স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
ষষ্ঠ খণ্ড
ভাববার কথা
*************************************************************************************************************
হিন্দুধর্ম ও শ্রীরামকৃষ্ণ
[ এই প্রবন্ধটি ‘হিন্দুধর্ম কি ?’ নামে ১৩০৪ সালে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের পঞ্চষষ্টিতম জন্মোৎসবের সময় পুস্তিকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ]
শাস্ত্র শব্দে অনাদি অনস্ত ‘বেদ’ বুঝা যায়। ধর্মশাসনে এই বেদই একমাএ সক্ষম।
পুরাণাদি অন্যান্য পুস্তক স্মৃতিশব্দবাচ্য ; এবং তাহাদের প্রামাণ্য -যে পর্যন্ত তাহারা শ্রুতিকে অনুসরণ করে, সেই পর্যন্ত।
‘সত্য’ দুই প্রকার।এক -যাহা মানব-সাধারণের পঞ্চেন্দ্রিয়-গ্রাহ্য ও তদুপস্থাপিত অনুমানের দ্বারা গ্রাহ্য। দুই-যাহা অতীন্দ্রীয় সূক্ষ্ম যোগজ শক্তির গ্রাহ্য।
প্রথম উপায় দ্বারা সঙ্কলিত জ্ঞানকে ‘বিজ্ঞান’ বলা যায়। দ্বিতীয় প্রকারের সঙ্কলিত জ্ঞানকে ‘বেদ’ বলা যায়।
‘বেদ’ -নামধেয় অনাদি অনস্ত অলৌকিক জ্ঞনরাশি সদা বিদ্যমান,সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং যাহার সহায়তার এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করিতেছেন।
এই অতীন্দ্রিয় শক্তি যে পুরুষে আবির্ভূত হন,তাঁহার নাম ঋষি, ও সেই শক্তির দ্বারা তিনি যে অলৌকিক সত্য উপলব্ধি করেন,তাহার নাম ‘বেদ’।
এই ঋষিত্ব ও বেদদ্রষ্টৃত্ব লাভ করাই যথার্থ ধর্মানুভূতি। যতদিন ইহার উন্মেষ না হয,ততদিন ‘ধর্ম’ কেবল ‘কথার কথা’ ও ধর্মরাজ্যের প্রথম সোপানেও পদস্থিতি হয় নাই,জানিতে হইবে।
সমস্ত দেশ-কাল-পাত্র ব্যাপিয়া বেদের শাসন আর্থাৎ বেদের প্রভাব দেশ-বিশেষে, কালবিশেষে বা পাত্রবিশেষে বদ্ধ নহে।
সার্বজনীন থর্মের ব্যাখ্যাতা একমাত্র ‘বেদ’ ।
অলৌকিক জ্ঞানবেত্তৃত্ব কিঞ্চিৎ পরিমাণে অস্মদ্দেশীয় ইতিহাস-পুরাণাদি পুস্তকে ও ম্লেচ্ছাদিদেশীয় ধর্মপুস্তকসমূহে যদিও বর্তমান, তথাপি অলৌকিক জ্ঞনরাশির সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ এবং অবিকৃত সংগহ বলিয়া আর্যজাতির মধ্যে প্রসিদ্ধ ‘বেদ’-নামধেয় চতুর্বিভক্ত অক্ষরাশি সর্বতোভাবে সবোর্চ্চ স্থানের অধিকারী, সমগ্র জগতের পূজার্হ এবং বা ম্লেচ্ছ ধর্মপুস্তকের প্রমাণভূমি ।
অর্যজাতির আবিষ্কৃত উক্ত ‘বেদ’ নামক শব্দরাশির সম্বন্ধে ইহাও বুঝিতে হইবে যে, তন্মাধ্যে যাহা লৌকিক, অর্থবাদ বা ঐতিহ্য নহে,তাহাই ‘বেদ’ ।
এই বেদরাশির জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড – দুইভাগে বিভক্ত। কর্মকাণ্ডের ক্রিয়া ও ফল মায়াধিকৃত জগতের মধ্যে বলিয়া দেশকালপাত্রাদি-নিয়ামাধীনে তাহার পারিবর্তন হইয়ায়েছে,হইতেছে ও হইবে।সামাজিক রীতিনীতিও এই কর্মকাণ্ডের উপর উপস্থাপিত বলিয়া কালে কালে পরিবর্তিত হইতেছে ও হইবে । লোকাচারসকলও সৎশাস্ত্রবিগর্হিত ও সাদাচারবিরোধী একমাত্র লোকাচারের বশবর্তী হওয়াই আর্যজাতির অধঃপতনের এক প্রধান কারণ ।
জ্ঞানকাণ্ড অথবা বেদান্তভাগই – নিষ্কামকর্ম, যোগ, ভক্তি ও জ্ঞানের সহায়তায় মুক্তিপ্রদ এবং মায়া – পার – নেতৃত্বপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া,দেশকাল- প্রাত্রাদির দ্বারা অপ্রতিহত বিধায় – সার্বলৌকিক ,সার্বভৌম ও সার্বকালিক ধর্মের একমাত্র উপদেষ্টা ।
মন্বাদি তন্ত্র কর্মকাণ্ডকে আশ্রয় করিয়া দেশ – কাল পাত্রভেদে অধিকভাবে সামাজিক কল্যাণকর কর্মের শিক্ষা দিয়াছেন।পুরণাদি তন্ত্র বেদান্তনিহিত তত্ত্ব উধ্বার করিয়া অবতারাদির মাহান্ চরিত – বর্ণন – মুখে ঐ সকল তত্তের বিস্তৃত ব্যাখ্যান করিতেছেন, এবং অনন্ত ভাবময় প্রভু ভগবানের কোন কোন ভাবকে প্রধান করিয়া সেই সেই ভাবের উপদেশ করিয়াছেন।
কিন্তু কালবশে সদাচারভষ্ট্র, বৈরাগ্যবিহীন,একমাত্র লোকাচারনিষ্ঠ ও ক্ষীণবুদ্ধি আর্যসন্তান এই সকল ভাববিশেষের বিশেষ-শিক্ষার জন্য আপাত – প্রতিযোগীর ন্যায় অবস্থিত ও অল্পবুদ্ধি মানবের জন্য স্থূল ও বহুবিস্তৃত ভাষায় স্থূলভাবে বৈদান্তিক সূক্ষ্মতত্তের প্রচারকারী পুরাণাদি তন্ত্রেরও মর্মগ্রহে অসমর্থ হইয়া, অনন্তভাবসমষ্টি অখণ্ড সনাতন ধর্মকে বিভক্ত করিয়া, সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা ও ক্রোধ প্রজ্বলিত করিয়া, তন্মধ্যে পরস্পরকে আহুতি দিবার জন্য সতত চেষ্টিত থাকিয়া যখন এই ধর্মভূমি ভারতবর্ষকে প্রায় নরকভূমিতে পরিণত করিয়াছেন-
তখন আর্যজাতির প্রকৃত ধর্ম কি এবং সততবিবদমান, আপাত – প্রতীয়মান – বহুধা – বিভক্ত, সর্বথা – প্রতিযোগী, আচারসঙ্কুল সম্প্রদায়ে সমাচছন্ন, স্বদেশীর ভ্রান্তিস্থান ও বিদেশীর ঘৃণাস্পদ হিন্দুধর্ম – নামক যুগ যুগন্তরব্যাপী বিখণ্ডিত ও দেশকাল – যোগে ইতস্ততঃ বিক্ষিত ধর্মখণ্ডসমষ্টির মধ্যে যথার্থ একতা কোথায় – এবং কালবশে নষ্ট এই সনাতন ধর্মের সার্বলৌকিক,সার্বকালিক ও সার্বদৈশিক স্বরূপ স্বীয় জীবনে নিহিত করিয়া, লোকসমক্ষে সনাতন ধর্মের জীবন্ত উদারণস্বরূপ আপনাকে প্রদর্শন করিতে লোকহিতের জন্য শ্রীভগবান রামকৃষ্ঞ অবতীর্ণ হইয়াছেন।
অনাদি-বর্তমান, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-কর্তার সহযোগী শাস্ত্র কি প্রকারে সংক্ষিপ্ত-সংস্কার ঋষিহৃদয়ে আবির্ভূত হন, তাহা দেখাইবার জন্য ও এবম্প্রকারে শাস্ত্র প্রমাণীকৃত হইলে ধর্মের পুনরুদ্ধার, পুনঃস্থাপন ও পুনঃপ্রচার হইবে, এই জন্য বেদমূর্তি ভগবান এই কলেবরে বহিঃশিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়াছেন।
বেদ অর্থাৎ প্রকৃত ধর্মের এবং ব্রাম্মণত্ব অর্থাৎ ধর্মশিক্সকত্বের রক্ষার জন্য ভগবান বারংবার শরীর ধারণ করেন, ইহা স্মৃত্যাদিতে প্রসিদ্ধ আছে।
প্রপতিত নদীর জলরাশি সমধিক বেগবান হয়; পুনরুত্থিত তরঙ্গ সমধিক বিস্ফারিত হয়। প্রত্যেক পতনের পর আর্যসমাজও শ্রীভগবানের করুণিক নিয়ন্তৃত্বে বিগতাময় হইয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর যশস্বী ও বীর্যবান হইতেছেন-ইহা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ।
প্রত্যেক পতনের পর পুনরুত্থিত সমাজ অন্তর্নিহিত সনাতন পূর্ণত্বকে সমধিক প্রকাশিত করিতেছেন এবং সর্বভূতান্তর্যামী প্রভূও প্রত্যেক অবতারে আত্মস্বরূপ সমধিক অভিব্যক্ত করিতেছেন।
বারংবার এই ভারতভূমি মূর্ছাপন্না হইয়াছিলেন এবং বারংবার ভারতের ভগবান আত্মাভিব্যাক্ত দ্বারা ইহাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন।
কিন্তু ষন্মাত্রযামা গতপ্রায় বর্তমান গভীর বিষাদ-রজনীর ন্যায় কোনও অমানিশা এই পুন্যভূমিকে সমাচ্ছন্ন করে নাই। এ পতনের গভীরতায় প্রাচীন পতন-সমস্ত গোষ্পদের তুল্য।
এবং সেই জন্য এই প্রবোধনের সমুজ্জ্বলতায় অন্য সমস্ত পুনর্বোধন সূর্যালোক তারকাবলীর ন্যায়। এই পুনরুত্থানের মহাবীর্যের সমক্ষে পুনঃপুনর্লদ্ধ প্রাচীন বীর্য বাললীলাপ্রায় হইয়া যাইবে।
পতনাবস্থায় সনাতন থর্মের সমগ্র ভাব-সমষ্টি অধিকারহীনতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়-আকারে পরিরক্ষিত হইতেছিল এবং অনেক অংশ লুপ্ত হইয়াছিল।
এই নবোত্থানে নদ বলে বলীয়মান মানবসন্তানে বিক্ষিপ্ত অধ্যাত্মবিদ্যা সমষ্টীকৃত করিয়া ধারণা ও অভ্যাস করিতে সমর্থ হইবে এবং লুপ্ত বিদ্বারও পুনরাবিষ্কার করিতে সমর্থ হইবে; ইহার প্রথম নিদর্শনস্বরূপ শ্রীভগবান পরম কারুণিক, সর্বযুগাপেক্ষা সমধিক সম্পূর্ণ, সর্বভাব -সমন্বিত, সর্ববিদ্যা-সহায় যুগাবতাররূপ প্রকাশ করিলেন।
অতএব এই মহাযুগের প্রত্যুষে সর্বভাবের সমন্বয় প্রচারিত হইতেছেন এবং এই অসীম অনন্ত ভাব,যাহা সনাতন শাস্ত্র ও ধর্মে নিহিত থাকিয়াও এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহা পুনরাবিষ্কৃত হইয়া উচ্চানিনাদে জনসমাজে ঘোষিত হইতেছে।
এই নব যুগধর্ম সমগ্র জগতের, বিশেষতঃ ভারাটবর্ষের কল্যাণের নিদান এবং এই নবযুগধর্ম-প্রবর্তক শ্রীভগবান পূর্বগ শ্রীযুগধর্মপ্রবর্তকদিগের পুনঃসংস্কৃত প্রকাশ।হে মানব, ইহা বিশ্বাস কর ও ধারণ কর।
মৃতব্যক্তি পুনরাগত হয় না। গতরাত্রি পুনর্বার আসে না।বিগতোচ্ছ্বাস সে রূপ আর প্রদর্শন করে না। জীব দুইবার এক দেহ ধারণ করে না। হে মানব, মৃতের পূজা হইতে আমরা তোমাদিগকে জীবন্তের পূজাতে আহ্বান করিতেছি। গতানুশোচনা হইতে বর্তমান প্রযত্নে আহ্বান করিতেছি। লুপ্ত পন্থার পুনরুদ্ধারে বৃথা শক্তিক্ষয় হইতে সদ্যোনির্মিত বিশাল ও সন্নিকট পথে আহ্বান করিতেছি; বুদ্ধিমান, বুঝিয়া লও।
যে শক্তির উন্মেষমাত্র দিগ্দিগন্তব্যাপী প্রতিদিন জাগরিত হইয়াছে, তাহার পূর্ণাবস্থা কল্পনায় অনুভব কর; এবং বৃথা সন্দেহ, দুর্বলতা ও দাসজাতি-সুলভ ঈর্ষাদ্বেষ ত্যাগ করিয়া এই মহাযুগচক্র পরিবর্তনের সহায়তা কর।
আমরা প্রভুর দাস, প্রভুর পুত্র, প্রভুর লীলার সহায়ক-এই বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও।
*************************************************************************************************************
রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি
[অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত পুস্তকের সমালোচনা]
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞদিগের অধিনায়ক। যে ঋগ্বেদ-সংহিতা পূর্বে সমগ্র কেহ চক্ষেও দেখিতে পাইত না, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বিপুল ব্যয়ে এবং অধ্যাপকের বহুবর্ষব্যাপী পরিশ্রমে এক্ষণে তাহা অতি সুন্দররূপে মুদ্রিত হইয়া সাধারণের পাঠ্য। ভারতের দেশদেশান্তর হইতে সংগৃহীত হস্তলিপি-পুঁথির অধিকাংশ অক্ষরগুলিই বিচিত্র এবং অনেক কথাই অশুদ্ধ; বিশেষ, মহাপণ্ডিত হইলেও বিদেশীর পক্ষে সেই অক্ষরের শুদ্ধ্যশুদ্ধি নির্ণয় এবং অতি স্বল্পাক্ষর জটিল ভাষ্যের বিশদ অর্থ বোধগম্য করা কি কঠিন, তাহা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের জীবনে এই ঋগ্বেদ-মুদ্রণ একটি প্রধান কার্য। এতদ্ব্যতীত আজীবন প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্যে তাঁহার বসবাস—জীবন-যাপন; কিন্তু তাহা বলিয়াই যে অধ্যাপকের কল্পনার ভারতবর্ষ—বেদ-ঘোষ-প্রতিধ্বনিত, যজ্ঞধূম-পূর্ণাকাশ, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-জনক-যাজ্ঞবল্ক্যাদি-বহুল, ঘরে ঘরে গার্গী-মৈত্রেয়ী-সুশোভিত, শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রের নিয়মাবলী-পরিচালিত, তাহা নহে। বিজাতি-বিধর্মি-পদদলিত, লুপ্তাচার, লুপ্তক্রিয়, ম্রিয়মান, আধুনিক ভারতের কোন্ কোণে কি নূতন ঘটনা ঘটিতেছে, তাহাও অধ্যাপক সদাজাগরূক হইয়া সংবাদ রাখেন। এদেশের অনেক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান—অধ্যাপকের পদযুগল কখনও ভারত-মৃত্তিকা-সংলগ্ন হয় নাই বলিয়া ভারতবাসীর রীতিনীতি আচার ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁহার মতামতে নিতান্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। কিন্তু তাঁহাদের জানা উচিত যে, আজীবন এদেশে বাস করিলেও অথবা এদেশে জন্মগ্রহণ করিলেও যে-প্রকার সঙ্গ সেই সামাজিক শ্রেণীর বিশেষ বিবরণ ভিন্ন অন্য শ্রেণীর বিষয়ে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান রাজপুরুষকে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ থাকিতে হয়। বিশেষ, জাতিবিভাগে বিভক্ত এই বিপুল সমাজে একজাতির পক্ষে অন্য জাতির আচারাদি বিশিষ্টরূপে জানাই কত দুরূহ। কিছুদিন হইল, কোনও প্রসিদ্ধ অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান কর্মচারীর লিখিত ‘ভারতাধিবাস’ নামধেয় পুস্তকে এরূপ এক অধ্যায় দেখিয়াছি—‘দেশীয় পরিবার-রহস্য’। মনুষ্যহৃদয়ে রহস্যজ্ঞানেচ্ছা প্রবল বলিয়াই বোধ হয় ঐ অধ্যায় পাঠ করিয়া দেখি যে, অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান-দিগ্গজ তাঁহার মেথর, মেথরানী ও মেথরানীর জার-ঘটিত ঘটনা-বিশেষ বর্ণনা করিয়া স্বজাতিবৃন্দের দেশীয়-জীবন-রহস্য সম্বন্ধে উগ্র কৌতূহল চরিতার্থ করিতে বিশেষ প্রয়াসী এবং ঐ পুস্তকের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সমাজে সমাদর দেখিয়া লেখক যে সম্পূর্ণরূপে কৃতার্থ, তাহাও বোধ হয়। ‘শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ’—আর বলি কি? তবে শ্রীভগবান্ বলিয়াছেন—‘সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে’ ইত্যাদি। যাক অপ্রাসঙ্গিক কথা; তবে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের আধুনিক ভারতবর্ষের, দেশদেশান্তরের রীতিনীতি ও সাময়িক ঘটনাজ্ঞান দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়, ইহা আমাদের প্রত্যক্ষ।
বিশেষতঃ ধর্ম সম্বন্ধে ভারতের কোথায় কি নূতন তরঙ্গ উঠিতেছে, অধ্যাপক সেগুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবেক্ষণ করেন এবং পাশ্চাত্য জগৎ যাহাতে সে বিষয়ে বিজ্ঞপ্ত হয়, তাহারাও বিশেষ চেষ্টা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী-প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ, থিওসফি সম্প্রদায় অধ্যাপকের লেখনী-মুখে প্রশংসিত বা নিন্দিত হইয়াছে। সুপ্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-নামক পত্রদ্বয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও উপদেশের প্রচার দেখিয়া এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার-লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণের বৃত্তান্তপাঠে১ রামকৃষ্ণ-জীবন তাঁহাকে আকর্ষণ করে। ইতোমধ্যে ‘ইণ্ডিয়া হাউস’-এর লাইব্রেরিয়ান টনি মহোদয়-লিখিত ‘রামকৃষ্ণচরিত’ও ইংলণ্ডীয় প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকায়২মুদ্রিত হয়। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা হইতে অনেক বিবরণ সংগ্রহ করিয়া অধ্যাপক ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক ইংরেজী ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন। তাহাতে ব্যক্ত করিয়াছেন যে, বহু শতাব্দী যাবৎ পূর্বমনীষিগণের ও আধুনিক কালে পাশ্চাত্য বিদ্বদ্বর্গের প্রতিধ্বনিমাত্রকারী ভারতবর্ষে নূতন ভাষায় নূতন মহাশক্তি পরিপূরিত করিয়া নূতন ভাবসম্পাতকারী নূতন মহাপুরুষ সহজেই তাঁহার চিত্তাকর্ষণ করিলেন। পূর্বতন ঋষি-মুনি-মহাপুরুষদিগের কথা তিনি শাস্ত্রপাঠে বিলক্ষণই অবগত ছিলেন; তবে এ যুগে এ ভারতে—আবার তাহা হওয়া কি সম্ভব? রামকৃষ্ণ-জীবনী এ প্রশ্নের যেন মীমাংসা করিয়া দিল। আর ভারতগতপ্রাণ মহাত্মার ভারতের ভাবী মঙ্গলের, ভাবী উন্নতির আশালতার মূলে বারিসেচন করিয়া নূতন প্রাণ সঞ্চার করিল।
