস্তুমাত্র, তাহা ভিন্ন আর কিছুই নয়। ধর্ম ইহাই বুঝাইয়া দেয়। যাহা কিছু এই তত্ত্ব বুঝাইয়া দেয় না, তাহার সবটাই অমঙ্গলময়। প্রত্যেকটি বাসনাই দুঃখের কারণ, যদি না উহা এই তত্ত্বটি বুঝাইয়া দেয়, যদি না তুমি উহার প্রকৃত তাৎপর্য ও লক্ষ্য ধরিতে পার। সমগ্র প্রকৃতি তাহার প্রত্যেক পরমাণুর মধ্য দিয়া একটি মাত্র জিনিষের জন্য আকূতি জানাইতেছে—উহা হইল মুক্তি।
তাহা হইলে ‘কর্মে পরিণত ধর্ম’-এর অর্থ কি? ইহার অর্থ মুক্তির অবস্থায় উপনীত হওয়া বা মুক্তি-প্রাপ্তি। এবং যদি এই পৃথিবী আমাদের ঐ লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিতে সহায় হয়, তাহা হইলে ইহা মঙ্গলময়; কিন্তু যদি তাহা না হয়, যদি সহস্র বন্ধনের উপর ইহা একটি অতিরিক্ত বন্ধন সংযুক্ত করে, তাহা হইলে ইহা মন্দে পরিণত হয়। সম্পদ্, বিদ্যা, সৌন্দর্য এবং অন্যান্য যাবতীয় বস্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্যে উপনীত হইতে সহায়তা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাহাদের ব্যাবহারিক মূল্য আছে। যখন মুক্তিরূপ লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইতে আর সাহায্য করে না, তখন তাহারা নিশ্চিতরূপে ভয়াবহ। তাই যদি হয়, তাহা হইলে কার্যে পরিণত ধর্মের স্বরূপ কি? ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সব-কিছু সেই এক উদ্দেশ্যে ব্যবহার কর, যাহাতে মুক্তিলাভ হয়। জগতে বিন্দুমাত্র ভোগ যদি পাইতে হয়, বিন্দুমাত্র সুখও যদি পাইতে হয়, তবে তাহার বিনিময়ে ব্যয় করিতে হইবে হৃদয়-মনের সম্মিলিত অসীম শক্তি।
এই জগতের ভাল ও মন্দের সমষ্টির দিকে তাকাইয়া দেখ। ইহাতে কি কোন পরিবর্তন হইয়াছে? যুগ যুগ অতিবাহিত হইয়াছে এবং যুগ যুগ ধরিয়া ব্যাবহারিক ধর্ম আপন কাজ করিয়া চলিয়াছে। প্রতিবার পৃথিবী মনে করিয়াছে যে, এইবার সমস্যার সমাধান হইবে। কিন্তু সমস্যাটি যেমন ছিল, তেমনি থাকিয়া যায়। বড়জোর ইহার আকৃতির পরিবর্তন ঘটে। ইহা বিশ সহস্র বিপণিতে স্নায়ুরোগ ও ক্ষয়রোগের ব্যবসায়ের জন্য পণ্য সরবরাহ করে, ইহা পুরাতন বাতব্যাধির মত। একস্থান হইতে বিতাড়িত কর, উহা অন্য কোন স্থানে আশ্রয় লইবে। শতবর্ষ আগে মানুষ পদব্রজে ভ্রমণ করিত বা ঘোড়া কিনিত। এখন সে খুব সুখী, কারণ রেলপথে ভ্রমণ করে; কিন্তু তাহাকে অধিকতর শ্রম করিয়া অধিকতর অর্থ উপার্জন করিতে হয় বলিয়া সে অসুখী। যে-কোন যন্ত্র শ্রম বাঁচায়, ইহাই আবার শ্রমিকের উপর অধিক গুরুভার চাপায়।
এই বিশ্ব, এই প্রকৃতি কিংবা অপর যে নামেই ইহাকে অভিহিত কর না কেন, ইহা অবশ্যই সীমাবদ্ধ, ইহা কখনও অসীম হইতে পারে না। সর্বাতীত পরম সত্তাকেও জগতের উপাদানরূপে পরিণত হইতে গেলে দেশ কাল ও নিমিত্তের সীমার মধ্যে আসিতে হইবে। জগতে যতটুকু শক্তি আছে, তাহা সীমাবদ্ধ। তাহা যদি এক স্থানে ব্যয় কর, তাহা হইলে অপর স্থানে কম পড়িবে। সেই শক্তির পরিমাণ সর্বদা একই থাকিবে। কোন স্থানে কোথাও যদি তরঙ্গ উঠে, তবে অন্য কোথাও গভীর গহ্বর দেখা দিবে। যদি কোন জাতি ধনী হয়, তাহা হইলে অন্য জাতিরা দরিদ্র হইবে। ভালর সহিত মন্দ ভারসাম্য রক্ষা করে। যে ব্যক্তি কোনকালে তরঙ্গশীর্ষে অবস্থান করিতেছে, সে মনে করে সকলই ভাল; কিন্তু যে তরঙ্গের নীচে দাঁড়াইয়া আছে, সে বলে—পৃথিবীর সব কিছুই মন্দ। কিন্তু যে ব্যক্তি পার্শ্বে দাঁড়াইয়া থাকে, সে দেখে ঈশ্বরের লীলা কেমন চলিতেছে। কেহ কাঁদে, অপরে হাসে। আবার এখন যাহারা হাসিতেছে, সময়ে তাহারা কাঁদিবে, তখন প্রথম দল হাসিবে। আমরা কি করিতে পারি? আমরা জানি যে, আমরা কিছুই করিতে পারি না।
আমাদের মধ্যে কয়জন আছে, যাহারা জগতের হিতসাধন করিব বলিয়াই কাজে অগ্রসর হয়? এরূপ লোক মুষ্টিমেয়। তাহাদের সংখ্যা আঙুলে গণা যায়। আমাদের মধ্যে বাকী যাহারা হিতসাধন করি, তাহারা বাধ্য হইয়াই ঐরূপ করি। আমরা না করিয়া পারি না। এক স্থান হইতে অন্য স্থানে বিতাড়িত হইতে হইতে আমরা আগাইয়া চলি। আমাদের করার ক্ষমতা কতটুকু? জগৎ সেই একই জগৎ থাকিবে, পৃথিবী সেই একই পৃথিবী থাকিবে। বড়জোর ইহার রঙ নীল হইতে বাদামী এবং বাদামী রঙ হইতে নীল হইবে। এক ভাষার জায়গায় অপর ভাষা, এক ধরনের কতক মন্দের জায়গায় অন্য ধরনের কতকগুলি মন্দ—এই একই ধারা তো চলিতেছে। যাহাকে বলে ‘ছয়’ তাহাকেই বলে ‘আধ ডজন’। অরণ্যবিহারী আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা তোমাদের মত দর্শনশাস্ত্র-সম্বন্ধীয় বক্তৃতা শুনিতে পারে না, কিন্তু তাহারা খাদ্য হজম করিতে পারে বেশ। তুমি তাহাদের একজনকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেল, পরমুহূর্তে দেখিবে, সে ঠিক উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু আমার বা তোমার যদি সামান্য একটু ছিঁড়িয়া যায়, তাহা হইলে ছয় মাস কাল হাসপাতালে শুইয়া থাকিতে হইবে।
জীবদেহ যতই নিম্নস্তরের হইবে, তাহার ইন্দ্রিয়সুখ ততই তীব্রতর হইবে। নিম্নস্তরের প্রাণীদের এবং তাহাদের স্পর্শশক্তির কথা ভাবো। তাহাদের স্পর্শেন্দ্রিয়ই বড়। মানুষের ক্ষেত্রে আসিয়া দেখিবে, লোকের সভ্যতার স্তর যত নিম্ন, তাহার ইন্দ্রিয়ের শক্তিও তত প্রবল। জীবদেহ যত উচ্চশ্রেণীর হইবে, ইন্দ্রিয়সুখের পরিমাণও তত কম হইবে। কুকুর খাইতে জানে, কিন্তু আধ্যাত্মিক চিন্তায় যে অনুপম আনন্দ হয়, তাহা সে অনুভব করিতে পারে না। তুমি বুদ্ধি হইতে যে আশ্চর্য আনন্দ পাও, তাহা হইতে সে বঞ্চিত। ইন্দ্রিয়জন্য সুখ অতি তীব্র। কিন্তু বুদ্ধিজ সুখ তীব্রতর। তুমি যখন প্যারিসে পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের ভোজে যোগদান কর, তাহা খুবই সুখকর, কিন্তু মানমন্দিরে গিয়া নক্ষত্রগুলি পর্যবেক্ষণ করা, গ্রহসমূহের আবির্ভাব ও বিকাশ দর্শন করা—এই-সব ভাবিয়া দেখ দেখি। এ আনন্দ নিশ্চয়ই বিপুলতর, কারণ আমি জানি, তোমরা তখন আহারের কথা ভুলিয়া যাও। সেই সুখ নিশ্চয়ই পার্থিব সুখ অপেক্ষা অধিক; তোমরা তখন স্ত্রী-পুত্র, স্বামী এবং অন্য সব কিছু ভুলিয়া যাও; ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জগৎ তখন ভুল হইয়া যায়। ইহাকেই বলে বুদ্ধিজ সুখ। সাধারণ বুদ্ধিতেই বলে যে, এই সুখ ইন্দ্রিয়সুখ অপেক্ষা নিশ্চয় তীব্রতর। তোমরা সর্বদা বড় সুখের জন্য ছোট সুখ ত্যাগ করিয়া থাক। এই মুক্তি বা বৈরাগ্য-লাভই হইল কার্যে পরিণত ধর্ম। বৈরাগ্য অবলম্বন কর।
ছোটকে ত্যাগ কর, যাহাতে বড়কে পাইতে পার। সমাজের ভিত্তি কোথায়?—ন্যায়, নীতি ও আইনে। ত্যাগ কর, প্রতিবেশীর সম্পত্তি অপহরণ করিবার ইচ্ছা পরিত্যাগ কর, প্রতিবেশীর উপর হস্তক্ষেপ করিবার প্রলোভন পরিহার কর, মিথ্যা বলিয়া অপরকে প্রবঞ্চনা করিয়া যে সুখ, তাহা বর্জন কর। নৈতিকতাই কি সমাজের ভিত্তি নয়? ব্যভিচার পরিহার করা ছাড়া বিবাহের আর কি অর্থ আছে? বর্বর তো বিবাহ করে না। মানুষ বিবাহ করে, কারণ সে ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। এইরূপই সর্বক্ষেত্রে। ত্যাগ কর, বৈরাগ্য অবলম্বন কর, পরিহার কর, পরিত্যাগ কর—শূন্যের নিমিত্ত নয়, নাস্তিভাবের জন্য নয়, কিন্তু শ্রেয়োলাভের জন্য। কিন্তু কে তাহা পারে? শ্রেয়োলাভের পূর্বে তুমি তাহা পারিবে না। মুখে বলিতে পার, প্রয়াস করিতে পার, অনেক কিছু করিবার চেষ্টাও করিতে পার, কিন্তু শ্রেয়োলাভ হইলে বৈরাগ্য আপনিই আসিয়া উপস্থিত হয়। অশ্রেয় তখন আপনা হইতেই ঝরিয়া পড়ে। ইহাকেই বলে ‘কার্যে পরিণত ধর্ম’। ইহা ছাড়া আর কিছুকে বলে কি—যেমন পথ মার্জনা করা এবং আরোগ্যনিলয় গঠন করাকে? তাহাদের মূল্য শুধু ততটুকু, যতটুকু উহাদের মূলে বৈরাগ্য আছে। বৈরাগ্যের কোথাও সীমারেখা নাই। মুশকিল হয় সেখানেই, যেখানে কেহ সীমা টানিয়া বলে—এই পর্যন্তই, ইহার অধিক নয়। কিন্তু এই বৈরাগ্যের তো সীমা নাই।
যেখানে ঈশ্বর আছেন, সেখানে আর কিছু নাই। যেখানে সাংসারিকতা আছে, সেখানে ঈশ্বর নাই। এই উভয়ের কখনও মিলন ঘটিবে না—যথা, আলো ও অন্ধকারের। ইহাই তো আমি খ্রীষ্টধর্ম ও তাহার প্রথম প্রচারকদের জীবনী হইতে বুঝিয়াছি। বৌদ্ধধর্মও কি তাহাই নয়? ইহাই কি সকল ঋষি ও আচার্যের শিক্ষা নয়? যে-সংসারকে বর্জন করিতে হইবে, তাহা কি? তাহা এখানেই রহিয়াছে। আমি আমার সঙ্গে সঙ্গে সংসার লইয়া চলিয়াছি। আমার এই শরীরই সংসার। এই দেহের জন্য, এই দেহকে একটু ভাল—একটু সুখে রাখিবার জন্য আমি আমার প্রতিবেশীর উপর উৎপীড়ন করি। এই দেহের জন্য আমি অপরের ক্ষতিসাধন করি, ভুলভ্রান্তিও করি।
কত মহামানবের দেহত্যাগ হইয়াছে; কত দুর্বলচিত্ত মানুষ মৃত্যু-কবলিত হইয়াছে; কত দেবতারও মৃত্যু ঘটিয়াছে। মৃত্যু, মৃত্যু—সর্বত্র মৃত্যুই বিরাজ করিতেছে। এই পৃথিবী অনাদি অতীতের একটি শ্মশানক্ষেত্র; তথাপি আমরা এই দেহকেই আঁকড়াইয়া থাকি আর বলি, ‘আমি কখনও মরিব না।’ জানি ঠিকই যে, দেহের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী; অথচ উহাকেই আঁকড়াইয়া থাকি। ঠিক অমর বলিতে আত্মাকে বুঝায়, আর আমরা ধরিয়া থাকি এই শরীরকে—ভুল হইল এখানেই।
তোমরা সকলেই জড়বাদী, কারণ তোমরা সকলেই বিশ্বাস কর যে, তোমরা দেহমাত্র। কেহ যদি আমার শরীরে ঘুষি মারে, আমি বলিব আমাকে ঘুষি মারিয়াছে। যদি সে আমার শরীরে প্রহার করে, আমি বলিব যে, আমি প্রহৃত হইয়াছি। আমি যদি শরীরই না হইব, তাহা হইলে এরূপ কথা বলিব কেন? আমি যদিও মুখে বলি—আমি আত্মা, তাহা হইলেও তাহাতে কিছু তফাত হয় না, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তের জন্য আমি শরীর; আমি নিজেকে জড়বস্তুতে পরিণত করিয়াছি। এইজন্যই আমাকে এই শরীর পরিহার করিতে হইবে, পরিবর্তে আমি স্বরূপতঃ যাহা, তাহার চিন্তা করিতে হইবে। আমি আত্মা—সেই আত্মা, যাহাকে কোন অস্ত্র ছেদন করিতে পারে না, কোন তরবারি খণ্ডিত করিতে পারে না, অগ্নি দহন করিতে পারে না, বাতাস শুষ্ক করিতে পারে না। আমি জন্মরহিত, সৃষ্টিরহিত, অনাদি, অখণ্ড, মৃত্যুহীন, জন্মহীন এবং সর্বব্যাপী—ইহাই আমার প্রকৃত স্বরূপ। সমস্ত দুঃখ-উৎপত্তির কারণ যে, আমি মনে করি—আমি ছোট একতাল মৃত্তিকা। আমি নিজেকে জড়ের সহিত এক করিয়া ফেলিতেছি এবং তাহার ফল ভোগ করিতেছি।
কার্যে পরিণত ধর্ম হইল নিজেকে আত্মার সহিত এক করা। ভ্রমাত্মক অধ্যাস-চিন্তা পরিহার কর। ঐদিকে তুমি কতদূর অগ্রসর হইয়াছ? তুমি দুই সহস্র আরোগ্য-নিকেতন নির্মাণ করিয়া থাকিবে, কিন্তু তাহাতে কি আসে যায়, যদি না তুমি আত্মানুভূতি লাভ করিয়া থাক? তুমি মরিবে সামান্য কুকুরেরই মত কুকুরের অনুভূতি লইয়া। কুকুর মৃত্যুকালে চীৎকার করে আর কাঁদে, কারণ সে জানে যে, সে জড়বস্তু এবং সে নিঃশেষ হইয়া যাইতেছে।
তুমি জান যে, মৃত্যু অনিবার্য; মৃত্যু আছে জলে বাতাসে—প্রাসাদে বন্দিশালায়—সর্বত্র। কোন্ বস্তু তোমাকে অভয় প্রদান করিবে? তুমি অভয় পাইবে তখনই, যখন তুমি তোমার স্বরূপ জানিতে পারিবে, জানিবে—তুমি অসীম, জন্মহীন, মৃত্যুহীন আত্মা; আত্মাকে অগ্নি দহন করিতে পারে না, কোন অস্ত্র হত্যা করিতে পারে না, কোন বিষ জর্জরিত করিতে পারে না। মনে করিও না—ধর্ম শুধু একটা মতবাদ, কেবল শাস্ত্রজ্ঞান। ধর্ম কেবল তোতাপাখীর মুখস্থ বুলি নয়। আমার জ্ঞানবৃদ্ধ গুরুদেব বলিতেনঃ তোতাপাখীকে যতই ‘হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল’ শেখাও না কেন, বেড়াল যখন গলা টিপে ধরে, তখন সব ভুল হয়ে যায়। তুমি সারাক্ষণ প্রার্থনা করিতে পার, জগতের সব শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে পার, যত দেবতা আছেন, সকলের পূজা করিতে পার, কিন্তু যতক্ষণ না আত্মানুভূতি হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি নাই। বাগাড়ম্বর নয়, তত্ত্বালোচনা নয়, যুক্তিতর্ক নয়, চাই অনুভূতি। ইহাকেই আমি বলি—বাস্তব জীবনে পরিণত ধর্ম।
