দেববাণী ~ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
চতুর্থ খণ্ড

দেববাণী

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা


*************************************************************************************************************

পটভূমিকা


[ইংরেজী Inspired Talks গ্রন্থারম্ভের পূর্বে মিস ওয়াল্ডো-লিখিত মূল্যবান্ ভূমিকাটির ইংরেজী শিরোনামা ‘Introductory Narrative’—দেববাণী পুস্তকে ইহার বাঙলা অনুবাদ ‘আমেরিকায় স্বামীজী’, উক্ত প্রবন্ধের প্রথমাংশে স্বামীজীর আমেরিকায় পদার্পণ কাল হইতে চিকাগো ধর্ম-মহাসভা, এবং তারপর পূর্ব উপকূলে বিভিন্ন স্থানে প্রচারকার্যের কথা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ। শেষাংশ ‘দেববাণী’র পটভূমিকারূপে এখানে প্রদত্ত হইল।]

অবশেষে স্বামীজী অনুভব করিলেন, স্বীয় আচার্য শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের সকল ধর্মের সত্যতা ও মৌলিক একত্ব-প্রতিপাদক উপদেশবাণী পাশ্চাত্য জগতের নিকট প্রচার করা-রূপ নিজ অভীপ্সিত মহাকার্যে তিনি বেশ কিছুটা অগ্রসর হইয়াছেন। ক্লাসটি এত শীঘ্র বাড়িয়া উঠিল যে, আর উপরের ছোট ঘরটিতে স্থান হয় না, সুতরাং নীচেকার বড় বৈঠকখানা-দুটি ভাড়া লওয়া হইল। এইখানেই স্বামীজী সেই ঋতুটির শেষ পর্যন্ত শিক্ষা দিতে লাগিলেন। এই শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে বিনা বেতনে প্রদত্ত হইত; প্রয়োজনীয় ব্যয়, স্বেচ্ছায় যিনি যাহা দান করিতেন, তাহাতেই চালাইবার চেষ্টা করা হইত। কিন্তু সংগৃহীত অর্থ—ঘরভাড়া ও স্বামীজীর আহারাদি-ব্যয়ের পক্ষে যথেষ্ট না হওয়ায় অর্থাভাবে ক্লাসটি উঠিয়া যাইবার উপক্রম হইল। অমনি স্বামীজী ঘোষণা করিলেন যে, ঐহিক বিষয়ে তিনি সাধারণের সমক্ষে কতকগুলি নিয়মিত বক্তৃতা দিবেন। সেগুলির জন্য পারিশ্রমিক লইতে তাঁহার বাধা ছিল না, সেই অর্থে তিনি ধর্মসম্বন্ধীয় ক্লাসটি চালাইতে লাগিলেন। তিনি বুঝাইয়া দিলেন যে, হিন্দুদের চক্ষে শুধু বিনামূল্যে শিক্ষা দিলেই ধর্মব্যাখ্যার কর্তব্য শেষ হইল না, সম্ভবপর হইলে তাঁহাকে এই কার্যের ব্যয়ভারও বহন করিতে হইবে। পূর্বকালে ভারতে এমনও নিয়ম ছিল যে, উপদেষ্টা শিষ্যগণের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করিবেন।

ইতোমধ্যে কতিপয় ছাত্র স্বামীজীর উপদেশে এতদূর মুগ্ধ হইয়া পড়িয়া-ছিলেন যে, যাহাতে তাঁহারা পরবর্তী গ্রীষ্ম ঋতুতেও ঐ শিক্ষালাভ করিতে পারেন, সেজন্য সমুৎসুক হইলেন। কিন্তু তিনি একটি ঋতুর কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং পুনরায় গ্রীষ্মের সময় ঐরূপ পরিশ্রম করা সম্বন্ধে প্রথমে আপত্তি করিয়াছিলেন। তারপর অনেক ছাত্র বৎসরের ঐ সময়ে শহরে থাকিবেন না। কিন্তু প্রশ্নটির আপনা-আপনি মীমাংসা হইয়া গেল। আমাদের মধ্যে একজনের সেণ্ট লরেন্স নদীবক্ষস্থ বৃহত্তম দ্বীপ ‘সহস্র-দ্বীপোদ্যানে’(Thousand Island Park) একখানি ছোট বাড়ী ছিল; তিনি উহা স্বামীজী এবং আমাদের মধ্যে যত জনের উহাতে স্থান হয়, তত জনের ব্যবহারের জন্য ছাড়িয়া দিবার প্রস্তাব করিলেন। এই ব্যবস্থা স্বামীজীর মনঃপূত হইল; তিনি তাঁহার জনৈক বন্ধুর ‘মেইন ক্যাম্প’(Maine Camp) নামক ভবন হইতে প্রত্যাগত হইয়াই আমাদের নিকট সেখানে আসিবেন বলিয়া স্বীকৃত হইলেন।

যে ছাত্রীটি বাড়ীখানির অধিকারিণী ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল মিস্ ডাচার। তিনি বুঝিলেন যে, এই উপলক্ষ্যে একটি পৃথক্ কক্ষ নির্মাণ করা আবশ্যক—যেখানে কেবল পবিত্র ভাবই বিরাজ করিবে, এবং তাঁহার গুরুর প্রতি প্রকৃত ভক্তি-অর্ঘ্য-হিসাবে আসল বাড়ীখানি যত বড়, প্রায় তত বড়ই একটি নূতন পার্শ্ব সংযোজন করিয়া দিলেন। বাড়ীটি এক উচ্চভূমির উপর অতি সুন্দর স্থানে অবস্থিত ছিল; সুরম্য নদীটি অনেকখানি এবং উহার বহুদূরবিস্তৃত সহস্রদ্বীপের অনেকগুলি তথা হইতে দৃষ্টিগোচর হইত। দূরে ক্লেটন অল্প অল্প দেখা যাইত, আর অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী বিস্তৃত ক্যানাডা উপকূলে উত্তরে দৃষ্টি অবরোধ করিত। বাড়ীখানি একটি পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত ছিল; পাহাড়টির উত্তর ও পশ্চিম দিক্‌ হঠাৎ ঢালু হইয়া নদীতীর ও উহারই যে ক্ষুদ্র অংশটি ভিতরের দিকে ঢুকিয়া আসিয়াছে, তাহার তীর পর্যন্ত গিয়াছে শেষোক্ত জলভাগটি একটি ক্ষুদ্র হ্রদের ন্যায় বাড়ীখানির পশ্চাতে রহিয়াছে। বাড়ীখানি সত্য সত্যই (বাইবেলের ভাষায়) ‘একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত’, আর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথর উহার চারিদিকে পড়িয়াছিল। নবনির্মিত সংযোজনটি পাহাড়ের খুব ঢালু অংশে দণ্ডায়মান থাকায় যেন একটি বিরাট আলোকস্তম্ভের মত দেখাইত। বাড়ীটির তিন দিকে জানালা ছিল এবং উহা পিছনের দিকে ত্রিতল ও সামনের দিকে দ্বিতল ছিল। নীচের ঘরটিতে ছাত্রগণের মধ্যে একজন থাকিতেন; তাহার উপরকার ঘরটিতে বাড়ীখানির প্রধান অংশ হইতে অনেকগুলি দ্বার দিয়া যাওয়া যাইত, এবং প্রশস্ত ও সুবিধাজনক হওয়ায় উহাতেই আমাদের ক্লাসের অধিবেশন হইত, এবং সেখানেই স্বামীজী অনেক ঘণ্টা ধরিয়া আমাদিগের সুপরিচিত বন্ধুর মত উপদেশ দিতেন। এই ঘরের উপরের ঘরটি শুধু স্বামীজীরই ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। যাহাতে উহা সম্পূর্ণরূপে নিরুপদ্রব হইতে পারে, সেজন্য মিস্ ডাচার বাহিরের দিকে একটি পৃথক্ সিঁড়ি করাইয়া দিয়াছিলেন। অবশ্য উহাতে দোতলার বারান্দায় আসিবার একটি দরজাও ছিল।

এই উপরতলার বারান্দাটি আমাদের জীবনের সহিত অতি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল; কারণ স্বামীজীর সকল সান্ধ্য কথোপকথন এই স্থানেই হইত। বারান্দাটি প্রশস্ত থাকায় উহাতে কতকটা জায়গা ছিল। উহার উপরে ছাদ দেওয়া ছিল, এবং উহা বাড়ীখানির দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশে বিস্তৃত ছিল। মিস্ ডাচার উহার পশ্চিমাংশটি একটি পর্দা দিয়া সযত্নে পৃথক্ করিয়া দিয়াছিলেন, সুতরাং যে-সকল অপরিচিত ব্যক্তি এই বারান্দা হইতে তত্রত্য অপূর্ব দৃশ্যটি দেখিবার জন্য সেখানে প্রায় আগমন করিতেন, তাঁহারা আমাদের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতে পারিতেন না।

এইখানেই আমাদের অবস্থান-কালের প্রতি সন্ধ্যায় আচার্যদেব তাঁহার দ্বারের সমীপে বসিয়া আমাদের সহিত কথাবার্তা বলিতেন। আমরাও সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে নির্বাক হইয়া বসিয়া তাঁহার অপূর্ব জ্ঞানগর্ভ বচনামৃত সাগ্রহে পান করিতাম। স্থানটি যেন সত্য সত্যই একটি পুণ্যনিকেতন ছিল। পাদনিম্নে হরিৎপত্রবিশিষ্ট বৃক্ষশীর্ষগুলি হরিৎসমুদ্রের মত আন্দোলিত হইত, কারণ সমগ্র স্থানটি ঘন অরণ্যে পরিবৃত ছিল। সুবৃহৎ গ্রামটির একখানি বাড়িও সেখান হইতে দৃষ্টিগোচর হইত না, আমরা যেন লোকালয় হইতে বহু যোজন দূরে কোন নিবিড় অরণ্যানী-মধ্যে বাস করিতাম। বৃক্ষশ্রেণী হইতে দূরে বিস্তৃত সেণ্ট লরেন্স নদী; উহার বক্ষে মাঝে মাঝে দ্বীপসমূহ; উহাদের মধ্যে কতকগুলি আবার হোটেল ও ভোজনালয়ের উজ্জ্বল আলোকে ঝিকমিক করিত। এগুলি এত দূরে ছিল যে, উহারা সত্য অপেক্ষা চিত্রিত দৃশ্য বলিয়াই মনে হইত। আমাদের এই নির্জন স্থানে জনকোলাহলও কিছুমাত্র প্রবেশ করিত না। আমরা শুধু কীটপতঙ্গাদির অস্ফুট রব, পক্ষিকুলের মধুর কাকলি, অথবা পাতার মধ্য দিয়া সঞ্চরমাণ বায়ুর মৃদু মর্মরধ্বনি শুনিতে পাইতাম। দৃশ্যটির কিয়দংশ স্নিগ্ধ চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত থাকিত, এবং নিম্নের স্থির জলরাশিবক্ষে দর্পণের ন্যায় চন্দ্রের মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হইত। এই অপূর্ব মায়া-রাজ্যে আমরা আচার্যদেবের সহিত সাতটি সপ্তাহ দিব্যানন্দে তাঁহার অতীন্দ্রিয় রাজ্যের বার্তাসমন্বিত অপূর্ব রচনাবলী শ্রবণ করিতে করিতে অতিবাহিত করিয়াছিলাম—তখন আমরা জগৎকে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, জগৎও আমাদিগকে ভুলিয়া গিয়াছিল। এই সময়ে প্রতিদিন সান্ধ্য-ভোজন-সমাপনান্তে আমরা সকলে উপরকার বারান্দায় গিয়া আচার্যদেবের আগমন প্রতীক্ষা করিতাম। অধিকক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইত না, কারণ আমরা সমবেত হইতে না হইতেই তাঁহার গৃহদ্বার উন্মুক্ত হইত এবং তিনি ধীরে ধীরে বাহিরে আসিয়া তাঁহার অভ্যস্ত আসন গ্রহণ করিতেন। তিনি আমাদিগের সহিত প্রত্যহ দুই ঘণ্টা এবং অনেক সময়েই তদধিক কাল যাপন করিতেন। এক অপূর্বসৌন্দর্যময়ী রজনীতে (সে দিন নিশানাথ প্রায় পূর্ণাবয়ব ছিলেন) কথা কহিতে কহিতে চন্দ্র অস্ত গেল; আমরাও যেমন কালক্ষেপের বিষয়ই কিছুই জানিতে পারি নাই, স্বামীজীও মনে হয় ঠিক তেমনি কিছুই জানিতে পারেন নাই।

এই-সকল কথোপকথন লিপিবদ্ধ করিয়া লওয়া সম্ভব হয় নাই; ঐগুলি শুধু শ্রোতৃবৃন্দের হৃদয়েই গ্রথিত হইয়া আছে। এই দিব্য অবসরে আমরা যে উচ্চাঙ্গের গভীর ধর্মানুভূতি লাভ করিতাম, তাহা আমাদের কেহই ভুলিতে পারিবে না। স্বামীজী ঐ সময়ে তাঁহার হৃদয়ের দুয়ার খুলিয়া দিতেন। ধর্মলাভ করিবার জন্য তাঁহাকে যে-সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া যাইতে হইয়াছিল, সেগুলি যেন পুনরায় আমাদের দৃষ্টিগোচর হইত। তাঁহার গুরুদেবই যেন সূক্ষ্মশরীরে তাঁহার মুখাবলম্বনে আমাদের নিকট কথা কহিতেন, আমাদের সকল সন্দেহ মিটাইয়া দিতেন, সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং সমুদয় ভয় দূর করিতেন। অনেক সময় স্বামীজী যেন আমাদের উপস্থিতিই ভুলিয়া যাইতেন—তখন আমরা পাছে তাঁহার চিন্তাপ্রবাহে বাধা দিয়া ফেলি এই ভয়ে যেন শ্বাস রুদ্ধ করিয়া থাকিতাম। তিনি আসন হইতে উঠিয়া বারান্দাটির সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে পায়চারি করিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে অনর্গল কথা বলিয়া যাইতেন। এই সময়ে তিনি যেরূপ কোমলপ্রকৃতি ছিলেন এবং সকলের ভালবাসা আকর্ষণ করিতেন, তেমন আর কখনও দেখা যায় নাই; তাঁহার গুরুদেব যেরূপে তাঁহার শিষ্যবর্গকে শিক্ষা দিতেন, ইহা হয়তো অনেকটা সেইরূপ ব্যাপার—তিনি নিজেই নিজ আত্মার সহিত ভাবমুখে কথা কহিয়া যাইতেন, আর শিষ্যগণ শুধু শুনিয়া যাইতেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় একজন লোকের সহিত বাস করাই অবিশ্রান্ত উচ্চ উচ্চ অনুভূতি লাভ করা। প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত সেই একই ভাব—আমরা এক ঘনীভূত ধর্মভাবের রাজ্যে বাস করিতাম। স্বামীজী মধ্যে মধ্যে বালকের ন্যায় ক্রীড়াশীল ও কৌতুকপ্রিয় হইলেও এবং সোল্লাসে পরিহাস করিতে ও কথার ক্ষিপ্র ও সরস প্রত্যুত্তর দিতে অভ্যস্ত থাকিলেও কখনও মুহূর্তের জন্য জীবনের মূলসুর হইতে বেশীদূরে যাইতেন না। প্রতি জিনিষটি হইতেই তিনি কিছু না কিছু বলিবার অথবা উদাহরণ দিবার বিষয় পাইতেন, এবং এক মুহূর্তে তিনি আমাদিগকে কৌতুকজনক হিন্দু পৌরাণিক গল্প হইতে একেবারে গভীর দর্শনের মধ্যে লইয়া যাইতেন। স্বামীজী পৌরাণিক গল্পসমূহের অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিলেন, আর প্রকৃতপক্ষে এই প্রাচীন আর্যগণের মত আর কোন জাতির মধ্যেই এত অধিক পরিমাণে পৌরাণিক গল্পের প্রচলন নাই। তিনি ঐ-সকল গল্প শুনাইয়া প্রীতি অনুভব করিতেন এবং আমরাও ঐগুলি শুনিতে ভালবাসিতাম, কারণ তিনি কখনও এই-সকল গল্পের অন্তরালে যে সত্য নিহিত আছে, তাহা দেখাইয়া দিতে এবং উহা হইতে মূল্যবান্ ধর্মবিষয়ক উপদেশ আবিষ্কার করিয়া দিতে বিস্মৃত হইতেন না। আর কোন ভাগ্যবান্ ছাত্রমণ্ডলী এরূপ প্রতিভাবান্ আচার্য-লাভে নিজদিগকে ধন্য জ্ঞান করিবার এমন সুযোগ পাইয়াছেন কিনা সন্দেহ।

আশ্চর্য, ঠিক দ্বাদশ জন ছাত্রী ও ছাত্র ‘সহস্রদ্বীপোদ্যান’-এ স্বামীজীর অনুগমন করিয়াছিলেন এবং তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি আমাদিগকে প্রকৃত শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছেন; এবং সেজন্যই তিনি আমাদিগকে এরূপ দিবারূপ প্রাণ খুলিয়া তাঁহার নিকট যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ বস্তু ছিল, তাহাই শিক্ষা দিতেন। এই বারো জনের সকলেই এক-সময়ে একত্র হয় নাই, ঊর্ধ্বসংখ্যায় দশ জনের অধিক কোন সময়ে উপস্থিত ছিলেন না। আমাদের মধ্যে দুইজন পরে ‘সহস্রদ্বীপোদ্যা’ এই সন্ন্যাসদীক্ষা গ্রহণ করিয়া সন্ন্যাসী হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তির সন্ন্যাসের সময় স্বামীজী আমাদের পাঁচজনকে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করিয়াছিলেন এবং অবশিষ্ট কয়জন পরে নিউ ইয়র্ক নগরে স্বামীজীর তত্রত্য অপর কয়েকজন শিষ্যের সহিত একসঙ্গে দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

‘সহস্যদ্বীপোদ্যান’-এ গমনকালে স্থিরীকৃত হইয়াছিল যে, আমরা পরস্পর মিলিয়া মিশিয়া একযোগে বাস করিব; প্রত্যেকেই গৃহকর্মের নিজ নিজ অংশ সম্পন্ন করিবেন, তাহাতে কোন বাজে লোকের সংস্পর্শে আমাদের গৃহের শান্তিভঙ্গ হইতে পারিবে না। স্বামীজী একজন পাকা রাঁধুনী ছিলেন, এবং আমাদের জন্য প্রায়ই উপাদেয় ব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করিতেন। তাঁহার গুরুদেবের দেহান্তের পরে যখন তিনি তাঁহার গুরুভ্রাতৃগণের সেবা করিতেন, সেই সময় তিনি রন্ধনকার্য শিখিয়াছিলেন। এই যুবকগণ সংঘবদ্ধ হইয়া যাহাতে শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রচারিত সত্যসমূহ সমগ্র জগতে ছড়াইয়া দিবার উপযুক্ত অধিকারী হইতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহার গুরুদেব কর্তৃক আরব্ধ শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার ভার তাঁহারই উপর পড়িয়াছিল।

প্রতিদিন প্রাতঃকালে আমাদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কার্যগুলি শেষ হইবামাত্র (অনেক সময় তাহার পূর্বে) স্বামীজী আমাদিগকে—যে বৃহৎ বৈঠকখানাটিতে আমাদের ক্লাসের অধিবেশন হইত, সেখানে সমবেত করিয়া শিক্ষাদান আরম্ভ করিতেন। প্রতিদিন তিনি কোন একটি বিশেষ বিষয় নির্বাচন করিয়া লইয়া তৎসম্বন্ধে উপদেশ দিতেন, অথবা শ্রীমদ্ভগবদগীতা, উপনিষৎ বা ব্যাসকৃত বেদান্তসূত্র প্রভৃতি কোন ধর্মগ্রন্থ লইয়া তাহার ব্যাখ্যা করিতেন। বেদান্তসূত্রে বেদান্তের অন্তর্গত মহাসত্যগুলি যতদূর সম্ভব স্বল্পাক্ষরে নিবদ্ধ আছে। তাহাদের কর্তা ক্রিয়া কিছুই নাই এবং সূত্রকারগণ প্রত্যেক অনাবশ্যক পদ পরিহার করিতে এত আগ্রহান্বিত থাকিতেন যে, হিন্দুগণের মধ্যে একটি প্রবাদ আছে—সূত্রকার বরং তাঁহার একটি পুত্রকে পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, কিন্তু তাঁহার সূত্রে একটি অতিরিক্ত অক্ষরও বসাইতে প্রস্তুত নন।

অত্যন্ত স্বল্পাক্ষর—প্রায় হেঁয়ালির মত বলিয়া বেদান্তসূত্রগুলিতে ভাষ্যকারগণের মাথা খাটাইবার যথেষ্ট অবকাশ আছে, এবং শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব, এই তিনজন হিন্দু মহাদার্শনিক উহাদের উপর বিস্তৃত ভাষ্য লিখিয়াছেন। প্রাতঃকালের কথোপকথনগুলিতে স্বামীজী প্রথমে এই ভাষ্যগুলির কোন একটি লইয়া, তারপর আর একটি ভাষ্য এইরূপ করিয়া ব্যাখ্যা করিতেন এবং দেখাইতেন—কিরূপে প্রত্যেক ভাষ্যকার তাঁহার নিজ মতানুযায়ী সূত্রগুলির বিকৃতার্থ করার অপরাধে অপরাধী, এবং যাহা তাঁহার নিজ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করিবে, নিঃসঙ্কোচে সেইরূপ অর্থই সেই সূত্রের মধ্যে ঢুকাইয়া দিয়াছেন! জোর করিয়া মূলের বিকৃতার্থ করা-রূপ কদভ্যাস কত পুরাতন, তাহা স্বামীজী আমাদিগকে প্রায়ই দেখাইয়া দিতেন।

কাজেই এই কথোপকথনগুলিতে কোনদিন মধ্ববর্ণিত শুদ্ধাদ্বৈতবাদ, আবার কোন দিন বা রামানুজ-প্রচারিত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ব্যাখ্যাত হইত। তবে শঙ্করের ব্যাখ্যায় অত্যন্ত চুলাচেরা বিচার আছে বলিয়া উহা সহজবোধ্য ছিল না, সুতরাং শেষ পর্যন্ত রামানুজই ছাত্রগণের মনের মত ব্যাখ্যাকার রহিয়া যাইতেন।

কখনও কখনও স্বামীজী ‘নারদীয় ভক্তিসূত্র’ লইয়া ব্যাখ্যা করিতেন। এই সূত্রগুলিতে ঈশ্বরভক্তির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে, এবং উহা পাঠ করিলে কথঞ্চিৎ ধারণা হয়—হিন্দুদের প্রকৃত সর্বগ্রাসী আদর্শ ঈশ্বরপ্রেম কিরূপ! সে-প্রেম সত্য সত্যই সাধকের মন হইতে অপর সমুদয় চিন্তা দূর করিয়া তাহাকে ভূতে-পাওয়ার মত পাইয়া বসে! হিন্দুগণের মতে ভক্তি ঈশ্বরের সহিত তাদাত্ম্যভাব লাভ করিবার একটি প্রকৃষ্ট উপায়, এ উপায় ভক্তগণের স্বভাবতই ভাল লাগে। ঈশ্বরকে—কেবল তাঁহাকেই ভালবাসার নাম ভক্তি।

এই কথোপকথনগুলিতেই স্বামীজী সর্বপ্রথম আমাদিগের নিকট তাঁহার মহান্ আচার্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা সর্ববিস্তারে বর্ণনা করেন—কিরূপে স্বামীজী দিনের পর দিন তাঁহার সহিত কাল কাটাইতেন এবং কিরূপে তাঁহাকে নিজ নাস্তিক মতের দিকে ঝোঁক দমন করিবার জন্য কঠোর চেষ্টা করিতে হইত এবং উহা যে সময়ে সময়ে তাঁহার গুরুদেবকে সন্তাপিত করিয়া তাঁহাকে কাঁদাইয়াও ফেলিত—এই সকল কথা বলিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অপর শিষ্যগণ প্রায়ই উল্লেখ করিয়াছেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদিগকে বলিতেন, স্বামীজী একজন মুক্ত মহাপুরুষ, বিশেষভাবে তাঁহার কাজে সাহায্য করিবার জন্যই আগমন করিয়াছেন এবং তিনি কে, তাহা জানিবামাত্র শরীর ছাড়িয়া দিবেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ আরও বলিতেন যে, উক্ত সময় উপস্থিত হইবার পূর্বে স্বামীজীকে শুধু ভারতেরই কল্যাণের জন্য নয়, কিন্তু অপর দেশসমূহের জন্যও কোন একটি বিশেষ কার্য করিতে হইবে। তিনি প্রায় বলিতেন, ‘বহুদূরে আমার আরও সব ভক্ত আছে; তাহারা এমন সব ভাষায় কথা বলে, যাহা আমি জানি না।’

‘সহস্রদ্বীপোদ্যান’-এ সাত সপ্তাহকাল অতিবাহিত করিয়া স্বামীজী নিউ ইয়র্কে প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং পরে অন্যত্র ভ্রমণে বাহির হইলেন। নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তিনি ইংলণ্ডে বক্তৃতা দিতে এবং ছাত্রগণকে লইয়া ক্লাস করিতে লাগিলেন। তারপর নিউ ইয়র্কে প্রত্যাবর্তন করিয়া সেখানে পুনরায় ক্লাস আরম্ভ করিলেন। এই সময়ে তাঁহার ছাত্রগণ জনৈক উপযুক্ত সাঙ্কেতিক-লিখনবিৎকে (stenographer) সংগ্রহ করিয়াছিলেন এবং এইরূপে স্বামীজীর উক্তিগুলি লিপিবদ্ধ করাইয়া রাখিয়াছিলেন। এই ক্লাসের বক্তৃতাগুলি কিছুদিন পরেই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছিল। এই পুস্তকগুলি ও পুস্তিকাকারে নিবদ্ধ তাঁহার সাধারণসমক্ষে বক্তৃতাগুলিই আজ স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকায় প্রচারকার্যের স্থায়ী স্মৃতিচিহ্নরূপে বর্তমান রহিয়াছে। আমাদের মধ্যে যাঁহারা এই বক্তৃতাগুলিতে উপস্থিত থাকিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নিকট মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলিতে স্বামীজীকে যেন আবার জীবন্ত বোধ হয় এবং তিনি যেন তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেছেন, এইরূপ মনে হয়। তাঁহার বক্তৃতাগুলি যে এরূপ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হইয়াছিল, সেজন্য কৃতিত্ব একজনের—যিনি পরে স্বামীজীর একজন মহা অনুরাগী ভক্ত হইয়াছিলেন। গুরু ও শিষ্য উভয়েরই কার্য নিষ্কামপ্রেম-প্রসূত ছিল, সুতরাং ঐ কার্যের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হইয়াছিল।

এস. ই. ওয়াল্ডো
(S. E. Waldo)

নিউ ইয়র্ক, ১৯০৮

দেববাণী



বুধবার, ১৯ জুন, ১৮৯৫


সহস্রদ্বীপোদ্যানে এই দিন হইতে স্বামীজী নিয়মিত শিক্ষাদান আরম্ভ করেন। আমাদের সকলে তখনও সমবেত হয় নাই, কিন্তু আচার্যের হৃদয় কাজ করিতে শুরু করিয়াছে; যে তিন-চারজন উপস্থিত ছিলাম, তাহাদিগকে লইয়াই তিনি শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন।

স্বামীজী একখানি বাইবেল হাতে করিয়া ছাত্রগণের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং উহা হইতে জনের গ্রন্থখানি১ খুলিয়া বলিলেন, তোমরা যখন সকলেই খ্রীষ্টান, তখন খ্রীষ্টীয় শাস্ত্র দিয়া আরম্ভ করাই ভাল।

জনের গ্রন্থ-প্রারম্ভেই আছেঃ ‘আদিতে শব্দমাত্র ছিল, সেই শব্দ ব্রহ্মের সহিতই ছিল, আর সেই শব্দই ব্রহ্ম।’

হিন্দুরা এই ‘শব্দ’কে বলে থাকেন ‘মায়া’ বা ব্রহ্মের ব্যক্তভাব, কারণ এটি ব্রহ্মেরই শক্তি। যখন সেই নিরপেক্ষ ব্রহ্মসত্তাকে আমরা বিশ্বজগতে প্রতিফলিত দেখি, তখন তাকে ‘প্রকৃতি’ বলে থাকি। ‘শব্দ’-এর দুটি বিকাশ, একটি এই ‘প্রকৃতি’—এইটিই সাধারণ বিকাশ; আর এর বিশেষ বিকাশ হচ্ছে কৃষ্ণ, বুদ্ধ, ঈশা রামকৃষ্ণ প্রভৃতি অবতার-পুরুষগণ। সেই নির্গুণ ব্রহ্মের বিশেষ বিকাশ যে খ্রীষ্ট, তাঁকে আমরা জেনে থাকি, তিনি আমাদের জ্ঞেয়। কিন্তু নির্গুণ ব্রহ্মবস্তুকে আমরা জানতে পারি না। আমরা পরম পিতাকে২ জানতে পারি না, কিন্তু তাঁর তনয়কে৩ জানতে পারি। নির্গুণ ব্রহ্মকে আমরা শুধু মানবত্ব-রূপ রঙের মধ্য দিয়ে দেখতে পারি, খ্রীষ্টের মধ্য দিয়ে দেখতে পারি।

জন-লিখিত গ্রন্থের প্রথম পাঁচ শ্লোকেই খ্রীষ্টধর্ম্মের সারতত্ত্ব নিহিত। এর প্রত্যেকটি শ্লোক গভীরতম দার্শনিক তত্ত্বে পূর্ণ।

পূর্ণস্বরূপ যিনি, তিনি কখনও অপূর্ণ হন না। তিনি অন্ধকারের মধ্যেও আছেন বটে, কিন্তু ঐ অন্ধকার তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। ঈশ্বরের দয়া সকলেরই উপর রয়েছে, কিন্তু পাপ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। আমরা নেত্ররোগাক্রান্ত হয়ে সূর্যকে অন্যরূপ দেখতে পারি, কিন্তু তাতে সূর্য যেমন তেমনই থাকে, তার কিছু এসে যায় না। জনের ঊনত্রিংশ শ্লোকে যে লেখা আছে, ‘তিনি জগতের পাপ দূর করেন’—তার মানে এই যে, খ্রীষ্ট আমাদিগকে পূর্ণতা লাভ করবার পথ দেখিয়ে দেবেন। ঈশ্বর খ্রীষ্ট হয়ে জন্মালেন—মানুষকে তার প্রকৃত স্বরূপ দেখিয়ে দেবার জন্য, আমরাও যে প্রকৃতপক্ষে ব্র্হ্মস্বরূপ, এইটি জানিয়ে দেবার জন্য। আমরা হচ্ছি দেবত্বের উপর মনুষ্যত্বের আবরণ, কিন্তু দেবভাবাপন্ন মানুষ-হিসাবে খ্রীষ্ট ও আমাদের মধ্যে স্বরূপতঃ কোন পার্থক্য নেই।

ত্রিত্ববাদীদের৪ যে খ্রীষ্ট, তিনি আমাদের মত সাধারণ মনুষ্য থেকে অনেক উচ্চে অবস্থিত। একাত্ববাদীদের (Unitarians) খ্রীষ্ট ঈশ্বর নন, শুধু একজন নৈতিক সাধুপুরুষ। এ দুয়ের কেউই আমাদের সাহায্য করতে পারেন না। কিন্তু যে খ্রীষ্ট ঈশ্বরাবতার, তিনি নিজ ঈশ্বরত্ব বিস্মৃত হননি, সেই খ্রীষ্টই আমাদের সাহায্য করতে পারেন, তাঁতে কোনরূপ অপূর্ণতা নেই। এই-সকল অবতারদের রাতদিন মনে থাকে যে, তাঁরা ঈশ্বর—তাঁরা আজন্ম এটি জানেন। তাঁরা যেন সেই-সব অভিনেতাদের মত, যাঁদের নিজ নিজ অংশের অভিনয় শেষ হয়ে গেছে—নিজেদের আর কোন প্রয়োজন নেই, তবু যাঁরা কেবল অপরকে আনন্দ দেবার জন্যই রঙ্গমঞ্চে ফিরে আসেন। এই মহাপুরুষগণকে সংসারের কোন মলিনতা স্পর্শ করতে পারে না। তাঁরা কেবল আমাদের শিক্ষা দেবার জন্য কিছুকাল আমাদের মত মানুষ হয়ে আসেন, আমাদেরই মত বদ্ধ বলে ভান করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কখনই বদ্ধ নন, সদাই মুক্তস্বভাব।

*****************

মঙ্গল বা কল্যাণভাব সত্যের সমীপবর্তী বটে, কিন্তু তবু পূর্ণ সত্য নয়। অমঙ্গল যেন আমাদের বিচলিত করতে না পারে, এটি শেখবার পর আমাদের শিখতে হবে, মঙ্গলও যেন আমাদের সুখী করতে না পারে। আমাদের জানতে হবে যে, আমরা মঙ্গল-অমঙ্গল দুইয়েরই বাইরে। ওদের উভয়েরই যে যথাযোগ্য স্থান আছে, সেটি আমাদের লক্ষ্য করতে হবে ও বুঝতে হবে—একটা থাকলেই অপরটাও থাকবেই থাকবে।

দ্বৈতবাদের ভাবটি প্রাচীন পারসীকদের৫ কাছ থেকে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে ভাল-মন্দ দুই-ই এক জিনিষ এবং উভয়েই আমাদের মনে। মন যখন স্থির ও শান্ত হয়, তখন ভাল-মন্দ কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। শুভাশুভ দুয়েরই বন্ধন কাটিয়ে একেবারে মুক্ত হও, তখন এদের কেউ আর তোমায় স্পর্শ করতে পারবে না, তুমি মুক্ত হয়ে পরমানন্দ ভোগ করবে। অশুভ যেন লোহার শিকল, আর শুভ সোনার শিকল; কিন্তু দুই-ই শিকল। মুক্ত হও এবং জন্মের মত জেনে রাখো— কোন শিকলই তোমায় বাঁধতে পারে না। সোনার শিকলটির সাহায্যে লোহার শিকলটি আলগা করে নাও, তার পর দুটোই ফেলে দাও। অশুভ-রূপ কাঁটা আমাদের শরীরে রয়েছে; ঐ ঝাড়েরই আর একটি (শুভ-রূপ) কাঁটা নিয়ে পূর্বের কাঁটাটি তুলে ফেলে শেষে দুটোকেই ফেলে দাও, এবং মুক্ত হও।

জগতে সর্বদাই দাতার আসন গ্রহণ কর। সর্বস্ব দিয়ে দাও, আর ফিরে কিছু চেও না। ভালবাসা দাও, সাহায্য দাও, সেবা দাও, যতটুকু যা তোমার দেবার আছে দিয়ে যাও; কিন্তু সাবধান, বিনিময়ে কিছু চেও না। কোন শর্ত কর না, তা হলেই তোমার ঘাড়েও কোন শর্ত চাপবে না। আমরা যেন আমাদের নিজেদের বদান্যতা থেকেই দিয়ে যাই—ঠিক যেমন ঈশ্বর আমাদের দিয়ে থাকেন।

ঈশ্বর একমাত্র দেনেওয়ালা, জগতের সকলেই তো দোকানদার মাত্র।… তাঁর সই-করা চেক যোগাড় কর, সর্বত্রই তার খাতির হবে।

ঈশ্বর অনিবর্চনীয় প্রেমস্বরূপ—তিনি উপলব্ধির বস্তু; কিন্তু তাঁকে কখনও ‘ইতি ইতি’ করে নির্দেশ করা যায় না।

*****************

আমরা যখন দুঃখকষ্ট ও সংঘর্ষের মধ্যে পড়ি, তখন জগৎটা আমাদের কাছে একটা অতি ভয়ানক স্থান বলে মনে হয়। কিন্তু যেমন আমরা দুটো কুকুর-বাচ্চাকে পরস্পর খেলা করতে বা কামড়াকামড়ি করতে দেখে সেদিকে আদৌ মনোযোগ দিই না, জানি যে দুটোতে মজা করছে, এমন কি, মাঝে মাঝে জোরে এক-আধটা কামড় লাগলেও জানি যে, তাতে বিশেষ কিছু অনিষ্ট হবে না, তেমনি আমাদেরও মারামারি ইত্যাদি যা কিছু—সব ঈশ্বরের চক্ষে খেলা বৈ আর কিছু নয়। এই জগৎটা সবই কেবল খেলার জন্য—ভগবানের এতে শুধু মজাই হয়। জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই তাঁর কোপ উৎপন্ন করতে পারে না।

*****************

‘পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী।
মায়া-ঝড় মোহ-তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।
একে মন-মাঝি আনাড়ী, রিপু ছজন কুজন দাঁড়ী,
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি;
ভেঙে গেছে ভক্তির হাল, উড়ে গেল শ্রদ্ধার পাল,
তরী হল বানচাল, উপায় কি করি?
উপায় না দেখে আর, নীলকমল ভেবেছে সার,
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার দুর্গানামের ভেলা ধরি।’

মা, তোমার প্রকাশ যে শুধু সাধুতেই আছে আর পাপীতে নেই, তা নয়; এ প্রকাশ প্রেমিকের ভিতরেও যেমন, হত্যাকারীর ভিতরেও তেমনি রয়েছে। মা সকলের মধ্য দিয়েই আপনাকে অভিব্যক্ত করছেন। অশুচি বস্তুর উপর পড়লেও আলোক অশুচি হয় না, আবার শুচি বস্তুর উপর পড়লেও তার গুণ বাড়ে না। আলোক নিত্যশুদ্ধ, সদা অপরিণামী। সকল প্রাণীর পেছনেই সেই ‘সৌম্যাৎ সৌম্যতরা’, নিত্যশুদ্ধস্বভাবা, সদা অপরিণামিনী মা রয়েছেন।

‘যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥’৬

তিনি দুঃখকষ্টে, ক্ষুধাতৃষ্ণার মধ্যেও রয়েছেন, আবার সুখের ভিতর, মহান্ ভাবের ভিতরও রয়েছেন। যখন ভ্রমর মধু পান করে, তখন প্রভুই ভ্রমর-রূপে মধু পান করেন। ঈশ্বরই সর্বত্র রয়েছেন জেনে জ্ঞানী ব্যক্তিরা নিন্দা-স্তুতি দুই-ই ছেড়ে দেন। জেনে রাখ যে, কিছুতেই তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারে না। কি করে করবে? তুমি কি মুক্ত নও? তুমি কি আত্মা নও? তিনি আমাদের প্রাণের প্রাণ, চক্ষুর চক্ষু, শ্রোত্রের শ্রোত্র-স্বরূপ।৭

আমরা সংসারের মধ্য দিয়ে চলেছি, যেন পাহারাওয়ালা আমাদের ধরবার জন্য পিছু পিছু ছুটছে—তাই আমরা জগতের যা সৌন্দর্য, তার শুধু ঈষৎ আভাসমাত্রই দেখে থাকি। এই যে আমাদের এত ভয়, ওটা জড়কে সত্য বলে বিশ্বাস করা থেকে এসেছে। পেছনে মন রয়েছে বলেই জড়তার সত্তা লাভ করে আমরা জগৎ বলে যা দেখছি, তা প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ঈশ্বরই।

রবিবার, ২৩ জুন


সাহসী ও অকপট হও—তারপর তুমি যে পথে ইচ্ছা ভক্তিবিশ্বাসের সহিত চল, অবশ্যই সেই পূর্ণ বস্তুকে লাভ করবে। একবার শিকলের একটা কড়া কোনমতে যদি ধরে ফেল, সমগ্র শিকলটা ক্রমে ক্রমে টেনে আনতে পারবে! গাছের মূলে যদি জল দাও, সমগ্র গাছটাই জল পাবে। ভগবানকে যদি আমরা লাভ করতে পারি, তবে সবই পাওয়া গেল।

একঘেয়ে ভাবই জগতে মহা অনিষ্টকর। তোমরা নিজেদের ভিতর যত ভিন্ন ভিন্ন ভাবের বিকাশ করতে পারবে, ততই জগৎকে বিভিন্নভাবে—কখনও জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, কখনও বা ভক্তের দৃষ্টিতে সম্ভোগ করতে পারবে। নিজের প্রকৃতিটা আগে ঠিক কর, তারপর সেই প্রকৃতি-অনুযায়ী পথ অবলম্বন করে তাতে নিষ্ঠাপূর্বক থাক। প্রবর্তকের পক্ষে নিষ্ঠাই (একটা ভাবে দৃঢ় হওয়া) একমাত্র উপায়; কিন্তু যদি যথার্থ ভক্তিবিশ্বাস থাকে এবং যদি ‘ভাবের ঘরে চুরি’ না থাকে, তবে ঐ নিষ্ঠাই তোমায় এক ভাব থেকে সব ভাবে নিয়ে যাবে। গির্জা, মন্দির, মত-মতান্তর, নানাবিধ অনুষ্ঠান, এগুলি যেন চারাগাছকে রক্ষা করবার জন্য তার চারদিকে বেড়া দেওয়া। কিন্তু যদি গাছটাকে বাড়াতে চাও, তা হলে শেষে সেগুলিকে ভেঙে দিতে হবে। এইরূপ বিভিন্ন ধর্ম, বেদ, বাইবেল, মত-মতান্তর—এ-সবও যেন চারাগাছের টবের মত, কিন্তু টব থেকে ওকে একদিন না একদিন বেরুতে হবে। নিষ্ঠা যেন চারাগাছটিকে টবে বসিয়া রাখা—সাধককে তার নির্বাচিত পথে আগলে রাখা।

*****************

সমগ্র সমুদ্রের দিকে চেয়ে দেখ, এক-একটি তরঙ্গের দিকে দেখ না; একটা পিঁপড়ে ও একজন দেবতার ভিতর কোন প্রভেদ দেখো না। প্রত্যেকটি কীট প্রভু ঈশার ভাই। একটাকে বড়, অপরটাকে ছোট বলো কি করে? নিজের নিজের স্থানে সকলেই যে বড়। আমরা যেমন এখানে রয়েছি, তেমনি সূর্য, চন্দ্র, তারাতেও আছি। আত্মা দেশকালের অতীত ও সর্বব্যাপী। যে-কোন মুখে সেই প্রভুর গুণগান উচ্চারিত হচ্ছে, তাই আমার মুখ; যে-কোন চক্ষু কোন বস্তু দেখছে, তাই আমার চক্ষু। আমরা কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ নই; আমরা দেহ নই, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই আমাদের দেহ। আমরা যেন ঐন্দ্রজালিকের মত মায়াযষ্টি ঘোরাচ্ছি, আর ইচ্ছামত আমাদের সম্মুখে নানা দৃশ্য সৃষ্টি করছি। আমরা যেন মাকড়সার মত আমাদেরই নির্মিত বৃহৎ জালের মধ্যে—মাকড়সা যখনই ইচ্ছা করে, তখনই তার জালের সুতোগুলোর যে-কোনটাতে যেতে পারে। বর্তমানে সে যেখানে রয়েছে, সেইটাই জানতে পারছে, কিন্তু কালে সমস্ত জালটাকে জানতে পারবে। আমরাও এখন যেখানে আমাদের দেহটা রয়েছে, সেখানেই নিজ সত্তা অনুভব করছি, এখন একটি মস্তিষ্কমাত্র ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু যখন পূর্ণজ্ঞান বা জ্ঞানাতীত অবস্থায় উপনীত হই, তখন আমরা সব জানতে পারি, সব মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারি। এখনই আমরা আমাদের বর্তমান জ্ঞানকে ধাক্কা দিয়ে এমন ঠেলে দিতে পারি যে, সে তার সীমা ছাড়িয়ে চলে গিয়ে জ্ঞানাতীত বা পূর্ণজ্ঞানভূমিতে কাজ করতে থাকবে।

আমরা চেষ্টা করছি, কেবল অস্তি-মাত্র, সৎস্বরূপ হতে; তাতে ‘আমি’ পর্যন্ত থাকবে না—কেবল শুদ্ধ স্ফটিকের মত হবে; তাতে সমগ্র জগতের প্রতিবিম্ব পড়বে, কিন্তু তা যেমন তেমনই থাকবে। এই অবস্থা লাভ হলে আর ক্রিয়া কিছু থাকে না, শরীরটা কেবল যন্ত্রের মত হয়ে যায়; সে সদা শুদ্ধভাবাপন্নই থাকে, তার শুদ্ধির জন্য আর চেষ্টা করতে হয় না; সে অপবিত্র হতেই পারে না।

নিজেকে সেই অনন্তস্বরূপ বলে জান, তা হলে ভয় একদম চলে যাবে। সর্বদাই বলো, ‘আমি ও আমার পিতা (ঈশ্বর) এক।’৮

*****************

আঙুরগাছে যেমন থোলো থোলো আঙুর ফলে, ভবিষ্যতে তেমনই থোলো থোলো খ্রীষ্টের অভ্যুদয় হবে। তখন সংসার-খেলা শেষ হয়ে যাবে। সকলেই সংসার চক্র থেকে বেরিয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। যেমন একটা কেটলিতে জল চড়ানো হয়েছে; জল ফুটতে আরম্ভ করলে প্রথমে একটার পর একটা করে বুদ্বুদ উঠতে থাকে, ক্রমে এই বুদ্বুদগুলোর সংখ্যা বেশী হতে থাকে, শেষে সমস্ত জলটা টগবগ করে ফুটতে থাকে ও বাষ্প হয়ে বেরিয়ে যায়। বুদ্ধ ও খ্রীষ্ট এই পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দুটি বুদ্বুদ। মুশা ছিলেন একটি ছোট বুদ্বুদ, তারপর ক্রমশঃ বড় বড় আরও সব বুদ্বুদ উঠেছে। কোন সময়ে কিন্তু জগৎসুদ্ধ এইরূপ বুদ্বুদ হয়ে বাষ্পাকারে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সৃষ্টি তো অবিরাম প্রবাহে চলছেই, আবার নূতন জলের সৃষ্টি হয়ে ঐ পূর্ব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলতে থাকবে।

সোমবার, ২৪ জুন


অদ্য স্বামীজী ‘নারদীয় ভক্তিসূত্র’ হইতে স্থানে স্থানে পাঠ করিয়া ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেনঃ

‘ভক্তি ঈশ্বরে পরমপ্রেম-স্বরূপ এবং অমৃত-স্বরূপ—যা লাভ করে মানুষ সিদ্ধ হয়, অমৃতত্ব লাভ করে ও তৃপ্ত হয়—যা পেলে আর কিছুই আকাঙ্ক্ষা করে না, কোন কিছুর জন্য শোক করে না, কারও প্রতি দ্বেষ করে না, অপর কোন বিষয়ে আনন্দ অনুভব করে না এবং সাংসারিক কোন বিষয়েই উৎসাহ বোধ করে না—যা জেনে মানব মত্ত হয়, স্তব্ধ হয় ও আত্মারাম হয়।’৯

গুরুদেব বলতেন, ‘এই জগৎটা একটা মস্ত পাগলা-গারদ। এখানে সবাই পাগল, কেউ টাকার জন্য পাগল, কেউ মেয়েমানুষের জন্য পাগল, কেউ নামযশের জন্য পাগল, আর জনকতক ঈশ্বরের জন্য পাগল। অন্যান্য জিনিষের জন্য পাগল না হয়ে ঈশ্বরের জন্য পাগল হওয়াই ভাল নয় কি? ঈশ্বর হচ্ছেন পরশমণি। তাঁর স্পর্শে মানুষ এক মুহূর্তে সোনা হয়ে যায়; আকারটা যেমন তেমনি থাকে বটে, কিন্তু প্রকৃতি বদলে যায়—মানুষের আকার থাকে, কিন্তু তার দ্বারা কারও অনিষ্ট করা যেতে পারে না, কিংবা কোন অন্যায় কর্ম হতে পারে না।’

‘ঈশ্বরের চিন্তা করতে করতে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ গায়, কেউ নাচে, কেউ কেউ অদ্ভুত বিষয় সব বলে। কিন্তু সকলেই সেই এক ঈশ্বরেরই কথা কয়।’১০

মহাপুরুষেরা ধর্মপ্রচার করে যান—কিন্তু যীশু, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ প্রভৃতির ন্যায় অবতারেরা ধর্ম দিতে পারেন। তাঁরা কটাক্ষে বা স্পর্শমাত্রে অপরের মধ্যে ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করতে পারেন। খ্রীষ্টধর্মে একেই পবিত্রাত্মার (Holy Ghost) শক্তি বলেছে—এই ব্যাপারকে লক্ষ্য করেই ‘হস্ত-স্পর্শ’-এর (The laying-on of hands) কথা বাইবেলে কথিত হয়েছে। আচার্য (খ্রীষ্ট) প্রকৃতপক্ষেই শিষ্যগণের ভিতর শক্তিসঞ্চার করেছিলেন। একেই ‘গুরুপরম্পরাগত শক্তি’ বলে। এই যথার্থ ব্যাপটিজম্ই (Baptism—দীক্ষা) অনাদিকাল থেকে জগতে চলে আসছে।

‘ভক্তিকে কোন বাসনাপূরণের সহায়রূপে গ্রহণ করতে পারা যায় না, কারণ ভক্তিই সমুদয় বাসনা-নিরোধের কারণস্বরূপ।’১১ নারদ ভক্তির এই লক্ষণগুলি দিয়েছেন, ‘যখন সমুদয় চিন্তা, সমুদয় বাক্য ও সমুদয় ক্রিয়া তাঁর প্রতি অর্পিত হয় এবং ক্ষণকালের নিমিত্ত তাঁকে বিস্মৃত হলে হৃদয়ে পরম ব্যাকুলতা উপস্থিত হয়, তখনই যথার্থ ভক্তির উদয় হয়েছে, বুঝতে হবে।’১২

‘পূর্বোক্ত ভক্তিই প্রেমের সর্বোচ্চ অবস্থা। কারণ অন্যান্য সাধারণ প্রেমে প্রেমিক প্রেমাস্পদের কাছ থেকে প্রতিদান চায়, কিন্তু ভক্ত এই প্রেমে কেবল তাঁর সুখে সুখী হয়ে থাকে।’১৩

‘প্রকৃত ভক্তিলাভ হলে যে সবকিছু ত্যাগ হয়—বলা হয়েছে, তার তাৎপর্য—ভক্তের সমুদয় লৌকিক ও বৈদিক কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়।’

‘যখন অন্য সব ত্যাগ করে চিত্ত ঈশ্বরের দিকে যায়, তাঁর শরণাগত হয়, তাঁর বিরোধী সমুদয় বিষয়ে উদাসীন হয়, তখনই বুঝতে হবে, যথার্থ ভক্তিলাভ হতে চলেছে।’১৪

যতদিন না ভক্তিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হচ্ছ, ততদিন শাস্ত্রবিধি মেনে চলতে হবে।’১৫

যতদিন না তোমার চিত্তের এতদূর দৃঢ়তা হচ্ছে যে, শাস্ত্রবিধি প্রতিপালন না করলেও তোমার হৃদয়ের যথার্থ ভক্তিভাব নষ্ট হয় না, ততদিন ঐগুলি মেনে চল, কিন্তু তারপর তুমি শাস্ত্রের পারে চলে যাও। শাস্ত্রের বিধিনিষেধ মেনে চলাই জীবনের চরম উদ্দেশ্য নয়। আধ্যাত্মিক সত্যের একমাত্র প্রমাণ—প্রত্যক্ষ করা। প্রত্যেককে নিজে নিজে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি কোন ধর্মাচার্য বলেন, আমি এই সত্য দর্শন করেছি, কিন্তু তোমরা কোন কালে পারবে না, তাঁর কথায় বিশ্বাস কর না; কিন্তু যিনি বলেন, তোমরাও চেষ্টা করলে দর্শন করতে পার, কেবল তাঁর কথায় বিশ্বাস করবে। জগতের সকল যুগের সকল দেশের সকল শাস্ত্র—সকল সত্যই বেদ। কারণ এই-সব সত্য প্রত্যক্ষ করতে হয়, আর যে-কোন মানুষই ঐ-সব সত্য আবিষ্কার করতে পারে।

যখন ভক্তিসূর্যের কিরণে দিগন্ত প্রথম উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তখন আমরা সকল কর্ম, ঈশ্বরে সমর্পণ করতে চাই এবং এক মুহূর্ত তাঁকে বিস্মৃত হলে অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করি।

