স্বামীজী সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু

 

স্বামীজী সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু

স্বামীজী সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু

(ছাত্রাবস্থায়) এমন একটা আদর্শের তখন আমার প্রয়ােজন ছিল, যার উপরে ভিত্তি করে আমার সমস্ত জীবনটাকে গড়ে তুলতে পারব—সব রকম প্রলোভন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। এমন একটি আদর্শ খুজে বের করা সহজ ছিল না। মানসিক অশান্তি আমাকে ভোগ করতে হত না, যদি আমি আর দশজনের মতো জীবনের দাবিকে সহজ ভাবেই মেনে নিতাম কিংবা দৃঢ় ভাবে জীবনের সমস্ত প্রলোভনকে তুচ্ছ করে যে-কোনাে একটা আদর্শকে আঁকড়ে ধরতাম। কিন্তু কোনােটাই আমি পারিনি। জীবনের সাধারণ প্রলোভনে ধরা দিতে আমি রাজি ছিলাম না, কাজেই সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।...

হঠাৎ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই যেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম। আমাদের এক আত্মীয় (সুহৃংচন্দ্র মিত্র) নতুন কটকে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ীর কাছেই থাকতেন। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার ঘরে বসে বই ঘাটছি হঠাৎ নজর পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলোর উপর। কয়েক পাতা উল্টেই বুঝতে পারলাম, এই জিনিসই আমি এতদিন ধরে চাইছিলাম। বইগুলাে বাড়ি নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। পড়তে পড়তে আমার হৃদয় মন আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। প্রধান শিক্ষক মশাই আমার মধ্যে সৌন্দর্য বােধ, নৈতিকবোধ জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন—জীবনে এক নতুন প্রেরণা এনে দিয়েছিলেন—কিন্তু এমন আদর্শের সন্ধান দিতে পারেননি যা আমার সমগ্র সত্তাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এই আদর্শের সন্ধান দিলেন বিবেকানন্দ। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আমি তাঁর বই নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলাম। আমাকে সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ করেছিল তার চিঠিপত্র ও বক্তৃতা। তাঁর লেখা থেকেই তাঁর আদর্শের মূল সুরটি আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম।...মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি—এই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। আদর্শ হিসেবে মধ্যযুগের স্বার্থ সর্বস্ব সন্ন্যাসী-জীবন কিংবা আধুনিক যুগের মিল ও বেন্থামের ‘ইউটিলিটারিয়ানিজম’ কোনােটাই সার্থক নয়। মানবজাতির সেবা বলতে বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝেছিলেন। তার জীবনীকার ও প্রধান শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা লিখে গেছেন, ‘মাতৃভূমিই ছিল তাঁর আরাধ্যা দেবী। দেশের এমন কোনাে আন্দোলন ছিল না যা তার মনে সাড়া জাগায়নি।'...বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'বল ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, মুর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।' তিনি বলতেন যে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য, একে একে সকলেরই দিন গিয়েছে, এখন পালা এসেছে শূদ্রের—এতদিন পর্যন্ত যারা সমাজে শুধু অবহেলাই পেয়ে এসেছে। তিনি আরাে বলতেন, উপনিষদের বাণী হল, ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ'—চাই শক্তি, নইলে সবই বৃথা। আর চাই নচিকেতার মতাে আত্মবিশ্বাস।...

বিবেকানন্দের আদর্শকে যে-সময়ে জীবনে গ্রহণ করলাম তখন আমার বয়স বছর পনেরও হবে কিনা সন্দেহ। বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমল পরিবর্তন এনে দিল। তাঁর আদর্শ ও তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতাকে পুরােপুরি উপলব্ধি করার মতাে ক্ষমতা তখন আমার ছিল না—কিন্তু কয়েকটা জিনিস একেবারে গােড়া থেকেই আমার মনে চিরকালের জন্য গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। চেহারায় এবং ব্যক্তিত্বে আমার কাছে বিবেকানন্দ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। তার মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম।... স্বামী বিবেকানন্দের পথই আমি বেছে নিলাম।...