প্রথমে আত্মা সম্পর্কে এই সত্য শ্রবণ করিতে হইবে। যদি শ্রবণ করিয়া থাক, অতঃপর মনন কর। মনন করা হইলে ধ্যান কর। বৃথা তর্কবিচার আর নিষ্প্রয়োজন। একবার নিশ্চয় কর, তুমি সেই অসীম আত্মা; তাহা যদি সত্য হয়, তবে নিজেকে দেহ বলিয়া ভাবা তো মূর্খতা। তুমি তো আত্মা এবং এই আত্মানুভূতিই লাভ করিতে হইবে। আত্মা নিজেকে আত্মারূপে দেখিবে। বর্তমানে আত্মা নিজেকে দেহরূপে দেখিতেছে। তাহা বন্ধ করিতে হইবে। যে মুহূর্তে তাহা অনুভব করিতে আরম্ভ করিবে, সেই মুহূর্তে তুমি মুক্ত হইবে।
তোমরা এই কাঁচটিকে দেখিতেছ। তোমরা জান, ইহা ভ্রান্তিমাত্র। কোন বৈজ্ঞানিক হয়তো তোমাকে বলিয়া দিবেন, ইহা শুধু আলোক ও স্পন্দন …। আত্মদর্শন উহা অপেক্ষা নিশ্চয়ই অধিক পরিমাণে সত্য, উহা নিশ্চয়ই একমাত্র বাস্তব অবস্থা, একমাত্র সত্য সংবেদন, একমাত্র বাস্তব প্রত্যক্ষ। এই যাহা কিছু দেখিতে পাইতেছ—এ-সকলই স্বপ্ন। আজকালকার দিনে তাহা তুমি জান। আমি প্রাচীন বিজ্ঞানবাদীদের কথা বলিতেছি না, আধুনিক পদার্থবিদ্যাবিদও বলিবেন—দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে আছে শুধু আলোক-স্পন্দন। আলোক-স্পন্দনের সামান্য ইতরবিশেষের দ্বারাই সমস্ত পার্থক্য ঘটিতেছে।
তোমাকে অবশ্যই ঈশ্বর দর্শন করিতে হইবে। আত্মানুভূতি করিতেই হইবে, আর উহা বাস্তব ধর্ম। যীশুখ্রীষ্ট বলিয়া গেলেন, ‘যাহাদের চিত্ত বিনয়নম্র, তাহারা ধন্য; কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই প্রাপ্য।’ বাস্তব ধর্ম বলিতে তো তোমরা আর উহা মানিতে চাও না। তাঁহার ঐ উপদেশ কি শুধু একটা তামাশার কথা? তাহা হইলে বাস্তব ধর্ম বলিতে তোমরা কি বোঝ? তোমাদের বাস্তবতা হইতে ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন! ‘যাহারা শুদ্ধচিত্ত, তাহারা ধন্য, কারণ তাহারা ঈশ্বর দর্শন করিবে।’—এই কথায় কি পথ পরিষ্কার করা, আরোগ্য-ভবন নির্মাণ করা প্রভৃতি বুঝায়? যখন শুদ্ধচিত্তে এ-সকল অনুষ্ঠান করিবে, তখনই ইহা সৎকর্ম। বিশ ডলার দান করিয়া নিজের নাম প্রকাশিত দেখিবার জন্য সান ফ্রান্সিস্কোর সমস্ত সংবাদপত্র ক্রয় করিতে যাইও না। নিজেদের ধর্মগ্রন্থে কি পাঠ কর নাই যে, কেহই তোমাকে সাহায্য করিবে না? ঈশ্বরকে উপাসনা করার মনোভাব লইয়া ঈশ্বরকেই দরিদ্র, দুঃখী ও দুর্বলের মধ্যে সেবা কর। তাহা সম্পন্ন করিতে পারিলে ফলপ্রাপ্তি গৌণ কথা। লাভের বাসনা না রাখিয়া ঐ ধরনের কর্ম অনুষ্ঠান করিলে আত্মার মঙ্গল সাধিত হয় এবং এরূপ ব্যক্তিদেরই স্বর্গরাজ্য লাভ হয়। এই স্বর্গরাজ্য রহিয়াছে আমাদেরই মধ্যে। সকল আত্মার আত্মা যিনি, তিনি সেখানেই বিরাজ করেন। তাঁহাকে নিজের অন্তরে উপলব্ধি কর। তাহাই কার্যে পরিণত ধর্ম, তাহাই মুক্তি। পরস্পরকে প্রশ্ন করিয়া দেখা যাক, আমরা কে কতদূর এই পথে অগ্রসর হইয়াছি, কতদূর আমরা এই দেহের উপাসক, কতদূরই বা পরমাত্মস্বরূপ ভগবানে ঠিক বিশ্বাস করি, এবং কতদূরই বা আমাদিগকে আত্মা বলিয়া বিশ্বাস করি? তখন সত্যসত্যই স্বার্থশূন্য হইব; ইহাই মুক্তি। ইহাই প্রকৃত ঈশ্বরোপাসনা। আত্মাকে উপলব্ধি কর। তাহাই একমাত্র কর্তব্য। নিজে স্বরূপতঃ যাহা, অর্থাৎ নিজেকে অসীম আত্মারূপে জান, তাহাই বাস্তব ধর্ম। আর যাহা কিছু, সকলই অবাস্তব। কারণ আর যাহা কিছু আছে, সকলই বিলুপ্ত হইবে। একমাত্র আত্মাই কখনও বিলুপ্ত হইবে না; আত্মাই শাশ্বত। আরোগ্য নিকেতন একদিন ধসিয়া পড়িবে। যাহারা রেলপথ-নির্মাতা, তাহারাও একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হইবে। এই পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হইয়া উড়িয়া যাইবে, সূর্য নিশ্চিহ্ন হইবে। কিন্তু আত্মা চিরকাল ধরিয়া বিরাজ করিবেন।
কোন্‌টি শ্রেয়—এই-সকল ধ্বংসশীল বস্তুর পশ্চাদ্ধাবন, না চির অপরিবর্তনীয়ের উপাসনা? কোন্‌টি অধিক বাস্তব? তোমার জীবনের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়া যে-সকল বস্তু আয়ত্ত করিলে, সেগুলি আয়ত্ত হইবার পূর্বে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়াই কি শ্রেয়, ঠিক যেমন সেই বিখ্যাত দিগ্‌বিজয়ীর ভাগ্যে ঘটিয়াছিল? তিনি সব দেশ জয় করিলেন, পরে মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে অনুচরদিগকে আদেশ দিলেন, ‘আমার সম্মুখে কলসীভর্তি দ্রব্যসম্ভার সাজিয়ে রাখ।’ তারপর বলিলেন, ‘বড় হীরকখণ্ডটি নিয়ে এস।’ তখন ঐটি আপন বক্ষমধ্যে স্থাপন করিয়া তিনি ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। এইরূপে ক্রন্দন করিতে করিতে তিনি দেহত্যাগ করিলেন—ঠিক যেমন একটি কুকুর করিয়া থাকে।
মানুষ সদর্পে বলে, ‘আমি বাঁচিয়া আছি’; সে জানে না যে, মৃত্যুভয়ে ভীত হইয়াই সে এই জীবনকে ক্রীতদাসের মত আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। সে বলে, ‘আমি সম্ভোগ করিতেছি।’ সে কখনও বুঝিতে পারে না যে, প্রকৃতি তাহাকে দাস করিয়া রাখিয়াছে।
প্রকৃতি আমাদের সকলকে পেষণ করিতেছে। যে সুখ-কণিকা পাইয়াছ, তাহার হিসাব করিয়া দেখ, শেষ পর্যন্ত দেখিবে—প্রকৃতি তোমাকে দিয়া নিজের কাজ করাইয়া লইয়াছে; এবং যখন তোমার মৃত্যু হইবে, তখন তোমার শরীর দ্বারা অপর বৃক্ষলতাদির পরিপুষ্টি হইবে। তথাপি আমরা সর্বদা মনে করি, আমরা স্বাধীনভাবেই সুখ পাইতেছি। এইরূপেই সংসারচক্র আবর্তিত হইতেছে।
সুতরাং আত্মাকে আত্মারূপে অনুভব করাই হইল বাস্তব ধর্ম। অপর সবকিছু ঠিক ততটুকু ভাল, যতটুকু ঐগুলি আমাদিগকে এই এক অতি উত্তম ধারণায় উপনীত করিতে পারে। সেই অনুভূতি বৈরাগ্য ও ধ্যানের দ্বারা লভ্য। বৈরাগ্যের অর্থ সমস্ত ইন্দ্রিয় হইতে বিরতি এবং যত কিছু গ্রন্থি, যত কিছু শৃঙ্খল আমাদিগকে জড়বস্তুর সহিত আবদ্ধ রাখে, সেগুলি ছিন্ন করা। ‘আমি এই জড়-জীবন লাভ করিতে চাই না, এই ইন্দ্রিয়ভোগের জীবন কামনা করি না, আমি কামনা করি উচ্চতর বস্তুকে’—ইহাই হইল বৈরাগ্য। অতঃপর যে ক্ষতি আমাদের হইয়া গিয়াছে, ধ্যানের দ্বারা তাহার প্রতিকার করিতে হইবে।
আমরা প্রকৃতির আজ্ঞানুরূপ কার্য করিতে বাধ্য। যদি বাহিরে কোথাও শব্দ হয়, আমাকে তাহা শুনিতেই হইবে। যদি কিছু ঘটিয়া থাকে, আমাকে তাহা দেখিতেই হইবে। আমরা ঠিক যেন বানরের মত। আমরা প্রত্যেকে যেন দুই সহস্র বানরের এক-একটি ঝাঁক। বানর এক অদ্ভুত প্রাণী! ফলতঃ আমরা অসহায়; আর বলি কিনা, ‘ইহাই আমাদের উপভোগ!’ অপূর্ব এই ভাষা! পৃথিবীকে আমরা উপভোগই করিতেছি বটে! আমাদের ভোগ না করিয়া গত্যন্তর নাই। প্রকৃতি চায় যে, আমরা ভোগ করি। একটি সুললিত শব্দ হইতেছে, আর আমি শুনিতেছি। যেন উহা শোনা না শোনা আমার হাতে! প্রকৃতি বলে, ‘যাও, দুঃখের গভীরে ডুবিয়া যাও’, মুহূর্তের মধ্যে আমি দুঃখে নিমজ্জিত হই। আমরা ইন্দ্রিয় ও সম্পদ্ সম্ভোগ করিবার কথা বলিয়া থাকি। কেহ হয়তো আমাকে খুব পণ্ডিত মনে করে, আবার অপর কেহ হয়তো মনে করে—‘এ মূর্খ।’ জীবনে এই অধঃপতন, এই দাসত্ব চলিয়াছে, অথচ আমাদের কোন বোধই নাই। আমরা একটি অন্ধকার কক্ষে পরস্পর মাথা ঠুকিয়া মরিতেছি।
ধ্যান কাহাকে বলে? ধ্যান হইল সেই শক্তি, যাহা আমাদের এই-সব কিছু প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা দেয়। প্রকৃতি আমাদের প্রলোভন দেখাইয়া বলিতে পারে, ‘দেখ—কি সুন্দর বস্তু!’ আমরা ফিরিয়াও দেখিব না। তখন সে বলিবে, ‘এই যে কি সুগন্ধ, আঘ্রাণ কর।’ আমি আমার নাসিকাকে বলিব, ‘আঘ্রাণ করিও না।’ নাসিকা আর তাহা করিবে না। চক্ষুকে বলিব, ‘দেখিও না।’ প্রকৃতি একটি মর্মন্তুদ কাণ্ড করিয়া বসিল; সে আমার একটি সন্তান হত্যা করিয়া বলিল, ‘হতভাগা, এইবার তুই বসিয়া ক্রন্দন কর। শোকের সাগরে ডুবিয়া যা।’ আমি বলিলাম, ‘আমাকে তাহাও করিতে হইবে না।’ আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম; আমাকে স্বাধীন হইতে হইবে। ইহা মাঝে মাঝে পরীক্ষা করিয়া দেখ না। এক মুহূর্তের ধ্যানের ফলে এই প্রকৃতিতেই পরিবর্তন আনিতে পারিবে। মনে কর, তোমার নিজের মধ্যে যদি সে ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে উহাই কি স্বর্গসদৃশ হইত না, উহাই কি মুক্তি হইত না? ইহাই হইল ধ্যানের শক্তি।
কি করিয়া উহা আয়ত্ত করা যাইবে? নানা উপায়ে তাহা পারা যায়। প্রত্যেকের প্রকৃতির নিজস্ব গতি আছে। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হইল এই যে, মনকে আয়ত্তে আনিতে হইবে। মন একটি জলাশয়ের মত; যে কোন প্রস্তরখণ্ড উহাতে নিক্ষিপ্ত হয়, তাহাই তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই তরঙ্গগুলি আমাদের স্বরূপ-দর্শনে অন্তরায় সৃষ্টি করে। জলাশয়ে পূর্ণচন্দ্র প্রতিবিম্বিত হইয়াছে; কিন্তু জলাশয়ের বক্ষ এত আলোড়িত যে, প্রতিবিম্বটি পরিষ্কাররূপে দেখিতে পাইতেছি না। ইহাকে শান্ত হইতে দাও। প্রকৃতি যেন উহাতে তরঙ্গ সৃষ্টি করিতে না পারে। শান্ত হইয়া থাক; তাহা হইলে কিছু পরে প্রকৃতি তোমাকে ছাড়িয়া দিবে। তখন আমরা জানিতে পারিব, আমরা স্বরূপতঃ কি। ঈশ্বর সর্বদা কাছেই রহিয়াছেন; কিন্তু মন বড়ই চঞ্চল, সে সর্বদা ইন্দ্রিয়াদির পশ্চাতে ছুটিয়া বেড়াইতেছে। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করিলেও তোমার ঘূর্ণিপাকের অবসান হইবে না। এই মুহূর্তে মনে করিতেছি, আমি ঠিক আছি, ঈশ্বরের ধ্যান করিব; অমনি মুহূর্তের মধ্যে আমার মন চলিল লণ্ডনে। যদি বা তাহাকে সেখান হইতে জোর করিয়া টানিয়া আনিলাম, তা অতীতে আমি নিউ ইয়র্কে কি করিয়াছি, তাহাই দেখিবার জন্য মন ছুটিল নিউ ইয়র্কে। এই-সকল তরঙ্গকে ধ্যানের দ্বারা নিবারণ করিতে হইবে।
ধীরে ধীরে এবং ক্রমে ক্রমে নিজেদের প্রস্তুত করিতে হইবে। ইহা তামাশার কথা নয়, একদিনের বা কয়েক বৎসরের অথবা হয়তো কয়েক জন্মেরও কথা নয়। কিন্তু সেজন্য দমিয়া যাইও না। সংগ্রাম চালাইতে হইবে। জ্ঞানতঃ—স্বেচ্ছায় এই সংগ্রাম চালাইতে হইবে। তিল তিল করিয়া আমরা নূতন ভূমি জয় করিয়া লইব। তখন আমরা এমন প্রকৃত সম্পদের অধিকারী হইব, যাহা কেহ কখনও আমাদের নিকট হইতে হরণ করিয়া লইতে পারিবে না; এমন সম্পদ্, যাহা কেহ নষ্ট করিতে পারিবে না; এমন আনন্দ, যাহার উপর আর কোন বিপদের ছায়া পড়িবে না।
এতকাল ধরিয়া আমরা অন্যের উপর নির্ভর করিয়া আসিতেছি। যখন আমি সামান্য সুখ পাইতেছিলাম, তখন সুখের কারণ যে ব্যক্তি, সে প্রস্থান করিলে অমনি আমি সুখ হারাইতাম। মানুষের নির্বুদ্ধিতা দেখ! আপনার সুখের জন্য সে অন্যের উপর নির্ভর করে! সকল বিয়োগই দুঃখময়। ইহা স্বাভাবিক। সুখের জন্য ধনের উপর নির্ভর করিবে? ধনের হ্রাসবৃদ্ধি আছে। সুখের জন্য স্বাস্থ্য অথবা অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভর করিলে আজ অথবা কাল দুঃখ অবশ্যম্ভাবী।
অনন্ত আত্মা ব্যতীত আর সব কিছু পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের চক্র আবর্তিত হইতেছে! স্থায়িত্ব তোমার নিজের অন্তরে ব্যতীত অন্য কোথাও নাই। সেখানেই অপরিবর্তনীয় অসীম আনন্দ রহিয়াছে। ধ্যানই সেখানে যাইবার দ্বার। প্রার্থনা, ক্রিয়াকাণ্ড এবং অন্যান্য নানাপ্রকার উপাসনা ধ্যানের প্রাথমিক শিক্ষা মাত্র। তুমি প্রার্থনা করিতেছ, অর্ঘ্যদান করিয়া থাক; একটি মত ছিল—যাহাতে বলা হইত, এ-সকলই আত্মিক শক্তির বৃদ্ধিসাধন করে; জপ, পুষ্পাঞ্জলি, প্রতিমা, মন্দির, দীপারতি প্রভৃতি ক্রিয়াকাণ্ডের ফলে মনে তদনুরূপ ভাবের সঞ্চার হয়; কিন্তু ঐ ভাবটি সর্বদা মানবের নিজের মধ্যেই রহিয়াছে, অন্যত্র নয়। সকলেই ঐরূপ করিতেছে; তবে লোকে যাহা না জানিয়া করে, তাহা জানিয়া করিতে হইবে। ইহাই হইল ধ্যানের শক্তি। তোমারই মধ্যে যাবতীয় জ্ঞান আছে। তাহা কিরূপে সম্ভব হইল? ধ্যানের শক্তি দ্বারা। আত্মা নিজের অন্তঃপ্রদেশ মন্থন করিয়া উহা উদ্ধার করিয়াছে। আত্মার বাহিরে কখনও কোন জ্ঞান ছিল কি? পরিশেষে এই ধ্যানের শক্তিতে আমরা আমাদের নিজ শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হই; তখন আত্মা আপনার সেই জন্মহীন মৃত্যুহীন স্বরূপকে জানিতে পারে। তখন আর কোন দুঃখ থাকে না, এই পৃথিবীতে আর জন্ম হয় না, ক্রমবিকাশও হয় না। আত্মা তখন জানে, আমি সর্বদা পূর্ণ ও মুক্ত।