ঈশ্বর ও তাঁর প্রতি তোমার ভক্তি—এ দুয়ের মাঝখানে যেন আর কিছু না বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে ভক্তি কর, তাঁর প্রতি অনুরাগী হও, তাঁকে ভালবাসো, জগতের লোক যে যা বলে বলুক, গ্রাহ্য কর না। প্রেমভক্তি তিন প্রকার১৬—প্রথম প্রকারে দাবীর ভাব, নিজে কিছু দেয় না; দ্বিতীয় প্রকারে বিনিময়ের ভাব থাকে; তৃতীয় প্রকারে প্রতিদানের কোন চিন্তা নেই; যেন আলোর প্রতি পতঙ্গের ভালবাসা—পুড়ে মরবে, তবু ভালবাসতে ছাড়বে না।

‘এই ভক্তি—কর্ম, জ্ঞান ও যোগ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।’১৭

কর্মের দ্বারা কর্মকর্তার নিজেরই চিত্তশুদ্ধি হয়, তার দ্বারা অপরের কোন উপকার হয় না। কর্ম দ্বারা আমাদের নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে হবে, মহাপুরুষেরা কেবল আমাদের পথ দেখিয়ে দেন মাত্র। যা চিন্তা কর, তাই হয়ে যাও—‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।’ যীশুর উপর যদি তুমি তোমার ভার দাও, তা হলে তোমায় সদা সর্বদা তাঁকে চিন্তা করতে হবে, এই চিন্তার ফলে তুমি তদ্ভাবাপন্ন হয়ে যাবে, তুমি তাঁকে ভালবাসবে। এইরূপ সদা সর্বদা ভাবনার নামই ভক্তি বা প্রেম।

‘পরা ভক্তি ও পরা বিদ্যা এক জিনিষ।’

তবে ঈশ্বর-সম্বন্ধে কেবল নানা মত-মতান্তরের আলোচনা করলে চলবে না। তাঁকে ভালবাসতে হবে এবং সাধন করতে হবে। সংসার ও সাংসারিক বিষয় সব ত্যাগ কর, বিশেষতঃ যতদিন ‘চারাগাছ’—মন শক্ত না হয়। দিবারাত্র ঈশ্বরচিন্তা কর এবং যতদূর সম্ভব অন্য বিষয়ের চিন্তা ছেড়ে দাও। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চিন্তাগুলি সবই ঈশ্বর-ভাবিত হয়ে করা যেতে পারে।

‘শয়নে প্রণাম-জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান, আহার কর মনে কর, আহুতি দিই শ্যামা মারে।’

সকল কার্যে, সকল বস্তুতে তাকে দর্শন কর। অপরের সঙ্গে ঈশ্বর-বিষয়ে আলাপ কর। এতে আমাদের সাধনপথে খুব সাহায্য হয়ে থাকে।

ভগবানের অথবা তাঁর যোগ্যতম সন্তান যে-সব মহাপুরুষ—তাঁদের কৃপালাভ কর।১৮ এই দুইটি হচ্ছে ভগবানলাভের প্রধান উপায়।

এই-সকল মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হওয়া বড়ই কঠিন, পাঁচ মিনিট কাল তাঁদের সঙ্গলাভ করলে সারাটা জীবন বদলে যায়।১৯ আর যদি সত্য সত্য প্রাণে প্রাণে এই মহাপুরুষ-সঙ্গ চাও, তবে তোমার কোন-না-কোন মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হবেই হবে।

এই ভক্তেরা যেখানে থাকেন, সেই স্থান তীর্থস্বরূপ হয়ে যায়; তাঁরা যা বলেন, তাই শাস্ত্রস্বরূপ; তাঁরা যে-কোন কার্য করেন, তাই সৎকর্ম; এমনি তাঁদের মাহাত্ম্য।২০তাঁরা যে-স্থানে বাস করেছেন, সেই স্থান তাঁদের দেহনিঃসৃত পবিত্র শক্তি-স্পন্দনে পূর্ণ হয়ে যায়; যারা সেখানে যায়, তারাই এই স্পন্দন অনুভব করে; তাতে তাদেরও ভিতরে পবিত্রভাবের সঞ্চার হতে থাকে।

‘এইরূপ ভক্তগণের ভিতর জাতি, বিদ্যা, রূপ, কুল, ধন প্রভৃতির ভেদ নেই। যেহেতু তাঁরা তাঁর।’২১

অসৎসঙ্গ একেবারে ছেড়ে দাও, বিশেষতঃ প্রথমাবস্থায়। বিষয়ী লোকদের সঙ্গ ত্যাগ কর, তাতে চিত্তচাঞ্চল্য উপস্থিত হয়ে থাকে। ‘আমি, আমার’—এই ভাব সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ কর। জগতে যাঁর ‘আমার’ বলতে কিছুই নেই, ভগবান্ তাঁরই কাছে আসেন। সব রকম মায়িক প্রীতির বন্ধন কেটে ফেল। আলস্য ত্যাগ কর। ‘আমার কি হবে?’—এরূপ ভাবনা একেবারে ভেবো না। তুমি যে-সব কাজ করেছ, তার ফলাফল দেখবার জন্য ফিরেও চেও না। ভগবানে সব সমর্পণ করে কর্ম করে যাও, কিন্তু ফলাফলের চিন্তা একেবারে কর না।২২ যখন সব মনপ্রাণ এক অবিছিন্ন ধারায় ভগবানের দিকে যায়, যখন টাকাকড়ি বা নামযশ খুঁজে বেড়াবার সময় থাকে না, ভগবান্ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করবার অবসর থাকে না, তখনই হৃদয়ে সেই অপার অপূর্ব প্রেমানন্দের উদয় হবে। বাসনাগুলো তো শুধু কাচের পুঁতির মত অসার জিনিষ।

প্রকৃত প্রেম বা ভক্তি অহৈতুকী, ‘এতে কোন কামনা নেই, এটি নিত্য নূতন ও প্রতিক্ষণ বাড়তে থাকে’, এটি সূক্ষ্ম অনুভব-স্বরূপ। অনুভবের দ্বারাই একে বুঝতে হয়, ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না।২৩

‘ভক্তিই সব চেয়ে সহজ সাধন। ভক্তি স্বাভাবিক, এতে কোন যুক্তিতর্কের অপেক্ষা নেই; ভক্তি স্বতঃপ্রমাণ, এতে আর অন্য কোন প্রমাণের অপেক্ষা নেই।’২৪ কোন বিষয়কে আমাদের মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ করাকে ‘যুক্তি’ বলে। আমরা যেন (মনরূপ) জাল ফেলে কোন বস্তুকে ধরে বলি, এই বিষয়টা প্রমাণ করেছি। কিন্তু ঈশ্বরকে আমরা কখনও জাল দিয়ে ধরতে পারব না—কোন কালেও নয়।

ভক্তি নিরপেক্ষ হওয়া চাই। এমন কি, আমরা যখন প্রেমের অযোগ্য কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে ভালবাসি, তখনও তা প্রকৃত প্রেম, প্রকৃত আনন্দের খেলা। প্রেমকে যেরূপেই ব্যবহার করি না কেন, শক্তি সেই একই। ‘প্রেমের প্রকৃত ভাব শান্তি ও আনন্দ।’২৫

হত্যাকারী যখন নিজ শিশুকে চুম্বন করে, তখন সে ভালবাসা ছাড়া আর সব ভুলে যায়। অহংটাকে একেবারে নাশ করে ফেল। কাম ক্রোধ ত্যাগ কর—ঈশ্বরকে সর্বস্ব সমর্পণ কর। ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’—পুরাতন মানুষটা একেবারে চলে গেছে, কেবল একমাত্র তুমিই আছ। ‘আমি—তুমি’। কারও নিন্দা কর না। যদি দুঃখ বিপদ আসে, জেন—ঈশ্বর তোমার সঙ্গে খেলা করছেন, আর এইটি জেনে পরম আনন্দিত হও। ভক্তি বা প্রেম দেশকালের অতীত, উহা পূর্ণস্বরূপ, নিরপেক্ষ।

মঙ্গলবার, ২৫ জুন


যখনই কোন সুখভোগ করবে, তারপর দুঃখ আসবেই আসবে—এই দুঃখ তখন তখনই আসতে পারে, অথবা খুব বিলম্বেও আসতে পারে। যে আত্মা যত উন্নত, তার সুখের পর দুঃখ তত শীঘ্র আসবে। আমরা যা চাই, তা সুখও নয়, দুঃখও নয়। এ উভয়ই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ ভুলিয়ে দেয়। উভয়ই শিকল—একটা লোহার শিকল, অপরটা সোনার শিকল। এ উভয়ের পশ্চাতেই আত্মা রয়েছেন—তাঁতে সুখও নেই, দুঃখও নেই। সুখ-দুঃখ উভয়ই অবস্থাবিশেষ, আর অবস্থামাত্রেই সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু আত্মা আনন্দস্বরূপ, অপরিণামী, শান্তিস্বরূপ। আত্মাকে যে আমাদের লাভ করতে হবে, তা নয়; আত্মাকে আমরা পেয়েই আছি, কেবল তাঁর উপর যে ময়লা পড়েছে, সেটি ধুয়ে ফেলে তাঁকে দর্শন কর।

এই আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হও, তা হলেই আমরা জগৎকে ঠিক ঠিক ভালবাসতে পারব। খুব উচ্চভাবে প্রতিষ্ঠিত হও; আমি যে সেই অনন্ত আত্মস্বরূপ—এই জেনে আমাদের জগৎপ্রপঞ্চের দিকে সম্পূর্ণ শান্তভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে। এই জগৎটা একটি ছোট শিশুর খেলার মত; আমরা যখন তা জানি, তখন জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই আমাদের চঞ্চল করতে পারবে না। যদি প্রশংসা পেলে মন উৎফুল্ল হয়, তবে নিন্দায় নিশ্চয় বিষণ্ণ হবে। ইন্দ্রিয়ের—এমন-কি মনেরও সমুদয় সুখ অনিত্য; কিন্তু আমাদের ভিতরেই সেই নিরপেক্ষ সুখ রয়েছে, যে-সুখ কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না। ঐ সুখ সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত সুখ, ঐ সুখ আনন্দস্বরূপ। সুখের জন্য বাইরের বস্তুর উপর নির্ভর না করে যত ভিতরের উপর নির্ভর করব—যতই আমরা ‘অন্তঃসুখ, অন্তরারাম’ হব, ততই আমরা আধ্যাত্মিক হব। এই আত্মানন্দকেই ‘ধর্ম’ বলা হয়।

অন্তর্জগৎ—যা বাস্তবিক সত্য, তা বহির্জগতের চেয়ে অনন্তগুণে বড়। বহির্জগৎটা সেই সত্য অন্তর্জগতের ছায়াময় প্রক্ষেপমাত্র। এই জগৎটা সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, এটা সত্যের ছায়ামাত্র। কবি বলেছেন, কল্পনা সত্যের সোনালী ছায়া।

আমরা যখন সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করি, তখনই তা আমাদের পক্ষে সজীব হয়ে ওঠে। আমাদের বাদ দিলে জগৎটা অচেতন, মৃত জড়পদার্থ মাত্র। আমরাই জগতের পদার্থসমূহকে জীবন দান করছি, কিন্তু আবার মূর্খের মত ঐ কথা ভুলে গিয়ে কখনও তা থেকে ভয় পাচ্ছি, কখনও আবার তাই ভোগ করতে যাচ্ছি।

সেই মেছুনীদের মত হয় না। কয়েকজন মেছুনী আঁষচুবড়ি মাথায় করে বাজার থেকে বাড়ী ফিরছিল—এমন সময় খুব ঝড়বৃষ্টি এলো। তারা বাড়ী যেতে না পেরে পথে তাদের এক আলাপী মালিনীর বাগানবাড়ীতে আশ্রয় নিলে। মালিনী রাত্রে তাদের যে ঘরে শুতে দিলে, তার ঠিক পাশেই ফুলের বাগান। হাওয়াতে বাগানের সুন্দর সুন্দর ফুলের গন্ধ তাদের নাকে আসতে লাগল—সেই গন্ধ তাদের এত অসহ্য বোধ হতে লাগলো যে, তারা কোনমতে ঘুমোতে পারে না। শেষে তাদের মধ্যে একজন বললে, ‘দেখ, আমাদের আঁষচুবড়িগুলোতে জল ছড়িয়ে দিয়ে মাথার কাছে রেখে দেওয়া যাক।’ তাই করাতে যখন নাকের কাছে সেই আঁষচুবড়ির গন্ধ আসতে লাগলো, তখন তারা আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।

এই সংসার আঁষচুবড়ির মত—আমরা যেন সুখভোগের জন্য ওর উপর নির্ভর না করি; যারা করে, তারা তামসপ্রকৃতি বা বদ্ধজীব। তারপর আবার রাজসপ্রকৃতির লোক আছে, তাদের অহংটা খুব প্রবল, তারা সদাই ‘আমি, আমি’ বলে থাকে। তারা কখনও কখনও সৎকার্য করে থাকে, চেষ্টা করলে তারা ধার্মিক হতে পারে। কিন্তু সাত্ত্বিক প্রকৃতিই সর্বশ্রেষ্ঠ—তারা সদাই অন্তর্মুখ—তারা সদাই আত্মনিষ্ঠ। প্রত্যেক ব্যক্তিতেই এই সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ আছে; এক এক সময় মানুষে এক এক গুণের প্রাধান্য হয় মাত্র।

সৃষ্টি মানে একটা কিছু নির্মাণ বা তৈরি করা নয়, সৃষ্টি মানে—যে সাম্য-ভাব নষ্ট হয়ে গেছে, সেইটাকে আবার ফিরে পাবার চেষ্টা, যেমন একটা শোলার ছিপি (cork) যদি টুকরো টুকরো করে জলের নীচে ফেলে দেওয়া যায়, তা হলে সেগুলো যেমন আলাদা আলাদা বা একসঙ্গে কতকগুলো মিলে জলের উপরে ভেসে ওঠবার চেষ্টা করে, সেই রকম। যেখানে জীবন—যেখানে জগৎ, সেখানে কিছু না কিছু মন্দ, কিছু না কিছু অশুভ থাকবেই থাকবে। একটুখানি অশুভ থেকেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। জগতে যে কিছু কিছু মন্দ রয়েছে, এ খুব ভাল; কারণ সাম্যভাব এলে এই জগৎই নষ্ট হয়ে যাবে। সাম্য ও বিনাশ যে এক কথা। যতদিন এই জগৎ চলছে, ততদিন সঙ্গে সঙ্গে ভাল-মন্দও চলবে; কিন্তু যখন আমরা জগৎকে অতিক্রম করি, তখন ভাল-মন্দ দুয়েরই পারে চলে যাই—পরমানন্দ লাভ করি।

জগতে দুঃখবিরহিত সুখ, অশুভবিরহিত শুভ—কখনও পাবার সম্ভাবনা নেই; কারণ জীবনের অর্থই হচ্ছে বিনষ্ট সাম্যভাব। আমাদের চাই মুক্তি; জীবন সুখ বা শুভ—এ-সবের কোনটাই নয়। সৃষ্টিপ্রবাহ অনন্তকাল ধরে চলেছে—তার আদিও নেই, অন্তও নেই, যেন একটা অগাধ হ্রদের উপরকার সদা-গতিশীল তরঙ্গ। ঐ হ্রদের এমন সব গভীর স্থান আছে, যেখানে আমরা এখনও পৌঁছতে পারিনি; আর কতকগুলো জায়গা আছে, যেখানে সাম্যভাব পুনঃস্থাপিত হয়েছে—কিন্তু উপরের তরঙ্গ সর্বদাই চলেছে, সেখানে অনন্তকাল ধরে ঐ সাম্যাবস্থা-লাভের চেষ্টা চলেছে| জীবন ও মৃত্যু একটা ব্যাপারেরই বিভিন্ন নামমাত্র, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। উভয়ই মায়া—এ অবস্থাটা পরিষ্কার করে বোঝাবার জো নেই; এক সময়ে বাঁচবার চেষ্টা হচ্ছে, আবার পরমু্হূর্তে বিনাশ বা মৃত্যুর চেষ্টা। আমাদের যথার্থ স্বরূপ আত্মা—এ দুয়েরই পারে। আমরা যখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করি, তা আর কিছু নয়, তা প্রকৃতপক্ষে সেই আত্মাই—যা থেকে আমরা নিজেদের পৃথক্ করে ফেলেছি, আর আমাদের থেকে পৃথক্ বলে উপাসনা করছি! কিন্তু সেই উপাস্য চিরকালই আমাদের প্রকৃত আত্মা—এক ও একমাত্র ঈশ্বর, যিনি পরমাত্মা।

সেই নষ্ট সাম্যাবস্থা ফিরে পেতে গেলে আমাদের প্রথমে তমঃকে ব্যর্থ করতে হবে রজঃ দ্বারা, পরে রজঃকে জয় করতে হবে সত্ত্ব দ্বারা। সত্ত্ব অর্থে সেই স্থির ধীর প্রশান্ত অবস্থা, যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, শেষে অন্যান্য ভাব একেবারে চলে যাবে। বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে দাও, মুক্ত হও, যথার্থ ‘ঈশ্বরতনয়’ হও, তবেই যীশুর মত পিতাকে দেখতে পাবে। ধর্ম ও ঈশ্বর বলতে অনন্ত শক্তি, অনন্ত বীর্য বুঝায়। দুর্বলতা—দাসত্ব ত্যাগ কর। যদি তুমি মুক্তস্বভাব হও, তবেই তুমি কেবল আত্মামাত্র; যদি মুক্তস্বভাব হও, তবেই অমৃতত্ব তোমার করতলগত; যদি মুক্তস্বভাব হন, তবেই বলব—ঈশ্বর যথার্থ আছেন।

*****************

জগৎটা আমার জন্য, আমি কখনও জগতের জন্য নই। ভাল-মন্দ আমাদের দাসস্বরূপ, আমরা কখনও তাদের দাস নই। পশুর স্বভাব—উন্নতি করা নয়, বরং যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় পড়ে থাকা; মানুষের স্বভাব—মন্দ ত্যাগ করে ভালটা পাবার চেষ্টা করা। আর দেবতার স্বভাব—ভাল-মন্দ কিছুর জন্য চেষ্টা থাকবে না—সর্বদা সর্বাবস্থায় আনন্দময় হয়ে থাকা। আমাদের দেবতা হতে হবে। হৃদয়টাকে সমুদ্রের মত মহান্ করে ফেল; সাংসারিক তুচ্ছতার পারে চলে যাও; এমন-কি অশুভ এলেও আনন্দে উন্মত্ত হয়ে যাও; জগৎটাকে একটা ছবির মত দেখ; এইটি জেনে রাখ যে, জগতে কোন কিছুই তোমায় বিচলিত করতে পারে না; আর এইটি জেনে জগতের সৌন্দর্য উপভোগ কর। জগতের সুখ কি রকম জান?—যেমন ছোট ছোট ছেলেরা খেলা করতে করতে কাদার মধ্য থেকে কাচের পুঁতি কুড়িয়ে পেয়েছে। জগতের সুখ-দুঃখের উপর শান্তভাবে দৃষ্টিপাত কর, ভাল-মন্দ উভয়কেই সমান বলে দেখ—দুই-ই ভগবানের খেলা; সুতরাং ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ—সবেতেই আনন্দ কর।

*****************

আমার গুরুদেব বলতেন, ‘সবই নারায়ণ বটে, কিন্তু বাঘ-নারায়ণের কাছ থেকে সরে থাকতে হয়। সব জলই নারায়াণ বটে, তবে ময়লা জল খাওয়া যায় না।’

‘গগনময় থালে রবিচন্দ্র-দীপক’ জ্বলে—অন্য মন্দিরের আর কি দরকার? ‘সব চক্ষু তোমার চক্ষু, অথচ তোমার চক্ষু নেই; সব হস্ত তোমার হস্ত, অথচ তোমার হস্ত নেই।’

কিছু পাবার চেষ্টা কর না, কিছু এড়াবার চেষ্টাও কর না—যা কিছু আসে গ্রহণ কর, ‘যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্ট’ হও। কোন কিছুতেই বিচলিত না হওয়াই মুক্তি বা স্বাধীনতা। কেবল সহ্য করে গেলে হবে না, একেবারে অনাসক্ত হও। সেই ষাঁড়ের গল্পটি মনে রেখ।

একটা মশা অনেকক্ষণ ধরে একটা ষাঁড়ের শিঙে বসেছিল—অনেকক্ষণ বসবার পর তার বিবেক বুদ্ধি জেগে উঠল; হয়তো ষাঁড়ের শিঙে বসে থাকার দরুন তার বড় কষ্ট হচ্ছে—এই মনে করে সে ষাঁড়কে সম্বোধন করে বলতে লাগল, ‘ভাই ষাঁড়, আমি অনেকক্ষণ তোমার শিঙের উপর বসে আছি, বোধ হয় তোমার অসুবিধে হচ্ছে, আমায় মাপ কর, এই আমি উড়ে যাচ্ছি।’ ষাঁড় বললে, ‘না, না, তুমি সপরিবারে এসে আমার শিঙে বাস কর না—তাতে আমার কি এসে যায়?’

বুধবার, ২৬ জুন


যখন আমাদের অহংজ্ঞান থাকে না, তখনই আমরা সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারি, অপরকে আমাদের ভাবে সবচেয়ে বেশী অভিভূত করতে পারি। বড় বড় প্রতিভাশালী লোকেরা সকলেই এ-কথা জানেন। ঈশ্বরই একমাত্র যথার্থ কর্তা—তাঁর কাছে হৃদয় খুলে দাও, নিজে নিজে কিছু করতে যেও না। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, ‘ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।’—হে অর্জুন, ত্রিলোকে আমার কর্তব্য বলে কিছুই নেই। তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর কর, সম্পূর্ণভাবে অনাসক্ত হও, তা হলেই তোমার দ্বারা কিছু কাজ হবে। যে-সব শক্তিতে কাজ হয়, সেগুলি তো আর আমরা দেখতে পাই না, আমরা কেবল তাদের ফলটা দেখতে পাই মাত্র। অহংকে সরিয়ে দাও, নাশ করে ফেল, ভুলে যাও; তোমার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর কাজ করুন—এ তো তাঁরই কাজ। আমাদের আর কিছু করতে হবে না—কেবল সরে দাঁড়াতে হবে, তাঁকে কাজ করতে দিতে হবে। আমরা যত সরে যাব, ততই ঈশ্বর আমাদের ভিতর আসবেন। ‘কাঁচা আমি’টাকে দূর করে দাও। কেবল ‘পাকা আমি’টাই থাক্।

আমরা এখন যা হয়েছি, তা আমাদের চিন্তারই ফলস্বরূপ। সুতরাং তোমরা কি চিন্তা কর, সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রেখো। বাক্য তো গৌণ জিনিষ। চিন্তাগুলিই বহুকালস্থায়ী, আর তাদের গতিও বহুদূরব্যাপী। আমরা যে-কোন চিন্তা করি, তাতেই আমাদের চরিত্রের ছাপ লেগে যায়; এইজন্য সাধুপুরুষদের ঠাট্টায় বা গালাগালিতে পর্যন্ত তাঁদের হৃদয়ের ভালবাসা ও পবিত্রতার একটুখানি রয়ে যায় এবং তা আমাদের কল্যাণসাধনই করে।

কিছুই কামনা কর না। ঈশ্বরের চিন্তা কর, কিন্তু কোন ফল-কামনা কর না। যাঁরা কামনাশূন্য, তাঁদেরই কাজ ফলপ্রসূ। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীরা লোকের দ্বারে দ্বারে ধর্ম বহন করে নিয়ে যান, কিন্তু তাঁরা মনে করেন, আমরা কিছুই করছি না। তাঁরা কোনরূপ দাবীদাওয়া করেন না, তাঁদের কাজ অজ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে। যদি তাঁরা (ঐহিক) জ্ঞান-বৃক্ষের ফল২৬ খান, তা হলে তো তাঁদের অহংকার এসে যাবে, আর যা কিছু লোক-কল্যাণ তাঁরা করবেন—সব লোপ পেয়ে যাবে। যখনই আমরা ‘আমি’ এই কথা বলি, তখনই আমরা আহাম্মক বনে যাই আর বলি, আমরা ‘জ্ঞান’ লাভ করেছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘চোখ-ঢাকা বলদের মত’ আমরা ঘানিতেই ক্রমাগত ঘুরছি। ভগবান্ বেশ ভালভাবে আপনাকে লুকিয়ে রেখেছেন, তাই তাঁর কাজও খুব ভাল। এইরূপ যিনি আপনাকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রাখতে পারেন, তিনি সবচেয়ে বেশী কাজ করতে পারেন। নিজেকে জয় কর, তা হলেই সমুদয় জগৎ তোমার পদতলে আসবে।

সত্ত্বগুণে অবস্থিত হলে আমরা সকল বস্তুর আসলস্বরূপ দেখতে পাই, তখন আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির অতীত দেশে চলে যাই। অহংই সেই বজ্রদৃঢ় প্রাচীর, যা আমাদের বদ্ধ করে রেখেছে—সত্যের মুক্ত বাতাসে যেতে দিচ্ছে না—সকল বিষয়েই, সকল কাজেই ‘আমি, আমার’ এই ভাব মনে এনে দেয়—আমরা ভাবি, আমি অমুক কাজ করেছি, তমুক কাজ করেছি, ইত্যাদি। এই ক্ষুদ্র আমিত্বটাকে দূর করে দাও, আমাদের মধ্যে এই যে অহংরূপ শয়তানি ভাব রয়েছে, তাকে একেবারে মেরে ফেলো। ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’ এই মন্ত্র উচ্চারণ কর, প্রাণে প্রাণে এটা অনুভব কর, জীবনে ঐ ভাবটাকে নিয়ে এস। যতদিন না এই অহংভাব-গঠিত জগৎটাকে ত্যাগ করতে পারছি, ততদিন আমরা কখনই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে পারব-না—কেউ কখনও পারেনি, আর পারবেও না। সংসার ত্যাগ করা মানে—এই ‘অহং’টাকে একেবারে ভুলে যাওয়া, অহংটার দিকে একেবারে খেয়াল না রাখা; দেহে বাস করা যেতে পারে, কিন্তু আমরা যেন দেহের না হয়ে যাই। এই দুষ্ট ‘আমি’টাকে একেবারে নষ্ট করে ফেলতে হবে। লোকে যখন তোমায় মন্দ বলবে, তুমি তাদের আশীর্বাদ কর; ভেবে দেখ, তারা তোমার কত উপকার করেছে; অনিষ্ট যদি কারও হয়, তো কেবল তাদের নিজেদের হচ্ছে। এমন জায়গায় যাও, যেখানে লোকে তোমাকে ঘৃণা করে; তারা তোমার অহংটাকে মেরে মেরে তোমার ভেতর থেকে বার করে দিক্—তুমি তা হলে ভগবানের খুব কাছে অগ্রসর হবে। বানরী যেমন তার বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে থাকে, কিন্তু পরিশেষে বাধ্য হলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাকে পদদলিত করতেও পশ্চাৎপদ হয় না, সেইরূপ আমরাও সংসারটাকে যতদিন পারি আঁকড়ে ধরে থাকি, কিন্তু অবশেষে যখন তাকে পদদলিত করতে বাধ্য হই, তখনই আমরা ঈশ্বরের কাছে যাবার অধিকারী হই। ন্যায়ধর্মের জন্য যদি অপরের অত্যাচার সহ্য করতে হয় তো আমরা ধন্য; যদি আমরা লিখতে পড়তে না জানি তো আমরা ধন্য; ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের তফাত করবার জিনিষ অনেক কমে গেল।

ভোগ হচ্ছে লক্ষফণা সাপ—তাকে আমাদের পদদলিত করতে হবে। আমরা এই ভোগ ত্যাগ করে অগ্রসর হতে থাকি; কিছুই না পেয়ে হয়তো আমরা নৈরাশ্যে অবসন্ন হই। কিন্তু লেগে থাক, লেগে থাক—কখনই ছেড় না। এই সংসারটা একটা অসুরের মত। এ যেন একটা রাজ্য—আমাদের ক্ষুদ্র ‘অহং’ তার রাজা। তাকে সরিয়ে দিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াও। কাম-কাঞ্চন, নাম-যশ ত্যাগ করে দৃঢ়ভাবে ঈশ্বরকে ধরে থাক, অবশেষে আমরা সুখে দুঃখে সম্পূর্ণ উদাসীনতা লাভ করব। ইন্দ্রিয়-চরিতার্থতাই সুখ—এ ধারণা একেবারে জড়বাদী। ওতে এক কণাও যথার্থ সুখ নেই; যা কিছু সুখ, তা সেই প্রকৃত আনন্দের প্রতিবিম্বমাত্র।

যাঁরা ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরা তথাকথিত কর্মীদের চেয়ে জগতের জন্য অনেক বেশী কাজ করেন। আপনাকে সম্পূর্ণ শুদ্ধ করেছে, এমন একজন লোক হাজার ধর্মপ্রচারকের চেয়ে বেশী কাজ করে। চিত্তশুদ্ধি ও মৌন থেকেই কথার ভিতর জোর আসে।

পদ্মের মত হও। পদ্ম এক জায়গাতেই থাকে, কিন্তু যখন ফুটে ওঠে, তখন চারদিক্ থেকে মৌমাছি আপনি এসে জোটে।

শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেন ও শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের ভিতর পাপ বা অশুভ দেখতে পেতেন না—তিনি জগতে কিছু মন্দ দেখতে পেতেন না, কাজেই সেই মন্দ দূর করবার জন্য চেষ্টা করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না। আর কেশবচন্দ্র একজন মস্ত নৈতিক সংস্কারক, নেতা এবং ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দ্বাদশ বর্ষ পরে এই শান্তপ্রকৃতি দক্ষিণেশ্বরের মহাপুরুষ শুধু ভারতে নয়, সমগ্র জগতের ভাবরাজ্যে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়ে গেছেন। এই-সকল নীরব মহাপুরুষ বাস্তবিক মহাশক্তির আধার—তাঁরা প্রেমে তন্ময় হয়ে জীবন-যাপন করে ভব-রঙ্গমঞ্চ হতে সরে যান। তাঁরা কখনও ‘আমি, আমার’ বলেন না। তাঁরা নিজেদের ঈশ্বরের যন্ত্রস্বরূপ জ্ঞান করেই ধন্য মনে করেন। এরূপ ব্যক্তিগণই খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ-সকলের নির্মাতা। তাঁরা সদাই ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে তাদাত্ম্য লাভ করেন, এই বাস্তব জগৎ থেকে বহুদূরে এক ভাব-জগতে বাস করেন। তাঁরা কিছুই চান না এবং জ্ঞাতসারে কিছু করেনও না। তাঁরাই প্রকৃতপক্ষে জগতের সর্বপ্রকার উচ্চভাবের প্রেরকস্বরূপ—তাঁরা জীবন্মুক্ত, একেবারে অহংশূন্য। তাঁদের ক্ষুদ্র অহংজ্ঞান একেবারে উড়ে গেছে, কোন আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নেই। তাঁদের ব্যক্তিত্ব লুপ্ত হয়ে গেছে, তাঁরা শুধুই তত্ত্বস্বরূপ।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন


(স্বামীজী অদ্য বাইবেলের নিউ টেস্টামেণ্ট লইয়া আসিলেন এবং পুনর্বার ‘জনের গ্রন্থ’ পড়িয়া ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।)

যীশুখ্রীষ্ট যে শান্তিদাতা পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন, মহম্মদ আপনাকে সেই ‘শান্তিদাতা’ বলে দাবী করতেন। তাঁর মতে—যীশুখ্রীষ্ট্রের অলৌকিক ভাবে জন্ম হয়েছিল, এ-কথা স্বীকার করবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। সকল যুগে, সকল দেশেই এইরূপ দাবী দেখতে পাওয়া যায়। সকল মহামানব দাবী করেছেন, দেবতা থেকেই তাঁদের জন্ম।

জ্ঞান আপেক্ষিক মাত্র। আমরা ঈশ্বর হতে পারি, কিন্তু তাঁকে কখনই জানতে পারি না। জ্ঞান একটা নিম্নতর অবস্থামাত্র। তোমাদের বাইবেলেও আছে, আদম যখন ‘জ্ঞান লাভ’ করলেন, তখনই তাঁর পতন হল। তার পূর্বে তিনি স্বয়ং সত্যস্বরূপ, পবিত্রতা-স্বরূপ, ঈশ্বরস্বরূপ ছিলেন। আমাদের মুখ আমাদের থেকে কিছু পৃথক্ পদার্থ নয়, কিন্তু আমরা কখনও আসল মুখটা দেখতে পাই না, শুধু প্রতিবিম্বটাই দেখতে পাই। আমরা নিজেরাই প্রেমস্বরূপ, কিন্তু যখন ঐ প্রেমসম্বন্ধে চিন্তা করতে যাই, তখনই দেখি—আমাদের একটা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। তাতেই প্রমাণ হয় যে, জড়বস্তু চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।

নিবৃত্তি-অর্থে সংসার থেকে সরে আসা। হিন্দুদের পুরাণে আছে, প্রথম সৃষ্ট চারজন ঋষিকে২৭ হংসরূপী ভগবান্ শিক্ষা দিয়েছিলেন—সৃষ্টিপ্রপঞ্চ গৌণমাত্র; সুতরাং তাঁরা আর প্রজাসৃষ্টি করলেন না। এর তাংপর্য এই যে, অভিব্যক্তির অর্থই অবনতি; কারণ আত্মাকে অভিব্যক্তি করতে গেলে শব্দ দ্বারা ঐ অভিব্যক্তি সাধিত হয়, আর ‘শব্দ ভাবকে নষ্ট করে ফেলে’।২৮ তা হলেও তত্ত্ব জড়াবরণে আবৃত না হয়ে থাকতে পারে না, যদিও আমরা জানি যে অবশেষে এইরূপ আবরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে আমরা আসলটাকেই হারিয়ে ফেলি। সকল বড় বড় আচার্যই এ-কথা বোঝেন, আর সেইজন্যই অবতারেরা পুনঃপুনঃ এসে আমাদের মূল তত্ত্বটি বুঝিয়ে দিয়ে যান, আর সেইকালের উপযোগী তার একটি নূতন আকার দিয়ে যান। আমার গুরুদেব বলতেনঃ ধর্ম এক; সকল অবতারকল্প পুরুষ একপ্রকার শিক্ষাই দিয়ে যান, তবে সকলকেই সেই তত্ত্বটি প্রকাশ করতে কোন-না-কোন আকার দিতে হয়। সেইজন্য তাঁরা তাকে তার পুরাতন আকার থেকে তুলে নিয়ে একটি নূতন আকারে আমাদের সামনে ধরেন। যখন আমরা নাম-রূপ থেকে—বিশেষতঃ দেহ থেকে মুক্ত হই, যখন আমাদের ভাল-মন্দ কোন দেহের প্রয়োজন থাকে না, তখনই কেবল আমরা বন্ধন অতিক্রম করতে পারি। ‘অনন্ত উন্নতি’ মানে অনন্তকালের জন্য বন্ধন; তার চেয়ে সকল রকম আকৃতির ধ্বংসই বাঞ্ছনীয়। সব রকম দেহ, এমন-কি দেবদেহ থেকেও আমাদের মুক্তিলাভ করতে হবে। ঈশ্বরই একমাত্র সত্যবস্তু, সত্যবস্তু কখনও দুটি থাকতে পারে না। একমাত্র আত্মাই আছেন, এবং ‘আমিই সেই’।

মুক্তিলাভের সহায়ক বলেই শুভকর্মের যা মূল্য; যে কাজ করে, ঐ কর্ম দ্বারা তারই কল্যাণ হয়—অপর কারও কিছু হয় না।

*****************

জ্ঞান মানে—শ্রেণীবদ্ধ করা, কতকগুলি জিনিষকে এক শ্রেণীর ভিতর ফেলা। আমরা একই প্রকারের অনেকগুলি জিনিষ দেখলাম—দেখে সেই সবগুলির একটা কোন নাম দিলাম, তাতেই আমাদের মন শান্ত হল। আমরা কেবল কতকগুলি ‘ঘটনা’ বা ‘তথ্য’ আবিষ্কার করে থাকি, কিন্তু কেন সেগুলি ঘটছে, তা জানতে পারি না। অজ্ঞানের অন্ধকারেই আরও খানিকটা বেশী জায়গা এক পাক ঘুরে এসে আমরা মনে করি, কিছু জ্ঞানলাভ করলাম। এই জগতে ‘কেন’র কোন উত্তর পাওয়া যেতে পারে না; ‘কেন’র উত্তর পেতে হলে আমাদের ভগবানের কাছে যেতে হবে। ‘জ্ঞাতা’কে কখনও প্রকাশ করা যায় না। এ যেন এক-টুকরো নুনের সমুদ্রে পড়ে যাওয়া—যেই পড়ল, অমনি গলে সমুদ্রে মিশে গেল।

বৈষম্যই সৃষ্টির মূল—একরসতা বা সমতাই ঈশ্বর। এই বৈষম্যভাবের পারে চলে যাও; তা হলেই জীবন ও মৃত্যু—দুই-ই জয় করবে, এবং অনন্ত সমত্বে পৌঁছবে, তখনই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হবে—ব্রহ্মস্বরূপ হবে। মুক্তিলাভ কর, সে চেষ্টায় প্রাণ যায়, তাও স্বীকার। একখানা বইয়ের সঙ্গে তার পাতাগুলির যে সম্বন্ধ, আমাদের সঙ্গে জন্মান্তরের জীবনগুলিরও সেই সম্বন্ধ; আমরা কিন্তু অপরিণামী, সাক্ষিস্বরূপ, আত্মা; আর তাঁরই উপর জন্মান্তরের ছায়া পড়ছে; যেমন একটা মশাল খুব জোরে জোরে ঘোরাতে থাকলে চোখে একটা বৃত্তের প্রতীতি হয়। আত্মাতেই সমস্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গতি; আর যেহেতু আত্মা অনন্ত, অপরিণামী ও অচঞ্চল, সেহেতু আত্মা ব্রহ্মস্বরূপ—পরমাত্মা। আত্মাকে জীবন বলতে পারা যায় না, কিন্তু তাই থেকেই সুখের উৎপত্তি হয়।

*****************

আজকাল জগতের লোক ভগবানকে পরিত্যাগ করছে, কারণ তাদের ধারণা—জগতের যতদূর সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করা উচিত, তা তিনি করছেন না; তাই লোকে বলে থাকে, ‘তাঁকে নিয়ে আমাদের লাভ কি?’ ঈশ্বরকে একজন মিউনিসিপ্যালিটির কর্তা বলে ভাবতে হবে নাকি?

আমরা এইটুকু করতে পারি যে, আমাদের সব বাসনা, ঈর্ষা, ঘৃণা, ভেদবুদ্ধি—এইগুলিকে দূর করে দিতে পারি। ‘কাঁচা আমি’কে নষ্ট করে ফেলতে হবে, মনকে মেরে ফেলতে হবে—একরকম মনে মনে আত্মহত্যা করা আর কি! শরীর ও মনকে পবিত্র ও সুস্থ রাখ—কিন্তু কেবল ঈশ্বরলাভ করবার যন্ত্ররূপে; এইটুকু এদের যথার্থ প্রয়োজন। কেবল সত্যের জন্যই সত্যের অনুসন্ধান কর; তার দ্বারা আনন্দলাভ হবে, এ-কথা ভেব না। আনন্দ আপনা হতে আসতে পারে, কিন্তু তার জন্যই যেন সত্যলাভে উৎসাহিত হয়ো না। ঈশ্বরলাভ ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য রেখ না। সত্যলাভ করবার জন্য যদি নরকের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, তাতেও পেছ-পা হয়ো না।

শুক্রবার, ২৮ জুন


(অদ্য সকলেই স্বামীজীর সহিত বনভোজনে যাত্রা করিয়াছিলেন। যদিও স্বামীজী যেখানেই থাকিতেন, সেখানেই অবিরাম শিক্ষা দিতেন, অদ্যকার উপদেশের কোন প্রকার ‘নোট’ রাখা হয় নাই; তাই তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার কিছুই লিপিবদ্ধভাবে নাই। তবে বাহির হইবার পূর্বে প্রাতরাশের সময় তিনি এই কয়েকটি কথা বলিয়াছিলেনঃ)

সর্বপ্রকার অন্নের জন্য ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞ হও—অন্নই ব্রহ্মস্বরূপ। তাঁর সর্বব্যাপিনী শক্তিই আমাদের ব্যষ্টিশক্তিতে পরিণত হয়ে আমাদের সর্বপ্রকার কার্য করতে সাহায্য করে থাকে।

শনিবার, ২৯ জুন


(অদ্য স্বামীজী গীতা হাতে করিয়া উপস্থিত হইলেন।)

গীতায় ‘হৃষীকেশ’ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বা (ইন্দ্রিয়যুক্ত) জীবাত্মাগণের ঈশ্বর কৃষ্ণ—‘গুড়াকেশ’কে অর্থাৎ নিদ্রার অধীশ্বর (অর্থাৎ নিদ্রাজয়ী) অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন। এই সংসারই ‘ধর্মক্ষেত্র’ কুরুক্ষেত্র। পঞ্চপাণ্ডব (অর্থাৎ ধর্ম) শত কৌরবের (আমরা যে-সকল বিষয়ে আসক্ত এবং যাদের সঙ্গে আমাদের সতত বিরোধ তাদের) সঙ্গে যুদ্ধ করছেন! পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীর অর্জুন (অর্থাৎ প্রবুদ্ধ জীবাত্মা) সেনাপতি। আমাদের সবচেয়ে আসক্তির বস্তু—সমুদয় ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, তাদের মেরে ফেলতে হবে। আমাদের নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমরা ব্রহ্মস্বরূপ, আমাদের আর সমস্ত ভাবকে এইভাবে ডুবিয়ে দিতে হবে।

শ্রীকৃষ্ণ সব কাজই করেছিলেন, কিন্তু আসক্তিবর্জিত হয়ে। তিনি সংসারে ছিলেন বটে, কিন্তু কখনই সংসারের হয়ে যাননি। সকল কাজ কর, কিন্তু অনাসক্ত হয়ে কর; কাজের জন্যই কাজ কর, কখনও নিজের জন্য কর না।

*****************

নামরূপাত্মক কোন কিছু কখনই মুক্তস্বভাব হতে পারে না। মৃত্তিকা-রূপ আত্মা থেকে ঘটাদির মত আমরা হয়েছি: এ অবস্থায় আত্মা সীমাবদ্ধ—আর মুক্ত নন; আপেক্ষিক সত্তাকে কখনও মুক্ত বলা যেতে পারে না। ঘট যতক্ষণ ঘট থাকে, ততক্ষণ সে কখনই বলতে পারে না, ‘আমি মুক্ত’; যখনই সে নাম-রূপ ভুলে যায়, তখনই মুক্ত হয়। সমুদয় জগৎটাই আত্মস্বরূপ—বহুভাবে অভিব্যক্ত, যেন এক সুরের মধ্যেই নানা রঙপরং তোলা হয়েছে—তা না হলে একঘেয়ে হয়ে পড়ত। সময়ে সময়ে বেসুরো বাজে বটে, তাতে বরং পরবর্তী সুরের ঐকতান আরও মিষ্ট লাগে। মহান্ বিশ্বসঙ্গীতে তিনটি ভাবের বিশেষ প্রকাশ দেখা যায়—সাম্য, শক্তি ও মুক্তি।

যদি তোমার স্বাধীনতা অপরকে ক্ষুণ্ণ করে, তা হলে বুঝতে হবে—তুমি স্বাধীন নও। অপরের কোন প্রকার ক্ষতি কখনও কর না।

মিল্টন বলেছেন, ‘দুর্বলতাই দুঃখ।’ কর্ম ও ফলভোগ—এই দুটির অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ। অনেক সময়েই দেখা যায়, যে বেশী হাসে, তাকে কাঁদতেও হয় বেশী—যত হাসি তত কান্না। ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’—কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়।

*****************

জড়বাদের দৃষ্টিতে দেখলে কুচিন্তাগুলিকে রোগজীবাণু বলা যেতে পারে। আমাদের দেহ যেন লৌহপিণ্ডের মত আর আমাদের প্রত্যেক চিন্তা যেন তার উপর আস্তে আস্তে হাতুড়ির ঘা মারা—তাই দিয়ে আমরা দেহটাকে যেভাবে ইচ্ছা গঠন করি।

আমরা জগতের সমুদয় শুভচিন্তারাশির উত্তরাধিকারী, অবশ্য যদি সেগুলিকে আমাদের মধ্যে অবাধে আসতে দিই।

শাস্ত্র তো সবসময় আমাদের মধ্যেই রয়েছে। মূর্খ, শুনতে পাচ্ছ না কি, তোমার নিজ হৃদয়ে দিবারাত্র সেই অনন্ত সঙ্গীত ধ্বনিত হচ্ছে—‘সচ্চিনানন্দঃ সচ্চিদানন্দঃ, সোঽহং সোঽহম্।’

আমাদের প্রত্যেকের ভিতর—কি ক্ষুদ্র পিপীলিকা, কি স্বর্গের দেবতা—সকলেরই ভিতর অনন্ত জ্ঞানের প্রস্রবণ রয়েছে। প্রকৃত ধর্ম একটিই। আমরা তার বিভিন্ন রূপ নিয়ে, বিভিন্ন প্রতীক নিয়ে—তার বিভিন্ন প্রকাশ নিয়ে ঝগড়া করে মরি। যারা খুঁজতে জানে, তাদের কাছে সত্যযুগ তো এখনই রয়েছে। আমরা নিজেরাই নষ্ট হয়েছি, আর মনে করছি—জগৎ সংসার গোল্লায় গেছে।

এ জগতে পূর্ণশক্তির কোন কার্য থাকে না। তাকে কেবল ‘অস্তি’ বা ‘সৎ’ মাত্র বলা যায়, তার দ্বারা কোন কাজ হয় না।

যথার্থ সিদ্ধিলাভ এক বটে, তবে আপেক্ষিক সিদ্ধি নানাবিধ হতে পারে।

রবিবার, ৩০ জুন


একটা কিছু কল্পনা আশ্রয় না করে চিন্তা করবার চেষ্টা আর অসম্ভবকে সম্ভব করবার চেষ্টা—এক কথা। আমরা কোন একটি বিশেষ জীবকে অবলম্বন না করে স্তন্যপায়ী কোন জীবের ধারণা করতে পারি না। ঈশ্বরের ধারণাসম্বন্ধেও ঐ কথা।

জগতে যতপ্রকার ভাব বা ধারণা আছে, তার যে সূক্ষ্ম সারনিষ্কর্ষ, তাকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি।

প্রত্যেক চিন্তার দুটি ভাগ আছে—একটি হচ্ছে ভাব, আর দ্বিতীয়টি ঐ ভাবদ্যোতক ‘শব্দ’; আমাদের ঐ দুটিকেই নিতে হবে। কি বিজ্ঞানবাদী (Idealist), কি জড়বাদী (Materialist), কারও মত খাঁটি সত্য নয়। ভাব ও তার প্রকাশ দুই-ই আমাদের নিতে হবে।

আমরা আরশিতেই আমাদের মুখ দেখতে পাই—সমুদয় জ্ঞানও সেইরকম প্রতিবিম্বিত বস্তুরই জ্ঞান। কেউ কখনও তার নিজের আত্মা বা ঈশ্বরকে জানতে পারবে না, কিন্তু আমরা স্বয়ংই সেই আত্মা, আমরাই ঈশ্বর বা পরমাত্মা।

তখনই তোমার নির্বাণ-অবস্থা লাভ হবে, যখন তোমার ‘তুমিত্ব’ থাকবে না। বুদ্ধ বলেছিলেনঃ যখন ‘তুমি’ থাকবে না, তখনই তোমার যথার্থ অবস্থা—তখনই তোমার সর্বোচ্চ অবস্থা অর্থাৎ যখন ক্ষুদ্র বা কাঁচা আমিটা চলে যাবে।

অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যে সেই অভ্যন্তরীণ দিব্য জ্যোতিঃ আবৃত ও অস্পষ্ট হয়ে রয়েছে; যেন একটা লোহার পিপের ভিতর একটা আলো রয়েছে, ঐ আলোর একটি রশ্মিও বাইরে আসতে পারছে না। একটু একটু করে পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতা অভ্যাস করতে করতে আমরা ঐ মাঝের আড়ালটাকে ক্রমশঃ পাতলা করে ফেলতে পারি। অবশেষে সেটা কাচের মত স্বচ্ছ হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণে যেন ঐ লোহার পিপে কাচে পরিণত হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে সেই অভ্যন্তরীণ জ্যোতিঃ যথার্থরূপে দেখা যাচ্ছে। আমরা সকলেই এইরূপ কাচের পিপে হবার পথে চলেছি—এমন-কি, এর চেয়েও উচ্চতর বিকাশের আধার হব। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আদৌ কোন পিপে রয়েছে, ততদিন আমাদের জড় উপায়ের সাহায্যেই চিন্তা করতে হবে। অসহিষ্ণু ব্যক্তি কোন কালে সিদ্ধ হতে পারে না।

*****************

বড় বড় সাধুপুরুষেরা আদর্শ তত্ত্বের (Principle) দৃষ্টান্তস্বরূপ; কিন্তু শিষ্যেরা ব্যক্তিকেই আদর্শ বা তত্ত্ব করে তোলে, আর ব্যক্তিকে নাড়াচাড়া করতে করতে তত্ত্বটা ভুলে যায়।

বুদ্ধ সগুণ ঈশ্বর-ভাবকে ক্রমাগত আক্রমণ করেছিলেন বলেই ভারতে প্রতিমাপূজার সূত্রপাত হল! বৈদিক যুগে প্রতিমার অস্তিত্বই ছিল না, তখন লোকে সর্বত্র ঈশ্বর দর্শন করত। কিন্তু বুদ্ধের প্রচারের ফলে আমরা জগৎস্রষ্টা ও ‘আমাদের সখা’ ঈশ্বরকে হারালাম, আর তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রতিমাপূজার উৎপত্তি হল। লোকে বুদ্ধের মূর্তি গড়ে পূজা করতে আরম্ভ করলে। যীশুখ্রীষ্ট-সম্বন্ধেও তাই হয়েছে। কাঠ-পাথরের পূজা থেকে যীশু-বুদ্ধের পূজা পর্যন্ত—সবই প্রতিমাপূজা, কিন্তু কোন-না-কোনরূপ মূর্তি ব্যতীত আমাদের চলতে পারে না।

*****************

জোর করে সংস্কারের চেষ্টার ফল এই যে, তাতে সংস্কার বা উন্নতির গতিরোধ হয়। কাউকে বল না—‘তুমি মন্দ’, বরং তাকে বল—‘তুমি ভালই আছ, আরও ভাল হও।’

পুরুতরা সব দেশেই অনিষ্ট করে থাকে; কারণ তারা লোককে গাল দেয় ও তাদের সমালোচনা করে। তারা একটা দড়ি ধরে টান দেয়, মনে করে—সেটাকে ঠিক করবে, কিন্তু তার ফলে আর দু-তিনটা দড়ি স্থানভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। প্রেমে কখনও কেউ গাল-মন্দ করে না, শুধু প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাতেই মানুষ ঐ রকম করে থাকে। ‘ন্যায়সঙ্গত রাগ’ বলে কোন জিনিষ নেই।

যদি তুমি কাউকে সিংহ হতে না দাও, তা হলে সে ধূর্ত শৃগাল হয়ে দাঁড়াবে। স্ত্রীজাতি শক্তিস্বরূপিণী, কিন্তু এখন ঐ শক্তি কেবল মন্দ বিষয়ে প্রযুক্ত হচ্ছে। তার কারণ, পুরুষ তার উপর অত্যাচার করছে। এখন সে শৃগালীর মত; কিন্তু যখন তার উপর আর অত্যাচার হবে না, তখন সে সিংহী হয়ে দাঁড়াবে।

সাধারণতঃ ধর্মভাবকে বিচার-বুদ্ধি দ্বারা নিয়মিত করা উচিত। তা না হলে ঐ ভাবের অবনতি হয়ে ওটা ভাবুকতা-মাত্রে পরিণত হতে পারে।

*****************
আস্তিকমাত্রেই স্বীকার করেন যে, এই পরিণামী জগতের পশ্চাতে একটা অপরিণামী বস্তু আছে—যদিও সেই চরম পদার্থের ধারণা-সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে মতভেদ আছে। বুদ্ধ এটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘ব্রহ্ম বা আত্মা বলে কিছু নেই।’

চরিত্র-হিসাবে জগতের মধ্যে বুদ্ধ সকলের চেয়ে বড়; তারপর খ্রীষ্ট। কিন্তু গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যা বলে গেছেন, তার মত মহান্ উপদেশ জগতে আর নেই। যিনি সেই অদ্ভুত কাব্য রচনা করেছিলেন, তিনি সেই-সব বিরল মহাত্মাদের মধ্যে একজন, যাঁদের জীবন দ্বারা সমগ্র জগতে এক এক নবজীবনের স্রোত বয়ে যায়। যিনি গীতা লিখেছেন, তাঁর মত আশ্চর্য মাথা মনুষ্যজাতি আর কখনও দেখতে পাবে না!