যে পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছিলাম সেটা মোটামুটি উদার ভাবাপন্ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের বিরুদ্ধে আমাকে বিদ্রোহ করতে হয়েছে। আমার বয়স যখন চোদ্দ কি পনের সে-সময়কার একটি ঘটনার কথা বলি। প্রতিবেশী আমার এক সহপাঠী (দেবেন দাস) একদিন আমাদের কয়েকজনকে তার বাড়ীতে খেতে বলে। মায়ের কানে কথাটা যেতেই তিনি স্রেফ আমাদের যেতে বারণ করে বসলেন। হয়তাে বন্ধুটি আভিজাত্যে আমাদের চাইতে ছােটো ছিল কিংবা আমাদের চেয়ে নীচ জাতের ছিল বলেই মা আপত্তি করেছিলেন, কিংবা হয়তাে বাইরে খেলে অসুখ-বিসুখ হতে পারে এরকম আশঙ্কা করেছিলেন। আমরাও বাস্তবিকই বাইরে খুব কমই খেতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে মায়ের আপত্তি আমার কাছে অত্যন্ত অসঙ্গত বলে মনে হল। আমি মায়ের নিষেধ অমান্য করেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম—এবং এতে কেমন একটা অদ্ভুত আনন্দও যেন অনুভব করেছিলাম। পরে যখন ধর্মচর্চা ও যোগসাধনা উপলক্ষে অনেকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ত, অনেক জায়গায় যেতে হত—তখন প্রায়ই বাবা-মার নিষেধ অমান্য করতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মনে কিছুমাত্র দ্বিধাও জাগেনি, কারণ তখন বিবেকানন্দের আদর্শ আমি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি—বিবেকানন্দ বলতেন আত্মােপলদ্ধির জন্য সব বাধাকেই তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে।

স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ধর্ম ছিল জাতীয়তাবাদের প্রেরণাস্থল। তিনি চেয়েছিলেন, যুব সমাজের মধ্যে ভারতবর্ষের অতীত সম্পর্কে গর্ববোধ এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশার মনােভাব সঞ্চারিত করতে; আর চেষ্টা করেছিলেন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগিয়ে তুলতে। স্বামীজী কোন রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করেননি। কিন্তু যারাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন বা তাঁর লেখা পড়েছেন তাঁদের মধ্যেই একটা দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মানসিকতা গড়ে উঠেছে। অন্তত বঙ্গভূমির ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দ আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবে সম্মানিত হবার যােগ্য। অত্যন্ত অল্প বয়সে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেহরক্ষা করেন। কিন্তু তার দেহান্তের পর তার প্রভাব আরও ব্যাপক হয়ে উঠেছে।

বিবেকানন্দ সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলেই আমি আত্মহারা হয়ে যাই। খুব কম লােকের পক্ষে, এমনকি তাঁর সংস্পর্শে থাকার সুবিধা যাঁদের হয়েছিল তাদের পক্ষেও তার সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করা বা তাকে গভীরভাবে বুঝতে পারা অসম্ভব বলেই মনে করি। সুগভীর, জটিল ও ঋদ্ধিসমন্বিত ব্যক্তিত্ব তাঁর বন্ধুতা ও লেখা থেকে ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অথচ তাঁর এই বক্তৃতা ও লেখার দ্বারাই তিনি তাঁর আশ্চর্য প্রভাব দেশবাসীর উপর, বিশেষত বাঙালীর উপর বিস্তার করেছিলেন। এই রকমের বলিষ্ঠ মানুষ বাঙালীর মনকে যেমন আকৃষ্ট করে, এমন আর কেউ করে না। ত্যাগে বেহিসেবি, কর্মে বিরামহীন, প্রেমে সীমাহীন স্বামীজীর জ্ঞান ছিল যেমন গভীর তেমনি বহুমুখী। ভাবাবেগে উচ্ছসিত স্বামীজী মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতির নির্মম সমালােচক ছিলেন, অথচ সারল্য ছিল তাঁর শিশুর মতাে। আমাদের জগতে এরূপ ব্যক্তিত্ব বাস্তবিকই বিরল।...

স্বামীজী ছিলেন পৌরুষ সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তিনি ছিলেন মনে প্রাণে সংগ্রামী, সেই জন্য তিনি ছিলেন শক্তির উপাসক। তিনি তাই দেশবাসীর উন্নয়নের জন্য বেদান্তের বাস্তব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘শক্তি শক্তি, শক্তির কথাই উপনিষদ বলেছেন’,—স্বামীজী এইকথাই বারবার বলেছেন। চরিত্র গঠনের উপর তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব আরোপ করে গেছেন। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে গেলেও সেই মহাপুরুষের বিষয় কিছু বলা হবে না, এমনি ছিলেন তিনি মহৎ, এমনি ছিল তাঁর চরিত্র—যেমন মহান তেমনি গভীর। তাঁর বিষয় বলতে গেলে বলতে হবে যে, তিনি আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চতম স্তরের যােগ্য—সত্যের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযােগ, জাতির ও মানব সমাজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধানে তাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত। আজ তিনি জীবিত থাকলে আমি তাঁর চরণেই আশ্রয় নিতাম। স্বামী বিবেকানন্দই বর্তমান বাংলার স্রষ্টা —এ কথা বললে বোধ হয় ভুল করা হবে না। 

 শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋণী তাহা ভাষায় কি করিয়া প্রকাশ করিব? তাঁহাদের পূণ্য প্রভাবে আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। নিবেদিতার মতাে আমিও মনে করি যে, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ একটা অখণ্ড ব্যক্তিত্বের দুই রূপ। আজ যদি স্বামীজী জীবিত থাকিতেন তিনি নিশ্চয়ই আমার গুরু হইতেন—অর্থাৎ তাকে নিশ্চয়ই আমি গুরুপদে বরণ করিতাম। যাহা হউক, যতদিন জীবিত থাকিব, ততদিন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একান্ত অনুগত ও অনুরক্ত থাকিব, একথা বলাই বাহুল্য।

স্বামী বিবেকানন্দের বহুমুখী প্রতিভার ব্যাখ্যা করা বড় কঠিন। আমাদের সময়ের ছাত্রসমাজ স্বামীজীর রচনা ও বক্তৃতার দ্বারা যেরূপ প্রভাবিত হইয়াছিল, সেরূপ আর কাহারও দ্বারা হয় নাই—তিনি যেন সম্পূর্ণভাবে তাহাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করিয়াছিলেন।

শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের সহিত একযোগে না দেখিলে স্বামীজীকে যথার্থভাবে বিচার করা যাইবে না। স্বামীজীর বাণীর মধ্য দিয়াই বর্তমানের মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তি গঠিত হইয়াছে। ভারতবর্ষকে যদি স্বাধীন হইতে হয়, তবে তাহাকে হিন্দুধর্ম বা ইসলামের বিশেষ আবাসভূমি হইলে চলিবে না তাহাকে জাতীয়তার আদর্শে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের একত্র বাসভূমি হইতে হইবে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যে বাণী-ধর্ম সমন্বয়--তাহা ভারতবাসীকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিতে হইবে।...

স্বামীজী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের, ধর্ম ও বিজ্ঞানের, অতীত ও বর্তমানের সমন্বয় করিয়াছিলেন, তাই তিনি মহৎ। তাহার শিক্ষায় দেশবাসী অভূতপূর্ব আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার বােধ লাভ করিয়াছে। 

রামকৃষ্ণ পরমহংস নিজের জীবনের সাধনার ভিতর দিয়া সর্বধর্মের যে সমন্বয় করিতে পারিয়াছিলেন, তাহাই স্বামীজীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল এবং তাহাই ভবিষ্যৎ ভারতের জাতীয়তার মূল ভিত্তি। এই সর্বধর্ম-সময় ও সকল-মত সহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা না হইলে আমাদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে জাতীয়তাবােধ নির্মিত হইতে পারিত না।...

রামমােহনের যুগ হইতে বিভিন্ন আন্দোলনের ভিতর দিয়া ভারতের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ক্ৰমশঃ প্রকটিত হইয়া আসিতেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে এই আকাক্ষা চিন্তারাজ্যে ও সমাজের মধ্যে দেখা দিয়াছিল, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তখনও দেখা দেয় নাই কারণ তখনও ভারতবাসী পরাধীনতার মােহ নিদ্রায় নিমগ্ন থাকিয়া মনে করিতেছিল যে, ইংরাজের ভারতবিজয় একটা দৈব ঘটনা বা Divine dispensation। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বাধীনতার অখণ্ডরুপের আভাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মধ্যে পাওয়া যায়। 'Freedom, freedom is the song of the Soul. -এই বাণী যখন স্বামীজীর অন্তরের রুদ্ধ দুয়ার ভেদ করিয়া নির্গত হয়, তখন তাহা সমগ্র দেশবাসীকে মুগ্ধ ও উন্মত্ত প্রায় করিয়া তােলে। তাঁহার সাধনার ভিতর দিয়া, আচরণের ভিতর দিয়া, কথা ও বক্তৃতার ভিতর দিয়া এই সত্যই বাহির হইয়াছিল।

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে যাবতীয় বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া খাঁটি মানুষ হইতে বলেন, এবং অপরদিকে সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচারে ভারতের জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপন করেন। 

ভগিনী নিবেদিতা তাঁর “The Master as I saw Him' পুস্তকে বলেছেন, "The queen of his adoration was his Motherland.'অর্থাৎ তার আরাধনার দেবী ছিল তাঁর মাতৃভূমি। পুরােহিত, উচ্চবর্ণ এবং বণিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি তাঁর লেখায়...আক্রমণ চালিয়েছিলেন...। সেসব কথা বলা একজন সর্বশ্রেষ্ঠ গোঁড়া সমাজতান্ত্রিকের পক্ষেও বিশেষ প্রশংসার বিষয়।

আপনারা যাকে আধ্যাত্মিক ভণ্ডামি বলতে পারেন স্বামীজীর মধ্যে তার বিন্দুমাত্র আভাসও ছিল না। তাঁর চোখে এসব অসহ্য বােধ হত। বকধার্মিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলতেনঃ 

Salvation will come through football and not through Gita.'