*************************************************************************************************************

ধর্মের সাধন-প্রণালী ও উদ্দেশ্য

০৫. ধর্মের সাধন-প্রণালী ও উদ্দেশ্য

পৃথিবীর ধর্মগুলি পর্যালোচনা করিলে আমরা সাধারণতঃ দুইটি সাধনপথ দেখিতে পাই। একটি ঈশ্বর হইতে মানুষের দিকে বিসর্পিত। অর্থাৎ সেমিটিক ধর্মগোষ্ঠীতে দেখিতে পাই—ঈশ্বরীয় ধারণা প্রায় প্রথম হইতেই স্ফূর্তিলাভ করিয়াছিল, অথচ অত্যন্ত আশ্চর্য যে, আত্মা সম্বন্ধে তাহাদের কোন ধারণা ছিল না। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, অতি-আধুনিককালের কথা ছাড়িয়া দিলে প্রাচীন য়াহুদীদের মধ্যে জীবাত্মা-সম্পর্কে কোন চিন্তার স্ফুরণ হয় নাই। (তাহাদের মতে) মন ও কতিপয় জড়-উপাদানের সংমিশ্রণে মানুষের সৃষ্টি, তাহার অতিরিক্ত আর কিছু নয়; মৃত্যুতেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি। অথচ এই জাতির মধ্যেই ঈশ্বর সম্বন্ধে অতি বিস্ময়কর চিন্তাধারার বিকাশ হইয়াছিল। ইহাও অন্যতম সাধনপথ। অন্য সাধনপথ—মানুষের ভিতর দিয়া ঈশ্বরাভিমুখে। এই দ্বিতীয় প্রণালীটি বিশেষরূপে আর্যজাতির, আর প্রথমটি সেমিটিক জাতির।
আর্যগণ প্রথমে আত্মতত্ত্ব লইয়া শুরু করিয়াছিলেন; তখন তাঁহাদের ঈশ্বরবিষয়ক ধারণাগুলি অস্পষ্ট, পার্থক্য-নির্ণয়ে অসমর্থ ও অপরিচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু কালক্রমে আত্মা সম্বন্ধে তাঁহাদের ধারণা যতই স্পষ্টতর হইতে লাগিল, ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা সম অনুপাতে স্পষ্টতর হইতে লাগিল। সেইজন্য দেখা যায়, বেদসমূহে যাবতীয় জিজ্ঞাসাই সর্বদা আত্মার মাধ্যমে উত্থাপিত হইয়াছিল এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে আর্যদিগের যত কিছু জ্ঞান সবই জীবাত্মার মধ্য দিয়াই স্ফূর্তি পাইয়াছে। সেইহেতু তাঁহাদের সমগ্র দর্শন-সাহিত্যে অন্তর্মুখী ঈশ্বরানুসন্ধানের বা ব্রহ্মজিজ্ঞাসার একটি বিচিত্র ছাপ অঙ্কিত রহিয়াছে।
আর্যগণ নিজেদের অন্তরেই চিরদিন ভগবানের অনুসন্ধান করিয়াছেন। কালক্রমে ঐ সাধনপ্রণালী তাঁহাদের নিকট স্বাভাবিক ও নিজস্ব হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহাদের শিল্পচর্চা ও প্রাত্যহিক আচরণের মধ্যেও ঐ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বর্তমানকালেও ইওরোপে উপাসনারত কোন ব্যক্তির প্রতিকৃতি আঁকিতে গিয়া শিল্পী তাঁহার দৃষ্টি ঊর্ধ্বে স্থাপন করাইয়া থাকেন। উপাসক প্রকৃতির বাহিরে ভগবানকে অনুসন্ধান করেন, দূর মহাকাশের দিকে তাঁহার দৃষ্টি প্রসারিত রহিয়াছে—এইভাবে সেই প্রতিমূর্তি অঙ্কিত হয়। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষে উপাসকের মূর্তি অন্যরূপ। এখানে উপাসনায় চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত থাকে, উপাসকের দৃষ্টি যেন অন্তর্মুখী।
এই দুইটি মানুষের শিক্ষণীয় বস্তু—একটি বহিঃপ্রকৃতি, অপরটি অন্তঃপ্রকৃতি। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী হইলেও সাধারণ মানুষের নিকট বহিঃপ্রকৃতিও—অন্তঃপ্রকৃতি (বা চিন্তা-জগৎ) দ্বারা সম্পূর্ণরূপে গঠিত। অধিকাংশ দর্শনশাস্ত্রে, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্রে, প্রথমেই অনুমিত হইয়াছে যে, জড়বস্তু এবং চেতন মন—দুইটি বিপরীতধর্মী। কিন্তু পরিণামে আমরা দেখি, উহারা বিপরীতধর্মী নয়; বরং ধীরে ধীরে উহারা পরস্পরের সান্নিধ্যে আসিবে এবং চরমে একত্র মিলিত হইয়া এক অন্তহীন অখণ্ড বস্তু সৃষ্টি করিবে। সুতরাং এই বিশ্লেষণ দ্বারা কোন একটি মতকে অপর মত হইতে উচ্চাবচ প্রতিপন্ন করা আমার অভিপ্রায় নয়। বহিঃপ্রকৃতির সাহায্যে সত্যানুসন্ধানে যাঁহারা ব্যাপৃত, তাঁহারা যেমন ভ্রান্ত নন, অন্তঃপ্রকৃতির মধ্য দিয়া সত্যলাভের যাঁহারা প্রয়াসী, তাঁহাদিগকেও তেমনি উচ্চ বলিয়া মনে করিবার কোন হেতু নাই। এই দুইটি পৃথক্ প্রণালী মাত্র। দুইটিই জগতে টিকিয়া থাকিবে; দুইটিরই অনুশীলন প্রয়োজন; পরিণামে দেখা যাইবে যে, দুইটি মতেরই পরস্পর মিলন হইতেছে। আমরা দেখি যে, মন যেমন দেহের পরিপন্থী নয়, দেহও তেমনি মনের পরিপন্থী নয়, যদিও অনেকে মনে করে, এই দেহটি একান্তই তুচ্ছ ও নগণ্য। প্রাচীনকালে প্রতিদেশেই এমন বহু লোক ছিল, যাহারা দেহকে শুধু আধি, ব্যাধি, পাপ ও ঐ জাতীয় বস্তুর আধাররূপেই গণ্য করিত। যাহা হউক, উত্তরকালে আমরা দেখিতে পাই, বেদের শিক্ষা অনুসারে এই দেহ মনে মিশিয়া গিয়াছে এবং মন দেহে মিশিয়া গিয়াছে।
একটি বিষয় স্মরণ রাখিতে হইবে, যাহা সমগ্র বেদে১ ধ্বনিত হইয়াছেঃ যথা, যেমন একটি মাটির ডেলা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকিলে আমরা বিশ্বের সমস্ত মাটির বিষয়ে জানিতে পারি, তেমনি সেই বস্তু কি, যাহা জানিলে আমরা অন্য সবই জানিতে পারি? কম-বেশী স্পষ্টতঃ বলিতে গেলে এই তত্ত্বই সমগ্র মানব-জ্ঞানের বিষয়বস্তু। এই একত্ব উপলব্ধির দিকেই আমরা সকলে অগ্রসর হইতেছি। আমাদের জীবনের প্রতি কর্ম—তাহা অতি বৈষয়িক, অতি স্থূল, অতি সূক্ষ্ম, অতি উচ্চ, অতি আধ্যাত্মিক কর্মই হউক না কেন—সমভাবে সেই একই আদর্শ একাত্বানুভূতির দিকে আমাদিগকে লইয়া যাইতেছে। এক ব্যক্তি অবিবাহিত। সে বিবাহ করিল। বাহ্যতঃ ইহা একটি স্বার্থপূর্ণ কাজ হইতে পারে, কিন্তু ইহার পশ্চাতে যে-প্রেরণা—যে-উদ্দেশ্য রহিয়াছে, তাহাও ঐ একত্ব উপলব্ধির চেষ্টা। তাহার পুত্র-কন্যা আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে; সে তাহার দেশকে ভালবাসে, এই পৃথিবীকে ভালবাসে এবং পরিণামে সমগ্র বিশ্বে তাহার প্রেম পরিব্যাপ্ত হয়। দুর্নিবার গতিতে আমরা সেই পূর্ণতার দিকে চলিতেছি—এই ক্ষুদ্র আমিত্ব নাশ করিয়া এবং উদার হইতে উদারতর হইয়া অদ্বৈতানুভূতির পথে। উহাই চরম লক্ষ্য; ঐ লক্ষ্যের দিকেই সমগ্র বিশ্ব দ্রুত-ধাবমান, প্রতি অণু-পরমাণু পরস্পরের সহিত মিলিত হইবার জন্য প্রধাবিত। অণুর সহিত অণুর, পরমাণুর সহিত পরমাণুর মুহুর্মুহুঃ মিলন হইতেছে, আর বিশালাকৃতি গোলক, ভূলোক, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহের উৎপত্তি হইতেছে। আবার উহারাও যথানিয়মে পরস্পরের দিকে বেগে ছুটিতেছে এবং এ-কথা আমরা জানি যে, চরমে সমগ্র জড়-জগৎ চেতন-জগৎ এক অখণ্ড সত্তায় মিশিয়া একীভূত হইবে।
নিখিল বিশ্বে বিপুলভাবে যে ক্রিয়া চলিতেছে, ব্যষ্টি-মানুষেও স্বল্পায়তনে সেই ক্রিয়াই চলিতেছে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যেমন একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র সত্তা আছে অথচ উহা নিয়তই একত্বের—অখণ্ডত্বের দিকে ধাবমান, আমাদের ক্ষুদ্রতর ব্রহ্মাণ্ডেও সেইরূপ প্রতি জীব যেন জগতের অবশিষ্টাংশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিত্য নবজন্ম পরিগ্রহ করিতেছে। যে যত বেশী মূর্খ ও অজ্ঞ, সে নিজেকে বিশ্ব হইতে তত বেশী বিচ্ছিন্ন মনে করে। যে যত বেশী অজ্ঞ, সে তত বেশী মনে করে যে, সে মরিবে অথবা জন্মগ্রহণ করিবে ইত্যাদি—এ-সকল ভাব এই অনৈক্য বা ভিন্নতাকেই প্রকাশ করে অথবা বিচ্ছিন্ন ভাবেরই অভিব্যঞ্জক। কিন্তু দেখা যায়, জ্ঞানোৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, নীতিজ্ঞান অভিব্যক্ত হয় এবং মানুষের মধ্যে অখণ্ড চেতনার উন্মেষ হয়। জ্ঞাতসারেই হউক বা অজ্ঞাতসারেই হউক, ঐ শক্তিই পিছনে থাকিয়া মানুষকে নিঃস্বার্থ হইতে প্রেরণা দেয়। উহাই সকল নীতিজ্ঞানের ভিত্তি; পৃথিবীর যে-কোন ভাষায় বা যে-কোন ধর্মে বা যে-কোন অবতারপুরুষ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মনীতিতে ইহাই সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য অংশ। ‘নিঃস্বার্থ হও,’ ‘নাহং, নাহং—তুঁহু, তুঁহু’—এই ভাবটি সকল নীতি ও অনুশাসনের পটভূমি। তুমি আমার অংশ, এবং আমিও তোমার অংশ। তোমাকে আঘাত করিলে আমি নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হই, তোমাকে সাহায্য করিলে আমার নিজেরই সাহায্য হইয়া থাকে, তুমি জীবিত থাকিলে সম্ভবতঃ আমরাও মৃত্যু হইতে পারে না—ইহার অর্থ এই ব্যক্তিভাবশূন্যতার স্বীকৃতি। যতক্ষণ এই বিপুল বিশ্বে একটি কীটও জীবিত থাকে, ততক্ষণ কিরূপে আমি মরিতে পারি? কারণ আমার জীবন তো ঐ কীটের জীবনের মধ্যেও অনুস্যূত রহিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই শিক্ষাও পাই যে, কোন মানুষকে সাহায্য না করিয়া আমরা পারি না, তাহার কল্যাণে আমারই কল্যাণ।
এই বিষয়ই সমগ্র বেদান্ত এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্য দিয়া অনুস্যূত। এ-কথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সাধারণভাবে ধর্মমাত্রই তিন ভাগে বিভক্ত।
প্রথমাংশ দর্শন—প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতি ও সারকথা। সেই তত্ত্বগুলি পুরাণের আখ্যায়িকা—মহাপুরুষ বা বীরগণের জীবন, দেবতা উপদেবতা বা দেব-মানবদের কাহিনীর মধ্য দিয়া রূপ পরিগ্রহ করে। বস্তুতঃ শক্তির প্রকাশনাই সকল পুরাণ-সাহিত্যের মূল ভাব। নিম্নস্তরের পুরাণগুলিতে—আদিমযুগের রচনায়—এই শক্তির অভিব্যক্তি দেখা যায় দেহের পেশীতে। পুরাণগুলিতে বর্ণিত নায়কগণ আকৃতিতে যেমন বিশাল, বিক্রমেও তেমনি বিপুল। একজন বীরই যেন সমগ্র বিশ্বজয়ে সমর্থ। মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার শক্তি দেহ অপেক্ষা ব্যাপকতর ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে মহাপুরুষগণ উচ্চতর নীতিজ্ঞানের নিদর্শনরূপে পুরাণাদিতে চিত্রিত হইয়াছেন। পবিত্রতা এবং উচ্চনীতিবোধের মধ্য দিয়াই তাঁহাদের শক্তি প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহারা স্বতন্ত্র-ব্যক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ—স্বার্থপরতা ও নীতিহীনতার দুর্বার স্রোত প্রতিরোধ করিবার সামর্থ্য তাঁহাদের আছে। সকল ধর্মের তৃতীয় অংশ—প্রতীকোপাসনা; ইহাকে তোমরা যাগযজ্ঞ, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম বল। পৌরাণিক উপাখ্যান এবং মহাপুরুষগণের চরিত্রও সর্বস্তরের নরনারীর প্রয়োজন মিটাইতে পারে না। এমন নিম্নপর্যায়ের মানুষও সংসারে আছে, যাহাদের জন্য শিশুদের মত ধর্মের ‘কিণ্ডারগার্টেন’ প্রয়োজন। এভাবেই প্রতীকোপাসনা ও ব্যাবহারিক দৃষ্টান্তের হাতে-নাতে প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হইয়াছে; এগুলি ধরা যায়, বোঝা যায়—ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জড়বস্তুর মত দেখা যায় এবং অনুভব করা যায়।
অতএব প্রত্যেক ধর্মেই তিনটি স্তর বা পর্যায় দেখা যায়; যথা—দর্শন, পুরাণ ও পূজা অনুষ্ঠান। বেদান্তের পক্ষে একটি সুবিধার কথা বলা যায় যে, সৌভাগ্যক্রমে ভারতবর্ষে ধর্মের এই তিনটি পর্যায়ের সংজ্ঞাই সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হইয়াছে। অন্যান্য ধর্মের মূলতত্ত্বগুলি উপাখ্যান অংশের সহিত এমনভাবে জড়িত যে, একটিকে অপরটি হইতে স্বতন্ত্র করা বড় কঠিন। উপাখ্যানভাগ যেন তত্ত্বাংশকে গ্রাস করিয়া প্রাধান্য লাভ করিয়াছে এবং কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সাধারণ মানুষ তত্ত্বগুলি একরূপ ভুলিয়া যায়, তত্ত্বাংশের তাৎপর্য আর ধরিতে পারে না। তত্ত্বের টীকা, ব্যাখ্যা প্রভৃতি মূলতত্ত্বকে গ্রাস করে এবং সকলে এগুলি লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে ও অবতার, প্রচারক, আচার্যদের কথাই কেবল চিন্তা করে। মূলতত্ত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়—এতদূর লুপ্ত হয় যে, বর্তমানকালেও যদি কেহ যীশুকে বাদ দিয়া খ্রীষ্টধর্মের তত্ত্বসমূহ প্রচার করিতে প্রয়াসী হয়, তবে লোকে তাহাকে আক্রমণ করিতে চেষ্টা করিবে এবং ভাবিবে সে অন্যায় করিয়াছে এবং খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে। অনুরূপভাবে যদি কেহ হজরত মহম্মদকে বাদ দিয়া ইসলামধর্মের তত্ত্বগুলি প্রচার করিতে অগ্রসর হয়, তবে মুসলমানগণও তাহাকে সহ্য করিবে না। কারণ বাস্তব উদাহরণ—মহাপুরুষ ও পয়গম্বরের জীবনকাহিনীই তত্ত্বাংশকে সর্বতোভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
বেদান্তের প্রধান সুবিধা এই যে, ইহা কোন ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়। সুতরাং স্বভাবতঃ বৌদ্ধধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম বা ইসলামের ন্যায় কোন প্রত্যাদিষ্ট বা প্রেরিত পুরুষের প্রভাব উহার তত্ত্বাংশগুলিকে সর্বতোভাবে গ্রাস অথবা আবৃত করে নাই। …
তত্ত্বমাত্রই শাশ্বত ও চিরন্তন, এবং প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ যেন গৌণপর্যায়ভুক্ত—তাঁহাদের কথা বেদান্তশাস্ত্রে উল্লিখিত হয় নাই। উপনিষদসমূহে কোন বিশেষ প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের বিষয় বলা হয় নাই, তবে বহু মন্ত্রদ্রষ্টা পুরুষ ও নারীর কথা বলা হইয়াছে। প্রাচীন য়াহুদীদের এই ধরনের কিছু ভাব ছিল; তথাপি দেখিতে পাই মোজেস্ হিব্রূ সাহিত্যের অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া আছেন। অবশ্য আমি বলিতে চাই না যে, এই সিদ্ধ মহাপুরুষগণ কর্তৃক একটা জাতির ধর্মজীবন নিয়ন্ত্রিত হওয়া খারাপ। কিন্তু যদি কোন কারণে ধর্মের সমগ্র তত্ত্বাংশকে উপেক্ষা করা হয়, তবে তাহা জাতির পক্ষে নিশ্চয়ই ক্ষতিকর হইবে। তত্ত্বের দিক্‌ দিয়া বিভিন্ন জাতির মধ্যে অনেকটা ঐক্যসূত্র খুঁজিয়া পাইতে পারি, কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক্ দিয়া তাহা সম্ভব নয়। ব্যক্তি আমাদের হৃদয়াবেগ স্পর্শ করে; তত্ত্বের আবেদন উচ্চতর ক্ষেত্র অর্থাৎ আমাদের শান্ত বিচারবুদ্ধিকে স্পর্শ করে। তত্ত্বই চরমে জয়লাভ করিবে, কারণ উহাই মানুষের মনুষ্যত্ব। ভাবাবেগ অনেক সময়ই আমাদিগকে পশুস্তরে নামাইয়া আনে। বিচারবুদ্ধি অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গুলির সহিতই ভাবাবেগের সম্বন্ধ বেশী; সুতরাং যখন তত্ত্বসমূহ সর্বতোভাবে উপেক্ষিত হয়, এবং ভাবাবেগ প্রবল হইয়া উঠে, তখনই ধর্ম গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয় এবং ঐ অবস্থায় ধর্ম এবং দলীয় রাজনীতি ও অনুরূপ বিষয়ে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না। তখন ধর্মসম্বন্ধে মানুষের মনে অতি উৎকট ও অন্ধ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং হাজার হাজার মানুষ পরস্পরের গলায় ছুরি দিতেও দ্বিধা করে না। যদিও এ-সকল প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের জীবন সৎকর্মের মহতী প্রেরণাস্বরূপ, নীতিচ্যুত হইলে ইহাই আবার মহা অনর্থের হেতু হইয়া থাকে। এই প্রক্রিয়া সর্বযুগেই মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার পথে ঠেলিয়া দিয়াছে এবং ধরিত্রীকে রক্তস্নাত করিয়াছে। বেদান্ত এই বিপদ এড়াইয়া যাইতে সমর্থ, কারণ ইহাতে কোন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের স্থান নাই। বেদান্তে অনেক মন্ত্রদ্রষ্টার কথা আছে—‘ঋষি’ বা ‘মুনি’ শব্দে তাঁহারা অভিহিত। ‘দ্রষ্টা’ শব্দটিও আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহৃত। যাঁহারা সত্য দর্শন করিয়াছেন, মন্ত্রার্থ উপলব্ধি করিয়াছেন—তাঁহারাই দ্রষ্টা।

‘মন্ত্র’ শব্দের অর্থ যাহা মনন করা হইয়াছে, যাহা মনে ধ্যানের দ্বারা লব্ধ; এবং ঋষি এই-সব মন্ত্রের দ্রষ্টা। এই মন্ত্রগুলি কোন মানব-গোষ্ঠীর অথবা কোন বিশেষ নর বা নারীর নিজস্ব সম্পত্তি নয়, তা তিনি যত বড়ই হউন। এমন কি বুদ্ধ বা যীশুখ্রীষ্টের মত শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষদেরও নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এগুলি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্রেরও যেমন সম্পত্তি, বুদ্ধদেবের মত মহামানবেরও তেমনি সম্পত্তি; অতি নগণ্য কীটেরও যেমন সম্পত্তি, খ্রীষ্টেরও তেমনি সম্পত্তি, কারণ এগুলি সার্বভৌম তত্ত্ব। এই মন্ত্রগুলি কখনও সৃষ্ট হয় নাই—চিরন্তন, শাশ্বত; এগুলি অজ—আধুনিক বিজ্ঞানের কোন বিধি বা নিয়মের দ্বারা সৃষ্ট হয় নাই, এই মন্ত্রগুলি আবৃত থাকে এবং আবিষ্কৃত হয়, কিন্তু অনন্তকাল প্রকৃতিতে আছে। নিউটন জন্মগ্রহণ না করিলেও জগতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরাজ করিত এবং ক্রিয়াশীল থাকিত। নিউটনের প্রতিভা ঐ শক্তি উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করিয়াছিল, সজীব করিয়াছিল এবং মানবীয় জ্ঞানের বিষয়বস্তুতে রূপায়িত করিয়াছিল মাত্র। ধর্মতত্ত্ব এবং সুমহান্ আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ সম্পর্কেও ঐ-কথা প্রযোজ্য। এগুলি নিত্যক্রিয়াশীল। যদি বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ মোটেই না থাকিত, যদি ঋষি এবং অবতারপ্রথিত পুরুষগণ জন্মগ্রহণ না করিতেন, তথাপি এই ধর্মতত্ত্বগুলির অস্তিত্ব থাকিত। এগুলি শুধু সাময়িকভাবে স্থগিত আছে, এবং মনুষ্যজাতি ও মনুষ্যপ্রকৃতির উন্নতি সাধন করিবার উদ্দেশ্যে ধীর-স্থিরভাবে ক্রিয়াশীল থাকিবে। কিন্তু যাঁহারা এই তত্ত্বগুলি দর্শন ও আবিষ্কার করেন, তাঁহারাই অবতারপুরুষ—তাঁহারাই আধ্যাত্মিক রাজ্যের আবিষ্কারক। নিউটন ও গ্যালিলিও যেমন পদার্থবিজ্ঞানের ঋষি ছিলেন, অবতারপুরুষগণও তেমনি অধ্যাত্মবিজ্ঞানের ঋষি। ঐ-সকল তত্ত্বের উপর কোন বিশেষ অধিকার তাঁহারা দাবী করিতে পারেন না, এগুলি বিশ্বপ্রকৃতির সাধারণ সম্পদ্।

হিন্দুদের মতে বেদ অনন্ত। বেদের অনন্তত্বের তাৎপর্য এখন আমরা বুঝিতে পারি। ইহার অর্থ—প্রকৃতির যেমন আদি বা অন্ত বলিয়া কিছু নাই, এ-সকল তত্ত্বেরও তেমনি আরম্ভ বা শেষ বলিয়া কিছু নাই। পৃথিবীর পর পৃথিবী, মতবাদের পর মতবাদ উদ্ভূত হইবে, কিছুকাল চলিতে থাকিবে এবং পরে আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে; কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতি একরূপই থাকিবে। লক্ষ লক্ষ মতবাদের উদ্ভব হইতেছে, আবার বিলয় হইতেছে। কিন্তু বিশ্ব একইভাবে থাকে। কোন একটি গ্রহ সম্পর্কে সময়ের আদি-অন্ত হয়তো বলা যাইতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ঐরূপ সীমানির্দেশ একেবারে অর্থহীন। নৈসর্গিক নিয়ম, জড়বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের তত্ত্বাদি সম্পর্কেও ঐ কথা সত্য। আদি-অন্তহীন কালের মধ্যে তাহারা বিরাজমান, এবং মানুষ অতি-সম্প্রতি, তুলনামূলকভাবে বলিতে গেলে জোর কয়েক হাজার বৎসর যাবৎ মানুষ এগুলির স্বরূপ-নির্ধারণে সচেষ্ট হইয়াছে। অজস্র উপাদান আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে। অতএব বেদ হইতে একটি মহান্ সত্য আমরা প্রথমেই শিক্ষা করি যে, ধর্ম সবেমাত্র শুরু হইয়াছে। আধ্যাত্মিক সত্যের অসীম সমুদ্র আমাদের সম্মুখে প্রসারিত। ইহা আমাদিগকে আবিষ্কার করিতে হইবে, কার্যকর করিতে হইবে এবং জীবনে রূপায়িত করিতে হইবে। সহস্র সহস্র প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের আবির্ভাব জগৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছে, ভবিষ্যতে আরও লক্ষের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করিবে।

প্রাচীন যুগে প্রতি সমাজেই অনেক প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ ছিলেন। এমন সময় আসিবে, যখন পৃথিবীতে প্রতি নগরের পথে পথে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে। বস্তুতঃ এমনও বলা চলে যে, প্রাচীনযুগের সমাজ-ব্যবস্থায় অসাধারণ ব্যক্তিগণই অবতাররূপে চিহ্নিত হইতেন। সময় আসিতেছে, যখন আমরা উপলব্ধি করিতে পারিব যে, ধর্মজীবন লাভ করার অর্থই ঈশ্বরকর্তৃক প্রত্যাদেশ লাভ করা এবং নর বা নারী সত্যদ্রষ্টা না হইয়া কেহই ধার্মিক হইতে পারে না। আমরা বুঝিতে পারিব যে, ধর্মতত্ত্ব শুধু মানসিক চিন্তা বা ফাঁকা কথার মধ্যে নিহিত নয়; পরন্তু বেদের শিক্ষা এই তত্ত্বের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, উচ্চ হইতে উচ্চতর তত্ত্বের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং সমাজে উহার প্রচারের মধ্যেই ধর্মের মূল রহস্য নিহিত। প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ বা ঋষি গড়িয়া তোলাই ধর্মচর্চার উদ্দেশ্য এবং বিদ্যায়তনগুলিও সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই গড়িয়া উঠিবে। সমগ্র বিশ্ব প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণে পূর্ণ হইবে। যতদিন মানুষ সত্যদ্রষ্টা বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ না হয়, ততদিন ধর্ম তাহার নিকটে শুধু কথার কথা হইয়া দাঁড়ায়। দেওয়ালকে যেমন দেখি, তাহা অপেক্ষাও সহস্রগুণ গভীরভাবে ধর্মকে আমরা প্রত্যক্ষ করিব, উপলব্ধি করিব—অনুভব করিব।