জগতে একটামাত্র শক্তিই রয়েছে—সেইটেই কখনও মন্দ, কখনও বা ভালভাবে অভিব্যক্ত হচ্ছে। ঈশ্বর আর শয়তান একই নদী—কেবল স্রোতটা পরস্পরের বিপরীত-গামী।

সোমবার, ১ জুলাই


(শ্রীরামকৃষ্ণদেব)
শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা একজন খুব নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণ ছিলেন—এমন-কি, তিনি সকল প্রকার ব্রাহ্মণেরও দান গ্রহণ করতেন না। জীবিকার জন্য তাঁর সাধারণের মত কোন কাজ করবার জো ছিল না। পুঁথি বিক্রি করবার বা কারও চাকরি করবার জো তো ছিলই না, এমন-কি, তাঁর কোন দেবমন্দিরে পৌরোহিত্য করবারও উপায় ছিল না। তিনি একরূপ আকাশবৃত্তি অবলম্বন করে ছিলেন, যা অযাচিতভাবে উপস্থিত হত, তাতেই তাঁর খাওয়া-পরা চলত; কিন্তু তাও কোন পতিত ব্রাহ্মণের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতেন না। হিন্দুধর্মে দেবমন্দিরের তেমন প্রাধান্য নেই। যদি সব মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও ধর্মের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। হিন্দুদের মতে নিজের জন্য বাড়ী তৈরি করা স্বার্থপরতার কাজ; কেবল দেবতা ও অতিথিদের জন্য বাড়ী তৈরি করা যেতে পারে। সেই জন্য লোকে ভগবানের নিবাস-রূপে মন্দিরাদি নির্মাণ করে থাকে।

অতিশয় পারিবারিক অসচ্ছলতা হেতু শ্রীরামকৃষ্ণ অতি অল্পবয়সে এক মন্দিরে পূজারী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মন্দিরে জগজ্জননীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল—তাঁকে প্রকৃতি বা কালীও বলে থাকে। একটি নারীমূর্তি একটি পুরুষমূর্তির উপর দাঁড়িয়ে আছেন—তাতে এই প্রকাশ হচ্ছে যে, মায়াবরণ উন্মোচিত না হলে আমরা জ্ঞানলাভ করতে পারি না। ব্রহ্ম স্বয়ং স্ত্রী বা পুরুষ কিছুই নন—তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। তিনি যখন নিজেকে অভিব্যক্ত করেন, তখন তিনি নিজেকে মায়ার আবরণে আবৃত করে জগজ্জননীরূপ ধারণ করেন ও সৃষ্টিপ্রপঞ্চের বিস্তার করেন। যে পুরুষমূর্তিটি শয়ানভাবে রয়েছেন, তিনি শিব বা ব্রহ্ম, তিনি মায়াবৃত হয়ে শব হয়েছেন। অদ্বৈতবাদী বা জ্ঞানী বলেন, ‘আমি জোর করে মায়া কাটিয়ে ব্রহ্মকে প্রকাশ করব।’ কিন্তু দ্বৈতবাদী বা ভক্ত বলেন, ‘আমরা সেই জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি দ্বার ছেড়ে দেবেন, আর তখনই ব্রহ্ম প্রকাশিত হবেন, তাঁরই হাতে চাবি রয়েছে।’

প্রতিদিন মা-কালীর সেবা-পূজা করতে করতে এই তরুণ পুরোহিতের হৃদয়ে ক্রমে এমন তীব্র ব্যাকুলতা ও ভক্তির উদ্রেক হল যে, তিনি আর নিয়মিতভাবে মন্দিরে পূজার কাজ চালাতে পারলেন না। সুতরাং তিনি তা পরিত্যাগ করে মন্দিরের এলাকার ভিতরেই যেখানে একপাশে ছোটখাটো জঙ্গল ছিল, সেইখানে গিয়ে দিবারাত্র ধ্যানধারণা করতে লাগলেন। সেটি ঠিক গঙ্গার উপরেই ছিল; একদিন গঙ্গার প্রবল স্রোতে ঠিক একখানি কুটির-নির্মাণের উপযোগী সব জিনিষপত্র তাঁর কাছে ভেসে এল। সেই কুটিরে থেকে তিনি ক্রমাগত প্রার্থনা করতে লাগলেন ও কাঁদতে লাগলেন—জগজ্জননী ছাড়া আর কোন বিষয়ের চিন্তা, নিজের দেহরক্ষার চিন্তা পর্যন্ত তাঁর রইল না। তাঁর এক আত্মীয় এই সময়ে তাঁকে দিনের মধ্যে একবার করে খাইয়ে যেতেন, আর তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন। কিছুদিন পর এক সন্ন্যাসিনী এসে তাঁকে তাঁর ‘মা’কে পাবার সহায়তা করতে লাগলেন। তাঁর যে-কোন প্রকার গুরুর প্রয়োজন হত, তাঁরা নিজে থেকেই তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হতেন। সকল সম্প্রদায়ের কোন-না-কোন সাধু এসে তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, আর তিনি আগ্রহ করে সকলেরই উপদেশ শুনতেন। তবে তিনি কেবল সেই জগন্মাতারই উপাসনা করতেন—তাঁর কাছে সবই ‘মা’ বলে মনে হত।

শ্রীরামকৃষ্ণ কারও বিরুদ্ধে কখনও কড়া কথা বলেননি। তাঁর হৃদয় এত উদার ছিল যে, সকল সম্প্রদায়ই ভাবত—তিনি তাদেরই লোক। তিনি সকলকেই ভালবাসতেন। তাঁর দৃষ্টিতে সকল ধর্মই সত্য, তাঁর কাছে সকলেরই স্থান ছিল। তিনি মুক্তস্বভাব ছিলেন, কিন্তু সকলের প্রতি সমান প্রেমেই তাঁর মুক্ত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেত, বজ্রবৎ কঠোরতায় নয়। এইরূপ কোমল থাকের লোকেরাই নূতন ভাব সৃষ্টি করেন, আর ‘হাঁক-ডেকে’ থাকের লোক ঐ ভাব চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সেণ্ট পল এই শেষ থাকের ছিলেন। তাই তিনি সত্যের আলোক চতুর্দিকে বিস্তার করেছিলেন।

সেণ্ট পলের যুগ কিন্তু এখন আর নেই। আমাদেরই এ যুগের নূতন আলোক হতে হবে। আমাদের যুগের এখন বিশেষ প্রয়োজন—এমন একটি সঙ্ঘ, যা আপনা হতেই নিজেকে দেশকালের উপযোগী করে নেবে। যখন তা হবে, তখন সেইটিই হবে জগতের শেষ ধর্ম। সংসার চক্র চলবে—আমাদের তাকে সাহায্য করতে হবে, তাকে বাধা দিলে চলবে না। নানাবিধ ধর্মভাবরূপ তরঙ্গ উঠছে পড়ছে, আর সেই-সকল তরঙ্গের শীর্ষদেশে সেই যুগের অবতার বিরাজ করছেন। রামকৃষ্ণ বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তাঁর ধর্ম গঠনমূলক, এতে ধ্বংসমূলক কিছু নেই। তাঁকে নূতন করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সত্য জানবার চেষ্টা করতে হয়েছিল, ফলে তিনি বৈজ্ঞানিক ধর্ম লাভ করেছিলেন। সে-ধর্ম কাউকে কিছু মেনে নিতে বলে না, নিজে পরখ করে নিতে বলে; বলে, ‘আমি সত্য দর্শন করেছি, তুমিও ইচ্ছা করলে দেখতে পার। আমি যে-সাধন অবলম্বন করেছি, তুমিও সেই সাধন কর, তা হলে তুমিও আমার মত সত্য দর্শন করবে।’ ঈশ্বর সকলের কাছেই আসবেন—সেই সামঞ্জস্য সকলেরই আয়ত্তের ভিতর রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ যা উপদেশ দিয়ে গেছেন, সেগুলি হিন্দুধর্মের সারস্বরূপ, তাঁর নিজের সৃষ্ট কোন নূতন বস্তু নয়। আর তিনি সেগুলি তাঁর নিজস্ব বলে কখনও দাবীও করেননি; তিনি নামযশের কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা করতেন না। তাঁর বয়স যখন প্রায় চল্লিশ, সেই সময় তিনি প্রচার করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তিনি ঐ প্রচারের জন্য কখনও বাইরে কোথাও যাননি। যারা তাঁর কাছে এসে উপদেশ গ্রহণ করবে, তাদের জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন।

হিন্দুসমাজের প্রথানুযায়ী তাঁর পিতামাতা তাঁর যৌবনের প্রারম্ভে পাঁচ বছরের একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। বালিকা এক সুদূর পল্লীতে তাঁর নিজ পরিজনের মধ্যেই বাস করতে থাকেন—তাঁর যুবা পতি যে কি কঠোর সাধনার ভিতর দিয়ে ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তার বিষয় তিনি কিছু জানতেন না। যখন তিনি বড় হলেন, তখন তাঁর স্বামী ভগবৎপ্রেমে তন্ময় হয়ে গিয়েছেন। তিনি হেঁটে দেশ থেকে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ীতে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। স্বামীকে দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন—তাঁর কি অবস্থা; কারণ তিনি স্বয়ং মহা পবিত্রা বিশুদ্ধা ও উন্নতস্বভাবা ছিলেন। তিনি তাঁর কাজে কেবল সাহায্য করবার ইচ্ছাই করেছিলেন; তাঁর কখনও এ-ইচ্ছা হয়নি যে, তাঁকে গৃহস্থের পর্যায়ে টেনে নামিয়ে আনেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভারতে মহান্ অবতারপুরুষগণের মধ্যে একজন বলে পূজিত হয়ে থাকেন। তাঁর জন্মদিন সেখানে ধর্মোৎসব-রূপে পরিগণিত হয়ে থাকে।

*****************

একটি বিশিষ্টলক্ষণযুক্ত গোলাকার শিলা বিষ্ণু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ভগবানের প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রাতঃকালে পুরোহিত এসে সেই শালগ্রামশিলাকে পুষ্পচন্দন নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজা করেন, ধূপকর্পূরাদির দ্বারা আরতি করেন, তারপর তাঁর শয়ন দিয়ে ঐভাবে পূজা করার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ঈশ্বর স্বরূপতঃ রূপবিবর্জিত হলেও তিনি ঐরূপ প্রতীক বা কোনরূপ জড়বস্তুর সাহায্য ব্যতীত তাঁর উপাসনা করতে পারছেন না, এই দোষ বা দুর্বলতার জন্য পূজারী তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি শিলাটিকে স্নান করান, কাপড় পরান এবং নিজের চৈতন্যশক্তি দ্বারা তাঁর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।

একটি সম্প্রদায় আছে, তারা বলে—ভগবানকে কেবল শিব ও সুন্দর-রূপে পূজা করা দুর্বলতামাত্র, আমাদের অশিব রূপকেও ভালবাসতে হবে, পূজা করতে হবে। এই সম্প্রদায় তিব্বত দেশের সর্বত্র বিদ্যমান, আর তাদের ভিতর বিবাহ-পদ্ধতি নেই। এই সম্প্রদায়ের ভারতে প্রকাশ্যভাবে থাকবার জো নেই, সুতরাং তারা গোপনে গোপনে সম্প্রদায় করে থাকে। কোন ভদ্রলোক গুপ্তভাবে ভিন্ন এই-সকল সম্প্রদায়ে যোগ দিতে পারেন না। তিব্বত-দেশে তিনবার সমাধিকারবাদ২৯ কার্যে পরিণত করবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই সে-চেষ্টা বিফল হয়। তারা খুব তপস্যা করে, আর শক্তি (বিভূতি)-লাভের দিক্ দিয়ে খুব সাফল্যও লাভ করে থাকে।

‘তপস্’ শব্দের ধাত্বর্থ তাপ দেওয়া বা উত্তপ্ত করা। এটা আমাদের উচ্চ প্রকৃতিকে ‘তপ্ত’ বা উত্তেজিত করবার সাধনা বা প্রক্রিয়াবিশেষ। যেমন, হয়তো উদয়াস্ত জপ করা—সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্রমাগত ওঙ্কার-জপ। এই-সকল ক্রিয়ার দ্বারা এমন একটা শক্তি জন্মায়, যাকে—আধ্যাত্মিক বা ভৌতিক—যে-কোনরূপে ইচ্ছা পরিণত করা যেতে পারে। এই তপস্যার ভাব সমগ্র হিন্দুধর্মে ওতপ্রোত রয়েছে। এমন-কি হিন্দুরা বলেন যে, ঈশ্বরকেও জগৎসৃষ্টি করবার জন্য তপস্যা করতে হয়েছিল। এটা যেন মানসিক যন্ত্রবিশেষ—এ দিয়ে সব করা যেতে পারে। শাস্ত্রে আছে—‘ত্রিভুবনে এমন কিছু নেই, যা তপস্যা দ্বারা পাওয়া যায় না।’

যে-সব লোক এমন সব সম্প্রদায়ের মতামত বা কার্যকলাপ বর্ণনা করে, যেগুলির সঙ্গে তাদের সহানুভূতি নেই, তারা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মিথ্যাবাদী। যারা সম্প্রদায়বিশেষে দৃঢ়বিশ্বাসী, তারা অপর সম্প্রদায়ে যে সত্য আছে, তা বড় একটা দেখতে পায় না।

ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমানকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—আজ মাসের কোন্ তারিখ? তিনি তাতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘রামই আমার চিরদিনের সন তারিখ সব। আমি আর কোন তারিখ গ্রাহ্য করি না।’

মঙ্গলবার, ২ জুলাই


(জগজ্জননী)
শাক্তেরা জগতের সেই সর্বব্যাপিনী শক্তিকে মা বলে পূজা করে থাকেন—কারণ মা-নামের চেয়ে মিষ্ট নাম আর কিছু নেই। ভারতে মাতাই নারী-চরিত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ। ভগবানকে মাতৃরূপে, প্রেমের উচ্চতম বিকাশরূপে পূজা করাকে হিন্দুরা ‘দক্ষিণাচার’ বা ‘দক্ষিণমার্গ’ বলেন, ঐ উপাসনায় আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়, মুক্তি হয়—এর দ্বারা কখনও ঐহিক উন্নতি হয় না। আর তারঁ ভীষণ রূপের—রুদ্রমূর্তির উপাসনাকে ‘বামাচার’ বা ‘বামমার্গ’ বলে; সাধারণতঃ এতে সাংসারিক উন্নতি খুব হয়ে থাকে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি বড় একটা হয় না। কালে ঐ থেকে অবনতি এসে থাকে, আর যারা ঐ সাধন করে, সেই জাতির একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।

জননীই শক্তির প্রথম বিকাশ-স্বরূপ, আর জনকের ধারণা থেকে জননীর ধারণা ভারতে উচ্চতর বিবেচিত হয়ে থাকে। মা-নাম করলেই শক্তির ভাব, সর্বশক্তিমত্তা—ঐশ্বরিক শক্তির ভাব এসে থাকে, শিশু যেমন নিজের মাকে সর্বশক্তিময়ী মনে করে ভাবে—মা সব করতে পারে। সেই জগজ্জননী ভগবতীই আমাদের অভ্যন্তরে নিদ্রিতা কুণ্ডলিনী—তাঁকে উপাসনা না করে আমরা কখনও নিজেদের জানতে পারি না।

সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই সেই মা। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্। তিনি একজন ব্যক্তি—তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে (যেমন রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)। সেই জগন্মাতার ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমরা যা খুশী তাই করতে পারি। তিনি অতি সত্বর আমাদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকেন।

তিনি যখন ইচ্ছা—যে-কোনরূপে আমাদের দেখা দিতে পারেন। সেই জগজ্জননীর নাম ও রূপ—দুই-ই থাকতে পারে, অথবা রূপ না থেকে শুধু নাম থাকতে পারে। তাঁকে এই-সকল বিভিন্ন ভাবে উপাসনা করতে করতে আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই, যেখানে নামরূপ কিছুই নেই, কেবল শুদ্ধসত্তামাত্র বিরাজিত।

যেমন কোন শরীরবিশেষের সমুদয় কোষগুলি (cells) মিলে একটি মানুষ হয়, সেইরূপ প্রত্যেক জীবাত্মা যেন এক-একটি কোষস্বরূপ, এবং তাদের সমষ্টি ঈশ্বর—আর সেই অনন্ত পূর্ণ তত্ত্ব (ব্রহ্ম) তারও অতীত। সমুদ্র যখন স্থির থাকে, তখন তাকে বলা যায় ‘ব্রহ্ম’, আর সেই সমুদ্রে যখন তরঙ্গ ওঠে, তখন তাকেই আমরা ‘শক্তি’ বা ‘মা’ বলি। সেই শক্তি বা মহামায়াই দেশকালনিমিত্ত-স্বরূপ। সেই ব্রহ্মই মা। তাঁর দুই রূপ—একটি সবিশেষ বা সগুণ, এবং অপরটি নির্বিশেষ বা নির্গুণ। প্রথমোক্ত রূপে তিনি ঈশ্বর, জীব ও জগৎ; দ্বিতীয় রূপে তিনি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। সেই নিরুপাধিক সত্তা থেকেই ঈশ্বর, জীব ও জগৎ এই ত্রিত্বভাব এসেছে। সমস্ত সত্তা—যা কিছু আমরা জানতে পারি, সবই এই ত্রিকোণাত্মক অস্তিত্ব; এটিই বিশিষ্টাদ্বৈত-ভাব।

সেই জগদম্বার এক কণা—এক বিন্দু হচ্ছেন কৃষ্ণ, আর এক কণা বুদ্ধ, আর এক কণা খ্রীষ্ট। আমাদের পার্থিব জননীতে সেই জগন্মতার যে এক কণা প্রকাশ রয়েছে, তারই উপাসনাতে মহত্ত্ব লাভ হয়। যদি পরম জ্ঞান ও আনন্দ চাও, তবে সেই জগজ্জননীর উপাসনা কর।

বুধবার, ৩ জুলাই


সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ভয়েতেই মানুষের ধর্মের আরম্ভ। ঈশ্বরভীতিই জ্ঞানের আরম্ভ। কিন্তু পরে তা থেকে এই উচ্চতর ভাব আসে যে, ‘পূর্ণ প্রেমের উদয়ে ভয় দূরে যায়।’ যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জ্ঞানলাভ করছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জানতে পারছি—ঈশ্বর কি বস্তু, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু না কিছু ভয় থাকবেই। যীশুখ্রীষ্ট মানুষ ছিলেন, সুতরাং তিনি জগতে অপবিত্রতা দেখতে পেতেন—আর তার খুব নিন্দাও করে গেছেন। কিন্তু ঈশ্বর অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ, তিনি জগতে কিছু অন্যায় দেখতে পান না, সুতরাং তাঁর ক্রোধেরও কোন কারণ নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ বা নিন্দাবাদ কখনও সর্বোচ্চ ভাব হতে পারে না। ডেভিডের হস্ত শোণিতে কলুষিত ছিল, সেই জন্য তিনি মন্দির নির্মাণ করতে পারেননি।৩০

আমাদের হৃদয়ে প্রেম, ধর্ম ও পবিত্রতার ভাব যতই বাড়তে থাকে, ততই আমরা বাইরে প্রেম, ধর্ম ও পবিত্রতা দেখতে পাই। আমরা অপরের কার্যের যে নিন্দাবাদ করি, তা প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিজেদেরই নিন্দা। তুমি তোমার ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডটাকে ঠিক কর—যা, তোমার হাতের ভিতর রয়েছে—তা হলে বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডও তোমার পক্ষে আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে। এ যেন জলস্থিতিবিজ্ঞানের (Hydrostatics) সমস্যার মত—একবিন্দু জলের শক্তিতে সমগ্র জগৎকে সাম্যাবস্থায় রাখা যেতে পারে। আমাদের ভিতরে যা নেই, বাইরেও তা দেখতে পারি না। বৃহৎ ইঞ্জিনের পক্ষে তৎসদৃশ অতি ক্ষুদ্র ইঞ্জিন যেরূপ, সমগ্র জগতের তুলনায় আমরাও সেইরূপ। ক্ষুদ্র ইঞ্জিনটির ভিতর কোন গোলমাল দেখে আমরা বৃহৎ ইঞ্জিনটিতেও কোন গোল হয়েছে, এরূপ কল্পনা করে থাকি।

জগতে যথার্থ যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তা প্রেমের শক্তিতেই হয়েছে। দোষ দেখিয়ে দেখিয়ে কোন কালে ভাল কাজ করা যায় না। হাজার হাজার বছর ধরে সেটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে। নিন্দাবাদে কোনই ফল হয় না।

যথার্থ বৈদান্তিককে সকলের সহিত সহানুভূতি করতে হবে, কারণ অদ্বৈতবাদ বা সম্পূর্ণ একত্বভাবই বেদান্তের সারমর্ম। দ্বৈতবাদীরা সাধারণতঃ গোঁড়া হয়ে থাকে—তারা মনে করে, তাদের পথই একমাত্র পথ। ভারতে বৈষ্ণব সম্প্রদায় দ্বৈতবাদী, আর তারা অত্যন্ত গোঁড়া। শৈবেরা আর একটি দ্বৈতবাদী সম্প্রদায়; তাদের মধ্যে ঘণ্টাকর্ণ নামক এক ভক্তের গল্প প্রচলিত আছে। সে শিবের এমন গোঁড়া ভক্ত ছিল যে, অপর কোন দেবতার নাম কানে শুনবে না। পাছে অপর দেবতার নাম শুনতে হয়, সেই ভয়ে সে দু-কানে দুটি ঘণ্টা বেঁধে রাখত। শিব তার প্রগাঢ় ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন, শিব ও বিষ্ণুতে যে কোন প্রভেদ নেই, তা একে বুঝিয়ে দেব। সেইজন্য তিনি তার কাছে অর্ধশিব অর্ধবিষ্ণু অর্থাৎ হরিহর-মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। সেই সময় ঘণ্টাকর্ণ তাঁকে আরতি করছিল। কিন্তু তার এমন গোঁড়ামি যে, যখন সে দেখলে ধূপধুনার গন্ধ বিষ্ণুর নাকে যাচ্ছে, তখন বিষ্ণু যাতে সেই সুগন্ধ উপভোগ করতে না পান, সেজন্য তাঁর নাক চেপে ধরলে!

*****************

মাংসাশী প্রাণী—যেমন সিংহ—এক আঘাত করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু সহিষ্ণু বলদ সারাদিন চলেছে, চলতে চলতেই সে খেয়ে ও ঘুমিয়ে নিচ্ছে। চঞ্চল, সদাক্রিয়াশীল ‘ইয়াঙ্কি’ (মার্কিন) ভাতখেকো চীনা কুলির সঙ্গে পেরে ওঠে না। যতদিন ক্ষাত্রশক্তির প্রাধান্য থাকবে, ততদিন মাংসভোজন প্রচলিত থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ কমে যাবে, তখন নিরামিষাশীর দল প্রবল হবে।

*****************

যখন আমরা ভগবানকে ভালবাসি, তখন যেন আমরা নিজেকে দু-ভাগ করে ফেলি—আমিই আমার অন্তরাত্মাকে ভালবাসি। ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আবার আমিও ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছি। আমরা ঈশ্বরকে আমাদের অনুরূপ করে সৃষ্টি করে থাকি। আমরাই ঈশ্বরকে আমাদের প্রভু হবার জন্য সৃষ্টি করে থাকি, ঈশ্বর আমাদের তাঁর দাস করেননি। যখন আমরা জানতে পারি, আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে এক, ঈশ্বর আমাদের সখা, তখনই প্রকৃত সাম্যাবস্থা লাভ হয়, তখনই আমাদের মুক্তি হয়। সেই অনন্ত পুরুষ থেকে যতদিন তুমি আপনাকে এক চুলও তফাত করবে, ততদিন ভয় কখনও দূর হতে পারে না।

ভগবৎ-সাধনা করে—ভগবানকে ভালবেসে জগতের কি কল্যাণ হবে?—বোকার মত এই প্রশ্ন কখনও কর না। চুলোয় যাক জগৎ, ভগবানকে ভালবাস—আর কিছু চেও না। ভালবাস এবং অপর কিছু প্রত্যাশা কর না। ভালবাস—আর সব মত-মতান্তর ভুলে যাও। প্রেমের পেয়ালা পান করে পাগল হয়ে যাও। বল, ‘হে প্রভু, আমি তোমারই—চিরকালের জন্য তোমারই’—এবং আর সব ভুলে গিয়ে ঝাঁপ দাও। ‘ঈশ্বর’ বলতে যে ‘প্রেম’ ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না। একটা বিড়াল তার বাচ্চাদের ভালবেসে আদর করছে দেখে সেইখানে দাঁড়িয়ে যাও, আর ভগবানের উপাসনা কর। সেই স্থানে ভগবানের আবির্ভাব হয়েছে। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, এ কথা বিশ্বাস কর। সর্বদা বল, ‘আমি তোমার, আমি তোমার’; কারণ আমরা সর্বত্র ভগবানকে দর্শন করতে পারি। তাঁকে কোথাও খুঁজে বেড়িও না—তিনি তো প্রত্যক্ষ রয়েছেন, তাঁকে শুধু দেখে যাও। ‘সেই বিশ্বাত্মা, জগজ্জ্যোতিঃ প্রভু সর্বদা তোমাদের রক্ষা করুন।’

*****************

নির্গুণ পরব্রহ্মকে উপাসনা করা যেতে পারে না, সুতরাং আমাদিগকে আমাদেরই মত প্রকৃতিসম্পন্ন তাঁর প্রকাশ-বিশেষকে উপাসনা করতেই হবে। যীশু আমাদের মত মনুষ্যপ্রকৃতিসম্পন্ন ছিলেন—তিনি ‘খ্রীষ্ট’ হয়েছিলেন। আমরাও তাঁর মত খ্রীষ্ট হতে পারি, আর আমাদের তা হতেই হবে। খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ অবস্থা-বিশেষের নাম—যা আমাদের লাভ করতে হবে। যীশু ও গৌতমের মধ্যে সেই সেই অবস্থা প্রকাশ পেয়েছিল। জগন্মাতা বা আদ্যাশক্তিই ব্রহ্মের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ—তারপর খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণ তাঁর থেকে প্রকাশ হয়েছেন। আমরাই আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা গঠন করে নিজেদের বদ্ধ করি, আবার আমরাই ঐ শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হই। আত্মা অভয়স্বরূপ। আমরা যখন আমাদের আত্মার বাইরে অবস্থিত ঈশ্বরের উপাসনা করি, তখন ভালই করে থাকি, তবে আমরা যে কি করছি, তা জানি না। আমরা যখন আত্মার স্বরূপ জানতে পারি, তখনই ঐ রহস্য বুঝি। একত্বই প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি।

পারসীক সুফীদিগের কবিতায় আছেঃ

‘একদিন এমন ছিল, যখন আমি নারী ও তিনি পুরুষ ছিলেন। উভয়ের মধ্যে ভালবাসা বাড়তে লাগল—শেষে তিনি বা আমি কেউই রইলাম না। এখন এইটুকু মাত্র অস্পষ্টভাবে স্মরণ হয় যে, এক সময়ে দুজন পৃথক্ লোক ছিল; শেষে প্রেম এসে উভয়কে এক করে দিলে।’৩১

জ্ঞান অনাদি অনন্তকাল বর্তমান—ঈশ্বর যতদিন আছেন, জ্ঞানও ততদিন আছে। যে-ব্যক্তি কোন আধ্যাত্মিক নিয়ম আবিষ্কার করেন, তাঁকেই ‘inspired’ বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ বা ঋষি বলে; তিনি যা প্রকাশ করেন, তাকে ‘revelation’ বা অপৌরুষেয় বাণী বলে। কিন্তু এরূপ অপৌরুষেয় বাণীও অনন্ত—এমন নয় যে এ-পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতেই তা শেষ হয়ে গেছে, এবং এখন অন্ধভাবে তার অনুসরণ করতে হবে। বিজেতারা হিন্দুদের ধর্মকে এতদিন ধরে সমালোচনা করে এসেছে যে, এখন তারা (হিন্দুরা) নিজেরাই নিজেদের ধর্ম সমালোচনা করতে সাহস করে, আর এর ফলে তারা স্বাধীনচেতা হয়ে গিয়েছে। তাদের বৈদেশিক শাসনকর্তারা অজ্ঞাতসারে হিন্দুদের পায়ের বেড়ি ভেঙে দিয়েছে। হিন্দুরা জগতের মধ্যে সব চেয়ে ধার্মিক জাতি হয়েও বাস্তবিকই ভগবন্নিন্দা বা ধর্মনিন্দা কাকে বলে, তা জানে না। তাদের মতে ভগবান্‌ বা ধর্মসম্বন্ধে যে-কোন ভাবে আলোচনা করা হোক না, তাতেই পবিত্রতা ও কল্যাণ লাভ হয়ে থাকে। আর তারা অবতার বা শাস্ত্র বা ধর্মধ্বজিতার প্রতি কোন প্রকার কৃত্রিম শ্রদ্ধা বা ভক্তি দেখায় না।

খ্রীষ্টের ধর্মসম্প্রদায় খ্রীষ্টকে তাদের নিজের মতানুযায়ী করে গড়ে তোলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু খ্রীষ্টীয় জীবনাদর্শে নিজেদের গড়বার চেষ্টা করেনি। এজন্যই খ্রীষ্ট-সম্বন্ধে যে-সকল গ্রন্থ উক্ত সম্প্রদায়ের সাময়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার সহায় হয়েছিল, কেবল সেগুলিকেই রাখা হয়েছিল। সুতরাং সেই গ্রন্থগুলির উপর কখনই নির্ভর করা যেতে পারে না। আর এইরূপ গ্রন্থ বা শাস্ত্র-উপাসনা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৌত্তলিকতা—ওটা আমাদের হাত-পা একেবারে বেঁধে রেখে দেয়। এদের মতে কি বিজ্ঞান, কি ধর্ম, কি দর্শন—সবকিছুই ঐ শাস্ত্রের মতানুযায়ী হতে হবে। প্রটেস্টাণ্টদের এই বাইবেলের অত্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক অত্যাচার। খ্রীষ্টান দেশসমূহের প্রত্যেকের মাথার উপর একটা প্রকাণ্ড গির্জা চাপান রয়েছে, আর তার উপরে একখানা ধর্মগ্রন্থ, কিন্তু তবুও মানুষ বেঁচে রয়েছে, আর তার উন্নতিও হচ্ছে। এতেই কি প্রমাণিত হচ্ছে না যে, মানুষ ঈশ্বরস্বরূপ?

জীবের মধ্যে মানুষই সর্বোচ্চ জীব, আর পৃথিবীই সর্বোচ্চ লোক। আমরা ঈশ্বরকে মানুষের চেয়ে বড় বলে ধারণা করতে পারি না; সুতরাং আমাদের ঈশ্বর মানুষ—আবার মানুষও ঈশ্বর। যখন আমরা মনুষ্যভাবের উপরে উঠে তার অতীত উচ্চতর কোন কিছু সাক্ষাৎ করি, তখন আমাদের এ জগৎ ছেড়ে, দেহ-মন-কল্পনা—এ-সবেরই বাইরে লাফ দিতে হয়। আমরা যখন উচ্চাবস্থা লাভ করে সেই অনন্তস্বরূপ হই, তখন আর আমরা এ জগতে থাকি না। আমাদের এই জগৎ ছাড়া অন্য কোন জগৎ জানবার সম্ভাবনা নেই, আর মানুষই এই জগতের সর্বোচ্চ সীমা। পশুদের সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পারি, তা কেবল সাদৃশ্যমূলক জ্ঞান। আমরা নিজেরা যা কিছু করে থাকি অথবা অনুভব করি, তাই দিয়ে আমরা তাদের বিচার করে থাকি।

সমুদয় জ্ঞানের সমষ্টি সর্বদাই সমান—কেবল সেটা কখনও বেশী, কখনও কম অভিব্যক্ত হয়—এই মাত্র। ঐ জ্ঞানের একমাত্র উৎস আমাদের ভিতরে এবং কেবল সেইখানেই ঐ জ্ঞান লাভ করা যায়।

*****************

সমুদয় কাব্য, চিত্রবিদ্যা ও সঙ্গীত কেবল ভাষা, বর্ণ ও ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভাবের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

*****************

ধন্য তারা, যারা শীঘ্র শীঘ্র পাপের ফল ভোগ করে—তাদের হিসাব শীঘ্র শীঘ্র মিটে গেল। যাদের পাপের প্রতিফল বিলম্বে আসে, তাদের মহা দুর্দৈব—তাদের বেশী বেশী ভুগতে হবে।

যাঁরা সমত্বভাব লাভ করেছেন, তাঁরাই ব্রহ্মে অবস্থিত বলে কথিত হন। সকল রকম ঘৃণার অর্থ—যেন আত্মার দ্বারা আত্মার হনন। সুতরাং প্রেমেই জীবনের যথার্থ নিয়ামক। প্রেমের অবস্থা লাভ করাই সিদ্ধাবস্থা; কিন্তু আমরা যতই সিদ্ধির দিকে অগ্রসর হই, ততই আমরা কম কাজ (তথাকথিত কাজ) করতে পারি। সাত্ত্বিক ব্যক্তিরা জানেন ও দেখেন যে, সবই ছেলেখেলামাত্র, সুতরাং তাঁরা কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না।

এক ঘা দিয়ে দেওয়া সোজা, কিন্তু হাত গুটিয়ে স্থির হয়ে থেকে ‘হে প্রভু, আমি তোমারই শরণাগত হলাম’ বলা এবং তিনি যা হয় করুন বলে অপেক্ষা করে থাকা খুবই কঠিন।

শুক্রবার, ৫ জুলাই


যতক্ষণ তুমি সত্যের অনুরোধে যে-কোন মু্হূর্তে বদলাতে প্রস্তুত না হচ্ছ, ততক্ষণ তুমি কখনই সত্য-লাভ করতে পারবে না; অবশ্য তোমাকে দৃঢ়ভাবে সত্যের অনুসন্ধানে লেগে থাকতে হবে।

*****************

চার্বাকেরা ভারতের একটি অতি প্রাচীন সম্প্রদায়—তারা সম্পূর্ণ জড়বাদী ছিল। এখন সে-সম্প্রদায় লুপ্ত হয়ে গেছে, আর তাদের অধিকাংশ গ্রন্থও লোপ পেয়ে গেছে। তাদের মতে আত্মা—দেহ ও ভৌতিক শক্তি থেকে উংপন্ন বলে দেহের নাশে আত্মারও নাশ, এবং দেহনাশের পরও যে আত্মার অস্তিত্ব থাকে, তার কোন প্রমাণ নেই। তারা কেবল ইন্দ্রিয়জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্বীকার করত—অনুমান দ্বারাও যে জ্ঞান-লাভ হতে পারে, তা স্বীকার করত না।

সমাধি-অর্থে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদভাব, অথবা সমত্বভাব লাভ করা।

জড়বাদী বলেন, আমি মুক্ত বলে আমাদের যে জ্ঞান হয়, সেটা ভ্রমমাত্র। বিজ্ঞানবাদী বলেন, আমি বদ্ধ বলে যে জ্ঞান হয়, সেটাই ভ্রম। বেদান্তবাদী বলেন, তুমি মুক্ত ও বদ্ধ দুই-ই। ব্যাবহারিক ভূমিতে তুমি কখনই মুক্ত নও, কিন্তু পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক ভূমিতে তুমি নিত্যমুক্ত।

মুক্তি ও বন্ধন উভয়েরই পারে চলে যাও।

আমরাই শিবস্বরূপ, অতীন্দ্রিয়, অবিনাশী জ্ঞানস্বরূপ। প্রত্যেক ব্যক্তির পশ্চাতে অনন্ত শক্তি রয়েছে, জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করলেই ঐ শক্তি তোমাতে আসবে।

‘হে মাতঃ বাগীশ্বরি, তুমি স্বয়ম্ভু, তুমি আমার জিহ্বায় বাক্-রূপে আবির্ভূতা হও!’

‘হে মাতঃ, বজ্র তোমার বাণীস্বরূপ—তুমি আমার ভিতর আবির্ভূতা হও! হে কালি, তুমি অনন্ত কালরূপিণী, তুমি অমোঘ শক্তিস্বরূপিণী!’

শনিবার, ৬ জুলাই


(অদ্য স্বামীজী ব্যাসকৃত বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্য অবলম্বন করিয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন।)

ওঁ তৎ সৎ!

শঙ্করের মতে জগৎকে দু-ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—অস্মদ্ (আমি) ও যুস্মদ্ (তুমি)। আর আলো ও অন্ধকার যেমন সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ বস্তু, ঐ দুটিও সেরূপ; সুতরাং বলা বাহুল্য, এ দুয়ের কোনটি থেকে অপরটি উৎপন্ন হতে পারে না। এই আমি বা বিষয়ীর (subject) উপর তুমি বা বিষয়ের (object) অধ্যাস হয়েছে। বিষয়ীই একমাত্র সত্য বস্তু, অপরটি অর্থাৎ বিষয় আপাতপ্রতীয়মান সত্তামাত্র। ইহার বিরুদ্ধ মত অর্থাৎ বিষয় সত্য ও বিষয়ী মিথ্যা—এ মত কখনও প্রমাণ করা যেতে পারে না। জড়পদার্থ ও বহির্জগৎ শুধু আত্মারই অবস্থাবিশেষ। প্রকৃতপক্ষে একটি সত্তাই রয়েছে।

আমাদের অনুভূত এই জগৎ সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে উৎপন্ন। যেমন বল-সামান্তরিকে৩২ দুই বিভিন্নমুখী বলপ্রয়োগের ফলে একটি বস্তুতে কর্ণাভিমুখী গতির উৎপত্তি হয়, সেরূপ এই সংসারও আমাদের উপর প্রযুক্ত বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ। এই জগৎ ব্রহ্মস্বরূপ ও সত্য; কিন্তু আমরা জগৎকে সেভাবে দেখছি না; যেমন শুক্তিতে রজত-ভ্রম হয়, তেমনি আমাদেরও ব্রহ্মে জগদ্‌ভ্রম হয়েছে। একেই বলে ‘অধ্যাস’। যে সত্তা একটা সত্য বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তাকেই অধ্যস্ত সত্তা বলে। যেমন পূর্বে যে দৃশ্য দেখেছি, এখন তার স্মরণ হল। সেই সময়ের জন্য সেটা সত্য বলে বোধ হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়; অথচ অধ্যাসের দৃষ্টান্ত অপরে এইরূপ দেন—উষ্ণতা জলের ধর্ম বা গুণ নয়, অথবা যেমন আমরা জলে উষ্ণতা কল্পনা করে থাকি। সুতরাং অধ্যাস মানে ‘অ-তস্মিন্ তদ্‌বুদ্ধিঃ’—যে বস্তু যা নয়, তাতে সেই বুদ্ধি করা। অতএব বোঝা যাচ্ছে যে, আমরা যখন জগৎ দেখছি, তখন আমরা সত্যকেই দর্শন করছি, কিন্তু যে মাধ্যমের ভেতর দিয়ে দেখছি—তার দ্বারা সত্য বিকৃতভাবাপন্ন হয়ে দেখা যাচ্ছে।

তুমি নিজেকে বাইরে বিষয়রূপে প্রক্ষেপ না করে কখনও নিজেকে জানতে পার না। ভ্রান্তির অবস্থায় আমাদের সামনের বস্তুগুলোকেই আমরা সত্য বলে মনে করি, অদৃষ্ট বস্তুকে কখনও সত্য বলে আমাদের বোধ হয় না। এইরূপে আমরা বিষয়কে (object) বিষয়ী (subject) বলে ভুল করে থাকি। আত্মা কিন্তু কখনও বিষয় (object) হন না। মনে হচ্ছে অন্তঃকরণ বা অন্তরিন্দ্রিয়, আর বহিরিন্দ্রিয়গুলি তারই যন্ত্রস্বরূপ। বিষয়ীতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে বহিঃপ্রক্ষেপশক্তি (objectifying power) আছে—তার দ্বারাই তিনি জানতে পারেন, ‘আমি আছি’। কিন্তু সেই আত্মা বা বিষয়ী নিজেরই বিষয়—মন বা ইন্দ্রিয়ের বিষয় নন। তবে আমরা একটা ভাবকে (idea) আর একটা ভাবের উপর অধ্যাস করতে পারি—যেমন আমরা যখন বলি, ‘আকাশ নীল’—আকাশটা একটা ভাবমাত্র, আর নীলত্বও একটা ভাব—আমরা নীলত্ব ভাবটা আকাশের উপর আরোপ বা অধ্যাস করে থাকি।

বিদ্যা ও অবিদ্যা বা জ্ঞান ও অজ্ঞান—এই দুই নিয়ে জগৎ, কিন্তু আত্মা কোন কালে অবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয় না। আপেক্ষিক জ্ঞানও ভাল, কারণ সেটা সেই চরম জ্ঞানে আরোহণ করবার সোপান। কিন্তু ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান বা মানসিক জ্ঞান, এমন কি দেব-প্রমাণজন্য জ্ঞানও কখনও পরমার্থ সত্য হতে পারে না; কারণ ঐগুলি সবই আপেক্ষিক জ্ঞানের সীমার ভিতর। প্রথমে ‘আমি দেহ’ এই ভ্রম দূর করে দাও, তবেই যথার্থ জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা হবে। মানবীয় জ্ঞান পশুজ্ঞানেরই উচ্চতর অবস্থামাত্র।

*****************

বেদের এক অংশে কর্মকাণ্ড—নানাবিধ অনুষ্ঠানপদ্ধতি, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতির উপদেশ আছে। অপরাংশে ব্রহ্মজ্ঞান ও যথার্থ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের বিষয় বর্ণিত আছে। বেদের এই ভাগ আত্মতত্ত্ব-সম্বন্ধে উপদেশ দেন, আর সেইজন্যই বেদের ঐ ভাগের জ্ঞান যথার্থ পারমার্থিক জ্ঞানের অতি সমীপবর্তী। সেই অনন্ত পূর্ণ পরব্রহ্মের জ্ঞান কোন শাস্ত্রের উপর বা অপর কিছুর উপর নির্ভর করে না; এই জ্ঞান স্বয়ংপূর্ণ-স্বরূপ। বহুশাস্ত্রপাঠেও এই জ্ঞান লাভ হয় না; এ কোন মতবিশেষ নয়, এ জ্ঞান অপরোক্ষানুভূতি। আরশির উপর যে ময়লা রয়েছে, তা পরিষ্কার করে ফেল। নিজের মনটা পবিত্র কর, তা হলেই দপ্ করে তোমার এই জ্ঞানের উদয় হবে যে, তুমি ব্রহ্ম।

শুধু ব্রহ্মই আছেন—জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, নরহত্যা নেই, কোনরূপ পরিণাম নেই, ভালও নেই, মন্দও নেই,—সবই আমরা ‘রজ্জুকে সর্প’ মনে করছি—ভ্রম আমাদেরই। আমরা তখনই কেবল জগতের কল্যাণ করতে পারি, যখন আমরা ভগবানকে ভালবাসি, এবং তিনিও আমাদের ভালবাসেন। হত্যাকারী ব্যক্তিও ব্রহ্মস্বরূপ—তার উপর হত্যাকারিরূপ যে আবরণ রয়েছে, সেটা তাতে অধ্যস্ত বা আরোপিত হয়েছে মাত্র। আস্তে আস্তে হাত ধরে তাকে এই সত্য জানিয়ে দাও।

আত্মাতে কোন জাতিভেদ নেই; আছে—ভাবাটাই ভ্রম। সেই রকম আত্মার জীবন বা মরণ বা কোন প্রকার গতি বা গুণ আছে—এরূপ ভাবাও ভ্রম। আত্মার কখনও পরিণাম হয় না, আত্মা কোথাও যানও না, আসেনও না। তিনি তাঁর নিজের সমুদয় প্রকাশগুলির অনন্ত সাক্ষিস্বরূপ, কিন্তু আমরা তাঁকে ঐ ঐ প্রকাশ বলে মনে করছি। এ এক অনাদি অনন্ত ভ্রম চিরকাল ধরে চলেছে। তবে বেদকে আমাদের ভূমিতে নেমে এসে উপদেশ দিতে হচ্ছে, কারণ বেদ যদি উচ্চতম সত্যকে উচ্চতম ভাবে বা ভাষায় আমাদের কাছে বলতেন, তা হলে আমরা বুঝতেই পারতাম না।

স্বর্গ আমাদের বাসনাসৃষ্ট কুসংস্কার-মাত্র, আর বাসনা চিরকালই বন্ধন—অবনতির দ্বারস্বরূপ। ব্রহ্মদৃষ্টি ছাড়া আর কোনভাবে কোন বস্তুকে দেখো না। তা যদি কর, তা হলে অন্যায় বা মন্দ দেখবে; কারণ আমরা যে বস্তু দেখতে পাই, তার উপর একটা ভ্রমাত্মক আবরণ প্রক্ষেপ করি, তাই মন্দ দেখতে পাই। এই-সব ভ্রম থেকে মুক্ত হও এবং পরমানন্দ উপভোগ কর। সব রকম ভ্রম থেকে মুক্ত হওয়াই মুক্তি।

এক হিসাবে সকল মানুষই ব্রহ্মকে জানে; কারণ সে জানে, ‘আমি আছি’; কিন্তু মানুষ নিজের যথার্থ স্বরূপ জানে না। আমরা সকলেই জানি যে, আমরা আছি, কিন্তু কি করে আছি, তা জানি না। অদ্বৈতবাদ ছাড়া জগতের অন্যান্য নিম্নতর ব্যাখ্যা আংশিক সত্যমাত্র। কিন্তু বেদের তত্ত্ব এই যে—আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে যে আত্মা রয়েছে, তা ব্রহ্মস্বরূপ। জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যে যা কিছু সব—জন্ম, মৃত্যু, বৃদ্ধি, উৎপত্তি স্থিতি ও প্রলয় দ্বারা সীমাবদ্ধ। আমাদের অপরোক্ষানুভূতি বেদেরও অতীত; কারণ বেদেরও প্রামাণ্য ঐ অপরোক্ষানুভূতির উপর নির্ভর করে। সর্বোচ্চ বেদান্ত হচ্ছে—প্রপঞ্চাতীত সত্তার তত্ত্বজ্ঞান।

‘সৃষ্টির আদি আছে’ বললে সর্বপ্রকার দার্শনিক বিচারের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়।

জগৎপ্রপঞ্চের অন্তর্গত অব্যক্ত ও ব্যক্ত শক্তিকে ‘মায়া’ বলে। যতক্ষণ সেই মাতৃরূপিণী মহামায়া আমাদের ছেড়ে না দিচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা মুক্ত হতে পারি না।

জগৎটা আমাদের উপভোগের জন্য পড়ে রয়েছে; কিন্তু কখনও অভাববোধ করে কিছু চেও না। অভাববোধ করাটা দুর্বলতা, অভাববোধই আমাদের ভিক্ষুক করে ফেলে। আমরা ভিক্ষুক নই, আমরা রাজপুত্র!