নিজে বৈদান্তিক হয়েও তিনি ভগবান বুদ্ধের পরম ভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বুদ্ধ সম্বন্ধে এমন অনুরাগ ও উৎসাহের সঙ্গে কথা বলছিলেন যে, একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ স্বামীজী, আপনি কি বৌদ্ধ ?' তৎক্ষণাৎ তাঁর মন ভাবাবেগে উচ্ছসিত হয়ে উঠল, তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেনঃ “কি বৌদ্ধ ? আমি বুদ্ধের সেবকের সেবক—তস্য সেবক। বুদ্ধের সম্মুখে তিনি নিজেকে ধুলার মতাে নত করে দিতেন। স্বামীজী প্রায়ই বলতেন—‘শঙ্করাচার্যের মনীষা, বুদ্ধের হৃদয়বত্তাই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত।'

এইভাবে তিনি একদিন খ্রীষ্ট সম্বন্ধে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। একজন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, তখনই তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং মধুর কণ্ঠে উত্তর দিলেনঃ যীশুখৃষ্টের সময় আমি জীবিত থাকলে আমি আমার চোখের জলে নয়, বুকের রক্ত দিয়ে তাঁর পা ধুইয়ে দিতাম। অবনমিতের প্রতি তার ভালবাসা ছিল সমুদ্র সমান। তাঁর সেই বাণী কি আমাদের স্মরণ আছে? 

‘দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। বল ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ ; আর বল দিন-রাত - হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমার মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।

স্বামী বিবেকানন্দই বাংলার ইতিহাসকে নতুন পথে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মানুষ তৈরীই আমার জীবনব্রত'। মানুষ তৈরীর ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ে তার মনােযােগ সীমাবদ্ধ রাখেননি—তিনি সমগ্র সমাজকে একসঙ্গে আলিঙ্গন করেছিলেন। তাঁর অগ্নিময়ী বাণী এখনাে বাংলার ঘরে ঘরে ধ্বনিত হচ্ছে - ‘নতুন ভারত বেরুক হাট থেকে, বাজার থেকে, কল-কারখানা থেকে। 

কাল মার্কসের গ্রন্থ থেকে এই সমাজতন্ত্রের জন্ম হয়নি। ভারতের চিন্তা ও সংস্কৃতিতে এর উৎস। স্বামী বিবেকানন্দ যে গণতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের রচনায় ও কর্মে মূর্তি পরিগ্রহ করেছিল।...

জাতিগঠনের প্রথম ভিত্তি—মানুষ তৈরী, তারপরেই সংগঠন। স্বামীজী ও অন্যান্যরা মানুষ তৈরী করতে চেষ্টা করেছেন, এবং দেশবন্ধু চেয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন।

আমাদের হীন মনােবৃত্তির কথা বলিবার সময়ে আর একটি বিষয়ে উল্লেখ

করিয়া পারি না। আজকাল জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষ করিয়া তরুণ সমাজের মধ্যে একপ্রকার লঘুতা ও বিলাসপ্রিয়তা যেন প্রবেশ করিয়াছে—অথচ আজকাল দেশের আর্থিক অবস্থা পর্বাপেক্ষা শােচনীয় হইয়া পড়িয়াছে। ইহা কি সত্য? যদি তাহা হয় তবে তাহার কারণ কি? আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ছাত্রমহলে ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্যের' খুব প্রচার ছিল। আজকাল নাকি তরুণ সমাজের মধ্যে ঐ সাহিত্যের তেমন প্রচার নাই! তার পরিবর্তে নাকি লঘুত্বপূর্ণ এবং সময়ে সময়ে অশ্লীলতা পূর্ণ সাহিত্যের খুব প্রচার হইয়াছে। একথা কি সত্য? যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা অত্যন্ত দুঃখের। বিষয়, কারণ মনুষ্যসমাজ যেরুপ সাহিত্যের দ্বারা পরিপুষ্ট হয় তার মনোবৃত্তি তদ্রুপ গড়িয়া ওঠে। চরিত্র গঠনের জন্য 'রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্য' অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনা করিতে পারি না।

Post a Comment

0 Comments