পাশ্চাত্য জগতে কতকগুলি মহাত্মা আছেন, যাঁহারা নিশ্চিত ভারতের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু ম্যাক্সমূলারের অপেক্ষা ভারতহিতৈষী ইওরোপখণ্ডে আছেন কিনা, জানি না।ম্যাক্সমূলার যে শুধু ভারতহিতৈষী, তাহা নহেন—ভারতের দর্শন-শাস্ত্রে, ভারতের ধর্মে তাঁহার বিশেষ আস্থা; অদ্বৈতবাদ যে ধর্মরাজ্যের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্ক্রিয়া, তাহা অধ্যাপক সর্বসমক্ষে বারংবার স্বীকার করিয়াছেন। যে সংসারবাদ৩ দেহাত্মবাদী খ্রীষ্টিয়ানের বিভীষিকাপ্রদ, তাহাও তিনি স্বীয় অনুভূতিসিদ্ধ বলিয়া দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেন; এমন কি, বোধ হয় যে, ইতঃপূর্ব-জন্ম তাঁহার ভারতেই ছিল, ইহাই তাঁহার ধারণা এবং পাছে ভারতে আসিলে তাঁহার বৃদ্ধ শরীর সহসা-সমুপস্থিত পূর্বস্মৃতিরাশির প্রবল বেগ সহ্য করিতে না পারে, এই ভয়ই অধুনা ভারতাগমনের প্রধান প্রতিবন্ধক। তবে গৃহস্থ মানুষ, যিনিই হউন, সকল দিক্ বজায় রাখিয়া চলিতে হয়। যখন সর্বত্যাগী উদাসীনকে অতি বিশুদ্ধ জানিয়াও লোকনিন্দিত আচারের অনুষ্ঠানে কম্পিতকলেবর দেখা যায়, ‘শূকরীবিষ্ঠা’ মুখে বলিয়াও যখন ‘প্রতিষ্ঠা’র লোভ, অপ্রতিষ্ঠার ভয় মহা-উগ্রতাপসেরও কার্য-প্রণালীর পরিচালক, তখন সর্বদা লোকসংগ্রহেচ্ছু বহুলোকপূজ্য গৃহস্থের যে অতি সাবধানে নিজের মনোগত ভাব প্রকাশ করিতে হইবে, ইহাতে কি বিচিত্রতা? যোগশক্তি ইত্যাদি গূঢ় বিষয় সম্বন্ধেও যে অধ্যাপক একেবারে অবিশ্বাসী, তাহাও নহেন।
‘দার্শনিক-পূর্ণ ভারতভূমিতে যে-সকল ধর্ম-তরঙ্গ উঠিতেছে’ তাহাদের কিঞ্চিৎ বিবরণ ম্যাক্সমূলার প্রকাশ করেন, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় অনেকে ‘উহার মর্ম বুঝিতে অত্যন্ত ভ্রমে পড়িয়াছেন এবং অত্যন্ত অযথা বর্ণন করিয়াছেন’। ইহা প্রতিবিধানের জন্য এবং ‘এসোটেরিক বৌদ্ধমত, থিওসফি প্রভৃতি বিজাতীয় নামের পশ্চাতে ভারতবাসী সাধুসন্ন্যাসীদের অলৌকিক ক্রিয়াপূর্ণ অদ্ভুত যে-সকল উপন্যাস ইংলণ্ড ও আমেরিকার সংবাদপত্রসমূহে উপস্থিত হইতেছে, তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্য আছে’,৪ ইহা দেখাইবার জন্য অর্থাৎ ভারতবর্ষ যে কেবল পক্ষিজাতির ন্যায় আকাশে উড্ডীয়মান, পদভরে জলসঞ্চরণকারী মৎস্যানুকারী জলজীবী, মন্ত্রতন্ত্র-ছিটাফোঁটা-যোগে রোগাপনয়নকারী, সিদ্ধিবলে ধনীদিগের বংশরক্ষক, সুবর্ণাদি-সৃষ্টিকারী সাধুগণের নিবাসভূমি, তাহা নহে; কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ, প্রকৃত ব্রহ্মবিৎ, প্রকৃত যোগী, প্রকৃত ভক্ত যে ঐ দেশে একেবারে বিরল নহেন এবং সমগ্র ভারতবাসী যে এখনও এতদূর পশুভাব প্রাপ্ত হন নাই যে, শেষোক্ত নরদেবগণকে ছাড়িয়া পূর্বোক্ত বাজীকরগণের পদলেহন করিতে আপামর-সাধারণ দিবানিশি ব্যস্ত—ইহাই ইওরোপীয় মনীষিগণকে জানাইবার জন্য ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের অগষ্টসংখ্যক ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক পত্রিকায় অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার ‘প্রকৃত মহাত্মা’-শীর্ষক প্রবন্ধে৫ শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিতের অবতারণা করেন।
ইওরোপ ও আমেরিকার বুধমণ্ডলী অতি সমাদরে এ প্রবন্ধটি পাঠ করেন এবং উহার বিষয়ীভূত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রতি অনেকেই আস্থাবান্ হইয়াছেন। আর সুফল হইয়াছে কি?—এই ভারতবর্ষ নরমাংসভোজী, নগ্নদেহ, বলপূর্বক বিধবা-দাহনকারী, শিশুঘাতী, মূর্খ, কাপুরুষ, সর্বপ্রকার পাপ ও অন্ধতা-পরিপূর্ণ, পশুপ্রায় নরজাতিপূর্ণ বলিয়া পাশ্চাত্য সভ্য জাতিরা ধারণা করিয়া রাখিয়াছিলেন; এই ধারণার প্রধান সহায় পাদরী-সাহেবগণ—ও বলিতে লজ্জা হয়, দুঃখ হয়, কতকগুলি আমাদের স্বদেশী। এই দুই দলের প্রবল উদ্যোগে যে একটি অন্ধতামসের জাল পাশ্চাত্যদেশ-নিবাসীদের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়াছিল, সেইটি ধীরে ধীরে খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইতে লাগিল। ‘যে দেশে শ্রীভগবান্ রামকৃষ্ণের ন্যায় লোকগুরুর উদয়, সে দেশ কি বাস্তবিক যে-প্রকার কদাচারপূর্ণ আমরা শুনিয়া আসিতেছি, সেই প্রকার? অথবা কুচক্রীরা আমাদিগকে এতদিন ভারতের তথ্য সম্বন্ধে মহাভ্রমে পাতিত করিয়া রাখিয়াছিল?’—এ প্রশ্ন স্বতই পাশ্চাত্য মনে সমুদিত।
পাশ্চাত্য জগতে ভারতীয় ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সাম্রাজ্যের চক্রবর্তী অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার যখন শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিত অতি ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে ইওরোপ ও আমেরিকার অধিবাসীদিগের কল্যাণের জন্য সংক্ষেপে ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’তে প্রকাশ করিলেন, তখন পূর্বোক্ত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভীষণ অন্তর্দাহ উপস্থিত হইল, তাহা বলা বাহুল্য।
মিশনরী মহোদয়েরা হিন্দুদেবদেবীর অতি অযথা বর্ণন করিয়া তাঁহাদের উপাসকদিগের মধ্যে যে যথার্থ ধার্মিক লোক কখনও উদ্ভূত হইতে পারে না—এইটি প্রমাণ করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিলেন; প্রবল বন্যার সমক্ষে তৃণগুচ্ছের ন্যায় তাহা ভাসিয়া গেল, আর পূর্বোক্ত স্বদেশী সম্প্রদায় শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তিসম্প্রসারণরূপ প্রবল অগ্নি নির্বাণ করিবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে হতাশ হইয়া পড়িয়াছেন। ঐশী শক্তির সমক্ষে জীবের শক্তি কি?
অবশ্য দুই দিক্ হইতেই এক প্রবল আক্রমণ বৃদ্ধ অধ্যাপকের উপর পতিত হইল। বৃদ্ধ কিন্তু হটিবার নহেন; এ সংগ্রামে তিনি বহুবার পারোর্ত্তীর্ণ। এবারও হেলায় উর্ত্তীর্ণ হইয়াছেন এবং ক্ষুদ্র আততায়িগণকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করিবার জন্য এবং উক্ত মহাপুরুষ ও তাঁহার ধর্ম যাহাতে সর্বসাধারণে জানিতে পারে, সেইজন্য তাঁহার অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ জীবনী ও উপদেশ সংগ্রহপূর্বক ‘রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি’ নামক পুস্তক প্রকাশ করিয়া উহার ‘রামকৃষ্ণ’ নামক অধ্যায়ে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়াছেনঃ
‘উক্ত মহাপুরুষ ইদানীং ইওরোপ ও আমেরিকার বহুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, তথায় তাঁহার শিষ্যেরা মহোৎসাহে তাঁহার উপদেশ প্রচার করিতেছেন এবং বহু ব্যক্তিকে, এমন কি, খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্য হইতেও রামকৃষ্ণ-মতে আনয়ন করিতেছেন, একথা আমাদের নিকট আশ্চর্যবৎ এবং কষ্টে বিশ্বাসযোগ্য … তথাপি প্রত্যেক মনুষ্যহৃদয়ে ধর্ম-পিপাসা বলবতী, প্রত্যেক হৃদয়ে প্রবল ধর্মক্ষুধা বিদ্যমান, যাহা বিলম্বে বা শীঘ্রই শান্ত হইতে চাহে। এই-সকল ক্ষুধার্ত প্রাণে রামকৃষ্ণের ধর্ম বাহিরের কোন শাসনাধীনে আসে না বলিয়াই অমৃতবৎ গ্রাহ্য হয়। … অতএব রামকৃষ্ণ-ধর্মানুচারীদের যে প্রবল সংখ্যা আমরা শুনিতে পাই, তাহা কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত যদ্যপি হয়, তথাপি যে ধর্ম আধুনিক সময়ে এতাদৃশী সিদ্ধিলাভ করিয়াছে এবং যাহা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে সম্পূর্ণ সত্যতার সহিত জগতের সর্বপ্রাচীন ধর্ম ও দর্শন বলিয়া ঘোষণা করে এবং যাহার নাম ‘বেদান্ত’ অর্থাৎ বেদশেষ বা বেদের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য, তাহা অস্মদাদির অতিযত্নের সহিত মনঃসংযোগার্হ।’৬
এই পুস্তকের প্রথম অংশে মহাত্মা পুরুষ, আশ্রম-বিভাগ, সন্ন্যাসী, যোগ, দয়ানন্দ সরস্বতী, পওহারী বাবা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাস্বামী সম্প্রদায়ের নেতা রায় শালিগ্রাম সাহেব বাহাদুর প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনীর অবতারণা করা হইয়াছে।
অধ্যাপকের বড়ই ভয়, পাছে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধে যে দোষ আপনা হইতেই আসে—অনুরাগ বা বিরাগাধিক্যে অতিরঞ্জিত হওয়া—সেই দোষ এ জীবনীতে প্রবেশ করে। তজ্জন্য ঘটনাবলী-সংগ্রহে তাঁহার বিশেষ সাবধানতা। বর্তমান লেখক শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষুদ্র দাস—তৎসঙ্কলিত রামকৃষ্ণ-জীবনীর উপাদান যে অধ্যাপকের যুক্তি ও বুদ্ধি-উদূখলে বিশেষ কুট্টিত হইলেও ভক্তির আগ্রহে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত হওয়া সম্ভব, তাহাও বলিতে ম্যাক্সমূলার ভুলেন নাই এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিগণ শ্রীরামকৃষ্ণের দোষোদ্ঘোষণ করিয়া অধ্যাপককে যাহা কিছু লিখিয়াছেন, তাহার প্রত্যুত্তরমুখে দুই চারিটি কঠোর মধুর কথা যাহা বলিয়াছেন, তাহাও পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষাপূর্ণ বাঙ্গালীর বিশেষ মনোযোগের বিষয়, সন্দেহ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ-কথা অতি সংক্ষেপে সরল ভাষায় পুস্তকমধ্যে অবস্থিত। এ জীবনীতে সভয় ঐতিহাসিকের প্রত্যেক কথাটি যেন ওজন করিয়া লেখা—‘প্রকৃত মহাত্মা’-নামক প্রবন্ধে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মধ্যে মধ্যে দেখা যায়, এবার তাহা অতি যত্নে আবরিত। একদিকে মিশনরী, অন্যদিকে ব্রাহ্ম-কোলাহল—এ উভয় আপদের মধ্য দিয়া অধ্যাপকের নৌকা চলিয়াছে। ‘প্রকৃত মহাত্মা’ উভয় পক্ষ হইতে বহু ভর্ৎসনা, বহু কঠোর বাণী অধ্যাপকের উপর আনে; আনন্দের বিষয়—তাহার প্রত্যুত্তরের চেষ্টাও নাই, ইতরতা নাই, আর গালাগালি সভ্য ইংলণ্ডের ভদ্র লেখক কখনও করেন না; কিন্তু বর্ষীয়ান্ মহাপণ্ডিতের উপযুক্ত ধীর-গম্ভীর, বিদ্বেষ-শূন্য অথচ বজ্রবৎ দৃঢ় স্বরে—মহাপুরুষের অলৌকিক হৃদয়োত্থিত অমানব ভাবের উপর যে আক্ষেপ হইয়াছিল, তাহা অপসারিত করিয়াছেন।
আক্ষেপগুলিও আমাদের বিস্ময়কর বটে। ব্রাহ্ম-সমাজের গুরু স্বর্গীয় আচার্য শ্রীকেশবচন্দ্রের শ্রীমুখ হইতে আমরা শুনিয়াছি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের সরল মধুর গ্রাম্য ভাষা অতি অলৌকিক পবিত্রতা-বিশিষ্ট; আমরা যাহাকে অশ্লীল বলি, এমন কথার সমাবেশ তাহাতে থাকিলেও তাঁহার অপূর্ব বালবৎ কামগন্ধহীনতার জন্য ঐ-সকল শব্দ-প্রয়োগ দোষের না হইয়া ভূষণস্বরূপ হইয়াছে। অথচ ইহাই একটি প্রবল আক্ষেপ!!
অপর আক্ষেপ এই যে, তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাহাতে অধ্যাপক উত্তর দিতেছেন যে, তিনি স্ত্রীর অনুমতি লইয়া সন্ন্যাসব্রত ধারণ করেন এবং যতদিন মর্ত্যধামে ছিলেন, তাঁহার সদৃশী স্ত্রী পতিকে গুরুভাবে গ্রহণ করিয়া স্বেচ্ছায় পরমানন্দে তাঁহার উপদেশ অনুসারে আকুমার ব্রহ্মচারিণীরূপে ভগবৎসেবায় নিযুক্তা ছিলেন। আরও বলেন যে, শরীরসম্বন্ধ না হইলে কি বিবাহে এতই অসুখ? ‘আর শরীরসম্বন্ধ না রাখিয়া ব্রহ্মচারিণী পত্নীকে অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মানন্দের ভাগিনী করিয়া ব্রহ্মচারী পতি যে পরম পবিত্রভাবে জীবন অতিবাহিত করিতে পারেন, এ বিষয়ে উক্ত ব্রতধারণকারী ইওরোপ-নিবাসীরা সফলকাম হয় নাই, আমরা মনে করিতে পারি, কিন্তু হিন্দুরা যে অনায়াসে ঐ প্রকার কামজিৎ অবস্থায় কালাতিপাত করিতে পারে, ইহা আমরা বিশ্বাস করি।’৭ অধ্যাপকের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক! তিনি বিজাতি, বিদেশী হইয়া আমাদের একমাত্র ধর্মসহায় ব্রহ্মচর্য বুঝিতে পারেন, এবং ভারতবর্ষে যে এখনও বিরল নহে, বিশ্বাস করেন; আর আমাদের ঘরের মহাবীরেরা বিবাহে শরীরসম্বন্ধ বই আর কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না!! যাদৃশী ভাবনা যস্য ইত্যাদি।
আবার অভিযোগ এই যে, তিনি বেশ্যাদিগকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন না। ইহাতে অধ্যাপকের উত্তর বড়ই মধুর; তিনি বলেন, শুধু রামকৃষ্ণ নহেন, অন্যান্য ধর্মপ্রবর্তকেরাও এ অপরাধে অপরাধী।
আহা! কি মিষ্ট কথা—শ্রীভগবান্ বুদ্ধদেবের কৃপাপাত্রী বেশ্যা অম্বাপালী ও হজরত ঈশার দয়াপ্রাপ্তা সামরীয়া নারীর কথা মনে পড়ে। আরও অভিযোগ, মদ্যপানের উপরও তাঁহার তাদৃশ ঘৃণা ছিল না। হরি! হরি! ‘একটু মদ খেয়েছে বলে সে লোকটার ছায়াও স্পর্শ করা হবে না’—এই না অর্থ? দারুণ অভিযোগই বটে! মাতাল, বেশ্যা, চোর, দুষ্টদের মহাপুরুষ কেন দূর দূর করিয়া তাড়াইতেন না, আর চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ছাঁদি ভাষায় সানাইয়ের পোঁ-র সুরে কেন কথা কহিতেন না! আবার সকলের উপর বড় অভিযোগ—আজন্ম স্ত্রী-সঙ্গ কেন করিলেন না!!!