রবিবার, ৭ জুলাই, প্রাতঃকাল


অনন্ত জগৎপ্রপঞ্চকে যতই ভাগ করা যাক না কেন, তা অনন্তই থাকে, আর তার প্রত্যেক ভাগটাও অনন্ত।

পরিণামী ও অপরিণামী, ব্যক্ত ও অব্যক্ত—উভয় অবস্থাতেই ব্রহ্ম এক। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়কে এক বলে জেন। জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই ত্রিপুটী জগৎপ্রপঞ্চরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। যোগী ধ্যানে যে ঈশ্বর দর্শন করেন, তা তিনি নিজ আত্মার শক্তিতেই দেখে থাকেন।

আমরা যাকে স্বভাব বা অদৃষ্ট বলি, তা কেবল ঈশ্বরেচ্ছা মাত্র। যতদিন ভোগসুখ খোঁজা যায়, ততদিন বন্ধন থেকে যায়। যতক্ষণ অপূর্ণ থাকা যায়, ততক্ষণই ভোগ সম্ভব; কারণ ভোগের অর্থ অপূর্ণ বাসনার পরিপূর্তি। জীবাত্মা প্রকৃতিকে সম্ভোগ করে থাকে। প্রকৃতি, জীবাত্মা ও ঈশ্বর—এদের অন্তর্নিহিত সত্য হচ্ছেন ব্রহ্ম। কিন্তু যতদিন আমরা তাঁকে বাইরে প্রকাশ না করছি, ততদিন তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। যেমন ঘর্ষণের দ্বারা অগ্নি উৎপাদন করতে পারা যায়, তেমনি ব্রহ্মকেও মন্থনের দ্বারা প্রকাশ করতে পারা যায়। দেহটাকে নিম্ন অরণি, প্রণব বা ওঙ্কারকে উত্তরারণি বলে কল্পনা কর, আর ধ্যান যেন মন্থন।৩৩ তা হলে আত্মার মধ্যে যে ব্রহ্মজ্ঞান-রূপ অগ্নি আছে, তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। তপস্যা দ্বারা এইটে করতে চেষ্টা কর। দেহকে সরল ভাবে রেখে ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে আহুতি দাও। ইন্দ্রিয়কেন্দ্রগুলি সব ভিতরে, তাদের যন্ত্র বা গোলকগুলি কেবল বাইরে।সুতরাং তাদের জোর করে মনে প্রবেশ করিয়ে দাও। তারপর ধারণা-সহায়ে মনকে ধ্যানে স্থির কর। যেমন দুধের ভিতর সর্বত্র ঘি রয়েছে, ব্রহ্মও সেইরূপ জগতের সর্বত্র রয়েছেন। কিন্তু মন্থন দ্বারা তিনি এক বিশেষ স্থানে প্রকাশ পান। যেমন মন্থন করলে দুধের মাখন উঠে পড়ে, তেমনি ধ্যানের দ্বারা আত্মার মধ্যে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার হয়।৩৪

সমুদয় হিন্দুদর্শন বলেন, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় ছাড়া একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। তাই দিয়েই অতীন্দ্রিয় জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে।

*****************

জগৎটা একটা অবিরাম গতি-স্বরূপ; আর ঘর্ষণ (friction) হতেই কালে সমুদয়ের নাশ হবে; তারপর দিন-কতক বিশ্রাম হয়ে আবার সব আরম্ভ হবে।

যতদিন এই ‘ত্বগম্বর’ মানুষকে বেষ্টন করে থাকে, অর্থাৎ যতদিন সে নিজেকে দেহের সঙ্গে অভিন্ন ভাবছে, ততদিন সে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না।

ঐ দিন, অপরাহ্ণ

ভারতের ছটি দর্শনকে ‘আস্তিক দর্শন’ বলে; কারণ তারা বেদে বিশ্বাসী। ব্যাসের দর্শন বিশেষভাবে উপনিষদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি সূত্রাকারে অর্থাৎ যেমন বীজগণিতশাস্ত্রে খুব সংক্ষেপে কয়েকটা অক্ষরের সাহায্যে ভাব-প্রকাশ করা হয়, তেমনি ভাবে এটা লিখেছিলেন—এতে কর্তা ক্রিয়া বড় একটা নেই। ব্যাসসূত্র এইরূপ সংক্ষেপে রচিত হওয়ায় শেষে তার অর্থ বুঝতে এত গোল হল যে, ঐ এক সূত্র থেকেই দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এবং অদ্বৈতবাদের উৎপত্তি হল। এই অদ্বৈতবাদই ‘বেদান্ত-কেশরী’। আর এই-সব বিভিন্ন মতের বড় বড় ভাষ্যকারেরা বেদের অক্ষর-রাশিকে তাঁদের দর্শনের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য সময়ে সময়ে ‘জেনে শুনে মিথ্যাবাদী’ হয়েছেন।

উপনিষদে কোন ব্যক্তিবিশেষের কার্যকলাপের ইতিহাস অতি অল্পই পাওয়া যায়; কিন্তু অন্যান্য প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থই প্রধানতঃ কোন ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস।

বেদে প্রায় শুধু দার্শনিক তত্ত্বেরই আলোচনা আছে। দর্শনবর্জিত ধর্ম কুসংস্কারে গিয়ে দাঁড়ায়, আবার ধর্মবর্জিত দর্শন শুধু নাস্তিকতায় পরিণত হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মানে অদ্বৈতবাদ, কিন্তু বিশেষযুক্ত। তার ব্যাখ্যাতা রামানুজ। তিনি বলেন, ‘বেদরূপ ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করে ব্যাস মানবজাতির কল্যাণের জন্য এই বেদান্তদর্শন-রূপ মাখন তুলেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন ‘জগৎপ্রভু ব্রহ্ম অশেষকল্যাণগুণ-সমন্বিত পুরুষোত্তম।’ মধ্ব পুরোদস্তুর দ্বৈতবাদী। … তিনি বলেন, স্ত্রীলোকের পর্যন্ত বেদপাঠে অধিকার আছে। তিনি প্রধানতঃ পুরাণ থেকে তাঁর মত-স্থাপনের জন্য শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, ব্রহ্ম মানে বিষ্ণু—শিব নন, কারণ বিষ্ণু ভিন্ন মুক্তিদাতা আর কেউ নেই।


সোমবার, ৮ জুলাই


মধ্বাচার্যের ব্যাখ্যার ভিতর বিচারের স্থান নেই—তিনি শাস্ত্রপ্রমাণেই সব গ্রহণ করেছেন।

রামানুজ বলেন, বেদই সর্বাপেক্ষা পবিত্র পঠনীয় গ্রন্থ। ত্রৈবর্ণিক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন উচ্চ বর্ণের সন্তানদের যজ্ঞোপবীত-গ্রহণের পর অষ্টম, দশম বা একাদশ বর্ষ বয়সে বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করা উচিত। বেদাধ্যয়নের অর্থ গুরুগৃহে গিয়ে নিয়মিত স্বর ও উচ্চারণের সহিত বেদের শব্দরাশি আদ্যন্ত কণ্ঠস্থ করা।

জপের অর্থ—ভগবানের পবিত্র নাম পুনঃপুনঃ উচ্চারণ; এই জপ করতে করতে সাধক ক্রমে ক্রমে সেই অনন্তরূপে উপনীত হন। যাগযজ্ঞাদি যেন ভঙ্গুর নৌকা। ব্রহ্মকে জানতে হলে ঐ যাগযজ্ঞাদি ছাড়া আরও কিছু চাই। আর ব্রহ্মজ্ঞানই মুক্তি। মুক্তি আর কিছু নয়—অজ্ঞানের বিনাশ; ব্রহ্মজ্ঞানেই এই অজ্ঞানের বিনাশ হয়। বেদান্তের তাৎপর্য জানতে গেলে যে এই-সব যাগযজ্ঞ করতেই হবে, তার কোন মানে নেই; কেবল ওঙ্কার জপ করলেই যথেষ্ট।

ভেদ-দর্শনই সমুদয় দুঃখের কারণ, আর অজ্ঞানই এই ভেদ-দর্শনের কারণ। এইজন্যই যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই; কারণ তাতে ভেদজ্ঞান আরও বাড়িয়ে দেয়। ঐ-সকল যাগযজ্ঞাদির উদ্দেশ্য কিছু (ভোগসুখ) লাভ করা—অথবা কোন কিছু (দুঃখ) থেকে নিস্তার পাওয়া।

ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়, আত্মাই ব্রহ্ম, এবং আমরাই সেই আত্মস্বরূপ—এই প্রকার জ্ঞানের দ্বারাই সকল ভ্রান্তি দূর হয়। এই তত্ত্ব প্রথম শুনতে হবে, পরে মনন অর্থাৎ বিচার দ্বারা ধারণা করতে হবে, অবশেষে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে হবে। মনন অর্থে বিচার করা—বিচার দ্বারা, যুক্তিতর্কের দ্বারা ঐ জ্ঞান নিজের ভিতর প্রতিষ্ঠিত করা। প্রত্যক্ষানুভূতি ও সাক্ষাৎকারের অর্থ সর্বদা চিন্তা বা ধ্যানের দ্বারা তাঁকে আমাদের জীবনের অঙ্গীভূত করে ফেলা। এই অবিরাম চিন্তা বা ধ্যান যেন একপাত্র থেকে অপর পাত্রে ঢালা অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার মত। ধ্যান দিবারাত্র মনকে ঐ ভাবের মধ্যে রেখে দেয় এবং তাইতে আমাদের মুক্তিলাভ করতে সাহায্য করে। সর্বদা ‘সোঽহম্, সোঽহম্’ চিন্তা কর—অহরহ এইরূপ চিন্তা মুক্তির প্রায় কাছাকাছি। দিবারাত্র বল—‘সোঽহম্, সোঽহম্’। সর্বদা এইরূপ চিন্তার ফলে অপরোক্ষানুভূতি লাভ হবে। ভগবানকে এইরূপ তন্ময়ভাবে সদাসর্বদা স্মরণের নামই ‘ভক্তি’।

সব রকম শুভকর্ম এই ভক্তিলাভ করতে গৌণভাবে সাহায্য করে থাকে। শুভ চিন্তা ও শুভ কার্য—অশুভ চিন্তা ও অশুভ কর্ম অপেক্ষা কম ভেদজ্ঞান উৎপন্ন করে, সুতরাং গৌণভাবে এরা মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। কর্ম কর, কিন্তু কর্মফল ভগবানে অর্পণ কর। কেবল জ্ঞানের দ্বারাই পূর্ণতা বা সিদ্ধাবস্থা লাভ হয়। যিনি ভক্তিপূর্বক সত্য-স্বরূপ ভগবানের সাধনা করেন, তাঁর কাছে সেই সত্য-স্বরূপ ভগবান্ প্রকাশিত হন।

আমরা যেন প্রদীপ-স্বরূপ, আর ঐ প্রদীপের জ্বালাটাকেই আমরা ‘জীবন’ বলি। যখনই অম্লজান ফুরিয়ে যাবে, তখনই আলোটাও নিবে যাবে। আমরা কেবল প্রদীপটাকে সাফ রাখতে পারি। জীবনটা কতকগুলি জিনিষের মিশ্রণে উৎপন্ন, সুতরাং জীবন অবশ্যই তার উপাদান-কারণগুলিতে লীন হবে।

মঙ্গলবার, ৯ জুলাই


আত্মা-হিসাবে মানুষ বাস্তবিক মুক্ত, কিন্তু মানুষ-হিসাবে সে বদ্ধ, প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক পরিবেশে সে পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ-হিসাবে তাকে একটা যন্ত্রবিশেষ বলা যায়, শুধু তার ভিতর একটা মুক্তি বা স্বাধীনতার ভাব আছে—এই পর্যন্ত। কিন্তু জগতের সর্বপ্রকার শরীরের মধ্যে এই মনুষ্য-শরীরই শ্রেষ্ঠ শরীর, আর মনুষ্য-মনই শ্রেষ্ঠ মন। যখন মানুষ আত্মোপলব্ধি করে, তখন সে আবশ্যকমত যে-কোন শরীর ধারণ করতে পারে; তখন সে সব নিয়মের পারে। এটা প্রথমতঃ একটা উক্তিমাত্র; একে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে কার্যে এটা নিজে নিজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে; আমরা নিজের মনকে বুঝাতে পারি, কিন্তু অপরের মনকে বুঝাতে পারি না। ধর্মবিজ্ঞানের মধ্যে একমাত্র রাজযোগই প্রমাণ করে দেখানো যেতে পারে, আর আমি নিজে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করে যা ঠিক বলে জেনেছি, শুধু তাই শিক্ষা দিয়ে থাকি। বিচার-শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থাই প্রাতিভ জ্ঞান, কিন্তু তা কখনও যুক্তিবিরোধী হতে পারে না।

কর্মের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয়, সুতরাং কর্ম—বিদ্যা বা জ্ঞানের সহায়ক। বৌদ্ধদের মতে মানুষ ও জীবজন্তুর হিতসাধনই একমাত্র কর্ম; ব্রাহ্মণদের মতে উপাসনা ও সর্বপ্রকার যাগযজ্ঞাদি-অনুষ্ঠানও ঠিক সেইরূপ কর্ম এবং চিত্তশুদ্ধির সহায়ক। শঙ্করের মতে—‘শুভাশুভ সর্বপ্রকার কর্মই জ্ঞানের প্রতিবন্ধক।’ যে-সকল কর্ম অজ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়, সেগুলো পাপ—সাক্ষাৎসম্বন্ধে নয়, কিন্তু কারণস্বরূপে, যেহেতু সেগুলির দ্বারা রজঃ ও তমঃ বেড়ে যায়। সত্ত্বের দ্বারাই কেবল জ্ঞানলাভ হয়। পুণ্য ও শুভকর্মের দ্বারা জ্ঞানের আবরণ দূর হয়, আর কেবল জ্ঞানের দ্বারাই আমাদের ঈশ্বরদর্শন হয়।

জ্ঞান কখনও উৎপন্ন করা যেতে পারে না, তাকে কেবল অনাবৃত বা আবিষ্কার করা যেতে পারে; যে কোন ব্যক্তি কোন বড় আবিষ্ক্রিয়া করেন, তাঁকেই উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত (inspired) পুরুষ বলা হয়। কেবল যদি তিনি আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কার করেন, আমরা তাঁকে ঋষি বা অবতার বলি; আর যখন সেটা জড়জগতের কোন সত্য হয়, তখন তাঁকে বৈজ্ঞানিক বলি। যদিও সকল সত্যের মূল সেই এক ব্রহ্ম, তথাপি আমরা প্রথমোক্ত শ্রেণীকে উচ্চতর আসন দিয়ে থাকি।

শঙ্কর বলেনঃ ব্রহ্ম সর্বপ্রকার জ্ঞানের সার—তত্ত্ব-স্বরূপ; আর জ্ঞাতা-জ্ঞান-জ্ঞেয়-রূপ যে অভিব্যক্তি, তা ব্রহ্মে কাল্পনিক ভেদমাত্র। রামানুজ ব্রহ্মে জ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। খাঁটি অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মে কোন গুণই স্বীকার করেন না—এমন-কি সত্তা পর্যন্ত নয়, সত্তা বলতে আমরা যাই কেন বুঝি না। রামানুজ বলেনঃ আমরা সচরাচর যাকে ‘জ্ঞান’ বলি, ব্রহ্ম তাঁরই সার-স্বরূপ। অব্যক্ত বা সাম্যভাবাপন্ন জ্ঞান—ব্যক্ত বা বৈষম্যাবস্থাপ্রাপ্ত হলেই জগৎপ্রপঞ্চের উৎপত্তি।

*****************

জগতের উচ্চতম দার্শনিক ধর্মসমূহের অন্যতম বৌদ্ধধর্ম ভারতের আপামর সাধারণ সকলের ভিতর ছড়িয়ে পড়েছিল। ভেবে দেখ দেখি, আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আর্যদের সভ্যতা ও শিক্ষা কি অদ্ভুত ছিল, যাতে তারা ঐরূপ উচ্চ উচ্চ ভাব ধারণা করতে পেরেছিল!

ভারতীয় শ্রেষ্ঠ দার্শনিকগণের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই জাতিভেদ স্বীকার করেননি, আর এখন ভারতে তাঁর একটিও অনুগামী দেখতে পাওয়া যায় না। অন্যান্য দার্শনিকেরা সকলেই সামাজিক কুসংস্কারগুলোর অল্পবিস্তর দালাল ছিলেন; তাঁরা যতই উঁচুতে উঠে থাকুক না কেন, তাঁদের মধ্যে একটু-আধটু ‘চিল-শকুনির ভাব’ ছিল। আমার গুরুদেব যেমন বলতেন, ‘চিল-শকুনি এত উঁচুতে ওঠে যে, তাদের দেখা যায় না; কিন্তু তাদের নজর থাকে গো-ভাগাড়ে—কোথায় এক টুকরো পচা মাংস পড়ে আছে!’

*****************

প্রাচীন হিন্দুরা অদ্ভুত পণ্ডিত ছিলেন—যেন জীবন্ত বিশ্বকোষ। তাঁরা বলতেন, বিদ্যা যদি পুঁথিগত হয়, আর ধন যদি পরের হাতে থাকে, কার্যকাল উপস্থিত হলে সে-বিদ্যা বিদ্যা নয়, সে-ধনও ধন নয়।৩৫

শঙ্করকে অনেকে শিবের অবতার বলে জ্ঞান করে থাকে।

বুধবার, ১০ জুলাই


ভারতে সাড়ে ছ-কোটি মুসলমান আছে—তাদের মধ্যে কতক সুফী আছে। এই সুফীরা জীবাত্মাকে পরমাত্মার সহিত অভিন্ন জ্ঞান করে। আর তাদের মাধ্যমেই ঐ ভাব ইওরোপে এসেছে। তারা বলে, ‘আন্ আল্ হক্’ অর্থাৎ আমিই সেই সত্য-স্বরূপ। তবে তাদের ভিতর বহিরঙ্গ (বা প্রকাশ্য), এবং অন্তরঙ্গ (বা গুহ্য) মত আছে। যদিও মহম্মদ নিজে এ মত পোষণ করতেন না।

‘হাশাশিন’ শব্দ থেকে ইংরেজী assassin (হত্যাকারী) শব্দ এসেছে। মুসলমানদের একটি প্রাচীন সম্প্রদায় ধর্মমতের অঙ্গ মনে করে কাফের বা অবিশ্বাসীদের হত্যা করত।

মুসলমানদের উপাসনার সময় এক কুঁজো জল সামনে রাখতে হয়। ঈশ্বর সমগ্র জগৎ পরিপূর্ণ করে রয়েছেন, এটা তাঁরই প্রতীক-স্বরূপ।৩৬

হিন্দুরা দশাবতারে বিশ্বাস করেন। তাঁদের মতে নয় জন অবতার হয়ে গেছেন, দশম অবতার পরে আসবেন।

*****************

বেদের সকল বাক্য তৎপ্রচারিত দর্শনের সমর্থক—এইটি প্রমাণ করতে শঙ্করকে কখনও কখনও কূট তর্কের আশ্রয় নিতে হয়েছে। বুদ্ধ অন্য সকল ধর্মাচার্যের চেয়ে বেশী সাহসী ও অকপট ছিলেন। তিনি বলে গেছেন, ‘কোন শাস্ত্রে বিশ্বাস কর না। বেদ৩৭ মিথ্যা। যদি আমার উপলব্ধির সঙ্গে বেদ মেলে, সে বেদেরই সৌভাগ্য। আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ শাস্ত্র; যাগযজ্ঞ ও দেবোপাসনায় কোন ফল নেই।’ মনুষ্যজাতির মধ্যে বুদ্ধই জগৎকে প্রথমে সর্বাঙ্গসম্পন্ন নীতিবিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। মঙ্গলের জন্যই তিনি মঙ্গলময় জীবন যাপন করতেন, ভালবাসার জন্যই তিনি ভালবাসতেন; তাঁর অন্য অভিসন্ধি কিছু ছিল না।

শঙ্কর বলেন, ব্রহ্মকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হবে, মনন করতে হবে, কারণ বেদ এইরূপ বলছেন। বিচার অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের সহায়ক। বেদ এবং অনুভূত যুক্তি বা ব্যক্তিগত অনুভূতি উভয়ই ব্রহ্মের অস্তিত্বের প্রমাণ। তাঁর মতে বেদ এক প্রকার অনন্ত জ্ঞানের সাকার বিগ্রহ-স্বরূপ। বেদের প্রমাণ এই যে, তা ব্রহ্ম হতে প্রসূত হয়েছে, আবার ব্রহ্মের প্রমাণ এই যে, বেদের মত অদ্ভুত গ্রন্থ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কারও প্রকাশ করবার সাধ্য নেই। বেদ সর্বপ্রকার জ্ঞানের খনিস্বরূপ; আর মানুষ যেমন নিঃশ্বাসের দ্বারা বায়ু বাইরে প্রক্ষেপ করে, সেইরূপ বেদও তাঁর ভেতর থেকে প্রকাশিত হয়েছে; সেইজন্যই আমরা জানতে পারি, তিনি সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ। তিনি জগৎ সৃষ্টি করে থাকুন বা না থাকুন, তাতে বড় কিছু আসে যায় না; কিন্তু তিনি যে বেদ প্রকাশ করেছেন, এইটেই বড় জিনিষ। বেদের সাহায্যেই জগৎ ব্রহ্ম-সম্বন্ধে জানতে পেরেছে—তাঁকে জানবার আর অন্য উপায় নেই।

শঙ্করের এই মত, অর্থাৎ বেদ সমুদয় জ্ঞানের খনি—এটা সমগ্র হিন্দুজাতির এমন মজ্জাগত হয়ে গেছে যে, তাদের মধ্যে একটা প্রবাদ এই যে, গরু হারালেও বেদে তা খুঁজে পাওয়া যায়।

শঙ্কর আরও বলেন, কর্মকাণ্ডের বিধিনিষেধ মেনে চলাই জ্ঞান নয়। ব্রহ্মজ্ঞান কোনপ্রকার নৈতিক বাধ্যবাধকতা, যাগযজ্ঞাদি-অনুষ্ঠান বা আমাদের মতামতের উপর নির্ভর করে না; যেমন একটা স্থাণুকে একজন ভূত মনে করছে বা অপর একজন স্থাণুজ্ঞান করছে, তাতে স্থাণুর কিছু আসে যায় না।

বেদান্তবেদ্য জ্ঞান আমাদের বিশেষ প্রয়োজন, কারণ বিচার বা শাস্ত্রদ্বারা আমাদের ব্রহ্ম উপলব্ধি হতে পারে না। তাঁকে সমাধি দ্বারা উপলব্ধি করতে হবে, আর বেদান্তই ঐ অবস্থালাভের উপায় দেখিয়ে দেয়। আমাদের সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের ভাব অতিক্রম করে সেই নির্গুণ ব্রহ্মে পৌঁছতে হবে। সব অনুভূতির ভেতর প্রত্যেক ব্যক্তিই ব্রহ্মকে অনুভব করছে৩৮; ব্রহ্ম ছাড়া আর অনুভব করবার দ্বিতীয় বস্তুই নেই। আমাদের ভিতর যেটা ‘আমি, আমি’ করছে, সেটাই ব্রহ্ম। কিন্তু যদিও আমরা দিনরাত তাঁকে অনুভব করছি, তথাপি আমরা জানি না যে, তাঁকে অনুভব করছি। যে মু্হূর্তে আমরা ঐ সত্য জানতে পারি, সেই মুহূর্তেই আমাদের সব দুঃখকষ্ট চলে যায়; সুতরাং আমাদের ঐ সত্যকে জানতেই হবে। একত্ব-অবস্থা লাভ কর, তা হলে আর দ্বৈতভাব আসবে না। কিন্তু যাগযজ্ঞাদি দ্বারা জ্ঞানলাভ হয় না; আত্মাকে অন্বেষণ করা, উপাসনা ও সাক্ষাৎ করা—এই-সকলের দ্বারাই সেই জ্ঞানলাভ হবে।

ব্রহ্মবিদ্যাই পরা বিদ্যা; অপরা বিদ্যা হচ্ছে বিজ্ঞান। মুণ্ডকোপনিষৎ অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের জন্য উপদিষ্ট উপনিষৎ এই উপদেশ দিচ্ছেন।৩৯ দুই প্রকার বিদ্যা আছে—পরা ও অপরা। তন্মধ্যে বেদের যে অংশে দেবোপাসনা ও নানাবিধ যাগযজ্ঞের উপদেশ—সেই কর্মকাণ্ড এবং সর্ববিধ লৌকিক জ্ঞানই অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর পুরুষকে লাভ করা যায়, তাই পরা বিদ্যা। সেই অক্ষর পুরুষ নিজের মধ্যে থেকেই সমুদয় সৃষ্টি করছেন—বাইরে অপর কিছু নেই, যা জগৎকারণ হতে পারে। সেই ব্রহ্মই সমুদয় শক্তিস্বরূপ, ব্রহ্মই যা কিছু আছে—সব। যিনি আত্মযাজী, তিনিই কেবল ব্রহ্মকে জানেন। মূর্খেরাই বাহ্য পূজাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, অজ্ঞানব্যক্তিরাই মনে করে, কর্মের দ্বারা আমাদের ব্রহ্মলাভ হতে পারে। যাঁরা সুষুম্নাবর্ত্মে (যোগীদের মার্গে) গমন করেন, তাঁরাই শুধু আত্মাকে লাভ করেন। এই ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা করতে হলে গুরুর কাছে যেতে হবে। সমষ্টিতেও যা আছে, ব্যষ্টিতেও তাই আছে; আত্মা থেকেই সব কিছু প্রসূত হয়েছে। ওঙ্কার হচ্ছে যেন ধনু, আত্মা হচ্ছে যেন তীর, আর ব্রহ্ম হচ্ছেন লক্ষ্য। অপ্রমত্ত হয়ে তাঁকে বিদ্ধ করতে হবে। তাঁতে মিশে এক হয়ে যেতে হবে।৪০ সসীম অবস্থায় আমরা সেই অসীমকে কখনও প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমরাই সেই অসীমস্বরূপ। এইটি জানলে আর কারও সঙ্গে আমরা তর্ক করি না।

ভক্তি, ধ্যান ও ব্রহ্মচর্যের দ্বারা সেই দিব্যজ্ঞানলাভ করতে হবে। ‘সত্যমের জয়তে নানৃতম্, সত্যেনৈব পন্থা বিততো দেবযানঃ।’৪১ সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার কখনই জয় হয় না। সত্যের ভিতর দিয়েই ব্রহ্মলাভের একমাত্র পথ রয়েছে; কেবল সেখানেই প্রেম ও সত্য বর্তমান।

বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই


মায়ের ভালবাসা ব্যতীত কোন সৃষ্টিই স্থায়ী হতে পারে না। জগতের কোন কিছুই সম্পূর্ণ জড়ও নয়, আবার সম্পূর্ণ চিৎও নয়। জড় ও চিৎ পরস্পর-সাপেক্ষ—একটা দ্বারাই অপরটার ব্যাখ্যা হয়। এই পরিদৃশ্যমান জগতের যে একটা ভিত্তি আছে, এ-বিষয়ে সকল আস্তিকই একমত, কেবল সেই ভিত্তিস্থানীয় বস্তুর প্রকৃতি বা স্বরূপ-সম্বন্ধেই তাঁদের মতভেদ। জড়বাদীরা জগতের ঐরূপ কোন ভিত্তি আছে বলে স্বীকারই করে না।

সকল ধর্মের জ্ঞানাতীত বা তুরীয় অবস্থা এক। দেহজ্ঞান অতিক্রম করলে হিন্দু, খ্রীষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ—এমন-কি যারা কোনপ্রকার ধর্মমত স্বীকার করে না, সকলেই ঠিক একই প্রকার অনুভূতি হয়ে থাকে।

যীশুর দেহত্যাগের পঁচিশ বৎসর পরে তাঁর শিষ্য টমাস (Apostle Thomas) কর্তৃক জগতের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ খ্রীষ্টান সম্প্রদায় ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা (Anglo-Saxons) তখনও অসভ্য ছিল—গায়ে চিত্র-বিচিত্র আঁকত ও পর্বতগুহায় বাস করত। এক সময়ে ভারতে প্রায় ৩০ লক্ষ খ্রীষ্টান ছিল, কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ হবে।

খ্রীষ্টধর্ম চিরকালই তরবারির বলে প্রচারিত হয়েছে। কি আশ্চর্য, খ্রীষ্টের ন্যায় নিরীহ মহাপুরুষের শিষ্যেরা এত নরহত্যা করেছে! বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রীষ্ট ধর্ম—জগতে এই তিনটিই প্রচারশীল ধর্ম। এদের পূর্ববর্তী তিনটি ধর্ম, যথা—হিন্দু, য়াহুদী ও জরথুস্ট্রের (পারসী) ধর্ম কখনও অপরকে ধর্মান্তরিত করে দলপুষ্টি করতে চেষ্টা করেনি। বৌদ্ধেরা কখনও নরহত্যা করেনি, তারা শুধু কোমল ব্যবহারের দ্বারাই এক সমেয় জগতের তিন-চতুর্থাংশ লোককে নিজমতে নিয়ে এসেছিল।

বৌদ্ধেরা ছিল সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত অজ্ঞেয়বাদী। বাস্তবিকই শূন্যবাদ বা অদ্বৈতবাদ, এই দুয়ের মাঝখানে সত্যি কোথাও থামতে পার না। বৌদ্ধেরা বিচারের দ্বারা সব কেটে দিয়েছিল—তারা তাদের মত যুক্তি দ্বারা যতদূর নিয়ে যাওয়া চলে, তা নিয়ে গিয়েছিল। অদ্ধৈতবাদীরাও তাদের মত যুক্তির চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছিল এবং সেই এক অখণ্ড অদ্বয় ব্রহ্মবস্তুতে পৌঁছেছিল—যা থেকে সমুদয় জগৎপ্রপঞ্চ ব্যক্ত হচ্ছে। বৌদ্ধ ও অদ্বৈতবাদী উভয়েরই একই সময়ে একত্ব ও বহুত্ব (অভেদ ও ভেদ)-বোধ আছে। এই দুটি অনুভূতির মধ্যে একটি সত্য, অপরটি মিথ্যা হবেই। শূন্যবাদী বলেন, পৃথকত্ব বা বহুত্ববোধ সত্য; অদ্বৈতবাদী বলেন, একত্ববোধই সত্য; সমগ্র জগতে এই বিবাদই চলেছে। এই নিয়েই ধস্তাধস্তি (tug of war) চলেছে।

অদ্বৈতবাদী জিজ্ঞাসা করেন, শূন্যবাদী একত্বের কোন ভাব পান কি করে? ঘূর্ণমান আলোটা (অলাতচক্র) বৃত্তাকার মনে হয় কি করে? একটা স্থিতি স্বীকার করলে তবেই গতির ব্যাখ্যা হতে পারে। সব জিনিষের পশ্চাতে একটা অখণ্ড সত্তা প্রতীয়মান হচ্ছে, সেটা শূন্যবাদী বলেন—ভ্রমমাত্র; কিন্তু এরূপ ভ্রমোৎপত্তির কারণ কি, তা তিনি কোনরূপে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। আবার অদ্বৈতবাদীও বোঝাতে পারেন না যে, এক বহু হল কি করে। এর ব্যাখ্যা কেবলমাত্র পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতীত অবস্থায় গেলেই পাওয়া যেতে পারে। আমাদের তুরীয় ভূমিতে উঠতে হবে, একেবারে অতীন্দ্রিয় অবস্থায় যেতে হবে। অতীন্দ্রিয় শক্তি যেন ঐ অবস্থায় যাবার একটি যন্ত্রস্বরূপ, আর তার ব্যবহার অদ্বৈতবাদীরই করায়ত্ত। তিনিই ব্রহ্মসত্তাকে অনুভব করতে সমর্থ; মানুষ ‘বিবেকানন্দ’ নিজেকে ব্রহ্মসত্তাতে পরিণত করতে পারে, আবার সেই অবস্থা থেকে মানবীয় অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। সুতরাং তার পক্ষে জগৎসমস্যার মীমাংসা হয়ে গেছে, আর গৌণভাবে অপরের পক্ষেও ঐ মীমাংসা হয়ে গেছে, কারণ সে অপরকে ঐ অবস্থায় পৌঁছবার পথ দেখিয়ে দিতে পারে। এইরূপে বোঝা যাচ্ছে, যেখানে দর্শনের শেষ সেখানে ধর্মের আরম্ভ। আর এইরূপ উপলব্ধির দ্বারা জগতের কল্যাণ এই হবে যে, এখন যা জ্ঞানাতীত রয়েছে, কালে তা সর্বসাধারণের পক্ষে জ্ঞানগম্য হয়ে যাবে। সুতরাং জগতে ধর্মলাভই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ কার্য; আর মানব অজ্ঞাতসারে এইটি অনুভব করেছে বলেই সে আবহমান কাল ধর্মভাবকে আশ্রয় করে রয়েছে।

ধর্ম যেন বহুগুণশালিনী পয়স্বিনী গাভী; সে অনেক লাথি মেরেছে, কিন্তু তাতে কি? সে অনেক দুধও দেয়। যে-গরুটা দুধ দেয়, গোয়ালা তার লাথি সহ্য করে যায়।

‘প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক’-এ আছে, মহামোহ ও বিবেক—এই দুই রাজায় লড়াই বেধেছিল। বিবেক-রাজার সম্পূর্ণ জয় আর হয় না। অবশেষে বিবেক-রাজার সঙ্গে উপনিষদ্-দেবীর পুনর্মিলন হয়, এবং তাঁদের প্রবোধ-রূপ পুত্রের জন্ম হল। আর সেই পুত্রের প্রভাবে তাঁর শত্রু বলে আর কেউ রইল না। তখন তাঁরা পরমসুখে বাস করতে লাগলেন। আমাদের প্রবোধ বা ধর্মসাক্ষাৎকার-রূপ মহৈশ্বর্যবান্ পুত্রলাভ করতে হবে। ঐ প্রবোধ-রূপ পুত্রকে খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করতে হবে, তা হলেই সে মস্ত একটা বীর হয়ে দাঁড়াবে।

ভক্তি বা প্রেমের দ্বারা বিনা চেষ্টায় মানুষের সমুদয় ইচ্ছাশক্তি একমুখী হয়ে পড়ে—স্ত্রী-পুরুষের প্রেমই এর দৃষ্টান্ত। ভক্তিমার্গ স্বাভাবিক পথ এবং তাতে যেতেও বেশ আরাম। জ্ঞানমার্গ কি রকম?—না—যেন একটা প্রবল বেগশালিনী পার্বত্যনদীকে জোর করে ঠেলে তার উৎপত্তিস্থানে নিয়ে যাওয়া। এতে অতি সত্বর বস্তুলাভ হয় বটে, কিন্তু বড় কঠিন। জ্ঞানমার্গ বলে, ‘সমুদয় প্রবৃত্তিকে নিরোধ কর।’ ভক্তিমার্গ বলে, ‘স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও, চিরদিনের জন্য পূর্ণ আত্মসমর্পণ কর।’ এ পথ দীর্ঘ বটে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত সহজ ও সুখকর।

ভক্ত বলেনঃ ‘প্রভো চিরকালের জন্য আমি তোমার। এখন থেকে আমি যা কিছু করছি বলে মনে করি, তা বাস্তবিকই তুমিই করছ—আর ‘আমি’ বা ‘আমার’ বলে কিছু নেই।’

‘হে প্রভো, আমার অর্থ নেই যে, আমি দান করব; আমার বুদ্ধি নেই যে, আমি শাস্ত্র শিক্ষা করব; আমার সময় নেই যে, যোগ-অভ্যাস করব; হে প্রেমময়, আমি তাই তোমাকে আমার দেহ-মন অর্পণ করলাম।’

যতই অজ্ঞান বা ভ্রান্তধারণা আসুক, কিছুই জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে ব্যবধান ঘটাতে পারে না। ঈশ্বর বলে কেউ যদি নাও থাকেন, তবু প্রেমের ভাবকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাক। কুকুরের মত পচা মড়া খুঁজে খুঁজে মরার চেয়ে ঈশ্বরের অন্বেষণ করতে করতে মরা ভাল। সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ বেছে নাও, আর সেই আদর্শকে লাভ করবার জন্য সারা জীবন নিয়োজিত কর। মৃত্যু যখন এত নিশ্চিত, তখন একটা মহান্ উদ্দেশ্যের জন্য জীবনপাত করার চেয়ে আর বড় জিনিষ কিছু নেই।৪২

ভক্তিদ্বারা বিনা আয়াসে জ্ঞানলাভ হয়—ঐ জ্ঞানের পর পরাভক্তি আসে।

জ্ঞানী বড় সূক্ষ্ম বিচার করতে ভালবাসে, অতি সামান্য বিষয় নিয়েও একটা হৈ-চৈ বাধিয়ে দেয়; কিন্তু ভক্ত বলে, ‘ঈশ্বর তাঁর যথার্থ স্বরূপ আমার কাছে প্রকাশ করবেন’; তাই সে সবকিছুই গ্রহণ করে।

রাবিয়া

রাবিয়া রোগেতে হয়ে মু্হ্যমান
নিজ শয্যা ’পরে আছিলা শয়ান।
এহেন কালেতে নিকটে তাঁহার
আগমন হল দুই মহাত্মার;—
পবিত্র মালিক, জ্ঞানী সে হাসান,
পূজেন যাঁদের সব মুসলমান।
কহিলা হাসান সম্বোধিয়া তাঁরে,
‘পবিত্র ভাবেতে প্রার্থনা যে করে,
যে শাস্তি ঈশ্বর দিন-না তাহারে,
সহিষ্ণুতা-বলে বহন সে করে।’
পবিত্র মালিক—গভীরাত্মা যিনি,
বলিলেন নিজ অনুভব-বাণী,
‘প্রভুর যা ইচ্ছা, তাই প্রিয় যার,
আনন্দ হইবে শাস্তিতে তাহার।’
রাবিয়া শুনিয়া দু-জনের বাণী,
স্বার্থগন্ধলেশ আছে তাহে গণি;
কহিলা, ‘হে ঈশ, কৃপার ভাজন,
দুঁহু প্রতি এক করি নিবেদন—
যে-জন দেখেছে প্রভুর বদন,
আনন্দ-পাথারে হইবে মগন।
প্রার্থনার কালে মনেতে তাহার
উঠিবে না কভু এমত বিচার—
শাস্তি পাইয়াছি আমি কোনকালে;
জানিবে না কভু শাস্তি কারে বলে।’

—পারসী কবিতা

শুক্রবার, ১২ জুলাই


(অদ্য বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্য হইতে পড়া হইতে লাগিল।)

চতুর্থ ব্যাসসূত্র—‘তৎ তু সমন্বয়াৎ’—আত্মা বা ব্রহ্মই সমুদয় বেদান্তের প্রতিপাদ্য।

ঈশ্বরকে—বেদান্ত থেকে জানতে হবে। সমুদয় বেদই—জগৎকারণ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-কর্তা ঈশ্বরের কথা বলছে। সমুদয় হিন্দু দেবদেবীর উপর ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও শিব এই দেবত্রয় রয়েছেন। ঈশ্বর এই তিনের একীভাব।

বেদ তোমাকে ব্রহ্ম দেখিয়ে দিতে পারে না। তুমি তো সেই ব্রহ্মই রয়েছ। বেদ এইটুকু করতে পারে, যে-আবরণটা আমাদের চোখের সামনে থেকে সত্যকে আড়াল করে রেখেছে, সেইটেই দূর করে দিতে সাহায্য করতে পারে। প্রথম চলে যায় অজ্ঞানাবরণ, তারপর যায় পাপ, তারপর বাসনা আর স্বার্থপরতা দূর হয়; এইভাবে সব দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়। এই অজ্ঞানের তিরোভাব তখনই হতে পারে, যখন আমরা জানতে পারি যে, ব্রহ্ম ও আমি এক; অর্থাৎ নিজেকে আত্মার সঙ্গে অভিন্ন বলে দেখ, মানবীয় উপাধিগুলির সঙ্গে নয়। দেহাত্মবুদ্ধি দূর করে দাও দেখি, তা হলেই সব দুঃখ দূর হবে। মনের জোরে রোগ ভাল করে দেওয়ার এই রহস্য। এই জগৎটা একটা সম্মোহনের (hypnotism) ব্যাপার; নিজের ওপর থেকে এই সম্মোহনের আবেশটা দূর করে ফেল, তা হলেই তোমার আর কষ্ট থাকবে না।

মুক্ত হতে গেলে প্রথমে পাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তারপর পুণ্য অর্জন করতে হয়, শেষে পাপ-পুণ্য দুই-ই ত্যাগ করতে হবে। প্রথমে রজঃ দ্বারা তমঃকে জয় করতে হবে, পরে উভয়কেই সত্ত্বগুণে লয় করতে হবে—সর্বশেষে এই তিন গুণকেই অতিক্রম করতে হবে। এমন একটা অবস্থা লাভ কর, যেখানে তোমার প্রতি শ্বাসপ্রশ্বাস তাঁর উপাসনা-স্বরূপ হবে।

যখনই দেখ যে অপরের কথা থেকে কোন কিছু শিখছ (বা লাভ করছ), জেনো যে পূর্বজন্মে তোমার সেই বিষয় সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কারণ অভিজ্ঞতাই আমাদের একমাত্র শিক্ষক।৪৩

যতই ক্ষমতা-লাভ হবে, ততই দুঃখ বেড়ে যাবে, সুতরাং বাসনাকে একেবারে নাশ করে ফেল। কোন কিছু বাসনা করা যেন ভীমরুলের চাকে কাটি দেওয়া। আর বাসনাগুলো সোনার পাতমোড়া বিষের বড়ি—এইটে জানার নামই বৈরাগ্য।

‘মন ব্রহ্ম নয়।’ ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই সেই, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’—আমিই ব্রহ্ম। যখন মানুষ এইটি উপলব্ধি করে, তখন ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ’।৪৪ তার সব হৃদয়গ্রন্থি কেটে যায়, সব সংশয় ছিন্ন হয়। যতদিন আমাদের উপরে কেউ, এমন কি ঈশ্বর পর্যন্ত থাকবেন, ততদিন অভয় অবস্থালাভ হতে পারে না। আমাদের সেই ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হয়ে জেতে হবে। যদি এমন কোন বস্তু থাকে যা ব্রহ্ম থেকে পৃথক্ তা চিরকালই পৃথক্ থাকবে; তুমি যদি স্বরূপতঃ ব্রহ্ম থেকে পৃথক্‌ হও, তুমি কখনও তাঁর সঙ্গে এক হতে পারবে না; আবার বিপরীতক্রমে যদি তুমি এক হও, তা হলে কখনই পৃথক্ থাকতে পার না। যদি পুণ্যবলেই তোমার ব্রহ্মের সহিত যোগ হয়, তা হলে পুণ্যক্ষয়েই বিচ্ছেদ আসবে। আসল কথা, ব্রহ্মের সহিত তোমার নিত্য যোগ রয়েছে—পুণ্যকর্ম কেবল আবরণটা দূর করবার সহায়তা করে। আমরা ‘আজাদ’ অর্থাৎ মুক্ত, এইটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।

‘যমেবৈষ বৃণুতে’—যাঁকে এই আত্মা বরণ করেন৪৫—এর তাৎপর্য, আমরাই আত্মা এবং আমরাই নিজেদের বরণ করি।

ব্রহ্মদর্শন কি আমাদের নিজেদের চেষ্টা ও পুরুষকারের উপর নির্ভর করছে, অথবা বাইরের কারও সাহায্যের উপর নির্ভর করছে?—আমাদের নিজেদের চেষ্টার উপর এটা নির্ভর করছে। আমাদের চেষ্টার দ্বারা আরশির উপর যে ময়লা পড়ে রয়েছে, সেইটে অপসারিত হয়—আরশি যেমন তেমনি থাকে, পরিবর্তিত হয় না। জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এ তিনের বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই। ‘যিনি জানেন যে তিনি জানেন না, তিনিই ঠিক ঠিক জানেন। যিনি কেবল একটা মত অবলম্বন করে বসে আছেন, তিনি কিছুই জানেন না।’৪৬ আমরা বদ্ধ—এই ধারণাটাই ভুল।

ধর্ম জিনিষটা জাগতিক নয়; ধর্ম হচ্ছে চিত্তশুদ্ধির ব্যাপার; এই জগতের উপর এর প্রভাব গৌণ মাত্র। মুক্তি জিনিষটা আত্মার স্বরূপ হতে অভিন্ন। আত্মা সদা শুদ্ধ, সদা পূর্ণ, সদা অপরিণামী। এই আত্মাকে তুমি কখনও জানতে পার না। আমরা এই আত্মার সম্বন্ধে ‘নেতি নেতি’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না। শঙ্কর বলেন, ‘যাকে আমরা মন বা কল্পনার সমুদয় শক্তি প্রয়োগ করেও দূর করতে পারি না, তাই ব্রহ্ম।’

*****************

এই জগৎপ্রপঞ্চ ভাবমাত্র, আর বেদ এই ভাবপ্রকাশক শব্দরাশিমাত্র। আমরা ইচ্ছামত এই সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্টি করতে পারি, আবার লয় করতে পারি। এক সম্প্রদায়ের—কর্মী (বা কর্মানুষ্ঠানকারী)-দের মত এই যে, শব্দের পুনঃপুনঃ উচ্চরণে তার অব্যক্ত ভাবটি জাগরিত হয়, আর ফল-স্বরূপ একটি ব্যক্ত কার্য উৎপন্ন হয়। তাঁরা বলেন, আমরা প্রত্যেকেই এক একজন সৃষ্টি কর্তা। শব্দবিশেষ উচ্চারণ করলেই তৎসংশ্লিষ্ট ভাবটি উৎপন্ন হবে, আর তার ফল দেখা যাবে। হিন্দু দর্শনের এক সম্প্রদায়—মীমাংসকগণ বলেন, ভাব হচ্ছে শব্দের শক্তি, আর শব্দ হচ্ছে ভাবের অভিব্যক্তি।

শনিবার, ১৩ জুলাই


আমরা যা কিছু জানি, তাই মিশ্রণ-স্বরূপ; আর আমাদের সমুদয় বিষয়ানুভূতি বিশ্লেষণ থেকেই এসে থাকে। মনকে অমিশ্র, স্বতন্ত্র বা স্বাধীন বস্তু ভাবাই দ্বৈতবাদ। শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না; বরং যত বই পড়বে, ততই মন গুলিয়ে যাবে। যে-সব দার্শনিক তত চিন্তাশীল নন, তাঁরা ভাবতেন—মনটা একটা অমিশ্র বস্তু; আর তাই থেকে তাঁরা ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ নামক মতবাদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। কিন্তু মনোবিজ্ঞান (Psychology) মনের অবস্থাসমূহের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, মন একটা মিশ্রবস্তু; আর যেহেতু প্রত্যেক মিশ্রবস্তু কোন-না-কোন বাহ্য শক্তিবলে বিধৃত থাকে, সেইহেতু মন বা ইচ্ছাও বহিঃস্থ শক্তিসমূহের সংযোগে বিধৃত রয়েছে। এমন কি, যতক্ষণ না মানুষের ক্ষুধা পাচ্ছে, ততক্ষণ সে খাবার ইচ্ছা করতেও পারে না। ইচ্ছা বা সঙ্কল্প (will) বাসনার (desire) অধীন। কিন্তু তবুও আমরা স্বাধীন বা মুক্তস্বভাব—সকলেই এটা অনুভব করে থাকে।

অজ্ঞেয়বাদী বলেন, এই ধারণাটা ভ্রমমাত্র। তা হলে জগতের অস্তিত্বের প্রমাণ কিরূপে হবে? এর এই মাত্র প্রমাণ যে, আমরা সকলেই জগৎ দেখছি ও তার অস্তিত্ব অনুভব করছি। তা হলে আমরা যে সকলেই নিজেদের মুক্তস্বভাব বলে অনুভব করছি, এ অনুভবও যথার্থ না হবে কেন? যদি সকলে অনুভব করছে বলে জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়, তবে সকলেই যখন নিজেদের মুক্তস্বভাব বা স্বাধীন প্রকৃতি অনুভব করছে, তখন তারও অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। তবে ইচ্ছাটাকে আমরা যেমন দেখছি, সেভাবে তার সম্বন্ধে ‘স্বাধীন’ কথাটা প্রয়োগ করা চলে না। মানুষের নিজ মুক্ত স্বভাব সম্বন্ধে এই স্বাভাবিক বিশ্বাসই সমুদয় তর্ক যুক্তি বিচারের ভিত্তি। ‘ইচ্ছা’—বদ্ধভাবাপন্ন হবার আগে যেরূপ ছিল, তাই মুক্ত স্বভাব। এই যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা—এতেই প্রতিমুহূর্তে দেখাচ্ছে যে, মানুষ বন্ধন কাটাবার চেষ্টা করছে। একমাত্র বস্তু, যা প্রকৃত মুক্তস্বভাব হতে পারে—তা অনন্ত, অসীম, দেশ-কাল-নিমিত্তের বাইরে। মানুষের ভিতর এখন যে স্বাধীনতা রয়েছে, সেটা একটা পূর্বস্মৃতিমাত্র—স্বাধীনতা বা মুক্তিলাভের চেষ্টামাত্র।

জগতে সকল জিনিষ যেন ঘুরে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করছে—তার উৎপত্তিস্থানে যাবার, তার একমাত্র যথার্থ উৎস আত্মার কাছে যাবার চেষ্টা করছে। মানুষ যে সুখের অন্বেষণ করছে, সেটা আর কিছু নয়—সে যে সাম্যভাব হারিয়েছে, সেইটা ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। এই যে নীতিপালন, এও বদ্ধভাবাপন্ন ইচ্ছার মুক্ত হবার চেষ্টা, আর এই থেকেই প্রমাণিত হয় যে, আমরা পূর্ণাবস্থা থেকে নেমে এসেছি।

*****************

কর্তব্যের ধারণাটা যেন দুঃখরূপ মধ্যাহ্ন-মার্তণ্ড—আত্মাকেই যেন দগ্ধ করে ফেলছে। ‘হে রাজন্, এই এক বিন্দু অমৃত পান করে সুখী হও।’ আত্মা অকর্তা—এই ধারণাই অমৃত।

ক্রিয়া হতে থাক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যেন না আসে; ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। শিশু আগুনে হাত দেয়—তার সুখ হয় বলেই; কিন্তু যখনই তার শরীর প্রতিক্রিয়া করে, তখনই পুড়ে যাওয়ার কষ্টবোধ হয়ে থাকে। ঐ প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে আমাদের আর ভয়ের কারণ কিছু নেই। মস্তিষ্ককে নিজের বশে নিয়ে এস, যেন সে প্রতিক্রিয়াটার খবর না রাখতে পারে। সাক্ষিস্বরূপ হও, দেখ—যেন প্রতিক্রিয়া না আসে, কেবল তা হলেই তুমি সুখী হতে পারবে। আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত সেইগুলি, যখন আমরা নিজেদের একেবারে ভুলে যাই। স্বাধীনভাবে প্রাণ খুলে কাজ কর, কর্তব্যের ভাব থেকে কাজ কর না। আমাদের কোনই কর্তব্য নেই। এই জগৎ তো একটা খেলার আখড়া—এখানে আমরা খেলছি; আমাদের জীবন তো অনন্ত আনন্দের অবকাশ!