ধর্মের এ-সকল বিবিধ বহিঃপ্রকাশের অন্তরালে একটি মূলতত্ত্ব বিদ্যমান এবং আমাদের জন্য তাহা পূর্বেই বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে। প্রত্যেক জড়বিজ্ঞান ঐক্যের সন্ধান পাইলেই শেষ হইবে, কারণ ইহার বেশী আর আমরা যাইতে পারি না। পূর্ণ ঐক্যে পৌঁছিলে তত্ত্বের দিক্ দিয়া বিজ্ঞানের আর বেশী কিছুই বলিবার থাকে না। ব্যাবহারিক ধর্মের কাজ শুধু প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটিগুলির ব্যবস্থা করা। উদাহরণস্বরূপ, যে-কোন একটি বিজ্ঞানশাখা—যথা রসায়নশাস্ত্রের কথা ধরা যাইতে পারে। মনে করুন, এমন একটি মূল উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেল, যাহা হইতে অন্যান্য উপাদানগুলি প্রস্তুত করা যাইতে পারে। তখনই বিজ্ঞান-হিসাবে রসায়নশাস্ত্র চরম উৎকর্ষ লাভ করিবে। তারপর বাকী থাকিবে প্রতিদিন ঐ মূল উপাদানটির নব নব সংযোগ আবিষ্কার করা এবং জীবনের প্রয়োজনে ঐ যৌগিক পদার্থগুলি প্রয়োগ করা। ধর্ম সম্বন্ধেও সেই কথা। ধর্মের মহান্ তত্ত্বসমূহ, উহার কার্যক্ষেত্র ও পরিকল্পনা সেই স্মরণাতীত যুগেই আবিষ্কৃত হইয়াছিল, যে-যুগে জ্ঞানের চরম এবং পরম বাণী বলিয়া কথিত—বেদের এই ‘সোঽহম্’ তত্ত্বটি মানুষ লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’-এর মধ্যে এই সমগ্র জড়জগৎ ও মনোজগৎ সমন্বিত, ইঁহাকে কেহ ঈশ্বর, কেহ ব্রহ্ম, কেহ আল্লা, কেহ যিহোবা অথবা অন্য কোন নামে অভিহিত করিয়া থাকে। এই মহান্ তত্ত্ব আমাদের জন্য পূর্বেই বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে; ইহার বাহিরে যাওয়া আমাদের সাধ্য নাই। আমাদের কর্মে, আমাদের জীবনের প্রত্যেক ব্যাপারে উহাকে সার্থক করিতে হইবে, পূর্ণ করিতে হইবে। এখন আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে—যেন আমরা প্রত্যেকে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হইতে পারি। আমাদের সম্মুখে বিরাট কাজ।

প্রাচীনকালে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের তাৎপর্য অনেকে উপলব্ধি করিতে পারিত না। সে-কালে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষকে একটি আকস্মিক ব্যাপার বলিয়া মনে করা হইত। তাহারা মনে করিত, প্রবল ইচ্ছাশক্তি বা তীক্ষ্ণবুদ্ধির প্রভাবে কোন ব্যক্তি উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারী হইতেন। আধুনিক কালে আমরা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত যে, প্রত্যেক জীবের—সে যে-ই হউক বা যেখানেই বাস করুক—এই জ্ঞানে জন্মগত অধিকার। এই জগতে আকস্মিক ব্যাপার বলিয়া কিছু নাই। যে-ব্যক্তি আকস্মিকভাবে কিছু লাভ করিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি, সেও ইহা পাইবার জন্য যুগযুগব্যাপী ধীর ও অব্যাহত তপস্যা করিয়াছে। সমগ্র প্রশ্নটি আমাদের উপর নির্ভর করে; আমরা কি সত্যই ঋষি বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হইতে চাই? যদি চাই, তবে অবশ্যই আমরা তাহা হইব।

প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ গড়িবার এই বিরাট কাজ আমাদের সম্মুখে বর্তমান। জ্ঞাতসারেই হউক আর অজ্ঞাতসারেই হউক, জগতের প্রধান ধর্মগুলি এই মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করিয়া যাইতেছে। পার্থক্য শুধু এই যে, দেখিবে বহু ধর্মমত ঘোষণা করেঃ আধ্যাত্মিক সত্যের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতি এ-জীবনে হইবার নয়, মৃত্যুর পর অন্য জগতে এমন এক সময় আসিবে, যখন সে সত্য দর্শন করিবে, এখন তাহাকে বিশ্বাস করিতে হইবে। কিন্তু যাহারা এ-সব কথা বলে, তাহাদিগকে বেদান্ত জিজ্ঞাসা করেঃ অবস্থা যদি বাস্তবিক এইরূপই হয়, তবে আধ্যাত্মিক সত্যের প্রমাণ কোথায়? উত্তরে তাহাদের বলিতে হইবে সর্বকালেই কতকগুলি বিশিষ্ট মানুষ থাকিবেন, যাঁহারা এ জীবনেই সেই অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত বস্তুসমূহের আভাস পাইয়াছেন।

অবশ্য ইহাতেও সমস্যার সমাধান হইবে না। যদি ঐ-সকল ব্যক্তি অসাধারণই হইয়া থাকেন, যদি অকস্মাৎই তাঁহাদের মধ্যে ঐ শক্তির উন্মেষ হইয়া থাকে, তবে তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিবার অধিকার আমাদের নাই। যাহা দৈবাৎ-লব্ধ তাহা বিশ্বাস করাও আমাদের পক্ষে পাপ, কারণ আমরা তাহা জানিতে পারি না। জ্ঞান কাহাকে বলে? জ্ঞানের অর্থ—বিশেষত্ব বা অদ্ভুতত্বের বিনাশ। মনে করুন, একটি বালক রাস্তায় বা কোন পশু-প্রদর্শনীতে গিয়া অদ্ভুত আকৃতির একটি জন্তু দেখিতে পাইল। সেই জন্তুটি কি—সে চিনিতে পারিল না। তারপর সে এমন এক দেশে গেল, যেখানে ঐ জাতীয় জন্তু অসংখ্য রহিয়াছে। তখন সে উহাদিগকে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্তু বলিয়া বুঝিল এবং সন্তুষ্ট হইল। তখন মূল তত্ত্বটি জানার নামই হইল জ্ঞান। তত্ত্ব-বর্জিত কোন একটি বস্তুবিশেষের যে জ্ঞান, তাহা জ্ঞান নয়। মূল সত্যটি হইতে বিচ্ছিন্ন কোন একটি বিষয় অথবা অল্প কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা যখন জ্ঞান লাভ করি, তখন আমাদের জ্ঞান হয় না, আমরা অজ্ঞানই থাকি। অতএব যদি এই প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ বিশেষ ধরনের ব্যক্তিই হইয়া থাকেন, যদি সাধারণের আয়ত্তের বাহিরে যে-জ্ঞান, তাহা লাভ করিবার অধিকার শুধু তাঁহাদেরই হইয়া থাকে এবং অন্য কাহারও না থাকে, তবে তাঁহাদিগের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ তাঁহারা বিশেষ ধরনের দৃষ্টান্ত মাত্র, মূলতত্ত্বের সহিত তাঁহাদের সম্পর্ক নাই। আমরা নিজেরা যদি প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হই, তবেই আমরা তাঁহাদের কথা বিশ্বাস করিতে পারিব।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সমুদ্র-নাগিনী সম্পর্কে নানা কৌতুকাবহ ঘটনার কথা তোমরা শুনিয়াছ; কৌতুকাবহ কেন? কারণ দীর্ঘকাল অন্তর কয়েকজন মানুষ আসিয়া লোকসমাজে ঐ সমুদ্র-নাগিনীদের কাহিনী প্রচার করেন, অথচ অন্য কেহ কখনও উহাদিগকে দেখে নাই। তাহাদের উল্লেখযোগ্য কোন বিশেষ তত্ত্ব নাই; কাজেই জগৎ উহা বিশ্বাস করে না। বস্তুতঃ ঐ-সকল কাহিনীর পশ্চাতে কোন শাশ্বত সত্য নাই বলিয়াই জগৎ উহা বিশ্বাস করে না। যদি কেহ আমার সম্মুখে আসিয়া বলে যে, একজন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ তাঁহার স্থূলশরীর সহ অকস্মাৎ ব্যোমপথে অদৃশ্য হইয়া গেলেন, তাহা হইলে সেই অসাধারণ ব্যাপারটি দর্শন করিবার অধিকার আমার আছে। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি—‘তোমার পিতা কিংবা পিতামহ কি দৃশ্যটি দেখিয়াছিলেন?’ সে উত্তরে বলে, ‘না, তাঁহারা কেহই দেখেন নাই, কিন্তু পাঁচহাজার বৎসর পূর্বে ঐরূপ ঘটনা ঘটিয়াছিল।’—আর ঐরূপ ঘটনা যদি আমি বিশ্বাস না করি, তবে অনন্তকালের জন্য আমাকে নরকে দগ্ধ হইতে হইবে।

এ কী কুসংস্কার! আর ইহারই ফলে মানুষ তাহার দেব-স্বভাব হইতে পশু-স্বভাবে অবনত হইতেছে। যদি আমাদিগকে সবকিছু অন্ধভাবেই বিশ্বাস করিতে হয়, তবে বিচারবুদ্ধি আমরা লাভ করিয়াছি কেন? যুক্তিবিরোধী কোন কিছু বিশ্বাস করা কি মহাপাপ নয়? ঈশ্বর যে উৎকৃষ্ট সম্পদটি আমাদিগকে দান করিয়াছেন, তাহা যথাযথ-ভাবে ব্যবহার না করিবার কী অধিকার আমাদের আছে? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে, ঈশ্বরদত্ত শক্তির ব্যবহারে অক্ষম অন্ধবিশ্বাসী অপেক্ষা যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীকে ভগবান্ সহজে ক্ষমা করিবেন। অন্ধবিশ্বাসী শুধু নিজের প্রকৃতিকে অবনমিত করে এবং পশুস্তরে অধঃপাতিত হয়—বুদ্ধিনাশের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুক্তিবিচারের আশ্রয় আমরা অবশ্য গ্রহণ করিব এবং সকল দেশের প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত এই-সকল ঈশ্বরের দূত বা মহাপুরুষের কাহিনীকে যখন যুক্তিসম্মত বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিব, তখন আমরা তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব। যখন আমাদের মধ্যেও তাঁহাদের মত প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষকে দেখিতে পাইব, তখনই তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব। তখন আমরা দেখিব যে, তাঁহারা বিচিত্র ধরনের কোন জীব নন, পরন্তু কতকগুলি তত্ত্বের জীবন্ত উদাহরণ মাত্র। জীবনে তাঁহারা তপস্যা করিয়াছেন, কর্ম করিয়াছেন, ফলে ঐ নীতি বা তত্ত্ব স্বতই তাঁহাদের মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। আমাদিগকে ঐ অবস্থা লাভ করিতে হইলে অবশ্য কর্ম করিতে হইবে। যখন আমরা প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ হইব, তখনই আমরা তাঁহাকে চিনিতে পারিব। তাঁহারা মন্ত্রদ্রষ্টা ছিলেন, ইন্দ্রিয়ের পরিধি অতিক্রম করিয়া অতীন্দ্রিয় সত্য দর্শন করিতেন—এ-সকল কথা আমরা তখনই বিশ্বাস করিব, যখন ঐরূপ অবস্থা নিজেরা লাভ করিতে সমর্থ হইব, তৎপূর্বে নয়।

বেদান্তের ইহাই একমাত্র মূলনীতি। বেদান্ত ঘোষণা করেন যে, প্রত্যক্ষ এবং জাগ্রত উপলব্ধিই ধর্মের প্রাণ; কারণ ইহকাল ও পরকাল, জন্ম ও মৃত্যু, ইহলোক ও পরলোকের প্রশ্ন, সবই সংস্কার ও বিশ্বাসের প্রশ্ন মাত্র। কাল অনন্ত, মানুষ তাহাকে খণ্ডিত করিতে চেষ্টা করে, কিন্তু সামান্য প্রাকৃতিক পরিবর্তন ভিন্ন দশ ঘটিকা এবং বার ঘটিকা সময়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কালপ্রবাহ অন্তহীন গতিতে চলিয়াছে। সুতরাং এই জীবন বা জীবনান্তরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? উহা সময়ের প্রশ্ন মাত্র এবং সময়ের হিসাবে যেটুকু ক্ষতি হয়, কর্মের গতিবৃদ্ধিতে তাহার পূরণ হইয়া থাকে। অতএব বেদান্ত ঘোষণা করিতেছেন—ধর্ম বর্তমানেই উপলব্ধি করিতে হইবে এবং তোমাকে ধার্মিক হইতে হইলে সংস্কারমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন মন লইয়া কঠোর শ্রমের সহিত অগ্রসর হইতে হইবে, তত্ত্ব উপলব্ধি করিতে হইবে। প্রত্যেকটি বিষয় স্বয়ং দর্শন করিতে হইবে; তাহা হইলে যথার্থ ধর্মলাভ করিবে। ইহার পূর্বে তুমি নাস্তিক ছাড়া আর কিছু নও, অথবা নাস্তিক অপেক্ষাও নিকৃষ্ট; নাস্তিক তবু ভাল, কারণ সে অকপট। অকপট ভাবেই সে বলে, ‘আমি এ-সব জানি না।’ আর অপর সকলে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা সত্ত্বেও নিজেদের জাহির করিয়া বলে, ‘আমরা অতি ধার্মিক।’ কেহ জানে না, তাহার ধর্ম কি, কারণ প্রত্যেকে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কতকগুলি আজগবি কাহিনী গলাধঃকরণ করিয়াছে, পুরোহিতেরা তাহাদিগকে সেগুলি বিশ্বাস করিতে বলিয়াছে; না করিলে তাহাদের উদ্ধার নাই। যুগে যুগে এই ধারাই চলিয়া আসিতেছে।

ধর্মের প্রত্যক্ষানুভূতিই একমাত্র পথ। আমাদের প্রত্যেককেই সেই-পথটি আবিষ্কার করিতে হইবে। প্রশ্ন উঠিবে, বাইবেল-প্রমুখ শাস্ত্রসমূহের তবে মূল্য কি? শাস্ত্রগুলির মূল্য অবশ্য যথেষ্টই আছে, যেমন কোন দেশকে জানিতে হইলে তাহার মানচিত্রের প্রয়োজন। ইংলণ্ডে আসিবার পূর্বে আমি ইংলণ্ডের মানচিত্র অসংখ্যবার দেখিয়াছি। ইংলণ্ড সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা পাইতে মানচিত্র আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে, তথাপি যখন এদেশে আসিলাম, তখন বুঝিলাম মানচিত্রে ও বাস্তবদেশে কত প্রভেদ! উপলব্ধি এবং শাস্ত্রের মধ্যেও তেমনি পার্থক্য। শাস্ত্রগুলি মানচিত্র মাত্র—এগুলি অতীত মহাপুরুষগণের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা। এগুলি আমাদিগকে একইভাবে একই অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিলাভে সাহস দেয় ও অনুপ্রাণিত করে।

বেদান্তের প্রথম তত্ত্ব এই—অনুভূতিই ধর্ম; অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিই ধার্মিক, অনুভূতিহীন ব্যক্তিতে ও নাস্তিকে কোন পার্থক্য নাই। বরং নাস্তিক ভাল, কারণ সে নিজের অজ্ঞতা অকপটে স্বীকার করে। আবার ধর্মশাস্ত্রসমূহ ধর্মানুভূতিলাভে প্রভূত সাহায্য করে। এগুলি শুধু আমাদের পথ-প্রদর্শক নয়, পরন্তু আমাদিগকে সাধনপ্রণালীর উপদেশ দেয়। প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব অনুসন্ধান-প্রণালী আছে। এ-জগতে এমন বহুলোক আছেন, যাঁহারা বলেন, ‘আমি ধার্মিক হইতে চাহিয়াছিলাম, সত্য উপলব্ধি করিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু পারি নাই; সুতরাং আমি কিছু বিশ্বাস করি না।’ শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও এইরূপ লোক দেখিতে পাইবে। বহুলোক তোমাকে বলিবে, ‘আমি ধার্মিক হইবার জন্য চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু আজীবন দেখিয়াছি, উহার মধ্যে কিছু নাই।’ আবার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যাপার দেখিবেঃ মনে কর, একজন রাসায়নিক—বড় বৈজ্ঞানিক তোমার নিকট আসিয়া রসায়নশাস্ত্রের কথা বলিলেন। যদি তুমি তাঁহাকে বল, ‘আমি রসায়নবিদ্যার কিছুই বিশ্বাস করি না, কারণ আজীবন রাসায়নিক হইতে চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু উহার মধ্যে কিছুই পাই নাই।’ তখন বৈজ্ঞানিক তোমাকে প্রশ্ন করিবেন, ‘কখন তুমি ঐরূপ চেষ্টা করিয়াছিলে?’ তুমি বলিবে, ‘যখন ঘুমাইতে যাইতাম, তখন পুনঃপুনঃ এই কথা উচ্চারণ করিতাম—হে রসায়নশাস্ত্র, আমার নিকট এস। কিন্তু সে কখনও আসে নাই।’ উত্তরে বৈজ্ঞানিক হাসিবেন ও বলিবেন, ‘না, উহা যথার্থ প্রণালী নয়। কেন তুমি পরীক্ষাগারে গিয়া ক্ষাররস, অম্লরস প্রভৃতি মিশাইয়া দিনের পর দিন গবেষণায় তোমার হাত পোড়াও নাই? ঐ প্রণালীতেই তুমি ধীরে ধীরে রসায়নশাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করিতে পারিতে।’ ধর্মের বেলায়ও ঠিক তেমনি। ধর্ম সম্বন্ধে ঐরূপ শ্রম স্বীকার করিতে কি প্রস্তুত আছ? প্রত্যেক বিজ্ঞানশাখারই যেমন শিক্ষার একটি বিশিষ্ট প্রণালী আছে, ধর্মানুশীলনেরও সেরূপ আছে। ধর্মেরও নিজস্ব পদ্ধতি আছে। এই বিষয়ে পৃথিবীর প্রাচীন প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষগণের, যাঁহারা ধর্ম উপলব্ধি করিয়াছেন এবং কিছু লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতে অবশ্য আমরা ধর্মলাভের কোন-না-কোন শিক্ষা পাইতে পারি এবং পাইব। তাঁহারা আমাদিগকে ধর্মের বিবিধ প্রণালী, বিশেষ পদ্ধতি শিখাইবেন, এবং এগুলির সাহায্যেই আমরা ধর্মের নিগূঢ় সত্যসমূহ উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইব। তাঁহারা আজীবন সাধনা করিয়াছেন, মনকে সূক্ষ্মতম অনুভূতির উপযোগী করিয়া মানসিক উৎকর্ষের বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়াছেন এবং এই সূক্ষানুভূতির সহায়তায় ধর্মতত্ত্ব উপলব্ধি করিয়াছেন। ধার্মিক হইতে হইলে, ধর্মকে উপলব্ধি ও অনুভব করিতে হইলে, প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ হইতে হইলে তাঁহাদের প্রদর্শিত পদ্ধতি গ্রহণ করিতে হইবে এবং তদনুযায়ী সাধন করিতে হইবে। তারপরও যদি কিছু না পাওয়া যায়, তখন অবশ্য এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের হইবে, ‘ধর্মের মধ্যে কিছুই নাই, কারণ আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি এবং বিফল হইয়াছি।’

ইহাই সকল ধর্মের ব্যাবহারিক দিক্। জগতের সকল ধর্মগ্রন্থেই ইহা পাইবে। কতকগুলি মত ও নীতিকথাতেই ধর্মশিক্ষা হয় না, পরন্তু মহাপুরুষদের জীবনে ধর্মের আচরণ বা তপস্যা দেখিতে পাও। যে-সকল আচার-আচরণের বিষয় হয়তো শাস্ত্রে পরিষ্কারভাবে লিখিত নাই, সেগুলিও এই-সকল মহাপুরুষের প্রাত্যহিক জীবনে—আহারে ও বিহারে প্রতিপালিত এবং অনুসৃত হয় দেখিতে পাইবে। মহাপুরুষদের সমগ্র জীবন, আচরণ, কর্ম-পদ্ধতি প্রভৃতি সব কিছুই জনসাধারণের জীবনধারা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সেইজন্যই তাঁহারা উচ্চতর জ্ঞান ও ভগবদ্দর্শনের অধিকার লাভ করিয়াছেন। আর আমরাও যদি ঐরূপ দর্শন লাভ করিতে চাই, তবে আমাদিগকেও অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। তপস্যা ও অভ্যাস-যোগের দ্বারাই আমরা ঐরূপ অবস্থায় উন্নীত হইতে পারিব। সুতরাং বেদান্তের পদ্ধতি এইঃ প্রথমে ধর্মের মূলনীতিগুলি নির্ধারিত করিতে হয়, লক্ষ্যবস্তুটি চিহ্নিত করিতে হয়, তারপর যে-প্রণালী সহায়ে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছান যায়, সেই নীতি শিখিতে হয়—বুঝিতে হয় এবং উপলব্ধি করিতে হয়।

আবার এ-সকল প্রণালীও বহুমুখী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রকৃতি পরস্পর হইতে এত স্বতন্ত্র যে, একই প্রণালী আমাদের একাধিক ব্যক্তির পক্ষে ক্বচিৎ সমভাবে প্রযোজ্য হইতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের রুচি ও প্রকৃতি পৃথক্, সুতরাং প্রণালীও ভিন্ন হওয়া উচিত। দেখিবে কেহ কেহ অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, কেহ কেহ দার্শনিক ও যুক্তিবাদী, কেহ বা আনুষ্ঠানিক পূজা-অর্চনার পক্ষপাতী—স্থূলবস্তুর সহায়তা পাইতে চান। আবার দেখিবে কেহ কেহ কোনপ্রকার রূপ, মূর্তি বা পূজা-অনুষ্ঠান পছন্দ করে না—ঐ-সব তাহাদের পক্ষে মৃত্যুতুল্য। আবার আর একজন একবোঝা তাবিজ, কবচ সারা শরীরে ধারণ করে; সে এই-সকল প্রতীকের প্রতি এত অনুরাগী! আর একজন ভাবপ্রবণ ব্যক্তি দানধ্যানের পক্ষপাতী; সে কাঁদে, ভালবাসে, আরও কত প্রকারে অন্তরের ভাব ব্যক্ত করে। অতএব এই-সকল ব্যক্তির জন্য কখনও এই প্রণালী উপযোগী হইতে পারে না। যদি ধর্মজগতে সত্যলাভের জন্য একটি মাত্র পথ নির্দিষ্ট থাকিত, তবে ঐ পথ যাহাদের উপযোগী নয়, তাহাদের পক্ষে উহা অনিষ্টের কারণ হইত, মৃত্যুতুল্য হইত। সুতরাং সাধনপ্রণালী বিভিন্ন হইবে। বেদান্ত সেইজন্য রুচির বৈচিত্র্য অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পথের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তদনুযায়ী নির্দেশ দিয়া থাকেন। তোমার রুচি অনুযায়ী যে-কোন একটি পথ গ্রহণ কর। একটি তোমার উপযোগী না হইলে অন্য একটি হয়তো উপযোগী হইবে।