আক্ষেপকারীদের এই অপূর্ব পবিত্রতা এবং সদাচারের আদর্শে জীবন গড়িতে না পারিলেই ভারত রসাতলে যাইবে! যাক রসাতলে, যদি ঐ প্রকার নীতিসহায়ে উঠিতে হয়।
জীবনী অপেক্ষা উক্তি-সংগ্রহ এ পুস্তকের অধিক স্থান অধিকার করিয়াছে। ঐ উক্তিগুলি যে সমস্ত পৃথিবীর ইংরাজী-ভাষী পাঠকের মধ্যে অনেক ব্যক্তির চিত্তাকর্ষণ করিতেছে, তাহা পুস্তকের ক্ষিপ্র বিক্রয় দেখিয়াই অনুমিত হয়। উক্তিগুলি তাঁহার শ্রীমুখের বাণী বলিয়া মহাশক্তিপূর্ণ এবং তজ্জন্যই নিশ্চিত সর্বদেশে আপনাদের ঐশী শক্তি বিকাশ করিবে। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ মহাপুরুষগণ অবতীর্ণ হন—তাঁহাদের জন্ম-কর্ম অলৌকিক এবং তাঁহাদের প্রচারকার্যও অত্যাশ্চর্য।
আর আমরা? যে দরিদ্র ব্রাহ্মণকুমার আমাদিগকে স্বীয় জন্ম দ্বারা পবিত্র, কর্ম দ্বারা উন্নত এবং বাণী দ্বারা রাজজাতিরও প্রীতি-দৃষ্টি আমাদের উপর পাতিত করিয়াছেন, আমরা তাঁহার জন্য করিতেছি কি? সত্য সকল সময়ে মধুর হয় না, কিন্তু সময়বিশেষে তথাপি বলিতে হয়—আমরা কেহ কেহ বুঝিতেছি আমাদের লাভ, কিন্তু ঐ স্থানেই শেষ। ঐ উপদেশ জীবনে পরিণত করিবার চেষ্টা করাও আমাদের অসাধ্য—যে জ্ঞান-ভক্তির মহাতরঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তোলিত করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে অঙ্গ বিসর্জন করা তো দূরের কথা। যাঁহারা বুঝিয়াছেন এ খেলা, বা বুঝিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে শুধু বুঝিলে হইবে কি? বোঝার প্রমাণ কার্যে। মুখে বুঝিয়াছি বা বিশ্বাস করি—বলিলেই কি অন্যে বিশ্বাস করিবে? সকল হৃদ্গত ভাবই ফলানুমেয়; কার্যে পরিণত কর—জগৎ দেখুক।
যাঁহারা আপনাদিগকে মহাপণ্ডিত জানিয়া এই মূর্খ দরিদ্র পূজারী ব্রাহ্মণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের নিবেদন এই যে, যে দেশের এক মূর্খ পূজারী সপ্তসমুদ্রপার পর্যন্ত আপনাদের পিতৃপিতামহাগত সনাতন ধর্মের জয়ঘোষণা নিজ শক্তিবলে অত্যল্প কালেই প্রতিধ্বনিত করিল, সেই দেশের সর্বলোকমান্য শূরবীর মহাপণ্ডিত আপনারা—আপনারা ইচ্ছা করিলে আরও কত অদ্ভুত কার্য স্বদেশের, স্বজাতির কল্যাণের জন্য করিতে পারেন। তবে উঠুন, প্রকাশ হউন, দেখান মহাশক্তির খেলা—আমরা পুষ্প-চন্দন-হস্তে আপনাদের পূজার জন্য দাঁড়াইয়া আছি। আমরা মূর্খ, দরিদ্র, নগণ্য, বেশমাত্র-জীবী ভিক্ষুক; আপনারা মহারাজ, মহাবল, মহাকুল-প্রসূত, সর্ববিদ্যাশ্রয়—আপনারা উঠুন, অগ্রণী হউন, পথ দেখান, জগতের হিতের জন্য সর্বত্যাগ দেখান, আমরা দাসের ন্যায় পশ্চাদ্গমন করি। আর যাঁহারা শ্রীরামকৃষ্ণনামের প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবে, দাসজাতিসুলভ ঈর্ষা ও দ্বেষে জর্জরিত-কলেবর হইয়া বিনা কারণে বিনা অপরাধে নিদারুণ বৈর প্রকাশ করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে—হে ভাই, তোমাদের এ চেষ্টা বৃথা। যদি এই দিগদিগন্তব্যাপী মহাতরঙ্গ—যাহার শুভ্রশিখরে এই মহাপুরুষমূর্তি বিরাজ করিতেছেন—আমাদের ধন, জন বা প্রতিষ্ঠা-লাভের উদ্যোগের ফল হয়, তাহা হইলে তোমাদের বা অপর কাহারও চেষ্টা করিতে হইবে না, মহামায়ার অপ্রতিহত নিয়মপ্রভাবে অচিরাৎ এ তরঙ্গ মহাজলে অনন্তকালের জন্য লীন হইয়া যাইবে; আর যদি জগদম্বা-পরিচালিত মহাপুরুষের নিঃস্বার্থ প্রেমোচ্ছ্বাসরূপ এই বন্যা জগৎ উপপ্লাবিত করিতে আরম্ভ করিয়া থাকে, তবে হে ক্ষুদ্র মানব, তোমার কি সাধ্য মায়ের শক্তিসঞ্চার রোধ কর?
*************************************************************************************************************
ঈশা-অনুসরণ
[স্বামীজী আমেরিকা যাইবার বহুপূর্বে বাঙলা ১২৯৬ সালে, অধুনালুপ্ত ‘সাহিত্য- কল্পদ্রুম’ নামক মাসিক পত্রে ‘Imitation of Christ’ নামক জগদ্বিখ্যাত পুস্তকের ‘ঈশা-অনুসরণ’ নাম দিয়া অনুবাদ করিতে আরম্ভ করেন। উক্ত পত্রের ১ম বর্ষের ১ম হইতে ৫ম সংখ্যা অবধি অনুবাদের ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদটি পর্যন্ত প্রকাশিত হইয়াছিল।আমরা সমুদয় (প্রকাশিত) অনুবাদটিই এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিলাম। সূচনাটি স্বামীজীর মৌলিক রচনা।]
সূচনা
‘খ্রীষ্টের অনুসরণ’ নামক এই পুস্তক সমগ্র খ্রীষ্টজগতের অতি আদরের ধন। এই মহাপুস্তক কোন ‘রোম্যান ক্যাথলিক’ সন্ন্যাসীর লিখিত—লিখিত বলিলে ভুল হয়, ইহার প্রত্যেক অক্ষর উক্ত ঈশা-প্রেমে সর্বত্যাগী মহাত্মার হৃদয়ের শোণিতবিন্দুতে মুদ্রিত। যে মহাপুরুষের জ্বলন্ত জীবন্ত বাণী আজি চারি শত বৎসর কোটি কোটি নরনারীর হৃদয় অদ্ভুত মোহিনীশক্তিবলে আকৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, রাখিতেছে এবং রাখিবে, যিনি আজি প্রতিভা ও সাধনবলে কত শত সম্রাটেরও নমস্য হইয়াছেন, যাঁহার অলৌকিক পবিত্রতার নিকটে পরস্পরে সতত যুধ্যমান অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত খ্রীষ্ট-সমাজ চিরপুষ্ট বৈষম্য পরিত্যাগ করিয়া মস্তক অবনত করিয়া রহিয়াছে—তিনি এ পুস্তকে আপনার নাম দেন নাই। দিবেন বা কেন? যিনি সমস্ত পার্থিব ভোগ এবং বিলাসকে, ইহজগতের সমুদয় মান-সম্ভ্রমকে বিষ্ঠার ন্যায় ত্যাগ করিয়াছিলেন—তিনি কি সামান্য নামের ভিখারী হইতে পারেন? পরবর্তী লোকেরা অনুমান করিয়া ‘টমাস আ কেম্পিস্’ নামক একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসীকে গ্রন্থকার স্থির করিয়াছেন, কতদূর সত্য ঈশ্বর জানেন। যিনিই হউন, তিনি যে জগতের পূজ্য তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
এখন আমরা খ্রীষ্টিয়ান রাজার প্রজা। রাজ-অনুগ্রহে বহুবিধ-নামধারী স্বদেশী বিদেশী খ্রীষ্টিয়ান দেখিলাম। দেখিতেছি, যে মিশনরী মহাপুরুষেরা ‘অদ্য যাহা আছে খাও, কল্যকার জন্য ভাবিও না’ প্রচার করিয়া আসিয়াই আগামী দশ বৎসরের হিসাব এবং সঞ্চয়ে ব্যস্ত—দেখিতেছি, ‘যাঁহার মাথা রাখিবার স্থান নাই’ তাঁহার শিষ্যেরা—তাঁহার প্রচারকেরা বিলাসে মণ্ডিত হইয়া, বিবাহের বরটি সাজিয়া, এক পয়সার মা-বাপ হইয়া ঈশার জ্বলন্ত ত্যাগ, অদ্ভুত নিঃস্বার্থতা প্রচার করিতে ব্যস্ত, কিন্তু প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান দেখিতেছি না। এ অদ্ভুত বিলাসী, অতি দাম্ভিক, মহা অত্যাচারী, বেরুস এবং ব্রুমে চড়া, প্রোটেষ্ট্যাণ্ট খ্রীষ্টিয়ান সম্প্রদায় দেখিয়া খ্রীষ্টিয়ান সম্বন্ধে আমাদের যে অতি কুৎসিত ধারণা হইয়াছে, এই পুস্তক পাঠ করিলে তাহা সম্যক্রূপে দূরীভূত হইবে।
‘সব্ সেয়ানকী এক মত’—সকল যথার্থ জ্ঞানীরই একপ্রকার মত। পাঠক এই পুস্তক পড়িতে পড়িতে গীতায় ভগবদুক্ত ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ উপদেশের শত শত প্রতিধ্বনি দেখিতে পাইবেন। দীনতা, আর্তি এবং দাস্যভক্তির পরাকাষ্ঠা এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে মুদ্রিত এবং পাঠ করিতে করিতে জ্বলন্ত বৈরাগ্য, অত্যদ্ভুত আত্মসমর্পণ এবং নির্ভরের ভাবে হৃদয় উদ্বেলিত হইবে। যাঁহারা অন্ধ গোঁড়ামির বশবর্তী হইয়া খ্রীষ্টিয়ানের লেখা বলিয়া এ পুস্তককে অশ্রদ্ধা করিতে চাহেন, তাঁহাদিগকে ন্যায়দর্শনের একটি সূত্র বলিয়া ক্ষান্ত হইবঃ ‘আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’—সিদ্ধপুরুষদিগের উপদেশ প্রামাণ্য এবং তাহারই নাম শব্দপ্রমাণ। এস্থলে ভাষ্যকর ঋষি বাৎস্যায়ন৮ বলিতেছেন যে, এই আপ্ত পুরুষ আর্য এবং ম্লেচ্ছ উভয়ত্রই সম্ভব।
যদি ‘যবনাচার্য’ প্রভৃতি গ্রীক জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ পুরাকালে আর্যদিগের নিকট এতাদৃশ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ভক্তসিংহের পুস্তক যে এদেশে আদর পাইবে না, তাহা বিশ্বাস হয় না।
যাহা হউক, এই পুস্তকের বঙ্গানুবাদ আমরা পাঠকগণের সমক্ষে ক্রমে ক্রমে উপস্থিত করিব। আশা করি, রাশি রাশি অসার নভেল-নাটকে বঙ্গের সাধারণ পাঠক যে সময় নিয়োজিত করেন, তাহার শতাংশের একাংশ ইহাতে প্রয়োগ করিবেন।
অনুবাদ যতদূর সম্ভব অবিকল করিবার চেষ্টা করিয়াছি—কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি, বলিতে পারি না। যে-সকল বাক্য ‘বাইবেল’-সংক্রান্ত কোন বিষয়ের উল্লেখ করে, নিম্নে তাহার টীকা প্রদত্ত হইবে। কিমধিকমিতি!
প্রথম পরিচ্ছেদ
খ্রীষ্টের অনুসরণ’ এবং সংসার ও যাবতীয় সাংসারিক অন্তঃসারশূন্য পদার্থে ঘৃণা
১। প্রভু বলিতেছেন, ‘যে কেহ আমার অনুগমন করে, সে অন্ধকারে পদক্ষেপ করিবে না।’৯
যদ্যপি আমরা যথার্থ আলোক প্রাপ্ত হইবার ইচ্ছা করি এবং সকল প্রকার হৃদয়ের অন্ধকার হইতে মুক্ত হইবার বাসনা করি, তাহা হইলে খ্রীষ্টের এই কয়েকটি কথা স্মরণ করাইতেছে যে, তাঁহার জীবন ও চরিত্রের অনুকরণ আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য।
অতএব ঈশার জীবন মনন করা আমাদের প্রধান কর্তব্য।১০
২। তিনি যে শিক্ষা দিয়াছেন, তাহা অন্য সকল মহাত্মাপ্রদত্ত শিক্ষাকে অতিক্রম করে এবং যিনি পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত, তিনি ইহারই মধ্যে লুক্কায়িত ‘মান্না’১১ প্রাপ্ত হইবেন।
কিন্তু এ প্রকার অনেক সময়ে হয় যে, অনেকেই খ্রীষ্টের সুসমাচার বারংবার শ্রবণ করিয়াও তাহা লাভের জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করে না, কারণ তাহারা খ্রীষ্টের আত্মার দ্বারা অনুপ্রাণিত নহে। অতএব যদ্যপি তুমি আনন্দ-হৃদয়ে এবং সম্পূর্ণভাবে খ্রীষ্ট-বাক্যতত্ত্বে অনুপ্রবেশ করিতে চাও, তাহা হইলে তাঁহার জীবনের সহিত তোমার জীবনের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য-স্থাপনের জন্য সমধিক যত্নশীল হও।১২
৩। ‘ত্রিত্ববাদ’১৩ সম্বন্ধে গভীর গবেষণায় তোমার কি লাভ হইবে, যদি সেই সমস্ত সময় তোমার নম্রতার অভাব সেই ঐশ্বরিক ত্রিত্বকে অসন্তুষ্ট করে?
নিশ্চয়ই উচ্চ বাক্যচ্ছটা মনুষ্যকে পবিত্র এবং অকপট করিতে পারে না; কিন্তু ধার্মিক জীবন তাহাকে ঈশ্বরের প্রিয় করে।১৪
অনুতাপে হৃদয়শল্য বরং ভোগ করিব—তাহার সর্বলক্ষণাক্রান্ত বর্ণনা জানিতে চাহি না।
যদি সমগ্র বাইবেল এবং সমস্ত দার্শনিকদিগের মত তোমার জানা থাকে, তাহাতে তোমার কি লাভ হইবে, যদি তুমি ঈশ্বরের প্রেম এবং কৃপা-বিহীন হও?১৫
‘অসার হইতেও অসার, সকলেই অসার; সার একমাত্র তাঁহাকে ভালবাসা, সার একমাত্র তাঁহার সেবা।’১৬
তখনই সর্বোচ্চ জ্ঞান তোমার হইবে, যখন তুমি স্বর্গরাজ্য প্রাপ্ত হইবার জন্য সংসারকে ঘৃণা করিবে।
৪। অসারতা—অতএব ধন অন্বেষণ করা এবং সেই নশ্বর পদার্থে বিশ্বাস স্থাপন করা।
অসারতা—অতএব মান অন্বেষণ করা ও উচ্চ পদলাভের চেষ্টা করা।
অসারতা—অতএব শারীরিক বাসনার অনুবর্তী হওয়া এবং যাহা অন্তে কঠিন দণ্ড ভোগ করাইবে তাহার জন্য ব্যাকুল হওয়া।
অসারতা—অতএব জীবনের সদ্ব্যবহারের চেষ্টা না করিয়া দীর্ঘজীবন লাভের ইচ্ছা করা।
অসারতা—অতএব পরকালের সম্বলের চেষ্টা না করিয়া কেবল ইহজীবনের বিষয় চিন্তা করা।
অসারতা—অতএব যথায় অবিনাশী আনন্দ বিরাজমান, দ্রতবেগে সে স্থানে উপস্থিত হইবার চেষ্টা না করিয়া অতিশীঘ্র-বিনাশশীল বস্তুকে ভালবাসা।
৫। উপদেশকের এ বাক্য সর্বদা স্মরণ কর—‘চক্ষু দেখিয়া তৃপ্ত হয় না, কর্ণ শ্রবণ করিয়া তৃপ্ত হয় না।’১৭
পরিদৃশ্যমান পার্থিব পদার্থ হইতে মনের অনুরাগকে উপরত করিয়া অদৃশ্য রাজ্যে হৃদয়ের সমুদয় ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত করিতে বিশেষ চেষ্টা কর, যেহেতু ইন্দ্রিয়সকলের অনুগমন করিলে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি কলঙ্কিত হইবে এবং তুমি ঈশ্বরের কৃপা হারাইবে।১৮
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আপনার জ্ঞান সম্বন্ধে হীনভাব
১। সকলেই স্বভাবত জ্ঞানলাভের ইচ্ছা করে, কিন্তু ঈশ্বরের ভয় না থাকিলে সে জ্ঞানে লাভ কি?
আপনার আত্মার কল্যাণচিন্তা পরিত্যাগ করিয়া যিনি নক্ষত্রমণ্ডলীর গতিবিধি পর্যালোচনা করিতে ব্যস্ত, সেই গর্বিত পণ্ডিত অপেক্ষা কি—যে দীন কৃষক বিনীতভাবে ঈশ্বরের সেবা করে, সে নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ নহে?
যিনি আপনাকে উত্তমরূপে জানিয়াছেন, তিনিই আপনার চক্ষে আপনি অতি হীন এবং তিনি মনুষ্যের প্রশংসাতে অণুমাত্রও আনন্দিত হইতে পারেন না। যদি আমি জগতের সমস্ত বিষয়ই জানি, কিন্তু আমার নিঃস্বার্থ সহানুভূতি না থাকে, তাহা হইলে যে ঈশ্বর আমার কর্মানুসারে আমার বিচার করিবেন, তাঁহার সমক্ষে আমার জ্ঞান কোন্ উপকারে আসিবে?