জীবনের সমগ্র রহস্য হচ্ছে নির্ভীক হওয়া। তোমার কি হবে—এ ভয় কখনও কর না, কারও উপর নির্ভর কর না। যে মুহূর্তে তুমি সকল সাহায্য প্রত্যাখান কর, সেই মুহূর্তেই তুমি মুক্ত। যে স্পঞ্জটা পুরো জলে শুষে নিয়েছে, সে আর জল টানতে পারে না।

*****************

আত্মরক্ষার জন্যও লড়াই করা অন্যায়, যদিও গায়ে পড়ে অপরকে আক্রমণ করার চেয়ে সেটা উঁচু জিনিষ। ‘ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ’ বলে কোন জিনিষ নেই, কারণ সকল বস্তুতে সমত্ববুদ্ধির অভাব থেকেই ক্রোধ এসে থাকে।

রবিবার, ১৪ জুলাই


ভারতে দর্শন-শাস্ত্রের অর্থ হচ্ছে—যে শাস্ত্র বা যে বিদ্যা দ্বারা আমরা ঈশ্বর-দর্শন করতে পারি। দর্শন হচ্ছে ধর্মের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা। সুতরাং কোন হিন্দু কখনও ধর্ম ও দর্শনের ভিতর সংযোগসূত্র কি, তা জানতে চায় না।

দার্শনিক চিন্তাপ্রণালীর তিনটি সোপান আছেঃ (১) স্থূল বস্তুসমূহের পৃথক্ পৃথক্ জ্ঞান (concrete); (২) ঐগুলিকে এক এক শ্রেণীতে শ্রেণীভুক্ত করা বা ঐগুলির মধ্যে ‘সামান্য’ আবিষ্কার করা (generalised); (৩) সেই সামান্যগুলির ভিতর আবার সূক্ষ্ম বিচার দ্বারা ঐক্য আবিষ্কার করা (abstract)। সমুদয় বস্তু যেখানে একত্ব-প্রাপ্ত হয়, সেই চূড়ান্ত বস্তু হচ্ছেন অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। ধর্মের প্রথমাবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক বা রূপবিশেষের সহায়তা গৃহীত হয়ে থাকে, দেখা যায়; দ্বিতীয় অবস্থায় নানাবিধ পৌরাণিক বর্ণনা ও উপদেশের বাহুল্য; সর্বশেষে অবস্থায় দার্শনিক তত্ত্বসমূহের বিবৃতি। এদের মধ্যে প্রথম দুটি শুধু সাময়িক প্রয়োজনের জন্য, কিন্তু দর্শনই ঐ-সকলের মূল ভিত্তিস্বরূপ, আর অন্যগুলি সেই চরমতত্ত্বে পৌঁছবার সোপান মাত্র।

পাশ্চাত্য দেশে ধর্মের ধারণা এই—বাইবেলের নিউ টেস্টামেণ্ট ও খ্রীষ্ট ব্যতীত ধর্মই হতে পারে না। য়াহুদীধর্মেও মুশা ও প্রফেটদের সম্বন্ধে এই রকম এক ধারণা আছে। এরূপ ধারণার হেতু এই যে, এই-সব ধর্ম কেবল পৌরাণিক বর্ণনার উপর নির্ভর করে। প্রকৃত সর্বোচ্চ ধর্ম এই-সকল পৌরাণিক বর্ণনা ছাড়িয়ে ওঠে; সে-ধর্ম কখনও শুধু এগুলির উপর নির্ভর করতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞান বাস্তবিকই প্রকৃত ধর্মের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করেছে। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডটা যে এক অখণ্ড বস্তু, তা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণ করা যেতে পারে। দার্শনিক যাকে ‘সত্তা’ (being) বলেন, বৈজ্ঞানিক তাকেই ‘জড়’ (matter) বলে থাকেন; কিন্তু ঠিক ঠিক দেখতে গেলে, এদের দুজনের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, কারণ তত্ত্বতঃ দুই-ই এক জিনিষ। দেখ না—পরমাণু অদৃশ্য ও অচিন্ত্য, অথচ তাতে ব্রহ্মাণ্ডের সমুদয় শক্তি ও সম্ভাবনা রয়েছে। বেদান্তীরাও আত্মা সম্বন্ধে ঠিক এইভাবের কথাই বলে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে সব সম্প্রদায়ই বিভিন্ন ভাষায় ঐ এক কথাই বলছেন।

বেদান্ত ও আধুনিক বিজ্ঞান উভয়ই জগতের কারণস্বরূপ এমন এক বস্তুকে নির্দেশ করছেন, যা হতে অন্য কিছুর সাহায্য ব্যতীত জগতের প্রকাশ হয়েছে। সেই এক কারণই নিমিত্ত-কারণ, আবার সমবায়ী ও অসমবায়ী উপাদান-কারণ—সবই। যেন কুম্ভকার মৃত্তিকা থেকে ঘট নির্মাণ করছে—এখানে কুম্ভকার হচ্ছে নিমিত্ত-কারণ, মৃত্তিকা হচ্ছে সমবায়ী উপাদান-কারণ, আর কুম্ভকারের চক্র অসমবায়ী উপাদান-কারণ। কিন্তু আত্মাই এই তিন। আত্মা কারণও বটে, আবার অভিব্যক্তি বা কার্যও বটে। বেদান্তী বলেন, এই জগৎটা সত্য নয়, আপাতপ্রতীয়মান মাত্র। প্রকৃতি আর কিছুই নয়, অবিদ্যাবরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ব্রহ্মমাত্র। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা বলেন, ঈশ্বর—প্রকৃতি বা এই জগৎপ্রপঞ্চ হয়েছেন। অদ্বৈতবাদীরা সিদ্ধান্ত করেন, ঈশ্বর এই জগৎপ্রপঞ্চরূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন বটে, কিন্তু তিনি এই জগৎ নন।

আমরা অনুভূতি-বিশেষকে একটা মানসিক প্রক্রিয়ারূপেই জানতে পারি—একে মানসিক একটি ঘটনারূপে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটা দাগরূপে জানতে পারি। আমরা মস্তিষ্ককে সম্মুখে বা পশ্চাতে চালাতে পারি না, কিন্তু মনকে পারি। মনকে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান—সমুদয় কালেই প্রসারিত করা যেতে পারে; সুতরাং মনের মধ্যে যা যা ঘটে, তা অনন্তকালের জন্য সঞ্চিত থাকে। মনের মধ্যে সব ঘটনা পূর্ব থেকেই সংস্কারের আকারে রয়েছে; মন সর্বব্যাপী কিনা।

‘দেশ-কাল-নিমিত্ত যে চিন্তারই প্রণালীবিশেষ’—এই আবিষ্ক্রিয়াই ক্যাণ্টের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। কিন্তু বেদান্ত বহু পূর্বেই এই তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছে, আর একে ‘মায়া’ নামে অভিহিত করেছে। শোপেনহাওয়ার শুধু যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে বেদোক্ত তত্ত্বগুলির যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন। শঙ্কর বেদকে ‘আর্য’ বলে গেছেন।

*****************

সকল বৃক্ষের মধ্যে যে এক বৃক্ষত্ব রয়েছে—সেইটে জানার নামই ‘জ্ঞান’। আর সর্বোচ্চ জ্ঞান হচ্ছে— এই একত্বের জ্ঞান।…

সমুদয় জগৎপ্রপঞ্চের চরম সামান্য বা সাধারণ ভাবই সগুণ ঈশ্বর; কেবল সেটা অস্পষ্ট, এবং সুনির্দিষ্ট ও দার্শনিক বিচারসম্মত নয়।…

সেই এক তত্ত্ব স্বয়ং অভিব্যক্ত হচ্ছে, তা থেকেই যা কিছু সব হয়েছে।…

পদার্থ-বিজ্ঞানের কাজ ঘটনাবলী আবিষ্কার করা, দর্শন যেন ঐ বিভিন্ন ঘটনারূপ ফুলগুলি নিয়ে তোড়া বাঁধবার সুতো। চিন্তাসহায়ে ঐক্য আবিষ্কারের চেষ্টামাত্রই দর্শনের এলাকায়। এমন কি, একটা গাছের গোড়ায় সার দেওয়ার ব্যাপারেও এইরূপ একটা প্রণালীর সহায়তা নিতে হয়।…

ধর্মের ভিতর—স্থূল, অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও চরম একত্ব—এই তিনটি ভাবই আছে। কেবল স্থূল বা বিশেষ নিয়েই পড়ে থেকো না। সেই চরম সূক্ষ্ম তত্ত্বে—সেই একত্বে চলে যাও।

*****************

অসুরেরা তমঃপ্রধান যন্ত্র, দেবতারা সত্ত্বপ্রধান যন্ত্র; কিন্তু দুই-ই যন্ত্র; মানুষই কেবল চেতন, জীবন্ত। যন্ত্রবৎ ভাবটাকে দূর করে দাও; ধারণা কর, তুমি যন্ত্র নিয়ে কাজ করছ—তুমি যন্ত্র নও, তবেই মুক্ত হতে পারবে। এই পৃথিবীই একমাত্র স্থান, যেখানে মানুষ নিজের মুক্তিসাধন করতে পারে।

‘যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ’—এই আত্মা যাকে বরণ করেন, এ কথাটা সত্য। বরণ বা মনোনীত করাটা সত্য, কিন্তু ভিতরের দিক্‌ থেকে এর অর্থ করতে হবে। বাইরে থেকে কেউ বরণ করছে—কথাটার যদি এইরূপ অদৃষ্টবাদমূলক ব্যাখ্যা করা যায়, তবে তো এটা ভয়ানক কথা হয়ে দাঁড়ায়।


সোমবার, ১৫ জুলাই


যেখানে স্ত্রীলোকদের বহুবিবাহ-প্রথা প্রচলিত আছে, যেমন তিব্বতে, সেখানে স্ত্রীলোকদের শারীরিক শক্তি পুরুষের চেয়ে বেশী। যখন ইংরেজরা ঐ দেশে যায়, এই স্ত্রীলোকেরা জোয়ান জোয়ান পুরুষদের ঘাড়ে নিয়ে পাহাড় চড়াই করে।

মালাবার দেশে অবশ্য মেয়েদের বহুবিবাহ নেই, কিন্তু সেখানে সব বিষয়ে তাদের প্রাধান্য। সেখানে সর্বত্রই বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার দিকে নজর দেখা যায়, আর বিদ্যাচর্চায় যারপরনাই উৎসাহ। ঐ দেশে দেখেছি—অনেক মেয়ে ভাল সংস্কৃত বলতে পারে, কিন্তু ভারতের অন্যত্র দশ লক্ষের মধ্যে একটি মেয়েও সংস্কৃত বলতে পারে কিনা সন্দেহ। স্বাধীনতার উন্নতি হয়, আর দাসত্ব থেকে অবনতিই হয়ে থাকে। পোর্তুগীজ বা মুসলমান কারও দ্বারাই মালাবার কখনও বিজিত হয়নি।

দ্রাবিড়ীরা মধ্য-এশিয়ার এক অনার্যজাতি—আর্যদের পূর্বেই তারা ভারতে এসেছিল, আর দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড়ীরাই সব চেয়ে সভ্য ছিল। তাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সামাজিক অবস্থা উন্নত ছিল। পরে তারা ভাগ হয়ে গেল; কতকগুলি মিশরে, কতকগুলি ব্যাবিলোনিয়ায় চলে গেল, অবশিষ্ট ভারতেই রইল।

মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই


(শঙ্কর)

অদৃষ্ট (অর্থাৎ অব্যক্ত কারণ বা সংস্কার) আমাদের যাগযজ্ঞ উপাসনাদি করায়, তা থেকে ব্যক্ত ফল উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মুক্তি লাভ করতে হলে আমাদের ব্রহ্ম সম্বন্ধে প্রথমে শ্রবণ, পরে মনন, তারপর নিদিধ্যাসন করতে হবে।

কর্মের ফল আর জ্ঞানের ফল সম্পূর্ণ পৃথক্। সর্বপ্রকার নীতি-ধর্মের মূল হচ্ছে বিধিনিষেধ—‘এই কাজ কর’ এবং ‘এই কাজ কর না’; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেহমনের সঙ্গেই এগুলির সম্বন্ধ। সর্বপ্রকার সুখদুঃখ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত; সুতরাং সুখদুঃখ ভোগ করতে গেলেই শরীরের প্রয়োজন। যার দেহ যত উন্নত, তার ধর্ম বা পুণ্যের আদর্শ তত উচ্চ; এই রকম ব্রহ্মা পর্যন্ত; এ পর্যন্ত সকলেরই শরীর আছে। আর যতক্ষণ শরীর আছে, ততক্ষণ সুখদুঃখ থাকবেই; কেবল দেহভাবমুক্ত হলেই সুখদুঃখ অতিক্রম করা যেতে পারে। শঙ্কর বলেন, আত্মা দেহহীন।

কোন বিধি-নিষেধের দ্বারা মুক্তিলাভ হতে পারে না। তুমি সদা মুক্তই আছ। যদি তুমি পূর্ব হতেই মুক্ত না থাক, তবে কিছুই তোমায় মুক্তি দিতে পারে না। আত্মা স্বপ্রকাশ। কার্যকারণ আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না—এই দেহশূন্য ভাব বা বিদেহ অবস্থার নামই মুক্তি। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান—সবকিছুর পারে ব্রহ্ম। যদি মুক্তি কোন কর্মের ফল হত, তবে তার কোন মূল্যই থাকত না, সেটা একটা যৌগিক বস্তু হত, সুতরাং তার ভিতর বন্ধনের বীজ নিহিত থাকত। এই মুক্তিই আত্মার একমাত্র নিত্যভাব, তাকে লাভ করতে হয় না, সেটা আত্মার যথার্থ স্বরূপ।

তবে আত্মার উপর যে আবরণ পড়ে রয়েছে, সেইটে সরাবার জন্য—বন্ধন ও ভ্রম দূর করবার জন্য—কর্ম ও উপাসনার প্রয়োজন; এরা মুক্তি দিতে পারে না বটে, কিন্তু তথাপি আমরা যদি নিজেরা চেষ্টা না করি, তা হলে আমাদের চোখ ফোটে না, আমরা আমাদের স্বরূপ জানতে পারি না। শঙ্কর আরও বলেন, অদ্বৈতবাদই বেদের গৌরব-মুকুট; কিন্তু বেদের নিম্নতর ভাগগুলিরও প্রয়োজন আছে, কারণ তারা আমাদের কর্ম ও উপাসনার উপদেশ দিয়ে থাকে, আর এইগুলির সাহায্যেও অনেকে ভগবানের কাছে গিয়ে থাকে। তবে এমন অনেকে থাকতে পারে, যারা কেবল অদ্বৈতবাদের সাহায্যেই সেই অবস্থায় যাবে। অদ্বৈতবাদ যে-অবস্থায় নিয়ে যায়, কর্ম এবং উপাসনাও সেই অবস্থাতেই নিয়ে যায়।

শাস্ত্র ব্রহ্ম-সম্বন্ধে কিছু শিক্ষা দিতে পারে না, কেবল অজ্ঞান দূর করে দিতে পারে। শাস্ত্রের কার্য নাশাত্মক (negative)। শঙ্করের প্রধান কৃতিত্ব এই যে, তিনি শাস্ত্রও মেনেছিলেন, আবার সকলের সামনে মুক্তির পথও খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু যাই বলো, তাঁকে ঐ নিয়ে চুলচেরা বিচার করতে হয়েছে। প্রথমে মানুষকে একটা স্থূল অবলম্বন দাও, তারপর ধীরে ধীরে তাকে সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে যাও। বিভিন্ন প্রকার ধর্ম এই চেষ্টাই করছে, আর এ থেকে বোঝা যায়—কেন ঐ-সকল ধর্ম জগতে এখনও রয়েছে এবং কি করে প্রত্যেকটিই মানুষের উন্নতির কোন-না-কোন অবস্থার উপযোগী। শাস্ত্র অবিদ্যা দূর করতে সাহায্য করে, কিন্তু শাস্ত্রও ঐ অবিদ্যার অন্তর্গত। শাস্ত্রের কাজ হচ্ছে জ্ঞানের উপর যে অজ্ঞানরূপ আবরণ এসে পড়েছে, তা দূর করা। ‘সত্য অসত্যকে দূর করে দেবে।’ তুমি মুক্তই আছ, তোমাকে মুক্ত করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ধর্মমতবিশেষ অবলম্বন করে আছ, ততক্ষণ তুমি ব্রহ্মকে লাভ করনি। ‘যিনি মনে করেন—আমি জানি, তিনি জানেন না।’৪৭ যিনি স্বয়ং জ্ঞাতাস্বরূপ, তাঁকে কে জানতে পারে?৪৮ দুটি চিরন্তন বস্তু আছে—ব্রহ্ম ও জগৎ। প্রথমটি অর্থাৎ ব্রহ্ম অপরিণামী, দ্বিতীয়টি অর্থাৎ জগৎ পরিণামী। জগৎ অনন্তকাল ধরে রয়েছে। যেখানে পরিণাম কতখানি হচ্ছে, মন তা ধরতে পারে না, তোমরা তো তাকেই অনন্ত বলে থাক। জগৎ ও ব্রহ্ম এক বটে, কিন্তু একই সময়ে তো তোমরা দুটো দেখতে পাও না—একখানা পাথরের উপর একটা ছবি বা মূর্তি খোদাই করা রয়েছে; যখন তোমার পাথরের দিকে খেয়াল থাকে, তখন খোদাই-এর দিকে থাকে না; আবার যখন খোদাই-এর দিকে মন দাও, তখন পাথরের খেয়াল থাকে না; অথচ দুই-ই এক।

তুমি কি এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে সম্পূর্ণ স্থির শান্ত করতে পার? সকল যোগীই বলেন, এটা করা সম্ভব।

*****************

সকলের চেয়ে বেশী পাপ হচ্ছে—নিজেকে দুর্বল ভাবা। তোমার চেয়ে বড় আর কেউ নেই; উপলব্ধি কর যে, তুমি ব্রহ্মস্বরূপ। কোন বস্তুতে তুমি যে শক্তির বিকাশ দেখ, সে শক্তি তোমারই দেওয়া।

আমরা সূর্য চন্দ্র তারা অতিক্রম করে রয়েছি, আমরা জগৎপ্রপঞ্চেরও উপরে। শিক্ষা দাও, মানুষ ব্রহ্মস্বরূপ। মন্দ বলে কিছু আছে—এটি স্বীকার কর না, যা নেই—তাকে আর নূতন করে সৃষ্টি কর না। সদর্পে বল—আমি প্রভু, আমি সকলের প্রভু। আমরাই নিজেদের শৃঙ্খল নিজেরা গড়েছি, আর আমরাই কেবল ঐ শিকল ভাঙতে পারি।

কোন প্রকার কর্ম তোমায় মুক্তি দিতে পারে না, কেবল জ্ঞানের দ্বারাই মুক্তি হতে পারে। জ্ঞান অপ্রতিরোধ্য; ইচ্ছা হল তাকে গ্রহণ করলাম, ইচ্ছা হল ত্যাগ করলাম—এরূপ হতে পারে না। যখন জ্ঞানোদয় হবে, মনকে তা গ্রহণ করতেই হবে। সুতরাং এই জ্ঞানলাভ মনের কার্য নয়, তবে মনে ঐ জ্ঞানের প্রকাশ হয়ে থাকে বটে।

কর্ম বা উপাসনার ফল এইটুকু যে, ওতে তোমার যে-স্বরূপ ভুলে ছিলে, তা ফিরে পাও। আত্মা যে দেহ, এইটে মনে করাই সম্পূর্ণ ভ্রম; সুতরাং আমরা এই শরীরে থাকতে থাকতেই মুক্ত হতে পারি। দেহের সঙ্গে আত্মার কিছুমাত্র সাদৃশ্য নেই। মায়ার অর্থ ‘কিছু না’ নয়, ‘অসৎ’কে ‘সৎ’ বা সত্য বলে গ্রহণ করা।

বুধবার, ১৭ জুলাই


রামানুজ জগৎপ্রপঞ্চকে চিৎ (জীবাত্মা বা প্রাণী), অচিৎ (জড়প্রকৃতি), এবং ঈশ্বর—এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন; অথবা চেতন, অবচেতন ও অধিচেতন—এই তিন ভাগ। শঙ্কর কিন্তু বলেনঃ (জীবাত্মা) চিৎ ও (পরমাত্মা) ঈশ্বর বা ব্রহ্ম একবস্তু। ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্তস্বরূপ; ঐ সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত তাঁর গুণ নয়। ব্রহ্মকে চিন্তা করতে গেলেই তাঁকে বিশিষ্ট করা হয়; তাঁর সম্বন্ধে বড় জোর বলা যেতে পারে ‘ওঁ তৎ সৎ’—অর্থাৎ তিনি সত্তাস্বরূপ, তিনি অস্তিস্বরূপ—এই মাত্র।

শঙ্কর আরও জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি সত্তাকে আর সব বস্তু থেকে পৃথক্ করে দেখতে পার? দুটি বস্তুর মধ্যে ‘বিশেষ’ বা পার্থক্য কোন্‌খানে? ইন্দ্রিয়জ্ঞানে নয়, কারণ তা হলে সব জিনিষই এক রকম বোধ হত। আমাদের বিষয়-জ্ঞান একটার পর আর একটা, এই ক্রমে হয়ে থাকে। একটা বস্তু কি, তা জানতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে জানতে হয়, সেটা কি নয়। দুটি বস্তুর মধ্যে পার্থক্যগুলি আমাদের স্মৃতির মধ্যে অবস্থিত, আর চিত্তে যা সঞ্চিত রয়েছে, তারই সঙ্গে তুলনা করে আমরা এগুলি জানতে পারি। বস্তুর স্বরূপের মধ্যে ভেদ নেই, সেটা আমাদের মস্তিষ্কে রয়েছে। বাইরে এক অখণ্ড বস্তুই রয়েছে; ভেদ কেবল ভেতরে, আমাদের মনে; সুতরাং বহুজ্ঞান মনেরই সৃষ্টি।

এই ‘বিশেষ’গুলিই গুণপদবাচ্য হয়—যখন তারা পৃথক্ থাকে, অথচ কোন একটি জিনিষের সঙ্গে জড়িত থাকে। এই ‘বিশেষ’ জিনিষটা কি, তা আমরা ঠিক করে বলতে পারি না। আমরা বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে দেখতে পাই ও অনুভব করি কেবল সত্তা বা একটা ‘অস্তি’ভাব। আর যা কিছু সব আমাদেরই মধ্যে রয়েছে। কোন বস্তুর সত্তাসম্বন্ধেই শুধু আমরা নিঃসংশয় প্রমাণ পেয়ে থাকি। বিশেষ বা ভেদগুলি প্রকৃতপক্ষে গৌণভাবে সত্য—যেমন রজ্জুতে সর্পজ্ঞান, কারণ ঐ সর্পজ্ঞানেরও সত্যতা আছে; ভুলভাবে হলেও একটা কিছু তো দেখা যাচ্ছে। যখন রজ্জুজ্ঞান বাধিত হয়, তখনই সর্পজ্ঞানের আবির্ভাব হয়, আবার বিপরীতক্রমে সর্পজ্ঞানের লোপে রজ্জুজ্ঞানের আবির্ভাব। কিন্তু তুমি একটা মাত্র জিনিষ দেখছ বলে প্রমাণিত হয় না যে, অন্য জিনিষটা নেই। জগৎ-জ্ঞান ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতিবন্ধক হয়ে তাকে আবরণ করে রেখেছে, তাকে দূর করতে হবে, কিন্তু তার যে অস্তিত্ব আছে, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে।

শঙ্কর আরও বলেন যে, অনুভূতিই (perception) অস্তিত্বের চরম প্রমাণ। অনুভূতি স্বয়ংজ্যোতিঃ ও আত্মসচেতন, কারণ ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বাইরে যেতে গেলে আমরা তাকে ছাড়তে পারি না। অনুভূতি কোন ইন্দ্রিয় বা কারণ-সাপেক্ষ নয়, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। চেতনা (consciousness) ব্যতীত অনুভূতি হতে পারে না; অনুভব স্বপ্রকাশ, তারই নিম্নতর মাত্রার প্রকাশকে ‘চেতনা’ বলে। কোন প্রকার অনুভব-ক্রিয়াই চেতনারহিত হতে পারে না, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক অনুভূতির স্বরূপই হচ্ছে চেতনা। সত্তা আর অনুভব এক বস্তু, দুটি পৃথক্ পৃথক্ ভাব এক সঙ্গে জোড়া নয়। যার কোন কারণ বা প্রয়োজন নেই, তাই অনন্ত; সুতরাং অনুভূতি যখন নিজেই নিজের চরম প্রমাণ, তখন অনুভূতিও অনন্তস্বরূপ; অনুভূতি সর্বদাই স্বসংবেদ্য। অনুভূতি নিজেই নিজের জ্ঞাতাস্বরূপ; এটা মনের ধর্ম নয়, কিন্তু তা থেকেই মন হয়েছে; অনুভূতি নিরপেক্ষ, পূর্ণই একমাত্র জ্ঞাতা, সুতরাং প্রকৃতপক্ষে অনুভূতিই আত্মা। অনুভূতি স্বয়ং অনুভব করে, কিন্তু আত্মাকে ‘জ্ঞাতা’ বলা যেতে পারে না; কারণ ‘জ্ঞাতা’ বললে জ্ঞানরূপ ক্রিয়ার কর্তাকে বুঝায়। কিন্তু শঙ্কর বলেন, আত্মা ‘অহং’ নন, কারণ তাঁতে ‘আমি আছি’ এই ভাবটি নেই। আমরা (অহং ভাব) সেই আত্মার প্রতিবিম্বমাত্র, আত্মা ও ব্রহ্ম এক।

যখনই তুমি সেই পূর্ণব্রহ্ম সম্বন্ধে কিছু বলো বা ভাবো, তখনই আপেক্ষিকভাবে ঐ কাজগুলি করতে হয়, সুতরাং সেখানে এই-সকল যুক্তিবিচার খাটে। কিন্তু যোগাবস্থায় অনুভব ও অপরোক্ষানুভূতি এক হয়ে যায়। রামানুজ-ব্যাখ্যাত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আংশিকভাবে একত্ব-দর্শন, এবং অদ্বৈতাবস্থার অভিমুখে একটি সোপানস্বরূপ। ‘বিশিষ্ট’ মানেই ভেদ বা পৃথক্‌করণ। ‘প্রকৃতি’ মানে জগৎ, আর তার সদা পরিণাম বা পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তনশীল চিন্তারাশি—পরিবর্তনশীল শব্দরাশি দ্বারা অভিব্যক্ত হয়ে কখনও সেই পূর্ণস্বরূপকে প্রমাণ করতে পারে না। ঐরূপ করে আমরা শুধু এমন একটা বস্তুতে উপনীত হই, যা থেকে কতকগুলি গুণ বাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু যা স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ নয়। আমরা কেবল শব্দগত একত্বে পৌঁছই, তার চেয়ে আর চরম ঐক্য বার করা যায় না, কিন্তু তাতে আপেক্ষিক জগতের বিলোপ-সাধন হয় না।

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই


(অদ্যকার আলোচ্য বিষয়ঃ প্রধানতঃ সাংখ্যদর্শনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্যের যুক্তি।)

সাংখ্যেরা বলেন, জ্ঞান একটি মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ, আর তারও পারে বিশ্লেষণ করতে করতে শেষে আমরা সাক্ষিস্বরূপ পুরুষের অস্তিত্ব অবগত হই। এই পুরুষ—সংখ্যায় বহু; আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি পুরুষ। অদ্বৈত-বেদান্ত কিন্তু এর বিরুদ্ধে বলেন, পুরুষ কেবল একটিই হতে পারেন, সেই পুরুষ চেতন; তিনি অচেতন বা কোন গুণসম্পন্ন হতে পারেন না, কারণ গুণ থাকলেই সেগুলি তাঁর বন্ধনের কারণ হবে, পরিণামে সেগুলির লোপও হবে। অতএব সেই এক বস্তু অবশ্যই সর্বপ্রকারগুণরহিত, এমন কি—জ্ঞান পর্যন্ত তাতে থাকতে পারে না, এবং সেই পুরুষ জগৎ বা আর কিছুর কারণ হতে পারে না। বেদ বলেন, ‘সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্’—হে সৌম্য, প্রথমে সেই এক অদ্বিতীয় সৎই ছিলেন।৪৯

যেখানে সত্ত্বগুণ সেইখানেই জ্ঞান দেখা যায় বলে প্রমাণিত হয় না যে, সত্ত্বই জ্ঞানের কারণ; বরং, মানুষের ভিতর জ্ঞান পূর্ব হতেই রয়েছে, সত্ত্বের সান্নিধ্যে সেই জ্ঞান উদ্‌বুদ্ধ হয় মাত্র। যেমন আগুনের কাছে একটা লৌহগোলক রাখলে ঐ আগুন লৌহগোলকটার ভিতর পূর্ব হতেই যে তেজ অব্যক্তভাবে ছিল, তাকেই ব্যক্ত করে গোলকটাকে উত্তপ্ত করে—তার ভিতরে প্রবেশ করে না, সেই রকম।

শঙ্কর বলেন—জ্ঞান একটা বন্ধন নয়, কারণ জ্ঞান সেই পুরুষ বা ব্রহ্মের স্বরূপ। জগৎ ব্যক্ত বা অব্যক্তরূপে সর্বদাই রয়েছে, সুতরাং চিরন্তন জ্ঞেয় বস্তু একটি আছেই। জ্ঞান-বল-ক্রিয়াই ঈশ্বর। জ্ঞানলাভের জন্য তাঁর দেহেন্দ্রিয়াদি কোন আকারেরই প্রয়োজন নেই; যে সসীম, তার পক্ষে সেই অনন্ত জ্ঞানকে ধরে রাখবার জন্য একটা প্রতিবন্ধকের (অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদির) প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু ঈশ্বরের ঐরূপ সহায়তার আদৌ কোন আবশ্যকতা নেই। বাস্তবিক এক আত্মাই আছেন, বিভিন্ন-লোকগামী ‘সংসারী’ জীবাত্মা বলে স্বতন্ত্র আত্মা কিছু নেই। পঞ্চ প্রাণ যাঁতে একীভূত হয়েছে—এই দেহের সেই চেতন নিয়ন্তাকেই ‘জীবাত্মা’ বলে, কিন্তু সেই জীবাত্মাই পরমাত্মা, যেহেতু আত্মাই সব। তুমি তাকে যে অন্যরূপ বোধ করছ, সে ভ্রান্তি তোমারই, জীবে সে ভ্রান্তি নেই। তুমিই ব্রহ্ম, আর তুমি নিজেকে আর যা কিছু বলে ভাবছ, তা ভুল। কৃষ্ণকে কৃষ্ণ বলে পূজা কর না, কৃষ্ণের মধ্যে যে আত্মা রয়েছেন, তাঁরই উপাসনা কর। শুধু আত্মার উপাসনাতেই মুক্তিলাভ হবে। এমন কি, সগুণ ঈশ্বর পর্যন্ত সেই আত্মার বহিঃপ্রকাশমাত্র। শঙ্কর বলেছেন, ‘স্বস্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে।’—নিজ স্বরূপের আন্তরিক অনুসন্ধানকেই ভক্তি বলে।

আমরা ঈশ্বরলাভের জন্য যত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে থাকি, সে সব সত্য। যেমন ধ্রুবতারাকে দেখাতে হলে তার আশপাশের নক্ষত্রগুলির সাহায্য নিতে হয়, এও তেমনি।

*****************

ভগবদ্গীতা বেদান্তসম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ প্রামাণিক গ্রন্থ।

শুক্রবার, ১৯ জুলাই


যতদিন আমার ‘আমি, তুমি’ এইরূপ ভেদজ্ঞান রয়েছে, ততদিন একজন ভগবান্ আমাদের রক্ষা করছেন, এ-কথা বলবার অধিকারও আমার আছে। যতদিন আমার এইরূপ ভেদবোধ রয়েছে, ততদিন এই ভেদবোধ থেকে যে-সকল অনিবার্য সিদ্ধান্ত আসে, সেগুলিও নিতে হবে, ‘আমি, তুমি’ স্বীকার করলেই আমাদের আদর্শস্থানীয় আর একটি তৃতীয় বস্তু স্বীকার করতে হবে, যা আমি-তুমির মাঝখানে আছে; সেইটিই ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুস্বরূপ। যেমন বাষ্প তুষার হয়, তুষার থেকে জল হয়, সেই জল আবার গঙ্গাদি নানা নামে প্রসিদ্ধ হয়; কিন্তু যখন বাষ্পাবস্থা, তখন আর গঙ্গা নেই; আবার যখন জল, তখন তার মধ্যে বাষ্প চিন্তা করি না।

সৃষ্টি বা পরিণামের ধারণার সঙ্গে ইচ্ছাশক্তির ধারণা অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যতদিন পর্যন্ত আমরা জগৎকে গতিশীল দেখছি, ততদিন তার পশ্চাতে ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব আমাদের স্বীকার করতে হয়। ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান যে সম্পূর্ণ ভ্রম, পদার্থবিজ্ঞান তা প্রমাণ করে দেয়; আমরা কোন জিনিষকে যেমন দেখি, শুনি, স্পর্শ ঘ্রাণ বা আস্বাদ করি, স্বরূপতঃ জিনিষটা বাস্তবিক তা নয়। বিশেষ বিশেষ প্রকারের স্পন্দন বিশেষ বিশেষ ফল উৎপন্ন করছে, আর সেইগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর ক্রিয়া করছে; আমরা কেবল আপেক্ষিক সত্যই জানতে পারি।

‘সত্য’-শব্দ ‘সৎ’ থেকে এসেছে। যা ‘সৎ’ অর্থাৎ ‘আছে’, যেটি ‘অস্তিস্বরূপ’ সেটিই সত্য। আমাদের বর্তমান দৃষ্টি থেকে এই জগৎপ্রপঞ্চ ইচ্ছা ও জ্ঞানশক্তির প্রকাশ বলে বোধ হচ্ছে। আমাদের কাছে আমাদের অস্তিত্ব যতটুকু সত্য, তাঁর নিজের কাছে সগুণ ঈশ্বরের অস্তিত্বও ততটুকু সত্য, তদপেক্ষা অধিক সত্য নয়। আমাদের রূপ যেমন দেখা যায়, ঈশ্বরকেও তেমনি সাকারভাবে দেখা যেতে পারে। মানুষ-হিসাবে আমাদের একটি ঈশ্বরের প্রয়োজন; আত্মস্বরূপে আমাদের ঈশ্বরের প্রয়োজন থাকে না। সেইজন্যই শ্রীরামকৃষ্ণ সেই জগজ্জননীকে সদাসর্বদা তাঁর কাছে বর্তমান দেখতেন—তাঁর চারপাশের অন্যান্য সকল বস্তু অপেক্ষা তাঁকেই বেশী বাস্তব বলে দেখতেন; কিন্তু সমাধি-অবস্থায় তাঁর আত্মা ব্যতীত আর কিছুর অনুভব থাকত না। সেই সগুণ ঈশ্বর ক্রমশঃ আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে থাকেন, শেষে তিনি যেন গলে যান, তখন ‘ঈশ্বর’ও থাকেন না, ‘আমি’ও থাকে না—সব সেই আত্মায় লীন হয়ে যায়।

চেতনার বোধ একটা বন্ধন। ‘সৃষ্টি দেখে স্রষ্টার কল্পনা’-রূপ এক মত আছে, তাতে রূপাদি-সৃষ্টির পূর্বে বুদ্ধির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু বুদ্ধি যদি কিছুর কারণ হয়, তবে তা আবার অপর কিছুর কার্যস্বরূপ। একেই বলে ‘মায়া’। ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেন, আবার আমরা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করি—এই হল মায়া। সর্বত্র এইরূপ চক্রগতি দেখা যায়ঃ মন দেহ সৃষ্টি করছে, আবার দেহ মন সৃষ্টি করছে; ডিম থেকে পাখি, আবার পাখি থেকে ডিম; গাছ থেকে বীজ, আবার বীজ থেকে গাছ। এই জগৎপ্রপঞ্চ একেবারে বৈষম্যে পূর্ণ নয়, আবার পুরোপুরি সমভাবাপন্নও নয়। মানুষ স্বাধীন—তাকে এই দুই ভাবের উপরে উঠতে হবে। এ দুটোই নিজ নিজ প্রকাশভূমিতে সত্য বটে, কিন্তু সেই যথার্থ সত্য—সেই অস্তি-স্বরূপকে লাভ করতে গেলে আমরা এখন যা কিছু অস্তিত্ব, ইচ্ছা, চেতনা, করা, যাওয়া, জানা বলে জানি, সে-সব অতিক্রম করতে হবে। (পৃথক্ বা স্বতন্ত্র) জীবাত্মার প্রকৃত ব্যক্তিত্ব নেই—ওটা মিশ্র বস্তু হলে তো কালে খণ্ড খণ্ড হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। যাকে আর কোনরূপে বিশ্লেষণ করা যায় না, কেবল সেই বস্তুই অমিশ্র এবং কেবল সেইটিই সত্যস্বরূপ, মুক্তস্বভাব, অমৃত ও আনন্দস্বরূপ। এই ভ্রমাত্মক স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করবার জন্য যত চেষ্টা, সবই বাস্তবিক পাপ, আর ঐ স্বাতন্ত্র্যকে নাশ করবার সমুদয় চেষ্টাই ধর্ম বা পুণ্য। এই জগতে সব কিছুই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এই স্বাতন্ত্র্যকে ভাঙবার চেষ্টা করছে। চারিত্র্যনীতির (morality) ভিত্তি হচ্ছে—এই পার্থক্যজ্ঞান বা ভ্রমাত্মক স্বাতন্ত্র্যকে ভাঙবার চেষ্টা, কারণ এইটিই সকল প্রকার পাপের মূল; চারিত্র্যনীতি আগে থেকেই রয়েছে, ধর্মশাস্ত্র ঐ নীতি পরবর্তী কালে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র। প্রথমে সমাজে নানাবিধ প্রথা স্বভাবতই উৎপন্ন হয়ে থাকে, সেগুলি ব্যাখ্যা করার জন্য পরে পুরাণের উৎপত্তি। যখন ঘটনাসমূহ ঘটে যায়, তখন সেগুলি যুক্তি-বিচারের চেয়ে উচ্চতর কোন নিয়মেই ঘটে থাকে, যুক্তিবিচারের আবির্ভাব হয় পরে—ঐগুলি বোঝবার চেষ্টায়। যুক্তিবিচারের কোন কিছু ঘটবার শক্তি নেই, এ যেন ঘটনাগুলি ঘটে যাবার পরে সেগুলির জাবরকাটা। যুক্তিতর্ক যেন মানুষের কার্যকলাপের ঐতিহাসিক (historian)।

বুদ্ধ একজন মহা বৈদান্তিক ছিলেন (কারণ বৌদ্ধধর্ম প্রকৃতপক্ষে বেদান্তের একটি শাখা মাত্র), আর শঙ্করকেও কখনও কখনও ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ বলা হয়। বুদ্ধ বিশ্লেষণ করেছিলেন, শঙ্কর সেইগুলি সংশ্লেষণ বা সমন্বয় করলেন। বুদ্ধ কখনও কারও কাছে মাথা নোয়াননি—বেদ, জাতিভেদ, পুরোহিত বা সামাজিক প্রথা—কারও কাছে নয়। যতদূর পর্যন্ত যুক্তিবিচার চলতে পারে, ততদূর নির্ভীকভাবে তিনি যুক্তিবিচার করে গেছেন। এরূপ নির্ভীক সত্যানুসন্ধান, আবার সকল প্রাণীর প্রতি এমন ভালবাসা—জগতে কেউ কখনও দেখেনি। বুদ্ধ যেন ধর্মজগতের ওয়াশিংটন ছিলেন, তিনি সিংহাসন জয় করেছিলেন শুধু জগৎকে দেবার জন্য, যেমন ওয়াশিংটন মার্কিনজাতির জন্য করেছিলেন। তিনি নিজের জন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করতেন না।

শনিবার, ২০ জুলাই


প্রত্যক্ষানুভূতিই যথার্থ জ্ঞান বা যথার্থ ধর্ম। অনন্ত যুগ ধরে আমরা ধর্ম সম্বন্ধে যদি কেবল কথা বলে যাই, তাতে কখনই আমাদের আত্মজ্ঞান হতে পারে না। কেবল মতবাদে বিশ্বাসী হওয়া ও নাস্তিকতায় কিছু তফাত নেই। মানুষ-হিসাবে এ দুয়ের মধ্যে নাস্তিকই বেশী খাঁটি। সেই প্রত্যক্ষানুভূতির আলোকে আমি যে কয় পা অগ্রসর হব, তা থেকে কোন কিছুই আমাকে কখনও হটাতে পারবে না। কোন দেশ যখন তুমি স্বয়ং গিয়ে দেখলে, তখনই তোমার তার সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান হল। আমাদের প্রত্যেককে নিজে নিজে দেখতে হবে। গুরু কেবল আমাদের কাছে ‘আধ্যাত্মিক খাবার’ এনে দিতে পারেন—ঐ খাদ্য থেকে পুষ্টিলাভ করতে গেলে আমাদের তা খেতে হবে। তর্কযুক্তি কখনও ঈশ্বরকে প্রমাণ করতে পারে না, কেবল যুক্তিসঙ্গত একটা সিদ্ধান্তরূপে তাঁকে উপস্থাপিত করে।

ভগবানকে আমাদের বাইরে পাওয়া অসম্ভব। বাইরে যা ঈশ্বরতত্ত্বের উপলব্ধি হয়, তা আমাদের আত্মারই প্রকাশমাত্র। আমরাই হচ্ছি ভগবানের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির। বাইরে যা দেখা যায়, তা আমাদের ভিতরের জিনিষেরই অতি অস্পষ্ট অনুকরণ-মাত্র।

আমাদের মনের শক্তিগুলির একাগ্রতাই আমাদের ঈশ্বরদর্শনে সহায়তা করবার একমাত্র যন্ত্র। যদি তুমি একটি আত্মাকে (নিজ আত্মাকে) জানতে পার, তা হলে তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ, ও বর্তমান সকল আত্মাকেই জানতে পারবে। ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই মনের একাগ্রতা-সাধন হয়—যুক্তি, বিচার, ভক্তি, ভালবাসা, প্রাণায়াম ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ের দ্বারা এই ইচ্ছাশক্তি উদ্বুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। একাগ্র মন যেন একটি প্রদীপ—এর দ্বারা আত্মার স্বরূপ তন্ন তন্ন করে দেখা যায়।

একপ্রকার সাধনপ্রণালী সকলের উপযোগী হতে পারে না। কিন্তু এই-সকল বিভিন্ন সাধনপ্রণালী যে সোপানের মত একটার পর একটা অবলম্বন করতে হবে, তা নয়। ক্রিয়াকলাপ অনুষ্ঠানাদি সর্বনিম্ন সাধন, তারপর ঈশ্বরকে আমাদের বাইরে দেখা, তারপর অন্তর্যামিরূপে দেখা। স্থলবিশেষে, একটার পর আর একটা—এইরূপ ক্রম আবশ্যক হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ স্থলে কেবল একটা পথই প্রয়োজন। ‘জ্ঞানলাভ করতে হলে তোমাকে কর্ম ও ভক্তির পথ দিয়ে প্রথমে যেতেই হবে’—সকলকেই এ-কথা বলা চরম মূর্খতা।

যতদিন না যুক্তিবিচারের অতীত কোন তত্ত্বলাভ করছ, ততদিন তুমি তোমার যুক্তিবিচার ধরে থাকো, আর ঐ অবস্থায় পৌঁছলে তুমি বুঝবে যে, সেটা যুক্তিবিচারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জিনিষ, কারণ ঐ অবস্থা তোমার যুক্তির বিরোধী হবে না। যুক্তিবিচার বা জ্ঞানের অতীত এই ভূমি হচ্ছে সমাধি, কিন্তু স্নায়বীয় রোগের তাড়নায় মূর্ছাবিশেষকে সমাধি বলে ভুল কর না। অনেকে মিছামিছি সমাধি হয়েছে বলে দাবী করে থাকে, স্বাভাবিক বা সহজ জ্ঞানকে সমাধি-অবস্থা বলে ভ্রম করে থাকে—এ বড় ভয়ানক কথা। বাইরের কোন লক্ষণ দেখে নির্ণয় করবার উপায় নেই—যথার্থ সমাধি হয়েছে কিনা, নিজে নিজেই তা টের পাওয়া যায়। তবে যুক্তিবিচারের সাহায্য নিলে ভুলভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, সুতরাং একে ব্যতিরেকী পরীক্ষা বলা যেতে পারে; ধর্মলাভ মানে হচ্ছে—যুক্তিতর্কের বাইরে যাওয়া, কিন্তু ঐ ধর্মলাভ করবার পথ একমাত্র যুক্তিবিচারেরই ভিতর দিয়ে। সহজাত জ্ঞান যেন বরফ, যুক্তিবিচার যেন জল, আর অলৌকিক জ্ঞান বা সমাধি যেন বাষ্প—সব চেয়ে সূক্ষ্ম অবস্থা। একটার পর আর একটা আসে। সব জায়গাতেই এই নিত্য পৌর্বাপর্য বা ক্রম রয়েছে—যেমন অজ্ঞান, সংজ্ঞা বা আপেক্ষিক জ্ঞান ও বোধি; জড় পদার্থ, দেহ মন। আর আমরা এই শৃঙ্খলের যে পাবটা (link) প্রথম ধরি, সেইটা থেকেই শিকলটা আরম্ভ হয়েছে—আমাদের কাছে এই রকম বোধ হয়। অর্থাৎ কেউ বলে—দেহ থেকে মনের উৎপত্তি, কেউ বা বলে থাকে—মন থেকে দেহ হয়েছে। উভয় পক্ষেই যুক্তির সমান মূল্য, আর উভয় মতই সত্য। আমাদের ঐ দুটোরই পারে যেতে হবে—এমন জায়গায় যেতে হবে, যেখানে দেহ বা মন কোনটি-ই নেই। এই যে ক্রম—এও মায়া।

ধর্ম যুক্তিবিচারের পারে, ধর্ম অতি-প্রাকৃত। বিশ্বাস-অর্থে কিছু মেনে নেওয়া নয়, বিশ্বাসের অর্থ—সেই চরম পদার্থকে ধারণা করা, বিশ্বাস হৃদয়-কন্দর উদ্ভাসিত করে দেয়। প্রথমে সেই আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে শোন, তারপর বিচার কর—বিচার দ্বারা উক্ত আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে কতদূর জানতে পারা যায় তা দেখ; এর উপর দিয়ে বিচারের বন্যা বয়ে যাক—তারপর বাকী যা থাকে, সেইটুকু গ্রহণ কর। যদি কিছু বাকী না থাকে, তবে ভগবানকে ধন্যবাদ দাও যে, তুমি একটা কুসংস্কারের হাত থেকে বেঁচেছ। আর যখন তুমি স্থির সিদ্ধান্ত করবে যে, কিছুই আত্মাকে উড়িয়ে দিতে পারে না, যখন আত্মা সর্বপ্রকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তখন তাকে দৃঢ় ভাবে ধরে থাক এবং সকলকে ঐ আত্মতত্ত্ব শিক্ষা দাও; সত্য কখনও পক্ষপাতী হতে পারে না, এতে সকলেরই কল্যাণ হবে। সবশেষে স্থিরভাবে ও শান্তচিত্তে তাঁর উপর নিদিধ্যাসন কর বা তাঁর ধ্যান কর, তোমার মনকে তাঁর উপর একাগ্র কর, ঐ আত্মার সঙ্গে নিজেকে একভাবাপন্ন করে ফেল। তখন আর বাক্যের কোন প্রয়োজন থাকবে না, তোমার ঐ মৌনভাবই অপরের ভিতর সত্য তত্ত্ব সঞ্চার করবে। বৃথা কথা বলে শক্তিক্ষয় কর না, চুপচাপ ধ্যান কর। আর বহির্জগতের গণ্ডগোল যেন তোমাকে বিক্ষুব্ধ না করে। যখন তোমার মন সর্বোচ্চ অবস্থায় উপনীত হয়, তখন তুমি তা জানতে পার না। চুপচাপ থেকে শক্তিসঞ্চয় কর, আর আধ্যাত্মিকতার বিদ্যুদাধার (dynamo) হয়ে যাও। ভিখারী আবার কি দিতে পারে? রাজাই কেবল দিতে পারে—সেও আবার শুধু তখনই দিতে পারে, যখন সে নিজে কিছু চায় না।

*****************

তোমার যা টাকাকড়ি, তা তোমার নিজের মনে কর না, নিজেকে ভগবানের ভাণ্ডারী বলে মনে কর। ধনের প্রতি আসক্ত হয়ো না। নামযশ টাকাকড়ি সব যাক্, এগুলি সব ভয়ানক বন্ধন। মুক্তির অপূর্ব পরিবেশ অনুভব কর। তুমি তো মুক্ত, মুক্ত, মুক্ত; অবিরত বল, আমি ধন্য, আমি আনন্দময়, আমি মুক্তস্বরূপ, আমি অনন্তস্বরূপ, আমার আত্মাতে আদি নেই, অন্ত নেই; সবই আমার আত্মস্বরূপ।

রবিবার, ২১ জুলাই


(পাতঞ্জল যোগসূত্র)

চিত্ত বা মন যাতে বৃত্তিরূপে বিভক্ত না হয়ে পড়ে, যোগশাস্ত্র তাই শিক্ষা দিয়ে থাকে—‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ।’ মনটা বিষয়-সমূহের ছাপ ও অনুভূতির, অর্থাৎ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মিশ্রস্বরূপ, সুতরাং তা নিত্য হতে পারে না। মনের একটা সূক্ষ্ম শরীর আছে, সেই শরীর দ্বারা মন স্থূল দেহের উপর কার্য করে থাকে। বেদান্ত বলেন, মনের পশ্চাতে যথার্থ আত্মা আছেন। বেদান্ত অপর দুটিকে—অর্থাৎ দেহ ও মনকে স্বীকার করে থাকেন; আর একটি তৃতীয় পদার্থ স্বীকার করেন—যা অনন্ত, চরমতত্ত্ব-স্বরূপ, বিশ্লেষণের শেষ ফলস্বরূপ, এক অখণ্ড বস্তু—যাকে আর ভাগ করা যেতে পারে না। জন্ম হচ্ছে পুনর্যোজন, মৃত্যু হচ্ছে বিয়োজন, সব কিছু বিশ্লেষণ করতে করতে শেষে আত্মাকে পাওয়া যায়। আত্মাকে আর ভাগ করতে পারা যায় না, সুতরাং আত্মাতে পৌঁছলে নিত্য সনাতন তত্ত্বে পৌঁছান গেল।

প্রত্যেক তরঙ্গের পশ্চাতে সমগ্র সমুদ্রটা রয়েছে—যত কিছু অভিব্যক্তি, সবই তরঙ্গ, তবে কতকগুলি খুব বড় আর কতকগুলি ছোট, এইমাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐসব তরঙ্গ স্বরূপতঃ সমুদ্র—সমগ্র সমুদ্র; কিন্তু তরঙ্গ-হিসাবে প্রত্যেকটি অংশ মাত্র। তরঙ্গসমূহ যখন শান্ত হয়ে যায়, তখন সব এক। পতঞ্জলি বলেন,—‘দৃশ্যবিহীন দ্রষ্টা’। যখন মন ক্রিয়াশীল থাকে, তখন আত্মা তার সঙ্গে মিশিয়া থাকেন। অনুভূত পুরাতন বিষয়গুলির দ্রুত পুনরাবৃত্তিকে ‘স্মৃতি’ বলে।

অনাসক্ত হও। জ্ঞানই শক্তি আর জ্ঞানলাভ করলেই তোমার শক্তিও আসবে। জ্ঞানের দ্বারা এমন কি এই জড় জগৎটাও তুমি উড়িয়ে দিতে পার। যখন তুমি মনে মনে কোন বস্তু থেকে এক একটা করে গুণ বাদ দিতে দিতে ক্রমে সব গুণই বাদ দিতে পারবে, তখন তুমি ইচ্ছে করলেই সমগ্র জিনিষটাকে তোমার জ্ঞান থেকে দূর করে দিতে পারবে।

যারা উত্তম অধিকারী, তারা যোগে খুব শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি করতে পারে—ছ-মাসে তারা যোগী হতে পারে। যারা তদপেক্ষা নিম্নাধিকারী, তাদের যোগে সিদ্ধিলাভ করতে কয়েক বৎসর লাগতে পারে, আর যে-কোন ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে সাধন করলে, অন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল সদা সর্বদা সাধনে রত থাকলে দ্বাদশ বর্ষে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। এই-সব মানসিক ব্যায়াম না করে কেবল ভক্তি দ্বারাও ঐ অবস্থায় যেতে পারা যায়, কিন্তু তাতে কিছু বিলম্ব হয়।

মনের দ্বারা সেই আত্মাকে যেভাবে দেখা বা ধরা যেতে পারে, তাকেই ‘ঈশ্বর’ বলে। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ‘ওঁ’, সুতরাং ঐ ওঙ্কার জপ কর, তার ধ্যান কর, তার ভিতর যে অপূর্ব অর্থসমূহ নিহিত রয়েছে, তা ভাবনা কর। সর্বদা ওঙ্কার জপই যথার্থ উপাসনা। ওঙ্কার সাধারণ শব্দমাত্র নয়, স্বয়ং ঈশ্বর-স্বরূপ।

ধর্ম তোমায় নূতন কিছুই দেয় না, কেবল প্রতিবন্ধগুলি সরিয়ে দিয়ে তোমার নিজের স্বরূপ দেখতে দেয়। ব্যাধিই প্রথম মস্ত বিঘ্ন—সুস্থ শরীরই সেই যোগাবস্থা লাভ করবার সর্বোকৃষ্ট যন্ত্রস্বরূপ। ‘দৌর্মনস্য’ বা মন খারাপ হওয়া-রূপ বিঘ্নটিকে দূর করা একরকম অসম্ভব বললেই হয়। তবে একবার যদি তুমি ব্রহ্মকে জানতে পার, পরে আর তোমার মন খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকবে না। সংশয়, অধ্যবসায়ের অভাব, ভ্রান্ত ধারণা—এগুলিও অন্যান্য বিঘ্ন।

*****************

প্রাণ হচ্ছে দেহস্থ অতি সূক্ষ্ম শক্তি—দেহের সর্বপ্রকার গতির উৎস। প্রাণ সর্বসুদ্ধ দশটি—তন্মধ্যে পাঁচটি অন্তর্মুখ আর পাঁচটি বহির্মুখ। একটি প্রধান প্রাণপ্রবাহ উপরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, অপরগুলি নীচের দিকে। প্রাণায়ামের অর্থ শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়মনের দ্বারা প্রাণসমূহকে নিয়মিত করা। শ্বাস যেন ইন্ধন, প্রাণ বাষ্প এবং শরীরটা যেন ইঞ্জিন। প্রাণায়ামে তিনটি ক্রিয়া আছেঃ পূরক—শ্বাসকে ভিতরে টানা, কুম্ভক—শ্বাসকে ভিতরে ধারণ করে রাখা, আর রেচক—বাইরে শ্বাস নিক্ষেপ করা।

গুরু হচ্ছেন সেই আধার, যাঁর মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক শক্তি তোমার কাছে পৌঁছয়। যে-কেউ শিক্ষা দিতে পারে বটে, কিন্তু গুরুই শিষ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করে থাকেন, তাতেই আধ্যাত্মিক উন্নতিরূপ ফল হয়ে থাকে। শিষ্যদের মধ্যে পরস্পর ভাই-ভাই-সম্বন্ধ, আর ভারতের আইন এই সম্বন্ধ স্বীকার করে থাকে। গুরু তাঁর পূর্ব পূর্ব আচার্যদের কাছ থেকে যে মন্ত্র বা ভাবশক্তিময় শব্দ পেয়েছেন, তাই শিষ্যে সংক্রামিত করেন—গুরু ব্যতীত সাধনভজন কিছু হতে পারে না; বরং বিপদের আশঙ্কা যথেষ্ট আছে। সাধারণতঃ গুরুর সাহায্য না নিয়ে এই-সকল যোগ অভ্যাস করতে গেলে কামের প্রাবল্য হয়ে থাকে, কিন্তু গুরুর সাহায্য থাকলে প্রায়ই এটা ঘটে না। প্রত্যেক ইষ্টদেবতার এক-একটি মন্ত্র আছে। ইষ্ট-অর্থে বিশেষ উপাসকের বিশেষ আদর্শ বুঝিয়ে থাকে। মন্ত্র হচ্ছে ঐ বিশেষ ভাব-ব্যঞ্জক শব্দ। ঐ শব্দের ক্রমাগত জপের দ্বারা আদর্শটিকে মনে দৃঢ়ভাবে রাখবার সহায়তা হয়ে থাকে। এইরূপ উপাসনাপ্রণালী ভারতের সকল সাধকের মধ্যে প্রচলিত।

মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই


(ভগবদ্‌গীতা—কর্মযোগ)

কর্মের দ্বারা মুক্তিলাভ করতে হলে নিজেকে কর্মে নিযুক্ত কর, কিন্তু কোন কামনা কর না—ফলাকাঙ্ক্ষা যেন তোমার না থাকে। এইরূপ কর্মের দ্বারা জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে—ঐ জ্ঞানের দ্বারা মুক্তি হয়। জ্ঞানলাভ করবার পূর্বে কর্মত্যাগ করলে তাতে দুঃখই এসে থাকে। ‘আত্মা’র জন্য কর্ম করলে তা থেকে কোন বন্ধন আসে না। কর্ম থেকে সুখের আকাঙ্ক্ষাও কর না; আবার কর্ম করলে কষ্ট হবে—এ ভয়ও কর না। দেহ-মনই কাজ করে থাকে, আমি করি না। সদাসর্বদা নিজেকে এই কথা বলো এবং এটি প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা কর। চেষ্টা কর—যাতে তোমার বোধই হবে না যে, তুমি কিছু করছ।

সমুদয় কর্ম ভগবানে অর্পণ কর। সংসারে থাকো, কিন্তু সংসারের হয়ে যেও না—যেমন পদ্মপত্রের মূলগুলি পাঁকের মধ্যে থাকে, কিন্তু তা যেমন সদাই শুদ্ধ থাকে, সেইরূপ লোকে তোমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করুক না, তোমার ভালবাসা যেন কারও প্রতি কম না হয়। যে অন্ধ, তার রঙের জ্ঞান নেই, সুতরাং আমার নিজের ভিতর দোষ না থাকলে অপরের ভিতর দোষ দেখব কি করে? আমরা আমাদের নিজেদের ভিতর যা রয়েছে, তার সঙ্গে বাইরে যা দেখতে পাই, তার তুলনা করি এবং তদনুসারেই কোন বিষয়ে আমাদের মতামত দিয়ে থাকি। যদি আমরা নিজেরা পবিত্র হই, তবে বাইরে অপবিত্রতা দেখতে পাব না। বাইরে অপবিত্রতা থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তার অস্তিত্ব থাকবে না। প্রত্যেক নরনারী, বালকবালিকার ভিতর ব্রহ্মকে দর্শন কর, ‘অন্তর্জ্যোতিঃ’ দ্বারা তাঁকে দেখ, যদি সর্বত্র সেই ব্রহ্মদর্শন হয়, তবে আমরা আর অন্য কিছু দেখতে পাব না। এই সংসারটাকে চেও না, কারণ যে যা চায়, সে তাই পায়। ভগবানকে—কেবল ভগবানকেই অন্বেষণ কর। যত অধিক ক্ষমতা-লাভ হবে, ততই বন্ধন আসবে, ততই ভয় আসবে। একটা সামান্য পিঁপড়ের চেয়ে আমরা কত অধিক ভীত ও দুঃখী। এই সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চের বাইরে ভগবানের কাছে যাও। স্রষ্টার তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কর, সৃষ্টের তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কর না।