এই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে বিচার করিলে আমরা দেখি যে, জগতে প্রচলিত একাধিক ধর্ম আমাদের পক্ষে কত গৌরবের বিষয়! বহুলোকের মনোমত মাত্র একজন আচার্য ও প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ না হইয়া বহু ধর্মগুরুর আবির্ভাব কত কল্যাণকর! মুসলমানগণ সমস্ত পৃথিবীকে ইসলামধর্মে, খ্রীষ্টানগণ খ্রীষ্টধর্মে এবং বৌদ্ধগণ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করিতে চান; কিন্তু বেদান্তের ঘোষণা এইঃ জগতের প্রত্যেকটি নরনারী নিজ নিজ পৃথক্ মতে বিশ্বাসী হউক। মতগুলির পশ্চাতে একই তত্ত্ব, একই একত্ব বিদ্যমান। যত অধিক সংখ্যায় প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের আবির্ভাব হইবে, যত বেশী শাস্ত্র থাকিবে, যত বেশী মন্ত্রদ্রষ্টা থাকিবেন, যত মত ও পথ থাকিবে, জগতের পক্ষে ততই মঙ্গল।

যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজে যত বেশী বৃত্তির সংস্থান থাকে, জনসাধারণের পক্ষে তত অধিক পরিমাণে কর্মলাভের সুযোগ হয়, ভাবজগতে এবং ধর্মজগতেও সেইরূপ হইয়া থাকে। বর্তমানকালে বিজ্ঞানের বহুমুখী বিকাশ হওয়াতে মানসিক উৎকর্ষের কী বহুবিধ সুযোগ মানুষের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে! জাগতিক ক্ষেত্রেও প্রয়োজন এবং রুচি অনুসারে নানা সামগ্রী আয়ত্তের মধ্যে পাইলে মানুষের পক্ষে কত বেশী সুবিধা হয়! ধর্মজগতেও সেইরূপ। ইহা ভগবানেরই এক মহিমময় বিধান যে, জগতে বহু ধর্মমতের উদ্ভব হইয়াছে। প্রার্থনা করি, এই ধর্মমতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বর্ধিত হউক এবং কালক্রমে প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার সংস্কার অনুযায়ী স্বতন্ত্র ধর্মমতের অনুবর্তী হইবার সুযোগ লাভ করুক।

বেদান্ত এই নিগূঢ় প্রয়োজন উপলব্ধি করিয়া এক সত্য প্রচার করেন এবং একাধিক সাধনপ্রণালী স্বীকার করেন। তুমি খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, য়াহুদী বা হিন্দু হও না কেন, যে-কোন পুরাণ-শাস্ত্রে বিশ্বাসী হও না কেন, নাজারেথের ঈশদূত, মক্কার প্রেরিতপুরুষ মহম্মদ, ভারতের বা অন্য কোন স্থানের অবতার ও প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের প্রতি আনুগত্য স্বীকার কর না কেন, তুমি নিজেই একজন সত্যদ্রষ্টা হও না কেন, বেদান্ত এ-সম্বন্ধে কিছুই বলিবে না। বেদান্ত শুধু সেই শাশ্বত নীতি প্রচার করেন, যাহা সকল ধর্মের ভিত্তি এবং যাহার জীবন্ত উদাহরণ ও প্রকাশরূপে অবতারপুরুষ ও মুনি-ঋষিগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হন। তাঁহাদের সংখ্যা যতই বর্ধিত হউক, তাহাতে বেদান্ত কোন আপত্তি উত্থাপন করিবে না। বেদান্ত শুধু তত্ত্বটি প্রচার করে এবং সাধনপ্রণালী তোমার উপর ছাড়িয়া দেয়। যে কোন পথ অনুসরণ কর, যে-কোন প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের অনুগামী হও—তাহাতে কিছু আসে যায় না। শুধু লক্ষ্য রাখিও সাধনপথটি যেন তোমার সংস্কার অনুযায়ী হয়, তাহা হইলেই তোমার উন্নতি নিশ্চিত।

*************************************************************************************************************

ভারতীয় ধর্মচিন্তা

০৬. ভারতীয় ধর্মচিন্তা

[আমেরিকার ব্রুকলিন শহরে ক্লিণ্টন এভেন্যু-এর উপর অবস্থিত পাউচ্‌ ম্যানসনে আর্ট গ্যালারী কক্ষে ব্রুকলিন এথিক্যাল সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় প্রদত্ত বক্তৃতা।]

ভারতবর্ষ আকারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক হইলেও তাহার জনসংখ্যা ঊনত্রিশ কোটি; অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমান, বৌদ্ধ২ এবং হিন্দু এই তিনটি ধর্মমতের আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমোক্ত ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছয় কোটি, দ্বিতীয়টির সংখ্যা নব্বই লক্ষ এবং প্রায় বিশ কোটি ষাট লক্ষ নরনারী শেষোক্ত ধর্মমতের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইল এই যে, ইহা ধ্যানাশ্রয়ী ও তত্ত্বচিন্তাশ্রয়ী দার্শনিক মতের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বেদের নানাখণ্ডে বিধৃত নৈতিক শিক্ষার উপর স্থাপিত। এই বেদ দাবী করেনঃ দেশের দিক্ হইতে এই ব্রহ্মাণ্ড অসীম এবং কালের দিক্ হইতে উহা অনন্ত। ইহার আদিও নাই, অন্তও নাই। জড়জগতে আত্মার শক্তির, সান্তের উপর অনন্ত শক্তির অসংখ্য বিকাশ ও প্রভাব ঘটিয়াছে; তথাপি অনন্ত অপরিমেয় আত্মা স্বয়ম্ভূ, শাশ্বত ও চির-অপরিবর্তনীয়। অনন্তের বক্ষে কালের গতি কোনরূপ চিহ্নই অঙ্কিত করিতে পারে না। মানবীয় বুদ্ধির অগম্য ইহার অতীন্দ্রিয় স্তরে অতীত বলিয়া কিছু নাই, ভবিষ্যৎ বলিয়াও কিছু নাই। বেদ প্রচার করেন, মানবাত্মা অবিনশ্বর। শরীর ক্ষয়-বৃদ্ধির নিয়মের অধীন—যাহারই বৃদ্ধি আছে, তাহারই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু প্রত্যগাত্মার সম্পর্ক অন্তহীন শাশ্বত জীবনের সহিত; ইহার কোনদিন আদি ছিল না, আবার কোনদিন অন্তও হইবে না। হিন্দু ও খ্রীষ্টান ধর্মের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য এই যে, খ্রীষ্টধর্মের মতে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের মুহূর্তকেই প্রত্যেক মানবাত্মার আরম্ভকাল ধরা হয়; কিন্তু হিন্দুধর্ম দাবী করে যে, মানবের আত্মা সনাতন ঐশী সত্তারই বহিঃপ্রকাশ এবং ঈশ্বরের যেমন আদি নাই, আত্মারও তেমনি আদি নাই। সে এক ব্যক্তিত্ব হইতে অপর ব্যক্তিত্বে নিরন্তর গমনাগমনের পথে আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশের মহান্ নিয়মানুসারে অগণিত রূপ পাইয়াছে এবং পূর্ণতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকার রূপ পাইতে থাকিবে; তারপর আর পরিবর্তন ঘটিবে না।

এ-সম্পর্কে এই প্রশ্ন প্রায়ই করা হয় যে, তাহাই যদি সত্য হয়, তবে অতীত জীবনসমূহের কিছুই কেন আমরা স্মরণ করিতে পারি না? আমাদের উত্তর এই যে, আমরা মানস মহাসমুদ্রের শুধু উপরিভাগের নাম দিয়াছি ‘চেতনা’, কিন্তু তাহার অতল গভীরে সঞ্চিত আছে আমাদের সর্বপ্রকার সুখ-দুঃখময় অভিজ্ঞতা। মানবাত্মা এমন কিছু পাইবার জন্যই লালায়িত, যাহা চিরস্থায়ী। কিন্তু আমাদের মন ও শরীর—বস্তুতঃ এই দৃশ্যমান বিশ্ব-প্রপঞ্চের সব-কিছুই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। অথচ আমাদের আত্মার তীব্রতম আকাঙ্ক্ষা এমন কিছুর জন্য, যাহার পরিবর্তন নাই, যাহা চিরকালের জন্য পরিপূর্ণতায় স্থিতি লাভ করিয়াছে। অসীম ভূমারই জন্য মানবাত্মার এই তৃষ্ণা। আমাদের নৈতিক উন্নতি যত গভীর হইবে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হইবে, এই কূটস্থ নিত্যের জন্য আকাঙ্ক্ষাও ততই তীব্র হইবে।

আধুনিক বৌদ্ধেরা এই শিক্ষা দেন, যাহা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না. তাহার অস্থিত্বই সম্ভব নয় এবং মানবাত্মার কোন স্বতন্ত্র সত্তা আছে—এ-বিশ্বাস ভ্রম মাত্র। অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদীরা (Idealist) দাবী করেন, প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বতন্ত্র সত্তা আছে, এবং তাহার মনোজগতে ধারণার বাহিরে বহির্বিশ্বের বাস্তবিক অস্তিত্ব নাই। এই দ্বন্দ্বের নিশ্চিত সমাধান এই যে, বস্তুতঃ বিশ্ব-প্রপঞ্চ স্বাতন্ত্র্য ও পরতন্ত্রতার—বস্তু ও ধারণার সংমিশ্রণ। আমাদের দেহ-মন বহির্জগতের উপর নির্ভরশীল এবং বহির্জগতের সহিত দেহমনের সম্বন্ধের অবস্থানুযায়ী এই নির্ভরশীলতার তারতম্য ঘটিয়া থাকে। কিন্তু ঈশ্বর যেমন স্বাধীন, প্রত্যগাত্মাও তেমনি মুক্ত, এবং শরীর ও মনের বিকাশ অনুযায়ী তাহাদের গতিকেও অল্পাধিক নিয়ন্ত্রণ করিতে সমর্থ।

মৃত্যু বলিতে অবস্থার পরিবর্তন মাত্রই বুঝায়। আমরা সেই একই বিশ্বের মধ্যে থাকিয়া যাই এবং পূর্বের মত সেই একই নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকি। এই বিশ্বকে যাঁহারা অতিক্রম করিয়াছেন, জ্ঞান ও সৌন্দর্য বিকাশের উচ্চতর লোকে যাঁহারা উপনীত, তাঁহারা তাঁহাদেরই অনুগামী বিশ্বব্যাপী সৈন্যবর্গের অগ্রগামী দল ভিন্ন আর কিছুই নন। এইরূপে সর্বোত্তম বিকাশপ্রাপ্ত আত্মা সর্বনিম্ন অনুন্নত আত্মার সহিত সম্বন্ধ এবং অসীম পূর্ণতার বীজ সকলের মধ্যেই নিহিত আছে। অতএব আমাদের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুশীলন করিতে হইবে এবং সকলের মধ্যেই যাহা কিছু উত্তম নিহিত আছে, তাহাই দেখিবার জন্য সচেষ্ট থাকিতে হইবে। বসিয়া বসিয়া শুধু আমাদের শরীর-মনের অপূর্ণতা লইয়া বিলাপ করিলে কোন লাভ হইবে না। সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে দমন করিবার জন্য যে বীরোচিত প্রচেষ্টা, তাহাই আমাদের আত্মাকে উন্নতির পথে চালিত করে। মানব-জীবনের উদ্দেশ্য—আধ্যাত্মিক উন্নতির নিয়মগুলিকে উত্তমরূপে আয়ত্ত করা। খ্রীষ্টানরা এ-বিষয়ে হিন্দুদের নিকট হইতে শিখিতে পারে। হিন্দুরাও খ্রীষ্টানদের নিকট হইতে শিখিতে পারে। বিশ্বের জ্ঞান-ভাণ্ডারে ইহাদের প্রত্যেকেরই মূল্যবান্ অবদান রহিয়াছে।

আপনারা সন্তান-সন্ততিদের এই শিক্ষাই দিন যে, প্রকৃত ধর্ম ইতিমূলক সৎ বস্তু, নেতিমূলক নয়; এই শিক্ষা দিন যে, শুধু পাপ হইতে বিরত থাকাই ধর্ম নয়, নিরন্তর মহৎ কর্মের অনুষ্ঠানই ধর্ম। প্রকৃত ধর্ম—কোন মানুষের নিকট হইতে শিক্ষাদ্বারা প্রাপ্য নয়, পুস্তকপাঠের দ্বারাও লভ্য নয়; প্রকৃত ধর্ম হইল অন্তরাত্মার জাগরণ এবং এই জাগরণ বীরোচিত পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা সংঘটিত হয়। এই পৃথিবীতে জাত প্রত্যেক শিশুই পূর্ব পূর্ব অতীত জীবন হইতে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা লইয়া জন্মগ্রহণ করে; এই-সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট চিহ্ন তাহাদের দেহ-মনের গঠনে লক্ষিত হয়। কিন্তু আমাদের সকলের মধ্যেই যে এক প্রকার স্বাতন্ত্র্যবোধ আছে, তাহা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, শরীর ও মন ব্যতীত আরও কিছু আমাদের মধ্যে বিরাজমান। আমাদের সকলের অন্তরে যে-আত্মা আধিপত্য করে, তাহা স্বাধীন এবং তাহাই আমাদের মনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগাইয়া দেয়। আমরা নিজেরা যদি মুক্ত না হই, তাহা হইলে এই পৃথিবীর উন্নতিসাধনের আশা কিরূপে করি? আমরা বিশ্বাস করি যে, মানবের প্রগতি আত্মার কার্যকলাপের ফলেই সম্ভব হয়। এই পৃথিবী যাহা এবং আমরা যাহা, তাহা আত্মার মুক্তস্বভাবেরই ফল। আমাদের বিশ্বাস—ঈশ্বর এক। তিনি আমাদের সকলের পিতা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তিমান্ এবং তিনি তাঁহার সন্তানদের অসীম ভালবাসার সহিত পরিচালন ও পরিপালন করেন। আমরা খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের ন্যায় সগুণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কিন্তু সেখানেই ক্ষান্ত নই, আমরা আরও অগ্রসর হইয়া বলি যে, আমিই সেই ঈশ্বর; আমরা বলি যে, তাঁহারই ব্যক্তিত্ব আমাদের মধ্যে বিকশিত, আমাদের অন্তরে তিনিই বাস করেন এবং আমরা তাঁহাতেই অবস্থিত। আমরা বিশ্বাস করি, সকল ধর্মেই কিছু না কিছু সত্যের বীজ নিহিত আছে, এবং হিন্দুগণ সকল ধর্মের নিকটই শ্রদ্ধাভরে মস্তক অবনত করেন; কারণ এই বিশ্ব-প্রপঞ্চে ক্রমবৃদ্ধির নিয়মেই সত্য লব্ধ হয়, অবিরাম বাদ দেওয়ার নিয়মে নয়। আমরা ভগবানের চরণে সকল ধর্মের সর্বোৎকৃষ্ট পুষ্পরাশি দ্বারা সজ্জিত একটি স্তবক নিবেদন করিব। আমরা তাঁহাকে ভালবাসিবার জন্যই ভালবাসিব, কোন কিছু লাভের আশায় নয়। আমরা কর্তব্যের জন্যই কর্তব্য করিব, কোন পুরস্কারের প্রত্যাশায় নয়। আমরা সৌন্দর্যের জন্যই সৌন্দর্যের উপাসনা করিব, লাভের আকাঙ্ক্ষায় নয়। এইরূপে চিত্তের পবিত্রতা লইয়াই আমরা ভগবানের দর্শন পাইব। যাগ-যজ্ঞ, মুদ্রা ও ন্যাস, মন্ত্রোচ্চারণ বা মন্ত্রজপ প্রভৃতিকে ধর্ম বলা চলে না। এ-সকল তখনই প্রশংসনীয়, যখন সেগুলি আমাদের মনে সাহসের সহিত সুন্দর ও বীরোচিত কর্ম সম্পাদনের জন্য উৎসাহ সঞ্চার করে এবং আমাদের চিত্তকে ভগবানের পূর্ণতা উপলব্ধি করিবার স্তরে উন্নীত করে।

যদি প্রতিদিন শুধু প্রার্থনাকালে স্বীকার করি যে, ঈশ্বর আমাদের সকলের পিতা, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক মানুষের সহিত ভ্রাতার ন্যায় ব্যবহার না করি, তাহা হইলে কি লাভ? পুস্তক-রচনার উদ্দেশ্য শুধু আমাদের জন্য উচ্চতর জীবনের পথ নির্দেশ করা। কিন্তু কোন শুভ ফলই দেখা দিবে না, যদি না অবিচলিত পদে সেই পথে আমরা চলিতে পারি। প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিত্বকে একটি কাঁচের গোলকের সঙ্গে তুলনা করিতে পারা যায়। প্রত্যেকটির কেন্দ্র একই শুভ্র জ্যোতি, ঐশী সত্তার একই প্রকার বিচ্ছুরণ; কিন্তু কাঁচের আবরণের বর্ণ ও ঘনত্বের পার্থক্যে রশ্মিনিঃসরণে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা ঘটিতেছে। কেন্দ্রে অবস্থিত শিখাটির দীপ্তি ও সৌন্দর্য সমান, কিন্তু যে জাগতিক যন্ত্রের মাধ্যমে তাহার প্রকাশ হয়, কেবল তাহারই অপূর্ণতাবশতঃ তারতম্যে প্রতীতি ঘটে। বিকাশের মানদণ্ড অনুসারে আমরা যতই উচ্চে আরোহণ করিতে থাকিব, ততই প্রকাশযন্ত্র স্বচ্ছ হইতে স্বচ্ছতর হইতে থাকিবে।

*************************************************************************************************************

কল্পকালীন স্থিতি ও পরিবর্তন

কল্পকালীন স্থিতি ও পরিবর্তন

[প্রথমবার আমেরিকায় অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে লিখিত]

জগতের সমতা নষ্ট হইয়াছে; বিনষ্ট সাম্যাবস্থার দৃষ্টান্ত এই সমগ্র বিশ্ব। জগতের সব গতিকেই এই সাম্যাবস্থা ফিরিয়া পাইবার প্রয়াস বলা যায়; সেইজন্য ইহাকে ‘গতি’ আখ্যা দেওয়া চলে না। অন্তর্জগতের সাম্যাবস্থা এমন একটি জিনিষ, যাহা আমাদের চিন্তার অতীত; কারণ চিন্তা নিজেই গতিবিশেষ। প্রসার মানে পূর্ণ সমতার দিকে অগ্রসর হওয়া; আর সমগ্র জগৎ সেইদিকেই ধাবমান। কাজেই পূর্ণসাম্যাবস্থা কখনই লাভ করা যায় না—এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের নাই। সাম্যাবস্থায় কোনরূপ বৈচিত্র্য থাকা অসম্ভব, উহাকে বৈচিত্র্যহীন হইতেই হইবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত মাত্র দুটি পরমাণু থাকিবে, ততক্ষণ উহারা পরস্পরকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করিয়া সাম্যভাব নষ্ট করিবে। সাম্যাবস্থা—একত্ব, স্থিতি ও সাদৃশ্যের অবস্থা। অন্তর্জগতের দিক্ হইতে এই সাম্যাবস্থা চিন্তাও নয়, শরীরও নয়, এমন কি যাহাকে আমরা গুণ বলি, তাহাও নয়। নিজের স্বরূপ বলিতে যাহা বুঝায়, এ অবস্থায় একমাত্র তাহাই থাকে; ইহাই সৎ-চিৎ-ও আনন্দ-স্বরূপ।