২। অত্যন্ত জ্ঞান-লালসাকে পরিত্যাগ কর, কারণ তাহা হইতে অত্যন্ত চিত্তবিক্ষেপ ও ভ্রম আগমন করে।
পণ্ডিত হইলেই বিদ্যা প্রকাশ করিতে এবং প্রতিভাশালী বলিয়া কথিত হইতে বাসনা হয়।
এ প্রকার অনেক বিষয় আছে, যদ্বিষয়ক জ্ঞান আধ্যাত্মিক কোন উপকারে আইসে না এবং তিনি অতি মূর্খ, যিনি যে-সকল বিষয় তাঁহার পরিত্রাণের সহায়তা করিবে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া এই-সকল বিষয়ে মন নিবিষ্ট করেন।
বহু বাক্যে আত্মা তৃপ্ত হয় না, পরন্তু সাধুজীবন অন্তঃকরণে শান্তি প্রদান করে এবং পবিত্র বুদ্ধি ঈশ্বরে সমধিক নির্ভর স্থাপিত করে।
৩। তোমার জ্ঞান এবং ধারণাশক্তি যে পরিমাণে অধিক, তোমার তত কঠিন বিচার হইবে, যদি সমধিক জ্ঞানের ফলস্বরূপ তোমার জীবনও সমধিক পবিত্র না হয়।
অতএব, তোমার দক্ষতা এবং বিদ্যার জন্য বহুপ্রশংসিত হইতে ইচ্ছা করিও না; বরং যে জ্ঞান তোমাকে প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাকে ভয়ের কারণ বলিয়া জান।
যদি এ প্রকার চিন্তা আইসে যে, তুমি বহু বিষয় জান এবং বিলক্ষণ বুঝ, স্মরণ রাখিও—যে-সকল বিষয় তুমি জান না, তাহারা সংখ্যায় অনেক অধিক।
জ্ঞানগর্বে স্ফীত হইও না, বরং আপনার অজ্ঞতা স্বীকার কর। তোমা অপেক্ষা কত পণ্ডিত রহিয়াছে, ঈশ্বরাদিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞানে তোমা অপেক্ষা কত অভিজ্ঞ লোক রহিয়াছে। ইহা দেখিয়াও কেন তুমি অপরের পূর্বদান অধিকার করিতে চাও?
যদি নিজ কল্যাণপ্রদ কোন বিষয় জানিতে এবং শিখিতে চাও, জগতের নিকট অপরিচিত এবং অকিঞ্চিৎকর থাকিতে ভালবাস।
৪। আপনাকে আপনি যথার্থরূপে জানা অর্থাৎ আপনাকে অতি হীন মনে করা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এবং উৎকৃষ্ট শিক্ষা। আপনাকে নীচ মনে করা এবং অপরকে সর্বদা শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং তাহার মঙ্গল কামনা করাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সম্পূর্ণতার চিহ্ন।
যদি দেখ, কেহ প্রকাশ্যরূপে পাপ করিতেছে অথবা কেহ কোন অপরাধ করিতেছে, তথাপি আপনাকে উৎকৃষ্ট বলিয়া জানিও না।
আমাদের সকলেরই পতন হইতে পারে; তথাপি তোমার দৃঢ় ধারণা থাকা উচিত যে, তোমা অপেক্ষা অধিক দুর্বল কেহই নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সত্যের শিক্ষা
১। সুখী সেই মনুষ্য, সাঙ্কেতিক চিহ্ন এবং নশ্বর শব্দ পরিত্যাগ করিয়া সত্য স্বয়ং ও স্ব-স্বরূপে যাহাকে শিক্ষা দেয়।
আমাদিগের মত এবং ইন্দ্রিয়সকল প্রায়শ আমাদিগকে প্রতারিত করে; কারণ বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বে আমাদের দৃষ্টির গতি অতি অল্প।
গুপ্ত এবং গূঢ় বিষয়সকল ক্রমাগত অনুসন্ধান করিয়া লাভ কি? তাহা না জানার জন্য শেষ বিচারদিনে১৯ আমরা নিন্দিত হইব না।
উপকারক ও আবশ্যক বস্তু পরিত্যাগ করিয়া স্ব-ইচ্ছায় যাহা কেবল কৌতূহল উদ্দীপিত করে এবং অপকারক—এ প্রকার বিষয়ের অনুসন্ধান করা অতি নির্বোধের কার্য; চক্ষু থাকিতেও আমরা দেখিতেছি না!
২। ন্যায়শাস্ত্রীয় পদার্থ-বিচারে আমরা কেন ব্যাপৃত থাকি? তিনিই বহু সন্দেহপূর্ণ তর্ক হইতে মুক্ত হয়েন, সনাতন বাণী২০যাঁহাকে উপদেশ করেন।
সেই অদ্বিতীয় বাণী হইতে সকল পদার্থ বিনিঃসৃত হইয়াছে, সকল পদার্থ তাঁহাকেই নির্দেশ করিতেছে; তিনিই আদি, তিনিই আমাদিগকে উপদেশ করেন।
তাঁহাকে ছাড়িয়া কেহ কিছু বুঝিতে পারে না অথবা কোন বিষয়ে যথার্থ বিচার করিতে পারে না।
তিনিই অচলভাবে প্রতিষ্ঠিত—তিনিই ঈশ্বরে সংস্থিত, যাঁহার উদ্দেশ্য একটি মাত্র, যিনি সকল পদার্থ এক অদ্বিতীয় কারণে নির্দেশ করেন এবং যিনি এক জ্যোতিতে সমস্ত পদার্থ দর্শন করেন।
হে ঈশ্বর, হে সত্য, অনন্ত প্রেমে আমাকে তোমার সহিত একীভূত করিয়া লও।
বহু বিষয় পাঠ এবং শ্রবণ করিয়া আমি অতি ক্লান্ত হইয়া পড়ি; আমার সকল অভাব, সকল বাসনা তোমাতেই নিহিত।
আচার্যসকল নির্বাক্ হউক, জগৎ তোমার সমক্ষে স্তব্ধ হউক; প্রভো, কেবল তুমি [আমার সহিত কথা] বল।
৩। মানুষের মন যতই সংযত অন্তঃপ্রদেশ হইতে সরল হয়, ততই সে গভীর বিষয়সকলে অতি সহজে প্রবেশ করিতে পারে; কারণ তাহার মন আলোক পায়।
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের মাহাত্ম্য-প্রকাশের জন্য সকল কার্য করে, আপনার সম্বন্ধে কার্যহীন থাকে এবং সকল প্রকার স্বার্থশূন্য হয়, সেই প্রকার পবিত্র, সরল ও অটল ব্যক্তি বহু কার্য করিতে হইলেও আকুল হইয়া পড়ে না। হৃদয়ের অনুন্মূলিত আসক্তি অপেক্ষা কোন্ পদার্থ তোমায় অধিকতর বিরক্ত করে বা বাধা দেয়?
ঈশ্বরানুরাগী সাধু ব্যক্তি অগ্রে আপনার মনে যে-সকল বাহিরের কর্তব্য করিতে হইবে, তাহা নির্দিষ্ট করিয়া লন; সেই-সকল কার্য করিতে তিনি কখনও বিকৃত আসক্তি-জনিত ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হন না; পরন্তু সম্যক বিচার দ্বারা আপনার কার্যসকলকে নিয়মিত করেন।
আত্মজয়ের জন্য যিনি চেষ্টা করিতেছেন, তদপেক্ষা কঠিনতর সংগ্রাম কে করে?
আপনাকে আপনি জয় করা, দিন দিন আপনার উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং ধর্মে বর্ধিত হওয়া—ইহাই আমাদিগের একমাত্র কর্তব্য।
৪। এ জগতে সকল পূর্ণতার মধ্যেই অপূর্ণতা আছে এবং আমাদিগের কোন তত্ত্বানুসন্ধানই একেবারে সন্দেহরহিত হয় না।
গভীর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসন্ধান অপেক্ষা আপনাকে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জ্ঞান করা ঈশ্বরপ্রাপ্তির নিশ্চিত পথ।
কিন্তু বিদ্যা গুণমাত্র বলিয়া অথবা কোন বিষয়ের জ্ঞানদায়ক বলিয়া বিবেচিত হইলে নিন্দিত নহে; কারণ উহা কল্যাণপ্রদ ও ঈশ্বরাদিষ্ট।
কিন্তু ইহাই বলা হইতেছে যে, সদ্বুদ্ধি এবং সাধুজীবন বিদ্যা অপেক্ষা প্রার্থনীয়।
অনেকেই সাধু হওয়া অপেক্ষা বিদ্বান হইতে অধিক যত্ন করে; তাহার ফল এই হয় যে, অনেক সময় তাহারা কুপথে বিচরণ করে এবং তাহাদের পরিশ্রম অত্যল্প ফল উৎপাদন করে অথবা নিষ্ফল হয়।
৫। অহো! সন্দেহ উত্থাপিত করিতে মানুষ যে প্রকার যত্নশীল, পাপ উন্মূলিত করিতে ও পুণ্য রোপণ করিতে যদি সেই প্রকার হইত, তাহা হইলে পৃথিবীতে এবম্প্রকার অমঙ্গল ও পাপকার্যের বিবরণ [আলোচনা] থাকিত না এবং ধার্মিকদিগের [ধর্মসংস্থাগুলির] মধ্যে এতাদৃশী উচ্ছৃঙ্খলতা থাকিত না।
নিশ্চিত শেষ-বিচারদিনে—‘কি পড়িয়াছি’, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ‘কি করিয়াছি’ তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে। কি পটুতাসহকারে বাক্যবিন্যাস করিয়াছি, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ধর্মে কতদূর জীবন কাটাইয়াছি, তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে।
যাঁহাদের সহিত জীবদ্দশায় তুমি উত্তমরূপে পরিচিত ছিলে এবং যাঁহারা আপন আপন ব্যবসায়ে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, সেই-সকল পণ্ডিত এবং অধ্যাপকেরা কোথায় বলিতে পার?
অপরে তাঁহাদিগের স্থান অধিকার করিতেছে এবং নিশ্চিত বলিতে পারি, তাহারা তাঁহাদের বিষয় একবার চিন্তাও করে না!
জীবদ্দশায় তাঁহারা সারবান্ বলিয়া বিবেচিত হইতেন, এক্ষণে কেহ তাঁহাদের কথাও কহেন না।
৬। অহো! সাংসারিক গরিমা কি শীঘ্রই চলিয়া যায়! আহা! তাঁহাদের জীবন যদি তাঁহাদের জ্ঞানের সদৃশ হইত, তাহা হইলে বুঝিতাম যে তাঁহাদের পাঠ এবং চিন্তা কার্যের হইয়াছে।
ঈশ্বরের সেবাতে কোন যত্ন না করিয়া বিদ্যামদে এ সংসারে কত লোকই বিনষ্ট হয়!
জগতে তাহারা দীনহীন হইতে চাহে না, তাহারা মহৎ বলিয়া পরিচিত হইতে চায়; সেইজন্যই আপনার কল্পনা-চক্ষে আপনি অতি গর্বিত হয়।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যাঁহার নিঃস্বার্থ সহানুভূতি আছে।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যিনি আপনার চক্ষে আপনি অতি ক্ষুদ্র এবং উচ্চপদলাভ রূপ সম্মানকে অতি তুচ্ছ বোধ করেন।
তিনিই যথার্থ জ্ঞানী, যিনি খ্রীষ্টকে প্রাপ্ত হইবার জন্য সকল পার্থিব পদার্থকে বিষ্ঠার ন্যায় জ্ঞান করেন।
তিনিই যথার্থ পণ্ডিত, যিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হন এবং আপনার ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কার্যে বুদ্ধিমত্তা
১। প্রত্যেক প্রবাদ অথবা মনোবেগজনিত ইচ্ছাকে বিশ্বাস করা আমাদের কখনও উচিত নহে, পরন্তু সতর্কতা এবং ধৈর্যসহকারে উক্ত বিষয়ের ঈশ্বরের সহিত সম্বন্ধ বিচার করিবে।
আহা! আমরা এমনি দুর্বল যে, আমরা প্রায়ই অতি সহজে অপরের সুখ্যাতি অপেক্ষা নিন্দা বিশ্বাস করি এবং রটনা করি। যাঁহারা পবিত্রতায় উন্নত, তাঁহারা সহসা সকল মন্দ প্রবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন না; কারণ তাঁহারা জানেন যে, মনুষ্যের দুর্বলতা মনুষ্যকে অপরের মন্দ রটাইতে এবং মিথ্যা বলিতে অত্যন্ত প্রবণ করে।
২। যিনি কার্যে হঠকারী নহেন এবং সবিশেষ বিপরীত প্রমাণ সত্ত্বে (থাকিলে) আপন মতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন না, যিনি যাহাই শুনেন তাহাই বিশ্বাস করেন না এবং শুনিলেও তাহা তৎক্ষণাৎ রটনা করেন না, তিনি অতি বুদ্ধিমান্।
৩। বুদ্ধিমান্ ও সদ্বিবেচক লোকদিগের নিকট হইতে উপদেশ অন্বেষণ করিবে এবং নিজ বুদ্ধির অনুসরণ না করিয়া তোমা অপেক্ষা যাঁহারা অধিক জানেন, তাঁহাদের দ্বারা উপদিষ্ট হওয়া উত্তম বিবেচনা করিবে।
সাধুজীবন মনুষ্যকে ঈশ্বরের গণনায় বুদ্ধিমান্ করে এবং এই প্রকার ব্যক্তি যথার্থ বহুদর্শন লাভ করে। যিনি আপনাকে আপনি যত অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জানেন এবং যিনি যত পরিমাণে ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন, তিনি সর্বদা তত পরিমাণে বুদ্ধিমান্ এবং শান্তিপূর্ণ হইবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
শাস্ত্রপাঠ
১। সত্যের অনুসন্ধান শাস্ত্রে করিতে হইবে, বাক্চাতুর্যে নহে। যে পরমাত্মার প্রেরণায় বাইবেল লিখিত হইয়াছে, তাহারই সাহায্যে বাইবেল সর্বদা পড়া উচিত।২১
শাস্ত্রপাঠকালে কূটতর্ক পরিত্যাগ করিয়া আমাদের কল্যাণমাত্র অনুসন্ধান করা কর্তব্য।
যে-সকল পুস্তকে পাণ্ডিত্যসহকারে এবং গভীরভাবে প্রস্তাবিত বিষয় লিখিত আছে, তাহা পড়িতে আমাদের যে-প্রকার আগ্রহ, অতি সরলভাবে লিখিত যে-কোন ভক্তির গ্রন্থে সেই প্রকার আগ্রহ থাকা উচিত।
গ্রন্থকারের প্রসিদ্ধি অথবা অপ্রসিদ্ধি যেন তোমার মনকে বিচলিত না করে। কেবল সত্যের প্রতি তোমার ভালবাসা দ্বারা পরিচালিত হইয়া তুমি পাঠ কর।২২
‘কে লিখিয়াছে’ সে তত্ত্ব না লইয়া ‘কি লিখিয়াছে’ তাহাই যত্নপূর্বক বিচার করা উচিত।
২। মানুষ চলিয়া যায়, কিন্তু ঈশ্বরের সত্য চিরকাল থাকে।
নানারূপে ঈশ্বর আমাদিগকে বলিতেছেন, তাঁহার কাছে ব্যক্তিবিশেষের আদর নাই।
অনেক সময় শাস্ত্র পড়িতে পড়িতে যে-সকল কথা আমাদের কেবল দেখিয়া যাওয়া উচিত, সেই-সকল কথার মর্মভেদ ও আলোচনা করিবার জন্য আমরা ব্যগ্র হইয়া পড়ি। এই প্রকারে আমাদের কৌতূহল আমাদের অনেক সময় বাধা দেয়।
যদি উপকার বাঞ্ছা কর, নম্রতা সরলতা ও বিশ্বাসের সহিত পাঠ কর এবং কখনও পণ্ডিত বলিয়া পরিচিত হইবার বাসনা রাখিও না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অত্যন্ত আসক্তি
১। যখন কোন মানুষ কোন বস্তুর জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়, তখনই তাহার আভ্যন্তরিক শান্তি নষ্ট হয়।২৩
অভিমানী এবং লোভীরা কখনও শান্তি পায় না, কিন্তু অকিঞ্চন এবং বিনীত লোকেরা সদা শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করে। যে মানুষ স্বার্থ সম্বন্ধে এখনও সম্পূর্ণ মৃত হয় নাই, সে শীঘ্রই প্রলোভিত হয় এবং অতি সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর বিষয়সকল তাহাকে পরাভূত করে।২৪
যাহার আত্মা দুর্বল ও এখনও কিয়ৎপরিমাণে ইন্দ্রিয়ের বশীভূত এবং যে-সকল পদার্থ কালে উৎপন্ন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভবের উপর যাহাদের সত্তা বিদ্যমান, সেই-সকল বিষয়ে আসক্তিসম্পন্ন পার্থিব বাসনা হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করা তাহার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। সেই জন্যই যখন সে অনিত্য পদার্থসকল কোনরূপে পরিত্যাগ করে, তখনও সর্বদা তাহার মন বিমর্ষ থাকে এবং কেহ তাহাকে বাধা দিলে সহজেই ক্রুদ্ধ হয়।