‘আমিই কর্তা ও আমিই কার্য।’ ‘যিনি কামক্রোধের বেগধারণ করতে পারেন, তিনি মহাযোগী-পুরুষ।’৫০

‘অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই কেবল মনকে নিরোধ করা যেতে পারে।’৫১

*****************

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধীর স্থির হয়ে ধর্ম ও ঈশ্বর সম্বন্ধে চিন্তা করে গেছেন, ফলে আমাদেরও ঐ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবার জন্য মস্তিষ্কটুকু রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা লাভের আশায় যে-রকম ছুটোছুটি আরম্ভ করেছি, তাতে সেটি নষ্ট হবার যোগাড় হচ্ছে।

*****************

শরীরের নিজেরই নিজেকে আরোগ্য করবার একটা শক্তি আছে—আর মানসিক অবস্থা, ঔষধ, ব্যায়াম প্রভৃতি নানা বিষয় এই আরোগ্য-শক্তিকে জাগিয়ে দিতে পারে। যতদিন আমরা প্রাকৃতিক অবস্থাচক্রের দ্বারা বিচলিত হই, ততদিন আমাদের জড়ের সহায়তা প্রয়োজন। আমরা যতদিন না স্নায়ুসমূহের দাসত্ব কাটাতে পারছি, ততদিন জড়ের সাহায্য আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।

আমাদের সাধারণ জ্ঞানভূমির নীচে মনের আর এক ভূমি আছে—তাকে ‘অজ্ঞানভূমি’ বা ‘অবচেতন মন’ বলা যেতে পারে; আমরা যাকে সমগ্র মানুষ বলি, জ্ঞান তার একটা অংশমাত্র। দর্শনশাস্ত্র মন সম্বন্ধে কতকগুলি আন্দাজমাত্র। ধর্ম কিন্তু প্রত্যক্ষানুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত—প্রত্যক্ষদর্শন জ্ঞানের একমাত্র ভিত্তি। মন যখন জ্ঞানেরও অতীত ভূমিতে চলে যায়, তখন সে যথার্থ বস্তু—যথার্থ বিষয়কেই উপলব্ধি করে। ‘আপ্ত’ তাঁদের বলে, যাঁরা ধর্মকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা যে উপলব্ধি করেছেন, তার প্রমাণ এই যে, তুমিও যদি তাঁদের প্রণালী অনুসরণ কর, তুমিও প্রত্যক্ষ করবে। প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব বিশেষ প্রণালী ও বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। একজন জ্যোতির্বিদ্ রান্নাঘরের সমস্ত হাঁড়িকুড়ির সাহায্য নিয়ে শনিগ্রহের বলয়গুলি দেখাতে পারেন না, তার জন্য দূরবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। সেইরূপ ধর্মের মহান্ সত্যাসমূহ দেখতে হলে, যারাঁ পূর্বেই সেগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের প্রণালীগুলি অনুসরণ করতে হবে। যে বিজ্ঞান যত বড়, তার শিক্ষা করবার উপায়ও তত নানাবিধ। আমরা সংসারে আসবার পূর্বেই ভগবান্ এ থেকে বেরুবার উপায়ও করে রেখেছেন। সুতরাং আমাদের চাই—শুধু সেই উপায়টাকে জানা। তবে বিভিন্ন প্রণালী নিয়ে মারামারি কর না; কেবল যাতে তোমার অপরোক্ষানুভূতি হয়, তার চেষ্টা কর, আর যে সাধনপ্রণালী তোমার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী হয়, তাই অবলম্বন কর। তুমি আম খেয়ে যাও, অপরে ঝুড়িটা নিয়ে ঝগড়া করুক। খ্রীষ্টকে দর্শন কর, তবে তুমি যথার্থ খ্রীষ্টান হবে। আর সবই বাজে কথামাত্র—কথা যত কম হয়, ততই ভাল।

জগতে যার কিছু বার্তা বহন করবার বা শিক্ষা দেবার থাকে, তাকেই ‘বার্তাবহ’ বা দূত বলা যেতে পারে; দেবতা থাকলে তবেই তাকে মন্দির বলা যেতে পারে, এর বিপরীতটা সত্য নয়।

ততদিন পর্যন্ত শিক্ষা কর, যতদিন পর্যন্ত না তোমার মুখ ব্রহ্মবিদের মত প্রতিভাত হয়, যেমন সত্যকামের হয়েছিল।৫২

আনুমানিক জ্ঞানের বিরুদ্ধে আনুমানিক জ্ঞান নিয়ে কথা বললেই ঝগড়া বাধে। কিন্তু যা প্রত্যক্ষ দর্শন করেছ, তারই সম্বন্ধে কথা বল দেখি—কোন মনুষ্যহৃদয়ই তাকে স্বীকার না করে পারবে না। প্রত্যক্ষানুভূতি করাতেই সেণ্ট পল্‌কে (St. Paul) ইচ্ছার বিরুদ্ধে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

(মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর অল্পক্ষণ কথাবার্তা হয়—সেই কথাবার্তা-প্রসঙ্গে স্বামীজী বলেনঃ)

ভ্রমই ভ্রমকে সৃষ্টি করে থাকে। ভ্রম নিজেকেই নিজে সৃষ্টি করে, আবার নিজেকেই নিজে ধ্বংস করে। একেই বলে ‘মায়া’। যেহেতু তথাকথিত সমুদয় জ্ঞানেরই ভিত্তি মায়া, ঐ জ্ঞান ‘অন্যোন্যাশ্রয়দোষদুষ্ট’। এমন এক সময় আসে—যখন ঐ জ্ঞান নিজেই নিজেকে নষ্ট করে। ‘ছেড়ে দাও রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।’ ভ্রম কখনও আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। যখনই আমরা সেই দড়িটাকে ধরি, মায়ার সহিত নিজেদের এক করে ফেলি, তখনই মায়া আমাদের উপর শক্তি বিস্তার করে। মায়াকে ছেড়ে দাও, কেবল সাক্ষিস্বরূপ হয়ে থাক। তা হলেই অবিচলিত থেকে জগৎপ্রপঞ্চ-রূপ ছবির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে পারবে।

বুধবার, ২৪ জুলাই


যিনি যোগে সম্পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁর পক্ষে যোগসিদ্ধিগুলি বিঘ্ন নয়, কিন্তু প্রবর্তকের পক্ষে সেগুলি বিঘ্নস্বরূপ হতে পারে, কারণ ঐগুলি প্রয়োগ করতে করতে ঐ-সবে একটা আনন্দ ও বিস্ময়ের ভাব আসতে পারে। সিদ্ধি বা বিভূতিগুলি যোগসাধনার পথে যে ঠিক ঠিক অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে, তারই চিহ্নস্বরূপ; কিন্তু সেগুলি মন্ত্রজপ, উপবাসাদি, তপস্যা, যোগসাধন, এমন কি ঔষধ-বিশেষের ব্যবহারের দ্বারাও আসতে পারে। যে যোগী যোগসিদ্ধিসমূহেও বৈরাগ্য অবলম্বন করেন এবং সমুদয় কর্মফল ত্যাগ করেন, তাঁর ‘ধর্মমেঘ’ নামে সমাধিলাভ হয়। যেমন মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করে, তেমনি তিনি যে যোগাবস্থা লাভ করেন, তা চারিদিকে ধর্ম বা পবিত্রতার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

যখন একরূপ প্রত্যয়ের ক্রমাগত আবৃত্তি হতে থাকে, তখনই সেটা ধ্যান-পদবাচ্য, কিন্তু সমাধি এক বস্তুতেই হয়ে থাকে।

মন আত্মার জ্ঞেয়, কিন্তু মন স্বপ্রকাশ নয়। আত্মা কোন বস্তুর কারণ হতে পারে না। কিরূপে হবে? পুরুষ প্রকৃতিতে যুক্ত হবে কিরূপে? পুরুষ প্রকৃতপক্ষে কখনও প্রকৃতিতে যুক্ত হন না, অবিবেকের দরুন বোধ হয়—পুরুষ প্রকৃতিতে যুক্ত হয়েছে।

*****************

লোককে করুণার চক্ষে না দেখে, অথবা তারা অতি হীন দশায় পড়ে আছে—এ-রকম মনে না করে, অপরকে সাহায্য করতে শিক্ষা কর। শত্রু-মিত্র উভয়ের প্রতি সমদৃষ্টি হতে শিক্ষা কর; যখন তা হতে পারবে, আর যখন তোমার কোন বাসনা থাকবে না, তখন তোমার চরমাবস্থা লাভ হয়েছে—বুঝতে হবে।

বাসনারূপ অশ্বত্থবৃক্ষকে অনাসক্তিরূপ কুঠার দ্বারা কেটে ফেল, তা হলেই তা একেবারে চলে যাবে—ও তো একটা ভ্রমমাত্র। ‘যাঁর মোহ ও শোক চলে গেছে, যিনি সঙ্গদোষ জয় করেছেন, তিনিই কেবল ‘আজাদ’ বা মুক্ত।’

কোন ব্যক্তিকে বিশেষভাবে—ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসা হচ্ছে বন্ধন। সকলকে সমানভাবে ভালবাসো, তা হলে সব বাসনা চলে যাবে।

সর্বভক্ষক কাল এলে সকলকেই যেতে হবে; অতএব পৃথিবীর উন্নতির জন্য—ক্ষণস্থায়ী প্রজাপতিকে রংচঙে করবার জন্য কেন চেষ্টা কর? সবই তো শেষে চলে যাবে। সাদা ইঁদুরের মত খাঁচায় বসে কেবল ডিগবাজি খেও না; সদাই ব্যস্ত অথচ প্রকৃত কাজ কিছু হচ্ছে না। বাসনা ভালই হোক আর মন্দই হোক, বাসনা জিনিষটাই খারাপ। এ যেন কুকুরের মত মাংসখণ্ড পাবার জন্য দিনরাত লাফান, অথচ মাংসের টুকরোটা ক্রমাগত সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, আর শেষ পর্যন্ত কুকুরের মত মৃত্যু। ও-রকম হয়ো না। সমস্ত বাসনা নষ্ট করে ফেল।

*****************

পরমাত্মা যখন মায়াধীশ, তখন তিনি ঈশ্বর; পরমাত্মা যখন মায়ার অধীন, তখনই তিনি জীবাত্মা। সমুদয় জগৎপ্রপঞ্চের সমষ্টিই মায়া, একদিন সেটা একেবারে উড়ে যাবে।

বৃক্ষের বৃক্ষত্বটা মায়া—গাছ দেখবার সময় আমরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মস্বরূপকেই দেখছি, মায়া-আবরণে ঢাকা। কোন ঘটনা সম্বন্ধে ‘কেন’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসাটাই মায়ার অন্তর্গত। সুতরাং ‘মায়া কিরূপে এল?’—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বৃথা, কারণ মায়ার মধ্য থেকে ওর উত্তর কখনও দেওয়া যেতে পারে না; আর মায়ার পরে কে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে? মন্দ বা মায়া অসদ্‌দৃষ্টিই ‘কেন’—এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে মায়া আসে না—মায়াই ঐ ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করে। ভ্রমই ভ্রমকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি-বিচার নিজেই একটা বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এটা একটা চক্রস্বরূপ, কাজেই যুক্তি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি একটা আনুমানিক জ্ঞান, আবার সব আনুমানিক জ্ঞানের ভিত্তি অনুভূতি।

অজ্ঞানে যখন ব্রহ্মজ্যোতিঃ প্রতিফলিত হয়, তখনই অজ্ঞান দৃশ্য হয়।স্বতন্ত্রভাবে ধরলে সেটা শূন্য ছাড়া কিছুই নয়। মেঘে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত না হলে মেঘকে দেখাই যায় না।

*****************

চারজন লোক দেশভ্রমণ করতে করতে একটা খুব উঁচু দেওয়ালের কাছে এসে উপস্থিত হল। প্রথম পথিকটি অতি কষ্টে দেওয়াল বেয়ে উঠল, আর পেছন দিকে চেয়ে না দেখেই দেওয়ালের ওপারে লাফ দিয়ে পড়ল। দ্বিতীয় পথিকটি দেওয়ালে উঠল, ভেতরের দিকে দেখলে, আর আনন্দধ্বনি করে ভেতরে পড়ল। তারপর তৃতীয়টিও দেওয়ালের মাথায় উঠল, তার সঙ্গীরা কোথায় গিয়াছে—সে দিকে লক্ষ্য করে দেখলে, তারপর আনন্দে হাঃ হাঃ করে হেসে তাদের অনুসরণ করলে। কিন্তু চতুর্থ পথিকটি দেওয়ালে উঠে তার সঙ্গীদের কি হল জেনে লোককে তা জানাবার জন্য ফিরে এল। এই সংসার-প্রপঞ্চের বাইরে যে কিছু আছে, আমাদের কাছে তার প্রমাণ হচ্ছে—যে-সকল মহাপুরুষ মায়ার দেওয়াল বেয়ে ভেতরের দিকে পড়েছেন, তাঁরা পড়বার আগে যে আনন্দে ‘হাঃ হাঃ’ করে হেসে উঠেন, সেই হাস্য।

*****************

আমরা যখন সেই পূর্ণ সত্তা থেকে নিজেদের পৃথক্ করে তাতে কতকগুলি গুণের আরোপ করি, তখন তাঁকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। ঈশ্বর হচ্ছেন—আমাদের মনের দ্বারা দৃষ্ট এই জগৎপ্রপঞ্চের মূল সত্তা। জগতের সমুদয় মন্দ ও দুঃখরাশিকে কুসংস্কারাছন্ন মন যেভাবে দেখে, তাকেই ‘শয়তান’ বলে।

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই


(পাতঞ্জল যোগসূত্র)

কার্য তিন প্রকারের হতে পারে—কৃত (যা তুমি নিজে করছ), কারিত (যা অপরের দ্বারা করাচ্ছ), আর অনুমোদিত (অপরে করছে—তাতে তোমার অনুমোদন আছে, কোন আপত্তি নেই)। আমাদের উপর এই তিন প্রকার কার্যের ফল প্রায় একরূপ।

পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি খুব প্রবল হয়ে থাকে। ব্রহ্মচারীকে কায়মনোবাক্যে মৈথুনবর্জিত হতে হবে। দেহটার যত্ন ভুলে যাও। যতটা সম্ভব, দেহচেতনা ভুলে যাও।

যে অবস্থায় স্থিরভাবে ও সুখে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারা যায়, তাকেই ‘আসন’ বলে। সর্বদা অভ্যাসের দ্বারা এবং মনকে অনন্তভাবে ভাবিত করতে পারলে এটি হতে পারে।

একটা বিষয়ে সর্বদা চিত্তবৃত্তি প্রবাহিত করার নাম ‘ধ্যান’। স্থির জলে যদি একটা প্রস্তরখণ্ড ফেলা যায়, তা হলে জলে অনেকগুলি বৃত্তাকার তরঙ্গ উৎপন্ন হয়—বৃত্তগুলি সব পৃথক্ পৃথক্, অথচ পরস্পর পরস্পরের উপর কার্য করছে। আমাদের মনের ভেতরেও এইরূপ বৃত্তিপ্রবাহ চলেছে; তবে আমাদের ভেতর সেটি অজ্ঞাতসারে হচ্ছে, আর যোগীদের ভেতর ঐরূপ কার্য তাঁদের জ্ঞাতসারে হয়ে থাকে। আমরা যেন মাকড়সার মত নিজের জালের মধ্যে রয়েছি, যোগ-অভ্যাসের দ্বারা আমরা মাকড়সার মত জালের যে অংশে ইচ্ছা যেতে পারি। যারা যোগী নয়, তারা যেখানে রয়েছে, সেই নির্দিষ্ট স্থল-বিশেষেই আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়।

*****************

অপরকে হিংসা করলে বন্ধন হয় ও আমাদের সামনে থেকে সত্য ঢাকা পড়ে যায়। শুধু নিষেধাত্মক ধর্মসাধনাই যথেষ্ট নয়। মায়াকে আমাদের জয় করতে হবে, তা হলে মায়াই আমাদের অনুসরণ করবে। যখন কোন বস্তুকে আমাদের আর বাঁধতে পারে না, তখনই আমরা সেই বস্তু পাবার যোগ্যতা লাভ করি। যখন ঠিক ঠিক বন্ধন ছুটে যায়, তখন সবই আমাদের নিকট এসে উপস্থিত হয়। যারা কোন কিছু চায় না, শুধু তারাই প্রকৃতিকে জয় করছে।

এমন কোন মহাত্মার শরণাগত হও, যিনি নিজের বন্ধন ছিন্ন করেছেন, কালে তিনিই কৃপাবশে তোমায় মুক্ত করে দেবেন। ঈশ্বরের শরণাগত হওয়া—এর চেয়ে উচ্চভাব, কিন্তু অতি কঠিন। প্রকৃতপক্ষে এটি কার্যে পরিণত করেছে—এমন লোক শতাব্দীর ভিতর বড়জোর একজন দেখা যায়। কিছু অনুভব কর না, কিছু জেনো না, কিছু কর না, নিজের বলে কিছু রেখ না—সবকিছু ঈশ্বরে সমর্পণ কর আর সর্বান্তঃকরণে বল, ‘তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হোক।’

আমরা বদ্ধ—এই ভাব আমাদের স্বপ্নমাত্র। জেগে ওঠ—বন্ধন চলে যাক। ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও, এই মায়া-মরু অতিক্রম করবার এই একমাত্র উপায়।

‘ছেড়ে দাও রজ্জু, বলো হে সন্ন্যাসি, ওঁ তৎ সৎ ওঁ।’৫৩

আমরা যে অপরের সেবা করতে পারছি, এ আমাদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য—কারণ ঐরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারাই আমাদের আত্মোন্নতি হবে। লোকে যে কষ্ট পাচ্ছে, তার কারণ তার উপকার করে আমাদের কল্যাণ হবে। অতএব দাতা দান করবার সময় গ্রহীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসুন এবং তাকে ধন্যবাদ দিন, গ্রহীতা সম্মুখে দাঁড়িয়ে থেকে দান করতে অনুমতি দিন। সব প্রাণীর মধ্যে সেই প্রভুকে দান করে তাঁকেই দান কর। যখন আমরা আর মন্দ কিছু দেখতে পাব না, তখন আমাদের পক্ষে জগৎপ্রপঞ্চই আর থাকবে না, কারণ প্রকৃতির অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই হচ্ছে—এই ভ্রম থেকে আমাদের মুক্ত করা। অপূর্ণতা বলে কিছু আছে—এইটে ভাবাই অপূর্ণতা সৃষ্টি করা। আমরা পূর্ণস্বরূপ ও ওজঃস্বরূপ, এই চিন্তাতেই কেবল ওটা দূর হতে পারে। যতই ভাল কাজ কর না কেন, কিছু মন্দ তাতে লেগে থাকবেই থাকবে। তবে সমুদয় কার্য নিজের ব্যক্তিগত ফলাফলের দিকে দৃষ্টি না রেখে করে যাও, সব ফল ঈশ্বরে সমর্পণ কর, তা হলে ভাল মন্দ কিছুই তোমায় অভিভূত করতে পারবে না।

কাজ করাটা ধর্ম নয় বটে, তবে ঠিক ঠিক ভাবে অনুষ্ঠিত কাজ মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে অপরকে করুণার চক্ষে দেখা অজ্ঞানমাত্র, কারণ আমরা করুণা করব কাকে? তুমি ঈশ্বরকে করুণার চক্ষে দেখতে পার কি? ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু আছে কি? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে, তিনি তোমাকে তোমার আত্মোন্নতির জন্য এই জগৎরূপ একটি নৈতিক ব্যায়ামশালা দিয়েছেন, কিন্তু কখনও ভেবো না—তুমি এই জগৎকে সাহায্য করতে পার। তোমায় যদি কেউ অভিশাপ দেয়, তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, কারণ গালাগালি বা অভিশাপ জিনিষটা কি, তা দেখবার জন্য সে যেন তোমার সম্মুখে একখানি আরশি ধরেছে, আর তোমাকে আত্মসংযম অভ্যাস করবার অবসর দিচ্ছে। সুতরাং তাকে আশীর্বাদ কর ও সুখী হও। অভ্যাস করবার অবকাশ না হলে শক্তির বিকাশ হতে পারে না, আর আরশি সামনে না ধরলে আমরা নিজের মুখ নিজে দেখতে পাই না।

অপবিত্র চিন্তা ও কল্পনা অপবিত্র ক্রিয়ার মতই দোষাবহ। কামনা দমন করলে তা থেকে উচ্চতম ফললাভ হয়। কাম-শক্তিকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিণত কর, কিন্তু নিজেকে পুরুষত্বহীন কর না, কারণ তাতে কেবল শক্তির অপচয় হয়। এই শক্তি যত প্রবল থাকবে, এর দ্বারা তত অধিক কাজ সম্পন্ন হতে পারবে। প্রবল জলের স্রোত পেলে তবেই জলশক্তির সাহায্যে খনির কাজ করা যেতে পারে।

আজকাল আমাদের বিশেষ প্রয়োজন এই যে, আমাদের জানতে হবে, একজন ঈশ্বর আছেন, আর এখানে এবং এখনই আমরা তাঁকে অনুভব করতে—দেখতে পারি। চিকাগোর একজন অধ্যাপক বলেন, ‘এই জগতের তত্ত্বাবধান তুমি কর, পরলোকের খবর ঈশ্বর নেবেন।’ কি আহাম্মকি কথা! যদি আমরা এই জগতের সব বন্দোবস্ত করতে পারি, তবে পরলোকের ভার নেবার জন্য আবার অকারণ একজন ঈশ্বরের কি দরকার?

শুক্রবার, ২৬ জুলাই


(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ)

সব কিছু ভালবাস, কেবল আত্মার ভিতর দিয়ে এবং আত্মার জন্য।

যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন, ‘আত্মার দ্বারাই আমরা সব জিনিষ জানতে পারছি।’ আত্মা কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না—যে নিজে জ্ঞাতা, সে কি করে জ্ঞেয় হবে?৫৪ যিনি নিজেকে আত্মা বলে জানতে পারেন, তাঁর পক্ষে আর কোন বিধিনিষেধ থাকে না। তিনি জানেন—তিনিই এই জগৎপ্রপঞ্চ, আবার এর স্রষ্টাও বটে।

*****************

পুরাতন পৌরাণিক ব্যাপারগুলিকে রূপকের আকারে চিরস্থায়ী করবার চেষ্টা করলে এবং তাদের নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করলে কুসংস্কার উৎপত্তি হয়, আর এটা বাস্তবিকই দুর্বলতা। সত্যের সঙ্গে যেন কখনও কিছুর আপস না করা হয়। সত্যের উপদেশ দাও, আর কোন প্রকার কুসংস্কারের দোহাই দিতে চেষ্টা কর না, অথবা সত্যকে শিক্ষার্থীর ধারণাশক্তির উপযোগী করবার জন্য নামিয়ে এন না।

শনিবার, ২৭ জুলাই


(কঠোপনিষৎ)

অপরোক্ষানুভূতি-সম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত অপর কারও কাছে আত্মতত্ত্ব শিক্ষা করতে যেও না। অপরের কাছে তা কেবল কথার কথামাত্র। প্রত্যক্ষানুভূতি হলে মানুষ ধর্মাধর্ম, ভূতভবিষ্যৎ—সর্বপ্রকার দ্বন্দ্বের পারে চলে যায়। ‘নিষ্কাম ব্যক্তি সেই আত্মাকে দর্শন করেন, আর তাঁর আত্মার শ্বাশ্বতী শান্তি এসে থাকে।’৫৫ শুধু কথা বলা, বিচার, শাস্ত্রপাঠ ও বুদ্ধির চূড়ান্ত পরিচালনা করা, এমন-কি বেদ পর্যন্ত মানুষকে সেই আত্মজ্ঞান দিতে পারে না।

আমাদের ভিতর পরমাত্মা ও জীবাত্মা—দুই-ই আছেন। জ্ঞানীরা জীবাত্মাকে ছায়াস্বরূপ, আর পরমাত্মাকে যথার্থ সূর্যস্বরূপ বলে জানেন।

আমরা যদি মনটাকে ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে সংযুক্ত না করি, তা হলে আমরা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয় দ্বারা কোন জ্ঞানই লাভ করতে পারি না। মনের শক্তি দ্বারাই বহিরিন্দ্রিয়গুলিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গুলিকে বাইরে যেতে দিও না, তা হলে দেহ এবং বহির্জগৎ—এই উভয়েরই হাত থেকে মুক্তি পাবে।

এই যে অজ্ঞাত বস্তুটাকে আমরা বহির্জগৎ বলে দেখছি, মৃত্যুর পর নিজ নিজ মনের অবস্থানুসারে একেই কেউ স্বর্গ, কেউ নরক বলে দেখে। ইহলোক পরলোক—এ দুটোই স্বপ্নমাত্র, পরেরটি আবার প্রথমটির ছাঁচে গড়া। ঐ দুই প্রকার স্বপ্ন থেকেই মুক্ত হও, জানো—সবই সর্বব্যাপী, সবই বর্তমান। প্রকৃতি, দেহ ও মনেরই মৃত্যু হয়, আমাদের মৃত্যু হয় না; আমরা যাই-ও না, আসি-ও না। এই যে মানুষ ‘স্বামী বিবেকানন্দ’—এর সত্তা প্রকৃতির ভিতর, সুতরাং এর জন্মও হয়েছে এবং মৃত্যুও হবে। কিন্তু আত্মা—যাঁকে আমরা স্বামী বিবেকানন্দ-রূপে দর্শন করছি—তাঁর কখনও জন্ম হয়নি; তিনি কখনও মরবেন না—তিনি অনন্ত ও অপরিণামী সত্তা।

আমরা মনঃশক্তিকে পাঁচটা ইন্দ্রিয়শক্তিতেই ভাগ করি বা একটা শক্তিরূপেই দেখি, মনঃশক্তি এক-রকমই থাকে। একজন অন্ধ বলে, ‘প্রত্যেক জিনিষের ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি আছে, সুতরাং আমি হাততালি দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের প্রতিধ্বনি দ্বারা আমার চতুর্দিকে কোথায় কি আছে, ঠিক ঠিক বলতে পারি।’ সুতরাং ঘন কুয়াশার ভিতর একজন অন্ধ একজন চক্ষুষ্মান্ লোককে অনায়াসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কারণ তার কাছে কুয়াসা বা অন্ধকারে কিছু তফাত হয় না।

মনকে সংযত কর, ইন্দ্রিয়গুলিকে নিরোধ কর, তা হলেই তুমি যোগী; তারপর বাকী যা কিছু—সবই হবে। শুনতে, দেখতে, ঘ্রাণ বা স্বাদ নিতে অস্বীকার কর; বহিরিন্দ্রিয়গুলি থেকে মনঃশক্তিকে সরিয়ে নাও। তুমি তো অজ্ঞাতসারে এটি সদাসর্বদাই করছ—যেমন যখন তোমার মন কোন বিষয়ে মগ্ন থাকে; সুতরাং তুমি জ্ঞাতসারেও এটি করবার অভ্যাস করতে পার। মন যেখানে ইচ্ছা ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রয়োগ করতে পারে। দেহের সাহায্যেই যে আমাদের কাজ করতে হবে, এই মূল কুসংস্কারটি একেবারে ছেড়ে দাও। তা তো করতে হয় না। নিজের ঘরে গিয়ে বস, আর নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে উপনিষদের তত্ত্বগুলি আবিষ্কার কর। তুমি সকল বিষয়ের অনন্তখনিস্বরূপ, ভূত-ভবিষ্যৎ সকল গ্রন্থের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যতদিন না সেই ভিতরের অন্তর্যামী গুরুর প্রকাশ হচ্ছে, ততদিন বাহিরের উপদেশ সব বৃথা। বাহিরের শিক্ষাদ্বারা যদি হৃদয়রূপ গ্রন্থ খুলে যায়, তবেই তার কিছু মূল্য আছে—বলা যেতে পারে।

আমাদের ইচ্ছাশক্তিই সেই ‘ক্ষুদ্র মৃদু বাণী’; সেই যথার্থ নিয়ন্তা, যে আমাদের বলছে—এই কাজ কর, এই কাজ কর না। এই ইচ্ছাশক্তি আমাদের যত বন্ধনের মধ্যে এনেছে। অজ্ঞ ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি তাকে বন্ধনে ফেলে, আর সেইটেই জ্ঞানপূর্বক পরিচালিত হলে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। সহস্র সহস্র উপায়ে ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করা যেতে পারে, প্রত্যেক উপায়ই এক এক প্রকার যোগ; তবে প্রণালীবদ্ধ যোগের দ্বারা এটা খুব শীঘ্র সাধিত হতে পারে। ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগের দ্বারা খুব নিশ্চিতরূপে কৃতকার্য হওয়া যায়। মুক্তিলাভ করবার জন্য তোমার যত প্রকার শক্তি আছে, সব প্রয়োগ কর; জ্ঞানবিচার, কর্ম, উপাসনা, ধ্যান—সব পথই অবলম্বন কর, সব পাল এক সঙ্গে তুলে দাও, সব কলগুলি পুরোদমে চালাও, আর গন্তব্যস্থানে উপনীত হও। যত শীঘ্র পার, ততই ভাল।

*****************

খ্রীষ্টানদের ব্যাপ্টিজ্‌ম্ (baptism) সংস্কার একটা বাহ্যশুদ্ধি-স্বরূপ—এটি অন্তঃশুদ্ধির প্রতীক। বৌদ্ধধর্ম থেকে এর উৎপত্তি।

খ্রীষ্টানদের ইউক্যারিস্ট নামক অনুষ্ঠান অসভ্য জাতিসমূহের একটি অতি প্রাচীন প্রথার অবশেষ। ঐ-সব অসভ্য জাতি—কখনও কখনও তাদের বড় বড় নেতারা যে-সব গুণে মহৎ হয়েছেন, সেইগুলি পাবার আশায় তাঁদের মেরে ফেলত এবং তাঁদের মাংস খেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, যে-সকল শক্তিতে তাদের নেতা বীর্যবান্, সাহসী ও জ্ঞানী হয়েছিলেন, এই উপায়ে সেই শক্তিগুলি তাদের ভিতর আসবে, আর কেবল এক ব্যক্তি ঐরূপ বীর্যবান্ ও জ্ঞানী না হয়ে সমগ্র জাতিটাই ঐরূপ হবে। নরবলি-প্রথা য়াহুদীজাতির ভিতরও ছিল, আর তাদের ঈশ্বর জিহোবা—ঐ প্রথার জন্য অনেক শাস্তি দিলেও তাদের ভিতর থেকে একেবারে লোপ পায়নি। যীশু নিজে শান্তপ্রকৃতি ও প্রেমিক পুরুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁকে য়াহুদীজাতির বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রচার করবার চেষ্টার ফলে খ্রীষ্টানদের মধ্যে এই মতবাদের উৎপত্তি হল যে, যীশু ক্রশে বিদ্ধ হয়ে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি-রূপে নিজেকে বলি দিয়ে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করলেন। য়াহুদীদের মধ্যে পূর্বে এক প্রথা ছিল—তাঁদের পুরোহিতেরা মন্ত্রপাঠ করে ছাগলের উপর মানুষের পাপ চাপিয়ে দিয়ে তাকে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিতেন—এখানে ছাগলের বদলে মানুষ, এই তফাত। এই নিষ্ঠুর ভাব প্রবেশ করার দরুন খ্রীষ্টধর্ম যীশুর যথার্থ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেল এবং তার ভিতর পরের উপর অত্যাচার করবার ও অপরের রক্তপাত করবার ভাব এল।

*****************

কোন কাজ করবার সময় বল না, ‘এটা আমার কর্তব্য’; বরং বল, ‘এটা আমার স্বভাব’।

‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্’—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার হয় না। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হও, তা হলেই তুমি ভগবানকে লাভ করবে।

অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারতে ব্রাহ্মণজাতি নিজেদের সর্বপ্রকার বিধিনিষেধের অতীত বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা নিজেদের ‘ভূদেব’ বলে দাবী করেন। তাঁরা খুব দরিদ্রভাবে থাকেন, তবে তাঁদের দোষ এই যে, তাঁরা আধিপত্য বা প্রভু্ত্ব খোঁজেন। যাই হোক, ভারতে প্রায় ছয় কোটী ব্রাহ্মণের বাস; তাঁদের কোনপ্রকার বিষয়-আশয় নেই, তাঁরা বেশ ভাল লোক, নীতিপরায়ণ। আর এইরূপ হবার কারণ এই যে, বাল্যকাল থেকেই তাঁরা শিক্ষা পেয়ে আসছেন যে, তাঁরা বিধিনিষধের অতীত, তাঁদের কোনপ্রকার শাস্তির বিধান নেই। তাঁরা নিজেদের ‘দ্বিজ’ বা ঈশ্বরতনয় জ্ঞান করে থাকেন।

রবিবার, ২৮ জুলাই


(দত্তাত্রেয়৫৬-কৃত অবধূত-গীতা)

‘মনের স্থিরতার উপর সমুদয় জ্ঞান নির্ভর করছে।’

‘যিনি সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চে পূর্ণভাবে বিরাজ করছেন, যিনি আত্মার মধ্যে আত্ম-স্বরূপ, তাঁকে আমি নমস্কার করি কিরূপে?’

আত্মাকে আমার নিজের স্বভাব—নিজের স্বরূপ বলে জানাই পূর্ণজ্ঞান এবং প্রত্যক্ষানুভূতি।

‘আমিই তিনি, এ-বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নেই।’

‘কোন চিন্তা, কোন বাক্য বা কোন কার্যই আমার বন্ধন উৎপন্ন করতে পারে না। আমি ইন্দ্রিয়াতীত, আমি চিদানন্দস্বরূপ।’

‘অস্তি নাস্তি’ কিছুই নেই, সবই আত্ম-স্বরূপ। সবই আপেক্ষিক ভাব। সমুদয় দ্বন্দ্ব দূর করে দাও, সব কুসংস্কার ঝেড়ে ফেল, জাতি কুল দেবতা—আর যা কিছু—সব চলে যাক। ব্রহ্ম হওয়া বা হয়ে যাওয়া—এ-সবের কথা কেন বল? দ্বৈত-বা অদ্বৈতবাদের কথাও ছেড়ে দাও। তুমি দুই ছিলে কবে যে, দুই ও একের কথা বলছ? এই জগৎপ্রপঞ্চ সেই নিত্যশুদ্ধ ব্রহ্মমাত্র, তিনি ছাড়া আর কিছু নয়। যোগের দ্বারা শুদ্ধ হব—এ-কথা বল না, তুমি স্বয়ং যে শুদ্ধ-স্বভাব। কেউ তোমায় শিক্ষা দিতে পারে না।

যিনি এই গীতা লিখেছেন, তাঁর মত লোকই ধর্মটাকে জীবন্ত রেখেছেন। তাঁরা বাস্তবিকই সেই ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা কোন কিছু গ্রাহ্য করেন না, শরীরের সুখদুঃখ গ্রাহ্য করেন না, শীত-উষ্ণ বা বিপদ-আপদ বা অন্য কিছু— মোটেই গ্রাহ্য করেন না। জ্বলন্ত অঙ্গার তাঁদের দেহকে দগ্ধ করতে থাকলেও তাঁরা স্থির হয়ে বসে আত্মানন্দ সম্ভোগ করেন, গা যে পুড়ছে, তা তাঁরা টের পান না।

‘জ্ঞাতা-জ্ঞান ও জ্ঞেয়-রূপ ত্রিবিধ বন্ধন যখন দূর হয়ে যায়, তখনই আত্মস্বরূপের প্রকাশ হয়।’

‘যখন বন্ধন ও মুক্তি-রূপ ভ্রম চলে যায়, তখনই আত্মস্বরূপের প্রকাশ হয়।’

‘মনঃসংযম করে থাক তাতেই বা কি, না করে থাক তাতেই বা কি? তোমার অর্থ থাকে তাতেই বা কি, না থাকে তাতেই বা কি? তুমি নিত্যশুদ্ধ আত্মা। বলোঃ আমি আত্মা, কোন বন্ধন কখনও আমার কাছে ঘেঁষতে পারেনি। আমি অপরিণামী নির্মল আকাশ-স্বরূপ; নানাবিধ বিশ্বাস বা ধারণারূপ মেঘ আমার উপর দিয়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু আমাকে তারা স্পর্শই করতে পারে না।’

‘ধর্মাধর্ম—পাপপুণ্য উভয়কেই দগ্ধ করে ফেল। মুক্তি ছেলেমানুষি কথামাত্র। আমি সেই অবিনাশী জ্ঞান-স্বরূপ, আমি সেই পবিত্রতা-স্বরূপ।’

‘কেউ কখনও বদ্ধ হয়নি, কেউ কখনও মুক্তও হয়নি। আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি অনন্তস্বরূপ, নিত্যমুক্তস্বভাব। আমাকে আর শেখাতে এস না—আমি চিদ্‌ঘনস্বভাব, কিসে আমার এই স্বভাব বদলাতে পারে? কাকেই বা শেখান যেতে পারে? কে শেখাতে পারে?’

তর্কযুক্তি, জ্ঞানবিচার ছুঁড়ে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দাও।

‘বদ্ধস্বভাব লোকই অপরকে বদ্ধ দেখে, ভ্রান্ত ব্যক্তিই অপরকে ভ্রান্ত মনে করে, যে অপবিত্র সেই অপবিত্রতা দেখে থাকে।’

দেশ-কাল-নিমিত্ত—এ সবই ভ্রম। তুমি যে মনে করছ তুমি বদ্ধ আছ, মুক্ত হবে—এটাই তোমার রোগ। তুমি অপরিণামী সত্তা। কথা বন্ধ কর, চুপ করে বসে থাক—সব জিনিষ তোমার সামনে থেকে উড়ে যাক—ওগুলি স্বপ্নমাত্র। পার্থক্য বা ভেদ বলে কোন কিছু নেই, ও-সব কুসংস্কারমাত্র। অতএব মৌনভাব অবলম্বন কর, আর নিজের স্বরূপ অবগত হও।

‘আমি আনন্দ-স্বরূপ।’ যেমন আদর্শের অনুসরণ করবার দরকার নেই—তুমি ছাড়া আর কি আছে? কিছুতে ভয় পেও না। তুমি সারসত্তা-স্বরূপ। শান্তিতে থাকো—নিজেকে ব্যতিব্যস্ত কর না। তুমি কখনও বদ্ধ হওনি। পুণ্য বা পাপ তোমাকে স্পর্শ করেনি। এই সমস্ত ভ্রম দূর করে দিয়ে শান্তিতে থাক। কাকে উপাসনা করবে? কেই বা উপাসনা করে? সবই তো আত্মা। কোন কথা কওয়া, কোনরূপ চিন্তা করাই কুসংস্কার। বার বার বল—‘আমি আত্মা, আমি আত্মা।’ আর সব উড়ে যাক।


সোমবার, ২৯ জুলাই, প্রাতঃকাল


আমরা কখনও কখনও কোন জিনিষ নির্ণয় করতে হলে তার পরিবেশ বর্ণনা করে থাকি। এ-কে তটস্থ লক্ষণ বলে। আমরা যখন ব্রহ্মকে ‘সচ্চিদানন্দ’ নামে অভিহিত করি, প্রকৃতপক্ষে আমরা তখন সেই অনির্বাচ্য সর্বাতীত সত্তারূপ সমুদ্রের তটের কিছু কিছু বর্ণনা করছি মাত্র। আমরা এ-কে ‘অস্তি’ বলতে পারি না, কারণ ‘অস্তি’ বলতে গেলেই তার বিপরীত ‘নাস্তি’র জ্ঞানও হয়ে থাকে, সুতরাং তাও আপেক্ষিক। তাঁর সম্বন্ধে কোন ধারণা, কোন প্রকার কল্পনা ঠিক ঠিক হতে পারে না। কেবল ‘নেতি, নেতি’—এ নয়, ও নয়—এই বলেই তাঁকে বর্ণনা করা যেতে পারে, কারণ তাঁকে চিন্তা করতে গেলেও সীমাবদ্ধ করতে হয়; সুতরাং চিন্তা দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না।

ইন্দ্রিয়গুলো দিবারাত্র তোমায় (ভুলজ্ঞান এনে দিয়ে) প্রতারিত করছে। বেদান্ত অনেককাল আগে এটি আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান সবেমাত্র ঐ তত্ত্বটি বুঝতে আরম্ভ করেছে। একখানা ছবির প্রকৃতপক্ষে কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে। কিন্তু চিত্রকর ছবিখানিতে কৃত্রিমভাবে গভীরতার ভাব ফলিয়ে প্রকৃতির প্রতারণা অনুকরণ করে থাকে। দুজন লোক কখনও এক জগৎ দেখে না। চূড়ান্ত জ্ঞানলাভ হলে তুমি দেখতে পাবে, কোন বস্তুতে কোন প্রকার গতি—কোন প্রকার পরিণাম নেই। কোন প্রকার গতি বা পরিবর্তন আছে, আমাদের এই ধারণাই মায়া। প্রকৃতিকে সমষ্টিভাবে আলোচনা কর অর্থাৎ গতির তত্ত্ব আলোচনা কর। দেহ ও মন কোনটাই আমাদের যথার্থ আত্মা নয়—দুই-ই প্রকৃতির অন্তর্গত, কিন্তু কালে আমরা এদের ভিতরের সারসত্য—যথার্থ তত্ত্বকে জানতে পারি। তখন আমরা দেহ-মনের পারে চলে যাই, সুতরাং দেহ-মনের দ্বারা যা কিছু অনুভব হয়, তাও চলে যায়। তখন তুমি এই জগৎপ্রপঞ্চকে দেখতে পাবে না বা জানতে পারবে না, তখনই তোমার আত্মোপলব্ধি হবে। আমাদের বাস্তবিক প্রয়োজন এই দ্বৈত বা আপেক্ষিক জ্ঞানকে অতিক্রম করা। অনন্ত মন বা অনন্ত জ্ঞান বলে কিছুই নেই, কারণ মন ও জ্ঞান—উভয়ই সসীম। আমরা এখন আবরণের মধ্য দিয়ে দেখছি—তারপর ক্রমশঃ আবরণকে অতিক্রম করে আমরা আমাদের সমুদয় জ্ঞানের সারসত্য-স্বরূপ সেই অজ্ঞাত বস্তুর কাছে পৌঁছব।

যদি আমরা একটা কার্ডবোর্ডের ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে একখানা ছবি দেখি, তা হলে আমরা ঐ ছবির সম্বন্ধে একটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা লাভ করি; তথাপি আমরা যা দেখি, তা বাস্তবিক ছবিটাই। ফুটোটা যত বড় করতে থাকি, ততই আমরা ছবিটার সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পেতে থাকি। আমাদের নামরূপের ভ্রমাত্মক উপলব্ধি অনুসারে আমরা সত্য জিনিষটারই সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণা করে থাকি। আবার যখন আমরা কার্ডবোর্ডখানা ফেলে দিই, তখনও আমরা সেই একই ছবি দেখে থাকি, কিন্তু এবার ছবিটাকে ঠিক ঠিক দেখতে পাই। আমরা ঐ ছবিটাতে যত বিভিন্ন প্রকার গুণ বা ভ্রমাত্মক ধারণা আরোপ করি না কেন, তা দ্বারা ছবিটার কিছু পরিবর্তন হয় না। এইরূপ—আত্মাই সকল বস্তুর মূল সত্যস্বরূপ; আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আত্মা—কিন্তু আমরা যেভাবে এদের নামরূপাকারে দেখছি, সেভাবে নয়। ঐ নামরূপ আবরণের অন্তর্গত—মায়ার অন্তর্গত।

ঐগুলি যেন দূরবীনের কাচের উপরের দাগ; আবার যেমন সূর্যের আলোকের দ্বারাই আমরা ঐ দাগগুলি দেখতে পাই, সেইরূপ ব্রহ্মরূপ সত্যবস্তু পশ্চাতে না থাকলে আমরা মায়াটাকেও দেখতে পেতাম না। ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বলে মানুষটা ঐ দূরবীনের কাচের উপর একটা দাগমাত্র। প্রকৃত ‘আমি’ সত্যস্বরূপ অপরিণামী আত্মা, আর কেবল সেই সত্যবস্তুটাই আমাকে—(নামরূপাত্মক) স্বামী বিবেকানন্দ দেখতে সমর্থ করছে। প্রত্যেকটি ভ্রমেরও সারসত্তা আত্মা—আর যেমন সূর্য কখনও ঐ কাচের উপরের দাগগুলির সঙ্গে এক হয়ে যায় না, দাগগুলি আমাদের দেখিয়ে দেয় মাত্র, সেইরূপ আত্মাও কখনই নামরূপের সঙ্গে মিশিয়ে যান না। আমাদের শুভ ও অশুভ কর্মসমূহ ঐ দাগগুলিকে যথাক্রমে কমায় বাড়ায় মাত্র, কিন্তু তারা আমাদের অন্তর্যামী ঈশ্বরের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। মনের দাগগুলি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে ফেল। তা হলেই আমরা দেখব—‘আমি ও আমার পিতা এক।’

আগে আমাদের অনুভূতি হয়, যুক্তিবিচার পরে এসে থাকে। আমাদের এই অনুভূতি লাভ করতে হবে, আর এই প্রত্যক্ষানুভূতিই হল বাস্তবিক ধর্ম। কোন ব্যক্তি শাস্ত্র, ধর্মমত বা অবতারের কথা কখনও না শুনে থাকতে পারে, কিন্তু তার যদি প্রত্যক্ষ অনুভূতি হয়ে থাকে, তবে আর কিছু দরকার নেই। চিত্ত শুদ্ধ কর—এই হচ্ছে ধর্মের সার কথা; আর আমরা নিজেরা যতক্ষণ না মনের ঐ দাগগুলো দূর করছি, ততক্ষণ আমরা সেই সত্যস্বরূপকে ঠিক ঠিক দর্শন করতে পারি না। শিশু কোথাও কোন পাপ দেখতে পায় না, কারণ বাইরের পাপটার পরিণাম নির্ণয় করবার কোন মাপকাঠি তার নিজের ভিতর নেই। তোমার ভিতর যে দোষগুলি আছে, সব দূর করে ফেল—তা হলেই তুমি আর বাইরে কোন দোষ দেখতে পাবে না। ছোটছেলের সামনে চুরি-ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে, তার কাছে এর কোন অর্থই নেই, সে এর কিছুই বোঝে না। ধাঁধার ছবির ভিতর লুকানো জিনিষটা একবার যদি দেখতে পাও, তা হলে পরেও সর্বদাই দেখতে পাবে। এইরূপে যখন তুমি একবার মুক্ত ও নির্দোষ হয়ে যাবে, তখন জগৎপ্রপঞ্চের ভিতর তুমি মুক্তি ও শুদ্ধতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না। সেই মুহূর্তেই হৃদয়ের গ্রন্থি সব ছিন্ন হয়ে যায়, সব বাঁকাচোরা সিধা হয়ে যায়, আর এই জগৎপ্রপঞ্চ স্বপ্নের মত মিলিয়ে যায়। আর ঘুম ভাঙলে ভেবে আশ্বর্য হই যে কি করে এই সব বাজে স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম।

‘যাঁকে লাভ করলে পর্বতপ্রমাণ দুঃখও হৃদয়কে বিচলিত করতে পারে না’, তাঁকে লাভ করতে হবে।৫৭

জ্ঞানকুঠার দ্বারা দেহমনরূপ চক্রদয়কে পৃথক্ করে ফেল, তা হলেই আত্মা মুক্তস্বরূপ হয়ে পৃথক্‌ভাবে দাঁড়াতে পারবে—যদিও পুরাতন বেগে তখনও দেহমনরূপ-চক্র খানিকক্ষণের জন্য চলবে। তবে তখন চাকাটি সোজাই চলবে, অর্থাৎ এই দেহমনের দ্বারা তখন শুভ কার্যই হবে। যদি সেই শরীরের দ্বারা কিছু মন্দ কার্য হয়, তা হলে জেনো সে ব্যক্তি জীবন্মুক্ত নয়—যদি সে আপনাকে ‘জীবন্মুক্ত’ বলে দাবী করে, তবে সে মিথ্যা কথা বলছে। এটাও বুঝতে হবে যে, তখন চিত্তশুদ্ধির দ্বারা চক্রের বেশ সরল গতি এসে গেছে, সেই সময় তার উপর কুঠারপ্রয়োগ সম্ভব। সকল শুদ্ধিকর কর্মই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ভ্রম বা অজ্ঞানকে নষ্ট করছে। অপরকে পাপী বলাই সবচেয়ে গর্হিত কাজ। ভাল কাজ না জেনে করলেও তার ফল একই প্রকার হয়—তা বন্ধন-মোচনের সহায়তা করে।

দূরবীনের কাচের দাগগুলি দেখে সূর্যকেও দাগমুক্ত মনে করাই আমাদের মৌলিক ভ্রম। সেই ‘আমি’-রূপ সূর্য কোনপ্রকার বাহ্যদোষে লিপ্ত নন—এইটি জেনে রাখো, আর নিজেকে ঐ দাগগুলি তুলতে নিযুক্ত কর। যত প্রাণী সম্ভব, তার মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও খ্রীষ্টের ন্যায় মনুষ্যের উপাসনাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনা। তোমার যা কিছুর অভাব বোধ হয়, তাই তুমি সৃষ্টি করে থাক;—বাসনামুক্ত হও।

দেবতারা ও পরলোকগত ব্যক্তিরা সকলে এখানেই রয়েছেন—এই জগৎকেই তাঁরা স্বর্গ বলে দেখছেন। একই অজ্ঞাত বস্তুকে সকলে নিজ নিজ মনের ভাব অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখছে। এই পৃথিবীতেই কিন্তু ঐ অজ্ঞাত বস্তুর উৎকৃষ্ট দর্শনলাভ হতে পারে। কখনও স্বর্গে যাবার ইচ্ছা কর না—এইটেই সব চেয়ে নিকৃষ্ট ভ্রম। এই পৃথিবীতেও খুব বেশী পয়সা থাকা ও ঘোর দারিদ্র্য, দুই-ই বন্ধন—দুই-ই আমাদের ধর্মপথ থেকে, মুক্তিপথ থেকে দূরে রাখে। তিনটি জিনিষ এ পৃথিবীতে বড় দুর্লভঃ প্রথম—মনুষ্যদেহ (মনুষ্যমনেই ঈশ্বরের উৎকৃষ্ট প্রতিবিম্ব বিদ্যমান; বাইবেলে আছে, ‘মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিস্বরূপ’)। দ্বিতীয়—মুক্ত হবার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তৃতীয়—মহাপুরুষের আশ্রয়লাভ, যিনি স্বয়ং মায়ামোহ-সমুদ্র পার হয়ে গেছেন, এমন মহাত্মাকে গুরুরূপে পাওয়া৫৮। এই তিনটি যদি পেয়ে থাক, তবে ভগবানকে ধন্যবাদ দাও, তুমি মুক্ত হবেই হবে!