একই কারণে এই অবস্থা কখনও দুই প্রকার হইতে পারে না। ইহা অদ্বিতীয়। এখানে তুমি-আমি প্রভৃতি সর্ববিধ কৃত্রিম বৈচিত্র্য অন্তর্হিত হইবেই; কারণ বৈচিত্র্য পরিবর্তন বা অভিব্যক্তির অবস্থা, উহা মায়ার অন্তর্গত। অবশ্য বলিতে পার, আত্মার এই অভিব্যক্ত অবস্থা দেখিয়া আত্মা পূর্বে স্থির ও মুক্ত ছিল, এ-কথা মনে হইলেও বর্তমান ভেদপূর্ণ অবস্থাই উহার প্রকৃত স্বরূপ; যাহা হইতে আত্মা এই পরিবর্তনশীল অবস্থায় আসিয়াছে, তাহা আত্মার আদিম অপরিণত অবস্থা; সে অবস্থায় আবার ফিরিয়া যাওয়া মানে অধঃপতন। এ-কথা বলিতে পার বটে, তবে এ-কথার কোন মূল্য বা গুরুত্ব নাই; থাকিত, যদি প্রমাণিত হইত যে, আত্মার একরূপতা ও নানাধর্মিতা নামক অবস্থাপ্রাপ্তি মাত্র একবারই ঘটে। কিন্তু তাহা তো নয়, যাহা একবার ঘটে, বার বার তাহার পুনরাবৃত্তি হইবেই। স্থিতিকে অনুসরণ করে পরিবর্তন—জগৎ। স্থিতির পূর্বে পরিবর্তন নিশ্চয়ই ছিল, এবং পরিবর্তনের পর স্থিতি আবার আসিবেই; বার বার এরূপ ঘটিবে। এ-কথা চিন্তা করা হাস্যকর যে, একদা নিরবচ্ছিন্ন স্থিতি ছিল এবং তারপর নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন আসিয়াছে। প্রকৃতির প্রতিটি কণা দেখাইতেছে যে, ক্রমান্বয়ে স্থিতি ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়া উহা নিয়মিতভাবে চলিতেছে।

দুইটি স্থিতিকালের মধ্যবর্তী ব্যবধানের নাম কল্প। কাল্পিক স্থিতি একটি পূর্ণ সমজাতীয় অবস্থা হইতে পারে না; হইলে ভাবী বিকাশের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ-কথা বলা অযৌক্তিক যে, বর্তমান পরিবর্তনের অবস্থা পূর্বের স্থিতি অবস্থার তুলনায় উন্নততর; কারণ তাহা হইলে ভাবী স্থিতি-অবস্থার কাল পূর্ববর্তী পরিবর্তন-অবস্থার কাল অপেক্ষা অধুনাতন হওয়ার জন্য সে অবস্থা পূর্ণতর হইবে! প্রকৃতি একই রূপ বারেবারে দেখাইতেছে; নিয়ম বলিতে বস্তুতঃ ইহাই বুঝায়। জীবাত্মাদের বেলা কিন্তু (বিভিন্ন কল্পে ক্রমশঃ) উন্নততর অবস্থাপ্রাপ্তি ঘটে; অর্থাৎ জীবাত্মারা কল্প হইতে কল্পান্তরে নিজ স্বরূপের অধিকতর নিকটবর্তী হয়; এভাবে ক্রমোন্নত হইতে হইতে প্রতি কল্পেই অনেক জীবাত্মা মুক্ত হইয়া যায়, আর তাহাদের সংসার-চক্রে আবর্তিত হইতে হয় না।

বলিতে পার, জীবাত্মা তো জগৎ ও প্রকৃতির অংশ, জগৎ ও প্রকৃতির মত সেও তো বার বার পুনরাবর্তন করিবে, তাহার মুক্তি হইতে পারে না; জগতের ধ্বংস না হইলে তাহার মুক্তি হইবে কিরূপে? উত্তরে বলা যায়, জীবাত্মা মায়ার কল্পনা মাত্র, স্বরূপতঃ সেও যথার্থ সত্তা বা ব্রহ্ম।

জীবাত্মাই নির্বিশেষ ব্রহ্ম। প্রকৃতির ভিতর যাহা সৎ বস্তু, তাহাই ব্রহ্ম; মায়ার অধ্যাসের জন্য তিনিই এই নানাত্ব বা প্রকৃতি বলিয়া প্রতীত হইতেছেন। মায়া দৃষ্টিবিভ্রম মাত্র; সেইজন্য মায়াকে ‘সৎ’ বলা যাইতে পারে না। তথাপি মায়া এই দৃশ্য-জগৎ সৃষ্টি করিতেছে। যদি বল, মায়া নিজে অসৎ হইয়া সৃষ্টি করে কিরূপে? তাহার উত্তরে বলা যায়—যাহা সৃষ্ট হয়, তাহাও যে অজ্ঞান (অসৎ), কাজেই স্রষ্টা তো অজ্ঞানী (অসৎ) হইবেই। জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞান সৃষ্ট হইতে পারে কিভাবে? কাজেই বিদ্যা ও অবিদ্যা—এই দুই রূপে মায়া কার্য করিতেছে। অবিদ্যা বা অজ্ঞানকে নাশ করিয়া বিদ্যা নিজেও বিনষ্ট হয়। এভাবে মায়া নিজেকে নিজেই বিনাশ করে; যাহা বাকী থাকে, তাহাই সচ্চিদানন্দ—ব্রহ্ম। প্রকৃতির ভিতর যাহা সৎবস্তু, তাহাই ব্রহ্ম। প্রকৃতি তিনটি রূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়—ঈশ্বর, চিৎ বা জীব, এবং অচিৎ বা জড়বস্তু। এ-সবেরই প্রকৃত স্বরূপ ব্রহ্ম। মায়ার ভিতর দিয়া দেখি বলিয়া তিনি নানারূপে প্রতিভাত হন। তবে ঈশ্বর-দর্শন করাই—চরম সত্তাকে ঈশ্বররূপে দর্শন করাই চরম সত্তার সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়া, এবং ইহাই সর্বোত্তম দর্শন। সগুণ ঈশ্বরের ভাবই মানবীয় ভাবের সর্বোচ্চ অবস্থা; প্রকৃতির গুণগুলি যে অর্থে সত্য, ঈশ্বরে আরোপিত গুণগুলিও সেই অর্থে সত্য। তথাপি এ-কথা যেন আমরা কখনও ভুলিয়া না যাই যে, নির্গুণ ব্রহ্মকে মায়ার ভিতর দিয়া দেখিলে যেরূপ দেখায়, তাহাই সগুণ ঈশ্বর।

*************************************************************************************************************

বিস্তারের জন্য সংগ্রাম

০৮. বিস্তারের জন্য সংগ্রাম

[প্রথমবার আমেরিকায় অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নে লিখিত]

আমাদের সর্ববিধ জ্ঞানের ভিতর অনুস্যূত রহিয়াছে সেই প্রাচীন সমস্যা—বীজ বৃক্ষের পূর্বে, না বৃক্ষ বীজের পূর্বে, সত্তার অভিব্যক্তির ক্রমে চৈতন্য প্রথম, না জড় প্রথম; ভাব প্রথম, না বাহ্য প্রকাশ প্রথম; মুক্তি আমাদের প্রকৃত স্বরূপ, না নিয়মের বন্ধন; চিন্তা জড়ের স্রষ্টা, না জড় চিন্তার স্রষ্টা; প্রকৃতিতে নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন স্থিতির পূর্বের অবস্থা, না স্থিতির ভাবটি পরিবর্তনের পূর্বের অবস্থা—এই-সব প্রশ্নের সমাধান সমভাবেই দুরূহ। তরঙ্গমালার পর্যায়ক্রমে উত্থান ও পতনের মত উপরি-উক্ত প্রশ্নগুলিও অনিবার্য পরম্পরায় একটি আর একটিকে অনুসরণ করে এবং মানুষ তাহার রুচি, শিক্ষা বা মানসিক গঠনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোন-না-কোন একটি পক্ষ সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা যায় যে, প্রকৃতির বিভিন্ন অংশগুলির ভিতর যে-সঙ্গতি রহিয়াছে, তাহা দেখিয়া স্পষ্ট মনে হয়—উহা চেতনাত্মক কার্যেরই ফল; পক্ষান্তরে তর্ক করা যাইতে পারে, চৈতন্যের অস্তিত্ব জগৎ সৃষ্টির পূর্বে থাকা সম্ভব নয়, কারণ বিবর্তনের ফলে উহা জড় এবং শক্তির দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে। যদি বলা যায়, প্রতিটি রূপের পশ্চাতে মনে একটি ভাবাদর্শ অবশ্যই থাকিবে, তাহা হইলে সমান জোর দিয়া বলিতে পারা যায়, ভাবাদর্শের সৃষ্টিই হইয়াছিল বহুবিধ বাহ্য অভিজ্ঞতার দ্বারা। একদিকে মুক্তি সম্বন্ধে আমাদের চিরন্তন ধারণার প্রতি আবেদন, অপরদিকে এ ধারণাও রহিয়াছে যে, জগতে কোন কিছুই কারণহীন নয় বলিয়া কি স্থূল, কি মানসিক—সব কিছুই কার্য-কারণ-নিয়মের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। শক্তির দ্বারা উৎপন্ন শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করিবার পর যদি স্বীকার করা যায়, চিন্তাই স্পষ্টতঃ এই শরীরের স্রষ্টা, তাহা হইলে ইহাও স্পষ্ট যে, শরীরের পরিবর্তনে চিন্তার পরিবর্তন হয় বলিয়া শরীর নিশ্চয়ই মনের স্রষ্টা। যদি যুক্তি প্রদর্শন করা যায়, সর্বজনীন পরিবর্তন নিশ্চয়ই একটি পূর্ববর্তী স্থিতির ফলস্বরূপ, তাহা হইলে সমান যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা যাইবে যে, অপরিবর্তনীয়তার ভাব একটি বিভ্রমজনক আপেক্ষিক ধারণা মাত্র, গতির তুলনামূলক প্রভেদের দ্বারা ইহার উদ্ভব হইয়াছে।

এইরূপে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সমস্ত জ্ঞানই এই বিষচক্রে পর্যবসিত হয়; কার্য ও কারণের অনির্দিষ্ট পরস্পর নির্ভরশীলতাই এই চক্র—ইহার ভিতর কোন্‌টি আগে, কোন্‌টি পরে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। যুক্তির নিয়মে বিচার করিলে এই জ্ঞান ভুল; এবং সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত কথা এই যে, এই জ্ঞান ভুল প্রমাণিত হয়, যথার্থ জ্ঞানের সহিত তুলনা করিয়া নয়, পরন্তু সেই একই বিষচক্রের উপর নির্ভরশীল নিয়মগুলিরই দ্বারা। সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যায়, আমাদের সমস্ত জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহা নিজেই নিজের অপরিপূর্ণতা প্রমাণ করে। আবার আমরা ইহাও বলিতে পারি না যে, এই জ্ঞান মিথ্যা, কারণ যে-সব সত্য আমরা জানি বা চিন্তা করি, সেগুলি এই জ্ঞানের ভিতর রহিয়াছে। আবার ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সব কিছুর জন্যই এই জ্ঞান যে যথেষ্ট, এ-কথা অস্বীকার করিতেও পারা যায় না। অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ—মানবিক জ্ঞানের এই অবস্থার অন্তর্গত এবং ইহাকেই বলা হয় ‘মায়া’। ইহা মিথ্যা, কারণ ইহা নিজেই নিজের অশুদ্ধতা প্রমাণ করে। আর এই অর্থে ইহা সত্য যে, ইহা পশু-মানবের সকল প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট।

বহির্জগতে ক্রিয়াকালে মায়া নিজেকে প্রকাশ করে আকর্ষণী ও বিকর্ষণী শক্তিরূপে এবং অন্তর্জগতে—প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি-রূপে। সমগ্র জগৎ বাহিরের দিকে ধাবিত হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। প্রতিটি পরমাণু উহার কেন্দ্র হইতে দূরে সরিয়া যাইবার জন্য সচেষ্ট। অন্তর্জগতে প্রতিটি চিন্তা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। আবার বহির্জগতে প্রতিটি কণা আর একটি শক্তি—কেন্দ্রাভিগ শক্তি দ্বারা নিরুদ্ধ হইতেছে; এই শক্তি কণাটিকে কেন্দ্রের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। সেইরূপ চিন্তাজগতে সংযম-শক্তি এই-সব বহির্মুখী প্রবৃত্তিগুলিকে সংযত করিতেছে। জড়ের দিকে অগ্রসর হইবার প্রবৃত্তি অর্থাৎ যন্ত্রবৎ চালিত হইবার দিকে ক্রমশঃ নামিয়া যাইবার প্রবৃত্তি পশু-মানবের ধর্ম। যখন ইন্দ্রিয়ের বন্ধন রোধ করিবার ইচ্ছা মানুষের হয়, শুধু তখনই তাহার মনে ধর্মের উদয় হয়। এইরূপে আমরা দেখি যে, ধর্মের কার্যক্ষেত্র হইতেছে মানুষকে ইন্দ্রিয়ের বন্ধনে পড়িতে না দেওয়া এবং মুক্তিলাভের জন্য তাহাকে সাহায্য করা। সেই উদ্দেশ্যে নিবৃত্তিশক্তির প্রথম প্রয়াসকে বলা হয় নীতি। সকল নীতির উদ্দেশ্য হইতেছে এই অধঃপতনকে রোধ করা ও এই বন্ধনকে ভাঙিয়া ফেলা। সকল চারিত্র-নীতিকে ‘বিধি’ ও ‘নিষেধ’—এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এই নীতি বলে, ‘ইহা কর’, না হয় বলে, ‘ইহা করিও না’। যখন ইহা বলে, ‘করিও না’, তখন স্পষ্টই বুঝিয়া লইতে হইবে যে, একটি বাসনাকে সংযত করিতে বলা হইতেছে, যে-বাসনা মানুষকে ক্রীতদাস করিয়া ফেলিবে। আর যখন ইহা বলে, ‘কর’, তখন ইহার উদ্দেশ্য হইতেছে—মানুষকে মুক্তির পথ দেখান এবং যে-কোন অধঃপতন মানুষের হৃদয়কে পূর্বেই অধিকার করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা নষ্ট করিয়া দেওয়া।

মানুষের সম্মুখে একটি মুক্তির আদর্শ থাকিলে তবেই চারিত্র-নীতির সার্থকতা। পূর্ণ মুক্তিলাভের সম্ভাবনার প্রশ্ন ছাড়িয়া দিলেও ইহা স্পষ্ট যে, সমগ্র বিশ্বই হইতেছে বিস্তারের জন্য সংগ্রামের, বা অন্য ভাষায় বলিতে গেলে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা; একটি পরমাণুর জন্যও এই অনন্ত বিশ্ব যথেষ্ট স্থান নয়। বিস্তারের জন্য এই সংগ্রাম অনন্তকাল ধরিয়া চলিবেই, যতদিন না মুক্তিলাভ হয়। ইহা বলা যাইতে পারে না যে, সন্তাপ এড়ান বা আনন্দলাভই এই মুক্তি-সংগ্রামের উদ্দেশ্য। যাহাদের ভিতর এইরূপ বোধশক্তি নাই, সেই নিম্নতম পর্যায়ের প্রাণীরাও বিস্তারের অন্য প্রয়াস করিতেছে এবং অনেকের মতে মানুষ নিজেই এই-সকল প্রাণীর বিস্তার।

*************************************************************************************************************

ঈশ্বর ও ব্রহ্ম

ঈশ্বর ও ব্রহ্ম

[ইওরোপে অবস্থানকালে—‘বেদান্তদর্শনে ঈশ্বরের যথার্থ স্থান কোথায়?’—এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ]

ঈশ্বর সকল ব্যষ্টির সমষ্টি-স্বরূপ। তথাপি তিনি ‘ব্যক্তি-বিশেষ’, যেমন মনুষ্যদেহ একটি বস্তু, ইহার প্রত্যেক কোষ একটি ব্যষ্টি। সমষ্টি—ঈশ্বর, ব্যষ্টি—জীব। সুতরাং দেহ যেমন কোষের উপর নির্ভর করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব তেমনি জীবের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে। ইহার বিপরীতটিও ঠিক তেমনি। এইরূপে জীব ও ঈশ্বর যেন সহ-অবস্থিত দুইটি সত্তা—একটি থাকিলে অপরটি থাকিবেই। অধিকন্তু আমাদের এই ভূলোক ব্যতীত অন্যান্য উচ্চতর লোকে শুভের পরিমাণ অশুভের পরিণাম অপেক্ষা বহুগুণ বেশী থাকায় সমষ্টি (ঈশ্বর)-কে সর্বমঙ্গল-স্বরূপ বলা যাইতে পারে। সর্বশক্তিমত্তা ও সর্বজ্ঞত্ব ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ গুণ, এবং সমষ্টির দিক্ হইতেই ইহা প্রমাণ করিবার জন্য কোন যুক্তির প্রয়োজন হয় না। ব্রহ্ম এই উভয়ের ঊর্ধ্বে, এবং একটি সপ্রতিবন্ধ বা সাপেক্ষ অবস্থা নয়। ব্রহ্মই একমাত্র স্বয়ংপূর্ণ, যাহা বহু এককের দ্বারা গঠিত হয় নাই। জীবকোষ হইতে ঈশ্বর পর্যন্ত যে-তত্ত্ব অনুস্যূত, যাহা ব্যতীত কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না এবং যাহা কিছু সত্য, তাহাই সেই তত্ত্ব বা ব্রহ্ম। যখন চিন্তা করি—আমি ব্রহ্ম, তখন মাত্র আমিই থাকি; সকলের পক্ষেই এ-কথা প্রযোজ্য; সুতরাং প্রত্যেকেই সেই তত্ত্বের সামগ্রিক বিকাশ।

*************************************************************************************************************

যোগের চারিটি পথ

যোগের চারিটি পথ

[আমেরিকায় প্রথমবার অবস্থানকালে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে লিখিত]

মুক্ত হওয়াই আমাদের জীবনের প্রধান সমস্যা। আমরাই পরব্রহ্ম—যতক্ষণ না আমাদের এই উপলব্ধি হইতেছে, ততক্ষণ আমরা যে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হই না, এ-কথা অতি স্পষ্ট। এই অনুভূতি-লাভের বহু পথ; এই পথগুলির একটি সাধারণ নাম আছে। উহাকে বলা হয় ‘যোগ’ (যুক্ত করা, আমাদের সত্তার সহিত নিজেদের যুক্ত করা)। নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হইলেও এই যোগগুলিকে মূলতঃ চারিটি পর্যায়ভুক্ত করা যাইতে পারে। প্রত্যেক যোগই গৌণতঃ সেই পরমকে উপলব্ধি করিবার পথ, সেইজন্য এগুলি বিভিন্ন রুচির পক্ষে উপযোগী। এখন আমাদিগকে অবশ্যই মনে রাখিতে হইবে, কল্পিত মানবই প্রকৃত মানব বা ‘পরম’ হয় না। পরমে রূপান্তরিত হওয়া যায় না। পরম নিত্যমুক্ত, নিত্যপূর্ণ, কিন্তু সাময়িকভাবে অবিদ্যা ইহার স্বরূপ আবৃত করিয়া রাখিয়াছে। অবিদ্যার এই আবরণ সরাইয়া ফেলিতে হইবে। প্রত্যেক ধর্মই এক-একটি যোগের প্রতিনিধি। যোগগুলি শুধু অবিদ্যার আবরণ উন্মোচন করে এবং আত্মাকে নিজের স্বরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। অভ্যাস ও বৈরাগ্য মুক্তির প্রধান সহায়। আসক্তিশূন্যতাকে বলা হয় ‘বৈরাগ্য’, কারণ ভোগৈষণা বন্ধন সৃষ্টি করে। যে কোন একটি যোগের নিয়ত অনুশীলনকে ‘অভ্যাস’ বলা হয়।

কর্মযোগঃ 

কর্মযোগ হইল কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি করা। ভাল অথবা মন্দ কর্ম করিলে ঐ কর্মের ফল অবশ্যই ভাল বা মন্দ হইবে। যদি অন্য কোন কারণ না থাকে, কোন শক্তিই উহার কার্য রোধ করিতে পারে না। সৎ কর্মের ফল সৎ এবং অসৎ কর্মের ফল অসৎ হইবে এবং মুক্তির কোন সম্ভাবনা না রাখিয়া আত্মা চির বন্ধনের ভিতর আবদ্ধ থাকিবে। কর্মের ভোক্তা কিন্তু দেহ অথবা মন, আত্মা কখনই নয়। কর্ম কেবল আত্মার সম্মুখে একটি আবরণ নিক্ষেপ করিতে পারে। অবিদ্যা—অশুভ কর্মের দ্বারা নিক্ষিপ্ত আবরণ। সৎ কর্ম নৈতিক শক্তিকে দৃঢ় করিতে পারে এবং এইরূপে নৈতিক শক্তি দ্বারা অনাসক্তির অভ্যাস হয়। নৈতিক শক্তি অসৎ কর্মের প্রবণতা উৎসাদন করে এবং চিত্ত শুদ্ধ করে। কিন্তু যদি ভোগের উদ্দেশ্যে কর্ম করা হয়, তাহা হইলে ঐ কর্ম সেই বিশেষ ভোগটি উৎপাদন করে এবং চিত্ত শুদ্ধ করে না। সুতরাং ফলাসক্তি শূন্য হইয়া সকল কর্ম করিতে হইবে। কর্মযোগীকে সকল ভয় ইহামুত্রফলভোগ চিরকালের জন্য ত্যাগ করিতে হইবে। উপরন্তু এষণাবিহীন কর্ম—সকল বন্ধনের মূলস্বার্থপরতা বিনষ্ট করিবে। কর্মযোগীর মূলমন্ত্র ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’ এবং কোন আত্মত্যাগই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কিন্তু স্বর্গপ্রাপ্তি, নাম, যশ বা কোন জাগতিক সিদ্ধির জন্য তিনি কর্ম করেন না। এই নিঃস্বার্থ কর্মের ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি কেবল জ্ঞানযোগেই আছে, তথাপি সব সম্প্রদায়ভুক্ত সব মতাবলম্বী মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্ব তাহাদের ভিতর লোক কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের অনুরাগ বাড়াইয়া তোলে। আবার অনেকের নিকট বিত্তের বন্ধন অত্যন্ত কঠিন। যে-বিত্তলালসা দানা বাঁধিয়া উঠে, তাহা ভাঙিবার জন্য বিত্তকর্মীদের পক্ষে কর্মযোগ একান্ত প্রয়োজনীয়।