তাহার উপর যদি সে কামনার অনুগমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার মন পাপের ভার অনুভব করে; কারণ যে শান্তি সে অনুসন্ধান করিতেছিল, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরাভূত হইয়া তাহার দিকে আর সে অগ্রসর হইতে পারিল না।
অতএব মনের যথার্থ শান্তি ইন্দ্রিয়জয়ের দ্বারাই হয়; ইন্দ্রিয়ের অনুগমন করিলে হয় না। অতএব যে ব্যক্তি সুখাভিলাষী, তাহার হৃদয়ে শান্তি নাই; যে ব্যক্তি অনিত্য বাহ্য বিষয়ের অনুসরণ করে, তাহারও মনে শান্তি নাই; কেবল যিনি আত্মারাম এবং যাঁহার অনুরাগ তীব্র, তিনিই শান্তি ভোগ করেন।২৫
*************************************************************************************************************
বর্তমান সমস্যা
[‘উদ্বোধন’-এর প্রস্তাবনা]
ভারতের প্রাচীন ইতিবৃত্ত—এক দেবপ্রতিম জাতির অলৌকিক উদ্যম, বিচিত্র চেষ্টা, অসীম উৎসাহ, অপ্রতিহত শক্তিসংঘাত ও সর্বাপেক্ষা অতি গভীর চিন্তাশীলতায় পরিপূর্ণ। ইতিহাস অর্থাৎ রাজা-রাজড়ার কথা ও তাঁহাদের কাম-ক্রোধ-ব্যসনাদির দ্বারা কিয়ৎকাল পরিক্ষুব্ধ, তাঁহাদের সুচেষ্টা-কুচেষ্টায় সাময়িক বিচলিত সামাজিক চিত্র হয়তো প্রাচীন ভারতে একেবারেই নাই। কিন্তু ক্ষুৎপিপাসা-কাম-ক্রোধাদি-বিতাড়িত, সৌন্দর্যতৃষ্ণাকৃষ্ট ও মহান্ অপ্রতিহতবুদ্ধি, নানাভাব-পরিচালিত একটি অতি বিস্তীর্ণ জনসঙ্ঘ, সভ্যতার উন্মেষের প্রায় প্রাক্কাল হইতেই নানাবিধ পথ অবলম্বন করিয়া যে স্থানে সমুপস্থিত হইয়াছিলেন—ভারতের ধর্মগ্রন্থরাশি, কাব্যসমুদ্র, দর্শনসমূহ ও বিবিধ বৈজ্ঞানিক তন্ত্রশ্রেণী, প্রতি ছত্রে তাঁহার প্রতি পদবিক্ষেপ, রাজাদিপুরুষবিশেষবর্ণনাকারী পুস্তকনিচয়াপেক্ষা লক্ষগুণ স্ফুটীকৃতভাবে দেখাইয়া দিতেছে। প্রকৃতির সহিত যুগযুগান্তরব্যাপী সংগ্রামে তাঁহারা যে রাশীকৃত জয়পতাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আজ জীর্ণ ও বাত্যাহত হইয়াও সেগুলি প্রাচীন ভারতের জয় ঘোষণা করিতেছে।
এই জাতি মধ্য-এশিয়া, উত্তর ইওরোপ বা সুমেরু-সন্নিহিত হিমপ্রধান প্রদেশ হইতে শনৈঃ-পদসঞ্চারে পবিত্র ভারতভূমিকে তীর্থরূপে পরিণত করিয়াছিলেন বা এই তীর্থভূমিই তাঁহাদের আদিম নিবাস—এখনও জানিবার উপায় নাই।
অথবা ভারতমধ্যস্থ বা ভারতবহির্ভূত-দেশবিশেষনিবাসী একটি বিরাট জাতি নৈসর্গিক নিয়মে স্থান ভ্রষ্ট হইয়া ইওরোপাদি ভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছেন এবং তাঁহারা শ্বেতকায় বা কৃষ্ণকায়, নীলচক্ষু বা কৃষ্ণচক্ষু, কৃষ্ণকেশ বা হিরণ্যকেশ ছিলেন—কতিপয় ইওরোপীয় জাতির ভাষার সহিত সংস্কৃত ভাষার সাদৃশ্য ব্যতিরেকে, এই-সকল সিদ্ধান্তের আর কোন প্রমাণ নাই। আধুনিক ভারতবাসী তাঁহাদের বংশধর কিনা, অথবা ভারতের কোন্ জাতি কত পরিমাণে তাঁহাদের শোণিত বহন করিতেছেন, এ-সকল প্রশ্নেরও মীমাংসা সহজ নহে।
অনিশ্চিতত্বেও আমাদের বিশেষ ক্ষতি নাই।
তবে যে জাতির মধ্যে সভ্যতার উন্মীলন হইয়াছে, যেথায় চিন্তাশীলতা পরিস্ফুট হইয়াছে, সেই স্থানে লক্ষ লক্ষ তাঁহাদের বংশধর—মানসপুত্র—তাঁহাদের ভাবরাশির, চিন্তারাশির উত্তরাধিকারী উপস্থিত। নদী, পর্বত, সমুদ্র, উল্লঙ্খন করিয়া, দেশকালের বাধা যেন তুচ্ছ করিয়া, সুপরিস্ফুট বা অজ্ঞাত অনির্বচনীয় সূত্রে ভারতীয় চিন্তারুধির অন্য জাতির ধমনীতে পঁহুছিয়াছে এবং এখনও পঁহুছিতেছে।
হয়তো আমাদের ভাগে সার্বভৌম পৈতৃক সম্পত্তি কিছু অধিক।
ভূমধ্যসাগরের পূর্বকোণে সুঠাম সুন্দর দ্বীপমালা-পরিবেষ্টিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-বিভূষিত একটি ক্ষুদ্র দেশে অল্পসংখ্যক অথচ সর্বাঙ্গসুন্দর, পূর্ণাবয়ব অথচ দৃঢ়স্নায়ুপেশীসমন্বিত, লঘুকায় অথচ অটল-অধ্যাবসায়-সহায়, পার্থিব সৌন্দর্যসৃষ্টির একাধিরাজ, অপূর্ব ক্রিয়াশীল, প্রতিভাশালী এক জাতি ছিলেন। অন্যান্য প্রাচীন জাতিরা ইঁহাদিগকে ‘যবন’ বলিত; ইহাদের নিজ নাম—গ্রীক।
মনুষ্য-ইতিহাসে এই মুষ্টিমেয় অলৌকিক বীর্যশালী জাতি এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। যে দেশে মনুষ্য পার্থিব বিদ্যায়—সমাজনীতি, যুদ্ধনীতি, দেশশাসন, ভাস্কর্যাদি শিল্পে—অগ্রসর হইয়াছেন বা হইতেছেন, সেই স্থানেই প্রাচীন গ্রীসের ছায়া পড়িয়াছে। প্রাচীন কালের কথা ছাড়িয়া দেওযা যাউক, আমরা আধুনিক বাঙ্গালী—আজ অর্ধশতাব্দী ধরিয়া ঐ যবন গুরুদিগের পদানুসরণ করিয়া ইওরোপীয় সাহিত্যের মধ্য দিয়া তাঁহাদের যে আলোটুকু আসিতেছে, তাহারই দীপ্তিতে আপনাদিগের গৃহ উজ্জ্বলিত করিয়া স্পর্ধা অনুভব করিতেছি।
সমগ্র ইওরোপ আজ সর্ববিষয়ে প্রাচীন গ্রীসের ছাত্র এবং উত্তরাধিকারী; এমন কি, একজন ইংলণ্ডীয় পণ্ডিত বলিয়াছেন, ‘যাহা কিছু প্রকৃতি সৃষ্টি করেন নাই, তাহা গ্রীক মনের সৃষ্টি।’
সুদূরস্থিত বিভিন্নপর্বত-সমুৎপন্ন এই দুই মহানদীর মধ্যে মধ্যে সঙ্গম উপস্থিত হয়; এবং যখন ঐ প্রকার ঘটনা ঘটে, তখনই জনসমাজে এক মহা আধ্যাত্মিক তরঙ্গে উত্তোলিত সভ্যতা-রেখা সুদূর-সম্প্রসারিত [হয়] এবং মানবমধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ়তর হয়।
অতি প্রাচীনকালে একবার ভারতীয় দর্শনবিদ্যা গ্রীক উৎসাহের সম্মিলনে রোমক, ইরানী প্রভৃতি মহা-জাতিবর্গের অভ্যুদয় সূত্রিত করে। সিকন্দরসাহের দিগ্বিজয়ের পর এই দুই মহাজলপ্রপাতের সংঘর্ষে প্রায় অর্ধ ভূভাগ ঈশাদি-নামাখ্যাত অধ্যাত্ম-তরঙ্গরাজি উপপ্লাবিত করে। আরবদিগের অভ্যুদয়ের সহিত পুনরায় ঐ প্রকার মিশ্রণ আধুনিক ইওরোপীয় সভ্যতার ভিত্তিস্থাপন করে এবং বোধ হয়, আধুনিক সময়ে পুনর্বার ঐ দুই মহাশক্তির সম্মিলন-কাল উপস্থিত।
এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ।
ভারতের বায়ু শান্তিপ্রধান, যবনের প্রাণ শক্তিপ্রধান; একের গভীর চিন্তা, অপরের অদম্য কার্যকারিতা; একের মূলমন্ত্র ‘ত্যাগ’, অপরের ‘ভোগ’; একের সর্বচেষ্টা অন্তর্মুখী, অপরের বহির্মুখী; একের প্রায় সর্ববিদ্যা অধ্যাত্ম, অপরের অধিভূত; একজন মুক্তিপ্রিয়, অপর স্বাধীনতাপ্রাণ; একজন ইহলোক-কল্যাণলাভে নিরুৎসাহ, অপর এই পৃথিবীকে স্বর্গভূমিতে পরিণত করিতে প্রাণপণ; একজন নিত্যসুখের আশায় ইহলোকের অনিত্য সুখকে উপেক্ষা করিতেছেন, অপর নিত্যসুখে সন্দিহান হইয়া বা দূরবর্তী জানিয়া যথাসম্ভব ঐহিক সুখলাভে সমুদ্যত।
এ যুগে পূর্বোক্ত জাতিদ্বয়ই অন্তর্হিত হইয়াছেন, কেবল তাঁহাদের শারীরিক বা মানসিক বংশধরেরা বর্তমান।
ইওরোপ-আমেরিকা যবনদিগের সমুন্নত মুখোজ্জ্বলকারী সন্তান; আধুনিক ভারতবাসী আর্যকুলের গর্ব নহেন।
কিন্তু ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় এই আধুনিক ভারতবাসীতেও অন্তর্নিহিত পৈতৃক শক্তি বিদ্যমান। যথাকালে মহাশক্তির কৃপায় তাহার পুনঃস্ফুরণ হইবে।
প্রস্ফুরিত হইয়া কি হইবে?
পুনর্বার কি বৈদিক যজ্ঞধূমে ভারতের আকাশ তরলমেঘাবৃত প্রতিভাত হইবে, বা পশুরক্তে রন্তিদেবের কীর্তির পুনরুদ্দীপন হইবে? গোমেধ, অশ্বমেধ, দেবরের দ্বারা সুতোৎপত্তি আদি প্রাচীন প্রথা পুনরায় কি ফিরিয়া আসিবে বা বৌদ্ধোপপ্লাবনে পুনর্বার সমগ্র ভারত একটি বিস্তীর্ণ মঠে পরিণত হইবে? মনুর শাসন পুনরায় কি অপ্রতিহত-প্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হইবে বা দেশভেদে বিভিন্ন ভক্ষ্যাভক্ষ্য-বিচারই আধুনিক কালের ন্যায় সর্বতোমুখী প্রভুতা উপভোগ করিবে? জাতিভেদ বিদ্যমান থাকিবে?—গুণগত হইবে বা চিরকাল জন্মগত থাকিবে? জতিভেদে ভক্ষ্যসম্বন্ধে স্পৃষ্টাস্পৃষ্ট-বিচার বঙ্গদেশের ন্যায় থাকিবে, বা মান্দ্রাজাদির ন্যায় কঠোরতর রূপ ধারণ করিবে, অথবা পঞ্জাবাদি প্রদেশের ন্যায় একেবারে তিরোহিত হইয়া যাইবে? বর্ণভেদে যৌন২৬ সম্বন্ধ মনূক্ত ধর্মের ন্যায় এবং নেপালাদি দেশের ন্যায় অনুলোমক্রমে পুনঃপ্রচলিত হইবে বা বঙ্গাদি দেশের ন্যায় একবর্ণ-মধ্যে অবান্তর বিভাগেও প্রতিবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিবে? এ-সকল প্রশ্নের সিদ্ধান্ত করা অতীব দুরূহ। দেশভেদে, এমন কি, একই দেশে জাতি এবং বংশভেদে আচারের ঘোর বিভিন্নতা দৃষ্টে মীমাংসা আরও দুরূহতর প্রতীত হইতেছে।
তবে হইবে কি?
যাহা আমাদের নাই, বোধ হয় পূর্বকালেও ছিল না। যাহা যবনদিগের ছিল, যাহার প্রাণস্পন্দনে ইওরোপীয় বিদ্যুদাধার হইতে ঘন ঘন মহাশক্তির সঞ্চার হইয়া ভূমণ্ডল পরিব্যাপ্ত করিতেছে, চাই তাহাই। চাই—সেই উদ্যম, সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তা, সেই আত্মনির্ভর, সেই অটল ধৈর্য, সেই কার্যকারিতা, সেই একতাবন্ধন, সেই উন্নতিতৃষ্ণা; চাই—সর্বদা-পশ্চাদ্দৃষ্টি কিঞ্চিৎ স্থগিত করিয়া অনন্ত সম্মুখসম্প্রসারিত দৃষ্টি, আর চাই—আপাদমস্তক শিরায় শিরায় সঞ্চারকারী রজোগুণ।
ত্যাগের অপেক্ষা শান্তিদাতা কে? অনন্ত কল্যাণের তুলনায় ক্ষণিক ঐহিক কল্যাণ নিশ্চিত অতি তুচ্ছ। সত্ত্বগুণাপেক্ষা মহাশক্তিসঞ্চয় আর কিসে হয়? অধ্যাত্মবিদ্যার তুলনায় আর সব ‘অবিদ্যা’—সত্য বটে, কিন্তু কয়জন এ জগতে সত্ত্বগুণ লাভ করে—এ ভারতে কয়জন? সে মহাবীরত্ব কয়জনের আছে যে, নির্মম হইয়া সর্বত্যাগী হন? সে দূরদৃষ্টি কয়জনের ভাগ্যে ঘটে, যাহাতে পার্থিব সুখ তুচ্ছ বোধ হয়? সে বিশাল হৃদয় কোথায়, যাহা সৌন্দর্য ও মহিমাচিন্তায় নিজ শরীর পর্যন্ত বিস্মৃত হয়? যাঁহারা আছেন, সমগ্র ভারতের লোকসংখ্যার তুলনায় তাঁহারা মুষ্টিমেয়।—আর এই মুষ্টিমেয় লোকের মুক্তির জন্য কোটি কোটি নরনারীকে সামাজিক আধ্যাত্মিক চক্রের নীচে নিষ্পিষ্ট হইতে হইবে?
এ পেষণেরই বা কি ফল?
দেখিতেছ না যে, সত্ত্বগুণের ধুয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে দেশ তমোগুণসমুদ্রে ডুবিয়া গেল। যেথায় মহাজড়বুদ্ধি পরাবিদ্যানুরাগের ছলনায় নিজ মূর্খতা আচ্ছাদিত করিতে চাহে; যেথায় জন্মালস বৈরাগ্যের আবরণ নিজের অকর্মণ্যতার উপর নিক্ষেপ করিতে চাহে; যেথায় ক্রুরকর্মী তপস্যাদির ভান করিয়া নিষ্ঠুরতাকেও ধর্ম করিয়া তুলে; যেথায় নিজের সামর্থ্যহীনতার উপর দৃষ্টি কাহারও নাই—কেবল অপরের উপর সমস্ত দোষনিক্ষেপ; বিদ্যা কেবল কতিপয় পুস্তক-কণ্ঠস্থে, প্রতিভা চর্বিত-চর্বণে এবং সর্বোপরি গৌরব কেবল পিতৃপুরুষের নাম-কীর্তনে—সে দেশ তমগুণে দিন দিন ডুবিতেছে, তাহার কি প্রমাণান্তর চাই?
অতএব সত্ত্বগুণ এখনও বহুদূর। আমাদের মধ্যে যাঁহারা পরমহংসপদবীতে উপস্থিত হইবার যোগ্য নহেন বা ভবিষ্যতে [হইবার] আশা রাখেন, তাঁহাদের পক্ষে রজোগুণের আবির্ভাবই পরম কল্যাণ। রজোগুণের মধ্য দিয়া না যাইলে কি সত্ত্বে উপনীত হওয়া যায়? ভোগ শেষ না হইলে যোগ কি করিবে? বিরাগ না হইলে ত্যাগ কোথা হইতে আসিবে?
অপর দিকে তালপত্রবহ্নির ন্যায় রজোগুণ শীঘ্রই নির্বাণোন্মুখ, সত্ত্বের সন্নিধান নিত্যবস্তুর নিকটতম, সত্ত্ব প্রায় নিত্য, রজোগুণপ্রধান জাতি দীর্ঘজীবন লাভ করে না, সত্ত্বগুণপ্রধান যেন চিরজীবী; ইহার সাক্ষী ইতিহাস।
ভারতে রজোগুণের প্রায় একান্ত অভাব; পাশ্চাত্যে সেই প্রকার সত্ত্বগুণের। ভারত হইতে সমানীত সত্ত্বধারার উপর পাশ্চাত্য জগতের জীবন নির্ভর করিতেছে নিশ্চিত, এবং নিম্নস্তরে তমোগুণকে পরাহত করিয়া রজোগুণপ্রবাহ প্রতিবাহিত না করিলে আমাদের ঐহিক কল্যাণ যে সমুৎপাদিত হইবে না ও বহুধা পারলৌকিক কল্যাণের বিঘ্ন উপস্থিত হইবে, ইহাও নিশ্চিত।
এই দুই শক্তির সম্মিলনের ও মিশ্রণের যথাসাধ্য সহায়তা করা ‘উদ্বোধন’-এর জীবনোদ্দেশ্য।
যদ্যপি ভয় আছে যে, এই পাশ্চাত্যবীর্যতরঙ্গে আমাদের বহুকালার্জিত রত্নরাজি বা ভাসিয়া যায়; ভয় হয়, পাছে প্রবল আবর্তে পড়িয়া ভারতভূমিও ঐহিক ভোগলাভের রণভূমিতে আত্মহারা হইয়া যায়; ভয় হয়, পাছে অসাধ্য অসম্ভব এবং মূলোচ্ছেদকারী বিজাতীয় ঢঙের অনুসরণ করিতে যাইয়া আমরা ‘ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্টঃ’ হইয়া যাই। এই জন্য ঘরের সম্পত্তি সর্বদা সম্মুখে রাখিতে হইবে; যাহাতে অসাধারণ সকলে তাহাদের পিতৃধন সর্বদা জানিতে ও দেখিতে পারে, তাহার প্রযত্ন করিতে হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে নির্ভীক হইয়া সর্বদ্বার উন্মুক্ত করিতে হইবে। আসুক চারিদিক হইতে রশ্মিধারা, আসুক তীব্র পাশ্চাত্য কিরণ। যাহা দুর্বল দোষমুক্ত, তাহা মরণশীল—তাহা লইয়াই বা কি হইবে? যাহা বীর্যবান্ বলপ্রদ, তাহা অবিনশ্বর; তাহার নাশ কে করে?