কেবল তর্কযুক্তির দ্বারা তোমার যে সত্যের জ্ঞান লাভ হয়, তা একটা নূতন যুক্তিতর্কের দ্বারা উড়ে যেতে পারে, কিন্তু তুমি যা সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ অনুভব কর, তা তোমার কোন কালে যাবার নয়। ধর্ম সম্বন্ধে কেবল বচনবাগীশ হলে কিছু ফল হয় না। যে-কোন বস্তুর সংস্পর্শে আসবে—যেমন মানুষ, জানোয়ার, আহার, কাজকর্ম—সকলের উপর ব্রহ্মদৃষ্টি কর; আর এইরূপ সর্বত্র ব্রহ্মদৃষ্টি করাকে একটা অভ্যাসে পরিণত কর।

ইঙ্গারসোল৫৯ আমায় একবার বলেন, ‘এই জগৎটা থেকে যতদূর লাভ করা যেতে পারে, তার চেষ্টা সকলের করা উচিত—এই আমার বিশ্বাস। কমলালেবুটাকে নিংড়ে যতটা সম্ভব রস বার করে নিতে হবে, যেন এক ফোঁটা রসও বাদ না যায়; কারণ এই জগৎ ছাড়া অপর কোন জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা সুনিশ্চিত নই।’ আমি তাকে উত্তর দিয়েছিলামঃ এই জগৎরূপ কমলালেবু নিংড়াবার যে প্রণালী আপনি জানেন, তার চেয়ে ভাল প্রণালী আমি জানি, আর আমি তা দ্বারা বেশী রস পেয়ে থাকি। আমি জানি—আমার মৃত্যু নেই; সুতরাং আমার ঐ রস নিংড়ে নেবার তাড়া নেই। আমি জানি, ভয়ের কোন কারণ নেই; সুতরাং বেশ করে ধীরে ধীরে আনন্দ করে নিংড়াচ্ছি। আমার কোন কর্তব্য নেই, আমার স্ত্রীপুত্রাদি ও বিষয়সম্পত্তির কোন বন্ধন নেই, আমি সকল নরনারীকে ভালবাসতে পারি। সকলেই আমার পক্ষে ব্রহ্মস্বরূপ। মানুষকে ভগবান্ বলে ভালবাসলে কি আনন্দ—একবার ভেবে দেখুন দেখি! কমলালেবুটাকে এইভাবে নিংড়ান দেখি—অন্যভাবে নিংড়ে যা রস পান, তার চেয়ে দশহাজারগুণ রস পাবেন—একটি ফোঁটাও বাদ যাবে না। প্রত্যেকটি ফোঁটাই পাবেন।

যাকে আমাদের ‘ইচ্ছা’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অধিষ্ঠানস্বরূপ আত্মা, এবং বাস্তবিকই তা মুক্তস্বভাব।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

যীশুখ্রীষ্ট অসম্পূর্ণ ছিলেন, কারণ তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তদনুসারে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করেননি, আর সর্বোপরি তিনি নারীগণকে পুরুষের তুল্য মর্যাদা দেননি। মেয়েরাই তাঁর জন্য সব করলে, কিন্তু তিনি য়াহুদীদের দেশাচার দ্বারা এতদূর বদ্ধ ছিলেন যে, একজন নারীকেও তিনি ‘প্রেরিত শিষ্য’ (Apostle) পদে উন্নীত করলেন না। তথাপি উচ্চতম চরিত্র হিসাবে বুদ্ধের পরেই তাঁর স্থান—আবার বুদ্ধও যে একেবারে সম্পূর্ণ নিখুঁত ছিলেন, তা নয়। যাই হোক, বুদ্ধ ধর্মরাজ্যে পুরুষের সহিত স্ত্রীলোকের সমানাধিকার স্বীকার করেছিলেন, আর তাঁর নিজের স্ত্রীই তাঁর প্রথম ও একজন প্রধানা শিষ্যা। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের অধিনায়িকা হয়েছিলেন। আমাদের কিন্তু এই-সকল মহাপুরুষের সমালোচনা করা উচিত নয়, আমাদের শুধু উচিত—তাঁদের আমাদের চেয়ে অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা। তা হলেও যিনি যত বড়ই হোন না কেন, কোন মানুষকেই আমাদের শুধু বিশ্বাস করে পড়ে থাকলে চলবে না, আমাদেরও বুদ্ধ ও খ্রীষ্ট হতে হবে।

কোন ব্যক্তিকেই তার দোষ বা অসম্পূর্ণতা দেখে বিচার করা উচিত নয়। মানুষের যে বড় বড় গুণগুলি দেখা যায়, সেগুলি তার নিজের, কিন্তু তার দোষগুলি মনুষ্যজাতির সাধারণ দুর্বলতা মাত্র; সুতরাং তার চরিত্র বিচার করবার সময় সেগুলি কখনও গণনা করতে নেই।

*****************

ইংরেজী ভার্চু (virtue)-শব্দটি সংস্কৃত ‘বীর’ (vira) শব্দ থেকে এসেছে, কারণ প্রাচীনকালে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদেরই লোকে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক লোক বলে বিবেচনা করত।

মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই


খ্রীষ্ট ও বুদ্ধের মত মহাপুরুষেরা কেবল বহিরবলম্বন; তাঁদের উপর আমাদের ভিতরের শক্তিগুলি আমরা আরোপ করে থাকি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে আমরাই আমাদেরই প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকি।

যীশু যদি না জন্মাতেন, তবে মনুষ্যজাতির কখনও উদ্ধার হত না—এরূপ ভাবা ঈশ্বরনিন্দার সমান। মনুষ্য-স্বভাবের ভিতর যে ঐশ্বরিক ভাব অন্তর্নিহিত রয়েছে, তাকে ঐ রূপ ভুলে যাওয়া বড় ভয়ানক—ঐ ঐশ্বরিক ভাব কোন-না-কোন সময়ে প্রকাশিত হবেই হবে। মনুষ্য-স্বভাবের মহত্ত্ব কখনও ভুলো না। ঈশ্বর অতীতে যা হয়েছেন, ভবিষ্যতে যা হবেন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমরাই। ‘আমি’ই সেই অনন্ত মহাসমুদ্র—খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণ তারই উপরে তরঙ্গ-মাত্র। তোমার নিজের অন্তরাত্মা ব্যতীত আর কারও কাছে মাথা নত কর না। যতক্ষণ না তুমি নিজেকে সেই দেবদেব বলে জানতে পারছ, ততক্ষণ তোমার মুক্তি হতে পারে না।

আমাদের সকল অতীত কর্মই বাস্তবিক ভাল, কারণ কর্মগুলিই আমাদের চরম আদর্শ লাভ করিয়ে দেয়। কার কাছে আমি ভিক্ষা করব?—আমিই যথার্থ সত্তা, আর যা কিছু আমার স্বরূপ থেকে ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়, তা স্বপ্নমাত্র। আমি সমগ্র সমুদ্র; তুমি নিজে ঐ সমুদ্রে যে একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গের সৃষ্টি করেছ, সেটাকে ‘আমি’ বল না। সেটা ঐ তরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয় বলে জেন। সত্যকাম (অর্থাৎ সত্যলাভের জন্য যাঁর প্রবল আকাঙ্ক্ষা হয়েছে) শুনতে পেলেন—তাঁর অন্তরের বাণী তাঁকে বলছে, ‘তুমি অনন্তস্বরূপ, সেই সর্বব্যাপী সত্তা তোমার ভিতরে রয়েছে।’ নিজেকে সংযত কর, আর তোমার যথার্থ আত্মার বাণী শ্রবণ কর।

যে-সকল মহাপুরুষ প্রচারকার্যের জন্য প্রাণপাত করে যান, তাঁরা—যে- সকল মহাপুরুষ নির্জনে নীরবে মহাপবিত্র জীবনযাপন করেন, বড় বড় ভাব চিন্তা করে যান এবং ঐরূপে জগতের সাহায্য করেন—তাঁদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অসম্পূর্ণ। ঐ-সকল শান্তিপ্রিয় নির্জনবাসী মহাপুরুষ একের পর এক আবির্ভূত হন—শেষে তাঁদের শক্তিরই চরমফলস্বরূপ এমন এক শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয়, যিনি সেই তত্ত্বগুলি চারিদিকে প্রচার করে বেড়ান।

*****************

জ্ঞান স্বতই বর্তমান রয়েছে, মানুষ কেবল সেটা আবিষ্কার করে মাত্র। বেদসমূহই এই চিরন্তন জ্ঞান—যার সহায়তায় ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। ভারতের দার্শনিকগণ উচ্চতম দার্শনিক তত্ত্ব বলে থাকেন, আর এই প্রচণ্ড দাবীও করে থাকেন।

সত্য যা, তা সাহসপূর্বক নির্ভীকভাবে লোকের কাছে বলো,—ঐ সত্য প্রকাশের জন্য ব্যক্তিবিশেষের কষ্ট হল বা না হল, সে দিকে খেয়াল কর না। দুর্বলতাকে আমল দিও না। সত্যের জ্যোতিঃ বুদ্ধিমান্ লোকদের পক্ষেও যদি অতিমাত্রায় প্রখর বোধ হয়, তাঁরা যদি তা সহ্য করতে না পারেন, সত্যের বন্যা যদি তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা যাক—যত শীঘ্র যায়, ততই ভাল। ছেলেমানুষী ভাব—শিশুদের ও বুনো অসভ্যদেরই শোভা পায়; কিন্তু দেখা যায়, ঐ-সব ভাব কেবল শিশুমহলে বা জঙ্গলেই আবদ্ধ নয়, ঐ-সকল ভাবের অনেকগুলি ধর্মপ্রচারকদেরও কুক্ষিগত।

আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ হলে আর সম্প্রদায়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকা খারাপ। তা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে দেহপাত কর।

উন্নতি যা কিছু, তা এই ব্যাবহারিক বা আপেক্ষিক জগতেই হয়ে থাকে। মানবদেহই সর্বশ্রেষ্ঠ দেহ এবং মানুষই সর্বোচ্চ প্রাণী, কারণ এই মানবদেহে—এই জন্মেই আমরা সম্পূর্ণরূপে এই আপেক্ষিক জগতের বাইরে যেতে পারি, সত্য সত্যই মুক্তির অবস্থা লাভ করতে পারি, আর ঐ মুক্তিই আমাদের চরম লক্ষ্য। শুধু যে আমরা পারি তা নয়, অনেকে সত্য সত্যই ইহজীবনে মুক্তাবস্থা লাভ করেছেন, পূর্ণতা-প্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং কেউ এ দেহ ত্যাগ করে যতই সূক্ষ্ম—সূক্ষ্মতর দেহ লাভ করুক, সে তখনও এই আপেক্ষিক জগতের ভিতরই রয়েছে, সে আর আমাদের চেয়ে বেশী কিছু করতে পারে না, কারণ মুক্তিলাভ করা ছাড়া আর কি উচ্চাবস্থা লাভ করা যেতে পারে।

দেবতারা (angels) কখনও কোন অন্যায় কাজ করেন না, কাজেই তাঁরা শাস্তিও পান না; সুতরাং তাঁরা মুক্ত হতেও পারেন না। সংসারের ধাক্কাই আমাদের জাগিয়ে দেয়, এই জগৎস্বপ্ন ভাঙবার সাহায্য করে। ঐরূপ ক্রমাগত আঘাতই এই জগতের অসম্পূর্ণতা বুঝিয়ে দেয়, আমাদের এ সংসার থেকে পালাবার—মুক্তিলাভ করবার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দেয়।

*****************

কোন বস্তু—যখন আমরা অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি, তখন আমরা তার এক নাম দিই, আবার সেই জিনিষকেই যখন সম্পূর্ণ উপলব্ধি করি, তখন অন্য নাম দিই। আমাদের নৈতিক প্রকৃতি যত উন্নত হয়, আমাদের উপলব্ধিও তত উৎকৃষ্ট হয়, আমাদের ইচ্ছাশক্তিও তত অধিক বলবতী হয়।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

আমরা যে জড় ও চিন্তারাশির ভিতর সামঞ্জস্য দেখতে পাই, তার কারণ উভয়ই এক অজ্ঞাত বস্তুর দুটি দিক্‌মাত্র, সেই জিনিষটাই দুভাগ হয়ে বাহ্য ও আন্তর হয়েছে।

ইংরেজী ‘প্যারাডাইস’ (Paradise)-শব্দটি সংস্কৃত ‘পরদেশ’ শব্দ থেকে এসেছে, ঐ শব্দটা পারস্য ভাষায় চলে গিয়েছিল—(ফার-দৌস)-এর শব্দার্থ হচ্ছে দেশের পারে, অথবা অন্য দেশ বা অন্য লোক। প্রাচীন আর্যেরা বরাবরই আত্মায় বিশ্বাস করতেন, তাঁরা মানুষকে কেবল দেহ বলে কখনও ভাবতেন না। তাঁদের মতে স্বর্গ নরক—দুই-ই অনিত্য ও সান্ত, কারণ কোন কার্যই কখনও তার কারণ-নাশের পর স্থায়ী হতে পারে না, আর কোন কারণই চিরস্থায়ী নয়; সুতরাং কার্য বা ফলমাত্রের নাশ হবেই। এই রূপকটিতে৬০ সমগ্র বেদান্তদর্শনের সার রয়েছেঃ

সোনার মত পালকযুক্ত দুটি পাখি একটা গাছে বসে আছে। উপরে যে পাখিটা বসে আছে, সে স্থির শান্তভাবে নিজ মহিমায় নিজে বিভোর হয়ে রয়েছে; আর যে পাখিটা নীচের ডালে রয়েছে, সে সদাই চঞ্চল—ঐ গাছের ফল খাচ্ছে—কখনও মিষ্ট ফল, কখনও বা কটু ফল। একবার সে একটা অতিরিক্ত কটু ফল খেলে, তখন সে একটু স্থির হয়ে উপরের সেই মহিমময় পাখিটার দিকে চাইলে। কিন্তু আবার সে শীঘ্রই তাকে ভুলে গিয়ে পূর্বের মত সেই গাছের ফল খেতে লাগলো। আবার একটা কটু ফল খেলে—এইবার সে টুপ টুপ করে লাফিয়ে উপরের পাখিটার দু-এক ডাল কাছে গেল। এইরূপ অনেকবার হল, অবশেষে নীচের পাখিটা একেবারে উপরের পাখিটার জায়গায় গিয়ে বসল, আর নিজেকে হারিয়ে ফেলল। সে অমনি বুঝলে যে, দুটো পাখি কোন কালেই ছিল না, সে নিজেই বরাবর শান্ত—স্থিরভাবে নিজ মহিমায় নিজে মগ্ন—উপরের পাখিই ছিল।

বুধবার, ৩১ জুলাই


প্রটেস্টাণ্টধর্ম-সংস্থাপক লুথার ধর্মসাধনের ভিতর থেকে সন্ন্যাস বা ত্যাগ বাদ দিয়ে তার স্থানে কেবল নীতিমাত্র প্রচার করে ধর্মের সর্বনাশ করে গেলেন। নাস্তিক ও জড়বাদীরাও নীতিপরায়ণ হতে পারে, কেবল ঈশ্বর-বিশ্বাসীরাই ধর্মলাভ করতে পারে |

সমাজ যাদের অসৎ বলে, তারা মহাপুরুষদের পবিত্রতার জন্য মূল্য দেয়—সুতরাং তাদের দেখে, ঘৃণা না করে ঐ কথাই ভাবা উচিত। যেমন গরীব লোকের পরিশ্রমের ফলে বড় লোকের বিলাসিতা সম্ভব হয়, আধ্যাত্মিক জগতেও সেইরূপ। ভারতের সাধারণ লোকের যে এত অবনতি দেখা যায়, সেটা মীরাবাঈ, বুদ্ধ প্রভৃতি মহাত্মাদের উৎপন্ন করার জন্য যেন প্রকৃতিকে তার মূল্য ধরে দিতে হয়েছে।

*****************

‘আমিই পবিত্রাত্মাদের পবিত্রতা’ ‘আমিই সকলের মূল, প্রত্যেকে নিজের মত করে সেটি ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু সবই আমি।’ ‘আমিই সব করছি, তুমি নিমিত্তমাত্র।’৬১

বেশী কথা বল না, তোমার নিজের ভিতর যে আত্মা রয়েছেন, তাঁকে অনুভব কর, তবেই তুমি জ্ঞানী হবে। এই হল জ্ঞান, আর সব অজ্ঞান। জানবার বস্তু একমাত্র ব্রহ্ম, তিনিই সব।

*****************

সত্ত্ব মানুষকে সুখ ও জ্ঞানের অন্বেষণে বদ্ধ করে, রজঃ বাসনা দ্বারা বদ্ধ করে, তমঃ ভ্রমজ্ঞান আলস্য প্রভৃতি দ্বারা বদ্ধ করে।৬২ রজঃ ও তমঃ—এই দুটি নিম্নতর গুণকে সত্ত্বের দ্বারা জয় কর, তারপর সমুদয় ঈশ্বরে সমর্পণ করে মুক্ত হও।

ভক্তিযোগের দ্বারা সাধক অতি শীঘ্র ব্রহ্মোপলব্ধি করেন ও তিন গুণের পারে চলে যান।৬৩

ইচ্ছা, চেতনা, ইন্দ্রিয়, বাসনা, রিপু—এইগুলি মিলিত হয়ে যা হয়েছে, তাকে আমরা ‘জীবাত্মা’ বলে থাকি।

প্রথম হচ্ছে প্রতীয়মান আত্মা (দেহ); দ্বিতীয়, মানস আত্মা—যে ঐ দেহটাকে ‘আমি’ বলে মনে করে (এইটি মায়াবদ্ধ ব্রহ্ম); তৃতীয়, যথার্থ আত্মা, যিনি নিত্যশুদ্ধ—নিত্যমুক্ত। তাঁকে আংশিকভাবে দেখলে ‘প্রকৃতি’ বলে বোধ হয়, আবার তাঁকেই পূর্ণভাবে দেখলে সমস্ত প্রকৃতি উড়ে যায়; এমন কি তাঁর স্মৃতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। প্রথম—পরিণামী ও অনিত্য (মরণধর্মী বা ধ্বংসশীল), দ্বিতীয়—সদা পরিবর্তনশীল, কিন্তু প্রবাহরূপে নিত্য (প্রকৃতি), তৃতীয়—কূটস্থ নিত্য (আত্মা)।

*****************

আশা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ কর, এই হল সর্বোচ্চ অবস্থা। আশা করবার কি আছে? আশার বন্ধন ছিঁড়ে ফেল, নিজের আত্মার উপর দাঁড়াও, স্থির হও; যাই কর না কেন, সব ভগবানে অর্পণ কর, কিন্তু তার ভিতর কোন কপটতা রেখ না।

ভারতে কারও কুশল জিজ্ঞাসা করতে ‘স্বস্থ’ (যা থেকে ‘স্বাস্থ্য’ কথাটা এসেছে) এই সংস্কৃত শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘স্বস্থ’ শব্দের অর্থ—স্ব অর্থাৎ আত্মাতে প্রতিষ্ঠিত থাকা। কোন জিনিষ দেখেছি, এটা বুঝাতে হলে হিন্দুরা বলে থাকে, ‘আমি একটা পদার্থ দেখেছি।’ ‘পদার্থ’ কি না পদ বা শব্দের অর্থ, অর্থাৎ শব্দপ্রতিপাদ্য ভাববিশেষ। এমন কি এই জগৎপ্রপঞ্চটা তাদের কাছে একটা ‘পদার্থ’ (অর্থাৎ শব্দের অর্থ)।

*****************

জীবন্মুক্ত সিদ্ধ পুরুষের দেহ আপনা-আপনি ন্যায় কার্যই করে থাকে (তার দ্বারা অন্যায় কার্য হয় না)। তাঁর শরীর কেবল শুভ কার্যই করতে পারে, কারণ তা সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে গেছে। অতীত সংস্কাররূপ যে বেগের দ্বারা তাঁদের দেহচক্র পরিচালিত হতে থাকে, তা সব শুভ সংস্কার। মন্দ সংস্কার সব দগ্ধ হয়ে গেছে।

*****************

সেই দিনকেই যথার্থ দুর্দিন বলা যায়, যে দিন আমরা ভগবৎ-প্রসঙ্গ না করি; কিন্তু যে দিন মেঘ-ঝড়-বৃষ্টি হয়, সে দিনকে প্রকৃতপক্ষে দুর্দিন বলা যায় না।৬৪

সেই পরম প্রভুর প্রতি ভালবাসাকে যথার্থ ‘ভক্তি’ বলা যায়। অন্য কোন পুরুষের প্রতি ভালবাসাকে—তিনি যত বড়ই হোন না কেন—‘ভক্তি’ বলা যায় না। এখানে ‘পরম প্রভু’ বলতে পরমেশ্বরকে বুঝাচ্ছে, তোমরা পাশ্চাত্য দেশে ব্যক্তি-ভাবাপন্ন ঈশ্বর (Personal God) বলতে যা বোঝ, তাকে অতিক্রম করে আছে এই ধারণা। ‘যা হতে এই জগৎপ্রপঞ্চের উৎপত্তি হচ্ছে, যাঁতে এর স্থিতি, আবার যাঁতে লয়, তিনিই ঈশ্বর—নিত্য, শুদ্ধ, সর্বশক্তিমান্, সদামুক্তস্বভাব, দয়াময়, সর্বজ্ঞ, সকল গুরুর গুরু, অনির্বচনীয়-প্রেমস্বরূপ।’

মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে ভগবানকে সৃষ্টি করে না; তবে তার যতদূর শক্তি, সে সেইভাবে তাঁকে দেখতে পারে, আর তার যত ভাল ভাল ধারণা তাঁতে আরোপ করে। এই এক-একটি গুণই ঈশ্বরের সবটাই, আর এই এক-একটি গুণের দ্বারা সবটাকে বোঝানোই বাস্তবিক ব্যক্তি-ঈশ্বরের (Personal God) দার্শনিক ব্যাখ্যা। ঈশ্বর নিরাকার, অথচ তাঁর সব গুণ রয়েছে। আমরা যতক্ষণ মানবভাবাপন্ন, ততক্ষণ ঈশ্বর, প্রকৃতি ও জীব—এই তিনটি সত্তা আমাদের দেখতে হয়। তা না দেখে থাকতেই পারি না।

কিন্তু ভক্তের পক্ষে এই-সকল দার্শনিক পার্থক্য বাজে কথা মাত্র। সে যুক্তি-বিচার গ্রাহ্যই করে না, সে বিচার করে না—সে দেখে, প্রত্যক্ষ অনুভব করে। সে ঈশ্বরের শুদ্ধ প্রেমে আত্মহারা হয়ে যেতে চায়; আর এমন অনেক ভক্ত হয়ে গেছেন, যাঁরা বলেন, মুক্তির চেয়ে ঐ অবস্থাই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। যাঁরা বলেন, ‘চিনি হওয়া ভাল নয় মন, চিনি খেতে ভালবাসি’৬৫ —আমি সেই প্রেমাস্পদকে ভালবাসতে চাই, তাঁকে সম্ভোগ করতে চাই।

ভক্তিযোগে বিশেষ প্রয়োজন এই যে, অকপটভাবে ও প্রবলভাবে ঈশ্বরের অভাব বোধ করা। আমরা ঈশ্বর ছাড়া আর সবই চাই, কারণ বহির্জগৎ থেকেই আমাদের সাধারণ সব বাসনা পূরণ হয়ে থাকে। যতদিন আমাদের প্রয়োজন বা অভাববোধ জড়জগতের ভিতরেই সীমাবদ্ধ, ততদিন আমরা ঈশ্বরের জন্য কোন অভাববোধ করি না; কিন্তু যখন আমরা এ জীবনে চারদিক্‌ থেকে প্রবল ঘা খেতে থাকি, আর ইহজগতের সকল বিষয়েই হতাশ হই, তখনই উচ্চতর কোন বস্তুর জন্য আমাদের প্রয়োজন বোধ হয়ে থাকে, তখনই আমরা ঈশ্বরের অন্বেষণ করে থাকি।

ভক্তি আমাদের কোন বৃত্তিকে ভেঙ্গেচুরে দেয় না, বরং ভক্তিযোগের শিক্ষা এই যে, আমাদের সব বৃত্তিই মুক্তিলাভ করবার উপায়স্বরূপ হতে পারে। ঐসব বৃত্তিকেই ঈশ্বরাভিমুখী করতে হবে—সাধারণতঃ যে ভালবাসা অনিত্য ইন্দ্রিয়-বিষয়ে নষ্ট করা হয়ে থাকে, সেই ভালবাসা ঈশ্বরকে দিতে হবে।

তোমাদের পাশ্চাত্য ধর্মের ধারণা থেকে ভক্তির এইটুকু তফাত যে, ভক্তিতে ভয়ের স্থান নাই—ভক্তি দ্বারা কোন পুরুষের ক্রোধ শান্ত করতে বা কাউকে সন্তুষ্ট করতে হবে না। এমন-কি এমন সব ভক্তও আছেন, যাঁরা ঈশ্বরকে তাঁদের সন্তান বলে উপাসনা করে থাকেন—এরূপ উপাসনার উদ্দেশ্য এই যে, ঐ উপাসনায় ভয় বা ভয়মিশ্র ভক্তির কোন ভাব না থাকে। প্রকৃত ভালবাসায় ভয় থাকতে পারে না, আর যতদিন পর্যন্ত এতটুকু ভয় থাকবে, ততদিন ভক্তির আরম্ভই হতে পারে না। আবার ভক্তিতে ভগবানের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার, আদান-প্রদানের ভাব কিছুই নাই। ভগবানের কাছে কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা ভক্তের দৃষ্টিতে মহা অপরাধ। ভক্ত কখনও ভগবানের নিকট আরোগ্য বা ঐশ্বর্য, এমন-কি স্বর্গ পর্যন্ত কামনা করেন না।

যিনি ভগবানকে ভালবাসতে চান, ভক্ত হতে চান, তাঁকে ঐ-সব বাসনা একটি পুঁটলি করে দরজার বাইরে ফেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। যিনি সেই জ্যোতির রাজ্যে প্রবেশ করতে চান, তাঁকে এর দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে আগে দোকানদারি ধর্মের পুঁটলি বাইরে ফেলে আসতে হবে। এ-কথা বলছি না যে, ভগবানের কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় না—সবই পাওয়া যায়, কিন্তু ঐরূপ প্রার্থনা করা অতি নীচু দরের ধর্ম, ভিখারীর ধর্ম।

‘উষিত্বা জাহ্নবীতীরে কূপং খনতি দুর্মতিঃ।’

সে ব্যক্তি বাস্তবিকই মূর্খ, যে গঙ্গাতীরে বাস করে জলের জন্য আবার কুয়া খোঁড়ে।

এই-সব আরোগ্য, ঐশ্বর্য ও ঐহিক অভ্যুদয়ের জন্য প্রার্থনাকে ভক্তি বলা যায় না—এগুলি অতি নিম্নস্তরের কর্ম। ভক্তি এর চেয়ে উঁচু জিনিষ। আমরা রাজরাজের সামনে আসবার চেষ্টা করছি। আমরা সেখানে ভিখারীর বেশে যেতে পারি না। যদি আমরা কোন মহারাজার সম্মুখে উপস্থিত হতে ইচ্ছা করি, ভিখারীর মত ছেঁড়া ময়লা কাপড় পরে গেলে সেখানে কি ঢুকতে দেবে? কখনই নয়। দরোয়ান আমাদের ফটক থেকে বার করে দেবে। ভগবান্ রাজার রাজা—আমরা তাঁর সামনে কখনও ভিক্ষুকের বেশে যেতে পারি না। দোকানদারদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই—সেখানে কেনাবেচা একেবারেই চলবে না। তোমরা বাইবেলেও পড়েছ, যীশু ক্রেতা-বিক্রেতাদের মন্দির থেকে বার করে দিয়েছিলেন।

সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, ভক্ত হবার জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, স্বর্গাদির কামনা একেবারে দূর করে দেওয়া। এরূপ স্বর্গ এই জায়গারই—এই পৃথিবীরই মত, না হয় এর চেয়ে একটু ভাল। খ্রীষ্টানদের স্বর্গের ধারণা এই যে, সেটা একটা তীব্র ভোগের জায়গা। তা কি করে ভগবান্ হতে পারে? এই যে সব স্বর্গে যাবার বাসনা—এ সুখভোগেরই কামনা। এ বাসনা ত্যাগ করতে হবে। ভক্তের ভালবাসা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিঃস্বার্থ হওয়া চাই—নিজের জন্য ইহলোকে বা পরলোকে কোন কিছু আকাঙ্ক্ষা করা হবে না।

সুখদুঃখ, লাভক্ষতি—এ-সকলের বাসনা ত্যাগ করে দিবারাত্র ঈশ্বরোপাসনা কর, এক মুহূর্তও যেন বৃথা নষ্ট না হয়।

আর সব চিন্তা ত্যাগ করে দিবারাত্র সর্বান্তঃকরণে ঈশ্বরের উপাসনা কর। এইরূপে দিবারাত্র উপাসিত হলে তিনি নিজ স্বরূপ প্রকাশ করেন, তিনিই তাঁর উপাসকদের শক্তি দেন—যাতে তারা তাঁকে অনুভব করতে পারে।

বৃহস্পতিবার, ১ অগাস্ট


প্রকৃত গুরু তিনি, আমরা যাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী। তিনিই সেই প্রণালী, যাঁর মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক প্রবাহ আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তিনিই সমগ্র আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে আমাদের সংযোগসূত্র। ব্যক্তিবিশেষের উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস থেকে দুর্বলতা ও পৌত্তলিকতা আসতে পারে; কিন্তু গুরুর প্রতি প্রবল অনুরাগে খুব দ্রুত উন্নতি সম্ভবপর হয়, তিনি আমাদের ভিতরের গুরুর সঙ্গে সংযোগ করে দেন। যদি তোমার গুরুর ভিতরে যথার্থ সত্য থাকে, তবে তাঁর আরাধনা কর, ঐ গুরুভক্তিই তোমাকে অতি চরম অবস্থায় নিয়ে যাবে।

শ্রীরামকৃষ্ণের পবিত্রতা ছিল শিশুর মত। তিনি জীবনে কখনও টাকা স্পর্শ করেননি, আর তাঁর ভিতরে কাম একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় ধর্মাচার্যদের কাছে জড়বিজ্ঞান শিখতে যেও না, তাঁদের সমগ্র শক্তি আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিতর মানুষ-ভাবটা মরে গিছল, কেবল ঈশ্বরত্ব অবশিষ্ট ছিল। বাস্তবিকই তিনি পাপ দেখতে পেতেন না—যে-চোখে মানুষ পাপ বা অন্যায় দেখে, তার চেয়ে তাঁর দৃষ্টি পবিত্রতর ছিল। এইরূপ অল্প কয়েকজন পরমহংসের পবিত্রতাই সমগ্র জগৎটাকে ধারণ করে রেখেছে। যদি এঁদের ধারা লুপ্ত হয়ে যায়, সকলেই যদি জগৎটাকে ত্যাগ করে যান, তা হলে জগৎ খণ্ড খণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁরা কেবল নিজে মহোচ্চ পবিত্র জীবন যাপন করে লোকের কল্যাণ-বিধান করেন, কিন্তু তাঁরা যে অপরের কল্যাণ করছেন, তা তাঁরা টেরও পান না; তাঁরা নিজেরা আদর্শ জীবনযাপন করেই সন্তুষ্ট থাকেন।

*****************

আমাদের ভিতর যে জ্ঞানজ্যোতিঃ বর্তমান রয়েছে, শাস্ত্র তার আভাস দিয়ে থাকে, আর তাকে অভিব্যক্ত করবার উপায় বলে দেয়, কিন্তু যখন আমরা নিজেরা সেই জ্ঞানলাভ করি, তখনই আমরা ঠিক ঠিক শাস্ত্র বুঝতে পারি। যখন তোমার ভিতরে সেই অন্তর্জ্যোতির প্রকাশ হয়, তখন আর শাস্ত্রে কি প্রয়োজন?—তখন কেবল অন্তরের দিকে দৃষ্টিপাত কর। সমুদয় শাস্ত্রে যা আছে, তোমার নিজের মধ্যেই তা আছে, বরং তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী আছে। নিজের উপর বিশ্বাস কখনও হারিও না, এ জগতে তুমি সব করতে পার। কখনও নিজেকে দুর্বল ভেব না, সব শক্তি তোমার ভিতর রয়েছে।

প্রকৃত ধর্ম যদি শাস্ত্রের উপর বা কোন মহাপুরুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তবে চুলোয় যাক সব ধর্ম, চুলোয় যাক সব শাস্ত্র। ধর্ম আমাদের নিজেদের ভিতর রয়েছে। কোন শাস্ত্র বা কোন গুরু আমাদের তাঁকে লাভ করবার জন্য সাহায্য ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। এমন-কি এদের সহায়তা ছাড়াও আমাদের নিজেদের ভিতরেই সব সত্য লাভ করতে পারি। তথাপি শাস্ত্র ও আচার্যগণের প্রতি কৃতজ্ঞ হও, কিন্তু এরা যেন তোমায় বদ্ধ না করেন; তোমার গুরুকে ঈশ্বর বলে উপাসনা কর, কিন্তু অন্ধভাবে তাঁর অনুসরণ কর না। তাঁকে যতদূর সম্ভব ভালবাস, কিন্তু স্বাধীনভাবে চিন্তা কর। কোনরূপ অন্ধবিশ্বাস তোমায় মুক্তি দিতে পারে না, তুমি নিজেই নিজের মুক্তি-সাধন কর। ঈশ্বরসম্বন্ধে এই একটিমাত্র ধারণা পোষণ কর যে, তিনি আমাদের চিরকালের সহায়।

স্বাধীনতার ভাব এবং উচ্চতম প্রেম—দুই-ই একসঙ্গে থাকা চাই, তা হলে এদের মধ্যে কোনটাই আমাদের বন্ধনের কারণ হতে পারে না। আমরা ভগবানকে কিছু দিতে পারি না, তিনিই আমাদের সব দিয়ে থাকেন, তিনি সকল গুরুর গুরু। তিনি আমাদের আত্মার আত্মা, আমাদের যথার্থ স্বরূপ। যখন তিনি আমাদের আত্মার অন্তরাত্মা, তখন আমরা যে তাঁকে ভালবাসব, এ আর আশ্চর্য কি? আর কাকে বা কোন্ বস্তুকে আমরা ভালবাসতে পারি? আমরা হতে চাই সেই স্থির অগ্নিশিখা—যার তাপ নেই, ধোঁয়া নেই! যখন তোমরা কেবল ব্রহ্মকেই দেখবে, তখন আর কার উপকার করতে পারবে? ভগবানের তো আর উপকার করতে পার না? তখন সব সংশয় চলে যায়, সর্বত্র সমত্বভাব এসে যায়। যদি তখন কারও কল্যাণ কর তো নিজেরই কল্যাণ করবে। এইটি অনুভব কর যে, দানগ্রহীতা তোমার চেয়ে বড়, তুমি যে তার সেবা করছ, তার কারণ—তুমি তার চেয়ে ছোট; এ নয় যে, তুমি বড় আর সে ছোট। গোলাপ যেমন নিজের স্বভাবেই সুগন্ধ বিতরণ করে, আর সুগন্ধ দিচ্ছে বলে সে মোটেই টের পায় না, তুমিও সেই ভাবে দিয়ে যাও।

সেই মহান্ হিন্দু সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এইরূপ নিঃস্বার্থ কর্মের অদ্ভুত দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর সমুদয় জীবনটা ভারতের সাহায্যকল্পে অর্পণ করেছিলেন। তিনিই সতীদাহ-প্রথা বন্ধ করেন। সাধারণতঃ লোকের বিশ্বাস, এই সংস্কার কার্য সম্পূর্ণরূপে ইংরেজদের দ্বারা সাধিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। রাজা রামমোহন রায়ই এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং একে রহিত করবার জন্য গভর্নমেণ্টের সহায়তালাভে কৃতকার্য হন। যতদিন না তিনি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন, ততদিন ইংরেজরা কিছুই করেনি। তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে বিখ্যাত ধর্মসমাজও স্থাপন করেন, আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়-স্থাপনের জন্য তিন লক্ষ টাকা চাঁদা দেন। তিনি তারপর সরে এলেন এবং বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে তোমরা নিজেরাই এগিয়ে যাও।’ তিনি নামযশ একদম চাইতেন না, নিজের জন্য কোনরূপ ফলাকাঙ্ক্ষা করতেন না।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

জগৎপ্রপঞ্চ অনন্তভাবে অভিব্যক্ত হয়ে ক্রমাগত চলেছে, যেন নাগরদোলা—আত্মা যেন ঐ নাগরদোলায় চড়ে ঘুরছে। এই ক্রম চিরন্তন। এক একজন লোক ঐ নাগরদোলা থেকে নেমে পড়ছে বটে, কিন্তু চিরকাল সেই একরকম ঘটনাই বার বার ঘটছে, আর এই কারণেই লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দেওয়া যেতে পারে; কারণ প্রকৃতপক্ষে সবই তো বর্তমান। যখন আত্মা একটা শৃঙ্খলের ভিতর এসে পড়ে, তখন তাকে সেই শৃঙ্খলের যা কিছু অভিজ্ঞতা তার ভিতর দিয়ে যেতে হবে। ঐরূপ একটা শৃঙ্খল বা শ্রেণী থেকে আত্মা আর একটা শৃঙ্খল বা শ্রেণীতে চলে যায়, আর কোন কোন শ্রেণীতে এলে তারা আপনাদের ব্রহ্মস্বরূপ অনুভব করে একেবারে তা থেকে বেরিয়ে যায়। ঐরূপ শ্রেণীর বা ঘটনা-পরম্পরার একটি প্রধান ঘটনাকে অবলম্বন করে সমুদয় ঘটনা-শৃঙ্খলটাই টেনে আনা যেতে পারে, আর তার ভিতরের সমুদয় ঘটনাই যথাযথ পাঠ করা যেতে পারে। এই শক্তি সহজেই লাভ করা যায়, কিন্তু এতে বাস্তবিক কোন লাভ নেই, আর ঐ শক্তিলাভের সাধনায় আমাদের সমপরিমাণ আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যয়িত হয়ে যায়। সুতরাং ও-সব বিষয়ের চেষ্টা কর না, ভগবানের উপাসনা কর।

শুক্রবার, ২ অগাস্ট


ভগবদ্-উপলব্ধির জন্য প্রথমে নিষ্ঠা দরকার।

‘সব্‌সে রসিয়ে সব্‌সে বসিয়ে সব্‌কা লীজিয়ে নাম।
হাঁ জী হাঁ জী কর্‌তে রহিয়ে বৈঠিয়ে আপনা ঠাম॥’

সকলের সঙ্গে আনন্দ কর, সকলের সঙ্গে বস, সকলের নাম লও, অপরের কথায় ‘হাঁ, হাঁ’ করতে থাক, কিন্তু নিজের ভাব কোন মতে ছেড় না। এর চেয়ে উচ্চতর অবস্থা—অপরের ভাবে নিজেকে যথার্থ ভাবিত করা। যদি আমিই সব হই, তবে আমার ভাইয়ের সঙ্গে যথার্থভাবে এবং কার্যতঃ সহানুভূতি করতে পারব না কেন? যতক্ষণ আমি দুর্বল, ততক্ষণ আমাকে নিষ্ঠা করে একটা রাস্তা ধরে থাকতে হবে; কিন্তু যখন আমি সবল হব, তখন অপর সকলের মত অনুভব করতে পারব, তাদের সকলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহানুভূতি করতে পারব।

প্রাচীনকালের লোকের ভাব ছিল—অপর সকল ভাব নষ্ট করে একটা ভাবকে প্রবল করা। আধুনিক ভাব হচ্ছে—সকল বিষয়ে সামঞ্জস্য রেখে উন্নতি করা। একটা তৃতীয় পন্থা হচ্ছে—মনের বিকাশ করা ও তাকে সংযত করা, তারপর যেখানে ইচ্ছা তাকে প্রয়োগ কর—তাতে ফল খুব শীঘ্র হবে। এইটি হচ্ছে যথার্থ আত্মোন্নতির উপায়। একাগ্রতা শিক্ষা কর, আর যে দিকে ইচ্ছা তাকে প্রয়োগ কর। এরূপ করলে তোমার কিছুই ক্ষতি হবে না। যে সমগ্রটাকে পায়, সে অংশটাকেও পায়। দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদের অন্তর্ভুক্ত।

‘আমি প্রথমে তাকে দেখলাম, সেও আমায় দেখলে; আমিও তার প্রতি কটাক্ষ করলাম, সেও আমার প্রতি কটাক্ষ করলে’—এইরূপ চলতে লাগলো। শেষে দুটি আত্মা এমন সম্পূর্ণভাবে মিলিত হয়ে গেল যে, তারা প্রকৃতপক্ষে এক হয়ে গেল।৬৬

*****************

সমাধির দু-টি ভাব আছেঃ এক ভাবে আমি নিজেরই ধ্যান করি, আর এক ভাবে বাইরের বস্তু ধ্যান করি। তারপর ধ্যানের ধ্যাতা ধ্যেয় অভেদ হয়ে যায়।

প্রত্যেক বিশেষ বিশেষ ভাবের সঙ্গে তোমাকে সহানুভূতি-সম্পন্ন হতে হবে, তারপর একেবারে উচ্চতম অদ্বৈতভাবে লাফিয়ে যেতে হবে। নিজে সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থা লাভ করে তারপর ইচ্ছা করলে নিজেকে আবার সীমাবদ্ধ করতে পার। প্রত্যেক কাজে নিজের সমুদয় শক্তি প্রয়োগ কর। খানিকক্ষণের জন্য অদ্বৈতভাব ভুলে দ্বৈতবাদী হবার শক্তিলাভ করতে হবে, আবার যখন খুশী যেন ঐ অদ্বৈতভাব আশ্রয় করতে পারা যায়।

*****************

কার্য-কারণ সব মায়া, আর আমরা যত বড় হব, ততই বুঝব যে, ছোট ছেলেদের পরীর গল্প এখন যেমন আমাদের কাছে বোধ হয়, তেমনি যা কিছু আমরা দেখছি, সবই ঐরূপ অসম্বদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে কার্য-কারণ বলে কিছু নেই, আর আমরা কালে তা জানতে পারব। সুতরাং যদি পার তো যখন কোন রূপক-গল্প শুনবে, তখন তোমার বুদ্ধিবৃত্তিকে একটু নামিয়ে এন, মনে মনে ঐ গল্পের পূর্বাপর সঙ্গতির বিষয়ে প্রশ্ন তুলো না। হৃদয়ে রূপক-বর্ণনা ও সুন্দর কবিত্বের প্রতি অনুরাগের বিকাশ কর, তারপর সমুদয় পৌরাণিক বর্ণনাগুলিকে কবিত্ব মনে করে উপভোগ কর। পুরাণ-চর্চার সময় ইতিহাস ও যুক্তিবিচারের দৃষ্টি নিয়ে এস না। ঐ-সব পৌরাণিক ভাবগুলি তোমার মনের ভিতর দিয়ে প্রবাহকারে চলে যাক। তোমার চোখের সামনে তাকে মশালের মত ঘোরাও, কে মশালটা ধরে রয়েছে—এ প্রশ্ন কর না, তা হলেই একটা আলোক-চক্র দেখতে পাবে; এতে যে সত্যের কণা অন্তর্নিহিত রয়েছে, তা তোমার মনে থেকে যাবে।

পুরাণ-লেখকেরা সকলেই—তাঁরা যা যা দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন, সেইগুলি রূপকভাবে লিখে গেছেন। তাঁরা কতকগুলি প্রবাহকার-চিত্র এঁকে গেছেন। তার ভিতর থেকে কেবল তার প্রতিপাদ্য বিষয়টা বার করবার চেষ্টা করে ছবিগুলিকে নষ্ট করে ফেল না। সেগুলিকে যথাযথ গ্রহণ কর, সেগুলি তোমার উপর কাজ করুক। এদের ফলাফল দেখে বিচার কর—তাদের মধ্যে যেটুকু ভাল আছে, সেইটুকুই নাও।

তোমার নিজের ইচ্ছাশক্তিই তোমার প্রার্থনার উত্তর দিয়ে থাকে—তবে বিভিন্ন ব্যক্তির মনের ধর্মসম্বন্ধীয় বিভিন্ন ধারণা অনুসারে সেটা বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পায়। আমরা তাকে বুদ্ধ, যীশু, জিহোবা, আল্লা বা অগ্নি—যেমন ইচ্ছা নাম দিতে পারি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই হচ্ছে আমাদের ‘আমি’ বা আত্মা।

আমাদের ধারণার ক্রমে উৎকর্ষ হতে থাকে, কিন্তু ঐ ধারণা যে-সকল রূপকাকারে আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়, তাদের কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই। আমাদের অলৌকিক দর্শনসমুহ অপেক্ষা মুশার অলৌকিক দর্শনে ভুলের সম্ভাবনা অধিক, কারণ আমাদের অধিকতর জ্ঞান এবং মিথ্যা ভ্রম দ্বারা প্রতারিত হবার সম্ভাবনা আমাদের অনেক কম।

যতদিন না আমাদের হৃদয়-রূপ আশ্রয় খুলছে, ততদিন শাস্ত্রপাঠ বৃথা। তখন ঐ শাস্ত্রগুলি আমাদের হৃদয়শাস্ত্রের সঙ্গে যতটা মেলে, ততটাই তাদের সার্থকতা। শক্তি কি, তা শক্তিমান্ ব্যক্তিই বুঝতে পারে; হাতিই সিংহকে বুঝতে পারে, ইঁদুর কখনও সিংহকে বুঝতে পারে না। আমরা যতদিন না যীশুর সমান হচ্ছি, ততদিন আমরা কেমন করে যীশুকে বুঝব? দুখানা পাঁউরুটিতে ৫০০০ লোক খাওয়ানো, অথবা ৫ খানা পাঁউরুটিতে দুজন লোক খাওয়ানো—এই দুই-ই মায়ার স্বপ্নরাজ্যে। এদের মধ্যে কোনটাই সত্য নয়, সুতরাং এই দুটোর কোনটাই অপরটির দ্বারা বাধিত হয় না। মহত্ত্বই কেবল মহত্ত্বের আদর করতে পারে, ঈশ্বরই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারেন। স্বপ্ন সেই স্বপ্নদ্রষ্টাই—তা ছাড়া আর কিছু নয়, তার অন্য কোন ভিত্তি নেই। ঐ স্বপ্ন বা স্বপ্নদ্রষ্টা পৃথক্ বস্তু নয়। সমগ্র সঙ্গীতটার ভিতর ‘সোঽহম্, সোঽহম্’—এই এক সুরে বাজছে, অন্যান্য সুরগুলি তারই ওলট-পালট মাত্র, সুতরাং তাতে মূল সুরের—মূল তত্ত্বের কিছু এসে যায় না। জীবন্ত শাস্ত্র আমরাই, আমরা যে-সব কথা বলেছি, সেগুলিই শাস্ত্র বলে পরিচিত। সবই জীবন্ত ঈশ্বর, জীবন্ত খ্রীষ্ট—ঐভাবে সব দর্শন কর। মানুষকে অধ্যয়ন কর, মানুষই জীবন্ত কাব্য। জগতে এ পর্যন্ত যত বাইবেল, খ্রীষ্ট বা বুদ্ধ হয়েছেন, সব আমাদেরই আলোকে আলোকিত। এই আলোক ব্যতীত ঐগুলি আমাদের পক্ষে আর জীবন্ত থাকবে না, মৃত হয়ে যাবে। তোমার নিজ আত্মার উপর দাঁড়াও।

মৃতদেহের সঙ্গে যেরূপ ব্যবহারই কর না, তাতে সে ক্ষুব্ধ হয় না। আমাদের দেহকে ঐরূপ মৃতবৎ করে ফেলতে হবে, আর দেহের সঙ্গে যে আমাদের অভিন্ন ভাব রয়েছে, সেটা দূর করে ফেলতে হবে।

শনিবার, ৩ অগাস্ট


যে-সকল ব্যক্তি এই জন্মেই মুক্তিলাভ করতে চায়, তাদের এক জন্মেই হাজার বছরের জীবন যাপন করতে হয়। তারা যে যুগে জন্মেছে, সেই যুগের ভাবের চেয়ে তাদের অনেক এগিয়ে যেতে হয়; কিন্তু সাধারণ লোক কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণের উৎপত্তি এইরূপেই।

*****************

একদা এক হিন্দু রানী৬৭ ছিলেন, তাঁর ছেলেরা এই জন্মেই মুক্তিলাভ করুক—এ বিষয়ে তাঁর এত আগ্রহ হয়েছিল যে, তিনি নিজেই তাদের লালন-পালনের সম্পূর্ণ ভার নিয়েছিলেন। তাঁদের শৈশবে যখন তিনি তাদের দোল দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন, তখন সর্বদা তাদের কাছে এই একটি গান গাইতেন—‘তত্ত্বমসি, তত্ত্বমসি’—তুমি সেই আত্মা, তুমি সেই ব্রহ্ম। তাদের তিনজন সন্ন্যাসী হয়ে গেল, কিন্তু চতুর্থ পুত্রকে রাজা করবার জন্য অন্যত্র নিয়ে গিয়ে মানুষ করা হতে লাগল। বিদায় দেবার সময় মা তাকে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বললেন, ‘বড় হলে পড় এতে কি লেখা আছে’। সেই কাগজখানাতে লেখা ছিল—‘ব্রহ্ম সত্য, আর সব মিথ্যা। আত্মা কখনও মরেন না, কখনও মারেনও না। নিঃসঙ্গ হও, অথবা সৎসঙ্গে বাস কর।’ যখন রাজপুত্র বড় হয়ে লেখাটি পড়লেন, তিনিও তখনই সংসারত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন।

ত্যাগ কর, সংসার ত্যাগ কর। আমরা এখন যেন একপাল কুকুর—রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছি, এক টুকরো মাংস খাচ্ছি, আর ভয়ে এদিক্ ওদিক্ চেয়ে দেখছি, পাছে কেউ এসে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তা না হয়ে রাজার মত হও—জেনো যে, সমুদয় জগৎ তোমার। যতক্ষণ না তুমি সংসার ত্যাগ করছ, যতক্ষণ সংসার তোমায় বাঁধতে থাকবে; ততক্ষণ ঐ ভাবটি তোমার আসতেই পারে না। যদি বাইরে ত্যাগ করতে না পার, মনে মনে সব ত্যাগ কর। অন্তরের অন্তর থেকে সব ত্যাগ কর। বৈরাগ্যসম্পন্ন হও। এই হল যথার্থ আত্মত্যাগ—এ না হলে ধর্মলাভ অসম্ভব। কোন প্রকার বাসনা কর না; কারণ যা বাসনা করবে তাই পাবে। আর সেইটাই তোমার ভয়ানক বন্ধনের কারণ হবে, যেমন সেই গল্পে আছে—এক ব্যক্তি তিনটি বর লাভ করেছিল এবং তার ফলে তার সর্বাঙ্গে নাক৬৮ হয়েছিল, বাসনা করলে ঠিক সেই রকম হয়। যতক্ষণ না আমরা আত্মরত ও আত্মতৃপ্ত হচ্ছি, ততক্ষণ মুক্তিলাভ করতে পারছি না। ‘আত্মই আত্মার মুক্তিদাতা, অন্য কেউ নয়।’

এইটি অনুভব করতে শিক্ষা কর যে, তুমি অন্য সকলের দেহেও বর্তমান—এইটি জানবার চেষ্টা কর যে, আমরা সকলেই এক। আর সব বাজে জিনিষ ছেড়ে দাও। ভালমন্দ কাজ যা করেছ, সেগুলি সম্বন্ধে একদম ভেব না—সেগুলি থু থু করে উড়িয়ে দাও। যা করেছ, করেছ। কুসংস্কার দূর করে দাও। সম্মুখে মৃত্যু এলেও দুর্বলতা আশ্রয় কর না।

অনুতাপ কর না—পূর্বে যে-সব কাজ করেছ, সে-সব নিয়ে মাথা ঘামিও না; এমন কি—যে-সব ভাল কাজ করেছ, তাও স্মৃতিপথ থেকে দূর করে দাও। আজাদ (মুক্ত) হও। দুর্বল, কাপুরুষ ও অজ্ঞ ব্যক্তিরা কখনও আত্মাকে লাভ করতে পারে না। তুমি কোন কর্মের ফলকে নষ্ট করতে পার না—ফল আসবেই আসবে; সুতরাং সাহসী হয়ে তার সম্মুখীন হও, কিন্তু সাবধান, যেন পুনর্বার সেই কাজ কর না। সকল কর্মের ভার ভগবানের উপর ফেলে দাও, ভাল-মন্দ—সব দাও। নিজে ভালটা রেখে কেবল মন্দটা তাঁর ঘাড়ে চাপিও না। যে নিজেকে নিজে সাহায্য করে, ভগবান্ তাকেই সাহায্য করেন।

*****************

বাসনা-মদিরা পান করে সমস্ত জগৎ মত্ত হয়েছে। ‘যেমন দিবা ও রাত্রি কখনই একসঙ্গে থাকতে পারে না, সেইরূপ বাসনা ও ভগবান্ দুই কখনও একসঙ্গে থাকতে পারে না।’৬৯ সুতরাং বাসনা ত্যাগ কর।

‘খাবার, খাবার’ বলে চেঁচান এবং খাওয়া, ‘জল, জল’ বলে চেঁচান এবং জল পান করা—এই দুটোর ভিতর আকাশ-পাতাল তফাত; সুতরাং কেবল ‘ঈশ্বর, ঈশ্বর’ বলে চেঁচালে কখনও ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির আশা করতে পারা যায় না। আমাদের ঈশ্বরলাভ করবার চেষ্টা ও সাধনা করতে হবে।