ভক্তিযোগঃ 

ভক্তি বা পূজা বা কোন-না-কোন প্রকার অনুরক্তি মানুষের সর্বাপেক্ষা সহজ, সুখকর এবং স্বাভাবিক পথ। এই বিশ্বের স্বাভাবিক অবস্থা হইতেছে আকর্ষণ, উহা কিন্তু নিশ্চিতভাবে একটি চূড়ান্ত বিচ্ছেদে পরিণত হয়। তাহা সত্ত্বেও প্রেম মানব-হৃদয়ে মিলনের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। প্রেম নিজে দুঃখের একটি মহা কারণ হইলেও যোগ্য বিষয়ের প্রতি নিয়োজিত হইলে মুক্তি আনয়ন করে। ভক্তির লক্ষ্য ঈশ্বর। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ বিনা প্রেম থাকিতে পারে না। প্রথমে এমন একজন প্রেমাস্পদ থাকা চাই, যিনি আমাদের প্রেমের প্রতিদান দিতে পারেন। সুতরাং ভক্তের ভগবানকে এক অর্থে মানবীয় ভগবান্ হইতেই হইবে। তিনি অবশ্যই প্রেমময় হইবেন। এইরূপ ভগবান্ আছেন বা নাই—এই প্রশ্ন ছাড়িয়া দিলেও ইহা সত্য যে, যাঁহাদের হৃদয়ে প্রেম আছে, তাঁহাদের নিকট এই নির্গুণ ব্রহ্মই প্রেমময় ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্মরূপে আবির্ভূত হন।

ভগবান্ বিচারক, শাস্তিদাতা বা এমন একজন, যাঁহাকে ভয়ে মানিতে হইবে—এই-সব ভাব নিম্ন পর্যায়ের পূজা। এই প্রকার পূজাকে প্রেমের পূজা বলা যায় না; এই-সব পূজা অবশ্য ধীরে ধীরে উচ্চাঙ্গের পূজায় রূপায়িত হয়। আমরা এখন নিরূপণ করিব, প্রেম কি বস্তু। আমরা প্রেমকে একটি ত্রিভুজের দ্বারা ব্যাখ্যা করিব, যে ত্রিভুজের পাদদেশের প্রথম কোণ ভয়শূন্যতা। যতক্ষণ ভয় থাকিবে, ততক্ষণ উহা প্রেম নয়। প্রেম সব ভয় দূর করে। শিশুকে রক্ষা করিবার জন্য মাতা ব্যাঘ্রের সম্মুখীন হন। দ্বিতীয় কোণ হইল—প্রেম কখনও কিছু চায় না, ভিক্ষা করে না। তৃতীয় বা শীর্ষকোণ হইতেছে—প্রেমের জন্যই প্রেম। এই প্রেম বিষয়- বিষয়ি-সম্পর্কশূন্য। ইহাই হইল প্রেমের সর্বোচ্চ বিকাশ এবং পরমের সহিত সমার্থক।

রাজযোগঃ 

এই যোগ আর সব যোগের সহিত খাপ খাইয়া যায়। বিশ্বাসযুক্ত বা বিশ্বাসহীন সর্ব শ্রেণীর জিজ্ঞাসুর পক্ষে রাজযোগ উপযুক্ত। রাজযোগ আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার যথার্থ যন্ত্র। যেমন প্রত্যেক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানের জন্য এক-একটি স্বকীয় ধারা থাকে, তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রে রাজযোগ। বিভিন্ন প্রকৃতি অনুযায়ী এই রাজযোগ-বিজ্ঞানের প্রয়োগ বিভিন্নভাবে হয়। ইহার প্রধান অঙ্গ হইল প্রাণায়াম, ধারণা ও ধ্যান। ঈশ্বর-বিশ্বাসীর পক্ষে গুরুর নিকট হইতে লব্ধ প্রণব বা ওঁকার বা অন্য কোন মন্ত্র খুব সহায়ক হইবে। প্রণব-মন্ত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ, উহা নির্গুণ ব্রহ্মের বাচক। জপের সহিত এই সব মন্ত্রের অর্থভাবনাই এখানে প্রধান সাধনা।

জ্ঞানযোগঃ 

জ্ঞানযোগ তিন ভাগে বিভক্ত। (১) শ্রবণ, অর্থাৎ আত্মা একমাত্র সৎ পদার্থ এবং অন্যান্য সব কিছু মায়া—এই তত্ত্ব শোনা। (২) মনন, অর্থাৎ সর্বদিক্ হইতে এই তত্ত্বকে বিচার করা। (৩) নিদিধ্যাসন, অর্থাৎ সমস্ত বিচার ত্যাগ করিয়া তত্ত্বকে উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধির চারিটি সাধন, যথা (১) ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’-রূপ দৃঢ় ধারণা; (২) সর্ব এষণা ত্যাগ; (৩) শমদমাদি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব। তত্ত্বের নিরন্তর ধ্যান এবং আত্মাকে উহার প্রকৃত স্বরূপ স্মরণ করাইয়া দেওয়া এই যোগের একমাত্র পথ। এই যোগ সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু কঠিনতম। এই যোগ অনেকের বুদ্ধিগ্রাহ্য হইতে পারে, কিন্তু অতি অল্প লোকই এই যোগে সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়।

*************************************************************************************************************

লক্ষ্য ও উহার উপলব্ধির উপায়

লক্ষ্য ও উহার উপলব্ধির উপায়

যদি সমগ্র মানবজাতি কেবল একটি ধর্ম—একটিমাত্র সর্বজনীন পূজাপদ্ধতিকে এবং একটিমাত্র নৈতিক মানদণ্ডকে স্বীকার ও গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়, তবে পৃথিবীর উপর কঠিন দুর্ভাগ্য নামিয়া আসিবে। সমস্ত ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পক্ষে উহা মৃত্যু-সদৃশ আঘাত হইবে। নিজেদের মতানুযায়ী সর্বোচ্চ সত্যের আদর্শটিকে সৎ বা অসৎ উপায়ে সকলকে গ্রহণ করাইবার জন্য উৎসাহ দিয়া এই ধ্বংসকারী ঘটনাটিকে বাস্তব রূপ দিবার চেষ্টা না করিয়া আমাদের উচিত চলার পথের সমস্ত অন্তরায়গুলি অপসারণ করার জন্য সচেষ্ট হওয়া, যাহাতে মানুষ তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ অনুযায়ী অগ্রসর হইতে পারে।

সমগ্র মানবজাতির শেষ পরিণতি, সর্বধর্মের লক্ষ্য ও পরিসমাপ্তি একই—ঈশ্বরের সহিত পুনর্মিলন, বা অন্য ভাষায় দেবত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এই দেবত্বই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ। কিন্তু লক্ষ্য এক হইলেও উপলব্ধির পন্থা মানুষের রুচি অনুযায়ী ভিন্ন হইতে পারে।
দেবত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্য ও পদ্ধতি উভয়কেই ‘যোগ’ বলা হয়। ইংরেজী ‘Yoke’ অর্থাৎ যুক্ত হওয়া—এই অর্থেই সংস্কৃতেও যোগ শব্দের উদ্ভব হইয়াছে। যোগ আমাদের স্বরূপের সহিত ঈশ্বরের যোগ করিয়া দেয়। এইরূপ যোগ বা মিলনের পদ্ধতি অনেক আছে; সেগুলির মধ্যে প্রধান হইতেছে কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ এবং জ্ঞানযোগ।
প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার স্বভাব অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত করিতে বাধ্য। যেমন প্রত্যেক বিজ্ঞানের একটি স্বকীয় পদ্ধতি আছে, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেরও আছে। ধর্মে সিদ্ধিপ্রাপ্তির উপায়কে ‘যোগ’ বলা হয়। মানুষের বিভিন্ন স্বভাব ও প্রকৃতি অনুযায়ী যোগগুলি আমরা শিক্ষা দিই। উক্ত যোগগুলিকে আমরা নিম্নলিখিত উপায়ে চারিটি শ্রেণীতে ভাগ করিঃ

(১) কর্মযোগ—যে-পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া মানুষ কর্ম ও কর্তব্যের মাধ্যমে স্বীয় দেবত্ব উপলব্ধি করে।
(২) ভক্তিযোগ—সগুণ ভগবানের ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা দেবত্বের অনুভূতি।
(৩) রাজযোগ—মনঃসংযোগের দ্বারা দেবত্বের উপলব্ধি।
(৪) জ্ঞানযোগ—জ্ঞানের দ্বারা দেবত্বের উপলব্ধি।
এই বিভিন্ন পথগুলি একই কেন্দ্রে অর্থাৎ ঈশ্বর-সমীপে লইয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম-বিশ্বাসের বহুলতায় সুবিধাই আছে; মানুষকে ধর্মজীবন যাপন করিতে যতক্ষণ উৎসাহ দেয়, ততক্ষণ সব বিশ্বাসই শুভ। ধর্মমত যত অধিক হয়, ততই মানুষের ভিতর যে দেবত্বের সংস্কার আছে, তাহার নিকট আবেদন করিবার বেশী সুযোগ পাওয়া যায়।
Oak Beach Christian Unity-র সমক্ষে বিশ্বজনীন মিলন-প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেনঃ
শেষ পর্যন্ত সকল ধর্মই এক—ইহা অতি সত্য কথা, যদিও খ্রীষ্টান চার্চ বাইবেলের উপাখ্যানের ফ্যারিসিদের মত ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়, এবং ভাবে যে, খ্রীষ্টধর্মই একমাত্র সত্য, অপর ধর্মগুলি সব ভুল এবং সেগুলির খ্রীষ্টধর্মের আলোকে আলোকিত হইবার প্রয়োজন আছে; তথাপি এ-কথা সত্য যে, পরিণামে সব ধর্মই এক। সর্বজনীন উদার ভাবের জন্য জগৎ তখনই মাত্র খ্রীষ্টান চার্চের সহযোগী হইতে ইচ্ছুক হইবে, যখন খ্রীষ্টধর্ম পরমতসহিষ্ণু হইবে। ঈশ্বর সকলের হৃদয়েই আছেন; যাঁহারা যীশুখ্রীষ্টের অনুসরণকারী, তাঁহাদের এই তত্ত্বটিকে স্বীকার করিতে সঙ্কোচ বোধ করা উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে যীশুখ্রীষ্ট প্রত্যেক সৎ মানবকে ঈশ্বরের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করিতে চাহিয়াছিলেন। যে-মানুষ স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা পালন করে, সে-ই সৎ, আর যে কেবল বাহ্য অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করে, সে সৎ নয়। সৎ হওয়া এবং সৎকর্ম করা—এই ভিত্তির উপরেই সমগ্র জগৎ মিলিতে পারে।

*************************************************************************************************************

ধর্মের মূলসূত্র

ধর্মের মূলসূত্র

[একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ, মিস ওয়াল্ডোর কাগজপত্রের মধ্যে প্রাপ্ত]

পৃথিবীর প্রাচীন বা আধুনিক, লুপ্ত বা জীবন্ত ধর্মগুলি এই চারি প্রকার বিভাগের মধ্য দিয়া ভালরূপে ধারণা করিতে পারিঃ

১. প্রতীক—মানুষের ধর্মভাব বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য বিবিধ বাহ্য সহায় অবলম্বন।
২. ইতিহাস—প্রত্যেক ধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব যেভাবে দিব্য বা মানবীয় আচার্যগণের জীবনে রূপায়িত হইয়াছে। পুরাণাদি ইহার অন্তর্গত, কারণ এক জাতি বা এক যুগের পক্ষে যাহা পুরাণ, অন্য জাতি বা যুগের নিকট তাহাই ইতিহাস। আচার্যগণের সম্বন্ধেও বলা যায়, তাঁহাদের জীবনের অনেকটাই পরবর্তীকালের মানুষেরা পৌরাণিক কাহিনী বলিয়া গ্রহণ করে।
৩. দর্শন—প্রত্যেক ধর্মের যুক্তিসিদ্ধ ভিত্তিসমূহ।
৪. অতীন্দ্রিয়বাদ—ইন্দ্রিয়জ্ঞান ও যুক্তি অপেক্ষা মহত্তর এমন কিছু, যাহা কোন কোন বিশেষ অবস্থায় কোন কোন বিশেষ ব্যক্তি বা সকল ব্যক্তি লাভ করিয়া থাকেন। ধর্মের অন্যান্য বিভাগেও এই অতীন্দ্রিয়বাদের কথা আছে।
পৃথিবীর প্রাচীন বা আধুনিক সকল ধর্মেই এই মূলনীতিগুলির একটি, দুইটি বা তিনটি বর্তমান দেখা যায়; অতি উন্নত ধর্মগুলিতে চারিটি তত্ত্বই আছে। অতি উন্নত ধর্মগুলির মধ্যে কতকগুলির আবার কোন ধর্মগ্রন্থ বা পুস্তক ছিল না, বা সেগুলি লুপ্ত হইয়াছে; কিন্তু যে-সকল ধর্ম পবিত্র গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলি আজও টিকিয়া আছে। সুতরাং পৃথিবীর আধুনিক সব ধর্মই পবিত্র গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিতঃ

বৈদিক ধর্ম (ভুল করিয়া বলা হয়, হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্ম) প্রতিষ্ঠিত বেদের উপর;
পারসীক ধর্ম আবেস্তার উপর;
মুশার ধর্ম ওল্ড টেষ্টামেণ্টের উপর;
বৌদ্ধধর্ম ত্রিপিটকের উপর;
খ্রীষ্টধর্ম নিউ টেষ্টামেণ্টের উপর;
ইসলাম কোরানের উপর।
চীনের তাও এবং কনফুসিয়াস-মতাবলম্বীদেরও ধর্মগ্রন্থ আছে, কিন্তু ঐগুলি বৌদ্ধধর্মের সহিত এমন নিবিড়ভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে, ঐগুলিকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত বলিয়া গণনা করা যায়।

আবার যদিও ঠিক ঠিক বলিতে গেলে সম্পূর্ণভাবে জাতিগত কোন ধর্ম নাই, তবু বলা যায়—ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে বৈদিক, য়াহুদী ও পারসীক ধর্মগুলি যে-সকল জাতির মধ্যে পূর্ব হইতে ছিল, সেই-সকল জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে; আর বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্ম প্রথমাবধি প্রচারশীল।

বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে জগৎজয়ের সংগ্রাম চলিবে, এবং জাতিগত ধর্মগুলিকেও অনিবার্যভাবে এই সংগ্রামে যোগ দিতে হইবে। এই জাতিগত বা প্রচারশীল ধর্মগুলির প্রত্যেকটি ইতোমধ্যেই নানা শাখায় বিভক্ত হইয়াছে এবং নিজেকে পরিবর্তনশীল অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইবার জন্য জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে। ইহা দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, ধর্মগুলির মধ্যে একটিও এককভাবে সমগ্র মানবজাতির ধর্ম হইবার উপযোগী নয়। যে-জাতি হইতে যে-ধর্ম উদ্ভূত হইয়াছে, সেই জাতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লইয়াই যেহেতু ঐ ধর্ম গঠিত হইয়াছে এবং ঐ ধর্মই আবার ঐ বৈশিষ্ট্যগুলির সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, অতএব ঐ-সকলের কোনটিই সমগ্র মানবজাতির উপযোগী হইতে পারে না। শুধু তাহাই নয়, উহাদের প্রত্যেক ধর্মে একটি নেতিবাচক ভাব আছে। প্রত্যেক ধর্ম মানব-প্রকৃতির একটি অংশের বিকাশ সাধনে অবশ্যই সাহায্য করে, কিন্তু যাহা কিছু তাহার ধর্মে নাই, সেগুলি দমন করিবার চেষ্টা করে। এইরূপ একটি ধর্ম যদি বিশ্বজনীন হয়, তাহা হইলে তাহা মানবজাতির বিপদ ও অবনতির সূচনা করিবে।

পৃথিবীর ইতিহাস পড়িলে দেখা যায়, সার্বভৌম রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী ধর্মরাজ্য-বিষয়ক স্বপ্ন-দুইটি মানবজাতির মনে বহুকাল যাবৎ ক্রিয়া করিতেছে, কিন্তু পৃথিবীর সামান্য একটি অংশ বিজিত হইবার পূর্বেই অধিকৃত রাজ্যগুলি শতধা ছিন্নভিন্ন হইয়া মহান্ দিগ্বীজয়ীদের পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ করিয়া দেয়, সেরূপ প্রত্যেক ধর্মই তাহার শৈশব অবস্থা উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়া পড়ে।

তথাপি ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় যে, সমাজ ও ধর্মের ক্ষেত্রে মানবজাতির ঐক্যসাধনই প্রকৃতির উদ্দেশ্য, যদিও সে ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা থাকিবে। সর্বাপেক্ষা স্বল্প বাধার পথে চলাই যদি কার্যসিদ্ধির যথাযথ উপায় হয়, তাহা হইলে আমার মনে হয়, প্রত্যেক ধর্ম যে এইভাবে বিভক্ত হইয়া সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, তাহা ধর্ম-সংরক্ষণেরই একটি উপায়, কারণ তাহার ফলে কঠিন একত্বের নিগড় চূর্ণ হয় এবং উহাতে আমরা যথার্থ পন্থার নির্দেশ পাই।

অতএব মনে হয়, উদ্দেশ্য—সম্প্রদায়গুলির ধ্বংস নয়, বরং উহাদের সংখ্যাবৃদ্ধি, যে পর্যন্ত না প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই একটি সম্প্রদায় হইয়া দাঁড়ায়। অন্যপক্ষে আবার সব ধর্ম মিলিত হইয়া একটি বিরাট দর্শনে পরিণত হইলেই ঐক্যের পটভূমিকা সৃষ্টি হয়। পৌরাণিক কাহিনী বা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম দ্বারা কখনও ঐক্য সাধিত হয় না, কারণ সূক্ষ্ম ব্যাপার অপেক্ষা স্থূল বিষয়েই আমাদের মতদ্বৈধ হয়। একই মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও মানুষ তাহার আদর্শস্থানীয় ধর্মগুরুর মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে।

সুতরাং এই মিলনের ফলে এমন একটি দার্শনিক ঐক্য আবিষ্কৃত হইবে, যাহা ঐক্যের ভিত্তি হইয়া দাঁড়াইবে, অথচ প্রত্যেকেই নিজ নিজ আচার্য বা সাধন-পদ্ধতি নির্বাচন করিবার স্বাধীনতা পাইবে। সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া এইরূপ মিলন স্বাভাবিকভাবে চলিয়া আসিতেছে; শুধু পারস্পরিক বিরুদ্ধাচরণ দ্বারা এই মিলন মাঝে মাঝে শোচনীয়ভাবে প্রতিহত হইয়াছে।

অতএব পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া প্রত্যেক জাতির আচার্যগণকে অন্য জাতির নিকট পাঠাইয়া সমগ্র মানবসমাজকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম শিক্ষা দেওয়া উচিত; ইহা দ্বারা বিভিন্ন জাতির মধ্যে পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের সহায়তা হইবে। কিন্তু খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতকে ভারতের মহামতি বৌদ্ধসম্রাট্ অশোক যেরূপ করিয়াছিলেন, আমরাও যেন সেইরূপ অন্যের নিন্দা হইতে বিরত হই, অপরের দোষানুসন্ধান না করিয়া তাহাকে সাহায্য করি এবং তাহার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়া তাহার জ্ঞানলাভের সহায় হই।

জড়বিজ্ঞানের বিপরীত অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে এক মহা সোরগোল পড়িয়া গিয়াছে। আমাদের ঐহিক জীবন ও এই পরিদৃশ্যমান জগৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়জ্ঞানের সীমার বহির্ভূত সকল ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অতি দ্রুত একটি ফ্যাশনে পরিণত হইতেছে, এমন কি ধর্মপ্রচারকেরাও একের পর এক এই ফ্যাশনের নিকট আত্মসমর্পণ করিতেছেন। অবশ্য চিন্তাহীন জনসাধারণ সর্বদা সুখাবহ ভাবরাশিই অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞান আশা করা যায়, তাঁহারা যখন নিজেদের দার্শনিক বলিয়া প্রচার করেন এবংঅর্থহীন ফ্যাশন অনুসরণ করেন, তখন উহা সত্যই শোচনীয়।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি যতক্ষণ স্বাভাবিক-শক্তিসম্পন্ন, ততক্ষণ তাহারা আমাদের সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য পথপ্রদর্শক এবং সেগুলি যে-সব তথ্য সংগ্রহ করিয়া দেয়, সে-সব যে মানবীয় জ্ঞানসৌধের ভিত্তি—এ-কথা কেহ অস্বীকার করে না। কিন্তু যদি কেহ মনে করে, মানুষের সমগ্র জ্ঞান শুধু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি—আর কিছু নয়, তবে আমরা ঐকথা অস্বীকার করিব। যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলিতে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানই বুঝায়—তার বেশী আর কিছু নয়, তবে আমরা বলিব, এরূপ বিজ্ঞান কোন দিন ছিল না, কোন দিন হইবেও না। উপরন্তু শুধু ইন্দ্রিয়জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন জ্ঞান কখনও বিজ্ঞান বলিয়া গৃহীত হইতে পারিবে না।
অবশ্য ইন্দ্রিয়গুলি জ্ঞানের উপাদান সংগ্রহ করে, এবং উহাদের সাদৃশ্য ও বৈষম্য অনুসন্ধান করে, কিন্তু ঐখানেই উহাদের থামিতে হয়।