কত পর্বতশিখর হইতে কত হিমনদী, কত উৎস, কত জলধারা উচ্ছ্বসিত হইয়া বিশাল সুর-তরঙ্গিণীরূপে মহাবেগে সমুদ্রাভিমুখে যাইতেছে। কত বিভিন্ন প্রকারের ভাব, কত শক্তিপ্রবাহ—দেশদেশান্তর হইতে কত সাধুহৃদয়, কত ওজস্বী মস্তিষ্ক হইতে প্রসূত হইয়া নর-রঙ্গক্ষেত্র কর্মভূমি—ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। লৌহবর্ত্ম-বাষ্পপোতবাহন ও তড়িৎসহায় ইংরেজের আধিপত্যে বিদ্যুদ্বেগে নানাবিধ ভাব—রীতিনীতি দেশমধ্যে বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। অমৃত আসিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে গরলও আসিতেছে; ক্রোধ-কোলাহল, রুধিরপাতাদি সমস্তই হইয়া গিয়াছে—এ তরঙ্গরোধের শক্তি হিন্দুসমাজে নাই। যন্ত্রোদ্ধৃত জল হইতে মৃতজীবাস্থি-বিশোধিত শর্করা পর্যন্ত সকলই বহু-বাগাড়ম্বরসত্ত্বেও, নিঃশব্দে গলাধঃকৃত হইল; আইনের প্রবল প্রভাবে, ধীরে ধীরে, অতি যত্নে রক্ষিত রীতিগুলিরও অনেকগুলি ক্রমে ক্রমে খসিয়া পড়িতেছে—রাখিবার শক্তি নাই। নাই বা কেন? সত্য কি বাস্তবিক শক্তিহীন? ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্’—এই বেদবাণী কি মিথ্যা? অথবা যেগুলি পাশ্চাত্য রাজশক্তি বা শিক্ষাশক্তির উপপ্লাবনে ভাসিয়া যাইতেছে, সেই আচরণগুলিই অনাচার ছিল? ইহাও বিশেষ বিচারের বিষয়।
‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ নিঃস্বার্থভাবে ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে এই-সকল প্রশ্নের মীমাংসার জন্য ‘উদ্বোধন’ সহৃদয় প্রেমিক বুধমণ্ডলীকে আহ্বান করিতেছে এবং দ্বেষ-বুদ্ধিবিরহিত ও ব্যক্তিগত বা সমাজগত বা সম্প্রদায়গত কুবাক্যপ্রয়োগে বিমুখ হইয়া সকল সম্প্রদায়ের সেবার জন্যই আপনার শরীর অর্পণ করিতেছে।
কার্যে আমাদের অধিকার, ফল প্রভুর হস্তে; আমরা কেবল বলি—হে ওজঃস্বরূপ! আমাদিগকে ওজস্বী কর; হে বীর্যস্বরূপ! আমাদিগকে বীর্যবান্ কর; হে বলস্বরূপ! আমাদিগকে বলবান্ কর।
*************************************************************************************************************
বাঙ্গালা ভাষা
[১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে ২০ ফেব্রুআরী আমেরিকা হইতে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদককে স্বামীজী যে পত্র লিখেন, তাহা হইতে উদ্ধৃত।]
আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতয় সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন, বিদ্বান এবং সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্য রামকৃষ্ণ পর্যন্ত—যাঁরা ‘লোকহিতায়’ এসেছেন, তাঁরা সকলেই সাধারণ লোকের ভাষায় সাধারণকে শিক্ষা দিয়েছেন। পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা—যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পাণ্ডিত্য গবেষণা মনে মনে কর; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভূতকিমাকার উপস্থিত কর? যে ভাষায় নিজের মনে দর্শন-বিজ্ঞান চিন্তা কর, দশজনে বিচার কর—সে ভাষা কি দর্শন-বিজ্ঞান লেখবার ভাষা নয়? যদি না হয় তো নিজের মনে এবং পাঁচজনে ও-সকল তত্ত্ববিচার কেমন করে কর? স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যে-দিকে ফেরাও সে-দিকে ফেরে, তেমন কোন তৈরী ভাষা কোন কালে হবে না। ভাষাকে করতে হবে—যেমন সাফ্ ইস্পাত, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছে কর—আবার যে-কে-সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না। আমাদের ভাষা—সংস্কৃত গদাই-লস্করি চাল—ঐ এক-চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়—লক্ষণ।
যদি বল ও-কথা বেশ; তবে বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারী ভাষা, কোন্টি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান্ হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যেদিক হতেই আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়। তখন প্রকৃতি আপনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কোন্ ভাষা লিখতে হবে, যত রেল এবং গতাগতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব-পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ঐ কলকেতার ভাষাই চলবে। কোন্ জেলার ভাষা সংস্কৃতর বেশী নিকট, সে কথা হচ্ছে না—কোন্ ভাষা জিতছে সেইটি দেখ। যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্প দিনে সমস্ত বাঙ্গলা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে-কথা-কওয়া ভাষা এক করতে হয় তো বুদ্ধিমান্ অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন। এথায় গ্রাম্য ঈর্ষাটিকেও জলে ভাসান দিতে হবে। সমস্ত দেশের যাতে কল্যাণ, সেথা তোমার জেলা বা গ্রামের প্রাধান্যটি ভুলে যেতে হবে। ভাষা ভাবের বাহক। ভাবই প্রধান; ভাষা পরে। হীরেমতির সাজ-পরান ঘোড়ার উপর বাঁদর বসালে কি ভাল দেখায়? সংস্কৃতর দিকে দেখ দিকি। ‘ব্রাহ্মণ’-এর সংস্কৃত দেখ, শবরস্বামীর ‘মীমাংসাভাষ্য’ দেখ, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ দেখ, শেষ আচার্য শঙ্করের ভাষ্য দেখ, আর অর্বাচীন কালের সংস্কৃত দেখ। এখুনি বুঝতে পারবে যে, যখন মানুষ বেঁচে থাকে, তখন জ্যান্ত-কথা কয়, মরে গেলে মরা-ভাষা কয়। যত মরণ নিকট হয়, নূতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচা ভাব রাশীকৃত ফুল-চন্দন দিয়ে ছাপবার চেষ্টা হয়। বাপ রে, সে কি ধুম—দশপাতা লম্বা লম্বা বিশেষণের পর দুম করে—‘রাজা আসীৎ’!!! আহাহা! কি প্যাঁচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস, কি শ্লেষ!!—ও সব মড়ার লক্ষণ। যখন দেশটা উৎসন্ন যেতে আরম্ভ হল, তখন এই সব চিহ্ন উদয় হল। ওটি শুধু ভাষায় নয়, সকল শিল্পতেই এল। বাড়ীটার না আছে ভাব, না ভঙ্গি; থামগুলোকে কুঁদে কুঁদে সারা করে দিলে। গয়নাটা নাক ফুঁড়ে ঘাড় ফুঁড়ে ব্রহ্মরাক্ষসী সাজিয়ে দিলে, কিন্তু সে গয়নায় লতা-পাতা চিত্র-বিচিত্রর কি ধুম!!! গান হচ্ছে, কি কান্না হচ্ছে, কি ঝগড়া হচ্ছে—তার কি ভাব, কি উদ্দেশ্য, তা ভরত ঋষিও বুঝতে পারেন না; আবার সে গানের মধ্যে প্যাঁচের কি ধুম! সে কি আঁকাবাঁকা ডামাডোল—ছত্রিশ নাড়ীর টান তায় রে বাপ! তার উপর মুসলমান ওস্তাদের নকলে দাঁতে দাঁত চেপে, নাকের মধ্য দিয়ে আওয়াজে সে গানের আবির্ভাব! এগুলো শোধরাবার লক্ষণ এখন হচ্ছে, এখন ক্রমে বুঝবে যে, যেটা ভাবহীন প্রাণহীন—সে ভাষা, সে শিল্প, সে সঙ্গীত কোন কাজের নয়। এখন বুঝবে যে, জাতীয় জীবনে যেমন যেমন বল আসবে, তেমন তেমন ভাষা শিল্প সঙ্গীত প্রভৃতি আপনা-আপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, তা দু-হাজার ছাঁদি বিশেষণেও নাই। তখন দেবতার মূর্তি দেখলেই ভক্তি হবে, গহনা-পরা মেয়ে-মাত্রই দেবী বলে বোধ হবে, আর বাড়ী ঘর দোর সব প্রাণস্পন্দনে ডগমগ করবে।
*************************************************************************************************************
জ্ঞানার্জন
ব্রহ্মা—দেবতাদিগের প্রথম ও প্রধান—শিষ্যপরম্পরায় জ্ঞান প্রচার করিলেন; উৎসর্পিণী ও অবসর্পিণী২৭ কালচক্রের মধ্যে কতিপয় অলৌকিক সিদ্ধপুরুষ—জিনের প্রাদুর্ভাব হয়, ও তাঁহাদের হইতে মানবসমাজে জ্ঞানের পুনঃপুনঃ স্ফূর্তি হয়, সেই প্রকার বৌদ্ধমতে সর্বজ্ঞ বুদ্ধনামধেয় মহাপুরুষদিগের বারংবার আবির্ভাব; পৌরাণিকদিগের অবতারের অবতরণ আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে বিশেষরূপে, অন্যান্য নিমিত্ত-অবলম্বনেও; মহামনা স্পিতামা জরথুষ্ট্র২৮ জ্ঞানদীপ্তি মর্ত্যলোকে আনয়ন করিলেন; হজরত মুশা, ঈশা ও মহম্মদও তদ্বৎ অলৌকিক উপায়শালী হইয়া অলৌকিক পথে অলৌকিক জ্ঞান মানব-সমাজে প্রচার করিলেন।
কয়েকজন মাত্র জিন হন, তাহা ছাড়া আর কাহারও জিন হইবার উপায় নাই, অনেকে মুক্ত হন মাত্র; বুদ্ধনামক অবস্থা সকলেই প্রাপ্ত হইতে পারেন; ব্রহ্মাদি পদবীমাত্র, জীবমাত্রেরই হইবার সম্ভাবনা; জরথুষ্ট্র, মুশা, ঈশা, মহম্মদ লোক-বিশেষ কার্য-বিশেষের জন্য অবতীর্ণ; তদ্বৎ পৌরাণিক অবতারগণ—সে আসনে অন্যের দৃষ্টিনিক্ষেপ বাতুলতা। ‘আদম’ ফল খাইয়া জ্ঞান পাইলেন, ‘নু’ (Noah) যিহোবাদেবের অনুগ্রহে সামাজিক শিল্প শিখিলেন। ভারতে সকল শিল্পের অধিষ্ঠাতা—দেবগণ বা সিদ্ধপুরুষ; জুতা সেলাই হইতে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমস্তই অলৌকিক পুরুষদিগের কৃপা। ‘গুরু বিন্ জ্ঞান নহি’; শিষ্য-পরম্পরায় ঐ জ্ঞানবল গুরু-মুখ হইতে না আসিলে, গুরুর কৃপা না হইলে আর উপায় নাই।
আবার দার্শনিকেরা—বৈদান্তিকেরা বলেন, জ্ঞান মনুষ্যের স্বভাব-সিদ্ধ ধন—আত্মার প্রকৃতি; এই মানবাত্মাই অনন্ত জ্ঞানের আধার, তাহাকে আবার কে শিখাইবে? কুকর্মের দ্বারা ঐ জ্ঞানের উপর যে একটা আবরণ পড়িয়াছে—তাহা কাটিয়া যায় মাত্র। অথবা ঐ ‘স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান’ অনাচারের দ্বারা সঙ্কুচিত হইয়া যায়, ঈশ্বরের কৃপায় সদাচারের দ্বারা পুনর্বিস্ফারিত হয়। অষ্টাঙ্গ যোগাদির দ্বারা, ঈশ্বরে ভক্তির দ্বারা, নিষ্কাম কর্মের দ্বারা, জ্ঞানচর্চার দ্বারা অন্তর্নিহিত অনন্ত শক্তি ও জ্ঞানের বিকাশ—ইহাও পড়া যায়।
আধুনিকেরা অপরদিকে অনন্তস্ফূর্তির আধারস্বরূপ মানব-মন দেখিতেছেন, উপযুক্ত দেশকালপাত্র পরস্পরের উপর ক্রিয়াবান হইতে পারিলেই জ্ঞানের স্ফূর্তি হইবে, ইহাই সকলের ধারণা। আবার দেশকালের বিড়ম্বনা পাত্রের তেজে অতিক্রম করা যায়। সৎপাত্র কুদেশে কুকালে পড়িলেও বাধা অতিক্রম করিয়া আপনার শক্তির বিকাশ করে। পাত্রের উপর—অধিকারীর উপর যে সমস্ত ভার চাপান হইয়াছিল, তাহাও কমিয়া আসিতেছে। সেদিনকার বর্বর জাতিরাও যত্নগুণে সুসভ্য ও জ্ঞানী হইয়া উঠিতেছে—নিম্নস্তর উচ্চতম আসন অপ্রতিহত গতিতে লাভ করিতেছে। নিরামিষভোজী পিতা-মাতার সন্তানও সুবিনীত বিদ্বান হইয়াছে, সাঁওতাল-বংশধরেরাও ইংরেজের কৃপায় বাঙ্গালীর পুত্রদিগের সহিত বিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থাপন করিতেছে। পিতৃপিতামহাগত গুণের পক্ষপাতিতা ঢের কমিয়া আসিয়াছে।
একদল আছেন, যাঁহাদের বিশ্বাস—প্রাচীন মহাপুরুষদিগের অভিপ্রায় পূর্বপুরুষপরম্পরাগত পথে তাঁহারাই প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং সকল বিষয়ের জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট ভাণ্ডার অনন্ত কাল হইতে আছে, ঐ খাজানা পূর্বপুরুষদিগের হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল। তাঁহারা উত্তরাধিকারী, জগতের পূজ্য। যাঁহাদের এ প্রকার পূর্বপুরুষ নাই, তাঁহাদের উপায়?—কিছুই নাই। তবে যিনি অপেক্ষাকৃত সদাশয়, উত্তর দিলেন—আমাদের পদলেহন কর, সেই সুকৃতিফলে আগামী জন্মে আমাদের বংশে জন্মগ্রহণ করিবে।—আর এই যে আধুনিকেরা বহুবিদ্যার আবির্ভাব করিতেছেন—যাহা তোমরা জান না, এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা জানিতেন, তাহারও প্রমাণ নাই। পূর্বপুরুষেরা জানিতেন বৈকি! তবে লোপ হইয়া গিয়াছে, এই শ্লোক দেখ—।
অবশ্য প্রত্যক্ষবাদী আধুনিকেরা এ সকল কথায় আস্থা প্রকাশ করেন না।
অপরা ও পরা বিদ্যায় বিশেষ আছে নিশ্চিত; আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিশেষ আছে নিশ্চিত; একের রাস্তা অন্যের না হইতে পারে; এক উপায় অবলম্বনে সকল প্রকার জ্ঞান-রাজ্যের দ্বার উদ্ঘাটিত না হইতে পারে, কিন্তু সেই বিশেষণ (difference) কেবল উচ্চতার তারতম্য, কেবল অবস্থাভেদ, উপায়ের অবস্থানুযায়ী প্রয়োজনভেদ; বাস্তবিক সেই অখণ্ড জ্ঞান ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ড-পরিব্যাপ্ত।
‘জ্ঞান-মাত্রেই পুরুষবিশেষের দ্বারা অধিকৃত এবং ঐ-সকল বিশেষ পুরুষ, ঈশ্বর বা প্রকৃতি বা কর্মনির্দিষ্ট হইয়া যথাকালে জন্মগ্রহণ করেন, তদ্ভিন্ন কোন বিষয়ে জ্ঞানলাভের আর কোন উপায় নাই’—এইটি স্থির সিদ্ধান্ত হইলে সমাজ হইতে উদ্যোগ-উৎসাহাদি অন্তর্হিত হয়, উদ্ভাবনী-শক্তি চর্চাভাবে ক্রমশঃ বিলীন হয়, নূতন বস্তুতে আর কাহারও আগ্রহ হয় না, হইবার উপায়ও সমাজ ক্রমে বন্ধ করিয়া দেন। যদি ইহাই স্থির হইল যে, সর্বজ্ঞ পুরুষবিশেষগণের দ্বারায় মানবের কল্যাণের পন্থা অনন্তকালের নিমিত্ত নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা হইলে সেই সকল নির্দেশের রেখামাত্র ব্যতিক্রম হইলেই সর্বনাশ হইবার ভয়ে সমাজ কঠোর শাসন দ্বারা মনুষ্যগণকে ঐ নির্দিষ্ট পথে লইয়া যাইতে চেষ্টা করে। যদি সমাজে এ বিষয়ে কৃতকার্য হয়, তবে মনুষ্যের পরিণাম যন্ত্রের ন্যায় হইয়া যায়। জীবনের প্রত্যেক কার্যই যদি অগ্র হইতে সুনির্দিষ্ট হইয়া রহিয়াছে, তবে চিন্তাশক্তির পর্যালোচনার আর ফল কি? ক্রমে ব্যবহারের অভাবে উদ্ভাবনী-শক্তির লোপ ও তমোগুণপূর্ণ জড়তা আসিয়া পড়ে; সে সমাজ ক্রমশই অধোগতিতে গমন করিতে থাকে।
অপরদিকে সর্বপ্রকারে নির্দেশবিহীন হইলেই যদি কল্যাণ হইত, তাহা হইলে চীন, হিন্দু, মিশর, বাবিল, ইরান, গ্রীস, রোম ও তাহাদের বংশধরদিগকে ছাড়িয়া সভ্যতা ও বিদ্যাশ্রী জুলু, কাফ্রি, হটেণ্টট্, সাঁওতাল, আন্দামানী ও অষ্ট্রেলিয়ান্ প্রভৃতি জাতিগণকেই আশ্রয় করিত।
অতএব মহাপুরুষদিগের দ্বারা নির্দিষ্ট পথেরও গৌরব আছে, গুরু-পরম্পরাগত জ্ঞানেরও বিশেষ বিধেয়তা আছে, জ্ঞানের সর্বান্তর্যামিত্বও একটি অনন্ত সত্য। কিন্তু বোধ হয়, প্রেমের উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হইয়া ভক্তেরা মহাজনদিগের অভিপ্রায়—তাঁহাদের পূজার সমক্ষে বলিদান করেন এবং স্বয়ং হতশ্রী হইলে মনুষ্য স্বভাবতঃ পূর্বপুরুষদিগের ঐশ্বর্য স্মরণেই কালাতিপাত করে, ইহাও প্রত্যক্ষসিদ্ধ। ভক্তিপ্রবণ হৃদয় সর্বপ্রকারে পূর্বপুরুষদিগের পদে আত্মসমর্পণ করিয়া স্বয়ং দুর্বল হইয়া যায় এবং পরবর্তী কালে ঐ দুর্বলতাই শক্তিহীন গর্বিত হৃদয়কে পূর্বপুরুষদিগের গৌরব-ঘোষণারূপ জীবনাধার-মাত্র অবলম্বন করিতে শিখায়।
পূর্ববর্তী মহাপুরুষেরা সমুদয়ই জানিতেন, কালবশে সেই জ্ঞানের অধিকাংশই লোপ হইয়া গিয়াছে, এ কথা সত্য হইলেও ইহাই সিদ্ধান্ত হইবে যে, ঐ লোপের কারণ, পরবর্তীদের নিকট ঐ লুপ্ত জ্ঞান থাকা না থাকা সমান; নূতন উদ্যোগ করিয়া, পুনর্বার পরিশ্রম করিয়া তাহা আবার শিখিতে হইবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে বিশুদ্ধচিত্তে আপনা হইতেই স্ফুরিত হয়, তাহাও চিত্তশুদ্ধিরূপ বহু আয়াস ও পরিশ্রম-সাধ্য। আধিভৌতিক জ্ঞানে যে-সকল গুরুতর সত্য মানব-হৃদয়ে পরিস্ফুটিত হইয়াছে, অনুসন্ধানে জানা যায় যে, সেগুলিও সহসা উদ্ভূত দীপ্তির ন্যায় মনীষীদের মনে সমুদিত হইয়াছে, কিন্তু বন্য অসভ্য মনুষ্যের মনে তাহা হয় না। ইহাই প্রমাণ যে, আলোচনা ও বিদ্যাচর্চারূপ কঠোর তপস্যাই তাহার কারণ।
অলৌকিকত্বরূপ যে অদ্ভুত বিকাশ, চিরোপার্জিত লৌকিক চেষ্টাই তাহার কারণ; লৌকিক ও অলৌকিক—কেবল প্রকাশের তারতম্যে।
মহাপুরুষত্ব, ঋষিত্ব, অবতারত্ব বা লৌকিক বিদ্যায় মহাবীরত্ব সর্বজীবের মধ্যে আছে, উপযুক্ত গবেষণা ও কালাদিসহায়ে তাহা প্রকাশিত হয়। যে সমাজে ঐ প্রকার বীরগণের একবার প্রাদুর্ভাব হইয়া গিয়াছে, সেথায় পুনর্বার মনীষিগণের অভ্যুত্থান অধিক সম্ভব। গুরুসহায় সমাজ অধিকতর বেগে অগ্রসর হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু গুরুহীন সমাজে কালে গুরুর উদয় ও জ্ঞানের বেগপ্রাপ্তি তেমনই নিশ্চিত।
*************************************************************************************************************
ভাববার কথা
(১)
ঠাকুর-দর্শনে এক ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত। দর্শনলাভে তাহার যথেষ্ট প্রীতি ও ভক্তির উদয় হইল। তখন সে বুঝি আদানপ্রদান-সামঞ্জস্য করিবার জন্য গীত আরম্ভ করিল। দালানের এক কোণে থামে হেলান দিয়া চোবেজী ঝিমাইতেছিলেন। চোবেজী মন্দিরের পূজারী, পহলওয়ান, সেতারী—দুই লোটা ভাঙ দুবেলা উদরস্থ করিতে বিশেষ পটু এবং অন্যান্য আরও অনেক সদ্গুণশালী। সহসা একটা বিকট নিনাদ চোবেজীর কর্ণপটহ প্রবলবেগে ভেদ করিতে উদ্যত হওয়ায় সম্বিদা-সমুৎপন্ন বিচিত্র জগৎ ক্ষণকালের জন্য চোবেজীর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি বিশাল বক্ষস্থলে ‘উত্থায় হৃদি লীয়ন্তে’ হইল। তরুণ-অরুণ-কিরণবর্ণ ঢুলুঢুলু দুটি নয়ন ইতস্ততঃ বিক্ষেপ করিয়া মনশ্চাঞ্চল্যের কারণানুসন্ধায়ী চোবেজী আবিষ্কার করিলেন যে, এক ব্যক্তি ঠাকুরজীর সামনে আপনভাবে আপনি বিভোর হইয়া কর্মবাড়ীর কড়া-মাজার ন্যায় মর্মস্পর্শী স্বরে নারদ, ভরত, হনুমান, নায়ক—কলাবতগুষ্টির সপিণ্ডীকরণ করিতেছে। সম্বিদানন্দ-উপভোগের প্রত্যক্ষ বিঘ্নস্বরূপ পুরুষকে মর্মাহত চোবেজী তীব্রবিরক্তিব্যঞ্জক-স্বরে জিজ্ঞাসা করিতেছেন—‘বলি বাপু হে, ও বেসুর বেতাল কি চীৎকার করছ!’ ক্ষিপ্র উত্তর এল—‘সুর-তানের আমার আবশ্যক কি হে? আমি ঠাকুরজীর মন ভিজুচ্চি।’ চোবেজী—‘হুঁ, ঠাকুরজী এমনই আহম্মক কি না! পাগল তুই, আমাকে ভিজুতে পারিসনি, ঠাকুর কি আমার চেয়েও বেশী মূর্খ?’