সমুদ্রের সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেলেই তরঙ্গ অসীমত্ব লাভ করতে পারে, কিন্তু তরঙ্গরূপে নয়। তারপর সমুদ্রস্বরূপ হয়ে গিয়ে আবার তরঙ্গাকার ধারণ করতে পারে ও যত বড় ইচ্ছা তত বড় তরঙ্গ হতে পারে। নিজেকে তরঙ্গপ্রবাহ বলে মনে কর না; জেন যে তুমি মুক্ত।

প্রকৃত দর্শনশাস্ত্র হচ্ছে—কতকগুলি প্রত্যক্ষানুভূতিকে প্রণালীবদ্ধ করা। যেখানে বুদ্ধিবিচারের শেষ, সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ। সমাধি বা ঈশ্বরভাবাবেশ যুক্তিবিচারের চেয়ে ঢ়ের বড়, কিন্তু ঐ অবস্থায় উপলব্ধ সত্যগুলি কখনও যুক্তিবিচারের বিরোধী হবে না। যুক্তিবিচার মোটা হাতিয়ারের মত, তা দিয়ে শ্রমসাধ্য কাজগুলি করতে পারা যায়, আর সমাধি বা ঈশ্বরভাবাবেশ (inspiration) উজ্জ্বল আলোকের মত সমগ্র সত্য দেখিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের ভিতর একটা কিছু করবার ইচ্ছা বা প্রেরণা আসাকেই ঈশ্বরভাবাবেশ (inspiration) বলতে পারা যায় না।

মায়ার ভিতর উন্নতি করা বা অগ্রসর হওয়াকে একটি বৃত্ত বলে বর্ণনা করা যেতে পারে—এতে এই হয় যে, যেখান থেকে তুমি যাত্রা করেছিলে, ঠিক সেইখানে এসে পৌঁছবে। তবে প্রভেদ এই যে, যাত্রা করবার সময় তুমি অজ্ঞান ছিলে, আর যখন সেখানে ফিরে আসবে, তখন তুমি পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছ। ঈশ্বরোপাসনা, সাধু-মহাপুরুষদের পূজা, একাগ্রতা, ধ্যান, নিষ্কাম কর্ম—মায়ার জাল কেটে বেরিয়ে আসবার এই-সব উপায়; তবে প্রথমেই আমাদের তীব্র মুমুক্ষুত্ব থাকা চাই। যে জ্যোতিঃ দপ্ করে প্রকাশ হয়ে আমাদের হৃদয়ান্ধকার দূর করে দেবে, তা আমাদের ভিতরেই রয়েছে—এ হচ্ছে সেই জ্ঞান, যা আমাদের স্বভাব বা স্বরূপ (ঐ জ্ঞানকে আমাদের ‘জন্মগত অধিকার’ বলা যেতে পারে না, কারণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্মই নেই)। কেবল যে মেঘগুলো ঐ জ্ঞানসূর্যকে ঢেকে রেখেছে, সেইগুলো আমাদের দূর করে দিতে হবে।

ইহলোকে বা স্বর্গে সর্বপ্রকার ভোগ করবার বাসনা ত্যাগ কর (ইহামুত্র-ফলভোগ-বিরাগ)। ইন্দ্রিয় ও মনকে সংযত কর (দম ও শম)। সর্বপ্রকার দুঃখ সহ্য কর, মন যেন জানতেই না পারে যে, তোমার কোনরূপ দুঃখ এসেছে (তিতিক্ষা)। মুক্তি ছাড়া আর সব ভাবনা দূর করে দাও, গুরু ও তাঁর উপদেশে বিশ্বাস রাখ। তুমি যে নিশ্চয়ই মুক্ত হতে পারবে, এটিও বিশ্বাস কর (শ্রদ্ধা)। যাই হোক না কেন, সর্বদা বল, ‘সোঽহম্, সোঽহম্’। খেতে বেড়াতে, কষ্টে পড়েও বল ‘সোঽহম্, সোঽহম্’; মনকে অবিরত ভাবে বল—এই যে জগৎপ্রপঞ্চ দেখছি, কোন কালে এর অস্তিত্ব নেই, কেবল আমি-মাত্র আছি (সমাধান)। দেখবে—একদিন দপ্ করে জ্ঞানের প্রকাশ হয়ে বোধ হবে—জগৎ শূন্যমাত্র, কেবল ব্রহ্মই আছেন। মুক্ত হবার জন্য প্রবল ইচ্ছাসম্পন্ন হও (মুমুক্ষুত্ব)।৭০

আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব সব পুরানো অন্ধকূপের মত; আমরা ঐ অন্ধকূপে পড়ে কর্তব্য, বন্ধন প্রভৃতি নানা স্বপ্ন দেখে থাকি—ঐ স্বপ্নের আর শেষ নেই। কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে আর ভ্রমের সৃষ্টি কর না। এ যেন বটগাছের মত ক্রমাগত ঝুরি নামিয়ে বাড়তেই থাকে। যদি তুমি দ্বৈতবাদী হও, তবে ঈশ্বরকে সাহায্য করতে চাওয়াই তোমার মূর্খতা। আর যদি অদ্বৈতবাদী হও, তবে তুমি তো স্বয়ংই ব্রহ্মস্বরূপ—তোমার আবার কর্তব্য কি? তোমার স্বামী, ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধব—কারও প্রতি কিছু কর্তব্য নেই।৭১ যা হচ্ছে হয়ে যাক্, চুপচাপ করে পড়ে থাক।

“রামপ্রসাদ বলে—ভব-সাগরে বসে আছি ভাসিয়ে ভেলা;
যখন আসবে জোয়ার উজিয়ে যাব, ভাটিয়ে যাব ভাটার বেলা॥”

শরীর মরে মরুক—আমার যে একটা দেহ আছে, এটা তো একটা পুরানো উপকথা বৈ আর কিছুই নয়। চুপচাপ করে থাক, আর জান, আমি ব্রহ্ম।

কেবল বর্তমান কালই বিদ্যমান—আমরা চিন্তায় পর্যন্ত অতীত ও ভবিষ্যতের ধারণা করতে পারি না; কারণ চিন্তা করতে গেলেই তাকে ‘বর্তমান’ করে ফেলতে হয়। সব ছেড়ে দাও, তার যেখানে যাবার ভেসে যাক। এই সমগ্র জগৎটাই একটা ভ্রমমাত্র, এটা যেন তোমায় আর প্রতারিত করতে না পারে। জগৎটা যা নয়, তুমি তাকে তাই বলে জেনেছ, অবস্তুতে বস্তু জ্ঞান করেছ, এখন এটা বাস্তবিক যা, একে তাই বলে জান। যদি দেহটা কোথাও ভেসে যায়, যেতে দাও; দেহ যেখানেই যাক না কেন, কিছু গ্রাহ্য কর না। কর্তব্যের নিদারুণ ধারণা ভীষণ কালকূট-স্বরূপ, জগৎ ধ্বংস করে ফেলছে।

স্বর্গে গেলে একটা বীণা পাবে, আর তাই বাজিয়ে যথাসময়ে বিশ্রাম-সুখ অনুভব করবে—এর জন্য অপেক্ষা কর না। এইখানেই একটা বীণা নিয়ে আরম্ভ করে দাও না কেন? স্বর্গে যাবার জন্য অপেক্ষা করা কেন? ইহালোকটাকেই স্বর্গ করে ফেল। স্বর্গে বিবাহ করা নেই, বিবাহ দেওয়াও নেই—তাই যদি হয়, এখনই তা আরম্ভ করে দাও না কেন? এইখানেই বিবাহ তুলে দাও না কেন? সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন মুক্তপুরুষের চিহ্ন। সংসারিত্ব-রূপ ভিক্ষুকের বেশ ফেলে দাও। মুক্তির পতাকা—গৈরিক বস্ত্র ধারণ কর।

রবিবার, ৪ অগাস্ট


‘অজ্ঞ ব্যক্তিরা যাঁকে না জেনে উপাসনা করছে, আমি তোমার নিকট তাঁরই কথা প্রচার করছি।’

এই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মই সকল জ্ঞাত বস্তুর চেয়ে আমাদের অধিক জ্ঞাত। তিনিই সেই এক বস্তু, যাঁকে আমরা সর্বত্র দেখছি। সকলেই তাদের নিজ আত্মাকে জানে; সকলেই—এমন-কি পশুরা পর্যন্ত জানে যে ‘আমি আছি’। আমরা যা কিছু জানি সব আত্মারই বহিঃক্ষেপ—বিস্তার-স্বরূপ। ছোট ছোট ছেলেদের শেখাও, তারাও এ তত্ত্ব ধারণা করতে পারে। অজ্ঞাতসারে হলেও প্রত্যেক ধর্ম এই আত্মাকেই উপাসনা করে এসেছে, কারণ আত্মা ছাড়া আর কিছু নেই।

আমরা এই জীবনটাকে এখানে যেমন ভাবে জানি, তার প্রতি এরূপ অশোভন আসক্তি সমুদয় অনিষ্টের মূল। এই থেকেই যত সব প্রতারণা ও চুরি হয়ে থাকে। এরই জন্য লোকে টাকাকে দেবতার আসন দেয়, আর তা থেকেই যত পাপ ও ভয়ের উৎপত্তি। কোন জড়বস্তুকে মূল্যবান্ বলে মনে কর না, আর তাতে আসক্ত হয়ো না। তুমি যদি কিছুতে, এমন-কি জীবনে পর্যন্ত আসক্ত না হও, তা হলে আর কোন ভয় থাকবে না। ‘মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি’৭২ যিনি এই জগতে নানা দেখেন, তিনি মৃত্যুর পর মৃত্যুকে প্রাপ্ত হন, বরাবর তিনি মৃত্যুর কবলে পড়েন। আমরা যখন সবই এক দেখি, তখন আমাদের শারীরিক মৃত্যুও থাকে না, মানসিক মৃত্যুও থাকে না। জগতের সকল দেহই আমার, সুতরাং আমার দেহ চিরকাল থাকবে; কারণ গাছপালা, জীবজন্তু, চন্দ্রসূর্য, এমন-কি সমগ্র জগদ্‌ব্রহ্মাণ্ডই আমার দেহ—ঐ দেহের আর নাশ হবে কি করে? প্রত্যেক মন, প্রত্যেক চিন্তাই যে আমার—তবে মৃত্যু আসবে কি করে? আত্মা কখনও জন্মানও না, মরেনও না—যখন আমরা এইটি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করি, তখন সকল সন্দেহ উড়ে যায়; ‘আমি আছি’, ‘আমি অনুভব করি’, ‘আমি ভালবাসি’—‘অস্তি, ভাতি, প্রিয়’—এগুলির উপর কখনই সন্দেহ করা যেতে পারে না। আমার ক্ষুধা বলে কিছু থাকতে পারে না, কারণ জগতে যে-কেউ যা-কিছু খাচ্ছে, তা আমিই খাচ্ছি। যদি একগাছা চুল উঠে যায়, আমরা মনে করি না যে আমরা মরে গেলাম। সেই রকম যদি একটা দেহের মৃত্যু হয়, সে তো ঐ একগাছা চুল উঠে যাওয়ারই মত।

সেই জ্ঞানাতীত বস্তুই ঈশ্বর—তিনি বাক্যের অতীত, চিন্তার অতীত, জ্ঞানের অতীত। … তিনটে অবস্থা আছে—পশুত্ব (তমঃ), মনুষ্যত্ব (রজঃ) ও দেবত্ব (সত্ত্ব)। যাঁরা সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করেন, তাঁরা অস্তিমাত্র বা সৎস্বরূপ হয়ে থাকেন। তাঁদের পক্ষে কর্তব্য একেবারে শেষ হয়ে যায়, তাঁরা মানুষকে কেবল ভালবাসেন, আর চুম্বকের মত অপরকে তাঁদের দিকে আকর্ষণ করেন। এরই নাম মুক্তি। তখন আর চেষ্টা করে কোন সৎকার্য করতে হয় না, তখন তুমি যে কাজ করবে তাই সৎকার্য হয়ে যাবে। ব্রহ্মবিৎ সকল দেবতার চেয়েও বড়। যীশুখ্রীষ্ট যখন মোহকে জয় করে বলেছিলেন, ‘শয়তান, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা’, তখনই দেবতারা তাঁকে পূজা করতে এসেছিলেন। ব্রহ্মবিৎকে কেউ কিছু সাহায্য করতে পারে না, সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁর সামনে প্রণত হয়ে থাকে, তাঁর সকল বাসনাই পূর্ণ হয়, তাঁর আত্মা অপরকে পবিত্র করে থাকে। অতএব যদি ঈশ্বরলাভের কামনা কর, তবে ব্রহ্মবিদের পূজা কর। যখন আমরা তিনটি দেবানুগ্রহ—মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব ও মহাপুরুষসংশ্রয় লাভ করি, তখনই বুঝতে হবে—মুক্তি আমাদের করতলগত।’৭৩

*****************

চিরকালের জন্য দেহের মৃত্যুর নামই ‘নির্বাণ’। এটা নির্বাণ-তত্ত্বের ‘না’-এর দিক্, এতে বলে—আমি এটা নই, ওটা নই। বেদান্ত আর একটু অগ্রসর হয়ে ‘হাঁ’-এর দিকটা বলেন—ওরই নাম মুক্তি। ‘আমি সৎ-চিৎ-আনন্দ, সোঽহম্—আমিই সেই’; এই হল বেদান্ত—নিখুঁতভাবে তৈরী একটি খিলানের যেন শীর্ষপ্রস্তর।

বৌদ্ধধর্মের মহাযান-সম্প্রদায়ের বেশীর ভাগ লোকই মুক্তিতে বিশ্বাসী—তারা যথার্থই বৈদান্তিক। কেবল সিংহলবাসীরাই নির্বাণের ‘বিনাশ’ অর্থ গ্রহণ করে।

কোনরূপ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস ‘আমি’কে নাশ করতে পারে না। যার অস্তিত্ব বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে এবং অবিশ্বাসে উড়ে যায়, তা ভ্রমমাত্র। আত্মাকে কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। ‘আমি আমার আত্মাকে নমস্কার করি।’ ‘স্বয়ংজ্যোতিঃ আমি নিজেকেই নমস্কার করি, আমি ব্রহ্ম।’ এই দেহটা যেন একটা অন্ধকার ঘর; আমরা যখন ঐ ঘরে প্রবেশ করি, তখনই তা আলোকিত হয়ে ওঠে, তখনই তা জীবন্ত হয়। আত্মার এই স্বপ্রকাশ জ্যোতিকে কিছুই স্পর্শ করতে পারে না, একে কোনমতেই নষ্ট করা যায় না। একে আবৃত করা যেতে পারে, কিন্তু কখনও নষ্ট করা যায় না।

বর্তমান যুগে ভগবানকে অনন্তশক্তিস্বরূপিণী জননী-রূপে উপাসনা করা কর্তব্য। এতে পবিত্রতার উদয় হবে, আর এই মাতৃপূজায় আমেরিকার মহাশক্তির বিকাশ হবে। এখানে (আমেরিকায়) কোন মন্দির (পৌরোহিত্যশক্তি) কাউকে দাবিয়ে রাখছে না, অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলির মত এখানে কেউ কষ্টভোগ করে না। নারীজাতি শত শত যুগ ধরে দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, তাই তাদের ভিতর অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিকাশ হয়েছে। তারা একটা ভাব আঁকড়ে ধরে থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না। এই জন্যই সকল দেশে তারা এমন-কি কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মসমূ্হের এবং পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষক-স্বরূপ হয়ে থাকে, আর এইটেই পরে তাদের স্বাধীনতার কারণ হবে। বৈদান্তিক হয়ে আমাদের বেদান্তের এই মহান্ ভাবকে জীবনে পরিণত করতে হবে। জনসাধারণকেও ঐ ভাব দিতে হবে—এটা কেবল স্বাধীন আমেরিকাতেই কাজে পরিণত করা যেতে পারে। ভারতে বুদ্ধ, শঙ্কর ও অন্যান্য মহামনীষী ব্যক্তিরা এই-সকল ভাব প্রচার করেছিলেন, কিন্তু জনসাধারণ সেগুলিকে ধরে রাখতে পারেনি। এই নূতন যুগে জনসাধারণ বেদান্তের আদর্শানুযায়ী জীবনযাপন করবে, আর মেয়েদের দ্বারাই এটা কাজে পরিণত হবে।

‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে,
মন, তুমি দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে।
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন ‘মা’ বলে ডাকে। (মাঝে মাঝে)
কুবুদ্ধি কুমন্ত্রী যত, নিকট হতে দিয়ো নাকো,
জ্ঞান-নয়নে প্রহরী রেখো, সে যেন সাবধানে থাকে।’

যত কিছু প্রাণী জীবনধারণ করছে, তুমি সে-সকলের পারে। তুমি আমার জীবনের সুধাকর-স্বরূপ, আমার আত্মারও আত্মা।

ঐদিন, অপরাহ্ণ

দেহ যেমন মনের হাতে একটা যন্ত্রবিশেষ, মনও তেমনি আত্মার হাতে একটা যন্ত্রস্বরূপ। জড় হচ্ছে বাইরের গতি, মন হচ্ছে ভিতরের গতি। কালেই সমুদয় পরিবর্তন বা পরিণামের আরম্ভ ও সমাপ্তি। আত্মা যদি অপরিণামী হন, তিনি নিশ্চিত পূর্ণস্বরূপ; আর যদি পূর্ণস্বরূপ হন, তবে তিনি অনন্তস্বরূপ; আর অনন্তস্বরূপ হলে অবশ্যই তিনি অদ্বিতীয়; কারণ দুটি অনন্ত থাকতে পারে না, সুতরাং আত্মা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’ই হতে পারেন। যদিও আত্মাকে বহু বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি এক। যদি কোন ব্যক্তি সূর্যের অভিমুখে চলতে থাকে, প্রতি পদক্ষেপে সে এক-একটা বিভিন্ন সূর্য দেখবে বটে, কিন্তু বস্তুতঃ সবগুলি তো সেই একই সূর্য।

‘অস্তিভাব’ই হচ্ছে সর্বপ্রকার একত্বের ভিত্তিস্বরূপ, আর ঐ ভিত্তিতে যেতে পারলেই পূর্ণতা লাভ হয়। যদি সব রংকে এক রঙে পরিণত করা সম্ভব হত, তবে চিত্রবিদ্যাই লোপ পেয়ে যেত। সম্পূর্ণ একত্ব হচ্ছে বিশ্রাম বা লয়; আমরা বলে থাকি—সকল প্রকাশই এক ঈশ্বর থেকে হয়েছে। তাও-বাদী৭৪, কংফুছ (Confucius)-মতাবলম্বী, বৌদ্ধ, হিন্দু, য়াহুদী, মুসলমান, খ্রীষ্টান ও জরথুস্ট্র-শিষ্যগণ (Zoroastrians) সকলেই প্রায় একপ্রকার ভাষায় এই মহৎ নীতি প্রচার করছেন, তুমি অপরের কাছ থেকে যেরূপ ব্যবহার চাও, অপরের প্রতি ঠিক সেইরূপ ব্যবহার কর’—কিন্তু হিন্দুরাই কেবল এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কারণ তাঁরা এর যুক্তি দেখতে পেয়েছিলেন। মানুষ অপর সকলকেই অবশ্য ভালবাসবে; কারণ সেই অপর সকলে যে সে নিজে, সেই এক বস্তুই রয়েছেন কিনা।

জগতে যত বড় বড় ধর্মাচার্য হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল লাওৎসে, বুদ্ধ ও যীশুই উক্ত নীতিরও উপরে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে গেছেন—‘তোমার শত্রুদেরও উপকার কর, যারা তোমায় ঘৃণা করে, তাদেরও ভালবাসো।’

তত্ত্বসমূহ পূর্ব থেকেই রয়েছে; সেগুলি আমরা সৃষ্টি করি না, আবিষ্কার করি মাত্র। ধর্ম কেবল প্রত্যক্ষানুভূতি। বিভিন্ন মতামত—প্রণালী মাত্র, ওগুলি ধর্ম নয়। জগতের যত ধর্ম, সব বিভিন্ন জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী ‘ধর্ম’-এরই বিভিন্ন প্রয়োগমাত্র। শুধু মতবাদ কেবল বিরোধ বাধিয়ে দেয়; দেখ না, কোথায় ঈশ্বরের নামে লোকের শান্তি হবে—তা না হয়ে জগতে যত রক্তপাত হয়েছে, তার অর্ধেক ঈশ্বরের নাম নিয়ে হয়েছে। একেবারে মূলে যাও; স্বয়ং ঈশ্বরকেই জিজ্ঞাসা কর—তাঁর স্বরূপ কি? যদি তিনি কোন উত্তর না দেন, বুঝতে হবে—তিনি নেই। কিন্তু জগতের সকল ধর্মই বলে যে, তিনি উত্তর দিয়ে থাকেন।

তোমার নিজের যেন কিছু বলবার থাকে, তা না হলে অপরে কি বলেছে, তার কোনরূপ ধারণা করতে পারবে কেন? পুরাতন কুসংস্কার নিয়ে পড়ে থেক না, সর্বদাই নূতন সত্যসমূহের জন্য প্রস্তুত হও। ‘মূর্খ তারা, যারা তাদের পূর্বপুরুষদের খোঁড়া কুয়ার নোনতা জল খাবে, কিন্তু অপরের খোঁড়া কুয়ার বিশুদ্ধ জল খাবে না।’ আমরা যতক্ষণ না নিজেরা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করছি, ততক্ষণ তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারি না। প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বভাবতঃ পূর্ণস্বরূপ। মহাপুরুষেরা তাঁদের এই পূর্ণস্বরূপকে প্রকাশ করেছেন, আমাদের ভিতর এখনও ওটা অব্যক্তভাবে রয়েছে। আমরা কি করে বুঝব যে, মুশা ঈশ্বর দর্শন করেছিলেন— যদি আমরাও তাঁকে দেখতে না পাই? যদি ঈশ্বর কখনও মুশার কাছে এসে থাকেন তো আমার কাছেও আসবেন। আমি একেবারে সোজাসুজি তাঁর কাছে যাব, তিনি যেন আমার সঙ্গে কথা কন। বিশ্বাসকে ভিত্তি বলে আমি গ্রহণ করতে পারি না—সেটা নাস্তিকতা ও ঘোর ঈশ্বরনিন্দা। যদি ঈশ্বর দু-হাজার বছর আগে আরবের মরুভূমিতে কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলে থাকেন, আজ আমার সঙ্গেও তিনি কথা কইতে পারেন। তা না হলে কি করে জানব, তিনি মরে যাননি? যে-কোন পথে হোক, ঈশ্বরের কাছে এস—কিন্তু আসা চাই। তবে আসবার সময় যেন কাউকে ঠেলে ফেলে দিও না।

জ্ঞানী ব্যক্তিরা অজ্ঞান ব্যক্তিদের করুণা করবেন। যিনি জ্ঞানী, তিনি একটা পিঁপড়ের জন্য পর্যন্ত নিজের দেহ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক থাকেন, কারণ তিনি জানেন দেহটা কিছুই নয়।

সোমবার, ৫ অগাস্ট


প্রশ্ন এইঃ সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ করতে গেলে কি সমুদয় নিম্নতর সোপান দিয়ে যেতে হবে, না একেবারে লাফিয়ে সেই অবস্থায় যাওয়া যেতে পারে? আধুনিক মার্কিন বালক আজ যে বিষয় পঁচিশ বছরে শিখে ফেলতে পারে, তার পূর্বপুরুষদের সে-বিষয়ে শিখতে এক-শ বছর লাগত। আধুনিক হিন্দু এখন বিশ বছরে সেই অবস্থায় আরোহণ করে, যে-অবস্থা লাভ করতে তার পূর্বপুরুষদের আটহাজার বছর লেগেছিল। শরীরের দৃষ্টি থেকে দেখলে দেখা যায়, গর্ভে ভ্রূণ সেই প্রাথমিক জীবাণুর (amoeba) অবস্থা থেকে আরম্ভ করে নানা অবস্থা অতিক্রম করে শেষে মানুষরূপে ধারণ করে। এই হল আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষা। বেদান্ত আরও অগ্রসর হয়ে বলেন, আমাদের শুধু মানবজাতির সমগ্র অতীত জীবনটা যাপন করলেই হবে না, সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবনটাও যাপন করতে হবে। যিনি প্রথমটি করেন, তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি; যিনি দ্বিতীয়টি করতে পারেন, তিনি ‘জীবন্মুক্ত’।

কাল বা সময় কেবল আমাদের চিন্তার পরিমাপক মাত্র, আর চিন্তার গতি অভাবনীয়ভাবে দ্রুত। কত দ্রুত আমরা ভাবী জীবনটা যাপন করতে পারি, তার কোন সীমা নির্দেশ করা যেতে পারে না। সুতরাং মানবজাতির সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবন নিজ জীবনে অনুভব করতে কতদিন লাগবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারা যায় না। এক মুহূর্তে হতে পারে, কারও বা পঞ্চাশ জন্ম লাগতে পারে। এটা বাসনা বা ইচ্ছার তীব্রতার উপর নির্ভর করছে। সুতরাং শিষ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী উপদেশও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হওয়া দরকার। জ্বলন্ত আগুন সকলের জন্যই রয়েছে—তাতে জল, এমন কি বরফের চাঙ্গড় পর্যন্ত নিঃশেষ করে দেয়। একরাশ ছট্‌রা দিয়ে বন্দুক ছোড়, অন্ততঃ একটাও লাগবে। লোককে একেবারে এক রাশ সত্য দিয়ে দাও, তারা তার মধ্যে যেটুকু নিজের উপযোগী তা নিয়ে নেবে। অতীত বহু জন্মের ফলে সংস্কার গঠিত হয়েছে, শিষ্যের প্রবণতা অনুযায়ী তাকে উপদেশ দাও। জ্ঞান, যোগ, ভক্তি ও কর্ম—এর মধ্যে যে-কোন একটি ভাবকে মূল ভিত্তি কর; কিন্তু অন্যান্য ভাবগুলিও সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দাও। জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তি দিয়ে সামঞ্জস্য করতে হবে, যোগপ্রবণ প্রকৃতিকে যুক্তিবিচারের দ্বারা সামঞ্জস্য করতে হবে, আর কর্ম—তত্ত্বকে কাজে পরিণত করার সাধনা যেন সকল পথেরই অঙ্গস্বরূপ হয়। যে যেখানে আছে, তাকে সেইখান থেকে ঠেলে এগিয়ে দাও, ধর্মশিক্ষা যেন ধ্বংসমূলক না হয়ে সর্বদা গঠনমূলক হয়।

মানুষের প্রত্যেক প্রবৃত্তিই তার অতীতের কর্ম-সমষ্টির পরিচায়ক। এটি যেন সেই রেখা বা ব্যাসার্ধ, যেটি ধরে মানুষকে চলতে হবে। সকল ব্যাসার্ধ অবলম্বন করেই কেন্দ্রে যাওয়া যায়। অপরের স্বাভাবিক প্রবণতা উলটে দেবার এতটুকু চেষ্টাও কর না, তাতে গুরু এবং শিষ্য উভয়েই পেছিয়ে যায়। যখন তুমি ‘জ্ঞান’ শিক্ষা দিচ্ছ, তখন তোমাকে জ্ঞানী হতে হবে আর শিষ্য যে-অবস্থায় রয়েছে, তোমাকে মনে মনে ঠিক সেইখানে যেতে হবে। অন্যান্য যোগেও এইরূপ। প্রত্যেকটি বৃত্তি এমন ভাবে বিকশিত করতে হবে যে, যেন সেটি ছাড়া আমাদের অন্য কোন বৃত্তিই নেই—এই হচ্ছে তথাকথিত সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতিসাধনের যথার্থ রহস্য, অর্থাৎ গভীরতার সঙ্গে উদারতা অর্জন কর, কিন্তু গভীরতা হারিয়ে উদারতা চেও না। আমরা অনন্তস্বরূপ; আমাদের মধ্যে কোন কিছুর ‘ইতি’ করা যেতে পারে না। সুতরাং আমরা সবচেয়ে নিষ্ঠাবান্ মুসলমানের মত গভীর, অথচ ঘোরতর নাস্তিকের মত উদার-ভাবাপন্ন হতে পারি।

এটি কার্যে পরিণত করার উপায় হচ্ছে মনকে কোন বিষয়বিশেষে প্রয়োগ করা নয়, আদত মনটারই বিকাশ করা ও তাকে সংযত করা। তা হলেই তুমি তাকে যেদিকে ইচ্ছা ফেরাতে পারবে। এইরূপে তোমার গভীরতা ও উদারতা দুই-ই লাভ হবে। জ্ঞান এমনভাবে উপলব্ধি কর যে, যেন জ্ঞানই একমাত্র রয়েছে। তারপর ভক্তিযোগ, রাজযোগ, কর্মযোগ নিয়েও ঐভাবে সাধন কর। তরঙ্গ ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের দিকে যাও, তবেই তোমার ইচ্ছামত তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারবে। তোমার নিজের মন-রূপ হ্রদকে সংযত কর, তা না হলে তুমি অপরের মন-রূপ হ্রদের তত্ত্ব কখনও জানতে পারবে না।

তিনিই প্রকৃত আচার্য, যিনি তাঁর শিষ্যের প্রবণতা অনুযায়ী নিজের সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করতে পারেন। প্রকৃত সহানুভূতি ব্যতীত আমরা কখনই ঠিক ঠিক শিক্ষা দিতে পারি না। মানুষ যে দায়িত্বপূর্ণ প্রাণী—এ ধারণা ছেড়ে দাও; কেবল পূর্ণতা-প্রাপ্ত ব্যক্তিরই দায়িত্বজ্ঞান আছে। অজ্ঞান ব্যক্তিরা মোহমদিরা পান করে মাতাল হয়েছে, তাদের সহজ অবস্থা নেই। তোমরা জ্ঞানলাভ করেছ—তোমাদের তাদের প্রতি অনন্ত-ধৈর্যসম্পন্ন হতে হবে। তাদের প্রতি ভালবাসা ছাড়া অন্য কোন প্রকার ভাব রেখ না; তারা যে-রোগে আক্রান্ত হয়ে জগৎটাকে ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দেখছে, আগে সেই রোগ নির্ণয় কর; তারপর যাতে তাদের সেই রোগ সেরে যায়, আর তারা ঠিক ঠিক দেখতে পায়, সে বিষয়ে সাহায্য কর। সর্বদা স্মরণ রেখ যে, মুক্ত বা স্বাধীন পুরুষেরই কেবল স্বাধীন ইচ্ছা আছে—বাকী সকলেই বন্ধনের ভিতর রয়েছে—সুতরাং তারা যা করছে, তার জন্য তারা দায়ী নয়। ইচ্ছা যখন ইচ্ছারূপে প্রকাশিত, তখন তা বদ্ধ। জল যখন হিমালয়ের চূড়ায় গলতে থাকে, তখন স্বাধীন বা উন্মুক্ত, কিন্তু নদীরূপ ধারণ করলেই তটের দ্বারা বদ্ধ হয়ে যায়; তথাপি তার প্রাথমিক বেগই তাকে শেষে সমুদ্রে নিয়ে যায়, সেখানে ঐ জল আবার পূর্বের স্বাধীনতা ফিরে পায়। প্রথমটা যেন ‘মানবের পতন’ (Fall of Man) ও দ্বিতীয়টি যেন ‘পুনরুত্থান’ (Resurrection)। একটা পরমাণু পর্যন্ত স্থির হয়ে থাকতে পারে না—যতক্ষণ না সেটি মুক্তাবস্থা লাভ করছে।

কতকগুলি কল্পনা অন্য কল্পনাগুলির বন্ধন ভাঙতে সাহায্য করে। সমগ্র জগৎটাই কল্পনা, কিন্তু একরকমের কল্পনাসমষ্টি অপর প্রকারের কল্পনাসমষ্টিকে নষ্ট করে দেয়। যে-সব কল্পনা বলে—জগতে পাপ দুঃখ মৃত্যু রয়েছে, সে-সব কল্পনা বড় ভয়ানক; কিন্তু আর একরকমের কল্পনা বলে—‘আমি পবিত্রস্বরূপ, ঈশ্বর আছেন, জগতে দুঃখ নাই’, এইগুলিই শুভ কল্পনা, আর এগুলিই অন্যান্য কল্পনার বন্ধন ভাঙতে সাহায্য করে। সগুণ ঈশ্বরই মানবের সর্বোচ্চ কল্পনা, যা আমাদের বন্ধন-শৃঙ্খলের পাবগুলি সব ভেঙে দিতে পারে।

‘ওঁ তৎ সৎ’ অর্থাৎ একমাত্র সেই নির্গুণ ব্রহ্মই মায়ার অতীত, কিন্তু সগুণ ঈশ্বরও নিত্য। যতদিন নায়াগারা-প্রপাত রয়েছে, ততদিন তাতে প্রতিফলিত রামধনুও রয়েছে; কিন্তু এদিকে প্রপাতের জলরাশি ক্রমাগত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। ঐ জলপ্রপাত জগৎপ্রপঞ্চ স্বরূপ, আর রামধনু সগুণ ঈশ্বরস্বরূপ; এই দুইটিই নিত্য। যতক্ষণ জগৎ রয়েছে, ততক্ষণ জগদীশ্বর অবশ্যই আছেন। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করছেন, আবার জগৎ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করছে—দুই-ই নিত্য সত্য। মায়া সৎও নয়, অসৎও নয়। নায়াগারা-প্রপাত ও রামধনু উভয়ই অনন্ত কাল ধরে পরিবর্তনশীল—এরা মায়ার মধ্য দিয়ে দৃষ্ট ব্রহ্ম। জরাথুস্ট্রীয় ও খ্রীষ্টানেরা মায়াকে দু-ভাগে ভাগ করে ভাল অর্ধেকটাকে ‘ঈশ্বর’ ও মন্দ অর্ধেকটাকে ‘শয়তান’ নাম দিয়েছেন। বেদান্ত মায়াকে সমষ্টি বা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন এবং তার পশ্চাতে ব্রহ্মরূপ এক অখণ্ড বস্তুর সত্তা স্বীকার করেন।

মহম্মদ দেখলেন খ্রীষ্টধর্ম সেমিটিক ভাব থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, ঐ সেমিটিক ভাবের মধ্যে থেকেই খ্রীষ্টধর্মের কিরূপ হওয়া উচিত—তার যে একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করা উচিত—এইটিই তাঁর উপদেশের বিষয়। ‘আমি ও আমার পিতা এক’—এই আর্যোচিত উপদেশের উপর তিনি বড়ই বিরক্ত ছিলেন, ঐ উপদেশে তিনি ভয় পেতেন। প্রকৃতপক্ষে মানব থেকে নিত্য পৃথক্ জিহোবা-সম্বন্ধীয় দ্বৈত ধারণার চেয়ে ত্রিত্ববাদ (Trinity) অনেক উন্নত। যে ভাব-পরম্পরা ক্রমশঃ ঈশ্বর ও মানবের একত্বজ্ঞান এনে দেয়, অবতারবাদ তার প্রথম ভাব। লোকে প্রথম বোঝে, ঈশ্বর একজন মানবের দেহে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তারপর দেখে বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন মানবদেহে আবির্ভূত হয়েছেন, অবশেষে দেখতে পায়—তিনি সব মানুষের ভিতর রয়েছেন। অদ্বৈতবাদ সর্বোচ্চ অবস্থা, একেশ্বরবাদ তার চেয়ে নীচের স্তর। বিচারযুক্তির চেয়েও কল্পনা তোমায় শীঘ্র ও সহজে সেই সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে যাবে।

অন্ততঃ কয়েকজন লোক কেবল ঈশ্বরলাভের জন্য চেষ্টা করুক, আর সমগ্র জগতের জন্য ধর্ম জিনিষটা রক্ষা করুক। ‘আমি জনক রাজার মত নির্লিপ্ত’— একথা বলে ভান কর না। তুমি জনক বটে, কিন্তু মোহ বা অজ্ঞানের জনকমাত্র।৭৫ অকপট হয়ে বল, ‘আদর্শ কি, তা আমি বুঝতে পারছি বটে, কিন্তু এখনও তার কাছে এগোতে পারছি না।’ বাস্তবিক ত্যাগ না করে ত্যাগ করবার ভান কর না। যদি বাস্তবিক ত্যাগ কর, তবে দৃঢ়ভাবে ঐ ত্যাগকে ধরে থাক। লড়াইয়ে এক-শ লোকের পতন হোক না, তবু তুমি পতাকা তুলে নাও এবং এগিয়ে যাও; যে পড়ে পড়ুক না কেন, তা সত্ত্বেও ঈশ্বর সত্য। যুদ্ধে যার পতন হবে, সে যেন অপরের হাতে পতাকাটি দিয়ে যায়—যাতে সে ঐ পতাকা বহন করে নিয়ে যেতে পারে। পতাকা কখনও ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না।

*****************

বাইবেলে আছে—প্রথমে ভগবানের রাজ্য অন্বেষণ কর, আর যা কিছু তা তোমাকে দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমি বলি, যখন ধুয়ে পুঁছে পরিষ্কার হলাম, তখন আবার অশুচিতা আমাতে জুড়ে দেবার কি দরকার? তাই বলি, প্রথমেই স্বর্গরাজ্য অন্বেষণ কর, আর বাকী যা কিছু সব চলে যাক। তোমাতে নূতন কিছু আসুক—এ কামনা কর না, বরং সবকিছু ত্যাগ করতে পারলেই খুশী হও। ত্যাগ কর, আর জেন—তুমি দেখতে না পেলেও সফলতা লাভ তুমি করবেই। যীশু বারটি জেলে শিষ্য রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ অল্প ক-টি লোকেই প্রবল রোমক সাম্রাজ্য উড়িয়ে দিয়েছিল।

ঈশ্বরের বেদীতে পৃথিবীর মধ্যে পবিত্রতম ও সর্বোৎকৃষ্ট যা কিছু, তাই বলিস্বরূপ অর্পণ কর। যিনি ত্যাগের চেষ্টা কখনও করেন না, তাঁর চেয়ে যিনি চেষ্টা করেন, তিনি অনেক ভাল। একজন ত্যাগীকে দেখলেই হৃদয় পবিত্র হয়। ঈশ্বরকে লাভ করব—কেবল তাঁকেই চাই—এই বলে দৃঢ়পদে দাঁড়াও, দুনিয়ার যা হবার হোক; ঈশ্বর ও সংসার—এই দুই-এর মধ্যে কোন আপস করতে যেও না। সংসার ত্যাগ কর, কেবল তা হলেই দেহবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে। আর ঐরূপে দেহে আসক্তি চলে যাবার পর দেহত্যাগ হলেই তুমি ‘আজাদ’ বা মুক্ত হলে। মুক্ত হও, শুধু দেহের মৃত্যু আমাদের কখনও মুক্ত করতে পারে না। বেঁচে থাকতে থাকতেই আমাদের নিজ চেষ্টায় মুক্তিলাভ করতে হবে। তবেই যখন দেহপাত হবে, তখন সেই মুক্ত পুরুষের আর পুনর্জন্ম হবে না।

সত্যকে সত্যের দ্বারা বিচার করতে হবে, অন্য কিছুর দ্বারা নয়। লোকের হিত করাই সত্যের কষ্টিপাথর নয়। সূর্যকে দেখবার জন্য আর মশালের দরকার করে না। যদি সত্য সমগ্র জগৎকে ধ্বংস করে, তা হলেও তা সত্যই—ঐ সত্য ধরে থাকো।

ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানগুলি করা সহজ—এগুলিই সাধারণকে আকর্ষণ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাহ্য অনুষ্ঠানে কিছু নেই।

‘মাকড়সা যেমন নিজের ভিতর থেকে জাল বিস্তার করে, আবার তাকে নিজের ভিতর গুটিয়ে নেয়, সেইরূপ ঈশ্বরই এই জগৎপ্রপঞ্চ বিস্তার করেন, আবার নিজের ভিতর টেনে নেন!’৭৬

মঙ্গলবার, ৬ অগাস্ট


‘আমি’ না থাকলে বাইরে ‘তুমি’ থাকতে পারে না। এই থেকে কতকগুলি দার্শনিক এই সিদ্ধান্ত করলেন যে ‘আমাতে’ ছাড়া বাহ্য জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ‘তুমি’ কেবল ‘আমা’তেই রয়েছে। অপরে আবার ঠিক এর বিপরীত তর্ক করে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে, ‘তুমি’ না থাকলে ‘আমার’ অস্তিত্ব প্রমাণই হতে পারে না। তাঁদের পক্ষেও যুক্তির বল সমান। এই দুটো মতই আংশিক সত্য—খানিকটা সত্য, খানিকটা মিথ্যা। দেহ যেমন জড় ও প্রকৃতির উপাদানে গঠিত, চিন্তাও তাই। জড় ও মন উভয়ই একটা তৃতীয় পদার্থে অবস্থিত—এক অখণ্ড বস্তু আপনাকে দু-ভাগ করে ফেলেছে। এই এক অখণ্ড বস্তুর নাম ‘আত্মা’।

সেই মূল সত্তা যেন ‘ক’, সেটিই মন ও জড়—উভয়রূপে নিজেকে প্রকাশ করছে। এই পরিদৃশ্যমান জগতে এর গতি কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রণালী অবলম্বন করে হয়ে থাকে, সেগুলিকেই আমরা ‘নিয়ম’ বলি। এক অখণ্ড সত্তা-রূপে তা মুক্তস্বভাব, বহু-রূপে সেটি নিয়মের অধীন। তথাপি এই বন্ধন সত্ত্বেও আমাদের ভিতর একটা মুক্তির ধারণা সদাসর্বদা বর্তমান রয়েছে, এরই নাম নিবৃত্তি অর্থাৎ ‘আসক্তি ত্যাগ করা’। আর বাসনাবশে যে-সব জড়ত্ববিধায়িনী শক্তি আমাদের সাংসারিক কার্যে বিশেষভাবে প্রবৃত্ত করে; তাদেরই নাম প্রবৃত্তি।

সেই কাজটাকেই নীতিসঙ্গত বা সৎ কর্ম বলা যায়, যা আমাদের জড়ের বন্ধন থেকে মুক্ত করে; তার বিপরীত যা, তা অসৎ কর্ম। এই জগৎপ্রপঞ্চকে অনন্ত বোধ হচ্ছে, কারণ এর মধ্যে সব জিনিষই চক্রগতিতে চলছে; যেখান থেকে এসেছে, সেইখানেই ফিরে যাচ্ছে। বৃত্তের রেখাটি বর্ধিত হয়ে আবার নিজের সঙ্গে মিলে যায়, সুতরাং এখানে—এই সংসারে—কোনখানে বিশ্রাম বা শান্তি নেই। এই সংসার বৃত্ত থেকে আমাদের বেরুতেই হবে। মুক্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য—একমাত্র গতি।

মন্দের কেবল আকার বদলায়, কিন্তু তার গুণগত কোন পরিবর্তন হয় না। প্রাচীনকালে যার শক্তি ছিল, সেই শাসন করত, এখন ধূর্ততা শক্তির স্থান অধিকার করেছে। দুঃখকষ্ট আমেরিকায় যত তীব্র, ভারতে তত নয়; কারণ এখানে (আমেরিকায়) গরীব লোক নিজেদের দুরবস্থার সঙ্গে অপরের অবস্থার খুব বেশী প্রভেদ দেখতে পায়।

ভাল মন্দ—এই দুটো অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—একটাকে নিতে গেলে অপরটাকে নিতেই হবে। এই জগতের শক্তিমানসমষ্টি যেন একটা হ্রদের মত—ওতে যেমন তরঙ্গের উত্থান আছে, ঠিক তদনুযায়ী একটা পতনও আছে। সমষ্টিটা সম্পূর্ণ এক—সুতরাং একজনকে সুখী করা মানেই আর এক জনকে অসুখী করা। বাইরের সুখ জড়সুখ মাত্র, আর তার পরিমাণ নির্দিষ্ট। সুতরাং এককণা সুখও পেতে গেলে তা অপরের কাছ থেকে কেড়ে না নিয়ে পাওয়া যায় না। কেবল যা জড়জগতের অতীত সুখ, তা কারও কিছু হানি না করে পাওয়া যেতে পারে। জড়সুখ কেবল জড়দুঃখের রূপান্তর মাত্র।

যারা ঐ তরঙ্গের উত্থানাংশে জন্মেছে ও সেইখানে রয়েছে, তারা তার পতনাংশটা—আর তাতে কি আছে, তা দেখতে পায় না। কখনও মনে কর না, তুমি জগৎকে ভাল ও সুখী করতে পার। ঘানির বলদ তার সামনে বাঁধা খড়ের গোছা পাবার জন্য চেষ্টা করে বটে, কিন্তু কোন কালে তার কাছে পৌঁছতে পারে না, কেবল ঘানি ঘোরাতে থাকে মাত্র। আমরাও এইরূপে সুখরূপ আলেয়ার অনুসরণ করছি—সর্বদাই সেটা আমাদের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, আর আমরা শুধু প্রকৃতির ঘানিই ঘোরাচ্ছি। এইরূপ ঘানি টানতে টানতে আমাদের মৃত্যু হল, তারপর আবার ঘানি টানা আরম্ভ হবে। যদি আমরা অশুভকে দূর করে দিতে পারতাম, তা হলে আমরা কখনই কোন উচ্চতর বস্তুর আভাস পর্যন্ত পেতাম না; আমরা তা হলে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতাম, কখনও মুক্ত হবার জন্য চেষ্টা করতাম না। যখন মানুষ বুঝতে পারে, জড়জগতে সুখ অন্বেষণের সকল প্রচেষ্টা একেবারে নিরর্থক, তখনই ধর্মের আরম্ভ। মানুষের যত রকম জ্ঞান আছে, সবই ধর্মের অঙ্গমাত্র।

মানবদেহে ভাল-মন্দের এমন ভারসাম্য বজায় আছে যে, তাইতেই মানুষের এ উভয় থেকে মুক্তিলাভ করবার ইচ্ছার সম্ভাবনা রয়েছে।

মুক্ত যে, সে কোনকালেই বদ্ধ হয়নি। মুক্ত কি করে বদ্ধ হল—এই প্রশ্নটাই অযৌক্তিক। যেখানে কোন বন্ধন নেই, সেখানে কার্যকারণ-ভাবও নেই। ‘স্বপ্নে আমি একটা শেয়াল হয়েছিলাম, আর একটা কুকুর আমায় তাড়া করেছিল’—এখন আমি কি করে প্রশ্ন করতে পারি যে, কুকুর কেন আমায় তাড়া করেছিল? শেয়ালটা স্বপ্নেরই একটা অংশ, আর কুকুরটাও ঐ সঙ্গে আপনা হতেই এসে জুটল; কিন্তু দুই-ই স্বপ্ন, বাইরে এদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। আমরা যাতে এই বন্ধনের বাইরে যেতে পারি, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই-ই আমাদের সে-বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে। তবে ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে প্রাচীন, আর আমাদের এই কুসংস্কার রয়েছে যে, ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে পবিত্র। এক হিসাবে পবিত্রও বটে, কারণ ধর্ম নীতি বা চরিত্রকে (morality) তার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ বলে মনে করে, কিন্তু বিজ্ঞান তা করে না।

‘পবিত্রাত্মারা ধন্য, কারণ তাঁরা ঈশ্বরকে দর্শন করবেন। যদি সব শাস্ত্র এবং সব অবতার লুপ্ত হয়ে যায়, তথাপি এই একটিমাত্র বাক্য সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করবে। অন্তরের এই পবিত্রতা থেকেই ঈশ্বর-দর্শন হবে। সমগ্র বিশ্বসঙ্গীতে এই পবিত্রতাই ধ্বনিত হচ্ছে। পবিত্রতায় কোন বন্ধন নেই। পবিত্রতা দ্বারা অজ্ঞানের আবরণ দূর করে দাও, তা হলেই আমাদের যথার্থ স্বরূপের প্রকাশ হবে, আর আমরা জানতে পারব—আমরা কোন কালে বদ্ধ হইনি। নানাত্ব-দর্শনই জগতের মধ্যে সব চেয়ে বড় পাপ—সবকিছুকেই আত্মরূপে দর্শন কর ও সকলকেই ভালবাসো। ভেদভাব সব একেবারে দূর করে দাও।

*****************

পিশাচপ্রকৃতি লোকও ক্ষত বা পোড়া ঘায়ের মত আমার দেহের একটা অংশ। যত্ন করে তাকে ভাল করে তুলতে হবে। দুষ্ট লোককেও ক্রমাগত সাহায্য করতে থাক, যতক্ষণ না সে সম্পূণ সেরে যাচ্ছে এবং অবার সুস্থ ও সুখী হচ্ছে।

আমরা যতদিন আপেক্ষিক বা দ্বৈতভূমিতে রয়েছি, ততদিন আমাদের বিশ্বাস করবার অধিকার আছে যে, এই আপেক্ষিক জগতের বস্তু দ্বারা আমাদের অনিষ্ট হতে পারে, আবার ঠিক সেই ভাবে সাহায্যও পেতে পারি। এই সাহায্য-ভাবের সূক্ষ্মতম ভাবকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। ঈশ্বর বলতে আমাদের ধারণা আসে যে, আমরা যত প্রকার সাহায্য পেতে পারি, তিনি তার সমষ্টিস্বরূপ।

যা-কিছু আমাদের প্রতি করুণাসম্পন্ন, যা-কিছু কল্যাণকর, যা-কিছু আমাদের সহায়ক, ঈশ্বর সেই সকলের সার সমষ্টিস্বরূপ। ঈশ্বরসমন্ধে আমাদের এই একমাত্র ধারণা থাকা উচিত। আমরা যখন নিজেদের আত্মরূপে ভাবি, তখন আমাদের কোন দেহ নেই, সুতরাং ‘আমি ব্রহ্ম, বিষও আমার কিছু ক্ষতি করতে পারে না’—এই কথাটাই একটা অসম্ভব বাক্য। যতক্ষণ আমাদের দেহ রয়েছে, আর সেই দেহটাকে আমরা দেখছি, ততক্ষণ আমাদের ঈশ্বরোপলব্ধি হয়নি। নদীটাই যখন লুপ্ত হল, তখন তার ভিতরের ছোট আবর্তটা কি আর থাকতে পারে? সাহায্যের জন্য কাঁদ দেখি, তা হলে সাহায্য পাবে—আর অবশেষে দেখবে, সাহায্যের জন্য কান্নাও চলে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যদাতাও চলে গেছেন; খেলা শেষ হয়ে গেছে, বাকী রয়েছেন কেবল আত্মা।

একবার এইটি হয়ে গেলে ফিরে এসে যেমন খুশী খেলা কর। তখন আর এই দেহের দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হতে পারে না; কারণ যতদিন না আমাদের ভিতরে কুপ্রবৃত্তিগুলো সব পুড়ে যাচ্ছে, ততদিন মুক্তিলাভ হবে না; যখন ঐ অবস্থালাভ হয়, তখন আমাদের সব ময়লা পুড়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে নির্ধূম শিখা, তাপ নেই—আলো আছে।৭৭

তখন প্রারব্ধ আমাদের দেহটাকে চালিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু তার দ্বারা তখন কেবল ভাল কাজই হতে পারে, কারণ মুক্তিলাভ হবার পূর্বে সব মন্দ চলে গেছে। চোর ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মরবার সময় তার প্রাক্তন-কর্মের ফল লাভ করলে। পূর্বজন্মে সে যোগী ছিল, যোগভ্রষ্ট হওয়াতে তাকে জন্মাতে হয়; এ জন্মেও পতন হওয়াতে তাকে চোর হতে হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব জন্মে সে যে শুভকর্ম করেছিল, তার ফল ফলল। তার যখন মুক্তিলাভ হবার সময় হল, তখনই তার যীশুখ্রীষ্টের সঙ্গে দেখা হল, আর তাঁর এক কথায় সে মুক্ত হয়ে গেল।

বুদ্ধ তাঁর প্রবলতম শত্রুকেও মুক্তি দিয়েছিলেন, কারণ সে ব্যক্তি তাঁকে এত দ্বেষ করত যে, ঐ দ্বেষবশে সে সর্বদা তাঁর চিন্তা করত। ক্রমাগত বুদ্ধের এত চিন্তায় তার চিত্তশুদ্ধি-লাভ হয়েছিল, আর সে মুক্তিলাভ করবার উপযুক্ত হয়েছিল। অতএব সর্বদা ঈশ্বরের চিন্তা কর, ঐ চিন্তার দ্বারা তুমি পবিত্র হয়ে যাবে।

*****************

(এই ভাবেই শেষ হইয়া গেল আমাদের প্রিয়তম গুরুদেবের ‘দিব্যবাণী’, পরদিন স্বামীজী সহস্রদ্বীপোদ্যান হইতে নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া যান।)

Post a Comment

0 Comments