প্রথমতঃ বাহিরের তথ্যসংগ্রহ-ব্যাপারও অন্তরের কতকগুলি ভাব এবং ধারণার উপর—যথা, দেশ ও কালের উপর—নির্ভর করে। দ্বিতীয়তঃ মানস পটভূমিকায় কিছুটা বিমূর্ত ভাব ব্যতীত তথ্যগুলির বর্গীকরণ বা সামান্যীকরণ অসম্ভব। সামান্যীকরণ যত উচ্চধরনের হইবে, বিমূর্ত পটভূমিকাও তত ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে থাকিবে। সেইখানেই অসংলগ্ন তথ্যগুলি সাজান হয়। এখন জড়বস্তু, শক্তি, মন, নিয়ম, কারণ, দেশ, কাল প্রভৃতি ভাবগুলি অতি উচ্চ বিমূর্তনের ফল; কেহই কোনদিন এগুলি ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করে নাই; অথবা বলা যায়, এগুলি একেবারে অতিপ্রাকৃতিক বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। অথচ এগুলি ছাড়া কোন প্রাকৃতিক তথ্য বোঝা যায় না। একটি গতিকে বোঝা যায়—একটি শক্তির সাহায্যে। কোন প্রকার ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি হয় জড়বস্তুর মাধ্যমে। বাহ্য পরিবর্তনগুলি বোঝা যায় প্রাকৃতিক নিয়মের ভিতর দিয়া, মানসিক পরিবর্তনগুলি ধরা পড়ে চিন্তায় বা মনে, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি শুধু কার্য-কারণের শৃঙ্খল দ্বারাই বোঝা যায়। অথচ কেহই কখনও জড় বা শক্তি, নিয়ম বা কারণ, দেশ বা কাল—কিছুই দেখে নাই, এমন কি কল্পনাও করে নাই।
তর্কচ্ছলে বলা যাইতে পারে—বিমূর্তভাবরূপে এগুলির অস্তিত্ব নাই, এগুলি বর্গ বা শ্রেণী হইতে পৃথক্ কিছু নয়, উহা হইতে এগুলি পৃথক্ করা যায় না। ইহাদিগকে কেবল গুণ বলা যাইতে পারে।
এই বিমূর্তন (abstraction) সম্ভব কিনা বা সামান্যীকৃত বর্গ ব্যতীত উহাদের আর কিছু অস্তিত্ব আছে কিনা—এই প্রশ্ন ছাড়াও ইহা স্পষ্ট যে, জড় বা শক্তির ধারণা, কাল বা দেশের ধারণা, নিমিত্ত নিয়ম বা মনের ধারণা—এগুলির প্রত্যেকটিই স্ব স্ব বর্গমধ্যে নিরপেক্ষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, এগুলিকে যখন শুধু এইভাবে—বিমূর্ত নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করা যায়, তখনই ইহারা ইন্দ্রিয়ানুভূতিলব্ধ তথ্যগুলির ব্যাখ্যারূপে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ এই ভাব ও ধারণাগুলি শুধু যে সত্য তাহা নয়, উহা ব্যতীত ইহাদের বিষয়ে দুইটি তথ্য পাওয়া যায়ঃ প্রথমতঃ এগুলি অতিপ্রাকৃতিক, দ্বিতীয়তঃ অতিপ্রাকৃতিকরূপেই এগুলি প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করে, অন্যরূপে নয়।

* * *

বাহ্যজগৎ অন্তর্জগতের অনুরূপ বা অন্তর্জগৎ বাহ্যজগতের অনুরূপ, জড়বস্তু মনেরই প্রতিকৃতি বা মন জড়জগতের প্রতিকৃতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা মনকে নিয়ন্ত্রিত করে অথবা মনই পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, ইহা অতি পুরাতন প্রাচীন প্রশ্ন, তবুও ইহা এখনও পূর্ববৎ নূতন ও সতেজ, ইহাদের কোন্‌টি পূর্বে বা কোন্‌টি পরে, কোন্‌টি কারণ ও কোন্‌টি কার্য—মনই জড়বস্তুর কারণ বা জড়বস্তুই মনের কারণ—এ-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করিলেও ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, বাহ্যজগৎ অন্তর্জগতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হইলেও উহা অন্তর্জগতের অনুরূপ হইতে বাধ্য, না হইলে উহাকে জানিবার আমাদের অন্য উপায় নাই। যদি ধরিয়াও লওয়া যায়, বাহ্যজগৎই আমাদের অন্তর্জগতের কারণ, তবুও বলিতে হইবে, এই বাহ্যজগৎ যাহাকে আমরা আমাদের মনের কারণ বলিতেছি, উহা আমাদের নিকট অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়, কেন-না আমাদের মন উহার ততটুকু বা সেই ভাবটুকুই জানিতে পারে, যাহা উহার সহিত উহার প্রতিবিম্বরূপে মেলে। প্রতিবিম্ব কখনও বস্তুটির কারণ হইতে পারে না। সুতরাং বাহ্যজগতের যে অংশটুকু—আমরা উহার সমগ্র হইতে যেন কাটিয়া লইয়া আমাদের মনের দ্বারা জানিতে পারিতেছি, তাহা কখনও আমাদের মনের কারণ হইতে পারে না, কারণ উহার অস্তিত্ব আমাদের মনের দ্বারাই সীমাবদ্ধ (মনের দ্বারাই উহাকে জানা যায়)।

এইজন্যই মনকে জড়বস্তু হইতে উৎপন্ন বলা যাইতে পারে না। উহা বলাও অসঙ্গত, কেন-না আমরা জানি যে, এই বিশ্ব-অস্তিত্বের যে অংশটুকুতে চিন্তা বা জীবনীশক্তি নাই ও যাহাতে বাহ্য অস্তিত্ব আছে, তাহাকেই আমরা জড়বস্তু বলি, এবং যেখানে এই বাহ্য অস্তিত্ব নাই এবং যাহাতে চিন্তা বা জীবনীশক্তি রহিয়াছে, তাহাকেই আমরা মন বলি। সুতরাং এখন যদি আমরা জড় হইতে মন বা মন হইতে জড় প্রমাণ করিতে যাই, তাহা হইলে যে-সকল গুণ দ্বারা উহাদিগকে পৃথক্ করা হইয়াছিল, তাহাই অস্বীকার করিতে হইবে। অতএব মন হইতে জড় বা জড় হইতে মন উৎপন্ন হইয়াছে, বলা শুধু কথার কথা মাত্র।

আমরা আরও দেখিতে পাই যে, এই বিতর্কটি মন ও জড়ের বিভিন্ন সংজ্ঞা-ব্যবহার-রূপ ভ্রান্তির উপর অনেকটা নির্ভর করিতেছে। আমরা মনকে কখনও-বা জড়ের বিপরীত ও জড় হইতে পৃথক্ বলিয়া বর্ণনা করিতেছি, আবার কখনও বলিতেছি মন ও জড় উভয়ই মনের অন্তর্গত, অর্থাৎ জড়জগতের দৃষ্টিতে অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ দুই-ই মনের অংশ-বিশেষ। জড়কেও সেরূপ কখনও-বা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য জগৎরূপে আবার কখনও বা বাহ্য বা আন্তর উভয় জগতের কারণরূপে বর্ণনা করা হইতেছে। জড়বাদিগণ ভাববাদিগণকে আতঙ্কিত করিয়া যখন বলেন, তাঁহারা তাঁহাদের পরীক্ষাগারের মূল তত্ত্বগুলি হইতে মন প্রস্তুত করিবেন, তখন তাঁহারা কিন্তু এমন এক বস্তুকে প্রকাশ করিতে চাহিতেছেন, যাহা তাঁহাদের সকল মূলতত্ত্বের ঊর্ধ্বে—বাহ্য ও অন্তর্জগৎ যাহা হইতে উৎপন্ন, যাহাকে তিনি জড় প্রকৃতিরূপে আখ্যা দিতেছেন। ভাববাদীও সেইরূপ যখন জড়বাদীর মূলতত্ত্বগুলি তাঁহারই চিন্তাতত্ত্ব হইতে উৎপন্ন বলিয়া মনে করেন, তখন কিন্তু তিনি এমন এক বস্তুর ইঙ্গিত পাইতেছেন, যাহা হইতে জড় ও চেতন উভয় বস্তুই উৎপন্ন হইতেছে; তাঁহাকেই তিনি বহু সময়ে ‘ঈশ্বর’ আখ্যাও দিতেছেন। ইহার অর্থ এই যে, একদল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অংশ মাত্র জানিয়া উহাকে ‘বাহ্য’ বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন এবং অন্যদল উহার অপর অংশ জানিয়া উহাকেই ‘আন্তর’ আখ্যা দিতেছেন। এই উভয় প্রয়াসই নিষ্ফল। মন বা জড় কোনটিই অপরটিকে ব্যাখ্যা করিতে পারে না। এমন আর একটি বস্তুর আবশ্যক, যাহা ইহাদের উভয়কেই ব্যাখ্যা করিতে পারে।
এইরূপ যুক্তি দেওয়া যাইতে পারে যে, চিন্তাও কখনও মন ব্যতীত থাকিতে পারে না। কারণ যদি এমন এক সময় কল্পনা করা যায়, যখন চিন্তার অস্তিত্ব ছিল না, তখন জড়—যেরূপে উহাকে আমরা জানি—কি করিয়া থাকিবে? অপর পক্ষে ইহা বলা যাইতে পারে যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয় এবং যখন ঐ অনুভূতি বাহ্যজগতের উপর নির্ভর করে, তখন আমাদের মনের অস্তিত্বও বাহ্যজগতের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করিতেছে।
ইহাও বলা যাইতে পারে না যে, ইহাদের (জড় ও মনের) একটি আরম্ভকাল (beginning) রহিয়াছে। সামান্যীকরণ ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয়। সামান্যীকরণও আবার কতকগুলি সদৃশ বস্তুর পূর্বাস্তিত্বের উপর নির্ভর করে। পূর্ব অনুভূতি ব্যতীত একটির সহিত আর একটির তুলনাও সম্ভব নয়। জ্ঞান সেইজন্য পূর্বজ্ঞানের অপেক্ষা করে, সেইজন্যই উহা চিন্তা ও জড়ের পূর্বাস্তিত্বের উপর নির্ভর করিতেছে, উহাদের আরম্ভকাল সেইজন্য সম্ভব নয়।
ইন্দ্রিয়জ্ঞান যাহার উপর নির্ভর করে, সেই সামান্যীকরণের পশ্চাতেও আবার এমন একটি বস্তু থাকা আবশ্যক, যাহার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংলগ্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি একত্র হইতে পারে, চিত্রাঙ্কনের জন্য যেমন চিত্রের পশ্চাতে একটি পটের একান্ত আবশ্যক, আমাদের বাহ্যানুভূতির জন্যও সেইরূপ একটি কিছুর একান্ত প্রয়োজন, যাহার উপর ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি একত্র হইতে পারে, যদি চিন্তা বা মনকে ঐ বস্তু বলা যায়, তবে উহার একত্রীকরণের জন্য আবার আর একটি বস্তুর প্রয়োজন হইবে। মন একটি অনুভূতির প্রবাহ ব্যতীত অন্য কিছু নয়, সুতরাং উহাদের একত্রীকরণের জন্য ঐরূপ একটি পটভূমিকার একান্ত প্রয়োজন হইবে। এই পটভূমিকা পাইলেই আমাদের সকল বিশ্লেষণ থামিয়া যায়। এই অবিভাজ্য একত্বে না পৌঁছান পর্যন্ত আমরা থামিতে পারি না। ঐ একত্বই আমাদের জড় ও চিন্তার একমাত্র-পটভূমি।

* * *

যৌগিক পদার্থের বিশ্লেষণ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কোন অখণ্ড অদ্বিতীয় সত্তা পাওয়া যায়। যে সত্তা আমাদের নিকট ‘জড়বস্তু’ ও ‘চিন্তা’ এই উভয়ের এই প্রকার একত্ব উপস্থাপিত করে উহাই সেই সঠিক অখণ্ড ভিত্তি, যাহার উপর নিখিল প্রপঞ্চও অধিষ্ঠিত; কারণ ইহার পরে আমরা আর কোন বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করিতে পারি না। অধিকন্তু ইহার অধিক বিশ্লেষণের আর প্রয়োজনও থাকে না, কারণ বাহ্য ও আন্তর প্রত্যক্ষের সকল প্রকার বিশ্লেষণ ইহারই অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়।

এ পর্যন্ত আমরা এইটুকু দেখিতে পাইলাম যে, ‘মন’ ও জড়প্রপঞ্চ এবং তাহাদেরও ঊর্ধ্বে সেই অদ্বিতীয় বস্তু, যাহার উপর এই দুই-ই আপন আপন ক্রিয়া করিয়া যাইতেছে—এই সমস্তই আমাদের অনুসন্ধানের অন্তর্ভুক্ত।

এই যে ঊর্ধ্বে অবস্থিত বস্তুটি, ইহা ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষের বিষয় হয় না; যুক্তির অবর্জনীয় অঙ্গরূপে ইহা আসিয়া পড়ে, এবং এক ভাষাতীত অনুভব-স্বরূপে ইহা আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিকট উপস্থিত হয়। আমরা ইহাও দেখিতে পাই যে, যুক্তির সততা রক্ষা করিতে হইলে এবং আমাদের সামান্যীকরণের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসরণ করিতে হইলে আমরা বাধ্য হইয়াই এই অনির্বচনীয় বস্তুতে উপনীত হই।
এমন যুক্তিও উঠিতে পারে যে, মানসিক ও জড়-প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের ঊর্ধ্বে অপর কোন সারবস্তু বা চেতন সত্তা আছে। ইহা মানিয়া লইবার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা জানিতে পারি বা জানি শুধু এই নিখিল প্রপঞ্চকে; এবং এই প্রপঞ্চের ব্যাখ্যার জন্য প্রপঞ্চাতীত কোন অপর বস্তুর প্রয়োজন হয় না। বিশ্লেষণের ধারা ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে না। পরন্তু সর্ব বস্তুর সমন্বয়-ক্ষেত্ররূপে কোন সারবস্তু আছে, এইরূপ যে বোধ হইয়া থাকে, ইহা মানসিক ভ্রান্তি মাত্র।
আমরা দেখিতে পাই, অতি পুরাকাল হইতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে দুইটি শ্রেণী বিরাজমান। এক পক্ষের মতে মানুষের মনে বস্তু সম্বন্ধে প্রত্যয় রচনা করিবার এবং বস্তুনিরপেক্ষ সূক্ষ্ম ধারণায় উপস্থিত হইবার যে অনিবার্য প্রয়োজন রহিয়াছে, উহাই জ্ঞানার্জনের স্বাভাবিক পথ-নির্দেশক, এবং যতক্ষণ না আমরা সমস্ত প্রপঞ্চকে অতিক্রম করিয়া এমন এক বিশুদ্ধ প্রত্যয়ে উপস্থিত হইতেছি, যাহা সর্বপ্রকারে স্বতন্ত্র এবং দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত, ততক্ষণ পর্যন্ত ইহার বিরাম নাই। এক্ষণে যদি আমরা স্থূল হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে উহাকে সূক্ষ্ম এবং সূক্ষ্মতরে বিলীন করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া চলি, যতক্ষণ না এমন কিছুতে উপনীত হই যেখানে অপর সব কিছুর সমাধান পাই, এবং এই প্রণালী অবলম্বনে চিন্তা ও পদার্থের দ্বারা বিরচিত নিখিল প্রপঞ্চের বিশ্লেষণপূর্বক পূর্বোক্ত চরম ধারণায় উপস্থিত হই, তবে ইহা স্বতই প্রতিভাত হইবে যে, এই চরম ফল ব্যতীত যাহা কিছু আছে, সে সবই ইহার বিবিধ বিকাশমাত্র। কাজেই এই চরম ফলটিই একমাত্র সত্য বস্তু; অপর যাহা কিছু আছে, তাহা উহার ছায়ামাত্র। অতএব ইন্দ্রিয়ের গণ্ডীর মধ্যে সত্য নাই; সত্য উহার অতীত।
অপর দিকে অপর পক্ষ বলেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের নিকট যাহা উপস্থিত করে, জগতে কেবলমাত্র তাহাই সত্য এবং যদিও ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতির সহিত তাহারও ঊর্ধ্বে অবস্থিত কোন একটা বস্তুর আভাস অনুস্যূত রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়, তথাপি উহা মনের ছলনামাত্র, এবং তাই উহা মিথ্যা।
অপরিবর্তনীয় কোন কিছুর ধারণা না থাকিলে পরিবর্তনশীল কোন কিছুর ধারণা হয় না। এখন যদি বলা হয় যে, যে অপরিবর্তনীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল বস্তুটিকে দেখা হয়, তাহাও একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিবর্তনশীল ঘটনামাত্র এবং উহার অপরিবর্তনীয়তা শুধু আপেক্ষিক এবং এইজন্য উহাকে বুঝিতে হইলে উহাকেও আর একটা কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে দেখিতে হইবে, এবং পর পর এইরূপই চলিতে থাকিবে, তাহা হইলে আমরা বলি, এই শৃঙ্খলা-পরম্পরাকে অনন্ত ধারায় যত দীর্ঘই করা হউক না কেন, পরিশেষে দেখা যাইবে, আমরা যেহেতু অপরিবর্তনীয়ের সহিত সম্বন্ধ ব্যতীত পরিবর্তনশীল বস্তুর ধারণা করিতে পারি না, অতএব বাধ্য হইয়াই আমাদিগকে এমন একটি সত্তার অস্তিত্ব মানিয়া লইতে হইতেছে, যাহা সকল পরিবর্তনশীল বস্তুর পশ্চাতে রহিয়াছে। বিভিন্ন অংশের মিলনে যাহা প্রস্তুত হয়, তাহার একাংশ গ্রহণ করিবার এবং অপরাংশ পরিত্যাগ করিবার অধিকার কাহারও নাই। কেহ যদি মুদ্রার প্রধান-নামাঙ্কিত দিকটি গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে উহার উল্টা দিকটাও গ্রহণ করিতে হয়, তা যতই তিনি উহা অপছন্দ করুন না কেন।
অধিকন্তু মানুষের প্রত্যেক ক্রিয়ার সঙ্গে ইহাই বিঘোষিত হয় যে, সে স্বাধীন। সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী হইতে সর্বাপেক্ষা অশিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত সকলেই জানে, সে স্বাধীন। অথচ প্রত্যেক মানুষ সেই সঙ্গে সামান্য চিন্তা করিলেই দেখিতে পায় যে, তাহার প্রতিটি কর্মের পশ্চাতে কতকগুলি অভিপ্রায় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা রহিয়াছে। এবং সেই অবস্থা ও অভিপ্রায়গুলি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ পর্যন্ত জাগতিক যে-কোন ঘটনাকে যেভাবে কার্য-কারণের নিয়মানুসারে নির্ণয় করা চলে, যে-কোন মানুষের জীবনের যে-কোন ঘটনাকেও তেমনি ঐ অভিপ্রায় ও অবস্থাগুলি হইতেই কার্য-কারণের সুনিশ্চিত ধারা অবলম্বনে নির্ণয় করা চলে।
এখানে আবার ঠিক পূর্বের অসুবিধারই সৃষ্টি হইতেছে। মানুষের ইচ্ছা একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষের বৃদ্ধি কিংবা একটি প্রস্তরখণ্ডের পতনের মতই কার্যকারণের কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ, এবং তথাপি এই-সকল বন্ধনের মধ্যেও মুক্তির অবিনশ্বর ধারণা অনুস্যূত রহিয়াছে। এস্থলেও যাঁহারা সম্পূর্ণ ঘটনার দিকে দৃষ্টি রাখেন, তাঁহারা ঘোষণা করিবেন যে, মুক্তির ধারণা ভ্রান্তিমাত্র, কারণ মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজনের দ্বারা পরিচালিত হয়।
এক্ষণে একদিকে ভ্রান্তি বলিয়া মুক্তিকে উড়াইয়া দিলে কোন ব্যাখ্যাই হইল না। অপরদিকে এরূপও তো বলা যাইতে পারে যে, প্রয়োজনের ধারণা বা বন্ধন বা কার্য-কারণ-সম্বন্ধের ধারণা অজ্ঞানপ্রসূত ভ্রান্তি। কোন মতবাদ যখন ঘটনাগুলিকে ব্যাখ্যা করিতে অগ্রসর হয়, তখন সে ঘটনাগুলির কোন-একটি ঐ মতবাদের অনুরূপ হইতেছে না দেখিয়া যদি ঐগুলিকে বাদ দিয়া বাকীগুলির সহিত নিজের সামঞ্জস্য স্থাপন করে, তবে সে মতটি গোড়াতেই ভ্রমাত্মক। এইটুকু পথ উন্মুক্ত রহিল যে আমাদিগকে প্রথমতঃ স্বীকার করিতে হইবে শরীর মুক্ত নহে, ইচ্ছাও মুক্ত নহে। কিন্তু শরীর মনের ঊর্ধ্বে এমন কিছু রহিয়াছে যাহা এবং

(অসমাপ্ত)

Post a Comment

0 Comments