* * *
ভগবান্ অর্জুনকে বলেছেনঃ তুমি আমার শরণ লও, আর কিছু করবার দরকার নাই, আমি তোমায় উদ্ধার করব। ভোলাচাঁদ তাই লোকের কাছে শুনে মহাখুশী; থেকে থেকে বিকট চীৎকারঃ আমি প্রভুর শরণাগত, আমার আবার ভয় কি? আমার কি আর কিছু করতে হবে? ভোলাচাঁদের ধারণা—ঐ কথাগুলি খুব বিটকেল আওয়াজে বারংবার বলতে পারলেই যথেষ্ট ভক্তি হয়, আবার তার ওপর মাঝে মাঝে পূর্বোক্ত স্বরে জানানও আছে যে, তিনি সদাই প্রভুর জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। এ ভক্তির ডোরে যদি প্রভু স্বয়ং না বাঁধা পড়েন, তবে সবই মিথ্যা। পার্শ্বচর দু-চারটা আহাম্মকও তাই ঠাওরায়। কিন্তু ভোলাচাঁদ প্রভুর জন্য একটিও দুষ্টামি ছাড়তে প্রস্তুত নন। বলি, ঠাকুরজী কি এমনই আহাম্মক? এতে যে আমরাই ভুলিনি!!
* * *
ভোলাপুরী বেজায় বেদান্তী—সকল কথাতেই তাঁর ব্রহ্মত্বসম্বন্ধে পরিচয়টুকু দেওয়া আছে। ভোলাপুরীর চারিদিকে যদি লোকগুলো অন্নাভাবে হাহাকার করে—তাঁকে স্পর্শও করে না; তিনি সুখদুঃখের অসারতা বুঝিয়ে দেন। যদি রোগে শোকে অনাহারে মরে ঢিপি হয়ে যায়, তাতেই বা তাঁর কি? তিনি অমনি আত্মার অবিনশ্বরত্ব চিন্তা করেন! তাঁর সামনে বলবান্ দুর্বলকে যদি মেরেও ফেলে, ভোলাপুরী ‘আত্মা মরেনও না, মারেনও না’—এই শ্রুতিবাক্যের গভীর অর্থসাগরে ডুবে যান! কোন প্রকার কর্ম করতে ভোলাপুরী বড়ই নারাজ। পেড়াপীড়ি করলে জবাব দেন যে, পূর্বজন্মে ওসব সেরে এসেছেন। এক জায়গায় ঘা পড়লে কিন্তু ভোলাপুরীর আত্মৈক্যানুভূতির ঘোর ব্যাঘাত হয়—যখন তাঁর ভিক্ষার পরিপাটিতে কিঞ্চিৎ গোল হয় বা গৃহস্থ তাঁর আকাঙ্ক্ষানুযায়ী পূজা দিতে নারাজ হন, তখন পুরীজীর মতে গৃহস্থের মত ঘৃণ্য জীব জগতে আর কেহই থাকে না এবং যে গ্রাম তাঁহার সমুচিত পূজা দিলে না, সে গ্রাম যে কেন মুহূর্তমাত্রও ধরণীর ভারবৃদ্ধি করে, এই ভাবিয়া তিনি আকুল হন।
ইনিও ঠাকুরজীকে আমাদের চেয়ে আহাম্মক ঠাওরেছেন।
* * *
‘বলি, রামচরণ! তুমি লেখাপড়া শিখলে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সঙ্গতি নাই, শারীরিক শ্রমও তোমা দ্বারা সম্ভব নহে, তার উপর নেশা-ভাঙ এবং দুষ্টামিগুলাও ছাড়তে পার না, কি করে জীবিকা কর, বল দেখি?’ রামচরণ—‘সে সোজা কথা, মশায়—আমি সকলকে উপদেশ করি।’
রামচরণ ঠাকুরজীকে কি ঠাওরেছেন?
(২)
লক্ষ্ণৌ সহরে মহরমের ভারি ধুম! বড় মসজেদ ইমামবারায় জাঁকজমক রোশনির বাহার দেখে কে! বে-সুমার লোকের সমাগম। হিন্দু, মুসলমান, কেরানী, য়াহুদী, ছত্রিশ বর্ণের স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা, ছত্রিশ বর্ণের হাজার জাতের লোকের ভিড় আজ মহরম দেখতে। লক্ষ্ণৌ ‘সিয়া’দের রাজধানী, আজ হজরত ইমাম্ হাসেন হোসেনের নামে আর্তনাদ গগন স্পর্শ করছে—সে ছাতিফাটান মর্সিয়ার কাতরানি কার বা হৃদয় ভেদ না করে? হাজার বৎসরের প্রাচীন কারবালার কথা আজ ফের জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ দর্শকবৃন্দের ভিড়ের মধ্যে দূর গ্রাম হতে দুই ভদ্র রাজপুত তামাসা দেখতে হাজির। ঠাকুর-সাহেবদের—যেমন পাড়াগেঁয়ে জমিদারের হয়ে থাকে—‘বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ’। সে মোসলমানি সভ্যতা, কাফ্-গাফের বিশুদ্ধ উচ্চারণসমেত লস্করী জবানের পুষ্পবৃষ্টি, আবা-কাবা চুস্ত-পায়জামা তাজ-মোড়াসার রঙ্গ-বেরঙ্গ সহরপসন্দ ঢঙ্গ অতদূর গ্রামে গিয়ে ঠাকুর-সাহেবদের স্পর্শ করতে আজও পারেনি। কাজেই ঠাকুররা সরল-সিধে, সর্বদা শিকার করে জমামরদ্ কড়াজান্ আর বেজায় মজবুত দিল্।
ঠাকুরদ্বয় তো ফটক পার হয়ে মসজেদ মধ্যে প্রবেশোদ্যত, এমন সময় সিপাহী নিষেধ করলে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিলে যে, এই যে দ্বারপার্শ্বে মুরদ খাড়া দেখছ, ওকে আগে পাঁচ জুতা মার, তবে ভিতরে যেতে পাবে। মূর্তিটি কার? জবাব এল—ও মহাপাপী ইয়েজ্বিদের মূর্তি। ও হাজার বৎসর আগে হজরত হাসেন হোসেনকে মেরে ফেলে, তাই আজ এ রোদন, শোকপ্রকাশ। প্রহরী ভাবলে, এ বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর ইয়েজ্বিদ-মূর্তি পাঁচ জুতার জায়গায় দশ তো নিশ্চিত খাবে। কিন্তু কর্মের বিচিত্র গতি। উলটা সমঝ্লি রাম—ঠাকুরদ্বয় গললগ্নীকৃতবাস ভূমিষ্ঠ হয়ে ইয়েজ্বিদ-মূর্তির পদতলে কুমড়ো গড়াগড়ি আর গদ্গদস্বরে স্তুতি—‘ভেতরে ঢুকে আর কাজ কি, অন্য ঠাকুর আর কি দেখ্ব? ভল্ বাবা অজিদ, দেবতা তো তুঁহি হ্যায় অস্ মারো শারোকো কি অভি তক্ রোবত।’ (ধন্য বাবা ইয়েজ্বিদ, এমনি মেরেচ শালাদের—কি আজও কাঁদছে!!)
* * *
সনাতন হিন্দুধর্মের গগনস্পর্শী মন্দির—সে মন্দিরে নিয়ে যাবার রাস্তাই বা কত! আর সেথা নাই বা কি? বেদান্তীয় নির্গুণ ব্রহ্ম হতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূয্যিমামা, ইঁদুরচড়া গণেশ, আর কুচোদেবতা ষষ্ঠী, মাকাল প্রভৃতি—নাই কি? আর বেদ-বেদান্ত দর্শন পুরাণ তন্ত্রে তো ঢের মাল আছে, যার এক-একটা কথায় ভববন্ধন টুটে যায়। আর লোকেরই বা ভিড় কি, তেত্রিশ কোটি লোক সে দিকে দৌড়েছে। আমারও কৌতূহল হল, আমিও ছুটলুম। কিন্তু গিয়ে দেখি, এ কি কাণ্ড! মন্দিরের মধ্যে কেউ যাচ্ছে না, দোরের পাশে একটা পঞ্চাশ মুণ্ডু, একশত হাত, দু-শ পেট, পাঁচ-শ ঠ্যাঙওয়ালা মূর্তি খাড়া! সেইটার পায়ের তলায় সকলেই গড়াগড়ি দিচ্ছে। একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলুম যে, ওই ভেতরে যে-সকল ঠাকুরদেবতা, ওদের দূর থেকে একটা গড় বা দুটি ফুল ছুঁড়ে ফেললেই যথেষ্ট পূজা হয়। আসল পূজা কিন্তু এঁর করা চাই—যিনি দ্বারদেশে; আর ঐ যে বেদ, বেদান্ত, দর্শন, পুরাণ—শাস্ত্রসকল দেখছ, ও মধ্যে মধ্যে শুনলে হানি নাই, কিন্তু পালতে হবে এঁর হুকুম। তখন আবার জিজ্ঞাসা করলুম—তবে এ দেবতার নাম কি? উত্তর এল—এঁর নাম ‘লোকাচার’। আমার লক্ষ্ণৌ-এর ঠাকুরসাহেবের কথা মনে পড়ে গেলঃ ‘ভল্ বাবা “লোকাচার” অস্ মারো’ ইত্যাদি।
গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্য—মহাপণ্ডিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর তাঁর নখদর্পণে। শরীরটি অস্থিচর্মসার; বন্ধুরা বলে তপস্যার দাপটে, শত্রুরা বলে অন্নাভাবে! আবার দুষ্টেরা বলে, বছরে দেড়কুড়ি ছেলে হলে ঐ রকম চেহারাই হয়ে থাকে। যাই হোক, কৃষ্ণব্যাল মহাশয় না জানেন এমন জিনিষটিই নাই, বিশেষ টিকি হতে আরম্ভ করে নবদ্বার পর্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ ও চৌম্বকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্বজ্ঞ। আর এ রহস্যজ্ঞান থাকার দরুন দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা হতে মায় কাদা, পুনর্বিবাহ২৯, দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে তিনি অদ্বিতীয়। আবার প্রমাণ-প্রয়োগ সে তো বালকেও বুঝতে পারে, তিনি এমনি সোজা করে দিয়েছেন। বলি, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র ধর্ম হয় না, ভারতের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছাড়া ধর্ম বুঝবার আর কেউ অধিকারীই নয়, ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার কৃষ্ণব্যালগুষ্টি ছাড়া বাকী সব কিছুই নয়, আবার কৃষ্ণব্যালদের মধ্যে গুড়গুড়ে!!! অতএব গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল যা বলেন, তাহাই স্বতঃপ্রমাণ। মেলা লেখাপড়ার চর্চা হচ্ছে, লোকগুলো একটু চমচমে হয়ে উঠেছে, সকল জিনিষ বুঝতে চায়, চাকতে চায়, তাই কৃষ্ণব্যাল মহাশয় সকলকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, মাভৈঃ, যে-সকল মুশকিল মনের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছে, আমি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করছি, তোমরা যেমন ছিলে তেমনি থাক। নাকে সরষের তেল দিয়ে খুব ঘুমোও। কেবল আমার বিদায়ের কথাটা ভুলো না। লোকেরা বললে—বাঁচলুম, কি বিপদই এসেছিল বাপু! উঠে বসতে হবে, চলতে ফিরতে হবে, কি আপদ!! ‘বেঁচে থাক্ কৃষ্ণব্যাল’ বলে আবার পাশ ফিরে শুলো। হাজার বছরের অভ্যাস কি ছোটে? শরীর করতে দেবে কেন? হাজারো বৎসরের মনের গাঁট কি কাটে! তাই না কৃষ্ণব্যালদলের আদর! ‘ভল্ বাবা “অভ্যাস” অস্ মারো’ ইত্যাদি।
*************************************************************************************************************
পারি প্রদর্শনী
[পারি প্রদর্শনীতে স্বামীজীর এই বক্তৃতাদির বিবরণ স্বামীজী স্বয়ং লিখিয়া ‘উদ্বোধন’-এ পাঠাইয়াছিলেন।]
এই মাসের৩০ প্রথমাংশে কয়েক দিবস যাবৎ পারি (Paris) মহাপ্রদর্শনীতে “কংগ্রেস দ’ লিস্তোয়ার দে রিলিজিঅঁ” [Congress of the History of Religions, August 1900] অর্থাৎ ধর্মেতিহাস-নামক সভার অধিবেশন হয়। উক্ত সভায় অধ্যাত্ম-বিষয়ক এবং মতামতসম্বন্ধী কোন চর্চার স্থান ছিল না, কেবলমাত্র বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস অর্থাৎ তদঙ্গসকলের তথ্যানুসন্ধানই উদ্দেশ্য ছিল। এ বিধায়, এ সভায় বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির একান্ত অভাব। চিকাগো মহাসভা এক বিরাট ব্যাপার ছিল। সুতরাং সে সভায় নানা দেশের ধর্মপ্রচারকমণ্ডলীর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় জনকয়েক পণ্ডিত, যাঁহারা বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি-বিষয়ক চর্চা করেন, তাঁহারাই উপস্থিত ছিলেন। ধর্মসভা না হইবার কারণ এই যে, চিকাগো মহামণ্ডলীতে ক্যাথলিক সম্প্রদায় বিশেষ উৎসাহে যোগদান করিয়াছিলেন; ভরসা—প্রোটেষ্টাণ্ট সম্প্রদায়ের উপর অধিকার বিস্তার; তদ্বৎ সমগ্র খ্রীষ্টান জগৎ—হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবর্গকে উপস্থিত করাইয়া স্বমহিমা-কীর্তনের বিশেষ সুযোগ নিশ্চিত করিয়াছিলেন। কিন্তু ফল অন্যরূপ হওয়ায় খ্রীষ্টান সম্প্রদায় সর্বধর্মসমন্বয়ে একেবারে নিরুৎসাহ হইয়াছেন; ক্যাথলিকরা এখন ইহার বিশেষ বিরোধী। ফ্রান্স ক্যাথলিক-প্রধান; অতএব যদিও কর্তৃপক্ষদের যথেষ্ট বাসনা ছিল, তথাপি সমগ্র ক্যাথলিক জগতের বিপক্ষতায় ধর্মসভা করা হইল না।
যে প্রকার মধ্যে মধ্যে Congress of Orientalists অর্থাৎ সংস্কৃত, পালি, আরব্যাদি ভাষাভিজ্ঞ বুধমণ্ডলীর মধ্যে মধ্যে উপবেশন হইয়া থাকে, সেইরূপ উহার সহিত খ্রীষ্টধর্মের প্রত্নতত্ত্ব যোগ দিয়া পারি-তে এ ধর্মেতিহাস-সভা আহূত হয়।
জম্বুদীপ হইতে কেবল দুই-তিনজন জাপানী পণ্ডিত আসিয়াছিলেন; ভারতবর্ষ হইতে স্বামী বিবেকানন্দ।
বৈদিক ধর্ম—অগ্নিসূর্যাদি প্রাকৃতিক বিস্ময়াবহ জড়বস্তুর আরাধনা-সমুদ্ভূত, এইটি অনেক পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞের মত।
স্বামী বিবেকানন্দ উক্ত মত খণ্ডন করিবার জন্য ‘পারি ধর্মেতিহাস-সভা’ কর্তৃক আহূত হইয়াছিলেন এবং তিনি উক্ত বিষয়ে এক প্রবন্ধ পাঠ করিবেন, প্রতিশ্রুত ছিলেন। কিন্তু শারীরিক প্রবল অসুস্থতানিবন্ধন তাঁহার প্রবন্ধাদি লেখা ঘটিয়া উঠে নাই; কোনমতে সভায় উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলেন মাত্র। উপস্থিত হইলে ইওরোপ অঞ্চলের সকল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতই তাঁহাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন; উঁহারা ইতঃপূর্বেই স্বামীজীর রচিত পুস্তকাদি পাঠ করিয়াছিলেন।
সে সময় উক্ত সভায় ওপর্ট নামক এক জার্মান পণ্ডিত শালগ্রাম-শিলার উৎপত্তি সম্বন্ধে এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাহাতে তিনি শালগ্রামের উৎপত্তি ‘যোনি’ চিহ্ন বলিয়া নির্ধারিত করেন। তাঁহার মতে শিবলিঙ্গ পুংলিঙ্গের চিহ্ন এবং তদ্বৎ শালগ্রাম-শিলা স্ত্রীলিঙ্গের চিহ্ন।শিবলিঙ্গ এবং শালগ্রাম উভয়ই লিঙ্গ-যোনিপূজার অঙ্গ।
স্বামী বিবেকানন্দ উক্ত মতদ্বয়ের খণ্ডন করিয়া বলেন যে, শিবলিঙ্গের নরলিঙ্গতা সম্বন্ধে অবিবেক মত প্রসিদ্ধ আছে; কিন্তু শালগ্রাম সম্বন্ধে এ নবীন মত অতি আকস্মিক।
স্বামীজী বলেন যে, শিবলিঙ্গ-পূজার উৎপত্তি অথর্ববেদসংহিতার যূপ-স্তম্ভের প্রসিদ্ধ স্তোত্র হইতে। উক্ত স্তোত্রে অনাদি অনন্ত স্তম্ভের অথবা স্কম্ভের বর্ণনা আছে এবং উক্ত স্কম্ভই যে ব্রহ্ম, তাহাই প্রতিপাদিত হইয়াছে। যজ্ঞের অগ্নি, শিখা, ধূম, ভস্ম, সোমলতা ও যজ্ঞকাষ্ঠের বাহক বৃষ যে প্রকার মহাদেবের অঙ্গকান্তি, পিঙ্গল জটা, নীলকণ্ঠ, ও বাহনাদিতে পরিণত হইয়াছে, সেই প্রকার যূপ-স্কম্ভও শ্রীশঙ্করে লীন হইয়া মহিমান্বিত হইয়াছে।
অথর্বসংহিতায় তদ্বৎ যজ্ঞোচ্ছিষ্টেরও ব্রহ্মত্ব-মহিমা প্রতিপাদিত হইয়াছে।
লিঙ্গাদি পুরাণে উক্ত স্তবকেই কথাচ্ছলে বর্ণনা করিয়া মহাস্তম্ভের মহিমা ও শ্রীশঙ্করের প্রাধান্য ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
পরে, হইতে পারে যে, বৌদ্ধাদির প্রাদুর্ভাবকালে বৌদ্ধস্তূপ-সমাকৃতি দরিদ্রার্পিত ক্ষুদ্রাবয়ব স্মারক-স্তূপও সেই স্তম্ভে অর্পিত হইয়াছে। যে প্রকার অদ্যাপি ভারতখণ্ডে কাশ্যাদি তীর্থস্থলে অপারগ ব্যক্তি অতি ক্ষুদ্র মন্দিরাকৃতি উৎসর্গ করে, সেই প্রকারে বৌদ্ধেরাও ধনাভাবে অতি ক্ষুদ্র স্তূপাকৃতি শ্রীবুদ্ধের উদ্দেশে অর্পণ করিত।
বৌদ্ধস্তূপের অপর নাম ধাতুগর্ভ। স্তূপমধ্যস্থ শিলাকরণ্ডমধ্যে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষুকদিগের ভস্মাদি রক্ষিত হইত। তৎসঙ্গে স্বর্ণাদি ধাতুও প্রোথিত হইত। শালগ্রাম-শিলা উক্ত অস্তিভস্মাদি-রক্ষণ-শিলার প্রাকৃতিক প্রতিরূপ। অতএব প্রথমে বৌদ্ধ-পূজিত হইয়া বৌদ্ধমতের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। অপিচ নর্মদাকূলে ও নেপালে বৌদ্ধপ্রাবল্য দীর্ঘস্থায়ী ছিল। প্রাকৃতিক নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ ও নেপালপ্রসূত শালগ্রামই যে বিশেষ সমাদৃত, ইহাও বিবেচ্য।
শালগ্রাম সম্বন্ধে যৌনব্যাখ্যা অতি অশ্রুতপূর্ব এবং প্রথম হইতেই অপ্রাসঙ্গিক; শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে যৌনব্যাখ্যা ভারতবর্ষে অতি অর্বাচীন এবং উক্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘোর অবনতির সময় সংঘটিত হয়। ঐ সময়ের ঘোর বৌদ্ধতন্ত্রসকল এখনও নেপালে ও তিব্বতে খুব প্রচলিত।
অন্য এক বক্তৃতা—স্বামীজী ভারতীয় ধর্মমতের বিস্তার-বিষয়ে দেন। তাহাতে বলা হয় যে, ভারতখণ্ডের বৌদ্ধাদি সমস্ত মতের উৎপত্তি বেদে। সকল মতের বীজ তন্মধ্যে প্রোথিত আছে। ঐ সকল বীজকে বিস্তৃত ও উন্মীলিত করিয়া বৌদ্ধাদি মতের সৃষ্টি। আধুনিক হিন্দুধর্মও ঐ সকলের বিস্তার—সমাজের বিস্তার ও সঙ্কোচের সহিত কোথাও বিস্তৃত, কোথাও অপেক্ষাকৃত সঙ্কুচিত হইয়া বিরাজমান আছে। তৎপরে স্বামীজী শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধ-পূর্ববর্তিত্ব সম্বন্ধে কিছু বলিয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বলেন যে, যে প্রকার বিষ্ণুপুরাণোক্ত রাজকুলাদির ইতিহাস ক্রমশঃ প্রত্নতত্ত্ব-উদ্ঘাটনের সহিত প্রমাণীকৃত হইতেছে, সেই প্রকার ভারতের কিংবদন্তীসমস্ত সত্য। বৃথা প্রবন্ধ-কল্পনা না করিয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যেন উক্ত কিংবদন্তীর রহস্য-উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। পণ্ডিত ম্যাক্সমূলার এক পুস্তকে লিখিতেছেন যে, যতই সৌসাদৃশ্য থাকুক না কেন, যতক্ষণ না ইহা প্রমাণিত হইবে যে, কোন গ্রীক সংস্কৃত ভাষা জানিত, ততক্ষণ সপ্রমাণ হইল না যে, ভারতবর্ষের সাহায্য প্রাচীন গ্রীস প্রাপ্ত হইয়াছিল। কিন্তু কতকগুলি পাশ্চাত্য পণ্ডিত ভারতীয় জ্যোতিষের কয়েকটি সংজ্ঞা গ্রীক জ্যোতিষের সংজ্ঞার সদৃশ দেখিয়া এবং গ্রীকরা ভারতপ্রান্তে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য সংস্থাপন করিয়াছিল অবগত হইয়া, ভারতের যাবতীয় বিদ্যায়—সাহিত্যে, জ্যোতিষে, গণিতে—গ্রীক সহায়তা দেখিতে পান। শুধু তাহাই নহে, একজন অতি সাহসিক লিখিয়াছেন যে, ভারতের যাবতীয় বিদ্যা গ্রীকদের বিদ্যার ছায়া!!
এক, ‘ম্লেচ্ছা বৈ যবনাস্তেষু এষা বিদ্যা প্রতিষ্ঠিতা। ঋষিবৎ তেঽপি পূজ্যন্তে’—এই শ্লোকের উপর পাশ্চাত্যেরা কতই না কল্পনা চালাইয়াছেন। উক্ত শ্লোকে কি প্রকারে প্রমাণীকৃত হইল যে, আর্যেরা ম্লেচ্ছের নিকট শিখিয়াছেন? ইহাও বলা যাইতে পারে যে, উক্ত শ্লোকে আর্যশিষ্য ম্লেচ্ছদিগকে উৎসাহবান করিবার জন্য বিদ্যার আদর প্রদর্শিত হইয়াছে।
দ্বিতীয়তঃ ‘গৃহে চেৎ মধু বিন্দেত, কিমর্থং পর্বতং ব্রজেৎ?’ আর্যদের প্রত্যেক বিদ্যার বেদে রহিয়াছে এবং উক্ত কোন বিদ্যার প্রত্যেক সংজ্ঞাই বেদ হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তমানকালের গ্রন্থসকলে পর্যন্ত দেখানো যাইতে পারে। এ অপ্রাসঙ্গিক যবনাধিপত্যের আবশ্যকতাই নাই।
তৃতীয়তঃ আর্য জ্যোতিষের প্রত্যেক গ্রীকসদৃশ শব্দ সংস্কৃত হইতে সহজেই ব্যুৎপন্ন হয়, উপস্থিত ব্যুৎপত্তি ত্যাগ করিয়া যাবনিক ব্যুৎপত্তি গ্রহণে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের যে কি অধিকার, তাহাও বুঝি না।
ঐ প্রকার কালিদাসাদিকবি-প্রণীত নাটকে ‘যবনিকা’ শব্দের উল্লেখ দেখিয়া যদি ঐ সময়ের যাবতীয় কাব্যনাটকের উপর যবনাধিপত্য আপত্তি হয়, তাহা হইলে প্রথমে বিবেচ্য যে, আর্যনাটক গ্রীকনাটকের সদৃশ কিনা। যাঁহারা উভয় ভাষায় নাটকরচনা-প্রণালী আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহাদের অবশ্যই বলিতে হইবে যে, ঐ সৌসাদৃশ্য কেবল প্রবন্ধকারের কল্পনাজগতে, বাস্তবিক জগতে তাহার কস্মিন্কালেও বর্তমানত্ব নাই। সে গ্রীক কোরস্ কোথায়? সে গ্রীক যবনিকা নাট্যমঞ্চের একদিকে, আর্যনাটকে তাহার ঠিক বিপরীতে। সে রচনা-প্রণালী এক, আর্যনাটকের আর এক।
আর্যনাটকের সাদৃশ্য গ্রীক নাটকে আদৌ তো নাই, বরং শেক্সপীয়র-প্রণীত নাটকের সহিত ভূরি ভূরি সৌসাদৃশ্য আছে।
অতএব এমনও সিদ্ধান্ত হইতে পারে যে, শেক্সপীয়র সর্ববিষয়ে কালিদাসাদির নিকট ঋণী এবং সমগ্র পাশ্চাত্য সাহিত্যে ভারতের সাহিত্যের ছায়া।
শেষ—পণ্ডিত ম্যাক্সমূলারের আপত্তি তাঁহারই উপর প্রয়োগ করিয়া ইহাও বলা যায় যে, যতক্ষণ ইহা না প্রমাণিত হয় যে, কোন হিন্দু কোন কালে গ্রীক ভাষায় অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিল, ততক্ষণ ঐ গ্রীক প্রভাবের কথা মুখে আনাও উচিত নয়।
তদ্বৎ আর্যভাস্কর্যে গ্রীক প্রাদুর্ভাব-দর্শনও ভ্রম মাত্র।
স্বামীজী ইহাও বলেন যে, শ্রীকৃষ্ণারাধনা বুদ্ধাপেক্ষা অতি প্রাচীন এবং গীতা যদি মহাভারতের সমসাময়িক না হয়, তাহা হইলে তদপেক্ষাও প্রাচীন—নবীন কোন মতে নহে। গীতার ভাষা মহাভারতের ভাষা এক। গীতায় যে-সকল বিশেষণ অধ্যাত্মসম্বন্ধে প্রয়োগ হইয়াছে, তাহার অনেকগুলিই বনাদি পর্বে বৈষয়িক সম্বন্ধে প্রযুক্ত। ঐ সকল শব্দের প্রচুর প্রচার না হইলে এমন ঘটা অসম্ভব। পুনশ্চ সমস্ত মহাভারতের মত আর গীতার মত একই এবং গীতা যখন তৎসাময়িক সমস্ত সম্প্রদায়েরই আলোচনা করিয়াছেন, তখন বৌদ্ধদের উল্লেখমাত্রও কেন করেন নাই?
বুদ্ধের পরবর্তী যে-কোন গ্রন্থে বিশেষ চেষ্টা করিয়াও বৌদ্ধোল্লেখ নিবারিত হইতেছে না। কথা, গল্প, ইতিহাস বা কটাক্ষের মধ্যে কোথাও না কোথাও বৌদ্ধমতের বা বুদ্ধের উল্লেখ প্রকাশ্য বা লুক্কায়িতভাবে রহিয়াছে—গীতার মধ্যে কে সে প্রকার দেখাইতে পারেন? পুনশ্চ গীতা ধর্মসমন্বয়-গ্রন্থ, সে গ্রন্থে কোন মতের অনাদর নাই, সে গ্রন্থকারের সাদর বচনে এক বৌদ্ধমতই বা কেন বঞ্চিত হইলেন, ইহার কারণ-প্রদর্শনের ভার কাহার উপর?
উপেক্ষা—গীতায় কাহাকেও নাই। ভয়?—তাহারও একান্ত অভাব। যে ভগবান্ বেদপ্রচারক হইয়াও বৈদিক হঠকারিতার উপর কঠিন ভাষা প্রয়োগেও কুণ্ঠিত নহেন, তাঁহার বৌদ্ধমতের আবার কি ভয়?
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যে প্রকার গ্রীক ভাষার এক এক গ্রন্থের উপর সমস্ত জীবন দেন, সেই প্রকার এক এক প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের উপর জীবন উৎসর্গ করুন; অনেক আলোক জগতে আসিবে। বিশেষতঃ এ মহাভারত ভারতেতিহাসের অমূল্য গ্রন্থ। ইহা অত্যুক্তি নহে যে, এ পর্যন্ত উক্ত সর্বপ্রধান গ্রন্থ পাশ্চাত্য জগতে উত্তমরূপে অধীতই হয় নাই।
বক্তৃতার পর অনেকেই মতামত প্রকাশ করেন। অনেকেই বলিলেনঃ স্বামীজী যাহা বলিতেছেন, তাহার অধিকাংশই আমাদের সম্মত এবং স্বামীজীকে আমরা বলি যে, সংস্কৃত-প্রত্নতত্ত্বের আর সে দিন নাই। এখন নবীন সংস্কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের মত অধিকাংশই স্বামীজীর সদৃশ এবং ভারতের কিংবদন্তী পুরাণাদিতে যে বাস্তব ইতিহাস রহিয়াছে, তাহাও আমরা বিশ্বাস করি।
অন্তে—বৃদ্ধ সভাপতি মহাশয় অন্য সকল বিষয় অনুমোদন করিয়া এক গীতার মহাভারত-সমসাময়িকত্বে দ্বৈত মত অবলম্বন করিলেন। কিন্তু প্রমাণ-প্রয়োগ এইমাত্র করিলেন যে, অধিকাংশ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মতে গীতা মহাভারতের অঙ্গ নহে।
*************************************************************************************************************
শিবের ভূত
[স্বামীজীর দেহত্যাগের বহুকাল পরে স্বামীজীর ঘরের কাগজপত্র গুছাইবার সময় তাঁহার হাতে লেখা এই অসমাপ্ত গল্পটি পাওয়া যায়।]
জার্মানীর এক জেলায় ব্যারন ‘ক’য়ের বাস। অভিজাত বংশে জাত ব্যারন ‘ক’ তরুণ যৌবনে উচ্চপদ, মান, ধন, বিদ্যা, এবং বিবিধ গুণের অধিকারী। যুবতী, সুন্দরী, বহুধনের অধিকারিণী, উচ্চকুল-প্রসূতা অনেক মহিলা ব্যারন ‘ক’য়ের প্রণয়াভিলাষিণী। রূপে, গুণে, মানে, বংশে, বিদ্যায়, বয়সে এমন জামাই পাবার জন্য কোন্ মা-বাপের না অভিলাষ? কুলীনবংশজা এক সুন্দরী যুবতী যুবা ব্যারন ‘ক’য়ের মনও আকর্ষণ করেছেন, কিন্তু বিবাহের এখনও দেরী। ব্যারনের মান ধন সব থাকুক, এ জগতে আপনার জন নাই—এক ভগ্নী ছাড়া। সে ভগ্নী পরমা সুন্দরী বিদুষী। সে ভগ্নী নিজের মনোমত সুপাত্রকে মাল্যদান করবেন। ব্যারন বহুধনধান্যের সহিত ভগ্নীকে সুপাত্রে সমর্পণ করবেন—তার পর নিজে বিবাহ করবেন, এই প্রতিজ্ঞা। মা বাপ ভাই সকলের স্নেহ সে ভগ্নীতে; তাঁর বিবাহ না হলে নিজে বিবাহ করে সুখী হতে চান না। তার উপর এ পাশ্চাত্য দেশের নিয়ম হচ্ছে যে, বিবাহের পর বর, মা, বাপ, ভগ্নী, ভাই—কারুর সঙ্গে আর বাস করেন না; তাঁর স্ত্রী তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্র হন। বরং স্ত্রীর সঙ্গে শ্বশুরঘরে গিয়া বাস সমাজসম্মত, কিন্তু স্ত্রী স্বামীর পিতামাতার সঙ্গে বাস করতে কখনও আসতে পারেন না। কাজেই নিজের বিবাহ—ভগ্নীর বিবাহ পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।
আজ মাস কতক হল সে ভগ্নীর কোন খবর নাই। দাসদাসী-পরিষেবিত নানাভোগের আলয় অট্টালিকা ছেড়ে, একমাত্র ভাইয়ের অপার স্নেহবন্ধন তাচ্ছিল্য করে সে ভগ্নী অজ্ঞাতভাবে গৃহত্যাগ করে কোথায় গিয়েছে! নানা অনুসন্ধান বিফল। সে শোক ব্যারন ‘ক’য়ের বুকে বিদ্ধশূলবৎ হয়ে রয়েছে। আহার-বিহারে তাঁর আস্থা নাই—সদাই বিমর্ষ, সদাই মলিনমুখ। ভগ্নীর আশা ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়জনেরা ব্যারন ‘ক’য়ের মানসিক স্বাস্থ্যসাধনে বিশেষ যত্ন করতে লাগলেন। আত্মীয়েরা তাঁর জন্য বিশেষ চিন্তিত—প্রণয়িনী সদাই সশঙ্ক।
প্যারিসে মহাপ্রদর্শনী। নানাদিগ্দেশাগত গুণিমণ্ডলীর এখন প্যারিসে সমাবেশ; নানাদেশের কারুকার্য, শিল্পরচনা প্যারিসে আজ কেন্দ্রীভূত। সে আনন্দতরঙ্গের আঘাতে শোকে জড়ীকৃতহৃদয় আবার স্বাভাবিক বেগবান স্বাস্থ্য লাভ করবে, মন দুঃখচিন্তা ছেড়ে বিবিধ আনন্দজনক চিন্তায় আকৃষ্ট হবে—এই আশায় আত্মীয়দের পরামর্শে বন্ধুবর্গ-সমভিব্যাহারে ব্যারন ‘ক’ প্যারিসে যাত্রা করলেন। …
0 Comments